বন্দর সুন্দরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০১৮
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ – রঞ্জন দত্ত
.
‘টিম টিম করে শুধু খেলো দুটি বন্দরের বাতি।
সমুদ্রের দুঃসাহসী জাহাজ ভেড়ে না সেথা;
—তাম্রলিপ্ত সকরুণ স্মৃতি।’
প্রেমেন্দ্র মিত্র
.
বৈশালী দাশগুপ্ত-কে
নিবেদন
যদিও ‘বন্দর সুন্দরী’ কোনও ইতিহাস বই নয়, ইতিহাস আধারিত কাহিনিমাত্র। তবুও এ কাহিনি রচনা করার সময় আমি চেষ্টা করেছি, উপন্যাসের পটভূমি যে সময়কালের সেই সময়ের মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ছবি তুলে ধরতে এবং ওই সময়ের মূল ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে পাঠকদের সামনে হাজির করতে। ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রাজ্ঞ মননশীল পাঠকমাত্রই জানেন, এ ধরনের উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় হল তথ্য সংগ্রহের কাজ। নতুন নাবিক যেমন শুধুমাত্র সাহসে ভর করে অজানা দেশের সন্ধানে জাহাজ ভাসায়, তেমনই অপটু নাবিকের মতো আমিও সাহসে ভর করে নেমে পড়েছিলাম তথ্য সংগ্রহের কাজে।
যেহেতু এই উপন্যাস বন্দর গণিকাদের প্রাচীন ইতিহাসের সময়কালকে কেন্দ্র করে, তাই তাদের সম্পর্কেই তথ্য সংগ্রহে আকর্ষণ ছিল বেশি। কিন্তু সমস্যা হল বিভিন্ন ঐতিহাসিক রচনা অথবা প্রাচীন সাহিত্যে নগরনটী আম্রপালী বা বসন্তসেনাদের সন্ধান মিললেও বন্দর গণিকাদের সম্পর্কে তথ্য বড় অপ্রতুল। কোনও কোনও সময় শুধু বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও খুব সামান্য উল্লেখ করা হয়েছে তাদের কথা। গণিকাদের মধ্যেও ব্রাত্য থেকে গেছে বন্দর গণিকারা।
বন্দরগুলো সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তা অধিকাংশই বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ। যেমন চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাঙের রচনায় পাওয়া যায় ‘তান মো লি’ অর্থাৎ তাম্রলিপ্ত বন্দরের সংক্ষিপ্ত অথচ খুব সুন্দর বিবরণ। সেখানে লিপিবদ্ধ আছে তমালিকা বন্দরের ভৌগোলিক অবস্থান থেকে শুরু করে ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার বিন্যাস পর্যন্ত।
এই উপন্যাসের বড় অংশ পাঁচশ বছর আগের তমালিকা বন্দর কেন্দ্রিক। কিন্তু সমস্যা হল, তারও বহু শতাব্দী আগে হিউ-এন-সাঙের বিবরণে তমালিকা বন্দরের প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ থাকলেও আমার উপন্যাসের সময়কালের তমালিকা বন্দরের ছবি তেমন পাওয়া যায় না। হয়তো পাওয়া যায়না তমালিকা বন্দর তখন প্রায় মৃত বন্দর বলেই। সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁয় তার কয়েক শতক আগেই বাংলার প্রধান হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
তাছাড়া তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পাঁচশো বছর আগে ভারতের বন্দর কর্তৃপক্ষ বা সাগরে পাড়ি দেওয়া বণিকরাও বেশ উদাসীন ছিলেন। ইউরোপীয় জাহাজগুলোতে তখন যাত্রাপথের বিবরণ ধরে রাখার জন্য, ‘লগবুক’ ব্যবস্থা চালু হয়ে গেলেও ভারতীয় বাণিজ্যপোতে তখনও যে ব্যবস্থা চালু হয়নি। ইউরোপের অনেক বন্দরে সে সময় জাহাজ ছাড়ার আগে বিভিন্ন জায়গাতে লিখিত বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে জাহজ কবে ছাড়বে, কোথায় গন্তব্য এমনকী নাবিকদের নামের তালিকা পর্যন্ত জানিয়ে দেওয়া হত জনসাধারণকে। সে সময় ভারতীয় বণিকরা বন্দরবাসীকে জাহাজ ছাড়ার খবর জানাত শঙ্খধ্বনি করে বা বন্দরের কোনও অংশে আগুন জ্বালিয়ে। কোনও তথ্য বা ‘রেকর্ড’ থাকত না।
তথ্য সংগ্রহের কাজে যখন অনভিজ্ঞ নাবিকের মতো ডুবতে বসেছি, তখন কিছু প্রাজ্ঞ মানুষ শেষ পর্যন্ত আমার ছোট নৌকাটাকে শেষ পর্যন্ত তীরে ভিড়তে সাহায্য করলেন তাদের জ্ঞান ভাণ্ডার দিয়ে। এ ব্যাপারে প্রথমেই যে মানুষটির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির প্রকাশনা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, ইতিহাস গবেষক ও সুলেখক শ্রীনির্বেদ রায়। নানা তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সময় তাঁকে সাক্ষাতে বা দুরাভাষে বিরক্ত করেছি। আর তিনিও আমাকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন হাসিমুখে। আমার এই উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁর লেখা বিভিন্ন বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই।
লেখার প্রয়োজনে আমাকে নানা বইপত্র ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন ইতিহাস গবেষক-লেখক শ্রী প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, শিক্ষিকা শ্রীমতী শ্রাবণী গুপ্ত সরকার, বন্ধুবর শ্রী সুগত চক্রবর্তী সহ আরও অনেকে। তাঁদের সকলের কাছেই আমি ঋণী।
অগ্রজ কথাসাহিত্যিক শ্রীঅনীশ দেব, অগ্রজ কথাসাহিত্যিক ও পত্রভারতীর কর্ণধার শ্রীত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় আমাকে উৎসাহিত করেছেন, সাহস যুগিয়েছেন এই সুবিশাল কাহিনি রচনার জন্য। তাঁদের ঋণও পরিশোধ করার নয়।
এতদসত্তেও ত্রুটি যদি থেকে যায়, তবে তা লেখকের নিজস্ব অক্ষমতা।
‘বন্দর সুন্দরী’-কে তুলে দিলাম পাঠক-পাঠিকাদের কাছে।
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
ফেব্রুয়ারি ২০১৮
পটভূমি
বন্দর সুন্দরী। এক নারী ও নাবিকের প্রেমকাহিনি। প্রাচীন তমালিকা বন্দরের বুকে ‘নাবিকের বন্দরে বন্দরে স্ত্রী থাকে’—বন্দরের প্রাচীন প্রবাদ। ‘স্ত্রী’ অর্থে শয্যাসঙ্গিনী- গণিকা। বন্দর সুন্দরী। যারা ঘরছাড়া নাবিকদের রোদে-পোড়া, সমুদ্রের নোনা বাতাসে রুক্ষ দেহকে তৃপ্ত করে, কখনও বা হয়তো তাদের মনকেও। তেমনই এক বন্দর সুন্দরীকে কেন্দ্র করেই ইতিহাসআশ্রিত এই উপন্যাস। সুদূর অতীত থেকেই ভারতের বন্দর সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে গড়ে উঠেছিল নানা গণিকালয়। এমনকী সমুদ্রের বুকে ভ্রাম্যমান গণিকালয়ও ছিল। যেসব সূচক দিয়ে নাবিকরা বন্দরের গুরুত্ব পরিমাপ করত, তার মধ্যে অন্যতম হল বন্দরে গণিকালয় আছে কিনা।
যে বন্দরে গণিকালয় নেই সে-বন্দরকে বন্দরের পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে নারাজ ছিল বিদেশি বণিকরা। বিশেষত সেই সময়ে, যে-সময়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে এক ভারতীয় বন্দর সুন্দরীর সঙ্গে এক পর্তুগিজ নাবিকের ভালোবাসার আখ্যান, যখন ইউরোপীয় বণিকদের সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে সুদূর এই ভারতবর্ষের বাণিজ্যের সিংহদুয়ার।
কোথায় ছোট্ট এক দেশ পর্তুগালের লিবসন বন্দর, টেগাস নদীর মোহনা! যেখান থেকে ‘নতুন পৃথিবী’ ভারতবর্ষের উদ্দেশে পাড়ি জমাত পর্তুগিজ বণিকরা, আর কোথায় এই ভারতবর্ষের কালিকট, বাংলার সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও বা তাম্রলিপ্ত বা তমালিকা বন্দর! কিন্তু সমুদ্র তাদের গেঁথে দিয়েছিল এক সূত্রে।
এই দীর্ঘ উপন্যাসকে এক অর্থে ঐতিহাসিক ‘থ্রিলার’ও বলা যেতে পারে। গড়ে উঠেছে দুঃসাহসী পর্তুগিজ নাবিক, অভিযাত্রী, পর্যটক, আবার কারও মতে, এক ছদ্মবেশী জলদস্যু ভাস্কো ডা গামার ভারত অভিযানকে কেন্দ্র করে। কালিকট বন্দরে ভাস্কোর দ্বিতীয় ভারত অভিযানের সময় এই কাহিনির সূচনাপর্ব। পরিসমাপ্তি ঘটেছে বাংলার তমালিকা বন্দরে, যখন ভাস্কো তৃতীয়বারের জন্য এদেশের মাটিতে পা রাখলেন গোয়াতে পর্তুগিজ উপনিবেশের ভাইসরয়ের দায়িত্ব নিতে। তবে ভাস্কো এই উপন্যাসের নায়ক নন। এ কাহিনির নায়ক এস্তাদিও নামের এক পর্তুগিজ নাবিক, নায়িকা বন্দরবেশ্যা মৎসগন্ধা। মৃতপ্রায় তমালিকা বন্দরের বন্দর সুন্দরী। তবে ভাস্কো অবশ্যই এই কাহিনির নিয়ন্ত্রক।
Dhonyobad.
Khajuraho sundori, adventure samagra 3,4 ei lekhok er. Ei boi gulo please upload korben.
Plz apnader dark mode ta back anen.. office ae kaj er fak ae boi porte osubidha hoi