খাওয়া-দাওয়া

খাওয়া-দাওয়া

পৃথিবীতে যতরকম আনন্দের ব্যাপার আছে, তার মধ্যে জনপ্রিয়তা আর পরিতৃপ্তির দিক থেকে খাওয়ার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা হয় না। অন্য আনন্দগুলোকে ছাড়তে হলে, হাজার কষ্ট হোক, তবু প্রাণে বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু খাওয়া ছাড়লেই অক্কা। তা ছাড়া নিজে খেতে যত না আনন্দ, পরকে খাওয়ানোতে তার চাইতেও বেশি আনন্দ। ভোগে জগতে খাওয়ার মতো জিনিস নেই। আর খাওয়া নিয়ে যেমন সব সরস গল্প শোনা যায় তেমন আর কিছু নিয়ে নয়।

আমার বাবা জরিপের কাজে বর্মার জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছিলেন। সেই সময় ঘোর বনের ধারে এক কাঠগুদামের মালিকের সঙ্গে ভাব হয়েছিল। লোকটি পশ্চিমা বামুন, তার রাঁধবার লোকটিও পশ্চিমা বামুন। মালিক বাবাকে একদিন রাতে খেতে বললেন।

বাবা মহা খুশি। ডাল আর শুকনো আলু আর নিজের হাতে মারা হরিণের মাংস খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছিল। ভেবেছিলেন নিশ্চয় পুরি আর ভাল ভাল ভাজি আর ক্ষীরের মিষ্টি খাওয়া যাবে। গিয়ে দেখলেন সে-গুড়ে বালি। মস্ত মস্ত দুটো বনমোরগ রোস্ট হচ্ছে। চারদিক সুগন্ধে ম-ম করছে। বলাবাহুল্য পুরি ভাজি না পেলেও সেদিনের খাওয়াটা মন্দ হয়নি।

খাওয়ার পর মুখে আমলকীর চূর ফেলে বাবা বললেন, ‘খুব ভাল খেলাম। তবে আমি অন্যরকম আশা করেছিলাম।’

লোকটি হাসলেন, ‘বামনাই খাবার বুঝি? তবে শুনুন আমার কাহিনি। আমরা বংশানুক্রমে ঘোর নিরামিষাশী। এখানে এসে বন্ধুবান্ধবের দলে পড়ে মাছ-মাংস খেতে শিখলাম। কেউ গিয়ে অমনি বাবার কানে কথাটা তুলে দিল। বাবাও পত্রপাঠ আমাদের পৈতৃক বামুনঠাকুরের ছেলেকে এখানে পাঠিয়ে দিলেন।

‘সে নিজে তো মাছ-মাংস ছোঁবেই না, আমি স্টোভে নিজের মতো বেঁধে খেলেও নাক সিঁটকোবে, নানারকম আপত্তিকর মন্তব্য করবে। ক’দিন আর সহ্য করা যায় বলুন?

‘শেষটা একদিন দুটো মোটাসোটা মুরগি নিয়ে ওর রান্নাঘরে ঢুকলাম। ও হাঁ হাঁ করে তেড়ে এল। আমি বললাম, ‘এ দুটোকে কাট্‌।’ ও বলল, ‘প্রাণ থাকতে নয়।’ আমি তখন পায়ের চটি খুলে ওকে আগাপাশতলা পেটালাম। ও বলল, ‘কাটছি! কাটছি!’

‘কাটা হয়ে গেলে বললাম, ‘এবার রাঁধ।’ ও বলল, ‘কিছুতেই না।’ আমি চটি খুলতেই ও বলল, ‘রাধছি! রাঁধছি!’ রান্না হলে, দু’ভাগ করে বললাম, ‘অর্ধেকটা তুই খা!’ ও বলল, ‘মেরে ফেললেও না।’ আমি তখন আবার চটি খুললাম। ও-ও সঙ্গে সঙ্গে থালা টেনে নিয়ে খেতে বসে গেল।

‘পরদিন কিছু বললাম না। ভাবলাম একটু একটু করে সইয়ে নিতে হবে। কিন্তু সেদিন ব্যাটা নিজের থেকেই মুরগি কিনে এনে, কেটেকুটে, বেঁধে-বেড়ে, দু’ভাগ করে, বড় ভাগটি নিজের জন্য তাকে তুলে রেখে দিল। সেই ইস্তক খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আর কোনও অসুবিধা হয়নি।’

এই তো গেল সুখীদের গল্প। আমার বন্ধু মীরা দত্তগুপ্তর জ্যাঠামশাই ছিলেন বাবার বন্ধু। সেই করুণা জ্যাঠার কাছে একটা চমৎকার গল্প শুনেছিলাম। উনি ছিলেন নামকরা এঞ্জিনিয়ার। একবার কোনও কাজে চাঁদপুরের ওদিকে যেতে হয়েছিল। কাজ সেরে ফেরবার পথে, বড় জাহাজে উঠে শুনলেন, তখনও ছাড়তে ঘণ্টা দুই দেরি আছে।

ওপরের ডেকে দাঁড়িয়ে জ্যাঠামশাই চারদিকের মনোরম দৃশ্যপট দেখতে লাগলেন। হঠাৎ চোখ পড়ল জাহাজের পাশে বাঁধা একটা ছোট মাছধরার নৌকোর ওপর। তার পাটাতনে তোলা উনুনে টগবগ করে ভাত ফুটছে। পাশে ছোট্ট কড়াইতে কলাপাতা চাপা দেওয়া কী যেন রয়েছে।

একটু পরেই স্নান উপাসনা সেরে, জেলে খেতে বসল। একটা কান-তোলা, চটা-ওঠা কলাই-করা থালায় এক রাশি ধোঁয়া-ওঠা ভাত ঢালল। তারপর কলা-পাতা তুলে, কড়াই কাত করে লাল রগ্‌রগে কীসের ঝোল ভাতের ওপর ঢেলে দিল। জ্যাঠামশাই দেখলেন প্রকাণ্ড বড় কীসের যেন ডিমের ঝোল। সাধারণ হাঁস-মুরগির অত বড় ডিম হয় না।

লোকটা ডিমটাকে কেবলি পাতের এধার থেকে ওধারে সরায় আর লাল রগ্‌রগে ঝোল দিয়ে ভাত মেখে, এই বড় বড় গরাস মুখে ফেলে আর উঃ! আঃ! করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে চিবিয়ে গেলে। কিন্তু ডিমটাকে ভাঙে না। শেষটা যখন ঝোল দিয়ে ভাতের পাহাড় শেষ হল, তখন হাত বাড়িয়ে নদীর জলে আঁচিয়ে, ডিমটাকে ভাল করে ধুয়ে-মুছে একটা থলির মধ্যে তুলে রাখল।

এবার জ্যাঠামশাই আর কৌতূহল চাপতে না পেরে, ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওটা কী করলে, ভাইজান?’ ওপর দিকে তাকিয়ে, সে বলল, ‘রোজ শুধু লঙ্কার ঝোল খেয়ে পেট ভরে না, বাবু তাই নুড়িটে দিয়ে রাঁধি।

একেক সময় ভাবি, ভাল খেতে, মন্দ খেতে বলে কিছু নেই; যার যেমন অভ্যেস। পঞ্চাশ বছর আগে শান্তিনিকেতনের কাছে সাঁওতালদের গ্রামে, বিশ্বভারতীর ছেলেরা একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছিল। বেশ পড়াশুনো করত ছেলেমেয়েরা।

পুরস্কার বিতরণের দিন সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া হল। আমরা চাঁদা তুলে দিয়েছিলাম। তাই দিয়ে শিঙাড়া জিলিপি কেনা হয়েছিল। পয়সা পয়সা করে ফুলকপির শিঙাড়া, পয়সা পয়সা জিলিপি। ছেলেমেয়েরা মহা খুশি।

পরে একটা ছোট ছেলেকে বললাম, ‘কী রে, জিলিপি শিঙাড়া কেমন লাগল?’ সে এক গাল হেসে বলল, ‘খুব ভাল। কিন্তুক্‌ মেঠো ইঁদুর আরও ভাল।’

পছন্দের কি আর কোনও নিয়মকানুন আছে? ওই সময় দিনু ঠাকুর একদিন আমাদের দুপুরে নেমন্তন্ন করলেন। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে শুঁট্‌কিমাছের ঝাল চচ্চড়িও ছিল। আমরা ডাল-ফেলা, পোরে ভাজা, নারকেল চিংড়ি ইত্যাদি খেয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে শুঁটকিমাছটি বারান্দার নীচে ফেলে দিলাম। কিন্তু দিনুদাদা একগ্রাস শুঁটকিমাছ আলাদা করে রেখে দিলেন, পায়েস খাবার পর মুখশুদ্ধি করবেন বলে।

সেই বর্মাতেই বাবা একবার এক মাসের ওপরে ঘোর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে, একদিন সন্ধ্যায় একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছলেন। সেখানে একটা বর্ধিষ্ণু গাঁ। গাঁয়ে সেদিন ঙাপ্পি তোলা হচ্ছে, তার গন্ধে গ্রামে টেকা দায়। শেষটা বাবারা গ্রামের বাইরে যেদিক থেকে বাতাস আসছিল, সেইদিকে তাঁবু ফেললেন।

বাবা স্নান সেরে, তাঁবুর বাইরে, ক্যাম্প-চেয়ারে বসলেন। তাঁর চাকর শশী ঘি দিয়ে লুচি ভাজতে লাগল। এমন সময় গাঁয়ের মোড়ল এসে হাত জোড় করে বলল, ‘ও সায়েব, তোমরা কী রান্না করছ, তার বিকট গন্ধে আমরা টিকতে পারছি না। দয়া করে আর কোথাও উনুন সরাও।’ ততক্ষণ লুচি ভাজা হয়ে গেছিল, কাজেই বাবা তাকে আশ্বাস দিয়ে ফেরত পাঠালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *