বিরজা হোম ও তার বাধা
ভৈরব চক্রবর্তীর মুখে এই গল্পটি শোনা। অনেকদিন আগেকার কথা। বোয়ালে-কদরপুর (খুলনা) হাই স্কুলে আমি তখন শিক্ষক। নতুন, কলেজ থেকে বার হয়ে সেখানে গিয়েছি।
ভৈরব চক্রবর্তী ওই গ্রামের একজন নিষ্ঠাবান সেকেলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। সকলেই শ্রদ্ধা করত, মানত। এক প্রহর ধরে জপ আহ্নিক করতেন, শূদ্রযাজক ব্রাহ্মণের জল স্পর্শ করতেন না, মাসে একবার বিরজা হোম করতেন, টিকিতে ফুল বাঁধা থাকত দুপুরের পরে। স্বপাক ছাড়া কারও বাড়িতে কখনো খেতেন না। শিষ্য করতে নারাজ ছিলেন, বলতেন শিষ্যদের কাছে পয়সা নিয়ে খাওয়া খাঁটি ব্রাহ্মণের পক্ষে মহাপাপ। আর একটি কথা, ভৈরব চক্রবর্তী ভালো সংস্কৃত জানতেন, কিন্তু কোনো ইস্কুলে পণ্ডিতি করেননি। টোল করাও পছন্দ করতেন না। ওতে নাকি গভর্মেন্টের দেয় বৃত্তির দিকে বড়ো মন চলে যায়। টোল ইন্সপেক্টরের খোশামোদ করতে হয়। তবে দু-টি ছাত্রকে নিজের বাড়িতে খেতে দিয়ে ব্যাকরণ শেখাতেন।
বর্ষা সে-বার নামে নামে করেও নামছিল না। দিনে-রাতে গুমোটের দরুন আমরা কেউ ঘুমুতে পারছিলাম না। হঠাৎ সেদিন একটু মেঘ দেখা দিল পূব-উত্তর কোণে। বেলা তিনটে। স্কুল খুলেছে গ্রীষ্মের ছুটির পরে। কিন্তু এত দুর্দান্ত গরম যে, পুনরায় সকালে স্কুল করার জন্য ছেলেরা তদবির করছে, মাস্টারদেরও উস্কানি তাতে আছে বারো আনা। হেডমাস্টার অফিসঘরে বসে আছেন। গোপীবাবু ইতিহাসের মাস্টার, গিয়ে উত্তেজিতভাবে বললেন— স্যার মেঘ করেছে—
মুরলী মুখুজ্যে (এই নামেই তিনি ও-অঞ্চলের ছাত্রদের মধ্যে কুখ্যাত) গম্ভীর স্বরে বললেন— কীসের মেঘ?
—আজ্ঞে, মেঘ যাকে বলে।
—কী হয়েছে তাতে?
—আজ্ঞে, বৃষ্টি হবে। স্কুলের ছুটি দিলে ভালো হত। ছেলেরা অনেক দূর যাবে, ছাতি আনেনি অনেকে।
—বৃষ্টি হবে না ও-মেঘে।
খাস ইন্দ্রদেবের অফিসের হেড কেরানিও এতটা আত্মপ্রত্যয়ের সুরে এ-কথা বলতে দ্বিধা করত বোধ হয়। কিন্তু সকলেই জানে মুরলী মুখুজ্যের পাণ্ডিত্যের সীমাপরিসীমা নেই, আবহাওয়া তত্ত্বটি তাঁর নখদর্পণে। গোপীবাবু দমে গিয়ে বললেন— বৃষ্টি হবে না!
—না।
—কেন স্যার? বেশ মেঘ করে এসেছে তো?
—মেঘের আপনি কী বোঝেন? ওকে বলে তাতমেঘা। ও মেঘে বৃষ্টি হবে না।
আমিও পাশের শিক্ষকদের বিশ্রামকক্ষ থেকে জানলা দিয়ে মেঘটা দেখেছিলাম এবং আসন্ন বৃষ্টির সম্ভাবনাতে পুলকিত হয়েও উঠেছিলাম। মুরলী মুখুজ্যের নির্ঘাত রায় শুনে আমি তাড়াতাড়ি বাইরে এসে বললাম— বৃষ্টি হবে বলে কিন্তু মনে হচ্ছে।
মুরলী মুখুজ্যে বললেন— তাতমেঘা। মেঘ হলেই বৃষ্টি হয় না।
—কোন মেঘে বৃষ্টি হয়?
—এখন বৃষ্টি হবে আলট্রোস্ট্রটোস মেঘে। যাকে বলে শিট-ক্লাউড।
—ও!
—তা ছাড়া হাওয়া বইছে দক্ষিণ থেকে। মনসুনের আগে হাওয়া ঘুরে যাবে পুবে।
—ও!
আর কোনো কথা বলতে আমাদের সাহস হল না। কিন্তু ইন্দ্রদেব সেদিন বড়োই অপদস্থ করলেন আবহাওয়া-তত্ত্ববিদ মুরলী মুখুজ্যেকে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই মেঘের চেহারা ঘন কালো হয়ে উঠল। মেঘের চাদর ঢাকা পড়ল আরও ঘন আর-একখানা মেঘের চাদরে। তারপর স্কুলের ছুটি হওয়ার সামান্য কিছু আগেই ঝম-ঝম করে মুষলধারে বর্ষা নামল। পুরো দু-টি ঘণ্টা খাল-বিল-নালা-ডোবা ভাসিয়ে রাম বৃষ্টি হওয়ার পরে বেলা সাড়ে-পাঁচটার সময় আকাশ ধরে গেল। ছেলেরা তখনও পর্যন্ত স্কুলেই আটকে ছিল। কোথায় আর যাবে! সবাই আমরা আটকে পড়েছিলাম।
গোপীবাবু জয়গর্বে উৎফুল্ল হয়ে মুরলী মুখুজ্যেকে গিয়ে বললেন— দেখলেন স্যার, তখন বললাম বৃষ্টি আসবে, তখন ছুটিটা দিয়ে দিলে আর এমন হত না।
মুরলীবাবু বললেন— অমন হয়ে থাকে। ইতিহাস পড়ান, হায়ার ম্যাথামেটিকস পড়ালে বুঝতেন। জগতে স্পেস অ্যান্ড টাইম নিয়ে অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। এডওয়ার্ড গার্নেটের প্রবন্ধ পড়ে দেখবেন এ বছরের ম্যাথামেটিক্যাল গেজেট-এ! বুঝলেন?
—সেটা কী?
—’অ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড’ পড়েছেন তো? অঙ্কশাস্ত্রে অ্যালিস (থ্রু) দা লুকিং গ্লাসের পরীক্ষা আর কী। পড়ে দেখুন।
গোপীবাবু চলে গেলেন। অঙ্কশাস্ত্রের কথা উঠলেই স্বভাবত তিনি সংকুচিত হয়ে পড়েন।
বৃষ্টি থেমেছে, স্কুল থেকে বেরিয়ে গোপীবাবু আর আমি চলেছি। দুজনেই আমরা মনে মনে বড়ো খুশি। হেডমাস্টারকে আজ বড়ো জব্দ করা গিয়েছে! রোজ রোজ কেবল চালাকি!
এমন সময় ভৈরব চক্রবর্তীর বাড়ির দাওয়ায় দেখি ভৈরব চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে, খুব খুশি মন। আমাকে দেখে ডেকে বললেন— কেমন ননীবাবু, বৃষ্টি হল তো?
—এই যে চক্কত্তিমশায়, নমস্কার। তা হল।
—হবে না? আজ তিন দিন থেকে হোম করছি বৃষ্টির জন্যে। ওর বাবাকে হতে হবে!
অবশ্যি বৃষ্টির পিতৃদেব কে, তা ভালো জানা ছিল না। বললাম— বলেন কী? হোম করার ফল তাহলে ফলেছে বলতে হবে!
গোপীবাবু অর্ধস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন— লাগে তাক না লাগে তুক!
ভৈরব চক্রবর্তী কথাটা শুনতে পেয়ে বললেন— আসুন দু-জনেই আমার বাড়িতে মাস্টারবাবুরা। আসুন, দেখাই—
গোপীবাবু ও আমি দু-জনে দাওয়ায় গিয়ে বসলাম। মনটা বেশ ভালো। দুঃসহ গরমের পর প্রচুর বৃষ্টি হয়ে দিনটি একেবারে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আজ পনেরো দিন দারুণ গুমোট, রাত্রে ঘুমুইনি।
গোপীবাবু কেবল বলেছিলেন— আজ খুব ঘুম হবে, কী বলেন?
—নিশ্চয়! তার আর ভুল?
ভৈরব চক্রবর্তী আমাদের নিয়ে গেলেন ঘরের মধ্যে। সেখানে সত্যি হোমের আগুনের কুণ্ড— বালি বিছিয়ে তৈরি, বেল কাঠ ও জগগি-ডুমুরের ডালের বাড়তি সমিধ (যজ্ঞের কাঠ) একপাশে গোছানো। পূর্ণ পাত্রে সিধে সাজানো, তামার টাটে নারায়ণ শিলা, সিঁদুর; বেলপাতা তামার বড়ো থালায়। হোম হয়ে গিয়েছে, উপকরণ এদিক-ওদিক ছড়ানো।
ভৈরব চক্রবর্তী বললেন— দেখলেন তো মাস্টারবাবু? হোম করার ফল আছে কি না দেখলেন?
গোপীবাবু বললেন— আপনি অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেন?
—নিশ্চয়ই! নিজের চোখে দেখা। অপদেবতার কাণ্ড দেখেছি যে কত পঞ্চমুণ্ডির আসনে জপ করার সময়!
—বলুন না কয়েকটা ঘটনা।
—না, সে সব বলব না, থাকগে। কিন্তু আজ এক বছরও হয়নি একটা অলৌকিক কাণ্ড দেখেছিলাম আমার এক যজমান-বাড়ি। সেইটেই বলি। একটু চা করতে বলি?
এমন সময় আবার কালো মেঘ করে বৃষ্টি শুরু হল। অন্ধকার হয়ে এল চারিদিক, ঝড় উঠল খুব ঠান্ডা হাওয়ার। ছড়-ছড় করে পাকা জাম পড়তে লাগল চক্কত্তিমশায়ের বাড়ির সামনের গাছটা থেকে। নতুন জলে ব্যাঙ ডাকতে লাগল চারিদিকে।
চা এল। আমরা ছাতি নিয়ে বেরুইনি। এই বৃষ্টি মাথায় করে যাবার উপায়ই নেই। বেশ জমিয়ে গল্প শোনবার জন্যে ভৈরব চক্রবর্তীর মাটির দাওয়ায় মাদুরের উপর বসে গেলাম।
ভৈরব চক্রবর্তী আমাদের চা দিয়ে তামাক সেজে নিয়ে এলেন। তারপর শুরু করলেন গল্প বলতে —
আর বছর ভাদ্র মাসের কথা। এখনও বছর পোরেনি। আমার এক যজমান-বাড়ি থেকে খবর পেলাম তার একটি মেয়ের বড়ো অসুখ। আমাকে তার বাড়িতে গিয়ে বিরজা হোম করতে হবে মেয়েটির জন্যে। বিরজা হোমে পূর্ণ আহুতি দিলে শক্ত রুগি ভালো হয়ে যায়। আমি এমন সারিয়েছি।
আমাকে তারা নৌকা করে নিয়ে গেল গোবরডাঙা স্টেশন থেকে যমুনা নদীর উপর দিয়ে। অজ পাড়াগাঁ, ঘর কতক ব্রাহ্মণ ও বেশির ভাগ গোয়ালা ও বুনোদের বাস। যমুনার ধারেই গ্রাম। গ্রামের মেয়েরা নদীর ঘাটেই স্নান করতে আসে।
—গ্রামের নাম কী?
—সাওবেড়ে। তারপর শুনুন— গ্রামে গিয়ে পৌঁছুলাম বিকেলে। খুব বনজঙ্গল গ্রামের মধ্যে। একটা ভাঙা শিবমন্দির আছে, সেকেলে ছোটো ইটের তৈরি। মন্দিরের মাথায় বট-অশ্বত্থের গাছ গজিয়েছে। প্রকাণ্ড বড়ো একটা শিবলিঙ্গ বসানো মন্দিরের মধ্যে, চামচিকের নাদিতে আকণ্ঠ ডোবা অবস্থায়। পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুদিন আগেই।
এইসময়ে আমাদের জন্যে ভৈরব চক্রবর্তীর বড়ো মেয়ে শৈল চালভাজা ও ছোলাভাজা নিয়ে এল তেল-নুন মেখে। ভৈরব চক্রবর্তীর বিপত্নীক, তাঁর মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে সবে ক-দিন হল; চলে গেলে চক্রবর্তীমশাই নিজেই রান্না করে খান।
আমরা সকলেই খাবার খেতে আরম্ভ করে দিলাম, ভৈরব চক্রবর্তীও সেই সঙ্গে। এখনও দিব্যি দাঁতের জোর, ওই বয়সে এমন চাল-ছোলাভাজা যে খেতে পারে, তার দাঁত বহু দিনেও নষ্ট হবে না।
তিনি খেতে-খেতেই বলে চললেন— এই শিবমন্দিরটার কথা মনে রাখবেন, এর সঙ্গে আমার গল্পের সম্পর্ক আছে। তারপর আমরা গিয়ে যে-বাড়িতে উঠে হাত-পা ধুয়ে জল খেয়ে ঠান্ডা হবার পর, গৃহস্বামী একটি ঘরে আমায় নিয়ে গেলেন; অসুস্থ মেয়েটি সেই ঘরে শুয়ে আছে। বয়েস তেরো-চোদ্দো হবে, নিতান্ত রোগা নয়, বেশ মোটাসোটা ছিল বোঝা যায়— গলায় একরাশ মাদুলি। মেয়েটি চোখ বুজে একপাশ ফিরে শুয়ে আছে। আমি ঘরের মধ্যে ঢুকতেই একবার সে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে আবার পাশ ফিরল।
মেয়েটির গায়ে জ্বর। বেশ জ্বর, তিনের কাছাকাছি হবে। চোখে ক্লান্ত দৃষ্টি, চোখের কোণ সামান্য লাল। নাড়ি দেখলাম, বেশ শক্তই আছে। হঠাৎ কোনো ভয়ের কারণ আছে বলে মনে হল না। তা ছাড়া, আমার উপর মেয়ের চিকিৎসার ভার নেই, আমি এসেছি হোম করতে।
গৃহস্বামী বললেন— আপনি আশীর্বাদ করুন, পায়ের ধুলো দিন মাথায় ওর।
পায়ের ধুলো মাথায় দিতে যাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ গৃহস্বামী আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন খাটের পাশে। আমি চমকে উঠলাম, হাত নড়ে গেল, লোকজন দৌড়ে এল কী হয়েছে দেখতে। কিছুই সেখানে নেই, না একটা কলার খোসা না-কিছু, লোকটি পড়ল কী করে? পায়ের ধুলো দেবার কথা চাপা পড়ে গেল। গৃহস্বামীর মাথায় ও মুখে ওঁর বড়ো শালা ঠান্ডা জল দিতে লাগল, মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সে এক হইচই ব্যাপার।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি তান্ত্রিক, হোম করি, কিছু কিছু দৈব ঘটনা বুঝি লক্ষণ, প্রতিলক্ষণ, চিহ্ন আর ইঙ্গিত— এই নিয়ে দৈব। গোড়াতেই এর লক্ষণ খারাপ ছিল বলে যেন মনে হচ্ছে। তবে কি হোম করব না? সন্ধ্যার কিছু পরে শিবমন্দিরের সামনের রাস্তায় পায়চারি করছি। বড্ড গরম, বাড়ির মধ্যে হাওয়া নেই, রাস্তায় তবু একটা হাওয়া বইছে। হঠাৎ আমার কানে এল, কে যেন বলছে— শুনুন, শুনুন। দু-বার কানে এল কথাটা। এদিক-ওদিক চাইতেই চোখে পড়ল, শিবমন্দিরের মধ্যে ঠিক দোরের গোড়ায় একটি কে মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে।
বললাম— আমায় বলছেন?
—হ্যাঁ। ও খুকির জন্যে বিরজা হোম করবেন না, ও বাঁচবে না।
—কে আপনি?
—আমি যেই হই, যদি ভালো চান, হোম করবেন না।
আমি বিস্মিত হলাম। নির্জন, অন্ধকার, ভাঙা মন্দির। সেখানে একটা মেয়েমানুষ আসবে কে? এমন আশ্চর্য কথাই বা বলে কেন? আমার খানিকটা রাগও হল, আমার ইচ্ছার উপর বাধা দেয় এমন লোক কে? মানুষ তো দূরের কথা, অপদেবতাকেও কখনো গ্রাহ্য করিনি। মায়ের আশীর্বাদে সবই সম্ভব হয়, ভৈরব চক্রবর্তীকে ভয় দেখানো সহজ নয়।
আমার এই অদ্ভুত দর্শনের কথা বাড়ি ফিরে কাউকে বললাম না। রাত্রে বসে হোমের জিনিসপত্রের ফর্দও করে দিলাম। তারপর রাত আটটা বাজল, গৃহস্বামী আমাকে রান্নাবান্না করতে বললেন। এইবার আমার গল্পের আসল অংশে আসব, তার আগে ওদের বাড়িটার সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার।
বাড়িটা খুব পুরোনো কোঠা বাড়ি, কোনো ছিরি-সৌষ্ঠব নেই, কিন্তু দোতলা। পল্লিগ্রামে দোতলা বাড়ি বড়ো-একটা দেখা যায় না। যমুনা নদীর ধারে ঠিক নয়, বাড়িটা সামান্য দূরে। মধ্যে কেবল একখানা বাড়ি। ওই বাড়ির ছাদ আর এ-বাড়ির ছাদের মধ্যে দশ-বারো ফুট চওড়া একফালি জমির ব্যবধান।
ছাদের উপর একখানা ঘর। সেই ঘরে আমার বিছানা পাতা হয়েছে, পাশে খোলা ছাদে তোলা উনুনে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সোনা মুগের ডাল, আতপ চাল, বড়ি, আলু আর ঘি। আমি একাই রাঁধছি, রান্নার সময় কাছে কেউ থাকে আমি পছন্দ করিনে। রান্নার আগে একবার চা করে খেলাম। পরের তৈরি চা খেয়ে তৃপ্তি পাইনে।
রান্না করতে রাত হয়ে গেল। রাত সম্পূর্ণ অন্ধকার। একটু জিরিয়ে তামাক খেয়ে নিয়ে ভাত নিলাম হাঁড়ি থেকে আস্ত কলার পাতে। তারপর খেতে বসলাম। খেতে বসবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল ছাদে আমি একা নই। এদিক-ওদিক চাইলাম, কেউ কোথাও নেই। রাত বেশি হয়েছে, বাড়ির লোকেও নীচের তলায় খেয়ে-দেয়ে শুয়েছে, গ্রামই নিশুতি হয়ে গিয়েছে। কেবল যমুনা নদীতে জেলেদের আলোয় মাছ ধরার ঠুক-ঠাক শব্দ হচ্ছিল।
হঠাৎ খেতে খেতে মুখ তুলে চাইলাম।
আমার সামনে ছাদের ধারে ওটা কী গাছ? কালো মতো, লম্বা তাল গাছের মতো? এতক্ষণ ছাদে বসে রান্না-বাড়া করছি, কই অত বড়ো একটা গাছ নজরে পড়েনি তো এর আগে! ছিল নিশ্চয়ই, নয় তো এখন দেখছি কী করে? কী গাছ ওটা? সত্যি, যখন চা খেলাম তখন দুটো বাড়ির মধ্যেকার ওই রাস্তাটা দিয়ে একখানা গোরুর গাড়ির ক্যাঁচ-কোচ শব্দে আমাকে ওদিকে তাকাতে হয়েছিল। তখন তো কই অত বড়ো তালগাছ— উঁহু, কই না, দেখিনি!
কিন্তু তালগাছটা এমনভাবে— ও কীরকম তালগাছ? ও কী? কী?
আমি ততক্ষণে বিভীষিকা দেখে ভাত ফেলে লাফিয়ে উঠে পড়েছি!
তালগাছ নয়।
এখনও ভাবলে— এই দেখুন গায়ে কাঁটা দিয়েছে। যদিও আমার নাম ভৈরব চক্রবর্তী। তান্ত্রিক। পিছনের ছাদের কার্নিশের ওপর দাঁড়িয়ে এক বিরাটকায় অসুর কিংবা দৈত্যের মতো মূর্তি, তার তত বড়ো হাত-পা সেই মাপে। মাথাটা ঢাকাই জালার মতো। চোখদুটো আগুনের ভাঁটার মতো রাঙা, আগুন ঠিকরে পড়ছে। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে অসুরটা, যেন আমাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে ফেলবে।
বিরাট মূর্তি! তালগাছের মতোই লম্বা, অনেক উঁচুতে তার মাথাটা, নীচু চোখে সেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ভালো করে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। দু-বার চোখ রগড়ালাম। দু-বার চা খেয়ে কী এমন হল? না, ওই তো সেই বিরাট তাল শাল নারকোল গাছের মতো তেঠ্যাঙা বেখাপ্পা অপদেবতার মূর্তি বিরাজ করছে সামনে জমাট অন্ধকারের মতো! এবার ভালো করে দেখে মনে হল, পিছনের ছাদে সেটা দাঁড়িয়ে নয়, কোথাও দাঁড়িয়ে নেই; দুই-বাড়ির মধ্যেকার ফাঁকটাতে দাঁড়িয়ে বলা যায়। কারণ ওই জীবের নাভিদেশ থেকে ওপর পর্যন্ত আমার সামনে। তার নীচেকার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার দৃষ্টিরেখার আড়ালে।
এ বর্ণনা করতে যত সময় লাগল, অতটা সময় লাগেনি আমার বার কয়েক দেখতে জীবটাকে। এক থেকে দশ গুনতে যত সময় লাগে, ব্যাস। আমি বলতে পারি অন্য যে কেউ ওই বিকট অপদেবতার মূর্তি অন্ধকারে নির্জন ছাদে গভীর রাতে দেখলে আর তাকে গোলার ধানের ভাত খেতে হত না পরদিন।
আমি অপদেবতা দেখেছি, পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসলে জপের শেষের দিকে ভয় দেখাত। কিন্তু সে যে এ-ধরনের বিকট ও বিরাট ব্যাপার নয়। ভয় পেয়ে গেলাম। ঠক-ঠক করে কাঁপতে লাগলাম। চোখে অন্ধকার দেখে পড়ে যাই আর কী! পড়লেই হয়ে যেত! দুর্বল মানুষ মরে ওদের হাতে। মন সবল হলে ওরাই পালায়।
নিজেকে তখুনি সামলে নিলাম। তারামন্ত্র জপ শুরু করলাম জোরে জোরে। সেইদিকে চেয়ে মন্ত্রজপ করতে করতে ক্রমে মূর্তি মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
মূর্তিটা আমার সামনে সবসুদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিল এক থেকে ত্রিশ গুনতে যতটা সময় নেয় ততটা। এর খুব বেশি হবে না কখনো। সেটা মিলিয়ে যেতে আর একবার চোখ রগড়ালাম, কিছুই নেই। বিশ্বাস করুন, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই নীচের তলা থেকে কান্নাকাটি উঠল। রুগি মেয়েটি মারা গিয়েছে।
—তখুনি?
—তখুনি। এ ব্যাপারের ব্যাখ্যা দিতে আমি রাজি নই। যা ঘটেছিল অবিকল তাই নিবেদন করলাম আপনাদের কাছে। বিশ্বাস করুন বা না করুন।
শ্রাবণ ১৩৫৫, মৌচাক