পিসেমশায়ের মামার গল্প

পিসেমশায়ের মামার গল্প

জানিস, আমার পিসেমশাইয়ের মামা ছিলেন বনেদি জমিদার। চপচপে ঘি দিয়ে পোলাও খেতেন, আস্ত-আস্ত পাঁঠা খেতেন, টগবগিয়ে ইয়া বড়াবড়া অস্ট্রেলিয়ান ঘোড়া হাঁকাতেন আর ভেলভেটে-মোড়া মস্ত তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে নানারকম একসপেরিমেন্টের কথা ভাবতেন।

–একসপেরিমেন্ট? সাইন্টিস্ট ছিলেন বুঝি?

–সাইন্টিস্ট না হাতি! বনেদি জমিদার আবার লেখাপড়া করে নাকি? কোনওমতে খবরের কাগজটা পড়তে পারতেন বিদ্যের দৌড় তো ওই পর্যন্তই।

–লেখাপড়া জানতেন না তো একসপেরিমেন্ট করতেন করতেন কী করে?

–আরে সেইটেই তো তোকে বলছি। খবরদার, ডিস্টার্ব করিসনি। কান পেতে শুনে যা।

পিসেমশাইয়ের মামা, মানে, যাঁর নাম ছিল নরসিংহবাবু, তাঁর পরীক্ষা চলত নানারকম চলতি কথা নিয়ে যাকে বলে প্রবাদ। সেগুলোকে তিনি কাজে লাগাবার চেষ্টা করতেন।

যেমন, পিসেমশাইয়ের মামা, মানে, নরসিংহবাবু শুনলেন, নেপোয় মারে দই। তাঁর এক দূর-সম্পর্কের ভাইপো ছিল, নাম নেপাল, সবাই তাকে নেপো বলে ডাকত। নরসিংহবাবু ভাবলেন, নেপো যখন আছে, দইও যখন পাওয়া যায় বিস্তর–তখন একবার পরখ করেই দেখা যাক। কাজেই দুটো পেল্লায় হাঁড়ি-ভর্তি প্রায় সের পাঁচেক দই এনে নেপোকে বললেন, খা। মানে সবটাই মেরে দিতে হবে তোকে।

দইয়ের হাঁড়ি দেখেই তো নেপোর আত্মারাম খাঁচাছাড়া। সে কাঁউমাউ করে বলল, কাকা, এতটা দই–

নরসিংহবাবু সিংহনাদ করে বললেন, কোনও কথা শুনতে চাই না। শাস্তোরে যখন বলেছে, আর তোর নাম যখন নেপো, তখন ও-দই তোকে মেরে দিতেই হবে। নইলে আমি তোকেই মেরে ফেলব।

তারপর নেপোর সে কী নিদারুণ দশা! দই খেতে-খেতে পেট ফুলে গেল, চোখ কপালে ঠেলে উঠল, দম বেরিয়ে যাওয়ার জো হল, তবু থামবার জো নেই। তারপর নেপো যখন গ্যাঁ-গ্যাঁ করে অজ্ঞান হয়ে গেল, সিকি হাঁড়ি দই তখন বাকি।

নরসিংহবাবু গোঁফে তা দিয়ে বললেন, যাক–পরীক্ষেটা সার্থক হল।

 আর নেপো? গলা ভেঙে, সর্দিজ্বরে ভুগে, সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার।

 তাঁর আর-এক ভাইপো ছিল, তার নাম নন্দ। বেশ মোটাসোটা, গোলগাল, ভালোমানুষ সে। একদিন কথা নেই বার্তা নেইনরসিংহবাবু নাপিত ডেকে নন্দর মাথাটা বিলকুল ন্যাড়া করে দিলেন।

ভয়ে নন্দ কথা বলতে পারল না, শৌখিন টেরি ছিল তার মাথায়, কেবল টেরির দুঃখে সে ফোঁসফোঁস করে কাঁদতে লাগল।

 নরসিংহবাবু ধমক দিয়ে বললেন, চোপরাও–এক্ষুনি চলে যাও পুকুরের ধারে বেলগাছের তলায়। ন্যাড়া বেলতলায় যায় কি না, সেটা আমি এবার দেখতে চাই।

নন্দ আর কী করে? সেই চকচকে ন্যাড়া মাথায় চলে গেল বেলতলায়। আর বেলতলায় বসে ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু বেশিক্ষণ কাঁদতেও হল না-হঠাৎ ফটাস আর সঙ্গে সঙ্গেই ধপাস!

-কে ফটাস-কী ধপাস?

–কে আবার ফটাস–পাকা বেল পড়ল নন্দর ন্যাড়া মাথায়। আর ধপাস–মানে একটা চিৎকার ছেড়েই নন্দ চিত। বরাত জোরে মাথাটা ফাটল না–একটা কমলালেবুর মতো ফুলে উঠল চাঁদিটা। আর পিসেমশাইয়ের মামা বেশ করে গোঁফে চাড়া দিয়ে বললেন, যাক, এ-পরীক্ষেটাও ভালোই হল। বুঝতে পারলুম–ন্যাড়া কেন বেলতলায় যায় না।

কী ডেঞ্জারাস লোক রে!

–ডেঞ্জারাস বলে ডেঞ্জারাস! বাড়িসুদ্ধ লোক প্রায় পাগল হয়ে গেল। নরসিংহবাবুর একসপেরিমেন্টে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল চারদিকে। তারপর একদিন নিজেই টের পেয়ে গেলেন, কত ধানে কত চাল হয়। ধর্মের ঢাক বেজে উঠল ব্যস-ঠাণ্ডা।

কী করে ঠাণ্ডা হলেন?

বলছি। সকলের ওপর পরীক্ষা-টরীক্ষা চালিয়ে একদিন তাঁর মনে হল, একবার দেখতে হবে পরের হাতে তামাক খেতে কেমন লাগে। অর্থাৎ তিনি তামাক খাবেন, আর অন্যলোক তাঁর মুখের কাছে হুঁকো ধরে থাকবে–তা এ আর শক্তটা কী? বাড়িতে তো ডজন দুই চাকর। তাদের তিনটেকে তিনি এই কাজে লাগিয়ে দিলেন। তারা তামাক সেজে আনে আর পিসেমশাইয়ের মামা বুরুরবুরুর করে সেই তামাক টানেন। দেখলেন, পরের হাতে তামাক খাওয়াটা ভারি সুখের ব্যাপার, হাতে করে হুঁকো ধরবার কষ্টটুকুও সইতে হয় না–যেদিকে মুখ ঘোরান সেদিকেই হুঁকো, এমনকি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটেন তখন তৈরি-হুঁকো তাঁর মুখের সামনে যেন নাচতে থাকে।

তামাক খাওয়ার এই নতুন কায়দাটা শিখে নরসিংহবাবুর আনন্দের আর সীমা রইল না। একদিন দুপুরে ভেলভেটে-মোড়া তাকিয়া ঠেসান দিয়ে অমনিভাবে তামাক খাচ্ছেন, আর-একটা নতুন কোনও একসপেরিমেন্টের প্ল্যান আঁটছেন, সেই সঙ্গে ঝিমোচ্ছন, অল্পসল্প, ঠিক তখন

তখন কোত্থেকে এক ডেয়ো পিঁপড়ে–বিশেষ কিছু করল না, কেবল যে-চাকরটা মুখের কাছে হুঁকো ধরে বসে ছিল, তার পায়ের আঙুলে বসিয়ে দিল এক মোম কামড়।

বাপ রে বলে চাকরটা মারল রামলাফ। হুঁকো থেকেও লাফিয়ে বেরুলো কল্কেটা, আর তার সবটা জ্বলন্ত তামাক, সব কটা গনগনে টিকে সোজা উল্টে পড়ল নরসিংহবাবুর টাকে।

গেছি–গেছি জ্বলে মরলুম–উরে ব্বাপস বলে নরসিংহবাবু খ্যাঁকশেয়ালের মতো দাপাদাপি করতে লাগলেন-চিৎকারে সাত-পাড়া এক হয়ে গেল। আর পিসেমশাইয়ের মামার সেইটেই হল শেষ একসপেরিমেন্ট। কারণ, সেদিনই তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝে গেলেন–ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে এই বচনটার মানে কী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *