খোঁয়ারি
অনেকক্ষণ ধরে কড়া নাড়ার পর ওপরতলা থেকে জবাব আসে, ‘আসি!’ তারপর আবার কোনো সাড়া-শব্দ নেই; গেটের ওপর মাধবীলতার ঝাড়ে চরে বেড়ায় পোকামাকড়, তাদের চলাচলের ধ্বনি ছাড়া এ বাড়ির কোনো স্পন্দন বোঝা যায় না। মাধবীলতায় ঢাকা উঁচু গেট তেমন চওড়া নয়। গেটের একটা কপাট কেটে আরেকটা ছোটো দরজা। কাঠের সঙ্গে পেরেক মেরে বড়ো গেটটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অন্তত ২২/২৩ বছর থেকে এরকম বন্ধ। সুতরাং এই বাড়িতে আসতে হলে মাথা নিচু করে ছোটো দরজা দিয়ে না ঢুকে উপায় নেই। ভেতরে ৪/৫ গজ জায়গা পাকা, পাকার ফাটলে রক্তহীন ঘাসের কদমছাঁট চাপড়া। এরপর উঁচু বারান্দা, বারান্দায় মোটাসোটা সব থাম। কখনো কখনো রাত করে বাড়ি ফিরে অমৃতলাল আদর করে জড়িয়ে ধরলে থামগুলো তার হাতের বেড়ে সবটা আসে না। সেই সব থামের ওপর দোতলা, দোতলার রেলিঙঘেরা ছাদ, ছাদের একপাশে চিলেকোঠা–নড়বড় করতে করতে শ’খানেক বছর দিব্যি কাটিয়ে দিলো। ভেতরে প্রাচীরের শ্যাওলায় ও প্রাচীর সংলগ্ন শূন্যতায় তেতো-সোঁদা গন্ধ। মাধবীলতার ফিকে সুবাসের সঙ্গে কাঁঠালিচাঁপা ফুলের ঘন গন্ধ জীবজন্তুর করোটিতে হঠাৎ করে ঢুকে মগজের সাজগোজ এলোমেলো করে দেয়। মাধবীলতা তো গেটের ওপর দ্যাখাই যাচ্ছে। কাঁঠালিচাঁপার ঝাড়টা কোথায়?
‘তাইলে আইছো?’ দরজা খোলার ক্যাচক্যাচ শব্দের সঙ্গে সমরজিতের কথা শুনলে মনে হয় পুরোনো তক্তপোষে ঘুমিয়ে পাশ ফিরতে ফিরতে স্বপ্নের মধ্যে কেউ গোঙাচ্ছে, ‘আমি কই, কৈ জইমা গেছে, আউজকা বুঝি আর আইলা না!’
সমরজিতের বয়স ৪০ ছুঁইছুঁই। তার তামাটে মুখে প্রথমে চোখে পড়ে উঁচু ও তীক্ষ্ণ নাক এবং পিচ-ওঠা সুকলাল দাস লেনের মতো ঠাসবুনুনী ব্রণের দাগে এবড়োখেবড়ো নাকের উপত্যকা। তারপর আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে তার বড়ো বড়ো চোখের গভীর কোটর। নাকের ছায়ায় ঠোঁটের ঢেউ বোঝা যায় না; ঠোঁটের ওপর কাঁচা-পাকা গোঁফ বটবৃক্ষের নিচে ঝোপের মতো, বিনয়ে নুয়ে থাকে। এই বারান্দায় কোনো বাল্ব নেই, ডি. সি. লাইনের ৪০ পাওয়ারের আলোর একটুখানি ময়লা আঁচল এসে লুটিয়ে পড়েছে দরজার পাশে, সেই আলোতে সমরজিৎকে বড়ো রোগা মনে হয়।
‘দেরি তো এখানেও হলো দোস্ত! কোড়া নেড়ে নেড়ে হাতে আমাদের কোড়া পড়ে গেলো, তুমি ছিলে কোথায়?’
‘ইফতেখার!’ সমরজিতের এই বিস্ময়ের জবাবে ইফতিখার হাসে, ‘চলে এলাম দোস্ত! ফারুকের সঙ্গে দেখা, তো বললো কে চলো সমরজিতের ঘরে চলো। ব্যস চলে এলাম।’ ইফতিখারের সংলাপে উর্দুভঙ্গি স্পষ্ট। এই উচ্চারণে বাঙলা বলে সে এ পর্যন্ত পাঁচজন বাঙালি মেয়েকে কাত করেছে, তাদের মধ্যে দু’জন বিবাহিতা।
‘চলো চলো, তাড়াতাড়ি করো’, ফারুক তাড়া দিলো, ‘রাত এগারোটায় কন্টিতে মানিক ভায়ের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট। তাড়াতাড়ি করো।’
‘চলো।’ হাই তুলতে তুলতে সমরজিৎ সরে দাঁড়ায় দরজার একপাশে। সবাই ঢুকলে সে এই দরজা বন্ধ করবে। সবার ঢুকে পড়া সম্পূর্ণ হতে হতে সে আরেকবার হাই তোলে। মুখের সামনে ডান হাতের আঙুলে তুড়ি বাজালে স্পষ্ট আওয়াজ হয় না। দরজা খোলার পর থেকে এই নিয়ে সে তিনবার হাই তুললো, প্রত্যেকের জন্য একটি নীরব অভ্যর্থনা।
এই ঘরে দুটো তক্তপোষ, দুটোই বেশ উঁচু ও পাকাপোক্ত। হাত না দিয়েও বোঝা যায় সলিড সেগুন কাঠের মাল। এর একটিতে শীতলপাটি বিছানো, অপরটিতে সতরঞ্চি পাতা, একপ্রান্তে গুটিয়ে রাখা তোষকে জড়ানো পুরু বিছানা। তোষকে হেলান দিয়ে অমৃতলাল গুছিয়ে বসছে, অমৃতলালের হাত পা ভিজে ভিজে, বোধহয় এক্ষুণি পায়খানা করে এসেছে। বসতে বসতে তাসের তাড়া হাতে সে পেশেন্স খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার মাথার ঠিক ওপরে কাগজের ফুলের মালায় হাবুডুবু খাওয়া শেখ মুজিবুর রহমান উল্টোদিকের দেওয়ালের তাকে দাঁড়ানো মুরলীধরের মুখোমুখি। দেওয়ালে কোনো জুয়েলারী দোকানের ক্যালেণ্ডারে সালঙ্কারা বাঙালি বধূ। দরজায় লক্ষ্মীপূজার সময় টাঙানো সোলার ঝরা। অমৃতলাল কারো দিকে ফিরেও তাকায় না, সে একমনে তাস বাটে। তার লম্বাটে ফর্সা মুখের পেশী একটুও কোঁচকায়নি, কপালের সরু মোটা ঢেউ যা আছে সবই পুরোনো। এই ঘর পেরোলে আরেকটি ঘর, চুন সুরকি ঝরে পড়ায় দেওয়াল একটু ভেংচি কাটে। তারপর সরু প্যাসেজের শেষ প্রান্তে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। ফারুক ও ইফতিখার ঐদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সমরজিৎ বাধা দেয়, ঐদিকে না।’
ফারুক জিগ্যেস করে, ‘ওপরে যাবে না?’
‘এই সিঁড়ির লগের দেওয়ালে কয়দিন হয় একটা চিড় ধরছে। ঐদিক দিয়া আর উঠি না।’
ইফতিখার ও ফারুক আগেও কয়েকবার এসেছে, কিন্তু আর কোনো সিঁড়ির খবর কৈ কোনোদিন শোনে নি তো।
সরু প্যাসেজ পার হলে দরজা, দরজা খুলে ফেললে আবার ঘর। সুরকি-ঝরা দেওয়ালের রঙ তবু ঝাপশা দ্যাখা যাচ্ছিলো, কারণ আলো জ্বলছে তার পাশের ঘরেই। কিন্তু এই সরু প্যাসেজ, ফের আরেকটি ঘর এসবের ভিজে ভিজে অন্ধকার ও জড় ভোঁতা গন্ধ ছাড়া আর কোনো পরিচয় বোঝা যায় না। এই ঘরের দরজা ভেজানো ছিলো। ধাক্কা দিতেই কপাট দুটো দুজন অন্ধ ভিখেরির মতো দুদিকে ঢলে পড়ে। এবার কোনো আওয়াজ হয় না। কাত হয়ে অল্প অল্প কাঁপতে থাকা কপাটজোড়ার ভেতর দিয়ে চলে গেলে চওড়া পাকা উঠান। চাঁদের ময়লা আলোতে এই উঠানকে হলদে রঙের নোংরা চাদর পাতা বিছানা বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু এরকম ভুল কেউ করে না।
সমরজিৎ সাবধান করে দেয়, ‘এট্টু দেইখা পা ফালাও। জলটল পইড়া এক্কেরে ইসে হইয়া রইছে।’
‘আস্তে হাঁটো, আস্তে হাঁটো ইফতেখার। তুমি পড়ে গেলে মীরপুর মোহাম্মদপুরে রি-এ্যাকশান হবে।’
ফারুকের এই ধমকে ইফতিখার মিনমিন করে, না দোস্ত! আমি খুব কেয়ারফুলি স্টেপ ফেলছি।
সমরজিৎ ফের বলে, ‘বাপে হালায় ঐদিনকা এই এহানেই পইড়া গিয়া ডাইন পায়ের আঙুল মচকাইয়া ফালাইছে।’
তোমার বাবা পড়ে গিয়েছিলো?’ ইফতিখার জিগ্যেস করে, ‘কিভাবে?’
‘সমরদা, একটু পেচ্ছার করা যাবে?’ প্রথমবারের মতো কথা বললো বলে জাফরের কণ্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসে ও মাঝখান দিয়ে চেরা। এই কণ্ঠস্বর তার বেলবটম, বড়ো কলারের খবর কাগজ আঁকা শার্ট, গলায় ঝোলানো চেন এবং সদাপ্রস্তুত ও সপ্রতিভ চেহারার সঙ্গে বেমানান।
‘এই তো দিন ৫/৬ হইবো। এই জায়গায় খাড়াইয়া বুইড়া গান ধরছিলো, একটা লাইনও পুরা গায় নাই, ব্যাস—’ ইফতিখারকে জবাব দিতে দিতে সমরজিৎ মনোযোগ দেয় জাফরের দিকে, ‘পেচ্ছাব করবেন? ঐখানে মাইরা দেন। ঐখানে সারি সারি তিনটে ছোটো ঘর। কোনোটারই ছাদ নেই, কেবল একেবারে বাঁদিকেরটার মাথায় টিনের ওপর হাঁট চাপা দিয়ে ছাদ তৈরি করা হয়েছে। সবগুলো ঘরের দেওয়ালে খিঁচিয়ে-থাকা দাঁতের গোড়ায় ছ্যাতলার মতো হলুদ জ্যোৎস্না।
‘এখানে?’ জাফর বোধহয় ইতস্তত করছে। সমরজিৎ স্টার সিগ্রেট ধরিয়ে ইফতিখারকে একটা দিলো। ফারুকের হাতে ফিল্টার-টিপড়।
‘এইগুলো কি রে?’
‘রান্নাঘর।’ সমরজিৎ প্রথমে জবাব দেয় ফারুককে।
‘এতো রান্নাঘর কেন? তোদের না জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিলো?’
‘বাথরুমটা কোনদিকে?’ জাফর ছটফট করে।
‘বাথরুমে যাইতে পারবেন?’ জাফরকে এই পাল্টা প্রশ্ন করে সমরজিতের মুখ ফের ঘুরে যায় ফারুকের দিকে, জয়েন্ট ফ্যামিলি অখনো আছে। এতোটি রান্নাঘর— কোনোটার মইদ্যে আমিষ রান্না হইতো, আবার নিরামিষ হবিষ্যি ঠাকুরের ভোগ রান্দনের আলাদা আলাদা ঘর আছিলো।’ তারপর জাফরকে বলে, ‘বাথরুমে যাইতে পারবেন না, অন্ধকার। পায়খানা এক্কেরে ঐদিকে, পাঁচিলের লগে। এইখানেই করেন না।’ ইফতিখার বলে, ‘না দোস্ত। বাবুর্চিখানায় পেশাব করবে কেন? তোমার মা কোলকাতা থেকে ফিরে এলেতো সবগুলো ফের ঠিক করে নেবে, না?’
‘আর ঠিক করবে কে? শুওরের বাচ্চারা ন’মাসে বাড়িটার কি অবস্থা করেছে। কে আসবে এখানে?’ ফারুক খুব জোর দিয়ে এইসব বললে কাচুমাচু মুখ করে ইফতিখার এদিক ওদিক তাকায়। রান্নাশালার উল্টোদিকে পোড়া একটা ঘর। ইফতিখার বলে, ‘এখানে কি ছিলো দোস্ত?’, সমরজিৎ তখন জাফরকে ঐ ঘরটাই দেখিয়ে দিলো, ‘যান, ঐখানে মাইরা দ্যান।’ গুটি গুটি পায়ে জাফর ঐদিকে চলে গেলে সমরজিৎ বলে ‘বহুত আগে ঐঘরে ঠাকুরের ভোগ রানতো।’
ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে রইলো জাফরের জন্যে। উঠানের এক কোণে গড়িয়ে-পড়া জল দেখে সমরজিতের ফের বাবার কথা মনে পড়ে, বাপে হালায়, বুঝলা, বৃহস্পতিবার, না না শনিবার দিন রাইতে খুব মাল টানছে, বহুত দিন বাদে কৈ পাইছিলো, আর চেক করতে পারে নাই। বাসায় আইসা এই জায়গায় না খাড়াইয়া গান ধরছে।’
জাফরের প্রসাবের বেগবান ধারা কোনো টিনের ওপর বৃষ্টিপাত ঘটায়। টিনের ওপর জল পড়ার টং টং ধ্বনিতে সমরজিতের দীর্ঘ সংলাপ বিভক্ত হয় পর্বে পর্বে, ‘আমি কই, এই রাইতে চিল্লায় কেঠায়? ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’—ঘর থিকা বারান্দায় আইলাম, দেখি তো রাজা চুতমারানী হালায় ক্যাঠায়?’
প্যান্টের চেন টানতে টানতে জাফর ফিরে আসে।
সবাই মিলে উঠান পেরোতে শুরু করলে জাফর বলে, ‘ঐ ঘরে টিন পাতা আছে নাকি?’
‘টিন?’ সমরজিতের প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে ক্লান্ত বিরক্তি, দূর, টিন কই পাইবেন?’ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সে খুক করে একটু হেসেও নেয়।
‘পেশাব পড়ছিলো তো টিনের ওপরে, দোস্ত। টিনেরই আওয়াজ মনে হলো না?’
ইফতিখারের কথায় সমরজিতের মনে পড়ে, ‘টিন? হ। কুয়ার উপরে টিন ফালাইয়া রাখছে।’
‘কুয়ো? ওখানে কুয়ো আছে নাকি?’
‘আমরা পোলাপান থাকতেই কুয়াটা বন্ধ কইরা টিন চাপাইয়া রাখছে। টিনের উপরে পুরানা কাঠকুঠ, দরজা, ভাঙা কপাট, ভাঙা চেয়ার টেবিল বহুত জমছিলো। নয়মাসে খানকির বাচ্চারা সেইগুলি জ্বালাইয়া ভাত খাইছে, অখন টিনগুলি বারাইয়া পড়ছে।’
‘ভাত খাবে কেন? রুটি সেঁকেছে, রুটি।’ জাফরের এই সংশোধনী শেষ হতে না হতেই ইফতিখার জিগ্যেস করে, ঘরের মধ্যে কুঁয়া কেন দোস্ত?’
‘এই ঘরে ঠাকুরের ভোগ রান্না হইতো তো। এই জল ব্যবহার হইতো ঠাকুরের ভোগ রান্দনের লাইগা।’
দেবদেবীর ভোগ রান্না হতো ঐ কুয়োর জলে। যশোর কালীবাড়িতে দরজা থেকে উঁকি-দিয়ে দ্যাখা মা কালীর ঠাণ্ডা শুকনো জিভ জাফরের শিরদাঁড়া চাটে।
এক বারান্দা থেকে নেমে উঠান পেরিয়ে আরেক বারান্দায় উঠে ফের ঢুকতে হয় আরেকটি ঘরে। এই ঘরে উঁচু ছাদের কাঠের বীম একটা বাল্বের ওপর অস্পষ্ট রেখায় শুয়ে থাকে। বাঁদিকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির অনেকগুলো ধাপ, দুবার ঘুরে পৌঁছেছে ওপরতলার বারান্দায়। নিচের ঘরে আলোতে সিঁড়ির ধাপগুলো কেবল উঁচু ও কালচে হলুদ। ওপরে উঠতে উঠতে নিচে তাকালে এই ধাপগুলোকে মনে হয় সর-পড়া ঠাণ্ডা জল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সমরজিৎ বলে, ‘আস্তে উইঠো।’ সে নিজে অবশ্য তাড়াতাড়ি উঠে বারান্দার লাগোয়া ঘরটিতে সুইচ টেপে, ঘরের আলো বারান্দা পেরিয়ে এদিক আসায় ওপরের পাঁচটা বাপের ঘুম ভেঙে যায়, ফের ঘুমোবে বলে আলো নেভবার আশায় তারা ঢুলু ঢুলু চোখে ঝিমাতে থাকে। সিঁড়ির দুই দিকেই দেওয়াল, রেলিঙ নয়, দেওয়াল। দেওয়ালে চারবার পাঁচকোণা তাক। এককালে আলো দেওয়ার জন্য এখানে প্রদীপ জ্বালানো হতো। এখন ইলেকট্রিসিটি আসায় সেই ব্যবস্থা উঠে গেছে, কিন্তু সিঁড়ির জন্য নতুন কোনো বাল্বও লাগানো হয়নি।
বারান্দা পেরিয়ে প্রথমে ঢুকলো সমরজিৎ, তারপর ফারুক, ফারুকের পেছনে জাফর ও ইফতিখার। ঘরে একটা সিঙল খাট, খাটের কাছে দুটো হাতলহীন চেয়ার, ক্যানভাস লাগানো ইজি চেয়ার, চুন সুরকির খোলস খুলতে থাকা মোটা দেওয়াল, দেওয়ালে তিনটে ছোটো আলমারি—শীতল শরীরে সবাই নিজ নিজ অবস্থানে স্থির। খাটের পাশে মাঝারী সাইজের একটা টেবিল, টেবিলে স্তূপাকৃতি কাপড়চোপড়।
অর্ধেক ভাঁজ করে ইজি চেয়ার ফের প্রায়-বিছানার মতো পেতে তার ওপর বসলো ফারুক, মাথাটা এলিয়ে দিলো কাঠের ওপর, একটা হাত রাখলো বুকে, আরেকটা চেয়ারের হাতলে। তারপর একটা নিশ্বাস ফেললো, ‘আঃ।’ তারপর, ‘সমরজিৎ, তাড়াতাড়ি করো, টাইম নাই।’ কাঠের চেয়ারে বসেছে জাফর, খাটের একপ্রান্তে ইফতিখার। আরেকটা চেয়ার দড়িতে ঝোলানো শার্টের ছায়ায় আধখানা ঢাকা। এটা নিশ্চয়ই সমরজিতের জন্য।
ডানদিক থেকে প্রথম সেলফের কাঠের পাল্লা খোলার জন্য সমরজিৎ চাবি বার করে দ্বিতীয় শেলফ থেকে। এই শেলফটা খোলা, এর ছোটো দরজা দুটো কেউ খুলে নিয়েছে, এর তিনটে তাকে আবোল তাবোল করে রাখা রাজ্যের জিনিস। এই এলোমেলো জিনিসের ভেতর থেকে এক নিমেষে চাবি খুঁজে পাওয়ায় সমরজিতকে ইফতিখার মনে মনে বাহবা দিলো। প্রথম শেলফের তালায় সে চাবি ঢুকিয়েছে, ফারুক বলে, ‘তালাচাবি দিয়ে রাখো?’
‘নাইলে থাকতো?
‘তোমার ঘরে এ্যালকহলিক চোর আসে নাকি?’
‘তো কি?’
‘কে আসে দোস্ত?’ ইফতিখারের প্রশ্নের ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় জবাবটাও তার জানা।
‘আসে না? চান্স পাইলেই বাপে হালায় বোতল ধইরা কয়টা সিপ মাইরা দিবো।’
সবাই হেসে ফেললেও সমরজিতের গম্ভীর মুখ ও কোঁচকানো কপাল অপরিবর্তিত রয়ে যায়। পাতলা কাগজে জড়ানো চারকোণা লম্বা একটা বোতল বার করে সে রেখে দেয় টেবিলের ওপর। তার বাঁ হাতের এক ধাক্কায় কাপড়েচোপড় সব গড়িয়ে পড়ে বিছানায়। আধখানা শুয়ে ফারুক বোতলটা দ্যাখে, ‘জনি ওয়াকার? গুড!’
ওদিকে ঘরের কোণে রাখা পেতলের কলসি থেকে প্লাস্টিকের নতুন জগে জল ঢালে সমরজিৎ। জল গড়াবার ঢকঢক আওয়াজে ঘর সঙ্কুচিত হয়। অবশ্য মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে। কারণ কলসির শেষ ধারা সিৎ সিং করে উঠলে সেই আওয়াজ মনে হয় আসছে অনেক দূর থেকে। তার রোগা হাতে চারটে বিভিন্ন আকৃতির গ্লাস ও প্লাস্টিকের জগ টেবিলে রাখতে গিয়ে সমরজিৎ দ্যাখে, জায়গা কম হচ্ছে। সুতরাং জগ রেখে দিতে হয় মেঝেতে। এরপর বেশ আয়েশ করে সে বসে খালি চেয়ারটায়। শার্টের ছায়া চেয়ার ছেড়ে এবার তার কোলের ওপর। বোতলের পাতলা কাগজের আবরণ আস্তে আস্তে ছাড়াতে গেলে কাগজটা এক জায়গায় এসে বড়ো ছটফট করে, তখন সে একটু থামে। বোতলের মাথা ধরে আস্তে টান দিলে আবরণ নিচে খসে পড়ে। সমরজিৎ তখন গলায় কামবোধ করে। কামবোধ তীব্র হয়ে ওর জিভ ও টাকরা পর্যন্ত ছড়ায়, বোতলের গ্রীবায় এক হাত ও কটিতে এক হাত দিয়ে ধরে মালটাকে সে তুলে ধরে সকলের সামনে। জনি ওয়াকার রেড লেবেল হুইস্কির টিম্বার রঙের স্বচ্ছ রক্তে কম ভোল্টেজের আলো গাঢ় ও ঘন সেডিমেন্ট ফ্যালে। বোতল খুলতে খুলতে সমরজিতের কপালের কোঁচকানো সব রেখা সমান হয়, তার চোখ দুটো এখন ফুটে উঠেছে সম্পূর্ণ ও স্পষ্ট হয়ে। বিগলিত মুদ্রায় উপুড় হয়ে সমরজিৎ বোতল প্রতিষ্ঠা করে টেবিলের ঠিক মাঝখানে। প্রতিষ্ঠা-পর্ব সম্পন্ন হলে সে গদগদ চোখে ফারুকের রূপ দ্যাখে, ‘ঢালো।’
‘তুমিই ঢালো না!’ ফারুক শুয়েই থাকে।
বড়ো পেগের পরিমাণে হুইস্কি ঢেলে দিলে দুটো নীল, একটি সবুজাভ ও একটি ঘোলাটে গ্লাসে মদের রঙ পাত্রের দ্বারা প্রভাবিত। ঘরের পুরনো, ভ্যাপসা ও ভিজে ভিজে গন্ধে হুইস্কির ঝাঁঝ মিশলে সকলের মাথায় সুড়সুড়ি লাগে। সমরজিৎ জলের জগ হাতে নিলে ফারুক বলে, ‘বরফ নেই?’
‘না দোস্ত। বরফ কৈ পাই?’
ফারুকের হাতে সবুজাভ গ্লাস, তার মুখে ইংরেজি বাক্য, ‘ফার্স্ট সিপ শুড বি এ স্ট্রেট ওয়ান।
সমরজিৎ তখন তার নিজের ও ইফতিখারের গ্লাসে জল ঢেলে তাকায় জাফরের দিকে, ‘আপনার?’
‘খুব অল্প।’
ফারুক ‘চিয়ার্স’ বলবার সঙ্গে সঙ্গে চারজনের হাতে চারটে গ্লাস শুন্যে টুং টাং বেজে ওঠে, এই ধ্বনিতে ঘর প্রসারিত হয়। সমরজিতের কপালের নিচে তখন রক্তের প্যারেড, লেফট রাইট লেফট রাইট লেফট! তার লম্বা চুমুকে প্রায় দেড় আউন্স পরিমাণ হুইস্কি গলায় গিয়ে ফের ওপরে উঠে করোটির ময়লা সাফ করে। ফারুকের জিভ দিয়ে তরল আগুন গড়িয়ে পড়ছে বলে ওর ঠোঁটের দুই কোণ ও গাল আঁচ লেগে একটু কোঁচকানো। আধশোয়া অবস্থাতেই সিগ্রেটের জন্য সে এদিক ওদিক হাতড়াতে শুরু করলে ইফতিখার একটু নিচু হয়ে মেঝেতে গাড়িয়ে-পড়া ডানহিলের লাল প্যাকেট কুড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে ধরে। কিন্তু সিগ্রেট জ্বালাবার জন্য ফারুকের কোনো উৎসাহ নেই। ডানহিল শুয়ে থাকে ইজিচেয়ারের হাতলে। ইফতিখারের চোখের কোণ ও নাকের দুই পাশ এখন একটু বাঁকা। একটি চুমুকের ভগ্নাংশ টেনে মেয়েদের তেঁতুল খাওয়ার সময় সুখ প্রকাশের ভঙ্গিতে টাকরায় জিভ দিয়ে সে ছোট্টো করে বাড়ি দেয়। ঘোলাটে গ্লাস তার ভাঙাচোরা গালের সঙ্গে ঠেকিয়ে বলে, ‘আঃ! সেভেনটি ওয়ানের পর হুইস্কি আর চোখেই দেখিনি দোস্ত!’
‘সেভেনটি ওয়ানে খুব খেতেন, না?’ জাফরের এই প্রশ্ন ইফতিখারের কানেই যায় না, সে মগ্নস্বরে গুনগুন করে, ‘মেরে ইস্কাচ, মেরে পেয়ারে!
‘কোথায় খেতেন?’ জাফরের ফর্সা মুখে তেতো হাসি, ক্যান্টনমেন্টে খেতেন নাকি?’
ফারুক বলে আঃ। বাদ দাও।’
এই ছোট্টো ধমকে ইফতিখার বল পায়, ‘আমি ভাই এখানে খেয়েছি, আপনি খেয়েছেন ওপারে। কোলকাতায় কোতো ভালো ভালো বার, বোড়ো বোড়ো, হোটেল!’
‘আমি কোলকাতা ছিলাম না।’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে জাফর নির্জলা কয়েকটা ধ্বনির ছিবড়ে ছুঁড়ে দেয়, ‘আমি ছিলাম ফ্রন্টে। এই হাতে তিনজন পাঞ্জাবি সোলজার মেরেছি, দালাল সাফ করেছি এ্যাট লীষ্ট হাফ এ ডজন। মদ খেতে আর মিটিং করতে তো আর দেশ ছাড়িনি।’
ফারুক অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে সিগ্রেট ধরায়। গ্যাস লাইটারের দীর্ঘ নীলাভ শিখায় তার মুখের আঁকাবাঁকা রেখা বড়ো চঞ্চল। লাইটার ধরে-থাকা ডান হাত দিয়ে কিংবা এমনি খালি বাঁ হাতে জাফরের গালে গোটা দুয়েক চড় দিতে পারলে এখন সুখ পাওয়া যায়। শুওরের বাচ্চা! খুব ফ্রন্টের গরম দ্যাখাস, তোর বাপ মানিক ভাই ফ্রন্টে গেছে কখনো? লীডাররা ফ্রন্টে যাবে তো অর্গানাইজ করবে কারা? তোমার মতো নতুন বাল-গজানো মস্তান? মানিক ভাইয়ের সামনে এসব চটাং চটাং কথা একবার উচ্চারণ করো তো দেখি?–গ্যাস লাইটার ফারুকের এ হাত ও হাত ঘোরে, কখনো ডানহাত খালি হয়, কখনো বাঁ হাত। কিন্তু জাফরকে চড় মারা আর হয়ে ওঠে না। এই সব নবজাগ্রত তরুণ মস্তানদের কিছু বলবার জো আছে? মানিক ভাই কাকে যে কার পেছনে লেলিয়ে রেখেছে, কেউ বলতে পারে না। সিগ্রেটে বড়ো বড়ো টান দিয়ে ফারুক খানিকটা সামলে নেয়। ঘরের বাইরে দক্ষিণ দিকের বারান্দা থেকে আসছে গোলাপের ছেঁড়া-ছেঁড়া গন্ধ; অবশ্য খুবই মৃদু, পাওয়া যায় কি যায় না। বারান্দার টবে ফুলগাছ পোষে কে? অমৃতলাল, না সমরজিৎ? সিগ্রেটের ধোঁয়ার সঙ্গে গোলাপের টুকরো বাইরে উড়াল দিলে ফারুক বলে, ‘জনি ওয়াকার বলো আর ভ্যাট বলো আর ডিম্পল বলো,–শিভাজ রিগালের মতো কিছু হয় না।’
‘শিভাজ রিগাল? নাম শুনছি খুব কোনোদিন চোখে দেখি নাই। ডি লাঙ্ক হুইস্কি, না?’
‘দেখি, মানিক ভাইয়ের সেলার থেকে যদি ঝেড়ে দিতে পারি তো একদিন নিয়ে আসবো একটা।’ বলতে বলতে ফারুক সোজাসুজি জাফরের মুখের দিকে তাকায় নীল গ্লাস, চকোলেট রঙের পানীয় ও ঘোলাটে আলো ভেদ করে জাফরের মুখের কোনো রেখাই স্পষ্ট দ্যাখা যাচ্ছে না, তার ঠোঁটে ধরা রয়েছে গ্লাস, সে একটি দীর্ঘ চুমুক দিতে মগ্ন।
ময়লা জমে ভোঁতা-হয়ে-যাওয়া এককালের গোলাপী জিভটাকে ভালো করে ঝাঁকাবার জন্য সমরজিৎ হুইস্কির একটা পাতলা লেয়ার বিছিয়ে রাখে তার ওপর, প্রত্যেকটা ঢোঁক গেলার আগে ভালো করে ভিজিয়ে নিচ্ছে একবার। বাঙলা মদ গিলে গিলে জিভের ওপর শ্যাওলা জমে গেছে। স্কটল্যাণ্ডের তরল রোদ একেক বার গড়িয়ে যেতেই জিভ শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাচ্ছে। পোড়া পোড়া গন্ধের সঙ্গে তেতো কষাটে স্বাদ ঠিক পৌঁছে যায় গলার খাঁজে। গলা থেকে পেটে পৌঁছবার আগে একটা টাল খায় বুক ও পেটের মাঝামাঝি এসে। এখন মনে হয়, জলের ভাগ নিচে পড়ে গেলো, নীট মালটা গলা পর্যন্ত এসে স্পিরিটের মতো ছড়িয়ে পড়লো শরীরের উর্ধ্বাংশে। এই সময় শরীরকে তার ভুলে যাওয়ার কথা, সমরজিৎ কিন্তু ভোলে না।
ফারুকের দিকেও তার মনোযোগ অখণ্ড।
‘তুমি তো হালায় খাইতেও পারো!’ এই সংক্ষিপ্ত স্তুতিতে ফারুক তার ডান পায়ের ওপর বাঁ পা রেখে একটু একটু নাচায়।
দ্বিতীয় পেগে চুমুক দিতে না দিতেই ইফতিখারের কণ্ঠে সংগঠিত ধ্বনি গুনগুন করে উঠলো। না কিসিকা আঁখ কা নূর হুঁ’—তার ভরাট গলা থেকে বাহাদুর শাহ্ জাফরের গান ফুটে বেরিয়ে সোজা উড়াল দেয় ওপরের দিকে এবং পারে তো কড়িকাঠের ওপর থেকে সেতারের ১০০ বছরের লুকোনো ছেঁড়া ধ্বনি টেনে এনে বিধিয়ে দেয় সকলের বুকে ও পিঠে। সমরজিৎ বড়ো ছটফট করে। এই ছেঁড়া ছেঁড়া ধ্বনি হয়তো তার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে, দাঁড়াবার জন্য উঠতে গিয়ে সে ফের বসে পড়ে। ইফতিখারের স্বর এখন আরো স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। সমরজিতের গ্লাসের হুইস্কির ওপর সেতারের টুংটাং নুড়ি ঝরে পড়ে কড়িকাঠ থেকে; তার আর উপায় থাকে না, সে সোজা উঠে দাঁড়ায়। প্রথম স্টেপ ফেললে বারান্দার রেলিঙ দ্যাখা যায়। আরেকটি স্টেপে টবে রাখা গোলাপগাছ এবং তৃতীয় স্টেপে পাশে গজিয়ে ওঠা রোগা গাঁজার চারা চোখে পড়ে। এই দ্যাখা সাঙ্গ হলে হঠাৎ কি যেন তার মনে পড়েছে— শরীরের এই ভঙ্গি করে সে গিয়ে দাঁড়ায় দেওয়ালের বাঁদিক থেকে প্রথম শেলফের সামনে। শেলফ থেকে কাগজের দুটো প্যাকেট নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রেখে দিলে একটা প্যাকেট আপনাআপনি খুলে গেলো। খোলা প্যাকেটে ঘোলাটে শাদা রঙের গোলগাল পনিরের অর্ধেকটা টুকরো। অন্যটা কাগজের ঠোঙা, খোলার আগেই বোঝা যায় ভেতরে চানাচুর কিংবা তেলে ভাজা চিনেবাদাম। এদিকে ইফতিখারের স্বর কিংবা নির্বাসিত সম্রাটের আক্ষেপ কিম্বা কড়িকাঠ থেকে ঝরে পড়া সেতারের নেপথ্য আলাপের ভিড়ে সকলের শরীর ও করোটিতে ট্রাফিক জাম হওয়ায় রক্ত চলাচল বন্ধ। এই জাম কাটাবার জন্য কিম্বা দেশপ্রেম, কি অন্য কোনো আবেগে চাঙা হয়ে উঠে জাফর শিস দিতে শুরু করে, বাঙলার মাটি, বাঙলার জল।’ এই গান ইদানীং এখানে খুব প্রচলিত। নইলে তার শিসের কল্যাণে এই সুর আরমান’ কি ‘দামান’ ছবির গানের সুর বলে ভুল হতে পারতো। শিস দেওয়ায় সে একেবারেই পটু নয়, শিস দিতে গেলে ঠোঁট ব্যথা করে, ঠোঁটের ভেতরটাও শুকিয়ে যায়। কিন্তু ইফতিখারকে থামিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে কতো মক্কেলের যে লাইন! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই পুরনো ঘিঞ্জি শহরের সবাইকে ফারুক ভাই চেনে। তার সঙ্গে এসব জায়গায় তিন পা হাঁটো তো থামতে হয় দু’বার। মানিক ভাই খুব এ্যাপ্রোপ্রিয়েট নাম দিয়েছে, ‘টাউন সার্ভিস’। এই যে মাউড়া শালা সেঁটে রয়েছে জোঁকের মতো, সে কি এখন থেকে? বেলা ১২টার দিকে দ্যাখা, না,–তখনো ১২টা বাজেনি, ঠাঠারি বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে শালা খুব উর্দু মারছিলো আরেক জাতভায়ের সঙ্গে। ফারুকভাই গ্যাঁক করে ব্রেক কষলো। এই যে যেখানে সেখানে গাড়ি থামানো, হুট করে নেমে পড়া, যখন তখন গলিতে তস্যগলিতে ঢুকে পড়া—এসবের কোনো মানে হয়? চারদিকে এনিমি। দেশ কি আর এতো সহজে শত্রুমুক্ত হয়? এতো সোজা? টার্মিনালে, ফুটপাশে, স্টেডিয়ামে, রেলস্টেশনে এতো লোক গিজগিজ করে, লজ্জা শরমের বালাই নেই, কাপড়চোপড়ের ধার ধারে না, এমন কি শালাদের গায়ের চামড়াও কি সিনথেটিক ফাইবারে তৈরি? –কি ট্রান্সপারেন্ট—শরীরের ভেতরের হাড়হার্ডডিও সব দ্যাখা যাচ্ছে। এরা সবাই সুরোধ দেশপ্রেমিক বাঙালি কে বললো?
‘আরে ইফতেখার। তুম সালা জিন্দা হো?’
এই বাক্যের জবাবে তাকে জড়িয়ে ধরে ইফতিখার হো হো হাসতে শুরু করে। পানের পিকে তার মুখ ভর্তি, নিচের ঠোঁট উঁচু করে পিক সামলাতে হয় তাকে, সে পিকও ফ্যালে না, ফারুকের এই সামান্য রসিকতা কি এমনি সাদা প্রশ্নবোধক বাক্যে তার হাসিও থামে না। তারপর শুরু হয় তাদের অবিরাম কথাবার্তা। বেশ বোঝা যায়, তাদের বহু কালের খাতির, দু’জনের মুখে নতুন রাস্তার নাম, লোকজনের নাম, রেস্টুরেন্টের নাম শুনতে শুনতে জাফরের মাথা ধরে যায়, এর মধ্যে ওর সেই জাতভাই কেটে পড়ায় ইফতিখারও এখন ফারুক ভাইয়ের গাড়িতে। ব্যাটা কাজ করতো ব্যাঙ্কে, স্বাধীনতার পর কয়েকটা দিন গা ঢাকা দিয়েছিলো, চাকরিটা সুতরাং নট। মীরপুরে বাড়ি করেছে কয়েক বছর হলো সেখানে বড়োভাই থাকতো, বাড়ি এখন অন্য লোকের দখলে। মানিক ভাইকে ধরে ফারুক যদি বাড়িটা উদ্ধার করে দেয় তো সেটা ভাড়া দিয়েও পেটটা চলে। পাখা ইস্ত্রি চেয়ার টেবিল খাট পালং সব বিক্রী হয়ে গেছে। আজ রেফ্রিজারেটর বিক্রি করেছে শুনে ফারুক বলে, ‘ফ্রিজ কাঁহা সে মিলা থা দোস্ত? খোদ তুম কবজা কিয়া আওর কোই কর্ণেল সাব তোহফা ভেজা থা? ইফতিখার মাতৃভাষা বলবে না কিছুতেই, ‘কি যে রং কোরো দোস্ত! ফ্রিজ আমার বোড়োভাই কিনেছিলো সিক্সটি এইটে। ফারুক ভাইও চালু কম নয়। ফ্রিজ বিক্রী করেছে শুনে ইফতিখারকে আর ছাড়তে চায় না। ফ্রিজের অর্ধেক টাকা তো খসালো ফারুক ভাই। পূর্বাণীতে বিয়ার পূর্বাণীতেই ফারুক বলে, ‘লাঞ্চ কাঁহা করোগে? ইফতিখার তো সদা প্রস্তুত, ‘কোথায় যাবে? দিল্লী মুসলিম চলো। ওদের পুরানো বাওর্চি ফিরে এসেছে, ফার্স্ট ক্লাস বিরিয়ানি চলবে, চলো!’ কিন্তু ফারুক ভাই ওমুখো হয় না, গাড়ি থামায় ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে। কন্টিতে হেভি লাঞ্চ, লাঞ্চের আগে লাইম জিন। ওখান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে পেট্রল নেওয়া—সেও ইফতিখারের পয়সায়। তবু ফারুক যদি মানিক ভাইকে বলে মীরপুরের বাড়িটা উদ্ধার করে দেয়। ওর বড়ো ভাইয়ের হার্ডওয়ারের দোকান ছিলো নবাবপুরে, দোকান সীল করে দিয়ে গেছে, ওটা যদি ঠিকঠাক করা যায়, ইফতিখারের ব্যাঙ্কের কাজও যদি ফের মেলে তো বেঁচে থাকা যাবে। মানিক ভাই পর্যন্ত না গেলেও চলে ফারুকের। খবরের কাগজ খুললেই তো ফারুকের নাম, ফারুকই বা কম কিসে? কিন্তু ফারুক ভাই এসব কথায় তেমন পাত্তাই দেয় না, কোনো রকম কথা দেওয়ার মধ্যে সে নেই, ফারুক ভাই অতো কাঁচা ছেলে নয়। বায়তুল মোকাররমে নেমে সবাই মিলে কোকাকোলা খাওয়া হলো, সেই একবারই পয়সা ছাড়লো ফারুক। ইফতিখার দামী একটা টাই কিনে দিলো ফারুককে। এমন কি গুলিস্তানের সামনে এক শেডী ক্যারেক্টারের কাছ থেকে এ্যাকশনের ছবি ভরা বিদেশী পর্ণোগ্রাফী কিনলো পঁয়ষট্টি টাকায় — সেও ইফতিখারের ওপর। জাফরের এসব ভালো লাগে না। রঙবাজি করে আর কতোদিন? চারদিকে খালি শত্রু, যেখানে যাও একটা না একটা ঘাপলা। অথচ কোনো সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবে না এরা, এদিকে ওয়ার্কিং কমিটিতে ঢোকার জন্য সব অস্থির। এতো বড়ো একটা ওলটপালট ঘটে গেলো, এদের কোনো চৈতন্যোদয় হলো? আড্ডা দিতে শুরু করলো তো পার্টি, কাজের কথা এক্কেবারে ভুলে গেলো। জাফর তাই সমরজিতের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘আপনার ফ্রেণ্ড সমর দাসকে তখন ফোন করলেন, যাবেন না?’
‘সমর দাস না, সমরজিৎ, সমরজিৎ রায় চৌধুরী।’ ফারুক তার বন্ধুর নাম সংশোধন
করে দেয়, তারপর ইফতিখারকে বলে, ‘চলো সমরজিতের বাড়ি চলো, যাবে?’ এ শালা তা হলে সমরজিতেরও বন্ধু, খসে পড়ার আর কোন সম্ভাবনাই রইলো না।
কিন্তু একটা লোক এতক্ষণ ধরে ঝুলে থাকলে কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়? সুতরাং আরো তীব্র শব্দ করে শিস দেওয়া ছাড়া জাফরের কোনো উপায় থাকে না। তার অম্ল শিসের এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড়ে গজলের মগ্নস্বর, ধমক খাওয়া শিশুর মতো, কি আর করে, ঘরের কড়িবর্গা ও দেওয়ালের ঝরে পড়া চুন সুরকিতে সেতারের টুটাফাটা বোল খুঁটে বেড়ানো ছেড়ে ইফতিখারের গলার চাপা গলি দিয়ে টলতে টলতে ফিরে যায় উল্টো দিকে এবং শেষ পর্যন্ত মুখ গুঁজে পড়ে থাকে তার পাকস্থলি কি তলপেটের জলকাদাময় নিভৃত কোণে। সেই শিশুকে ঘুম পাড়ানো দরকার। ইফতিখার তাই একটু ঝুঁকে জংধরা ছুরি দিয়ে পনিরের এবড়োখেবড়ো স্লাইস করে। তারপর একাই পুরু দুটো স্লাইস মুখে দিয়ে লম্বা এক চুমুকে গ্লাসের মদ শেষ করে ফেলে। সমরজিতের হাতেও পনিরের স্লাইস। চানাচুরের ঠোঙায় জাফরের ডান হাতের দুটো আঙুল চিনেবাদাম খোঁজে। ফারুক এসব স্পর্শও করে না। হঠাৎ করে সে বলে, ‘আচ্ছা সমরজিৎ, এটার কি করলে?’ প্রশ্নবোধক মুখে সমরজিৎ তাকালে ফারুক হাসে, ঐ যে তোমাদের পাড়ার ছেলেদের একটা আবদার ছিলো।’ এখন সমরজিতের মুখে কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই। তার কপালের পাশে একটা রগ একটু টানটান হয় এবং সে এদিক ওদিক দ্যাখে। ফারুকের আঙুলে পনিরের একটি ভগ্নাংশ। আমাদের ছেলেরা তোমার বাবার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিলো। উনি বোধ হয়, বোধ হয়, আই মিন আমাদের পারপাজটা ঠিক ধরতে পারেন নি।’
এই পর্যন্ত বলে সে ফের গ্লাসে চুমুক দেয়। পনিরের পাতলা টুকরো তার আঙুলের ফাঁকে নড়াচড়া করে, কখন যে মুখে উঠবে?
‘না বাবায় তো ভাড়া দিতে চায় না, আমারেও কইছে, দিবো না।’ সমরজিৎ কথা বললে পনিরের ভগ্নাংশ অবশেষে ফারুকের জিভে প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘তোমাদের এতো বড়ো বাড়ি, এখন লোক বলতে তো তুমি আর তোমার বাবা। বাড়িটা খালি পড়ে আছে, ধরো টাকা পয়সাও তো তোমাদের দরকার।’
‘আমার কাকা, কাকীমা, কাকার দুই পোলা, জ্যাঠাইমা’-
‘আমি জানি তো’, ফারুক থামিয়ে দেওয়ায় সমরজিতের তালিকা আর দীর্ঘ হতে পারে না, ‘তোমার কাকা না সিক্সটি ফোরে চলে গিয়েছিলো, আবার ফিরে এসেছে?’
‘না সিক্সটি ফোরে কৈ গেলো? গেছিলো আমাগো লগেই। সিক্সটি ফোরে আমাগো বাড়ির কেউ যায় নাই। কিছু ভাগছে ফিফটিতে, আরগুলিতো রইয়াই গেলো।
আরে জানি তো। কাগজীটোলার খবর আমি জানি না?’ ফারুক একটু বিরক্ত হলো।
‘এখন এই এরিয়ার স্পোকসম্যান প্র্যাকটিকালি ফারুক ভাই একাই। পার্টি মিটিঙে সবসময় খালি ওল্ড সিটির কথা বলে। শিস দিয়ে ইফতিখারের গজল বন্ধ করার পর জাফর এই প্রথম মুখ খুললো। তার মন্তব্য সম্পূর্ণ করতে দিয়ে ফারুক বলে, ‘তোমার কাকারা না ঐদিকে থাকে?’
‘অখন আর ক্যামনে থাকে? ঐদিকটায় চিড় ধরছে একটা। বিল্ডিঙের একদিকের ইটাউটা খুইলা হালারা কিছু রাখছে? বিল্ডিঙ হালায় কখন পড়ে কখন পড়ে!’ সমরজিতের কথার তোড়ে ফারুকের মুখ গম্ভীর। মুখের চামড়ায় বোধহয় টান পড়েছে কোথাও, রগটগ সব আড়ষ্ট, সে নিজেই বোতল থেকে মদ ঢালে।
‘এইবার আইসা তো এইবাড়িতে উঠতে পারি নাই। আট নয়টা মাস বাড়ির কিছু রাখছে নাকি? মারে আনলাম না, ঠাকুরমারে আনলাম না,–বাড়ির কি হাল হইছে না দেইখা ক্যামনে আনি? আমরাও তো এইবার আইসা একটা মাস থাকলাম গ্যাণ্ডারিয়া প্রবীরগো বাড়ি। প্রবীরগো বাড়ি থাইকা—’
‘প্রবীরকে আসতে বললে না কেন? প্রবীর শালা থাকলে খুব জমে।’
‘প্রবীর তো কলকাতায়।
‘কবে গেছে?’
‘প্রবীর তো ইণ্ডিয়া গেলো গোলমালের পিরিওডো, ইফতিখার চাঙা হয়ে উঠলো, প্রবীরের কলকাতা-গমনে সে বেশ সুখী, বসেছে ঋজু হয়ে, একটু জড়িয়ে গেলেও তার প্রত্যেকটি শব্দ স্পষ্ট, এরপর কি আর ফিরে এসেছে?’ সে নিজেই ফের এই প্রশ্নের জবাব দেয়, ‘না, আর ফেরেনি। ফারুকের মোটা ও কালচে ঠোঁটের কোণে হাসির একটি কুচি খেলে যায় এবং খুক করে আওয়াজ করে সমরজিতের করোটিতে সে একটি টোকা দেয়।
‘কলকাতা থেকে আসবে কবে?’
‘অকুপেশন পিরিওডে চাকরি পাইছিলো কর্পোরেশনে’, সমরজিৎ একটু নুয়ে পড়ে, লিবারেশনের পর ফেরে নাই।’
‘চাকরির খবর তো জানতাম। স্বাধীনতার পর সবাই ফিরে এলো। যারা অনেক আগে গিয়েছিলো তারাই এলো, আর প্রবীর তো গেলো সেভেনটি ওয়ানে।’ ফারুক কথা বলছে আর সমরজিতের মাথায় ট্রাফিক জাম হয়ে পড়ায় ঘরের গন্ধ ও আয়তন ক্রমেই চাপা হয়ে আসছে। মাথায় হাওয়া খেলবার মতো স্পেস নেই। তার আশা : গ্লাসে বেশি করে জল দিই তো মাথার জামটা কাটে।
‘বাঙলাদেশের জন্যে সকলের ফিলিং তো আর জেনুইন না। এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবার সময় কণ্ঠ থেকে ক্রোধ ছেঁকে ফেলবার জন্য জাফরের কোনো চেষ্টাই নেই, ‘ইণ্ডিয়া গেলো প্রাণ বাঁচাতে, চাকরি পেলো তো দেশের পাছায় লাথি দিয়ে বিদেশেই থেকে গেলো। আবার এদিকে দ্যাখো, আরেক দল পাকিস্তানে টাকা-পয়সা সোনা-দানা সব পার করে দিয়ে ওয়েট করছে, কবে রেডক্রসের ক্লিয়ারেন্স আসে। গলার তেজটা ঝরে পড়লে এমনি সাদা কণ্ঠে বলে, ‘কিছু মনে করবেন না সমরদা। চারদিকে এনিমি। আমরা করবো কি? মানিকভাই সব সময় বলে, পার্জিং দরকার, পার্জিং!’
ইফতিখারের দুটো চোখই পড়ে থাকে বোতলের সোনালি বর্ডার দেওয়া লাল লেবেলে। বোতল আস্তে আস্তে ঝাপশা হচ্ছে। ফারুক একটু হাসে, ইফতেখারের এসব প্ররেম নেই। কি দোস্ত? তুমি তো শালা হাফ বাঙালি হয়ে গেছো!’
কিন্তু জাফরের লক্ষ পূর্ণতার দিকে, ‘উই নীড সেণ্ট পার্সেন্ট বেঙ্গলীজ। কেবল বাঙলা শিখলেই চলবে? না নিজের মাতৃভাষা ভুলে যেতে হবে?—পূর্ণ বাঙালি হওয়ার নিয়ম-কানুন জেনে নেওয়ার জন্য ইফতিখার উদগ্রীব হলো। কিন্তু এই কথাটা কিভাবে জেনে নেওয়া যায়—এই ভাবতে না ভাবতে ফারুক তাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসে, ‘না দোস্ত। আমাদের একটু কুইক করতে হয়। ফরেন পার্টির সঙ্গে ডীল, খুব টপ লোকের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে মানিক ভাই এ্যারেঞ্জ করে দিলো। এদিক ওদিক হলে মানিক ভাই টলারেট করবে না।’ সমরজিতের বড়ো ইচ্ছা করে, যাই না, বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়াই! ‘তো তুমি কি ডিসাইড করলে? তোমাদের বাড়িটা আমাদের দরকার।’ কিন্তু বারান্দায় দাঁড়াবার জন্য সমরজিৎ উসখুস করে।
দক্ষিণের এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে চোখে পড়ে ইট-পাটকেলের ছড়ানো স্তূপ। এককালে ওর ঠাকুরদার নাটমন্দির ছিলো এখানে। সমরজিতের ছেলেবেলাতেও পূজার সময় গলির এমাথা ওমাথা জুড়ে মেলা বসে যেতো। চামারটুলির ঐ কোণের দোতলা বাড়ি থেকে আসতো যমুনাবালা, বছরে ঐ একবারই এই বাড়ির একেবারে ভেতরে ঢোকবার অধিকার ছিলো তার। সন্তোষ কাকা ছিলো যমুনাবালার লোক, ছেলেবেলায় কতবেল কি বিলেতি আমড়া চুরি করতে সমরজিৎ কখনো কখনো ওদের বাড়িতে গিয়েছে। যমুনাবালা তাকে দেখতে পেলে বরং ডেকে ঘরে বসতে দিতো। অপরিচিত গন্ধে ঝাপশা হয়ে আসা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা সেই ঘরে কার্পেটের আসনে বসে দুধমুড়ির ফলার খেতে খেতে সমরজিৎ যমুনাবালার মুখে কত গল্প শুনেছে। সন্তোষ কাকার গল্প, তাদের পূর্বপুরুষের গল্প। মা জানতে পারলে রাগ করতো, কিন্তু ঠাকুরমা কোনোদিন কিছু বলেনি। ঠাকুরমা কতো বড়ো ঘরের মেয়ে, ভাগ্যকূলের কত মানী লোক ওরা। ঠাকুরদার বাবা ঠাকুরদার বিয়ের সময় সমস্ত ঢাকা শহর মাৎ করে দিয়েছিলো। এমন কি নবাব বাহাদুরও কিছুক্ষণের জন্য এসে একগ্লাস সিদ্ধির সরবত খেয়ে যায়।
‘ছেলেরা কি বলেছে তোমার বাবা ঠিক বুঝতে পারেননি। একটু বেয়াদবী হয়তো করেছিলো, তা উনি তো বকেই দিয়েছেন। ঠিকই তো, গুরুজনদের সঙ্গে বেয়াদবী করবে কেন?
‘বেয়াদবী করলো কে? জাফর খুব তীব্র কণ্ঠে ফারুকের প্রতিবাদ করে, ‘উনিই তো খুব মেজাজ করছিলেন। ফর নাথিং মেজাজ করার মানে কি?–আমার বাড়ি আমার বসতবাড়ি ছাড়বো কেন? যারে তারে বাড়ির মইদ্যে ঢুকতে দিমু ক্যান?’ –শেষের দিকে সে অমৃতলালের—বাচনভঙ্গি পর্যন্ত ভ্যাংচাতে চেষ্টা করে।
‘আঃ! চুপ করো না!’
জাফরকে ধমক দিয়ে ফারুক সমরজিৎকে বোঝায়, ‘আরে ছেলেদের কথা ছাড়ো। যে ছেলেরা তোমার বাবার কাছে এসেছিলো অল অফ দেম আর ভেরি নাইস বয়েজ। আমার পাড়ারই ছেলে সব। আজকালকার ছেলে, আমাদের সঙ্গে ঠিক কম্যুনিকেশন হয় না, আর এ তো বুড়ো মানুষের ব্যাপার, জেনারেশন গ্যাপ।’ সমরজিতের মুখের দিকে দীর্ঘ একটা দৃষ্টি ছেড়ে সে বলে, ‘নিচের তলাটা দিয়ে দাও দোস্ত। তোমার বাবা একা থাকেন, তুমি থাকো অফিসে, কখন কি হয়, দিয়ে দাও!’
যমুনাবালা, চামারটুলির বড়োবাড়ি, ছোটোবাড়ি, সন্তোষকাকা — ডান হাতে সবাইকে ঠেলে দিয়ে বাঁহাতে সমরজিৎ নিজের মাথা চুলকায়, ‘বাবায় এক্কেরে রাজী হইতে চায় না। মায়ে আইসা পড়বো, ঠাকুমায় আইবো, আমার ছোটোবোনটা ম্যাট্রিক পাশ করছে গোলমালের আগে, অরে কলেজে ভর্তি করতে হইবো, —সকলে তো বাড়িতেই থাকবো, ক্যামনে ভাড়া দেই কও?’
জাফরের পক্ষে মেজাজ ঠিক রাখা ক্রমেই কষ্টকর হচ্ছে। খুব সাধারণ একটা জিনিষ বুঝতে এদের এতো সময় লাগে কেন?
তখন দ্যাখা যাবে। আপনাদের বাড়িতে অফিস করতে পারলে কাগজীটোলা, সূত্রাপুর, বাঙলাবাজার, ওদিকে ফরাশগঞ্জ শ্যামবাজার–হোল এরিয়াটা কনট্রোল করা যাবে। প্রব্লেমটা বুঝতে পারছেন না কেন?’
ওদের সমস্যা সে অনুধাবন করতে পেরেছে—এই রকম ভঙ্গি করে সমরজিৎ ঘাড় নাড়ে, ‘বুঝলাম, কিন্তু —!’
‘শুধু নিজের নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন না। নিউ সিটির জন্য আমরা কেয়ার করি না, বাড়ি চাইলেই পাওয়া যায়, আমরা ভাড়া যা দেবো অতো টাকা আর কে দিতে পারবে? ট্রাবল আপনাদের এইসব রটন এরিয়ায়। ব্যাক ডেটেড সব ফালতু ভ্যালুজ নিয়ে এখনো ডাঁট মারে।’ জাফরের বাচনভঙ্গিতে ফারুকের সামনে ভেসে ওঠে মানিক ভাই। সুতরাং তার বুকের বাঁ কোণটা একটু জ্বলে। ঠোঁটের সঙ্গে গ্লাস চেপে ধরলে নাকটা ঢুকে পড়ে গ্লাসের গর্তে। দীর্ঘ ও প্রবল এক চুমুকে তার গ্লাসের তলানিটুকুও শেষ হয়ে যায়।
‘তুমি বোধহয় ভয় পাচ্ছো, না? ছোকরারা এসে ঝালেমা করতে পারে, এইতো?’
‘না, ঠিক ভয় না, ঠিক—।’
‘এনিওয়ে’ ফারুক বসে পড়লো একেবারে সোজা হয়ে, ‘আমাদের তো আর রাজনৈতিক সংগঠন নয়, আমাদের ভয় পাওয়ার কি আছে? আমাদের পিওর উউথ ফ্রন্ট, আমরা মন্ত্রিত্ব চাই না, এমন কি উই রিফিউজ এ সীট ইন দ্য পার্লামেন্ট। আমরা শুধু দেখবো সাব ভারসিভ এলিমেন্টস বিপ্লবের নাম করে কিংবা গভর্মেন্টের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশকে ধ্বংস করতে না পারে। নট ওনলি দ্যাট, আমরা এ্যালার্ট থাকবো যাতে কোরাপ্ট লোকজন আমাদের ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে ঢুকে রেইন করতে না পারে। একজনের কেরিশমার চান্স নিয়ে দশজনে লুটে পুটে না খায়।’ এই পর্যন্ত বলে আড়চোখে সে জাফরকে দ্যাখে।-–না, জাফরের মুখে অভিনন্দনসূচক কোনো অনুমোদন নেই। কিন্তু ফারুকের ফ্লো বন্ধ করা এখানে অসম্ভব। সে তার বক্তৃতার উপসংহার টানে, ‘মানিক ভাই আমাদের ইয়াং জেনারেশনের আনলিমিটেড এনার্জিকে ঠিকভাবে চ্যানেলাইজ করতে চায়। তোমরা যদি কো-অপারেট না করো–।’ এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা ও কর্তব্য পালনজনিত অবসাদ ও সুখে তার নিশ্বাস এখন দ্রুত ও দীর্ঘ। তার হুইস্কি ঢালার হাতও বেশ ক্লান্ত।
গলা খাঁকারি দিয়ে বারান্দায় এসে রেলিঙ ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে ইফতিখার। এক পেগ পেটে গেলে সে শুরু করেছিলো বাহাদুর শাহ্ জাফরের গজল। এটাই তার নিয়ম। অনেক আগে সে শুরু করতো নওশাদকে দিয়ে, মাঝখানে মেহদী হাসান ছিলো ওর সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু শুরু যাকে দিয়েই হোক না, ‘দো গজ জমিন ভি না মিলা কোয়ে ইয়ার মে’–বাহাদুর শাহ্ জাফরের এই জায়গায় পৌঁছলে সে বেশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করবে। দু’তিন পশলা কাঁদবার পর চোখের নোনা ভাবটা কেটে গেলে স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে সে সবাইকে দেখবে এবং একটু পর শুরু হবে তার অবিরাম স্মৃতিচারণ, খুব জোরে ধমক দিয়ে থামিয়ে না-দেওয়া পর্যন্ত এরকমই চলবে। কিন্তু আজ সে একেবারে চুপ। তার কোন শৈশবে দ্যাখা কি কোনোদিন না- দ্যাখা লক্ষ্মৌ শহর; লক্ষ্মৌ শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে বারবাঙ্কভা গ্রাম; তাদের গ্রামের অতুল ঐশ্বর্য, তার পরিত্যক্ত ধনসম্পদের পরস্পরবিরোধী হিসাব দাখিল; দিল্লী লাহোর—এবং নেশা আরো ভালো জমলে লণ্ডন-প্যারিসে বসবাসকারী তার এম. এসসি ও পিএইচ. ডি করা ভাইবোনদের রূপগুণের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ; কোনো কোনোদিন নবাব ইসমাইল বা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং আরো ঘন মুডে থাকলে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের সঙ্গে নিজেদের আত্মীয়তা স্থাপন; ছেলেবেলায় তার বীরত্ব ও মেধায় মুগ্ধ রূপসীদের অস্থিরচিত্তের দীর্ঘ বিবরণ–সবরকম বাখোয়াজি এখন তার বন্ধ। তার মাথাটা নিচের দিকে ঝুলছে; নিচে দাঁড়িয়ে ওপরের এই বারান্দার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখলে মনে হবে, মন খারাপ করে নিজেকে সে প্রত্যাহার করে নিতে চাইছে, কিন্তু প্রত্যাহার করবার পদ্ধতি কি, প্রত্যাহার করতে হবে কেন—এইসব ব্যাপারে তার স্পষ্ট কি অস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এইসব জটিলতা ছাড়াও মনে মনে সে ভয়ানক আফসোস করে : কতোকাল পর স্কচ হুইস্কি পাওয়া গেলো, সঙ্গে দু’জন বন্ধুও আছে, অথচ কোনো কাজেই লাগলো না। তার গলায় পড়ে পাহাড়ী শিশির, ফোঁটায় ফোঁটায় নয়, একেকটা ঢোকে ঢল নামে, কিন্তু বুকে পড়তে না পড়তে সবটা শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাচ্ছে। আজকাল তার গলায় ও বুকে এক ধরনের কাশি লেগেই থাকে। শুকনো কাশি, অনেকক্ষণ ধরে গলা খাঁকারি দিলে ব্যাণ্ডেজের তুলোর ছেঁড়া টুকরোর মতো কফ বেরিয়ে আসে। হায়রে, এই শুকনো গলা ও ব্যাণ্ডেজের তুলো-তুলো কফ কি পাহাড়ী শিশির বিন্দু সব একেবারে শুষে নিলো?
‘উঠি সমরজিৎ।’ ফারুক এবার সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়ায়, তুমি ভেবে দ্যাখো। এসব ব্যাপারে কো-অপারেট না করা-
‘সাবভারসিভ। যেখানে আপনার সুযোগ আছে, আপনি দেশের ন্যাশনাল ইউথ অর্গানাইজেশনকে হেল্প না করে বরং অপোজ করছেন কেন? আপনি আমাদের কমপেল করছেন টু টেক—।’
মেঝের দিকে তাকিয়ে সমরজিৎ জাফরের উত্তেজিত বাক্যের জবাব দেয়, ‘না, না, অপোজ করার প্রশ্নই উঠতে পারে না–।’
ফারুক বলে, ‘এনিওয়ে, জাফর একদিক থেকে রাইট। ধরো আমি না হয় তোমাদের ভালো করে চিনি। অকুপেশন পিরিওডে তোমাদের সাফারিঙের কথাও তো জানি। মেশিনগানের গুলির নিচ দিয়ে পালানো—ওঃ হরিবল! কিন্তু–।’
ফারুকের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই সমরজিতের শরীরের রক্ত উজান উঠে বসে তার করোটির ছাদে, ছাদের বীমে এবং মেঘ হয়ে কিছুক্ষণ থমকে থেকে অবশেষে বৃষ্টিপাত শুরু করে। এই বৃষ্টির উৎস করোটির মেঘ, করোটির মেঘের উৎস তার শরীরের রক্ত। সুতরাং বর্ষণের রঙও লাল, অবিরাম লাল বৃষ্টিপাত চোখের সামনে একটি সীমাহীন জলপর্দা টাঙিয়ে দেয়। পর্দায় দ্যাখা যায়, হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে সমরজিত্ত পালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে পালিয়ে প্রথমে কমলাঘাটের কাছে এক গ্রাম, শটি বাড়ি। প্রথম কয়েকটা দিন কাটলো কানাই ঘোষের পেঁয়াজ, রসুন ও শুকনো লঙ্কার আড়ত আছে, সেখানে। তারপর জামদিয়ার আরব আলী সিকদারের বাড়ি। ঢাকা থেকে বেরিয়ে এতো লোকজনের সঙ্গে এঘাট ওঘাট করা,–নৌকায়, হেঁটে, রিকশায় করে কমলাঘাট যাওয়া কোনো কিছুর রূপ দ্যাখা যায় না, যদিও পর্দায় প্রত্যেকটি পদক্ষেপই স্পষ্ট। কেবল বৃষ্টি, বৃষ্টির বিশাল পর্দা। কিন্তু মনে তো আছে সবই। সবাইকে নিয়ে রামচন্দ্রপুরের লঞ্চে ওঠা, হিন্দু যাত্রী বহন করতে সারেঙের ক্রমাগত ‘না না’, জ্যাঠাইমার কাছ থেকে দেড় ভরি সোনার বালা নিয়ে সারেঙকে ঘুষ দেওয়া, অলঙ্কারশোকে জ্যাঠাইমার ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না; তিন মাইল যাওয়ার পর বাঁদিকের কাটাখালে সেনাবাহিনীর গানবোট চলে গেলো পশ্চিমদিকে, সাত আট মাইল পর নদীর দক্ষিণ পাড় জুড়ে দগ্ধ জনপদ, ঝলসানো গাছপালা, নদীতে গুলি-বিদ্ধ ফেঁটে-ওঠা লাশদের জলকেলি—সব মনে আছে। কিন্তু হলে কি হবে, বৃষ্টির ঘন পর্দায় সব ছায়া ফ্যালে সিল্যুয়েটের মতো। কানের পাতলা পর্দায় ঢাকের মতো বাজে কেবল ঝড়ের মধ্যে প্রবল বৃষ্টিপাত। সন্ধ্যার দিকে রামচন্দ্রপুর পৌঁছবার কথা। কিন্তু তার আগেই লঞ্চের টিকেট মাস্টার এসে অমৃতলালকে আস্তে আস্তে জিগ্যেস করে, ‘কর্তা, যাইবেন তো হেইপার, না?’ কর্তা কোনো কথা না বললে তার দাড়ি-না-কামানো মুখ প্রবলভাবে কাঁপতে শুরু করে।
সমরজিৎ বলে, আর কৈ?’
‘তে আপাগো এটা কথা কই।’ টিকেট মাস্টারের হলদে-দাঁতে-গিজ-গিজ-করা মুখ এখন সমরজিতের মুখের কাছে, ‘রামচন্দ্রপুর নাইমেন না।’
‘ক্যান?’
‘আরে কইলাম তো গোয়ালঘুর্ণী নাইমা পইডেন!’
গোয়ালঘুর্ণীর টিকেট দিয়ে লোকটা অন্যদিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর খুচরো পয়সা ফেরত দিতে এসে সে ফিসফিস করে, আসাদুল্লারে দেখছেন? লঞ্চে উঠছে, দেখছেন?’
‘হ দেখছি।’
‘অরে চিনেন না?’
‘চিনি না? মহল্লার মানুষ, চিনুম না?’
আমিও তো আপনাগো মহল্লার মানুষ আছিলাম’, টিকেট মাস্টারের গলা একটু চড়া, ‘আমারে চিনছেন?’
লোকটা তাদের পাড়ায় রেশনের দোকানে ক্যাশ মেমো লিখতো, সমরজিৎ ঠিকই চিনেছে! সে কথা বলে আর লাভ কি?
লোকটা তার গলা একেবারে খাদে নিয়ে আসে, ‘আসাদুল্লায় রামচন্দ্রপুর যায়। আগরতলার পাসিঞ্জারগো লুট করনের তালে আছে, বুঝলেন? আপনারা গোয়ালঘূর্ণী নাইমেন, রাইতটা কাটাইয়া দিয়া বিয়ানে উইঠা যাত্রা কইরেন, ঐদিকেও বর্ডার আছে, দুই চাইর মাইল বেশি হাঁটতে হইতে পারে।’
কিন্তু গোয়ালঘুর্ণী ঘাটে নামতে না নামতেই মেঘ করে এলো। সমরজিত্রা এতগুলো লোক এখন যায় কোথায়? সমরজিৎ নিজে, তার ঠাকুরমা, সমরজিতের বাবা, মা, বিধবা জ্যাঠাইমা, সধবা কাকীমা, সদ্য টাইফয়েড-ফেরত মেজকাকা, সেজকাকার তিন ছেলে, দুই মেয়ে ও এক জামাই, জামাইটা গাধা, ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, তোতলায়, অথচ বিয়ে করলো বিশটি হাজার টাকা নিয়ে—সমরজিতের নিজের বোন দুটো, কলকাতাবাসী মেজদির বিধবা শাশুড়ি ও সেই শাশুড়ির মেয়ে—রঙ চাপা হলেও ফিগার ভালো,–পিসীমার এক ননদ–সেই ননদ ছিলো বিধবা পিসীমার একমাত্র সঙ্গী, এবং পিসীমার মৃত্যুর পর তার যাবতীয় অলঙ্কারের মালিক—কলকাতাবাসী বড়দার সম্বন্ধী মশায়ের উন্মাদ স্ত্রী—এদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই, সমরজিতের বাড়ির কাজের মেয়ে জগতের মা,—এতগুলো লোক এখন যায় কোথায়? কেবলি ফুলতে থাকা পোয়াতী মেঘের নিচে হাঁটতে হাঁটতে যদিও বাড়ি একটা পাওয়া গেলো,–পাকা বাড়ি, গ্রামের সবচেয়ে বড়োলোকের বাড়িই হবে,–তো কোনো লাভ হলো না। বাড়ির লোকদের বড়ো ভয়, ‘না বাবা, আমাগো মাফ করতে হইবো। খবর পাইছি আমরা, এদিকে মিলিটারী আইছে। দশ বারোদিন আগে গাঙের হেইপার চাইর পাঁচখান গাঁও জ্বলাইয়া খাক করছে, একখান পোকও যদি বাদ রাখছে! হেই উত্তরে যান, হাইস্কুলের লাল বিল্ডিং আছে, আপনাগো ব্যাকটির ইস্থান হইবো। ঐ বাড়ির একজন বুড়োমানুষ সান্তনা দেয়, ‘আরে ডরান ক্যান? এই ম্যাগে পানি আইবো না।’ সবাই মিলে সামনের দিকে কয়েক পা ফেলেছে এমন সময় ব্রহ্মাণ্ড তোলপাড় করে মোটা স্বরে গর্জে উঠলো বিদ্যুৎ। আকাশের এমাথা ওমাথা জুড়ে দীপ্ত শিখায় জ্বলে উঠলো
উঠলো চরাচর। সেই সঙ্গে অনেক লোকের সমবেত চিৎকার। এ গ্রাম, ও গ্রাম, নদী, মাঠ—সব জায়গায় ফেটে ওঠে মানুষের কণ্ঠে অর্থহীন উদ্দাম উচ্চধ্বনি; যেদিকেই কান পাতা যায়, কেবল অবিন্যস্ত এলোমেলো শব্দমালা। এক পলকের জন্য মনে হতে পারে যে বিদ্যুতের হুঙ্কারে এই অঞ্চল বোধহয় এইভাবে সাড়া দিচ্ছে। কিন্তু আসলে নদীর উল্টোদিকে আরো দুটো ঘাট পেছনে মথুরাপাড়ায় তখন সেনাবাহিনীর গানবোট ভিড়েছে। কি গুলির শব্দ, কি মানুষের চিৎকার বাতাসে ছেঁকে আসতে আসতে সবই পরিণত হয় ভয়-দ্যাখানো ধ্বনিতে। আর বৃষ্টি নামে বড়ো বড়ো ফোঁটায়, আর সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে বাতাস। গজগজ করতে করতে ঠাকুরমা তবু যাহোক হাঁটছিলো, এখন তার হাঁটাও বন্ধ। তাকে এখন ধরে কে? অমৃতলালের হাতে চামড়ার ব্যাগ, ব্যাগে অমৃতলালের ঠাকুরদার উইল, বাড়ি ও সম্পত্তির দলিল দস্তাবেজ,–হাত খালি করার জন্য সেটা তো আর কারো হাতে দেওয়া যায় না। কাকীমার কোমরের কোনো এক নিভৃত কোণে গোঁজা রয়েছে তার সমস্ত গয়নাগাটি, তার একটা হাত সবসময়ই রেখে দিতে হয় কোমরেই, কাকীমা ঠাকুরমাকে আর ধরে কি করে? জ্যাঠাইমার হাতে, মার হাতে নিজের নিজের পুঁটিলি। সকলেরই হাত জোড়া। সুতরাং সমরজিৎ কি আর করে, বড়দার সম্বন্ধীর হাতে বাক্সটা তুলে দিয়ে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় ঠাকুরমাকে। তবে ঠাকুরমার যতো দোষই থাক, বুড়ির ওজন খুব হাল্কা। হঠাৎ করে বাতাসের বেগ ভয়ঙ্কর বেড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে অন্ধকার। তীব্রবেগে বৃষ্টি পড়ে। সমরজিতের খয়েরি-সাদা-কালো চোখে এই তুমুল বৃষ্টিপাত পাকা লাল রঙের দাগে স্থায়ী হয়ে আছে। নয়নের মাঝখানে ঠাঁই নেওয়ায় এই দাগ সব সময় দ্যাখা যায় না, একটি বালুকণার মতো চোখে কেবল খচখচ করে। অনেক দূরে চলছে গুলিবর্ষণের সঙ্গত, আর এখানে বাতাস ও জলের সম্মিলিত ধ্বনির পেছনে ‘ও মা’ ‘ও সমর’, ‘ও সমইরা’, ‘মাগো’, ‘রাধেশ্যাম,’ ‘রাধেশ্যাম,’ ‘ভগবান’, ‘ভগবান গো’, ‘সুভাষ’, ‘সুভাষরে’, ‘চিত্ত’, ‘অমৃত’, ‘অমৃতরে’, ‘কাকা’,–এইসব আহ্বানকে একনাগাড় গুলিবর্ষণের সঙ্গে ঘর-বাড়ি পোড়াবার আওয়াজ ও আলুথালু মানুষের বিলাপ বলে ভুল হয়। এখন সন্ধ্যাকাল না গভীর রাত্রি? এটা কি নগরীর রাজপথ না নিভৃত বাঙালি গ্রাম? বৃষ্টি না ট্যাঙ্ক? বাতাস না মর্টার? উত্তর দক্ষিণে কি গাছপালা না
সেনাবাহিনী? মাঠ না ক্যান্টনমেন্ট? মগজে এইসব ঘাপলা, কোলে ঠাকুরমা। যতো হাল্কাই হোক না, ঠাকুরমাকে নিয়ে আর দৌড়ানো যাচ্ছে না। বৃষ্টির তোড়ে কেউ কাউকে দেখতে পায় না। প্রত্যেকে ভাবছে, আর সবাই আছে একসঙ্গে, হায়রে দলছুট হয়ে পড়েছি কেবল আমিই। এদিকে এতো শোঁশোঁস্রাৎসাৎছলছলআঁআঁ বিক্ষোভ ও কাত্রানির মধ্যে ঠাকুরমা অবিরাম ঘ্যানঘ্যান করে, ‘রাধাশ্যামের বিগ্রহ ফালাইয়া আইলি? অষ্টধাতুর বিগ্রহ —হ্যার অমর্যাদা করলি, এ্যা? তরা তগো বাড়ির স্বত্ব হারাইলি রে সমর, অহন বাস করবি কৈ? ঠাকুরে তর বাপের ঠাকুরদায়—সম্পত্তি লেইখা দিছে রাধাশ্যামের বিগ্রহরে, তরা তারে ডাকাইতের হাতে সমর্পণ করলি? অহন কি হইবো রে সমইরা? অহন কি হয়? ‘বৃষ্টির তোড়ে তার একটানা বাক্যপ্রয়াস ধুয়ে ধুয়ে যায়। এরই মধ্যে চলে এলোপাথাড়ি দৌড়ানো। ঠাকুরমা আস্তে আস্তে চুপচাপ। অন্ধকারে কিছু দ্যাখা যায় না। বাতাস জল গাছপালা ও বিক্ষুদ্ধ ধ্বনিপুঞ্জ পরিণত হচ্ছে একটি সঙ্ঘবদ্ধ গর্জনে। বাতাস ও জল উথালপাতাল মাথা কোটে; এরা এখন কোনদিকে যায়? সমরজিৎ তখন ক্ষণে ক্ষণে কেবল আকাশের দিকে তাকায়, তার ভরসা আকাশের এমাথা ওমাথা ছিঁড়ে ফেলে বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠে তো রাস্তাটা অন্তত ঠাহর করতে পারে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেকার হুঙ্কার করে ওঠা বজ্র আত্মসমর্পণ করলো এই বিরূপ আকাশেরই কোনো নিভৃত খাপে, এই ঘোর ঘনঘটায় তাকে পাওয়া যায় কোথায়?
‘কিন্তু হোয়াট এ্যাবাউট আদার পিপল?’ এই ইংরেজি বাক্য শোনা গেলো আকাশের নিভৃত খাপ থেকে—এই ভয়ে সমরজিৎ চমকে উঠে দ্যাখে, না, কথা বলছে ফারুক, ‘কিন্তু অন্যদের আমি বোঝাবো কি করে? মানিক ভাইকে নিয়ে প্রব্লেম হলো এই যে ইডিওলজির জন্য উনি যে কোনো অপ্রিয় কাজও করতে পারেন। তুমি আমাদের সঙ্গে কো-অপারেট করতে রিফিউজ করেছো শুনলে হি মে পুট ইউ ইনটু ট্রাবল। কতোদিনের ওপার, বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরী শীতলক্ষার ওপার গোয়ালঘুর্ণী ঘাটে বিদ্যুৎ চমকায়। মানুষের সমবেত চিৎকারের ধ্বনি সমরজিতের পাছায়, সমরজিতের বুকে লাথি মারে। আমি বলি দোস্ত, বাড়িটা ছেড়ে দাও। নিচের তলা ভাড়া দিয়ে ওপরে থাকতে তোমাদের যদি খুব অসুবিধা হয় তো বলো, তোমাকে আরো ভালো বাড়ি রিকুইজিশন করে দিই, চাও তো ওয়ারি এলাকায় বাড়ি দিচ্ছি, এ্যাবানডণ্ড বাড়ি এখন কতো! তোমাদের এই বাড়িটা আমাদের দরকার।’
ঝড়-বৃষ্টি ও গোলাগুলি থিতিয়ে এলে সমরজিতের ফের ঝিমুনি ধরে। হাই তুলতে তুলতে সে মুখের সামনে তুড়ি বাজায়, ‘বাবায় রাজি হইতে চায় না।’
সমরজিৎ হয়তো আরো বলতো, কিন্তু জাফর তাকে থামিয়ে দেয়, ‘লেটস গো।‘
‘ইফতেখার কোথায় গেলো? ইফতেখার?’ ফারুক বারান্দার দিকে তাকায়। ইফতিখার তো এখনো রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়েই রয়েছে। সে বার বার গলা খাকারি দিচ্ছে, কিন্তু গলার জমে থাকা কফ আর কিছুতেই বেরোয় না। ভালো করে কাশতে গেলে বমি বমি লাগে। এই ধরনের বিবমিষা তার আগে ছিলো না, আগে মদ খেতে খেতে অনেক সময় হড়হড় করে বমি হয়ে যেতো। আর এখন গলায় শিরশির করে, ফাইনাল বমি আর হয় না। অনেকক্ষণ ধরে গর্জাবার পর বড়োজোর পানসে-তেতো ও পানসে টক ছটাকখানেক আঠালো লালা গড়িয়ে পড়ে ঠোঁটের দুই পাশে ও চিবুকে। আজকাল প্রায়ই দাড়ি কামানো থাকে না তার, তাই লালা গড়ালেই খোঁচাখোঁচা দাড়িয়ে লেগে বিশ্রী লেপ্টালেপ্টি। সমস্ত মাথা জুড়ে তার অস্পষ্ট আওয়াজ, ফলে চুলটুল বড়ো এলোমেলো। কতোকাল পর আজ টাকা পাওয়া গেলো কিছু, এই টাকার অর্ধেকটা পাঠানো দরকার তার আম্মাকে। একে ওকে ধরে, এক মিনিস্টারের চামচাকে আম্মার গয়নাগাটি উপহার দিয়ে বড়োভাইয়ের সঙ্গে আম্মাকে কলকাতা পর্যন্ত পাচার করা গেছে। কলকাতায় আত্মীয়-স্বজন যারা আছে, সবাই খুব দূর-সম্পর্কের, তাদের ওপর আর কতোদিন? টাকাটা কোনোরকমে হাতে পেলে ওর আম্মা লক্ষ্ণৌ চলে যেতো। সেখানে যারা আছে, তারাই কি আর খুব খুশি হবে? তবে মামুদের অনেকেই তো এখনো ওখানে বসবাস করছে, আম্মা কোনোরকমে পৌঁছতে পারলে ব্যবস্থা একটা হতোই। এদিকে চাল, ডাল, আটা, আলু কিনে রাখলেও কয়েকটা দিন নিজেদের ভাতটা রুটিটা মিলতো। মাঝখানে দিন যা গেলো! ঘরের ফার্নিচার উর্নিচার বেচে দেওয়ার জন্য বাইরে বার করবে তারও কি জো ছিলো? কোনোভাবে গন্ধ পেয়েছে কি ঘরের মধ্যে পাবলিক জমে গেলো। তারপর একটানা ভনভনানি, এ টেবিল কোথায় পেলেন ভাই?’ ‘আমার ড্রেসিং টেবিল বেচবেন আমারই কাছে?’ ‘এই তো আমারই আলনা। রেফ্রিজারেটরটা অবশ্য অল্প দামেই পাওয়া গিয়েছিলো, ঠাঠারি বাজারের ইসরাইল জোগাড় করেছিলো কোত্থেকে, এক কিন্তুী দাম দেওয়ার পর ব্যাটা কোথায় সাফ হয়ে গেছে, আর টাকা দিতে হয়নি। কিন্তু একটু ভালো দামে বেচে আজ লাভটা কি হলো? দালালকে দেওয়ার পর তার প্রায় সবটাই খসলো ফারুক আর জাফরের পেছনে। ফারুক তো এখন ওপরের লোক। মাদারচোদ কাম কি করবে কে জানে?
সমরজিৎ ডাকে, ইফতেখার!’
ইফতিখার ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ালে কম ভোল্টেজের আলোতেও তার চোখে একটু ধাঁধা লাগে। ফারুক বলে, ‘চলো তোমাকে নামিয়ে দেবো।’ কিন্তু ইফতিখারের ইচ্ছা অন্যরকম, ‘তোমরা তো কন্টিতে যাবে? চলো, আমিও যাই।। মানিক ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও না! আমার চাকরির কথাটা না হয় বলি।’
‘আজ মানিক ভাই খুব বিজি থাকবে। আপনি অন্য একদিন এ্যাপয়েন্টমেন্ট করবেন।’ জাফর এবার পা বাড়ায়, চলেন ফারুক ভাই।’
আবার সেই দোতলার প্যাসেজ, গুহার ভেতর এলোমেলো প্রস্তরমালার মতো সিঁড়ির উঁচুনিচু ধাপ, নিচের অন্ধকার ও আলোগ্রস্ত ঘরবারান্দা, দরজার দুর্বল পাল্লা, হলদে উঠান, দাঁত খিচিয়ে-থাকা দেওয়াল, আবার দেওয়াল, তারপর আবার দেওয়াল পেরিয়ে ওরা চারজন অমৃতলালের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে দ্যাখে বাইরের বারান্দায় জলচৌকিতে কার্পেটের আসন পেতে বসে রয়েছে অমৃতলাল নিজে। পায়ের অবস্থান পাল্টিয়ে সে বসেই থাকে। কেবল জলচৌকির তলায় একটা বোতল সরিয়ে রাখতে গিয়ে ঠুনঠুন আওয়াজ হয়।
নিচু হয়ে ছোটো দরজা পেরোবার সময় জাফরের মাথায় কাঠ ঠেকে গেলো। এসব বড়ো বিরক্তিকর। বড়ো গেটটা খুলে দিলেই পারেন। এসব বন্ধ করে দুর্গের মধ্যে থাকেন কেন? এখনো সবাইকে শত্রু ভাবেন নাকি?’
‘এট্টু অসুবিধাই হইলো আপনার!’ সমরজিৎ বেশ সঙ্কুচিত।
অফিস ওপেন করার আগে আপনাদেরই সব ঠিকঠাক করে দিতে হবে।’ জাফরের হিমস্বরে ফারুকের পদক্ষেপ ধীরগতি হয় এবং সমরজিতের কানের কাছে সে মুখ বাড়ায়, ‘রাজি হয়ে যাও সমরজিৎ। তোমার ভালোর জন্যেই বললাম। এরপর কোনো অসুবিধা হলে আমি হেল্প করতে পারবো না। কইতেও পারবো না, সইতেও পারবো না।
‘বাবায় রাজী হইবো না।’
সেই সন্ধে থেকে এক কথা। এতো করে বোঝানো হলো, কয়েকটা পেগ পেটে পড়লো, তবু একই জবাব।
‘তোমার ভালোর জন্যই বললাম। আর লাভ কি? বাদ দাও। যাক, আরেকটা পেগ হলে জমতো, না?’
‘জিন খাইবা? এক্সপোর্ট কোয়ালিটি রইছে এক বোতল, খাইবা?’
‘কেরুর?’
‘আর কি পাই? একটা সিপ মাইরা দিয়া যাও।’ কিন্তু সমরজিতের আহ্বান বড়ো আড়ষ্ট। জাফরও ঐরকম কাঠ-কাঠ, ‘আরে চলেন, কন্টিতে মানিক ভাই ওয়েট করছে। ফরেন পার্টি কি খাওয়ায়, দেখবেন।’
গাড়িতে উঠতে উঠতে ফারুক একটা চামড়া খোলে, ‘সমরজিৎ, কন্টি ফন্টি আর ভাল্লাগে না। হোটেল, ক্লাব, এমব্যাসি, পশ এরিয়ায় আর পোষায় না দোস্ত! আমাদের হাক্কা কতো ভালো ছিলো! কি কোজি, কি ইন্টিমেট! ঐ হাক্কা শালার জয়েণ্টে পিপুল গাছের নিচে বেঞ্চে বসে আস্তে আস্তে সিপ মারা এরকম সুখ আর কোথাও নেই!’ ফারুকের এই দীর্ঘ সংলাপে ইফতিখারের শরীরে বড়ো কোলাহল শুরু হয়। তার গায়ের সিক্সটিফাইভ-থার্টিফাইভ শার্ট ফুলে ওঠে বেলুনের মতো। মধ্যরাত্রির নবাবপুরকে জায়গা করে দেওয়ার জন্যে তাকে একটু সরে বসতে হয়। মধ্যরাত্রে বন্ধুদের সঙ্গে মেহবুব আলী ইনস্টিট্যুট এলাকা থেকে বেরিয়ে নবাবপুর অতিক্রম করা; নবাবপুরের কামুক গন্ধ, পানের দোকানের সামনে অন্তরঙ্গ ভীড়, ঠাঠারি বাজারের মোড়ে কোনো বন্ধ দোকানের রকে বসে মুখের ভেতরকার পানের পিক নিচের ঠোঁট দিয়ে উঁচু করে আটকে রেখে বলকানো বাক্যে আড্ডা দিচ্ছে কয়েকজন বয়স্ক লোক; আমজাদিয়ায় কয়েক রাউণ্ড চা মেরে দক্ষিণের কোনো রেস্টুরেন্টের দিকে চলে যাচ্ছে কালো ঋজু ও দীর্ঘদেহী শান্ত পুরুষ, তাকে ঘিরে কয়েকজন চঞ্চল যুবক; কোনো কোনো রাতে ‘নিগারের সামনে সমস্ত রাস্তা জুড়ে ছড়ানো কাওয়ালির আসর; মাইকে আল্লা, রসুলুল্লা ও খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর প্রশস্তি; রাস্তার ধার ঘেঁষে লোহার তোলা উনুনে সেঁকা হচ্ছে শিককাবার, শিককাবাবের গন্ধে সাড়া পড়ছে পেটের ভেতর-বাড়িতে; রথখোলার মোড়ে ভুট্টা ভাজা হচ্ছে; কান্দুপট্টির গলির মাথায় তিনজন ফাইটিং মাতাল; ইফতিখারের ভরা গলায় মোহাম্মদ রফি কি মেহেদী হাসান; এরই মধ্যে আখতার বকে চলেছে চির্কিন খাঁর পদ্য। কোনো কোনোদিন খালেদ মোহাম্মদের তোতলা শায়েরী, ‘ইয়ে নবাবপুর রাত হ্যায়, আসমানমে চাঁদ হ্যায়, মিঠি মিঠি বাত হ্যায়’, শুনে সকলের একটানা বিরতিহীন হাসি, এর সঙ্গে মিলিয়ে সমরজিতের ঠাট্টা, ‘সামনে বড়া গাত হ্যায়, গিরনে সে বরবাদ হ্যায়’; নবাবপুর পার হলে সমকামী বালকদের ‘মালিস’ বলে ডাক দিয়ে যাওয়া—নস্টালজিয়ায় কাত হয়ে ইফতিখারের বমি বমি লাগে, গলার টক স্বাদ ফুসফুসে হাওয়া চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে, তাতে এমন কি একটা স্ট্রোকও হতে পারে। সুতরাং সে উচ্ছ্বাস ও বাক্য দমন করে। কথা বলে সমরজিৎ, ‘খালি হ্যাংওভার হয়, মদ খাইলেই হ্যাংওভার, ছাড়তেও পারি না, কি যে করি? খোঁয়ারির মধ্যে রাত কাটে, সারাটা সকাল জুইড়া খালি খোঁয়ারি, অফিসে বইসা ঝিমাই, ভাল্লাগে না।’ সমরজিতের বকা শেষ হতে না হতে ওদের গাড়ি চলতে শুরু করে এবং সমরজিৎ ঘরে ফেরে।
অমৃতলাল তখন বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁচু প্রাচীর ও বারান্দার মাঝখানে স্পেসের ওপর জ্বলতে থাকা চাঁদ দেখতে চেষ্টা করছে। মোটা গলায় একটানা গুনগুন পুলক, সে বেশ টলোমলো। সমরজিৎ তার বাপকে এড়িয়েই ওপরে উঠে যেতো, এতেই সে অভ্যস্ত, কিন্তু অমৃতলাল গম্ভীর গলায় ডাকে, ‘সমর।’
বাপের ভরাট স্বর নস্যাৎ করে দিয়ে সমরজিৎ জবাব দেয়, ‘কি কও?’
‘হ্যারা বাড়ি লইতে চায়, না?’,
‘অগো তুমি কি কইছ?’
‘কি কইছি?’ অমৃতলাল হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়লে তার চোপসানো গালের ভেতর দিয়ে একটা ঢেকুর বেরিয়ে আসে। ঢেকুরপ্রয়োগের পর তাকে কাশতে হয় প্রায় মিনিটখানেক। তারপর ঘর-কাঁপানো আওয়াজ থুতু ফেললে সেটা বারান্দা অতিক্রম করতে পারে না। অথচ আগে এমন ছিলো না। আগে এখান থেকে একটু স্পিডে কাশ থুতু ছুঁড়লে বারান্দা তো পেরোতোই, এমন কি এই স্পেস ডিঙিয়ে গিয়ে সেঁটে থাকতো দেওয়ালের সঙ্গে। বয়সের ভারবোধ তাকে একটু নীরব করে, কিংবা এই ক্লান্তির সুযোগে সে বাক্য গোছায়, কিন্তু ছিমছাম কথা তার মুখ পর্যন্ত আর আসে না, বলে, ‘কি কইছি? কইছি নিজেগো বসত-বাড়ি ভাড়া দিমু না, তো কি হইছে?
‘নাঃ কি হইবো?’ সমরজিৎ খুব পরিণত দুঃখের হাসি ছাড়ে, ‘কি আর হইবো? মানুষ চিনো না, কারে কি কও!’
‘চিনুম না ক্যান, বেশি ছটফট করছে তো আসাদুল্লার পোলায়, খচ্চইরা ছ্যামরাটা! আসাদুল্লার বাপে কতো পইড়া রইছে এই বারান্দার মইদ্যে, ঘরে ঢুকবার সাহস করছে? তর ঠাকুরদার পায়ে ধরছে–কি?–না কর্তা, আমারে আপনার ফিটনটা চালাইতে দ্যান। —বাবায় দেয় নাই। ক্যামনে দেয়? বাবার ফিটন চালাইছে ফালুমিয়া। বাবায় মানুষ রাখছে বাইছা বাইছা, ফালুর ভায়রা আছিলো নবাববাড়ির খানসামা, বুঝলি?’ অমৃতলাল বেশ ফর্মে এসে গেছে, এতো অল্পেই ঠিক কাজ করে লোকটার, ‘আমাগো এই বাড়ির মইদ্যে নবাব সাহেব আহে নাই? আহে নাই? আমার জন্মের আগে, তর ঠাকুরদার বিয়ার মইদ্যে আইছিলো নবাবসাব নিজে, বুঝলি? আর আমি দেখছি নবাব ইউসুফরে, হ্যাও নবাব, নবাব সাবের মাউসা না পিসা, হ্যারা খালুমালু কি কয় –হ্যারে দেহি নাই আমি? দেহি নাই? সিদ্ধি বানাইছিলো মধু বোষ্টমী, কুলপীর মইদ্যে সিদ্ধি, খাইয়া নবাব সাবে হাইস্যা বাঁচে না!’ সমরজিৎ আস্তে আস্তে সরে যায়, দরজায় আওয়াজ করে উঠানের দিকে হাঁটে, অমৃতলাল তবু ক্ষান্ত হয় না। ‘তে হ্যায় আর ওঠে না, লক্ষ্মৌ থাইকা বাইজি আইছিলো, নবাব সাবে খালি মধু বোষ্টমীর লগেই ফুসুর ফাসুর করে, ‘চলো, তুম মেরে সাথ পরীবাগমে চলো।’ মতিবাবু, সনাতনবাবু, ধানকুরা, মুড়াপাড়া –কুনো বাবু রাজা মহারাজা বাদ পড়ছে নাকি? বাদ পড়েছে? তরা কি দ্যাখছস? কি দ্যাখছস তরা? আমরাই কি আর দেখছি?’
না দেখেই যা—সমরজিৎ ঘরের পর ঘর, বারান্দা, উঠান, সিঁড়ি পেরিয়ে যায়—দেখলে না জানি কি হতো! বাবার প্রলাপ এখান থেকেও শোনা যায়, ‘আরে কুসুমবালার সেতারের বোল শুনছে তো’ — কুসুমবালার সেতার শোনার জন্য অমৃতলাল তার বহু-ব্যবহৃত কানজোড়া আবার কুমারী করার চেষ্টা করে, এদিকে সমরজিতের কানের পর্দায় কাগজের পুরু প্লাস্টার সাঁটা, সেই প্লাস্টার এখন খোলে কে?
.
নিজের ঘরের বারান্দায় ইজি চেয়ার পেতে বসে সমরজিৎ পকেট থেকে গাঁজার পুরিয়া বের করলো। গোবিন্দ শালা দু’টাকার গাঁজা দিয়েছে, আগে চার আনাতেও এর চেয়ে বেশি পাওয়া যেতো। আবার দ্যাখো, এইটুকু মালে বিচি কতো! এরকম ফেলে দেওয়া কোনো বিচি থেকে রজনীগন্ধার টবে এই গাঁজার গাছ গজিয়েছে। মাঝখান থেকে রজনীগন্ধার চারাটা মরে গেলো। এ গাঁজার চারাও কোনো কাজে আসবে না। জল টল দিয়ে এতো বড়ো করলো তো দ্যাখো শালার পাতায় পাতায় পোকা ধরে গেছে। স্টার সিগ্রেটের তামাকটা ফেলে দিয়ে খোলটার মধ্যে গাঁজা ঢুকিয়ে জ্বালিয়ে নিয়ে একটা সুখটান দিলে বারান্দার রেলিঙ একটুখানি কাপে। তারপর আবার সেই একই অবস্থা। সমরজিতের চোখ একেবারে খটখটে, শূন্য। সেখানে একটু ধোঁয়া কি কোনো রঙিন পর্দা কি এমনি ব্ল্যাক এ্যাণ্ড হোয়াইট ছবি–কিছুই দ্যাখা যায় না। পেটের চিনচিন-করা ব্যথা একবার ওঁয়া করে কেঁদে ফের ঘ্যানঘ্যান করে গোঙাতে শুরু করে। ওদিকে হৃষিকেশ দাশ রোডে যানবাহন চলাচলের আওয়াজ কমে আসছে। কাগজীটোলায় এককালের গুণ্ডা ও এখনকার দেশপ্রেমিক আসাদুল্লার বাড়ির ছাদে টেপরেকর্ডার বাজছিলো আর্তস্বরে—একবার চলছিলো ‘ববি’ ছবির গান, একবার নেতার বজ্র হুঙ্কার—এখন তাও বন্ধ। কলকে ধরার ভঙ্গিতে গাঁজা-পোরা সিগ্রেট জাপটে ধরে আরেকবার খুব জোরে টান দিলে সমরজিতের করোটির দেওয়ালে জোরে জোরে টোকা পড়ে। এইবার আশা করা যায়। এইবার নেশা হবে। এইতো মগজে তোলপাড়, পাঁজরায় তোলপাড়। এইবার হবে! আশায় উত্তেজনায় সমরজিৎ রেলিং ধরে দাঁড়ায়। চোখের সামনে সানগ্লাসের মতো পাতলা মেঘ ভেদ করে সে দ্যাখে, নিচে কে যেন চাঁদের ভগ্নাংশ খুঁজে বেড়াচ্ছে খুব মনোযোগ দিয়ে। কে সে? কিন্তু বড়োজোর এক মিনিট, এই মেঘ ছিঁড়ে উড়ে চলে যায় এবং সমরজিৎ দ্যাখে, গেটের মাধবীলতার ঝাড় ও বারান্দার হৃষ্টপুষ্ট থাম পর্যন্ত স্থলকেলি করে বেড়াচ্ছে অমৃতলাল। তার কণ্ঠে একটানা গড়ানো নেশা, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’ কিংবা ‘বলেছিলে চিঠি দিও’ কিংবা ‘প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার।’ কিন্তু পুরনো বাড়ি, একতলা দোতলায় দূরত্ব
দূরত্ব অনেকখানি। গাঁজার ধোঁয়া মগজে ছোটো ছোটো রোঁয়া হয়ে মাথায় কুটকুট করে, চোখের নির্মেঘ খরা আর কাটে না। সমরজিতের পাশে গাঁজা গাছের ঝাঁঝরা পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ে নেশাগ্রস্ত পোকামাকড় হেঁটে বেড়াচ্ছে পা টিপে টিপে। তাদের টলোমলো পদক্ষেপ ও এলোমেলো পদধ্বনির ভেতর দিয়ে উঁকি দেওয়া মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’ কি ‘যদি দিতে এলে ফুল হে প্রিয়’ তার কানের পর্দায় পাঁচড়ার মতো চুলকাতে শুরু করলে ইজি চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়া ছাড়া সমরজিৎ আর কি করতে পারে?
১৯৭৫