প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

অক্ষয় বলিলেন, “স্বামীই স্ত্রীর একমাত্র তীর্থ। মান কি না?”

পুরবালা। আমি কী পণ্ডিতমশায়ের কাছে শাস্ত্রের বিধান নিতে এসেছি? আমি মার সঙ্গে আজ কাশী চলেছি এই খবরটি দিয়ে গেলুম।

অক্ষয়। খবরটি সুখবর নয়– শোনবামাত্র তোমাকে শাল-দোশালা বকশিশ দিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।

পুরবালা। ইস, হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে– না? সহ্য করতে পারছ না?

অক্ষয়। আমি কেবল উপস্থিত বিচ্ছেদের কথা ভাবছি নে– এখন তুমি দুদিন না রইলে, আরো কজন রয়েছেন, একরকম করে এই হতভাগ্যের চলে যাবে। কিন্তু এর পরে কী হবে? দেখো, ধর্মকর্মে স্বামীকে এগিয়ে যেয়ো না– স্বর্গে তুমি যখন ডবল প্রোমোশন পেতে থাকবে আমি তখন পিছিয়ে থাকব– তোমাকে বিষ্ণুদূতে রথে চড়িয়ে নিয়ে যাবে, আর আমাকে যমদূতে কানে ধরে হাঁটিয়ে দৌড় করাবে–

গান। পরজ

স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাবে উড়িয়ে,
পিছে পিছে আমি চলব খুঁড়িয়ে।
ইচ্ছা হবে টিকির ডগা ধরে

পুরবালা। আচ্ছা, আচ্ছা, থামো।

অক্ষয়। আমি থামব, কেবল তুমিই চলবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই বন্দোবস্ত?– নিতান্তই চললে?

পুরবালা। চললুম।

অক্ষয়। আমাকে কার হাতে সমর্পণ করে গেলে?

পুরবালা। রসিকদাদার হাতে।

অক্ষয়। মেয়েমানুষ, হস্তান্তর করবার আইন কিছুই জান না। সেইজন্যেই তো বিরহাবস্থায় উপযুক্ত হাত নিজেই খুঁজে নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়।

পুরবালা। তোমাকে তো বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হবে না।

অক্ষয়। তা হবে না।

গান। কাফি

কার হাতে যে ধরা দেব প্রাণ;
তাই ভাবতে বেলা অবসান।
ডান দিকেতে তাকাই যখন, বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন
বাঁয়ের লাগি ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান।

আচ্ছা, আমার যেন সান্ত্বনার গুটি দুই-তিন সদুপায় আছে, কিন্তু তুমি

বিরহ-যামিনী কেমনে যাপিবে,
বিচ্ছেদতাপে যখন তাপিবে
এপাশ ওপাশ বিছানা মাপিবে,
মকরকেতনে কেবলি শাপিবে–

পুরবালা। রক্ষে করো, ও মিলটা ঐখানেই শেষ করো।

অক্ষয়। দুঃখের সময় আমি থামতে পারি নে– কাব্য আপনি বেরোতে থাকে। মিল ভালো না বাস অমিত্রাক্ষর আছে, তুমি যখন বিদেশে থাকবে আমি “আর্তনাদবধ কাব্য’ বলে একটা কাব্য লিখব– সখী, তার আরম্ভটা শোনো–

(সাড়ম্বরে)বাষ্পীয় শকটে চড়ি নারীচূড়ামণি
পুরবালা চলি যবে গেলা কাশীধামে
বিকালে, কহ হে দেবী অমৃতভাষিণী
কোন্‌ বরাঙ্গনে বরি বরমাল্যদানে
যাপিলা বিচ্ছেদমাস শ্যালীত্রয়ীশালী
শ্রীঅক্ষয়!

পুরবালা। (সগর্বে) আমার মাথা খাও, ঠাট্টা নয়, তুমি একটা সত্যিকার কাব্য লেখো-না।

অক্ষয়। মাথা খাওয়ার কথাটা যদি বললে, আমি নিজের মাথাটি খেয়ে অবধি বুঝেছি ওটা সুখাদ্যের মধ্যে গণ্য নয়। আর ঐ কাব্য লেখা, ও কার্যটাও সুসাধ্য বলে জ্ঞান করি নে। বুদ্ধিতে আমার এক জায়গায় ফুটো আছে, কাব্য জমতে পারে না– ফস ফস করে বেরিয়ে পড়ে।

তুমি জান আমার গাছে ফল কেন না ফলে!
যেমনি ফুলটি ফুটে ওঠে আনি চরণতলে।

কিন্তু আমার প্রশ্নের তো কোনো উত্তর পেলুম না। কৌতূহলে মরে যাচ্ছি। কাশীতে যে চলেছ, উৎসাহটা কিসের জন্যে? আপাতত সেই বিষ্ণুদূতটাকে মনে মনে ক্ষমা করলুম, কিন্তু ভগবান ভূতনাথ ভবানীপতির অনুচরগুলোর উপর ভারি সন্দেহ হচ্ছে। শুনেছি নন্দী ও ভৃঙ্গী অনেক বিষয়ে আমাকেও যেতে, ফিরে এসে হয়তো এই ভূতটিকে পছন্দ না হতেও পারে!

অক্ষয়ের পরিহাসের মধ্যে একটু যে অভিমানের জ্বালা ছিল, সেটুকু পুরবালা অনেকক্ষণ বুঝিয়াছে। তাহা ছাড়া, প্রথমে কাশী যাইবার প্রস্তাবে তাহার যে উৎসাহ হইয়াছিল, যাত্রার সময় যতই নিকটবর্তী হইতে লাগিল ততই তাহা ম্লান হইয়া আসিতেছে।

সে কহিল, “আমি কাশী যাব না।”

অক্ষয়। সে কী কথা! ভূতভাবনের যে ভৃত্যগুলি একবার মরে ভূত হয়েছে তারা যে দ্বিতীয় বার মরবে।

রসিকের প্রবেশ

পুরবালা। আজ যে রসিকদাদার মুখ ভারি প্রফুল্ল দেখাচ্ছে?

রসিক। ভাই, তোর রসিকদাদার মুখের ঐ রোগটা কিছুতেই ঘুচল না। কথা নেই বার্তা নেই প্রফুল্ল হয়েই আছে– বিবাহিত লোকেরা দেখে মনে মনে রাগ করে।

পুরবালা। শুনলে তো, বিবাহিত লোক! এর একটা উপযুক্ত জবাব দিয়ে যাও।

অক্ষয়। আমাদের প্রফুল্লতার খবর ও বৃদ্ধ কোথা থেকে জানবে? সে এত রহস্যময় যে, তা উদ্ভেদ করতে আজ পর্যন্ত কেউ পারলে না– সে এত গভীর যে আমরাই হাতড়ে খুঁজে পাই নে, হঠাৎ সন্দেহ হয় আছে কি না।

পুরবালা। “এই বুঝি!” বলিয়া রাগ করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল।

অক্ষয় তাহাকে ধরিয়া ফিরাইয়া কহিল, “দোহাই তোমার, এই লোকটির সামনে রাগারাগি কোরো না– তা হলে ওর আস্পর্ধা আরো বেড়ে যাবে।– দেখো দাম্পত্য-তত্ত্বানভিজ্ঞ বৃদ্ধ, আমরা যখন রাগ করি তখন স্বভাবত আমাদের কণ্ঠস্বর প্রবল হয়ে ওঠে, সেইটেই তোমাদের কর্ণগোচর হয়; আর অনুরাগে যখন আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, কানের কাছে মুখ আনতে গিয়ে মুখ বারম্বার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়তে থাকে, তখন তো খবর পাও না!”

পুরবালা। আঃ– চুপ করো।

অক্ষয়। যখন গয়নার ফর্দ হয় তখন বাড়ির সরকার থেকে সেকরা পর্যন্ত সেটা কারো অবিদিত থাকে না, কিন্তু বসন্তনিশীথে যখন প্রেয়সী–

পুরবালা। আঃ– থামো।

অক্ষয়। বসন্তনিশীথে প্রেয়সী–

পুরবালা। আঃ– কী বকছ তার ঠিক নেই!

অক্ষয়। বসন্তনিশীথে যখন প্রেয়সী গর্জন করে বলেন, “আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাব, আমার এক দণ্ড এখানে থাকতে ইচ্ছে নেই– আমার হাড় কালী হল– আমার–‘

পুরবালা। হাঁগো মশায়, কবে তোমার প্রেয়সী বাপের বাড়ি যাব বলে বসন্তনিশীথে গর্জন করেছে?

অক্ষয়। ইতিহাসের পরীক্ষা? কেবল ঘটনা রচনা করে নিষ্কৃতি নেই? আবার সন-তারিখ-সুদ্ধ মুখে মুখে বানিয়ে দিতে হবে? আমি কি এতবড়ো প্রতিভাশালী?

রসিক। (পুরবালার প্রতি) বুঝেছ ভাই, সোজা করে ও তোমার কথা বলতে পারে না– ওর এত ক্ষমতাই নেই– তাই উল্‌টে বলে; আদরে না কুলোলে গাল দিয়ে আদর করতে হয়।

পুরবালা। আচ্ছা মল্লিনাথজি, তোমার আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। মা যে শেষকালে তোমাকেই কাশী নিয়ে যাবেন স্থির করেছেন।

রসিক। তা, বেশ তো, এতে আর ভয়ের কথাটা কী? তীর্থে যাবার তো বয়সই হয়েছে। এখন তোমাদের লোলকটাক্ষে এ বৃদ্ধের কিছুই করতে পারবে না– এখন চিত্ত চন্দ্রচূড়ের চরণে–

মুগ্ধস্নিগ্ধবিদগ্ধমধুরৈর্লালৈঃ কটাক্ষৈরলং
চেতঃ সম্প্রতি চন্দ্রচূড়চরণধ্যানামৃতে বর্ততে।

পুরবালা। সে তো খুব ভালো কথা– তোমার উপরে আর কটাক্ষের অপব্যয় করতে চাই নে, এখন চন্দ্রচূড় চরণে চলো– তা হলে মাকে ডাকি!

রসিক। (করজোড়ে) বড়দিদি ভাই, তোমার মা আমাকে সংশোধনের বিস্তর চেষ্টা করছেন, কিন্তু একটু অসময়ে সংস্কারকার্য আরম্ভ করেছেন– এখন তাঁর শাসনে কোনো ফল হবে না। বরঞ্চ এখনো নষ্ট হবার বয়স আছে, সে বয়সটা বিধাতার কৃপায় বরাবরই থাকে, লোলকটাক্ষটা শেষকাল পর্যন্ত খাটে, কিন্তু উদ্ধারের বয়স আর নেই। তিনি এখন কাশী যাচ্ছেন, কিছুদিন এই বৃদ্ধ শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতিসাধনের দুরাশা পরিত্যাগ করে শান্তিতে থাকুন– কেন তোরা তাঁকে কষ্ট দিবি।

জগত্তারিণীর প্রবেশ

জগত্তারিণী। বাবা, তা হলে আসি।

অক্ষয়। চললে না কি মা? রসিকদাদা যে এতক্ষণ দুঃখ করছিলেন যে তুমি–

রসিক। (ব্যাকুলভাবে) দাদার সকল কথাতেই ঠাট্টা! মা, আমার কোনো দুঃখ নেই– আমি কেন দুঃখ করতে যাব?

অক্ষয়। বলছিলে না, যে, বড়োমা একলাই কাশী যাচ্ছেন, আমাকে সঙ্গে নিলেন না?

রসিক। হাঁ, সে তো ঠিক কথা। মনে তো লাগতেই পারে– তবে কি না মা যদি নিতান্তই–

জগত্তারিণী। না বাপু, বিদেশে তোমার রসিকদাদাকে সামলাবে কে? ওঁকে নিয়ে পথ চলতে পারব না।

পুরবালা। কেন মা, রসিকদাদাকে নিয়ে গেলে উনি তোমাকে দেখতে শুনতে পারতেন।

জগত্তারিণী। রক্ষে করো, আমাকে আর দেখে শুনে কাজ নেই। তোমার রসিকদাদার বুদ্ধির পরিচয় ঢের পেয়েছি।

রসিক। (টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে) তা মা, যেটুকু বুদ্ধি আছে তার পরিচয় সর্বদাই দিচ্ছি– ও তো চেপে রাখবার জো নেই– ধরা পড়তেই হবে। ভাঙা চাকাটাই সব চেয়ে খড়্‌ খড়্‌ করে– তিনি যে ভাঙা সেটা পাড়াসুদ্ধ খবর পায়। সেইজন্যেই বড়োমা চুপচাপ করে থাকতেই চাই, কিন্তু তুমি যে আবার চালাতেও ছাড় না।

নিজের শৈথিল্যে যাহার কিছুই মনের মতো হয় না, সর্বদা ভর্ৎসনা করিবার জন্য তাহার একটা হতভাগ্যকে চাই। রসিকদাদা জগত্তারিণীর বহিঃস্থিত আত্মগ্লানিবিশেষ।

জগত্তারিণী। আমি তা হলে হারানের বাড়ি চললুম, একেবারে তাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠব– এর পরে আর যাত্রার সময় নেই। পুরো, তোরা তো দিনক্ষণ মানিস নে, ঠিক সময়ে ইস্টেশনে যাস।

তাঁহার কন্যাজামাতার অসামান্য আসক্তি মা বেশ অবগত ছিলেন। পঞ্জিকার খাতিরে শেষ মুহূর্তের পূর্বে তাহাদের বিচ্ছেদসংঘটনের চেষ্টা তিনি বৃথা বলিয়াই জানিতেন।

কিন্তু পুরবালা যখন বলিল “মা আমি কাশী যাব না”, সেটা তিনি বাড়াবাড়ি মনে করিলেন। পুরবালার প্রতি তাঁহার বড়ো নির্ভর। সে তাঁহার সঙ্গে যাইতেছে বলিয়া তিনি নিশ্চিন্ত আছেন। পুরবালা স্বামীর সঙ্গে সিমলা যাতায়াত করিয়া বিদেশ-ভ্রমণে পাকা হইয়াছে; পুরুষ-অভিভাবকের অপেক্ষা পুরবালাকেই তিনি পথসংকটে সহায়রূপে আশ্রয় করিয়াছেন। হঠাৎ তাহার অসম্মতিতে বিপন্ন হইয়া জগত্তারিণী তাঁহার জামাতার মুখের দিকে চাহিলেন।

অক্ষয় তাঁহার শাশুড়ির মনের ভাব বুঝিয়া কহিলেন, “সে কি হয়? তুমি মার সঙ্গে না গেলে ওঁর অসুবিধা হবে। আচ্ছা মা, তুমি এগোও, আমি ওকে ঠিক সময়ে স্টেশনে নিয়ে যাব।” জগত্তারিণী নিশ্চিন্ত হইয়া প্রস্থান করিলেন। রসিকদাদা টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে বিদায়কালীন বিমর্ষতা মুখে আনিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

অক্ষয়। কে মশায়! আপনি কে?

“আজ্ঞে মশায়, আপনার সহধর্মিণীর সঙ্গে আমার বিশেষ সম্বন্ধ আছে”– বলিয়া পুরুষবেশধারী শৈল অক্ষয়ের সঙ্গে শেক্‌-হ্যাণ্ড করিল।

শৈল। মুখুজ্যেমশায়, চিনতে তো পারলে না?

পুরবালা। অবাক করলি! লজ্জা করছে না?

শৈল। দিদি, লজ্জা যে স্ত্রীলোকের ভূষণ– পুরুষের বেশ ধরতে গেলেই সেটা পরিত্যাগ করতে হয়। তেমনি আবার মুখুজ্যেমশায় যদি মেয়ে সাজেন, উনি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবেন না। রসিকদাদা, চুপ করে রইলে যে!

রসিক। আহা শৈল! যেন কিশোর কন্দর্প! যেন সাক্ষাৎ কুমার, ভবানীর কোল থেকে উঠে এল! ওকে বরাবর শৈল বলে দেখে আসছি, চোখের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল– ও সুন্দরী কি মাঝারি, কি চলনসই, সে কথা কখনো মনেও ওঠে নি– আজ ঐ বেশটি বদল করেছে বলেই তো ওর রূপখানি ধরা দিলে! পুরোদিদি, লজ্জার কথা কী বলছিস, আমার ইচ্ছে করছে ওকে টেনে নিয়ে ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করি!

পুরবালা শৈলের তরুণ সুকুমার প্রিয়দর্শন পুরুষমূর্তিতে মনে মনে মুগ্ধ হইতেছিল। গভীর বেদনার সহিত তাহার কেবলই মনে হইতেছিল, আহা শৈল আমাদের বোন না হয়ে যদি ভাই হত। ওর এমন রূপ এমন বুদ্ধি ভগবান সমস্তই ব্যর্থ করে দিলেন! পুরবালার স্নিগ্ধ চোখ দুইটি ছলছল করিয়া উঠিল।

অক্ষয় স্নেহাভিষিক্ত গাম্ভীর্যের সহিত ছদ্মবেশিনীকে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “সত্যি বলছি শৈল, তুমি যদি আমার শ্যালী না হয়ে আমার ছোটো ভাই হতে তা হলেও আমি আপত্তি করতুম না।”

শৈল ঈষৎ বিচলিত হইয়া কহিল, “আমিও করতুম না মুখুজ্যেমশায়।”

বাস্তবিক ইহারা দুই ভাইয়ের মতোই ছিল। কেবল সেই ভ্রাতৃভাবের সহিত কৌতুকময় বয়স্যভাব মিশ্রিত হইয়া কোমল সম্বন্ধ উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল।

পুরবালা শৈলকে বুকের কাছে টানিয়া কহিল, “এই বেশে তুই কুমারসভার সভ্য হতে যাচ্ছিস?”

শৈল। অন্য বেশে হতে গেলে যে ব্যাকরণের দোষ হয় দিদি! কী বল রসিকদাদা।

রসিক। তা তো বটেই, ব্যাকরণ বাঁচিয়ে তো চলতেই হবে। ভগবান পাণিনি বোপদেব এঁরা কী জন্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন? কিন্তু ভাই শ্রীমতী শৈলবালার উত্তর চাপকান-প্রত্যয় করলেই কি ব্যাকরণ রক্ষে হয়।

অক্ষয়। নতুন মুগ্ধবোধে তাই লেখে। আমি লিখে পড়ে দিতে পারি, চিরকুমার-সভার মুগ্ধদের কাছে শৈল যেমন প্রত্যয় করাবে তাঁরা তেমনি প্রত্যয় যাবেন। কুমারদের ধাতু আমি জানি কি না।

পুরবালা একটুখানি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া শৈলকে কহিলেন, “তোর মুখুজ্যেমশায়কে আর এই বুড়ো সমবয়সীটিকে নিয়ে তোর খেলা তুই আরম্ভ কর্‌– আমি মার সঙ্গে কাশী চললুম।”

পুরবালা এই-সকল নিয়মবিরুদ্ধ ব্যাপার মনে মনে পছন্দ করিত না। কিন্তু তাহার স্বামীর ও ভগিনীটির বিচিত্র কৌতুকলীলায় সর্বদা বাধা দিতেও তাহার মন সরিত না। নিজের স্বামিসৌভাগ্যের কথা স্মরণ করিয়া বিধবা বোনটির প্রতি তাহার করুণা ও প্রশ্রয়ের অন্ত ছিল না। ভাবিত, হতভাগিনী যেমন করিয়া ভুলিয়া থাকে থাক্‌। পুরবালা জিনিসপত্র গুছাইতে গেল।

এমন সময় নৃপবালা ও নীরবালা ঘরে প্রবেশ করিয়াই পলায়নোদ্যত হইল। নীর দরজার আড়াল হইতে আর-একবার ভালো করিয়া তাকাইয়া “মেজদিদি” বলিয়া ছুটিয়া আসিল। কহিল, “মেজদিদি, তোমাকে ভাই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ঐ চাপকানে বাধছে। মনে হচ্ছে তুমি যেন কোন্‌ রূপকথার রাজপুত্র, তোপান্তর-মাঠ পেরিয়ে আমাদের উদ্ধার করতে এসেছ।”

নীরর সমুচ্চ কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত হইয়া নৃপও ঘরে প্রবেশ করিয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া রহিল। নীর তাহাকে টানিয়া লইয়া কহিল, “অমন করে লোভীর মতো তাকিয়ে আছিস কেন? যা মনে করছিস তা নয়, ও তোর দুষ্যন্ত নয়– ও আমাদের মেজদিদি।”

রসিক।

ইয়মধিকমনোজ্ঞা চাপ্‌ কানেনাপি তন্বী।
কিমিব হি মধুরাণাং মণ্ডনং নাকৃতীনাম॥

অক্ষয়। মুঢ়ে, তোরা কেবল চাপকানটা দেখেই মুগ্ধ! গিল্‌টির এত আদর? এ দিকে যে খাঁটি সোনা দাঁড়িয়ে হাহাকার করছে।

নীরবালা। আজকাল খাঁটি সোনার দর যে বড়ো বেশি, আমাদের এই গিল্‌টিই ভালো! কী বল ভাই মেজদিদি!– বলিয়া শৈলর কৃত্রিম গোঁফটা একটু পাকাইয়া দিল।

রসিক। (নিজেকে দেখাইয়া) এই খাঁটি সোনাটি খুব সস্তায় যাচ্ছে ভাই– এখনো কোনো ট্যাঁকশালে গিয়ে কোনো মহারানীর ছাপটি পর্যন্ত পড়ে নি!

নীরবালা। আচ্ছা বেশ, সেজদিদিকে দান করলুম। (বলিয়া রসিকদাদার হাত ধরিয়া নৃপর হাতে সমর্পণ করিল) রাজি আছিস তো ভাই?

নৃপবালা। তা আমি রাজি আছি।– বলিয়া রসিকদাদাকে একটা চৌকিতে বসাইয়া সে তাঁহার মাথার পাকা চুল তুলিয়া দিতে লাগিল।

নীর শৈলর কৃত্রিম গোঁফে তা দিয়া পাকাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। শৈল কহিল, “আঃ, কী করছিস, আমার গোঁফ পড়ে যাবে।”

রসিক। কাজ কী, এ দিকে আয় না ভাই, এ গোঁফ কিছুতেই পড়বে না।

নীরবালা। আবার! ফের! সেজদিদির হাতে সঁপে দিলুম কী করতে? আচ্ছা রসিকদাদা, তোমার মাথার দুটো-একটা চুল কাঁচা আছে, কিন্তু গোঁফ আগাগোড়া পাকালে কী করে?

রসিক। কারো কারো মাথা পাকবার আগে মুখটা পাকে।

নীরবালা। দিদিদের সভাটা কোন্‌ ঘরে বসবে মুখুজ্যেমশায়?

অক্ষয়। আমার বসবার ঘরে।

নীরবালা। তা হলে সে ঘরটা একটু সাজিয়ে গুজিয়ে দিইগে।

অক্ষয়। যতদিন আমি সে ঘরটা ব্যবহার করছি, একদিনও সাজাতে ইচ্ছে হয় নি বুঝি?

নীরবালা। তোমার জন্যে ঝড়ু বেহারা আছে, তবু বুঝি আশা মিটল না?

পুরবালার প্রবেশ

পুরবালা। কী হচ্ছে তোমাদের?

নীরবালা। মুখুজ্যেমশায়ের কাছে পড়া বলে নিতে এসেছি দিদি। তা উনি বলছেন, ওঁর বাইরের ঘরটা ভালো করে ঝেড়ে সাজিয়ে না দিলে উনি পড়াবেন না। তাই সেজদিদিতে আমাতে ওঁর ঘর সাজাতে যাচ্ছি। আয় ভাই।

নৃপবালা। তোর ইচ্ছে হয়েছে তুই ঘর সাজাতে যা-না– আমি যাব না।

নীরবালা। বাঃ, আমি একা খেটে মরব আর তুমি সুদ্ধ তার ফল পাবে, সে হবে না।

নৃপকে গ্রেফতার করিয়া লইয়া নীর চলিয়া গেল।

পুরবালা। সব গুছিয়ে নিয়েছি। এখনো ট্রেন যাবার দেরি আছে বোধ হয়।

অক্ষয়। যদি মিস করতে চাও তা হলে ঢের দেরি আছে।

পুরবালা। তা হলে চলো, আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দেবে। চললুম রসিকদাদা– তুমি এখানে রইলে, এই শিশুগুলিকে একটু সামলে রেখো।

[প্রণাম

রসিক। কিছু ভেবো না দিদি, এরা সকলে আমাকে যেরকম বিপরীত ভয় করে, টুঁশব্দটি করতে পারবে না।

শৈল। দিদিভাই, তুমি একটু থামো। আমি এই কাপড়টা ছেড়ে এসে তোমাকে প্রণাম করছি।

পুরবালা। কেন? ছাড়তে মন গেল যে?

শৈল। না ভাই, এ কাপড়ে নিজেকে আর-একজন বলে মনে হয়, তোদের গায়ে হাত দিতে ইচ্ছে হয় না! রসিকদাদা, এই নাও, আমার গোঁফটা সাবধানে রেখে দাও, হারিয়ো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *