নির্বাসিত

নির্বাসিত

রাত্রি প্রায় এগারোটা।

শহরের এ প্রান্তে আজ একটা ব্ল্যাক-আউট অর্থাৎ দীপ-নির্বাণপর্ব ছিল। ঘণ্টা দুয়েক ঘুটঘুটে অন্ধকারের পর এইমাত্র আলো জ্বালা হইয়াছে। শুধু আলো নিবানো নয়, সব রকম আওয়াজ পর্যন্ত চাপিয়া লোকেরা এক রকম জবুথবু হইয়া বসিয়া ছিল। আলো জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে অবরুদ্ধ কলোচ্ছ্বাসটা আবার চতুর্গুণ বেগে জাগিয়া উঠিল। কলিকাতার এ চাকলাটাকে যেন রাহুতে গ্রাস করিয়াছিল, মুক্তির পর আবার উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিয়াছে।

অম্বিকা গাঙ্গুলী পার্কের ধারে ধারে ফুটপাথ দিয়া ঠুকঠুক করিয়া আসিতেছিলেন। মনটা অত্যন্ত অপ্রসন্ন, নিতান্ত একটা বাজে হুজুগে দাবা খেলাটা আজ বন্ধ গেল। বিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম—এক হিসাবে। আর একবার বন্ধ রাখিতে হইয়াছিল, কিন্তু এ রকম বাজে কাজ নয় বলিয়া ওরই মধ্যে একটা সান্ত্বনা ছিল। সেবার নেহাত তাঁহার স্ত্রী-বিয়োগ হয়। এক-আধ দিনের নয়, সাঁইত্রিশ বৎসরের পুরানো স্ত্রী—এগারো বৎসরে বিবাহ করিয়াছিলেন, আটচল্লিশ বৎসরে গেলেন মারা। তবুও বাদ দিতেন না; ‘হাঁ’ ‘না’ করিতে করিতে উপস্থিত হইয়াছিলেন আড্ডায়; কিন্তু যাহার সঙ্গে দাবা-খেলা, সেই ভৈরব হালদার তাঁহার মৃতা পত্নীর জন্য এমন শোকাচ্ছন্নভাবে তাঁহাকে সান্ত্বনা দিতে লাগিল যে, তাহার উপর দাবা-খেলার কথা তোলা নিতান্ত কি রকম দেখাইত যেন। চক্ষুলজ্জা বলিয়াও একটা জিনিস আছে তো। তাহা ছাড়া একটা অনিষ্ট যে ঘটিবেই, এই বিশ্বাসে আরো মনটা তিক্ত হইয়া আছে। কবে কে আসিয়া দুইটি বোমা ফেলিবে না-ফেলিবে, সেই ভয়ে এখন হইতে অন্ধকার করিয়া বসিয়া থাকিয়া এই রকম ভাবে চোর ডাকাতদের সুবিধা করিয়া দিলে তাহারা দুই হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিবে। আজ এই দুই ঘণ্টার মধ্যে কত কি হইয়া গিয়াছে নিশ্চয়, কালকের কাগজেই খবর পাওয়া যাইবে। কেন যে এই ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলোনো’!

শুধু তাই? আজকে আবার হল্যান্ডে প্যারাশুট বাহিয়া সৈন্য নামিবার যা সব খবর পাওয়া গেল, যদি এই অন্ধকারের সুযোগ লইয়া আকাশ হইতে—

চিন্তাটাকে জোর করিয়া এইখানেই স্থগিত রাখিয়া গাঙ্গুলী মশাই পা চালাইয়া দিলেন। মোটা মানুষ দুশ্চিন্তায় পরিশ্রমে ঘামিয়া একশা হইয়া যাইতেছেন।

.

বাড়ির গলির সামনে আসিয়া বড় রাস্তাটা পার হইলেন। গলিটার মুখটায় আলো একটু কম, দুই দিন হইতে দুইটা মাঝারি সাইজের গাছের ডালপালা গলির মুখটাকে একটু চাপিয়া দিয়াছে। একটা গাছের গুঁড়ির চারিদিকে তারের জাল দিয়া ঘেরা। পাশে একটা পানওয়ালা বসে, সে তারের জালের উপর একটা ছেঁড়া চট শুকাইতে দিয়াছে। সেইখানটা অন্ধকার একটু জমাট। পানওয়ালা ব্ল্যাক-আউটের হিড়িকে দোকান বন্ধ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। চটটা তুলিতে ভুলিয়া গিয়া থাকিবে।

.

রাস্তা পার হইয়া গলিটায় প্রবেশ করিবেন, তারের বেড়ার ও-পাশটায়, অর্থাৎ অন্ধকার দিকটায়, একটা হাঁচির আওয়াজ শুনিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িতে হইল। অমন বেয়াড়া জায়গায় হঠাৎ হাঁচে কে? মনে হয়, গা-ঢাকা দিয়া আছে; অথচ হাঁচিল, যেন একটা বাজ পড়ার শব্দ হইল। বেড়াটার পাশ দিয়া চটের আড়ালে দৃষ্টি পড়িতেই চক্ষুস্থির! একটি অদ্ভুত ধরণের পোশাক-পরা ষণ্ডাগুণ্ডা-গোছের মানুষ বেড়ার ঠিক পাশটিতে দুই হাঁটু তুলিয়া তাহার মধ্যে মাথাটা গুঁজিয়া হাঁটু দুইটা দুই হাতে জড়াইয়া বসিয়া আছে। মাথায় বিলাতী হেলমেট টুপির উপর কতকটা শুঁড়ের মত পিতলের কি একটা আঁটা, দেখিতে অনেকটা ফায়ার-ব্রিগেডের টুপির মত। গায়ের জামাটা একটু নূতন ধরণের। মিলিটারি কোট বা ওইরকম ধরণের কিছু নয়। খুব হালকা কোন একটা কাপড়ের হাতকাটা জামা, খাকী রঙের বলিয়াই মনে হয়, কিন্তু বেশ ভাল রকম বোঝা যাইতেছে না। গলার কাছটা অনেকটা খোলা। এদিকে নামিয়াছে উরুর প্রায় আধাআধি, মাঝখানে একটা পটি।

লোকটা রাস্তার পানে মুখ করিয়া, অর্থাৎ গাঙ্গুলী মশাইয়ের দিকে পিছন ফিরিয়া, বসিয়া আছে। কোমরে কি পরিহিত, পিছন হইতে ঠিক বোঝা যায় না। একবার মনে হয়, হাফ প্যান্ট; একেবার মনে হয়, না, হাইল্যান্ডের গোরারা যেমন কতকটা ঘাগরা-গোছের একটা জিনিস পরে, এও সেই রকম একটা কিছু। এসবের উপর কাঁধ হইতে নীচে পর্যন্ত একটা চাদরের মত ঝলঝল করিতেছে। কোমরে একটা খাপ ঝুলিতেছে, তাহাতে ছোরা আছে, কি পিস্তল আছে বোঝা যাইতেছে না। প্রথমটা দারুণ বিস্ময় হইল, এ পোশাকই বা কোথাকার? এমনভাবে মাথা গুঁজিয়া বসিয়া আছেই বা কেন, এই বেয়াড়া জায়গায় আর এই অসময়ে? গাঙ্গুলী মহাশয় দাঁড়াইয়া মুঠোর উপর চিবুকটা চাপিয়া, লোকটার দিকে চাহিয়া একটু চিন্তা করিবার চেষ্টা করিলেন। সাড়া-শব্দ নাই। একটু গলা-খাঁকারি দিলেন। সাড়া-শব্দ নাই। এসব অঞ্চলে, এই সময় এক-একবার এমন হয় যে, দুইচার মিনিট বোধ হয় লোকই থাকে না ফুটপাথে; কাহারও সঙ্গে যে একটা পরামর্শ করিবেন, তাহারও সুবিধা হইতেছে না। আর একবার গলা-খাঁকারি দিয়া কোন রকম শব্দ না পাইয়া দুই পা আগাইয়া দেখিতে যাইবেন, একটা কথা মনে পড়িয়া সমস্ত শরীরটা যেন একেবারে হিম হইয়া গেল। ঠিক যা ভাবিয়াছেন তাই—নিশ্চয় অকাট্য! গাঙ্গুলী মহাশয় অস্ফুটস্বরে নিজের মনেই বলিলেন, “কি সব্বনাশ, এখানেও।’ খুব সন্তর্পণে দুই পা পিছাইয়া সরিয়া আসিলেন এবং আর একবার ঘাড় বাঁকাইয়া মূর্তিটিকে দেখিয়া লইয়া হনহন করিয়া পা চালাইয়া দিলেন। শুধু পিছন ফিরিয়া এক-একবার দেখা, তারপর যত জোরে পা চলে—! মুখে এক-একবার শুধু অস্ফুট—’কি সব্বনাশ, এখানেও।’ শেষে তাহাতেও হইল না, অর্থাৎ আরও খানিকটা হাঁটিয়া যে একেবারে বাড়ি গিয়া উঠিবেন, সে সাহসটুকুও অবশিষ্ট রহিল না। ছকড়ির ডিস্পেন্সারিটা খোলা দেখিয়া আর একবার পিছনে দেখিয়া লইয়া তাড়াতাড়ি ঢুকিয়া পড়িলেন।

ছকড়ি আর কম্পাউন্ডার দ্বারিকবাবু একই সঙ্গে প্রশ্ন করিয়া উঠিল, “কি, গাঙ্গুলীকাকা যে, ব্যাপার কি? এরকম হন্তদন্ত হয়ে? এত রাত্তিরে?”

“নেমেছে।”—বলিয়া গাঙ্গুলী মহাশয় একেবারে কাউন্টারের ও-পাশে গিয়া বলিলেন, “নেমেছে, শিগগির দোর বন্ধ ক’রে দাও সবগুলা।”

“নেমেছে কি কাকা?”

গাঙ্গুলী মহাশয় একটা ডেক-চেয়ারে এলাইয়া পড়িয়া বিরক্তভাবে বলিলেন, “কি? প্যারাশুট। নাববে না? তাদের সুবিধে করে দিলে তারা নাববে না? নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে তারা তোমাদের মত? কর ব্ল্যাকআউট—”  

দুইজনে একসঙ্গে চিৎকার করিয়া উঠিল, “প্যারাশুট? কোথায় কাকা?”

ছকড়ি প্রশ্ন করিল, “জার্মান প্যারাশুটিস্ট?”

গাঙ্গুলী মহাশয় খিঁচাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “জার্মানরা এতদূর কি করতে আসবে? ইটালিয়ান। বম্বের কাছে ‘পাঠান’ জাহাজটাকে কি জার্মানরা ডোবাতে এসেছিল? কিন্তু তুমি আগে দোর-জানলাগুলো বন্ধ করে দাও দ্বারিক। নাঃ, কি দরকার ছিল ব্ল্যাকআউটের বল তো?”

ব্যাপারটার আকস্মিকতায় এবং গাঙ্গুলী মহাশয়ের অবস্থা দেখিয়া ইহারা ঘাবড়াইয়া গিয়াছে অনেকটা। দ্বারিকবাবু দুয়ারটা বন্ধ করিতে উঠিয়া মুখ বাড়াইয়া একবার বাহিরে চাহিয়া লইয়া বলিলেন, “রোঁদের পুলিস আসছে।”

দুইজনের মুখে একটু ভরসার ভাব ফুটিল। ছকড়ি বলিল, “ডাকুন।”

.

গাঙ্গুলী মহাশয় আর গেলেন না, জায়গাটা বুঝাইয়া দিয়া দ্বারিকবাবুর সঙ্গে দোকানে বসিয়া রহিলেন। ছকড়িকে বলিয়া দিলেন, “বেশী কাছে যেও না, বেশি ঘাঁটিও না। আগে দেখ, দেখাই পাও কিনা! সেদিন দেখলে তো খবরের কাগজে, ওদের প্রত্যেকটি লোকের কাছে সাইকেল থেকে আরম্ভ ক’রে তাঁবু, রেডিও, মেশিনগান কিছুই বাদ থাকে না। আর যদি পাওই দেখা, তো যা বলে মেনে নিও বাপু, কাজ কি?”

দূর হইতেই দেখা গেল, গলির মোড়ে ছোটখাটো একটি ভিড় জমিয়াছে। তাহাদের মধ্য দিয়া পুলিস ছকড়ির সঙ্গে সামনে আসিয়া দাঁড়াইল।

পুলিস আসিতেই নালিশে ব্যাখ্যানে একটা হৈ-চৈ পড়িয়া গেল। টের পাওয়া গেল— লোকটা কি জাতি, কিই বা উদ্দেশ্য তাহার কিছুই টের পাওয়া যায় নাই, তবে এইটুকু পর্যন্ত জানা গিয়াছে যে মাতাল। লোকেরা চারিদিক হইতে নানা রকম প্রশ্ন করিলে কোন উত্তর না দিয়া ওই রকম গোঁজ হইয়া বসিয়া থাকে। তখন পিছনে কোথা হইতে একটি ছোট্ট কাঁকর আসিয়া তাহার পিঠে পড়ে। ইহাতে লোকটা একেবারে ক্ষেপিয়া যায় এবং এলোপাথাড়ি সবাইকে পিটিবার চেষ্টায় কয়েকবার নিজেই গড়াইয়া গড়াইয়া পড়িয়া আবার পূর্বস্থানে ফিরিয়া গিয়া ওই ভাবে বসিয়াছে। জাঁদরেল চেহারা আর অদ্ভুত সাজগোজ দেখিয়া কেহ আর কাছে যাইতে সাহস করিতেছে না।

পুলিস একটু দূর হতেই একবার ঝুঁকিয়া, একবার সিধা হইয়া, ডাইনে বাঁয়ে আঁকিয়া বাঁকিয়া খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করিল, তাহার পর বীরের পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, “কোন্ মুলুক্কা আদমি হ্যায়, কুচভি মালুম নহি কর্ সকা?”

উত্তর হইল, “কি ক’রে মালুম হবে? ওই একভাবে সেই থেকে ব’সে আছে, জিজ্ঞেস করলে না উত্তর দেয়, না কিছু, ক্রমেই মাথাটা যেন কোলে গুঁজড়ে যাচ্ছে।”

ছকড়ি প্রশ্ন করিল, “যখন উঠে মারতে এসেছিল, তখন কি ভাষায় গালাগালি করেছিল, শোনেন নি একটু খেয়াল করে?”

লোকটা বিস্মিতভাবে মুখের পানে চাহিয়া বলিল, “তাই কি পারে মশাই কেউ? সে মোদো মাতাল, ছোরা নিয়ে তাড়া করছে—সেদিকে লক্ষ্য না রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে তাই বিভোর হয়ে শুনব? আপনি যে অবাক করলেন!”

ছকড়ি লোকটার পানে কটমট করিয়া একবার চাহিল। অন্য একজনকে প্রশ্ন করিল, “আচ্ছা, যখন উঠেছিল, হাতে ভাঁজ করা ছাতার মত কিছু ছিল?”

বিস্মিত প্রশ্ন হইল, “ভাঁজ-করা ছাতা?”

“হ্যাঁ, যা নিয়ে আকাশ থেকে নামা যায়?”

“আজ্ঞে, না মশাই, এমন কিছু দেখি নি। কই, তোমরা কেউ দেখেছ নাকি হে?”

হেলমেট হ্যাটের দিকে দেখাইয়া বলিল, “মাথায় ওই ছাতার মত একটা টুপি আছে; ওটা মাথায় দিয়ে আকাশ থেকে নামা যায় তো বুঝুন।”

বোধ হয় অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করিতেছে দেখিয়া একটু সন্দিগ্ধভাবে ছকড়ির পানে আড়চোখে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি করেন?”

ছকড়ি তাহার দিকেও এবার কটমট ভাবে চাহিয়া পুলিসটাকে কি বলিতে যাইতেছিল, একটি ছোকরা আগাইয়া আসিয়া প্রশ্ন করিল, “হ্যাঁ মশাই, আপনি কি বলতে চান, এরোপ্লেন থেকে প্যারাশুট ধরে নেমে এসেছে?”

ছকড়ি বলিল, “আপনাদের কি সন্দেহ আছে?”

ছোকরা পিছাইয়া একটু ভিড়ের মধ্যে ঢুকিয়া গেল। প্রশ্ন করিল, “কিন্তু প্যারাশুট কোথায়? আর ওদের সঙ্গে তো ভাঁজ করা সাইকেল, রেডিও-সেট, তাঁবু, মেসিনগান— আরও কি কি সব থাকে? সেদিন খবরের কাগজে ছবি দেখলাম।”

ভিড় আরও বাড়িয়া উঠিয়াছে এবং ছকড়ির চারিদিকে চাপ বাঁধিয়া উঠিতেছে। প্যারাশুটের ব্যাপারটা বোঝে কয়েকজন; যাহারা বোঝে না, তাহারা বুঝিয়া লইয়া শঙ্কিতভাবে নানা জল্পনাকল্পনা করিতে লাগিল। যেমন কিছু কিছু লোক খসিতে লাগিল, তেমনিই মুখে মুখে কথাটা প্রচার হইয়া তাহার চেয়ে অধিক লোক আসিয়া জুটিতে লাগিল। লোকটা যে প্যারাশুট হইতে অবতরণ করিয়াছে—এ সম্বন্ধে অল্প লোকেরই সন্দেহ রহিল। একজন তারের বেড়ায় ছড়ানো চটটাই প্যারাশুট বলিয়া অভিমত দিল; একজন বলিল, “অন্তত প্যারাশুটের একটা অংশ হইতে পারে।” সবাই যে বিশ্বাস করিল এমন নয়, তবে যাহারা বিশ্বাস না করিল, তাহারাও বেশ খানিকটা দূরে সরিয়া গিয়া ইহাদের প্যারাশুট সম্বন্ধে গভীর অজ্ঞতায় বিদ্রূপ করিতে লাগিল। মোট কথা নানা রকম আন্দাজী অভিমতে, শঙ্কিত বিদ্রূপে জায়গাটা গমগম করিয়া উঠিল।

রোঁদের পুলিস লাঠি দিয়া দূর হইতে চটটাকে পরীক্ষা করিতে যাইতে ছিল, একজন বলিল, “ওসব কিছু ছুঁয়ে-টুয়ে কাজ নেই সিপাইজি, ওদের কোন্‌খানে কি নুকুনো আছে! বোধ হয় ওর মধ্যে থেকেই নাড়া পেয়ে একটা বোমা খ’সে প’ড়ে রাস্তা, বাড়িঘরদোর, মানুষ—স -ব-

পুলিস লাঠিটা সরাইয়া লইল। লোকটা বলিল, “হ্যাঁ, কাজ নেই, আমি বলছিলাম, থানায় একটা টেলিফোন-–”

একজন আগাইয়া আসিয়া বলিল, “থানার চেয়ে একেবারে লালবাজারে—”  

একজন গলা বাড়াইয়া বলিল, “সবচেয়ে ভাল হয় একেবারে কেল্লায় ফোন ক’রে দেওয়া — Come at once with—”

ছকড়ি প্রশ্ন করিল, “টেলিফোন এখানে আছে, কারোও বাড়ি?”

“ফোন একটু দূরেই তেতলা বাড়িটাতে আছে, কিন্তু দেবে কি ব্যবহার করতে?”

পুলিস বীরদর্পে পা বাড়াইয়া বলিল, “আলবৎ দেগা।”

খানিকটা ভিড় সমেত কয়েক পা অগ্রসর হইয়াছে, একটা চ্যাংড়া-গোছের ছোকরা বুড়া আঙুল চুষিতে চুষিতে ঠেলিয়া ঠুলিয়া সামনে আসিয়া বলিল, “জমাদার-সাহেব, লোকটা ‘ওফ’ ক’রে একটা আওয়াজ করলে এই মাত্তোর।”

ভিড়ের মুখ আবার ফিরিল, পুলিস প্রশ্ন করিল, “কোন্ ভাষামে?”

‘ওফ’ শব্দটা বিশেষ কোন্ ভাষার খাস সম্পত্তি বুঝতে না পারিয়া ছেলেটা একটু থতমত খাইয়া গেল। বুড়ো আঙুল চোষা বন্ধ করিয়া একটু যেন চিন্তা করিয়া লইয়া বলিল, “হিন্দিতে। আবার কাঁদছেও যেন।”

একজন লোক প্রশ্ন করিল, “কাঁদছেও হিন্দিতে?”

ছেলেটা বলিল, “হুঁ, ফোঁপাচ্ছে।”

ফোপাইতেছে এমন আসামীকে পুলিসে কখনও ভয় করে না; লাঠিটা ঘাড়ে ফেলিয়া বলিল, “চলো, দেখে।”

ছোঁড়াটা আগে, তাহার পিছনে পুলিস, তাহার ঠিক পিছনে ছকড়ি, ভিড়ের আর সবাই আগে পিছে। ছোঁড়াটা একেবারে সামনে গিয়া নিজের হাঁটুতে দুই হাতে ভর দিয়া লোকটার সামনে নীচু হইয়া দাঁড়াইল, তাহার পর ঘাড়টা বাঁকাইয়া আরও নীচু করিয়া দেখিয়া লইয়া বলিল, “এখনও বোধ হয় কাঁদছে।”

তাহার সাহস দেখিয়া সকলে বিস্মিত হইল এবং লোকটা কিছু করিল না দেখিয়া আরও বিস্মিত, খানিকটা আশ্বস্ত এবং বেশ খানিকটা লজ্জিত হইল। পুলিস ছোঁড়াটার পাশে আসিয়া প্রশ্ন করিল, “এই, তুমি কোন্ হ্যায়, কাঁহা রহতা হ্যায়?”

কোন উত্তর হইল না; তবে লোকটা মাথা তুলিল একটু। তখনই অবশ্য নামাইয়া লইল, কিন্তু যাহারা কাছে ছিল, উহারই মধ্যে মোটামুটি এক রকম দেখিয়া লইল। রাঙা টকটকে মুখ, গোফদাঁড়ি কামানো, হেলমেট টুপির নীচে কয়েকটা কোঁকড়ানো চুলের গুচ্ছ— যাহাদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ তাহাদের মনে হইল, চুলের রঙটা একটু যেন পিঙ্গল।

মোট কথা, প্যারাশুট লইয়া নামুক আর নাই নামুক, লোকটা যে ভিন্‌ দেশী এবং ইউরোপীয়, সে বিষয়ে আর কাহারও সন্দেহ রহিল না। সাহস বাড়িয়া যাওয়ায় একটি লোক তারের বেড়ার চটটাও টানিয়া লইল। না, সেটাও পারাশুট নয়, কাপড়ের যাহাতে গাঁটরি বাঁধা হয় সেই রকম নিরীহ আটপৌরে চটই। পুলিসও দেখিল।

আরও কড়া সুরে হুকুম হইল, “বোলো কৌন হ্যায় তুম, কাঁহা ঘর হ্যায়?”

লোকটা হঠাৎ আর একবার মুখটি তুলিয়া স-কারবহুল কি একটা কথা যেন বলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু শেষ করিবার পূর্বেই ঘাড়টা আবার লুটাইয়া পড়িল, এবং কথাটা ক্রমেই অস্ফুট হইতে হইতে মুখে মিলাইয়া গেল। একটি মাঝবয়সী ভদ্রলোক আগাইয়া আসিয়া ইংরেজিতেও নানা ভাবে প্রশ্ন করিল। কোন উত্তর নাই।

ছকড়ি বলিল, “ওতে হবে না, একে ভাষা বুঝতে পারছে না, তায় বেজায় মদ খেয়ে রয়েছে। ওকে থানায় নিয়ে চল। কাল ধাতস্থ হ’লে কোন জার্মান বা ইটালিয়ান কয়েদী ধ’রে নিয়ে এলেই বাছাধনের জাতকুল বেরিয়ে পড়বে। তবে আমি ব’লে দিচ্ছি, ও ইটালিয়ান, আগেকার গ্রীক-রোমানদের মত পোশাক ওর। আমার মনে হচ্ছে যে, মদ খাওয়া ওর একটা ভান; অন্ধকারের সুযোগে ঘুরে ঘুরে সন্ধান নিচ্ছিল, আলো জ্বলা মাত্রই একটু আড়াল দেখে ব’সে পড়েছে। যা হোক, নিয়ে চল থানাতেই।”

“না যেতে চায়, বেঁধে নিয়ে চল, দড়ি সঙ্গে আছে?”

আশ্চর্য, পুলিস ধরিয়া তুলিবার সময়ও লোকটা কোন বেগ দিল না। শুধু গভীর শোকের একটা বুকভাঙা ‘ওফ’, শব্দ করিয়া বুকের উপর মাথাটা গুঁজিয়া দিল। পুলিস তাহার মাথার হেলমেট টুপিটা খুলিয়া লইতে যাইতেছিল, ছকড়ি তাড়াতাড়ি বারণ করিয়া উঠিল, বলিল, “থাক জমাদার সাহেব, ওদের হ্যাটের ভেতরেই যে কি অস্ত্র নুকুনো আছে বলা যায় না, বোধ হয় তুললেই একটা দুম ক’রে শব্দ হয়ে সমস্ত ভিড় পরিষ্কার ক’রে দেবে; যেমন আছে থাক্ আপাতত।”

কয়েদী লইয়া ভিড়টা আবার সচল হইল। নিতান্ত কৌতূহলবশেই দুই-একজন সেই ডানপিটে চ্যাংড়াটার খোঁজ লইল; কিন্তু তাহার সন্ধান পাওয়া গেল না।

.

থানার ফটকের বাহিরে ভিড়টাকে আটকাইয়া দিয়া তিনজন থানার মধ্যে প্রবেশ করিল- পুলিস, কয়েদী এবং ছকড়ি। অফিস-ঘরে দারোগাবাবু একটা সবুজ শেড দেওয়া টেবিল- ল্যাম্পের সামনে বসিয়া মাথা গুঁজিয়া একরাশ জরুরি কাগজপত্র লইয়া ব্যস্ত আছেন, পুলিস গিয়া এত্তালা দিল—একটা বিদেশী মাতাল রাস্তায় বেহুঁশ হইয়া পড়িয়াছিল, ধরিয়া আনা হইয়াছে।

মোটাসোটা, ঢিলাঢালা-গোছের খুব পুরানো দারোগা; নূতন রায়সাহেব হইয়াছেন, সাহেব মাত্রকেই বেশ একটু সম্ভ্রমের চোখে দেখিতে হয়। কথা বলেন মেজাজের তারতম্য অনুযায়ী—বাংলা, হিন্দি কিংবা ইংরেজিতে; মেজাজটা উষ্ণ শৈত্য মিশ্রিত থাকিলেও ভাষাও দেন মিশাইয়া। একটু শঙ্কিতভাবে মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিলেন, “বিদেশী মানে? সায়েব? আংরেজ?”

উত্তর হইল, “না, ইংরেজ নয়, তবে কটা চামড়া বটে। কোথাকার লোক তাহা টের পাওয়া যাইতেছে না। একে মদ খাইয়া আছে; তায় ভাষা যেন একেবারেই এক নূতন ধরনের। প্রশ্ন করিলে উত্তরও দিতেছে না, এক-আধটা কথা ফসকাইয়া বাহির হইয়া গিয়াছে।”

দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন, “পোশাক কি রকম?”

পুলিস পোশাক যথাযথ বর্ণনা করিল। দারোগা একবার কাগজের রাশির উপর দৃষ্টি বুলাইয়া খানিকটা ক্লান্তি আর বিরক্তির সহিত বলিলেন, “লে আও সামনে।”

পুলিস জানাইল, একজন বাঙালি ডাক্তারবাবুও সঙ্গে আছেন। সে বলে, “লোকটা বোধ হয় আকাশ হইতে নামিয়াছে।”

একে কতকগুলো দরকারী কাজের মধ্যে নূতন উপদ্রবে মনটা খিঁচড়াইয়া গিয়াছে, তাহার উপর এই আজগুবী কাহিনীর অবতারণা,—প্রায় এই সময়েই আবার খবরের কাগজেরা একটা গাঁজাখুরি চালাইয়াছে যে, উত্তর বেহারে কোথায় নাকি মৎস্য-বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। দারোগা রাগিয়া বলিলেন, “যো এসা বোলতা হ্যায় ওভি দারু পিয়া, ইসকোভি ঠাণ্ড গারদমে দেও!”

কয়েদী প্রবেশ করিতেই শেডটা ঘুরাইয়া দিয়া দারোগা তাহার উপর আলো ফেলিলেন; হেলমেটের সোনালী চক্রটা ঝকঝকে করিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ তো মুখে কথাই ফুটিল না। তাহার পর অনেকবার ভাল করিয়া আপাদমস্তক দেখিয়া লইয়া ইংরেজিতে প্রশ্ন করিলেন, “কি জাত তুমি? রাস্তায় কি করছিলে?”

নির্বাক, নিস্পন্দ। পা দুইটা ঈষৎ ফাঁক করিয়া, উভয় বাহুতে বুকটা জড়াইয়া বীরের ভঙ্গীতে দাঁড়াইয়া আছে। শুধু মাথাটা বুকের উপর গোঁজা। মুখের গৌরবর্ণ সুরার উচ্ছ্বাসে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। আচ্ছা ফ্যাসাদ তো। প্রশ্ন হইল অবশ্য ইংরেজিতেই।—

“কি নাম তোমার? বাড়ি কোথায়?”

সেই চাপা গোঁজড়ানো কণ্ঠে মাতালের চাপা উচ্চারণে একটা শব্দ হইল, যেটা বাংলায় কতকটা গিরীশ-এর মত শুনিতে! যেন গ-এ, র-এ, শ-এ জড়াইয়া জিবে মিলাইয়া গেল। দারোগা মনোযোগের ভঙ্গীতে ঘাড়টা বাড়াইয়া আবার প্রশ্ন করিলেন, কিন্তু কোন উত্তর হইল না। কি ভাবিয়া একবার বাংলাতেও প্রশ্ন করিলেন, কোন উত্তর নাই। হিন্দিতে,—তথৈবচ। তখন ভাষা ছাড়িয়া সঙ্কেত ধরিলেন, ইটালিয়ান? জার্মান? ফ্রেঞ্চ? রাশিয়ান? যুগোশ্লাভ?

হাল ছাড়িয়া দিয়া বিরক্তভাবে বলিলেন, “ভ্যালা ফ্যাসাদে পড়া গেল তো!”

পুলিসটাকে বলিলেন, “নিয়ে যা একে লক-আপে; থাক্, লক্-আপে কাজ নেই, কেরানী বাবুকো ঘরমে বৈঠা রাখো। একঠো আরাম-কুর্সি পর লেটা দেও। বাঙালিবাবুকো বোলাও।”

ছকড়িকে ডাকিয়া আনিল।

প্রশ্ন হইল, “কি করেন আপনি?”

“ডাক্তারি।”

“বলেছেন—আকাশ থেকে নেমেছে লোকটা?”

“ঠিক আমি বলি নি, দু-একজন আন্দাজ করেছিল।”

“আপনি যান, তাদের মাথার চিকিৎসা করুন গিয়ে। আচ্ছা, আসুন তা হ’লে নমস্কার।”

কলমটা তুলিয়া কাগজে মাথা গুঁজড়াইয়া দিলেন।

ছকড়ি একটু অপ্রতিভ হইয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল, এমন সময় অন্য একজন পুলিস আসিয়া এত্তালা দিল, মোটরে করিয়া জন পাঁচেক লোক আসিয়াছে, খুব জরুরি দরকার, দেখা করিতে চায়। দুইজন আওরতও সঙ্গে আছে।

দারোগাবাবু বিরক্তভাবে বলিলেন, “ভ্যালা ফ্যাসাদ! ক্রমাগতই—আচ্ছা, জরুরি কাম তো থোড়া বইঠ নে কহো।”

পুলিসটা বলিল, “আওর সবকা পোশাক, হুজুর, সই মাতোয়ালা সাহেবকা মাফিক হ্যায়।”

দারোগা বিস্মিতভাবে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, “মাতাল সাহেবটার মত পোশাক? যাও, বোলা লে আও!”

প্রথম পুলিসটাকে বলিলেন, “যাও, মাতোয়ালা সাহেবকো লে আও তুম।” লোকটাকে আনা হইলে সে আবার হতসম্মান বীরের ভঙ্গীতে ঈষৎ টলিতে টলিতে আসিয়া দাঁড়াইল মাথা নীচু করিয়া।

পুলিসের সঙ্গে আগন্তুক তিনজন প্রবেশ করিয়া চেঁচাইয়া উঠিল, “দিব্যি বাওয়া! আর আমরা ও-দিকে—”

টেবিলের উপর একটা রাশভারী ঘুষির শব্দে তাহাদের চৈতন্য হইল যে, তাহারা থানায়—খোদ দারোগার সামনে। একটু জড়সড় হইয়া দারোগাবাবুকে নমস্কার করিয়া দাঁড়াইল তিনজনে। দেখা গেল, একটা চ্যাংড়াও ইহাদের পিছনে আসিয়া বারান্দার কপাটের পাশটিতে দাঁড়াইয়া চকচক করিয়া বুড়া আঙুল চুষিতেছে। পুলিসের তাড়া খাইয়া দেওয়ালের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল।

দুইজনের পোশাক মাতাল সাহেবটার অনুরূপ, শুধু মাথায় হেলমেট হ্যাট নাই। অপরজনের পোশাক একটু অন্য ধরনের, কোমরে নানা রকমে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া পরা একটা রঙিন সিল্কের শাড়ি, গায়ে একটা রঙিন ফতুয়া, কানে কুণ্ডল, হাতে বাজুবন্ধ — থিয়েটার-পরিচালকদের মতানুযায়ী আমাদের রাজা রাজড়ারা আগে যেমন কিম্ভূতকিমাকার একটা সাজ করিতেন, অনেকটা সেই রকম। আওরত যাহারা সঙ্গে আসিয়াছে বলিয়া টের পাওয়া গিয়াছিল, তাহারা নামে নাই, মোটরেই আছে! চল্লিশ বৎসরের ঘটনাবহুল চাকরির মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয় নাই। নিতান্ত বিমূঢ়ভাবে দারোগা একবার এদিকে, একবার ওদিকে চাহিয়া আগন্তুকদের প্রশ্ন করিলেন, “ব্যাপার কি? বাঙালি? তবে যে আমি তখন থেকে ইটালিয়ান, কি ফ্রেঞ্চ, কি রাশিয়ান—জিজ্ঞেস ক’রে হয়রান হচ্ছি?”

এ প্রশ্নের সদুত্তর উহারা কেহই দিতে পারিল না।

একজন বলিল, “স্যার, আমরা থিয়েটার করছিলাম—চন্দ্রগুপ্ত…ডি. এল. রায়ের চন্দ্ৰগুপ্ত।”

ছকড়ি, পুলিস, দারোগা সকলেই একবার যেন নূতন দৃষ্টিতে কয়েদী আর আগন্তুকদের পানে চাহিল। দারোগা চক্ষু দুইটা বড় বড় করিয়া বলিলেন, “থিয়েটার হচ্ছিল? হুঁ, তাই তো দেখছি। তা এতদূর পর্যন্ত গড়াল কি ক’রে?”

“গেরো স্যার, তবে আর বলছি কি! মদনকে দেওয়া হয়েছিল গ্রীক সেনাপতি অ্যান্টিগোনাসের পার্ট। প্রথম অঙ্কের প্রথম সীনেই আলেকজান্দারের সামনে বেয়াদবি করার জন্যে আলেকজান্দার নির্বাসিত ক’রে দিলে না স্যার? সেই যে স্টেজ থেকে ঘাড় হেঁট ক’রে বেরিয়ে এসে কোথায় সরল সবার চোখে ধুলো দিয়ে, আর পাত্তা নেই। খোঁজ খোজ রব উঠে গেল। একটু পরেই টের পাওয়া গেল, সেই বেশেই চরণ সা’য়ের দোকানে ঢুকে এক পাঁট মদ সাফ করেছে! তার পরে যে কোথায় গেছে, কেউ বলতে পারলে না। থিয়েটার তো মাথায় উঠল স্যার, পরের ছেলে, তায় আবার নেশাখোর, দেখছেনই সামনে। চারিদিকে লোক ছুটিয়ে দেওয়া হ’ল। প্লে ছাই হবে; বলুন স্যার, এ অবস্থায় ফিলিং আসে? সেকেন্ড অ্যাক্টে আলেকজান্দারকে আন্টিগোনাসের পার্ট দিয়ে কোন রকমে চাপাচুপি দিয়ে চালাচ্ছি, এমন সময় এই ছোঁড়াটা গিয়ে হাজির। দেখতে যে রকমই হোক, দেবদূত স্যার, বাঁচিয়েছে আমাদের—কোথায় গেলি রে ছোঁড়া, সামনে এসে দাঁড়া। একবারে স্টেজে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা স্যার—। ‘আপনাদের সব প্লেয়ার ঠিক আছে? সব গ্রীক প্লেয়ার?’—প্রথমটা মনে হ’ল নুকুই। ঘরের গলদ কে প্রকাশ করতে চায় স্যার? আবার ভাবলাম, পরের ছেলে, ব্ল্যাক-আউটের পর হুড়মুড়িয়ে ট্রাফিক আরম্ভ হয়ে গেছে; মোটর চাপাই পড়বে, কি ট্রাম চাপাই পড়বে। বললাম, ‘আন্টিগোনাসকে নির্বাসিত করবার পর আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।’ বললে,’ভাবতে হবে না, সে থানায় আছে’। শুনতে দেরি স্যার, ট্যাক্সি ক’রে চ’লে আসছি, পোশাক ছাড়বারও তর সয় নি স্যার। ছায়া আর হেলেন সঙ্গে এসেছে, মোটরে আছে। ছায়া আবার ওর মেসো স্যার, মানে—মদনা হচ্ছে ছায়ার শালী-পো।—এই স্যার ব্যাপার সংক্ষেপে। এখন দয়া ক’রে ছেড়ে দিন গরিবের ছেলেকে। অনেক কষ্টে এর বাপকে রাজী করিয়েছিলাম, ছাড়তে চায় না; বলে, ছেলেকে আমার বকিয়ে দেবে তোমরা! বুঝুন স্যার। ওকে আমরা বকাব! এখনও দশ বছর ওর পায়ের তলায় বসে শিখতে পারি। এবারটা দেন খালাস, এই স্যারের সামনে নাক-কান মলছি, ও ছেলেকে আর কখনও—আর তুইও যে মদনা, মদ গিলে রাস্তায়

মদনা একটু একটু টলছিল, সামলাইয়া সিধা হইয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিয়া এতক্ষণে মুখ খুলিল। রক্তজবার মত চক্ষু দুইটি টিপটিপ করিয়া টানিয়া টানিয়া বলিল, “মদনার হিসাব ঠিক আছে সম্রাট। নির্বাসিত হয়ে বেরিয়ে এসে লজ্জায় অপমানে মুখ নীচু করে বশে ছিল; রামচন্দ্রের মত বেয়াহা নয় তো যে বুক ফুলিয়ে টহল দিয়ে বেড়াবে। জিজ্ঞেস কর্ ডাক্তারবাবুকে, জিজ্ঞেস কর্ জমাদার সায়েবকে, কোন খুঁত পেয়েল পার্ট করার মধ্যে? ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অ্যান্টিগোনাস স্পিকটি নট। নির্বাসিত গ্রীকসেনাপতি বাওয়া, লজ্জায় অধোবদন হয়ে বশে আছি, দণ্ড তুলে নাও, শুড়শুড় ক’রে আবার উঠব গিয়ে। এই, একে বলে পার্ট করা, বুজরুকি করবে বেছে রাজা-উজিরের পার্ট নিয়ে চেয়ার ঘামালেই হ’ল না। চল এবার। তা হ’লে আশ্‌শি দারোগাবাবু, গুন্নাইট স্যার।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *