ইচ্ছাপূরণ

ইচ্ছাপূরণ

রাতে ঠাণ্ডা ছিল না। ভিজে আবহাওয়াও নয়। তবু লেক্সনাম ভিলার ছোট্ট বৈঠকখানার পর্দাগুলো টানা ছিল। আগুনও জ্বলছিল বেশ উজ্জ্বলভাবে। দাবা খেলতে বসেছিলেন বাবা আর ছেলে। বাবা মি. হোয়াইট দাবা খেলার ব্যাপারে নানারকম মৌলিক পরিবর্তন আনার কথা প্রায়ই ভাবতেন। কিন্তু তিনি তাঁর রাজাটিকে এমন এক জায়গায় চাললেন যে তাঁর স্ত্রী মিসেস হোয়াইটও কথা না বলে থাকতে পারলেন না। সাদা চুলের বুড়িটি এতক্ষণ আগুনের পাশে একমনে সেলাই করে যাচ্ছিলেন।

খুব দেরি হয়ে গেলেও মি. হোয়াইট বুঝলেন তিনি মারাত্মক ভুল করে বসেছেন। তিনি বলে উঠলেন, কীসের একটা শব্দ হলো না? তিনি চাইছিলেন তাঁর ভুল যেন ছেলে দেখতে না পায়।

ছেলে হার্বার্ট মনোযোগ দিয়ে ছকটি দেখতে দেখতে বলল, হ্যাঁ, শুনেছি। তারপর হাতটা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, কিস্তি।

মি. হোয়াইট দাবার ছকের উপর হাতটা বাড়িয়ে রেখে বললেন, মনে হয় না তিনি আজ রাতে আসবেন।

হার্বার্ট শুধু উত্তরে বলল, কিস্তিমাত।

মি. হোয়াইট হঠাৎ যেন রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, এত দূরে থাকার কোনো মানে হয়! জঘন্য পাঁকে ভরা, পোডড়া জায়গা অনেক দেখেছি বাবা, কিন্তু এমনটি আর দেখিনি। ফুটপাতগুলো খানায় খন্দে ভরা রাস্তায় যেন জলের স্রোত বইছে। জানি না লোকেরা কী ভাবে। মনে হয় তাদের কিছু এসে যায় না। কেন না রাস্তায় মাত্র দুটো বাড়িই তো থাকার মতো।

স্ত্রী মিসেস হোয়াইট সান্ত্বনা দেয়ার সুরে বললেন, মন খারাপ কোরো না। পরের গেমে তুমিও জিততে পারো।

মা ছেলের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। সেদিকে চোখ পড়ল মি. হোয়াইটের। তিনি চুপ করে গেলেন। অপরাধীর মতো মুখ করে হাসার চেষ্টা করলেন। তার পাতলা ধূসর দাড়ির মধ্যে সেই হাসি মিলিয়ে গেল ।

গেট খোলার শব্দ হলো জোরে। দরজার দিকে এগিয়ে আসছে ভারী পদধ্বনি। ওই যে তিনি এলেন। বলল হার্বার্ট হোয়াইট।

মি. হোয়াইট তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন, দরজা খুলে দিলেন এবং অতিথির আসতে কষ্ট হয়েছে বলে দুঃখপ্রকাশ করতে লাগলেন। মেহমানও স্বীকার করলেন তার একটু কষ্ট হয়েছে। মি. হোয়াইট লম্বা, মোটাসোটা ছোট ছোট চোখ এবং লাল মুখ একজন লোককে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকলেন। আস্তে করে কাশলেন মিসেস হোয়াইট।

মি. হোয়াইট বললেন, ইনিই সার্জেন্ট মেজর মরিস।

সার্জেন্ট মেজর করমর্দন পর্ব সেরে বসে পড়লেন আগুনের পাশে একটা চেয়ারে। হুইস্কি এবং গ্লাস বার করলেন মি. হোয়াইট। তামার কেটলিটা আগুনের ওপর। মরিসের দৃষ্টি এ সবের দিকেই।

তৃতীয় গ্লাস হাতে নিয়ে সার্জেন্ট মেজরের চোখ জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল। তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর চওড়া কাঁধ চেয়ারে ছড়ানো। তিনি বলে চলছিলেন অদ্ভুত সব দৃশ্যের কথা। তার দুঃসাহসী কাজের কথা, যুদ্ধ, প্লেগ এবং অদ্ভুত সব মানুষ নিয়েও তার গল্প চলল।

মি. হোয়াইট স্ত্রী আর পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, একুশ বছর হয়ে গেল। যখন মরিস চলে যায় তখনও সদ্য যুবক। আর আজ ওকে দেখ।

তারপর য়েগ করলেন, আমি নিজে একবার ভারতে যেতে চাই। নিজের চোখে সবকিছু দেখব আর কি।

সার্জেন্ট মেজর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশ তো আছেন এখানে। তিনি খালি গ্লাসটা মুখ থেকে নামালেন। হালকা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।

মি. হোয়াইট বললেন, আমি ওইসব পুরানো মন্দির, ফকির আর যাদুকরদের দেখতে চাই। আচ্ছা মরিস, আপনি সেদিন বানরের থাবা না কী যেন একটা জিনিসের কথা বলছিলেন না?

মরিস তাড়াতাড়ি বললেন, কিছু না। ওটা শোনার মতো কিছু নয়।

মিসেস হোয়াইট আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, বানরের থাবা?

সার্জেন্ট মেজর বললেন, আপনারা একে ভোজবাজি বলতে পারেন।

তিনজন শ্রোতা সাগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকলেন। মরিস অন্যমনস্কভাবে খালি গ্লাসটাই মুখে তুলে ধরে আবার সেটি টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। খালি গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে দিলেন মি. হোয়াইট।

সার্জেন্ট মেজর পকেট হাতড়াতে লাগলেন। বললেন, একটা ছোট্ট সাধারণ থাবা। শুকিয়ে মমি হয়ে গেছে।

তিনি পকেট থেকে জিনিসটি বার করলেন। রাখলেন সামনে। মিসেস হোয়াইট একটু পিছিয়ে গেলেন ভয়ে। কিন্তু ওঁর ছেলে হাতে নিল ওটা। দেখতে লাগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।

ছেলের হাত থেকে থাবাটি নিলেন মি. হোয়াইট। ভালো করে দেখলেন, তারপর বললেন, এর বিশেষত্বটা কী? টেবিলের উপর রাখলেন থাবাটি।

একজন বুড়ো ফকির এই থাবাটিকে মন্ত্র পড়ে জাগিয়ে তোলেন। ছিলেন খুব ধার্মিক। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন ভাগ্যই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যারা একে আটকাতে চায়, তারা শুধু দুঃখকেই ডেকে আনে। তিনি থাবাটিকে মন্ত্রপূত করেছিলেন, থাবাটি তিনজন মানুষের তিনটি ইচ্ছাপূরণ করবে।

এইসব কথা শুনে ওদের মুখে হালকা হাসি ফুটল।

হার্বার্ট বলল, আচ্ছা, আপনি আপনার তিনটে ইচ্ছের কথা বলেননি?

প্রগলভ তরুণের দিকে যেভাবে মধ্যবয়স্করা তাকায়, ঠিক সেভাবেই মরিস তাকালেন হার্বার্টের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম। তাঁর ব্ৰণে ভরা মুখটি সাদা দেখাল।

মিসেস হোয়াইট জানতে চাইলেন, আপনার তিনটে ইচ্ছেই কি পূরণ হয়েছিল?

হয়েছিল, জবাব দিলেন সার্জেন্ট মেজর। শক্ত দাঁতে গ্লাসটি তিনি ঠক ঠক করে ঠুকলেন।

আর কেউ কি কিছু চেয়েছিল? বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন।

একজন তার তিনটে ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেছিল। সার্জেন্ট মেজর উত্তর দিলেন। প্রথম দুটি ইচ্ছে কী ছিল জানি না। তৃতীয়টিতে সে চেয়েছিল তার মৃত্যু। তারপর থাবাটি চলে আসে আমার হাতে।

মরিসের গলার গম্ভীর স্বরে পরিবেশ হয়ে উঠল থমথমে। সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। শেষে নীরবতা ভঙ্গ করে মি. হোয়াইট বললেন, মরিস, এটির তো আপনার আর দরকার নেই তাহলে আর এটিকে সঙ্গে রেখেছেন কেন?

মরিস মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বললেন, নিছক শখ বলতে পারেন। ভেবেছিলাম এটাকে বিক্রি করে দেব। কিন্তু বিক্রি হবে বলে মনে হয় না। অপকার যা করার তা ইতিমধ্যে থাবাটি করে ফেলেছে। তাছাড়া কেউ এটা কিনতেও চাইবে না। কারণ সবার ধারণা এটা একটা গল্পকথা। কেউ হয়তো অন্য কিছু ভাবে। কিন্তু তারাও চায় আগে পরখ করে দেখতে। তারপর টাকার কথা।

মি. হোয়াইট মরিসের দিকে তাকালেন। আপনি তো আপনার আরও তিনটে ইচ্ছের কথা বলতে পারেন? সেগুলো কি পূরণ হবে?

মরিস বললেন, আমি জানি না, সত্যি জানি না।

তিনি থাবাটি হাতে নিলেন। দু আঙুলে টিপে ধরে দোলাতে লাগলেন সেটিকে। তারপর হঠাৎ ছুঁড়ে দিলেন আগুনের ওপর। হোয়াইট ঝুঁকে পড়ে থাবাটি টেনে নিলেন।

এটা পুড়ে গেলেই ভালো, শান্ত আর গম্ভীর গলায় বললেন মরিস।

মরিস, আপনার তো আর থাবাটির দরকার নেই। তাহলে এটা আমার কাছেই থাক, মি. হোয়াইট বললেন।

মরিস বললেন, এ জিনিস আপনি রেখে দিতে পারেন। তবে তারপর যা ঘটবে সেজন্য আমাকে যেন দোষ দেবেন না। তাই বলি, বুদ্ধিমান লোকের মতো থাবাটিকে ফের আগুনেই ফেলে দিন।

হোয়াইট মাথা নাড়লেন। খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন তার নতুন সম্পত্তিটিকে। তারপর বললেন, আচ্ছা বলুন তো কীভাবে ইচ্ছের কথা বলতে হয়।

থাবাটিকে ডান হাত তুলে ধরে তারপর ইচ্ছের কথা জোরে বলবেন, সার্জেন্ট মেজর বললেন, ফের বলছি এর পরিণাম কিন্তু খারাপ হতে পারে।

আরব্য রজনীর গল্পের মতো শোনাচ্ছে, বললেন মিসেস হোয়াইট। তিনি উঠে পড়লেন। রাতের খাবারের জোগাড় যন্ত্র করতে হবে। একটু হেসে বললেন, তুমি যেন আমার জন্য চার জোড়া হাত চেয়ে বোসো না।

মি. হোয়াইট পকেট থেকে থাবাটি বার করলেন। সার্জেন্ট মেজর তাঁর হাতটি ধরে ফেললেন চট করে। কর্কশ গলায় বলে উঠলেন, যদি কিছু চাইতেই হয়, তাহলে বরং ভালো কিছু চান। তিনি যেন সবাইকে সাবধান করে দিতে চাইছিলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে তিনজনেই হেসে উঠলেন।

মি. হোয়াইট ফের তার পকেটে পুরে ফেললেন থাবাটি। এরপর সবাই বসলেন খাবার টেবিলে। খাওয়া-দাওয়া চলতে লাগল। থাবাটির কথা প্রায় ভুলেই গেলেন সবাই। তিনজন শ্রোতা ভারতে মরিসের সৈনিক জীবনের দুর্ধর্ষ সব ঘটনার কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলেন।

খাওয়া শেষে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মরিস। তাঁকে শেষ ট্রেনটি ধরতে হবে।

হার্বার্ট বলল, উনি যেসব গল্প বলছিলেন তার চেয়ে বোধ হয় এই বানরের থাবার গল্পটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা দিয়ে তোমার খুব একটা লাভ হবে না বাবা।

মিসেস হোয়াইট বললেন, এই জন্য তুমি কি ওকে কিছু দিয়েছ?

সামান্য কিছু, তিনি একটু বাড়িয়ে বললেন, মরিস নিতে চাননি। আমি জোর করেই দিলাম। উনি আবার আমাকে বলেছেন ওটাকে ফেলে দিতে।

হাবার্ট হালকা গলায় বলল, কেন আমরা তো বড়লোক হয়ে যাব। চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের সুখের শেষ থাকবে না। বাবা, তুমি বরং রাজা হতে চাও। তাহলে দেখবে তোমাকে আর মায়ের কথা মতো ওঠ-বস করতে হবে না।

রাগের ভান করে মিসেস হোয়াইট ঢাকনা হাতে নিয়ে ছেলের দিকে তেড়ে গেলেন। হাবার্টি টেবিলের অন্যদিকে গিয়ে লুকালো।

মি. হোয়াইট তাঁর পকেট থেকে থাবাটি বের করলেন। সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলেন জিনিসটার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, এর কাছে যে কী চাইব তাই বুঝতে পারছি না।

হার্বার্ট বলল, বাড়িটার দেনা শোধ হলেই তো তুমি খুশি হও, তাই না? তাহলে এক কাজ করো। দুশো পাউন্ড চাও। ওতেই কাজ মিটে যাবে।

মি. হোয়াইট থাবাটি ডান হাতে নিয়ে উপরে তুলে ধরলেন। হার্বার্টি গম্ভীর মুখ করে পিয়ানোর ধারে বসে পড়ল। বেশ কয়েকটা সুর তুলল। এরই মধ্যে মায়ের দিকে তাকিয়ে সে একবার চোখ টিপল।

মি. হোয়াইট স্পষ্ট গলায় বললেন, আমার দুশো পাউন্ড চাই। তারপর তিনি ভয়ার্ত চিৎকার দিলেন।

মিসেস হোয়াইট আর হাবাটি দৌড়ে গেলেন তাঁর কাছে।

ভীষণ ভয় পাওয়া গলায় হোয়াইট সাহেব বললেন, নড়ে উঠেছিল ওটা। মেঝেয় পড়ে আছে থাবাটি। ওটার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বললেন, যখন আমি ওই কথাগুলো বললাম তখন থাবাটি আমার হাতের মধ্যে সাপের মতো কিলবিল করে উঠল।

হার্বার্ট থাবাটি তুলে নিয়ে টেবিলে রাখল। তারপর বলল, কই, তোমার টাকা কই? আমি হলফ করে বলতে পারি ওই টাকা আর আসবে না।

মিসেস হোয়াইট উদ্বেগের চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি বললেন, থাবা আবার নড়বে কেন? ও তোমার কল্পনা।

মি. হোয়াইট মাথা নাড়লেন। বললেন, যাকগে, বাদ দাও। এতে তো কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি কিন্তু চমকে গিয়েছিলাম।

আগুনের ধারে তারা আবার বসলেন। বাবা ও ছেলের মুখে পাইপ। বাইরে জোরে বাতাস বইছিল। ওপরতলার একটা দরজায় জোর শব্দ হচ্ছিল।

মি. হোয়াইটের চোখে ভয় ফুটে উঠল। একটা অস্বাভাবিক নীরবতা এবং অবসাদ যেন সবাইকে গিলে ফেলল। শেষে হোয়াইট দম্পতি উঠে পড়লেন। তাদের শোবার সময় হয়ে গেছে।

হাবার্ট তাদের শুভরাত্রি জানাল। বলল, মনে হচ্ছে তোমাদের বিছানার মাঝখানে একটা বড় থলের মধ্যে তোমরা টাকাটা পাবে। আর বাবা, তুমি যখন ওই টাকাটা পকেটে পুরবে, তখন দেখবে ওয়ার্ডরোবের ওপর থেকে একজোড়া ভয়ঙ্কর চোখ তোমার ওপর নজর রাখছে।

দুই

শীতের সকালের ঝলমলে রোদ টেবিলের ওপর খেলা করছে। ব্রেকফাস্টে বসেছেন ওঁরা তিনজন। হার্বার্ট গতরাত্রের ঘটনা নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিল। আলমারির তাকের ওপর অবহেলায় পড়ে আছে নোংরা, কোঁচকানো সেই থাবাটি। যেন নির্দোষ, নিষ্ঠুণ একটা জিনিস।

মিসেস হোয়াইট বললেন, অবসর নেয়া সব সৈনিকই সমান। আর আমরাও বোকার মতো বসে বসে আজগুবি গল্প শুনলাম। আজকের দিনে ইচ্ছা পূরণের ঘটনা ঘটে?

হালকা গলায় হার্বার্ট বলল, হয়তো আকাশ থেকেই বাবার মাথার ওপর টাকাগুলো খসে পড়বে।

মি. হোয়াইট বললেন, মরিস বলেছিলেন ঘটনাগুলো এত স্বাভাবিকভাবে ঘটে যে তোমরা ব্যাপারগুলোকে ইচ্ছে করলে দৈবের মতো কোনো ঘটনা নামনে করতেও পারো।

হার্বার্ট টেবিলে ছেড়ে উঠে পড়ল, আমি ফেরার আগে যেন টাকাটা খরচ করে ফেল না। ভয় হয় টাকাটা পাছে তোমাকে অন্য মানুষ করে। তোলে। তখন কিন্তু তোমাকে আর বাবা বলে ডাকতে পারব না!

মিসেস হোয়াইট হাসলেন। ছেলেকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তারপর ব্রেকফাস্টের টেবিলে ফিরে এলেন। স্বামীর বিশ্বাসপ্রবণতা নিয়ে হাসিঠাট্টায় নিজেকে খুব হালকা লাগছিল তাঁর। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ল ডাকপিয়ন। তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ডাকপিয়ন দর্জির দোকানের বিল দিয়ে গেল।

.

সেদিন ডিনারে বসে মিসেস হোয়াইট বললেন, তোমার ছেলে যখন ফিরবে তখন দেখবে সে আরও কত মজার মজার কথা বলবে। ভারি দুষ্টু।

বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে মি. হোয়াইট বললেন, তা হয়তো বলবে। তবে কসম খেয়ে বলছি ওটা আমার হাতের মধ্যে নড়াচড়া করছিল।

তোমার মনে হয়েছিল ওটা নড়ছে, নরম গলায় বললেন মিসেস হোয়াইট।

আমি বলছি ওটা নড়ছিল। ভাবাভাবির ব্যাপার নয়। এটা ঠিক

মাঝপথে কথা থামিয়ে দিলেন তিনি। তারপর বললেন, কী হলো? অমন করে কী দেখছ?

মিসেস হোয়াইট উত্তর দিলেন না। তিনি বাইরে একটি লোকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। খুব রহস্যজনকভাবে ভদ্রলোক ঘোরাফেরা করছিলেন। বাড়িটার দিকে তিনি এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন মনস্থির করতে পারছিলেন না কী করবেন।

আগন্তুকের পোশাক পরিচ্ছদ খুব চমৎকার। মাথায় পশমের টুপি, চকচকে, নতুন। বার তিনেক ভদ্রলোক গেটের সামনে থামলেন। তারপর আবার হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন। চতুর্থবার তিনি গেটের ওপর হাত রেখে দাঁড়ালেন। এবং হঠাৎ কী মনে করে গেট খুলে ফেললেন। এগিয়ে আসতে লাগলেন সামনের দিকে।

মিসেস হোয়াইটের হাত সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিছনে চলে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি অ্যাপ্রনের দড়ি খুলে ফেললেন। চেয়ারের গদির তলায় ঢুকিয়ে দিলেন সেটা। ভদ্রলোককে ঘরে নিয়ে এলেন। মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক খুব অস্বস্তিতে ভুগছেন। একবার তিনি আড়চোখে মিসেস হোয়াইটের দিকে তাকালেন। মিসেস হোয়াইট তাঁর অগোছালো ঘর এবং তাঁর স্বামীর কোটটির জন্য বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলেন। সাধারণত বাগানে কাজ করার সময় কোটটি মি. হোয়াইট পরে থাকেন। কিন্তু এ কথা যেন ভদ্রলোকের কানে যাচ্ছিল না। মিসেস হোয়াইট ভাবছিলেন, ভদ্রলোক হয়তো এবার তাঁর আসার কারণ জানাবেন। কিন্তু তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। ভদ্রলোক অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।

তারপর এক সময় টেনে টেনে বললেন, আমাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে। ভদ্রলোক একটু নিচু হলেন, তারপর তাঁর ট্রাউজার থেকে একটা আঁশ তুলতে তুলতে বললেন, আমি আসছি ম অ্যান্ড মেগিন্স থেকে।

মিসেস হোয়াইট চমকে উঠলেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে তিনি বললেন, কী ব্যাপার? হার্বার্টির কিছু হয়েছে? দয়া করে বলুন কী হয়েছে?

মি. হোয়াইট বললেন, শোনো, শোনো, চেয়ারে বোসো। আবোল তাবোল ভাবছ কেন?

তারপর আগন্তুকের দিকে তাকালেন, আপনি নিশ্চয় আমাদের জন্য কোনো খারাপ নিয়ে আসেননি।

আগন্তুক বললেন, আমি খুব দুঃখিত–

হার্বার্টির কী কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে? তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হোয়াইট।

আগন্তুক মাথা নাড়লেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, বড় একটা দুর্ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু এখন আর তার কোনো কষ্টই নেই।

যাক বাঁচা গেল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এর জন্য ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ–হঠাৎ মিসেস হোয়াইট থমকে গেলেন।

আগন্তুকের কথাটির মানে তিনি যেন হঠাৎ বুঝতে পারলেন। তিনি আবার তাকালেন ভদ্রলোকের মুখের দিকে। তাঁর বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে মিসেস হোয়াইট বুঝে গেলেন আসলে কী ঘটেছে।

তাঁর নিঃশাস যেন বন্ধ হয়ে গেল। স্বামীর দিকে ফিরলেন তিনি। কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখলেন স্বামীর হাতের উপর। কারো মুখে কোনো কথা নেই।

অনেকক্ষণ পর আগন্তুক আস্তে আস্তে বললেন, তাকে যন্ত্র পিষে ফেলেছে।

মি. হোয়াইট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তার হাতের মধ্যে স্ত্রীর হাত। তিনি তাঁর স্ত্রীর হাতের ওপর অল্প অল্প চাপ দিচ্ছিলেন। ঠিক চল্লিশ বছর আগে তাদের পূর্বরাগের দিনগুলোর মতো।

এক সময় আগন্তুকের দিকে আস্তে আস্তে ফিরে তিনি বললেন, আমাদের ওই একটিই মাত্র ছেলে। ওর কী খবর নিয়ে এসেছেন আপনি।

আগন্তুক কাশলেন, উঠে দাঁড়ালেন তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন জানালার কাছে। বললেন, আপনাদের এই নিদারুণ ক্ষতিতে কোম্পানি আপনাদেরকে গভীর সহানুভূতি জানিয়েছে। আশা করি বুঝতে পারছেন আমি এদের একজন কর্মচারী মাত্র। আমি এসেছি শুধু ওদের নির্দেশ পালন করতে।

প্রত্যুত্তরে কেউ কিছু বললেন না। মিসেস হোয়াইটের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। দৃষ্টি স্থির। তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যাচ্ছিল না। আর মি. হোয়াইট ভাবছিলেন, সার্জেন্ট মেজরের কথাগুলো হয়তো এইভাবেই ফলতে শুরু করল।

ভদ্রলোক বলে বললেন, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ম. অ্যান্ড মেগিন্স সব দায়িত্ব অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো দায়িত্বই নেই। কিন্তু আপনাদের পুত্রের কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ তারা আপনাদের কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে চেয়েছেন।

মি. হোয়াইটের শিথিল হাত থেকে তাঁর স্ত্রীর হাত ছুটে গেল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চোখ মুখে আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আগন্তুকের দিকে। তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে। কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন, কত?

দুশো পাউন্ড।

মিসেস হোয়াইট চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু সে চিৎকার মি. হোয়াইটের কানে গেল না। তাঁর মুখে হাসির রেখা। তিনি অন্ধের মতো হাত দুটো বাড়িয়ে দিলেন সামনের দিকে। তারপর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

তিন

দুমাইল দুরের নতুন বড় গোরস্থানে প্রিয় পুত্রকে সমাহিত করে হোয়াইট দম্পতি বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়িটি এখন শোকের ছায়া আর নির্জনতায় ভরা। ঘটনাগুলো এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে তাঁরা যেন কিছুই বুঝতে উঠতে পারছিলেন না। তাঁদের মনে হচ্ছিল, হয়তো আরও কিছু ঘটবে। তাঁদের এই পাষাণভার হালকা হয়ে যাবে। এই বয়সে ওই ভার আর তারা বইতে পারছিলেন না। তাঁদের মনে হচ্ছিল হয়তো আরও কিছু ঘটবে। তাঁদের এই পাষাণভার হালকা হয়ে যাবে। এই বয়সে ওই ভার আর তাঁরা। বইতে পারছিলেন না।

কিন্তু দিন গেল । আশা করতে করতে এক সময় তাঁরা যেন সব কিছু ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দিলেন। তাঁদের এই আশাহীন আত্মসমর্পণ অনেকে উদাসীনতা মনে করল । অনেক সময় তারা নিজেদের মধ্যেও কথা বলতেন না। কারণ তাঁদের কথা বলার আর কিছু ছিল না। তাঁদের দিনগুলো ছিল দীর্ঘ ক্লান্তিতে ভরা।

প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল। একদিন রাত্রে হঠাৎ মি. হোয়াইটের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়িয়ে বুঝতে পারলেন বিছানায় তিনি একা। ঘরে আলো জ্বলছে না। জানালার ধার থেকে একটা চাপা কান্নার শব্দ আসছিল। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, বিছানায় এসো। তোমার ঠান্ডা লাগবে।

কত আর ঠান্ডা লাগবে, মিসেস হোয়াইট বললেন, ফের ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি।

কান্নার শব্দ আর মি. হোয়াইটের কানে গেল না। গরম বিছানায় তাঁর চোখ জোড়া যেন জড়িয়ে আসছিল। তার তন্দ্রা এসে গেল। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেল। মিসেস

হোয়াইট পাগলের মতো চিৎকার করে বলছেন, বানরের থাবা! বানরের থাবা!

মি. হোয়াইট চমকে উঠলেন। তাঁর চোখে মুখে ভয়। বললেন,  কোথায় বানরের থাবা? কী হলো?

মিসেস হোয়াইট টলমল পায়ে তাঁর দিকে ছুটে এলেন। শান্ত গলায় বললেন, আমি সেটা চাই। তুমি নষ্ট করে ফেলনি তো?

বৈঠকখানায় রেখেছি, তাকের ওপর। কিন্তু কেন? তার গলার বিস্ময়।

মিসেস হোয়াইট কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি হেসে উঠলেন। নিচু হয়ে স্বামীর গালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন।

প্রলাপের মতো বললেন, আমার কেবল এখনই মনে পড়ল। আগে কেন মনে পড়েনি? হা গো, তোমার কেন আগে এ কথা মনে হয়নি?

কীসের কথা তুমি বলছ? তিনি প্রশ্ন করলেন।

কেন বাকি দুটি ইচ্ছের কথা? আমাদের তো কেবল একটি ইচ্ছে পূরণ । হয়েছে।

মি. হোয়াইট রেগে বললেন, যা হয়েছে, তা-ই কি যথেষ্ট নয়?

না, জোর গলায় বললেন মিসেস হোয়াইট । আমাদের আরো একটা। ইচ্ছে রয়েছে। নিচে যাও। থাবাটা নিয়ে এসো। আর সেটা হাতে নিয়ে বলো, আমাদের বাছা আবার বেঁচে উঠুক।

মি. হোয়াইট বিছানায় উঠে বসলেন। চাদরটা গা থেকে ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, ওহ গড, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?

নিয়ে এসো ওটা। শিগগির নিয়ে এসো। হাতে নিয়ে তোমার ইচ্ছের কথা বলো। আহারে বাছা আমার, বললেন মিসেস হোয়াইট।

মি. হোয়াইট দেশলাই জ্বেলে বাতি ধরালেন। গলায় জোর পেলেন না। তবু তিনি বললেন, বিছানায় চলে এসো। তুমি কী বলছ নিজেই বুঝতে পারছ না।

আমাদের প্রথম ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয়টা পূরণ হবে না কেন? যেন ঘোরের মধ্যে বললেন মিসেস হোয়াইট।

মি. হোয়াইট শুধু বলতে পারলেন, ওটা ঘটে গেছে কাকতালীয়ভাবে।

যাও ওটা নিয়ে এসো, তোমার ইচ্ছের কথা বলো, চিৎকার করে বললেন মিসেস হোয়াইট। স্বামীকে দরজার দিকে ঠেলে দিলেন তিনি।

মি. হোয়াইট অন্ধকারে নিচে নামলেন। হাতড়ে হাতড়ে পৌঁছে গেলেন বৈঠকখানায়। তারপর সেই তাকে। থাবাটি সেখানেই ছিল। তাঁর ভীষণ ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল ঘর থেকে বেরুবার আগেই হয়তো দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত চেহারা নিয়ে তাঁর ছেলে সামনে এসে হাজির হবে। তিনি কাঁপছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন দরজায় যাবার পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। ভ্রুতে ঘাম জমেছে। টেবিলের চারদিকে ঘুরে দেয়াল ধরে ধরে তিনি বাইরে এলেন। হাতে সেই অস্বস্তিকর জিনিসটা।

তিনি ঘরে ঢুকলেন। তাঁর স্ত্রীর মুখের চেহারাই যেন পালটে গেল । মি. হোয়াইটের চোখেমুখে ভয়। তিনি দেখলেন তার স্ত্রী অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে থাবাটির দিকে তাকিয়ে আছেন।

মিসেস হোয়াইট শক্ত গলায় বললেন, তোমার ইচ্ছার কথাটা বলো।

এটা ঠিক হচ্ছে না, বোকর মতো কাজ হচ্ছে, কথাটা যেন মি. হোয়াইটের গলায় আটকে গেল।

বলো তুমি, ফের বললেন মিসেস হোয়াইট।

মি. হোয়াইট হাতখানা তুলে ধরলেন। তারপর চিৎকার করে বললেন, আমার ছেলে আবার বেঁচে উঠুক।

থাবাটা মেঝেতে পড়ে গেল। ভয়ে শিউরে উঠে মি. হোয়াইট থাবাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একসময় কাঁপতে কাঁপতে তিনি চেয়ারের মধ্যে ডুবে গেলেন। আর তাঁর স্ত্রী জ্বলন্ত এক জোড়া চোখ নিয়ে জানালার এক ধারে এসে দাঁড়ালেন। টেনে খুলে নিলেন পর্দাটা।

মি. হোয়াইট বসে রইলেন। ঠাণ্ডায় যেন জমে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন স্ত্রীর আবছা চেহারার দিকে। মিসেস হোয়াইটের দৃষ্টি জানালার বাইরে। বাতির আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। একটা ভৌতিক ছায়া পড়ছিল সিলিং আর ছাদের ওপর। হঠাৎ দপ করে বাতিটা নিভে গেল। মি. হোয়াইট হাঁফ ছেড়ে বাচলেন।

না, থাবাটা এবারে আর কাজ দিল না। তিনি বিছানায় ফিরে এলেন। দুএক মিনিট পরে ধীর পায়ে বিছানায় এলেন মিসেস হোয়াইটও। পাশে শুয়ে পড়লেন উদাসীনভাবে।

কেউ কোনো কথা বলছিলেন না। নীরবে তারা ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনে যাচ্ছিলেন। সিঁড়িতে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হলো। একটা ইঁদুর কিচমিচ করতে করতে দেওয়াল ধরে ছুটল। অন্ধকারটা যেন বুকে চেপে বসেছিল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর মনে সাহস আনতে বিছানা থেকে নেমে মি. হোয়াইট দেশলাইয়ের বাক্সটা নিলেন। জ্বালাতে গিয়ে কাঠিটা নিভে গেল। আর একটা কাঠি জ্বালাতে যাচ্ছেন ঠিক তখন ঠক ঠক করে একটা শব্দ হলো। শব্দটা হলো খুব আস্তে। এত আস্তে যে কষ্ট করে শুনতে হয়। শব্দটা আসছিল ফ্রন্ট ডোর থেকে।

দেশলাইটা তার হাত থেকে পড়ে গেল। তিনি পাথরের মতো নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইলেন। এমন সময় শব্দ হলো আর একবার। তিনি পিছু ফিরলেন। দৌড়ে চলে এলেন ঘরে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। ফের আওয়াজ হলো। ঠক ঠক। সেই শব্দ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল।

চমকে উঠে মিসেস হোয়াইট চিৎকার করে উঠলেন, কীসের শব্দ?

একটা ইঁদুর। সিঁড়িতে আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে গেল, কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন মি. হোয়াইট।

মিসেস হোয়াইট বিছানার ওপর উঠে বসলেন। কান খাড়া। বেশ জোরে ঠকঠক করে শব্দ হলো। সারা বাড়ি গমগম করে উঠল সেই শব্দে।

আমার হার্বার্ট! আমার হার্বার্ট এসেছে, চিৎকার করে উঠলেন মিসেস হোয়াইট।

তিনি দৌড়ে চলে গেলেন দরজার দিকে। তাঁর সামনে তাঁর স্বামী। মি. হোয়াইট স্ত্রীর হাতটা জোর করে ধরে রইলেন।

খসখসে চাপা গলায় বললেন, কোথায় যাচ্ছ?

যন্ত্রের মতো হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে মিসেস হোয়াইট চিৎকার করে বললেন, আমার বাছা, আমার হার্বার্ট এসেছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম– দু মাইল পথ পার হতে তো একটু দেরি হবেই। হ্যাঁ গো, তুমি কেন আমাকে মিছিমিছি ধরে রেখেছ। আমাকে যেতে দাও লক্ষ্মীটি। দরজাটা খুলতে দাও।

ঈশ্বরের দোহাই, ওকে তুমি আসতে দিও না, ঠক ঠক করে কেঁপে উঠলেন মি. হোয়াইট।

তুমি তোমার ছেলেকে ভয় পাচ্ছ! হার্বার্ট, আমি আসছি। তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে যেতে দাও।

দরজায় আর একবার ঘা পড়ল। আরও একবার। মিসেস হোয়াইট হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিলেন। তারপর ছুটলেন। মি. হোয়াইট সিঁড়ি পর্যন্ত এলেন। বলতে লাগলেন, দোহাই, তুমি যেও না, ফিরে এসো। শিকল খোলার খড় খড় শব্দ কানে এলো তার। নিচের শক্ত খিলটাও আস্তে আস্তে খুলে গেল। তারপর মিসেস হোয়াইটের ক্লান্ত, হাঁফ ধরা গলা ভেসে এলো- ওপরের খিলটার নাগাল পাচ্ছি না। তুমি এসো তো একবার।

তখন মি. হোয়াইট হামাগুড়ি দিয়ে পাগলের মতো মেঝেতে থাবাটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। বাইরে যে আছে, সে ঘরে ঢোকার আগেই থাবাটিকে খুঁজে পেতে হবে।

সারা বাড়িতে ঠক ঠক শব্দ ছড়িয়ে পড়ছিল। মিসেস হোয়াইট টানতে টানতে একটা চেয়ার আনলেন। দরজার সামনে রাখলেন। খিলটা কাঁচ করে খুলে গেল। আর ঠিক সেই সময়েই থাবাটি হাতে ঠেকল মি. হোয়াইটের। তিনি পাগলের মতো চিৎকার করে বলে উঠলেন তার তৃতীয় ও শেষ ইচ্ছার কথা।

হঠাৎ থেমে গেল সেই শব্দ। শুধু রয়ে গেল তার প্রতিধ্বনি। মি. হোয়াইট শুনতে পেলেন চেয়ার সরানোর শব্দ। শুনলেন দরজাটা খুলে গেল। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে।

হতাশায় দুঃখে হাহাকার করে উঠলেন মিসেস হোয়াইট। মি. হোয়াইট দৌড়ে গেলেন স্ত্রীর পাশে। তারপর আস্তে আস্তে গেট খুলে বাইরে এলেন। শব্দহীন, জনমানবশূন্য রাস্তায় শুধু জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আলো। আর কোথাও কিছু নেই, কেউ নেই।

–ডব্লু. ডব্লু জ্যাকবস

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *