ঘড়ির গোলমাল

ভলিউম ৯ – ঘড়ির গোলমাল – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ১৯৯০

০১.

ঘড়ির ভেতর থেকে শোনা গেল চিৎকার!

আতঙ্কিত কণ্ঠ। শুরু হলো মৃদু ভাবে, জোড়ালো হতে লাগলো, তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর। কিশোর পাশার মনে হলো, কানের পর্দা ছিঁড়ে যাবে। শিরশির করে উঠলো শিড়দাঁড়া। জীবনে যতো ভয়ঙ্কর চিৎকার শুনেছে সে, তার মধ্যে এটা অন্যতম।

পুরনো চেহারার একটা ঘড়ি, বিদ্যুতে চলে। চলে কিনা সেটা দেখার জন্যেই প্লাগটা সকেটে ঢুকিয়েছিলো, সঙ্গে সঙ্গে ওই চিৎকার। কর্ড ধরে একটানে প্লাগটা বের করে আনলো সকেট থেকে। থেমে গেল। চিৎকার। হাঁপ ছাড়লো সে।

পেছনে শোনা গেল পদশব্দ। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে কাজ করছিলো তার দুই সহকারী, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড, পাশে এসে যেন ব্রেক কষে দাঁড়ালো।

কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো রবিন। কে, চিৎকার করলো?

খাইছে! মুসা বললো, উদ্বিগ্ন। কিশোর, ব্যথাট্যাথা পেয়েছো?

মাথা নাড়লো গোয়েন্দাপ্রধান। শোনো, অস্বাভাবিক শব্দ। বলেই আবার প্লগ ঢোকালো সকেটে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো রক্ত-পানি-করা চিৎকার। টেনে প্লাগ খুলে চিৎকার থামালো।

মারছে? অস্বস্তিতে হাত নাড়লো মুসা। একে শুধু অস্বাভাবিক বলছো কেন? নিশ্চয় ঘড়ির ভূত!

হ্যাঁ, সত্যি অস্বাভাবিক, গোয়েন্দাপ্রধানের সঙ্গে একমত হলো রবিন। ঘড়ি এরকম চিৎকার করে বলে শুনিনি। দেখো, সুইচ টিপলে পাখা গজিয়ে না উড়ে চূলে যায়

হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে ঘড়িটা দেখছে কিশোর। সন্তুষ্ট হয়ে বললো, মম!

হুম্ কি? এই, কী? ভুরু নাচালো মুসা।

অ্যালার্মের লিভারটা অন করা, জানালো কিশোর। দেখি অফ করে আবার প্লগ ঢুকিয়ে… বলতে বলতেই প্লাগটা সকেটে ঢোকালো। আর চিৎকার করলো না। মৃদু গুঞ্জন তুলে চলতে শুরু করলো ঘড়ি।

দেখি এবার অন করে, আবার বললো সে। লিভার অন করতেই চিৎকার করে উঠলো ঘড়ি, তাড়াতাড়ি অফ করে দিলো কিশোর। যাক, একটা রহস্যের সমাধান হলো। ঘন্টা বাজানোর বদলে চিৎকার করে এই ঘড়িটা।

রহস্য দেখলে কোথায় এতে? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

ঘড়ি চিৎকার করে, এটা রহস্য নয়? কিশোরের হয়ে জবাব দিলো রবিন। আর, কেন চিৎকার করে সেটাও বোঝা গেল।

কেন নয়, সুধরে দিলো কিশোর। বলো, কখন। অ্যালার্ম লিবার সেট করলে চিৎকার করে। কেন করে, সেই রহস্যের সমাধান এখনও হয়নি।

তারমানে, তদন্ত? মুসা বললো। একটা ঘড়ির ব্যাপারে কি তদন্ত করবে? প্রশ্ন করবে ওটাকে? জবাব না দিলে চাপাচাপি করবে?

মুসার কথায় কান দিলো না কিশোর। বললো, কেন চিৎকার করে বোঝার চেষ্টা করবো। নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।

আগ্রহী মনে হলো রবিনকে। কিন্তু শুরুটা করবে কিভাবে?

জবাব না দিয়ে টুলকিটের জন্যে হাত বাড়ালো কিশোর। তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওয়ার্কশপে রয়েছে ওরা। কিট থেকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে ঘড়ির পেছনের কভার খুলতে শুরু করলো। খুলে, এক নজর দেখেই আবার বললো, হুমম!

আবার হুমম কেন? মুসার প্রশ্ন।

স্ক্রু-ড্রাইভারের মাথা নেড়ে ঘড়ির ভেতরে দেখালো কিশোর। যন্ত্রপাতির মাঝে বসানো আধুলির সমান গোল একটা ডিস্ক। চিৎকারের এটাই কারণ। অ্যালার্ম বেলের বদলে এটা বসিয়ে দিয়েছে কেউ।

কেন? রবিনের প্রশ্ন।

 সেটাই তো রহস্য। জানতে হবে কে করেছে কাজটা।

কিভাবে? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

দূর, নিরাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর। গোয়েন্দা কোনোদিনই হতে পারবে না তুমি। ভাবতেই জানো না ঠিকমতো…

দাঁড়াও দাঁড়াও, বলি। প্রথমে জানতে হবে ঘড়িটা কোত্থেকে এসেছে।

হ্যাঁ, এই তো মাথা খুলছে।

পুরনো জঞ্জালের মাঝে পেয়েছে। তারমানে রাশেদ আংকেল ওটা কিনে এনেছেন। হয়তো বলতে পারবেন কোন জায়গা থেকে কিনেছেন।

রোজই তো কতো মাল কেনেন, রবিনের কণ্ঠে সন্দেহ। তাঁর মনে আছে?

থাকতে পারে। জঞ্জালের মাঝে পেয়েছি, কথাটা ঠিক নয়। আধ ঘন্টা আগে একটা বাক্স আমার হাতে দিয়েছে চাচা। পেয়েছি ওটার ভেতরেই। আরও কি কি যেন আছে। দেখি।

বেঞ্চের ওপর রাখা একটা শক্ত মলাটের বাক্স। ভেতর থেকে বেরোলো একটা স্টাফ করা পেঁচা-পালক বেশির ভাগই খসে গেছে। পুরনো একটা কাপড় ঝাড়ার ব্রাশ পাওয়া গেল। আরও আছে একটা ভাঙা টেবিল-ল্যাম্পের অর্ধেকটা, চলটা ওঠা একটা ফুলদানী, দুটো বইয়ের দুমড়ানো প্লাস্টিক-কভার, আর আরও কিছু টুকিটাকি। প্রায় সবগুলো জিনিসই বাতিল, ব্যবহারের অযোগ্য।

দেখে তো মনে হয় ঘর পরিষ্কার করেছিলো কেউ, কিশোর বলল। বাক্সে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলো। বেকার বা ভিখিরি কেউ সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করেছে পুরনো মালের দোকানে, সেখান থেকে কিনে এনেছে চাচা।

কেন যে কিনলেন? অবাক লাগছে মুসার। ঘড়িটা ছাড়া তো আর সবই বেকার। কোনো কাজে লাগবে না। তবে ঘড়ি বটে একখান। ভাবো একবার, সকালে অ্যালার্মের বদলে ওই ভূতুরে চিৎকার শুনে জেগে ওঠার কথা

হুমম! তৃতীয়বার বললো কিশোর। ভালো না। খুব খারাপ। কাউকে ভয় পাওয়ানোর জন্যে যথেষ্ট। হার্টের অবস্থা খারাপ হলে মারাও যেতে পারে। মেরে ফেলতে চাইলে শুধু তার বেডরুমে ঘড়িটা রেখে দিয়ে এলেই হলো। সহজেই খুন, অথচ কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারবে না।

বলো কি! ভুরু কোঁচকালো রবিন। ওরকম কিছুই হলো নাকি?

জানি না। শুধু সম্ভাবনার কথা বলছি। চলো, চাচাকে জিজ্ঞেস করি ঘড়ি কোথায় পেলো?

ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে অফিসের দিকে চললো ওরা। কাজে ব্যস্ত ইয়ার্ডের দুই কর্মচারী বোরিস আর রোভার। কয়েকটা পুরনো আসবাবপত্র দেখছিলেন রাশেদ পাশা, ডাক শুনে ফিরে তাকালেন। ছেলেদের মুখ দেখেই বুঝলেন, প্রশ্ন। আছে। মিটিমিটি হেসে, মস্ত গোঁফে তা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তারপর, ত্রিরত্ন, ব্যাপার কি? খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে।

চাচা, ঘড়িটা দেখালো কিশোর। এটা কোত্থেকে আনলে? একটু আগে যে বাক্সটা দিলে, তার মধ্যে পেয়েছি।

পেয়েছি মাগনা। ফাও বলতে পারো। এটার মধ্যে ছিলো, পুরনো একটা আলমারি দেখালেন তিনি। হলিউডের এক পুরনো মালের দোকান থেকে কিনেছি।

কোন দোকান? মালিকের নাম?

নাম, ডেরিক। অনেক মাল কিনেছি আজ। এক ট্রাক দিয়ে গেছে। আরও এক ট্রাক নিয়ে আসবে। তখন জিজ্ঞেস করো…

এই সময় গেটে শোনা গেল এঞ্জিনের শব্দ। ফিরে তাকাল চারজনে। একটা পিকআপ ঢুকছে। বলে উঠলেন রাশেদ পাশা, ওই যে, এসে গেছে।

আসবাবপত্রের স্তূপের কাছে এসে থামলো গাড়ি। ওভারঅল পরা একজন লোক নেমে এলো, খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

এসেছো, বললেন রাশেদ পাশা।

হ্যাঁ, কাছে এসে দাঁড়ালো ডেরিক। নিয়ে এলাম তোমার সব মাল। কপাল ভালো তোমার, রাশেদ, ভালো মাল পেয়েছো, ধরতে গেলে বিনে পয়সায়। কিছু কিছু তো একেবারে নতুন…

আরে দূর! বাতাসে থাবা মারলেন রাশেদ পাশা। বাড়িয়ে বলার স্বভাব তোমার গেল না। এগুলো নতুন? আমি বলে কিনছি…যাক, যা আছে, আছে। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। দশ ডলার দেবো সবগুলোর জন্যে। ও কে?

দাও। কি আর করা? টাকার খুব ঠেকা, নইলে একশোর কমে দিতাম না…

মেরি আছে অফিসে। ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাও। ও, এক মিনিট, এ আমার ভাতিজা, কিশোর। তোমাকে কি জানি জিজ্ঞেস করবে।

জলদি বলে ফেলো, খোকা। তাড়া আছে আমার, বললো ডেরিক।

একটা বাক্সের কথা জানতে চাই, কিশোর বললো। আপনার দেয়া এই আলমারিতে পাওয়া গেছে। বাক্সের ভেতরে এই ঘড়িটা ছিলো। কার কাছ থেকে কিনেছেন, মনে আছে?

ঘড়ি? বিষণ্ণ হাসি হাসলো ডেরিক। হপ্তায় ওরকম কয়েক ডজন ঘড়ি বেচতে আনে আমার কাছে। বেশির ভাগই অচল। কিনি, কোনোটা বিক্রি হয়, কোনোটা ফেলে দিই।

একটা বাক্সের মধ্যে ছিলো এটা, রবিন বললো। ভেতরে একটা স্টাফ করা পেঁচাও…

ও, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। স্টাফ করা পেঁচা খুব কমই পাই, সেজন্যেই মনে আছে। কিন্তু কার কাছ থেকে যেন কিনলাম…কার কাছ..নাহ, সরি, মনে করতে। পারছি না, মাথা নাড়লো ডেরিক। প্রায় হপ্তা দুই আগের কথা। মনে নেই। হাজার লোকে বেচতে আনে, কজনের কথা মনে রাখবো?

.

০২.

ব্যস, গেল এই কেস, মুসা বললো। ঘড়িটা কোত্থেকে এসেছে তা-ই জানি না, রহস্যের কিনারা করবো কি? কিশোর?

ওয়ার্কশপে ফিরে এসেছে তিনজনে। অন্যমনস্ক হয়ে বাক্সটা নাড়াচাড়া করছিলো কিশোর, মুখ ফিরিয়ে তাকালো, উঁ?…মাঝে মাঝে বাক্সের গায়ে ঠিকানা লেখা থাকে। কোথায় পাঠানো হবে, সেই ঠিকানা।

আমার কাছে মুদী দোকানের বাক্সের মতো লাগছে, রবিন বললো।

আমার কাছেও। কিন্তু ঠিকানা লেখা নেই।

সেই কথাই তো বলছি, আগের কথার খেই ধরলো মুসা। এই কেসের সমাধান আমাদের সাধ্যের বাইরে। …রবিন, কি ওটা?

ছাপার মেশিনটার নিচ থেকে চার কোনা এক টুকরো কাগজ তুলে নিয়েছে। রবিন। কিশোরকে দেখিয়ে বললো, বাক্স থেকে পড়লো।

মুদী দোকানের মালের লিস্টি হবে হয়তো, মুসা বললো।

কিন্তু তার কথা ঠিক নয়। কাগজটায় লেখা রয়েছেঃ

ডীয়ার মিলার
আস্ক রোবিড়
আস্ক বারকেন
আস্ক জেলডা
দেন অ্যাক্ট। দ্য রেজাল্ট উইল সারপ্রাইজ ঈভন ইউ।

জোরে জোরে পড়লো রবিন। চেঁচিয়ে উঠলো, আশ্চর্য! কি মানে এর?

প্রিয় মিলার, বিড়বিড় করে বললো কিশোর। রোবিডকে জিজ্ঞেস করো। বারকেনকে জিজ্ঞেস করো। জেলভাকে জিজ্ঞেস করো। তারপর কাজে নামো। ফলাফল দেখে তুমি পর্যন্ত চমকে যাবে।

আরে সে তো বুঝলাম। কিন্তু এসব কথার মানে কি?

আরেকটা রহস্য। নিশ্চয় চেঁচানো ঘড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে।

ঘড়ির সঙ্গে যোগাযোগ, কিভাবে বুঝলে?

তাই তো হওয়ার কথা। দুই ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি মাপে কাটা হয়েছে। পেছনে দেখো। এই যে এখানটায়। কি দেখছো?

শুকনো আঠা।

রাইট। তারমানে এই কাগজটা কোনো কিছুতে সাঁটানো ছিলো। ঘড়িটা উল্টে তলা দেখালো সে। এই যে দেখো, এখানেও শুকনো আঠা। আগেই লক্ষ। করেছি। মাপ দেখে আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না, এই কাগজ এখানেই লাগানো। ছিলো। বেশি নাড়াচাড়ায় খুলে পড়ে গেছে।

কিন্তু ওরকম একটা কাগজ কেন ওখানে সাঁটতে যাবে? মুসার জিজ্ঞাসা। কে? ওই লেখার মানেই বা কি? মাথামুণ্ডু তো কিছুই বোঝা যায় না।

এতো সহজেই বোঝা গেলে কোনো রহস্যই আর রহস্য থাকতো না।

তা ঠিক। লাভের মধ্যে শুধু আরও একটা রহস্য যোগ হলো, ঘড়ির চেঁচানোর সঙ্গে। আমরা যে অন্ধকারে ছিলাম, সেখানেই রয়েছি। বরং বলা যায় অন্ধকার আরও ঘন হয়েছে। এখন কি করবে?

চেঁছে ঘড়ির নিচ থেকে আঠা তুলবো। কি যেন খোদাই করা রয়েছে। বেশি ছোট, বুঝতে পারছি না। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দরকার। চলো, হেডকোয়ার্টারে চলো।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো ওরা। ডেস্কের ওপাশে বসে মাথার ওপরের উজ্জ্বল আলো জ্বেলে দিলো কিশোর। ড্রয়ার থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস আর ছুরি বের করে কাজে লাগলো। ছুরি দিয়ে চেঁছে আঠা তুলে, খোদাই করা লেখা। পড়ে মাথা ঝোঁকালো নীরবে। রবিনের দিকে ঠেলে দিলো ঘড়ি আর গ্লাস।

রবিনও পড়লো। খুব খুদে অক্ষরে লেখা রয়েছেঃ ডি. টেমপার। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, মানে কি? কারও নাম?

বলছি এখুনি, বলে, মুসার দিকে তাকালো কিশোর। মুসা, টেলিফোন গাইডটা দেখি তো, প্লীজ।

পাতা উল্টে চললো গোয়েন্দাপ্রধান। কিছুক্ষণ পর চেঁচিয়ে উঠলো খুশি হয়ে, এই দেখো!

দুই সহকারীও দেখলো, ছোট একটা বিজ্ঞাপন, ঘড়ির দোকানের। ইংরেজিতে লেখা রয়েছেঃ ডি, টেমপার–ঘড়ি মেরামতকারী-অস্বাভাবিক কাজ আমাদের বিশেষত্ব। নিচে হলিউডের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর লেখা।

মেকাররা অনেক সময়, বললো কিশোর। ঘড়িতে সাঙ্কেতিক চিহ্ন বা নম্বর বসিয়ে দেয়। যাতে পরে আবার চিনতে পারে ওটা কার কাজ। ধোপার দোকানে কাপড়ে যেমন চিহ্ন দেয়। এক ধাপ এগোলাম আমরা। অ্যালার্ম সিসটেম খুলে ডিস্ক কে ঢুকিয়েছে ঘড়িতে, এটা জানলাম। পরের ধাপ, গিয়ে মিস্টার টেমপারকে জিজ্ঞেস করা, কে ঘড়িটা মেরামত করতে দিয়েছিল।

.

০৩.

হলিউড বুলভারের একটা গলির ভেতর পাওয়া গেল টেমপারের দোকানটা। গলিতে ঢোকে না বিশাল রোলস রয়েস, যেটাতে চড়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা। গাড়িটা গলির মুখে রেখে হেঁটে রওনা হলো ওরা। ড্রাইভিং সিটে বসে রইলো ইংরেজ শোফার হ্যানসন।

ধুলোয় ধূসর, জানালার কাঁচের ওপাশে নামটা কোনোমতে পড়া যায়ঃ ডি, টেমপার–ঘড়ি মেরামতকারী। সোনালি রঙের অক্ষরগুলো মলিন হয়ে এসেছে। ভেতরের তাকে অসংখ্য ঘড়ি, ছোট-বড় নতুন-পুরনো, নানা ধরনের নানা আকারের। দরজায় এসে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা। ওরা ভেতরে পা রাখতেই লম্বা একটা ঘড়ির নিচের কাঠের দরজা খুলে গেল, মার্চ করে বোলো এক খেলনা। সৈনিক, বিউগল বাজিয়ে সময় ঘোষণা করে আবার ঢুকে গেল তার কুঠুরিতে। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

 খাইছে! তাজ্জব হয়ে গেছে মুসা। কী কাণ্ড! তবে, চিৎকারের চেয়ে অনেক ভালো।

চলো, মিস্টার টেমপারের সঙ্গে কথা বলা যায় কিনা দেখি। বললো কিশোর।

ঘরে অনেক ঘড়ি, অনেক রকম আওয়াজ। মনে হচ্ছে হাজার হাজার মৌমাছি গুঞ্জন তুলেছে একসঙ্গে।

চামড়ার অ্যাপ্রন পরা ছোটখাটো একজন মানুষ এগিয়ে এলো। চকচকে কালো চোখের ওপরে সাদা ভুরু, যেন দুটো ছোট ছোট ঝোপ। খুশি খুশি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কি চাই? ঘড়ি মেরামত করাবে? নাকি অদ্ভুত কিছু লাগাবে?

না, স্যার, বিনীত কণ্ঠে জবাব দিলো কিশোর, ওসব নয়। একটা ঘড়ির ব্যাপারে জানতে এসেছি। ব্যাগ খুলে ওটা বের করে কাউন্টারের ওপর দিয়ে ঠেলে দিলো সে।

ঘড়িটা দেখলো টেমপার। হুঁ, বেশ পুরনো। দাম কম। এটা মেরামত করে পোষাবে না।

মেরামত করতে আনিনি, স্যার। কিছু মনে না করলে প্রাগটা লাগান।

শ্রাগ করলো ছোট মানুষটা। সকেটে প্লাগ ঢোকালো। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো ঘড়ি। তাড়াহুড়ো করে লিভারটা অফ করে দিলো মেকানিক। ঘড়িটা হাতে নিয়ে পেছনে দেখলো সে। হাসলো। হুঁ, চিনতে পারছি। আমিই লাগিয়েছিলাম। খুব জটিল কাজ।

আপনিই তাহলে চিৎকার শিখিয়েছেন এটাকে? মুসা বললো।

হ্যাঁ। আমি বলেই পেরেছি…যাকগে, কি জন্যে এসেছো? খারাপ হয়ে গেছে?

না, স্যার, কিশোর বললো। রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি এটা। কার জিনিস জানি না। নিচে আপনার নাম দেখলাম। ভাবলাম, মালিকের নাম বলতে পারবেন। তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেবো।

তাই? দ্বিধা করছে টেমপার। কাস্টোমারের নাম গোপন রাখি আমরা। অনেক সময়…

মুফতে দেয়ার ইচ্ছে আমাদের নেই, স্যার, বাধা দিয়ে বললো রবিন। এরকম একটা জিনিস, নিশ্চয় খুব শখের। ফিরিয়ে দিলে হয়তো পুরস্কার দেবেন তিনি…

হাত তুললো টেমপার। বুঝতে পেরেছি। ঠিকই বলেছো, জিনিসটা তার শখের। ঘড়ি জোগাড়ের হবি আছে লোকটার। নাম ক্লক।

ক্লক! একই সঙ্গে বলে উঠলো রবিন আর মুসা।

নাম তো তা-ই বলেছে লোকটা। আমার বিশ্বাস, ওটা তার বানানো নাম। আসল নাম অন্য কিছু। নানা রকম ঘড়ি এনেছে আমার কাছে, বিচিত্র সব, ফরমায়েশ। কোনোটাকে দিয়ে চিৎকার করাতে হবে, কোনোটাকে হাসাতে হবে, কোনোটাকে…

আমার কাছেও আসল নাম মনে হচ্ছে না, টেমপারকে থামিয়ে দিলো। কিশোর। নিশ্চয় ঠিকানা দিয়েছে? বলবেন, প্লীজ? আমরা নিজেই নিয়ে যাবো তার কাছে।

ঠিকানা তো দেয়নি, শুধু ফোন নম্বর। বলে, কাউন্টারের নিচের একটা তাক থেকে মোটা এক রেকর্ড বুক বের করলো টেমপার। পাতা উল্টে এক জায়গায়। এসে থামলো। হ্যাঁ, লিখে নাও। এইচ. ক্লক। নম্বর…

নোটবুক বের করে দ্রুত নম্বরটা লিখে নিলো রবিন।

চলবে তো এতে? টেমপার জিজ্ঞেস করলো। অবশ্য আর কিছু জানতেও পারবো না। জানি না। আর হ্যাঁ, ঘড়ির কাজ করাতে হলে নিশ্চিন্তে চলে এসো। যে-কোনো রকম কাজ।…তোমাদের আর কিছু বলার না থাকলে কিছু মনে কোরো না, আমার কাজ পড়ে আছে…

নিশ্চয়, নিশ্চয়, বললো কিশোর। অনেক ধন্যবাদ, স্যার, আপনাকে।

দোকান থেকে বেরিয়ে সঙ্গীদের বললো, আরেক ধাপ এগোনো গেল। এবার ফোন করতে হবে জনাব ঘড়িকে। মোড়ের বুঁদ থেকেই করি, চলো।

কি বলবে? কিশোর বুদে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

ঠিকানা জোগাড়ের চেষ্টা করবো, বলে ঢুকে গেল কিশোর।

মুসা আর রবিনও ঢুকলো। জায়গা কম, গাদাগাদি করে দাঁড়ালো ওরা। মুদ্রা ফেলে ডায়াল করলো কিশোর। ওপাশে রিসিভার তুললো, এক মহিলা।

গুড আফটারনুন, গলাটাকে ভারি করে তুললো কিশোর, বড়দের মতো। দক্ষ অভিনেতা সে, ভালো পারে এসব কাজ। টেলিফোন কোম্পানি থেকে বলছি। ক্রসড সার্কিটের গোলমাল হচ্ছে।

ক্রসড সার্কিট? বুঝলাম না, জবাব এলো।

আমরা কমপ্লেন পেয়েছি, আপনার সেকশনে নাকি বেশি বেশি রঙ নাম্বার হচ্ছে। দয়া করে যদি ঠিকানাটা বলেন? সার্কিট চেক করবো।

ঠিকানা? নিশ্চয়। একশো বারো ফ্র্যাঙ্কলিন স্ট্রীট। কিন্তু বুঝতে পারছি না… কথা শেষ করতে পারলো না মহিলা, তার আগেই শোনা গেল চিৎকার। বয়স্ক কোনো মানুষ আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠেছে। যেন জবাই করার জন্ধ্যে চেপে ধরা হয়েছে তাকে।

হাত থেকে রিসিভার ছেড়ে দিলো কিশোর।

.

০৪.

হ্যানসন, এই ব্লকটাই মনে হচ্ছে, বললো কিশোর। আস্তে চালান। নম্বরগুলো দেখি।

ফ্র্যাঙ্কলিন স্ট্রীট ধরে ধীরে চালালো হ্যানসন। পুরনো এলাকা। এককালের বিশাল বাড়িগুলো এখন মলিন, বিবর্ণ।

ওই যে! চেঁচিয়ে বললো মুসা।

বাঁকের কাছে গাড়ি রাখলো হ্যানসন। নেমে হেঁটে চললো তিন গোয়েন্দা। আশপাশে চোখ রাখছে। নির্জন লাগছে বাড়িটা, জানালার সমস্ত পর্দা টানা। সামনের দরজায় ছোট্ট সিঁড়ি, মাত্র দুটো ধাপ। তাতে উঠে ঘন্টা বাজালো কিশোর।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। আবার বেল বাজাতে যাবে, এই সময় নড়ে উঠলো দরজা। সামান্য ফাঁক হলো। উঁকি দিলো এক মহিলার মুখ। বয়েস তেমন। বেশি না। তবে খুব ক্লান্ত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

মাপ করবেন, কিশোর বললো। মিস্টার ক্লকের সঙ্গে দেখা হবে?

মিস্টার ক্লক? অবাক হলো যেন মহিলা। ওই নামে তো এখানে কেউ থাকে না।

নামটা বোধহয় আসল নয়, সেজন্যে চিনতে পারছেন না। তিনি ঘড়ি পছন্দ করেন। এখানেই তো থাকার কথা। কিংবা হয়তো থাকতেন।

ঘড়ি? তুমি মনে হয় মিস্টার রোজারের কথা বলছে। কিন্তু মিস্টার রোজার…

বলো না! বলো না! পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো একটা ছেলে। বয়েস। ওদেরই মতো হবে। কালো চুল। মহিলাকে ঠেলে সরিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো। ভ্রূকুটি করলো গোয়েন্দাদের দিকে চেয়ে। কথাই বলো না ওদের সাথে, মা। দরজা লাগিয়ে দাও। কেন এসেছে ওরা এখানে?

শোন, টিম, মহিলা বললো। এভাবে কথা বলতে নেই। ছেলেগুলোকে তো ভালোই মনে হচ্ছে আমার। মিস্টার রোজারের খোঁজ করতে এসেছে, দোষটা কোথায়?

একটু আগে কি মিস্টার রোজারই চিৎকার করেছিলেন? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসলো কিশোর।

কড়া চোখে তাকালো টিম। হ্যাঁ, সে-ই! গলা চড়ালো সে। ওটা তার মরণ চিৎকার, মরে যাচ্ছিলো!যাও, ভাগো এখন আমাদের অনেক কাজ। ওকে মাটি দিতে হবে।

দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো ছেলেটা।

শুনলে তো? চাপা গলায় বললো মুসা। লোকটাকে খুন করে এখন কবর দেয়ার কথা ভাবছে।

পুলিশ ডাকা দরকার, বললে রবিন।

আরও পরে, কিশোর বললো। আগে সব কথা জেনে নিই। বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করি।

দরজা ভেঙে ঢুকবে নাকি?

না, মাথা নাড়লো গোয়েন্দাপ্রধান। ওরাই ঢুকতে দেবে। জানালা দিয়ে উঁকি মারছে টিম… বেলপুশ টিপে ধরলো সে। ধরেই রাখলো, যতক্ষণ না, ঝটকা দিয়ে আবার খুললো দরজা।

ভাগতে বললাম না! গর্জে উঠলো টিম। কেন বিরক্ত করছো?

বিরক্ত করলাম কোথায়? নিরীহ কণ্ঠে বললো কিশোর। আমরা একটা রহস্যের তদন্ত করছি, তোমাদের সাহায্য দরকার। এই যে আমাদের কার্ড।

কার্ডটা পড়ে ভুরু কোঁচকালো টিম।

ব্যাগ থেকে চেঁচানো ঘড়িটা বের করে টিমের হাতে দিলো কিশোর।

কৌতূহল ফুটলো টিমের চোখে। এটাতে রহস্যের কি আছে?

ইলেকট্রিক সকেট কোথায়? কি রহস্য, দেখাচ্ছি, বলতে বলতেই ঘরের ভেতর পা ঢুকিয়ে দিলো কিশোর। বাধা দিতে গিয়েও কি ভেবে সরে দাঁড়ালো। টিম। একটা হলঘর, আবছা অন্ধকার। একপাশ থেকে দোতলায় সিঁড়ি উঠে গেছে। আরেক পাশে বিরাট এক গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লক, টিকটিক কানে না এলে চোখে, পড়তো না গোয়েন্দাদের। ঘড়ির পাশে টেবিলে টেলিফোন।

রহস্যময় মিস্টার রোজারের লাশ খুঁজছে মুসা আর রবিনের চোখ, দেখতে পেলো না। ঘড়িটার পাশে দেয়ালে সুইচবোর্ডে সকেট দেখে, সেদিকে এগোলো কিশোর। হাতের ঘড়িটা টেবিলে রেখে, সকেটে প্রায় ঢুকিয়ে লিভার অন করতেই চেঁচিয়ে উঠলো ঘড়ি। প্রতিধ্বনিত হলো বদ্ধ ঘরে। রোম, খাড়া হয়ে গেল দুই সহকারী গোয়েন্দার।

শুনলে তো, প্রাগটা খুলে নিয়ে বললো কিশোর। রহস্যময় না ঘড়িটা?

না, মোটেই অবাক হয়নি টিম। যে কেউ ওরকম চেঁচানি ঢোকাতে পারে, ঘড়িতে। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি। গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকের পেছন থেকে একটা কর্ড বের করে প্লাগটা সকেটে ঢোকালো সে। শোনা গেল মোটা গলায় আতঙ্কিত চিৎকার, জবাই করার জন্যে চেপে ধরা হয়েছে যেন।

কিশোরের সন্দেহ নেই, ফোনে এই চিৎকারই শুনেছে।

দ্রুত ঘরে এসে ঢুকলো মহিলা। টিম, দোহাই লাগে তোর… ছেলেদের ওপর চোখ পড়তে থেমে গেল। ও, ঢুকতে দিয়েছে তোমাদেরকে? টিম, হঠাৎ মত বদলালি যে?

ওরাও একটা চেঁচানো ঘড়ি নিয়ে এসেছে, সকেট থেকে প্লাগ খুলে ফেলেছে টিম। ছোট। আগে আর দেখিনি। আমার বিশ্বাস ওটা মিস্টার রোজারেরই। টেবিলে রাখা ঘড়িটা মা-কে দেখালো সে।

মাথা নাড়লো টিমের মা। আমিও দেখিনি। কি করে বুঝলি, ওটা মিস্টার। রোজারের?

বুঝেছি। ঘড়িতে চিৎকার ঢোকানোর বুদ্ধি আর কারও মাথায় আসবে না।

না, তা আসবে না, আবার মাথা নাড়লো মহিলা। ছেলেগুলো পেলো কোথায় এটা, বলেছে?

জিজ্ঞেস করিনি এখনও। পরিচয় দিয়েছে, ওরা গোয়েন্দা। ভাবছি, কথা বলবো ওদের সঙ্গে। মিস্টার রোজারের ঘড়িটা নিয়ে এসেছে যখন। একটা দরজা খুলে ইশারায় ভেতরে যেতে বললো তিন গোয়েন্দাকে।

বড় একটা লাইব্রেরি। এক পাশের দেয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে বাধা কয়েকটা তৈলচিত্র। আরেক পাশে বিরাট এক আয়না। বাকি দুদিকের দেয়ালে অসংখ্য তাক, বইয়ে ঠাসা। র‍্যাক আছে অনেকগুলো।

লাইব্রেরিতে বই থাকবে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু ওদেরকে অবাক করলো ঘড়ি। ছোট বড় নানারকম ঘড়ি রয়েছে ঘরটায়। মেঝেতে, টেবিলে, তাকে, দেয়ালে। নতুন-পুরনো, ছোট-বড়, দামী-কমদামী। তবে সব কটারই একটা বিশেষত্ব আছে, সবগুলোই বিদ্যুতে চলে। ফলে টিকটিক আওয়াজ না করে তুলেছে গুঞ্জন, যেন শত শত মৌমাছিকে কয়েদ করে রাখা হয়েছে ঘরটায়।

কি দেখছো? গোয়েন্দাদের তাজ্জব করে দিয়ে আনন্দ পাচ্ছে টিম। শুনলে আরও অবাক হবে, এর প্রত্যেকটা ঘড়িই চেঁচাতে পারে।

.

০৫.

চিৎকারে ভরে গেল যেন ঘরটা।

 শুরু হলো শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে। তারপর গর্জাতে লাগলো একজন রেগে যাওয়া মানুষ। তৃতীয়টা বন্য, হিংস্র চিতাবাঘ। তারপর চারদিক থেকে শুরু হলো চিৎকার, কান্না, ফোপানি, গজানি, ফোঁসফোসানি-মানুষেরও, জানোয়ারেরও।

লম্বা একটা কাউচে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে তিন গোয়েন্দা। শিউরে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।

একটা ডেস্কের ওপাশে বসে একের পর এক সুইচ টিপছে টিম। দাঁত বের করে হাসছে মেহমানদের দিকে চেয়ে। অবশেষে সব কটা সুইচ অফ করে দিলো। সে। নীরব হয়ে গেল ঘর।

জীবনে কখনও শুনেছো এরকম? বললো টিম।

ঘরটা কি সাউণ্ডপ্রফ? প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। এতোক্ষণে নিশ্চয় পুলিশকে ফোন করে দিয়েছে প্রতিবেশীরা।

অবশ্যই সাউণ্ডপ্রুফ। এটা মিস্টার রোজারের চেঁচানো ঘর। রাতে এখানে বসে। চেঁচানো শুনতেন…মানে… থেমে গেল টিম।

মিস্টার রোজারের কিছু হয়েছে?

কেন? হবে কেন?

ওই যে, শুনতেন বললে। তারপর থেমে গেলে। ভাবলাম, কিছু হয়েছে।

 চলে গেছে, ব্যস। তাতে তোমাদের কি?

আমাদের? না, কিছু না। চেঁচানো ঘড়ি দিয়ে শুরু করেছিলাম। ঢুকলাম। চেঁচানো ঘরে। এখন শুনছি এর মালিকই গায়েব। রহস্য জটিল হচ্ছে আরকি। আচ্ছা, বলতে পারো, কেন এতোগুলো ঘড়িতে চিৎকার ঢোকালেন তিনি? কিছু তো বুঝতে পারছি না।

এতে আর বোঝাবুঝির কি আছে? বলে উঠলো মুসা। মাথায় ছিট ছিলো আরকি। নইলে রাতে একলা বসে চেঁচামেচি শোনে কেউ?

এটা তাঁর হবি ছিলো, মিস্টার রোজারের পক্ষ নিলো টিম। অনেক হবিরই কোনো অর্থ থাকে না। তোমাদেরটার আছে?

আছে, মাথা কাত করলো কিশোর। রহস্যের সমাধান করা। এই যেমন, ঘড়ি-রহস্যের সমাধান করতে এসেছি।

আমি তো বলছি, এতে কোনো রহস্য নেই!

তাহলে ওরকম আচরণ করছো কেন? এমন ভাব করছে, যেন দুনিয়ার সবাইকে ঘৃণা করো। খুলে বলছো না কেন? সব শুনলে হয়তো সাহায্য করতে পারবো।

তোমরা কি সাহায্য করবে? জ্বলে উঠলো টিম। আর আমিও অদ্ভুত আচরণ করছি না। তোমরাই বরং করছে। এখন যাও, ওঠো। একা থাকতে দাও আমাকে প্রায় ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে। পথ দেখো! আর কখনও আসবে না…আরি!

দরজায় দেখা দিলো একজন লোক। তেমন লম্বা নয়, কিন্তু কাধ খুব চওড়া। তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে ভুরু কোঁচকালো। কারা ওরা, টিম? বন্ধু নিয়ে এসেছো খেলতে, গোলমাল করতে, আমাকে বিরক্ত করতে? বলে দিয়েছি না, হৈ চৈ আমি একদম পছন্দ করি না?

হৈ-চৈ করছি না আমরা, মিস্টার লারমার, গম্ভীর হয়ে বললো টিম। আর শব্দ তো বাইরে যায় না। এই ঘর সাউণ্ডপ্রুফ। আপনার অসুবিধে-..

হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলো লারমার। দীর্ঘ এক মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে রইলো তিন গোয়েন্দার দিকে, যেন তাদের চেহারা মনে গেঁথে নিলো। বললো, যাচ্ছি। তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

দুপদাপ করে পায়ের শব্দ হলো দোতলার সিঁড়িতে।

কাউকে তোমাদের বাড়িতে আনলে তার কি? লারমারের ব্যবহারে কিছুটা অবাকই হয়েছে রবিন। বাড়িটা তোমাদের, তাই না?

না, মিস্টার রোজারের। আমার মা তার হাউসকীপার। তিনি চলে যাওয়ার পর ওপর তলার ঘরগুলো লারমারকে ভাড়া দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছে মা। যাও, এখন যাও তোমরা। ঝামেলাতেই ফেলেছো…

যাচ্ছি। সহকারীদের দিকে ফিরে বললো কিশোর, চলো যাই। টিমকে বললো, অনেক ধন্যবাদ, টিম, ঘড়িগুলো দেখানোর জন্যে।

হলে ফিরে টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরলো কিশোর। বেরিয়ে চলে এলো রোলস রয়েসটা যেখানে পার্ক করা আছে।

দূর, কোনো লাভ হলো না, গাড়িতে উঠে বললো মুসা। ঘড়ি জোগাড়ের নেশা আছে লোকটার। ব্যস, রহস্য ওই পর্যন্তই।

হুঁ, বলে কি বোঝাতে চাইলো কিশোর, বোঝা গেল না। হ্যানসনকে বললো, হলিউডে এলামই যখন, মিস্টার ক্রিস্টোফারের অফিসে একবার ঢু মেরে যাই। কি বলেন?

নিশ্চয়ই, বলে এঞ্জিন স্টার্ট দিলো হ্যানসন।

দাঁড়ান, দাঁড়ান! বলে উঠলো রবিন।

সবাই দেখলো, টিম দৌড়ে আসছে। পাশের জানালা নামিয়ে দিলো মুসা। কাছে এসে হাঁপাতে লাগলো ছেলেটা। যাক, ধরতে পেরেছি…দেখো, সত্যি আমার সাহায্য দরকার। থেমে দম নিলো সে। আমার বাবা জেলে, কোনো অপরাধ না করেই। তাকে যদি নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারতে, বড় উপকার হবে।

০৬.

গাড়িতে ওঠো, দরজা খুলে দিয়ে ডাকলো কিশোর। খুলে বলো সব বুঝে দেখি সাহায্য করতে পারবো কিনা।

পেছনের সিটে চাপাচাপি করে বসলো চার কিশোর। অল্প কথায় সব জানালো টিম। বছর তিনেক আগে স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে, এসে থাকার জন্যে মিস্টার রোজারের বাড়িতে উঠেছিলো তার বাবা বেকার ডেলটন। বীমা কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ করতো। সামান্য আয়ে সংসার চলতো না। তাই বাধ্য হয়ে মিস্টার রোজারের হাউসকীপারের চাকরি নিয়েছিলো টিমের মা। বাড়ির পেছনে ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসও বিনা ভাড়ায় পেয়েছিল থাকার জন্যে।

ভালোই কাটছিলো। তারপর, মাস ছয়েক আগে বেভারলি হিল-এ এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে চুরি হলো। তিনটে দামী, ছবি। কিভাবে ঢুকেছিলো চোর, জানতে পারেনি পুলিশ। অনুমান করছে, হয় সরু জানালা দিয়ে, জোরজার করে ঢুকেছে, কিংবা নকল চাবি বানিয়ে নিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলো ওরা, চুরির হপ্তা দুই আগে ওই বাড়িতে গিয়েছিলো ডেলটন। মালিকের একটা পলিসি করানোর জন্যে। ছবিগুলো দেখেছে।

শুধু ওই বাড়িতে যাওয়ার অপরাধেই ডেলটনের অ্যাপার্টমেন্টে এসে ছবি খুঁজেছে পুলিশ। রান্নাঘরে পেয়েছে চোরাই মাল। ধরে নিয়ে গিয়ে পাঁচ বছরের জন্যে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মাস তিনেক আগে বিচার শেষ হয়েছে তার। অনেক মিনতি করেছে ডেলটন, কসম খেয়েছে। বলেছে, সে চুরি করেনি।- ছবি চেনে না। দামী কিনা বলতেই পারবে না। তাছাড়া দুজনের আয়ে সংসার চলে যাচ্ছিলো। ভালোমতোই, চুরি কেন করতে যাবে? কিন্তু জুরিরা শুনলো না সে কথা।

বিশ্বাস করো, শেষে বললো টিম, বাবা চুরি করেনি। আমার বাবা চোর নয়। হলে আমি আর মা জানতাম। পুলিশের ধারণা, এই এলাকায় গত দশ বছর ধরে যতো ছবি চুরি হয়েছে, সবগুলোর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাবা। বীমার দালাল, লোকের বাড়িতে ঢোকা তার জন্যে সহজ। থেমে দম নিলো সে। তারপর হঠাৎ কিশোরের হাত চেপে ধরে বললো, তোমাদের ভাড়া করতে চাই। আমাকে সাহায্য করো। ব্যাংকে পনেরো ডলার জমিয়েছি আমি, তোমাদের দেবো। এর। বেশি দিতে পারবো না, নেই আমার কাছে। আমার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করে দাও, প্লীজ!।

চোখ মিটমিট করলো কিশোর, চিন্তিত। রবিন আর মুসার চোখে শূন্য দৃষ্টি। না জেনেশুনে ভালোমতো সাক্ষী-প্রমাণ না নিয়ে কি আর একটা লোককে জেলে ঢুকিয়েছে পুলিশ?

কাজটা খুব কঠিন, টিম, বোঝানোর চেষ্টা করলো কিশোর। তবু, সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।

কঠিন, সে-তো, জানিই। সহজ হলে কি আর গোয়েন্দার সাহায্য লাগতো?

 নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। আচ্ছা, একটা কথা বলো তো, ছবিগুলো তোমাদের রান্নাঘরে গেল কি করে?

বলতে পারবো না। মিস্টার রোজারের কাছে অনেকে আসতো। তাদের কেউ রেখে যেতে পারে। কিংবা বাবার কোনো শত্রু।

দরজায় তালা লাগানো থাকতো না? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

থাকলেই বা কি? পুরনো দরজা, পুরনো তালা। সহজেই খোলা যায়। তাছাড়া এমন দামী কিছু থাকে না রান্নাঘরে, যে সাবধান থাকবো।

হুমম্। নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটেই চলেছে গোয়েন্দাপ্রধান।

মিস্টার রোজারই চুরি করেননি তো? মুসা বললো। চুরি করে এনে হয়তো তোমাদের রান্নাঘরে লুকিয়েছিলেন। ওটাই সহজ জায়গা।

টিম জবাব দেয়ার আগেই কিশোর বললো, মিস্টার রোজারকে সন্দেহ করেছিলো পুলিশ?

মাথা নাড়লো টিম। মিস্টার রোজার ওরকম কাজ করতেই পারেন না। আমাদের পছন্দ করতেন। তাছাড়া, ছবিগুলো যেরাতে চুরি হয়েছে, সেরাতে ঘরে ছিলেন তিনি।

কিছু মনে কোরো না, বললো কিশোর। গোয়েন্দাগিরিতে কাউকেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে নেই। তাই জিজ্ঞেস করলাম। একটা ব্যাপার অদ্ভুত লাগছে আমার।

অদ্ভুত? রবিন ফিরে তাকালো।

তদন্ত শুরু করলাম চেঁচানো ঘড়ির। এখন দেখছি ছবি চুরির কেস। কি যেন একটা যোগাযোগ রয়েছে।

তা কি করে হয়? প্রশ্ন তুললো মুসা।

বুঝতে পারছি না। টিম, মিস্টার রোজারের কথা সব খুলে বলবে? রবিন, নোট নাও।

বেশি কিছু জানাতে পারলো না টিম। বেঁটে, মোটা, হাসিখুশি মানুষ মিস্টার রোজার। অনেক টাকার মালিক। ডেলটনদের ধারণা বছর কয়েক আগে হঠাৎ ওগুলো কারও কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন রোজার। অনেক লোক যাতায়াত করতো তার কাছে। ওদেরকে দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয়নি, একসময় অভিনেতা ছিলেন রোজার, কিংবা থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তিনি সেকথা কখনও ডেলটনদের বলেননি।

টিমের বাবা চোর, একথা রোজারও মানতে পারেননি। নিজের খরচে উকিল রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না ডেলটনকে। এতেই বোধহয় মন খারাপ হয়ে যায় তার। বেকার ডেলটন জেলে যাওয়ার পর পরই বিদেশে চলে গেলেন তিনি। বলে গেলেন, হাওয়া বদলাতে যাচ্ছেন। বাড়িটা দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন টিমের মায়ের ওপর।

সঙ্গে শুধু দুটো সুটকেস নিয়ে সেই যে গেছেন রোজার, গেছেনই, আর কোনো খোঁজ নেই তার। একটা চিঠিও লেখেননি। যাওয়ার পর কিছুদিন বন্ধুরা এসেছে। দেখা করতে, না পেয়ে ফিরে গেছে। ওদের আসাও বন্ধ হয়ে গেছে এখন।

টিমের মাকে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন রোজার। এক সময় শেষ হয়ে গেল সেই টাকা। ঠিক এই সময় ভাড়া বাড়ির খোঁজে এসে হাজির হলো লারমার। টাকা নেই, খাবে কি? অগত্যা লারমারকে বাড়ি ভাড়া দিয়ে দিলো মিসেস ডেলটন। লারমারের শর্ত, তাকে নিরিবিলিতে থাকতে দিতে হবে, আর কোনোরকম হৈ-চৈ করা চলবে না বাড়িতে।

ব্যস, এইই জানি, টিম বললো। কিছুক্ষণ উসখুস করলো সে। তারপর বললো, দেখো, শুরুতে তোমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, কিছু মনে রেখো না। ফোনে মা যখন তোমাদের সঙ্গে কথা বলছিলো, তখন আমিই ঘড়িটার চিৎকার চালু করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, খবরের কাগজের লোক ওদের দেখতে পারি না আমি। কাজের কাজ কিছু করতে পারে না, খালি…যাক ওসব কথা। তোমরা কিছু মনে রেখো না। আমার মনের অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।

পারছি, মাথা ঝোঁকালো কিশোর। তোমার সমস্যাটা নিয়ে ভাববো। কিছু বুঝতে পারলে, জানাবো।

টিমকে গুডবাই জানালো তিন গোয়েন্দা। গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল টিম।

আবার এঞ্জিন স্টার্ট দিলো হ্যানসন। কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো, মিস্টার ক্রিস্টোফারের ওখানেই যাবো?

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা কাত করলো কিশোর। যান। ওখানেই তো যেতে চাইছিলাম আমরা। এখন তো যাওয়াই দরকার। রোজার অভিনেতা হলে হয়তো তাকে চিনতে পারবেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।

কয়েক মিনিটেই প্যাসিফিক স্টুডিওর গেটে পৌঁছে গেল গাড়ি। আরও কয়েক মিনিট পর বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে ঢুকলো তিন গোয়েন্দা।

এই যে, ছেলেরা, বিশাল ডেস্কের ওপর থেকে বললেন পরিচালক। হঠাৎ? নতুন কোনো কেস?

হ্যাঁ, স্যার, কিশোর বললো। গোলমেলে ঘড়ির তদন্ত শুরু করেছিলাম…

প্রথম দুটো শব্দ বাংলা বলেছে কিশোর, বুঝতে পারলেন না পরিচালক। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসের তদন্ত বললে?

গোলমেলে ঘড়ি, স্যার। স্ক্রীমিং ক্লক।

কীই! স্ক্রীমিং ক্লক! ভুরু আরও কুঁচকে গেছে তাঁর, রীতিমতো অবাক হয়েছেন। অনেক বছর কোনো খোঁজ নেই। কি হয়েছিলো তার?

.

০৭.

তার? বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। স্ক্রীমিং ক্লক নামে কোনো মানুষ আছে?

ওটা তার ডাকনাম, জানালেন পরিচালক। ওর আসল নাম হ্যারিসন ক্লক। চেঁচাতো তো, সেজন্যেই লোকে নাম রেখেছিলো স্ক্রীমিং ক্লক। স্ক্রীমার ছিলো সে।

স্ক্রীমার? বুঝতে পারছে না কিশোর।

কিশোর পাশাও তাহলে অনেক কিছু জানে না, মুচকি হাসলেন পরিচালক। চেঁচানোকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলো হ্যারি। রহস্যময় কণ্ঠে বললেন তিনি।

বুঝিয়ে বলবেন, স্যার, প্লীজ!

অনেক বছর আগে, টেলিভিশন তখনও এতো উন্নত হয়নি। রেডিওর চলই ছিলো বেশি। রেডিওতে তখন নাটক শুনতো লোকে। রহস্য গল্প নিয়েও নাটক হতো। লোকে পছন্দও করতে খুব। একবার তো মনে আছে আমার, শুধু রহস্য গল্প নিয়েই এক হপ্তায় হয়েছিলো পঁয়তিরিশটা নাটক। আজকাল টেলিভিশনে যেমন উপভোগ করো তোমরা, আমরা করতাম রেডিওতে শুনে। রোমাঞ্চিত হতাম।

সে-সব নাটকে কণ্ঠ দিতে হতো অনেককে। বিশেষ সাউণ্ড ইফেক্টের জন্যে চেঁচানোর দরকার পড়তো। শুনে যতো সহজ মনে হচ্ছে, কাজটা মোটেও ততো সহজ নয়। এটাও একটা আর্ট। এর জন্যে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা সব কিছুরই প্রয়োজন আছে। খুব ভালো শিল্পী ছিলো হ্যারি। পরিচালকদের কাছে তাই তার কদরও ছিলো খুব।

আমার দুটো ছবিতে তাকে দিয়ে কাজ করিয়েছি আমি। চিৎকারে তার জুড়ি নেই। শিশু, মহিলা, পুরুষের কণ্ঠ তো বটেই, নানারকম জন্তুজানোয়ারের ডাকও সে নিখুঁত নকল করতে পারে।

সময় বদলালো। টেলিভিশন জনপ্রিয় হলো। রেডিওর কদর আর রইলো না। ফলে হ্যারিসন ক্লকের মতো লোকদের দামও কমতে লাগলো। বছর কয়েক আগে। আমার দুটো ছবিতে কাজ করার পর গায়েব হয়ে গেল হ্যারি। আর কোনো খোঁজ পাইনি। তার ব্যাপারেই তদন্ত করছো?

কি জানি, হতেও পারে, বললো কিশোর। তবে আপাতত একটা স্ক্রীমিং ক্লকের তদন্ত করছি আমরা। ব্যাগ থেকে ঘড়িটা বের করে টেবিলে রাখলো সে। ওটা হাতে আসার পর থেকে যা যা ঘটেছে, খুলে বললো।

আশ্চর্য! গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালেন পরিচালক

শুনে তো হ্যারিসন ক্লকের মতোই লাগছে, রোজারকে। ক্লক বেঁটে ছিলো। হালকা-পাতলা। রোজার বেঁটে, মোটা। তবে পাতলা মানুষ মোটা হতে সময় লাগে না। আরেকটা ব্যাপার, রেডিওতে আয় কমে গিয়েছিলো, কিন্তু শেষ দিকে কি করে যেন হঠাৎ বড়লোক হয়ে গিয়েছিলো হ্যারি। আনমনে প্রশ্ন করলেন নিজেকেই, কিন্তু নাম বদলাবে কেন?

পেইন্টিঙের ব্যাপারে কি তার আগ্রহ ছিলো, স্যার? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

জানি না। অনেক অভিনেতারই অবশ্য থাকে। ক্লকের ছিলো বলে শুনিনি।

থ্যাংক ইউ, স্যার, উঠে দাঁড়ালো কিশোর। অন্য দুজনও উঠলো। অনেক, মূল্যবান তথ্য জানালেন। এসব নিয়ে ভাবতে হবে।

পরিচালকের অফিস থেকে বেরিয়ে এলো ওরা।

রকি বীচে, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে ওদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। হ্যানসন।

গেটের ভেতরে ঢুকেই থমকে গেল কিশোর। পেছনে প্রায় তার গায়ের ওপর এসে পড়লো অন্য দুজন। কতগুলো আসবাবপত্রের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে একজন মানুষ।

হাই, ছেলেরা, এগিয়ে এলো সে। চিনতে পারছো?

 পারছে। মাত্র ঘন্টাখানেক আগে ওকে দেখেছে রোজারের বাড়িতে।

একটা ঘড়ি আছে তোমার কাছে, কিশোরের দিকে চেয়ে বললো লারমার। ওটা আমার জিনিস।

হাতের ব্যাগটা পেছনে নিয়ে গেল কিশোর।

লাফিয়ে এগিয়ে এলো লারমার। আমার জিনিস আমাকে দিচ্ছো না কেন? জলদি দাও। নইলে…

কিশোর আর লারমারের মাঝে এসে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে গেল মুসা। কিছুই করতে পারবেন না আপনি, মিস্টার। ওটা আপনার জিনিস হলে নিশ্চয়ই দেবো। কিন্তু প্রমাণ করতে হবে…।

এক ধাক্কায় মুসাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো লোকটা। গায়ে মোষের। জোর, এতোটা আশা করেনি গোয়েন্দা-সহকারী। ইদানীং কারাত শিখছে সে, সেই ভরসায়ই সামনে এসেছিলো। হাল ছাড়লো না। কিশোরের হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালালো লারমার। জাপানী জুজিৎসুর কায়দায় তার কব্জি চেপে। ধরলো মুসা।

সেই একই কায়দায় চোখের পলকে হাত ছাড়িয়ে নিলো লারমার। বুঝতেই পারলো না মুসা, কখন ঘুরে গেছে সে, তার পিঠ এখন লোকটার দিকে। শার্টের কলার ধরে তুলে তাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো লারমার। আবার কিশোরের হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিতে গেল।

এই মিস্টার! মস্ত থাবা পড়লো লারমারের কাঁধে, যেন ভালুকের থাবা। তিন। গোয়েন্দাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান, বোরিস। হচ্ছে কী?

ফিরে তাকালো লারমার। আমার জিনিস চুরি করেছে। ওটা ফেরত চাই।

ব্যাগ ছাড়ুন, শান্ত কণ্ঠে বললো বোরিস।

তোমার কথায়, না? ভালুক কোথাকার! বলেই ধাঁ করে হাত চালালো বোরিসের গলা সই করে, কারাতের কায়দায়।

গলাটা সরিয়ে নিলো শুধু বোরিস। কারাত-ফারাতের ধার দিয়েও গেল না। লারমারের হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে আরও কাছে নিয়ে এলো। তারপর দুহাতে ধরে তাকে তুলে নিলো মাথার ওপর, টারজানের মতো। জনি ওয়াইসমুলারকে বোরিসের খুব পছন্দ, সুযোগ পেলেই তাঁকে অনুকরণের চেষ্টা করে। কিশোর, কি করবো ব্যাটাকে? আছাড় মেরে কোমর ভাঙবো, না পুলিশ ডাকবে?

না, ওসব কিছু না, দ্রুত ভাবনা চলেছে গোয়েন্দাপ্রধানের মাথায়। পুলিশকে ডেকে এনে উন্মেও হতে পারে, হয়তো লারমার প্রমাণ করে দেবে ঘড়িটা তারই। তাহলে জটিল একটা রহস্য হাতছাড়া হয়ে যাবে। মাপ করে দিন ওকে।

লারমারকে বুকের কাছে নামিয়ে এনে হাত থেকে ছেড়ে দিলো বোরিস। গমের বস্তার মতো দড়াম করে মাটিতে পড়লো লোকটা। কোমরে হাত দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। মুসার গা-জ্বালানো হি-হি হাসি উপেক্ষা করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, বেশ, দেখে নেবো আমি!….

হাত বাড়ালো বোরিস। তাহলে হয়ে যাক না এখুনি আরেকবার…

ঝট করে পিছিয়ে গেল লারমার। কিশোরের দিকে ফিরলো। পস্তাবে, মনে রেখো! আমি…আমি… কথা শেষ না করেই গটমট করে হেঁটে চলে গেল সে।

.

০৮.

পরদিন হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসলো তিন গোয়েন্দা। টিমও রয়েছে।

সকালে লারমার চলে যাওয়ার পর টিমকে ফোন করেছিলো কিশোর। কথায় কথায় জেনেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে তার, পুরনো একটা গাড়িও আছে। গাড়িটা তার বাবার। চাইলে ওটা কাজে লাগাতে পারে তিন গোয়েন্দা। গাড়ি নিয়ে। ওকে আসতে বলেছিলো সে।

তারপর, রবিন; তোমার খবর বলো, সামনে ঝুঁকলো কিশোর।

লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা বড় খবরের কাগজে কাজ করেন রবিনের বাবা। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলো সে, রেকর্ড রুমে পুরনো কাগজ ঘেঁটে দেখার জন্যে, অবশ্যই কিশোরের পরামর্শে। পকেট থেকে কয়েক পাতা কাগজ বের করে ভাঁজ খুলে টেবিলে বিছালো রবিন।

টিমের বাবা বেকার ডেলটনের সম্পর্কে নতুন তেমন কিছুই জানতে পারেনি। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেছে। দশ বছর ধরে হলিউড আর লস অ্যাঞ্জেলেসে যতো ছবি চুরি হয়েছে, সবগুলোর সঙ্গে ডেলটন জড়িত ছিলো, একথা, তার মুখ দিয়ে বের করাতে চেয়েছে। কিন্তু বেকার ডেলটনের এক কথাঃ সে চোর নয়। ছবির ব্যাপারে কিছুই বোঝে না। এসব কথা সঙ্গীদের জানিয়ে টিমের দিকে ফিরলো রবিন। জিজ্ঞেস করলো, তোমরা স্যান ফ্রান্সিসকোয় থাকতেই অনেকগুলো চুরি হয়েছে, তাই না?

হ্যাঁ। ছয় বছর আগে হলিউডে এসেছি আমরা। চুরি হচ্ছে আরও বছর চারেক আগে থেকেই। এতেই বোঝা যায়, আমার বাবা নির্দোষ।

চুরিগুলো একটা দলই করছে কিনা সেটা বুঝতে হবে আগে, কিশোর বললো। রবিন, দশ বছরে কটা ছবি চুরি হয়েছে?

বেশি দামী ছবি মোট বারোটা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জানালা কিংবা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে চোর, ফ্রেম থেকে কেটে ছবি বের করে নিয়ে চলে গেছে। পুলিশের ধারণা, ওগুলো ধনী দক্ষিণ আমেরিকানদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। লুকিয়ে রাখবে ওরা, কাউকে দেখাবে না। জেনেশুনেই চোর ও-ধরনের লোকের কাছে বিক্রি করেছে।

যাতে কেউ কখনও খুঁজে না পায় ওগুলো?

হ্যাঁ। টিমদের রান্নাঘরেরগুলোও নিখোঁজ হততা, সময় মতো পুলিশ ওখানে না। গেলে।

দাম কেমন হবে বারোটা ছবির?

সঠিক বলা যাবে না। ছবি বিশেষজ্ঞদের আন্দাজ, নীলামে এক কোটি ডলারে উঠতে পারে।

খাইছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। এত দাম!

মাথা ঝাঁকালো রবিন।

এখন প্রশ্ন হলো, টিমদের রান্নাঘরে এলো কিভাবে তিনটে ছবি? বললো কিশোর। প্রশ্ন অবশ্য আরও আছে। কে চুরি করেছে? মিস্টার রোজার ওরফে ক্লক হাওয়া বদল করতে গিয়ে কেন গায়েব হয়ে গেলেন? আর এটাই বা কোত্থেকে এলো? টেবিলে রাখা ঘড়িটা ছুঁলো সে। কোনো না কোনোভাবে এটার মূল্য আছে। নইলে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে খেপে যেতো না লারমার।

ওকে বলাটাই আমার অন্যায় হয়েছে, কোলের ওপর রাখা দুই হাতের দিকে তাকিয়ে বললো টিম। মুখ তুললো। কি করবো, বলো? এমনভাবে শাসাতে লাগলো মাকে…তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করলো। শেষে বলতে বাধ্য হলাম, একটা ঘড়ি এনেছো তোমরা। কার্ডটা দেখাতেই আর দেরি করলো না। ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছুটলো।

ভাগ্যিস তখন ইয়ার্ডে ছিলো বোরিস। আচ্ছা, টিম, লারমার যে তোমাদের বাড়িতে থাকে, সন্দেহজনক আচরণ কিছু করে-টরে?

মাঝে মাঝে রাতে উঠে বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়! মা কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো। জবাব দিয়েছে, সে লেখক। রাতে প্রটের কথা ভাবতে ভাবতে মাথ গরম হয়ে যায়, বাইরে বেরিয়ে ঠাণ্ডা করে। এক রাতে শুনলাম, দেয়ালে হাতুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি দিচ্ছে। গিয়ে দেখলাম। মনে হলো, কিছু খুঁজছে।

হুমম! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। একটা সন্দেহ জাগছে, তবে ভুলও হতে পারে। যাকগে, ওসব পরে। আগের কাজ আগে। বুঝতে পারছি না, পুলিশ যে চুরির সমাধান করতে পারেনি, সেটা আমরা কি করে করবো? ঘড়ি ধরেই এগিয়ে দেখা যাক।

তাতে আমার কি লাভ হবে? হাত নাড়লো টিম। বাবা রয়েছে জেলে, আর তোমরা করতে চাইছে ঘড়ির তদন্ত…

কোনোখান থেকে শুরু করতে হবে তো? অনেকগুলো রহস্য জমা হয়েছে।– আমার বিশ্বাস, ঘড়িটার সঙ্গে ওগুলোর কোনো যোগাযোগ আছে।

বেশ, খুশি হতে পারছে না টিম, করো। কিন্তু কি করে বুঝবে ওটা কোত্থেকে এসেছে?

তলায় একটা কাগজ লাগানো ছিলো, মেসেজ। ড্রয়ার খুলে একটা গোপন কুঠুরি থেকে ছোট কাগজটা বের করলো কিশোর। জোরে জোরে পড়ে শোনালো টিমকে।

কাদের নাম? মুসার প্রশ্ন। কারা ওরা? কি করে খুঁজে বের করবো? আর যদি পাই-ই, কি কথা জিজ্ঞেস করবো ওদের?

দাঁড়াও। এক আঙুল তুললো কিশোর, একবারে একটা প্রশ্ন। মিলারের কাছে লেখা হয়েছে মেসেজটা। আগে তার ঠিকানা বের করা যাক।

কিভাবে?

ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। ভাবলেই বুঝতে পারবে। মিলার নিশ্চয় রোজারের বন্ধু, নইলে তার কাছে লিখতো না। হাত বাড়ালো কিশোর, টিম, অ্যাড্রেসবুক পেয়েছো?

না। অনেক খুঁজেছি। একটা লিস্ট পেয়েছি শুধু, ড্রয়ারে অনেক কাগজের মধ্যে গোঁজা। ওদেরকে ক্রিস্টমাস কার্ড পাঠিয়েছিলেন মিস্টার রোজার। এই যে।

ভাঁজ করা কাগজটা খুলে টেবিলে বিছিয়ে হাত দিয়ে ডলে সমান করলো কিশোর। গুড। মনে হচ্ছে এতেই চলবে। অনেক নাম-ঠিকানা আছে।

নাম আর ঠিকানাগুলো পরিষ্কার ভাবে টাইপ করা রয়েছে কাগজটায়। হেনরি মিলার একজনই পাওয়া গেল। জেনি রোবিডও একজন, উত্তর হলিউডের ঠিকানা। তবে বারকেন দুজন, একজন জেসিয়াস বারকেন, আরেকজন হিরাম বারকেন। দুজনেই প্যাসাডোনার কাছে থাকেন। জেলড়াও দুজন–জেলডা ডেনমার আর জেলডা ট্রিক্সটার। দুজন থাকেন দুই জায়গায়।

নামগুলোর পাশে টিক চিহ্ন দিলো কিশোর। বললো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবাই। দুদলে ভাগ হয়ে দেখা করতে যাবো আমরা। রবিন, তুমি টিমের সঙ্গে যাবে। মিলার আর মিস রোবিডকে খুঁজে বের করবে। একই দিকে থাকে দুজনে, সুবিধে হবে তোমাদের। রোলস রয়েসটা নিয়ে আমি আর মুসা যাবো অন্য দুজনকে খুঁজতে। ঠিক আছে?

কিন্তু দেখা হলে কি জিজ্ঞেস করবো?

মিলারকে জিজ্ঞেস করবে, মিস্টার ক্লক ঘড়িটা তার কাছে পাঠিয়েছিলেন কিনা? আর নিচে লাগানো মেসেজটা দেখেছেন কিনা। ঘড়িটা বরং নিয়ে যাও সাথে করে। দেখালে হয়তো সহজে চিনতে পারবেন উনি।

বেশ, নিলাম। আর মিস রোবিডকে?

তার কাছে রোজার কোনো মেসেজ পাঠিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করবে। বলবে, মেসেজটা তোমাকে জেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ক্লক। প্রয়োজন হলে ঘড়িটা মিস রোবিডকেও দেখাবে।

তা নাহয় দেখালাম। কিন্তু তুমি? তোমার ঘড়ি দরকার হবে না?

অবিকল এক রকম দেখতে আরেকটা ঘড়ি নিয়ে যাবো আমি। এমনও হতে পারে দেখানোর দরকারই হবে না। তবু, বলা যায় না। ওরকম ঘড়ি আরেকটা জোগাড় করে রেখেছি আমি।

এখুনি রওনা হবো?

তোমাদের গাড়ি আছে। চলে যেতে পারো। আমাদের বসতে হবে। হ্যানসন। গাড়ি নিয়ে এলে, তারপর…

কিশোর, হাত তুললো মুসা। একটা খুব জরুরী কথা ভুলে বসে আছে। এখুনি রওনা হতে পারি না আমরা।

কেন? অবাক হলো কিশোর।

কারণ, গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো মুসা, এখন লাঞ্চের সময়।

.

০৯.

এখানেই কোথাও হবে, মোড়ে মোড়ে লাগানো রোড-নম্বরগুলো দেখছে রবিন। হ্যাঁ, ওই যে, মিস্টার মিলার ওই গলিতেই থাকেন।

পথের মোড়ে পুরনো সেডান গাড়িটা পার্ক করলো টিম। দুজনেই নামলো গাড়ি থেকে।

 বাপরে, বিরাট বড়লোক, পাথর বসানো ড্রাইভওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো টিম। বাড়ি দেখেছো কত বড়!

মাথা ঝাঁকালো রবিন। হাতে ব্যাগ। বেল বাজাতে গিয়ে অবাক হয়ে ভাবলো রবিন, এই বাড়ি থেকেই ঘড়িটা বেরিয়েছে?

দরজা খুলে দিলো এক মহিলা। ভুরু কুঁচকে তাকালো ওদের দিকে। মাঝবয়েসী, মনে হচ্ছে, কোনো কারণে উত্তেজিত হয়ে আছে। কি চাই? কড়া গলায় বললেন। চাঁদা? কবার দেবো?

না, ম্যাডাম, ভদ্র কণ্ঠে বললো রবিন, চাঁদা চাইতে আসিনি। মিস্টার মিলারের সঙ্গে দেখা করতে চাই, প্লীজ।

হবে না। উনি অসুস্থ। কয়েক মাস হলো হাসপাতালে রয়েছেন।

ওহ, সরি। তাই নাকি? দ্রুত ভাবছে রবিন। মিস্টার মিলার যদি কয়েক মাস ধরে হাসপাতালেই থেকে থাকেন, তিনি নিশ্চয় ঘড়িটা ফেলেননি। জিজ্ঞেস করলো, তার পুরো নাম কি হেনরি মিলার?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবিনকে দেখছেন মহিলা। বোধহয় আন্দাজ করতে চাইছেন, ছেলেটা ভালো না মন্দ–মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবেন কিনা। ভালোই মনে হলো হয়তো, তাই জবাব দিলেন, হ্যাঁ। কেন? কোনো রকম…

না না, কোনো রকম অসৎ উদ্দেশ্য নেই আমাদের, তাড়াতাড়ি বললো রবিন। মিসেস মিলার। আপনিই নিশ্চয় মিসেস মিলার। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, একটা ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছি আমরা। ব্যাগ থেকে ঘড়ি খুলে দেখালো। এই যে, এটা।

আবার ওটা! চেঁচিয়ে উঠলেন মহিলা। ওরকম বিচ্ছিরি একটা জিনিস আমার স্বামীর কাছে পাঠিয়েছে। ভাবো একবার, তার অসুখের সময়। ভাগ্যিস চিৎকার শোনেনি। তাহলে নির্ঘাত হার্টফেল করতো। আমি সুস্থ মানুষ, আমিই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম আরেকটু হলে!

চকিতে দৃষ্টি বিনিময় করলো রবিন আর টিম। ঠিক জায়গাতেই এসেছে।

 নিশ্চয় মিস্টার ক্লক পাঠিয়েছেন? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

হ্যারিসন ক্লক! ও আবার ভদ্রলোক নাকি? ভেবে দেখো, অসুস্থ একজন মানুষকে ওরকম উপহার পাঠায়? কিসের সুবাদে? না, ওরা একসঙ্গে কাজ করতো একসময়। আমার স্বামী রেডিওর জন্যে রহস্য নাটক লিখতো। ঘড়িটা পেয়ে প্রথমে কিছু মনে করিনি! কিন্তু প্রাগ লাগিয়ে চিৎকার শুনে…ও মাগো! শিউরে উঠলেন মিসেস মিলার। সোজা নিয়ে গিয়ে ময়লার বাক্সে ফেলে দিয়ে এলাম। তোমরা ওখান থেকে কুড়িয়ে এনেছো নাকি?

না। এক বাতিল মালের দোকান থেকে কেনা হয়েছে। নিচে একটা মেসেজ ছিলো, দেখেছেন?

মেসেজ? নূকুটি করলেন মহিলা। না, দেখিনি। পাওয়ার পরদিনই ফেলে দিয়েছি। ঘড়িটার সঙ্গে ছোট একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলো। ওটাও ফেলে দিয়েছি।

কি লেখা ছিলো মনে আছে? ব্যাপারটা জরুরী।

ছিলো?…ছিলো, ঘড়িটা কাজে লাগালে নাকি অনেক টাকার মাল পাবে। মাথামুণ্ড কিছু বুঝিনি। রসিকতার আর সময় পেলো না লোকটা। এদিকে আমার। স্বামী হাসপাতালে মরে, টাকার অভাব, এই সময় কোনো ভালো মানুষ ওসব কথা লেখে? বুঝলাম না, এভাবে আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়ে কি আনন্দ সে পেতে চেয়েছে। থেমে আবার ভ্রূকুটি করলেন মিসেস মিলার। কিন্তু তোমার এসব জানার কি দরকার? ঘড়ি নিয়ে তোমার এতো আগ্রহ কেন?

দরকার আছে, ম্যাডাম। মিস্টার ক্লক নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁকে খোঁজা হচ্ছে। হয়তো এই ঘড়িতেই রয়েছে সূত্র। কোত্থেকে ওটা পাঠানো হয়েছে, কিছু বুঝতে পেরেছেন?

না। অবাকই লেগেছে। হ্যারিসন ক্লক যে নিখোঁজ হয়েছে, খবরটা আমিও শুনেছি। ভাবছি…এহহে ফোন বাজছে। যাই। যা যা জানি, সব বলেছি তোমাদেরকে। গুডবাই, বয়েজ।

দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

টিমের দিকে ঘুরলো রবিন। হও আরও গোয়েন্দা! ভিখিরির মতো বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে..যত্তোসব! তিক্ত কণ্ঠে বললো সে। তেমন কিছু জানাও গেল না। শুধু জানলাম, মিস্টার ক্লক ঘড়িটা পাঠিয়েছিলো। ওটা অসুস্থ মিলারের হাতে পড়েনি। মিসেস মিলার পেয়ে ফেলে দিয়েছেন। মেসেজের মানে বুঝলাম না।

এই, গোয়েন্দাগিরিতে মজা পাচ্ছে টিম, অপমান গায়েই মাখেনি, এখানে। দাঁড়িয়ে না থেকে, চলো না মিস জেনি রোবিডের ওখানে যাই। তিনি হয়তো কিছু বলতে পারবেন।

কিন্তু মিস রোবিডও বিশেষ কিছু জানাতে পারলেন না। উত্তর হলিউডের উডল্যাণ্ড হিল-এ ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকেন তিনি। নানা রকম গাছের ঝোপ আর ঘন কলা ঝাড়ের ওপাশে কটেজটা খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হলো ওদের। হালকা-পাতলা মানুষ। রবিনের মনে হলো, কথা বলার সময় পাখির মতো কিচিরমিচির করেন। ধূসর চুল, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, পোশাক-আশাকে মনে হয় এইমাত্র বেরিয়ে এলেন রূপকথার জগত থেকে।

দুজনকে আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসালেন লিভিং-রুমে! সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন আর সুদৃশ্য কুশনে বোঝাই ঘরটা দেখে রবিনের মনে হলো, এখানে কিছু রাখলে জীবনেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবিনের প্রশ্ন শুনেই চশমা কপালের ওপর ঠেলে তুলে দিয়ে ডেস্কের ভেতর খুঁজতে শুরু করলেন তিনি, আর পাখি-কণ্ঠে একনাগারে কিচির-মিচির করে চললেন, ভাবতেই পারিনি ওটার জন্যে কেউ আসবে। মেসেজটা নিতে। আমি ভেবেছি রসিকতা, মিস্টার কুকের রসিকতা। খুব রসিক লোক, স্টুডিওতে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো। আমিও তখন। রেডিওতে কাজ করতাম। একদিন গায়েব হয়ে গেল ক্লক। আর কোনো হদিস পেলাম না। তারপর হঠাৎ ওই চিঠি। সঙ্গে আরেকটা ছোট, কাগজ, মেসেজ। চিঠিতে বলেছে, কেউ মেসেজ নিতে এলে যেন দিয়ে দেয়া হয়। অবশ্যই, যদি ঘড়ির কথা বলে। আরে, রাখলাম কোথায়? চশমাটাও তো পাচ্ছি না। দেখবো কিভাবে?

চশমা কোথায় আছে, বললো রবিন। তাড়াতাড়ি আবার ওটা নাকের ওপর। টেনে নামালেন মিস রোবিড়। ড্রয়ারের ছোট একটা খোপে ঢুকে গেল হাত, বেরিয়ে আসতে দেখা গেল দুআঙুলে ধরে রেখেছেন একটা খাম। এই যে। আমি জানি ওখানে রেখেছি। যাবে কোথায়? এই তো, পেলাম। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, হ্যারিসন ক্লকের কথা। রসিক লোক ছিলো। ভালো লোক। আমার বন্ধু। কিন্তু ওর কণ্ঠ নিশ্চয় রেডিওতে শোনোনি তোমরা?

না, ম্যাডাম, শুনিনি। তবে রসিকতা নিয়েই তদন্ত করছি আমরা। জানতে চাই, তিনি কি বলতে চেয়েছেন। মেসেজটার জন্যে অনেক, অনেক ধন্যবাদ।

আরে না না, এর জন্যে আবার ধন্যবাদ কেন? যখন খুশি চলে আসবে। তোমরা, আমার সাধ্যমতো সাহায্য করবো। হাজার হোক, ক্লকের রসিকতা নিয়ে। গবেষণা করছো। ওর সঙ্গে দেখা হলে আমার কথা বোলো। যা দারুণ চিৎকার। করতে পারতো না.ও! ওর চিৎকার শোনার জন্যে লোকে সব কাজ বাদ দিয়ে। রেডিওর সামনে বসে থাকতো। একটা নাটকের কথা তো বিশেষভাবে মনে আছে। হেনরি মিলারের আ স্ক্রীম অ্যাট মিডনাইট গল্পের ওপর ভিত্তি করে। কি চমৎকার ভয় যে পাওয়াত না, কি বলবো! আর মিলারও লেখক বটে! ধাঁধা, সূত্র, রহস্যে তার জুড়ি নেই। খুউব বুদ্ধি। ওহহো, ভুলেই গিয়েছি। তোমাদেরকে চা খেতেই তো বললাম না? খাবে না? আচ্ছা, ঠিক আছে, আরেক সময় এলে খেও। যাবে? তাড়াহুড়ো বেশি? বেশ, যাও। বাচ্চাদের স্বভাবই ওরকম। সব কিছুতেই তাড়া।

বাইরে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়লো দুই কিশোর।

মেরে ফেলেছিলো আরেকটু হলে। গাড়িতে উঠে হাসলো টিম। এতো বকতে পারে! থামে না। তবে কাজ হয়েছে। কি লেখা আছে মেসেজে, দেখি?

খাম খুলে একটা কাগজের টুকরো বের করলো রবিন। আগ্রহে ঝুঁকে এলো। টিম। হাঁ করে তাকিয়ে আছে দুজনে।

লেখা রয়েছেঃ

ইটস কোয়ায়েট দেয়ার ঈভ ইন আ রিকেন।
জাস্ট আ ওয়ার্ড অভ অ্যাডভাইস, পোলাইটলি গিভেন।
ওল্ড ইংলিশ বোম্যান লাভড ইট।
বিগার দ্যান আ রেইনড্রপ; স্মলার দ্যান অ্যান ওশন।
আয়্যাম ফোর। হাউ ওল্ড আর ইউ?
ইট সিটস অন আ শেলফ লাইক আ ওয়েল-ফেড-এলফ।

সর্বনাশ! মগজ ঘোলা করে দেবে! গুঙিয়ে উঠলো টিম। মানে কি এগুলোর?

.

১০.

প্যাসাডেনায় গিয়ে সঠিক জেলডাকে খুঁজে বের করলো কিশোর আর মুসা। তিনি জেলডা ডেনমোর। ভীষণ মোটা। মুসার মনে হলো, পাকা একটা মিষ্টি কুমড়ো। রেডিওতে কাজ করতেন, এখন অবসর নিয়েছেন।

বেড়াল পোষেন মিসেস ডেনমোর, অনেক বেড়াল। সব সিয়ামিজ। ছেলেদের যেখানে বসালেন, সারা ঘরেই বেড়াল গিজগিজ করছে। তার চেয়ারের দুই হাতায় বসেছে দুটো, দুটোর গায়েই হাত বুলিয়ে আদর করছেন তিনি।

কিশোরের প্রশ্নের জবাবে বললেন, হ্যাঁ, চিনি তাকে। তাহলে তোমাদেরকেই মেসেজটা দিতে অনুরোধ করেছে?

মিস্টার ক্লক মেসেজ পাঠিয়েছেন? এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো কিশোর। কখন?

হপ্তা দুই আগে। সঙ্গে একটা চিঠি। লিখেছে, কেউ নিতে এলে যেন তাকে দিয়ে দিই। সামনে থেকে একটা বেড়াল সরিয়ে ড্রয়ার খুললেন মিসেস, ডেনমোর, খাম বের করে দিলেন কিশোরের হাতে। কি করছে এখন ক্লক? ওর সঙ্গে দেখা নেই অনেকদিন। রেডিও থেকে কাজ চলে যাওয়ার আগে বেশ টাকার টানাটানিতে পড়েছিলো বেচারা। নতুন কোনো কাজও পাচ্ছিলো না। রেডিও জনপ্রিয়তা হারানোতে অনেক স্ক্রীমারই পথে বসলো।

তার সম্পর্কে আমরাও খুব একটা জানি না। কয়েক মাস আগে কোথায় যেন। চলে গেছেন।

অন্য কেউ হলে অবাক হতাম। তবে ব্লকের পক্ষে সবই সম্ভব। আজব লোক। কখন যে কি ভাবে, কি করে বসে, ঠিকঠিকানা নেই। নানা পেশার লোকের সঙ্গে পরিচয় ছিলো তার, ঘনিষ্ঠতা ছিলো। চোর, ডাকাত, জুয়াড়ীরাও ছিলো তার বন্ধু।

তাই নাকি? থ্যাংক ইউ, মিসেস ডেনমোর। আজ তাহলে উঠি। মুসা, চলো যাই। আরও কাজ আছে।

 মহিলাকে তাঁর বেড়ালের পালের মধ্যে রেখে বেরিয়ে এলো দুই গোয়েন্দা। গাড়িতে অপেক্ষা করছে হ্যানসন।

মেসেজটা দেখি? হাত বাড়ালো মুসা।

 গাড়িতে চলো আগে।

গাড়িতে উঠে খাম খুললো কিশোর। ছোট এক টুকরো কাগজ বের করলো। কতগুলো নম্বর লেখা রয়েছে শুধু তাতে। এরকমঃ

৩-২৭৪-৩৬৫-১৯৪৮-১২৭-১১১৫-৯১০১-২৫-১৬ ৪৫-৩৭৯৮-৯৮২০-১৩৫৮৪-৯

আরও আছে নম্বর। সবই প্রথমগুলোর মতো অর্থহীন, প্রথম দৃষ্টিতে তা-ই মনে : হলো।

খাইছে! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। কি অঙ্ক?

অঙ্ক না. মাথা নাড়লো কিশোর। কোনো ধরনের সঙ্কেত। পরে চেষ্টা করবো। কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো সে। এখন বারকেনকে খুঁজে এক বের করা দরকার।

কোথায় যেতে হবে, বলা হলো হ্যানসনকে। ছুটে চললো রোলস রয়েস।

গম্ভীর হয়ে বসে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। নীরব।

মুসাও ভাবছে। ভাবছে, অগ্রগতি কি কিছু হয়েছে? এক মেসেজে তো রয়েছে দুর্বোধ্য সংখ্যা, আরেক মেসেজে কি আছে?

পুরনো একটা এলাকায় একটা বাড়ির সামনে এনে গাড়ি থামালো হ্যানসন। মুসা আর কিশোর নেমে হেঁটে এগোলো।

বেল বাজালো কিশোর।

দরজা খুলে দিলো একজন লোক। বড়জোর কিশোরের সমান লম্বা, তার মতোই পাতলা। দুই পায়ের মাঝে ফাঁক অনেক বেশি, দুদিকে ধনুকের মতো বেঁকে রয়েছে। কি চাই?

আচ্ছা, লোকটার কড়া দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো কিশোর। এটা কি মিস্টার জেসিয়াস বারকেনের বাড়ি?

কি দরকার তাকে?

জিজ্ঞেস করতাম, মিস্টার হ্যারিসন ক্লককে চেনেন কিনা।

ক্লক? কে বললো আমি তাকে চিনি? জীবনে ওই নামও শুনিনি। যাও, ভাগো।

এক মিনিট, বারকেন, পেছন থেকে বললো একটা ভদ্ৰ কণ্ঠ। দেখা দিলো লম্বা চেহারার এক লোক। চকচকে কালো চুল ব্যাকব্রাশ করা। কথায় স্প্যানিশ টান। ক্লককে খুঁজছো কেন? মুসা আর কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো। গোয়েন্দা নও তো? হাসলো।

সত্যি বলতে কি… আরম্ভ করেও কিশোরের কনুইয়ের গুতো খেয়ে থেমে গেল মুসা।

মিস্টার ক্লকের পাঠানো কয়েকটা মেসেজ খুঁজছি আমরা, বললো কিশোর। তার রেখে যাওয়া কয়েকটা ঠিকানা পেয়েছি। মিস্টার বারকেনের নামও আছে…

ইনটারেসটিং, বললো লম্বা লোকটা। এসো, ভেতরে এস। মনে হচ্ছে তোমাদের সাহায্য করতে পারবো। আমার বন্ধুর হয়ে মাপ চেয়ে নিচ্ছি, বারকেনের কাঁধে হাত রেখে বললো।

দুজনকে অনুসরণ করে একটা অগোছালো লিভিং রুমে ঢুকলো কিশোর আর মুসা।

দেখো, মারকো, গোঁ গোঁ করে বললো বারকেন। আমার এসব ভাল্লাগছে। কি করছো, কিছুই বুঝতে পারছি না।

চুপ থাকো, ধমক দিলো মারকো। কিশোরের দিকে চেয়ে বললো, শোনো, ক্লক নিখোঁজ হওয়ায় আমরা খুব চিন্তায় আছি। বারকেনের কাছে আজব একটা মেসেজ নাকি পাঠিয়েছে। মনে হচ্ছে তোমরা ব্যাপারটা জানো। জানো, ক্লক কোথায়?

না, স্যার, জবাব দিলো কিশোর। তবে আমরা মেসেজগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি, এটা ঠিক। প্রথমে অদ্ভুত একটা ঘড়ি হাতে এলো:..

ঘড়ি? সঙ্গে আছে?

ব্যাগ খুলে নকল ঘড়িটা বের করলো কিশোর। এই যে, স্যার।

হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘড়িটা দেখলো মারকো। অতি সাধারণ। হ্যাঁ, এরার মেসেজের কথা বলো। কি কি জেনেছো?

মেসেজে জেলডা আর বারকেনকে জিজ্ঞেস করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কি জিজ্ঞেস করতে হবে, বলেনি। জেল ডেনমোরকে খুঁজে বের করেছি আমরা, তার কাছে একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন মিস্টার ক্লক। সেখান থেকেই এলাম। ক্লকের ক্রিস্টমাস কার্ডে মিস্টার জেসিয়াস বারকেনের নাম-ঠিকানা দেখলাম তো। মিস্টার বারকেন, আমাদের জন্যে কোনো মেসেজ পাঠানো হয়েছে?

মেসেজ একটা পেয়েছে বটে, জবাবটা দিলো মারকো। সাথের চিঠিতে লিখেছে, ওটা ডেলিভারি দেয়ার আগে অন্য মেসেজগুলো যেন দেখে নেয়া হয়। দেখি তো, জেলডার মেসেজটা? হাত বাড়ালো সে।

কিন্তু… দ্বিধা করছে কিশোর। পকেট থেকে বের করলো সংখ্যা লেখা কাগজটা।

দেখলো মারকো। শুধুই তো নম্বর! হতাশ মনে হলো তাকে। কোড-টোড হতে পারে। মানে কি?

জানি না। আরেকটা মেসেজ দেখলে হয়তো বোঝা যাবে। মিস্টার বারকেনের মেসেজ।

হয়তো। বেশ, সব দায়িত্ব এখন আমার। এই ঘড়ি আর মেসেজগুলো তোমাদের জন্যে নয়, তোমাদের কাছে পাঠানো হয়নি। আর কোনো মেসেজ থাকলে দিয়ে দাও। আমিই সব সামলাবো।

আর নেই, সামান্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কিশোরের চেহারা। লম্বা লোকটার হাব-ভাব ভালো ঠেকছে না তার। দেখুন, ঘড়ি আর মেসেজ দিয়ে দিন, প্লীজ। ওগুলো আমাদের। আমরা তদন্ত…

চুপ! খেঁকিয়ে উঠলো মারকো। ডিংগো, ধরো ব্যাটাদের। দেখি, কোথায়। কি লুকিয়ে রেখেছে!

চোখের পলকে পেছন থেকে মুসার গলা জড়িয়ে ধরলো জেসিয়াস বারকেন ওরফে ডিংগো। বেঁটে, হাড্ডি সর্ব, রগ বের হওয়া প্যাকাটির মতো হাতে যে এতো জোর, ভাবতেও পারেনি গোয়েন্দা-সহকারী।

.

ঠিক ওই সময়, অনেক দূরে রবিন আর টিমও পড়েছে গোলমালে।

বাড়ি ফিরে চলেছে ওরা। রকি বীচের মাইলখানেক দূরে সান্তা মনিকা পর্বতের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। ওখানটায় এসে পেছনের গাড়িটা লক্ষ্য করলো রবিন। ঘন নীল শরীর, সাদা ছাত। দেখেছে আরও আগেই, গুরুত্ব দেয়নি। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দ্রুত ছুটে আসছে।

 টিম! উত্তেজিত কণ্ঠে বললো রবিন। মনে হয় পিছু নিয়েছে। ধরতে আসছে এখন।

পারলে ধরুক, বলতে বলতেই গ্যাস প্যাডালে পায়ের চাপ বাড়িয়ে দিলো টিম।

লাফ দিয়ে আগে বাড়লো পুরনো গাড়িটা। শাঁ করে একটা মোড় পেরিয়ে তীব্র গতিতে নেমে চললো ঢালু পথ বেয়ে।

আবার পেছনে তাকালো রবিন। নীল গাড়িটাও গতি বাড়িয়েছে। দ্রুত কমছে দূরত্ব। ইতিমধ্যেই একশো গজের ভেতরে এসে গেছে।

প্যাডালে পায়ের চাপ আরও বাড়ালো টিম। মারাত্মক গতিবেগ। কিন্তু তার পরেও ছাড়াতে পারছে না নীল গাড়িটাকে, এগিয়েই আসছে, কমছে মাঝখানের ফাঁক।

আরেকটা তীক্ষ্ণ মোড় নিলো টিম। আরেকটু হলেই পথের ধার দিয়ে খাদে পড়ে গিয়েছিলো সেডান। কোনোমতে সোজা করে আবার পথের ওপর নিয়ে এলো। ওটাকে। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। ভালোমতো চালাতে শিখিনি এখনও। আর যা রাস্তা খালি মোড়…নাহ, পারলাম না। ধরে ফেলবে।

হাল ছেড়ো না, সাহস দিলো রবিন। রকি বীচে ঢুকলে তখন আর আসতে। সাহস করবে না।

চেষ্টা করছি। সাইড দেবো না। আগে যেতে না পারলে থামাতে পারবে না আমাদের।

গতি কমিয়ে পথের মাঝ দিয়ে গাড়ি চালালো টিম।

ফিরে চেয়ে আছে রবিন। এদিক ওদিক সরে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে নীল গাড়িটা। স্টীয়ারিঙে ঝুঁকে থাকা মানুষটাকে পরিচিত লাগছে, কিন্তু চিনতে পারছে না।

নির্জন পথ ধরে ছুটে চলেছে দুটো গাড়ি। সামনে পথের ওপর একটা ছোট গর্ত দেখে এড়াতে গেল টিম, এই সুযোগে পাশে চলে এলো পেছনের গাড়িটা। সরতে সরতে সেডানটাকে নিয়ে এলো একেবারে পথের ধারে। আর সরার জায়গা। নেই। ধাক্কা লাগলেই এখন পড়ে যাবে খাদে।

থামতেই হবে! চেঁচিয়ে বললো টিম। কায়দা করে ফেলেছে হারামজাদা!

গ্যাস প্যাডাল থেকে পা সরিয়ে ব্রেক চাপলো সে। সেডানটা থামতে শুরু করতেই পাশের গাড়িটাও গতি কমালো।

কালো চশমা পরা লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। চেনার চেষ্টা করছে। কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারলো না।

থেমে গেল সেডান। পাশে থামলো নীল গাড়ি। হঠাৎ আবার খেপা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে আগে বাড়লো, শাঁ শাঁ করে ছুটে হারিয়ে গেল পথের বাঁকে।

তাজ্জব কাণ্ড! অবাক হয়েছে টিম। পিছু নিলো, থামলো, এখন পালালো…

বুঝতে পারলো কারণটা। পেছনে শোনা যাচ্ছে সাইরেনের শব্দ। এগিয়ে। আসছে দ্রুত। কিছুক্ষণ পরে ঘ্যাঁচ করে এসে পাশে থামলো একটা পুলিশের গাড়ি। নেমে ওদের দিকে এগিয়ে এলো একজন অফিসার, বর্ষার মেঘলা আকাশের মতো থমথমে চেহারা। হাত বাড়ালো, দেখি লাইসেন্স!

১১.

ধরে রাখো, ছেড়ো না, আদেশ দিলো মারকো।

মুসার হাত মুচড়ে পিঠের ওপর নিয়ে এসেছে ডিংগো।

টেবিল থেকে একটা কাগজ কাটার ছুরি তুলে নিয়ে কিশোরের বুকে ঠেকিয়েছে মারকো। ভয়ানক কণ্ঠে বললো, দাও, যতোগুলো মেসেজ আছে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। মুসা দেখতে পাচ্ছে না তাকে। সে চুপ, থাকলো না। ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। কারাতের স্কুলে শিখেছে, কি করে কব্জি ছাড়াতে হয়। হঠাৎ মাছের মতো মোচড় দিয়ে উঠলো তার শরীরটা। সোজা হয়ে গেল হাত। সামনের দিকে ঝটকা দিয়ে ঝুঁকে গেল মাথা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুসার পিঠের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল ডিংগো। বাড়ি খেলো মারকোর গায়ে। তাকে নিয়ে দড়াম করে পড়লো মাটিতে।

 জলদি ভাগো! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। মেঝেতে মাথা ঠুকে গেছে মারকোর, চিত হয়ে আছে। তার বুকের ওপর চেপে রয়েছে ডিংগো। দুজনেরই হতবিহ্বল অবস্থা। মারকোর হাত থেকে মেসেজটা টেনে নিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিলো কিশোর। একই সময়ে দরজায় পৌঁছলে মুসা। ধাক্কা লেগে গেল দুজনের।

ঘড়ি! চিৎকার করে বললো মুসা। ফেলে এসেছো!

থাকুক, থামলো না কিশোর। ওটা লাগবে না।

হাঁপাতে হাঁপাতে এসে গাড়িতে উঠলো ওরা। কিশোর বললো, হ্যানসন, গাড়ি ছাড়ুন, কুইক!

তিন গোয়েন্দার সঙ্গে অনেক দিনের পরিচয় হ্যাঁনসনের, জানে এই সব জরুরী মুহূর্তে কি করতে হয়। বিন্দুমাত্র দেরি করলো না সে, প্রশ্ন করলো না, ছেড়ে দিলো গাড়ি।

আরি, কিশোর, বলে উঠলো মুসা। মেসেজটা তো ছিঁড়ে ফেলেছো!

হাতের দিকে তাকালো কিশোর। তাই তো! অর্ধেকটা ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে। বাকি অর্ধেক নিশ্চয় রয়ে গেছে মারকোর হাঙে।

গেল! নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো মুসা।

ফিরে গিয়ে নিয়ে আসবো নাকি? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো কিশোর।

আবার! আর পারবো না। একবারই ছাড়া পেয়েছি অনেক কষ্টে।

নাহ, গিয়েও আর লাভ নেই। এতোক্ষণ নিশ্চয় বাকি অর্ধেক লুকিয়ে ফেলেছে। মারকো। জিজ্ঞেস করলে স্রেফ অস্বীকার করবে।

আর কোথাও যাবো? জিজ্ঞেস করলো হ্যানসন। নাকি সোজা ইয়ার্ডে?

না, যাবো বললো কিশোর। ভুল বারকেনের ওখানে গিয়েছিলাম আমরা জেসিয়াস নয়, আমাদের দরকার হিরাম বারকেনকে, এখন বুঝতে পারছি। ঠিকানা বলে সিটে হেলান দিলো সে।

 আচ্ছা, কিশোর, মুসা বললো। মেসেজের জন্যে এতো আগ্রহ কেন। ব্যাটাদের?

বুঝতে পারছি না। মিস্টার কুকের ব্যাপারে এমন কিছু জানে হয়তো, যা আমরা জানি না। মেসেজগুলোকে মূল্যবান ভাবছে। কেন ভাবছে, সেটা আমাদের জানতে হবে।

কিভাবে?

 মেসেজের মর্ম উদ্ধার করে।

যদি পারা যায়! নিষ্প্রাণ হাসি হাসলো মুসা। তততদিনে চুল-দাড়ি পেকে সব সাদা হয়ে যাবে আমাদের, মরার সময় হয়ে যাবে। তাছাড়া পুরো মেসেজটা থাকলেও এক কথা ছিলো, ছিঁড়ে তো এনেছে মাত্র অর্ধেকটা।

চেষ্টা তো করতে হবে, বলে চুপ হয়ে গেল কিশোর।

গাড়ি থামলো। বোধহয় এই জায়গাই, হ্যানসন বললো। এবার কোনো বিপদ আশা করছেন? আমি আসবো?

না। বিপদে পড়লে জোরে জোরে চিল্লাবো। মুসা, এসো যাই।

স্প্যানিশ ধাঁচের ছোট্ট সুন্দর একটা বাড়ি, বাগানে ঘেরা। গোলাপের যত্ন করছেন এক বৃদ্ধ। পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

মিস্টার হিরাম বারকেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ। হ্যাঁ, আমি। হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও? অটোগ্রাফ? মৃদু হাসলেন তিনি। বহু বছর পরে আবার অটোগ্রাফ…আ স্ক্রীম অ্যাট মিডনাইট-এ গোয়েন্দার অভিনয় করার পর কতো লোক যে এসেছিলোনাটকটা নিশ্চয় শোনননি? নাকি?

না, স্যার। খুব জমজমাট নাটক হয়েছিলো, তাই না?

খালি জমজমাট! রোম খাড়া করে দিয়েছিলো কতো লোকের। আর চেঁচাতেও পারতো বটে হ্যারি ক্লক। হ্যারি আর হেনরি, দুজনে মিলেই লিখেছিলো। হ্যারির পুট, আর হেনরির কলম। ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে এমন এক কাহিনী দাঁড় করিয়েছিলো…যাকগে, ওসব পুরনো ইতিহাস। তা, তোমাদের অটোগ্রাফ… খাতার জন্যে হাত বাড়ালেন মিস্টার বারকেন।

অটোগ্রাফ নয়, স্যার…

তাহলে কি? কিছুটা নিরাশই মনে হলো ভদ্রলোককে, তবে হাসি মলিন হলো না। চাদা? নাকি নতুন ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন?

না, ওসব না, স্যার। মেসেজ। মিস্টার কুকের মেসেজ।

 ও, মেসেজ! উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন আবার বারকেন। নিশ্চয়। বহুদিন ক্লকের কোনো খবর নেই, বছর বছর ক্রিস্টমাস কার্ড ছাড়া। এই প্রথম এলো চিঠি। এসো, ঘরে এসো, দেখি খুঁজে পাই কিনা।

চমৎকার সাজানো গোছানো একটা ঘরে ওদেরকে নিয়ে এলেন বারকেন। সবার আগে চোখে পড়ে পুরনো স্টাইলের বিশাল এক টেপ রেকর্ডার। শেলফে সাজানো সারি সারি টেপের বাক্স।

ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করলেন তিনি। এই যে। খুলে পড়েছি। সেই পুরনো হ্যারিসন কুক, দুর্বোধ্য সব কথাবার্তা। একটা শব্দও বুঝিনি।

মেসেজটা হাতে নিলো কিশোর। ঝুঁকে এলো মুসা। লেখা রয়েছেঃ

টেক ওয়ান লিলি; কিল মাই ফ্রেণ্ড এলি।
পজিটিভলি নাম্বার ওয়ান।
টেক আ ব্রুম অ্যাণ্ড সোয়্যাট আ বী।
 হোয়াট ইউ ডু উইদ ক্লথস, অলমোস্ট।
নট মাদার, নট সিসটার, নট ব্রাদার; বাট পারহ্যাপস ফাদার।
 হাইমস? হামস? হোমস? অলমোস্ট, নট কোয়াইট।

খাইছে! এটা কবিতা না, দাঁত ভাঙার মেশিন?

কিংবা মাথা ভাঙার হাতুড়ি, হেসে বললেন বারকেন। মানে বোঝার অনেক চেষ্টা করেছি, বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি শেষে। যতদূর জানি, এলি নামে হ্যারির কোনো বন্ধু ছিলনা। অথচ পড়ে মনে হয়, বন্ধু এলিকে খুন করে তার, বুকে একটা পদ্ম রেখে দেয়ার কথা ভাবছে, তাই না? শব্দ করে হাসলেন। সাথে একটা নোটও লিখে দিয়েছে। কেউ নিতে এলে যেন মেসেজটা তাকে দিয়ে দিই। ও, ভালো কথা, তোমাদের পরিচয়ই জানা হলো না এখনও।

নিশ্চয়ই, পকেট থেকে কার্ড বের করে দিলো কিশোর।

কার্ডটা পড়লেন মিস্টার বারকেন। হাত মেলালেন দুই গোয়েন্দার সঙ্গে। তোমরা গোয়েন্দা জেনে খুশি হলাম। একটা কথা, হ্যারির ব্যাপারে যখন আগ্রহ, নিশ্চয় তার দুএকটা নাটক শুনতে চাইবে? মানে, নাটকে তার চিৎকার। আজকালকার ছেলে তোমরা, টেলিভিশন দেখে অভ্যাস। রেডিওতে নাটকের মজা যে কী, জানো না। শুনবে? ওই যে টেপগুলো দেখছো, অনেক নাটক রেকর্ড করা আছে ওগুলোতে। আমার অভিনয় করা সমস্ত নাটক। প্রত্যেকটাতে আছে হ্যারিসন ক্লকের কণ্ঠ।

লোভ হলো দুই গোয়েন্দার। রেডিওর নাটকের কথা অনেক শুনেছে ওরা। রাশেদ পাশাও মাঝে মাঝেই বলেন। সময় থাকলে এই সুযোগ ছাড়তো না, কিন্তু। এখন মোটেই সময় নেই ওদের। মিস্টার বারকেনকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে, শুড় বাই জানিয়ে মেসেজটা নিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। গাড়িতে এসে উঠলো।

হ্যানসনকে ইয়ার্ডে ফিরে যেতে বলে মুসার দিকে তাকালো কিশোর। টিম। আর রবিন কি করেছে কে জানে। সবগুলো মেসেজ একসাথে পেলে সমাধান। করতে সুবিধে হতে গিয়ে এখন ওদেরকে হেডকোয়ার্টারে পেলেই হয়। আর

হেডকোয়ার্টারেই রয়েছে তখন রবিন আর টিম, তবে তিন গোয়েন্দার নয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। নতুন ডিউটি অফিসার রবিনকে চেনে না। দুজনকে নিয়ে ঢুকলো চীফের অফিসে। বয়সের কোন

আরে, রবিন তুমি? বলে উঠলেন ইয়ান ফ্লেচার।

চীফকে দেখে হাঁপ ছাড়লো রবিন। হ্যাঁ, স্যার, ধরে আনা হয়েছে।

 কি করেছিল?

কি করেছিলো, জানালো ডিউটি অফিসার।

সরি, রবিন, তোমাদের কাছ থেকে এটা আশা করিনি, আন্তরিক দুঃখিত মনে হলো ফ্লেচারকে। খুব অন্যায় করেছে। এতো জোরে গাড়ি চালানো। অন্যের তো বটেই, নিজেরও ক্ষতি হতে পারতো।

ইচ্ছে করে করিনি, স্যার। আমাদের তাড়া করা হয়েছিলো। আরেকটা গাড়ি। ধরে ফেলেছিলো আমাদের। সময়মতো ইনি না গেলে, ডিউটি অফিসারকে দেখালো রবিন। কিছু একটা করতে আমাদের।

তাড়া করেছিলো? হাসি ফুটলো চীফের মুখে। নতুন কোনো কেস-টেস?

হ্যাঁ, স্যার, একটা চেঁচানো ঘড়ি।

বলে চেঁচানো ঘড়ি! আশ্চর্য তো! ঘড়ি আবার চেঁচায় কিভাবে?

আমাদের গাড়িতেই আছে, স্যার। বললে এনে দেখাতে পারি।

অফিসারের দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করলেন ফ্লেচার। যাও ওদের সঙ্গে। নিয়ে এসো।

 ফিরে এলো খানিক পরে। খালি হাতে। মাথা নাড়লো অফিসার, নেই। ঘড়ি নেই। ওরা বলছে একটা ব্যাগ ছিলো সেটাও দেখলাম না।

আমার বিশ্বাস, স্যার, মুখ কালো হয়ে আছে রবিনের, চুরি করে নিয়ে গেছে!

.

১২.

এতো দেরি করছে কেন ওরা? মুসা বললো।

মিস্টার বারকেনের কাছে পাওয়া মেসেজটা টেবিলে রেখে ঝুঁকে দেখছিলো কিশোর, সোজা হয়ে তাকালো। যাই, দেখি, আসছে কিনা।

সর্ব-দর্শনে গিয়ে চোখ রাখলো সে। জানালো, টিমের গাড়ি সবে ঢুকেছে ইয়ার্ডে। .

কিছুক্ষণ পর সাঙ্কেতিক টোকা পড়লো দুই সুড়ঙ্গের দরজায়।ট্র্যাপোর খুলে দিলো মুসা। উঠে এলো রবিন আর টিম। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওদের।

মেসেজ পেয়েছো? জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, তা পেয়েছি, বসতে বসতে বললো রবিন। কিচ্ছু বোঝা যায় না।

দেখি? হাত বাড়ালো কিশোর। ঘড়িটা কই?

নেই।

নেই মানে? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে গোয়েন্দাপ্রধানের দৃষ্টি। হারিয়ে ফেলেছো?

চুরি হয়ে গেছে, টিম জানালো, পুলিশ স্টেশনের বাইরে গাড়ি পার্ক করেছিলাম…

পুলিশ স্টেশন? মুসার প্রশ্ন। সেখানে কি করছিলে? ডাকাতে ধরেছিলো নাকি?

বেশি জোরে চালাচ্ছিলাম বলে পুলিশে ধরেছিলো। আগেই পিছু নিয়েছিলো একটা গাড়ি, পাহাড়ের মাঝামাঝি আসতেই ভাড়া করলো। ছুটলাম…

কি হয়েছিলো, জানানো হলো মুসা আর কিশোরকে।

ছেড়ে দিলেন আমাদেরকে চীফ, বলা শেষ করলো রবিন। বলে দিয়েছেন, জরুরী কিছু জানলে, কিংবা বিপদের সম্ভাবনা দেখলেই যেন তাকে জানাই।

হুঁ, আনমনে মাথা ঝোঁকালো কিশোর। জানানোর সময় এখনও হয়নি। কিছুই জানি না এখনও। পুলিশ বিশ্বাস করবে না, হাসবে। ভাববে, হ্যারিসন। ক্লকের রসিকতা। সাহায্য তো পাবোই না, বরং বেকায়দায় পড়ে যেতে পারি।

মারকো আর ডিংগোর কথা বললো কিশোর, মাঝে মাঝে কথা যোগ করলো মুসা।

তাহলে বুঝতেই পারছো, কিশোর বললো! মেসেজ আর ঘড়ির ব্যাপারে ইনটারেস্ট আছে আরও অনেকের। হতে পারে, তোমাদেরকে যে তাড়া করেছে, সে-ই ঘড়িটা চুরি করেছে। পুলিশের সাইরেন শুনে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে ছিলো কোথাও, তারপর সুযোগ বুঝে গিয়ে হাজির হয়েছে থানার কাছে। কেউ নেই দেখে টুক করে তোমাদের গাড়ি থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে গেছে।

কিন্তু সেই লোকটা কে? রবিন বললো। ঘড়ি আর মেসেজের ব্যাপারে এতো আগ্রহ কেন?

লারমারের কথা ভুলে গেছো? সে জানে ঘড়ির কথা। আরও কাউকে বলে থাকতে পারে। এক কান দুকান হতে হতে দশ কান হতে বাধা কোথায়? না। জেনে ভুল করে মারকো আর ডিংগোকেও অনেক কথাই বলে এসেছি আমরা। ঘড়ি আর মেসেজ তো বটেই, আমরা কি করছি, সেটাও জেনে গেছে ওরা।

দূর, আমার এসব ভাল্লাগছে না! বাতাসে থাবা মারলো মুসা। তা রবিনের মেসেজে কি লেখা? প্রলাপ-ই?

রবিনের আনা মেসেজটা টেবিলে রাখলো কিশোর। প্রলাপ নয়। তবে একই রকম কঠিন।

কেন ভণিতা করছো? গুঙিয়ে উঠলো মুসা। এটাকে শুধু কঠিন বলে? হাতুড়ি, বলো, হাতুড়ি, মাথায় লাগলেই খুলি খতম, মগজ ঘোলা।

হয়নি, হাসলো কিশোর। হাতুড়ি নয়। ডাবল ব্যারেল শটগান। মাথায় লাগলে খুলি, মগজ সব উড়ে যাবে। এবার খুশি তো?

হ্যাঁ, এইবার ঠিক বলেছো, খুশি হয়ে মাথা দোলালো মুসা।

কাজের কথায় আসি এবার। দেখা যাক, শটগানের ভেতর থেকে কিছু। বেরোয় কিনা। রবিন, মিস্টার মিলার আর মিস রোবিডের সাথে যা যা কথা হয়েছে, সব খুলে বলল। কিছু বাদ দেবে না।

বলতে থাকলো রবিন। কিশোর শুনছে, চুপচাপ, কোনো প্রশ্ন নেই। নোট করে নিচ্ছে মনের খাতায়। রবিনের কথা শেষ হলে বিড়বিড় করলো আনমনে, তাহলে, মিস্টার মিলার হাসপাতালে, অসুস্থ। মিস্টার ক্লক তাঁর কাছেই ঘড়িটা পাঠিয়েছিলেন, মেসেজগুলো জোগাড় করে রহস্যের সমাধানের জন্যে। এখন প্রশ্ন হলো, সমাধান করলে কি বেরোবে?

নিশ্চয় এমন কিছু, যাতে চমকে যাবেন মিস্টার মিলার, রবিন বললো। ঘড়ির নিচে লাগানো মেসেজে তো তাই বলা হয়েছে।

হয়েছে। কিন্তু কি দেখে চমকাবে? কি ঘটবে? সেটাই বুঝতে হবে এখন আমাদের। দেখি চেষ্টা করে, মেসেজগুলোর মানে বুঝতে পারি কিনা।

টেবিলে রাখা মেসেজটার দিক থেকে চোখ ফেরালো টিম। মেসেজ?? নিঃসন্দেহ হতে পারছে না সে। একে মেসেজ বলছো? কোনো ধরনের কোড?

তাছাড়া আর কি? জবাব দিলো কিশোর। মিস্টার ক্লক আর মিস্টার মিলার, দুজনেই রহস্য ভালোবাসেন। ধাঁধা পছন্দ করেন। এমনও হতে পারে; কথাগুলোর মানে জানা আছে মিস্টার মিলারের, আর সেজন্যেই ওভাবে লিখেছেন মিস্টার ক্লক। নিজেরা ঠিকই বুঝতে পারবেন, অথচ অন্য কেউ পারবে না।

তোমার কি মনে হয়? হাত নাড়লো মুসা। তুমি পারবে?

 আমার তো মনে হচ্ছে ক্রসওয়ার্ড পাজলস জাতীয় কিছু। প্রতিটি লাইনে একটি করে বিশেষ শব্দ পাওয়া যাবে, ছয় লাইনে ছয়টা। আর ছয়টা শব্দ দিয়ে হবে একটা বাক্য, যেটার মানে বোঝা যাবে সহজেই।

তাহলে তৈরি করে ফেলো বাক্যটা। প্রথম লাইন থেকেই শুরু করো। বলা হচ্ছে, হারিকেনের সময়ও শান্ত থাকে। হারিকেনের সময় কোন জায়গাটা সব চেয়ে শান্ত থাকে?

আমি জানি, বলে উঠলো টিম। স্টর্ম সেলার। ঝড়ের সময় যেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয় মানুষ।

তার চেয়েও নিরাপদ ব্যাংকের ভল্ট, তিক্ত কণ্ঠে বললো রবিন।

কি জানি, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর, ভল্ট হতেও পারে। আসলেই তো নিরাপদ! এখানে দামী জিনিসের আভাস যখন পাওয়া যাচ্ছে।

দূর, হেঁয়ালি করে কথা বলো না তো! রেগে গেল মুসা।

 হেঁয়ালি কোথায়? দামী জিনিস না হলে মেসেজগুলোর জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে কেন কিছু লোক? আর দামী জিনিস ব্যাংকের ভল্টেই সব চেয়ে নিরাপদ। এবার দুনম্বর লাইনঃ জাস্ট আ ওয়ার্ড অভ অ্যাডভাইস, পোলাইটলি গিভেন। এখানে একটা শব্দই বিশেষভাবে চোখে লাগে, অ্যাডভাইস! মানে, উপদেশ। অ্যাডভাইসের আর কি কি মনে হয়? প্রতিশব্দ? মুসা, প্লীজ, ডিকশনারীটা দেবে?

বইয়ের তাক থেকে ডিকশনারী এনে দিলো মুসা।

নীরবে পাতা ওল্টালো কিশোর। এই যে, অ্যাডভাইসের প্রতিশব্দ, ওপিনিয়ন! দেখা যাক, মেলে কিনা? ব্যাংক ভল্ট…ওপিনিয়ন.. নাহ্, ঠিক হচ্ছে না।

 তা তো হচ্ছেই না, জোর দিয়ে বললো মুসা। ভদ্র ভাষায় আমার পরামর্শ হলো…

মুসাআ! হাত তুললো কিশোর।

কড়া চোখে তার দিকে তাকালো মুসা। থামবো? কেন? আমার পরামর্শ…

তাকে অবাক করে দিয়ে তুড়ি বাজালো হঠাৎ কিশোর। ঠিক বলেছো! পরামর্শ! বলছে পোলাইটলি গিভেন অ্যাডভাইস। পরামর্শও এক ধরনের উপদেশ, ভদ্রভাবে দেয়া উপদেশ। মুসা, দিয়েছ সমাধান করে লাইনটার।

চোখ মিটমিট করছে গোয়েন্দা-সহকারী। যতোটা ভেবেছি, ততোটা কঠিন নয় তাহলে! আশ্চর্য!…কিন্তু আমি এখনও ব্যাংক ভল্টের সঙ্গে পরামর্শ মেলাতে পারছি না।

আমিও না। দেখি, বাকি শব্দগুলো বের করলে মেলে কিনা।

 তিন নম্বর লাইন হলো, রবিন বললো, ওল্ড ইংলিশ বোম্যান লাভড ইট। কি ভালোবাসতো? বোম্যানরা একটা জিনিসই ভালোবাসে, সেটা তীর-ধনুক। সে ইংরেজই হোক, আর অন্য দেশীই হোক, আগের দিনেরই হোক, বা এখনকারই হোক।

বোম্যানের আরেকটা মানে যদি করা হয়? ভুরু কুঁচকে, মাথা নেড়ে বললো কিশোর। যদি ধরা হয়, তীরন্দাজ? তাহলে তো যুদ্ধও ভালোবাসবে।

ব্যাংক ভল্ট…পরামর্শ…তীরন্দাজ! চেঁচিয়ে উঠলো টিম, আরো ঘোল্য হয়ে। যাচ্ছে মগজ! মাথাটা এবার সত্যি খারাপ হবে!

কি জানি, ভ্রূকুটি করলো কিশোর। কিন্তু…

বাধা পড়লো কথায়। বাইরে থেকে শোনা গেল মেরিচাচীর কণ্ঠ, ডাকছেন। কিশোওর! কোথায় তোরা? খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

চমৎকার! টেবিলে চাপড় মারলো মুসা। এই হলো গিয়ে একটা কথার মতো কথা। চুলোয় যাক মেসেজ। চলো খেয়ে নিই আগে।

টিমকে খেয়ে যাবার অনুরোধ করলো কিশোর। রাজি হলো না সে। বললো তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলে দিয়েছে মা। আরেকদিন খাবে।

ঠিক আছে, যাও তাহলে, কিশোর বললো। যোগাযোগ রাখবো। আর হ্যাঁ, লারমারের ওপর চোখ রেখো। বলা যায় না, সে-ই হয়তো তোমাদের পিছু। নিয়েছিলো। ঘড়ি চুরি করেছে।

 রাখবো, ঘাড় নাড়লো টিম। লোকটাকে আমিও পছন্দ করি না। দেখলেই মনে হয়, কিছু একটা শয়তানীর তালে আছে।

মুখ খুলতে যাচ্ছিলো কিশোর, বাধা পড়লো আবার। টেলিফোন বাজছে। রিসিভার তুলে নিলো। তিন গোয়েন্দা। কিশোর পাশা বলছি।

হাল্লো। কণ্ঠটা প্রথমে চিনতে পরলো না কিশোর। হিরাম বারকেন। হ্যারিসন ক্লকের মেসেজ নিতে আজ বিকেলে এসেছিলে আমার বাড়িতে।

হ্যাঁ, স্যার!

তখন থেকেই ভাবছি তোমাদের জানাবো কিনা। তোমরা যাওয়ার পর একটা ঘটনা ঘটেছে।

 ঘটনা?

আরেকজন এসেছিলো মেসেজ চাইতে। লম্বা, কালো চুল, দক্ষিণ আমেরিকার লোক বলে মনে হলো। সঙ্গে তার এক বন্ধু, বেঁটে। বললো, ক্লক নাকি ওদের পাঠিয়েছে।

নিশ্চয় মেসেজ দিতে পারেননি। আমাদেরকেই তো দিয়ে দিয়েছেন।

না, পারিনি। ওরা চাপাচাপি করতে লাগলো কাকে দিয়েছি বলার জন্যে। তোমাদের কার্ড দেখিয়ে দিয়েছি ওদের। নাম ঠিকানা লিখে নিলো। তারপর থেকেই ভাবছি, কাজটা কি উচিত হলো? ওদের ভালো লোক মনে হয়নি আমার, বিশেষ করে লম্বাটাকে। মারকো। এতো বেশি ভদ্র, বিনয়…

দিয়ে দিয়েছেন ঠিকানা, কি আর করা। যাকগে, যা হবার হবে। কষ্ট করে আবার আমাদের ফোন করবেন, অনেক ধন্যবাদ।

লাইন কেটে গেল। রিসিভার রেখে বন্ধুদের দিকে তাকালো কিশোর। মারকো আর ডিংগো এখন আমাদের নাম-ঠিকানা জানে। লারমার জানে। তিনজনেই ঘড়িটা চায়, মেসেজগুলো চায়। লারমার ঘড়িচোর না হলে, অন্য আরেকটা দল আছে। সবাই ইনটারেসটেড। লোক কেউই সুবিধের নয় ওরা। আমাদের বিপদটা বুঝতে পারছো আশা করি?

.

১৩.

পরদিন সকালে স্যালভিজ ইয়ার্ডে যাওয়ার জন্যে তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সারছে রবিন, এই সময় এলো ফোন। লাইব্রেরিয়ান ফোন করেছেন, যেখানে সে পার্টটাইম চাকরি করে। কয়েক ঘন্টা কাজ করে দেয়ার অনুরোধ জানালেন।

সেদিন রবিনের অফ ডে, ইচ্ছে করলে মানা করে দিতে পারে। ইয়ার্ডে রহস্যময় মেসেজ নিয়ে গবেষণা করবে কিশোর আর, মুসা, একথা ভেবে একবার ভাবলো না-ই করে দেয়। শেষে ভাবলো, হয়তো জরুরী দরকার, নয়তো কোনো কারণে আটকে গেছেন লাইব্রেরিয়ান। বললো, বিশ মিনিটের মধ্যে হাজির হবে।

নাস্তা সেরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রবিন। লাইব্রেরিতে এসে জানলো, অ্যাসিসট্যান্ট লাইব্রেরিয়ানের শরীর খারাপ, আসতে পারবেন না।

দুপুর পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত রইলো রবিন। বিকেলটাও তাকে থেকে যেতে বললেন লাইব্রেরিয়ান। কি আর করা। থেকে গেল। সঙ্গে আনা স্যাণ্ডউইস দিয়ে খাওয়া সেরে রেফারেন্স বই খুলে বসলো।

প্রথমেই হারিকেনের ওপর লেখা অধ্যায়টা খুললো। রহস্যময় মেসেজে রয়েছে হারিকেনের উল্লেখ। পড়তে পড়তে একসময় উত্তেজিত হয়ে উঠলো সে, নোট লিখে রাখলো। তারপর বের করলো মধ্যযুগীয় ইংরেজ তীরন্দাজদের ওপর লেখা অধ্যায়। আবার উত্তেজিত হয়ে নোট লিখলো নোটবইয়ে। এরপর পড়লো সাগরের ওপর লেখা লেখাটা। কারণ মেসেজে ওশন শব্দটা রয়েছে। নোট করার মতো কিছু পেলো না এখানে। লাঞ্চের সময় শেষ। বই বন্ধ করে উঠে গেল কাজ করার জন্যে।

পাঁচটার আগে ছাড়া পেলো না রবিন। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে সাইকেলে চেপে সোজা চললো স্যালভিজ ইয়ার্ডে। দুপুরে বিশেষ কথাগুলো জানার পর থেকে এতোক্ষণ উত্তেজনা চেপে রাখতে খুব কষ্ট হয়েছে তার। এখন আর তর সইছে না।

ইয়ার্ডে ঢুকে বুঝলো, সকালে না এসে ভালোই করেছে। সারাটা দিন মুসা আর কিশোরকে গাধার খাটুনি খাটতে হয়েছে। কয়েক ট্রাক মাল কিনে এনেছেন রাশেদ পাশা। সেগুলো গোছানো তখনও শেষ করতে পারেনি।

উফফ, মরে গেছি, রবিনকে দেখেই বলে উঠলো কিশোর। সকালে মুসা। এলো। সবে হেডকোয়ার্টারে ঢুকবো ঢুকবো করছি, এই সময় চাচা নিয়ে এলো মালগুলো। বোরিস আর রোভারেরও অবস্থা কাহিল আজ।

টিমের কোনো খবর আছে? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

ফোন করেছিলো। কাল যাওয়ার পরই নাকি লারমার ধরে জিজ্ঞেস করেছে, এতোক্ষণ কোথায় কি করেছে টিম। ভয়ে বলে দিতে বাধ্য হয়েছে সে। এখানে যা যা শুনে গেছে সব। শুনে নাকি আরও রেগে গেছে লারমার।

রাগলো কেন?

জানে না।

মেসেজগুলো আমাদের হাতে পড়েছে জেনেই হয়তো রেগেছে। আমরা সাবধান করে ফেললে হয়তো তার কোনো অসুবিধে হবে। নোটবই বের করলো রবিন। কিশোর, কি জেনেছি জানো…

আরে, রবিন এসে গেছো? পেছন থেকে বলে উঠলেন মেরিচাচী, কখন। এসেছেন বুঝতেই পারেনি ওরা। ছিলে কোথায়? নিশ্চয় লাইব্রেরিতে। যাক, এসেছো ভালো হয়েছে। নাও, বলতে বলতে ইয়া বড় এক খাতা তার হাতে গুঁজে দিলেন তিনি। মালের লিস্টটা করে ফেলো তো। ভুলটুল কোরো না। আমি যাই, রাতের খাবার লাগবে এতোগুলো লোকের…

এক মুহূর্ত আর দাঁড়ালেন না তিনি। ছেলেদেরকে কোনোরকম প্রতিবাদের। সুযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লেন সেখান থেকে।

নাও, শুরু করো, দুহাত নাড়লো মুসা। আমরা তো মরেছি। তুমি আর বাদ থাকো কেন?

বলো, খাতাটা খুলে কলম নিয়ে তৈরি হলো রবিন।

 একটা রকিং চেয়ার, মুসা বললো।

 একটা রকিং—চেয়ার। তারপর?

এক সেট বাগান করার যন্ত্রপাতি। মরচে পড়া

 এক সেট…বাগান…করার…যন্ত্রপাতি…

আরও এক ঘন্টা কাজ চললো। ক্লান্ত হয়ে ওখানে ঘাসের ওপর বসে পড়লো কিশোর। মুসা শুয়েই পড়লো। রবিন বসলো ওদের পাশে। তার আবিষ্কারের কথা জানানোর জন্যে নোটবই বের করলো আবার। এই শোনো, মেসেজটার মানে বের করতে হবে না?

আমি আর আজ ওসবে নেই, জোরে হাত নাড়লো মুসা। তোমরা পারলে করোগে। আমার একটা আঙুল নড়ানোরও ক্ষমতা নেই।

আমিও ঠিকমতো ভাবতে পারবো না এখন, কিশোর বললো। যা করার কাল সকালে করবো।

কিন্তু কয়েকটা সূত্র পেয়েছি আমি, বললো রবিন। অন্তত দুটো লাইনের সমাধান তো হবেই। মিলে যায়…

সূত্র? বাতাসে খামচি মারলো মুসা। শব্দটাই শুনিনি কখনও।

আচ্ছা, এক কাজ করা যাক না, মুসাকে বললো কিশোর। ওর কথাগুলো তো শুনতে পারি আমরা। তাতে কোনো কষ্ট হবে না। রবিন, বলো, শুনি।

হারিকেনের ওপর একটা লেখা পড়লাম দুপুরে। লিখেছে, হারিকেনের সব চেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো ওটার কেন্দ্র। একেবারে শান্ত। অথচ ওই জায়গাকে কেন্দ্র করেই চারপাশে ঘন্টায় একশো মাইল বেগে বইতে থাকে ঝড়।

থামলে কেন? বলে যাও।

হারিকেনের ওই কেন্দ্রকে বলা হয় আই, বাংলায় চোখ। কিছু বুঝলে? আই-এর উচ্চারণ আই, অর্থাৎ আমির মতো। এবং এই আই হলো মেসেজের পয়লা শব্দ।

আমি এখন পয়লা শব্দ যেটা শুনতে চাই, সেটা খাবার, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে পেটে হাত বোলালো মুসা।

রবিন, মুসার কথায় কান দিলো না কিশোর, সোজা হয়ে গেছে পিঠ। ঠিক বলেছো! আর কি জেনেছো?

বোম্যান। আগের দিনে ইংরেজ তীরন্দাজরা তীর বানাতে ইউ গাছ দিয়ে…

ইউ গাছ? ফোড়ন কাটলো মুসা। গ্রীক দেবতারা দিয়ে যেতো নাকি? নামও তো শুনিনি।

কটা গাছের নামই বা তুমি জানো? ইউ হলো একজাতের চিরশ্যামল গাছ। বানান, ওয়াই-ই-ডাবলিউ। উচ্চারণ ওয়াই-ও-ইউ দিয়ে তৈরি শব্দ ইউ-এর মতো।

ইউ, মানে তুমি, বিড়বিড় করলো কিশোর। হাতের তালুতে চাপড় মারলো। সে। রবিন, ঠিকই বলেছো। আরেকটা শব্দ পাওয়া গেল .চলো, হেডকোয়ার্টারে। খাবার রেডি হতে দেরি আছে। ততোক্ষণে মানেগুলো বের করে ফেলি।

কাল করলে হতো না? মিনমিন করে বললো মুসা। কিন্তু কিশোর আর রবিন রওনা হতেই সে-ও চললো পিছু পিছু।

পাঁচ মিনিট পর ডেস্ক ঘিরে বসলো তিন গোয়েন্দা।

হ্যাঁ, তাহলে কি পাওয়া গেল? শুরু করলো কিশোর। প্রথম লাইনঃ ইটস কোয়ায়েট দেয়ার ঈভন ইন আ হারিকেন। ধরলাম এই লাইন দিয়ে আই বোঝানো হয়েছে। শব্দটা লিখে নিলো একটা কাগজে। দ্বিতীয় লাইনঃ জাস্ট আ ওয়ার্ড অভ অ্যাডভাইস, পোলাইটলি গিভেন। পরামর্শ বলতে চেয়েছে। কাগজে লিখলো ইংরেজিতে, সাজেশন। এখন তৃতীয় লাইনের ওল্ড ইংলিশ বোম্যান লাভড ইট দিয়ে যদি হয় ইউ… প্রথম দুটো শব্দের পাশাপাশি লিখলো এই শব্দটাও। তাহলে হলোঃ আই সাজেশন ইউনাহ, হলো না। তার চেয়ে বলিঃ আই সাজেস্ট ইউ…।

আই সাজেস্ট ইউ, চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। ক্লান্তি আর ক্ষুধার কথা ভুলে গেছে। বেমালুম, হচ্ছে, কিশোর, হচ্ছে! খাইছে, পরের শব্দটা কি? ক

বিগার দ্যান আ রেইনড্রপ; স্মলার দ্যান অ্যান ওশন। জলরাশি বোঝাতে চেয়েছে মনে হয়। জলরাশি তো কত রকমই আছে, নদী-নালা খাল-বিল, পুকুর, হ্রদ, সাগর…

দাঁড়াও, দাঁড়াও, হাত তুললো রবিন। বলেছে, বৃষ্টির ফোঁটার চেয়ে বড়, মহাসাগরের চেয়ে ছোট, সাগরই ধরে নিলাম। কি দাঁড়ালো? সাগর। সী। এস-ই এ, কিন্তু উচ্চারণ এস-ডাবল-ই, সী-এর মতো…

সী, মানে দেখা, বলতে বলতে শব্দটা লিখে নিলো কিশোর।

এখন পাঁচ নম্বর, রবিন বললো। আয়্যাম ফোর। হাউ ওল্ড আর ইউ? হ্যাঁ, এটা বেশ কঠিন। কি বোঝাতে চেয়েছে?

আমার বয়েস চার। তোমার কতো?

এটা তো বাংলা মানে হলো। কিন্তু ইংরেজি শব্দটা কি?

ওই আগের লাইনগুলোর মতোই ঘুরিয়ে বলেছে। বর্ণমালার চার নম্বর। অক্ষরটার কথা বলেনি তো?

চার নম্বরটা কি? উত্তেজিত কণ্ঠে বললো মুসা। বেশ মজা পাচ্ছে এখন। ডি। তাতে কি?

তাতে? অনেকে ডি-এর উচ্চারণ দি-এর মতো করে। যদি ধরি টি-এইচ-ই, দি, বা দা, বা দ্য, লিখে ফেললো শব্দটা, তাহলে মেলে। আর মাত্র একটা শব্দ বের করতে পারলেই ইট সিটস অন আ শেলফ লাইক আ ওয়েল-ফেড-এলফ। কি বোঝা যায়? দুই সহকারীর দিকে তাকালো গোয়েন্দাপ্রধান।

ই-এল-এফ, এল মানে তো হলো একজাতের ভূত, রবিন বললো।

শেলফে ভূতের মতো কি বসে থাকে? মুসার প্রশ্ন। ছারপোকা? তেলাপোকা? টিকটিকি…

এলফ শব্দটাও ব্যবহার করেছে দ্বিধায় ফেলার জন্যে, বললো কিশোর। রবিন, লাইব্রেরিতে শেলফের দিকে তাকালেই কি চোখে পড়ে? এফের মতো বেঁটে মোটা মোটা ভূত…

মোটা মোটা বই! উত্তেজনায় লাফ দিয়ে টুল থেকে উঠে পড়লো রবিন।

হ্যাঁ, বই।

আর ওয়েল-ফেড, মানে পেট-পুরে-খাওয়া বলে বোঝাতে চেয়েছে অক্ষরে বোঝাই..ঠিক, বই-ই। আর কোনো সন্দেহ নেই।

শব্দটা লিখে নিয়ে বললো কিশোর, তাহলে, ছয়টা শব্দ দিয়ে একটা পুরো লাইন হলো। আই সাজেস্ট ইউ সী দা বুক।

বাহ্, চমৎকার, চুটকি বাজালো মুসা। খুব সহজ এর মানে। বইতে কিছু দেখার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু কি দেখবো? কোন বইতে দেখবো? আর দেখার পর ওটা দিয়ে কি করবো?

জানা যাবে। আরও দুটো মেসেজ আছে। ওগুলোর মানে বের করতে পারলেই…

কিশোওর! মুসাআ! বাইরে থেকে ডাক শোনা গেল মেরিচাচীর। এইমাত্র দেখলাম এখানে…কোথায় গিয়ে ঢুকলি?।

দূর, এতো তাড়াতাড়ি সেরে ফেললো? বিরক্ত কণ্ঠে বললো কিশোর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো। আজ আর হচ্ছে না। কাল সকালে চেষ্টা করবো। চলো।

.

১৪.

খেতে খেতে আলোচনা চললো।

বইটা কি বই? একই প্রশ্ন আবার করলো মুসা। বাইবেল?

মনে হয় না, মাথা নাড়লো কিশোর। বড় একটা মাংসের বড়া নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে ছুরি দিয়ে কাটতে কাটতে বললো, আন্দাজে কিছু বলে লাভ নেই। কাল অন্য মেসেজগুলোর মানে বের করতে পারলেই…

 কী বলছিস তোরা? মুখ তুললেন রাশেদ পাশা। নতুন কোনো কেস পেয়েছিস নাকি?

কতগুলো অদ্ভুত মেসেজ পেয়েছি, চাচা। তোমার আনা ওই চেঁচানো ঘড়িটা দিয়েই শুরু। একটা মেসেজের মানে অবশ্য বের করে ফেলেছি…

এই বকবক না করে চুপচাপ খা তো! ধমক লাগালেন মেরিচাচী। এই বেশি ভেবে ভেবেই অকালে পাগল হবি। কতোবার বলেছি, এতো ভাববি না। সারা দিন গতর খাটাবি, পেট ভরে খাবি, রাতে নাক ডেকে ঘুমাবি। শরীর-মন দুটোই ভালো থাকবে, বাচবিও বেশি দিন। বড় করে এক টুকরো কেক কেটে মুসার পাতে দিতে দিতে বললেন, এই ছেলেটাই ভালো। খেতে পারে, খাটতেও পারে, কথা বলে। কম…

হেসে ফেললো কিশোর। তা ঠিক। বেশি খেলে ঘুম তো আসবেই। এই এখন আমার যেমন আসছে। আজ মেরে ফেলেছো, চাচী। সারা শরীর ব্যথা হয়ে। গেছে।

আরে না, কি যে বলো? মেরিচাচীর পক্ষ নিলো মুসা। বেশি খেলে ঘুম আসবে কেন? বলতে না বলতেই মস্ত এক হাই তুললো সে।

 রবিন আর রাশেদ পাশাও হাসতে শুরু করলেন। চেষ্টা করেও গম্ভীর হয়ে থাকতে পারলেন না মেরিচাচী।

খাওয়ার পর বারান্দায় বেরোলো তিন গোয়েন্দা।

আবার যাবে নাকি হেডকোয়ার্টারে? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

না, আজ আর না, বললো কিশোর। কাল সকালে।

বিদায় নিয়ে সাইকেলে চাপলো মুসা আর রবিন। রওনা হলো যার যার বাড়ি। দুটো ব্লক একসাথে এসে আলাদা হয়ে দুজনে চললো দুদিকে খেয়াল করলো, ইয়ার্ডের গেট থেকেই ওদের পিছু নিয়েছিলো একটা ছোট ডেলিভারি ভ্যান। এখন অনুসরণ করছে রবিনকে।

দুই বন্ধুকে বিদায় দিয়ে কিশোর ঢুকেছে রান্নাঘরে। টেবিল সাফ করে বাসন পেয়ালা ধুতে সাহায্য করেছে চাচীকে। একের পর এক হাই তুলছে।

দেখে মেরিচাচী বললেন, যা, তুই ঘুমোতে যা। আমি একাই পারবো।

সোজা নিজের ঘরে এসে কাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়লো কিশোর। ভেবেছিলো, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়বে। এতো ক্লান্তিতেও ঘুম এলো না। মনে এসে ভিড় জমালো হাজারো ভাবনা। কি আছে মেসেজগুলোতে?

আই সাজেস্ট ইউ সী দা বুক। কি বই? দ্বিতীয় মেসেজে কি আছে জবাবটা? : ভাবনা যতো বাড়ছে, দূর হয়ে যাচ্ছে ঘুম। না, হবে না। দ্বিতীয় মেসেজটার সমাধান না করে ঘুমোতে পারবে না। উঠে বসলো সে।

আবার কাপড় পরে নেমে এলো নিচতলায়। চাচা-চাচী টেলিভিশন দেখছিলেন, অবাক হয়ে তাকালেন।

কি-রে, কিশোর, মেরিচাচী জিজ্ঞেস করলেন। ঘুমোসনি?

ঘুম আসছে না। কতগুলো বাজে ভাবনা ঢুকেছে মাথায়। জঞ্জালের মধ্যে ফেলে দিয়ে আসি ওগুলো। নইলে ঘুমোতে পারবো না।

তোর মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে…।

মেরিচাচীর কথা শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে এলো কিশোর। বারান্দা থেকে নেমে রওনা হলো ওয়ার্কশপের দিকে। মেইন গেট বন্ধ। চলে এলো বেড়ার কাছে। একটা বিশেষ জায়গায় আঙুলের চাপ দিতেই নিঃশব্দে উঠে গেল দুটো সবুজ বোর্ড। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার অনেকগুলো গোপন পথের এটা আরেকটা, সবুজ ফটক এক। বেরিয়ে পড়েছে সরু প্রবেশ পথ? ওখান দিয়ে ঢুকলো ওয়ার্কশপে। তারপর দুই সুড়ঙ্গের মুখের ঢাকনা সরিয়ে পাইপের ভেতর দিয়ে চলে এলো মোবাইল হোমে। অফিসে ঢুকলো।

মাথার ওপরের আলোটা জ্বেলে দিয়ে ডেস্কের ড্রয়ার থেকে বের করলো মেসেজগুলো। সে আর মুসা গিয়ে মিস্টার হিরাম বারকেনের কাছ থেকে যেটা এনেছে, সেটা নিয়ে বসলো।

বার বার পড়লো লেখাগুলো। সেই সাথে চলেছে গভীর ভাবনা। ধীরে ধীরে আসতে আরম্ভ করেছে ধারণাগুলো। প্রথম মেসেজটা সমাধান করতে পারায়, দ্বিতীয়টা সহজ হয়ে গেল। সঠিক পথ দেখালো ওকে প্রথমটা-ই।

প্রথম লাইনের শুরুতে একটা ফুল নেয়ার জন্যে বলা হচ্ছে। কাগজে লিখলো। সেঃ টেইকওয়ান লিলি। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লেখাটার দিকে। এলিকে মেরে ফেলতে বলা হয়েছে। কিভাবে? হঠাৎ বুঝে ফেললো। ওয়ান লিলি-র ওয়ান এর প্রথম দুটো অক্ষর আর লিলি-র শেষ দুটো অক্ষর বাদ দিলেই হয়ে যায় ই-এল আই, এলি। এলিকে মারতে বলা হয়েছে। দুটো শব্দের মাঝের তিনটে, অক্ষর কেটে দিলো সে। বাকি চারটে অক্ষর একসাথে করতেই হয়ে গেল ওনলি।

ওনলি! একা একাই চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। পেয়েছি! এবার দ্বিতীয় লাইন। বলছেঃ পজিটিভলি নাম্বার ওয়ান।

প্রথম মেসেজটায় আয়্যাম ফোর বলে ডি বুঝিয়েছে। এটাতেও হয়তো ওয়ান বলে আ বোঝাতে চেয়েছে। ওনলির পাশে লিখলো আ। তার মনে হলো, তৃতীয় লাইনে ব্রম শব্দটার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কারণ, ঝাড়ু নিয়ে মৌমাছি তাড়াতে বলা হয়েছে। তারমানে ঝাড়ুটাই এখানে প্রধান। বী মানে মৌমাছি, ইংরেজি দ্বিতীয় অক্ষরের উচ্চারণও বী বী-টাকেই তাড়াতে বলা হয়েছে। ব্রম থেকে বী বাদ দিলে হলো রুম।

 ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কিশোর। অনর্গল কথা বলছে নিজের সঙ্গে। জোরে জোরে। একা গভীর মনোযোগের কাজ করার সময় এরকম করে মাঝে মাঝে।

এরপর আসছে, বললো সে। হোয়াট ইউ ডু উইদ ক্লথস, অলমোস্ট। কাপড় দিয়ে কি করি আমরা? পরি। পরা ইংরেজি, ওয়্যার। বানান, ডাবুলিউ-ই-এ আর। ওনলি আ রুম-এর সঙ্গে ওয়্যার মেলে না। তাহলে কি মেলে? আরেকটা ওয়্যার, কিংবা হোয়্যার। উচ্চারণ প্রায় একই, কিন্তু বানান আর মানে আলাদা। লিখে ফেললো প্রথম তিনটে শব্দের পাশেঃ ডাবলিউ-এইচ-ই-আর-ঈ। বললো, তাহলে দাঁড়ালো, ওনলি আ রুম হোয়্যার: হ্যাঁ, পরিষ্কার হচ্ছে আস্তে আস্তে।

 পাঁচ নম্বর লাইনের মানে বের করা এতো সহজ হলো না। লাইনটার মানে, মা-ও নয়, বোন-ও নয়, ভাই-ও নয়, বাবা হতে পারে। ফাদার বসালে কিছু হয় না। ড্যাড, পপ বসিয়েও হলো না। পরিবারের প্রধান যদি ধরা হয় ফাদারকে? হেড অভ দা ফ্যামিলি? নাহ, হচ্ছে না।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করলো সে। কি বলতে চাইছে? ফাদার ক্রিসমাস? না। ফাদার টাইম? আঁ, ফাদার টাইম! ঘড়ি নিয়ে কারবার যখন… ঠিক, ফাদার টাইম!

 দ্রুত লিখে ফেললো ওনলি আ রুম হোয়্যার-এর পাশে ফাদার টাইম। বাকি। রইলো মাত্র একটা লাইন। ফাদার টাইম, অর্থাৎ বাবা ঘড়ি কি করে? সময় দেয়। আর কি করে। শব্দ করে। কিভাবে? মেকানিক্যাল হলে টিকটিক, ইলেকট্রিকে চললে গুঞ্জন না, ঠিক গুঞ্জনও বলা যায় না। আসলে শব্দটা সঠিক ভাবে বোঝানোর কোনো উপায় নেই। সেকথা বলাও হয়েছে, অলমোস্ট, নট কোয়াইট। তাহলে, গুঞ্জন ইংরেজি হলো হামস। লিখে ফেললো শব্দটা, হামস।

পুরো লাইনটা হলোঃ ওনলি আ রুম হোয়্যার ফাদার টাইমস হামস।

 হ্যাঁ, ঠিক আছে, আপনমনে মাথা দোলালো কিশোর। শুধু একটা ঘর, যেখানে বাবা ঘড়ি গুঞ্জন করে। কথা হলো, কোথায় গুঞ্জন করে? ওই মুহূর্তে একটা ঘরের কথাই মনে হলো তার। মিস্টার ক্লকের সেই সাউণ্ডপ্রুফ ঘরটা, যেখানে অসংখ্য ঘড়ি রয়েছে। তবে মেসেজ থেকে বোঝা গেল না, কোন বইয়ের ঘড়ির গোলমাল কথা বলা হয়েছে। যাবে, পাওয়া যাবে, নিজেকে আশ্বস্ত করলো সে। ছেঁড়া মেসেজটা বের করলো। নম্বরগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। প্রথম লাইনে রয়েছেঃ ৩-২৭৪-৩৬৫-১৯৪৮-১২৭-১১১৫-৯

 কি বোঝাতে চায়? বইটার ব্যাপারে কিছু? কোনো বিশেষ বইয়ের সাহায্যে কোড মেসেজ তৈরি করা যুদ্ধের সময় বেশ জনপ্রিয় ছিলো, এখনও গুপ্তচর মহলে এর ব্যবহার আছে। বইয়ের পাতা থেকে শব্দ বাছাই করে লাইন তৈরি করে। প্রেরক। কোন পাতার কোন লাইনের কোন শব্দটি নিয়েছে, গুনে নম্বর লিখে দেয়। প্রাপক সেটা খুঁজে বের করে বুঝে নেয় মেসেজের মানে। সহজ কোড, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরাপদ। কারণ, অন্য কারও হাতে পড়লেও তার বোঝার উপায় নেই, কোন বই থেকে নেয়া হয়েছে। সেটা জানে শুধু প্রেরক আর প্রাপক।

সুতরাং কিশোরের জন্যেও বইয়ের নাম জানাটা খুব জরুরী। কিভাবে জানা যাবে? আর বইটা পেলেও কি আধখানা মেসেজ থেকে পুরো লাইনটা বোঝা সম্ভব?

বড় করে হাই তুললো সে। ঘুম পেয়েছে। থাক, আজ রাতের জন্যে যথেষ্ট। হয়েছে। কাল সকালে উঠে আবার চেষ্টা করা যাবে, ভেবে, মেসেজগুলো আবার। ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো কিশোর। ট্র্যাপডোরের দিকে এগোতে যাবে, এই সময় বাজলো টেলিফোন।

এতো রাতে কে! অবাক হলো সে। তুলে নিলো রিসিভার। তিন গোয়েন্দা। কিশোর পাশা বলছি।

অন্য পাশের কণ্ঠটা শুনে স্থির হয়ে গেল সে। জমে গেছে যেন বরফের মতো।

.

১৫.

এগিয়ে চলেছে রবিন। পেছনে এঞ্জিনের শব্দ শুনছে, কিন্তু ফিরে তাকানোর কথা ভাবলো না একবারও। রাস্তায় গাড়ি থাকতেই পারে।

এক জায়গায় রাস্তার ধারে কোনো বাড়ি-ঘর নেই, খালি জায়গা। ঠিক ওখানটায় এসে পেছন থেকে শা করে সামনে চলে এলো ভ্যানটা, রবিনের পথরোধ করে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো।

লাফিয়ে বেরোলো এক কিশোর। রবিন!

অবাক হয়ে ব্রেক চাপলো রবিন। টিম! উত্তেজিত। সাইকেল থেকে নেমে ঠেলে নিয়ে তার দিকে এগোলো রবিন। কি ব্যাপার, টিম? কিছু হয়েছে?

পেছনের দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামলো ছোটখাটো একজন মানুষ। হয়নি, তবে আমাদের কথা না শুনলে অনেক কিছুই হবে, কড়া গলায় বললো সে। খবরদার, পালানোর চেষ্টা কোরো না।

সরি, রবিন, অস্বস্তিতে গলা কাঁপছে টিমের। তোমার কাছে নিয়ে আসতে বললো ওরা। মাকে ঘরে তালা আটকে রেখে এসেছে।

হয়েছে হয়েছে, অতো ব্যাখ্যা করতে হবে না, ধমক দিলো লোকটা। এই, তোমার সাইকেল ছাড়ো। ওঠো গাড়িতে।

চট করে চারপাশে চোখ বোলালো একবার রবিন। নির্জন পথ। সাহায্যের জন্যে যে ডাকবে, সে উপায় নেই। দৌড় দিয়েও সুবিধে করতে পারবে না। সহজেই ধরে ফেলবে তাকে।

হ্যান্ডেল ধরে সাইকেলটা কেড়ে নেয়া হলো তার কাছ থেকে। পিঠে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে লোকটা বললো, দাঁড়িয়ে আছো কেন? জলদি ওঠো। টিম, তুমিও।

গাড়িতে আলো নেই। অন্ধকারে উঠে বসলো রবিন। তার পাশে টিম। সাইকেলটা ভ্যানে তুলে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলো লোকটা। বন্দি হলো দুই কিশোর।

আমাদের ক্ষতি করবে না বলেছে, নিচু কণ্ঠে বললো টিম। ওরা শুধু তথ্য চায়। ঘড়ি আর মেসেজগুলো সম্পর্কে। আমি তেমন কিছু বলতে পারিনি, তাই তোমাদের কাছে নিয়ে আসতে বাধ্য করলো। বললো, তোমাদের যে-কোনো একজনকে হলেই চলবে। ইয়ার্ডের ওপর অনেকক্ষণ থেকেই চোখ রাখছিলো। তুমি আর মুসা বেরোতেই পিছু নিলো।

মৃদু ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটছে ভ্যান। গন্তব্য দুজনের কাছেই অজানা।

কারা ওরা? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

একজন, লারমার। আরও দুজন আছে। বেঁটে লোকটার নাম ডিংগো। আর লম্বা আরেকজন আছে, নাম মারকো।

ডিংগো আর মারকো! ওরা দুজনই কাল কিশোরদেরকে ধরেছিলো। একটা মেসেজের অর্ধেকটা ছিঁড়ে রেখে দিয়েছে।

হ্যাঁ, ওরাই। কটা মেসেজ, মানে কী, জানতে চায়। মূল্যবান কোনো জিনিসের ইঙ্গিত রয়েছে মেসেজে। ওদের ধারণা, জিনিসটা কি, কোথায় লুকানো আছে জানি আমরা।

কে বললো আমরা জানি? কিশোরের অনুমান, দামী জিনিস আছে, ব্যস।

আজ বিকেলে ডিংগো আর মারকো এসেছে লারমারের সঙ্গে দেখা করতে। অনেকক্ষণ কথা বলেছে। তারপর এসে ধরলো আমাকে, যা যা জানি বলার জন্যে। বলতে বাধ্য করলো। সরি, রবিন, না বলে উপায় ছিলো না। খুব শয়তান লোক। আমাকে মেরে ফেললেও বলতাম না, কিন্তু মার ওপর অত্যাচার করার ভয়। দেখালো…

 আরে না না, তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আমি হলেও তা-ই করতাম। তোমার মাকে তালা দিয়ে রেখেছে বললে না?

হ্যাঁ, আমরা যে বাড়িতে থাকি, মানে মিস্টার ক্লকের বাড়িতে। এরাও ক্লক ক্লকই করছিলো। আড়ি পেতে শুনেছি ওদের কথা। লারমার বললো, সে এই বাড়িতে উঠেছে গোপন জায়গা খুঁজতে। এমন একটা জায়গা, যেখানে দামী জিনিস লুকানো থাকতে পারে। রবিন, প্লীজ, তুমি যা জানো বলে দিও। নইলে আমার মাকে ছাড়বে না। বলবে তো?

মুশকিল কি জানো, আমি নিজেই কিছু জানি না, সত্যি কথাই বললো রবিন। একটা মেসেজের সমাধান করেছি। তাতে বলা হয়েছে বইটা দেখতে। কোন বই, জানি না। তাই তিনি কোন

বলতে না পারলে খুব রেগে যাবে ওরা, শঙ্কিত হয়ে উঠলো টিম। ওরা ধরেই নিয়েছে, তোমরা মেসেজের সমাধান করে ফেলেছো। তোমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে। জেনেছে, আগেও অনেক জটিল রহস্যের সমাধান তোমরা করেছে।

সমাধান আসলে কিশোর করেছে, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো রবিন। ওদেরকে বিশ্বাস করাতে হবে, সত্যিই আমি কিছু জানি না। তাহলেই হয়তো ছেড়ে দেবে। আটকে রেথে তো লাভ নেই, অযথা ঝামেলা বাড়াতে চাইবে না। ওরা।

ওই আশা মনে নিয়েই নীরব হলো দুজনে। ভ্যান চলেছে। মোড় নিচ্ছে মাঝে মাঝে। বুঝতে পারলো না ওরা যাচ্ছে কোনদিকে। দীর্ঘ কয়েক যুগ পরে যেন অরশেষে থামলো গাড়ি। বড় একটা দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। ঝনঝন করে উঠে গেল স্পিঙ লাগানো দরজা, বোধহয় কোনো গ্যারেজের। আবার চললো ভ্যান, কয়েক ফুট এগিয়ে থামলো। পেছনে দরজা নামিয়ে দেয়ার শব্দ। ভ্যানের দরজার তালা খুললো খাটো লোকটা, ডিংগো।

নামো, দুজনেই, আদেশ দিলো সে। ভালো চাইলে চুপচাপ থাকবে। নইলে কপালে দুঃখ আছে।

রবিন আগে নামলো, পেছনে টিম। কংক্রীটের মেঝে। চারপাশে চোখ বোলালো রবিন। গ্যারেজই, বড় একটা ডাবল-গ্যারেজ। দরজা নামানো। দুপাশে দুটো জানালা, পর্দা টানা, পাল্লা বন্ধ কিনা বোঝা গেল না। মাথার ওপরে একটা বাল্ব জ্বলছে। আর কোনো গাড়ি নেই। একটা গাড়িই বোধহয় রাখা হয়, কারণ আরেকটা গাড়ির জায়গাকে ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করে–জিনিসপত্র দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একটা ওয়ার্কবেঞ্চ, একটা ব্রোল্যাম্প আর কিছু যন্ত্রপাতি আছে।

বেঞ্চের পাশে কয়েকটা চেয়ার। সেগুলো দেখিয়ে ডিংগো বললো, যাও, বসো। মুখে কুৎসিত হাসি। আরামেই বসো, কষ্ট করার দরকার নেই।

রবিন আর টিম বসলো।

নগ্ন আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে লারমারের লম্বা মুখটা, চোখ আর নাকের নিচে অদ্ভুত ছায়া কেমন যেন কিস্তুত করে তুলেছে চেহারাটাকে। এগিয়ে এলো দুই, কদম। তার পেছনে ভ্যান থেকে নেমে হাসিমুখে এগোলো লম্বা লোকটা, মারকো।

 দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধো, ডিংগোকে আদেশ দিলো লারমার। তারপর কথা।

 বেঞ্চের ওপর থেকে দড়ি এনে রবিন আর টিমকে চেয়ারের সঙ্গে পেঁচিয়ে বাঁধলো ডিংগো।

একটা চেয়ার টেনে ওদের মুখোমুখি বসলো লারমার। সাগর কলার মতো মোটা এক সিগার ধরিয়ে আরাম করে টান দিলো কয়েকটা। মুখ-ভর্তি ধোয়া নিয়ে। ফুঁ দিয়ে ছাড়লো দুই বন্দির মুখে। ফিকফিফ করে হাসলো শয়তানী হাসি। তামাক পছন্দ না, না? তোমার বয়েসে আমি অবশ্য খুবই পছন্দ করতাম। কি স্বাদ যে মিস করছো, বুঝতে পারছে না।

স্বাদের দরকার নেই আমার, গম্ভীর হয়ে বললো রবিন। ফুসফুস কালি করার। কোনো ইচ্ছে নেই।

ভালো কথা। বোঝা গেল, নিজের জন্যে মায়াদর আছে। প্রশ্নের জবাব তাহলে সরাসরিই দেবে আশা করি। সিগারে আরেকটা লম্বা টান দিলো সে। হ্যাঁ, টিম নিশ্চয় সব জানিয়েছে?

বলেছে, মেসেজের মানে আপনারা জানতে চান, গলা কাঁপছে রবিনের।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে। দামী কিছু জিনিস কোথাও লুকানো আছে। মেসেজে আছে ইঙ্গিত। জানতে চাই, সেটা কোথায়। ভুরু কুঁচকে বিকট করে তুললো চেহারাটা। বদলে গেল কণ্ঠস্বর, মেসেজগুলো কিভাবে পেয়েছো, জানি। চেঁচানো ঘড়িটা পেয়ে, হ্যারিসন ক্লকের কথা জেনে গেছো তোমরা। ঠিক গিয়ে খুঁজে বের করেছো হেনরি মিলারকে, তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এসেছে। আরও দুজনের কাছ থেকে দুটো মেসেজ এনেছো। রবিনের চোখে চোখে তাকালো। এখন বলে ফেলো, কি লেখা আছে ওগুলোতে।

আর হ্যাঁ, রবিন জবাব দেয়ার আগেই মারকো বললো, আমি জানতে চাই, হেনরি মিলারের কাছে ওই চেঁচানো ঘড়িটা পাঠানোরই বা কি অর্থ? ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে কেন পাঠিয়েছে মেসেজগুলো? কি খেলায় মেতেছে হ্যারিসন ক্লক?

ক্লক কি খেলায় মেতেছে, সেটা ও জানবে কি করে? ডিংগো বললো। ক্লকের পেটে খালি শয়তানী বুদ্ধি, কথা পর্যন্ত সোজা করে বলে না। কেন করেছে এসব, একমাত্র ও-ই বলতে পারবে। আর যেহেতু ওকে পাওয়া যাচ্ছে না…

জানাও যাবে না, বাক্যটা শেষ করে দিলো লারমার। ওসব জানার দরকারও নেই আমাদের। মাল কোথায় লুকানো আছে, এটা জানলেই আমি খুশি। নাও খোকা, শুরু করো। মেসেজে কি বলেছে?

জোরে ঢোক গিললো রবিন। ইয়ে, একটা মেসেজের মানে বের করেছি আমরা। লিখেছেঃ আই সাজেস্ট ইউ সী দা বুক। ব্যস। এই একটা লাইনই।

আই সাজেস্ট ইউ সী দা বুক! ঠোঁট কামড়ালো লারমার। কি বই?

জানি না, বলেনি।

দ্বিতীয়টায় নিশ্চয় বলেছে, অধৈর্য হয়ে উঠছে লারমার। কি লিখেছে?

জানি না, আবার ঢোক গিললো রবিন। মানে করার সময়ই পাইনি। ক্লান্ত ছিলাম। আগামী কাল করবো ভেবেছি।

দেখো, ছেলে! কঠোর কণ্ঠে বললো লারমার, মিথ্যে বলো না! দ্বিতীয় মেসেজে কি লিখেছে জলদি বলো!

সত্যি বলছি আমি জানি না। ওটা নিয়ে ভাবিইনি। কাল সকালের জন্যে রেখে দিয়েছি।

সত্যি কথাই বলছে মনে হয়, মারকো বললো।

হয়তো, নিশ্চিত হতে পারছে না লারমার। বেশ, ধরে নিলাম, দ্বিতীয়টার মানে জানো না। তৃতীয়টার? ওটা তো জানো? ওই যে, শুধু নম্বর লেখা আছে যেটায়। অর্ধেকটা আমার কাছে, মারকো ছিঁড়ে রেখে দিয়েছিলো। পকেট থেকে ছেঁড়া কাগজটা বের করে রবিনের নাকের কাছে নাড়লো। কি মানে এসব নম্বরের?

আমি বলতে পারবো না, মাথা নাড়লো রবিন। কিশোর হয়তো পারবে।

ভীষণ হয়ে উঠলো লারমারের কুৎসিত চেহারা। তবে, নিশ্চিত হলো, রবিন। মিথ্যে বলছে না।

তার মানে আরও অপেক্ষা করতে হবে আমাদের, মারকো বললো। সেটা করতে তো আপত্তি ছিলো না, কিন্তু অসুবিধে আছে। ছেলেগুলো বুঝে ফেললেই পুলিশের কাছে যাবে, তাদের নিয়ে যাবে লুকানোর জায়গাটায়। আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না তখন। কাজেই দেরি করা যাচ্ছে না। তো, কী করা?

কি আর? খেপা কুকুরের মতো ঘড়ঘড় করে উঠলো লারমার। এখুনি অন্য মেসেজগুলো নিয়ে নিতে হবে। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মানে বের করতে পারলে আমরা কেন পারবো না? ওগুলো লাগবে। এই ছেলে, কার কাছে মেসেজগুলো?

কিশোরের কাছে, জবাব দিলো রবিন। ও এখন ঘুমোচ্ছে।

ঘুমোলে চলবে না, জাগতে হবে। ওকে ফোন করে বলো, মেসেজগুলো নিয়ে। যেন এখানে চলে আসে। আমরা সবাই মিলে সমাধান করবো।

বললেই কি আসবে? প্রশ্ন তুললো মারকো।

বন্ধুকে ভালোবাসে ও, তাই না? রবিনের দিকে চেয়ে ভ্রূকুটি করলো লারমার। ওর কোনো ক্ষতি নিশ্চয় চায় না। আমরা বললে খুশি হয়েই মেসেজগুলো নিয়ে হাজির হবে। তুমি কি বলো, ছেলে?

আমি কি করে জানবো? হতাশ হয়েছে রবিন। সে ভেবেছিলো, মেসেজের মানে জেনে না বললে তাদেরকে ছেড়ে দেবে লারমার। ছাড়লো তো না-ই, বরং কিশোরকে আনানোরও মতলব করেছে ব্যাটারা।

আমি জানি, লারমার বললো। সে আসবে। এক কাজ করো, প্রথমে তোমার বাড়িতে ফোন করো। বাবা-মাকে জানিয়ে দাও, জরুরী কাজে আটকা পড়েছে, রাতে বাড়ি ফিরবে না। কিশোরের ওখানে থাকবে। চিন্তা যাতে না করে। তারপর ফোন করো তোমার কোকড়াচুলো বন্ধুকে। আমাদের নির্দেশ জানিয়ে দাও।

ডিংগো, ফোনটা দাও ওকে, মারকো বললো। হাত খুলে দাও।

ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর রাখা যন্ত্রটা তুলে এনে রবিনের কোলে রাখলো ডিংগো। নাও, ধরো।

আমি পারবো না, মরিয়া হয়ে বললো রবিন। কাউকে ফোন করবো না। আমি। যা যা জানি সব বলেছি…এখন…এখন… শুকনো ঠোঁট চাটলো সে। আবার এসব করতে বলছেন!

ডিংগো, ইঙ্গিতে ওয়ার্কবেঞ্চটা দেখালো লারমার। ব্রোল্যাম্পটা জ্বেলে আমার হাতে দাও তো।

কথামতো কাজ করলো ডিংগো।

ব্লোল্যাম্পটা শক্ত করে ধরলো লারমার। হিসহিস শব্দে জ্বলছে উজ্জ্বল হলুদ আগুনের শিখা। ধীরে ধীরে সামনে বাড়ালো ওটা সে। মুখে তাপ লাগছে রবিনের। চোখ বন্ধ করে ফেললো।

কি হলো? রিসিভার তোলো, বললো লারমার।

বাড়িতে নাহয় বললাম, মিনমিন করে বললো রবিন। কিন্তু কিশোরকে ওকে কোথায় পাবো?

হেডকোয়ার্টারে।

বললাম না, ও এখন ঘরে ঘুমোচ্ছ।

তাহলে ঘরেও করবে। আর একটি কথাও নয়। তোলো, রিসিভার ভোলো পাঁচ সেকেণ্ড সময় দিচ্ছি। তারপর প্রথমে চুলে লাগাবো আগুন।

১৬.

কিশোর, মহাবিপদে পড়েছি! টেলিফোনে ভেসে এলো রবিনের কণ্ঠ। তোমার সাহায্য লাগবে!,

হয়েছে কি? উদ্বিগ্ন হলো কিশোর।

মিস্টার লারমার, মারকো আর ডিংগো ধরে নিয়ে এসেছে আমাকে টিমকেও।

কিভাবে কি ঘটেছে, জানালো রবিন। শেষে বললো, মাকে বলে দিয়েছি আজ রাতে তোমার সঙ্গে থাকবো। মিস্টার লারমারের ইচ্ছে, তুমি মেরিচাচীকে বলে আসো, আমার সঙ্গে থাকবে। কেউ কিছু সন্দেহ যেন করতে না পারে। হুমকি দিচ্ছেন, কথামতো কাজ না করলে নাকি খুব খারাপ হবে আমাদের। থামলো এক মুহূর্ত। তবে, মেসেজগুলো যদি আনো, আর কাউকে কিছু না বললো, তাহলে ছেড়ে দেবেন কথা দিয়েছেন। কিশোর, কি ভাবছো? কথা শুনবে? আমার পরামর্শ, শুনে না, পুলিশকে…

চটাস করে চড় পড়লো। আঁউ করে উঠলো রবিন। ভেসে এলো লারমারের কর্কশ কণ্ঠ, শোনো ছেলে, বন্ধুকে বাঁচাতে চাইলে, তার অঙ্গহানী করাতে না চাইলে, যা বলেছি করবে। মেসেজগুলো নিয়ে জাঙ্কইয়ার্ডের গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঠিক আধ ঘন্টা সময় পাবে। ইতিমধ্যে পৌঁছে যাবে আমার ভ্যান। তুলে আনবে তোমাকে। খবরদার, কাউকে কিছু বলতে পারবে না। বুঝেছো? কথা না শুনলে প্রথমে তোমার বন্ধুর দুটো কাটা আঙুল উপহার পাবে, তারপর একটা কান, তারপর…

ঠিক আছে, মিস্টার লারমার, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। আমি আসছি। গেটে দাঁড়িয়ে থাকবো। গাড়ি পাঠান।

এই তো বুদ্ধিমান ছেলে। কিশোরের মনে হলো আনন্দে ঘোৎ ঘোঁৎ করলো একটা শুয়োর। লাইন কেটে দিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার। মুসাকে ডাকবে? না; থাক। অযথা তাকে এসবে জড়িয়ে লাভ নেই। লারমারকে ঠিক বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কি করবে, বোঝার উপায় নেই। হয়তো মিথ্যে হুমকি দেয়নি। মেসেজগুলো চাইছে। দিয়ে দিলেই যদি ঝামেলা চুকে যায়, দেয়াই উচিত। মানে তো জানা-ই হয়ে গেছে দুটোর।

তিনটে মেসেজই-ছেঁড়াটা সহ-গুছিয়ে শার্টের পকেটে নিলো কিশোর। ট্র্যাপড়োরের দিকে এগোতে গিয়ে আবার থামলো। সাবধান হতে দোষ কি? ফিরে এসে একটা কাগজে নোট লিখলোঃ ঘড়ির ঘরে খোঁজ করো আমাদেরকে। তার স্থির বিশ্বাস, ওর ঘরেই রয়েছে সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি; কাগজটা পেপার ওয়েইট চাপা দিয়ে এসে নামলো দুই সুড়ঙ্গে।

হামাগুড়ি দিয়ে পাইপ বেয়ে চলে এলো মুখের কাছে। মুখ বের করে দেখলো আশপাশটা। কারও থাকার কথা নয় এখন এখানে, তবু দেখলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হুঁশিয়ার করছে, তাকে। পাইপ থেকে বেরিয়ে হেঁটে গেল সবুজ ফটক এক-এর দিকে।

সবে পৌঁছেছে, খুলবে, এই সময় ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো একটা ছায়ামূর্তি। জঞ্জালের সাথে মিশে ছিলো।

পাঁই করে ঘুরেই সুড়ঙ্গের দিকে দৌড় দিলো কিশোর। কিন্তু লোকটার সঙ্গে পারলো না। ছুটে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরলো তাকে। মুখ চেপে ধরলো কঠিন থাবা, যেন লোহার সাঁড়াশি। কানের কাছে কথা বললো হাসি হাসি একটা কণ্ঠ, তারপর? আবার আমাদের দেখা হলো। এবং এইবার আমিই জিতবো।

কথায় ফরাসী টান। চিনতে পারলো কিশোর। শোঁপা! ইউরোপের কুখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল আর্ট থিফ। আরেকবার ওর সঙ্গে প্রতিযোগিতা হয়েছিলো তিন গোয়েন্দার, ওকে ভুলবে না কিশোর। তাকে আর মুসাকে আটকে ছিলো ভয়াবহ গোরস্থানে, প্রচণ্ড কুয়াশার মধ্যে, মনে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

তাহলে আবার বললো শোঁপা, চিনতে পেরেছে। সেবারেই বুঝেছো, বেশি। চালাকি পছন্দ করি না আমি। কিছুক্ষণের জন্যে ছাড়তে পারি এখন, কথা বলবো। চেঁচাতে পারবে না। চেঁচালে নিজেই ক্ষতি করবে। বিশ্বাস করো কথাটা।

বিশ্বাস করলো কিশোর। কোনোমতে মাথা ঝাঁকালো।

মুখ থেকে হাত সরালো শোঁপা। তারা, আর দূর থেকে আসা ইলেকট্রিক বাল্বের আবছা আলোয় লোকটার মুখের আদল দেখতে পেলো কিশোর। হাসিটাও চেনা পেল।

খুব অবাক হয়েছে না? শোঁপা বললো। কেন, একবারও মনে পড়েনি আমার কথা? এক মিলিয়ন ডলারের চোরাই ছবি, অথচ শোঁপা তার কাছে থাকবে না, এটা কোনো কথা হলো?

চোরাই ছবি? চমকে গেল কিশোর। সেটাই খুঁজছেন নাকি?

কেন, তুমি জানো না? কণ্ঠেই প্রকাশ পেয়ে গেল, বিস্মিত হয়েছে শোঁপা। পাঁচটা চমৎকার ছবি, দশ লাখ ডলার দাম, বছর দুই আগে চুরি গিয়ে এখনও নখোঁজ হয়ে আছে। সেগুলো খুঁজতেই এসেছি আমি। তুমি নিশ্চয় জানো, না। জানার ভান করছে। নইলে কিসের তদন্ত করছো কদিন ধরে?

মিথ্যে বলবো না, একটা চেঁচানো ঘড়ির রহস্য ভেদের চেষ্টা করছি। কিছু সূত্র হাতে এসেছে। বুঝতে পারছিলাম, মূল্যবান কোনো জিনিসের সাথে এর সম্পর্ক আছে। কি জিনিস, জানতাম না।

ঘড়ি? হ্যাঁ, জিনিসটা আমাকে অবাক করেছে। টুকরো টুকরো করে…

আপনি চুরি করেছেন? কাল আপনিই রবিন আর টিমকে তাড়া করেছিলেন?

আমিই করেছি। তোমাদের পেছনেও লোক লাগিয়েছিলাম, কিন্তু গাধাগুলো লেগে থাকতে পারলো না, হারিয়ে ফেললো। গাড়ি রেখে তোমার বন্ধুরা থানার ভেতরে ঢুকলো। এই সুযোগে নিয়ে গেছি ঘড়িটা। সমস্ত যন্ত্রপাতি খুলে ফেলেছি। কোনো সূত্র পেলাম না। আমি ভেবেছি, খোদাই করে কোথাও কিছু লেখা আছে। তুমি নিশ্চয় কিছু পেয়েছো। তোমার যা ব্রেন আর চোখ, নজর এড়াতেই পারে না। কি পেয়েছো?

আপনাকে কেন বলবো? জানেন, আমি চেঁচালে এখুনি ছুটে আসবে বোরিস আর রোভার। ওদের একজনের সঙ্গেই পারবেন না আপনি। ধরে থানায় নিয়ে যাওয়াটা কোনো ব্যাপারই না।

শব্দ করে হাসলো শোঁপা। ভালো, খুব ভালো। তোমার মতো সাহসী ছেলেদের পছন্দ করি আমি। কিন্তু তুমিই বা কি করে ভাবলে, আমি একা এসেছি? ইচ্ছে করলে আমিও তোমাকে…যাকগে, হুমকি দিয়ে লাভ নেই। আমি তোমাকে একটা অফার দিচ্ছি, বিনিময়ে কিছু চাইবো। আমি তোমাকে সাহায্য করবো, তুমিও আমাকে করবে।

আমাকে কি সাহায্য করবেন?

ক্লকের বাড়ির যে ছেলেটার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হয়েছে, টিমের কথা বলছি। ওর বাবা জেলে। তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সাহায্য করবো তোমাকে। আমি ছবিগুলো নিয়ে যাবো, তুমি মানুষটাকে জেল থেকে বের করে আনবে। নাকি, রাজি নও??

দ্রুত ভাবছে কিশোর। মাথা আঁকালো। বেশ, করবো। যদি আপনি কথা রাখেন। আরও একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।

কী?

সব কথা খুলে বললো কিশোর। রবিন আর টিম এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে, আধ ঘন্টার মধ্যে ভ্যান আসবে ইয়ার্ডের গেটে তাকে তুলে নেয়ার জন্যে, নিয়ে যাবে লারমার, মারকো আর ডিংগো যেখানে দুই কিশোরকে আটকে রেখেছে, সেখানে।

ফরাসী ভাষায় কি যেন বললো- শোঁপা। ইংরেজিতে বললো, ওই গাধাগুলো! এতোখানি এগিয়ে যাবে, ভাবিনি। ভেবেছিলাম, ওরা কিছু বোঝার আগেই ছবিগুলো বের করে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবো।

ওদের কথাও জানেন আপনি? অবাক হয়ে বললো কিশোর।

জানি না মানে! শুনলে অবাক হবে, আরও অনেক কিছু জানি আমি। দুসপ্তা ধরে আছি এই শহরে, সূত্র খুঁজছি। তদন্তের নিজস্ব কায়দা আছে আমার। এখানকার অনেক চোর-ডাকাত আর অপরাধীর টেলিফোন লাইন টেপ করে রেখেছি আমি, ওদের গোপন আলোচনা শুনি। ঠিক আছে, তোমার বন্ধুদের মুক্তিরও ব্যবস্থা করবো। ছবিগুলো বের করে নিয়ে চলে যাবো আজ রাতেই। কাল এ-সময়ে থাকবো পাঁচ হাজার মাইল দূরে। হ্যাঁ, ওরা যেভাবে বলেছে, সেভাবেই কাজ করে যাও। গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। গাড়ি এসে যেখানে নিয়ে যায়, যাও. লোকজন নিয়ে তোমাদের পেছনেই থাকবো আমি। কিচ্ছু ভেবো না, যা করার আমিই করবো!

কি করবেন?

সেটা তোমার জানার দরকার নেই।

শোঁপাকে বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। সবুজ ফটক এক দিয়ে বেরিয়ে ঘরের দিকে চললো কিশোর। চেঁচানো ঘড়ির ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে বলে নিজেকেই গাল দিচ্ছে এখন। রবিন আর টিমকে মুক্ত করতে পারবে তো ফরাসীটা? পারবে, আশা করলো সে।

বসার ঘরে ঢুকে দেখলো, চাচা-চাচী তখনও টেলিভিশন দেখছেন। বললো, রবিন ফোন করেছে। রাতটা ওদের বাড়িতেই কাটাবে। এরকম মাঝে মাঝেই গিয়ে থাকে কিশোর। অমত করলেন না রাশেদ পাশা। মেরিচাচীও কিছু বললেন না। অনুমতি নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো সে। গরম জ্যাকেট পড়লো।

আবার নিচতলায় নেমে, চাচা-চাচীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরোলো কিশোর। গেটের দিকে এগোলো।

ওখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছে শোঁপা। এগিয়ে এসে কিশোরের কাঁধে হাত রেখে বললো, একটুও চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। গাড়ি এলে। সোজা উঠে পড়বে। ওদের যাতে কোনো সন্দেহ না হয়। বুঝেছো? 

বলে আর দাঁড়ালো না শোঁপা। ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো। মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। গাড়িটা কোথায়, দেখতে পেলো না কিশোর। ইয়ার্ডের আরেক পাশে হয়তো লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। অন্ধকার খুব বেশি। আর নীরব। কেঁপে উঠলো একবার সে, ঠাণ্ডায় নয়।

হেডলাইট দেখা গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটা ছোট ভ্যান। কিশোরের পাশে এসে দাঁড়ালো। ঝটকা দিয়ে খুললো দরজা। মুখ বের করলো। ডিংগো।

আছো, খসখসে কণ্ঠস্বর। এসো, ওঠো।

.

১৭.

হলিউডের দিকে চলেছে গাড়ি। চালাচ্ছে মারকো। ডিংগো আর মারকোর মাঝে গাদাগাদি করে বসেছে কিশোর।

মেসেজগুলো নিয়েছে তো? একসময় জিজ্ঞেস করলো মারকো।

নিয়েছি, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলো কিশোর।

 গুড, বললো ডিংগো। আরি, মারকো?

রীয়ার-ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে আছে মারকো। দেখেছ, মনে হয় ফলো কুরছে।

ফলো! চেঁচিয়ে উঠলো ডিংগো। খপ করে চেপে ধরলো কিশোরের হাত। এই ছেলে, পুলিশকে…

না, স্যার, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। আতঙ্কিত। সবটা অভিনয় নয়। শোঁপার গাড়িটা দেখে ফেলেছে ওরা। সত্যি সত্যি বিপদ হতে পারে এবার।

পুলিশ নয়? কঠিন কণ্ঠে বললো মারকো। তাহলে কে? কি হলো, কথা বলছো না কেন? কে?

আমি কি করে জানবো? পুলিশকে বলিনি। কাউকেই জানাইনি আমি।

কে তাহলে?

মেসেজের কথা জানে এমন কেউ হতে পারে। কাল ঘড়িটা চুরি হয়ে গেছে, টিমের গাড়ি থেকে। আমরা তো ভেবেছি আপনারা নিয়েছেন।

আমরা নিইনি।

তাহলে ওই লোকটাই নিয়েছে, বুড়ো আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করলো কিশোর। আমার ওপর চোখ রেখেছিলো হয়তো। এখন পিছে পিছে আসছে। কোথায় যাচ্ছি দেখতে চায়।

হ্যাঁ, তা হতে পারে, মাথা দোলালো ডিংগো। ঘড়ি খোয়া যাওয়ার কথা লারমারকে বলেছে টিম। তার মানে মিথ্যে বলেনি। মালের পেছনে আরও লোক লেগেছে। মারকো, জলদি খসাও।

খসাচ্ছি। দেখি কততক্ষণ লেগে থাকতে পারে।

আরও মিনিট দুই একই গতিতে গাড়ি চালালো মারকো। ফ্রীওয়ের কাছে এসে, হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিলো, পলকে ফ্রীওয়েতে উঠে ঢুকে গেল গাড়ির ভিড়ে। দেখতে দেখতে চলে এলো অনেকগুলো গাড়ির মাঝামাঝি। তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে গাড়িগুলো, হলিউডের দিকে।

লস অ্যাঞ্জেলেস আর হলিউডের মাঝে বিছিয়ে রয়েছে যেন ফ্রীওয়ের জাল, নানাদিক থেকে বেরিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা মিশেছে অসংখ্য পথ, আশপাশের সমস্ত এলাকার সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের যোগাযোগ রক্ষা করেছে। সারাটা দিন আর রাতেরও বেশির ভাগ সময় অগুণতি গাড়ি চলাচল করে ওসব পথে। রাতের এই সময়েও সিক্স লেন হাইওয়ের একটা লেন ফাঁকা নেই। নানারকম গাড়ি আর ট্রাক ছুটে চলেছে ভীষণ গতিতে।

অ্যাক্সেলারেটরে পায়ের চাপ বাড়িয়ে পাশে সরতে শুরু করলো মারকো, গাড়ির ভিড় থেকে বের করে আনতে চায় ভ্যান। মিনিট দুয়েক পর পেছনের গাড়িটা আর দেখা গেল না, হারিয়ে গেছে বোধহয় বড় বড় কয়েকটা ট্রাকের পেছনে। সন্তুষ্ট হতে পারলো না মারকো। আরও দশ মিনিট ধরে কয়েকবার করে গাড়ির ভিড়ে ঢুকলো আর বেরোলো। শেষে আউটার লেনে বেরিয়ে শা করে মোড় নিয়ে নেমে এলো একটা একব্জিট র‍্যাম্প-এ-হাইওয়ে থেকে বেরোনোর মুখ।

নিচের সিটি স্ট্রীটে নেমে গতি কমালো মারকো। তাকালো রীয়ার-ভিউ মিররের দিকে। এতোক্ষণে সন্তুষ্ট হলো। নেই।

স্বাভাবিক গতিতে চলছে এখন ভ্যান। মনে মনে দমে গেছে কিশোর। শোঁপার ওপর ভরসা করেছিলো সে। কিন্তু মারকোর সাথে পারেনি শোঁপার ড্রাইভার, সাহায্যের আশাও শেষ।

কিছুক্ষণ পর দুটো বাড়ির মাঝের গলিপথে ঢুকলো ভ্যান। মোড় নিয়ে ঢুকলো। একটা ড্রাইভওয়েতে। বড় একটা গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়ালো। একবার হর্ন বাজালো মারকো। মুহূর্ত পরেই গ্যারেজের একটা দরজা উঠে গেল। ভ্যান ভেতরে ঢুকতেই নেমে গেল আবার।

একপাশের দরজা খুলে মারকো নামলো। আরেক পাশেরটা খুলে কিশোরকে নিয়ে নামলো ডিংগো।

লারমারকে দেখতে পেলো কিশোর। তার পেছনে বসে আছে রবিন আর টিম, চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা।

কোনো অসুবিধে হয়েছিলো? জিজ্ঞেস করলো লারমার। দেরি করে ফেলেছো।

একটা গাড়ি পিছু নিয়েছিলো, মারকো জানালো। ওটাকে খসাতে সময় লাগলো। ছেলেটা বলছে পুলিশ নয়। ঘড়ি-চোরটা হতে পারে। কাল টিমের বাড়ি থেকে নাকি নিয়ে গিয়েছিলো।

আসেনি, ভালোমতো দেখেছো তো?

মাথা ঝাঁকালো মারকো।

গুড। কড়া চোখে কিশোরের দিকে তাকালো লারমার। কোনো চালাকি টালাকি করলে বুঝবে মজা। তো, মেসেজগুলো এনেছো তো? হাত বাড়ালো। দেখি?

পকেট হাতড়ে একটা কাগজ বের করলো কিশোর। এই যে, মিস্টার লারমার, পয়লা মেসেজটা।

হাতে নিয়ে পড়লো লারমার। কিশোরের লেখা কাগজঃ আই সাজেস্ট ইউ সী দা বুক। হ্যাঁ, তোমার বন্ধু বলেছে-এটার কথা। কি বই?

জানি না।

দ্বিতীয় মেসেজে কিছু বলেনি?

 এই যে, স্যার, নিয়ে এসেছি। নিজের চোখেই দেখুন।

 ওনলি আ রুম হোয়্যার ফাদার টাইম হামস! মানে কি?

বোধহয় মিস্টার ক্লকের ঘড়ি-ঘরের কথা বলেছে। সেখানে অসংখ্য ঘড়ি, সারাক্ষণ গুঞ্জন করছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। তা-ই বুঝিয়েছে। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি ঘরটা, কিছুই পাইনি। দেখি, তৃতীয় মেসেজের অর্ধেকটা আছে আমার কাছে, পকেট থেকে ছেঁড়া কাগজটা বের করলো লারমার।

কিশোরও পকেটে হাত ঢোকালো।

এই সময় ঘটলো ঘটনা। ঝনঝন করে ভাঙলো দুপাশের জানালার কাঁচ। ঝটকা দিয়ে পাল্লা খুলে গেল। পর মুহূর্তেই হ্যাঁচকা টানে পর্দা সরলো। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন নীল পোশাক পরা লোক, হাতে অটোমেটিক পিস্তল।

হাত তোলো! লারমার, মারকো আর ডিংগোকে আদেশ দিলো একজন পুলিশ। কুইক!

পুলিশ! চেঁচিয়ে উঠলো ডিংগো।

 বিড়বিড় করে স্প্যানিশ ভাষায় কি বললো মারকো, বোঝা গেল না।

চুপ! ধমকে উঠলো আরেকজন পুলিশ। জলদি হাত তোলো। পালাতে পারবে না। যা বলছি করো।

ধীরে ধীরে হাত তুললো ডিংগো আর মারকো। লারমার পিছিয়ে গেল ওয়ার্কবেঞ্চের কাছে। মনে হলো, কিছু একটা অস্ত্র খুঁজছে।

কিন্তু পুলিশের নজর আছে ওর ওপর। চিৎকার করে উঠলো প্রথম লোকটা, এই, কি করছো? হাত তুলতে বললাম না?…আরে, পুড়ছে কী!

মেসেজগুলো পুড়ছে! চেঁচিয়ে বললো কিশোর।

বেঞ্চের ওপর ব্রোল্যাম্পটা জ্বলছে, তার শিখাতেই কাগজগুলো পোড়াচ্ছে লারমার। দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল ওগুলো।

নাও, করো এবার সমাধান, দাঁত বের করে হাসলো লারমার।

প্রথম দুটো মনে আছে আমার, পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললো কিশোর। কিন্তু তিন নম্বরটা…, হাত ওল্টালো সে। নাহ, ক্লক কি বোঝাতে চেয়েছে, জানবো না!

কেন, মগজ খাটাও, হেসে উঠলো লারমার। ডিংগো আর মারকোর দিকে চেয়ে হাসি মুছে গেল। গাধা কোথাকার! হিসিয়ে উঠলো সে। খসিয়ে দিয়ে না এসেছিলে! এই বিচ্ছু ছেলেটা টেক্কা মেরে দিলো তোমাদের ওপর। পুলিশকে ঠিকই খবর দিয়ে এসেছে। আর তোমরা… রাগে বাক্যটা শেষ করতে পারলো না সে, দাঁতে দাঁত চাপলো।

বিশ্বাস করুন, পুলিশকে কিচ্ছু বলিনি আমি, লারমারের মতোই অবাক হয়েছে কিশোরও। কি করে ঘটলো এটা, বুঝতে পারছে না।

পিস্তল ধরে রাখো, মিক, একজন পুলিশ আরেকজনকে বলে সরে গেল জানালার কাছ থেকে। ঘুরে গিয়ে তুলে দিলো গ্যারেজের দরজা। ঘরে ঢুকলো, ততীয় আরেকজন। পেছনে আবার নামিয়ে দেয়া হলো দরজা।

ছায়া থেকে আলোয় এসে দাঁড়ালো লোকটা। হাসি হাসি মুখ। বললো, বাহ, চমৎকার। সব কিছু কন্ট্রোলে এসে গেছে।

কপাল কুঁচকে ফেললো কিশোর। কোনোমতে শুধু বললো, মিস্টার শোঁপা! বুঝতে পারছে না, পুলিশের সঙ্গে চোরের খাতির হৃলো কিভাবে।

.

১৮.

হ্যাঁ, আমি, বললো শোঁপা। বিখ্যাত আর্ট থিফ, তিন মহাদেশের পুলিশ যার জ্বালায় অস্থির। লারমারের দিকে তাকালো। কি করে ভাবলে, তোমাদের মতো তিনটে শুয়োপোকা আমাকে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাবে?

মনে হলো, লারমারও শোঁপার নাম শুনেছে। কালো হয়ে গেছে মুখ, চোখে অস্বস্তি। দুই সহকারীর মতোই নীরব। কিছু করার নেই। পরিস্থিতি আয়ত্তের। বাইরে চলে গেছে।

কিন্তু…কিন্তু… বুঝতে পারছে না কিশোর। আপনাকে খসিয়ে দিয়েছিলো ওরা। আমি নিজেও দেখেছি, আপনার গাড়িটা দেখা যায়নি। চিনে এলেন কি করে?

যে পেশায় আছি, সাবধান তো হতেই হয় আমাকে, তাই না, হালকা গলায় বললো শোঁপা। এগিয়ে এসে কিশোরের জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘোট, চ্যাপ্টা একটা জিনিস বের করলো। এটা ইলেকট্রনিক সিগন্যালিং ডিভাইস। ইয়ার্ডে তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় এক ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। আমার গাড়িতে রেডিও রিসিভার আছে। তোমার পকেটে যন্ত্রটা একনাগাড়ে সঙ্কেত দিয়ে, যাচ্ছিলো। কাজেই, ফ্রীওয়েতে গাড়ি দেখে অনুসরণ করতে হয়নি আমাকে। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম কখন কোন দিকে যাচ্ছে ভ্যান। তোমরা গ্যারেজে ঢোকার কয়েক মিনিট পরেই চলে এলাম আমরাও। তারপর আর কি? আমার দুজন সহকারীকে পাঠালাম কাজ শেষ করতে।

মিস্টার শোঁপা! কথা বললো রবিন। চেয়ারে বাধা, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। রয়েছে লোকটার দিকে। কাল আপনিই আমাদের গাড়ির পিছু নিয়েছিলেন, না? ঘড়ি চুরি করেছেন।

বাউয়ের কায়দায় মাথা নোয়ালো শোঁপা। সরি, বয়, আমিই। তবে তোমাদের কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে ছিলো না। বরং সাহায্যই করতে চেয়েছি, যাতে কাজে আরও তাড়াতাড়ি সফল হও। সে যাক, সময় খুব কম। নইলে আরও কথা বলতাম তোমাদের সঙ্গে, ভালোই লাগছে। হাজার হোক, পুরনো বন্ধু, হাসলো সে। সহকারীদের দিকে চেয়ে বললো, দাঁড়িয়ে আছো কেন? হাতকড়া লাগাও।

গ্যারেজের মাঝখানে ইস্পাতের একটা খুঁটি বসানো রয়েছে, ছাতের ভার রাখার জন্যে। পিস্তলের মুখে তিন চোরকে ওই খুঁটির কাছে নিয়ে গেল দুই পুলিশ। তিনজনকে মুখোমুখি দাঁড় করালো। তিন জোড়া হাতকড়া দিয়ে একজনের ডান হাতের সঙ্গে আরেকজনের বা হাত বেঁধে দিলো। খুঁটিটাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে পারবে ওরা এখন। বসতে পারবে, দাঁড়াতেও পারবে, কিন্তু যেতে পারবে না কোথাও।

বাহ, ভালো বুদ্ধি করেছে, প্রশংসা করলো শ্রোপা। এবার যাওয়া দরকার। কাজ পড়ে আছে।

এক মিনিট, শোঁপা, লারমার বললো। এক সাথে কাজ করলেও তো পারি, আমরা। সুবিধে হয় তাহলে। জিনিসগুলো তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করতে পারবো। কি বলো?

কি সুবিধে হবে? লারমারের কথায় গুরুত্বই দিলো না শোঁপা। তোমরা যতোখানি জানো, আমিও জানি। আমাকে ফাঁকি দিয়ে একাই মেরে দিতে। চেয়েছিলে। মারো এখন। তোমাদের সাথে কাজ করার কোনো দরকারই এখন। আমার নেই। দেখতেই পাচ্ছো, পুলিশ আমার সঙ্গে রয়েছে। নীল পোশাক পরা। দুজনকে বললো, ছেলেগুলোকে খোলো। হ্যারি ক্লকের বাড়িতে যেতে হবে: আবার।

 কিছুক্ষণ পর গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এলো তিনজন লোক, আর তিন। কিশোর। কালো একটা সেডান গাড়িতে চড়ে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চললো হলিউডের রাস্তা ধরে।

আপনমনেই হাসলো শোঁপা।

কি ভাবছো? পাশে বসা কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো সে। নিশ্চয় আশা ছেড়ে দিয়েছিলে। আমার গাড়িটা হারিয়ে যেতে দেখে।

হ্যাঁ, তা দিয়েছিলাম, স্বীকার করলো কিশোর। চমকে গিয়েছিলাম জানালায়। পুলিশ দেখে। সত্যি বলবো? অসমাপ্ত কাজ পছন্দ নয় আমার। সব শেষ করে গিয়ে পুলিশ ডাকার আলাদা মজা…

জোরে হেসে উঠলো শোঁপা। পুলিশ, না? ভেবো না, তোমার মজা নষ্ট হয়নি। ওরা পুলিশ নয়। পুলিশের পোশাক পরে আছে। পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে ওরকম ইউনিফর্ম সহজেই জোগাড় করা যায় আজকাল সেই যে প্রবাদ। আছে নাঃ বাইরের চেহারা দেখে ভুলো না। হাহ্ হাহ্ হা!

ঢোক গিললো কিশোর। তেতো হয়ে গেল মন। তাকে কেউ বোকা বানিয়ে আনন্দ পাক, এটা সহ্য করতে পারে না সে। শোঁপার প্রতি তার বিদ্বেষ বাড়লো।

টিম, গায়ের সঙ্গে চেপে বসা টিমকে বললো কিশোর। মিস্টার শোঁপার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে আমার। তোমাকে আর রবিনকে মুক্ত করবেন। তার কথা তিনি রেখেছেন। আরও একটা কাজ করার কথা দিয়েছেন তিনি, তোমার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন।

করবেন? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো টিম। ইস্, কি ভালোই না হতো!

ভেবো না, শোঁপা বললো, হয়ে যাবে। আমি যখন হাত দিয়েছি…শোঁপার জন্যে কঠিন কিছুই নেই। হ্যাঁ, কিছু কথা তোমাদের জানানো দরকার। কিশোর, নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছো, হ্যারি কুক ভালো লোক ছিলো না। বাইরে অভিনেতার খোলস, আসলে ছিলো চোরের সর্দার। দামী দামী ছবি চুরি করে সেগুলো ধনী ক্রেতার কাছে বিক্রি করা ছিলো তার দলের কাজ।

হুঁ, সে-জন্যেই, বলে উঠলো রবিন, নাম পাল্টে রহস্যময় আচরণ করতো ক্লক। চোর ছিলো, বলেই। চুরি করে এনে রান্নাঘরে ছবিগুলো তাহলে সে-ই লুকিয়েছিলো।

চুরি হয়তো সে করেনি, অন্য কেউ করে এনে তার হাতে দিয়েছে। অনেক সহকারী ছিলো তার। ডিংগো তাদের একজন। আগে জকি ছিলো। জকি মানে, জানো তো? রেসের ঘোড়ার পেশাদার ঘোড়সওয়ার। ডিংগোর আরও সহকর্মী ছিলো। সব কজন অসৎ। ফলে মাঠ থেকে বের করে দেয়া হলো ওদেরকে। ছোট হালকা শরীর, জানালা দিয়ে সহজেই ঢুকতে পারে। তাই ওদেরকে বেছে নিলো ক্লক। ছবি চুরি করে এনে ক্লকের কাছে দিতো ওরা। ক্লক সেগুলো নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতো ধনী দক্ষিণ আমেরিকানদের কাছে। যাদের কাছে বেচতো, তারাও লোক সুবিধের না।

বছর দুই আগে কয়েকটা ছবি চুরি করার পর বেশি গোলমাল শুরু করলো পুলিশ। ওগুলো পাচার করার সুযোগ পেলো না ক্লক। যার কাছে বিক্রি করার কথা, ছিলো, সেই লোকটা জড়িয়ে পড়লো রাজনৈতিক গণ্ডগোলে, ধরে তাকে জেলে। ভরে দিলো তার দেশের সরকার। ছবিগুলো লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হলো ক্লক। ইচ্ছে ছিলো, সময় সুযোগমতো পরে কারো কাছে বিক্রি করবে। ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে আসবে পরিস্থিতি।

ডিংগো আর মারকোর টাকা দরকার। কয়েক দিন পর আরও তিনটে ছবি চুরি করে আনলো ওরা। আগেরগুলোই বিক্রি করতে পারেনি ক্লক, আরও তিনটে নিয়ে কি করবে? কিন্তু সে-কথা শুনতে চাইলো না দুই চোর। ওরা চাপাচাপি শুরু করলো টাকার জন্যে। ক্লককে বললো, টাকা দিতে না পারলে ছবিগুলো ফেরত দিয়ে দিক। আগের পাঁচটা ছবি লুকিয়ে ফেলেছে ক্লক, বের করতে চাইলো না। দশ লাখ ডলারের মাল, কে হাতে পেয়ে ফেরত দিতে চায়?

একটা রফা হয়তো হয়ে যেতো, কিন্তু কাকতালীয় একটা ব্যাপার ভণ্ডুল করে দিলো ক্লকের সমস্ত পরিকল্পনা। পুলিশের চোখ পড়লো টিমের বাবার ওপর। শেষ তিনটে ছবি চুরির ব্যাপারে তাকে সন্দেহ করে বসলো ওরা। এটা বুঝতে পেরে এক চাল চাললো ক্লক। ছবিগুলো লুকিয়ে রাখলো রান্নাঘরে। যাতে ওগুলো খুঁজে পায় পুলিশ, দোষ চাপে গিয়ে বেকার ডেলটনের ঘাড়ে।

আ-আমার বাবাকে ফাঁসিয়েছে! ক্লঅক! তিক্ত কণ্ঠে বললো টিম, বিশ্বাস করতে পারছে না। অথচ আমি আর মা ভাবতাম কতো ভালো মানুষ!

এই দুনিয়ায় লোক চেনা মুশকিল! হ্যাঁ, তোমার বাবাকে ক্লকই ফাঁসিয়েছে। এর কিছুদিন পরই রহস্যজনক ভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আমার বিশ্বাস, টাকার জন্যে চাপ দিচ্ছিলো ডিংগো, মারকো আর লারমার। দিতে পারেনি বলেই পালিয়েছিলো ক্লক। দক্ষিণ আমেরিকাতে লুকিয়েছিলো। পুলিশ আর সহকারীদের চোখে ধুলো দিলেও আমাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। দুনিয়ার সব জায়গায় লোক আছে আমার।

যোগাযোগ করলাম ওর সাথে। চুক্তিতে আসতে চাইলাম। ঘঘাড়েল লোক, কিছুতেই রাজি হলো না। রাগ করে চলে এলাম। নিজেই খুঁজে বের করার চেষ্টা, করলাম ছবিগুলো। কিছু দিন পর অসুখে পড়লো ক্লক। ডাক্তার বলে দিলো, বাঁচবে না। লোকের মুখে শুনলাম, টিমের বাবার জন্যে অনুতপ্ত সে। তাদের জন্যে কিছু করতে চায়। অদ্ভুত কতগুলো মেসেজ লিখে কয়েকজন বন্ধুর কাছে পাঠালো। সেই সাথে একটা আজব চেঁচানো ঘড়ি। এর কিছু দিন পর মারা গেল সে।

 ঘড়ি আর মেসেজগুলো কেন পাঠালো, জানেন? রবিন জিজ্ঞেস করলো। তার চেয়ে পুলিশের কাছে একটা চিঠি লিখে সব বলে দিলেই কি ভালো হতো না? নির্দোষ জানলে টিমের বাবাকে ছেড়ে দিতে পুলিশ, হয়তো বিনা দোষে জেলে পাঠানোর জন্যে ক্ষতিপূরণও দিতো।

 আসলে ক্লক লোকটাই ছিলো জটিল। সহজ কাজ সহজভাবে না করে খালি প্যাঁচের মধ্যে যেতো। তবে কেন করেছে, তারও নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। সবগুলো মেসেজের সমাধান হলেই বুঝতে পারবো।

মেসেজ তো পুড়িয়ে ফেলেছে, মনে করিয়ে দিলো কিশোর। মানে আর বের করবেন কিভাবে?

কেন, মনে নেই? একবার পড়লেই তো সব মনে থাকে তোমার, উৎকণ্ঠা। চাপা দিতে পারলো না শোঁপা, প্রকাশ পেয়ে গেল কণ্ঠস্বরে।

প্রথম দুটো মনে আছে, কিন্তু তৃতীয়টার মানেই বের করতে পারিনি। অর্ধেকটা আমার কাছে, বাকি অর্ধেক লারমারের…প্রথম মেসেজটাতে লিখেছেঃ আই সাজেস্ট ইউ সী দা বুক। দ্বিতীয়টাতেঃ ওনলি আ রুম হোয়্যার ফাদার টাইম হামস।

বই? কিসের বই? ঘড়ি কোন ঘরে গুঞ্জন করে, সেটা বোঝা সহজ। জানি আমরা। আমার মনে হয়, ওই ঘরটায় গেলেই সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে।

মোড়ের কাছে গাড়ি রাখতে বললো শোঁপা।

নেমে সবাই হেঁটে চললো ক্লকের বাড়ির দিকে। ওদেরকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এসে মায়ের খোঁজে চললো টিম। মাআ! মাআ! বলে ডাকলো।

ভাঁড়ার ঘর থেকে শব্দ শোনা গেল। দরজায় জোরে জোরে কিল মারছে।

দরজার বাইরের হুড়কো খুলে দিলো, টিম। সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা খুলে বেরিয়ে এলো তার মা। তুই এসেছিস, টিম! ওই শয়তান লারমার আর সঙ্গীরা! আটকে ফেললো ভাঁড়ারে.. .আরে, পুলিশ নিয়ে এসেছিস দেখি। ভালোই হয়েছে। এখুনি ব্যাটাদের অ্যারেস্ট করতে বল।

ওদের ব্যবস্থা হয়েছে, ম্যাডাম, টিমের মায়ের সামনে এসে ফরাসী কায়দায় বাউ করলো শোঁপা। আপনাদের ভালো চাই।

মা, ইনি মিস্টার শোঁপা। বলছেন, বাবা নাকি নির্দোষ।

 তাই নাকি? ইনি জানেন আমার স্বামী নিরপরাধ?

জানি, ম্যাডাম। তবে সেটা পুলিশের কাছে প্রমাণ করতে হরে। আর সেই প্রমাণ রয়েছে মিস্টার ক্লকের ঘরে। ও, ক্লক কে জানেন না বোধহয়। রোজার, জেমস রোজার। তার আরেক নাম হ্যারিসন ক্লক। লাইব্রেরির কিছু জিনিস নষ্ট করতে হতে পারে, সবই আপনাদের ভালোর জন্যে। আপত্তি আছে?

আপত্তি! মোটেই না। তবু টিমের বাবাকে ছাড়িয়ে আনুন।

থ্যাংক ইউ। আপনি এখানেই থাকুন। রবিন, টিম, তোমরাও থাকো। আমরা ঢুকি। শোনো, কারো সাথে যোগাযোগ করবে না। ফোন এলে ধরবে না। ঠিক আছে?

ধরবো না, টিমের মা বললো। ছেলেদের নিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছি আমি। খেয়েছি সেই কখন। খিদেয় পেট জ্বলছে। আপনারা যান, মিস্টার শোঁপা।

মহিলাকে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে কিশোরের দিকে ফিরলো শোঁপা। চলো, পথ দেখাও।

.

ঐদিকে যখন মহা-উত্তেজনা, মুসা ওদিকে ড্রইং রুমে বাবার সঙ্গে বসে টেলিভিশন দেখছে। চোখই শুধু রয়েছে পর্দায়, মন বসাতে পারছে না। হ্যারিসন ব্লক আর তার আজব ঘড়ির কথা ভাবছে।

বাবা, জিজ্ঞেস করলো মুসা, হ্যারিসন ক্লকের নাম শুনেছো? রেডিওতে নাটক করতো। নানারকম চিৎকার করতো আরকি।

হ্যারিসন ক্লক? চিনি। তেমন পরিচয় ছিলো না। গোটা দুই ছবির শুটিং করার সময় দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। চেঁচাতে পারতো! রক্ত ঠাণ্ডা করে দিতো। একেবারে। পুরানো একটা নাটকে এক কাণ্ড করেছিলো সে।

কাণ্ড! আনমনে হাত বাড়িয়ে সামনের টেবিলে রাখা প্লেট থেকে কয়েকটা পোট্যাটো চিপসতুলে মুখে পুরলো মুসা। কি কাণ্ড, বাবা?

অ্যাঁ? মুসার কথায় মন নেই বাবার। ওয়েস্টার্ন ছবি হচ্ছে টিভিতে। কাহিনীতে গতি এসেছে।

আরার একই প্রশ্ন করলো মুসা।

পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে অনেকটা অন্যমনস্ক হয়েই জবাব দিলেন মিস্টার আমান।

চোখ মিটমিট করলো মুসা। তার বাবা এখন যে তথ্যটা জানালেন, নিশ্চয় জানে না কিশোর। মেলাতে পারছে না মুসা, কিন্তু মনে হচ্ছে, কোথায় একটা যোগসূত্র রয়েছে। কিশোর হয়তো বুঝবে। ডাকবে নাকি? বলবে? তথ্য মূল্যবান হলে, কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে তুললেও কিছু মনে করবে না কিশোর।

দ্বিধা করছে মুসা। এই সময় বলে উঠলেন মিস্টার আমান, অনেক রাত হয়েছে। যাও, ঘুমাতে যাও।

যাচ্ছি।

সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই হাই উঠতে আরম্ভ করলো তার। ভাবলো, থাক এখন। সকালে জানালেই হবে কিশোরকে।

.

১৯.

লাইব্রেরিতে ঢুকেই কাজে লাগলো শোঁপা, মুহূর্ত সময় নষ্ট করলো না। দুই সহকারীকে দরজা-জানালার সমস্ত পর্দা টেনে দিতে বলে, নিজে গিয়ে আলো জ্বাললো। চোখ বোলালো সারা ঘরে।

শত শত বই, নিজে নিজেই কথা বলতে লাগলো। তিনটা পেইনটিং, বাজে। বড় একটা আয়না। অনেক ঘড়ি। দেয়ালে কতগুলো খোপ, বহু জিনিস রাখা যাবে। মেসেজে বলেছে, বইয়ে দেখার জন্যে। দ্বিতীয়টাতে বলেছে, ঘড়ির ঘরে খুঁজতে। তৃতীয়টায় বলেছে…কিশোর, দেখি তো তোমার অর্ধেকটা।

বের করে দিলো কিশোর।

নম্বরগুলো দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকে গেল শোঁপার। কোন পাতা, আর কতো নম্বর শব্দ, সেটা বোঝাতে চেয়েছে। বইটা পেলে কয়েক মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু কোন বই? কিশোর, কোন্‌ বইয়ের কথা বলেছে?

বুঝতে পারছি না। বইটা হয়তো এ-ঘরেই আছে।

হুঁ, আমারও তা-ই মনে হয়। এসো না কয়েকটা খুঁজে দেখি।

কাছের তাকটা থেকে তিন-চারটে বই নামিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখলো শোঁপা। তারপর আবার তুলে রেখে দিলো।

না, কিছুই বোঝা যায় না। এতো বই, কটা দেখবো? পুরো মেসেজটা থাকলে…তোমার মাথাটা খাটাও তো কিশোর। পারলে তুমিই পারবে।

নিচের ঠোঁটে জোরে জোরে চিমটি কাটতে আরম্ভ করলো কিশোর।

 মিস্টার শোঁপা… কিছুক্ষণ পর বললো সে।

হ্যাঁ?

মেসেজগুলো হেনরি মিলারের জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। তিনি হয়তো সমাধান করতে পারবেন। অন্তত কোনো সূত্র-টুত্র তো দিতে পারবেনই। নিশ্চয় বইটার নামও জানেন।

ঠিক বলেছো, তুড়ি বাজালো শোঁপা। ফোন করে জিজ্ঞেস করো।

কিন্তু তিনি তো হাসপাতালে।

অ্যাঁ! তাহলে? ঝুলে পড়লো শোঁপার চোয়াল, আর কোনো উপায়?

 তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে পারি। জানতেও পারেন।

যাও। জলদি করো।

রবিনকে দিয়ে বরং করাই। তার সঙ্গে মহিলার পরিচয় আছে, কথা হয়েছে।

মিসেস ডেলটনের সঙ্গে বসে তখন চা খাচ্ছে রবিন আর টিম।

কি হলো, কিশোর? কিছু পেয়েছো? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

নাহ্। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, কি করতে হবে বুঝিয়ে বললো। কিশোর।

হলঘরে গিয়ে ডিরেক্টরি থেকে মিস্টার মিলারের নম্বর বের করে ডায়াল করলো রবিন। ফোন ধরলেন মিসেস মিলার, গলা শুনেই চিনতে পারলো সে। মেসেজের কথা বলে, বইটার কথা জিজ্ঞেস করলো। তিনি কি কিছু বলতে পারবেন?

ওপাশে কয়েক সেকেণ্ড নীরবতা, বোধহয় ভাবছেন মহিলা। তারপর বললেন, একটা বইয়ের নাম খুব মনে পড়ছে। বইয়ের কাহিনী ক্লকের, লিখেছে হেনরি। এতো বেশি আলোচিত হয়েছে, স্পষ্ট মনে আছে নামটা। আ স্ক্রীম অ্যাট মিডনাইট। চলবে?

 নিশ্চয়! টেলিফোনেই চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ! রিসিভার রেখে খবরটা জানালো কিশোরকে।

 চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরেই লাইব্রেরিতে ছুটলো কিশোর। পেছনে দৌড় দিলো শোঁপা। ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।

 বিভিন্ন তাকে মিনিট দুই খোঁজাখুঁজি করে বইটা বের করলো শোঁপা। এই যে, আ স্ক্রীম অ্যাট মিডনাইট, বাই হ্যারিসন ক্লক অ্যাণ্ড হেনরি মিলার। কপাল। খুলছে। মেসেজটা কোথায়? ছেঁড়াটা..হ্যাঁ, দেখি…তিন নম্বর পৃষ্ঠা, সাতাশ নম্বর শব্দ-কাগজ-কলম নাও…

দ্রত পাতা উল্টে তিন নম্বর পৃষ্ঠায় থামলো শোঁপা। শব্দটা লেখো…স্ট্যাণ্ড…তারপর হলো গিয়ে…

একের পর এক শব্দ বলছে শোঁপা, কিশোর লিখে নিচ্ছে।

 শেষ হয়ে গেল মেসেজ। বইটা বন্ধ করে শোঁপা বললো, ব্যস, এইই। পড় তো, কি হয়েছে?

পড়লো কিশোর, স্ট্যাণ্ড ইন দা মিডল অভ দা রুম অ্যাট ওয়ান মিনিট টু মিডনাইট। হ্যাভ টু ডিটেকটিভস অ্যাণ্ড টু রিপোর্টারস উইদ ইউ। হোল্ড হ্যাঁণ্ডস, মেকিং আ সার্কল; অ্যাণ্ড কীপ অ্যাবসলুটলি সাইলেন্ট ফর ওয়ান মিনিট। অ্যাট মিডনাইট এক্সাক্টলি থেমে গেল সে। আর নেই।

ইসসি, আসল জায়গায় ছিঁড়ে ফেলেছে হারামজাদা! ঠিক মাঝরাতে কি ঘটবে? কি ঘটতে পারে? জানার কোনো উপায় নেই! মেসেজ পুড়িয়ে ফেলেছে। ক্লক মৃত। কে বলতে পারবে? জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। অসাধারণ ধূর্ত ছিলো। লোকটা, ক্ষুরধার বুদ্ধি। ঠিক তার মতো করে কে ভাবতে পারবে?…এখন এক কাজ করা যায়। আরও ভালোমতো খুঁজতে হবে এঘরে। দরকার হলে দেয়াল ভেঙে ফেলবো। কিন্তু যদি এঘরে লুকানো না থাকে?

তাহলে আর জানা যাবে না কোনোদিন, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর। হঠাৎ হাত তুললো, মিস্টার শোঁপা, দেয়ালের ওই ছবিগুলো নয় তো! আসল ছবির ওপর নতুন করে আঁকা…

না, এতো সহজের মধ্যে যাবে না ক্লক। তবু, দেখি।

একটা ছবি নামিয়ে প্রথমে খালি চোখে পরীক্ষা করে দেখলো শোঁপা। কিছু বোঝা গেল না। পকেটনাইফ বের করে ক্যানভাসের  এক কোণায় রঙ চেঁছে তুলে ফেললো।

না, একেবারেই বাজে জিনিস, ঠোঁট বাঁকালো সে। বইয়েই খুঁজতে হবে। লুকানো চাবি-টাবিও রেখে যেতে পারে। এক ধার থেকে সব বই দেখবো।

দাঁড়ান! একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়।

 কী?

মেসেজের বাকিটা উদ্ধার করতে পারবো মনে হচ্ছে।

কিভাবে!

বই থেকে শব্দ বাছাই করে মেসেজ তৈরির সময় অনেকেই শব্দের তলায় দাগ দিয়ে রাখে। সুবিধে হয়। মিস্টার ক্লকও ওরকম কিছু করে থাকলে…

আরি, খেয়াল করলাম না তো দাগ আছে কিনা! দেখি আবার? তাড়াতাড়ি আবার বইটা খুলে দেখলো শোঁপা। ঠিক! ঠিকই বলেছো তুমি। দাগ দিয়েছে। পেন্সিলের হালকা দাগ, এতো আবছা, প্রায় চোখে পড়ে না। দেখো।

বইটা হাতে নিয়ে এক এক করে পাতা ওল্টাতে শুরু করলো কিশোর, খুব ধীরে। মনোযোগ দিয়ে দেখছে প্রতিটি পাতার প্রতিটি লাইন। এবার কাগজ-কলম। নিয়েছে শোঁপা। অবশেষে একটা পাতায় থেমে একটা শব্দ বললো কিশোর। লিখে নিলো শোঁপা।

মোটা বই। অপরিসীম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হলো কিশোরকে। দিলো। এসব কাজে কষ্ট করতে তার কোনো আপত্তি থাকে না।

শেষ পাতাটাও ওল্টানো শেষ হলো। আর শব্দ নেই। বই বন্ধ করলো কিশোর।

শেষ, না? শোঁপা বললো। প্রথম থেকে পড়ি। স্ট্যাণ্ড ইন দা মিডল অভ দা রুম অ্যাট ওয়ান মিনিট টু মিডনাইট। হ্যাভ টু ডিটেকটিভস অ্যাণ্ড টু রিপোর্টারস উইদ ইউ। হোল্ড হ্যাঁণ্ডস, মেকিং আ সার্কল, অ্যাণ্ড কীপ অ্যাবসলুটলি সাইলেন্ট ফর ওয়ান মিনিট। অ্যাট মিডনাইট এক্সাক্টলি দা অ্যালার্ম অভ দা স্ক্রীমিং ক্লক হুইচ আই সেন্ট ইউ শুড গো অফ। হ্যাভ ইট সেট অ্যাট ফুল ভলিউম। লেট দা স্ক্রীম কনটিনিউ আনটিল মাই হাইডিং প্লেস ইজ আনকাভারড।

পড়া শেষ করে মুখ তুলে তাকালো শোঁপা। কিছু বুঝলে?

ভুরু কুঁচকে ভাবছিলো কিশোর, দাঁত দিয়ে নখ কাটছে, শোঁপার প্রশ্নে মুখ। তুললো। উঁম?

আবার একই প্রশ্ন করলো শোঁপা, কিছু বুঝলে?

মানে তো সহজ, মুখ থেকে আঙুল সরালো কিশোর। মাঝরাতের এক মিনিট আগে, অর্থাৎ এগারোটা উনষাট মিনিটে ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। দাঁড়ালাম। দুজন গোয়েন্দা আর দুজন সাংবাদিককে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। গোয়েন্দা পাবো, কিন্তু সাংবাদিক আনা সম্ভব না। নাকি?

না, সম্ভব না, মাথা নাড়লো শোঁপা।

তারপর বলছে, হাত ধরাধরি করে একটা চক্র তৈরি করে নীরবে অপেক্ষা। করতে। আসলে নীরবে অপেক্ষা করাটাই আসল কথা, হাত ধরাধরিটা কোন ব্যাপার নয়। ওরা বেশি নাটকীয়তা, নাটকের লোক তো, সেজন্যেই ওরকম করতে বলেছে। না করলেও হয়তো চলবে। বলছে, ঠিক বারোটায় বাজবে অ্যালার্ম ক্লক, যেটা হেনরি মিলারের কাছে পাঠিয়েছিলো। বাজবে মানে চিৎকার করে উঠবে আর কি। এই রাত বারোটার ব্যাপারটারও কোনো মানে নেই, আমার বিশ্বাস। এটাও নাটকীয়তা, রহস্য গল্পের রহস্য বাড়ানোর হাস্যকর প্রচেষ্টা-ঠিক রাত বারোটা, কিংবা মধ্যরাত, যেন সন্ধ্যা আটটা কিংবা ভোর চারটেয় হলে রহস্য জমে না। যত্তোসব! হ্যাঁ, যা বলা হয়েছে, ঘড়ি তো চিৎকার করবে, ভলিউম পুরো বাড়িয়ে দিতে হবে ওটার। চিৎকার করিয়ে যেতে হবে যততক্ষণ না ক্লকের গোপন জায়গা বেরিয়ে পড়ে।

তোমার ধারণা, চেঁচানো ঘরিটাতেই রয়েছে রহস্যের চাবিকাঠি?

সরাসরি জবাব দিলো না কিশোর। ঘুরিয়ে বললো, হতে পারে, এমন কোনো মেকানিজম রয়েছে গোপন জায়গাটায়, চিৎকারের শব্দে সক্রিয় হয়ে উঠবে। সরে যাবে কোনো লুকানো প্যানেল-ট্যানেল বা দরজা। শব্দের সাহায্যে তালা খোলা তো আজকাল কোনো ব্যাপারই নয়। কিছু তালা আছে, আপনি ভালো করেই জানেন, মালিককে কাছে গিয়ে শুধু বলতে হয় খোলো, ব্যস, খুলে যায়। মিস্টার ক্লকের কণ্ঠস্বরও বোধহয় ওরকম কিছুই করবে।

হ্যাঁ, এটা সম্ভব, মাথা দোলালো শোঁপা। শব্দের সাহায্যে অনেক তালা খুলেছি আমি।

ঘড়িটা কোথায়? নিয়ে আসুন, চেষ্টা করে দেখি।

 নেই। নষ্ট করে ফেলেছি।

নষ্ট করে ফেলেছেন!

হ্যাঁ, বললাম না, খুলে ফেলেছি। যন্ত্রপাতি কোথায় যে কোনটা ফেলেছি…মাঝে মাঝে এমন গাধামো করি না..অন্য কি করা যায়, বল।

আর কি করবেন? হতাশ ভঙ্গিতে দুহাত নাড়লো কিশোর। হবে না।

হতেই হবে! দরকার হলে ঘর ভেঙে ফেলবো আমি। এক সহকারীর দিকে ফিরে আদেশ দিলো, বিল, যন্ত্রপাতি। কুইক!

.

২০.

লাইব্রেরি বলে আর চেনা যায় না এখন ঘরটাকে। হাতুড়ি, বাটালি, ড্রিল মেশিন, কুড়াল আর শাবল নিয়ে আক্রমণ করেছিলো শোঁপার লোকেরা। প্রথমেই তাক থেকে সমস্ত বই নামিয়ে মেঝেতে স্তূপ করেছে। তারপর নামিয়েছে ছবিগুলো আর আয়না। দেয়ালের এক ধার থেকে খোঁজা আরম্ভ করেছে, ফাপা জায়গা, কিংবা গোপন ফোকর আছে কিনা দেখেছে। দেয়ালের কয়েকটা তাকও ভেঙে টেনেটুনে নামিয়েছে। ধারণা ছিলো, লুকানো দরজা-টরজা বা দেয়াল আলমারি থাকতে পারে। ছাতও বাদ রাখেনি। অনেক জায়গার আস্তরণ খসিয়ে ফেলেছে। মোট কথা, ধসিয়ে দেয়াটা বাকি রেখেছে শুধু।

কিন্তু নিরাশ হতে হয়েছে ওদেরকে, ব্যর্থ হয়েছে চেষ্টা। কিছুই পায়নি। কিচ্ছু। লুকানো ফোকর, দরজা, কিংবা দেয়াল আলমারির চিহ্নও নেই। ছবি লুকিয়ে রাখার মতো কোনো জায়গা-ই নেই।

প্রচণ্ড হতাশা রাগিয়ে দিয়েছে শোঁপাকে।

শেষ পর্যন্ত পারলাম না, আঁ! কপালের ঘাম মুছলো সে। হেরে গেলাম। ক্লকের কাছে? বিশ্বাসই করতে পারছি না! কোথায় লুকালো? কোথায়?

তার মানে টিমের বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারছেন না? কিশোর প্রশ্ন করলো।

ছবিগুলো না পেলে কি করে করি? তোমার চোখের সামনেই তো খোঁজা হলো।…আর কোনো উপায়? বুদ্ধি-টুদ্ধি কিছু?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করলো কিশোর। আনমনে মাথা দোলালো কিছুক্ষণ। মিস্টার শোঁপা, বাঁ হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঘড়ি নষ্ট হয়েছে বটে। কিন্তু চিৎকারটা বোধহয় হয়নি।

মানে? দুই লাফে কাছে চলে এলো শোঁপা।

চেয়ারে হেলান দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড পা দোলালো কিশোর। ধীরে ধীরে বললো, মিস্টার শোঁপা, হিরাম বারকেনের কাছে অনেকগুলো টেপ আছে। রেডিওর নাটক রেকর্ড করে রেখেছেন। হ্যারিসন কক যতগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছে, সব। তার মধ্যে আ স্ক্রীম অ্যাট মিডনাইটও নিশ্চয় আছে। ঘড়ির মধ্যে যে চিৎকারটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলো, সেটা কোনো নাটকেরও হতে পারে। মানে, ওরকম ভাবে চিৎকার করেছিলো হয়তো কোনো নাটকে। তাহলে টেপ বাজালেই সেই চিৎকার পেয়ে যাবো আমরা। এখন, মিস্টার বারকেন দয়া করে টেপগুলো আর রেকর্ডারটা দিলেই হয়। ঘড়ি আর দরকার হবে না আমাদের।

এখুনি, এক্ষুণি ফোন করো তাকে! চেঁচিয়ে উঠলো শোঁপা। দপদপ করে লাফাচ্ছে কপালের একটা শিরা। সময় খুব কম।

হলঘরে এসে বারকেনকে ফোন করলো কিশোর।

শুনে প্রথমে অবাক হলেন বারকেন। বুঝিয়ে বললো কিশোর।

হ্যাঁ, এবার বুঝেছি, বললেন তিনি। কোন চিৎকারটার কথা বলেছো, তা-ও বুঝেছি। ঠিক যেটা চাইছো, সেটাই দিতে পারবো। ওই চিৎকারই বিখ্যাত করেছিলো হ্যারিকে। আমি টেপটা বের করে রাখছি। মেশিনও রেডি রাখবো। এসে নিয়ে যাও। তবে কথা দিতে হবে, পরে সমস্ত ঘটনা আমাকে খুলে বলবে। রহস্যটা দারুণ ইনটারেসর্টিং।

কথা দিলো কিশোর। বললো, একজন লোক পাঠাচ্ছে, টেপ আর রেকর্ডার আনার জন্যে।

রান্নাঘর থেকে এসে রবিন, টিম আর মিসেস ডেলটনও কিশোরের কথা শুনছিলো। তার সঙ্গে লাইব্রেরিতে চললো। ঘরটার অবস্থা দেখে চমকে গেল ওরা।

হায় হায়, করেছে কি? মাথায় হাত দিলো রবিন। একেবারে লণ্ডভণ্ড…তা, কিছু পেলে?

এখনও পাইনি, কিশোর বললো।

বাড়ি ভাঙার চেষ্টা হয়েছিলো নাকি! মিসেস ডেলটনের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। এই কাণ্ড করবে জানলে কক্ষণো খোঁজার অনুমতি দিতাম না।

আপনার স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টাই করছি আমরা, মিসেস ডেলটন, শোঁপা বললো। প্রমাণ খুঁজছি। নির্দোষ যে, এটা প্রমাণ করতে হবে আদালতে। আর খুঁজতে মানা করছেন?

নষ্ট যা করার তো করেই ফেলেছেন। আর বাকিই বা আছে কি। খুঁজুন। দেখুন, প্রমাণ বেরোয় কিনা।

না, আর-কিছু ভাঙবো না। হলে এখন ভালোভাবেই হবে। তবে এই-ই শেষ চেষ্টা।

আপাতত আর কিছু করার নেই। টেপ আর রেকর্ডার এলে তারপর যা করার করবে। কাজেই বসে থাকতে হলো। গাড়ি নিয়ে মিক গেছে ওগুলো আনার জন্যে।

ঘন্টাখানেক পর ফিরলো সে। ভারি মেশিনটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো, আরিব্বাপরে, দশ মন হবে! টেপ ঢুকিয়েই দিয়েছে এর মধ্যে। শুধু চালালেই হবে এখন।

কিশোর, শোঁপা বললো, চালাতে পারবে এটা?

পারবো। উঠে এসে চামড়ার বাক্স থেকে মেশিনটা বের করলো কিশোর। সকেটে প্লগ ঢুকিয়ে কানেকশন দিলো। ভুল হয়ে গেছে। এতোক্ষণ শুধু শুধু বসে না থেকে ঘরটা গুছিয়ে ফেলতে পারতাম। ঠিক আগের মতো হবে না, যতোটা পারা যায় আরকি। ছবিগুলো জায়গা মতো ঝোলাতে হবে, আয়নাটা আগের জায়গায়। বইগুলো তাকে।

প্রতিবাদ করতে গিয়েও কি ভেবে থেমে গেল শোঁপা। সঙ্গীদের নির্দেশ দিলো কাজ করার।

আয়নাটা লাগালো ওরা। ছবিগুলো ঝোলালো। বই যতোগুলো সম্ভব, তুলে সাজিয়ে রাখলো তাকে, আর বুকশেলফে।

উহ্, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। নাও, শুরু করো, কিশোরকে বললো শোঁপা। দেখো, কিছু হয় কিনা।

টেপ চালু করে দিলো কিশোর। ভলিউম কমিয়ে রেখেছে। বসে থাকেনি সে। টেপটা চালিয়ে সেই জায়গায় নিয়ে এসেছে, যেখান থেকে শুরু হয়েছে চিৎকার। ওয়াইও করে সামান্য পিছিয়ে নিয়ে আবার প্লে-এর বোতামটা টিপে দিলো। বললো, সবাই চুপ, প্লীজ। একটুও শব্দ করবেন না।

সবাই নীরব হতেই ভলিউম বাড়িয়ে দিলো কিশোর।

নারী-পুরুষের কিছু সংলাপের পর চিৎকারটা হলো। তীক্ষ্ণ, কাঁপা কাঁপা, ভয়ঙ্কর। বদ্ধঘরে প্রতিধ্বনি তুললো। শেষ হলো ধীর লয়ে।

সবাই অধীর হয়ে আছে। ভাবছে, দেয়ালের কোথাও কোনো গোপন ফোকরের দরজা খুলে যাবে, কিংবা দেয়ালের কোনো জায়গায় ফাঁক দেখা দেবে। আরব্য উপন্যাসের আলিবাবার গুহার মতো।

সে-রকম কিছু ঘটলো না।

জানতাম, হবে না! উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, ধপ করে আবার বসে পড়লো শোঁপা। ঘাড় ডলছে। ওরকম কিছু থাকলে আগেই পেয়ে যেতাম। তেমন। জায়গা নেই এঘরে। ছবিগুলোও নেই।

আমার মনে হয়, আছে, হঠাৎ-আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়লো কিশোর। একটা পরিবর্তন চোখে পড়েছে তার। বুঝতে পারছে, কোথায় লুকানো রয়েছে ছবিগুলো। আবার করে দেখি, বললো সে। ভলিউম বোধহয় আরও বাড়াতে হবে।

ভলিউম পুরো বাড়িয়ে দিলো কিশোর। টেপ রিওয়াইণ্ড করে প্লে-বাটন টিপলো।

ভীষণ চিৎকার যেন চিরে দিলো কানের পর্দা। চড়ছে…চড়ছে…চড়ছে..কানে আঙুল দিতে হলো সবাইকে।

এই সময় ঘটলো ঘটনাটা।

ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল বড় আয়নাটা। ঝুরঝুর করে মেঝেতে ঝরে পড়লো কাঁচ। মাত্র এক সেকেণ্ডেই ফ্রেমে আটকানো কয়েকটা ছোট টুকরো ছাড়া আর সব পড়ে গেল।

আয়নার জায়গায় এখন দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল রঙের একটা ছবি। ওদের চোখের সামনেই গোল হয়ে মুড়ে মেঝেতে পড়ে গেল ওটা। পেছনে আরেকটা। ওটাও পড়লো। তার পেছনে আরও একটা। পর পর পাঁচটা ছবি পড়লো কাঁচের টুকরোর ওপর। ফ্রেমের পেছনের শক্ত পর্দা আর আয়নার মাঝখানে রাখা হয়েছিলো। ছবিগুলো।

অবশেষে বোঝা গেল চেঁচানো ঘড়িতে অ্যালার্মের জায়গায় চিৎকারের ডিস্ক লাগানোর কারণ।

 ছুটে গেল শোঁপা। কাঁচের পরোয়া করলো না, মাড়িয়ে গিয়ে নিচু হয়ে তুলে নিলো একটা ছবি। কালোর পটভূমিকায় ঝলমল করে উঠলো গাঢ় লাল, নীল, সবুজ। এগুলোই! হ্যাঁ, এগুলোই! ফিসফিস করছে সে, যেন জোরে কথা বললে কাঁচের মতোই ছবিগুলোও চুরমার হয়ে যাবে। দশ লাখ ডলার..পেলাম…

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল লাইব্রেরির ভেজানো দরজা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ এলো, খবরদার, নড়বে না! হাত তোলো!

এক মুহূর্ত স্তব্ধ নীরবতা।

দরজার দিকে ঘুরে গেল সাত জোড়া চোখ।

দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছে দুজন পুলিশ। হাতে উদ্যত, রিভলভার। তাদের পেছনে উঁকি দিচ্ছে পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারের মুখ। তার পেছনে মুসার বাবা মিস্টার রাফাত আমান। দুজন পুলিশের মাঝের ফাঁক বেড়ে গেল, ঠেলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের। সেখানে দেখা দিলো আরেকটা মুখ। মাথার খুলি কামড়ে রয়েছে যেন বাঁকা তারের মতো চুল, খাটো করে ছটা। কুচকুচে কালো মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত, ছবিগুলোর মতোই ঝলমল করছে ঝকঝকে সাদা দাঁত।

খাইছে, কিশোর, বলে উঠলো মুসা আমান। এক্কেরারে সময়মতো হাজির হয়ে গেছি, না? তা ঠিকঠাক আছো তো তোমরা? ঘুমোতে গিয়েছিলাম, বুঝলে। ঘুম এলো না। কেন যেন খালি দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো তোমাদের জন্যে। তাছাড়া বাবা। একটা কথা বলেছে, খচখচ করছিলো মনে। তোমাকে বলার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলাম। সকালের জন্যে আর বসে থাকতে পারলাম না। উঠে ফোন করলাম। তোমাদের বাড়িতে। শুনলাম রবিনদের বাড়ি গেছে। করলাম ওদের ওখানে। রবিনের মা বললো, রবিন তোমাদের ওখানে গেছে। ভাবলাম, হেডকোয়ার্টারে আছো। ফোন করলাম। ধরলো না, কেউ। সন্দেহ হলো। ছুটে গেলাম ওখানে। টেবিলের ওপর পেলাম তোমার নোট। ফোন করলাম এখানে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেছি। কেউ ধরলো না। তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে বাবাকে বললাম। তাকে নিয়ে। সোজা ছুটলাম থানায়। তারপর আর কি। পুলিশ নিয়ে চলে এলাম।

ঘরে ঢুকলেন ইয়ান ফ্লেচার। এগিয়ে এসে শোঁপার হাত থেকে নিয়ে নিলেন। ছবিটা। সাবধানে রাখলেন টেবিলে। একবার দেখেই মাথা নাড়লেন, চিনেছি। থানায় ফটো পাঠানো হয়েছিলো এটার। বছর দুই আগে এক গ্যালারি থেকে চুরি.: গিয়েছিলো। কিশোরের দিকে ফিরলেন। কালই বুঝেছি, ডেঞ্জারাস কোনো কেসে জড়িয়েছে। থানার কাছেই টিমের গাড়ি থেকে ঘড়ি চুরি হয়ে গেল! ভাগ্যিস মুসা। গিয়েছিলো, সময়মতো আসতে পেরেছি।

শোঁপার দিকে তাকালো কিশোর। ধরা পড়েছে, অথচ বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই চেহারায়। শান্ত। হাসছে। ফ্লেচারের অনুমতি নিয়ে হাত নামালো। সিগার বের করে ধরালো। ধোয়া ছেড়ে বললো, চীফ, অ্যারেস্ট তো করলেন। কিন্তু আমার অপরাধ জানতে পারি?

সেটা আবার বলতে হবে নাকি? মেজাজ দেখিয়ে বললেন চীফ। চোরাই মাল সহ হাতেনাতে ধরেছি। তাছাড়া অন্যের ঘরে বেআইনী ভাবে ঢুকে মালপত্র নষ্ট…

তাই? চীফকে থামিয়ে দিলো শোঁপা। জোরে জোরে দুবার টান দিলো সিগারে। সেটা আঙুলের ফাঁকে নিয়ে ওপরের দিকে মুখ করে হালকা ধোয়ার মেঘ সৃষ্টি করতে করতে বললো, অযথা লজ্জায় পড়তে যাবেন না, প্লীজ। খবরের কাগজ ওলারা আপনার চাকরি খেয়ে ছাড়বে। আর যদি কপাল গুণে চাকরিটা বেঁচেই যায়, অজাগা-কুজাগায় ট্রান্সফার এড়াতে পারবেন না। আমি বেআইনী কিছুই করিনি। কতগুলো চোরাই ছবি খুঁজে বের করতে এসেছি। যে-কেউ সেটা করতে পারে, পেলে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বাহবা নিতে পারে। আমিও শুধু তা-ই করেছি। এই ছেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করুন, কিশোর, রবিন আর টিমকে দেখালো সে। ওরা সাক্ষী। জিজ্ঞেস করুন, ওরাও আমার সঙ্গে খুঁজেছে কিনা?

কিন্তু মালপত্র নষ্ট…, খানিক আগের গলার জোর হারিয়েছেন ক্যাপ্টেন।

অনুমতি নিয়েই করেছি। মালিকের অবর্তমানে এই বাড়ি দেখাশোনার ভার রয়েছে এই মহিলার ওপর, টিমের মাকে দেখালো শোঁপা। তাকে বার বার জিজ্ঞেস করেছি আমি, খুঁজবো কিনা। ছবিগুলো পাওয়া গেছে। আপনারা এসেছেন। দয়া করে নিয়ে যেতে পারেন ওগুলো। আপনারা না এলে আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসতাম। বিমল হাসি ছড়িয়ে পড়লো চিত্র-চোরের চেহারায়।

কিন্তু..কিন্তু কথা খুঁজে পাচ্ছেন না চীফ।

কিন্তুর কি আছে? জিজ্ঞেস করুন। সাক্ষীরা তো এখানেই আছে। ওরা মিথ্যে বলরে না। কিশোর, বলো না, আমি সত্যি বলছি, না মিথ্যে?

চোখ মিটমিট করলো কিশোর। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলতে হলো, হ্যাঁ, স্যার, মিস্টার শোঁপা ঠিকই বলছেন। চোরাই ছবি খুঁজে বের করতে আমরাও সাহায্য করেছি তাকে।

কিন্তু ও ফেরত দিতো না! রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন ফ্লেচার। অসহায় ভঙ্গিতে থাবা মারলেন নিজের উরুতে। কিছুতেই দিতো না। নিয়ে পালিয়ে যেতো।

সেটা আপনার ধারণা, শান্তকণ্ঠে বললো শোঁপা। প্রমাণ করতে পারবেন ] তো, আমি এখন যাই। জরুরী কাজ আছে। আর যদি অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে চান, নিতে পারেন। নিজেরই ক্ষতি করবেন শুধু শুধু।

দুই সহকারীকে হাত নামানোর ইঙ্গিত করলো শোঁপা। চলো! এখানে আর আমাদের দরকার নেই।

দাঁড়াও! চেঁচিয়ে উঠলো একজন পুলিশ। এতো সহজে ছাড়া পাবে না। পুলিশের পোশাক পরার অপরাধে ওই দুজনকে ধরতে পারি আমরা।

পারেন নাকি? হাই তুললো শোঁপা, যেন ঘুম ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। এই বিল, এদিকে এসো। ওনাকে দেখাও মনোগ্রামগুলো…

এন,ওয়াই-পি-ডি! অবাক হলেন চীফ।

 হ্যাঁ, স্যার, বিনীত কণ্ঠে বললো শোঁপা। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। এটা একটা নিছক রসিকতা। ওরা দুজনেই অভিনেতা, ভাড়া করেছি ছবিগুলো খোঁজায় সাহায্য করতে। জানেনই তো, নিউ ইয়র্ক এখান থেকে তিন হাজার মাইল দূরে, এই শহরে ওখানকার পুলিশের কাজ করার অধিকার নেই। করতে হলে আপনাদের অনুমতি নিয়ে করতে হবে। কাজেই, লস অ্যাঞ্জেলেসে নিউ ইয়র্ক পুলিশের ব্যাজ পরাটা বেআইনী কিছু নয়, আসলে কোনো ব্যাপারই নয় ওটা। ওরা নিউ ইয়র্কের আসল পুলিশ হলে অনুমতি না নেয়ার জন্যে আটকাতে পারতেন। আপনারা। অভিনয়ের জন্যে পারেন না। তা-ও পারতেন, যদি পুলিশের পোশাক পরে ধাপ্পা দিয়ে কারো কোনো ক্ষতি করতো। কিছুই করেনি ওরা।

ঢোক গিললো কিশোর। আরেকবার গাধা মনে হলো নিজেকে। অন্যদের, মতো সে-ও ঠকেছে, দুজনকে লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ মনে করে।

এই, চলো,,সহকারীদের বলে দরজার দিকে রওনা হলো শোঁপা।

বাঘের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেদিকে ক্যাপ্টেন। শক্ত হয়ে গেছে হাতের মুঠো।

দরজার কাছে গিয়ে ঘুরলো শোঁপা। হাসি হাসি মুখ করে বললো, কিশোর, চলি। তোমার সাথে কাজ করার মজাই আলাদা। আগেও বলেছি, আবার বলছি, আমার দলে চলে এসো। তোমার বুদ্ধি আর আমার অভিজ্ঞতা একসাথে হলে দুনিয়ার কোনো বাধাই বাধা থাকবে না আমাদের জন্যে। আসবে?

আপনি বরং আরেক কাজ করুন না, পাল্টা প্রস্তাব দিলো কিশোর। চুরি ছেড়ে গোয়েন্দা হয়ে যান। আমাদের সঙ্গে হাত মেলান। দুনিয়ার সব না হোক, কিছু চোর অন্তত চুরি ছাড়তে বাধ্য হবে। কিংবা হাজতে ঢুকবে।

স্থির দৃষ্টিতে এক মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলো শোঁপা। তারপর হাসলো। এ-কারণেই তোমাকে আমার পছন্দ, ইয়াং ম্যান। আই লাইক ইউ। চলি, আবার দেখা হবে।

আমার সঙ্গেও তোমার দেখা হবে, শোঁপা, কঠিন কণ্ঠে বললেন ফ্লেচার। কথা দিচ্ছি, এবারের মতো আর বোকামি করবো না তখন। অসময়ে হাজির হবো

তার দিকে চেয়ে সামান্য মাথা নুইয়ে, হেসে বেরিয়ে গেল শোঁপা।

.

২১.

চেঁচানো ঘড়ির কেসের বিবরণ লিখে শেষ করেছে রবিন। উপসংহারে লিখলোঃ

দক্ষিণ আমেরিকায় খোঁজ নিয়েছে পুলিশ। সত্যিই মারা গেছে হ্যারিসন ক্লক।

সেই গ্যারেজ থেকে ধরা হয়েছে ডিংগো, মারকো, আর লারমারকে। তেমনি। হাতকড়া পরা অবস্থায়ই ছিলো ওরা, ছুটতে পারেনি। নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে। ব্লকই ছবিগুলো রান্নাঘরে লুকিয়েছিলো টিমের বাবাকে ফাঁসানোর জন্যে, এই জবানবন্দীও দিয়েছে আদালতে। জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে বেকার ডেলটন।

আ স্ক্রীম অ্যাট মিডনাইট নাটকে চিৎকার করেছে ক্লক, সেই চিৎকারই ডিস্কে রেকর্ড করে ঘড়িতে ঢুকিয়েছে। নাটকটিতে একটা দৃশ্য ছিলো, চিকারের শব্দে চুরচুর হয়ে ভেঙে গেছে একটা আয়না। ছবি লুকানোর ক্ষেত্রে ওই কায়দাটাকেই কাজে লাগিয়েছে ধড়িবাজ ক্লক। তার জানা ছিলো, বিশেষ পরিবেশে, বিশেষ শব্দ তরঙ্গের জোরালো ধাক্কা সইতে পারে না পাতলা কাঁচ, ভেঙে যায়।

সেদিন রাতে, নাটকের ওই দৃশ্যটার কথাই বলেছিলেন মিস্টার রাফাত আমান। শুনে, মুসার মনে হয়, তথ্যটা জরুরী, কিশোরকে জানানো দরকার।

.

থুতনিতে কলমের মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো রবিন। আর কোনো পয়েন্ট আছে? না, সবই লেখা হয়েছে। কিছু বাকি নেই। ফাইলটা বন্ধ করে, ফিতে বেঁধে, সযত্নে রেখে দিলো ফাইলিং কেবিনেটে। আগামী দিন এটা নিয়ে যাবে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে দেখা করার জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *