৫
শাজাহান বুড়ো, হুঁ কোটাকে ছইয়ের ভিতরের বাখারিতে ঝুলিয়ে রেখে হালে বসেছে, অন্যরা দাঁড়ে। বোটের সঙ্গে বেঁধে রাখা দড়িটা খুলে ফেলে ঝপাঝপ করে দাড় বেয়ে ওরা বোট ছেড়ে ছোটবালির মুখের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
নোঙর তুলতে এঞ্জিন স্টার্ট করে বোট চালু করতে মিনিট তিন-চার সময় লাগল। তারপর পুট পুট পুট করে বোটটা এগিয়ে চলল। একটু গিয়েই আমরা শাজাহানের নৌকোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম।
বাঁকটা ঘুরতেই দেখলাম, মীরজাফরদের নৌকোটা লগিতে বাঁধা দড়ির সঙ্গে ছোটবালির চরে লাগানো। ওরা নৌকোর পাশেই বালিতে লাফালাফি করছে। বালির মধ্যে একটা কালো জলের জালা পড়ে রয়েছে।
আমাদের আসতে দেখে ওরাও নৌকো খুলে এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে—কিছু বলবে বলে। ওদের খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
ঋজুদা কেবিনে চলে গিয়েছিল বোট স্টার্ট হতেই। দেখি পায়জামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে অন্য পোশাক পরে, রাইফেলটা হাতে নিয়ে ডেকে এসে দাঁড়িয়েছে দু মিনিটের মধ্যে।
ওদের নৌকোটার কাছে আসতেই নীলমণি বোটের এঞ্জিন বন্ধ করে দিল। ভাসতে ভাসতে বোট ওদের নৌকোর কাছে পৌঁছে গেল।
লোকগুলো বলল, মামা! মামা! বাবু, মামা!
ততক্ষণে শাজাহানের নৌকোও এসে ভিড়ে গেছে পাশে। ছোট নৌকোর লোকেরা বলল, ওরা যখন জল কাটছে সকলে মিলে কথা বলতে বলতে তখন…
এমন সময় হঠাৎ শাজাহান বুক-ফাটা চিৎকার করে উঠল, বাপজান! আমার বাপজান রে…
আমি তখনই প্রথম লক্ষ করলাম যে, ছোট নৌকোয় যারা গিয়েছিল তাদের সকলেই আছে, শুধু মীরজাফর নেই।
শাজাহান নিজের বুকে নিজে ঘুষি মেরে, দাড়ি টেনে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল পাগলের মতো। খেপলা জাল মেরামত করছিল যে দু-জন, তারা শাজাহানকে ধরে রাখতে পারছিল না।
ঋজুদা শাজাহানের দিকে না তাকিয়ে ঐ লোকগুলোকে জিগ্যেস করল, কী হয়েছিল বলো?
ওরা বলল, মীরজাফর একা নৌকোতে ছিল। আগের দিন ও নোঙর তোলার সময় পায়ে একটু চোট পেয়েছিল। বলল, তোমরা যাও চাচা, আমি বসি। এখান থেকে তোমাদের তো দেখাই যাবে। ওরাও জল কাটতে-কাটতে মীরজাফরকে দেখতে পাচ্ছিল। মীরজাফর ঘষে-ঘষে পায়ে শর্ষের তেল লাগাচ্ছিল। এমন সময় ওদের চারজনের বিস্ফারিত চোখের সামনে একটা বিরাট বাঘ ঘাসবন থেকে বেরিয়ে বালির উপর দিয়ে নিঃশব্দে দৌড়ে গিয়ে পিছন দিক থেকে মীরজাফরের ঘাড় কামড়ে ওকে নিয়ে অর্ধ-গোলাকার একটা চক্কর মেরে জঙ্গলে ঢুকে গেল বালি পেরিয়ে।
মীরজাফর কোনো শব্দ করবারও সময় পায়নি।
ঋজুদা আমাকে বলল, রুদ্র, তুই বোটে থাক। বোট ছোট- বালিতে নোঙর করে রাখবি। রাইফেলে গুলি ভরে নীলমণির কেবিনের মধ্যে চারদিকের পর্দা উঠিয়ে সজাগ হয়ে বসে থাকবি। কেউ যেন বোট থেকে বালিতে না নামে।
বলেই, নীলমণিকে বোট এগিয়ে নিয়ে বালিতে যেতে বলল।
বোটটা এগোতে লাগল যখন, তখন বলল, আমি যদি সন্ধের মধ্যে না ফিরি তাহলে বোট খুলে তোরা সোজা ক্যানিং চলে যাবি। পুলিসে রিপোর্ট করে কলকাতা ফিরে যাস।
নীলমণিকে আরও কীসব বলল ঋজুদা। গদাধরকে বলল, শাজাহানরা সকলেই এখন আমাদের সঙ্গেই থাকবে। ওদের জন্যে রান্না করিস।
এত সব কাণ্ড, কথাবার্তা কিছুই মগজে ঢুকছিল না আমার।
যখন হঠাৎ বুঝলাম যে, ঋজুদা সন্ধের আগে না-ফিরে আসা মানে ঋজুদা আর কোনোদিনই ফিরবে না, তখনই প্রথম পুরো ব্যাপারটার ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন হলাম।
মীরজাফর যেমন আর ফিরবে না, ঋজুদাও নয়!
বোটের নোঙর ফেলল পরেশ আর নটবর। কাঠের সিঁড়িটা নামানো হল বালিতে বোট থেকে নামার জন্যে। ঋজুদা নেমে যাওয়ার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাল।
আমি হঠাৎ বললাম, ঋজুদা, আমি যাব।
ঋজুদা কঠিন গলায় বলল, একদম না। যা-যা বললাম সেই মতো কাজ করবি।
গদাধর কী যেন বলতে গেল, কিন্তু ঋজুদা তা শোনার জন্যে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে বালিতে নেমে যেখানে মীরজাফরদের নৌকো ছিল সেখানে সোজা চলে গেল, গিয়ে বালিতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখে দেখে এগিয়ে চলল। ঋজুদা ফোর-ফিফটি-ফোর হাতে ড ডাবল ব্যারেল রাইফেলটা না নিয়ে থি-সিক্সটি-সিক্স ম্যানলিকার রাইফেলটা নিয়ে গেলো দেখলাম।
ছোট নৌকোর লোকগুলো বলল, বাবু ঠিক যেতিচেন, ঐ পথেই মামা মীরজাফরকে মুখি করে…
শাজাহান নিচু গলায় বলল, বাপজান!
আমি ঋজুদাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এইবার ষড়-বড় ঘাসের মধ্যে ঢুকে পড়বে। ঋজুদার গায়ে একটা খাকি হাফ-হাতা সোয়েটার সবুজ হাফশার্টের উপর। শর্টস, আর পায়ে গলফ খেলার জুতো। শেষ-বার দেখা গেল। তারপর ঋজুদা অদৃশ্য হয়ে গেল।
শাজাহান আবার বলল, মীরজাফর, মীরজাফর! বেইমান কুথাকার! বুড়া বাপকি এইভাবে মেইরে যেতি হয় বাপ?
ঋজুদা চলে যেতে আমি নীলমণিকে শুধোলাম, ক’টা বাজল নীলমণি?
নীলমণি হাতের ঘড়ি দেখে বলল, আটটা বাজে।
বলেই বলল, সাতসকালে এমন ঘটনা.!…
জোয়ার বারোটা নাগাদ পুরো হয়ে যাবে। তারপর ভাঁটি দিতে শুরু করবে। তারপর আবার জোয়ার ঘুরে আসবে।
নীচে থেকে ঋজুদার ফোর-ফিফটি ফোর হান্ড্রেড ডাবল ব্যারেল রাইফেলটা এনে ছ-ব্যারেলেই গুলি ভরে আমি সারেঙের কেবিনে এসে বসলাম। একটু রোদও যেন উঠেছে বলে মনে হল। মেঘ অনেকটা কেটে গেছে। মাথার উপরে সূর্য মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিচ্ছে এখন। হাওয়া না থাকলেও ঠাণ্ডা আছে বেশ।
মেঘ কেটে গেলে আরও ঠাণ্ডা পড়বে, নীলমণি বলল।
শাহাজানকে অন্যান্যরা ঘিরে ছিল। বুড়ো যেন পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু কথা বিশেষ বলছে না। শুনেছিলাম, অল্প শৈাকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। ছেলে হারানো শাজাহান বুড়োকে দেখে এই প্রথম বুঝলাম কথাটার মানে।
আমি ভাবছিলাম যে, এখন না হয় আমরা আছি। মোটর বোট, লোকজন, রাইফেল হাতে শিকারী। কিন্তু ওরা তো এমনি করেই দিশি নৌকোয় দিনের পর দিন ঝড়ে, জলে, শুক্লপক্ষে, কৃষ্ণপক্ষে সুন্দরবনের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়! কী দুঃসাহস এদের! মৃত্যুর সঙ্গে একঘরে বাস করে এরা। সহায়-সম্বলহীন, প্রতিকারহীন গরিব লোকগুলো। আমরা নিজেদের কখনও-কখনও কত না সাহসী বলে মনে করি। কিন্তু এদের তুলনায় আমাদের সাহসের দাম কানাকড়িও নয়।
যে লোক দুটো খেপলা জাল মেরামত করছিল তাদের মধ্যে একজন বোটে এল জল খেতে। আমি তাকে কাছে ডেকে বসালাম। যারা মীরজাফরের সঙ্গে জল কেটে নিতে নেমেছিল ডাঙায়, তাদের মুখ দেখে মনে হল, মীরজাফরের বদলে তাদের কাউকে যে নেয়নি তাতেই তারা খুশি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরা বড় স্বার্থপর হয়ে ওঠে। দোষ দেওয়া যায় না ওদের। মৃত্যুভয় এমনই!
সেই লোকটাকে জিগ্যেস করলাম যে, আমরা যদি এখন এখানে না থাকতাম তবে ভরা কী করত?
ও সাদামাটা গলায় একটুও নাটক না করে বলল যে, করার আর কী ছিল? যেখানে বাঘে নিয়েছে মীরজাফরকে, সেখানে একটি ঝামটি পুঁতে দিয়ে ওরা চলে যেত। কিন্তু যাওয়ার আগে ওদের জল-কেটে নিতেই হত। না হলে পিপাসায় মরতে হত। বাঘের হাতে মরলেও মরা; পিপাসায় মরলেও মরা। বাঘ তক্ষুনি মানুষ নিয়েছে— তাই বাঘ তখন খেতে ব্যস্ত থাকবে। তখনকার মতো অন্য মানুষরা নিরাপদ। এই ভরসায় ওরা তাড়াতাড়ি জল কেটে নিয়ে আবার বাধ-জাল ফেলার জন্যে খাঁড়ি বা খালে যেখানে ওদের যাওয়ার, সেখানে চলে যেত। মীরজাফরের বাবা ছেলের জন্যে শোক করার সময়ও পেত না হয়ত। গরিবের সময় কোথায় শোক করার? এতক্ষণে শাজাহান হালে বসে থাকত দূরের জঙ্গলের দিকে চেয়ে ঝপাত ঝপাত করে দাড় পড়ার শব্দ হত জলে। পাড় থেকে জোয়ারি পাখি ডাকত পুত্, পুত, পুত্র, পুত্, করে। শাজাহানের দু চোখের নোনা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে সুন্দরবনের নোনা নদীর জলে মিশে যেত। শাজাহানও যেন তার স্তব্ধ নীরবতার মধ্যে জোয়ারি পাখির পুত্র হারানোর দুঃখে একাত্ম হয়ে যেত।
জোয়ারি পাখির পুত ভাসিয়ে নিয়েছিল জোয়ারে, আর শাজাহানের পুত নিয়েছে সুন্দরবনের অমোঘ নিয়তি—বাঘে।
এবার রোদ বেশ উঠেছে। দুরের জঙ্গলের সাদাবানী গাছগুলোর সাদা নরম গায়ে রোদের সোনা লেগেছে। আকাশটা কী দারুণ নীল! কিন্তু রোদটার যেন জ্বর হয়েছিল। এখনও কেমন নিস্তেজ। বড়-বড় কেওড়া গাছগুলোর ডালপালা ছড়িয়ে গেছে দূরে-দূরে। হরিণ চরে বেড়াচ্ছে তার নীচে-নীচে। রোদ ওঠায় বাঁদরগুলোর আনন্দ বুঝি ধরে না। হুপ-হাপ, চিৎকারে বন-সরগরম করে তুলেছে। একটা মাঝারি কুমির ছোট-বালিতেই, কিন্তু অনেক সামনে ধীরে ধীরে জল থেকে তার গা-ঘিনঘিন খাঁজকাটা শরীরটাকে তুলে বালিতে পোড়া- কাঠের মতো স্থির হয়ে রয়েছে। রোদ পোয়াচ্ছে কুমিরটা।
সুন্দরবনের কুমির লেজের বাড়ি মেরে মানুষকে নৌকো থেকে জলে ফেলে মুখে করে নিয়ে যায়। আবার কত লোক নৌকোয় বসে জলে পা ডুবিয়ে পা ধুতে গিয়ে পা খুইয়েছে হাঙরের মুখে। হাঙরের দাঁতে এমন ধার যে যখন কাটে, ঠিক তখন তেমন বোঝা পর্যন্ত যায় না যে কাটল।
নীচে গদাধর মশলা বাটছিল, তার গাবুক-গুবুক আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। আমি বললাম, গদাধরদাদা, তুমি দেখি ফিস্টি শুরু করে দিলে। ফেনাভাত কি খিচুড়ি যা হয় একটা চাপিয়ে দাও। খিদে কারোরই নেই। তুমি যে নেমন্তন্ন-বাড়ি করে তুললে দেখছি বোটটাকে।
তারপর একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, এত আনন্দ কিসের?
গদাধর বল, তাতেই তো। আনন্দ একশবার। আজকে আমার বাপের শত্রুর ছেরাদ্দ করবে দাদাবাবু—তাইই তো রাইফেল নে বাঘের পেছনে গেল। আজ আমার বড় আনন্দের দিন। আমি দেখতে চাই শয়তানটার চেহারা। দাদাবাবু এখন তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক।
সেইটেই ভাবার কথা। আর কে কী ভাবছিল জানি না, আমি কিন্তু ঋজুদা নেমে যাওয়ার পরই আমার মনের স্টপ-ওয়াচ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। টিক্ টিক্ করে তারপর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত আমার বুকের মধ্যে শব্দ করছিল। সদ্য কিল-করা বাঘ অথবা গুলি-খাওয়া বাঘকে ফলো করতে যে কত সময় লাগে—এক গজ জায়গা পেরোতে যে কী সাবধানতা ও স্নায়ুর জোরের দরকার হয় তা যাঁরা করেছেন কখনও, একমাত্র তাঁরাই জানবেন।
মনে মনে একটা হিসেব করছিলাম, ঋজুদা কত দূর গেছে এতক্ষণে? বাঘটা এখন কী করছে? .ছোটবালিতে কি এখন একটাই বাঘ আছে? যদি ঋজুদাকে অন্য বাঘে পিছন বা পাশ থেকে আক্রমণ করে?
কিছু ভাল লাগছিল না। আরও খারাপ লাগছিল, ঋজুদা আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেল না বলে। এমন এর আগে মাত্র একবারই করেছিল ঋজুদা। লবঙ্গীর জঙ্গলে একটি বাঘ ঋজুদার কলকাতার এক সাহেব-বন্ধুর গুলিতে আহত হয়। আহত হয় বীটিং শিকারে। সেই বাঘকে খুঁজে মারার সময় কিছুতেই আমাকে সঙ্গে নেয়নি। সঙ্গে নিয়েছিল শুধু ঋজুদার ওড়িশার জঙ্গলের বন্ধু চন্দ্রকান্তকে। কিন্তু অন্যান্য সব জঙ্গল একরকম, আর সুন্দরবন অন্যরকম। তাও ছোটবালিতে বালি থাকায় হাঁটা চলার সুবিধে। সুন্দরবনের অন্যান্য জায়গায় যে জুতো পরে হাঁটা পর্যন্ত যায় না। খালি পায়ে কাদার মধ্যে হেঁটে দেখেছি। পা সামলাব, না কেওড়ার শুলো সামলাব, না বাঘের দিকে চোখ রাখব? রাইফেল-বন্দুক হাতে যখন-তখন কাদার উপর ঝপাং করে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আর শুলোর উপর পড়লে তো ছুরিবিদ্ধ হবার মতই এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যেতে হবে।
বেলা বাড়ছিল। দূরের বঙ্গোপসাগর থেকে আসা ঢেউগুলোর দিকে চেয়ে আমি ভাবছিলাম, লোথিয়ান্ আইল্যাণ্ড, ভাঙাডুনি আইল্যাণ্ড, আর মায়া দ্বীপের কথা। মায়া দ্বীপের নাম শুনলেই যেন মনটা কেমন করে। মায়া দ্বীপই বটে।
শাজাহানের নৌকোর সেই লোকটি আমার পাশে বসে নানা গল্প করছিল। আজ তাদের রান্না করে খেতে হবে না। সুন্দরবনে এমন নেমন্তন্ন ওরা কখনও বোধ হয় খায়নি। একটু খাওয়া, এক বেলা; তাতেই কত খুশি ওরা। কত কৃতজ্ঞ। খিদে বুঝি বাঘের চেয়েও ভয়ংকর—তাই তো ওরা খিদেয় মরার চেয়েও বাঘ, কুমির, হাঙরের মুখে মরাকে অনেক কম কষ্টের বলে মনে করে।
ও গল্প করছিল, একবার ওরা মাছ ধরছিল চামটাতে—বড় চাটায়। গরমের দিন। অনেক গোলপাতা কাটার নৌকো এসেছিল। তার মধ্যে বড়-বড় মহাজনী নৌকোও ছিল। শুক্লপক্ষ। সেবার বাঘের বড় উপদ্রব। চাটাতে উপদ্রব বরাবরই একটু বেশি। সারাদিন যে যার কাজ করে চাটার খালের মাঝে সব নৌকো পাশাপাশি লাগিয়ে রাতে থাকত ওরা। বাউলে, মউলে, জেলেরা সব একসঙ্গে; বাঘের ভয়ে।
লোকটা একটা বিড়ি ধরাল। হঠাৎ কোনো একজন মাঝি চেঁচিয়ে উঠল, সামনে বালির ওপাশে বড়-বড় কোমরসমান ঘাসি বনে লাল মতো কী যেন একটা জানোয়ার দেখেছে সে এক ঝলক।
আমি তাড়াতাড়ি তাকালাম সেদিকে। কিছুই দেখতে পেলাম না। ঘাস-বন দোলাদুলি করছিল, কিন্তু তা হাওয়ার জন্যেও হতে
পারে। তবু, সাবধানে, কোনো কথা বা গল্প না করে ভাল করে নজর করতে লাগলাম সামনের তিনদিকে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর লোকটা আবার নিজের মনে গল্প করে যাচ্ছিল। এমন মেহনতহীন অবকাশে একটু পেট পুরে খাওয়ার স্বপ্নে যেন লোকটা বুঁদ হয়ে ছিল।
ও বলছিল, সেদিন পূর্ণিমা কী তার আগের দিন। ফুট-ফুট্ করছে জ্যোৎস্না। নদীর জলে চাঁদের মুখ যেন লক্ষ লক্ষ চাঁদ হয়ে ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় আয়নার মতো ভাঙছে আর চুরছে। হাওয়া বইছিল এলোমেলো। জঙ্গল থেকে লতা পাতা ফুল, সোঁদা মাটি সবকিছুর গন্ধ ভেসে আসছিল সেই হাওয়ায়। ওদের নৌকোটা একটা বড় গোলপাতার নৌকোর গলুইয়ের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। সেই বড় নৌকোর সঙ্গের জালি-বোটে রান্না করছিল একজন। তার গাবুক-গুবুক করে মশলা বাটার আওয়াজ ভেসে আসছিল। কষে মশলা বাটার জন্যে জালিবোটটাও হেলছিল- দুলছিল।
আমি বললাম, তোমরা কী করছিলে তখন?
আমরা আর কী করব? আমরা তো সন্ধ্যে হতি-না-হতিই খাওয়া-দাওয়া সারি।
বাঘের উপদ্রবের জন্যে রেঞ্জার সাহেবের বোটও সেখানে ছিল। সবসুদ্ধু, ছোট-বড় মিলিয়ে খান দশ-বারো নৌকো। আর চাটার খাল তো আপনাদের দেখাই। সুন্দরবনের বাদার খাল তো আর আপনাদির আদি গঙ্গা লয়, বেশ চওড়াই। বাউলি নৌকো থেকে কে যেন গলা ছেড়ে গান ধরেছিল। আমরা খাওয়ার পর বিড়িতে ছটান দিয়ে শুয়ে পড়েছি। মুখের উপর চাঁদটা ড্যাব-ড্যাব করে চেয়ে আছে। সুঁতিখালের মধ্যে সাপে মাছ তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে। তার হুতলি-পুতলি শব্দ শুনতিচি শুয়ে শুয়ে। এমন সময় ঝপাং করি একটা হালকা আওয়াজ। আমি ভাবলাম, গোলপাতার বড় নৌকো থেকে কোনো নোক বুঝি লাফ দে নামল রান্নার নৌকোয়। খানিক পরে শুনি হৈ-হৈ উঠল চারপাশ থেকে। তাড়াতাড়ি পাটাতনে উইটে বসে দেখি, জলের মধ্যে একটা কালো বড় জালার মতো গোল বাঘের মাথাটা ভেইসে যাইছে আর তার মাথার একদিকে একটা মানুষের উঁচু হয়ে থাকা কাঁধ আর হাত সেই সঙ্গেই ভেইসে ভেইসে চলেছে।
নিল রে নিল, জানোয়ারে নিল বলে চিৎকার উঠল চারধার থেকে। রেঞ্জার সাহেব লুঙ্গি-পরে ডেকচেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন, দৌড়ে গিয়ে বন্দুক এনে দমাদ্দম করে ফাঁকা আওয়াজ করলেন গোটা চারেক। কিন্তু বাঘের দিকে গুলি করতে পারেন না, পাছে রাজেনের গায়ে লেগে যায় গুলি।
ঐ হট্টগোল আর গোলাগুলির পরও বাঘ রাজেনকে ছাড়ল না। লোকটার নাম ছিল রাজেন দেয়াসি। দেয়াসির ছেলে সে। তারেও ছাড়ল না বাঘ। বাঘ সোজা সাঁতার কেইটে পাড়ে গিয়ে রাজেনকে মুখ থেকে উগরে ফেলার মতো করে উগরে ফেলে হ্যাঁতালের ঝোপে ঢুকে গেল।
অমনি বোট খুলে, সার্চ-লাইট জ্বেলে, বন্দুক লোড করে রেঞ্জার সাহেব এগুলেন। সঙ্গে ছোট ছোট নৌকো নিয়ে আমরাও বোটের পিছন পিছন। অনেক চিৎকারে নদী জমিয়ে, জঙ্গল ফাটিয়ে ওপারের কাছাকাছি গিয়ে দেখি বাঘ তো চলে গেছে, কিন্তু তিলের নাড়ু চিবোনোর মতো করে রাজেনের মাথাটাকে চিবিয়ে রেখে গেছে বাঘ।
ওর গল্প শেষ হওয়ার পরও অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই পূর্ণিমার রাতের দুর্ঘটনার বিভীষিকা আমার মাথার মধ্যে শীত-শীত ভাব রেখে গেল একটা।
আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য এবার পশ্চিমের দিকে এগোচ্ছে। ভাঁটি পুরো হবে বিকেল চারটে নাগাদ। তার পর আবার জোয়ার দেবে।
ততক্ষণে গদাধরের রান্না হয়ে গিয়েছিল। নীলমণি, পরেশ, নটবর ও গদাধর সকলকে যত্ন করে খাওয়াচ্ছিল। ফেনাভাত, ডিমসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ, পাপড় ভাজা আর আচার। শাজাহান খেল না কিছুতেই।
আমি অনুরোধ করায় বলল, খোকাবাবু, খাব, খাব। সবই করব। খাদ্য-খাদক খাব, ঘুমোব, আবারও মাছ ধরব, কিন্তু একটু সময়ের পেরোজোন। আমার মীরজাফর আর তুমি বরাবরই হবে বয়সে। কিন্তুক আমার যে বাপ, মীরজাফর ছাড়া আর কেউ ছেলনি —বুড়ো বয়সে দানাপানি দিবে এমন কেউ তো আর লাই—যতদিন বাঁচি এই হতচ্ছাড়া পেটটার জন্যি আমাকে তো এই সব্বনেশে বাদায় আসতিই হবেক।
তারপরই গলা তুলে একটা গাল দিয়ে বলল, হতচ্ছাড়া জানোয়ার, তুই আমাকে নেলি না কেন? তুই আমার সোনার পুতটারে নেলি কী আইক্কেলে?
নীলমণি আমাকে বলল, রুদ্রদাদা, ওকে জোর না করাই ভাল। ওকে একটু সময় দিতে হবে।
পরেশ লাল লুঙ্গিটা কোমরে দু-পাট্টা করে জড়িয়ে মহা বিজ্ঞের মতো আমাকে ফিসফিস করে বলল, সময় সব ভুলিয়ে দেয়—শোক লিশ্চয় ধুয়ে লিবে সময়, এই মাতলা গোসাবা হেড়োভাঙার জলে। সবাই ভোলে সবাইকে। এই দুদিনের কান্নাই সার গো। দুদিন বই লয়। বুড়োর আর ছেলে নেই বইলে শোকটা বড় নেগেছে। খাওয়াবে কে রোজগার কইরো? না খাটতি পারলি উপবাস। ছেলেটা মইরো বাঁচল দুঃখ কষ্ট থেইকে, আর তার বুড়ো বাপ বেঁইচে মরল। কী বলা দাদাবাবু?
ওরা যখন খাওয়া-দাওয়া করছে, খেতে-খেতে দু-একটা কথা ও বলছে, এমন সময় জঙ্গলের গভীর থেকে গুড়ুম্ করে একটা গুলির শব্দ হল। রাইফেলের গুলির আওয়াজ।
বঙ্গোপসাগর থেকে হাওয়া : যেন শব্দটাকে উড়িয়ে নিয়ে এসে বোটে আছাড় মেরে ফেলল। আমরা বোটে, নৌকোয়, যে যেখানে ছিলাম, কান খাড়া করে রইলাম।
কিন্তু তারপর সব চুপচাপ। আর কিছু শোনা গেল না।
আমি জানি, বড় বাঘের বেলা কোনো চান্স, নেয় না ঋজুদা। এক গুলিতে বাঘ পড়ে গেলেও আরও একটি গুলি করে বাঘের বাঁচার বা আক্রমণের সম্ভাবনাকে নির্মূল করে।
কিন্তু একটিই গুলি হল। এবং গুলি হওয়ার একটুক্ষণ পরেই বাঘের প্রচণ্ড গর্জনে সমস্ত ছোটবালি যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। খালের বুকের জলও যেন ভয়ে টলটল করে উঠল।
কিন্তু আর গুলি হল না। সমস্ত জঙ্গল নিথর হয়ে গেল। শুধু হাওয়ার শব্দ, জলের শব্দ, পাতায়-ঝোপে হাওয়ার অস্থির হাত বুলোনোর খস্থসানি। জলের লক্ষ লক্ষ বিভিন্নাকৃতি আয়নায় আলোর মুহুর্মুহু প্রতিফলন, প্রতিসরণ; নড়া-চড়া।
আমাকে প্লেটে করে একটুখানি ফেনাভাত এনে দিয়েছিল গদাধর সারেঙের কেবিনেই। দু’পা ছড়িয়ে, কেবিনে হেলান দিয়ে বসে, দুই উরুর উপরে রাইফেলটাকে শুইয়ে রেখে আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম।
সকলেই বালির দিকে তাকিয়ে বাবুর বা দাদাবাবুর কী হল তাই নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। আমিও তা করছিলাম, মনে মনে। একটা গুলি হল, তারপর আর গুলি হল না কেন? বাঘ গর্জন করে উঠল। যদি বাঘ মরে গিয়ে থাকে তবে ঋজুদার ফিরে আসা উচিত। বড় জোর আধ ঘণ্টার মধ্যে। কারণ গুলির আওয়াজ ও বাঘের গর্জন যেখান থেকে হল তা জল থেকে বেশি ভিতরে নয়।
আধ ঘণ্টা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আমার অস্বস্তি হতে লাগল। কিন্তু এখানে আমিই ঋজুদার রিপ্রেজেন্টেটিভ। আমি ছোটই হই আর যাই-ই হই, ঋজুদা বোট থেকে নেমে যাওয়ার পর আমাকেই যা কিছু ডিসিশান নেবার তা নিতে হবে। একা একা। এখন যা কিছু করব তাতে কাউকে জিগ্যেস করার নেই।
আরও এক ঘণ্টা কেটে গেল। বিকেল চারটে নাগাদ ভাঁটি পুরো হয়ে গিয়ে আবার জোয়ার দেবে। নিস্তেজ রোদটা বোধ হয় সরে যাবে একটু পরে। গুলির শব্দ হওয়ার পরে প্রায় দু’ঘণ্টা হয়ে গেছে।
এখনও ঋজুদার দেখা নেই। ঋজুদা বলে গিয়েছিল আমাদের সন্ধে অবধি দেখতে, তারপর ক্যানিংএ চলে যেতে।
অমন বললেই তো আর হয় না। ফিরে গিয়ে সবাইকে কী বলব? ঋজুদা বাঘের পিছনে নেমেছিল, তারপর গুলির শব্দ ও বাঘের গর্জন শুনলাম এবং তারপরও আমি হাতে-রাইফেল ধরা শিকারী হয়েও কী হল তার খবর না নিয়েই বোট নিয়ে ফিরে যাব ক্যানিংয়ে।
গায়ে থুথু দেবে না সকলে? দুয়ো দেবে বন্ধুরা। মুখ দেখাতে পারব না কোথাও ভীরু বলে।
আর ঋজুদা? ঋজুদাকে ফেলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
নীলমণির ঘড়িতে যখন তিনটে বাজল তখন আমি উঠে দাড়ালাম। বললাম, আমি নামব। এতক্ষণ হয়ে গেল, এবার খোঁজ করতে হয়।
গদাধর বলল, খবরদার লয়। দাদাবাবু যা পারে, তুমি কি তাই-ই পারো? তোমারে বাঘে নেলে, দাদাবাবু ফিরি এইলে আমরা বলব কী তেনারে? ছেলেমানুষ, ছেলেমানুষের মতো থাক দিকিনি, রুদ্রবাবু।
আমার রাগ হয়ে গেল। আমি বললাম, ছেলেমানুষ ছেলে- মানুষ বলবে না বারবার।
শাজাহান বুড়ো ছইয়ের নীচে শুয়ে ছিল। শুয়ে শুয়েই বলল, যেইও না বাপ্। এ ঠাই বড় কঠিন ঠাঁই। বুইঝতে পর্যন্ত পারবেনি কোথা থেকে কী হয়। এমন কম্ম করোনি বাপ–তুমার বাপেরও কি এই বুড়োর দশা কইরবে?
আমি ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা পর-পর ভাবলাম। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘প্রস্ অ্যাণ্ড কস্’। এক এক করে ভাবলাম।
১) হয়তো ঋজুদার কোনো বিপদ হয়নি। খুব ভাল কথা। তাহলে ঋজুদা সন্ধের আগে বোটে ফিরে আসবে।
২) হয়তো ঋজুদার বিপদ হয়নি, বাঘকে এক গুলিতেই মেরেছে।
ওখানে একাধিক বাঘের পায়ের দাগ দেখেছে বলে হয়তো গুলি অযথা নষ্ট করতে চায়নি। হয়তো মীরজাফরকে বয়ে নিয়ে রাইফেল কাঁধে করে এবং চারদিকে নজর রেখে ধীরে ধীরে আসতে অনেক সময় লাগছে।
৩) হয়তো বাঘ ঋজুদাকে কিছু করেছে। ঋজুদাকেও…
৪) হয়তো যে-বাঘকে গুলি করেছে ঋজুদা সে অন্য বাঘ। মীর- জাফরকে এখনও খুঁজেই পায়নি ঋজুদা এবং এখনও হয়তো যে-বাঘ মীরজাফরকে নিয়েছে তাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে।
৫) যদি সন্ধে অবধি ঋজুদা ফিরে না আসে তাহলে আমার কিছুই করার থাকবে না। অন্ধকারে রাইফেল হাতে থাকলেও এই সুন্দর- বনের জঙ্গলে যে-বাঘ সদ্য মানুষ নিয়ে গেছে তাকে অনুসরণ করার ক্ষমতা বা সাহস আমার নেই। তাই সন্ধে অবধি ঋজুদা সত্যি-সত্যিই না ফিরলে পরদিন ভোরের আগে আমার করার কিছুই থাকবে না। ঋজুদার যদি কোনো সাহায্যের দরকার হয়ে থাকে, তাহলে সন্ধে নামার অনেক আগেই সেই সাহায্য পৌঁছাতে হবে আমার।
অনেক ভাবলাম, কিন্তু ভাবতে সময় লাগল না বেশি। আমার মাথা যেন তখন কম্প্যুটরের মতো কাজ করতে লাগল। মহা বিপদে পড়লে অনেক সময় এ রকম হয়।
অনেক ভেবে আমি নেমে যাওয়াই ঠিক করলাম। ভয় যে করছিল না তা নয়, বেশ ভয়ই করছিল।
আমি ওদের শক্ত গলায় বললাম যে, আমি যাচ্ছি ঋজুদাকে দেখতে।
পরেশ, নটবর, গদাধর নীলমণি সব হাঁ-হাঁ করে উঠল। বলল, ছেলে- মানুষি কোরো না। তারপর তুমিও না এলি আমাদের যে হাজত বাস
করতি হবে সারাজীবন। আমরা যে তুমাদের জলে ফেইলে দিই আসিনি, এ-কথা কেউ কি বিশ্বাস করবে?
আমি বললাম, সময় নষ্ট করার সময় নেই। আমি যাচ্ছি, তোমরা সাবধানে থেকো। সবাই একসঙ্গে।
তারপর বেল্টের সঙ্গে টর্চটা বেঁধে নিয়ে, আমি রাইফেল রেখে ডাবল-ব্যারেল বন্দুকটা নিলাম। দুটো গুলি পুরলাম ব্যারেলে। ডানদিকে স্ফেরিকাল বল আর বাঁদিকে এল-জি। আরও চারটে গুলি পকেটে নিলাম।
গদাধর বলল, রুদ্রদাদা, আমাদের কথা ভাবো। কী চিন্তায় যে পড়লাম আমরা—কত চিন্তায় যে থাকব।
তারপর বলল, খুব সাবধান, বিশেষ সাবধান হইয়ে যেও।
শাজাহানের নৌকোয় একটি অল্পবয়সী ছেলে, আমার চেয়ে সে বছর তিন চারের বড় হবে জোর, হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আম্মো যাব।
বোট ও নৌকো দুটোর সক্কলের চোখ ছেলেটার মুখে পড়ল। একটা খয়েরি লুঙ্গি, গায়ে একটা নীল-রঙা ছেঁড়া সুতির শার্ট।
ছেলেটি বলল, বাবুনক্কল আমাদের মীরজাফরের জন্যেই এত ঝুঁকি লিইতেছেন, আর আমি ওনার সঙ্গে যেতি পাইরব না?
শাজাহান বিড়-বিড় করে বলল, সিটা তো গেছেই, সিটা কি আর বেঁইচে আচে এতক্ষণ। আবার তুরা মইরতে যেইতিচিস কেন?
তারপরই বলল, বুঝি না; বুঝি না।
আমি বললাম, না। তুমি থাকো ভাই। আমি একাই যাব!
ছেলেটি হাসল। এক অদ্ভুত হাসি দেখলাম ওর মুখে।
ও যেন বলল, শহুরে সৌখিন শিকারী খোকা, তুমি এ বন-জঙ্গলের ঘোঁত-ঘাত জানোনি—তুমি একা নামলি সঙ্গে সঙ্গে বাঘের খাদ্য-খাদক হইয়ে যাবে। আমি সঙ্গী থাকলি তুমারই মঙ্গল। আমরা তো খালি হাতেই যাই রোজদিন—পেইটের লিগে! আর তুমার হাতে তো টোটা-ভরা বিলাতি বন্দুক। আমার ভয়টা কিসের?
ছেলেটি গামছাটাকে কোমরে বেঁধে নিল। তারপর আমার আগে আগেই নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। মুখে বলল, চলো।
তারপর বোটের উপরে আর নৌকোয় দাঁড়িয়ে থাকা ওদের সকলকে বলল, ভয় নাই কোনো খোকাবাবুর জন্যি, আমি সঙ্গে যেতিচি।
শাজাহান উঠে এসে নৌকোর গলুইয়ে দাড়াল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, খুদাতাল্লা, দোয়া রেইখো ছোঁড়াদের পরে।