প্ৰথম খণ্ড – সংঘর্ষ—পুণ্য ও পাপে

প্ৰথম খণ্ড – সংঘর্ষ—পুণ্য ও পাপে

প্রথম পরিচ্ছেদ – রোগ শয্যায়

“যদি আমি এখন একবার রায়মল্ল সাহেবকে দেখতে পেতেম, তা’ হ’লে দুই লক্ষ টাকার কাজ হ’ত।”—

রাজস্থানের পার্বত্য প্রদেশে বুঁদী নামক স্থানে একটি ক্ষুদ্র একতালা বাটীতে অশীতিপর এক বৃদ্ধের রোগশীর্ণ মুখ হইতে অতি কষ্টে এই কথাগুলি ধীরে ধীরে বাহির হইল। বৃদ্ধ রোগ-শয্যায় শায়িত। তাঁহার দেহ অতি ক্ষীণ—তিনি মৃত্যুমুখে অগ্রসর। তাঁহার নিকটেই ষোড়শবর্ষীয়া এক অপূর্ব্ব লাবণ্যবতী সুন্দরী নবীনা উপবিষ্টা। তাহার বেশ-ভূষা অতি সামান্য, কিন্তু তাহার অপরূপ রূপের ছটায় সমগ্র ঘরখানি আলো করিয়া রহিয়াছে। সে আপনার কোমল হাত দুইখানি দিয়া অতি যত্নে আসন্ন-মৃত্যু বৃদ্ধের গায়ে হাত বুলাইতেছিল। সেই কুসুমসুকুমার অঙ্গসৌষ্ঠব, সেই পরম রমণীয় লাবণ্য সন্দর্শনে মনে হয়, যেন কোন দেববালা বুদ্ধের সেবায় নিযুক্ত। সে বদনকমলে সাহসিকতা ও কোমলতা যেন একাধারে বর্ত্তমান।

নবীনা জিজ্ঞাসা করিল, “রায়মল্ল সাহেব কে, বাবা?”

বৃদ্ধ। রায়মল্ল সাহেবকে আমি নিজে কখনও দেখি নি, কিন্তু তাঁর নাম আমি অনেকবার শুনেছি। তিনি বিশ্বাসী, সাহসী, তীক্ষ্মদৃষ্টি, সদ্বিবেচক। তাঁর বাপের সঙ্গে আমার খুব আলাপ ছিল? না— আলাপ কেন, বন্ধুতাও ছিল। শুনেছি, তাঁর ছেলে রায়মল্ল এখন ইংরেজ-সরকারে চাকরী করেন। তাই লোকে তাকে বলে, রায়মল্ল সাহেব। তিনি একজন নামজাদা গোয়েন্দা। তাঁর মত আশ্চর্য্য ক্ষমতাবান্ গোয়েন্দা নাকি এ প্রদেশে আর নাই।

“তাঁকে একখানা চিঠি লিখলে কি হয় না, বাবা?“

বৃদ্ধ এই কথা শুনিয়া সেই নবীনার হাত দুইখানি ধরিয়া খুব কাছে টানিয়া আনিয়া উচ্ছসিত স্বরে বলিলেন, “তারা, মা! আর আমি তোমার কাছে সেই ভয়ানক গুপ্তকাহিনী প্রকাশ না ক’রে থাকতে পারছি না। আমার জীবন অবসান-প্রায়—এই যাত্রা আর বুঝি আমি রক্ষা পাব না। তারা! তারা! মা আমার! তোমার আমি কিছুই ক’রে যেতে পারলেম না। আমার শেষ-মুহূর্ত্ত আসন্ন প্রায়।”

তরুণীর নাম তারাবাই। বৃদ্ধের এই কথা শুনিয়া তারাবাই কাঁদিতে লাগিল; কিন্তু তখনও তাহার বদনে সেই পূর্ণজ্যোতিঃ বিরাজমান। সাহসে নির্ভর করিয়া তারা বলিল, “না বাবা! আপনি ভাববেন না—আপনি না বাঁচলে অভাগিনী তারাকে কে দেখবে—কে যত্ন করবে? বিধাতা আমার প্রতি কখনই এমন নিদয় ব্যবহার করবেন না—”

বৃদ্ধ। মা! আর তোমায় বৃথা প্রবোধ বাক্যে ভুলিয়ে রাখা অত্যন্ত অন্যায়—আর তোমায় প্রবঞ্চনা করাও মিছে! আমার প্রাণ-বায়ু প্রায় কণ্ঠাগত। তবু যদি আমি এখনও একবার রায়মল্ল সাহেবকে দেখতে পেতেম, তা’ হ’লেও তোমার একটা যা’ হয়, উপায় করতে পারতেম। যদি তাঁর হাতে তোমার রক্ষা-ভার দিয়ে যেতে পারতেম, তবু আমার মনে ভরসা থাকৃত, আর তোমার কোন বিঘ্ন ঘবে না। কিন্তু হায়! জীবনের বিন্দুমাত্র আশা থাকতে আমি সে চেষ্টা করি নাই, এখন আর দুঃখ করলে কি হবে? তোমার জন্য আমি এত চেষ্টা ক’রে কিছু ক’রে যেতে পারলেম না। যে কাজ তোমার জন্য আরম্ভ করেছিলেম, আর দিন-কতক বাঁচলে তা’ সিদ্ধ হ’ত—

বাকী কথা না শুনিয়াই তারা বলিল, “আমার জন্য কি কাজ, বাবা?”

বৃদ্ধ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “হাঁ মা! তোমারই জন্য। যখন দেখছি, আমার, বাঁচ্‌বার আশা নাই, তখন তোমায় সমস্ত সত্যকথা ব’লে যাওয়াই ভাল। তোমায় মানুষ করবার জন্য আমি এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত অকাতরে পরিশ্রম করেছি। মনে বড় আশা ছিল, তোমাকে তোমার যথার্থ প্রাপ্য অতুল সম্পত্তির অধিকারিণী হ’তে দেখে যাব; কিন্তু হায়! বিধাতা তাতে বাদ সাধলেন। বাণিজ্যের ভরা নৌকা কিনারায় এসে ডুবে গেল।”

তারা। আমি অতুল-সম্পত্তির অধিকারিণী! একি কথা, বাবা?

বৃদ্ধ। মা! তুমি আমার আশ্রয়ে থেকে কোন দিন দুটী খেতে পাও, কোন দিন পাও না; কিন্তু তোমার অতুল ঐশ্বর্য্য নিয়ে আর একজন স্বচ্ছন্দে খুব বড়-মানুষী করছে। অদৃষ্টের দোষে তুমি আমার পালিতা কন্যা; নইলে তোমার বিষয়-আশয় যা’ আছে, অনেক রাণীর তা’ নাই। অনেক জুয়াচোরে মিলে তোমায় তোমার যথার্থ প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে;এখনও কোন প্রকারে যাতে তুমি সে বিষয় জানতে না পার, তার জন্যই সম্পূর্ণ সচেষ্ট রয়েছে। যদি আমি এ-যাত্রা রক্ষা পেতাম, তা’ হ’লে রায়মল্ল সাহেবকে তোমার সহায়তায়, নিযুক্ত করতেম। পৃথিবীতে যদি কেউ তোমার যথার্থ প্রাপ্য সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে, তা’ হ’লে কেবল তিনিই একমাত্র ব্যক্তি। যারা তোমায় প্রবঞ্চিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হ’তে যদি কেউ সাহস করে, তবে তিনিই একমাত্র সাহসী বীর এ-কালে বর্ত্তমান। কেবল একজন বিচক্ষণ সাহসী ও মহানুভব গোয়েন্দার সাহায্যই আমি আপাততঃ বিশেষ আবশ্যক বিবেচনা করি। উকীল-মোক্তার পরে দরকার হবে।

তারা। তা’ এই রায়মল্ল সাহেবকে কি কোন রকমে এখানে আনা যায় না বাবা? একখানা চিঠি লিখলে কি হয় না?

বৃদ্ধ। না—তা” আর হয় না। সে সময় আর নাই। দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে যদি আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হ’ত, তা’ হ’লেও বোধ হয়, আমি তাঁকে সমস্ত কথা ব’লে যা’ হয় একটা উপায় ক’রে যেতে পারতেম।

তারা। তিনি এখান থেকে কত দূরে থাকেন?

বৃদ্ধ। বহুদূরে। কিন্তু আমি শুনেছি, তিনি এখন লালপাহাড়ে এসেছেন! বিশেষ কাৰ্য্যোপলক্ষে সেইখানেই নাকি এখন কিছুদিন থাকবেন।

তারা। লালপাহাড় এখান থেকে সাত আট ক্রোশের বেশি ত হ’বে না।

বৃদ্ধ। তা’ আমি জানি।

তারা। তবে আর কি? আমি অনায়াসে ঘোড়ায় চড়ে লালপাহাড়ে যেতে পারি। তিনি কি রামলালজীর বাড়ীর কাছে থাকেন?

বৃদ্ধ। তিনি রামলালজীর বাড়ীতেই না কি বাসা নিয়েছেন; কিন্তু তা’ হ’লে কি হয়? রাত্রি হয়ে এল—তুমি বালিকা, অসহায়া, একাকিনী। তোমায় কি আমি সাহস করে ছেড়ে দিতে পারি? বিশেষতঃ এদিককার পর্বতশ্রেণীতে কত দস্যু, কত বদমায়েস, কত খুনে বাস করে; তুমি কি তাদের অতিক্রম ক’রে যেতে পারবে? আমি কোন রকমেই সাহস ক’রে তোমায় যেতে বলতে পারি না

তারা। না বাবা, আমার জন্য আপনার কোন ভয় নাই। আমি আমার নিজের কাজের জন্য যাব না; তবে যদি আপনার এতে একটু ভাবনা কমে, যদি আপনি একটু শান্ত হ’ন, তাই আমি যাব।

বৃদ্ধ। না মা! আমি তোমায় যেতে দিতে পারি না, তোমায় পাঠাতে আমার সাহস হয় না। তারা অল্পবয়স্কা—কিন্তু সে রাজপুত-কুমারী। যে রাজপুত-কুল-মহিলার সাহসিকতার দৃষ্টান্তে ভারতের ইতিহাসবেত্তারা এখনও গৌরব করিয়া থাকেন; রাজস্থানের ইতিহাসের প্রতি ছত্ৰে, প্ৰতি শব্দে এখনও যাঁহাদের গৌরব জাজ্বল্যমান, তারা সেই রাজপুত-কুলোদ্ভবা। রাজপুত রমণী চিরকালই যুদ্ধ-ব্যবসায়ে অগ্রগামিনী—বীর-ভর্ত্তার উপযুক্ত বীরপত্নী। অস্ত্র-শস্ত্রাদি সঞ্চালন, অশ্বপৃষ্ঠে দেশ- দেশান্তর ভ্রমণ, আবশ্যক মতে স্বহস্তে কৃপাণ ধারণ করিয়া শত্রুদমন প্রভৃতি সকল প্রকার সামরিক কার্য্যে তাঁহারা বিশিষ্ট নিপুণ না হইলেও স্বার্থ সাধনার্থ কখনই ঐ সকল কার্য্যে ভীতি বা নারী-স্বভাব- সুলভ লজ্জার বশবর্তিনী হইয়া পরাজুখী হইতেন না। একে তার ধমনীতে রাজপুত-রক্ত প্রবহমান, তাহাতে আবার সে বাল্যকালে পালক-পিতার যত্নে অশ্বারোহণ, অশ্বচালনাদি এবং এমন কি বন্দুক, পিত্তল প্রভৃতি ব্যবহার করিতে রীতিমত শিক্ষা করিয়াছিল। যদিও তাহার শৈশবাবস্থা এইরূপ পুরুষোপযোগী কার্য্যে পরিবাপিত হইয়াছিল, তথাপি যৌবন-সমাগমে তাহার মাধুরী ঐরূপ করিবার জন্য কোন ক্রমেই হ্রাসপ্রাপ্ত হয় নাই। তাহার লাবণ্য পদ্মপত্রস্থ জলের ন্যায় ঢল ঢল যৌবনের প্রথম বিকাশের সহিত তাহার রীতিনীতির পরিবর্ত্তন হয় নাই।

তারা পাশ্ববর্ত্তী আট-দশ ক্রোশের মধ্যে প্রায় সকল স্থানই অবগত ছিল; সুতরাং ঘোড়ায় চড়িয়া সাত-আট ক্রোশ দূরে লালপাহাড়ে যাইতে উৎসুক হইবে, ইহা আর আশ্চর্য্যের বিষয় কি? উহা তাহার দৈনন্দিন ক্রীড়ার মধ্যে গণ্য—তাই তারা ধীর, গাম্ভীর্য্যপূর্ণস্বরে বলিল, “বাবা আপনার অবাধ্য কখনও হইনি, কিন্তু আজ আপনারই তুষ্টির নিমিত্ত আমি আপনার নিষেধ অবহেলা ক’রে লালপাহাড়ে যাব। আপনি ভাবিত হবেন না, আমি নিরাপদে উদ্দেশ্যসাধন করে অতি শীঘ্রই ফিরে আসব।”

মুমূর্ষু বৃদ্ধ কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিলেন, “মা! তুমি অসমসাহসিকের কার্য্যে অগ্রসর হচ্ছ, কিন্তু না গেলেও আর উপায় নাই—যেতেই হবে। দেখ, আমার মনে কেমন একটা ভীষণ আশঙ্কা আছে।”

তারা। বাবা আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—আপনি ত জানেন, আমি ছেলেবেলা থেকে ঘোড়ায় চড়া অভ্যাস করেছি। ছেলেবেলা থেকেই আরাবল্লী পর্ব্বতে অশ্বারোহণ করে বেড়িয়েছি, কখনও ত কোন বিপদে পড়ি নি। পাহাড়ের আট-দশ ক্রোশ পৰ্য্যন্ত পথঘাট আমার এক রকম জানা আছে; পথ ভুলে যাবার ভয়ও নাই, তবে আর আপনার ভাবনা কিসের?

বৃদ্ধ। আচ্ছা মা, যদি রাস্তায় রঘুনাথের সামনে পড়িস?

এই কথায় তারার বদনকমল ক্রোধে ঈষৎ রক্তাভ হইল। নয়নদ্বয়, উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। সে নির্ভীকস্বরে উত্তর করিল, “রঘুনাথকে ভয় কি, বাবা? তবে এ-সময়ে তার সঙ্গে দেখা না হওয়াই ভাল। তাকে আমি ঘৃণা করি—ভয় করি না।”

এ কথা রাজপুত-কুমারীর মুখেই শোভা পায়।

বৃদ্ধ যে রঘুনাথের কথা বলিলেন, তাহার প্রকৃত নাম রঘুনাথ সিংহ। রঘুনাথও রাজপুত-বংশজাত। বাল্যকাল হইতেই রঘু ‘ তারাকে জানিত। তারার পালক-পিতার বাটীর নিকটেই রঘুনাথের পিত্রালয়। তারা ও রঘুনাথ ছেলেবেলায় একত্রে খেলা করিত। প্রায়ই তাহারা একত্রে থাকিত, সন্ধ্যা হইলে আপন আপন আবাসে যাইত। তারা যত বড় হইতে লাগিল, ক্রমে যখন কৌমার্য্যসীমা অতিক্রম করিয়া যৌবনে পদার্পণ করিতে লাগিল, রঘুনাথের পাপপ্রবৃত্তি ততই প্রবল ভাব ধারণ করিতে লাগিল। রঘুনাথ তারাকে পত্নীরূপে পাইবার প্রয়াসী হইল। তারা যদিও রঘুনাথকে যত্ন করিত, তথাপি তাহার পত্নী হইবার ইচ্ছা তাহার কোন কালেই মনে উদিত হয় নাই। তাহাকে বিবাহ করিবার কথা সে কল্পনায়ও মনে স্থান দিত না। এইরূপে বিফল মনোরথ হইয়া রঘুনাথের অন্তরে, ঈর্ষাবহ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। সে ভাবিল, তারা তাহার অপমান করিয়াছে;এ-অপমানের প্রতিশোধ লইতে হইবে। তারার নিকটে সে তাহার অকৃত্রিম প্রণয়ের পরিবর্ত্তে কেবল ঘৃণা ও অপমান লাভ করিয়াছে প্রতিহিংসা তাহার উপযুক্ত। সে নিশ্চয়ই প্রতিহিংসা গ্রহণ করিবে। হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করিতে সে সদসৎ জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার প্রতিজ্ঞা অটল, অবশ্যই তাহাকে তাহা পূরণ করিতে হইবে। রঘুনাথ ভয়ানক কপটাচারী, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, নিৰ্দ্দয়। সহজ কথায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, সে ‘মরিয়া’ গোছের লোকের মত। পরস্বাপহরণ, ডাকাতি, খুন—কোন প্রকার পাপ-কাৰ্য্যই তাহার অনায়ত্ত ছিল না। ভীষণ পাপাচারী হইলেও কিন্তু এই সকল দুষ্কর্ম্ম সে এতদূর সতর্কতার সহিত সম্পন্ন করিত যে, এ-পর্যন্ত কখনও কেহ তাহার দুষ্ক্রিয়ার কথা জানিতে পারে নাই। তবে রঘুনাথ সিংহ নামে একজন ঘোর দুবৃত্ত পাষণ্ড, নরঘাতী, ব্যক্তি সে-প্রদেশে আছে, সকলেই তাহা জানিত; কিন্তু সে যে কোন্ রঘুনাথ, তাহা কেহই জানিতে পারিত না। অনেকে তাহাকে সন্দেহ করিত; কিন্তু নিশ্চয় করিয়া কেহ কিছু বলিতে পারিত না।

তারার পালক-পিতার আরব-দেশী একটি অতি উৎকৃষ্ট ঘোটক ছিল;বৃদ্ধ তাঁহার অন্যান্য সমুদয় সম্পত্তি অপেক্ষা ঐ অশ্বটিকে মূল্যবান্ জ্ঞান করিতেন। সেই সময়ে সেই-প্রদেশে ঘোড়াচুরির বিশেষ প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। বৃদ্ধ বিশেষ যত্নে, বহু অনায়াসে এই অপহারকদলের কবল হইতে নিজের সেই অশ্বটিকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

বৃদ্ধ যদিও তারাকে বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার অধিকক্ষণ বাঁচিবার সম্ভাবনা নাই, তথাপি সে কথায় তারার আদৌ বিশ্বাস হয় নাই। সে ভাবিয়াছিল, হয় ত তিনি আপনার শরীরের অবস্থা যথার্থরূপ অনুভব করিতে পারিতেছেন না! এক মুহূর্ত্তের জন্যও তারা ভাবে নাই; তাহার পরম দয়ালু পালক-পিতার আসন্নকাল উপস্থিত। তবে যে সে লালপাহাড়ে যাইতে ব্যগ্র হইয়াছিল সে কেবল বৃদ্ধের প্রীতির জন্য। যিনি তাহাকে কত যত্নে, বহু ক্লেশ সহ্য করিয়া পালন করিয়াছিলেন। তাঁহার তুষ্টিসাধনের জন্য চেষ্টা, তাহার সর্ব্বতোভাবে উচিত। এই কৰ্ত্তব্যবোধই এবং রমণীহৃদয়েও যে কৃতজ্ঞতার স্থান আছে, তাহাই দেখাইবার জন্য সে লালপাহাড়ে যাইতে আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিল। বৃদ্ধ যে তাহাকে বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন সে কথা সে আদৌ বিশ্বাস করে নাই। সে মনে ভাবিয়াছিল, সে কথাগুলি বিকারগ্রস্ত রোগীর প্রলাপ-বাক্য মাত্র। দারিদ্র্যদুঃখপীড়িতা পরান্নে প্রতিপালিতা কন্যার আবার বিষয় সম্পত্তি কি? এই সকল কথা মনে উদয় হওয়াতেই তারা স্থির করিয়াছিল, হয় ত রোগের প্রভাবে চিত্তবিকৃত বশতঃ বৃদ্ধ প্রলাপ বকিতেছেন।

পালক-পিতার নিকট কিয়ৎকাল বসিয়া তারা পথ-সম্বন্ধে আরও একটি সন্ধান লইল। পরে আস্তাবলে গিয়া কুমারকে (তারা আদর করিয়া ঘোড়ার নাম কুমার রাখিয়াছিল) জীন পরাইয়া সওয়ারের জন্য প্রস্তুত করিল। তারপর আপনার শয়নাগারে আসিয়া উপযুক্ত বেশে সজ্জিত হইল। সঙ্গে দুইটি পিস্তল লইতেও ত্রুটি করিল না। পিতাকে প্রণাম করিতে গেল। বৃদ্ধ কন্যার মস্তক আঘ্রান করিয়া আশীর্বাদ করিলেন। তারা নাম লইয়া, তারা অশ্বারোহণ করিয়া পাবতীর পথাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল। পথে কত বিভীষিকা রাক্ষসী তাহার জন্য মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে, সরলা তারা তাহার কি বুঝিবে?

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পাৰ্ব্বত্যপথে

লালপাহাড়ে উঠিয়া রামলালজীর বাটীতে পৌঁছিতে যে প্রশস্ত রাস্তা আছে, তাহার দূরত্ব অনেক বলিয়া তারা বনপথে চলিল। যাইবার সময় বৃদ্ধ বার বার তাহাকে সে পথে যাইতে নিষেধ করিয়াছিলেন। কিন্তু তারা সে নিষেধ সত্ত্বেও সত্বর রামলালজীর বাটীতে পৌঁছিবার জন্য সে বনপথই অবলম্বন করিয়াছিল।

শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নাময়ী রজনী। সনাথনক্ষত্রাবলী গগনে উদিত হইয়া ধরাতলে আলোক বিতরণ করিতেছেন। এমন সময়ে সেই অপূৰ্ব্ব-লাবণ্যবতী, পূর্ণযৌবনা তারা অশ্বারোহণে পার্বত্যপ্রদেশীয় বনজঙ্গল অতিক্রম করিয়া অকুতোভয়ে তীরবেগে অশ্বচালনা করিতেছে। সে কোমলে-কঠিন মিলন দেখিবার যোগ্য। সেই স্থির সৌদামিনী, তিলোত্তমাসমা চম্পকবর্ণা তারার অপূর্ব্ব অশ্বচালনা- কৌশল দেখিলে মনে হয়, রাজপুতনার রমণীগণ বীরপত্নী, বীর-প্রসবিনী কেন না হইবেন?

তারা চলিয়াছে—বিদ্যুদগতিতে অশ্ব ধাবিত হইতেছে। পার্ব্বতগাত্রে অশ্বের পদধ্বনিতে যেন বোধ হইতেছে, কোন বীরপুরুষ সদম্ভে শত্রু দমনোদ্দেশে উন্মত্তের ন্যায় কাহারও পশ্চাদ্ধাবিত হইতেছে।

লালপাহাড়ে উঠিতে গেলে প্রথমতঃ প্রায় এক ক্রোশ পর্ব্বতের উপর বাঁকা-চোরা উঁচু-নীচু পথ অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়। তাহার পর লালপাহাড়ের সমতল উপত্যকা ভূমিতে পড়া যায়। তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সেই আয়াস-সাধ্য পথ অতিক্রম করিয়া সমতল ক্ষেত্রে উপনীত হইল এবং অশ্বের গতি কিছু কম করিয়া দিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। এই পাৰ্ব্বতীয় সমতল ভূমিতেই দস্যুগণের ভয়ানক অত্যাচার কাহিনী শ্রুত হইত। তারার বিশ্বাস ছিল, ইংরেজের শাসনে চোর- ডাকাইতেরা ভারতবর্ষ পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছে।

তারা নির্ভয়ে অশ্বচালনা করিতেছে, এমন সময়ে সহসা তাহার অশ্ব বিরুদ্ধভাব ধারণ করিল। আর সে অগ্রসর হইতে চাহিল না। তারা যতই কসাঘাত করিতে লাগিল, ততই যেন অধিকতর উন্মত্ত ভাব প্রদর্শন করিল; ক্ষণে ক্ষণে হ্রেষারব করিতে লাগিল। তারা ভাবিল বোধ হয়, নিকটেই কোন বন্য-জন্তুকে দেখিয়া অশ্ব ভীত হইয়াছে। তখন অনন্যোপায় হইয়া তারা ঘোড়ার পিঠে চাপড়াইয়া, হাত বুলাইয়া তাহাকে শান্ত করিতে চেষ্টা করিল। অনেক চেষ্টার পর ‘কুমার’ শান্ত হইল বটে, কিন্তু সেখান হইতে আর এক পদও অগ্রসর হইল না।

বিস্মিত ও চমকিতনেত্রে তারা দেখিল, ঠিক সম্মুখে ঘোড়ার মাথার কাছে যেন পৰ্ব্বত-গর্ভ ভেদ করিয়া সহসা এক ভীষণ মূৰ্ত্তি উত্থিত হইল। এতক্ষণে ঘোটকের ভয়ের কারণ জানা গেল।

চন্দ্রালোকে সৌন্দর্য্য-বিকশিত তারার লাবণ্যময়ী মূৰ্ত্তি দর্শনে সেই ভীষণ পুরুষ কথা কহিল বলিল, কে গো—কে গো ধনি? এত রাত্রে কোথা যাও?

স্থির, ধীর, শান্ত অথচ নির্ভীকস্বরে তারা উত্তর দিল, “আপনি একটু পাশ কাটিয়ে স’রে দাঁড়ান, আপনাকে দেখে আমার ঘোড়া ক্ষেপে উঠেছে, পথ ছেড়ে দিন;আমি বড় ব্যস্ত হ’য়ে এক জায়গায় যাচ্ছি।”

সেই ভীমাকৃতি পুরুষ ভীষণ হাসি হাসিয়া ভীষণস্বরে, উল্লসিতভাবে কহিল, “আরে বল কি, এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ?”

এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া সে উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই জামার পকেট হইতে একটি বাঁশী বাহির করিল এবং সজোরে বাজাইল। পর মুহূর্ত্তেই আর একটি বাঁশীর শব্দে কে প্রত্যুত্তর দিল। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই প্রকার ভীমাকৃতি আরও জন কয়েক লোক সেইখানে উপস্থিত হইল। তাহাদের মধ্যে একজন আসিয়া একেবারে তারার অশ্ববল্গা ধারণ করিল। অশ্ব আরও ক্ষেপিয়া উঠিল।

তারা কাতরকণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “সরে দাঁড়াও। তোমাদের চেহারা দেখে আমার ঘোড়া এত ক্ষেপে উঠেছে যে, আর একটু হ’লে আমাকে এই পৰ্ব্বত থেকে ফেলে দেবে।”

পর মুহূর্ত্তেই তারার হৃদয়ে, ভীতির আবির্ভাব হইল। তাহাদের একজনের কণ্ঠস্বর শুনিয়াই তাহার আশা-ভরসা, সাহস সমস্ত কমিয়া আসিল, ভয়ে তাহার রক্ত যেন জল হইয়া গেল। সে বিকট চীৎকার করিয়া বলিল, “চন্দ্ৰ সূৰ্য্য মিথ্যা হবে, তবু আমার কথা মিথ্যা হবে না। আমি নিশ্চয় বলতে পারি, এ সেই তারার গলার আওয়াজ।”

আর একজন অমনই প্রত্যুত্তরে বলিল, “তবে ত তারা নিশ্চয় বুড়োর সেই ঘোড়াটায় চড়ে এসেছে। ভালই হয়েছে—ভালই হয়েছে। আমাদের কপাল ভাল। ঘোড়াটার বেশ দাম হবে। অনেক দিন থেকে ঐ ঘোড়াটার উপর আমার নজর আছে।”

তারা এতক্ষণে বেশ বুঝিতে পারিল, সে কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে। একবার ভাবিল, কেন বৃদ্ধ পিতার কথা অবহেলা করিয়া অন্য পথ দিয়া আসিলাম, জানা পথে আসিলে হয় ত এ-বিপদ্ ঘটিত না।

তারা বুঝিল, সে নিষ্ঠুর ভয়ানক দস্যুদলের মধ্যে পড়িয়াছে। রমণী হইলেও তাহার অনিষ্ট করিতে তাহারা বিন্দুমাত্র সঙ্কুচিত হইবে না। বৃদ্ধের নিকটে তারা বলিয়া আসিয়াছিল, “আমি রঘুনাথকে ঘৃণা করি, কিন্তু তাহাকে ভয় করি না।” কিন্তু এখন সেই রঘুনাথের কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে বড়ই ভীত হইল, তাহার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইতে লাগিল। অন্য সময়ে যদি তারা রঘুনাথকে দেখিত, তাহা হইলে বাস্তবিকই বিন্দুমাত্র ভয় করিত না;কিন্তু এখন এই দস্যুদের সঙ্গে তাহাকে দেখিয়া ভয়ে তাহার প্রাণ উড়িয়া গেল। নিজের জীবনের জন্য তারা বিন্দুমাত্র চিন্তিত বা দুঃখিত হইল না; কিন্তু যে রঘুনাথকে সে কতবার ঘৃণায় দূর করিয়া দিয়াছে, যে রঘুনাথ তাহাকে পাইবার জন্য জীবন-মরণ পণ করিয়াছে, এরূপ নিঃসহায় অবস্থায় তাহার হাতে পড়িলে তাহার পালক-পিতার কি দুৰ্দ্দশা হইবে, তাহাই তখন তাহার মনে ভীষণ আন্দোলন উপস্থিত করিল।

ক্ষণমাত্র এই সকল কথা ভাবিয়াই তারা পলায়নের উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। যদিও মৃত্যু হয়, তথাপি বিনা চেষ্টায় আত্মসমর্পণ করিতে তাহার প্রবৃত্তি হইল না। তারা ভাবিল, যদি একবার সে কোন রকমে তাহার অশ্বটীকে উত্তেজিত করিয়া চালাইয়া দিতে পারে, তাহা হইলে আর তাহাকে পায় কে? নির্বিবাদে সে সকল বিপদ্ অতিক্রম করিয়া চলিয়া যাইতে পারিবে; কিন্তু অশ্বচালনাতেও প্রবল অন্তরায়—দুইজন লোক দুই পার্শ্বে তাহার অশ্ববল্লা ধরিয়া দাড়াইয়া আছে। তারা গম্ভীরভাবে বলিল, “সরে দাঁড়াও—আমায় যেতে দাও—আমার বড় দরকার—আমাকে যেতেই হবে—”

দস্যুদলের মধ্যে একজন বিকট হাস্য করিয়া অশ্ববল্লা আরও জোর করিয়া ধরিয়া উত্তর করিল, “এরই মধ্যে কেন গো! ঘোড়া থেকে নামো—তোমার চেহারাখানা একবার দেখি, তার পর যাবে এখন। তোমার কোমল অঙ্গ—এত তেজী ঘোড়ায় চড়া কি তোমার সাজে। তোমাকে আমরা এই ঘোড়ার বদলে একটি বেশ ধীর স্থির শান্ত ঘোড়া দিতে পারি।”

বিপদে পড়িয়া তারা একেবারে হতবুদ্ধি হয় নাই। সে তখনও পলায়নের উপায় অনুসন্ধান করিতেছিল। অশ্ববল্লাধারীকে কথায় ভুলাইয়া দু-এক মুহূৰ্ত্ত সময় অতিবাহিত করিবার অভিপ্রায়ে এবং এইরূপে তাহাকে অন্যমনস্ক করিয়া পলায়নের সুযোগ পাইবার আশায় বলিল, “কৈ তোমাদের ঘোড়া দেখি—আমার এ ঘোড়ার চেয়ে তেজী ঘোড়া না হ’লে আমি বদল করব না।”

একজন অশ্ববল্লাধারী হাসিয়া বলিল, “বাঃ বিবিজান্! তুমি ত দেখছি বেশ বাহাদুর! আমরা ভেবেছিলাম, তুমি আর বড় একটা কথা কইবে না।”

তারা মনে মনে ভাবিল, দস্যুগণকে প্রতারণা করা সহজ নয়। তাহাদের ইতর উপহাসে তাহার মনে বড় কষ্ট হইতেছিল;কিন্তু কি করিবে, কোন উপায় নাই। বিষম সঙ্কটে পড়িয়াও তারা একেবারে হতাশ হয় নাই। সে ভাবিল, “এই সকল স্নেহ-মমতা-বিহীন নির্দয় ও নিষ্ঠুর প্রকৃতি দস্যুগণের হস্তে আত্মসমর্পণ করা অপেক্ষা যে কোন উপায়ে হউক, পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করা উচিত; তাহাতে যদি মৃত্যু হয়, সে-ও ভাল।” তাই অনন্যোপায় হইয়া, সেই মহাদুৰ্বৃত্ত দস্যুগণের কবল হইতে উদ্ধার- লাভেচ্ছায় একবার তারা অসমসাহসীর ন্যায় কার্য্য করিল।

সহসা অশ্বরশ্বি সংযত করিয়া রাজপুত-বালা ‘কুমারের’ পৃষ্ঠে সজোরে কসাঘাত করিল। এই অল্প সময়ের মধ্যে অশ্বটীও কিঞ্চিৎ শান্তভাব ধারণ করিয়াছিল— সে-ও যেন উপস্থিত বিপদ্ বুঝিতে পারিয়াছিল;আরোহিণী কর্তৃক উৎসাহিত হইয়া কুমার একেবারে হঠাৎ লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক তড়িদ্বেগে পার্বত্যপথে অগ্রসর হইল। যে দুই ব্যক্তি অশ্ববল্লা ধরিয়াছিল, তাহারা সহসা-সমুখিত সে-ভীষণ বেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া সেইখানে লুণ্ঠিত হইয়া পড়িল।

অশ্বটীকে অধিকতর প্রোৎসাহিত করিবার অভিপ্রায়ে তারা দুই-একবার চাবুকের শব্দ করিয়া বলিল, “চল, চল কুমার, তীরবেগে চল।” বিষম বিপদের অবস্থা যেন অনুভব করিয়া কুমার, তীরবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। বাল্যকাল হইতে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া তারা যখনই ভ্ৰমণ করিতে যাইত, বেগে অশ্বচালনার প্রয়োজন হইলে তখনই সে কুমারকে ঐরূপভাবে উদ্দীপন করিত। তাই সেই চিরপরিচিত সম্ভাষণ শুনিয়া কুমার বিদ্যুদ্বৎ দ্রুতবেগে ধাবমান হইল। আশে-পাশে যে যে দস্যু দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা স্তম্ভিত হইয়া চাহিয়া রহিল। “চল চল, কুমার!” বলিয়া তারা মুহুৰ্ত্ত মধ্যে বহু পথ অতি দ্রুত অতিক্রম করিল।

নৈশ-নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া পিস্তলের গুড়ুম্ গুডুম্ আওয়াজ হইল। তারার কানের কাছ দিয়া গুলি সাঁই সাঁই করিয়া চলিয়া গেল। তারা বুঝিল, দস্যুরা পিছু লইয়াছে এবং তাহারা কেবল অশ্বটিকে লক্ষ্য করিয়া পিস্তল ছুড়িতেছে। পাছে সেই লক্ষ্যে নিজে আহত হয়, এই ভয়ে তারা ঘোড়ার পিঠের উপরে শুইয়া পড়িয়া, তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল এবং কুমারকে অত্যন্ত উত্তেজিত করিতে লাগিল। এইভাবে আর দশ পনের মিনিটকাল কাটাইতে পারিলেই তারা নির্বিঘ্নে দস্যুবৃন্দের কবল হইতে মুক্ত হইয়া সাহসিকতার উপযুক্ত ফললাভ করিতে পারিত; কিন্তু বিধাতা বিরোধী! পরিত্রাণ কোথায়?

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – দস্যুহস্তে

পর্ব্বতের পথ সকল তাহার বিশেষ পরিচিত থাকিলেও বিপদে পড়িয়া সে দিগ্বিদিক্‌-জ্ঞান-শূন্য হইল। সমস্তই যেন তাহার নূতন ও অজ্ঞাত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। কিছুদূর গিয়াই সে এমন স্থানে উপস্থিত হইল, যেখান হইতে দুই-তিনটী পথ ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলিয়া গিয়াছে। অপর সময়ে বোধ হয়, তারা লালপাহাড়ে যাইবার সোজা পথ সহজেই নির্ণয় করিতে পারিত, কিন্তু সুকুমার-মতি তারা ভীষণ দস্যুদলের হস্ত হইতে উদ্ধার-লাভের আশায় প্রাণপণ যত্নে অশ্ব ছুটাইতেছিল, আতঙ্কে তখনও তাহার দেহ কাঁপিতেছিল, উদ্বেগ তখনও মনে, বিলীন হইয়া যায় নাই, বুদ্ধি-বৃত্তি-পরিচালনার সম্যক্ শক্তি তখনও তাহার চিত্তে ফিরিয়া আসে নাই। কাজেই সেইখানে দাঁড়াইয়া কোন্ পথটী ঠিক, তাহা বিচার করিবার অবসর পায় নাই। পশ্চাতে উন্মত্তের ন্যায় দস্যুগণ অনুসরণ করিতেছে জানিয়া, অবলা মুহূৰ্ত্তও অপব্যয়িত করা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বিবেচনা করিল না। সে ইচ্ছানুরূপ অশ্ববল্লা বামদিকে আকর্ষণ করিল। অশ্বও পূর্ব্ববৎ অত্যন্ত দ্রুতবেগে বামদিকের রাস্তা ধরিয়া ছুটিতে লাগিল। পথ-নির্বাচনে এই ভ্রান্তিই তারার কাল হইল। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়াই সে বুঝিতে পারিল, সে ভ্রমক্রমে বিপথে আসিয়া পড়িয়াছে, আর যাইবার পথ নাই। সম্মুখে এক প্রকাণ্ড অলঙ্ঘনীয় খড়। অশ্বের সাধ্য কি, সে লম্ফপ্রদানে তাহা অতিক্রম করে। আর দুই চারিপদ অগ্রসর হ’লেই একেবারে সহস্র সহস্র হস্ত নিম্নে পতিত হইয়া অশ্ব ও আরোহিণী উভয়েই চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইত। পশ্চাতে পদধ্বনি শুনিয়া তারা অনুমান করিল, দস্যুগণ শিকার পলাইতেছে ভাবিয়া, মৃগান্বেষী ব্যাঘ্রের ন্যায় পশ্চাদ্ধাবন করিতেছে। সম্মুখে আবার ভয়ানক খড়। তারা বিষম সমস্যায় পড়িল—কি করিবে, কিছুই স্থির করিতে পারিল না। অবশেষে যে পথ দিয়া আসিয়াছিল সে পথে প্রত্যাবর্তন করিবে, স্থির করিল। ঘোর অমানিশার অন্ধকারে আলোক রশ্মির মত এই একমাত্র আশালোক তাহার মনোমধ্যে তখন উদিত হইল। তারা ভাবিল, দস্যুদের পৌঁছিবার পূর্ব্বেই সে আপনার ভ্রম সংশোধন করিয়া লালপাহাড়ে যাইবার সোজা পথে উপস্থিত হইতে পারিবে। নির্ভীকা রাজপুত-দুহিতা আশান্বিত চিত্তে পুনঃপ্রত্যাবর্তন করিল;কিন্তু আশা মরীচিকা! দশ হাত আসিতে-না আসিতেই সে দেখিল, সেই সকল পিশাচ-অবতারগণ তাহার পথ রোধ করিয়া দণ্ডায়মান।

রঘুনাথ চীৎকার করিয়া বলিল, “তারা! এখনও বলছি, ঘোড়া থামাও।” রঘুনাথের স্বর চিনিতে পারিয়া মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তারা অশ্ববেগ সংযত করিল। পলায়নের সকল আশা নির্মূল হইল। রঘুনাথকে দেখিয়াই তারার হৃদয়ে অধিকতর আতঙ্ক হইল, ভয়ে সৰ্ব্বাঙ্গ অবশ হইয়া পড়িল, হৃদয়ের স্পন্দনের ক্ষমতাও যেন কে অপহরণ করিল। ক্ষণকালের মধ্যেই সশস্ত্র দস্যুবৃন্দ তারার চারিদিক্ বেষ্টন করিয়া ফেলিল। শিকার পুনঃ কবলিত হইতেছে দেখিয়া, তেল-কালী-মাখাবৎ কুৎসিত মুখে তাহাদের অপূৰ্ব্ব আনন্দাবির্ভাব হইতে লাগিল। একবার স্ত্রীবুদ্ধির কাছে পরাজিত হইয়াছে বলিয়া এবার দস্যুগণ পূৰ্ব্ব হইতে সাবধান হইয়া রহিল। তারাকে ভয় দেখাইবার জন্য তাহারা তাহার বক্ষঃস্থল লক্ষ্য করিয়া নিজ নিজ পিস্তল উঠাইয়া ধরিল। অসহায়া অবলাকে এইরূপ ভয় দেখাইতে ও আক্রমণ করিতে দুরাশয়গণ কিছুমাত্র কুণ্ঠিত বা লজ্জিত হইল না।

রঘুনাথ পৈশাচিক হাসি হাসিয়া কর্কশস্বরে কহিল, “আরে ময়না পাখি! বেশ উড়েছিলে— আর যাতে না উড়তে পার, তার বন্দোবস্ত করছি। তারাসুন্দরী! এখন দয়া ক’রে একেবারে ঘোড়টা থেকে নেমে পড় দেখি!” রঘুনাথের সেই বিকট হাসি ও কটু-সম্ভাষণে তারা শিহরিয়া উঠিল। এদিকে নেতার আদেশক্রমে দুইজন ডাকাত, বিশেষ সতর্কতার সহিত তারার ঘোড়ার মুখ ধরিয়া রহিল। অসহায়া তারা তখন আর সুবিধা মত অশ্বচালনা করিয়া পলায়নের চেষ্টা বৃথা বিবেচনা করিল। দস্যুগণ স্থিরনেত্রে তাহার প্রত্যেক অঙ্গ সঞ্চালন লক্ষ্য করিতেছে। তাহার জীবন এখন এই নরঘাতী মহাপাতকীদের অধীন; কিন্তু প্রাণনাশের ভয় তারার হৃদয়ে স্থান পায় নাই। তাহার কেবল এইমাত্র চিন্তা, পাছে রঘুনাথ এই অবসর বুঝিয়া তাহার পাপপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার চেষ্টা করে। পাছে তাহার সযত্নরক্ষিত কৌমার্য্য-রত্ন এইবার এই পাপাচারী দুবৃত্তের হস্তে অপহৃত হয়। তারার মনে এই ভীতি সঞ্চারিত হইতে-না-হইতেই তাহার হস্ত পিস্তলের উপর পড়িল। তারা মনে করিলেই তৎক্ষণাৎ রঘুর মানবলীলা শেষ করিতে পারিত। বোধ-হয়, তাহা হইলে নেতৃত্ববিহীন হইয়া রঘুর নিদয় সহচরগণ তারাকে ধরিয়া রাখিতে বা তাহার প্রতি কোন অত্যাচার করিতে সাহস করিত না।

হউক না কেন তারাবাই বীর রাজপুত্রবংশীয়া, কিন্তু তাহার হৃদয় রমণীর কোমল উপাদানে গঠিত। তাহাই সহসা নরহত্যার কথা মনে উদিত হইতেই তাহার যেন একপ্রকার মোহ উপস্থিত হইল। রক্তস্রোতের কথা হৃদয়ে জাগিয়া উঠিতেই তারা আপনা আপনিই শিহরিয়া উঠিল। সে কি নরঘাতিনী হইতে পারে? কুসুমে কীট প্রবেশ করিবে? সূর্য্যে কলঙ্ক স্পর্শ করিবে? তারা এ কথা ভাবিতে পারিল না। রমণীহৃদয় বিগলিত হইল। যে মনুষ্য তাহার সম্মুখে সাক্ষাৎ পিশাচের ন্যায় বর্ত্তমান থাকিয়া নৃত্য করিতেছে, যাহার মনে ক্ষণকালের জন্যও মৃত্যুচিন্তা স্থান পাইতেছে না, কেমন করিয়া তারা তাহাকে হঠাৎ নরকের জ্বলন্ত ছবি দেখাইয়া দিবে? কেমন করিয়া পাপীকে প্রস্তুত হইবার সময় না দিয়া, তারা তাহাকে সেই সর্ব্বনিয়ন্তা, পাপপুণ্যের দণ্ড পুরস্কার-বিধাতা সৰ্ব্বময়ের বিচারাসনের সন্নিকটে বিচারার্থ উপস্থিত করিবে? কামিনীর কোমল অন্তঃকরণে এ-চিন্তা স্থান পাইল না। যদিও রঘুনাথ তাহার সর্বনাশের জন্য উৎসুক হইয়া রহিয়াছে, যদিও রঘুনাথের পাপজীবন তখন তাহারই হস্তে, তথাপি সহৃদয় রাজপুত কুমারী নরঘাতিনী হইতে সহসা সাহস করিল না। সে ভাবিল, তাহার প্রতি দেবতা রুষ্ট হইবেন। জীবহত্যা রমণীর কার্য্য নয়, তাহাই তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া কাষ্ঠ-পুত্তলিকাবৎ তুরঙ্গোপরি বসিয়া রহিল।

রঘুনাথ বলিল, “এস তারা! আমি তোমার হাত ধরে ঘোড়া থেকে নামিয়ে দিচ্ছি।” এই কথা বলিয়া রঘুনাথ তাহার হস্ত ধারণ করিবার জন্য হস্ত প্রসারণ করিল।

ঈষৎচকিত হইয়া তারা নির্ভয়ে উত্তর করিল, “রঘু! কেন তুমি আমার উপর এত অত্যাচার করছ? আমাকে এমন করে ধরে রেখে তোমার কি লাভ হবে? ছেলেবেলার কথা একবার মনে ক’রে আজকের মত আমার উপরে দয়া কর, আজকের মত আমায় ছেড়ে দাও, আমি বড় বিপদে প’ড়ে এক জায়গায় যাচ্ছি।”

রঘু। তারা, কেন নির্ব্বোধের ন্যায় তর্ক করছ? আমি কথায় ভুলি না। এখনও বল্‌ছি, কথা শোন বুদ্ধিমতীর মত কাজ কর। আমার কথা শুনলে তোমার কোন অনিষ্ট হবে না—কেউ তোমার একগাছা কেশ পর্য্যন্ত স্পর্শ করতে পারবে না।

তারা অনন্যোপায় হইয়া বলিল, “রঘু সিংহ! কেন তুমি আমায় এমন ক’রে পথের মাঝখানে বাধা দিচ্ছ? তুমি যদি আমার ঘোড়াটা নিয়ে সন্তুষ্ট হও, তা’ হ’লে আমার সঙ্গে চল। আমার পিতা মুমূর্ষু, দেরী হ’লে বোধ হয়, আর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে না।”

এই কথা শুনিয়া রঘুনাথের আরও আনন্দ হইল। সে স্বচ্ছন্দে বলিল, “বল কি? তোমার বাবা মর-মর-“

বাধা দিয়া তারা বলিল, “হাঁ, তিনি মৃত্যুমুখে। মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনি তাঁর একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, তাই আমি তাড়াতাড়ি তাঁকে ডাকতে যাচ্ছি। পথের মাঝখানে তুমি আর তোমার অনুচরেরা আমায় বাধা দিলে। যদি আমার ঘোড়াটা নেওয়া তোমার অভিপ্রায় হয়, তা’ হ’লে ঘোড়াটা নিয়ে আমায় ছেড়ে দাও। বাবার সঙ্গে একবার আমার শেষ দেখা করতে দাও।”

রঘু। তারা, তুমি কি মনে করেছ, কেবল আমি তোমার ঘোড়াটা নিয়েই সন্তুষ্ট হ’ব? আমি কি কেবল তোমার ঘোড়াটা চাই? আমি তোমায়ও চাই।

তারা। আচ্ছা, তবে আজ আমায় ফিরে যেতে দাও, এর পরে তোমার মনে যা’ আছে, করো। রঘুনাথ সহাস্যে বলিল, “আজ তোমায় ছেড়ে দিলে আর কি তোমায় পাব? এখন বাজে কথা ছেড়ে ঘোড়া থেকে আস্তে আস্তে ভাল মানুষের মত নেমে পড় দেখি। আর কি তোমায় আমি বিশ্বাস করি?”

তারার সকল আশা-ভরসা উন্মূলিত হইল। তারা বুঝিল, রঘুনাথ আর সহজে ভুলিবার পাত্র নয়। ভয় দেখাইয়া রঘুনাথকে বশ করিতে চেষ্টা করা বাতুলতামাত্র। তাহারা ভদ্রতার সম্মান রাখে না, শিষ্টাচারের ধার ধারে না, রাজনিয়মেরও বশবর্ত্তী নয়। আরাবল্লী পর্ব্বত তাহাদের রাজধানী। তাহারাই তথাকার রাজা। পুলিসের শাসন তথায় লব্ধপ্রবিষ্ট হয় না। অনেকদিন ধরিয়া কোম্পানী বাহাদুর এই সকল দস্যুদমনার্থ চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু সমর্থ হ’ন নাই। তাহারা কোথায় থাকে, কি করে, কেমন করিয়া জীবন ধারণ ক’রে, তাহা কেহই বলিতে পারে না। লোকমুখে কেবল শোনা যায় যে, ঐ সকল পৰ্ব্বতে ভয়ানক দস্যুগণ বাস করে; সেইজন্য সাধ্যসত্তে সে পথে কেহ পদার্পণ করে না; অথচ পর্ব্বতের দুইদিকে বড় বড় সহর। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অনেক মহাজনকেও দায়ে ঠেকিয়া সে পার্বত্যপথে আগমন করিতে হয়। অন্য পথে যাইতে হইলে যে পরিশ্রম ও অর্থব্যয় হয়, তাহাতে লাভ পোষায় না। কাজেকাজেই সওদাগরগণ অতি সাবধানে দু’দশজন শরীর-রক্ষক ও পুলিসের লোক সমভিব্যাহারে দিনের বেলায় পাৰ্ব্বত্য পথ দিয়া গমনাগমন করিত। অনেক সময়ে এরূপ শ্রুত হওয়া গিয়াছে, সে রকম দলকে ঐ দানব-স্বভাবেরা হত্যা করিয়া খড়ের মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে; কিন্তু কে হত্যা করিল, সে-দস্যুগণ কোথায় থাকে বা কোথা হইতে আসিয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করিল, শত চেষ্টাতেও কেহ তাহা নিরাকরণ করিতে পারে নাই। এই কার্য্যের জন্য কতবার কত সুদক্ষ পুলিস-কৰ্ম্মচারী নিয়োজিত হইয়াছে;কিন্তু সকলকেই অকৃতকাৰ্য্য হইতে হইয়াছে। এমন কি, অনেকে আর জীবিত ফিরিয়া আসেন নাই।

রঘুনাথ তারাকে ঘোটক হইতে নামাইবার জন্য হাত বাড়াইল। অশ্বটী সম্মুখের পা তুলিয়া ক্ষেপিয়া উঠিল। অমনি চারি-পাঁচজনে মিলিয়া ‘কুমারকে’ সুস্থির করিবার জন্য বল্গা ধারণ করিল। তারপর রঘুনাথ তারাকে ঘোড়া হইতে নামাইয়া লইল। তারার অশ্বটী লইয়া অন্যান্য দস্যুগণ চলিয়া গেল। ইতিমধ্যে যে চারি-পাঁচজন লোক কুমারকে শান্ত করিতে নিযুক্ত হইয়াছিল, তাহাদের একজন তারাকে ঘোড়ার উপর হইতে নামাইবার পূর্ব্বে কোন অজুহাতে তারার কাছে গিয়া চুপি চুপি বলিয়াছিল, “ভয় নাই—আমি তোমাকে রক্ষা করর্—তুমি নির্ভয়ে থাক।”

মুহূর্তের মধ্যে এই কথা বলিয়া সেই লোকটা একটু সরিয়া দাঁড়াইল। উহা তাদৃশ বিশ্বাস্য কথা নয় বটে; তথাপি এই কথা শুনিয়া তারার হৃদয়ে যেন কি অপূর্ব্ব আশা সমুদিত হইল। দস্যুদলের মধ্যে “ভয় নাই—আমি নিশ্চয়ই রক্ষা করব—তুমি নির্ভয়ে থাক!” এ কথা যে বলে, সে নিশ্চয়ই সামান্য লোক নয়, ইহাই তাহার ধ্রুব জ্ঞান হইল। উত্তমরূপে লক্ষ্য করিয়া তারা দেখিল, যে লোকটী কানের কাছে চুপি চুপি তাহাকে উক্ত কথাগুলি বলিয়া ভরসা দিয়াছিল, তাহার পরিচ্ছদ অবিকল অন্যান্য দস্যুগণের ন্যায়। এমন কি সে কথাও কহিতেছে, সেইরূপ কর্কশ স্বরে;কিন্তু চুপি চুপি তারার কাছে আসিয়া যখন সে বলিয়াছিল, “ভয় নাই, আমি তোমায় রক্ষা করব—তুমি নির্ভয়ে থাক,” সে স্বর যেন দস্যুর মত নয়—সে-স্বরে যেন কি একটা মাধুর্য্য ছিল। তারা বুঝিল, সে-স্বর যাহার কণ্ঠনিঃসৃত, অবশ্যই সে কোন সহৃদয় পরোপকারী ব্যক্তি। তাই সেই-স্বরে তারার হৃদয়ে কথঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হইয়াছিল। তারার মনে হইয়াছিল, সে-ব্যক্তি কখনই দস্যুদলের সহকারী নয়, ছদ্মবেশে কোন মহাপুরুষ স্বকার্য্যসাধনোদ্দেশে দস্যুদলস্থ হইয়া রহিয়াছেন, তারা ভাবিল, সে ব্যক্তি যে স্বরে তাহাকে আশ্বাস প্রদান করিয়াছেন, চুপি চুপি কথা কহিলেও সেই স্বরই তাঁহার স্বাভাবিক স্বর— অপর স্বর দস্যুগণের সন্দেহ দূর করিবার জন্য বোধ হয়, তিনি অনুকরণ করিয়াছেন মাত্র। তখন তারা স্থির করিল, এ বিপদে তাহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত একজন সাহসী বীরপুরুষ ছদ্মবেশে দস্যুগণের মধ্যে আছেন; এবং কার্য্যকালে তিনি তাহাকে সকল বিপদ হইতে রক্ষা করিবেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – এই কি সেই

এদিকে তারার কাতরোক্তি শুনিয়া রঘুনাথ কিঞ্চিৎ নম্রভাবে বলিল, “যদি তোমার বাবার এমন মৃতপ্রায় অবস্থা, তবে আর তুমি সেখানে গিয়া কি করবে।”

ব্যথিত হইয়া তারা উত্তর দিল, “ওঃ—রঘুনাথ! তোমার হৃদয় কি কঠিন, তুমি কি মানুষ, না পিশাচ? তোমায় মিনতি ক’রে বলছি, আমায় আজকের মত ছেড়ে দাও! যদি বিশ্বাস না হয়, তুমিও আমার সঙ্গে চল। বাবার মৃত্যু হ’লে তুমি যদি দস্যুদল ছেড়ে দিবে এ কথা স্বীকার কর, তা’ হ’লে আমি প্রতিজ্ঞা ক’রে বলছি, তখন তুমি আমায় যা করতে বলবে, আমি তাই করতে রাজী আছি।”

রঘুনাথ। তারা! আর তোমায় আমার বিশ্বাস হয় না। শৈশবকাল থেকে তোমায় আমি দেখছি, তোমায় কি আমি জানি না? এতদিন যদি তোমার বাবা আমার সঙ্গে তেমার বিবাহ দিতেন, তা’ হলে হয় ত আমি কখনও ডাকাতের দলে মিশতেম না। হয় ত আমরা উভয়ে বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে গৃহস্থের মত হয়ে থাকতেম। তোমায় না পেয়েই ত আমার এ-দুৰ্দ্দশা! তোমায় যদি পত্নীরূপে পেতেম, তবে হয় ত এসব কাজে আমার প্রবৃত্তিও হত না। তুমি আমার সর্বনাশ করেছ, তা’ কি জান না, তারা? পূর্ব্বে আমার ভাল অবস্থাতেও তুমি আমায় ঘৃণা করেছ। আর এখন সেই তুমি আমার উপস্থিত এই ঘৃণ্য অবস্থায় আমায় পূজা করবে, এইটি দেখার আমার সাধ আছে।

কাতর তারা করুণোক্তিসহকারে বলিল, “আমায় আজকের মত বিশ্বাস ক’রে ছেড়ে দাও—”

সমস্ত কথা বলিতে-না বলিতেই রঘুনাথ বিরক্তভাবে উত্তর করিল, “তুমি স্ত্রীলোক! স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস কি?”

তারা এতক্ষণে আপনার ভয়ানক অবস্থা প্রকৃতপক্ষে অনুভব করিতে পারিল। তাহার ধৈর্য্য, সাহস সমস্তই এককালে তিরোহিত হইল। অনেক কাকুতি-মিনতি করিল। সে পাষাণ হৃদয় কিছুতেই বিগলিত হইল না। রঘুনাথ অবশেষে বলিল, “অসম্ভব তারা, একান্ত অসম্ভব। তোমায় আমি আর কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারি না। আমার এখন অন্য অনেক কাজ আছে। তোমার সঙ্গে বেশি কথা কহিবারও সময় নাই। এখন আমি যা বলি, তা’ শোন। তারপর তোমার বিষয় যা’ ভাল বিবেচনা হয় করব।”

নিরুপায় হইয়া তারা রঘুনাথের সঙ্গে সঙ্গে চলিল। যেখানে আগুন জ্বালিয়া অন্যান্য দস্যুরা তাহার চতুস্পার্শে বসিয়া হাসি ঠাট্টা ও অন্যান্য গল্প-গুজব করিতেছিল, সেইখানে রঘুনাথ তারাকে লইয়া গেল। যে-লোকটী “ভয় নাই—আমি তোমাকে রক্ষা করব—তুমি নির্ভয়ে থাক,” এই কথা বলিয়া তারাকে আশ্বাস প্রদান করিয়াছিল, চঞ্চলচক্ষে তারা তাহারই অনুসন্ধান করিতে লাগিল। তাহাকে চিনিয়া লইতে তারার বড় অধিক সময় লাগিল না। তাহার মাথায় যে লাল কাপড়ের পাগড়ী ছিল, অন্যান্য দস্যু সেরূপ কাপড়ের পাগড়ী পরে নাই। তাহার বেশ সমস্তই দস্যুগণের ন্যায়, মুখে লম্বা গোঁফ, চোখে অপূৰ্ব্ব জ্যোতিঃ। সে জ্যোতিঃ সাহসিকতার পরিচায়ক— সে জ্যোতিঃ বিচক্ষণতার লক্ষণ। তারা ভাবিল, “ইনি নিশ্চয়ই ছদ্মবেশী। আমার অনুমান নিশ্চয়ই সত্য।”

ঠিক সেই সময়ে দূরে কে যেন সজোরে শিস্ দিল। রঘুনাথ চকিত হইয়া সেইদিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ও কে আসে?”

দস্যুরা সকলেই সেইদিকে চাহিল। একজন বলিল, “এ রাত্রে আজ কই কারও ত আস্বার কথা নাই। “

রঘুনাথ বলিল, “একজন লুকিয়ে দেখে এস, গতিক বড় ভাল বোধ হচ্ছে না।”

তৎক্ষণাৎ একটি লোক অন্ধকারে গুঁড়ি মারিয়া যেদিক হইতে শিসের শব্দ আসিয়াছিল, সেইদিকে গেল। দস্যুগণ সকলেই পিস্তল বাহির করিয়া সেইদিক্ লক্ষ্য করিয়া রহিল। যে লোকটি দেখিতে গিয়াছিল, কিয়ৎক্ষণ পরেই সে আবার একজন লোককে সঙ্গে করিয়া ফিরিয়া আসিল। দস্যুগণ সকলেই তাহাকে দেখিয়া পিস্তল নামাইল।

রঘুনাথ বলিল, “আরে কেও, তুমি? কোথা গেছলে?”

আগন্তুক আগুনের কাছে আসিয়া বলিল, “সে কথা পরে হবে, এখন একটা বড় সংবাদ আছে, শুনবে?”

রঘুনাথ। কি? পথে কাউকে দেখলে না কি? তুমি ত অন্ধকারে গাছের পাতাটি নড়লে, কুটোটি নড়লে ভয় পাও। বল বল, কাউকে এদিকে আসতে দেখেছ, বুঝি?

আগন্তুক। না, তোমরা কাউকে দেখেছ?

রঘুনাথ। না।

আগন্তুক। আজ মস্ত খবর নিয়ে এসেছি। অনেক কষ্টে সে-সন্ধান পেয়েছি।

রঘু। বুঁদী গ্রামের লোকেরা আমাদের ধরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করেছে—এই কথা ত?

আগন্তুক। না, তার চেয়েও শক্ত খবর।

রঘু। ভাল খবর?

আগন্তুক। ভাল বলতে পার—মন্দও বলতে পার। কিন্তু আর গতিক বড় ভাল নয়।

রঘু। কি বলেই ফেল না, অত ভুমিকা করছ কেন?

আগন্তুক। এবার গোয়েন্দা রায়মল্ল সাহেব নাকি আমাদের পিছু নিয়েছে! কোম্পানী বাহাদুর রায়মল্ল সাহেবকে নিযুক্ত করে একবার শেষ চেষ্টা দেখছেন। শুনেছি, সে লোকটা ভারি ফন্দিবাজ।

আগন্তুকের কথা শুনিবার জন্য এতক্ষণ দস্যুগণ সকলেই বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিল, কিন্তু যেমন তাহারা প্রসিদ্ধ গোয়েন্দা রায়মল্ল সাহেবের নাম শুনিল, অমনিই তাহাদের মুখ শুকাইয়া গেল। ভয়ে যেন তাহাদের প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিল—সকলেরই যেন হৃৎকম্প হইতে লাগিল।

ঘটনাক্রমে এই সময়ে তারা সেই আশ্বাসদাতা লালপাগড়ী পরা ব্যক্তির দিকে চাহিয়াছিল। তারা দেখিল, সে লোকটির মুখের ভাব সহসা বদলাইয়া গেল। রঘুনাথ সকলকে এইরূপ ভীত হইতে দেখিয়া আপনার কটিদেশ হইতে একখানি বড় ছোরা বাহির করিয়া সজোরে ধরাতলে বিদ্ধ করিল। মহাদম্ভে আস্ফালন করিয়া রঘুনাথ বলিল, “দেখ, যদি রায়মল্ল সাহেব আমাদের পিছু নিয়ে থাকে, তা’ হলে এই রকম করে তার বুকে ছুরি মারব। দু-শ চার-শ পুলিস-পাহারা মেরে খড়ের ভিতর ফেলে দিলাম, কত গোয়েন্দা আমাদের পিছু নিয়ে ধরার ভার লাঘব করলে; যদি রায়মল্ল সাহেবের মরণ ঘনিয়ে এসে থাকে, তাহলে তারও সেই দশা হবে।”

তারা তখনও সেই লোকটির উপর দৃষ্টি রাখিয়াছিল। দেখিল, তাহার চক্ষুদ্বয়ে যেন আরও জ্যোতি ফুটিয়া উঠিল, বদনে যেন কি এক অপূর্ব্ব ভাবের সমাবেশ হইল।

তারার মনে তখন আর এক ভাবের উদয় হইল। সে ভাবিল, “তবে এই কি সেই প্ৰসিদ্ধ গোয়েন্দা রায়মল্ল সাহেব! যে লোককে খুন করে ফেলবে ব’লে রঘুনাথ এত দম্ভ আস্ফালন করছে, এই কি সেই!”

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – এ কি দৈববাণী

তারা কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইল। কে যেন তারার কানে কানে বলিয়া দিল, “তারা, তোমার কোন ভয় নাই।” “ভয় নাই, আমার উদ্ধার হবে, আমি নির্ভয়ে থাকি,” এই কথা কয়টী যেন তাহার হৃদয়যন্ত্রের প্রতি তারে ধ্বনিত হইতে লাগিল। এতক্ষণে তারা বুঝিল, সময় হইলেই রায়মল্ল সাহেবের চেষ্টায় তাহার মুক্তি হইবে। তৎসঙ্গে তিনি দস্যুদলেরও উচ্ছেদ সাধন করিবেন। কল্পনাময় দৃশ্য তারা অত্যাশ্চর্য্য বলিয়া বোধ করিতে লাগিল। যাহার অনুসন্ধানে মুমূর্ষু পিতাকে একা রাখিয়া হিতাহিত-বোধ-পরিশূন্য হইয়া সে পার্বত্য প্রদেশে যাইতেছিল; তাহাকে এরূপভাবে দস্যুবৃন্দের ভিতরে হঠাৎ দেখিতে পাইবে, তারা এরূপ অভাবনীয় অচিন্তনীয় কল্পনা কখনই করে নাই। যদি ঘটনাচক্রের আবর্তনে রঘুনাথ কর্তৃক তারা আক্রান্ত না হইত, তাহা হইলে রায়মল্ল সাহেবকে সে হয় ত কখনই খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিত না। হিতে বিপরীত হইত। যাহা মন্দ ভাবিয়াছিল, তাহা হইতে ভাল হইবে, এরূপ আশা তারার মনে একবারও স্থান পায় নাই। চক্রীর চক্রে, অভাগিনীর অদৃষ্টে এরূপ অভাবনীয় ঘটনা ঘটিবে, তাহা কি তারার অনুভবে আসিতে পারে?

তারা যখন এইরূপ আত্মচিন্তায় ব্যাকুল, দস্যুগণ তখন আপনাদের বিপদের কথা লইয়াই ব্যস্ত। যাঁহার নাম শুনিলে সে-সময় দুরাত্মামাত্রেরই আপাদমস্তক ভয়ে কম্পিত হইত, যাঁহার নামে রাজপুতনার অধিকাংশ দস্যুই দেশ ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছিল, রঘু ডাকাতের দলও যে তাহার নাম শুনিয়া বিত্ৰস্ত হইবে, তাহা অসম্ভব কি? তারা স্থির হইয়া একমনে দস্যুদলের পরামর্শ শুনিতে লাগিল।

আগন্তুক কহিতে লাগিল, “তা তোমরা যতই আস্ফালন কর না কেন, আমার বিশ্বাস, রায়মল্ল সাহেব যখন আমাদের পিছু নিয়েছে, তখন যা’ হয়, একটা হেস্ত নেস্ত না করে আর ছাড়ছে না। যতক্ষণ সে বেঁচে আছে, ততক্ষণ আমরা নিরাপদ্ নহি।”

রঘুনাথ বলিল, “এ সময়ে আমার সমস্ত লোক ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। যদি আমরা সবাই একত্র থাকতেম, তা’হলে আমার তত ভাবনা হত না। তবু বার-তেরজন এখানে এখন আমরা আছি। রায়মল্ল সাহেব একা এসে বড় কিছু করতে পারছে না।”

একজন দস্যু মাঝখান হইতে বলিয়া উঠিল, “কিছু বলা যায় না। তার যে কত বুদ্ধি, তা’ কেউ ঠিক বলতে পারে না। ভূতের মত সে আশে-পাশে থাকে তাকে কেউ দেখতে পায় না—সে কিন্তু সব জানে। তার নাম মনে হ’লে আমার বুক গুর্ গুর্ করে।”

রঘু। কেন, সে তোমায় একবার জেলে পাঠিয়েছিল ব’লে? আমি দেখছি, তার কথা পড়লেই তোমার পিলে চমকে উঠে। তোমার মত ভীতু লোক আর দুটো-চারটে আমার দলে থাকলেই ত আমায় আরাবল্লী পর্ব্বত ছেড়ে বনের মধ্যে পালিয়ে যেতে হবে দেখছি।

আগন্তুক। কি সর্দ্দার, তোমার মুখে আর ও কথা শোভা পায় না। তুমি গাছের গুঁড়িতে ছোরা বিধৃতে পার, বাতাসের সঙ্গে লড়াই করতে পার, আপনার দলের ভিতরে বসে আস্ফালন করতে পার; কিন্তু রায়মল্ল সাহেব তোমার যম, সে কথা যেন মনে থাকে। মনে পড়ে, একবার তুমি তার হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছ?

রঘু। সেবার আমি একা পড়েছিলেম, আর দৈবাৎ আমার কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, তাই আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। এখন সদাই আমার কাছে পিস্তল, ছোরা থাকে। এখন যদি একবার দেখা হয়, ত বুঝতে পারি, সে কেমন গোয়েন্দা—

সহসা কোথা হইতে কে বলিল, “শীগগির দেখা হবে, প্রস্তুত হ’য়ে থাক।”

রঘুনাথ চীৎকার করিয়া উঠিল, “কে কথা কইলে? কে এ কথা বলে?”

কেহই উত্তর দিল না। প্রজ্বলিত অগ্নির তেজ তখন অনেকটা নিবিয়া আসিয়াছিল। সকলের মুখ তখন স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল না। ক্রোধভরে রঘুনাথ চারিদিকে চাহিল—কেহ কোন উত্তর দিল না। আবার অতি কঠোরস্বরে ক্রোধোন্মাদে রঘুনাথ বলিল, “তবে হয় আমাদের দলের মধ্যে কেউ নেমকহারাম আছে, নয় রায়মল্ল সাহেবের চর কেউ এখানে ঘুরছে।”

আগন্তুক কহিল, “যাক্, ও কথা ছেড়ে দাও। কেহ হয় ত ঠাট্টা করে তোমায় রাগাবার জন্য এ কথা বলেছে। এখন তুমি রেগেছ, আর কি কেউ স্বীকার করবে? এখন বল দেখি, উপায় কি! রাগারাগী করে ত কোন ফল হবে না। ভাল রকম বিবেচনা করে এখন হ’তে সাবধান হ’য়ে চলা দরকার নয়? যতক্ষণ না রায়মল্ল সাহেবকে খুন করতে পারছ, ততক্ষণ আমাদের আর নিস্তার নাই।”

তারা যাহার দিকে চাহিয়াছিল, তাহাকে ছাড়িয়া অন্যদিকে কাহারও পানে অধিকক্ষণ চাহিয়া থাকে নাই। তাহার মনে স্থির বিশ্বাস হইয়াছিল, সেই ব্যক্তিই রায়মল্ল সাহেব। তারার বিশ্বাস, “শীঘ্র দেখা হবে—তুমি প্রস্তুত হ’য়ে থাক,” এ কথা সেই রায়মল্ল সাহেব ভিন্ন আর কেহ বলে নাই। ঠিক সেই সময়ে তাহার দিকে দৃষ্টি ছিল না বটে, কিন্তু এ-কথা যে অন্যে বলে নাই, তাহা তারার দৃঢ় ধারণা।

তারা ভাবিতে লাগিল, কেমন করিয়া সে রায়মল্ল সাহেবের সঙ্গে কথা কহিবে, কেমন করিয়া তাঁহাকে জানাইবে, তারার মুমুর্ষু পিতার মৃত্যুশযার পার্শ্বদেশে রায়মল্ল সাহেবের উপস্থিতি একান্ত প্রার্থনীয়। নিজের বিপদের জন্য তারা বিন্দুমাত্র ভীত নহে; কিন্তু রায়মল্ল সাহেবকে কিরূপে বুঁদীতে আপন পিতার নিকট একবার যাইতে বলিবে, এই চিন্তাই তাহার হৃদয়ে অতি প্রবল ভাব ধারণ করিল। প্রত্যুৎপন্নমতি তারার মনে অতি অল্পক্ষণের মধ্যে একটি উপায় স্থিরীকৃত হইল। সে একেবারে রঘুনাথের সম্মুখে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “রঘুনাথ! তোমরা রায়মল্ল গোয়েন্দার কথা বল্‌ছ?”

বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে রঘুনাথ তাহার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁ, তুমি তার কি জান? তারা উত্তর দিল, “আমি ত তাঁকেই খুঁজতে যাচ্ছিলেম, পথে তোমরা বাধা দিলে।”

তারা এই কথা বলিয়াই সেই আশ্বাসদাতার দিকে অপাঙ্গ নিক্ষেপ করিল। সেই ব্যক্তি প্রকৃত রায়মল্ল সাহেব কি না, এইবার চাহিয়াই তারা তাহা বুঝিতে পারিল। তারা রায়মল্লের নাম উচ্চারণ করিবামাত্র সেই ব্যক্তি আশ্চর্যান্বিত হইয়া তারার মুখের দিকে চাহিয়াছিলেন—তাঁহার চক্ষুদ্বয় হইতে এক অপূৰ্ব্ব দীপ্তি প্রকাশিত হইতেছিল।

তারা ভুল বুঝে নাই—তিনিই ছদ্মবেশে স্বয়ং গোয়েন্দা—সর্দ্দার রায়মল্ল সাহেব।

ভোজসিংহ নামে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি রায়মল্ল সাহেবের কাছে যাচ্ছিলে?”

তারা। হাঁ।

দস্যুগণ সকলেই আশ্চর্য হইয়া তারার মুখপানে চাহিয়া রহিল।

নারায়ণরাম তারার দিকে ফিরিয়া বলিল, “দেখেছ ব্যাপার? জানি, এখানকার লোকে এখন আমাদিগকে ধরিয়ে দেবার জন্য রায়মল্ল গোয়েন্দার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। এই বালিকাকে দিয়ে নিশ্চয় কোন সংবাদ পাঠাচ্ছিল।”

রঘুনাথ বলিল, “সে কি, তারা! তুমি রায়মল্ল সাহেবের কাছে কেন যাচ্ছিলে?”

প্রত্যুৎপন্নমতি তারা তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, “আমি রায়মল্ল গোয়েন্দার কাছে একটা খবর নিয়ে যাচ্ছিলেম।”

ভোজসিংহ লাফাইয়া উঠিয়া একেবারে বালিকার সম্মুখে গিয়া বলিল, “কি? তুমি রায়মল্ল গোয়েন্দার কাছে সংবাদ নিয়ে যাচ্ছিলে? তবে সে কি সংবাদ বলতে হ’বে, নইলে মুখ চিরে কথা বার করে নেব।”

যেমন ভোজসিংহ ঐরূপভাবে ভীষণাকৃতিতে বালিকার নিকট উপস্থিত হইল, অমনই কোথা হইতে অলক্ষ্যভাবে ঠিক সময়ে রায়মল্ল সাহেবও তাহার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তারা বুঝিল, পাছে ভোজসিংহ তাহার প্রতি কোন অত্যাচার করে, এইজন্য তিনি ভোজসিংহের পশ্চাতে দণ্ডায়মান হইয়াছেন।

সাহসে নির্ভর করিয়া তারা বলিল, “আমায় ভয় দেখাচ্ছ কেন, আমি আপনিই ত বলছি। শোন—অনেক দিন পূর্ব্বে আমার পিতার সহিত রায়মল্ল সাহেবের পিতার বন্ধুত্ব ছিল। আমার পিতা একবার ঐ বন্ধুর (রায়মল্লের পিতার) জীবন রক্ষা করেছিলেন। বাবা যদিও রায়মল্ল সাহেবকে কখনও দেখেন নাই; কিন্তু তিনি বিবেচনা করেন, রায়মল্ল সাহেব কখনই তাঁহার অহিতৈষী হবেন না।”

ভোজসিংহ বলিল, “আরে রাখ তোর হিতৈষী আর অহিতৈষী! এখন কি খবর নিয়ে যাচ্ছিলি, তাই আগে বল্।”

তারা যেন কিছু ভীত হইয়া বলিল, “বাবা এখন মুমূর্ষু। মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনি রায়মল্ল গোয়েন্দাকে একটি আশ্চর্য গুপ্তকথা ব’লে যেতে চান্। বাবা কা’র কাছে শুনেছিলেন, রায়মল্ল গোয়েন্দা এখন লালপাহাড়ে আছেন। তাই তিনি আমাকে দিয়ে এই কথা ব’লে পাঠাচ্ছিলেন যে, বুঁদীগ্রামে বাবার সঙ্গে একবার রায়মল্ল সাহেবের দেখা হওয়া বিশেষ দরকার। আমি এই সংবাদ দিতেই রায়মল্ল সাহেবের অনুসন্ধানে লালপাহাড়ে যাচ্ছিলেম।”

তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্না তারা এইরূপ কৌশলে আপনার জ্ঞাতব্য বিষয় ছদ্মবেশী রায়মল্লকে জানাইয়া সংক্ষেপে আপনার বাসস্থানের ঠিকানাও বলিয়া নিশ্চিন্ত হইল। তারা যে কি খেলা খেলিল, দস্যুগণ কেহই তাহার কিছুই বুঝিতে পারিল না। অথচ অতি সহজে তাহার কার্য্যসিদ্ধি হইল।

ভোজসিংহ বলল, “বাঃ! বেশ চমৎকার মজার কথা বললে, যা হ’ক, এতে আমাদের আর কি উপকার হবে?”

রঘুনাথ বলিল, “চমৎকার! আমার এমন ইচ্ছে হচ্ছে যে, তারাকে আর একবার ছেড়ে দিই। ও রায়মল্ল গোয়েন্দার সঙ্গে দেখা করুক্।”

আর একজন দস্যু জিজ্ঞাসা করিল, “তাতে আর কি ফল হবে?”

রাক্ষসবৎ উৎকট হাসিয়া কঠোরস্বরে রঘুনাথ বলিল, “তাতে এই ফল হবে যে, রায়মল্ল একা রুদীগ্রামে তারার বাবার কাছে অসহায় অবস্থায় যাবে, আর আমরা সকলে মিলে তাকে আক্রমণ করব।”

ঠিক এই সময়ে আর একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটিল। কে কোথা হইতে বলিল, “আজ রাত্রেই রায়মল্ল তারার বাপের কাছে যাবে। কারও সাধ্য থাকে— সেখানে যেয়ো।”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – রক্ষাকৰ্ত্তা

সহসা বজ্রপতন হইয়া যদি সেই স্থলে একজনের মৃত্যু হইত তাহা হইলেও দস্যুগণ এত চমকিত হইত কি না সন্দেহ; কিন্তু সে কোথা হইতে কথা কহিতেছে, জানিতে না পারিয়া তাহারা আরও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল।

দস্যুগণ বড় বিচলিত হইল বটে, কিন্তু তারার মনে অপার আনন্দ। এত সহজ উপায়ে তাহার কাৰ্য্যসিদ্ধি হইল দেখিয়া, সে নিশ্চিন্ত হইল।

রঘুনাথ তখন এক-এক করিয়া প্রত্যেকের সম্মুখে উপস্থিত হইল, প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এ কথা বলেছ?” কেহই স্বীকার করিল না। অবশেষে রঘুনাথ প্রতাপের নিকটে উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “প্রতাপ, তবে তুমি আমাকে রাগাবার জন্য এ কথা বলেছ?”

পাঠক! জানিয়া রাখুন, রায়মল্ল সাহেব প্রতাপসিংহ নামে দস্যুগণের নিকটে পরিচিত ছিলেন।

প্রতাপবেশী রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “প্রমাণ কর।”

রঘুনাথ। প্রমাণ করবার আমার দরকার নাই! আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে, তুমিই বলেছ। তা’ দেখ, আমি তোমায় সোজা কথা বলছি, যদি ভাল চাও, এ রকম করে আর আমায় রাগিয়ো না। ফের যদি এ রকম কাজ কর, তা’ হ’লে তোমারই একদিন, কি আমারই একদিন।

প্রতাপ ওরফে রায়মল্ল কোন কথা কহিলেন না। তাঁহার যুক্তি ও কার্য্যের ফল অন্য লোকের বুদ্ধির অগম্য। অন্য লোকে হয় ত ভাবিত, এরূপ করিলে পাকে-প্রকারে ছদ্মবেশী ধরা পড়িবে; কিন্তু রায়মল্ল সাহেব এরূপ স্থলে ভাবিতেন, ইহাতে তাঁহার কার্য্যসিদ্ধি হইবে। অপরে যাহা ঠিক বলিয়া বিবেচনা করিত, তিনি তাহা তাহার বিপরীতভাবে দেখিতেন।

রায়মল্ল সাহেব আবার আগুনের কাছে গিয়া বসিলেন।

ভোজসিংহ জিজ্ঞাসা করিল, “এ প্রতাপ লোকটা কে? কোথা থেকে এল?”

রঘুনাথ বলিল, “ও জয়পুরে একটা ডাকাতের দলে ছিল।”

একজন দস্যু জিজ্ঞাসা করিল, “এখানে কেমন ক’রে জুল?”

আর একজন দস্যু উত্তর করিল, “রাজারাম সিংহের ডাকাতের দলে এসে প্রতাপ প্রথমে ভৰ্ত্তি হয়। তারপর রায়মল্ল সাহেব যখন রাজারামের সমস্ত দল পাকড়াও করে, সেই সময়ে প্রতাপ আর দুই-তিনজন ছিকে এসে রঘুনাথের দলে মেশে; কিন্তু রঘুনাথের সঙ্গে প্রতাপের ভাল বনে না। একদিন-না-একদিন দুজনে খুনোখুনী হবে।”

রঘুনাথ তারার নিকটে আসিয়া বলিল, “তারা! তুমি আজ রাত্রির মত ঐ ছোট তাঁবুর ভিতরে গিয়ে থাক, কাল তোমার সঙ্গে কথা হবে। এখন একটা বিশেষ কাজে যাব, তোমার কোন ভয় নাই: কাল সকালে আমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।”

তারা যাহাতে পলাইতে না পারে, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া রঘুনাথ অন্যান্য দুই-চারিজন অনুচরসহ প্রস্থান করিল। অনন্যোপায় হইয়া তারা ক্ষুদ্র শিবিরের দিকে অগ্রসর হইতেছে, এমন সময়ে রায়মল্ল সাহেব ইঙ্গিতে তাহাকে ডাকিলেন। তারা তাঁহার নিকটে গেল।

রায়মল্ল সাহেব ওরফে প্রতাপ বলিলেন, “আমার কথার কোন জবাব দিতে হবে না; আমি যা’ বলি, মন দিয়ে শুনে রাখ। বোধ হয়, তুমি বুঝতে পেরেছ, আমি কে?”

তারা ঘাড় নাড়িয়া বুঝাইল, “সে বুঝিতে পারিয়াছে।”

রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “যদি বুঝতে পেরে থাক, তা’ হলে আমার উপর বিশ্বাস ক’রে নির্ভয়ে তাঁবুর ভিতরে গিয়ে শুয়ে থাক— নির্ভয়ে নিদ্রা যাও; কেউ তোমার দেহস্পর্শ করতে পারবে না। এইখানে সকল সময়ে তোমাকে রক্ষা করবার জন্য আমি ছাড়া অন্য তিন-চারিজন লোক আছে। তোমার কোন ভয় নাই। আমি তোমার বাবার কাছে চল্লেম। রঘুনাথও সেখানে যাবে, তা’ আমি বেশ বুঝতে পেরেছি।”

রায়মল্ল সাহেব চলিয়া গেলেন। তারা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় যতক্ষণ তাঁহাকে দেখা গেল, ততক্ষণ তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – আগন্তুক

তারার পিতার নাম এ পর্য্যন্ত পাঠককে জানান হয় নাই। এখন আর তাহা অপ্রকাশ রাখা চলে না।

তারার পিতার নাম অজয়সিংহ।

পূর্ব্ববর্ণিত ঘটনার প্রায় তিন ঘণ্টা পরে অজয়সিংহের বাটীর বহির্দ্বারে কে আঘাত করিল। শয্যা হইতেই রুগ্ন অজয়সিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “দরজায় ঘা দেয় কে?”

একজন বৃদ্ধ অজয়সিংহের পার্শ্বে বসিয়া তাঁহার গায়ে হাত বুলাইতেছিল। সে অজয়সিংহের প্রশ্নের উত্তর দিল, “চোর ছ্যাঁচোর, না হয় ডাকাত হবে, নইলে এত রাত্রে কে আর এখানে আসবে?”

অজয়সিংহ ক্ষীণস্বরে বলিলেন, “না, আজ রাত্রে আমার সহিত একজন লোকের সাক্ষাৎ করবার কথা আছে। একবার গিয়ে দেখে এস।”

বৃদ্ধ আর কোন কথা না বলিয়া বিড় বিড় করিয়া বকিতে বকিতে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। এই বৃদ্ধের নাম মঙ্গল। অজয়সিংহের সম্পন্ন অবস্থায় সে তাঁহার চাকর ছিল। বৃদ্ধের একটী গুণ ছিল, সে উত্তমরূপে নাড়ী পরীক্ষা করিতে পারিত এবং নানাবিধ ঔষধাদি জানিত। এমন অনেক গাছ-পালা সে চিনিত, যাহার গুণাগুণ অনেক বিচক্ষণ চিকিৎসক বিদিত নহেন। মঙ্গল অনেক কাল অজয়সিংহের বাটীতে ছিল। প্রায় চারি বৎসর কাল সে কোথায় চলিয়া গিয়াছিল, কেহ তাহার সংবাদ পায় নাই কিন্তু এরূপ বিপদের সময়ে সে কেমন করিয়া কোথা হইতে আসিয়া জুটিল তাহাও কেহ বলিতে পারে না। প্রভুভক্ত ভৃত্য আসিয়াই অজয়সিংহের অবস্থা দেখিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল। তার পর অন্যান্য কথাবার্ত্তায় সে এতদিন কোথায় ছিল, তাহা বলিয়া বৃদ্ধের সেবা-শুশ্রূষায় নিযুক্ত হইয়াছিল। তারা রায়মল্ল সাহেবের উদ্দেশে লালপাহাড়ে যাইবার কিছু পরেই মঙ্গল আসিয়া জুটিয়াছিল।

অজয়সিংহের আজ্ঞাক্রমে মঙ্গল সদর দরজা খুলিয়া দিলে একজন বলিষ্ঠ যুবাপুরুষ গৃহে প্রবিষ্ঠ হইল।

আগন্তুক যুবা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “এই কি অজয়সিংহের বাড়ী?”

মঙ্গল। হাঁ।

আগন্তুক। এই রুগ্ন ব্যক্তিই কি অজয়সিংহ?

ক্ষীণকণ্ঠে অজয়সিংহ উত্তর করিলেন, “হাঁ, আমারই নাম অজয়সিংহ। আপনি কে?”

আগন্তুক। “আমার নাম রায়মল্ল, আমি কোম্পানীর তরফে গোয়েন্দার কাজ করি। অনেক সময়ে সাহেবের বেশ পরিধান করি বলিয়া, লোকে আমায় ‘রায়মল্ল সাহেব’ বলিয়া ডাকে।”

গাম্ভীর্য্যপূর্ণস্বরে অলক্ষিতভাবে কে কোথা হইতে বলিল, “মিথ্যাকথা!”

যে আগন্তুক যুবা আপনাকে রায়মল্ল গোয়েন্দা বলিয়া পরিচয় দিয়াছিল, সে বিস্মিত ও চকিতনেতে চারিদিকে চাহিয়া কাহাকেও কোথায়ও দেখিতে না পাইয়া সক্রোধে মঙ্গলকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, “এ কথা কে বললে? তুই বলেছিস্, পাজী বুড়ো! আমার সঙ্গে ঠাট্টা!”

মঙ্গল বলিল, “কৈ আমি ত কিছুই বলি নি।”

অজয়। আপনি এখানে কি উদ্দেশ্যে এসেছেন?

আগন্তুক। উদ্দেশ্য? আপনিই ত আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার নিজের কোন উদ্দেশ্যে এখানে আসি নাই।

অজয়। আমি যে আপনাকে ডাকিয়ে পাঠিয়েছি, এ-সংবাদ আপনাকে কে দিল?

আগন্তুক। আপনার কন্যা তারা আমায় এই খবর দিয়েছে।

অজয়। তবে আপনার সঙ্গে তা’র সাক্ষাৎ হয়েছিল?

আগন্তুক। আজ্ঞে হ্যাঁ।

অজয়। সে কি বলে, আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই?

আগন্তুক। তারা বলে, আপনি আমার নিকটে কি একটি গুপ্ত কথা বলার ইচ্ছা করেন। আগন্তুক যুবা যে ভাবে অজয়সিংহের প্রশ্নগুলির উত্তর প্রদান করিল, তাহাতে সন্দেহের কোন বিশেষ কারণ পরিলক্ষিত হইল না। অজয়সিংহও তাহাকে অবিশ্বাস করিলেন না। যে সকল কথা তিনি রায়মল্ল সাহেবের কাছে বলিবেন স্থির করিয়াছিলেন, সেই সকল কথা বলিতে উদ্যত হইয়াছেন, এমন সময়ে আবার কে সেই প্রকোষ্ঠের এক কোণে অদৃশ্য থাকিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, “বিশ্বাস করবেন না—ও ডাকাত।”

রোষকষায়িতলোচনে আগন্তুক মঙ্গলের দিকে ফিরিয়া বলিল, ফের পাজী বুড়ো—পাগলামী করছিস্!”

মঙ্গল এবার কোন কথা না বলিয়া চুপ্ করিয়া রহিল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – ইনি স্বয়ং

এই সময়ে একজন লোক সদম্ভপদক্ষেপে সেই গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। তাহার বেশ রাজপুত ভদ্রলোকের ন্যায়। আকার-প্রকার দেখিলে বোধ হয়, তিনি কোন উচ্চ-বংশ সদ্ভূত। গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইয়াই নবাগত ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে হে?”

কর্কশস্বরে আগন্তুক যুবা জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”

দুইজনে এইরূপভাবে বাগ্-বিতণ্ডা হইতেছে, এমন সময়ে সভয়ে ক্ষীণস্বরে অজয়সিংহ নবাগত ব্যক্তিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আমি তোমায় চিনি, তোমার মুখ দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। তোমার বাপের মুখখানি ঠিক যেন তোমার মুখে বসান’ রয়েছে। যদি তারা তোমার কাছে যথাসময়ে উপস্থিত না হ’য়ে সংবাদ দিতে না পেরে থাকে, তাহলেও আজ ভগবান তোমায় এখানে এনে দিয়েছেন। তোমার নাম রায়মল্ল না হ’য়ে যায় না। নিশ্চয় তুমি সেই স্বনামখ্যাত গোয়েন্দা-সর্দ্দার রায়মল্ল।”

রায়মল্ল সাহেব হাসিয়া অজয়সিংহকে প্রণাম করিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ লোকটা কে?”

অজয়। যাক্, যা’ হয়ে গেছে, তা’ হয়ে গেছে। লোকটা প্রবঞ্চক। কি আশ্চর্য্য। তোমার নামে নিজ-পরিচয় দিচ্ছিল।

রায়মল্ল সাহেব যেন কথঞ্চিৎ ক্রুদ্ধ হইয়া উত্তর করিলেন, “বলেন কি? আমার নামে পরিচয় দিচ্ছিল? তবে ত বাস্তবিকই লোকটা কে তা’ দেখা আবশ্যক। “

এই পৰ্য্যন্ত বলিয়াই আগন্তুক যুবাকে ভাবিবার সময় না দিয়াই তাহার দাড়ী গোঁফ ধরিয়া রায়মল্ল সাহেব সজোরে এক টান মারিলেন। পরচুলের দাড়ী গোঁফ খুলিয়া যাওয়ায় রঘুনাথের মূর্ত্তি ধরা পড়িল।

চমকিতনেত্রে অজয়সিংহ সেই মুখপানে চাহিয়া বলিলেন, “কি রঘুনাথ! তোমার এই কাজ! উঃ কি বিশ্বাসঘাতক—“

রায়মল্লের নাম শুনিয়াই ভয়ে রঘুনাথের আত্মাপুরুষ যেন উড়িয়া গিয়াছিল। সে যে-কোন উপায়ে হউক, পলাইবার চেষ্টা দেখিতেছিল। রায়মল্ল সাহেব যখন তাহাকে টানিয়া তাহার পরচুলের দাড়ী গোঁফ খুলিয়া ফেলিলেন, সেই টানাটানির সময়ে, রঘুনাথ তাঁহার হাত ছাড়াইয়া পলায়ন করিল। জোর করিলে যে, রঘুনাথ পলাইতে পারিত তাহা নয়; তবে যে কেন রায়মল্ল গোয়েন্দা তেমন দুৰ্দ্দান্ত দস্যুকে হাতে পাইয়াও ছাড়িয়া দিলেন, তাহার একটি বিশেষ কারণ ছিল। রঘুনাথের ধরা পড়িবার তখনও সময় হয় নাই।

রঘুনাথ রায়মল্লকে চিনিতে পারিল না। তাহার কারণ, তিনি তখন ছদ্মবেশী প্রতাপ ত নন্। কেবল বেশের ভিন্নতা কেন, কণ্ঠধ্বনিও পরিবর্তিত। সে সকল পরিচয় দেবার প্রয়োজন ছিল না বলিয়া, রায়মল্ল রঘুনাথের নিকটে প্রতাপের নাম বা তাহার কথা উত্থাপন করিয়া কোন ঘোর-ঘটা করিলেন না।

রঘুনাথ পলায়ন করিলে রায়মল্ল সাহেব স্থির-ধীর গম্ভীরভাবে অজয়সিংহের শয্যাপার্শ্বে সমাসীন হইলেন; পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি, আমার সহিত সাক্ষাতের বাসনা করেছিলেন?”

অজয়। তোমায় কে বলিল?

রায়মল্ল। সে কথা এখন না-ইবা শুনলেন?

অজয়। তারার সঙ্গে কি তোমার দেখা হয়েছিল?

রায়মল্ল। হয়েছিল।

অজয়। কোথায়?

রায়মল্ল। তারা এখন রঘু ডাকাতের অধীনে বন্দিনী।

অজয়। বন্দিনী! কি ভয়ানক! তবে তোমার সঙ্গে তার কি উপায়ে দেখা হ’ল?

সংক্ষেপে রায়মল্ল সাহেব সমস্ত কথা বিবৃত করিলেন।

ব্যাকুল হইয়া কাঁদিয়া অজয়সিংহ বলিলেন, “আহা বাছা! আমার জন্যই তোমার অমূল্য জীবনরত্ন নষ্ট হ’ল। হায়! আমি কি করলেম—কেন অভাগিনীকে যেতে দিলেম–“

রায়মল্ল সাহেব অজয়সিংহকে সান্ত্বনা করিবার প্রয়াস পাইতে লাগিলেন! কাঁদিতে কাঁদিতে অজয়সিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “রঘু ডাকাত কে?”

রায়মল্ল। যাকে এইমাত্র দেখলেন।

অজয়। রঘুনাথ কি এখন দস্যুদলে মিশেছে?

রায়মল্ল। মিশেছে কি! ঐ ত পাহাড়ী ডাকাতের দলের সর্দ্দার! ওর দলকে দলশুদ্ধ ধরিয়ে দেবার জন্যই ত আমি কোম্পানী বাহাদুর কর্তৃক নিয়োজিত হয়েছি।

অজয়। আমার তারার তবে কি হবে? তাকে কি খুন ক’রে ফেলবে?

প্রশান্তচিত্তে রায়মল্ল সাহেব উত্তর করিলেন, “আপনি চিন্তিত হচ্ছেন কেন? তারার একগাছি চুলও কেউ ছুঁতে পারবে না। আমার প্রাণ যায় সেও স্বীকার, তবু তারার কোন অমঙ্গল হ’তে দিব না। তারার মুখেই আমি আপনার সব কথা শুনেছি—”

রায়মল্লের উক্তি সম্পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা না করিয়াই অজয়সিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি তাহাকে এমন ঘোর বিপদে রেখে ছেড়ে চলে এলে কেন? তাকে নিয়ে এলে না কেন? না জানি, হতভাগিনী কত যাতনাই ভোগ করছে!”

ঈষদ্ধাস্যে রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “আমার উপরে যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, তা’ হলে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তারার কোন বিপদ্ হয় নি—হবেও না—তার বিপদ্ হ তেই পারে না। এখন আপনি যদি আমায় কিছু বলতে চান্ তবে শীঘ্র ব’লে ফেলুন;আর আমার বেশি দেরী করবার সময় নাই। “

অজয়। এত তাড়াতাড়ি কেন?

রায়মল্ল। মনে রাখবেন, আপনার তারা এখন দস্যুহস্তে বন্দিনী—রঘুনাথও অপমানিত হয়ে রেগে ফিরে যাচ্ছে। আমারও সেখানে এখন উপস্থিত থাকা আবশ্যক। কি জানি, যদি তারার কোন বিপদ হয়।

অজয়। সে কথা সত্য। অনেক কথা তোমায় বলতে হবে—অনেক সময় লাগবে। তুমি ভিন্ন এই পিতৃ-মাতৃহীন বালিকার প্রাপ্য সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে আর কেউ সমর্থ হবে না।

রায়মল্ল। কোন্ অনাথা বালিকার কথা বলছেন?

অজয়। আমার পালিতা কন্যা ঐ তারার কথাই বলছি।

রায়মল্ল। আমার প্রাণ দিলে যদি আপনার কোন উপকার হয়, তাও আমি করব। শুনেছি, আপনি একবার আমার পিতার জীবন রক্ষা করেছিলেন। আমি অকৃতজ্ঞ নই, যদি পারি, সে পিতৃঋণ পরিশোধ করব।

অজয়। তুমিই পারবে, অন্য লোকের সাধ্য নয়। তারা আমার, অতুলসম্পত্তির অধিকারিণী;কিন্তু তারার স্বত্বপ্রমাণার্থে যে যে কাগজপত্র বা দলিল-দস্তাবেজের প্রয়োজন, সে সমস্ত খোয়া গিয়াছে। রায়মল্ল। আপনি কেমন ক’রে জানলেন যে, যারা এখন তারার বিষয় নির্বিবাদে ভোগ দখল করছে, তারা সে কাগজ-পত্র নষ্ট করেনি?

অজয়। না-না তা’ পারবে না। সে সব কাগজপত্র নষ্ট করলে, যারা এখন তারার বিষয়সম্পত্তি ভোগ দখল করছে, তাদের আর সে অধিকার থাকবে না।

রায়মল্ল। তা’ আপনি এতদিন এ কথা কারও কাছে প্রকাশ করেন নাই কেন?

অজয়। এতদিন চেষ্টা করলে কোন ফল হত না। এখন যে সুযোগ পেয়েছি, এ সুযোগ পূর্ব্বে ছিল না। সম্প্রতি আমি কতকগুলো কাগজ-পত্র ও দুই-একটা এমন সন্ধান পেয়েছি, যাতে আমার মনে অনেকটা আশা হচ্ছে—তোমার মত লোক এ কাজে হাত দিলে অভাগিনী আপনার ন্যায্যপ্রাপ্য সম্পত্তি পুনঃপ্রাপ্ত হবে।

রায়মল্ল সাহেব আর অধিক সময় ব্যয় করিতে না পারিয়া অতিশয় ব্যস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আমি আর অপেক্ষা করিতে পারি না।”

অজয়সিংহ মঙ্গলকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মঙ্গল! আর আমি কতক্ষণ বাঁচব?” মঙ্গল। এখনও অনেক বৎসর।

অজয়। আমায় প্রবোধবাক্যে সান্ত্বনা করবার কোন আবশ্যক নাই—সত্য বল।

মঙ্গল। সত্যই বলছি, যদি পাহাড়ী গাছপালার রসের কোন গুণ থাকে, আর আমার বৃদ্ধ বয়সে নাড়ীজ্ঞান যদি পরিপক্ক হ’য়ে থাকে, তা’ হলে আমার কথা ঠিক খাবে। আমি নিশ্চয় বলছি, আপনি এখনও অনেক দিন বাঁচ্‌বেন।

অজয়সিংহ আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন, “তবে যাও রায়! স্বকার্য্যসাধনে অগ্রসর হও। তারাকে দস্যুগণের কবল হইতে উদ্ধার কর। তোমার কার্য্য উদ্ধার হ’লেই আমার কাছে ফিরে এস। আমি তোমায় সে সব গুপ্তকাহিনী বলব।”

রায়মল্ল সাহেব এত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন, যে, এ সকল কথার কোন উত্তর না দিয়াই তিনি প্রস্থান করিলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, তিনি রঘুনাথের পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইবেন; কিন্তু ঘটনাচক্রে তাহার অন্যথা হইয়া পড়িল।

পথে অন্য কার্য্যে রঘুনাথের কিছু বিলম্ব হইয়াছিল। সে বিলম্বের কারণ রায়মল্ল সাহেব জানিতেন তাই তিনি অজয় সিংহের সহিত দুইচারিটী কথা কহিতে অবসর পাইয়াছিলেন। পার্ব্বতীয় পথে অশ্বারোহণে তিনি অত্যন্ত দ্রুতগমন করিতে পারিতেন;সুতরাং তাঁহার কিছু বিলম্ব হইলেও রঘুনাথের পূর্ব্বে তিনি উপস্থিত হইতে পারিয়াছিলেন।

যে স্থানে তারা বন্দিনী ছিল, তাহার কিয়দ্দূরে একটি ক্ষুদ্র জঙ্গলের নিকটে তিনি অশ্ব-গতি রোধ করিলেন। তৎক্ষণাৎ সেই বনমধ্য হইতে কৃষকবেশী একটি লোক বাহির হইয়া অসিল। রায়মল্ল সাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রঘুনাথ ফিরে এসেছে?”

কৃষকবেশী সেই ব্যক্তি বলিল, “না।”

রায়মল্ল। ঐ দূরে অশ্বের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বোধ হয়, রঘুনাথ আছে। সত্বর আমার ছদ্মবেশ আমায় দাও, আর ঘোড়াটিকে নিয়ে যাও।

সে লোকটী তাহাই করিল। দু-চার মিনিটের মধ্যে রায়মল্ল সাহেব বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া লইলেন। সে লোকটী তাঁহার পরিত্যক্ত বসন ও অশ্বটী লইয়া বনের ভিতরে চলিয়া গেল। প্রতাপের বেশে রায়মল্ল সাহেব দ্রুতপদে শিবিরে উপস্থিত হইয়া অন্যান্য নিদ্রিত দস্যুগণের এক পার্শ্বে শয়ন করিলেন।

এরূপ অল্প সময়ের মধ্যে আশ্চর্য্য ব্যাপার সম্পাদন করা গোয়েন্দা সদার রায়মল্লেরই সাজে। অশ্বারোহণে পার্বত্যপথে অবাধে অতিক্রম করা, পথিমধ্যে ছদ্মবেশ পরিত্যাগ ও পরিধান করা, বিষম শত্রুকে সামনাসামনি উপস্থিত হইয়া চমকিত করা, তিনি ভিন্ন অন্য কাহারও সাধ্যায়ত্ত নয়। অনেক বিবেচনা করিয়া কোম্পানী বাহাদুর তাঁহাকে এত সম্মানসহ রাখিয়াছিলেন এবং উচ্চপদ প্রদান করিয়াছিলেন।

নবম পরিচ্ছেদ – গুপ্ত পরামর্শ

রঘুনাথ ফিরিয়া আসিয়া প্রথমেই প্রতাপের অনুসন্ধান করিল। দেখিল, সে একপার্শ্বে পড়িয়া গাঢ় নিদ্রা যাইতেছে।

অনেকক্ষণ ধরিয়া রঘুনাথ কি ভাবিল। মনে করিয়াছিল, ফিরিয়া আসিয়া সে প্রতাপকে দেখিতে পাইবে না। প্রতাপের উপর তাহার সন্দেহ হইয়াছিল। সে কখনও ভাবিত, প্রতাপ রায়মল্লের চর। আবার কখনও ভাবিত, সে নিজেই বা রায়মল্ল সাহেব; কিন্তু আজ রঘুনাথের সে ভ্রম দূর হইল। প্রতাপ যে ছদ্মবেশী রায়মল্ল সাহেব নয়, এ বিষয়ে তাহার স্থির ধারণা জন্মিল। যদি রায়মল্ল হইত, তাহা হইলে অজয়সিংহের গৃহে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে কেমন করিয়া? রঘুনাথ সিদ্ধান্ত করিল, প্রতাপ রায়মল্লের একজন চর হইতে পারে বটে।

নিদ্রিত দস্যুগণের মধ্যে হইতে বাছিয়া একজন দস্যুকে রঘুনাথ টানিয়া উঠাইল। নিদ্রাভঙ্গের জন্য প্রথমে সে বড় বিরক্ত হইয়াছিল; কিন্তু রঘুনাথকে দেখিয়া তাহার বিরক্তির ভাব দূর হইল। রঘুনাথ বলিল, “ভোজসিংহ! একবার আমার সঙ্গে বাহিরে এস দেখি, বড় দরকারী কথা আছে।”

ভোজসিংহ রঘুনাথের আজ্ঞাক্রমে তাহার সঙ্গে শিবিরের বাহিরে গেল। যে স্থানে ক্ষুদ্র শিবিরে তারা বন্দিনী ছিল, তাহারই পশ্চাতে যাইয়া উভয়ের কথাবার্তা চলিতে লাগিল।

রঘুনাথ বলিল, “দেখ, আজ রাত্রে আমার সঙ্গে রায়মল্ল গোয়েন্দার দেখা হয়েছিল।” ভোজ। এতদিনে বুঝি তোমার চোখ ফুল?

রঘুনাথ। কেন?

ভোজ। পাঁচ ঘণ্টা আগে যদি আমায় এ কথা জিজ্ঞাসা করতে তা’ হ’লে আমি তোমায় ব’লে দিতে পারতেম যে, রায়মল্ল গোয়েন্দা আমাদের দলের মধ্যে মিশে আছে।

রঘুনাথ। অ্যা—বল কি! আমাদের দলের মধ্যে?

ভোজ। হাঁ।

রঘুনাথ। না—তুমি যা’ ভাবছ, তা’ নয়;তবে এখানে তার এক চর আছে, কথা আমি নিশ্চয় বলতে পারি।

ভোজ। কে?

রঘুনাথ। প্রতাপ।

ভোজ। তুমি ঠিক বলতে পার, প্রতাপ রায়মল্ল গোয়েন্দা নয়?

রঘুনাথ। হাঁ, আমি নিশ্চয় বলতে পারি। কেন জান? আজ রাত্রে অজয়সিংহের বাড়ীতে আমি রায়মল্ল গোয়েন্দাকে দেখেছি।

ভোজ। তার পর কি হ’ল?

রঘুনাথ সংক্ষেপে সমস্ত বিবরণ বর্ণন করিল। কেবল নিজে যেরূপভাবে অপদস্থ হইয়াছিল, সে ঘটনাটুকু বাদ দিয়া বলিল।

ভোজ। তাই ত, লোকটা অন্তর্যামী নাকি! যে সময়ে যেখানে দরকার, ঠিক সময়ে সেখানে আবির্ভাব হয়। ভূতের মত লোকের আশে-পাশে ঘুরে বেড়ায়; কিন্তু কেউ কখন তাকে ধরতেও পারে না।

রঘুনাথ। এইবার যদি তাকে আমি আমার পাল্লায় পাই, একেবারে খুন ক’রে ফেলব।

ভোজ। বড় শক্ত কাজ! রায়মল্ল গোয়েন্দার মাথার একগাছি চুল ছুঁতে পারাও বড় শক্ত কথা রাতারাতি গুম-খুন করতে পারলে তবেই সুবিধা।

রঘুনাথ। এখন কি করা যায়, বল দেখি?

ভোজ। এখান থেকে জাল গুটোও।

রঘুনাথ। তাতে আমার মত্ আছে। রায়মল্ল যখন পিছু নিয়েছে, তখন দিন-কতক গা-ঢাকা দেওয়াই ভাল।

ভোজ। তা’ মন্দ নয়।

রঘুনাথ। কিন্তু যাবার আগে একটা কাজ করতে হবে, এ প্রতাপ বেটাকে মেরে যেতে হবে, ওটা বিশ্বাসঘাতক— রায়মল্লের চর।

ভোজ। আমার মনেও ঠিক ঐ কথা উঠেছিল; কিন্তু আমি তোমায় এতক্ষণ বলিনি। খুন ক’রে না হয় খড়ের ভিতরে ফেলে দিলাম; কিন্তু খুন করাই যে শক্ত। দলের ভিতর অনেক লোক ওর সহায়—অনেকের সঙ্গে ওর বড় ভাব।

রঘুনাথ। আমি তার এক মতলব ঠাওরেছি। ঐ যে তিনজন নুতন লোক আমাদের দলে এসে সম্প্রতি মিশেছে, ওরা এদেশী নয়—এ দেশের লোকের উপর ওদের বড় মায়াদয়া নাই। ওদের দ্বারাই প্রতাপকে খুন করতে হবে। তুমি ওদের ডেকে নিয়ে এস। তারপর আমি সব পরামর্শ বলছি।

উভয়ে এইরূপ কথা কহিতে কহিতে চলিয়া গেল। ক্ষুদ্র শিবিরমধ্য হইতে তারা তাহাদের সমস্ত কথাই শুনিল। বারবার তারার মনে বিশ্বাস ছিল, প্রতাপ ওরফে রায়মল্ল সাহেব তাহাকে সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার করিবেন; কিন্তু এইরূপ পরামর্শ শুনিয়া তাহার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল। সে একবার উঁকি মারিয়া দেখিল, রঘুনাথ ও ভোজসিংহ চলিয়া গিয়াছে; এবং যে প্রহরী তাহার রক্ষকস্বরূপ নিযুক্ত হইয়াছিল, সে-ও নিদ্রিত। তারা আর স্থির থাকিতে পারিল না; নিঃশব্দে বাহির হইয়া দস্যুগণের শিবিরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তথায় সকল দস্যুই নিদ্রা যাইতেছিল। একপার্শ্বে প্ৰতাপকে দেখিয়া তারা তাঁহার কাছে গেল।

প্রতাপ এক মুহূর্ত্তের জন্যও নিদ্রিত হন্ নাই। তাঁহার দুই-চারিজন অনুচরও মাঝে মাঝে তাঁহাকে দুই-একটি খবর দিয়া যাইতেছিল। তিনি নাসিকাধ্বনি করিয়া নিদ্রিতের ন্যায় শয়ন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু কোথায় কি হইতেছে, তাহার সংবাদ একটিও তাঁহার অজ্ঞাত ছিল না। সমস্ত সংবাদই চরে তাঁহাকে অবগত করাইতেছিল।

তাঁহার মাথার কাছে বসিয়া তারা কানে কানে বলিল, “আমি আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি। রঘুনাথ আপনাকে হত্যা করবার পরামর্শ করছে।”

প্রতাপ হাসিয়া বলিলেন, “আমি জানি। আমার জন্য তোমার কোন ভয় নাই। তবে যে তুমি নিজে আমায় সাবধান করে দিতে এসেছ, তার জন্য আমি তোমায় ধন্যবাদ দিই। তুমি যেখানে ছিলে, সেইখানে যাও। রঘুনাথ তোমায় যেখানে নিয়ে যেতে চায়, তার সঙ্গে সেইখানে যেয়ো। জেনো, আমি ছায়ার ন্যায় তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব। এখানে আর ব’সে থেকো না—কেউ তোমায় আমার কাছে দেখলে সন্দেহ করবে—সবদিক্ নষ্ট হবে।”

তারা আর কথা কহিতে পারিল না। সেখান হইতে উঠিয়া চলিয়া আসিতেছে, এমন সময়ে আর একটা কথা মনে পড়াতে প্রতাপকে বলিতে গেল। সেই সময়ে পশ্চাদ্দিক্ হইতে কে তাহার বস্ত্র ধরিয়া এক টান মারিল।

দশম পরিচ্ছেদ – তারা ও রঘু

যে ব্যক্তি তারার বসন ধরিয়া টানিয়াছিল, সে রঘুনাথ। তৎপশ্চাতে ভোজসিংহ দন্ডায়মান।

রঘুনাথ। তারা! তুমি ওদিকে যাচ্ছিলে কেন?

তারা। প্রতাপকে সাবধান করে দিবার জন্য।

রঘুনাথ। কিসের সাবধান?

তারা। তোমরা ওঁকে খুন করবার মতলব করছ তাই।

রঘুনাথ। আশ্চার্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কেমন ক’রে জানলে?”

তারা। আমি তোমাদের পরামর্শ সব শুনেছি।

রঘুনাথ। আমাদের কথায় তোমার থাকবার কোন দরকার নাই। তুমি নিজের বিপদ্ নিজে ডেকে আন্‌ছ। তুমি এ পর্য্যন্ত বাঁধা ছিলে না, এইবার তোমায় বেঁধে রাখতে হবে।

তারা কাঁদিয়া বলিল, “তোমার হাতে পড়েছি, এখন তোমার যা’ ইচ্ছা করতে পার;কিন্তু জেনো রঘুনাথ উপরে একজন আছেন, তিনি তোমার এই পাপ কাজ সব দেখতে পাচ্ছেন। একদিন-না- একদিন এর প্রতিফল তুমি পাবেই পাবে।”

বালিকার মুখে এরূপ সতেজ কথা শুনিয়া রঘুনাথের বড় রাগ হইল। তারার গলায় হাত দিয়া ধাক্কা দিতে দিতে সে তাহাকে শিবিরের বহিৰ্দ্দেশে লইয়া আসিল। তারপর বলিল, “যাও, তুমি যেখানে ছিলে, সেইখানে যাও। ভাগ্যে আমি ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলাম, তাই ত তুমি প্রতাপের সঙ্গে কথা কহিতে পেলে না, নইলে আমাদের গুপ্ত-পরামর্শ প্রতাপ ত সব টের পেত!”

ডাকাতের কড়া হাতের ভয়ানক ধাক্কা খাইয়া তারার কোমল দেহে গুরুতর আঘাত লাগিল। কাঁদিতে কাঁদিতে অভাগিনী শিবিরে প্রবেশ করিল। রঘুনাথ প্রথমে তারাকে প্রতাপের সহিত কথা কহিতে দেখে নাই। তারা যখন দ্বিতীয় বার প্রতাপের কাছে যাইতেছিল, তখন রঘুনাথ তাহাকে দেখিয়াছিল; সুতরাং রঘুনাথের বিশ্বাস হইয়াছিল, তারা প্রতাপকে কোন কথা বলিবার অবকাশ পায় নাই।

রঘুনাথের আদেশে ভোজসিংহ একে একে প্রত্যেক দস্যুকে জাগাইল। কেবল প্রতাপকে কেহ ডাকিয়া উঠাইল না। নিঃশব্দে অন্যান্য দস্যুগণ চলিয়া গেল। কেবল রঘুনাথ, ভোজসিংহ আর তিনজন বিদেশীয় দস্যু প্রতাপকে হত্যা করিবার জন্য রহিল। রঘুনাথের আদেশক্রমে তারাকেও অন্যান্য দস্যুগণের সহিত যাইতে হইল। এতক্ষণে অভাগিনীর আশা-ভরসা একেবারে উন্মুলিত হইবার উপক্রম হইল।

কেমন করিয়া হত্যা করিতে হইবে, কোন্ খড়ের ভিতরে প্রতাপের মৃতদেহ ফেলিয়া দিতে হইবে, এই সমস্ত কথা বিশেষরূপে শিক্ষা দিয়া, অবশেষে সেই তিনজন বিদেশীয় দস্যুকে রাখিয়া ভোজসিংহ ও রঘুনাথ উভয়েই প্রস্থান করিল।

যখন সকলে চলিয়া গেল, তখন হাসিতে হাসিতে প্রতাপ নেত্রপাত করিলেন। তিনি তাহাদের তিনজনের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “বেশ কাজ করেছ! বেশ বোকা ভুলিয়েছ! আমি তোমাদের উপর বড় সন্তুষ্ট হয়েছি। রঘুনাথ যে তোমাদিগকে আমার অনুচর ভাবে নি, এইটিই তার মন ভিজাইতে পেরেছ, আর তোমাদের উপরে বিশ্বাস ক’রে যে সে এত বড় একটা হত্যাকাণ্ডের ভার দিয়েছে, এই তোমাদের কার্য্যদক্ষতার যথেষ্ট প্রমাণ।”

পাঠক! এতক্ষণে বোধ হয়, ব্যাপারটা কি বুঝিতে পারিলেন। এই তিন বিদেশীয় দস্যু রায়মল্লের অনুচর এবং তাঁহারই শিক্ষায় শিক্ষিত। তাহারা অনেক মিথ্যাকথা বলিয়া রঘুনাথের দলে মিশিয়াছিল কিন্তু রঘুনাথ একদিনও ইহা সন্দেহ করে নাই যে, তাহারা রায়মল্লেরই সাহায্যকারী। প্রথমে প্রতাপকে রায়মল্ল ভাবিয়াই রঘুনাথ সন্দেহ করিয়াছিল;কিন্তু অজয়সিংহের বাড়ীতে রায়মল্ল সাহেবকে দেখিয়া তাহার সে বিশ্বাস তিরোহিত হইয়াছিল।

রঘুনাথ প্রতাপকে রায়মল্ল গোয়েন্দার প্রধান অনুচর বলিয়া স্থির করিয়াছিল। পাছে প্রতাপ জীবিত থাকিলে রায়মল্ল তাহাদের গতিবিধির কথা জানিতে পারেন, এইজন্য প্রতাপকে হত্যা করিবার কল্পনা রঘুর মনে উদিত হয়।

প্রতাপ একজন দস্যুকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “দুইখানি ছোরায় রক্ত মাখিয়ে রঘুনাথকে দেখাও যে, তোমরা প্রতাপকে হত্যা করেছ। এখন তারা সকলে রাজেশ্বরী উপত্যকায় যাচ্ছে। তোমরাও সেইখানে যাও। লালপাহাড়ের পাশে বনের ভিতর দিয়েও রাজেশ্বরী উপত্যকায় যাওয়া যায়। দস্যুরা সে পথ দিয়ে যাবে না, তাহাদিগকে অনেক ঘুরে যেতে হবে; সেখানে পৌঁছিতে প্রায় বেলা আড়াইটা হবে। আমি ইতিমধ্যে একটা প্রয়োজনীয় কাজ সেরে লালপাহাড়ের পাশে বনের ভিতর দিয়েই রাজেশ্বরী উপত্যকায় উপস্থিত হ’ব। বোধ হয়, সকলের আগে আমি সেখানে পৌঁছিব। আমি যাকে যেমন ভাবে কাজ করতে শিখিয়ে দিয়েছি, ঠিক সেই রকম যেন সকলে করে। তার একটু ব্যাতিক্ৰম হ’লেই ধরা প’ড়ে যাবে। খবরদার—খুব সাবধান।”

একাদশ পরিচ্ছেদ – পূৰ্ব্বকথা

এই ঘটনার কিয়ৎক্ষণ পরে প্রতাপ পূর্ব্বে অজয়সিংহের বাড়ী হইতে আসিয়া যেখানে একটা ঘোড়া রাখিয়া আসিয়াছিলেন, পুনরায় তথায় উপস্থিত হইলেন। আবার সেই ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাকে বসন-ভূষণ প্রদান করিল। ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া, সেই সকল বস্ত্রাদি পরিধান পূর্ব্বক প্ৰতাপ রায়মল্ল সাজিলেন।

ঊষার চিহ্ন তখনও চারিদিকে সম্পূর্ণ দৃষ্ট হয় নাই। অল্প অল্প আলো, অল্প অল্প অন্ধকার তখনও বৰ্ত্তমান। ভগবান অংশুমালী তখনও গগনপটে অনুদিত। রায়মল্ল সাহেব ঘোটকে আরোহণ করিয়াই তীরবেগে অশ্বচালনা করিলেন। দিনমণি আকাশে পূর্ণজ্যোতিঃ প্রকাশ করিবার পূর্ব্বেই তিনি অজয়সিংহের বাটীতে পৌঁছিলেন। মঙ্গল আসিয়া সদর দরজা খুলিয়া দিল। নিঃশব্দে তিনি রোগীর শয্যাপার্শ্বে যাইয়া উপবেশন করিলেন।

অজয়সিংহ নানা প্রশ্ন করিলে, তিনি সংক্ষেপে সমস্ত কথা তাঁহাকে বিবৃত করিয়া তারার আদ্যোপান্ত ঘটনা বর্ণন করিতে অনুরোধ করিলেন। অজয়সিংহ বলিতে আরম্ভ করিলেন, “তারার পিতা অতুল সম্পত্তি রাখিয়া পরলোক গমন করেন। তারা তাঁহার একমাত্র কন্যা, অন্য উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারিণী কেহ ছিল না। তারার পিতা মৃত্যুকালে এই মৰ্ম্মে একখানা উইল করেন, যতদিন না তারার বিবাহ হয়, ততদিন তাহার বিমাতা তাহার অভিভাবিকা স্বরূপ থাকিবেন। তারার বিবাহ হইলে সেই জামাতা তাঁহার বিষয়ের অধিকারী হইবেন, এবং তারার বিমাতা খোরাক-পোষাক ও পাঁচশত টাকা মাসহারা পাইবেন। কিন্তু যদি দুরদৃষ্টক্রমে তারার মৃত্যু হয়, তাহা হইলে তারার বিমাতা পোষ্যপুত্র গ্রহণ করিবেন এবং সেই-ই তাঁহার বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইবে। তাহাতেও তারার বিমাতা আজীবন মাসহারা ও খোরাক-পোষাক প্রাপ্ত হইবেন।

“তারার বয়ঃক্রম যখন পাঁচ বৎসর, তখন তারার বিমাতা তাহাকে তাহার মাসীর বাড়ীতে ছল করিয়া পাঠাইয়া দেন। সেখানে লোক লাগাইয়া একটা পুষ্করিণীতে তাহাকে ডুবাইয়া মারে।

“তারার পিতা আমার খুড়তুতো ভাই। আমাদের দুই ভায়ে বড় অসদ্ভাব ছিল। পূর্ব্বে আমাদের পৈতৃক-সম্পত্তি ভাগ হয় নাই; কিন্তু তারার পিতার সহিত আমার অসদ্ভাব হওয়াতে মোকদ্দমা করিয়া আমি বিষয়-সম্পত্তির ভাগ করিয়া লই।

“তারার পিতা ব্যবসা-বাণিজ্য করিতেন। আমিও ব্যবসা-বাণিজ্য করিতাম। তিন পুরুষ আমরা তাহাই করিতেছি। আমার পিতামহ হইতে কেহ কখনও দাসত্ব স্বীকার করেন নাই। অদৃষ্টগুণে তারারপিতা ব্যবসায়ে বিশেষ উন্নতি করেন। আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি ব্যবসায়ে সৰ্ব্বস্বান্ত হই। তাঁহার মৃত্যুর কিছু পূর্ব্বে আবার আমার সহিত তাহার সদ্ভাব হয়।”

“যখন আমি তারার পুকুরে ডুবে মরার সংবাদ পাই, তখন মৃতদেহ দেখিবার জন্য আমি তথায় যাই-“

রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “তারার মৃতদেহ! আপনি কি বলছেন? তারা ত এখনও জীবিত! “ অজয়সিংহ হাসিয়া বলিলেন, “ঐটুকুই ত কথা। তারার মৃত্যু হয় নাই বটে, কিন্তু ঠিক তারার মত আর একটি মেয়ের মৃত্যু ঘটিয়াছিল। তারার বিমাতা সেই মৃতদেহটিকে তারার মৃতদেহ বলিয়া লইয়া য়ায়। কাজেকাজেই লোক জানে তাহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি তারাকে খুব কমই দেখিয়াছিলাম, মৃতদেহ দেখিয়া তাই পূর্ব্বে চিনিতে পারি নাই।”

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – পূৰ্ব্বকথা—ক্রমশঃ

রায়মল্ল বলিলেন, “তার পর তারাকে আপনি কেমন ক’রে পেলেন, আর কেমন ক’রেই বা জানলেন, এই তারাই সেই তারা?”

অজয়সিংহ বৃদ্ধ মঙ্গলকে দেখাইয়া বলিলেন, “তারার যখন জন্ম হয়, তখন এই মঙ্গল আমার ভায়ের ভৃত্য ছিল। যতদিন আমার ভাই জীবিত ছিলেন, ততদিন মঙ্গল তারাকে লালন-পালন করে। তার পর তাঁহার মৃত্যু হইলে, মঙ্গল আসিয়া আমার কাছে থাকে। তারার চিবুকে ছেলেবেলায় দু- একটা কাটাকুটির চিহ্ন ছিল। তাহা মঙ্গল জানিত। সে চিহ্ন দেখিয়াই জীবিত তারাকে মঙ্গল চিনিতে পারিয়াছিল।”

রায়মল্ল। তারাকে কি উদ্দেশ্যে তাহার বিমাতা মেরে ফেলতে চেষ্টা করে?

অজয়। তারাকে মেরে ফেলতে পারলেই আমার ভায়ের অতুল সম্পত্তি তারার বিমাতার ভোগে আসে; একটা নামমাত্র পোষ্যপুত্র নিয়ে আজীবন সুখে-স্বচ্ছন্দে সমস্ত বিষয় ভোগ করতে পারে।

রায়মল্ল। কেন? তারার বিমাতা যে টাকা মাসহারা পাবেন, সেই টাকাতেই ত তাঁর বেশ চলতে পারে?

অজয়। তা’ বললে কি হয়? লোভ বড় ভয়ানক জিনিষ। তা’ ছাড়া এর মধ্যে আর অন্য কোন লোক আছে। তারই ষড়যন্ত্রে এই সব ঘটেছে। তারার বিমাতার চরিত্র ভাল নয়। জগৎসিংহ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে সে দুশ্চরিত্রা—গুপ্ত প্রণয়ে আবদ্ধ। তারই পরামর্শে এই সব হয়েছে। সে লোকটা রাজার হালে আছে। বিষয়-সম্পত্তি এখন যেন সবই তার হয়েছে। পূর্ব্বে সে আমার ভায়ের বিষয়- সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক ছিল। তাঁর জীবিতাবস্থায়ই তারার বিমাতার সঙ্গে সেই লোকটির গুপ্ত-প্ৰণয় হয়; কিন্তু সে কথা কেহ জানতে পারে নাই। এখন সে নামে বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক, কাজে—সে- ই হৰ্ত্তা-কৰ্ত্তা-বিধাতা।

রায়মল্ল। আপনি এই সব কথা কেমন ক’রে জানতে পারলেন?

অজয়। একে একে সব ব’লে যাচ্ছি। সমস্ত শুনলেই বুঝতে পারবে—ব্যস্ত হ’য়ো না।

রায়মল্ল। আচ্ছা, বলুন।

অজয়। আমার ভ্রাতার মৃত্যুর দিন-কয়েক পরেই তারাকে কে চুরি ক’রে নিয়ে যায়। মঙ্গল একবার ছুটি নিয়ে বাড়ী যায়। দেশে যাবার সময়ে বাঙ্গালা মুল্লুকে এক স্থানে সে তারাকে দেখে চিনতে পারে। বর্দ্ধ মানে একটি গৃহস্থ লোকের বাড়ীতে মঙ্গল রাত্রিবাসের জন্য অতিথি হয়। সেইখানে সে তারাকে প্রথম দেখে, দেখিয়াই তার সন্দেহ হয়। তার পর গৃহস্বামীকে মঙ্গল সে কথা জিজ্ঞাসা করে। গৃহস্বামী একজন বাঙ্গালী বাবু। তাঁর নাম জনাৰ্দ্দন দত্ত—ভদ্র কায়স্থ। তিনি বলেন, “অনেক দিন পূর্ব্বে আমার বাড়ীতে একজন পশ্চিম দেশীয় রাজপুত এই মেয়েটিকে নিয়ে আসেন, আর এক রাত্রি থাকবার জন্য আমার আশ্রয় চান্। ভদ্রলোক বিপদে পড়েছেন দেখে, আমি তাঁকে আশ্রয় দিই। বিশেষতঃ মেয়েটিকে দেখে আমার বড় মায়া হয়। পাছে রাত্রে থাকবার স্থানাভাবে মেয়েটির কষ্টহয়, এই ভেবে আমি আমার বাহিরের একটা ঘর খুলে দিই। আহারাদি শেষে রাত্রিতে সেই রাজপুত ভদ্রলোকটি মেয়েটিকে নিয়ে শয়ন করে। আমিও যেমন প্রতিদিন বাড়ীর ভিতরে শয়ন করি, সেদিনও সেইরূপ করি। পরদিন প্রাতে আমার চাকর আমার নিদ্রাভঙ্গ ক’রে আমায় বলে, ‘বাবু, এই মেয়েটি এক্‌লা বাহিরের ঘরে প’ড়ে কাঁদছে, আর সেই লোকটি কোথায় চলে গেছে।’ ব্যস্ত-সমস্ত হ’য়ে আমি বাহিরে এসে দেখি, বাস্তবিকই রাজপুত ভদ্রলোকটা মেয়েটাকে রেখে পলায়ন করেছেন; তার পর তাঁর অনেক অনুসন্ধান করেও তাঁকে খুঁজে পাই নাই। মঙ্গল গৃহস্বামীর এই কথা শুনে তাঁকে প্রকৃত কথা বলে এবং তারার পরিচয় দেয়। তারাকে অনেক দিন হ’তে প্রতিপালন করে তার উপর গৃহস্বামীর একটু মায়া বসেছিল; সেজন্য সহজে তিনি তাকে ছেড়ে দিতে চাহেন নাই। তার পরে মঙ্গলের পত্র পেয়ে আমি সেখানে উপস্থিত হ’য়ে তারাকে নিয়ে আসি।”

রায়মল্ল। তারাকে পেয়ে, আপনি রাজদ্বারে বিচারপ্রার্থী হ’লেন না কেন?

অজয়। হয়েছিলেম—নালিশ করেছিলেম বারদিন ধ’রে ক্রমাগত মোকদ্দমা ক’রে শেষে আমার হার হয়।

রায়মল্ল। কেন? প্রমাণ করতে পারলেন না?

অজয়। না, তারার বিমাতা বলে, এ মেয়েটিকে সে কখনও দেখে নি। তার ভগিনী, সম্পর্কে তারার মাসী, যার বাড়ীতে ছল ক’রে তারাকে পাঠান হয়েছিল, তিনিও বলেন, এ মেয়েটিকে পূৰ্ব্বে কখনও দেখেছেন ব’লে স্মরণ হয় না। যে জেলে পুষ্করিণী থেকে জালে তারার মৃতদেহ উত্তোলন করেছিলেন, সে-ও হলফ নিয়ে মিথ্যাকথা কইলে। এ ছাড়া ঘুষ খেয়ে প্রতিবাসী দু-চার জন লোকও মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে পাপের মাত্রা বাড়ালো। কাজেই আমি প্রকৃত তারার অস্তিত্ব ও স্বত্ব প্রমাণ করতে পারলেম না। মোকদ্দমায় হার হ’য়ে শেষ-দশায় যা’ কিছু পুঁজিপাটা ছিল, তাও খোয়ালাম। তারপর এতদিন অতি কষ্টে কায়ক্লেশে তারার ভরণপোষণ করেছি। যদি ভগবান্ দিন দেন, তবে একদিন তারা সুখীনী হবে। আমি সেইটুকু দেখে মরতে পারলেই জন্ম সার্থক বলে বিবেচনা করব।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – আশার সঞ্চার

রায়মল্ল সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন এমন কি প্রমাণ পেয়েছেন, যাতে আপনি তারার স্বত্ব প্রমাণ করতে সাহস করছেন?”

অজয়। কাগজ-পত্র ছাড়া আমি এখন তিনটী বিষয় পেয়েছি, যাতে তারার যথার্থ প্রাপ্য সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের পক্ষে আর কোন কষ্ট হবে না।

রায়মল্ল। বলুন।

অজয়। আমার প্রথম এবং প্রধান সাক্ষ্য মঙ্গল। ছেলেবেলায় সে প্রতিপালন করেছিল, সুতরাং তার কথা আদালত গ্রাহ্য করবে।

রায়মল্ল। গ্রাহ্য না করলেও করতে পারে। মঙ্গল ছেলেবেলায় তারাকে মানুষ করেছিল ব’লেই যে, সে এখনও তাকে ঠিক চিনতে পারবে, সে কথার সারবত্তা কি?

অজয়। আমার দ্বিতীয় কারণ, তোমাকে মুখে না ব’লে হাতে হাতে দেখাচ্ছি। এই ছবিখানি কার, বল দেখি?

অজয়সিংহ রায়মল্লের হাতে হাতীর দাঁতের উপরে ক্ষোদিত একখানি বহু পুরাতন ছবি দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বল দেখি এখানি কার ছবি?” রায়মল্ল ছবিখানি দেখিবামাত্রই চিনিতে পারিলেন।

রায়মল্ল। কেন? এ ত তারার ছবি।

অজয়। ভাল করে দেখ।

রায়মল্ল। আমি ভাল করেই দেখেছি। এ নিশ্চয় তারারই ছবি।

অজয়। তারা এই ছবিখানি জীবনে কখন দেখে নাই।

রায়মল্ল। বলেন কি? তবে এ কার ছবি?

অজয়। তুমি আমায় এইমাত্র জিজ্ঞাসা করছিলে, কেমন ক’রে আমি তারাকে চিনতে পারলেম কিন্তু এই দেখ, তার এক প্রমাণ। এ ছবিখানি আমার ভায়ের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর—তার নিজ-জননীর ছবি। এই ছবি দেখে যদি তারার ছবি ব’লে ভ্রম হয়, তাহলে প্রকৃত তারাকে দেখে চিনতে আর কতক্ষণ লাগে?

রায়মল্ল। আদালতে এ তর্কও যে কতদূর দাঁড়াবে, তা আমি ঠিক বলতে পারি না।

অজয়। আচ্ছা, এও যদি প্রকৃত প্রমাণ ব’লে গ্রাহ্য না হয়, তা’ হলে আর একটি কারণে আমি বোধ হয়, মোকদ্দমায় জয়ী হব। যে রাজপুত তারাকে বালিকাকালে জনাৰ্দ্দন দত্তের বাড়ীতে রেখে এসেছিল, এখন সে লোকটাকে ধরা গিয়াছে। মঙ্গল অনেক অনুসন্ধানের পর সে লোকটাকে বার করেছে।

রায়মল্ল। লোকটা কি করে?

অজয়। কিছুই করে না। অর্থের লোভে এই ঘৃণিত পাপ কাজে সহায়তা করেছিল। এখন সে খেতে পায় না। হাতে হাতে পাপের প্রতিফল পেয়েছে। কষ্টে প’ড়ে তার একটু ধৰ্ম্মজ্ঞান হওয়াতে আদালতে আমার সহায়তা করতে সম্মত হয়েছে।

রায়মল্ল। আদালতে এ সাক্ষীও বড় বিশেষ কোন কাজ হবে না; তবে তার দ্বারা কাজ আরম্ভ করবার পক্ষে সুবিধা হবে।

অজয়। কেন, সে লোকটি নিজমুখে যদি দোষ স্বীকার করে, আর যে ব্যক্তি তাকে এই কাজে নিযুক্ত করেছিল, তাকে যদি চিনিয়ে দিতে পারে, তা’ হ’লেও কি কাজ হবে না?

রায়মল্ল। না, তাতেও কোন কাজ হবে না। কেন না, তারা এখন বড় হয়েছে। সে লোকটি শপথ ক’রে এমন কথা বলতে পারবে না যে, এই সেই তারা এবং এই তারাকেই বালিকাকালে সে বৰ্দ্ধমানে বিসর্জ্জন দিয়ে এসেছিল।

অজয়সিংহের সকল উৎসাহ, সকল তেজ যেন নষ্ট হইল। তিনি হতাশ হইয়া পড়িলেন। অত্যন্ত নৈরাশ্যব্যঞ্জক স্বরে বলিলেন, “তবে আর তারার অপহৃত সম্পত্তির পুনরুদ্ধার হবে না? অভাগিনীর যথার্থ প্রাপ্য সম্পত্তি আর সে ফিরে পাবে না?”

রায়মল্ল। ততদূর নিরাশ হবেন না। তারা সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ফিরিয়ে পেলেও পেতে পারে। অজয়। এই যে তুমি বললে, ও প্রমাণে কোন কাজ হবে না, তবে কি ক’রে তারা সম্পত্তি ফিরিয়ে পাবে?

রায়মল্ল। আপনি যে সব প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন, তাতে আদালতে কোন কাজ না হ’তে পারে কিন্তু আমি তাতেই কাজ চালাব;আপনি আমার কথা ঐ দেয়ালের গায়ে লিখে রেখে দিন। যদি আমি জীবিত থাকি, তাহলে তারার প্রাপ্য সমস্ত বিষয় সম্পত্তি নিশ্চয়ই পুনরুদ্ধার ক’রে দিব।

অজয়। কেমন করে?

রায়মল্ল। সে কথা এখন আমি আপনাকে বলব না। আমার ফন্দী আছে। আমার ফন্দী, আমার কোন মতলব, আমি কারও কাছে আগে প্রকাশ করি না।

অজয়। সকল মানুষেরই ভুল হয়। তুমিও মানুষ, তোমার ভুল হ’তে পারে। অভ্রান্ত মানুষ জগতে কেহ নাই; যদি তুমি তোমার উদ্দেশ্যসাধনে অপারক হও, যদি কোন ভুল কর, যদি ঠকে যাও— রায়মল্ল।

রায়মল্ল। গোয়েন্দা আজ পৰ্য্যন্ত ত কোন কাজে বিফল মনোরথ হয় নি—আজ পৰ্য্যন্ত ত কোন কাজে ঠকে নি।

অজয়। কখন্ তুমি এ কাজে হাত দেবে?

রায়মল্ল। রঘু ডাকাতের শ্রাদ্ধ শেষ করেই এ কাজে হাত দেবো।

অজয়। কতদিনে রঘু ডাকাতের শেষ হবে?

রায়মল্ল। আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে।

অজয়। রঘুনাথ যখন এত ভয়ানক লোক, তখন তুমি হয় ত বিপদে পড়তে পার। তাহাদের দলকে দলশুদ্ধ ধর-পাকড় করতে যাবে? তারা খুনে লোক, তোমায় খুন ক’রে ফেলতে পারে।

রায়মল্ল। রঘুনাথের হাতে মৃত্যু, বিধাতা আমার কপালে লেখে নাই। যদি মরি, তুচ্ছ রঘু ডাকাতের হাতে কখনই নয়। আমায় মারতে তার চেয়ে বুদ্ধিমান, তার চেয়ে বীর, তার চেয়ে সাহসী পুরুষের দরকার।

এই পৰ্য্যন্ত কথাবার্তা শেষ করিয়া রায়মল্ল গোয়েন্দা বিদায় গ্রহণ করিয়া অশ্বারোহণে আবার পাৰ্ব্বতীয় পথে প্রস্থান করিলেন। রঘু ডাকাতের সর্বনাশের জন্য যাহা কিছু প্রয়োজন, আজ দুই মাসকাল ধরিয়া তিনি তাহার সমস্ত আয়োজন করিতেছিলেন, এতদিনে তাহার সমস্ত অভিসন্ধি পূর্ণ হইয়াছে। চারিদিকে আট-ঘাট বাঁধিয়া কাজ করিয়াছেন, পাহাড়ের সর্বস্থানে পুলিসের লোকজন ছদ্মবেশে পরিভ্রমণ করিতেছে। এমন কি রঘু ডাকাতের দলের সঙ্গেও তাঁহারই কয়জন লোক মিশিয়া রহিয়াছে। এখন মাত্র তাঁহার শেষ কাৰ্য্য বাকী।

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – সাহস সঞ্চার

রঘুনাথ রায়মল্ল গোয়েন্দার ভয়ে পার্ব্বতীয় নিভৃত উপত্যকায় গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিল। রাজেশ্বরী উপত্যকায় বড় ভূতের ভয়! সাধারণজনগণ বা পৰ্ব্বতনিবাসী নীচজাতি পৰ্য্যন্তও তথায় কেহ গমনাগমন করিত না। বিশেষতঃ সে প্রদেশ নিবিড়-জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কাঠুরিয়া ছাড়া তথায় আর কাহারও যাইবার বিশেষ আবশ্যক হইত না। রাজেশ্বরী উপত্যকায় একটি মাত্র দ্বার। প্রবেশ ও প্রত্যাগমনের পথ সেইটি ব্যতীত আর দ্বিতীয় নাই। দসুগণ তাহাই জানিত, জনসাধারণেও তাহাই জানিত। পার্ব্বতীয় জাতির মধ্যে দু-একজন অশীতিপর বৃদ্ধের মুখে শোনা যাইত, অন্যদিক্ দিয়া রাজেশ্বরী উপত্যকায় যাইবার ও আসিবার আরও একটি পথ ছিল;কিন্তু তাহা জঙ্গলে এমন পূর্ণ হইয়া গিয়াছে যে, বর্তমানে এখন তাহার চিহ্নমাত্রও লক্ষিত হয় না। রায়মল্ল গোয়েন্দা কোন বৃদ্ধের মুখে এই কথা শুনিয়া রাজেশ্বরী উপত্যকার অন্য পথ আবিষ্কার করিতে যত্নবান্ হন্। অনেক দিন অনুসন্ধানের পর তিনি তাহা আবিষ্কার করিয়া লোকজন লাগাইয়া বন পরিষ্কৃত করা

সে প্রদেশের বাল-বৃদ্ধ-বনিতা জনিত, রাজেশ্বরী উপত্যকায় প্রেতযোনীর উপদ্রব আছে; কিন্তু রায়মল্ল গোয়েন্দা জানিতেন, সে প্রেতযোনী আর কেহ নহে—দস্যুগণই সেই প্রেতযোনী আখ্যাপ্রাপ্ত হইয়া নির্ভয়ে তথায় বাস করে। তাহাদের অত্যাচারে সে প্রদেশস্থ অধিবাসিগণ অস্থির। কাজেকাজেই সকলে বলে রাজেশ্বরী উপত্যকায় অসংখ্য প্রেতের আবাস।

এমন কোন পাপকার্য্য নাই, যাহা রঘুনাথ জানিত না—বা করিত না। রাজেশ্বরী উপত্যকায় সেদিন জনকয়েক নোট-জালিয়াতের জন্য সে অপেক্ষা করিতেছিল। রঘুনাথকে যে যখন যে কাজে নিয়োজিত করিত, কখনও সে ‘না’ বলিত না। খুন, ডাকাতি প্রভৃতি তাহার নিকটে মানাস্পদ কাৰ্য্য। তাহাতে কখনও সে পশ্চাৎপদ হইত না।

উক্ত উপত্যকায় পৌঁছিয়া দুই-তিনটি শিবির সংস্থাপিত হইলে, বেলা তিন-চারিটার সময়ে রঘুনাথ একবার তারার শিবিরে উপস্থিত হইল। পূর্ব্বস্থান পরিত্যাগ করিয়া অবধি, এ পর্যন্ত তারার সহিত রঘুনাথ কোনও কথা কহে নাই।

তারা অসহায়া—অভাগিনী, সরলা বালিকা হতাশায় ম্রিয়মানা। রঘুনাথ সেই শিবিরে প্রবেশ করিবামাত্র তাহার হৃদয়ে মহাভীতির সঞ্চার হইল। আশা-ভরসা তাহার হৃদয়ে তখন আর কিছুই স্থান পাইতেছিল না। মায়া-মমতাবিহীন নরপিশাচবৎ রাক্ষসগণের হস্তে পরিত্রাণের উপায় একমাত্র প্রতাপসিংহ, তিনিও ত অন্তর্হিত। তাঁহারও ত আর কোন খোঁজ-খবর নাই—তাঁহাকেও তারা অনেকক্ষণ দেখে নাই। তবে কি যথার্থই রঘুনাথের ঘৃণিত চক্রান্তে পড়িয়া মহাশূর রায়মল্ল গোয়েন্দা ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন? এই সকল ভাবনা তারার মনোমধ্যে উপস্থিত হইল।

রঘুনাথের মহাস্ফূর্ত্তি, বড় আস্ফালন। মুখে আর হাসি ধরে না। সে কঠোর স্বর, সে কর্কশ কথা, সে ভীষণ দৃষ্টি এখন যেন আর কিছুই নাই। নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্ত মনে নির্ভয় রঘুনাথ জিজ্ঞাসা করিল, “তারা! এতটা পথ এসে বড় ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছ?”

ক্রোধকষায়িতলোচনে, কম্পিতদেহে কঠিনকণ্ঠে তারা উত্তর করিল, “খুনি! মহাপাতকি! তুই আবার আমার সামনে এসেছিস?”

রঘুনাথ। আমি খুনি?

তারা। খুনী নয় ত কি?

রঘুনাথ। কাকে খুন করতে তুমি আমায় দেখেছ?

তারা। প্রতাপকে।

রঘুনাথ। তাতে আমার দোষ কি? আমাদের দলের কেউ তাকে ভালবাসত না, সকলের সঙ্গেই তার মহা শত্রুতা। কারও সঙ্গে বোধ হয় ঝগড়া হয়েছিল, সে রাগ সামলাতে না পেরে মেরে ফেলেছে।

তারা। রাক্ষস! এই কথা ব’লে তুই এখন আমায় ভুলাতে চাস্—হৃদয় থেকে কি এ কথা বলছিস্, নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখ দেখি।

আর রঘুনাথ সহ্য করিতে পারিল না। শিরায় শিরায়, ধমনীতে ধমনীতে রক্তস্রোতঃ প্রবাহিত হইতে লাগিল। সক্রোধে রঘুনাথ বলিল, “শোন তারা! তোমার অনেক কথা আমি সহ্য করেছি, কিন্তু আর করব না। আজ রাত্রে তোমাকে আমার উপভোগ্য হতেই হবে—আজকেই আমাদের বাল্যকালের বিবাদভঞ্জন হবে—আজই আমি তোমার আন্তরিক ঘৃণার পরিশোধ নেব।”

তারার দেহের সমস্ত শোণিত জল হইয়া আসিতে লাগিল। মৃত্যুর ভীষণ ছায়া যেন তাহার সম্মুখে নৃত্য করিতে লাগিল। যদি রঘুনাথ ব্যস্ত বা কোন বিষয়ে চিন্তিত থাকিত, তাহা হইলে তারা কতকটা নির্ভয়ে সুসময়ের অপেক্ষা করিতে পারিত; কিন্তু তাহার নিশ্চিন্ত, ভাবনাবিহীন, হাসিমাখা মুখ দেখিয়া ও এইরূপ মিষ্টলাপ শুনিয়া তারার সকল আশাভরসা উন্মুলিত হইয়াছিল।

তারা জিজ্ঞাসা করিল, “রঘু! তোমাকেও একদিন মরতে হবে। সে কথা কি একবারও ভেবে দেখ না?”

রঘু। না।

তারা। কি? তুমি মরবে না? তোমার ইহজন্মে মৃত্যু হবে না?

রঘু। না—আমার কখনও মৃত্যু হবে না। আমি মহাদেবের মত অমর হ’য়ে চিরকাল বেঁচে থাকব। তোমার তাতে কিছু আপত্তি আছে?

তারা। আচ্ছা, সব বুঝলেম। কেন তুমি আমার সর্ব্বনাশ করতে উদ্যত হয়েছ?

রঘু। তোমাকে বড় ভালবাসি ব’লে।

তারা। ভালবাসা কি এর নাম—এই রকম করে বন্দিনী ক’রে রেখে, অবলা অসহায়া অনাথিনীর সর্ব্বনাশ সাধন করা কি ভালবাসার লক্ষণ?

রঘু। আমি তোমায় ভালবাসি কি না, তার প্রমাণ দিচ্ছি। যে কথা বলি মন দিয়ে শোন।

তারা। আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না। আমায় বাড়ী পাঠিয়ে দাও। আমার বৃদ্ধ পিতার মৃত্যু শয্যাপার্শ্বে একবার আমায় যেতে দাও।

রঘু। আমি তোমাকে আজ যথারীতি বিবাহ ক’রে আমার ভালবাসার পরিচয় দিতে চাই। আজ সন্ধ্যার সময় তুমি আমার পরিণীতা বনিতা হবে।

চক্ষু বড় করিয়া দৃঢ়তাপরিপূর্ণস্বরে তারা বলিল, “কখনই না—কখনই না।”

রঘু। আর আমি বলছি, নিশ্চয়—নিশ্চয়! অদ্য রাত্রে আমায় স্বামী ব’লে তোমাকে স্বীকার করতেই হবে। চন্দ্র সূর্য্য মিথ্যা হবে, তথাপি আমার কথা বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে না।

তারা। ততক্ষণ পর্যন্ত আমায় জীবিত দেখতে পাবে কি না, সন্দেহ। তোমার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার যদি আর কোন উপায় না পাই, আত্মহত্যা করব।

রঘু। যাতে আত্মহত্যা না করতে পার, সে বিষয়ে আমার বিশেষ দৃষ্টি থাকবে। তার উপায় আমি করছি, তার পরে যখন তুমি আমার পত্নী হবে, তখন তোমার রক্ষণাবেক্ষণের ভার লওয়ায় আমার সম্পূর্ণ অধিকার থাকবে।

তারা। রঘুনাথ! আমি এখনও বলছি, তোমার পাপ-অভিসন্ধি কখনই পূর্ণ হবে না—ভগবান্ আমায় রক্ষা করবেন

রঘু। তোমার ভগবানে আমি বড় বিশ্বাস করি না। মানুষ ত কোন্ ছার! এখানে এসে তোমার সে ভগবাও তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না। এখানে যত লোক দেখছ, সকলেই আমার বিশ আমার কথায় সকলেই ওঠে-বসে। আমি এখানে রাজা, যা’ মনে করব, তাই করতে পারব।

তারা। কিন্তু তুমি যা স্বপ্নে ভাব নাই, এমন উপায়ে আমার জীবন রক্ষা হতে পারে, আর সেই সঙ্গে তোমারও সর্বনাশ হতে পারে।

রঘু। তারা! যার আশায় এখনও এত সাহস ক’রে কথা কইছ, সেই প্রতাপ আর জীবিত নাই। তোমার সকল আশা, সেই প্রতাপের ঘৃণিত দেহের সঙ্গে অবসান হয়েছে।

বাস্তবিক তারার চক্ষে এখন চারিদিক্ অন্ধকার বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। নিঃসহায়া অবলাবালার সহায়তা করে বা তাহাকে উৎসাহ দেয়, এমন লোক আর কেউ নাই। শমন যেন ভীষণ মুখব্যাদন করিয়া তারাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে! এ অবস্থায় তারা কাহার আশায় জীবিত থাকিবে? কে এ বিপদে অভাগিনীকে রক্ষা করিবে; কে এ ভয়ানক পাপাচারী, নরহত্যাকারী রাক্ষসগণের হস্ত হইতে এই বিপদগ্রস্তা, কাতরা, ব্যাকুলা রাজপুতবালাকে উদ্ধার করিবে? রঘুনাথের মুখ দেখিয়া ও তাহার কথাবার্তা শুনিয়া এখন তাহার মনে এই সকল কথা উদয় হইতে লাগিল। এত বিপদেও তারা স্থিরপ্রতিজ্ঞ। তারা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, যদি মৃত্যু হয়, তাহা হইলেও সে রঘুনাথের পত্নী হইবেনা।

রঘুনাথ বলিল, “তারা! এখন বিবেচনা করে কাজ কর। ভালমানুষী করবার এখনও সময় আছে! এখনও তোমার প্রতি আমি বল প্রকাশ করি নি।”

তারা কোন উত্তর দিবার পূর্ব্বেই দূরে দস্যুগণের বংশীধ্বনি শ্রুত হইল। রঘুনাথ ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ বলিল, “বাহিরে আমায় কে ডাক্‌ছে। তোমায় ভাল করে বুঝাতে সময় পেলেম না—আমি চল্লাম। যত শীঘ্র পারি, ফিরে আছি। ইতিমধ্যে তুমি মন স্থির কর, যাতে বিনা বলপ্রকাশে আমার প্রস্তাবে সম্মত হ’তে পার, তজ্জন্যও প্রস্তুত হও।”

অনেকক্ষণ ধরিয়া তারা অনেক কথা ভাবিল। যাহার উৎসাহবচনে উৎসাহিত হইয়া সে আশায় বুক বাঁধিয়াছিল, সেই প্রতাপসিংহ রঘুনাথের ভীষণ চক্রান্তে অকালে কালকবলিত হইলেন। এখন কে আর তাহাকে এ বিপদে উদ্ধার করিবে? কে তাহাকে রঘুনাথের কঠোর হস্ত হইতে রক্ষা করিবে?

তারা বসনে বদনাবৃত করিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিল। একবার তাহার পালক-পিতা অজয়সিংহের দুর্দ্দশার কথা তাহার মনে উদিত হইল। তাঁহার সেই রোগশয্যা, সেই আসন্ন-মৃত্যুকাল সমস্তই মনে পড়িল। আর মনে পড়িল, পূর্ব্বেকার সুখের দিন, বর্তমান দুঃখের দশা! কল্পনাপথে বাল্যকালের সকল কথাই একে একে অন্তরে জাগিতে লাগিল। শৈশবে সেই রঘুনাথের আদর, সেই একসঙ্গে খেলা-ধূলা, একসঙ্গে দৌড়াদৌড়ি, একসঙ্গে খেলাঘরে কত পরামর্শ—সকলই স্মৃতিপথে দেখা দিল। তার পর কি ভাবিয়া তারা উঠিয়া দাঁড়াইল। বক্ষঃস্থলের আবরণ উন্মোচন করিয়া একখানি সুতীক্ষ্ণ ছুরিকা টানিয়া বাহির করিল, আত্মহত্যায় প্রস্তুত হইল। আপনা-আপনি বলিল, “আর কেন, এই ত সময়! আর কার আশায় জীবন রক্ষা করব? রঘুর বিবাহিত পত্নী হওয়া অপেক্ষা আমার মরণই ভাল।” তারা নিজ বক্ষঃ লক্ষ্য করিয়া দৃঢ়মুষ্টিতে তাহা ধারণ করিল। তৎক্ষণাৎ সেই শানিত ছুরিকা ঊর্দ্ধে উত্থিত হইল।

এমন সময় কে পশ্চাদ্দিক হইতে বলিল, “থামো, আত্মহত্যা ক’রো না।”

চমকিত হইয়া তারা পশ্চাদ্দিকে ফিরিয়া চাহিল। ঠিক পশ্চাতে শিবিরের যবনিকা ঈষৎ অপসাহিত করিয়া কে একজন লোক তাহার দিকে স্থিরলক্ষ্য করিয়া রহিয়াছে।

তারা জিজ্ঞাসা করিল, “কে আপনি! কেন আমায় এমন বাধা দিলেন?”

সে লোকটি বাহির হইতে গম্ভীরস্বরে বলিলেন, “তুমি বড় চপলা বালিকা! এত ভীত হচ্ছ কেন?

তোমার কোন ভয় নাই—রঘুনাথ তোমার একগাছি চুলও ছুঁতে পারবে না।”

এই পৰ্য্যন্ত বলিয়াই সে লোকটি তদ্দণ্ডেই অন্তর্হিত হইল! কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ়া হইয়া তারা সেইখানে বসিয়া পড়িল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *