নিশ্চিত জিনিস

নিশ্চিত জিনিস

আমার গল্পের খুব শীঘ্রই সমাপ্তি ঘটছে। এভাবে নিজের জীবনলিপি লেখার মতো সময়ও আজকাল অনেক কমে এসেছে। মনে হয় না শেষ পর্যন্ত এইভাবে লিখে যেতে পারব আমি।

এজন্য বেশ হতাশ আমি। তবে কী আর করার আছে? এখন থেকে সংক্ষেপে লিখব আমি।

সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মৃত্যুর আগে মিয়াগির ঋণের পুরোটা শোধ করে যাব আমি। কিন্তু বোকার মতো কোনোকিছু না জেনেশুনে কাজ করার অভ্যাসটা আমার এখনও দূর হয়নি। তবে গল্পের যেটুকু অংশ বাকি রয়েছে, সেসবের ভুল বের করার সময় এখন আর নেই। প্রথমত, কাজটা প্রায় অসম্ভবের কাতারে পড়ে। স্কুলে থাকতে হিমেনো ঐ শিক্ষিকার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে জাপানিজ চাকরিজীবীর সারাজীবনের আয় এর যে সংখ্যাটা বলেছিল, মিয়াগির ঋণ তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি। মাত্র দু’মাসের মধ্যে একজন সামান্য কলেজপড়ুয়া ছেলের পক্ষে ওরকম টাকা আয় করা সম্ভব নয়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি চেষ্টা করা ছাড়লাম না। এখন যেটুকু সময় আছে, তাতে প্রচণ্ড পরিশ্রম কিংবা ধীরে ধীরে টাকা জমানোর সুযোগটা হাতে নেই আমার। দুমাস প্রচণ্ড পরিশ্রম করলে হয়তো মিয়াগির দেয়া তিনশো হাজার ইয়েনটা ফেরত দিতে পারব আমি, কিন্তু সেটুকুই। এর বেশি টাকা কামানো সম্ভব না। তবে ঐ টাকার জন্য গাধার মতো খাটুনিটাকে বোধহয় মিয়াগি ভালো চোখে দেখবে না। চুরি, ডাকাতি, ভণ্ডামি কিংবা ছেলেধরার কাজও হয়তো সে আমাকে করতে দেখতে চায় না। ওর পছন্দ নয়, এমন কোনো কাজ করে ওরই কাজে লাগানোর মতো টাকা উপার্জন করা চলবে না।

জুয়া খেলার কথা মাথায় আসল। তবে ঐ জগতে ঢোকার মতো এত বোকা নই আমি। নিজের খারাপ অবস্থায় জুয়া খেলা মানেই তুমি নিশ্চিত হারবে। যাদের অঢেল টাকা আছে, তারাই কেবল জুয়া খেলায় জেতে।

ভাগ্যদেবীকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে সে পালিয়ে যায়। তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। ধীরে ধীরে তাকে তোমার কাছে আসতে দেবার সুযোগ করে দিতে হবে। আর একদম সঠিক সময়ে তাকে খপ করে ধরে ফেলতে হবে। কিন্তু আমার কাছে তো সেরকম সময় নেই। তাছাড়া আমার বুদ্ধিশুদ্ধি এতটাই কম যে, ঐ নিখুঁত সময় বের করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

মনে হচ্ছিল যেন একটা মেঘকে হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করছি। যদি সত্যিই দু’মাসের মধ্যে একজীবনের আয় করা অর্থের সমপরিমাণ অর্থ কামানো যেত, তবে সবাই ঐ কাজটা বেছে নিত। এমন একটা জিনিস আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম, যেটা কিনা আমার আগে অনেকেই করতে গিয়ে সেটাকে অসম্ভব বলে প্রমাণ করে ফেলেছে। আমার একমাত্র সুবিধা হলো—আমি জানি আমি কবে মারা যাব। আর তাই যেকোনো ঝুঁকি আমার পক্ষে নেয়া সম্ভব। কিন্তু টাকা উপার্জন করতে গিয়ে নিজের জীবন বাজি রাখা-এই পথেও আমি একলা নই। স্বাভাবিকভাবেই এ দলের বেশিরভাগ মানুষ ব্যর্থ হয়ে থাকে।

তা সত্ত্বেও ভেবেই চললাম। অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা, আমি জানি। যদি কারো পক্ষে এ কাজ সম্ভব না হয়ে থাকে, তবে আমাকেই প্রথম সফল হয়ে দেখাতে হবে। নিজেকে বারবার বললাম, “ভাবো, ভাবো, ভাবো! এই দুমাসে কীভাবে মিয়াগির সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করা যায়? সে যাতে প্রতিরাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেতে পারে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আমার কী করা উচিত? আমি চলে যাওয়ার পর তার যাতে নিঃসঙ্গ বোধ না হয়, সে ব্যাপারে আমার কী করা দরকার?”

ভাবতে ভাবতে আমি শহরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। বিশ বছরের অভিজ্ঞতা আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, সহজে উত্তর দেয়া যায় না এমন প্রশ্নের উত্তর বের করতে হলে হাঁটাহাঁটি করেই সেটা বের করা সম্ভব।

এরপরের দিনও হাঁটলাম।

তার পরের দিনও।

আশা করছিলাম, এভাবে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো কোথাও না কোথাও সঠিক সমাধানটার দেখা মিলবেই।

এই ভাবনাচিন্তার সময়টুকুতে আমি খাবার মুখে দিলাম না বললেই চলে। বিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত আরেকটা শিক্ষা হচ্ছে, ক্ষুধা আমার মস্তিষ্কটাকে আরেকটু শানিয়ে নেয়। এ সুফল পাওয়ার জন্যই খাওয়া-দাওয়ায় এরকম অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলাম আমি।

ঐ প্রতিষ্ঠানের কথা মনে পড়তে বেশিদিন লাগল না। ঐ ভাঙাচোরা বিল্ডিং এ যেয়ে আরও দুবার ‘বিক্রির’ সুযোগ রয়েছে আমার হাতে-যে বিল্ডিং আমাকে এই হতাশাময় জীবনের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিল।

একদিন আমি মিয়াগি’কে একটা প্রশ্ন করলাম। “তোমার কারণে আমি আগের তুলনায় অনেক বেশি সুখী মানুষে পরিণত হয়েছি। এখন যদি আমি তোমাদের প্রতিষ্ঠানে যাই, তবে এখন আমার জীবনের মূল্য কত হতে পারে বলে তোমার ধারণা?”

“তুমি যা ধরেছিলে, ঠিক তাইমানুষের জীবনের মূল্য নানান সময় ওঠানামা করে, তবে তা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত,” মিয়াগি ব্যাখ্যা করতে লাগল। “দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আত্মকেন্দ্রিক সুখ কিন্তু ‘জীবনের মূল্যে’ তেমন একটা প্রভাব ফেলে না। যেগুলো প্রভাব ফেলে তা হলো মাপা, হিসাব করা যায় এমন সুখ। অবশ্য আমি এটাকে ভালো চোখে দেখি না।”

“তাহলে জীবনের মূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে এমন কী কাজ আছে?”

“সমাজে অবদান রাখা, খ্যাতি যেসব জিনিস খুব সহজেই হিসাব করা যায়, সেসবই জীবনের মূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে।”

“খুব সহজে হিসাব করা যায় এমন কাজ-আচ্ছা।”

“ইয়ে, কুসুনোকি—”

“কী হয়েছে?”

“দয়া করে কোনোধরনের উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় এনো না,” আমার কথাবার্তায় সে খানিকটা চিন্তিতবোধ করছে।

“আমি কোনো উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথাতেই আনছি না। একদম আমি যেভাবে সাধারণত চিন্তাভাবনা করি, সেভাবেই করছি।”

“তুমি কী ভাবছ, তা আন্দাজ করতে পারছি আমি,” সে বলল। “তুমি আমার ঋণ শোধ করার উপায় খুঁজছ, তাই না? যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আমি শুধু এ চিন্তা মাথায় আনার জন্যই অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। সত্যি বলছি। কিন্তু তাই বলে তুমি তোমার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো এসব কাজ করে ব্যয় কর, এ আমি চাই না। যদি তুমি ভেবে থাক এ কাজ করলে আমাকে সুখী করতে পারবে, তবে তুমি ভুল পথে এগোচ্ছ।”

“তাহলে প্রশ্নটা করেই ফেলি, কী করলে তুমি সুখী হবে?”

“আমার সাথে কথা বলো,” গাল ফুলিয়ে অভিমানের স্বরে বলল মিয়াগি। “কদিন ধরে তুমি আমার সাথে কথাবার্তা বলছই না।”

মিয়াগি একদম ঠিক ধরেছে। আমি আসলেই উল্টোপাল্টা চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম।

কিন্তু মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয়ার মতো মানুষ আমি নই। বড্ড বেশি বেয়াড়া আমি।

জীবনের মূল্য বৃদ্ধি করতে হলে সমাজে অবদান রাখতে হবে কিংবা খ্যাতি লাভ করতে হবে। এটাই আসল সত্য। আরও সঠিকভাবে বললে, তোমাকে খুব ভালো আর প্রশংসিত একজন মানুষে পরিণত হতে হবে, যার নাম সকলেই জানে।

প্রচুর টাকা কামানোর সহজ পথ, নাকি প্রচুর দামে বিক্রি করা যাবে এমন একটা মানুষে পরিণত হওয়া-কোনটা সবচেয়ে বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্য? আমার জানা নেই। দুটাই আমার কাছে সমানভাবে অসম্ভব। যদি আমার আর কোনো উপায় না থাকে, তবে ঐ পথগুলো পরীক্ষা করে দেখব।

একলা একলা যতটুকু ভাবা সম্ভব, তা করে ফেলেছি। এখন অন্যের কল্পনার সাহায্য নেবার সময় হয়ে এসেছে।

সবার আগে পুরোনো বইয়ের দোকানটায় গেলাম। মন অস্থির হলেই ওখানে যাওয়ার অভ্যাস আমার। শেলফে রাখা বইগুলোয় চোখ বুলিয়ে আর আমার সমস্যার সাথে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক-এমন সব বই হাতে নিয়ে অনেকসময় আমার সমস্যার সমাধান পেয়েছি অনেকবার। এখন যে সমস্যার সম্মুখীন আমি, তা এত সহজে সমাধান হবে না, তবে আজকে আমি বইয়ের সাহায্য নেব না।

আজকে বরং বইয়ের দোকানদার সেই বুড়োর সাহায্য নেব আমি।

বুড়ো তখন দোকানের পেছনে একটা রেডিওতে বেসবল খেলার খবর শুনতে ব্যস্ত ছিল। আশপাশে সারি করে রাখা বইগুলোর আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। চোখ উপরে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন বিড়বিড় করলেন।

সিদ্ধান্ত নিলাম, বুড়োকে আমার আয়ু বিক্রি করার কথা বলব না। আমি জানতে চাই, বুড়ো ঐ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আসলে কতটুকু জানে। গতমাসে আমার সাথে কী হয়েছে তা উনাকে জানাতে চাই আমি। কিন্তু সেটা বলতে গেলে এটা ফাঁস হয়ে যাবে যে, আমার হাতে বাঁচার মতো আর মাত্র দু’মাস আছে। আর তখন তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করতে শুরু করবেন। ঠিক এ কারণেই তাকে জানাতে চাই না আমি।

তাই আয়ু বিক্রির প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলাম। এই প্রথমবারের মতো মিয়াগি যে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা তাকে বুঝতে দিলাম না। নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম : বেসবল, আবহাওয়া, গল্পের বই, উৎসব। ওগুলো নিয়ে বেশিক্ষণ কথা আগাল না, তবে বলতে গিয়ে বেশ শান্তি শান্তি লাগছিল। বোধহয় এই দোকানটা আর দোকানের মালিককে আমি পছন্দ করি, সেজন্যই এত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম।

মিয়াগি যখন বইয়ের শেলফে ঢুঁ মারতে চলে গেল, আমি আস্তে আস্তে বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার জীবনের মূল্য বাড়ানোর জন্য আমার কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?”

এতক্ষণ কথাবার্তা বলার পর অবশেষে রেডিও বন্ধ করলেন তিনি। বললেন, “ভালো প্রশ্ন করেছ। আমার ধারণা, নিজেকে ধীরস্থির রাখলেই চলবে। আমি তা করতে পারিনি। এখন বুড়ো হয়ে গিয়েছি আমি, আর এতদিন লেগে গিয়েছে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে। যেটুকু পথ তোমার পক্ষে পাড়ি দেয়া সম্ভব, সেটুকুই পাড়ি দাও। ধীরে ধীরে সঞ্চয় কর। আর সেভাবেই এগিয়ে যেতে থাক।”

“হুম,” বিড়বিড় করলাম আমি।

“তবে,” সে এতক্ষণ ধরে বলা উপদেশগুলো সব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল যেন। “আরও গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার আছে কিন্তু। আর সেটা হলো আমার মতো মানুষদের উপদেশ না নেয়া। যে মানুষগুলো নিজে সফল না হয়ে সাফল্যগাঁথা শোনায়, তারা আসলে পরাজিত মানুষ। ওরা সেটা স্বীকার করতে চায় না। সেজন্যই তারা জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারে না। কেন তারা ব্যর্থ, সেটাও তারা বের করতে পারে না। ঐসব মানুষগুলোর কথা শুনে কিছু একটা শিখতে পেরেছ-এমন ভান করার কোনো প্রয়োজন নেই…ব্যর্থদের মধ্যে অনেক মানুষকে তুমি পাবে যারা আস্ফালন করবে ‘আরেকটা সুযোগ পেলে, আরেকটা জীবন পেলে দেখিয়ে দিতাম’! কিন্তু ঐ মানুষগুলো—যাদের ভেতর আমিও রয়েছি-তারা সবাই একই ভুল করছি। হ্যাঁ, একজন ব্যর্থ মানুষের হারার ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু হারার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা থাকা আর সাফল্যের অভিজ্ঞতা-দুটা সম্পূৰ্ণ আলাদা জিনিস। কষ্টেসষ্টে নিচ থেকে নিজেকে ওপরে তোলা মানেই কিন্তু সাফল্য নয়। তুমি যেখানে শুরুতে ছিলে, সেখানেই ফিরে এলে মাত্র। এটাই বেশিরভাগ মানুষ বুঝে না, বুঝতে চায় না।”

মিয়াগিও এরকম একটা কথা বলেছিল আমাকে। তার মুখে কথাটা হাস্যকর লেগেছিল। তারা কেবল প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। এর মানে এতদিন জুয়াতে হেরে হেরে অবশেষে তাদের মনে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। জীবনে এটাই একমাত্র সুযোগ-এই চিন্তা থেকে কখনোই ভালো কিছু আসে না।

সবার শেষে বুড়ো বলল, “তাহলে তুমি আবার তোমার আয়ু বিক্রি করার কথা ভাবছ?”

“কী বলতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না,” তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম।

.

প্রথম দিনের মতোই আজকে বইয়ের দোকান থেকে সিডির দোকানে গেলাম। ওখানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা চুল ব্লিচ করে সোনালি বানানো ছোকরা আমাকে দেখে হাসিমুখেই অভিবাদন জানাল। এখানেও আমি মিয়াগি আশপাশে থাকা অবস্থায় আয়ু বিক্রি নিয়ে কোনো কথা তুললাম না। বরং নতুন কী কী এলবাম সে শুনেছে, সেটা নিয়ে আড্ডা জুড়ে দিলাম আমি।

একটু পর মিয়াগি আমার চোখের আড়াল হতেই ছেলেটাকে প্রশ্ন করলাম, “ধরো, অল্প সময়ের মধ্যে তুমি কিছু পেতে চাও। তাহলে তুমি কী করবে?”

তার জবাব ছিল সংক্ষিপ্ত। “তাহলে তো আমার অনেকজনের সাহায্য লাগবে, ঠিক না? কারণ, একলা একলা তো খুব বেশি কিছু করা যায় না। তাই অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। একজনের ক্ষমতার ওপর আমি খুব একটা বিশ্বাস রাখি না। যদি ক্ষমতার আশিভাগ দেবার পরেও কোনো সমস্যার সমাধান করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়, তখন আমি সাথে সাথে অন্যের সাহায্য নিই।”

বেশ প্যাঁচালো উপদেশ। আমার কাজে লাগবে কিনা জানা নেই আমার।

বাইরে তাকিয়ে দেখি, গ্রীষ্মের ঝড় বাইরে আচমকা উদয় হয়েছে। বের হয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ছোকড়া আমাকে থামাল। হাতে একটা প্লাস্টিকের ছাতা ধরিয়ে দিয়ে সে বলল,

“আপনি কী করতে চাইছেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, তবে কিছু একটা অর্জন করতে চাইলে সবার আগে আপনার স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত।”

ধন্যবাদ জানালাম তাকে, তারপর প্লাস্টিকের ছাতাটা খুলে আমি মিয়াগির সাথে বাড়ির পথ ধরলাম। ছোট্ট একটা ছাতা ছিল, তাই আমাদের দুজনের কাঁধই ভিজে একসা হয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টিতে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষেরা আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। স্বাভাবিক। একপাশে জায়গা রেখে আমি ছাতাটা ধরে রেখেছিলাম, সেই সাথে আপনমনে নিজের সাথে কথা বলছিলাম-এ দেখে আমাকে পাগলাটে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

“আমার এ জিনিসটা খুব ভালো লাগে,” মিয়াগি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল।

“কোন জিনিসটা?” জিজ্ঞেস করলাম।

“এই যে, অন্যের কাছে কোনো জিনিসটা পাগলামি মনে হচ্ছে, অথচ কাজটার পেছনে একটা কারণ রয়েছে-যেমন এই যে, ছাতাটা তুমি নিজের কাঁধ ভিজিয়ে হলেও আমার জন্য ধরে রেখেছ-এই জিনিসটা।”

“ওহ।” আমার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

“নির্লজ্জ, লাজুক একটা ছেলে তুমি,” আমার কাঁধে খোঁচা মারল সে।

এ পর্যায়ে এসে আমাকে নিয়ে কে কী ভাবল, সে নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা হয় না আজকাল। বরং কেউ আমাকে ছিটগ্রস্ত মানুষ বলে ধরে নিলেই ভালো লাগে আমার। মিয়াগি তাতে আনন্দ পাবে, মুখে হাসি ফুটবে তার। আর আমি যতই পাগলাটে আচরণ করি, ততই আনন্দ বাড়ে তার।

ঝড়ের প্রকোপ বাড়তেই আমরা কয়েকটা দোকানের সামনে আশ্রয় নিলাম। দূর থেকে বজ্রপাতের গুড়গুড় শব্দ কানে এল। বৃষ্টির পানি জমে গিয়ে রাস্তায় ছোটখাটো একটা বন্যার সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে আমার জুতোর ভেতরটা পর্যন্ত ভিজে গিয়েছে।

অকস্মাৎ একটা পরিচিত মুখ চোখে পড়ল। মানুষটা একটা কালচে-নীল রঙের ছাতা মাথায় ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। আমাকে দেখামাত্র সে থেমে গেল।

কলেজের এক সহপাঠী। তার সাথে আমার “হাই-হ্যালো”র সম্পর্ক। “অনেকদিন পর দেখা হলো,” সে শীতলদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল। “কেমন কাটছে দিনকাল? অনেকদিন ধরেই ক্লাসে দেখছি না।”

আমি মিয়াগির কাঁধে হাত রেখে বললাম, “আমি এই মেয়েটার সাথে ঘুরছি। ওর নাম মিয়াগি।”

বিতৃষ্ণায় তার ভ্রু কুঁচকে গেল। “ঠাট্টা কর না ভাই। এরকম পাগলামি বন্ধ কর।”

“ওরকম প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য আমি তোমাকে খুব একটা দোষ দিতে পারি না,” আমি বললাম। “আমি যদি তোমার স্থানে থাকতাম, হয়তো আমিও সেরকমই প্রতিক্রিয়া দেখাতাম। কিন্তু সত্যিটাই বলছি, আমার পাশেই মিয়াগি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার কথাটা বিশ্বাস না করাকেও আমি সম্মান দেখাব, তাই আশা করি তুমিও আমার চিন্তাধারাকেও সম্মান দেখাবে।”

“শোনো কুসুনোকি। আমি সারাজীবনই তোমাকে পাগল ভেবে এসেছি। কারো সাথে তুমি ঘোরাঘুরি কর না; নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখো। একবারের জন্য হলেও কি একটু বাইরের জগতটার দিকে তাকাতে পার না ভাই?” ক্ষোভে ফেটে পড়ল সে। তারপর হনহন করে হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করল।

আমি একটা বেঞ্চে বসে বৃষ্টির অনবরত পতন দেখতে থাকলাম। বৃষ্টির জোর ছিল না তেমন, তাই অল্পক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি পড়া বন্ধ হতেই মেঘের আড়াল থেকে সূর্যি মামা উঁকি দিল। রাস্তার পানিতে প্রতিফলিত হয়ে সে রশ্মি আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল, তাই আমরা চোখ কুঁচকাতে বাধ্য হলাম।

“ইয়ে, তোমাকে-ধন্যবাদ,” বলে মিয়াগি আমার কাঁধে তার মাথা এলিয়ে দিল।

আমি তার মাথায় হাত রেখে তার মোলায়েম চুলগুলোয় হাত বোলাতে থাকলাম।

তোমাকে ধীরস্থির থাকতে হবে, বইয়ের দোকানের বুড়ো আমাকে উপদেশ দিয়েছিল। বাক্যটা পুনরাবৃত্তি করে নিজেকে শোনালাম। সে আরও বলেছিল, তার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কথাগুলোর পেছনের অর্থটা খুঁজে পেয়েছিলাম।

মিয়াগির ঋণ পরিশোধ করা নিয়ে বোধহয় বেশিই চিন্তা করা শুরু করেছিলাম আমি। অথচ এই মুহূর্তেই আমি মিয়াগিকে সুখী করার জন্য কিছু করতে পারি। সে চেয়েছিল, আমি যাতে তাকে সময় দিই। তাতেই সে সুখী হবে। এমনকি রাস্তাঘাটে পাগলামি করেও তার মুখে হাসি ফোটানো যায়।

যে কাজটা আমার হাতের নাগালে আছে, সেটা করছি না কেন আমি?

ঠিক ঐ মুহূর্তে মিয়াগি হয়তো আমার হৃদয়ের এই পরিবর্তনটা টের পেয়েছিল, কারণ সে বলল, “কুসুনোকি, শোনো। তুমি যে তোমার জীবনের স্বল্প এই সময়টা আমার জন্য ব্যয় করছ, তাতে আমি প্রচণ্ড খুশি—কিন্তু তোমাকে আর সেটা করতে হবে না। তুমি আমাকে রক্ষা করেছ। তুমি চলে যাওয়ার কয়েক যুগ পরেও আমি নিশ্চিত ভাবেই তোমার সাথে কাটানো এই সময়গুলো স্মরণ করব, করে হাসব, কাঁদব। এই স্মৃতিগুলোর জন্য আমার জীবনটা একদম সহজ হয়ে যাবে। তাই তোমাকে আর পরিশ্রম করতে হবে না। দয়া করে আমার ঋণটার কথা ভুলে যাও।”

সে আমার কাঁধে রাখা শরীরটার ভার বাড়িয়ে দিল।

“এর থেকে আমাকে স্মৃতি উপহার দাও। যত পার তত স্মৃতি। তুমি চলে যাবার পর নিঃসঙ্গতার সাথে যুদ্ধ করার সময় এই স্মৃতিগুলো যাতে আমায় উষ্ণতা দিতে পারে, আমায় সঙ্গ দিতে পারে।”

.

আমার জঘন্য জীবনের একদম শেষ পর্যায়ের কাছাকাছি চলে এসেছি। জীবনটা গাধামি করেই কাটিয়ে এসেছি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমার নেয়া শেষ সিদ্ধান্তটা ছিল সবচেয়ে বুদ্ধিমানের মতো একটা কাজ। আমার এই রেকর্ড এর একদম শেষে পৌঁছালে এর মানে টের পাবেন।

মিয়াগি আর আমি একটা বাসে উঠে বিশাল পুকুরওয়ালা একটা পার্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

ওখানে গিয়ে আমি কী করেছি, তা শুনলে বেশিরভাগ মানুষই হাসিতে ফেটে পড়বে, বাকিরা মুখ গম্ভীর করে ফেলবে।

আমি ডক থেকে একটা নৌকা ভাড়া করলাম। চাইলেই একটা সাধারণ বৈঠাওয়ালা নৌকা নেয়া যেত, কিন্তু আমি একটা কিম্ভূতকিমাকার সোয়ান – বোট বেছে নিলাম। ডকে থাকা কর্মচারী অবশ্য আমাকে একলা নৌকায় উঠতে দেখে খানিকটা অবাকই হলো। কারণ, এই সোয়ান-বোট যারা ভাড়া নেয়, তাদের সাথে সঙ্গিনী থাকে একজন।

আমি মিয়াগির দিকে তাকিয়ে হাসলাম। “চলো উঠে পড়া যাক।” কর্মচারীর মুখটা আরও বেঁকে গেল, সে তড়িঘড়ি করে আমার থেকে পালাল।

মিয়াগি দৃশ্যটা দেখে এতটাই মজা পেয়েছিল যে, সে বৈঠা বাওয়ার পুরোটা সময় খিলখিল করে হাসছিল।

“মানে যে কেউ দেখলে ভাববে, এক পূর্ণবয়স্ক মানুষ একলা একলা এই হাস্যকর নৌকা চালাচ্ছে!”

“যতটা ভাবছ ততটা কিন্তু হাস্যকর না। বেশ মজাই পাচ্ছি কিন্তু, “ আমিও হাসলাম।

ধীরে ধীরে পুরো পুকুরটাকে চক্কর দিলাম। পানির ওপর দিয়ে নৌকার সরসর করে চলার ফাঁকে মিয়াগি “স্ট্যান্ড বাই মি” গানটা শিস বাজাল। শান্তিপূর্ণ এক গ্রীষ্মের বিকেল ছিল সেদিন।

পুকুরকে ঘিরে চেরি গাছ লাগানো হয়েছিল। বসন্তকালে এ জায়গাটায় নিশ্চিত চেরি ফুল ফোটার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। পানিতেও ফুল ঝরে পড়ে জায়গাটা আরও সুশোভিত করে। আর শীতকালে এই পুকুরের পানি সম্ভবত জমে বরফ হয়ে যায়। তখন এই সোয়ান-বোটগুলো পুকুর থেকে উঠিয়ে ফেলা হয়, সেটার ওপর দিয়ে সত্যিকারের সোয়ান মানে রাজহাঁস দেখা যায়।

হঠাৎ মনে দুঃখ হলো, আমি আর বসন্ত কিংবা শীতকালের এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারব না। কিন্তু পাশে বসে থাকা মিয়াগির হাসিমুখ আমার সে দুঃখটা ভুলিয়ে দিল। ও পাশে থাকলে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে ইচ্ছে হয় না।

নৌকাভ্রমণটা তো কেবল শুরু ছিল। পরবর্তী দিনগুলোয় আমি অনেকগুলো কাজে ব্যস্ত রইলাম। একদিক দিয়ে ভাবলে যে কাজগুলো একা একা করা উচিত না, তার প্রায় সবই করে ফেললাম আমি। আমার সাথে মিয়াগি থাকলেও সবার চোখে আমি ছিলাম একা।

একা একা ফেরিস হুইল চড়লাম।

মেরি-গো-রাউন্ডে একা চড়লাম।

একা একা পিকনিক উপভোগ করলাম।

একা একা একুরিয়াম ঘুরতে গেলাম।

চিড়িয়াখানায় একা গেলাম।

পুলে গিয়ে একা একা সাঁতার কাটলাম।

বারে গেলাম একলা।

একা একাই বার্বিকিউ উপভোগ করলাম।

একা একা যে কাজ করতে মানুষ লজ্জাবোধ করে, তার প্রায় সবই করে ফেললাম আমি। প্রত্যেকটা কর্মকাণ্ডের সময় আমি জোর করে হলেও জনসম্মুখে মিয়াগির নাম উচ্চারণ করলাম, তার হাত ধরে ধরে হাঁটলাম, সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালাম, আরও যে যে ভাবে তার উপস্থিতি অন্যদের সামনে তুলে ধরা সম্ভব সবই করলাম। যখন টাকা ফুরিয়ে আসতে শুরু করল, কিছু টুকটাক পার্ট টাইম কাজ করে এরকম কর্মকাণ্ড চালানোর মতো টাকা জোগাড় করতে থাকলাম।

সেসময় জানা ছিল না যে, আমার এলাকায় আমি ইতোমধ্যে ‘বিখ্যাত’ হয়ে গিয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই কিছু লোক আমাকে দেখে হাসিঠাট্টা করে, অনেকে আমার দিকে তাকাতেই চায় না, অনেকের দৃষ্টিতে ভয়মিশ্রিত থাকে। কিন্তু বাকিরা আমার কাজকর্মকে মূকাভিনয় বলেই ধরে নিয়েছিল। অর্থাৎ আমি মনে হয় একজন মূকাভিনেতা। তাদের মধ্যে অনেকে নাকি আমার কাজকর্ম দেখে আনন্দ পেত, অনেকের নাকি শান্তি শান্তিও লাগত। সংক্ষেপে বললে, প্রত্যেকেরই প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন ভিন্ন।

আরও অবাক লেগেছিল এই দেখে যে, আমাকে খারাপ চোখে দেখা আর ভালো চোখে দেখা-দুদলের সংখ্যাই ছিল সমানে সমান।

কেন এই বিশাল সংখ্যক মানুষ আমার এই বোকামি দেখে, পাগলের মতো কাজকর্ম দেখে আনন্দ পাচ্ছে? শান্তি পাচ্ছে?

বোধহয় উত্তরটা অনেক সাধারণ।

কারণ আমি নিজে সত্যিকার অর্থেই সুখী ছিলাম। একদম ভেতর পর্যন্ত সুখী আমি।

আর সে কারণেই হয়তো আমি এই আনন্দটা ছড়িয়ে দিতে পারছি।

***

“আমি কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি?” একদিন সকালে মিয়াগি হুট করে জিজ্ঞেস করল।

“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“কদিন ধরেই মনে হচ্ছে, আমাকে শুধু দিয়েই যাচ্ছ তুমি। মাঝেমধ্যে আমারও তোমাকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে।”

“বিশেষ কিছু তো আমার মাথায় আসছে না। আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি চিন্তাভাবনা করে দেখব,” আমি বললাম। “তোমার জন্য কিছু করা লাগবে?”

“না না। ইতোমধ্যে তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করে ফেলেছ। যদি আমার কোনো ‘ইচ্ছে’ থেকেই থাকে, তবে সেটা হলো তোমার ‘ইচ্ছে জানা।”

“তাহলে আমার ‘ইচ্ছে’ হলো তোমার ইচ্ছে জানা।”

এভাবে চারবার অর্থহীন কথা পাল্টাপাল্টির পর অবশেষে মিয়াগি হার মেনে নিল।

“আমার যদি আর কয়েক মাস আয়ু থাকে তবে আমি কী কী করব, সেটার একটা উত্তর দিয়েছিলাম তোমাকে, মনে আছে?”

“তারার লেক, নিজের কবর বানানো আর তোমার পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করা।

“হ্যাঁ।”

“তুমি তাহলে তোমার ঐ বন্ধুর সাথে দেখা করতে চাও?”

সে মাথা নাড়ল। খানিকটা ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে সে বলল, “ভেবে দেখলাম, আমি যেকোনো দিনই মারা যেতে পারি। তাই এখনই ওকে দেখতে যাওয়াটা আমার জন্য ভালো হবে। অন্তত সে যে বেঁচে আছে, এটুকু নিশ্চিত আমি। আর দেখা মানে ওকে সামনাসামনি গিয়ে দেখতে চাই আমি-আমার সাথে যাবে?”

“অবশ্যই যাব।”

“আর তোমার ইচ্ছেটাও একদিন শুনতে চাই আমি কুসুনোকি।”

“যদি কিছু মাথায় আসে তবেই বলব।”

কাজে নেমে পড়লাম। কীভাবে পাবলিক বাসে করে গন্তব্যে যাওয়া যাবে, তা দেখে নিলাম, তারপর মিয়াগির জন্মস্থান-এ যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম আমরা।

পাহাড়ি পথের ভেতর দিয়ে বাস চলাকালীন সময়ে মিয়াগি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি আমি হতাশ হব। আমার আশাটা নিতান্তই স্বার্থপর। বাচ্চাদের মতো স্বপ্ন দেখছি আমি। কোনো কিছুর পরিবর্তন যাতে না ঘটে, সেটাই ছোটবেলায় চেয়েছিলাম, আর তাই ঘটেছিল-কিন্ত আজ যদি সেটার কোনো অস্তিত্বই না থাকে, তবে আমার মনে হয় আমি সেটা মেনে নিতে পারব। কারণ তুমি আমার পাশে রয়েছ।”

“একটা ব্যর্থ মানুষের পাশে যদি তার থেকেও আরও বেশি ব্যর্থ কোনো মানুষ থাকে, তাহলে সে নিজের ব্যর্থতা ভুলে যায়।”

“আমি তো তা বোঝাইনি। তুমি কি বোকার অভিনয় করছ নাকি?”

“জানি জানি। ক্ষমাপ্রার্থী,” বলে স্নেহভরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। “এই যে, এটার জন্য, তাই না?”

“একদম।” সে একমত হলো।

.

ছোট্ট একটা গ্রাম। যেখানের বাজারে অবস্থিত ইলেক্ট্রনিক্স এর দোকানে ভিড় লেগেই থাকে, যেখানে ছোটখাটো সাইজের সুপারমার্কেটে মানুষ লাইন ধরে কেনাকাটা করে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলশেষে ঘোরার কোনো জায়গা না পেয়ে শেষমেশ কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে জমায়েত হয়-এরকম ছোট্ট একটা গ্রাম ছিল সেটা।

যেদিকেই তাকানো হোক না কেন, আশপাশের সব জায়গার দৃশ্য নিতান্তই পানসে লাগবে। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে সবকিছুই অসাধারণ লাগছে। গোটা জগতকে সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই আমার, সবকিছু যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই গ্রহণ করে যেতে হবে আমাকে।

দুনিয়াটাকে যখন আমি কোনো ধরনের বাঁধা ছাড়া মুক্তদৃষ্টিতে দেখা শুরু করলাম, তখন থেকে দুনিয়াটাকে অনেক উজ্জ্বল আর নতুন লাগতে শুরু করেছিল। মনে হচ্ছিল এতদিন আমি দুনিয়াটাকে একটা স্বচ্ছ পর্দার আড়াল থেকে দেখে আসছিলাম, সেটা আচমকা সরে গিয়েছে।

আজকের দিনে মিয়াগি আমাকে পথ দেখাবে। তার ছোটবেলার বন্ধু নাকি এখানেই থাকে। তবে সঠিক ঠিকানাটা তার জানা নেই। তার থাকার সম্ভাব্য জায়গাগুলো আমরা একে একে ঘুরে দেখব। ছেলেটার নাম এনিশি, মিয়াগি আমাকে জানিয়েছিল।

অবশেষে যখন এনিশি’কে খুঁজে পেলাম, মিয়াগি কিন্তু তার সামনে গেল না। আমার পেছনে লুকিয়ে থেকে উঁকি মেরে তাকে দেখে নিল। তারপর সতর্কভঙ্গিতে হাঁটি হাঁটি পা করে ধীরে ধীরে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

ছোট্ট একটা ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। এতটাই ছোট যে, দশজন মানুষ থাকলেই ভিড় ভিড় লাগতে শুরু করবে আপনার। এনিশি এক কোণে থাকা বেঞ্চে বসে একটা বই পড়ছিল। তার উচ্চতা আর চেহারা সাধারণের তুলনায় ভালো ছিল, তবে তার সবচেয়ে চমৎকার দিক ছিল তার মুখভঙ্গি। আত্মবিশ্বাসী চেহারা ছিল তার। আজকাল আমি অল্পস্বল্প হলেও বুঝতে পারি, এ চেহারা বানানোর পেছনে কী কী লেগেছে।

চেহারা দেখেই আমি বলতে পারি, এই মানুষটা কাউকে ভালোবাসে এবং এটা তার জ্ঞাত যে, ঐ মানুষটাও তাকে পাল্টা ভালোবাসে।

বুঝতে পারছিলাম, এনিশি ট্রেনে চড়ার জন্য না, বরং ট্রেন থেকে নামবে এমন কারো অপেক্ষায় সেখানে বসে ছিল। আমি চাচ্ছিলাম না ঐ মানুষটাকে মিয়াগি দেখুক।

সময় দেখার ভান করে বিড়বিড় করলাম, “চলো, যাওয়া যাক?” কিন্তু মিয়াগি মাথা নাড়ল।

“না, এখন না। আমি ‘ও’কে দেখতে চাই। আমি জানতে চাই সে এখন কোন ধরনের মানুষের প্রেমে পড়েছে।”

দুইবগিওয়ালা একটা ট্রেন এসে স্টেশনে থামল। বেশিরভাগ যাত্রীই ছিল ছাত্রছাত্রী, তবে একজন বিশোর্ধ, স্নিগ্ধ চেহারার মেয়েকে চোখে পড়ল।

খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, এই মেয়েটার জন্যই অপেক্ষা করছিল এনিশি। তাদের একে অপরের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকানোর আগেই তা বোধগম্য হয়ে গিয়েছিল।

মেয়েটার মুখে খুবই স্বাভাবিক একটা হাসি লেগে ছিল। সত্যি বলতে কী, এতটাই স্বাভাবিক ছিল সে হাসি যে তা অস্বাভাবিক লাগতে শুরু করেছিল। অধিকাংশ মানুষের হাসিতেই অল্প হলেও মেকি ব্যাপার থাকে। কিন্তু এনিশির বান্ধবীর হাসি ছিল পুরোপুরি নির্মল আর স্নিগ্ধ। সারাটা জীবন সবকিছুকে হাসিমুখে গ্রহণ করার ফলাফল বোধহয় এই।

তারা যে কোনো কথা না বলেই একে অপরের সাথে মিলিত হলো, তা থেকে টের পেলাম যে তারা অনেকদিন ধরেই একসাথে রয়েছে। অথচ তাদের চোখেমুখে যে প্রতিক্রিয়াটা দেখতে পেলাম, তা প্রথমবার দেখা হওয়া দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার চোখেমুখেই শোভা পায়। দৃশ্যটা কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলেও যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে যে, তারা দুজনে অত্যন্ত সুখী ছিল।

এনিশি তাহলে মিয়াগি’কে ছাড়াই সুখী জীবন কাটাচ্ছে।

মিয়াগি কাঁদল না, হাসলও না। সে দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যদি কেউ চমকিয়ে থাকে, তবে সেটা আমি। এনিশি আর তার বান্ধবীর মধ্যে আমি নিজেকে আর মিয়াগি’কে দেখতে পাচ্ছিলাম। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভবিষ্যতের সেই শান্তিপূর্ণ, আনন্দময়, সুখী একটা জীবনকে কল্পনায় দেখার চেষ্টা করলাম।

এমন একটা ভবিষ্যৎ যেখানে আমার মরার কোনো প্রয়োজনই ছিল।

তারা হেঁটে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল। রইলাম কেবল আমি আর মিয়াগি।

“সত্যি বলতে কী, আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অদৃশ্য থাকার এই সুবিধাটাকে কাজে লাগিয়ে কিছু করে বসি,” সে বলল। “কিন্তু সেসবের কিছুই করলাম না।”

“কী করতে চেয়েছিলে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“ইচ্ছে করছিল দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি।”

“ওহ, এটুকুই? আমি তোমার জায়গায় থাকলে এর থেকে আরও বেশি কিছু করে বসতাম।”

“আমার জায়গায় থাকলে তুমি কী করতে?” মিয়াগি জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল, কিন্তু কথাগুলো তার মুখ থেকে বের হবার আগেই আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর যেটা করতে চেয়েছিলাম, সেটা করলাম।

প্রায় দুমিনিট ধরে স্থায়ী হলো সেটা।

প্রথমে মিয়াগি অবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সে পাল্টা চুম্বন ফেরাতে শুরু করল।

দুমিনিট পর সরে গিয়ে আমি বললাম, “কেউ যদি আমাকে না থামায়, তবে মাঝেমধ্যে আমি এরকম স্বার্থপরের মতো আচরণ করে বসব।”

“-–ঠিক আছে। কেউ তোমাকে থামাবে না,” মিয়াগি মাটিতে চোখ রেখে অবশেষে উত্তর দিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *