ভলিউম ৯ – পোচার – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০
০১.
মাউনটেইনস অভ দা মুন! বিড়বিড় করলো কিশোর পাশা, উত্তেজনায় মৃদু কাঁপছে কণ্ঠ।
বাংলায় কি হয়? জিজ্ঞেস করলো রবিন। চাঁদের পাহাড়?
কিংবা চন্দ্রপর্বত! বললো গোয়েন্দাপ্রধান।
নামের মতোই সুন্দর পাহাড়টা, মুসা বললো। নিচের পর্বতশ্রেণীর দিকে তাকিয়ে আছে সে।
দক্ষিণ-পুবে উড়ে চলেছে ছোট্ট বিমান। গন্তব্য, টিসাভো। লোকে বলে রহস্য আর খুনের খুনি টিসাভো। আফ্রিকার বৃহত্তম ন্যাশনাল পার্ক, যেখানে জন্তুজানোয়ারেরা নিরাপদে থাকার কথা, কিন্তু থাকতে পারে না। পোচার, অর্থাৎ চোরাশিকারীরা বেআইনীভাবে মেরে শেষ করছে হাতি, গণ্ডার, জিরাফ, জলহস্তী আর অন্যান্য প্রাণী। তাদের ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন গেম ওয়ারডেন ডেভিড টমসন মুসার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কিন্তু পারছেন না। আর পারবেনই বা কি করে? আট হাজার বর্গমাইল বুনো অঞ্চলের কোথায় যে লুকিয়ে থাকে পোচাররা, খুঁজে বের করা কি সহজ কথা?
প্লেন চালাচ্ছেন টমসন। কপালে, গভীর ভাঁজ পড়েছে, ভাবছেন। কন্ট্রোলে। হাত। নিচে একে একে সরে গেল ভিকটোরিয়া হ্রদ, নীল নদের উৎপত্তিস্থল, সিংহের জন্যে বিখ্যাত বিশাল সেরেংগেটি অঞ্চল, তুষারের মুকুট পরা মাউন্ট কিলিমানজারো…খেয়ালই করছেন না যেন তিনি। তার মন পড়ে আছে আরও দূরের সেই রক্তাক্ত এলাকায়, যেখানে মাঝে মাঝেই চোখে পড়বে রক্ত, আতঙ্ক, অত্যাচার আর মৃত্যুর রোমহর্ষক দৃশ্য।
এক অসম লড়াই, আনমনে বললেন তিনি। শত্রুরা দলে এতো ভারি, কিছুতেই পারছি না। মাত্র দশ জন লোক আমার পোচারদের তুলনায় নগণ্য। কি করে পারবো? এক জায়গা থেকে খেদাই তো পরদিনই আরেক জায়গায় গিয়ে শুরু করে। নাহ, আর পারা যায় না।
কজন গেছে আপনার? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
বাইশ জন ছিলো। বারো জনকে মেরে ফেলেছে।
তীর দিয়ে?
হ্যাঁ। বিষ মাখানো তীর। পোচারদের সবার কাছে অস্ত্র আছে; তীর-ধনুক, বল্লম, ছুরি, কারো কারো কাছে পুরনো মাসকেট রাইফেল। আমার দুজন লোক ওদের ফাঁদে আটকা পড়েছিলো, জানোয়ার ধরার জন্যে পেতে রাখা ফাঁদ। মাসখানেক পরে ওভাবেই পেয়েছি, শুধু দুটো কঙ্কাল।
খাইছে! আঁতকে উঠলো মুসা। কঙ্কাল?
হ্যাঁ। আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না।
নিশ্চয় পানির অভাবে মরেছে? অনুমানে বললো রবিন। তারপর হায়েনারা এসে খেয়ে ফেলেছে…
আটকা পড়া জীবকে অসহায় দেখলে মরার অপেক্ষা করে না হায়েনারা। আমার বিশ্বাস, জ্যান্তই খেয়ে ফেলেছে।
শিউরে উঠলো রবিন। মুখ কালো হয়ে গেল। মুসার মুখও থমথমে। আফ্রিকায়, তার নিজের মহাদেশে বেড়াতে আসার কথাটা ভাবতে ভালো লাগছে না আর এখন। চট করে তাকালো একবার কিশোরদের দিকে। গোয়েন্দাপ্রধানকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে। তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।
এবারের ছুটিতে আফ্রিকায় বেড়াতে আসার প্রস্তাবটা মুসার। রবিন আর কিশোরও শুনেই রাজি। তিনজনে মিলে অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়েছে মুসার বাবা মিস্টার রাফাত আমানকে। তিনি সর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ডেভিড টমসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছেন, ছেলেদের পাঠাতে চান। তিন গোয়েন্দার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও জানিয়েছেন বন্ধুকে। বন্ধুর অনুরোধ এড়াতে পারেননি। ওয়ারডেন, কিংবা এড়াতে চানওনি হয়তো, তাই তিন কিশোরকে কিছুদিন মেহমান রাখতে রাজি হয়ে জবাব দিয়েছেন চিঠির।
ছেলেদের মনমরা হয়ে যেতে দেখে হাসলেন ওয়ারডেন। কি ব্যাপার, ভয় পেয়ে গেলে নাকি?
না না, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। ভয় পাবো কেন? বিপদকে ভয় পাই না আমরা।
রাফাতও তাই লিখেছে। তোমরা ভীষণ সাহসী। আমাজানের গহীন জঙ্গল থেকেও জন্তুজানোয়ার ধরে নিয়ে এসেছিলে। এসব শুনেই রাজি হয়েছি। নইলে যেখানে পোচার আছে, আসতে বলতাম না। পোচার মানেই তো বিপদ।
দশজন আছে তো, মুসা বললো। এখন ধরে নিতে পারেন তেরো জন। আমরাও আছি আপনার সঙ্গে। ওই পোচার ব্যাটাদের একটা ব্যবস্থা না করে আমরাও আমেরিকায় ফিরছি না।
দেশপ্রেম?
দেশপ্রেমিক, বুনো পশু-পাখি-প্রেমিক, অন্যায়-বিরোধী, যা খুশি বলতে পারেন। কিন্তু টিসাভোর ওই পোচারগুলোকে খতম না করে আমি মুসা আমান অন্তত ফিরছি না।
এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে নিগ্রো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন টমসন। তারপর মাথা নাড়লেন, তোমার বাবা মিথ্যে লেখেননি। সত্যি তোমরা ভালো ছেলে।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার, কিশোর বললো।
ওই যে, তুষারে ঢাকা পর্বতের একটা ধার দেখিয়ে বললেন ওয়ারডেন। ওই টিসাভো।
চমৎকার দৃশ্য! কে ভাববে, ওরকম একটা জায়গায় সারাক্ষণ চলে মৃত্যুর আনাগোনা? সবুজ বন, দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি, নিঝুম পাহাড়, রূপালি নদী, শান্ত হ্রদ, উজ্জ্বল রোদ, নিবিড় ছায়া-সবকিছু মিলিয়ে তিন গোয়েন্দার মনে হলো যেন পৃথিবীর কোনো জায়গা নয় ওটা।
সুন্দরের পুজারি কিশোর পাশার স্বপ্নিল চোখ দুটো আরও গাঢ় হয়ে উঠলো। ভাবছে, বাংলাদেশেও কি এতো সুন্দর জায়গা আছে?
আল্লাহরে! এ-তো বেহেশত! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
হ্যাঁ, মাথা দোলালো রবিন। সুন্দর জায়গা পৃথিবীর সবখানেই আছে। আমাদের আয়ারল্যাণ্ডেও আছে।
আছে, একমত হলেন ইংরেজ ওয়ারডেন। এবং সব জায়গাতেই শয়তানও আছে। ওরা না থাকলে…এই টিসাভোর কথাই ধরো, পোচারগুলো না থাকলে সত্যি স্বর্গ বলা যেতো জায়গাটাকে। জানোয়ারের নিরাপদ বাসভূমি, টুরিস্টদের আনন্দ। ওই যে নদীটা, একটা জায়গায় বেশি ছড়ানো দেখছো, ওখানে একটা আণ্ডারওয়াটার অভজারভেটরি আছে। ওখান থেকে নদীর নিচের দৃশ্য দেখা যায়। এখন আর সুন্দর কিছু দেখবে না, পোচাররা সর্বনাশ করে দিয়েছে। ডজন ডজন জলহস্তী মেরে… দৃশ্যটা কল্পনা করে চেহারা বিকৃত করে ফেললেন তিনি।
মেরে ফেলে ওদের কি লাভ? জানতে চাইলো মুসা।
ওদের যা দরকার নিয়ে চলে গেছে। জলহস্তীর একেকটা মাথার দাম চার পাঁচ হাজার ডলার। চামড়ার দামও অনেক। মাথা কেটে, চামড়া ছিলে, ধড়টা। ফেলে রেখে গেছে।
নরপিশাচের দল! দাঁতে দাঁত চাপলো কিশোর। খেতে যদি, তা-ও এক কথা ছিল, শুধু কিছু টাকার জন্যে এভাবে খুন করে জানোয়ারগুলোকে!
ওদের পিশাচ বললে কম বলা হয়, টমসন বললেন। জানোয়ারের ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে, গেল একেকজন মানুষের জন্যে শিকার নিষিদ্ধ নয়, কোনোকালেই ছিলো না। আদিম যুগেও শিকার করতো মানুষ, মাংসের জন্যে, খেয়ে বাঁচার তাগিদে। আফ্রিকায় এখনও অনেক উপজাতি আছে, শিকার না পেলে যারা না খেয়ে মরবে। তাদের শিকারে কিছু হয় না, জন্তুজানোয়ারের বংশ। লোপ পাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বড় একটা হরিণ মারতে পারলে এক-গা লোকের খাওয়া হয়ে যায়। আর ঘরে খাবার থাকলে অহেতুক জানোয়ারও মারে না তারা। কিন্তু ওই পোচাররা তো তা করে না। পালে পালে মারে। যতো বেশি। মারতে পারবে, ততোই পয়সা। জানোয়ার খুন করার জন্যে রীতিমতো আর্মি বানিয়ে নিয়েছে ওরা, থামলেন ওয়ারডেন। তারপর বললেন, টিসাভোর পোচারদের সর্দারের নাম লঙ জন সিলভার। অবশ্যই ছদ্মনাম। ট্রেজার আইল্যাণ্ডের সেই কুখ্যাত জলদস্য সিলভারের নাম নিয়েছে। তফাত শুধু স্টিভেনসনের ডাকাতটা লুট করতে সোনার মোহর, আমাদের ডাকাতটা করে জানোয়ারের দাঁত-মাথা-হাড়-চামড়া।
সিলভারের আসল পরিচয় জানেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
না। পরিচয় তো দুরের কথা, তার আসল চেহারাই নাকি কেউ দেখেনি। বিদেশী, না আফ্রিকান, তা-ও জানি না। আশা করি, এই রহস্যের সমাধান তোমরা করতে পারবে।
চেষ্টা করবো।
মোমবাসা থেকে জাহাজে করে পৃথিবীর বড় বড় শহরে পাচার হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য জলহস্তীর মাথা, গাদা গাদা হাতির দাঁত, গণ্ডারের শিং; চিতাবাঘ, বানর, পাইথনের চামড়া। মাঝেসাঝে কিছু কিছু মাল আটক করা হয়, দুএকটা চুনোপুটি ধরাও পড়ে, কিন্তু আসল লোকটার পাত্তাও পাওয়া যায় না। যাদেরকে ধরা হয়, তারাও কিছু বলতে পারে না। হয়তো সে মোমবাসার কোনো ধনী ব্যবসায়ী, কিংবা এ-দেশের কোনো উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আর্মি গড়তে তাই তার। সুবিধে হয়েছে। তবে সবই অনুমান। তাকে না ধরা পর্যন্ত কোনো কিছুই শিওর হয়ে বলা যাবে না।
.
০২.
বিমানটা জার্মানীর তৈরি, চার সীটের একটা স্টর্ক বিমান। ডুয়্যাল কনট্রোল। জয়স্টিকের এক মাথা ধরে রেখেছেন টমসন। আরেক মাথা কো-পাইলটের সীটে বসা মুসার দুই হাঁটুর ফাঁকে। সতৃষ্ণ নয়নে বার বার ওটার দিকে তাকাচ্ছে মুসা, চেপে ধরার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করছে। চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। তার। কিছু দিন ধরে প্লেন চালানো শিখছে সে। ওগুলো সব আমেরিকান প্লেন, এটা জার্মান। ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের সমস্ত যন্ত্রপাতির তলায় আর মিটারের লেখা জার্মান ভাষায়, বেশির ভাগই পড়তে পারে না। তাছাড়া যন্ত্রপাতিগুলোও কেমন যেন এলোমেলো, আমেরিকানগুলোর সঙ্গে মিল কম। পারবে, ভাবলো মুসা, সময় লাগবে আরকি। প্র্যাকটিস করতে হবে।
ওই যে উঁচু পাহাড়টা, দেখালেন ওয়ারডেন। চোখা চূড়া।
হ্যাঁ, দেখছি, মুসা বললো। ওপরে প্যাভিলিয়ন মতো কি যেন।
প্যাভিলিয়নই। তাতে টেলিস্কোপ বসানো। একে আমরা বলি পোচারস লুকআউট। ওই টেলিস্কোপ দিয়ে সারাক্ষণ নজর রাখে রেঞ্জাররা, পোচার আছে কিনা দেখে।
কতদূর দেখা যায় ওখান থেকে? মুসার পেছনের সীট থেকে জিজ্ঞেস করলো রবিন।
বেশি না, জবাব দিলেন টমসন। মাত্র কয়েক মাইল। আরও বেশি যেতো, বন আর পাহাড়ের জন্যে পারা যায় না। চোখের সামনে বাধা হয়ে যায়। না হলেও বা আর কতদূর দেখতাম? আট হাজার মাইল এলাকা, পুরোটা দেখতে হলে কয়েক শো লুকআউট দরকার। সেটা অসম্ভব। অতো জোগান দিতে পারবে না। সরকার। লোকই দিতে পারে না। ছিলো বাইশ জন, বারো জন শেষ। এরপর কতো লেখালেখি করছি, লোকের জন্যে। অবশেষে রাজি হয়েছে। কাল-পরশু আরও বিশ-তিরিশজন পাবো আশা করি।
পাহারা দেয়া হয় তাহলে কি করে? পেছন থেকে জানতে চাইলো কিশোর। প্লেন নিয়ে ঘোরেন সারাদিন?
সারাদিন হয় না। শুধু আমি চালাতে পারি এটা। পোচার দেখা ছাড়াও আরও অনেক কাজ আছে আমার। তবু সময় পেলেই উড়ি।…আমাদের ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। পোচারস লুকআউটের ওপাশে।
সামনে মাইল পাঁচেক দূরে কতগুলো কেবিন দেখা গেল, কুঁড়ে বলাই ভালো। খড়ের চালা, বাঁশের বেড়া। ওটাই তাহলে বিখ্যাত কিতানি সাফারি লজ! অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। টুরিস্ট মৌসুমে এখানেই এসে দলে দলে ভিড় জমায়। ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা! আর দশটা খুদে আফ্রিকান গ্রামের সঙ্গে বিশেষ, তফাত নেই ক্যাম্পটার।
চঞ্চল হয়ে ঘুরছে মুসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বায়ে হাত তুলে জিজ্ঞেস করলো, ওটা কি?
একবার চেয়েই শাঁ করে প্লেনের মুখ ঘুরিয়ে দিলেন ওয়ারডেন। উড়ে চললেন সেদিকে। তুমি খুব ভালো রেঞ্জার হতে পারবে, মুসা। চোখ আছে। ওটাটাপ লাইন।
ট্র্যাপ-লাইন?
আমি জানি ট্র্যাপ-লাইন কি, রবিন জবাব দিলো। পোচারদের পাতা ফাঁদের। সারি।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে, টমসন বললেন।
দেখে তো বেড়া মনে হচ্ছে, বললো কিশোর।
বেড়া-ই। কাঁটা ঝোপ আর বাঁশ দিয়ে বানায় পোচাররা। পঞ্চাশ গজ থেকে শুরু করে এক মাইল, দুমাইল পর্যন্ত লম্বা করে। এটা মাইল খানেকের কম হবে না। মাঝে ফাঁকগুলো দেখছে না, প্রত্যেকটা ফাঁকে একটা করে ফাঁদ পাতা আছে।
জানোয়ার ধরা পড়ে কি করে? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
ধরো, তুমি একটা জানোয়ার। চরে খেতে খেতে চলে এলে বেড়ার কাছে। ওপাশে যাওয়ার ইচ্ছে হলে কি করবে? এতো লম্বা বেড়া ঘুরে যাবে না নিশ্চয়। উঁচু, লাফিয়ে যাওয়াও কঠিন। তার চেয়ে সহজ কাজটাই করবে, ফাঁক দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করবে। এমন ভাবে বেরোতে চাইবে, যাতে বেড়ার কাটা তোমার গায়ে না লাগে। জায়গা মতো লাগানো আছে তারের ফাঁস। মাথা দিয়ে ঢুকে আটকে যাবে তোমার গলায়। ভয় পেয়ে তখন টানাটানি শুরু করবে, সেটাই স্বাভাবিক। খুলবে না ফাঁস, আরও চেপে বসবে গলায়, চামড়া কেটে মাংসে বসে যাবে। রক্তের গন্ধে ছুটে আসবে মাংসাশী জানোয়ার। জ্যান্তই ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।
খেয়েই যদি ফেললো আমাকে পোচাররা, আর কি পাবে?
পাবে, পাবে। তুমি হাতি হলে ওরা তোমার দাঁত পাবে, পায়ের পাতা পাবে ওয়েইস্ট-পেপার বাস্কেট বানানোর জন্যে। লেজ দিয়ে বানাবে মাছি তাড়ানোর। ঝড়ন। হায়েনারাও ওসব খায় না; ফেলে যায়। গণ্ডার কিংবা অন্য জানোয়ার। হলেও অসুবিধে নেই। পোচারদের জিনিস পোচাররা পেয়েই যায়।
দ্রুত নামছে প্লেন।
কি করবেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
পোচারদের ভয় দেখাবো। বোঝাবো, ওদের আড্ডা দেখে ফেলেছি। অনেক সময় ভয় পেয়ে সরে যায় ওরা, দলে লোক কম থাকলে। বেশি থাকলে অবশ্য। আক্রমণ করে বসে। ভালো করেই জানে ওরা, রেঞ্জার মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন আমাদের। তবে আরও যে আসছে, সেকথা এখনও জানে না। ওরা এলে, রাস্তা দিয়ে দল বেধে এসে ধরবো ব্যাটাদের।
আরও নিচে নামলো বিমান। ঠিক বেড়ার ওপর দিয়ে উড়ে গেলেন টমসন। দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি ফাঁকেই আটকা পড়েছে জানোয়ার। কোনোটা ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে, কোনোটা লুটিয়ে রয়েছে মাটিতে, প্রাণহীন, নিথর। বেড়ার দুপাশে ঘোরাঘুরি করছে, মারামারি কামড়া-কামড়ি করছে শবভোজী প্রাণীর দল- হায়েনা, শিয়াল, বুনো কুকুর, শকুন। প্লেনের শব্দ ছাপিয়ে কানে। আসছে ওদের চিৎকার।
একশো চল্লিশ থেকে শুধু তিরিশ মাইলে গতিবেগ নামিয়ে আনলেন টমসন। গাছের জটলার ভেতরে কয়েকটা খড়ের ছাউনি চোখে পড়লো। পোচারদের অস্থায়ী আস্তানা। মাটির পঞ্চাশ ফুট ওপর দিয়ে সেদিকে উড়ে গেল বিমান।
এতোগুলো আছে ভাবিনি! বিড়বিড় করলেন ওয়ারডেন।
হঠাৎ বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একঝক কালো মানুষ। হাতে তীর ধনুক আর বল্লম। প্লেন সই করে ছুঁড়ে মারলো। যদিও একটাও লাগলো না, বিমানের গায়ে।
বিশেষ কাজের জন্যে তৈরি করা হয়েছে এই প্লেন। সীটের নিচে পায়ের কাছে অ্যালুমিনিয়মের চাঁদরের পরিবর্তে লাগানো হয়েছে শক্ত প্লাস্টিক, যাতে নিচের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়। সবই দেখতে পাচ্ছে ওরা।
আবার পোচারদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল বিমান। ছুটে এলো আরও এক ঝাঁক তীর। একটা কনুই জানালার বাইরে রেখেছিলেন টমসন, ঝটকা দিয়ে নিয়ে এলেন ভেতরে। ভীষণ চমকে গেছেন। অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। জয়স্টিক চেপে ধরলেন। দ্রুত উঁচু হয়ে গেল বিমানের নাক। সোজা ছুটলো। কিতানি সাফারি লজের দিকে।
.
০৩.
পাশে বসে মুসা দেখতে পেলো না, তার পেছনে বসে রবিনও না। কিন্তু পেছনে বসা কিশোর ঠিকই দেখলো। কালো ছোট একটা তীর বিধে রয়েছে টমসনের বাহুতে। মাংস এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে আছে তীরের চোখা মাথা।
মুসাআ! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। উনি, উনি তীর খেয়েছেন…
পাশে কাত হয়ে তীরটা দেখতে পেলো মুসা। ওরা ভয় পাবে বলে দেখাতে চাননি ওয়ারডেন, লুকিয়ে ফেলেছিলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন, কিচ্ছু ভেবো না। ঘুমিয়ে পড়ার আগেই ক্যাম্পে পৌঁছে যাবো।
বিষ আছে না? অন্য দুজনের মতোই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে রবিন।
বোধহয়।
তীরের মাথাটা ভালো করে দেখলো মুসা। মারাত্মক বিষাক্ত অ্যাকোক্যানূথেরা গাছের কালো আঠা আঠা রস মাখিয়ে নেয় জংলীরা, শুনেছে সে। তীরের মাথায় সে-রকম কিছু চোখে পড়লো না। কই, বিষ তো নেই। শুধু রক্ত।
ওখানে তো দেখবে না। ও-জায়গায় লাগায় না ওরা।
কেন?
নিজেদের গায়ে লাগার ভয়ে। পিঠের তৃণে তীর নিয়ে ঝোপঝাড়ে চলাফেরা করে, দৌড়ায়। হোঁচট খেয়ে পড়ে। তখন যে-কোনো সময় তীরের খোঁচা লাগতে পারে। যার সঙ্গে থাকে তার গায়েও, যারা সাথে থাকে তাদের গায়েও। নিজেদের বিষে নিজেরাই মরবে।
তাহলে কোথায় লাগায়?
ডাণ্ডায়। তীরের মাথার ঠিক পেছনে।
সর্বনাশ! ওই জায়গাটাই তো ঢুকে আছে আপনার হাতে। বের করে ফেলা। যায় না?
তা যায়। কিন্তু নাগালই তো পাবে না, ঠিকই বলেছেন টমসন। তার আর কো-পাইলটের মাঝের সীটে দুই ফুট ব্যবধান। আহত হাতটা রয়েছে আরও দূরে। ওখানে পৌঁছতে হলে যন্ত্রপাতির ওপরে ঝুঁকে হাত বাড়াতে হবে, মুসাকে, প্লেন নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে পড়বে। রবিন রয়েছে আরও দূরে, তার পক্ষে আরও কঠিন।
আমি পারবো, কিশোর বললো। বলুন, কি করতে হবে।
এক মুহূর্ত ভাবলেন- টমসন। টেনে বের করতে পারবে না, ফলা আটকে যাবে। দেখো, মাথাটা ভাঙতে পারো কিনা।
পাইলটের সীটের ওপর দিয়ে ঝুঁকে এক হাতে তীরের মাথা, অন্য হাতে ডাণ্ডাটা চেপে ধরলো কিশোর। চাপ দিলো। আরে! যা ভেবেছিলো তা তো নয়। যথেষ্ট শক্ত। আরও জোরে চাপ দিলো সে। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল হাত, পিছলে যাচ্ছে। ধরে রাখতে পারছে না। ঘামতে শুরু করেছে দরদর করে। না, গরমে নয়, টমসনের কি রকম কষ্ট হচ্ছে সেকথা ভেবে। নিশ্চয় ভীষণ ব্যথা পাচ্ছেন। কিন্তু টু শব্দ করলেন না তিনি।
মট করে ভাঙলো অবশেষে। আলাদা হয়ে গেল তীরের মাথা। এবারের কাজ আরও জটিল। তাড়াতাড়ি ডাণ্ডাটা বের করে আনা।
ভাণ্ডা ধরে হ্যাঁচকা টান মারলো কিশোর। খুললো না ওটা।
রক্তাক্ত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে রবিনের দিকে ফিরলো। কিশোর। দেখো তো, ওঁর হাতটা ধরতে পারো, কিনা? নাগাল পাবে?
উঠে চেষ্টা করে দেখলো রবিন। প্লেনের ভেতরে জায়গাই নেই। পারলো না।
আবার একা কিশোরকেই চেষ্টা করতে হলো। ডাণ্ডাটা ধরে দাঁতে দাতে চেপে আবার মারলো টান। কন্ট্রোলের ওপর থেকে হাত নড়ে গেল টমসনের। দুলে উঠলো প্লেন। কিন্তু যেখানের ডাণ্ডা সেখানেই রইলো। তাড়াতাড়ি প্লেনটাকে সামলালেন তিনি।
হাড়ে আটকে গেল না তো? গলা কাঁপছে রবিনের। দেখো আরেকবার টেনে।
মুসার আশা ছিলো, বড় হয়ে সার্জন হবে, এখানেই বাদ দিয়ে দিলো সেই ভাবনাটা। মানুষের এসব কষ্ট দেখলে সহ্য হয় না তার।
তৃতীয়বার টান দিলো কিশোর। লাভ হলো না। শেষে মরিয়া হয়ে ডাণ্ডাটা ধরে ওপরে-নিচে করে, আশেপাশে নেড়ে ছিদ্রটা বড় করতে লাগলো। মানুষটাকে কতোখানি ব্যথা দিচ্ছে কল্পনা করে তার নিজেরই বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে। শেষ। পর্যন্ত আরেকবার ধরে গায়ের জোরে দিলো টান, ছাড়লো না, টানতে লাগলো।
খুলে এলো ডাণ্ডাটা।
মুখ খুললেন টমসন। কিশোর ভাবলো বজ্জাত ছেলে বলে তাকে গাল দেবেন ওয়ারড়েন। কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বললেন শুধু তিনি, গুড বয়!
ধপ করে সীটে এলিয়ে পড়লো কিশোর। হাঁপাচ্ছে, ঘামছে। কেনিয়ার প্রচণ্ড গরম তো আছেই, সেই সাথে ভয়ানক উত্তেজনা। চোখের সামনে ডাণ্ডাটা তুলে। দেখলো সে। ভাঙার মাথার কাছে লেগে রয়েছে লাল রক্ত আর কালো বিষ।
কিন্তু এতো কষ্ট করে তীরটা খুলে লাভ হবে তো? ওয়ারডেন কি বাঁচবেন? বিষ যা ঢোকার তা তো ঢুকেই গেছে রক্তে। সবই নির্ভর করে এখন তার দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। এই বিষে শিশুরা কয়েক মিনিটেই মরে যায়। মহিলারা টেকে বড় জোর বিশ মিনিট। তবে, কিশোর শুনেছে, লড়াই করতে গিয়ে শত্রুর তীর খেয়ে দুই ঘন্টা বেহুশ হয়ে ছিলো একজন আফ্রিকান যোদ্ধা, তারপর ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে।
আরও একটা ব্যাপার, বিষটা কতোখানি নতুন তার ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। পুরনো হলে, ধুলো-ময়লা বেশি লেগে থাকলে কার্যক্ষমতা কমে যাবে অনেকখানি। মনে মনে প্রার্থনা করলো কিশোর, খোদা, তা-ই যেন হয়!
জয়স্টিকের ওপর ঢলে পড়লেন ওয়ারডেন। সঙ্গে সঙ্গে গোঁত্তা খেয়ে নাক পোচার নামিয়ে ফেললো বিমান, ধেয়ে চললো মাটির দিকে।
নিজের হাঁটুর ফাঁকে জয়স্টিকের আরেকটা অংশ ধরে জোরসে টান দিলো মুসা, সরাতে পারলো না। বেজায় ভারি টমসন। ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে আসছে। যেন ধরণী। চেঁচিয়ে উঠলো সে, জলদি সরাও ওকে!
নিচের দিকে ঝুঁকে গেছে বিমান। এই অবস্থায় কিশোর আর রবিনও সোজা হতে পারছে না। তাড়াতাড়ি সীটবেল্ট বেঁধে নিলো দুজনে। টমসনের কাধ ধরে টেনে সূরানোর চেষ্টা করলো কিশোর। রবিনের নাগালের মধ্যেই আসছে না তেমন, তবু কোনোমতে ওয়ারডেনের শার্টের কলার খামচে ধরে টানলো। মুসা চুপ। করে নেই; সে টেনে ধরে রেখেছে জয়স্টিক।
আস্তে আস্তে বেহুঁশ টমসনকে টেনে তুললো কিশোর আর রবিন।
দ্রুত এগিয়ে আসছে একটা লম্বা ক্যাপোক গাছ। চোখ বন্ধ করে স্টিকে টান মারলো মুসা। ভাবছে, গাছের সঙ্গে বাড়ি লাগলে মরতে কি খুব কষ্ট হবে? বাড়ি লাগলো না। শেষ মুহূর্তে শ করে গাছের ওপর দিয়ে বেরিয়ে এলো প্লেন।
ধরে না রাখলে আবার হেলে পড়ে যাবেন টমসন। দুদিক থেকে তাকে ধরে রেখেছে কিশোর আর রবিন। মুসা প্লেন সামলাতে ব্যস্ত। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের দিকে। গিজমোটা কোথায়, যেটা ব্রেক নিয়ন্ত্রণ করে? জার্মান বিমানের ফুট প্যাডাল কি কি কাজ করে? চাপ দিতে গিয়েও পা সরিয়ে আনলো সে, সাহস হলো না। উড়ে চলা সহজ, কিন্তু ওঠানো নামানো খুব কঠিন কাজ। পারবে? নামাতে পারবে? এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। ওদের। চারজনের জীবন নির্ভর করছে এখন তার হাতে। যা করে আল্লাহ! ভেবে, তৈরি হয়ে গেল ল্যাণ্ডিঙের জন্যে।
ল্যাণ্ডিংফীল্ডটা খুঁজলো তার চোখ। সারি সারি কেবিন দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু অ্যাসফল্টে বাঁধানো কোনো রানওয়ে চোখে পড়লো না। অবশেষে উইণ্ড-সকটা দেখতে পেলো। উড়ে গেল সেদিকে। রানওয়ে নেই। ঘাসে ঢাকা লম্বা এক চিলতে জমি। ওটাতেই বোধহয় নামানো হয় এই প্লেন।
যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া শুরু করলো সে। কয়েক মিনিটেই অনেকখানি বুঝে ফেললো, কোনটা কি কাজ করে। ক্যাম্পের ওপর চক্কর দিলো একবার। উড়ে গেল আবার মাঠের দিকে। মনে মনে আন্দাজ করে নিলো কোন জায়গাটায় নামালে গাছের গায়ে ধাক্কা লাগবে না।
প্লেনের নাক নিচু করে ল্যাণ্ডি করতে যাবে, এই সময় এয়ারস্ট্রিপের ঘাসের মধ্যে একটা নড়াচড়া চোখে পড়লো। হলুদ আর কালো রঙের কি যেন। নড়ে উঠলো আবার। কী, বোঝা গেল। সিংহের একটা পরিবার।
রোদ পোহাচ্ছে ওরা। প্লেনের আওয়াজে কর্ণপাত করছে না। মুসার জানা। আছে, প্লেন, রেলগাড়ি, মোটরগাড়ির আওয়াজকে ভয় করে না সিংহ, বিশেষ করে ন্যাশনাল পার্কের জানোয়ারগুলো। ওসব যানবাহন দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে ওদের।
সিংহগুলোর জন্যে প্লেন নামানো যাবে না, ল্যাণ্ডিঙের পথ জুড়ে রয়েছে ওগুলো। কখন যাবে না যাবে তারও ঠিক নেই। দেরিও করা যাচ্ছে না। টমসনের। অবস্থা খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে, তাড়াতে হবে। সিংহগুলোকে।
প্রায় ডাইভ দিয়ে ওগুলোর বিশ ফুটের মধ্যে চলে এলো বিমান নিয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরাম করে শুয়ে-বসে আছে ওরা ঘাসের মধ্যে। অল্প বয়েসীগুলো অলস চোখে তাকালো প্লেনের দিকে, বয়স্কগুলো চোখই মেললো না। কালো কেশরওয়ালা বিশাল এক পশুরাজ চিত হয়ে আছে, বাঁকা করে চার পা তুলে রেখেছে আকাশের দিকে।
মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে মাটির একেবারে কাছাকাছি, সিংহগুলোর ওপরে চলে এলো মুসা। থ্রটল পুরোপুরি খুলে রেখেছে। প্রচণ্ড গর্জন করছে এঞ্জিন। এইবার একটা সিংহীর টনক নড়লো। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আর এখানে থাকা নিরাপদ মনে। করলো না। প্লেনের দিকে চেয়ে একবার মুখ ভেংচে উঠে দাঁড়ালো, তার শাবকগুলোকে জড়ো করে হেলেদুলে এগিয়ে চললো কয়েকটা গাছের দিকে।
আবার ফিরে এলো মুসা।
বিরক্ত হয়ে চোখ মেললো বুড়ো সিংহটা। বিকট হাঁ করে হুঙ্কার ছাড়লো একবার। দূর, এখানে ঘুমানো যায় নাকি? যত্তোসব! এরকম একটা ভাব করে। উঠে দাঁড়ালো। রওনা হলো সিংহীটা যেদিকে গেছে সেদিকে। পরিবারের অন্যেরাও আর থাকলো না ওখানে। বুড়োর পেছন পেছন চললো।
ল্যাণ্ড করার জন্যে তৈরি হলো মুসা। প্রথমবার মাটিতে চাকা ছোঁয়াতে গিয়েও আবার তুলে ফেললো। সাহস হচ্ছে না। যদি ঝাঁকুনিতে ভেঙে পড়ে? দ্বিতীয়বারেও, পারলো না। তৃতীয়বারে আর ভাবলো না।
জোর ঝাঁকুনি লাগলো, তবে ভাঙলো না বিমান। মোটামুটি ভালোই ল্যাণ্ড করেছে। ঝাঁকুনি খেতে খেতে ট্যাক্সিইং করে ছুটলো। খানিক দূর এগিয়ে বিশাল এক গাছের মাত্র কয়েক ফুট দূরে আরেকবার জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে দাঁড়ালো বিমান, এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে।
.
০৪.
মরার মতো এলিয়ে পড়েছেন টমসন। নাড়ি দেখলো কিশোর। খুব মৃদু চলছে। আশা আছে এখনও। তিনজনে মিলে ধরাধরি করে মাটিতে নামালো তাঁকে। কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে দৌড়ে এলো একটা লোক। কুচকুচে কালো এক নিগ্রো। পরনে হালকা রঙের ইউনিফর্ম। মাথায় মিলিটারিদের মতো ক্যাপ, ওটার পেছনে ঝুলছে পাতলা কাপড়ের কেপি, ঘাড় ঢেকে দিয়েছে–পোকামাকড়ের জ্বালাতন থেকে বাঁচার ব্যবস্থা। তিন গোয়েন্দার বুঝতে অসুবিধে হলো না, লোকটা একজন রেঞ্জার।
কি হয়েছে? ভাঙা ইংরেজিতে বলতে বলতে অচেতন দেহটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো সে।
বিষ মাখানো তীর, জানালো কিশোর।
ওয়ারডেনের বুকে কান রাখলো রেঞ্জার। মরেনি। জজের কাছে নিয়ে যাবো। ঠিক করে দেবেন।
জজ দিয়ে কি হবে? ডাক্তার দরকার।
জজই ডাক্তার। ভালো করে ফেলবেন।
জজের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করলো না কিশোর। পকেট থেকে রুমাল বের করে বাধলো টমসনের হাতে, ক্ষতের কিছুটা ওপরে।
ওয়ারডেনকে বয়ে নিয়ে আসা হলো মূল কেবিনটাতে। ভেতরে কয়েকটা ভালো চেয়ার আছে, আর একটা বড় ডেস্ক। এই কেবিনেই ঘুমান তিনি, অফিসও এটাই। বিছানায় শোয়ানো হলো তাকে। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন ছোটখাটো একজন মানুষ।
এই যে, জজ এসেছেন, রেঞ্জার বললো। তিনি ঠিক করে দেবেন।
চেহারা আর চামড়ার রঙ দেখেই বোঝা গেল জজের বাড়ি এশিয়ায়, সম্ভবত ভারতে। অ্যাকসিডেন্ট? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
সংক্ষেপে জানালো রবিন।
আমি না থাকলে তো সর্বনাশ হতো, জজ বললেন। ভাগ্যিস এসে পড়েছিলাম। যাকগে, আর কোনো ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
চুপচাপ জজকে দেখছে কিশোর। তার মনে হলো, টমসনের ভয়ানক বিপদে জজ মোটেও উদ্বিগ্ন নন। বরং যেন কিছুটা খুশিই লাগছে তাঁকে। কি জানি, হয়তো ওরকম হাসিখুশি স্বভাবই লোকটার। কিংবা হয়তো বুঝতে পারছেন, ভয়ের কিছু নেই, সেরে উঠবেন ওয়ারডেন।
প্রথমেই হাত থেকে দ্রুত রুমালটা খুলে ফেলে দিলেন তিনি।
এটা কি করলেন? বলে উঠলো কিশোর। রক্তে বিষ আরও বেশি ঢুকে যাবে না?
যা গেছে তা গেছেই, শান্ত কণ্ঠে বললেন জজ। আরও যাতে যেতে পারে সে-জন্যে খুলোম। এক জায়গায় আটকে রাখার চেয়ে সমস্ত সিসটেমে বিষ ছড়িয়ে দেয়াটাই ভালো। অ্যাকশন কমে যায় তাতে। বিশেষ করে অ্যাকোকেনথেরার।
এরকম থিওরি জীবনেও শোনেনি কিশোর। ভাবলো, কি জানি, এখানকার বিষের ব্যাপারে নিশ্চয় জজ সাহেব তার চেয়ে ভালো বোঝেন। তর্ক করলো না। বললো, ডিসটিলড ওয়াটার দিয়ে ধুয়ে নিলে ভালো হতো না?
খারাপ হবে আরও, খোকা, ধৈর্য ধরে ছেলেকে বোঝাচ্ছেন যেন অভিজ্ঞ পিতা। ওসব বোয়ামোছা বাদ দিয়ে আগে ইনজেকশন দিতে হবে। বিষের প্রতিষেধক।
অ্যামোনিয়াম কারবোনেট?
সরু হয়ে গেল জজের চোখ। ওই কিশোর ছেলেটা এতো কিছু জানে দেখে। অবাক হয়েছেন, যেন, কিছুটা অস্বস্তিও ফুটলো বুঝি চোখের তারায়। পরক্ষণেই মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়লো মুখে, দূর হয়ে গেল অস্বস্তি। এইবার ঠিক বলেছো। দেখি, ডিসপেনসারিতে আছে কিনা।
ওঘর থেকে বেরিয়ে, বারান্দা দিয়ে গিয়ে আরেকটা ঘরে ঢুকলেন জজ। কৌতূহলী হয়ে তার পিছু নিলো কিশোর। সময় মতোই গিয়ে ঢুকলো ডিসপেনসারিতে। দেখলো, তাকের সামনের সারি থেকে একটা বোতল তুলে নিয়ে সবগুলো সারির পেছনে রেখে দিচ্ছেন তিনি, এমন জায়গায়, সহজে যাতে চোখে পড়ে। পায়ের শব্দে ফিরে তাকালেন। অ্যামোনিয়াম নেই। পেলে ভালো। হতো। নেই যখন, কি আর করা? কোরামিনই দিতে হবে। হার্ট স্টিমুল্যান্ট। হৃৎপিণ্ডটাকে চাঙ্গা করে তুলতে হবে এখন।
একমত হলো কিশোর। জজের ওপর ভক্তি ফিরে এলো আবার! কোরামিন। খুঁজতে সাহায্য করলো তাকে।
কিশোর! ও কিশোর! রবিনের ডাক শোনা গেল। জলদি এসো! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে!
বেডরুমে ছুটে গেল কিশোর।
কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে ওয়ারডেনের চেহারা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দ্রুত গিয়ে তার মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া হলো কিঞ্জ হাতে ঘরে ঢুকশোর। উরুতে দ্বির, কালচে বাদাগেই হঠাৎ চালাতে শুরু করলো সে।
চালিয়ে গেল, যতোক্ষণ না আপনাআপনি শ্বাস নিতে পারলেন টমসন। হৃৎপিণ্ডে উত্তেজক কিছু ঢোকাতে না পারলে থেমে যাবে আবার শিগগিরই। জজের হলো কি? সিরিঞ্জে কোরামিন ভরতে পারলেন না এখনও?
সিরিঞ্জ হাতে ঘরে ঢুকলেন জজ। টমসনের পাশে বসে সুচ লাগালেন ক্ষতে। ওখানে কে?–ভাবলো কিশোর। উরুতে দিলে ভালো হতো না? তারপর চোখ পড়লো সিরিঞ্জের ভেতরের তরল পাদর্থের ওপর, কালচে বাদামী।
আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেল কিশোর। সুচ ঢোকানোর আগেই হঠাৎ জজের কব্জি চেপে ধরলো। কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালেন জজ।
মাপ করবেন, স্যার, হাত ধরে রেখেই বললো কিশোর।
বোধহয় ভুল হয়েছে আপনার। রঙটা দেখুন। কোরামিন নয়, বরং অ্যাকোকেনথেরার মতোই লাগছে।
সিরিঞ্জের দিকে তাকালো জজ, আঁতকে উঠলো। তাই তো! ঠিকই তো বলেছো। সর্বনাশ করে দিয়েছিলাম আরেকটু হলেই। পাশাপাশি দুটো বোতল ছিলো। তাড়াহুড়োয় কোরামিন ভরতে যেয়ে ভুলে আরেকটা ভরে ফেলেছি।
প্রায় জোর করে সিরিঞ্জটা জজের আঙুলের ফাঁক থেকে বের করে নিয়ে ডিসপেনসারিতে রওনা হলো কিশোর। লোকটার ডাক্তারি বিদ্যার ওপর ভরসা নেই আর তার, সন্দেহ জাগছে। তবে ডিসপেনসারিতে ঢুকে সন্দেহ দূর হয়ে গেল। মিথ্যে বলেননি জজ। মাঝের তাকে পাশাপাশি দুটো বোতল রাখা আছে, একটাতে লেবেল লাগানো রয়েছে কোরামিন, আরেকটাতে অ্যাকো। ওভাবে রাখাটা স্বাভাবিক। কারণ একটার পর পরই আরেকটা ব্যবহার হয়। রেঞ্জাররা যখন বড় কোনো জানোয়ার ধরে, চিকিৎসা করার জন্যে, ওটাকে বেহুশ করে নিতে হয়। আগে। হাতি-গণ্ডার-জিরাফ-সিংহ কোনোটাই সচেতন অবস্থায় চিকিৎসা নিতে রাজি নয়। খুব সামান্য পরিমাণ অ্যাকোনাইট ঢুকিয়ে দেয়া হয় জানোয়ারের রক্তে। ডাটের সাহায্যে। তাতে বেহুশ হয়ে যায় জীবটা। পরে কোরামিন দিয়ে ওটাকে আবার সুস্থ করে তোলা হয়।
জজের ওপর থেকে সন্দেহ চলে গেল কিশোরের। একজন ভদ্রলোককে সন্দেহ করেছিলো বলে লজ্জা লাগলো এখন। বিষ ভরা সিরিঞ্জটা ভেঙে ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটা সিরিঞ্জ বের করে তাতে কোরামিন ভরে নিলো। ফিরে এসে জজকে অনুরোধ করলো, আমি পুশ করি, স্যার? পারবো, ফার্স্ট এইডের ট্রেনিং আছে আমার।
নীরবে মাথা কাত করলেন জজ। সরে জায়গা করে দিলেন।
টমসনের উরুতে ইনজেকশন দিলো কিশোর। তারপর নাড়ি ধরে বসে রইলো চুপ করে। শ্বাস আর বন্ধ হলো না তার। তবে নাড়ির গতিও বাড়ছে না, খুব ক্ষীণ। আধ ঘন্টা পর বাড়তে শুরু করলো। এতো দ্রুত, প্যালপিটেশন শুরু হয়ে গেল। ভালো লক্ষণ নয় এটা। ঘাবড়ে গেল সে। জজকে বললো সেকথা।
পায়চারি করতে করতে থমকে দাঁড়ালেন জজ। বললেন, ভয় নেই, ঠিক হয়ে। যাবে। ওরকমই হয়।
তা-ই হলো। ধীরে ধীরে কমে আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো নাড়ির গতি।
সেকথা জানাতেই ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন জজ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। উদ্বেগ চলে গেল চেহারা থেকে। বললেন, ওকে হারালে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের। ওর মতো লোক এখন দরকার, বেচারা। জানোয়ারগুলোকে বাঁচানোর জন্যে। পোচাররা শেষ করে ফেলবে সব। ওদের জ্বালায় অস্থির হয়ে আছি…ও হ্যাঁ, জানো না বোধহয়, আফ্রিকান ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটির আমি একজন ডিরেক্টর। ব্যাটাদের ধরতে পারলে, দাঁত কিড়মিড় করলেন তিনি। আর যদি কোর্টে আমার সামনে পাই! এমন শাস্তি দেবো…কি যে কষ্ট দিয়ে মারে জানোয়ারগুলোকে, না দেখলে বুঝবে না! চোখের কোণে পানি টলমল করে উঠলো তার। তাকালেন ওয়ারডেনের দিকে। ও শুধু আমার বন্ধু না, ভাইয়ের মতো। ও না বাচলে… গলা ধরে এলো তার। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।
কারও দুঃখ সইতে পারে না মুসা। তার চোখেও পানি এসে গেল। রবিন নীরব। শুধু কিশোরের কোনো ভাবান্তর নেই। চুপচাপ তাকিয়ে আছে জজের। দিকে। চিন্তিত।
.
০৫.
নড়ে উঠলেন টমসন। দুই লাফে গিয়ে কিশোরকে সরিয়ে পাশে বসে পড়লেন জজ। ওয়ারডেনের হাত তুলে নাড়ি টিপে ধরলেন।
চোখ মেলতেই উদ্বিগ্ন, অশ্রুভেজা একটা প্রিয় মুখ দেখতে পেলেন টমসন। উষ্ণ আন্তরিক চাপ অনুভব করলেন হাতে। চুপ করে পড়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর কথা বললেন। দুর্বল কণ্ঠই বুঝিয়ে দিলো কতোখানি নরম হয়ে গেছে তার। শক্তিশালী শরীরটা। থ্যাঙ্ক ইউ.. তুমি যে কতো উপকার করলে আমার! ছেলেদের ওপর নজর পড়তে বললেন, পরিচয় হয়েছে?
না, বললেন জজ। তোমাকে নিয়েই তো কাটলো। সময় আর পেলাম কই?। পোচার।
তাহলে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে হাত মেলাও। ও কিশোর পাশা—মুসা আমান: রবিন মিলফোর্ড। ছেলেরা, এ হলো গিয়ে আমার প্রিয় বন্ধু জজ নির্মল। পাণ্ডা। এবার নিয়ে কয়েকবার প্রাণ বাঁচালো আমার। তুমি না থাকলে, নির্মল…
আরে রাখো তো ওসব কথা, বন্ধুকে থামিয়ে দিলেন জজ পাণ্ডা। মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, এমন কোনো কঠিন কাজ ছিলো না। অবশ্য জানা থাকলে সব। সহজই মনে হয়। একটা কোরামিন ইঞ্জেকশন, ব্যস।
অনেক কিছু জানে ও, ছেলেদের কাছে বন্ধুর প্রশংসা করলেন ওয়ারডেন। কিভাবে কি করেছে ভালোমতো দেখেছো তো? শিখে রাখলে কাজ দেবে।
হ্যাঁ, তা দেখেছি, জবাব দিলো কিশোর। খুব কাছে থেকেই দেখেছি, জিভের ডগায় এসে গিয়েছিলো, না দেখলে এতোক্ষণে মরে যেতেন আপনি, কিন্তু বললো না। তাড়াহুড়োয় ওরকম ভুল করতেই পারে লোকে, জজ সাহেব তো আর ডাক্তার নন। ডাক্তাররাও ভুল ওষুধ দিয়ে রোগী মেরে ফেলে অনেক সময়। তাছাড়া। মিস্টার টমসনকে খুন করে তার কি লাভ?
তবে, খুন করার ইচ্ছে থাকলে মস্ত একটা সুযোগ গেছে। ক্ষতের মধ্যে রয়েছে। অ্যাকো বিষ, রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আরও খানিকটা ইনজেক্ট করে ঢুকিয়ে দিলে কেউ ধরতে পারতো না, এমনকি ময়না তদন্তেও ফারাকটা বোঝা যেতো না। দূর, কি আজেবাজে কথা ভাবছে! নিজেকে ধমক দিয়ে জোর করে ভাবনাটা মন থেকে সরিয়ে দিলো কিশোর। ওই তো বসে আছেন হাসিখুশি ছোট্ট মানুষটা, নিষ্পাপ চেহারা, বন্ধুর জন্যে জান কোরবান।
শুনে খুশি হবে, নির্যাল, ওয়ারডেনের গলার জোর কিছুটা বেড়েছে। ছেলেগুলোর সুনাম আছে আমেরিকায়। এই বয়েসেই তুখোড় গোয়েন্দা হয়ে। গেছে। এমনকি পুলিশের চীফ পর্যন্ত ওদেরকে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে। বেড়াতে এসেছে এখানে। খুব রেগেছে পোচারদের কথা শুনে। আমাদের সাহায্য করবে কথা দিয়েছে।
আচ্ছা! তাই নাকি? মিষ্টি করে হাসলেন জজ। খুব ভালো কথা। তবে ছেলেরা, সাবধান করে দিচ্ছি। এটা আমেরিকা নয়। আর হারানো আঙটি কিংবা বাচ্চার পুতুল খুঁজে দেয়ার ব্যাপারও নয়। এখানে একদল খুনীকে নিয়ে কারবার। এই তো, একটু আগেই তো দেখলে, ওয়ারডেনকেই শেষ করে দিচ্ছিলো।
নির্মল, এতো ছোট করে দেখোনা ওদের। অনেক অভিজ্ঞতা আছে, খুনে বদমাশও ধরেনি তা নয়। আমাজানের গভীর জঙ্গল থেকেও ঘুরে এসেছে ওরা, নরমুণ্ড শিকারীদের খপ্পর থেকে পালিয়ে এসেছে, ধরে নিয়ে এসেছে অনেক দুর্লভ, ভয়ঙ্কর জানোয়ার।
কিন্তু তবু, নরম গলায় প্রতিবাদ করলেন জজ। পোচারদের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।
সেটা ঠিক। তবে আমরা নরম হয়ে আছি লোকবল নেই বলে। কাল থেকে বোধহয় আর থাকবে না।
কেন?
আরও জনা তিরিশেক রেঞ্জার আসছে।
কখন?
আশা করছি কাল দুপুরে।
হঠাৎ কি মনে পড়তে যেন চমকে উঠলেন জজ। হায় হায়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। জরুরী কাজ আছে, ভুলেই গেছি। নাইরোবিতে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, পথেই যখন পড়লো দেখা করে যাই। মনে হয় তোমার ভাগ্যই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো। যাকগে, উঠি, নইলে রাতের আগে পৌঁছতে পারবো না। ও, আসল। কথাটাই এখনও জানা হয়নি। তীরটা কোন জায়গায় খেলে?:
পশ্চিমে ক্যাম্প করেছে ব্যাটারা। এখান থেকে মাইল সাতেক হবে।
তাহলে তো কাছেই। লোকও যখন পাচ্ছো, আশা করি ধরে ফেলতে পারবে। তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, বয়েজ। আবার সাবধান করছি। মনে। রেখো, এটা আমেরিকার আধুনিক শহর নয়, বলে, আবার একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে গেলেন জজ।
দিন একটা গেল বটে তোমাদের! জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন জজ। আমার জন্যে আর ভেবো না, ঠিক হয়ে যাবো। যাও, গিয়ে বিশ্রাম নাও। তিন নম্বর ব্যাণ্ডায় তোমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কিছু দরকার হলে যে-কোনো একজন রেঞ্জারকে ডেকে বলো। ওদেরকে নির্দেশ দেয়া আছে।
কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখলো ওরা, একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। নিশ্চয় জজ নির্মল পাণ্ডার গাড়ি। ভুরু কুঁচকে তাকালো কিশোর। ওদিকে যাচ্ছে কেন? নাইরোবির সড়ক তো উত্তরে। ওটা যাচ্ছে পশ্চিম দিকে!
পড়ন্ত বেলার রোদ লাগছে চোখেমুখে। চোখ ছোট ছোট করে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা, যতোক্ষণ না ওটা ছায়াঢাকা বুনোপথে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে, গেল।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ওদিকে গেল কেন? নাইরোবি তো ওদিকে গেল কেন? নাইরোবি তো ওদিকে নয়।
লোকটার আচরণ ভারি অদ্ভুত লেগেছে আমার, রবিন বললো।
কিশোর কিছু বললো না। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। পোচার
***
কেবিন, বা কটেজের আফ্রিকান নাম, ব্যাণ্ডা। তিন নম্বর ব্যাণ্ডায় বেশ বড় একটা লিভিংরুম আছে, বড় বড় চেয়ারে আরাম করে বসা যায়। ওপর দিকে তাকালেই চোখে পড়বে খড়ের চালায় অসংখ্য টিকটিকি, মাছি পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ধরে খেয়ে ফেলছে। পাশেই বেডরুম, তাতে তিনটে বিছানা পাতা। গোসলখানা আছে, ভাড়ার ঘর আছে। সব চেয়ে লোভনীয় মনে হলো ওদের কাছে, রেলিঙে ঘেরা বেশ ছড়ানো একটা বারান্দা। ডাইনিং টেবিল আছে ওখানে, আর কিছু ক্যাম্প চেয়ার বসে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। জন্তুজানোয়ার আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারবে। যতো খুশি।
তিরিশ ফুট দূরে আলাদা একটা কুঁড়েতে রান্নাঘর বানানো হয়েছে। একটা আফ্রিকান ছেলে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, খাবার লাগবে কিনা। হাসি এসে গেল মুসার।
খোলা জায়গায় বসে খাওয়া আর চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা চললো একই সঙ্গে। সবুজ উপত্যকার পরে লাল পাহাড়, দূরে নীলকিলিমানজারো পর্বতের উনিশ হাজার ফুট উঁচু তুষারে ঢাকা চূড়া।
উপত্যকা থেকে রোদ চলে গেছে। নামছে গোধূলির আবছা অন্ধকার। কিন্তু সূর্য যে একেবারে ডুবে যায়নি, কিলিমানজারোর চকচকে চূড়ার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সাদা তুষার এখন গাঢ় লাল। সূর্য যতোই দিগন্তের নিচে হারিয়ে যেতে লাগলো, ফ্যাকাসে হয়ে গেল লাল রঙ, শেষে আর কিছুই থাকলো না। ঝুপ করে হঠাৎ যেন নেমে এলো অন্ধকারের চাদর। আকাশে ফুটলো বড় বড় উজ্জ্বল তারা।
দূরে দূরে ছিলো এতোক্ষণ জন্তুজানোয়ারেরা,রাত নামতেই খাবারের গন্ধে আর পানির লোভে পায়ে পায়ে এসে হাজির হলো অনেকে।
বসে বসে কিছুক্ষণ দেখলো ছেলেরা। সারা দিন প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে। ঘুমে জড়িয়ে এলো চোখ। বসে থাকতে পারলো না আর। উঠে, শুতে চললো।
০৬.
ওদের মনে হলো, সবে শুয়েছে এই সময় দরজায় থাবা দিয়ে জাগিয়ে দেয়া। হয়েছে। চোখ মেলে দেখলো, বাইরে অন্ধকার কেটে গেছে। খোলা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভোরের ধূসর আকাশ।
দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন টমসন। সকালের পেট্রলে যেতে চাও? জানোয়ার দেখার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।
ওয়ারডেনকে দেখে অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। অসামান্য ক্ষমতা তাঁর শরীরের। এতো বড় একটা ধকলের পর এতো তাড়াতাড়ি সামলে নিলেন!
আপনার হাত কেমন? ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হাতের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
ভালোই। এই যে, নাড়তে পারছি। কপাল ভালো, মাংসে গেঁথে ছিলো। তীরটা, হাড়-টাড়ে লাগেনি। কদিনেই ভালো হয়ে যাবে। ওঠো, উঠে কাপড় পরে নাও। আমি কফির কথা বলছি।
হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পরে বারান্দায় এসে দেখলো ওরা, টেবিলে বড় এক পাত্র কফি আর কয়েকটা কাপ সাজানো। বাইরে এখনও কুয়াশা। কিলিমানজারোর নিচের অংশটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু রোদ পড়ে চকচক করছে চূড়া। কাঁচা রোদে এখন হয়ে গেছে সোনালি। ভাসছে যেন কুয়াশার ওপর। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তিন গোয়েন্দা।
মুসাকে ঘন ঘন রান্নাঘরের দিকে তাকাতে দেখে হেসে ফেললেন টমসন। এখানে অন্যরকম নিয়ম আমাদের। ভোর বেলা অলস হয়ে থাকে জানোয়ারের: দল, বেশির ভাগই বাইরে থাকে। টুরিস্টদেরকে তাই এই সময়ই দেখানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধু কফি খেয়েই চলে যাই। নটার দিকে ফিরে এসে নাস্তা।
টুরিস্ট কই? রবিন জিজ্ঞেস করলো। আর কাউকে তো দেখছি না। ওই ব্যাণ্ডাগুলো সব খালি নাকি?
হ্যাঁ, জানালেন ওয়ারডেন। এখন টুরিস্ট সীজন নয়। তবে আগে এসময়ও কিছু কিছু আসতো। এখন সীজনের সময়ও আসে না, পোচারদের জ্বালায়। শয়তানগুলোকে দমাতে না পারলে কেনিয়া সরকারের একটা বড় ইনকাম নষ্ট হয়ে যাবে।
কফি খেয়ে এসে ওয়ারডেনের ল্যাণ্ড রোভারে উঠলো সবাই। আধ মাইল এগোতেই দেখা গেল, সামনে পথ রুদ্ধ। এক পাল মোষ দাঁড়িয়ে আছে। শখানেকের কম হবে না। বিশাল কালো শরীর, মস্ত শিং।
গাড়ি থামিয়ে দিলেন টমসন। ভেতর দিয়ে যাওয়া যাবে না।
দলের সব চেয়ে বড় মোষটা শিং বাগিয়ে তেড়ে এলো, থেমে গেল গাড়ির বিশ ফুট দূরে। ভয়ানক ভঙ্গিতে শিং নেড়ে হুমকি দিলো।
ব্যাটা দলের সর্দার, নিচু কণ্ঠে বললেন টসমন। বিপদ বুঝলেই হামলা চালাবে। চোখের পলকে সব কটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর।
খাইছে! তাহলে? কুঁকড়ে গেল মুসা।
বসে থাকতে হবে আমাদের। ওরা চলে গেলে তারপর এগোবো।
মাটিতে পা ঠুকে কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করলো মোষটা। প্রতিপক্ষকে লড়াই ঘোষণা করতে না দেখে যেন নিরাশ হয়েই ফিরে চললল। কয়েক কদম গিয়ে ফিরে চেয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করলো, যেন ভীতুর ডিম বলে ব্যঙ্গ করলো। তারপর গিয়ে ঢুকলো পালের মধ্যে। উত্তেজিত হয়ে সর্দারের হাবভাব লক্ষ্য করছিলো দলটা, ভাটা পড়লো উত্তেজনায়। কেউ মুখ নামিয়ে ঘাস ছিঁড়তে শুরু করলো, কেউ বা বাচ্চার পরিচর্যায় মন দিলো। কয়েক মিনিট ওভাবেই কাটানোর পর রওনা হলো দলটা। হারিয়ে গেল বনের ভেতরে।
আবার চললল ল্যাণ্ডরোভার। পোচারস লুকআউটে চলে যাবো, বললেন ওয়ারডেন।
খোলা জায়গা পেরিয়ে বনে এসে ঢুকলো গাড়ি। জঙ্গল এখানে পাতলা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গাছপালা। অ্যাকেইশাঁই বেশি। কাঁটা ঝোপঝাড় রয়েছে। অনেক। ওগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে হাটবীস্ট, ওয়াটারবাক, জেরিনুক, আর হাই-জাম্প লং-জাম্প দুটোতেই ওস্তাদ সুন্দর ইমপালা হরিণ। ঘোৎ ঘোঁৎ করে পথের ওপর এসে পড়ছে বনের ভাড় নামে পরিচিত শুয়োর, ওয়ার্টহগ। গাড়ি দেখে চমকে উঠে হাস্যকর ভঙ্গিতে শরীর মাথা নাচিয়ে গিয়ে আবার ঢুকে পড়ছে। বড় একটা গাছের মাথায় বসে থাকতে দেখা গেল এক ঝাঁক বেবুনকে। গাড়িটা নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় কুকুরের মতো দাঁত ভেঙচে অনেকটা কুকুরের মতোই ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।
এক জায়গায় দেখা গেল, গাছের ডাল-পাতা ভেঙে ভেঙে খাচ্ছে ডজনখানেক ছোট-বড় হাতি। একেবারে পাশ দিয়ে গেল গাড়িটা, ফিরেও তাকালো না ওরা। নিজের কাজে ব্যস্ত।
নানারকম জানোয়ার আর পাখি দেখতে দেখতে চলেছে ওরা। শটাশট ক্যামেরার শাটার টিপছে মুসা, যা দেখছে তারই ছবি তুলছে। কিশোরও তুলছে, তবে বেছে বেছে।
বন থেকে বেরিয়ে, উপত্যকা পেরিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছলো ল্যাণ্ডরোভার। পাহাড়ী পথ বেয়ে উঠে এলো ওপরে, পোচারস লুকআউটে। টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে যন্ত্রটার মতোই স্থির হয়ে আছে একজন রেঞ্জার। টমসন ডাকতে ফিরে চেয়ে স্যালুট করলো।
কিছু দেখা যাচ্ছে? জিজ্ঞেস করলেন ওয়ারডেন।
তেমন কিছু না। শুধু শকুন।
টেলিস্কোপে চোখ রেখে দেখলেন টমসন। সরে জায়গা করে দিলেন, ছেলেদের জন্যে। ওরাও একে একে দেখলো। বনের কিনারে আকাশে চক্কর মারছে কয়েকটা শকুন। মরা দেখতে পেলে যেমন করে।
পোচার আছে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
মনে হয় না। আমাদের লজ থেকে জায়গাটা মাত্র দুমাইল। এতো কাছে আসার সাহস করবে না ব্যাটারা। তবু চলো, গিয়ে দেখি।
গাড়ি চলে গেল ওখানে। ছোট ছোট কয়েকটা গাছের গোড়ায় পড়ে আছে বিরাট একটা দেহ। ধারেকাছে পোচারদের ছায়াও নেই। ওরা গাড়ি থেকে নেমে এগোতেই ডানা জাপটে উড়ে গেল কয়েকটা শকুন।
গণ্ডার, বললেন টমসন।
মৃত জানোয়ারটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। পেটে পিপার মুখের সমান বড় এক ফোকর। ভেতরে নাড়িভুড়ি কিছু নেই, সব সাফ করে খেয়ে ফেলেছে। দুর্গন্ধে পাক দিয়ে ওঠে পেটের ভেতর। সইতে না পেরে নাকে রুমাল চাপা দিলো মুসা। রবিন তো ওয়াক থু করে বমিই করতে বসে গেল।
উঁকি দিয়ে গর্তের ভেতরে দেখলো কিশোর। বিড় বিড় করলো, বেচারা! কি করে মরলো? অসুখে?
তাই হবে হয়তো, মুসা বললো।
তীক্ষ দৃষ্টিতে গণ্ডারটার মাথার দিকে তাকিয়ে আছেন টমসন। ভুল করেছি আমি, বললেন তিনি। ভেবেছিলাম, পোচাররা এতো কাছে আসার সাহস পাবে না, ভুল বলেছি। দেখো, শিং নেই। কেটে নিয়ে গেছে। গণ্ডারের শিং খায় না। কোনো জানোয়ার। তার মানে পোচাররা নিয়ে গেছে। ওরাই মেরেছে এটাকে, গলার কাছে একটা ক্ষত দেখালেন। দেখো, বল্লম দিয়ে মেরেছে।
ইস, পিশাচ নাকি ওরা! গণ্ডারটার ক্ষতবিক্ষত লাশের দিকে তাকাতে পারছে না রবিন।
এটা আর এমন কি? ওদের নিষ্ঠুরতা তো দেখোইনি। চলো, দেখাবো।
কয়েক মিনিট গাড়ি চালিয়ে একটা জায়গায় এসে থামলেন টমসন। এই যে, টিসাভো নদী।
কোনো নদী চোখে পড়লো না ছেলেদের। শুধু কালো রুক্ষ একটা ছোট পাহাড়।
কই, নদী কোথায়? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
নদীর ওপর দিয়ে হেঁটেছে কখনও? মুসার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন ওয়ারডেন, হাসছেন মিটিমিটি। না হাঁটলে এটাই সুযোগ। হেঁটে নাও।
কালো পাথরে উপত্যকার ওপর দিয়ে ছেলেদের নিয়ে চললেন তিনি। একখানে থেমে জোরে লাথি দিলেন মাটিতে। ফাপা আওয়াজ হলো।
লাভার স্তর মনে হচ্ছে? কিশোর বললো।
লাভ-ই। আদিমকালে কোনো সময় কিলিমানজারো থেকে নেমে এসে ঢেকে দিয়েছে নদীটা। আমাদের পায়ের নিচেই বইছে ওটা। ভাটির দিকে যাচ্ছি আমরা।
যতোই এগোচ্ছে, কানে আসছে একটা ঝিরঝির শব্দ। বাড়ছে শব্দটা। শেষে, একটা টিলা ঘুরে এসে দেখতে পেলো, টিলার গোড়ার বিশাল ফোকর থেকে সগর্জনে ছিটকে বেরোচ্ছে তীব্রস্রোতা পাহাড়ী নদীর পানি। অতিকায় এক ড্রেনের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে যেন। নিচে যেখানে পড়ছে, বড় একটা দীঘি তৈরি করেছে। সেখানে, কিংবা বলা যায় ছোট হ্রদ। হ্রদ থেকে বেরিয়ে উপত্যকা ধরে একেবেকে বয়ে গেছে সরু নদী।
এর নাম মিজিমা স্প্রিং। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ থাকে পানি, ওয়ারডেন বললেন।
কিন্তু এখন পানি পরিষ্কার নয়। লালচে বাদামী, দুর্গন্ধ হয়ে আছে।
এতোক্ষণ নদীর ওপর দিয়ে এসেছো, বললেন তিনি। এবার তলায় নিয়ে যাবো।
ছেলেদের নিয়ে একটা ঝোপের ভেতরে ঢুকলেন টমসন। মাটিতে একটা গর্ত দেখা গেল। ওটা দিয়ে ঢুকে, ঢালু সুড়ঙ্গ বেয়ে একটা প্রাকৃতিক গুহায় এসে ঢুকলো। ওরা। গুহাটাকে কেটে ঘরের মতো বানিয়ে নেয়া হয়েছে। আণ্ডারওয়াটার। অভজারভেটরি, নদীর তলার দৃশ্য দেখার জন্যে। জানালার ভেতর দিয়ে নদীর। নিচটা দেখা গেল পরিষ্কার। পানির ওপরে রোদ ঝলমল করছে, নিচেও আসছে। আলো।
জানালার কাছে নাক ঠেকালো তিন গোয়েন্দা। বাইরের দৃশ্য দেখে গা গুলিয়ে। উঠলো। অসংখ্য জলহস্তী, নদীর তলায় চরে বেড়াচ্ছে না আর ওগুলো, জলজ ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে না, মরে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। মরা লাশের স্তূপ, কোনো কোনোটা বেশি ফুলে গিয়ে ভেসে উঠেছে ওপরে। মারাত্মক ক্ষতগুলো থেকে এখনও রক্ত চুঁইয়ে বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে পানির সঙ্গে। লেজ কাটা। জায়গায় জায়গায় চামড়া ছিলে নেয়া হয়েছে। বড় বড় শ্বদন্তগুলো সব উপড়ে তুলে নিয়ে গেছে পোচাররা। কিছু জানোয়ারের মাথা কেটে নিয়ে গেছে, বিশেষ করে মাদীগুলোর।
কয়েকটা শিশু জলহস্তী এখনও জীবিত, ক্ষুধায় কাহিল হয়ে বার বার গিয়ে নাক ঘষছে মৃত মায়ের গায়ে। অবোধ শিশুগুলো বুঝতে পারছে না, আর কোনোদিন জাগবে না মা, আদর করে গা চেটে দিয়ে দুধ খাওয়াবে না।
বড় বড় কুমির দল বেঁধে এসে মহানন্দে জলহস্তীর মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে। বুড়ো মাংসে অরুচি ধরে যাওয়াতেই বোধহয় কোনো কোনোটা মরা হাতি বাদ দিয়ে শিশু হাতির নধর কচি মাংস দিয়ে নাস্তা সারছে। বিরাট হাঁ একেকটার, আর ইয়া বড় বড় দাঁত। দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। মাঝে মাঝে লড়াই লেগে যাচ্ছে পছন্দসই মাংসের মালিকানা নিয়ে, শক্তিশালী লেজের জোরালো ঝাপটায় আলোড়িত হচ্ছে পানি। শুধু কুমিরই না, শয়ে শয়ে মাংসাশী মাছও গপ গপ করে গিলছে জলহস্তীর মাংস।
বেশিক্ষণ এই দৃশ্য দেখা যায় না। জানালার কাছ থেকে সরে এলো ছেলেরা। নীরবে ফিরে চললো ওয়ারডেনের পিছু পিছু। রবিন নীরব। কিশোরের চেহারা থমথমে। মুসার চোখে পানি। পোচার ধরতে টমসনকে সাহায্য করবে কথা দিয়েছিলো ওরা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এখন, দলের, সবকটার হাতে হাতকড়া না পরিয়ে টিসাভো থেকে যাবে না।
নটার মধ্যেই লজে ফিরে এলো। নাস্তা করতে বসলো, কিন্তু রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। মুসাও তেমন গিলতে পারছে না। বার বার চোখের সামনে ভাসছে অসহায় বাচ্চাগুলোর চেহারা।
.
০৭.
সেদিনই বেলা বারোটার দিকে এলো তিরিশ জন লোক, লরিতে করে। তাদের স্বাগত জানালেন টমসন। দমে গেলেন মনে মনে। ট্রেইনড রেঞ্জার নয় একজনও। কুলিকামিন গোছের লোক। একজন ট্র্যাকার, আর দুতিন জন পেশাদার শিকারী আছে, এককালে শ্বেতাঙ্গ শিকারীর সহকারী ছিলো ওরা, পয়সার বিনিময়ে টুরিস্টদের নিয়ে সাফারিতে যেতো। কি আর করা? নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো, ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিলেন ওয়ারডেন।
ব্যাণ্ডার পেছনে তাবু খাঁটিয়ে তিরিশ জন লোকের থাকার ব্যবস্থা হলো। খাবার এনে দিলো লজের বাবুর্চিরা।
খেতে খেতে ওদের সঙ্গে আলোচনা চললো। কাজটা কি, জেনেশুনেই এসেছে ওরা। মাসাই উপজাতির লোক, নেহায়েত মাংসের দরকার না হলে কখনও শিকার করে না। পোচারদের ঘৃণা করে। টিসাভোতে ওদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনী শুনে জ্বলে উঠলো সবাই। চেঁচাতে শুরু করলো, এক্ষুণি চলুন! কল্লা আলাদা করে ফেলবো ব্যাটাদের! খুন করে ফেলবো!
বুঝিয়ে শুনিয়ে ওদের শান্ত করলেন ওয়ারডেন। বললেন, ব্যাটাদের খুন। করতে পারলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু করা যাবে না। মানুষ খুনের অপরাধে আমাদেরকেই জেলে যেতে হবে তাহলে।
তো কি করবো? এমনি এমনি ছেড়ে দেবো শয়তানগুলোকে? রেগে উঠলো বিশালদেহী এক মাসাই, যেন একটা দৈত্য। ট্র্যাকারের কাজ করেছে অনেক দিন। নাম মুগামবি।
ছাড়বো কেন? ধরে নিয়ে যাবো কোর্টে। ব্যস, আমাদের কাজ শেষ। এরপর ওদেরকে জেলে পাঠানোর দায়িত্ব জজ সাহেবের।
কিন্তু ধরবোটা কিভাবে? পায়ে গুলি করে?
না, বন্দুক নেয়া যাবে না সঙ্গে। উত্তেজনার সময় মাথা ঠিক থাকবে না। পায়ে না করে যদি মাথায় কিংবা বুকে গুলি করে বসে কেউ?
বুঝতে পারছেন না, ওদের সঙ্গে বিষাক্ত তীর আছে, বল্লম আছে। আমরা না মারলেও আমাদেরকে ছাড়বে না ওরা। ঠিক খুন করবে।
তা করবে, স্বীকার করলেন ওয়ারডেন। সেজন্যেই ওদেরকে ধরা খুব বিপজ্জনক হবে। জানোয়ারেরও অধম ওরা।
হাসি মুছে গেছে মাসাইদের মুখ থেকে। খালি হাতে সিংহ ধরতে রাজি আছে ওরা, কিন্তু পোচার নয়।
দেখ, ওদের মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন টমসন। নিজেদের ইচ্ছেয়। এসেছে তোমরা, কাজ করলে পয়সা পাবে, এই শর্তে। যার পয়সার দরকার, যাবে আমার সঙ্গে, যার দরকার নেই, যাবে না। জোর করবো না কাউকে। ধরতে পারলে ধরবো, না পারলে ফিরে আসবো। পুলিশকে জানাবো। যা করার করবে। ওরা। আমি বন্দুক সাথে নিয়ে গিয়ে খুনের আসামী হতে রাজি নই।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছিলো কিশোর। হাত তুললো, স্যার, তীর-ধনুক আর বল্লমও কি নেয়া যাবে না?
না। কারণ ওসব দিয়েও মানুষ খুন করা যায়। মারাত্মক অস্ত্র।
তাহলে, এমন কোনো অস্ত্র যদি নেয়া হয় সঙ্গে, যেটা অবশ্যই মারাত্মক, কিন্তু ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে কততখানি মারাত্মক হবে?
ভুরু কোঁচকালেন ওয়ারডেন। কি বলতে চাইছো?
হাসলো কিশোর। জানোয়ার ধরার অস্ত্র।
খুলে বলো। মনে হচ্ছে কোনো একটা প্ল্যান করেছো তুমি।
খুলে বললো কিশোর।
.
০৮.
কয়েক মিনিট পর যখন রওনা হলো দলটা, দেখা গেল একজন মাসাইও বাদ পড়েনি। সবাই এসেছে। আর এসেছে টমসনের পাঁচজন রেঞ্জার। অন্য পাঁচজন। ক্যাম্পে নেই, ডিউটিতে গেছে পার্কের বিভিন্ন জায়গায়, পোচার খোঁজার জন্যে।
তবে পাঁচজন রেঞ্জারের জায়গা দখল করার মতো পোচার-শিকারী, একটা আছে দলে। মানুষ নয়, কুকুর। মিশ্র রক্ত ওর ধমনীতে। মা, এক শ্বেতাঙ্গ শিকারীর অ্যালসেশিয়ান; বাবা, আফ্রিকার জঙ্গলের ভয়ঙ্করতম শিকারী হিংস্র বুনো কুকুর। বনের মধ্যে অসহায় অবস্থায় বাচ্চাটা কুড়িয়ে পেয়েছিলো সাফারিম্যান কালিমবো, নিয়ে এসে যত্ন করে বড় করে তুলেছে, নাম রেখেছে সিমবা, অর্থাৎ সিংহ। গায়ে গতরে সিংহের সমান না হলেও হিংস্রতায় যে পশুরাজকে ছাড়িয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই মুসার। দেখেই সিমবাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে, মনে মনে। আফসোস করছে, ইস, ওরকম একটা কুকুর যদি থাকতো তার!
পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে জীপ, ভ্যান,ট্রাক আর লরির লম্বা মিছিলটা।
একেবারে সামনের ল্যাণ্ড-রোভারে রয়েছেন ওয়ারডেন, গাড়ি চালাচ্ছেন, পাশে কিশোর। মুসা আর রবিন বসেছে পেছনে।
এমনও হতে পারে, টমসন বললেন। লাগতেই আসবে না ওরা। এতোগুলো গাড়ি দেখলেই ভয়ে পালাবে।
ওরা পালাক, এটা নিশ্চয় চান না আপনি? কিশোর বললো। ওদের ধরতে চান।
চাইলেই তো আর হবে না। ওদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।
আপনার কি মনে হয়, সত্যি পালাবে?
নির্ভর করে। নেতা না থাকলে পালাবে। আর, সিলভার যদি সাথে থাকে, উত্তেজিত করে ওদেরকে, সাহস দেয়, তাহলে আক্রমণ করবে।
আরে, তাই তো! কিশোর ভুলেই গিয়েছিলো সিলভারের কথা।
ওই পালের গোদাটাকে ধরতে না পারলে হাজার পোঠর ধরেও লাভ হবে না, আবার বললেন টমসন। এক জায়গা থেকে তাড়ালে আরেক জায়গায় গিয়ে। পোচিং শুরু করবে।
হুঁ! মাতা দোলালো কিশোর।
আরও কয়েক মিনিট চলার পর গাড়ি থামাতে বললো সে। রবিন আর মুসাকে নিয়ে নেমে গিয়ে উঠলো সাপ্লাই ভ্যানে। আবার চললো মিছিল।
ক্যাম্প থেকে কয়েক ডজন ডার্ট নিয়ে আসা হয়েছে, ওগুলোতে ওষুধ ভরতে হবে। ডার্টগুলো দেখে মনেই হয় না, হাতিকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে নিমেষে। আট ইঞ্চি লম্বা, কড়ে আঙুলের মতো মোটা। এক মাথায় ইঞ্জেকশনের সুচের মতো, সুচ, তবে আরও খাটো। আরেক মাথায় হালকা এক গুচ্ছ পালক বাধা, ভারসাম্য বজায় রেখে যাতে নিশানা মতো গিয়ে আঘাত হানতে পারে ডার্ট সেজন্যে।
বার বার এপাশে ওপাশে মোড় নিচ্ছে গাড়ি, ভীষণ ঝাঁকুনি। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখলো কিশোর। পথ ছেড়ে বিপথে নেমেছে ভ্যান, কিংবা বলা ভালো উঠেছে। চাকার নিচে ছোট ছোট টিলা-টক্কর। আশেপাশের কোনো কোনোটা বেশ বড়,পনেরো-বিশ ফুট উঁচু। উইয়ের ঢিবি। ছোটগুলোর ওপর দিয়ে চলেছে গাড়ি, বড়গুলোর পাশ কাটাচ্ছে।
ঢিবিগুলো পেরিয়ে এসে গাড়ি থামলো। সামনে পাঁচশো গজ মতো দূরে পোচারদের বেড়া। বেড়া থেকে দূরে গাড়ি থামানোর কারণ আছে। পোচাররা থাকলে তীর ছুঁড়তে পারে। বেশি কাছে গেলে গায়ে লাগবে তীর, ঝুঁকি নেয়ার। মানে হয় না। তাই দূরেই রেখেছেন ওয়ারডেন।
এসো, জলদি হাত লাগাও, দুই সহকারীকে বললো গোয়েন্দপ্রধান। প্রাস্টিকের ব্যাগ খুলে ভ্যানের মেঝেতে ঢাললো ডার্টগুলো। বড় একটা শিশি বের করলো, তার মধ্যে পানির মতো পাতলা সাদাটে ওষুধ।
জিনিসটা কি? মুসা জিজ্ঞেস করলো। অ্যাকোর রঙ তো কালো—
এটা সেরনিল, মাসকিউলার অ্যানাসথেটিক। জানোয়ার ধরার জন্যে ব্যবহার হয়। রক্তে ঢুকলেই ঘুমিয়ে যায়।
দ্রুত ডার্টে ওষুধ ভরে নিতে লাগলো ওরা। ভরা শেষ করে তিনটে চামড়ার বাকেটে ডাটগুলো নিয়ে, নামলো ভ্যান থেকে। চলে এলো ল্যাণ্ড-রোভারের পাশে।
পোচারদের দেখা নেই। বেড়ার ওপাশে ওদের কুঁড়েগুলো আছে। আর আছে। বেড়ার ফাঁকে ফাঁদে আটকা পড়া অসহায় জানোয়ারের দল। যন্ত্রণা আর আতঙ্কে চিৎকার করছে।
মাসাইরা সবাই নেমে এসেছে। তাদের মাঝে ডার্ট বিলি করে দিলেন ওয়ারডেন আর তিন গোয়েন্দা। বেড়ার দিকে মুখ করে পাশাপাশি এক সারিতে রাখা হয়েছে গাড়িগুলো। ওগুলোর সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়ালো ঘুম-যোদ্ধারা। ডার্ট ছোঁড়ার জন্যে নিশপিশ করছে হাত। কিন্তু শত্রু কই? অধৈর্য হয়ে আগে বাড়লো কয়েকজন মাসাই।
এই, থামো! চেঁচিয়ে বললেন ওয়ারডেন। কোথায় যাচ্ছো? পিছাও।
আরে, দেখো দেখো, হাত তুললো মুসা। এহহে, সরে গেল! বেড়ার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করেছিলো। কালো চাপদাড়ি।
কাউকে দেখলো না রবিন। কিশোরও না। সিলভার না তো?–ভাবলো সে। মুসা যখন বলছে দেখেছে, নিশ্চয় দেখেছে। তার কান আর চোখের ওপর পুরোপুরি। ভরসা করা যায়।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে সবাই, কিন্তু কাউকে এগোতে দিলেন না ওয়ারডেন। কে জানে বেড়ার ওপাশে ঘাপটি মেরে আছে কিনা পোচাররা।
হঠাৎ তারস্বরে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো সিমবা। ঝাড়া দিয়ে কালিমবোর হাত থেকে গলার বেল্ট ছাড়িয়ে ছুটে যাওয়ার জন্যে জোরাজুরি করতে লাগলো। ফাঁদে পড়ার ভয় আছে, ছাড়লো না তাকে তার মালিক।
অবশেষে, এক ফাঁকে দেখা দিলো একটা কালো মাথা। আরেক ফাঁকে আরেকটা। তারপর আরেকটা।
ব্যাটারা দেখছিলো আমাদের, রবিন বললো। বোঝার চেষ্টা করছিলো আমারদের উদ্দেশ্য।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। নিরাপদ বুঝে এখন বেরিয়ে এসেছে।
ঠিকই বলেছে দুজনে। লুকিয়ে থেকে দেখছিলো পোচাররা। রাইফেল নেই। দেখে সাহস পেয়ে বেরিয়ে এসেছে এখন। মুমূর্ষ জানোয়ারগুলোর আশপাশ দিয়ে পা টিপে টিপে বেরোলো ওরা। হাতে তীর-ধনুক, পিঠে বাঁধা বল্লম। ফলায় বিষ মাখানো, সন্দেহ নেই। বেড়ার এপাশে, এসে সারি দিয়ে দাঁড়ালো ওরাও। জনা পঞ্চাশের কম না।
এমনভাবে চেয়ে আছে পোচাররা, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। গাধা। নাকি! ক্যাম্প থেকে এসেছে শত্রু এলাকায়, অথচ সঙ্গে রাইফেল-বন্দুক কিচ্ছু নেই, শুধু ছোট ছোট কয়েকটা লাঠির মতো জিনিস। উপজাতীয় আধা-জঙলী ওরা, এ ধরনের আধুনিক ডার্টগান দেখেনি জীবনে, অস্ত্রগুলোর মাহাত্ম জানে না। একজন তো হেসেই ফেললো। ব্যস, সংক্রামিত হয়ে গেল হাসিটা। হাসতে শুরু করলো সবাই। আর সে-কি হাসি! হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে গেল সবাই, উরুতে চাপড় মারছে ঠাস ঠাস করে। শেষে উলুকের মতো নাচতে আরম্ভ করলো। তীর ছুঁড়লো। কয়েকজন। পাঁচশো গজ অনেক দূর, নিশানায় পৌঁছার বহু আগেই মাটিতে পড়ে গেল সেগুলো।
তীর-ধনুক আর বল্লম তুলে, শরীর সামান্য কুঁজো করে, এক পা এক পা করে এগোতে শুরু করলো পোচাররা। দেখে দেখে সাবধানে পা ফেলছে। নইলে নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাই আটকাবে। লম্বা ঘাসের ভেতরে পেতে রাখা হয়েছে ওসব ফাঁদ।
রেডি থাকো, বললেন ওয়ারডেন। আমি না বললে ফায়ার করবে না কেউ।
মাসাইদের অনেকে, ইংরেজি বোঝে না। দেশীয় ভাষায় সেটা অনুবাদ করে বললো মুগামবি।
বেড়ার ওপাশ থেকে আদেশ শোনা গেল। এগোতে বলছে পোচারদের। আড়াল থেকে বেরিয়ে একটা ফাঁকে এসে দাঁড়ালো সে। দলের আর সবার মতো শুধু নেংটি পরা আধা-উলঙ্গ নয়। গায়ে বুশ জ্যাকেট, পরনে সাফারি ট্রাউজারস। দাড়িতে ঢাকা মুখ, চামড়ার রঙেই বোঝা যায় আফ্রিকান নয় লোকটা।
ওই যে, চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। বলেছিলাম না। নিশ্চয় সিলভার।
আস্ত হারামী, রবিন বললো। নিজে পেছনে থেকে দলের লোক পাঠিয়েছে। মরলে ওরা মরবে, তার কি?
আবার আদেশ দিলো লোকটা। যাদের হাতে ধনুক ছিলো, তাড়াতাড়ি কাঁধে ঝুলিয়ে খুলে নিলো পিঠে বাঁধা বল্লম।
বল্লম নিচ্ছে কেন? রবিনের প্রশ্ন।
তীর দিয়ে লঙ রেঞ্জে লড়াই করে, ওয়ারডেন জবাব দিলেন। কাছে থেকে বলুম বেশি মারাত্মক। ওরা মনে করেছে আমরা নিরস্ত্র, তাই কাছে এসে খুঁচিয়ে মারতে চাইছে। জানোয়ার মেরে সাহস এত বেড়েছে, মানুষ মারতেও আর দ্বিধা নেই এখন। হুঁশিয়ার থাকবে। বল্লমের মাথায়ও বিষ লাগায়।
টমসনের দিকে তাকিয়ে আছে মাসাইরা। কখন তিনি আদেশ দেন। কিন্তু চুপ করে রইলেন তিনি। বিশ ফুটের মধ্যে চলে এলো পোচাররা।
রেডি! চেঁচিয়ে বললেন ওয়ারডেন।
ডার্ট তুললো সবাই। নিজেদের কাছেই হাস্যকর লাগছে তাদের এই অস্ত্র, পোচাররা তো হাসবেই। আট ফুট লম্বা বিষাক্ত বল্লমের বিরুদ্ধে কয়েক ইঞ্চি লম্বা কতগুলো খাটো লাঠি! তবে, উগাণ্ডা কিংবা কঙ্গোর লোক হলে হাসতো না ওরা, ঠিকই বুঝতে বল্লমের চেয়ে কতো বেশি মারাত্মক লাঠিগুলো। কেনিয়ায় এই অস্ত্র এখনও সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিত।
ভাবতে অবাক লাগছে কিশোরের, ডার্টগান কি সিলভারও চেনে না? নাকি দূর থেকে বুঝতে পারছে না?
দূর থেকে প্রথমে চিনতে পারেনি, বোঝা গেল। হঠাৎ চেঁচিয়ে কি বলতে শুরু করলো সে। সোয়াহিলি ভাষা। মুগামবি অনুবাদ করে বললো, চিনে ফেলেছে। ওদের ফিরে যেতে বলছে সে।
চিনতে অনেক দেরি করে ফেলেছে সিলভার। লড়াইয়ের উন্মাদনা রক্তে নাচন তুলেছে তখন পোচারদের, নেতার কথা শুনলো না। বিজয় তো অনিবার্য, কেন ফিরে যাবে? ফিরেও তাকালো না ওরা। বল্লম বাগিয়ে হুল্লোড় করে ছুটে এলো।
ফায়ার! আদেশ দিলেন ওয়ারডেন।
চোখের পলকে ছুটে গেল একঝাঁক খুদে-বর্শা। কালো দেহগুলোতে বিধে গেল ইঞ্জেকশনের সুচ, চোখের পলকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওষুধ ঢুকিয়ে দিলো শরীরে।
চমকে গেল পোচাররা। ওরা ভাবলো, অ্যাকো। টান দিয়ে দিয়ে শরীর থেকে খুলে ফেলতে লাগলো ডার্টগুলো। সুচের মাথা থেকে টপটপ করে ঝরছে সাদা তরল। অ্যাকোর রঙ কালচে বাদামী, এটার রঙ সাদা, তারমানে অ্যাকো নয়। আতঙ্ক দূর তো হলোই না, আরও বাড়লো ওদের। ভাবলো, অ্যাকোর চেয়েও খারাপ কোনো বিষ। ভয়েই পড়ে গেল কয়েকজন, মাটিতে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করলো।
অ্যাকোর চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করলো সেরনিল। অবশ করে দিলো। মাংসপেশী। ক্ষণিক আগের শক্তিশালী পাগুলো গেল দুর্বল হয়ে, শরীরের ভার রাখতে পারছে না আর। ভয়ে যারা পড়েছিলো, তারা বেহুশ হলো। যারা দাঁড়িয়ে ছিলো, টলে উঠে ধড়াস ধড়াস করে পড়তে লাগলো কাটা কলা গাছের মতো। আর যারা ডার্ট খেয়ে দৌড় দিয়েছিলো, তারাও বাঁচতে পাড়লো না, হুমড়ি খেয়ে পড়লো এক এক করে। কয়েকজন পড়লো সত্যিকার বিপদে। এলোপাতাড়ি দিশেহারা হয়ে ছোটার সময় মনেই রইলো না, ফাঁদ পাতা আছে। ধরা পড়লো ওই ফাঁদে। ভীষণ দুঃসাহসী কয়েকজন ভাবলো এমনিতেওঁ মরেছি, ওমনিতেও, এগিয়ে এসে বল্লম দিয়ে খোঁচা মেরে তিনজন মাসাইকে আহত করে দিলো বেহুশ হওয়ার আগে।
যেমন শুরু হয়েছিলো তেমনি প্রায় হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল লড়াই। ঘাসের ওপর লুটিয়ে আছে অসংখ্য কালো দেহ। ফাঁদে আটকা পড়েছে যারা, তারাও গোঙাচ্ছে না ব্যথায়, গভীর ঘুমে অচেতন।
তোলো সব কটাকে, ওয়ারডেন আদেশ দিলেন। খাঁচায় ভরো।
পার্কের এক জায়গা থেকে অনেক সময় আরেক জায়গায় জানোয়ার স্থানান্তরের প্রয়োজন পড়ে, তখন ওসব খাঁচা ব্যবহার হয়। এতো বড় খাঁচা আছে, জিরাফকেও ভরে রাখা যায়। পাওয়ারওয়াগনে করে বয়ে নেয়া হয় সেসব খাঁচা। কিশোরের বুদ্ধিতেই কয়েকটা ওয়াগন নিয়ে আসা হয়েছে সঙ্গে করে, একটাতে হাতির খাঁচা। খুশি হয়েই অচেতন দেহগুলোকে বয়ে এনে খাঁচায় ভরতে লাগলো। মাসাইরা।
ছোট জানোয়ারের ফাঁদে যারা ধরা পড়েছে তাদেরকে ছাড়ানো কঠিন হলো না, মুশকিল হলো হাতি আর সিংহের ফাঁদে যারা আটকেছে। পায়ে কেটে বসেছে। ইস্পাতের দাঁত।
ওরকম একটা ফাঁদের কাছে গিয়ে হাত নেড়ে ডাকলেন ওয়ারডেন তিন গোয়েন্দাকে।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা।
আমাদের দুজন রেঞ্জার এরকম ফাঁদেই আটকে মরেছে? ওয়ারডেন। বললেন। বোঝো এখন কারণটা। নিশ্চয় ভেবে অবাক হয়েছে, কেন ওরা নিজেদের ছাড়াতে পারেনি। মানুষের শরীরে দুটো চমৎকার টুলস আছে, হাত।
জানোয়ারের নেই। দেখি তো, ফাঁদ থেকে খোলো তো লোকটাকে।
কিশোর চেষ্টা করে বিফল হলো। রবিন গেলই না। শার্টের হাতা গুটিয়ে ব্যায়াম পুষ্ট পেশল বাহু বের করে বীর-বীক্রমে এগোলো মুসা আমান, ভাবখানা– এটা একটা কাজ হলো নাকি? ফাঁদের দুটো চোয়াল দুই হাতে ধরে টান দিলো। নড়লোও না ওগুলো। জোর বাড়ালো সে, কপালে ঘাম জমলো, চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসবে যেন হাতের পেশী। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ফোঁস করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়লো। খাইছে! সাঙ্ঘাতিক শক্ত!
হ্যাঁ, মাথা দোলালেন টমসন। হাতিও পা ছাড়াতে পারে না। খালি হাতে খোলা যাবে না, যন্ত্র লাগবে।
কিশোর তাকিয়ে আছে ফাঁদ বাঁধার শেকলটার দিকে। দশ ফুট লম্বা লোহার শেকল, এক মাথা ফাঁদের সঙ্গে আটকানো, আরেক মাথা লোহার গজালের সঙ্গে। গজালটা মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়েছে।
কি ভাবছো বুঝতে পারছি, হেসে বললেন ওয়ারডেন। রেঞ্জাররা ওই খুটি টেনে তুললো না কেন, এই তো? তাহলে ফাঁদ নিয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে গাড়িতে উঠতে পারতো। তোমার তো দুটো পা-ই ভালো। যাও, দেখো ওপড়াতে পারো কিনা।
টানতে টানতে নীল হয়ে গেল কিশোরের মুখ। তার সঙ্গে গিয়ে মুসাও হাত লাগালো। দুজনে মিলে টেনেও নাড়তে পারলো না গজালটা। পোঁতা হয়েছে উইয়ের ঢিবিতে। গোলমাল শুনে বিরক্ত হয়েই যেন কি হচ্ছে দেখতে বেরোলো উইয়েরা।
পারবে না, মাথা নাড়লেন টমসন। খামোকা কষ্ট করছে। তিন ফুট লম্বা একেকটা। বড় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বসানো হয়েছে। উইয়ের ঢিবিগুলো দেখতে দেখা যাচ্ছে মাটি, আসলে সিমেন্টের মতো শক্ত। হাতির পায়ে শেকল বেঁধে দিয়ে দেখো, তারও টেনে তুলতে কষ্ট হবে। আর ফাঁদে আটকা থাকলে তো পারেই না, ভীষণ ব্যথা লাগে পায়ে। যাও, সাপ্লাই ভ্যান থেকে শাবল নিয়ে এসো। চাড় মেরে খুলতে হবে।
গিয়ে শাবল আনলো মুসা।
দাঁতের ফাঁকে শাবল ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে চোয়াল দুটো ফাঁক করলেন টমসন। বেচারা লোকটার রক্তাক্ত পা-টা বের করে আনা হলো। মাংস কেটে হাড়ে গিয়ে বসেছিলো দাঁত। তাড়াতাড়ি অ্যানটিসেপটিক আর ব্যাণ্ডেজ এনে, ক্ষত পরিষ্কার করে বেঁধে দিতে লাগলো কিশোর।
.
০৯.
আরি! বেড়ার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। দাড়িওয়ালা কোথায়?,
প্রচণ্ড উত্তেজনায় সিলভারের কথা ভুলে গিয়েছিলো সবাই।
হাঁটু গেড়ে বসে কিশোরের ব্যাণ্ডেজ বাঁধা দেখছিলো মুসা, লাফ দিয়ে উঠে। দাঁড়ালো। চেঁচিয়ে ডাকলো, মুগামবি, কালিমবো, জলদি এসো। সিমবাকে নিয়ে এসো।
আগে আগে ছুটলো ট্র্যাকার মুগামবি, লম্বা ঘাস এড়িয়ে থাকছে যতোটা সম্ভব, যাতে ফাঁদে পা না পড়ে। তার পেছনে রইলো অন্যেরা।
বেড়ার একটা ফাঁক দিয়ে আরেক পাশে চলে এলো। কেউ নেই।
কুঁড়েগুলোতে দেখো, বলেই একটা কুঁড়ের দিকে দৌড় দিলো মুসা।
সব কটা কুঁড়েতে খুঁজে এলো সে আর কালিমবো। ফিরে এসে দেখলো, এক জায়গায় মাটিতে ঝুঁকে কি যেন দেখছে মুগামবি।
মাটিতে পায়ের ছাপের ছড়াছড়ি, পোচারদের নগ্ন পা। পাঁচটা করে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ওগুলোর মাঝে এক সারি ছাপ আছে, যেগুলোর আঙুল নেই।
বুট, মুগামবি বললো। দাড়িওয়ালাটা। বুট পরেছিলো। ধরে ফেলা যাবে।
বুটের ছাপ অনুসরণ করে চললো ট্র্যাকার। বারো-তেরো কদম এগিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। চোখে বিস্ময়। ছাপ নেই আর। আচমকা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে বুটধারী। গাছে চড়লো নাকি?
ওপরে তাকালো মুগামবি। নেই। একটা নিচু ডালও নেই, যেটাতে উঠতে পারবে বুট পরা লোকটা।
মহা শয়তান, বাতাসে থাবা মারলো মুগামবি। বুট খুলে নিয়েছে। কেউ যাতে পিছু নিতে না পারে।
এখানেও পায়ের ছাপ অনেক আছে, বুট পরা একটাও নেই, সব নগ্ন। সিলভারের ছাপ কোনটা এখন আর বোঝার উপায় নেই।
সিমবা! তুড়ি বাজালো মুসা। কুকুরটাকে দিয়ে চেষ্টা করালে কেমন হয়?
ডেকে সিমবাকে সেই জায়গাটায় নিয়ে গেল কালিমবো, বুটের ছাপ যেখান থেকে শুরু হয়েছে। শুকতে বললো। কথা বুঝলো বুদ্ধিমান কুকুরটা। নাক নিচু করে বুটের ছাপ শুকলো কয়েকবার, ওপরে মাথা তুলে গন্ধ নিলো বাতাসে। ছাপ অনুসরণ করে চলে এলো যেখানে বুটের চিহ্ন শেষ হয়েছে। থেমে ওপরের দিকে নাক তুলে আবার গন্ধ শুকলো। মৃদু ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা থেকে।
টমসনও এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, কুকুরটা চালাক বটে। কিন্তু বুট আর। খালি পায়ের ছাপ আলাদা করে চিনতে পারবে না।
দেখুন না কি করে? হেসে বললো কালিমবো।
ফিরে গিয়ে আবার শুরুর জায়গায় বুটের ছাপ শুকলো সিমবা। তারপর আশপাশের অন্য ছাপগুলো.। আশা-নিরাশায় দুলছে মুসার মন। সবই নির্ভর করছে এখন ছাপগুলো নতুন না পুরনো তার ওপর। নতুন হলে চামড়ার গন্ধে ঢাকা পড়ে যাবে লোকটার ঘামের গন্ধ। কিন্তু যদি পুরনো হয়, এই গরমে ঘামে ভিজে গন্ধ হয়ে যাবে জুতোর চামড়া, তীব্র সেই গন্ধ কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারবে না কুকুরের প্রখর ঘ্রাণশক্তিকে।
হলোও তাই। খেঁকিয়ে উঠলো সিমবা। আবার নাক নামিয়ে বুটের ছাপ। শুকলো। তারপর জোরে ঘেউ করে উঠে দৌড়ে এলো বুটের ছাপ যেখানে শেষ হয়েছে তার কাছে। কয়েকটা নগ্ন পায়ের ছাপ শুকলো। একটার কাছে এসে আরেকবার চেঁচিয়ে উঠে দিলো দৌড়। কয়েক পা গিয়ে আবার শুকলো। চললো আবার।
পেয়েছে! বাচ্চা ছেলের মতো হাততালি দিয়ে উঠলো মুসা। পেয়ে গেছে। সে-ও ছুটলো কুকুরটার পেছনে।
কিন্তু লোকটা বোকা নয়। মাসাইদের সঙ্গে কুকুর আছে, নিশ্চয় দেখেছে। কিছু দূর গিয়ে আরেক ফন্দি করেছে ধোকা দেয়ার জন্যে। নিজের রক্তের ওপর পড়ে রয়েছে একটা মরা মোষ। সোজা গিয়ে সেই রক্তে পা ভিজিয়েছে সিলভার। পচা রক্তের গন্ধে ঢাকতে চেয়েছে নিজের গায়ের গন্ধ। মোষটার চারপাশে ঘুরেছে কয়েকবার, যততক্ষণ না পা থেকে রক্ত মুছে গেছে, বালি লেগেছে পায়ে। তারপর অন্য আরও অনেক চাপের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে গেছে। এখন বের করবে কি করে সিমবা?
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ওয়ারডেন।
কিন্তু কালিমবোর বিশ্বাস আছে তার কুকুরের ওপর?
ছাপ চিনতে বেশ দেরি হলো সিমবার। বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা ঝাড়ছে, যেন শিওর নয় সে।
তবে এখন তাকে সাহায্য করতে পারলো আরেক ওস্তাদ। পিছিয়ে গিয়ে সিলভারের খালি পায়ের ছাপ ভালো মতো দেখলো মুগামবি। মাপ নিলো। এগিয়ে এসে রক্তে ভেজা ছাপ মাপলো। বেরিয়ে যাওয়া ছাপগুলো থেকে ঠিক বের করে ফেললো, কোনটা দাড়িওয়ালার ছাপ। সিমবা যে জোড়া বেছে নিয়েছে, ওগুলোই।
গুড, বললো মুগামবি। আঙুলগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা চেপে রয়েছে…বুট…যা সিমবা, এগো।
চেয়ে রয়েছে…বুট বলে কি বোঝালো? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
বুটের জন্যে ওরকম হয়েছে বললো, হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলেন টমসন। সব সময় কেউ শক্ত বুট পরে থাকলে পায়ের আঙুল পাশাপাশি চেপে মাঝের ফাঁক কমে যায়। আর যারা সব সময় খালি পায়ে হাঁটে তাদের আঙুল ছড়িয়ে যায়, বড় হয়ে যায় ফাঁক।
কিছু দূর গিয়ে আবার নতুন কায়দা করেছে সিলভার। মোড় নিয়ে এগিয়ে সোজা নেমে গেছে টিসাভো নদীতে।
হতাশ হয়ে গর্জে উঠলো সিমবা। অ্যালসেশিয়ানের ডাকের সঙ্গে মিল নেই, একেবারে বুনো কুকুরের চিৎকার। আফ্রিকার তৃণভূমিতে, জঙ্গলে ওই ডাক অহরহ শোনা যায়।
আর হবে না, মুগামবিও হাল ছেড়ে দিলো। সরাসরি ওপারে গিয়ে নিশ্চয় ওঠেনি। হয় উজানে গেছে, নয়ত ভাটিতে। সাঁতরে ভাটিতে যাওয়ারই বেশি সুবিধে। অনেক দূর গিয়ে ওপারে কোনো ঝোপের ভেতর দিয়ে উঠে গেছে। হাজার খুঁজলেও পাওয়া যাবে না আর। আমি শিওর, ঘাসের ওপর উঠেছে সে। আর যা গরম। ঘাসের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেছে পানি। ব্যাটা গেছে। অনেকক্ষণ হয়েছে। আমরা যেতে যেতে ছাপের কোনো চিহ্নই থাকবে না।
.
১০.
সাতচল্লিশ জন. ঘুমন্ত পোচারকে মরা মাছের মতো গাদাগাদি করে ভরা হলো। হাতির খাঁচার মধ্যে। অন্তত আরও ঘন্টা চারেক ঘুমিয়ে থাকবে ওরা, একশো তিরিশ মাইল পেরিয়ে মোমবাসা যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট সময়। ওখানে জেলখানায় ঘুম ভাঙবে ওদের।
জেল-ওয়ারডেনের কাছে একটা নোট লিখে দিলেন টমসনঃ পোচিঙের অপরাধে সাতচল্লিশ জন পোচারকে ধরে পাঠালাম, বিচারের জন্যে। একজন রেঞ্জারের হাতে নোটটা দিয়ে ওয়াগনের সঙ্গে যেতে বললেন।
অন্যদের থাকতে হবে, অনেক কাজ পড়ে আছে। শখানেকের বেশি। জানোয়ার আটকা পড়ে আছে ফাঁদে, যেগুলো এখনও মরেনি, ছাড়াতে হবে।
মরা কিংবা মুমূর্ষ জানোয়ারগুলোকে মাছির মতো হেঁকে ধরেছে শকুনের দল। মানুষ কাছে যেতেই উড়ে গেল। হায়েনা আর শেয়ালের পালও সরে গেল, একেবারে গেল না অবশ্য, মানুষ চলে গেলেই আবার আসবে।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে কিছু কিছু জানোয়ার। তাতে গলায় আরও চেপে বসছে তারের ফাঁস, ধারালো ছুরির মতো চামড়া কেটে ঢুকে যাচ্ছে মাংসের গভীরে। রক্ত ঝরছে। এভাবে বেশিক্ষণ টানাটানি করতে থাকলে আপনা-আপনি। জবাই হয়ে যাবে।
বাঁচার সম্ভাবনা আছে এমন কিছু জীবকে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ফাঁস-মুক্ত করলো মাসাইরা। যেগুলোর জখম কম, ছাড়া পেয়েই ছুটে পালালো। বেশি জখমিগুলোকে লরিতে তুলে নেয়া হলো, হাসপাতালে নিয়ে যাবে।
প্রতিটি ফাঁস কেটে দেয়া হলো, নষ্ট করা হলো মাটিতে পেতে রাখা ফাঁদ।
কুঁড়েগুলোর কি হবে? কিশোর জিজ্ঞেস.করলো।
বেড়া, কুঁড়ে, সব পুড়িয়ে দেবো, বললেন ওয়ারডেন। এ আগুন লাগানো হলো বেড়ায়। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো এক মাইল লম্বা শুকনো কাঁটালতা। জিনিসপত্র সব বের করে এরপর কুঁড়েগুলোতেও আগুন, লাগানো হলো। মনে হচ্ছে যেন দাবানল লেগেছে।
জিনিসগুলো আলাদা আলাদা জায়গায় জড়ো করা হয়েছে।
জীবনে দেখিনি এরকম কাণ্ড! আনমনে বিড়বিড় করতে করতে মাথা নাড়লো। রবিন। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে প্রায় তিনশো হাতির পায়ের দিকে। ফুটখানেক ওপর থেকে কেটে নেয়া হয়েছে, মাঝের হাড়মাংস সব ফেলে দিয়ে ওয়েইস্ট-পেপার বাস্কেট বানানো হবে।
আরেক জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে অসংখ্য চিতাবাঘের মাথা। প্রতিটি মাথা কয়েক হাজার ডলারে বিকোবে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে সাফারিতে আসে। লোকে। তাদের মাঝে অনেক ধনী মানুষ থাকে, যার চিতাবাঘ শিকার করে মাথা। নিয়ে গিয়ে নিজের বাড়ির ড্রইংরুমে সাজাতে চায়। চিতাবাঘ নিশাচর জীব, অসাধারণ ধূর্ত, দক্ষ শিকারীর পক্ষেও শিকার করা কঠিন। আনাড়ি টুরিস্ট সেটা পারে না। কয়েক রাত গাছের ডালে কিংবা মাচায় কাটিয়েই বিরক্ত হয়ে যায়। শেষে সহজ কাজটাই করে। সোজা গিয়ে নাইরোবি থেকে একটা মাথা কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরে, হয়তো বাহাদুরি দেখিয়ে বলে আমি মেরেছি। কে দেখতে আসছে, সে সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে?
চিতাবাঘের মাথার পাশে জমানো হয়েছে চিতার চামড়া। সোফার কাভার হবে হয়তো ওগুলো দিয়ে, কিংবা ডিভানের পায়ের কাছের কার্পেট। শান্ত, ন্দ্র, মিষ্টি যে মহিলাটি ঘর সাজাবেন ওগুলো দিয়ে, এয়ারগান দিয়ে শিকার করা চড়ুই পাখি ছেলের হাতে দেখলে শিউরে ওঠেন যিনি, মুহূর্তের জন্যেও ভাববেন না, শুধু তাঁর ড্রইংরুমের শোভা বাড়ানোর জন্যেই অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে কতগুলো অপূর্ব সুন্দর জানোয়ারকে।
ওগুলো কি? কয়েকটা কাঠের পাত্রে রাখা অদ্ভুত কিছু বাঁকা বাঁকা চুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা।
মনে হয় হাতির চোখের পাপড়ি, জবাব দিলো রবিন।
দূর, কি বলো? ওসব দিয়ে কি করবে?
করবে বলেই তো নিয়েছে।
কি হয়?
আসলে হয়তো হয় না কিছুই, সুযোগ পেয়ে বিদ্যে ঝাড়তে শুরু করলো। বইয়ের পোকা শ্রীমান রবিন মিলফোর্ড, ওরফে চলমান জ্ঞানকোষ। সব কুসংস্কার। কিন্তু সিঙ্গাপুরে এর দারুণ চাহিদা। কুসংস্কারে বিশ্বাসী লোকেরা মনে করে, যার কাছে যতোটা হাতির চোখে পাপড়ি থাকবে, সে ততোটা ছেলেপুলের বাপ হবে। নানারকম অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীও নাকি ওই চুল। বইয়ে পড়েছি, একজন পিগমী রাজা নাকি বায়ান্ন শো পাউণ্ড দামের হাতির দাঁত দিয়ে ফেলেছিলো শুধু একটি মাত্র পাপড়ি জোগাড়ের জন্যে। অ্যারাবিয়ানদের অনেকের কাছেও এর যথেষ্ট কদর। তাদের বিশ্বাস, ওই পাপড়ি দিয়ে মালা বানিয়ে গলায় ঝোলালে রাইফেলের গুলি লাগে না শরীরে, কাছে এসেও পাশ কাটিয়ে আরেক দিকে চলে যায়।
বাহ, দারুণ বর্ম তো!
মালমশলা তো হাতের কাছেই আছে, হেসে বললেন ওয়ারডেন। বানিয়ে ঝুলিয়ে ফেলো না একটা। তীর লাগবে না আর শরীরে।
ওদের মতো বলদ নাকি আমি? মুখ বাঁকালো মুসা।
তার কথার ধরনে হা-হা করে হেসে ফেললেন টমসন।
কতগুলো গণ্ডারের শিং দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা, রবিন, এগুলো দিয়ে কি হয়? পুড়িয়ে গুঁড়ো করে ফেলে গণ্ডারের মতো শিং গজায় নাকি ব্যাটাদের মাথায়? শত্রুকে গুঁতোতে পারে?
ওর কথায় ওয়ারডেন তো হাসছেনই, কিশোর আর রবিনও হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতেই রবিন বললো, এগুলোর বেশি ভক্ত চীনারা। গুড়ো করে। চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খায়।
কেন, পাগলামি সারানোর জন্যে?
না, শক্তিশালী হওয়ার জন্যে। গায়ে নাকি গণ্ডারের জোর আসে, বুকে সিংহের সাহস।
হয়?
মনের জোর বাড়ে হয়তো। মানসিক ব্যাপার। কিন্তু ওদের ওই বিশ্বাসের কারণে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে গণ্ডারের। ইনডিয়ান গণ্ডার তো শেষই করে দিয়েছে। চীনারা, এ-হারে মারা পড়তে থাকলে আফ্রিকান গণ্ডারও শীঘ্রি খতম হয়ে যাবে। শেষে চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও দেখা যাবে না ওদের।
পুড়ে ছাই হলো বেড়া আর ঘাসের কুঁড়েগুলো।
ট্রাকে তোলা হলো সস্ত হাতির দাঁত, লেজ, চোখের পাপড়ি, পায়ের পাতা, জলহস্তীর দাঁত আর চর্বি, জিরাফের লেজ, পেছনের পায়ের শিরা, সিংহের মাথা আর চর্বি, চিতাবাঘের মাথা, চিতার চামড়া, অ্যানটিলোপ আর গ্যাজেল হরিণের শিং, কুমির আর অজগরের চামড়া, ইগ্রেট, ফ্ল্যামিংগো, উটপাখি আর লম্বা-গলা। ধবল-বকের পালক; আরও নানা রকম জানোয়ারের শরীরের বিভিন্ন অংশ। তারের ফাঁস আর নষ্ট ফাঁদগুলোও তুলে নেয়া হলো। নইলে অন্য পোচাররা এসে ওগুলো আবার কাজে লাগাবে।
কি হবে ওসব দিয়ে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। বিক্রি করবেন?
না, বললেন ওয়ারডেন। নিরীহ পশুর রক্তে ভেজা ওই টাকা আমাদের চাই না। তার চেয়ে নিয়ে গিয়ে কোনো মিউজিয়মে রাখার ব্যবস্থা করবো। লোকে দেখবে। পোচারদের ওপর রাগ হবে তাদের, পোচিঙের বিরুদ্ধে তৈরি হবে শক্তিশালী জনমত। প্রতিবাদের ঝড় উঠবে।
লজে ফিরে এলো গাড়ির মিছিল। ওয়ারডেনের ব্যাণ্ডায় ঢুকলেন টমসন, সাথে তিন গোয়েন্দা। হাসিমুখে তাদের স্বাগত জানালেন জজ নির্মল পাণ্ডা। মুখে। মোলায়েম হাসি।
তুমি! চেঁচিয়ে উঠলেন টমসন। দেখা হয়ে ভালোই হলো। নাইরোবিতে ঠিকঠাক মতো গিয়েছিলে তো?
হ্যাঁ। মোমবাসায় ফিরে যাচ্ছি। ভাবলাম, দেখেই যাই পোচারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কতোটা লাভ হলো।
লাভ মানে! বললে বিশ্বাস করবে না, সাতচল্লিশ জনকে ধরে পাঠিয়েছি মোমবাসা জেলে। কাল সকালে হাজির করবে তোমার কোর্টে।
তাই নাকি, তাই নাকি? ভারি আনন্দের কথা, জজের কণ্ঠ শুনে রবিনের মনে হলো, আনন্দে ঘড়ঘড় করছে যেন বেড়াল। হাতে পেয়ে নিই আগে, উচিত শিক্ষা। দেবব ব্যাটাদের। পোচিঙের নাম ভুলিয়ে ছাড়বো। সর্দারটাকে ধরেছো?
সিলভার? নাহ। পালিয়ে গেল।
হায় হায়, করলে কি? আসল বদমাশটাকেই ধরতে পারলে না। গিয়ে তো। আরেক জায়গায় দল বানাবে, আর জানোয়ার মারা শুরু করবে। পালালো। কিভাবে?
ভীষণ চালাক, ব্যাটা। দলের লোকদের আগে বাড়তে বলে নিজে রইলো। পেছনে। দলের লোক যখন হেরে গেল, আমরা ওদেরকে ধরায় ব্যস্ত, সেই সুযোগে পালালো। কুকুর নিয়ে অনেক খুঁজলাম। পেলাম না। নদীতে নেমে গায়েব হয়ে গেছে।
কুকুরটার দিকে তাকালেন জজ। বাহু, ভারি সুন্দর কুকুর। একেবারে বাঘের বাচ্চা। এটাকে ফাঁকি দিয়েছে সিলভার? হাত বাড়িয়ে মাথায় চাপড় দিতে গেলেন তিনি।
অপরিচিত লোককে পছন্দ করতে পারলো না সিমবা। মৃদু ঘড়ঘড় করে। পিছিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে গেল ঘাড়ের রোম। চোখ দেখে মনে হলো এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাড়াতাড়ি ওর কলার চেপে ধরলো মুসা। কি জানি কেন, শুরু থেকেই তাকে পছন্দ করে ফেলেছে সিমবা। কালিমবোর মতোই মুসার কথাও শোনে।
আরও দুচারটে কথা বলে বিদায় নিয়ে বেরোলেন জজ। তাকে এগিয়ে দিতে চললেন ওয়ারডেন, পিছু নিলো তিন গোয়েন্দা।
তীক্ষ্ণ চোখে জজ সাহেবের গাড়িটা দেখছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। আকাশ থেকেই দেখেছে নাইরোবি যাওয়ার কাঁচা সড়কটা লাল মাটিতে ঢাকা। গাড়ি চললেই লাল ধুলো ওড়ে। জমার কথা লাল ধুলো, অথচ তার গাড়িটাতে পড়ে আছে সাদা ধুলোর হালকা আস্তরণ। বলেই ফেললো,গাড়িটা পরিষ্কার পরিষ্কার লাগছে? লাল ধুলোয় ঢেকে থাকার কথা।
অবাক হলেন জজ। সামান্য ওপরে উঠে গেল একটা ভুরু। তারপর হেসে ফেললেন। ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম তোমরা গোয়েন্দা। তা বলেছো ঠিকই, ওই রাস্তায় একবার গেলেই লালে লাল। ফেরার সময় এতো ময়লা হয়ে গেল, শেষে পরিষ্কার না করিয়ে আর পারলাম না। পার্কে ঢোকার মুখেই পেট্রোল স্টেশনটা, ওখানে ওয়াশ করিয়েছি, আবার হাসলেন। আর কোনো প্রশ্ন?
না, লজ্জিত মনে হলো গোয়েন্দাপ্রধানকে। অভিনয় কিনা বোঝা গেল না।
জজ সাহেবও মাইও করেননি তার কথায়, অন্তত তার চেহারা দেখে তা-ই মনে হলো। ওয়ারডেনকে বললেন, চলি, ডেভিড। সাবধানে থাকবে, ওই পোচার হারামজাদাগুলোর কথা কিছুই বলা যায় না। কখন আবার লুকিয়ে-চুরিয়ে তীর মেরে বসে, তিন কিশোরকে বললেন। গোয়েন্দারা, আশা করি সিলভারকে ধরে ফেলতে পারবে। চলি, গুড বাই।
১১.
কি ভাবছো, কিশোর? পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করলেন ওয়ারডেন।
খাচ্ছে না কিশোর, বসে বসে ভাবছে। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে কফি। মুসা আর। রবিনের সঙ্গে এতোক্ষণ কথা বলেছেন তিনি, তাদের আলোচনায় যোগ দেয়নি সে।
মুখ তুলে হাসলো কিশোর। অ্যাঁ?
বলবে আমাকে?
দ্বিধা করলো কিশোর। ইয়ে…আপনার বন্ধু…জজ নির্মল পাণ্ডা। খুব বিশ্বাস করেন তাকে, না?
করি, স্বীকার করলেন টমসন। যখন-তখন অযাচিত ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার অনেক উপকার করেছে। এই তো, গত পরশুই তো আমার প্রাণ বাঁচালো। তোমরা দেখেছো।
উনি…, বলতে গিয়ে কিশোরের চোখের দিকে চেয়ে থেমে গেল রবিন। আরেকটু হলেই বলে ফেলেছিলো বাঁচাননি, বরং আমরা না থাকলে খুন। করতেন।
আর, একটা ব্যাপারে আমাদের খুব মিল, বলে চললেন ওয়ারডেন। পোচার। আমিও ওদের দেখতে পারি না, সে-ও পারে না। ওকে না পেলে যে কি করতাম…আমি ওদেরকে ধরতে পারি, কিন্তু শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। শাস্তি দেয় নির্মল। সে ওদেরকে ফাইন করে, জেলে পাঠায়। পোচিঙের বিরুদ্ধে আইন খুব কড়া। কঠিন শাস্তি হয়, অনেক দিন জেল।
শাস্তি দেন তো ঠিকমতো?
বলে তো দেয়। আর বলে যখন, নিশ্চয়ই দেয়।
বিচারের সময় কখনও কোর্টে ছিলেন?
না, এতো বেশি ব্যস্ত থাকি, যেতে পারিনি। তবে আমার যাওয়ার দরকার নেই। আমার কাজ আমি করি, ওর কাজ ও।
ডিম ভাজার প্লেটটা টেনে নিলো কিশোর। নীরবে খেলো কয়েক মিনিট। হঠাৎ বললো, ভেরি ইনটারেস্টিং! জজ সাহেবের কথা বলছি, ভারি মজার মানুষ। তার কাজ দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। আজ অনেক লোকের বিচার করবেন। গিয়ে দেখতে পারবো?
আমি যেতে পারবো না, মাথা নাড়লেন টমসন। তবে ইচ্ছে করলে তোমরা যেতে পারো। কিন্তু যাবে কিভাবে? যেতে-আসতে প্রায় আড়াইশো মাইল, পথও খুব খারাপ। এখানে আমি ছাড়া এখন আর কেউ নেই যে গাড়ি চালাতে-জানে, নিয়ে যাবে, তোমাদেরকে।…একটা কাজ করলে অবশ্য পারো। মুসা বেশ ভালো। পাইলট, সেদিন স্টর্কটাকে যেভাবে সামলেছে শুনলাম। প্লেন নিয়ে যেতে পারো। বসো, আসছি।
ডেস্ক থেকে একটা ম্যাপ বের করে নিয়ে এলেন তিনি। এই যে মোমবাসা..আর এই এখানে আমাদের লজ। জানো নিশ্চয়, শহরটা গড়ে উঠেছে। একটা দ্বীপের ওপর। মেন ল্যাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কজওয়ের সাহায্যে। এই এখানটায় হলো ল্যাণ্ডিংফীল্ড, পেন্সিল দিয়ে একটা গোল দাগ দিলেন টমসন। প্লেন রেখে ট্যাক্সি নিয়ে আদালতে চলে যেও এই এখানটায়। আদালত, আরেকটা চিহ্ন আঁকলেন তিনি।
লাইসেন্স লাগবে না? রবিন জিজ্ঞেস করলো। মুসার তো প্লেন চালানোর লাইসেন্স নেই।
বলে দেবো শিক্ষানবীস। একটা চিঠি লিখে দেবো, এয়ারপোর্টের ম্যানেজারকে দেখিও, অসুবিধে হবে না, মুসার দিকে ফিরলেন ওয়ারডেন। চলো, আরও প্র্যাকটিস করে নাও।
এয়ারস্ট্রিপে এসে প্রথমে বিমানটায় তেল ভরলেন তিনি। দুই ডানার ট্যাঙ্ক তো বোঝাই করলেনই, পেছনের ইমারজেন্সি ট্যাঙ্কও ভরে দিলেন। বিমানের ভেতরের একটা হ্যাঁণ্ডপাম্প দেখালেন তিন গোয়েন্দাকে, প্রয়োজন হলে ওই পাম্পের সাহায্যে পেছনের ট্যাঙ্ক থেকে ডানায় তেল সরিয়ে আনা যায়।
ককপিটের যন্ত্রপাতিতে লেখা জার্মান শব্দগুলো পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দিলেন। কোনটা কোন যন্ত্র, কিভাবে কাজ করে।
যাও, উড়ে এসো খানিকক্ষণ, মুসাকে বললেন তিনি। ওঠা আর নামাটাই আসল, ভালোমতো প্র্যাকটিস দরকার।
পাইলটের সীটে উঠে বসলো মুসা,। রবিন আর কিশোরকে মানা করলো, তোমরা এখন না। আগে আমি দেখে আসি উড়ে। কেন, আমাদের নিয়ে পোচার প্র্যাকটিস হবে না? রবিন বললো।
হবে, ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসলো মুসা। তবে, অ্যাক্সিডেন্ট করে মরলে আমি বরং একাই মরি। তিনজন একসাথে মরে লাভ কি? কি বলো, কিশোর মিয়া? তুমি যেমন একা বুদ্ধির প্র্যাকটিস করো, আমিও এখন ফ্লাইং প্র্যাকটিস করি, নাকি?
সুযোগ পেয়ে খুব একহাত নিচ্ছে তাকে মুসা, বুঝে মুখ গোমড়া করে সরে এলো কিশোর। রবিন তর্ক করতে লাগলো।
মুসা ঠিকই বলেছে, পক্ষ নিলেন ওয়ারডেন। মরবে না ও, হাসলেন তিনি। অপরিচিত একটা মেশিনকে যেভাবে সামলেছে, শুনে অবাকই লেগেছে আমার। একেবারে জাত-বৈমানিক। ভবিষ্যতে ভালো পাইলট হবে…।
তাহলে আর আমাদের যেতে অসুবিধে কি? ফস করে বললো রবিন।
তবু, তার কথা কানে তুললেন না টমসন। ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। অ্যাক্সিডেন্টের কথা কিছু বলা যায় না, কিশোর আর রবিনের দিকে চেয়ে আবার হাসলেন। একজন জাত-বৈমানিকের সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা ভেঙে অকেজো হয়ে থাকুক একজন জাত-গোয়েন্দা আর একজন জাত-গবেষক, তা-ও চাই না।
হাসি ফুটলো গোয়েন্দাপ্রধান আর নথি-গবেষকের মুখে।
তাহলে আসি, হাত তুলে বিদায়ী ভঙ্গিতে সালাম জানালো মুসা, করুণ করে। তোলার চেষ্টা করলো মুখটাকে। কিন্তু অভিনেতা নয় সে, হাসি ঢাকতে পারলো না। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবো। যদি ভুলভাল বোতাম টিপে না বসি।
উইণ্ড-সকের দিকে তাকালো সে। সামনের বড় বড় গাছগুলোর দিকে চেয়ে। দমে গেল। সময় মতো উড়াল দিতে পারবে ওগুলোর মাথার ওপর দিয়ে! পারবে, পারবে, নিজেকে বোঝালো সে। মন শক্ত করে স্টার্ট দিলো এঞ্জিন। বুস্টার পাম্প পরীক্ষা করে দেখলো। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলো অয়েল টেম্পারেচার বাড়ার জন্যে।
থ্রটল দিতেই ট্যাক্সিইং করে চললো প্লেন। গতি বাড়তে চাইছে না। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে মুসা, যেন তাতেই শক্তি পাবে এঞ্জিন। আফসোস করছে, ইস, ঘাসের না হয়ে যদি অ্যাসফল্টে বাঁধানো হতো স্ট্রিপটা! দুলছে প্লেন, ঝাঁকুনি খাচ্ছে, তবে গতি বাড়ছে দ্রুত।
কন্ট্রোলে নড়াচড়া করছে মুসার হাত। ঘাসের ওপর ভেসে উঠলো প্লেন।
তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে বড় বড় গাছগুলো। আড়াআড়ি বইছে বাতাস, ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছে ডানে। প্লেনটা ছোট, ডানার দৈর্ঘ্য মাত্র উনচল্লিশ ফুট, অথচ এটার তুলনায়ও এয়ারস্ট্রিপটা সরু। প্লেন একটু এদিক ওদিক সরলেই বিপদ। লেগে যাবে গাছের সঙ্গে।
শেষ মুহূর্তে ঝটকা দিয়ে নাক অনেকখানি উঁচু করে ফেললো বিমান। উড়ে বেরিয়ে গেল গাছের মাথার সামান্য ওপর দিয়ে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো কিশোর বৈমানিক। আনমনেই হাসলো দাঁত বের করে। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো স্নায়ু।
গাছপালার ওপরে কিছুক্ষণ চক্কর দিয়ে বেড়ালো মুসা। শাঁ করে উড়ে গেল দুই বন্ধু আর ওয়ারডেনের মাথার ওপর দিয়ে। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওপর দিকে। হাত নাড়লো সে।
হয়ে গেছে। ওড়াটা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। এবার নিরাপদে নামতে পারলেই, ব্যস। পরশু জানতো না স্টর্কের ব্রেক কোথায়, আজ জানে। গাছ পেরিয়ে এসে নাক নামিয়ে দিলো বিমানের। ঝরা পাতার মতো যেন ঝরে পড়তে লাগলো বিমানটা, অন্তত তার তা-ই মনে হলো। ঘাস ছুঁলো চাকা। ব্রেক চাপলো সে।
ঝাঁকুনি এড়াতে পারলো না। এই নিয়ে যতোবার ল্যাণ্ড করেছে সে, যতো প্লেন, কোনোটাই মসৃণ ভাবে নামতে পারেনি। তার মানে ওই কাজটাই বেশি কঠিন। দক্ষ পাইলটের বাহাদুরিই ওখানটায়।
ট্যাক্সিইং করে আগের জায়গায় এসে থামলো বিমান। বাবল খুলে বেরিয়ে এলো মুসা।
চমৎকার! প্রশংসা করলেন টমসন। সত্যি, খুব ভালো উড়তে পারবে তুমি।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।
মোমবাসায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে প্লেনে চড়লো তিন গোয়েন্দা। এবার আর বিমান ওড়াতে কোনো অসুবিধে হলো না মুসার। ছহাজার ফুট ওপর দিয়ে টিসাভো নদী বরাবর এগিয়ে চললো পুবমুখো।
টিসাভো রেল স্টেশন পেরিয়ে ডানে মোড় নিলো। ম্যাপ দেখে দেখে বলে দিচ্ছে কিশোর, কোন দিকে যেতে হবে। নিচে এক পাশে লাল সড়ক, আরেক পাশে রেল লাইন।
এই সেই জায়গা, জ্ঞানকোষের পাতা খুললো যেন রবিন। অনেক রক্ত লেগে আছে ওই রেললাইনে। অনেক বছর আগের কথা। খবরের কাগজের পাতা খুললেই নাকি তখন দেখা যেতো সেই রোমাঞ্চকর হেডলাইনঃ আবার আঘাত হেনেছে টিসাভোর মানুষখেকো! ভয়ানক কতগুলো সিংহ মানুষখেকো হয়ে উঠেছিলো, রোজই ধরে নিয়ে যেতে রেললাইনের শ্রমিকদের। ওগুলোর যন্ত্রণায় রাতে ঘরেও থাকতে পারতো না শ্রমিকরা। বেড়া ভেঙে ঢুকে ধরে নিয়ে যেতো ভয়াবহ সিংহের দল। শেষে…
বাঁয়ে গ্যালানা নদীর চকচকে রূপালী রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল রবিন। চোখ। বড় বড় করে দেখছে। সবুজ চাঁদরের ওপর অবহেলায় আঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে থাকা একটা ফিতে যেন। সেই ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে নদীটা, জানে সে। উত্তরে শত শত মাইল জুড়ে বিছিয়ে রয়েছে টিসাভো পার্কের বুনো প্রান্তর, মাঝে মাঝে ঠেলে উঠেছে লাল পাহাড়।
চোখে পড়লো লুগার্ডস ফল। জলপ্রপাতের নিচে যেন টগবগ করে ফুটছে পানি, পুরু হয়ে জমেছে সাদা ফেনা, অপরূপ লাগছে সকালের আলোয়। প্রপাতের পানি জমে এক জায়গায় একটা পুকুরমতো সৃষ্টি হয়েছে, তার পাড়ে ভিড় করেছে। হাতি, গণ্ডার, জিরাফ। আশপাশে ছোট ছোট আরও অনেক ডোবা আছে, ওগুলোর পাড়ে নানারকম জন্তুজানোয়ারের ভিড়, পানি খেতে এসেছে। পাশের সবুজ তৃণভূমিতে চরছে মোষ, জেব্রা আর ওয়াইল্ডবীস্টের দল। ঝোপের কিনারে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখা গেল একটা সিংহ পরিবারকে, শিকার ধরবে বোঝা যাচ্ছে। চিতাবাঘ একটাও চোখে পড়লো না। নিশাচর জীব ওরা, রাতে বেরিয়ে শিকার করে, দিনে ঘুমিয়ে থাকে পাহাড়ের গুহায়, কিংবা গভীর বনের অন্ধকারে।
এক গুচ্ছ গাছের ভেতর থেকে হালকা ধোয়া উঠতে দেখা গেল।
পোচারদের ক্যাম্প? কিশোর বললো।
দেখো দেখো, ওই যে ট্র্যাপ-লাইন! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। বেড়া বানিয়ে ফাঁদ পেতেছে পোচাররা, সেদিকে তাকিয়ে আছে সে। খাইছে। পাঁচ মাইলের কম হবে না।
জোরে জোরে হিসেব শুরু করলো কিশোর, তারমানে ছাব্বিশ হাজার ফুট। প্রতি পাঁচ ফুট পর পর যদি একটা করে ফাঁদ পাতা হয়, তাহলে কম করে হলেও পাঁচশো ফাঁদ। এর অর্ধেক ফাঁদেও যদি জানোয়ার ধরা পড়ে…সর্বনাশ…! থেমে গেল সে।
অর্ধেক হবে কেন? রবিন বললো। কাল যেটা নষ্ট করলাম আমরা, কোনো ফাঁকই বাদ ছিলো না। প্রত্যেকটাতে জানোয়ার পড়েছিলো। প্রতি হপ্তায় একবার করে ফাঁদ পরিষ্কার করে নতুন করে পাতে ব্যাটারা। তারমানে মাসে দুহাজার! মাহ, আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা!
আর মনে রেখো, কিশোর বললো। বেড়া এই একটা নয়। এর চেয়ে অনেক বড় বড় ফাঁদ পাতা রয়েছে পূর্ব আফ্রিকার নানান জায়গায়…ওয়ারডেন কি বললেন, শোনোনি?
সহজ পথ। ম্যাপ দেখার প্রয়োজনই পড়ছে না। রেলপথ, সড়কপথ দুটোই গেছে মোমবাসায়। ওগুলো ধরে উড়লেই হলো।
অবশেষে সাগর চোখে পড়লো। ভারত মহাসাগরের মাঝে যেন মূল্যবান ঝকঝকে পাথরের মতো ফুটে রয়েছে প্রবাল দীপগুলো, সব চেয়ে বড়টার নাম মোমবাসা।
শহরের আট মাইল দূরে এয়ারফীল্ড। প্লেন থেকে নেমে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করলো তিন গোয়েন্দা। টমসনের চিঠি দেখালো।
এয়ারফীল্ড থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে আদালতে রওনা হলো ওরা।
কি জানি কি মনে হলো, বিচারকক্ষে ঢোকার আগে ডাবলডোরের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকালো কিশোর।
ঘরের শেষ মাথায়, উঁচু মঞ্চের ওপর ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন জজ নির্মল পাণ্ডা। তাকে এখন আর ছোট লাগছে না। পরনের কালো আলখেল্লা আভিজাত্য এনেছে। তার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে সাতচল্লিশ জন পোচারকে। ঘরের। বাকি অংশে সারি সারি চেয়ারে বসে আছে অনেক দর্শক। কোনো জুরি নেই, বাদী পক্ষের উকিল নেই, আসামী পক্ষেরও না। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এখানে। একজন লোক, জজ সাহেব। বাদী পক্ষ সব অসহায় জানোয়ার, তাদের হয়ে কে আর ওকালতি করবে? :
জজ যেন আমাদের দেখতে না পান, ফিসফিসিয়ে বন্ধুদের বললো গোয়েন্দাপ্রাধান। মাথা নিচু রেখে চট করে ঢুকে পড়বে। ও-কে?
নীরবে ঢুকে গেল তিন গোয়েন্দা। চোখের পলকে মিশে গেল চেয়ারের পেছনে দাঁড়ানো জনতার ভিড়ে।
পোচারদের ভাষা বোঝেন না বোধহয় জজ। একজন দোভাষী রেখেছেন। জজের প্রশ্নের জবাবে একজন পোচার যা বললো, সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে। জানালো দোভাষী, ও বলছে, খুব গরীব লোক। আট ছেলেমেয়ে। আরও চারজন আসছে।
চারজন আসছে।
হ্যাঁ। ওর চার স্ত্রী।
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন জজ। ব্যাটা বুঝতে পারছে, আমি ওকে দশ বছরের জেল দিতে পারি?
পারছে।
বেশ, ভুল যখন বুঝতে পারছে, অনুশোচনা হচ্ছে, মাপ করে দেয়া গেল। তাকে। যোলোজনের ভরণ-পোষণ করতেই ব্যাটার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। জ্বালিয়ে খাক করে ফেলবে তাকে চার স্ত্রী মিলে। জেলের চেয়ে সেটা বড় শাস্তি।
হেসে উঠলো জনতা। ঠিকই বলেছেন জজ, রসিক লোক।
কেস ডিসমিসড, রায় দিলেন বিচারক।
তাঁর এই বদান্যতায় সবাই খুশি হতে পারলো না। কিশোরের পাশে দাঁড়ানো এক আফ্রিকান তরুণ নিচু কণ্ঠে বিড়বিড় করলো, এভাবে পোচিং বন্ধ করতে পারবে নাকি!
মাথা নাড়লো কিশোর, লোকটার সঙ্গে একমত। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এতো কষ্ট করে লোকগুলোকে ধরা হলো এতো সহজে ছেড়ে দেয়ার জন্যে।
আরেকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন জজ, তুমি জানো না, জানোয়ার মারা অন্যায়?
না, দোভাষীর মুখে জবাব দিলো লোকটা। আমার গায়ের লোকেরা সব সময়ই জানোয়ার মারে, না হলে খাবে কি? যুগ যুগ ধরে শিকার চলে আসছে। আমাদের সমাজে, এটা আমাদের প্রথা। আমাদের বাবারা শিকার করেছে, তাদের বাবারা করেছে, তাদের বাবারা করেছে, তাদের বাবারা করেছে, তাদের বাবারা…
আরে থামো, থামো, হাত তুললেন জজ। যাই হোক; ঠিকই বলেছো তুমি। যুগ যুগ ধরে যে নিয়ম তোমার রক্তে মিশে আছে, সেটা আর ভাঙবে কি করে? কেস ডিসমিসড!
পরের লোকটা আরেক কৈফিয়ত দিলো। বললো, আমি খুব ভালো মানুষ, মন নরম। জানোয়ার মারতে একটুও ভাল্লাগে না আমার। কিন্তু সিলভার বাধ্য করে, না মেরে কি করবো?
বিষণ্ণ হয়ে গেল জজের চেহারা। মাথা নেড়ে সহানুভূতি জানিয়ে বললেন, তাই তো, কি করবে? ওরকম একটা খুনীর বিরুদ্ধে-নিজের ইচ্ছেয় সত্যি মারো না তো?
না।
সিলভারটা একটা আস্ত শয়তান। ওকে নিশ্চয় খুব ভয় করো?
আমরা সবাই করি।
গুড। মানে…, চট করে জনতার দিকে তাকালেন জজ। তুমি নিজের ইচ্ছেয় করো না তো, সে জন্যে গুড বললাম। যে অপরাধ মন থেকে করোনি, সেটার শাস্তি দিই কি করে? আর কোনদিন করো না। কেস ডিসমিসড।
পরের লোকটা কেন জানোয়ার মারে, জিজ্ঞেস করলে জানালো, তার কিছু ছাগল আছে। মেরে শেষ করে বুনো জানোয়ারে। ছাগল বাঁচাতেই জানোয়ার মারে সে।
কি জানোয়ার মারো?
এই গণ্ডার, জিরাফ, হাতি, জলহস্তী, জেব্রা, হরিণ…।
তাই নাকি? তাহলে আর কি শাস্তি দিই তোমাকে? নিজের ছাগল বাঁচাতে যেকেউই জানোয়ার মারবে, বলে ঘোষণা করলেন জজ। কেস ডিসমিসড।
কিশোরের গায়ে কনুই দিয়ে গুতো মারলো আফ্রিকান তরুণ। রাগে গজগজ করলো; যেসব জানোয়ারের নাম বললো, সব কটা ঘাস খায়, নাকের কাছে এসে বসে থাকলেও ছাগল মারবে না। পুরো ব্যাপারটাই প্রহসন।
ঝটকা দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে গেল সে।
.
১২.
ছেলেরাও বিরক্ত হয়ে গেছে। তবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাতচল্লিশ জন পোচারের, হাস্যকর কৈফিয়ত আর জজের খোঁড়া যুক্তি শুনলো। বার বার কেস ডিসমিসড শুনতে ভালো লাগে না, এটা তিনিও বোঝেন, আর সে জন্যেই কয়েকজনকে শাস্তি দিলেন।
একজনকে জেল দেয়া হলো। না, দশ বছরের নয়, মোটে তিন দিন। রায় শুনে দাঁত বের করে হাসলো লোকটা। জেলে আরাম করে বিশ্রাম নিতে পারবে তিন দিন, আর ভালো খাবার পাবে, বাড়িতে ওরকম খাবার পায় না।
আরেকজনের তরমুজ খেত আছে জানালো। তাকে জরিমানা করা হলো। একটা তরমুজ।
অন্য একজনের আছে মুরগীর খামার। তাকে দিতে হবে দুটো ডিম, জরিমানা।
তবে বেশির ভাগই বেকসুর খালাস পেয়ে গেল।
জজের অলক্ষ্যেই আবার বিচার-কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা। রাগে, ক্ষোভে গম্ভীর হয়ে আছে তিনজনেই।
প্রাণের পরোয়া করলাম না, বাইরে বেরিয়েই ফেটে পড়লো রবিন। আর কিনা এভাবে ছেড়ে দিলো! ধরে এনে তাহলে লাভটা হলো কি?
ব্যাটা আরও ক্ষতি করে দিলো, মুসা সব চেয়ে বেশি রেগেছে। পোচার হারামজাদারা বুঝে গেল, ধরা পড়লেও কিচ্ছু হবে না। বেপরোয়া হয়ে উঠবে এখন ওরা আরও।
কিন্তু জজের ব্যাপারটা কি, বল তো কিশোর? রবিন বললো। এত বড় বড় কথা বলে এলো আমাদের কাছে, পোচারদের হেন করবে, তেন করবে। জন্তুজানোয়ারের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললো। সব কি তবে মিস্টার টমসনকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে? আমার কথা বুঝতে পারছো? আমার বিশ্বাস, সিলভারের সঙ্গে যোগসাজশ আছে তার। লাভের বখরা।
মাথা নাড়লো কিশোর। বুঝতে পারছি না। লোকটাকে দেখে মনে হয় না খারাপ। সিলভারের মতো বাজে লোকের সঙ্গে নাহ, বিশ্বাস হয় না। আরেকটা কথা ভাবছি। মায়াদরদ দেখিয়ে শয়তানকে পথে আনার চেষ্টা করছেন হয়তো…
গোড়ার ডিম করছেন! বুড়ো আঙুল নাচালো মুসা। হাজী মোহাম্মদ মহসীন সেজেছেন! শয়তান কোথাকার!
আহাআ, ভদ্রলোক সম্পর্কে ওভাবে কথা বলা উচিত না।
পথের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে ওরা। তিনজনেই নীরব। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
দেখো, হঠাৎ বলে উঠলো মুসা। তোমার ডিটেকটিভ ব্রেন এখন কোথায়? কাজ করছে না কেন? আমি বলছি, ব্যাটা একটা শয়তান। সিলভারের দোস্ত। ওর মুখোশটা খুলে দেয়া উচিত আমাদের।
মৃদু হাসলো শুধু কিশোর, কিছু বললো না। তার মনে হচ্ছে, মুসার অনুমান ঠিক নয়। অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে জজের এই রহস্যময় আচরণের। সিলভারের দোস্ত নয় লোকটা।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে মেন রোড থেকে সরে এলো ওরা। বড় বড় সুন্দর অট্টালিকাগুলো পেছনে পড়লো। ঢুকলো এসে পুরনো শহরের এক সরু গলিতে, আরবদের বসবাস বেশি শহরের এদিকটায়। দোকানগুলোর দরজা খোলা, কিন্তু শো-কেস বা জিনিসপত্র কিছু চোখে পড়ছে না। দরজার পরেই অন্ধকার, যেন অজগরের হাঁ, তার পরে রহস্যময় এক জগৎ, কি আছে বোঝার উপায় নেই। কিছু দোকানের ভেতর থেকে আসছে ফল আর সজির গন্ধ, কোনো কোনোটা থেকে মাংসের। একটা দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অদ্ভুত গন্ধ পেলো মুসা, লোহা, তার, তেলের–হার্ডওয়্যারের দোকানে যেমন থাকে। সে কথা জানালো দুই বন্ধুকে।
পরামর্শ করে দোকানটায় ঢুকলো তিনজনে। ঢুকেই একটা ধাক্কা খেলো যেন। দেয়ালে, মাটিতে যেখানেই চোখ পড়লো, দেখা গেল রাশি রাশি ফাঁদ, জানোয়ার ধরার জন্যে যতো রকম থাকতে পারে। তারের ফাঁস থেকে শুরু করে সব।
কোণের বিষণ্ণ অন্ধকার থেকে হাত ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো লম্বা-নাক এক আরব। কি, ফাঁদের ব্যাপারে আগ্রহ?
খুউব, জবাব দিলো কিশোর। পোচারদের কাছে বিক্রি করেন, না?
মাথা ঝোঁকালো দোকানদার।
কাজটা বেআইনী হয়ে গেল না?
আইন? হা-হা করে হাসলো লোকটা। এই দেশে আবার আইন আছে নাকি? এখানে আইনের কথা যারা বলে তারাই বেআইনী লোক। যাকগে। তোমরা কে? কোনো দল-টল পোষো?
দল?
শিকারীর দল, শিকারী। আইনের লোকদের পোচার। সিলভারের মতো দল।
সিলভারকে চেনেন নাকি?
চিনি না মানে? ও আমার সবচে বড় কাস্টোমার। একেবারে এক হাজারের কম কেনে না।
কতো করে পড়ে দাম?
আড়াই গজী তারের ফাঁস আধ ডলার করে। ওই হিসেবে যতো বড় নাও। তবে একসঙ্গে অনেক নিলে কিছু কম হবে, পাইকারী।
আচ্ছা, বুঝলাম। এখন বলুন, এক হাজার ফাঁস যদি নিই, কততগুলো জানোয়ার ধরতে পারবো?
সেটা সীজনের ওপর নির্ভর করে। আর তাছাড়া একেক শিকারীর একেক রকম হিসাব। সিলভার বলে, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রতি ফাসে হপ্তায়। একটা করে জানোয়ার, মাসে চার। তার মানে, হাজার ফাসে আটাশ হাজার, সাত মাসে। শুকনোর সময়, মানে আগস্ট থেকে অক্টোবরে মাসে একটা। তিন মাসে ধরো আরও তিন হাজার। মাইগ্রেশন সীজনে সবচে বেশি। মাসে দশটা। নভেম্বর, আর ডিসেম্বর শুধু এই দুমাসেই ধরা পড়ে বিশ হাজার। সব মিলিয়ে বছরে হলো গিয়ে একান্ন হাজার।
ভালো ব্যবসা!
খুব ভালো। এদেশের সবচে বড় ব্যবসা।
সবচে বড় শয়তানী! রাগ চাপতে না পেরে ফস করে বলে বসলো মুসা। কিশোরের আরও কিছু জানার ছিলো, দিলো সব ভণ্ডুল করে। জানোয়ারদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখেছো মিয়া, ফাঁসে গলা ঢোকাতে কেমন লাগে?
ক্ষণিকের জন্যে থ হয়ে গেল আরবটা। মানে… মানে…তোমরা জন্তু প্রেমিক! রাগে বেগুনী হয়ে উঠলো চোহারা। হায় হায়, কতো কথা বলে ফেলেছি! এই, বেরোও বেরোও আমার দোকান থেকে! নইলে…
নইলে কি করবে? হাতা গোটাতে শুরু করলো মুসা। আফ্রিকায় এসে যেন জোর বেড়ে গেছে তার, যদিও বাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে।
ঝগড়া বাড়তে দিলো না কিশোর আর রবিন। দুজনে মিলে টেনে দোকান থেকে বের করে নিয়ে এলো মুসাকে।
রাস্তাটা ধরে আবার এগোলো ওরা। আরেকটা দোকানের সামনে থমকে দাঁড়ালো কিশোর, তীব্র বোটকা গন্ধ আসছে ভেতর থেকে। ওই গন্ধ তিনজনেরই পরিচিত। মনে করিয়ে দিলো. পোচারদের ক্যাম্পের কথা। কাঁচা চামড়ার স্তূপ, কাটা মাথা…
এই দোকানেও ঢুকলো ওরা। মস্ত ঘর, এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যায় না ভালো মতো। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত স্তূপ করে রাখা হয়েছে নানা জানোয়ারের শরীরের বিভিন্ন অংশ। সিংহ, চিতাবাঘ, চিতা, জিরাফ, মহিষ, জেব্রা, ওয়াইল্ডবীস্ট, গণ্ডার, জলহস্তী আর হরিণের মাথা, হাতির পায়ে তৈরি ময়লা ফেলার ঝুড়ি আর ছাতা রাখার স্ট্যাণ্ড; হাতির দাঁত, গণ্ডারের শিং, সব জাতের বানরের স্টাফ করা দেহ, বিরাট হাতি থেকে খুদে বুশ-বেবি পর্যন্ত প্রায় সব জানোয়ারের চামড়া; আর আরও নানারকম জিনিস।
মালিকের চেহারা দেখেই বোঝা গেল, সে ভারতীয়।
ছোট টমি হরিণের ডালপালা ছড়ানো শিংওয়ালা সুন্দর একটা মাথা তুলে নিলো কিশোর। জিজ্ঞেস করলো, কতো?
কটা চাই?
এটার দাম কতো?
সরি, ইয়াং ম্যান, একটা করে বেচি না। পাইকরী। এটা পাইকারী দোকান।
অ। তা পাইকারী কি হিসেবে? ডজন, শ, নাকি হাজার?
হাসলো দোকানদার। না, ভাই, এতো কম না। সবচেয়ে কম, দশ হাজার। আসলে, জাহাজ হিসেবে বিক্রি করি আমরা। এক জাহাজ এতো, দুই জাহাজ এতো, এভাবে। এই তো, কাল সকালেই তিন জাহাজ মাল চালান দিলাম। আজ সকালেই ছেড়ে যাওয়ার কথা ওগুলোর।
কোত্থেকে? আই মীন, কোন বন্দর থেকে?
ওল্ড হারবার।
দেখুন, আমরা এখানে নতুন। মোমবাসা দেখতে এসেছি। চিনিটিনি না কিছু..।
সোজা চলে যাও। বন্দরটা এই পথের শেষ মাথায়।
.
দ্বীপের উত্তর-পূর্ব কোণে, প্রবালের দেয়াল ঘেরা একটা বেসিন মতো জায়গায় তৈরি হয়েছিলো মোমবাসার ওল্ড হারবার বা পুরনো বন্দর। গা ঘেষাঘেষি করে নোঙর করে আছে অসংখ্য আরব ডাউ। বড় বড় এই জাহাজগুলোর পেছনে পুরনো ধাচের উঁচু মঞ্চ দেখলে জলদস্যু আমলের কথা মনে পড়ে। কোন-কোনটা ছাড়ার জন্যে তৈরি, দেখলেই বোঝা যায়। বিশাল ল্যাটিন পাল তুলে দেয়া হয়েছে, পতপত করছে বাতাসে।
ছাড়তে প্রস্তুত, ওরকম ডাউগুলোর সবচেয়ে বড়টার গ্যাঙওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে বাদামী-চামড়ার এক আরব। চেহারা, পোশাক-আশাকে ছেলেদের মনে হলো, কবর থেকে উঠে এসেছে বুঝি সেই তিনশো বছর আগের কোনো জলদস্যু সর্দার।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা। কিশোর জিজ্ঞেস করলো, আপনিই বোধহয় এই জাহাজের ক্যাপ্টেন?
মাথা ঝাঁকালো লোকটা।
অভিনয় শুরু হয়ে গেল। অলসভঙ্গিতে দুলছে জাহাজের মস্ত পাল, সেদিকে চেয়ে বিস্ময়ে বড় বড়, হলো কিশোরের চোখ। কাঁধ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে অনুরোধ করলো, ছবি তুলি?
নীরবে মাথা কাত করলো ক্যাপ্টেন।
ছবি তুললো কিশোর। জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন?
বমবাই।
বোম্বে? ভালো। খুব সুন্দর আপনার জাহাজটা। পাল আরও সুন্দর। এখান থেকে সুবিধে হচ্ছে না। ডেকে উঠে যদি তুলি, কিছু মনে করবেন?..
হাত নেড়ে ডেক দেখিয়ে দিলো ক্যাপ্টেন, অর্থাৎ যাও। লোকটা যদি মত বদলায়, এই ভয়ে এক মুহূর্ত দেরি করলো না কিশোর। মুসা আর রবিনকে নিয়ে ডেকে উঠে এলো। আরও দুটো ছবি তুলে ফিরে চেয়ে দেখলো, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ক্যাপ্টেন। চট করে তারও একটা ছবি তুলে নিলো। হাসিতে বিগলিত হলো লোকটার মুখ, গোয়েন্দাপ্রধানের মনে হলো, হাসিটাও জলদস্যুদের মতো।
বোম্বেতে কি নিয়ে যাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
সত্যি কথা শুনবে, আশা করেনি সে। কিন্তু লুকোছাপার ধার দিয়েও গেল না ক্যাপ্টেন। বোঝা গেল, গুপ্তচর, সাদা পোশাকে পুলিশ কিংবা কাস্টমের লোকের ভয় করছে না। ভয় করার কারণই নেই হয়তো। চলো, দেখাচ্ছি।
টান দিয়ে একটা তারপুলিনের কোণা তুললো ক্যাপ্টেন। ফাঁক দিয়ে দেখা গেল নিচের ডেক। খোলে বোঝাই হয়ে আছে জন্তুজানোয়ারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, খানিক আগে দোকানটায় যা দেখে এসেছে তিন গোয়েন্দা, সেসব জিনিস। গর্বের হাসি ফুটলো জলদস্যুর মুখে। দারুণ, না?
জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো কিশোর, কতোগুলো আছে এখানে? পোচার।
দেখতে হবে, বলে, গিয়ে বিল অভ লেডিং বের করে আনলো লোকটা। কোন জানোয়ারের কয়টা অঙ্গ আছে, কত টাকার জিনিস, সব লেখা আছে। হিসেব করে জানালো সে, অন্তত এক লাখ আশি হাজার জানোয়ার মেরে জোগাড় করতে হয়েছে ওগুলো।
স্তব্ধ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। যে তিনটা জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার কথা, তার একটাতেই আছে ওই পরিমাণ মাল! কি হারে জানোয়ার মারা হচ্ছে, ভেবে এই গরমের মাঝেও গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো কিশোরের, শীত শীত লাগলো।
.
কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়লেন ওয়ারডেন, তিন গোয়েন্দার রিপোর্ট শুনে। নির্মল ওরকম করলো কেন? আসলে ওর মনটা বেশি নরম, কারো কষ্ট সইতে পারে না। না জানোয়ারের, না মানুষের। জজ না হয়ে ঋষি হওয়া উচিত ছিলো তার। দেখি, দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো, বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তিনি। মুসা, আরেকবার কষ্ট করতে হবে তোমাকে। প্লেনে করে দুটো যাত্রীকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। ইচ্ছে করলে তোমরাও যেতে পারো, রবিন আর কিশোরের দিকে ইঙ্গিত করলেন।
আবার প্লেন নিয়ে বেরোতে পারবে শুনে খুব খুশি মুসা। জিজ্ঞেস করলো, যাত্রীরা কে?
এসো, দেখাচ্ছি।
.
১৩.
জানোয়ারের হাসপাতালে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে এলেন টমসন। ঘড়ঘড়, গোঁ গোঁ, ঘোৎ ঘোৎ, চি চি, কিউ কিউ আর আরও নানা রকম বিচিত্র শব্দ হচ্ছে হাসপাতালে। রোগী নানা ধরনের আফ্রিকান জন্তুজানোয়ার।
আফ্রিকার সুন্দরতম বানরের সঙ্গে পরিচিত হও, হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন ওয়ারডেন। ইনি মিস্টার কোলোবাস।
বানরটা সত্যি খুব সুন্দর। কোলোবাস মাংকি আগেও চিড়িয়াখানায় দেখেছে। তিন গোয়েন্দা, তবে ওগুলো কোনোটাই এটার মতো সুন্দর নয়। বন থেকে সদ্য এসেছে তো। সব জীবই তার প্রিয় প্রাকৃতিক পরিবেশে অন্যরকম থাকে। কুচকুচে কালোর মাঝে তুষার-শুভ্র ছোপ যেন ফুটে রয়েছে। পিঠের নিচে, পেটের সামান্য ওপরে আর মুখমণ্ডলে ওই সাদা রঙ। লেজের ডগায় ফোলা রোমগুলোও সাদা।
সাংঘাতিক সুন্দর তো! অবাক হয়ে দেখছে রবিন।
হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালেন টমসন। আর এ-কারণেই মরতে হচ্ছে এগুলোকে। খুব চাহিদা, মহিলাদের পোশাক তৈরি হয়। দামও অনেক বেশি। ফলে পোচাররা লেগে আছে পেছনে। কোলোবাসের বংশ নির্বংশ করার প্রতিজ্ঞা করেছে যেন। অনেক কমে গেছে ওরা, খুব সামান্যই আছে আর। শীঘ্রি পোচিং থামাতে না পারলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, ডোডো পাখির মতো নামটাই শুধু অবশিষ্ট থাকবে।
কি একখান লেজ! মুগ্ধ চোখে দেখছে মুসা। এতো লম্বা কেন? অন্য বানরের তো এতো বড় না।
হ্যাঁ, বড়ই। বত্রিশ ইঞ্চি বানরের চল্লিশ ইঞ্চি লেজ। কেন লম্বা, বলতে পারবো না। প্রকৃতির খেয়াল, নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।
তা কোথায় নিয়ে যেতে হবে এটাকে?
যেখানে বেশি নিরাপদ। এখানকার বনে ছাড়লে আবার পোচারদের খপ্পরে পড়ার ভয় আছে। আর এই অঞ্চল কোলোবাসের বাড়িও নয়। কি করে এদিকে এসে পড়লো কে জানে। উঁচু অঞ্চলে এদের বাস, বিশেষ করে অ্যাবেরডেয়ার পার্বত্য এলাকায়। বড় বড় গাছ আছে ওখানে, বাতাসে সব সময় শীতের আমেজ-বড় বড় বোম দেখছো না? চির-শীতের দেশে থাকার জন্যে ওগুলো, দরকার। ওখানেই নিয়ে গিয়ে যদি রেখে আসো, ভালো হয়।
যাবো, বলতে এক মুহূর্ত দেরি করলো না গোয়েন্দা-সহকারী। কিন্তু মিস্টার কোলোবাস যেতে রাজি হবেন তো?
না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ফাঁসে আটকেছিলো, গলা কেটেছে। শুকিয়ে গেছে এখন।
প্রেনের ভেতর থাকবে শান্ত হয়ে?
কি জানি। তোমাদের বিশ্বাস করতে পারলে গোলমাল না-ও করতে পারে। আমাজান থেকে জানোয়ার ধরে এনেছো, কি করে সামলাতে হয় নিশ্চয় ভালো জানো। এটাকেও না পারার কোনো কারণ দেখি না।
সুন্দর মুখটা কাত করে, বড় বড় কোমল বাদামী চোখ মেলে তিন কিশোরকে, দেখছে বানরটা। দাড়ি চুলকালো। গাল আর থুতনির লম্বা সাদা রোমগুলোকে দাড়ির মতোই দেখতে লাগে। চাপদাড়ি।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। বুড়ো আঙুল কই? কেটে ফেলেছে নাকি?
না, বিদ্যে ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে গেল রবিন। কাটেনি। কোলোবাসের থাকেই না। ভাবো একবার, বুড়ো আঙুল ছাড়া জিনিসপত্র ধরার কথা? কঠিন না? খুব কঠিন। আমার তো বিশ্বাস মানুষের বুড়ো আঙুল না থাকলে আজকের এই মানব সভ্যতাই গড়ে উঠতে পারতো না।
একেবারে ভুল বলোনি, রবিনের সঙ্গে একমত হলেন ওয়ারডেন। এসো, তোমাদের আরেক যাত্রীকে দেখবে।
ওদেরকে একটা খাঁচার কাছে নিয়ে এলেন তিনি। ভেতরে খচ্চরের সমান একটা জীব। দেখতে মোটেও খচ্চরের মতো নয়।
ইনি আফ্রিকার সব চেয়ে দুর্লভ প্রাণীদের একজন, তর্জনী তুলে জানোয়ারটার দিকে বাতাসে খোঁচা মারলেন ওয়ারডেন। মিস্টার ওকাপি।..
বিচিত্র জীব। একই অঙ্গে নানা রঙের বাহার। যেন হাতের কাছে যতগুলো রঙ পেয়েছেন শিল্পী তুলিতে লাগিয়ে সবগুলোর পরশ বুলিয়েছেন। হলুদ, লাল, পিঙ্গল, কালো, সাদা, কালচে নীল, মেরুন, কালচে-বাদামী, মাখন, কমলা, বেগুনী, সমস্ত রঙ খুব নিখুঁতভাবে লাগানো হয়েছে চকচকে নরম চামড়াটাতে।
আর একটাতেই কয়েক জানোয়ারের মিশ্রণ। মাথায় জিরাফের খাটো শিং, গায়ে জেব্রার ভোরাকাটা, বুনন কুকুরের বড় ছড়ানো কান, আর অ্যানটিলোপ হরিণের মতো সরু পায়ের খুরের ওপরে সাদা রোমশ মোজা। ও, জিভটাও অন্য জানোয়ারের, অ্যান্ট-ঈটার বা পিঁপড়ে-খেকোর। ফুটখানেক লম্বা লিকলিকে ওই জিভ দিয়ে সহজেই কানের গোড়া আর পেছনটা চুলকাতে পারে।
কোলোবাসের মতোই এটাও এখানে এসেছে অন্য জায়গা থেকে, ওয়ারডেন। বললেন। এখানকার বনে ছাড়লে মারা পড়বে। এরা থাকে উত্তর কঙ্গোর গহীন অন্ধকার জঙ্গলে। মাত্র তিরাশি বছর আগে এর নাম জেনেছে. শ্বেতাঙ্গরা। পিগমীরা। বহু আগে থেকেই জানতো, কথায় কথায় বলে দিয়েছিলো শ্বেতাঙ্গ শিকারীকে। কেউ বিশ্বাস করেনি তখন। তারপর যখন দেখে ফেললো; আর কোনো সন্দেহ রইলো না। কে জানে, আরও কতো জানোয়ার লুকিয়ে আছে ওসব জঙ্গলে, যার কথা শুনিইনি এখনও আমরা! ওকাপিটার দিকে আবার হাত তুললেন তিনি। এরা খুব লাজুক। মানুষের সামনে বেরোয় না, সাড়া পেলেই লুকিয়ে পড়ে আরও গভীর: বনে। ওভাবেই লুকিয়ে থেকেছে তিন কোটি বছর ধরে।
কপাল কুঁচকে ফেললো মুসা। তিইন কোওটি!
হ্যাঁ, উনি ঠিকই বলেছেন, জ্ঞান বিতরণ শুরু করলো আবার রবিন। অনেক পুরনো ওরা, একেবারে খান্দানী বংশ। বিজ্ঞানীরা বলেন লিভিং ফসিল,..
জ্যান্ত জীবাশ্ম, বিড়বিড় করলো কিশোর।
কি বললে? ভুরু কোঁচকালেন টমসন।
না, লিভিং ফসিলের বাংলা বললো, আগের কথার খেই ধরলো রবিন। সেই তিন কোটি বছর আগে জন্মেছিলো ওকাপির প্রথম পূর্বপুরুষ। আরও অনেক জানোয়ারই জন্মেছিলো সেই আদিম পৃথিবীতে। অনেকেরই পরিবর্তন হয়েছে, হয়। ছোট হয়েছে, নয়তো বড়। অনেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, আজ আর বেঁচে নেই .. একটাও। কিন্তু ওকাপি রয়ে গেছে, তখন যেমন ছিলো এখনও তেমনি। তবে পোচারদের পোচিং না থামালে আর বেশি দিন থাকবে বলে মনে হয় না।
না, ভাই, মরার দরকার নেই, মিস্টার ওকাপির দিকে চেয়ে হাত নাড়লো মুসা। দোয়া করি, আরও তিন কোটি বছর বেঁচে থাকো, ওয়ারডেনের দিকে ফিরলো। তা এই বিশেষ ভদ্রলোক কোথাকার বাসিন্দা? কোথায় রেখে আসতে হবে?
হেসে ফেললেন টমসন। ইনি যে কোথাকার, কি করে বলি? অবাকই লাগছে আমার, এলো কি করে এখানে? কঙ্গোতে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারলেই ভালো। হতো; সেটা সম্ভব না। আরেক জায়গায় অবশ্য রাখা যায়, ওখানে পোচারদের হাত পড়েনি এখনও। আরও কিছু দিন পড়বে বলেও মনে হয় না।
কোথায়? আগ্রহ দেখালো কিশোর।
ভিক্টোরিয়া হ্রদের একটা বড় দ্বীপে। রুবনডো-র নাম শুনেছো? পঞ্চান্ন একর জায়গা নিয়ে গভীর বন, ওকাপিরা যেরকম পছন্দ করে। ওটা একটা নিরাপদ গেম স্যাংচুয়ারি, কড়া পাহারা। তাছাড়া চারপাশে পানি, যখন-তখন ঝড় ওঠে। ক্যানূ নিয়ে যেতেই পারবে না.পোচাররা, ডুবে মরবে। তবে বলা যায় না, কোন দিন জাহাজ নিয়ে গিয়ে হাজির হবে। তবে ততোদিন নিরাপদেই থাকবে ওখানকার জন্তুজানোয়ার। এয়ারফীল্ড নেই দ্বীপটায়। মেন ল্যাণ্ডে নামতে হবে তোমাদের, তারপর বোট ভাড়া করে নিয়ে যেতে হবে। কি মনে হয়, পারবে?
ভেলায় করে আমাজানের জঙ্গল থেকে জাগুয়ার আর অ্যানাকোপ্তা নিয়ে এলাম, মুসা বললো। আর এটা তো কোনো ব্যাপারই না। নিশ্চয় পারবো। কতো আর সময় লাগবে? ফেরিতে করে বড় জোর এক-দুই ঘন্টা।
হাসলেন টমসন। দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ, লেক ভিক্টোরিয়া। দ্বীপে যেতে কমপক্ষে পনেরো ঘন্টা লাগবে। আর ওই পনেরো ঘন্টায় অন্তত পাঁচটা ঝড়ের কবলে যদি না পড়েছে, তো নাম বদলে ফেলবো আমার। ভেবে দেখো, ঝুঁকিটা নেবে?
কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিলেন আমাদের, কিশোর বললো। এরপর আর না গিয়ে পারা যায় না। হ্রদটা দেখতেই হবে।
হ্যাঁ, দেখতেই হবে, সুর মেলালো রবিন।
বেশ, চলো অফিসে, বলে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলেন ওয়ারডেন।
.
১৪.
এই যে, অ্যাবারডেয়ার, টেবিলে বিছানো পূর্ব আফ্রিকার ম্যাপের এক জায়গায়, আঙুল রাখলেন টমসন। এই হলো নাইরোবি, এর উত্তরে। নাইয়েরিতে নামবে তোমরা, তারপর গরুর গাড়িতে করে যাবে ট্রীটপস-এ। নাম শুনেছো?
মাথা ঝাঁকালো বইয়ের পোকা রবিন। নিশ্চয়ই। দানবীয় ক্যাপ চেস্টনাট গাছের ওপরে তৈরি হোটেলটার কথা বলছেন তো?
ওখানকার বেশির ভাগ গাছই দানবীয়। কোলোবাসের খুব পছন্দ। রাতে গাছের ওপরের বাড়িতে কাটাবে। পরদিন প্লেন নিয়ে চলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমে, তিনশো মাইল দূরের মুয়ানজায়। এই যে, এখানে। পাশে এটা লেক ভিক্টোরিয়া। আর এই হলো রুবনডো দ্বীপ, সরাসরি গেলে একশো মাইল।
কখন রওনা হচ্ছি আমরা? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
এখন বেরোলে রাতের আগেই পৌঁছে যাবে ট্রীটপসে।
চলো, যাই, বন্ধুদের বললো কিশোর।
যাত্রীদের জায়গা করার জন্যে পেছনের দুটো সীট খুলে ফেলতে হলো। বাঁশের খাঁচায় ভরে, পাঁচজন লোকে বয়ে নিয়ে গিয়ে মিস্টার ওকাপিকে প্লেনে তুললো।
বেশি ভারি হয়ে যাবে না? মুসা জানতে চাইলো।
না, বললেন ওয়ারডেন। আড়াইশো হর্সপাওয়ারের এঞ্জিন। আড়াই টন ওজন তুলতে পারে। ওকাপিটা কোয়ার্টার টনের বেশি হবে না।
তিন কোটি বছরের বনেদি জীবৃটা জীবনে কখনও বিমানে ওঠেনি, মোটেও পছন্দ করতে পারলো না ওই বদ্ধ পরিবেশ। উদ্বিগ্ন ঘোড়ার মতো চি-চি করে প্রতিবাদ জানাতে লাগলো। শক্ত মাথা দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি মারলো খাঁচার বেড়ায়। গোয়েন্দাদের ভয় হলো, ভেঙে না যায়।
কচি পাতাওয়ালা একটা গাছের ডাল ভেঙে এনে খাঁচার ওপরে রেখে দিলেন। টমসন, আড়াআড়ি বাধা বাঁশের কঞ্চির ফাঁক দিয়ে পাতাগুলো ঝুলে রইলো ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে বারো ইঞ্চি লম্বা ফিতের মতো জিভটা বের করে পাতায় পেঁচিয়ে শক্ত দাঁতের আওতায় টেনে নিয়ে এলো মিস্টার ওকাপি। যতোক্ষণ ওই লোভনীয় খাবার মাথার ওপর থাকবে, কোনো গোলমাল করবে না সে আর।
শান্ত স্বভাবের মিস্টার কোলোবাসের জন্যে খাঁচার, প্রয়োজন হলো না। বুদ্ধিমান জীব, ফলে কৌতূহল তার জন্মগত। প্রথমেই কন্ট্রোল প্যানেলের। যন্ত্রপাতিগুলো ধরে ধরে দেখলো, তারপর চড়ে বসলো মুসার কাঁধে, সেখান থেকে এক লাফে গিয়ে উঠলো ওকাপির খাঁচার ওপর। ওখানে বসেই গম্ভীর হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চোখ বোলালো পুরো কেবিনটায়। মুসার পাশে গাদাগাদি করে উঠে। বসলো রবিন আর কিশোর। ওড়ার সময় বসতে কষ্ট হবে না তেমন, অসুবিধে হবে ওঠা আর নামার সময় সীটবেল্ট বাঁধা নিয়ে। শেষে একটা বেল্টই ঘুরিয়ে এনে দুজনের পেটের ওপর বাঁধলো। এঞ্জিন স্টার্ট দিলো মুসা। লাফিয়ে এসে তার কাঁধে চাপলো মিস্টার কোলোবাস। চালাতে অসুবিধে হবে কিশোর পাইলটের, তাই ওটাকে সরিয়ে দিলো কাধ থেকে। কিন্তু কিভাবে আকাশে ওঠে প্লেন, দেখবেই। যেন বানরটা, অগত্যা কিশোর আর রবিনের কাঁধে ভাগাভাগি করে বসলো।
স্টর্ক নিয়ে ওঠা-নামা করতে করতে হাত অনেক পেকে গেছে মূসার। ভারি বোঝা নিয়েও সহজে উঠে গেল গাছের মাথায়।
উত্তর-পশ্চিমে নাইরোবির দিকে চলে যাওয়া লাল সড়কের ওপর দিয়ে উড়ে চললো বিমান। কিছু দূর এগিয়ে মোড় নিলো উত্তরে মাউন্ট কেনিয়ার সতেরো হাজার ফুট উঁচু চোখ ধাঁধানো চূড়ার দিকে। পেছন থেকে বইছে বাতাস। গতি বেড়ে গেল বিমানের। প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ তিনশো মাইল, পাড়ি দিয়ে এলো দুঘন্টায়। নামলো অ্যাবারডেয়ারে, বনের কিনারে একটা ছোট ল্যাণ্ডিংফীল্ডে।
কিভাবে কি করতে হবে সব ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েছেন মিস্টার টমসন। সেই মতোই কাজ করলো তিন গোয়েন্দা। প্লেন থেকে নেমে যেতে হবে আউটস্প্যান হোটেলে। গেম রিজার্ভে টুকে ট্রীটপসে রাত কাটানোর অনুমতি নিতে হবে ওখান থেকে।
সবে বিমানের চাকা মাটি ছুঁয়েছে, প্রায় ছুটে এসে হাজির হলো হোটেলের শ্বেতাঙ্গ শিকারী-কাম-পথপ্রদর্শক। ছেলেদের কাছে নিজের পরিচয় দিলো কল মী। হাঙ্গার, অর্থাৎ আমাকে হাঙ্গার নামে ডেকো। মিস্টার-ফিস্টার বলার ঝামেলা করতে হবে না, সে-কথাও ঘোষণা করে দিলো মুক্তকণ্ঠে।
বিমানেই রেখে যাওয়া হলো ওকাপিটাকে। ঝামেলা করবে না। প্রচুর রসালো খাবার ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে খাঁচার ওপর। রাতের খাবারের পরও প্রচুর অবশিষ্ট থাকবে, নাস্তা সারতে পারবে।
ওকে নিয়ে ভেবো না, বললো হাঙ্গার। কি নাম যেন বললে? ও, মিস্টার ওকাপি। হ্যাঁ, ওকে দেখার লোক আছে হোটেলে। এখন দয়া করে আমার জীপে ওঠো, খুশি হবো।
হাঙ্গারকে খুশি করলো তিন গোয়েন্দা। মুসার কাঁধে চড়ে বসলো মিস্টার কোলোবাস। কিছু মনে করলো না গোয়েন্দা-সহকারী। বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে কাঁচা সড়ক, জায়গায় জায়গায় কাদা। তিন মাইল ওই বুনোপথ পেরিয়ে শেষ মাথায় পৌঁছলো গাড়ি। তারপর থেকে শুরু হয়েছে দানবীয় গাছের জঙ্গল, মাথার অনেক ওপরে খাড়া উঠে গেছে টাওয়ারের মতো।
হাঁটতে হবে এবার, জানালো হাঙ্গার। বেশি না, এই কোয়ার্টার মাইল।
মৌন হয়ে থাকা বিশাল দানবগুলোর ফাঁক দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে খুব সরু পায়েচলা পথ। ধীরে ধীরে উত্তেজিত হয়ে উঠছে বানরটা। বড় বড় গাছগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন তাকে, খাসা বাড়ি হবে এখানে। মাউন্ট কেনিয়ার তুষার ছুঁয়ে নেমে আসা বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা। কোলোবাসের উপযুক্ত জায়গা। এটা।
মই কিসের ওটা? গাছের গায়ে বড় বড় পেরেক দিয়ে আটকে রাখা লম্বা মই দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। আরে, আরও আছে দেখছি।
এখুনি বুঝতে পারবে, গম্ভীর হয়ে গেছে হাঙ্গার। ওই মই বেয়ে ওঠো, জলদি!
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
আহ, কথা বাড়িও না! যা বলছি করো।
আগে আগে উঠতে শুরু করলো মুসা, গলা জড়িয়ে ধরে রইলো বানরটা। তার পেছনে রবিন, কিশোর, সবার শেষে হাঙ্গার। বনের ভেতরে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে, ভেঙেচুরে মারিয়ে একাকার করে ফেলছে যেন গাছপালা। শোনা গেল হাতির গুরুগম্ভীর চিৎকার। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো গাছের আড়াল থেকে, পথের ওপরে।
আরও ওপরে ওঠো! চেঁচিয়ে বললো হাঙ্গার।
শেষ মাথায় উঠে গেল মুসা। মইটা অনেক লম্বা। সবার নিচে থাকা হাঙ্গারের পা-ও শুড় বাড়িয়ে ধরতে পারবে না হাতি। সে চেষ্টা অবশ্য করলোও না ওরা।
বুঝতে পারলে তো এখন, কেন এই মই? বললো হাঙ্গার। জন্তুজানোয়ারে বোঝাই এই বন। যখন তখন বেরিয়ে আসে পথের ওপর। এখানে একটা কথা প্রচলিত আছেঃ গণ্ডার আর মোষ হলে আট ফুট, হাতি হলে আঠারো ফুট। তার মানে কোন জানোয়ার আসছে সেটা বুঝে নিয়ে তার নাগালের বাইরে যেতে হলে ততোখানি উঠতে হবে।
পার্কের মধ্যেও বুনো-হয়ে আছে নাকি? মানুষের ক্ষতি করে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
পার্ক কি আর পোষ মানানোর জন্যে? নিরাপদে রাখার জন্যে। বুনোই তো থাকবে। তবে মানুষ দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে যায় ওগুলোর, না খোঁচালে সহজে ক্ষতি করে না। তবুও, ঝুঁকি না নেয়াই উচিত। হাতি-গণ্ডার-মোষের মেজাজ-মর্জি বোঝা মুশকিল। আর আহত হলে তো সর্বনাশ। দেখা মাত্র মারতে আসবে।
এখন কি করবো?
জাস্ট ওয়েইট। অপেক্ষা।
কতক্ষণ?
পাঁচ মিনিট হতে পারে, পাঁচ ঘন্টাও লাগতে পারে। আমরা তাড়াহুড়ো করলে কিছু হবে না। ওদের যখন ইচ্ছে যাবে।
অপেক্ষা করার জায়গাটা সুবিধের নয়, ভাবলো মুসা। মই আঁকড়ে ধরে থাকা, তার ওপর কাঁধে রয়েছে এক বানর।
বিন্দুমাত্র তাড়া নেই হাতিগুলোর। অলস ভঙ্গিতে ডালপাতা ভেঙে ভেঙে খাচ্ছে। চারা গাছ ওপড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ওপরে তাকিয়ে দেখছে, মানুষগুলো আগের জায়গাতেই আছে কিনা।
অস্থির হয়ে উঠছে মিস্টার কোলোবাস। বার বার ওপরে তাকাচ্ছে। মুসার মনে হলো, ওপরে জীবন্ত কিছু আছে, ওটাই বানরটার আকর্ষণ। সে-ও তাকালো। প্রথমে কিছু দেখলো না, তারপর মগডালে পাতার আড়ালে মৃদু নড়াচড়া চোখে। পড়লো।
মুখটা দেখতে পেলো আরও পরে। কপাল-কান-মাথা সব কালো; কপালের নিচটা, গাল, থুতনি সাদা। নিশ্চয় কোলোবাস। আরেকটু মুখ বের করলো ওপরের বানরটা। কিচির-মিচির করে ডাকলো মিস্টার কোলোবাসকে, ওটার কাছে যাওয়ার জন্যে।
অন্যেরাও লক্ষ্য করেছে ব্যাপারটা।
দেবো নাকি ছেড়ে? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
দাও, হাঙ্গার বললো.। কোলোবাসের জন্যে ভালো জায়গা। তাছাড়া মিস ভাকছেন। মিস্টারের অনাদর হবে বলে মনে হয় না।
মিস, না মিসেস? দাঁত বের করে হাসলো মুসা।
এখন তো মিসই মনে হচ্ছে। মিস্টার গেলে পরে মিসেস হবেন আরকি।
বানরটাকে ভালোবেসে ফেলেছে মুসা। ছাড়তে কষ্টই হলো। তবু, তার কাছে থাকার চেয়ে বনে অনেক ভালো থাকবে ভেবে মন শক্ত করলো। ওটার গায়ে হাত রেখে তারপর ডালে চাপড় মেরে দেখিয়ে বললো, যা, যা।
লাফ দিয়ে গিয়ে ডালটায় বসলো মিস্টার কোলোবাস। ফিরে তাকালো মুসার দিকে তাকিয়ে রইলো চিন্তিত চোখে। মনস্থির করে নিয়ে ঘুরলো। লাফিয়ে ধরে ফেললো ওপরের আরেকটা ডাল। সে-ডাল থেকে আরেক ডাল. করে করে উঠে গেল ওপরে। পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আরও কয়েকটা বানর। আশ্চর্য দক্ষতায় লুকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ। মেহমানকে স্বাগত জানাতেই যেন সম্মিলিত কিচির-মিচির জুড়ে দিলো। যাক, মিস্টার কোলোবাসকে সাদরেই গ্রহণ করেছে, তবে হয়তো মিস কোলোবাসের বদান্যতায়।
আরে, কেঁদে ফেলছো কেন? মুসার দিকে চেয়ে বললো হাঙ্গার। মন খারাপ করো না। আবার দেখতে পাবে ওকে।ট্রীটপস লেকে রোজ রাতে পানি খেতে যায় কোলোবাসেরা।
রওনা হয়ে গেল হাতিরা। বনের ভেতর মিলিয়ে গেল,ওদের শব্দ। মই থেকে নেমে আবার ট্রীটপসের দিকে চললো চারজনে।
গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়লো ট্রীটপস। অদ্ভুত দৃশ্য! মনে হচ্ছে যেন শূন্যে ভেসে রয়েছে একটা বড় বাড়ি। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে, দুলছে। বাতাসে গাছের ডাল দোলে, সেই সাথে বাড়িটাও। আরও কাছে এগিয়ে দেখা গেল ওটার ভিত-ডালপালা। দরজা থেকে নেমে এসেছে বিচিত্র কাঠের সিঁড়ি।
একটা হ্রদের দিকে মুখ করে আছে বাড়িটা। ছোট হ্রদ, তীরে ঘন বন। এই বিখ্যাত জায়গাটার কথা অনেক শুনেছে তিন গোয়েন্দা। রাতের বেলা বন থেকে বেরিয়ে হ্রদে পানি খেতে আসে অনেক রকম জানোয়ার। আরও একটা আকর্ষণ আছে ওগুলোর, হ্রদের আশেপাশে লবণের গর্ত। হোটেলের ব্যালকনি থেকে হ্রদ আর গর্তগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। চুপ করে থাকলে, কোনো রকম শব্দ না করলে নিচের অনেক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায় ওখানে বসে।
অনেক বিখ্যাত লোক রাত কাটিয়ে গেছেন ওই হোটেলে, রবিন বললো।
জানি, বললো কিশোর। রানী এলিজাবেথও নাকি এসেছিলেন।
তখনও তিনি রানী হননি, শাহজাদী ছিলেন। ওই হোটেলে থাকার সময়ই রাতে খবর এলো, তার বাবা মারা গেছেন, সিংহাসনে বসতে হবে এবার তাকে।
রাজা ফিলিপ আসেননি? মুসা প্রশ্ন করলো।
কয়েকবার, জবাব দিলো হাঙ্গার। আফ্রিকান ওয়াইল্ড লাইফ রক্ষায় তার দান অপরিসীম। অনেক কিছু করেছেন তিনি এখানকার বুনো জানোয়ারের জন্যে।…এসো, ওপরে উঠি।
সিঁড়ির নিচে জালে ঘেরা একটা ছোট জায়গায় গিয়ে ঢুকলো ওরা। অনেকটা টেলিফোন বুদের মতো, তবে ছাত নেই। সিঁড়ির নিচের ধাপটা বারো ফুট ওপরে। অবাক হয়ে ভাবলো তিন গোয়েন্দা, ওখানে উঠবে কি করে। একটা বোতাম টিপলো হাজার। হড়হড় করে নেমে এলো সিঁড়িটা, ঘেরা জায়গার ভেতরে। তাতে তিন গোয়েন্দাকে তুলে দিয়ে হাজারও উঠলো। আরেকটা বোতাম টিপতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওপরে উঠতে লাগলো সিঁড়ি, বন্দর ছাড়ার আগে জাহাজের সিঁড়ি যেভাবে টেনে তুলে নেয়া হয় অনেকটা তেমনি ভাবে।
এই ব্যবস্থা কেন? জানতে চাইলো রবিন। জানোয়ারের ভয়ে?
হ্যাঁ, হাঙ্গার বললো। বড় জানোয়ার এসে ভেঙে ফেলতে পারে। কিংবা ওপরে উঠে গিয়ে মহা অনর্থ ঘটাতে পারে চিতাবাঘ। সেজন্যেই ওগুলোর নাগালের বাইরে তুলে রাখা হয় সিঁড়ি।
দুর্গের ড্রব্রিজের মতো, বিড়বিড় করলো কিশোর।
গাছের মাথার সুরক্ষিত দুর্গের দোরগোড়ায় পৌঁছলো ওরা।
ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারের সঙ্গে তিন গোয়েন্দার পরিচয় করিয়ে দিলো হাঙ্গার।
হোটেল হিসেবে খুবই হোট ট্রীটপস মাত্র বারোজন মেম্বারের জায়গা হয়, কিন্তু গাছের মাথার বাড়ি হিসেবে আবার অনেক বড়। ডাল দুললেই বাড়ি দোলে। এমনকি কোনো লোক যদি জোরে হাঁটে, কিংবা আস্তেও লাফ দেয়, কেঁপে ওঠে গোটা বাড়ি।
ছেলেদের ঘরের বাইরে একটা ব্যালকনি। ওখানে বসে হ্রদের একপাশ স্পষ্ট দেখা যায়।ট্রীটপসের ছাতে যাওয়ার সিঁড়িও আছে। ওখান থেকে নিচে চারপাশেই। নজর চলে।
.
১৫.
এখানে যেন শুধুই ফিসফিসানী। নোটিশ লেখা রয়েছে, জোরালো শব্দ করে যাতে জন্তুজানোয়ারকে বিরক্ত না করা হয়। ফলে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে না কেউ। মেহমানরা ফিসফিস করছে, ফিসফিস করছে হোটেলের পরিদর্শক, চাকর-বাকর সবাই। সবার পায়ে রবার সোলের জুতো। এটা নিয়ম। মেহমানদের কারও ওরকম জুতো না থাকলে হোটেল থেকে কিনে নিয়ে পরতে হবে, চামড়ার জুতো পরে মচমচ করা চলবে না।
একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, মুসা বললো। আমাদের কথা নাহয় না শুনলো, গন্ধ তো পাবে? ওগুলোর কাছ থেকে মাত্র পঞ্চাশ ফুট ওপরে রয়েছি আমরা।
পঞ্চাশ ফুট কেন, সিকি মাইল দূরে থাকলেও পেতো, জবাব দিলো হাঙ্গার। যদি নিচে থাকতাম আমরা, ওদের নাকের লেভেলে। কিন্তু এতো ওপরে রয়েছি, আমাদের গায়ের গন্ধ নিচে নামতে পারছে না, তার আগেই সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস, ওদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে। আমরা আছি এটা বুঝতে পারবে শুধু শব্দ করলেই। সে-কারণে সর্দি লাগা কোনো লোকের এখানে আসা বারণ। একটা কাশি শুনলেই চোখের পলকে জঙ্গলে পালাবে সমস্ত জানোয়ার। পরে ফিরে আসবে। অবশ্য। জায়গাটাকে ওরা ভালোবাসে। হ্রদের ধারে কাদামাটিতে লবণের ছড়াছড়ি। পানি তো বটেই, লবণ ও খেতে আসে।
ডাইনিং রুমের লম্বা টেবিলে চমৎকার ডিনার দেয়া হলো। পেট পুরে খেলো সবাই। তারপর নিঃশব্দে ব্যালকনিতে চলে এলো বারোজন মেহমান। তাকিয়ে রইলো নিচের দিকে। পরনে ভারি পোশাক ওদের, ঠাণ্ডা যাতে না লাগে। কেউ কেউ তো বিছানা থেকে কম্বল এনে গায়ে জড়িয়েছে। সমুদ্র সমতলের সাত হাজার ফুট ওপরে রয়েছে, কনকনে শীত এখানে।
রাতের অন্ধকারে ঢাকা পড়লো নিচের দৃশ্য। জ্বলে উঠলো শক্তিশালী ফ্লাডলাইট। হ্রদের পাড়ের অনেকখানি জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো আলো। জানোয়ারেরা এই আলোতে অভ্যস্ত, বোঝা গেল। দুটো শুয়োর; একটা ওয়াটহগ, আর একটা ওয়াটারবাক এসে ইতিমধ্যেই হাজির হয়েছে। আলোর দিকে চোখ তুলে তাকালো একবার। অবাক হলো না তেমন। হয়তো ভাবছে, এটাও খুদে কোনো সূর্য। আলোর জন্যে ব্যালকনিটা দেখতে পেলো না, ফলে ঘাবড়ালো না, লবণ খোঁটায় মন দিলো।
চারটে গণ্ডার বেরিয়ে এলো বন থেকে। এসেই লবণাক্ত কাদা চাটতে শুরু করলো। একটু পরেই লেগে গেল ঝগড়া, সব চেয়ে ভালো জায়গাটার দখল নিয়ে। এ-ওকে ধাক্কা মারছে, রেগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে শুয়োরের মতো, তবে শুয়োরের। চেয়ে ওদের গলার জোর অনেক বেশি আকারটাও তো দেখতে হবে। কানগুলো। বার বার এদিক-ওদিক নাড়ছে, অনেকটা রাডারের মতো, সন্দেহজনক সামান্যতম শব্দ পেলেই ছুটে পালাবে।
কাশির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে হোটেল কর্তৃপক্ষ, কিন্তু ভোলা জায়গায় মশার বিরুদ্ধে কি করবে? মিনি জেট প্লেনের মতো বোঁ বোঁ করে সোজা এসে কিশোরের নাক দিয়ে ঢুকে পড়লো একটা। আর কি থাকা যায়। গায়ের জোরে হ্যাচচো করে উঠলো সে।
দুপদাপ করে ছুটে পালালো জানোয়ারের দল। নিমেষে হ্রদের তীর খালি।
তবে, বেশিক্ষণ লাগলো না, পায়ে পায়ে আবার ফিরে আসতে শুরু করলো। গোটা চারেক গণ্ডারও এলো আবার, বোধহয় আগেরগুলোই কিংবা অন্য জানোয়ার। একটার পেছনে আরেকটা সারি দিয়ে এলো, নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করছে, কয়লার রেল-এঞ্জিনের মতো।
তারপর এলো হাতি। বিরাট বিরাট দানব একেকটা। দল বেঁধে নেমে গেল পানিতে। শুড় দিয়ে নিজের গায়ে, একে-অন্যকে পানি ছিটালো কিছুক্ষণ, ধুয়ে গেল ধূসর-কালো চামড়ায় লেগে থাকা ধুলো-ময়লা। পানি থেকে উঠে এলো ওরা। গণ্ডারের পায়ের চাপে ছোট ঘোট গর্ত হয়ে গেছে নরম পারে, পানি ঠেলে উঠছে। ওগুলোতে শুড়ের ডগা ডুবিয়ে দিলো হাতিরা, লবণ সংগ্রহ করে মুখে পাচার করতে লাগলো। মাঝে মাঝে কুতকুতে চোখ মেলে তাকাচ্ছে ফ্লাডলাইটের দিকে। ওই তাকানো পর্যন্তই, চাঁদ কিংবা সুরুজ মনে করেই হয়তো গুরুত্ব দিচ্ছে না। কি ভাবছে ওরাই জানে।
গণ্ডারের মতো বদমেজাজী নয় হাতি। অন্তত নিজেদের মধ্যে অযথা লড়াই করছে না। শান্তভাবে লবণ খাচ্ছে। কোনো শিশু কিংবা অল্পবয়েসী হাতি এসে বড়টার গর্তে শুড় ডোবানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঔড় তুলে নিয়ে ওটাকে জায়গা দিয়ে দিচ্ছে বড়টা। নিজে খুঁজে নিচ্ছে অন্য গর্ত।
ভয়ঙ্কর চেহারার পাঁচটা মোষ বেরিয়ে এলো। গণ্ডারের চেয়েও বদমেজাজী। এসেই জায়গার দখল নিয়ে লেগে গেল নিজেরা, সেই ক্ষোভ অন্যের ওপর গড়াতে দেরি হলো না। গণ্ডার আর মোষে লড়াই বেধে গেল দেখতে দেখতে। শিংয়ের। সঙ্গে শিংয়ের ঠোকাঠুকি, রাগতঃ, ঘোঁৎ ঘোৎ, খুরের দাপাদাপি চললো কয়েক মিনিট। গায়ে পড়ে হাতিদের সঙ্গে গিয়ে লাগলো দুই জাতের বদমেজাজী। কতো আর সওয়া যায়? রাগলো হাতিরাও। মোষগুলোকে পিটুনি লাগালো প্রথমে। ওগুলো পিছু হটে যেতেই গণ্ডারের পিঠে মোটা চাবুকের মতো আছড়ে পড়তে লাগলো শুড়। কিছুক্ষণ গাঁইগুই করে সরে যেতে বাধ্য হলো ওরাও। এই বিরক্তিকর যুদ্ধের পর আর খাওয়া, খেলা কোনোটাই জমে না। হাতিগুলোও চলে গেল।
বন থেকে বেরিয়ে এসে পানি খেতে নামলো একটা জিরাফ। সামনের পা। অনেক বেশি লম্বা, প্রকৃতিই গড়েছে ওদের ওরকম করে, গলা তুলে উঁচু ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খাওয়ার সুবিধের জন্যে। একসাথে দুটো সুবিধে তো আর দেয়া যায় না, গলা নামিয়ে পানি খেতে তাই অসুবিধে হয় জিরাফের। সামনের দুই পা অনেক ছড়িয়ে ফাঁক করে মুখ দিয়ে পানির নাগাল পেতে হয়।
জানোয়ারের ভিড় লেগেছে হ্রদের তীরে। অনেক ধরনের হরিণ এসেছে : ইমপালা, টমি, গ্র্যান্ট, কুড়ু, ওয়াটারবাক, ক্লিপম্প্রিঙ্গার।
মুসার গায়ে কনুই দিয়ে আলতো গুতো দিলো রবিন, নীরবে হাত তুলে দেখালো একদিকে।
বনের কিনারে একটা গাছের ডালে জমায়েত হয়েছে অনেকগুলো কোলোবাস বানর। সতর্ক চোখে আলোর উৎসের দিকে তাকাচ্ছে। দ্বিধা করলো কিছুক্ষণ, তারপর দোল খেয়ে মাটিতে নামলো দলপতি। টুপটাপ করে লাফিয়ে পড়তে লাগলো অন্যগুলো। দল বেঁধে এগোলো পানির দিকে। প্রাকৃতিক পরিবেশে অপূর্ব সুন্দর লাগছে প্রাণীগুলোকে। তীব্র আলোয় চকচক করছে কালো-সাদা রোম। মহিলারা যে পছন্দ করে, খামোকা নয়। আর তাদের পছন্দের কারণে প্রতি মাসে জীবন দিতে হচ্ছে দশ হাজার করে কোলোবাসকে।
দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো মুসা। মিস্টার কোলোবাসও কি আছে দলে? দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। হাঙ্গারের কাছ থেকে একটা বিনকিউলার চেয়ে নিলো সে।
হ্যাঁ, আছে। গলার ওই ফাসের দাগ কোনো দিন মুছবার নয়। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে খুব সুখেই আছে মনে হয় বানরটা। বুকের কোথায় যেন খচ করে উঠলো মুসার। একেই কি বলে জেলাসি? লজ্জিত হলো মনে মনে। তার কাছে থাকলে মিস্টার কোলোবাস অনেক আদর পেতো, সন্দেহ নেই, কিন্তু ওই স্বাধীনতা কি পেতো? হোক না একটা বানর, ওটার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার কি অধিকার আছে তার? তাকে যদি কেউ খাঁচায় পুরে ভালো ভালো খাবার দিতো…আর ভাবতে পারলো না মুসা।
অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকলো মেহমানরা। তারপর একে একে উঠে চলে গেল যার যার ঘরে। তিন গোয়েন্দাও ঘুমাতে চললো।
১৬.
ফ্যানটাসটিক আইডিয়া! সকালে নাস্তা খেতে খেতে হাঙ্গারকে বললো কিশোর। হ্রদের ধারে গাছের ওপর হোটেল বানানো!
একমত হলো পথপ্রদর্শক। হ্যাঁ, এর জন্যে কল্পনাশক্তি দরকার। বেরিয়েছিলো এক ভদ্রমহিলার মাথা থেকে। তাঁর নাম লেডি বেটি ওয়াকার। অনেক দিন আগে ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে এসেছিলেন। বিখ্যাত ক্লাসিক সুইস। ফ্যামিলি রবিনসনের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। সেই বই পড়া থাকায়ই গাছের ওপর বাড়ি বানানোর আইডিয়া ঢোকে তাঁর মাথায়। বেড়াতে এসে বন্ধুদের বলেছিলেন সেকথা। শুনে তো হেসেই খুন ওরা। কিন্তু লেডি ওয়াকার দমলেন না। বানিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
একটা কাজের কাজই করেছেন তিনি, রবিন বললো। তার সৌজন্যেই কাল রাতে ওই চমৎকার দৃশ্য দেখার সুযোগ পেলাম।
তা তো পেলাম, শূন্য প্লেটটা ঠেলে সরালো মুসা। আমি ভাবছি আজকের কথা। সামনে খুব কঠিন কাজ পড়ে আছে।
প্লেনে ফিরে দেখা গেল, খাঁচার মধ্যে আরামে পাতার নাস্তা চিবুচ্ছে মিস্টার ওকাপি। হাজারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিমানে চড়লো তিন গোয়েন্দা।
সিংহের জন্যে বিখ্যাত সেরেঙ্গেটি প্লেইন-এর ওপর দিয়ে মুয়ানজার দিকে, উড়ে চলেছে বিমান। দুই ঘন্টা পর নামলো ভিক্টোরিয়া হ্রদের দক্ষিণ পারে।
বন্দরে এসে ভালো কোনো বোট পেলো না তিন গোয়েন্দা। অনেক চেষ্টার পর একটা নৌকা মিললো, নড়বড়ে ভেলাই বলা চলে ওটাকে। এককালে নদীতে ফেরী পারাপার করতো। একটিমাত্র আউটবোর্ড মোটর, বহু পুরনো, প্রচণ্ড আওয়াজ। অগত্যা ওটা নিয়েই রুবনডো আইল্যাণ্ডে চললো ওরা। ওয়ারডেন টমসন বলে দিয়েছেন, যেতে পনেরো ঘন্টা লাগবে, আর ওই সময়ে ঝড় আসবে অন্তত পাঁচবার। ভুল করেছেন তিনি। একটা ঝড়ই এলো, কিন্তু টিকে রইলো পনেরো ঘন্টারও বেশি।
বিশাল হ্রদ। উত্তর তীর থেকে দক্ষিণ তীরের দূরত্ব আড়াইশো মাইল। ঝড় এলো উত্তর থেকে, পুরো হ্রদটা পাড়ি দিয়ে বয়ে চললো দক্ষিণে। বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ভেলার ওপর। ভিজিয়ে চুপচুপে করে দিচ্ছে যাত্রীদের।
বিমান-যাত্রা নির্বিবাদে সহ্য করেছে মিস্টার ওকাপি, নৌ-যাত্রা মোটেই পছন্দ করতে পারলো না। নানারকম বিচিত্র শব্দ করে প্রতিবাদ জানিয়েই চলেছে। অভ্যাস নেই, ভেলার দুলুনি সইতে পারলো না বেশিক্ষণ, বমি শুরু করলো। পেট থেকে বেরিয়ে এলো সমস্ত পাতা। ভেলার পাটাতনের কাঠামোতে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে খাঁচাটা, এতো মচমচ করছে, গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছে খুলে, ভেঙে না। চলে যায়।
আর শুধু ঝড়ই নয়, ভিক্টোরিয়ার আরও দুর্নাম আছে। না না, মহারানী ভিক্টোরিয়া নন-যার নামে নাম রাখা হয়েছে এই অগাধ জলরাশির, ভিক্টোরিয়া। হ্রদের কথা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই এর নিচে রয়েছে বালির চরা, পানির সমতলের ঠিক নিচে। ওগুলোতে আটকে যাচ্ছে ভেলা। ঢেউ তখন উপকারই করছে। আটকে থাকতে দিচ্ছে না। তবে সব সময় সেটা পারছে না। তখন ব্যাক গীয়ার দিয়ে পিছিয়ে আনতে হচ্ছে ভেলা। কখনও কখনও শুধু এঞ্জিনের জোরে কুলাচ্ছে না, চরায় নেমে ঠেলা লাগাতে হচ্ছে তিন গোয়েন্দাকে। একবার তো ওরকম ঠেলা লাগাতে গিয়ে রবিন পড়লো বিপদে, আরেকটু হলেই ভেসে গিয়েছিলো গভীর পানিতে, তাহলে আর বাঁচতো না। সবে চরায় নেমেছে ওরা, ছয় ফুট উঁচু এক ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়ে চিত করে ফেলে দিলো ওকে। ভাগ্যিস মুসার হাত ধরে রেখেছিলো। সে আর কিশোর মিলে টেনে-হিঁচড়ে সোজা করলো রবিনকে।
বিপদ আরও আছে। কুমির আর জলহস্তী। অগুনতি। কিলবিল করছে যেন হ্রদের পানিতে, বিশেষ করে ইয়া বড় বড় কুমির। মাঝে মাঝে ঘ্যাঁশশ করে ঘষা লাগায় ভেলার নিচে, যেন গাছের গুঁড়ি একেকটা। উল্টে দেয়ার চেষ্টা করে। না পারলে পাশে ভেসে ওঠে। অসতর্ক আরোহী পেলে লেজের বাড়ি মেরে ফেলে দিতে পানিতে, তারপর, গাঁপ!
জলহস্তীর ভয় আপাতত তেমন নেই। ঝড়ের দাপটে পানিতে থাকতে পারছে না ওরা, গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে হ্রদের মাঝে মাঝে জেগে ওঠা দ্বীপে। ওরকম একটা দ্বীপের কিনার দিয়ে চলার সময় ধুড়ুম করে হঠাৎ কিসের সঙ্গে যেন বাড়ি লাগলো। ভেলার। মুহূর্ত পরেই দেখা গেল, এক পাশ ঠেলে উঠছে ওপর দিকে। নিচে থেকে কিসে যেন ঠেলে কাত করে যাত্রীদের ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। সুবিধে করতে না পেরে বেরিয়ে এলো ওটা। বিরাট এক মদ্দা হিপো, মানে জলহস্তী। বিরাট হাঁ করে মোটা মোটা দাঁত দেখিয়ে ভেঙচি কাটলো, তারপর বন্ধ করলো। এমন বিকট শব্দ হলো, মনে হলো সিন্দুকের ডালা পড়েছে। একটা বলে সুবিধে করতে পারেনি, ওটার একটা সহকারী থাকলেই দিয়েছিলো ভেলীর সর্বনাশ করে।
দিনটা কাটলো কোনোমতে, এলো অন্ধকার রাত। বুনো হ্রদে উত্তাল ঝড়ের মাঝে শুরু হলো যেন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা, এই সময়, বহু যুগ পরে যেন চোখে পড়লো দূরে ক্ষীণ আলো, সেই সঙ্গে জাগলো। আশার আলো। রুবনডো আইল্যাণ্ড! ক্ষণিকের জন্যে দেখা গেল আলোটা, তারপরেই মুষলধারে বৃষ্টি আর কুয়াশার মাঝে হারিয়ে গেল। শুধু আন্দাজের ওপর ভেলা চালাচ্ছে চালক। এই হ্রদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট পরিচয় না থাকলে অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিতো।
কিছুক্ষণ পর আবার দেখা গেল আলো।ঠিক সময়মতো। আরেকটু হলেই পাশ দিয়ে সরে চলে গিয়েছিলো ভেলা। এমনিতেই অনেকখানি বিপথে সরে গেছে।
যা-ই হোক, দুর্গম নৌ-যাত্রার অবসান ঘটলো অবশেষে। দ্বীপের কিনারে ছোট একটা খাড়িতে ঢুকলো ভেলা। বাতাস তেমন ঢুকতে পারে না এখানে, ফলে ঢেউও খোলা হ্রদের তুলনায় অনেক কম। চেঁচিয়ে ডাকলো চালক।
সাড়া এলো তীর থেকে।
কাছে এসে দাঁড়ালেন এখানকার ওয়ারডেন। নাম জানালেন, অরিফিয়ানো ডেল মারটিগা হিসটো। হেসে বললেন, খুব লম্বা নাম, না? তোমাদের এতো কষ্ট। করতে হবে না। শুধু অরিফ বললেই চলবে, খাঁচাটা নামাতে সাহায্য করলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কি নিয়ে এসেছো?
একটা ওকাপি।
সেটা বুঝতেই পারছি। মিস্টার, না মিসেস?
প্রশ্নটা অদ্ভুত মনে হলো তিন গোয়েন্দার কাছে। পুরুষ না মাদী, তাতে কি এসে যায়?
মিস্টার,জবাব দিলো কিশোর।
গুড। এই দ্বীপে আর একটা মাত্র ওকাপি আছে, মিসেস। বংশবৃদ্ধির চান্স হলো। খুব দুর্লভ জানোয়ার, ওকাপির কথা বলছি। দাঁড়াও, আসছি।
দৌড়ে ছোট কেবিনে গিয়ে ঢুকলেন ওয়ারডেন। ফিরে এলেন একটা বড় তোয়ালে নিয়ে। ভিজে একেবারে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে গোয়েন্দাদের, ওরা ভাবলো ওদের জন্যে এনেছেন। তা নয়। খাঁচার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। মোলায়েম হাতে ওকাপিটার গা মুছতে শুরু করলেন।
একেবারে জামাই আদর। ওকাপির গায়ের প্রতিটি ইঞ্চি যত্ন করে মুছলেন মিস্টার হিসটো, ওটার ঠাণ্ডা শরীর গরম করলেন। ব্যস, হয়েছে, আর ঠাণ্ডা লাগার ভয় নেই।
খাওয়ার কি ব্যবস্থা? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
আছে। বনের মধ্যে ঢুকলেই পেয়ে যাবে। যেদিকে ফিরবে সেদিকেই খাবার। পানির তো অভাবই নেই…।
তাহলে কি এখন শুধু ছেড়ে দিলেই হবে? বাধা দিয়ে বললো রবিন।
সেটাই উচিত। নিজের দায়িত্ব নিজেই নেয়া ভালো। এই দ্বীপে ওর কোনো শত্রু নেই। সিংহ, চিতাবাঘ, পোচার, কিচ্ছু না।
বড় জানোয়ার নেই? কিশোর জানতে চাইলো।
আছে। নিরাপদে রাখার জন্যে গণ্ডারের মতো বড় জানোয়ারও তুলে আনা হয়েছে। তবে মাংসাশী কাউকেই আনা হয়নি। ফলে তৃণভোজীদের বেহেশত হয়ে দাঁড়িয়েছে রুবনড়ডা দ্বীপ।
গা গরম হয়েছে। খাঁচার দরজা খোলা। দীর্ঘ দিন বন্দি থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছে, তাই সুযোগ পেয়ে আর দেরি করলো না মিস্টার ওকাপি। খাঁচা থেকে বেরিয়ে রওনা হয়ে গেল তার সবুজ বেহেশতের দিকে।
আমি কিন্তু ওটার খাবারের কথা বলিনি, আবার বললো মুসা। আমার পেটে এখন ছুঁচোর বেহেশত। সেই যে কবে কোন কালে খেয়েছি মনেই নেই। নাড়িভুড়ি সব হজম। পেটের চামড়াটাই আছে যা শুধু এখন….।
হো হো করে হেসে উঠলেন মিস্টার অরিফিয়ানো ডেল মারটিগা হিসটো। আরে তাই তো! ওকাপিটাকে পেয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম..চলো, চলো!
.
১৭.
গা মুছে, আগুনে হাত-পা সেঁকে গরম হয়ে খাবার খেতে খেতে মাঝরাত পেরোলো।
শোয়ার পর মিনিট খানেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো মুসা। রবিন দুই মিনিট। কিন্তু কিশোর জেগে রইলো আরও কিছুক্ষণ। ফেরার কথা ভাবছে। সাংঘাতিক ওই হ্রদের পানিতে আবার পনেরো ঘন্টা কাটানোর কথা ভাবতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে চাইছে তার। তারপর রয়েছে দুই ঘন্টার বিমানযাত্রা। কাল রাতের আগে কিছুতেই টিসাভোয় ফিরতে পারবে না। আর অন্ধকারে সরু ওই ল্যাণ্ডিং স্ট্রিপে প্লেন নামাতে পারবে মুসা?
কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো কিশোর, বলতে পারবে না। ঘুম ভাঙলো ডিম আর মাংস ভাজার চমৎকার সুগন্ধে।
নাস্তার টেবিলে সুখবর দিলেন ওয়ারডেন। বললেন, আমাদের লঞ্চে মুয়ানজায় যেতে পারবে। তাতে মাত্র সাত ঘন্টা লাগবে, অর্ধেকের বেশি সময় বাঁচবে তোমাদের। তবে একটা শর্ত আছে।
কী? আগ্রহে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কিশোর। ভাবতেই পারেনি, এরকম একটা সুবিধে পাবে। ওই ভেলায় আর পা রাখতে চায় না সে, লঞ্চে করে যাওয়ার জন্যে যে-কোন শর্তে রাজি।
তোমাদের প্লেনে করে টিসাভোয় লিফট দিতে হবে আমাকে, ওয়ারডেন বললেন। টমসনের সঙ্গে কিছু জরুরী আলোচনা আছে। রুবনড়ডায় চারটে গণ্ডার চালান দেয়ার ব্যাপারে।
ফেরার পথেও ঝড় এলো কয়েকবার। তবু, ভেলার তুলনায় লঞ্চে করে যাওয়াটাকে মনে হলো আনন্দভ্রমণ। দুপুরের পর বিমানে চড়লো ওরা। উড়ে চললো রহস্যময় সেরেঙ্গেটি প্লেইন-এর ওপর দিয়ে।
একটা জিনিস দেখাবো তোমাদেরকে, হিসটো বললেন। ওই যে কাটা দাগটা দেখছো, ওর ওপর দিয়ে যাও।
লম্বা গভীর একটা খাত, অনেকটা গিরিখাতের মতো দেখতে। ওটার ওপর দিয়ে উড়ে চললো মুসা।
কি যেন মনে করার চেষ্টা করছে রবিন। বললো, ওলডুভাই গর্জ না ওটা?
অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন ওয়ারডেন। ডক্টর লীকি-র নাম তাহলে শুনেছো?
শুনেছে কিশোরও।
এঁকেবেঁকে গেছে গর্জ, ঠিক ওটার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে বিমান চালালো মুসা। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ বাঁক ঘুরে অন্যপাশে আসতেই লোকগুলোকে দেখা গেল, ফাটলের তলায় খুঁড়ছে। এঞ্জিনের শব্দে মুখ তুলে তাকালো। হাত নাড়লো, ওয়ারডেনও হাত নেড়ে জবাব দিলেন। দেখতে দেখতে ওদেরকে পেছনে ফেলে এলো বিমান।
মুসা এই গর্জের নাম শোনেনি। জিজ্ঞেস করলো, কি দেখাবেন বলেছিলেন?
দেখলে না? ওয়ারডেন বললেন। মাটি খুঁড়ছে।
সেটা এমন কি স্পেশাল ব্যাপার হলো?
ও, ওলডুভাইয়ের নাম তাহলে শোনননি তুমি? অনেক বছর আগে ডক্টর লীকি বিশ লক্ষ বছরের পুরনো আদিম মানুষের হাড় খুঁজে পেয়েছিলেন ওখানে। সারা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে গিয়েছিলো তখন। তার পর থেকেই লেগে আছে বিজ্ঞানীরা। আরও পুরনো ফসিল পাওয়া যায় কিনা খুঁজছে।
অ, আদিম মানুষের ব্যাপারে আগ্রহ নেই মুসার। প্লেন ঘোরানো?
ঘোরাও।
পৃথিবীর বৃহত্তম জ্বালামুখ দেখালেন ছেলেদেরকে ওয়ারডেন। অদ্ভুত নাম মুখটার, নৃগোবরাংগোররা। বহু দিন আগেই মরে গেছে আগ্নেয়গিরিটা। জ্বালামুখে চারপাশের দেয়াল আড়াই হাজার ফুট উঁচু। দেয়ালের গোড়া থেকে শুরু হয়েছে ঘন সবুজের রাজত্ব, ছড়িয়ে গেছে দেড়শো বর্গমাইল। ঘন বনের মাঝে মাঝে বিস্তীর্ণ। তৃণভূমি, কোথাও বা নীল হ্রদ। জন্তুজানোয়ারে বোঝাই এই এলাকা।
অনেক জানোয়ার দেখা যাচ্ছে, কিশোর বললো।
কি কি জানোয়ার? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
চলো, নিজের চোখেই দেখবে, ওয়ারডেন বললেন। নিচে দিয়ে ওড়ো।
সিংহ, হাতি, গণ্ডার অনেক দেখা গেল। তৃণভূমিতে চরছে হাজার হাজার গরু-ছাগল-মোষ। পোষা। মাঝে মাঝে লাঠি হাতে লম্বা মাসাই রাখালদের দেখেই সেটা বোঝা যায়।
জ্বালামুখ পেছনে ফেলে এলো ওরা। সামনে দেখা গেল বিশাল এক হ্রদ, ওটার নাম লেক মনিয়ারা, জানালেন ওয়ারডেন। হ্রদের পানি নীল নয়, কালোও নয়, আশ্চর্য লাল! কাছে আসার পর বোঝা গেল কারণটা। কোটি কোটি ফ্ল্যামিংগো ভাসছে, সাঁতার কাটছে হ্রদের পানিতে এত ঘন হয়ে, দূর থেকে আলাদা করে চেনা যায় না, মনে হয় হ্রদের পানিই বুঝি লাল।
এতো পাখি থাকে কি করে একখানে! বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
থাকে যেমন, মরেও, ওয়ারডেন বললেন। আগে এতো মরতো না, ইদানীং শুরু হয়েছে। কেন যেন হ্রদের পানি অতিরিক্ত লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে লবণ, পাখিগুলোর পায়ে দানা জমে যায়। জমে জমে তিন-চার ইঞ্চি পুরু হয়ে গেলে পা বেজায় ভারি হয়ে যায়, তখন আর উড়তে পারে না ফ্ল্যামিংগো। এই হ্রদে এখন আর ওদের খাবার নেই। অন্য জায়গা থেকে খেয়ে আসতে হয়। উড়তে না পারলে যেতেও পারে না, না খেয়ে মরে।
ফিরে আসে কেন?
হয়তো বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে যেতে মন চায় না, রসিকতা করলো রবিন।
আসলেও কিন্তু তাই, ওয়ারডেন বললেন। আদিম কোনো প্রবৃত্তি কাজ করছে পাখিগুলোর রক্তে তাই লেক মনিয়ারায় ফিরে ফিরে আসে।
ওদের বাঁচানোর কোনো উপায় নেই? জানতে চাইলো কিশোর।
বাঁচাতে হলে হ্রদের পানির লবণ কমাতে হবে, সেটা সম্ভব নয়। ওই যে, ছেলেগুলোকে দেখছো, ওরা বাঁচানোর চেষ্টা করছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পা থেকে লবণ ভেঙে দিচ্ছে, যাতে উড়ে যেতে পারে।
যাক, আফ্রিকান ছেলেরা তাহলে সচেতন হয়েছে, খুশি হলো মুসা। বুড়োগুলোর মাথা থেকে শয়তান নামলেই এখন বেঁচে যেতো অনেক জানোয়ার।
মাউন্ট কিলিমানজারোর ওপর দিয়ে আসার সময় এক ঝলক বরফ-শীতল বাতাস এসে লাগলো গায়ে। সরে আসতেই আবার গরম বাতাস। চোখে পড়লো টিসাভো ন্যাশনাল পার্ক।
অফিসেই আছেন ওয়ারডেন টমসন। হিসটোকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন। আন্তরিক শুভেচ্ছা জানালেন একে অন্যকে।
নিরাপদে ওকাপি আর বানরটাকে রেখে এসেছে, টমসনকে শুধু একথা জানিয়ে ব্যান্ডায় রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। গোসল সেরে এসে পরে সব কথা। খুলে বলবে।
দরজার নিচে ফেলে রাখা কাগজটা আগে রবিনের চোখে পড়লো। নিচু হয়ে। তুলে নিলো। ভঁজ খুলে পড়লো। গম্ভীর হয়ে গেল চেহারা। কিশোরের হাতে তুলে দিতে দিতে বললো, হুমকি দিয়েছে।
জোরে জোরে পড়লো কিশোরঃ : বাড়ি যাও, বিচ্ছুরা। দ্বিতীয়বার আর সাবধান করবো না। নইলে মরবে, জানোয়ারগুলোর মতো। মনে রেখো, দুনিয়ায় এখনো এমন কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে মানুষের ট্রফি সাজিয়ে রাখা হয়।
–এল জে এস।
এল জে এস মানে কি? মুসা বললো। লঙ জন সিলভার?
তাছাড়া আর কে? চিন্তিত দেখাচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধানকে।
ফালতু হুমকি না তো?
মনে হয় না। সে সিরিয়াস লোক। যা বলেছে করবে। আর শুধু সে কেন? কোটি কোটি ডলার কামানোর জন্যে দুনিয়ার অনেক লোকই মানুষ খুন করতে দ্বিধা করবে না।
তাহলে? বাড়ি ফিরে যাচ্ছি?
মাথা খারাপ। একটা শয়তানের শাসানিতে ভয়ে পালাবো? অসম্ভব। সিলভারকে ব্রোঞ্জ বানিয়ে ছাড়বো আমি, দাঁতে দাঁত চাপলো কিশোর।
আমিও, দৃঢ় কণ্ঠে বললো মুসা। টিসাভো থেকে পোচার উচ্ছেদ না করে যাচ্ছি না আমি।
কিন্তু ব্যাটাকে ধরি কিভাবে? প্রশ্ন রাখলো রবিন।
দেখা যাক, কিশোর বললো। বুদ্ধি একটা বের করতে হবে। পাঁচ মাইল লম্বা যে ট্র্যাপ-লাইনটা দেখেছিলাম, কাল সকালে যাবো ওখানে। এবার আর পোচার নয়, সিলভারকে ধরার দিকে নজর দেবো।
.
১৮.
সেরাতে গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। ভোর রাতে আবার ঘুম ভাঙলো, শুনলো, চলে যাচ্ছে গাড়িটা।
সকালে নাস্তার পর ট্র্যাপ-লাইনে যাবার জন্যে তৈরি হলো গোয়েন্দারা। সঙ্গে যাবে ওয়ারডেনের কয়েকজন রেঞ্জার আর তিরিশজন মাসাই। হিসটোর সঙ্গে জরুরী কাজ আছে টমসনের, তিনি যেতে পারছেন না। তবে অসুবিধে নেই, রেঞ্জারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিলেন তিনি, কিশোরের কথা যেন মেনে চলে।
ট্র্যাপ-লাইনের মাইল খানেকের মধ্যে থামলো গাড়ির মিছিল।
সাপ্লাই ভ্যানে টিয়ার গ্যাসের ক্যানূ আছে, মাসাইদের বললো কিশোর। সবাই একটা করে নিয়ে এসো, কিভাবে কি করতে হবে বুঝিয়ে দিলো সে।
আবার এগোলো গাড়ির মিছিল।ট্রাপ-লাইনের কয়েক শো গজ দূরে এসে থামলো, আগের বার এক মাইল লম্বা লাইনটার সামনে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলো, সেভাবে। পোচারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে জোরে জোরে হর্ন বাজাতে লাগলো। লাইনের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করলো কালো কালো মুখ। বারোজন মাসাইকে নিয়ে, ঘুরে, পোচারদের ক্যাম্পের পেছনের বনে গিয়ে ঢুকলো কিশোর। রবিন আর মুসাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে এসেছে।
আগের বারের কৌশল এবারেও করতে পারে সিলভার। দলের পেছনে নিরাপদ জায়গায় থাকতে পারে। যদি দেখে পোচাররা হেরে যাচ্ছে, চুরি করে পালানোর চেষ্টা করবে আগের বারের মতোই। বনের ভেতর দিয়ে ছাড়া অলক্ষ্যে। যাওয়ার জায়গা নেই, তাই এখানে চলে এসেছে কিশোর।
মাসাইদের নিরস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাহস পেয়ে গেল পোচাররা। তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে গেল। বাধা আসছে না দেখে সাহস আরও বাড়লো। মাসাইদের টিটকারি মারতে মারতে এগুলো বল্লম হাতে।
ইঙ্গিতের জন্যে বার বার মুসার দিকে তাকাচ্ছে মাসাইরা।
পোচাররা পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে চলে এলে প্রথম ক্যানূটা ছুঁড়ে মারলো মুসা। মারো! বলে রবিনও তার হাতেরটা ছুঁড়লো।
উড়ে গেল এক ঝক ক্যান। জন্তু-খুনীদের সামনের শক্ত মাটিতে পড়ে ফাটলো একের পর এক। চোখের পলকে ওদেরকে ছেয়ে ফেললো হলদে-সাদা ধোয়া। কাশতে শুরু করলো পোচাররা। দম বন্ধ হয়ে আসছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আতঙ্কে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে শুরু করলো কেউ কেউ, লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লম্বা ঘাসে নাক গুঁজে ধোয়া থেকে বাঁচতে চাইলো। কয়েকজন টলতে টলতে ছুট দিলো কুঁড়ের দিকে।
ঠিক এই সময় বন থেকে বেরিয়ে উল্টো দিক থেকে ছুটে এলো কিশোর। সিলভারকে খুঁজতে লাগলো। কোথাও দেখা গেল না তাকে। মাটিতে বুটের ছাপও নেই। আধ ঘন্টা ধরে খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে কিছু পোচার, কিন্তু চোখে ভীষণ জ্বালা। পানি গড়াচ্ছে। দেখতে পারছে না ঠিকমতো। লড়াইয়ের উদ্যম একেবারেই তিরোহিত হয়েছে। ঘিরে ফেলা হলো ওদের।
মোমবাসায় জেলে গিয়ে কটা দিন সুখে কাটিয়ে আসার ইচ্ছে যাদের ছিলো, হতাশ হতে হলো তাদেরকে।
গাঁয়ে ফিরে যেতে বলুন ওদের, মুগামবিকে বললো কিশোর। হুঁশিয়ার করে দিন, আবার জানোয়ার মারতে এসে ধরা পড়লে কপালে অনেক দুঃখ আছে।
পোচাররা চলে গেল।
ফাঁদে আটকা পড়া জানোয়ারগুলোর মাঝে যেগুলো তখনও বেঁচে রয়েছে, ছেড়ে দেয়া হলো। বেশি জখমীগুলোকে গাড়িতে তুলে নেয়া হলো চিকিৎসার জন্যে। আর যেগুলো মরে গেছে তো গেছেই। সমস্ত ফাঁস, ফাঁদ তুলে নেয়া হলো।
সব কটা কুঁড়ে আর পাঁচ মাইল লম্বা, ঘাসের বেড়া পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া। হলো।
লজে ফিরে এলো গাড়ির মিছিল। সব কথা টমসনকে জানালো তিন গোয়েন্দা। সিলভারকে পায়নি বলে দুঃখ করলো অনেক।
মন খারাপ করো না, সান্তনা দিলেন ওয়ারডেন। ব্যাটাদের অনেক ক্ষতি করে দিয়ে এসেছে। ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কম করোনি। যাবে কোথায় সিলভার? আজ হোক কাল হোক, ধরা তাকে পড়তেই হবে। ও, ভালো কথা, জজ নির্মল পাণ্ডা তোমাদের গুড লাক জানিয়েছেন।
কোথায় উনি? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
তখন বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কাল রাতে এসেছিলো, ভোরে চলে গেছে তাড়াহুড়ো করে। জরুরী কাজ নাকি আছে।
আমরা যে আজ পোচার ঠেঙাতে যাবো, সেকথা বলেছিলেন ওকে?
নিশ্চয়। পোচারদের ব্যাপারে সব সময় তার আগ্রহ।
দ্বিধা করে শেষে বলেই ফেললো কিশোর, স্যার, জজ সাহেব আপনার ঘনিষ্ঠ। বন্ধু। কথাটা কিভাবে নেবেন জানি না। একটা প্রশ্ন জাগছে আমার মনে, উনি কি সত্যি আমাদের পক্ষে না বিপক্ষে?
খুব অবাক হলেন ওয়ারডেন। ভুরু কুঁচকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন কিশোরের দিকে। দেখোএমন একজন লোককে সন্দেহ করছো, যাকে কোনো মতেই অবিশ্বাস করা উচিত না। এদেশে পোচিঙের বিরুদ্ধে যারা সব চেয়ে বেশি শোরগোল তুলেছেন, জজ সাহেব তাঁদের একজন। জন্তুজানোয়ারের জন্যে নিবেদিত প্রাণ। আমাদের বিপক্ষে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। এই সেদিনও তোমাদের সামনেই আমার প্রাণ বাঁচালো।
শুধু মুখে মুখেই জানোয়ারকে ভালোবাসার কথা বলে? না করেও কিছু?
অবশ্যই করে।
ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা চেক বের করলেন টমসন। টেবিলের ওপর রেখে কিশোরের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, এই দেখো, কাল রাতে দিয়েছে। ওর সময়। নেই। আমাকে ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটিতে পাঠিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছে।
দুহাজার পাউণ্ডের চেক।
এবার বুঝলে তো? কিশোরকে নীরব দেখে আবার বললেন ওয়ারডেন। শুধু কথা নয়, কাজেও করে দেখায়। এদেশে একজন জজের বেতন আর কতো বলো? তার থেকে জমিয়ে দুহাজার পাউণ্ড জন্তুজানোয়ারের উপকারের জন্যে দান। করা…না,কিশোর, নির্মল সত্যি মহৎ।
কি জানি, স্যার, সন্দেহ গেল না কিশোরের। হয়তো আমিই লোক চিনতে ভুল করেছি। সাধারণত এমন ভুল হয় না আমার।
ভুল মানুষেরই হয়, কথাটা সামান্য রুক্ষই শোনালো।
ব্যানডায় ফিরে এলো কিশোর। মুসা আর রবিনকে জানালো যা যা কথা হয়েছে।
কি জানি, হয়তো সত্যি ভুল করেছো, মুসা বললো। লোকটাকে দেখে কিন্তু খারাপ মনে হয় না।
না, ভুল আমি করিনি, জোর দিয়ে বললো কিশোর। অসম্ভব ধড়িবাজ লোক ওই জজ।
তাহলে টাকা যে দিলো? রবিন বললো।
সেটা তো খুব সহজ একটা ব্যাপার। ওই ধ্যাটা কি আর জজের বেতন দিয়ে চলে? কোটিপতির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। টাকার অভাব আছে নাকি? ওর কাছে দুহাজার পাউও কিচ্ছু না। কিন্তু দান করে ওয়ারডেনের চোখে ভেলকি লাগিয়ে দিয়েছে। আমি শিওর, সিলভারের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ওর।
সেটা নাহয় আমরা বিশ্বাস করলাম, ওয়ারডেনকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারবে না। করাতে হলে জোরালো প্রমাণ দরকার।
সেটাই জোগাড় করতে হবে আমাদের, যেভাবে হোক।
কিন্তু কিভাবে? মুসা প্রশ্ন করলো।
জানি না এখনও, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার গোয়েন্দাপ্রধান। আজকে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে? সিলভারকে পোচারদের কুঁড়েতে পাওয়া যায়নি। কেন? কারণ, আগেই তাকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। আমরা আজ পোচার ধরতে যাবো, একথা কাল রাতে জজকে বলেছেন টমসন। খুব ভোরে উঠে চলে গেল সে। কোথায়? নিশ্চয় পোচারদের ক্যাম্পে, সিলভারকে বলার জন্যে, হাতের উল্টো পিঠ কপালে ঘষলো কিশোর। তবে সবই আমার অনুমান। আদালতে টেকে, এমন প্রমাণ জোগাড় করতে হবে?
তাহলে সেই চেষ্টাই করা যাক, মুসা বললো। এখানে বসে থেকে সেটা হবে। না নিশ্চয়!
.
১৯.
পোচারদের আরেকটা ক্যাম্প আবিষ্কার করেছে তিন গোয়েন্দা।
পাহাড় আর উপত্যকার ওপর দিয়ে চক্কর মারছে মুসা। বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে তন্নতন্ন করে নিচের এলাকা খুঁজছে কিশোর, মাঝে মাঝে যন্ত্রটা তুলে দিচ্ছে রবিনের হাতে। আরেকটা ট্র্যাপ-লাইন খুঁজছে ওরা। লাইন থাকলে পোচার থাকরে, পোচার থাকলে সিলভারকে পাওয়ার সম্ভাবনা।
লাইন দেখা গেল না। শুধু কয়েকটা ঘাসের কুঁড়ে। মানুষ চোখে পড়লো না। আশেপাশে মাইলের পর মাইল জুড়ে একই অবস্থা, নির্জন।
ভয় পেয়ে চলে গেছে হয়তো, রবিন বললো।
আমার মনে হয় না, মাথা নাড়লো কিশোর। বনে গিয়ে লুকিয়েছে বড় জোর। মুসা, ওই ডোবাটার কাছে যাও তো।
জানোয়ার গিজগিজ করছে ডোবার পাড়ে; হাতি, গণ্ডার, জেব্রা, হরিণ; দিবাচর আফ্রিকান যতো প্রাণী আছে, প্রায় সব। শুধু পোচার বাদে।
হঠাৎ, ফোয়ারার মতো ছিটকে উঠলো ডোবার পানি, তারপর কাদা, সব শেষে ধোয়া। কানে এলো বিস্ফোরণের শব্দ। বাতাস অস্থির হয়ে যাওয়ায় সাঙ্ঘাতিক দুলে উঠলো বিমান। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ছোট ছোট জানোয়ার, বড়গুলো সুতো-ছেঁড়া গ্যাস-বেলুনের মতো লাফিয়ে উঠলো শূন্যে। মুহূর্ত আগে যে জায়গাটা স্বর্গ ছিলো ওদের জন্যে, সেটা হয়ে গেল নরক। শত শত জীবের গোরস্থান।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। ডিনামাইট!
কিছুই বললো না কিশোর। নীরবে মাথা দোলালো শুধু।
বন থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসতে লাগলো পোচারের দল। জখমী বড়। জানোয়ারগুলোকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে মারতে শুরু করলো। ছোট ছোট জানোয়ারের মাথা, লেজ, আর দরকারী অঙ্গ কেটে নিতে লাগলো জীবন্ত অবস্থায়ই। রোমহর্ষক দৃশ্য!
উত্তেজনায় প্রথমে প্লেনটা দেখতে পায়নি পোচাররা, খেয়াল করতেই লুকিয়ে পড়ার জন্যে দৌড় দিলো বনের দিকে। তাড়াতাড়ি লজে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলো মুসাকে কিশোর।
ওয়ারডেনকে পাওয়া গেল না, জরুরী কাজে বেরিয়েছেন হিসটোকে নিয়ে। দেরি করলো না কিশোর। যতো দ্রুত পারলো, মাসাইদের নিয়ে ফিরে এলো সেই ডোবাটার ধারে।
কিন্তু, এতো তাড়াতাড়ি করেও কিছু করতে পারলো না। অনেক সময় গেছে। ইতিমধ্যে যা যা নেয়ার, নিয়ে কেটে পড়েছে পোচাররা। ডোবার ধারে জন্তুজানোয়ারের খণ্ডিত, ক্ষত-বিক্ষত লাশ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। পানিতেও অসংখ্য মৃতদেহ। তুলে না ফেললে পচে নষ্ট হবে ডোবার পানি। ওই পানি খেয়ে মড়ক লাগবে জানোয়ারের, পালে পালে মরবে।
কাজে লেগে পড়লো রেঞ্জার আর মাসাইরা। অমানুষিক পরিশ্রম করে সমস্ত মৃতদেহ তুলে আনলো পানি থেকে। ডাঙায় ফেলে রাখলে অসুবিধে নেই। খেয়ে সাফ করে ফেলবে শবভোজী প্রাণীরা। পরদিন সকালে এলে হাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না।
সন্ধ্যার পর লজে ফিরলো দলটা। ভীষণ ক্লান্ত। পেটে খিদে। মেজাজ খারাপ।
.
পরদিন সকালে আবার বিমান নিয়ে বেরোলো গোয়েন্দারা। সরে এলো উত্তরে, চল্লিশ মাইল দূরে…পঞ্চাশ …ষাট…ডানে খানিকটা মোড় নিয়ে পেরিয়ে এলো। আরো দশ মাইল। চোখে পড়লো ধোঁয়া।
কাছে গিয়ে যা দেখলো, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। বেশ কিছুটা জায়গা ঘিরে শুকনো ঘাসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। জ্বলছে দাউ দাউ করে। আগুনের বৃত্তের মাঝে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে অনেকগুলো হাতি। বেরোনোর পথ পাচ্ছে না।
পোচাররা রয়েছে নিরাপদ দূরত্বে।
বারো ফুট লম্বা হাতিঘাসের জঙ্গলে নিশ্চিন্তে চরছিলো হাতিগুলো। ভাবতেই পারেনি ওদের ওপর নেমে আসবে নির্মম মৃত্যুর করাল থাবা, জীবন্ত পুড়ে কাবাব হবে। বড় বড় কয়েকটা জানোয়ার মরিয়া হয়ে ছুটলো আগুনের ভেতর দিয়েই। ফলে মৃত্যু হলো আরও নির্মম, আরও যন্ত্রণাদায়ক। আগুনের বাইরে বেরিয়ে অদ্ভুত ভাবে নাচতে শুরু করলো, উন্মাদ হয়ে গেছে যেন। আসলে, পায়ের পাতা পুড়ে গেছে ওগুলোর। মাটিতে পা রাখতে পারছে না। সেই সাথে রয়েছে শরীরের অন্য জায়গা পুড়ে যাওয়ার জ্বালা। মরবে ওগুলো, জানা কথা। বৃত্তের ভেতরে থাকলেই বরং ভালো ছিলো, তাড়াতাড়ি মরতো। পোড়া পায়ের পাতা নিয়ে হাঁটতে পারবে না। খাবার, বিশেষ করে পানির অভাবে কাহিল হবে। অসহায় শিকারে পরিণত হবে হায়েনা, কিংবা হিংস্র পোচারের।
নগ্ন কালো পিশাচগুলোর মাঝে আরেকটা দাড়িওয়ালা পিশাচকে দেখা গেল, গায়ে বুশ জ্যাকেট, পরনে সাফারি ট্রাউজার।
সিলভার! হাত তুলে দেখালো রবিন।
শাঁ করে আরও কাছে বিমান নিয়ে গেল মুসা, নিচে নামলো। শব্দ শুনে ওপর দিকে চেয়ে হাসলো সিলভার, হাত নাড়লো।
শয়তান! দাঁতে দাঁত পিষলো মুসা। ব্যাটা জানে, এখন আমরা কিছু করতে পারবো না। লজে গিয়ে দলবল নিয়ে আসতে আসতে চলে যাবে।
চলো, জলদি ফিরে চললা, কুইক! তাড়া দিলো কিশোর। দেখিই না এসে, কিছু করা যায় কিনা?
কিছুই করা গেল না। চলে গেছে পোচাররা। তাড়াহুড়োয় যা যা নিতে পেরেছে; নিয়ে গেছে। লেজ, পায়ের পাতা, চোখের পাপড়ি, কান। তবে সব চেয়ে দামী জিনিসটাই ফেলে যেতে হয়েছে। দাঁত।
হাতির দাঁত খুলে নেয়া খুবই কঠিন কাজ। হাড় আর মাংসে শক্ত হয়ে লেগে থাকে, যেন সিমেন্টে গাঁথা। কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে কেটে বের করতেও কষ্ট হয়। সহজ উপায় হলো, লাশটা ফেলে রাখা। পচে গলে মাংস খসে গেলে তখন। নেড়েচেড়ে গোড়া থেকে খুলে নেয়া যায় দাঁত। কিন্তু তার জন্যে অনেক সময় দরকার।
.
এরপর থেকে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল সিলভার আর তার খুনীর দল। পাহাড়, জঙ্গল, তৃণভূমির ওপর চক্কর দিয়ে দিয়ে ফিরলো গোয়েন্দারা। কিন্তু কিছুই দেখলো না আর। ঘাসের কুঁড়ে নেই, ট্র্যাপ-লাইন নেই, ডিনামাইট ফাটলো না, আগুন লাগলো না।
পোচিং ছেড়ে দিলো নাকি ব্যাটারা? অবাকই হয়েছে রবিন। ভয় পেলো শেষমেষ!
ইবলিস কি আর শয়তানী ছাড়ে? প্লেন চালাতে চালাতে মন্তব্য করলো মুসা। লুকিয়েছে আরকি। হয়তো কিছুদিনের জন্যে গিয়ে গর্তে ঢুকেছে।
গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলো কিশোর। ঝট করে মাথা ফেরালো। কি বললে? গর্ত? তুড়ি বাজালো। ঠিক বলেছো! নিশ্চয় গর্তেই লুকিয়েছে। কোথায় যেন পড়েছি, হাতি ধরার জন্যে গর্ত খুঁড়ে রাখে, পিগমিরা। ওপরটা ঢেকে রাখে ডালপাতা দিয়ে। না দেখে হাতি গিয়ে পড়ে সেই গর্তে। ওপর থেকে তখন বড় বড় পাথর ছুঁড়ে আর বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে সেটাকে মেরে খেয়ে ফেলে।
একেবারে আদিম পদ্ধতি, বিড়বিড় করলো রবিন। প্রাগৈতিহাসিক মানুষও ওভাবে ম্যামথ শিকার করতো।
আরও একটা কাজ করে পিগমিরা, রবিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি গোয়েন্দাপ্রধান। জরুরী মুহূর্তে ওই গর্তকে বাংকার হিসেবেও ব্যবহার করে।
তারমানে, মুসা বললো। তুমি বলতে চাইছো, পোচাররাও হাতি ধরার গর্তকে বাংকার হিসেবে ব্যবহার করছে?
হ্যাঁ! আজ আর বেলা নেই। কাল সকালে এসে খুঁজবো।
লজে ফিরে দেখলো ওরা, জজ নির্মল পাণ্ডা হাজির।
এই যেছেলেরা, দেখেই হাসিমুখে বলে উঠলেন তিনি। খুঁজে পেয়েছো?
এখনও পাইনি। তবে পাবো, গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো কিশোর।
যাবে কোথায় শুয়োরের বাচ্চা? ইচ্ছে করেই গালিটা দিলো মুসা। আড়চোখে তাকালো জজের দিকে।
আমি হলে হাল ছেড়ে দিতাম, হাসি বিন্দুমাত্র মলিন হলো না জজের। তোমরাও ছাড়বে। এখনও বুঝতে পারছে না তো। আমরা কি আর কম চেষ্টা করেছি, কম খুঁজেছি? পাইনি। দেখো, চেষ্টা করে দেখো। পেলে তো ভালোই।
কিশোরের মনে হলো, জজের কথাবার্তা আর হাসির পেছনে কি যেন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। রাগে মুসার মতোই গাল দিয়ে উঠতে যাচ্ছিলো, অনেক কষ্টে সামলালো নিজেকে। শান্তকণ্ঠে বললো, আপনার মহানুভবতার কথা বলেছেন আমাকে মিস্টার টমসন। ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটিকে নাকি অনেক টাকা দান করেছেন।
বিগলিত হলো জজের হাসি, হাত নাড়লো বিনীত ভঙ্গিতে। ও কিছু না.। নেই তো, দেবো কোত্থেকে? ইচ্ছে করে দুনিয়ার সমস্ত ধন এনে লাগাই অসহায় অবলা জানোয়ারগুলোর উপকারে। কিন্তু কয় পয়সা আর বেতন পাই বলো? তা থেকেই কষ্টেসৃষ্টে জমিয়ে যা পেরেছি দিয়েছি।
খুব ভালো, খুব ভালো, আপনার অনেক দয়া। তবে ইচ্ছে করলে অনেক বেশি টাকা কামাতে পারেন। এদেশের অনেক জজ সাহেবই সেটা করছেন।
মানে? কালো হয়ে গেল জজের মুখ। হাসি উধাও।
ধরুন–মানে, আমি কল্পনা করতে বলছি আরকি আপনাকে আপনি মোটেই সৎ লোক নন। ভদ্রলোক নন, নিতান্তই ছোটলোক। পোচারদের সঙ্গে আপনার যোগসাজশ আছে। পোচারদের ধরে আপনার কোর্টে পাঠালে নানারকম অজুহাত দেখিয়ে বেশির ভাগকেই ছেড়ে দেন, অল্প কয়েকজনকে লোক দেখানো শাস্তি দেন, এই দুচার দিনের জন্যে। শহরে যতো বড় বড় অন্যায় ঘটে, সব দেখেও না, দেখার ভান করেন। কেন করেন? দুহাত ভরে টাকা দেয়া হয় আপনাকে, বিনিময়ে। কালো টাকার পাহাড় জমিয়ে ফেলছেন। অথচ এমন ভাব করে থাকেন, যেন আপনার মতো সৎ লোক আর হয় না, সবার জন্যে দরদ উথলে পড়ে। মাঝে মাঝেই টাকা দান করেন ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটিতে, যাতে আপনার ওপর সন্দেহ না পড়ে কারও।
রাগে লাল হয়ে গেছে জজের মুখ। মোলায়েম দৃষ্টি আর মোলায়েম নেই, যেন ইস্পাতের তলোয়ারের ধারালো ফলার চোখা মাথা। কিশোরের হৃৎপিণ্ডে বেঁধার চেষ্টা করছে। জোর করে শুকনো হাসি ফোঁটালেন মুখে। খুব কল্পনাপ্রবণ ছেলে তুমি। আমার মতো নিরীহ, জানোয়ার, দরজার দিকে চোখ পড়তে থেমে গেলেন।
খোলা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সিমবা। মুসাকে খুঁজতেই এসেছিলো বোধহয়, জজ সাহেবকে দেখে রেগে গেছে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। চাপা ঘড়ঘড় করতে করতে ঘরে ঢুকলো।
কি ভেবে জ্বলে উঠলো কিশোরের চোখ। দুই সহকারীকে বললো, চলো, যাই।
অবাক হলো রবিন আর মুসা, কিন্তু কিছু বললো না। কিশোরের এই অদ্ভুত
ব্যবহারের নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। পিছু পিছু বেরিয়ে এলো ওরা।
ঠোঁটে আঙুল রেখে ওদেরকে চুপ থাকতে বলে জানালার কাছে গিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিলো কিশোর।
বাঘের দৃষ্টিতে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছেন জজ। দরজার মুখে বসে, আছে ওটা। জোরে জোরে হাত নেড়ে ওটাকে ভাগার নির্দেশ দিলেন। নড়লো না সিমরা। গোঁ গোঁ করে উঠলো। দাঁত খিচালো আরেকবার! টেবিলে জোরে কিল মারলেন জজ। তারপর ছুটে গিয়ে ধা করে এক লাথি মারলেন কুকুরটার গলায়। আর যায় কোথায়। গাউক করে এসে তার বুকে দুপা তুলে দিলো সিমবা। টুটি কামড়ে ধরতে গেল। চোখের পলকে ছুরি বেরিয়ে এলো নিরীহ জজের হাতে। শিকারী কুকুরের বংশধর সিমবা, অসাধারণ ক্ষিপ্র। পেটে ছুরি বেঁধার আগেই লাফ দিয়ে সরে গেল। পরমুহূর্তে কামড়ে ধরলো জজের ছুরি ধরা হাত। ছুরিটা ফেলার পর তবে ছাড়লো।
হেরে গিয়ে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন জজ। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পুরো এক মিনিট চাপা গলায় গর্জালো বুনো-কুকুরের বাচ্চা, তারপর বেরিয়ে গেল।
জানালার কাছ থেকে সরে এলো তিন গোয়েন্দা। মুসাকে দেখে আবার তার কাছে চলে এলো সিমবা।
ব্যানডায় ফিরে বললো কিশোর, এই তাহলে নিরীহ জন্তু-প্রেমিক!
এতো সুন্দর একটা কুকুরের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে, মুসা বললো। ব্যাটা মানুষ নাকি?
তোমার কথাই ঠিক, কিশোর, রবিন বললো। জজ নির্মল পাণ্ডা লোক ভালো নয়।
কিন্তু কে বিশ্বাস করবে আমাদের কথা? ভুরু নাচালো গোয়েন্দাপ্রধান। প্রমাণ লাগবে। প্রমাণ!
.
২০.
আমার মনে হয় এখানেই আছে গর্তগুলো।
নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা, কন্ট্রোলে হাত। গর্ত চোখে পড়ছে না। তবে অনেক জায়গার ঝোপঝাড় কাটা, নিচে মাটি দেখা যায় না, ডালপাতা আর ঘাস বিছিয়ে আছে। কাছাকাছি রয়েছে বাওবাব গাছের ছোট জঙ্গল। অনেক ওপর থেকে মনে হয়, পেট ফেটে নাড়ীভুড়ি বেরিয়ে থাকা মরা জলহস্তী। মোটা, পেট ফোলা, বাকলও জলহস্তীর চামড়ার মতো দেখতে।
আশেপাশে কোথাও পোচারদের একটা কুঁড়ে চোখে পড়লো না। জনমানবের ছায়াও নেই। গর্ত থাকলে ঝোপঝাড়গুলোর মাঝেই আছে, নিচে লুকিয়ে রয়েছে পোচাররা।
নিচে না নামলে বোঝা যাবে না, কিশোর বললো। লজে ফিরে চলো। লোক নিয়ে আসবো।
আরও মিনিট দশেক ঠিকমতোই চললো বিমান। তারপর শুরু করলো গোলমাল। নাচছে, দুলছে, কাত হয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। পাড় মাতাল হয়ে গেছে। যেন।
ব্যাপার কি? বুঝতে পারছে না রবিন। পকেট?
নাহ, উঁকি দিয়ে বিমানের শরীরের বাইরের অংশ দেখার চেষ্টা করছে কিশোর। এয়ার পকেট নয়। তাছাড়া এখানে থাকার কোনো কারণ দেখছি না। অন্য কিছু হয়েছে।
সেটা কী? মুসা, কন্ট্রোলে কোনো গণ্ডগোল?
কি জানি। আমি কোথাও নড়চড় করিনি।
কিন্তু কিছু একটা তো হয়েছে!
ভীত ঘোড়ার মতো নাচতে শুরু করেছে এখন প্লেন।
ওই দেখো, চেঁচিয়ে বললো কিশোর। ডানের ডানাটা কেমন ঝুলে যাচ্ছে!
থরথর করে কাঁপছে ডানাটা, ঝরা পাতার মতো খসে উড়েই যাবে বুঝি যে কোনো মুহূর্তে।
বিমানের নাক সোজা রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মুসা, সম্ভব হচ্ছে না। কথাই শুনতে চাইছে না যেন ওটা। উঁচু একটা ক্যাােেক গাছের ওপর দিয়ে শা করে বেরিয়ে এলো, আর সামান্য নিচে নামলেই বাড়ি লেগে ছাতু হয়ে যেতো। বেড়ে গেছে দুলুনি।
কিছুতেই সামলাতে পারছি না, মুসার গলা কাঁপছে। ক্র্যাশ করবেই। তৈরি থাকো তোমরা। দরকার হলে লাফিয়ে পড়তে হবে।
বিমানের নাক নিচের দিকে। ধাক্কা লাগানোর জন্যে দ্রুত ধেয়ে আসছে যেন। মাটি। ইগনিশন অফ করে দিলো মুসা। এঞ্জিন বন্ধ, নিজের ইচ্ছেয় ছুটছে বিমান। চাকা লাগলো মাটিতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি…তীক্ষ্ণ একটা শব্দ, ছিঁড়ে পড়ে গেল ডান ডানা…বড় একটা উইয়ের ঢিবিতে তো লাগিয়ে স্থির হয়ে গেল প্লেন।
যাক, বাঁচলাম! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মুসা।
বাঁচার কি হলো? চেঁচিয়ে বললো রবিন।
আগুন লাগেনি। মরিনি আমরা। বাঁচলাম না?
বাঁচলাম বলা যাবে না এখনও। বেঁচে নামলাম। লজে ফিরে যেতে না পারলে..এই কিশোর, কি ভাবছো? কিছু বলছো না কেন?
উ! ফিরে তাকালো কিশোর। কি বলবো? ডানা ছেঁড়ার ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। কেন ছিড়বে?..চলো, নেমে দেখি।
পঞ্চাশ ফুটু পেছনে পড়ে আছে ডানাটা। কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা। ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখলো কিশোর। বিড়বিড় করলো আনমনে, আপনা-আপনি ছেঁড়েনি। ছেঁড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মানে! অবাক হয়ে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকালো দুই সহকারী।
বুঝতে পারছো না? এই দাগটা দেখো। স্বাভাবিক ভাবে ছিড়লে এটা অন্য রকম হতো, এতো নিখুঁত, সোজা নয়। করাত দিয়ে কেটে দুর্বল করে রাখা। হয়েছিলো ডানার গোড়া, যাতে কিছুক্ষণ ওড়ার পরই ভেঙে পড়ে। সম্মানিত বোধ করছি, তিক্ত কণ্ঠ, বিরক্তিতে কুঁচকে গেছে মুখ। কেউ একজন আমাদের ইমপরট্যান্ট লোক ভাবতে আরম্ভ করেছে। তার পাকা ধানে যাতে মই দিতে না পারি সে-জন্যে খুন করতে চেয়েছে।
ছড়ে যাওয়া কনুই ডলছে রবিন। বাঁ হাঁটুতে হাত বোলাছে মুসা। টিপ দিয়েই উহ করে উঠলো।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
না, কিছু না। নামার সময় বাড়ি লেগেছে হয়তো। ফুলে গেছে। তো, এখন কি করা? প্লেনে তো রেডিও নেই। আগুন জ্বেলে সংকেত দেবো?
লাভ হবে না। লজ এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে। এতো দূর থেকে কেউ দেখবে না। বরং যারা দেখবে, তারা পোচার। ছুটে আসবে। মরিনি দেখে খুশিই হবে। ওদেরকে জ্বালানোর শোধ তুলবে আমাদের ওপর।
তাহলে কি করবো? রবিন বললো। এখানেই বসে থাকবো? আমাদেরকে ফিরতে না দেখে খুজতে আসবে ওয়ারডেনের লোক।
আসবে বলতে পারি না, তবে খুঁজতে বেরোবে। একশো মাইল বুনো এলাকায় আমাদের খুঁজে বের করতে ওদের কহপ্তা লাগবে কে জানে! যখন পাবে, কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। একটাই উপায় আছে এখন। হেঁটে লজে চলে যাওয়া।
ব্যাগ-ট্যাগগুলো নেয়ার জন্যে প্লেনে ফিরে চললো ওরা। কিশোর লক্ষ্য করলো, সাংঘাতিক খোঁড়াচ্ছে মুসা। আরি, তোমার পায়ের অবস্থা তো খুব খারাপ। ভাঙেনি তো?
না।
কিন্তু পঞ্চাশ মাইল হাঁটতে তুমি পারবে না।
পারবো, পারবো। চলোই না।
কি করে পারবে? পঞ্চাশ ফুটই তো. পারছে না। বেশি চাপাচাপি করলে আরও ফুলবে। বয়ে নিতে হবে শেষে। তোমাকে বয়ে নেয়া আমার আর রবিনের কম্মো নয়।
তাহলে?
তুমি আর রবিন প্লেনেই থেকে যাও। আমি একাই যেতে পারবো।
আরে দূর, কি যে বলো। রবিনকে তুমি নিয়ে যাও। আমি একলা থাকতে পারবো। প্লেনে বসে বসে জাস্ট ঘুমাবো, হাসলো মুসা, তাতে যন্ত্রণার ছাপ।
না, আমি একা যাবো। প্লেনটাকে দেখার জন্যেও এখানে কাউকে থাকা দরকার। জখমী পা নিয়ে তুমি কিছু করতে পারবে না। রবিনকে থাকতেই হচ্ছে।
প্লেনটাকে দেখার আর কি আছে? আফ্রিকান জানোয়ারে প্লেন খায় না।
খায়। পোচাররা এসে দামী যন্ত্রপাতি নষ্ট করতে পারে। হাতি আর গণ্ডারও কৌতূহলী হতে পারে। কিছুদিন আগে মারকিনস-এ একটা বিমান পড়েছিলো, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলো ওটাকে গণ্ডারে। হায়েনারা আরও এক কাটি বাড়া। রবার ওদের খুব প্রিয়, টায়ার খেয়ে ফেলে। আহত না হলেও বিমানটাকে বাঁচানোর জন্যে কাউকে এখানে থাকতে হতো।
ঠিক আছে, বললো অনিচ্ছুক মুসা। থাকবো। হারামি পা-টা ব্যথা পাওয়ার আর সময় পেলো না।
বেশিক্ষণ থাকতে হবে না তোমাদের, কম্পাস, ম্যাপ আর ওয়াটার বটল গুছিয়ে নিতে নিতে হাসলো কিশোর। মাত্র তো পঞ্চাশ মাইল। সকাল-বিকাল তোমার সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে আজকাল ভালোই হাঁটতে পারি আমি, জানো। বারো-চোদ্দ ঘন্টার বেশি লাগবে না। তারপর ট্রাক নিয়ে ফিরে আসতে, ধরো, আরও দুই ঘন্টা। আমার বিশ্বাস, ওই মোল ঘন্টা বেঁচে থাকতে পারবে তোমরা।
কিন্তু, বিকেল হয়ে গেল, রবিন বললো। রাতে হাটবে? কাল সকালে গেলে হতো না?
রাতে হাঁটাই সুবিধে, আবহাওয়া ঠাণ্ডা। চাঁদও থাকবে। ভেবো না, আমি ঠিকই চলে যাবো। হুঁশিয়ার থেকো। সকালে ফিরে আসছি আমি।
কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরলো কিশোর। পেছন থেকে ডেকে বললো মুসা, এই শোনো, ভালো দেখে কয়েকটা স্যাণ্ডউইচ নিয়ে এসো। সারারাত হায়েনা তাড়িয়ে সকালে আমি নিজেও হায়েনা হয়ে যাবো।
হেসে উঠলো তিনজনেই।
.
বেলা ডুবতেই ঠাণ্ডা হয়ে এলো গরম বাতাস। বন থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। নিশাচর জানোয়ারেরা। প্রায় সবাই আগ্রহ দেখালো প্লেনটার প্রতি। পায়ে পায়ে এসে জমা হতে লাগলো–কেউ বসলো, কেউ দাঁড়িয়ে রইলো, চারপাশ ঘিরে। ভীতু যারা, দূরে রইলো। সাহসীরা এগিয়ে এলো। বেশি সাহসী কেউ কেউ এসে বিমানে উঠে সঙ্গী হতে চাইলো দুই গোয়েন্দার। ডানায় চড়ে বসলো বেবুনের দল। জানালায় নাক ঠেকিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো ভারভেট মাংকি।
চারটে গণ্ডার এসে হাজির হলো প্লেনের কাছে। বার কয়েক নাক টানলো, ঘোৎ ঘোঁৎ করলো। তেড়ে এলো একটা। কিন্তু আজব জানোয়ারটাকে নীরব। দেখে মাঝপথে থেমে আবার ফিরে গেল সঙ্গীদের কাছে। ব্যাটাকে নিয়ে কি করা। যায়, সেই আলোচনা চালালো যেন।
গণ্ডারগুলো যেন বোঝাতে চাইছে, তাদের এলাকায় থাকার কোনো অধিকার নেই এই আজব জন্তুটার। মাথা নুইয়ে শিং বাগিয়ে তেড়ে এলো একসঙ্গে। স্টর্কটাকে ধ্বংস করার জন্যে একটা গণ্ডারই যথেষ্ট। সেই জায়গায় চারটে মিলে কি করতে পারবে, ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেল দুই গোয়েন্দার। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইলো ওরা। প্লেন থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় দেয়ার ইচ্ছেটা দমন করলো অনেক কষ্টে।
গণ্ডারগুলো কাছে এসে গেছে, এই সময় সংবিৎ ফিরলো যেন মুসার। উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে জোরে জোরে চেঁচাতে শুরু করলো। রবিনও যোগ দিলো তার সঙ্গে।
থমকে গেল চার-দানব। ওরা বোধহয় মনে করলো, আজব জীবটাই বিচিত্র চিৎকার করছে। দ্বিধায় পড়ে গেল। একে আক্রমণ করা উচিত হবে কিনা ঠিক করতে পারছে না। ঘেৎ ঘোৎ করে ফিরে গেল আগের জায়গায়, আবার আলোচনা শুরু করলো।
গণ্ডারের মতো বদমেজাজী জানোয়ার আলোচনা করে একবার যে একমত হয়েছিলো, সে-ই বেশি। দ্বিতীয়বার আর পারলো না। তর্কাতর্কি করে নিজেরাই পোচার। লেগে গেল শেষে। প্রচণ্ড মারপিটের পর একেকটা চলে গেল একেক দিকে। হাঁপ ছাড়লো রবিন আর মুসা।
তীক্ষ্ণ নজর রেখে বিমানটার চারপাশে ঘুরছে গ্যাজেল হরিণ আর জিরাফ। ইমপালা হরিণেরা পেয়ে গেছে আরেক মজা। লাফিয়ে প্লেনের কে কতো ওপর দিয়ে যেতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় মেতেছে যেন। আড়াল থেকে বিদ্যুতের মতো বেরিয়ে এসে একটা হরিণের ওপর পড়লো চিতাবাঘ, মট করে ঘাড় ভেঙে ফেললো বেচারা প্রাণীটার।
সাঁঝের বাতাস চিরে দিলো একটা তীক্ষ্ণ চিত্তার। মুসা ভাবলো, মদ্দা হাতি। কিন্তু রবিনের জানা আছে ওটা কিসের ডাক, চিড়িয়াখানায় শুনেছে। ওরকম চিৎকার করতে পারে কোন প্রাণী, সেটা বইয়েও পড়েছে। গেছো হাইর্যাক্স। মাত্র ফুটখানেক লম্বা একটা নিশাচর জীব।
টুপ করে ঝরে গেল যেন গোধূলির শেষ আলোটুকুও। চাঁদ উঠতে সময় লাগবে। ঘন ছায়া নেমেছে বন, পাহাড় আর তৃণভূমি জুড়ে। কিলিমানজারোর তুষারে ছাওয়া চূড়াটাও ঢাকা পড়েছে অন্ধকারে। নীলচে-কালো আকাশের পটভূমিকায় এখন মস্ত এক ম্লান-ধূসর ছায়ামাত্র ওটা।
.
২১.
ঘুমানোর চেষ্টা করলো মুসা।
দূর! বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিলো। এরকম একটা সীটে ঘুমানো যায় নাকি? পা বাকা করে রাখতে হচ্ছে, তাতে ব্যথা আরও বেশি করছে। জানোয়ারের ভয় ইতিমধ্যে অনেকখানি কেটে গেছে। প্লেনের ডানার নিচে নরম ঘাসের বিছানা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারলো না গোয়েন্দা-সহকারী। ঝুঁকি নিয়েও নামলো নিচে।
ডানার নিচে ছায়া ছায়া অন্ধকার, উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার মাঝে বেশ প্রকট। ওখানেই গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। আশা করলো, এখানে চোখ পড়বে না হাতি, গণ্ডার কিংবা মোষের।
তবে আরেকটা মহা-বিপজ্জনক প্রাণীর কথা বেমালুম ভুলে গেল সে। সর্বনেশে পিঁপড়ে।
খবর পৌঁছে গেল পিপিলিকার রাজত্বে। দল বেঁধে পিলপিল করে এসে হাজির। হলো ওরা। আরামেই ঘুমিয়ে ছিলো মুসা, কুট করে কামড় লাগলো আহত পায়ে। পাত্তা দিলো না। ভাবলো, যন্ত্রণার পরিবর্তন ঘটছে। হাতে-পায়ে-গলায়-মুখে। একসাথে আরও কয়েকটা কামড় লাগতেই চোখ মেললো। দেরি করে ফেলেছে বেশ।
বুকের ওপর ঢলে পড়েছিলো রবিনের মাথা। চিৎকার শুনে ঝট করে সোজা হলো। দেখলো, উন্মাদ-নৃত্য জুড়েছে মুসা আমান। শরীরের যেখানে-সেখানে। চাপড় মারছে, টেনে ছিঁড়ে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে গায়ের কাপড়। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে।
আমাজানের জঙ্গলের কথা মনে পড়ে গেল রবিনের। কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের গায়ের গন্ধ আকৃষ্ট করে পোকামাকড়কে, এসে চড়াও হয়। ওখানেও মুসার ওপর চড়াও হয়েছিলো পিঁপড়েরা, এমনকি রক্তচোষা বাদুড় এসেও আগে ধরেছিলো মুসাকেই।
কিভাবে বন্ধুকে সাহায্য করবে, সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই মুসার সাহায্যে এগিয়ে। এলো একটা বিচিত্র প্রাণী। পরোক্ষে মুসাকে সাহায্য করলেও, প্রত্যক্ষভাবে আসলে নিজেকেই সাহায্য করতে এসেছে। অনেক নাম ওটারঃ কেউ বলে অ্যান্ট-ঈটার, কেউ অ্যান্ট-বীয়ার, কেউ বা ডাকে আর ডু ভার ক, অর্থাৎ গর্তের শুয়োর বলে। তবে অ্যান্ট-ঈটার বা পিঁপড়েখেকো নামটাই বেশি মানানসই, কারণ, পিঁপড়ে খাওয়ার সুযোগ মিললে আর ছেড়ে কথা কয় না। সারা দিন গর্তে পড়ে ঘুমায়, রাতে বেরোয় খাবারের সন্ধানে। মুসার ভাগ্য ভালো, কাছাকাছিই ছিলো ওটা।
এগিয়ে এলো চার ফুট লম্বা জীবটা। ওজন একশো চল্লিশ পাউণ্ড মতো হবে। ভালুকের মতো থাবা, তাতে বড় বড় বাকা নখ–উইয়ের ঢিবি চেরার জন্যে, ক্যাঙারুর মতো লেজ, গাধার কান আর শুয়োরের মুখ নিয়ে ওকাপির চেয়ে কম। বিচিত্র নয় জনাব আবু ডু ভার।
কাছে এসেই কাজে লেগে গেল পিঁপড়েখেকো। আঠারো ইঞ্চি লম্বা জিভ বের। করে প্রায় ছেকে নিতে শুরু করলো, যেন পিঁপড়ের দলকে। আমাজানের জঙ্গলে এরকম জীবকে রীতিমতো লড়াই করে পরাজিত করেছে মুসা, এদের সম্পর্কে ভয় নেই তার। সোজা গিয়ে দাঁড়ালো ওটার জিভের কাছে। মাটি থেকে তোলার চেয়ে চামড়া থেকে নেয়া সহজ, কাজেই, সহজ কাজটাই আগে করলো ওটা। জামাকাপড় সব খুলে একেবারে দিগম্বর হয়ে গেছে সহকারী গোয়েন্দা, রবিনকে আরেক দিকে তাকিয়ে থাকার অনুরোধ করছে বার বার।
কিন্তু চাঁদের আলো নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছে মুসার কালো নগ্ন দেহের দিকে, মুহূর্তের জন্যে মুখ ফেরানোর নাম নেই। নিজের দিকে চেয়ে নিজেরই হাসি পেলো মুসার। পিঁপড়ে নেই আর শরীরে। হেসে উঠলো জোরে। প্লেনে বসা রবিনও হেসে ফেললো। এতোক্ষণ উত্তেজনায় খেয়ালই করেনি পিঁপড়েখেকো, মানুষের শরীর চাটছে। হাসির শব্দে যেন হুশ হলো। বড় বড় কয়েক লাফ দিয়ে। সরে গেল দূরে, সন্দিগ্ধ চোখে মুসার দিকে আরেকবার তাকিয়ে আবার পিঁপড়ে খাওয়ায় মন দিলো।
কাপড়চোপড় পরে ফেলল এবার, আরেক দিকে চেয়েই বললো রবিন। পরে জলদি উঠে এসো। যতদূর জানি, অ্যান্ট-বীয়ার সিংহের খুব প্রিয় খাবার।
মুহূর্ত দেরি করলো না মুসা। প্যান্টটা পায়ে গলিয়ে কোমরে বোতাম আঁটলো। বাকি কাপড়গুলো হাতে নিয়ে উঠে এলো ওপরে। আহত পা নিয়ে কষ্ট হলো, তাকে সাহায্য করলো রবিন।
ঠিকই, পিঁপড়েখেকোর গন্ধ পেয়ে কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছে একটা সিংহ। চাঁদের আলোয় বিশাল ছায়া পড়েছে ওটার। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর ছায়ার মতোই নীরবে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো, থেমে গেল। প্লেনের ডানার নিচে, ছায়ায়। ধক ধক করে জ্বলছে চোখ, দৃষ্টি পিঁপড়েখেকোটার ওপর নিবদ্ধ।
সিংহ তার খাবার ধরবে, এটাই স্বাভাবিক। অন্য সময় হলে হয়তো কিছু বলতো না মুসা, কিন্তু এখন পিঁপড়েখেকোটা ঋণী করে ফেলেছে তাকে। ঋণ শোধ করার জন্যে নিজের বিপদ উপেক্ষা করলো সে, হাত তালি দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে সাবধান করে দিলো জীবটাকে।
রাগে গর্জে উঠলো সিংহটা। ছুটে গেল শিকারের দিকে।
ততোক্ষণে হুশিয়ার হয়ে গেছে পিঁপড়েখেকো। অবিশ্বাস্য একটা কাণ্ড করলো। ছুটে পালানোর চেষ্টাও করলো না, করলেও সিংহের সঙ্গে দৌড়ে পারতো না। দুই থাবা দিয়ে নরম মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। এতো দ্রুত, যেন আশ্চর্য ক্ষমতাশালী একটা খোঁড়ার-যন্ত্র। সিংহটা ওটার কাছে গিয়ে পৌঁছার আগেই খোঁড়া হয়ে গেল গর্ত, ভেতরে ঢুকে পড়লো জানোয়ারটা। মুসা আর রবিন দেখতে পাচ্ছে না এখন, অনুমান করলো নিশ্চয় খোঁড়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ওটা। লম্বা সুড়ঙ্গ বানিয়ে চলে যাবে সিংহের নাগালের বাইরে।
ওদের অনুমান ঠিক। গর্তের মুখে নাক নামিয়ে শুকলো সিংহ। আরেকবার গর্জন করলো। নিরাশ হয়ে সরে এলো গর্তের কাছ থেকে। মুখ তুলে তাকালো। প্লেনের দিকে।
দুরুদুরু করে উঠলো দুই গোয়েন্দার বুক। এবার? কি ভাবছে ব্যাটা?
.
ভালো ঘুম কি আর হয়? দুবার হায়েনার ডাকে চমকে জেগে উঠলো দুজনে।, প্লেনের নিচে এসে, হুটোপুটি লাগিয়েছে ওগুলো। টায়ার কামড়াতে শুরু করেছে। চেঁচিয়ে, বিমানের গায়ে বাড়ি দিয়ে ওগুলোকে তাড়ালো ওরা। আবার তন্দ্রায় ঢলে পড়লো।
ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখলো মুসা। ভয়ানক এক গণ্ডার আক্রমণ করেছে তাকে। মাটিতে পেড়ে ফেলে শিং দিয়ে তোচ্ছে বুকে। চিৎকার করে জেগে উঠলো সে। দেখলো, সকাল হয়ে গেছে। বুকে হাত রেখে ঠেলছে কিশোর। ষোল ঘন্টার আগেই ফিরে এসেছে।
আরে, এই মিয়া, ওঠো, হেসে বললো কিশোর। কতো ঘুমাবে? এই নাও তোমার স্যাণ্ডউইচ।
রবিন আগেই জেগেছে।
মুসা দেখলো, প্লেনের পেছনে গাড়ির মিছিল। ওয়ারডন টমসন এসেছেন, সঙ্গে এসেছে তার তিনজন রেঞ্জার আর তিরিশজন মাসাই।
খেয়ে নাও জলদি, দুই বন্ধুকে তাড়া দিলো কিশোর। পোচার ব্যাটাদের ধরতে যেতে হবে।
প্লেনটা? স্যাণ্ডউইচ চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞেস করলো মুসা। কিভাবে নেয়া হবে?
নাইরোবিতে মেকানিকের জন্যে তার পাঠিয়ে দিয়েছেন ওয়ারডেন। প্লেনের ভাবনা এখন আর আমাদের নয়। গিয়ে গর্তগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
বিশ মাইল দূরে সেই বাওবাব ওরফে জলহস্তী গাছের জঙ্গল। আগের দিনের মতোই নির্জন। হঠাৎ, চাপা একটা শব্দ শোনা গেল। মানুষের কণ্ঠস্বর। মনে হলো, মাটির নিচ থেকে আসছে।
ঝোপঝাড়ের মাঝে ফাঁকা জায়গাগুলো দেখে মাসাইরা জানালো, হাতি ধরার ফাঁদই তৈরি করা হয়েছে ওসব জায়গায়। ওপরের ডালপাতা সরানো বিপজ্জনক। পোচাররা নিচে থেকে থাকলে, সরানোমাত্র তীর ছুঁড়তে পারে।
উবু হয়ে শুয়ে সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল কয়েকজন মাসাই। একটা গর্তের কিনারে পৌঁছে আলগা ডালপাতা ধরে টেনে সরালো, ফাঁক করে উঁকি দিলো নিচে। কোনো তীর কিংবা বল্লম ছুটে এলো না ওদের দিকে। সামনে মুখ বাড়িয়ে আরও ভালোমতো দেখলো। কেউ নেই।
এক এক করে সবগুলো গর্ত দেখা হলো। কোনোটাতেই মানুষ নেই। কিন্তু মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।
ভয় পেয়ে গেল মুসা। খাইছে! ভূত নাকিরে বাবা! নির্ভীক বৈমানিকের এহেন উক্তি শুনে না হেসে পারলেন না ওয়ারডেন।
কিশোর নীরব। কান পেতে শুনছে। কোনো সন্দেহ নেই, মানুষেরই কণ্ঠস্বর। গর্তে নেই, ঝোপের ভেতরে নেই আসছে কোথা থেকে তাহলে? চিন্তিত ভঙ্গিতে বাওবার গাছগুলোর দিকে তাকালো সে। ওগুলোতেও ঘন ডালপাতা নেই, যার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে মানুষ। তাহলে?
পায়ে পায়ে একটা গাছের কাছে চলে এলো গোয়েন্দাপ্রধান। থেমে গেল কথা বলা, আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মাসাইরাও নীরব। একটা মোটা গাছের চারপাশে ঘুরে এলো সে, নেই কেউ।
হতাশ হয়ে প্রায় হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলো কিশোর, হঠাৎ পেছনে ফিসফিস করে বলে উঠলো রবিন, কিশোর, এক মিনিট। আমার মনে হয় ব্যাটারা এখানেই আছে।
আছে? কোথায়?
কোনো রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারলে, সেটা রবিন। আর মুসা না। বুঝলে তাদের দিকে যেভাবে চেয়ে মিটিমিটি হাসে কিশোর, এখন ঠিক তা-ই করলো রবিন। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, অনুমান করো।
তার চেয়ে কেউ বেশি জানুক, এটা সইতে পারে না কিশোর। ভোঁতা কণ্ঠে বললো, জানি না…না না, দাঁড়াও! তুড়ি বাজালো। বুঝেছি!
কোথায়? মুসাও এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
এই গাছগুলোর কাণ্ড কতো মোটা দেখেছো? মুসাকে বললো রবিন। পাশ ফুটের বেশি উঁচু হয় না বাওবাব, কিন্তু পাশে বাড়ে। বেঁটে, অসম্ভব মোটা মানুষের মতো কুৎসিত হয়ে যায়। পেটের বেড় হয়ে যায়, ষাট ফুটের ওপর।. এই যে, এগুলোর বেড় আরও বেশি মনে হচ্ছে। নিশ্চয় অনেক পুরনো, পাঁচশো থেকে হাজার বছরের, সেজন্যেই এতো মোটা। মজা হলো, পাশে যতো বাড়তে থাকে, পুরনো বাওবাবের ভেতরটা ততো ফোপরা হয়ে যায়। একেবারে খালি কোঠা। বিশজন মানুষ অনায়াসে থাকতে পারে।
কিন্তু ঢুকলো কোন দিক দিয়ে? গাছগুলোর ওপরে-নিচে আবার তাকালো। মুসা। ফোকর-টোকর তো দেখছি না।
ডাল যেখান থেকে ছড়িয়েছে।
ঢোকার মুখ ওখানে? হাত তুলে একটা গাছ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা। গাছটার ডালগুলো ছড়িয়েছে মাটির বারো ফুট ওপর থেকে। রবিন জবাব দেয়ার আগেই হাত নেড়ে মুগামবিকে ডাকলো সে।
কাছে এসে দাঁড়ালো বিশালদেহী মাসাই। তার কাঁধে চড়ে একটা ডাল ধরে ফেললো মুসা। পায়ের ব্যথা অনেক কম, নাড়াচাড়া করলেও আর তেমন লাগে না। এখন। ডালে উঠে লম্বা হয়ে শুয়ে ক্রল করে নিচের দিকে এগোলো। সবগুলো ডাল যেখানে মিলিত হয়েছে, ঠিক তার মাঝখানে বড় একটা কালো ফোকর। ওটার কাছে এসে সাবধানে মুখ বাড়ালো সে, নিচে উঁকি দিলো।
আশা করেছিলো, তীর ছুটে আসবে একঝাঁক।
কিছুই এলো না। ভেতরের বিষণ ছায়ায় দেখা গেল অনেকগুলো কালো মুখ। ওপর দিকে চেয়ে আছে। দুষ্টুমি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বাচ্চা ছেলে যেরকম করে, অনেকটা সেরকম ভাবসাব।
সরে এসে আবার মুগামবির কাঁধে নামলো মুসা। সেখান থেকে মাটিতে।
গাছের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো পোচাররা। টপাটপ লাফিয়ে। পড়লো মাটিতে। খালি হাতে বেরিয়েছে, অস্ত্রশস্ত্র সব রেখে এসেছে। গাছের ভেতরে। আক্রমণের ইচ্ছে নেই, পালানোরও নয়। সম্পূর্ণ পরাজিত, আত্মসমর্পণ করতে বেরিয়েছে।
এগিয়ে এলেন ওয়ারডেন। বললেন, মুগামবি, জিজ্ঞেস কর তো, এতো ভালো হয়ে গেল কেন হঠাৎ?
সোয়াহিলি ভাষায় জিজ্ঞেস করলো মুগামবি। জবাব দিলো নেতা গোছের একজন পোচার। ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনালো সেটা মাসাইদের সর্দার, ওরা আর লড়াই করতে চায় না। একাজ ছেড়ে দিতে চায়।
কেন?
অনেক কষ্ট করে ফাঁদ পাতে ওরা, কুঁড়ে বানায়। বার বার আমরা গিয়ে নষ্ট করে দিই। গত কিছু দিন ধরে একটা ফাঁদ থেকেও কিছু আয় করতে পারেনি। ওরা। খালি সিলভারের ধমক-ধামক শুনেছে। ওদের সঙ্গে তার চুক্তি, মাল দেবে, টাকা নেবে। দিতেও পারেনি, নিতেও পারেনি। অহেতুক গাধার খাটনি খাটতে আর রাজি নয় ওরা।
নেতা গোছের লোকটা অন্যান্য গাছের দিকে চেয়ে জোরে জোরে কি বললো।
আরও কয়েকটা গাছ থেকে বেরিয়ে এলো অনেক পোচার। একটা গাছ থেকে কয়েকজন পোচারের সঙ্গে বেরোলো স্বয়ং লঙ জুন সিলভার, কিন্তু সে আত্মসমর্পণ করবে না। দুই হাতে দুই রিভলভার, দাড়িতে ময়লা, রাগে দুদিকে সরে গেছে। ঠোঁটের দুই কোণ। চেঁচিয়ে লড়াই করার আদেশ দিলো. পোচারদের। ওরা, কথা। শুনছে না, দেখে লাফাতে শুরু করলো। রিভলভার তুলে গুলি ছুড়লো আকাশে। তারপরও শুনছে না দেখে কেউ বাধা দেয়ার আগেই গুলি করে মেরে ফেললো একটা লোককে। বব্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে যেন।
এবার নড়লো পোচাররা। তবে মাসাইদের বিরুদ্ধে নয়। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেললো তাদের নিজের নেতাকেই। গুলিতে আহত হলো আরও কয়েকজন। পরোয়া করলো না। সিলভারের হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিয়ে কিল-ঘুসি মারতে মারতে মাটিতে শুইয়ে ফেললো তাকে। টমসন আর মাসাইরা বাধা না দিলে মেরেই ফেলতো লোকটাকে।
ওঠো, আদেশ দিলেন ওয়ারডেন।
কম্পিত পায়ে উঠে দাঁড়ালো সিলভার। বিড়বিড় করে গাল দিচ্ছে। চোখ লাল। তিন গোয়েন্দার দিকে চোখ পড়তে আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। ঘুসি পাকিয়ে ছুটে এলো ওদের দিকে।
খানিক দূরে বসে উৎসুক চোখে গণ্ডগোল দেখছিলো সিমবা। নিজে কিছু, করার সুযোগ পাচ্ছিলো না। এইবার পেলো। বাপ-দাদার অনুকরণে হিংস্র গর্জন ছেড়ে ধেয়ে এলো তীব্র গতিতে। সিলভারের বুকে দুপা তুলে দিয়ে গলায় কামড় বসাতে গেল।
কিছুই বললো না মুগামবি। কিন্তু বাধা দিতে ছুটে গেল মুসা। না না, সিমবা! সি-ম-বাআ! ওটার কলার চেপে ধরে টান দিলো।
ভীষণ রেগেছে আজ বুনো কুকুরের বংশধর। ঝাড়া দিয়ে মুসার হাত থেকে বেল্ট ছাড়িয়ে নিয়ে আবার কামড় বসাতে গেল। ধস্তাধস্তি করতে করতে মাটিতে চিত হয়ে পড়লো সিলভার। লম্বা হয়ে তার গায়ের ওপর সেটে এলো সিমবা, শিকারকে পাকড়াও করে খুন করার আগে যেভাবে চেপে ধরে বুনো কুকুর, তেমনিভাবে।
এই বার এসে হাত লাগালো মুগামবি। অনেক কসরত করে টেনে সরালো কুকুরটাকে। এখন আদরে কাজ হবে না, জানা আছে তার, ঠাস ঠাস করে কষে দুই থাপ্পড় লাগালো সিমবার মাথার দুই পাশে। শান্ত হলো কুকুরটা।
কোনোমতে উঠে বসলো সিলভার। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। ডলছে আহত জায়গাগুলো।
তোমার খেল খতম, সিলভার, ওয়ারডেন বললেন। অনেক জ্বালান। জ্বালিয়েছো..ভাগ্যিস তিন গোয়েন্দাকে পেয়েছিলাম…
আমার কচুটাও করতে পারবে না তুমি, বুড়ো আঙুল দেখালো সিলভার, তেজ কমেনি। অনেক টাকা আছে আমার। টাকার জোরে পার পেয়ে যাবো।
আদালতে গিয়ে জজ নির্মল পাণ্ডাকে বলো সেকথা। তোমার ছাল ছাড়িয়ে নেবে। জানোয়ার তো মেরেছোই, সেই সঙ্গে মানুষ খুনও করেছো। তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে নির্মল। দুনিয়ার সব টাকা দিলেও তার হাত থেকে নিস্তার পাবে না।
জোরে হেসে উঠলো সিলভার।
তার হাসি শুনে আবার রেগে গেল সিমবা। ঝাড়া দিয়ে বেল্ট ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে যেতে চাইলো। কিন্তু মুগামবির সঙ্গে পারলো না।
এখনও পাণ্ডা পাণ্ডা করছেন, স্যার? গম্ভীর হয়ে ওয়ারডেকে বললো। কিশোর। কথা শুনেও কিছু বুঝতে পারছেন না? অনেকখানি বদলে ফেলেছে বটে চেহারা, কণ্ঠস্বর কিন্তু পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি। এতোদিনের বন্ধু আপনার, এতো ঘনিষ্ঠতা, তা-ও চিনতে পারছেন না?
অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকালেন টমসন। কি বলছো?
ঠিকই বলছি, সিলভার কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাত বাড়িয়ে তার দাড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারলো কিশোর। খুলে এলো নকল দাড়ি বেরিয়ে পড়লো জজ নির্মল পাণ্ডার মুখ।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন ওয়ারডেন। কথা সরছে না মুখে।
হা হা করে হাসলো জজ। কেন ঘাবড়াইনি বুঝতে পারছো তো? আমি জজ, আদালতে আমার বিচার আমিই করবো। তুমি একটা আস্ত গাধা, ওয়ারডেন। হাহ হাহ হা!
হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নাইরোবি পুলিশের হাতে পড়ার পরই শুধু নরম হলো জজ নির্মল পাণ্ডা, যখন দেখলো ঘুষ খায় না, এমন লোকও আছে। কোটি কোটি টাকার লোভ দেখিয়েও যাকে দিয়ে অন্যায় করানো যায় না। ওখানকার জজকে কিনতে পারলো না সে। যাবজ্জীবন জেল হয়ে গেল। অন্যায়ভাবে অর্জিত তার সমস্ত টাকা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দান করে দেয়া হলো আফ্রিকান ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটিকে।
নিজের মুখে সব কুকর্মের কথা স্বীকার করেছে নির্মল পাণ্ডা, তবু যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না ওয়ারডেন টমসন। ওরকম নিরীহ চেহারার হাসিখুশি একজন ভদ্রলোক এতো খারাপ হতে পারে, কল্পনাই করেননি তিনি কোনোদিন। সব। চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছেন, একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়েছেন বলে, অন্তত তিনি নিজে জজ নির্মল পাণ্ডাকে বন্ধু হিসেবেই নিয়েছিলেন।
.
ফেরার দিন এলো তিন গোয়েন্দার। স্টর্ক বিমানটা ঠিক হয়ে গেছে। তাতে চড়েই, নাইরোবি যাবে ওরা। সেখান থেকে জেট লাইনারে চড়ে আমেরিকায়।
ওয়ারডেন টমসন যেতে পারবেন না ওদের সঙ্গে। জরুরী কাজ আছে। তাছাড়া জায়গাও নাকি হবে না বিমানটায়। কেন হবে না, বুঝতে পারলো না তিন গোয়েন্দা। প্রশ্ন করেও কোনো জবাব মিললো না, শুধু রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন তিনি।
নির্দিষ্ট দিনে বিমানটায় উঠলো তিন গোয়েন্দা, পাইলটের সীটে অবশ্যই মুসা আমান। উঠেই অবাক হয়ে গেল। তার পেছনের সীটের পায়ের কাছে আরাম করে শুয়ে ছিলো বুনো কুকুরের বংশধর, সাড়া পেয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো সীটে। মৃদু গাউ করে উঠলো। স, আরি, তুই! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। তুই এখানে কি করছিস? যা যা, নাম। আমরা চলে যাচ্ছি।
না, ও-ও যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে, নিচে থেকে হাসিমুখে বললেন ওয়ারডেন। পাশে দাঁড়ানো মুগামবির দিকে একবার চেয়ে আবার ফিরলেন কিশোর বৈমানিকের দিকে। আমার তরফ থেকে, মুগামবির তরফ থেকে, আফ্রিকান ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটির তরফ থেকে তিন গোয়েন্দাকে উপহার। অনেক করেছো তোমরা। উপহার দিয়ে সেই ঋণ শোধ করা যাবে না। এই সামান্য উপহারটুকু নিলে আমরা সবাই খুশি হবো।
কিন্তু মুগামবির প্রিয়…, বলতে গিয়ে বাধা পেলো মুসা।
ও-ই তো প্রস্তাবটা দিয়েছিলো আমাকে, বললেন টমসন। তুমি যে সিমবাকে ভালোবেসে ফেলেছো, তোমাকেও কুকুরটা ভালোবেসেছে, এটা ওর নজর এড়ায়নি…
কিন্তু, তবু…
তুমি ওটা নাও, মুসা, এবার বাধা দিলো মুগামবি। না নিলেই বরং আমি। দুঃখ পাবো। বুনো কুকুর অনেক আছে এখানে, দরকার হলে সহজেই আরেকটা বাচ্চা আমি জোগাড় করে নিতে পারবো। জন্তুজানোয়ারের প্রতি তোমার। ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। তোমার মতো ছেলেরা যখন জন্মাচ্ছে, বুঝতে পারছি, সুদিন আসছে আফ্রিকার, চোখ মুছলো মাসাই-সর্দার। কিশোর, রবিন, তোমরাও জন্মভূমির গর্ব। শুধু যার যার দেশেরই নও, সারা দুনিয়ার গর্ব তোমরা। দোয়া করি, বখে যাওয়া কিশোররা তোমাদের দেখে শিখুক, ভালো হোক, মানুষ হোক…
তাজ্জব হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা, অশিক্ষিত এক মাসাইয়ের দেশপ্রেম দেখে, নীতিবাক্য শুনে, অনেক বড় বড় শিক্ষিত মানুষও এভাবে গুছিয়ে বলতে পারবে না।
নরম কথা শুনলে মুসার চোখে পানি এসে যায়। এখনও তার ব্যতিক্রম হলো। না। আপনার জন্যেও গর্ববোধ করছি আমি, মিস্টার মুগামবি। থ্যাঙ্ক ইউ।
হাসি ফুটলো মাসাইয়ের কালো চোখের তারায়। সিমবার দিকে তাকালো, যা বাবা, ভালো থাকিস। বন্ধুর কথা শুনবি সব সময়, গোলমাল করবি না।
রবিন, কিশোরও মুগামবি আর টমসনকে ধন্যবাদ দিলো।
এই চিঠিটা নিয়ে যাও, কিশোরের হাতে একটা খাম দিলেন ওয়ারডেন। এয়ারপোর্ট ম্যানেজারকে দিও। স্টর্কটীকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা তিনি। করবেন..আর হ্যাঁ, আমার ব্যানড়া সব সময় তোমাদের জন্যে খোলা রইলো। সুযোগ পেলেই বেড়াতে চলে এসো। যাও, উইশ ইউ গুড লাক।
সিমবাও যেন ভাবলো, গুড লাক জানানো দরকার নতুন মনিবকে। পেছন থেকে মুসার গাল, কান চেটে দিলো। হেসে উঠলো সবাই। তরল হয়ে গেল পরিবেশ। হাসিমুখে স্টর্কের এঞ্জিন স্টার্ট দিলো মুসা আমান।