কাব্যের মূলতত্ত্ব

কাব্যের মূলতত্ত্ব

টিফিন-পিরিয়ডের ঘণ্টাখানেক পরে বাংলার পণ্ডিত দেবকণ্ঠবাবু অসুস্থ হইয়া বাড়ি চলিয়া গেলেন।

একেবারে অভাবনীয় সৌভাগ্য। সেকেন্ড পণ্ডিতের কোষ্টিতে যে আবার অসুখে পড়া লেখা আছে, যতদূর মনে পড়ে, সাত-আট বৎসরের পাঠ্যজীবনে এ অভিজ্ঞতা আমাদের এই প্রথম। তাও এমন সুবিবেচনার সহিত অসুখে পড়া যে, মনটা আপনি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হইয়া পড়ে। আজ সপ্তমঘণ্টা অর্থাৎ শেষ ঘণ্টায় ছুটি—হেডপণ্ডিত মহাশয়ের অ্যাডিশনাল ক্লাস, তিনি বোসপাড়ায় শ্রাদ্ধ করাইতে গিয়াছেন। এখন দুইটি ঘণ্টা একসঙ্গে ছুটি পাওয়া যাইবে। সেকেন্ড পণ্ডিত মহাশয়ের এই একটি দিনের সুবিবেচনার জন্য আমাদের বরাবরের পুঞ্জীভূত আক্রোশ একেবারে ধুইয়া মুছিয়া নিঃশেষ হইয়া গেল।

পঞ্চম ঘণ্টার পরে আমরা সব ফার্স্ট ক্লাসের ছেলেরা মুখ যতদূর সম্ভব বিষণ্ণ করিয়া আপিসঘরে হেডমাস্টারের কাছে গিয়া উপস্থিত হইলাম। মুখপাত্র হিসাবে আমি মুখটা যতটা পারা গেল অন্ধকার করিয়া বলিলাম, “সার্, সেকেন্ড পণ্ডিত মশাইয়ের ক্লাস—”

“হ্যাঁ, ঠিক মনেই ছিল না; কখনও তো পড়েন না ভদ্রলোক অসুখে কিনা—তাই তো! আবার হেডপণ্ডিত মশাইও গরহাজির, তিনি থাকলেও বা তোমাদের বাংলাটা পড়িয়ে দিতে পারতেন।”

হেডমাস্টার মহাশয়ের দুশ্চিন্তায় আমরা মুখটা আরও বিষণ্ণ করিবার চেষ্টা করিলাম। আমার নিজের মুখের কথা বলিতে পারি না, তবে দেখিলাম, এরূপ অমানুষিক চেষ্টার ফলে, কৃত্রিম বিষণ্ণতার পাশে ভিতরের অকৃত্রিম পুলক ঠেলা মারিয়া আসিয়া, হরার মুখটা এমন বিকৃত করিয়া দিয়াছে যে, দেখিলে না হাসিয়া থাকা দুষ্কর হইয়া পড়ে। বিলাস তো বাংলার শোকে ফোঁস করিয়া একটা দীর্ঘশ্বাসই ফেলিয়া বসিল। ওর নিয়ম, সকলে কি করে, সেটা প্রথমে লক্ষ্য করিবে, তাহার পর সকলের উপর টেক্কা দিয়া একটা কিছু করিবে।

ঘরে বসিয়া ছিলেন সেকেন্ড মাস্টার, মৌলবী সাহেব আর কেরানী অটলবাবু।

হেডমাস্টার বলিলেন, “অটলবাবু তা হ’লে আপনিই না হয়—”

“আমায়ই যেতে হবে?—” বলিয়া দলটির পানে মুখ তুলিয়া চাহিতেই তাঁহার চোখ পড়িল হেডমাস্টারের চেয়ারের পিছনে বলাইয়ের উপর। সে প্রবল মিনতির সঙ্কেতস্বরূপ কোলের কাছে হাত দুইটি একত্র করিয়া ঘষিতেছে।

অটলবাবু ঠোটে একটা হাসি চাপিয়া মুখ ঘুরাইয়া বলিলেন, “যেতে আপত্তি নেই, তবে মাইনের বিলটা তা হ’লে কাল তোয়ের হওয়া মুশকিল, বড্ড কাটাকাটি কিনা এ মাসে—”

হেডমাস্টার ব্যস্তভাবে বলিলেন, “না না, তবে থাক, পরশু ইন্সপেক্টার আসবে, ঠিক সময় মাইনে পায় নি সব দেখলে আবার —”

অটলবাবু একবার বলাইয়ের দিকে চাহিলেন, সে সঙ্গোপনে অঞ্জলিবদ্ধ হাতটা তুলিয়া আর ওদিকে মাথাটা একটু নামাইয়া কৃতজ্ঞতা জানাইল।

হেডমাস্টার বলিলেন, “তবে আর উপায় কি? তোমরা যাও। ছুটি তো খোঁজই সব। একটু ক্ষতি হ’ল, তা যাক, বাংলা তো!”

অস্বাভাবিক বিষণ্ণতায় দম বন্ধ হইয়া যাইতেছিল যেন, ঠেলাঠেলি করিয়া দুয়ারের ভিতর দিয়া বাহির হইতেছি, এমন সময় বিলাস হতভাগা বাদ সাধিল। উদ্দেশ্যসিদ্ধ তো হইয়াই গিয়াছে, ফাঁকতালে খানিকটা যশ অর্জন করিয়া লইবার জন্য মুখটা আবার একচোট বিষণ্ণ করিয়া লইয়া মুরুব্বীয়ানার চালে বলিল, “নেহাত উপায় নেই তাই, নইলে বাংলা কি আর তাচ্ছিল্য করবার জো আছে সার? কি রকম ফেল করছে আজকাল বাংলাতে! বরং আজ হেডপণ্ডিত মশাই আসেন নি, যদি দুটো ঘণ্টাই বাংলা হ’ত—বাঙালির ছেলে হয়ে—”

কয়েকজন একসঙ্গে বিলাসের জামার খুঁট ধরিয়া টানিলাম। সে থামিল বটে, কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে। হেডমাস্টার একটু চিন্তিতভাবে মাথা নাড়িলেন, তাহার পর বলিলেন, “তা বলছ ঠিক। তা হ’লে –”

আমরা সবাই শ্বাসরুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। চিন্তিতভাবে মাথা নাড়িতে নাড়িতে হেডমাস্টার হঠাৎ মাথা তুলিয়া সেকেন্ড মাস্টারের দিকে চাহিলেন; একটু হাসিয়া বলিলেন, “এই তো কালীবাবু রয়েছেন। কি মশাই, আপনার মতো ম্যাথেম্যাটিক্স-জানা লোকের কিছু আটকাবার কথা নয়, দেখবেন নাকি একবার চেষ্টা করে? আপনার এ ঘণ্টা তো ফুরসুতও আছে।”

পিছনে বিলাসের চারিধারে দাঁতে দাঁত ঘষার একটা উৎকণ্ঠ আওয়াজ হইল। হেডমাস্টার মহাশয় ঘুরিয়া চাহিতেই হরা সঙ্গে সঙ্গে মুখটা প্রসন্ন করিয়া লইয়া বলিল, “তা হ’লে বেশ হয় সার্।”

সেকেন্ড মাস্টার মহাশয়ের চেহারাটা বেশ মনে আছে, মোটাসোটা দীর্ঘাকৃতি পুরুষ। দর্প, প্রসন্নতা এবং দাড়িতে ভরা মুখমণ্ডল; দেখিলে ভয়, শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রমে মাথা নত হইয়া আসে। সর্বদাই ভাল করিয়া কাচা এবং ইস্ত্রিকরা একটি কামিজ গায়ে। গলার কোঁচানো চাদর দুই কাঁধের উপর দিয়া বুকের মাঝামাঝি আসিয়া পড়িয়াছে। তাহাতে বিশাল বক্ষটিকে আরও বিশাল বলিয়া বোধ হইত। মাস্টার মহাশয়ের একটা অভ্যাস ছিল, প্রায়ই চাদরের কোঁচানো প্রান্ত দুইটি দুই হাতে মাঝামাঝি আনিয়া তাহাদের মুখ মিলাইয়া আবার ছাড়িয়া দিতেন। বোধ হয় কোন দিকে বেশি, কোন দিকে কম ঝুলিয়া থাক তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। জিনিসটাকে আমরা মাস্টার মহাশয়ের ম্যাথেম্যাটিক্যাল জিমন্যাসটিক্স বা অঙ্কের কসরত বলিতাম।

এই অঙ্কই ছিল তাঁহার দর্প।

দর্পের মূলে ছিল দুইটি কথা। এক, তাঁহার নিজের শক্তির উপর প্রবল আস্থা, –অবশ্য শক্তিও ছিল অবিসংবাদিত; আর দ্বিতীয়, শাস্ত্রটার উপর তাঁহার অটুট নিষ্ঠা।

সেকেন্ড মাস্টার বলিতেন, “সমস্ত সৃষ্টিটা বিধাতার কষা একটা অঙ্ক মাত্র। আমাদের ধর্মে যে বলে, এটা তাঁর ধ্যানের পরিণাম, এ কথাও যেমন ভুল, খ্রীষ্টান মতের খামখেয়ালী ইচ্ছার থিয়োরিটাও ঠিক তেমনই ভুল। তারা যে বলে—ভগবান বলিলেন, জল হউক, আর অমনই জল হইল, এ কথার কোন মানে হয় না। গণিতধর্মী সৃষ্টির কোন গাণিতিক প্রয়োজনের জন্যই ভগবানকে জল সৃজন করিতে হইয়াছিল এবং তাহা করিতে হইয়াছিল নিখুঁত অঙ্কের হিসাবে যথাপরিমাণ অক্সিজেনের সহিত যথাপরিমাণ হাইড্রোজেন মিশ্রিত করিয়া। ইহাতে যদি একটুও ভুল হইত তো ধ্যানই বল, কিংবা খামখেয়ালী ইচ্ছাই বল, মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও জলের জন্ম হইত না।”

সৃষ্টির মূলতত্ত্ব গণিত বলিয়া মাস্টার মহাশয়ের মতে এর সব রহস্যের কুলুপই এক গণিতের ‘মাস্টার কী’ বা রাম-চাবি দিয়া খোলা যায়। ধর্ম—অঙ্ক, সঙ্গীত—অঙ্ক, ইতিহাস- দর্শন—অঙ্ক, ব্যাকরণ—অঙ্ক।

আজ টিফিন-পিরিয়ডেই একচোট ঘোর তর্ক হইয়া গেল। সেকেন্ড মাস্টার মহাশয় বুকের উপর চাদরের দুই প্রান্ত মিলাইয়া ধরিয়া বলিতেছেন, “অঙ্কের ভেতরই কি নেই মশাই? আর অঙ্কের বাইরে আছেই বা কি? নিউটন অঙ্কের একটি খুট ধরে টান দিলেন, সামান্য একটি ফল-পড়া নিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির সারা রহস্য ফরফর ক’রে বেরিয়ে এল। আপনারা কালিদাস কালিদাস করেন, ভাবলাম, একবার দেখাই যাক না, ব্যাপারটা কি? সেদিন মেঘদূত পড়ছিলাম, ভেবে সারা হচ্ছিলাম, আপনারা ওতে ভাবে এলিয়ে পড়বার মত কি পান এত? ও তো এক্কেবারে খাঁটি অঙ্কের হিসেব, কি রেটে গেল, কোথায় থামলে, কোন্ সময়ে কি ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ করতে করতে যাবে তার নিক্তি দিয়ে ওজন-করা হিসেব। অ্যালজেব্রার গ্রাফের এমন সুন্দর উদাহরণ দেখাই যায় না। যক্ষরাজ যেন একটি সুন্দর টাইম-টেব্‌ব্ল ছ’কে দিয়েছে। বলুন, ম্যাথেমেটিক্স নয়? খোলের আওয়াজ একটু কানে গেলে ভাবের ঘোরে মূর্ছা যান সব; বলুন তো, বৈষ্ণব ধর্মের মূল তত্ত্বটা কি? শ্রীকৃষ্ণ কড়ে আঙুল দিয়ে গোবর্ধন পাহাড়টা তুলে ধরলেন,—পিওর ব্যালান্সিং, ভারসাম্য তত্ত্বের একেবারে গোড়ার কথা। যদি রূপক হিসেবে ধরেন তো ওই একই কথা, অর্থাৎ ম্যাথেমেটিক্স ছিল শ্রীকৃষ্ণের কড়ে আঙুলের ডগায়; আর একটু এগিয়ে যান, শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান ব’লেই ধ’রে নিন—মানেটা কি হ’ল? এই নয় কি যে, সর্বশক্তিমান ভগবানের মূলশক্তি হচ্ছে ম্যাথেমেটিক্স? সর্বশক্তির গোড়ায় অঙ্ক? সব চুপ ক’রে রইলেন যে?”

.

সেকেন্ড মাস্টার মহাশয় বলিলেন, “তা হ’লে, সত্যি আমায় যেতে হবে নাকি? তবে তোমরা এগোও, আমি আসছি; হ্যাঁ, কম্পাস, চকখড়ি আর আফিস থেকে গজের ফিতেটা নিয়ে যেও।”

আমরা যাইবার জন্য ঘুরিয়া আবার আশ্চর্য হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলাম। অনাথ ভয়টা আর চাপিতে পারিল না, শুষ্ককণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “আবার অঙ্ক করাবেন নাকি সার্?”

মাস্টার মহাশয় হাসিয়া বলিলেন, “কেন সাহিত্য কি অঙ্কের বাইরে?”

হতভাগা বিলাস। আমরা এদিকে দারুণ নিরাশায় মুষড়িয়া পড়িয়াছি, আর সে স্বচ্ছন্দে মুখে হাসি টানিয়া আনিতে পারিল! বলিল, “অঙ্ক আর পদ্য যে আলাদা জিনিস, আমি এই প্রথম শুনলুম সার্! তা ছাড়া অঙ্ক আগে না পদ্য আগে? পদ্য তো সেদিন বাল্মীকি এক দুই ক’রে অক্ষর গুনে রচনা করলেন!”

ডেঁপোমির গন্ধ ছিল বেশ একটু, কিন্তু বোধ হয় তাঁহার অঙ্কের পরিপোষক বলিয়া সেকেন্ড মাস্টার চটিলেন না; বরং হেডমাস্টারের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ছন্দ যে অঙ্ক— এ কথা বলেইছি আপনাদের কতবার। ‘না’ বলবার জো নেই। তোমরা চল।”

বারান্দা হইতেই একটু একটু করিয়া অসন্তোষের আরম্ভ হইল এবং সকলে ক্লাসে ঢুকিলে সেটা রীতিমত গোলমালে দাঁড়াইল। লক্ষ্য সবার একা বিলাস। “ইডিয়ট, কে তোকে মুরুব্বীয়ানা করতে বলেছিল র‍্যা? ওঃ, বাংলার জন্যে ওঁর প্রাণ ডুকরে কেঁদে উঠল! শুভঙ্কর বাল্মীকির কত আগে র‍্যা বিলাস? আজ ফুটবল খেলার সময় সামনে একবার আসিস বিলে, সাহস থাকে তো, যেখানে শুভঙ্কর আছেন, সেইখানে পাঠিয়ে দোব। ওর তো সময় থাকবে না, ও যে সেকেন মাস্টারের সঙ্গে হুঁকো টানতে টানতে—”

বিলাস প্রথমটা অপরাধীর মত মুখ বুজিয়া রহিল, তাহার পর আঘাতে আঘাতে একেবারে মরীয়া হইয়া উঠিয়া উত্তর দিতে যাইবে, এমন সময় দু হাতে চাদরের খুঁট মুঠা করিয়া ধরিয়া সেকেন্ড মাস্টার প্রবেশ করিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, “কই, কি আছে তোমাদের, নিয়ে এস।”

বিলাস তৃতীয় বেঞ্চ হইতে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “পদ্য সার্!”

হরা চাপা গলায় ব্যঙ্গকটু স্বরে বলিল, “বল্ পদ্যাঙ্ক।”

বিলাস দুষ্টামি করিয়া তাহার দিকে মুখ ঘুরাইয়া উঁচু গলায় প্রশ্ন করিল, “কি বলতে বলছিস?”

হরা ভয়ে প্রথমটা হকচকিয়া গেল, তাহার পর দাঁড়াইয়া উঠিয়া সেকেন্ড মাস্টারের দিকে চাহিয়া বলিল, “পদ্য আছে সার্। নবীন সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’।”

তাহার পর হাত দিয়া নিজের বইয়ের গোছাটা নীচে ফেলিয়া কুড়াইবার অছিলায় ঝুঁকিয়া পড়িল এবং সেখান হইতে দুইটা হাত জোড় করিয়া বিলাসের দিকে চাহিয়া রহিল। বিলাস আস্তে আস্তে বলিল, “ওঠ, আর কখনও করিস নি।”

সেকেন্ড মাস্টার প্রসন্নভাবে ক্লাসের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বলিলেন, “পলাশীর যুদ্ধ—ব্যাট্ল অব প্ল্যাশী? অনাথ, কোন্ সালে হয়েছিল, বলতে পার?”

হরা আস্তে আস্তে বলিল, “এতেও অঙ্কের গন্ধ পেয়েছে।”

অনাথ দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “১৭৫৭, সার্।”

“সেভেনটিন ফিফটি-সেভেন,–বেশ, কোন্ সেনচুরি হ’ল?”

অনাথ চুপ করিয়া রহিল। সেকেন্ড মাস্টার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া পিছনের বেঞ্চে ভবেশের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া বলিলেন, “তুমি, কবি?”

ভবেশ কবিতা লেখে বলিয়া একটু বিশেষভাবে সেকেন্ড মাস্টারের লক্ষ্যস্থল হইয়া বলিল, “আজ্ঞে, সপ্তদশ শতক।”

“তা তো হবেই; ১৭৫৭ সতেরো শতাব্দী না হয়ে যায় কোথায়? আবার সপ্তদশ শতক: ভাষার জলুস দেখ না! তুমি যে এর মধ্যে শতদল’ কি ‘কিশলয়’ এনে ফেল নি, এই আমার বাবার ভাগ্যি! তুমি, শৈলেন?”

বলিলাম, “অষ্টাদশ শতাব্দী সার্।”

“কেন বলতে পার? এদিকে তো ১৭৫৭, অষ্টাদশ শতাব্দী হ’ল কি ক’রে?” রহস্যটা জানা ছিল না, চুপ করিয়া রহিলাম।

“তোমরা বাপু এসেছ মহাকাব্য ‘পলাশীর যুদ্ধ’ পড়তে অথচ এদিকে ১৭৫৭ কোন্ সেনচুরি হ’ল জান না; যদিই বা জান এক-আধজন তো কি ক’রে হ’ল বলতে পার না। তোমরা কাব্যটার কি ছাই রসগ্রহণ করবে, শুনি?”

আমরা লজ্জায় অধোবদন হইয়া রহিলাম; অনেকে লজ্জায়, অনেকে আবার পরস্পরের পানে আড়চোখে চাহিবার সুবিধার জন্য।

“হয়েছে, আর লজ্জা দেখাতে হবে না, লজ্জা পাবার কথা তো বেচারী নবীন সেনের, তোমাদের মত পাঠকের হাতে প’ড়ে যাঁর নাকালের অন্ত নেই। যীশুখ্রীস্ট কতদিন পূর্বে জন্মেছিলেন, বলতে পারেন বলাইবাবু?”

বলাই পাখার দড়ির দিকে চাহিয়া রহিল।

“তুমি, অনাথ? ইংরাজি এটা কত সাল?”

“উনিশ শো বারো সার্।”

“তা হ’লে?”

“উনিশ শো বারো বছর পূর্বে জন্মেছিলেন সার্।”

“অর্থাৎ–”  

চকখড়িটা হাতে লুফিতে লুফিতে মাস্টার মহাশয় উঠিলেন এবং বোর্ডে গিয়া পড়িয়া পড়িয়া লিখিলেন, “উনিশ শো বারো মাইনাশ উনিশ শো বারো—ইজ ইকোয়াল টু জিরো। অর্থাৎ?”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আবার ক্লাসের দিকে চাহিলেন। সকলেই হতভম্ব হইয়া গিয়াছিলাম, তাঁহার দৃষ্টি এড়াইয়া বোর্ডের ১৯১২–১৯১২-র বিয়োগফল শূন্যটার পানে শূন্যনেত্রে চাহিয়া রহিলাম।

সেকেন্ড মাস্টার মহাশয়, বোধ হয়, কাব্যটা অঙ্কের জটিলতা অবলম্বন করিতে আরম্ভ করিয়াছে দেখিয়া প্রসন্নভাবে স্মিতহাস্য করিলেন, তাহার পর শূন্যটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করিয়া বলিলেন, “অর্থাৎ এই জিরো হ’ল স্টার্টিং পয়েন্ট, এইখান থেকে হিসেবের শুরু। অর্থাৎ?”

আমরা ক্রমেই ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিতেছিলাম। যাহারা একটু-আধটু বুঝিতেছিলাম, সাহস করিয়া উত্তর দিতে পারিলাম না! মাস্টার মহাশয় আরও প্রসন্নতার সহিত হাস্য করিলেন।

“অর্থাৎ এই শূন্য থেকে এক শো বছর পর্যন্ত হ’ল প্রথম সেন্‌চুরি, এক শো থেকে দু শো বছর হ’ল—”

প্রায় সমস্ত ক্লাস হইতে মুক্তকণ্ঠের একটা আওয়াজ উঠিল, “দ্বিতীয় সেন্‌চুরি সার্।”

“বুঝেছ তো?”

বিলাস বলিল, “একেবারেই জল হয়ে গেছে সার্।”

“টুকে নাও।”

এ কথাটা মাস্টার মহাশয়ের একটা মুদ্রাদোষে দাঁড়াইয়া গিয়াছিল প্রতিদিন পাঁচ-ছয় পিরিয়ড করিয়া অঙ্ক কষাইতে কষাইতে। টুকিবার কিছু না থাকিলেও আমরা খাতার উপর একটু পেন্সিল চালাইয়া, অতঃপর কি বলেন শুনিবার জন্য আবার মাস্টার মহাশয়ের দিকে চাহিলাম।

মাস্টার মহাশয় বলিলেন, “তোমরা যুদ্ধের কাহিনী পড়তে যাচ্ছ, কিন্তু জেনে রেখো, কাব্য পড়া মাত্রই একটু যুদ্ধ করা;—শুধু কাব্য বলি কেন, যে কোন জিনিস পড়াই যুদ্ধ করা। কোন একটা জিনিস বোঝা মানেই সেই জিনিসটাকে আয়ত্ত করা অর্থাৎ জয় করা। তোমরা এক্ষেত্রে নবীন সেনের কাব্য—’পলাশীর যুদ্ধ’ আয়ত্ত করতে যাচ্ছ, তার রস উপলব্ধি করবে ব’লে, এই তো? এই যে কাব্যের বিরুদ্ধে বিজয়-অভিযান, এতে তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র থাকা চাই তো? এখন, সে অস্ত্র কি? তুমি? তুমি? ভবেশ?”

ভবেশ ডেস্কে হাত দুইটার উপর ভর দিয়া একটু ঝুঁকিয়া বলিল, “হৃদয়রূপী —

“ব’স বাপু, আমি জানি, তুমি সোজা ব্যাপারটিকে জটিল না ক’রে ছাড়বে না। বিলাস?”

“অঙ্ক সার্।”

“অঙ্ক! তবে শুধু অঙ্ক নয়, ইতিহাস ভূগোল সবই আছে, এই সমস্ত জিনিসের জ্ঞানই হ’ল তোমার অঙ্ক।”

বিলাস বলিল, “ইতিহাস ভূগোলও তো অঙ্ক থেকে আলাদা নয় সার্!”

“নয়ই তো! এইবার মনে হচ্ছে, যেন তোমরা কতক কতক বুঝেছ! পড় দেখি পদ্যটা এইবার।”

.

বিলাসেরই দিন আজ। ‘আবার আবার সেই কামান গর্জন’—বলিয়া অ্যাটিঙের ঢঙে আরম্ভ করিতে যাইতেছিল, সেকেন্ড মাস্টার বাধা দিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, কামান-গর্জন থামাও একটু। বলি, রণক্ষেত্র সম্বন্ধে কোন একটা ধারণা ক’রে নিয়েছ আগে?”

ক্লাসে একটা চাপা আক্রোশের হাসি উঠল। বিলাস থামিয়া গিয়া অপ্রতিভভাবে বলিল, “না সার্।”

“তা করবে কেন? তাতে যে অঙ্কের গন্ধ আছে একটু। অথচ যিনি লিখেছেন, তাঁকে সমস্ত অঙ্কশাস্ত্রটি মগজের মধ্যে রেখে তবে এই যুদ্ধের ইতিহাসটি বর্ণনা করতে হয়েছে।”

সেকেন্ড মাস্টার উঠিয়া গিয়া বোর্ডের গায়ে উঁচু দিকের ফলাটা নির্দেশ করিয়া একটি তীর আঁকিলেন, এবং ফলার মুখে একটি ইংরেজি ‘N’ অক্ষর বসাইয়া দিলেন। কে একজন চাপা গলায় প্রশ্ন করিল, “ওটা আবার কেন?

হরা সেইরূপ স্বরে উত্তর করিল, “বাংলা সাহিত্যের জন্য শক্তিশেল।”

সেকেন্ড মাস্টার বলিলেন, “এটা হ’ল উত্তর দিক।”

তীরের সমান্তরাল আর একটি দাঁড়ি টানিলেন, বলিলেন, “ভাগীরথী।” এবং দাঁড়িটির উভয় প্রান্তে মাঝে একটু জায়গা ছাড়িয়া দুইটি চতুষ্কোণ ঘর আঁকিলেন, একটির মাঝখানে লিখিলেন—’ইং’, অপরটির মাঝখানে ‘ন’, তাহার পর অনাথের পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, “কিছু বোধগম্য হচ্ছে অনাথবাবুর?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ সার্, এদিকটা হ’ল নবাবের সৈন্য। আর এদিকটা ইংরেজের।”

“কি করে দাঁড়িয়ে আছে সব? তালগোল পাকিয়ে?”

“আজ্ঞে না সার্।”

“তবে?”

অনাথ প্রশ্নটার অর্থ কি এবং কি ধরণের উত্তর চাহেন, তাহার কোনও হদিস না পাইয়া হতাশ ভাবে বোর্ডের দিকে চাহিয়া রহিল।

“খুব বুঝেছ সব। তুমি? তুমি? ইউ, তুমি শৈলেন?”

আমি মুখটা ফেকাশে করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম, আকুলভাবে বোর্ডের সেনাবাহিনীর দুইকক্ষের দিকে চাহিলাম। তাহার পর তীরের ফলায় নজরটা আটকাইয়া গিয়া একটা বুদ্ধি আনিল, বলিলাম, ‘সঙিন উঁচু ক’রে সার্।”

ভাল ছেলে বলিয়া আমার একটু নাম ছিল। মাস্টার মহাশয় এমন গভীরভাবে নিরাশ হইয়া গেলেন যে, আমার উত্তরের উপর কোন মন্তব্য প্রকাশ করিলেন না।

ভবেশকে বলিলেন, “যা, বোর্ডের কাছে যা, জিওমেট্রির ছয়ের প্রব্লেমটা মুখস্থ আছে?”

ভবেশ চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া ছাদের দিকে এমন ভাবে চাহিয়া রহিল, মনে হইল, যেন ছাদ ভেদ করিয়া আকাশে কোন নক্ষত্রলোকে, ছয়ের প্রব্লেমটার অনুসন্ধান করিতেছে। সেকেন্ড মাস্টার বলিলেন, “যা, ওই এক কোণে বসে পদ্য লিগে যা। বলাই?”

ভবেশের অবস্থার সঙ্গে বলাইয়ের অবস্থার কোন প্রভেদ লক্ষিত হইল না। সেকেন্ড মাস্টার তখন নিজে বোর্ডের কাছে গেলেন এবং সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেক চতুষ্কোণ ঘরটিতে পূর্ব-পশ্চিমে গোটাকতক করিয়া সোজা লাইন টানিলেন। বলিলেন, “এই সৈন্যেরা দাঁড়িয়ে আছে, প্রত্যেক লাইনটি পরস্পর সমান্তরাল, কেন না, আমি প্রত্যেকটিকে প্রথম লাইনটির সঙ্গে প্যারালাল ক’রে টেনেছি। কোন্ থিয়োরেম?”

বিলাস দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “পনরোর থিয়োরেম সার্।”

অনাথ সামনের খাতার দিকে মুখটা নীচু করিয়া আমার দিকে আড়চোখে বলিল, “অঙ্কের জের ধ’রে কোন্‌খানে চ’লে এলেন দেখ। কোথায় পলাশীর যুদ্ধ আর কোথায় পনরোর থিয়োরেম!”

সেকেন্ড মাস্টার সমান্তরাল লাইনগুলির উপর দিয়া তির্যকভাবে একটি সোজা লাইন টানিলেন, বলিলেন, “ঠিক। ব’স। পনরোর থিয়োরেম বলছে, যদি দুই কিংবা ততোধিক লাইন অন্য একটি লাইনের সঙ্গে সমান্তরাল হয় তো তারা পরস্পরের মধ্যেও সমান্তরাল হবে।”

অঙ্কের খেলা পুরোমাত্রায় জমিয়া গিয়াছে। মাস্টার মহাশয় সমস্ত থিয়োরেমটি বিধি অনুসারে বুঝাইয়া দিয়া বলিলেন, “তা হ’লে সৈনোরা তালগোল পাকিয়ে, (আমার দিকে শ্লেষ কটাক্ষ করিয়া) সঙিন খাড়া ক’রে না থেকে প্যারালাল লাইনে সারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুনের ব্যূহ রচনার কথা শুনেছ তো? পিয়োর ম্যাথেমেটিক্স; নিজের সৈন্যের সংখ্যা আর শক্তি বুঝি, তাকে বিভিন্ন সেকশনে ভাগ ক’রে দাঁড় করানো শুধু হায়ার ম্যাথেম্যাটিক্সের খেলা—জিয়োমেট্রি, অ্যালজেব্রা, ট্রিগনোমেট্রি, কেমন—ভাল লাগছে, ইন্টারেস্টিং বোধ হচ্ছে?”

ঢং ঢং করিয়া ষষ্ঠ ঘণ্টা শেষ হইল।

“নাও, পদ্যটা পড় দিকিনি এইবার।”

অপ্রস্তুত হইবার ভয়ে বিলাস আর উঠিল না। বোধ হয় অঙ্কের হাত হইতে পরিত্রাণ পাইবার আশায় প্রত্যেক বেঞ্চে দুই-একজন করিয়া ছেলে উঠিয়া দাঁড়াইল, ভবেশ পর্যন্ত।

মাস্টার মহাশয় অনাথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, “ইউ।”

অনাথ পড়িল—

আবার আবার সেই কামান গর্জন,
উগরিল ধূমরাশি
আঁধারিল দশদিশি
গরজিল সেই সঙ্গে ব্রিটিশ বাজন।

মাস্টার মহাশয় চিন্তিতভাবে মাথা নাড়িলেন বলিলেন, “যতটা সহজ ভাবছ, ততটা নয়। জিনিসটাকে খুব ভাল করে অ্যানালাইজ ক’রে দেখতে হবে, লিখে ফেল বোর্ডে।”

অনাথ রণস্থলের নীচে পদ্যটা লিখিয়া ফেলিল। মাস্টার মহাশয় একবার মনে মনে পড়িয়া লইয়া বলিলেন, “ধূমরাশি’র ওপর ১ লেখ্ ‘উগরিল’র ওপর ২, ‘দশে’র ওপর ৩, ‘দিশি’র ওপর ৪, ‘আঁধারিল’ ৫, ‘সেই’ ৬, ‘সঙ্গ’ ৭, ‘ব্রিটিশ’ ৮, ‘গরজিল’ ৯–যাও, নিজের সীটে ব’স গিয়ে। এটা কি হ’ল বলতে পার?”

সবাই বুঝিল, কবিতাটির অন্বয় করা হইল, কিন্তু নিগূঢ় কোন অঙ্কের কারসাজি আশঙ্কা করিয়া কেহ আর উত্তর দিল না। “ইউ ইউ” করিতে করিতে মাস্টার মহাশয়ের নজর হরার উপর পড়িল? সে বেঁটে হওয়ার সুবিধায় মাথা নীচু করিয়া ঢুলিতেছিল।

মাস্টার মহাশয় ডাকিলেন, “হরা!”

হরা হন্তদন্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

“নিদ্রা দেওয়া হচ্ছে? পদ্যর মাথায় ওই ফিগারগুলো কি হ’ল?”

তন্দ্রা হইতে একেবারে অঙ্কের মাঝখানে পড়িয়া হরার আর ভাবিয়া দেখিবার শক্তি রহিল না; বলিল, “একুশ আপন—”  

সেকেন্ড মাস্টার একরকম ভেংচাইয়াই বলিলেন, “হ্যাঁ, বলে যাও, একুশ আপন পাঁচশো চৌত্রিশ আপন ন’শো।”

ললিত ঠিক সামনেই প্রথম বেঞ্চে বসিয়া ছিল। সেকেন্ড মাস্টারের রসিকতায় হাসিলে তিনি সন্তুষ্ট হইয়া যদি প্রশ্নাদি না করেন, এই আশায় সবে হাসিতে শুরু করিয়াছে, সেকেন্ড মাস্টার আঙুল দেখাইয়া বলিলেন, “তুমি, ললিত?”

ললিতের মুখটা যেন ছাইয়ের মত হইয়া গেল। ও বেচারার জায়গা প্রথম বেঞ্চে নয়, শেষ বেঞ্চে নিরুপদ্রবে বসিয়া সাতটি ঘণ্টা কাটাইয়া বাড়ি চলিয়া যায়; আজ গোলমালে কেমন অন্যমনস্কভাবে প্রথম বেঞ্চে বসিয়া পড়িয়াছে। একে পড়াশুনার সঙ্গে কোন কালেই কোন সম্বন্ধ নাই, তাহাতে আবার অঙ্ক শেষ হইয়া পদ্য চলিতেছে, কি পদ্য শেষ হইয়া এই আসলে অঙ্ক আরম্ভ হইল, সে সম্বন্ধে কোন ধারণাই পাকা করিয়া উঠিতে পারে নাই! ধীরে ধীরে উঠিয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত বোর্ডের পানে চাহিয়া পদ্যের উপর লেখা অঙ্কগুলো পড়িতে পড়িতে স্খলিত কণ্ঠে বলিল, “একুশ কোটি তিপ্পান্ন লক্ষ ঊনপঞ্চাশ হাজার ছশো আটাত্তর।”

চারিদিকে একটা চাপা হাসি উঠিল। সেকেন্ড মাস্টার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “চমৎকার! একুশ কোটি কি, তা শুনি?”

ললিত আরও ঘাবড়াইয়া গিয়া বলিল, “সৈন্য সার্!”

“ভারতবর্ষের লোক-সংখ্যা কত?”

“তিরিশ কোটি সার্।”

“তা হ’লে প্রায় সবাই পলাশীর যুদ্ধে নেমে পড়েছিল বল?”

ললিত চুপ করিয়া রহিল। সেকেন্ড মাস্টার নিরাশ হইয়া বলিলেন, “ব’স। আমারও যেমন দুর্ভোগ, তোমাদের মত গর্দভদের ক্রিটিক্যালি পদ্য পড়াতে যাওয়া! তুমি, শৈলেন?”

আমি সংখ্যার নির্দেশমত ভয়ে ভয়ে কথাগুলো পড়িয়া অম্বয়টা দাঁড় করাইলাম। মাস্টার মহাশয়ের রাগটা পড়িয়া গেল। প্রশ্ন করিলেন, “এবার তোমরা বুঝতে পেরেছ যে, পদ্যের গোড়ার রহস্য হচ্ছে ম্যাথেম্যাটিক্স?”

কাহারও কাছে কোন উত্তর না পাইয়া বলিলেন, “দেখ, তোমাদের সামনে গদ্য আর পদ্য—দুই একসঙ্গে রয়েছে, দুটোর মধ্যে মূলগত প্রভেদটা কি?”

আমি বলিলাম, “ছন্দ সার্।”

“ছন্দটা কি?”

চুপ করিয়া রহিলাম।

“তুমি কবি?”

ভবেশ বলিল, “শব্দের এমন সংযোজনা সার্—”

“ব’স বাপু, তুমি আরম্ভই করলে অনুপ্রাস দিয়ে। ছন্দটা আর কিছু নয়, ম্যাথেম্যাটিক্স—সময়ের অতি সূক্ষ্ম বিভাগ—কথাটা মনে রেখো,—বিভাগ, ডিভিশন— মাইন্ড ইউ। পদ্য থেকে এই ম্যাথেম্যাটিক্স বের ক’রে নাও, যা অবশেষ থাকবে তা গদ্যেরও অধম। তা হ’লে দাঁড়াল—নবীন সেন বাইরেই নবীন সেন, তাঁর ভেতরে রয়েছে—ভেতরে রয়েছে—?”

বিলাস বলিল, “যাদব চক্রবর্তী সার্।”

মাস্টার মহাশয় প্রীতিপ্রসন্ন দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, “বুঝেছ তো?’

“একেবারে জল হয়ে গেছে সার্।”

“সমস্ত ডায়াগ্রামটা এঁকে নাও। এইবার মানেটা একবার প’ড়ে নাও দিকিনি—অর্থাৎ কাব্যের ভাবের দিকটা আর কি। দেখবে, তার মধ্যে ম্যাথেম্যাটিক্স আরও সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করেছে। কি বলছে?—

আবার আবার সেই কামান গর্জন
উগরিল ধূমরাশি
আঁধারিল দশদিশি

হিয়ার ইউ আর, দশদিশি—দি টেন ডিভিশন্‌স অব দি কম্পাস। অনাথ!”

এমন সময় ঢং ঢং করিয়া শেষ ঘণ্টা পড়িল। মাস্টার মহাশয় ক্লাসের চারিদিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, “আর একটু তা হ’লে পড়বে নাকি সব?

বিলাস গোড়ায় মজাইয়াছিল, শেষের দিকে কিন্তু সে-ই উদ্ধার করিল। আমরা শঙ্কিতভাবে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতেছি, বিলাস বলিল, “আজ না হয় আর থাক স্যর্, জিনিসটাকে সত্যিই যতটা সহজ ভেবেছিলাম, ততটা নয়, অনেক ভাববার কথা আছে।”

মাস্টার মহাশয় গভীর প্রীতির সহিত চাদরের প্রান্তভাগ দুই মুষ্টিতে একত্র করিয়া উঠিয়া পড়িলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *