1 of 2

নৌকাডুবি ৪৪

এ কয়দিন অক্ষয় দেখা দেয় নাই। নলিনাক্ষ কাশীতে চলিয়া গেলে আজ সে যোগেন্দ্রের সঙ্গে অন্নদাবাবুর চায়ের টেবিলে দেখা দিয়াছে। অক্ষয় মনে মনে স্থির করিয়াছিল যে, রমেশের স্মৃতি হেমনলিনীর মনে কতখানি জাগিয়া আছে তাহা পরিমাপ করিবার সহজ উপায় অক্ষয়ের প্রতি তাহার বিরাগপ্রকাশ। আজ দেখিল, হেমনলিনীর মুখ প্রশান্ত; অক্ষয়কে দেখিয়া তাহার মুখের ভাব কিছুমাত্র বিকৃত হইল না; সহজ প্রসন্নতার সহিত হেমনলিনী কহিল, “আপনাকে যে এতদিন দেখি নাই?”

অক্ষয় কহিল, “আমরা কি প্রত্যহ দেখিবার যোগ্য?”

হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “সে যোগ্যতা না থাকিলে যদি দেখাশোনা বন্ধ করা উচিত বোধ করেন, তবে আমাদের অনেককেই নির্জনবাস অবলম্বন করিতে হয়।”

যোগেন্দ্র। অক্ষয় মনে করিয়াছিল একলা বিনয় করিয়া বাহাদুরি লইবে, হেম তাহার উপরেও টেক্কা দিয়া সমস্ত মনুষ্যজাতির হইয়া বিনয় করিয়া লইল, কিন্তু এ সম্বন্ধে আমার একটুখানি বলিবার কথা আছে। আমাদের মতো সাধারণ লোকই প্রত্যহ দেখাশোনার যোগ্য– আর যাঁরা অসাধারণ, তাঁহাদিগকে কদাচ-কখনো দেখাই ভালো, তাহার বেশি সহ্য করা শক্ত। এইজন্যই তো অরণ্যে-পর্বতে-গহ্বরেই তাঁহারা ঘুরিয়া বেড়ান– লোকালয়ে তাঁহারা স্থায়িভাবে বসতি আরম্ভ করিয়া দিলে অক্ষয়-যোগেন্দ্র প্রভৃতি নিতান্তই সামান্য লোকদের অরণ্যে-পর্বতে ছুটিতে হইত।

যোগেন্দ্রের কথাটার মধ্যে যে খোঁচা ছিল, হেমনলিনীকে তাহা বিঁধিল। কোনো উত্তর না দিয়া তিন পেয়ালা চা তৈরি করিয়া সে অন্নদা অক্ষয় ও যোগেন্দ্রের সম্মুখে স্থাপন করিল। যোগেন্দ্র কহিল, “তুমি বুঝি চা খাইবে না?”

হেমনলিনী জানিত, এবার যোগেন্দ্রের কাছে কঠিন কথা শুনিতে হইবে, তবু সে শান্ত দৃঢ়তার সহিত বলিল, “না, আমি চা ছাড়িয়া দিয়াছি।”

যোগেন্দ্র। এবারে রীতিমত তপস্যা আরম্ভ হইল বুঝি! চায়ের পাতার মধ্যে বুঝি আধ্যাত্মিক তেজ যথেষ্ট নাই, যা-কিছু আছে, সমস্তই হর্‌তুকির মধ্যে? কী বিপদেই পড়া গেল! হেম, ও-সমস্ত রাখিয়া দাও। এক পেয়ালা চা খাইলেই যদি তোমার যোগ-যাগ ভাঙিয়া যায়, তবে যাক-না– এ সংসারে খুব মজবুত জিনিসও টেঁকে না, অমন পলকা ব্যাপার লইয়া পাঁচ জনের মধ্যে চলা অসম্ভব।

এই বলিয়া যোগেন্দ্র উঠিয়া স্বহস্তে আর-এক পেয়ালা চা তৈরি করিয়া হেমনলিনীর সম্মুখে রাখিল। সে তাহাতে হস্তক্ষেপ না করিয়া অন্নদাবাবুকে কহিল, “বাবা, আজ যে তুমি শুধু চা খাইলে? আর কিছু খাইবে না?”

অন্নদাবাবুর কণ্ঠস্বর এবং হাত কাঁপিতে লাগিল, “মা, আমি সত্য বলিতেছি, এ টেবিলে কিছু খাইতে আমার মুখে রোচে না। যোগেনের কথাগুলো আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত নীরবে সহ্য করিতে চেষ্টা করিতেছি। জানি আমার শরীর-মনের এ অবস্থায় কথা বলিতে গেলেই আমি কী বলিতে কী বলিয়া ফেলি– শেষকালে অনুতাপ করিতে হইবে।”

হেমনলিনী তাহার পিতার চেয়ারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “বাবা, তুমি রাগ করিয়ো না। দাদা আমাকে চা খাওয়াইতে চান, সে তো ভালোই; আমি তো কিছু তাহাতে মনে করি নাই। না বাবা, তোমাকে খাইতে হইবে– খালি-পেটে চা খাইলে তোমার অসুখ করে আমি জানি।”

এই বলিয়া হেম আহার্যের পাত্র তাহার বাপের সম্মুখে টানিয়া আনিল। অন্নদা ধীরে ধীরে খাইতে লাগিলেন।

হেমনলিনী নিজের চৌকিতে ফিরিয়া আসিয়া যোগেন্দ্রের প্রস্তুত চায়ের পেয়ালা হইতে চা খাইতে উদ্যত হইল। অক্ষয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া কহিল, “মাপ করিবেন, ও পেয়ালাটি আমাকে দিতে হইবে, আমার পেয়ালা ফুরাইয়া গেছে।”

যোগেন্দ্র উঠিয়া আসিয়া হেমনলিনীর হাত হইতে পেয়ালা টানিয়া লইল এবং অন্নদাকে কহিল, “আমার অন্যায় হইয়াছে, আমাকে মাপ করো।”

অন্নদা তাহার কোনো উত্তর করিতে পারিলেন না, দেখিতে দেখিতে তাঁহার দুই চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।

যোগেন্দ্র অক্ষয়কে লইয়া আস্তে আস্তে ঘর হইতে সরিয়া গেল। অন্নদাবাবু আহার করিয়া উঠিয়া হেমনলিনীর হাত ধরিয়া কম্পমান চরণে উপরের ঘরে গেলেন।

সেই রাত্রেই অন্নদাবাবুর শূলবেদনার মতো হইল। ডাক্তার আসিয়া পরীক্ষা করিয়া বলিল, তাহার যকৃতের বিকার উপস্থিত হইয়াছে– এখনো রোগ অগ্রসর হয় নাই, এইবেলা পশ্চিমে কোনো স্বাস্থ্যকর স্থানে গিয়া বৎসরখানেক কিংবা ছয় মাস বাস করিয়া আসিলে শরীর নির্দোষ হইতে পারিবে।

বেদনা উপশম হইলে ও ডাক্তার চলিয়া গেলে অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেম, চলো মা, আমরা কিছুদিন নাহয় কাশীতে গিয়াই থাকি।”

ঠিক একই সময়ে হেমনলিনীর মনেও সে কথা উদয় হইয়াছিল। নলিনাক্ষ চলিয়া যাইবামাত্র হেম আপন সাধনসম্বন্ধে একটু দুর্বলতা অনুভব করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। নলিনাক্ষের উপস্থিতিমাত্রই হেমনলিনীর সমস্ত আহ্নিকক্রিয়াকে যেন দৃঢ় অবলম্বন দিত। নলিনাক্ষের মুখশ্রীতেই যে একটা স্থির নিষ্ঠা ও প্রশান্ত প্রসন্নতার দীপ্তি ছিল তাহাই হেমনলিনীর বিশ্বাসকে সর্বদাই যেন বিকশিত করিয়া রাখিয়াছিল, নলিনাক্ষের অবর্তমানে তাহার উৎসাহের মধ্যে যেন একটা ম্লান ছায়া আসিয়া পড়িল। তাই আজ সমস্ত দিন হেমনলিনী নলিনাক্ষের উপদিষ্ট সমস্ত অনুষ্ঠান অনেক জোর করিয়া এবং বেশি করিয়া পালন করিয়াছে। কিন্তু তাহাতে শ্রান্তি আসিয়া এমনি নৈরাশ্য উপস্থিত হইয়াছিল যে, সে অশ্রুসংবরণ করিতে পারে নাই। চায়ের টেবিলে দৃঢ়তার সহিত সে আতিথ্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, কিন্তু তাহার মনের মধ্যে একটা ভার চাপিয়া ছিল। আবার তাহাকে তাহার সেই পূর্বস্মৃতির বেদনা দ্বিগুণবেগে আক্রমণ করিয়াছে– আবার তাহার মন যেন গৃহহীন-আশ্রয়হীনের মতো হা হা করিয়া বেড়াইতে উদ্যত হইয়াছে। তাই যখন সে কাশী যাইবার প্রস্তাব শুনিল তখন ব্যগ্র হইয়া কহিল, “বাবা, সেই বেশ হইবে।”

পরদিন একটা আয়োজনের উদ্‌যোগ দেখিয়া যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কী, ব্যাপারটা কী?”

অন্নদা কহিলেন, “আমরা পশ্চিমে যাইতেছি।”

যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “পশ্চিমে কোথায়?”

অন্নদা কহিলেন, “ঘুরিতে ঘুরিতে একটা কোনো জায়গা পছন্দ করিয়া লইব।” তিনি যে কাশীতে যাইতেছিলেন এ কথা এক দমে যোগেন্দ্রের কাছে বলিতে সংকুচিত হইলেন।

যোগেন্দ্র কহিল, “আমি কিন্তু এবার তোমাদের সঙ্গে যাইতে পারিব না। আমি সেই হেড্‌মাস্টারির জন্য দরখাস্ত পাঠাইয়া দিয়াছি, তাহার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করিতেছি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *