নোরা – প্রথম অঙ্ক

প্রথম অঙ্ক

[বেশ খোলামেলা আরামদায়ক একটি ঘর। আসবাবপত্র সেরকম দামি নয়, তবে রুচিশীল। পিছনের দেয়ালে দুটি দরজা। ডানদিকের দরজা দিয়ে হলঘরের দিকে আর বাঁ-দিকের দরজা দিয়ে হেলমারের পড়ার ঘরের দিকে যাওয়া যায়। দুটো দরজার মাঝখানে দেয়ালে ঠেস দেয়া একটা পিয়ানো।

বাঁ-দিকের দেয়ালের মাঝ বরাবর অন্য একটি দরজা। দরজার কাছাকাছি জানালা আছে। জানালার কাছে একটি গোল টেবিল, হাতল-চেয়ার ও ছোট্ট একটা সোফা। ডানদিকের দেয়ালে প্রায় পিছনের দিকে আর একটা দরজা। একটু দূরে দেয়ালের গায়ে লাগোয়া স্টোভ। স্টোভের সামনে দু–একটা ইজিচেয়ার ও দোলনাচেয়ার। দরজা এবং স্টোভের মাঝখানে ছোট্ট একটি টেবিল।

দেয়ালে কিছু খোদাই কাজের নিদর্শন। চীনা কারুকাজ-করা একটি কেবিনেট এবং আরও কিছু আনুষঙ্গিক এটাওটা। একটা ছোট্ট বই-শেল্ফ। শেলফে চমৎকার বাঁধানো কিছু বই। মেঝেতে গালিচা। স্টোভ জ্বলছে।

সময় : শীতের কোনও একদিন।

বাইরে হলঘরের বেল বাজে। তারপরই দরজা খোলার শব্দ শোনা যায়। আনন্দিত নোরা গুনগুন করতে করতে ঘরে প্রবেশ করে। কাপড়চোপড় দেখেই বোঝা যায় বাইরে থেকে এসেছে। দুই হাত ভরা কেনাকাটার ঠোঙা। নোরা সেগুলো ডানদিকের টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে। হলঘরের দরজা খোলা থাকে। হলঘরের দরজার কাছে কুলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কুলির হাতে একটা ক্রিসমাস ট্রি এবং বড় একটা ঝুড়ি। কাজের যে-মেয়েটি দরজা খুলেছিল কুলিটি তার কাছে ক্রিসমাস ট্রি ও ঝুড়িটি দেয়।]

নোরা : হেলেনা, গাছটা খুব সাবধানে কোথাও লুকিয়ে রাখো। বাচ্চারা যেন সন্ধ্যার আগে টের না পায়। কখন সাজানো-গোছানো হল কিছুই যেন জানতে না পারে। [কুলির দিকে ফিরে নোরা হাতব্যাগ বের করে] কত যেন?

কুলি : পঞ্চাশ ওর।

নোরা : নাও এখানে এক ক্রোন। না, না, তুমি রাখো, খুচরা দিতে হবে না।

[কুলি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায়। নোরা দরজা বন্ধ করে। গুনগুন করে দুষ্টুমির হাসি হাসে। কাপড়চোপড় ছাড়ে। পকেট থেকে মাকারুনের ছোট্ট প্যাকেট বের করে একটা-দুটো মুখে পুরে দেয়। তারপর পা টিপে টিপে তার স্বামীর ঘরের দিকে গিয়ে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করে।]

হ্যাঁ, আছে, ঘরেই আছে।

[নোরা আবার গুনগুন করে ডানদিকের টেবিলের কাছে চলে যায়।]

হেলমার : [পড়ার ঘর থেকে] কে ওখানে? কার কিচিরমিচির, আমার পাখি কি ফিরল নাকি?

নোরা : [ব্যস্ত হাতে মোচা খুলতে খুলতে] হ্যাঁগো হ্যাঁ—সেই-ই।

হেলমার : কাঠবিড়ালির মতো চঞ্চল ছুটছে।

নোরা : হ্যাঁগো—হ্যাঁ।

হেলমার : কখন এল কাঠবিড়ালি?

নোরা : এই তো। [মাকারুনের প্যাকেটটা পকেটে পুরে হাত দিয়ে মুখ মোছে।]

টোরভাল্ড, একটু এসো না। দেখে যাও কী কিনেছি।

হেলমার : আমি এখন ব্যস্ত। [মুহূর্ত পরে হেলমার দরজা খুলে মুখ বাড়ায়। তার হাতে কলম।] তুমি কী কিনেছ বললে? কী? আমার চঞ্চলমতি বধূয়া নিছক টাকা খরচ করার জন্যেই আবার বাইরে গিয়েছিল। তাই না?

নোরা : টোরভাল্ড, এবার কিন্তু আমরা একটু বেশি খরচ করতে পারব। কি, পারব না? এই প্রথম বড়দিনে কিছুটা বেহিসেবি খরচ করা যাবে, কী বল?

হেলমার : তবুও অপচয় করাটা কি ঠিক?

নোরা : তা হয়তো ঠিক নয়। কিন্তু কিছুটা তো যায়। এই একটু। কি, যায় না? তুমি অনেক টাকা বেতন পেতে যাচ্ছ। এরপর তো তোমার কেবল টাকা আর টাকা। অপচয় কিছুটা বোধহয় এখন করতে পারি।

হেলমার : হ্যাঁ, নতুন বছর শুরু হলে ঠিক আছে। কিন্তু তার আগে? এরপরও যে বছরের চারভাগের একভাগ বাকি, তারপর গিয়ে টাকা পাব।

নোরা : তাহলেও—তার আগ পর্যন্ত ধার উদ্ধার করব।

হেলমার : নোরা! [কাছে যায় এবং দুষ্টুমির চালে নোরার কান ধরে।] সেই একই হালকামতি। ভাবনা নেই, চিন্তা নেই, হাওয়ায় ভাসা। আচ্ছা ধর, আমি আজ এক হাজার ক্রোনার কারও কাছ থেকে ধার করলাম আর তুমি বড়দিনের মাঝেই পুরোটা শেষ করে দিলে—তারপর নববর্ষের সন্ধ্যায় আমার মাথায় একটা টালি ছুটে এসে পড়ল—ব্যাস চিৎপাত—ব্যাপারটা ভাবো তো—

নোরা : [হেলমারের মুখের উপর একটি হাত রেখে] চুপ, এরকম বিশ্রী ভয়ানক কথা বল না তো!

হেলমার : না, ধর এরকম কিছু একটা যদি ঘটে তাহলে….

নোরা : ওরকম ভয়াবহ কিছু একটা যদি ঘটেই যায় তাহলে আমার মনে হয় না আমি অন্যকিছু মনে রাখব। কে টাকা পায় আর না পায় সেটা তখন কোনও ব্যাপারই না আমার কাছে।

হেলমার : কিন্তু যার কাছ থেকে টাকাটা এনেছি তার কী হবে? তার তো কোনও দোষ নেই।

নোরা : তখন আর তার ব্যাপারে কে চিন্তা করে? সে তো আমার কাছে অচেনা বাইরের মানুষ ছাড়া কিছু নয়।

হেলমার : নোরা! নোরা! পৃথিবীর হাজার কোটি মেয়েদের মতো কথা। ঠাট্টা নয় নোরা, সত্যি সত্যি বলছি এ ব্যাপারে আমার কী মত সে তো তুমি জানো কোনও ঋণ নয়, কোনও ধার নয়। যে সংসার ঋণ আর ধারের উপর দাঁড়িয়ে থাকে সে সংসারে শ্বাসরুদ্ধকর কুৎসিত একটা ব্যাপার থাকে। তুমি আর আমি যে করেই হোক এখনও এসব থেকে মুক্ত—বাকি কটা দিনও মুক্ত থাকতে চাই। ঋণ—টিনে আর জড়াতে চাই না।

নোরা : [স্টোভের কাছে যেতে যেতে] ঠিক আছে তুমি যা বলবে তাই হবে।

হেলমার : [নোরাকে অনুসরণ করে] এই দেখ দেখ। আমার লক্ষ্মী দোয়েল পাখির অমনি মন খারাপ হয়ে গেল।

[মানিব্যাগ বের করে] নোরা, এর মধ্যে কী আছে বল তো?

নোরা : [ ঝট করে ঘুরে দেখে] টাকা!

হেলমার : এই নাও। [কিছু টাকার নোট দেয়] আরে আমি তো জানি, বড়দিনের সময় ঘরে খরচ কী লাগে সেটা আমি জানি না ভাবলে?

নোরা : [গুনছে] দশ-বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ। ওহ্—সত্যি টোরভাল্ড, তোমাকে যে কী বলব! এতে আমার বহুদিন চলে যাবে।

হেলমার : হ্যাঁ, খেয়াল রেখো যেন যায়।

নোরা : অবশ্যই। না-না দেখো, সত্যি সত্যি খেয়াল রাখব। এস—দেখবে চল কী সব কিনেছি। বেশ শস্তায় আইভারের জন্য একটা নতুন স্যুট আর একটা তলোয়ার। ববের জন্য একটা ঘোড়া আর একটা মৃদঙ্গ। এটা হল এমির পুতুল আর এই হল পুতুলের বিছানা। এগুলো একটু কমদামি, অবশ্য ক্ষতি নেই, কালকেই তো টুকরা-টুকরা করে ফেলবে। কোথায় কী যাবে তার ঠিক আছে? আর এগুলো কাজের মেয়েদের জামার কাপড় ও রুমাল। দাইমা’র জন্য অবশ্য আরও কিছু আনা উচিত ছিল।

হেলমার : আর ওই প্যাকেটে কী?

নোরা : [প্রায় চিৎকার করে] না, না, টোরভাল্ড, ওটা তুমি আজ সন্ধ্যার আগে দেখবে না।

হেলমার : আচ্ছা খুদে উড়নচণ্ডি! এবার তোমার নিজের জন্য কী চাও বল।

নোরা : আমার জন্য! কিছু না। একদম কিছু না। আমার কিচ্ছু চাই না।

হেলমার : কিন্তু নিতে তো হবেই। বল—একটা কিছু বল। অবশ্য সঙ্গতির মধ্যে।

তোমার ভালো লাগে সেরকম কিছু একটা বল।

নোরা : না—[একটু ভেবে] তেমন কিছু চিন্তা করতে পারছি না। যদি না… টোরভাল্ড…

হেলমার : হ্যাঁ, বল।

নোরা : [হেলমারের দিকে না তাকিয়ে—ওয়েস্ট কোটের বোতাম নাড়াচাড়া করতে করতে] তুমি যদি সত্যি কিছু দিতে চাও—তাহলে—ঠিক আছে তাহলে….

হেলমার : বলই না। বলে ফেল।

নোরা : [ঝট্ করে] আমাকে তুমি টাকা দিতে পার। মনে কর যতটা দিলে তোমার অসুবিধা হবে না। এর মাঝেই এক ফাঁকে আমি তাহলে একটা কিছু কিনে নেব।

হেলমার : কিন্তু নোরা–

নোরা : আচ্ছা দাও না—টোরভাল্ড, দাও না লক্ষ্মীটি। দাও। তারপর আমি সেটাকে সোনালি কাগজ দিয়ে মুড়ে ক্রিসমাস গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখব। মজা হবে না?

হেলমার : ওদের যেন কী বলে—ওই যারা সবসময় টাকা ওড়ায়

নোরা : জানি, সে আমি জানি। অপব্যয়ী। তা বলুক গে। সত্যি, দাও না। আমি যা বলছি তাই কর—দাও। এর মধ্যে আমি সত্যি কী চাই সেটা ভেবে দেখার সময় পাব। ব্যাপারটা যুক্তিসংগত কিনা বল।

হেলমার : [হেসে] হ্যাঁ। খুব। অবশ্য সেটা যদি তুমি কর—মানে তোমাকে যে টাকা দেব সেটা যদি তুমি রেখে দাও এবং তা দিয়ে সত্যি সত্যি নিজের জন্য কিছু কেনো। তবে তা না করে যদি ঘরের কাজে লাগাও আর উল্টোপাল্টা অর্থহীন জিনিস কিনে শেষ কর তাহলে আমাকে আবার দিতে হবে, এই যা।

নোরা : ওহ্—কিন্তু টোরভাল্ড

হেলমার : এ-কথা তুমি অস্বীকার করতে পার না। কী, পার? [হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে] এটা হল একটি ছোট্ট মিষ্টি পাখি। তবে এ পাখি পুষতে খরচ অনেক। তোমার মতো এরকম একটি ছোট্ট পাখি যার ঘরে আছে সে মানুষের যে কী পরিমাণ খরচ হয় সেটা বললে তুমি বিশ্বাসও করবে না।

নোরা : এটা কিন্তু ঠিক বললে না। আমি তো যতটুকু পারি সঞ্চয়ও করি।

হেলমার : [হেসে] হ্যাঁ—এটা খুব সত্য ‘যতটা তুমি পার’। তবে সত্যি হল, তুমি মোটেও পার না।

নোরা : [আনন্দে মাথা দুলিয়ে] আহা—আমাদের মতো পাখিদের কী খরচ সেটা যদি একবার বুঝতে।

হেলমার : তুমি অদ্ভুত ধরনের একটি বাচ্চামেয়ে। তোমার বাবার মতো। প্রায় সবসময়ই টাকা যা পাও তাই হাতড়িয়ে নিতে চাও—এবং পাওয়ামাত্রই টাকাগুলো তোমার আঙুলের ফাঁক গলিয়ে পলকে উধাও—কী হল কোথায় গেল তার হিসাবও থাকে না। যাহোক, তুমি যেমন তাই নিয়েই আমি খুশি—এখানে তোমার তো কিছু করার নেই, রক্তে আছে। আসলেই এ ব্যাপারগুলো বংশগত।

নোরা : বাবার ভালো গুণের আরো কিছু পেলে ভালো হত।

হেলমার : তাহলেও তুমি যেমন তার বেশি অথবা তার থেকে আলাদা কিছু আমি চাইতাম না। তুমি যেমন তেমনি আমার ভালো। আমার ছোট্ট গানের পাখি। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, তোমাকে দেখতে লাগছে…, লাগছে…, কীভাবে বলি? দাঁড়াও এমন লাগছে যেন আজ সারাদিন তোমার দুষ্টুমি করেই কাটবে।

নোরা : তাই!

হেলমার : হ্যাঁ। সত্যি সেরকম। একেবারে সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকাও তো।

নোরা : [তাকিয়ে] হ্যাঁ বল। তাকালাম তো।

হেলমার : [তার দিকে আঙুল নেড়ে] আজকে বোধহয় শহরে গিয়ে কিছু খাওনি?

নোরা : না। অমন কথা ভাবলে কী করে?

হেলমার : কোনও কনফেকশনারিতে কি উকিও মারনি!

নোরা : না–না। সত্যি বলছি টোরভাল্ড।

হেলমার : মিষ্টি কোনও একটা কিছু কামড় দিয়েও দেখনি!

নোরা : না-না সত্যিই না।

হেলমার : একটা দুটো মাকারুন খুঁটে খুঁটে খাওয়া। তা–ও না?

নোরা : না গো। টোরভাল্ড, কসম কেটে বলতে হবে?

হেলমার : না না, তার দরকার নেই, একটু ঠাট্টা করলাম আর কী।

নোরা : [ডানদিকের টেবিলের কাছে যেতে যেতে] তুমি যা পছন্দ কর না আমি কখনও তা করি না।

হেলমার : তুমি কর না সেটা আমি জানি—তার ওপর কথাও দিয়েছ। [নোরার কাছে যায়] ঠিক আছে, বড়দিনের রহস্যটুকু তোমার কাছেই থাকুক। সন্ধের দিকে যখন গাছে বাতি জ্বলবে তখন একবারে সব দেখে নেব।

নোরা : ডাক্তার র‍্যাংককে বলেছ?

হেলমার : না তো—অবশ্য তার দরকারও নেই। এটা তো জানা কথাই সে আমাদের সাথে খাবে। দুপুরে এলে বলে দেব। একটা দারুণ ওয়াইন জোগাড় করেছি। কী আগ্রহে আমি আজ সন্ধ্যার অপেক্ষা করছি তুমি ভাবতেও পারবে না।

নোরা : আমিও টোরভাল্ড। বাচ্চাদের যে কী আনন্দ হবে!

হেলমার : সঞ্চয় আর স্বাচ্ছন্দ্য আসলেই একটা দারুণ ব্যাপার। নিরাপদ একটি চাকরি আর পর্যাপ্ত টাকা—তুমি যা চাও তাই করতে পার, ভাবতেই বেশ লাগে তাই না?

নোরা : সত্যি দারুণ!

হেলমার : গত বড়দিনের কথা তোমার মনে আছে? বড়দিনের আগে প্রায় পুরো তিনটি সপ্তাহ তুমি তোমাকে বন্দি করে রাখলে। সন্ধ্যা থেকে প্রায় শেষরাত পর্যন্ত। ফুল বানালে, ক্রিসমাস ট্রি বানালে, আরো কত ছোট ছোট জিনিস বানিয়ে তুমি আমাদের অবাক করে দিলে। সত্যি ওই তিন সপ্তাহ আমার বড় একা আর ক্লান্তিকর লেগেছে। আমার জীবনে একমাত্র অসহায় সময়।

নোরা : কিন্তু আমার জন্য মোটেও বিরক্তিকর ছিল না। ব্যস্ততায় কখন সময় কেটে গ্যাছে টেরই পাইনি।

হেলমার : [হেসে] কিন্তু দুঃখের বিষয় এত কষ্ট করেও তুমি আমাদের তেমন কিছুই দেখাতে পারনি।

নোরা : খোঁচা দিয়ে কথা বলছ কেন? আমি কী করব? একটা বিড়াল ঢুকে সব কিছু কেটে কুটি-কুটি করে ফেলল, সে দোষ কি আমার?

হেলমার : না, দোষ তোমার না। তোমার কী-ই বা করার ছিল। আমাদের একটু আনন্দ দেবার জন্য তুমি তোমার যথাসাধ্য করেছ—সেটাই আসল। যাক, ভাবতে ভালো লাগছে যে আমাদের কষ্টের দিনগুলো এবার বোধহয় শেষ হল।

নোরা : হ্যাঁ, সত্যি ভালো লাগছে ভাবতে।

হেলমার : আমি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে। এরকম অকারণ ক্লান্ত হওয়ার কোনও মানে নেই। আমাকে দেখে দেখে তোমার চোখদুটো ক্লান্ত হচ্ছে, আঙুলগুলোও—থাক যাই।

নোরা : [হাততালি দিয়ে] না সেটা নয়। [হেলমারের হাত ধরে] দাঁড়াও, তোমাকে আমি বলছি—কীভাবে সবকিছু ভেবেচিন্তে গোছগাছ করা দরকার তার একটা পরিকল্পনা, দাঁড়াও বলছি। টোরভাল্ড, বড়দিন চলে গেলেই—

[হলঘরে বেল বাজে]

দরজায় কে যেন আবার? [নোরা ঘরটা একটু গোছগাছ করে।] কেউ একজন হয়তো দেখা করতে এসেছে—আশ্চর্য এই অসময়ে আবার–

হেলমার : মনে রেখো আমি কিন্তু ঘরে নেই।

হেলেনা : [দরজার কাছ থেকে] একজন ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

নোরা : ঠিক আছে নিয়ে এসো।

হেলেনা : [হেলমারকে] ডাক্তার সাহেবও এসেছেন স্যার।

হেলমার : পড়ার ঘরের দিকে গ্যাছে?

হেলেনা : জি!

[হেলমার তার পড়ার ঘরের দিকে চলে যায়। হেলেনা মিসেস লিন্ডেকে নিয়ে ঘরের ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। মিসেস লিন্ডেকে দেখলেই বোঝা যায় সে বহুদূর থেকে এসেছে। কাপড়চোপড়ে সেটা টের পাওয়া যায়।]

মিসেস লিন্ডে : [কিছুটা নিচু গলায় সংশয়ের সাথে।] কেমন আছ নোরা?

নোরা : [ চিনতে না-পারার দ্বিধা] আপনি ভালো তো—

মিসেস লিন্ডে : তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারনি?

নোরা : না—মানে, আমি ঠিক—এক মিনিট [একটু উত্তেজিত। আবেগতাড়িত] তুমি ক্রিস্টিনা। তাই না? ক্রিস্টিনা—আমি ঠিক দেখছি তো!

লিন্ডে : হ্যাঁ। তাই।

নোরা : ক্রিস্টিনা! ইশ্—ভাবো তো আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। কী আশ্চর্য! চিনলাম না কেন? [একটু আত্মস্থ হয়ে] তোমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

লিন্ডে : হ্যাঁ—তা হয়েছে—নয় বছর—না, প্রায় দশ বছর—অনেক লম্বা সময়, তাই না?

নোরা : এতগুলো দিন চলে গেল? সেই তোমার সঙ্গে শেষ দেখা হল—এর মাঝে দশ বছর চলে গেল? হ্যাঁ—তা হবে। কিন্তু, জানো, গত আট বছর আমি খুব সুখে কাটিয়েছি। আর এখন তুমিও শহরে চলে এসেছ? সাহসও বটে তোমার—এই শীতের মাঝে এতটা পথ—

লিন্ডে : স্টিমারে এসেছি। আজ সকালে।

নোরা : ঠিক সময়ে এসেছ। বড়দিনও এসে গেছে। বাহ্। সময়টা খুব আনন্দে কাটানো যাবে। আরে কাপড়চোপড় ছাড়ো—ঠাণ্ডায় তো জমে যাচ্ছ [লিন্ডেকে সাহায্য করে] এই তো। এবার চুলোর পাশে এসে একটু বস, আরাম লাগবে। না—এই হাতলচেয়ারটাতে বস—আমি এই দোলনাচেয়ারটাতে বসছি। [লিন্ডের হাত ধরে] হ্যাঁ, এবার তোমাকে ক্রিস্টিনার মতো লাগছে। অনেকদিন পর দেখলাম তো—কিন্তু, তোমাকে একটু ফ্যাকাসে লাগছে, একটু বোধহয় শুকিয়েও গেছ

লিন্ডে : অনেক বুড়ো হয়ে গেছি নোরা।

নোরা : সামান্য কিছুটা হয়তো—অত বেশি না। [হঠাৎ নিজের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে] এই দেখ, আমি কেমন বকবক করে কথা

বলছি। ক্রিস্টিনা, সত্যি আমার ভুল হয়ে গেছে

লিন্ডে : কেন? কী বলছ তুমি?

নোরা : সত্যি কার যে কখন কী হয়! তোমার স্বামী মারা গেলেন-

লিন্ডে : হ্যাঁ তিন বছর হয়ে গেল।

নোরা : আমি জানি। কাগজে পড়েছিলাম। খবরটা পড়ার পর তোমাকে চিঠি লিখব ভেবেছি। প্রতি মুহূর্তেই ভেবেছি লিখব—একটুও মিথ্যা বলছি না কিন্তু সব সময়ই একটা—না—একটা কিছু এসে পড়েছে—শেষ পর্যন্ত আর হলই না।

লিন্ডে : আমি বুঝি নোরা। বাস্তবতা অন্য জিনিস।

নোরা : ব্যাপারটা সত্যি খুব খারাপ হয়েছে। কী বিপদের মধ্যে যে সময় কেটেছে তোমার। তাছাড়া সে তো তোমার জন্য কিছু রেখেও যায়নি, তাই না?

লিন্ডে : না।

নোরা : কোনও বাচ্চাও না?

লিন্ডে : নাহ্।

নোরা : কোনওকিছুই না?

লিন্ডে : না। সেজন্যে আমার বুকভাঙা কোনও দুঃখও নেই।

নোরা : [অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকায়] যাহ্—এটা তুমি ঠিক বললে না।

লিন্ডে : [ম্লান মুচকি হেসে নোরার চুলটা নেড়ে দিয়ে] কখনও কখনও এরকম ও হয় নোরা।

নোরা : কিন্তু এভাবে একেবারে একা হয়ে যাওয়া, এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে? আমার তিনটি তুলতুলে বাচ্চা আছে। এখন অবশ্য ঘরে নেই, আয়ার সাথে বেরিয়েছে। ক্রিস্টিনা, সব খুলে বল তো!

লিন্ডে : আমার খুলে বলার কিছু নেই। তোমার কথা বল শুনি

নোরা : না, তুমিই আগে বল। আজ আর এতটা স্বার্থপর হব না। তোমার বিপদের দিনক্ষণ, জীবনের কথা ছাড়া আমি আর এখন কিছুই শুনতে চাই না অবশ্য একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। তুমি বোধহয় জানো না, কয়েকদিন আগে আমাদের দারুণ একটা সুখবর এসেছে। সৌভাগ্যেরই বলতে পার।

লিন্ডে : তাই নাকি? কী বলত?

নোরা : টোরভাল্ড, আমার স্বামী, সেভিংস ব্যাংকের ম্যানেজার হয়েছে।

লিন্ডে : তোমার স্বামী? বাহ্ দারুণ ব্যাপার তো।

নোরা : সত্যিই অবিশ্বাস্য। আইনজীবীর জীবন এক অনিশ্চয়তার জীবন—বিশেষ করে সেই আইনজীবীর, যে বেছে বেছে কেস নেবে; উল্টাপাল্টা কেসের ধারে-কাছেও যাবে না। টোরভাল্ড কখনওই এটা করবে না—অবশ্য তার সঙ্গে আমিও একমত। আমাদের আনন্দের ব্যাপারটা তো বুঝতেই পারছ। নতুন বছরের শুরুতেই টোরভাল্ড কাজে যোগ দেবে। অনেক টাকা বেতন, তার ওপর আবার মোটা কমিশন। আশা করি এখন থেকে একেবারে আলাদাভাবে, মানে যেভাবে চাই সেরকমই চলতে পারব। ক্রিস্টিনা, সত্যি আমার আনন্দ হচ্ছে। প্রাচুর্য সত্যি দারুণ আনন্দের ব্যাপার, কোনও ভাবনা নেই চিন্তা নেই, নেই অভাবের অকারণ টানাটানি। তাই না?

লিন্ডে : হ্যাঁ তাই। যা প্রয়োজন তার সব পাওয়া গেলে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হয়।

নোরা : না, শুধু প্রয়োজন মেটানোই নয়। প্রচুর টাকা। থরে থরে সাজানো। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।

লিন্ডে : [মুচকি হেসে] এখনও একটু সংযত হতে শিখলে না। সেই স্কুলজীবনে যেমন খরচের হাত ছিল এখনও তেমনি আছে।

নোরা : [শান্তভাবে হেসে] টোরভাল্ডও তোমার মতো বলে। [আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে] কিন্তু নোরা—নোরা অতটা বোকা নয় যতটা তোমরা ভাবো। অপচয় করার মতো টাকা আমাদের ছিল না। আমাদের দুজনেরই কাজ করতে হয়েছে।

লিন্ডে : তুমিও কাজ করেছ?

নোরা : হ্যাঁ। সূচিকাজের সেইসব বিদ্ঘুটে টুকিটাকি কাজ। কুরুশ-কাঁটার কাজ, অ্যাম্ব্রয়ডারি এই সব। আরও আছে। [স্বাভাবিকভাবে] কিছু কিছু আবার অন্যভাবেও। তারপর দেখ, আমাদের বিয়ের পর পরই টোরভাল্ড সরকারি চাকরি ছেড়ে দিল। সে চাকরিতে উন্নতির কোনও আশাই ছিল না। চাকরি ছেড়ে দিল কিন্তু তাকে আগের চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করতে হত। ঘর-সংসার হয়েছে। প্রথম বছর তাকে সাধ্যের চেয়েও বেশি কাজ করতে হল—একটু বাড়তি আয়ের জন্য যেখানে যা-কিছু বাড়তি কাজ পেত তাই করত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা কঠিন পরিশ্রম। শরীরে আর কত সয়—বিছানায় পড়ে গেল—সে যে কী বিপদ! ডাক্তাররা দক্ষিণে গিয়ে হাওয়া বদলের পরামর্শ দিল। উপায় নেই, যেতেই হবে।

লিন্ডে : হ্যাঁ, তাই তো। পুরো একটা বছর তোমরা ইতালিতে ছিলে না?

নোরা : হ্যাঁ ছিলাম। কিন্তু এই বিশাল ব্যয় বহন করা এত সহজ ছিল না। আইভার তখন সবে জন্মেছে। তারপরও যেতে হল। বেড়ানোর কথা বললে—সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। সুন্দর। এই হাওয়া বদলের কারণেই টোরভাল্ড জীবনে বেঁচে গেল। টোরভাল্ড সেরে উঠল ঠিকই কিন্তু পুরো ব্যাপারটাতে যা খরচ হল সেটা আর কী বলব! প্রচুর টাকা ব্যয় হল, ক্রিস্টিনা।

লিন্ডে : সে তো বুঝিই। টাকা লাগবে না?

নোরা : বারোশ ডলার। চার হাজার আট শত ক্রোনার। বিশাল অঙ্কের টাকা।

লিন্ডে : হ্যাঁ, এরকম বিপদের সময় টাকা থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার।

নোরা : হ্যাঁ, টাকাটা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম।

লিন্ডে : ও হ্যাঁ, তোমার বাবাও তো ওই সময়ই মারা গেলেন।

নোরা : হ্যাঁ—ঠিক ওই সময়ই। ভেবে দেখ, একবার যেতেও পারিনি, নিজ হাতে যে একটু শুশ্রূষা করব তা-ও পারিনি। আইভার তখন হয় হয়। যখন— তখন অবস্থা। তার ওপর টোরভাল্ড। সাংঘাতিক অসুস্থ আমার স্বামী। সবসময় তাকে দেখতে হয়। এত যে প্রিয় আমার বাবা তাঁকে একবার চোখের দেখাও দেখতে পারেনি। আমার বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে কঠিন এই ব্যথা আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

লিন্ডে : হ্যাঁ, আমি তো জানি তিনি তোমার কত প্রিয় ছিলেন, তো তারপরই তুমি ইতালি গেলে?

নোরা : হ্যাঁ, বাবার মৃত্যুর একমাস পর। হাতে তখন টাকা ছিল। ডাক্তারও বলল দেরি করলে চলবে না।

লিন্ডে : তারপর স্বামীকে সুস্থ করে ফিরলে?

নোরা : আবার আগের মতো। নিখুঁত স্বাস্থ্য।

লিন্ডে : কিন্তু সেই ডাক্তার…?

নোরা : কোন্ ডাক্তার?

লিন্ডে : ওই যে আমি আসার সময় যিনি এলেন। আমার মনে হল তোমার কাজের মেয়ে ডাক্তারের কথাই বলেছে।

নোরা : ওহ্—ডাক্তার র‍্যাংক। সে অবশ্য ডাক্তার হিসেবে এখানে আসে না। আমাদের পারিবারিক বন্ধু। দিনের মধ্যে অন্তত একবার সে ঢুঁ মারবেই। না—তারপর থেকে টোরভাল্ডের আর কোনো অসুখই হয়নি। একটি দিনের জন্যও না। বাচ্চারাও সুন্দর শক্ত-সমর্থ। আর আমাকে তো দেখতেই পাচ্ছ। (হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে হাততালি দেয়) ওহ্ ক্রিস্টিনা, সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকাটা সত্যি চমৎকার ব্যাপার। দেখ, কী মানুষ আমি, একাই শুধু বকবক করছি। [ক্রিস্টিনার পাশে একটি বেঞ্চি নিয়ে বসে এবং ক্রিস্টিনার উরুতে হাত রাখে।] ক্রিস্টিনা, আমার ওপর রাগ করো না ভাই, আচ্ছা তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসতে না—এ-কথা কি সত্য? ভালো না বাসলে বিয়ে করলে কেন?

লিন্ডে : আমার মা তখনও বেঁচে। বহুদিন ধরে শয্যাশায়ী। অত্যন্ত অসহায় অবস্থা। তার ওপর ছোট দুটো ভাই। ওদের দেখাশুনা আমাকেই করতে হত। এরকম অবস্থায় তার প্রস্তাব আমি ফেলতে পারিনি।

নোরা : সেটা অবশ্য ঠিক। এ অবস্থায় পারাও যায় না। তাছাড়া তখন তো সে রীতিমতো ধনী।

লিন্ডে : ধনী না হলেও সচ্ছল ছিল। তবে ব্যবসাপাতি তখনই তেমন ভালো যাচ্ছিল না। মারা যাবার সাথে সাথে সবকিছু কর্পূরের মতো উবে গেল, কিছুই আর বাকি রইল না।

নোরা : আর তুমি…?

লিন্ডে : আর কী, সেই থেকে শুরু হয়ে গেল জীবনযুদ্ধ। ছোট্ট একটা দোকান চালাতাম, তারপর একটা ছোট্ট স্কুল। হাতের কাছে যা পেতাম তাই করতাম। গত তিন বছরে একটি মুহূর্তের বিশ্রাম নিইনি। যাকগে, সে-সব তো এখন শেষ হয়ে গেছে নোরা। মা বেচারি তো চলেই গেল, ও পালা শেষ। ভাইরাও মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। কাজটাজ করে নিজেরাই নিজেদের চালিয়ে নিচ্ছে।

নোরা : যাক সেদিক, থেকে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছ।

লিন্ডে : না—একটা শূন্যতা আমাকে জড়িয়ে আছে। কাউকে বলতে পারি না— বললেও কেউ বুঝবে না। এখন আমার আর কেউ নেই যার জন্য বাঁচব। [অস্থিরভাবে উঠে দাঁড়ায়] সেজন্যেই এলাম। বদ্ধজলের সীমাবদ্ধতা আর সহ্য হচ্ছিল না। অনেকদিন টেনেছি, আর পারছি না। এখানে যেমন—তেমন একটা কাজ জোগাড় করা হয়তো কঠিন হবে না। ব্যস্ততার মধ্যে থাকলে মনের ছবিগুলো কিছুটা হলেও তো সরিয়ে রাখা যাবে। ভাগ্যগুণে যদি অফিস-টফিসে কোনও কাজ জুটে যায় তো ভালো হয়। তাতে দৌড়ঝাঁপ করার হাত থেকে অন্তত বাঁচি।

নোরা : কিন্তু সে-ও তো ক্লান্তিকর, এমনিতেই তুমি ক্লান্ত। তার চেয়ে বরং কিছুদিন বিশ্রাম নেয়াটাই তোমার জন্য ভালো।

লিন্ডে : [জানালার কাছে যেতে যেতে] আমার তো বাবা নেই যে আমার খরচ জোগাবে।

নোরা : [উঠতে উঠতে] রাগ কোরো না।

লিন্ডে : [নোরার কাছে ফিরে এসে] না, নোরা। বরং তুমি আমার ওপর রাগ কর না। আমাদের মতো জীবনের দুর্বিষহ দিকই তো এই অসহায়ত্ব—দেখ, তোমার এমন কেউ নেই যার জন্য তোমার কাজ করার দায় আছে, অথচ থামতেও পারছ না। তোমাকে বাঁচতে হবে আর সেজন্যে শুধু নিজের কথাই ভাবতে হচ্ছে। জানো, তুমি যখন তোমার সৌভাগ্যের কথা বলছিলে তখন আমার বেশ ভালো লাগছিল। না, তোমার জন্য নয়— আমার নিজের জন্য।

নোরা : তুমি কী ভাবছ আমি বুঝতে পারি। হয়তো ভাবছ টোরভাল্ড তোমার জন্য কিছু করতে পারে।

লিন্ডে : হ্যাঁ, তাই ভাবছি।

নোরা : হ্যাঁ, তা সে করবে। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি অত্যন্ত কৌশলে কথাটা তুলব—একটু ভুলিয়ে-ভালিয়ে মনটা ঠিক করে কথাটা ওঠাব তোমার জন্য এ কাজটুকু করতে পারলে আমিও সুখ পাব।

লিন্ডে : আমার জন্য এ কাজ করতে চাওয়াটাও তোমার মহানুভবতা নোরা, তুমি তো জীবনের দুঃখকষ্ট দেখনি

নোরা : আমি? দেখিনি বলছ?

লিন্ডে : [হেসে] হায় ঈশ্বর, সামান্য কিছু সেলাই-সুতোর কাজ! জীবনের অভিজ্ঞতায় তুমি একটা বাচ্চা নোরা।

নোরা : [মাথা নাড়িয়ে ঘর পার হতে হতে] নিজেকে অতটা অভিজ্ঞ মনে করো না।

লিন্ডে : মনে করব না?

নোরা : তুমিও অন্য সবার মতো। সবাই মনে করে আমি যেন কাজের কিছুই বুঝি না

লিন্ডে : আচ্ছা!

নোরা : তুমি মনে কর আমি একটা নির্বিবাদ নির্ঝঞ্চাট সহজ জীবন কাটিয়ে এসেছি।

লিন্ডে : তুমি তো তোমার জীবনের সব ঝামেলার কথাই বললে। যা বললে ওটুকূ জীবনে স্বাভাবিক।

নোরা : যাহ্, ওটা তো কিছুই না। (গলা নিচে নামিয়ে) আসলটা এখনো বলিনি।

লিন্ডে : আসল! সেটা কী?

নোরা : হয়তো তুমি আমাকে ঘৃণার চোখে দেখবে—কিন্তু আশা করি সেটা করবে না। অনেকগুলো বছর তোমার মায়ের জন্য তুমি কঠোর পরিশ্রম করেছ, সেটাই তোমার গর্ব।

লিন্ডে : আমি কাউকেই ঘৃণা করি না। তবে গর্ব যদি বল, হ্যাঁ, সেটা কিছুটা আছে—এবং আনন্দও, কারণ মা’র জীবনের শেষ দিনগুলোকে কিছুটা হলেও সহজ করতে পেরেছিলাম।

নোরা : ভাইদের জন্য যা করেছ তারজন্যেও তো গর্ব বোধ কর। না কি?

লিন্ডে : এইটুকু তো আমি করতে পারি, কি বল?

নোরা : হ্যাঁ, তা মানি। ঠিক আছে তাহলে এবার আমার কথা শোনো, ক্রিস্টিনা। তোমার মতো আমিও এমন কিছু করেছি যা নিয়ে গর্ব করতে পারি।

লিন্ডে : হয়তো নিশ্চয়ই করেছ। কী সেটা?

নোরা : না, সেটা অত জোরে বলা যাবে না। টোরভাল্ড শুনে ফেলতে পারে। আমি কোনওমতেই চাই না সে জানুক। জগতের আর কাউকেই সে কথা বলা যাবে না। শুধু তুমি। তোমাকেই শুধু বলব।

লিন্ডে : কিন্তু সেটা কী বল।

নোরা : এস। এদিকে এস। [ লিন্ডেকে সোফায় নিয়ে তার পাশে বসায়] হ্যাঁ, এটা গর্বেরই বটে তুমি তোমার মা’র জন্য করেছ, তোমার ভাইদের জন্য করেছ। আমি করেছি আমার স্বামীর জন্য। আমি টোরভাল্ডের জীবন রক্ষা করেছি। আমি তাকে বাঁচিয়েছি।

লিন্ডে : বাঁচিয়েছ? কীভাবে?

নোরা : তোমাকে ইতালি যাওয়ার কথা বলেছি। সেখানে না গেলে টোরভাল্ড কোনওদিনই সেরে উঠত না।

লিন্ডে : হ্যাঁ, কিন্তু প্রয়োজনীয় টাকা তো দিয়েছেন তোমার বাবা।

নোরা : [হেসে] টোরভাল্ড সেটাই জানে, অন্যেরাও তাই জানে।…

লিন্ডে : তা হলে?

নোরা : বাবা একটি পয়সাও দেয়নি। টাকার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হয়েছে।

লিন্ডে : তোমাকে? অত টাকা?

নোরা : বারোশ ডলার। চার হাজার আটশ ক্রোনার। ভাবো তো একবার।

লিন্ডে : কিন্তু কীভাবে করলে নোরা? কোনো লটারি পেয়েছিলে নাকি?

নোরা : [ঘৃণাভরে] লটারি! [অবজ্ঞাসূচক শব্দ করে] লটারি পেলে আর গর্ব কোথায়!

লিন্ডে : তাহলে কোথায় পেলে অত টাকা?

নোরা : [হেঁয়ালির হাসি হেসে] আহা-হা-(গুনগুন করে] টা-রা-লা-লা।

লিন্ডে : এত টাকা তো তুমি ধারও পাবে না।

নোরা : কেন পাব না?

লিন্ডে : কারণ স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী তো ধারও করতে পারে না।

নোরা : [মাথা দুলিয়ে] পারে—পারে। যে স্ত্রীর স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি আছে, সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য কী করতে হবে এই বোধ যার আছে সে স্ত্রী পারে।

লিন্ডে : সত্যি নোরা, আমি বুঝতে পারছি না।

নোরা : কেমন করে বুঝবে। বোঝার কোনও কারণও নেই। তাছাড়া টাকা ধার করেছি এ-কথাও তো আমি বলিনি। কোনও না—কোনওভাবে টাকাটা আমি পেতামই। [সোফায় এলিয়ে] আমাকে পছন্দ করে সেরকম কারও কাছ থেকেও তো পেতে পারতাম—অথবা অন্য কারও কাছ থেকে আমার আকর্ষণ কি শেষ হয়ে গেছে—এখনও…

লিন্ডে : না, না, ফাজলামো কোরো না।

নোরা : তোমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে—তাই না?

লিন্ডে : নোরা, নোরা। শোনো, আমার কথা শোনো। তুমি কি এমন কিছু করেছ?—মানে, না বুঝে, বেপরোয়া হঠকারী কিছু?

নোরা : [সোজা হয়ে বসে] স্বামীর জীবন রক্ষা কি হঠকারী কাজ?

লিন্ডে : তাকে না জানিয়ে কিছু করাই তো হঠকারী।

নোরা : কিন্তু তাকে বলার তো কোনও উপায় ছিল না। ঈশ্বর! তুমি বুঝবে না। সে-যে কতটা অসুস্থ সেটা বোঝার ক্ষমতাও তার ছিল না। ডাক্তাররা আমার কাছে বলেছে। তারা বলল তার অবস্থা আশঙ্কাজনক এবং হাওয়া বদল করতে দক্ষিণে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তোমার কি মনে হয় না আমি তাকে অন্যভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। ভুলিয়ে- ভালিয়ে রাজি করাবার চেষ্টা করেছি। আমি তাকে অন্য কথাই বলেছি— বলেছি, অন্যসব তরুণী স্ত্রীদের মতো আমার কি বাইরে যেতে সাধ হয় না। ছুটি নিয়ে বাইরে কিছুদিন ঘুরে এলে আমার ভালো লাগবে—এসব কথা আমি তাকে বুঝিয়েছি। চেষ্টার কোনও ত্রুটি করিনি। আমি তাকে আমার অবস্থা চিন্তা করতে বলেছি। সুবোধ বালকের মতো আমার কথামতো চলতে তাকে আমি অনুরোধ করেছি। তাকে এ ইঙ্গিত দিয়েছি যে চাইলেই আমরা ধার করতে পারব। সে আমার ওপর খেপে গেল। আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলল—আমি চপলমতি, ছ্যাবলা মেয়েমানুষ এবং আমার খেয়ালখুশির বানে ভেসে যাওয়া স্বামী হিসেবে তার উচিত নয়, এমনি আরও কত কী! আমি চিন্তা করেছি, ঠিক আছে বলুক। কিন্তু যেভাবেই হোক তার জীবন রক্ষা আমাকে করতেই হবে। আর কিছু জানি না—স্বামীর জীবন—আর তখনই একটা পথ খুঁজে বের করলাম।

লিন্ডে : তাহলে টাকাটা যে তোমার বাবা দেননি সে-কথাও নির্ঘাৎ তোমার বাবা তাকে বলেছেন?

নোরা : না, বাবা মারা যাবার পরপরই এই ঘটনা। ভেবেছিলাম কথাটা ওকে বলব এবং ক্ষমা চেয়ে নেব, কিন্তু ও এতই অসুস্থ ছিল যে…. তাছাড়া শেষে দিকে মনে হল বলার আর দরকারই নেই

লিন্ডে : তার মানে কথাটা তোমার স্বামীকে কখনওই বলনি?

নোরা : হায় ঈশ্বর! কীভাবে বলি? সে যে কী শক্ত মানুষ তা তো তুমি জানো না। ও—ধরনের কিছু একটা করেছি শুনলে—তাছাড়া টোরভাল্ডের একধরনের গর্ব আছে, পুরুষদের থাকেই, আমার কাছে সে ঋণী এ-কথা জানতে পারলে সে অত্যন্ত দুঃখ পাবে এবং অপমান বোধ করবে। জানতে পারলে হয়তো আমাদের সম্পর্কই চুকে যেত—এই আমার মায়াবী সুখের সংসার কখনওই আর আগের মতো থাকত না।

লিন্ডে : তার মানে কোনওদিন বলতেও চাও না?

নোরা : [একটু চিন্তা করে—সামান্য মুচকি হাসে] হয়তো বলব কোনও এক দিন। আর বেশিদিন নয়। যখন আর দেখতে এরকম সুন্দর থাকব না। যখন আমার আর আকর্ষণ করার ক্ষমতা থাকবে না। না, না, হেসো না। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হল, টোরভাল্ড এখনও আমাকে দারুণ ভালোবাসে। যখন সে এতটা ভালো আর বাসবে না—যখন আমার এই চপলতা, আমার সাজগোজ, আমার কবিতা আবৃত্তি তাকে আর কোনও আনন্দ দেবে না তখন বলব। এটাই তখন নতুন আনন্দের ব্যবস্থা করতে পারবে। [ প্রসঙ্গ বদলায় ] কিন্তু এসব অর্থহীন। সে সময় কোনওদিন আসবেই না। আচ্ছা ক্রিস্টিনা, আমার এই গোপনীয়তা সম্পর্কে তোমার কী মনে হয়? এখনো কি তোমার মনে হয় আমি কোনও কাজের নই? এখনও কি আমাকে অকেজো মনে হয়? বিশ্বাস কর, এই ব্যাপারটা আমার কাছে সবসময়ের লজ্জা আর ভয়ের কারণ। আমার নৈতিক দায়িত্বগুলো আমি ঠিকমতো পালন করতে পারিনি। তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে ব্যবসায়ে ‘প্রান্তিক পরিশোধ’ অথবা কিস্তিতে পরিশোধের একটি ব্যাপার আছে কিন্তু দেখবে কখনওই নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না। কিস্তিতে পরিশোধ করাটা ভয়াবহ রকম কঠিন। আমার অবস্থাও তাই হয়েছে—কষ্টেসৃষ্টে এখান থেকে একটু, ওখান থেকে একটু নিয়ে জড়ো করেছি। যখন যা পেরেছি। ঘর চালানোর টাকা থেকে তেমন একটা কখনওই বাঁচাতে পারি না। টোরভাল্ডের আবার যেমন—তেমন হলে চলে না। তার সবটাই ঠিকমতো চাই। তাছাড়া বাচ্চাদের কাপড়চোপড়ে আমি দারিদ্র্যের ছোঁয়া রাখিনি। ওদের জন্য টাকাপয়সা আমি ষোলো আনাই প্রস্তুত রেখেছি। বাচ্চাদের ভাগ্য কেটে কিছু করব সেটা আমি কোনওদিনই করিনি।

লিন্ডে : তাহলে পুরোটাই তোমার হাতখরচা বাঁচিয়ে করতে হয়েছে? বেচারি নোরা!

নোরা : অবশ্যই। আর যাই হোক কাজটা তো আমার নিজের। সুতরাং টোরভাল্ড যখনই আমাকে নতুন কাপড়চোপড় বানাতে বা অন্যকিছু কিনতে টাকাপয়সা দিয়েছে—আমি কখনও অর্ধেকের বেশি খরচ করিনি—সব সময় সাদাসিধে কমদামি জিনিস কিনেছি। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমি যা পরি তাতেই আমাকে বেশ মানায়—সুতরাং টোরভাল্ডের কখনও চোখেও পড়েনি। ক্রিস্টিনা, কাজটি কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না—আমাকেও তো কিছু ছাড়তে হয়েছে। সুন্দর সুন্দর কাপড়চোপড় পরে সেজেগুজে থাকতে তো ভালোই লাগে, তাই না?

লিন্ডে : তা তো লাগেই।

নোরা : এরপর আমি আরও উপার্জনের পথ খুঁজে বের করলাম। গত শীতে সৌভাগ্যক্রমে অনেকগুলো কপি করার কাজ জুটে গেল—একেবারে দরজা বন্ধ করে লিখতে লেগে গেলাম। কখনও কখনও মাঝরাত পার হয়ে যেত। ওহ্—দু–একসময় এত ক্লান্ত লাগত যে সে-কথা আর কী বলব! তবুও ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ মজার ছিল—বসে বসে কাজ করা আর টাকা উপার্জন করা। প্রায় একজন পুরুষমানুষের মতো কাজ করেছি তখন।

লিন্ডে : এখন পর্যন্ত কত শোধ করেছ?

নোরা : সেটা ঠিক করে বলতে পারব না। এসব ব্যপারে হিসাব রাখা খুব কঠিন। আমি শুধু এটুকুই জানি, হাতটাত লাগিয়ে যেখান থেকে যতটুকু জোগাড় করেছি তার পুরোটাই দিয়ে দিয়েছি। কখনও কখনও কী করব কী করা উচিত বুঝতে পারতাম না। [হেসে] তখন এখানে এই চেয়ারে বসে বসে কল্পনা করতাম একজন ধনী বৃদ্ধলোক আমার প্রেমে পড়েছে।

লিন্ডে : তাই? কে সে?

নোরা : দাঁড়াও—তারপর ধর, একসময় লোকটি মারা গেল। এবং সবাই যখন তার উইলটা পড়ল, দেখা গেল সেখানে লেখা আছে : ‘আমার সব টাকাপয়সা পাবে মিসেস নোরা হেলমার। এবং পুরোটাই নগদ

লিন্ডে : কিন্তু, লোকটা কে?

নোরা : হায় ঈশ্বর! তুমি বোঝনি? বাস্তবে সেরকম কোনও বৃদ্ধ ভদ্রলোক নেই এখানে বসে বসে আমি এসবই কল্পনা করতাম—মাঝে মাঝেই যখন কোত্থেকে টাকাপয়সা পাব ভেবে ভেবে আর দিশা পেতাম না তখন এখানে বসে এসবই কল্পনা করতাম। যাক, সেসব অবশ্য এখন পার হয়ে গেছে। কল্পনার সে বৃদ্ধ ভদ্রলোক এখন যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকুন, তাকে অথবা তার উইল কোনটারই আমার আর দরকার নেই। আমার দুঃখের দিন শেষ হয়েছে। [হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়] একবার ভেবে দেখ তো ক্রিস্টিনা, কোনরকম দুশ্চিন্তা নেই, ছেলেমেয়ে নিয়ে হৈ চৈ করে ছুটে বেড়াচ্ছি। ঘরবোঝাই টোরভাল্ডের পছন্দমতো আধুনিক সব মনভোলানো জিনিসপত্র—তারপর দেখ অল্পদিন পরেই বসন্ত, আসছে নিৰ্মল নীলাকাশ—হয়তো বাচ্চাদের নিয়ে একটু দূরে কোথাও ঘুরে আসব। হয়তো আমার আবার সাগর দেখার সৌভাগ্য হবে। আহ্, কী চমৎকার। আনন্দে বেঁচে থাকা কী চমৎকার, তাই না!

[হল থেকে বেলের শব্দ শোনা যায়]

লিন্ডে : [উঠে] বোধহয় কেউ এসেছে—আমি যাই।

নোরা : না, না। বস। টোরভাল্ডের কাছে বোধহয় কেউ এসেছে, এখানে আসবে না। হেলেনা : [হলের দরজার কাছে] মাফ করবেন, ম্যাডাম, ব্যারিস্টার সাহেবের সঙ্গে একজন লোক দেখা করতে চাচ্ছেন।

নোরা : ব্যাংক ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে?

হেলেনা : হ্যাঁ। ব্যাংক ম্যানেজার। আমি কিছু বলিনি—উনি তো ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে।

নোরা : লোকটি কে?

ক্রোগস্ট্যাড : [প্রবেশপথ থেকে] আমি মিসেস হেলমার।

[মিসেস লিন্ডে উঠতে যায়। কিন্তু কী মনে করে জানালার দিকে সরে আসে]

নোরা : [কিছুটা উত্তেজিত চাপা স্বরে লোকটির দিকে এক পা এগিয়ে] আপনি! কী ব্যাপার! ওর সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন কেন? কী দরকার?

ক্রোগস্ট্যাড : ব্যাংক সংক্রান্ত একটু আলাপ। সেভিংস ব্যাংকে আমি ছোট্ট একটা চাকরি করি। শুনলাম আপনার স্বামী আমাদের নতুন ম্যানেজার হচ্ছেন।

নোরা : ওহ্—তাহলে এই ব্যাপার—

ক্রোগস্ট্যাড : নিরেট অফিসের কাজ মিসেস হেলমার। অন্য কিছু না।

নোরা : ঠিক আছে। পড়ার ঘরে আছে, যান। [সে সৌজন্যের খাতিরে মাথাটা নোয়ায়—হলঘরের দরজা বন্ধ করে। তারপর চুলোর কাছে গিয়ে রান্নাবান্না দেখতে থাকে।]

লিন্ডে : নোরালোকটি কে?

নোরা : একজন আইনজীবী। নাম ক্রোগস্ট্যাড।

লিন্ডে : তাহলে সে-ই

নোরা : তুমি ওকে চেনো নাকি?

লিন্ডে : একসময় চিনতাম। সে অনেক বছর আগে। একটা আইনজীবী অফিসে কাজ করত।

নোরা : হ্যাঁ, তাই করত।

লিন্ডে : মানুষের কী পরিবর্তন!

নোরা : বিবাহিত জীবনে বেচারার সুখ হল না।

লিন্ডে : এখন কি বিপত্নীক?

নোরা : অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। [ হঠাৎ খেয়াল করে ] হায়, হায়, পুড়ে যাচ্ছে, দাঁড়াও। [নোরা স্টোভের পাল্লা বন্ধ করে দেয়— দোলনাচেয়ারটা একপাশে একটু সরিয়ে আনে। ]

লিন্ডে : লোকে বলে সে নাকি সবকিছুতেই আছে। সবধরনের ব্যবসা।

নোরা : তাই নাকি? হয়তো ঠিকই বলে। আমি অবশ্য অতশত জানি না—যাক, ব্যবসার কথা বলে কাজ নেই, নীরস বিষয়।

[ডাক্তার র‍্যাংক হেলমারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে]

র‍্যাংক : [প্রবেশপথে] না, না রে ভাই, আমি তোমাদের মধ্যে থাকতে চাই না। আমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু গল্পগুজব করি।

[দরজাটা বন্ধ করতেই লিন্ডেকে দেখতে পায়।] দুঃখিত, এখানেও তো দেখি সেই একই অবস্থা

নোরা : বিশেষ কোনো অবস্থা না ডাক্তার। আসুন। [তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।]

ইনি ডাক্তার র‍্যাংক আর ইনি মিসেস লিন্ডে।

র‍্যাংক : বাহ্! এ নাম তো আমি এ ঘরে সবসময়ই শুনছি। মনে হয় সিঁড়িতে উঠতে উঠতে তখন আপনাকেই দেখেছিলাম।

লিন্ডে : হ্যাঁ। সিঁড়িতে আমার বড় অসুবিধা হয়। একটু আস্তে আস্তেই উঠি।

র‍্যাংক : কেন—কোনও দুর্বলতা,-মানে অসুস্থতা….?

লিন্ডে : হ্যাঁ, হয়তো অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে কিছু

র‍্যাংক : এটাই শুধু! তাহলে আপনি বিশ্রাম নিতেই শহরে এসেছেন, পার্টি টার্টি–

লিন্ডে : কাজ খুঁজতে এসেছি—

র‍্যাংক : এটাকে কি অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে মুক্তির উপায় বলা যাবে?

লিন্ডে : মানুষকে তো বাঁচতে হয় ডাক্তার।

র‍্যাংক : হ্যাঁ, স্বাভাবিকভাবে মানুষ তাই তো বলে। এটা নাকি দরকারি।

নোরা : ডাক্তার র‍্যাংক, আপনিও নিজেও বাঁচতে চান সেটা আপনি কি জানেন?

র‍্যাংক : হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি চাই। যত দুর্ভাগাই আমি হই না কেন এই যন্ত্রণা আমি যতদূর সম্ভব বাড়াতে চাই। আমার রোগীদেরও ওই একই ধারণা। আবার যে মানুষের অসুস্থতা নীতিগত তারাও দেখেছি ওই একই মত পোষণ করে। এই মুহূর্তে হেলমারের ঘরে একজন মানসিক রোগী আছে। এবং—

লিন্ডে : [কোমল সুরে] হায়!

নোরা : কার কথা বলছেন?

র‍্যাংক : ওহ্—আপনি তাকে চিনবেন না। একজন আইনজীবী। নাম ক্রোগস্ট্যাড আগাপাশতলা একটা নষ্ট মানুষ—কিন্তু প্রথম কথাটিই বলল—যেন কত গুরুত্বপূর্ণ কথা—বলল সে বাঁচতে চায়। তাকে বাঁচতেই হবে।

নোরা : টোরভাল্ডের কাছে তার কী কাজ?

র‍্যাংক : ঠিক জানি না। তবে যা শুনলাম তাতে মনে হল ব্যাংক সংক্রান্ত কিছু।

নোরা : ক্রোগ—মানে এই আইনজীবীর ব্যাংকে কোনও কাজ আছে তা তো জানতাম না।

র‍্যাংক : আছে। একটা চাকরি আছে। [মিসেস লিন্ডেকে] আপনি এখানকার লোক কি না আমি জানি না তবে এখানে এমন কিছু লোক আছে যারা প্রতিনিয়ত নোংরা ঘেঁটে বেড়ায়, নৈতিক দুর্নীতি খোঁজে। সেটা যখন পেয়ে যায় তখন এমন একটা কাজে সেটাকে লাগায় যার থেকে সে ফায়দা লুটতে পারে, আর ভালো লোকগুলো অসহায়ভাবে সেসব তাকিয়ে দেখে।

লিন্ডে : দুর্বলদের শুশ্রূষার প্রয়োজন হয়।

র‍্যাংক : [ঘাড় বাঁকিয়ে] তা যা বলেছেন! এই বিশ্বাসের কারণেই তো গোটা একটা সম্প্রদায় একটা নিয়মিত হাসপাতালে পরিণত হয়েছে।

[নোরা এতক্ষণ নিজের চিন্তায় নিমগ্ন ছিল—হঠাৎ হেসে হাততালি দিয়ে ওঠে।]

র‍্যাংক : এ কথায় হাসলেন যে? আপনি কি সত্যি করে জানেন সম্প্রদায়টি কী?

নোরা : আপনার ভয়ংকর সেকেলে সম্প্রদায় দিয়ে আমি কী করব? আমি অন্য একটা ব্যাপারে হাসছিলাম। ভীষণ মজার একটা ব্যাপার। আচ্ছা বলুন তো ডাক্তার র‍্যাংক, ব্যাংকে যারা কাজ করে তারা সবাই কি টোরভাল্ডের ওপর নির্ভরশীল?

র‍্যাংক : এটাই কি আপনার ভীষণ মজার ব্যাপার?

নোরা : [হেসে গুনগুন করে] হ্যাঁ, ওটা আমার জানা দরকার। ওটাই আমার জানা দরকার। [ঘরময় পায়চারি করতে করতে] হ্যাঁ, ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগে যে টোরভাল্ড এতগুলো মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। [পকেট থেকে একটি থলি বের করে] ডাক্তার র‍্যাংক, মাকারুন খাবেনহ মাকারুন? আরে আরে। ওটা তো এখানে নিষিদ্ধ জানতাম।

নোরা : হ্যাঁ। তবে এই ক্রিস্টিনা কয়েকটা দিল।

লিন্ডে : কী? কিন্তু আমি তো…

নোরা : না, না, ভয় পেয়ো না। টোরভাল্ড যে এই পদার্থটি নিষিদ্ধ করেছে সে তো আর তুমি জানতে না। ব্যাপারটা হল টোরভাল্ডের ভয় মাকারুন খেলে আমার দাঁত নষ্ট হয়ে যাবে। ধ্যাত—এই একটাই তো। কী বলেন। ঠিক না ডাক্তার র‍্যাংক? এইবার [একটা মাকারুন ডাক্তার র‍্যাংকের মুখে পুরে দেয়।] তুমিও একটা নাও ক্রিস্টিনা। তাহলে আমিও একটা নিই, এই এতটুকুন, ছোট্ট একটি। ইচ্ছে করলে অবশ্য আরও একটি আমি নিতে পারি। তবে দুটোর বেশি নেব না। [আবার পায়চারি শুরু করে।] আহা, আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। পৃথিবীতে এখন শুধু আমার একটা জিনিস চাই। সাংঘাতিকভাবে চাই।

র‍্যাংক : তাই? জিনিসটা কী?

নোরা : একটা কিছু যেটা আমি শুধু টোরভাল্ডের সামনে বলব বলে বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছি।

র‍্যাংক : তাহলে বলছেন না কেন?

নোরা : সাহসে কুলোচ্ছে না। ব্যাপারটা খুব খারাপ।

লিন্ডে : খারাপ?

র‍্যাংক : তাহলে না-বলাই ভালো। যদিও আমাদের কাছে…আচ্ছা টোরভাল্ডের সামনেই বলতে হবে ব্যাপারটা এমন কী?

নোরা : সত্যি আমি সাংঘাতিকভাবেই বলতে চাইছি কথাটা। বলতে চাইছি আমি অভিশপ্ত!

র‍্যাংক : আপনার মাথা খারাপ হয়েছে।

লিন্ডে : হায় ঈশ্বর! নোরা

র‍্যাংক : ঠিক আছে ওই যে হেলমার আসছে, বলুন।

নোরা : [মাকারুন লুকাতে লুকাতে] চুপ চুপ! [হেলমার তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এক হাতের উপর কোট ও অন্য হাতে হ্যাট।]

নোরা : [হেলমারের কাছে গিয়ে] টোরভাল্ড, ছাড়া পেলে শেষপর্যন্ত?

হেলমার : হ্যাঁ, গেছে।

নোরা : পরিচয় করিয়ে দিই, এই হল ক্রিস্টিনা, এখন শহরে চলে এসেছে।

হেলমার : ক্রিস্টিনা? ইয়ে—আমি ঠিক…..

নোরা : মিসেস লিন্ডে। আহা টোরভাল্ড, ক্রিস্টিনা লিন্ডে।

হেলমার : ও হো, তাই বল। ছোটবেলায় আপনারা একসঙ্গে ছিলেন, তাই না?

লিন্ডে : হ্যাঁ, তখন আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম।

নোরা : অনেক দূর থেকে ও তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

হেলমার : আমার সঙ্গে?

নোরা : ক্রিস্টিনা অফিসের কাজে দারুণ! ও এখন একজন সত্যিকারের দক্ষ লোকের সঙ্গে কাজ করতে চায়—তাহলে আরও ভালো করে কাজটা শিখতে পারে।

হেলমার : এটা তো সত্যি বুদ্ধিমতীর কাজ।

নোরা : তুমি ব্যাংক ম্যানেজার হয়েছ শুনেই দেরি না করে ছুটতে ছুটতে এসেছে। এরা নাকি টেলিগ্রামের মাধ্যমে তোমার ম্যানেজার হবার খবর পেয়েছে। তুমি ওর জন্য নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে, তাই না? আমাকে খুশি করার জন্য হলেও করবে। কি, করবে না?

হেলমার : হ্যাঁ, তা হয়তো, এটা তেমন অসম্ভব কিছু নয়—মিসেস লিন্ডে আমার মনে হয় আপনার স্বামী–

লিন্ডে : জি। উনি নেই।

হেলমার : আপনার তো বাণিজ্যিক কাজটাজের অভিজ্ঞতা আছে, তাই না?

লিন্ডে : হ্যাঁ, তা কিছুটা আছে।

হেলমার : তাহলে অসুবিধা নেই। একটা কিছু খুঁজে বের করা যাবে।

নোরা : বাহবা। এইতো! দেখলে?

হেলমার : মিসেস লিন্ডে, আপনি একেবারে ঠিক সময়ে এসেছেন।

লিন্ডে : ওহ্, কীভাবে যে কৃতজ্ঞতা জানাব।

হেলমার : না, না, তার প্রয়োজন নেই….. [ওভারকোট পরে নেয়] তবে এখন যে আমাকে যেতে হচ্ছে।

র‍্যাংক : দাঁড়াও, আমিও যাব তোমার সঙ্গে। [সে হলঘর থেকে পশমি কোটটা নিয়ে এসে স্টোভে গরম করে। ]

নোরা : টোরভাল্ড, দেরি করো না।

হেলমার : ঘণ্টাখানেক। তার বেশি না।

নোরা : ক্রিস্টিনা, তুমিও যাচ্ছ নাকি?

লিন্ডে : [বাইরে যাবার কাপড়চোপড় পরে নেয়] হ্যাঁ, যাই। একটা থাকার জায়গা তো ঠিক করতে হবে।

হেলমার : ঠিক আছে, তাহলে চলুন একত্রে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি।

নোরা : [ লিন্ডেকে সাহায্য করতে করতে] লজ্জা লাগছে। আমাদের এখানে জায়গা এত কম যে কী বলব—আমরা হয়তো—

লিন্ডে : আরে না, না। তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ঠিক আছে, আবার তো দেখা হবে। নোরা, আমার জন্য তুমি এত কিছু করলে। দারুণ খুশি লাগছে।

নোরা : আপাতত বিদায় তাহলে—আজ সন্ধ্যায় কিন্তু তুমি আসছ। আসবে না? আপনিও ডাক্তার র‍্যাংক। কি, মন চাইলে? না, না, আসতেই হবে। ঠাণ্ডা লাগবে, ভালো করে জড়িয়ে নিন। [কথা বলতে বলতে তারা হলঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়িতে বাচ্চাদের শব্দ পাওয়া যায়।] এই যে এসে পড়েছে, এসে পড়েছে।

[দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। আয়া অ্যানা মারিয়া বাচ্চাদের নিয়ে প্রবেশ করে।] এস, এস, ভিতরে এস। [একটু নুয়ে বাচ্চাদের চুমু খায়] আচ্ছা, আমার লক্ষ্মী ছানা। দেখ, ক্রিস্টিনা, আমার বাচ্চাগুলো মিষ্টি না?

র‍্যাংক : ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে গল্প করাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

হেলমার : আসুন মিসেস লিন্ডে, আমরা যাই, এখানে মা আর বাচ্চার ব্যাপার। আমাদের কিছু করার নেই। [হেলমার, র‍্যাংক ও মিসেস লিন্ডে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। আয়া বাচ্চাদের নিয়ে ভিতরে আসে। নোরা হলঘরের দরজা বন্ধ করে বাচ্চাদের অনুসরণ করে।]

নোরা : বাহ্, বেশ খরখরে মনে হচ্ছে— ফ্রেশ। গোলাপি গোলাপি গাল। গোলাপ আর আপেলের মতো। [পরবর্তী অংশটি চলার সময় বাচ্চারা তার সাথে কিচিরমিচির করে গল্প করতে থাকে।]

বাইরে ঘুরতে ভালো লেগেছে? ভালো, ভালো, বেশ ভালো। এমি আর ববকে স্লেজে করে টেনে নিয়েছ তাই না, দুইজনকে একসঙ্গে পারলে? মাগো—ভাবতে পার, দুইজনকে—তুমি তো বড় হয়ে গেছ আইভার। মস্ত জোয়ান। দেখি, দেখি, ওকে একটু দাও, একটু কোলে নিই। [আয়াকে] দাও—এইতো আমার পুতুল বাচ্চা। [নোরা আয়ার কাছ থেকে সবচেয়ে ছোটটিকে কোলে তুলে নেয় এবং নাচতে থাকে।] হ্যাঁ, হ্যাঁ, মা ববের সাথেও নাচবে। দাঁড়াও। কী? কী করেছ? তুষার বল খেলেছ? ইশ্ আমি কেন গেলাম না? তাহলে বেশ মজা হত, তাই না? না, না, ওদের নিও না। [আয়াকে] আমার কাছে একটু থাকুক। দাঁড়াও আমি কাপড়চোপড় খুলে দিচ্ছি। আহা, আমাকে করতে দাও—এইতো আনন্দের। হায় হায় তুমি দেখি একেবারে জমে গেছ। যাও, পাশের ঘরে স্টোভে তোমার জন্য গরম কফি আছে, যাও। [আয়া বাঁ-দিকের ঘরে চলে যায়। নোরা বাচ্চাদের বেড়ানোর কাপড়চোপড় খুলে এখানে-ওখানে ছুড়ে দেয়—বাচ্চারা সবাই সমস্বরে কথা বলতে থাকে।]

হ্যাঁ, তাহলে একটা বিরাট কুকুর তোমাদের পিছনে পিছনে এসেছিল? কিন্তু তোমাদের কামড়ায়নি তাই না? না, কুকুর পুতুলের মতো সুন্দর বাচ্চাদের কামড়ায় না। এই, আইভার, না না বাবা ওগুলো খুলো না। তাহলে কিন্তু হবে না। বল তো এর মধ্যে কী আছে? আহ্, জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না? না না, তেমন মজার কিছু নেই। তুমি খেলতে চাচ্ছ? কী খেলবে বল? লুকোচুরি? আচ্ছা ঠিক আছে চল আমরা লুকোচুরি খেলি। বব, বাবু, প্রথম তুমি। তুমি প্রথম লুকাও। আমি? আমি লুকাব? আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই প্রথম লুকাচ্ছি।

[নোরা আর বাচ্চারা এই ঘর এবং ডানদিকের ঘরে দৌড়াদৌড়ি হাসাহাসি হৈচৈ করে খেলতে থাকে। শেষে নোরা গিয়ে টেবিলের নিচে লুকায়। বাচ্চারা ছুটে আসে। মাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না। তারপর একটি চাপা হাসির শব্দ শুনে তারা টেবিলের দিকে ছুটে যায়। টেবিলের কাপড় ওঠায় এবং মাকে দেখতে পায়। সবাই মিলে বিকট চিৎকার করে ওঠে। সে হালুমহুলুম করে বাচ্চাদের ভয়-দেখানোর ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসে। আবার সেই চিৎকার। এই হুটোপুটির মাঝে বাইরে দরজায় কেউ একজন ঠকঠক করছিল—হৈচৈ-এর মাঝে শোনা যায়নি। দরজাটা অর্ধেক খুলে যায়—ক্রোগস্ট্যাডকে দেখা যায়। খেলা চলছে দেখে সে একটু অপেক্ষা করে।]

ক্রোগস্ট্যাড : মাফ করবেন, মিসেস হেলমার

নোরা : [হাঁফাচ্ছে। চমকে ঘোরে। দাঁড়াতে যায়।] ওহ্—আপনি! আপনি কী চান?

ক্রোগস্ট্যাড : দুঃখিত, সামনের দরজাটা খোলা ছিল। কেউ হয়তো বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

নোরা : [উঠে দাঁড়ায়] ও তো নেই মিস্টার ক্রোগস্ট্যাড।

ক্রোগস্ট্যাড : হ্যাঁ, আমি জানি।

নোরা : তাহলে—আপনি কী চান?

ক্রোগস্ট্যাড : আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

নোরা : কী? কী কথা? [শান্তভাবে বাচ্চাদেরকে] তোমরা একটু দাইমা’র কাছে যাও, কেমন? কী? না, না, এ অচেনা লোকটি মাকে কিছু বলবে না, এখনি চলে যাবে। তারপর আমরা আবার খেলা করব—যাও। [সে বাঁ-দিকের দরজা দিয়ে বাচ্চাদের বের করে দেয়। ওরা বেরিয়ে গেলে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর চাপা উত্তেজনা এবং সতর্কতার সাথে।] আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন?

ক্র্যোগস্ট্যাড : হ্যাঁ।

নোরা : আজই? কিন্তু মাসের প্রথম তো এখনো আসেনি।

ক্রোগস্ট্যাড : না, তা আসেনি। আজ বড়দিন, বড়দিনের আনন্দ মাটি হোক এমন কিছু আপনি নিশ্চয়ই করবেন না।

নোরা : কী চান আপনি? আজ কোনও ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়

ক্রোগস্ট্যাড : ও ব্যাপারে নয়। এ প্রসঙ্গটা একটু আলাদা। আপনার কি একটু সময় হবে?

নোরা : হ্যাঁ, তা হয়তো হবে, তবে—

ক্রোগস্ট্যাড : ব্যাস্ তাহলে ঠিক আছে, অলসেনের রেস্তোরাঁতে এতক্ষণ বসে ছিলাম। আপনার স্বামীকে যেতে দেখলাম।

নোরা : তাই!

ক্রোগস্ট্যাড : একজন মহিলা সঙ্গে।

নোরা : হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?

ক্রোগস্ট্যাড : যদি কিছু মনে না করেন—মহিলাটি কি মিসেস লিন্ডে?

নোরা : হ্যাঁ।

ক্রোগস্ট্যাড : শহরে এসেছে বেশি সময় হয়নি বোধহয়?

নোরা : না—আজই

ক্রোগস্ট্যাড : আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাকি?

নোরা : হ্যাঁ, খুব ঘনিষ্ঠ। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি না আপনি তার সম্বন্ধে এত খোঁজ নিচ্ছেন কেন?

ক্রোগস্ট্যাড : আমিও তাকে একসময় চিনতাম।

নোরা : আমি জানি।

ক্রোগস্ট্যাড : তাই! আপনিও জানেন? আমি অবশ্য তাই ভেবেছিলাম। তাহলে আমি আপনাকে সরাসরিই জিগ্যেস করতে পারি। মিসেস লিন্ডে কি ব্যাংকে কোনও চাকরির ব্যাপারে এসেছেন?

নোরা : এ-কথা আপনি আমাকে জিগ্যেস করছেন কেন? আর আপনার সাহসই বা কী করে হচ্ছে? আপনি আমার স্বামীর একজন অধস্তন কর্মচারী। ঠিক আছে, জিগ্যেস যখন করেই ফেলেছেন তখন বলি—হ্যাঁ। হ্যাঁ, সে চাকরির জন্যই এসেছে এবং পাবেও। আমিই তার কথা বলেছি — আশা করি এখন আপনি বুঝতে পারছেন, মিস্টার ক্রোগস্ট্যাড।

ক্রোগস্ট্যাড : হ্যাঁ, আমিও তাই ভেবেছি।

নোরা : [পায়চারি করে] মহিলা হলেই তার প্রভাব কম থাকবে এটাই বোধহয় আপনার মনে হয়? আসলে ব্যাপারটি ঠিক নয়—মিস্টার ক্রোগস্ট্যাড, তাছাড়া অধস্তন কর্মচারীদের এমন কাউকে চটানো ঠিক নয়, বিশেষ করে যাদের—যা হোক

ক্রোগস্ট্যাড : যাদের প্রভাব আছে?

নোরা : ঠিক ধরেছেন।

ক্রোগস্ট্যাড : [কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে] মিসেস হেলমার, তাহলে দয়া করে আমার ব্যাপারে একটু বলবেন। একটু প্রভাব–

নোরা : কীভাবে? আপনার কী হয়েছে?

ক্রোগস্ট্যাড : ব্যাংকে আমার চাকরিটা যেন থাকে দয়া করে এইটুকু যদি করতেন – নোরা : কী বলছেন? আপনার চাকরি নিচ্ছে কে?

ক্রোগস্ট্যাড : আপনি সবই জানেন। আমার কাছে না-জানার ভান করার কি কোনও প্রয়োজন আছে? আমাকে এভাবে গুঁতো দিয়ে ফেলে দেয়াটা বোধহয় আপনার বন্ধুর উচিত হবে না—তাছাড়া এখন তো আমি জেনে গেলাম যার জন্যে চাকরি খোয়াচ্ছি সে মানুষটি কে

নোরা : কিন্তু আপনি কেন চাকরি খোয়াবেন?

ক্রোগস্ট্যাড : হ্যাঁ, তা অবশ্য, অবশ্যই, কিন্তু এপাশ-ওপাশ পিটাবার তো প্রয়োজন নেই—আমি আপনাকে বলছি, যেহেতু এখনও হাতে সময় আছে, ব্যাপারটি যাতে না ঘটে সেই চেষ্টাই করুন। প্রভাবটা ওখানেই একটু খাটান।

নোরা : কিন্তু ওরকম প্রভাব আমার নেই।

ক্রোগস্ট্যাড : নেই? একটু আগেই তো আপনি বললেন —

নোরা : কথাটা আমি ওভাবে বলিনি, তাছাড়া আপনি কেমন করে ভাবলেন যে আমার স্বামীকে এসব ব্যাপারে আমি প্রভাবিত করতে পারব?

ক্রোগস্ট্যাড : মানে, আমি আপনার স্বামীকে তার ছাত্রজীবন থেকেই চিনি জানি। আমার মনে হয় আমাদের মহান ব্যাংক-ম্যানেজার অন্য স্বামীদের মতোই হবেন। অতটা একগুঁয়ে একরোখা নন। স্বামীদের কিছুটা নমনীয় তো হতেই হয়।

নোরা : আমার স্বামী সম্পর্কে কোনও অসম্মানজনক কথা বললে এখনই আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে।

ক্রোগস্ট্যাড : আপনার তো বেশ সাহস।

নোরা : আপনাকে আমার আর কোনো ভয় নেই। বড়দিনের পরে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার সবকিছু পরিষ্কার করে আমি মুক্ত হয়ে যাব।

ক্রোগস্ট্যাড : [কিছুটা সংযত হয়ে] শুনুন মিসেস হেলমার। প্রয়োজন হলে জীবনে বাঁচার জন্য যেরকম লড়তে হয়, ব্যাংকে আমার ওই ক্ষুদ্র চাকরিটি টিকিয়ে রাখার জন্য আমি সেভাবেই লড়ে যাব।

নোরা : হ্যাঁ, তাইতো মনে হয়।

ক্রোগস্ট্যাড : টাকার জন্য আমি ভাবি না, ওটা এখানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসলেই অন্য একটা ব্যাপার আছে—হ্যাঁ, আপনাকে বলা যায়, ব্যাপারটা হল—আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সবাই জানে, কয়েক বছর আগে আমি একটা বিপদে পড়েছিলাম।

নোরা : হ্যাঁ, মনে হয় শুনেছিলাম।

ক্রোগস্ট্যাড : এ নিয়ে নিয়মমাফিক কোনও মামলা-মোকদ্দমা হয়নি সত্য কিন্তু এই কারণেই আমার সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল—আর সেই থেকেই এখন যেটা করছি বলে আপনি জানেন এই ব্যবসা আমাকে শুরু করতে হয়েছে। কোনও-না-কোনও উপায়ে আমাকে বাঁচতে তো হবে—আর এটা বোধহয় আমি জোর গলায় বলতে পারি যে অন্য অনেকের মতো তেমন খারাপ কিছু করিনি। যা হোক, এখন আমি আর ওসব করতে চাই না, ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে একটু অন্যরকম বাঁচতে চাই। ছেলেরা বড় হচ্ছে। ওদের মুখের দিকে চেয়েই আমাকে শহরে একসময় আমার যে-সম্মানটুকু ছিল সেটা যতটুকু সম্ভব ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সেই গন্তব্যের প্রথম পদক্ষেপই হল আমার ব্যাংকের এই চাকরিটা। এই সিঁড়ি বেয়ে যখন উঠতে যাচ্ছি— তখনই আপনার স্বামী আমাকে লাথি মেরে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিচ্ছেন সেই পুরাতন পাঁকে।

নোরা : আমি সত্যিই বলছি আপনাকে সাহায্য করার মতো শক্তি আমার নেই।

ক্রোগস্ট্যাড : আপনি করতে চাচ্ছেন না তাই এটা বলছেন। আপনি করতে বাধ্য হবেন এরকম পথও কিন্তু আমার জানা আছে।

নোরা : আপনার কাছ থেকে আমি টাকা ধার করেছি এটা আশা করি আপনি আমার স্বামীকে বলবেন না?

ক্রোগস্ট্যাড : হ্যাঁ, এই তো—যদি বলি।

নোরা : তাহলে আপনি একটি জঘন্য কাজ করবেন। [ধরা গলায়] এই গোপনীয়তাটুকু নিয়েই আমি এতকাল গর্ব করেছি। কুৎসিত আর কঠোরভাবে এ-কথাটা কেউ তাকে শোনাবে সেটা আমার সহ্য হবে না। আর সেটা যদি আপনার মতো একজন মানুষের কাছ থেকে শোনে তাহলে ব্যাপারটা আমাকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে।

ক্রোগস্ট্যাড : শুধুই কি অস্বস্তিকর?

নোরা : [প্রবল শক্তিতে] ঠিক আছে বলুন তাকে—কিন্তু মনে রাখবেন কাজটা আপনার জন্যে খুব ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। আমার স্বামী বুঝতে পারবেন কতটা নীচ প্রকৃতির মানুষ আপনি আর সেক্ষেত্রে চাকরিটা আপনি নির্ঘাত খোয়াবেন।

ক্রোগস্ট্যাড : আমি জিগ্যেস করেছিলাম আপনি কি শুধু পারিবারিক অস্বস্তিকর অবস্থার ভয় করছেন? নাকি অন্য কিছু?

নোরা : আমার স্বামী জানতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার পাওনা টাকাটা মিটিয়ে দেবেন। তার পরে আর কী? আপনার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক থাকার তো কথা নয়।

ক্রোগস্ট্যাড : [নোরার দিকে একটু এগিয়ে] শুনুন মিসেস হেলমার, হতে পারে আমার স্মৃতিশক্তি তেমন প্রখর নয় অথবা আপনি ব্যবসাপাতি সম্পর্কে তেমন কিছুই বোঝেন না। আমার বোধহয় আর একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার।

নোরা : বলুন!

ক্রোগস্ট্যাড : আপনার স্বামী যখন অসুস্থ তখন আপনি আমার কাছে বারোশ ডলার ধার নিতে এসেছিলেন।

নোরা : হ্যাঁ। সে তো আমি আর কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলে।

ক্রোগস্ট্যাড : আমি কথা দিয়েছিলাম টাকার একটা ব্যবস্থা আমি করে দেব- নোরা : এবং সেটা আপনি দিয়েছেনও।

ক্রোগস্ট্যাড : তবে কয়েকটি শর্তে সেটা আমি করেছিলাম। স্বামীর অসুস্থতায় আপনি তখন দিশেহারা এবং দক্ষিণে যাবার খরচের ব্যাপারে দারুণ উদ্বিগ্ন, তখন এটা খুবই সম্ভব যে খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো আপনি অতটা সচেতন বা গভীরভাবে দেখেননি। সেই কথাগুলো এখন যদি আপনাকে আবার আমি মনে করিয়ে দিই তাহলে হয়তো অসঙ্গত হবে না। যাহোক, একটি হ্যান্ডনোট–এর মাধ্যমে টাকার ব্যবস্থা আমি করব বলেছিলাম এবং সেভাবেই হ্যান্ডনোট তৈরি করেছিলাম।

নোরা : হ্যাঁ। সেটা আমি সইও করেছি।

ক্রোগস্ট্যাড : ঠিক তাই। তবে হ্যান্ডনোটের নিচে আপনার বাবাকে জামানত করে কয়েকটি লাইন আমি লিখে দিয়েছিলাম। সেটা সই করার কথা ছিল আপনার বাবার।

নোরা : ছিল কি? উনি তো সেটা সইও করেছেন।

ক্রোগস্ট্যাড : আমি তারিখের জায়গাটা খালি রেখেছিলাম। এইজন্য রেখেছিলাম যে আপনার বাবা যেদিন সই করবেন সেই দিনের তারিখটা বসিয়ে দেবেন। মনে আছে?

নোরা : হ্যাঁ, তাই তো মনে হয় —

ক্রোগস্ট্যাড : তারপর ডাকে আপনার বাবার কাছে পাঠাবার জন্য কাগজপত্রগুলো আপনার হাতে দিয়েছিলাম। ঠিক তো?

নোরা : হ্যাঁ।

ক্রোগস্ট্যাড : এবং সেটা আপনি নির্ঘাত সঙ্গে সঙ্গেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ মাত্র পাঁচ-ছয় দিন পরেই আপনার বাবার সই-করা সেই কাগজপত্র আপনি আমার কাছে ফেরত নিয়ে এসেছিলেন এবং আপনার হাতে আমি টাকাগুলো দিয়েছিলাম।

নোরা : ঠিক আছে। কিন্তু আপনার টাকা কি আমি নিয়মিত পরিশোধ করিনি?

ক্রোগস্ট্যাড : হ্যাঁ। একেবারে নিয়মিতই করেছেন। কিন্তু আপনার কথাতেই ফিরে যাই। আপনি তখন দিশেহারা। আপনার জীবনের সেটা একটি দুঃসময় ছিল মিসেস হেলমার।

নোরা : হ্যাঁ, তাই-ই ছিল।

ক্রোগস্ট্যাড : আপনার বাবাও তখন মরণাপন্ন। তাই না?

নোরা : হ্যাঁ, মুমূর্ষু অবস্থা

ক্রোগস্ট্যাড : এবং কয়েকদিনের মধ্যেই মারা গেলেন?

নোরা : হ্যাঁ।

ক্রোগস্ট্যাড : এখন আমাকে বলুন মিসেস হেলমার, আপনার বাবার মৃত্যুর দিনটি কি আপনার মনে আছে? মানে আমি বলছি, মৃত্যুর তারিখটি?

নোরা : সেপ্টেম্বরের ঊনত্রিশ তারিখে বাবা মারা যান।

ক্রোগস্ট্যাড : হ্যাঁ। ঠিক তাই। তারিখের ব্যাপারে আমি নিজেও খোঁজখবর করেছি। এবং এই তারিখটিই আমাদের একটা অদ্ভুত জায়গায় নিয়ে এসেছে—একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে] দেখুন, ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছে না।

নোরা : অদ্ভুত? কী বলছেন? এখানে অদ্ভুত তো কিছু নেই।

ক্রোগস্ট্যাড : মিসেস হেলমার, অদ্ভুত জিনিসটা হল আপনার বাবা তাঁর মৃত্যুর তিনদিন পর এই কাগজে সই করেছেন

নোরা : সেটা কেমন করে? কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না।

ক্রোগস্ট্যাড : ২৯ সেপ্টেম্বর আপনার বাবা মারা গেছেন। কিন্তু দেখুন, আপনার বাবার সইয়ে তারিখটা ২ অক্টোবর। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয় মিসেস হেলমার?

[নোরা চুপচাপ। কোনও কথা নেই] এ সম্পর্কে আপনার কী বলার আছে?

[নোরা এখনো চুপচাপ]

এ ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অদ্ভুত এবং এর চেয়েও অদ্ভুত হল ‘২ অক্টোবর এবং সাল’। এ-দুটো আপনার বাবার হাতের লেখা নয়। তবে এ হাতের লেখা আমার মনে হচ্ছে আমি চিনি। এটার অবশ্য একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। আপনার বাবা হয়তো সই করে তারিখটা বসাতে ভুলে গেছেন। অন্য কেউ হয়তো ভেবেচিন্তে তারিখটা বসিয়েছেন, আপনার বাবা যে মারা যাবেন সেটা হয়তো তার তখন জানা ছিল না। এটা অবশ্য দোষের কিছু না। কিন্তু সইটাই হল আসল। সইটা তো আসল, তাই না মিসেস হেলমার? আপনার বাবা নিজের হাতেই তো তাঁর নাম লিখেছিলেন, তাই না?

নোরা : [একমুহূর্ত চুপ থাকে। তারপর মাথাটা একটু পেছন দিকে বাঁকিয়ে অগ্রাহ্য করার ভঙ্গিতে] না, বাবা নয়। বাবার নামটা আমিই লিখেছিলাম।

ক্রোগস্ট্যাড : দেখুন মিসেস হেলমার। আপনি কিন্তু সাংঘাতিক বিপজ্জনক স্বীকারোক্তি করছেন।

নোরা : কেন? তা কেন হবে? আপনি তো আপনার টাকা পেয়েই যাচ্ছেন।

ক্রোগস্ট্যাড : একটা কথা জিগ্যেস করব? কাগজগুলো আপনি আপনার বাবার কাছে কেন পাঠাননি?

নোরা : আমি পারিনি; বাবা তখন সাংঘাতিক অসুস্থ। তার মধ্যে এ-কথা বলিই বা কেমন করে। তাছাড়া টাকার কথা বললেই কারণ জানতে চাইতেন। যেখানে তিনি নিজেই এত অসুস্থ সেখানে আমার স্বামীর অসুস্থতার কথা তাঁকে কী করে শোনাই। আমি পারিনি।

ক্রোগস্ট্যাড : এমতাবস্থায় বিদেশে না-যাওয়াটাই আপনার জন্য ভালো হত।

নোরা : সেটাও আমি করতে পারিনি। এই ভ্রমণের কারণে আমার স্বামী বেঁচে উঠবে—নয়তো বাঁচবে না—সেক্ষেত্রে আমি না গিয়ে পারি?

ক্রোগস্ট্যাড : কিন্তু সেজন্য আমার মতো মানুষকে আপনি ফাঁকি দিয়ে বিপদে ফেলেছেন— এ-কথাটা একবারও মনে আসেনি?

নোরা : এটা নিয়ে চিন্তা করার সময় তখন ছিল না। আপনার সম্পর্কে আমি ভাবিই নি। আমার স্বামীর মরণাপন্ন অবস্থা জেনেও আপনি যেভাবে দেরি করছিলেন এবং সবকিছু জটিল করছিলেন সেটাই আমার সহ্য হচ্ছিল না।

ক্রোগস্ট্যাড : মিসেস হেলমার, আপনি এখনো ঠিক অনুধাবন করতে পারছেন না আপনার অপরাধ কোথায়। কী বলছি শুনুন— যে কারণে বা যে অপরাধে আজকে আমার এই অবস্থা, এত বদনাম, সেটা আপনার অপরাধের চেয়ে বেশি ছিল না, বা অতটা খারাপও ছিল না।

নোরা : আপনি, আপনি কি এই বলতে চাচ্ছেন যে আপনার স্ত্রীর জীবন রক্ষা করার জন্য আপনি আরও সাহসী কিছু করতেন?

ক্রোগস্ট্যাড : আইন কিন্তু উদ্দেশ্য দেখে না মিসেস হেলমার।

নোরা : তাহলে সেটা কোনও আইনই নয়। অর্থহীন।

ক্রোগস্ট্যাড : অর্থপূর্ণ অথবা অর্থহীন যাই হোক, এই কাগজ যদি আমি কোর্টে দাখিল করি তাহলে সেই আইন আপনার বিচার করবে।

নোরা : এ-কথা আমি বিশ্বাস করি না। মৃত্যুপথযাত্রী একজন বাবার দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ কমিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব বা অধিকার কি তার কন্যার নেই? স্বামীর জীবন রক্ষার অধিকার কি স্ত্রীর নেই? আইন সম্বন্ধে আমি তেমন কিছু জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আইনে এই ব্যাপারটিকে কোথাও-না-কোথাও বৈধ করা হয়েছেই। আপনি একজন আইনজীবী, আপনি জানেন না? না-জানলে আপনি একজন মূর্খ আইনজীবী মিস্টার ক্রোগস্ট্যাড।

ক্রোগস্ট্যাড : হতে পারে। কিন্তু আমি-যে আমার করণীয় কাজ বুঝি এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। বিশেষ করে যে-কাজে আপনি এবং আমি দু-জনই জড়িত। ঠিক আছে, আপনি যা বোঝেন তাই করুন। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে যদি আবার ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় তাহলে আপনার অবস্থাও কিন্তু আমার মতো হবে এই বলে গেলাম। [মাথা নেড়ে অভিবাদন করে হলঘরের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়।]

নোরা : [একটু সময় ভাবে; তারপর মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে] যত্তসব বাজে কথা! আমাকে ভয় দেখাচ্ছে! অতটা বোকা আমি নই। [বাচ্চাদের কাপড়চোপড় গোছগাছ করায় নিজেকে ব্যস্ত করে—কিন্তু একটু পরেই থেমে যায়।] কিন্তু—না, সেটা সম্ভব নয়—আমি যা করেছি আমার ভালোবাসার জন্য করেছি।

বাচ্চারা : [বাঁ-দিকের দরজার কাছে] মাম্মি, অচেনা লোকটা সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

নোরা : হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি। শোনো, এই অচেনা লোকটার কথা তোমরা কাউকে কিছু বলবে না, কেমন? বাবাকেও না, মনে থাকবে?

বাচ্চারা : আচ্ছা, বলব না আমরা। এখন তুমি আমাদের সাথে খেলবে না?

নোরা : না বাবা, এখন না।

বাচ্চারা : কিন্তু মাম্মি, তুমি কথা দিয়েছিলে?

নোরা : হ্যাঁ, দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন যে পারছি না। তোমরা খেল গে যাও—এখন আমি ব্যস্ত। যাও খেল গে। এই তো লক্ষ্মীসোনা, যাও। [বাচ্চাদের আদর করে অন্য ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে এ ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সোফার উপর বসে পড়ে। সুই সুতোর কাজ তুলে নেয়—একটা দুটো সুইয়ের ফোঁড় দিয়ে আবার থেমে যায়।] না! [সুই-সুতোর কাজ রেখে দেয়। উঠে দাঁড়ায়, হলঘরের দরজার দিকে যায়—ডাকে] হেলেনা—গাছটা নিয়ে এসো। [বাঁ-দিকের টেবিলের কাছে যায়। ড্রয়ারটা খোলে—তারপর আবার থামে। ] না—এটা একদমই সম্ভব নয়।

হেলেনা : [ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে প্রবেশ করে] কোথায় রাখব মা?

নোরা : এখানে, ঘরের মাঝখানে রাখো।

হেলেনা : আর কিছু লাগবে?

নোরা : না, না, সব আছে, তুমি যাও।

[হেলেনা গাছটি নামিয়ে রেখে চলে যায়।]

নোরা : [ব্যস্ত হয়ে গাছটি সাজাতে সাজাতে] এখানে একটি মোমবাতি…. কিছু ফুল এখানটায়…লোকটা ভয়ঙ্কর। না, না, এ-সবই অর্থহীন….অর্থহীন।

এরমধ্যে মন খারাপ করার কী আছে? ঠিক আছে দারুণ সুন্দর একটা গাছ বানাব টোরভাল্ড, তুমি যা যা ভালোবাস তার সবটুকু আমি করব। তোমার জন্য আমি নাচব, গান গাইব।

[কতগুলো কাগজ বগলে চেপে হেলমার প্রবেশ করে]

নোরা : ওমা, তুমি এরমধ্যেই ফিরলে?

হেলমার : হ্যাঁ, এখানে কেউ এসেছিল নাকি?

নোরা : এখানে? না তো!

হেলমার : কী অদ্ভুত! আমি যে ক্রোগস্ট্যাডকে গেট থেকে বেরোতে দেখলাম।

নোরা : দেখেছ নাকি? ওহ্ হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছ। ক্রোগস্ট্যাড এক পলকের জন্য এসেছিল।

হেলমার : নোরা, তোমার চেহারা দেখেই আমি বুঝতে পারি ক্রোগস্ট্যাড কেন এসেছিল।

নোরা : কেন বল তো?

হেলমার : তার হয়ে দু–একটা সুন্দর কথা যাতে তুমি আমাকে বল সেই অনুরোধ করতেই এসেছিল।

নোরা : হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছ।

হেলমার : এবং কথাটা এমনভাবে বলবে যেন তোমার নিজের কথা। আমাকে কোনওমতেই বুঝতে দেবে না যে সে এখানে এসেছিল। কি, ঠিক না? এ-কথা সে বলেনি?

নোরা : হ্যাঁ, টোরভাল্ড, কিন্তু…

হেলমার : নোরা, নোরা, তুমি এরকম কাজ করতে পার? ওরকম একটা মানুষের সাথে কথা বলা, তাকে কথা দেয়া? সবচেয়ে খারাপ হল ওরকম একটা মানুষের হয়ে আমার কাছে মিথ্যে বলা!

নোরা : মিথ্যে!

হেলমার : তুমি বললে না কেউ এখানে আসেনি? [নোরার দিকে আঙুল নাচিয়ে আমার ছোট্ট গানের পাখি, আর কখনও এরকম করবে না। গানের পাখি অত্যন্ত পরিষ্কার গলায় সুরে গাইবে। কখনও বেসুরো হলে চলে না।

[নোরাকে গিয়ে ধরে] ব্যাপারটা সত্য, তাই না? হ্যাঁ, আমি জানতাম এটা সত্য। [নোরাকে ছেড়ে] যাক এ নিয়ে এখন আর কোনও কথা নয়। [স্টোভের পাশে বসে] আহ্ চমৎকার, আরাম লাগছে। [কাগজগুলোতে চোখ বুলাতে থাকে]

নোরা : [গাছটা নিয়ে একটু সময় ব্যস্ত হয়ে পড়ে] টোরভাল্ড?

হেলমার : হুঁ

নোরা : আমি অস্থির হয়ে পরশুর জন্য অপেক্ষা করছি।

হেলমার : কেন? কেন?

নোরা : স্টেনবোর্গে পার্টি, বিলাসী-কাপড়চোপড়।

হেলমার : আর আমি ‘অস্থির হয়ে আছি আমার জন্য কোন্ চমকের পরিকল্পনা করেছ সেটা জানার জন্য।

নোরা : ওহ্—ওটা তো নেহাতই অর্থহীন……

হেলমার : কোন্টা।

নোরা : আমি কী করব বুঝতে পারছি না। সবকিছু কেমন নীরস অর্থহীন মনে হচ্ছে।

হেলমার : তাহলে লক্ষ্মীমেয়ে নোরা এটা বুঝতে পেরেছে?

নোরা : [হেলমারের চেয়ারের পিছনে, চেয়ারের গায়ে হাত রেখে] তুমি কি খুব ব্যস্ত, টোরভাল্ড?

হেলমার : কিছু বলবে?

নোরা : কী কাগজ ওগুলো?

হেলমার : ব্যাংকের।

নোরা : শুরু হয়ে গেছে?

হেলমার : কর্মচারী আর কাজের পদ্ধতিতে কিছু রদবদল করা দরকার। সেটা আমি করব। বিদায়ী ম্যানেজারকে আইনসম্মতভাবে এই অধিকার আমাকে দেয়ার জন্য বললাম। এই কাজে বড়দিনের সপ্তাহটা পুরো লেগে যাবে। নতুন বছরের শুরুতেই আমি সবকিছু একেবারে প্রস্তুত চাই

নোরা : তাহলে সেজন্যেই বেচারি ক্রোগস্ট্যাড—

হেলমার : হুঁ–

নোরা : [এখনও চেয়ারের পিছনদিকটা ধরে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে হেলমারের চুলে হাত বুলাচ্ছে।] টোরভাল্ড, তুমি এতটা ব্যস্ত না হলে তোমাকে সাংঘাতিক একটা অনুরোধ করতাম।

হেলমার : আচ্ছা? কী সেটা বল।

নোরা : টোরভাল্ড, তোমার মতো রুচি আমি আর কারও মধ্যে দেখি না। ফেন্সি ড্রেস পার্টিতে কী পরে যাব, বলে দাও না! আমি চাই মানুষজন একটু দেখুক, মানে আমাকে যেন দেখতে ভালো লাগে আর কী!

হেলমার : আহা—তাহলে আমার ছোট্ট বউটি দেখছি এবার অথৈ জলে পড়েছে। তুলে আনতে বাইরের সাহায্য লাগছে।

নোরা : হ্যাঁ টোরভাল্ড, তুমি সাহায্য না করলে আমি কিছুই করতে পারি না।

হেলমার : ঠিক আছে ঠিক আছে, সেটা ভাবা যাবে। একটা কিছু ঠিক করে দেব।

নোরা : যাক বাঁচা গেল। [সে আবার গাছের কাছে যায়। নীরবতা] লাল ফুলগুলো এখানে কী সুন্দর লাগছে আচ্ছা ক্রোগস্ট্যাডের ব্যাপারটা একটু বল তো। সত্যিই কি খুব খারাপ–ও কী করেছিল?

হেলমার : একটা সই জাল করেছে। সই জাল করার ব্যাপারটা কতদূর কী সেটা কি তুমি বোঝ!

নোরা : সে নিরুপায় হয়েই কাজটা করেছে এমনও তো হতে পারে।

হেলমার : পারে। আবার অন্যদের মতো বোকামিও হতে পারে। আমি অবশ্য এতটা হৃদয়হীন নই যে একজন মানুষের একটা মাত্র ভুলের জন্য তাকে সোজাসুজি বরখাস্ত করব।

নোরা : না, না, সেটা তুমি করবে না, আমি জানি টোরভাল্ড। কিন্তু কী করবে? হেলমার : অকপটে দোষ স্বীকার করে শাস্তি গ্রহণ করলে অনেক মানুষই আবার তার বদনাম ঘুচাতে পারে, আবার মুক্ত হতে পারে।

নোরা : শাস্তি!

হেলমার : কিন্তু ক্রোগস্ট্যাড সেরকম কিছু করেনি। নিজেকে বাঁচানোর জন্য ছলনা আর কৌশল অবলম্বন করেছে। এটাই তাকে ডুবিয়েছে।

নোরা : তুমি কি মনে কর এটা…

হেলমার : একটু ভেবে দেখ, এরকম একজন জালিয়াতকে কী পরিমাণ মিথ্যা বলতে হয়, মানুষকে ঠকাতে কত রকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়, তার কাছের মানুষগুলোর সামনেও তাকে কীভাবে মুখোশ পরে থাকতে হয়—হ্যাঁ, এমনকি তার বউ ছেলেমেয়ের সামনেও। ভাবো তো, ছেলেমেয়ের সামনেও, এরচেয়ে সাংঘাতিক কী হতে পারে!

নোরা : কেন?

হেলমার : কারণ, এরকম মিথ্যার পরিবেশ সংক্রামক রোগের মতো ঘরের সবগুলো প্রাণীকে বিষাক্ত ও সংক্রামিত করে ফেলে। এ ধরনের সংসারের বাচ্চারা শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য যে-বাতাস গ্রহণ করে সেটাও অনিষ্টের জীবাণুতে পূর্ণ থাকে।

নোরা : [হেলমারের দিকে একটু ঝুঁকে] তুমি কি নিশ্চিত?

হেলমার : নোরা, একজন আইনজীবী হিসেবে এটা আমি বহু দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যারা খারাপ হয়ে গেছে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে একজন করে মিথ্যুক মা আছে। থাকবেই।

নোরা : শুধু মা’র কথা বলছ কেন?

হেলমার : সাধারণত মায়ের দোষেই এরকম হয়—তবে বাবার জন্য যে হয় না সে কথা বলা যায় না—এটা আইনজীবী মাত্রেই জানেন। আমি নিশ্চিত বলতে পারি এই ক্রোগস্ট্যাড লোকটি বহুকাল ধরে বাড়িতে গেছে আর তার ছেলেপুলেকে সমানে বিষাক্ত করেছে। ঠকবাজি আর মিথ্যা দিয়ে তাদের জীবন জর্জরিত করেছে। সেজন্যই আমি ওকে বলি নীতিভ্রষ্ট, পতিত। [নোরার দিকে হাত বাড়িয়ে] লক্ষ্মী নোরা, ওর হয়ে কোনও কথা তুমি আমাকে বোলো না। এই দয়াটুকু কর। কি, কথা দিলে তো? ও কী! হাতটা দাও। এই তো বেশ। শোনো, এটা কিন্তু দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। তোমাকে বলছি শোনো, ওকে নিয়ে কাজ করা আমার পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব নয়। ওরকম লোক পাশে থাকলেও নিজেকে অসুস্থ মনে হয়।

নোরা : [হাতটা সরিয়ে গাছের অপর প্রান্তে চলে যায়।] এখানে সাংঘাতিক গরম লাগছে। ইশ্! এখনও অনেক কাজ পড়ে আছে।

হেলমার : [তার কাগজপত্র গুছিয়ে উঠতে উঠতে] হ্যাঁ, আমারও। রাতে খাবারের আগেই কাগজপত্রের অনেকগুলো দেখে ফেলতে হবে। তোমার কাপড়চোপড়ের ব্যাপারেও ভাবতে হবে। আচ্ছা, সোনালি কাগজে পুরে আমাকেও তো একটা কিছু এই গাছে ঝোলাতে হবে। [দুই হাতের মধ্যে নোরার মুখটা নিয়ে] লক্ষ্মী গানের পাখি। [দরজা বন্ধ করে হেলমার তার ঘরের দিকে চলে যায়]

নোরা : [প্রায় ফিসফিস করে—একটু পরে] না, না, এটা সত্য নয়—হতেই পারে না। না, সম্ভব নয়। এটা হয় না।

আয়া : [বাঁ-দিকের দরজায়] মা, ছেলেমেয়েরা তো তোমার কাছে আসতে চাইছে। ভীষণ কান্নাকাটি করছে!

নোরা : না, না। এখন আর আমার কাছে আসতে দিও না। তোমার কাছেই রাখ। আয়া : ঠিক আছে, মা। [দরজা বন্ধ করে]

নোরা : [আশঙ্কায় সাদা হয়ে যায়] বাচ্চারা কলুষিত হয়ে যাবে—বিষ ছড়িয়ে পড়বে আমার ঘরে?

[একটু থামে—তারপর মাথাটা ঝাঁকি দেয়] না, সত্য নয়—এ-কথা সত্য নয়। এ হতে পারে না—কখনওই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *