অপ্রকাশিত রচনা – ১০

অপ্রকাশিত রচনা

প্রবাসীর চিঠি

শ্রীমান খসরু বাবাজিউ,

সুবুদ্ধি গোয়ালার কুবুদ্ধি হইল,
ভাঁড়েতে রাখিয়া দুধ পীরকে ফাঁকি দিল
 মানিক পীর ভবনদী পার হইবার লা–
আমার হল তাই;
 ছিলাম সুখে সিলেট জেলায় ঢুকল মাথায় পোকা
কাণ্ড দেখে বুঝল সবাই লোকটা গবেট বোকা।
বহুত দেশ তো দেখা হল খেলাম মেলাই ঘোল
চোখের জলে ভাসি এখন, খুঁজি মায়ের কোল।
চক্ষু বুজে বসে যখন ভাবি বরদায়
–দেহখানা বন্ধ ঘরে– দেশপানে মন ধায়
 মেলাই ছবি আঁকি, মনের পটে বুলাই তুলি
দুঃখ কষ্ট এই ফিকিরে অনেক কিছুই ভুলি ॥
মনে হল আমি যেন পেরিয়ে বছর কুড়ি
 ফিরে গেছি সিলেট আবার চড়ি খেয়াল-ঘুড়ি
বড়দিনের ছুটির সময় নাইব নদীর জলে
 বালুর চড়ায় বসে আছি, গামছা নিয়ে গলে।
 লাল্লুমিয়ার দোকান থেকে খানিকটা নুন নিয়ে
ডান হাতে কুল, বাঁ হাতে নুন তাই মিলিয়ে দিয়ে
 মঞ্চসুধার সৃষ্টি যেন। নাই কিছুরই তাড়া
 পরীক্ষা বা অন্য বালাই সামনেও নেই খাড়া
 অলস চোখে দেখছি চেয়ে এপার ওপার যাওয়া
খেয়া নায়ের চিরন্তনী টিমে তেতাল বাওয়া।
মহাজনি নৌকা চলে গদাই লশকরি
কমলানেবু বোঝাই করা; লোভ করে ফস করি
 গণ্ডা দুয়েক সরিয়ে নেব, কিন্তু চাচা, শোনো
চেষ্টা কবু কোরোনাকো লাভ তাতে নেই কোনও।
 ব্যাটারা সব লক্ষ্মীছাড়া খায় না কেন গুলি,
কোনও বাঙাল নেইকো বসে চোখে দিয়ে ঠুলি।
যতই কেন বাড়াও না হাত মহা সন্তর্পণে
 ব্যাটারা সব চালাক অতি বৈঠার ঘা অর্পণে।
থাক সে কথা, গামছা কাঁধে নাওয়ার বেলা যায়
আবার বলি বদ্ধ ঘরে দেশ পানে মন ধায়।
খসরু-পূর্ব(১) বছর সাতেক, বসন্ত কী শীতে,
তোমার মাইজুলা ফুফুর(২) বিয়া হৈল চৌকিতে।
চৌকি আছে নবীগঞ্জের গায়ের সঙ্গে মিশে
সেখান থেকে কই পাঠালেন তোমার মেজ পিসে।
বাপ রে সে কী বিরাট বপু উদর আণ্ডাময়
মুখে দিলে মাখন যেন জঠর ঠাণ্ডা হয়।
তোমার মা তো সেই দেশেরই যেথায় শুনি লোক
 মাছ না পেলে ব্যাঙ-ভাজাতে ভোলে মাছের শোক।
 শুধালে কি পাবে খবর তুমি তাঁহার কাছে
নউজ বিল্লা(৩); সত্যি খবর তোমার বাবার আছে।
তামাম জাহান খোদার কাছে সব কিছু নেয় মাগি,
আমার পেটের আঁকুপাঁকু কই মাছেরই লাগি ॥
আরো একটা জিনিস খসরু সত্যি তোমায় বলি।
যার লাগিয়া তৈরি আমি জানটা দিতে বলি।
–ভাবনা শুধু জানা গেলে খাব কেমন করে
পেট আর জান তো একই দেহে, আছে একই ঘরে–
তোমার মায়ের দেশের জিনিস বড়ই চমৎকার
অর্ধ জগৎ ঘুরে আমি পাইনি জুড়ি তার
চোঙ্গা-পিঠা,(৪) আহা চাচা বোলব তোমায় কী?
 যখন ভাবি ইচ্ছা হয় যে রেজিগনেশন দি।
 ধরে সোজা পয়লা গাড়িদেওর আইলে(৫) দি ছুট
চাকরি-বাঁধন, রাজার শাসন সবকিছু ঝুটমুট।
 নামটা সত্যি হলে পরে খাতির পাব মেলা
খানা-পিনা ধুম-ধামেতে কাটবে সারা বেলা।
চোঙ্গা-পিঠার সঙ্গে মালাই দেবে তোয়াজ করে।
 নয়ত দেবে হরিণ-শিকার হয়ত আছে ঘরে।
 করিমগঞ্জের হরিণ সে যে বড়ই খান্দানি।
 খোরাক তাদের আমলকি ফল, ঝরনা-মিঠা পানি।
মহীমিয়ার বাবা ছিলেন বাঘা শিকারি।
নুন আর মরিচ সঙ্গে নিয়ে হাতির সোয়ারি–
পাহাড় ঘেঁষে চলে যেতেন গভীর বনের পাশ
 হরিণ শিকার খেতেন স্রেফ ঝাড়া তিনটি মাস।
সঙ্গীবিহীন অন্ধ ঘরে আসন্ন সন্ধ্যায়
সুর্মা নদীর দেশের পানে উদাসী মন ধায় ॥
 চটছে হয়ত মনে মনে ভাবছ একি হল
চাচার যেসব কাব্যি ছিল সব কিছু আজ ম’ল
 খাবার কথা কয় যে খালি আর কি কিছু নেই।
 তাও আছে; তোমার পাতে সন্তর্পণে দেই।

* * *

সিলেটের উত্তরেতে সোজা গিয়ে চলে
 চৈত্র মাসে, মিঠা রোদে, উজায়ে সুরমা,
 গেয়ে সারি, গান–
ধরিয়া পালের দড়ি করিবারে বারুণীর স্নান
 মেলা দৃশ্য দেখিয়াছি।
স্তূপীকৃত ধান মণ মণ
 দুই পারে
তার পরে
কী রুপালি ঝিলিমিলি সোনালি ধানের
 যেন যে হীরার মালা হাজার হাজার
–কাতার কাতার
 হেমাঙ্গীর স্বর্ণবক্ষে।
 দীর্ঘ শর্বরীর
শিশিরে করিয়া স্নান এলায়েছে দেহ
 আতপ্ত কিশোর রৌদ্রে।
 অগভীর স্বচ্ছ জল
বালুর বুলায় দেহ।
 সে জলে ডুবায়ে গা
 দেখিয়াছি
তালহীন শব্দহীন মাছের নাচন,
জলের নিচেতে।
উপরেতে নাচে রবিকর
 হীরার নূপুর পরে।
 হঠাৎ
কেন না জানি–
তলা থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ওঠে ছোট মাছ।
 কটিখানি কাঁপাইয়া নটরাজ দোলে
জলের উপরে মারে ঘা–
যেন কোন খেয়ালি বাদশাহ।
 টাকা নিয়ে খেলে ছিনিমিনি।
 কখনও বা দেখিয়াছি
 দয়ে মজে গিয়ে
একপাল ছোট মাছ চক্রাকার ঘুরপাক খেয়ে
– গরবা নাচের ছাঁদে
ইচ্ছা অনিচ্ছায়
অলখ মাদলে মেতে অজানা সে কিসের নেশায়
 ক্রমে ক্রমে উঠে উপরেতে;
মাছরাঙা স্টুকা ডাইভার
পার্ফেক্ট টাইমিং
 পড়িল বিদ্যুৎ বেগে হল বজ্রাঘাত।
 হুড়মুড় করে
এ ওর ঘাড়েতে পড়ে
মুহূর্তেই হল অন্তর্ধান।
হয়ত বলিতে তুমি
তাতেই বা কী?
 এসবের বর্ণনার কী বা আছে বাকি?
 হক কথা
 তবু যতবার
 বসিয়া বিদেশে
চোখ বুজে মনে করি যেন আমি সুর্মা উজিয়ে
বরদার অবিচার অত্যাচার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে
 চলিয়াছি
 তখনই
বড় ব্যথা বাজে প্রাণে,
মনে হয় জানি ঠিক জানি আমার দেশের
স্নিগ্ধ শান্ত শ্যামল বনানী
পশ্চাতে তাহার নীলগিরি যবনিকা
তাহার উপরে লিখা
 শুভ্রতার শিখা
রুপার ঝরনা
 নীলের উপরে সে যে কী বিচিত্রা মিনা।
 পদমূলে
 প্রস্তরে উপলে
কলকল উচ্চহাস্য
 হাসিছে খাসিয়া নারী পাঁচশো সাতশো।
মধুরের ধ্যানে আমি বার বার ডুবে
যে রাগিণী দেখিয়াছি চতুর্দিকে যার স্বপ্রকাশ
 কাব্যে ছন্দে রূপ তার মূর্তি আর হল না বিকাশ।
 এ কি বিধাতার লীলা?
রূপে গন্ধে রসে শ্বাসে পরিপূর্ণ এ রমণী হল মূক শিলা
তাই কি শিলেট?
কাব্যে তার মাথা হেঁট!

***

কিন্তু চাচা মাফ করো, আজ কাজ আছে মোর মেলা
কাব্য-সাগর যেদিক পানে যায়নি জীবন-ভেলা–
চড়ায় লেগে আটকে আছে জোয়ার নাহি আসে
 পুব হাওয়াও দেয়নি ঠেলা নৌকা নাহি ভাসে।
আগাগোড়া ভুলে ভরা জগা-খিচুড়ি
বয়স হল হিসেব করে দেখি যে দুই কুড়ি।
চহ সালে উরে আজিজ গুজশৎ(৬)
কালাপানির গারদ মাঝে ভালে হানি দণ্ড।(৭)
তাই বলি
সুবুদ্ধি গোয়ালার কুবুদ্ধি হইল
ভাঁড়েতে রাখিয়া দুধ পীরকে ফাঁকি দিল
মানিক পীর ভবনদী পার হইবার লা।
সেই পীরেরে স্মরণ করে তোমার ছোট চাচা ॥
—মৌচাক, কার্তিক ১৩৬০

[১. খসরু-পূর্ব খ্রিস্টপূর্বের তুলনায়, অর্থাৎ খসরুর জন্মের বছর সাতেক পূর্বে। ২. মেজো পিসি।

২.তওবা, তওবা!

৩.বাঁশের চোঙার ভিতর চাল ভরে সেই চোঙা আগুনে ঝলসে তৈরি একরকম পিঠে।

৪.দেওর আইল অর্থাৎ দেবর এল, খসরুর মামার গ্রামের নাম।

৬. ইরানি কবি সাদির বিখ্যাত ছত্র। আমার জীবনের প্রিয় চল্লিশ বৎসর গেল, কিন্তু এখনও ছেলেমানুষি গেল না। খসরু তখন ফারসি শিখেছিল বলে ছত্রটি তোলা হয়েছে।

৭. হাত।

যথা– বেকার-মোকা/বেমক্কা, খামকা, যত্রতত্র।

ওকিবহাল/ বিশেষজ্ঞ, Specialist

বেশুমার অসংখ্য

বে/ Without

 শুমার/ Number, আদমশুমারি তুলনীয়

এলেম নব হাসিল/ নবজ্ঞান লাভ

 বেশক/দ্বিধাহীন, অসংশয়

লেকিন/কিন্তু]

.

ক্রিকেট

হুজুগে মেতে ক্রিকেট খেলা দেখিতে যদি চাও
মাথাটি মোর খাও–
 গাড়োল-পানা প্রশ্ন মেলা ঝেড়ো না খালি খালি
খেলাটা যদি না বোঝো তবে দিয়ো না হাততালি
এলোপাতাড়ি বেগার-মোকা ক্যাবলা হবার মতো।
রয়েছে শত শত।
 কায়দা-কেতায় ওকিব-হাল খেলার সমঝদার
 শুধিয়ো নাকো ওদের মিছে প্রশ্ন বেশুমার।
শুধাও যদি মানা না শুনে, কী হবে ফল, বলি,
 ট্যারচা-মুখো জবাব দিয়ে থামাবে ঢলাঢলি।
যেমন ধরো, জানো না কিছু শুধালে ভয়ে ভয়ে
যে গুণী পাশে আছে বসে– দিন তো মোরে কয়ে,
কাঠের ওই ডাণ্ডাগুলো, কী নাম হয় তার?
পাশের যিনি হইবে মনে রাগত হন যেন
 ঘ্যানরঘ্যান লাগিবে ভালো কেন!
বলেন তিনি মিনিট তিন থাকিয়া নিশ্চুপ
উকেট কয়। গলাতে যেন রয়েছে বিদ্রূপ।
 হকচকিয়ে দিলে তো তুমি অনেক ধন্যবাদ।
 খানিক পরে তবুও মনে হইল তব সাধ
 এলেম নব হাসিল লাগি। কিন্তু তাতে ভয়
তেড়ে না যান এবার তিনি গুণী তো নিশ্চয়–
থাকিয়া চুপ, ভাবিয়া খুব, গলাটি সাফ করে
 চুলকে ঘাড় শুধালে মৃদু স্বরে
উকেট কয়? বেশ কথা; লেকি, কন্ স্যার
ওসবগুলো হোথায় কেন কী হয় উপকার?
কটমটিয়ে এবার গুণী তাকান তব পানে
বাসনা যেন প্রাণটি তব হানেন আঁখি-বাণে–
হুঙ্কারিয়া হাঁকেন শেষে, ওগুলো কার তরে?
 খেলাড়ি সব বসবে বসে ক্লান্ত হলে পরে।

—-মৌচাক, বৈশাখ ১৩৬৭

বছর দুই পূর্বে আমি যখন ঢাকাতে আমার ছোট বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠলুম, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। আমার ভগ্নী আসমা ঘড়িঘড়ি রেডিয়ো খুলে লেটেস্ট স্কোর শুনে নিচ্ছিল। আমি দু একটি প্রশ্ন শুধিয়েই বুঝে গেলুম আসমা ক্রিকেটতত্ত্বে একদম অগা, অর্থাৎ আমার চেয়েও কম ক্রিকেট খেলা বোঝে। এ কবিতাটি তারই উদ্দেশে; এবং যেহেতু কবিতাটি ঢাকায় রচিত তাই ঢাকাই বিদেশি শব্দ একটু বেশি রয়েছে।

.

প্রদীপের তলাটাই অন্ধকার কেন?

পিলসুজপরে হেরো জ্বলে দীপশিখা,
 চতুর্দিকে যে আঁধার ছিল পূর্বে লিখা
মুহূর্তেই মুছে ফেলে।
কিন্তু অতি অবহেলে
মাভৈঃ বলিয়া তারে ছেড়ে দেয় স্থান
যে আঁধার পায়ে ধরে মাগে পরিত্রাণ।

—সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৬৯

.

উচ্ছে ভাজা সন্দেশ

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন যে, স্কুলের, এমনকি কলেজের গোড়ার দিকেও ছেলেমেয়েদের শেক্সপিয়র পড়ানো উচিত নয়। কারণ শেক্সপিয়রের ভাষা প্রাচীন দিনের। সে ভাষার অনেক শব্দ, অনেক ইডিয়ম আজকের দিনের ইংরেজিতে আর ব্যবহার করা হয় না। ছেলেমেয়েরা সেটা না বুঝতে পেরে সেগুলো আপন লেখাতে লাগিয়ে দিয়ে একটা খিচুড়ি ভাষা তৈরি করে বসে। উচিত : প্রথম আধুনিক ইংরেজিটা শিখে নেওয়া এবং তার পর শেক্সপিয়র ইত্যাদি ক্লাসিকস্ পড়া। নিজের থেকেই ছেলেমেয়েরা অনুভব করবে কোনটা প্রাচীন দিনের শব্দ, এখন আর চলে না।

আমার মনে হয় বাংলার বেলায়ও এখন সেই অবস্থা। ধরে নিলুম, তোমার বয়স বারো-চোদ্দ। তুমি যদি বিস্তর বঙ্কিম পড়ো তবে বাংলা লেখার সময় তুমি এমন ভাষা শিখবে যেটা আজকের দিনে পণ্ডিতি-পণ্ডিতি, গুরুগম্ভীর মনে হবে। তাই আমার মনে হয়, এই বয়সে, রবীন্দ্রনাথের শেষদিকের লেখা বার বার পড়ে সেটা আয়ত্ত করে নেওয়া। আয়ত্ত করার অর্থ এ নয় যে তখন তুমি তার মতো লিখতে পারছ। তা হলে তো আর কোনও ভাবনাই ছিল না। আমরা সবাই গণ্ডায় গণ্ডায় নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতুম। তার অর্থ, তুমি মোটামুটি জেনে গেছ, কী কী শব্দ কোন কোন ইডিয়ম ব্যবহার করলে কেউ বলতে পারবে না এগুলো প্রাচীন দিনের, এখন আর চলে না। এটা হয়ে যাওয়ার পর পড়বে রবীন্দ্রনাথের যৌবনকালের লেখা। বিশেষ করে তার প্রাচীন সাহিত্য। কিন্তু সেটা খুব সহজ নয়। আমি একটি ছত্র তুলে দিচ্ছি : একবার মনে করিয়া দেখিলেই হয় দ্রৌপদীর নাম যদি ঊর্মিলা হত, তবে সেই পঞ্চবীর-পতিগর্বিতা ক্ষত্ৰনারীর দীপ্ত তেজ এই তরুণ কোমল নামটির দ্বারা পদে পদে খণ্ডিত হইত। কঠিন বাঙলা। কিন্তু কী সুন্দর! কী মধুর!!

তার পর বঙ্কিম। বিদ্যাসাগর। কালীপ্রসন্নের মহাভারত এবং সর্বশেষেআলালের ঘরের দুলাল ও হুতোম প্যাঁচার নকশা। তারও পরে যদি নিতান্ত কোনও-কিছু না থাকে, বৃষ্টির দিন, বাড়ির থেকে বেরনো যাচ্ছে না, তবে পড়বে– বড় অনিচ্ছায় বলছি- সৈয়দ মুজতবা আলী। কিন্তু তিন সত্য দিয়ে বলছি, পয়সা খরচ করে না। ধার করে।

এ গল্পটা তো জানো? মার্কিন লেখক মার্ক টুয়েনের আপন লাইব্রেরিখানা নাকি সত্যিই দেখবার মতো ছিল। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত বই, বই, শুধু বই। এমনকি কার্পেটের উপরও গাদা গাদা বই স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে থাকত– পা ফেলা ভার। এক বন্ধু তাই মার্ক টুয়েনকে বললেন, বইগুলো নষ্ট হচ্ছে; গুটাকয়েক শেলফ যোগাড় করছ না কেন?

মার্ক টুয়েন খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে বললেন, ভাই, বলছ ঠিকই কিন্তু লাইব্রেরিটা যে কায়দায় গড়ে তুলেছি, শেলফ তো আর সে কায়দায় যোগাড় করতে পারিনে। শেলফ তো আর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার চাওয়া যায় না।

উপদেশ দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম। সেটা তেতো। উচ্ছে ভাজা। কিন্তু সন্দেশ দিয়ে শেষ করলুম তো!

.

ক্লাইন এর্না

ক্লাইন এর্না জরমনির ছোট্ট একটি মেয়ে। আমাদের যেরকম গোপালভাড় দারুণ চালাক, এই মেয়েটি সেরকম ভীষণ বোকা। তবে, মাঝে মাঝে সে এমন কথা কয় যে তার উত্তর মেলা ভার। যেমন ধর, এর্নার মা বলছে, হেই ক্লাইন এর্না! বেড়ালের ন্যাজটা মিছে মিছে টানছিস কেন? এর্না বলল, আমি টানছি কোথায়? কী যে বল মা! বেড়ালটাই তো খালি খালি টানছে। আমি তো সুদু ন্যাজটা ধরে আছি।

ক্লাইন মানে ছোট, ক্ষুদে। কিন্তু কারও কারও নাম বড় হয়ে যাবার পরও ছোট থেকে যায়। আমাদের দেশেও তাই বাড়ির বড় বড় কর্তারা সব ওপারে চলে গিয়েছেন, কিন্তু ছোট (ক্লাইন বাবুর নামছোট বাবুই রইল।

ক্লাইন এর্নার বেলাও তাই। আর এ গল্পটা আমার বিশেষ করে ভালো লাগে, কারণ গল্পটা আমাদের দেশেও চালু আছে। … ক্লাইন এর্নার তখন একটুখানি বয়স হয়েছে। স্কুলে বয়-ফ্রেন্ড জুটেছে। সে বলল, চল ক্লাইন এর্না। নৌকো ভাড়া করে আমরা ওই হোথাকার চর হেলিগোলান্ডে যাই। দু তিন টাকা লাগবে। সে আমার আছে। কী বল? লক্ষ্মীটি, না বলো না।

আমাদের ক্লাইন এর্না সত্যি লক্ষ্মী মেয়ে। না বলবে কেন? তদ্দশ্যেই রাজি হয়ে গেল।

নৌকো ভাড়া করে বন্ধু শুধোল, ক্লাইন এর্না, তুমি দাঁড় ধরতে পার? আমি তা হলে বৈঠে বাই। নইলে–

ক্লাইন এর্না বাধা দিয়ে বলল, দাঁড় ধরতে পারব না কেন? বাবার সঙ্গে কতবার নৌকোয় করে মাছ ধরতে গিয়েছি।

ঘন্টাখানেক বৈঠে ঠেলার পর ফ্রেন্ড বলল, ক্লাইন এর্না, একঘণ্টা তো হয়ে গেল। এখনও হেলিগোলান্ডে পৌঁছলুম না কেন? ওটা তো দেখা যাচ্ছে না।

ক্লাইন এর্না বলল, অ। তাই বুঝি। আম্মো তো খেয়াল করিনি। নৌকো যে পাড়ে খুঁটিতে এখনও বাধা। আমি খেয়ালই করিনি।

আমাদের দেশেও বলে, পুরা রাইত নাও বাইয়া দেখি, বাড়ির ঘাটেই আছি। এর আসল অর্থ : মোদ্দা, সবচেয়ে যেটা প্রয়োজনীয়, সেটা আগে না করলে বাদবাকি পণ্ডশ্রম।

.

বিদেশি ভাষা–ক্লাইন এর্না

স্বৰ্গত সুকুমার রায় একদা বলেছিলেন, কেই বা শোনে কাহার কথা, কই যে দফে দফে– গাছের ওপর কাঁঠাল দেখে তেল দিয়ো না গোঁফে। অর্থাৎ মানুষ উপদেশ শুনতে মোটেই ভালোবাসে না। বিশেষ করে যারা ছেলেমানুষ। নিজের কথা যদি তুলি তবে নির্ভয়ে, কিন্তু ঈষৎ লজ্জাসহ বলব, আমি যখন ছেলেমানুষ ছিলুম তখন কারওরই কোনও উপদেশে কান দিতুম না। একমাত্র মায়ের আদেশ উপদেশ–না সেকথা বাদ দাও, এখনও, এই পরিপক্ক বৃদ্ধ বয়সে আমার চোখে জল আসে। হ্যাঁ, কী বলছিলুম? বলছিলুম কী, তাই উপদেশ দিতে আমার বড়ই অনিচ্ছা। কিন্তু আজ কিছুটা দিতেই হচ্ছে। খুলে বলি। পরশু দিন আমার প্রতিবেশী একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলে আমায় শুধোল, স্যর, এটা কি সত্য, ইউ অ্যান্ডারস্টেন্ড টুয়েনটি ল্যাঙগুঁজেস? আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। আই মিসআন্ডারস্টেন্ড মোর দেন টুয়েনটি ল্যাঙগুঁজেস। এর থেকেই বোঝা যায় যে, এ পাড়ায় আমার বদনাম আছে, আমি নাকি একাধিক ভাষা জানি। তাই ইংরেজি শেখা সম্বন্ধে দু একটি কথা এই সুবাদে বলে নিতে চাই। মাস্টারমশাইরা সর্বদাই বলে থাকেন, যে বই পড়বে তার কোনও শব্দ জানা না থাকলে অভিধান খুলে দেখে নেবে। এটা অবশ্যই টেকস্ট বই সম্বন্ধে খাটে। কিন্তু ভেবে দেখ তো, তুমি যেসব কঠিন বাঙলা শব্দ শিখেছ, তার কটি অভিধান দেখে? যেসব বাঙলা গল্প উপন্যাস ভ্রমণ-কাহিনী পড়ছ তাতে বার বার কঠিন শব্দ এখানে-ওখানে ঘুরে-ফিরে এসেছে এবং তারই ফলে শব্দগুলোর সঙ্গে মোটামুটি একটা পরিচয় হয়ে গিয়েছে। ইংরেজির বেলাও এই পদ্ধতি প্রযোজ্য।… এবং এই রেপিড রিডিং জিনিসটি আরম্ভ করবে শারলক হোমস, আগাথা ক্রিসটি ইত্যাদির ডিটেকটিভ নভেল দিয়ে। সেগুলো এমনই ইটরেসটিং যে, হেসেখেলে বইয়ের শেষ পাতায় পৌঁছে যাবে। যতক্ষণ অবধি গল্পটা বুঝতে পারছ, ততক্ষণ অভিধানের কোনও প্রয়োজন নেই। এ সম্বন্ধে আরও অল্পবিস্তর বলার আছে। উপস্থিত ভাষা নিয়ে আমাদের ক্লাইন এর্নার একটা গল্প মনে এল।… ক্লাইন এর্না বিয়ে করেছে এক ইংরেজকে, কিন্তু হায়, এক বছর যেতে না যেতে তার বর হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। তার পর তার একটি বাচ্চা হল। কিন্তু হায়, হায়, ছ দিনের দিন বাচ্চাটি মারা গেল। বেচারির কী কান্না, কী কান্না। তার মা তাকে অনেক প্রবোধবাক্য শোনানোর পর শেষটায় বলল, আর দ্যাখ, ক্লাইন এর্না, বাচ্চাটার বাপ তো ইংরেজ। মুখে কথা ফুটতেই সে ইংরেজি বলত। আমি তো ইংরেজি জানিনে। দিদিমা হয়ে তার এক বর্ণও বুঝতে পারব না– সেটা কি খুব ভালো হত?

.

ক্লাইন এর্না

ক্লাইন এর্না গোয়ালঘরের সামনে বসে হোম-টাস্ক লিখছে। এমন সময় তার আদরের গাইটি পাশে এসে দাঁড়িয়ে শুধাল, কী লিখছ, ক্লাইন এর্না?

চুলোয় যাক। মোটরগাড়ি সম্বন্ধে লিখতে বলছে। আমার মাথায় কিছু আসছে না।

গোগম্ভীর কণ্ঠে গাই বলল, আমি বলে যাই, তুমি লেখ। মোটরগাড়ি অবিশ্বাস্য অদ্ভুত জানোয়ার। এদের বিকট বিকট দুটো দারুণ উজ্জ্বল চোখ থাকে। কিন্তু সে দুটো শুধু রাতের অন্ধকারেই জ্বলে ওঠে।… এরা যখন রাস্তার উপর দিয়ে হুশ হুশ করে যায় তখন সম্পূর্ণ অচেনার মতো একে অন্যের দিকে কোনও খেয়াল না করে চলে যায়। কিংবা দুম করে একে অন্যকে মারে মরণ-ধাক্কা। তখন দু জনাই মারা যায়। আশ্চর্য, এদের কোনও মধ্যপন্থা বা তৃতীয় পন্থা নেই।… এরা নিজেদের খাবার যোগাড় করতে পারে না। মানুষই এদের জল-তেল আরও কী যেন খেতে দেয়। আমার আশ্চর্য লাগে, ওরা মুখ দিয়ে ও অন্য দিক দিয়ে, দু দিক দিয়েই খায় কী প্রকার!… লোকে ভাবে, ওরা খুব তীব্রগতিতে চলতে পারে। আদৌ না। ওই সেদিন আমার এক বান্ধবী রাস্তা দিয়ে আপন গোয়ালে ফিরছিল। পিছন থেকে, অনেকক্ষণ ধরে ওদেরই একজন কোক-কেক, কেক-কোঁঁক করে চিৎকার করছিল, কিন্তু এগিয়ে যেতে পারছিল না। অবশেষে আমার বান্ধবী যখন বাঁ-দিকে মোড় নিয়ে তার বেডরুমে পৌঁছে গেল তখন বাবু এগোলেন … ওরা রাস্তায় যা ফেলে যান সেটা খুঁটেকুড়োনি ঘৃণার চোখে দেখে।… শেষ প্রশ্ন– ওরা কি মোটেই কোনও বন্ধু-বান্ধব চায় না? সেদিন সন্ধ্যাবেলা ওদেরই একজন রাস্তার পাশে কাটার বেড়া ভেঙে আমাদেরই মাঠের মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন। ওর সঙ্গীসাথী মানুষরা ওকে ফেলে চলে গেল। আমি ভাবলুম, আহা বেচারি, একা একা রাত কাটাবে। একটুখানি সঙ্গ দিই। কোনও সাড়া পেলুম না। তখন দেখি ওর চোখদুটোও জ্বলছে না। পরদিন সকালবেলা এল তার মা। বিরাট দেহ। দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলল শহরপানে। আমি যখন তার মার সামনে দাঁড়িয়ে– নমস্কার, আসুন তবে, বললুম, তখন তিনি সুপ্রসন্ন কোঁক-কোক বলে উত্তর দিলেন। মা-টি মেয়ের চেয়ে ঢের ঢের ভদ্র।

.

গুরুদেব

প্রমথ চৌধুরীর মতো মনীষী যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার যোগাযোগের কথা অনবদ্য ভাষায় লেখেন, তখন তা পড়ে আমরা বুঝতে পারি, রবীন্দ্রনাথের বিপুল ব্যক্তিত্বের গৌরব এবং মহিমা তিনি পরিপূর্ণভাবেই উপলব্ধি করেছেন। তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভাবের গভীরতা, চিন্তার ঐশ্বর্য এবং রবীন্দ্র-জীবনের বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমরা নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে পারি।

আমার লেখাও সফল হত যদি আমি কবি বা স্রষ্টা হতুম। কবির দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনাই হোক, আর তাঁর কাব্যালোচনাই হোক, কিঞ্চিৎ সৃজনী-শক্তি না থাকলে সে রচনা কবির বিরাট ব্যক্তিত্বের পটভূমিতে প্রক্ষিপ্ত হয়ে শুধু বৈচিত্র্যহীনতার পরিচয় দেয়। তাই রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কিছু লিখতে আমার বড় সংকোচ বোধহয়। ভয় হয়, যত ভেবেচিন্তেই লিখি না কেন বিদগ্ধজনেরা পড়ে বলবেন, দীর্ঘ পাঁচ বত্সর রবীন্দ্রনাথের কাছে শিক্ষালাভ করেও এই ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিত্বের যথার্থ পরিচয় পেল না। এই অভিমত যে নিদারুণ সত্য তা আমি জানি; তাই স্থির করেছিলুম যে, কয়েক বৎসর রবীন্দ্রনাথকে যে তার প্রাত্যহিক জীবনে সহজ, সরলভাবে পেয়েছিলুম, সেকথা একেবারে অপ্রকাশিতই রাখব।

কিন্তু মুশকিল হল এই যে– কবি-প্রণামের রচনা-সংগ্রাহকগণ ও আমার নিজের দেশ শ্রীহট্টের অনেকেই জানেন যে, আমি শান্তিনিকেতনে শিক্ষালাভ করেছি। এই সঞ্চয়িতার মধুকর যে আমার লেখা চেয়ে আমাকে পরম সম্মানিত করেছেন, তার একমাত্র কারণ তিনি জানেন যে, আমি রবীন্দ্রনাথের শিষ্য; তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল। কিন্তু আমার দেশবাসী প্রিয়জনকে কী করে বোঝাই যে, রবীন্দ্রনাথের ঘরের দেয়াল, আসবাব তাঁকে আমার চেয়ে ঢের বেশি দেখেছে। আপনারা বলবেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তোমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা বাদ দাও, তার কাব্য আলোচনা কর। উত্তরে আমি বিনীতভাবে বলতে চাই সে তো সহজ কর্ম নয়।…তবে আর কিছু না হোক, এ আমি নিশ্চয় করে জানি যে, আমার মনোজগৎ রবীন্দ্রনাথের গড়া। প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বলুন, দর্শন, কাব্য, ধর্মের ভিতর দিয়ে বহুর মধ্যে একের সন্ধান বলুন; কালিদাস, শেলি, কিটসের কাব্যের ভিতর দিয়ে বিশ্ব-সাহিত্যের রসাস্বাদই বলুন– আমার মনোময় জগৎ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। জানা-অজানায় পঠিত আমার চিন্তা, অনুভূতির জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জীবনের ক্রমবিকাশ-পথে নানাদিক থেকে রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কিন্তু, সেই কাব্যসৌন্দর্যের বিশ্লেষণ কতটুকুই-বা আমি করতে পারি? তাই এতদিন সে চেষ্টা করিনি। কিন্তু দেশের ডাকে তো নীরব থাকতে পারলাম না। তাই রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় আমার অক্ষমতা-নিবন্ধন যা আমি করতে পারিনি, আজ তাঁর জীবনান্তে সেই ব্রত উদযাপন করতে ব্রতী হয়েছি।

একথা তো ভুলতে পারিনে যে, একদিন তার চরণপ্রান্তে বসে আশীর্বাদ লাভ করেছি, তার অজস্র অকৃপণ দাক্ষিণ্যে ধন্য হয়েছি সেই অপরিমেয় স্নেহের ঋণ অপরিশোধ্য। তাই আজ অশ্রুসজল চিত্তে সকলের সঙ্গে কবিগুরুকে আমারও সম্মিলিত প্রণাম নিবেদন করছি।

***

১৯২৯ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়তে যাই। বিদ্যালয়ের বিশাল প্রাসাদে পথ ভুলে ফনেটিক ইনসৃটিটুটের বক্তৃতাগৃহে উপস্থিত হই। বহু ছাত্রছাত্রী ভিড় করে বসে আছে– বক্তৃতা শুরু হবার দেরি নেই। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি দেশবাসী কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে বসে পড়লুম। প্রোফেসার বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, অদ্যকার বক্তৃতা ফনেটিক বিজ্ঞানের অবতরণিকা। নানা ভাষায় নানা দেশের লোকের নানা উচ্চারণ আজ শোনানো হবে। ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে দেয়ালে ম্যাজিক লেন্টনের ছবি ফেলা হল।…রবীন্দ্রনাথ!–সঙ্গে সঙ্গে কলের গান বেজে উঠল, সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর :

Through ages India has sent her voice– অন্ধকার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ঋজুদীর্ঘ মূর্তির আলোকোদ্ভাসিত প্রতিচ্ছবি। কণ্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথের না তপোবনের ঋষির শৃন্বন্তু বিশ্বে, ভারতবর্ষের সেই চিরন্তন বাণী।

আবার আলো জ্বলল। অধ্যাপক বললেন, এমন গলা, ঠিক জায়গায় জোর দিয়ে অর্থ প্রকাশ করার এমন ক্ষমতা শুধু প্রাচ্যেই সম্ভব। পূর্বদেশে মানুষ এখনও বটকে (শহ্ম) বিশ্বাস করে। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বরে তারই পূর্ণতম অভিব্যক্তি। কণ্ঠস্বরের এমন মাধুর্য, বাক্যের এমন ওজস্বিতা পশ্চিমে কখনও হয় না।

গর্বে আমার বুক ভরে উঠল। ডাইনে তাকালুম, বাঁয়ে তাকালুম। ভাবটা এই, আলবৎ, ঠিক কথা, ভারতবাসীই শুধু এমন ধ্বনির ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে পারে। ক্লাসের বহু ছাত্রছাত্রী সে সন্ধ্যায় আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি মাথা উঁচু করে বসেছিলুম। আমার গুরুদেব ভারতবর্ষের, আমিও ভারতবাসী।

***

তার চেয়েও আশ্চর্য হয়েছিলুম ১৯২৭ সালে জর্মনি যাওয়ার দুই বত্সর পূর্বে–কাবুলে।

ইউরোপ যাওয়ার জন্য অর্থ-সংস্থান করতে গিয়েছিলুম কাবুলে। ফরাসি ও ফারসি জানি বলে অনায়াসে চাকরি পেয়েছিলুম। তখনকার দিনে বিশ্বভারতীই ছিল একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ফরাসি, ফারসি, জর্মন একসঙ্গে শেখা যেত।

দুশো টাকা মাইনেতে গিয়েছিলুম; কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই কাবুল সরকার আবিষ্কার করলেন যে আমি জর্মনও জানি। মাইনে ধা করে একশো টাকা বেড়ে গেল। পাঞ্জাবি ভায়ারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওজিরে মাওয়ারিফের (শিক্ষামন্ত্রী) কাছে ডেপুটেশন নিয়ে ধরনা দিয়ে বললেন, সৈয়দ মুজতবা এক অনরেকগনাইজড় বিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাধারী। আমরা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ; এম.এ। আমাদের মাইনে শ-দেড়শো; তার মাইনে তিনশো, এ অন্যায়।

শিক্ষামন্ত্রীর সেক্রেটারি ছিলেন আমাদের বন্ধু। তিনি আমার কাছে ঘটনাটা বর্ণনা করেছিলেন ফারসিতে।*–জানো, বন্ধু, শিক্ষামন্ত্রী তখন কী বললেন? খানিকক্ষণ চুপ করে জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বললেন– বিলকুল ঠিক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, তোমাদের ডিগ্রিতে দস্তখত রয়েছে পাঞ্জাবের লাটসাহেবের। তাকে আমরা চিনি না, দুনিয়াতে বিস্তর লাটবেলাট আছেন– আমাদের ক্ষুদ্র আফগানিস্তানেও গোটাপাঁচেক লাট আছেন। কিন্তু মুজতবা আলীর সনদে আছে রবীন্দ্রনাথের দস্তখত– সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি সমগ্র প্রাচ্যের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।

[*(খ্রি দানি আগাজান, ওজিরে মাওয়ারিফ চি গুফতন্দ)।]

***

এসব অভিজ্ঞতা যে কোনওদিন হবে সে তো স্বপ্নেরও অগোচর ছিল, যখন ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাই। বিশ্বভারতীর কলেজ বিভাগ তখনও খোলা হয়নি। ছ মাস পরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের পৌরোহিত্যে তার ভিত্তিপত্তন হয়। বিশ্বভারতীতে তখন জনদশেক ছাত্রছাত্রী ছিলেন, তাঁরা সবাই শান্তিনিকেতন স্কুল থেকেই কলেজে ঢুকেছেন–শ্রীহট্টবাসীরূপে আমার গর্ব এই যে বিশ্বভারতীর কলেজ বিভাগে আমিই প্রথম বাইরের ছাত্র।**

[**রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখি ১৯১৯-এ শ্রীহট্ট শহরে। পূজ্যপাদ গোবিন্দনারায়ণ সিংহের আমন্ত্রণে তিনি শ্রীহট্টের আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন।]

প্রথম সাক্ষাতে গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন, কী পড়তে চাও?

আমি বললুম, তা তো ঠিক জানিনে তবে কোনও একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই।

তিনি বললেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী?

আমি বললুম, মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনও জিনিস বোধহয় ভালো করে শেখা যায় না।

গুরুদেব আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, একথা কে বলেছে?

 আমার বয়স তখন সতেরো থতমত খেয়ে বললুম, কনান ডয়েল।

গুরুদেব বললেন, ইংরেজের পক্ষে এ বলা আশ্চর্য নয়।

কাজেই ঠিক করলুম, অনেক কিছু শিখতে হবে। সম্ভব অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। গুরুদেবের সঙ্গে তখন সাক্ষাৎ হত ইংরেজি ও বাংলা ক্লাসে। তিনি শেলি, কিটস আরবলাকা পড়াতেন।

তার পর ১৯২২-এর কাছাকাছি শান্তিনিকেতনে টলস্টয়ের ভাবধারা হঠাৎ ছাত্রছাত্রীদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করল। আমরা বললুম, শান্তিনিকেতনে আমরা যে জীবনযাপন করছি সেটা বুর্জুয়া জীবন, বিলাসের জীবন। তাতে সরলতা নেই, সাম্য নেই, স্থৈর্য নেই। আমাদের উচিত সেই সহজ সরল জীবনকে ফিরিয়ে আনা, মাটির টানে প্রকৃতির কোলে ফিরে গিয়ে ক্ষেত করা, ফসল ফলানো। আমাদের মতবাদ যখন প্রবল হয়ে বিদ্রোহের আকার ধরেছে, তখন একদিন গুরুদেব আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমাদের মতবাদের বিরুদ্ধে তিনি তর্ক করলেন। নাস্তানাবুদ হয়ে আমরা আধঘণ্টার ভেতর চুপচাপ। সবশেষে তিনি বললেন, আমি জানি একতারা থেকে যে সুর বেলোয় তাতে সরলতা আছে কিন্তু সে সরলতা একঘেয়েমির সরলতা। বীণা বাজানো ঢের শক্ত। বীণাযন্ত্রের তার অনেক বেশি, তাতে জটিলতাও অনেক বেশি। বাজাতে না জানলে বীণা থেকে বিকট শব্দ বেরোয় কিন্তু যদি বীণাটাকে আয়ত্ত করতে পার তবে বহুর মধ্যে যে সামঞ্জস্যের সৃষ্টি হয় হারমনি ইন্ মল্‌টিপ্লিসিটি) তা একতারার একঘেয়েমির সরলতার (মনটনস্ সিমপ্লিসিটি) চেয়ে ঢের বেশি উপভোগ্য। আমাদের সভ্যতা বীণার মতো, কিন্তু আমরা এখনও ঠিকমতো বাজাতে শিখিনি। তাই বলে সে কি বীণার দোষ, আর বলতে হবে যে একতারাটাই সবচেয়ে ভালো বাদ্যযন্ত্র।

আমার মনে হয় এইটেই ছিল রবীন্দ্রনাথের মূল সুর। চিরজীবন তিনি বহু-র ভেতর একের সন্ধান করেছিলেন। তার সে সাধনা আমি প্রত্যক্ষ দেখেছি। সৌভাগ্যক্রমে প্রায় এক বৎসর শান্তিনিকেতনে আমি ছিলুম এক ঘরের নিচের তলায়। সেখান থেকে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেই দেখতে পেতুম, গুরুদেব তাঁর জানালার পাশে বসে লেখাপড়া করছেন। সকালে চারটার সময় দুঘন্টা উপাসনা করতেন। তার পর ছটার সময় স্কুলের ছেলেদের মতো লেখাপড়া করতেন। সাতটা, আটটা, নটা, তার পর দশ মিনিটের ফাঁকে জলখাবার। আবার কাজ–দশটা, এগারোটা, বারোটা। তার পর খেয়েদেয়ে আধঘণ্টা বিশ্রাম। আবার কাজ– লেখাপড়া; একটা, দুটো, তিনটে, চারটা, পাঁচটা কাজ, কাজ, কাজ। পাঁচটা থেকে সাতটা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন– বা দিনুবাবুর আসরে বসে গান শুনতেন, অথবা গল্প-সল্প করতেন। তার পর খাওয়াদাওয়া সেরে আবার লেখাপড়া, মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান– আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত! কী অমানুষিক কাজ করার ক্ষমতা। আর কী অপরিসীম জ্ঞানতৃষ্ণা!

আমি তখন নিতান্তই তরুণ। আমার থেকে যারা প্রবীণ এবং জ্ঞানী তারা গুরুদেবের জীবনের অনেক ইতিহাস জানেন। তারা রবীন্দ্রনাথের নানা সৃষ্টির নানা আলোচনা করবেন। তাঁর সৃষ্টির অনেক কিছু অমর হয়ে থাকবে, অনেক কিছু লোপ পাবে।

কিন্তু এ বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, চিরন্তন হয়ে থাকবে রবীন্দ্রনাথের গান। জর্মনিরলিডর গান ইউরোপের গীতিকাব্যের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। এমন সব গান লিডরে আছে যার কথা দিয়েছেন গ্যেটের মতো কবি আর সুর দিয়েছেন বেটোফেনের মতো সুনিপুণ সুরশিল্পী। আমার মনে হয়, তার চাইতেও শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথের গান। কারণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল একাধারে গীতিকার এবং সুরস্রষ্টার প্রতিভা। রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির কণ্ঠে চিরকাল বেঁচে থাকবে। কেউ যদি বলেন, না, চিরস্থায়ী তা হবে না– আমি তর্ক করব না। কারণ আর যা নিয়ে চলুক; গান নিয়ে, গীতি-কবিতা নিয়ে তর্ক চলে না। গানের আবেদন সরাসরি একেবারে মানুষের মর্মস্থলে গিয়ে পৌঁছায়। গান হৃদয়কে দোলা দেয়, অন্তরে জাগায় অনির্বচনীয় অনুভূতি; যুক্তিতর্কের অপেক্ষা রাখে না।

প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং সঙ্গীত সম্বন্ধে দু চারটি কথা বললাম। সে বিপুল সাহিত্যের খানিকটা বুঝেছি, বেশিরভাগই বুঝিনি। কিন্তু, তার সাহিত্যালোচনার দিন আজ নয়। আজ শুধু আমার স্নেহপ্রবণ গুরুদেবের সংবেদনশীল অন্তরটির পরিচয় দেবার জন্যেই আরও কয়েকটি কথা বলে এ প্রসঙ্গ শেষ করব। কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার অতীত; সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কিন্তু আমাদের কাছে তিনি যে ছিলেন স্নেহাসক্ত গুরু, নিতান্তই মাটির মানুষ। কিন্তু মানুষ রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ উদঘাটিত করাও যে দুঃসাধ্য। হিমালয়ের পাদমূলে বসে বিচিত্র পুষ্প চয়নকালেও ক্ষণে ক্ষণে গৌরী-শিখরের বিরাট, বিশাল, গম্ভীর মহিমা হৃদয়কে নির্বাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।

শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে অবসর সময়ে ক্যাটালগ তৈরি করতুম। তখন প্রতিদিন দেখতুম পাঠান্তে নতুন পুরাতন বই তিনি লাইব্রেরিতে ফেরত পাঠাতেন। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, নতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, কাব্য, কত বলব! এমন বিষয় নেই যাতে তাঁর অনুসন্ধিৎসা ছিল না।

এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন আজীবন জ্ঞান-সাধক। কিন্তু তাই বলে জীবনকে সকল দিক থেকে বঞ্চিত করে কঠোর জ্ঞানমার্গ তিনি অবলম্বন করেননি। তিনি তার একটি বিখ্যাত কবিতায় বলেছেন ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসন সে নহে আমার পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগের আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন কঠোর সংযমী। এক হিসেবে তিনি ছিলেন প্রকৃত তপস্বী। তপস্যা;- সে তো শক্তি সঞ্চয়ের জন্যেই। তার একটি কবিতায় আছে–

জানি জানি এ তপস্যা দীর্ঘ রাত্রি
করিছে সন্ধান,
চঞ্চলের মৃত্যুস্রোতে আপন উন্মত্ত অবসান।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ জীবনে অতীন্দ্রিয় সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর ঋষি-দৃষ্টির সমক্ষে সত্যের স্বরূপটি উদ্ঘাটিত হয়েছিল পরিপূর্ণ মহিমায়। তারই পরিচয় তার অজস্র গানে, কবিতায়, ধর্ম এবং শান্তিনিকেতনের নিবন্ধগুলোতে। রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান শুধু পুঁথি-পড়া জ্ঞান নয়, তা সম্পূর্ণই অনুভূতির।

মহুয়া প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ নিজে চয়ন করে সঞ্চয়িতা প্রকাশ করেন; তাতে মহুয়ার অতি অল্প কবিতা স্থান পায়। তখন রব উঠেছেমহুয়াতে কবির সৃজনী-শক্তির অপ্রাচুর্যের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। ভয় হল, রবীন্দ্রনাথও বুঝি তাই বিশ্বাস করে মহুয়ার যথেষ্ট কবিতা সঞ্চয়িতায় স্থান দেননি। কলকাতায় থাকতুম; শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি সঞ্চয়িতাতে মহুয়ার আরও কবিতা দিলেন না কেন? আমাকে যদি সঞ্চয়িতা সম্পাদন করার ভার দেওয়া হত, আমি তা হলে মহুয়ার মলাট ছিঁড়েসওয়িতা নাম দিয়ে প্রকাশ করতুম। বলতুম, এতেই সবচাইতে ভালো কবিতা সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

গুরুদেব হেসে বললেন, ভাগ্যিস তোমাকে সঞ্চয়িতা তৈরি করবার ভার দেওয়া হয়নি। আমি মহুয়ার কবিতা সঞ্চয়িতাতে যে বেশি পরিমাণে দিইনি, তার কারণ এই যে, মহুয়ার কাব্য-সৌন্দর্য সম্বন্ধে আমি সন্দিহান। আসলে মহুয়ার কবিতাগুলো মাত্র সেদিনের লেখা। কবিতার ভালোমন্দ বিচার করার জন্য যে দূরত্বের প্রয়োজন সেটা মহুয়ার বেলায় এখনও যথেষ্ট হয়নি।

ঠিক সেই কারণেই, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আলোচনা করার দিন বোধহয় এখনও আসেনি। যে পৃথিবীকে তিনি দীর্ঘকাল ধরে অতি নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছিলেন সেই পৃথিবী ছেড়ে তিনি মাত্র সেদিন চলে গেছেন। শোকে বাংলাদেশ মুহ্যমান। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য-সমালোচনার জন্য যে পরিমাণ সময়ের ব্যবধান প্রয়োজন তা আমরা এখনও পাইনি।

১৯৩৯ সালে গুরুদেবের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হল শান্তিনিকেতনে।

তাকিয়ে বললেন, লোকটি যে বড় চেনা-চেনা ঠেকছে। তুই নাকি বরোদার মহারাজা হয়ে গেছিস?

আমি আপত্তি জানালুম না। তর্কে তাঁর কাছে বহুবার নাজেহাল হয়েছি। আপত্তি জানালে তিনি প্রমাণ করে ছাড়তেন, আমিই বরোদার মহারাজা, নয়তো কিছু একটা জাঁদরেল গোছের।

নিজেই বললেন, না না। মহারাজা নয়, দেওয়ান-টেওয়ান কিছু একটা।

আমি তখনও চুপ। মহারাজা দিয়ে যখন আরম্ভ করেছেন, কোথায় থামবেন তিনিই জানেন।

 তার পর বললেন, কীরকম আছিস? খাওয়া-দাওয়া?

 আমি বললুম, আপনি ব্যস্ত হবেন না।

আরে না না, আজকালকার দিনে খাওয়া-দাওয়া যোগাড় করা সহজ কর্ম নয়। তোকে আমি একটা উপদেশ দি। ওই যে দেখতে পাচ্ছিসটাটা ভবন তাতে একটি লোক আছে, তার নাম পঞ্চা; লোকটি রাধে ভালো। তার সঙ্গে তুই যদি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারিস তবে ওখানে তোর আহারের দুর্ভাবনা থাকবে না।

আমি তাকে আমার খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবার জন্যে অনুরোধ জানালাম।

তখন বললেন, তুই এখনও বরোদা কলেজে ধর্মশাস্ত্র পড়াস, না?

আমি জানতুম, তিনি ঠিক জানেন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রেরা কে কী করে। তাই মহারাজা বা দেওয়ান আখ্যায় আপত্তি জানাইনি।

তার পর বললেন, জানিস, তোদের যখন রাজা-মহারাজারা ডেকে নিয়ে সম্মান দেখায় তখন আমার মনে কী গর্ব হয়, আমার কী আনন্দ হয়। আমার ছেলেরা দেশ-বিদেশে কৃতী হয়েছে।

তার পর খানিকক্ষণ আপন মনে কী ভেবে বললেন, কিন্তু জানিস, আমার মনে দুঃখও হয়। তোদের আমি গড়ে তুলেছি, এখন আমার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তোদের প্রয়োজন। গোখলে, শুক্ল, তোরা সব এখানে থেকে আমাকে সাহায্য করবি। কিন্তু তোদের আনবার সামর্থ্য আমার কোথায়?

তা যাক। বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসছেন কাঁচি হাতে করে?

আমি অবাক। মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে, অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মা নিয়ে। কাঁচি হাতে করে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ কাঁচি নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ঘেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু-মুসলমান আর কতদিন এরকম আলাদা হয়ে থাকবে।

তার পর আধঘণ্টা ধরে অনেক কিছু বললেন হিন্দু-মুসলমানের কলহ নিয়ে। তাঁকে যে এই কলহ কত বেদনা দিত সে আমি জানি। আমাকে যে বলতেন তার কারণ বোধহয় আমি তার মুসলমান ছাত্র। বোধহয় মনে করতেন আমি তাকে ঠিক বুঝতে পারব।

গুরুদেব তখন বেশি কথা বললে আঁপিয়ে উঠতেন। আমি তাই তার কথা বন্ধ করার সুযোগ খুঁজছিলাম। তিনিই হঠাৎ লক্ষ করলেন, আমার জামার পকেটে ছোট্ট ক্যামেরা। বললেন, ছবি তোলার মতলব নিয়ে এসেছিস বুঝি। তোল, তোল। ওরে সুধাকান্ত,

পরদাগুলো সরিয়ে দে তো। কীরকম বসব বল।

আমি বললুম, আপনি ব্যস্ত হবেন না; আমি ঠিক তুলে নেব।

তোর বোধহয় খুব দামি ক্যামেরা, জার্মানি থেকে নিয়ে এসেছিস, সব কায়দায় ছবি তোলা যায়। অন্যেরা বড় জ্বালাতন করে; এরকম করে বসুন, ওরকম করে বসুন। কত কী!

ছবি তোলা শেষ হলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে বললেন, কী রে, কিছু বলবি নাকি?

আমি বললুম, একটা কথা বলতে চাই যদি কিছু মনে না করেন।

 তিনি ক্লাসে যেরকম উৎসাহ দিতেন ঠিক সেইরকমভাবে বললেন, বল, বল, ভয় কী?

আমি বললুম, এই যে আপনি বললেন, আপনার সামর্থ্য নেই আমাদের এখানে নিয়ে আসবার, সেই সম্পর্কে আমি শুধু আমার নিজের তরফ থেকে বলছি যে, বিশ্বভারতীর সেবার জন্য যদি আমাকে প্রয়োজন হয় তবে ডাকলেই আসব। যা দেবেন হাত পেতে নেব।

গুরুদেব বললেন, সে কি আমি জানিনে রে, ভালো করেই জানি। তাই তো তোদের কাছে আমার সামর্থ্যহীনতার কথা স্বীকার করতে সঙ্কোচ হয় না।

মনে হল গুরুদেব খুশি হয়েছেন।

.

গুরুদেব আজ নেই।

কিন্তু সেই হারানো দিনের স্মৃতি আজও আমার মনে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

.

রবির বিশ্বরূপ

রবীন্দ্রনাথকে সমগ্রভাবে গ্রহণ করার শক্তি আমাদের নেই। গীতাতে উক্ত তিন মার্গেই একসঙ্গে একই মানুষ চলেছে এর উদাহরণ বিরল। তিনি জ্ঞানী ছিলেন; শব্দতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তিনি কর্মী ছিলেন; গ্রামোন্নয়ন, কৃষির উৎকর্ষ, সমবায় সমিতি, শ্রীনিকেতন বিদ্যালয় তিনি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি রসের সাধক ছিলেন– এটাকে ভক্তিমার্গ বলা যেতে পারে তিনি তাঁর ভগবানকে প্রধানত রসম্বরূপেই আরাধনা করেছিলেন এবং ইহজগতের প্রিয়া, প্রকৃতিকে সেই রসস্বরূপেই কাব্যে, নাট্যে, গানে প্রকাশ করেছেন।

অথচ কোনও স্থলেই তিনি খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন নন। অর্থাৎ প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের মতো যখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শব্দ সঞ্চয় করে ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে পুস্তিকা লিখছেন তখন তাঁর ভাষা কঠিন শব্দতাত্ত্বিকের নয়, তাঁর ভাষা সরস কবির মতো। এবং সেখানে তিনি কর্মযোগীর ন্যায় এ উপদেশও দিচ্ছেন, কী করে সে ভাষাতত্ত্বের পুস্তক কাজে লাগাতে হয়। পক্ষান্তরে তিনি যখন বর্ষা, বসন্তের গান লিখছেন তখন উদ্ভিদবিদ্যায় অজ্ঞ সাধারণ কবির মতো একই ঋতুতে কদম্ব আমঞ্জরী ফোঁটান না। বস্তুত আমাদের দেশে যে শত শত দিশি বিদেশি ফুল ফোটে, কোন জায়গায় কী সার দিলে ভালো করে ফোটে, এসব খবরও রাখতেন। বিদেশি ফুলের নামকরণ করতেন, একাধিক নাম-না-জানা দিশি ফুলেরও নামকরণ করেছেন। কথিত আছে–শহরাগত এক নবীন শিক্ষক অত্যন্ত সাধারণ জাম না গাবগাছ চিনতে পারেননি বলে কবি তাঁর হাতে শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের সঁপে দিতে নারাজ হয়েছিলেন। আবার হাল চালানো, গাছ পোতার মতো নীরস গদ্যময় ব্যাপার কী হতে পারে?– শ্রীনিকেতনে যারাই হলকর্ষণ বৃক্ষরোপণ উৎসব দেখেছেন তারাই জানেন কবি কীভাবে এ দুই সাধারণ কর্মকে সৌন্দর্যের পর্যায়ে তুলে নিয়েছেন। অনেকেরই বিশ্বাস–

এসো এসো হে তৃষ্ণার জল

বর্ষার গান। অন্তত সেই ঋতুতেই গাওয়া হয়। তা হলে প্রশ্ন উঠবেভেদ করি কঠিনের ক্রুর বক্ষতলগূঢ় অন্ধকার হতে কে আসছে? মরুদৈত্য কোন মায়াবলে তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে কে সে?

আসলে এটি রচিত হয় শান্তিনিকেতনে প্রথম টিউবওয়েল খননের সময়। মাটির নিচে যে জল বন্দি হয়ে আছে তাকে বেরিয়ে আসবার জন্য কবি কর্মযোগের প্রতীক কলকজার বন্দনা-গীতি ধরেছেন।

সবসময়েই তিনটি জিনিস যে একই আধারে থাকবে এমন কোনও ধরাবাধা নেই কিন্তু মোটামুটি বলা যেতে পারে, তিনি দুই, আড়াই কিংবা তিন ডাইমেনশনেই চলুন, আমরা চলতে জানি শুধু এক ডাইমেনশনে এবং তাই তাঁর সমগ্র রূপ আমাদের পক্ষে ধরা কঠিন, প্রায় অসম্ভব (তিরোধানের পূর্বে তিনি এক চতুর্থ ডাইমেনশনে চলে যান এবং সেটি এমনই রহস্যাবৃত যে, উপস্থিত সেটি উল্লেখ করব না; কারণ ওইটে ভালো করে বোঝবার জন্য আমি এখনও হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছি)।

সে অসম্ভব কি কখনও সম্ভব হবে, এবং যদি হয় তবে কী প্রকারে হবে?

এটা বোঝানো যায় শুধু তুলনা দিয়ে।

চিত্রকর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে গুণী রসিকেরা চেনেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি বাল্যবয়স থেকেই ক্ষীণ। তিনি চার হাত দূরের থেকেই কোনও জিনিস ভালো করে দেখতে পেতেন না।

যৌবনে তিনি একখানি বিরাট দেয়াল-ছবি বা ফ্রেস্কো আঁকতে আরম্ভ করেন। বড় বড় চিত্রকররাও সম্পূর্ণ ফ্রেস্কোর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখার জন্য বার বার পিছনে হটে ছবিটাকে সমগ্ররূপে দেখে নেন। আমরা, দর্শকরাও ছবি শেষ হওয়ার পর যখন সেটি দেখি তখন দূরের থেকে তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখি তখন খুঁটিনাটি, সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখতে পাইনে– পরে কাছে গিয়ে খুঁটিনাটি দেখি তখন আর তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখতে পাইনে।

পূর্বেই বলেছি, বিনোদবিহারী দূরের থেকে কিছুই দেখতে পান না। তাই তিনি অনুমানের ওপর নির্ভর করে একদিকে ছবি আঁকা আরম্ভ করে অন্যপ্রান্তে এসে শেষ করতেন, কিংবা খাবলা খাবলা করে যেখানে খুশি খানিকটে এঁকে নিতেন। পরে দেখা যেত পার্সপেকটিভ না দেখতে পেয়েও বিনোদবিহারীর বিরাট ফ্রেস্কোর এ-কোণের হাতি ও-কোণের প্রজাপতির চেয়ে যতখানি বড় হওয়ার কথা ততখানি বড়ই হয়েছে। তিনি অবশ্য কখনও সেটা দেখতে পেতেন না, কারণ যতখানি দূরে এলে আমরা সমগ্র ছবি দেখতে পাই ততখানি দূরে এলে তিনি সবকিছু ধোয়াটে দেখতেন।

একদিন তাঁর এক শিষ্য একটি ক্যামেরা নিয়ে এসে উপস্থিত। যতখানি দূরে দাঁড়ালে পুরো ক্যামেরায় ধরা পড়ে ততখানি দূরে দাঁড়িয়ে সে ক্যামেরায় ঘষা কাঁচের উপর প্রতিবিম্বিত পুরো ফ্রেস্কোটি সে বিনোদবিহারীকে দেখাল। এই তিনি তাঁর আঁকা পূর্ণাঙ্গ ছবি জীবনে প্রথম দেখতে পেলেন। একসঙ্গে এককোণের হাতি ও অন্যকোণের প্রজাপতি দেখতে পেলেন, এক চিত্রাংশ অন্য চিত্রাংশের সঙ্গে ঠিক ঠিক যেমনটি তিনি চেয়েছিলেন খাপ খেয়ে আঁকা হয়েছে কি না দেখতে পেলেন। অবশ্য ঘষা কাঁচের উপর খুঁটিনাটি কারুকার্য দেখতে পাননি, কিন্তু সে জিনিসে তার প্রয়োজন ছিল না; কারণ কাছে দাঁড়িয়ে তো তিনি সেগুলো ভালো করেই দেখতে পান।

এই ক্ষুদ্র রচনায় আমি এত দীর্ঘ একটি উপমা দিলাম কেন? কারণ বহু বৎসর ধরে ভেবে ভেবেও আমি এযাবৎ খুঁজে পাইনি কী করে আরও সংক্ষেপে আমার বক্তব্যটা বোঝাতে পারি।

পূর্বেই বলেছি, সমগ্রভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হলে আমাদের যতখানি দূরে যেতে হয় ততখানি দূরে গেলে আমাদের সবকিছু ধোঁয়া লাগে। ঘষা কাঁচ হলে আমরা তার পূর্ণ রূপ দেখতে পেতুম।

তা হলে এই ঘষা কাচ জিনিসটে কী?

কোনও মহৎ কবির পরবর্তীকালে যখন সবাই তার বিরাট সমগ্র রূপ দেখার চেষ্টা করে নিষ্ফল হচ্ছে তখন হঠাৎ আবির্ভূত হন আরেক মহৎ ব্যক্তি যিনি কবির সর্বাঙ্গসুন্দর সমগ্র ছবি ঘষা কাঁচের মতো তাঁর বুকে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর রচনায়, তাঁর কাব্যে তিনি তখন কবিকে এমনভাবে এঁকে দেন যে আমরা অক্লেশে তার পূর্ণ ছবিটি দেখতে পাই। শক্তিমান জন দ্বারা কোনও দুরূহ কার্য সমাধিত হওয়ার পর সাধারণের পক্ষে তা অতি সহজ হয়ে দাঁড়ায়। তাই কালিদাস বলেছেন,

মণৌ বজ্র-সমুত্তীর্ণে সূত্রস্যেবাস্তি মে গতিঃ

কঠিন মণিকে হীরক দ্বারা বিদ্ধ করিলে যেমন সেই ছিদ্র দিয়া অনায়াসে ওই মণির মধ্যে সূত্রের প্রবেশ সম্ভব।

কালিদাস সুবাদেই বলি, এই এ যুগের আমাদের রবীন্দ্রনাথই তার যে সর্বাঙ্গসুন্দর ছবি এঁকেছেন, ভারতীয় সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে তার যে বিরাট কলেবর আমাদের দেখিয়েছেন, সে তো অন্য কেউ ইতোপূর্বে করে উঠতে পারেননি।

পৃথিবীর ইতিহাসে এ যোগাযোগ বিরল নয়। এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা ভাগ্যবান জর্মন সাহিত্য। গ্যোটের পঞ্চমুখে পঞ্চতন্ত্র কথা একইসঙ্গে শোনবার ক্ষমতা অর্জন করার জন্য জর্মনিকে বহুকাল অপেক্ষা করতে হয়নি। তাদের সৌভাগ্য, অংশত গ্যোটেরও সৌভাগ্য যে, তাঁরই জীবদ্দশায় হাইনের মতো কবি জন্মগ্রহণ করেন। দু জনাতে কয়েক মিনিটের তরে দেখাও হয়েছিল মাত্র একবার। সে অভিজ্ঞতা কারওরই পক্ষে সুখদা হয়নি। কিন্তু পরবর্তী যুগে হাইনে যখন ঘষা কাঁচের মতো তার বুকের উপর গ্যোটের পূর্ণ ছবি প্রতিবিম্বিত করলেন তখন জর্মন মাত্রই গ্যোটের বিরাট ব্যক্তিত্ব অতি সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পারল।

রবীন্দ্রনাথকে সেভাবে দেখাবার মতো মনীষী এখনও এ জগতে আসেননি।

প্রার্থনা করি, আমাদের জীবদ্দশায়ই তিনি আসেন। বড় বাসনা ছিল, মৃত্যুর পূর্বে তার বিশ্বরূপটি দেখে যাই ৷

.

ইউরোপ ও রবীন্দ্রনাথ

ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশবাসীর সঙ্গে যারাই অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন তারাই হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে, ইউরোপবাসী রবীন্দ্রনাথকে চেনে কত অল্পই। অথচ আমরা সকলেই জানি যে, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি যখন প্রথম বিলাতে প্রকাশিত হয় তখন তিনি সেদেশে কী অদ্ভুত সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। তার কয়েক বৎসর পর যখন কবি কন্টিনেন্ট ভ্রমণ করেন তখন তাঁকে দেখবার জন্য, তাঁর বক্তৃতা শোনবার জন্য কী অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে কত লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর চতুর্দিকে সমবেত হয়েছে। এবং সর্বশেষ কথা এ জানি যে, ক্রমে ইউরোপে তার খ্যাতি ম্লান হতে থাকে, এমনকি একাধিক সুপরিচিত সমালোচককে একথাও বলতে শোনা গিয়েছে, তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল কোন স্থূল বুদ্ধিতে এবং যারা টমসনের রবীন্দ্রজীবনী মন দিয়ে পড়েছেন তারাও হতাশ হলেন এই দেখে যে তিনি পর্যন্ত কাব্যরসে আদৌ নিমজ্জিত হতে পারেননি, অথচ তিনি যে খানিকটা বাঙলা ভাষা জানতেন সেকথাও সত্য। এ বইখানা রবীন্দ্রনাথকেও কিঞ্চিৎ বিক্ষুব্ধ করেছিল এবং বোধহয় তার প্রধান কারণ তিনিও হতাশ হলেন এই ভেবে যে, টমসনই যখন তার কাব্যরস আস্বাদন করতে পারলেন না তখন ইউরোপের সাধারণ পাঠক করবে কী প্রকারে?

রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি নিয়ে যখন ইংরেজ কবিগণ মত্ত তখন এদেশে আমরা আশ্চর্য হয়েছি যে এর ভিতর ইংরেজ কী পাচ্ছে যে তার এত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে। গীতাঞ্জলির গান বাংলায় গাওয়া হয় ইংরেজিতে তা নেই- বাঙলায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে এ গানগুলো ইংরেজিতে যেন চুম্বক, এবং বাঙলা কবিতারূপে এ গানগুলোর যে গীতিরস পাই (সুর বাদ দিয়েও) ইংরেজিতে তা কই! মনকে তখন এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছি যে, হয়তো ইংরেজ পাঠক ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে তার মাতৃভাষায় এমন এক ইংরেজি গীতিরস পায় যেটা আমাদের অনভ্যস্ত কান ধরতে পারে না।

হংস যেমন মানসযাত্রী তেমনি সারা দিবস রাত্রি
একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণপারে।

 এটিকে কবিতারূপে পড়ে আমরা যে গীতিরস পাই,

Like a flock of homesick cranes flying night & day back to their mountain nests, let all my life take its voyage to its enternal home, in one salutation to Thee:

পড়ে তো সে-রস পাইনে। তখন মনকে বুঝিয়েছি যে হয়তো এই ইংরেজি অনুবাদে শব্দগুলো এমনভাবে চয়ন ও সাজানো হয়েছে যে ইংরেজ তার ভিতর আপন গীতির পেয়ে মুগ্ধ হয়েছে।

গীতাঞ্জলির ফরাসি জর্মন এবং অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ ইংরেজি অনুবাদ থেকে। সেসব অনুবাদে মূলের রস আরও পরিশুষ্ক হওয়ার কথা।  

রসের দিকের কিছুটা বাদ দিয়ে যখন ভাবের দিকটা দেখি তখন বরঞ্চ খানিকটা বুঝতে পারি, ইংরেজি এবং অংশত ফরাসি-জর্মন তথা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার গীতাঞ্জলি কেন গুণীজনকে মুগ্ধ করেছিল।

প্রথমত রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি অনুবাদে ব্যবহার করেছেন কিঞ্চিৎ প্রাচীন ইংরেজি। সে ভাষা কিছুটা ইংরেজি বাইবেলের ভাষা। এদেশের তুলনা নিলে বলব, যে বাঙালি বৈষ্ণবভক্ত বিদ্যাপতি পড়ে আনন্দ পান তিনি ভানুসিংহের পদাবলীর ভাষা পড়েই মুগ্ধ হবেন, তার গভীরে অতখানি প্রবেশ করবেন না– বিশেষত সে যদি অবাঙালি হয় এবং বৈষ্ণব না হয়ে স্লেচ্ছ-যবন হয়।

দ্বিতীয়ত গীতাঞ্জলিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রভু-সখা-প্রিয়কে যে রূপ দিয়েছেন তার সঙ্গে ইংরেজ কিছুটা পরিচিত। বাইবেলের সং অব সংস (সং অব সলোমন) এবং সাম্স গীতির সঙ্গে যারা পরিচিত তাঁরা মিলটি অনায়াসেই দেখতে পাবেন। পার্থক্য শুধু এই যে সং অব সলোমনে প্রেমের দৈহিক দিকটা অনেকখানি প্রাধান্য পেয়েছে– গীতাঞ্জলিতে তা নয়– এবং সামস গীতিতে ভগবানের প্রিয় স্বরূপ কম, তিনি সেখানে দয়াল প্রভু, তিনি সর্বশক্তিমান কর্তা, তিনি ইচ্ছে করলে এ দাসকে তার করুণা থেকে বঞ্চিতও করতে পারেন। এর সঙ্গে যোগ দেওয়া যেতে পারে সান্ খোয়ান দে লা ক্রুসের ভগবদ্ প্রেমের কাব্য। এর মিল সং অব সংসের সঙ্গে কিঞ্চিৎ কায়িক প্রেম। যে ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে ইউরোপের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত করে দিয়েছিলেন তিনি সান খোয়ানের ভক্ত ছিলেন এবং তার রচনাতে এর প্রচুর উদ্ধৃতি আছে। কিছুটা এই কারণেও ইয়েটস এবং তার সম্প্রদায়ের পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে বোঝা সহজ হয়েছিল।

তৃতীয়ত গীতাঞ্জলির প্রভু-সখা-প্রিয় কোনও বিশেষ সম্প্রদায় বা ধর্মের ভগবান নহেন। ইংলন্ডে এরকম অনেক ভাবুক আছেন যারা খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে উদাসীন, এবং তাই সম্প্রদায়মুক্ত চিত্তে ঈশ্বরের কাছে আসতে চান। ওদিকে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু (এখানে ব্রাহ্ম-হিন্দুর পার্থক্যের কথা উঠছে না–বিদেশির কাছে এ-দেশের ব্রাহ্মণ মাত্রই যে হিন্দু সে তারা ধরে নেয়) হয়েও যে ব্রহ্মকে তাদের সামনে কাব্যে রসস্বরূপ প্রকাশ করলেন তা দেখে তাদের বিস্ময়ের অবধি রইল না। এইসব সংস্কারমুক্ত ইংরেজ দূর-বিদেশির আরাধনার ধন আপন সাধনার ধনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে–দুই-ই এক ভগবান। তারা আশ্বস্ত হল, তারা একা নয়। খ্রিস্টধর্মে আস্থা হারিয়েও তারা দেখে ধর্ম তাদের ছাড়েনি।

অনেকটা এইসব কারণেই ডাকঘর তাই জনপ্রিয় হয়েছিল।

তাই আমার মনে হয়, ইংরেজ রবীন্দ্রনাথের ভাবের দিকটাই দেখেছিল বেশি, তাঁর রস-সৃষ্টি তারা ধরতে পারেনি। আমরা বাঙালি কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে চিনি প্রধানত রসস্রষ্টারূপে; তাই তাঁর বর্ষাবসন্তের গীতি, তাঁর বিরহ-বেদনার প্রতি প্রীতি আমাদের বেশি। রবীন্দ্রনাথ যতই অভিমান করে থাকুন না কেন, আমরা তাঁকে চিনেছি অন্য যে কোনও জাত অপেক্ষা বেশি।

তা সে যাই হোক, মূলকথায় ফিরে গিয়ে বলি, ভাবের পরিবর্তন হয় রসের পরিবর্তনের চেয়ে বেশি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিজেতা ইংলন্ডেই ভগবানের বিশ্বাস একসঙ্গে অনেকখানি কমে যায়। বরঞ্চ পরাজিত জর্মনি আর কিছু না পেয়ে ভগবানকে আঁকড়ে ধরল। ইংলন্ডে তার জনপ্রিয়তা কমল; জর্মনিতে বাড়ল; তার কয়েক বৎসরের মধ্যেই জর্মন যখন আপন পায়ে খানিকটে দাঁড়াল সেখানেও তার জনপ্রিয়তা কমল– স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সেটা লক্ষ করে উল্লেখ করেছেন।

এর সঙ্গে একটা অত্যন্ত স্থল কথা বলে রাখি। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ভাবের দিক দিয়ে হয়তো-বা ইউরোপের দু একজন গুণীজ্ঞানী গীতাঞ্জলির ব্রহ্মকে চিনতে পারবেন, কিন্তু ওই মহাদেশের সাধারণজন হয় তাকে অবহেলা করে, নয় চার্চের ভগবানকে নিয়েই তারা সন্তুষ্ট। আপন চেষ্টায় রসস্বরুপ পরমেশ্বরকে পাবার চেষ্টা তাদের নেই বললেও চলে। কিছুটা আছে ক্যাথলিক মিস্টিক ফাদারদের ভিতর কিন্তু তাঁরাও আপন ধর্মের দিগদর্শন নিয়েই সন্তুষ্ট। কাজেই এদিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ইউরোপে কখনও জনপ্রিয় হবেন আমার মনে হয় না।

তাই যখন তার খ্যাতি ইউরোপে কমল, আমরা আশ্চর্য হইনি।

আজ যে রবীন্দ্রনাথের স্মরণে বিশ্ববাসী তাকে সম্মান জানাচ্ছে, তাঁকে নিয়ে আনন্দ করছে তাতে আমরা খুশি। কিন্তু কারণ অনুসন্ধান করলে জানব, আজ পৃথিবীর সব দেশই আমাদের প্রিয় হতে চায় তার অন্যতম কারণদ্বয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। এ উচ্ছ্বাস রবীন্দ্রনাথের সত্য পরিচয়ের উৎস থেকে উদ্বেলিত হয়নি। তাই বর্ষশেষে আবার যদি দেখি–১৯১৯ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত যা দেখেছিলুম– সে জোয়ার কোনও চিহ্নই রেখে যায়নি তাতে যেন বিস্মিত বা মর্মাহত না হই।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার অত্যন্ত সুদৃঢ় বিশ্বাস ইউরোপ একদিন রবীন্দ্রনাথের সত্য পরিচয় পাবে। সেটা সম্ভব হবে যেদিন ইংরেজ ফরাসি জর্মনের বেশকিছু লোক বাঙলাভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ব্যাপকভাবে আপন আপন মাতৃভাষায় তাঁর রসসৃষ্টির অনুবাদ করবে। তার কিছু কিছু লক্ষণ এদিক-ওদিক দেখতে পাচ্ছি। একাধিক ক্যাথলিক ইতোমধ্যে অত্যুত্তম বাঙলা শিখে নিয়েছেন এবং একাধিক জর্মন এই নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, আরও অনেক বিদেশি বাঙলা শিখবে এবং অবশেষে রবীন্দ্রনাথের রচনা উপযুক্ত লোক দ্বারা অনূদিত হবে।

আমার ভয় শুধু একটি, এ দেশে তথা বিদেশে ক্লাসিকদের সম্মান ক্রমেই কমে যাচ্ছে। মানুষ মনোরঞ্জক দিকটাই দেখছে বেশি; ক্লাসিকদের স্থায়ী গভীর সচ্চিদানন্দ রস তারা পরিশ্রম করে আস্বাদ করতে চায় না অথচ রবীন্দ্রনাথের মূল উৎস সেইখানেই।

সেই ভয় আমি কাটাই এই ভরসা করে যে, রেনেসাঁসও তো হয়। বিরক্ত হয়ে আধুনিককে বর্জন করে মানুষ এ সংসারে কত-না বার অপেক্ষাকৃত প্রাচীনের সন্ধানে বেরিয়ে নিত্য নবীনের সন্ধান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিত্য নবীন।

.

কবিগুরু গুরুদেব

রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বহু প্রতিষ্ঠান নানা পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করছেন। এঁদের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এই সম্পর্কে একটি শর্ত আরোপ করেন যে, কোনও লেখক যেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ের উপলক্ষ করে কোনও রচনা না পাঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির মনে হয়তো শঙ্কা ছিল, রবীন্দ্রনাথের নাম করে এঁরা হয়তো নিজেদের আত্মজীবনী লিখে বসবেন। শঙ্কাটা কিছু অমূলক নয়।

কিন্তু এ শর্তের ভিতর একটা গলদ রয়ে গেল। এই প্রথম শতবার্ষিকী উপলক্ষেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা উল্লেখ করা যাবে দ্বিতীয় জন্ম-শতবার্ষিকীর সময় এত দীর্ঘায়ু কেউ থাকবেন বলে ভরসা হয় না। কাজেই এই শতবার্ষিকীতে কেউই যদি মানুষ রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে চিনেছিলেন, সেকথা না লেখেন, তবে দ্বিতীয় শতবার্ষিকীতে যারা আজকের দিনের প্রকাশিত প্রবন্ধাদি পড়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটি নির্মাণ করতে চাইবেন, তারা নিশ্চয়ই বিক্ষুব্ধ হবেন। অবশ্য এই নিয়ে যে অন্যত্র ভূরি ভূরি লেখা হয়নি তা নয়, কিন্তু শতবার্ষিকীর নৈমিত্তিক ধ্যান একরকমের, অন্য নিত্য-রচনা অন্য ধরনের।

***

কিন্তু এই মানুষ-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়, তারও বর্ণনা দেওয়া কি সহজ? প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ, আর পাঁচজন কবি কিংবা গায়কের মতো আপন কবিতা বা গান রচনা করার পর চট করে ধুলার সংসারে ফিরে এসে রাম-শ্যাম-যদুর মতো তাস পিটে, হুঁকো টেনে দিন কাটাতেন না। দৈনন্দিন জীবনে ফিরে আসার পরও তার বেশভূষা, বাক্যালাপ, আচার-আচরণে, দুষ্টের দমনে এবং শিষ্টের পালনে (আশ্রমের ছাত্রদের কথা হচ্ছে) তিনি কবিই থেকে যেতেন। এমনকি, আশ্রমের নর্দমা সম্বন্ধে আলোচনা করার সময় কবিজনোচিত কোনও বাক্য বেমানানসই মনে হলে এবং মনে রাখা উচিত সেই বেমানানসইটাও তাঁর কবিসুলভ হৃদয়ই ধরে নিত– সেটাকে তিনি অন্তত কিছুটা হাস্যরস দিয়ে উচ্চপর্যায়ে তুলে নিয়ে আসতেন। কিংবা সামান্য একটু অন্যধরনের একটি উদাহরণ নিন।

তার ভৃত্য বনমালী তাঁর জন্য এক গেলাস শরবত এনে দেখে বাইরের কে বসে আছেন বনমালী থেমে যাওয়াতে কবি বললেন, ওগো বনমালী দ্বিধা কেন? কবি বলেছিলেন সাধারণ ধুলো-মাটির দৈনন্দিন ভাষাকে একটু মধুরতর করার জন্যে। অথচ বাক্যটি তাঁর নিজের মনেও এমনই চাঞ্চল্য তুলল যে তিনি সেদিনই গান রচনা করলেন,

হে মাধবী, দ্বিধা কেন,
আসিবে কি ফিরিবে কি–
 আঙিনাতে বাহিরেতে
মন কেন গেল ঠেকি॥

এমনকি কমলালেবুর সওগাত পেয়ে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে যে তাকে সেগুলো নিবেদন করেছিল, তার স্মরণে তিনি যেসব কবিতা লিখেছেন, সেগুলো অনেক পাঠকই তাকে ব্যক্তিগতভাবে না-চিনেও স্মরণ করতে পারবেন।

এতেও কিন্তু তার এদিকটার পরিচয় অতিশয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা তাকে প্রধানত চিনেছি গুরুরূপে। সে সম্বন্ধে সুধীরঞ্জন দাশ, প্রমথনাথ বিশী প্রাঞ্জল ভাষায় সবিস্তর লিখেছেন- আমারও সংক্ষেপে লেখার সুযোগ অন্যত্র হয়েছে। কিন্তু কেমন যেন মনে হয়, আমরা যেটুকু অসম্পূর্ণভাবে দেখেছি সেটিও যেন সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারিনি।

এমন গুরু হয় না। পড়াবার সময় তিনি কখনও বাক্য অসম্পূর্ণ রাখতেন না– প্যারেনথেসিসে, অর্থাৎ এক বাক্যের ভিতর অন্য বাক্য এনে কখনও ছাত্রদের মনে দ্বিধার সৃষ্টিও করতেন না, এবং প্রত্যেকটি বক্তব্য তাঁর পরিপূর্ণ মধুরতম ভাষায় প্রকাশ করতেন। আমার মনে কণামাত্র দ্বিধা নেই যে, তার ক্লাস-পড়ানো যদি কেউ শব্দে শব্দে লিখে রাখতে পারত তবে সে রচনা তারপঞ্চভূত কিংবা অন্য যে কোনও শ্রেষ্ঠ রচনার সঙ্গে একাসনে বসতে পারত। এমনকি একথাও অনায়াসে বলা যায়, সে হত এক অদ্ভুত তৃতীয় ধরনের রচনা। এবং আশ্চর্য, তারই মাঝে মাঝে তিনি আমাদের প্রশ্নও জিগ্যেস করেছেন, উত্তরগুলো শুদ্ধ করে দিয়েছেন, তার একটি-আধটি শব্দ বদলে কিংবা সামান্য এদিক-ওদিক সরিয়ে তাকে প্রায় সুষ্ঠু দ্র-গদ্যে পরিণত করেছেন।

ছাত্রের সব প্রশ্নের উত্তর কোনও গুরু দিতে পারেন কি না বলা কঠিন, কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আমাদের সম্ভব-অসম্ভব সব প্রশ্নের কথা ভেবে নিয়ে প্রতিদিন তিনি অনেক মূল্যবান (মূল্যবান এই অর্থে বলছি যে, তিনি যদি ওই সময়ে বিশ্বজনের জন্য গান কিংবা কবিতা রচনা করতেন, তবে তারা হয়তো বেশি উপকৃত হত) সময় ব্যয় করে পড়া তৈরি করে আসতেন। শেলি-কিটসের বেলা তা না-হয় হল, কিন্তু একথা কি সহজে বিশ্বাস করা যায়, তিনি তার আপন রচনাবলাকা পড়াবার সময়ে পূর্বে দেখে নিয়ে রেখে তৈরি হয়ে আসতেন।

এই ক্লাসেরই বৃহত্তর রূপ আমাদের সাহিত্য-সভা।

রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত নিয়মানুরাগী ছিলেন। যদিও আমাদের সাহিত্য-সভা নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার তবু তিনি যেভাবে সে সভা চালাতেন, তার থেকে মনে হত অন্তত আইনের দিক দিয়ে যেন তিনি কোনও লিমিটেড কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারের মিটিং পরিচালনা করছেন। কোথায় কখন সভা হবে তার কর্মসূচি বা এজেন্ডা নিয়মানুযায়ী হল কি না, প্রত্যেকটি জিনিস তিনি অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। একটি সামান্য উদাহরণ দিই।

সভাতে পাকাপাকিভাবে এজেন্ডা অনুযায়ী গান, প্রতিবেদন-পাঠ (মিনিটস অব দি লাস্ট মিটিং), প্রতিবেদনে কোনও আপত্তি থাকলে সে সম্বন্ধে আলোচনা এবং সর্বসম্মতিক্রমে তার পরিবর্তন, প্রবন্ধ পাঠ, আবৃত্তি, সঙ্গীত ইত্যাদির পর সাধারণের বক্তব্য (জেনারেল ডিসকাশন) শেষ হয়ে গেলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সভাপতির বক্তব্য বলতেন। এবং বিষয় গুরুতর হলে তাকে একঘণ্টা দেড়ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিতেও শুনেছি।

একদা প্রতিবেদন পাঠের সময় সভার সবকিছু উল্লেখ করার পর আমি পড়ে যাচ্ছি। সর্বশেষে গুরুদেব সভাপতির বক্তব্যে বলেন–

এখানে এসে আমি থামলুম। কারণ গুরুদেব তাঁর পূর্ববর্তী সভাতে প্রায় এক ঘণ্টাকাল বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এবং আমার প্রতিবেদনে তার সারাংশ লিখতে গিয়ে সাধারণ খাতার প্রায় আট পৃষ্ঠা লেগেছিল। আমার মনে সন্দেহ জাগল, এই দীর্ঘ আট পৃষ্ঠার প্রতিবেদন শোনার মতো ধৈর্য গুরুদেবের থাকবে কি না। কারণ যে জিনিস তিনি অতি সুন্দর ভাষায় একঘণ্টা ধরে বলেছেন, তারই সারাংশ লিখেছে একটি আঠারো বছরের বালক তার কাঁচা, অসংলগ্ন ভাষায়। সেটা শোনা কবির পক্ষে স্বভাবতই পীড়াদায়ক হওয়ার কথা। আমি তাই পড়া বন্ধ করে গুরুদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাভরা স্বরে শুধালুম, এই সারাংশটি আট পৃষ্ঠার। পড়ব কি? তিনি তার চিবুকে হাত রেখে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, পড়ো। আমাকে পড়তে হল। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল। কিছুদিন পরে দ্বিতীয় সভাতেও তারই পুনরাবৃত্তি। এবারেও সেই দ্বিধা প্রকাশ করলুম। একই উত্তর, পড়ো।

তখন বুঝলুম, তিনি সম্পূর্ণ না শুনে প্রতিবেদন-পুস্তকে তার নাম সই করবেন না। সেটা নিয়মানুযায়ী– লিগেল নয়।

কিন্তু পাঠককে চিন্তা করতে অনুরোধ করি, আঠারো বছরের ছোকরার কাঁচা বাঙলায় লেখা তাঁরই সর্বাঙ্গসুন্দর বক্তৃতার বিকলাঙ্গ প্রতিবেদন শোনার মতো পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতাও তিনি এড়িয়ে যেতেন না। আমার শুধু মনে হত, এই অযথা কালক্ষয় না করে ওই সময়টাকে বাঁচিয়ে তিনি তো কোনও মহৎ কাজ করতে পারতেন।

***

রবীন্দ্রনাথ আমাদের গুরু এবং তিনি কবি। তাই তিনি আমাদের কবিগুরু। তিনি অবশ্য তাবৎ বাঙালির কাছেই কবিগুরু, কিন্তু সেটা অন্যার্থে অন্য সমাস। আমরা তাঁর কবি-রূপ দেখেছি অন্যভাবে।

তিনি দিনের পর দিন কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং বিশেষ করে গান রচনা করে যেতেন এবং প্রত্যেকটি শেষ হলেই আমাদের ডেকে শোনাতেন। এই ভিন্ন রূপটি সম্বন্ধে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই সচেতন ছিলেন।

কোনও কবিতা লেখা শেষ হলে তিনি সেটি শ্রীযুক্তা নির্মলকুমারী মহলানবিশকে কপি করে পাঠাতেন। একবার একটি গান পাঠিয়ে সঙ্গের চিঠিতে লেখেন–

বলা বাহুল্য, বর্ষামঙ্গলের গানগুলো একটা-একটা করে রচনা করা হয়েছে। যারা বইয়ে পড়বে, যারা উৎসবের দিন শুনবে, তারা সবগুলো একসঙ্গে পাবে। প্রত্যেক গান যে অবকাশের সময় আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেটাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে তারা দেখবে। আমার বিবেচনায় এতে একটা বড় জিনিসের অভাব ঘটল। আকাশের তারাগুলো ছিঁড়ে নিয়ে হার গাঁথলে সেটা বিশ্ব-বেনের বাজারে দামি জিনিস হতেও পারে, কিন্তু রসিকেরা জানে যে, ফাঁকা আকাশটাকে তৌল করা যায় না বটে কিন্তু ওটা তারাটির চেয়েও কম দামি নয়। আমার মতে যেদিন একটি গান দেখা দিলে, সেইদিনই তাকে স্বতন্ত্র অভ্যর্থনা না করে অনেকখানি নীরব সময়ের বুকে একটিমাত্র কৌস্তুভমণির মতো ঝুলিয়ে দেখাই ভালো। তাকে পাওয়া যায় বেশি। বিক্রমাদিত্যের সভায় কবিতা পড়া হত, দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে– তখন ছাপাখানার দৈত্য কবিতার চারদিকের সময়কাশকে কালি দিয়ে লেপে দেয়নি। কবিও প্রতিদিন স্বতন্ত্র পুরস্কার পেতেন– উপভোগটা হাইড্রলিক জাতায় সংক্ষিপ্ত পিণ্ডাকারে এক গ্রাসের পরিমাণে গলায় তলিয়ে যেত না। লাইব্রেরিলোকে যেদিন কবিতার নির্বাসন হয়েছে, সেদিন কানে শোনার কবিতাকে চোখে-দেখার শিকল পরানো হল, কালের আদরের ধন পাব্লিশারের হাটের ভিড়ে হল নাকাল। উপায় নেই– নানা কারণে এটা হয়ে পড়েছে জটলা পাকানোর যুগ– কবিতাকেও অভিসারে যেতে হয় পটলডাঙার কলেজপাড়ায় অমনিবাসে চড়ে। আজ বাদলার দিনে আমার মন নিশ্বাস ফেলে বলছে, আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে–দুর্যোগে জন্মালুম ছাপার কালিদাস হয়ে–মাধবিকা, মালবিকারা কবিতা কিনে পড়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনে না। ইতি–১৫ই শ্রাবণ, ১৩৩৬ (দেশ, ১৩৬৮, পৃ. ৮৩৫)!

আমরা তাকে পেয়েছি যেভাবে তিনি চেয়েছিলেন তাঁরই ভাষায় বলি, আজকের দিনের মাধবিকা, মালবিকার মতো নয়।

কিন্তু এই রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে গঙ্গাজলে যে গঙ্গাপুজো করলুম, তার পর নিজের আর কোন অর্ঘ্য এনে বিড়ম্বিত হই?

.

মোল্লা ফয়েজ

অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের স্মরণ থাকিবার কথা আমানউল্লা আফগানিস্তানকে রাতারাতি ফ্রান্সভূমিতে পরিবর্তন করিতে গিয়া কী দুরবস্থায় রাজত্ব হারান। যুদ্ধে পরাজিত হইয়া তিনি কাবুল হইতে পলায়ন করিলে পর দস্যু-দলপতি হবিবউল্লা, তখলুস বাচ্চা-ই-সকাও (ভারতবর্ষে বাচ্চা-সক্কা নামে পরিচিত) কাবুল ও উত্তর আফগানিস্তানের বাদশাহ হন।

বাচ্চা ডাকাত। কাজেই রাজা হইয়া কাবুলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করিবার দুরভিসন্ধি তাহার ছিল না। শান্তি স্থাপন করা অর্থ লুটতরাজ বন্ধ করা, আর লুটতরাজ বন্ধ করিলে তাহার সৈন্যেরাই-বা মানিবে কেন? তাহাদিগকে তো ওই লোভেই দলবদ্ধ করিয়া আমানউল্লার সঙ্গে লড়ানো হইল। রাজকোষ হইতে অর্থ দিয়া তাহাদিগকে শান্ত করিবার কথাই উঠে না, কারণ আমানউল্লা তাহার অর্ধেক ফুকিয়া দিয়াছিলেন নানারকম বিবেকবুদ্ধিহীন, অর্থগৃধু দলপতিদিগকে বাচ্চার সঙ্গে লড়িবার জন্য প্ররোচিত করিতে গিয়া। দলপতিরা টাকা লইয়াছিল অসঙ্কোচে ও ততোধিক অসঙ্কোচে ও তৎপরতার সঙ্গে টাকা লইয়া উধাও-ও তাহারা হইয়াছিল। কিছু দিয়া কিছু হাতে রাখিয়া, টালবাহানা দিয়া লড়ানোর হুঁশিয়ার ফেরেব্বাজি জানিতেন আমানউল্লার পিতা আমির হবিবুল্লা ও তাঁহার পিতামহ, পরমনমস্য আমির আব্দুর রহমান।

জলের মতো অর্থ ব্যয় আর কলকাতা শহরে বলা চলে না কাজেই বলি ইনফ্লেশেনি অর্থ ব্যয় করিয়া যখন আমানউল্লা লড়াই ও অর্থ উভয়ই হারাইলেন তখন তাহার চৈতন্যোদয় হইল। সূর্যোদয়ের পূর্বেই এক কালরাত্রিতে তিনি বাকি অর্ধেক অর্থ লইয়া কান্দাহার মামার বাড়ি পলায়ন করিলেন– বিপদকালে আমির-ফকির সকলেই মামার বাড়ির সন্ধান লয়।

কান্দাহার ইন্তিহার মেহমানদারি করিল বটে, কিন্তু যুদ্ধে প্রাণ দিতে নারাজ এ তত্ত্বটিও বুঝাইয়া দিল। আমানউল্লা তখন দেশত্যাগ করিলেন।

এদিকে বাচ্চার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চমস্তম্ভীয় মোল্লাদের জেল্লাই বাড়িল কিন্তু অর্থাগম সরগরম হইল না। বাচ্চার সৈন্যকেই যখন লুট করিয়া জান বাঁচাইতে হয়, তখন মোল্লার তত্ত্বতালাশ করিবে কোন ইয়ার– ডাকুর সর্দারের তো কথাই উঠে না। তবুও বাচ্চা কৃতজ্ঞতা দেখাইবার জন্য মোল্লাদের চেল্লাচেল্লিতে কান দিলেন– তাহাদিগকে নানারকম ছোটখাটো চাকরি দিলেন। কিন্তু যে দেশে বিশেষ কায়দায় পাগড়ি পরিলেই মোল্লা হওয়া যায় সেখানে মোল্লার সংখ্যা সাকুল্যে বিল্লির চেয়ে বেশি। বাচ্চা নিরুপায় হইয়া ফালতুদিগকে মুহতসিব কর্মে নিযুক্ত করিয়া কাবুল বাসিন্দাদিগের পশ্চাতে লেলাইয়া দিলেন।

মুহতসিব এক অদ্ভুত কর্মচারী। ইনি একরকমরিলিজিয়স পুলিশম্যান। তাহার কর্ম হাতে চাবুক লইয়া রাস্তাঘাটে নিরীহ প্রাণীকে নানারকমে উদ্ব্যস্ত করা। আজানের পর তুমি এখানে ঘোরাঘুরি করিতেছ কেন, ঈদের নামাজে কয়বার সেজদা দিতে হয়, আসরের নামাজের পর নফল পড়া মুনাসিব কি না, ইফতারের নিয়ম কী? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর না পাইলে মুহতসিব নাগরিকের পৃষ্ঠদেশে নির্মম চাবুক লাগান, অথবা নাগরিক ঠিকঠিক ব্যাপারটা বুঝিতে পারিয়া মুহতসিবের দক্ষিণহস্তে ক্ষিপ্রগতিতে কিঞ্চিৎ পারিতোষিক দিয়া পৃষ্ঠপ্রদর্শন নহে– পৃষ্ঠরক্ষা করে। মুহতসিব প্রতিষ্ঠানই খারাপ একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নহে, কিন্তু অজ্ঞ মোল্লাকে বেতন না দিয়া নাগরিকের পশ্চাতে লাগাইয়া দিলে সে যে বহুদিন যাবৎ গৃহস্থের অন্ন ধ্বংস করিয়া কাননস্থ মহিষকে তাড়না করিবে না তাহাতে কী সন্দেহ? বিজ্ঞ এবং ধার্মিক মোল্লারা এই মতই পোষণ করিতেন।

১৯২৮-২৯-এর শীতকালে কাবুলের রাস্তায় একদিকে লুটতরাজ অন্যদিকে মুহতসিব।

আমাকে একদিন ওই সময় বিশেষ কর্মোপলক্ষে বাহির হইতে হইয়াছিল। বিশেষ কি, অত্যন্ত বিশেষ কর্ম থাকিলেও তখন কেহ বাহির হইত না। কারণ যেখানে মরণ-বাচন সমস্যা সেখানে রাস্তায় নিশ্চয় প্রাণ দিতে বাহির হইবে কে? কিন্তু আমি নিতান্ত নিরুপায় হইয়া দুইটি প্রাণ বাঁচাইবার জন্য বাহির হইয়াছিলাম– বন্ধুবরকে রাখিয়া গিয়াছিলাম তাহার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে সাহস দিতে ও নিজে ডাক্তারের সন্ধানে।

পথে মোল্লা আবুল ফয়েজের সঙ্গে দেখা। তিনি ছিলেন মকতব-ই-হবিবিয়ার ধর্মশাস্ত্র বা দীনিয়াতের অধ্যাপক আমার সহকর্মী। মোল্লাজি ছিলেন পরস্পরবিরোধী আচার-বিশ্বাসের মনোয়ারি জাহাজ। দেওবন্দের টাইটল কোর্স পাস ভাষ্যকর দিগগজ মৌলানা– অথচ পরিতেন সুট, পাগড়ি না– কারাকুলি টুপি অথবা ফেল্ট হ্যাট, গোঁফ ছিল কিন্তু দাড়ি অতি নিয়মিত কামাইতেন! নামাজ কড়াগণ্ডায় আদায় করিতেন, রোজা ফাঁকি দিতেন না; কিন্তু অন্য কোনও ধর্মকর্ম বা ধর্মালোচনায় কখনও তাঁহাকে লিপ্ত হইতে দেখি নাই। অনুসন্ধিৎসু হইয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে উত্তর দিতেন; কিন্তু কলেজের অন্যান্য মোল্লাদের সঙ্গে মসলা-মসাইল লইয়া কখনও বাকবিতণ্ডা করিতেন না। আমানউল্লার পক্ষ লইয়া হামেশা লড়িতেন এবং আফগানিস্তানের স্বাধীনতা রক্ষা করার একমাত্র উপায় যে ইংরেজ-রুশকে বাঁদরনাচ নাচাইয়া সে বিষয়ে তাহার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। প্রকাশ্যে সেই রায়ই জাহির করিতেন।

তাঁহাকে রাস্তায় পাইয়া যেন জান কলবে ফিরিয়া আসিল। কিন্তু তাঁহার বেশভূষা দেখিয়া আমার সেই কলব ধুকুধুকু করিতে লাগিল। বাচ্চার ভয়ে তখন বিদেশি ছাড়া কেহই সুট পরিবার সাহস করিত না। প্যারিস-ফের্তা পয়লা নম্বরের কাবুলি সায়েবরা তখন কুড়িগজি শেলওয়ার ও বাইশ-গজি পাগড়ি পরিতে আরম্ভ করিয়াছে। অথচ দেখি মোল্লা আবুল ফয়েজ সেই মারাত্মক চেকের কোটপাতলুন পরিয়া নির্বিকারচিত্তে ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে চলিয়াছেন। আমাকে দেখিয়া আলিঙ্গন করিলেন ও আমার মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও আমাকে আমার গন্তব্যস্থানে পৌঁছাইয়া দিবার প্রস্তাব নিজেই করিয়া নিজেই বহাল করিলেন। আমি তাহাকে ওই উল্কট সঙ্কটের সময় কেন সুট পরিয়াছেন জিজ্ঞাসা করিতে যাইব এমন সময় কোথা হইতে এক ভীষণ-দর্শন মুহতসিব ততোধিক রোমাঞ্চন প্রজনন চাবুক হস্তে লইয়া আমাদিগকে ক্যা করিয়া ধরিল।

আমার দিকে তাকাইয়া মুহতসিবজি বলিলেন, আপনি (শুমা) বিদেশি, আপনার উপর আমার কোনও হক নাই। আপনি যাইতে পারেন।

বান্ধব-ত্যাগ সংকটের সময় অনুচিত। বিশেষত সেই বান্ধব ত্যাগ করিয়া যখন বৈদ্যরাজের বাড়িতে একা যাওয়া ততোধিক অনুচিত অর্থাৎ প্রাণহানির সম্ভাবনা। সবিনয়ে বলিলাম, হুজুর যদি ইজাজত দেন তবে দোস্তের আখেরি হাল কী হয় দেখিয়া যাইবার ইরাদা। মুহতসিব বিরক্তির সঙ্গে বাঞ্ছিত ইজাজত মঞ্জুর করিলেন।

এদিকে দেখি মোল্লা আবুল ফয়েজ ঊর্ধ্বমুখে, নির্বিকারচিত্তে কাবুল পর্বত-গাত্রে চিনার পত্রে সূর্যরশির ক্রীড়াজনিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অভিনিবেশ সহযোগে নিরীক্ষণ করিতেছেন। কোন বিপদে, কোন ভাবে, তাহার খেয়ালই নাই।

মুহতসিবের মুখ দিয়া তখন শিকার ভোজনের লালা পড়িতেছে। সুটপরা কাবুলি! বেদীন নিশ্চয়ই দীনের দও জানে না, ইহাকে দীনিয়াতের তর্ক-বিতর্কের দয়ে মজাইতে ডুবাইতে কতক্ষণ। তার পর বিলক্ষণ অর্থাগম।

হায় মুহতসিব, তোমার হাতে চাবুক থাকুক আর না-ই থাকুক, জানিতে না কোন বাঘার খপ্পরে পড়িয়াছ!

হুঙ্কার দিয়া, শহর-আরা হইতে চিল-শকুন প্রকম্পিত করিয়া, মুহতসিব জিজ্ঞাসা করিলেন, বল তো দেখি (ফারসিতে দুইরকম সম্বোধন আছে, শুমা অর্থাৎ আপনি বা তুমি, আর তু অর্থাৎ তুই অপরিচিত কাহাকেও তু বলা অভদ্রতার চরম লক্ষণ) কোনও ইঁদারায় ইঁদুর পড়িয়া মরিয়া গেলে, সেই ইঁদারা হইতে কয় ডোল পানি তুলিলে পর সেই পানি নামাজের জন্য পুনরায় পাক বা জাহিজ হইবে?

প্রশ্নটি কিছু সৃষ্টিছাড়া নহে। কিন্তু সাধারণ নাগরিককে এহেন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা দুষ্টবুদ্ধির কর্ম। মুহতসিবের কর্তব্য সাধারণ নাগরিককে নিত্য অবশ্য প্রয়োজনীয় নামাজ রোজা সংক্রান্ত প্রশ্ন করা, সেগুলি না জানিলে ফর্জকর্মগুলো আদায় করা যায় না। ইঁদারা। কোন অবস্থায় পাক আর কোন অবস্থায় না-পাক এ প্রশ্নের উত্তর দিবেন আলিম মৌলবি-মৌলানারা। কারণ কাহারও ইঁদারায় ইঁদুর পড়িলে ব্যাপারটা এমন কিছু জরুরি দীন-ঘাতি নয় যে, তাহার ফৈসালা না জানিলে তদ্দণ্ডেই কাফির হইয়া যাইবার সমূহ সম্ভাবনা। সাধারণ নাগরিককে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার অর্থ আর কিছুই নহে, তা হোকে বিপদারণ্যে নিক্ষেপ করা ও তৎপরে গুলি করিয়া তাহার মাংস ভক্ষণ করা।

দেখি মোল্লা আবুল ফয়েজ তখনও তাঁহার সঙহিট গুনগুন করিতেছেন–

শবি আগর আজ লবে ইয়ার বোসনেয় তলবম
জোয়ান শওম, জসেরো জিন্দেগি দুবারা কুনম।*

[* আজি এ নিশীথে প্রিয় অধরেতে চুম্বন যদি পাই
যৌবন পাব, গোড়া হতে হবে এ জীবন দোহরাই।]

 মুহতসিব এবারে দারুল আমান হইতে খাক-ই-জব্বার পর্যন্ত বিদীর্ণ করিয়া চিৎকার করিলেন, শুনিতে পাস নাই?

আবুল ফয়েজ বলিলেন, বিলক্ষণ, কিন্তু মসালা এতই পাচিদা যে মুক্ত রাজবর্যে তাহার সমূহ আলোচনা ও সমস্যা-নিরূপণ সহজে সম্ভব হইবে না। এই তো কাওয়াখানা, চলুন চা খাইতে খাইতে শাস্ত্রালোচনা ও অন্যান্য বিবেচনা করা যাইবে।

অন্যান্য বিবেচনার কথা শুনিয়া মুহতসিবের দুষ্টমুখে মিষ্টহাসি খেলিয়া গেল– যেন কাবুলি বরফে সোনালি রোদ– বাঙলায় যাহাকে বলেগাছে না উঠিতেই এক কাদি!

কাওয়াখানায় ঢুকিয়া মোল্লা আবুল ফয়েজ ছোকরাকে দুইজনের জন্য চা আনিতে বলিলেন। আমি নিজের জন্য চার হুকুম দিতে গেলাম মোল্লা ফয়েজ আমাকে থামাইয়া বলিলেন, সে কী কথা, দুইজনের চা তো তোমার-আমার জন্য। মুহতসিব সাহেবকে আমরা চা খাওয়াইব কী করিয়া, সে তো রিশও দেওয়া হইবে; তওবা তওবা, সে বড় অপকর্ম, কবিরা গুণাহ, ওস্তাগফিরুল্লাহি রব্বি জম্বি মিন কুল্লি, ওতুবু ইলাইহি।

বলিয়া মুহসিবের দিকে কটাক্ষে চাহিয়া একগাল হাসিয়া লইলেন।

মুহতসিব রাগে সিদ্ধ-চিংড়ির রঙ ধারণ করিয়াছেন। তবে কাওয়াখানার পাবলিক অর্থাৎ আমাণুন্নাসের সম্মুখে হুংকার দিবার ঠিক হিম্মত না পাইয়া বলিলেন, ফিতরতি রাখ, সওয়ালের জবাব দে।

মোল্লা ফয়েজ বলিলেন, খাস আরবিতে ইস্তানা সুগাইর, অর্থাৎ ধৈর্যংকুরু; মসালা খয়নি পেচিদা অর্থাৎ বড়ই প্যাচালো। ঝটপট উত্তর হয় না, প্রথম বিবেচনা করা উচিত বায়দ দিদা শওদ– ইঁদুর কেন ইঁদারায় পড়িল? সেইসব মজবুত পোকাঁপোখতা মওজুদ না হওয়া পর্যন্ত জবাব অত্যন্ত কঠিন, বসিয়ার দুশওয়ার!

মুহতসিব চটিয়া বলিলেন, কী বাজে বকিতেছ, ইঁদুর ইঁদারায় পড়িয়াছে সেই তো কাফি।

মোল্লা ফয়েজ বারতিনেক অর্ধচক্রাকারে দক্ষিণ হইতে বাম দিকে মস্তকান্দোলন করিয়া বলিলেন, ওয়াহ ওস্তাদ! কারণ বিনা কার্যের অনুসন্ধান– বেগয়ের ওয়াজহ তফতিশ বিলকুল বেফায়দা। প্রথম মনঃসংযোগ করিয়া দেখিতে হইবে ইঁদুর কেন ইঁদারায় পড়িল। তাই তো বলিলাম, খসালা বসিয়ার পেচিদা। তবু আপনার তকদির ভালো–আমার মতো পাক্কা ফিকাহ জাননেওয়ালা পাইয়াছেন। শুনুন, আমার মনে হয়, ইঁদুরকে কোনও বিড়াল তাড়া করিয়াছিল, তাই সে প্রাণের ভয়ে ইঁদারার দিকে পালাইয়া যায় ও জলে ডুবিয়া মরে। নয় কি?

এই বলিয়া মোল্লা ফয়েজ আমার দিকে এমনভাবে তাকাইলেন যেন গভীর অতল সমুদ্র হইতে অতি উজ্জ্বল বহুমূল্য খনি উত্তোলন করিয়াছেন। সে তাকানোতে আত্মশ্লাঘা যেন ঝিলমিল করিয়া উঠিল।

আমি হাওয়া কোন দিকে বহিতেছে ঠিক আন্দাজ করিতে না পারিয়া অন্ধকারেই লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিয়া বলিলাম, বেশক, আলবৎ, জরুর।

মোল্লা ফয়েজ পরম পরিতোষের দিলখুস হাসি হাসিয়া বলিলেন, দেখুন মুহতসিব সাহেব, দীনদুনিয়ার মামলায় নাদান এই নওজোয়ানও সায় দিতেছে। আচ্ছা, আবার মোদ্দা কথায় ফিরিয়া যাই। যখন প্রমাণসবুত হইল যে প্রাণরক্ষার্থে মূষিক কূপতলস্থ হইয়া পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়াছে তখন সে তো শহিদ। কারণ, কোন উলু জানে না, জান বাঁচানা ফর্জ? ফর্জকাম করিতে গিয়া ইঁদুর শহিদ হইল। তাহার কবর হইবে বিনা দফন কাফনে। তাহাই হইল। শহিদের লাশ পানি নাপাক করিবে কেন? পানি দুরুস্ত।

মুহতসিব দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া বলিলেন, সে কী কথা?

মোল্লা ফয়েজ তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন, ইস্তান্না, ইস্তান্না সুগহির, সবুর, সবুর। মসলা মসাইলের মামেলা, ধীরেসুস্থে কদম ফেলিতে হয়। ইঁদুর মরিবার আরও তো কারণ থাকিতে পারে, সব কি আর নাই?

এ-ও তো হইতে পারে যে, ইঁদুর জান বাঁচানার ফর্জকামে মশগুল ছিল না। সে ইঁদারার কিনারায় খেল-কুদ করিতেছিল, হঠাৎ পা পিছলাইয়া পড়িয়া গিয়া জান কজ হইল। তাহা হইলে তো সে আলবত্তা শহিদ নহে। তবেই সওয়াল– আর সে সওয়াল আরও পেচিদা– ইঁদুরের দরজা কী? আমি বহুত তফতিশ করিয়া দেখিলাম, ইঁদুর যে খেল-কুদ করিতেছিল সে সম্পর্কে হদিস আছে। নওমুসলিম ও আনসাররা মদিনা শরিফে বহুত খেল-কুদ করিতেন কাফেরের সঙ্গে লড়িবার জন্য। লেহাজা কাজে কাজেই আনসাররা যাহা কর্তব্যকর্ম বিবেচনা করিয়া করিতেন তাহা নবির উপদেশ মতোই। অতএব ফর্জ কাজের ফায়দা না পাইলেও সে কর্ম সুন্নতুন্নবী, অর্থাৎ নবীর আদেশে-কৃত অতিশয় অনুমোদিত পুণ্য কাজ। তাহার লাশেও তো পানি না-পাক হইতে পারে না। কী বল, আগা, জান? শুধাইয়া মোল্লা ফয়েজ আরেক দস্ত হাসিয়া লইলেন।

মুহতসিব বেশ কড়া সুরে বলিলেন, দেখ, ওসব ঠাট্টা-মশকরার কথা নয়

সবুর সবুর, মোল্লা ফয়েজ বলিলেন সবুর করুন সরকার। বুঝিলাম, আপনার রসকস বিলকুল নাই। তবে মরুন গিয়া আপনার দশ ডোল না বারো ডোল পানি তুলিয়া পাড়ার যে কোনও মোল্লাকে জিজ্ঞাসা করুন, সে বাতলাইয়া দিবে। ভাবিয়াছিলাম, গুণীজনের সহবতে আসিয়াছেন, জখনি মসলা-মসাইল দুরুস্ত করিয়া লইবেন, সে মতলব যখন নাই তখন আমি বে-চারা না-চার। চল হে আগাঁজান, তুমি না হেকিমের বাড়ি যাইবে!

বাহির হইবার সময় শুনিলাম, কাওয়াখানায় অট্টহাস্যের রোল উঠিয়াছে।

.

বড়লাটি লাঠি

বড়লাট ভারতবর্ষের নেতাদের ডাকিয়া তাঁহাদের হাতে লাঠি দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন; যাহাতে তাহারা গাঁটের খাইয়া মনের আনন্দে বনের মহিষ তাড়াইতে পারেন। নেতারা সে লাঠিটা আত্মসাৎ করিবার লোভে একে অন্যের বাড়িতে বিস্তর হাঁটাহাঁটি বিস্তর লাঠালাঠি করিয়া দেখিলেন ভাগ-বখরার প্রচুর বখেড়া। কেহ চায় সে লাঠির পাঁচ বিঘৎ, কেহ চায় তিন বিঘৎ, কেহ বলে লাঠিটা উদয়াস্ত বনবন করিয়া ঘুরিবে, কেহ বলে, না, যখন বড়লাটি লাঠি তখন লাট সাহেব ইচ্ছা করিলেই বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন। ইত্যাকার বাক্য বিনিময় মনোমালিন্যের পর যখন কিছুতেই কোনওপ্রকার চরম নিষ্পত্তি হইল না, তখন লাট সাহেব প্রকাশ্যে অশ্রুবর্ষণ করিয়াও গোপনে সানন্দে মৌলা আলিতে মানত পূর্ণ করিয়া লাঠিখানা মাচাঙে তুলিয়া রাখিলেন। লাঠিখানি তিলোত্তমার কার্য উত্তমরূপে সমাধান করিয়াছে। ভবিষ্যতে যদি দেখা যায় আবার সুন্দ-উপসুন্দ ভাই-ব্রাদার হইয়া কৌসিল রণাঙ্গনে দেবতাদের পর্যুদস্ত করিবার উপক্রম করিয়াছে, তাহা হইলে শুষ্ক যষ্টিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।

বড়ভাই বলিতেছেন, ছোটভাই বড়ই অর্বাচীন; ছোটভাই বলিতেছেন, ভাই ভাই কোরও না বলছি। তুমি আমার ভাই নাকি, তুমি আমার জানি দুশমন। তিলক-কাটা গোড়া ভাইকে ডাকা হয় নাই বলিয়া তিনি খণ্ডিত বিপ্রলব্ধের ন্যায় রোদন করিতেছিলেন (এমনকি এই শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে যাইবেন বলিয়া মস্কোর ফলার উপেক্ষা করিয়া অনুশোচনা করিতেছিলেন), লাঠির ভাগাভাগি হইল না দেখিয়া পরমানন্দে বগল বাজাইতেছেন।

আমরা দুঃখিত হই নাই, আনন্দিতও হই নাই। এ যষ্টি যে আমাদের তমসাবৃত দেশকে জ্যোতিতে লইয়া যাইবে, মৃত্যু হইতে অমৃতে লইয়া যাইবে এমন আশা আমরা কখনও করি নাই। যুদ্ধের পর বেকারি, অর্থাভাব, পল্টনকের্তা সৈন্যের কৃষিক্ষেত্রাভাব ইত্যাদি যে গন্ধমাদন জগদ্দলন হইয়া আমাদের দেশের বুকের উপর চাপিবে, তাহা ওই যষ্টি-লিভার দ্বারা উত্তোলন করা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়। এতদ্ব্যতীত যষ্টি লোভ না করার আরও বাহান্নটা কারণ আছে তাহার নির্ঘন্ট অথবা ফিরিস্তি উপস্থিত নিষ্প্রয়োজন। শুধু বাহান্ন নম্বরের কারণটা নিবেদন করি; যাহারা মানদণ্ডকে রাজদণ্ডে পরিণত করিতে পারে, তাহাদের সে রাজদণ্ড হর্ষের ন্যায় সন্তোষক্ষেত্রে দান করিবার ক্ষমতা নাই।

অপিচ অকপট চিত্তে স্বীকার করি যে, বিপক্ষে বাহান্নটা কারণ থাকা সত্ত্বেও যষ্টিতে লোভ করিবার সপক্ষে একটি প্রকৃষ্ট যুক্তি ছিল। সে যুক্তি নিবেদন করিতে আমাদের অত্যন্ত লজ্জা ও সঙ্কোচ বোধ হয়, কারণ যাঁহাদের জন্য আমাদের এই লোভ তাঁহারা হয়তো এই বৃত্তিকে ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য ভাবিয়া আমাদিগকে ধিক্কার দিবেন।

আমরা রাজবন্দিদের কথা ভাবিতেছি।৪২ আন্দোলনের দেশসেবক, তৎপূর্ববর্তী তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী, স্টালিন-বিরোধী গণতন্ত্রী, জমিয়ত উল-উলামার কর্মীগণের কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয় যে, ইঁহাদের দুঃখের অবসান যদি হিমালয়ের কলির শৈলেশ্বরকে সন্তুষ্ট করিয়াই হয়, তবে তাহাই হউক। আত্মজন বন্ধুজন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা হইতে বৎসরের পর বৎসর বিরহ, দিনে দিনে জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার তুষানল দাহন, যৌবনের সূক্ষ্ম সুকুমার বৃত্তির নিষ্পেষণ, কারাগারে পাষাণপ্রাচীরের অন্তরালে বিপাকের বিভীষিকাময় রজনী যাপন, আশাহীন উদ্যমহীন নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ত ঘূর্ণমান; তাঁহাদের অদৃষ্ট চক্রনেমিতে এইগুলিই তো তীক্ষ্ণ লৌহকীলক। স্বাধীনতা সংগ্রামে সফল হইয়া তাহাদের বিজয়মাল্যে বিভূষিত করিয়া হৃদয়ে টানিয়া লইবার আশা যখন দিন দিন মরীচিৎকার মতো চক্রবাল হইতে চক্রবালান্তরে বিলীন হইয়া যাইতেছে তখন আর অত শাস্ত্র মিলাইয়া সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিচার করিয়া কীই-বা হইবে। বলিতে ইচ্ছা করে, হে গিরীশ্বর, হে গণ (পার্টি) পতিগণ, যে যাহা চাও লও। বুকের-শিরা-ছিন্ন-করা-ভীষণ পূজাই যদি আত্মজনের মুক্তি দিবার একমাত্র বিধান হয়, তবে পরাজয় স্বীকার করিতেছি। যে ইংরাজ রাজত্বকে একদিন শয়তানি নাম দিয়াছিলাম আজ তাহারই প্রতীক বড়লাটকে দেশের প্রধান নেতা বলিয়া স্বীকার করিয়া লইলাম। মান-অপমান-বোধ আজ আর নাই। মুক্তি দাও, মুক্তি দাও, সে মুক্তি রাজকারা হইতে বাহির করিয়া নিত্য কারাগারে লইয়া যাইলেও তাহা শিরোধার্য।

বড়লাটি পরিকল্পনা গ্রহণ না করায় দেশ-বিদেশের বহু লোক বলিতেছেন, কংগ্রেস অসহযোগ করিয়া এমন অসহযোগমনা হইয়া গিয়াছে যে, সে শুভক্ষণ শুভ যোগ চিনিতে পারিল না। গুজরাতি প্রবচন আছে যে, চুবায়ুগ্রস্ত লোককে স্বয়ং লক্ষ্মী টিকা পরাইতে আসিলেও সে অন্ধকূপের দিকে ছুটে মুখ ধুইবার জন্য। অর্থাৎ কংগ্রেসের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পাইয়াছে।

বড়লাটি পরিকল্পনা গ্রহণ করার অর্থ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়া রাজ্যচালন করা। অর্থাৎ তাহার পর দেশে যেসব আইন জারি হইবে, যেসব ক্রিয়াকর্ম হইবে তাহার জন্য ভারতবাসী দায়ী হইবে। বিদেশে যেসব ভারতীয় সৈন্য যাইবে সে মিশরেই হউক ফলস্তিনেই হউক আর মালয়েই হউক, তাহারা আইনত ভারতীয় আর শুধু ভারতীয় নহে, স্বাধীনতাকামী ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের আশীর্বাদ শিরে বহন করিয়া যাইবে; অথচ তাহাদের উপর কী আদেশ কখন হইবে তাহার নিয়ন্ত্রণাধিকার জাতীয়তাবাদীদের থাকিবে না। বিস্তর বাক্যবিন্যাস করিবার কোনও প্রয়োজন নাই, একবার ভাবিয়া দেখিলেই হয় যে, যদি মিশরি সৈন্যরা একদিন কলিকাতার জনতার উপর কোনও কারণে গুলি চালায়, আর যদি তখন ওয়াফদিরা মিশরের শাসনকর্তারূপে বিরাজ করেন– সে শাসন আইনত (ডি জুরে) হউক কার্যতই (ডি ফাক্টো) হউক– তাহা হইলে প্রাতঃস্মরণীয় সাইজগলুল পাশা ও তাহার অনুবর্তীগণের প্রতি আমাদের কতটুকু ভক্তি থাকিবে?

সে যাহাই হউক। কথাটা তুলিলাম এই কারণে যে, যদিও পরাধীন জাতির কোনও পলিটিকস্ থাকিতে পারে না, একমাত্র স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া, তবু মিশর আরব পরাধীন ভারতবর্ষের নেতাদের ক্রিয়াকলাপের খবর রাখে। মিশরি ফলস্তনিরা আমাকে প্রায় বলিতেন, আমাদের ক্ষুদ্র দেশ, আমাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, কিন্তু তোমাদের কথা স্বতন্ত্র। তোমরা অন্যের সাহায্য ব্যতিরেকে ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া স্বাধীনতা অর্জন করিবার ক্ষমতা রাখ। আর তোমরা যদি স্বরাজ পাও, তবে মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যনীতির অবসান হইবে। ভারতবর্ষের প্রতি তাঁহাদের এই ভক্তি-উচ্ছ্বাস শুনিয়া তখন লজ্জা অনুভব করিয়াছি। যাহারা অপেক্ষাকৃত অসহিষ্ণু তাহারা স্পষ্ট বলিতেন যে, আমাদের পরাধীনতাই তাঁহাদের পরাধীনতাকে অটুট করিয়া রাখিয়াছে। এমনকি কাবুলেও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিতে বিরক্ত আফগানদের মুখে শুনিয়াছি যে, আমাদের দৌর্বল্যই ব্রিটিশ রাজনীতিকে পুষ্ট করিতেছে এবং আফগানিস্তানকেও তাহার ফল ভোগ করিতে হয়। আমি তাহাদের যুক্তির সারবত্তা সবসময় মানি নাই; এস্থলে কিন্তু আমার এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করার উদ্দেশ্য এই যে কাবুল হইতে মিশর তুর্কি পর্যন্ত সব দেশের লোক আমাদের গতিবিধির পর্যালোচনা করে। আমরা সাধারণত তাহাদের খবর রাখি না।

বড়লাটি পরিকল্পনা স্বীকার না করাতে যাঁহারা নিতান্ত মর্মাহত হইয়াছেন, তাহাদের শুধু এইটুকু আমার বলিবার ইচ্ছা যে যাহারা অস্বীকার করিয়াছেন, তাঁহারা সৃষ্টিছাড়া কিছু করেন নাই।

প্রথম ধরুন মিশর। মিশরের ওয়া দল ভারতবর্ষের কংগ্রেস-লীগ অপেক্ষা অনেক বলীয়ান। সে দলকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী যদি কাজে লাগাইতে পারে তবে তাহার যে কত সুবিধা হয়, তাহার খবর ওয়াফ জানে, সাম্রাজ্যবাদীও জানে। ওয়াদ এত ভালো করিয়া জানে যে, যেসব বিভীষণরা সাহায্য করিতে অত্যধিক মাত্রায় প্রস্তুত তাহাদের পরিষ্কার বলিয়া দেয় চাচা যেন আপন প্রাণ বাঁচায়। পাঠকের অজানা নাই যে, কেহ কেহ নিজের প্রাণটা ঠিক রক্ষা করিতে পারে নাই। ইংরেজদের প্রভুত্বহীন মিশরে ওয়া সর্বদাই রাজত্ব করে ও করিতে প্রস্তুত কিন্তু রাজা যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর ক্রীড়নক হইয়া পড়েন, তখন ওয়া আর সহযোগ করিতে সম্মত হয় না। তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ওয়াদকে বলে, তোমরা রাজত্ব চালাইতেছ না কেন? তোমাদের সঙ্গে আমাদের স্বার্থের অনেক মিল, সে কি বুঝিতে পার না। এই ধর না সুয়েজ খাল। তাহার কন্ট্রাক্ট তো প্রায় শেষ হইল, নতুন কন্ট্রাক্টে তোমাদিগকে অনেক কিছু দিতে হইবে, সেজন্য আমরা প্রস্তুত। তোমরা তো এখন আর দুগ্ধপোষ্য শিশু নহ, তোমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আমরা তো মানিয়া লইয়াছি। তোমরা মুরুব্বি, আইস সুয়েজখাল সম্বন্ধে আলোচনা করা যাউক। হ্যাঁ, আর সেই সুদানের ব্যাপারটা! হ্যাঁ, হ্যাঁ, সুদানও তোমাদের ফিরাইয়া দিতে হইবে বইকি। সে তো আমরা সর্বদাই বলি। তবে কি না কোনও কোনও সুদানি (পাঠকের অবগতির জন্য বলি এইসব সুদানি নুন মুদলেয়ার গোত্রীয়) আপত্তি জানাইয়াছেন, মিটিং করিয়াছেন, ডেপুটেশন ভেজিয়াছেন। সেকথাটাও তো বিবেচনা করিতে হয়। তাই পরিষ্কার কিছু বলিতে পারিতেছি না। আর ছাই বলিবই-বা কাহাকে? তোমরা যদি দেশের রাজ্যশাসনভার গ্রহণ না কর (দিশি ভাষায় বড়লাটি লাঠি গ্রহণ না কর), তবে তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিব কী করিয়া, তোমাদের লুকস স্টান্ডি কোথায় (অর্থাৎ মুসলমানি ভাষায় তওবা করিয়া কুফ ইকার কর, বৈদিক ভাষায়, হে ব্রাত্য যজ্ঞোপবীত ধারণ কর)?

আরে আরে, ও শ্যামদাস পালাস কেন? শো-ই না। সেই যে ইংরেজ পল্টন মিশরে বসিয়া আছে। সত্যি ভাই, তাতে মিশরিদের আত্মসম্মানে ঘা লাগে, আমরাও বুঝি। সে বিষয়েও একটা সমঝাওতার বড় প্রয়োজন। আহা কী মুশকিল, পালাচ্ছিস কোথায়?

কিন্তু মুস্তফা নহাজ পাশা ঘুঘু ছেলে। মুখের ভদ্রতা অন্তত উশকুরুকুম (থ্যাঙ্কু) পর্যন্ত না বলিয়া তিনি তুর্কি টুপির ফুন্না উড়াইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে আজহর মসজিদে আশ্রয় লন। এবং নহহাজ্ব পাশার পিছনে থাকে তামাম দেশ– যাহারা থাকে না, তাহাদের বিপদের কথা পূর্বেই সভয়ে পেশ করিয়াছি।

মুস্তফা ও ওয়াদিরা যে কত বড় লোভ সম্বরণ করিয়া সর্বপ্রকার সমঝাওতা, দরকষাকষি প্রত্যাখ্যান করেন, তাহা আমাদের পক্ষে অনুমান করা শক্ত। সুয়েজ খাল, সুদান, ব্রিটিশ পল্টন এই তিন প্রশ্নের সমাধান তাহাদের কাছে বৌদ্ধদের ত্রিশরণ অপেক্ষাও কাম্য।

ফলস্তিনের (প্যালেস্টাইন) মতো দুর্ভাগ্য দেশ পৃথিবীতে আমি কোথাও দেখি নাই। ইহুদি পঙ্গপাল দেশটাকে ছাইয়া ফেলিবার পূর্বে (১৯১৮) আরবদের সুখে দুঃখে দিন কাটিত– আফগানিস্তান যেমন তাহার দারিদ্র্য নিয়াও বাঁচিয়া আছে। ফলস্তিন তখন তুর্কির অধিকারে ছিল ও খলিফার অধঃপতনের যুগে তাহার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পবাণিজ্যের উন্নতির কোনওপ্রকার চেষ্টা করা হইতেছিল না বলিয়া ফলস্তিন নবীনেরা স্বরাজ্য আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছিলেন। সে আন্দোলনের নেতারা সফলতা লাভ করিতেন কি না-করিতেন সে প্রশ্ন অবান্তর- মূল কথা এই যে ফলস্তিন শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাৎপদ থাকিলেও আপামর জনসাধারণ জাফা কমলানেবুর চাষ করিয়া নিজের জমিতে নিজের কুঁড়েঘরে জীবনযাপন করিত।

কুক্ষণে তাহারা লরেনসের ধাপ্পায় ভুলিল, কুক্ষণে তাহারা খাল কাটিয়া ঘরে কুমির আনিল। সে ইতিহাস আজ আর তুলিব না। ইহুদিরা আসিয়া তাহাদের কোটি কোটি টাকার পুঁজির জোরে আরবদের ঘরছাড়া ভিটেছাড়া করিয়া এমন অবস্থায় পৌঁছাইল যে অবস্থায় মানুষ আর কিছু না করিতে পারিয়া দাঁত দিয়া কামড়ায়, নখ দিয়া ছিঁড়ে। পৃথিবীর সহানুভূতি ফলস্তিন পায় নাই, কারণ ইহুদিরা দুনিয়ার প্রেসের মালিক। তবু মনে আছে ১৯৩৪ সালে যখন আমি ফলস্তিনে বাস করিতেছিলাম তখন ভারতবর্ষের পক্ষ হইতে আমি আরবদের বলিয়াছি যে, আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদীরা তাহাদের কল্যাণ কামনা করেন। নিঃস্ব আর্ত আরবদের সেকথা শুনিয়া চক্ষে জল আসিতে আমি দেখিয়াছি। ফলস্তিনের বেদুইন চাষি হয়তো কংগ্রেস-লীগ চিনে না কিন্তু আমি জানি যে সে দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিরা খবর পাইয়াছেন যে, ভারতের নিপীড়িত জনসাধারণ কংগ্রেস ও লীগের ভিতর দিয়া আরবদের মঙ্গল কামনা করিয়াছে। দোহাই কংগ্রেস-লীগের কর্তাগণ, যাহা খুশি কর কিন্তু তোমাদের আশীর্বাদ লইয়া যেন গুর্খা পাঠান শিখ মারাঠা ফলস্তিনে না যায়।

ফলস্তিন পূর্ণ স্বাধীনতা চাহিয়াছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন করিয়াছে। কিন্তু ইহুদিরা গণতন্ত্র চায় না যতদিন না দেশের লোক শতকরা ৫১ জন ইহুদি হয়। ততদিন দলে দলে ইহুদি আমদানি হইতেছে।

বয়তউল-মুকদ্দসের (জেরুজালেমের) মনিসিপ্যালিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। তাহাতে যোগদান করিলে আরবদের অনেক ছোটখাটো সুবিধা হয়, কিন্তু তৎসত্ত্বেও যখনই তাঁহারা দেখিতে পান ক্ষুদ্র সহযোগের দ্বারা তাঁহাদের বৃহত্তর স্বার্থ স্বাধীনতা লাভের প্রচেষ্টা ব্যাহত হইতেছে, তখনই তদ্দণ্ডেই তাঁহারা বড়লাটি দণ্ডকে হাতে লওয়া পণ্ডশ্রম মনে করেন। অসহিষ্ণু মহা-মুফতি তো ফ্যাসিস্ট দলেই যোগদান করিলেন। কিছুদিন হইল খবর আসিয়াছে, আরবরা মুকদ্দসে মনিসিপ্যালিটি বয়কট করাতে সরকার ছয়জন সিভিল কর্মচারী নিযুক্ত করিয়াছেন।

ফলস্তিনদের বাঙাল রাগ। বিশেষ অপবিত্র তরল দ্রব্য দ্বারা বরঞ্চ চিড়া ভিজায় তবু জল ব্যবহার করে না।

লেবানন সিরিয়া ফরাসিকে তাড়াইবার জন্য ইংরাজের সাহায্য লইতে পরাজুখ হয় নাই। ভালো করিতেছে কি মন্দ করিতেছে ফরাসিকে তাড়ানোর কথা হইতেছে, না ইংরেজের সাহায্য লওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করিতেছে– আল্লাই জানেন। কন্টক দিয়া কণ্টক উৎপাটিত করা হইতেছে সন্দেহ নাই, কিন্তু শেষের কন্টক যেন মুষল হইয়া বাহির না হয়। তখন যদুকুল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

তবু যেন কেহ মনে না করেন যে, লেবানন-সিরিয়া আজাদ-জিন্নার ব্যবহারে উষ্ণ হইয়া গোস্সা প্রকাশ করিবে। নিজেরাই তাহারা ফরাসি যষ্টি বারম্বার প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। নীতি একই।

ইরাক ক্ষাত্রভেজে বলীয়ান। সেখানে সামাজ্যবাদীদের ডাল বেশিদিন গলিবে না। গত যুদ্ধের পর তাহারাই সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যবাদীদের অর্ধচন্দ্ৰ দিয়াছিল। ইরাকেও অসহিষ্ণু নেতার অভাব ছিল না, এখনও নাই।

হে মাতঃ মুক্তি দাও যাহাতে রোরুদ্যমান হইয়া প্রাণরক্ষা করিতে পারি– হেন ক্রন্দনধ্বনি ইরাকের ক্রন্দসী হইতে উত্থিত হইতেছে।

ইরানের স্নেহজাতীয় পদার্থের প্রতি সকলেরই লোভ। রুশ সপত্নও হুঙ্কারধ্বনি ছাড়িতেছেন। যে রুশ একদিন মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া উত্তর ইরানের স্বাধিকার ত্যাগ করিয়াছিল, সেই রুশই আজ ইরানের তেল চায়– কারণ তৈল একা আসে না। ঘৃত লবণ তৈলতণ্ডুল বস্ত্র ইন্ধন একসঙ্গে যায়। আজরবাইজানের প্রতি রুশের লোভ নাই একথা এত জোরে বলা হইতেছে যে, আমরা শেক্সপিয়রি ভাষায় বলি –মহারাজ, মহিলা বড় বেশি প্রতিবাদ করিতেছে। রুশিয়া যে ইরানের প্রতি রুষিয়াছেন তাহাতে কোনও বাতুল সন্দেহ করিবে না। কিন্তু কহি তবু তো ইরানের ইংরেজ-প্রেম সঞ্চারিত হইতেছে না। ইরান ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করিয়া অস্থির করিয়া তুলিল, হে কর্তারা, যুদ্ধ তো শেষ হইয়াছে, তবে পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো বিদায় লইতেছ না কেন? তোমাদের জন্য আতর সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছি, আর কেন, আমাদের অনেক শিক্ষা হইয়াছে। কিন্তু মুজঃফর (বিজয়ী) নগরের কম্বল ছাড়িবে কেন?

শুনিয়াছি ইরানে নাকি ভারতীয় সৈন্য আছে; যদি থাকে তবে বড় ভাগ্য মনে গণি যে, ইহাদের কপালে বিজয়তিলক কংগ্রেস-লীগ অঙ্কন করেন নাই। লাঞ্ছন শ্বেত-গৈরিক-শ্যাম নহে।

আফিগানিস্তান সম্বন্ধে আলোচনা নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন। আমি সমরশাস্ত্রে নিতান্তই মূর্খ, সংখ্যাতত্ত্বে ততোধিক। যত আফগানযুদ্ধ হইয়াছে তাহাতে কী পরিমাণ গোরা, কী পরিমাণ পাঠান-গুর্খা-শিখ-মারাঠা ছিল জানি না।

আফগানিস্তানের ব্রিটিশ প্রীতি সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলিতে পারি যে, আমি যখন কাবুলে ছিলাম তখন সমগ্র আফগানিস্তানে মাত্র কজন ইংরেজ ছিলেন এবং সকলেই ব্রিটিশ রাজদূতাবাসের কর্মচারী। আফগানিস্তানের স্কুল-কলেজে তখন ফরাসি পড়াইতেন ফরাসি গুরুরা, জর্মন পড়াইতেন জর্মন গুরুরা, কিন্তু ইংরেজি পড়াইতেন ভারতবাসীরা। আমি যখন শিক্ষামন্ত্রীকে বলিয়াছিলাম যে ইংরেজের প্রয়োজন, তা না হইলে ছাত্রদের উচ্চারণ ভালো হইবে না, তিনি মৃদু হাস্যসহকারে বলিয়াছিলেন, কুরান তো আর ইংরেজি ভাষায় লেখা হয় নাই যে উরুশ্চারণের জন্য সায়েবদের মেলা তকলিফ দিয়া এই পাণ্ডববর্জিত দেশে আনিতে হইবে।

ইংরেজ তখন রুশিয়ার পাসপোর্ট বরঞ্চ পাইত, কিন্তু আফগানিস্তান! বরঞ্চ পঞ্চম মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করিতে পাইত, কিন্তু ইংরেজ লান্ডিকোটালের ওই পারে পা দিতে গেলে নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হইত।

ইংরেজ-রুশে বন্ধুত্ব হওয়ায় আফগানিস্তান মহা বিপদে পড়িয়াছে। হায় জলালাবাদ হায়, মজার-ই-শরিফ!

বড়লাটি লাঠি আমরা হাতে লইলে বেচারি পাঠানদের দুইখানা লাঠির খর্চার ধাক্কায় পড়িতে হইবে। সে কি উত্তম প্রস্তাব? কাবুলিদের ভদ্রতা-বোধ কম। ভারতবাসীদের তাহারা গোলাম বলে। গোলামের হাতে কি লাঠি শোভে? লাঠি বাজিবে না।

হাইলে সেলাসি সাম্রাজ্যবাদীদের অনুনয় করিয়া বলিয়াছেন, তাহারা যেন দয়া করিয়া আর আদিস-আব্বাবার মতো বর্বর শহরে থাকিয়া বিস্তর কষ্টভোগ না করেন। ইতালীয়রা হাবশিদের যথেষ্ট সভ্য করিয়া গিয়াছে, ওইটুকুতেই তাহাদের কাজ চলিবে। সাম্রাজ্যবাদীরা নাকি তথাপিশ্বেতভদ্রভার নামাইতে পারিতেছেন না। হাবশিদের হৃদয়ও অত্যন্ত কৃষ্ণবর্ণ, সহযোগ যষ্টি লইবার জন্য হস্তোত্তলন করিতেছে না।

তুর্কিরা অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাসীদের দিলিদোস্ত! কারণ কোন মূর্খ বলিবে যে, তুর্কি জর্মনির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা না করিলে জর্মনি পরাজিত হইত। সে যুদ্ধে কী পরিমাণে লোকক্ষয়, বলক্ষয় হইয়াছে তাহা এখনও প্রকাশিত হয় নাই তবে আশা করিতে পারি ভারতবর্ষে যত পরাজিত জাপানি সমরবন্দি আছে, তুর্কিতে তাহা অপেক্ষা বেশি জর্মন বন্দি আছে। তবে সব সময়েই কি আরফলেন পরিচিয়তে। বরঞ্চমা ফলেষু এইক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তৎসত্ত্বেও হায় রে তুর্কি, তোমার দার্দানেলেজ যে যায়-যায়। মিত্রশক্তি যখন তোমাকে অনুনয়-বিনয় করিয়াছিল, তখন তুমি সাম্রাজ্যবাদীর যষ্টি হাতে নাও নাই, এখন তোমার সপ্ত-কৃশ-বৎসরের চক্র। কিন্তু বল তো আলেপ্পো, তোমাকে কে ভেট দিতেছে?

 কিন্তু তুর্কি স্বাধীন। হিজ্জাজের ইবনে সউদ স্বাধীন, যমনের ইমাস ইয়হিয়া স্বাধীন। সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে তাঁদের সহযোগিতা-অসহযোগিতা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। ট্রেনসজর্ডানও গুছাইয়া লইয়াছে।

বুঝিতে পারিতেছি পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির উপক্রম। আর কাব্যবিন্যাস করিব না। তবে আশা করি এইটুকু বুঝিতে কাহারও অসুবিধা হইবে না যে, বড়লাটি লাঠি ভারতীয়দের হাতে না আসায় দুঃখ করিবার কিছু নাই। কংগ্রেস-লীগ ভিন্ন ভিন্ন কারণে লাঠি নেন নাই বা পান নাই, কিন্তু আর যাহাই হউক, মধ্যপ্রাচ্য সেজন্য তাঁহাদের নিন্দা করিবে না। সাম্রাজ্যবাদীরা করিতেছে, তাহাতেই মনে হয় ভালো কর্মই করিয়াছি। আল্লা মেহেরবান, আমাদের অজানাতেই হয়তো আমাদিগকে শুভবুদ্ধি দিয়াছেন।

.

যুবরাজ-রাজা-কাহিনীর পটভূমি

তুলনাত্মক শব্দতত্ত যেরূপ কোনও এক শুভদিনে আপাদমস্তক নির্মিত হয়নি ঠিক সেইরূপ তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্ব হঠাৎ একদিন জন্মগ্রহণ করেনি। গ্রিক-রোমান ঐতিহাসিকরা যেসব জাতির সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের ধর্মের বিবরণও অল্পবিস্তর দিয়েছেন। বলা বাহুল্য এসব বিবরণের অধিকাংশই পক্ষপাতদুষ্ট। আর এদের ভিতর যারা নাস্তিক ছিলেন তারা নানা ধর্মের বিবরণ দেবার সময় সবকটাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন, নিজেরটাকেও ব্যত্যয় দেননি, অর্থাৎ প্রতিচ্ছবির স্থলে কেরিকেচার এঁকেছেন। তথাপি যে পদ্ধতির গ্রন্থই হোক না কেন, এগুলোকে বাদ দিয়ে কোনও বিশেষ ধর্মের বা একাধিক ধর্মের ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব, এবং বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস রচিত না হওয়া পর্যন্ত তুলনাত্মক ধর্মশাস্ত্রের গোড়াপত্তনও অসম্ভব।

খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসার হওয়ার ফলে গ্রিক, রোমান তথা ইউরোপীয় অন্যান্য ধর্ম লোপ পায়। শুধু তাই নয়, ভিন্ন ধর্মের বিবরণ লেখার ঐতিহ্য কয়েক শতাব্দী ধরে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা হয়। আজ যারা জানতে চান, গ্রিক, রোমান, টুটনদের ধর্ম প্রাথমিক খ্রিস্টধর্মের ওপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল তাঁদের তন্ন তন্ন করে গ্রিক ও রোমানদের সর্বপ্রকারের রচনা পড়তে হয় এবং সেখান থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেন সেগুলোর সন্ধান নিতে হয় প্রাথমিক খ্রিস্টধর্মের কোন কোন আচার অনুষ্ঠানে এরা নির্বিঘ্নে অনুপ্রবেশ করেছে, কিংবা খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থের অনুশাসন উপেক্ষা করে নবদীক্ষিত খ্রিস্টানগণ নিজেদের প্রাক খ্রিস্টীয় আচার অনুষ্ঠান নতুন ধর্মে কীভাবে এবং ইউরোপের কোন কোন জায়গায় প্রবর্তন তথা সংমিশ্রণ করেছে– এইসব তাবৎ তথ্য প্রভূত পরিশ্রম তথা গভীর গবেষণা দ্বারা সঞ্চয় করে তবে খ্রিস্টধর্মের সম্পূর্ণ ইতিহাস লেখা সম্ভব। আজ যেরকম ভারতীয় চার্বাক প্রভৃতির লোকায়ত দর্শন পুনর্নির্মাণ করা অতিশয় সুকঠিন কর্ম।

সপ্তম শতাব্দীতে নবজাত ইসলামের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের সংঘর্ষের ফলে একে অন্যের ধর্মের বিরুদ্ধে রূঢ়তম কুৎসা প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু মুসলমানদের বাধ্য হয়ে অনেকখানি সংযত ভাষা ব্যবহার করতে হল কারণ পবিত্র কুরানে খ্রিস্টকে আল্লার প্রেরিত-পুরুষ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, ক্রুসেডের নৃশংস যুদ্ধ সত্ত্বেও দুই ধর্মের গুণীজ্ঞানী একে অন্যের বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। আরবরা ব্যাপকভাবে গ্রিক দর্শন পদার্থবিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্র আরবিতে অনুবাদ করলেন ও পরবর্তীকালে আরব দর্শনশাস্ত্রের লাতিন অনুবাদ ইউরোপে প্রচার ও প্রসার লাভ করল। এবং এস্থলে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে আরব (ও পরবর্তীকালে ইরানের) সুফিপন্থা (ভক্তিবাদ ও রাজযোগের সমন্বয়) খ্রিস্টীয় মিস্টিজিম বা রহস্যবাদের সঙ্গে বারম্বার নিবিড় সংস্পর্শে এল এবং ফলে একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারিত করল। কোনও কোনও ইউরোপীয় পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, ইতোমধ্যে ভারতীয় রহস্যবাদ আরব সুফিতত্ত্বকে প্রভাবান্বিত করেছিল।

এস্থলে স্পেনবাসী আরব ধর্মপণ্ডিত ইবন্ হজম-এর উল্লেখ করতে হয়। তিনি ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম নিয়ে অতি গভীর আলোচনা করেন, কিন্তু পুস্তকখানা যদিও বহু বহু স্থলে অমূল্য রত্ন ধারণ করে, তবু পূর্ণ পুস্তক পক্ষপাতদুষ্ট। ইবন্ হজমের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সপ্রমাণ করা : ইসলাম সর্বোৎকৃষ্ট ধর্ম এবং শুধু তাই নয়, ইসলামের যে শতাধিক শাখা-প্রশাখা বহুবিধ সেকট, স্কুলস আছে, তার মধ্যে তিনি নিজের যেটিতে জন্মগ্রহণ করেন সেইটিই সর্বোৎকৃষ্ট বটে ও সর্বগ্রাহ্য হওয়া উচিত।

এক হাজার বছর পূর্বেকার গজনির বাদশাহ মাহমুদের সভাপতি আলবিরুনির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য– যদিও তিনি মূলত তাঁর ভারতের বিবরণ গ্রন্থে হিন্দুধর্ম, তার নানা শাখা-প্রশাখা, আচার-অনুষ্ঠান, কুসংস্কার, কিংবদন্তির বয়ান দিয়েছেন এবং যেহেতু ভারতীয় ধর্ম মাত্রই কোনও না কোনও দর্শনের দৃঢ়ভূমির ওপর নির্মিত, তিনি তাঁর প্রামাণিক গ্রন্থে ভারতীয় দর্শন সাতিশয় নৈপুণ্যসহ বিশ্লেষণ করেছেন। এবং স্থলে স্থলে ইসলামের সঙ্গে তুলনাও করেছেন। প্রতিমানাশক, কট্টরতম মুসলমান মাহমুদের সভাপণ্ডিত কোনও স্থলে হিন্দু ধর্মের বিশেষ কোনও মতবাদ বা আচারের প্রতি দৈবাৎ সহানুভূতি প্রকাশ করলে সেটা যে তার স্বাস্থ্যের পক্ষে সাতিশয় উপকারী হত না সেটা তো সে যুগের রাজ-জুহ্লাদ ভিন্ন অন্যজনও নিঃসঙ্কোচে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারত। তৎসত্ত্বেও পরম আশ্চর্যের বিষয় তিনি ইসলামের প্রতি সরল অনুরাগ প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ধর্মের প্রশংসনীয় দিকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং কোনও কোনও নিন্দনীয় আচারের কারণ দেখিয়েছেন। পাঠক মাত্রই সহজে প্রত্যয় করবেন না, যে-মাহমুদ হিন্দুর প্রতিমা ভঙ্গ করাটা অতিশয় শ্লাঘার বিষয় বলে মনে করতেন তাঁরই সভাপণ্ডিত আভাসে ইঙ্গিতে এবং তুলনার সাহায্যে প্রতিমাপূজার পিছনে যে হেতুটি রয়েছে সেটা যে অত্যন্ত স্বাভাবিক সেটা বুঝিয়ে বলেছেন। এ-স্থলে জরাজীর্ণ স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে সংক্ষেপে সেটি নিবেদন করি : মক্কা গমনে সম্পূর্ণ অসমর্থ অথচ হজ পালন করা যখন তার একমাত্র অবশিষ্ট কাম্য, সেই অর্ধমৃতজনকে যদি কেউ মক্কার একখানা ছবি দেখায় তবে কি তার সর্বাঙ্গ শিহরিত হবে না, অশ্রুজল দুই চক্ষু সিক্ত করবে না, কম্পিত কলেবরে সে হজকামী ছবিখানাকে হয়তো বারম্বার চুম্বন দিতে আরম্ভ করবে এবং হয়তো-বা যুক্তিতর্কের বিধান বিস্মৃত হয়ে সেই অতি সাধারণ জড় কাগজখণ্ডকে অলৌকিক দৈবশক্তির আধার বলে সম্মান প্রদর্শন করতে আরম্ভ করবে! অতএব যে স্থলে কলায় সুনিপুণ শিল্পী বহুমানবের ধারণা সাধনাকে মূয়রূপ দিতে সক্ষম হন, সে-প্রতিমার সম্মুখে কি সাধারণ মানুষ নতজানু হবে না? অবশ্য গোড়াতেই আলবিরুনি প্রতিমাপূজার প্রতি আপন বিরাগ প্রকাশ করেছেন। এস্থলে স্মরণীয় যে অম্মদেশীয় বহু বেদান্তবাগীশ তথা ব্রাহ্মসমাজ প্রতিমা-পূজা সমর্থন করেন না। অন্যান্য অনেকেই এ মার্গকে নিম্নস্তরে স্থান দেন।

পাঠান যুগে যদিও নিজামউদ্দীন আউলিয়া প্রভৃতি চিশতি সম্প্রদায়ের সুফি ভাবাপন্ন সাধুগণ অতিশয় পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন বলে যে কোনও ব্যক্তি আপন ধর্ম ত্যাগ না করে তাঁদের শিষ্য হতে পারত, তথাপি ব্যাপকভাবে উভয় ধর্ম নিয়ে বিশেষ কোনও চর্চা হয়েছে বলে এ অক্ষম লেখকের জানা নেই। তবে নিজামউদ্দীনের শিষ্য ও সখা সুকবি আমির খুসরৌ ভারতের প্রচলিত ভাষা, সাহিত্য ও ধর্ম সম্বন্ধে অতিশয় অনুসন্ধিৎসু ছিলেন।

পাঠান রাজবংশ ভারতে বাস করার ফলে ক্রমে ক্রমে মার্জিত রুচিসম্পন্ন হয়ে যান। তাঁদের তুলনায় সে যুগের মোগলদের বর্বর বললে অত্যুক্তি করা হয় না। বাবুর অসাধারণ মেধাবী, বহুগুণধারী পুরুষ। কিন্তু যদিও তিনি তাঁর রোজনামচায় ঘন ঘন আল্লাতালার নাম স্মরণ করেছেন, সেজন্য তাকে সত্য ধর্মানুরাগী মনে করাটা বোধহয় ঠিক হবে না (ইংরেজ প্রতিদিন পাঁচশো বারথ্যাঙ্কু আওড়ায়; অতএব তার কৃতজ্ঞতাবোধ, উপকারীর প্রতি তার আনুগত্য আমাদের চেয়ে পাঁচশো গুণে বেশি এহেন মীমাংসা বোধহয় সমীচীন হবে না)। কারণ ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম-নিন্দিত একাধিক ব্যসনে অত্যধিক আসক্ত তিনি তো ছিলেনই, তদুপরি যুদ্ধজয়ের পর তিনি যে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ইসলামের মূল সিদ্ধান্ত অনুশাসন লঙ্ঘন করে উৎপীড়ন, বর্বরতম পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ সমাপন করেছেন, সেসব তিনি সগর্বে নিজেই আপন রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

বস্তুত এক কথায় বলা যেতে পারে, ইসলামে দীক্ষিত বাবুরাদি তুৰ্কৰ্মন (মোগল নামে এদেশে পরিচিত) ইসলাম সেভাবে গ্রহণ করেনি, বাঙলা দেশের মুসলমান যেরকম হৃদয় দিয়ে করেছে। আর মোগল রাজাদের ভিতর এক ঔরঙ্গজেব ছাড়া অন্য সকলেই ছিলেন স্বধর্ম ইসলামের প্রতি উদাসীন, একাধিকজন সিনিক এবং প্রায় সকলেই কি ইসলাম কি হিন্দুধর্ম সব ধর্ম ব্যবহার করেছেন অস্ত্ররূপে রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য।

হুমায়ুনের জীবন এতই সগ্রামবহুল যে তিনি অন্য কোনও বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ করতে পারেননি। আপন যুবরাজ সম্পূর্ণ নিরক্ষর রইলেন তাঁরই চোখের সামনে।

নিরক্ষরজন যে অশিক্ষিত হবে এমন কোনও আপ্তবাক্য নেই।

নিরক্ষরজন সম্বন্ধে কিন্তু একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেহেতু সে সাক্ষর হয়ে প্রচলিত বিদ্যাভ্যাস করেনি তাই কোন পুস্তক উত্তম আর কোনটা অধমাধম, কোনটা সত্য আর কোনটা নিছক বুজরুকি, এক কথায় তার মূল্যায়নবোধ বিকশিত হয় না। তারই ফলে দেখা যায় নিরক্ষরজন সাধারণত আপন স্বার্থের সামগ্রী ভিন্ন অন্য কোনও বাবদে বিশেষ কৌতূহলী নয়। পক্ষান্তরে এটাও মাঝে মাঝে দেখা যায় যে কোনও কোনও নিরক্ষরজনের বিধিদত্ত জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, সে সাক্ষর হয়ে প্রচলিত বিদ্যাভ্যাসের রীতি অনুযায়ী উত্তম অধম-নানাবিধ পুস্তক অধ্যয়ন করেনি। ফলে তার মূল্যায়নবোধ যথোপযুক্তরূপে বিকাশলাভ করতে পারেনি।

আকবর এরই প্রকৃষ্টতম উদাহরণ। সর্বোচ্চ শাসনকর্তা হিসেবে তিনি উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন যে, ভারতের সর্বপ্রধান সনাতন হিন্দুধর্ম, ইসলাম, দুই ধর্মের শাখাপ্রশাখা এবং হিন্দু-মুসলমান সাধুসন্ত সর্বধর্মের মিলন সাধনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন যেসবপন্থা প্রচার করেছেন এগুলোর কোনও একটা সমন্বয় না করতে পারলে সাম্প্রদায়িক কলহের ফলে যে কোনও দিন মোগল বংশ সিংহাসনচ্যুত হতে পারে। অতএব আহ্বান জানালেন, সর্বধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিদের। এমনকি যে-জৈনদের সংখ্যা ভারতে নগণ্য এবং সে যুগে তারা প্রধানত গুজরাত, কাটিয়াওয়াড় ও মারওয়াড় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাঁদেরও প্রধানতম জৈন ভিক্ষুকে নিমন্ত্রণ জানালেন। তিনি অতি সুন্দর ভাষায় জৈনধর্মের মূল সিদ্ধান্ত এবং বিশেষ করে জীবে দয়া সম্বন্ধে আম-দরবারে বক্তৃতা দিয়ে মায় আকবর সভাজনকে মুগ্ধ করলেন। ওদিকে আকবর ছিলেন ছিদ্রান্বেষী যথা ইনসাইড স্টোর জানবার জন্য মহা কৌতূহলী এবং তিনি জানতেন, হিন্দু এবং জৈনদের মধ্যে একটা আড়াআড়ি ভাব আছে। রাত্রে ডেকে পাঠালেন হিন্দু পণ্ডিতকে। তিনি বললেন, জৈন গুরু যে এত লম্ফঝম্প করলেন তাঁকে শুধোবেন তো মহারাজ, এ প্রবাদটির অর্থ কী–

হস্তীনা তাডমানপি ন গচ্ছেৎ জৈন মন্দির।
হস্তী কর্তৃক বিতাড়িত হলেও জৈন মন্দিরে (বা গৃহে) প্রবেশ করেন না।

আকবর পরদিন প্রশ্নটি শুধানোর পর জৈন গুরু মৃদু হাস্যসহকারে বললেন, আমি যদি উত্তরে বলি–

হস্তীনা তাডমানপি ন গচ্ছেৎ (শৈব) মন্দিরম*

[*অধমের সংস্কৃত জ্ঞান এতই অল্প যে তার জন্য ক্ষমাভিক্ষা করতেও লজ্জা বোধ করি। বানানে নিশ্চয়ই একাধিক ভ্রম আছে। পাঠক নিজ গুণে শুধরে নেবেন। কাহিনীটিও স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে লিখেছি।

সৈয়দ মুজতবা আলীর এই অপ্রকাশিত প্রবন্ধ রচনার একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। প্রবন্ধটি রচনার তারিখ ১৯৭৩ সনের ৩০ জানুয়ারি। ওই বছরটি ছিল রামমোহন রায়ের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকীর বছর। ইন্দো-ইটালিয়ান সোসাইটির বর্তমান সম্পাদক শ্রীরবিউদ্দীনের (যিনি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ইউরোপ যাবার সময় কবির একান্ত সচিব ছিলেন) প্রচেষ্টায় রাজা রামমোহনের জন্মস্থান রাধানগরের সন্নিকটস্থ নতিবপুর গ্রামে ওই উপলক্ষে একটি সভার আয়োজন করা হয়। সভার আলোচ্য বিষয় ছিল রাজা রামমোহন ও যুবরাজ দারাশিকুহর উদার সহনশীল সমন্বয়ধর্মী কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা। ওই সভার সভাপতি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং প্রধান অতিথি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষার ভূতপূর্ব অধ্যাপক ড. অমলেন্দু বসু। ওই আলোচনা সভার জন্য এই প্রবন্ধটি রচনা করেন সৈয়দ মুজতবা আলী তার একান্ত স্নেহভাজন ডাক্তার মহম্মদ আব্দুল ওয়ালির বিশেষ অনুরোধে এবং আলী সাহেব এই প্রবন্ধটি পড়বার দায়িত্বও ডাক্তার ওয়ালির ওপর ন্যস্ত করেন।]

 হস্তী কর্তৃক বিতাড়িত হলেও শৈব মন্দিরে (বা শৈবের গৃহে) প্রবেশ করে না। তা হলে ছন্দপতন হয় না, অর্থও তদ্বৎ শুধু জৈনের পরিবর্তে শৈবের কুৎসা করা হয়। বিদ্বেষপ্রসূত এসব প্রবাদের কোনও সত্যমূল্য নেই।

আকবর রাজনৈতিক কারণে, নিজ স্বার্থে, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের বিবরণ শোনার পর স্বয়ং একটি নবীন ধর্ম প্রচার করতে চেয়েছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, ইসলামের হজরত নবী ছিলেন নিরক্ষর আমিও নিরক্ষর। তদুপরি আমার হাতে রাজদণ্ড। আমা দ্বারা এ কর্ম সফল হবে না কেন? সে যা-ই হোক, তিনি তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্বের নিরপেক্ষ সন্ধানীজন নন। তবে একথা অতি সত্য যে তিনি সর্বধর্মের সবগুরুকে বাদশাহি নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাজদরবারে আসন দেওয়ার ফলে ধর্ম বাবদে মোগল রাজসভা অনেকখানি সঙ্কীর্ণতামুক্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে সর্বধর্ম জিজ্ঞাসার পন্থাটি সুখগম্য করে তোলে।

জাহাঙ্গির সর্ব বিষয়েই ছিলেন উদাসীন–যা অত্যধিক মদ্যাসক্তজনের প্রায়শ হয়ে থাকে।

শাহজাহানের মতিগতি বোঝা কঠিন। সুবৃহৎ লালকেল্লাতে কত না রঙমহল, কত না হাম্মাম, সম্পূর্ণ একটি হট্ট, কত না নিষ্কর্মা এমারৎ, নহবৎখানা, বন্দিশালা, এবং দুই বিরাট সভাগৃহ। অথচ বেবাক ভুলে গেলেন (?) দুর্গবাসীদের পাঁচ বেলা নামাজ পড়ার জন্য একটি ছোটাসে ছোটা মসজিদ বানাতে! দিল্লির দারুণ গ্রীষ্ম এবং নাকেমুখে আঁধির ধুলো খেতে খেতে তাদের দ্বিপ্রহরে যেতে হত জামি মসজিদে। দিল্লির কাঠ-ফাটা শীতের রাত্রে এশার নামাজ পড়তে।

তা সে যাই হোক, তিনি অদ্ভুত একটা একত্সপেরিমেন্ট করেছিলেন তাঁর চার পুত্রের শিক্ষাব্যবস্থায়। এক পুত্রকে স্পেশালাইজ করালেন রণকৌশলে, অন্যকে সঙ্গীতাদি

চারুকলায়, কনিষ্ঠ ঔরঙ্গজেবকে ছেড়ে দিলেন কট্টর মোল্লাদের হাতে এবং তার সর্বাধিক প্রিয় জ্যেষ্ঠ দারা শিকুহকে শেখালেন সর্বধর্ম সর্ব সম্প্রদায়ের জ্ঞানবিজ্ঞান দর্শন।

***

সর্বধর্ম চর্চা করার জন্য মোল্লাদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও আকবর যে পথ সুগম করে দিয়ে সর্বধর্মগুরুকে রাজসভায় ডেকে এনে বসিয়েছিলেন, সেই সুপ্রশস্ত রাজবক্স দুই পুরুষ ধরে ছিল অনাবৃত অবহেলিত। দারা স্বয়ং সে পথ দিয়ে যাত্রারম্ভ করলেন। এবং শুধু তাই নয়, আকবরের কালে মৌলভি সাহেব সভাস্থলে প্রচার করতেন ইসলাম, হিন্দু পণ্ডিত প্রচার করতেন হিন্দুধর্ম, যে যার আপন ধর্ম— দারা সম্মুখে আদর্শ করলেন সর্বশাস্ত্র মূল ভাষাতে অধ্যয়ন করে, ব্রাহ্মণসন্তান যেরকম সংস্কৃত অধ্যয়ন করে, মুসলিম-সন্তান যেরকম আরবি ভাষা আয়ত্তে আনে তিনি একাই যেন সর্বধর্মের মুখপাত্র হতে পারেন। কিন্তু এস্থলে একটি বিষয়ে আমাদের মনে যেন কোনও দ্বন্দ্ব না থাকে, দারা কোনও নবধর্ম প্রবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে অধ্যয়ন, গবেষণা তথা অনুবাদকর্মে লিপ্ত হননি। আকবর যে পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন সেটা দারার মনঃপূত হয়নি। আকবর ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের বিবরণ শোনার পর প্রত্যেক ধর্মের কতকগুলি সিদ্ধান্ত, যেগুলো ওই ধর্মের প্রত্যেককে বিনা যুক্তিতর্কে মেনে নিতে হয় অর্থাৎ ডকট্রিন, শিবলেথ এবং ওই ধর্মের অবশ্য করণীয় আচার-অনুষ্ঠান রিচুয়াল এ দুটি অঙ্গের ওপর দিলেন প্রধান জোর; ডকট্রিন এবং রিচুয়াল। অতঃপর আকবর সর্বপ্রধান প্রধান ধর্মের সর্ব ডকট্রিন ও রিচুয়াল সংগ্রহ করে বিচার করে দেখলেন এর কোন-কোনগুলো এ দেশের জনসাধারণে প্রচলিত ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়েই আছে, কোন-কোনগুলো আপন ধর্মে না থাকা সত্ত্বেও সে ধর্মের লোক ওইগুলো আপত্তিজনক বলে মনে করে না এবং কোন-কোনগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিদ্বেষ, কলহ এমনকি রক্তপাত পর্যন্ত ঘটিয়েছে। বিচার-বিবেচনার পর তিনি তাঁর নবীন ধর্মের এমন সব ডকট্রিন ও রিচুয়াল নিলেন যেগুলো সর্বধর্মগ্রাহ্য হয়েই আছে এবং যেগুলো হওয়ার সম্ভাবনা ধরে।

দারা এ পথ নিলেন না। তিনি বিচার করে দেখলেন, প্রত্যেক ধর্মের অন্তত কয়েকজন গুণী আপন আপন ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন এবং অল্প-সংখ্যক ধর্মানুরক্তজনের ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকলেও সেগুলো প্রাণবন্ত, ডায়নেমিক। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি মুগ্ধ হলেন হিন্দুর উপনিষদের গভীরে প্রবেশ করে। তসওউফ বা সুফিতত্ত্বকে তিনি ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে দৃঢ়বিশ্বাস রাখতেন– ইসলামের সর্বশাস্ত্র অধ্যয়ন করার পর। এবং নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, দুই সাধনার ধারাই সম্মিলিত হয়েছে একই সিন্ধুতে। তাই তার উপনিষদ-সাধনা পুস্তকের নামকরণ করেছিলেন– দ্বিসিন্ধু মিলন– মুজম্ উল্ বরেন্। সে যুগে দুই ভিন্ন ধর্মের সাধক একান্তে বসে ধর্মালোচনা করতেন না– বস্তুত আপন ধর্মের তত্ত্বজ্ঞানের যে বিশেষ ভাষা হয় সেটা অন্যজনের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অবোধ্য।

দারার আশা ছিল, উপনিষদ সযত্নে ফারসি ভাষাতে অনুবাদ করলে মুসলিম তত্ত্বজ্ঞানী সুফি উল্লাসে ইউরেকা শব্দ দ্বারা আপন আবিষ্কারজনিত হর্ষপ্রকাশ করবেন।

দারার বিশ্বাস ছিল, যদিও আপাতদৃষ্টিতে হিন্দুর পুরোহিত তথা মুসলমানের মোল্লা যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন, তথাপি তাঁদের মূল উৎস দুই ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদের অধিকারী যারা তারাই।

মুসলিম সুফি একবার হিন্দুর উপনিষদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তাঁর ও হিন্দু ব্রহ্মবাদীর মাঝখানে তো কোনও অন্তরাল থাকবে না– কুৎসা-কলহের তো কথাই ওঠে না। ফলে এঁরাই পুরোহিত মোল্লাদের যে নতুন অনুপ্রেরণা দেবেন, তারই ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শাশ্বত মিলন স্থাপিত হবে।

নিয়তি দারাকে আপন কর্ম সমাপ্ত করতে দিলেন না। নইলে তিনি যে হিন্দুর বিচিত্র সব মণিমানিক্য মুসলমানের সামনে এবং মুসলিম জওহর-জওয়াহির হিন্দুর সম্মুখে ক্রমে ক্রমে তুলে ধরতেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

ভারতেরই নিয়তি, বিবেকানন্দ দীর্ঘজীবী হলেন না, শঙ্করাচার্যের আয়ুষ্কাল তো মাত্র বত্রিশ, চৈতন্যের বিয়াল্লিশ। রামমোহন দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন বটে কিন্তু তিনি হাত দিলেন একই সময়ে সর্বকঠিন দুটি কর্মে, যার একটাই যে কোনও কালের যুগশ্রেষ্ঠ পুরুষোত্তমকে নিঃশেষ করে দেয়– ধর্ম সংস্কার এবং সমাজ সংস্কার যুগপৎ! তদুপরি তাকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আরও বহুবিধ কর্মে লিপ্ত হতে হয়; সর্বশেষে উল্লেখ করতে হয়, পাদ্রি-মোল্লাদের সঙ্গে তর্কবিতর্কে তাঁর কালক্ষয় হয় প্রচুর।

দারা ও রামমোহনের উভয়েরই শিক্ষার বাহন ফারসি, সংস্কৃত এবং আরবি। দীক্ষা দু জনার ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু উভয়েই মিলিত হয়েছিলেন উপনিষদের একই সিন্ধুতে। অতএব দারার গ্রন্থমুজম উল-বহরেন এই উভয় সাধকের বেলাও প্রযোজ্য। অপিচ রামমোহনের ফারসিতে লিখিত প্রথম কেতাব তুহফাতুল মুওয়াহহিদিন–একম এবং অদ্বিতীয়-এ বিশ্বাসীজনের প্রতি সওগাত যদি কাউকে উৎসর্গ করতে হয় রাজার সঙ্গে একই তীর্থের যাত্রী রাজপুত্র দারাকে। রামমোহনের প্রথম পুস্তক ফারসিতে এবং দারার পুস্তকও ওই ভাষায় এবং উভয়ের পুস্তকের শিরোনাম আরবিতে। দু জনাই পুস্তক লিখেছেন মুসলমান সাধকের উদ্দেশ্যে। দারা আপন বক্তব্য বলেছেন উপনিষদ মারফত, রামমোহন তার যুক্তিতর্ক সঞ্চয় করেছেন ইসলামের ভাণ্ডার থেকে। দুই পুস্তকই ধর্ম ও দর্শনের সংমিশ্রণ। আরও বহুক্ষেত্রে দু জনার ঐক্য, একাত্মবোধ ধরা পড়ে শুধু লক্ষ্যবস্তু ও দৃষ্টিভঙ্গিতেই নয়।

নেতির দিক দিয়ে দেখলে যে সাদৃশ্য চোখে পড়ে সেটি বিস্ময়কর। কেউই কোনও নতুন ধর্ম প্রচার করেননি, করতে চাননি।

দারা এবং রাজা সম্বন্ধে গত ত্রিশ বৎসর ধরে যেসব গবেষণা হয়েছে তার অধিকাংশ অধিকাংশ কেন, শতাংশের একাংশ পড়বার সুযোগ আমার হয়নি। গ্রহচক্রে আমি সে মণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। তাই এই রচনায় বিস্তর ত্রুটিবিচ্যুতির অবকাশ অনিবার্য। তবু কেন যে বার্ধক্যে এই অর্বাচীনসুলভ অপকর্ম করলুম সে তত্ত্ব সম্পাদক মহাশয় অবগত আছেন। পাঠককে জানিয়ে কোনও লাভ নেই। লেখকের ভুলভ্রান্তি তার চক্ষুগোচর হলে সে অকৃপণ হস্তে হতভাগ্যের কর্ণমর্দন করার সময় আদৌ কর্ণপাত করে না– বেচারা লেখকের ওজুহাত-অছিল তথা করুণকণ্ঠে তার ক্ষমাভিক্ষার প্রতি।

.

যোগাযোগ

নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা লাভ করার উপলক্ষে যে কোনও জাতিরই উল্লসিত হওয়ার কথা; বিশেষত যে জাতির গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে, যে জাতি অতীতে মানবসংসারে জ্ঞানের চিরন্তন দেয়ালি উৎসবে বহু প্রদীপ জ্বালিয়াছে, তার স্বরাজ্যলাভে পৃথিবীর বিদগ্ধ সম্প্রদায়েরও নিরঙ্কুশ আনন্দ হওয়ারই কথা। যে জাতি একদিন উপনিষদের দর্শন দিল, তথাগতের অমৃতবাণী শোনাল, গীতার সর্বধর্মসম্মেলন শিখাল, ত্রিমূর্তি নির্মাণ করল, তাজমহলের মর্মর স্বপ্ন দেখাল, তার কাছ থেকে পৃথিবীর গুণীজ্ঞানীরা এখন অনেক কিছুই আশা করবেন। স্বাধীনতা লাভের পর এখন আর তাদের নিরাশ করার কোনও অজুহাত আমাদের রইল না। এখন আর ইংরেজের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আমরা রেহাই পাব না।

সাংস্কৃতিক বৈদগ্ধ্যের নবজীবন লাভ অনেকখানি নির্ভর করে দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুসামঞ্জস্যের ওপর। দারিদ্র্য যদি না ঘোচে, শক্তির সাধনায় স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা যদি খাদ্যের পরিবর্তে আগ্নেয়াস্ত্র সঞ্চয়ে মনোযোগ দিয়ে দেন, তা হলে যে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-কলা-দর্শন এদেশে পুনরায় বিকশিত হবে না, সে বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি। হিটলারের জর্মনি, স্তালিনের রুশিয়া যে বিশ্বমানবকে হতাশ করেছে, সেকথা কারও অজানা নয়।

মহাত্মা গান্ধী যখন আততায়ীর হাতে প্রাণ দিলেন, তখন আমরা ভয় করেছিলাম যে হয়তো-বা আততায়ীর শাক্ত সম্প্রদায় তাবৎ দেশটাকে গ্রাস করে নব নব হিটলার, নব নব স্তালিনের দাসগ্রহণ করবেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য আমরা সে মহতী বিনষ্টির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি, আমাদের চরম সান্ত্বনা যে দেশের আপামর জনসাধারণও সে নিষ্কৃতির কিছুটা হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হয়েছে।

পণ্ডিত নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল যে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, আমরা শান্তি ও মৈত্রীর কল্পনা করি, কোনও দেশ জয় করার কামনা আমাদের নেই, হিন্দুস্থান-পাকিস্তান সংযুক্ত করার কোনও ইচ্ছা আমাদের নেই, এ বড় কম কথা নয়। কারণ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, আমাদের ভৌগোলিক অবস্থা এমন যে, একমাত্র পাকিস্তান ভিন্ন অন্য কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম হবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নেই। তাই আশা করতে পারি, আজ না হোক কাল নেতাদের সর্বপ্রচেষ্টা দেশের অভাব-অনটন মোচন করাতে নিয়োজিত হবে।

কিন্তু তাই বলে একথা বলা চলে না যে, দেশের দারিদ্র্য না ঘোচা পর্যন্ত সংস্কৃতির বৈদগ্ধ্যের ক্ষেত্রে আমাদের বীজ পেতার প্রয়োজন নেই, ফসল ফলাবার তৃরা নেই। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক এই তিন প্রচেষ্টাই একই সঙ্গে চালাতে হয়– অবস্থার তারতম্যে বিশেষ জোর দেওয়া বিশেষ কোনও অঙ্গে, এইমাত্র।

ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যে বিকট রুদ্র রূপ নেবে না, সে সম্বন্ধে আশ্বস্ত হওয়ার পরও প্রশ্ন থেকে যায় সংস্কৃতির দিক দিয়ে এই দুই রাষ্ট্রের যোগাযোগ থাকবে কি থাকবে না, এবং যদি থাকে তবে সেটি কী প্রকারের হবে।

একটা দৃষ্টান্ত পেশ করি। সকলেই জানেন, প্যালেস্টাইনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ট্রান্সজর্ডান এবং তার প্রতিবেশী সউদি আরব যে প্যালেস্টাইনের আরবকে ইহুদি অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনও সাহায্য করতে পারল না, তার প্রধান কারণ আমির আবদুল্লা ও ইবনে সউদের শত্রুতা। আমির আবদুল্লার ভয় ছিল যে তিনি যদি সর্বশক্তি নিয়ে প্যালেস্টাইন আক্রমণ করতে পারেন, আবদুল্লার পক্ষে উভয় রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা অসম্ভব হবে– হিটলারও পারেননি এবং ফলে তার দুই কূলই যাবে।

কিন্তু তাই বলে ট্রান্সজর্ডান ও সউদি আরবের কৃষ্টিগত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। কাবাশরিফের চতুর্দিকে ধর্ম সম্বন্ধে আরব তথা অন্য দেশবাসী শেখরা প্রতিদিন যে বক্তৃতা দেন, সেগুলোতে ট্রান্সজর্ডানের অধিবাসীরা আগেরই মতো হাজিরা দিয়েছে এবং আম্মানে লেখা কেতাব মক্কাতে পূর্বেরই ন্যায় সম্মান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, মক্কা এবং আম্মান উভয় শহরের বিদ্যার্থীরাই কাইরোর আজহরে গিয়ে আগেরই মতো পড়াশোনা করেছে। ইবনে সউদ মক্কা দখল করার পর বহু বৎসর পর্যন্ত মিশর-মক্কায় মনোমালিন্য ছিল– এমনকি মিশর থেকে কাবাশরিফের বাৎসরিক গালিচা আসা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের মক্কা-মদনওয়ি ছাত্রাবাস বন্ধ হয়ে যায়নি কিংবা ছাত্রেরও অপ্রাচুর্য হয়নি– মিশরে ছাপা ইমাম আবু হনিফার ফিকার কিতাব আগেরই মতো মক্কার বাজারে বিক্রয় হয়েছে।

আরব-ভূমি আজ কত ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত, তবু যখন আজহরে পড়তুম, সব রাষ্ট্রের ছেলেদের সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় হয়েছে, তাদের আপন আপন হস্টেলে গিয়েছি, সকলে মিলে বাজার থেকে মুরগি কিনে এনে হৈ-হুল্লোড় করে রান্না করে খেয়েছি। বিশ্বাস করবেন না, রান্নার সর্দার ছিল মালদ্বীপের একটি ছেলে মালদ্বীপ কোথায়, সেকথাই বহু ছাত্র জানত না।

এইবার গোটা দুই ইউরোপীয় উদাহরণ পেশ করি। ভাষা এবং কৃষ্টির দিক দিয়ে দেখতে গেলে ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বাংশ পড়েছে সুইটজারল্যান্ডের ভিতর। উত্তরাংশের খানিকটা পড়েছে লুসুমবুর্গের ভিতর এবং আরও খানিকটা বেলজিয়ামের ভিতর। এসব দেশের লোকেরা আপন আপন রাষ্ট্রের প্রতি সর্বান্তকরণে আনুগত্য স্বীকার করে ফ্রান্সও কখনও বলে না, এসব ফরাসি-ভাষী ভূখণ্ডগুলো লড়াই করে দখল করব। অথচ কৃষ্টিগত আদান-প্রদান এই তিন ভূমিতে হামেশাই চলেছে। প্যারিসে আঁদ্রে জিদের বই যেদিন বেরোয় ঠিক সেইদিনই সে বই জিনিভা, লুসুমবুর্গ এবং ব্রাসেলসে কিনতে পাওয়া যায়। জিনিভার বড় প্রকাশকরা প্যারিসে ব্রাঞ্চ রাখে, ব্রাসেলুসে প্রকাশকরা জিনিভায় আপন শাখা খুলতে পারলে খুশি হয়।

কিন্তু ঢাকার সাহিত্যামোদী এবং প্রকাশক হয়তো বলবেন, আমরা কলকাতার ধামাধরা হয়ে থাকতে চাইনে, কাজেই এ উদাহরণটা আমাদের মনঃপূত হল না।

উত্তরে ভিয়েনা-বার্লিনের দৃষ্টান্ত পেশ করব। দুই শহর দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী। কেউ কারও চেয়ে কম নয় এবং এককালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির (মায় যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া) প্রতাপ জর্মনির চেয়ে কিছুমাত্র কম ছিল না। দু শহরের লোকই জর্মন বলে, জর্মন থিয়েটার দেখে, জর্মন অপেরা শোনে। ভিয়েনাতে কোনও নাট্য-সমঝদারের সাবাসি পেলে সঙ্গে সঙ্গেই নাট্যকার, অভিনেতা এবং নর্তক-নর্তকীদের নিমন্ত্রণ হয় বার্লিনে বার্লিনে কোনও লেখক নাম করতে পারলে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি তাঁকে অনারারি ডক্টরেট দেয়।

এই দু শহরের দুশমনি-বর্জিত আড়াআড়িতেই বিরাট জর্মন সাহিত্য গড়ে উঠেছে, জর্মন সঙ্গীত বলতে একথা কেউ শুধায় না মৎসার্ট, স্ট্রাউসের জন্ম কোথায় হয়েছিল এবং একথা সকলেই জানে যে সঙ্গীতসম্রাট বেটোফেনের জন্ম হয় বন (উপস্থিত পশ্চিম জর্মনির রাজধানী) শহরে এবং জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি কাটান ভিয়েনাতে।

বাঙলা ভূমিতে ফিরে আসি।

বাঙলার বিদগ্ধ সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয় প্রায় দেড়শো বৎসর পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকে কেন্দ্র করে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ (এমনকি শরৎচন্দ্র পর্যন্ত), প্রমথ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম এঁরা সবাই জীবনের অধিকাংশ ভাগ কাটিয়েছেন কলকাতায়। বাঙলা সাহিত্য (গদ্যসাহিত্য তো বটেই) রাজধানীর সাহিত্য কম্যুনিস্টরা এই সাহিত্যকেই গালাগাল দিয়ে বলেন বুর্জোয়া সাহিত্য– যদিও আমাদের কর্ণে এ গালাগাল বংশীধ্বনির ন্যায় শোনায়।

মাত্র সেদিন পুব-বাঙলার লোক সাহিত্যের আসরে নামলেন। বুদ্ধদেব, অচিন্ত্য, মানিককে কিন্তু বাধ্য হয়ে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়েছে। ঢাকা যে সাহিত্যের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি, তার প্রধান কারণ ঢাকা কখনও কলকাতার মতো তামাম ভারত এবং বাঙলার রাজধানী হয়ে উঠতে পারেনি।

আমাদের ভয় হয়েছিল পূর্ববঙ্গ পাছে বাঙলা ভাষা বর্জন করে উর্দু গ্রহণ করে বসে। সে ভয় কেটে গিয়েছে এবং ঢাকার বাঙলা যে উর্দু হরফে লেখা হবে না, সে খবরটা পেয়েও আমরা আশ্বস্ত হয়েছি।

এইবার ঢাকার পালা নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করবার। কলকাতা যে অদ্যকার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা লাভের ফলে নবীন উৎসাহ, নবীন উদ্দীপনায় নতুন সাহিত্য গড়তে মন দেবে, সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই এবং কলকাতার অধিকাংশ সাহিত্যিকই যে পূর্ববঙ্গে আপন পুস্তকের বহুলপ্রচার কামনা করেন, সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মনে একটু দ্বিধা রয়ে গিয়েছে পূর্ব বাঙলার ভবিষ্যৎ সাহিত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে। কেউ কেউ ভাবছেন পুব-বাঙলা হয়তো এমন সব শব্দ বাক্যবিন্যাস আরবি-ফারসি থেকে গ্রহণ করতে আরম্ভ করবে যে, কালে কলকাতার লোক ঢাকায় প্রকাশিত বাংলা বই পড়ে বুঝতে পারবে না। তাদের এ ভয় দূর করে দেবার জন্যই আজ আমার এ প্রবন্ধ লেখা– যাতে করে পশ্চিমবঙ্গবাসীর স্বাধীনতা লাভের আনন্দ আজ সর্বপ্রকার দ্বিধাবর্জিত নিরঙ্কুশ হয়।

ইচ্ছে করলেই যে কোনও ভাষা থেকে জাহাজ-বোঝাই শব্দ গ্রহণ করা যায় না। দৃষ্টান্তস্থলে আজকের দিনের বাঙলা ভাষাই নিন। এ ভাষা যে শব্দ সম্পদে কত দীন, সেকথা যারা অর্থনীতি, বিজ্ঞান এবং অন্যান্য নতুন চিন্তা নিয়ে বাঙলায় কারবার করেন তারাই জানেন এবং তাদের অধিকাংশই ইংরেজি থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি শব্দ গ্রহণ করতে পারলে বহু মুশকিল, বহু গর্দিশ থেকে বেঁচে যেতেন। কিন্তু উপায় নেই তারা বিলক্ষণ জানেন, ইংরেজি-অনভিজ্ঞ যে পাঠকের জন্য তাঁরা বই লিখতে যাচ্ছেন, তারাই সে বই বুঝতে পারবে না। তা হলে আর লাভটা কী হল?

পুব-বাঙলায় তার চেয়েও বড় বাধা এই যে, গাদা গাদা আরবি-ফারসি শব্দ ঢোকাবার মতো উমদা আরবি-ফারসি এবং বাঙলা জানেন কয়টি গুণী? ড. শহীদুল্লাহ তো একজন।

এবং বঙ্গবিভাগের পরও তিনি বেধড়ক, বেদরদ আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগ করেননি। যদি করেনও, বুঝবে কটা লোক? এন্তার আরবি-ফারসি মেশানো বাঙলা বোঝার মতো এলেম পূর্ব-বাঙালির এবং আপনার-আমার পেটে তো নেই। আর যদি বলেন ভবিষ্যতে একদিন পূর্ব বাঙলার জনসাধারণ, চাষাভূষো সব্বাই উত্তম আরবি-ফারসি শিখে যাবে আর হুশ হুশ করে আরবি-ফারসির বগহারে রান্না বাঙলা ভাষা বুঝে ফেলতে পারবে, তা হলে তো সে আনন্দের কথা। প্রত্যেক ব্যক্তি তিনটি ভাষার (তার একটা আরবির মতো কঠিন ভাষা! বিবেচনা করুন) আলিম-ফাজিল, এত বড় ডাঙর সুখস্বপ্ন পূর্ব-বাঙলার নমস্য ব্যক্তিরাও দেখেন না।

আর যদি বলেন, নজরুল ইসলামের মতো কোনও শক্তিশালী লেখক এসে সেই কর্মটি করে দেবেন তবে উত্তরে বলি, একদা পশ্চিম-বাঙলাতেই এবং আরবি-ফারসি অনভিজ্ঞ রসিক সম্প্রদায়ের ভিতরই তাঁর কদর হয়েছিল প্রথম পূর্ব-বাঙলা তাকে আদর করে বহু পরে। আজ যদি ঢাকায় নজরুল ইসলামের মতো কবি জন্মান, তবে কলকাতা তার কেতাব আগেরই মতো উদগ্রীব, স্তম্ভিত-নিঃশ্বাস হয়ে পড়বে। তাতে করে তাবৎ বাঙলা সাহিত্যই শক্তিশালী হবে, শুধু পূর্ব-বাঙলার সাহিত্যই না।

তাই এই আনন্দের দিনে নিবেদন করি, রাজনৈতিকরা উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তির বাণী প্রচার করেছেন। ভারতীয় অন্তত বাঙালি সাহিত্যিক যেন সংস্কৃতি-বৈদগ্ধের ভিতর দিয়ে সে শান্তি পরিপূর্ণতায় পৌঁছিয়ে দেয়।

.

‘বাংলা-একাডেমী পত্রিকা’

পূর্ববঙ্গের বাঙলা-একাডেমীর ইতিহাস দিতে গিয়ে একাডেমীর মুখপত্র বলেছেন :

পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের সহিত বাংলা-একাডেমীর ইতিহাস অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ১৯৪৮ ইংরেজির একেবারেই গোড়ার দিকে বাঙলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতিদানের জন্য যে স্বতঃস্ফূর্ত দাবি দেশের তরুণ ছাত্র-সমাজ হইতে উত্থিত হয়, নানা বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করিয়া তাহা দৈনন্দিন প্রবলতর ও ব্যাপকতর হইতে থাকে। মাত্র চারি বৎসর পার হইতে না হইতেই, ১৯৫২ ইংরেজিতে আসিয়া এই আন্দোলন চরম বেগ সঞ্চয় করে এবং তাহার ফলে এই সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গণে ভাষা-আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনায় চারিটি ছাত্র নিহত এবং আরও কতিপয় ছাত্র আহত হয়। এই দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই ভাষা-আন্দোলন ছাত্র-সমাজের সীমা উল্লঙ্ঘন করিয়া দেশের সর্বত্র গণআন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে।…আন্দোলনটি অচিরেই সরকারের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যায়। এইভাবে ১৯৫৩ সাল কাটিয়া গেলে পর, ১৯৫৪ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবার জন্য জনাব মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী-মুসলিম-লীগ যে একুশ দফা কর্মসূচি লইয়া আগাইয়া আসেন, বাঙলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি দিয়া বর্ধমান হাউসে একটি বাঙলা-একাডেমী স্থাপনের পরিকল্পনাও ছিল তাহার মধ্যে অন্যতম।… নূতন যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে ১৯৫৫ ইংরেজির ৩ ডিসেম্বর একুশ দফার রূপায়ণরূপে ইহার অন্যতম দফা বাংলা-একাডেমীর উদ্বোধন কার্য বর্ধমান হাউসে সুসম্পন্ন করা হয়।

একাডেমীতে থাকবে (অ) গবেষণা বিভাগ : তার দুটি শাখা– (১) বাঙলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস, (২) পাণ্ডুলিপি তথা লোকগাথা লোকসঙ্গীত ইত্যাদির সংগ্রহ ও প্রকাশ। (আ) অনুবাদ বিভাগ (ই) সংকলন ও প্রকাশনা-বিভাগ, (ঈ) সাংস্কৃতিক বিভাগ পাঠাগার, সাহিত্য-সভা, পুরস্কার বিতরণ ইত্যাদি।

বক্ষ্যমাণ সংখ্যা বাঙলা-একাডেমী* পত্রিকার প্রথম সংখ্যা।

[*একাডেমীর ইংরেজি উচ্চারণই যখন নেওয়া হয়েছে তখন একাডেমি লিখলেই বোধহয় ভালো হত; কারণ ইংরেজিতে মি হ্রস্ব।]

পত্রিকায় ন টি তথ্য ও তত্ত্ব সম্বলিত মূল্যবান প্রবন্ধ রয়েছে মাত্র একটি ছাড়া আর সবকটি প্রবন্ধই একাডেমির সাহিত্যসভায় পড়া হয়েছিল।

প্রথম প্রবন্ধটি উভয় বাঙলায় সুবিখ্যাত পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সায়েবের রচনা– এ প্রবন্ধে তিনি পণ্ডিত রেয়াজ অল্ দিন আহমদ মাশহাদি নামক একজন বাঙালি লেখকের সমাজ ও সংস্কারক নামক পুস্তকখানির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তার প্রয়োজনও বিলক্ষণ ছিল, কারণ ১২৯৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ সরকার পুস্তকখানি বাজেয়াপ্ত করেন। কেন করেছিলেন সেটা পুস্তকের উদ্ধৃতি থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। রেয়াজ অল্-দিন রাজনৈতিক নেতা জমাউদ্দীন আফগানির ন্যায় ইংরেজের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার প্রয়াসী ছিলেন। এই প্রচেষ্টা করতে গিয়ে রেয়াজ অল্-দিন হৃদয়ঙ্গম করেন যে একদল হিন্দু যেরকম অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন সবকিছু আমাদের শাস্ত্রেই আছে, ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে এমন কিছু নেই যা আমাদের মুনি-ঋষিরা জানতেন না ঠিক সেইরকম বেশিরভাগ মুসলমানই বিশ্বাস করেন যে, আরবির মাধ্যমে তাঁরা যে আরবি-ইরানি আভিচেন্না আভেরস এবং গ্রিক প্রাতো-আরিস্টটলের দর্শন-বিজ্ঞান ৮০০/১০০০ বৎসর পূর্বে আয়ত্ত করেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীতেও সে-ই যথেষ্ট, নতুন কিছু শেখবার নেই। এ বিতর্কের সঙ্গে বাঙলা সাহিত্যের তেমন কোনও আন্তরিক সম্পর্ক নেই, কিন্তু রেয়াজ অল-দিন সেদিন তার পর্যবেক্ষণ, মনোবেদনা ও পথনিদর্শন যে-ভাষায় প্রকাশ করেছেন সেটি তার গভীর পাণ্ডিত্য ও একাধিক ভাষার সঙ্গে তাঁর দৃঢ় যোগসূত্রের পরিচয় দেয়।

হিজরি দ্বিতীয়াদি শতাব্দীতে মোসলমান পণ্ডিতেরা যে সমস্ত দর্শন-বিজ্ঞান-গণিতবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন, ইদানীন্তন শাস্ত্রকোবিদগণও সম্পূর্ণরূপে তাহারই অনুবর্তন করেন। বিশেষ যাঁহাদিগের রচনাশক্তি ও কল্পনাশক্তি সমধিক তেজস্বিনী, তাহারা সেই কীট নিষ্কষিত প্রাচীনতম শাস্ত্রের ব্যাখ্যা বিবৃতি প্রকৃতি লিখিয়া আপনাদের গৌরব বৃদ্ধি করিয়া থাকেন। তাঁহাদের বিবেচনা অনুসারে বর্তমান চিন্তা ও নবাবিষ্কৃত সমস্তই ভ্রমপ্রদানের আশ্রয় ও অকিঞ্চিৎকর; কেবল প্রাচীন পণ্ডিতগণের মতের ধ্বংসাবশেষ দ্বারা পৃথিবী এখনও চলিতেছে; অনুবীক্ষণ, দূরবীক্ষণ, লৌহবর্ক্স, তড়িতবার্তাবহ, তাপমান, বাতমান প্রভৃতি লোকসমাজের আবশ্যক ও বিজ্ঞানের নবাবিষ্কৃত সত্যাদি সমুদায়ই হিন্দুদিগের বিশ্বকর্মার ন্যায় মুসলমানদের লোমান-হাকিমের চর্বিত-চর্বণ মাত্র। এ সমস্তকে কল্পতরুরূপী বর্তমান বিজ্ঞান-বৃক্ষের অভিনব বিষ-অমৃত-ফল তাহা মুসলমান অর্ধশিক্ষিত লোকেরা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারে না, তাঁহারা আরস্তু (আরিস্টটল), আফলাতুন্ (প্লেটো) প্রভৃতির প্রাচীন জীর্ণ মতসকল গভীর মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়া কৃতার্থ হয়েন বটে, কিন্তু আধুনিক নিউটন, গালিলিয়ো, কেলার, ডারুইন, লাপ্লাস, কটির (কৎ) অতুল প্রতিভার দিকে তাহাদের অণুমাত্রও মনঃসংযোগ নাই। প্রত্যুত একপ্রকার বিদ্বেষ-বুদ্ধি দৃষ্ট হয়। প্রাচীন মোসলমান মহাপণ্ডিতগণ ভারতবর্ষ ও গ্রিসকে আপনাদের শিক্ষাগুরু বলিয়া জগতে অকুণ্ঠিত চিত্তে, মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন, কিন্তু আধুনিক অজ্ঞান মোসলমান শিক্ষিত লোকেরা তাদৃশ্য প্রাধান্যের কথা মুখে আনিতেও লজ্জা বিবেচনা করেন। সুতরাং পৃথিবীর জাতিসাধারণের পরস্পরের মধ্যে বিজ্ঞান ও বুদ্ধির আদান-প্রদানে যে কুশল ও কল্যাণ সম্ভব, মোসলমানেরা তাহা লইতে সম্পূর্ণ বিদূরিত রহিয়াছেন। কিন্তু যাহা সত্য তাহা নিউটনের সত্য, কোপার্নিকস বা আর্যভট্টের সত্য বা আবু আলি সিনার (আভিচেন্না) সত্য নহে, তাহাতে প্রত্যেক বিশ্ববাসীরই তুল্য অধিকার!

মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি মুসলমানদের ঔদাসীন্য দেখে রেয়াজ অল দিন যে কতদূর মর্মাহত হয়েছিলেন এবং কী অকুণ্ঠ ভাষায় তার প্রকাশ দিয়েছিলেন নিম্নে তার উদাহরণ দিই;–

যাহারা এসলাম গ্রহণ পূর্বক মোসলমান নামে বিখ্যাত হয়েন, তাঁহাদের গভীর প্রেম, স্বপ্ন, স্নেহ ও স্বদেশবাৎসল্য সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হইয়া যায়, কেবল তৎসমুদায়ের স্থানে এক সামান্যরূপে সাম্প্রদায়িক সহানুভূতির সঞ্চার দৃষ্ট হয়। সুতরাং তাহাদের হস্ত সকলের বিরুদ্ধে এবং সকলের হস্ত তাঁহাদের বিরুদ্ধে সম্মুখিত হইয়াছে। মাতৃভূমি ও জন্মভূমি ঘটিত ভাষার প্রতি তাঁহাদের মমতাজ্ঞান নাই; প্রত্যুত তৎসমস্ত পরদেশ ও পরভাষা বলিয়া অবিরত উপেক্ষিত হইতেছে। তাহাদের স্বদেশও নিজ ভাষা বলিয়া অপর কোনও পৃথক বস্তু দৃষ্ট হয় না, অথবা তাহারা অখিল মোসলমান সমাজ ও ধর্মকে এক ভাষার অধীনে স্থাপন করিতে উদ্যত।

এই প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষকে অনায়াসে বাঙালি মুসলমানের রামমোহন বলা যেতে পারে। কিন্তু হায়, বাঙালি মুসলমান এঁকে তখন চিনতে পারেনি। আজ যদি বাঙলার মুসলমান এঁকে চিনতে পারে, তবে পুব বাঙলার একাডেমি আমাদের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য অন্তহীন প্রশংসা অর্জন করবেন।

দ্বিতীয় প্রবন্ধে পুব বাঙলার জনপ্রিয় মাসিক মাহেনও-এর সম্পাদক জনাব আবদুল কাদির, কবি মালিক মুহম্মদ জয়সীরপদুমাবৎ কাব্যের অনুবাদক পুব বাঙলার কবি সৈয়দ আলাওল ও তাঁর কাব্যের সঙ্গে আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।পদ্মাবতীর পুঁথি সংগ্রহ করা অতি কঠিন। লেখক এই প্রবন্ধের উদ্ধৃতি এতই পাণ্ডিত্য ও রসবোধের সঙ্গে করেছেন যে মূল পড়া না থাকলেও কাব্যখানির সঙ্গে যে পরিচয় হয় তা অকৃত্রিম ও বিকৃতিহীন। তবে লেখক যে আলাওলকেনিঃসন্দেহে ভারতচন্দ্র হইতেও শ্রেষ্ঠ কবি বলেছেন, সে সম্বন্ধে আমাদের মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ আছে। আশা করি কাদির সাহেব এ সম্বন্ধে দীর্ঘতর প্রবন্ধ লিখে আমাদের সন্দেহভঞ্জন করবেন।

অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী মীর মশাররফ হোসেনের কর্মজীবন ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে যে গভীর গবেষণাত্মক প্রবন্ধটি লিখেছেন তাতে বিষাদ সিন্ধুর অনুরাগীদের প্রভূত উপকার হবে সন্দেহ নেই। মশাররফ হোসেনকে বাঙালি এক বিষাদ-সিন্ধুর লেখক হিসেবেই চেনে; তার বহুমুখী প্রতিভার প্রচুর পরিচয় এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ থেকেই পাওয়া যায়।

সৈয়দ মোর্তাজা আলী সাহেব বাঙলা গদ্যের আদিযুগ সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে চারটি উদাহরণ দিয়েছেন। (১) ১৫৫৫ খ্রি. অহমরাজ চুকম্পাকে লেখা কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের চিঠি, (২) ১৬৪৭ খ্রি. শ্রীহট্টাঞ্চলে লেখা একটি হকিকত নামা, (৩) জয়ন্তিয়া বুরুঞ্জী থেকে উদ্ধৃত আসামরাজকে লেখা জয়ন্তিপুরের রাজার একখানা চিঠি ও (৪) মনোলদা-আসসুমের কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ থেকে। যে সমস্ত অঞ্চলের ভাষা থেকে তিনি উদাহরণ নিয়েছেন সেসব অঞ্চলের ঐতিহ্য ও বর্তমান প্রচলিত উপভাষাগুলোর সঙ্গে তিনি সুপরিচিত এবং তার হিসটরি অব জয়ন্তিয়া ওই ভূখণ্ড সম্বন্ধে ইংরেজিতে লিখিত একমাত্র গ্রন্থ (পাঠান-মোগল কেউই খাসিয়া পাহাড়ের সানুদেশে অবস্থিত জয়ন্তিয়া রাজত্ব অধিকার করতে পারেনি বলে এদেশে প্রাচীন হিন্দু পলিটির প্রচুর আবিষ্কৃত নিদর্শন পাওয়া যায়) ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের চর্চাকারীর পক্ষে অপরিত্যজ্য। অগ্রজের সাহিত্যচর্চার নিরপেক্ষ আলোচনা নন্দনশাস্ত্রসম্মত, কিন্তু সংস্কার বাধা দেয়।

পাবনার সাধক কবি জহীরউদ্দীনের জীবন ও গীত সম্বন্ধে লিখেছেন মৌলবি গোলাম সাকলায়েন ও শ্রীহট্টের কবি শাহ হুসেন আলম সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন মৌলবি নিজামউদ্দীন আহম্মদ।

ইরানের সুফি মতবাদ বাঙলা দেশে এদেশের নিজস্ব শ্রীরাধাকেন্দ্রিক বৈষ্ণব ভক্তিবাদের সঙ্গে মিলে যাওয়াতে এইসব মারিফতি (গুহ্য তত্ত্বাত্মক) গীতের সৃষ্টি জর্মন পণ্ডিত গড়ৎসিহার ও হর্টেনের বিশ্বাস ইরানে থাকাকালীনই সুফি মতবাদ বেদান্ত, যোগ ও নারদ শাণ্ডিল্যের ভক্তিবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল; ফরাসি পণ্ডিত মাসিনো অস্বীকার করেন কিন্তু ইরানি এবং আরব কবিদের ন্যায় এঁরা আপন জীবনকাহিনী তাদের সৃষ্টির ভিতর বুনে দিতেন না। আত্মগোপন করার ভারতীয় ঐতিহ্যই বরঞ্চ তারা স্বীকার করে নিয়েছিলেন কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন, চণ্ডীদাস কয় জাতীয় ভণিতা মুসলমানদের কাছ থেকে নেওয়া)। দুই প্রবন্ধের লেখকই যেটুকু খবর পাওয়া যায় তাই নিঙড়ে নিঙড়ে তাদের কাব্যসৃষ্টি থেকে বের করেছেন। এই ধরনের কাজের প্রতি একাডেমি যে বিশেষ মনোযোগ দেবেন সেকথা পূর্বেই বলেছি। ভালই, কারণ পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা যথেষ্ট আরবি-ফারসি জানেন না বলে মুকুন্দরাম-ভারতচন্দ্রের আরবি-ফারসি-ভর্তি অংশগুলোর টীকাটিপ্পনী কর্মটি পর্যন্ত এড়িয়ে যান– এ কাজ বিশেষ করে পূর্ব বাঙলাতেই ভালো হবে।

চৌধুরী শামসুর রহমান সায়েবেরআমাদের সাংবাদিক প্রচেষ্টা তথ্যবহুল প্রবন্ধ অশেষ পরিশ্রমের পরিপূর্ণ সাফল্য।

মধুরেণ সমাপয়েৎ করেছেন একাডেমির সুযোগ্য সম্পাদক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যের একমাত্র মুসলিম মহিলা কবিরহীমুননিসা প্রবন্ধ দিয়ে। ১৭৬৩-১৮০০-র মধ্যবর্তী কালের এই মহিলা কবি সরস স্বাভাবিক বাঙলায় যে কাব্যসৃষ্টি করে গিয়েছেন তার বিস্তৃত আলোচনা করেছেন হক সাহেব–ভবিষ্যতে আরও হবে সে আশা রাখি। উপস্থিত দু একটি উদাহরণ পেশ করছি। স্বামীর আদেশে তিনি সৈয়দ আলাওলেরপদ্মাবতী নকল করে দেন; সেই সম্পর্কে বলেন–

শুন গুণিগণ হই এক মন
লেখিকার নিবেদন।
অক্ষর পড়িলে
টুটাপদ হৈলে
শুধরিতা সর্বজন ॥
পদ এই রাষ্ট্র হেন মহাকষ্ট
পুঁথি সতী পদ্মাবতী।
 আলাওল মণি বুদ্ধি বলে গুণী
বিরচিল এ ভারতী ॥
 পদে উকতি বুঝি কি শকতি
মুই হীন তিরী জাতি।
 স্বামীর আদেশ মানিয়া বিশেষ
সাহস করিনু গাঁথি ॥

রহীমুন্নিসার পিতামহ ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চট্টগ্রামে অজ্ঞাতবাস বরণ করেন :

অগ্রগামী হৈয়া ইংরাজ যুদ্ধ দিল।
দৈবদশা ফিরিঙ্গীর বিজয় হইল ॥
 মুখ্য মুখ্য সবের বহুল রত্নধন।
লুটিয়া করিল খয় যত পাপিগণ ॥

পিতামহের মাতৃভাষা নিশ্চয়ই হয় ফারসি, নয় উর্দু ছিল। রহীমুন্নিসা কিন্তু খাঁটি বাঙালি। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন,

স্বামী আজ্ঞা শিরে পালি লিখি এ-ভারতী।
রহিমন্নিচা নাম জান, আদৌ ছিরীমতী।

অর্থাৎ তার নাম শ্রীমতী রহিমুন্নিসা।

শোকের কবিতায় এ মহিলার অসাধারণ সরল কবিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। সামান্য উদাহরণ দিলেও ভবিষ্যতে এর ভারতী আরও প্রকাশিত হবে এই আশা নিয়ে এ আলোচনা শেষ করি;

নয়া সন নয়া মাস ফিরে বারে বার।
মোর জাদু কাল ফিরি না আসিল আর ॥
আশ্বিনেতে খোয়াময় কান্দে তরুলতায়,
ভাই বলি কান্দি উভরায়।
আমার কান্দন শুনি বনে কান্দে করঙ্গিনী
জলে মাছ কান্দিয়া লুকায় ॥

একাডেমির ভার যোগ্য স্কন্ধে পড়েছে, এ বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহ নেই।

একাডেমির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমরা প্রশ্ন জিগ্যেস করব না। বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হলে তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ফ্যারাডেকে নাকি এক মহিলা এই প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি নাকি গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ম্যাডাম, নবজাত শিশুর ভবিষ্যৎ কী কে বলতে পারে!

উপস্থিত দেখতে পারছি শিশুটি বলিষ্ঠ, প্রাণবন্ত ও তার কৌতূহল অসীম। আমরা মুক্তকণ্ঠে বলি, শতং জীব, সহস্রং জীব।

.

রাষ্ট্র, ধর্ম ও সমাজ
(
বগুড়া কলেজের সাহিত্য-অধিবেশনের সভাপতিরূপে অভিভাষণ)

পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সভ্যতা এবং সমস্ত ধর্মমত ভৌগোলিক কারণে অল্পপরিসর নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের সভ্যতা এবং ধর্মমত গড়ে তুলেছে। কিন্তু যখনই সেই সভ্যতা এবং ধর্মমত নিজের গতি মুক্ত হয়ে বাইরে অন্যের সঙ্গে যোগস্থাপন করেছে তখনি তাদের মধ্যে দেশকাল, পাত্রভেদে একটু পরিবর্তন হয়েছে। আমার আজকের বক্তব্য ইসলাম সম্বন্ধে এবং ইসলাম ধর্ম প্রসঙ্গে আপনাদের আমার আগের কথাটা একটু চিন্তা করতে বলি। আমি নিজে মুসলমান, কাজেই এ বিষয়ে আমার স্বাভাবিক আগ্রহ থাকা ছাড়া আমি নানা দেশ ঘুরে এবং এ সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞানসঞ্চয় করে আমার নিজস্ব চিন্তাধারা আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করছি।

আজ বিজ্ঞানের কৃপায় দেশে-দেশের ভৌগোলিক ব্যবধান ঘুচেছে, কাজেই এক দেশ আর এক দেশকে, এক সভ্যতা আর এক সভ্যতাকে নিবিড় করে জানবার সুযোগ পাচ্ছে। এই আধুনিক যুগে সত্যিকারের ইসলামের সেবককে মানসিক জড়ত্ব ত্যাগ করে ইসলামের সঙ্গে অন্য প্রচলিত সব ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা করে তার আপেক্ষিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে– শুধু মৌলভি-মোল্লার অনুশাসন এবং ধর্মব্যাখ্যানের ওপর নির্ভর করলে চলবে না।

ইসলাম সম্বন্ধে আপনাদের বোধহয় একটা ধারণা আছে যে ইহাই একমাত্র ভগবান কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট একমাত্র সত্যধর্ম। কিন্তু সেটা সত্যি নয়– কেননা এর আগেও মুশা ও যিশুখ্রিস্টের নিকট ভগবানের প্রত্যাদেশ সত্যধর্মরূপে প্রকাশ হয়েছিল। এক বিষয়ে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে ইসলামের সাদৃশ্য আছে– আল্লাহ যুগে যুগে সত্যপুরুষ বা প্রফেটের মাধ্যমে সত্যবাণী প্রকাশ করেন, কাজেই ইসলামকে একেবারে আকস্মিক বলে ধরলে চলবে না– পূর্বোক্ত দুই ধর্মমতের পরিণতি হিসেবেই জানতে হবে এবং কোরানও এ সম্বন্ধে এই এক কথাই বলেন।

নতুন কোনও ধর্মপ্রচারের পশ্চাতে শুধু ধর্মের মহান বাণী ব্যতীত একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি না-থাকলে তার প্রতিষ্ঠা হওয়া শক্ত। যিশুখ্রিস্ট সুদখোর ইহুদি বণিক-সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মস্থানকে টাকার লেনদেনের স্থান দেখে তার প্রতিবাদ করেছিলেন– ধনীশোষিত জনসাধারণ তাঁকে সমর্থন করলেও স্বার্থহানিভীত ধনী ইহুদিরা তাঁকে রাজদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত করে তার প্রাণহানি করিয়েছিলেন। হজরত মুহম্মদের নতুন ধর্ম ইসলামের প্রচারের পশ্চাতেও এইপ্রকার একটা আর্থিক প্রোগ্রাম ছিল কি না ধনীদের আয়ের কিয়দংশ জাকাত অর্থাৎ গরিবদের দান করতে হবে। এতে হ্যাভ-নটরা আশ্বস্ত হলেওহ্যাভের দল আশঙ্কিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে আরম্ভ করল। একেশ্বরবাদ প্রচারে যারা বিশেষ বিচলিত হয়নি সেই কোরেশ-সম্প্রদায় তাঁকে মক্কা-ছাড়া করল! কাজেই ইসলামের এই সাম্যের ভিত্তিতে ধনবণ্টন নীতি যদি পালন না-করা হয়– redistribution of wealth দ্বারা যদি হ্যাভ-নটদের কোনও সুব্যবস্থা না হয়, তা হলে ইসলামের মূলনীতি মানা হবে না। সবাইকে ধনী-দরিদ্রকে সঙ্গে নিয়ে শুধু একসঙ্গে আহার এবং বাসের সুবিধা দিলেই Islamic democracy প্রতিষ্ঠিত হবে না। ইসলামের যে অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম আছে তাকেও কার্যকরী করে তোলবার জন্য প্রয়াস করতে হবে।

হজরত মুহম্মদ যখন মদিনা থেকে আবার মক্কায় ফিরে এলেন তখন মক্কাবাসীরা তাঁর ধর্মকে সাদরে গ্রহণ করল– কোনও রক্তপাতের দরকার হয়নি। সেটা শুধু তাঁর মহাপুরুষত্বের জন্য, না তিনি হ্যাভ-নটদের সহানুভূতি পেয়েছিলেন বলে? তার পর খলিফাঁদের আমলে পারস্যসাম্রাজ্য জয়ে ইসলামের এই অর্থবণ্টননীতি কার্যকরী হয়েছিল পারস্যের জনগণ করভারে নিষ্পিষ্ট হচ্ছিল এবং যখনই ইসলামের অর্থনৈতিক প্রোগ্রামের কথা ছড়িয়ে পড়ল তাদের মধ্যে তখনই তারা ইসলামকে সাদরে বরণ করে নিল– নইলে যে বিরাট পারস্যবাহিনী গ্রিকদের পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছিল তারা কেন ইসলামের কাছে পরাস্ত হবে! ইসলামের ধনসাম্যের Message বা বাণী তাদের জনগণের Morale একেবারে নষ্ট করে দিয়েছিল। এই ইসলামেয় বাণীই তুরস্ক, মিশর, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন জয়ে সাহায্য করেছে– সুদ্ধ অস্ত্রবল এবং নতুন ধর্মের বাণীতে হয়নি। ইসলামের আদিযুগের কাহিনী হচ্ছে এই।

তার পর যখন ইসলামের ক্ষমতা বিস্তৃত হল– দেশজয়ে যখন সম্পদে ইসলাম সাম্রাজ্য-সমৃদ্ধ হতে লাগল, তখন থেকে তারা হ্যাভ-নটদের কথা বিস্মৃত হতে লাগল এবং ইসলামের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে পতন আরম্ভ হল। ভারতে যখন মুসলমান এল তখন ইসলামের সেই Message আর নেই। কাজেই দেখি নবাব ওমরাহদের বংশধর ব্যতীত মধ্যভারতের কয়েকটি শহর অঞ্চল ছাড়া ইসলাম আর কোথাও প্রতিষ্ঠিত হল না। বাঙলায়ও মুসলমান ধর্মের প্রসার হত না যদি আরব থেকে প্রচারকরা ইসলামের মূল নীতির বাহক ও ধারক হয়ে এখানে প্রচারে অবতীর্ণ না হতেন।

এদিকে ভারতে ঢুকেও ইসলাম নিজের ধর্মমত সম্বন্ধে একপেশে হয়ে রইল। কারণ হিন্দুধর্মের ভগবান-সম্পর্কিত দিকটা বড় উদার– তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে যাকে যখন খুশি মেনে নিলেই হল– তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু খাওয়া-ছোওয়া বিবাহাদি ব্যাপারে সামাজিক অনুশাসন বেশ কড়া বিশেষ বিশেষ পন্থি এবং নিয়মকানুনের মধ্যে আবদ্ধ করা হয়েছে সেসব অমান্য করলেই জাত গেল। মুসলমানদের এ বিষয়ে ঠিক হিন্দুদের বিপরীত– ভগবানএকমেবাদ্বিতীয়ম এটা মানতেই হবে এবং এ সম্বন্ধে কোনও ভিন্নমত পোষণ করা একেবারেই চলবে না। আর সামাজিক ব্যাপারে অর্থাৎ আহারবিহারে একেবারে উদার। কাজেই হিন্দুধর্মের সঙ্গে কোনও Common Platform বা আপসক্ষেত্র পাওয়া গেল না, কাজেই মুসলমান হিন্দুর সঙ্গে সাত-আটশো বছর বাস করলেও হিন্দুর বিরাট দর্শনশাস্ত্র ইসলামে কোনও ছায়াপাত করতে পারল না।

এইভাবে হিন্দু এবং মুসলমান টোল এবং মাদ্রাসাতে মশগুল হয়ে রইল। ধর্মমতের মিল আর হয়ে উঠল না। কেউ কাউকে জানার জন্য বিশেষ চেষ্টাও করল না। ইংরেজ এসে কিন্তু মিরাকেল ঘটাল টোল-মাদ্রাসা ছেড়ে হিন্দু-মুসলমান এক বিদ্যায়তনে পড়াশুনা করতে লাগল– ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি ফারসির জায়গায় রাষ্ট্রভাষা হওয়াতে মুসলমান কিছুকাল মুখ ফিরিয়ে অভিমান করে বসেছিল হিন্দুরা আগেই এসেছে বলে শিক্ষায় মুসলমানরা একটু পেছিয়ে গেল। কিন্তু আজকের দিনে রাষ্ট্র দুটো হলেও দু রাষ্ট্রের মধ্যে সকল ধর্মের লোক আছে, কিন্তু তাতে শিক্ষার বা কালচারের অসুবিধা কেন হবে। হিন্দু-মুসলমানে কোনও কোনও বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গির একটা ঐক্য থাকতে পারে– সেখানে ধর্মের কোনও স্থান নেই। পারস্যের কালচার যেমন পারস্যভাষার সাহায্যে নতুন করে গড়ে উঠেছে– যদিও পারসি ভাষা আরবি অর্থাৎ পবিত্র কোরানের ভাষা নয়– একেবারে কাফেরের ভাষা। পারসি ভাষায় রুমি, জালালুদ্দিন, সাদি, হাফিজ সার্থক সাহিত্যের সৃষ্টি করলেন। ভারতের উর্দুভাষা কিন্তু আরবি-পারসি-হিন্দি মন্থন করে গড়ে ওঠেনি উর্দুর বিশিষ্ট লেখকদের মধ্যে তো ঢের হিন্দু রয়েছে। উত্তরভারত ও দাক্ষিণাত্যের বহু মন্দিরের গঠনশিল্প কি হিন্দু ও ইসলামের মিলিত কালচারের চিহ্ন বহন করছে না? গজনির সুলতান মামুদের সভাকবি আলবেরুনি এদেশে দীর্ঘকাল বাস করেছেন। শুধু এদেশের সভ্যতাকে জানবার জন্য এবং সেটার যেটুকু ভালো সেটুকু আহরণ করে নিজের দেশের সভ্যতার অঙ্গবৃদ্ধি করার জন্য। এই যে Power of assimilation বা পরের ভালোটুকু আত্মস্থ করে নেওয়ার ক্ষমতা সেটা একদিন ইসলামের ছিল– সেক্ষেত্রে সে ধর্মনিরপেক্ষভাবেই চলেছিল।

আজ পূর্ব পাকিস্তানের এই বিরাট জনসংখ্যাকে ইসলামের ঐতিহ্য মনে রাখতে হবে এবং সেই পরমতসহিষ্ণুতাকে সম্বল করে নিজের ধর্মমতকে আর একটু পরের সমালোচনার দ্বারা সহনশীল এবং তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্র করে অগ্রসর হতে হবে তা হলে জনসংখ্যায় এবং আয়তনে পারস্যাপেক্ষা বড় এই যে পূর্ব-বাঙলা, এ কি উন্নত হতে পারবে না? শুধু ধর্মের ঝুলির ওপর নিজস্ব বিচারবুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে একটা নতুন দেশের পত্তন করা যায় না। নতুন রাষ্ট্রকে নতুনরূপে দেখতে হলে ইসলামধর্ম ভালো করে জানতে হবে পড়তে হবে ইসলামের মূলনীতিগুলো যা সর্বদেশের এবং সর্বকালের জন্য। তা হলেই দেশ-স্বাধীন সত্যিকারের হবে। প্রাক-স্বাধীন যুগে ছিল ভাঙার কাজ– স্বাধীনোত্তর সময়ে হবে গড়ার কাজ। ভারত ডোমিনিয়নের কটা বন্দুক-কামান আছে এবং আমাদেরই-বা কটা আছে এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে দেশের কোনও উপকার হবে না। হিন্দুস্তান-পাকিস্তানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা নয় নিজের দেশের কিসে ভালো হবে, দেশের লোক কিসে পেটভরে খেতে এবং পরতে পারবে সেইসব শুভঙ্করী বুদ্ধিবৃত্তির দিকে আপনাদের উৎসাহ প্রয়োগ করতে হবে। যদি এই কথা মনে রাখেন, দেশের সেবাই আপনাদের উদ্দেশ্য তা হলে পাতঞ্জলের ভাষায় সেটাই হবে আপনাদের রাষ্ট্রের দৃঢ়ভিত্তি– তার ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে এর আর অধঃপতন নেই।

.

বৈদেশিকী

ইংরেজ রাজত্বে আমাদের মস্ত সুবিধা এই ছিল যে দেশ-বিদেশের খবর রাখার আমাদের কোনও দায় ছিল না। জর্মনির সঙ্গে লড়াই করার প্রয়োজন বোধ করলে ইংরেজ যে শুধু আমাদের জিজ্ঞাসা না করেই যুদ্ধ বাধাত তা নয়, আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে হতভাগা দেশকেও সে তার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলত। কোনও সরল ইংরেজ যদি তখন শুধাত যে ভারতবাসীর এ যুদ্ধে সায় আছে কি না, তখন লন্ডনের বড়কর্তারা অভিমানভরে বলতেন, এ বড় তাজ্জব প্রশ্ন! এ প্রশ্নে লুকানো রয়েছে আমাদের প্রতি অন্যায় সন্দেহ। খবর নাও, দেখতে পাবে ভারতবর্ষে আমরা কস্মিনকালেও জবরদস্তি-রঙুরুট (কনক্রিপশন) করিনি। ভারতের প্রত্যেকটি সেপাই আপন খুশ এক্তেয়ারে জর্মনির বিরুদ্ধে লড়ছে।

কাজেই এরকম উত্তর শুনে ভূ-ভারত ভাবত, ভারতীয় সৈন্য অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায়ের আদর্শবাদী বীরপুরুষ। তাঁরা যে উচ্চশিক্ষিত সে বিষয়ে আর কী সন্দেহ? তারা নিশ্চয়ই হিটলারের মাইন কাম, রজেনবের্গেরমিথ পড়েছেন, কন্সাট্রেশন ক্যাম্প সম্বন্ধে তারা ওকিব-হাল, নাৎসি দলের বর্বরতা সম্বন্ধে তারা বিলক্ষণ সচেতন এবং তাই তারা পৃথিবীতে সত্যসুন্দরমঙ্গল সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য জর্মনির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন।

তাই যদি হত তা হলে আমাদিগকে মেহন্নত করে এই বৈদেশিক পর্যায় আরম্ভ করতে হত না। আমরা জানি, ভারতবাসী আপন বিরাট দেশ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত, এমনকি তার জাতীয় সঙ্গীতে যে পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা-দ্রাবিড়ের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো সম্বন্ধেও তার জ্ঞান অত্যন্ত সীমাবদ্ধ।

কাউকে দোষ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। পরাধীনতার সবচেয়ে মারাত্মক অভিসম্পাত সপ্রকাশ হয় তার শিক্ষা-পদ্ধতিতে। আমরা এতদিন ধরে যে শিক্ষালাভ করেছি তার প্রধান উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আমরা দেশ-বিদেশ সম্বন্ধে জ্ঞানসঞ্চয় করে পৃথিবীতে আপন আসন বেছে নিই। আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাদিগকে আত্মবিস্মৃত জড়ভরত করে রাখার; তাতে ইংরেজের লাভ ছিল।

তাই আশ্চর্য বোধ হয় যখন বাঙালির ছেলে দেশ-বিদেশ সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করে। আনন্দ বোধহয় যে অশিক্ষা-কুশিক্ষা, দুঃখ-দৈন্যের ভিতরও তারা তাদের মনের জানালা ক খানা বন্ধ করে দেয়নি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা এখানে তুলব না– দেশ-বিদেশ ভ্রমণকারী বান্ধবদের মুখে শুনেছি যে, তারা বিদেশে কী শিক্ষা পেয়েছেন, সে সম্বন্ধে বাঙালি তরুণের যত না অনুসন্ধিৎসা তার চেয়ে অনেক বেশি তাদের কৌতূহল যে-দেশ তারা ভ্রমণ করে এসেছেন সে-দেশের নানা খবরাখবর শুনতে। বই পড়াতেও তাদের উৎসাহ কম নয়, আর খবরের কাগজ তো তারা পড়েই।

কিন্তু খবরের কাগজে তারা বিদেশি খবরের সন্ধান পায় কতটুকু?

আমি বাঙালি দৈনিক কাগজগুলোর কথা ভাবছি। সেগুলোতে বিদেশি খবর যেটুকু পরিবেশন করা হয় সে এতই নগণ্য যে তার ওপর নির্ভর করে যদি কোনও বাঙালি সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষায় বসে, তবে তার অনার্স বা সসম্মান ফেল অনিবার্য। বাঙলা দৈনিক পড়ে মনে হয়, বিদেশি খবর দেবার বরাত যেন ইংরেজি কাগজের, আবারদেশি ইংরেজি কাগজ পড়লে মনে হয় তারা যেন বরাত চাপিয়ে দিচ্ছেনস্টেটসম্যানের ঘাড়ে। বিদেশি খবর? ওগুলো দেবে বিদেশি কাগজ ওসব হচ্ছেস্টেটসম্যানের কর্ম। যেন বাঙালি কাগজ বাঙালি বিধবার শামিল। বিলিতি বেগুনের মতো বিলিতি খবর তার পক্ষে নিষিদ্ধ!

আর বিদেশি খবর যে-হোমিওপ্যাথিক মাত্রায় দেন সে-ও আবার সর্বপ্রকার টীকা-টিপ্পনী বিবর্জিত। ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সের মতো সুশিক্ষিত দেশের কাগজওলারা পর্যন্ত খবর রাখে যে সাধারণ পাঠক কতটুকু জানে না-জানে এবং সেই হিসেবে বিদেশি খবর পরিবেশন করার সময় প্রয়োজনীয় টীকা-টিপ্পনী দিতে কসুর করে না। শুধু তাই নয়, সম্পাদকীয় স্তম্ভে সে সম্বন্ধে দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখা হয়, রবিবারের কাগজে তার বিস্তৃত সচিত্র বিবরণ বেরোয় এবং যদি সমস্ত ব্যাপারটা দেশের সাধারণ লোকের মনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে তবে রাজনৈতিক কর্তাদের আসরে নেমে আপন আপন বক্তব্য খোলসা করে বলতে হয়। শেষ পর্যন্ত হয়তো প্রধানমন্ত্রীকেই বিবৃতি দিতে হয়। দেশের লোকেরা তখন অন্তত এইটুকু প্রত্যয় রাখে যে তাঁর বিবৃতি বিশেষজ্ঞের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর তৈরি করা হয়েছে। সে বিশেষজ্ঞ রাজদূত; যে-দেশ নিয়ে আন্দোলন আলোড়ন চলছে তিনি সে দেশে বসবাস করেন ও প্রতিদিন না হোক, প্রতি সপ্তাহের সে দেশ সম্বন্ধে একখানা গোপনীয় রিপোর্ট বা প্রতিবেদন পাঠান।

আমাদের পত্রিকাওলারা কোনওরকম মেহন্নত করতে নারাজ। পাঠক কী খবর চায় না-চায়, তাকে কী করে পৃথিবীর খবর সম্বন্ধে উৎসুক করে তোলা যায়, সে সম্বন্ধে তাঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন। বায়স্কোপওলারা যদি যথেষ্ট বিজ্ঞাপন দেয়, বড় বড় কোম্পানির নেকনজর থেকে যদি তারা বঞ্চিত না হন তবে কাগজ চলবেই– কেউ ঠেকাতে পারবে না। ভালো খবর পরিবেশন করার চেষ্টা দেখতে পাওয়া যায় একমাত্র নবজাত কাগজের মধ্যে। বাচ্চা হরিণের মতো তাঁরা ছুটোছুটি করেন ভালো খবরের সন্ধানে কিন্তু কাগজ চালু হয়ে যাওয়ার পর তারাও মেদস্ফীত হরিণের ন্যায় পাঁচতলা-গাছের ছায়ায় শুয়ে থাকাটাই জীবনের চরম মোক্ষ বলে ধরে নেন।

বক্ষ্যমাণ মাসিক এ সমস্ত অভাব ঘুচিয়ে দেবার স্পর্ধা বা দম্ভ করে না। তার যদি কোনও দম্ভ থাকে তবে সেটুকু মাত্র এই যে সে চেষ্টায় কসুর করবে না। এবং তার ভরসা যে একদিন যোগ্য পাত্র এসে আমাদের আরব্ধ কর্ম সুসম্পন্ন করে দেবেন।

দেশের অত্যন্ত কাছে, যে দেশকে বিদেশ বলা প্রায় ভুল, সেই দেশ নিয়ে আমাদের এ পর্যায় আরম্ভ হল।

.

আফগানি দাবি

একদা এক কান্দাহারি রাজকুমারী বহুশত যোজন অতিক্রম করে বরের সন্ধানে দিল্লিতে এসে উপস্থিত হন। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় কবি তখন ভূ-ভারত দাবড়ে বেড়াচ্ছিলেন– রাজকন্যার দিকে ভালো করে এক নজর তাকিয়ে বললেন, এ কন্যার নিদেনপক্ষে একশো বাচ্চা হবেই হবে। একশো বাচ্চা শুনে যেন আমরা আশ্চর্য না হই; কান্দাহারি পাঠান কুমারীর দৈর্ঘ্যপ্রস্থ দেখলে এরকম ভবিষ্যদ্বাণী সবাই করে থাকে– গান্ধারীকে দেখে হস্তিনাপুরের ব্যাস যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেটা ফলেছিল তো বটেই, এমনকি ছেলেগুলো ঠ্যাঙাবার জন্য একটা বোনও পেয়ে গিয়েছিল।

এ হল প্রায় চার হাজার বৎসরের কথা। কিন্তু আফগানিস্তান পাহাড়ি মুলুক, আইনকানুন জানে না, দলিল-দস্তাবেজের ধার ধারে না। সেদেশে কোনও দাবিদাওয়ার মেয়াদ ফুরোয় না, কোনও পাওয়া তামাদি হয় না-টাইমবার নামক বাঁধাবাঁধি আফগান ঐতিহ্যে কখনও ঠাই পায়নি। তাই আজ চার হাজার বৎসর পর আফগানিস্তান তার কান্দাহারি মেয়ের বিয়ের যৌতুক হিসেবে পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশ চেয়ে বসেছে।

এ খবর শুনতে পেয়ে পাকিস্তানিরা ঈষৎ উদ্বিগ্ন হয়েছে। ডমিনিয়নবাসীরা বক্রহাসি হেসে বলছেন, কয়রা পাকিস্তান, হও আলাদা। এইবারে ঠ্যালাটা সামলাও। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বলে হুঙ্কার দিতে না এককালে?– এইবার তাগড়া পাঠানদের সঙ্গে লড়ে বাঁচাও আপন জান আপন পাকিস্তান।

পাকিস্তানিদের মনে আবছা-আবছা ধারণা, আফগানিস্তানের ভাষা পশতু, আফগানরা জাতে পাঠান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বাসিন্দারাও পশতু বলে, তারাও জাতে পাঠান। অতএব আফগানিস্তানের দাবিটা হয়তো সম্পূর্ণ কাবুলি পাওনাদারের লাঠির জবরদস্তির ভয় দেখানো নয়।

এ ধারণা ভুল ইতিহাস পড়ার ফল।

আর্য অভিযান থেকে আরম্ভ করি। আর্যরা এদেশে এসেছিলেন আফগানিস্তান হয়ে। আজ যারা আফগান-পাঠান নামে পরিচিত তারা আমাদেরই এক অংশ। পশতু ভাষা আর্য ভাষা।

আফগানিস্তানের প্রাচীন ইতিহাস পাওয়া যায় আমাদের মহাভারত পুরাণে– আফগানিস্তানের নিজস্ব কোনও দলিল-দস্তাবেজ নেই। বহিক দেশ (ফারসি বখ), কাম্বোজ, বক্ষু নদী (Oxus = গ্রিক অক্ষুস) বিধৌত পার্বত্যভূমি আজ আফগানিস্তান নামে পরিচিত। আমাদের ইতিহাসে এসব অঞ্চলকে ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আজও কাবুলিওয়ালারা যে জাফরান ও হিও বলখ অঞ্চল থেকে এ দেশে নিয়ে আসে তার নাম সংস্কৃতেবাহিক।

পাকাপাকি ইতিহাস আরম্ভ হয় সিকন্দার সাহেব বিজয়-অভিযানের পর থেকে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বঙ্খ বাদে সমস্ত আফগানিস্তান গ্রিকদের কাছে কিনে নেন।

রাজা অশোক বৌদ্ধশ্রমণ মাধ্যন্তিককে পাঠান আফগানিস্তানে। আফগানরা অগ্নি-উপাসনা (সে উপাসনাও বৈদিক ধর্মের অংশবিশেষ ও জরথুস্ত্রি ধর্ম নামে পরিচিত) ছেড়ে দিয়ে খাস ভারতবর্ষীয় বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। আফগানিস্থানের পর্বতগাত্রে খোদিত বামিয়ানের বিরাট বৌদ্ধমূর্তিযুগল ভারতীয় শিল্পের নিদর্শন। গান্ধার শিল্পের যে ভাণ্ডার আফগানিস্তানে পাওয়া গিয়াছে তাও ভারতীয় ও গ্রিক শিল্পকলার সম্মেলনে তৈরি। এসব শিল্পকলাতে আফগানরা কোনও অংশ নেয়নি।

মৌর্য পতনের পর গ্রিকরা আফগানিস্তানে রাজত্ব করে। তারাও যে কতদূর ভারতীয় প্রভাবে পড়েছিল সেটা প্রমাণ হয় তাদের মুদ্রালাঞ্ছন থেকে। তাতে রয়েছে গ্রিক ও ভারতীয় ব্রাহ্মী লিপি– পশতুর কোনও সন্ধান নেই।

কনিষ্ক ভারত-আফগানিস্তানের রাজা ছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল পেশোয়ারে–কাবুলে নয়।

গুপ্তরা আফগানিস্তান দখল করেননি। কিন্তু গুপ্তযুগের পুনরুজ্জীবিত হিন্দুধর্ম আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্ধর্ষ পাঠানের পক্ষে তথাগতের অহিংসানীতি পালন করা যে সুকঠিন হয়ে উঠেছিল সে তত্ত্বটা সহজেই অনুমান করতে পারি।

সপ্তম শতাব্দীর চীনা পর্যটক হিউ এন সাঙ কাবুলে এসে দেখেন আফগানিস্তানবাসীদের অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক বৌদ্ধ। তিনি কান্দাহার, গজনি, কাবুল অঞ্চলকে ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন।

পাঠক যেন মনে না করেন যে ভারতবর্ষ যেসব যুগে আফগানিস্তানে রাজত্ব করেনি সেসব যুগে আফগানরা ভারতবর্ষে রাজত্ব করেছেন। আফগানরা লড়াই করতে জানে, কিন্তু শান্তি-স্থাপনার কর্ম অনেক কঠিন– আফগানের পেটে সে বিদ্যে নেই। আর শান্তি স্থাপন না করে রাজত্ব করা যায় কী প্রকারে?

তার পর আফগানিস্তান ও পশ্চিম ভারতবর্ষ মুসলমান হয়ে গেল। পাঠান রাজারা আফগানিস্তানে রাজত্ব করেননি সত্য কিন্তু দিল্লি ফরাসি সভ্যতার কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠল। কাবুলিরা শিক্ষাদীক্ষা অর্থাগমের জন্য ভারতবর্ষে আসতে লাগল। আলাউদ্দিন খিলজির সভাকবি আমির খুসরৌ ফারসিতে যেইশকিয়া নামক কাব্য লিখেছেন তাতেদেব-দেবীর প্রেমের কাহিনী বর্ণিত আছে। কত শত বৎসর হতে চলল আজও কাবুল শহরে জনপ্রিয় কবি ভারতীয় আমির খুসরৌ। কোনও আফগান কবির নাম তো কেউ কখনও এদেশে শোনেনি।

বাবুর আফগান নন। তার আত্মজীবনীতে তিনি কান্দাহার, গজনি, কাবুলকে ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে ধরেছেন ও এসব জায়গার প্রতি তার যতই দরদ থাকুক না কেন, তিনি রাজধানী বসিয়েছিলেন দিল্লিতে। তাঁর পৌত্র জালালউদ্দিন আকবর জালালাবাদ শহরের নতুন ভিত্তি নির্মাণ করে শহরকে আপন নাম দিলেন। তাঁর পৌত্র শাহজাহান কাবুলে বাবুরের কবরের কাছে যে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন তামাম কাবুল শহরে সেই একমাত্র দ্রষ্টব্য স্থপতি। (বাবুর কান্দাহার, গজনি, কাবুল অঞ্চলকে তাঁর আত্মজীবনীতে ভারতের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন)।

কিন্তু এসব তথ্যের চেয়ে বড় তত্ত্বকথা এই যে, আফগানরা এককালে ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ভারতীয় শিল্পকলা গ্রহণ করেছিল; পাঠান-মুঘল যুগে দিল্লিতে এসে আরবি-ফারসি শিখত। ১৭৪৭ সালে আহম্মদ শাহ দুররানি কর্তৃক আফগানিস্তানে স্বাধীন রাজত্ব (আফগানিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম স্বাধীন রাজ্য) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও, এবং আজ পর্যন্ত আফগানরা আরবি-ফারসি এবং ধর্ম শিক্ষার জন্য আসে ভারতবর্ষের দেওবন্দ-রামপুরে। তারা পারস্যে যায় না, কারণ পারস্যবাসীরা শিয়া। শিক্ষাদীক্ষায় আফগানিস্তান যে ভারতবর্ষের কাছে কী পরিমাণ ঋণী তার সামান্যতম উদাহরণ এই যে, ভারতবর্ষের কোথাও ফারসি মাতৃভাষারূপে প্রচলিত নয়, কাবুলবাসীদের মাতৃভাষা ফারসি এবং কাবুলিরা আসে ফারসি শিখতে ভারতবর্ষে। দেওবন্দ-রামপুরে ফারসি শেখাবার জন্য যেরকম বিদ্যালয় আছে, আফগানিস্তানের কোথাও সেরকম নেই।

শুধু ইসলাম শাস্ত্র চর্চার জন্য যে আফগান এদেশে আসে তা নয়, বিস্তর ভারতীয় অধ্যাপক, শিক্ষক কাবুল-জালালাবাদের স্কুল-কলেজে শিক্ষাদান করেছেন। আজ যদি এরা সব চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন তবে আফগানিস্তানেরওজারত-ই-ম আরিফ (শিক্ষা দফতর) চোখে নরগিস ফুল দেখবেন। পক্ষান্তরে আজ যদি সব কাবুলিওলা এদেশ থেকে চলে যায় তবে বহু কলের মজুর মৌলা আলিতে শিরনি চড়াবে।

এসব তো হল প্রাচীন অর্বাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-বৈদগ্ধ্যের কথা। তার সব দলিল যে সবাই মেনে নেবেন সে আশা দুরাশা। কারণ শিক্ষা-দীক্ষার জগতে আজকের দিনে সবচেয়ে বড় কালোবাজার চলছে ইতিহাস-পট্টিতে। হিটলার থেকে আরম্ভ করে ট্রম্যান পর্যন্ত সে বাজারে এক্স-দিল্ দামের সাত ডবল দাম চায়! সাদা বাজারের সসেজ-খেকো, ভুড়িওলা জর্মন সেখানে নর্ডিক-হিরো, ট্রম্যান-পট্টিতে সুদখোর ইহুদি প্রিয়দর্শী অশোকের ন্যায় (প্যালেস্টাইনে) ধর্মপ্রচারাকাক্ষী শ্ৰমণ!

কাজেই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েই আলোচনা হোক। আফগানদের যুক্তি যদি ভাষা ও জাতীয়তার (racial) ঐক্যের ওপর খাড়া হয় তবে আফগানিস্তানের প্রথম কর্তব্য হবে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল রুশিয়াকে (অর্থাৎ উজবেগিস্তান তুর্কিস্থান) ছেড়ে দেওয়া; কারণ এ অঞ্চলের লোক জাতে এবং ভাষায় তুর্কোমান মোঙ্গল, উজবেগ।

দ্বিতীয় কর্তব্য হবে আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল ইরানকে ছেড়ে দেওয়া; কারণ এ অঞ্চলের লোক জাতে এবং ভাষায় ইরানি।

অথবা উচিত রুশকে দাবি জানানো; রুশরা যেন তাদের উজবেগিস্তান ও তুর্কিস্থান আফগানিস্তানের হাতে সঁপে দেয় এবং ইরানকে বলা যেন তাবত ইরানভূমি আফগানিস্তানের অংশীভূত হয়ে যায়।

এ দাবিটা যে কতদূর বেহেড তার একটা তুলনা দিই। সুইস জাতি গড়ে উঠেছে তার পশ্চিম অঞ্চলের ফরাসি, উত্তর অঞ্চলের জর্মন ও পূর্ব অঞ্চলের ইতালীয়কে নিয়ে। এই তিন অঞ্চল আবার শব্দার্থে অঞ্চল, কারণ এরা সবাই মূল শাড়ি ফ্রান্স, জর্মনি এবং ইতালির প্রান্ত থেকে খসে পড়ে সুইজারল্যান্ডে লুটোচ্ছে। আজ যদি সুইজারল্যান্ড খেপে গিয়ে ফ্রান্স, জর্মনি এবং ইতালিকে সুইস রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য দাবি জানায় তবেই তার তুলনা হবে আফগান দাবির সঙ্গে।

কিন্তু যদিও এ দাবি শুধু পাগলা-গারদেই নির্ভয়ে করা চলে তবু এ ধরনের দাবি আমাদের সম্পূর্ণ অজানা নয়। কাবুলিওলাদের সুদের দাবি যে অনেক সময় আসলের বিশগুণ হয়ে দাঁড়ায় সে অনেক মজুরই জানে।

পশতুভাষী উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত তো কস্মিনকালেও আফগানিস্তানের অংশরূপে পরিচিত হয়নি, বরঞ্চ কান্দাহার– গজনি কাবুল জালালাবাদ অঞ্চল (এবং এই অঞ্চলই খাস আফগানিস্তান– এই অঞ্চলের লোকই পশতু বলে এবংপাঠান নামে পরিচিত– পূর্বেই বলেছি বাদবাকি অঞ্চল ইরান ও সোভিয়েট তুকমানিস্তানও উজবেগিস্তানের অংশরূপে পরিচিত) ভারতবর্ষের অংশ, অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল থেকে কেটে নিয়ে আফগানিস্তানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন এই, খেয়ালি দাবির হাওয়া বইয়ে কাবুলি পাগলকে জাগাল কে?

রুশ।

ফরাসিতে প্রবাদবাক্য আছে, প্য সা শাজ, প্ল সে লা মেম্ শোজ, অর্থাৎ যতই সে বদলায় ততই তার চেহারা বেশি করে আগের মতো দেখায়। স্তালিনি গুণীরা যতই তাদের বৈদেশিক নীতি বদলাতে চান ততই তাদের চেহারা জারের চেহারার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। রক্ত-শোষক জার ও প্রলেতারিয়ার রক্ষক স্তালিনের বৈদেশিক নীতিতে আজ আর কোনও পার্থক্য নেই। বাংলা সাহিত্য পাটনির বরাতজোরে দুধে-ভাতে বেঁচে ওঠা সন্তান। কিন্তু এই উপযুক্ত সঙিন বৈদেশিক নীতি তার ছাপ এই মোলায়েম সাহিত্যের ওপরও রেখে গিয়েছে;

বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনও এক সময়ে ইংরেজ গভর্নমেন্টের চিরন্তন জুজু রাশিয়া কর্তৃক ভারত আক্রমণের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিল। কোনও হিতৈষিণী আত্মীয়া আমার মায়ের কাছে সেই আসন্ন বিপ্লবের সম্ভাবনাকে মনের সাধে পল্লবিত করিয়া বলিয়াছিলেন। পিতা তখন (ইং ১৮৬৮ মে- ১৮৭০ ডিসেম্বর) পাহাড়ে ছিলেন। তিব্বত ভেদ করিয়া হিমালয়ের কোন একটা ছিদ্রপথ দিয়া (আসলে আফগানিস্তান দিয়ে –লেখক) যে রুশীয়েরা সহসা ধূমকেতুর মতো প্রকাশ পাইবে তাহা তো বলা যায় না। এইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাহার এই উল্কণ্ঠার সমর্থন করেন নাই। মা সেই কারণে পরিণত-বয়স্ক দলের সহায়তা লাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালককে আশ্রয় করিলেন। আমাকে বলিলেন, রাশিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখ তো৷ মাতার-উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না। দফতরখানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হইলাম। পাঠ যথাবিহিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু ভাষাটাতে জমিদারি সেরেস্তার সরস্বতী যে জীর্ণ কাগজের শুষ্ক পদ্মদলে বিহার করেন তাহারই গন্ধ মাখানো ছিল। এই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম। তাতে পিতা লিখিয়াছিলেন– ভয় করিবার কোনও কারণ নাই, রাশিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন। এই প্রবল আশ্বাসবাণীতেও মাতার রাশিয়ান-ভীতি দূর হইল বলিয়া বোধ হইল না কিন্তু পিতার সম্বন্ধে আমার সাহস খুব বাড়িয়া উঠিল। (রবীন্দ্র-রচনাবলী, ১৭ খণ্ড, ৩০৫ পূ.)।

যে জুজুর ভয়ের উল্লেখ করে কবিগুরু কাহিনীটি বলেন, আফগানিস্তান আজ সেই জুজুর ভয়ই দেখাচ্ছে। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে রুশ তখন যে ভয় দেখাত আজ সেটা প্রকাশ পাচ্ছে আফগানিস্তানের মুখভেংচিতে। এবং সঙ্গে সঙ্গে এ সত্যও জানি যে রুশ যেমন অন্তরে অন্তরে বুঝত যে আফগানিস্তান শেষ পর্যন্ত ভারত আক্রমণ করতে কখনও রাজি হবে না, আজও তেমনি আফগানিস্তান যত ভেংচিই কাটুক না কেন, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধং দেহি বলে আসরে নামবে না। দোস্ত মুহম্মদ, আব্দুর রহমান, হবিবউল্লাকে রাশা বিস্তর তোয়াজ করেছে ভারত আক্রমণের জন্য। শেষ পর্যন্ত এ-দোহাই পর্যন্ত পেড়েছে যে মুসলিম আফগানের উচিত ভারতীয় মুসলিমকে কাফির ইংরেজের অত্যাচার থেকে মুক্ত করা, কিন্তু কাবুল নদীর জলে কোনও দিব্য-দিলাশার হাল কোনওদিনই কোনও পানি পায়নি। কারণ দোস্ত, রহমান, হবিব তিনজনাই জানতেন, ভারত আক্রমণ করেছ কি সঙ্গে সঙ্গে রুশ ককরে আফগানিস্তানটি গিলে ফেলবে। হিটলারের বহুপূর্বেই কাবুলি গুণীরা জানতেন যে একসঙ্গে দুই অঙ্গনে নাচা-কুঁদা যায় না।

অধম ঝাড়া দুটি বৎসর কাবুলে ছিল। কাবুল এমনি নীরস নিরানন্দ পুরী যে সেখানে বেঁচে থাকতে হলে রাজনৈতিক দাবাখেলায় মনোযোগ করা ছাড়া অন্য কোনও পন্থা নেই। আফগানিস্তানের সৈন্যবল, অস্ত্রবল আমাদের যাত্রার দলের ভীমসেনের গদার মতো– ফাঁপা এবং কাঁকরে ভর্তি। শব্দ করে প্রচুর।

আফগানিস্তানের আসল জোর তার পার্বত্যভূমি, তার গিরিসঙ্কটে। তাই দিয়ে সে আত্মরক্ষা করে আর আপন স্বাধীনতা বজায় রাখে। কিন্তু আফগানিস্তান ভারত আক্রমণ করলে তো আর পার্বত্যভূমি, গিরিসঙ্কট আপন কাঁধে করে নিয়ে এসে ভিন্ন দেশে কাজে লাগাতে পারবে না।

কিন্তু এসব হল পাকিস্তান এবং ডমিনিয়নের বৈদেশিক রাষ্ট্রনীতি। সে আলোচনা আর একদিন হবে। এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল, আফগানিস্তানের অন্তঃসারশূন্য দাবি নিয়ে আলোচনা করার।

সর্বশেষে বক্তব্য, পাকিস্তান যদি আফগানিস্তানকে নিয়ে কোনওদিন সত্যই বিপদগ্রস্ত হয় তবে ডমিনিয়নের তাতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ শুধু পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশ নয়, ভারতেরও বটে।

সুদিনে দুর্দিনে জর্মনি

চীনের সঙ্গে যে আমাদের হৃদ্যতা আছে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এত প্রাচীন, বিরাট, বিপুল দেশ যে একদিন আমাদের রাজাধিরাজ চক্রবর্তী বুদ্ধ তথাগতের দর্শনলাভ না করেও তার পদানত হয়েছিল সেকথা ভাবতে আমাদের হৃদয়ে গৌরবের সঞ্চার হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিক থেকে সেদিন পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক জাত্যাভিমানকে যখনই ইংরেজ অবমানিত করেছে তখনই আমরা আমাদের অধমর্ণ চীনের কথা ভেবে সান্ত্বনা পেয়েছি।

আরেকটি দেশ সে দুর্দিনে আমাদের আত্মপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। সে দেশ জর্মনি। কবিগুরু গ্যোটে শকুন্তলার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে, শোপেনহাওয়ার উপনিষদের প্রশস্তি গেয়ে জর্মনির বিদ্বজ্জনের দৃষ্টি ভারতবর্ষের প্রতি আকর্ষণ করেন। ফলে জর্মন পণ্ডিতরা সংস্কৃত ও পালি নিয়ে যে গবেষণা আরম্ভ করেন সে মণিমঞ্জুষার দশমাংশের সঙ্গেও আমরা এখনও পরিচিত হইনি। ভারতীয় বৈদগ্ধ্যানুরাগী কিন্তু জানেন, আচার্য মোক্ষমূলর আর্যাভিযানের বিজয়রথ কী করে জাহ্নবীর ন্যায় অনুসরণ করেছেন, ইয়াকবি জৈনধর্মের লুপ্তপ্রায় গৌরব উতঙ্কের ন্যায় পুনরুদ্ধার করলেন, তাঁর শিষ্য কিফেল অগাধ পুরাণশাস্ত্রে নিমজ্জিত হয়ে মৎস্যাবতারের মতো বিরাট পুস্তকইন্ডিশে কলগনি মস্তকে তুলে ধরলেন, গেন্ডনার গণপতির ন্যায় ঋগ্বেদ জর্মন ভাষায় অনুলিখন করলেন, উইনটারনিৎস সর্বশেষে সঞ্জয়ের ন্যায় ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস ভারতবর্ষ সম্বন্ধে অজ্ঞ অন্ধ পৃথিবীকে সামসঙ্গীত উদাত্ত কণ্ঠে শুনিয়ে দিলেন।

মৃচ্ছকটিকর জর্মন অনুবাদ অন্ততপক্ষে সাতজন লেখক করে গিয়েছেন, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ওপর থিসিস লিখে কজন জর্মন, অজর্মন ডক্টরত্ব পেয়েছেন সে সম্বন্ধেও একখানা থিসিস লেখা যায়।

জর্মন ঔপন্যাসিক টেয়োডোর স্টর্মের ইমেজে পুস্তকের গোড়ার দিকে একপাল ছেলেমেয়ে ছোট্ট একখানা গাড়ি বানিয়ে তার মধ্যে গুটিকয়েক বসেছে, বাদবাকিরা গাড়ি টানছে, আর সবাই চেঁচিয়ে বলছে;–

নাখ ইন্ডিয়েন্, নাখ ইন্ডিয়েন!

অর্থাৎ

ভারত চল, ভারত চল!

পিরামিডের দেশ মিশর রইল, ড্রাগনের দেশ চীন রইল, আরব্যোপন্যাসের বাগদাদ রইল, ছেলেগুলোর মন কেন ভারতবর্ষেরই দিকে ধাওয়া করল কে জানে? তবু যদি শকটটি মাটির গড়া হত তবু বুঝতুম, কারণ মৃচ্ছকটিকার দেশ ভারতবর্ষ। তবে হ্যাঁ, হয়তো শকটটি ক্ষুদ্র ছিল বলে সে হীনযানকে শরণ করে তারা তথাগতের দেশে পৌঁছতে চেয়েছিল। কিন্তু শঙ্করাচার্য বলেছেন বালকেরা ক্রীড়া করে এবং বৃদ্ধেরা চিন্তা করেন। শকটিকাতত্ত্ব আবিষ্কার করবেন বৃদ্ধেরা চিন্তা করে, বালকের মধ্যে যদি কোনও আবিষ্কার-শক্তির সন্ধান পাওয়া যায় তবে সে জিনিস নিশ্চয়ই কল্পনাপ্রসূত।

এবং ভারতবর্ষ সম্বন্ধে জর্মনদের শিশু এবং কবি মনের কল্পনা যে নৈসর্গিকতার বেড়া কতবার ভেঙেছে তার লেখাজোখা নেই। হাইনরিশ হাইনে যে শুধু সুকবি ছিলেন তা নয়, সুপণ্ডিতও ছিলেন। তিনি পর্যন্ত বলেছেন

কী অপূর্ব দৃশ্য!

শ্যামাঙ্গী সুন্দরী গঙ্গাতটে নতজানু হয়ে গঙ্গাজলে প্রস্ফুটিত শ্বেতপদ্মের উপাসনা করছে।

পদ্মপূজা! সে পদ্মও ফুটেছেন গঙ্গাস্রোতে! একেই বলে কল্পনা।

ওদিকে ভারতবর্ষও জর্মনিকে প্রচুর সম্মান দেখিয়েছে। আমরা জৰ্মনিকে যে সম্মান জানিয়েছি তার বেশি দেখানো আমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম মহাপুরুষ মহাত্মা গান্ধী যখন রৌন্ড-টেবিল কনফারেন্সে যোগদান করতে বিলেত যান তখন বহু সাংবাদিক মহাত্মাজিকে এদেশ-ওদেশ বহুদেশ দেখে যাবার জন্য অনুরোধ জানান। মহাত্মাজি বলেন যে, একমাত্র গ্যোটের বাইমার দেখবার তার বহুদিনের ঐকান্তিক ইচ্ছা।

শুনে জর্মনি যে আনন্দধ্বনি করেছিল তার প্রতিধ্বনি জর্মন বেতারে বেতারে বহুদিন ধরে শোনা গিয়েছিল। জর্মনির বড়কর্তারা তৎক্ষণাৎ দূত পাঠিয়ে মহাত্মাজিকে ষোড়শোপচারে আমন্ত্রণ করেন; হামবুর্গ বেতারকেন্দ্র মহাত্মাজিকে বেতারে যৎকিঞ্চিৎ বলার জন্য তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়ে যায় এবং আর সব বেতারকেন্দ্রের ঈর্ষা তখন যেমন যেমন বিকট হতে বিকটতর রূপ নিতে লাগল, হামবুর্গ বেতারকেন্দ্রের ঢক্কানিনাদ সেই অনুপাতে জর্মনির কর্ণপটহ ছিঁড়ে ফেলবার উপক্রম করল। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, যেদিন হামবুর্গ বেতারকেন্দ্র প্রথম খবর দিল যে মহাত্মাজি বেতারযন্ত্রের সামনে উপস্থিত হতে স্বীকৃত হয়েছেন তখন প্রচারকের (এনাউন্সরের) কণ্ঠে কী গদগদ ভাব, চোখের সামনে যেন স্পষ্ট দেখতে পেলুম লোকটা আনন্দে গলে পড়ছে আর সখী, আমায় ধরো ধরো বলে ঢলে পড়ছে, রেডিয়োর আর পাঁচজন তাকে চতুর্দিক থেকে ঠেকো দিয়ে কোনওগতিকে খাড়া করে রেখেছে।

তার পর যেদিন দুঃসংবাদ দেবার কাললগ্ন এল যে মহাত্মাজি কনফারেন্সে বিফলমনোরথ হয়েছেন বলে বাইমার আসবেন না তখন সে প্রচারকের আর সন্ধান নেই। যে দেবদূত মা-মেরিকে যিশুর শুভাগমনের সুসমাচার দিয়েছিলেন তিনি এবং সঞ্জয় কী করে এক ব্যক্তি হতে পারেন?

ভেবেছিলুম অন্যান্য বেতারকেন্দ্র হামবুর্গের কান কাটাতে বগল বাজাবে কিন্তু তার পরিবর্তে শোনা গেল কেন্দ্রে কেন্দ্রে দরদী গলা এবং সবাই মিলে একজোটে কনফারেন্সের বড়কর্তা ইংরেজের পিঠে মারল কিল।

মহাত্মাজি যে বাইমার যেতে পারেননি সেকথাটা বড় নয়। আসল কথা হচ্ছে, ভারতবর্ষের মহত্তম আদর্শবাদের প্রতীক মহাত্মাজি লন্ডন বসে ব্যঞ্জনায় বলেছিলেন, ইউরোপে যদি দেখবার মতো কিছু থাকে তবে সে হচ্ছে গ্যোটের বাইমার।

***

পরশুদিন চিঠি পেলুম জর্মন সতীর্থ পাউল হারের (Paul Harster) কাছ থেকে। জর্মনির এখন যা দুরবস্থা এবং ভারতবর্ষের মাথায় এখন যা কাজের চাপ তার মাঝখানে জর্মনির সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র ক্ষীণ হয়ে গিয়ে ঠেকেছে জর্মনির পাউল এবং ভারতের অখ্যাতনামা লেখকের সঙ্গে।

পাউল চিঠি আরম্ভ করেছে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভে আনন্দ প্রকাশ করে। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত আমরা দুজনে রাইনের পারে, ভিনাস পাহাড়ের (ভেনুস-বের্গ) উপরে, বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়, কাফের ধুয়োর মাঝখানে কখনও উচ্চস্বরে, কখনও নীরবে, কখনও পত্রবিনিময়ে ভারতবর্ষের ভাবী স্বাধীনতা লাভের সুখস্বপ্ন গড়েছি। আমি বলতাম, ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার পূর্বেই আমি মরব। পাউল বাঁকা হাসি হেসে বলত, আগাছা সহজে মরে না, কাটাতে পোকা ধরে না; স্বরাজ না দেখার পূর্বে তোমার মতো কাটা শুকিয়ে ঝরে পড়বে না।

আজ ভারতবর্ষ স্বাধীন, কিন্তু জর্মনি পরাধীন। সে পরাধীনতার চরমে পৌঁছেছিল গেল শীতে। অনাহারে পাউলের দুই শিশুকন্যার যক্ষ্মা হয়, তার স্ত্রী মৃত সন্তান প্রসব করেন। ছাত-চোয়ানো হিমজলে ভিজে পাউলের নিউমনিয়া হয়; ভুগুন্তি কপালে এখনও অনেক বাকি আছে বলে পাউল এখনও পটল বা কপি কিছুই তুলতে পারেনি।

পাউল লিখেছে;

সুসংবাদ দিয়ে চিঠি আরম্ভ করি। আহারাদির বন্দোবস্ত আগের চেয়ে অল্প ভালো হয়েছে। তার কারণ কিন্তু এই নয় যে, মিত্রশক্তি আমাদের দুর্দশা দেখে বিগলিত করুণায় আমাদের ভিক্ষা দিতে রাজি হয়েছেন। খুব সম্ভব তুমি জানো যে মিত্রশক্তিরা লড়াই জেতার পর স্থির করেছিলেন যে, ১৯৫১ পর্যন্ত অর্থাৎ লড়াইয়ের যে ছ বছর আমরা তাদের ভুগিয়েছি, ঠিক সেই পরিমাণ –আমাদের না খাইয়ে মারবেন। কিন্তু কর্তাদের মত বদলে গিয়েছে, এবং তার কারণ–

১. আমাদের কলকারখানা যদি আগুন নিবিয়ে বসে থাকে তবে হলান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, গ্রিস আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে না এবং তা হলে তাদেরও আমাদেরি মতো দুরবস্থা হবে। হলান্ড তো গেল বৎসরও তার শাকসজি বিনে পয়সায় দিতে রাজি ছিল, কিন্তু ইংরেজ এতদিন অনুমতি দেয়নি (এক বত্সর পরে আজ এই পয়লা তরকারি খেলুম)।

হলান্ড-ডেনমার্ক ইত্যাদি দেশের দুরবস্থা যেন জনির মতো না হয় সে দুশ্চিন্তা ইংরেজের মাথায় কেন ঢুকল সেকথা পাউল লেখেনি। অনুমান করি, মার্শাল প্ল্যান চালু করে রুশকে ঠেকাবার জন্য এসব দেশের ধনদৌলত বাড়ানো ইংরেজ ও আমেরিকার পক্ষে অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২.বেভিন সায়েব বিপদগ্রস্ত হয়েছেন : আমরা যদি মাল-সরঞ্জাম তৈরি এবং রপ্তানি না করি, তবে আমাদের অন্য কোনও উপার্জন নেই। ইংরেজ জনসাধারণকে তা হলে গাঁটের পয়সা খরচ করে আমাদের খাওয়াতে পরাতে হবে। আর যদি ইংরেজ আমাদের কলকারখানা চালু করতে দেয় তা হলেও বিপদ– আমাদের দুরবস্থা চরমে পৌঁছে যাওয়ার দরুন আমাদের খাইখর্চা এত তলায় এসে ঠেকেছে যে, আমাদের মাল তৈরি হবে অত্যন্ত সস্তাদরে–জাপান যেরকম একদা অত্যন্ত সস্তা মাল তৈরি করতে পারত– এবং সে সস্তা মাল ইংরেজের রপ্তানি-মালের দাম কমিয়ে দেবে। শেষটায় ইংরেজ ইউরোপে আর কিছুই বিক্রি করতে পারবে না।

ইংরেজ যদি কোনওটাতেই রাজি না হয় তা হলে কী হবে সেকথাটা পাউল লেখেনি। বিবেচনা করি, না খেতে পেলে জর্মনরা হন্যে হয়ে সবাই কম্যুনিস্ট হয়ে যাবে এবং তাই রুশ ভালুককে ঠেকাবার জন্য ইংরেজ জর্মনিকে বাঘের দুধ খাওয়াতেও রাজি আছে।

৩. আমেরিকার সমস্যা, হয় মার্কিন কলকারখানা পুরোদমে চালু রেখে পশ্চিম ইউরোপকে কলকজা, মালপত্র দাও– কিন্তু ভুলো না, বিনি পয়সায় নয় রপ্তানি একদম বন্ধ করে দাও, কিন্তু ভুলো না, তা হলে রপ্তানি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন কলকারখানাও বন্ধ হয়ে যাবে এবং বেকার সমস্যা বাড়বে।

পাউল লেখেনি, কিন্তু বিবেচনা করি, আমেরিকা বাইরের শত্রু রুশের চেয়েও ভেতরের শত্রু বেকার সমস্যাকে ভয় করে বেশি।

এদিকে আমেরিকা পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপে যাতে ক্যুনিজম না ঢুকতে পারে তার জন্য ধনপ্রাণ সব দিতে প্রস্তুত। এই তো সেদিন মার্কিন যখন দেখল ইতালির লোক ভোট দিয়ে হয়তো ক্যুনিজম ডেকে আনবে, সেদিনই সে বড় বড় জাহাজ ভর্তি খানাদানা ইটালিতে পাঠাতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিনরা আমাদের খবর পাঠাল যে আমাদেরও রেশন বাড়িয়ে দেবে।

ওদিকে রুশ রেশন বাড়াচ্ছেন জর্মনির আপন এলাকায়। এদিকে মার্কিন রুশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আপন অধিকৃত জর্মন অঞ্চলেও রেশন বাড়াচ্ছেন। এত দুঃখেও আমার হাসি পায়, এই নিলামের ডাকাডাকির দস্তুর দেখে।

শুধু পাউলের নয়, আমাদেরও হাসি পায়। দু দিন আগে যে জর্মনিকে মার্কিন রুশ দু দিক থেকে পাইকারি কিল মেরে ধরাশায়ী করেছিলেন, আজ তাকে চাঙ্গা করে তোলবার জন্য গলায় ঢালছেন ব্রান্ডি, অন্যজন নাকে ধরেছেন স্মেলিঙ-সন্টের শিশি! শুধু কি তাই, গ্যোবেল সাহেব মরার পূর্বে যে একখানা সাত-পৌন্ডি টাইম-বম্ রেখে গিয়েছিলেন সেখানা কানে তালা লাগিয়ে ফেটেছে। গ্যোবে মার্কিন-ইংরেজের উদ্দেশে বলেছিলেন, আমাদের যে তোমরা বিনাশ করছ, তার জন্য তোমরা একদিন আফসোস করবে। তোমাদের শত্রু জৰ্মনি নয়, শত্রু তোমাদের রুশ। এবং সেই রুশের সঙ্গে লড়বার জন্য আমাদের আবার বাঁচিয়ে তুলতে হবে, তোমাদের টাকায় বিয়ার-সসি খাইয়ে, বাড়ি-ঘরদোর বানিয়ে দিয়ে।

গ্যোবেলসের সে টাইম-ব–আমরা বলি ফলিত-জ্যোতিষ– ফেটেছে। রুশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করতে গিয়ে মার্শাল ট্রুম্যান যেসব বক্তৃতা ঝাড়েন সেগুলো শুনে মনে হয়, ট্রমান যেন মাইন কাম্ফ পড়ে শোনাচ্ছেন, মার্শালের গলা আর গ্যোবেলসের গলায় তফাৎ ধরতে পারিনে।

শুধু কি তাই, হিটলার একদিন সদম্ভে চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করেছিলেন– গণতান্ত্রিক চেম্বারলেনের গালে ঠাস্ করে চড় মেরে। ঠিক সেই কায়দায় রুশ যখন সেদিন চেকোশ্লোভাকিয়ার গণতন্ত্র গলা টিপে মেরে ফেলল (মাজারিক নাকি আত্মহত্যা করেছেন, বেনেশ নাকি বাণপ্রস্থ অবলম্বন করেছেন!), তখন আমেরিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। জর্মনি চেঁচিয়ে বলল, কিছু কর না কর, অন্তত চোখদুটো রাঙা কর। আমেরিকা চোখ-দুটি বন্ধ করেছে।

ফরাসিতে প্রবাদ আছে, প্ল্যুসা শাঁজ, প্ল্যা সে লা মেম শোজ। অর্থাৎ যতই সে রঙ বদলায় ততই তাকে আগের মতন দেখায়। অনেকটা বাঙলা দেশেরগবিতা লেখকদের মতো। যতই তারা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ঢাকতে চান, ততই তাদের লেখাতে সে প্রভাব ধরা পড়ে।

মার্কিন, রুশ, ইংরেজ যতই তাদের রাজনীতি বদলাতে চায় ততই তাদের চেহারা আগের মতন হতে চলে।

জর্মনি আবার শক্তিশালী হবে।

***

 ভুলে গিয়েছিলুম পাউলের চিঠি শেষ হয়েছে প্রশ্ন দিয়ে, Was fangen die Inder mit der wiedergewonnenen Freitheit an? Sich gegenseitig zu erschlagen kann doch unmoeglich das einzige Ergebnis gewesen sein.

অর্থাৎ, নবলব্ধ স্বাধীনতা দিয়ে ভারতবাসীরা কী করছে? একে অন্যকে খুন করাই তো আর সে স্বাধীনতার একমাত্র ফল হতে পারে না।

উত্তরে কী লিখি যদি কেউ বলে দেন!

.

অ্যানডরুজ সাহেব

আমরা ওই নামেই তাঁকে চিনতুম। আমি তাকে গুরুরূপে পাই ১৯২১ থেকে ১৯২৬ অবধি। তার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শুণী-জ্ঞানীরা তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর মহত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করবেন। সে অধিকার আমার নেই।

১৯২১-এর বর্ষায় শান্তিনিকেতনে ভরতি হওয়ার কয়েকদিন পরই জানলুম, আসাম চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্য তিনি এদিক-ওদিকে ছুটোছুটি করছেন। গুরুদেব তখন বিদেশে। ফিরে এলেন জুলাই মাসে। বোম্বাইয়ে নেমেই নাকি তিনি মহাত্মা গাঁধীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একমত হতে পারেননি বলে তার বিরুদ্ধে আপন বক্তব্য স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছেন। ওদিকে আবার রবীন্দ্রনাথের সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ গাঁধীজিকে তার আশীর্বাদ জানিয়েছেন। শুনলাম, অ্যানড়রুজ সায়েব রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীজি দু জনারই সখা এবং দ্বিজেন্দ্রনাথের শিষ্য। এই তিনজনের সখ্য, প্রীতি, স্নেহ তিনি একসঙ্গে পান কী করে? সে যুগে যারা যুবক ছিলেন তাঁরা স্মরণে আনতে পারবেন, একদিক দিয়ে আমাদের সর্বগর্ব ছিল রবীন্দ্রনাথের গান, কাব্যাদি নিয়ে, অন্য দিক দিয়ে আমরা যোগ দিয়েছি গাঁধীজির অসহযোগ আন্দোলনে। এই দ্বন্দেই আমরা দিগভ্রান্ত। আর অ্যানডরুজ সায়েব এই তিনমুখী লড়াই সামলান কী করে?… এমন সময় শান্তিনিকেতনে খবর পৌঁছল, গুরুদেব ও গাঁধীজিতে নাকি মুখোমুখি বসে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে। অন্যে যা বলুন, বলুন, আমার বিশ্বাস এই মোলাকাতটির ব্যবস্থা করেন অ্যানরুজ সায়েব। তার দু-একদিন পরেই গুরুদেব আর সায়েব আশ্রমে ফিরে এলেন। এবং আমরা আরও দিগ্ভ্রান্ত, এঁদের আলোচনার কোনও রিপোর্ট কোনও কাগজে বেরোয়নি। অ্যানডরুজ সায়েব সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনিও কিছু বলেননি। শুনেছি রুদ্ধদ্বারে চার ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হয়েছিল। বিশ্বজনের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু আর্টিস্ট ঠেকায় কে? আচার্য অবনীন্দ্রনাথ চাবির ফুটো দিয়ে ভিতরকার অবস্থাটা একপলক দেখে নিয়ে একটি ছবি আঁকেন। সেটি এখন শন্তিনিকেতনের কলাভবনে।… আশ্রমে ফেরার দু-একদিন পরই সায়েব বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীদের ডেকে পাঠালেন। সায়েব সর্বপ্রথম বললেন– অর্ধশতাব্দী পরে আমার প্রতিবেদনে যদি ভুলভ্রান্তি থেকে যায় তবে সে সভায় উপস্থিত কোনও মহাশয় সেটি সংশোধন করে দিলে অধম বড়ই কৃতজ্ঞ হবে– গুরুডেব (সায়েব ডদ-য়ে তফাৎ করতে পারতেন না) এবং মহামাজি কলকাতাতে যে আলোচনা করেছেন সেটা জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করার কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু তোমাদের জানানো দরকার। কিন্তু তোমরাও সেটি কাগজে প্রকাশ করো না।

আহা, কী সুন্দর ইংরেজি উচ্চারণ! এতদিন যা দু-চারবার ইংরেজের মুখে ইংরেজি শুনেছি তার চোদ্দ আনা বুঝতে পারিনি। তারা ছিল চা-বাগানের মালিক। খুব সম্ভব কনি। আর ইনি যা বলছেন তার প্রত্যেকটি শব্দ বুঝতে পারছি। যদিও তাঁর কথাগুলো বিরাট দাড়িগোঁফের মাঝখান দিয়ে হেঁকে হেঁকে বেরুচ্ছিল।

পরদিন নোটিশ বেরুল সায়েব আমাদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ক্লাস নেবেন। অধ্যক্ষ বিধুশেখরের বারান্দায়। হায়, আজকের তোক বুঝতে পারবে না, আমাদের কী স্থানাভাব ছিল! ব্ল্যাকবোর্ড ছিল না বলে সায়েব বারান্দার মেঝের সঙ্গে আনা চক দিয়ে বিশেষ বিশেষ বিষয়বস্তুর শিরোনামা লিখতেন। বিরাট দেহ। সমস্ত রক্ত চলে আসত দাড়ি আর চোখের মাঝখানে।…

ঘণ্টা বাজল। সায়েব ছুটলেন তার থালা আনতে। সে আমলে সব্বাইকে যেতে হত আপন আপন থালা নিয়ে রান্নাঘরের পাশে ডাইনিংরুমে। কিন্তু বিদেশিদের অন্য ব্যবস্থা ছিল। সায়েব সেখানে মাঝে-মধ্যে যেতেন। কিন্তু বেশিরভাগ খেতেন আমাদের সঙ্গেই।… তার পর সায়েব পড়ালেন শেক্সপিয়র এবং আমাদের অনুরোধে নিউ টেসটামেন্ট। কিন্তু কোনও বই-ই তিনি শেষ করার সুযোগ পেতেন না। আজ ওই হোথায় পাঞ্জাবে না কোথায় পুলিশ মজুরদের কোথাও ব্যস্ হয়ে গেল। তার ক্লাস বন্ধ।

কিন্তু কে শুনতে চায় আজকের দিনে এসব কাহিনী!

.

যুগ-যুগ-ধাবিত যাত্রী

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ ও নব রাষ্ট্র নির্মাণপ্রচেষ্টা বহু মহাপুরুষের দেশপ্রীতি এবং আত্মত্যাগ দ্বারাই সম্ভবপর হয়েছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সঙ্গে আরও দুটি কথা স্বীকার করতে হয় যে ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও এর জন্য অংশত দায়ী। তাই ভারতীয় রাষ্ট্র ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে সে আলোচনা করতে গেলে ওই তিনটি জিনিসেরই প্রতি লক্ষ রাখা প্রয়োজন।

কোনও ভূখণ্ড পরাধীন হয়ে গিয়েছিল, ফের স্বাধীন হল এ পরিস্থিতি পৃথিবীতে বহুবার হয়ে গিয়েছে এবং তার নকশা প্রতিবারেই কিছু না কিছু আলাদা হয়েছে। তাই যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের কিছুটা মিল আছে তাদের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলে ভবিষ্যতের ভারত সম্বন্ধে কিছুটা আবছা-আবছা ধারণা হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরব ভূখণ্ডের এক বৃহৎ অংশ, তুর্কি, ইরান ও আফগানিস্তান স্বাধীন হয়ে যায়। এর কারণ অনুসন্ধান করলে আমরা এ প্রবন্ধ যে মূল সূত্র নিয়ে আরম্ভ করেছি তার-ই পুনরাবৃত্তি করতে হয়। কিন্তু উপস্থিত দ্রষ্টব্য এইসব দেশ তাদের নবলব্ধ স্বাধীনতা নিয়ে করল কী?

মুস্তফা কামাল ধর্মে বিশ্বাস করতেন না– এ বিষয়ে তিনি যে সম্পূর্ণ একা ছিলেন তা নয়, তুর্কি পল্টনের বিস্তর অফিসার ফ্রান্স অথবা জর্মনিতে শিক্ষা লাভ করেছিলেন বলে ধর্মের প্রতি এঁদের কোনওপ্রকারের শ্রদ্ধা ছিল না। তিনি যখন স্বাধীনতা লাভের পর দেশ নির্মাণ শুরু করলেন তখন বুনিয়াদি স্বার্থ ধর্মের মুখোশ পরে তাঁকে প্রতিপদে বাধা দিতে লাগল। একে তো মুস্তফা কামাল জাত কালাপাহাড়, তার ওপর তার শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। জীবনটাকে তিনি একটা আস্ত জুয়ো খেলা বলে ধরে নিয়েছিলেন বলেই শত্রুর সামান্যতম পণের বিপক্ষে তিনি গোটা জীবনটাকে পণ ধরেখেলায় নামতেন। এরকম লোক হয় তিন দিনেই দেউলে হয়, অর্থাৎ আততায়ীর হাতে প্রাণ দেয়, কিংবা কোটিপতি হয় অর্থাৎ শত জীবন লাভ করে। তাই মুস্তফার কাছে প্রতি বাজিতে মোল্লাদের নির্মম হার মানতে হল। একবার ভেবে দেখলেই হয়, আজ যদি পণ্ডিতজি হুকুম দেন গায়ত্রী সংস্কৃতে উচ্চারণ না করে রাষ্ট্রভাষা হিন্দিতে পড়তে হবে তবে তাবৎ ভারতবর্ষে কীরকম বিরাট আন্দোলন সৃষ্ট হবে। অথচ মুস্তফা কামাল ঠিক ওই হুকুমটিই জারি করেছিলেন– আজান আরবি ভাষায় না দিয়ে দিতে হবে তুর্কিতে, নামাজের মন্ত্রোচ্চারণ করতে হবে তুর্কি ভাষায়!

আফগানিস্তানের বাদশা আমানউল্লাও আপন দেশটাকে গড়ে তুলতে গিয়ে দেখেন মোল্লারা শক্রতা সাধছেন। তিনিও তখন রুদ্ররূপ নেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু একে তো তিনি মুস্তফার মতো জুয়াড়ি ছিলেন না, দ্বিতীয়ত তাকে সাহায্য করবার জন্য তাঁর মতো স্বাধীনচেতা জোয়ান আফগানিস্তানে ছিলেন অতি অল্পই। আরও কারণ আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ দুটো কারণই তাঁর পরাজয়ের পক্ষে যথেষ্ট।

কিন্তু আসল যুদ্ধটা লাগল আরবে। একদিকে ইবন্ সউদ, অন্যদিকে কট্টরতম মোল্লার পাল। তুর্কি-আফগানিস্তান ইসলাম ধর্মের পীঠভূমি নয়, এসব দেশের লোক ধর্মান্তর গ্রহণ করে ইসলাম নিয়েছে। কিন্তু আসল ইসলাম জন্ম নেয় আরব দেশে, আরবের সভ্যতা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য যা কিছু তার সবই ইসলামের চতুর্দিকে গড়ে উঠেছে, ইসলাম ছাড়া অন্য সভ্যতার সঙ্গে তারা বহু যুগ ধরে কোনও সংস্পর্শে আসেনি বলে জগতের অন্য কোনও চিন্তাধারা, অন্য কোনও জীবন-সমস্যা সমাধান যে হতে পারে সে সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। লোকমুখে তারা শুনেছে, আরবের বাইরে রমণীরা উচ্ছল, পুরুষেরা নাস্তিক, ধর্মের বন্ধন সেখানে একেবারেই নেই, সেখানকার নরনারী নির্লজ্জতায় পশুরও অধম।

গোড়ার দিকে ইবন্ সউদ নিজেও ওই দলেরই ছিলেন কিন্তু নদ ও হিজ্জাজের রাজা হওয়ার পর তিনি যখন রাজ্য গঠনকর্মে নিযুক্ত হলেন তখন দেখেন ইউরোপীয় যন্ত্রপাতি ভিন্ন কৃষি-বাণিজ্য কোনও প্রতিষ্ঠানেরই দ্রুত এবং দীর্ঘস্থায়ী উন্নতি করা অসম্ভব। এ তত্ত্বটি তিনি তখন ধীরে ধীরে মোল্লা সম্প্রদায়কেও বোঝাতে চেষ্টা করলেন– ওদিকে আবার প্রগতিশীল মিশর থেকে প্রত্যাবর্ত যুবক সম্প্রদায় দু-একখানা মোটরগাড়ি, কিছু কিছু গ্রামোফোনও সঙ্গে আনতে আরম্ভ করেছেন। মোদ্দা কথা, ধর্মের দোহাই দিয়ে আজকের সংসারের আনাগোনা, যোগাযোগ কী করে সম্পূর্ণ বন্ধ করা যায়?

মোল্লারা ক্রমে ক্রমে নরম হলেন। তখন প্রশ্ন উঠল বন্দুক-কামান ডাইনামো ট্রাক্টর কেনবার মতো কড়ি ইন্ সউদের কোথায়–আরবের মরুভূমি এমন কী ফলায়, যার বদলে এসব কেনা যায়? তখন দেখা গেল সউদি আরবের মাটির তলায় প্রচুর পেট্রল ৷ ইবন্ সউদ সেটা মার্কিনদের কাছে বিক্রি করে পেলেন কোটি কোটি ডলার। তাই দিয়ে অনেক কিছু হল– এখন ইবন সউদের প্রাসাদে লিফট হয়েছে, সে প্রাসাদ অ্যার-কন্ডিশনড়। আবার সেই টাকার জোরেই মিশর এবং ভারতবর্ষ থেকে লক্ষ লক্ষ কুরান কেনা হচ্ছে এবং আরবদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে (সউদি আরবে ছাপাখানার ব্যবস্থা ভালো নয় বলে বোম্বাই-লক্ষ্ণৌয়ে নওলকিশোর প্রেসে ছাপা কুরান সেখানে যায়, কলকাতা থেকে এখনও ঢাকায় লক্ষ লক্ষ কুরান যায়)। ওদিকে সউদি আরবের কোনও কোনও শহরে গোপনে গোপনে স্কচু পানও আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।

আরবেরধর্মে ও ইউরোপের অধর্মে খানিকটা সমঝাওতা হয়ে গিয়ে থাকা সত্ত্বেও একথা মানতে হবে যে ইউরোপীয় চিন্তাধারা এখনও মক্কা-মদিনাতে প্রবেশ করতে পারেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরও চারটি দেশ স্বাধীন হয়ে গণতন্ত্র নির্মাণ করেছে ভারতবর্ষ, পাকিস্তান, বর্মা এবং ইন্দোনেশিয়া, মিশরও যুগধর্ম রক্ষা করে গণতন্ত্র হতে চলল এবং চীন কম্যুনিস্ট হয়ে গিয়েছে।

স্বাধীনতা-লাভের প্রথম কট্টর প্রতিক্রিয়া দেখা গেল ইন্দোনেশিয়ানদের মধ্যে। তারা রাতারাতি তাবৎ ডাছ রাস্তার নাম, প্রতিমূর্তি, স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে চুরমার করে দিল (আমাকে এদেশে আগত ইন্দোনেশিয়ানরা প্রায়ই জিগ্যেস করে আমরা এখনও ময়দানে ব্রিটিশ প্রতিমূর্তিগুলো বরদাস্ত করি কেন। উত্তরে আমি বলি, কলা হিসেবে এগুলো এতই নিম্নশ্রেণির যে এগুলো রেখে দিলেই ইংরেজ মাথা হেঁট করবে, অন্যান্য বিদেশি মৃদু হাস্য করবে)।

কিন্তু তাই বলে ইন্দোনেশিয়া ইউরোপীয় সভ্যতাকে বর্জন করল না। ওলন্দাজদের পরিবর্তে তারা এখন ইংরেজি সভ্যতার কিছুটা গ্রহণ করার চেষ্টায় আছে। সুলতান শহরিরের মতো আরও অনেক বিচক্ষণ ব্যক্তি ইন্দোনেশিয়ায় আছেন– এঁরা পণ্ডিত নেহরু গোত্রীয়, এঁরা ইউরোপীয় সভ্যতার আওতায় বড় হয়েছেন এবং দেশের ঐতিহ্যকে জাতীয়তাবাদী হিসেবে শ্রদ্ধা করলেও সে ঐতিহ্যের সঙ্গে এঁদের যোগসূত্র সূক্ষ্ম এবং ক্ষীণ।

কিন্তু তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সউদি আরবের মতো ইন্দোনেশিয়ায়ও ধর্ম মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। নব রাষ্ট্র-নির্মাণে এঁদের বিশেষ একটা হক্কও ছিল–শহরির-সুকানোর বহু বহু পূর্বে এঁরা হজে যাওয়ার ফলে মক্কা-মদিনার প্ররোচনায় দেশে ফিরে স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। এঁরা যে ভূমি নির্মাণ করেছিলেন তারই উপর শহরির সম্প্রদায় তাঁদের ফুলের বাগান সাজাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কিন্তু পূর্বেই নিবেদন করেছি, স্বদেশ-জাত ধর্মের বেলায় মানুষ যেরকম উত্তেজনা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মের পুনরুত্থানের জন্য চেষ্টা করে বিদেশাগত ধর্মের জন্য বিশেষত এই জাতীয়তাবাদের যুগে মানুষ অতখানি করে না। তাই ইন্দোনেশিয়ার মোল্লা সম্প্রদায় ইরানের কশানি সম্প্রদায়ের মতো বহু বল ধারণ করলেও এখনওআধুনিক সম্প্রদায়ীদের আসনচ্যুত করতে পারেননি।

বর্মাতে ধর্মান্দোলন আরও কম, আর পাকিস্তানের খবর সকলেই অল্পবিস্তর রাখেন। চীন কম্যুনিস্ট, তবু চীন সম্বন্ধে একটি কথা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে– চীনে ধর্ম এবং সমাজ আলাদা আলাদা থাকে বলে ধর্ম সেখানে অনেকটা আমাদের দার্শনিক মতবাদের মতো। এদেশে পিতা যদি বেদান্ত মানেন, পুত্র যদি সাংখ্যবাদী হন এবং নাতি যদি যোগশাস্ত্রের চর্চা করেন তবে তিনজনকে পৃথক পৃথক বাড়ি বানিয়ে আলাদা আলাদা বসবাস করতে হয় না। তাই চীনের একই বাড়িতে এক ভাই বৌদ্ধ, দ্বিতীয় মুসলমান, তৃতীয় খ্রিস্টান এবং এঁরা একই বাড়িতে নির্বিবাদে গুষ্টিসুখ অনুভব করেন। তিন ভ্রাতাই কিন্তু চীনা ঐতিহ্যের সম্মান করেন এবং তাই আজ চীন ১৯১৭ সালের রুশ বলশেভিকদের মতো আপন বৈদগ্ধ্যবুর্জুয়া নামে গালাগাল দিয়ে চীন-দরিয়ায় ভাসিয়ে দেয়নি। বরঞ্চ শুণীদের মুখে শুনতে পাই মাওসেতু যখন ক্যুনিজম সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন তখন বিশেষ করে চোখে পড়ে তার নিজস্ব চীনা রূপ ভাব, ব্যঞ্জনা, অলঙ্কার প্রয়োগে মাও নাকি খাঁটি চীনা ঐতিহ্য মেনে চলেন।

এস্থলে একটি কথায় বিশেষ জোর দেওয়া দরকার। প্রাচ্যের কোনও দেশই ভারতীয়দের মতো অতখানি ইংরেজি পড়ে ইউরোপীয় সভ্যতার আওতায় পড়েনি– এমনকি তুর্কিও অতখানি ফরাসি শেখেনি। ইউরোপীয় সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস-লেখন-পদ্ধতি, অর্থশাস্ত্র, রাজনীতি আমাদের যতখানি প্রভাবান্বিত করেছে তার শতাংশের একাংশ অন্য কোনও প্রাচ্য দেশে হয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি, আমরা সংস্কৃত, বাঙলা সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রায় একশো বৎসর ধরে ইংরেজির মাধ্যমে সর্বপ্রকারের জানচর্চা করেছি– চীন কিংবা আরব একদিনের তরেও তা করেনি। তাই আজ আমরা বাঙলায় ফিরে গিয়ে ইংরেজি ভাবের বাঙলা অনুবাদ করার সময় শব্দের সন্ধানে মাথা কুটে মরি। চীন-আরবে এ সমস্যা অনেক সরল, নেই বললেও চলে এবং ঠিক তেমনি তাদের সাহিত্য বর্তমান যুগের আন্তর্জাতিক সাহিত্য-কলার সম্পদ আহরণ করে অতখানি বিত্তবান-আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য, কলা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মতো হতে পারেনি।

এই বিত্ত এই সম্পদের বিরুদ্ধে ভারতেও একদল ওয়হহাবি (আরবের কট্টর) কশানি সম্প্রদায় দেখা দিয়েছেন। এঁরা সকলে মিলে যে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক সম্প্রদায় করেছেন তা নয়, যে কোনও রাজনৈতিক দলের ভিতর এই মতবাদের বিস্তর লোক পাওয়া যায়। এঁদের ধারণা যে খুব স্পষ্ট তা-ও নয়, কিন্তু মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে, এঁরা চান অতীতের কোনও সত্যযুগে ফিরে যেতে, এদের বিশ্বাস ভারতের ইতিহাসে এরকম পাপতাপহীন যুগ ছিল এবং সে যুগে ফিরে যাওয়া অসম্ভব নয়।

আমি ধর্মে বিশ্বাস করি, ঐতিহ্যে বিশ্বাস করি। কিন্তু সত্যধর্মের জন্য আমাকে পশ্চাতের কোনও বিশেষ যুগে ফিরে যেতে হবে একথা বিশ্বাস করি না। ধর্মে বিশ্বাস করি বলেই কায়মনোবাক্যে মানি,

নানা শ্রান্তায় শ্রীরস্তি ইতি রোহিত শুশ্রুম।
 পাপো নষদ বরো জনঃ ইন্দ্ৰ ইচ্চরতঃ সখ্য ॥
চরৈবেতি, চরৈবেতি

চলিতে চলিতে যে শ্রান্ত তাহার আর শ্রীর অন্ত নাই, হে রোহিত, এই কথাই চিরদিন শুনিয়াছি। যে চলে দেবতা ইন্দ্রও সখা হইয়া তাহার সঙ্গে চলেন। যে চলিতে চাহে না, সে শ্রেষ্ঠ জন। হইলেও সে ক্রমে নীচ (পাপী) হইতে থাকে, অতএব, অগ্রসর হও, অগ্রসর হও।

এবং ধর্মের চেয়েও বেশি মানি ভারতীয় বৈদগ্ধ্যকে– যে বৈদগ্ধ্যকে আমরা এতদিন অবহেলা করেছি।

যদি জানতুম যে ইউরোপীয়, আরব কিংবা চীনা বৈদগ্ধ্যের তুলনায় ভারতীয় বৈদগ্ধ্য বিত্তহীন তা হলে হয়তো আমি সনাতন পন্থায় সে বৈদগ্ধ্য নিয়ে আলোচনা করতুম, কোনও বিশেষ যুগের বিশেষ বৈদগ্ধ্য আঁকড়ে ধরে বসে থাকতুম, কিন্তু দেখছি দেশে দেশের মাঝখানের সর্বপ্রকার ভৌগোলিক বাধা প্রায় লোপ পেতে বসেছে, আজ যেমন ইংরেজি-ফরাসি-জর্মন বৈদগ্ধ্য একে অন্যের গোপনতম সম্পদের খবর রাখে ঠিক তেমনি সেদিন শীঘ্রই এসে উপস্থিত হবে যখন ভারতীয় বৈদগ্ধ্যকে আর সব বৈদগ্ধ্যের সামনে এসে দাঁড়াতে হবে। আমার সম্পদকে তখন তাদের সামনে এমনভাবে সাজিয়ে দিতে হবে, তাকে এমনি ধরনে যুগধর্মোপযোগী করতে হবে যে বিশ্বজন যেন তাকে বুঝতে পারে, এবং তার পর এগিয়ে চলতে হবে তাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে, ইউরোপ, চীন, আরবের সর্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান-কলার সর্বোত্তম নিদর্শন গ্রহণ করে, ভারতীয় সম্পদ দান করে।

তাই ভারতের ভাগ্যবিধাতা নিয়ে চলেছেন,

‘পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী’কে

তারা দাঁড়িয়ে নেই তারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না

.

ভাষার হাটে বেইমানি

একদা এদেশে মুসলমানি সভ্যতা-সংস্কৃতি এতদূর ছড়িয়ে পড়েছিল যে বাঙলার সভ্যতা, বেশভূষা, আলাপ-আচরণে অনেকখানি মোগলাই-মোগলাই রঙ ধরেছিল। আমার নমস্য গুরুজন জয়রাম মুন্সি চোগা-চাপকান পরতেন আর বড় বড় মজলিসে তার ফারসি বয়েত আওড়ানো শুনে দেশ-বিদেশের জমায়েত মৌলবি-মওলানারা শাবাশ শাবাশ বলতেন। তার পর আমরা একদিন কোট-পাতলুন পরে কাঁটা-চামচ দিয়ে খেতে আরম্ভ করলুম আর আমাদের ইংরেজি কপচানো শুনে দেশ-বিদেশের লোক ধন্যি ধন্যি বলল। সেদিনও গেছে– হরেদরে আমরা সবকিছু সামলে নিয়ে এখন আবার অনেকখানি সম্বিতে ফিরেছি।

আরবি-ফারসি থেকে শব্দ সঞ্চয় করার ফলে বাঙলা ভাষা গতিবেগ পেল সেকথা পূর্বেই একদিন নিবেদন করেছি। আলাল, হুতোমের জোয়ার কেটে যাওয়ার পর বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ হয়ে বাঙলা ভাষা এমন জায়গায় এসে দাঁড়াল সেখানে সে অনায়াসে গুরু-গুম্ভীর ভাবাবেগ প্রকাশ করতে পারে, আবার চাষিবউয়ের কান্নাহাসিরও ঠিক ঠিক খবর দিতে জানে। এ ভাষা দিয়ে যেরকম প্রাচীন সাহিত্যের মরব শোনানো যায় ঠিক তেমনি রামের সুমতির মতো ভেজা ভেজা ঘরোয়া সুখ-দুঃখের কাহিনীও শোনানো যায়– শুধু শব্দ আর বাচনভঙ্গির বেলায় একটুখানি হিসাব করে নিলেই হল।

ঊনবিংশ শতকের শেষ আর এ শতকের গোড়ার দিকে যে হিন্দি লেখা হত সে হিন্দিও মোটামুটি এই কায়দায়ই রচনা করা হত। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ হিন্দি লেখক উত্তম উর্দুও জানতেন বলে তাঁদের হাতের নাগালে রইত বিস্তর আরবি-ফারসি শব্দ- কারণ বাঙলা যেরকম শব্দভাণ্ডারের জন্য প্রধানত নির্ভর করে সংস্কৃতের ওপর, উর্দু নির্ভর করে আরবি-ফারসির ওপর। আরবির শব্দ ভাণ্ডার সংস্কৃতেরই মতো বিরাট (সংস্কৃতের মতো আরবিও আপন ধাতু থেকে অসংখ্য শব্দ বানাতে পারে, যথা জালাসা =বসা, তার থেকে মজলিস, এজলাস ইত্যাদি) এবং বাঙলায় যেরকম যেকোনো– তা সে ক্রন্দসীর মতো অজানা শব্দই হোক না কেন– সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করার শাস্রাধিকার আছে, উর্দুও ঠিক সেইরকম আরবির লক্ষ লক্ষ শব্দের যে কোনও শব্দ ব্যবহার করতে পারে।

তার পর হিন্দিতে এল ভাষাশুদ্ধীকরণের বাই। তার ফলে সে ভাষা বিদ্যেসাগরি ভাষার রঙ না ধরে ধরল সঙ। কারণ বিদ্যেসাগর মশায়ের মতো ওরকম জবরদস্ত লেখক হিন্দিতে কেউ তখন ছিলেন না। তবু সে ভাষা আরবি-ফারসি বিকটভাবে বর্জন করেনি বলে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস তখনও তর্জমা করা হত।

স্বাধীনতা পাওয়ার পর কিন্তু এ বাই চরমে গিয়ে পৌঁছল। আমরা বাঙলায় বলি তার পর, কিংবা তার বাদে (বাদ শব্দটা আরবি সেকথা আমরা বেবাক ভুলে গিয়েছি) হিন্দিতে মাত্র একটি উপায়ে বলা যায় এবং সেটি হচ্ছে উসকে বাদ। হিন্দিওলারা তাই সেই বাদটুকুকে পর্যন্ত বাদ দিয়ে বলতে আরম্ভ করেছেনউকে পশ্চাৎমে!

বছর তিনেক পূর্বে শ্ৰীযুত অমরনাথ ঝা-র একটি ভাষণ আমি শুনি। পূর্ণ অর্ধ ঘন্টা ভদ্রলোক অতি বিশুদ্ধ হিন্দিতে বক্তৃতা দিয়ে শেষ করলেন এই কথা বলে অব জো হমারি রাষ্ট্রভাষা হোগি বহু সংস্কৃতময়ি হিন্দি হোগি অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্রভাষা সংস্কৃতময়ী হবে।

শ্রী ঝা তার অর্ধ ঘণ্টাব্যাপী ভাষণে একটিমাত্র আরবি কিংবা ফারসি শব্দ ব্যবহার করলেন না।

আজ তাই হিন্দি ভাষা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে সে অনায়াসে সীতার বনবাস অনুবাদ করতে পারে, কিন্তু রামের সুমতি কিংবাগডড্ডলিকা করতে পারে না।

এ বড় মারাত্মক অবস্থা সেই কথাটি আমি পাঠককে বলতে চাই। কারণ একথা ভুললে চলবে না, গণ-আন্দোলনের ফলেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনির্মাণের জন্য জনগণের সহযোগিতার প্রয়োজন। চাষাভুষোর সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশা নিয়ে আমাদের বই লিখতে হবে, বক্তৃতা দিতে হবে, নাটক সিনেমা বানাতে হবে। এসব জিনিস বিদ্যেসাগরি বাঙলা দিয়ে যেরকম প্রকাশ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব ঠিক তেমনি আজকের দিনে হিন্দি দিয়েও প্রকাশ করা যায় না। একেবারে যায় না বলা অনুচিত, কিন্তু সে ভাষা যে সাহিত্যের পর্যায়ে ওঠে না তা-ই নয়, সে ভাষা অবোধ্য।

সুশীল পাঠক হয়তো অতিষ্ঠ হয়ে বলবেন, হিন্দি কী করে না করে, তা নিয়ে তোমার অত শিরঃপীড়া কেন? কথাটা খুবই ঠিক, কারণ হিন্দি আমার মাতৃভাষা নয়, হিন্দি নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেললে আমার কিংবা আপনার ব্যক্তিগত কোনও লাভক্ষতি নেই– অবশ্য যতক্ষণ হিন্দি আপন জমিদারিতেই দাবড়ে বেড়ায়, আমাদের পাকা ধানে মই না দিতে আসে।

সেইখানেই তো বিপদ। মেনে নেওয়া হয়েছে হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা হবে ও ক্রমে ক্রমে বাঙালি, আসামি, মাদ্রাজি সবাইকে যে শুধু হিন্দি পড়তে হবে তাই নয়, সে ভাষায় লিখতে হবে, বলতেও হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র-নির্মাণের কর্ম অনেকখানি হিন্দির মাধ্যমে করতে হবে। আজকের দিনে ঘঁত্বাইগ্রস্ত হিন্দি দিয়ে কি সে-কর্ম সুচারুরূপে সমাধান হবে?

রসিকতা বাদ দিন। পরশুরামের ছি ছি বলিয়া তৃপ্তি হয় না, তওবা, তওবা, বলিতে ইচ্ছা করের অনুবাদ তো হয়ই না, ইংরেজকে যে খেদাতে হবেআৰু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে সেই জোরালো বাঙলা পর্যন্ত অনুবাদ করা যাবে না। কারণ আব্রু, ইজ্জত, ইমান শব্দ ফারসি-আরবি–হিন্দি এ শব্দগুলো বরদাস্ত (থুড়ি! সহ্য করবেন না।আব্রুর সংস্কৃত কী জানিনে, ইজ্জৎ না হয় কেঁদে-কুকিয়েমান দিয়ে চালালুম, কিন্তু ইমান শব্দের সংস্কৃত নেই সেকথা নিশ্চয় জানি।বেইমানির জায়গায় বিশ্বাসঘাতকতা চালাতে গেলেভাষার হাটে বেইমানি করা হয়।

যে ভাষা রাষ্ট্রভাষা হতে চায় তার শব্দভাণ্ডার হবে বিরাট। কারণ বহু প্রদেশের নানারকম চিন্তাধারা তাকে প্রকাশ করতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনমতো নানা প্রদেশ থেকে নানারকম নতুন শব্দও তাকে গ্রহণ করতে হবে– ইংরেজি যেমন নানা দেশ থেকে নানারকমের শব্দ নিয়ে আপন ভাষা বিত্তবতী করেছে।

যে ভাষা আপন শব্দভাণ্ডার থেকে অকাতরে খেদিয়ে দিয়ে বিস্তর শব্দ শুদ্ধমাত্রপবিত্র হওয়ার জন্য, সে ভাষা ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ থেকে নানাপ্রকারের শব্দ নিতে রাজি হবে সে আশা দুরাশা।

আমার একমাত্র সান্ত্বনা যে, হিন্দি সাহিত্যিকদের ভিতর এমন লোকও আছেন যারা শ্রীঝার মত সমর্থন করেন না।

.

ধৈর্যং কুরু! পুনঃ গচ্ছং ঢাকায়ে

গত পঁচিশ বৎসর ধরে কি ঘটি কি বাঙাল কলকাতায়, মাছের বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময় দিবাস্বপ্ন দেখেছে, আহা ঢাকার লোক কী সুখেই না আছে। বিশেষ করে বাঙাল ছেলেমেয়েরা বাচ্চা বয়েস থেকে মা-মাসির কাছ থেকে ঢাকা, বিক্রমপুর, গোয়ালন্দ ইস্টিমারের বিশ্বভুবনে অতুলনীয় রাইসকারির কথা শুনেছে। ঢাকার কই? সে তো ঘটিদের ইলিশের সাইজ। আর কোথাকার ইলিশ? সে তো তিমি মাছের সাইজ। গোটা পৃথিবীটা নাকি কোন এক প্রাণীর মাথায় বিরাজ করছে কিন্তু খাস ঢাকাইয়া মাত্রই জানে ঢাকার জন্য ভিন্ন। ব্যবস্থা। সৃষ্টির আদিম প্রভাতে ব্রহ্মাণ্ড অলিম্পিকে যে তিনটে ইলিশ হেভিওয়েট প্রাইজ পায় সেই তিনটির উপর ঢাকা শহর নির্মিত। এ তত্ত্ব আপনার অজানা থাকলে চেপে যাবেন– নইলে ইলশায় হাসব।

তদুপরি ঢাকার নবাববাড়ির আওতায়, দীর্ঘ তিনশো বৎসর ধরে নির্মিত মোগলাই খানা! মোগলাই রান্নার উৎপত্তিস্থল দিল্লি-আগ্রা। একটা শাখা গেছে লক্ষৌয়ে, অন্য শাখা যমুনা বেয়ে বেয়ে এলাহাবাদ, কাশি থেকে একটু মোড় নিয়ে মোগলসরাই, ফের গঙ্গা বেয়ে পাটনা তার পর মুর্শিদাবাদ। ওদিকে পদ্ম বেয়ে বেয়ে ছোট নদী ধরে ঢাকা। রান্নার শেষ তীর্থ সিলেট কারণ ওটা পাঠান-মোগল উভয়েরই শেষ সীমান্ত-নগরী।

বিক্রমপুর উল্লেখ করলুম কেন তবে? সে তো গ্রাম– আজ না হয় মেনে নিলুম ওটা মহকুমা সাইজ ধরে। এবং এ তো অতিশয় সুপরিচিত সত্য যে, কোনও একটি বিশেষ রন্ধনপদ্ধতি (ফরাসিতে কুইজিন এবং এই শব্দটিই এখন আন্তর্জাতিক) গ্রামাঞ্চলে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না।

পাঠান-মোগলের পূর্বে বিক্রমপুর ছিল হিন্দুরাজাদের রাজধানী। এই তো কিংবদন্তি। জঙ্গিলাটরা যেরকম যুদ্ধের পর যুদ্ধের কালানুক্রমিক নির্ঘণ্ট থেকে সে দেশের ইতিহাস নির্মাণ করেন, এ রসনা-পূজারি রন্ধনপদ্ধতির (কুইজিনের) উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ধরে ধরে সে দেশের ইতিহাস নির্মাণ করে। জনশ্রুতি যদি সেখানে আমার কুইজিন-ইতিহাসকে সায় দেয়। তবে সেই জনশ্রুতিই সত্য ইতিহাস বাঁড়ুয্যে-সরকার সেস্থলে অপাঙক্তেয়।

বিক্রমপুরের কুইজিন ছিল মৎস্যকেন্দ্রিক। ঢাকার মোগলাই রান্না স্পস্টতই মাংসকেন্দ্রিক। কিন্তু তাই বলে বিক্রমপুরকে ঠেকানো যায়নি। বস্তুত, এই ঢাকাতেই আপনি পাবেন মৎস্য-মাংস কুইজিনের বিরলতম সমন্বয় গঙ্গা-যমুনার সম্মেলন। এ তীর্থে যে বঙ্গজন আসে না তার পিতা নির্বংশ হোক (এটা বিদ্যেসাগর থেকে চুরি)। যে এ তীর্থের প্রসাদ বেক্তেয়ার হয়ে উদরে ধারণ এবং পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয় সে আখেরে যাবে বেহেশতে, যেখানে বিস্তর সুদূর নিস্তরঙ্গ নহর-তরঙ্গিণী মৌজুদ এবং বলা বাহুল্য সেগুলোতে ইলিশ আবজাব করছে, কোনওপ্রকারে সিজন, অফ সিজনের তোয়াক্কা না করে। সৃষ্টিকর্তা ভক্তের মনোবাঞ্ছ কদাচ অপূর্ণ রাখেন না। আর সে যদি হিন্দু হয় তবে অতি অবশ্যই সে তদ্দশ্যেই যাবে শিবলোকে, অর্থাৎ তার বাসস্থান হবে শিবশঙ্কুর জটালোকে যেখান থেকে বেরিয়েছেন,

দেবী সুরেশ্বরী / ভগবতী গঙ্গে
ত্রিভুবন-তারিণী, / তরল তরঙ্গে।

আর একথা কি আমার মতো যবনকে তৈলবট গ্রহণ করে বিধান দিতে হবে যে সে গঙ্গায় বিরাজ করেন ইলিশ শুধু ইলিশ, দূরদিগন্তব্যাপী ইলিশ।

***

 কিন্তু হায়, পদ্মার ইলিশ পরিপাটিরূপে রাঁধবার জন্য সুনিপুণা বিক্রমপুরাগতা লক্ষণা সমাজ– বিশেষ করে বৈদ্য বর্ণোদ্ভবা। এ বর্ণের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব পাঠক ক্ষণতরে বিস্মৃতির বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিন। এদের একেকটি যেন সাক্ষাৎ ভানুমতী। এঁদের হাতে কই-ইলিশ থেকে আরম্ভ করে এস্তেক কেঁচকি চুনোপুঁটি পর্যন্ত না জানি কোন ইন্দ্রজালের মহিমায় এমনই এক অপরূপ সত্তায় পরিণত হন যে তখন তাঁরই রসে সিক্ত রসনা গেয়ে ওঠে :

ইহাকে জানেন যারা
জগতে অমর তারা
য এতদৃবিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি ॥

***

কোথায় আজ সে নবাববাড়ি যাকে কেন্দ্র করে একদা পূর্বাচলের মোগলাই কুইজিন গড়ে উঠেছিল? কলকাতার গোড়াপত্তন থেকেই সে ভুইফোড় আপস্টার্ট। কাজেই সেখানে অল্পকালের মধ্যেই দেখা দিল হোটেল, রেস্তরাঁ, চায়ের দোকান, মায় পাইস হোটেল এবং এদানির কফি হৌসগুলো। যদ্যপি একশো বছর পূর্বেও কলকাতায় প্রবাদ ছিল, বাঙাল দেশের জাত মারলে তিন সেন। উইলসেন, কেশব সেন আর ইস্টিশন। ইউলসনের হোটেল, কেশব সেনের ব্রাহ্মধর্ম আর স্টেশনে তো জাত মানার উপায়ই নেই। ঢাকাতে সেরকম হুশ হুশ করে রেস্তরা গজাল না। বিরিয়ানি, পোলাও, চতুর্ককার– কোরমা, কালিয়া, কাবাব, কোফতা– দোপেঁয়াজা, এবং ঢাকার অত্যুৎকৃষ্ট রেজালা, বুরহানি, সাদামাটা নেহারি (এটা বরঞ্চ সহজলভ্য), ঢাকাই পরোটা (ভিতরে অষ্টগ্রামের পনিরের পূর দেওয়া পরোটা), নানাবিধ সমোসা গয়রহ গয়রহ তাই রেস্তরার মাধ্যমে ভালো করে প্রচার প্রসার লাভ করার পূর্বেই ঢাকার স্কন্ধে ভর করল ঢাউস ঢাউস বিলিতি মার্কা হোটেল– তাদের অপেয় সুপ, অখাদ্য ইস্ট, অকাট্য রোস্ট ইত্যাদি ট্যাশ যত সব গব্বযন্তনা। আর দিশি পোলাওয়ের নামে এক প্রকারের অগা খিচুড়ি (জগা নয়), কোরমার নামে আইরিশ ইন্টুর সঙ্গে ইন্ডিয়ান মশলার সমন্বয় সরি, খুনোখুনি। যা কিছু গলা দিয়ে নামে সঙ্গে নিয়ে যায় রিটার্ন টিকিট। তিন দিনের নয়, তিন মিনিটের রিটার্ন। কপাল ভালো থাকলে এবং পেটে সুইডিশ স্টিলের লাইনিং থাকলে ঘণ্টা তিনেকের ম্যাদ।

তবে হ্যাঁ, এখনও আছে বাকির (বাখর) খানি রুটি, এবং সুখা রুটি। কথিত আছে জনৈক পশ্চিমা খানদানি মনিষ্যি এন্তের জাগির পেয়েছিলেন বরিশালে। ঢাকা থেকে বেরুবার সময় সঙ্গে নিয়ে যেতেন এক ভঁই সুখা রুটি (খাস উর্দুতে অবশ্য সুখি রুটি)। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি আবিষ্কার করেন এই অপূর্ব চিজ। কোথায় লাগে এর কাছে উৎকৃষ্টতম ক্রিম ক্রেকার? ঝাড়া একটি মাস থাকে মুরমুর ক্রিপ। জনশ্রুতি, এই বাকির খানের নামেই হয় বরিশালের অন্য নাম বাকরগঞ্জ।

নেই নেই করে অনেক কিছুই আছে।

কিন্তু কিন্তু ঠিক এই সময়টায় তীর্থযাত্রাটা স্থগিত রাখুন। ভাদ্ৰাশ্বিনে পূর্বাচলযাত্রা নাস্তি। একাধিক মৌলিক দ্রব্যের অনটন। তবে কি না শিগগিরই ট্যুরিস্ট ব্যুরো খুলবে। আসা-যাওয়ার সুখ-সুবিধে হবে। আসছে শীত নাগাদ পাসপোর্ট-ভিজার কড়াকড়িও কমবে।

বন্ধুবান্ধবদের যে সদুপদেশ দিয়েছি, সুশীল পাঠক, তোমাকে তো তার উল্টোটা বলতে পারি!

.

ঈদ-আনন্দোৎসব

ধর্মের একটা দিক চিরন্তন এবং যার পরিবর্তন হয় না। এই যে আমি পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে বিশ্বভুবনের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছি তার বাইরে যে সত্তার কল্পনা আমি অনুভব করতে চাই, তিনি আদিঅন্তহীন, অপরিবর্তনীয়। যে মানুষ সাধনার ক্ষেত্রে যতখানি অগ্রসর হয় সে সেই অনুপাতে তাঁর নিকটবর্তী হয়, তার অনুভূতি নিবিড়তর হয়। আমাদের হজরত বলতেন তিনি সেই চরম সত্তাকে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেন তাঁর স্কন্ধের শিরার (স্পন্দনের) মতো। বলা বাহুল্য আমরা মনন দ্বারা যে পরমসত্তাকে অনুভব করি তিনি চিন্ময়। শিরার স্পদন-জনিত অনুভূতি সম্পূর্ণ মৃন্ময়। চিন্তার মারফত আমরা কল্পলোকে যে অনুভূতি পাই, স্পর্শলব্ধ দৃঢ় মৃত্তিকাজাত শিরার অনুভূতি তার তুলনায় অনেক বেশি নিবিড়, অনেক বেশি দৃঢ়। তাই হজরত সেই পরম সত্তাকে শারীরিক অভিজ্ঞতার ভ্রান্তিহীন সত্যের মতো প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতেন। পক্ষান্তরে ধর্মানুভূতির জগৎ থেকে বেরিয়ে ধর্মাচরণের কর্মভূমিতে আমরা যখন নামি, তখন সে আচরণের অনেকখানি দেশকালপাত্রের ওপর নির্ভর করে। অবশ্য অন্বেষণ বিশ্লেষণ করলে অবশেষে দেখা যাবে আমাদের প্রত্যেকটি ধর্ম-আচরণও সেই অপরিবর্তনীয় চিরন্তন সত্তাশ্রিত। কর্মজগতে তাই প্রথমতো পাত্রের ওপর নির্ভ করে ধর্মাচরণ– আমল। আমি পক্ষাঘাতে চলৎশক্তিহীন, অথর্ব। মক্কা শরিফ দর্শনের তরে আমার চিত্ত যতই ব্যাকুল হোক না কেন, আমার যত অর্থ সম্পদই থাকুক না কেন, কোনও ধর্মজ্ঞজন কোনও ফকিহ আমার হজযাত্রার অপারগতাকে নিন্দনীয় বলে মনে করবেন না। আমি এ অবস্থায় যে কোনও হাজিকে, আমার হয়ে, পুনরায় হজ করার জন্য মক্কা শরিফে পাঠাতে পারি; অবশ্য তার সমস্ত খর্চা-পত্র আমাকেই দিতে হবে। এর থেকে কিন্তু এহেন মীমাংসা করা সম্পূর্ণ ভুল হবে যে, আমার ওপর যেসব ধর্মাচরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তার সবকটাই আমি অন্যলোককে দিয়ে করাতে পারি।

পাত্রের মতো কালও ধর্মাচরণের সময় হিসাবে নিতে হয়। পূর্বাকাশ ঈষৎ আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে সলাৎজির ধ্যানধারণার পক্ষে সর্বোত্তম সময় ইহলোকে সব ধর্মই একথা স্বীকার করেছেন।

এস্থলে বলা প্রয়োজন মনে করি যে, একশো বছর আগেও সাধারণ ধার্মিকজন আপন ধর্মবিশ্বাস (ইমান) ও ধর্ম-আচরণ ক্রিয়াকর্ম (আমল) নিয়ে সন্তুষ্ট থাকত, প্রতিবেশীর ধর্ম সম্বন্ধে তার কোনও কৌতূহল ছিল না। থাকলেও সে কৌতূহল নিবৃত্তি করা আদৌ সহজ ছিল না। কারণ অধিকাংশ স্বধর্মে বিশ্বাসীজনই পরধর্মাবলম্বীর সংস্রব এড়িয়ে চলত, তথা তাকে আপন ধর্মকাহিনী শোনাতে কোনও উৎসাহ বোধ করত না। উপরন্তু হিন্দু, জৈন এবং পারসিরা বহু শত বৎসর পরধর্মাবলম্বীকে আপন ধর্মে দীক্ষিত করার দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছেন। এবং আশ্চর্য বোধ হয়, আমাদের আলিম-ফাজিলগণ প্রতিবেশী হিন্দুকে শুদ্ধমাত্র কাফিরা, হানুদ, মলাউন ইত্যাদি কটুবাক্য দ্বারা বিভূষিত করেই পরম তৃপ্তি অনুভব করেন; অথচ তারা সকলেই আমার মতো না-দানের চেয়ে ঢের ঢের বেশি দানিশমন্দ– তাঁরা বিলক্ষণ অবগত আছেন, তাঁদের পক্ষে আপন ধর্ম প্রচার করা অবশ্য কর্তব্য। এবং তাঁরা কেন, অতিশয় আহাম্মুখও জানে, বিধর্মীর ধর্ম তুলে কটুবাক্য বললে, তাকে ইসলামের প্রতি তো আকৃষ্ট করা যায়ই না, উপরন্তু আরেকটি প্রতিবেশীকে রুষ্ট করা হয় মাত্র।…

কাল ও পাত্রের কথা হল। দেশের ওপর ধর্মাচরণ নির্ভর করে আরও বেশি। যে-দেশে ছ মাস ধরে সূর্যাস্ত হয় না, সেখানকার মুসলিমের এবং বাংলাদেশের রোজা রাখার কায়দা-কানুন যে হুবহু একই রকমের হতে পারে না সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।

ঈদের পরব, এবং অন্যান্য তাবৎ পরবই এই দেশ অর্থাৎ স্থানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে। এবং এই সুবাদে আবার পাঠকের স্মরণে এনে দিই, বহুবিধ কারণে আমরা প্রতিবেশীর ধর্ম সম্বন্ধে এখন আর সম্পূর্ণ উদাসীন থাকতে পারিনে। মহরমের আর জগদ্ধাত্রী পুজোর মিছিল যদি একই দিনে পড়ে তবে তার হিসাব যে নগরপাল আগের থেকেই নেয় না, তাকে আমরা বিচক্ষণ আইজি বলে মনে করব না। তদুপরি খ্রিস্টান মিশনারিরা দু-শো বছর ধরে পাক নবীর বিরুদ্ধে এত কুৎসা রটিয়েছে যে তেনাদের ধর্ম বিংশ শতাব্দীর প্রচলিত খ্রিস্টধর্ম, যে ধর্ম একদিকে শেখায়কেউ ডান গালে চড় মারলে বা গাল এগিয়ে দেবে, অন্যদিকে বিশ-পঁচিশ বৎসর পরপর আপসে কেরেস্তানে কেরেস্তানে লাগায় প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ, টাকার লোভ দেখিয়ে দুই দলই টেনে আনে বিধর্মীদের, সরল নিগ্রোদের, এবং সর্বশেষে শুশানযজ্ঞ চালায় হিরোশিমার নিরীহ নারীশিশুদের ওপর। এবং সঙ্গে সঙ্গে নতমস্তকে স্বীকার না করে উপায় নেই, ইয়েহিয়া এদেশে যে তাণ্ডবনৃত্য জুড়েছিলেন সেটাও ধর্মের নামে ইসলামের দোহাই দিয়ে সেটাও জিহাদ! কিন্তু এই আনন্দের, ঈদের মৌসুমে হানাহানির কাহিনী সর্বৈব বর্জনীয়। আমি শুধু তুলনার জন্য কথাটা পেড়েছি, মুসলমানদের আনন্দোৎসব তার সত্য পরিপ্রেক্ষিতে দেখবার জন্য।

ঈদ অর্থাৎ আনন্দ, আনন্দ-দিবস, পরবের দিন। ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উদ-দোহাতে কিন্তু ঈদ সীমাবদ্ধ নয়।

ইমানদার ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দোৎসব করার বিশেষ একটা কারণ আছে। এক মাস ধরে সুখে-দুঃখে, মানসিক অশান্তির ভিতর দিয়েও উপবাস করাটা সহজ কাজ নয়– কঠিন শারীরিক পীড়া ইত্যাদির ব্যত্যয় অবশ্য আছে। তাই যে মুসল্লি পূর্ণ ঊনত্রিশ বা ত্রিশ দিন শরিয়তের আদেশমতো উপবাস করতে সক্ষম হয়েছে, তার আনন্দই সর্বাধিক হয়। তার অর্থ এই নয়, যে-ব্যক্তি পূর্ণ মাস রোজা রাখতে পারেনি, সে ঈদ আনন্দোৎসবে যোগ দেবে না। অবশ্যই দেবে। যে লোক বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে যোগ দিতে পারেনি যে কোনও কারণেই হোক তাকে স্বাধীনতা-দিবসের ঈদ-আনন্দোৎসব থেকে বঞ্চিত করার হক স্বাধীনতা-সংগ্রামে যারা লিপ্ত হয়েছিলেন তাঁদের পুরুষোত্তমেরও নেই। অতিশয় অভাজন জনও যদি আনন্দোৎসবে যোগ দিতে আসে তাকে বিমুখ করা, তার সঙ্গে তর্কাতর্কি করা ঈদের অঙ্গহানি করে। কারণ আনন্দের দিনে যে কোনওপ্রকারের অপ্রিয় কর্ম করা নিরানন্দের লক্ষণ, অতএব সর্বথা বর্জনীয়।

ঈদ বা আনন্দ সম্বন্ধে সুন্নি ও শিয়া এবং শিয়াদের নানা শাখা-প্রশাখা সকলেই প্রাগুক্ত ধারণা পোষণ করেন। বাংলাদেশে একদা প্রচুর খোঁজা ও বোরা ছিলেন। এদের দু দলই ইসমাইলি শিয়া, পক্ষান্তরে মুর্শিদাবাদ ও সিলেটের পৃথীম-পাশার শিয়ারা ইসনাআশারি শিয়া নামে পরিচিত। ঈদ সম্বন্ধে সকলেরই ধারণা মোটামুটি এক হলেও ঈদ পরব পালনের কর্ম-পদ্ধতি শিয়াদের ভিতর অতি বিভিন্ন।

সুন্নি হানিফিরা বিশুদ্ধ শরিয়তের দৃষ্টিবিন্দু থেকে ঈদ সম্বন্ধে সর্বোৎকৃষ্ট পথনির্দেশ পাবেন ইমাম আবু হানিফা ও তার শিষ্যগণ, ইমাম আবু ইউসুফ ইত্যাদির সাহচর্যে সংকলিত প্রামাণিক ফিকাহ গ্রন্থে। ঈদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গভীর আলোচনা পাবেন প্রখ্যাত দার্শনিক, ফকিহ ও সুফিহ ইমাম গাজ্জালির অজরামর কিমিয়া সাদৎ গ্রন্থে। মরহুম ইউসুফ খানের অনুবাদ অনিন্দ্যসুন্দর। কলকাতায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।

তুলনাত্মক আলোচনা করলে দেখা যায়, ঈদ বা আনন্দ মাত্রেরই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দেশ বা ভৌগোলিক অবস্থান তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামের উদয়কালে খাস আরবদেশ সমৃদ্ধিশালী ছিল না। পক্ষান্তরে ভারত বহু বহু শতাব্দী ধরে ছিল ধন-ধান্যের বিত্তবান দেশ। জনসাধারণের অবকাশও ছিল যথেষ্ট। তাই এই বঙ্গভূমিতে, বর্তমান দারিদ্রের দুরবস্থাতেও কি হিন্দু কি মুসলমান সকলেই বারো মাসে তের পার্বণের কথা জানে। ওইসব পার্বণে একদা দানই ছিল প্রধান অঙ্গ–অন্নবস্ত্র, ছত্র, পাদুকা, প্রকৃতপক্ষে কুটির শিল্পে হেন বস্তু ছিল না যেটা বিত্তবান কিনে নিয়ে দান করত না। কিন্তু দান বাধ্যতামূলক ছিল না।

পক্ষান্তরে গরিব আরবদেশে নিত্য নিত্য নানামুখী দান কষ্টসাধ্য বা অসম্ভব ছিল; ধর্ম কখনও মানুষকে এ ধরনের কর্ম করতে বাধ্য করে না। তদুপরি আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ইসলামের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই সে ধর্ম যে একদিন আরবভূমির বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে তার সম্ভাবনাও ছিল। সেসব দেশ আরবভূমির চেয়ে বেশি ধনী বেশি গরিবও হতে পারে। অতএব যতদূর সম্ভব অল্প সংখ্যকঈদ বা আনন্দের দিন বিধিবদ্ধ করে দেওয়া হয়। দান কিন্তু ইসলামের বিধিবদ্ধ আইন, তার অতি শৈশব অবস্থা থেকেই। ঈদ-উল-ফিতরে দান অলঙ্ ধর্মাঙ্গ। বস্তুত ইসলামই ইনকাম ট্যাক্স- জাকাত– ধর্মের অঙ্গরূপে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম বাধ্যতামূলক করে।

সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখি, আনন্দোৎসব (ঈদ) বা বাধ্যতামূলক ধর্মাচার (নামাজ রোজা ইত্যাদি) একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

পাঁচ ওকৎ নামাজ বাড়িতে পড়তে পার কিংবা মসজিদে। জুম্মার নামাজ কিন্তু অবশ্যই মসজিদে পড়তে হবে। কারণ ধর্মসাধনা ভিন্ন এর অন্য উদ্দেশ্য ছিল; প্রত্যেক মুসলিম যেন সপ্তাহে অন্তত একদিন মসজিদে প্রতিবেশী সহধর্মীর সঙ্গে মিলিত হয়ে একাত্ম-বোধ-জাত শক্তি অনুভব করতে পারে।

এর পরই আসে বৎসরে দু বার করে ঈদের নামাজ। ইমানদার মুসলিম মাত্রই চেষ্টা করে, বৃহত্তম মুসলিম জনসংঘের সঙ্গে বৃহত্তম জমাত-এ সে যেন নামাজ পড়তে পারে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য যত দূর-দূরান্ত থেকে যত সব নামাজার্থী ঈদগাহতে জমায়েত হয় তাদের সংখ্যা, তাদের ধর্মানুরাগ দেখে তাদের প্রত্যেকেই যেন আত্মবল, সংহতি-শক্তি অনুভব করতে পারে। ওইদিন পরিচিত জনের মাধ্যমে বিস্তর অপরিচিতের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ভ্ৰাতৃভাবে আলিঙ্গন দ্বারা। এই দূর-দূরান্ত থেকে, বৃহত্তম জমাত যে ঈদগাহে হবে, সেখানে নামাজ পড়ার পুণ্য ইচ্ছা নিয়ে ধাবমান যাত্রীদলকে আমি একাধিকবার বহুদূর অবধি তাকিয়ে দেখে দেশের জনসাধারণের প্রতি প্রীতি ও শ্রদ্ধা অনুভব করেছি, বিস্ময় বোধ করেছি।

বাড়িটি ছিল একেবারে বিরাট পদ্মার পাড়ে, রাজশাহীতে। ওপারে, বহুদূরে দেখা যেত শ্যামল একটি রেখা- ভারত সীমান্ত। বারান্দায় দাঁড়িয়েছি অতি ভোরে। অন্ধকার মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে দেখি, কত না দূর-দূরান্ত থেকে, হেথা-হোথা ছড়ানো চরভূমি থেকে, শুনলুম পদ্মার ও-পার ভারত থেকে, কত না নামাজার্থী শীতের শুকনো বালুচরের উপর দিয়ে হেঁটে আসছে রাজশাহী শহরের দিকে। শহরের প্রায় পূর্বতম প্রান্তের বাড়িটি থেকে দেখি, যেখানে সূর্য অস্ত যায় সেই দূরে অতি পশ্চিম প্রান্ত অবধি যেন পিপীলিকার সারির মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানবসন্তান শহরের দিকে এগিয়ে আসছে–নিরবচ্ছিন্ন ধারায়। পূর্বপ্রান্তে, যারা প্রাচীন দিনের জাহাজের খেয়াঘাট, পাশের ফুটকি পাড়ার দিকে এগিয়ে আসছে তাদের নতুন পাজামা-কুর্তা, বাচ্চাদের রঙিন বেশভূষা, হাসিমুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সবাই অক্লান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে সদর রাজশাহীর ঈদগাহের দিকে।

এদের কেউই হয়তো জানে না, ঈদের নামাজের সামাজিক মেলামেশার তাৎপর্য। গ্রামের জুম্মাঘর বা শহরের জামি মসজিদ ত্যাগ করে করে বৃহত্তম ঈদগাহে এসে বহুগুণে বিস্তৃত অঞ্চলের ঐক্যবদ্ধাবস্থায় বেশুমার নামাজরত মুসলিমের সঙ্গে শব্দার্থে তথা ভাবার্থে কাঁধ মিলিয়ে তখন পদ্মাচরের সরল মুসলিম ঈদের নামাজ পাঠ শেষ করে তখন সে কি সচেতন যে, বর্ষার উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল পদ্মা তার চরকে তার বউবাচ্চাকে বাদ-বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেও ঈদগার মুসল্লিদের কাছ থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। দীন ইসলামের চিরন্তন চিন্ময় বন্ধনে প্রলয়ঙ্করী পদ্মার তাণ্ডব নর্তন কস্মিনকালেও ছিন্ন করতে পারবে না– অনুভব করে তার অবচেতন মন।

কার্যত আমরা রোজার ঈদেই আনন্দোল্লাস করি বেশি। কিন্তু সর্ব দৃষ্টিবিন্দু থেকেই ঈদ-উল-আজহা বহুগুণে গুরুত্বব্যঞ্জক।

(১) আপন আবাসে পড়া পাঁচ ওক্ত নামাজের ক্ষুদ্রতম গণ্ডি, (২) সেটা ছাড়িয়ে জুম্মার নামাজের বৃহত্তর পরিবেশ, (৩) সে পরিবেশ ছাড়িয়ে ঈদগার বৃহত্তম পরিবেশ সাধারণ মুসলিমের জন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু আল্লা যাকে তওফিক দিয়েছে, (৪) সে যেন জীবনে অন্তত একবার মক্কা শরিফে গিয়ে বিশ্ব মুসলিমের সঙ্গে একত্র হয়। বিশ্ব মুসলিমের সত্তা-সংহতি-ব্যাপ্তি সে যেন দেখে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করে, তার ক্ষুদ্র সত্তা যেন বৃহত্তম মুসলিম সত্তার সঙ্গে সম্মিলিত হয়।

সে কাহিনী দীর্ঘ, সর্ব বিশ্বে তার গুরুত্ব ছেয়ে আছে। তার জন্য আগামীতে অন্য ঈদ।

.

ভাষা- বাঙলা

বাঙলা ভাষা মারফত সরকারি বেসরকারি সব কাজ নিষ্পন্ন করাটা আপাতদৃষ্টিতে যতই কঠিন মনে হোক না কেন, আমি অন্তত একটা দেশের কথা জানি, যেখানে এ সমস্যাটা সহস্রগুণে কঠিনতম ছিল এবং সে দেশ সেটা প্রায় সমাধান করে ফেলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্যালেস্টাইনে এসে জুটতে লাগল শব্দার্থে কুল্লে দুনিয়া থেকে ইহুদির পাল। কত যে ভিন্ন ভিন্ন। মাতৃভাষা নিয়ে তারা এসেছিল সে খতিয়ান নেবার চেষ্টা করা বৃথা। আমাদের পশ্চিম ভারত থেকে পর্যন্ত একদল খাঁটি ভারতীয় ইহুদি মারাঠি জাত তাদের কোঁকনি উপভাষা নিয়ে ইজরায়েলে উপস্থিত হয়। আপন রাষ্ট্র গড়ে তোলার আগের থেকেই ইজরায়েলের প্রধান শিরঃপীড়া ছিল– তাদের রাষ্ট্রভাষা হবে কী? শেষটায় স্থির করা হল হিব্রু যে ভাষাতে– আমি খুব মোটামুটি আন্দাজ থেকে বলছি– অন্তত হাজার বছর ধরে কেউ কথা বলেনি, সাহিত্য সৃষ্টি করেনি– শুধু পড়েছে মাত্র, তা-ও শুধুমাত্র ইহুদি যাজক পণ্ডিত রাব্বি সম্প্রদায়। যেসব ইহুদি অতি প্রাচীনকাল থেকে প্যালেস্টাইন ত্যাগ করে অন্য কোথাও যায়নি, নির্বাসিত হলেও কয়েক বৎসরের মধ্যে ফিরে এসেছে তাদের সক্কলেরই মাতৃভাষা আরবি– প্রায় বারোশো বৎসর আরবদের সঙ্গে বসবাস করার ফলে। সেটাকে রাষ্ট্রভাষা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। যেসব রাব্বি হিব্রুতে ওল্ড টেস্টামেন্ট ও প্রধানত হিব্রুর সমগোত্রীয় আরমেয়িক ভাষায় রচিত তালমূদ, মিদ্রাশ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারেন তাদের সংখ্যা শতকরা এক হয় কি না হয়। তদুপরি হিব্রুভাষা প্রধানত শাস্ত্রগ্রন্থের ভাষা। আড়াই হাজার বছর ধরে ইউরোপীয় সভ্যতা সংস্কৃতি যেসব শব্দ গড়ে তুলেছে তার একটিও এ ভাষাতে নেইদূরআলাপনী বাঅনপনেয় কালির তো কথাই ওঠে না। সবচেয়ে বড় বিপদ, বহিরাগত ইহুদিদের মাতৃভাষা– রাশান-পোলিশ, ইডিশ থেকে আরম্ভ করে ফরাসি, জর্মন, ইতালীয়, ফিনিশ– বলতে গেলে ইউরোপের তাবৎ ভাষা, আরবি, তুর্কি, ফারসি, কুর্দি এস্তেক কোঁকনি–সে ফিরিস্তি তো আমি আগেই এড়িয়েছি। এখন সমস্যা হল, মাস্টার যে হিব্রু শেখাবে, সেটা কোন ভাষার মাধ্যমে? তাবৎ ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষার লোক এক বিশেষ জেলায় জড়ো করে তাদের বৈদিক ভাষা শেখানো ঢের ঢের সহজ।

অথচ ইহুদিরা এই অলৌকিক কর্মটি প্রায় সমাধান করে এসেছে। টেলিফোন, ওয়ান উয়ে ট্র্যাফিক, মোটরের যন্ত্রপাতি যতরকম সম্ভব-অসম্ভব শব্দ তৈরি তো করা হলই এবং কত না অসংখ্য ভাষায়, প্রাচীন-অর্বাচীন, বর্ণশঙ্কর হিব্রু শব্দসহ এসব নতুন শব্দের অভিধান রচিত হল। নতুন নতুন শব্দের ফিরিস্তি, বয়ান, নিত্যি নিত্যি সাপ্তাহিক-মাসিকে বেরোয়, সাপ্লিমেন্টরূপে অভিধান যারা ক্রয় করে ফেলেছেন তাদের নামে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে ইজরায়েল যে কতখানি কৃতকার্য হয়েছে, এবং এখনও তারা কতখানি যোগ্যতাসহ কর্মতৎপর তার একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট। আপনি ট্যুরিস্ট। রাত দুটোর সময় আপনার দরকার হয়েছে একখানা ট্যাক্সির। অনুবাদ বিভাগকে–নামটা আমি সঠিক জানিনে প্রাগুক্ত সাড়ে বত্রিশভাষার যে কোনও একটিতে ফোন করে শুধোতে পারেন, আপনারা হিব্রুতে ট্যাক্সি শব্দের কী অনুবাদ করেছেন? পাঁচ সেকেন্ডের ভিতর হয় হিব্রু শব্দটি পাবেন, নয় অন্য প্রান্ত বলবে, শব্দটি এতই আন্তর্জাতিক যে আমরা এটার অনুবাদ করিনি। আপনি স্বচ্ছন্দে ট্যাসি, টাসি টাসে যা খুশি বলতে পারেন। মোদ্দা কথা, যে কোনও লোক ইজরায়েলে আগত ইহুদিদের যে কোনও ভাষায় যে কোনও সময় যে কোনও শব্দের হিব্রু প্রতিশব্দ শুধোতে পারেন ও সদুত্তর পাবেন। অবশ্য এ হিব্রু যদিও বাইবেলের হিব্রুর ওপর প্রতিষ্ঠিত তবু এটাকে অভিনব হিব্রু বলাই উচিত। এ ভাষার প্রধান সম্পদ, বিদেশি ভাষা থেকে অকাতরে অসংখ্য শব্দ গ্রহণ করে নির্মিত হয়েছে।

এহেন অলৌকিক কাণ্ড অবশ্য সম্ভবপর হত না যদি ইজরায়েলে বিশেষ কোনও ভাষা-ভাষীর জোরদার সংখ্যাগুরুত্ব থাকত। ৩৮ বৎসর পূর্বে আমি যখন তেলআভিভ যাই তখন রাস্তাঘাটে এত জর্মন শুনতে পাই, ফোন ডিরেক্টরিতে এত বেশি জর্মন নাম দেখি যে, আমার মনে ধারণা হয়েছিল শেষটায় ইজরায়েলের প্রধান ভাষা বুঝি জর্মনই হয়ে যাবে। কিন্তু ইহুদিরা এমনই মরণকামড় দিয়ে আপন ঐতিহ্য, ধর্মমূলক কিংবদন্তি আঁকড়ে ধরতে জানে, উৎপীড়ন অত্যাচার বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সে অনুরাগ এমনই দিগ্বিদিকজ্ঞানহীন ধর্মান্ধতায় পরিণত হয়, এবং যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে ইজরায়েলবাসী সার্থক রাষ্ট্রনির্মাণে প্রবৃত্ত হয়েছে, তার সম্মুখে প্রাচীনতম পূতপবিত্র হিব্রু ভাষার দুর্বার গতি রোধে কে?

কিন্তু হায়, তবু স্বীকার করতে হয় তাদের সমস্ত আদর্শ, লক্ষ্য, কর্মপন্থা, যে ভূমির ওপর তারা সর্বজনগ্রাহ্য রাষ্ট্রভাষার বিরাট সৌধ নির্মাণ করতে চাইছে তার সবই কৃত্রিম, সবই এক স্বপ্নলোকের রূপকথা, মূর্তিমান করার ন দেবায় ন ধর্মায় প্রয়াস।

বার বার অসংখ্যবার নিপীড়িত এই জাতিকে যেন ইয়াহূভে নিষ্ঠুরতম হিটলারের হাত থেকে রক্ষা করেন। এক আমেরিকা ছাড়া তারা এত অসংখ্য শক্র সৃষ্টি করেছে বিশেষত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে, যেখানে বিস্তর খ্রিস্টানও ইহুদিদের প্রাচ্যভূমি থেকে বিতাড়িত হতে দেখলে প্রকাশ্যে জয়ধ্বনি করবে যে, তাদের মনে সম্প্রতি প্রশ্ন জেগেছে মার্কিন সাহায্য বিপদকালে পুনর্বার কতখানি কার্যকরী হবে? ইয়েহিয়ার দিল জানু-এর প্যারা দোস্ত নিন কী না করেছেন, নিরস্ত্র রাইফেল মাত্র সম্বল বাঙালকে ঘায়েল করতে, তদুপরি চীনও তো কম যাননি। উভয়ে মিলে ভারতকে জুজুর ভয় দেখিয়েছেন এবং পারলে অবশ্যই ভারত মায় বাংলাদেশ শ্মশানে পরিণত করতেন। তাই ইহুদিরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে, মার্কিন মদতের ওপর কতখানি ভরসা করা যায়? তাদের দুসরা ভরসা ছিল, আরব রাষ্ট্রগুলো একদম ঐক্যবদ্ধ হতে জানে না। কিন্তু কে কসম খাবে, এরা কস্মিনকালেও একজোট হবে না?

আমার মনে হয়, পূর্ব বাঙলায় বাঙলাকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রভাষা করার যে উদ্যোগ, বিশেষ করে সরকারের ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রীদের দপ্তরগুলোতে যে সহযোগিতার আত্যন্তিক প্রয়োজন, জনসাধারণের যে সদাজাগ্রত চেতনাবোধ, বাঙলা খবরের কাগজের সহযোগিতা, দিনের পর দিন নিজেদের প্রচেষ্টায় অন্তত একটি কলম জুড়ে নতুন নতুন যেসব পারিভাষিক শব্দ সরকার তথা জনগণ দ্বারা দৈনন্দিন কর্ম সমাধানের জন্য নিত্য নিত্য নির্মিত হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা, ভাষাবিদ, চিকিৎসক, এঞ্জিনিয়ার, আইনবিদ ইত্যাদিদের সেসব আলোচনায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো, এসব যথেষ্ট পরিমাণে হচ্ছে না। একদা বিশেষ করে ১ বৈশাখে, কখনও-বা ২১ ফেব্রুয়ারির রাত্রে স্কুল-কলেজের ছাত্ররা তাবৎ ঢাকা শহরের উর্দু, ইংরেজিতে লেখা নেমেপ্লেট, দেয়াল থেকে উপড়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে বাঙলার প্রভুত্ব বুঝিয়ে দিত। এখন তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক। তারা নির্ভয়ে প্রত্যেক গৃহস্থকে অনুরোধ, প্রয়োজন হলে বাধ্য করতে পারে, বাড়ির নাম স্থির করুন, কিন্তু বাঙলাতে। (হোটেলপূর্বাণীর কর্তৃপক্ষ ৪/৫ বৎসর পূর্বেই জানতেন, হাওয়া কোনদিকে বইছে তাই মগরিবি সরাই বা গুলস্তান বোস্তান– হটেল দ্য লাহোর বা রেস্তরাঁ আইয়ুবিয়েন স্বপ্নেও মনে স্থান দেননি)। ইনডাসট্রিয়াল ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে মহাজন একটা মোটা টাকা পূর্বাণীতে খাটান তিনি সোল্লাসে সায় দিয়েছিলেন, কারণ এর বহু পূর্বেই তিনি তাঁর আপন ভবনটির নাম করেছিলেনশেফালি এবং তার মামি শিক্ষা বিভাগের এক প্রধান কর্মচারী তার গৃহভালে তিলক অঙ্কন করেন সনাতনপ্রান্তিক নাম দ্বারা। আমি জানি, এসব এমনকিছু ইনকিলাবি দুঃসাহসী শহিদজনোচিত কঠিন কর্ম নয়, কিন্তু সে কর্ম প্রতিটি গৃহস্থকে বহুদিন ধরে সচেতন রাখবে, কয়েক মাস পরপর লেটার-হেড ছাপবার সময় আত্মজনকে ঠিকানা দেবার সময় তার একটি বিস্তীর্ণ কর্মক্ষেত্র গড়ে উঠবে এবং দৈনন্দিন উত্তেজনাহীন কিন্তু অতিশয় বাস্তব সেই আধ-ভোলা ভাষা আন্দোলনকে প্রগতির পথে সদাজাগ্রত করে রাখবে। ওদিকে চলুক সরকারি প্রচেষ্টা। সেটা বাঙলা একাডেমি, বাংলা উন্নয়ন বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ–প্রয়োজন হলে নতুন বিভাগ স্থাপন ইত্যাদি যে কোনও প্রতিষ্ঠান, এ কাজের ভার নিতে পারেন, ইজরায়েলের উদাহরণ তো এইমাত্র দিলুম। প্রায় ৫০ বত্সর পূর্বে সর্ব রাজকার্য গুজরাতিতে সমাধান করার জন্য বরোদার মহারাজা যে কমিটি নির্মাণ করেন তার সদস্যসংখ্যা সীমাবদ্ধ ছিল। তবু অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তারা কর্মসমাপণ তথা মুদ্রণান্তে যে বিরাট কোষ দফতরে দফতরে পাঠালেন সে কলেবরের পুস্তক দূর থেকে দেখেই আমি সেই বিভীষিকাকে মারণাস্ত্ৰক অস্ত্রসমূহের নির্ঘণ্টে স্থান দেবার জন্য পুলিশকে অনুরোধ জানাই। অথচ বছর তিনেকের ভিতরই ইংরেজির স্থান গুজরাতি দখল করে নিল, অক্লেশে!

শ্ৰীযুক্ত শঙ্কর ক্ষোভ করেছেন, বাংলা ভাষা আজ ওপার বাংলাতে তেমন প্রাণোচ্ছাস সৃষ্টি করে না। … একুশে ফেব্রুয়ারি আজ তেমনভাবে আর অনেককে নাড়া দেয় না। শ্রদ্ধেয়া উমা চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, কোনও একটা ঘটনাকে কেউ কোলে নিয়ে তো বসে থাকতে পারে না। দুটো কথাই ঠিক। কিন্তু শ্ৰীযুক্ত শঙ্কর তার সঙ্গে সঙ্গে এ আশাও করছেন, তার সুন্দর সরল ভাষায় সবিস্তর বলে না থাকলেও, একুশের প্রতি শ্রদ্ধা উভয় বঙ্গের বাঙলাপ্রেমীদের চিরন্তন অনুপ্রেরণার অফুরন্ত উৎস হয়ে থাকবে– নিত্যদিনের ব্যবহারিক ভাবচিন্তার আদান-প্রদানের জন্য তো বটেই, সেই শ্রদ্ধাপ্রসাদাৎ রবি কবি যে অক্ষর ভাণ্ডার রেখে গেছেন তার যোগ্য ওয়ারিশানও আমরা হতে পারব। আমি আরও আশা রাখি, যোগ্যজন সে ভাণ্ডারের শ্রীবৃদ্ধিও করতে পারবেন। অবশ্যই শঙ্কর একথা বলতে চাননি, একুশেকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে এবং নিশ্চয়ই শ্রদ্ধেয়া উমা একথা বলেননি যে, একুশের প্রতি কোনওপ্রকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন নিষ্প্রয়োজন। অধিকাংশ নীতিই চরমে টেনে নিয়ে গেলে সেটা অনেকখানি রিডাকশিও আড় আবসুড়ুম হয় বটে, কিন্তু বহু ক্ষেত্রে উভয়ের বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে যায়, তখন ধরা পড়ে উভয়ের বক্তব্যের মধ্যে তেমন কিছু নীতিগত পার্থক্য নেই, পার্থক্য যেটুকু আছে– যদি আদৌ থাকে তবে সেটুকু শুধু মাত্রা নিয়ে। অবশ্য কট্টরপন্থি লোক সর্বাবস্থায়ই কিছু না কিছু থাকবে। ঢাকা-কলকাতার বিস্তর লোক আছেন যারা ঘোরতর আপত্তি তুলে বলেন, বাঙলা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা যদি কোনও বিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হয় তবে সে বিদ্যালয়কে সরকার কোনও আর্থিক সাহায্য তো করতে পারবেনই না– ওই বিদ্যালয়কে কোনওপ্রকারের স্বীকৃতিও দিতে পারবেন না।

রবীন্দ্রনাথ নীতিগতভাবে এবং কার্যত পারতপক্ষে বিশ্বভারতীর অধ্যয়ন-অধ্যাপনা বাঙলার মাধ্যমেই করতেন– আর আদ্যবিভাগের (স্কুলের) তো কথাই নেই। অথচ শ্রীযুক্ত সুধীরঞ্জন দাশ স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে, স্কুল-স্থাপনার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাদানার্থে একটি স্বতন্ত্র শাখা খোলেন, কিংবা প্রচেষ্টা করে কৃতকার্য হননি– আমার ঠিক মনে নেই।

***

আমি মাসের পর মাস ঢাকায় কাটিয়ে এসেছি। বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে যে কত কণ্টক, কত অগণন সমস্যা তার একটা অতিশয় অসম্পূর্ণ লিস্টি আমি দিনের পর দিন পূর্ণ একটি মাস ধরে খবরের কাগজ থেকে এবং আত্মজনের বাচনিক মাত্র এই দুটি পন্থায় নির্মাণ করার প্রচেষ্টা দিল– অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে যাইনি, পূর্ববঙ্গীয় সাংবাদিকদের আমি প্রায় চিনি না বললেও অত্যুক্তি হয় না, কোনওপ্রকারের স্ট্যাটিটি সগ্রহ করার জন্য যত্রতত্র টো টো করার মতো সামান্যতম শারীরিক বল আমার নেই– বস্তৃত প্রতি মাস অন্তত একটিবার বাসভবন দেহলি আমার ছায়াটি দেখেছে কি না সে বিষয়ে প্রতিবেশীগণের মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।… শেষটায় নিরাশ হয়ে ফিরিস্তি নির্মাণকর্মে ক্ষান্ত দিই।

বাংলাদেশ সরকার অতি উত্তমরূপেই অবগত আছেন তাদের সমস্যা কী– এই একটি বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।৭১-এর ন মাস যেন বন্যার মতো পুব-বাংলার লোককে হত্যা করে, ইতস্তত নিক্ষিপ্ত করে, গৃহহীন অন্নহীন আত্মীয়-আত্মজনহীন করে দিয়েছিল, কিন্তু, কিন্তু এখন? এখন দিনের পর দিন– কতদিন ধরে চলবে তৃষ্ণার্তের এক আঁজলা পানির তরে আকুতি? যে বন্যা কুল্লো মুলুক ভাসিয়ে ছয়লাপ করে দিয়েছিল সেই বন্যাই যাবার বেলা নিয়ে গেছে তৃষাতুরের শেষ জলকণাটুকু! কিস্মত! কিস্মত!! কিস্মত!!!

বাংলাদেশের আপামর আচণ্ডাল ভদ্রেতর, কি রাষ্ট্রের কর্ণধার, কি নাগরিক, কি জনপদবাসী সক্কলের সম্মুখে যে কী নিদারুণ পরীক্ষা সেটা এ বাংলা থেকে তো কথাই নেই, ও বাংলায় বাস করে হৃদয়ঙ্গম করা অতিশয় সুকঠিন।

যত কঠিনই হোক না কেন, একটা সত্যে আমি বিশ্বাস করি :

আপনি অবশ হলি,
তবে বল দিবি তুই কারে?
উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া,
ভেঙে পড়িস না রে ॥
 করিস নে লাজ, করিস নে ভয়,
আপনাকে তুই করে নে জয়
 সবাই তখন সাড়া দেবে,
ডাক দিবি তুই যারে ॥
 বাহির যদি হলি পথে
ফিরিস নে তুই কোনওমতে,
থেকে থেকে পিছন পানে
চাস নে বারে বারে ॥
নেই যে রে ভয় ত্রিভুবনে,
ভয় শুধু তোর নিজের মনে
 অভয়চরণ শরণ করে
বাহিরে হয়ে যা রে ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *