তৃতীয় অঙ্ক
[দৃশ্য একই। ঘরের টেবিল ও চেয়ারগুলো মাঝখানে সরিয়ে আনা হয়েছে। টেবিলে একটি বাতি জ্বলছে। হলঘরের দরজাটা খোলা। দোতলার ফ্যাট থেকে নাচ ও সংগীতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মিসেস লিন্ডে টেবিলের পাশে বসে অলসভাবে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। পড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু মনোযোগ নেই। একবার দু-বার বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্নভাবে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে।]
লিন্ডে : [ঘড়ি দেখে] এখনো এল না! কী ব্যাপার! বেশি দেরি তো করা যাবে না—… [আবার শোনে] আহ্ এসেছে—এসেছে তাহলে! [সে হলঘরের দিকে যায়। অত্যন্ত সাবধানে বাইরের দিকের দরজাটি খোলে। সাবধানী মৃদু পায়ের শব্দ পাওয়া যায় সিঁড়িতে। ক্রিস্টিনা ফিসফিস করে বলে] ভেতরে এস, কেউ নেই এখানে।
ক্রোগস্ট্যাড : [প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে] বাড়িতে তোমার একটা চিরকুট পেলাম। কী ব্যাপার বল তো?
লিন্ডে : তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ক্র্যোগস্ট্যাড : সে-কথা বলতে এই বাড়ি কেন?
লিন্ডে : আমি যেখানে থাকি সেখানে তোমার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। আমার ঘরে ঢোকার আলাদা কোনও পথ নেই। এস, ভেতরে এস, কেউ নেই, একেবারে নির্জন। কাজের মেয়ে ঘুমোচ্ছে—হেলমার দম্পতি দোতলায় নাচে ব্যস্ত।
ক্রোগস্ট্যাড : [প্রবেশ করে] কী? হেলমাররা নৃত্য করছে? সত্যি?
লিন্ডে : হ্যাঁ। কেন নয়?
ক্রোগস্ট্যাড : তাই তো? নয় কেন?
লিন্ডে : শোনো নিল্স, আমরা সরাসরি কথায় যাই।
ক্রোগস্ট্যাড : তোমার-আমার কোনও কথা কি আর বাকি আছে?
লিন্ডে : আছে। এখনও অনেক বাকি আছে।
ক্রোগস্ট্যাড : আমি তো মনে করি না।
লিন্ডে : তুমি সত্যিকার অর্থে কোনওদিনই আমাকে বোঝনি।
ক্রোগস্ট্যাড : বোঝার কি কিছু ছিল? সারাজগতের মানুষের কাছেই তো সব পরিষ্কার ছিল। একজন হৃদয়হীনা মহিলা বিত্তবান কাউকে পেলে স্বল্পবিত্ত মানুষকে ছেড়ে যায়—এটাই তো স্বাভাবিক।
লিন্ডে : তুমি কি মনে কর, আমি অতটা হৃদয়হীনা? অত সহজেই তোমাকে ছেড়ে গিয়েছি?
ক্রোগস্ট্যাড : যাওনি?
লিন্ডে : নিল্স, তুমি কি সত্যি তাই ভেবেছিলে?
ক্রোগস্ট্যাড : সত্যিই যদি না হবে তাহলে আমাকে সেসব কথা কেন লিখেছিলে সেদিন?
লিন্ডে : আর কী করতে পারতাম আমি। তোমাকে ছাড়তে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। সুতরাং আমার প্রতি তোমার যে নরম অনুভূতি ছিল তাকেও আমার হত্যা করতে হয়েছিল।
ক্রোগস্ট্যাড : [হাত কচলাতে কচলাতে] এই তাহলে সত্য? সবটুকু টাকার জন্য—শুধু টাকার জন্যই তুমি এসব করেছিলে?
লিন্ডে : ভুলে যেও না, আমরা তখন একেবারে অসহায়। আমার ছোট্ট ছোট্ট দুটো ভাই। তোমার জন্য অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না নিল্স। তাছাড়া তোমার অবস্থার যে উন্নতি হবে সেরকম ভরসাও তখন ছিল না।
ক্রোগস্ট্যাড : তাহলেও। অন্য কারও জন্য আমাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কোনও অধিকারও তোমার ছিল না।
লিন্ডে : অধিকার ছিল কি না আমি অনেকবার আমার নিজেকে সে প্রশ্ন করেছি …আমি সত্যিই জানি না।
ক্রোগস্ট্যাড : [নম্রভাবে] তোমাকে হারিয়ে আমার মনে হয়েছিল যেন আমার পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে দেখ—যেন একজন জাহাজডুবু মানুষ একটুকরো কাঠ কোনওরকমে ধরে বেঁচে আছে—
লিন্ডে : কূল হয়তো কাছেই ছিল।
ক্রোগস্ট্যাড : ছিল, কিন্তু তুমি এসে আবার সেখানেও বাধার সৃষ্টি করলে।
লিন্ডে : আমি কিছুই জানতাম না নিল্স। আজই আমি জানতে পেরেছি ব্যাংকে তোমার জায়গাটিতেই আমাকে নেয়া হচ্ছে।
ক্রোগস্ট্যাড : তুমি বলছ বলে তোমার কথা আমি বিশ্বাস করছি। কিন্তু এখন তো জেনেই গেছ। তাহলে ছেড়ে দাও।
লিন্ডে : না। সেটা তোমার কোনও উপকারে আসবে না।
ক্রোগস্ট্যাড : উপকার! উপকার! কিন্তু আমি হলে তো এই-ই করতাম।
লিন্ডে : কাজ করার আগে ভালোভাবে ভেবে নিতে হয়, এটাই আমি শিখেছি। জীবনের তিক্ত প্রয়োজনই আমাকে এসব শিখিয়েছে।
ক্রোগস্ট্যাড : জীবন আমাকেও শিখিয়েছে। সুন্দর সুন্দর কথায় যেন না ভুলি এটা আমাকে জীবনই শিখিয়েছে।
লিন্ডে : তাহলে জীবন তোমাকে অমূল্য শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু কর্মে তো তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে, নাকি?
ক্রোগস্ট্যাড : মানে? কী বলছ তুমি?
লিন্ডে : একটু আগেই বলেছ তুমি জাহাজডুবু মানুষের মতো একটুকরো ভাসমান কাঠ আঁকড়ে বেঁচে আছ।
ক্রোগস্ট্যাড : এ-কথা বলার যুক্তি আছে।
লিন্ডে : আমিও সেরকম জাহাজডুবু মেয়েমানুষ। ওই তোমার মতোই ভাসমান কাঠের টুকরো ধরে বেঁচে আছি। একটা মানুষ নেই যার জন্য কাঁদব— একটা মানুষ নেই যার জন্য বাঁচব।
ক্রোগস্ট্যাড : সে পথ তুমি ইচ্ছে করেই বেছে নিয়েছিলে।
লিন্ডে : অন্য কোনও পথ ছিল না বলে।
ক্রোগস্ট্যাড : তাই কি?
লিন্ডে : নিস। ধর আমরা দুটি জাহাজডুবু একা-মানুষ যদি একত্রিত হই দু-জনার শক্তি যদি আবার একত্রিত হয়—কি? হতে পারে না?
ক্রোগস্ট্যাড : কী বলছ তুমি?
লিন্ডে : একটি ভাসমান কাঠ ধরে জাহাজডুবু একজন থাকার চেয়ে দু-জন থাকলে তো ভালো হয়, নাকি?
ক্রোগস্ট্যাড : ক্রিস্টিনা!
লিন্ডে : আমি কেন শহরে এসেছি তুমি কি বোঝ?
ক্রোগস্ট্যাড : তুমি কি সত্যি আমার কথা ভেবেছিলে?
লিন্ডে : আমাকে কাজ করতেই হবে—কাজ ছাড়া আমার জীবন অসহ্য অসাড় মনে হয়। যতটুকু মনে করতে পারি, আমার সারাজীবন আমি শুধু কাজ করেছি। সেটাই আমার আনন্দের একমাত্র উৎস। কিন্তু এখন যখন এ পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই—নিজেকে বড় নিঃস্ব লাগে, রিক্ত লাগে—মনে হয় আমি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি—সব তখন বড় অসহ্য মনে হয়। শুধু নিজের জন্য কাজ করার মধ্যে কোনও আনন্দ নেই নিস। আমাকে একটা কিছু পেতে দাও—একজন, যার জন্য আমি কাজ করে সুখ পাব। জীবনটাকে জীবনের মতো মনে হবে।
ক্রোগস্ট্যাড : আমি বিশ্বাস করি না। তোমার এ-কথাগুলো নারীর মহত্ত্বের অতিরঞ্জিত বোধ ছাড়া কিছু নয়—এই তাৎক্ষণিক বোধ-প্রভাবিত সময়ে সে আত্মত্যাগেও প্রস্তুত থাকে।
লিন্ডে : তুমি আমার মধ্যে অতিরঞ্জিত কিছু কি কখনও লক্ষ করেছ?
ক্রোগস্ট্যাড : না। কিন্তু তুমি কি আমার অতীত জানো? বল—জানো?
লিন্ডে : হ্যাঁ, জানি।
ক্রোগস্ট্যাড : এখানে আমার নাম-সুনাম সম্পর্কে তোমার কি কোনও ধারণা আছে? লিন্ডে : একটু আগেই তুমি বলেছ—আমাকে পেলে তুমি অন্য মানুষ হতে পারতে—তোমার জীবন অন্যরকম হত।
ক্রোগস্ট্যাড : আমি নিশ্চিত জানি।
লিন্ডে : সেটা কি আবার হতে পারে না?
ক্রোগস্ট্যাড : ক্রিস্টিনা—যা-কিছু বলছ সত্যি করে বল তো তুমি এসব ভেবেছ কি না? হ্যাঁ, ভেবেছ। সে আমি তোমার চোখ দেখেই বুঝতে পারি। কিন্তু সত্যি কি তোমার সেই সাহস আছে?
লিন্ডে : আমি কারও মা হতে চাই—তোমার ছেলেমেয়েদের মায়ের স্নেহযত্ন দরকার। আমাকে তোমার দরকার, তোমাকেও আমার প্রয়োজন। প্রকৃত নিসের ওপর আমার এখনও পুরো ভরসা আছে। তুমি সঙ্গে থাকলে আমি ভয় করি না।
ক্রোগস্ট্যাড : [খপ্ করে ক্রিস্টিনার হাত ধরে] ওহ্ ক্রিস্টিনা! তুমি আমাকে বাঁচালে। কী বলে যে…। এখন আমি জগতের চোখে নিজেকে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। ওহ্—কিন্তু আমি তো ভুলে যাচ্ছিলাম—
লিন্ডে : [কান পেতে শোনে] চুপ চুপ। ট্যারান্টেলা। যাও তুমি—তাড়াতাড়ি।
ক্রোগস্ট্যাড : কেন? কী ব্যাপার বল তো?
লিন্ডে : পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছ না? নাচ শেষ হলে সাথে সাথে ওরা এসে পড়বে।
ক্রোগস্ট্যাড : ও হ্যাঁ। আমি যাই। কিন্তু এ সবকিছুই তো অর্থহীন হয়ে যাবে— হেলমারদের বিরুদ্ধে আমি কী করছি সে তো তুমি জানো না।
লিন্ডে : হ্যাঁ জানি, সেটাও আমি জানি।
ক্রোগস্ট্যাড : এরপরও তোমার সাহস থাকবে?
লিন্ডে : হতাশা যে তোমার মতো একটা মানুষকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে আমি সেটা খুব ভালো করে জানি।
ক্রোগস্ট্যাড : ওহ্—একবার যদি ফিরিয়ে নেয়া যেত।
লিন্ডে : সেটা তুমি পার—তোমার চিঠি এখনও বাক্সেই আছে।
ক্রোগস্ট্যাড : তুমি কি নিশ্চিত?
লিন্ডে : কোনও সন্দেহ নেই— কিন্তু
ক্রোগস্ট্যাড : [ক্রিস্টিনার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে] যে-কোনওকিছুর বিনিময়ে তুমি তোমার বন্ধুকে রক্ষা করতে চাও—এই তো? ভণিতার দরকার নেই, সোজাসুজি বল—এই তো?
লিন্ডে : তুমি যখন একবার অন্যের জন্য নিজেকে বিক্রি করেছ—তখন দ্বিতীয়বার আর করতে যেও না।
ক্রোগস্ট্যাড : তাহলে চিঠিটা ফেরত চাই।
লিন্ডে : না—না।
ক্রোগস্ট্যাড : কিন্তু পেতে তো হবে।
হেলমার নিচে আসা পর্যন্ত আমি এখানে অপেক্ষা করব—আমি তাকে আমার চিঠি ফেরত দিতে বলব। চিঠিটা আমার বরখাস্ত সংক্রান্ত, সুতরাং সে ওই চিঠি পড়বে না। আমি তাকে বারণ করব।
লিন্ডে : না, চিঠিটা তুমি ফেরত চাইবে না, নিস।
ক্রোগস্ট্যাড : কিন্তু বিশেষ করে সে কারণেই তো তুমি আমাকে এখানে আসতে বলেছ!
লিন্ডে : হ্যাঁ, আমার উদ্বেগের প্রথম পর্যায়ে আমি তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন একটা পুরো দিন চলে গেছে এবং এর মধ্যেই আমি এই বাড়িতে এমন কিছু দেখেছি যা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমি মনে করি হেলমারের পুরো ব্যাপারটা জানা উচিত—এই সর্বনাশী গোপনকে খুলে ফেলা দরকার, একজন আর একজনকে তাহলে ভালো করে বুঝতে পারবে। ওরা একজন আর একজনকে কৌশলে এড়ানোর চেষ্টা করছে। অনেক কিছু ঢেকে রাখছে। এ অবস্থায় একের পক্ষে অপরকে বোঝা সম্ভব নয়।
ক্রোগস্ট্যাড : বেশ, সেই ঝুঁকি নেয়াটা যদি তুমি সঙ্গত মনে কর তাহলে কর তবে একটা কাজ আছে সেটা আমি করতে পারি—আর সেটা করলে করতে হবে এক্ষুনি।
লিন্ডে : [শোনে] তাহলে যাও—তাড়াতাড়ি। নাচ কিন্তু শেষ। এখানে আর এক মুহূর্তও আমরা দেরি করতে পারব না।
ক্রোগস্ট্যাড : আমি তোমার জন্য নিচে অপেক্ষা করব।
লিন্ডে : ঠিক আছে। তুমি আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাবে।
ক্রোগস্ট্যাড : ক্রিস্টিনা, আমার জীবনে এরচেয়ে চমৎকার সময় আর কখনও আসেনি।
[সে বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই ঘর এবং হলঘরের মাঝের দরজাটা খোলাই থাকে। ]
লিন্ডে : [ঘরটা একটু ঠিকঠাক করে—হাতাকাটা কোট ও হ্যাটটা গুছিয়ে কাছে রাখে।] ওহ্, মুহূর্তে সময় কত আলাদা হয়ে যায়! কত আলাদা! একজন কারও জন্য পরিশ্রম করা—বিশেষ কারও জন্য বেঁচে থাকা—ওহ্ কী পার্থক্য! একটা সংসার দেখাশোনা করা, আহ্—আমি এ সংসারকে সুখ ও শান্তির নীড়ে রূপান্তরিত করব। ওহ্—ওরা কেন আসছে না! [শোনার চেষ্টা করে] ওই তো আসছে—কাপড়চোপড় পরে ফেলি।
[সে তার হ্যাট ও হাতাকাটা কোটটি তুলে নেয়। বাইরে হেলমার এবং নোরার কণ্ঠ শোনা যায়। চাবি ঘোরানোর শব্দ এবং হেলমার নোরাকে প্রায় জোরপূর্বক টানতে টানতে ঘরে প্রবেশ করে। নোরার সাজপোশাক ইতালীয়। একটা কালো শাল জড়ানো গায়ে। হেলমারের গায়ে একটা আলখাল্লার মতো কালো ডোমিনো। খুলতেই দেখা যায় তার পরনে সান্ধ্যপোশাক।]
নোরা : [এখনও প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে হেলমারের সাথে জোরাজুরি করছে] না-না আমি ভিতরে যাব না—ছাড়। আমি আবার উপরে যাব। এত তাড়াতাড়ি আসব কেন? এখনো সময় হয়নি।
হেলমার : কিন্তু লক্ষ্মী নোরা-
নোরা : ওহ্—দোহাই টোরভাল্ড—আমি হাতজোড় করছি—আর একটা ঘণ্টা।
হেলমার : এক মিনিটও না। নোরা—নোরা, তোমার মনে নেই আমরা একটা ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলাম? এস, ভিতরে এস—বাইরে থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
[নোরার জোরাজুরি সত্ত্বেও হেলমার শান্তভাবে তাকে ভিতরে নিয়ে আসে]
লিন্ডে : শুভসন্ধ্যা।
নোরা : ক্রিস্টিনা!
হেলমার : আরে, মিসেস লিন্ডে, এত রাতে?
লিন্ডে : হ্যাঁ—মাফ করবেন, নোরাকে তার নাচের পোশাকে একটু দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিল।
নোরা : তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?
লিন্ডে : হ্যাঁ। আমার পৌছতে একটু দেরি হয়ে ছিল—এসে দেখি তোমরা উপরে চলে গেছ। ভাবলাম তোমাদের সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা ঠিক উচিত হবে না।
হেলমার : [নোরার কালো শাল খুলতে খুলতে] হ্যাঁ দেখুন, ওর দিকে দেখুন। আমাকে জিগ্যেস করলে আমি বলব—দারুণ। লাবণ্য কেমন ফুটে উঠেছে—কী বলেন মিসেস লিন্ডে?
লিন্ডে : ও তো সুন্দরীই।
হেলমার : বলে বেড়ানোর মতো সুন্দরী কি না বলুন? অনুষ্ঠানেরও সবাই তাই মনে করে। কিন্তু এই মিষ্টি ছোট্ট জিনিসটি একেবারে একরোখা। একগুঁয়ে। ওকে নিয়ে কী করি বলুন তো! আপনি বিশ্বাস করবেন না—ওকে বাগে আনতে দস্তুরমতো জোর প্রয়োগ করতে হয়েছে।
নোরা : মাত্র একটি ঘণ্টা বেশি তুমি আমাকে থাকতে দাওনি টোরভাল্ড, এজন্য তোমাকে দুঃখ করতে হবে বলে দিলাম।
হেলমার : শুনুন কী বলে, মিসেস লিন্ডে। সে ট্যারান্টেলা নাচল সাংঘাতিক ব্যাপার—সত্যিই তাই। মানুষজন হৈ হৈ করে উঠেছে, যদিও একটু বেশি রিয়ালিস্টিক হয়েছে, মানে, যা প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে একটু বেশি; আমি বলতে চাই, মানে, সমালোচকের মতো যদি বলি—তাহলে শিল্পের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার তার চেয়ে একটু বেশিই হয়েছে—অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না, পুরো ব্যাপারটা দারুণ হয়েছে। একেবারে সাংঘাতিক। এরপরও যদি নাচে তাহলে কি রেশটা থাকে? নষ্ট হয়ে যাবে না? তাই আমি নিয়ে এলাম। আমি আমার উড়নচণ্ডি বালিকা বধূটির কাঁধে হাত রাখলাম এবং চোখের পলকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরে ঘুরে দর্শকদের অভিবাদন—তারপর ওই উপন্যাস—টুপন্যাসে যেমন বলে— পলকে সেই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য উধাও। প্রস্থানটি সবসময় একেবারে ঠিক সময়ে হওয়া দরকার মিসেস লিন্ডে। এই ব্যাপারটি কোনওভাবেই আমি নোরাকে বোঝাতে পারছি না। সে বুঝতে চায় না। বাহ্—এখানে তো বেশ গরম! [সে তার আলখাল্লা খুলে একটা চেয়ারের উপর রাখে এবং তার নিজের ঘরের দরজাটা খোলে।] ওমা—অন্ধকার দেখি! ও হ্যাঁ—হবেই তো—মাফ করবেন—[সে ভিতরে গিয়ে মোমবাতি জ্বালায়]
নোরা : [রুদ্ধশ্বাসে ফিসফিসিয়ে] কী করেছ?
লিন্ডে : [শান্তভাবে] তার সঙ্গে কথা হয়েছে।
নোরা : তাই?
লিন্ডে : তোমার স্বামীকে সবকিছু খুলে বল।
নোরা : আমি জানতাম।
লিন্ডে : ক্রোগস্ট্যাডকে ভয় করার কারণ নেই। কিন্তু তোমার স্বামীকে বলতেই হবে।
নোরা : না। তাকে আমি কখনওই বলব না।
লিন্ডে : তুমি না বললেও চিঠি বলবে।
নোরা : ধন্যবাদ তোমাকে ক্রিস্টিনা, তুমি অনেক করেছ। আমাকে কী করতে হবে সেটা এখন আমি জেনে ফেলেছি। চুপ-চুপ…।
হেলমার : [এ-ঘরে ফিরে আসে] কী ব্যাপার মিসেস লিন্ডে, প্রশংসা হচ্ছে?
লিন্ডে : হ্যাঁ, তাই… তবে এখন আমি যাই—
হেলমার : কী? এখনই? হয়ে গেল? এটা কি আপনার? এই বোনার কাজটা?
লিন্ডে : [নিয়ে] ও হ্যাঁ। আমি তো ভুলেই যাচ্ছিলাম, ধন্যবাদ।
হেলমার : আপনি বোনার কাজও করেন?
লিন্ডে : এ্যা—হ্যাঁ।
হেলমার : আপনি সুচের কাজ করলেই হয়তো বেশি ভালো করতেন।
লিন্ডে : কেন?
হেলমার : দারুণ ব্যাপার। দাঁড়ান আপনাকে দেখাচ্ছি। আপনি বাম হাতে এইভাবে গোল চাকতিটা ধরুন। তারপর ডান হাত দিয়ে সুচ চালাতে থাকুন, সঙ্গে লম্বা লম্বা ফোঁড়—এরকম না?
লিন্ডে : হ্যাঁ, অনেকটা এরকমই।
হেলমার : তবে নিটিং ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অন্যরকম। অশোভন। এখানে দেখুন, হাত দিয়ে শক্ত করে ধরা—সুচটা একবার উপরে যাচ্ছে একবার নিচে যাচ্ছে— একটার উপরে একটা—কেমন একটা চাইনিজ ভাব। —ওরা শ্যাম্পেনটা কিন্তু দারুণ দিল।
লিন্ডে : আমি তাহলে চলি—শুভরাত্রি। নোরা, আর গোয়ার্তুমি কোরো না কেমন? হেলমার : ঠিক বলেছেন, মিসেস লিন্ডে।
লিন্ডে : শুভরাত্রি মিস্টার হেলমার।
হেলমার : [ক্রিস্টিনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়] শুভরাত্রি—শুভরাত্রি। পৌঁছতে অসুবিধা হবে না আশা করি। আমার খুব ভালো লাগত—যদি… তবে খুব বেশি দূর তো না, কী বলেন? শুভরাত্রি, শুভরাত্রি।
[ক্রিস্টিনা চলে যায়। হেলমার দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসে]
ওহ্—মনে হচ্ছিল মহিলাটি কখনওই যাবে না—সাংঘাতিক বিরক্তিকর মহিলা।
নোরা : টোরভাল্ড, তোমার কি ক্লান্তি নেই?
হেলমার : না, একেবারেই না।
নোরা : ঘুম পাচ্ছে না?
হেলমার : না, মোটেও না। বরং উজ্জীবিত মনে হচ্ছে। তোমার কেমন লাগছে? হ্যাঁ তোমাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে, কেন? ঘুমে দু-চোখ জড়িয়ে আসছে?
নোরা : হ্যাঁ, খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ব।
হেলমার : তাহলেই দেখ—দেখ, তুমি তো আসতেই চাইছিলে না—আমি ঠিক ধরেছিলাম—সেইজন্যই জোর করে নিয়ে এলাম। আমি ঠিকই করেছি।
নোরা : তুমি সব সময়েই ঠিক, টোরভাল্ড। তুমি যা কর সেটাই ঠিক।
হেলমার : [নোরার কপালে চুমু খায়] এই তো আমার লক্ষ্মীপাখি, বুদ্ধিমতীর মতো কথা বলছে। র্যাংক কিন্তু আজ রাতে বেশ আনন্দে ছিল। কী? তুমি কি খেয়াল করেছ?
নোরা : তাই নাকি? ওহ্—তার সাথে একটু কথা বলার সুযোগও পাইনি।
হেলমার : আমিও তেমন বলিনি। তবে এরকম ফুরফুরে মেজাজে ওকে আমি বহুদিন দেখিনি। [মুহূর্তের জন্য নোরার দিকে তাকায়, তারপর কাছে আসে] আহ্! কী যে ভালো লাগছে আমরা ঘরে ফিরে এসেছি তুমি-আমি ব্যাস্—আর কেউ নেই, লোভনীয় নির্জনতা। দারুণ লাগছে তোমাকে লাবণ্য আমার।
নোরা : ওভাবে তাকিও না, টোরভাল্ড।
হেলমার : আমার অত্যন্ত প্রিয় সম্পত্তির দিকে তাকাব না? যে সুন্দর শুধু আমার, যে সৌন্দর্য কেবল আমার ব্যক্তিগত, আর কারও নয়, তাকে দেখব না?
নোরা : [ঘুরে টেবিলের অন্য প্রান্তে চলে যায়।] আজ রাতে তুমি ওরকম কথা বল না, টোরভাল্ড।
হেলমার : [নোরাকে অনুসরণ করে] ট্যারান্টেলা এখনো তোমার রক্তের মধ্যে দেখছি। এটাই তোমাকে আরও মোহময়ী করে তুলছে। শোনো, অনুষ্ঠান শেষ, লোকজন চলে যাচ্ছে—একটু পরে সমস্ত বাড়ি খালি হয়ে যাবে শূন্য শান্ত হয়ে যাবে…।
নোরা : হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে।
হেলমার : হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে না লক্ষ্মী নোরা? তোমাকে একটা কথা বলি শোনো, আমি তোমাকে নিয়ে কোনও অনুষ্ঠানে গেলে তোমার সঙ্গে তেমন কথা বলি না কেন জানো—তোমার কাছেও তেমন যাই না—শুধু দূর থেকে মাঝেমধ্যে চোরা চোখে তাকিয়ে দেখি—কেন জানো? কারণটা হল আমি তোমাকে না চেনার ভান করি, যেন আমরা চুপি চুপি প্রেমে পড়েছি—যেন কেউ কিছু এখনও জানে না—সবার অগোচরে যেন আমাদের বাগদান হয়ে গেছে—কিন্তু কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে না আমাদের মধ্যে কিছু আছে।
নোরা : ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি যে সবসময় আমাকে নিয়েই ভাব সে তো আমি জানি।
হেলমার : তারপর যখন বিদায়ের সময় আসে, তোমার লাবণ্যঝরা কাঁধে জড়িয়ে দিই নকশা চাদর—ঢেকে দিই অপূর্ব হরিণী গ্রীবা, তখন আমার মনে হয় তুমি যেন আমার নববিবাহিতা বধূটি, যেন আমরা এইমাত্র বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নাচ থেকে বেরিয়েছি। কী অদ্ভুত একটা অনুভূতি! যেন এই প্রথম আমি তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি—যেন এই প্রথমবারের মতো লোকচক্ষুর আড়ালে তোমাকে কাছে পাব——চারিদিকের শুনশান আকাঙ্ক্ষিত নীরবতার মাঝে তোমার তিরতির করে কেঁপে কেঁপে ওঠা লাবণ্য দীপ্তির ছোঁয়ায় আমি দীপ্তিমান হব। সারাটা সন্ধ্যা আর কিছু নয়, আমি শুধু তোমার আকাঙ্ক্ষাই করেছি—তোমাকেই কাছে পেতে চেয়েছি—ট্যারান্টেলায় যখন দেখলাম তুমি দুলছ—ইশারায় ডাকছ, তখনই আমার রক্তে আগুনের ছোঁয়া টের পেলাম। কিছু বলিনি, ধৈর্য ধারণ করেছিলাম যতক্ষণ পারি। তারপর একসময় ধৈর্যের আগল খুলে যেতে থাকল…। আর সে জন্য একটু আগেই তোমাকে বৃন্তচ্যুত ফুলের মতো ঘরে নিয়ে এলাম।
নোরা : নাটোরভাল্ড। যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও—আমি এসব চাই না। চাই না…
হেলমার : কী ব্যাপার? ওহ্! শরবিদ্ধ শিকারের সাথে খেলছে নোরা। চাও না? আমি তোমার স্বামী, কি, অস্বীকার করবে?
[বাইরের দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়]
নোরা : [চমকে উঠে] দেখ তো!
হেলমার : [হলঘরের দিকে যেতে যেতে] কে? কে?
র্যাংক : আমি। ভেতরে একটু আসব?
হেলমার : [রাগে ফিসফিস করে] ও এখন আবার কী চায়? [গলা উঁচিয়ে] দাঁড়াও, খুলছি। [গিয়ে দরজা খোলে] বাহ্—একবার এ-ঘরে ঢুঁ না মেরে সোজা যে চলে যাওনি সেজন্য খুশি হলাম ডাক্তার।
র্যাংক : মনে হল তোমরা কথা বলছ। তাই ভাবলাম একবার একটু দেখেই যাই। [সে ঘরের চারদিকে চকিতে চোখটা ঘুরিয়ে নিল।] হ্যাঁ, আমার অত্যন্ত চেনা জায়গা; তোমরা দু-জন বেশ সুখে আরামেই এখানে থাকছ।
হেলমার : তোমাকে তো উপরতলাতেও বেশ খুশি-খুশি দেখলাম।
র্যাংক : দারুণভাবে—কেন হব না? পৃথিবীর দান কেন উপভোগ করব না? যা-কিছুর বিনিময়েই হোক, যতটুকু সম্ভব এবং যত দীর্ঘকাল সম্ভব, কেন করব না? ওয়াইনটা কিন্তু সাংঘাতিক ছিল, তাই না?
হেলমার : বিশেষ করে শ্যাম্পেন।
র্যাংক : তাহলে তোমারও তাই মনে হয়েছে? আমি যে কত গিলেছি সেটা বিশ্বাসই করতে পারবে না।
নোরা : আজ রাতে টোরভাল্ডও বেশ টেনেছে।
র্যাংক : তাই?
নোরা : হ্যাঁ, আর এরকম হলেই টোরভাল্ড সজীব হয়ে ওঠে।
র্যাংক : কেন নয়? সারাদিনের খাটাখাটুনির পর একটা মানুষ এরকম চমৎকার একটি সন্ধ্যা চাইবেই বা না কেন?
হেলমার : সারাদিনের খাটাখাটুনি? তাহলে আমি নিশ্চয়ই সেটা দাবি করতে পারি না?
র্যাংক : [হেলমারের পিঠে থাপ্পড় দিয়ে] তুমি পার না, কিন্তু আমি পারি।
নোরা : ডাক্তার র্যাংক, আপনি আজ তাহলে বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা চালিয়েছেন?
র্যাংক : ঠিক তাই।
হেলমার : বাহ্ বাহ্—নোরা তাহলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়েও কথা বলছে।
নোরা : নিরীক্ষার ফলাফলে কি শুভেচ্ছা জানাতে হবে?
র্যাংক : তা জানাতে পারেন।
নোরা : পরীক্ষা তাহলে ভালোই বলে, কী বলেন?
র্যাংক : যতদূর সম্ভব ভালো—ডাক্তার এবং রোগী দু-জনার জন্যেই নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে।
নোরা : [ঝট্ করে তীক্ষ্ণভাবে] নিশ্চয়তা?
র্যাংক : সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা। সুতরাং একটা আনন্দময় সন্ধ্যা কেন মাটি হবে?
নোরা : হ্যাঁ, অবশ্যই ডাক্তার, কেন মাটি হবে? উপভোগ করুন।
হেলমার : আমিও একমত। তবে লক্ষ রাখবে পরদিন সকালেই এজন্য যেন মূল্য দিতে না হয়।
র্যাংক : সেটা ঠিক—তবে কিছু না দিলে জীবনে কিছু পাওয়াও যায় না।
নোরা : পোশাকি অনুষ্ঠান আপনার বেশ ভালো লাগে, তাই না ডাক্তার র্যাংক?
র্যাংক : হ্যাঁ, অনেকগুলো ঝলমলে সুন্দর সুন্দর পোশাক হলে বেশ লাগে।
নোরা : তাহলে বলুন আগামী অনুষ্ঠানে আপনি এবং আমি কী পরতে পারি?
হেলমার : ওমা—এর মধ্যেই পরবর্তী অনুষ্ঠানের চিন্তা!
র্যাংক : আপনি এবং আমি? ও হ্যাঁ, বলতে পারি—আপনি হবেন মাসকাট।
হেলমার : হুম্—কী পোশাক পরলে মাসকাট হওয়া যাবে?
র্যাংক : তোমার বউ প্রতিদিন যা পরে সেটা পরলেই হবে।
হেলমার : অত্যন্ত সুন্দর বলেছ। কিন্তু তুমি কী পরবে সেটা জানো?
র্যাংক : হ্যাঁ, তা জানি, হে বন্ধু হে প্রিয়—সে ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত।
হেলমার : আচ্ছা?
র্যাংক : আগামী পোশাকি অনুষ্ঠানে আমি অদৃশ্য হব।
হেলমার : অদ্ভুত পরিকল্পনা!
র্যাংক : এক ধরনের বড় কালো হ্যাট পাওয়া যায়—তুমি অদৃশ্য হ্যাটের কথা শুনেছ? তুমি শুধু পরবে, ব্যাস কেউ আর তোমাকে দেখতে পাবে না।
হেলমার : [হাসি লুকিয়ে] কী জানি, হতে পারে তুমি ঠিকই বলেছ।
র্যাংক : এই দেখ, আমি যে-কারণে এসেছি সেটা তো ভুলেই যাচ্ছিলাম। হেলমার, একটা চুরুট দাও দেখি, কালো হাভানা—একটা দাও।
হেলমার : সানন্দে—[চুরুট কেসটা এগিয়ে দেয়]
র্যাংক : [একটা নিয়ে গোড়াটা কাটে] অনেক ধন্যবাদ।
নোরা : [ম্যাচ জ্বালিয়ে] আমি আপনাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছি।
র্যাংক : ধন্যবাদ।
[নোরা আগুন ধরে, র্যাংক চুরুট জ্বালায়] তাহলে এখন বিদায়।
হেলমার : বিদায়—বিদায় — বন্ধু।
নোরা : নিশ্চিন্তে এখন ঘুমান গিয়ে ডাক্তার।
র্যাংক : আপনার এ শুভকামনার জন্য ধন্যবাদ।
নোরা : আমার জন্যও এই কামনাই করবেন।
র্যাংক : আপনার জন্য? অবশ্য আপনি যদি চান—নিদ্রা সুখের হোক আপনার। আগুনের জন্য আবারও ধন্যবাদ। [তাদের দু-জনকে অভিবাদন করে চলে যায়।]
হেলমার : [নিচুস্বরে] মাত্রাটা বোধহয় একটু বেশি হয়ে গেছে।
নোরা : [উদাসীনভাবে] হবে হয়তো।
[হেলমার পকেট থেকে চাবি বের করে হলঘরের দিকে চলে যায়।]
নোরা : ওখানে কী করছ, টোরভাল্ড?
হেলমার : চিঠির বাক্সটা প্রায় ভরে আছে, একটু খালি করে ফেলি। না হলে কালকে আর কাগজ রাখা যাবে না।
নোরা : রাতে কি কাজ করবে?
হেলমার : করব না সে তো ভালো করেই জানো। কী ব্যাপার? এটা কী? তালা ধরেছিল নাকি কেউ?
নোরা : তালা?
হেলমার : হ্যাঁ। নির্ঘাত কেউ ধরেছে। এর মানে কী? কাজের মেয়েটি করেছে বলে তো মনে হয় না। নোরা, একটা ভাঙা চুলের কাঁটা—হ্যাঁ, তোমারই তো–
নোরা : [চট্ করে] হতে পারে বাচ্চারা…
হেলমার : তুমি তাহলে ওদের বারণ কোরো।
[চিঠির বাক্স খালি করতে করতে রান্নাঘরের দিকে ডাক দেয়] হেলেনা, হেলেনা—বাইরের বাতিটা নিভিয়ে দাও—[সে সামনের দরজাটা বন্ধ করে হাতে চিঠিপত্র নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।]
দেখ—একবার দেখ—কত্ত চিঠিপত্র! [বাছতে থাকে] এটা কী?
নোরা : [জানালার কাছে] চিঠি! নাটোরভাল্ড—না।
হেলমার : র্যাংকের দুটো ভিজিটিং কার্ড।
নোরা : ডাক্তার র্যাংকের?
হেলমার : [কার্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে] এস, র্যাংক এম ডি—এ দুটোই তো সবার উপরে ছিল! নিশ্চয়ই যাবার সময় ফেলে গেছে।
নোরা : কিছু লেখা আছে নাকি?
হেলমার : নামের উপর কালো ক্রস দেয়া আছে, দেখ। কীসব অদ্ভুত চিন্তা—যেন নিজেই সে তার মৃত্যুর ঘোষণা দিচ্ছে।
নোরা : হ্যাঁ, সেটাই তো করছে।
হেলমার : কী? তুমি কি এ ব্যাপারে কিছু জানো? সে কি তোমাকে কিছু বলেছে?
নোরা : হ্যাঁ। এই কার্ড এলে বুঝতে হবে সে আমাদের চিরবিদায়-সম্ভাষণ জানাচ্ছে—দরজা বন্ধ করে এখন সে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে।
হেলমার : ওহ—র্যাংক আমার পুরনো দিনের বন্ধু! বেচারা! অবশ্য জানতাম সে বেশিদিন আর আমাদের মাঝে নেই—কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি…! আহত জন্তুর মতো কোথাও গিয়ে লুকোবে—
নোরা : যেতেই যদি হয়—তাহলে নীরবে চলে যাওয়াই তো ভালো, তাই না টোরভাল্ড?
হেলমার : [পায়চারি করে] সে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। র্যাংক নেই আমি ভাবতেই পারি না। সে তার সবটুকু একাকিত্ব এবং যন্ত্রণা নিয়েই আমাদের জীবনের ঘন কালো মেঘের আয়োজনকে বারবার ব্যর্থ করে দিয়েছে। আমাদের সুখশান্তিকে নিজের বুকে ধারণ করে সূর্যের আলোর উজ্জ্বলতা দিয়েছে। যাহোক—যেমন করেই হোক—তার জন্য এটাই বোধহয় ভালো হল। [থমকে যায়] এবং আমাদের জন্যও হতে পারে নোরা, এখন তুমি আর আমি ছাড়া তৃতীয় কোনও ব্যক্তি নেই। [এক হাত দিয়ে নোরাকে জড়িয়ে ধরে] নোরা, কেন যেন মনে হয়—আমি যেন তোমাকে আর অতটা কাছে ধরে রাখতে পারছি না। নোরা, তুমি তো জানো, আমি মাঝে মাঝে বলতাম তুমি যেন সাংঘাতিক কোনও বিপদে পড়—যাতে আমি তোমাকে রক্ষা করার জন্য আমার সবকিছুর ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি –সে ঝুঁকি যদি আমার জীবনের ঝুঁকি হয় তাতেও ক্ষতি নেই।
নোরা : [নিজেকে মুক্ত করে দৃঢ় এবং সচেতনভাবে কথা বলতে বলতে।] এখন তুমি তোমার চিঠিগুলো পড়বে টোরভাল্ড।
হেলমার : না, না, আজ আর না। আমি আমার বধূয়ার সঙ্গে রাত কাটাব।
নোরা : কী বললে? ওদিকে তোমার প্রিয় বন্ধু মারা যাচ্ছে—আর তুমি…
হেলমার : হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের দু-জনারই মন আজ কেমন করছে। আমাদের দুজনার মাঝে কুৎসিত কিছু একটা এসে দাঁড়িয়েছে—বিশাল এক মৃত্যুচিন্তা। এ কুৎসিতকে ঝাঁকি দিয়ে ফেলে দিতে হবে—বেরিয়ে আসতে হবে আরও উজ্জ্বল সময়ের প্রত্যাশায়—সে পর্যন্ত চলো আমরা আলাদাই থাকি।
নোরা : [হেলমারের গলা জড়িয়ে ধরে] শুভরাত্রি, টোরভাল্ড, শুভরাত্রি।
হেলমার : [নোরার কপালে চুমু খায়] শুভরাত্রি নোরা—ঘুমিয়ে যাও—গানের পাখি আমার। এখন গিয়ে আমি চিঠিগুলো পড়ব। [চিঠিগুলো নিয়ে সে তার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।]
নোরা : [উন্মত্ত চোখে প্রায় অন্ধের মতো হাতড়িয়ে সে হেলমারের অনুষ্ঠানের আলখাল্লাটা ধরে ফেলে—নিজের গায়ে সেটা জড়ায়। দ্রুত, কর্কশ এবং ভাঙা ভাঙা গলায় ফিসফিস করে] ওকে আর কোনওদিন আমি দেখব না—কোনওদিন না—কখনও না— [সে শালটা মাথার উপর ঘোমটার মতো পরে।] আমার ছেলেমেয়ে—ছেলেমেয়েদেরও আর কোনওদিন দেখতে পাব না। কোনওদিনই না—। কালো জল, বরফের মতো ঠাণ্ডা—হিমশীতল—গভীর। কত গভীর! ওহ্—যদি পার হয়ে যেত এই অসহ্য সময়—! টোরভাল্ড চিঠিটা এর মধ্যেই পেয়েছে নিশ্চয়—হয়তো পড়ছে—না, না—এখনও না। বিদায় টোরভাল্ড— বিদায় আমার বাচ্চা—
[নোরা হলঘরের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত : ঠিক এমন সময় হেলমার দরাম করে দরজাটা খুলে সেখানে দাঁড়ায়। তার হাতে খোলা চিঠি।]
হেলমার : নোরা!
নোরা : [জোরে চিৎকার করে] আহ্―!
হেলমার : নোরা, এসব কী? এ চিঠিতে কী আছে তুমি কি জানো?
নোরা : হ্যা—আমি জানি। আমাকে যেতে দাও। যেতে দাও।
হেলমার : [ধরে ফেলে] কোথায় যাচ্ছ তুমি?
নোরা : [নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে] আমাকে বাধা দিও না টোরভাল্ড।
হেলমার : [চমকে] এসব সত্যি! চিঠিতে যা লেখা আছে সেসব তাহলে সত্যি! কী সাংঘাতিক! না-না এ অসম্ভব—এটা সত্যি হতেই পারে না!
নোরা : সত্যি টোরভাল্ড, সত্যি। আমি তোমাকে পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবেসেছি।
হেলমার : শোনো, অর্থহীন কথাবার্তা বোলো না।
নোরা : [হেলমারের দিকে এক পা এগিয়ে এসে] টোরভাল্ড!
হেলমার : সর্বনাশী মেয়ে—এটা কী করেছ তুমি?
নোরা : আমাকে যেতে দাও। তোমার কোনও বদনাম হবে না টোরভাল্ড। আমার জন্য তুমি ভুগবে তা হবে না।
হেলমার : নাটক কোরো না। [সে গিয়ে সামনের দরজায় তালা দেয়।] তুমি কোথাও যাবে না। এখানে থাকবে আর আমাকে সব খুলে বলবে। তোমার কি বোধ আছে? তুমি কি জানো তুমি কী করেছ? উত্তর দাও—তুমি কি বোঝ?
নোরা : [একদৃষ্টে তার দিকে তাকায়। কথা বলতে বলতে নোরার প্রকাশভঙ্গি দৃঢ় হয়] হ্যাঁ। এখন আমি পরিষ্কার বুঝতে শুরু করেছি।
হেলমার : [অশান্ত পায়চারি করতে থাকে] কী সাংঘাতিক বোধোদয় —! গত আটটা বছর ধরে তুমি ছিলে আমার আনন্দ—আমার গর্ব—আর এখন দেখছি তুমি একটি মিথ্যুক ভণ্ড… তার চেয়েও বেশি তুমি একটি দুর্বৃত্ত। ওহ্ কী কুৎসিত! কোনও শব্দের শক্তি নেই এই কুৎসিতের মাত্রা ধারণ করে, ওহ্!
[নোরা দৃঢ়ভাবে অপলক তাকিয়ে থাকে। কোনও কথা বলে না। হেলমার এসে তার সামনে দাঁড়ায়।] ওহ্! আমার জানা উচিত ছিল এরকম কিছু একটা ঘটবে। আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল। তোমার বাবার সেই অকম্মা চরিত্র। চুপ কর। একেবারে চুপ। তোমার বাবার চরিত্রের সব অক্ষমতা তোমার ওপর ভর করেছে। প্রবঞ্চনা। ওহ্! ধর্ম নেই, নীতি নেই—কর্তব্যবোধ নেই। তাকে ক্ষমা করে, মার্জনা করে শেষপর্যন্ত আমি এই পেলাম। তোমার জন্য আমি সব করেছিলাম, সব সয়েছিলাম—আর এইভাবে তার প্রতিদান দিলে!
নোরা : হ্যাঁ, এইভাবেই।
হেলমার : তুমি আমার সব সুখ নষ্ট করেছ, শান্তি বিনাশ করেছ—সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছ আমার গোটা ভবিষ্যৎ। ওহ্—এটা চিন্তাই করা যায় না! আমি এখন নীতিজ্ঞানশূন্য একটা অবিবেচকের হাতের মুঠোয়। সে এখন আমাকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করাতে পারে। তাকে জিজ্ঞাসা কর সে আমার কাছে কী চায়—তার ইচ্ছামতো আমাকে নির্দেশ দিতে বল—এখন তো আমার আর ‘না’ করার শক্তি নেই। তোমার মতো একজন অবিবেচক অপদার্থ মহিলার জন্য দেখ, কী করুণ অধঃপতন আমার!
নোরা : আমি সরে গেলেই তোমার মুক্তি হবে।
হেলমার : কাব্য কোরো না। তোমার বাবাও সবসময় এরকম সুন্দর সুন্দর কথা বলতেন। কথা তার তৈরিই থাকত। ‘সরে গেলে’ ওই যে বললে, তাতে আমার কী লাভটা হবে? এখন আর তোমার থাকা না-থাকাতে কী আসে যায়? এখন সে এসব কথা বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দেবে। একবার ছড়ালেই তো হয়ে গেল, মানুষ ধরেই নেবে আমিও তোমার অসৎ কাজের সঙ্গী। সঙ্গত কারণেই তারা ভাবতে পারে আমিই এর পেছনে—আমিই তোমাকে এই পথে নামিয়েছি। এবং এসব কিছুর জন্য ধন্যবাদ তো তোমারই প্রাপ্য—তোমার! যাকে আমার বিবাহিত জীবনের এতগুলো বছর মনের মধ্যে রেখেছি—ভালোবেসেছি। বোঝ, কী সর্বনাশ তুমি করেছ?
নোরা : [ঠাণ্ডা শক্ত] হ্যাঁ।
হেলমার : এটা আমার কাছে এতই অবিশ্বাস্য যে আমি কী করব বুঝতে পারছি না। সবটাই আমার বোধের বাইরে। কিন্তু আমাদের একটা বোঝাপড়ায় আসতেই হচ্ছে। গা থেকে চাদর খুলে রাখো—খোলো বলছি! কোনও না-কোনওভাবে তাকে থামাতেই হবে—যে করেই হোক এ জিনিস চাপা দিতেই হবে। আমাদের প্রসঙ্গে—আমরা যেমন ছিলাম তেমনি চলব—তবে সে শুধু মানুষকে দেখাবার জন্য। তুমি আমার ঘরেই থাকবে—সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমি তোমার ওপর আমার বাচ্চা মানুষ করার ভার দিতে পারি না। তাদের ব্যাপারে তোমাকে আমি আর বিশ্বাস করতে পারি না। ওহ্—এসব কথা আমাকে বলতে হচ্ছে এটা চিন্তা করতেও আমার … বিশেষ করে এমন কাউকে যাকে আমি সত্যি ভালোবেসেছিলাম— এখনও — যাহোক এখন তো সব শেষই হয়ে গেল—এখন থেকে সুখের প্রশ্ন তো আর আসছেই না—তবে বিনাশকে ঠেকা দেবার একটা চেষ্টা তো করতে হবে—তা–ও পুরোপুরি হয়তো হবে না—ক্ষুদ্র অংশে—শুধু বহিরঙ্গে— [বাইরের দরজায় বেল বাজে।]
হেলমার : [একটু আত্মস্থ হয়ে] কে আবার? এই অসময়ে? সামনে যেও না নোরা, বলে দাও তুমি অসুস্থ।
[নোরা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। হেলমার গিয়ে হলঘরের দরজা খোলে।]
হেলেনা : [দরজার কাছে। বিস্রস্ত।] ম্যাডামের একটা চিঠি।
হেলমার : আমাকে দাও। [চিঠি নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়] হ্যাঁ—তারই চিঠি। এ চিঠি তুমি পাবে না। আমি নিজে পড়ব।
নোরা : হ্যাঁ, পড়।
হেলমার : [বাতির কাছে গিয়ে] ওহ্—সাহস হচ্ছে না—এ ক্ষুদ্র চিঠির মধ্যে হয়তো আমাদের সর্বনাশ লেখা আছে। নাহ্! আমাকে জানতেই হবে! [চিঠিটা ছিঁড়ে—কয়েকটি লাইনের উপর গড়গড় করে চোখ বুলায় উল্টিয়ে সংযুক্ত একটি কাগজ দেখে—তারপর আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।] নোরা!
[নোরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।] নোরা—দাঁড়াও আমি আবার পড়ছি—হ্যাঁ, সত্যই। ওহ্ বেঁচে গেলাম। নোরা আমি বেঁচে গেছি, ওহ্ আমি বেঁচে গেছি।
নোরা : আর আমি?
হেলমার : তুমিও। আমরা দু-জনেই। তুমি এবং আমি। দেখ, সে বন্ডটা পাঠিয়ে দিয়েছে। লিখেছে—সে অনুতপ্ত, ক্ষমা চাইছে—একটা সুখময় পরিবর্তন হয়েছে তার জীবনে। ধ্যাত, তার কী হয়েছে তাতে কিছু যায়-আসে না, আমরা রক্ষা পেয়েছি সেটাই আসল। নোরা, এখন আর তোমাকে কেউ স্পর্শও করতে পারছে না। ওহ্ নোরা, নোরা—দাঁড়াও, প্রথমেই জঘন্য এই ঝামেলা দূর করি—[আবার সে বন্ডে চোখ বুলায়। ] না—তাকিয়েও দেখব না। আমি সব ছিঁড়ে ফেলব—যেন কিছু হয়নি—যেন একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র। [বন্ড এবং চিঠি দুটো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে—জ্বলন্ত স্টোভটায় ছুড়ে দেয়। তাকিয়ে তাদের জ্বলে যাওয়া দেখে—] ব্যাস—সব শেষ। সে চিঠিতে লিখেছিল বড়দিনের সন্ধ্যা থেকে তোমার… ওহ্—নোরা গত তিনটা দিন তোমার সাংঘাতিক গেছে।
নোরা : অত্যন্ত কঠিন টানাপোড়েনে কেটেছে।
হেলমার : সাংঘাতিক কষ্ট হয়েছে তোমার—কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিলে না—শুধু… যাক ভালোই হল, এই ঘৃণ্য ব্যাপারগুলো এবার মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেল। এখন আমরা আনন্দে চিৎকার করতে পারি— বারবার। সব ঝামেলা চুকেবুকে গেছে—শেষ হয়ে গেছে। শোনো, নোরা, তুমি বোধহয় বুঝতে পারছ না–নোরা, এখন আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই—সব ঝামেলা চুকে গেছে। কী হল? নোরা, চেহারাটা অমন করে আছ কেন? ও বুঝেছি—আমি যে তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি সেটা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না এই তো? কিন্তু সত্যি। এখন আর আমি কিছুই মনে করছি না—দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমি তোমার সবকিছু ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন আমি বুঝলাম—তুমি যা করেছ সে আমার ভালোবাসার জন্যই
নোরা : এটাই সত্য।
হেলমার : স্বামীকে যেভাবে ভালোবাসা উচিত তুমি সেভাবেই আমাকে ভালোবেসেছ—অভিজ্ঞতা নেই বলেই যা করেছ সেটা বুঝতে পারনি। আচ্ছা তুমি কি ভাবছ কাজটা ঠিকমতো করতে পারনি বলে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কমে গেছে? না, না, মোটেও তা নয়—তুমি আমার ওপর ভরসা করতে পার। এরপর থেকে আমিই তোমাকে পরামর্শ দেব, পথ দেখিয়ে দেব। তোমার মেয়েলি অসহায়ত্ব বরং তোমাকে আমার কাছে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় করে তুলেছে—সেটা না করলে তো আমি সত্যিকার অর্থে পুরুষই না। প্রথম যখন কথাগুলো শুনলাম মনে হল পৃথিবীর তাবৎ বিদ্রূপের হাসি আমার কানে ঢুকছে—আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। ওই ভয়াবহ মুহূর্তে যে-কথাগুলো তোমাকে বলেছি সেগুলো একটু শক্তই ছিল। যাহোক সেসব একেবারে ভুলে যাও—মনে রেখো না। আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। আমি শপথ করে বলছি—তোমার সব অপরাধ আমি ভুলে গেলাম, নোরা।
নোরা : তোমার মহানুভবতার জন্য ধন্যবাদ। খুশি হয়েছি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ। [ডানদিকের দরজা দিয়ে নোরা বেরিয়ে যায়]
হেলমার : না, যেও না। [ভেতরে উকি দিয়ে দেখে] কী করছ ওখানে?
নোরা : [নেপথ্যে] বিলাসী কাপড়চোপড় খুলছি।
হেলমার : [খোলা দরজার কাছে] হ্যাঁ, খুলে ফেল। একটু স্থির হওয়ার চেষ্টা কর—মনটাকে শান্ত কর। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তুমি নিশ্চিন্তে আরাম কর আর আমি আমার দুটি পাখা দিয়ে তোমাকে আড়াল করব। [দরজার কাছেই সে পায়চারি করে।] নোরা, কী সুন্দর উষ্ণ আর আপন আমাদের এ বাড়ি—এটাই তোমার নির্ভয় আশ্রম। ক্ষিপ্র বাজের তীক্ষ্ণ নখের কবল থেকে পালিয়ে আসা পাখির মতো তোমাকে আমি অভয়ারণ্য দেব। একটু একটু করে তোমার অস্থির বিক্ষিপ্ত হৃদয়কে শান্তির ছোঁয়া দেব নোরা, তোমাকে কথা দিচ্ছি। সকালেই দেখবে সবকিছু সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে—পলকেই সবকিছু সেই আগের মতো। তোমাকে ক্ষমা করেছি কি না সেটা আমার মুখে আর বলতে হবে না—নিজেই বুঝবে—তোমার ভেতরেই তুমি টের পাবে। তুমি কেমন করে ভাবো যে তোমাকে আমি প্রত্যাখ্যান করব? প্রত্যাখ্যান তো দূরের কথা, গালমন্দ করার কথাও কি ভাবতে পার? সত্যিকারের পুরুষমানুষের হৃদয় কী, সে তুমি জানো না নোরা। একজন পুরুষমানুষ যখন নিজের অন্তরেই জানে যে সে তার স্ত্রীকে ক্ষমা করেছে, সম্পূর্ণভাবে অন্তরের অন্তস্তল থেকে—তখন তার মনে একরকমের মধুময় আত্মতৃপ্তি জাগে, একধরনের আনন্দ হয়—সে আনন্দ কাউকে বলে বোঝাবার নয়—অনির্বচনীয়! সে আনন্দ দ্বিগুণ করে পাওয়ার আনন্দ—যেন একেবারে নতুনকে পাওয়ার অনাবিল সুখ। এক অর্থে, সে একাধারে তার স্ত্রী এবং সন্তান হয়ে যায়। এখন থেকে আমার কাছে তুমি তাই। আমার নোরা, ভীতু সন্ত্রস্ত অসহায় খুদে গানের পাখি! কোনওকিছুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই—শুধু সবকিছু আমাকে খুলে বল। আমিই তোমার ইচ্ছা, আমিই তোমার বিবেক, ভয় পাবে কেন? এ কী? ঘুমাবে না? কাপড়চোপড় বদলালে যে?
নোরা : [তার প্রাত্যহিক সাজে] হ্যাঁ টোরভাল্ড, কাপড় বদলেছি। পরিবর্তন করলাম।
হেলমার : কিন্তু কেন? এত রাতে?
নোরা : আজ রাতে আমি ঘুমাব না।
হেলমার : কিন্তু নোরা, লক্ষ্মী নোরা!
নোরা : [নিজের ঘড়ি দেখে] রাত এখনো তেমন হয়নি। টোরভাল্ড, এখানে একটু বস। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। [টেবিলের একপ্রান্তে বসে পড়ে।]
হেলমার : এসব কী হচ্ছে, নোরা! তোমাকে তো আমি বুঝতে পারছি না।
নোরা : তাই ঠিক। তুমি আমাকে বোঝ না। এবং আজ রাতের আগে তোমাকে আমিও কখনও বুঝিনি। না—আমাকে বাধা দিও না—আমার কথাগুলো শুধু শুনে যাও। বলতে পার এটা দেনাপাওনা—হিসেবনিকেশের ব্যপার।
হেলমার : কী বলছ তুমি?
নোরা : [একটু নীরব থেকে] তোমার কি মনে হচ্ছে না এভাবে আমাদের দু-জনের
বসার মধ্যেই অদ্ভুত একটা কিছু আছে?
হেলমার : না—কী?
নোরা : আজ আট বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। তোমার কি মনে হচ্ছে না আট বছরে এই প্রথম আমরা দু–জন, তুমি আর আমি—স্বামী–স্ত্রী—একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা নিয়ে বসেছি?
হেলমার : গুরুত্বপূর্ণ? মানে?
নোরা : এই আটটি বছরে—না, তার চেয়েও বেশি হবে—আমাদের প্রথম দেখার পর থেকে, কখনও আমরা কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করিনি।
হেলমার : তুমি যা পার না সে-ধরনের কাজে তোমাকে টেনে এনে অকারণ দুশ্চিন্তায় ফেলার কোনও কারণও তো ছিল না।
নোরা : আমি দুশ্চিন্তার কথা বলছি না। যা বলছি সেটা হল—আমরা কখনও কোনওদিন আন্তরিকভাবে যে-কোনও একটি সমস্যার গভীরে গিয়ে ভেবে দেখার চেষ্টা করিনি।
হেলমার : কিন্তু—নোরা, তাতে তোমার কি ভালো হত?
নোরা : সেটাই তো কথা—তুমি আমাকে কখনওই বোঝনি। আমাকে সাংঘাতিকভাবে ভুল বোঝা হয়েছে, টোরভাল্ড। প্রথম ভুল বুঝেছে আমার বাবা—তারপর তুমি।
হেলমার : কী বললে? তোমার বাবা এবং আমি? দুটি নাম করলে যারা তোমাকে পৃথিবীর সবার চাইতে বেশি ভালোবাসত।
নোরা : [মাথা ঝাঁকিয়ে] তুমি কখনও আমাকে ভালোবাসনি। ভালোবাস এটা ভাবতেই তোমার ভালো লাগত।
হেলমার : নোরা, এসব কী বলছ তুমি?
নোরা : সত্যি বলছি, টোরভাল্ড। বাবার সঙ্গে যখন ছিলাম তখন যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে সে তার ধ্যানধারণার কথা আমাকে শুনিয়েছে, বুঝিয়েছে। সুতরাং আমার বাবার ধারণাটাই আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিল। কখনও যদি আলাদা করে ভেবেছি—সেটা তাঁকে বলতে পারিনি, বরং লুকিয়েছি। কারণ জানতাম সেটা তিনি পছন্দ করবেন না। তিনি আমাকে তাঁর ছোট্ট পুতুল বলে ডাকতেন—আমি যেমন আমার পুতুলের সঙ্গে খেলা করতাম আমার বাবা তেমনই আমার সঙ্গে খেলা করতেন। তারপর আমি তোমার ঘরে বসবাস করতে এলাম-
হেলমার : বিয়ে দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে এভাবে কথা বলা যায় না।
নোরা : [নির্বিকার] মানে, আমি বলতে চাই, যখন আমি বাবার হাত থেকে তোমার হাতে পাচার হলাম, তুমি সবকিছু তোমার পছন্দমতো সাজালে—তোমার পছন্দই আমার পছন্দ হয়ে গেল—কখনও সখনও বলতে পার পছন্দ করার ভণিতা করেছি। আমি নিশ্চিত না যে কোন্টা করেছি— হয়তো কমবেশি দুটোই। কখনও এটা কখনও ওটা। কখনও হয়তো সত্যি পছন্দ করেছি— কখনও হয়তো ভণিতা করেছি। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আমি আসলে তোমার সংসারে একটা ভিক্ষুকের মতো সময় কাটিয়েছি—দিন আনি দিন খাই—ব্যস্। আমি কৌশল করে তোমার সংসারে জীবনযাপন করেছি টোরভাল্ড। তুমিও এভাবেই চেয়েছ। আমার বাবা এবং তুমি আমার প্রতি ভয়ানক অন্যায় করেছ। তোমরা পাপ করেছ। তোমাদের পাপেই তোমাদের দোষেই আমার জীবনে কিছু হল না।
হেলমার : এ কথার কোনও যুক্তি নেই নোরা, এটা অকৃতজ্ঞতা। তুমি এখানে সুখ পাওনি? তুমি এখানে সুখে ছিলে না?
নোরা : না। সেই জিনিসটাই আমি কখনও পাইনি। ভেবেছি সুখে আছি—কিন্তু আসলে কখনও থাকিনি।
হেলমার : সুখী ছিলে না? কখনও না?
নোরা : না—শুধু ফুর্তিতে ছিলাম। তুমি আমাকে সবসময় দয়া দেখিয়েছ। যাকে তুমি সংসার বলো সে কেবল খেলাঘরই ছিল। আমি এখানে ছিলাম তোমার পুতুল–বউ—যেমন বাবার বাড়িতে ছিলাম পুতুল-মেয়ে। আবার আমার সন্তানরা আমার পুতুল। তুমি যখন এসে আমার সঙ্গে খেলা করতে আমার ভালো লাগত, যেমন আমি আমার বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করলে ওদের লাগে। আমাদের বিয়ে, টোরভাল্ড, শুধু এই ছিল।
হেলমার : তুমি যদিও একটু বেশি বলছ এবং বাড়িয়ে বলছ তবু এ-কথার মধ্যে কিছুটা সত্য আছে। ঠিক আছে, এখন থেকে সবকিছু ভিন্নভাবে হবে। খেলার সময় শেষ—এখন শিক্ষার সময় শুরু।
নোরা : কার শিক্ষা? আমার, না বাচ্চাদের?
হেলমার : তোমার এবং তোমার বাচ্চাদের।
নোরা : উঁচু, টোরভাল্ড, তোমার সত্যিকারের বউ হওয়ার শিক্ষা আমাকে দেয়ার মতো যোগ্যতা তোমার নেই—
হেলমার : সেটা তুমি কীভাবে বলছ?
নোরা : সেই শিক্ষা, যে শিক্ষায় আমি তোমার বাচ্চা মানুষ করার যোগ্য হতে পারি।
হেলমার : নোরা!
নোরা : একটু আগে তুমি নিজে বলনি যে তোমার বাচ্চাদের ব্যাপারে তুমি আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছ না?
হেলমার : সে তো রাগের মাথায় কত কথাই বলা হয়, সেটা ধরে রাখলে কি চলে?
নোরা : তবে তুমি ঠিক বলেছ—এ সবের যোগ্য আমি নই। আর একটি কাজ আছে যেটা আমাকে সবার আগে শেষ করতে হবে—নিজেকে শিক্ষিত করা। এ ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করার যোগ্যতাও তোমার নেই—এটা আমাকে একা একাই করতে হবে। সেজন্যই আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি।
হেলমার : [পায়ের পাতার উপর ভর করে উঠে দাঁড়ায়] কী? কী বললে তুমি?
নোরা : এই গণ্ডির বাইরের পৃথিবীকে এবং আমার নিজেকে যদি জানতে হয় তাহলে আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সেজন্যই আমি এখানে তোমার সঙ্গে আর থাকছি না।
হেলমার : নোরা নোরা!
নোরা : আমি চলে যাচ্ছি। আমি নিশ্চিত একটা রাতের জন্য ক্রিস্টিনা আমাকে ফেলে দেবে না।
হেলমার : তুমি জানো না কী বলছ। তোমাকে আমি সেটা করতে দেব না—আমি নিষেধ করছি।
নোরা : এখন আমাকে আর নিষেধ করে কোনও লাভ নেই। আমার নিজের কিছু জিনিস আমি নিয়ে যাচ্ছি—তবে তোমার কোনওকিছুই আমি নেব না— এখন অথবা পরে—কখনওই না।
হেলমার : এটা পাগলামি হচ্ছে—
নোরা : কাল আমি বাড়ি চলে যাব—আমার পুরনো বাড়িতে— সেখানে করার মতো কিছু একটা জোটানো হয়তো আমার জন্য সহজ হবে।
হেলমার : হায়! অন্ধ অনভিজ্ঞ জীবন—
নোরা : টোরভাল্ড, আমি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চাই।
হেলমার : সেজন্য তোমার বাড়ি ছাড়তে হবে—স্বামী-সন্তান ছাড়তে হবে—মানুষ কী বলবে তুমি সেটাও ভেবে দেখবে না?
নোরা : সেটা ভাবা আমার কাজ নয়। এটা আমার প্রয়োজন—এটুকুই আমি জানি।
হেলমার : কিন্তু এটা অপমানকর, লজ্জাজনক! তুমি কি এভাবেই তোমার পবিত্র দায়িত্বকে অবজ্ঞা করবে—প্রত্যাখ্যান করবে?
নোরা : কোনটাকে আমার পবিত্র দায়িত্ব বলছ?
হেলমার : সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে? তোমার স্বামী-সন্তানের প্রতি কি তোমার কোনও কর্তব্য নেই?
নোরা : এরকম পবিত্র দায়িত্ব আমার আরও একটি আছে।
হেলমার : কোন্ দায়িত্বের কথা বলছ?
নোরা : আমার নিজের প্রতি আমার দায়িত্ব।
হেলমার : সবকিছুর আগে তুমি স্ত্রী এবং মা।
নোরা : সেটা আমি এখন আর বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি সবকিছুর আগে আমি একজন মানুষ—যতটুকু তুমি, ততটুকু আমি। অথবা যে করেই হোক ততটুকু হবার চেষ্টা করব। আমি খুব ভালো করেই জানি টোরভাল্ড বেশিরভাগ লোক তোমাকেই সমর্থন করবে, তুমি বই ঘেঁটেও এর প্রমাণ দেখাতে পারবে—কিন্তু আমি বেশিরভাগ মানুষ কী বলবে অথবা বইয়ে কী লেখা আছে তাতে আর সন্তুষ্ট নই। আমি আমার মতো করে একটা কিছু খুঁজে বের করব এবং সেটাকেই বোঝার চেষ্টা করব।
হেলমার : সবার আগে তোমার নিজের সংসারে তোমার অবস্থান বোঝা উচিত নয় কি? এ ব্যাপারে সেই অভ্রান্ত পথপ্রদর্শক কী বলে?—তোমার ধর্ম?
নোরা : ওহ্—টোরভাল্ড, ধর্ম কী সেটাই আমি সত্যি জানি না।
হেলমার : বলছ কী তুমি এসব!
নোরা : আমার বিয়ের সময় প্যাস্টর হ্যানসেন যা শিখিয়েছিলেন আমি শুধু সেটুকুই জানি। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন ধর্ম হচ্ছে এটা, ওটা এবং অন্যকিছু। যখন এসব ছেড়েছুড়ে গিয়ে আমার নিজের মতো থাকব, তখন সেটাও আমি দেখতে চাই। আমি দেখব প্যাস্টর হ্যানসেন যা-কিছু বলেছেন সেটা ঠিক কি না—অন্তত আমার জন্য ঠিক কি না।
হেলমার : তোমার মতো অল্পবয়সী মেয়েদের মুখে এরকম কথা কখনও শোনা যায় না। ধর্ম যদি তোমাকে পথ দেখাতে না পারে তাহলে তোমার বিবেকের কাছে আমি বলছি—তোমার কিছুটা নীতিবোধ তো আছে? আমি কি ভুল বলছি? কী জানি হয়তো সে বোধও তোমার নেই।
নোরা : টোরভাল্ড, এটা বলা শক্ত। আমি সত্যি জানি না—এই ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত জটিল। যেটা আমি জানি, তা হল অনেক ব্যাপারে তোমার এবং আমার ধারণা এক নয় এবং এখন বুঝি, আমি যা ভেবেছি আইন তার চেয়ে অনেক আলাদা। তাছাড়া আইনই যে সঠিক সেটাও তো আমাকে আমি বোঝাতে পারি না। মেয়েদের বৃদ্ধ বাবার মৃত্যুশয্যা ছেড়ে যাওয়ার অধিকার নেই অথবা স্বামীর জীবন রক্ষা করার অধিকার নেই—এসব ব্যাপার আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি না। সুতরাং এসব জিনিসে আমি বিশ্বাসও করতে পারি না।
হেলমার : অবোধ শিশুর মতো কথা বলছ? যে-জগতে বাস কর সে জগৎই তুমি চেনো না।
নোরা : সত্যি। আমি চিনি না। আমি এখন সেটাই চেনার চেষ্টা করব। পৃথিবী সঠিক না আমি সঠিক সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
হেলমার : তুমি অসুস্থ নোরা—তুমি জ্বরাক্রান্ত। আমার বিশ্বাস তোমার মতিভ্রম হয়েছে। তুমি কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছ না।
নোরা : আজ রাতের চেয়ে পরিষ্কার এবং নিশ্চিতভাবে আমি আর কোনওদিন দেখিনি।
হেলমার : এতটাই পরিষ্কার এবং নিশ্চিত যে স্বামী-সংসার-ছেলেমেয়ে ত্যাগ করতেও বাধছে না?
নোরা : হ্যাঁ।
হেলমার : এসবের তাহলে একটাই সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আছে…।
নোরা : কী?
হেলমার : আমাকে তুমি আর ভালোবাস না।
নোরা : না, বাসি না।
হেলমার : নোরা, কী করে বললে এ-কথা?
নোরা : কথাটা বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে টোরভাল্ড—কারণ তুমি সবসময় আমাকে দয়া দেখিয়েছ—কিন্তু না বলে আমার কোনও উপায় নেই— তোমাকে আমি আর ভালোবাসি না এটাই সত্য।
হেলমার : [কষ্ট করে নিজেকে সংযত করে] এ ব্যাপারেও কি তুমি পরিষ্কার এবং নিশ্চিত?
নোরা : হ্যাঁ, চূড়ান্তভাবে পরিষ্কার এবং নিশ্চিত। এবং সেজন্যই আমি আর এখানে থাকব না।
হেলমার : আচ্ছা, তুমি কি ব্যাখ্যা করতে পারবে কীভাবে তোমার ভালোবাসার অধিকার আমি হারালাম?
নোরা : হ্যাঁ—অবশ্যই পারব। এটা আজ সন্ধ্যায়। অলৌকিক ব্যাপারটা ঘটার আগের মুহূর্তগুলোতে। তখনই কেবল আমি বুঝেছি এতকাল আমি তোমাকে যে-মানুষ ভেবে এসেছি তুমি আসলে তা নও
হেলমার : বুঝলাম না। আর একটু খুলে বল।
নোরা : গত আট বছর ধরে আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছি, ঈশ্বর জানেন, এটা আমি বুঝেছিলাম যে অলৌকিক প্রতিদিন ঘটে না। সুতরাং অপেক্ষা করেছি। তারপর এল এই আকস্মিক সর্বনাশ—তখন আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলাম যে সেই প্রতীক্ষিত অলৌকিক এবার আসবে। ক্রোগস্ট্যাডের চিঠিটা যখন ওখানে পড়ে ছিল, আমি একমুহূর্তের জন্যও ভাবিনি যে তুমি তার শর্তের কাছে হার মানবে। আমি একশো ভাগ নিশ্চিত ছিলাম যে তুমি বলবে—’যাও, ছাপাও—ছাপিয়ে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দাও।’ এবং সেটা যখন হয়ে যাবে—
হেলমার : হ্যাঁ—তারপর কী? আমার নিজের স্ত্রীকে লজ্জার মুখে, অপমানের মাঝে কখন ছাড়লাম?
নোরা : সেটা হয়ে যাবার পর, আমি ভেবেছিলাম, আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত ছিলাম যে তুমি এগিয়ে এসে সব দোষ তোমার কাঁধে তুলে নেবে—বলবে, ‘আমিই অপরাধী।’
হেলমার : নোরা!
নোরা : তোমার মনে হয় তোমার কাছ থেকে এরকম কোনও ত্যাগ আমি গ্রহণ করতাম না? না, অবশ্যই করতাম না। তবে তোমার কথার চেয়ে আমার কথার মূল্য কেউ বেশি দিত না। এই অলৌকিকের আশাই আমি করেছিলাম—এবং ভীষণ ভয়ও হচ্ছিল। আমি মনে মনে আত্মহত্যার জন্য তৈরি হয়েছিলাম এবং আত্মহত্যাকে ঠেকাবার জন্যই আমি এই অলৌকিকের আশা করেছিলাম।
হেলমার : নোরা, দিনরাত তোমার জন্য যদি কাজ করতে হত আমি হাসিমুখে সেটা করতাম। তোমার জন্য আমি দারিদ্র্যের অভিশাপ এবং দুঃখও সইতে পারতাম, কিন্তু কোনও পুরুষই নিজের আত্মসম্মান ত্যাগ করে না, ভালোবাসার মানুষের জন্যও না।
নোরা : কিন্তু হাজার হাজার মেয়ে তো তা করেছে এবং করছে।
হেলমার : তুমি একটা নির্বোধ শিশুর মতো ভাবছ এবং কথা বলছ।
নোরা : সম্ভবত… কিন্তু যেই মানুষের কাছে আমি বাঁধা থাকব তুমি তো তার মতো চিন্তাও করছ না, কথাও বলছ না। তোমার প্রথম উদ্বেগ যখন কেটে গেল—উদ্বেগ অবশ্য আমার জন্য নয়—–তোমার নিজের জন্য— তোমার কী হতে পারত সেটাই তোমার উদ্বেগ আর আমার দুশ্চিন্তা তোমার কাছে কিছু নয়। যাই হোক সেই উদ্বেগ যখন কেটে গেল তখন তোমার মনে হল যেন কোথাও কিছু হয়নি—তোমার নিজের ব্যাপারে কোনও ভয় নেই বলেই তোমার কোনও উদ্বেগও নেই। আমার ব্যাপারে একটু ভাবলেও না। আমি তো তোমার ছোট্ট গানের পাখি—খেলার পুতুল—সুতরাং হয়তো ভেবেছ তুলতুলে ভঙুর জিনিসের মতো সাবধানে নাড়াচাড়া করলেই চলবে। [উঠতে উঠতে] ঠিক সেই সময় টোরভাল্ড, সেই সময় আমার মনে হল, আমি অনুভব করলাম যে গত আটবছর আমি একটি অচেনা মানুষের সঙ্গে এখানে ঘর করেছি এবং তার তিনটি সন্তান গর্ভে ধারণ করেছি। ওহ্—এটা আমি চিন্তাও করতে পারি না—নিজেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে ইচ্ছে করছে।
হেলমার : হ্যাঁ। বুঝেছি—বুঝেছি! তোমার-আমার মধ্যে এখন এক-সমুদ্রের ব্যবধান…ওহ্—কিন্তু নোরা—এই ব্যবধান কি কোনওভাবে ঘোচানো যায় না?
নোরা : আমার এখনকার অবস্থায় আমি আর তোমার যোগ্য স্ত্রী নই।
হেলমার : আমি পরিবর্তন করব-
নোরা : তোমার পুতুল হারিয়ে গেলে হয়তো তা সম্ভব হতে পারে।
হেলমার : কিন্তু নোরা—তোমাকে হারানো—তোমাকে হারানো—নোরা! না, না,
এটা আমি ভাবতেও পারি না…।
নোরা : [ডানদিক দিয়ে বাইরে যায়।] সেজন্যই এটা ঘটবে। [সে বাইরে যাবার কাপড়চোপড় এবং একটি ব্যাগ নিয়ে পুনঃপ্রবেশ করে। ব্যাগটি টেবিলের ধারে একটি চেয়ারের উপর রাখে।]
হেলমার : নোরা! এখন না—নোরা! কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
নোরা : [কোট পরতে পরতে] অচেনা মানুষের ঘরে রাত কাটানো যায় না।
হেলমার : ভাইবোনের মতোও তো থাকা যায়।
নোরা : [হ্যাটটা পরতে পরতে] তুমি খুব ভালো করেই জানো সেটা টিকবে না। [চাদরটা শরীরে জড়ায়] তাহলে চলি, টোরভাল্ড। ছেলেমেয়েদের দেখব না। আমার চেয়ে ভালো হাতেই তারা পড়েছে, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। আমার এখনকার অবস্থায় আমি তাদের কোনও কাজেই লাগব না।
হেলমার : কিন্তু কখনও কোনওদিন, নোরা, কোনওদিন?
নোরা : কী করে বলব? আমার কী হবে তা তো জানি না।
হেলমার : কিন্তু তুমি আমার স্ত্রী—এখন তোমার যদি কিছু হয় তবে—
নোরা : টোরভাল্ড, শোনো, আমি শুনেছি যদি কোনও স্ত্রী তার স্বামীর ঘর ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে যায়—যেমনটা আমি এখন করছি, তাহলে স্বামীটি আইনগতভাবে স্ত্রীর প্রতি সব দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। যাহোক, আমিও তোমাকে মুক্ত করে গেলাম। তুমি এখন আর কোনওকিছুতে বাধ্য নও। আমিও না। আমরা উভয়েই মুক্ত। নাও, এই যে তোমার আংটি, ফেরত দিলাম—আমারটা আমাকে দাও।
হেলমার : এটাও?
নোরা : হ্যাঁ। এটাও।
হেলমার : এই নাও।
নোরা : ব্যাস, তাহলে সব শেষ হয়ে গেল। এই এখানে তোমার চাবিগুলো থাকল। কাজের লোকেরা ঘরের কোথায় কী আছে, কীভাবে সংসার চালাতে হবে সেটা আমার চেয়েও ভালো জানে। কাল ক্রিস্টিনা এসে আমার জিনিসপত্রগুলো, যা আমি বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম, বেঁধেছেদে নিয়ে যাবে। আমি যাওয়ার পর সেগুলো পাঠিয়ে দিও।
হেলমার : শেষ হয়ে গেল? সব শেষ? নোরা, আর কখনও তুমি আমার কথা ভাববে না—চিন্তা করবে না?
নোরা : ভাবব। তোমার কথা, ছেলেমেয়েদের কথা এই বাড়ির কথা- প্রায়ই ভাবব।
হেলমার : আমি কি তোমাকে চিঠি লিখতে পারব?
নোরা : না—সেটা তুমি কখনওই করবে না।
হেলমার : কিন্তু আমি তো তোমাকে এটা-ওটা পাঠাতে….
নোরা : কিছু না—কিছুই না
হেলমার : যদি কখনও কিছু প্রয়োজন হয়
নোরা : না, আমি তোমাকে বলছি—অচেনা কারও কাছ থেকে আমি কিছু নেব না।
হেলমার : নোরা, এর চেয়ে বেশি কিছু কি আর হতে পারি না? শুধুই অচেনা? এর বেশি কিছু নয়?
নোরা : [ব্যাগ ওঠাতে ওঠাতে] ওহ্ টোরভাল্ড, তাহলে তো অলৌকিকের চেয়েও অলৌকিক কিছু একটা ঘটত
হেলমার : কী সেটা? অলৌকিকের অলৌকিক?
নোরা : আমাদের দু-জনেরই এতটা পরিবর্তিত হতে হবে যে—ওহ্—টোরভাল্ড, আমি এখন আর কোনও অলৌকিকে বিশ্বাস করি না।
হেলমার : কিন্তু আমি বিশ্বাস করব। বল, এতটা পরিবর্তন যে—?
নোরা : যে আমাদের জীবন একত্রে সত্যিকার বিয়ের মতো হত—চলি–বিদায়। [সে হলঘর দিয়ে বেরিয়ে যায়।]
হেলমার : [দরজার পাশে একটা চেয়ারে ধীরে ধীরে বসে পড়ে। দুই হাতে মুখ ঢাকে।] নোরা! নোরা!
[সে উঠে চারদিকে দেখে। ]
শূন্য! এখানে সে আর নেই।
[আশার একটু আভাস যেন পায়]
‘অলৌকিকের অলৌকিক ….?’
[নিচ থেকে সজোরে দরজা বন্ধ করার শব্দ পাওয়া যায়।]