সপ্তম পরিচ্ছেদ
চন্দ্রমাধববাবু যখন ডাকিলেন– “নির্মল”, তখন একটা উত্তর পাইলেন বটে “কী মামা”, কিন্তু সুরটা ঠিক বাজিল না। চন্দ্রবাবু ছাড়া আর যে-কেহ হইলে বুঝিতে পারিত সে অঞ্চলে অল্প একটুখানি গোল আছে।
“নির্মল, আমার গলার বোতামটা খুঁজে পাচ্ছি নে।”
“বোধ হয় ঐখানেই কোথাও আছে।”
এরূপ অনাবশ্যক এবং অনির্দিষ্ট সংবাদে কাহারো কোনো উপকার নাই, বিশেষত যাহার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। ফলত এই সংবাদে অদৃশ্য বোতাম সম্বন্ধে কোনো নূতন জ্ঞানলাভের সহায়তা না করিলেও নির্মলার মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে অনেকটা আলোক বর্ষণ করিল। কিন্তু অধ্যাপক চন্দ্রমাধববাবুর দৃষ্টিশক্তি সে দিকেও যথেষ্ট প্রখর নহে। তিনি অন্য দিনের মতোই নিশ্চিন্ত নির্ভরের ভাবে কহিলেন, “একবার খুঁজে দেখো তো ফেনি।”
নির্মলা কহিল, “তুমি কোথায় কী ফেল আমি কি খুঁজে বের করতে পারি?”
এতক্ষণে চন্দ্রবাবুর স্বভাবনিঃশঙ্ক মনে একটুখানি সন্দেহের সঞ্চার হইল; স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “তুমিই তো পার নির্মল! আমার সমস্ত ত্রুটিসম্বন্ধে এত ধৈর্য আর কার আছে?”
নির্মলার রুদ্ধ অভিমান চন্দ্রবাবুর স্নেহস্বরে অকস্মাৎ অশ্রুজলে বিগলিত হইবার উপক্রম করিল; নিঃশব্দে সম্বরণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
তাহাকে নিরুত্তর দেখিয়া চন্দ্রমাধববাবু নির্মলার কাছে আসিলেন এবং যেমন করিয়া সন্দিগ্ধ মোহরটি চোখের খুব কাছে ধরিয়া পরীক্ষা করিতে হয় তেমনি করিয়া নির্মলার মুখখানি দুই আঙুল দিয়া তুলিয়া ধরিয়া ক্ষণকাল দেখিলেন এবং গম্ভীর মৃদু হাস্যে কহিলেন, “নির্মল আকাশে একটুখানি মালিন্য দেখছি যেন! কী হয়েছে বলো দেখি।”
নির্মলা জানিত চন্দ্রমাধববাবু অনুমানের চেষ্টাও করিবেন না। যাহা স্পষ্ট প্রকাশমান নহে তাহা তিনি মনের মধ্যে স্থানও দিতেন না। তাঁহার নিজের চিত্ত যেমন শেষ পর্যন্ত স্বচ্ছ অন্যের নিকটও সেইরূপ একান্ত স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করিতেন।
নির্মলা ক্ষুব্ধ স্বরে কহিল, “এত দিন পরে আমাকে তোমাদের চিরকুমার-সভা থেকে বিদায় দিচ্ছ কেন? আমি কী করেছি?”
চন্দ্রমাধববাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “চিরকুমার-সভা থেকে তোমাকে বিদায়? তোমার সঙ্গে সে সভার যোগ কী?”
নির্মলা। দরজার আড়ালে থাকলে বুঝি যোগ থাকে না? অন্তত সেই যতটুকু যোগ তাই বা কেন যাবে?
চন্দ্রবাবু। নির্মল, তুমি তো এ সভার কাজ করবে না– যারা কাজ করবে তাদের সুবিধার প্রতি লক্ষ রেখেই–
নির্মলা। আমি কেন কাজ করব না? তোমার ভাগ্নে না হয়ে ভাগ্নী হয়ে জন্মেছি বলেই কি তোমাদের হিতকার্যে যোগ দিতে পারব না? তবে আমাকে এত দিন শিক্ষা দিলে কেন? নিজের হাতে আমার সমস্ত মনপ্রাণ জাগিয়ে দিয়ে শেষকালে কাজের পথ রোধ করে দাও কী বলে?
চন্দ্রমাধববাবু এই উচ্ছ্বাসের জন্য কিছুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না; তিনি যে নির্মলাকে নিজে কী ভাবে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন তাহা নিজেই জানিতেন না। ধীরে ধীরে কহিলেন, “নির্মল, এক সময়ে তো বিবাহ করে তোমাকে সংসারের কাজে প্রবৃত্ত হতে হবে– চিরকুমার-সভার কাজ–”
“বিবাহ আমি করব না।”
“তবে কী করবে বলো।”
“দেশের কাজে তোমার সাহায্য করব।”
“আমরা তো সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়েছি।”
“ভারতবর্ষে কি কেউ কখনো সন্ন্যাসিনী হয় নি?”
চন্দ্রমাধববাবু স্তম্ভিত হইয়া হারানো বোতামটার কথা একেবারে ভুলিয়া গেলেন। নিরুত্তর হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
উৎসাহদীপ্তিতে মুখ আরক্তিম করিয়া নির্মলা কহিল, “মামা, যদি কোনো মেয়ে তোমাদের ব্রত গ্রহণের জন্যে অন্তরের সঙ্গে প্রস্তুত হয় তবে প্রকাশ্যভাবে তোমাদের সভার মধ্যে কেন তাকে গ্রহণ করবে না? আমি তোমাদের কৌমার্যসভার কেন সভ্য না হব?”
নিষ্কলুষচিত্ত চন্দ্রমাধবের কাছে ইহার কোনো উত্তর ছিল না। তবু দ্বিধাকুণ্ঠিতভাবে বলিতে লাগিলেন, “অন্য যাঁরা সভ্য আছেন–”
নির্মলা কথা শেষ না হইতেই বলিয়া উঠিল, “যাঁরা সভ্য আছেন, যাঁরা ভারতবর্ষের হিতব্রত নেবেন, যাঁরা সন্ন্যাসী হতে যাচ্ছেন– তাঁরা কি একজন ব্রতধারিণী স্ত্রীলোককে অসংকোচে নিজের দলে গ্রহণ করতে পারবেন না? তা যদি হয় তা হলে তাঁরা গৃহী হয়ে ঘরে রুদ্ধ থাকুন, তাঁদের দ্বারা কোনো কাজ হবে না।”
চন্দ্রমাধববাবু চুলগুলার মধ্যে ঘন ঘন পাঁচ আঙুল চালাইয়া অত্যন্ত উস্কোখুস্কো করিয়া তুলিলেন। এমন সময় হঠাৎ তাঁহার আস্তিনের ভিতর হইতে হারানো বোতামটা মাটিতে পড়িয়া গেল; নির্মলা হাসিতে হাসিতে কুড়াইয়া লইয়া চন্দ্রমাধববাবুর কামিজের গলায় লাগাইয়া দিল– চন্দ্রমাধববাবু তাহার কোনো খবর লইলেন না– চুলের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে মস্তিষ্ককুলায়ের চিন্তাগুলিকে বিব্রত করিতে লাগিলেন।
চাকর আসিয়া খবর দিল, পূর্ণবাবু আসিয়াছেন। নির্মলা ঘর হইতে চলিয়া গেলে তিনি প্রবেশ করিলেন। কহিলেন, “চন্দ্রবাবু, সে কথাটা কি ভেবে দেখলেন? আমাদের সভাটিকে স্থানান্তর করা আমার বিবেচনায় ভালো হচ্ছে না।”
চন্দ্র। আজ আর-একটি কথা উঠেছে, সেটা পূর্ণবাবু, তোমার সঙ্গে ভালো করে আলোচনা করতে ইচ্ছা করি। আমার একটি ভাগ্নী আছেন বোধ হয় জানো?
পূর্ণ। (নিরীহভাবে) আপনার ভাগ্নী?
চন্দ্র। হাঁ, তাঁর নাম নির্মলা। আমাদের চিরকুমার-সভার সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের খুব যোগ আছে।
পূর্ণ। (বিস্মিতভাবে) বলেন কী!
চন্দ্র। আমার বিশ্বাস, তাঁর অনুরাগ এবং উৎসাহ আমাদের কারো চেয়ে কম নয়।
পূর্ণ। (উত্তেজিতভাবে) এ কথা শুনলে আমাদের উৎসাহ বেড়ে ওঠে। স্ত্রীলোক হয়ে তিনি–
চন্দ্র। আমিও সেই কথা ভাবছি, স্ত্রীলোকের সরল উৎসাহ পুরুষের উৎসাহে যেন নূতন প্রাণ সঞ্চার করতে পারে– আমি নিজেই সেটা আজ অনুভব করেছি।
পূর্ণ। (আবেগপূর্ণভাবে) আমিও সেটা বেশ অনুমান করতে পারি।
চন্দ্র। পূর্ণবাবু, তোমারও কি ঐ মত?
পূর্ণ। কী মত বলছেন?
চন্দ্র। অর্থাৎ, যথার্থ অনুরাগী স্ত্রীলোক আমাদের কঠিন কর্তব্যের বাধা না হয়ে যথার্থ সহায় হতে পারেন?
পূর্ণ। (নেপথ্যের প্রতি লক্ষ করিয়া উচ্চকণ্ঠে) সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই, স্ত্রীজাতির অনুরাগ পুরুষের অনুরাগের একমাত্র সজীব নির্ভর– পুরুষের উৎসাহকে নবজাত শিশুটির মতো মানুষ করে তুলতে পারে কেবল স্ত্রীলোকের উৎসাহ।
শ্রীশ ও বিপিনের প্রবেশ
শ্রীশ। তা তো পারে পূর্ণবাবু, কিন্তু সেই উৎসাহের অভাবেই কি আজ সভায় যেতে বিলম্ব হচ্ছে?
পূর্ণ এত উচ্চস্বরে বলিয়া উঠিয়াছিল যে নবাগত দুইজনে সিঁড়ি হইতেই সকল কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন।
চন্দ্রবাবু কহিলেন, “না, না, দেরি হবার কারণ, আমার গলার বোতামটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি নে।”
শ্রীশ। গলায় তো একটা বোতাম লাগানো রয়েছে দেখতে পাচ্ছি– আরো কি প্রয়োজন আছে? যদি-বা থাকে, আর ছিদ্র পাবেন কোথা?
চন্দ্রবাবু গলায় হাত দিয়া বলিলেন, “তাই তো!” বলিয়া ঈষৎ লজ্জিত হইয়া হাসিতে লাগিলেন।
চন্দ্র। আমরা সকলেই তো উপস্থিত আছি, এখন সেই কথাটার আলোচনা হয়ে যাওয়া ভালো, কী বল পূর্ণবাবু?
হঠাৎ পূর্ণবাবুর উৎসাহ অনেকটা নামিয়া গেল। নির্মলার নাম করিয়া সকলের কাছে আলোচনা উত্থাপন তাহার কাছে রুচিকর বোধ হইল না। সে কিছু কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, “সে বেশ কথা, কিন্তু এ দিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে না?”
চন্দ্র। না, এখনো সময় আছে। শ্রীশবাবু, তোমরা একটু বোসো-না, কথাটা একটু স্থির হয়ে ভেবে দেখবার যোগ্য। আমার একটি ভাগ্নী আছেন, তাঁর নাম নির্মলা–
পূর্ণ হঠাৎ কাসিয়া লাল হইয়া উঠিল। ভাবিল চন্দ্রবাবুর কাণ্ডজ্ঞানমাত্রই নাই– পৃথিবীর লোকের কাছে নিজের ভাগ্নীর পরিচয় দিবার কী দরকার– অনায়াসে নির্মলাকে বাদ দিয়া কথাটা আলোচনা করা যাইতে পারে। কিন্তু কোনো কথার কোনো অংশ বাদ দিয়া বলা চন্দ্রবাবুর স্বভাব নহে।
চন্দ্র। আমাদের কুমারসভার সমস্ত উদ্দেশ্যের সঙ্গে তাঁর একান্ত মনের মিল।
এত বড়ো একটা খবর শ্রীশ এবং বিপিন অবিচলিত নিরুৎসুক ভাবে শুনিয়া যাইতে লাগিল। পূর্ণ কেবলই ভাবিতে লাগিল, নির্মলার প্রসঙ্গ সম্বন্ধে যাহারা জড় পাষাণের মতো উদাসীন, নির্মলাকে যাহারা পৃথিবীর সাধারণ স্ত্রীলোকের সহিত পৃথক করিয়া দেখে না, তাহাদের কাছে সে নামের উল্লেখ করা কেন?
চন্দ্র। এ কথা আমি নিশ্চয় বলতে পারি, তাঁর উৎসাহ আমাদের কারো চেয়ে কম নয়।
শ্রীশ ও বিপিনের কাছ হইতে সাড়া না পাইয়া চন্দ্রবাবুও বোধ করি মনে মনে একটু উত্তেজিত হইতেছিলেন।
চন্দ্র। এ কথা আমি ভালোরূপ বিবেচনা করে দেখে স্থির করেছি, স্ত্রীলোকের উৎসাহ পুরুষের সমস্ত বৃহৎ কার্যের মহৎ অবলম্বন। কী বল পূর্ণবাবু!
পূর্ণবাবুর কোনো কথা বলিবার ইচ্ছাই ছিল না; কিন্তু নিস্তেজভাবে বলিল, “তা তো বটেই।”
চন্দ্রবাবুর পালে কোনো দিক হইতে কোনো হাওয়া লাগিল না দেখিয়া হঠাৎ সবেগে ঝিঁকা মারিয়া বলিয়া উঠিলেন, “নির্মলা যদি কুমারসভার সভ্য হবার জন্য প্রার্থী থাকে তা হলে তাকে আমরা সভ্য না করব কেন?”
পূর্ণ তো একেবারে বজ্রাহতবৎ! বলিয়া উঠিল, “বলেন কী চন্দ্রবাবু?”
শ্রীশ পূর্ণর মতো অত্যুগ্র বিস্ময় প্রকাশ না করিয়া কহিল, “আমরা কখনো কল্পনা করি নি যে, কোনো স্ত্রীলোক আমাদের সভার সভ্য হতে ইচ্ছা প্রকাশ করবেন, সুতরাং এ সম্বন্ধে আমাদের কোনো নিয়ম নেই–”
ন্যায়পরায়ণ বিপিন গম্ভীরকণ্ঠে কহিল, “নিষেধও নেই।”
অসহিষ্ণু শ্রীশ কহিল, “স্পষ্ট নিষেধ না থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের সভার যে-সকল উদ্দেশ্য তা স্ত্রীলোকের দ্বারা সাধিত হবার নয়।”
কুমারসভায় স্ত্রীলোক সভ্য লইবার জন্য বিপিনের যে বিশেষ উৎসাহ ছিল তাহা নয়, কিন্তু তাহার মানসপ্রকৃতির মধ্যে একটা স্বাভাবিক সংযম থাকায় কোনো শ্রেণী-বিশেষের বিরুদ্ধে এক-দিক-ঘেঁষা কথা সে সহিতে পারিত না। তাই সে বলিয়া উঠিল, “আমাদের সভার উদ্দেশ্য সংকীর্ণ নয়, এবং বৃহৎ উদ্দেশ্য সাধন করতে গেলে বিচিত্র শ্রেণীর ও বিচিত্র শক্তির লোকের বিচিত্র চেষ্টায় প্রবৃত্ত হওয়া চাই। স্বদেশের হিতসাধন একজন স্ত্রীলোক যেরকম পারবেন তুমি সেরকম পারবে না এবং তুমি যেরকম পারবে একজন স্ত্রীলোক সেরকম পারবেন না– অতএব সভার উদ্দেশ্যকে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণভাবে সাধন করতে গেলে তোমারও যেমন দরকার স্ত্রীসভ্যেরও তেমনি দরকার।”
লেশমাত্র উত্তেজনা প্রকাশ না করিয়া বিপিন শান্তগম্ভীরভাবে বলিয়া গেল– কিন্তু শ্রীশ কিছু উত্তপ্ত হইয়া বলিল, “যারা কাজ করতে চায় না তারাই উদ্দেশ্যকে ফলাও করে তোলে। যথার্থ কাজ করতে গেলেই লক্ষকে সীমাবদ্ধ করতে হয়। আমাদের সভার উদ্দেশ্যকে যত বৃহৎ মনে করে তুমি বেশ নিশ্চিন্ত আছ আমি তত বৃহৎ মনে করি নে।”
বিপিন শান্তমুখে কহিল, “আমাদের সভার কার্যক্ষেত্র অন্তত এতটা বৃহৎ যে, তোমাকে গ্রহণ করেছে বলে আমাকে পরিত্যাগ করতে হয় নি এবং আমাকে গ্রহণ করেছে বলে তোমাকে পরিত্যাগ করতে হয় নি। তোমার-আমার উভয়েরই যদি এ স্থানে স্থান হয়ে থাকে, আমাদের দুজনেরই যদি এখানে উপযোগিতা ও আবশ্যকতা থাকে, তা হলে আরো একজন ভিন্ন প্রকৃতির লোকের এখানে স্থান হওয়া এমন কী কঠিন?”
শ্রীশ চটিয়া কহিল, “উদারতা অতি উত্তম জিনিস, সে আমি নীতিশাস্ত্রে পড়েছি। আমি তোমার সেই উদারতাকে নষ্ট করতে চাই নে, বিভক্ত করতে চাই মাত্র। স্ত্রীলোকেরা যে কাজ করতে পারেন তার জন্যে তাঁরা স্বতন্ত্র সভা করুন, আমরা তার সভ্য হবার প্রার্থী হব না, এবং আমাদের সভাও আমাদেরই থাক্। নইলে আমরা পরস্পরের কাজের বাধা হব মাত্র। মাথাটা চিন্তা করে মরুক, উদরটা পরিপাক করতে থাক্– পাকযন্ত্রটি মাথার মধ্যে এবং মস্তিষ্কটি পেটের মধ্যে প্রবেশচেষ্টা না করলেই বস্।”
বিপিন। কিন্তু তাই বলে মাথাটা ছিন্ন করে এক জায়গায় এবং পাকযন্ত্রটাকে আর-এক জায়গায় রাখলেও কাজের সুবিধা হয় না।
শ্রীশ অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিল, “উপমা তো আর যুক্তি নয় যে সেটাকে খণ্ডন করলেই আমার কথাটাকে খণ্ডন করা হল। উপমা কেবল খানিক দূর পর্যন্ত খাটে”–
বিপিন। অর্থাৎ যতটুকু কেবল তোমার যুক্তির পক্ষে খাটে।
এই দুই পরম বন্ধুর মধ্যে এমন বিবাদ সর্বদাই ঘটিয়া থাকে। পূর্ণ অত্যন্ত বিমনা হইয়া বসিয়াছিল; সে কহিল, “বিপিনবাবু, আমার মত এই যে, আমাদের এই-সকল কাজে মেয়েরা অগ্রসর হয়ে এলে তাতে তাঁদের মাধুর্য নষ্ট হয়।”
চন্দ্রবাবু একখানা বই চক্ষের অত্যন্ত কাছে ধরিয়া কহিলেন, “মহৎ কার্যে যে মাধুর্য নষ্ট হয় সে মাধুর্য সযত্নে রক্ষা করবার যোগ্য নয়।”
শ্রীশ বলিয়া উঠিল, “না চন্দ্রবাবু, আমি ও-সব সৌন্দর্য-মাধুর্যের কথা আনছিই নে। সৈন্যদের মতো এক চালে আমাদের চলতে হবে, অনভ্যাস বা স্বাভাবিক দুর্বলতাবশত যাঁদের পিছিয়ে পড়বার সম্ভাবনা আছে তাঁদের নিয়ে ভারগ্রস্ত হলে আমাদের সমস্তই ব্যর্থ হবে।”
এমন সময় নির্মলা অকুণ্ঠিত মর্যাদার সহিত গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া নমস্কার করিয়া দাঁড়াইল। হঠাৎ সকলেই স্তম্ভিত হইয়া গেল। যদিচ একটা অশ্রুপূর্ণ ক্ষোভে তাহার কণ্ঠস্বর আর্দ্র ছিল তথাপি সে দৃঢ় স্বরে কহিল, “আপনাদের কী উদ্দেশ্য এবং আপনারা দেশের কাজে কতদূর পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত আছেন তা আমি কিছুই জানি নে– কিন্তু আমি আমার মামাকে জানি, তিনি যে পথে যাত্রা করে চলেছেন আপনারা কেন আমাকে সে পথে তাঁর অনুসরণ করতে বাধা দিচ্ছেন?”
শ্রীশ নিরুত্তর, পূর্ণ কুণ্ঠিত অনুতপ্ত, বিপিন প্রশান্ত গম্ভীর, চন্দ্রবাবু সুগভীর চিন্তামগ্ন।
পূর্ণ এবং শ্রীশের প্রতি বর্ষার রৌদ্ররশ্মির ন্যায় অশ্রুজলস্নাত কটাক্ষপাত করিয়া নির্মলা কহিল, “আমি যদি কাজ করতে চাই– যিনি আমার আশৈশবের গুরু, মৃত্যু পর্যন্ত যদি সকল শুভচেষ্টায় তাঁর অনুবর্তিনী হতে ইচ্ছা করি, আপনারা কেবল তর্ক করে আমার অযোগ্যতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন কেন? আপনারা আমাকে কী জানেন!”
শ্রীশ স্তব্ধ। পূর্ণ ঘর্মাক্ত।
নির্মলা। আমি আপনাদের কুমারসভা বা অন্য কোনো সভা জানি নে, কিন্তু যাঁর শিক্ষায় আমি মানুষ হয়েছি তিনি যখন কুমারসভাকে অবলম্বন করেই তাঁর জীবনের সমস্ত উদ্দেশ্য-সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন এই কুমারসভা থেকে আপনারা আমাকে দূরে রাখতে পারবেন না। (চন্দ্রবাবুর দিকে ফিরিয়া) তুমি যদি বল আমি তোমার কাজের যোগ্য নই তা হলে আমি বিদায় হব, কিন্তু এঁরা আমাকে কী জানেন। এঁরা কেন আমাকে তোমার অনুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন করবার জন্যে সকলে মিলে তর্ক করছেন?
শ্রীশ তখন বিনীত মৃদুস্বরে কহিল, “মাপ করবেন, আমি আপনার সম্বন্ধে কোনো তর্ক করি নি, আমি সাধারণত স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে বলছিলুম–”
নির্মলা। আমি স্ত্রীজাতি-পুরুষজাতির প্রভেদ নিয়ে কোনো বিচার করতে চাই নে– আমি নিজের অন্তঃকরণ জানি এবং যাঁর উন্নত দৃষ্টান্তকে আশ্রয় করে রয়েছি তাঁর অন্তঃকরণ জানি, কাজে প্রবৃত্ত হতে এর বেশি আমার আর-কিছু জানবার দরকার নেই।
চন্দ্রবাবু নিজের দক্ষিণ করতল চোখের অত্যন্ত কাছে লইয়া নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। পূর্ণ খুব চমৎকার করিয়া একটা কিছু বলিবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু তাহার মুখ দিয়া কোনো কথাই বাহির হইল না। নির্মলা দ্বারের অন্তরালে থাকিলে পূর্ণর বাক্শক্তি যেরূপ সতেজ থাকে আজ তাহার তেমন পরিচয় পাওয়া গেল না।
তবু সে মনে মনে অনেক আবৃত্তি করিয়া বলিল, “দেবী, এই পঙ্কিল পৃথিবীর কাজে কেন আপনার পবিত্র দুইখানি হস্ত প্রয়োগ করিতে চাচ্ছেন?”
কথাটা মনে যেমন লাগিতেছিল মুখে তেমন শোনাইল না– পূর্ণ বলিয়াই বুঝিতে পারিল কথাটা গদ্যের মধ্যে হঠাৎ পদ্যের মতো কিছু যেন বাড়াবাড়ি হইয়া পড়িল। লজ্জায় তাহার কান লাল হইয়া উঠিল। বিপিন স্বাভাবিক সুগম্ভীর শান্তস্বরে কহিল, “পৃথিবী যত বেশি পঙ্কিল পৃথিবীর সংশোধন-কার্য তত বেশি পবিত্র।”
এই কথাটায় কৃতজ্ঞ নির্মলার মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া পূর্ণ ভাবিল, “আহা, কথাটা আমারই বলা উচিত ছিল।’ বিপিন বলিয়াছে বলিয়া তাহার উপর অত্যন্ত রাগ হইল।
শ্রীশ। সভার অধিবেশনে স্ত্রীসভ্য লওয়া সম্বন্ধে নিয়মমত প্রস্তাব উত্থাপন করে যা স্থির হয় আপনাকে জানাব।
নির্মলা এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করিয়া পালের নৌকার মতো নিঃশব্দে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল। হঠাৎ অধ্যাপক সচেতন হইয়া ডাকিলেন, “ফেনি, আমার সেই গলার বোতামটা?”
নির্মলা সলজ্জ হাসিয়া মুদুকণ্ঠে ইশারা করিয়া কহিল, “গলাতেই আছে।”
চন্দ্রবাবু গলায় হাত দিয়া “হাঁ হাঁ আছে বটে” বলিয়া তিন ছাত্রের দিকে চাহিয়া হাসিলেন।