পদশব্দ

পদশব্দ

এক

বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় বহু প্রাচীন। মফস্বল শহরটির এ মহল্লার বেশিরভাগ বাড়িঘর পুরানো। তবে ১৯ নম্বর বাড়িটি পুরানোদের মধ্যেও পুরানো। গির্জার গাম্ভীর্য ধারণ করে রয়েছে বাড়িটি, ভীষণ ধূসর এবং ভীষণ ঠান্ডা। বাড়িটির মধ্যে কেমন নিষিদ্ধ একটি ভাব আছে, গা ছমছমে একটি ব্যাপার রয়েছে। অন্য কোনো শহরে হলে এ বাড়িটি সহজেই ভুতুড়ে তকমা পেয়ে যেত কিন্তু ওয়েমিনস্টারে কোনো ভূতের উপদ্রবের কথা কস্মিনকালেও শোনা যায়নি। ১৯ নম্বর বাড়িটি কোনো ভৌতিক বাড়ি নয় তবু বছরের পর বছর ধরে এ বাড়ির সামনে ঝুলে আছে একটি সাইনবোর্ড :

এ বাড়িটি ভাড়া অথবা বিক্রি করা হবে

দুই

মিসেস ল্যাংকাস্টার বাড়িটির দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন। বাড়ির বাঁচাল এজেন্টটি সেই থেকে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেই। ১৯ নম্বর বাড়িটি ভাড়া দেবার একটা মওকা মেলার সুযোগেই বোধহয় তার এমন খুশি। সে দরজার তালা খোলার সময়ও বকবক থামাল না।

বাড়িটি কদ্দিন ধরে খালি পড়ে আছে? জানতে চাইলেন মিসেস ল্যাংকাস্টার।

এজেন্ট র‍্যাডিস জবাব দিতে গিয়ে একটু তোতলাল। আ-উ-কয়েক বছর ধরে।

আমিও তা-ই ভেবেছি, শুকনো গলা মিসেস ল্যাংকাস্টারের।

আধো আলোয় হলঘরটি বিশ্রীরকম ঠান্ডা। কল্পনা পিয়াসী কোনো নারী হলে হয়তো শিউরে উঠত কিন্তু মিসেস ল্যাংকাস্টার অন্য ধাঁচের মানুষ। ভীষণ রকম বাস্তববাদী। তিনি বেশ লম্বা, কোমর ছাপানো বাদামী কেশ, চক্ষু দুটি নীল এবং শীতল।

তিনি বাড়ির চিলেকোঠা থেকে সেলার পর্যন্ত সব ঘুরে দেখলেন, এজেন্টকে মাঝেমাঝে প্রাসঙ্গিক দুএকটি প্রশ্ন করলেন। বাড়ি দেখা শেষ হলে ফিরে এলেন রাস্তার দিকে মুখ ফেরানো একটি ফ্রন্ট রুমে। গম্ভীর চেহারা নিয়ে এজেন্টের মুখোমুখি হলেন।

এ বাড়ির সমস্যা কী?

প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল র‍্যাডিস। আসবাবহীন বাড়ি একটু গা ছমছমে মনে হবেই, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল সে।

ধ্যাত্তেরি, বললেন ল্যাংকাস্টার। আমি তা জিজ্ঞেস করিনি। এরকম বিশাল একটি বাড়ি অথচ ভাড়া অবিশ্বাস্য কম। এর নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। বাড়িটি কি ভুতুড়ে?

আবারও চমকাল এজেন্ট, তবে তক্ষুণি কিছু বলল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ল্যাংকাস্টার। একটু পরে কথা বললেন তিনি আবার।

ভূত প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই। আর এ বাড়ি নিয়ে আমি কোনো অভিযোগও করছি না। তবে জানেনই তো ভৃত্যরা কুসংস্কার কীরকম বিশ্বাস। করে এবং ভয়ও পায়। আপনি আমাকে খোলা মনে বলতে পারেন এ বাড়িটিকে কোনো অপ্রাকৃত শক্তি তাড়া করে ফিরছে কি না।

আ-ইয়ে-আমি ঠিক জানি না, আবার বিড়বিড় করল এজেন্ট র‍্যাডিস। অবশ্যই জানেন, শান্ত গলায় বললেন মিসেস ল্যাংকাস্টার। আমি সত্যি কথাটি না জেনে এ বাড়ি ভাড়া নেব না। কী ছিল ঘটনা? খুন খারাবী?

আরে! না, প্রায় আর্তনাদ করে উঠল এজেন্ট। ঘটনা একটা একটা বাচ্চাকে নিয়ে।

বাচ্চা? কী?

গল্পটা সত্যি কি মিথ্যা জানি না আমি, কারণ নানাজনে নানা কথা বলে। তবে শুনেছি ত্রিশ বছর আগে উইলিয়ামস নামে এক লোক এ বাড়িটি ভাড়া করেছিল। তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি; সে কোনো চাকর বাকর রাখত না; তার কোনো বন্ধু ছিল না; দিনের বেলা খুব কমই বেরোত সে। তার একটি সন্তান ছিল। একটি বাচ্চা ছেলে। এ বাড়িতে দুমাস থাকার পরে সে লন্ডনে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। কীসের অভিযোগে তাও আমার জানা নেই। তবে অভিযোগটা নিশ্চয় গুরুতর ছিল । কারণ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে গুলি করে আত্মহত্যা করে। এদিকে বাচ্চাটি তখন এ বাড়িতে ছিল একা। তার বাবা তার জন্য অল্প কিছু খাবার রেখে গিয়েছিল। বাবার ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছিল সে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো তার বাবা তাকে কঠোরভাবে বারণ করেছিল সে যেন কোনো অবস্থাতেই ঘরের বার না হয় এবং কারও সঙ্গে কথা না বলে। বাচ্চাটি ছিল ভীষণ দুর্বল এবং ভীতু প্রকৃতির। বাবার আদেশ অমান্য করার সাহস তার ছিল না। পড়শীরা জানত না যে তার বাবা তাকে রেখে চলে গেছে। তারা মাঝে মাঝে খালি বাড়িতে ছেলেটির কান্নার আওয়াজ শুনত।

বিরতি দিল র‍্যাডিস।

এবং-আ-ছেলেটি অনাহারে মৃত্যুবরণ করে, নিরুত্তাপ গলায় উপসংহার টানল সে।

এবং সেই বাচ্চাটির ভূত এখন এ বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়? জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ল্যাংকাস্টার।

না, না, সেরকম কিছু না, দ্রুত বলে উঠল এজেন্ট। কেউ কিছু বা কাউকে দেখেনি এখানে। শুধু লোকে বলে, তাদের কথা হাস্যকর অবশ্যই, তারা বলে তারা নাকি মাঝে মাঝে বাচ্চাটির কান্না শুনতে পায়।

সদর দরজার দিকে পা বাড়ালেন ল্যাংকাস্টার।

এ বাড়িটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে, বললেন তিনি। এ ভাড়ায় এত সুন্দর বাড়ি আর পাব বলে মনে হয় না। সে যাকগে, আপনাকে আমি শীঘ্রি জানাচ্ছি।

তিন

বাড়িটি খুব সুন্দর, তাই না, বাবা?

মিসেস ল্যাংকাস্টার সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখছেন তার নতুন বাসস্থান। ধূসর রঙের কার্পেট, নতুন ঝকঝকে ফার্নিচারসহ ঘর সাজানোর নানান উপকরণে বাড়িটির চেহারাই বদলে গেছে। ১৯ নম্বর বাড়ি থেকে সেই গা ছমছমে ভাবটি একেবারেই অদৃশ্য।

তিনি কথা বললেন রোগা-পাতলা, বয়সের ভারে ন্যুজ্ব একটি মানুষের সঙ্গে। মেয়ের সঙ্গে বিপত্নীক মি, উইনবানের কোনো মিলই নেই বলতে গেলে।

হুঁ, হাসলেন মি. উইনবার্ন। কেউ কল্পনাই করতে পারবে না বাড়িটি ভুতুড়ে ছিল।

বাবা, বাজে কথা বলবে না। আজ সবে এলাম আমরা এ বাড়িতে।

আবারও হাসলেন উইনবার্ন সাহেব।

ঠিক আছে, আমরা সবাই এ ব্যাপারে একমত যে পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই।

এবং প্লিজ, বললেন ল্যাংকাস্টার। নিষাদের সামনে যেন এসব নিয়ে কিছু বোলো না। ও ভয় পাবে।

জফ মিসেস ল্যাংকাস্টারের একমাত্র ছেলে। জফের জন্মের বছরখানেক বাদে তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। পরিবারে সদস্য এখন জফ, তার মা আর দাদু। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালার কাঁচে ফোঁটা পড়ে শব্দ তুলছে– টুপটাপ, টুপটাপ।

শোনো, বললেন উইনবার্ন, বৃষ্টির শব্দটা মনে হচ্ছে না বাচ্চা ছেলের পায়ের আওয়াজ?

ওটা বৃষ্টির শব্দই, বাবা, হাসলেন ল্যাংকাস্টার।

উঁহু, আমি যেন পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, কৃত্রিম ভয়ে চিৎকার দিয়ে কান খাড়া করলেন উইনবার্ন সাহেব।

হাসতে হাসতে খুন হলেন ল্যাংকাস্টার। বাবার রসিকতার অভ্যাসটা যত বয়স বাড়ছে তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হেসে ফেললেন মি. উইনবার্নও। হলরুমে বসে চা পান করছিলেন বাবা ও মেয়ে। সিঁড়ির দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছিলেন উইনবার্ন। এবারে চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিলেন সিঁড়ি অভিমুখে।

তার নাতি জিওফ্রি ওরফে জফ সিঁড়ি বেয়ে ধীর গতিতে নেমে আসছে। অচেনা জায়গা দেখলে বাচ্চাদের চেহারায় যেমন একটা কৌতূহল এবং ভয়ের ভাব থাকে, সেরকম একটা ভাব তার চেহারায়। সিঁড়িগুলো ওক কাঠের তবে ওতে এখনও কার্পেট পাতা হয়নি। জফ সিঁড়ি বেয়ে নেমে মায়ের কাছে চলে এল। উইনবার্ন সাহেব একটু চমকে উঠলেন। জফ যখন মেঝেতে পা ফেলে হেঁটে আসছিল ওই সময় তিনি সিঁড়িতে আরেকটি পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছেন, যেন কেউ পিছু নিয়েছে তাঁর নাতির। টেনে টেনে পা ফেলছিল কেউ, যেন হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কাঁধ ঝাঁকালেন মি. উইনবার্ন। নিশ্চয়ই বৃষ্টির শব্দ মনে মনে বললেন।

আমি স্পঞ্জ কেক খাব, বলে প্লেট থেকে এক টুকরো কেক তুলে নিয়ে মুখে পুরল জফ।

নতুন বাড়ি তোমার পছন্দ হয়েছে, সোনা? জানতে চাইলেন ল্যাংকাস্টার।

খুব, কেক চিবোতে চিবোতে সংক্ষেপে জবাব দিল জিওফ্রি। পুরোটা খাওয়ার পরে এক গ্লাস পানি খেল সে ঢকঢক করে। হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে কথার তুবড়ি ছোটাল।

মাম্মি, এ বাড়িতে চিলেকোঠা আছে আমাকে বলেছে জেন। আমি ওখানে যেতে পারি, মা? নিশ্চয় ও ঘরে কোনো গোপন দরজা আছে যদিও জেন বলছে নেই। কিন্তু আমি জানি আছে। ওখানে পানির পাইপও আছে নিশ্চয়। ওগুলো নিয়ে আমি খেলব? প্রত্যাশা নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল জফ।

নিশ্চয় খেলবে, সোনা। বললেন ল্যাংকাস্টার। কাল আমরা চিলেকোঠায় যাব, কেমন? এখন তুমি ইট দিয়ে বাড়ি বানাও গে।

খুশি মনে চলে গেল জফ।

এখনও বৃষ্টি পড়ছে সমানে। বৃষ্টির শব্দ শুনছেন মি. উইনবার্ন। তিনি তখন কাঁচের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দই হয়তো শুনেছিলেন। কিন্তু তবু তাঁর মন খচখচ করতে থাকে। বারবার মনে হচ্ছিল কোনো বাচ্চার পায়ের আওয়াজই আসলে তিনি শুনতে পেয়েছিলেন।

সে রাতে অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখলেন মি. উইনবার্ন।

স্বপ্নে দেখলেন তিনি একটি শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। বড় একটি শহর। কিন্তু মনে হচ্ছিল এটি শিশুদের শহর, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নেই এখানে, শুধু শিশু ছাড়া। শত শত শিশু। স্বপ্নের মধ্যে সবাই তাঁর কাছে ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করছিল, তুমি কি ওকে নিয়ে এসেছ? ওরা কাকে নিয়ে আসতে বলছে তা যেন বুঝতে পারলেন উইনবার্ন সাহেব। করুণ মুখ করে ডানে বামে মাথা নাড়লেন। আনেননি। তখন বাচ্চাগুলো উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল তাঁর কাছ থেকে।

শহর এবং শিশুরা অদৃশ্য হয়ে গেল। জেগে গেলেন উইনবার্ন সাহেব। দেখলেন বিছানায় শুয়ে আছেন। কিন্তু বাচ্চাদের কান্না, ফোঁপানির আওয়াজ এখনও যেন ভেসে আসছে কানে। পুরোপুরি জেগে গেছেন তিনি তবু কান্নার আওয়াজটা শুনতে পেলেন পরিষ্কার। ভেসে আসছে দূর থেকে। ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে কেউ। শিশু কণ্ঠের কান্না। জফ নিচতলায় ঘুমায়। কান্নার শব্দটা ওখান থেকে আসছে না। আসছে ওপরতলা থেকে। বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। একটি দেশলাই কাঠি জ্বাললেন। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল কান্নার আওয়াজ।

চার

স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্ন পরবর্তী ঘটনার কথা মেয়েকে কিছুই বললেন না উইনবার্ন সাহেব। তিনি জানেন ওটা তার কল্পনা ছিল না এবং দিনের বেলা আবারও পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন। চিমনি থেকে হাওয়ার গোঙানি শোনা যাচ্ছিল তবে ওই আওয়াজ ছাপিয়েও পরিষ্কার শব্দটা শুনতে পেলেন। তিনি– ককিয়ে ককিয়ে কাঁদছে কেউ।

এবং উইনবার্ন সাহেব শীঘ্রি আবিষ্কার করলেন শিশু কণ্ঠের কান্না তিনি ছাড়া আরও দুএকজন শুনেছে। কাজের বুয়া জেন পার্লার মেইডকে বলছিল, জফ বাবুকে সে সকালবেলায় কাঁদতে শুনেছে। আড়াল থেকে কথাটা শুনে ফেললেন উইনবার্ন সাহেব। তবে জফ যখন নাশতা খেতে এল তাকে দারুণ সজীব দেখাচ্ছিল, দেখে মনে হলো না সে সকালবেলায় কান্নাকাটি করেছে। মি. উইনবার্ন ভালো করেই জানেন কাজের বুয়া জফ নয় সেই বাচ্চাটির কান্না শুনেছে যে বাচ্চাটির পায়ের শব্দ শুনে গতকাল বিকেলে তিনি চমকে উঠেছিলেন।

তবে মিসেস ল্যাংকাস্টার কিছু শুনলেন না। অন্য ভুবনের কোনো শব্দ শোনার জন্য সম্ভবত তৈরি করা হয়নি তাঁর কান।

তবে একদিন বিকেলে তিনি তড়িতাহতের মতো চমকে উঠলেন।

মাম্মি, আবদারের গলায় ডাকল জফ। আমাকে ওই ছোট্ট বাবুটার সঙ্গে তুমি খেলতে দেবে?

গল্প লেখায় মগ্ন ছিলেন ল্যাংকাস্টার, ছেলের ডাকে চমকালেন।

কোন্ ছেলে, সোনা? মুখ তুলে চাইলেন তিনি জফের দিকে।

ওর নাম জানি না। তবে চিলেকোঠায় থাকে, মেঝেয় বসে কাঁদছিল। আমাকে দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেল। মনে হয় খুব লাজুক ছেলে, আমার মতো এখনও বড় হয়নি। আমি নার্সারি বিল্ডিং বানাচ্ছি, দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ একা লাগল বাচ্চাটাকে। মনে হলো আমার সঙ্গে খেলতে চায়। আমি বললাম, এসো, একসঙ্গে বিল্ডিং বানাই। কিন্তু ও কিছু বলল না। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে একটা চকোলেটের বাক্স দেখছে কিন্তু তার মা তাকে বাক্সটা ধরতে মানা করেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল জফ। কিন্তু আমি যখন জেনকে ছেলেটার কথা বললাম, জানালাম আমি ওর সঙ্গে খেলতে চাই, সে আমাকে বলে কিনা এ বাড়িতে কোনো বাচ্চা ছেলে নেই। আমাকে চোখ রাঙাল যেন বানিয়ে কিছু না বলি। জেনটাকে আমার একদম ভাল্লাগে না।

চেয়ার ছাড়লেন জিওফ্রির মা।

জেন ঠিকই বলেছে। এ বাড়িতে কোনো বাচ্চা ছেলে থাকে না।

কিন্তু আমি যে ওকে স্পষ্ট দেখলাম। ও মা, আমাকে ওর সঙ্গে খেলতে যেতে দাও না! ছেলেটা খুবই একা আর বড় দুঃখী। ওর জন্য কিছু করতে চাই আমি, যাতে ওর মনটা ভালো হয়ে যায়।

ল্যাংকাস্টার কড়া গলায় সন্তানকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মাথা নেড়ে তাকে মানা করলেন উইনবার্ন সাহেব।

দাদু, কোমল গলায় বললেন তিনি নাতিকে, ওই বাচ্চাটা নিশ্চয় খুব দুঃখী আর ওর দুঃখ দূর করার জন্য তোমারও কিছু করা উচিত। কিন্তু আগে ভেবে বের করতে হবে কী করলে ওর মন ভালো হয়ে যাবে, দূর হয়ে যাবে একাকীত্ব। মনে করো এটা একটা ধাঁধা। এবং এ ধাঁধার জবাব তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে।

বড়দের মতো করে ধাঁধার জবাব খুঁজব? তার মানে কি আমি বড় হয়ে যাচ্ছি?

হ্যাঁ, তুমি বড় হয়ে যাচ্ছ।

নিঃসঙ্গ ছেলেটার জন্য কিছু একটা করতে পারবে এ খুশিতে চলে গেল জফ। মিসেস ল্যাংকাস্টার অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে ফিরলেন বাবার দিকে।

বাবা, দিস ইজ অ্যাবসার্ড। ছেলেটাকে ওভাবে উৎসাহিত করা মানে চাকর-বাকরদের গল্পে ওকে বিশ্বাসী করে তোলা।

না, ওরা কিছু ওকে বলেনি, বললেন বৃদ্ধ। ও দেখেছে আমি যা শুনেছি, মানে ওর বয়সী হলে আমিও একই জিনিস হয়তো দেখতাম।

কী আবোল তাবোল বকছ! আমি কেন কিছু দেখিনি কিংবা শুনিনি? মি. উইনবার্ন তাঁর ব্যাংকার এবং পার্টটাইম লেখক মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসলেন কেবল, জবাব দিলেন না।

কেন?

প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন ল্যাংকাস্টার। আর তুমি ওকে বলতেই বা গেলে কেন ওই ওকে-ওটাকে সাহায্য করতে পারবে?

বললাম কারণ তোমার সেই ওটার ব্যাপারে জফের মনে একটা অন্ধ বিশ্বাস জন্মেছে। সকল শিশুর মধ্যেই দারুণ কল্পনাপ্রবণ একটা মন থাকে। কিন্তু আমরা যত বড় হই, এ কল্পনা থেকে ততই দূরে সরে যাই এবং এক সময় কল্পনাপ্রবণ মনটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিই। আর মাঝে মাঝে, খুব যখন বুড়িয়ে যাই, একটা হালকা আলোকরেখা ফিরে আসে আমাদের কাছে, মনে করিয়ে দেয় শৈশবের অনেক স্মৃতি। এজন্যই আমার মনে হয়েছে জফ সাহায্য করতে পারবে।

ঠিক বুঝলাম না, অস্পষ্ট গলায় বললেন ল্যাংকাস্টার। আমিও যে ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝতে পেরেছি তা নয়। ওই-ওই বাচ্চাটা বিপদে আছে- সে মুক্ত হতে চায়। কিন্তু কীভাবে মুক্ত হবে? এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। তবে একটা বাচ্চা অসহায়ের মতো শুধু কেঁদে চলেছে, কথাটা ভাবলেও বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে।

পাঁচ

এ ঘটনার এক মাস পরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল জিওফ্রি। ডাক্তার মুখ গম্ভীর করে জানালেন কেস খুব খারাপ। ছেলের মাকে বললেন, আপনার ছেলের লাং-এ অনেকদিন ধরেই সমস্যা। ও আর সুস্থ হবে বলে মনে হয় না।

ছেলের শুশ্রূষা করতে গিয়ে অন্য আরেকটি বাচ্চার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেন ল্যাংকাস্টার। ফোপানি বা গোঙানির আওয়াজটাকে তিনি প্রথমে বাতাসের আর্তনাদ ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে শব্দটা ক্রমে আরও জোরাল এবং স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি পরিষ্কার শুনতে পেলেন ইনিয়ে বিনিয়ে অসহায় গলায়, হৃদয় ভেঙে দেয়া স্বরে কাঁদছে একটি শিশু।

প্রচন্ড জ্বরে প্রায় বেহুঁশ জফ এ সময় ককিয়ে উঠে বারবার বলতে লাগল, আমি ওকে সাহায্য করতে চাই। আমি ওকে সাহায্য করতে চাই!

কান্নার চোটে হেঁচকি উঠে গেল ছেলেটার, তারপর কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ল। শরীর হয়ে উঠল শক্ত, নিঃশ্বাস প্রায় নিচ্ছেই না বলা চলে, নিশ্চুপ হয়ে গেল। এখন ওকে চুপচাপ দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তারপর রাত এল। স্থির রাত। বাতাসের আন্দোলন নেই কোথাও।

হঠাৎ নড়ে উঠল জিওফ্রি। চাইল চোখ মেলে। মাকে ছাড়িয়ে দৃষ্টি চলে গেল খোলা দরজায়। কথা বলার চেষ্টা করল, জফের দিকে ঝুঁকে এলেন ছেলের কথা শুনতে।

হাঁপাতে হাঁপাতে জফ বলল, ঠিক আছে। আমি আসছি। বলেই মাথাটা এলিয়ে পড়ল বালিশে।

দারুণ ভয় পেলেন ল্যাংকাস্টার, এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে মি. উইনবার্নের কাছে গেলেন। কাছে পিঠে কোথাও থেকে ভেসে এল সেই বাচ্চার খলখল হাসি। হাসছে আনন্দে, বিজয়ের উল্লাসে। তার খুশি ভরা হাসির আওয়াজ প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ল ঘরে।

আমার ভয় লাগছে, বাবা! আমার ভয় করছে! গুঙিয়ে উঠলেন মিসেস ল্যাংকাস্টার।

মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা। অকস্মাৎ এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া চমকে দিল দুজনকেই। দমকা বাতাসটি মুহূর্তেই উধাও। আবার আগের মতোই ছির হাওয়া।

থেমে গেছে ভৌতিক হাসি। এবারে শোনা গেল মদু একটি শব্দ। এমনই আবছা, কানে প্রায় শোনাই যায় না, তবে আওয়াজের মাত্রা ক্রমে বেড়ে চলল এবং তারা শব্দটিকে চিনতে পারলেন। পায়ের আওয়াজ হালকা পদশব্দ এবং দ্রুত।

কাঁচের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার মতো শব্দ- টুপ-টাপ-টুপটাপ ।

থেমে থেমে শব্দটা হচ্ছে। এবারে এ শব্দের সঙ্গে যোগ হলো নতুন আরেক জোড়া পায়ের আওয়াজ। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে দুটি শিশু হাঁটছে।

শব্দগুলো এগিয়ে এল দরজার কাছে।

দরজা পার হলো পায়ের শব্দ। টুপটাপ, টুপটাপ, থপথপ থপথপ দুজন মানুষের পায়ের শব্দ মিশে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কাউকে।

মিসেস ল্যাংকাস্টার উন্মাদের মতো মুখ তুলে তাকালেন। ওরা এখন দুজন!

ভয়ে সাদা হয়ে জফের ঘরের দরজায় ছুটে যেতে চাইলেন তিনি। কিন্তু তার বাবা তাকে ধরে রাখলেন জোর করে। হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন সিঁড়ির দিকে। ওই শোনো, স্বাভাবিক গলায় বললেন তিনি।

দুজোড়া পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে নিচে।

টুপটাপ, টুপটাপ, থপথপ, থপথপ ।

তারপর কেবলই নিরবতা।

–আগাথা ক্রিস্টি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *