পিতৃবিয়োগ

পিতৃবিয়োগ

সুমা দেওয়া চোখ, কপালের ভাঁজ খুলে যাওয়ায় ফর্সা চামড়া এখন পাথরের মতো মসৃণ। শাদা কাপড়ে লোবান ও আতরের গন্ধ। শিয়রে ও পায়ে ধুপকাটি পোড়ে, মনে হয় ধোঁয়াটাও শরীরের ভেতর থেকে আসছে। আর যা সব আগের মতোই। মাঝখান দিয়ে আঁচড়ানো ছোটো করে ছাঁটা চুলে শাদা রেখা যা ছিলো তাই আছে। পাছে তার আঙুলগুলো কোন ফাঁকে ঐ চুলে বিলি কাটতে শুরু করে এই ভয়ে ইয়াকুব নিজের হাতজোড়া সরিয়ে রাখে। খাড়া নাকের নিচে গোঁফের ঝোপে শাদা কাঁটার সংখ্যা বোধ হয় একটিও বাড়েনি। গালের নীলচে আভাটা নেই, গালে অতি সংক্ষিপ্ত চিবুকে দাড়ির অঙ্কুর, তার বেশ কয়েকটির রঙ শাদা। ফ্যাকাশে ঠোঁট একটির ওপর আরেকটি টাইট করে আঁটা, চিরকাল এমনি ছিলো। চোখের ওপর শোয়ানো চোখের পাতা। ভেতরের মণির রঙ কালো কি গাঢ় খয়েরি জানা নেই। ঐ মণির দিকে কি কখনো সরাসরি তাকানো গেছে? এখন মণিজোড়া একেবারে আড়ালে চলে গেলো। চোখের পাতা আর কোনোদিন নিজে নিজে খুলবে না।

আর সামলানো যায় না। ইয়াকুবের মাথা নুয়ে পড়ে নিচের দিকে। চোখ জুড়ে মেঘ নামে। লাশের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে নেওয়ার পর তার সারা শরীরে যে গা-এলিয়ে দেওয়া অবসাদ নেমে এসেছিলো তা কেটে যাওয়ায় মাথা, চোখ ও গলাকে এখন স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরতে শুরু করলে ইচ্ছা হয় ‘আব্বা’ বলে খুব জোরে একবার হামলে উঠি। কিন্তু জীবিত আশরাফ আলির গম্ভীর ও শীতল মুখের কথা ভেবে, তার আকাঙ্ক্ষিত পিতৃ-সম্বোধন দাঁত ও নোনা জিভের চাপে বেরিয়ে আসে ফোঁপানির মধ্যে। সামনে সব ঝাপশা।

.

‘দেখতেছেন?’ কে যেন পাশ থেকে কথা বলে, তাকেও দ্যাখা যায় না, ‘ভালো করি দেখি নেন বাবা! আর কোনোদিন দেখতি পাবেন না!’

‘একটা দিন আগে আসলিও তো দেখতি পারতেন! কপাল! ‘আরে একটা দিন আগে আসলি উনার বাপে মরে? ছেইলে এখেনে থাকলি পর ডাক্তারে কি তারে বগলদাবা করি নিয়ে মাল টানতি পারে?’

‘আস্তে-আস্তে! ছেইলে তো বাপু! তিনি ছেলেন মাটির মানুষ, যে যেখানে ডেকিছে গেছেন!’

‘ঐটে কোনো কতা নয়! কপাল! অদ্দেষ্ট! শ্যাষ পর্যন্ত ছেইলেরে দেখতি পারলো না!’

‘ছেইলির জন্যি শ্যাষে দেখলে না কেমন মাথা বেঁকিয়ে দুই চোখের নাটা দুইখান ঘুরোয়ে ঘুরোয়ে দেখতিছিলো, মন্তাজ ভাই খেয়াল করিছো?’

‘করি নাই? আমারে কয়, ও মন্তাজ, একমাত্তর ছেইলে তারে দেখতি পালাম না! খপর দিও!’

‘ও মণি! তুমি এইডে কি কও? তার কি আর কতা কওয়ার হুশ ছেলো?’

‘আহাহারে! একমাত্তর সন্তান! মরার আগে তার হাতে এক ঢোঁক পানি খাতি পারলো না!’—এইসব সংলাপের শব্দ ইয়াকুবের কানে আসে, কিন্তু বাক্যে বাঁধা পড়বার আগেই গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। ছেলের হাতে পানি খেয়ে মরা কি, ছেলের উপার্জনে ভাত খাওয়ার আয়োজনও তো ইয়াকুব করে ফেলেছে। তার ধীর-স্থির বাবা আর একটা বছর ধৈর্য ধরতে পারলো না? তেইশটা বছর একেবারে একা একা কাটালো। কোথায় এই দক্ষিণের গ্রাম, এখানে কে তাকে দেখতো, কে খাওয়াতো, আদর-যত্ন করতো কে? এসবের জন্য তার পরোয়াও ছিলো না। চার মাস আগেই তো রিটায়ার করার কথা, এক্সটেনশন হলো এক বৎসরের জন্য। ইয়াকুব তখন চাকরি পেয়ে গেছে, বাপের এখন চাকরি করার দরকারটা কি? না, তার এক কথা, দিলো যখন আর একটা বছর কাজ করি। ইয়াকুবের চাকরি হয়েছে গোপালপুর শুগার মিলে, পোস্ট ছোটোখাটো, কিন্তু পারচেজে আছে, কাঁচা পয়সার জায়গা। মিলের বাড়ি পেয়েছে, হার্ডবোর্ডের সিলিং-দেওয়া দুটো টিনের ঘর, ছোট্টো উঠান, বাতাবিনেবু গাছের নিচে পাকা কলপাড়, টিউবওয়েল, কলাগাছের ঝাড়, দুটো পেঁপে গাছ। দূরত্ব যাই হোক এখান থেকে ট্রেনে চাপলে বদলাবদলি নেই, এক নাগাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সাড়ে পাঁচ ঘন্টা চললেই গোপালপুর।

কিন্তু নমাস চাকরি হলো তার, আশরাফ আলিকে একটি বারের জন্য নিয়ে যেতে পারলো না। দুই মামাকে দিয়ে বললো, চিঠি লিখলো দুবার। দুবারই তার একই জবাব, ‘কর্মজীবনের প্রান্তে অনাবশ্যক ছুটি লইয়া কর্তব্যে অবহেলা ঘটাইতে চাই না।’ চিঠির কপালেও ভাঁজ, ভুরুতে ডবল গেরো। তার পোস্টকার্ড আসতো মাসের মাঝামাঝি, পিঁপড়ের সারির মতো গুটি গুটি অক্ষর, তাতেই উপদেশ, শ্বশুরবাড়ির সকলের কুশল জিজ্ঞাসা এবং নাম ধরে ধরে ‘শ্রেণীমত সালাম ও দোয়া’ জ্ঞাপন করা। দিন যায়, সালাম পাওনাদারদের সংখ্যা কমে, দোয়াপ্রার্থীরা বাড়তে থাকে, যথাস্থানে ঠিক ঠিক লোকের নাম লিখতে আশরাফ আলির কখনো ভুল হয় না। মাসের প্রথমদিকে বরাদ্দ ছিলো মানি অর্ডারের টাকা, মানি অর্ডারের কুপন জুড়ে পিপীলিকা বাহিনীর পুনরাবির্ভাব, ফের উপদেশ, ফের কুশল জিজ্ঞাসা এবং সালাম ও দোয়া নিবেদন। কি পোস্টকার্ড কি মানি অর্ডার কুপন —প্রত্যেকটির কপালে ভাঁজ, খাড়া ও কাঁটা কাঁটা গোঁফের নিচে বন্ধ পাতলা ঠোঁট। মামারা যে তার বাপের শালা তাদের সামনে পর্যন্ত সেই ঠোঁটজোড়ার কষ একটুও ঢিলে হতো না। মামাদের মধ্যে মেজোমামাটারই ভাগ্নের দিকে টানটা বেশি। আবার আদর করে ওকে এখানে-ওখানে নিয়ে গেলে ইয়াকুব কারো সঙ্গে তেমন কথা বলতে পারতো না বলে বাড়ি ফিরে মেজোমামা মাঝে মাঝে বকতো, ‘তোর বাপ হলো হাঁড়িমুখো পোস্টমাস্টার, চিঠিতে সীল মারতে মারতে মুখখানাকেও সীলের ডিজাইনে নিয়ে এসেছে! তারই তো ছেলে, তুই আর লোকের সঙ্গে কথা বলবি কি?’ নানী তখনো বেঁচে। ছেলের এই একটি বাক্য তার সারাদিনের প্যাচালের উ ৎস খুলে দিতো : ‘তাই ভালো। বেশি রসকস থাকলে ছেলেটা সমায়ের হাতে পড়তো না? ভাগ্নেকে টাকা পয়সা খরচা করে মানুষ করার ক্ষমতা তোমাদের আছে? নিজেদেরগুলোই টানতে পারে না আবার ভাগ্নেকে লেখাপড়া করাতো, এ্যাঁ? বাপ টাকা না পাঠালে এই ছেলে কোথায় ভেসে যেতো!’

টাকাটা আশরাফ আলি পাঠাতো খুব নিয়মিত। টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে জোহরা বিবির কন্যাশোক উথলে উঠতো, ‘বিয়ের পর আঠারোটা মাসও কাটলো না! ফিরোজা, মা আমার, কি কপাল করে এসেছিলি মা’রে, ছেলেকেও ভালো করে দেখতে পারলি না! একুব, ভাইরে কি কপাল করে এলি রে ভাই, মাকে একবার দেখতেও পারলি না!’

কিন্তু নানীর কাছে, খালাদের কাছে, মামাদের কাছে গল্প শুনতে শুনতে মাকে তার একরকম দ্যাখাই হয়ে গেছে। মায়ের রঙ ছিলো চাপা, কালোর দিকেই বলা যায়, ইয়াকুব পেয়েছে মায়ের রঙ। ইয়াকুবের স্বভাবও অবিকল তার মায়ের স্বভাব। সে কারো সঙ্গে চড়া গলায় কথা বলতে পারে না, যে যা-ই বলুক না, ‘না’ বলার শক্তি তার নেই। কিন্তু আশরাফ আলির রগ অন্যরকম। আর বিয়ের সময় তার শ্বশুরের ইসলামপুরে কাটা কাপড়ের জমজমাট কারবার। তার শালাদের বয়স তখন কম, শ্বশুর কতোবার তার ব্যবসায়ে ঢুকতে বললো। তার এক কথা, ‘না’। শ্বশুর শেষ পর্যন্ত না পেরে কলেজে পড়া চালিয়ে যাওয়ার খরচ দিতে চাইলো। তাতেও ‘না’। কারো কথায় কান না দিয়ে আশরাফ আলি প্রাণান্ত পরিশ্রম করে এই চাকরি জোগাড় করলো, নতুন বৌ নিয়ে ড্যাং-ড্যাং করে রওয়ানা দিলো খুলনা না যশোর জেলার কোন গ্রামের দিকে, সেই গ্রামে সে হলো পোস্টমাস্টার। সাহসটা দ্যাখো! কয়েক মাস পরে পোয়াতি মেয়েটা আসে বাপের বাড়ি। সময়মতো ব্যথা উঠলো, মেয়ে গেলো হাসপাতালে, সেই তার শেষ যাওয়া। তার বদলে ঘরে এলো তার ছেলে। তা আশরাফ আলি ছেলেকে নিজের কাছে রেখেই মানুষ করতো, সে যা একরোখা লোক, তার পক্ষে সবই সম্ভব। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার আগেই তার হাতে-পায় ধরার উপক্রম করে জোহরা বিবি, বড়ো মেয়ের একমাত্র স্মৃতিটাকে সে কোলেপিঠে করে রাখতে চায়।

আশরাফ আলির তখন যা বয়স তাতে তার বিয়ে না করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর ‘রাজপুত্র জামাই আমার, মিছে কথা বলবো কেন?–মেয়ের তুলনায় জামাই আমার অনেক সুন্দর! তুই তো হয়েছিস একটা ছুচো! একে তো কালো হলি মায়ের মতো, আবার বাপের মতো যদি একটু উঁচা-লম্বাও হতিস!’ সেই ফর্সা-লম্বা আশরাফ আলি মা-মরা ছেলেকে রেখে ফের চলে যায় পোস্টমাস্টারি করতে, কতো জায়গায় যে ঘুরলো, এই কুষ্টিয়া, এই যশোর-খুলনার গ্রামেই বেশি। ডুমুরিয়া, বাহিরদিয়া, দিয়ানা, নলতা, নাভারন, নীলমণিগঞ্জ, আলমডাঙা—নিজেরই হাতে মারা কতো ডাকঘরের সীল যে তার লেখা পোস্টকার্ডে থাকতো! এর কয়েকটি জায়গায় ইয়াকুবও গেছে। আশরাফ আলি নিজেই একবার নিয়ে গিয়েছিলো তখন এ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ, শীতকাল ছিলো। ইয়াকুব তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। আলমডাঙা, কুষ্টিয়া জেলার সাব-পোস্টঅফিস। তারপর আর একবার ডুমুরিয়া গিয়েছিলো ছোটোমামার সঙ্গে। আশরাফ আলির অসুখের খবর পেয়ে জোহরা বিবি দুজনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।

কিন্তু রোগশয্যায় শুয়ে আশরাফ আলি ভ্রু কোঁচকায়, ‘আমার অসুখ? কে বললো?’

‘আপনার চিঠিতেই তো ছিলো। মা বললো। ছোটামামা মিনমিন করে, ‘ইয়াকুবকে বোধ হয় লিখেছিলেন।’

টাকা পাঠাতে সেবার একটু দেরি হয়। তাই মানি-অর্ডারের কুপনের এক কোণে হঠাৎ লেখা হয়ে গিয়েছিলো, ‘শারীরিক দুর্বলতার দরুন পত্র দিতে বিলম্ব হইল।’

আশরাফ আলির মুখ লাল হয়ে যায়, ব্যস, ‘এই জন্যে দু’জনে ড্যাংড্যাং করে চলে এলে? স্কুল-কলেজ থেকে নাম কাটানো হয়ে গেছে?’

ছোটোমামা তখন নতুন-নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছে, তার খুব রাগ হয়েছিলো। ঢাকায় ফিরে রাগ ঝাড়লো মায়ের ওপর, ‘অসুখের খবর শুনে গেলাম। মনে হয় মার্ডার করে তার কাছে গিয়েছি শেলটার নিতে! আরে, মানুষের রোগে মানুষ যাবে না? অসুস্থ লোককে দেখতে গেলেই তার প্রেসটিজ পাঙচার হয়ে গেলো?’ ছোটোমামার কথা শুনে রাগে ইয়াকুবের গা জ্বলে যায়, কিন্তু কাউকে চড়া করে কথা বলা তার সাধ্যের বাইরে। সুতরাং মনে মনে কেবল ফোঁসে, আমার বাবা কি তোমাদের মতো মাগী টাইপের? তোমাদের মতো নাক দিয়ে দু’ফোঁটা জল পড়লেই ফোঁৎ ফোঁৎ করে রাজ্যময় ন্যুমোনিয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে বেড়ায় না। স্যাতঁসেতে কথাবার্তা শুনতে তার বাপের ঘেন্না হয়। ইয়াকুবের নিজেরই কতোবার বাবার সঙ্গে সোহাগ করতে ইচ্ছা করেছে, আশরাফ আলি আমল দেয়নি। ওর বড়োমামা অফিস থেকে ফিরলে বড়োমামার ছেলেমেয়েরা বাপের সঙ্গে কি জড়াজড়িটাই না করে! বড়োমামা কেমন দিব্যি এই টুকুকে চুমু খাচ্ছে, খুকুকে নিয়ে লোফালুফি করছে। আর মেজোমামা তো দোকান বন্ধ করে বাড়ির কাছাকাছি এসে ‘আমার আব্বুজান’, ‘আমার বাপপুজান’ বলে চ্যাঁচাতে শুরু করে। অনেকদিন পর একবার আশরাফ আলি বাড়ি এসেছে। ইয়াকুব এক দৌড়ে দরজায় গিয়ে ‘আব্বু’ বলে বাপের বুকে উঠে গলা জড়িয়ে ধরলো। আশরাফ আলি আস্তে আস্তে তার হাত দিয়ে ছেলের হাত দুটো খুলে তাকে মেঝের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে বলে, ‘বয়স হলে ন্যাকামো শোভা পায় না।’

আর একবারের কথা খুব মনে পড়ে। দুতিনদিন পরপর স্বপ্নে মসজিদের মতো একটি জায়গার সামনে দাঁড়ানো অস্পষ্ট নারীমূর্তির হাতছানি দেখতে পেয়ে ভয়ে ইয়াকুবের জ্বর এসে গিয়েছিলো। তখন খুব ছোটো নয়, বারো তেরো বছর বয়েস। জ্বরের ঘোরে তার প্রলাপ বকা শুনে জোহরা বিবি ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে আর মৃত কন্যার উদ্দেশ্যে বিলাপ করে, ‘মাগো, ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে হাত বাড়ালি? মারে, তোর ছেলেকে এতোটা বড়ো করলাম, কেন নিবি মা?’ টেলিগ্রাম পেয়ে বেনাপোল থেকে বাবাকে চলে আসতে হয়। শাশুড়ির কাছে পুত্রধনের স্বপ্নদর্শনের কথা শুনে তার চাপা ঠোঁট আরো সেঁটে যায়। ফিরে গিয়ে পাক্ষিক পত্রে আবার ভ্রূ-কোঁচকানো উপদেশ : জাগ্রত অবস্থায় তরল বিষয়ের প্রতি অবাঞ্ছিত মনোযোগ ও অহোরাত্র লঘু কল্পনার জগতে অনুচিত বিচরণই এইরূপ স্বপ্নদর্শনের কারণ। চিত্ত উচ্চস্তরের চিন্তা দ্বারা শক্তিশালী হইলে এইরূপ কলঙ্ক ঘটিবার সম্ভাবনা রহিত হয়।

কতোক্ষণ ধরি গল্পগুজব করলে! উজির আলি সরকার এলো, তার সাথে কতো ঠাট্টা-ইয়োর্কি, কতো হাসাহাসি!’ এই পর্যন্ত বলার পর লোকটার গলায় কাঁদো-কাঁদো স্বর ফোটে, এতো হাসিখুশি মানুষ, এরকম কাউরি কিছু না বলি চেরটাকালের মতো বিদায় নিয়ে যায়, এ্যা? মন তো শান্তি পায় না বাবা, মনকে বুঝ দিতি পারি না!’ ইয়াকুবের পিঠে হাত রেখে বলে, ‘আমারে তুমি চেনো না বাবা! আমার নাম এহোসান আলি, ডাক্তারি করি, বাজারে ডিসপেন্সারি আছে। এহোসান ডাক্তারের দোকান বললি কাপপক্ষীও চেনে। তোমার আব্বার বন্ধু বলো আত্মীয় বলো ছোটোভাই বলো–আমাদের ওঠা বসা খাওয়া-দাওয়া সব এক সাথে ছেলো, বুঝেছো? আমি রয়ে গেলাম মানুষের নাড়ি টিপতি, আর যে মানুষ সদাসর্বদা হাসিয়ে রাখতো, হাস্যরসে সর্বজনেরে মাতিয়ে রাখতো, সেই কিনা সবারে কাঁদায়ে চলি গেলো। এ্যা?’ লোকটার কথা সব স্পষ্ট শোনা গেলো। নোনতা জল ভরা চোখ ও বাষ্পাচ্ছন্ন মাথাতেও ইয়াকুবের অস্বস্তি লাগে। লোকটা কে? –গ্রামের ডাক্তার, এহসান ডাক্তার। কার সম্বন্ধে কথা বলছে? –বাবার সম্বন্ধে? বাবার মুখটা ভালো করে দ্যাখা দরকার। হ্যাঁ, সেই আশরাফ আলিই বটে! সেই ছোট্টো চিবুক, সেই গাল এবং পান-না-খাওয়া ও বিড়ি-না-টানা চাপা ঠোঁট এইসব মিলেই গম্ভীর মুখমণ্ডল, মামারা খালারা যাকে বলতো পোস্টঅফিসের সীল 1 বড়োখালার রিপোর্ট অনুসারে আশরাফ আলির টাইপটা শুরু থেকেই এ রকম।

আশরাফ আলি পড়াশোনা করতো ফিরোজার মামার বাড়িতে থেকে। সে মামাবাড়ি ওদের একই রাস্তায়, বেচারাম দেউড়ির এমাথা ওমাথা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে খড়ম পায়েই সে মিটফোর্ড হাসপাতাল পর্যন্ত দুটো চক্কর দিয়ে আসতো। এই প্রাতঃভ্রমণ করতে করতে নিমের দাঁতনে মেসওয়াক করা। ফজরের নামাজ পড়ে মাথার কিস্তি টুপি না খুলেই ফিরোজার মামাতো ভাই-বোনদের সে কড়াকিয়া শতকিয়া মুখস্থ করাতো। সাড়ে নটার দিকে তার পরনে পাজামা-শার্ট, অর্থাৎ এখন তার কলেজে যাওয়ার সময়। আশরাফ আলি থাকতো একটা ঘরে একাই। তার ঘরে কোনো টেবিল ছিলো না। তোষকটা ছোটো থাকায় তক্তপোষের একদিকে বেরিয়ে পড়তো। ওখানে আশরাফ আলির বইপত্র সাজানো থাকতো। তক্তপোষের নিচে সে রেখে দিতো পুঁটলিতে বাঁধা চিঁড়ে-গুড়। আর ছিলো কাগজে জড়ানো চিরতার কাঠি। খিদে পেলে দরজা বন্ধ করে আশরাফ আলি শুকনো চিঁড়ে খেতো। ‘বুঝলি না, তোর বাবা ছিলো পুরো গাঁইয়া, তোরা আজকাল ‘খ্যাত’ বলিস না–সেই মাল।’ বড়োখালাম্মার কথাবার্তা ভয়ানক কাটা-কাটা, শুনতে একটুও ভালো লাগে না, ‘তোর বাবা কলেজে গেলে কি মসজিদে গেলে আমরা তার ঘরে ঢুকে চিঁড়ে খেয়ে ফেলতাম, চিরতার কাঠি ফেলে দিতাম, আর তোর বাপ ফিরে এসে সবই বুঝতো, রাগে গজগজ করতো, মেয়েদের ঠাট্টা বোঝার ক্ষমতাও তার ছিলো না। মেয়েদের দিকে তাকানো তো দূরের কথা, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গেও তার বলতে গেলে কোনো সম্পর্কই ছিলো না।

বাবা থাকতো তার পড়াশোনা নিয়ে, অঙ্ক-বাঙলা ভালোই জানা ছিলো, দিনরাত্রি হয় লেখাপড়া নয় কোরান তেলাওয়াৎ। ইংরেজিটা রপ্ত করতে পারেনি বলে আই. এ আর পাস করা হয়নি। খালাম্মা বলে ‘বিয়ে হলে আমরা ভাবলাম আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। হায়রে কপাল! কিসের কি? একটা ইঞ্চি যদি বদলায়!’

অতো সোজা! তার বাবা তো বদলাবার লোক নয়। বিয়ে তো তুচ্ছ কথা, মরণের পরও আশরাফ আলি একটুও বদলায়নি। সেই টাইট করে সাঁটা ঠোঁট, সেই কাঁটাঝোপের গোঁফ। তার মাজা ছিলো সোজা, পায়ের পাতায় জোর ছিলো, তাই নিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছে, কাউকে পরোয়া করেনি। দ্যাখো না কেমন ডাঁটসে শুয়ে রয়েছে। তোমরা একবার দ্যাখো না! এই মুখে হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য ইয়াকুবের দুই হাতের আঙুল নিসপিস করে! কিন্তু না। একটুও বিরক্ত করতে সাহস হয় না।

.

‘বাবা, এসেছো?’ দরজার ওপার থেকেই মেজোমামার ভেঙে-পড়া গলা শোনা যায়। মেজোমামা এসে ইয়াকুবকে জড়িয়ে ধরে, নাই! নাই! নাই! এতিম হয়ে পড়লি বাবা! তোর মামী শুনে কাঁদতে কাঁদতে গড়ায় আর বলে একুব এতিম হয়ে গেলো। এই শোকাহত আলিঙ্গনের ফলে মেজোমামার বুকে ইয়াকুবের মুখ, মেজোমামার বুকের শক্ত মাদুলিটা তার নাকে বড়ো কঠিন লাগে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজোমামা ইয়াকুবকে ছেড়ে ‘দুলাভাই! দুলাভাই!’ বলে চশমা খুলে খাটিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে আশরাফ আলির বুকে নিজের মুখ ঘষতে শুরু করে। মেজোমামার এসব কাজ অনুমোদন করা যায় না। এই মাখো-মাখো ভাব আশরাফ আলির অসহ্য। আশরাফ আলি মরতে না মরতে এই লোকটা কি তার স্বভাব একেবারে ভুলে গেলো?

এহসান ডাক্তার এসে মেজোমামাকে ধরে বাইরে নিয়ে যায়, ‘আপনে এমন ভেইঙে পড়লি চলবে কেনে? ভাইগ্নেরে বুঝোয়ে সুজোয়ে থামান। বাদ জোহর জানাজা পড়ি আসরের আগেই দাফন সেরি ফেলতি চাই।’

এহসান ডাক্তার বাইরে গেলে স্বস্তি পাওয়া যায়। আব্বা বোধহয় এই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাতো। আব্বার কি রোগ? তবে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক নিশ্চয়ই খুব ভালো ছিলো? মনে হয় আশরাফ আলির জন্য শোকটা বেচারার চামড়া ফুঁড়ে আরেকটু ভেতরে বিঁধে গেছে। তাই কার সম্বন্ধে কি বলছে ঠিক ঠাহর করতে পাচ্ছে না।

ফের ভেতরে এসে মেজোমামা আলগোছে ওর পিঠে হাত রাখলে শিরদাঁড়া শির শির করে ওঠে, বলতে ইচ্ছা করে, ‘মেজোমামা, আর একটা বছর বাঁচলে আব্বা আর আমি এক সঙ্গে থাকতে পারতাম! সারাটা জীবন আব্বা একা থাকলো, আব্বার জন্যে কিছুই করতে পারলাম না!’ কিন্তু বলা হয় না। আশরাফ আলির কাফন-মোড়া লাশ লোবান-ধূপের গন্ধের তর্জনী তুলে আদিখ্যেতা করতে বারণ করে। মোজোমামাকে বাইরে ডেকে নিয়ে কারা যেনো বাঁশ-চাটাই কেনার টাকা চেয়ে নেয়। আবার সে যেনো বলে, ‘হাট ছাড়া চাটাই পাওয়া যাবে না।’ হাট কোথায়? –হাট কাছেই, দেড়ক্রোশ পথ, কিন্তু বৃহস্পতিবার ছাড়া হাট বসবে না। ডাক্তার পরামর্শ দেয়, দ্যাখো তো কুসুমহাটিতে যাও দিনি, মুকুন্দ সাহার গদিতে চাটাই থাকতি পারে।’

‘মুকুন্দ সাহা খুচরো বেচপে?’

‘শালা চামার! বেচতে চাইবে না। দুটো পয়সা বেশি দিলি পরে শালার বাপে ঘাড়ে করি এইনে দিয়ে যাবেখন।‘

আধ ঘণ্টার মধ্যেই আর একজন কে চলে এলো, ঢুকতে ঢুকতেই বলে, ‘কখন হলো? কিভাবে হলো? কি হয়েছিলো বলো দিনি? এ্যা? এখন গফুর পিওন গিয়ে বলে, ও বাবু, মাস্টার সাহেবের জন্যি চাটাই কেনবো। —চাটাই ক্যানে? চাটাই দিয়ে কি হবে?—না, মাস্টার সাহেব মরি গিয়েছে, কব্বরে চাটাই লাগবে!’ বেঁটে ও কালো লোকটা ধৃতির খুঁট দিয়ে চোখ মোছে, ধরা গলায় বলে, ‘আমারে কেউ খবর দিলে না, এ্যাঁ! পেরায় হাটে আমার গদিতে গিয়ে হাঁক দিতো, ও সাহামশায়!—ব্যস তেনি ঘরে ঢুকলেন তো আমরা কাজকাম বন্ধ করি তারেই ঘিরি বসলাম। মাস্টার সাহেব এলি পরে কিসের হিশেব-নিকেশ, কিসের বেচা-কেনা। এই বয়সে কতো পোস্টমাস্টার দ্যাখলাম, বিটিশ আমল, পাকিস্তান–কতো দ্যাখলাম। এরকম মাটির মানুষ কোনোদিন এই পোস্টঅফিসে আসে নাই। কি রসিক মানুষ, একবার গল্পগুজব শুরু করলো তো রাত দশটাই কি আর বারোটাই কি?’

ইয়াকুব বেশ ঝামেলায় পড়ে, তার মাথার গাঁথুনি শিথিল হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। ছবিতে স্মৃতিতে, চোখে ঠোঁটে চিবুকে, প্রোফাইলে প্রোট্রেটে আশরাফ আলিকে যেভাবে সে গড়ে তোলে, এই সব সংলাপের তোড়ে সবই দারুণরকম টাল ধায়।

‘সেদিন কি করিছেন, জানেন? কবে? গত হাটের দিন এট্টু দেরি করি গেছে। হাট ভেঙি গিয়েছে, রাত্রি সোয়া আটটা হবে। আমি খবর শুইনে রেডিও বন্ধ করি দিয়ে গদিতে বসিছি তো মাস্টারসায়েব গিয়েই বললেন, ও মুকুন্দবাবু, নীলমনিগঞ্জ ইস্টিশনের কাছে বড়ো এ্যাকসিডেন হয়ি গেলো, খবরে বলে নাই?–না তো। কোয়ানে?—আরে এই তো নীলমনিগঞ্জ—আহা কোমল হিরদয়ের মানুষ, বলতি বলতি কেঁইদে ভাষায়!’ তার কথা শেষ হতে না হতে ধূতি পরা আর একজন লোক বললো, ‘সোমবার সন্ধ্যায় হাই ইস্কুলের ফিল্ডে বসি ঐ এ্যাকসিডেন নিয়ে কতো আক্ষেপ করলে, কতো দুঃখ করলে! বলে, নিতাইবাবু, ঐ গাড়িতে আমিও থাকতি পারতাম না? আমার ছেইলে চাকরি করে গোপালপুর, রাজশাহী জেলা, তো তার ওখানে যাতি হলি তো আমার ঐ লাইনেই যাতি হবে, আমিও তো থাকতি পারতাম! — বলেন আর কাঁদেন। আমরা বলি মাস্টার সাহেব নরম মানুষ তাই সতি পারতিছেন না। আসলে কি? মরন তারে জানান দিয়ে গেছে, বুইলেন না?’

এসব উক্তি কার সম্বন্ধে করা হচ্ছে? সামনে শোয়ানো কাফন-ঢাকা মৃতদেহ ভালো করে দ্যাখা দরকার। মুখের কাপড় তুললেই তো দ্যাখা যায়। ভরসা হয় না। সেই গম্ভীর চেহারা ভেদ করে যদি কারো হাসিখুশি মুখ ভেসে ওঠে, তাহলে?

তবে নিতাই কুণ্ডুকে দ্যাখাবার জন্য গফুর পিওন কাপড়টা তুললে ইয়াকুবও ঝুঁকে পড়ে। না, কোথায়? এসব লোক কি বলছে? বাবার সেই মুখ, সেই আটকানো ঠোঁট। সেই ঠাণ্ডা কপাল। এমনকি প্রাণপণ মনোযোগে খুঁটিয়ে দেখলে শুকিয়ে যাওয়া জলের রেখার মতো বিরক্তির পাকা দাগটাও পাওয়া যেতে পারে। বোধহয় আর আধ ঘন্টাও থাকবে না। এই তো শেষ। এর মধ্যেই যা দ্যাখার শেষবার দেখে নাও। এই তো তার বন্ধ দুটো চোখ, চোখের ভেতরে মণি দুটো দ্যাখা যায় না। কপালের ভাঁজ খসে পড়ছে, একটু আগে অস্পষ্ট যে রেখার অনুসন্ধান চলছিলো তার সমস্ত সম্ভাবনা মসৃণ ফর্সা চামড়ার নিচে অস্ত গেছে। দুই ঠোঁটের টাইট গাঁথুনি কি আলগা হয়ে আসছে? এইবার এই ঠোঁটজোড়া কি অট্টহাসির ওজন নিয়ে গড়িয়ে পড়বে তারই মাথার ওপর? নিজের মাথায় হাত রেখে ইয়াকুব আরো তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, এই কি আশরাফ আলি? এই তো তার বাবা?

.

‘কলেমা শাহাদৎ পড়েন, সকলেই পড়েন?’ যিনি নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি হলেন সাব রেজিস্ট্রার, এক্ষুণি এলেন, এসেই কবরযাত্রীদের নেতৃত্ব ও লাশের খাটিয়ার একটি অংশ তার পাঞ্জাবী আবৃত স্কন্ধে তুলে নিলেন।

‘আশহাদো আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আশাহদো আন্না মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ। পালাক্রমে সবাই লাশ বহন করে। ইয়াকুব একেকবার তার বেঁটে ঘাড় পেতে দিলে ঘাড়ের ওপর খুব হাল্কা ঠেকে। তার পা জোড়া টলমল করে ওঠে : খাটিয়া কি শূন্য? আশরাফ আলি জীবনে কোনোদিন ভালো করে কথাও বললো না, মরণের পর তার এ কিরকম আচরণ? এই আচরণ বুঝতে না বুঝতে শবযাত্রা গ্রামের গোরস্তানে পৌঁছে যায়। জানাজার পর সাব রেজিস্ট্রার বলে, ‘তোমার বাবার হয়ে মাফ চেয়ে নাও। পোস্টমাস্টার সাহেব ছিলেন সদাহাস্য সদাপ্রফুল্ল ব্যক্তি। সকলেই তাঁকে ভালোবাসতো। আপনারা তাঁর ওপর কোনো দাবি রাখবেন না।

ডাক্তার বলে, ‘মাফ চাও বাবা?’

‘কেন?’

মেজোমামা বলে, ‘মাফ চাও। তুমি তাঁর একমাত্র সন্তান।’

ডাক্তার প্রম্পট করে, ইয়াকুব বলে, ‘আপনারা, আপনারা, আপনারা আমার বাবাকে মাফ করে দেবেন।’

লাশ নামাবার জন্যে কবরে তিনজন লোক দরকার। প্রথমে নামলো মেজোমামা, তারপর গফুর পিওন। ইয়াকুব নামবার উদ্যোগ নিতেই মেজোমামা বলে, ‘তুমি নেমো না বাবা, তুমি ধরতে পারবে না।’ তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনাদের একজন নামেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, পাক-সাফ থাকে—এমন কেউ আসেন।’ কিন্তু ধার্মিক ও পবিত্র কেউ নামবার আগেই ইয়াকুব নেমে পড়লো।

‘মুর্দার মুখ পশ্চিম দিকে করে দাও, কেবলামুখী করো।’

‘একবার মুখের ঢাকনা খোলো, সবাইকে দ্যাখাও বাবা।’

ইয়াকুব নিজেই ভালো করে দেখতে চায়। কিন্তু চোখের সামনে মোনাজালের জাফরি কাটা পর্দা। বাবার ঠোঁটের কোণে কি তার চোখের জল ঢেউ খায়? ফর্সা রঙের শান্ত কপালে একটা পেন্সিলের রেখা এঁকে দিলেই বাবার পরিচিত বিরক্ত মুখটা দ্যাখা যেতো। এখানকার লোকজন কি এই দাগটা কোনোদিন দেখতে পায়নি? নাকি এটা অন্য কারো মুখ? নাকি সে এতোকাল অন্য কাউকে দেখে এসেছে? কাকে?—নিশ্বাস নেওয়ার জন্য ইয়াকুব ওপরের দিকে মুখ তোলে।

আসরের নামাজের পর সবাই স্কুলের মাঠে বসলো। হেডমাস্টার, সাব রেজিস্ট্রার, স্টেশন মাস্টার, রেলওয়ের এক গার্ডসায়েব, এহসান ডাক্তার, করিম গাজী, রজব আলি সানা—এরা সবাই চায় যে কুলখানিটা এখানেই হোক। ইয়াকুবদের কোনো অসুবিধা হবে না, খাটাখাটনি যা সব এরাই করবে। তিনদিন পর অনুষ্ঠান শেষ হলে ইয়াকুর ও তার মামা ফিরে যাবে।

সাব রেজিস্ট্রার লোকটার গঠনমূলক উপদেশ দেওয়ার বাতিক, ‘দ্যাখো, বেশি খরচ করো না, ফকির মিসকিন খাওয়াও, ম্যাক্সিমাম ২৫/৩০ জন, কোরান খতম করাও, মিলাদ পড়াও, তাহলে তোমার আব্বার রুহের শান্তি হয়।’

‘কার?’

ইয়াকুবের এই প্রশ্নে তার বিচলিত চিত্তের কথা ভেবে লোকজন আরো অভিভূত হয়। করিম গাজী বলে, ‘আহা রে, বাপের মতো নরম স্বভাব পেইয়েছে! মাটির মানুষ বাবা, তিনি ছেলের মাটির মানুষ। আমার মেইয়ে বুয়েছো, এই এতো বড়ডি হইয়েছে’ করিম গাজী মাঠে আসন পেতে বসেই হাত উঁচু

পরে মেয়ের বয়স বোঝাবার চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে কেবল তার আড়াই হাত উচ্চতাই বোঝা যায়, ‘তো সে মেইয়ে জামগাছ থেকে পড়ি জখম হয়েছে। তাই সে আসতি পারলে না, মাস্টার সাহেবের খবর শোনবার পর থেইকে সে কেইন্দে-কেইটে একাকার।’ বলে করিম গাজী নিজেও ফোঁৎ-ফোঁৎ করে নাক ঝাড়ে এবং খোনা গলায় কোঁকায়, ‘জামগাছ থেইকে পড়ার পর মেইয়ে আমার খালি চেঁচায়, খালি কান্দে, দুতিনদিন তার খাওয়া দাওয়ার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তার মা কেইন্দে মরে, একটা দানা যদি মেইয়ের মুখি দেওয়া যায়। শেষ মেষ মাস্টারসাহেব দেখতি গেলো — নিজে হাতে মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেইখে তার মুখি তুলি দেয়, তবে তার পেটে অন্ন পড়ে। মাস্টারসাহেব বলে, ‘ও মনি তুমি না খাও তো তোমার এই বুড়ো ছেলিটা না খেয়েই মরবে।’

এদিকে ইয়াকুবের পাশে বসে গফুর পিওন মেজোমামার কানে ফিস-ফিস করে, ‘শালার এহোসান ডাক্তারই মাস্টারসায়েবরে খেলো, বুইলেন? শালা পেত্যেক দিন নিজির দোকানে বসি ওয়ারে মৃতসঞ্জীবনী খাওয়াতো। বাঞ্চোৎ কিপ্টের একশেষ, নিজেও ওঁয়ার পয়সায় বোতল বোতল মাল গিলতো। মাস্টার সাহেবের বুকির ব্যথা হলো মাল খেতি খেতি! এই মাটির মানুষটারে, শালা শেষ করি ফেললো!’ মেজো মামা শুনে ভয়ে অস্থির, থাক বাবা এসব কথা এখন থাক।’ গফুর পিওন থামতে চায় না। কিন্তু করিম গাজীর কথা তখন বক্তৃতায় গড়িয়ে পড়েছে, সুতরাং মেজোমামার অখণ্ড মনোযোগ এখন সেই দিকেই। ‘বুঝলেন, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, ধনী-নির্ধন, হিন্দু-মুসলমান সকলেই তার উন্নত চরিত্রের কথা মনে করিয়া মুগ্ধ হইত।’ মনোযোগী জনতা দেখে করিম গাজীর গলা চড়ে। সাব রেজিস্ট্রার তখন সভাপতিসুলভ ভঙ্গিতে বলে, ‘অনেকেই অনেক কথা বলবেন। তাঁর কথা বলে শেষ করা যায় না। তবে আমার মনে হয়, আমি বলতে চাই যে, তাঁর রসবোধ বা হাস্যরস বা রসিকতাই তাঁহার চরিত্রের সর্বপ্রধান গুণ। এখনো আমার চক্ষু দুইখানি বন্ধ করলে তাঁর হাসিমুখের প্রসন্ন মূর্তিখানি আমার সামনে প্রতিভাত হইয়া ওঠে।’

রাত্রে পোস্টঅফিস সংলগ্ন আশরাফ আলির বাসগৃহে আশরাফ আলির চওড়া তক্তপোষে শুয়ে মেজোমামা হু-হু করে কাঁদে। লোকটা বড্ডো কাঁদতে পারে। নানীর মৃত্যুর পর এক মাস ধরে এক নাগাড়ে কান্নাকাটি করেছে। একটু বিরতি দিয়ে সে ডাকে, ‘গফুর।’ গফুর পিওন বারান্দায় মশারি টাঙাচ্ছিলো। সে এলে মেজোমামা বলে, ‘এক গ্লাস পানি খাওয়াও তো ভাই।’

হ্যারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে ঘরের দেওয়াল, বিছানা, টেবিল, আলনা, জলের কুঁজো, দড়িতে ঝোলানো গামছা, লুঙি সব দুলে উঠলো পানি-খাওয়া ঠাণ্ডা গলায় বলা মেজামামার কথাও শিরশির করে কাঁপে, ‘দুলাভাই এখানে খুব পপুলার ছিলো, না রে?’ শুয়ে পড়তে পড়তে মেজোমামা ফের বলে, ‘হ্যারিকেন কমাবার দরকার নেই।’

এই ঘর, দেওয়াল, বিছানা, দেওয়ালের ছায়া—সবই ইয়াকুবের অপরিচিত। আশরাফ আলি এই ঘরে পাঁচ ছয় বৎসর কাটিয়ে দিয়েছে, তেইশটা বছর সে এইভাবে জীবন যাপন করেছে। এই বিছানায় শুয়ে থাকতো। শালার মেজোমামাকে হটিয়ে এখানে আশরাফ আলিকে দিব্যি শুইয়ে দেওয়া চলে। কিন্তু বাবার মুখটা এই সময় হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কবরে নামাবার পর চোখের পাতা খুলে মণি দুটো ভালো করে দেখে নিলে হতো। যে বালিশে আশরাফ আলির মাথা রাখার কথা তার একটি কোণে আঙুল দিয়ে ঘষলে তার চোখের পাতা ওপরে ওঠে এবং অপরিচিত চোখের মণি ভালো করে মেলতে না মেলতে বুজে যায়। লণ্ঠনের আগুন, কেরোসিন ও ধোঁয়ার মিলিত গন্ধে ইয়াকুবের নাক খচখচ করে। ফলে তার নিজেরই তৈরি বিভ্রম ভেঙে গেলেও সে মন খারাপ করার সুযোগ পায়না।

এই চেয়ে বাবার ওপর রাগ করতে পারলে বরং একটু স্বস্তি পাওয়া যায়। আব্বার ওপর রাগ করার কারণ কাছে বৈ কি? না জীবনে, না মরণে–লোকটা কোনোদিনই তাকে পাত্তা দিলো না। এদিকে দ্যাখো, এহসান ডাক্তারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে বোতল ওড়ায়। কার না কার মেয়ে জামগাছ থেকে পড়ে ঠ্যাং ভাঙলে কোন অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে তার জন্যে ভাত মাখে। —কিন্তু বাবাকে শালা জুৎ করে কোথাও বসানো যাচ্ছে না। দেখতে না দেখতে সব হাওয়া হয়ে যায়। দরজায় লম্বা একটি ছায়া পড়লো, সেদিকে ভালো করে তাকাবার ভরসা হয় না, পাছে নতুন কাউকে দ্যাখে। বুকে বল ধরে ইয়াকুব যদি বা মুখ ফেরালো তো দ্যাখো কোথায় কি? কেউ নেই, কিচ্ছু নেই।

বাবাকে না পেয়ে তার ওপর রাগ করার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে মাথা নিচে নেমে আসে, দুই হাঁটুর মধ্যে কখন মাথা গোঁজা হয়ে যায়। তিন মিনিটের তন্দ্রায় একটা মাঠে বসে কয়েকজন গল্পগুজব করে। এটা কোথাকার মাঠ?–কোন মাঠ, কোন মাঠ—ঠাহর করতে করতে উচ্চকণ্ঠ হাসির দমকে মাঠটা ছড়িয়ে পড়ে বিশাল প্রান্তরে, সেখানে মাঠের কোনো চিহ্নই আর বাকি থাকে না। এমন করে হাসে কে?

সন্ধ্যাবেলার ময়লা শূন্যতা ঝোলে, তার ফাঁকে ফাঁকে হেডমাস্টারকে দ্যাখ্যা যায়, তার পাশে সাব রেজিস্ট্রার। এহসান ডাক্তার আছে, করিম গাজী আছে, জামগাছের ভাঙা ডাল থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে তার আড়াই হাত লম্বা মেয়ে। কিন্তু আশরাফ আলি কোথায়? এরকম জোরে জোরে হাসছে কে? আশরাফ আলির হাসি ইয়াকুবের অপরিচিত। তাকে সনাক্ত করে কি করে? ফের দমকা একটা হাসি বেজে উঠলে তার তন্দ্রা একেবারে তছনছ হয়ে যায়। চোখ মেলে ইয়াকুব শূন্য ঘর দ্যাখে। বাবা কোথায়? নেই।

ভোর হবার আগেই মেজোমামাকে ডেকে ইয়াকুব বলে, ‘মেজোমামা, ছ’টার ট্রেনে আমি চলে যাই।’

দরজা খোলা, বারান্দায় গফুরের মশারি হাওয়ায় কাঁপে। ভোরবেলায় বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। মেজোমামা পিঠের নিচে থেকে বিছানার চাদর তুলে গায়ের ওপরে চড়িয়েছে। জড়োসড়ো হয়ে বসে মেজোমামা বলে, ‘কি?’

আমার অফিসে অনেক কাজ, আজ বরং আমি চলে যাই।’

কিছুক্ষণ পর মেজোমামা উঠে দাঁড়ায়, ‘কেন? কুলখানি না পরশু!’

‘আপনি ম্যানেজ করে নেবেন।

মেজোমামা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, ‘ভয় করে? স্বপ্ন দেখেছিস?’

‘নাঃ! ভয় কিসের?’ প্যান্টের ভেতরে শার্ট গুঁজে দিতে দিতে ইয়াকুব বলে, ‘যাই মামা।

‘খারাপ লাগছে? একা একা আরো খারাপ লাগবে। কুলখানির পর আমিও তোর সঙ্গে যাবো। তোর অফিসারকে বলে সপ্তাহখানেকের সি. এল নিবি, তারপর একসঙ্গে ঢাকা যাবো, তোর মামানীও বলে দিয়েছে।’

এই লোকটা বৌয়ের রেফারেন্স ছাড়া কথা বলতে পারে না।

‘শোন ইয়াকুব, আমার কথাটা রাখ। কুলখানি সেরেই যা।’

‘কার?’

ইয়াকুবের জন্য মেজোমামার খুব খারাপ লাগে। ছেলেটা এতিম হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে বলে, ‘লোকজন মাইণ্ড করবে। তোর বাবাকে এখানকার লোক খুব ভালোবাসতো।’

‘কাকে?’

লোকজন কাকে ভালোবাসতো? বাবার মুখটা সম্পূর্ণ নিয়ে আসার জন্য ইয়াকুব আরেকটা এ্যাটেম্পট্ নিলো। গম্ভীর একজন লোক একবার হাতের নাগালে আসে তো আরেকজনের গ্লাস থেকে ঢালা মদের ছলকে সমস্ত গাম্ভীর্য মুছে যায়। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হাসিখুশি মুখ করে একটি বালিকার জন্য মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখে। দেখতে দেখতে ভাতের থালা তার সামনে থেকে সরে যায়, লোকটা চিঠি লিখতে বসে, তার টাইট মুখের নিচে ও তার শক্ত আঙুলের ঠিক তলায় বেরিয়ে আসে পিপঁড়ের সারি, তার ভ্রূর গেরো কঠিন হতে থাকে। এই পরিচিত লোকটিকে তার চোখের মণিতে এঁটে রাখবার জন্য ইয়াকুব মনোযোগী হতে না হতে নীলমনিগঞ্জে রেল এ্যাকসিডেন্টের খবরে কাঁদতে থাকা লোকটির চোখের জলে সব ধুয়ে যায়। না, কেউ থাকে না, দুজনের একজনও নেই।

মেজোমামা ফের মিনতি করে, ‘ভেঙে পড়িস না বাবা! আজ বাদজোহর মৌলবি আসবে, কোরান খতম হবে; কবর জিয়ারত করবি না?’

‘কার?’ ইয়াকুবের মাথা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে, শূন্য চোখে সে মামার দিকে তাকিয়ে থাকে।

মেজোমামার মন ফের খারাপ হয়ে যায়। সারারাত ছেলেটার ঘুম হয়নি। ঢাকায় নিয়ে ভালো করে আদরযত্ন করা দরকার।

কিন্তু ভোরের আলো ভালো করে ফুটে ওঠার আগেই ইয়াকুব দরজার কাছে দাঁড়ায়, ‘যাই মেজোমামা, স্লামালেকুম।’

‘আরে দাঁড়া, রাস্তাঘাট চিনিস না, সঙ্গে গফুর যাক না!’

কিন্তু অপরিচিত রাস্তা পার হওয়ার জন্য ইয়াকুব একা একাই রওয়ানা হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *