বাঘের গল্প

বাঘের গল্প

বলেছি তো চার রকম গল্প খুব উতরোয়, বাঘের প্রেমের চোরের আর ভূতের। তার মধ্যে বাঘের কথাই ধরা যাক। ছোটবেলা থেকে বাবার কাছে অজস্র বাঘের গল্প শুনে এসেছি। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ সাব-ডিভিশনের মসূয়া গ্রামে।

চারদিকের জল-জংলায় বড় বড় ডোরাকাটা বাঘ কিলবিল করত। তারা দিনের বেলাও গ্রামে এসে দাপিয়ে বেড়াতে পেছপাও হত না! বেঘো কাশি শোনামাত্র চারদিকে, ‘বাঘ আইসে! বাঘ আইসে!’ রব উঠত। যে যেখানে ছিল দুমদাম দরজা-জানলা বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকত। যতক্ষণ না গাঙ পার হয়ে বাঘের বনে ফেরার খবর পাওয়া যেত, ততক্ষণ কেউ বেরোত না। শুনেছি বাবার ঠাকুমার সময়ও এইরকম অবস্থা ছিল।

বাবার ছোটবেলাটা দেশে কেটেছিল, তবে ততদিনে বাঘের উপদ্রব অনেক কমে গেছিল। কমেছিল, কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়নি। আমার বড় জ্যাঠা, মেট্রোপলিটান কলেজের অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায় পড়াশুনোর সঙ্গে সঙ্গে শরীর মজবুত করাতে বিশ্বাস করতেন। ছুটিছাটাতে দেশে গিয়ে গাঁসুদ্ধ ছেলেদের নিয়ে খেলাধুলো, মাছধরা, সাঁতার কাটা, শিকার করায় মেতে যেতেন।

কী শিকার? না বুনো শুয়োর আর শেয়াল। এরা গৃহস্থদের তরমুজ খেতের বড়ই ক্ষতি করত। ঠিক হল ফাঁদ তৈরি করে, শেয়াল ধরা হবে। মহা উৎসাহে জাল দিয়ে কাঠ দিয়ে ফাঁদ তৈরি হল। তারপর প্রায় রোজই ফাঁদে শেয়াল পড়তে লাগল। সকলের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল।

একদিন ছোট জ্যাঠা আর বাবা, দুজনে সবার আগে উঠে, বড়দের কাউকে কিছু না বলেই ফাঁদ দেখতে ছুটলেন। কেউ কোত্থাও নেই, চারদিক থমথম করছে, পাখিটাখিও ডাকছে না। আর ফাঁদের মধ্যে সমস্ত জায়গাটা জুড়ে, গোঁফ ফুলিয়ে একটা হলদে-কালো ডোরাকাটা বাঘ বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে। শুনেছি ঠাকুমার বকাবকির ফলে ফাঁদ ভেঙে ফেলা হল।

বাঘের সঙ্গে বাবার মোকাবিলা হয় এর অনেক পরে, যখন ভারতীয় জরিপ বিভাগের কাজে উত্তর-পূর্ব ভারতে, শ্যামদেশে, বর্মায় বনে-জঙ্গলে তাঁকে দলবল নিয়ে যেতে হত। যত না চোখে দেখতেন, তার চেয়েও অনেক বেশি আশ্চর্য সব গল্প শুনতেন।

একবার বর্মার বেঘো জঙ্গলে মাপজোকের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞ আর জবরদস্ত লোক নেওয়া হচ্ছিল। একজন লম্বা চওড়া আধাবয়সি পূর্ববঙ্গের লোক এসে দরখাস্ত দিল। এই ধরনের লোকই দরকার ছিল, শক্তপোক্ত শরীর, মনে হল কষ্ট সইতে পারবে আর সাহস আছে। লোকটাকে বাবার পছন্দ হল।

দোষের মধ্যে বাঁ হাতটা কাঁধ থেকে কাটা, অথচ বর্মার দুর্গম সব জায়গায় অনেক দিন কাটিয়ে এসেছে, ওদিককার ভাষাও কিছু কিছু জানে। একটা ভাষা তো আর নয়; জায়গায় জায়গায় স্থানীয় ভাষা। জরিপের কাজও খানিকটা রপ্ত ছিল; একটা হাত কুড়িটা হাতের মতো দক্ষ। শেষ পর্যন্ত তাকেই নেওয়া হয়েছিল এবং অনেক বছর সে ওস্তাদের মতো জরিপের কাজ করেছিল। নাম তার রাঘব।

সেই লোকটার মুখে বাবা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কাহিনি শুনেছিলেন। সেকালে অনেক সাহসী বাঙালি ব্যাবসাদার কাঠ কাটার জন্য বর্মার বনের অনেকখানি করে জায়গা ইজারা নিত। ভারতে বর্মায় সব জায়গায় ব্রিটিশ রাজত্ব, তাই এতে কোনও অসুবিধা ছিল না।

বর্মার বন নানারকম দামি গাছে ভরতি ছিল, শাল, সেগুন, মেহগিনি। আসবাব তৈরি করার জন্য সুদূর বিদেশেও তার চাহিদা ছিল। ভাল টাকা পাওয়া যেত বলে রাঘব আর তার ছোট ভাই জানকী নাম লিখিয়ে বর্মা গেল। বয়স তাদের কুড়ি-একুশ, বিয়ে-থা করেনি, ভারী বেপরোয়া।

বনের মাঝখানে কাঠগুদামের ক্যাম্প। ও জায়গায় মানুষখেকো বাঘের বেজায় উপদ্রব। কাছেই সালওয়েন নদী বয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পের চার দিক ঘিরে ২৫ ফুট গাছের গুঁড়ির দেওয়াল। সেই দেওয়ালে যাওয়া-আসার দরজা বসানো। বাঘ নাকি ২২ ফুটের বেশি লাফায় না। অন্তত ইজারাদার তাই বুঝিয়েছিল।

সারাদিন বাঘেরা ঝোপেঝাড়ে গাঢাকা দিয়ে থাকত, সন্ধে হলে বেরোত। খালাসিরাও সারাদিন দা টাঙি কুড়ুল বন্দুক নিয়ে হই-হল্লা করে গাছ খুঁজত, পরখ করত, মাপত, দাগা দিত, পরে কাটতও। কিন্তু সূর্য ডোবার আগেই রোজ ডেরায় ফিরে আসত।

ডেরা মানে ওই ২৫ ফুট দেওয়াল ঘেরা, লম্বা একটা কাঠের বাড়ি। তাতে দুটি মস্ত ঘর। একটাতে ২৬টা সরু তক্তাপোশ। প্রত্যেকটার তলায় মালিকের ছোট টিনের তোরঙ্গ। অন্যটাতে উনুন আর রান্নার সরঞ্জাম, ২৬টা পিঁড়ি, তাকের ওপর ২৬টা পেতলের থালা, বাটি, গেলাস। তখনও ওসব জায়গায় অ্যালুমিনিয়ামের চল হয়নি।

ঘোর জঙ্গলে চোরের উপদ্রব ছিল না। তা ছাড়া ২৬ ফুট দেওয়াল ঘেরা ক্যাম্প। বেরোবার ফটকে তালা দেওয়া থাকত। এমনি স্বাস্থ্যকর হলেও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল। জানকী দুজন লোক সঙ্গে নিয়ে, কাছের গঞ্জ থেকে মাসকাবারের সওদা করতে গিয়ে, জ্বর গায়ে ফিরল।

জানকী তো শয্যা নিল। ম্যালেরিয়ার বড়িও খেল। এদিকে বর্ষা নামার আগে গাছ-কাটার কাজ শেষ করে ফেলতে না পারলে, বড় ক্ষতি হবে। সকলেই মহা ব্যস্ত, রুগি দেখে কে? শেষপর্যন্ত তাকে ওষুধপত্র দিয়ে, মাথার কাছে খাবার জল রেখে, সবাই কাজে বেরোল। খেয়েদেয়ে বেরোত, আবার ফিরে এসে পালা করে রান্না চাপাত।

তা ফিরবে তো সেই সন্ধ্যার আগে। জ্বোরো ভাইকে একা ফেলে রেখে যেতে রাঘবের মন খুঁতখুঁত করলেও, উপায় ছিল না। বাতাস চলাচলের জন্য বাড়ির দরজা খোলা রইল। বাইরের ফটকে তালা দেওয়া হল।

বিকেলে ফিরে এসে জানকীর কাছে যেতেই, সে বলল, ‘দাদা, এই বড় বাঘ এসে তক্তাপোশ আর পিঁড়ি গুনে গেছে। রাতে এসে নিশ্চয় মানুষ নিয়ে যাবে। চল, আমরা সকলে নৌকো করে গঞ্জে পালাই।’

এ কথা শুনে ক্যাম্পের লোকদের কী হাসি! ‘ব্যাটা প্রলাপ বকছে। বাঘ কি ২৫ ফুট লাফাতে পারে, না কি পিঁড়ি গুনতে পারে! আমরা এই ক্লান্ত শরীরে দাঁড় বেয়ে গঞ্জে যাই আর কী!’

কিন্তু জানকী ওদের কথা মানল না। তখন তার জ্বর নেই, মাথা ঠান্ডা। সে বলল, ‘আমি তো জানি কী দেখেছি। দাদা, ওরা যখন যাবেই না। চল আমরা যাই। বিধবা মায়ের ছেলে আমরা।’

ওর পেড়াপিড়িতে শেষপর্যন্ত দুই ভাই দুটি কাটারি হাতে বেরিয়ে পড়ল। ক্যাম্পের সকলে হতভম্ব। নদীর ঘাটে পৌঁছে জানকী বলল, ‘আগে ওদের নেবে। তারপর বাঘেরা আমাদের খুঁজতে আসবে। ওরা সাঁতার জানে। এসো খান ২০-২৫ বল্লম বানাই।’

বল্লম বানাতেই রাত হয়ে গেল। তারি মধ্যে জানকী হঠাৎ বলল, ‘ওই দেখ!’ রাঘবের মনে হল কী একটা বড় জিনিস নিয়ে একটা বাঘ বনে ঢুকে পড়ল! রাঘবের মুখে আর কথা নেই!

আরও ৮-১০টা বল্লম আর মশাল তৈরি করতে আরও ৫-৭ বার ওইরকম মনে হল। তারপর ভীষণ গর্জন শোনা যেতে লাগল। জানকী বলল, ‘আর দেরি নয়। ওরা বুঝেছে দুটো লোক কম! শীগগির মশাল বল্লম নিয়ে নৌকোয় ওঠা যাক।’

মনে মনে রাঘব ভাবছিল, আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে! কিন্তু মাঝ নদীতে পৌঁছবার আগেই কয়েকটা বাঘ জলে নেমে ওদের পিছু নিল। তখন মশাল জ্বেলে বল্লম নিয়ে একজন তাদের ঠেকায়, আর একজন প্রাণপণে দাঁড় টানে! এইভাবে অনেক কষ্টে প্রাণ হাতে নিয়ে এক সময় তারা বনের এলাকা ছাড়িয়ে এল। বাঘেরা পেছিয়ে পড়ল। এর মধ্যে একটা বাঘ নৌকোর কাঁদার কাছে এসে থাবা মেরে রাঘবের হাতের অনেকটা মাংস তুলে নিয়েছিল। গঞ্জে পৌঁছে ওষুধপত্র করলেও, হাতটা বিষিয়ে গেল। হাত কেটে ফেলতে হল।

ইজারাদার ওদের কথা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু বন্দুক-টন্দুক নিয়ে যারা দেখতে গেছিল, তারা ফিরে এসে বলল, ‘কেউ নেই। খালি থাবার দাগ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *