পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা

পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা

পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে শেষপর্যন্ত বাংলা ভাষাই হবে সে সম্বন্ধে আমাদের মনে কখনও কোনও সন্দেহ ছিল না এবং একথাও নিঃসন্দেহে জানি যে যদিও এখনকার মতো বাংলার দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে তবু উর্দুওয়ালারা আবার সুযোগ পেলেই মাথা খাড়া করে উঠতে পারেন। আমরা যে এতদিন এ-সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিনি তার প্রধান কারণ বাংলা-উর্দু-দ্বন্দু রাজনৈতিক রঙ ধরে নিয়ে দলাদলির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল; সে অবস্থায় সুস্থ মনে, শান্ত চিত্তে বিচার করার প্রবৃত্তি কোনও পক্ষেরই ছিল না। আবহাওয়া এখন ফের অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে; এইবেলা উভয়পক্ষের যুক্তিগুলো ভালো করে তলিয়ে দেখে নিলে ভবিষ্যতের অনেক তিক্ততা এবং অর্থহীন দ্বন্দ্ব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে।

উর্দুওয়ালাদের প্রথম ও প্রধান যুক্তি এই : পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান অভিন্ন রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের কেন্দ্রে যে ভাষা প্রচলিত পূর্ব পাকিস্তানে যদি সে-ভাষা প্রচলিত না থাকে তবে রাজনৈতিক ও কৃষ্টিগত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

উত্তরে আমরা বলি, পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণকে বাংলা ভুলিয়ে উর্দু শিখিয়ে যদি কেন্দ্রের সঙ্গে এক করে দেওয়া সম্ভবপর হত তা হলে যে এ বন্দোবস্ত উত্তম হত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন, এ কাজ কি সোজা? উত্তরে আমরা বলি এ কাজ অসম্ভব।

কেন অসম্ভব এ প্রশ্ন যদি শোধান তবে তার উত্তর দু রকমের হতে পারে। প্রথমরকমের উত্তর দেওয়া যায় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত দিয়ে। আমরা যদি একথা সপ্রমাণ করতে পারি যে পৃথিবীর ইতিহাসে কস্মিনকালেও এহেন কাণ্ড ঘটেনি এবং যতবার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই সে চেষ্টা নিষ্ফল হয়েছে তবে হয়তো অনেকেই স্বীকার করে নেবেন যে, অসম্ভব কর্ম সমাধান করার চেষ্টা করে মূর্খ, বলদকে দোয়াবার চেষ্টা সেই করে যার বুদ্ধি বলদেরই ন্যায়।

ইয়োরোপ আমেরিকা থেকে উদাহরণ দেব না। উর্দুওয়ালারা এসব জায়গার উদাহরণ মেনে নিতে স্বভাবতই গড়িমসি করবেন। তাই উদাহরণ নেব এমন সব দেশ থেকে যেসব দেশকে সাধারণত পাক অর্থাৎ পবিত্র অর্থাৎ ইসলামি বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এসব দেশের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি উর্দুওয়ালাদের জানার কথা, না জানলে জানা উচিত।

আরব ও ইরানের (পারস্যের) মানচিত্রের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন যে এ দু দেশের মাঝখানে কোনও তৃতীয় দেশ নেই। অর্থাৎ আরবদেশের পূর্ব সীমান্তে যেখানে আরবি ভাষা এসে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই ফারসি ভাষা আরম্ভ হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তেও যেখানে আরবি ভাষা শেষ হয়েছে সেখান থেকেই তুর্কি ভাষা আরম্ভ হয়েছে।

সকলেই জানেন খলিফা আবু বকরের আমলে মুসলিম আরবেরা অমুসলিম ইরান দখল করে। ফলে সমস্ত ইরানের লোক আগুন-পূজা ছেড়ে দিয়ে মুসলিম হয়। মুসলিম শিক্ষাদীক্ষা মুসলিম রাজনৈতিক অনুপ্রেরণার কেন্দ্রভূমি তখন মদিনা। কেন্দ্রের ভাষা আরবি এবং যে ভাষাতে কুরান নাজিল অর্থাৎ অবতীর্ণ হয়েছেন, হজরতের বাণী হাদিসরূপে সেই ভাষায়ই পরিস্ফুট হয়েছে। কাজেই আমরা অনায়াসে ধরে নিতে পারি যে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসূত্র দৃঢ় করার বাসনায় ইরানে আরবি ভাষা প্রবর্তিত করার ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছিল। আমরা জানি বহু ইরানবাসী ইসলাম গ্রহণ করে, আরবি শিখে, মুসলিম জগতে নাম রেখে গিয়েছেন। আরও জানি পরবর্তী যুগে অর্থাৎ আব্বাসিদের আমলে আরবি রাষ্ট্রকেন্দ্র ইরানের আরও কাছে চলে এসেছিল। ইরাকের বাগদাদ ইরানের অত্যন্ত কাছে ও আব্বাসি যুগে বহু ইরানি বাগদাদে বসবাস করে উচ্চাঙ্গের আরবি শিখতে সমর্থ হয়েছিলেন। সমস্ত ইরানদেশে তখন আরব গবর্নর, রাজকর্মচারী, ব্যবসাদার, পাইক-বরকন্দাজে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। ইরানের সর্বত্র তখন আরবি মক্তব-মাদ্রাসার ছড়াছড়ি, আরবিশিক্ষিত মৌলবি-মৌলানায় ইরান তখন গমগম করত।

তবে কেন তিনশত বৎসর যেতে-না-যেতে ফারসি ভাষা মাথা খাড়া করে উঠল? দশম শতাব্দীর শেষভাগে দেখতে পাই, ফারসি ভাষার নবজাগরণের চাঞ্চল্য সমস্ত ইরানভূমিকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। গল্প শুনি, ফিরদৌসিকে নাকি ফরমাইশ দেওয়া হয়েছিল ইরানের প্রাকমুসলিম সভ্যতার প্রশস্তি গেয়ে যেন কাব্য রচনা করা হয়, এবং ততোধিক গুরুত্বব্যঞ্জক (মুহি) ফরমাইশ, সে কাব্য যেন দেশজ ফারসি কথায় রচিত হয়, তাতে যেন আরবি শব্দ বিলকুল ঢুকতে না পারে। গল্পটি কতদূর সত্য বলা কঠিন। কারণ ফিরদৌসির মহাকাব্যে অনেক আরবি কথা আছে কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে আর আরবি ভাষা যে কোনও কারণেই হোক, দেশের আপামর জনসাধারণকে তৃপ্ত করতে পারেনি বলেই ফারসির অভ্যুত্থান হল।

তার পর একদিন ফারসি ইরানের রাষ্ট্রভাষা হয়ে গেল।

উর্দুওয়ালারা হয়তো উত্তরে বলবেন যে ইরান শিয়া হয়ে গেল বলেই সুন্নি আরবের সঙ্গে কলহ করে ফারসি চালাল। এ উত্তরে আছে লোকঠকানোর মতলব। কারণ ঐতিহাসিকমাত্রই জানেন ফিরদৌসির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন গজনির সুলতান মাহমুদ এবং তিনি ছিলেন এতই কট্টর সুন্নি যে তিনি সিন্ধুদেশের হাজার হাজার করামিতাকে (ইসমাইলি শিয়া) কতল-ই আমে অর্থাৎ পাইকারি হননে–ফিনারিজহান্নম বা পরলোকে পাঠিয়েছিলেন। কাজেই বোঝা গেল যে এই আরবিবিরোধী ফারসি আন্দোলনের পশ্চাতে শিয়া-সুন্নি দুই সম্প্রদায়ই ছিলেন।

না-হয় ইরান শিয়াই হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তুর্কির বেলা কী? তুর্কির আপামর জনসাধারণ সুন্নি এবং শুধু যে সুন্নি তাই নয়, হানিফি সুন্নিও বটে। ইরানেরই মতো একদিন তুর্কিতেও আরবি চালাবার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত সে চেষ্টা সফল হয়নি। শেষপর্যন্ত তুর্কি ভাষাই তুর্কের রাষ্ট্রভাষা হল। উর্দুওয়ালাদের স্মরণ থাকতে পারে যে কয়েক বৎসর পূর্বে তুর্কি ও ইরান উভয় দেশে জোর জাতীয়তাবাদের ফলে চেষ্টা হয় তুর্কি ও ফারসি থেকে বেবাক আরবি শব্দ তাড়িয়ে দেওয়ার। আমরা এ ধরনের উগ্রচণ্ডা জাতীয়তাবাদ ও ভাষাবিশুদ্ধিকরণ বাইয়ের পক্ষপাতী নই; তবুও যে ঘটনাটির কথা উর্দুওয়ালাদের স্মরণ করিয়ে দিলুম তার একমাত্র কারণ, কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসূত্র যতই মূল্যবান হোক না কেন, তার জন্য মানুষ সবসময় সবকিছু বিসর্জন দিতে রাজি হয় না। (এস্থলে ঈষৎ অবান্তর হলেও একটি কথা বলে রাখা ভালো পাছে উর্দুওয়ালারা আমাদের নীতি ঠিক বুঝতে না পারেন– আমরা ভাষাশুদ্ধিকরণে বিশ্বাস করি না বলেই বাংলা থেকে সংস্কৃত শব্দ তাড়াতে চাইনে। তা হলে সেই পাগলামির পুনরাবৃত্তি করা হবে মাত্র; আজকের দিনে কে না বুঝতে পারে ফোর্ট উইলিয়ামি পণ্ডিতরা বাংলা থেকে আরবি-ফারসি শব্দ বর্জন করে কী আহাম্মুকিই না করেছিলেন।)

উর্দুওয়ালারা হয়তো প্রশ্ন শুধাবেন, তা হলে মিশরে আরবি চলল কী করে? মুসলমান বিজয়ের পূর্বে মিশরের ভাষা তো আরবি ছিল না। তার উত্তর এই যে, মিশর জয়ের পর লক্ষ লক্ষ আরব মিশরে বসবাস আরম্ভ করে ও কালক্রমে দেশের আদিম অধিবাসী ও বিদেশিতে মিলে গিয়ে যে ভাষা গড়ে ওঠে তারই নাম মিশরি আরবি। সংমিশ্রণ একটি কথা দিয়েই সপ্রমাণ করা যায়; যদিও আরবিতে জিম হরফের উচ্চারণ বাংলার জ-এর মতো, তবু মিশরিরা উচ্চারণ করেগ-এর মতো। জবলকে বলেগবল, নজিবকে বলে নগিব, অল্পশিক্ষিত লোক ইজা জা নসরউল্লা না বলে বলে ইজাগা- ইত্যাদি। অন্যদিক দিয়ে মিশরি ফল্লাহিন (চাষা) ও আরবি বেদুইনের মধ্যে দেহের গঠন, চামড়ার রঙ ইত্যাদিতে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই।

এতগুলো উদাহরণ দেবার পরও যদি কেউ সন্তুষ্ট না হন তবে তার সামনে একটি ঘরোয়া উদাহরণ পেশ করি। পাঠান মোগল (এমনকি ইংরেজ রাজত্বের প্রথমদিকে) যুগে এদেশে শুধু কেন্দ্রে নয়, সুবাগুলোতে পর্যন্ত ফারসি ছিল রাষ্ট্রভাষা। তবু কেন সে ভাষা দেশজ হিন্দি বাংলা প্রভৃতি ভাষাকে মেরে ফেলে নিজে অজরামর হয়ে কায়েমি খুঁটি গাড়তে পারল না? উর্দুওয়ালারা হয়তো বলবেন, ইংরেজ ফারসি উচ্ছেদ করে দিল তাই।

কিন্তু সে উচ্ছেদের ব্যবস্থা তো পাঠান-মোগলরাই করে গিয়েছিলেন। পাঠান আমলের বিখ্যাত কবি আমির খুসরৌ ফারসিতে উচ্চাঙ্গের কাব্য রচনা করে গিয়েছিলেন অথচ দূরদৃষ্টিবলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, শেষপর্যন্ত ফারসি এদেশে চলবে না, দেশজ ভাষা পুনরায় আপন আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। এ তত্ত্বটা ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ফারসি ও তখনকার দেশজ ভাষা হিন্দি মিশিয়ে কবিতা রচনার একসপেরিমেন্ট করে গিয়েছিলেন। নিচের উদাহরণটি উর্দুওয়ালাদের জানবার কথা :

হিন্দুবাচ্চেরা ব নিগর আজব হুসন্ ধরত হৈ।
দ ওয়কতে সুখন গুফতন্ মুহ ফুল ঝরত হৈ ॥
গুফতম্ বিয়া কে বর লবেতো বোসে বাগিরম
গুফৎ আরে রাম ধরম নষ্ট করত হৈ ॥

 হিন্দু তরুণ কী অপূর্ব সৌন্দর্যই-না ধারণ করে। যখন কথা বলে তখন মুখ হতে ফুল ঝরে– বললুম, আয় তোর ঠোঁটে একটি চুমো খাব বললে, আরে রাম! ধর্ম নষ্ট করত হায়–

এই এক্সপেরিমেন্টের ফলেই দেখতে পাই শাহজাহানের আমলে উর্দু ভাষা সৃষ্টি হয়েছে ও অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেখতে পাই ফারসি আস্তে আস্তে হটে গিয়ে উর্দুর জন্য জায়গা করে দিচ্ছে। আজকের দিনে পরিস্থিতিটা কী? ফারসির লীলাভূমি দিল্লি-লক্ষ্ণৌয়ে এখন সাহিত্য সৃষ্ট হয় উর্দু ভাষাতে, ফারসি সেখানে আরবি এবং সংস্কৃতের মতো মৃত ভাষা বা ডেড ল্যানগুইজ।

হয়তো উর্দুওয়ালারা বলবেন, উর্দুতে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ থাকায় তিনি পদে উঠে গেছেন। এর উত্তর বলি, ফারসি যেরকম বিস্তর আরবি শব্দ গ্রহণ করেও ফারসিই থেকে গিয়েছে, উর্দুও সেইরকম বিস্তর আরবি-ফারসি শব্দ গ্রহণ করা সত্ত্বেও উর্দুই থেকে গিয়েছে, সে এই দেশের দেশজ ভাষা। বিদেশি শব্দের প্রাধান্য অপ্রাচুর্য নিয়ে ভাষার বর্ণ, গোত্রের বিচার হয় না। পূর্ববঙ্গের আলিম-ফাজিলগণ যখন অকাতরে আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগ করে বাংলায়ওয়াজ বাপাবলিক লেকচর দেন তখন সে-ভাষা আরবি, ফারসি বা উর্দু নামে পরিচিত হয় না, সে ভাষা বাংলাই থেকে যায়।

ঘোড়াটি আমার ভালোবাসিত গো শুনিতে আমার গান
 এখন হইতে সে ঘোড়াশালেতে বাঁধা রবে দিনমান।
 জিনি তরঙ্গ সুন্দরী মোর তাতারবাসিনী সাকি
 লীলাচঞ্চলা রঙ্গনিপুণা শিবিরে এসেছি রাখি।
 ঘোড়ার আমার জুটিবে সোয়ার ইয়ার পাইবে সাকি
শুধু মা আমার এ বুড়া বয়সে কাঁদিয়া মুদিবে আঁখি।
–সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

 শব্দের প্রাচুর্য-অপ্রাচুর্যভেদে যদি ভাষার বংশবিচার করতে হয় তা হলে বলতে হবে এই কবিতার চতুর্থ ছত্র সংস্কৃত, পঞ্চম ছত্র আরবি-ফারসি ও গোটা কবিতাটা খোদায় মালুম কী। কিন্তু উপস্থিত এ আলোচনা মুলতবি থাক–উর্দু কী হিসেবেপাক ও বাংলা না-পাক সে আলোচনা পরে হবে।

এ প্রসঙ্গে উর্দুওয়ালাদের কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন : ত্রয়োদশ শতকে মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয় থেকে আরম্ভ করে ঊনবিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত ফারসি-উর্দু এদেশে চালু ছিল। শাহজাহানের আমল থেকে আজ পর্যন্ত বেশুমার মৌলবি-মৌলানা, আলিম-ফাজিল দেওবন্দ রামপুর থেকে উর্দু শিখে এসে এদেশে উর্দুতে ওয়াজ ঝেড়েছেন, উর্দুতেগুফতগু করেছেন; মনে পড়েছে ছেলেবেলায় দেখেছি উদ্ধত অর্বাচীন তরুণ যখনই তর্কে মোল্লাদের কাবু করেছে তখনই তারা হঠাৎ উর্দুতে কথা বলতে আরম্ভ করে (আজ জানি সে উর্দু কত ন্যক্কারজনক ভুলে পরিপূর্ণ থাকত) আপন যুক্তির অভাব অথবা দুর্বলতা ঢাকবার চেষ্টা করেছেন এবং চাষাভুষার কাছে মুখ বাঁচিয়েছেন। সেকথা থাক, কারণ এমন মৌলবি-মৌলানার সংস্পর্শেও এসেছি যাদের সঙ্গে তর্কে হেরেও আনন্দ পেয়েছি, কিন্তু আসল প্রশ্ন : এইসব আলিম-ফাজিলগণ বাংলা দেশের শিক্ষা ও কৃষ্টি নির্মাণের সম্পূর্ণ ভার হাতে পেয়েও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চেষ্টা করা সত্ত্বেও এদেশের আপামর জনসাধারণকে নাপাক বাংলা ভুলিয়ে ফারসি বা উর্দু চালাতে সক্ষম হলেন না কেন? ইংরেজি স্কুল তখন ছিল না, সংস্কৃত টোল তখন অনাদৃত, আরবি-ফারসি-উর্দু শিখলে তখন উমদা উমদা নোকরি মিলত, বাদশাহ-সুবাদারের মজলিসে শিরোপা মিলত, মনসব মিলত, আর আরবি-ফারসির জরিয়ায় বেহেস্তের দ্বার তো খুলতই। ইহলোক-পরলোক উভয় লোকের প্রলোভন সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমান নাপাক বাংলায় কেন কথাবার্তা বলল, জারিমর্সিয়া রচনা করল, ভাটিয়ালি-পিরমুর্শিদি, আউলবাউল, সাঁইদরবেশি গান গাইল, কেচ্ছা-সাহিত্য তৈরি করল, রাধার চোখের পানি নিয়ে বিদাত কবিতা পর্যন্ত লিখল? এবং একথাও তো জানি যে মৌলবি-মৌলানারা এসব লোকসাহিত্যের প্রতি উদাসীন ছিলেন না, তাঁরা বার বার ফতোয়া দিয়েছেন যে এসব সাহিত্যবিদাত, নাজাইজ, কুফর, শিরক। তৎসত্ত্বেও এগুলো এখনও খেয়াঘাটে, বাথানে, চাষার বাড়িতে পড়া হয়, এসব বই এখনও ছাপা হয়, হাটবারে বটতলায় বিক্রয় হয়।

শুধু তাই? পাঠান বাদশাহরা পয়সা খরচ করে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দিয়ে মহাভারত, রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করালেন। বাদশাহদের দরবারে বিস্তর আলিম-ফাজিল ছিলেন। তারা তখন নিশ্চয়ই এই ফুজুল, বিদাত, ওয়াহিয়াত, ইসরাফের বিরুদ্ধে তারস্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কিন্তু শেষপর্যন্ত তো তত্ত্বকথা এই যে, আজ পর্যন্ত এদেশে পরাগল খান, ছুটি খানের নাম রয়ে গিয়েছে বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে।

কিন্তু আমাদের আসল প্রশ্নটা যেন ধামাচাপা পড়ে না যায়। উর্দুওয়ালাদের কাছে আমার সবিনয় প্রশ্ন : বাংলাদেশের কৃষ্টিজগতে প্রায় ছয়শত বৎসর একাধিপত্য করেও তারা যখন উর্দু চালাতে পারেননি তখন বর্তমান যুগের নানা কৃষ্টিগত দ্বন্দ্ব, বহু নিদারুণ দারিদ্র্য, ক্রমবর্ধমান বাংলাসাহিত্য ও ভাষার সঙ্গে বিজড়িত মুসলমান-হিন্দুকে তাদের মাতৃভাষা ভুলিয়ে উর্দু চালানো কি সম্ভবপর?

আরব-ইরান পাশাপাশি দেশ, এক দেশ থেকে আরেক দেশে গমনাগমনে কোনও অসুবিধা ছিল না, উর্দুর তুলনায় আরবি বহু পূতপবিত্র ভাষা ও সে ভাষা ইসলামের তাবত দৌলত ধারণ করে; তৎসত্ত্বেও যখন ইরানে আরবি চলল না তখন যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তান বহুশত ক্রোশ দূরে– মাঝখানে আবার এমন রাষ্ট্র যার সঙ্গে এখনও পুরা সমঝাওতা হয়নি, যে পশ্চিম পাকিস্তানেও আবার পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রচলিত– সেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একজোট হবেই-বা কী করে আর একে অন্যকে উর্দু শেখাবেই-বা কী প্রকারে? এ তো দু পাঁচজন মাস্টারের কথা নয়, আমাদের দরকার হবে হাজার হাজার লোকের। আর হাজার নবাগতকে পোষবার ক্ষমতা যদি পূর্ব পাকিস্তানের থাকতই তবে পূর্ব পাঞ্জাব থেকে বিতাড়িত হতভাগ্য মুসলমানদের কি পূর্ব পাকিস্তান এতদিনে আমন্ত্রণ করে চোখের জল মুছিয়ে দিত না, মুখে অন্ন তুলে ধরত না?

হয়তো উর্দুওয়ালারা বলবেন যে, সমস্ত দেশকে উর্দু শেখানো তাঁদের মতলব নয়; তাঁদের মতলব প্রাইমারি স্কুলে অর্থাৎ গ্রাম্য পাঠশালায় বাংলা শেখানো এবং হাইস্কুল ও কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে উর্দু চালানো।

তাই যদি হয় তবে ফল হবে এই যে, হাইস্কুল-কলেজে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত গুণী-জ্ঞানীরা কেতাব লিখবেন উর্দুতে। তাতে ইসলামের প্রাচীন ইতিহাস থাকবে, সে ঐতিহ্যের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের নবীন রাষ্ট্র কী করে গড়ে তুলতে হবে তার কায়দাকানুনের বয়ান থাকবে, আল্লা-রসুলের বাণী সেসব কেতাবে নতুন করে প্রচারিত হবে এবং এসব তাবত দৌলতের ভোগী হবেন উর্দু জাননেওলারা। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৮০/৯০ জন চাষা-মজুর; তাদের শিক্ষাসমাপ্তি যে পাঠশালা পাসের সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যাবে সেকথাও নিশ্চয়ই জানি এবং তারা এসব কেতাব পড়তে পারবে না। এই শতকরা আশিজনের ওপর যে নবীন রাষ্ট্র নির্মিত হবে তার আদর্শ নতুন, আকাক্ষা নতুন এবং সে আদর্শে পৌঁছানোর জন্য যেসব বয়ান উর্দু ভাষাতে লেখা হবে তারা সেসব পড়তে সক্ষম হবে না। অর্থাৎ শতকরা আশিজন কোনওকিছু না জেনেশুনে আদর্শ রাষ্ট্র গড়াতে উঠেপড়ে লেগে যাবে।

এ বড় মারাত্মক ব্যবস্থা, এ বড় অনৈসলামিক কুব্যবস্থা। প্রাচীন ঐতিহ্যপন্থী মৌলবি-মৌলানাকে যত দোষ দিতে চান দিন, কিন্তু এ দোষ তাদের জানী দুশমনও দিতে পারবেন না যে তারা ধনী এবং গরিবের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা করেছিলেন। ধনীর ছেলেকে তারা যেমন আরবি-ফারসি-উর্দু শিখিয়েছিলেন, গরিবের ছেলেকেও ঠিক সেই কারিকুলামের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। যদি পাকচক্রে পূর্ব পাকিস্তানকে কোনওদিন উর্দু গ্রহণ করতেই হয় এবং স্বীকার করে নিতেও হয় যে আমাদের সাহিত্য এবং অন্যান্য সৃষ্টি উর্দুতেই হবে, তবে তাঁরা পাঠশালায়ও উর্দু চালাবেন। দেবভাষা ও গণভাষা বলে পৃথক পৃথক বস্তু স্বীকার করা ইসলাম-ঐতিহ্য পরিপন্থী।

পাকিস্তান বড়লোকের জন্য নয়, গরিবের হক পাকিস্তানে বেশি।

ইংরেজও ভদ্রলোক ওছোটলোকের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা করে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজ কৃষি রিপোর্ট বের করত ইংরেজি ভাষায় এবং চাষাভুষাদের শেখাত বাংলা! বোধহয় ভাবত বাঙালি মাছিমারা কেরানি যখন ইংরেজি না জেনেও ইংরেজি দলিলপত্র নকল করতে পারে তখন ইংরেজি-অনভিজ্ঞ চাষাই-বা ইংরেজিতে লেখা কৃষি রিপোর্ট, আবহাওয়ার খবরাখবর পড়তে পারবে না কেন? এই পাগলামি নিয়ে যে আমরা কত ঠাট্টা-মশকরা করেছি সেকথা হয়তো উর্দুওয়ালারা ভুলে গিয়েছেন কিন্তু আমরা ভুলিনি। তাই শুধাই, এবার কি আমাদের পালা? এখন আমরা কৃষি রিপোর্ট, বাজারদর, আবহাওয়ার খবরাখবর বের করব উর্দুতে আর চাষিদের শেখাব বাংলা! খবর শুনে ইংরেজ লন্ডনে বসে যে অট্টহাসি ছাড়বে আমরা সিলেটে বসে তার শব্দ শুনতে পাব।

উর্দুওয়ালারা বলবেন, ক্ষেপেছ? আমরা উর্দু কৃষি রিপোর্ট বাংলাতে অনুবাদ করে চাষার বাড়িতে পাঠাব।

উত্তরে আমরা শুধাই : সে অনুবাদটি করবেন কে? কৃষি রিপোর্টের অনুবাদ করা তো পাঠশালা-পাসের বাংলা বিদ্যে দিয়ে হয় না। অতএব বাংলা শেখানোর জন্য হাইস্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়াতে হবে। অর্থাৎ আমাদের সক্কলকে স্কুল-কলেজে বাংলা উর্দু দুই-ই বেশ ভালো করে শিখতে হবে (কৃষি-রিপোর্ট ছাড়া উর্দুতে লেখা অন্যান্য সাহিত্যও তো বাংলাতে তর্জমা করতে হবে); ফলে দুই কুলই যাবে, যেমন ইংরেজ আমলে গিয়েছিল—না শিখেছিলুম বাংলা লিখতে, না পেরেছিলুম ইংরেজি ঝাড়তে।

ইংলন্ড, ফ্রান্স, জার্মানিতে যে উচ্চশিক্ষার এত ছড়াছড়ি, সেখানেও দশ হাজারের মধ্যে একটি ছেলে পাওয়া যায় না যে দুটো ভাষায় সড়গড় লিখতে পারে। আরব, মিশরের আলিম-ফাজিলগণও এক আরবি ছাড়া দ্বিতীয় ভাষা জানেন না।

না হয় সবকিছুই হল কিন্তু তবু মনে হয়, এ বড় অদ্ভুত পরিস্থিতি যে রিপোর্ট পড়নেওয়ালার শতকরা ৯৯ জন জানে বাংলা, সে রিপোর্টের মূল লেখা হবে উর্দুতে! ব্যবস্থাটা কতদূর বদখত বেতালা তার একটা উপমা দিলে আমার বক্তব্য খোলসা হবে : যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত শ-খানেক রুটি-খানেওয়ালা পাঞ্জাবি আছেন অতএব তাবৎ দেশে ধানচাষ বন্ধ করে গম ফলাও! তা সে আল-বাধা, জলে টইটম্বুর ধানক্ষেতে গম ফলুক আর না-ই ফলুক।

উর্দুওয়ালারা তবু বলবেন, সব না হয় মানলুম, কিন্তু একথা তো তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না কেন্দ্রের ভাষা যে উর্দু সে সম্বন্ধে পাকাপাকি ফৈসালা হয়ে গিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের লোক যদি উর্দু না শেখে তবে করাচির কেন্দ্রীয় পরিষদে তাঁরা গাকগাক করে বক্তৃতা ঝাড়বেনই-বা কী প্রকারে, এবং আমাদের ছেলেছোকরারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ডাঙর ডাঙর নোকরিই-বা করবে কী প্রকারে?

বক্তৃতা দেওয়া সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, আমরা যত ছেলেবেলা থেকে যত উত্তম উর্দুই শিখি না কেন, উর্দু যাদের মাতৃভাষা তাঁদের সঙ্গে আমরা কস্মিনকালেও পাল্লা দিয়ে পেরে উঠব না। আমাদের উচ্চারণ নিয়ে উর্দুভাষীগণ হাসিঠাট্টা করবেই এবং সকলেই জানেন উচ্চারণের মশকরা-ভেংচানি করে মানুষকে সভাস্থলে যত ঘায়েল করা যায় অন্য কিছুতেই ততটা সুবিধে হয় না। অবশ্য যাদের গুরদা-কলিজা লোহার তৈরি তাঁরা এসব নীচ ফন্দি-ফিকিরে ঘায়েল হবেন না কিন্তু বেশিরভাগ লোকই আপন উচ্চারণের কমজোরি বেশ সচেতন থাকবেন, বিশেষত যখন সকলেই জানেন যে প্রথম বহু বৎসর ধরে উত্তম উচ্চারণ শেখবার জন্য ভালো শিক্ষক আমরা জোগাড় করতে পারব না, এবং একথাও বিলক্ষণ জানি যে একবার খারাপ উচ্চারণ দিয়ে বিদ্যাভ্যাস আরম্ভ করলে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে সে জখমি উচ্চারণ আর মেরামত করা যায় না। দৃষ্টান্তের জন্য বেশিদূর যেতে হবে না। পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষাভাষী মৌলবি সাহেবদের উচ্চারণের প্রতি একটু মনোযোগ দিলেই তাদের উচ্চারণের দৈন্য ধরা পড়ে। সে উচ্চারণ দিয়ে পূর্ববাংলায়ওয়াজ দেওয়া চলে কিন্তু যাদের মাতৃভাষা উর্দু তাঁদের মজলিসে মুখ খোলা যায় না। এমনকি দেওবন্দ-রামপুর ফের্তা কোনও কোনও মৌলবি সাহেবকে উচ্চারণ বাবতে শরমিন্দা হতে দেখেছি, অথচ বহুক্ষেত্রে নিশ্চয় জানি যে এঁদের শাস্ত্রজ্ঞান দেওবন্দ-রামপুরের মৌলানাদের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু এরা নিরুপায়, ছেলেবেলা ভুল উচ্চারণ শিখেছিলেন, এখনও তার খেসারতি ঢালছেন।

কিন্তু কী প্রয়োজন জান পানি করে ছেলেবেলা থেকে উর্দু-উচ্চারণে পয়লানম্বরি হওয়ায়? অন্য পন্থা কি নেই?

আছে। গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূমি সুইজারল্যান্ডে চারটি ভাষা প্রচলিত। তাদের পার্লামেন্টে সকলেই আপন আপন মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেন। সেসব বক্তৃতা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়। উর্দুওয়ালারা প্রশ্ন শুধাবেন : এসব বক্তৃতা অনুবাদ করে কারা?

সেই তত্ত্বটা এইবেলা ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার। এই ধরুন, আপনার মাতৃভাষা বাংলা, আপনি উর্দুও জানেন। কিন্তু উর্দুতে বক্তৃতা দিতে গেলে আপনি হিমশিম খেয়ে যান। অথচ অল্প উর্দু জানা সত্ত্বেও যদি আপনাকে কোনও উর্দু বক্তৃতা বাংলায় তর্জমা করতে হয় তবে আপনি সেটা অনায়াসে করে দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ফ্রান্স, জর্মনি, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সফর করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তখন তিনি দুনিয়ার বাহান্নটা ভাষায় বক্তৃতা দেননি? বক্তৃতা দিয়েছিলেন হামেশাই ইংরাজিতে। এবং অনুবাদকেরা আপন আপন মাতৃভাষায় সেসব বক্তৃতা অনুবাদ করেছিলেন।

মার্শাল বুলগানিন, আইসেনহাওয়ার, চার্চিল, মাও-সে-তুঙ, চিয়াং-কাই-শেক যখন ঘন্টার পর ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা করেন– আর চার্চিল তো মামুলি কথা বলতে গেলেও ওজস্বিনী বক্তৃতা ঝাড়েন তখন সকলেই আপন আপন মাতৃভাষাতেই কথা বলেন। দোভাষী তর্জুমানরা সেসব আলাপ-আলোচনার অনুবাদ করেন।

এত বড় যে ইউনাইটেড নেশনস অরগেনাইজেশন (উনো), যেখানে দুনিয়ার প্রায় তাবৎ ভাষাই শুনতে পাওয়া যায়; সে-ও চলে তর্জুমানদের মধ্যস্থতায়।

পাঠক হয়তো বলবেন অনূদিত হলে মূল বক্তৃতার ভাষার কারচুপি অলঙ্কারের ঝলমলানি, গলা ওঠানো-নাবানোর-লম্ফঝম্ফ মাঠে মারা গিয়ে বক্তৃতা রসকষহীন সাদামাটা হয়ে বেরোয়, ওজস্বিনী বক্তৃতা তখন একঘেয়ে রচনা পাঠের মতো শোনায়। সেকথা ঠিক– যদিও প্রোফেশনাল এবং বিচক্ষণ তর্জুমান মূলের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ জৌলুস রাখতে সমর্থ হন– কিন্তু যখন সব বক্তারই বক্তৃতা অনূদিত হয়ে সাদামাটা হয়ে গেল তখন সকলেই সমান লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।

গুণীরা বলেন, আলাপ-আলোচনা যেখানে ঝগড়া-কাজিয়ায় পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেখানে কদাচ বিপক্ষের মাতৃভাষায় কথা বলবে না; তুমি একখানা কথা বলতে-না-বলতে সে দশখানা বলে ফেলবে। বিচক্ষণ লোক মাত্রই স্টেশনে লক্ষ করে থাকবেন যে হুঁশিয়ার বাঙালি বিহারি মুটের সঙ্গে কদাচ উর্দুতে কথা বলে না। আর মুটে যদি তেমনি ঘুঘু হয় তবে সে-ও বাংলা জানা থাকলেও আপন উর্দু চালায়। তবু তো বিহারি মুটেকে কিছুটা ভালো উর্দু জানা থাকলে ঘায়েল করা যায়, কিন্তু করাচিতে যেসব উর্দুভাষীদের মোকাবেলা করতে হবে তাদের উর্দুজ্ঞান পয়লানম্বরি হবে নিশ্চয়ই। প্রেমালাপের কথা স্বতন্ত্র, সেখানে কোনও ভাষারই প্রয়োজন হয় না, টোটিফুটি উর্দু বললেও আপত্তি নেই।

তুলসী দাস কহেন–

জো বালক কহে তোতরি বাতা
সুনত মুদিত নেন পিতু আরু মাতা—

বালক যখন আধা-আধা কথা বলে তখন পিতামাতা মুদ্রিত নয়নে (গদগদ হয়ে) সেকথা শোনেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যগণ শুধু রসালাপ করার জন্য করাচি যাবেন না। স্বার্থের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলে, দরকার বোধ করলে তাদের তো বাগবিতণ্ডাও করতে হবে।

কেন্দ্রের ডাঙর ডাঙর নোকরির বেলাও এই যুক্তি প্রযোজ্য। আমরা যত উত্তম উর্দুই শিখি না কেন, প্রতিযোগিতাত্মক পরীক্ষায় উর্দু-মাতৃভাষীর সঙ্গে কখনওই টক্কর দিতে পারব না। অথচ আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় পরীক্ষা দিই, এবং উর্দু-মাতৃভাষীরা তাঁদের মাতৃভাষায় পরীক্ষা দেন তবে পরীক্ষায় নিরপেক্ষতা রক্ষা করা হবে। তখন প্রশ্ন উঠবে, বাঙালি ছেলেরা উর্দু না জেনে কেন্দ্রে নোকরি করবে কী করে? উত্তরে বলি, সিন্ধি বেলুচি ছেলে যে প্রকারে কেন্দ্রে কাজ করবে ঠিক সেই প্রকারে তাদের মাতৃভাষাও তো উর্দু নয়। পাঠানেরা পশতুর জন্য যেরকম নাড়াচাড়া আরম্ভ করেছেন তাঁদের ওই একই অবস্থা হবে। অথবা বলব উর্দু-মাতৃভাষীরা যে কৌশলে বাংলাদেশে নোকরি করবেন ঠিক সেই কৌশলে। এ সম্বন্ধে বাকি বক্তব্যটুকু অন্য প্রসঙ্গে বলা হবে।

উর্দুওয়ালারা এর পরও শুধাতে পারেন, আমরা যদি উর্দু না শিখি তবে কেন্দ্র থেকে যেসব হুকুম ফরমান, আইন-কানুন আসবে সেগুলো পড়ব কী করে?

উত্তরে বলি, তার জন্যে ঢাকাতে তর্জুমানদের ব্যবস্থা করতে হবে। একথা শুনে উর্দুওয়ালারা আনন্দে লাফ দিয়ে উঠবেন। বলবেন, তবেই তো হল। তর্জুমানদের যখন উর্দু শেখাতেই হবে তখন তামাম দেশকে উর্দু শেখালেই পারো।

এ বড় অদ্ভুত যুক্তি। উদাহরণ না দিলে কথাটা খোলসা হবে না বলে নিবেদন করি, আরব, ফ্রান্স, জর্মনি, স্পেন, রুশিয়া, চীন ইত্যাদি দেশে পাকিস্তানের লোক রাজদূত হয়ে যাবে। তাই কি পাকিস্তানের লোককে আমরা দুনিয়ার তাবৎ ভাষা শেখাই?

একটা গল্প মনে পড়ল। স্বয়ং কবিগুরু সেটি ছন্দে বেঁধেছেন; তাই যতদূর সম্ভব তাঁর ভাষাতেই বলি–

কহিলা হবু শুন গো গোবু রায়
কালিকে আমি ভেবেছি সারারাত্র
 মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়
ধরণী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র?
 শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার
নহিলে কারও রক্ষা নাহি আর।

 মন্ত্রী তখন,

অশ্রুজলে ভাষায়ে পাকা দাড়ি
কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে
যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে
পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে।

 শেয়ানা উত্তর। কিন্তু রাজা মন্ত্রীর চেয়েও ঘড়েল তাই বললেন–

–কথাটা বটে সত্য,
 কিন্তু আগে বিদায় করো ধূলি
ভাবিয়ো পরে পদধূলির তত্ত্ব!

 তখন নানা তরকিব নানা কৌশলে রাজার পা দু খানাকে ধুলা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হল। সাড়ে সতেরো লক্ষ বঁটা দিয়ে তামাম দুনিয়া সাফ করার প্রথম চেষ্টাতে যখন কোনও ফল হল না তখনএকুশ লাখ ভিস্তি দিয়ে জল ঢালার ব্যবস্থা করা হল। তাতেও যখন কিছু হল না তখন–

কহিল, মন্ত্রী, মাদুর দিয়া ঢাকো;
ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।
কহিল কেহ, রাজারে ঘরে রাখো।
কোথাও যেন না থাকে কোনও রন্ধ্র।

রাজার কপাল ভালো বলতে হবে, কেউ যে তাঁর পা দুখানা কাটার ব্যবস্থা করলেন না। শেষটায় সমস্বরে–

কহিল সবে, চামারে তবে ডাকি
চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী।
তখন ধীরে চামার কুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
বলিতে পারি করিলে অনুমতি
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
 নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।

 এত সোজা সমাধান? তাই তো বটে! এই করেই হল জুতা আবিষ্কার। তিনকুড়ি কেন্দ্রীয় সদস্য, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে শ-দুই চাকুরে, আরও শ-দুই তর্জুমানের উর্দু জানার প্রয়োজন [হিসেবটা অত্যন্ত দরাজ হাতে করা গেল); তার জন্য চার কোটি লোককে উর্দু কপচাতে হবে!

না হয় পাঁচশো নয়, সাতশো নয়, পাঁচ হাজার লোকেরই উর্দু বলার প্রয়োজন হবে। তবে তাদের পায়েই উর্দুর জুতা পরিয়ে দিই; এই ভলভলে কাদার দেশে চার কোটি লোককে জুতো পরাই কোন্ হস্তী-বুদ্ধির তাড়নায়?

রবীন্দ্রনাথের গল্পটি এইখানেই শেষ নয়; আমাদের কথাও এখানে ফুরোয় না। আমরা যখন এই জটিল সমস্যার সরল সমাধান বাৎলে দিই তখন

কহিলা রাজা, এত কি হবে সিধে,
ভাবিয়া মল সকল দেশসুদ্ধ।

মন্ত্রী কহে,

বেটারে শূলে বিধে
কারার মাঝে করিয়া রাখ রুদ্ধ।

চামারের মতো সরল সমাধান যারা করতে যায় তাদের জন্য শূলের হুকুম জারি হয়। তাদের তখন নামকরণ হয়এনিমিজ অব দি স্টেট, আজ প্রভোকাতর!!

ইতিহাস দিয়ে যদি-বা সপ্রমাণ করা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানের মতো বিশাল দেশের বিপুল সংখ্যক লোককে কখনও তাদের মাতৃভাষা ভুলিয়ে অন্য ভাষা শেখানো সম্ভবপর হয়নি, ইরান-তুর্কি প্রভৃতি দেশে এ প্রকারের চেষ্টা সর্বদাই নিষ্ফল হয়েছে, তবু একরকমের লোক যারা আপন স্বাধিকার-প্রমত্ততায় দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে নাথিং ইজ ইমপসিবল বুলি কপচান, এ সম্প্রদায়ের লোক যদি দেশের দণ্ডধর না হতেন তবে আমাদের ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজই আর পাঁচজনকে সত্যনিরূপণ করাতে সমর্থ হত। তাই প্রশ্ন, এসব দণ্ডধরদের সামনে অন্য কোন যুক্তি পেশ করা যায়, কী কৌশলে বোঝানো যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে উর্দু চালানো সম্পূর্ণ অসম্ভব।

ফারসিতে বলে জান-মাল, বাংলায় বলিধন-প্রাণ মানুষ এই দুই বস্তু বড় ভালোবাসে; ইতিহাস যা বলে বলুক, এই দুই বস্তু যদি মানুষের হাত এবং দেহ ছাড়ার উপক্রম করে তবে দণ্ডধরেরা পর্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়েন; হাতের পাখি এবং প্রাণপক্ষী বাঁচাবার জন্য তখন ঝোঁপের ইমপসিবল চিড়িয়ার তালাশি বন্ধ হয়ে যায়।

তাই প্রথম প্রশ্ন, ঝোঁপের উর্দু চিড়িয়া ধরতে হলে যে ফাঁদ কেনার প্রয়োজন তার খর্চার বহরটা কী?

ধরা যাক আমরা পূর্ব পাকিস্তানের পাঠশালা, স্কুল, কলেজ সর্বত্র উর্দু চালাতে চাই। পূর্ব পাকিস্তানে ক হাজার পাঠশালা, ক জন গুরুমহাশয়, দ্বিতীয় শিক্ষক, স্কুলমাস্টার, কলেজ প্রফেসার আছেন জানি না, কিন্তু একথা নিশ্চয় জানি যে কেবলমাত্র পাঠশালাতেই যদি আজ আমরা উর্দু চালাবার চেষ্টা করি তবে আমাদের হাজার হাজার উর্দু-শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। সেসব শিক্ষকরা আসবেন বিহার এবং যুক্তপ্রদেশ থেকে। তারা আঠারো কুড়ি-টাকার মাইনেতে পূর্ব বাংলার গায়ে পরিবার পোষণ করতে পারবেন না। আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাইদের কিছু কিছু জমিজমা আছে, কেউ কেউ হালও ধরে থাকেন, এবং তৎসত্ত্বেও তারা যে কী দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে জীবনযাপন করেন সে নিদারুণ কাহিনী বর্ণনা করার মতো শৈলী এবং ভাষা আমার কলমে নেই। লেখাপড়া শিখেছেন বলে গ্রামের আর পাঁচজনের তুলনায় এঁদের সূক্ষ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা এবং আত্মসম্মানজ্ঞান হয় বেশি। মহাজনের রূঢুবাক্য, জমিদারের রক্তচক্ষু এদের হৃদয়-মনে আঘাত দেয় বেশি এবং উচ্চশিক্ষা কী বস্তু তার সন্ধান তারা কিছুটা রাখেন বলে মেধাবী পুত্রকে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা না দিতে পারাটা এঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ইত্তেহাদ, আজাদ মাঝে মাঝে এঁদের হস্তগত হয় বলে এঁরা জানেন যে যক্ষ্মারোগী স্বাস্থ্যনিবাসে বহুস্থলে রোগমুক্ত হয়, হয়তো তার সবিস্তর বর্ণনাও কোনও রবিবাসরীয়তে তারা পড়েছেন এবং তার পর যখন পুত্র অথবা কন্যা যক্ষ্মারোগে চোখের সামনে তিলে তিলে মরে তখন তারা কী করেন, কী ভাবেন, আমাদের জানা নেই। বাইবেলি ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়, ধন্য যাহারা অজ্ঞ, কারণ তাহাদের দুঃখ কম। পণ্ডিতের তুলনায় গাঁয়ের আর পাঁচজন যখন জানে না স্বাস্থ্যনিবাস সাপ না ব্যাঙ না কী, তখন তারা যক্ষ্মা-রোগকে কিস্মতের গর্দিশ বলেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে।

সুদূর যুক্তপ্রদেশ, বিহার থেকে যারা উর্দু শেখাবার জন্য বাংলার জলেভেজা, কাদাভরা, পানাটাকা, জ্বরেমারা পাড়াগাঁয়ে সপরিবার আসবেন তারা মাইনে চাইবেন কত? আমাদের গায়ে গায়ে ফালতত জমিজমা আর নেই যে চাকরি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের লাখেরাজ বা ব-খেরাজ ভূসম্পত্তি দিয়ে দেব আর তারা সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে চন্দ রোজের মুসাফিরি কোনও সুরতে গুজার করে নেবেন। তাই তাদের মাইনে অন্ততপক্ষে কত হওয়া উচিত, আপনারা এবং আর পাঁচজন গাঁও-বুড়ারা, মাথা মিলিয়ে ধরে দিন। আমরা মেনে নেব।

যত কমই ধরুন না কেন, তার দশমাংশ দেবার মতো তাগদও পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রীর নেই (শুধু পূর্ব পাকিস্তানের কেন, এরকম পাগলা প্ল্যান চালাতে চাইলে ইংলন্ড-ফ্রান্সেরও নেই)। জমির সার, হালের বলদ, কলকজা কেনা সবকিছুর জন্য পয়সা খরচা বন্ধ করে এই কি এডুকেশনাল এক্সপেরিমেন্ট করার মোকা!

এতক্ষণ ধনের কথা হচ্ছিল, এখন প্রাণের কথাটা তুলি।

বিহার, যুক্তপ্রদেশ থেকে শিক্ষক আনিয়ে তো আমাদের পাঠশালাগুলো ভর্তি করা হল। আটার অভাবে তাঁরা মাসোহারা পেয়েও অর্ধাহারী রইলেন। তা থাকুন, কিন্তু যেসব হাজার হাজার পাঠশালার বাংলা শিক্ষককে পদচ্যুত করে বিদেশিদের জায়গা করা হল তারা যাবেন কোথায়? কোনও দোষ করেননি, এনিমিজ অব দি স্টেট এরা নন, এঁদের বরখাস্ত করা হবে কোন্ হক্কের জোরে, কোন্ ইসলামি কায়দায়?

পাকিস্তান সফল করেছেন কারা? গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানের প্রোপাগান্ডা ছড়াল কে, সিলেটের প্লেবিসিটের সময় কুর্তা বিক্রয় করে নৌকা ভাড়া করল কারা, পোলোয় করে মরণাপন্ন ভোটারকে বয়ে নিয়ে গেল কার বেটা-বাচ্চারা?

এরাই লড়েছে পাকিস্তান-বিরোধীদের সঙ্গে। এরা কুর্দিনশীন, মোটর-সওয়ার পলিটিশিয়ান নয়। এরা লড়তে জানে। দরকার হলে এরা দলে দলে ঢাকার দিকে ধাওয়া করবে, সঙ্গে যাবে তাদের বাধ্য চাষা-মজুর। তাদের সংখ্যা কী হবে অনুমান করতে পারছিনে, কিন্তু শুনেছি এক ঢাকা শহরের বাংলাভাষী মুষ্টিমেয় ছাত্রসম্প্রদায়ের হাতেই বাংলা-উর্দু বাবদে কোনও কোনও দণ্ডধর কর্তাব্যক্তি লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়েছেন। ছাত্ররা শহরবাসী কিন্তু এরা গ্রাম্য; এরা প্রাণের ভয় দেখাতে জানে। ধন তো আগেই গিয়েছিল বিদেশ থেকে শিক্ষক আনিয়ে, তখন আরম্ভ হবে প্রাণের ওপর হামলা।

খুদা পানাহ। আমরা এ অবস্থার কল্পনাও করতে পারিনে। আমাদের বিশ্বাস, কর্তাব্যক্তিরা তার বহু পূর্বেই কিতাবুমুবিন দেখে সিরাতুল মুস্তাকিমের সন্ধান পাবেন;-ওয়া আম্মাস্সইলা ফলা তনহর, অর্থাৎ সাইল (প্রার্থী)-দের প্রত্যাখ্যান কোরো না!১ এস্থলেসাইল শব্দ আরবি অর্থে নিতে হবে, উর্দু অর্থে নয়, এবং তা হলে কথাটা আমাদের গরিব গুরুমহাশয়দের বেলাই ঠিক ঠিক খাটে।

হিটলার কুরানের এ আদেশ মানেননি। যে রোম ও তার সাঙ্গোপাঙ্গের কর্মতৎপরতার দরুন তিনি জার্মানিতে তার তৃতীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, দেড় বৎসর যেতে-না-যেতে তিনি র্যোম এবং তার প্রধান সহকর্মীদের গুলি করে মেরেছিলেন। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস আমাদের কর্তাব্যক্তি কুতুবমিনাররা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন এবং ইসলামে গণতন্ত্রের অর্থ হক ওসবর-এর ওপর নির্ভর করা (ওয়া তাত্তাসাও বিল হক্তি, ও তত্তাসাও বিস্-সবর)।

এ তো গেল পাঠশালার কথা। হয়তো উর্দুওয়ালারা বলবেন যে তারা পাঠশালায় বাংলাই চালাবেন কিন্তু স্কুল-কলেজে পড়াবেন উর্দু। দু রকম শিক্ষাব্যবস্থার অধর্ম ও কুফল আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি; আপাতত শুধু এইটুকু দ্রষ্টব্য যে স্কুল-কলেজে তাবৎ বিষয়বস্তু উর্দুর মাধ্যমিকে পড়াতে হলে উপস্থিত যেসব শিক্ষকরা এসব বিষয় পড়াচ্ছেন তাদের সকলকে বরখাস্ত করতে হবে এবং তাঁদের স্থলে যুক্তপ্রদেশ ও বিহার থেকে হাজার হাজার শিক্ষক আনাতে হবে।

কাজেই প্রথম প্রশ্ন, এসব মাস্টাররা কি অন্ন-হারা হওয়ার দুর্দৈবটা চোখ বুজে সয়ে নেবেন? প্রত্যেক অনুন্নত দেশের বেকার সমস্যার প্রধান অংশ সমাধান করে শিক্ষাবিভাগ, কারণ তার হাতে বিস্তর চাকরি। পূর্ব পাকিস্তান সে সমস্যার সমাধান দূরে থাক, পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি শিক্ষকদের বরখাস্ত করে বাইরের থেকে লোক ডেকে সৃষ্টি করবেন বৃহৎ বেকার সমস্যা।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক এবং কলেজে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, কৃষিবিদ্যা, পূর্ত-খনিজ-বৈদ্য-শাস্ত্র পড়াবার জন্য উর্দুভাষী শিক্ষক পাওয়া যাবে তো? ভুললে চলবে না যে পূর্ব পাকিস্তান যদি উর্দু গ্রহণ করে তবে সিন্ধুপ্রদেশ এবং বেলুচিস্তানেও ঠিক আমাদের কায়দায়ই উর্দু মাস্টার, প্রফেসরের চাহিদা ভয়ঙ্কর বেড়ে যাবে। ফলে যখন আমরা ঢাকার স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের যে মাইনো দিচ্ছি সে মাইনের চেয়ে দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ দিতে হবে এইসব বহিরাগতদের। অত টাকা কোথায়? এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস উর্দুর মাধ্যমিকে উপরে লিখিত তাবৎ বিষয় পড়াবার মতো শিক্ষক বিহার যুক্তপ্রদেশে পাঞ্জাবে প্রয়োজনের দশমাংশও নেই।

তৃতীয় প্রশ্ন, তাবৎ পাঠ্যপুস্তক উর্দুতে লেখবার জন্য গ্রন্থাকার কোথায়? প্রয়োজনীয় শিক্ষকের দশমাংশ যখন বাজারে নেই তখন লেখকের দশমাংশও যে পাব না সে তথ্যও অবিসংবাদিত সত্য। কিছু বই লাহোর থেকে আসবে সত্য, কিন্তু বাংলার ভূগোল, ইতিহাস, কৃষিবিদ্যা তো লাহোরে লেখা হবে না এবং পূর্ব পাকিস্তানে এসব বিষয় লেখার লোক নেই। এবং যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করি না কেন, আমাদের পাঠ্যপুস্তক-লেখকদের রুটি বহু বৎসরের জন্য নির্ঘাত মারা যাবে।

চতুর্থ প্রশ্ন, উর্দু ছাপাখানা, কম্পজিটর, প্রুফ-রিডার কোথায়? বাংলা প্রেস, প্রুফ-রিডাররা বেকার হয়ে যাবে কোথায়?

এবং সর্বশেষ দ্রষ্টব্য : পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশের স্কুল-কলেজে এখনও উর্দু শিক্ষার মাধ্যমিক হয়নি। বিবেচনা করি, আস্তে আস্তে হবে। কিন্তু পাঞ্জাবিদের পক্ষে এ কর্ম অপেক্ষাকৃত সরল হবে কারণ উর্দু তাদের মাতৃভাষা। দরকার হলে কেঁদেককিয়ে তারা উর্দুতে আপন আপন বিষয় পড়াতে পারবেন কিন্তু বাঙালি মাস্টার-প্রফেসারের পক্ষে উর্দু শিখে আপন কর্তব্য সমাধান করতে বহু বহু বৎসর লাগবে। ততদিন আমরা থ্রি-লেগেড রেস রান করি? বিশেষ করে যখন কি না পূর্ব পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাষ্ট্রাংশ করার জন্য আমাদের কর্তব্য (ফ বললে ভালো হয়) ঊর্ধ্বশ্বাসে, ত্বরিতগতিতে সম্মুখপানে ধাবমান হওয়া।

উর্দুওয়ালারা যদি বলেন, আমরা স্কুল-কলেজে উর্দু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শেখাব, আজ যেরকম ফারসি, আরবি, সংস্কৃত অপশনাল সেকেন্ড ল্যান্গুইজ হিসেবে শেখাচ্ছি, তা হলে এ প্রস্তাবে যে আমাদের বিন্দুমাত্রও আপত্তি নেই শুধু তাই নয়, আমরা সর্বান্তঃকরণে সায় দিই। প্রসঙ্গান্তরে সে আলোচনা হবে।

এ বিষয়ে আরেকটি কথা এইবেলা বলে নেওয়া ভালো। সাধারণত ওদিকে কেউ বড় একটা নজর দেন না। আমাদের প্রশ্ন, সব বিষয় পড়াবার জন্য যদি আমরা উর্দু শিক্ষক পেয়েও যাই, উর্দু শিক্ষয়িত্রী পাব কি? না পেলে আমাদের স্ত্রীলোকদের শিক্ষার কী ব্যবস্থা হবে, উর্দুওয়ালারা ভেবে দেখবেন কি? আমাদের কাছে পাকাপাকি খবর নেই, কিন্তু শুনতে পাই বাংলা শিক্ষয়িত্রীর অভাবেই আমরা যথেষ্ট কাহিল হয়ে পড়েছি। (এস্থানে উল্লেখ করি শ্রীহট্ট শহরের মহিলা মুসলিম লীগ তথা অন্যান্য মহিলারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গত নভেম্বর মাস থেকে একটানা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, পাকিস্তান নবজাত শিশুর ন্যায় নবজাত রাষ্ট্র। মাতৃভাষারূপ মাতৃস্তন্য ব্যতীত অন্য যে কোনও খাদ্য তার পক্ষে গুরুপাক হবে।)।

উর্দুওয়ালারা কেউ কেউ বলে থাকেন– অতশত বুঝি না, আমরা চাই, বাংলা ভাষার আজ যে পদ পূর্ব পাকিস্তানে আছে ঠিক সেইরকমই থাক, এবং ইংরেজির আসনটি উর্দু গ্রহণ করুক। তার অর্থ এই যে উর্দু উচ্চশিক্ষার মাধ্যমিক (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) হোক।

মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা শিক্ষার মাধ্যমিক করলে যে কী প্রাণঘাতী বিষময় ফল জন্মায় তার সবিস্তর আলোচনা না করে উপায় নেই।

প্রথম পৃথিবীর কোন শিক্ষিত সভ্য দেশ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছে? ইংলন্ড, ফ্রান্স, জর্মনি, ইতালি, চীন, জাপান, রুশ, মিশর, ইরাক, তুর্কি, ইরান এমন কোন দেশ আছে যেখানকার লোক আপন মাতৃভাষাকে অবমাননা করে আপন দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে? আরবি পূতপবিত্র, ঐশ্বর্যশালিনী, ওজস্বিনী ভাষা; কিন্তু কই, তুর্কি, ইরান, চীন, জাভার কোটি কোটি লোকে তো আরবির মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে না, বিদ্যাভ্যাস শাস্ত্রচর্চা করে না। তবে বাংলার বেলা এ ব্যত্যয় কেন? বাংলা ভাষাভাষী লোকসংখ্যা তো নগণ্য নয়। সংখ্যা দিয়ে যদি ভাষার গুরুত্ব নির্ণয় করি এবং সে নির্ণয়করণ কিছু অন্যায় নয়– তবে দেখতে পাই চীনা, ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু, রুশ, জর্মন ও স্পেনিশের পরেই বাংলার স্থান। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ছয় কোটি (পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সোয়া চার কোটি) এবং তার তুলনায় ভুবনবিখ্যাত ফরাসি ভাষায় কথা বলে সাড়ে চার কোটি, ইতালিয়ানে চার কোটি, ফারসিতে এক কোটি, তুর্কিতে সত্তর লক্ষ, এমনকি আরবিতেও মাত্র আড়াই কোটি। যে ভাষায় এত লোক সাহিত্যসৃষ্টি করবার জন্য সুযোগ অনুসন্ধান করছে তাদের এতদিন চেপে রেখেছিল মৌলবি-মৌলানাদের আরবি-ফারসি-উর্দু এবং পরবর্তী যুগে ইংরেজি। বাংলার সময় কি এখনও আসেনি, সুযোগ কি সে কোনওদিনই পাবে না?

মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষাদানের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে এবং তার ফল কী সেকথাও ঐতিহাসিকদের অবিদিত নয়। ক্যাথলিক জগতে কেন্দ্র অর্থাৎ পোপের সঙ্গে যোগ রাখার প্রলোভনে (আজ পূর্ব পাকিস্তান করাচির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য যেরকম প্রলুব্ধ) একদা ইয়োরোপের সর্বত্র লাতিনের মাধ্যমিকে শিক্ষাদান পদ্ধতি জনসাধারণের মাতৃভাষার উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। এবং সে পাথর সরাবার জন্য লুথারের মতো সংস্কারক ও প্রোটেস্টান্ট ধর্মের মতো নবীন সংস্কারপদ্ধতির প্রয়োজন হয়েছিল। পরবর্তী যুগে দেখতে পাই ফরাসি লাতিনের জায়গা দখল করেছে এবং তার চাপে দিশেহারা হয়ে ফ্রেডরিক দি গ্রেটের মতো জর্মন সম্রাট মাতৃভাষা জর্মনকে অবহেলা করে ফরাসিতে কবিতা লিখেছেন এবং সে কবিতা মেরামত করবার জন্য ফরাসি গুণী ভলতেয়ারকে পৎসদামে নিমন্ত্রণ করেছেন। ঠিক সেইরকম রাশিয়ারও অনেক বত্সর লেগেছিল ফরাসির নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে। আজ উর্দুওয়ালারা বাংলাকে যেরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন ঠিক সেইরকম জর্মন ও রুশ আপন আপন মাতৃভাষাকে অবহেলা করে বহু বৎসর যশের মন্দিরে প্রবেশ লাভ করতে পারেননি।

এসব উদাহরণ থেকে এইটুকু স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যতদিন পর্যন্ত মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমিকরূপে গ্রহণ না করা হয় ততদিন শিক্ষা সমাজের উচ্চস্তরের গুটিকয়েক লোকের সংস্কৃতিবিলাসের উপকরণ মাত্র এবং যেখানে পূর্বে শুধু অর্থের পার্থক্য মানুষে মানুষে বিভেদ আনত সেখানে উচ্চশিক্ষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য দুই শ্রেণির বিরোধ কঠোরতর করে তোলে।

এ দেশে যে ইসলামি শিক্ষা কখনও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি তার প্রধান কারণ বাংলার মাধ্যমিকে কখনও শাস্ত্রচর্চা করা হয়নি। যে বস্তু মাতৃভাষায় অতি সহজ, অত্যন্ত সরল, বিদেশি ভাষায় সেই বস্তুই অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন আরম্ভ হয় স্কুল থেকে পালানোর পালা এবং মধ্যবিত্ত ও ধনীর গৃহের চাপের ফলেই এই দুই শ্রেণির ছেলে তখনও লেখাপড়া শেখে, কিন্তু অনুন্নত গরিব তখন ভাবে যে পরিবারে যখন কেউ কখনও লেখাপড়া শেখেনি তখন এ ছেলেই-বা পারবে কেন, বাপ-দাদার মতো এরও মাথায় গোবর ঠাসা।

মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষা দিলে যে দেশের কতদূর ক্ষতি হয় তার সামান্যতম জ্ঞান এখনও আমাদের হয়নি। সে শিক্ষাবিস্তারে যে তখন শুধু অজস্র অর্থ ব্যয় হয় তা নয়, সে শিক্ষা ছাত্রের বুদ্ধিবৃত্তিকে অবশ করে তোলে, কল্পনাশক্তিকে পঙ্গু করে দেয় এবং সর্বপ্রকার সৃজনীশক্তিকে কণ্ঠরোধ করে শিক্ষার আঁতুড়ঘরেই গোরস্তান বানিয়ে দেয়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- আমার অভিজ্ঞতা কলেজের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকরূপে অর্জিত যে পশ্চিম ভারতের কার্ভে স্ত্রী-মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যদিও দু-এক দিক দিয়ে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে পশ্চাৎপদ তবু স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা যেমন তাদের বেশি তেমনি প্রকাশক্ষমতা, আত্মপরিচয় দানের নৈপুণ্য তাদের অনেক বেশি। তার একমাত্র কারণ কার্ভে স্ত্রী-মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আপন আপন মাতৃভাষায় মাধ্যমিকে লেখাপড়া করে আর বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা লেখাপড়া শেখে ইংরেজির মাধ্যমিকে। কার্ভের মেয়েরা সেই কারণে আপন মাতৃভাষায় নিঃসঙ্কোচ অবাধ গতিতে আপন বক্তব্য বলতে পারে; বোম্বাই, কলিকাতা, ঢাকার ছেলেরা না পারে বাংলা শিখতে, না জানে ইংরেজি পড়তে।

এ কাহিনীর শেষ নেই কিন্তু আমাকে প্রবন্ধ শেষ করতে হবে। তাই পাঠককে সবিনয় অনুরোধ করি তিনি যেন শিক্ষাবিভাগের কোনও পদস্থ ব্যক্তিকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন। শ্রীহট্টের খ্যাতনামা আলিম মৌলানা সখাওতুল আম্বিয়া প্রমুখ গুণীগণ আমার সম্মুখে বহুবার স্বীকার করেছেন যে মাদ্রাসাতে যদি বাংলাভাষা সর্বপ্রকার বিষয় শিক্ষার মাধ্যমিক হত তবে আমাদের আরবি-ফারসির চর্চা এতদূর পশ্চাৎপদ হত না। এবং কৌতুকের বিষয় এই যে, যে উর্দুওয়ালারা বাংলাকে এত ইনকার-নফরৎ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন তাদেরও অনেকেই কঠিন বিষয়বস্তু যখন উর্দুতে বোঝাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যান তখন নোয়াখালি, সিলেটের গ্রাম্য উপভাষারই শরণাপন্ন হন।

এত সরল জিনিস উর্দুওয়ালাদের কী করে বোঝাই? কী করে বোঝাই যে পারস্যের লোক যখন ফারসির মাধ্যমিকে আরবি (এবং অন্যান্য তাবৎ বিষয়) শেখে, তুর্কির লোক যখন তুর্কি ভাষার মাধ্যমিকে আরবি শেখে, তখন বাংলার লোক আরবি (এবং অন্যান্য তাবৎ বিষয়) শিখবে উর্দুর মাধ্যমিকে কোন আজগুবি কাণ্ডজ্ঞানহীনতার তাড়নায়?

এ প্রসঙ্গের উপসংহারে শেষ কথা নিবেদন করি, মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমিক না করলে সে ভাষা কখনও সমৃদ্ধিশালী হবার সুযোগ পায় না।

স্বরাজ এল পাকিস্তান হল কিন্তু হায়, গোস্বামী খাসলত (মনোবৃত্তি ও আচার-ব্যবহার) যাবার কোনও লক্ষণ তো দেখতে পাচ্ছিনে। এতদিন করতুম ইংরেজির গোলামি, এখন স্বেচ্ছায় বরণ করে নিচ্ছি উর্দুর গোলামি। খতম আল্লাহু আলা কুপুবিহিম ইত্যাদি। খুদাতালা তাদের বুকের উপর সিল এঁটে দিয়েছেন। (কুরান থেকে এ অংশটুকু এখানে উদ্ধৃত করার কোনও প্রয়োজন হত না, যদি কোনও কোনও মৌলানা বাংলা ভাষার সমর্থকদের কাফির হয়ে যাওয়ার ফতোয়া না দিতেন)।

এইবার দেখা যাক, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সরকারি ও সাংস্কৃতিক ভাষারূপে গ্রহণ করতে উর্দুওয়ালাদের আপত্তিটা কী?

তাদের প্রধান আপত্তি, বাংলা হেঁদুয়ানি ভাষা। বাংলাভাষায় আছে হিন্দু ঐতিহ্য, হিন্দু কৃষ্টির রূপ। পূর্ব পাকিস্তানি যদি সে ভাষা তার রাষ্ট্র ও কৃষ্টির জন্য গ্রহণ করে তবে সে হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে যাবে।

উত্তরে নিবেদন, বাংলাভাষা হিন্দু ঐতিহ্য ধারণ করে সত্য, কিন্তু এইটেই শেষ কথা নয়। বাংলাভাষার জন্ম হয়েছে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

বুদ্ধদেব যেরকম একদিন বৈদিক ধর্ম ও তার বাহন সংস্কৃতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৎকালীন দেশজ ভাষায় (পরে পালি নামে পরিচিত) আপন ধর্ম প্রচার করেন, ঠিক সেইরকম বাংলাভাষার লিখিত রূপ আরম্ভ হয় বৌদ্ধ চর্যাপদ দিয়ে। পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যরূপ নেয় বৈষ্ণব পদাবলির ভিতর দিয়ে। আজ পদাবলি সাহিত্যকে হিন্দুধর্মের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয় কিন্তু যে যুগে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারিত সে যুগে তাকে বিদ্রোহের অস্ত্র ধারণ করেই বেরুতে হয়েছিল। তাই শ্রীচৈতন্য প্রচলিত ধর্ম সংস্কৃতে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছিল বাংলায়। সঙ্গে সঙ্গে রামায়ণ-মহাভারতের যে অনুবাদ বাংলায় প্রকাশিত হয় তার পেছনে ছিলেন মুসলমান নবাবগোষ্ঠী। কেচ্ছা-সাহিত্যেরই সম্মান আমরা দিই– হিন্দুরা দেন না এবং সে সাহিত্য হিন্দু ঐতিহ্যে গড়া নয়। এর পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে বাংলাগদ্যের পত্তন হয় তার অনুপ্রেরণা খ্রিস্টান সভ্যতা থেকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু বলে স্বীকার করেন কি না, সেকথা অবান্তর– তাঁর অবদান যে উপনিষদ-সংস্কৃতি ও ইয়োরোপীয় প্রভাবের ফলে গঠিত সেকথা অনস্বীকার্য। শ্রীরামকৃষ্ণদেব প্রচলিত নতুন ধারাকে বৈদিক কিংবা সনাতন বলা ভুল, সে ধারা গণ-উপাসনার উৎস থেকে প্রবাহিত হয়েছে এবং সে উৎসকে গোঁড়া হিন্দুরা কখনও শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেননি। স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদের মূল বেদ উপনিষদ নয়।

উর্দুওয়ালারা বলবেন, এসব খাঁটি হিন্দু না হতে পারে, কিন্তু আর যাই হোক না কেন, ইসলামি নয়।

আমরা বলি, ইসলামি নয় সত্য কিন্তু এর ভেতরে যে ইনকিলাব মনোবৃত্তি আছে সেটি যেন চোখের আড়ালে না যায়। এই বিদ্রোহ ভাব বাংলায় ছিল বলে কাজী নজরুল ইসলাম একদিন আপনবিদ্রোহী দিয়ে রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত মরমিয়াপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে যে নবীন কৃষ্টি গঠিত হবে সেটা এই বিদ্রোহ দিয়েই আপন বিজয় অভিযান আরম্ভ করবে।

এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে আরেকটি কথা বলি : উত্তরভারতের তাবৎ সংস্কৃতভাবাপন্ন। ভাষার মধ্যে (হিন্দি, মারাঠি, গুজরাতি ইত্যাদি) বাংলাই সবচেয়ে অসংস্কৃত। হিন্দি, মারাঠি পড়বার বা বলবার সময় সংস্কৃত শব্দ খাঁটি সংস্কৃত উচ্চারণে পড়া এবং বলা হয়–পরীক্ষা পড়া হয় পরীক্ষা, আত্মা পড়া হয়আত্মা–কিন্তু বাংলায় সংস্কৃত শব্দ, এমনকি সংস্কৃত ভাষা উচ্চারণ করার সময়ও উচ্চারণ করা হয় বাংলা পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে বাঙালি হিন্দু পর্যন্ত উর্দুভাষী মুসলমানের চেয়ে এককাঠি বাড়া। উর্দুভাষী মুসলমান তার ভাষার সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করে খাঁটি সংস্কৃত কায়দায়, বাঙালি হিন্দু উচ্চারণ করে অনার্য কায়দায়।

না-হয় স্বীকার করেই নিলুম, বাংলাহের্দুয়ানি ভাষা কিন্তু প্রশ্ন, এই ভাষা এতদিন ধরে ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান কি না-পাক, হির্দু হয়ে গিয়েছে? পাকিস্তান-স্বপ্ন সফল করাতে কি পূর্ব পাকিস্তানের না-পাক মুসলমানদের কোনও কৃতিত্ব নেই? পাকিস্তান-স্বপ্ন কি সফল হল লাহোর, লক্ষৌর কৃপায়? পূর্ব পাকিস্তানে যারা লড়ল তারা কি সবাই উর্দুর পাবন্দ আলিম-ফাজিল, মৌলানা-মৌলবির দল? না তো। লড়ল তো তারাই যারা উর্দু জানে না, এবং বাংলার জন্য আজ যারা পুনরায় লড়তে তৈরি আছে। এইসব লড়নেওয়ালারা এতদিনকার ইংরেজ আধিপত্য এবং হিন্দুপ্রভাবের ফলেও যখন হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে যায়নি, তখন পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলেই তারা রাতারাতি ইসলামি জোশ হারিয়ে পাকিস্তানের শত্রু বনে যাবে? এ তো বড় তাজ্জব কথা! বাংলাভাষার এত তাগদ?

দ্বিতীয় বক্তব্য আমরা ইতিহাস নিয়ে আরম্ভ করি। পূর্বেই বলেছি ফিরদৌসির আমলে ইরানের সর্বত্র আরবি প্রচলিত ছিল– ইরানের রাষ্ট্রভাষা ছিল আরবি। তখনকার দিনে যেটুকু ফরাসি প্রচলিত ছিল সে ছিল কাফির, অগ্নি-উপাসক, জরথুস্ত্রিদের ভাষা। সে ভাষায় একেশ্বরবাদের নামগন্ধ তো ছিলই না, তাতে ছিল দ্বৈতবাদের প্রচার, এককথায় সে ভাষা ছিল ন-সিকে ইসলাম-বিরোধী, কাফিরি। তবু কেন সে ভাষা চর্চা করা হল, এবং সে চর্চা করলেন কারা? কাফিরি জরথুস্ত্রিরা করেনি, করেছিলেন আরবি জাননেওয়ালা মুসলমানেরাই। কেন?

তুর্কিতেও তাই। কেন?

এ দুটো খাঁটি ইসলামি দেশের উদাহরণ; এবার স্বদেশে সেই দৃষ্টান্তই খোঁজা যাক। পাঠান-মোগল যুগে এদেশে ফারসি বহাল তবিয়তে রাষ্ট্রভাষার রাজ-সিংহাসনে বসে দিশি ভাষাগুলোর ওপর রাজত্ব করত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সেই ফারসির সঙ্গে দেশজ হিন্দি মিলিয়ে উর্দুভাষা কেন নির্মাণ করা হল? কিন্তু সেটা আসল প্রশ্ন নয়, আসল প্রশ্ন যে হিন্দিকে নিয়ে উর্দু বানানো হল সে ভাষা কিপাক ছিল?

আমরা জানি সে ভাষায় তখন তুলসীদাসের রামায়ণ সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক– এখনও তাই। সেই পুস্তকের আওতায় সমস্ত হিন্দিসাহিত্য গড়ে উঠেছে এবং তাতে আছে ইসলামদ্রোহী কট্টর মতবাদ। বাল্মীকির রামায়ণে যে ব্যক্তি মানুষ, রাজা এবং বীর, তিনি তুলসীর রামায়ণে খুদ ভগবানের আসন তসরুপ করে বসে আছেন। ইসলামে মানুষকে আল্লার আসনে তোলা সবচেয়ে মারাত্মক কুফর।

আজকের বাংলা ভাষা সেদিনকার হিন্দির তুলনায় বহুগুণে পাক। আজ বাংলা সাহিত্যে যে ঈশ্বর গানে-কবিতায় নন্দিত হচ্ছেন তিনি সুফির মরমের আল্লাহ, হক। তার সন্ধান গীতাঞ্জলিতে– সে পুস্তক তামাম পৃথিবীতে সম্মান লাভ করেছে।

এবার যে দৃষ্টান্ত পেশ করব সেটি সভয়ে এবং ঈষৎ অনিচ্ছায়। দৃষ্টান্তটি কুরানের ভাষা নিয়ে এবং এ জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করার হক আলিম-ফাজিলদের। কিন্তু শ্রদ্ধেয় গোলাম মোস্তফা সাহেব যখন রসুলুল্লার জীবনী থেকে নজির তুলে পূর্ববঙ্গবাসী মুসলমানকেপাঞ্জাবি প্রভুত্ব বরদাস্ত করতে উপদেশ দিয়েছিলেন, (মক্কা হইতে মোহাজেরগণ যখন দলে দলে মদিনায় পৌঁছিতে লাগিলেন, তখন মদিনার আনসারগণ মক্কাবাসীদিগকে সাদরে গ্রহণ করিতেন, ) আজ তাহারা– পাঞ্জাবিরা আমাদের দুয়ারে অতিথি। আমাদের কি উচিত নয় তাহাদের প্রতি একটু (!) সহানুভূতি দেখানো? (বিস্ময়বোধক চিহ্ন আমার) তখন আমিই-বা এমন কী দোষ করলুম?

আরবি ভাষায় কুরান শরিফ যখন অবতীর্ণ হলেন তখন সে ভাষার কী রূপ ছিল? সে ভাষা কিপাক পবিত্র ছিল, না পৌত্তলিকতার গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল? আমরা জানি লাত, উজ্জা, মনাত প্রভৃতি দেব-দেবীর প্রশস্তিতে সে ভাষা পরিপূর্ণ ছিল এবং একেশ্বরবাদ বা অন্য কোনও সত্যধর্মের (খ্রিস্ট অথবা ইহুদি) কণামাত্র ঐতিহ্য সে ভাষায় ছিল না।

পক্ষান্তরে আরবদেশে বিস্তর ইহুদি ও খ্রিস্টান ছিলেন। হজরতের বহুপূর্বেই হিব্রুভাষা তওরিত, (তোরা এবং ওল্ড টেস্টামেন্ট) বুকে ধরে পবিত্র ভাষারূপে গণ্য হয়েছিল, এবং হিব্রুর উপভাষা আমারমেইকের মাধ্যমে মহাপুরুষ ইসা ইঞ্জিল (এভানজেলিয়াম অথবা বাইবেলেরনিউ টেস্টামেন্ট) প্রচার করেছিলেন। কুরান অবতীর্ণ হবার প্রাক্কালে হিব্রুভাষা একেশ্বরবাদের চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে, এবং বাইবেল-ভক্ত মাত্রেই জানেন সেই একেশ্বরবাদ, মৃত্যুর পরের বিচার, এর ফলস্বরূপ স্বর্গ অথবা নরক ইত্যাদি ইসলামের মূল বিশ্বাস (নবুওত ব্যতীত) প্রচারের ফলে হিব্রুভাষা সেমিতি ধর্মজগতে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল।

তবু কেন সে ভাষায় অবতীর্ণ না-হয়ে কুরান শরিফ পৌত্তলিকের ভাষায় নাজিল হলেন।

এ পরম বিস্ময়ের বস্তু এবং শুধু আমরাই যে আজ বিস্মিত হচ্ছি তা নয়, স্বয়ং মহাপুরুষের আমলেও বিস্ময় বহুমুখে প্রকাশ হয়েছিল।

কিন্তু সে বিস্ময়ের সমাধান স্বয়ং আল্লাহতালা কুরান শরিফে করে দিয়েছেন। পাছে বাংলা অনুবাদে কোনও ভুল হয়ে যায় তাই মৌলানা আব্দুলা য়ুসুফ আলীর কুরান-অনুবাদ থেকে শব্দে শব্দে তুলে দিচ্ছি। আল্লা বলেন,

Had we sent this as
 A Quran (in a language)
Other than Arabic, they would
Have said :Why are not
 Its verses explained in detail?
 What! (a Book) not in Arabic
And (a Messenger) an Arab?

অর্থাৎ আমরা যদি আরবি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষায় কুরান পাঠাতুম তা হলে তারা বলত এর বাক্যগুলো ভালো করে বুঝিয়ে বলা হল না কেন? সে কী! (বই) আরবিতে নয় অথচ (পয়গম্বর) আরব!

খুদাতালা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, আরব পয়গম্বর সে আরবি ভাষায় কুরান অবতরণের আধার হবেন সেই তো স্বাভাবিক, এবং অন্য যে কোনও ভাষায় সে কুরান পাঠানো হলে মক্কার লোক নিশ্চয়ই বলত, আমরা তো এর অর্থ বুঝতে পারছিনে।

কুরানের এই অঙ্গুলিনির্দেশ মতো চললেই বুঝতে পারব ভাষার কৌলিন্য-অকৌলীন্য অত্যন্ত অবান্তর প্রশ্ন, আসল উদ্দেশ্য ধর্মপুস্তক যেন আপামর জনসাধারণ বুঝতে পারে। বার বার কতবার কুরানে বলা হয়েছে, এ বই খোলা বই, এ বই আরবিতে অবতীর্ণ হল যাতে করে সর্বসাধারণের জন্য এ বই সরল দিগদর্শক হতে পারে।

সর্বসাধারণ সনাতন ধর্মের বাণী মাতৃভাষায় বুঝুক এই মাহাত্ম্য যে কত গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বব্যঞ্জক সেকথা আমরা এখনও সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস পূর্বাচার্যগণ এ বাণী হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সক্ষম হয়েছিলেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধর্মজ্ঞান যদি মুষ্টিমেয় পণ্ডিতের বিদ্যাচর্চার বিলাসবস্তু না হয়ে আপামর জনসাধারণের নিত্য অবলম্বনীয় সখারূপে সপ্রকাশ হতে চায় তবে সে ধর্মশিক্ষা মাতৃভাষাতেই দিতে হবে। কোনও বিদেশি ভাষা দ্বারা জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে ধর্মশিক্ষা দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব, মাতৃভাষার সাহায্য নিতেই হবে, তা সে মাতৃভাষা পূতপবিত্রই হোক আর ওছা নাপাকই হোক। এ তত্ত্বটা ইরানের মনীষীরা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই একদা ইরানে আরবির বহুল প্রচার থাকা সত্ত্বেও নাপাক ফারসি ভাষাকে ধর্মশিক্ষার বাহনরূপে ব্যবহার করেছিলেন। ভারতীয় মনীষীরা ঠিক সেই কারণেই এদেশে বিদেশি ফারসি প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও না-পাক হিন্দির সঙ্গে আরবি-ফারসি মিলিয়ে উর্দু নির্মাণ করেছিলেন।

বাংলাদেশের মৌলবি-মাওলানারা সস্তায় কিস্তিমাত করতে চেয়েছিলেন বলেই দেশজ বাংলাকে ধর্মশিক্ষার বাহনরূপে স্বীকার করেননি উর্দু দিয়ে ফাঁকতালে কাজ সারিয়ে নেবার চেষ্টাতেই ছিলেন। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে আজ এই খেসারত দিতে হচ্ছে যে নিজ বাসভূমে, পরবাসী হওয়ার মতো নিজ মাতৃভাষায় যে কোনও কিছুরই চর্চা করতে পারেনি। যুক্তপ্রদেশ তথা পাঞ্জাবের মৌলবি-মাওলানাগণ যেরকম মাতৃভাষা উর্দুর সাহায্যে শাস্ত্রচর্চা করেছিলেন, বাঙালি আলিমগণও যদি বাংলায় সেরকম শাস্ত্রচর্চা করে রাখতেন তা হলে সেই সূত্রপাতের খেই ধরে আজ বাঙালি মুসলমান নানা সাহিত্য নির্মাণ করে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারত। এবং যখন দেখি যে বাঙালি আলিমগণ বাংলায় শাস্ত্রচর্চা না করে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে অজ্ঞ রাখলেন তাঁরাই বাঙালি তরুণকে তার ধর্মশাস্ত্রের অজ্ঞতা নিয়ে তাচ্ছিল্য অবহেলা করেন তখন বিস্ময়ে বাক্যস্ফুরণ হয় না। আপন কর্তব্যচ্যুতি ঢাকবার এই কি সরলতম পন্থা? এবং, তাঁরা এ কথাটাও বুঝলেন না যে, বাঙালি হিন্দু, যেরকম সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে শাস্ত্রগ্রন্থ বাংলাতে অনুবাদ ও প্রচার করার জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়, তাঁরাও বাংলায় ইসলামি শাস্ত্রের চর্চা করলে বাঙালি মুসলমানের কাছ থেকে সেরকম শ্রদ্ধাঞ্জলি পেতেন।

আবার বলি, এখনও সময় আছে। উর্দু-বাংলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা সরল বাংলা (লিসানু-ম্মুবীন) গ্রহণ করবেন, না আবার উর্দু দিয়ে ফোকটে কাজ সারবার তালে থাকবেন?

ধর্মজগতে পোপকে একদা এই দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার খাস-পেয়ারা লাতিন সর্বদেশের সর্বমাতৃভাষাকে পদদলিত করে

পাকা রাস্তা বানিয়ে বসে দুঃখীর বুক জুড়ি
ভগবানের ব্যথারপরে হাঁকায় সে চার-ঘুড়ী

–করবে, না তিনি লুথারের প্রস্তাবমতো মাতৃভাষায় শাস্ত্রচর্চা করতে দেবেন? পোপ সত্যপথ দেখতে পাননি, তিনি ভুল করেছিলেন। ফলে খ্রিস্টজগৎ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।

আজ যদি জোর করে পোপের ভ্রান্তাদর্শ অনুসরণ করে উর্দুওয়ালা পূর্ব পাকিস্তানের স্কন্ধে উর্দু চাপান তবে লুথারের মতো লোক পূর্ব পাকিস্তানে খাড়া হতে পারে। যারা অখণ্ড পাকিস্তান চান তারা এই কথাটি ভেবে দেখবেন।

ভাষার পাকি না-পাকি সম্বন্ধে আমার শেষ দ্বিধাটি এইবার নিবেদন করি। আমরা যে এত তর্কাতর্কি করছি, কিন্তু নিজের মনকে কি একবারও জিগ্যেস করেছিপাকিস্তান শব্দটির জন্ম কোথায়, সে জাতেপাক, না নাপাক?পাক কথাটা তো আরবি নয়, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিপ (অথবাপে) অক্ষরটি আরবি নয়, প অক্ষরটি ফারসি অর্থাৎ প্রাচীন ইরানি, অর্থাৎ অগ্নি-উপাসক কাফিরদের শব্দ, এবং এই জেন্দা-আবেস্তার শব্দটির সঙ্গে যুক্ত আছে সংস্কৃতপ শব্দ (পা শব্দটি সংস্কৃত নয়, কিন্তু আবেস্তা ও সংস্কৃত যমজ-ভাষা) এবং স্তান কথাটি যে সংস্কৃত স্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেকথাও সকলেই জানেন। দুটি শব্দই আরবি নয়, প্রাচীন ইরানি, এবং প্রাচীন ইরানি বাংলা অপেক্ষা কোনওদিক দিয়ে পাক নয়। ভাষার দিক দিয়ে যদি সত্যই সম্পূর্ণপাক নাম দিতে হয় তবে তো পাকিস্তানকে বয়তুল মুদ্দাসের ওজনে মুমলকতুল মুকদ্দস জাতীয় কোনও নাম দিতে হয়।

তাই বলি পাক না-পাকের প্রশ্ন শুধানো ইসলাম-ঐতিহ্য পরিপন্থী। কোনও মানুষকে না-পাক বলে যেমন তাকে কলমা থেকে বঞ্চিত করা যায় না, কোনও ভাষাকে ঠিক তেমনি না-পাক নাম দিয়ে ইসলামি শিক্ষা-ঐতিহ্যের বাহক হওয়া থেকে বঞ্চিত করা যায় না। ছুৎ বাই ইসলামি মার্গ নয়।

কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন, কেন্দ্রের চাকরি, কেন্দ্রীয় পরিষদে বক্তৃতাদান ইত্যাদি বিষয়ে বাংলা কতদূর প্রতিবন্ধক হবে-না-হবে সে বিষয়ে আলোচনা অন্য প্রসঙ্গে প্রবন্ধের গোড়ার দিকে করা হয়ে গিয়েছে। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা সম্বন্ধে আর যেসব ছোটখাটো আপত্তি আছে তার অন্যতম ব্যবসাবাণিজ্য।

উর্দুওয়ালারা বলেন, ইংরেজি তাড়িয়ে দিলুম, উর্দু শিখলুম না, তা হলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করব কী করে?

এর উত্তর এতই সরল যে দেওয়াটা বোধহয় নিষ্প্রয়োজন। ইংলন্ডের শতকরা ৯৯ জন ফরাসি জানে না, ফ্রান্সের ৯৯.৯ জন ইংরেজি জানে না, তৎসত্ত্বেও ব্যবসা চলে। তার চেয়েও সরল উদাহরণ আছে। মারোয়াড়িরা প্রায় একশো বৎসর ধরে বাংলাদেশ শুষে খাচ্ছে, আমাদের কাফনের কাপড় বিক্রি করে তারা মারোয়াড়ে তিনতলা বাড়ি বানায় কিন্তু সমস্ত মারোয়াড় দেশে বাংলা পড়াবার জন্য একটা স্কুল নেই, কোনওকালে ছিলও না। এসব তো হল খুচরা ব্যবসায়ের কথা। প্রদেশে প্রদেশে, দেশে দেশে ব্যবসায়ের যোগাযোগ হয় বড় বড় কারবারিদের মধ্যস্থতায়। দমস্কসে যে জর্মন ভদ্রলোক সিমেন শুকার্টের কলকজা বিক্রয় করতেন তিনি তড়বড় করে আরবি বলতে পারতেন– তাই বলে গোটা জর্মনির পাঠশালা-স্কুলে তো আরবি পড়ানো হয় না।

পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যে বড় বড় ব্যবসা হবে, সে হবে করাচির সঙ্গে। করাচির ভাষা সিন্ধি কারবারি মহলে চলে ইংরেজি, সিন্ধি এবং কিঞ্চিৎ গুজরাতি। ব্যবসায়ের জন্য ভাষা শিখতে হলে তো আমাদের সিন্ধি শিখতে হয়।

ব্যবসা যে করে ভাষার মাথাব্যথা তার। শিক্ষাবিভাগ এবং দেশের দায়িত্ব এইটুকু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগে তার জন্য সামান্যতম বন্দোবস্ত করে দেওয়া। সেটুকু কেন, তার চেয়ে ঢের বেশি উর্দু আমরা পূর্ব পাকিস্তানে শেখাব। সেকথা পরে হবে।

এ জাতীয় খুঁটিনাটি আরও অনেক সমস্যা আছে কিন্তু তা হলে মূল বক্তব্যে কখনওই পৌঁছানো যাবে না।

উর্দু-বাংলা দ্বন্দ্বের শেষ সমাধান করতে হলে বিচার-বিবেচনা আবশ্যক যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ কী? আশা করি এ কথা কেউ বলবেন না যে একমাত্র উর্দুর সেবা করার জন্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের আদর্শ কী সে সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত মত দেবার কোনও অর্থ হয় না। নানা গুণী যে নানা মত দিতেছেন তার মাঝখানে একটি সত্যকথা সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন সে হচ্ছে এই যে পাকিস্তানকে সর্বপ্রথম সমৃদ্ধবান রাষ্ট্র করতে হবে।

তা হলেই প্রশ্ন উঠবে, সমৃদ্ধশালী হতে হলে যে শক্তির প্রয়োজন সে শক্তি সুপ্তাবস্থায় আছে কোন্‌খানে?

পাকিস্তান তথা ভারত ইউনিয়নের স্বাধীনতা যে সফল হল তার প্রধান কারণ গণআন্দোলন। যতদিন কংগ্রেস বলতেস্টেটসমেনের ভাষায়ভড্রলোক ক্লাস, যতদিন লীগ বলতে রামপুর-ভূপাল খানবাহাদুর-খানসায়েবদের বোঝাত ততদিন ইংরেজস্বরাজ এবংপাকিস্তানের থোড়াই পরোয়া করেছে। কিন্তু যেদিন দেখা গেল যে লীগের পশ্চাতে জনসাধারণ এসে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ লীগ আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ ধারণ করেছে সেদিন আর পাকিস্তানের দাবি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনসাধারণের শক্তি প্রয়োগে।

জনসাধারণের সেই শক্তি সেদিন বিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল। আজ সে শক্তি সুষুপ্ত এবং সেই শক্তি যদি পাকিস্তান গঠনে নিয়োজিত না হয় তবে পাকিস্তান কখনওই পূর্ণাবয়ব, প্রাণবন্ত রাষ্ট্ররূপে দুনিয়ার মজলিসে আসন নিতে পারবে না। মার্কসবাদের মূল সিদ্ধান্ত ঠিক কি না সে আলোচনা এ স্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর, ইসলামের সঙ্গে যাদের সামান্যতম পরিচয় আছে তারাই জানেন, ইসলাম কোনও বিশেষ বর্ণ, জাতি বা শ্রেণিকে শ্রেষ্ঠত্বের আশীর্বাদ দিয়ে অজরামর করে তুলতে সম্পূর্ণ নারাজ।

যারা ধর্মকে– তা সে ইসলামই হোক্ আর হিন্দুধর্মই হোক–রাজনীতি থেকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে চান তাদের উদ্দেশে আমার এস্থানে দু-একটি বক্তব্য আছে। ধর্মে বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, ধর্ম যে এ দুনিয়ায় এখনও প্রচণ্ড শক্তির আধার সেকথা অস্বীকার করলে আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতি পদে অপ্রত্যাশিত সংকটের সম্মুখে উপস্থিত হব। এই যে আমরা বার বার শুনতে পাই ইয়োরোপ নাস্তিক, ইয়োরোপীয় রাজনীতি ধর্মকে উপেক্ষা করে চলে, সে কথাটা কতদূর সত্য? ফ্রান্স-জর্মনিতে এখনও ক্রিশ্চান পার্টিগুলো কতটা শক্তি ধারণ করে সেকথা সবচেয়ে বেশি জানেন কম্যুনিস্টরা। ক্রিশ্চান ডেমোক্রেট, ক্যাথলিক সেন্টার এদের অবহেলা করে কোনও ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন চালানো এখনও ফ্রান্স, জর্মনি, ইতালিতে অসম্ভব। এই তো সেদিন রাজনীতি-ক্ষেত্রে এখনও পোপের কত ক্ষমতা সেটা ধরা পড়ল ইতালির গণভোটে। পোপ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ যেদিন সশরীরে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে আসরে নামলেন সেদিন কমরেড তল্লাত্তি প্রমাদ গুনলেন। শেষরক্ষার জন্য ধর্মহীন তল্লাত্তিকে পর্যন্ত বলতে হল, ভবিষ্যৎ ইতালীয় কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি, বিষয়-আশয়ে কোনওপ্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না, এযাবৎ তারা যেসব সুখসুবিধা উপভোগ করে আসছেন তার সবকটাই তারা নিশ্চিত মনে উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু এ শ্মশান-চিকিৎসায়ও ফল হল না, তল্লাত্তির নির্মম পরাজয়ের কথা সকলেই জানেন। পোপ এই ভোট-মারে নেবে ভালো করেছিলেন কি মন্দ করেছিলেন সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর, আমাদের শুধু এইটুকুই দেখানো উদ্দেশ্য যে ধর্ম এখনও বহু শক্তি ধারণ করে।

মৃত্যুর পর বেহেশত বা মোক্ষ দান করাই ধর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বিশেষত ইসলাম সংসারের সর্বস্ব ত্যাগ করে গুহা-গহ্বরে বসে নাসিকাগ্রে মনোনিবেশ করার ঘোরতর বিরুদ্ধ মতবাদ প্রচার করে। আল্লাতালা কুরান শরিফে বার বার বলেছেন যে এই সংসারে তিনি নানারকম জিনিস মানুষকে দিয়েছেন তার আনন্দ বর্ধনের জন্য। তাই মুসলিম মাত্রই প্রার্থনা করে, হে আমাদের প্রভু, ইহলোকে আমাদের শুভ হোক, পরলোকে আমাদের শুভ হোক। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় ইহলোকের মঙ্গল অতীব কাম্য, তাই প্রশ্ন ওঠে পার্থিব বস্তু কোন পদ্ধতিতে উপভোগ করব যাতে করে অমঙ্গল না হয়?

তাই বিশেষ করে ইসলামই পার্থিব বস্তুর ভাগবাটোয়ারা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। কুরান শরিফ বার বার ধনবন্টন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন, এবং সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত দেন।

মহাপুরুষ মুহম্মদের (স.) সঙ্গে মক্কাবাসীদের দ্বন্দ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ পার্থিব বস্তুর নবীন বণ্টনপদ্ধতি নিয়ে। সাইল অর্থ ভিখারি নয়, সাইল বলতে আজকাল আমরা ইংরেজিতে হ্যাভ নট বাক্যে যা বুঝি তাই। সাইলকে বিমুখ করো না এই আদেশ মক্কার ধনপতিগণ গ্রহণ করতে কিছুতেই সম্মত হয়নি, অথচ এই নবীন পদ্ধতি দুস্থ নিপীড়িত বিত্তহীনদের প্রাণে নতুন আশার বাণী এনে দিয়েছিল। ফলে দেখতে পাই মহাপুরুষের প্রথম শিষ্যদের ভেতর বিত্তহীন ও দাসের সংখ্যা বেশি।

ইহকাল-পরকালের মঙ্গল আদর্শ নিয়ে এই যে আন্দোলন সৃষ্ট হল তার বিজয় অভিযান পৃথিবীর ইতিহাসে আপন স্থান করে নিয়েছে কিন্তু সে ইতিহাস আলোচনা করা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এইটুকু দেখাতে চাই, মহাপুরুষের চতুর্দিকে যে বিরাট আন্দোলন ক্রমে ক্রমে জাগ্রত হল সে আন্দোলন গণআন্দোলন। মহাপুরুষ যে নবীন আন্দোলন সফল করে তুললেন সে এই জনগণের সাহায্যে।

আজ পাকিস্তান যে বিরাট আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে আন্দোলন জনগণ দিয়েই গঠিত হবে। এ আন্দোলনে থাকবে নতুন ধনবন্টন পদ্ধতি, নতুন ধনার্জন পন্থা, শিক্ষার প্রসার, গণতান্ত্রিক নির্বাচনপন্থা, স্বাস্থ্যের উন্নতি, সংস্কৃতি-বৈদগ্ধ্য নির্মাণপ্রচেষ্টা– এককথায় প্রাচীন শোষণনীতি সমূলে উৎপাটন করে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার সর্বাঙ্গীণ সম্পূর্ণ বিকাশ।

কিন্তু যদি জনগণ এ আন্দোলনে অংশীদার না হয় তবে সমস্ত আন্দোলন ব্যর্থ হবে। জনসাধারণ যদি আন্দোলনের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে এবং না বুঝতে পেরে আপন প্রচেষ্টা নিয়োগ করতে কুণ্ঠিত হয়, অথবা প্রয়োজনমতো স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত না হয় কিংবা ধনপতিদের উৎকোচে বশীভূত হয়, অথবা দু চার আনা মজুরি বৃদ্ধিতেই যদি বৃহত্তর স্বার্থকে ত্যাগ করে তবে সম্পূর্ণ আন্দোলন নিষ্ফল হবে।

এবং এস্থলে আমার কণ্ঠে যত শক্তি আছে তাই দিয়ে আমি চিৎকার করে বলতে চাই, মাতৃভাষা বাংলার সাহায্য বিনা জনসাধারণকে এই বিরাট আন্দোলনের বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা সম্বন্ধে সচেতন এবং ওয়াকিবহাল করা যাবে না, যাবে না, যাবে না।

উর্দুওয়ালারা বলবেন, উচ্চশিক্ষা উর্দুর মাধ্যমিকে দেব বটে কিন্তু শিক্ষিতেরা কেতাব লিখবেন বাংলায়।

আমার বক্তব্য, ঠিক ওই জিনিসটেই হয় না, কখনও হয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখাই, ইংরেজ আমাদিগকে কখনও ইংরেজি বই লিখতে বাধ্য করেনি, তবুও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে গত একশত বৎসর ধরে যত উত্তম উত্তম ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতন্ত্র, দর্শন সম্বন্ধে বই বেরিয়েছে তার শতকরা ৯৫ খানা ইংরেজিতে কেন? জ্ঞানচর্চা করব এক ভাষায় আর তার ফল প্রকাশ করব অন্য ভাষায়, এই বন্ধ্যা-প্রসব কখনও কস্মিনকালেও হয় না। মানুষ যখন আপন মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয় চিন্তা করতে শেখে তখনই সে মাতৃভাষায় লিখতে শেখে।

অর্থাৎ ইংরেজি আমলে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি হবে। একদল উর্দুশিক্ষিত লোক উর্দুতে লেখাপড়া শিখবেন, বড় বড় নোকরি করবেন, বহিরাগত উর্দুভাষীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, আর বাদবাকি আমরা চাষাভুষো পাঁচজন যে তিমিরে ছিলুম সেই তিমিরেই থাকব।

তাই পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিই হজরতের চতুর্দিকে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল এবং পরে যে রাষ্ট্র-সংগঠন অভিযান আরম্ভ হয়েছিল তার মাধ্যমিক ছিল আপামর জনসাধারণের ভাষা– আরবি। বিদগ্ধ হিব্রুকে তখন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছিল।

উর্দুওয়ালারা বলবেন– বাংলা জানলেই কি সব বাংলা বই পড়া যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি বাংলা চালাই, এবং ফলে যদি সকল রকমের বই-ই বাংলাতে লেখা হয় তা হলেই কি আপামর জনসাধারণ সেসব বই পড়তে পারবে?

উত্তরে বলি, সকলে পারবে না, কিন্তু অসংখ্য লোক পারবে।

আমি যে শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছি তাতে দেশের শতকরা নব্বইজন মাইনর, ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়বে। এবং সে মাইনর-ম্যাট্রিকের শিক্ষাদান অনেক বেশি উন্নত পর্যায়ের হবে। ইংরেজি বা উর্দুর জন্য জান পানি করবে না বলে তারা অতি উত্তম বাংলা শিখবে এবং ইংলন্ড, ফ্রান্স, মিশর, ইরানে যেরকম সাধারণ শিক্ষিত লোক মাতৃভাষায় লেখা দেশের শ্রেষ্ঠ পুস্তক পড়তে পারে, এরাও ঠিক তেমনি দেশের উন্নততম জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। দেশের তাবৎ লোকই যে উত্তম উত্তম পুস্তক পড়বে সেকথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়–কারণ সকলেই জানেন জ্ঞানতৃষ্ণা কোনও বিশেষ শ্রেণি বা সমাজের মধ্যে নিবদ্ধ নয়, এমনকি উচ্চশিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার ওপরও সে জিনিস সম্পূর্ণ নির্ভর করে না; কত বিএ, এমএ, পরীক্ষা পাসের পর চেকবই ছাড়া অন্য কোনও বইয়ের সন্ধানে সময় নষ্ট করেন না, আর কত মাইনরের ছেলে গোগ্রাসে যা পায় তাই গেলে– কিন্তু মাতৃভাষা দেশের শিক্ষাদীক্ষার বাহন হলে কোনও তত্ত্বানুসন্ধিৎসু অল্প চেষ্টাতেই দেশের সর্বোত্তম প্রচেষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এর সত্যতা সপ্রমাণ হয় আরেকটি তথ্য থেকে ইয়োরোপের বহু সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক-আবিষ্কর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন না-করেও যশস্বী সৃষ্টিকার হতে সমর্থ হয়েছেন।

তাই দেখতে হবে, মাতৃভাষার যে নিঝরিণী দিয়ে বিদ্যাভ্যাস আরম্ভ, সেই নিঝরিণীই যেন বিশাল এবং বিশালতর হয়ে বিশ্ববিদ্যার অগাধ সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছয়। মাঝখানে ইংরেজি বা উর্দুর দশ হাত শুকনো জমি থাকলে চলবে না।

বিশেষ করে উর্দুওয়ালা মৌলবি-মৌলানাদের একথাটি বোঝা উচিত। বাংলাতে ধর্মচর্চা না করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মুসলিম ধর্মের কুসংস্কারে নিমজ্জিত। ডান দিক থেকে বাঁ দিকে ছাপা বই দেখলেই সে ভয়ে ভক্তিতে বিমূঢ় হয়ে যায় তা সে গুল-ই-বাকাওলির কেচ্ছাই হোক আর দেওয়ান-ই-চিরকিই হোক। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করবার জন্য তাকে শেখাতে হবে :

১। ইসলামের ইতিহাস* এবং বিশেষ করে শেখাতে হবে এই তথ্যটা যে সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করা অসম্ভব। আব্বাসি-ওম্মাই যুগের ভেতর দিয়ে মুসলিম সংস্কৃতি যে রূপ নিয়েছে সে রূপ পূর্ব পাকিস্তানে আবার নেবে না। অথচ ইসলামের গণতন্ত্রের খুঁটি এবং ধনবণ্টনে সমতার নোঙর জোর পাকড়ে ধরে থাকতে হবে।

[*পাকিস্তানকে theocratic রাষ্ট্র করার কথা উঠছে না। আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, ধর্মের নামে যে রাজনৈতিক ধাপ্পা, অর্থনৈতিক শোষণ চলে তার শেষ কোনওদিনই হবে না, যতদিন-না দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হন। ভারতীয় ইউনিয়ন সম্বন্ধেও এই নীতি প্রযোজ্য।]

২। শত শত বৎসরের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করে ইয়োরোপ যে শক্তি সঞ্চয় করেছে, মিশর দমস্ক আজ তাই শিখতে ব্যস্ত। প্রাচীন ঐতিহ্য যেরকম প্রশ্ন জিগ্যেস না করে গ্রহণ করা যায় না, ইয়োরোপীয় কর্ম এবং চিন্তাপদ্ধতি ঠিক সেইরকম বিনাবিচারে গ্রহণ করা চলবে না।

৩। ইসলাম আরবের বাইরে যেখানেই গিয়েছে সেখানেই তথাকার দেশজ জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলাকে গ্রহণ করে নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে। ইরানের সুফিতত্ত্বের যশ কোন দেশে পৌঁছয়নি? তাজমহল এই করেই নির্মিত হয়েছে, উর্দু ভাষা এই পদ্ধতিতেই গড়ে উঠল, খেয়াল গান এই করেই গাওয়া হল, মোগল ছবি এই করেই পৃথিবীকে মুগ্ধ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভারতীয় ঐতিহ্য নগণ্য নয়, অবহেলনীয় নয়। পূর্ববঙ্গের বহু হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বনামধন্য হয়েছেন, তাঁদের বংশধরগণ যেদিন নবীন রাষ্ট্রে আসন গ্রহণ করে সভ্যতা-কৃষ্টি আন্দোলনে যোগ দেবেন সেদিনই উভয় সম্প্রদায়ের অর্থহীন তিক্ততার অবসান হবে। (এস্থলে অবান্তর হলেও বলি ঠিক, তেমনি ভারতীয় ইউনিয়নের মুসলমানদের অবহেলা করেও সে রাষ্ট্র পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পারবে না।) একথা কিছুতেই ভুললে চলবে না যে মামুন, হারুনের সময় যখন আরবেরা জ্ঞান-গরিমায় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান ঠিক তখনই তারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে চরকসুশ্রুতপঞ্চতন্ত্র আরবিতে অনুবাদ করেছিল, গজনির মাহমুদের আমলে ঐতিহাসিক আল-বিরুনি কী বিপুল পরিশ্রম করে সংস্কৃত শিখে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে প্রামাণিক গ্রন্থ লিখেছিলেন।

আরবেরা সমুদ্র উত্তীর্ণ হয়ে ভারতীয় সভ্যতার অনুসন্ধানে এদেশে এল। আর আজ পূর্ব পাকিস্তানের লোক বাংলাভাষার গায়ে বৈষ্ণব নামাবলী দেখে ভড়কে যাচ্ছে! কিমাশ্চর্যমতঃপর

কত গবেষণা, কত সৃজনশক্তি, কত শাস্ত্রাশাস্ত্র বর্জন গ্রহণ, কত গ্রন্থ নির্মাণ, কত পুস্তিকা প্রচার, কত বড় বিরাট, সর্বব্যাপী, আপামর জনসাধারণ সংযুক্ত বিরাট অভিযানের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান!

এর উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যোগাবে কে?

প্রধানত সাহিত্যিকগণ। এবং আমি বিশেষ জোর দিয়ে জানাতে চাই, সে সাহিত্য-সৃষ্টি মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষাতে হতে পারে না।

আবার ইতিহাস থেকে নজির সংগ্রহ করি।

 ফ্রান্স এবং ইংলন্ডে আঠারো মাইলের ব্যবধান। প্রতি বৎসর হাজার হাজার ইংরেজ প্যারিসে বেড়াতে আসে। বায়রন-শেলি উত্তম ফরাসি জানতেন কিন্তু কই, আজ পর্যন্ত তো একজন ইংরেজ ফরাসি-সাহিত্যে নাম অর্জন করতে পারেননি, আজ পর্যন্ত একজন ফরাসি ইংরেজি লিখে পাঁচজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। অথচ বাংলা-উর্দুতে যে পার্থক্য, ফরাসি-ইংরেজিতে পার্থক্য তার চেয়ে ঢের কম। ফ্রেডরিক দি গ্রেটের যুগে বার্লিন এবং ভিয়েনার শিক্ষিত লোকমাত্রই ফরাসি চর্চা করত (আমরা যতটা ইংরেজি করি তার চেয়ে ঢের বেশি), কিন্তু তবুও তো একজন জর্মন ভাষাভাষী ফরাসি লিখে নাম করতে পারেননি। তুর্গেনিয়ে, তলস্তয়ের আমলে রুশ অভিজাত মাত্রই ফরাসি গভর্নেসের হাতে বড় হতেন, বাল্যকাল হতে ফরাসি লিখতেন (তলস্তয়ের রুশ-পুস্তকে যে পরিমাণ পাতার পর পাতা সির্ফ ফরাসি লেখা আছে সেরকম ইংরেজি-ভর্তি বাংলা বই আমাদের দেশে এখনও বেরোয়নি) কিন্তু তৎসত্ত্বেও একজন রুশ ফরাসিতে সার্থক সৃষ্টিকার্য করতে পারেননি।

অত দূরে যাই কেন? সাতশো বৎসর ফারসির সাধনা করে ভারতবর্ষের সাহিত্যিকেরা এমন একখানা বই লিখতে পারেননি যে বই ইরানে সম্মান লাভ করেছে। যে গালিব আপন ফারসির দম্ভ করতেন তার ফারসি কবিতা ইরানে অনাদৃত, অপাঙক্তেয়, অথচ মাতৃভাষায় লেখা তাঁর উর্দু কবিতা অজর অমর হয়ে থাকবে।

আরও কাছে আসি। মাইকেলের মতো বহুভাষায় সুপণ্ডিত দ্বিতীয় বাঙালি এদেশে জন্মাননি। তাঁর পূর্বে বা পরে কোনও বাঙালি তার মতো ইংরেজি লিখতে পারেননি, তবু দেখি আপ্রাণ চেষ্টা করে তিনিও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে এতটুকু আঁচড় কেটে যেতে পারেননি। অথচ অল্পায়াসে লেখা তাঁরমেঘনাদ বাংলা সাহিত্য থেকে কখনও বিলুপ্ত হবে না।

আরও কাছে, একদম ঘরের ভেতর চলে আসি। লালন ফকিরও বলেছেন, ঘরের কাছে পাইনে খবর/খুঁজতে গেলেম দিল্লি শহর। পূর্ব পাকিস্তানের আপন ঘরের মৌলবি-মৌলানারা যে শত শত বৎসর ধরে আরবি, ফারসি এবং উর্দুর চর্চা করলেন, এসব সাহিত্যে তাঁদের অবদান কী? গালিব, হালি, ইকবালের কথা বাদ দিন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে একজন দুসরা দরজার উর্দুকবি দেখাতে পারলেই আমরা সন্তুষ্ট হয়ে যাব।

মৌলবি-মৌলানাদের যে কাঠগড়ায় দাঁড় করালুম তার জন্য তারা যেন আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হন। নওজোয়ানরা তাদের শ্রদ্ধা করুক আর না-ই করুক, আমি তাঁদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখি। উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের (হিন্দুস্তানের) বহু মৌলবি-মৌলানার সংস্রবে এসে আমার এ বিশ্বাস আরও বদ্ধমূল হয়েছে যে, পূর্ববঙ্গের আলিম সম্প্রদায় শাস্ত্রচর্চায় তাঁদের চেয়ে কোনও অংশে কম নন। যেখানে সম্পূর্ণ বিদেশি ভাষা নিয়ে কারবার যেমন মনে করুন আরবি সেখানে পূর্ববঙ্গের আলিম অনেক স্থলেইহিন্দুস্তানের আলিমকে হার মানিয়েছেন কিন্তু উর্দুতে সাহিত্যসৃষ্টি তো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। যে স্পর্শকাতরতা, সূক্ষ্মানুভূতি, হৃদয়াবেগ মাতৃভাষার ভেতর দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করে সেসব তাঁদের আছে কিন্তু উর্দু তাঁদের মাতৃভাষা নয় বলে তাদের সর্বপ্রচেষ্টা পঙ্গু, আড়ষ্ট ও রসবর্জিত হয়ে যে রূপ ধারণ করে তাকে সাহিত্য বলা চলে না। বিয়ের প্রীতি উপহারেই তার শেষ হদ।

অথচ দেখি, অতি যৎসামান্য আরবি-ফারসির কল্যাণে কাজী নজরুল বাংলা সাহিত্যে কী অক্ষয় খ্যাতি অর্জন করলেন। মুসলমানও যে বাংলাতে সফল সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে সে তথ্য একা কাজী সাহেবই সপ্রমাণ করে দিয়েছেন।

তাই পুনরায় বলি, মাতৃভাষার সাহায্য ব্যতিরেকে কেউ কখনও কোনও দেশে সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেনি। আজ যদি আমাদের সাহিত্যপ্রচেষ্টা উর্দু স্বর্ণমৃগের পশ্চাতে ধাবমান হয় তবে তার চরম অবসান হবে অনুর্বর মরুভূমিতে। সমস্ত উনবিংশ ও এ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উর্ধ্বশ্বাসে প্রগতির দিকে ছুটে চলল; অর্থাভাবে, শিক্ষার অভাবে, দুঃখের তাড়নায় বাঙালি মুসলমান সে কাফেলাকে এগিয়ে যেতে দেখল কিন্তু সঙ্গী হতে পারল না। এখনও কি সময় হয়নি যে সে তার সৃজনশক্তির সদ্ব্যবহার করার সুযোগ পায়?

অথচ দেখি, অশিক্ষিত চাষা এবং অর্ধশিক্ষিত মুন্সিমোল্লা আপন সাহিত্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের লোকসাহিত্য যখন বিশ্বজনের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করল তখন দেশে-বিদেশে বহু রসিকজন তার যে প্রশংসা করলেন সে প্রশংসা অন্য কোনও দেশের লোকসাহিত্যের প্রতি উচ্ছ্বসিত হয়নি। ভাষার বাজারে বহু বৎসর ধরে এ অধম বড় বড় মহাজনদের তামাক সেজে ফাই-ফর্মাস খেটে দিয়ে তাঁদের আড়তের সন্ধান নিয়েছে, এবং সে হলপ খেয়ে বলতে প্রস্তুত, লোকসাহিত্যের ফরাসি, জর্মন, ইতালি, ইংরেজি আড়তের কোনওটিতেই পূর্ববঙ্গ লোকসাহিত্যের মতো সরেস মাল নেই।

আমাদের ভাটিয়ালি মধুর কাছে ভগার গান চিটেগুড়– হাসন রাজা, লালন ফকির, সৈয়দ শাহনূরের মজলিশে এসে দাঁড়াতে পারেন এমন একজন গুণীও ইয়োরোপীয় লোকসাহিত্য দেখাতে পারবে না।

অথচ কী আশ্চর্য, কী তিলিস্মাৎ, পূর্ববঙ্গের মুসলিম শিক্ষিত সম্প্রদায় কিছুই রচনা করতে পারলেন না! ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে শিক্ষিত বলতে বোঝাত উর্দুসেবীগণ, তার পরের দুঃখ-দৈন্যের ইতিহাস তো পূর্বেই নিবেদন করেছি। কাজেই যারা শত শত বৎসর ফারসি এবং উর্দুর সেবা করে কোনও সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেননি, অন্তত তাদের মুখে একথা শোভা পায় না যে বাঙালি মুসলমান বাংলা সাহিত্যের সেবা করে সে ভাষাকে আপন করে নিতে পারেনি।

কিন্তু কার দোষ বেশি, আর কার দোষ কম সেকথা নিয়ে এখানে আর আলোচনা করব না। এখানে শুধু এইটুকু নিবেদন করি : যে দেশের চাষি-মাঝি ভুবনবরেণ্য লোকসঙ্গীত রচনা করতে পারল সেদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় সফল সাহিত্য রচনা করতে পারবে না একথা কি কখনও বিশ্বাস করা যায়? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে বাধো বাধো ঠেকে কিন্তু না বলে উপায় নেই, তাই অতি সবিনয় নিবেদন করছি, খুদাতালা এ অধমের জন্য বহু দেশে রুটি রেখেছিলেন। আরব, মিশর, আফগানিস্তান, ফ্রান্স, জর্মনি প্রভৃতি নানা দেশে নানা পণ্ডিত নানা সাহিত্যিকের সেবা করে এ অধমের ধ্রুব বিশ্বাস জন্মেছে, পূর্ববঙ্গে সাহিত্যসৃষ্টির যে উপাদান আছে এবং পূর্ববঙ্গবাসীর হৃদয়মনে যে সামান আছে তার বদৌলতে একদিন সে অতি উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সৃষ্টি করবে।

সোয়া চার কোটি মানুষ সাহিত্যসৃষ্টির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে। বহুশত বৎসর ধরে তাদের আতুর হিয়া প্রকাশের জন্য আকুলি-বিকুলি করেছে; কখনও ফারসি, কখনও উর্দুর মরুপথে তাদের ফল্গুধারা উষ্ণবাষ্পে পরিণত হয়ে গিয়েছে, আজ সেসব হৃদয় শুধু মর্মবাণীরই সন্ধানে নয়, আজ নবরাষ্ট্র নির্মাণের প্রদোষে তারা ওজস্বিনী ভাষায় দেশের জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে চায়।

হাঙ্গেরির জাতীয় সঙ্গীতে আছে :

দেশের দশের ডাক শোনা ওই ওঠো ওঠো মাডিয়ার
এই বেলা যদি পারো তো পারিলে না হলে হল না আর।

আমি বলি :

দেশের ভাষার ডাক শোনো ওই হে তরুণ বাংলার
এই বেলা যদি পারো তো পারিলে না হলে হল না আর।

এই বিরাট সাহিত্য নির্মাণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি তরুণ যেন সাহস না হারায়। সে যেন না ভাবে যে উর্দু গ্রহণ করলে তার সব মুশকিল আসান হয়ে যেত। সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান বাবদে ইংরেজি ঢের বেশি মুশকিল আসান। উর্দুতে আছে অল্পবিস্তর মসলা-মাসাইলের কেতাব, এন্তার দোয়া-দরুদের বই। তুমি যে রাষ্ট্র নির্মাণ করতে যাচ্ছ তার মালমসলা উর্দুতে যা পেতে সে জিনিস সৃষ্টি করতে তোমার পাঁচ বছরও লাগবে না। ইরান দেশ যেরকম একদিন ইরানি সভ্যতা নির্মাণ করে ফিরদৌসি, রুমি, হাফিজ, সাদি, খৈয়ামের জন্ম দিয়েছিল সেই রকম তুমিও সম্মুখে আদর্শ রাখবে পূর্ব পাকিস্তানে এক নতুন সভ্যতা গড়বার। ইরান আরবি এবং ফারসি দুই মিলিয়ে তার সাহিত্য-সংস্কৃতি গড়েছিল, তুমি আরবি, বাংলা, ফরাসি, সংস্কৃত, উর্দু, ইংরেজি মিলিয়ে ব্যাপকতর এবং মধুর সাহিত্য-সংস্কৃতি সৃষ্টি করবে।

অন্যান্য সম্প্রদায় যেন অযথা ভয় না পান। বৌদ্ধচর্যাপদের সূতিকাগৃহে যে শিশুর জন্ম, বৈষ্ণবের নামাবলী যে শিশুর অঙ্গে বিজড়িত, আরবি-ফারসির রুটি-গোস্ত যে শিশু বিস্তর খেয়েছে, গীতাঞ্জলির একেশ্বরের বন্দনা গেয়ে গেয়ে যে শিশু যৌবনে পৌঁছল, সে যুবক ইসলামের ইতিহাস চর্চা করলে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। রাধাকৃষ্ণন, সুরেন দাশগুপ্ত যেসব দর্শনের কেতাব ইংরেজিতে লিখেছেন তাতে বিস্তর সংস্কৃত শব্দ আছে; মার্গোলিয়াত মুইর ইসলাম সম্বন্ধে যেসব গ্রন্থ ইংরেজিতে লিখেছেন তাতেও বিস্তর আরবি শব্দ আছে, তাই বলে ইংরেজি ভাষার জাত যায়নি। ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে যে পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগ করেছেন সে পরিমাণ যদি পুনরায় কাজে লাগে তা হলে আপত্তি কী? আলালের ঘরের দুলালও তো বাংলা বই।

রামমোহন রায় বাংলা ভাষায় যে চিন্তাধারা প্রবর্তন করেছিলেন তার বিরুদ্ধে সে যুগে গোঁড়া হিন্দুরা প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন, রামকৃষ্ণদেবকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষায় যে নবচেতনার উৎপত্তি হয়েছিল তখনকার বিদগ্ধ (প্রধানত ব্রাহ্মণ) সমাজ সেটাকে গ্রহণ করতে চাননি, এবং রবীন্দ্রনাথ সনাতন ঐতিহ্যপন্থী নন বলে তাকে পর্যন্ত সুরেশ সমাজপতি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছিল। আজ এসব সংগ্রামের কথা লোকে ভুলে গিয়েছে, এবং বাংলা সাহিত্যে এখন যদি মুসলিম-সংস্কৃতির (এবং সেইটেই যে তার একমাত্র প্রচেষ্টা হবে তা-ও নয়) আলোচনা হয় তা হলে বিচক্ষণ লোক বিভীষিকা দেখবেন না।

আমার মতো অজ্ঞ লোককে বহু হিন্দু-মুসলমান যখন বাংলাতে মুসলিম সংস্কৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করতে অনুরোধ জানিয়ে থাকতে পারেন তখন যোগ্যজন এ কর্মে নিয়োজিত হলে যে বহুলোক তাঁকে আশীর্বাদ করবেন তাতে আর কী সন্দেহ?

পূর্ব পাকিস্তানে তা হলে উর্দুর স্থান কোথায়?

প্রথমত বলে রাখা ভালো যে, বর্তমানে আমাদের দেশে যে শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলিত আছে তার সঙ্গে আমাদের পরিকল্পনার শিক্ষাপদ্ধতির কোনও তুলনাই হতে পারে না। উপস্থিত দেখতে পাই, স্কুলে চার বৎসর এবং কলেজে চার বৎসর একুনে আট বৎসর পড়েও সাধারণ ছাত্র চলনসই আরবি বা সংস্কৃত শিখতে পারে না। কাজেই যখন বলি উর্দু অপশনাল ভাষা হিসেবে ম্যাট্রিকের শেষের চার শ্রেণিতে পড়ানো হবে তখন উর্দুওয়ালারা যেন না-ভাবেন যে, ছাত্রদের উর্দু-জ্ঞান আমাদের গ্রাজুয়েটদের ফারসি-জ্ঞানেরই মতো হবে। কলেজেও উর্দুর জন্য ব্যাপক বন্দোবস্ত থাকবে। একথা ভুললে চলবে না যে পাকিস্তানের কলেজে ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি নামক এক বিশেষ বিষয়বস্তু পড়ানো হবে। মোগল স্থাপত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত যেরকম সকলেরই গর্বের বিষয় (কোনও ইংরেজ বা মার্কিন যখন তাজমহলের প্রশংসা করে তখন কোনও হিন্দু তো তাজমহল মুসলমানের সৃষ্টি বলে নিজেকে সে দায় থেকে মুক্ত করেন না, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়া সম্বন্ধে কথা উঠলে কোনও বাঙালি মুসলমানকে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু বলে নতশির হতে তো দেখিনি; অবনীন্দ্রনাথ মোগল শৈলীতে ছবি আঁকেন, তাঁর শিষ্য নন্দলাল অজন্তা শৈলীতে, তাই বলে একথা কারও মুখে শুনিনি যে নন্দলাল গুরুর চেয়ে বড় চিত্রকর) ঠিক তেমনি উর্দু ভাষা এবং সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই শ্লাঘার সম্পদ। যেসব ছাত্র ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব অথবা আরবি-ফারসি সাহিত্য অধ্যয়ন করবে তাদের বাধ্য হয়ে উর্দুর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক এবং কেন্দ্রীয় পরিষদে জানেওয়ালা সদস্য এইসব বিষয়ের সঙ্গে ছাত্রজীবনে সংযুক্ত থাকবেন বলে উর্দুর সঙ্গে তাঁদের যথেষ্ট পরিচয় হবে। যারা ভাষা ব্যাপারে অসাধারণ মেধাবী তারা হয়তো করাচিতে উর্দু ভাষায় বক্তৃতা দেবেন কিন্তু অধিকাংশ সদস্যকে কেন বাংলাতেই বক্তৃতা দিতে হবে এবং সেজন্য যে অসুবিধা হবে সেটা কী করে সরাতে হবে তার আলোচনা প্রবন্ধের গোড়ার দিকেই সবিস্তর করেছি।

কেন্দ্রের চাকরি সম্বন্ধে বক্তব্য, যেদিন পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তান থেকে ইংরেজি অন্তর্ধান করবে সেদিন পাঞ্জাবি মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রকারে চাকরি করবে পূর্ব পাকিস্তানের লোক ঠিক সেই প্রকারেই কেন্দ্রে চাকরি করবে। এবং একথা তো কেউ অস্বীকার করবেন না যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বদৌলতে আমরা আরবি-ফারসির ভেতর দিয়ে উর্দুর সঙ্গে যুক্ত আছি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়েও থাকব, কিন্তু পাঞ্জাবি-সিন্ধির সেরকম বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনও ঐতিহ্য নেই। কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমরা হারব কেন? কিন্তু এ বিষয়ে অতিরিক্ত বাক্য ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। উর্দুওয়ালারাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, সকল অবস্থাতেই বাঙালির জন্য করাচিতে ওয়েটেজ থাকবে। অর্থাৎ স্বয়ং উর্দুওয়ালারাই মেনে নিচ্ছেন যে আমরা প্রাণপণ উর্দু শিখলেও পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুভাষাভাষীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারব না। তাদের এই মেনে নেওয়াটা খুব সম্ভব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত। আমরাও বলি, আমাদের আলিম-ফাজিলগণ যখন উর্দুতে যুক্তপ্রদেশের মৌলবিগণকে পরাজিত করতে পারেননি, তখন আমাদের মতো তিফলে মকতব, কমসিনদের দিয়ে কোন জঙ্গ-ই-জবান জয় সম্ভবপর?

এ সম্পর্কে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো। পরাধীন এবং অনুন্নত দেশেই চাকরি নিয়ে মাথা ফাটাফাটি খুন-রেজি। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, কৃষি-খনিজ, দুগ্ধ-ঘৃত উৎপাদন করে যে দেশ সমৃদ্ধশালী সে-দেশে চাকরি করে অল্প লোক, তাদের সম্মানও অনেক কম। দৃষ্টান্তস্বরূপ অঙ্গুলি নির্দেশ করি চাটগাঁয়ের দিকে। পাকিস্তান হয়েছে মাত্র এক বছর এর মাঝেই শুনতে পাই চাটগাঁয়ের কোনও কোনও বড় সরকারি কর্মচারী নোকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। দেশ সমৃদ্ধশালী হলে কটা লোক বিদেশ যায়, তা-ও আবার চাকরির সন্ধানেই? দেশের ভেতরেই দেখতে পাই, যে বৎসর খেত-খামার ভালো হয় সে বৎসরে শহরে বাসার চাকরের জন্য হাহাকার পড়ে যায়।

মুসলিম ঐতিহ্যও চাকরির প্রশংসা করেনি, প্রশংসা করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের। ইসলাম দেশদেশান্তরে বিস্তৃতি লাভ করেছে ধর্মপ্রচারকদের কর্মতৎপরতায় এবং সদাগরদের ধর্মানুরাগে। এখনও মধ্য-আফ্রিকায় ক্রিশ্চান মিশনারিদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে হাতির দাঁতের ব্যবসায়ী মুসলমান সদাগরেরা। ক্রিস্টান মিশনারিরা সবাই মাইনে পায়, তারা চাকুরে। তাদের দুঃখের অন্ত নেই যে তারা সদাগরদের সঙ্গে পেরে উঠছে না।

পূর্ব পাকিস্তানের আদর্শ কী সে সম্বন্ধে বিচার করার সময় উর্দুওয়ালারা একটা ভয়ঙ্কর জুজুর ভয় দেখান। তাঁরা বলেন, পূর্ব পাকিস্তান যদি উর্দু গ্রহণ না করে তবে সে পশ্চিম পাকিস্তান তথা কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং তারই সুযোগে ভারতীয় ডোমিনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানটিকে বিনা নুন-লঙ্কায় কপাৎ করে গিলে ফেলবে।

ভারতীয় ইউনিয়নে এবং পাকিস্তানে লড়াই হবে কি না, হলে কবে হবে এ আলোচনায় এত যদি এবংকিন্তু আছে যে সে আলোচনা যুক্তি-তর্কের বিষয়বস্তু না হয়ে ফলিত জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বাণীর জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ফলিত জ্যোতিষ জানিনে, উপস্থিত আমরা ধরে নিচ্ছি যে লড়াইটা লাগবে, কারণ সেটা ধরে না নিলে জুজুর ভয় ভাঙানো যাবে না। অন্ধকার ঘরে বাচ্চা ছেলেকে ভূত নেই বললে তার ভয় যায় না, বরঞ্চ ভূত মেনে নিলেও আপত্তি নেই, যদি সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বালানো হয়। তাই আলোর সন্ধানই করা যাক।

কে মিত্র, কে শত্রু সে কি ভাষার ওপরই নির্ভর করে আমেরিকা, ফ্রান্স, রুশ লড়ল জর্মন, ইতালির বিরুদ্ধে। আমেরিকা, ফ্রান্স এবং রুশ তাই বলে কি একই ভাষায় কথাবার্তা কয়, না জর্মনি ইতালির ভাষাই-বা এক? আজ বলছি রুশের বিরুদ্ধে ধনতান্ত্রিক ফ্রান্সের একমাত্র ভরসা মার্কিন সাহায্য। আজ যদি উর্দুওয়ালাদের কায়দায় ফ্রান্সকে বলা হয়, তোমরা যদি ইংরেজি গ্রহণ না কর তবে তোমরা আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এবং রুশ ফ্রান্সটিকে বিনা মাস্টার্ডে কপাৎ করে গিলে ফেলবে, তা হলে কি ফ্রান্সের লোক মাতৃভাষা বর্জন করে মাথায় গামছা বেঁধে ইংরেজি শিখতে লেগে যাবে?

পক্ষান্তরে এক ভাষা হলেই তো হৃদ্যতা চরমে পৌঁছয় না। আমেরিকা যখন ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই লড়েছিল তখনও সে ইংরেজি বলত। আইরিশমেনের মাতৃভাষা ইংরেজি, তাই বলে সে কি ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়েনি? পশতুভাষী মুসলিম পাঠানের একদল লড়ল সুভাষচন্দ্রের ঝাণ্ডার নিচে দাঁড়িয়ে জাপানের হয়ে, আরেকদল লড়ল ইংরেজের ঝাণ্ডার নিচে দাঁড়িয়ে তাদের হয়ে।

তার চেয়েও ভালো উদাহরণ আছে আরবদেশে। আরবের লোক কথা বলে আরবি ভাষায়, তারা সকলেই এক এক গোষ্ঠীর লোক (একবর্ণ), তারা সকলেই মুসলিম অথচ আজ সে দেশ (১) ইরাক, (২) সিরিয়া, (৩) লেবানন, (৪) ফিলিস্তিন, (৫) ট্রান্স-জর্ডন, (৬) সউদি আরব, (৭) ইয়েমেনে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত (এগুলো ছাড়া আরবি-ভাষাভাষী মিশর, টুনিস, আলজেরিয়া, মরক্কোও রয়েছে)।

এই সাত রাষ্ট্রের মধ্যে মন-কষাকষির অন্ত নেই। ইবনে সউদ এবং মক্কার শরিফের মধ্যে যে লড়াই হয়েছিল সে তো আমাদের সকলেরই স্পষ্ট মনে আছে। তার জের এখনও চলছে আমির আব্দুল্লা এবং ইবনে সউদের শত্রুতার মধ্যে। আজ যে ফিলিস্তিন অসহায় হয়ে ইহুদির হাতে মার খাচ্ছে তার প্রধান কারণ এই যে ইবনে সউদ আর আব্দুল্লার মধ্যে ঠিক ঠিক মনের মিল হচ্ছে না। আরব লিগের সর্বপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে– অথচ সকলেই জানেন যে উপযুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমঝাতা হয়ে গেলে দশদিনের ভেতর ইহুদিদের রাজ্যলিপ্সাফি নারি জাহান্নামে পাঠানো সম্ভবপর হবে।

পক্ষান্তরে সুইজারল্যান্ডে তিনটি (চতুর্থটির লোকসংখ্যা অত্যন্ত কম) ভাষা, বেলজিয়ামে দুইটি, চেকোশ্লোভাকিয়ায় দুইটি, যুগোশ্লোভাকিয়ায় গোটা চারেক, কানাডায় দুইটি ইত্যাদি ইত্যাদি। সুইজারল্যান্ডের দৃষ্টান্ত বিশেষ করে দ্রষ্টব্য। সেদেশের প্রধান দুই অংশ জর্মন এবং ফরাসি বলে। বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও একে অন্যের ভাষা সাধারণত রপ্ত করতে পারে না (ভাষা শেখা বাবতে সুইসরা বড়ই কাহিল), অথচ ফ্রান্স এবং জর্মনিতে যখন লড়াই লাগে তখন ফ্রেঞ্চ সুইসরা একথা কখনও বলেনি যে তারা ফ্রান্সের হয়ে লড়বে, জর্মন সুইও অনুরূপ ভয় দেখায়নি। গত যুদ্ধে দু জনে মিলে নিরপেক্ষ ছিল এবং হিটলার জানতেন যে সুইস-জর্মন যদিও তার জাতভাই, তবু তাদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না।

তাই বলি unity (ঐক্য) ও uniformity (সমতা) এক জিনিস নয়। সমতা হলেই ঐক্য হয় না। আর যারা সমতা চায় তাদের জেদ-বয়নাক্কার অন্ত নেই। আজ তারা বলবে ভাষায় সমতা চাই, পূর্ব পাকিস্তান উর্দু নাও; কাল বলবে পোশাকের সমতা চাই, শেলওয়ার কুর্তা পাগড়ি পরো; পরশু বলবে খাদ্যের সমতা চাই, মাছ-ভাত ছেড়ে গোস্ত-রুটি ধরো; তার পরদিন বলবে নৌকা বখদু জিনিস, তার বদলে গরুর গাড়ি চালাও। তার পর যদি একদিন পূর্ব পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের বলে, দৈর্ঘ্যের সমতা হলে আরও ভালো হয়, লড়াইয়ের জন্য ইউনিফর্ম বানাতে তা হলে সুবিধে হবে, কিন্তু তোমরা বড় উঁচু, তোমাদের পায়ের অথবা মাথার দিকের ইঞ্চি তিনেক কেটে ফেল, তা হলেই হয়েছে!

ঐক্য বা ইউনিটি অন্য জিনিস। প্রত্যেকে আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে যখন সংঘবদ্ধ হয়ে মানুষ একই স্বার্থ, একই আদর্শের দিকে ধাবমান হয় তখনই তাকে বলে ঐক্য। তুলনা দিতে গিয়ে শুণীরা বলেছেন, বীণার প্রত্যেক তারের আপন আপন ধ্বনি আছে– সব তার যখন আপন আপন বিশিষ্ট ধ্বনি প্রকাশ করে, একই সুরের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তখনই সৃষ্ট হয় উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত। সবকটা তারই যদি একধরনের বাধা হয় তবে বীণায় আর একতারায় কোনও তফাৎ থাকে না। সে যন্ত্র বিদগ্ধ সঙ্গীত প্রকাশ করতে অক্ষম।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আপন আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে, কী প্রকারে এক আদর্শের রাখি বেঁধে সম্মিলিত করা যায় তার সাধনা করবেন রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ। উপস্থিত শুধু আমরা এইটুকু বলতে পারি, পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয় তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মা শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবে– এ জিনিস অত্যন্ত স্বাভাবিক, তার জন্য উর্দু ভাষাভাষীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই– এবং ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বর্ণের কৌলীন্য যেমন শোষণের কারণ হতে পারে, ভাষার কৌলীন্যও ঠিক সেইরকম শোষণপন্থা প্রশস্ততর করে দেয়।

তারই একটি মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত নিন : তুর্কি একদা তাবৎ আরবখণ্ডের ওপর রাজত্ব করত। তুর্কি সুলতান সর্ব-আরবের খলিফাও ছিলেন বটে। তৎসত্ত্বেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত আরব ভূখণ্ড খলিফার জিহাদ ফরমান উপেক্ষা করে সারা ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তুর্কিকে পর্যুদস্ত করল। আমাদের কাছে এ বড় বিস্ময়ের কথা খলিফার জিহাদ হুকুমের বিরুদ্ধে লড়া মানে তো কাফির হয়ে যাওয়া। যে আরবদের ভেতর দিয়ে ইসলাম প্রথম সপ্রকাশ হলেন তারা ধর্মবুদ্ধি হারাল?

তাই আমাদের সবিনয় নিবেদন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যেন কোনও মহত্তর আদর্শের অনুপ্রেরণায় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়। পূর্বেই নিবেদন করেছি গুণীরা সে আদর্শের সন্ধান করবেন। আমার জ্ঞান-অভিজ্ঞতা অত্যল্প কিন্তু নানা দেশের গুণীদের মুখে শুনেছি, নানা সগ্রন্থে পড়েছি, দীন ইসলাম বলেন, সে আদর্শ হবে রাষ্ট্রের দীনদুঃখীর সেবা করা। উভয় পাকিস্তান যদি এই আদর্শ সামনে ধরে যে তাদের রাষ্ট্রভিত্তিও নির্মিত হবে চাষামজুরকে অন্ন দিয়ে, দুস্থকে সেবা করে, অজ্ঞকে জ্ঞানদান করে, এককথায়সাইলকে (অভাবে আতুরকে)গনি (অভাবমুক্ত করে, তা হলে আর ভয় নেই, ভাবনা নেই। উভয় প্রান্তে গণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা যে ঐক্যসূত্রে সম্মিলিত হবে সে সূত্র ভিন্ন হওয়ার ভয় নেই।

সেই মহান আদর্শের দিকে উদ্দীপ্ত উদ্বুদ্ধ করতে পারে সতেজ সবল সাহিত্য। সে জাতীয় সাহিত্য মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষাতে কেউ কখনও নির্মাণ করতে পারেনি। জনগণের মাতৃভাষা উপেক্ষা করে গণরাষ্ট্র কখনওই নির্মিত হতে পারে না।

উপসংহারে বক্তব্য : যুদ্ধ কাম্যবস্তু নয়। অন্যের বিনাশ বাসনা সর্বা বর্জনীয়। পাকিস্তান বিনষ্ট হলে ভারতীয় ইউনিয়নের লাভ নেই, ভারতীয় ইউনিয়ন বিনষ্ট হলে পাকিস্তানের লাভ নেই। উভয় রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে বিত্তবান হোক, এই আমাদের প্রধান কাম্য। ইয়োরোপের তাণ্ডবলীলা থেকে আমরা কি কোনও শিক্ষাগ্রহণ করব না?

শিক্ষাগ্রহণ করি আর না-ই করি, কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার ভয় অহরহ বুকে পুষে সেই দৃষ্টিবিন্দু থেকে সর্বসমস্যার সমাধান অনুসন্ধান করা মারাত্মক ভুল। বাড়িতে আগুন লাগার ভয়ে অষ্টপ্রহর চালে জল ঢালা বুদ্ধিমানের কর্ম নয়।

আজ যদি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় মাতৃভাষা বর্জন করি তবে কাল প্রাণ যাওয়ার ভয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *