বনবিবির বনে – ৪

আমার মনে হল তখনও রাত আছে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম যে, দুর্যোগ ও পর্দা টানা ছিল বলে অন্ধকার মনে হচ্ছে কেবিনের ভিতরটা।

চিৎকার শুনে বুকটা ধক্ করে উঠল। তাড়াতাড়ি বন্দুকটা হাতে নিয়ে ডেকে উঠে এলাম। এসে দেখি সকলেই তখন ডেকে দাঁড়িয়ে। ঋজুদা, নীলমণি, নটবর, পরেশ এবং গদাধরও।

কখন শেষ রাতে ভাঁটি দিয়েছে কে জানে। ঋজুদা, নীলমণি ও নটবরের খেয়াল করা উচিত ছিল যে, ঐ ছোট্ট খালে আমরা যখন ঢুকি, তখন জোয়ারের সময় অনেক জল ছিল যদিও, কিন্তু ভাঁটিতে আমাদের বোট প্রায় কাদায় ঠেকে যাবে। দেখলাম, বোটের বাঁ দিকটা যাকে ইংরিজিতে বলে পোর্ট-সাইড, একেবারে পারের সঙ্গে এবং নদীর পেলব কাদাময় বিছানার সঙ্গে সেঁটে গেছে।

অনেক কিছুই হতে পারত রাতে, যখন আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু যা ঘটেছে তা দেখেই আমাদের সকলের চক্ষুঃস্থির হয়ে গেল। নরম কাদায় বাঘের অজস্র পায়ের চিহ্ন। বাঘটা কতবার যে বোটের একেবারে গায়ে-গায়ে কাদার উপর হেঁটেছে ভাঁটি দেওয়ার পর, তার ইয়ত্তা নেই। এপাশে গেছে ওপাশে গেছে—সমস্ত পারের নরম কাদায় বাঘের পায়ের দাগে দাগে ছুঁচ ফেলার জায়গা নেই। বাঘটা যে ডাঙায় উঠে চলে গেছে, তার দাগও পরিষ্কার দেখা গেল। এবং আশ্চর্য! সেই দাগে তখনও জল চুঁইয়ে যাচ্ছে। মানে নীলমণির ঘুম ভাঙা অবধিও বাঘটা বোটের সঙ্গে প্রায় লেগেই ছিল বলতে গেলে।

ঋজুদার অনুমানই সত্যি হয়েছে। বহুদিনের সংস্কারবশে বাঘ মোটরবোটে ওঠার সাহস করতে পারেনি। যদি উঠে আসতে চাইত, তাহলে কাদাতে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সহজেই উঠে আসত পারত এবং যে-কোনো একজনকে তুলে নিয়ে যেতে পারত।

দেখলাম, গদাধর ও পরেশ বিস্ফারিত চোখে নীলমণি ও নটবরের সঙ্গে কথা বলছে। কী হতে পারত, সেটাই তাদের গবেষণার বিষয়।

ঋজুদা বলল, বৃষ্টিতে ভিজে তোরা কী করছিস? ভিতরে যা সকলে। চায়ের জল চাপা। বেলা অনেক হয়েছে। দুর্যোগ এখন ও কাটেনি বলে বোঝা যাচ্ছে না।

আমি মুখ ধুতে ও রাতের জামা-কাপড় ছাড়তে কেবিনে এলাম। দেখি ঋজুদাও নেমে এসেছে। ঋজুদাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছিল।

আমাকে বলল, খুব অন্যায় হয়ে গেছে কাল, বুঝলি রুদ্র? যদি ওদের কাউকে সত্যিই তুলে নিয়ে যেত, তাহলে কী করে মুখ দেখাতাম বল তো? আমি তো নিজে এত ঘুমিয়েছি যে, সাড় ছিল না। ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকেও স্বচ্ছন্দে তুলে নিতে পারত। অসুবিধা কিছুই ছিল না।

আমি বললাম, চলো না, এক্ষুনি নেমে বাঘটাকে স্টক করি— ফলো করি।

ঋজুদা হাসল। বলল, সুন্দরবনের বাঘকে তুই জানিস না এবং এখানকার টোপোগ্রাফিও জানিস না। এখানে অধৈর্য হওয়া মানেই মৃত্যু। বাঘের পিছু নেওয়ার সময় এখন নয়। সময় যখন হবে, তখন আমিই বলব। গদাধরকে যা বলেছি, তা করব।

অনেকদিন পর দেখলাম, ঋজুদার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল। মাঝে মাঝে ঋজুদা হঠাৎ কেমন দূরে, অনেক দূরে চলে যায়। তখন মনে হয়, এ-মানুষটাকে চিনিই না যেন।

বেলা হল; কিন্তু রোদ উঠল না। কাল রাতের মতো অতটা দুর্যোগ নেই বটে, কিন্তু এখন টিপ-টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে এবং ঝোড়ো হাওয়া বইছে।

বোটের নোঙর তুলে নিয়ে আমরা বড় খালে এসে আবার নোঙর করলাম। বাউলে ও জেলেরা ছোটবালিতে জল-কেটে নিতে আসে, যদি তাদের সঙ্গে সবজি, নুন, দেশলাই, বিড়ি বিনিময় করে মাছ নেওয়া যায়। সুন্দরবনের জলে-বাদায় টাকার দাম নেই কানাকড়ি। টাকা এখানে কাগজ বৈ নয়। নুন লঙ্কা মশলার বদলে মাছ পাওয়া যায়, অথবা সবজির বদলে কাঁকড়া। মিষ্টি জলের বদলে তো সবকিছুই পাওয়া যায়। কিন্তু যেহেতু আমরা ছোটবালির কাছেই আছি, মিষ্টি জলের দাম এখানে তেমন নয়।

জল-কেটে নেওয়া মানে মাটির জালায় বা মেঠোতে পানীয় জল তুলে নেওয়া। বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে নিলে তিরতির করে মিষ্টি জল জমে সেখানে। যারা জল ছেঁচে তুলে নিয়ে যায়—তারা চলে গেলে সেই গর্তে আবার জল ভরে ওঠে ধীরে ধীরে। অনেকদিন কেউ জল না কাটলে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যায় গর্তটা ঝরে-পড়া বালিতে।

আমরা যখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি ‘তখন দূর থেকে ছপাছপ, দাঁড়ের শব্দ শোনা গেল আর মানুষের গলার স্বর। কে একজন গলা খাঁকুরে কাসল। সামনে খালটা বাঁক নিয়েছে বলে এখনও নৌকো দেখা যাচ্ছে না।

এদিকে ডাকাতিও হয় মাঝে-মধ্যে। রাতের বেলা ছইয়ের নীচে মিট্‌মিটে লণ্ঠন ঝুলিয়ে কোনো নৌকো এসে বলে, একটু আগুন হবে? ছিলিম ধরাতাম।

অবশ্য মোটরবোটে বড় একটা হয়নি। নৌকো করে ডাকাতরা মোটরবোটে ডাকাতি করতে এলে তাদের জব্দ করবার সবচেয়ে সোজা উপায় হচ্ছে দূর থেকে হেভি রাইফেল দিয়ে তাদের নৌকোর তলা ফাঁসিয়ে দেওয়া। যদি কুমির-হাঙরে না ধরে, তবে সাঁতরে গিয়ে তাদের ডাঙায় উঠতে হবে। এবং কুমির হাঙরের হাত থেকে বাঁচলেও বাঘের হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনা কম, নৌকাডুবির পর।

অবশ্য আজকাল ডাকাতরা আর আগের মতো লাঠি-সড়কি কি পাইপগান কি গাদা-বন্দুক দিয়ে ডাকাতি করে না। তাদের কাছে লাইট মেশিনগান, হাতবোমা, স্টেনগান, ব্রেনগান সবকিছুই থাকে। তাদের পক্ষে বোটে উঠে ডাকাতি করাটাও কিছুই নয়।

দুটো নৌকো বাঁকের মুখে দেখা গেল। দুটিই জেলেনৌকো। একটি বড়, একটি ছোট। ছোটটিতে ওরা বোধহয় রান্নাবান্না করে। হাঁড়ি-কুড়ি, মিষ্টি জলের জালা, উনুন এসব রয়েছে তাতে। দুজন লোক। আর বড় নৌকোটাতে জনা ছয়েক লোক। দুটিতেই ছই দেওয়া। জেলে-নৌকো ওগুলো। বড় নৌকোতে বসে একজন বুড়ো সাদা-দাড়িওয়ালা মাঝি হুঁকো খাচ্ছে। ছইয়ের উপর খেপলো জাল শুকোচ্ছে। সেই জাল গোছ করে টাঙানো আছে বাঁশের খোঁটাতে। গল্প-গুজব করতে করতে আসছে জেলেরা।

নৌকো দুটো কাছে আসতেই নীলমণি চেঁচিয়ে উঠল, মাছ হবে নাকি গো?

তেমন লাই বাবু। ভেটকি আছে খান দুই, আর কেঁকড়া। কেঁকড়া লাও ত’ লাও। ভেটকিও দেতে পারি একখানা।

তাই-ই দাও। নীলমণি বলল। তারপর বলল, বদলে লেবে কী?

যা দেবে। তরকারি আছে নাকি কিছু? পনর দিন তরকারি খাইনি।

আছে আছে। নৌকো লাগাও দেখি।

অনেকদিন পর ওরা মানুষের মুখ দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে উঠল।

নীলমণি আর গদাধর মাছ ও কাঁকড়া নিয়ে ওদের তরি-তরকারি দিল বদলে। বিড়ি বিনিময় হল। ছোট নৌকোতে একটি পনর বছরের ছেলে ছিল। বুদ্ধিভরা মিষ্টি মুখ। কালো, মাজা চেহারা। রোদে পুড়ে গায়ের রঙ তামাটে। নোনা জলে চান করে করে চুলে পানকৌড়ির মতো জেল্লা লেগেছে।

ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে কৌতূহলী চোখে ঋজুদার মুখের পাইপটাকে লক্ষ করছিল।

হঠাৎ হেসে ফেলে জিগ্যেস করল, তোমার হুঁকাটা অত ছোট কেন গো বাবু? আমার বাবার কাছে বড় হুঁকা আছে, দু টান দাও দিখি ওতে, ভিরমি লেগে যাবে।

ঋজুদা হাসল। বড় সহজে এবং খুব তাড়াতাড়ি বন-জঙ্গল-গ্রামের মানুষজনকে আপন করে নিতে পারে ঋজুদা।

বলল, আমি কি তুমার বাবার মতো তামাক খেতিছি লাকি? ইতে কী আছে তা জানো ছেলে?

কী? উদ্‌গ্রীব হয়ে ছেলেটি শুধোল।

ঋজুদা ঠাট্টা করে বলল, বিলাইতি তামাক আছে। এক টান মাইরলে তুমার বাবারও ভিরমি লেইগ্যে যাবে গো।

এমন সময় একটা বড় পাখি এসে বসল খালের পারে। এই দুর্যোগে বোধহয় বেচারা ডানা -শুকোবার অবসর পায়নি। জলটা ধরেছে বলে বোধহয় একটু হাওয়া লাগাতে বেরিয়েছে।

গদাধর সোঁদরবনের লোক হলে কী হয়, সে এখন কলকাতাইয়া বাবু হয়ে গেছে।

গদাধর সেই ছেলেটিকে বলল, ঐটা কী পাকি গো ছেলে?

ছেলেটি মুখ ঘুরিয়ে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বলল, মদনটাকি!

ঋজুদা বলল বুড়ো মাঝিকে, তোমার নামটা কী হে?

বুড়ো বলল, সাজাহান এজ্ঞে।

ঋজুদা বলল, দাড়িটা তো শাজাহানের মতোই রেখেছ, কী বলো?

ঐ হইয়ে গেছে আর কী। আমাদের আবার দাড়ি। গজাতি গজাতি এক কাড়ি।

ঋজুদা আবার শুধোল, ছেলের নাম কী দেছ গো?

বুড়ো বলল, মীরজাফর।

ঋজুদা অবাক হয়ে বলল, শাজাহানের ছেলে মীরজাফর কেন?

বুড়ো বলল, শাজাহানের ছেলির নাম রাখলি তো বুড়ো বয়সে বাপকি ঐ অবস্তাতিই নেত। তার চেয়ে অন্য নামই ভাল।

কিন্তু মীরজাফর কেন?

বেইমান। বেইমান। সব বেইমান। জোয়ান হলি কি বুড়রে দেইখবে? দেইখবে না ছাই। তাই আমি আগে থাকতিই বুক বেঁধে রাইখছি—যাতে কষ্ট-টষ্ট বেশি না পেতি হয়।

ঋজুদা হাসল। বলল, ইটা বইলেছ ভাল।

তারপর বলল, মাছ ধরতেছিলে কোথায়? চামটায় লাকি?

চামটার নাম কোরোনি বাবু। বড় চামটা, ছোট চামটা, সবই বড় সব্বনেশে জায়গা। মামার রাজত্ব। আবার শুনতেচি নাকি মামা- সকলের বংশবিরিদ্ধির নির্মিত্তি সোঁদরবনে বাঘ-পেকল্প কইরবেন উনারা। মজা মন্দ লয়। মামায় খেইয়ে খেইয়ে আমাদের বংশ-লাশ হবার উপক্রম, আর কর্তারা সব লাকি মামাদিগের বংশবিরিদ্ধির কাজে নেইগেচেন।

ঋজুদা বলল, মানুষ তো আর বাঘের আসল খাবার নয়। চোরা শিকারীরা এসে সব হরিণ, শুয়োর মেরে সাফ করে দিয়েছে বলেই তো বাঘ এখন মানুষ খায়। বাঘ-প্রকল্প হলে তোমাদের ক্ষতি কী?

শাজাহান চটে উঠে বলল, ই এটা কতার মতো কতা কইলো বটে তুমি। কবে মামায় মানুষ খেইত্যো না শুনি। আমি তো জন্ম থিকেই শুইনে আসতিচি, দেইখ্যে আসতিচি যে, মামায় মানুষ নিতেচে পতিবছর। তোমরা শেষে সোঁদরবনের বাঘের মাস্টার হইয়েছ, আমরা গরিব-গুরবো মুক্কু-সুক্কু মানুষ হয়ে কী আর বলি? বলার লাই কিছুই।

ঋজুদা বুঝল, বুড়ো শাজাহান চটেছে। বলল, চা খাবে?

তা খেতি পারি।

ঋজুদা গদাধরকে ধলল, গদাধর, ভাল করে তেজপাতা, লবঙ্গ, আদা-টাদা দিয়ে চা বানা ত বেশি করে ওদের সকলের জন্যে। আর হ্যাঁ, খাবার কিছু আছে?

গদাধর দেশের লোককে খাতির করার অর্ডার পেয়ে পুলকিত হয়ে বলল, ডিম আছে অনেক। তুমি যা এনেছ দাদাবাবু, তা তো পুরো পল্টনের খাবার। পাঁউরুটিও আছে। আমি ওদের ফ্রেঞ্চ টোস্ট করে দিচ্ছি। ভাল করে পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে।

বেশি করে করিস। ঋজুদা বলল। তারপর বলল, শাজাহান, একটু চা-টা খেয়েই যাও। তাড়া কিসের? তোমরা যাচ্ছিলে কোথা?

আর কোতা? পানি-কাটতি। তারপর বলল, চা তো খাওয়াবেন বাবু, তার আগে এট্টু পানি যদি দেতেন।

নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। বলেই ঋজুদা হাঁক ছাড়লো, ওরে নটবর, পরেশ, ওদের সবাইকে জল খাওয়া আগে।

বুড়ো শাজাহান বলল, আমরা পানি-কেইটে ফেরার পথি তোমাদের পানি তোমাদের শোধ কইরে যাব!

ঋজুদা হাসল। বলল, আমাদের দু-দুটো ড্রামে জল আছে। তোমাদের জল ফেরত দিতে হবে না।

আমি ভাবলাম—কী ভাল এরা। কত সম্মানজ্ঞান। ভিক্ষে চায় না কোনো কিছুই। দয়া চায় না কারো কাছে।

ঋজুদা বলল, নুন-টুন আছে তো শাজাহান? না, দেব বলো?

লবণ তো বড় সমস্যা লয় এখানি। পানি জ্বাল দিলিই তো লবণ —তবে বড় কষা-কষা লাগে। থাকলি দিতি পারো এট্টু। ব্যঞ্জনে সোয়াদ হত।

ঋজুদা পরেশকে বলল, এক প্যাকেট টেবল সল্ট এনে দে তো ওদের।

ঋজুদার ব্যবহারে লোকগুলো বেশ ঢিলে-ঢালা হয়ে বসেছিল। বিড়ি খাচ্ছিল, হুঁকো খাচ্ছিল। সাধারণত মোটরবোট দেখলেই বাউলে-মউলে-জেলেরা ভয় পায়। কতরকম বড় লোক আছে এদেশে। ওদের কাছ থেকে মাছ কেড়ে নিয়ে যায়, পয়সা না দিয়েই, বা নামমাত্র পয়সা দিয়ে। ওরা যখন নৌকোর গলুইয়ে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে স্বগতোক্তি করে, বড় খেতি হইয়ে গেল, বড়ই খেতি হইয়ে… তখন বাবুরা, ব্যাটাদের কেমন ঠকিয়েছে, এই নিয়ে জয়োল্লাস করেন। ঠকানোটা একটা উঁচুদরের আর্ট, খেলা ওঁদের কাছে।

শাজাহান খেদের সঙ্গে বলে, ইখানে খাদ্য-খাদকের বড়ই অভাব বুইজলেন বাবু।

আমি ওর বাংলা শুনে হেসে ফেললুম। খাদ্য-খাদক বলতে ও খাবার-দাবার বোঝাচ্ছিল।

আমাকে হাসতে দেখে ও হাসির কারণ বুঝতে না পেরে বলল, কী গো খোকা। বিশ্বেস কইরলে না বুজি?

আমাকে খোকা বলাতে আমার ভীষণ রাগ হল।

ঋজুদা মজা পেয়ে বলল, আরে খোকার মতামত ধরতে গেলে কি চলে? ছেলেমানুষ। ও কী জানে?

ভাল হবে না কিন্তু। আমি বললাম, ঋজুদাকে।

ঋজুদা বলল, কথা না বলে চুপ করে শোন শাজাহানের কথা! সারা জীবনের অভিজ্ঞতা। ওর কথা শুনলে তুই কত কী শিখতে পারবি। চুপ-চাপ থাক। তা না, নিজেই কথা বলছিস কেবল।

আমি চুপ করে গেলাম লজ্জা পেয়ে।

ঋজুদা বলল, কী শাজাহান? তুমি চুপ করে গেলে কেন? কিছু বলো।

বুড়ো লজ্জিত হল। সঙ্কুচিতও। বলল, কী যে বলেন বাবু আমরা মুক্কু-শুক্কু লোক—এই বাদার মধ্যিই জনম-করম, আমরা হতিছি গিয়ে ডোবার ব্যাঙ। আপনাদের সামনি কি মুখ খুলতি পারি আমরা?

আমি লজ্জিত হলাম। আশ্চর্যও হলাম। যারা সত্যিই অনেক জানে, অভিজ্ঞতা যাদের অশেষ, তারাই বোধহয় নির্বাক থাকে। কথা বলে না। কথা না বলতেই ভালবাসে। আর যাদের জ্ঞান কম, ওপর- ওপর, কোনো কিছুরই গভীরে যারা যায়নি, তারাই তাদের অনভিজ্ঞ- তার অল্প জলে কই মাছের মতো খলবল করে—নিজেদের বিদ্যা জাহির করার জন্যে।

ঋজুদার অনেক পীড়াপীড়িতেও শাজাহান কিছু বলল না। শুধু বলল, বলার মতো কী আছে? মাছ ধরতি আসি ফি বছর, কেউ ফিরি, কেউ ফিরি না। বড় কষ্ট গো আমাদের বাবু। বাঘ, কুমির, হাঙর, মহাজন, ফরেস্ট ডিপাট এই নে আমাদের ঘর। এই-ই সব।

ঋজুদা চুপ করে রইল। দেখলাম, খাল যেখানে গিয়ে দূরের জঙ্গলে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চেয়ে রয়েছে ঋজুদা। শাজাহানও চুপ করে ছিল।

হঠাৎ আমার মনে হল, জল বাদার সাধারণ মানুষ বড় দুঃখী। এই মানুষটার সঙ্গে এই মুহূর্তে ঋজুদা কোথায় যেন মিশে গেছে। অন্যের দুঃখ নিজের হৃদয়ে অনুভব করার ক্ষমতা ভগবান সকলকে দেন না। ঋজুদাকে দিয়েছেন। আশীর্বাদ!

জোয়ার আসছে। জোরে জল ঢুকছে খালে; সুঁতিখালে। জলের উপরে-উপরে নিচু দিয়ে উড়ে চলেছে একদল মেছো বক। ওদের ডানার ছন্দ যেন জলের ছন্দের সঙ্গে মিশে গেছে।

বাঁদর ডাকছিল পাশের জঙ্গল থেকে হুপ-হাপ। দুপ-দা, ঝুড়-ঝাড় শব্দ করছিল ওরা ডালপালায়।

শাজাহান ঐ দূরাগত শব্দ শুনে বলল, এট্টু, সাবধানি পানি কাটিস মীরজাফর তোরা। আমার মনটা কেন জানি হঠাৎ কু ডাকতিছে!

আবহাওয়াটার আস্তে আস্তে উন্নতি হচ্ছে। হাওয়ার বেগটাও যেন কম কম মনে হচ্ছে। আজ বিকেলের দিকে মেঘভার কেটে গিয়ে রোদ উঠলেও উঠতে পারে।

গদাধর, পরেশ, নটবর, সকলে মিলে ট্রেতে বসিয়ে গরম-গরম ফ্রেঞ্চ-টোস্ট, পাঁপড় ভাজা আর চা নিয়ে এল ওদের সকলের জন্যে।

কাপে চা দেখে শাজাহানের পছন্দ হল না। বলল, গ্লাস নেই লাকি গো? আমারটা গ্লাসি করি দাও। এমন ভাল চা কি ঐ ছোট্ট কাপি খেইয়ে সুখ হয়?

মীরজাফর চায়ে চুমুক দিয়েই চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বলল, কমমো ফতে। তারপরই চেঁচিয়ে বলল, ও বাপজান, ই চায়ে কী যেন মিইশে দিছে।

ঋজুদা হো-হো করে হেসে ফেলল, ওর কথা শুনে।

শাজাহান নিজের গেলাসে এক চুমুক মেরে বলল, এরই কারণে মীরজাফর তুই মাদ্রাসায় যেতি পারলিনি। তেজপাতা আর আদার গন্ধ চিনতি পারলিনি?

মীরজাফর সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠল, তুমি না-হয় উসব গন্ধ-টন্ধর কথা বলতি পারো, আমি কবে তেজপাতা আর আদা দে চা খেলাম যে জাইনব?

শাজাহান খুশি হল। বলল, ইটা একটা কতার মতো কতা কইচিস বটে তুই। লে, ইবার বাক্যি বন্ধ কইরো খাদ্য-খাদক খেয়ে লে দিকিনি বাপ। তোর বাপজান তো তুরে এমন সব বিল!ইতি খাদ্য-খাদক খাওয়াতি পারেনি কখনো। তারপর সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল, কী বলো হে সাগরেদরা। ঠিক বইলতিচি কিনা।

ঠিক। ঠিক। একশোতে দুশো। ঠিকই বলতিচো গো শাজাহান চাচা। ওরা একসঙ্গে বলল।

একটু পর শাজাহান বলল, লে, তুরা ইবার গবাগর্ খা দিকিন। খেইয়ে-দেইয়ে তারপর যা তুরা, পানি কাটতি যা। আমি ই বাবুটার সঙ্গে এটু কতা কই। আবার দেখা হয় কি, লা হয়, কে জানে।

মীরজাফর আর শাজাহানের আরো তিনজন সঙ্গী খাওয়া-দাওয়া করে, চা ও জল খেয়ে ছোট নৌকোটা খুলে নিয়ে বে-গোনে দাঁড় টেনে ছপাছপ, করে চলে গেল ছোটবালির দিকে।

ওরা যেখানে নৌকো নোঙর করে জল কাটবে, সে-জায়গাটা এখান থেকে বড় জোর আধমাইলটাক হবে। তবে ঘন জঙ্গল থাকায় এবং নদীটা সামনে গিয়ে বাঁক নেওয়ায় এখান থেকে তা দেখা যায় না।

একটা লাল রঙের খোপখোপ লুঙ্গি মেলা ছিল নৌকোটার ছইয়ের উপরে। সেটা জঙ্গলের নরম ভিজে সবুজের মধ্যে বাঁকের মুখে দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল।

শাজাহান তার হুঁকোতে ভাল করে তামাক সেজে হু কো খেতে খেতে গল্প করতে লাগল ঋজুদার সঙ্গে। বুড়োর সঙ্গে আরো যারা ছিল, তারা নিজের-নিজের কাজ করছিল। বাধ-জালের গোছাটা খুলে ছইয়ের উপর মেলে দিল দুজন। আর দুজন খেপলা-জালটা মেরামত করতে লাগল মনোযোগ দিয়ে, মাথা নিচু করে।

আকাশ আস্তে-আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। জোরে জোয়ারের জল ঢুকছে নদী দিয়ে। আমাদের বোটটা জল বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে আস্তে- আস্তে উঁচু হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর-পর খেয়াল করলে বোঝা যায়। ঝড়বৃষ্টিতে নানা-রঙা পাতা, খড় কুটো, মরা ডাল ঝরে পড়েছিল। সেগুলো সব ভেসে চলেছে। একটু পরেই জোয়ার সম্পূর্ণ হবে। ডানদিকে, ইংরিজিতে যাকে স্টারবোর্ড সাইড বলে, বোটের গায়ে ঘষে ঘষে সড়সড়, সিরসির আওয়াজ করে ভেসে যাচ্ছে সেগুলো। একটা হাঙর একবার মাঝনদীতে উল্টে উঠেই ডুবে গেল।

জোয়ারের স্রোতের সঙ্গে খালের মধ্যে ভাঙন মাছ ঢুকছে লাফালাফি করে। একটা সুঁতিখাল এসে মিশেছে সামনেই। সেই খালেও জলের সঙ্গে মাছ ঢুকছে। যখন ভাঁটা দেবে, মাছগুলো জলের সঙ্গে আবার নেমে আসবে। তখন কোনো ফিশক্যাট বা বাগরোল থাবা মেরে-মেরে মাছ ধরে খাবে। অনেক দূর থেকে নীল-হলুদ-লাল মেশানো বড় মাছরাঙা আশ্চর্য ধাতব ডাক ডাকতে-ডাকতে উড়ে আসছে এদিকে। তার সেই ডাকে এই জলজ প্রভাতী নিস্তব্ধতা কাঁচের বাসনের ভেঙে পড়ার শব্দের মতো শব্দ করে চুরচুর করে ভেঙে যাচ্ছে।

যে-লোকগুলো মুখ নিচু করে খেপলা-জালটা মেরামত করছিল, তাদের মধ্যে একজন গুনগুন করে একটা গান গাইছিল।

ঋজুদা শুনতে পেয়ে বলল, এটু জোরে গাইলি তো আমরাও শুনতে পেতাম।

যে গাইছিল, সে ঐ কথায় চমকে উঠে লজ্জা পেল।

ঋজুদা আবার বলল, গাও না ভাই—শোনাও তো একটা গান।

ওর সঙ্গী সাথীরাও পীড়াপীড়ি করল। তাতে লোকটি মুখ না তুলেই, তার জোড়া হাঁটুর উপর থুতনি রেখে গান ধরল। সুন্দর জারিনারে, তোমারে কইরব বিয়া…

তার গানের সুরে এমন এক উদাস, বিধুর রেশ ছিল যে, আমার মনে হল সুন্দরবনে না হলে ও গান মানাত না। সুন্দরবনের লোকের লেখা, সুন্দরবনের মানুষের গলায় এবং সুন্দরবনেই গাইবার জন্ম ও গান।

গান থামলে, শাজাহান বলল, এ হল গিয়ে যাত্রার গান। কবিগানও হয় মাঝে-মাঝে। কবির-লড়াই।

এমন সময়ে হঠাৎ শাজাহান উৎকর্ণ হয়ে সোজা হয়ে বসল। ওর চোখ মুখ কপালের উপরে সার সার বলিরেখা কুঁচকে উঠল। পরক্ষণেই ও নৌকোর পাটাতনের উপর উঠে দাড়াল। কান খাড়া করে কী যেন শুনতে চেষ্টা করল।

ঋজুদাকেও দেখলাম, হঠাৎ উত্তেজিত। জোরে বলল, নটবর, পরেশ, একদম চুপ কর। মশলা পরে বাটবি। কোনো শব্দ করিস না। বলেই, ঋজুদাও দাঁড়িয়ে উঠে কী যেন শোনার চেষ্টা করল।

দূর থেকে হৈ-হৈ আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজটা জলের উপর দিয়ে পিছলে আসছিল। দুমদাম করে আছাড়ি পটকা ফাটার শব্দ হল।

ঋজুদা সঙ্গে সঙ্গে নটবর ও পরেশকে সংক্ষিপ্ত অর্ডার দিল, নোঙর তোল। তারপরই বলল, নীলমণি বোট খোলো, শিগগির ছোটবালির দিকে বোট নিয়ে চলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *