দ্বিতীয় খণ্ড – পুণ্যের জয় হইল

দ্বিতীয় খণ্ড – পুণ্যের জয় হইল

প্রথম পরিচ্ছেদ – তারার সহায়

অভাগিনী তারা সেই বিপদ-সঙ্কুল অবস্থায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্যা হইয়া অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিল; কিন্তু উপায় স্থির করিতে পারিল না। সে যতবার নিরুৎসাহ হইয়াছিল, যতবার মরিবার চেষ্টা করিয়াছিল, ততবারই কাহারও-না-কাহারও উত্তেজনায় তাহার যেন কতকটা সাহস হইয়াছিল। তারা আপনা-আপনি বলিল, “কে আমায় এ-বিপদে উদ্ধার করিবে? কেন এরা আমায় বাধা দেয়? কার আশায়, কি সাহসে বুক বাঁধিব?”

পশ্চাদ্দিক হইতে কে আবার বলিল, “কেন তুমি ভয় পাচ্ছ? তোমায় রক্ষা করবার জন্য চারিদিকে লোক রয়েছে! তোমার অনিষ্ট করে, কার সাধ্য?”

তারা পশ্চাদ্দিকে চাহিয়া দেখিল, সেই পূর্ব্বেকার মত শিবিরের পরদা একটু সরাইয়া সে লোক তাঁহাকে সাহস প্রদান করিতেছে।

তারা বলিল, “আপনি যেই হ’ন, জানেন না, আমি কত বড় বিপদে পড়েছি। এ রকম নিঃসহায় অবস্থায় রঘুর হাত থেকে কে আমায় উদ্ধার করবে? এ বিপদে কে আমার সহায় হবে?”

উত্তর। তোমার এখন কোন বিপদ ঘটে নি।

তারা। আপনি কে?

উত্তর। আমি একজন তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

তারা। আপনি আমার সহায়তা করতে পারবেন? আমায় ঐ বিপদ্ হ’তে রক্ষা করতে পারবেন?

উত্তর। নিশ্চয়ই পারব; নইলে আমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? তোমার কোন ভয় নাই, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। তুমি তোমার বিপদ্ যত নিকটবর্ত্তী ব’লে মনে করছ, রঘুনাথের বিপদ্ তার চেয়ে এগিয়ে এসেছে।

তারা। দস্যুদলের মধ্যে প্রতাপসিংহ-ই আমার একমাত্র আশার স্থল ছিলেন। তিনি যখন রঘুনাথের চক্রান্তে প’ড়ে অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হ’লেন, তখন আর কার ভরসায়

উত্তর। তাতে আর কি হয়েছে?

তারা। তাঁরই ভালবাসায় আমি এতক্ষণ পর্য্যন্ত নিরাশ হই নি।

উত্তর। তিনি ছাড়া আরও লোক আছেন।

তারা। কে?

উত্তর। পরে জানতে পারবে। এখন তুমি সাবধান হও। এখনই রঘুনাথ ফিরে আসবে। তুমি যে ভয় পেয়েছ, সে ভাব তাঁকে কিছু দেখিও না। আর রঘুকে ভয় করবারও কোন কারণ নাই।

তারা। আশ্চর্য্য কথা!

উত্তর। কিছুই আশ্চর্য্য নয়। যখন সময় হবে, তখনই গুপ্ত-রহস্য বুঝতে পারবে।

তারা। যদি রঘুনাথ আমার উপর অত্যাচার করে? যদি আমায় তার সঙ্গে যেতে বলে?

উত্তর। যেতে বলে, যাবে। কোন ভয় নাই; রঘু তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

তারা। তবে আপনি কখনই আমার হিতৈষী নন্, নিশ্চয়ই রঘুর চর।

উত্তর। না, তুমি ভুল বুঝেছ। আমি তোমার হিতকারী। তুমি আমার কথায় বিশ্বাস কর। রঘুনাথের চেয়েও বলবান্ অনেক লোক এই দলে আছেন। প্রতি মুহূর্ত্তেই তোমার উপরে তাঁরা নজর রাখছেন। রঘুনাথ যা’ ব’লে, তাই কর। ওর দিন ফুরিয়ে এসেছে। ঐ রঘু আসছে—

যেমন তারা অন্যদিকে মুখ ফিরাইল, ঈষদুন্মুক্ত যবনিকান্তরাল হইতেও সে মূৰ্ত্তি অন্তর্হিত হইল। তারা পুনরায় সেদিকে ফিরিয়া আর তাঁহাকে দেখিতে পাইল না।

পরক্ষণে রঘুনাথ আসিয়াই বলিল, “এস তারা, আমাদের বিবাহের সব প্রস্তুত। যাবে, না জোর ক’রে টেনে নিয়ে যাব?”

তারা বলিল, “না, আমি যাচ্ছি, তুমি আমার গায়ে হাত দিও না। “

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বিবাহ-বিভ্ৰাট

রঘুনাথ বিস্মিত হইল। সে মনে করিয়াছিল, তারা সহজে কখনই তাহার সহিত যাইতে সম্মত হইবে না। সে কত অনুনয়-বিনয়, কত কাকুতি-মিনতি, কত কান্নাকাটি করিবে। রঘুনাথের প্রস্তাবমা — এক কথায় সে, সে তাহার সঙ্গে যাইতে উদ্যত হইবে, এ কথা রঘুনাথের পক্ষে কল্পনার অতীত। রঘুনাথ বলিল, “এতক্ষণে তুমি তোমার যথার্থ অবস্থা বুঝতে পেরেছ—এতক্ষণে তোমার জ্ঞান হয়েছে, না তারা?“

তারা। আমি এখন তোমার হাতে পড়েছি, কপালে যা আছে, তাই হবে। ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে কি করব?

রঘুনাথ। এমন কথা বলো না, তারা! বাস্তবিক আমি তোমাকে বড় ভালোবাসি।

ঘৃণাব্যঞ্জকস্বরে তারা বলিল, “তুমি আমায় ভালবাস? আমি তোমায় ঘৃণা করি।”

রঘুনাথ। তারা! অকারণ আমায় গাল দিচ্ছ। সত্য বলছি, আমার সঙ্গে তোমার বিবাহ হ’লে তুমি সুখিনী হবে। তুমি দেখতে পাবে, আমি তোমার উপযুক্ত স্বামী।

তারা আর সহ্য করিতে পারিল না। ক্রোধ সম্বরণ করিতে না পারিয়া কঠোর স্বরে বলিল, তোমার সঙ্গে বিবাহ হ’লে আমার সুখ হবে? ছি! ছি! ধিক্-ধিক্—এ কথা আর দ্বিতীয়বার মুখে উচ্চারণ ক’রো না। তোমার দেহ রাশি রাশি পাপে পূর্ণ, যদি ছোরাছুরি, গোলাগুলি, বন্দুক-ধনুক সব ছেড়ে দিয়ে নৃশংসতা ভুলে যেতে পার, অন্তরের অন্তস্থলের কলঙ্ক কালিমা নিজের রক্তে যদি ধুয়ে ফেলতে পার, তবেই তুমি আমার পতি হ’বার যোগ্য ব’লে পরিচয় দিতে পারবে; নইলে যা’ বছ সবই মিথ্যা।”

রঘুনাথ কিঞ্চিৎ কুপিত হইয়া উত্তর করিল, “না তারা! তুমি বড় বাড়িয়ে তুলে। তোমার এ সব বিষ-মাখান কথা আমার হাড়ে হাড়ে বিঁধে যাচ্ছে। মিছামিছি তুমি আমায় রাগিয়ে দিচ্ছ। তুমি এখনও বুঝছ না, যাক তুমি এইসব কথায় গাল দিচ্ছ, যার উপর তোমার এত ঘৃণা, আর আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে তার যথারীতি শাস্ত্রসম্মত পরিণীতা ভার্য্যা হ’তে হবে। এখন ভাল চাও ত, বিনাবাক্যব্যয়ে আমার সঙ্গে চলে এস।”

তারা তাহাই করিল। অসীমসাহসে সে তাহার বুক বাঁধিয়াছে, সর্ব্বশেষে সে কি করিবে, তাহা স্থির করিয়াছে। আর তাহার মনে ভয়-ভাবনা বা কোন কামনা নাই। সে আপনার পথ আপনি ঠিক করিয়া রাখিয়াছে। অনেকবার তারা শুনিয়াছে, শুনিয়া বুঝিয়াছে, দস্যুদলের মধ্যে তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য এক বলবান্ সহায় আছে। বারে বারে সে নিরাশায় উৎসাহিত হইয়াছে। এবার সে শেষ মুহূৰ্ত্ত পর্যন্ত দেখিবার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ। যদি বলবানের সহায়তার বিপদে নিষ্কৃতি প্রাপ্ত না হয়, তাহা হইলে মরিতে সে বিন্দুমাত্র ভীত বা সঙ্কুচিত হইবে না—ইহাই তাহার কল্পনা! তবে আর কিসের ভয়! রঘুনাথের পরিণীতা ভার্য্যা হওয়া অপেক্ষা সে সহজে এবং স্বচ্ছন্দে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে প্রস্তুত।

সেই ক্ষুদ্র তাঁবুর ভিতর হইতে রঘুনাথের সহিত তারা বহির্গত হইল। কিছুদূরে একটি বৃহৎ বৃক্ষতলে যে কয়েকজন লোক দণ্ডায়মান ছিল, তাহাদের দিকে তাহার চক্ষু পড়িল। বিবাহ উপযোগী উপকরণাদি তথায় সজ্জিত। পুরোহিতবেশী একজন লোকও একটি আসনে উপবিষ্ট।

তারা এই সকল দেখিতে দেখিতে ধীরে ধীরে রঘুনাথের সঙ্গে সেই বৃক্ষতলে উপস্থিত হইবামাত্র দস্যুদলের মধ্যে একজন মুখভঙ্গী ও হস্তের ইঙ্গিত করিয়া তারাকে জানাইল, “কোন ভয় নাই।”

রঘুনাথ তারার হস্তধারণ করিল। অবলা রাজপুতবালার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইল। তারপর উভয়ে পুরোহিতের সমীপস্থ হইবামাত্র তিনি তাহাদিগকে ভিন্ন আসনে বসাইয়া একেবারে মন্ত্র উচ্চারণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

সহসা একজন লোক পুরোহিতের সম্মুখীন হইয়া বলিলেন, “খবরদার! এ বিবাহ কখনই হ’তে পারে না।”

আগন্তুকের মুখপানে চাহিয়াই রঘুনাথের সমস্ত রক্ত জল হইয়া গেল। কারণ এই বিবাহে বাধা দিবার জন্য যে সাহসী আগন্তুক তাহার সম্মুখে বীরদর্পে অকুতোভয়ে দণ্ডায়মান, তিনি আর কেহই নহেন—সেই প্রতাপ। যে প্রতাপ রঘুনাথের ষড়যন্ত্রে প্রাণত্যাগ করিয়াছে, সে প্রতাপ কোথা হইতে কেমন করিয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল? প্রতাপের প্রেতাত্মা কি প্রতিশোধ লইতে আসিয়াছে? কিন্তু সম্মুখে প্রতাপের হস্তে উদ্যত পিস্তল দেখিয়া রঘুনাথের সে ভ্রম তৎক্ষণাৎ দূর হইল।

পুরোহিতবেশী সেই লোকটী উদ্ধতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি? এ শুভ কার্য্যে কেন বাধা দাও?”

প্রতাপ সেই পুরোহিতের বক্ষঃস্থল লক্ষ্য করিয়া একটী পিস্তল উদ্যত করিলেন। সদম্ভে তিনি উত্তর করিলেন, “আমি যেই হই না কেন, তোমার কোন দরকার নাই। ফের যদি এক পা এগোবে, কি একটি কথা কইবে, তা হ’লেই জানবে তোমার আয়ু শেষ হয়েছে।”

রঘুনাথ সেই সময় অঙ্গরাখার ভিতর হইতে পিস্তল বাহির করিবার উদ্যোগ করিতেছিল, এমন সময়ে সে দেখিল, দুস্যবেশী অন্য একজন তাহার মুখ লক্ষ্য করিয়া একটি পিস্তল খাড়া করিয়া রহিয়াছে। রঘুনাথ অবাক্ হইয়া গেল। বিস্মিত ও চকিত হইয়া চাহিয়া দেখিল, যাহাদিগকে স্বপ্নেও শত্রু বলিয়া কল্পনা করে নাই, সেই সকল অনুচর প্রতাপ আসিয়া দাঁড়াইবামাত্র বিরুদ্ধভাব অবলম্বন করিয়াছে। অনেকেরই হাতে এক-একটি পিস্তল। অবশ্যই রঘুনাথ বুঝিল, “জালে মাছি পড়িয়াছে।” সে বুঝিল, যাহাদিগকে সে আপন অনুচর বলিয়া ভাবিত, তাহারা প্রায় সকলেই এক মন্ত্রে দীক্ষিত, এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এত দিনে রঘুনাথের আশা, ভরসা, উৎসাহ সকলই গেল। তাহার উদ্যম ভঙ্গ হইল। প্রাণে আশায় তথাপি একবার তাহার শেষ চেষ্টা করিবার ইচ্ছা হইল। একজন দস্যু বলিয়া উঠিল, “খবরদার! এক চুল, ন’ড়ো না।”

রঘুনাথ তাহার দিকে চাহিয়া রহিল, সে যাহাকে বিশ্বাস করিয়া প্রতাপকে হত্যা করিবার ভার দিয়াছিল, সে সেই ব্যক্তি। তাহাকে সেইরূপ পিস্তল উদ্যত করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াই রঘুনাথ বুঝিতে পারিল, প্রতাপ নিহত হয় নাই, এই প্রতাপই—সেই প্ৰতাপ।

প্রতাপ বলিলেন, “রঘু সর্দ্দার? আর কেন বৃথা চেষ্টা করছ? তোমার দিন ফুরিয়ে এসেছে, তা’ কি বুঝতে পারছ না?

দেখিতে দেখিতে কোথা হইতে পঁচিশ-ত্রিশজন সশস্ত্র প্রহরী আসিয়া উপস্থিত হইল। নিরাশ হইয়া ভগ্নকণ্ঠে রঘুনাথ জিজ্ঞাসা করিল, “এর মানে কি? তোমরা সকলেই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছ? তোমরা সকলেই আমার শত্রু?’

প্রতাপ রঘুর কাতরোক্তিপূর্ণ প্রশ্নের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া কহিলেন, “যে এক চুল নড়বে তার প্রাণ যাবে। যে সহজে আত্মসমর্পণ করবে, তারই মঙ্গল। যে বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করবে, তারই জীবনলীলা সাঙ্গ হবে। খবরদার! সাবধান! যার কাছে যে অস্ত্র আছে, সব মাটিতে রেখে আমার সামনে দাঁড়াও।”

প্রতাপের ইঙ্গিতে প্রহরিগণ একে একে দস্যুদিগের হাতে হাতকড়া দিতে লাগিল।

রঘুনাথ মরিয়ার ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “কি বিনা বাধায়, বিনা চেষ্টায়, বিনা বল প্রকাশে মেষপালের ন্যায় আমরা ধরা দেব? না—তা’ কখনই হবে না।”

প্রতাপ বলিলেন, “পরের জন্য তোমার আর ভাবতে হবে না। তোমার নিজের চরকায় তেল দাও। তোমার কি হবে, তাই ভাব। নিজেকে কেমন করে বাঁচাবে, এখন তারই উপায় দেখ।”

বিনা বাধায় সকলে ধরা দিল। সকলের হাতেই হাতকড়ি পড়িল, কেহ একটিও কথা কহিতে সাহস করিল না। প্রতাপ তখন রঘুনাথের সম্মুখীন হইয়া বলিলেন, “রঘুনাথ! তুমি অনেকবার চেষ্টা ক’রে আমায় খুঁজে বার করতে পার নি, তাই আমি নিজে তোমার কাছে এসেছি।”

রঘুনাথ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি?”

প্রতাপ। গোয়েন্দা-সর্দ্দার রায়মল্ল বা রায়মল্ল সাহেব, যা’ বললে তুমি সন্তুষ্ট হও।

রায়মল্ল। নাম শুনিয়া দস্যুগণ ভয়ে বিহ্বল হইয়া উঠিল।

রায়মল্ল গোয়েন্দা অনেক সময় অনেক কাজ করিয়াছেন, অনেক আশ্চর্য্য ঘটনা তাঁহার দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছে। কোম্পানী বাহাদুর তন্নিবন্ধন তাঁহার সাহসিকতার শত শত প্রশংসা করিয়া থাকেন, আজ রায়মল্ল গোয়েন্দা যে কাৰ্য্য সম্পন্ন করিলেন, তাহা অন্য লোকের স্বপ্নের অগোচর কল্পনার সীমা বহির্ভূত। একজন নয়, দুইজন নয়, একেবারে দলকে দল বন্দী করা একটা কম আশ্চর্যের বিষয় নয়, কম শ্লাঘা বা কম বাহাদুরী নয়! যাহারা মৃত্যুর ভয় করে না, কথায় কথায় মানুষ খুন করা যাহাদের অভ্যাস, শত শত বিপত্তি যাহারা অবাধে অতিক্রম করে, সহস্র-প্রহরী পরিবেষ্টিত নগরের মধ্য হইতে যাহারা অবাধে ধনরত্ন লুণ্ঠন করে, মরণকে অম্লানবদনে যাহারা আলিঙ্গন করে, হাসতে হাসতে যাহারা যমরাজের সম্মুখীন হয়, একসঙ্গে তাহাদের সকলকে তর্জ্জনী হেলনে অবহেলায় বন্দী করা রায়মল্ল গোয়েন্দা ব্যতীত আর কাহার ক্ষমতা?

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – সিংহ-কবলে

এতক্ষণে দুই-একটি পূর্ব্ব ঘটনা বিবৃত করিবার সময় আসিয়াছে। রায়মল্ল গোয়েন্দা প্রায় দুই বৎসর ধরিয়া রঘু ডাকাতের দলকে-দল ধরিয়া দিবার জন্য চেষ্টা করিতেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি স্বকার্য্যসাধন করিতেছিলেন। তাঁহার পূর্ব্বে অন্যান্য অনেক সুদক্ষ পুলিশ-কৰ্ম্মচারী এ কার্য্যে নিয়োজিত হইয়াছিলেন; কিন্তু কেহই কৃতকাৰ্য্য হন্ নাই। এমন কি তাঁহাদের মধ্যে অনেককে আর জীবিত ফিরিয়া আসিতে দেখা যায় নাই। সাধারণের বিশ্বাস, তাঁহারা দস্যুগণের হস্তে নিহত হইয়াছেন।

রঘু ডাকাতের দলে প্রায় তিন সহস্র লোক। সে তাহাদিগের সদর। রঘু ডাকাতের দল নানাদিকে নানা কাৰ্য্যে ব্যাপৃত হইত। কোন সময়েই এক স্থানে সমস্ত লোক থাকিত না। ভিন্ন ভিন্ন কাৰ্য্যে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রেরিত হইয়া সমস্ত ভারতবর্ষ ছাইয়া থাকিত।

রায়মল্ল গোয়েন্দা দুই বৎসর ধরিয়া এই দস্যুদলের মূলোচ্ছেদ করিবার জন্য নানাবিধ উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন দোষে দোষী সাব্যস্ত করাইয়া তিনি দিনে দিনে রঘুনাথের দলের লোকসংখ্যা কমাইতেছিলেন। রঘুনাথ জানিত, তাহার দল সমস্ত ভারতবর্ষ ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে, আবশ্যক মত তাহাদের সাহায্য পাওয়া যাইবে; তবে এক-একটি লুণ্ঠনকার্য্যে এক-একটি দল নিযুক্ত হইয়া আর ফিরে আসে না কেন, এ সন্দেহও তাহার মনে মধ্যে মধ্যে উদিত হইত। কখনও রঘুনাথ ভাবিত, তাহারা আরও কোন নূতন কার্য্যে দূরদেশে গমন করিয়াছে, তাই ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব হইতেছে। কিন্তু ইহাও রায়মল্ল গোয়েন্দার ছল। রায়মল্ল প্রতাপের বেশে দস্যুদলের মধ্যে মিশিয়াছিলেন, সুতরাং কোন সংবাদই তাঁহার অগোচর থাকিত না কোথায় কখন্ কোন্ দল লুণ্ঠনকার্য্যে অগ্রসর হইতেছে, তিনি সে সকল সংবাদই রাখিতেন এবং পূৰ্ব্ব হইতেই তদপেক্ষা অধিক লোক সংগ্রহ করিয়া, তাহাদিগকে বন্দী করিয়া প্রমাণ-প্রয়োগ সংগ্রহে রাজদ্বারে দন্ডিত করাইতেন। অতর্কিত অবস্থা—এমন কি কখন কখন পথিমধ্যে নিদ্রিত অবস্থায় এক-একটি ছোট দস্যুদল ধৃত হইত; এইরূপে দিন দিন রঘুনাথের দলের সংখ্যা কমিয়া আসিতেছিল, তাহা রঘুনাথ অনুভব করিতে পারে নাই।

রায়মল্ল সাহেব দস্যুগণের ন্যায় কর্কশস্বরে কথা কহিতে পারিতেন। তাহাদের চলতি কথা, গ্ৰাম্য শব্দের ব্যবহার, ইঙ্গিত, গুপ্তকথা অনেক প্রকার গুপ্ত সঙ্কেত সকলই জানিতেন। এই কারণেই অনেকের সন্দেহ হইতে তিনি নির্বিঘ্নে পরিত্রাণ পাইতেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন দস্যুগণও তাঁহাকে সহজে চিনিতে পারিত না। একে একে তিনি রঘুনাথের দল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া নিজের লোক দ্বারা তাহাদিগের স্থান অধিকৃত করিতেছিলেন। তিনি সহসা কোন কাজ করেন নাই। চারিদিকের আটঘাট বাঁধিয়া, বেশ হিসাবে দোরস্ত রাখিয়া কৰ্ম্ম সম্পন্ন করিয়াছেন। ইহাতে বিঘ্ন-বিপত্তি হইবার, কত বিপদ-আপদ ঘটিবার, কতবার প্রাণ বিনষ্ট হইবার আশঙ্কা তাঁহাকে অতিক্রম করিতে হইয়াছিল।

এত বিপৎসঙ্কুল অবস্থায় পড়িয়াও রায়মল্ল সাহেব তারার কথা মুহুর্ত্তের জন্যও বিস্মৃত হন নাই। তাঁহার লোকজনের উপরে এই আজ্ঞা ছিল যে, যদি তারাকে সহসা কোন বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিতে কাহারও প্রাণ যায়, তথাপি প্রাণের আশা ছাড়িয়াও সে তাহা সম্পন্ন করিবে। মনে করিলে তিনি তারাকে যখন ইচ্ছা করিতেন, তখনই বলপ্রকাশে উদ্ধার করিতে পারিতেন; কিন্তু আত্মপ্রকাশ করিলে পাছে এতদিনের চেষ্টা বিফল হয়, পাছে রঘু ডাকাত পলায়ন করিতে সমর্থ হয়, এই ভয়ে তিনি যতক্ষণ পর্য্যন্ত না সমস্ত আয়োজন পূর্ণ করিতে পারিয়াছিলেন, ততক্ষণ বাধ্য হইয়া তারাকে দস্যু-কবল হইতে উদ্ধার করিতে চেষ্টা করেন নাই। বিশেষ প্রয়োজন হইলে তারার রক্ষার্থ নিশ্চয়ই তিনি নিশ্চেষ্ট থাকিতেন না।

পূর্ব্ব পরিচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনায় স্পষ্টই বলা হইয়াছে, রায়মল্ল গোয়েন্দার নাম উচ্চারিত হইবামাত্রই দস্যুগণ চমকিত বিস্মিত ও চকিত হইয়াছিল; তাহাদের কেশরাশি কণ্টকিত হইয়া ভয়ে সৰ্ব্বাঙ্গ কম্পান্বিত হইয়াছিল। সেই একজনের নামেই তাহাদের উষ্ণ শোণিত শীতল হইয়া গিয়াছিল। সদার রঘুনাথের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়াছিল। তাহার কথা কহিবার সামর্থ্য ছিল না। অতিকষ্টে ক্ষীণস্বরে সে বলিল, “আমি সব বুঝেও কানা হইয়াছিলাম।”

তারা আশ্চর্যান্বিত হইয়া এই অপূর্ব্ব ব্যাপার সন্দর্শন করিতেছিল। চারিদিকে এত লোক, সশস্ত্র প্রহরিবর্গ বেষ্টিত হস্তবদ্ধ দস্যুগণ, অথচ সেদিকে তাহার দৃষ্টি নাই। সে নির্নিমেষ নয়নে রায়মল্ল সাহেবের সেই বীরবপু প্রাণ-মন ভরিয়া দেখিতেছিল। মহা-সমর-বিজয়ী সেনাপতির ন্যায়-মহোল্লাসে উল্লসিত, অথচ চিন্তাযুক্ত ও ভবিষ্যৎ ভাবনায় চঞ্চল সেই নয়নদ্বয়ের দিকেই তাহার স্থির দৃষ্টি পড়িয়াছিল।

তারা ভাবিতেছিল, “এত গুণ না থাকিলে ভারতবর্ষের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কর্নে রায়মল্ল সাহেবের নাম প্রতিধ্বনিত হইবে কেন? এত সাহস, এত বুদ্ধি না থাকিলে এ গুরুতর কার্যভার তাঁহার উপরে পড়িবে কেন? বাস্তবিক বিনা রক্তপাতে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এই দস্যুগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা কম সাহস ও বুদ্ধির পরিচয় নয়।”

তারার দিকে একবার দৃষ্টি পড়াতেই রায়মল্ল সাহেব তাহার মনের ভাব বুতে পারিলেন;বুঝিয়া একটু হাসিলেন, তারা লজ্জিতা হইল।

রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “রঘু! এখন তোমার কি মনে হয়? কোম্পানী বাহাদুরের হাতে পড়লেই ত তোমার যাবজ্জীবন কারাবাস দন্ড হবে—”

কথায় বাধা দিয়া ক্রোধোন্মাদে রঘুনাথ বলিল, “রায়মল্ল গোয়েন্দা! কি আর বলব, রাগে আমার গা কাঁপছে; তোমার সর্ব্বনাশ হোক্!”

হাসিয়া রায়মল্ল কহিলেন, “রঘুনাথ! আমার সর্বনাশ যখন হবার তখন হবে, তখন তোমায় সাহায্যের জন্য ডাকতে যাব না; কিন্তু তুমি যার যোগ্য নও, যে অনুগ্রহ তোমার উপর করা যায় না, আমি আজ তাই করতে প্রস্তুত। তুমি আমার দয়া পেতে ইচ্ছা কর?”

রঘুনাথ। তোমার আর এত অধিক অনুগ্রহ দেখাতে হবে না। আজই না হয় বুদ্ধির দোষে তোমার হাতে পড়েছি। চিরদিন কখন এ রকম যাবে না। আমারও সময় আসবে, তখন দেখে নেবো, তুমি কত বড় গোয়েন্দা!

রায়মল্ল এ কথায় কর্নপাত না করিয়া হাসিমুখে অথচ অল্প গাম্ভীর্য্যের সহিত উত্তর করিলেন, “আমি তোমার উপকার করতে পারি, এ যাত্রা তোমায় বাঁচিয়ে দিতে পারি। মনে পড়ে, গাছের গুঁড়িতে ছোরা ছুড়ে কতকগুলো অকৃতকর্ম্মা লোকের কাছে এই আত্মশ্লাঘা করেছিলে যে, যদি আমার দেখা পাও, তা’ হ’লে আমার সেই দশা করবে—আমাকেও সেইরকম ক’রে হত্যা করবে। কৈ, আজ আমি ত একক তোমাদের সম্মুখে উপস্থিত। তোমার সে আত্মশ্লাঘা মনে পড়ে না?”

রঘু। তা’ হ’লে তুমি তখন ছদ্মবেশে আমাদের দলে মিশেছিলে, কেমন?

রায়মল্ল! হাঁ।

রঘু। তখন তুমি লোকটা কে, একবার অঙ্কুশেও জানতে দাও নি কেন? তা’ হলেই আমি তোমার কি করতেম, তা’ দেখতে পেতে।

রায়মল্ল। তখনও দেখা দেবার সময় হয় নি, তাই জানতে দিই নাই।

রঘু। তার মানে কি?

রায়মল্ল। কেন জান, তোমার সেদিনকার আত্মশ্লাঘা দেখে আমার মনে হয়েছিল, যেদিন সুযোগ হবে, সেইদিন তোমার দর্প চূর্ণ করব। আজ এতদিন পরে আমার মনের আশা মিটেছে। আমি যা’ বলি, তা’ করবে?

রঘু। তোমার কোন কথাই আমি আর শুতে চাই না।

রায়মল্ল। আমি যদি তোমার পালাবার উপায় করে দিই, তা’ হ’লে তুমি কি বল?

রঘুনাথ। পালাবার উপায় তুমি ক’রে দেবে? হাঁ ধিক্! মিথ্যাবাদী—প্রবঞ্চক!

রায়মল্ল। আমি মিথ্যা বলছি না। যদি তুমি আমার সঙ্গে পেরে উঠ, তা’ হ’লে তোমায় ছেড়ে দেবো।

রঘুনাথ। ছেড়ে দেবে? আশ্চৰ্য্য কথা!

রায়মল্ল সাহেব সদম্ভে বলিলেন, “হাঁ, ছেড়ে দেবো। তুমি আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছ?”

রঘুনাথ। যদি তোমায় খুন করে ফেলি, তা’ হ’লে যে আমার ফাঁসী হবে।

রায়মল্ল। আমি বলছি তোমার কিছু হবে না; বরং তুমি পালাতে পারবে।

রঘুনাথ। তোমার এই সব লোকজন আমায় সহজে ছাড়বে কেন?

রায়মল্ল। ওরা আমার হুকুম শুনতে বাধ্য। আমি যা’ বল্ব, তাই করবে। আমার আদেশ থাকলে ওরা তোমার কেশস্পর্শ করবে না।

রঘুনাথ। আমি ওসব কথা শুনতে চাই না। তোমার মত বিশ্বাসঘাতক লোকের কথায় আমার বিশ্বাস হয় না।

ক্রুদ্ধভাবে রায়মল্ল বলিলেন, “কি! যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা! যদি তুমি বন্দী না হ’তে, তা’ হ’লে আমায় বিশ্বাস করতে কি না করতে তা’ দেখে নিতুম। মুখ চিরে তোমার মুখের কথা মুখে প্রবেশ করিয়ে দিতুম।”

রঘুনাথ। এখন আমি তোমার হাতে বন্দী! তুমি যা মনে করবে তাই করতে পারবে। ইচ্ছা করলে তুমি আমায় কেটে ফেলতে পার। তোমার দয়ার উপরে এখন আমার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।

রায়মল্ল। বাঃ! তুমি ত বেশ মজার লোক দেখতে পাই। হাজার হাজার পাপ ক’রে হাজার হাজার লোকের ধন-রত্ন লুণ্ঠন, সতীত্বাপহরণ, প্রাণ বিনাশ ক’রে এখন আবার কেটে ফেলার কথা বলছ? মনে ক’রে দেখ দেখি, নিঃসহায় নিরপরাধ ব্যক্তিগণকে পাৰ্ব্বতীয় পথে যখন সামান্য ধনলোভে হত্যা করতে, তখন কি জানতে— তোমারও পাপের শাস্তিবিধান করবার জন্য উপরে একজন আছেন? তখন কি মনে হত, মানুষের প্রাণ সবারই সমান? তোমার প্রাণের যত মায়া-মমতা, তার প্রাণের ততোধিক মায়া হ’তে পারে। একদিনের তরেও কি ভেবে দেখেছিলে, দর্পহারী কারও দর্প রাখেন না— তোমারও দর্পও একদিন চূর্ণ হবে। আমি তোমায় অস্ত্ৰ-শস্ত্র দিচ্ছি, যা’ তোমার ইচ্ছা, তাই নাও—একবার আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর। যদি আমায় খুন করতে পার, তা হ’লেই তুমি আবার স্বাধীন হবে।

রঘুনাথ। আর তোমার এতগুলো লোক কোথায় যাবে? ওরা কি আমাকে সহজে ছাড়বে?

রায়মল্ল। একজন লোকও আমাদের যুদ্ধে বাধা দিবে না।

রঘুনাথ। আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব না।

রায়মল্ল। ভীরু! এতদিনের পর এই একটা সত্য কথা তোর মুখ থেকে বেরুল। তুই আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবি নি—নরাধম! তোর সাহস হয় না তাই বল্। তুই নেড়ী-কুত্তার জাত্।

রঘুনাথ। এখন তোমার মুখে যা’ আসে তাই বলতে পার; আমি তোমার অধীন। সকল কথাই আমাকে সহ্য করতে হবে।

রায়মল্ল। তোর মত ভীরু কাপুরুষ আমি নই। সম্মুখ-যুদ্ধে মরণকে আমি তুচ্ছজ্ঞান করি। আমি আমার এক হাত শরীরের সঙ্গে বেঁধে আর এক হাতে তোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছি। তোর দু’হাতে তুই যে অস্ত্র ইচ্ছে নে, আর আমার এক হাতে কেবল একখানা তলোয়ার দে, আমি সেই এক হাতেই তোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছি। আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি, কেউ আমার সহায়তা করতে আসবে না—কেউ আমাদের যুদ্ধে বাধা দেবে না—কেউ আমাদের মানা করবে না।

রঘুনাথ। রায়মল্ল, কিছুতেই আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজী নই।

ক্রোধে অধীর হইয়া বন্দী দস্যুগণের প্রতি দৃষ্টিসঞ্চালন করিয়া রায়মল্ল গোয়েন্দা বলিলেন, “দেখরে হতভাগারা! এতদিন কার সেবা করছিলি, কার অনুগত হয়েছিলি, কার কথায় উঠতিস্, বতিস্, কি রকম লোক তোদের উপরে প্রভুত্ব করত, কাকে তোরা রাজভোগ খাওয়াতিস্, লুণ্ঠিত দ্রব্যের অর্দ্ধভাগ প্রদান করতিস্। তোদের দলপতি কতবড় সাহসী বীরপুরুষ, একবার চেয়ে দেখ।”

বন্দী দস্যুগণ রায়মল্ল সাহেবের বীরত্বের প্রশংসা ও রঘুনাথের ভীরুতার নিন্দা করিতে লাগিল। এতদিন কুক্কুরের সেবা করিয়াছে বলিয়া তাহাদের অন্তরের অন্তস্তল হইতে ঘৃণার উদ্রেক হইল। সে চিহ্ন মুখে পৰ্য্যন্ত স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতে লাগিল।

রায়মল্ল গোয়েন্দা বড় আশা করিয়া এই সকল কথা বলিতেছিলেন;একদিন হাতে হাতে রঘুনাথকে নিজের বলবীর্য্য দেখাইবার জন্য তাঁহার বড় আশা ছিল। রঘুনাথকে এত ভীরু কাপুরুষ বলিয়া তিনি অনুমান করেন নাই। যখন দেখিলেন, রঘুনাথ যুদ্ধে কিছুতেই অগ্রসর হইতে সাহস করিতেছে না, তখন তিনি বলিলেন, “আচ্ছা রঘুনাথ! আমি তোমার দলকে দলশুদ্ধ ছেড়ে দিতে রাজী আছি, তুমি একবার আমার সঙ্গে সাহস ক’রে যুদ্ধ কর। মানুষ কেউ ত আর অমর নয়, একদিন না-একদিন মরতে ত হবেই, তবে বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে মর না কেন? রাজপুতের নামে কলঙ্ক ঘুচিয়ে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন কর না কেন? দেখ, যুদ্ধের কথা কিছু বলা যায় না। হয়ত তোমার অস্ত্রাঘাতে আমার প্রাণ বিয়োগ হ’তে পারে, হয়ত তুমি বেঁচে যেতে পার; তা’ হ’লে আজীবন তোমার একটা কীর্তি থাকবে—তোমার অনুচরগণ তোমায় দেবতার ন্যায় ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। কখনও কেউ তোমায় আর জেলে দিতে পারবে না, কখনও কেউ তোমায় বন্দী করতে সমর্থ হবে না। তুমি যেমন স্বাধীন ছিলে, যেমন পাৰ্ব্বতীয় প্রদেশের রাজা ছিলে, সেই রকমই থাকবে। আর কেউ তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে সাহস করবে না। কেউ তোমার কাছে ঘেঁসতে পারবে না।

রঘুনাথের আর উচ্চবাচ্য নাই। মুখে আর কথা সরে না। চারিদিকে দস্যুগণ গালি পাড়িতেছে। একজনের জন্য সকলের মুক্তি পাইবার আশা সত্বেও সে তাহাতে অগ্রসর হইতেছে না দেখিয়া, তাহাদের অন্তৰ্দ্দাহ উপস্থিত হইয়াছে। রঘুনাথের আর মুখ তুলিবার যো নাই, সাহস করিয়া কোনদিকে চাহিবার উপায়ও নাই।

তখন রায়মল্ল সাহেব নিরাশচিত্তে ঘৃণাসূচক স্বরে একজন প্রহরীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ইহাকে পদাঘাত করিতে করিতে কোতোয়ালীতে নিয়ে যাও। মানুষের চামড়া এর গায়ে আছে বটে, কিন্তু ওর দেহে মনুষ্যত্বের একবিন্দু নাই। যদি আমি দস্যুদলের মধ্যে ভীরু কাপুরুষ অথচ আত্মশ্লাঘায় পূৰ্ণ কোন লোক দেখে থাকি, তা’ হলে এর চেয়ে হীন ও নীচ আর কাকেও দেখি নি।”

রঘুনাথ মনে মনে বলিতে লাগিল, “মা গো বসুমতি দ্বিধা হও, আমি তোমার মধ্যে প্রবেশ করি—আর সহ্য হয় না।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – রায়মল্লের আবির্ভাব

রায়মল্ল সাহেব অন্যান্য কাজকর্ম্ম সারিয়া অনুচরবর্গের প্রতি আদেশ দিলেন, “তোমরা প্রতি দস্যুর সঙ্গে দুইজন করিয়া লোক থাক। কোনরূপে পলাইতে বা পৰ্ব্বত হইতে খড়ের ভিতর লাফাইয়া পড়িতে না পারে। খবরদার! খুব সাবধান!”

প্রায় একঘণ্টা পরে প্রহরিবর্গবেষ্টিত একদল দস্যু বন্দী হইয়া পাৰ্ব্বতীয় পথে চলিতে লাগিল। সে দৃশ্য দেখিতেও কৌতুকপ্রদ! মধ্যাহ্নকালের মধ্যে অন্যান্য ভিন্ন ভিন্ন স্থান হইতেও ঐরূপভাবে দস্যুগণকে গোয়েন্দার লোকের বন্দীকৃত করিয়া আনিতে লাগিল। রায়মল্ল সাহেব চারিদিকে জাল ফেলিয়া রাখিয়াছিলেন। যখন তিনি সে জাল গুটাইলেন, তখন দেখা গেল, এই দুই বৎসরে প্রায় দুই হাজার পাঁচ শত দস্যু বন্দী করিয়াছেন। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বনমধ্যস্থ ভগ্নদুর্গে নিভৃত নিৰ্জ্জন পৰ্ব্বতগুহায়, স্থানীয় ছোট ছোট কোতোয়ালীতে, গ্রাম মধ্যে কারাগারে তিনি এতদিন ধরিয়া কেবল দস্যুগণকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিলেন। আজ এতদিন পরে তাহাদিগকে সমস্ত একত্র করিলেন। এ দৃশ্য দেখিবার যোগ্য বটে।

গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে এ কথা প্রচারিত হইল। রায়মল্ল গোয়েন্দা দুই বৎসর পরিশ্রমের পর রঘু ডাকাতের ভয়ানক দলকে দলশুদ্ধ বন্দী করিতে পারিয়াছেন, এ কথা ক্ষণেকের মধ্যে বোধ হয়, বিশ ক্রোশ ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। তবে ক্রমে ক্রমে যে সমধিক বা অত্যাধিক মাত্রায় সংবাদটা অতিরঞ্জিত হইতে লাগিল, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই।

চারিদিকে যে যে শুনিল, তাহারাই রায়মল্ল গোয়েন্দাকে অজস্র ধন্যবাদ ও প্রাণ ভরিয়া আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিল। সকলেই পুলকিত হইল। স্ত্রী-পুত্রাদি লইয়া এখন গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে নির্ভয়ে লোক বাস করিতে পারিবে, তাহাদের মনে সে আশা হইল। কোম্পানী-বাহাদুর রায়মল্ল গোয়েন্দাকে উপাধি ও কয়েক সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক স্বরূপ প্রদান করিলেন।

দুইদিন দুই রাত্রি অনবরত পরিশ্রম করিয়া, রায়মল্ল সাহেব দস্যুগণের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা খাড়া করিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত মনে অবসর গ্রহণ করিলেন।

তারাকে যথাসময়ে অজয় সিংহের ভবনে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল।

সুতরাং সে বিষয়ে রায়মল্ল সাহেব এক প্রকার নিশ্চিন্ত ছিলেন। এই ঘটনার পর তৃতীয় দিবসে তিনি অজয় সিংহের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য বহির্গত হইলেন।

পথিমধ্যে রাত্রি হইলে তিনি সেই রাত্রিটার জন্য পার্ব্বতীয় একটি সামান্য চটিতে আশ্রয়- গ্রহণার্থে প্রবেশ করিলেন। তখন তাঁহার হস্তে আর অন্য কার্য্য নাই। তিনি এইবার তারার অপহৃত বিষয়-সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে যত্নবান হইলেন।

সরায়ে প্রবেশ করিয়াই তিনি শুনিলেন, দুই-চারিজন লোক একত্রে বসিয়া তাঁহারই নামোচ্চারণ করিতেছে। তাহারা একটি কক্ষে একখানি তক্তপোষের উপরে বসিয়া মদ্যপান করিতেছে, আর তাঁহার সম্বন্ধেই আলোচনা করিতেছে।

রায়মল্ল গোয়েন্দা গৃহে প্রবেশ করিয়াই শুনিলেন, একজন বলিতেছে, ‘হাঁ, আমার বিবেচনা রায়মল্ল কিছু কম পাজী নয়। ভয়ানক ঘুসখোর! ভয়ানক পাজী! রঘু ডাকাতের চেয়ে রায়মল্ল কিছু কম পাপী নয়। লুকিয়ে লুকিয়ে সব বদমায়েসীটুকু করে, আর লোকের কাছে সাধুতা জানায়। “

রায়মল্ল গোয়েন্দাকে দেখিয়া সেই লোকদের চুপ করিয়া থাকিবার কোন আবশ্যকতা বোধ হয় নাই। বিশেষতঃ তাঁহাকে দেখিলে কেহ অনুমান করিতে পারে না যে, তিনি সেই অসাধারণ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। শান্তভাবে তাঁহাকে দেখিলে অপরিচিত কোন ব্যক্তিই তাঁহাকে সেই স্বনামখ্যাত রায়মল্ল গোয়েন্দা বলিয়া অনুমান করিতে পারে না। ভীতিদায়ক কোন চিহ্ন তাঁহার শরীরে ছিল না। তবে তাঁহার উজ্জ্বল ও সতর্ক চক্ষুদ্বয় দেখিলে বিচক্ষণ ব্যক্তি মাত্রেই অনুমান করিতে পারেন, সে নয়নযুগলে অপূৰ্ব্ব জ্যোতিঃ বিরাজমান! তাহাতে অভূতপূর্ব্ব সাহসিকতা ও দূরদৃষ্টির পরিচায়ক! অনেক মহাপাপী সেই চক্ষের জ্যোতিতে ঝসিয়া গিয়াছে। সে চাহনি ও বঙ্কিম ভ্রূভঙ্গে অনেক সময়ে অনেককে কম্পিত করিয়াছে।

রায়মল্ল গোয়েন্দার বড় আনন্দ হইল। এ পাৰ্ব্বত্য প্রদেশে এই ছোট ছোট সরায়ে অপরিচিত লোকজনের সহিত সকলেই কথা কয়—আলাপ পরিচয় করে, তাহাতে কেহ সঙ্কুচিত হয় না। আলাপ নাই বলিয়া কেহ কাহারও সহিত কথা কহিতে পরাজুখ হয় না, সকলেই ক্ষণমধ্যে আপনার মত করিয়া লয়। যেন কতদিনের আলাপ—কতদিনের পরিচয়। একবার দেখিয়াই পরস্পরে আকৃষ্ট হইয়া পড়ে।

রায়মল্ল গোয়েন্দা সেই লোকটীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি বোধ হয়, রায়মল্লকে চেনেন না, তাই তাঁর প্রতি অযথা দোষারোপ করছেন। আপনার সঙ্গে রায়মল্লের পরিচয় আছে কি?”

উত্তর। আছে।

রায়মল্ল। কখনই নয়, যদি আপনার সহিত তাঁর পরিচয় থাকৃত তা’ হ’লে কখনই এরূপ অন্যায় দোষারোপ করতে পারতেন না।

উত্তর। হতে পারে। আপনার সঙ্গে রায়মল্লের আলাপ আছে কি?

রায়মল্ল। আজ্ঞে হাঁ, তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কিছু আলাপ আছে।

সে লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি তাকে ভাল লোক ব’লে, বিবেচনা করেন?’

রায়মল্ল। আজ্ঞে হাঁ।

যে কয়জন লোক তথায় বসিয়াছিল, তাহারা এ কথোপকথন বা বাদ বিসম্বাদে যোগ দিল না। তাহারা স্থিরভাবে উভয়ের কথাবার্তা শুনিতে লাগিল।

সেই লোকটি উদ্ধতভাবে বলিল, “আমি বলছি, সে লোক ভাল নয়। কৈ—কে আমার কথায় প্রতিবাদ করতে সাহস করে দেখি।”

রায়মল্ল। তাঁকে ভাল লোক না বলার আপনার কোন বিশেষ কারণ আছে কি?

উত্তর। কারণ? কারণ আবার কি? চোর না হ’লে কি চোর ধরতে পারে?

রায়মল্ল। সব সময়ে সকলের পক্ষে ও কথা খাটে না।

উত্তর। তুমি কে হে? তোমায় ত কেউ আমাদের কথাবার্তায় বাধা দিতে ডাকে নি। তোমার এ রকম চড়া চড়া কথায় আমার রাগ হচ্ছে, বলছি—

রায়মল্ল। (বাধা দিয়া) রাগ হয়, ঘরের ভাত বেশি করে খেয়ো। তোমার কথা আমার অন্যায় ব’লে বোধ হ’ল, তাই আমি প্রতিবাদ করলেম। রায়মল্ল বোধ হয়, কখনও তোমার কিছু অনিষ্ট করেন নি। তাঁর অপরাধ দেওয়াতে তোমার কোন লাভ নাই।

উত্তর। তুমি কেমন ক’রে জানলে, সে কখনও আমার কোন অনিষ্ট করে নি?

রায়মল্ল। বটে, তবে তুমিও বুঝি রঘুনাথের দলের একজন? রঘুনাথকে দল শুদ্ধ ধরিয়ে দেওয়াতে বুঝি, তোমার এত গায়ের জ্বালা হয়েছে?

রায়মল্ল সাহেব যে লোকটার সঙ্গে কথা কহিতেছিলেন, তাহার আকার প্রকার দেখিলে সাধারণ লোক ভয় পায়। তাহার দেহ বেশ বলিষ্ঠ, সুগঠিত। সহসা দেখিলেই মনে হয়, তিনি অমিত পরাক্রমশালী তাহার সহিত এরূপভাবে বচসা করাতে সেখানে যে কয়জন লোক বসিয়াছিল, তাহারাসকলেই একটা ভয়ানক মারামারির সম্ভাবনা ভাবিতেছিল। সকলেই মনে করিতেছিল, এত বড় একটা প্রকাণ্ড পালওয়ানের সঙ্গে ঐ ক্ষীণদেহবিশিষ্ট, শান্তপ্রকৃতি লোকটা কি সাহসে এত বচসা করিতেছে। সে ওর একটা চড়ের ভর সহিতে পারিবে না যে! যাহা হউক, কেউ কিন্তু কোন কথা বলিতে সাহস করিল না। সে অনলে ঘৃতাহুতি প্রদানে কে উৎসুক হইবে?

সে লোকটি কিন্তু ক্রোধোন্মত্ত নয়। সুতরাং সে স্থির, ধীর, তজ্জন্য গম্ভীর হইয়া সে ব্যক্তি উত্তর করিল, “আমার বোধ হয়, তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ, তা’ জান না। আমি এখনও তোমার ভালর জন্য বলছি, মুখ সামলে কথা কও।”

রায়মল্ল। যে মহাপুরুষের সঙ্গে আমি কথা কইছি, সৌভাগ্যক্রমে তাঁর পরিচয় এখনও পাই নি আর জাব্বারও বড় বিশেষ কোন আবশ্যকতা দেখছি না।

তৎপরে রায়মল্লের প্রতি প্রশ্ন হইল, “তুমি কি এইখানকার লোক?”

রায়মল্ল। আমি যখন যেখানে থাকি, তখন সেইখানকার লোক। আমি এই রাজ্যের একজন প্ৰজামাত্র।

পুনরায় সেই লোকটা জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি দেখছি, রায়মল্লের বেজায় গোঁড়া। তার কোন অপবাদ শুনলে তোমার বড় কষ্ট হয়। কেমন, এই কথা ন্যায়? ‘

রায়মল্ল বলিলেন, “হাঁ, এ কথা কতকটা সত্য বটে। তাঁর অনুপস্থিতে যদি তাঁর উপরে কেউ মিথ্যা দোষারোপ করে, তা আমি সে কথা সহ্য করিতে পারি না।”

“আমি কি মিথ্যা দোষারোপ করছি?”

“নিশ্চয় করছ, তার আর কোন ভুল আছে? “

“আমার যা’ বিশ্বাস, আমি তাই বলছি।”

“তোমার এ বিশ্বাস ভুল।”

“কি! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? ফের্ যদি ও কথা বলবে, তবে এখনই মজা দেখাব, এখনই টের্ পাবে।”

“সেজন্য আমি কিছুমাত্র ভীত বা নিশ্চিন্ত নই। তুমি অনায়াসে আমার মজাটা দেখাতে পার আমি তার জন্য প্রস্তুত হ’য়েই আছি।”

“দেখ বন্ধু। তোমার মত স্পষ্টবক্তা লোক বড় ভালবাসি।”

রায়মল্ল। ইঃ। সহসা তোমার এরূপ বিরূপভাব দেখে আমার যে মনে বড় আশঙ্কা হচ্ছে। অকস্মাৎ মহাশয়ের মনোগতি এরূপভাবে পরিবর্তিত হ’ল যে?

“দেখ, তোমার মত আমুদে লোক আমার একটি দরকার; তুমি আমায় যে সব কড়া কথা বলেছ, সে সব আমি ক্ষমা করতে প্রস্তুত আছি।”

“আজ্ঞে সহসা অতটা দয়ালু হ’য়ে পড়বেন না। অধীন আপনার অনুগ্রহ প্রয়াসী নয়!” “তবে তুমি আমাকে রাগাবার জন্যই এই সব কথা বল্‌ছ?”

সেই মহাবলশালী ব্যক্তি এইবারে কিছু গম্ভীর অথচ ঈষৎ কোপান্বিত হইয়া উপরোক্ত কথা কয়টি বলিলেন। যেন বোধ হইল, এইবার রায়মল্ল গোয়েন্দা আর দ্বিতীয় কথা কহিলেই তিনি তাঁহাকে আক্রমণ করিবেন।

কিন্তু রায়মল্ল সাহেব এ কথায় কোন উত্তর না দিয়া মৃদু-মধুরভাবে হাসিতে লাগিলেন। সেই লোকটি তাঁহার এত সাহস দেখিয়া সেই সরাই-রক্ষককে সম্বোধন করিয়া বলিল, “এই লোকটা কি তোমার পরিচিত?“

সরাই-রক্ষক উত্তর করিল, “আমি ওকে পূৰ্ব্বে কখনও দেখি নাই, তবে আমি এই পৰ্য্যন্ত বলতে পারি, যে ভদ্রলোক আমার এই সামান্য চটিতে আসেন, ভদ্র ব্যবহার করেন, তিনি আমার বন্ধু”।

“দেখ, তোমায় আমি বলছি, তুমি ঐ লোকটিকে এখনই এই স্থান পরিত্যাগ করতে বল; তা’ না হ’লে ভাল হবে না।”

সরাই-রক্ষক উত্তর করিল, “ওকে তাড়িয়ে দেবার ত বিশেষ কোন কারণ দেখছি না। আমার এখানে আপনারও যেমন অধিকার, তারও সেই রকম। উনি ত কোন অন্যায় ব্যবহার করেন নি, কেন আমি ওকে চলে যেতে বলব?”

“তুমি যদি ওকে সরাই থেকে বিদায় করে দিতে না পার, তবে আমাকেই কি সে কাজ করতে হবে?”

আশে-পাশে বসিয়া যে-সকল লোক কেবল মজা দেখিতেছিল, তাহারা ভাবিল, “এইবারেই একটা বুঝি লড়াই বাধে।”

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – আবির্ভাবের ফল

রায়মল্ল সাহেব শঙ্কিত বা সঙ্কুচিত হইবার কোন চিহ্ন দেখাইলেন না। বরং সেই লোকটিকে আরও ক্রুদ্ধ করিবার জন্য উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিয়া উঠিলেন।

সরাই-রক্ষক বলিল, “যদি দরকার বিবেচনা হয়, আমার সরাই থেকে একজন লোককে আমিই বের্ ক’রে দিতে পারি—অন্য লোকের সে কাজে হাত দেবার কোন দরকার নাই।”

“ও লোকটি অনর্থক আমাকে রাগিয়েছে, ওকে এই দণ্ডেই এখান থেকে স’রে যেতে হবে।”

রায়মল্ল গোয়েন্দা বিদ্রূপচ্ছলে স্বরভঙ্গী করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়ের নাম? থাকা হয় কোথায়?”

সেই ব্যক্তিটি শান্তভাবে, ধীর গম্ভীরস্বরে উত্তর করিলেন, “জগৎ সিংহ! এ পাৰ্ব্বতীয় প্রদেশে আমায় জানে না বা ভয় করে না, এমন লোক একটিও নাই।”

জগৎ সিংহ মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম শুনিলেই ঘরসুদ্ধ লোক চমকিয়া উঠিবে, এবং যে লোকটি তাঁহার সহিত বাগ্বিতণ্ডা করিতেছে, সেও ক্ষান্ত হইয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিবে, অথবা মূৰ্চ্ছা যাইবে;কিন্তু অত্যন্ত ক্ষোভের বিষয়, রায়মল্ল সে নাম শুনিয়া মূর্ছিত চমকিত বা কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না; বরঞ্চ তাঁহার মনে আনন্দ হইল। জগৎ সিংহের আরও পরিচয় জানিতে তাঁহার ইচ্ছা হইল, তবে প্রকাশ্যে তিনি সে ভাব জ্ঞাপন করিলেন না।

জগৎ সিংহ বাস্তবিকই সে প্রদেশের একজন প্রসিদ্ধ দুর্দান্ত ব্যক্তি বলিয়া পরিচিত। দস্যুদলের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, এ কথাও অনেকে অনুমান করিত। প্রকাশ্যভাবে এ পর্য্যন্ত যদিও তাঁহাকে কখনও দস্যুদলের সংস্রবে কেহ দেখে নাই, কিন্তু গুপ্তভাবে তিনি যে রঘুনাথের সঙ্গে অনেক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, অনেকেই তাহা কানাকানি করিত, কাজেই সর্ব্বসাধারণেই তাহা শুনিয়াছিল। তিনি আত্মপরিচয় প্রদান করিবামাত্রই গৃহমধ্যস্থ অন্য সকল লোকেই চমকিত হইল; কিন্তু রায়মল্ল গোয়েন্দা ঠিক পূৰ্ব্বপ্রকৃতি, সহাস্যবদন ও শান্তভাব বজায় রাখিলেন। জগৎ সিংহ যাহা আশা করিয়াছিলেন, তাহা ঘটিল না দেখিয়া যেন কথঞ্চিৎ নিরাশ হইলেন। মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, “আমার নামে বাঘে বলদে একঘাটে জল খায়, আর এ লোকটা বিন্দুমাত্র বিচলিত হ’ল না! কে এ ব্যক্তি? এর সাহস ত বড় কম নয়!”

রায়মল্ল গোয়েন্দা কহিলেন, “তবে রঘুনাথ দলকে-দল শুদ্ধ ধরা পড়াতে তোমার বড় ক্ষতি হয়েছে?”

জগৎ সিংহ এই কথা শুনিয়াই ক্রোধে রক্তবর্ণচক্ষুঃ হইয়া কঠোরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলে? তোমার এ কথার মানে কি?”

রায়মল্ল। কেন? আমি বেশ সাদা কথায় বলেছি। এর মানে ত বুঝিয়ে দেবার দরকার নাই। আমি যা বলেছি, তা’ তোমার মত চালাক লোকের খুব সহজে একেবারেই বোঝা উচিত।

জগৎ। তুমি ফের ও কথা বলিলে তোমার মাথা গুঁড়িয়ে দেবো।

রায়মল্ল। সাহস থাকে অনায়াসে চেষ্টা ক’রে দেখতে পার; কিন্তু আমার মাথাটা কিছু শক্ত — সহজে ভাঙা যায় না।

জগৎ। তুমি না বল্‌ছিলে, আমি রায়মল্লের উপরে মিথ্যা দোষারোপ করেছি?

রায়মল্ল। হাঁ, তা’ ত আমি বলেছি। বলেছি কেন? এখনও বলছি, তুমি ঘোরতর মিথ্যাবাদী।

জগৎ সিংহের আর সহ্য হইল না। তিনি নিজ অঙ্গরাখার মধ্য হইতে পিস্তল বাহির করিবার জন্য যথাস্থানে হস্ত প্রদান করিলেন। তৎপরেই বলিলেন, “খবরদার! মুখ সামলে কথা কও! এখনই উচিত মত শিক্ষা পাবে।”

রায়মল্ল গোয়েন্দা দেখিলেন, জগৎ সিংহ তাকে গুলি করিবার নিমিত্ত পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছেন। তিনি তথাপি বিচলিত হইলেন না; বরং জগৎ সিংহ অপেক্ষা কঠোরতর স্বরে বলিলেন, “আমি কেন তোমায় মিথ্যাবাদী বলেছি, তা’র কারণ আছে। রায়মল্ল গোয়েন্দা তোমার কোন ক্ষতি করেন নাই, অথচ তুমি তাঁর বদনাম দিচ্ছিলে–“

তাঁহার সমস্ত কথা মুখ হইতে বাহির হইতে-না হইতেই জগৎ সিংহ ঈষৎ পশ্চাতে হটিয়া আসিয়া অঙ্গরাখার ভিতর হইতে পিস্তলটা বাহির করিয়া ফেলিলেন। রায়মল্ল গোয়েন্দাও তাহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনিও নিমেষ মধ্যে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় জগৎ সিংহের ঘাড়ের উপরে লাফাইয়া পড়িলেন। যাহারা রায়মল্ল সাহেবের শান্তমূর্তি দর্শনে তাঁহাকে নিরীহ ভালমানুষ ভিন্ন আর কিছুই ভাবেন নাই, তাঁহারই চকিতনেত্রে চাহিয়া দেখিলেন, অত বড় প্রকাণ্ড দেহধারী জগৎ সিংহকে তিনি জাপ্‌টাইয়া ধরিয়া, অকাতরে অল্প চেষ্টায় অধিক ধস্তাধস্তি না করিয়া মুহূর্তের মধ্যে ভূমিতে ফেলিয়া দিলেন; পরে বলিলেন, “এখন মানে মানে পিস্তলটি ফেলে দেবে কি না? “

জগৎ সিংহের হাত হইতে পিস্তলটি পড়িয়া গেল। কেহ তাঁহাদিগের কার্য্যে বাধা দেয় নাই; কিন্তু ব্যাপার দেখিয়া প্রত্যেকেই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিল। বলিতে গেলে জগৎ সিংহকে ভূতলশায়ী করিতে বোধ হয় রায়মল্লের অতি সামান্যই ক্লেশ হইয়াছিল; কাহারও রক্তপাত হইল না, অথচ সেই শান্ত শিষ্ট ক্ষুদ্রাকৃতি রায়মল্ল অত বড় একজন কুস্তিগীর পুরুষকে যেমন একটি বালকের ন্যায় ভূশায়ী করিলেন। জগৎ সিংহ পিস্তলটা ফেলিয়া দিবামাত্র রায়মল্ল সাহেব সেই পিস্তলটী কুড়াইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। জগৎ সিংহ একখানি শাণিত ছুরিকা কটিদেশ হইতে বাহির করিয়া রায়মল্লকে আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইলে তৎক্ষণাৎ গোয়েন্দা-সর্দ্দার রায়মল্ল সেই পিস্তলটা তাহার দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “তোমার নিজের পিস্তলেই নিজে মরবে কেন—এখনও সতর্ক হও।”

জগৎ সিংহ উচ্চরবে জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুই?”

রায়মল্ল। আমি কে, তুমি জানতে চাও?

জগৎ। হাঁ।

রায়মল্ল। লোকে আমায় ‘রায়মল্ল গোয়েন্দা’ ব’লে ডাকে, আর কোম্পানি-বাহাদুর ‘রায়মল্ল সাহেব’ বলেন।

জগৎ সিংহ তৎক্ষণাৎ নিজ হস্তস্থিত শানিত ছুরিকা ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া যেন কত ভালমানুষের মত বিনীতভাবে বলিল, “ওঃ! তা’ না হ’লে কি এত সাহস হয়? আপনাকে চিনতে পারি নি, মাপ করবেন।”

জগৎ সিংহ যখন দম্ভভরে নিজ নাম উচ্চারণ করিয়াছিল, তখন অন্য লোকজন যত না চমকিত হইয়াছিল, রায়মল্ল গোয়েন্দার নাম উচ্চারিত হইবামাত্র তাহারা যেন সেইখানে একেবারে জমাট বাঁধিয়া গেল। হতবাক হইয়া তাহারা সেই অদ্ভুত গোয়েন্দার মুখপানে চাহিয়া রহিল। এতদিন যে লোকের কেবল নাম শুনিয়া তাহারা বিস্মিত হইত, আজ সেই লোক সম্মুখে উপস্থিত।

রায়মল্ল গোয়েন্দা এ সকল বিষয়ে লক্ষ্য না করিয়া, পার্শ্বস্থ একটি ক্ষুদ্র গৃহে প্রবেশ করিয়া তাহার দ্বার রুদ্ধ করিলেন। পান্থশালাধ্যক্ষকে কেবল বলিয়া গেলেন, “সকাল হইলেই আমার ঘুম ভাঙিও।” ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন বটে, কিন্তু তিনি নিদ্রাগত হইলেন না। তাঁহার মনে এখন একটা নতুন ভাবনা জুটিল। তিনি কেবল জগৎ সিংহের নাম লইয়াই ভাবিতে লাগিলেন। জগৎ সিংহের নাম তিনি অনেকবার শুনিয়াছেন। তিনি পাৰ্ব্বতীয় প্রদেশস্থ একজন বিখ্যাত বদমায়েস। তাঁহার নামে অনেক খুন মোকদ্দমা, অনেক গ্রেপ্তারী পরওয়ানা আছে; কিন্তু তা’ ছাড়াও জগৎ সিংহের নাম যেন তিনি আর কাহারও কাছে শুনিয়াছেন। অনেকক্ষণ চিন্তার পর তাঁহার মনে পড়িল, অজয়সিংহ একবার তাঁহার সাক্ষাতে তাহার পরিচয় দিবার সময়ে এই নাম উচ্চারণ করিয়াছিলেন। তখন তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “এই কি সেই জগৎ সিংহ? এই লোকই কি তারার বিমাতার সহিত অবৈধপ্রণয়ে আবদ্ধ? এই কি তারার বিষয়-সম্পত্তি নির্বিঘ্নে ভোগদখল করিতেছে? যাহাকে বহু অনুসন্ধানে বাহির করিতে হইত, ভাগ্যক্রমে সে কি আজ আপনা-আপনি আমার সহিত পরিচিত হইয়া গেল!”

এইরূপ ভাবনা চিন্তায় তিনি অনেকক্ষণ অতিবাহিত করিলেন। হঠাৎ তাঁহার চিন্তায় বাধা পড়িল। সরাইয়ে বহির্দেশে তিনি যেন কাহার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলেন। কে যেন অতিশয় ব্যস্ত-সমস্তভাবে বলিতেছে, “আজ রাত্রে গিয়ে আর কি ফল হবে? কাল সকালে তখন যাবেন।”

আর একজন লোক উত্তর দিল, “না—না—আমাকে এই রাত্রেই যেতে হবে। তুমি আমার ঘোড়াটা নিয়ে এস।”

“এই অন্ধকারে কেমন ক’রে যাই বলুন, তবে আপনি একান্ত পীড়াপীড়ি করলে বাধ্য হয়েই যেতে হবে।”

“আমি আজ যাবই—আমাকে আজ যেতেই হবে।”

রায়মল্ল সাহেব এই কথোপকথন ও কণ্ঠস্বর শুনিয়াই অনুমান করিলেন, জগৎ সিংহ সরাই পরিত্যাগ করিয়া সেই রাত্রেই প্রস্থানের উদ্যোগ করিতেছে, আর সরাই-রক্ষক তাহাতে বাধা দিতেছে। তিনি ভাবিতে লাগিলেন কেন জগৎ সিংহ এত ব্যস্ত হইয়া আজ রাত্রিতেই এখান হইতে পলায়নের চেষ্টা করিতেছে।

কিয়ৎক্ষণ পরেই তিনি আবার সরাই-রক্ষকের কণ্ঠস্বর শুনিলেন। সে বলিল, “রাত্রে পাহাড়ীপথে যাওয়া বড় ভয়ানক কাজ। আমি এখনও আপনাকে বারণ করছি, আপনি যাবেন না। গেলে বিপদে পড়বেন।”

রায়মল্ল সাহেব কান পাতিয়া বেশ ভাল করিয়া সব শুনিতে লাগিলেন। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “এই রাত্রে জগৎ সিংহ কেন এখান হইতে চলিয়া যাইতে চায়?”

রায়মল্ল সাহেব উন্মুক্ত বাতায়ন-পথ দিয়া দেখিতে লাগিলেন, জগৎ সিংহ অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া সরাই-রক্ষককে জিজ্ঞাসা করিল, “এখান হইতে বুঁদী গ্রামে যাবার কোন সহজ রাস্তা নাই?“

সরাই-রক্ষক উত্তর করিল, “না।”

জগৎ। এখান থেকে কত দূর হইবে?

সরাই-রক্ষক। প্রায় দশ ক্রোশ।

রায়মল্ল সাহেব এই কথা শুনিয়াই ভাবিলেন, “এ বুঁদীগ্রামে যেতে চায় কেন? নিশ্চয় কোন বিশেষ দুরভিসন্ধি আছে। হ’ল না, আজ রাত্রে আমার শোয়া হ’ল না দেখছি।”

কিয়ৎক্ষণ পরেই তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া, বাতায়ন পথ দিয়া লাফাইয়া পড়িলেন। অন্ধকারে আস্তাবলের দিকে গিয়া আপনার অশ্বটিকে বন্ধনমুক্ত করিয়া লইলেন। অশ্বের পদশব্দে পাছে জগৎ সিংহ বুঝিতে পারেন, তিনি তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিতেছেন, তাই তিনি অশ্বপদ হইতে লৌহনিৰ্ম্মিত ‘নাল’ খুলিয়া লইলেন। অশ্বারোহণে অর্দ্ধ ঘণ্টাকালের মধ্যেই তিনি জগৎ সিংহের অশ্বের পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। তখন তাঁহার মনে অপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হইল। দূরে একটি সরায়ের ক্ষুদ্র আলোকরশ্মি তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল। সহসা তিনি আর জগৎ সিংহের অশ্বের পদশব্দ শুনিতে পাইলেন না। তিনি বুঝিলেন, সেই সরায়ে জগৎ সিংহ আশ্রয় লইলেন। সে সরায়ে কিরূপ লোকের গমনাগমন হইত, তাহা রায়মল্ল গোয়েন্দার অবিদিত ছিল। তিনি জানিতেন, যত চোর বদমায়েস, প্রবঞ্চক, খুনী, ফেরারী লোক পরস্পরের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিত ও সন্ধান লইয়া রজনীযোগে তথায় সম্মিলিত হইত এবং নিজ নিজ কার্য্যসাধন করিয়া চলিয়া যাইত। জগৎ সিংহ এখানে আসিয়া কি উদ্দেশ্যে অবতরণ করিলেন, তাহাই জানিবার জন্য রায়মল্ল গোয়েন্দা বড় ব্যগ্র হইলেন। তিনি অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া, একটি বৃক্ষে তাহাকে বাঁধিয়া রাখিয়া উচু নীচু পাহাড় ও গাছপালার অন্তরালে থাকিয়া প্রায় জগৎ সিংহের নিকটবর্ত্তী হইলেন। দেখিলেন, জগৎ সিংহ আপনার অশ্বটিকে একটি তরুতলে রাখিয়া পথিকশালার অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। রায়মল্ল গোয়েন্দাও খুব সাবধানে পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।

সহসা একবার বংশীধ্বনি শ্রুত হইল। তিনি বুঝিলেন, ইহাও জগৎ সিংহের কার্য্য। সরায়ে নিশ্চয়ই তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার কারণে কোন লোক অপেক্ষা করিতেছে। তাহাকে দূর হইতেসংবাদ দিবার জন্য এই বংশীবাদন হইল। প্রকৃতপক্ষে ঘটিলও তাহাই। জগৎ সিংহের সেই বংশীরব শুনিবামাত্র পান্থশালার দ্বারদেশ উন্মুক্ত হইল। একজন লোক বাহিরে অসিয়া ঠিক সেইরূপ বংশীধ্বনি করিয়া জানাইল, সে উপস্থিত আছে। তাহার পরেই তাহার সঙ্গে আরও দুইজন লোক বাহির হইয়া আসিল। রায়মল্ল গোয়েন্দা দেখিলেন, তিনজন লোক ও জগৎ সিংহ নিকটস্থ একটী বৃক্ষতলে সমবেত হইয়া কথাবার্তা কহিতে লাগিল। তিন্যি লুক্কায়িতভাবে তাহাদিগের পশ্চাতে গিয়া এমন স্থানে দাঁড়াইলেন, যেখান হইতে অনায়াসেই তাহাদিগের পরামর্শ সব শোনা যায়। এইরূপভাবে তাহাদিগের নিকটস্থ হইতে পারায় তিনি মনে মনে নিজ-সৌভাগ্যের প্রশংসা করিতে লাগিল।

জগৎ সিংহ সেই তিনজন লোককে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “খবর ভাল ত?”

একজন উত্তর করিল, “ভাল।”

জগৎ। ঠিক জায়গায় যেতে পেরেছিলে?

উত্তর। হাঁ।

জগৎ। কাজ হয়েছে?

উত্তর। হয়েছে।

জগৎ। তাকে দেখেছ?

উত্তর। হাঁ।

জগৎ। তাকে আনতে পারবে?

উত্তর। নিশ্চয়।

জগৎ। কখন?

উত্তর। আমাদের পাওনার কথা ঠিক হলেই।

জগৎ। আমি ত তোমাদের আগেই বলেছি, এক হাজার ক’রে এক একজনকে দেবো।

উত্তর। তাতে হবে না—এখন অবশ্যই কিছু বাড়াতে হবে।

জগৎ। কত চাও?

উত্তর। প্রত্যেকে দুই হাজার করে।

জগৎ। একটা সামান্য কাজের জন্য অনেক টাকা চাইছ!

উত্তর। বড় সোজা কাজও নয়।

জগৎ। কেন?

উত্তর। এখন রায়মল্ল গোয়েন্দা তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়েছে। তা’ ছাড়া আর একটা কথাও শুন্‌লেম, ঐ মেয়েটা নাকি অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারিণী; অথচ কে বঞ্চনা করে তার বিষয়-আশয় ভোগ-দখল করছে। রায়মল্ল সাহেব না কি প্রতিজ্ঞা করেছেন, সে সব অপহৃত বিষয়-সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করবেন।

জগৎ। এ ভুল সংবাদ কে তোমাদের দিলে? কোথা থেকে এ গাঁজাখুরী কথা শুনলে?

উত্তর। আছে—আছে। আমাদেরও সন্ধান-সুলভ আছে। তা সে কথা নিয়ে সময় কাটাবার দরকার কি?

জগৎ। রায়মল্ল সাহেবই যে সেই ছুঁড়ীটার রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়েছে, তা’কেমন ক’রে জানলে? গুজব কথাও ত হ’তে পারে।

উত্তর। না গুজব কথা নয়।

জগৎ। তা’ যা’ হোক্, তোমরা তাকে আনতে পারবে?

উত্তর। হাঁ।

জগৎ। কখন?

উত্তর। এই রাত্রেই—যদি সব বন্দোবস্ত ঠিক হয়; আমরা যা’ চাই তা’ যদি আপনি দিতে রাজী হন্।

জগৎ। আজ রাত্রের মধ্যেই কেমন ক’রে?

উত্তর। সে ভার আমাদের—আপনি আমাদের কথায় রাজী হ’লেই কাজ হাঁসিল হবে।

জগৎ। এখান থেকে বুঁদী গ্রাম কত দূর?

উত্তর। প্রায় পাঁচক্রোশ হবে।

জগৎ। আজ রাত্রের মধ্যে তবে যাওয়া-আসা অসম্ভব।

উত্তর। সে কথায় আপনার দরকার কি? আপনার কাজ নিয়ে কথা। আপনি দু’হাজার করে দিতে স্বীকৃত হ’লেই আমরা আমাদের কাজ দেখাব।

জগৎ। আচ্ছা, সেই বালিকাকে আমার কাছে এনে দাও, আমি তোমাদের কথাতেই রাজী আছি।

একজন বলিল “দু’ হাজার করে দিতে হবে।”

জগৎ। দু’ হাজার করেই দেবো।

আর একজন বলিল, “তখন পেছলে কিন্তু আমরা শুনব না।”

জগৎ। আমি যখন বলছি দেবো, তখন আর কথায় কাজ কি?

অমনই তৃতীয় ব্যক্তি বলিল, “আমরা তাকে এনেছি।”

অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জগৎ সিংহ জিজ্ঞাসা করিল, “এনেছ?”

উত্তর। হাঁ।

জগৎ। কাকে বল দেখি?

উত্তর। যাকে আপনি আনতে বলেছিলেন।

জগৎ। কোথায়?

উত্তর। দেখুন, আমরা সুবিধা পেয়ে ছাড়ব কেন?, রাত্রে ঘাটে কাপড় কাচ্‌তে যাচ্ছিল, সেই সুযোগে তাকে ধ’রে ফেলি, তাকে এখন এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি।

জগৎ। কোথায়? এই সরায়ে?

উত্তর। তা’ এখন বল্‌ব কেন?

এইরূপ কথাবার্তা শুনিয়া রায়মল্ল সাহেব স্পষ্টই বুঝিলেন, তাহারা কোন্ বালিকাকে অপহরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছে। তিনি ভাবিলেন, হয় ত জগৎ সিংহ তারাকে হত্যা করিয়া নির্বিবাদে তাহার বিষয়-সম্পত্তি ভোগদখল করিবার জন্যই সকল ষড়যন্ত্র করিয়াছে। ইহাই সম্ভব।

জগৎ সিংহ ও সেই তিনজন লোক সরায়ের দিকে অগ্রসর হইল। সরাইরক্ষকও যে এই ভয়ানক কার্য্যে তাহাদের সহায়তা করিতেছে, তাহাও তিনি অনুমান করিলেন। সরায়ে উপস্থিত হইয়াই সেই দুবৃত্তগণ বেগবান্ অশ্বের পদশব্দ শুনিয়া চমকিত হইল। সরাই-রক্ষককে এ কথা জিজ্ঞাসা করাতে সে অবাক হইয়া কেহ তথায় আসিতেছে কিনা দেখিতে লাগিল। অবশ্য কাহারও আসিবার কথা ছিল না বলিয়া, সে সহসা ঐ কথায় কোন উত্তর দিতে পারিল না।

জগৎ সিংহ জিজ্ঞাসা করিল, “ও কে আসে?”

সরাই-রক্ষককে আর কোন উত্তর করিতে হইল না। একজন বৃদ্ধ মাতাল টলিতে টলিতে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বন্দিনী তারা

চারিজন ষড়যন্ত্রকারী মাতাল অবস্থায় এই বৃদ্ধকে দেখিয়া সেদিকে বড় নজর করিল না। তাহারা আপনা আপনি যে যার নিজের কথা কহিতে লাগিল।

বৃদ্ধ মাতাল বলিল, “সরাইওয়ালা! আমায় আজ রাত্রের মত একটা ঘর ছেড়ে দিতে পার? দেখ্‌ছ, আমি কিছুতেই দাঁড়াতে পারছি না। পা দুখানা ভারি অবাধ্য হ’য়েছে।”

সরাই-রক্ষক বলিল, “যাও যাও, আজ আর ঘর ছেড়ে দেয় না, মাতাল কোথাকার। আজ আমার সব ঘরে লোক আছে।”

বৃদ্ধ মত্ততার সহিত মৃদুমন্দভাবে নৃত্য করিতে করিতে বলিল, “ব’লে যাও—বলে যাও বাবা, তোতা পাখি! তুমি বেশ বল্‌ছ, ভাল গাইছ, একটা দেখে-শুনে দাওনা বাপ্! বেজায় মাতাল হ’য়ে পড়েছি।”

সরাই-রক্ষক। কেন ভিড় বাড়াবে, বাবা? আজ আমার আর জায়গা নাই। তোমায় সিধে পথ দেখতে হচ্ছে। আজ রাত্রে আর এখানে হচ্ছে না।

বৃদ্ধ। রাত্রি কোথায় বাবা, রাত্রি কি আছে? দেখ, এতক্ষণে বুঝি রদ্দুর উঠে প’ড়ল। অন্ততঃ একটাকে তুলে বিদায় ক’রে দিয়ে আমার একটু জায়গা করে দাও না। তারা সারারাত ঘুমিয়েছে, আমি সারারাত মদ খেয়েছি। এখন আমায় খানিক্‌টে ঘুমুতে দাও।

সরাই-রক্ষক কর্কশস্বরে বলিল, “আমি বলছি, আজ এখানে আর জায়গা নাই—তুমি সোজা পথ দেখ।”

বৃদ্ধ। এখান থেকে আর একটা সরাই কত দূর হবে?

সরাই-রক্ষক। ক্রোশখানেক দূরে। এই রাস্তা ধ’রে বরাবর সমান চ’লে যাও।

বৃদ্ধ বেগতিক দেখিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িল। নানাবিধ অঙ্গভঙ্গী ও মুখভঙ্গীপূর্ব্বক বিজড়িত স্বরে উত্তর করিল, “বাবা, অতদূর! এখান থেকে আর কোন্ বেটা এক পা নড়ে। আমার শিকড় নেমে গেছে, বাবা! এখন আমায় আর টেনে তোলা দায় হবে!” এই বলিয়া বৃদ্ধ সেই উঠানে ঘাসবনের মাঝখানে লম্বাভাবে উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িল, এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহার নাসিকা গৰ্জ্জন আরম্ভ হইল।

তাহার কথাবার্তা ও ভাবগতিক দেখিয়া তাহাকে কেহই সন্দেহ করিতে পারিল না। সরাই-রক্ষক তাহার এই দুরবস্থা দেখিয়া কোন কথা বলিল না। সকলে ভাবিল, “যাক্, বুড়োটা ঐ খানেই মড়ার মত প’ড়ে থাক্, তাতে আর আমাদের কি ক্ষতি হবে?”

ষড়যন্ত্রকারিগণও বৃদ্ধ মদ্যপের এই অবস্থা দেখিয়া আপন-আপন কথাবার্ত্তা আরম্ভ করিল। তার পর তাহাদের সমস্ত কথা শেষ হইলে দুজন সেই অপহৃতা বালিকাকে আনয়নার্থ আর একটি ঘরে চলিয়া গেল। সরাইরক্ষকও ঐ দুর্বৃত্ত কয়জনের ঘোড়া আনিবার জন্য আস্তাবলের দিকে অগ্রসর হইল।

তাহাদের কথাবার্তায় ও পরামর্শে ধার্য্য হইল, ঐ কয়জন লোক জগৎ সিংহের সহিত অশ্বারোহণে কোন পৰ্ব্বত-সমীপস্থ গ্রাম পৰ্য্যন্ত যাইবে। তথায় তাহাকে একখানি গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া টাকা কড়ি চুকাইয়া লইয়া চলিয়া আসিবে।

যে বৃদ্ধ মাতাল কথা কহিতে কহিতে তথায় পড়িয়া কুম্ভকর্ণের মত নিদ্রা যাইতেছিল, সে প্রকৃতপক্ষে মাতাল নহে—নিদ্রিতও হয় নাই। এস্থলে বলিয়া দেওয়া উচিত। এই বৃদ্ধ আর কেহই নহে, সেই রায়মল্ল গোয়েন্দা। এ কথা বোধ হয়, পাঠক অনেক পূর্ব্বে অনুমান করিয়া লইয়াছেন। অনুমানের উপর নির্ভর না করিয়া এস্থলে খুলিয়া বলা গেল। গুপ্ত মন্ত্রণাকারীদের প্রত্যেক কথার উপরে রায়মল্ল লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন। তিনি উপায় কি করিবেন, তাহাই ভাবিতেছিলেন। নিজ জীবনের জন্য যদি হইত, তাহা হইলে তিনি একাকী এই পঞ্চজনের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হইতে বিন্দুমাত্ৰ ভীত বা সঙ্কুচিত হইতেন না;কিন্তু তিনি কি করিবেন, পঞ্চজন ভায়ানক অসম সাহসিক লোকের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া যদি তিনি কোন প্রকারে আহত হইয়া পড়েন, আর এই বালিকা যদি তারাবাই হয়, তাহা হইলে অভাগিনী তারার দশা কি হইবে, এই ভাবনাতেই তাঁহার মস্তিষ্ক আলোড়িত হইতে লাগিল। কেমন করিয়া তারাকে এই দস্যুগণের কবল হইতে মুক্ত করিবেন, তাহাই তাহার একমাত্র চিন্তা হইল। তিনি অবশেষে স্থির করিলেন, দেখি কত দূর গড়ায়! কোন রকম একটা সুবিধা কি হইবে না?

তারার বিপদের উপর বিপদ্ ঘটিতে লাগিল। নিতান্ত বালিকা বয়স হইতে তাহার সম্পত্তি অপহরণ করিবার লোভে তাহাকে স্বীয় জন্মস্থান ছাড়াইয়া বৰ্দ্ধমানে স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল। তারপর সে জীবিত, কী মৃত অনেক দিন কেহ তাহার সন্ধান পায় নাই। মধ্যে রঘুনাথ তাহার রূপমোহে মুগ্ধ হইয়া তাহাকে পাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াও কিছু করিতে পারে নাই। ঘটনাক্রমে অভাগিনী সেই রঘুর হাতে বন্দিনী হয়। রায়মল্ল গোয়েন্দা সহায় না হইলে সে যাত্রা কি হইত বলা যায় না। পাঠক, এ সকল সংবাদ পূর্ব্বেই একবার পাইয়াছেন। সে বিপদে তারার কেহ ক্ষতি করিতে পারিল না বটে, কিন্তু এ আবার কি নূতন বিপদ্! এতদিন পরে জগৎসিংহ, তারা প্রকৃতই জীবিত আছে জানিয়াই কি এইরূপ ষড়যন্ত্র করিয়া তারার প্রাণ বিনষ্ট করিতে বদ্ধ পরিকর হইয়াছে? হায়! অর্থই অনর্থের মূল। যদি তারার বিষয়-বিভব না থাকিত, তাহা হইলে কে তাহার অনিষ্ট করিতে চেষ্টা করিত?

ঘটনাচক্রের আবর্তনে কি অদ্ভুত পরিবর্ত্তন! কি বিষম পরিণাম! কোথাও, স্বনামখ্যাত গোয়েন্দা সর্দ্দার প্রসিদ্ধ রায়মল্ল, আর কোন অভাগিনী রাজপুতবালা তারা! কেমন অপূৰ্ব্ব-সুযোগ! বিধাতা যদি রায়মল্লের প্রাণে এইরূপ দয়ার উদ্রেক না করিয়া দিতেন, তাহা হইলে তারা এতদিন জীবিত থাকিত কিনা সন্দেহ। ইহাই বড় আশ্চর্য্যের কথা বলিতে হইবে যে, দুইবারই ঘটনাক্রমে রায়মল্ল সাহেব যেন তারার বিপদ্ জানিতে পারিয়াই যথাসময়ে কাৰ্য্যস্থলে উপস্থিত হইলেন!

কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইলে পর এক লোমহর্ষক ব্যাপার ঘটিল। যে দৃশ্য দেখিলে কঠোর হৃদয়ও কোমল হয়, প্রস্তর দ্রবীভূত হয়, তাহাই সম্মুখে উপস্থিত হইল।

সেই লোমহর্ষন দৃশ্যে রায়মল্লের ন্যায় ধীর, স্থির, বুদ্ধিজীবী লোকেরও বুদ্ধিভ্রংশ হইবার উপক্রম হইয়াছিল।

অর্দ্ধোলঙ্গ তারাবাইকে লইয়া সেই দুজন দস্যু ফিরিয়া আসিল। একবার দেখিয়াই রায়মল্ল গোয়েন্দা তারাকে চিনিতে পারিলেন। তারা কাঁদিয়া বলিল, “ওগো! তোমরা আমায় একেবারে কেটে ফেল না কেন? এ রকম ক’রে দগ্ধে দগ্ধে মারবার দরকার কি? আমি তোমাদের কোন অনিষ্ট করি নি—কেন তোমরা আমায় এ যন্ত্রণা দিচ্চ? আমি তোমাদের এ অত্যাচারের যে কিছুই কারণ বুঝতে পারছি না। হা ভগবান্! তোমার এমন দয়ালু অনুচর কি এখানে কেউ নাই যে, আমাকে এই বিপদে—“

জগৎসিংহ বাধা দিয়া কহিল, “আমি তোমায় রক্ষা করতে পারতেম; কিন্তু কি করব বল, ওরা তিনজন আমি একা।”

রায়মল্ল গোয়েন্দার একবার ইচ্ছা হইল, তিনি ভূমিতল হইতে লাফাইয়া উঠিয়া ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া অভাগিনী তারাকে বলেন, “ভয় কি তারা! এই যে আমি রয়েছি এখানে। তোমার অনিষ্ট করবার কাহারও ক্ষমতা নাই!” কিন্তু রায়মল্ল গোয়েন্দা তাহা যুক্তিমূলক বিবেচনা করিলেন না। তিনি ক্রমাগত সুবিধাই অন্বেষণ করিতে লাগিলেন।

তারার ক্রন্দন, অনুনয় বিনয় শ্রবণেও ব্যাকুলতা কাতরতা-সন্দর্শনে রায়মল্লের বুক ফাটিয়া যাইতেছিল। তিনি আর ধৈর্য্যধারণ করিতে পারিতেছিলেন না। তাঁহার ইচ্ছা হইতেছিল, ক্ষুধাৰ্ত্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় সেই দুর্বৃত্তগণের স্কন্ধে অধিরুঢ় হইয়া তাহাদের দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া ফেলেন। অত অধিকক্ষণ সহিষ্ণুতা অবলম্বন করিয়া থাকা তাঁহার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর বোধ হইতে লাগিল। অভাগিনীর ক্রন্দনধ্বনি আর তাহার সহ্য হয় না। সহসা তিনি ভান করিয়া জাগরিত হইলেন। কৃত্রিম, কপট নিদ্রাত্যাগের তাঁহার আর একটি কারণ ছিল। তিনি যে কোন প্রকারে হউক, তারাকে ইঙ্গিতে তাঁহার উপস্থিতি বুঝাইয়া দিতে পারিলে, অভাগিনী মনে মনে আশ্বস্ত হইবে, এই উদ্দেশ্যেই ছল করিয়া কপট সুষুপ্তি ভঙ্গ করিয়া উঠিলেন।

সেই কয়জন চক্রান্তকারী দস্যুর সম্মুখে তারা হৃদয়ভেদী ক্রন্দন সহকারে করুণকণ্ঠে কাকুতি- মিনতি করিতেছে, তাহাকে ছাড়িয়া দিতে বলিতেছে, আর সে কখন কাহারও কিছু হানি করে নাই, তাহাই বুঝাইতে প্রয়াস পাইতেছে। তারা মনে মনে ভাবিতেছে, বুঝি সে আবার রঘুনাথের দলের হাতে পড়েছে; এবার বোধ করি, আর তাহার নিস্তার নাই।

রায়মল্ল গোয়েন্দা টলিতে টলিতে তাহাদের মধ্যস্থলে গিয়া দাঁড়াইলেন। বিকৃতভাবে, বিজড়িতস্বরে বলিলেন, “এই বাচ্ছা মেয়ে মানুষটাকে নিয়ে বাঘের মত তোমরা ক’জনে প’ড়ে কেন টানাটানি করছ, বাবা! তোমরা কি মানুষ খাও?”

তারা চীৎকার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “আমায় বাঁচান মশাই। আমায় রক্ষা করুন। আমি নিরপরাধী, এদের আমি কোন অনিষ্ট করি নি, এরা আমায় জোর ক’রে ধ’রে নিয়ে এসেছে, আমায় এরা কেটে ফেলবে, এরা আমার—“

তারা আর কিছু বলিতে পারিল না, তাহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া আসিল।

রায়মল্ল মত্তের ন্যায় মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “তুমি এদের—স-ঙ্গে—যেতে চাও না? না যেতে চাও—এরা তোমায় খেয়ে ফেলবে—তার আগে একটা মজা হোক, আমি তোমার কানটা একবার কামড়ে এঁটো করে দিই—ব্যস্।”

এই কথা বলিয়া ছদ্মবেশী রায়মল্ল টলিয়া টলিয়া, বিস্তৃতরূপে মুখব্যাদন করিয়া একেবারে তারার কানের কাছে মুখ লইয়া গেলেন। চক্রান্তকারিগণ মাতালের মজা দেখিতেছিল। তাহারা প্রথমতঃ বৃদ্ধ সুরাপায়ীর ঐ কার্য্যে বাধা দেওয়া বা আপত্তি করা যুক্তিযুক্ত মনে করিল না। রায়মল্ল সাহেব কিন্তু ইতিমধ্যে ফিফিস্ করিয়া তারার কানে কানে এইমাত্র বলিয়া লইলেন, “কোন ভয় নাই, তারা! আমি এসেছি।”

তাহার পরেই আবার সেইরূপভাবে টলিতে টলিতে বৃদ্ধবেশী রায়মল্ল গোয়েন্দা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এদের সঙ্গে—যেতে— চাও না—না?“

তারা উত্তর করিল, “না—না—ওদের সঙ্গে আমি কখনই যাব না, ওরা ডাকাত! ওরা খুনী! ওরা আমায় বাড়ী থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছে।”

তারা এইরূপভাবে উত্তর করিল বটে, কিন্তু ঐ বৃদ্ধের ঐ কয়েকটি সামান্য ইঙ্গিতেই সে বুঝিল, বৃদ্ধ কে? রায়মল্ল গোয়েন্দাই বৃদ্ধ সাজিয়া ছদ্মবেশে মাতালের ন্যায় কথা কহিতেছেন, তীক্ষ্ণবুদ্ধি তারার আর তাহা বুঝিতে বাকী রহিল না। এতক্ষণে তাহার প্রাণে আশার সঞ্চার হইল। এতক্ষণে সে বুঝিল, আর কেহ তাহার অনিষ্ট করিতে পারিবে না। তারার মনে পড়িল, কি ভয়ানক অবস্থায় রঘু ডাকাতের হস্ত হইতে রায়মল্ল সাহেব তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন! যাঁহার সাহসিকতা তারা একবার প্রত্যক্ষ দেখিয়াছে, তবে এখন তাঁহার তদনুরূপ কর্ম্মে কেন সন্দেহ ঘটিবে?

রায়মল্ল কহিলেন, “না যেতে চাও—নাই যাবে। তার এত ঝগড়া কেন? (ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি) কেন বাবা! তোমরা একে ধ’রে টানাটানি করছ, ওকে ছেড়ে দাও।”

এই কথা শুনিয়াই একজন দস্যু রায়মল্লের মুখের কাছে একটা পিস্তল খাড়া করিয়া বলিল, “তোর সে কথায় দরকার কি রে মাতাল বুড়ো! আমাদের যা’ ইচ্ছে তাই করব, তুই কে?”

পিস্তল দেখিয়াই রায়মল্ল ভয়ে যেন জড়সড় হইয়া পঞ্চ হস্ত সরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “পিস্তল সরাও বাবা! নাকের কাছে পিস্তল খাড়া ক’রে ও কিরকম ইয়ারকি? খুন করবে না কি?”

সপ্তম পরিচ্ছেদ – অনুসরণ

দস্যু উচ্চহাস্য করিয়া বলিল, “খুন করব, না ত কি? তুই আমাদের কাজে বাধা দিচ্ছিস্ কেন? “ রায়মল্ল। দেখ, তুই অতি ভীরু! আমি বুড়ো হয়েছি বটে, কিন্তু এক চড়ে তোর মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিতে পারি।

দস্যুগণ ও জগৎসিংহ সকলেই হোঃ হোঃ রবে হাসিয়া উঠিল।

একজন দস্যু বলিল, “যাক, আর তোমার বীরত্বে কাজ নাই। এখন এখান থেকে আস্তে আস্তে স’রে পড়।”

রায়মল্ল। তা’ সহজে যাচ্ছি না। এই মেয়েটিকে আমি নিয়ে যাব।

জগৎসিংহের পোষাক-পরিচ্ছদ বেশ ভদ্রলোকের ন্যায়। তাহার উপরে সে এরূপ ভাবভঙ্গী দেখাইতেছিল, যেন সে দস্যুগণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নহে। বৃদ্ধবেশী রায়মল্ল গোয়েন্দার অবশ্য তাহা অজানা ছিল না। তিনি ছল করিয়া জগৎসিংহের নিকটস্থ হইয়া কহিলেন, “আপনাকে ত ভদ্ৰলোক দেখছি; এ রকম অত্যাচার দেখে আপনি আমার মতেই মত দিবেন। আমি প্রস্তাব করি—আসুন, আমরা দুজনে চেষ্টা ক’রে এই বালিকাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাই।”

জগৎসিংহ রায়মল্লের কানে কানে বলিল, “ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে আমার সাহস হয় না। তবে আমরা ভালমানুষী করে বুঝিয়ে ব’লে দেখতে পারি, তাতে যতদূর হয়। পরের জন্য বেশি হাঙ্গামে দরকার কি?”

রায়মল্ল কহিলেন, “ওদের কাছে ভালমানুষী করা আর মৃতব্যক্তির জীবনদান করিতে যমরাজকে অনুরোধ করা, একই কথা।”

জগৎ। আমরা ওদের নামে নালিশ করতে পারি।

রায়মল্ল। আর ততক্ষণে এদিকে যে কাজ ফর্সা হ’য়ে যাবে।

জগৎসিংহ রায়মল্লের কথার উত্তর না দিয়া একজন দস্যুকে ইঙ্গিত করিবামাত্র সে রায়মল্লের নিকটবৰ্ত্তী হইয়া কহিল, “দেখ্ বুড়ো, তুই যদি আর বেশি বাড়াবাড়ি করিস্, তোকে এবার নিশ্চয় গুলি করে ফেল।”

রায়মল্ল মাতালের ন্যায় ভঙ্গী করিয়া কহিলেন, “আমি এক পাও নড়ব না, তুই কি করতে পারিস্ কর্। আমি এ মেয়েটিকে নিয়ে তবে যাব।”

রায়মল্ল সাহেব এই কথা বলিবামাত্র একজন দস্যু তাঁহাকে ধাক্কা দিতে আসিল। যেমন সে হস্ত প্রসারণ করিবে, অমনিই চিৎপাত হইয়া পড়িয়া গেল। বৃদ্ধের একটি ধাক্কার ভার সহ্য করিতে পারিল না।

অন্য দুইজন দস্যু তাহাদিগের সহচরের এই দশা দেখিয়া ক্রোধে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া বৃদ্ধকে আক্রমণ করিতে ধাবিত হইল। রায়মল্ল সাহেব তৎক্ষণাৎ পশ্চাৎ হটিয়া নিজের অঙ্গরাখার মধ্য হইতে দুইটি পিস্তল বাহির করিয়া দুই হস্তে ধারণ করিলেন। দস্যুগণ তদ্দর্শনে বিস্মিত হইল! রায়মল্ল কহিলেন, “এস, কার সাহস আছে, এগিয়ে এস। এক গুলিতে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।”

এই ব্যাপার দেখিয়াই জগৎসিংহ সেই কক্ষের প্রদীপ সহসা নির্ব্বাণ করিয়া দিল। তৎক্ষণাৎ তারার কাতর ক্রন্দনধ্বনি শ্রুত হইল, বোধ হইল, কে যেন তাহাকে লইয়া টানাটানি করিতেছে। তৎক্ষণাৎ এমন একটা শব্দ হইল, কে যেন দ্বার উদ্‌ঘাটিত করিয়া লাফাইয়া পড়িল। তৎক্ষণাৎ অশ্বের পদধ্বনি শ্রুতিগোচর হইল। রায়মল্ল সাহেব বুঝিলেন, একজন তারাকে লইয়া পলায়ন করিল। তিনি বাতায়ন উন্মুক্ত করিয়া পিস্তলের চারিটা আওয়াজ করিলেন। একজন দস্যু পলায়ন করিতে চেষ্টা করিতেছিল, সে আহত হইয়া সেই স্থানে পড়িয়া গেল।

রায়মল্ল সাহেবও সেই অবকাশে বাহির হইয়া যে স্থানে তাঁহার আপনার ঘোড়া বাঁধিয়া রাখিয়াছিলেন, তথায় আসিয়া চকিতমধ্যে উপনীত হইলেন। অশ্বারোণ পূর্ব্বক দুই-তিনবার পিস্তলের আওয়াজ করিলেন। সেই শব্দে শঙ্কিত হইয়া জগৎসিংহের ও আর একজন দস্যু ঘোড়া পলায়নপরায়ণ হইল। রায়মল্ল গোয়েন্দা আর তথায় অপেক্ষা না করিয়াই বেগে পলায়িত দস্যুর পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। এদিকে জগৎসিংহ, সরাই-রক্ষক এবং আর একজন দস্যু বৃদ্ধের এই সকল ব্যাপার দেখিয়া অবাক্ হইয়া সেইখানে বসিয়া পড়িল।

সরাই-রক্ষক কহিল, “এ কি মহাশয়! এ বুড়ো ত সাধারণ নয়? “

জগৎসিংহ কহিল, “ও আর কেউ নয়, সেই রায়মল্ল গোয়েন্দা! ও নিশ্চয়ই আমার পিছু পিছু এসেছিল।”

দস্যু। তা’ যদি হয়, তা’ হ’লে তারা হাত ছাড়া হয়েছে। রায়মল্ল নিশ্চয়ই রাজারামের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেবে। আর রাজারামেরও বোধ হয় প্রাণ যাবে।

দস্যু প্রকৃত কথাই বলিয়াছিল। যিনি একক, পঞ্চজন অসীমসাহসী কালান্তকতুল্য যমদূতের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে ভরসা করেন, তিনি একটা মাত্র দস্যুকে তুচ্ছ বিবেচনা করেন। রাজারাম তাঁহার নিকট নগণ্য। তাহার হস্ত হইতে তারাকে উদ্ধার করিতে পারিবেন, এ কিছু বিচিত্র নয়, দুরূহ কাণ্ড নয়?

জগৎসিংহ ও সেই দস্যুদ্বয় মুহূৰ্ত্তমাত্র ব্যয় না করিয়া আপন আপন অশ্বের অনুসন্ধানে দ্রুতপদবিক্ষেপে ধাবিত হইল; কিন্তু সে অশ্বদ্বয় পূৰ্ব্বেই দৌড়িয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে, আর খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। জগৎসিংহ নিরাশ হইয়া বলিলেন, “ও নিশ্চয়ই সেই রায়মল্ল গোয়েন্দা — আমাদের সব ষড়যন্ত্র এতদিনে নিষ্ফল হ’ল!”

তাহারা আবার সরাইখানায় ফিরিয়া গেল। তারাকে অপহরণ করিয়া যে দস্যু প্রাণ উপেক্ষা করিয়া অশ্বারোহণে বিদ্যুদ্বেগে ধাবিত হইয়াছিল, তাহারই অনুসরণে রায়মল্ল গোয়েন্দা প্রবৃত্ত হইলেন।যে ভয়ে তিনি দস্যুগণের সহিত প্রথমে বাদ-বিসম্বাদ করেন নাই, তাহাই ঘটিল। তারাকে লইয়া স্বচ্ছন্দে তাঁহার হাত ছাড়াইয়া একজন প্রস্থান করিল। তিনি তখন তাহার কিছু করিতে পারিলেন না। প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিয়া, তাহাকে সেই অন্ধকারে কেবল অশ্বের পদশব্দ লক্ষ্য করিয়া গিরিপথে ছুটিতে হইল। তিনি বুঝিয়াছিলেন, এবারে তাহারা তারাকে নিশ্চয়ই হত্যা করিবে। অন্যের না হউক, জগৎসিংহের পক্ষে তারা জীবিত থাকা এক প্রধান অন্তরায়। এ কথা যদি রাজারাম জানিতে পারিয়া থাকে, তাহা হইলে সে-ও অনায়াসে সে কার্য্য সমাধা করিয়া জগৎসিংহের নিকট পুরস্কার প্রাপ্ত হইতে পারে। তাই তিনি দস্যু রাজারামের পশ্চাৎগমন করা উচিত বিবেচনা করিলেন।

প্রভাত হইল। তথাপি রায়মল্ল সাহেব রাজারামকে ধরিতে পারিলেন না। অশ্বের পদচিহ্ন দেখিয়া তাঁহার স্পষ্ট প্রতীতি হইল, রাজারাম রাজেশ্বরী উপত্যকার দিকে গিয়াছে। সুতরাং তিনি আর তখন অধিক অগ্রসর হইলেন না। রাজেশ্বরী উপত্যকায় উপস্থিত হইবার সুগম পথ তিনি জানিতেন; সুতরাং অল্পসময়ের মধ্যেই তথায় উপস্থিত হইতে পারিবেন, এই আশায় তিনি বিশ্রামলাভার্থ ও মদ্যপ বৃদ্ধের বেশ পরিত্যাগ করিয়া অন্যবিধ ছদ্মবেশ ধারণ করিবার অভিপ্রায়ে পথিমধ্যস্থ একটি ক্ষুদ্র পান্থশালায় প্রবেশ করিলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – ছদ্মবেশ

দিবা দ্বিপ্রহরের সময়ে রাজেশ্বরী উপত্যকায় প্রায় দশ-বারজন দস্যু সম্মিলিত হইয়া নানাবিধ কথাবার্তা কহিতেছে, এমন সময়ে প্রতাপবেশী একজন লোক তথায় উপস্থিত হইলেন। পাঠক পাঠিকা! তিনি আর কেহই নহেন, স্বয়ং রায়মল্ল গোয়েন্দা।

এই স্থলে কয়েকটা কথা বলা আবশ্যক। পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে, রঘুনাথ দলের নেতা ছিল; কিন্তু তাহার দলের সমস্ত লোক এক সময়ে এক স্থানে থাকিত না। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন কাৰ্য্যে দশ বা পনের জন মিলিয়া এক-একটি ক্ষুদ্র দল বাঁধিয়া থাকিত। এই সকল ক্ষুদ্র দলের এক-একটি নেতা ছিল। তাহারই আজ্ঞায় এই সকল ক্ষুদ্র দস্যুদল চালিত হইত; কিন্তু ইহারা সকলেই এক নিয়ম, এক পদ্ধতিক্রম এবং এক প্রকার সঙ্কেত, ইঙ্গিত অবলম্বন করিত। একটি ক্ষুদ্র দস্যুদলের নিয়োজিত নূতন একজন লোক অন্যদলের লোকের সহিত অপরিচিত হইলেও তাহার ইঙ্গিত, ইসারা ও দুই-একটি সাঙ্কেতিক চিহ্ন থাকিলেই অবিকল বুঝিতে পারিত যে, সে লোক তাহাদেরই দলস্থ একজন বটে। রায়মল্ল গোয়েন্দা প্রতাপ সাজিয়া, অনেক দিন ধরিয়া রঘুনাথের দলে মিশিয়াছিলেন। তিনি অপরিচিত দস্যুদলের নিকটে পরিচিত হইবার আবশ্যকীয় সকল বিষয়ই জানিতেন। যে প্রতাপ সেই যে রায়মল্ল, একথা রঘুনাথ এবং রঘুনাথের দলের যে কয়জন কারারুদ্ধ হইয়াছে, তাহারা জানিতে পারিয়াছিল বটে; কিন্তু তাহারা ত আর এখন তাঁহার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে আসিতে পারিবে না। বিশেষতঃ রাজারামের ক্ষুদ্র দল সবেমাত্র মধ্যভারত প্রদেশ হইতে বহু অর্থ সঞ্চয় করিয়া প্রধান আড্ডায় ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহারা প্রতাপের কীর্তিকলাপের কিছুই অবগত ছিল না। এই সকল ভাবিয়া-চিন্তিয়া রায়মল্ল গোয়েন্দা নির্ভয়ে রাজেশ্বরী উপত্যকায় প্রতাপের বেশে রাজারামের দলস্থিত দস্যুগণের সম্মুখীন হইলেন। প্রয়োজনীয় চিহ্ন, গুপ্ত সঙ্কেত ইত্যাদি সমস্তই তিনি জানেন দেখিয়া, কেহই তাঁহাকে ছদ্মবেশী বলিয়া অনুভব করিতে পারিল না। তিনি তাহাদের মধ্যে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যেন বেশ পরিচিতের ন্যায় কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। রঘুনাথ বন্দী হইয়াছে শুনিয়া, রাজারামের নেতৃত্ব-ভার গ্রহণ করিতে ইচ্ছা হইয়াছিল। রাজারাম রঘুনাথের ন্যায় ভীরু কাপুরুষ নয়, রায়মল্ল গোয়েন্দা তাহা জানিতেন, অনেক দিন পূর্ব্বে একবার তিনি রাজারামকে একাকী শৈলপথে অবরুদ্ধ করিবার সুযোগ প্রাপ্ত হন। তাহাতে তাঁহার সহিত রাজারামের ঘোরতর দাঙ্গা হয়। তারপর অন্যান্য লোকজন আসিয়া পড়াতে বন্দী হইবার ভয়ে রাজারামকে পলায়ন করিতে হয়। সেই পৰ্য্যন্ত রাজারাম মধ্যভারত প্রদেশে ছিল। রায়মল্লের আশা মেটে নাই। তিনি বীরত্বের সম্মান রক্ষা করিতে সতত প্রস্তুত ছিলেন। তাঁহার বড় আশা ছিল, যদি কখন আবার রাজারামের দেখা পান, তাহা হইলে তাহার বাহুবল ও অস্ত্র শিক্ষানৈপুণ্য একবার ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিবেন। এই অবসরে যদি দুর্ঘটনার সুযোগ ঘটে, সেই আশায় রায়মল্ল সাহেব তথায় প্রতাপের পরিচ্ছদ পরিহিত হইয়া উপস্থিত হইলেন। দস্যুদলের সহিত আলাপ করিতে তাঁহার কোন ক্লেশ হইল না।

অন্যান্য কথাবার্তার পর রাজারাম জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা প্রতাপ। রায়মল্ল গোয়েন্দা ত আমাদের সর্বনাশ করলে। তাকে কি কোন রকমে জব্দ করা যায় না?”

প্রতাপ। যাবে না কেন? সুবিধামত পেলেই হয়। লোকটা যেন অন্তর্যামী। আমরা কি করি, কোথায় যাই, কোথায় থাকি, সে সব খবর রাখে। কাল তাকে আমি হাতে পেয়েও কিছু করতে পারলেম না।

রাজারাম যেন বিস্মিত হইয়া বলিল, “কাল তাকে দেখেছিলে? কোথায় বল দেখি?”

প্রতাপ। বুঁদীগ্রামে যাবার রাস্তায়।

রাজারাম। তাকে কি রকম পোষাকে দেখলে বল দেখি?

প্রতাপ। সে বুড়ো সেজে ছদ্মবেশে যাচ্ছিল।

রাজারাম তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, “তবে ত ঠিক হয়েছে, সেই লোকটাই বটে!”

প্রতাপ। কি রকম? তুমিও দেখেছিলে না কি?

রাজারাম। শুধু দেখেছিলেম? সে আমাকে অবাক্ ক’রে দিয়েছে। কাল আর একটু হ’লেই তার হাতে আমার মৃত্যু হত।

প্রতাপ। তবে তুমিই বুঝি জগৎসিংহের কথায় বিশ্বাস করে বুঁদীগ্রাম থেকে একটা মেয়ে চুরি করে এনেছ?

রাজারাম। তুমি কেমন ক’রে জানলে?

প্রতাপ। আমি আর জানি না। জগৎসিংহ ত প্রথমে আমাকেই এই কাজের ভার নিতে বলে। তা’ আমি কব কেন? জগৎসিংহকে কি আমি চিনি না? আর একবার তার একটা কাজ ক’রে দিয়েছিলেম— সে এক পয়সাও আমায় দেয় নি, লোকটা ভারি জুয়াচোর। আরও একটা কথা এই যে, যে মেয়েটিকে তুমি এনেছ, রায়মল্ল গোয়েন্দা তার সহায়! যদি প্রাণ যায়, তবু তাকে উদ্ধার করতে সে চেষ্টা করবে। যদি পয়সাই না পাই, তবে একটা দুঃসাহসিক কাজে আমি সহজে হাত দিতে যাব কেন?

রাজারাম। জগৎসিংহকে কি তুমি বিশ্বাস কর না?

প্রতাপ। কেমন ক’রে করি বল? যে লোকটা কাজ করিয়ে নিয়ে টাকা দেয় না, তাকে কি ক’রে বিশ্বাস করি? তার উপরে যে বালিকার ব্যাপার নিয়ে তার এত ঝোঁক, তার উপরে কোন অত্যাচার করতে গেলেই রায়মল্ল গোয়েন্দার হাতে পড়তে হবে। সে ত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। রঘু ডাকাত ত ঐ জন্যই মারা গেল—দলকে দল শুদ্ধ ধরা পড়ল।

রাজারাম কিছু ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বল কি? তবে ত সৰ্ব্বনেশে কাজে আমি হাত দিয়েছি। আচ্ছা, যদি ঐ বালিকাকে রক্ষা করবার জন্য রায়মল্ল গোয়েন্দার এত ঝোঁক্, তবে সে জগৎসিংহকে জব্দ করে দেয় না কেন?”

প্রতাপ। তা’ বুঝি জান না? কাল রাত্রে জগৎসিংহ ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। রাজারাম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি রকম?”

প্রতাপ। আঃ সে নাস্তানাবুদের একশেষ। শেষকালে অপমান হ’য়ে ভয়ে সরাই থেকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। পিছু পিছু অমনই রায়মল্ল গোয়েন্দা তাকে তাড়া করল। আমি ত কাণ্ডকারখানা দেখেই স’রে পড়লেম। তা’ছাড়া জগৎসিংহের উপরে আমার রাগ ছিল ব’লে আমি আর কিছু করলেম না। ও জুয়াচোর বেটা মারা যায় যাক্—আমার তায় ক্ষতিবৃদ্ধি নি। আমি ত তাই চাই

রাজারাম রায়মল্ল গোয়েন্দাকে প্রথমে একটু সন্দেহ করিয়াছিল; কিন্তু তাঁহার এই সকল কথা শুনিয়া সে সন্দেহ অনেকটা তিরোহিত হইয়া গেল। রায়মল্ল সাহেব কিন্তু এরূপভাবে কথাবার্তা কহিয়া একটি বিশেষ কার্য্যসাধন করিয়া লইলেন। তাঁহার প্রথম উদ্দেশ্য—তারা এখনও রাজারামের নিকটে অবরুদ্ধ দশায় আছে কি না জানিয়া লওয়া। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, জগৎসিংহের উপরে রাজারামের অবিশ্বাস জন্মাইয়া দেওয়া। বলা বাহুল্য, তাঁহার সে দুই উদ্দেশ্যই সফল হইল।

নবম পরিচ্ছেদ – অনুসরণের ফল

এইরূপে রাজারাম ও প্রতাপ ওরফে রায়মল্ল গোয়েন্দা উভয়ের বিস্তর কথাবার্ত্তা চলিল। রাজারাম কোথায় কি ভাবে ডাকাতি করিয়াছে, তাহা সমস্তই তাঁহার নিকটে বর্ণন করিল। প্রতাপ কথায় কথায় তাহার নিকট হইতে অনেক সন্ধান জানিয়া লইলেন। রাজারাম প্রতাপের সহিত খুব বিশ্বাসী বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করিল। এরূপভাবে দস্যুদলের মধ্যে রায়মল্ল গোয়েন্দা নিঃসহায় অবস্থায় আসিতে সাহস করিবেন, ইহা কি রাজারামের কল্পনাতে আসা সম্ভব।

ক্রমে সন্ধ্যা অতীত হইল। রজনীর গাঢ়তা হইল। দস্যুগণের আহারাদি প্রস্তুত হইলে সকলেই আহার করিল। রায়মল্ল সাহেবও তাহাতে যোগ দিলেন। একে একে সকলে শিবির মধ্যে শয়ন করিল, রাজারাম ও রায়মল্ল সেই সঙ্গে শয়ন করিয়া নিদ্রিত হইলেন।

প্রকৃতপক্ষে প্রতাপবেশী রায়মল্ল সাহেব নিদ্রিত হন্ নাই। তিনি দেখিয়াছিলেন, রাজারাম চুপি চুপি একজনকে কি আজ্ঞা করিল। সেই আজ্ঞামতে সে আহারীয় দ্রব্য-সামগ্রী লইয়া একদিকে চলিয়া গেল। তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন, সে আহারীয় দ্রব্য তারার জন্য প্রেরিত হইল। তারাকে কোথায় বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছে, তাহা তিনি যদিও জানিতেন না, কিন্তু এ পর্যন্ত জানা থাকাতে সে স্থান- নির্ণয়ে আর বিশেষ কোন কষ্ট হইবে না ভাবিয়া তিনি নিশ্চিন্ত হইলেন। তাঁহার নাসিকাধ্বনি শুনিতে শুনিতে রাজারাম নিদ্রিত হইল।

রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় যে দুইজন লোক শিবিরের অনতিদূরে পাহারা দিতেছিল, তাহাদের মধ্যে একজন আসিয়া রাজারাম ও অন্যান্য দস্যুকে উঠাইল।

রাজারাম জিজ্ঞাসা করিল, “কি হয়েছে?”

প্রহরী দস্যু বলিল, “জগৎসিংহ নামে একটা লোক এখনই দেখা করতে চায়। তাকে আমরা আর একটু হলেই গুলি করে ফেলেছিলেম; কিন্তু সে আমাদের সাঙ্কেতিক বাঁশী বাজিয়ে হঠাৎ রক্ষা পেয়ে গেছে।”

রাজারাম। তাকে নিয়ে এস—সে আমার জানা লোক। তার সঙ্গে একটা কাজ চলছে।

ক্ষণপরে প্রহরী জগৎসিংহকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিল।

জগৎসিংহ আসিয়াই জিজ্ঞাসা করিল “সে বালিকা হাতছাড়া হয় নি ত?”

রাজারাম। না।

জগৎ। তোমার পিছু পিছু একজন লোক তাড়া করেছিল, তা’ জান?

রাজারাম। জানি।

জগৎ। সে লোক কে, তা’ জান?

রাজারাম। কে?

জগৎ। রায়মল্ল গোয়েন্দা।

রাজারাম বিস্মিত হইয়া বলিল, “বল কি! তা’ ভালই হয়েছে, এবার তাকে আমি ফাঁকি দিয়েছি।”

জগৎ। কিছু বলা যায় না। আমি একবার সেই মেয়েটাকে দেখতে চাই। নইলে আমার মনের সন্দেহ ঘুচবে না।

রাজারাম। কেন? তোমার কি বিশ্বাস হয় না?

জগৎ। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়, চল দেখি।

এই সময়ে রাজারাম একবার প্রতাপের জন্য চারিদিকে চাহিল;কিন্তু তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। জগৎসিংহকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি প্রতাপকে জান?‘

জগৎ। কে প্রতাপ?

রাজারাম। কেন, যাকে তুমি প্রথমে এই কাজে হাত দিতে বলেছিলে?

জগৎ। কৈ, আমি ত আর কাউকে কখন বলি নি।

রাজারাম। কাউকে বল নি? সে কি রকম! সে গেল কোথায়?

রাজারাম ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া চারিদিকে প্রতাপের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। জগৎসিংহ জিজ্ঞাসা করিল, “কি, ব্যপার কি বল?”

রাজারাম। একটা লোক এসে সব ঠিকঠাক বলে, তোমার সঙ্গে তার পরিচয় আছে—তুমি তাকে ঠকিয়েছ—টাকা দাও নি, তাও বললে, রঘুনাথের কথা বলে, আমাদের সঙ্কেত, ইঙ্গিত, ইসারা, ধরন-ধারণ সব জানে, দেখলেম; সে লোকটা গেল কোথায়?

আবার রাজারাম নিতান্ত অস্থির হইয়া চারিদিকে ছুটোছুটি করিয়া প্রতাপের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। অবশেষে কোন স্থানে তাহাকে দেখিতে না পাইয়া নিরাশ হইয়া কহিল, “পালিয়েছে— লোকটা নিশ্চয়ই প্রবঞ্চক! তোমার নাম ধ’রে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিল, তোমাকে আসতে দেখেই বেমালুম স’রে পড়েছে।”

জগৎসিংহ মাথায় হাত দিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িল। ভগ্নকণ্ঠে কহিল, “এ সব কথা যদি ঠিক হয়, তা’হ’লে সে বালিকাও নাই। আমি দশ হাজার টাকা বাজী রাখতে পারি; সে যদি পালিয়ে থাকে, তবে সে বালিকাও সঙ্গে সঙ্গে হাত-ছাড়া হয়েছে।”

রাজারাম। ওঃ! আমি এতক্ষণে সব বুঝতে পেরেছি। এ-ও সেই রায়মল্ল গোয়েন্দার ছল! উঃ! লোকটা কি ভয়ানক জাঁহাবাজ! কি ভয়ানক সাহসী! অকুতোভয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলে। একসঙ্গে আহারাদি হ’ল, এক সঙ্গে নিদ্রা গেল! উঃ, আচ্ছা ঠকানটা ঠকিয়েছে!

রাজারাম প্রতাপের সঙ্গে তাহার সে রাত্রির কথা সংক্ষেপে সমস্ত বলিলে তারাকে যে স্থানে রাখা হইয়াছিল, জগৎসিংহ সেই স্থান দেখিতে চাহিল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দস্যুগণ অনতিদূরে একটা পুরাতন অট্টালিকার সম্মুখবর্তী হইল। রাজারাম প্রথমে সেই ভগ্ন অট্টালিকার মধ্যে একটি কক্ষে প্রবেশ করিয়াই বলিল, “নাই—নাই—নিয়ে পালিয়েছে, সর্ব্বনাশ করেছে!”

ক্রোধে, ক্ষোভে রাজারাম দন্তে দত্ত ঘর্ষণ করিয়া বলিল, “আমি ভূত বিশ্বাস করি না; কিন্তু এ রায়মল্ল গোয়েন্দা মানুষ না ভূত? দেখছি যে, এ লোকটা ভূতের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান্! এর কাজ সব ছায়াবাজীর মত! বলিহারি সাহস!!”

উত্তমরূপে সন্দেহ বিমোচনের জন্য জগৎসিংহ আলো ধরিয়া সেই কক্ষের অন্তরালে ও নিভৃত স্থান সকল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ভাল করিয়া দেখিতে লাগিল। একজন দস্যু একখানি টুক্রা কাগজ কুড়াইয়া পাইল। রাজারাম তাহা লইয়া জগৎসিংহকে পাঠ করিয়া শুনাইল, —

“অভাগিনী তারার ভাল-মন্দের ভার আমি গ্রহণ করিয়াছি। এখন আমি তাহার রক্ষক। যে তাহার প্রতি কোন অত্যাচার করিবে, সে আমার পরম শত্রু। শমনের ন্যায় আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ারূপে ভ্রমণ করিব। সাবধান! কেউ তারার অনিষ্ট চেষ্টা করিয়া নিজের মৃত্যুপথ পরিষ্কার করিও না।

সরকারী গোয়েন্দা—
শ্রীরায়মল্ল সাহেব।”

এই পত্র শ্রবণ করিয়া জগৎসিংহের মুখ ম্লান হইয়া গেল। বক্ষঃস্থল কম্পিত হইল—ঘন ঘন নিঃশ্বাস বহিতে লাগিল। সে ভাবিতে লাগিল, তারার বিষয় রায়মল্ল গোয়েন্দা কতদূর জানে? তারা কে, কার কন্যা, কে তার বিষয় ফাঁকি দিয়া ভোগ করিতেছে, এ সব কথা কি সে জানে? সে কি তারার বিষয় বাস্তবিকই পুনরুদ্ধার করিয়া দিবার ভার লইয়াছে? যদি তা হয়, তা’ হ’লে আমার ঐশ্বর্য্য সম্ভোগের দিন বুঝি বা চিরস্থায়ী হ’ল না।

যদিও আদালতের মোকদ্দমায় বার বার তাহার জয় হইয়াছে, যদিও বর্ত্তমান তারা, প্রকৃত তারা বলিয়া প্রমাণীকৃত হয় নাই, তথাপি রায়মল্ল গোয়েন্দা তারার ভাল-মন্দের ভার গ্রহণ করিয়াছে শুনিয়া জগৎসিংহের অন্তরাত্মা স্তম্ভিত হইল। জগৎসিংহ মোকদ্দমা শেষ হইবার পর হইতেই যে কোন প্রকারে হউক, তারাকে হস্তগত করিবার চেষ্টা করিতেছিল। যতদিন অজয় সিংহ পীড়িত হন নাই, ততদিন সে অনেক চেষ্টা করিয়াও কিছু করিতে পারে নাই।

এতদিনে জগৎসিংহ বুঝিতে পারিল, বার বার রেহাই হইয়াছে, কিন্তু এবার উদ্ধারপ্রাপ্ত হওয়া আর বড় সহজ কাজ নয়। রায়মল্ল গোয়েন্দা এ পর্য্যন্ত কোন কার্য্যে বিফল হন নাই। তারার বিষয় পুনরুদ্ধারে যে তিনি সমার্থকমনোরথ হইবেন তাতেই বা বিচিত্রতা কি? রায়মল্ল সাহেব যদি রীতিমত উদ্যোগ করেন, তাহা হইলে তিনি যেমন করিয়া হউক, প্রমাণাদি সংগ্রহ করিয়া তবে আদালতে উপস্থিত হইবেন। জগৎসিংহ এতদিন পরে প্রমাদ গণিল। সে উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “চল, আমরা এখনই রায়মল্লের পশ্চাদ্ধাবন করব। সে এতক্ষণে কতদূর গিয়াছে। যে রায়মল্ল গোয়েন্দাকে খুন ক’রে তারাকে আমার হাতে সমর্পণ করতে পারবে তাকে আমি দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবো। আমরা এত লোক এক সঙ্গে মিলে একটা লোককে আর খুন করতে পারব না?”

দস্যুগণ সকলেই লাফাইয়া উঠিল। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে সকলেই ঘোড়ায় চড়িয়া তীরবেগে রাজেশ্বরী উপত্যকা হইতে বাহির হইয়া পড়িল।

দশম পরিচ্ছেদ – বন্দিনীর উদ্ধার

পাঠক মহাশয়ের স্মরণ থাকিতে পারে, যে সময়ে দস্যুগণ নিদ্রা যাইতেছিল, রায়মল্ল সাহেব সে সময়ে নাসিকাধ্বনি করিয়া আপন উপায় চিন্তা করিতেছিলেন। যখন তিনি দেখিলেন, জনপ্রাণীও আর জাগ্রত নাই, তখন ধীরে ধীরে শয্যা পরিত্যাগ করিয়া তারার অনুসন্ধানে চলিলেন। কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়াই তিনি দেখিলেন, পর্ব্বতের অন্তরালে একটি প্রকাণ্ড প্রস্তরনির্ম্মিত ভগ্ন-বাটী রহিয়াছে। স দেখিলেই বোধ হয়, যেন উহা একটি প্রাচীন দুর্গ। হয় ত পূর্ব্বকালে রাজস্থানের কোন রাজা গ্রীষ্মের সময়ে এই বাটীতে আসিয়া বাস করিতেন। বহুকাল আর তথায় কেহ বাস করে না। তাই বুঝি, এখন নিৰ্জ্জন ভগ্ন অট্টালিকা দস্যুগণের আবাসস্থলে পরিণত হইয়াছে।

ভগ্ন অট্টালিকার দ্বারে উপস্থিত হইবামাত্রই তিনি যেন অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি শুনিতে পাইলেন। তাঁহার মনে হইল, “এইখানেই নিশ্চয় দস্যুগণ তারাকে বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছে। অভাগিনী না জানি, কত ক্লেশই ভোগ করিতেছে!” বিদ্যুদগতিতে তিনি বাটীমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। দেখিলেন, সম্মুখস্থ বিস্তৃত প্রাঙ্গণ বনজঙ্গলে পরিব্যাপ্ত। কেবল সদরদরজার দুইপার্শ্বে দুইটিমাত্র কক্ষ বাসোপযোগী। তাহারই একটি ঘর হইতে সে অস্পষ্ট ক্রন্দনধ্বনি নিঃসৃত হইতেছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিয়া অনুচ্চৈস্বরে ডাকিলেন, “তারা! তারা! তুমি এখানে?”

তারা জিজ্ঞাসা করিল, “কে আপনি?”

রায়মল্ল। তারা! আমি রায়মল্ল—আমি এসেছি! আমার কণ্ঠস্বরে আমায় চিনতে পারছ না! তুমি আমার সঙ্গে উঠে আসতে পারবে?

তারা অতিশয় আগ্রহের সহিত উত্তর করিল, “আপনি এসেছেন, তবে আমি বাঁচব। ডাকাতেরা আমায় বিনা অপরাধে খুন করতে পারবে না। আপনি আমায় উদ্ধার করুন, বাঁচান্। এরা আমার হাত পা বেঁধে এখানেই ফেলে রেখেছে।”

রায়মল্ল তৎক্ষণাৎ দীপশলাকা জ্বালিয়া গৃহের অবস্থা এবং তারার দশা দেখিয়া লইলেন। তারপরেই পকেট হইতে একখানি ছুরিকা বাহির করিয়া তারাকে বন্ধনমুক্ত করিলেন।

রায়মল্ল বলিলেন, “এস তারা। কথা কহিবার সময় নাই।”

তারা একটি কথাও কহিল না। রায়মল্ল সাহেব যাহা বলিলেন, সে তাহাই করিল। প্রাণের দায়ে ঝোপের পাশ দিয়া আড়ালে আড়ালে গুঁড়ি মারিয়া দুইজনে বহুদূর গেলেন। তাহার পর রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “আর ভয় নাই। এইবার আমরা নিরাপদ স্থানে এসে পড়েছি। রাজেশ্বরী উপত্যকা থেকে বাহির হ’বার দুটি পথ জানি। দস্যুরা তা’ জানে না। এইখানে আমরা খানিকক্ষণ লুকিয়ে থাকব। যদি দস্যুরা এদিক্ পর্য্যন্ত খুঁজতে আসে, তা’ হ’লে আমরা অনায়াসে পালাতে পারব। আর যদি এদিকে অনুসন্ধান না করে, তা’ হলে আমরা অন্য উপায় অবলম্বন করব। দস্যুরা —রাজেশ্বরী উপত্যকায় প্রবেশ করবার যে পথ জানে, আমিও সেই পথ দিয়া এসেছি। তার কিছু দূরেই বনের ভিতর একস্থানে আমার ঘোড়াটি বাঁধা আছে। আমার বোধ হয়, তোমাকে না দেখতে পেলেই দস্যুরা বুঝতে পারবে, আমি এখানে এসেছি। আমি যে তোমাকে উদ্ধার ক’রে নিয়ে পালিয়ে গেছি, তাও তাদের ধারণা হবে। তা’ হলে কখনই তা’রা এখানে নিশ্চিন্ত হ’য়ে বসে থাকবে না। তা’রা সকলে মিলে আমার পশ্চাদ্ধাবন করতে চেষ্টা করবে। আমরাও অনায়াসে যে পথ দিয়ে এসেছি, সেই পথেই বেরিয়ে যেতে পারব।”

তারা কাতরভাবে বলিল, “তার চেয়ে আমরা অন্য পথ দিয়ে পালাই না কেন?”

রায়মল্ল। অন্য পথ দিয়ে পালাতে গেলে আমাদের হেঁটে যেতে হবে। এ পথ দিয়ে বেরিয়ে যদি একবার ঘোড়ায় চড়তে পারি, তা’ হ’লে আর আমাদের ধরে কে?

অগত্যা তারা তাহাতে সম্মত হইল। তাহার পর দস্যুগণ রাজেশ্বরী উপত্যকা হইতে চলিয়া গেলে রায়মল্ল সাহেব তারাকে লইয়া তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন এবং অতি সত্বর উভয়ে এক অশ্বে আরোহণ পূর্বক প্রস্থান করিলেন। রায়মল্ল সাহেব বুঝিয়াছিলেন, দস্যুগণ তারাকে পাইবার জন্য বুঁদি গ্রাম পৰ্য্যন্ত যাইবে। তাই তিনি সেদিকে না গিয়া ভিন্ন পথ অবলম্বন করিলেন।

একাদশ পরিচ্ছেদ – অন্য চেষ্টা

এবার তারাকে উদ্ধার করিয়া রায়মল্ল সাহেব আর বুঁদিগ্রামে ফিরিয়া গেলেন না।

পর্ব্বতের অপর পারে সমতল ভূমিখণ্ডে একটি ক্ষুদ্র নগর। এই স্থানে তারার পৈতৃক বাসবাটী ছিল। সে বাটী প্রকাণ্ড— রাজ-রাজড়ার ন্যায় সমস্ত আস্বাব। লোকজন, গাড়ী, ঘোড়া প্রভৃতি একজন ধনাঢ্য লোকের যাহা কিছু আবশ্যক, তারার পিতার তাহা সকলই ছিল। হায়, কার ধন কে পায়। সে রাজৈশ্বর্য্য এখন জগৎসিংহ ভোগ করিতেছে।

রায়মল্ল সাহেব এই নগরে উপস্থিত হইয়া তারাকে খুব নির্জ্জন স্থানে পুলিশের তত্ত্বাবধানে রক্ষা করিয়া তারার সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে যে যে লোক এবং যে যে প্রমাণ সংগ্রহ করা আবশ্যক, তজ্জন্য ব্যস্ত হইলেন।

জগৎসিংহ বাটীতে ফিরিয়া, কেমন করিয়া রায়মল্ল গোয়েন্দার হস্তে নিস্তার পাইবে, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিল।

তাহার প্রথম লক্ষ্য হইল, রঘু ডাকাতের উপরে। একমাত্র রঘু ডাকাতই তারার সমস্ত বিষয় জানে। সে রঘু ডাকাতই ত এখন রায়মল্লের চক্রে বন্দিভাবে জেলখানায় পড়িয়া আছে। বিপদে পড়িয়া সে হয় ত সকল কথা স্বীকার করিয়া ফেলিতে পারে। জগৎসিংহ সন্ধান লইতে লাগিল, রঘু ডাকাত এখন কোন্ কারাগারে বন্দী। দুইদিন পরে সে প্রকৃত সন্ধান পাইল। ঘুষ দিয়া রঘু ডাকাতকে উদ্ধার করিতে চেষ্টা করা, আর স্বেচ্ছায় ধরা দেওয়া একই কথা। এই বিবেচনায় সে সে পথ অবলম্বন করিল না। সে অনেক চেষ্টায় রঘু ডাকাতের তুল্যাকৃতি একটা লোক ঠিক করিল। সে- ও দস্যুদলস্থ লে।ক; নগরে থাকিয়া রঘু ডাকাতকে লুঠের সন্ধান প্রদান করিত। দস্যুগণের এরূপ সংবাদদাতা নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে অসংখ্য থাকে। সে লোকটিও সেইরূপ প্রকৃতির একজন। রায়মল্ল গোয়েন্দার চেষ্টাতে এখন চারিদিকে দস্যুদল ধরা পড়িতেছে দেখিয়া, সে আর সেরূপ কাৰ্যে বড় হাত দিতে সাহস করিত না; অথচ অন্নাভাবে তাহার পেট চালান দায় হইয়া উঠিয়াছিল।

জগৎসিংহ তাহাকে বলিল, “তুই একটা কাজ করতে পারিস্? আমি তোকে পাঁচ হাজার টাকা দেবো।”

যে পঞ্চাশ টাকা একসঙ্গে কখনও দেখে নাই, তাহার পক্ষে পাঁচহাজার টাকা কুবেরের ভাণ্ডার তুল্য বলিয়া বোধ হয়। মনে করিল, “আমি পাঁচ হাজার টাকা পেলে একেবারে রাতারাতি বড় মানুষ হ’ব।” আশ্চর্য্য ও আনন্দিত হইয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, “কি কাজ করতে হবে?”

জগৎ। বাপু হে, “জেল খাটতে হবে।”

সে কিছু বুঝিতে পারিল না। টাকার নাম শুনিয়া সে এত উন্মত্ত হইয়াছিল যে, কারণ জিজ্ঞাসা না করিয়া সে জেলে যাইতে প্রস্তুত হইল।

জগৎসিংহ তাহাকে আপন বাটীতে লইয়া গেল। সেইখানে তাহাকে সমস্ত কথা বুঝাইয়া বলিল। সে তাহাতে স্বীকৃত হইল।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – দুরভিসন্ধি

রায়মল্ল সাহেব কোথায় কি ভাবে আছেন, তাহা কেহ জানে না; কিন্তু তিনি যেখানে যান, যেন কেহ তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করে। এতদিন গোয়েন্দাগিরি কাজ করিয়াছেন, কিন্তু কেহ কখন তাঁহার অনুসরণে সাহসী হয় নাই। রায়মল্ল গোয়েন্দার দোর্দণ্ড প্রতাপ—অখণ্ডনীয় প্রভাব। তাঁহার নাম শুনিয়া দস্যু, তস্করগণ ভয়ে দূরে পলাইত। আজ কয়দিন ধরিয়া কে যেন তাঁহার পদানুসরণ করিতেছে। তিনি যেখানে যাইতেছেন, সেইখানেই যেন কেহ তাঁহার উপরে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেছে, পথে ঘাটে চলিতে গেলেও প্রায় কালমুস্কো জোয়ান দু-একটা সহসা তাঁহার পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতেছে। দুইজন দূরে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া যেন কি পরামর্শ করিতেছে। অলক্ষ্যে কে যেন সতত তাঁহার কার্য্যকলাপের দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি রাখিয়াছে। রায়মল্ল সাহেব এ দায়ে কখনও ঠেকেন নাই, তাই তাঁহার মনে হইল, এইবার জগৎসিংহ আর কিছু উপায় না দেখিতে পাইয়া, তাঁহাকে হত্যা করিয়া সকল দায় হইতে উত্তীর্ণ হইবার কল্পনা করিয়াছে। ভয় কাহাকে বলে, তাহা তিনি জানিতেন না। এ সকল দেখিয়া-শুনিয়াও তাঁহার বড় বিশেষ ভয় হইল না। কিন্তু তারার জন্য তিনি সতর্ক রহিলেন।

পত্র লিখিয়া তিনি বুঁদিগ্রাম হইতে অজয়সিংহকে আনাইয়া রাখিয়াছিলেন; সে-ই মঙ্গলও আসিয়াছিল। আর যে রাজপুত, তারাকে বৰ্দ্ধমানে বিসর্জ্জন দিয়া আসিয়াছিল, তাহাকেও তিনি অনেক অনুসন্ধানের পর বাহির করিয়াছিলেন।

এইরূপে কতিপয় দিবস অতিবাহিত হইলে পর একদিন রায়মল্ল সাহেব রজনীযোগে বহির্গত হইয়াছেন, এমন সময়ে তিনি সহসা দেখিলেন, তাঁহার দুই পার্শ্ব দিয়া দুইজন লোক তড়িদ্বেগে চলিয়া গেল। তিনি বুঝিলেন, ইহারা এখনও তাহার সঙ্গ ছাড়ে নাই। কি কারণে জানি না, সেদিন তাঁহার নিকটে অস্ত্র-শস্ত্রাদি কিছুই ছিল না। তিনি দেখিলেন, সেই দুইজন লোক কিয়দ্দূরে অগ্রসর হইয়া যেন পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিতেছে এবং তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া কি পরামর্শ আঁটিতেছে। যে গলি দিয়া তিনি যাইতেছিলেন, তাহা এক প্রকার নির্জ্জন স্থান বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অথচ যদি তিনি সেই স্থান হইতে পশ্চাৎপদ হন্, তাহা হইলে যে দুইজন লোক তাঁহার পিছু লইয়াছিল, তাহারা শিকার হাতছাড়া হইবার আশঙ্কায় দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে পারে। এই সকল কথা ভাবিতে ভাবিতে তিনি ফিরিয়া না আসিয়া ক্রমাগত অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সেই জনশূন্য গলিতে তিনি সেই অগ্রবর্ত্তী লোক এই দুইটি ব্যতীত আর কেহই নাই। তিনি বুঝিতে পারিলেন, আর কিছুদূর অগ্রগামী হইলেই তাহারা আক্রমণ করিবে। বহু চিন্তার পর তিনি একটি সরাপখানায় প্রবেশ করিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহার একজন অনুচর তথায় উপস্থিত ছিল। সে লোকটির ছদ্মবেশ দেখিয়া প্রথমে রায়মল্ল সাহেবের ভ্রান্তি হইয়াছিল। তিনি তাঁহাকে চিনিতে পারেন নাই; কিন্তু তিনি তথায় প্রবেশ করিবা মাত্রই সে উঠিয়া তাঁহার কাছে আসিল।

রায়মল্ল সাহেব নিম্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে কি দরকার, অজিৎ?”

অজিৎ। সেই আপনি যার পিছু নিতে বলেছিলেন, তার সঙ্গে সঙ্গেই আছি।

রায়মল্ল। এখানে আমাদের আর কেউ আছে?

অজিৎ। চার-পাঁচজন আছে।

রায়মল্ল। তোমার কাছে পিস্তল আছে?

অজিৎ। হাঁ।

রায়মল্ল। আমাকে দাও। তোমরা প্রস্তুত থেকো, এখনই একটা ভয়ানক কাজ করতে হ’বে; যে লোকটার উপর লক্ষ্য রাখতে বলেছি, সে-ও যাতে হাত-ছাড়া না হয়, তার উপায় করো—আমি আছি।

এই বলিয়া রায়মল্ল সাহেব পিস্তলটি লইয়া প্রস্থান করিলেন।

সরাপখানায় প্রয় দশ-বারোটি লোক মালামী করিতেছিল; কিন্তু তাহাদের মধ্যে যাহারা মদ না খাইয়া মাতালের ভান করিয়া মাতালগণের সঙ্গে সমান মালামী করিতেছিল, তাহারাই রায়মল্ল গোয়েন্দার অনুচর

রাস্তায় জনমানব নাই। সরাপখানায় যে কয়জন লোক ছিল, তাহাদিগকে দেখিলে ভাল লোক বলিয়া বোধ হয় না—পল্লীটাও ভাল নয়। ভদ্রলোকের বাস খুব কম। যে স্থলে অন্যলোক ভয়ে কম্পিত হইত, প্রাণনাশের বিভীষিকায় আকুল হইত, রায়মল্ল সাহেব সেই স্থলে অপূৰ্ব্ব সাহসিকতা ও অতুল মানসিক তেজের পরিচয় দিলেন। তিনি, শুঁড়িখানা হইতে বাহির হইয়া পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে রাস্তায় চলিতেছিলেন, সেইরূপভাবেই পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিলেন।

জগৎসিংহ যে লোককে পাঁচ হাজার টাকা দিতে স্বীকৃত হইয়াছিল, তাহাকে নিজালয়ে লইয়া গিয়া কি বলিয়াছিল এবং তাহার পর কি করিয়াছিল, তাহা পাঠক-বর্গ অবগত নহেন।

জগৎসিংহ মহাপাপী। যে প্রভুপত্নীর পতিব্ৰত্যে জলাঞ্জলি প্রদান করে, তার মত বিশ্বাসঘাতক, তার মত পাপী, আর কে আছে? পরের সম্পত্তি অপহরণ করিয়া পার্থিব ঐশ্বর্য্য ভোগ করিতেছে। এতদিন যে অতুল বিষয় সম্পত্তি সে নির্বিবাদে ভোগ করিয়াছে এবং ভবিষ্যতে যাহাতে সে সুখে বঞ্চিত হইতে না হয়, তজ্জন্য যখন এত আয়াস স্বীকার করিয়াছে, তখন কি তাহা সহজে ছাড়িয়া দিতে পারে? সে রায়মল্লের প্রাণবিনাশ করিয়া কন্টকের মূলোচ্ছেদ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইল। বিলক্ষণ অনুসন্ধানে সে জানিল, রায়মল্ল সাহেব রাজেশ্বরী উপত্যকা হইতে তারাকে উদ্ধার করিয়া আর বুদিগ্রামে প্রত্যাগত হন্ নাই। তখন সে সেই প্রসিদ্ধ গোয়েন্দার কার্য্যের উপরে গোয়েন্দাগিরি করিবার জন্য বহু লোক নিযুক্ত করিল। কিন্তু তাহার নিয়োজিত লোকজনের মধ্যে কেহই রায়মল্ল সাহেবের প্রাণ বিনষ্ট করিতে সাহসী হইল না। তখন তাহার মনে হইল, রাজারাম, রঘু ডাকাত অথবা দুইজনে একত্র সম্মিলিত না হইলে অপর কাহারও দ্বারা এ দুরূহ কার্য সম্পন্ন হইবার নয়। রাজারাম তাহার অভিসন্ধি শুনিয়া সেই কথারই প্রতিধ্বনি করিল। সে চিরকাল রঘু ডাকাতকে সর্দ্দার বলিয়া স্বীকার করিয়া আসিয়াছে এবং তাহার সূতীক্ষ্ণবুদ্ধি প্রভাবে অনেক সময়ে বিশেষ লাভবান্ হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত তাহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস, রঘু ডাকাতের মত অদ্বিতীয় সাহসী পুরুষ ভারতবর্ষের মধ্যে আর কেহ নাই। এই সকল কারণে রাজারাম জগৎসিংহকে পরামর্শ দিল, রঘু ডাকাত যদি একবার জেল হইতে বাহির হইতে পারে, তাহা হইলে রায়মল্লের ন্যায় দশটা লোককে হত্যা করিতে পারিবে।

জগৎসিংহও ভাবিয়া-চিন্তিয়া তাহাই ধাৰ্য্য করিল। তার পর সে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিতে স্বীকৃত হইয়া একটি লোক নিযুক্ত করিল। তাহাকে বুঝাইল, দেখ, তুমি দেখতে অনেককটা রঘু ডাকাতের মত। রঘু ডাকাতের আত্মীয় ব’লে পরিচয় দিয়ে তোমাকে জেলের ভিতরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। সেখানে সে যে পোষাক পরে আছে, সেই পোষাক তুমি পারবে, আর তাকে তোমার পোষাক ছেড়ে দেবে। রঘু তোমার পোষাক পরে জেল থেকে বেরিয়ে আসবে, আর তুমিই জেলে থাকবে। তাকে আমার এখন বড় আবশ্যক। রঘু ডাকাত মনে করে আদালতে তোমাকে নিয়ে বিচার হবে, তাতে নিশ্চয়ই তোমার সপরিশ্রম কারাদণ্ড হবে? যদি পারি, পরে তোমায় উপায়ন্তরে উদ্ধার করব। এখন মনে কর, তোমায় জেল খাটতে হবে। আর সেইজন্যই তোমায় পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছি। তোমায় জেল খাটতে হবে বটে, কিন্তু তোমার স্ত্রী- পুত্র পরিজনের ভরণ-পোষণের ভার আমি লইলাম। ঐ পাঁচ হাজার টাকা তোমার সঞ্চিত থাকবে। তুমি জেলখানা থেকে ফিরে এলে যা-হোক একটা লাভজনক ব্যবসা-বাণিজ্য ক’রে চালাতে পারবে।

জগৎসিংহ যে ব্যক্তিকে এই সকল পরামর্শ দিল সে একে গরীব, তায় দারুণ অন্নকষ্টে ক্লিষ্ট। স্ত্রী- পুত্র-পরিবার প্রভৃতির ভবিষ্যৎ সুখাশায় ও বৰ্ত্তমান অন্নদায় হইতে নিষ্কৃতিলাভার্থে জগৎসিংহের এই জঘন্য ঘৃণ্য পরামর্শে সম্মত হইয়া জেলে গেল। রঘু ডাকাত কারাগার হইতে বহির্গত হইয়া রাজারাম ও জগৎসিংহের সহিত মিলিত হইল। রায়মল্লের উপর রঘুনাথের জাতক্রোধ হইয়াছিল। তাঁহার প্রণনাশ করিতে সে উৎসাহের সহিত সে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইল। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, গোয়েন্দা সদার রায়মল্ল জানিতে পারিয়াছিলেন, কোন মন্দ অভিসন্ধিতে কেহ তাঁহার পিছু লাগিয়াছে।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – দুঃসংবাদ

রঘুনাথ একজন ভদ্র পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া কিছু কিছু শিক্ষা করিয়াছিল। বুঁদিগ্রামে তাঁহার পৈতৃক ভবন। বাল্যকালে সে তারার সহিত একসঙ্গে খেলা করিত। তাহার পর পিতৃমাতৃহীন হইলে রঘুনাথের চরিত্র অপবিত্র ও কলঙ্কিত হইয়া যায়। অসৎসঙ্গে মিশিয়া ক্রমশই সে নররাক্ষস ভীষণ পিশাচবৎ হইয়া উঠে, এই সময়ে জগৎসিংহের সহিত তারার আলাপ হয়। জগৎসিংহ তারাকে বৰ্দ্ধমানে পাঠাইয়া এক প্রকার নিশ্চিন্ত ছিল। তৎপরে অজয় সিংহ যখন তারার স্বত্ব প্রমাণ করিবার জন্য আদালতে উপস্থিত হন, সেই সময়ে তারা কেমন করিয়া বর্দ্ধমান হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল, তাহা জানিবার অভিলাষে জগৎসিংহ রঘু ডাকতকে নিযুক্ত করে। রঘুনাথ তৎপূর্ব্ব হইতেই তারাকে জানিত। তারা তাহার বাল্যকালের সাথী—অজয় সিংহের কন্যা, এই পর্যন্ত তাহার জানা ছিল। এই কথা কিন্তু রঘু ডাকাত জগৎসিংহকে একবারও বলে নাই।

জগৎসিংহ রঘু ডাকাতকে বিশ্বাস করিয়া সমস্ত গুপ্ত কাহিনী বিদিত করিয়াছিল। রঘু ডাকাতের সেই অবধি তারাকে হস্তগত করিবার লোভ জন্মে। তারাকে বিবাহ-শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিতে পারিলে, সে যে সেই অতুল সম্পত্তির অধিকারী হইতে পারিবে, সে আশা কি সে সহজে বিসৰ্জ্জন দিতে পারে? তাই রঘুনাথ তারাকে বিবাহ করিতে এত ব্যগ্র হইয়াছিল।

লোভে পড়িয়া রঘুনাথ, জগৎসিংহের নিকট হইতে তাহার স্বত্ব প্রমাণার্থ যে সকল দলিল পত্র ছিল, তাহা নানাপ্রকার কলা-কৌশলে হস্তগত করিয়া লয়। জগৎসিংহও রঘুনাথের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝিতে না পারিয়া তাহার হস্তে সেই সকল কাগজ-পত্র রাখিতে কোন প্রকার সন্দেহ করে নাই। বরং সে ভাবিয়াছিল, যদি কোন দিন তারার স্বত্ব-সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া কোন প্রকার দলিল পাওয়া যায় কি না, দেখিবার জন্য কোম্পানীর লোকে তাহার বাড়ীতে খানা-তল্লাসী করে, তাহা হইলেই সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িবে। সুতরাং সে সকল দলিল-দস্তাবেজ হস্তান্তর করিয়া রাখিলে আর কোন ভয়ের কারণ থাকিবে না। এই ভাবিয়া সে রঘুনাথকে উপযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য পাত্রবোধে তাহার কাছেই সে সকল কাগজ-পত্র রাখিয়াছিল।

পূর্ব্বেই বলিয়াছি, রঘুনাথ যৎসামান্য লেখাপড়া জানিত। সে উক্ত কাগজ-পত্র পড়িয়া বুঝিয়াছিল, সেই সকল অকাট্য নিদর্শন বিচার-মন্দিরে একবার দেখাইতে পারিলেই তারা তাহার অপহৃত বিষয় সম্পত্তি সমস্তই পুনঃপ্রাপ্ত হইবে। তাই সে কন্টকে কন্টক উদ্ধার করিবার কল্পনা করিয়া সেই সকল দলিল-দস্তাবেজ এমন স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছিল যে, অন্যলোকে অন্তর্যামী না হইলে আর তাহা বাহির করিবার সম্ভাবনা ছিল না। এক কথায় রঘুনাথ জগৎসিংহের অর্থ উদরসাৎ করিয়া তাহারই অনিষ্টসাধন করিতেছিল। একদিকে জগৎসিংহ তারাকে হস্তগত করিবার জন্য নানা উপায় উদ্ভাবন করিতেছিল, অন্যদিকে দস্যু-সর্দ্দার রঘুনাথ তারাকে পাইবার জন্য জাল বিস্তার করিয়া রাখিয়াছিল।

রায়মল্ল সাহেব তারাকে রাজেশ্বরী উপত্যকায় দস্যুকবল হইতে উদ্ধার করিয়া আনিয়া প্ৰথমে কোতোয়ালীর নিকটে একটি নির্জ্জন স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন; তাহার পর অজয় সিংহকে বুঁদিগ্রাম হইতে আনাইয়া তিনি একটি ছোট-খাট বাড়ী ভাড়া করেন।

সে বাড়ীটির চতুর্দ্দিকে উদ্যান। লোকালয় হইতে কিছুদূরে ইহা অবস্থিত। রায়মল্ল সাহেব প্রথমে মনে করিয়াছিলেন, কেহ এতদূর অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করিতে পারিবে না।

তিনি এই বাটীতে অজয় সিংহ, তারা ও মঙ্গলকে পুলিশের লোকের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত করেন। প্রতিদিন একবার কি দুইবার করিয়া তিনি তাহাদিগকে দেখিতে আসিতেন; কিন্তু বড় আশা করিয়াছিলেন যে, অতি শীঘ্রই অভাগিনী তারার সমস্ত অপহৃত অর্থ পুনরায় সে প্রাপ্ত হইবে; কিন্তু তিনি তথায় যাইয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার হৃদয় বড় বিচলিত হইল। তিনি দেখিলেন, বাড়ীর দরজার সম্মুখেই সিঁড়ীর নীচে মুখ-হাত-পা বাঁধা পুলিশের লোক— তাঁহারই ছদ্মবেশী অনুচরদ্বয় অচেতন অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের বন্ধনমোচন করিয়া মুখে জল দিলেন। তাহাদের জ্ঞান হইলে তিনি আর কোন কথা না কহিয়াই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, একটি ঘরে মেঝের উপরে অচেতন অবস্থায় অজয় সিংহ পড়িয়া রহিয়াছেন।

ধীরে ধীরে তাহার জ্ঞান সঞ্চার হইতেছে দেখিয়া তিনি কথঞ্চিৎ শান্ত হইলেন। তাঁহার অনুচরদ্বয় তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইলে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি?”

একজন উত্তর দিল, “আমরা যেমন প্রতিদিন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকি, সেই রকমই দাঁড়িয়ে ছিলাম। সর্দ্দার খেতে গিয়েছিল। আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে সুখ-দুঃখের দুটো-একটা কথা কইছি, এমন সময়ে হঠাৎ কে যেন পিছন দিক্‌ থেকে কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরলে। সেই কাপড়ে একটা চড়া গন্ধ ছিল। সেই গন্ধে অজ্ঞান হ’য়ে পড়লেন। তার পর কি হ’ল কিছুই জানি না।”

রায়মল্ল সাহেব অপর অনুচরকে জিজ্ঞাসা করিলে সে-ও তাহাই বলিল। সুতরাং তিনি স্থির করিয়া লইলেন যে, অন্ততঃ দুইজন লোক দুইজনকে এক সময়ে আক্রমণ করিয়াছিল এবং অজ্ঞানকার আরক দ্বারা এক সময়ের মধ্যে দুইজনকেই অচৈতন্য করিয়া ফেলিয়াছিল।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – আবার বিপদ

অজয় সিংহ চক্ষু চাহিয়াও সকল কথা যেন ঠিক বুঝিতে পারিতেছিলেন না। অবাক্ হইয়া চারিদিকে চাহিয়াছিলেন। তখনও যেন তাঁহার চারিদিক্ অন্ধকার, সব ধোঁয়ার ন্যায় বোধ হইতেছিল। তখনও তাঁহার নিজের অবস্থা ও পূর্ব্বাপর ঘটনা কিছুই স্মরণ হইতেছিল না;সহসা তাঁহার সে ঘোর কাটিয়া গেল। তিনি রায়মল্ল সাহেব ও তাঁহার অনুচরবর্গের কথা বুঝিতে পারিলেন। একে একে সমস্ত পূর্ব্বাপর ঘটনা স্মরণপথে উদিত হইল। তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন! কাঁদিতে কাঁদিতে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “রায়মল্ল! তুমি এসেছ? আমার সর্বনাশ হয়েছে। তারাকে নিয়ে গেছে!”

রায়মল্ল সাহেব তাহা অনেকক্ষণ বুঝিয়াছিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে নিয়ে গেল?” অজয়। তা’ কি জানি, কিছুই বলতে পারি না। তাহারা কে, তাও জানি না। কোথায় কিছুই নাই, একেবারে ঘরের ভিতর দশ-বারজন লোক এসে ঢুকলো। সকলেই গুণ্ডা—ভয়ানক চেহারা! তুমি বারণ করেছিলে ব’লে আমি ত এখানে এসে অবধি একদিনও বাড়ীর বাহির হই নি। তাহারা ঘরের ভিতরে এসেই প্রথমে তারাকে জাপটে ধরলে, তারা ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। আমি বাধা দেবার জন্য যেমন উঠে দাঁড়িয়েছি, এমনই একজন একখানা কি বিশ্রী চড়া গন্ধওয়ালা রুমাল আমার নাকের উপরে চেপে ধরলে। আমি টানাটানি করতে করতে সেই গন্ধে অজ্ঞান হ’য়ে পড়লেম;বড় নিদ্রাকর্ষণ হ’লে যে রকম শরীর অবসন্ন হয়, সেই রকম যেন ঘুমের ঘোরে আধা সচেতন, অধা অচেতন অবস্থায় আমি যেন অনুভব করলেম, অভাগিনী তারাকে তাহারা টানা-হেঁচড়া ক’রে নিয়ে চলে গেল। হায় হায়! কি হ’ল। আমার সর্বনাশ হ’ল! এত করে আমার তারা শেষে আবার দস্যুদের হাতে পড়ল। এতক্ষণ কি তাহারা তাকে জীবিত রেখেছে?

রায়মল্ল সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইলেন। চলিয়া যাইতে যাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মঙ্গল কোথায়?” অজয়। কি জানি, মঙ্গল কোথায়? সে সন্ধ্যার পরে আমাদের জন্য খাবার কিনতে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। তারও কি হ’ল, কিছুই জানি না।

অজয় সিংহের কথা শেষ হইতে না হইতেই কোথা হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে মঙ্গল দৌড়িয়া আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিল, “এই যে রায়মল্ল সাহেব, এই যে—আমাদের সর্বনাশ হয়েছে, তারাকে আবার ডাকাতে নিয়ে গেছে! আহা! বাছাকে এইবার কেটে ফেলবে গো! কেটে ফেলবে! বাবা রায়মল্ল সাহেব! কি হবে বাবা, কি হবে?”

বৃদ্ধ মঙ্গল হাঁপাইতে হাঁপাইতে, কাঁদিতে কাঁদিতে এই কয়টি কথা বলিয়া কম্পিত কলেবরে সেইখানে বসিয়া পড়িল।

রায়মল্ল গোয়েন্দা বলিল, “আর আমার একটিও কথা কহিবার সময় নাই। আমাকে এখনই যেতে হবে। দস্যুরা তারাকে কোথায় নিয়ে গেছে, তাও আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি প্রাণ দিয়ে ও তারাকে উদ্ধার করে আনব! আপনারা এখানে থাকুন।”

এই পর্য্যন্ত বলিয়াই রায়মল্ল সাহেব উন্মত্তের ন্যায় ছুটিলেন। তাঁহার জীবনের যত ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাতে একদিনের জন্যও তিনি এরূপ উন্মত্তভাবে কোন কার্য্য করেন নাই। দৌড়িতে দৌড়িতে তিনি আপনার একজন অনুচরকে তাঁহার পশ্চাদগামী হইতে দেখিয়া বলিলেন, “কোন ভয় নাই, আমার জন্য কোন চিন্তা নাই, আমার সঙ্গে আসতে হবে না। যখন আমি মরিয়া হয়েছি, একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ভয় করি না। তুমি এখনই কোতোয়ালীতে গিয়ে আমার নাম ক’রে আরও দশজন অস্ত্রধারী লোক নিয়ে আজ রাত্রিকার মত এ বাড়ীতে পাহারা দাও।”

দ্রুতপদবিক্ষেপে রায়মল্ল সাহেব প্রস্থান করিলেন। সকলে তাঁহার সেই ভীষণ মূর্ত্তি দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া চাহিয়া রহিল। অনেকক্ষণ কেহ কোন কথা কহিতে পারিল না। শেষে অজয় সিংহ মঙ্গলের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মঙ্গল! তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”

মঙ্গল তখন কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়াছিল। সে ধীরে ধীরে উত্তর করিল “আমি আপনার খাবার আব্বার জন্য দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, এমন সময়ে একজন লোক এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলে, তোমার নাম মঙ্গল? তুমি অজয় সিংহের বাড়ীতে থাক?” আমি বললেম, “হাঁ।” সে লোকটা বললে, “তবে তুমি শীগগীর এস।’ আমি তার কথা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেম, ‘ব্যাপার কি বল।’ সে আমায় বলে, সে কথা বলার সময় নাই। রায়মল্ল সাহেব এই কাছেই একটা বাড়ীতে মর-মর অবস্থায় পড়ে আছেন। দেরী করলে তাঁকে জীবিত দেখতে পাবে না। তিনি তোমার হাতে তারার বিষয় আশয় সম্বন্ধে কি কাগজ-পত্র দিয়ে কতকগুলি কথা ব’লে যেতে চান্। তুমি আর দেরী ক’রো না, দৌড়ে এসে ঐ গাড়ীখানায় চড়ে ব’স। রায়মল্ল সাহেব মৃত-প্রায়—এই কথা শুনে আমি আর কিছুই ভাববার সময় পেলেম না। তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়ীতে চড়লেম। সে লোকটাও আমার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ীতে উঠে বস্ল। তৎক্ষণাৎ তীরবেগে গাড়ী ছুটল। পথের মাঝখানে আর দু’জন লোক ছুটে এসে গাড়ীর দু’ধারে পা-দানীর উপরে উঠে দু’দিকের দরজা বন্ধ ক’রে দিলে। অমনই তৎক্ষণাৎ ভিতরে যে লোকটা ছিল, সে একখানা বড় চক্‌চকে ছুরি বার ক’রে আমায় দেখিয়ে বলে, ‘আমার নাম রঘু ডাকাত! কথা কইবি, কি চেঁচাবি ত, তোকে এখনই খুন ক’রে ফেলব।’ আমি কাজেকাজেই হতভম্বের মত ব’সে রইলেম।”

অজয় সিংহ বিস্মিত হইয়া ভীতচকিত নেত্রে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তারপর! তার পর?”

মঙ্গল। তার পর সহর ছাড়িয়ে একটা পাড়াগাঁর মত জায়গায় আমায় নিয়ে গিয়ে একটা বাগান-বাড়ীতে তুলে।

অজয়। তার পর?

মঙ্গল। সেই বাড়ীতে একটা ঘরে আমায় পুরে চাবি দিয়ে তা’রা সবাই চলে গেল। প্রায় একঘণ্টা চেষ্টা ক’রে একটা জানালার গরাদ ভেঙে পালিয়ে আছি, এমন সময়ে পথে দেখলেম যে, লোকগুলো সেই গাড়ীতেই সেই রকম আবার কাকে নিয়ে তীরবেগে ছুট্‌ছে। তখনই আমার মনে কেমন সন্দেহ হ’ল। গাড়ীর পিছনে পিছনে আমিও ছুটলেম। বুড়ো মানুষ, পারব কেন? গাড়ীখানা অনেকটা এগিয়ে গেল, তবু আমি ছুট্‌তে ছাড়লেম না। খানিকদূর গিয়েই দেখি, সেই গাড়ীখানা একটা মস্ত বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খানিক বাদে দেখলেম, তা’রা একটি মেয়ে-মানুষকে ধরাধরি করে গাড়ী থেকে নামিয়ে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গেল। আমার ঠিক যেন বোধ হ’ল, সে আর কেউ নয়, আমাদের তারাকেই তা’রা ঐ রকম করে, নিয়ে যাচ্ছে। একে আমি বুড়ো মানুষ, তাতে আবার তা’রা পালওয়ান গুণ্ডা, তাদের সঙ্গে কি করব? কিছু করতে গেলেই হয় ত তা’রা আমার বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে। কাজেকাজেই আর ভরসা হ’ল না। রায়মল্ল সাহেবের কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, এ বিপদে তিনি ভিন্ন আর কেউ রক্ষা করতে পারবেন না। যেমন এই কথা মনে উদয় হওয়া, অমনই কোতোয়ালীর দিকে দৌড়ালেম। সেখানে গিয়ে রায়মল্ল সাহেবকে দেখতে না পেয়ে বরাবর এইখানে আছি। হায় হায়!—আমি যা ভেবেছি, তাই হ’ল! আমাদের তারাকে এতদিন পরে ডাকাতে খুন করলে—

বৃদ্ধ মঙ্গল এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া আর কোন কথা কহিতে পারিল না। অশ্রুধারায় তাহার বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইতে লাগিল।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – দুর্বৃত্ত দলন

সদার রায়মল্ল সাহেব সরাপখানা হইতে বাহির হইয়া কি করিয়াছিলেন, এ পর্যন্ত তাহা বলা হয় নাই।

তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া অনেক দূরে গেলেন। সম্মুখে বা পশ্চাতে কাহাকেও দেখিলেন না। সহসা পিস্তলের আওয়াজ হইল। সোঁ করিয়া একটা গুলি তাঁহার পাশ দিয়া চলিয়া গেল। তিনি বুঝিলেন, দস্যুগণ তাঁহাকে সামনাসামনি আক্রমণ না করিয়া দূর হইতে প্রাণনাশের চেষ্টায় আছে। এরূপভাবে দেহ পরিত্যাগে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। কাজেকাজেই তাঁহাকে একটু সাবধান হইতে হইল।

রাস্তার ধারেই একটি বড় বাড়ী নির্ম্মিত হইতেছিল। তাহারই সম্মুখস্ত ভিত্তি নির্ম্মাণ করিবার নিমিত্ত একটি প্রকাণ্ড খাদ খনন করা হইতেছিল। তিনি তখনকার মত এক সুযোগ অবলম্বন করিলেন। লম্ফপ্রদানে তিনি তাহার ভিতরে পড়িলেন। যে দুইজন দস্যু তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছিল, তাহারা এতক্ষণ অলক্ষিতভাবে তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া আসিতেছিল; কিন্তু সহসা তাঁহাকে দেখিতে না পাইয়া মনে করিল, তাহাদের গুলির আঘাতে রায়মল্ল সাহেব আহত হইয়া ভূতলশায়ী হইয়াছেন। মহাহ্লাদে উল্লসিত হইয়া ছুটিয়া তাহারা সেইদিকে আসিল।

একজন বলিল, “কৈ হে?”

আর একজন বলিল, “তাই ত হে, কোথায় গেল, বল দেখি?”

দুইজনে মিলিয়া আশে-পাশে অনেক অনুসন্ধান করিল, তারা রায়মল্ল সাহেবকে খুঁজিয়া পাইল না।

একজন কহিল, “এই রায়মল্ল সাহেব কখনই মানুষ নয়। হয় উপদেবতা, নয় পিশাচসিদ্ধ। দেখতে দেখতে মানুষকে মানুষ উবে গেল বাবা! এ কি ছায়াবাজী নাকি?

আর একজন বলিল, “তা নয়—তা নয়, ঐ গর্তের ভিতরে নিশ্চয় প’ড়ে গেছে। গুলির আওয়াজ শুনে প্রাণের ভয়ে ঐ দিক্ দিয়ে হয় পালাচ্ছিল, গৰ্ত্তটা অত লক্ষ্য করেনি, একেবারে তার ভিতর প’ড়ে গেছে।”

“তবে ভালই হয়েছে—এইবারে ত ঠিক্ বাগে পেয়েছি। আর যায় কোথা!”

দুইজনে অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া তথায় উপস্থিত হইল। গর্ভের ভিতর অন্ধকার! কেহ তাহার ভিতর আছে কি না, জানিবার কোন উপায় নাই।

একজন বলিল, “গুলি করা যাক্।”

অপরজন বলিল, “ততে কি লাভ হবে, অন্ধকারে লাগ্‌ল কি না লাগ্ল কিছুই বোঝা যাবে না। তার চেয়ে চল, দু’জনে গর্ভের ভিতর নেমে পড়ি।”

রায়মল্ল সাহেব এ অবস্থায় কি করিবেন, তাহা পূর্ব্বে ভাবিয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। পাঠক, এস্থলে জানিয়া রাখুন, দস্যুদ্বয়ের মধ্যে একজন রাজারাম ও আর একজন রঘু ডাকাত।

রঘুনাথ বলিল, “রাজারাম! দুজনে একদিক দিয়ে নামা হবে না, তুমি ওদিক্ দিয়ে এস, আমি এই দিক্‌ দিয়ে নামি।”

রাজারাম তাহাই করিল। রায়মল্ল সাহেবও প্রস্তুত ছিলেন। যেই রঘু ডাকাত একদিক্ দিয়া ধীরে ধীরে অবতরণ করিতেছে, রায়মল্ল সাহেব তৎক্ষণাৎ তাহার দুই পা ধারণ করিয়া সজোরে এক টান্‌ দিলেন। রঘুনাথ পড়িয়া গিয়াই চীৎকার করিয়া উঠিল। রায়মল্ল সাহেব তাহার হাত হইতে পিস্তলটি কাড়িয়া লইয়া, তাহার বুকের উপর চড়িয়া বসিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিলেন। রাজারাম তাড়াতাড়ি নামিতেছিল;কিন্তু সহসা রঘু ডাকাতের কণ্ঠ নিঃসৃত গোঁ গোঁ শব্দে সে যেন ক্ষণকাল হতবুদ্ধি হইয়া গেল। সেই অল্প অবকাশের মধ্যে রায়মল্ল সাহেব নিজে বস্ত্রমধ্যে হইতে একগাছি ছোট-খাট দড়ি বাহির করিয়া রঘু ডাকাতের করদ্বয় পশ্চাদ্দিকে বাঁধিয়া ফেলিলেন। তিনি যেরূপ ভাবে রঘু ডাকাতের গলা টিপিয়া ধরিয়াছিলেন, তাহাতে যদিও তাহার মৃত্যু হয় নাই, কিন্তু তাহার কথা কহিবার সামর্থ্য ছিল না। মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হইবার যো হইতেছিল। রঘু ডাকাতের কণ্ঠনিঃসৃত অস্পষ্ট শব্দ শুনিয়া রাজারাম কিছুক্ষণের জন্য কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে রঘু ডাকাতের ন্যায় ভীরু কাপুরুষ নয়। তাহার সাহস আছে, শক্তি আছে, মনের তেজ আছে। দুই-চারি মুহূর্ত অপেক্ষা করিয়াই সে-ও বিপদে গর্ভের ভিতর নামিয়া পড়িল। রায়মল্ল সাহেব সেই সময়ে একটু পাশ কাটাইয়া দাঁড়াইলেন। যেমন রাজারাম তাঁহার নিকটস্থ হইল তিনি সজোরে এক ধাক্কা দিলেন। সে তাহাতেই পড়িয়া গেল। রাজারামের হস্তে যে পিস্তল ছিল, সে পড়িয়া যাওয়াতে সেই পিস্তলের একটা আওয়াজ হইল। গুলি পিস্তল হইতে বাহির হইয়া রাজারামকেই আঘাত করিল। সেই আঘাতেই সে অজ্ঞান হইয়া পড়িল।

রায়মল্ল সাহেব বুঝিতে পারিলেন যে, রাজারাম আপনার গুলিতে নিজেই আহত হইয়াছে, নইলে নিশ্চয়ই পড়িয়াই উঠিতে চেষ্টা করিত। তিনি আর কালবিলম্ব না করিয়া তাহাকেও পূর্ব্বোক্ত প্রকারে ধরিয়া ফেলিলেন।

এতক্ষণে রঘু ডাকাত কথা কহিতে পারিল। রঘুনাথ ডাকেন “রাজারাম! “রাজারাম!”

কেহই উত্তর করিল না। রায়মল্ল সাহেব ক্রোধভরে রঘুনাথের মুখে পদাঘাত করিয়া বলিলেন, খবরদার! কথাটি ক’য়ো না। আস্তে আস্তে উঠে আমার সঙ্গে চলে এস।”

রঘুনাথ বলিল, “কেমন ক’রে যাব, আমার হাত যে বাঁধা”।

রায়মল্ল সাহেব তাহাকে উঠাইয়া দাঁড় করাইলেন। বলিলেন রঘু! এবার আর তোমার পরিত্রাণ নাই; কিন্তু এখনও যদি আমার কথা শোন, তা’ হ’লে তোমার শাস্তির অনেক লাঘব করে দিতে পারি।”

রঘুনাথ। আমায় যদি তুমি মেরে ফেল, তা’ হ’লেও আমি তোমার কথা শুনতে প্রস্তুত নই। আমায় নিয়ে তোমার যা ইচ্ছা, তাই করতে পার; আজ যদিও আমি তোমার কিছু করতে পারলেম না, কিন্তু এক দিন আমারই হাতে তোমার মৃত্যু হবে। আজ যদি আমি জেলে যাই, তবু তোমার কথা ভুলব না। দু’বৎসর হ’ক্, দশ বৎসর হ’ক্ জেল থেকে খালাস পেলেই, আগে এসে তোমাকে খুন করব।

রায়মল্ল সাহেব দেখিলেন, রঘু ডাকাত সহজে তাঁহার কথায় সম্মত হইবে না। তিনি তাহাকে পুনরায় সজোরে এক ধাক্কা মারিলেন। রঘুনাথ অকস্মাৎ ধাক্কা খাইয়া আর সাম্‌লাইতে পারিল না— পড়িয়া গেল। রায়মল্ল সাহেব রঘুনাথের গায়ের কাপড় খুলিয়া পুনরায় তাহার হস্ত পদ দৃঢ়রূপে বন্ধন করিলেন। তারপর সেই গর্ত হইতে উঠিয়া সেই সরাপখানার দিকে ছুটিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া দুইজন অনুচরকে সঙ্গে লইলেন এবং আর একজন অনুচরকে একখানি গাড়ী ডাকিয়া আনিতে বলিলেন। অর্ধ ঘণ্টার মধ্যে রঘু ডাকাত ও রাজারাম কোতোয়ালীর অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হইল।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ – বিপদের অবসান

সদার রায়মল্ল অনুচরগণের উপর সমস্ত ভার সমর্পণ করিয়া যে নির্জ্জন বাড়ীতে অজয় সিংহ এবং তারাকে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন, তথায় উপস্থিত হইলেন। তথায় গিয়া যাহা দেখিলেন, তাহা পূৰ্ব্বেই বলা হইয়াছে। সেখান হইতে তিনি উন্মত্তের ন্যায় ছুটিয়া তারপর কি করিলেন বা কোথায় গেলেন, তাহা বলি নাই, এখন বলিতেছি।

তিনি একেবারে তারার পিতৃভবনের পশ্চাদ্দেশে উপস্থিত হইলেন। তারার পিত্রালয় না বলিয়া এখন জগৎসিংহের বাটী বলিলেও চলে। তখন লোকজন বড় কেহ ছিল না। তিনি অনায়াসে প্রাচীর উলঙ্ঘন করিয়া বাটীর ভিতরে পড়িলেন।

তারার পিতৃভবনের চতুর্দ্দিকে উদ্যান, মধ্যস্থলে সেই প্রকাণ্ড বাটী। রায়মল্ল সাহেব দ্রুতপদে সেই বাটীর নিকটবর্ত্তী হইলেন। সেই বাটীতে যেন জনমানব নাই। সকলেই যেন ঘোরতর অভিভূত ভাবে নিদ্রিত। রায়মল্ল সাহেব একটি সুদীর্ঘ বৃক্ষে আরোহণ করিলেন। সে বৃক্ষটী এমনভাবে দেওয়াল ঘেঁসিয়া উঠিয়াছে যে, চেষ্টা করিলে তাহারই একটা ডাল ধরিয়া অনায়াসে দ্বিতলের একটি দরদালানে অবতীর্ণ হওয়া যায়, বুঝিয়া রায়মল্ল সাহেব তাহাই করিলেন; তথাপি তিনি কাহারও কণ্ঠস্বর বা পদশব্দ শুনিতে পাইলেন না। তিনি এদিক-ওদিক্ চারিদিকে অনুসন্ধান করিলেন; কিন্তু কোথায়ও কাহারও আগমন অনুভব করিতে পারিলেন না। যেন বাড়ীতে কেহ নাই—চারিদিক্ নীরব।

রায়মল্ল সাহেব ত্রিতলে উঠিলেন। সেখানেও এদিক্-ওদিক্ চারিদিক্ অনুসন্ধান করিয়াও কিছু বুঝিতে পারিলেন না। একটী কক্ষের ভিতরে যেন খুব ক্ষীণ আলোকরশ্মি বহির্গত হইতেছিল। ব্যাগ্রভাবে সেই ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া, খড়খড়ীর একটী পাখী তুলিয়া দেখিলেন, ঘরের এক কোণে নিষ্প্রভভাবে একটি আলোক জ্বলিতেছে। আর শয্যার উপরে একটি স্ত্রীলোক শুইয়া আছে। রায়মল্ল সাহেব সেই কক্ষের দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া দরজার শিকল ধরিয়া টানিলেন। দরজা ভিতরদিক্ হইতে বন্ধ ছিল না, টানিবামাত্র খুলিয়া গেল। তিনি গৃহ মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। শয্যার পার্শ্বে দন্ডায়মান হইয়া দেখিতে পাইলেন, অভাগিনী তারা অচেতন অবস্থায় শিথিলবেশে আলুলায়িতকেশে সেই শয্যার উপরে পড়িয়া রহিয়াছে। রায়মল্ল সাহেব তারাকে সচেতন করিবার অনেক চেষ্টা করিলেন। কিন্তু সে উঠিল না। তিনি বুঝিলেন, তাহারা তারাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলিয়া রাখিয়াছে।

সেই সময়ে গৃহের বহির্দেশে যেন কাহার পদশব্দ শ্রুত হইল। রায়মল্ল সাহেব আর কোন উপায় না দেখিয়া পালঙ্কের নিম্নে লুকাইলেন। এক মুহূর্ত্ত পরেই সেই ঘরে জগৎসিংহ ও তারার বিমাতা প্রবেশ করিল।

তারার বিমাতা কহিল, “দেখ, আমি তোমাকে এখনও বারণ করছি—খুন ক’রো না।”

জগৎ। তুমি বুঝতে পারছ না সুন্দরি। তারাকে খুন করা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। যদি কোন জায়গায় লুকিয়ে রখি। রায়মল্ল তাকে যেমন ক’রে হক্, বার করবেই করবে। অন্তর্যামীর অজানিত ও বরং কিছু থাকতে পারে, কিন্তু ঐ রায়মল্লের অজানা কিছু নাই। এই যে আমরা এইখানে দাঁড়িয়ে কথা কচ্ছি, হয় ত অলক্ষিতভাবে সে আমাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। রায়মল্ল ভূতের মত লোকের পিছনে পিছনে ফেরে। কেউ তাকে দেখতে পায় না, কিন্তু সে সকলকে দেখতে পায়। দেশ- দেশান্তরে কোথায় কি ঘটনা হচ্ছে, সবই যেন তার নখদর্পণে রয়েছে। কে জানে, সে কি রকম? বোধ হয়, পিশাচবিদ্ধ হবে।

তারার বিমাতা বলিল, “এখন রায়মল্ল গোয়েন্দা কোথায়?”

জগৎ। রঘু ডাকাত আর রাজারাম দু’জনে মিলে রায়মল্লের পিছু নিয়েছে। আজ তারা রায়মল্লকে খুন করবে! কিন্তু এখনও ফিরে আসছে না ব’লে আমার সন্দেহ হচ্ছে। হয় ত রায়মল্লের হাতে ধরা প’ড়ে থাকবে।

তারার বিমাতা জিজ্ঞাসা করিল, “তা তুমি এখন কি করবে?”

জগৎ। আর খানিকটে অপেক্ষা ক’রে দেখ। যদি তা’রা ফিরে না আসে, তা’ হ’লে নিজেই খুন কব। দুজন লোক আমাদের খিড়কীর পুকুরের পাড়ে তেঁতুল গাছের তলায় একটা গর্ত খুঁড়ছে। খুন ক’রে সেইখানে পুঁতে ফেলব।

তারার বিমাতা। পুঁতেই যদি ফেলবে, তবে আর খুন করবার দরকার কি? এই অজ্ঞান অবস্থাতেই ত অনায়াসে পুঁতে ফেলতে পার।

জগৎ। ও আপদ চোকানই ভাল।

এই পৰ্য্যন্ত কথাবাৰ্ত্তা কহিয়া উভয়ে প্রস্থান করিল। রায়মল্ল সাহেব তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে বহির্গত হইয়া অলক্ষিতভাবে তাহাদের পশ্চাদগমন করিয়া দেখিলেন, তাহারা একটি পাশ্ববর্তী কক্ষে প্রবেশ করিল। রায়মল্ল সাহেব আর অপেক্ষা না করিয়াই তাড়াতাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। ক্ষিপ্রহস্তে তারাকে নিজস্কন্ধে তুলিয়া লইয়া প্রস্থান করিলেন। ত্রিতল হইতে দ্বিতল, তথা হইতে একতল, কোথাও কেহ বাধা দিল না; কিন্তু একতলে আসিয়া তিনি আর দ্বার খুঁজিয়া পাইলেন না। শেষে পদাঘাতে একটা দ্বারের অর্গল ভগ্ন করিয়া বহির্গত হইলেন।

সেই শব্দে বাড়ীর অন্যান্য লোকজন জাগিয়া উঠিল। ‘বাড়ীতে চোর এসেছে’ ‘ডাকাত পড়েছে’ ইত্যাকার রবে চারিদিকে একটা বিশেষ গোল পড়িয়া গেল। সেই গোলমালে জগৎসিংহ চক্ষু মুছিতে মুছিতে উঠিয়া আসিল, যেন কত নিদ্ৰা গিয়াছিল।

রায়মল্ল সাহেব ততক্ষণে নিরুদ্দেশ! তিনি তীরবেগে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িলেন। প্রথমেই যে প্রহরীকে দেখিলেন, তাহাকেই পুলিশের চিহ্ন দেখাইয়া সাহায্য করিতে বলিলেন। সে “জুড়ীদার হো,” “জুড়ীদার হো” বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে তাহার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়িতে লাগিল। পথিমধ্যে একটা গাড়ীর আড্ডা পাইয়া রায়মল্ল সাহেব একজন নিদ্রিত এক্কাওয়ালাকে উঠাইলেন। সে পাহারাওয়ালা দেখিয়াই চমকিত হইয়া গেল। রায়মল্ল সাহেব তারাকে লইয়া এক্কায় উঠিয়া বসিলেন, পাহারাওয়ালা আর একধারে উঠিল। হাঁকাহাঁকিতে আরও দুই চারিজন পাহারাওয়ালা আসিয়া পৌঁছিল। তাহারাও দুইজন করিয়া একখানি এক্কায় চড়িল। অতি অল্পক্ষণের মধেই রায়মল্ল সাহেব অজয় সিংহের নিকটে চৈতন্যবিহীনা তারাকে আনিয়া পৌঁছাইয়া দিলেন। মঙ্গল তারার সেবা-শুশ্রূষা করিতে লাগিল। রায়মল্ল সাহেব একখানি পত্র লিখিয়া কোতোয়ালীতে পাঠাইয়া দিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে পত্রের উত্তর আসিল। তাহা এই;-

“আপনার আদেশানুসারে আজ সমস্ত রাত্রি এবং কাল যতক্ষণ পর্য্যন্ত আপনার নিকট হইতে আমি নূতন আদেশ না পাই, ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত জগৎসিংহের বাটীর চতুর্দ্দিকে প্রহরিগণ নিযুক্ত থাকিবে। যাহাতে উক্ত বাটী হইতে একজন লোকও পলাইতেও না পারে, তজ্জন্য সম্পূর্ণ সচেষ্ট থাকিব। জগৎসিংহের সদর দরজার নিকটে আমি স্বয়ং ছদ্মবেশে উপস্থিত থাকিব। আপনার আজ্ঞামত আমার প্রহরীরাও সকলে ছদ্মবেশে অপরিচিতের ন্যায় বিচরণ করিবে। যাহাতে জগৎসিংহের বাটীর কোন লোক আমাদের উপস্থিতি বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহ করিতে না পারে, সে বিষয়ে আমার বিশেষ দৃষ্টি থাকিবে।”

পত্রের এইরূপ উত্তর পাইয়া রায়মল্ল সাহেব সেই বাটীতেই সেদিনকার মত বিশ্রামের আয়োজন করিলেন। অনুচরবর্গের মধ্যে তিনি যাহাকে যেরূপ অনুমতি দিলেন, সে তৎপ্রতিপালনার্থ ধাবিত হইল।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – উপসংহার

পরদিন প্রাতঃকাল হইতে বেলা দুইটা পৰ্যন্ত রায়মল্ল সাহেব কোথায় রহিলেন, কি করিলেন, তাহার কিছুই স্থিরতা রহিল না। তাহার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক হইলে, তিনি জগৎসিংহের বাটিতে উপস্থিত হইলেন।

জগৎসিংহ বৈঠকখানায় বসিয়া দুই—একজন অনুচরের সহিত গত রজনীর সমস্ত কথা আন্দোলন করিতেছিল, এবং কি উপায়ে সকল দিক্ রক্ষা হয়, সেই সম্বন্ধে একটা পরামর্শ স্থির হইতেছিল।

রায়মল্ল সাহেব উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “জগৎসিংহ কার নাম?”

তিনি যে জগৎসিংহকে চিনিতে পারেন নাই, তাহা নয়; তথাপি কেন যে এরূপ ভাবে প্রশ্ন করিলেন, তাহা তিনিই জানেন্।

জগৎসিংহ সন্দিগ্ধচিত্তে জিজ্ঞাসা করিল, “কেন মহাশয়! আপনার কি আবশ্যক? আপনার নাম?”

রায়মল্ল সাহেব গম্ভীরভাবে উত্তর প্রদান করিলেন, “আমার নাম? আমার নাম রায়মল্ল। আমি গোয়েন্দাগিরি কার্য্য করি। সরকারী লোকে আমায় সর্দ্দার রায়মল্ল নামে ডাকে, আর সকলে রায়মল্ল গোয়েন্দা বলে।”

জগৎ। কি উদ্দেশ্যে এখানে আপনার পদার্পণ হয়েছে?

রায়মল্ল। আমি আপনার বিষয়-সম্পত্তি ক্রয় করতে এসেছি।

জগৎ। আমাদের বিষয়-সম্পত্তি এক টুকরাও বিক্রয়ের জন্য নাই। এ ছাড়া যদি আপনার অন্য কোন উদ্দেশ্য না থাকে, আপনি সোজা পথ দেখতে পারেন।

রায়মল্ল। আমি মহাশয়ের নিকটে অনুগ্রহপ্রয়াসী নই! বিষয়-সম্পত্তি বিক্রয় করবার জন্য আপনাকে অনুরোধ করতে আসি নাই। আপনাকে বাধ্য হ’য়ে বিক্রয় করতে হবে, তাই জানাতে এসেছি।

জগৎ। দেখুন, আপনি মনে রাখবেন যে, আপনি আমার বাড়ীতে দাঁড়িয়ে কথা কহিতেছেন। আমি ইচ্ছা করলে এখনই আপনাকে এখান থেকে বিদায় ক’রে দিতে পারি।

রায়মল্ল সাহেব রুষ্টভাবে কহিলেন, “এ বাড়ী আপনার নয়। আইন মতে এ বাড়ীর একখানি ইষ্টক আপনার প্রাপ্য নয়।”

এই কথা বলিয়াই রায়মল্ল সাহেব একটি ছোট বাঁশী পকেট হইতে বাহির করিয়া বাজাইলেন। তৎক্ষণাৎ একজন লোক সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। সেই লোকটিকে দেখিয়াই জগৎসিংহ চমকিয়া উঠিল। রায়মল্ল তাহাকে দেখাইয়া কহিলেন, “এই লোকটিকে দেখে মনে পড়ে কি, অভাগিনী তারাকে বর্দ্ধমানে বিসর্জ্জন দেওয়ার মূলই আপনি?”

জগৎসিংহ বলিল, “মিথ্যাকথা! ওকে আমি কখনও চিনি না, কখনও দেখি নাই।”

রায়মল্ল সাহেব আবার বংশী ধ্বনি করিলেন। তৎক্ষণাৎ আর একটি বৃদ্ধলোক সেই ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। জগৎসিংহ তাহাকে দেখিয়াই রক্তবর্ণ চক্ষে জিজ্ঞাসা করিল, “এ কে? এ-ও কি তোমাদের ষড়যন্ত্রের একজন না কি?”

বৃদ্ধ মঙ্গল তৎক্ষণাৎ কহিল, “আজ আমায় চিনতে পারবে কেন? আর কি সে বৃদ্ধ মঙ্গল ব’লে মনে পড়ে? (ক্রোধে) চোর! বিশ্বাসঘাতক!“

জগৎসিংহ লম্ফ প্রদান করিয়া দাঁড়াইয়া মঙ্গলের নিকটে আসিয়া বলিল, “কি! আমার বাড়ীতে এসে তুই আমায় গালি দিচ্ছিস্? জুতো মেরে, গলাধাক্কা দিয়ে বার্ ক’রে দেবো, তা’ জানিস্, পাজী! বদমাস্!”

রায়মল্ল সাহেব জগৎসিংহের হাত ধরিয়া টানিয়া তাহাকে বসাইলেন। বলিলেন, “এত রাগ কেন গো মহাপ্রভু! একটু ঠাণ্ডা হ’য়ে ব’সে আমার কথাগুলোই আগে শোনা হ’ক্‌ না।”

জগৎসিংহ ক্রোধষায়িতলোচনে কহিল, “দেখ রায়মল্ল গোয়েন্দা, তুমি বাড়ী চড়াও হয়ে এসে একজন ভদ্রলোকের অপমান করছ, তা যেন মনে থাকে। আইনে তোমার দণ্ড হতে পারে, তা’ জান?”

রায়মল্ল সাহেব সহাস্যবদনে মৃদুমধুরস্বরে কহিল, “তা’ আর জানি না—মহাশয়ের চেয়ে আমার আইন-কানুন কিছু কম জানা নাই। আমি যে কাজ করছি, তার পূর্ব্ব পশ্চাৎ ভেবে তবে করছি। মহাশয় সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।”

তার পর সহসা রায়মল্ল সাহেব রুদ্রমূর্তি ধারণ করিয়া, দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া ক্রোধভরে কহিলেন, “পাপিষ্ঠ! তুই এখনও সাহস ক’রে আমার সঙ্গে কথা কইছিস? চেয়ে দ্যাখ্! বোধ হয়, অলক্ষ্যে তারার মৃত পিতার আত্মা এইখানে আবির্ভূত হয়েছেন! তুই যার বিষয়-সম্পত্তি বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে ভোগ-দখল করছিস্, তাকে কেমন ক’রে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলি, সে সকল কিরূপে এখন সপ্রমাণ হয় এবং তোর মত বিশ্বাসঘাতকের কি দণ্ড হয়, দেখার জন্য বোধ হয়, তিনি স্বৰ্গ থেকে নেমে এসেছেন। নারকি! এখনও তুই অস্বীকার করছিস্?”

রায়মল্ল সাহেব আবার বংশীবাদন করিলেন। এবার অজয় সিংহ ধীরে ধীরে সেই কক্ষে প্রবিষ্ট হইলেন।

জগৎসিংহ তাঁহাকে দেখিয়াই বলিল, “ওঃ! একে আমি খুব চিনি! এ একজন মস্ত ফন্দীবাজ জুয়াচোর! একটা জাল বালিকাকে খাড়া ক’রে আমার সঙ্গে মোকদ্দমা করতে এসেছিল। তা’ আদালতে তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হ’য়ে গেছে। একে নিয়ে তোমরা ষড়যন্ত্র ক’রে আমায় ঠকাতেএসেছ? আমি তোমাদের স্পষ্ট ভাষায় সাদা কথায় বলছি, আমার কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে তোমরা একটি কানাকড়িও আদায় করতে পারবে না!”

রায়মল্ল সাহেব পুনরায় বাঁশী বাজাইলেন। চারিজন প্রহরীবেষ্টিত, হাতে হাতকড়ি দেওয়া রঘু ডাকাত ও রাজারাম, সেই ঘরে প্রবেশ করিল!

রঘু ডাকাতকে এইরূপ বন্দীভাবে দেখিয়াই জগৎসিংহের সমস্ত রক্ত জল হইয়া গেল। সে নিরাশ হইয়া করুণকণ্ঠে কহিল, “একি রঘুনাথ! তুমিও আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছ?”

রঘু ডাকাত উত্তর করিল, “দেখ জগৎসিংহ! আর তোমার বুকি খাবে না। এখনও মানে মানে যার বিষয় তাকে ফিরিয়ে দাও। রায়মল্ল সাহেবের পায়ে-হাতে ধর, যদি তাতে তোমার শাস্তির কিছু লাঘব হয়। তোমার জন্য আমার সর্বনাশ হয়েছে। তোমার কাজে হাত দিয়ে পর্য্যন্ত আমার এই দুৰ্দ্দশা। এখন আমি দায়ে প’ড়ে তোমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে দাঁড়িয়েছি। তারার স্বত্ব স-প্রমাণ করতে যে সব কাগজ আবশ্যক, সে সমস্তই আমি রায়মল্ল সাহেবের হাতে দিয়েছি। আর তোমাদের উদ্ধারের কোন উপায় নাই।

জগৎসিংহ ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া চীৎকার করিয়া কহিল, “সব জুয়াচুরী! কাগজ-পত্র দলিল দস্তাবেজ সব জাল! তোমরা সব ষড়যন্ত্র ক’রে আমায় মজাবার চেষ্টায় আছ।”

রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “দেখ, জগৎসিংহ, তোমার অদৃষ্ট নিতান্ত মন্দ, তাই তুমি আমার সঙ্গে এখনও চাতুরী করতে চেষ্টা করছ। তুমি জান না, আমি যে কাজে হাত দিই, তার আটঘাট না বেঁধে আমি কিছুই করি না। মনে ক’রো না, উপযুক্ত প্রমাণ সংগ্রহ না ক’রে আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি যদি এখন অস্বীকার কর, তা’হলে এই দন্ডেই আমার হুকুমে প্রহরীরা তোমার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে, সদর রাস্তা দিয়ে কোতোয়ালীতে টেনে নিয়ে যাবে। এখনও বলছি, বিবেচনা ক’রে কাজ কর।”

জগৎসিংহ তখন কাঁদ-কাঁদ ভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি করতে বলেন?”

রায়মল্ল। এই এত লোকের সাক্ষাতে তুমি কাগজ কলমে লিখিয়া যার বিষয় তাকে ফিরিয়ে দাও। ইহারা সকলে সাক্ষীও হবেন। যদি তাতে রাজী না হও, তা’ হলে তুমি এতদিন ধ’রে যত খুন ডাকাতি, জাল জালিয়াতী করেছ, সকল বিষয়েরই আদালতে তন্ন তন্ন করে বিচার হবে। তাতে শেষে কম পক্ষে তোমার যাবজ্জীবন কারাবাস দন্ড ভোগ করতে হবে।

জগৎসিংহ কহিল, “এ বিষয়ে একবার তারার বিমাতাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত। আমি একবার বাড়ীর ভিতরে যেতে চাই। পালাব না, ভয় নাই।”

রায়মল্ল সাহেব হাসিয়া বলিলেন, “পালাবার কি উপায় রেখেছি, যে পালাবে? এ বাড়ী থেকে এখন একটি মাছি বেরিয়ে যেতে পারবে না। “

জগৎসিংহ বাড়ীর ভিতরে গিয়া তৎক্ষণাৎ বিষণ্নমুখে ফিরিয়া আসিল। রায়মল্ল সাহেব জিজ্ঞসা করিলেন, “এত শীঘ্র ফিরে এলে যে?”

জগৎসিংহ কহিল, “আর ফিরে এলেম! সর্ব্বনাশ হয়েছে—সর্ব্বনাশ হয়েছে! তারার বিমাতা বোধ হয়, আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে এ সব কথা শুনে বিষ খেয়ে প্রাণত্যাগ করেছে। তার মৃতদেহ ঘরের মেজেয় প’ড়ে রয়েছে।”

অজয় সিংহ কহিলেন, “ভালই হয়েছে, তিনি খুব বুদ্ধির কাজ করেছেন। ভদ্রলোকের মেয়ের পক্ষে জেলখাটার চেয়ে মরাই ভাল। তার পাপের শাস্তি ইহলোকেই কতকটা হ’য়ে গেল, পরলোকে বাকীটা হবে, পাপিষ্ঠার আত্মহত্যায় দুঃখ করবার কোন কারণ নাই। “

এদিকে রায়মল্ল সাহেব যাহা লিখিতে বলিলেন, জগৎসিংহ কলের পুত্তলিকাপ্রায় তাহাই লিখিল। তখন সেই ঘরে যে কয়জন লোক বসিয়াছিল, তাহারাও তাহাতে দস্তখৎ করিল। এমন কি রায়মল্ল সাহেব আসিবার পূর্ব্বে জগৎসিংহের সহিত যে কয়জন তাহারই অনুচর বসিয়া ছিল, বাধ্য হইয়া তাহারও সাক্ষীর তালিকায় নাম স্বাক্ষর করিল।

আপনার কার্য্য শেষ করিয়া রায়মল্ল গোয়েন্দা, জগৎসিংহ ও তাহার অনুচরগণকে এবং রঘু ডাকাত ও রাজারামকে যথারীতি চালান দিলেন।

রঘু ডাকাতকে এরূপভাবে না পাইলে রায়মল্ল সাহেব তারার স্বত্ব প্রমাণ করিতে পারিতেন কি না সন্দেহ? তাহার নিকট যে সকল কাগজপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ ছিল, সে সকল না পাইলে তারার স্বত্ব প্রমাণ করিতে রায়মল্ল গোয়েন্দাকে অধিক কষ্ট স্বীকার করিতে হইত। প্রথমে রঘু ডাকাত, রায়মল্ল সাহেবের কথায় সম্মত হয় নাই, কিন্তু যখন তাহাকে একে একে তৎকর্তৃক খুন ও ডাকাতির একটা লম্বা তালিকা দেখান হইল, এবং তাহার নামে কতকগুলি গ্রেপ্তারি পরওয়ানা আছে, তাহা বলা হইল তখন পাছে আরও কঠোর শাস্তি হয়, এই ভয়ে সে রায়মল্ল সাহেবের শরণাপন্ন হইল।

জগৎসিংহের নিকট হইতে নানা প্রকার কলা-কৌশলে রঘু ডাকাত সেই সকল কাগজাদি আদায় করিয়া রাজেশ্বরী উপত্যকায় এক গুপ্তস্থানে লুকাইয়া রাখে। তারাকে হস্তগত করিবার আশা রঘুনাথ শেষ পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতে পারে নাই। তাই জগৎসিংহের কৌশলে যখন রঘুনাথ কারামুক্ত হয়, সেই সময়েই সে রাজেশ্বরী উপত্যকায় গিয়া সেই সকল দলিল লইয়া আসে। তাহার মনে মনে এই আশা ছিল যে, যদি সে গোয়েন্দা-সর্দার রায়মল্লকে শমনসদনে প্রেরণ করিতে পারে তাহা হইলে যে কোন উপায়ে হউক, তারাকে হস্তগত করিয়া, তাহার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করিয়া আপনি সেই রাজৈশ্বর্য্য ভোগ করিবে; কিন্তু সেই ভূত-ভবিষ্যৎ বৰ্ত্তমান ত্রিকালজ্ঞ অন্তৰ্য্যামী চক্রীর চক্রে সকলই বিপরীত ঘটিল। অধর্ম্মের পরাজয় ও ধর্ম্মেরই জয় হইল। রঘু ডাকাত পুনরায় রায়মল্লের হস্তে কয়েদ হইল। এবার বন্দী হইয়া নিজের শান্তিলাভের জন্য রায়মল্ল গোয়েন্দার হস্তে সেই সকল কাগজপত্র-প্রদান করিল।

রায়মল্ল সাহেব যাহা স্বপ্নেও ভাবেন নাই, তাহাই প্রাপ্ত হইয়া রঘু ডাকাতকে আশ্বাস প্রদান করিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে এই কারণেই তাহার যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ডাজ্ঞা না হইয়া তাহা অপেক্ষা কতক লঘুদণ্ড হইল!

জগৎসিংহের চিরনির্বাসন দণ্ডাজ্ঞা প্রচারিত হয়, কিন্তু হতভাগ্যকে তাহা আর ভোগ করিতে হয় নাই। তৎপূর্ব্বেই কারাগারে সর্পদংশনে তাহার মৃত্যু ঘটিয়াছিল।

রাজারামের দ্বাদশ বৎসর কারাবাস দণ্ড হয়, এতদ্ব্যতীত অন্যান্য চক্রান্তকারী দস্যুগণের যথোপযুক্ত দণ্ড হইয়াছিল। তদবধি রাজস্থানের জনপদবাসিগণের ভয়-ভাবনার মাত্রা তিরোহিত হয়।

তারা আপন বিষয়-সম্পত্তি প্রাপ্ত হইয়া, খুল্লতাত অজয় সিংহের উপর সমস্ত ভারার্পণ করিয়া নিশ্চিত হইলে অজয় সিংহ রায়মল্লের সহিত তারার বিবাহের প্রস্তাব করেন। তারা রায়মল্ল সাহেবের গুণে যেরূপ বিমুগ্ধ ও কৃতজ্ঞপাশে আবদ্ধ হইয়াছিল, তাহাতে এ প্রস্তাবে অমত করিবার কোন কারণ ছিল না। সুতরাং শুভদিন শুভক্ষণে শুভ বিবাহে রায়মল্ল ও তারার শুভ-সম্মিলন হইল। পরে অজয় সিংহ তারার গর্ভজাত এক পুত্র ও এক কন্যা দেখিয়া পরলোক গমন করেন।

রঘু ডাকাত কারাগারে পূর্ণ দণ্ডভোগ করিয়া মুক্তি পাইলে পুনরায় রায়মল্ল গোয়েন্দা ও তারার শরণাপন্ন হয়। তাঁহারাও তাহার সকল দোষ ভুলিয়া গিয়া, যতদিন সে জীবিত ছিল, ততদিন তাহাকে প্রতিপালন করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *