প্রণয় কলহ

প্রণয়-কলহ

অরুণা ও হিরণ পিঠোপিঠি হইয়া বিপরীত মুখে বসিয়াছিল। উদাস দৃষ্টি আকাশের দিকে। মাঝে মাঝে আড়চক্ষে পরস্পরকে দেখিয়া লইবার চেষ্টা করিতেছে।

দু’জনের মনে সংশয় জাগিয়াছে—ও আমাকে ভালবাসে না। তাহাদের জীবনে এই প্রথম কলহ।

অরুণা সহসা ফিরিয়া বসিল; তাহার বয়স সতেরো, তাই ধৈর্য ও সংযম এখনও দানা বাঁধে নাই। অবরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল—

‘কেন আন বসন্ত নিশীথে
আঁখি-ভরা আবেশ বিহ্বল—
যদি বসন্তের শেষে শ্রান্ত মনে ম্লান হেসে
কাতরে খুঁজিতে হয় বিদায়ের ছল?’

হিরণও ফিরিল; তাহার বৈরাগ্যের ভস্মাবরণের ভিতর দিয়া ঈষৎ তৃপ্তির ঝিলিক খেলিয়া গেল। তবু সে উদাস গম্ভীর স্বরে বলিল,—

‘কেন তুমি মূর্তি হয়ে এলে,
রহিলে না ধ্যান-ধারণার।
সেই মায়া-উপবন কোথা হল অদর্শন।
কেন হায় ঝাঁপ দিতে শুকাল পাথার।’

অরুণার চোখের জল এবার ঝরিয়া পড়িল, সে বলিল,—

‘বুঝেছি আমার নিশার স্বপন
হয়েছে ভোর।
মালা ছিল, তার ফুলগুলি গেছে,
রয়েছে ডোর।
নেই আর সেই চুপি-চুপি চাওয়া
ধীরে কাছে এসে ফিরে ফিরে যাওয়া—’

অরুণার মুখখানি নতবৃন্ত পুষ্পের মতো বুকের উপর নামিয়া পড়িল।

হিরণ বলিল,—

‘দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি।
মন নাহি মোর কিছুতে—’

তাহার উদাসীন দৃষ্টি যেন আকাশের দুরবগাহ দূরত্বের মধ্যে ডুবিয়া গেল!

কিছুক্ষণ নীরব। তারপর কাতর চক্ষু তুলিয়া অরুণা থরথর স্বরে বলিল,—

‘এখনি কি শেষ হয়েছে প্রাণেশ।
যা কিছু আছিল মোর?
যত শোভা যত গান যত প্রাণ,
জাগরণ, ঘুমঘোর।
শিথিল হয়েছে বাহুবন্ধন
মদিরাবিহীন মম চুম্বন,

জীবনকুঞ্জে অভিসার-নিশা
আজি কি হয়েছে ভোর?
ভেঙে দাও তবে আজিকার সভা,
আনো নব রূপ, আনো নব শোভা—

প্রবল রোদনোচ্ছ্বাসে অরুণার কথা শেষ হইল না।

হিরণের মনটা গলিয়া টলমল করিতে লাগিল। কিন্তু তবু প্রথম কলহের নূতন ঐশ্বর্য সহজে ছাড়া যায় না। সে অন্য সুর ধরিল; ব্যথিত কণ্ঠে কহিল,—

‘তুমি যদি আমায় ভালো না বাস
রাগ করি যে এমন আমার সাধ্য নাই,
এমন কথার দেব নাকো অভাসও
আমারো মন তোমার পায়ে বাধ্য নাই—’

অরুণা সচকিতে মুখ তুলিয়া চাহিল,—

‘ওগো ভালো করে বলে যাও—’

হিরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল,—

‘বর্ষে বর্ষে বয়স কাটে,
বসন্ত যায় কথায় কথায়,
বকুলগুলা দেখতে দেখতে
ঝরে পড়ে যথায় তথায়,
মাসের মধ্যে বারেক এসে
অস্তে পালায় পূর্ণ ইন্দু,
শাস্ত্রে শাসায় জীবন শুধু
পদ্মপত্রে শিশির-বিন্দু।
তাদের পানে তাকাব না
তোমায় শুধু আপন জেনেই
সেটা বড়ই বর্বরতা,—
সময় নেই,—সময় যে নেই!’

অরুণা অভিমান-ভরা দুই চক্ষু ক্ষণকাল হিরণের উপর স্থাপন করিয়া দু’হাতে মুখ ঢাকিল।

হিরণ তখন উঠিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল, ক্ষুব্ধ স্বরে কহিল,—

‘মিথ্যা আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে!’

অরুণাও চোখ মুছিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল—

‘বুক ফেটে কেন অশ্রু পড়ে
তবুও কি বুঝিতে পার না?
তর্কেতে বুঝিবে তা কি? এই মুছিলাম আঁখি,
এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা।’

হিরণ কম্পিতহস্তে তাহার হাত ধরিল—

‘হে নিরুপমা,
চপলতা আজ যদি কিছু ঘটে
করিয়ো ক্ষমা।
তোমার দুখানি কালো আঁখি’পরে
শ্যাম আষাঢ়ের ছায়াখানি পড়ে,
ঘনকালো তব কুঞ্চিত কেশে
যুথীর মালা।
তোমারি ললাটে নববরষার।
বরণডালা।’

অরুণার চোখের ছায়া দূর হইল না; সে বলিল,—

‘ভালোবাস কি না বাস বুঝিতে পারি নে—’

হিরণের বাহুবন্ধন আরও দৃঢ় হইল, সে বলিল,—

‘তোমাকেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শতরূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।’

অরুণার চোখের দৃষ্টিতে যুগান্তরের কুহক ঘনাইয়া আসিল। উভয়ে পরস্পরের আরও নিকটবর্তী হইতে লাগিল। তারপর—

‘রসভরে দুহুঁ তনু
থরথর কাঁপই—’

১৩৪৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *