আধিদৈবিক
পুলিনবিহারী পালের নাম অল্প লোকেই জানে। অথচ তাঁহার মতো প্রগাঢ় পণ্ডিত, সর্বশাস্ত্রবিশারদ জ্ঞানী পুরুষ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয় আছে কিনা সন্দেহ। দেশী ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের খেতাব তাঁহার এত ছিল যে, তিনি ইচ্ছা করিলে নিজের নামের পিছনে ময়ূরপুচ্ছ রচনা করিতে পারিতেন। জ্ঞানমার্গের পাকা সড়কের কথা ছাড়িয়া দিই, সমস্ত গলিঘুঁজির সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল; অতিবড় গূঢ় বিদ্যার আলোচনা করিয়াও কেহ তাঁহাকে ঠকাইতে পারিত না। কেবল একটি বিদ্যা তাঁহার ছিল না—ঘানিযন্ত্র হইতে কি করিয়া তৈল বাহির করিতে হয় তাহা তিনি শিখিতে পারেন নাই। এই জন্যই বোধ করি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহার খোঁজ রাখে না।
ছেলেবেলা হইতেই তাঁহার সহিত আমার পরিচয় ছিল; ভক্তিভরে তাঁহাকে পুলিন্দা বলিয়া ডাকিতাম। বিপদে আপদে অর্থাৎ বিদ্যাঘটিত কোনও সঙ্কটে পড়িলে তাঁহার শরণাপন্ন হইতাম। কখনও নিরাশ করেন নাই, তাঁহার ভাস্বর বুদ্ধির প্রভায় মনের সমস্ত সংশয় ঘুচাইয়া দিয়াছেন। মানুষ হিসাবে হয়তো সহজ ও স্বাভাবিক বলা যায় না, সাধারণে তাঁহাকে খামখেয়ালী বলিবে। কিন্তু এমন পরিপূর্ণরূপে আত্মস্থ, একান্তভাবে নিরভিমান মানুষ আর দেখি নাই। বিবাহাদি করেন নাই; পয়সার পিছনে দৌড়িবার মতো মানসিক দীনতা যেমন তাঁহার ছিল না, পয়সার প্রয়োজনও তেমনি খুব কম ছিল। উচ্চ অঙ্গের দুই একটা ইংরেজী ও মার্কিন পত্রিকাতে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখিয়া কিছু কিছু টাকা পাইতেন, তাহাতেই তাঁহার অনাড়ম্বর একক জীবন চলিয়া যাইত।
বছর দুই পুলিন্দাকে দেখি নাই; মাঝে মাঝে ডুব মারা তাঁহার অভ্যাস। একদিন খবর পাইলাম, তিনি কলিকাতার উপকণ্ঠে বজ্বজ্ লাইনের একটি জনপদে বাস করিতেছেন এবং একাগ্রচিত্তে বাংলা ভাষাতত্ত্বের গবেষণা করিতেছেন। বিস্মিত হইলাম না, কারণ অকস্মাৎ ডুব মারিয়া অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত স্থানে আবির্ভূত হওয়া পুলিন্দার পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক কার্য।
একদিন বৈকালে তাঁহার সহিত দেখা করিতে গেলাম। অনেক দিন তাঁহাকে দেখি নাই সেজন্যও বটে, তা ছাড়া আরও একটা কারণ ছিল। কয়েক মাস হইতে একটা আধ্যাত্মিক সংশয় আমার মনকে পীড়া দিতেছিল; বোধ করি ত্রিশের কোঠা পার হইলে সকলেরই এইরূপ হয়। আধ্যাত্মিক সংশয়টি আর কিছুই নয়, সেই আদিম সংশয়—জন্মান্তর আছে কিনা, মরিবার পর আত্মা থাকে কিনা, ভূতপ্রেত আছে কিনা। প্রাচীন মুনি ঋষি অবতারগণের সহিত আধুনিক মুনি কবি ও চিন্তাবীরগণের এ বিষয়ে এত অধিক মতদ্বৈধ যে মনটা একেবারে গুলাইয়া গিয়াছিল। খাঁচায় ধরা পড়া ইদুরের মতো আমার বুদ্ধি একবার এদিক একবার ওদিক ছুটাছুটি করিতেছিল কিন্তু কোনও দিকেই পথ খুঁজিয়া পাইতেছিল না। এইরূপ মানসিক সঙ্কটের মধ্যে পুলিন্দার খবর পাইয়া ভাবিলাম তাঁহার কাছেই যাই, এ সমস্যার একটা বুদ্ধিগ্রাহ্য সন্তোষজনক সমাধান যদি কেহ দিতে পারে তো সে পুলিন্দা।
তাঁহার আস্তানায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম ছোট্ট স্টেশনের নিকটে প্রকাণ্ড এক তামাকের গুদামে তিনি বাস করিতেছেন। দ্বিতল বাড়ির উপরতলায় তামাকের পাতার বস্তা ঠাসা আছে, নীচের তলায় দুটি ঘর লইয়া পুলিন্দা থাকেন। উপরতলার সহিত তাঁহার কোনও সম্বন্ধ নাই, অধিকাংশ সময়ই উপরতলাটা বন্ধ থাকে।
এই দুই বৎসরে পুলিন্দার বয়স যে বাড়িয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহার মাথাটি স্বভাবতই ডিম্বাকৃতি; লক্ষ্য করিলাম, ডিম্বের উপর হইতে চুল ঝরিয়া গিয়া শীর্ষস্থানটি বেশ চক্চকে হইয়াছে; নাকের উপর একজোড়া চাল্শের চশমা বসিয়াছে। কিন্তু স্বভাব বিন্দুমাত্র বদ্লায় নাই; তেমনি মেঝেয় মাদুর পাতিয়া চারিদিকে পুঁথি কাগজপত্র ছড়াইয়া বসিয়া আছেন। আমাকে চশমার উপর দিয়া দেখিয়া সাগ্রহে আহ্বান করিলেন, ‘এই যে এসেছ।’ এবং এক টিপ নস্য লইয়া সঙ্গে সঙ্গে ভাষাতত্ত্বের আলোচনা শুরু করিয়া দিলেন।
বলিলেন—‘দ্যাখো, বাংলা ভাষাটা দিন দিন বড় দুর্বল হয়ে পড়ছে—আর সে তেজ নেই, ধমক নেই, বড় বেশী বিনয়ী বড় বেশী মিহি হয়ে যাচ্চে। ঐ যে আমাদের সাহিত্যে ব্রাহ্ম সংস্কৃতি ঢুকেছিল এটা তারই ফল। এমন দিন ছিল যখন বাঙালী রেগে গেলে দু’চারটে গরম গরম কথা বলতে পারত, শব্দের তাল ঠুকে বহ্বাস্ফোট করতে পারত; কিন্তু এখন বাঙালীকে জুতো-পেটা করলেও তার মুখ দিয়ে গোঙানি আর কাৎরানি ছাড়া আর কোনও আওয়াজ বেরুবে না। বেরুবে কোত্থেকে? ভাষার সে হুঙ্কার, শব্দের সে দাপট থাকলে তো! বাঙালী জাতটাও তাই দিন দিন মিইয়ে যাচ্চে, মেদিয়ে যাচ্চে। বাঙালীকে আবার চাঙ্গা করে তুলতে হলে নতুন নতুন জোরালো শব্দ আমদানি করতে হবে—সংস্কৃত ইংরিজি ফারসী ভাষায় যেখানে যত জবরদস্ত শব্দ আছে সব বাংলা ভাষার পেটের মধ্যে পুরে দিয়ে তাদের হজম করতে হবে। দ্যাখো, বাংলা ভাষাটা অপভ্রংশের ভাষা। অপভ্রংশের দোষ এই যে, সে শব্দকে মোলায়েম করে ফেলে, সহজ করে ফেলে। ও আর চলবে না। এখন থেকে ইয়া বড় বড় গোব্দা গোব্দা মৌলিক শব্দ ব্যবহার করো। নইলে নিস্তার নেই।’
আমি ক্ষীণভাবে আপত্তি করিলাম—‘কিন্তু ক্রমাগত সাধু ভাষায় কথা বলা—’
পুলিন্দা বলিলেন—‘তুমি একাট পুঙ্গব।’
চমকিয়া বলিলাম—‘সে কি?’
তিনি বলিলেন—‘মানে ষাঁড়। আমার কথাটা ভাল করে বোঝো—’
অতঃপর দুই ঘণ্টা ধরিয়া বঙ্গবাণীর শিরাধমনীতে নূতন রক্ত সঞ্চারের প্রসঙ্গ চলিল; বাংলা ভাষা তথা বাঙালীর যে নিদানকাল উপস্থিত হইয়াছে এবং অচিরাৎ নাদব্রহ্মরূপী বিষ-বটিকা প্রয়োগ না করিলে রোগীর কোনও আশাই নাই একথা পুলিন্দা অত্যন্ত মজবুতভাবে প্রমাণ করিয়া দিলেন। উদ্বিগ্নভাবে শ্রবণ করিলাম। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত প্রশ্নটি ভুলি নাই; তাই অন্ধকার হইয়া গিয়াছে দেখিয়া তিনি যখন আলো জ্বালিতে উঠিলেন, তখন আমি তাক্ বুঝিয়া আমার আধ্যাত্মিক সমস্যাটি পেশ করিয়া দিলাম।
পুলিন্দা আলো জ্বালিয়া আবার আসিয়া বসিলেন; নাকের মধ্যে ডবল-টিপ নস্য ঠুসিয়া দিয়া সজলনেত্রে বলিলেন—‘ভূত প্রেত আত্মা পরমাত্মা পরলোক জন্মান্তর অসিদ্ধ—কারণ প্রমাণাভাব।’
এইভাবে আলোচনা আরম্ভ করিয়া পুলিন্দা ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলেন; ক্রমে প্রসঙ্গ জমিয়া উঠিল; আমি মুগ্ধ হইয়া শুনিতে লাগিলাম। সমস্ত যুক্তি-প্রমাণের উল্লেখ করিবার স্থান নাই; কিন্তু যুক্তির ধাপে ধাপে প্রমাণের সোপান রচনা করিয়া তিনি শেষ পর্যন্ত আমার বুদ্ধিকে যে স্থানে লইয়া উপনীত করিলেন সেখানে ভূতপ্রেত নাই জন্মান্তরও নাই। দেখা গেল আসলে ওগুলি বাসনাপ্রণোদিত অলীক ভাবনা—wishful thinking! চার্বাক হইতে বারট্রাণ্ড রাসেল পর্যন্ত সমস্ত মনীষীর উক্তি তাঁহার যুক্তিকে সমর্থন করিল—শরীরই সর্বস্ব, মন-বুদ্ধি-আত্মা সমস্তই দেহের বিকার মাত্র, সুতরাং শরীর নাশ হইলে আর কিছুই থাকে না। ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ?
রাত্রি অনেক হইয়া গেলেও আলোচনার শেষে মনে বেশ শান্তি অনুভব করিলাম; যা হোক তবু পাকা রকম একটা কিছু পাওয়া গেল। আত্মার দেহবিমুক্ত স্বতন্ত্র অস্তিত্ব যদি নাই থাকে তবে সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া ভাল। দু’নৌকায় পা দিয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করার কোনও মানে হয় না।
আর একদিন আসিব, বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছি, হঠাৎ মাথার উপর ভীষণ দুম-দাম্ শব্দে চমকিয়া উঠিলাম; যেন উপরের গুদাম ঘরে অনেকগুলা পালোয়ান যৌথভাবে মল্লযুদ্ধ শুরু করিয়া দিয়াছে। উপরে কেহ থাকে না শুনিয়াছিলাম, তামাক পাতার আড়তে মানুষের থাকা সম্ভবও নয়; তবে এত রাত্রে কাহারা বদ্ধ ঘরের মধ্যে এমন দুর্দান্ত দুরন্তপনা আরম্ভ করিয়া দিল?
বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করিলাম—‘ও কী?’
পুলিন্দা নিশ্চিন্তভাবে নাকের চশমা খাপে পুরিতে পুরিতে বলিলেন—‘ও কিছু নয়। এগারোটা বেজেছে তো! রোজ রাত্রে ঐ রকম হয়। ওপরে কয়েকটা ভূত আছে, তারাই এই সময় দাপাদাপি করে।’
স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। উপরে দাপাদাপি চলিতে লাগিল। বিমূঢ় হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, উপরের ঘরে সত্যই যদি ভূতের পাল কুস্তি লড়িতেছে তবে এতক্ষণ ধরিয়া কী শুনিলাম?
পুলিন্দা বলিলেন—‘ভয়ের কিছু নেই, ওরা কোনও অনিষ্ট করে না। দশ মিনিট পরে সব চুপচাপ হয়ে যাবে।’
আমি বলিয়া উঠিলাম—‘পুলিন্দা! সত্যই ওরা ভূত? আপনি বিশ্বাস করেন?’
তিনি বলিলেন—‘হ্যাঁ, আমি খুব ভাল করে অনুসন্ধান করেছি, জ্যান্ত জীব হতে পারে না। ইঁদুর বেড়াল তামাকের ধার ঘেঁষে যাবে না, আর মানুষও নয়। সুতরাং ভূতই বটে।’
‘কিন্তু—কিন্তু এতক্ষণ ধরে এই যে আপনি প্রমাণ করলেন—’
পুলিন্দা বলিলেন—‘তুমি একটি হঁর্দম—মানে হাঁদা। প্রমাণের সঙ্গে বিশ্বাসের সম্বন্ধ কি? ভূত আছে এটা ন্যায়শাস্ত্রমতে প্রমাণ করা যায় না, তাই বলে বিশ্বাস করব না? ঐ যারা ওপরে হুটোপাটি করছে ওরা কি প্রমাণের তোয়াক্কা রাখে? জেনে রাখো, যুক্তির সঙ্গে বিশ্বাসের কোনও সম্পর্ক নেই। আচ্ছা রাত হয়েছে, আজ এস তাহলে—’
উপরে ভূতের নৃত্য চলিতে লাগিল। আমি চলিয়া আসিলাম।
২৮ চৈত্র ১৩৫১