অশরীরী

অশরীরী

নানারকম অদ্ভুত গল্প হচ্ছিল সেদিন আমাদের লিচুতলার আড্ডায়। কিন্তু সে-সব নিতান্ত পানশে গোছের ভূতের গল্প। পাড়াগাঁয়ের বাঁশবাগানের আমবাগানের গেঁয়ো ভূত। সাদা কাপড় পরে রাত্রে দাঁড়িয়ে থাকে— ওসব অনেক শোনা আছে। ওর বেশি আর কেউ কিছু বলতে পারলে না।

এমন সময় শরৎ চক্রবর্তী আড্ডায় ঢুকলেন। তিনি আবগারি বিভাগে বহুদিন কাজ করে অবসর গ্রহণ করেছেন সম্প্রতি। ষাটের কাছাকাছি বয়স। তান্ত্রিক-সাধনা করেন। ঠিকুজি-কুষ্ঠি বিনা পয়সায় করে দেন। কোন রত্নের আংটি ধারণ করলে কার সুবিধে হবে, ঠিক করে দেন। পরের বেগার খাটতে ওঁর জুড়ি বড়ো একটা দেখা যাবে না এসব কাজে। লোক অতিসজ্জন, সকলে মানে, শ্রদ্ধা করে। অনেকে ওঁর সামনে ধূমপান পর্যন্ত করে না।

শরৎবাবু ঢুকে বললেন— এই যে, কী হচ্ছে আজ? যে বাদলা নেমেচে!

শ্যামাপদ মোক্তার বললে— আসুন, আসুন চক্কত্তিমশায়। আমাদের ভূতের গল্প হচ্ছে বাদলার দিনে। তবে তেমন জমচে না। আপনার তো—

শরৎ চক্রবর্তীমশায় বললেন— আমি একটা গল্প বলতে পারি, তবে সেটা ভূতের গল্প নয়। সেটা কীসের গল্প তা আমি জানিনে। আপনারা শুনে বিচার করুন।

শরৎবাবুর মুখে সেই গল্প শুনে আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম। স্বর্গমর্ত যেন একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেল সেই ঘন বর্ষার বর্ষণমুখর মেঘের আবরণ ভেদ করে।

শরৎবাবু বললেন— আমাকে সেবার হঠাৎ জলপাইগুড়ির ওধারে ডুয়ার্স অঞ্চলে বদলি করলে। আমার পরিবারবর্গ তখন ঢাকায়, তাদের ওখানে রেখে জলপাইগুড়ি চলে গেলাম। নতুন জায়গা। সেখানে নিজে না দেখেশুনে কী করে সবাইকে নিয়ে যাই। বিশেষ করে, ছেলেমেয়েরা তখন ঢাকা স্কুলে পড়াশোনা করচে।

যেখানে গেলাম সেখানটা জলপাইগুলি থেকে অনেক দূর। ছোটো লাইনে যেতে হয়, পথে চা-বাগান পড়ে। বনময় অঞ্চল। কিন্তু দূরে সবুজ বনরেখার পটভূমিকায় হিমালয়ের উত্তুঙ্গ শিখরমালা চোখে পড়ে। বড়ো নির্জন স্থান। আমি যে-জায়গায় গেলাম, তার নাম হলদিয়া। ছোট্ট জায়গা, আমি সেখানে গিয়ে সিনিয়র সাবইনস্পেকটরের বাসায় উঠলাম; কারণ, আমার বাসা তখনও ঠিক হয়নি। সে ভদ্রলোকের নাম, রেবতীমোহন মুখুজ্যে, বাড়ি নদীয়া জেলা। বেশ ফর্সা, লম্বা, দোহারা চেহারা। আমায় খুব যত্ন করলেন, দিন কয়েকের মধ্যেই বাসা ঠিক করে দেবেন ভরসা দিলেন।

তৃতীয় দিন সকালে আমায় বললেন— আপনাকে একটা কথা বলি—

—কী?

—আপনার এখন এখানে আসা খুব ভুল হয়েচে।

—কেন বলুন তো?

—আপনি জানেন না কিছু এদেশের ব্যাপার?

—না। কী ব্যাপার?

—এই বর্ষাকালে এখানে ভয়ানক ব্ল্যাক-ওয়াটার জ্বর হচ্ছে চারিধারে। আপনি নতুন লোক, আপনার তো খুবই জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। দু-এক বার জ্বর হলেই ব্ল্যাক-ওয়াটার জ্বর দেখা দেবে। তখন জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। এইরকম এদেশের কাণ্ড।

—তবে আপনারা আছেন কী করে?

—সেকথা আর বলে লাভ নেই। ইচ্ছে করে নেই। আছি পড়ে পেটের দায়ে। চাকরি ছেড়ে দিলে এ-বয়সে যাবো কোথায়, খাবো কী? আমার দু-টি মেয়ে পর পর মারা গিয়েচে ব্ল্যাক-ওয়াটার ফিভারে। তবুও বদলি পেলাম না। কী করি বলুন শরৎবাবু।

—তবেই তো—

—একটু সাবধানে থাকলেই হবে। জলটা গরম না-করে খাবেন না বাইরে গিয়ে।

—ব্ল্যাক-ওয়াটার ফিভার হলেই কী মানুষ মারা যায়?

—ভালো চিকিৎসা না-হলে বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। বিশেষ করে এই বর্ষাকালে যাঁরা নতুন আসেন, তাঁদের ধরলে বাঁচানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আমি এরকম দুটো কেস দেখেচি। দুটোই মারা গেল।

শুনে মনে ভয় হল, কিন্তু সাবধান হয়েই বা কী করবো। বিদেশে বেরিয়ে কতদূর সাবধান হওয়াই-বা চলে। যা থাকে কপালে ভেবে কাজ আরম্ভ করে দিলাম। দশ-বারো মাইল দূরে দূরে গাঁজার দোকান, মদের দোকান তদারক করে বেড়াতে লাগলাম।

খুব ভালোই লাগছিল। বর্ষার সবুজ অভিযান শুরু হয়েছে বনে বনে। কত রকমের ফুল ফোটে। কত ধরনের পাখি ডাকে। দূরে হিমালয়ের তুষারাবৃত কী একটা শৃঙ্গ একদিন দেখা গেল। মিছরির পাহাড়ের মতো ঝকঝক করছে সকালের সূর্যকিরণে। তবে রোদ বড়ো একটা উঠতে ইদানীং আর বেশি দেখা যেত না।

ইতিমধ্যে রেবতীবাবুর চেষ্টায় ভালো একটা বাসা পাওয়া গেল। উঁচু কাঠের খুঁটির ওপর কাঠের তক্তা বসিয়ে তার ওপর বাংলো ধরনের ঘর করা হয়েছে। কাঠের মেজে বেশ শুকনো খটখটে। ঘরটা বেশ বড়ো। আলো হাওয়া বেশ আসে।

মনের ভয় ক্রমে কেটে গেল। তখন মনে ভাবি, রেবতীবাবুর ওটা উচিত হয়নি। এখানকার মাটিতে পা দিতে না-দিতে অমন ভয় দেখিয়ে দেওয়া কি ভালো হয়েছে? কেন করলেন ওটা রেবতীবাবু? অন্য কোনো মতলব ছিল নাকি? সাত-পাঁচ ভাবি।

এখানে আমার এক ব্রাহ্মণ আরদালি জুটল। নাম দিগম্বর পাঁড়ে। লোকটা অনেকদিন সেখানে আছে। রান্না করত খুব ভালো। সে হাটবাজার রান্নাবান্না সবই করত। কোনো অসুবিধা ছিল না।

মাস-দুই পরে সেবার ‘বামনাপাড়া নর্থ’ বলে একটা জায়গায় আবগারি তদারকে গেলাম। সেটা একটা চা-বাগানের পাশে ছোট্ট বাজার। চা-বাগানটার ট্রাকগুলোর গায়ে লেখা আছে, ‘বামনাপাড়া নর্থ টি এস্টেট’। পাহাড়ি একটা ছোটো নদী পেরিয়ে আমার গোরুর গাড়ি বাজারে গিয়ে থামল। বেলা তখন দশটা। দু-টি মাড়োয়ারি মহাজনের গদি আছে। তারা বন অঞ্চলের উৎপন্ন সওদা করে। দেবেন সামন্ত বলে মেদিনীপুরের একজন ব্যবসায়ীর কাঠের কারবার আছে। গাঁজা ও আফিমের দোকান সেই দেবেন সামন্তের ভাই, শশী সামন্তের।

ওখানে বসে থাকতে থাকতেই আমার শরীর কেমন খারাপ হল। মাথা ধরল। দেবেন সামন্তকে বলতে সে কী একটা হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধ দিলে। বললে, এতেই সেরে যাবে। কোনো ভয় নেই।

আমি বললাম— আপনাদের এখানে ব্ল্যাক-ওয়াটার হয়?

—খুব।

—মানুষ মরে?

—তা মন্দ মরে না।

—আপনারা ভয় পান না?

—আমরা অনেক দিন আছি। নতুন যাঁরা আসেন, তাঁদের ভয় একটু বেশি।

সবাই দেখছি একই কথা বলে। গাঁজার হিসাব চেক করতে করতে আর যেন বসতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ি। জল তেষ্টা পাওয়াতে বামনাপাড়া নর্থ চা-বাগানের একটা গুমটি টিনের শেড থেকে জল চেয়ে খাই এক নেপালি দারওয়ানের কাছ থেকে।

যখন বাসায় পৌঁছলাম তখন বেলা গিয়েছে। আমার তখন খুব জ্বর। পথেই কম্প দিয়ে জ্বর এসেছে। খবর পেয়ে রেবতীবাবু ছুটে এলেন। ডাক্তার ডাকা হল। ওষুধ ও ইঞ্জেকশান চলল। তিনদিনের মধ্যে জ্বর ছেড়ে গেল।

দিন পনেরো বেশ আছি।

সবাই বললে, ঠান্ডা লেগে অমনটা হঠাৎ হয়েছিল। ও কিছু না।

আমিও নিজেকে সেইভাবেই বোঝালুম। আবার বেশ কাজকর্ম করি। শরীরে কোনো গ্লানি নেই। একদিন হলদিয়া পুলিশ থানায় বসে থানার দারোগার সঙ্গে গল্প করছি, হঠাৎ আবার জ্বর এল। দারোগাবাবু লোক দিয়ে আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

আরদালি দিগম্বর পাঁড়েকে বললাম— জল দাও। জল খেয়ে শুয়ে পড়ালাম, তিনদিন ভীষণ জ্বরের ঘোরে কাটল। রেবতীবাবু এবং থানার দারোগাবাবু দু-বেলাই আসতেন। কীভাবে আমার সাবু-বার্লি তৈরি করতে হবে, আমার আরদালিকে শিখিয়ে দিয়ে যেতেন। তিনদিন পরে জ্বর কমে গেল।

ক্রমে বেশ সেরে উঠলাম। কাজকর্ম আবার শুরু করে দিলাম। দিন পনেরো পরে চা-বাগানের একটা আবগারি কেস দেখতে গিয়েছি, আবার হঠাৎ জ্বর এল। এবার একটা জিনিস লক্ষ করলাম।

এখানকার জ্বর ভেল্কিবাজির মতো আসে, আবার ভেল্কিবাজির মতো চলে যায়। সুতরাং প্রথম প্রথম জ্বর এলে আমার যে-রকম ভয় হত, এখন গা সওয়ার দরুন সে ভয় একেবারেই নেই। আরদালিকে ডেকে বলে দিলাম, আগের মতো পথ্য প্রস্তুত করে আমাকে যেন খাওয়ায়।

এবার কিন্তু একটু অন্যরকম হল।

অতসহজে এবার আমি নিষ্কৃতি পেলাম না। দিন দুই পরে উৎকট ব্ল্যাক-ওয়াটার জ্বরের সব লক্ষণগুলি আমার মধ্যে ফুটে বেরুল। অতিরিক্ত রক্তপাতের দরুন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লাম। সেরে উঠতে পাঁচ-ছ-দিন লেগে গেল। দিন দুই পথ্য করার পর একদিন সকাল বেলা আমার সঙ্গে রেবতীবাবু আর দারোগাবাবু দেখা করতে এলেন। আরদালিকে চা করে দিতে বললাম, কিন্তু তাঁরা চা খেলেন না। পরে বুঝেছিলাম, তাঁরা চা খাননি— ব্ল্যাক-ওয়াটারকে ছোঁয়াচে জ্বর ভেবেই। দারোগাবাবু বললেন— শরৎবাবু, একটা কথা বলি।

—বলুন।

—আপনি এখান থেকে চলে যান।

—কেন বলুন তো?

—ডাক্তারবাবুর তাই মত।

—আমাকে তো কিছু বলেননি।

দারোগাবাবু ইতস্তত করে বললেন— না, আপনাকে বলেননি। আমাদের বলেছেন আপনাকে বলবার জন্য কিনা। তাই বলা উচিত ভাবলাম। উনি বলেছেন, আপনার অসুখ খুব খারাপ। মানে—

—আমি তো সেরে গিয়েছি।

—ও সারা বড়ো কঠিন শরৎবাবু।

—বেশ, তাহলে স্টেশন পর্যন্ত আমি যাবো কী করে? রক্ষিয়াঘাট পার হবার তো কোনো উপায় দেখিনে।

—কিছু ভাববেন না। স্ট্রেচার জোগাড় করছি চা-বাগান থেকে। কুলি পাঠাবো। পুলিশের একজন লোক সাথী থাকবে, আপনাকে ট্রেনে উঠিয়ে না-দিয়ে তারা ফিরবে না।

—বেশ।

আমি তখন জানতাম না যে, সেদিনই আমার জীবনের শেষদিন হত, যদি— কিন্তু সে কথা ক্রমে বলছি।

আমি সম্মতি দিলে দারোগাবাবু চলে গেলেন।

তখন বেলা ন-টা হবে। গরম জল করে নিয়ে আসতে বললাম আরদালিকে, গা-হাত মুছবো বলে। তারপর একবাটি বার্লি খেলাম। আরও একটু বেলা হলে দু-টি ভাতও খেলাম।

বেলা বারোটার পর লোকজন এল স্ট্রেচার নিয়ে। এই পর্যন্ত বলে শরৎ চক্রবর্তী বললেন— একটু চা খাবার ইচ্ছে হচ্ছে।

আমরা বললাম— গল্পটা শেষ করুন।

—চা খেয়ে নিয়ে বলবো। এই বার গল্পের আসল অংশটাতে এসে গিয়েছি কিনা, একটু গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলি।

নিতাইবাবু উকিল বললেন— একই কথা। আপনি বললেন, ব্ল্যাক-ওয়াটার জ্বর হল, সেরে গিয়ে আপনি পথ্য করলেন, অথচ ডাক্তারবাবু কেন আপনার অসুখ খারাপ বললেন? অসুখ তো সেরে গিয়েছিল।

—সেরে গিয়েছিল কীরকম সেবার, এখুনি সেটা শুনলে বুঝতে পারবেন। আসলে সারেনি।

—তবে পথ্য দিয়েছিল কেন ডাক্তার?

—এ-কথার জবাব আমি দিতে পারব না। কাউকে জিগ্যেসও করিনি। তবে যেমন ঘটেছিল, সেইরকম বলে যাচ্ছি—

—এটা একটা অদ্ভুত কথা বলছেন আপনি। কীরকম সে দেশের ডাক্তার বুঝলাম না মশাই!

—এ-কথাটা আমিও কখনো ভেবে দেখিনি। আচ্ছা, এবার বলি গল্প। শরৎ চক্রবর্তী পুনরায় গল্প আরম্ভ করলেন —

বেলা বারোটার পর স্ট্রেচার নিয়ে এল চা-বাগানের লোকজন। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন রেবতীবাবু ও দারোগাবাবু। আমি আর আরদালি জিনিসপত্র গোছাচ্ছি, এমন সময় আবার এল জ্বর। ভীষণ কম্পজ্বর! আর আমি বসতে পারলাম না। ঘরের মধ্যে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাঁধা বিছানা আরদালিকে দিয়ে খুলিয়ে পাতিয়ে শুয়ে পড়ালাম। এবার আমি আর কিছুই জানিনে। আমার সমস্ত চৈতন্য লুপ্ত হয়ে গেল এক ঘন অন্ধকারের আবরণের অন্তরালে।

যখন আবার আমার জ্ঞান হল, তখন দুটো জিনিস আমার চোখে পড়ল প্রথমেই। অন্ধকারের মধ্যে একটা কী গাছের ডাল পাশের জানালার বাইরে হাওয়ায় দুলছে। দ্বিতীয় জিনিস হল, আমার বাক্স ও পুঁটুলি আমার পায়ের দিকে দেওয়ালের কাছে রয়েছে এবং আমার ছাতিটা দেওয়ালের কোণে হেলানো রয়েছে।

আমি কি রেলওয়ে ট্রেনে উঠেছি?

কিন্তু এত অন্ধকার কেন রেলের কামরা? অন্য লোকই বা নেই কেন কামরায়? তারপর আস্তে আস্তে আমার মনের আকাশ মেঘমুক্ত হয়ে আসতে লাগল। আমার মনে পড়ল যে, আমি স্ট্রেচারে আদৌ উঠিনি, জ্বর আসাতে ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিলাম।

কিন্তু ঘরই যদি হয় আরদালি দিগম্বর কই? ঘরে আলো জ্বালেনি? আমি কোথায়?

তৃষ্ণা এসেছিল। ডাকতে গেলাম তাকে। গলায় স্বর আটকে গেল। দু-বার ডাকতে গেলাম, দু-বারই তাই হল।

আমার মনে হল বাইরে চাঁদ উঠেছে। জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে চাঁদের সামান্য আলো এসে পড়েছে। কিছুক্ষণ সামনের দিকে চেয়ে রইলাম, ঘরের মধ্যে বা বাইরে কোথাও কোনো শব্দ নেই।

হঠাৎ আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল বাইরের দিকে। কে ওখানে বাইরে?

এই দেখুন, এতদিন পরে মনে পড়েও আমার গা শিউরে উঠল। দেখলাম কী জানেন, একটি কালো মতো মেয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আমার ঘরের চারিপাশে ঘুরছে, আর একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে কী করছে— দু-বার আমার সামনের দরজার ফাঁক দিয়ে সে নীচু হয়ে ঘুরে গেল। তিন বারের বার মেয়েটি হঠাৎ মুখ উঁচু করে আমার দিকে চেয়ে হাত নেড়ে বললে— কোনো ভয় নেই— গণ্ডি দিচ্ছি— আজ রাত্রে কেউ গণ্ডির মধ্যে আসতে পারবে না, ঘুমো—

অতি অল্পক্ষণের জন্যে মেয়েটিকে চোখের সামনে দেখলাম, তারপর সে ঘুরে গেল ওদিকে। আমার আর জ্ঞান রইল না। ঘুমিয়ে পড়লাম কি?

এরপর কতক্ষণ পরে জেগে উঠেছিলাম তা বলতে পারব না; কিন্তু তখন চোখ খুলেই দেখলাম, সেই কালো মেয়েটি আমার শিয়রের কাছে বসে। তার বয়স আঠারো বছরের বেশি হবে বলে আমার মনে হল না। আর একটা জিনিস লক্ষ করলাম, মেয়েটি যেন খুব ঘেমেছে, ওর মুখ ঘামে ভিজে গিয়েছে যেন। সারাশরীর দিয়ে যেন দরদর করে ঘাম ঝরছে।

আমি ওর দিকে চেয়ে দেখতেই মেয়েটি চমৎকার শান্ত স্নেহময় সুরে বলে উঠল— জাগলি কেন? ঘুমো-ঘুমো— কোনো ভয় নেই, ঘুমো—

শেষবার যখন ও ‘ঘুমো’ বলেছে, তখন আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ওর কথা শুনতে শুনতে। ঘুমিয়ে পড়বার আগে সেই গাছের ডালটার দিকে নজর পড়ল জানালার বাইরে। তার গায়ে জ্যোৎস্না পড়েছে।

এইখানেই আমার গল্প শেষ হল।

সকালে আমি যখন জেগে উঠলাম, তখন আমার মনে হল, স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থায় ঘুম থেকে আমি জেগে উঠেছি।

আমার শরীরে কোনো গ্লানি নেই। কিন্তু শরীর বড়ো দুর্বল। বিছানা ছেড়ে উঠতে পরলাম না। ক্রমে ক্রমে একটু বেলা হল! তখন দেখি, দিগম্বর পাঁড়ে আরদালি সন্তর্পণে পা টিপে এসে ঘরের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। আমি ডাকতেই সে যেন চমকে উঠল, কোনো উত্তর দিল না। আমি বললাম— রেবতীবাবুকে ডেকে নিয়ে এসো।

থতমত খেয়ে সে যেন চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে অনেক লোক এল আমাকে দেখতে। তারমধ্যে রেবতীবাবুও ছিলেন।

রেবতীবাবু বললেন— কেমন আছেন শরৎবাবু?

—ভালো। আমি কিছু খাবো।

তখনই রেবতীবাবু বাইরে গিয়ে কাকে কী বললেন। খানিক পরে এক বাটি বার্লি এল আমার জন্যে। বার্লি খেয়ে শরীরে বল পেলাম। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন, জ্বর ছেড়ে গিয়েছে।

এর দিন-দুই পরে আমি সম্পূর্ণ নীরোগ হয়ে উঠলাম। পথ্যও করলাম। তখন ক্রমে ক্রমে শুনলাম, সেই ভীষণ রাত্রে আমাকে মুমূর্ষ মনে করে সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল একা ফেলে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন রাত কাটবে না। এমনকী, সকালে আমার সৎকারের জন্যে কে-কে যাবে, কোথায় কাঠ পাওয়া যাবে, এসব বন্দোবস্ত নাকি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সকালেই লোক পাঠিয়ে আমার পরিবারবর্গকে টেলিগ্রামে আমার মৃত্যুসংবাদ জানানোর জন্যে থানা থেকে একজন কনস্টেবল পাঠাবেন, দারোগাবাবু তাও ঠিক করে রেখেছিলেন।

অথচ সেই নির্বান্ধব, পরিত্যক্ত অবস্থায় কে আমার মৃত্যুশয্যার পাশে সারারাত বসেছিল, কে আমার ঘরের চারিধারে গণ্ডি এঁকে দিয়েছিল, আমাকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে। সবাই পরিত্যাগ করলেও কে আমাকে সেই অসহায় অবস্থার মধ্যেও পাহারা দিয়েছিল— এ-সব প্রশ্নের কোনো জবাবই আমি দিতে পারব না।

যদি আপনারা বলেন, সবটাই জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি— তারও কোনো প্রতিবাদ আমি করতে চাই না। স্বপ্ন যদি হয়, বড়ো মধুর, বড়ো উন্নত ধরনের উদার স্বপ্ন দেখেছিল আমার মুমূর্ষু মন। সে স্বপ্নের ঘোর আমার সারাজীবন চোখে রইল মাখা। মস্ত বড়ো একটা আশার বাণী দিয়ে গেল প্রাণে।

শরৎ চক্রবর্তী চুপ করলেন। মনে হল তাঁর চোখে যেন জল চকচক করছে। উকিল নিতাইপদ রাহা বললে— সেরে উঠে হলদিয়াতে আপনি ছিলেন কতদিন?

—যতদিন গবর্নমেন্ট আমাকে বদলি না করেছিল, প্রায় দু-বছর।

—এভাবে একা ছিলেন বাসায়?

—আমি আর দিগম্বর। আর কেউ না।

—আর কোনোদিন কিছু দেখেছিলেন?

—না।

—আর অসুখে ভুগেছিলেন?

—না।

.

ঘন বর্ষার রাত। বাইরে বেশ অন্ধকার। জোনাকি জ্বলেছিল উঠানের শিউলি গাছটার ডালে-পাতায়। আমরা সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। নিতাই উকিলও আর বেশি কথা বলেনি। বৃষ্টি এসে পড়বে বলে শরৎ চক্রবর্তীকে আমরা বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম ছাতি দিয়ে।

জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯, আরো একটি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *