2 of 3

বিদুরের খুদ

বিদুরের খুদ

যে কোনো শস্যের ক্ষুদ্র অংশ বা কণাকে বলা হয় খুদ। এদেশে সাধারণত চালের ক্ষুদ্র অংশকে খুদ বলি আমরা। দীনজনের বা গরিব মানুষের শ্রদ্ধাসহকারে নিবেদন করা সামান্য উপহারকে বিদুরের খুদ আখ্যায়িত করা হয় সাধারণভাবে।

মহাভারতের এক বিশিষ্ট চরিত্র বিদুর। চন্দ্রবংশীয় মহারাজ শান্তনুর পুত্র ভীষ্ম, চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। ভীষ্ম ছিলেন চিরকুমার। শান্তনুর প্রথম স্ত্রী গঙ্গার গর্ভে ভীষ্ম এবং দ্বিতীয় স্ত্রী দাসরাজকন্যা সত্যবতীর গর্ভ চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের জন্ম হয়। চিত্রাঙ্গদ অল্প বয়সে যুদ্ধে নিহত হন। কাশীরাজের কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকা ছিলেন বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী। বিয়ের সাত বছরের মধ্যে মহারাজ বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু হয় যক্ষ্মারোগে। তৎকালীন রেওয়াজ অনুযায়ী বিচিত্রবীর্যের বৈপিত্রেয় ভাই (সত্যবতীর কুমারী অবস্থায় পরাশর মুনির ঔরসে জন্ম) কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র এবং অম্বালিকার গর্ভে পাণ্ডুর জন্ম দেন।

বিচিত্রবীর্যের প্রথম স্ত্রী অম্বিকার রূপবতী শূদ্র দাসীর গর্ভে ব্যাসদের বিদুরের জন্ম দেন। বিদুর ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। বিদর্ভরাজ আহুকের পুত্র দেবকের এক শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত এক সুন্দরী কন্যার সাথে বিদুরের বিয়ে হয়। উল্লেখ্য যে, দেবকের অন্য সাত কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের বাবা বসুদেব। দেবকী ঐ দেবকের কন্যা। বলা যেতে পারে যে, বসুদেব ও বিদুর পরস্পর ভায়রা। অর্থাৎ বিদুর হলেন শ্রীকৃষ্ণের মেশোমশাই বা খালু। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সৎভাই বিদুর। ধর্ম ও আইন বিষয়ে বিদুর ছিলেন অত্যন্ত প্রাজ্ঞ। তার অনেক পুত্র ছিল। কৌরবদের মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাদের অন্যায় আচরণ ও লোভ বিষয়ে বিদুর বরাবর তাদের সতর্ক করেছেন এবং শান্তি স্থাপনের জন্য চেষ্টা করেছেন বারবার।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালে একবার শ্রীকৃষ্ণ হস্তিনাপুরে (দিল্লির পূর্বে মিরাটের কাছে গঙ্গার দক্ষিণ তীরে) এলেন যুধিষ্ঠিরের দূত হয়ে। ঐ সময় দুর্যোধন তাকে অভ্যর্থনা করে নেমন্তন্ন করেন। শ্রীকৃষ্ণ তার আতিথ্য গ্রহণে রাজি না হয়ে বললেন, ‘দূতগণ কাজ সমাধা হবার পরই ভোজন ও সেবা গ্রহণ করে থাকেন। অথবা লোকে বিপন্ন হয়ে বা কেউ প্রীতিপূর্বক দিলে অন্যের অন্ন ভোজন করে থাকে। আমার কাজ শেষ হয়নি। আমি বিপন্নও নই কিংবা আপনি আমাকে প্রীতিপূর্বক দিচ্ছেন না। সুতরাং নিরপেক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ মহাত্মা বিদুরের ভবন ছাড়া অন্য কোথাও আতিথ্য গ্রহণ করা আমার কাছে উপযুক্ত মনে হচ্ছে না।’

অতএব শ্রীকৃষ্ণ রওনা হলেন বিদুর-ভবনের উদ্দেশে। একজন মন্ত্ৰী হওয়া সত্ত্বেও সততা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে বিদুর যাপন করতেন সাধারণ জীবন। তার বাড়িতে সবসময় দারিদ্র্যের চিহ্ন থাকতো। এমনকি দু’বেলা ভালোভাবে খাবার জোটানোও তার পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। এমন নানা কিংবদন্তির কথা শাস্ত্রকাহিনীতে পাওয়া যায়।

একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণ বিদুর-ভবনে উপস্থিত হলে গরিব বিদুর দরিদ্রতাবশত অন্য বড় ধরনের খানার যোগাড় করতে না পেরে ঘরে থাকা চালের খুদ দিয়েই অতিথির ভোজন-আয়োজন করেন। শ্রীকৃষ্ণও পরম তৃপ্তি-সহকারে সেই খুদ খান।

বিদুর কর্তৃক সামান্য আহার্যে শ্রীকৃষ্ণকে আপ্যায়ন করার এই কাহিনী অনুসারে বিদুরের খুদ প্রবাদের উদ্ভব। এজন্য ভক্তি সহকারে সামান্য বস্তু প্রদত্ত হলে তাকে বিদুরের খুদ বলে। যেমন কেউ কাউকে স্বাভাবিক আপ্যায়ন করার পর বলে, ‘এ আমার বিদুরের খুদ।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *