বসে থাকা সেই পর্যবেক্ষক

বসে থাকা সেই পর্যবেক্ষক

এমনিতেই শরীরটা ভালো লাগছিল না, তার ওপর সে রাতে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তাই রাতে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটা তখন নিজের কাছে একদম বাস্তব মনে হচ্ছিল।

ঘুম ভেঙে যাবার পর চাদরের তলায় মাথাটা ঢেকে স্বপ্নটা আবার রোমন্থন করার চেষ্টা করলাম। নাহ, দুঃস্বপ্ন ছিল না সেটা। বরং অনেকদিন পর সুখী সুখী বোধ হচ্ছিল। সমস্যা হচ্ছে, সুখের অনুভূতি জাগানো স্বপ্নের থেকে কষ্টদায়ক আর কিছুই নেই এই জগতে।

স্বপ্নটায় আমি একটা পার্কে অবস্থান করছিলাম। চেনাজানা কোনো পার্ক ছিল না সেটা। তবে সেখানে আমার আশপাশে যারা ছিল, সকলেই ছিল আমার এলিমেন্টারি স্কুলের সহপাঠী। মনে হচ্ছিল, পার্কটায় কোনো ক্লাস রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সকলেই আতশবাজি নিয়ে খেলা করছিল। আতশবাজির ফুলঝুরিতে চারদিকে আলোকিত। আমি পার্কের একদম প্রান্তে দাঁড়িয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছিলাম।

“হাইস্কুল কেমন কাটছে?”

হঠাৎ করে হিমেনো আমার পাশে উদয় হয়ে প্রশ্ন করে বসল।

আমি তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কেন জানি তাকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল। শেষ তাকে যখন দেখেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল দশ। তাই এখন তার চেহারা কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। হয়তো সে কারণেই আমার মস্তিষ্ক স্বপ্নের ভেতর তার কোনো চেহারা তৈরি করতে পারেনি।

“খুব একটা আনন্দ পাচ্ছি না,” সত্যিটাই বললাম তাকে। “কিন্তু খুব যে খারাপ কাটছে, সেটা বললে ভুল হবে।”

“মনে হয় আমার সেরকমই কাটছে,” হিমেনো একমত হলো।

মনে মনে অবশ্য তাকে এরকম থাকতে দেখে খুশিই হলাম। আমি একা নই তাহলে।

“বারবার ঐ সময়ের কথা মনে পড়ছে আজকাল,” সে বলল। “মনে হচ্ছে, আগের ঐ সময়টাই সবচেয়ে আনন্দের ছিল।”

“কোন সময়?” জিজ্ঞেস করলাম।

উত্তর না দিয়ে সে আমার দিকে তাকাল। “তুমি কি এখনও তুচ্ছ একটা মানুষ রয়ে গিয়েছ কুসোনাকি?”

“তাই তো মনে হয়,” তার প্রতিক্রিয়াটা বোঝার চেষ্টা করলাম।

“ওহ,” হিমেনো মুচকি হাসল। “আমিও হয়তো তাই রয়ে গিয়েছি”।

বলেই হেসে ফেলল সে। গাল দুটোয় টোল পড়ল তার। সে আরও যোগ করল, “ভালোই হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ীই সবকিছু হচ্ছে।”

“হ্যাঁ, একদম পরিকল্পনামত,” সহমত হলাম তার সাথে।

ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।

বিশ বছর বয়সী কারো এরকম স্বপ্ন দেখার কথা না। খুব ছেলেমানুষী একটা স্বপ্ন ছিল সেটা। নিজের ওপর ঘেন্না লাগছিল এরকম স্বপ্ন দেখার জন্য। কিন্তু মনের ভেতর একটা অংশ চেষ্টা করছিল স্বপ্নের স্মৃতিটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। স্বপ্নটাকে ভুলতে দেয়া যাবে না। শূন্যে যেন মিলিয়ে না যায় স্বপ্নটা।

হ্যাঁ, দশ বছর বয়সে হয়তো হিমেনোকে আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না। যদি কোনো প্রকার ‘ভালোলাগা’ লেগেও থাকে তখন, তার পরিমাণ ছিল অতিক্ষুদ্র।

সমস্যা হচ্ছে, সে চলে যাবার পর এই ক্ষুদ্র পরিমাণ ভালো লাগাটা আর কারোর প্রতিই লাগেনি।

হয়তো সেই অতিক্ষুদ্র পরিমাণ ভালো লাগাটাই আমার জীবনের সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ দিয়েছিল-আফসোস, সে চলে যাবার পরই সেটা টের পেয়েছিলাম আমি।

হিমেনোকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের প্রতিটা জিনিস একদম মুখস্থ করে ফেলার পরে আমি শুয়ে শুয়ে গতকালের ঘটে যাওয়া সবকিছু ভাবতে লাগলাম। পুরোনো ঐ বিল্ডিংটায় গিয়ে আমি তিনমাস বাদে বাকি সবটুকু আয়ু বিক্রি করে এসেছি।

কোনো দুঃস্বপ্ন ছিল না সেটা। পরের দিন ঘুম থেকে ওঠার পরও সেটা উধাও হয়ে যায়নি। আসলেই সেটা ঘটেছে।

না, এরকম খেয়ালের বশে নিজের জীবনটা বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্তটা আমাকে ভাবাচ্ছে না। অবশ্য কী যে বিক্রি করে এসেছি, সেটার মূল্য আমি এখনও টের পাচ্ছি না। বরং কেন জানি নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে।

জীবনটাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম একটা ছোট্ট আশা থেকে হয়তো- হয়তো ভবিষ্যতে ভালোকিছু ঘটবে আমার সাথে। একদমই অযৌক্তিক একটা আশা ছিল সেটা। কিন্তু সেই অযৌক্তিক আশাটা ছেড়ে দেয়াও অনেক কঠিন একটা কাজ। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা মানুষটাও আশা করে, একদিন ভাগ্য বদলে যাবে তার, মুছে দেবে সকল দুঃখকষ্ট।

এই আশাটা আমাকে মুক্তি দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বন্দীও করে ফেলেছিল।

আসলে এই জিনিসটা আমার জন্য দরকার ছিল। কেউ যখন আপনাকে নিশ্চয়তার সাথে জানাবে, ‘ভবিষ্যতে আপনার সাথে ভালোমন্দ কিছুই ঘটবে না’, তখন স্বাধীনতা অনুভব করবেন আপনি

এখন নিশ্চিন্তে মরা যায়।

এখন তাহলে জীবনটাকে একটু উপভোগ করে দেখা যাক।

যখন তিন মাস পর আমার আয়ু শেষ হয়ে যাবে, তখন একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, “জঘন্য একটা জীবন কাটিয়েছি আমি। কিন্তু মৃত্যুটাকে সত্য বলে মেনে নেবার পরের শেষ এই তিন মাস খুব সুখী ছিলাম আমি।”

প্রথমে কোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে কিছু ম্যাগাজিন পড়ব। তারপর বাকি সময়টুকু দিয়ে কী করা যায় ভেবে দেখব আমি। ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল বেজে উঠল।

কারো তো আসার কথা না। কয়েক বছর কেটে গিয়েছে কেউ আসেনি আমার বাসায়, আগামী তিনমাসেও কারো পদধূলির অপেক্ষায় ছিলাম না। যেই আসুক না কেন, ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না।

কলিংবেলটা আবার বেজে উঠল।

ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়েই টের পেলাম, ভুল হয়ে গিয়েছে। গতরাতের মাথা ব্যথা এখনও দূর হয়নি। এখনও হ্যাংওভারে ভুগছিলাম। তা সত্ত্বেও টলতে টলতে দরজার সামনে গিয়ে দরজাটা খুললাম। দেখি, অপরিচিত একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাশে একটা চাকাওয়ালা স্যুটকেস। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সেটা তার।

“আপনি কে?” জিজ্ঞেস করে বসলাম।

আমার প্রশ্নটা শুনে মেয়েটা যে বিরক্ত হয়েছে তার মুখভঙ্গি দেখে সহজেই বোঝা গেল। সে ব্যাগ থেকে চশমা বের করে পরে নিল। তার চোখমুখের ভঙ্গি এখন বলছে : কী, এইবার পরিষ্কার তো?

ঠিক তখনই চিনতে পারলাম তাকে।

“গতকাল যিনি আমার জীবনের মূল্য হিসাব করেছিলেন-”

“ঠিক ধরেছেন,” মেয়েটা জবাব দিল।

গতকাল তার স্যুট পরা অবয়বটা মাথায় এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে, সাধারণ পোশাকে দেখে তাকে চিনতে পারিনি। সুতির ব্লাউজ আর নীল রঙের ডেনিম স্কার্ট পরে ছিল সে। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে খানিকটা ভেতরের দিকে বেঁকে গিয়েছে। অবশ্য আগের দিন সেরকম ছিল কিনা তা বলতে পারছি না, কারণ তখন সে চুল বেঁধে রেখেছিল। চোখজোড়ায় কেমন জানি একটা বিষণ্ণতা খেলা করছিল তার। ডান পায়ের উরুতে একটা বড়সড় ব্যান্ডেজ লাগানো ছিল। ক্ষতটা বোধহয় ভালোই গভীর, কারণ ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত ব্যান্ডেজের নিচের অংশ সামান্য ভিজিয়ে দিয়েছে।

তার বয়স আঠারো থেকে চব্বিশের মধ্যে প্রথম দেখায় আমি এটাই ধারণা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে সাধারণ পোশাকে দেখে বুঝতে পারলাম, মেয়েটা আমার বয়সী। তারমানে উনিশ কি বিশ হবে বয়স।

কিন্তু সে এখানে কী করছে?

প্রথমে মনে হলো, সে বোধহয় এখানে আমাকে জানাতে এসেছে যে গতকালের হিসেবে খানিকটা ভুল ধরা পড়েছে। নম্বরগুলো উল্টোপাল্টা করে ফেলেছে সে হয়তো। কারো সাথে মিলিয়ে ফেলা অস্বাভাবিক কিছু না। কেন জানি মনে মনে একটু আশা করতে থাকলাম, হয়তো সেজন্য আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে।

পরে থাকা চশমা সে খুলে আবার কেসে রেখে দিল। তারপর অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে।

“আমার নাম মিয়াগি। আজ থেকে আমি আপনার পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকব,” বলে সে মাথা নোয়াল।

পর্যবেক্ষক।

ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। সে গতকাল আমাকে এ ব্যাপারে জানিয়েছিল। এখন মনে পড়ছে তার কথাবার্তা শুনে। কথাটা মনে পড়ে যেতেই গতকালকের ঘটনাটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। বমিটা কোনোমতে ঠেকিয়ে টয়লেটের দিকে দৌড় দিলাম।

একদম খালি পেট নিয়ে টয়লেট থেকে বের হবার পর দেখি, মিয়াগি দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো মনিটর করাই তার কাজ, কিন্তু অন্যের সাথে কীভাবে দূরত্ব মেনে চলতে হয় সেটা তার জানা নেই। তাকে সরিয়ে আমি বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পানি মুখে নিয়ে কুলকুচা করে, গড়গড় করে পিচিক করে সে পানি ফেলে দিলাম। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে মেঝেতে বিছানার ওপর বসলাম আমি। মাথাব্যথাটা আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। আজকের আবহাওয়া আর্দ্র হওয়ায় তা ব্যথা নিরাময়ে কোনো কাজেই দিচ্ছে না।

“গতকাল আপনাকে যেটা ব্যাখ্যা করেছিলাম,” মিয়াগি এখন আমার বালিশের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। “আপনার এখন একবছরেরও কম আয়ু রয়েছে। তাই এখন থেকে সর্বক্ষণ আপনার পাশে একজন পর্যবেক্ষক থাকবে। সেই সাথে—”

“এসব কথাবার্তা পরে বললে হয় না?” বিরক্ত হয়ে বললাম আমি। “দেখতেই পাচ্ছেন, আমার শরীরের কেমন বেহাল অবস্থা। এখন এসব ব্যাখ্যা শোনার মতো শরীর আমার নেই।”

“ঠিক আছে। আমি তাহলে অপেক্ষা করছি।”

বলেই মিয়াগি তার স্যুটকেসটা নিয়ে ঘরের কোণে চলে গেল। দেয়ালে স্যুটকেসটা ঠেস দিয়ে রেখে সে মেঝেতে বসে পড়ল। হাত দুটো দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে চুপচাপ করে বসে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে।

বুঝতে পারলাম, আমি যতক্ষণ অ্যাপার্টমেন্টে থাকব, সে বসে থেকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করবে।

“ধরে নিন, আমি এখানে নেই,” মিয়াগি ঘরের কোণ থেকে বলে উঠল । “আপনি সাধারণত যেভাবে দিন কাটান, সেভাবেই কাটাতে থাকুন।”

কিন্তু তার এরকম আশ্বাসেও তো এটা ভুললে চলবে না যে একটা সমবয়সী মেয়ে আমার ঘরে থেকে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার অস্তিত্ব চাইলেও ভোলা সম্ভব না আমার পক্ষে। আড়চোখে তার দিকে তাকালাম। সে তখন একটা নোটবুকে কী যেন লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বোধহয় তার পর্যবেক্ষণের নোট করছে তাতে।

এভাবে কেউ আমাকে যাচাই করছে, ব্যাপারটা ভাবতেই মুখ তিতে হয়ে যাচ্ছে। তার প্রখর দৃষ্টির খোঁচাটা আমি এখানে বসে থেকেই টের পাচ্ছি।

গতকাল সত্যিই সে আমাকে তার কাজটার ব্যাখ্যা বেশ ভালোভাবে দিয়েছিল। মিয়াগির কথা অনুযায়ী, আয়ু বিক্রি করে দেয়া মানুষগুলোর মধ্যে যাদের কেবল একবছর কিংবা তার কম সময় বেঁচে থাকে, তারা নাকি অনেক ধরনের ঝামেলা তৈরি করতে শুরু করে। কী ধরনের ‘ঝামেলা’ তা অবশ্য জিজ্ঞেস করলাম না। খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছি।

মানুষ নিয়ম মেনে চলে কারণ, বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বাস আর সম্মান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেউ যখন জেনেই ফেলে যে তার জীবন শেষ হয়ে আসছে, সবকিছু পাল্টে যায়। কারণ, মৃত্যুর পর তো ঐ ‘সম্মান’ কিংবা ‘বিশ্বাস’ তোমাকে সঙ্গ দেবে না।

তাই যারা আয়ু বিক্রি করে দিয়েছে, তারা যাতে কোনোধরনের গন্ডগোল করতে না পারে, সেজন্য এই ‘পর্যবেক্ষক’ ব্যবস্থাটা দাঁড়া করানো হয়েছে। যাদের আয়ু একবছর কিংবা তারও কম রয়েছে, তাদেরকে একজন করে পর্যবেক্ষক দেয়া হয়। মানুষগুলো যদি উল্টোপাল্টা কাজ করা শুরু করে, তবে পর্যবেক্ষক সাথে সাথে জানিয়ে দেবে প্রতিষ্ঠানে। আর জানার পর প্রতিষ্ঠান ঠিক তখনই তার জীবনটা কেড়ে নেবে-আয়ু যতই বাকি থাকুক না কেন। ঘরের কোণে বসে থাকা মেয়েটা একটা মাত্র ফোন করে আমার জীবন খতম করে দিতে পারবে।

অবশ্য-জোগাড় করা ডাটা থেকে নাকি এটা জানা গিয়েছে যে, মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে মানুষ অন্যকে জ্বালানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাই মৃত্যুর ঠিক তিনদিন আগে পর্যবেক্ষক ফিরে যায়।

জীবনের শেষ তিনটা দিনই আমি কেবল একা থাকতে পারব।

***

ঠিক কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা মনে নেই। ঘুম ভাঙতেই টের পেলাম, বমি বমি ভাব আর মাথাব্যথা দূর হয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে তখন সাতটা বাজে প্রায়। মাত্র তিন মাস আয়ু রয়েছে আমার। এই তিন মাসের প্রথম দিনটা যতটা বাজে ভাবে কাটানো সম্ভব, কাটিয়ে ফেলেছি আজই।

মিয়াগি তখনো ঘরের কোণে ঠিক সেভাবেই বসে রয়েছে, বিন্দুমাত্র নড়েনি।

সে এখানে নেই ভেবে নিয়ে আমার কাজকর্ম করতে থাকলাম। ঠান্ডা পানি দিয়ে দাঁত মেজে নিয়ে একটা ঢোলা, রং ক্ষয়ে যাওয়া জিনস আর ভাঁজ পড়া টি-শার্ট পরে বের হলাম। রাতের খাবার কিনতে হবে।

আমার পর্যবেক্ষক আমার থেকে পাঁচ পা দূরে থেকে আমাকে অনুসরণ করতে লাগল।

সূর্যাস্তের তীব্র আলো থেকে চোখকে বাঁচানোর জন্য হাত দিয়ে চোখ ঢাকতে হলো আমাকে। আজকের সূর্যাস্তের রং হলুদ। দূরের গাছপালা থেকে সিকাডার গুঞ্জন কানে ভেসে আসল। ফুটপাতের পাশ দিয়ে রাস্তায় অলসভাবে গাড়ি চলাচল করছে।

পুরোনো বিশ্বরোডের পাশের রেস্তোরাঁটার সামনে অবশেষে উপস্থিত হলাম। বেশ প্রশস্ত একটা বিল্ডিং, ঠিক পেছনে বেশ কয়েকটা গাছপালা সেটার ছাদটাকে ঢেকে দিয়েছে। এখানে কালের ছাপ পড়েনি, এমন একটা জায়গা খুঁজে পাওয়াই ভার। ভেতরে দেয়ালের সাথে প্রায় দশটা ভেন্ডিং মেশিন সারি ধরে বসানো। আর রয়েছে দুটো সরু টেবিল, যাতে গোলমরিচের কৌটা আর অ্যাশট্রে রাখা। এক কোণে থাকা কয়েকটা আর্কেড (দেখে মনে হবে অন্তত দশ বছরের পুরোনো সেগুলো) থেকে গেমের টুংটাং আওয়াজই এই ধূসর, মলিন, প্রায়-ভেঙে পড়া এই জায়গাটাকে এখনও জীবিত রেখেছে।

একটা নুডুলসের ভেন্ডিং মেশিনে তিনশো ইয়েন ঢুকিয়ে সিগারেট ধরালাম। যতক্ষণে আমার নুডুলস তৈরি হচ্ছে, ততক্ষণ সিগারেট ফোঁকা যাক। মিয়াগি একটা গোলাকৃতির টুলে বসে মাথার ওপর তিরতির করে কাঁপতে থাকা একটা টিউবলাইটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলে সে কীভাবে খাবে? খাবার আর পানি ছাড়া তো সে বাঁচতে পারবে না। কিন্তু তার আচরণ এত অদ্ভুত ঠেকছে যে, সে হয়তো সেসব ছাড়াও বাঁচতে পারে বলে মনে হচ্ছে। একদম রোবটের মতো চরিত্র। মানুষ হতে হলে যে পরীক্ষায় পাস করতে হয়, সে পরীক্ষায় কোনোমতে পাস করতে পারবে মেয়েটা।

সস্তা টেমপুরা-সোবা নুডুলস (ভাগ্য ভালো নুডুলসটা গরম ছিল) দিয়ে কোনোমতে রাতের খাবারের পাট চুকালাম। বেভারেজ ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা কফির ক্যান বের করে সেটায় ধীরে ধীরে চুমুক দিলাম। অত্যধিক চিনি দিয়ে মিষ্টি করা কফিটা আমার অন্তঃসারশূন্য শরীরে মিশে যেতে থাকল।

আমি আর মাত্র তিনমাস বাঁচব-তাহলে কেন আমি ভেন্ডিং মেশিন থেকে বের হওয়া সস্তা, বিস্বাদ খাবার খাচ্ছি?

কারণ, আমার যে এর বেশি কল্পনা করার ক্ষমতা নেই।

গতকালের আগ পর্যন্ত আমি এতটাই গরিব ছিলাম যে, কখনই সাহস করে দামি কোনো রেস্তোরাঁয় পা ফেলার সুযোগ পর্যন্ত পাইনি। তাই হুট করে সে অভ্যাসটা ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। গত কয়েকবছরের এই গরিবদশা আমার কল্পনাটা একদম শূন্য করে দিয়েছে।

***

বাড়ি ফিরে একটা কলম আর নোটবুক নিয়ে বসলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, ভবিষ্যৎ বলতে আমার কাছে যেটুকু সময় আছে সে সময়ে যা যা করব, তার একটা তালিকা তৈরি করা যাক। প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিল, কী কী করব ‘না’, সেটার তালিকা তৈরি করলেই বরং ভালো হবে। তবে আস্তে আস্তে অনেক কিছুই মাথায় আসতে শুরু করল।

মৃত্যুর আগে যেসব কাজ করতে হবে

* কলেজে যেতে হবে না

* কাজে যেতে হবে না

* কোনোকিছু পছন্দ হলে নিজেকে থামানো যাবে না

* সুস্বাদু কিছু খেতে হবে

* অপূর্ব কিছু দেখতে হবে

* উইল লিখতে হবে

* নারুসের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে হবে

* হিমেনোর সাথে দেখা করতে হবে এবং তাকে বলতে হবে যে, আমি তাকে পছন্দ-

“আমি আপনার জায়গায় থাকলে ওটা করার কথা ভাবতাম না।”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, মিয়াগি আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আমি কী লিখছি, তা পড়ার চেষ্টা করছিল।

অদ্ভুত ব্যাপার, সর্বশেষ বাক্যটা, মানে ‘হিমেনোর সাথে দেখা’-এটা নিয়েই তার যত সমস্যা।

“একজন পর্যবেক্ষকের কী এভাবে তার টার্গেটের ওপর নজরদারি করা উচিত?” জিজ্ঞেস করলাম।

মিয়াগি আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। বরং নিজে থেকেই সম্পূর্ণ অন্য এক প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করল, “এই হিমেনো মেয়েটার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে। মাত্র সতেরো বছর বয়সে সে মা হয়েছে। একবছর পর হাইস্কুল ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করে সে, কিন্তু সে বিয়েও বেশিদিন টেকেনি। একবছর পরই ডিভোর্স হয়ে যায় তার। এখন, অর্থাৎ বিশ বছর বয়সে সে তার বাবা মায়ের সাথে থাকছে, সেই সাথে তার বাচ্চাটাকে বড় করছে। আজ থেকে দুইবছর পর সে বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে। আর তার রেখে যাওয়া চিঠিটা হবে অনেক অনেক ভয়ঙ্কর-আপনি যদি ওর সাথে দেখা করতে যান, ভালো কিছুই ঘটবে না। আর তাছাড়া হিমেনো আপনাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছে। দশ বছর বয়সে আপনি ওর সাথে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেটার কথা তার মনেই নেই।”

স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ আমার ফুসফুস থেকে সব বাতাস বের করে নিয়েছে।

“আপনি আমার ব্যাপারে এতকিছু জানেন?” অবশেষে মুখ খুলতে পারলাম আমি। নিজের ভেতরের আতঙ্কটা লুকানোর চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম তাকে, “আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, সামনে যা যা ঘটবে সবই আপনার জানা আছে।”

মিয়াগি কয়েকবার চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়ল।

“আপনার জীবনে কী কী ঘটতে পারে, কেবল তা জানা আছে আমার মিস্টার কুসুনোকি। অবশ্য এই মুহূর্তে এসব তথ্যের কোনো মূল্য নেই। আপনার জীবনটা সম্পূর্ণ বিক্রি করে দিয়ে আপনি আপনার ভবিষ্যতটাকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছেন। আর তাই যেসব ঘটার কথা ছিল, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোই কেবল আমার জানা রয়েছে।”

নোটবুক থেকে চোখ এখনও সরেনি তার। চুলগুলো সামনে থেকে সরিয়ে কানের পেছনে নিয়ে সে বলল, “হিমেনো আপনার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিল দেখা যাচ্ছে। আপনার জীবনের সারসংক্ষেপে কেবল বারবার তার কথাই এসেছে। সবকিছু ছিল শুধু তাকে ঘিরেই।”

“যতটা বলছেন, ততটা না,” প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম। “এর মানে আসলে জীবনে গুরুত্ব দেবার মতো কোনো মানুষ ছিল না আমার।”

“আপনি বোধহয় ঠিকই বলছেন,” মিয়াগি বলল। “আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, এখন হিমেনোর সাথে দেখা করতে গেলে সময়ের অপচয় বাদে আর কিছুই হবে না। তার ব্যাপারে আপনার যেসব স্মৃতি রয়েছে, সেসবই শুধু নষ্ট হবে।”

“আমার জন্য এত ভাবার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু ঐ স্মৃতিগুলো অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”

“আপনার সময়টা বাঁচিয়ে দিলাম, ঠিক না?”

“হয়তো-আমার একটা প্রশ্ন আছে। এভাবে কারো সামনে ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা বলার অধিকার আপনার রয়েছে?”

তাকে একটু কৌতূহলী মনে হলো। “প্রশ্নটা ঘুরিয়ে আপনার দিকেই ছুঁড়ে দিচ্ছি। আপনার কেন মনে হচ্ছে আমার এসব বলা উচিত না?”

ভালো কোনো উত্তর মাথায় এল না। যদি আমি ভবিষ্যতের তথ্য ব্যবহার করে কোনোপ্রকার গণ্ডগোল করার চেষ্টা করি, তবে তার একটা ফোন করলেই হবে। মুহূর্তের মধ্যে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাব আমি।

“সংক্ষেপে বললে আমরা চাই আপনি যাতে নীরবে, কোনোপ্রকার গণ্ডগোল না করে বাকি জীবনটুকু কাটান।” সে ব্যাখ্যা করতে শুরু করল। “সেজন্যই আপনার ভবিষ্যতে যা যা ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা দিয়ে আপনাকে ক্ষতিকর সব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছি।”

মাথা চুলকালাম। খুব ইচ্ছে করছিল রাগে ফেটে পড়ে তার ওপর রাগের বহিঃপ্রকাশটা করতে।

“হয়তো আপনার কাছে মনে হচ্ছে যে, এভাবে আপনি আমাকে দুঃখ- কষ্ট কিংবা হতাশা থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এভাবেও তো ভাবা যায়-আপনার কর্মকাণ্ডের কারণে আমি আমার এভাবে হতাশ হওয়া কিংবা দুঃখ পাবার স্বাধীনতাটুকু হারিয়ে ফেলছি? এমন হতে পারে না যে, এসব কথা আমি আসলে হিমেনোর মুখ থেকেই শুনতে চেয়েছিলাম—যাতে সেটা আমাকে দুঃখ দেয়? আপনি শুধু আমার জীবনে অযাচিত ভাবে নাক গলিয়েছেন, আর কিচ্ছু করেননি।”

মিয়াগি বিরক্তির ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল!

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ভেবেছিলাম যে আমি ভালো একটা কাজই করছি। যদি সত্যি তাই হয়ে থাকে, তবে আমার কথা বলাতে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। আমি অনেক দুঃখিত,” বলে সে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল। কিন্তু তার কথা বলা শেষ হয়নি। “কিন্তু আমারও একটা কথা বলে নেয়া উচিত। সামনে আপনার কী ঘটবে না ঘটবে, সে ব্যাপারে আপনার খুব একটা আশা না করাটাই ঠিক হবে। আপনি আপনার ভবিষ্যৎ জীবন বিক্রি করে দিয়েছেন। এর মানে আপনি এখন এমন একটা জগতে প্রবেশ করেছেন, যা কঠোর নিয়ম ও আইন-কানুন দ্বারা পরিচালিত। এখানে আপনার ‘স্বাধীনতা’ কিংবা ‘অধিকার’ নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। আপনি সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছেয় এই জগতটাকে বেছে নিয়েছেন।

বলে মিয়াগি আবার ঘরের কোণে তার স্থানে চলে গিয়ে আগের মতো বসে পড়ল।

“কিন্তু এই একবারের জন্য আপনার মতামতটাকে আমি গুরুত্ব দেব। আপনার দুঃখকষ্ট কিংবা হতাশ হওয়ার স্বাধীনতাকে সম্মান করব। আপনার লিস্টে থাকা অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়েও আমি কোনোপ্রকার মন্তব্য করব না। আপনার যা ইচ্ছে আপনি করতে পারেন। যদি সেই কাজটা অন্যের জন্য ক্ষতিকর না হয়ে থাকে, তবে আপনাকে আমি থামাব না।”

তুমি না বললেও এটাই আমি করতে যাচ্ছিলাম, মনে মনে ভাবলাম।

আড়চোখে লক্ষ্য করেছিলাম, মিয়াগির চোখে কেমন যেন একটা কষ্টের ছাপ দেখা যাচ্ছে। অবশ্য তখন সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিইনি আমি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *