নারী রহস্যময়ী

নারী রহস্যময়ী

গোড়াতেই কিছু বলে রাখতে চাই।

কলম ধরার আগেই, কেন এই দুঃসাহসিক কর্মে লিপ্ত হয়েছি তার জন্যে একটু কৈফিয়ৎ দেওয়া দরকার বোধহয়।

রহস্য কাহিনী কখনও আমি লিখিনি, লিখতে পারিনে—আমার তাবৎ লেখাই হাস্যকর (হয়তো এটিও শেষ পর্যন্ত তাই হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিছুই বলা যায় না—) তা সত্ত্বেও কেন যে এই রোমাঞ্চকর পথে অকস্মাৎ আমার পদার্পণ তার একটা কারণ আছে অবশ্যই।

একজন বহু বিখ্যাত লেখক এই সংখ্যাতেই হাসির উপন্যাস লিখছেন জেনেই তাঁর আদর্শের অনুসরণেই যে আমার নিজের কীর্তির চেয়েও মহৎ হয়ে মহত্তর রচনার অপপ্রয়াস তা হয়তো ঠিক নয়। রজনীগন্ধার উদার দাক্ষিণ্যের অর্থলোভই যে আমায় প্রলুব্ধ করে এই বিপথে টেনে এনেছে তাও আমি বলতে পারি না।

অর্থের খাতিরে নয়, খ্যাতির অর্থেও না…

রজনীগন্ধার থেকে এ ধরনের রহস্যময় প্রস্তাব আসতেই আমি বলেছিলাম—

ধীরে রজনী, ধীরে!

না, রজনীগন্ধাকে না, নিজেকে সম্বোধন করেই আমার ওই উচ্চারণ—নিজের প্রতিই উক্ত বঙ্কিম-কটাক্ষ! এই হঠকারিতার পূর্বে তিনবার চিন্তা করে দ্যখো হে! এ কর্ম তোমার সাজে কি না, তোমার পক্ষে নিতান্তই সাজা হবে কি না খতিয়ে দ্যাখো একবার!

বারম্বার নিজেকে একথা বলেছি, কিন্তু টাকাটা আগাম আসতেই হাতালাম। তারপরে বাধ্য হয়েই কলম ধরতে হল আর তারপরেই এই…এই রহস্যের অবতারণা!

এবং এই কথাগুলি বলা। আমার কাহিনীর ভূমিকা হিসেবে নয়—বস্তুত এটা আমার এজাহার।

বইটার সঙ্গে যে একটা হত্যাকাণ্ড জড়ানো তা আপনারা ধরে নিতে পারেন। রহস্য কাহিনীর সঙ্গে খুনোখুনি জড়ানো থাকে, থাকবেই।

আর প্রত্যেক হত্যাকাণ্ডেই, আসামিকে, এমনকী আসামি না হয়েও অনেককে এজাহার দিতে হয়। হত্যা ব্যাপারের এই একটা বড় দোষ। তা হলেও এটাই দস্তুর। এবং এই দায় থাকার জনাই অনেকের মনে হত্যাকাণ্ডের সাধ থাকলেও হাত উঠতে চায় না হঠাৎ।

কে হত্যাকারী? এই কাহিনীর হত্যাকারী যে কে তা খুঁজে বার করতে আপনাদের দস্তুর মতো বেগ পেতে হবে। যাকে এবং যাকে যাকে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করবেন শেষটায় দেখা যাবে যে সে নয়। যে লোকটি খুন হয়েছে আর যিনি গোয়েন্দা এই দু’জন বাদে প্রায় সবার প্রতিই অপবাদে সন্দেহ হবে—এবং লেখক হিসেবে, বলতে কী, সেইখানেই আমার বাহাদুরি।

এমনকী, এক এক সময় গোয়েন্দার প্রতি সন্দেহ জাগাও কিছু বিচিত্র নয়—বাহাদুরির ওপরে সেটা আরও এক কাঠি! হয়তো বা শেষে যদি এমনও মনে হয়, যে খুন হওয়া লোকটি নিজেই খুন করে বসেছিল (অথচ সেটা তার আত্মহত্যা নয়) তা হলেও আমি কিছুমাত্র বিস্মিত হব না।

ডিটেকটিভ কাহিনীতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই—যদিও বিস্ময়ের বিষয় পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে ছড়ানো থাকে। এবং সেই ছত্রাকারের শেষটায় গিয়ে কী দাঁড়ায়, একজন হত্যাকারীর দর্শন পাওয়াও দুর্ঘটনা হতে পারে—সেই চরম দুর্ঘটনার সাক্ষী হবেন আপনারাই।

তবে সেটা সম্পূর্ণই আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপরে নির্ভর করে—আমার পক্ষে আগেভাগেই বলে দেওয়া সাজে না।

তবে একটা কথা আমি বলতে পারি, এবং বলতে চাই যে যাকে আপনারা কিছুতেই সন্দেহ করবেন না, করতেই পারবেন না—-আসলে সে-ই হচ্ছে এই বইয়ের আসল হত্যাকারী।

সে আর কেউ নয়।

এই কাহিনীর হত্যাকারী আমিই। এই কথাই আমি হলফ করে বলতে চাই। সেই হেতুই আমার এই এজাহার।

ডিটেকটিভ গল্প আমি লিখি না। লিখতেন আমাদের হেমেনদা—স্বৰ্গত হেমেন্দ্রকুমার রায় আর লেখেন আমার বন্ধু ডাঃ নীহার গুপ্ত। আগেকার কালে লিখে গেছেন পাঁচকড়ি দে, দীনেন্দ্রকুমার রায়, চমৎকার লেখা তাঁদের, পড়ে চমৎকৃত হয়েছি। কিন্তু মনে মনে প্রেরণা পেলেও কখনও তাঁদের অননুকরণীয় রচনার অনুসরণে যাবার উৎসাহবোধ করিনি কখনও। তবে এতদিন পরে সেই শখ হল কেন, তার গোড়াকার কাহিনীটি বলি এবার।

আমার এই এজাহারের মধ্যে সেই কথাটাই লিপিবদ্ধ।

এর গোড়ায় এই রজনীগন্ধা নয়, হেমেনদাই বরং, গোড়াতেই তা বলে রাখি।

আমাদের হেমেনদাকে নিয়েই কাণ্ডটা ঘটেছিল? এর প্রেরণা পেয়েছিলাম আমি সেই কালেই। হেমেনদার জীবদ্দশাতেই বদ্ধমূল সেই বাসনা অগোচরে অবচেতনে লালিত হয়েছে এতকাল। সে বিষয়ে আমি সচেতন না থাকলেও আমার অন্তর্গত সেই মনসা আধুনা এই তরুণ সম্পাদকের ধুনার গন্ধে উস্কানি পেয়েছেন—ফলে যা হবার! অবচেতনের গহ্বর থেকে ফণা বিস্তার করে বেরিয়েছেন। সেই প্ররোচনা থেকেই এই রচনা।

এবার আমার এজাহারের বক্তব্যে আসা যাক।…

খ্যাতির জন্য মানুষ কী না করে! খ্যাতির খাতির একটা আলাদা। এমনকী, লেখকরাও চায় তাদের খ্যাতির চৌহদ্দি বাড়ুক। যিনি কবিতা লেখেন তিনি হঠাৎ উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। আর উপন্যাসকার তাঁর চারপোয়া কীর্তি উপচে উঠে কবিতার কসরতে লেগে যান—নিদেনপক্ষে গদ্য কবিতায়। এবং তারপরেও—না টাক গিয়ে নাটকে চলে যান সড়াৎ করে—এমনকী, প্রহসন হয়ে উঠতেও তাঁর বাধে না। আরম্ভর আগেও যেমন আরম্ভ থাকে তেমনি শেষ হবার পরেও আড়ম্বরের শেষ হয় না। এমনই হয়ে থাকে। অতএব আমিও কিছু তার ব্যতিক্রম হতে পারি না।

আমার এই আরম্ভর আগেও যে আরম্ভ ছিল, সেই কথাই বলি।

আমার যে খ্যাতি আছে, বা কদাচ হতে পারে, এ সন্দেহ আমার কখনও ছিল না। কিন্তু সেই ধারণা সেদিন আমার টলেছিল। একজনের পত্রাঘাতেই সে ধারণা টলিয়ে দিয়েছিল আমার।

সেকালে ডাকঘর ছিল না, ভাবুন একবার। লেখকদের কী কষ্টটাই না গেছে। নিজেদের খ্যাতির বহর টের পাবার কোনও উপায় ছিল না তখন। দূর দুরান্তরের পাঠক-পাঠিকার কাছ থেকে চিঠিপত্রের ছলনায় নির্জলা সাধুবাদ না এলে কি লেখবার সাধ হয়? লেখার আস্বাদই চলে যায়। আপনারাই বলুন না! অথচ ভবভূতির কথাই ধরুন, কিংবা কালিদাসকেই ধরা যাক। তাদের দুঃখের কথা ভাবলে আমাদের দুঃখ হবে। চিঠি পেতেন না, তবু কোন সুখে যে তাঁরা লিখতেন লিখে লিখে মরতেন তাঁরাই জানেন!

বাস্তবিক, সেকালে তাঁদের কোন বই পাঠকসমাজ ঠিক কীভাবে নিল জানবার কোনও উপায়ই ছিল না তখন। কেননা, সেকালে ডাকঘর ছিল না, তাই পাঠকদের জানাবার কোনও উপায় ছিল না। সত্যি বলতে, কোনও লেখক তাঁর পাঠকদের কাছ থেকে কতগুলি করে চিঠি পেয়ে থাকেন তা-ই তো তাঁদের সাফল্যের নিরিখ!

কেবল সম্মানদণ্ডই নয়, তাঁদের লেখার মানদণ্ডও তাই। তাই নাকি?

অবিশ্যি, ভবভূতির বাল্যকালের প্রাক্তন সতীর্থদের কয়েকজন ছিলই যারা পলান্ন কি পরমান্ন খেতে পেলে তাঁর লেখার বাহবা দিতে কার্পণ্য করত না। পায়স পিস্টকের বিনিময়ে চিরদিনই তারা তাঁকে উৎসাহ দিয়ে এসেছে। এবং হয়তো কালিদাসের ভাগ্যও একেবারে মরুভূমি ছিল না। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের উজ্জয়িনীর শ্রেষ্ঠীরা, এমনকী স্বয়ং নগরপালও হয়তো কোনও-না কোনও দিন তাঁর পিঠ চাপড়ে বলে বসেন, ‘লেগে থাকো ছোকরা, চর্চা ছেড়ো না। ভাল হোক মন্দ হোক, লেখার অভ্যাস রেখে যাও। চালিয়ে যাও, আমি বলছি।…ক্রমে ক্রমে নাম হবে, খ্যাতি ছড়াবে। কালেক্কে একদিন তুমিও নামজাদা হবে। ব্যাস বাল্মীকির মতো না হোক, তা হলেও তুমিও একটা হবে একদিন। কিছু আশ্চর্য নয়।’

এমন উৎসাহলাভ তো আমাদের বরাতেও ঘটে থাকে। আমাদের এলাকার দারোগা, অতদূর না হোক, একজন ডাকপিয়ন সেদিন আমার একখানি বই-এর প্রচুর সুখ্যাতি করে গেলেন। দুঃখের বিষয় বইখানি আমার লেখা নয়। কার লেখা, তাও জানি না। এবং চপ কাটলেট খাওয়ালে আমাদের বন্ধুরাই বা কেন আমাদের লেখাকে এমন খারাপ বলবে? তা মনে মনে যতই শত্রুতা থাক না? কিন্তু সে কথা তো নয়। কাছাকাছি প্রশংসামাত্রই স্বার্থপ্রণোদিত কিংবা অর্থহীন। একেবারে অর্থহীন হয়তো নয়, বরং বেশ খরচান্তকর, তবে কিনা তার কোনও মানে হয় না। অজানার অচেনার এবং সুদূরের সার্টিফিকেটেরই যা দাম।

‘আমি সুদূরের পিয়াসী!’ সাধে কি গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ? ‘কক্ষে তার রুদ্ধ দুয়ার’ তথাপি সব কিছু পাসরি কবি সুদূরের অভিলাষী হয়েছিলেন। কিন্তু আজ আর কোনও লেখকের সুদূর পিয়াসার চরিতার্থতায় কক্ষচ্যুত হতে হয় না, সুদূর-পরাহতই চিঠির ছদ্মবেশে উল্কাবেগে ছুটে এসে অদুর পরাহত হয়।

এই সুবিধা সেকালের কালিদাস ভবভূতির ছিল না, আমাদের আছে। ডাকঘর কল্পতরুর প্রসাদে নব নব পত্রোদ্গমের এই সুবিধা। এই চিঠি পাওয়া-পাওয়ি নিয়ে লেখকদের মধ্যে কি কম রেষারেষি হয় নাকি? কোনও সাহিত্যিক বৈঠকে দু’জন লেখকের প্রথম আলাপ হয়তো এই ভাবেই হয়ে থাকে।

‘ওঃ কী চিঠিই আসছে যে আজকাল। পাঠক পাঠিকাদের প্রশংসার জ্বালায় তো গেলাম ভাই! কখন যে অত অত চিঠির জবাব দেব ভেবেই পাইনে, আমার নাবার খাবার ফুরসুৎটুকুও নেই। কী করি বলতো? আমার হয়ে গুছিয়ে জবাবগুলো দিয়ে দিতে পারে এমন একজন কাজের লোক কাউকে দিতে পারো আমায়? এই পার্সোনাল অ্যাসিসট্যান্ট কি সেক্রেটারি গোছের?’

‘দুঃখের কথা আর বোলো না ভায়া।’ দ্বিতীয় জন জবাব দিয়েছেন—দু’জন সেক্রেটারি ছিল আমার কেবল এই কর্মের জন্যেই। কিন্তু বস্তা বস্তা চিঠি এলে তাদের অবস্থা কেমন হয় বারেক ভেবে দ্যাখো। তাদের আর কী দোষ? আমার কপালের দোষ। সকালে তারা দু’জনেই ভেঙে পড়েছে—’

‘ভেগে পড়েছে? কী বললে? চিঠির ভয়ে ভেগেছে নাকি?’

‘ভাগবে কেন হে? কী বললাম আমি। গ আর ঙ-র তফাৎ বোঝ না—কী রকম লেখক? ক খ গ—তার পরে ঘ পেরিয়ে ঙ না? তাও তুমি জানো না? আমি বললাম ভেঙে পড়েছে…।’

‘চিঠির ভারে ভেঙে পড়েছে? উষ্ট্রের পৃষ্ঠে সেই শেষ কুটোটির মতই? বড় দুঃখের কথা তো। যাক, পালায়নি তো? সেই রক্ষে!’

‘না, না, পালাবে কোথায়? চিঠির ভয়ে নয় চিঠির ভারে কোলাপ্স করেছে। সেই কথাই তো বলছি। দু’জনেই তারা এখন হাসপাতালে, আইস ব্যাগ মাথায় দিয়ে শয্যাশায়ী। চিঠি তো আকচারই পাই, কিন্তু এত বেশি চিঠি কখনও এর আগে পাইনি ভাই। কেন এত পাচ্ছি বলতে পারো?’

প্রথম জন প্রথমটা একটু ভড়কে গেলেও সামলে নিয়েছেন। এবং বেশ উষ্ণ হয়েই এবার তিনি বলেছেন ‘বটে? গত সপ্তাহে তুমি কতগুলি চিঠি পেয়েছিলে শুনি একবার?’

‘তুমি কতগুলি?’

‘আমি আগে জিজ্ঞেস করেছি। প্রাথমিক লেখক বলেছেন—’আগে তার জবাব দাও।’

এবং তারপর আর কোনও জবাব নয়, পরস্পরকে তাঁরা জবাব দিয়েছেন হয়তো বা জন্মের মতোই। যারা লেখকদের উৎসাহিত করবার অভিপ্রায়ে চিঠি দেন, তাঁরা সম্ভবত জানেন না যে ওই চিঠি দিয়েই আড়াআড়ি করতে গিয়ে কত সুহৃদের চিরদিনের জন্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ভগবান, তুমি এই চিঠিদাতাদের মার্জনা কোরো, তারা জানে না, তারা কী করে—চিঠি দিয়ে অজ্ঞাতসারে কোন সর্বনাশ তারা করে বসে, তারা জানে না।

তবে আমিও কি কারও চিঠি পাইনে? পাই বই কি। কখনও যে পাইনি, তা বলা যায় না! অল্প বিস্তর পেয়ে থাকি আমিও। সত্যি বললে বলতে হয়, অল্পের দিকটা একেবারে অত্যল্প নয়, মানে শূন্য নয় একেবারে, আর বিস্তরের দিকেও তেমনি খুব বেশি বিস্তার নেই। প্রায় মাঝামাঝি। আমার বই যারা পড়ে তারা নিতান্তই পাঠক, লেখার তারা কোনও ধার ধারে না, এইরূপ আমার ধারণা। হয় তারা চিঠিপত্র লিখতে ভালবাসে না, অধিক লেখা বাহুল্য মনে করে, কিংবা লিখলে, পত্রলেখক না হয়ে একেবারে পত্রিকার লেখক হতে চায়, নয় তো লেখার তেমন কোনও সুযোগ তাদের নেই।

প্রথমত মন খারাপ হলে লোকে আমার বই নিয়ে পড়ে, এই রকম শুনেছি। তখন কি চিঠি লিখতে মন চায়? তারপর জেলখানার কয়েদিরা আমার লেখা পড়তে ভালবাসে, কিন্তু তাদের চিঠিপত্র লেখবার সুযোগ কম। পকেটমাররাও নাকি আমার বই পড়ে বলে শুনে থাকি। আমার লেখা পড়ে পড়ে তারা নাকি চৌকস হয়। নিত্য কর্মে বেরোনোর আগে কাঁচির সঙ্গে শিব্রাম চকরবরতির একখানা বই নিয়ে তারা বেরোয়। যেদিন এর অন্যথা করে, সেদিন হয় তারা কারও পকেট ধরতে পারে না, নয় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। আবার এও শোনা গেছে পাশ করা ছেলেরা আমার বই পড়ার জন্যই ফেল করে ফেলেছে। তারপরে ফেল করার দুঃখ ভুলতে আবার তাদের আমার বই পড়তে হয়েছে। এবং তারপরে তার ফলে আবার পুনঃ পুনঃ যাকে ইংরেজিতে পাপচক্র না পাকচক্র কী বলে থাকে। কিন্তু এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না। একাধারে শক্তিশেল এবং বিশল্যকরণী এতদূর ক্ষমতা আমার বইয়ের আছে আমি বিশ্বাস করিনে। এমনকী, যে সব ছেলেমেয়েরা আমার বই পড়ে, আমার বই ছাড়া কিছুই পড়ে না, তারা কিছু না পড়েই পাশ করতে পারে; এই জনশ্রুতিও নিতান্ত অলীক এবং অবিশ্বাস্য।

হ্যাঁ, চিঠি পাবার যে কথা বলছিলাম। আমিও চিঠি পেয়ে থাকি—নিতান্ত কম নয়। একের পিঠে অনেকগুলি শুন্য যোগ করলেই তার ইয়ত্তা পাবে। শূন্যগুলি এখনও শূন্য রয়ে গেছে এই যা দুঃখ, আপাতত আমি একখানাই পেয়েছি। এতদিনে সেই একখানাও যে আমার কোনও গুণমুগ্ধ পাঠিকার হয়তো সেকথা হলফ করে বলা যায় না।

চিঠিখানি ‘শিবরাম চক্রবর্তী—কলকাতা’ এইরূপ বিরাট ঠিকানা বহন করে এসেছিল। তবু যে এসে পৌঁছেছিল, এর মূলে আমার খ্যাতি কি ডাকঘরের কেরামতি কী আছে তা আমি বলতে পারব না। আমার মনে হয় এই কৃতিত্ব আমার অকৃত্রিম বন্ধু সেই ডাকপিয়নের, তারই অসামান্য কীর্তি।

যাই হোক, নাগা পাহাড় থেকে আসা সেই চিঠিখানি এইরূপ,

‘মাই ডিয়ার চক্রবর্তীবাবু,

মনিপুরের ইস্কুলে পড়তে একটি বাঙালি মেয়ের সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল। তার মুখে আপনার কথা শুনেছিলাম। আপনার ভাষায় নাকি ভারী অলঙ্কার সে বলত। আমরা নাগা মেয়েরা সাধারণত আমাদের জাতীয় গয়না পরি কিন্তু তা পরতে আমার ইচ্ছে করে না। সেগুলো পরা ভারী কষ্টদায়ক। আমার বাবা, তিনি এখানকার নাগাদের সর্দার, বলেছেন আমার সেই বাঙালি বন্ধুর মতো অলঙ্কার আমাকে কিনে দেবেন। অতএব আপনি অনুগ্রহ করে যত শীঘ্ৰ পারেন আপনার সমস্ত অলঙ্কারের একখানা তালিকা আমাকে পাঠিয়ে সুখী করবেন। অলঙ্কারগুলির দামও জানাবেন দয়া করে। ক্যাটালগটা ভি-পি করে পাঠালে ভাল হয়।

ইতি—

একান্তভাবে আপনার

‘কুমারী ‘নিন্ ফ্যাচাঙ।’

ওই চিঠি পাবার পর অনেকদিন আমার ঘুম হয়নি। ওর কী জবাব হতে পারে; কী জবাব দেব, আমি ভেবে পাইনি। এখন অবধি আমাকে, বাধ্য হয়েই নিরুত্তর থাকতে হয়েছে।

ভাষাগত আমার যাবতীয় অলঙ্কার (যদি সত্যিই কিছু থাকে) তালিকাবদ্ধ করে পাঠাতে হলে আমার পুরো একসেট বই-ই পাঠাতে হয়। বই থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আটা দিয়ে সেঁটে সেঁটে মেয়েটির গায়ে লাগানো যাবে না যে তা নয়, কিন্তু তেমন অলঙ্কার নাগাদের মুল্লুকেও কতটা জনপ্রিয় হবে আমার জানা নেই। দুনিয়ার হালচাল, সেই সঙ্গে ফ্যাশানও, আজকাল এমন উড়ুক্কু বোমার বেগে বদলাচ্ছে যে তার তাল রাখা মুশকিল।

তারপর এই সেদিনের কথা বলি। আমি যে কতদূর বিখ্যাত লেখক এর থেকে পরিচয় পেলাম। তোমরাও সেটা পাও—সেইজন্যেই আমার বলা।

কফি হাউসে সেদিন একলাটি এক টেবিলে বসে আপনমনে কফি পান করছি, এমন সময় একটি অচেনা মেয়ে আমার সামনের কৌচে এসে বসল। সদ্য কলেজে ওঠা কোনও মেয়ে। আমার অচেনা হলেও আমি তার বেশ চেনা; তার হাবভাব দেখে এই রকমটাই বোধ হল।

‘কী ভাগ্যি আমার। এখানে আপনার দর্শন পাব এ আমি আশা করিনি—’ বলল সে।

এর উত্তরে ‘আমারও কী ভাগ্যি’ এই জাতীয় কোনও কথা বলাই বোধ হয় উচিত ছিল, কিন্তু বলব কী? সহসা আক্রান্ত হয়ে অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় কিছুক্ষণ আমার মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরুল না।

‘তা বটে।’ বললাম আমি অবশেষে।

‘আজ আমার জীবনের কী শুভলগ্ন। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা বলতে পারি না। এক মুখে তা বলা যায় না! আপনার প্রত্যেকটি লেখা আমি মন দিয়ে পড়ে থাকি। তা জানেন?’

‘জেনে খুব খুশি হলাম। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করি যদি কিছু না মনে করো, তুমি কি পরীক্ষায় ফেল করেছ নাকি?’

‘কক্ষনো না। আমি কেন, আমাদের বাড়ির কেউ কখনও কোন পরীক্ষায় ফেল হয়নি! আমি না, আমার দিদিরা নয়, আমার দাদারা নয়—ভাইরাও নয়। আমার দিদি আপনার বই পড়তে কী ভাল যে বাসেন!’

‘খুব মনোকষ্ট বুঝি তোমার? সব সময়েই মন খারাপ হয়ে থাকে তাই বুঝি?’

‘না না, তা কেন? খুব স্ফুর্তিবাজ মেয়েই তো! আমার দাদাও আপনার লেখার ভারী ভক্ত। তিনি আলিপুরে থাকেন।’

‘ও জেলখানায় বুঝি? বুঝেছি৷’

‘না, জেলে কেন? সেখানকার এক সরকারি অফিসে তিনি কাজ করেন কিনা।’

‘বটে? ভারী আশ্চর্য তো!’ আমার নিজেরই আশ্চর্য লাগে এবারে।

‘আপনার বই পড়তে বসলে আমাদের আহার নিদ্রা ঘুচে যায়, নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। আর এমন রোমাঞ্চ হতে থাকে কী বলব! আপনার মতো ডিটেকটিভ বই আর কেউ লিখতে পারে না—’

‘কিন্তু আমি তো ডিটেকটিভ বই লিখিনে—’ বাধা দিয়ে বলতে গেলাম। কিন্তু কে শোনে? আমার বাধা অগ্রাহ্য করে মেয়েটি বলেই চলে—’উঃ, আজ কী মজাই না হবে; বাড়ি ফিরে মাকে, দিদিকে আর আমার ভাইদের বলব যে কফি হাউসে কার সঙ্গে আজ এক টেবিলে বসে খেয়েছি জানিস? শুনলে তাদের চোখ বড় বড় হয়ে উঠবে! সে আর কেউ না, খোদ আমাদের শ্রীহেমেন্দ্রকুমার রায়।’

কফি হাউসের ঘটনাটা বলতেই হর্ষবর্ধন হেসে খুন হন—’কী বললেন! আপনাকে হেমেনবাবু বলে ভুল করল মেয়েটি? আশ্চর্য! আপনি যে তাঁর নখের যুগিও নন মশাই! তাঁর মতন গোয়েন্দা কাহিনী লিখতে পারেন আপনি?’

পারি না যে তা মানতে হয়; আমি বলি—’তাঁর কেন, তাঁর কুকুরের নখের যোগ্যতা আমার নেই। এমনকী, তাঁর বাঘার দন্ত নখরও আমার চাইতে প্রখর।’

আর তারপর থেকেই আমার ভাবনা ধরল। হেমেনেদার পাঠক-পাঠিকার কাছে কোনওদিন আমি পাত্তা পাব না, জানি আমি; কিন্তু শেষে কি হর্ষবর্ধনেরও হৃদয়কোণের কণাংশ থেকে পাত্তাড়ি গুটোতে হবে আমায়? সেই কারণেই সাত তাড়াতাড়ি এই গোয়েন্দা কাহিনীটি ফাঁদা হয়েছিল সেইকালেই…

আর সেই কালেই প্রায় দুই যুগ আগে রূপাঞ্জলি নামের এক পত্রিকায় এটি অংশত প্রকাশ পায়। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক শেষ করা হয়নি। এতদিন পরে হর্ষবর্ধনের প্রেরণালব্ধ গল্পের সেই চারাটি সম্প্রতি রজনীগন্ধার অর্থবর্ষণে সঞ্জীবিত হয়ে সম্পূর্ণ হল শেষটায়।

দৈনিক বিশ্ববার্তার মফস্সল সংস্করণ ছাপা হচ্ছিল তখন। বিরাট মুদ্রা যন্ত্রের গহ্বর থেকে প্রতি মিনিটে পাঁচ হাজার করে কপি উদ্গারিত হচ্ছে। কোন আশ্চর্য কৌশলে অতগুলি করে কপি আপনা হতেই এপিঠ ওপিঠ ছাপা হয়ে ভাঁজ হয়, থাকে থাকে সজ্জিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে আসছিল, বাহাদুররাই তা বলতে পারেন।

প্রায় তিন মাইল পরিমাণ কাগজে প্রাত্যহিক বিশ্ববার্তা ছাপা হয়। কাগজগুলি পাশাপাশি ছড়িয়ে রাখলে তিন মাইল পরিমিত জায়গা জুড়ে বসবে। কিন্তু আসলে, ওই তিন মাইল কাগজ তিন মাইলের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সারা ভারতবর্ষেই (কত হাজার মাইল কে জানে!) ছড়িয়ে যায়। প্রত্যেকেই আমরা প্রাতঃকালীন চায়ের সঙ্গে বিশ্ববার্তা পড়ি নতুবা চায়ের আস্বাদ পাই না।

বিশ্ববার্তার বাড়িটাও একটা যা-তা নয়। ঠিক তিন মাইল ব্যাপী নহলেও, তিন তলা জুড়ে বড় বড় ত্রিশখানি ঘর ব্যেপে বিস্তারিত কলকাতার কোনও এক নামজাদা রাজপথের ওপরেই এর কার্যালয়। এবং বলা বাহুল্য, বিশ্ববার্তার দৌলতেই রাস্তাটার এমন নামডাক।

তুমি যদি বিশ্ববার্তার গহ্বরে কখনও প্রবেশ লাভ করো তা হলে দেখবে, সবাই সেখানে শশব্যস্ত। দেউড়ির দারোয়ান থেকে শুরু করে ভেতরের কর্মচারীরা, কম্পোজিটাররা, সংবাদদাতারা, বিজ্ঞাপনদাতারা সকলেই সর্বদা ইতস্তত ধাবমান। সদরে-অন্দরে সমান দৌড়-ঝাঁপ। এমনকী, কাগজ ছেপে বেরোতে না বেরোতে হকাররা বগলদাবা করে নিয়ে দৌড় মারছে, তাও তুমি দেখতে পাবে। নিদারুণ কেনবার ইচ্ছে হলেও, তাদের কাউকে দাঁড় করিয়ে এক কপি কিনতে পারবে কি না সন্দেহ।

উঃ! এতলোক কাজ করে বিশ্ববার্তায়। আর এতজন সেখানে যাতায়াত করে কাজে অকাজে। ভাবলে আকুল হতে হয়। ধরো, তাদের সবাইকে যদি সার-বন্দি দাঁড় করিয়ে দেখা যায় (অবিশ্যি এভাবে দাঁড়াতে তাঁরা সহজে রাজি হবেন না) তা হলে সেই লাইন খুব সম্ভব সুন্দরবন ঘুরে আসবে। দুই লাইনে খাড়া করলে তার ডবল জায়গা ঘেরাও হতে পারে। আর যদি শোভাযাত্রা করে বার করা যায়, তা হলে ঢাকুরিয়া লেকের মাঝ বরাবর গিয়ে পৌঁছবে। এতদ্বারা অধিকাংশ নাগরিককে জলাঞ্জলি দিতে হয় বলে কলকাতার পুলিশ কমিশনার এই শোভাযাত্রার সম্ভবত অনুমতি দেবেন না। কিন্তু, তা না দিলেও, এতেই ব্যাপারটা কেমন ঘোরালো তা হৃদয়ঙ্গম হবে।

এই মুহূর্তে এই বিরাট অট্টালিকায় দারুণ হইচই। এই মুহূর্তে নয়—এটা প্রতি মুহূর্তের ব্যাপার। দিনে রাতে কখনও একটু ক্ষণের জন্যও বিশ্ববার্তা কার্যালয় চুপচাপ রয়েছে একথা ভাবতে পারা যায় না। তার ঘরে ঘরে কর্ম কোলাহল চললেও একটি ঘর নীরব, নিথর ঠাণ্ডা। সেই ঘরটি বিশ্ববার্তার বড় কর্তার ঘর। যাঁর বুদ্ধিবলে এবং কর্মফলে বিশ্ববার্তা আজ বিশ্বের প্রায় সবচেয়ে বড় বার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে—বিশ্ববার্তার সমস্ত কিছু নির্ভর করছে যাঁর বিরাট স্কন্ধে, সেই থরহরি দত্তর ঘরটিই কেবল চুপচাপ।

সারা বাড়িটিকে বাড়ির সবাইকে এবং সব কিছুকে কম্পমান রাখলেও থরহরি নিজে কিন্তু নিষ্কম্প। শুধু নিষ্কম্প নন, নিবাত নিষ্কম্প। বাত তিনি খুব কমই বলেন খুব কম লোকের সঙ্গেই বলেন। তাঁর মধ্যে কোনও ব্যস্ততা, কোনও চাঞ্চল্য নেই। তাঁর বিরাট দেহ দেখলে মনে হয় সত্যিই তিনি বিরাট দেহ, এবং মুখভাব দেখলে মনে হয়, তাঁর মাথার ভেতরে যে বিরাট মস্তিষ্ককে তিনি অকাতরে বহন করছেন তা চারটিখানি না। কাজেই উন্নত লোকেরাও যে তাঁর কাছে এসে সহজেই অবনত হয়ে পড়বে তার আর বিচিত্র কী? তবে তাঁর মুখভাব দেখে তাঁর মনের মধ্যে প্রবেশ করা কারও সাধ্য নয়। বড় কর্তা প্রকাণ্ড চেয়ারে বসেছিলেন। আর তাঁর টেবিলের চার ধারে কাগজপত্রের ছড়াছড়ি। তাঁর ওই টেবিলের ওপর দিয়েই বিশ্বের সমস্ত বার্তা বয়ে চলেছে—যেসব বার্তা সম্পাদকদের সম্পাদিত, মুদ্রাকরদের দ্বারা মুদ্রিত, হকারদের দ্বারা হকৃত হয়ে বিশ্ববার্তারূপে পুনশ্চ আবার প্রবাহিত হবে। কিন্তু চেয়ারের ওই মানুষটিকে সরিয়ে নাও, দেখবে বিশ্ববার্তা অচল। এমনকী এত বড় আমাদের বিশ্বও অচল বলে তোমার ভ্রম হবে।

এই সময়ে আমাদের গল্পের যবনিকা উন্মোচিত হতে দেখা গেল (এর আগে এই যবনিকা উন্মোচনের কোনও অর্থ ছিল না) দেখা গেল যে বড় করতে কী একটা সংবাদ গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠ করছেন।

তার বার্তা, বেতার বার্তা কিংবা টেলিফোন বার্তা নয়, এক টুকরো কাগজে হাতে লেখা একটা খবর। কিন্তু চোখ বুলোতেই চকিতের মধ্যে তিনি সংবাদের মর্ম বুঝতে পেরেছেন বলে বোধ হল।

‘কী সর্বনাশ!’ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন।

এর চেয়ে বেশি কথা, তীব্রতর ভাষা থরহরির কণ্ঠ থেকে কেউ কোনওদিন শোনেনি। এই নিরেট, আত্মনিষ্ঠ, স্বয়ং সৃষ্ট মানুষ এর অধিক বাক্য ব্যয় কদাচই করেছেন। এর চেয়ে বেশি লম্বা এবং বেশি শক্ত কথা তাঁর মুখ থেকে খসলে তাঁর ব্যক্তিত্বের মর্যাদাহানি ঘটত।

‘কী সর্বনাশ! তিনি পুনরুক্তি করলেন: ‘কৃত্তিবাস খুন হয়েছে! নিজের বাড়িতে! কী আশ্চর্য, কাল রাতে যে একসঙ্গে আমরা খেলাম গো! আমি তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি আমার নিজের গাড়িতে!’

‘তুমি যেতে পারো।’ সংবাদদাতাকে তিনি বললেন। তারপর টেলিফোনটা হাতে নিয়ে (একটুও চিন্তা না করে তিনি টেলিফোনের চোঙ হাতে নিতে পারতেন; এমনকী চিন্তা করতে করতেও টেলিফোন করার তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল) চোঙটা হাতে নিয়ে, ঠান্ডা গলায়, কাটা কাটা কথায়—একটিও কথা বাজে বরবাদ না করে বলতে শুরু করলেন:

‘হ্যালো, অপারেটার! পুট মি থ্রু-টু-টু-টু ফোর। হ্যালো। কে? দুই দুই চার? হ্যালো, দুই দুই চার? কান্তিকুমার মিত্রকে চাই। কান্তিই কথা বলছ?… ওঃ কান্তি! আমি থরহরি। কাশীপুরে একটা খুন হয়েছে এক বাগান বাড়িতে। কৃত্তিবাস সেনের বাড়ি। কৃত্তিবাস নিজেই নিহত। তুমি সেখানে চলে যাও—চট করে এক্ষুণি। এই খুনের রহস্য তোমাকে উন্মোচন করতে হবে। যত টাকা লাগে ব্যয়ের কোনও কার্পণ্য কোরো না। বিশ্ববার্তা তোমার পেছনে রয়েছে। গাড়ি ভাড়া আছে তো তোমার কাছে, বেশ। বেরিয়ে পড় তা হলে।’

‘রিসিভারের চোঙ যথাস্থানে রেখে তার পর মুহূর্তে বড়কর্তা ঘূর্ণিচেয়ারের আরেক ধারে ঝুঁকে পড়লেন (এই চল্লিশ ডিগ্রি আন্দাজ)। ঝুঁকে পড়ে তার যোগে আরাকানের যে সব বার্তা এসেছিল নিজস্ব এবং পরস্মৈপদী সংবাদদাতাদের দ্বারা প্রেরিত সেই সব সংবাদে মনোযোগ দিলেন। কৃত্তিবাসকে তিনি আর চিন্তায় স্থান দিলেন না।

তাঁর কাজ করার ধারাই এই। বোধ হয় সব বিরাট ব্যক্তিরই ধরন-ধারণ এই রকম।

খুনের কিনারা করা তো ঢের পরের কথা, কিন্তু মতলব তাই হলেও, আগে তার কিনারায় পৌঁছানো দরকার। লাশের কাছে এবং আশেপাশে অপরাধীর নানান নিশানা সাধারণ সৃষ্টির অগোচরে ছড়ানো থাকা—সন্ধানী নজরের অপেক্ষায়। কান্তি কুমারের গোয়েন্দা সুলভ সেই সূক্ষ্মদৃষ্টি ছিল। কান্তি গোয়েন্দা নয়, কিন্তু অনেক গোয়েন্দার কান কাটে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই কান্তি কুমারকে একটা মোটরে উপবিষ্ট হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে কাশীপুরের দিকে ছুটতে দেখা গেল। গ্রে স্ট্রিটের মোড় পেরুতে না পেরুতেই তার কানে গেল, হকাররা হাঁকছে: ‘কাউন্সিলার খুন! বিশ্ববার্তা টেলিগ্রাম পড়ুন বাবু! আরেকজন কাউন্সিলার খুন!’

গাড়ি থামিয়ে দশ পয়সা ফেলে দিয়ে এক পাতার একখান্য টেলিগ্রাম কান্তিকুমার কিনেছে। গাড়িতে বসেই দুর্ঘটনার ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়েছে একবার।

কৃত্তিবাস সেন নামজাদা একজন কাউন্সিলার। তাঁর গঙ্গা তীরবর্তী বাড়িতে কে বা কারা তাঁকে খুন করে রেখে গেছে। যেসব লক্ষণ দেখা যায়, তাতে খুন বলেই সন্দেহ হয়—এমনকী লক্ষণগুলির প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা খুঁটিয়ে দেখলেও খুন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। কর্পোরেশনের এই হতভাগ্য কাউন্সিলার মৃত্যুকালে বেশভূষায় সুসজ্জিত ছিলেন—দেখলে বেশ ধারণা হয় মৃত্যুর জন্য আদৌ তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। একটু আগে যে তিনি বিলিয়ার্ড খেলেছেন, এরূপ ধারণা করাও খুব কঠিন নয়। বিলিয়ার্ড রুমে চিৎপাৎ অবস্থায় তাঁকে পাওয়া গেছে—তাঁর একটা পা বিলিয়ার্ড টেবিলের এক পায়ায় ঠেকানো। একটা চটকদার কাপড়ের টুকরো যদ্দুর মনে হয় তাঁরই নিজের রুমাল, তাঁর গলায় পাক দিয়ে জড়ানো—সেই রুমালের সঙ্গে আটকানো আবার বিলিয়ার্ড কিউ। তাঁর সারা মুখে প্রশান্ত হাসি। অদ্ভুত এক প্রসন্নতা, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় শ্বাসরুদ্ধ হয়েই তাঁর জীবন অবসান ঘটেছে। তাঁর দেহে দুটি গুলির গর্তও দেখা যায়, প্রত্যেক দিকে একটি করে দেহের ভিতর দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে পিস্তলের গুলিটা বেরিয়ে গেছে মনে হয়। তার ওপরে আবার পিঠের শিরদাঁড়া ভাঙা। তাঁর হাতদুটি স্বামী বিবেকানন্দের স্টাইলে বুকের ওপর বিন্যস্ত। এক হাতের মুঠোয় এখন পর্যন্ত বিলিয়ার্ডের একটা বল ধরা। ঘরের মধ্যে ধস্তাধস্তি মারামারির কোনও চিহ্ন নেই—যাবতীয় আসবাবপত্র যে যার যথাস্থানে—কোথাও একটুকু বিশৃঙ্খলা ঘটেনি। কেবল পরিধেয় বস্ত্র থেকে চৌকা একটা ফালি অন্তর্হিত হয়েছে।

বিশ্ববার্তার সম্পাদকীয় স্তম্ভে এই খুনের নানাদিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। পত্রিকা বলছে, এই নিয়ে দু’সপ্তাহের মধ্যে তিনটে কাউন্সিলার মারা পড়ল। এইভাবে কাউন্সিলার মারা পড়লে এই জাতি, মানে এই কাউন্সিলার জাতি কতদিন টেঁকসই হবে? অহেতুক কোনরূপ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা তাঁদের অভিপ্রায় নয় : কিন্তু তা না হলেও, তাঁদের মতে এই কাউন্সিলার হানির আশু অবসান ঘটা উচিত। প্রত্যেক জিনিসেরই একটা সীমা আছে, যুক্তিসঙ্গত সীমা। এমনকী কাউন্সিলার মতকেও। খামোখা কেন এক-একজন কাউন্সিলার খুন হতে থাকবে?

অবশ্যি প্রশ্ন উঠতে পারে, কাউন্সিলারদের বেঁচে থাকারই বা কী দরকার? তাঁদের বেঁচে থেকে বাঁচিয়ে রেখেই বা লাভ কী? কিন্তু এ প্রশ্নের কোনও মানে হয় না। তাঁরা বেঁচে থাকে। বেঁচে বর্তে থাকতে দেখা যায় তাদের অত্যন্ত স্বভাবতই। এমনকী সবদিক বিবেচনা করে দেখলে দেখা যাবে জনসাধারণের কাছে সমাজের কাছে, কাউন্সিলারদের দাবি এমন কিছু বেশি নয়। এমন কিছু বেশি তারা চায় না যেজন্য তাদের এভাবে অপসারণ করা আবশ্যক। কী চায় তারা? মাঝে মাঝে একটু তোয়াজ, কখনও ঘুষ, এবং সময়ে অসময়ে ভেট। ব্যস, এর বেশি কিছু নয়। এর জন্যেই কি তাঁদের ধরে ধরে খুন করতে হবে? এইভাবে কাউন্সিলার খতমের দ্বারা কলকাতায় যে লাভ হয় তা কি কর্পোরেশনের ক্ষতির তুলনায় ওজনে কিছু ভারী? সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ আছে।

হত্যাকাণ্ডটির চুলচেরা খতিয়ে বিশেষ সংস্করণে বিশ্ববার্তার সম্পাদক এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, এই ধারায় কাউন্সিলার বিয়োগ হতে থাকলে আর এক জেনারেশনের (কিংবা ডিজেনারেশনের) মধ্যে আর একজন কাউন্সিলারেরও অস্তিত্ব থাকবে না। মিসিংলিঙ্কের মতো এরাও লোপ পাবে। এই জীবদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কি আমাদের সকলেরই সমবেতভাবে তৎপর হওয়া উচিত নয়—এই প্রশ্নে তাঁর সম্পাদকীয় বক্তব্যের তিনি উপসংহার করেছেন।

কান্তিকুমার মিত্র গোয়েন্দা নয়, আগেই বলেছি। কান্তিকুমার রিপোর্টার। বিশ্ববার্তার নিজস্ব বিশেষ সংবাদদাতাদের মধ্যে তিনি বিশেষত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদ্দশা সাঙ্গ করে বিশ্ববার্তার কার্যালয়ে তিনি চাকরি নিয়েছেন এই দু’মাস। কিন্তু দু’মাসের মধ্যেই তিনি উন্নতির চূড়া থেকে চূড়ান্তরে উঠেছেন। কাজ নেওয়ার প্রথম সপ্তাহেই তিনি এক গুরুতর সমস্যা ভেদ করেন : পাটের বাজার থেকে পাট লোপাট হওয়ার সমস্যা। দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের কেলেঙ্কারি তিনি প্রকাশ করেছেন। তৃতীয় সপ্তাহে এই শহরের কতিপয় গণ্যমান্য নাগরিকের কুকীর্তি তিনি লোকচক্ষে অনাবৃত করেন। তারপর থেকে জটিল কুটিল যেখানে যা সমস্যামূলক হয়ে রহস্য ভেদের অপেক্ষায় আছে সে সমস্ত ভার বিশ্ববার্তার দপ্তর থেকেই তাঁর ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব এই খুনের কিনারা করার হেতু বিশ্ববার্তার বড় কর্তা থরহরিবাবু যে কান্তিকুমারের স্কন্ধে নির্ভর করবেন তাতে আর আশ্চর্য কী?

কান্তিকুমার অচিরেই খুনের কিনারায় এসে পৌঁছলেন। গঙ্গার গা ঘেঁষেই প্রকাণ্ড ইমারত—বড় রাস্তার ওপরেই। এধারে রাস্তা ওধারে গঙ্গা। কান্তিকুমার দেখল পুলিশ চারধার ঘেরাও করে ফেলেছে। সেই ঘেরাওয়ের এখানে ওখানে ইতস্তত অলস কৌতুহলীর দল জোড়ে বিজোড়ে দু’পাঁচ সাতজনে জড়ো হয়ে জটলা পাকাচ্ছে আর গুলতানি করছে। চারধারেই পাহারাওলা। তাদের মুখের চেহারায় যেন এই প্রশ্ন দেগে দেওয়া—অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি, এরপর আরও না জানি কী আছে। এইরূপ যেন একটা হতভম্ব ভাব—যা কেবল পুলিশের মুখেই দেখা যায়। সাধারণ পাহারাওলার মধ্যে পুলিশ কর্মচারীরও অভাব ছিল না। তাঁদের একজন বলছিলেন, ‘এই ব্যাপারের পিছনে নিশ্চয়ই একটা গভীর ষড়যন্ত্র আছে কিন্তু তা যে কী আমি আন্দাজ করতে পারছিনে।’ অপর ব্যক্তির জবাব শোনা গেল, ‘আমিও ভাই তাই অথৈবচ।’

থানার বড় দারোগা, তাঁর চেহারাখানাও বেশ বড়! লম্বা-চওড়া রাজসংস্করণ চেহারা চোখে-মুখে কোটালসুলভ কৌটিল্য। সাধারণত বড় দারোগাদের মধ্যে যেমনটি দেখা যায়। এই লোকটিই কি সেই লোক যাঁর ঘোষণা আমরা যেখানে সেখানে যখন তখন দেখেছি শহর আর শহরতলির আনাচে কানাচে যাঁর সজাগ দৃষ্টি সর্বদা পাহারা দিচ্ছে? সে সতর্ক দৃষ্টি ঠগি আর বদমাইশদের হাত থেকে আমাদের বাঁচতে দ্বিধাবোধ করছে না—অবশ্যই আমরা মারা যাবার পরেই। না, বোধহয় তিনি নন।

বাড়ির সামনের একটা সরকারি ল্যাম্প পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, কান্তিকুমারকে দেখে তিনি গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়লেন।

‘কী আক্কেল গুড়ুম নাকি আদ্যনাথ?’ কান্তিকুমার জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, কান্তি আবার আমার আক্কেল গুড়ুম।’ জবাব দিলেন বড় দারোগা ওরফে আদ্যনাথ। তাঁর কণ্ঠস্বর করুণ বলে বোধ হল। ‘আমার ধারণা ছিল এটার আমি কিনারা করতে পারব ! কিন্তু এবারও আমি কোনও কূল পাচ্ছি না।’

আদ্যনাথ রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছবার ছলনায় চোখের কোণদুটো মুছে নিলেন।

‘এই নাও, সিগরেট’, বলল কান্তি: ‘এখন বলো তো ব্যাপারখানা কী? শুনি আগাগোড়া। রহস্যটা কোথায় দুর্ভেদ্য হয়েছে দেখা যাক খতিয়ে !’

সিগরেট পেয়ে আদ্যনাথবাবুর চেহারা আরও উজ্জ্বল বোধ হল। চোর ছেঁচড়রা যেমন ঘুষি পেলেই খুশি হয়, পুলিশের লোকেরা তেমনি কোনও-না-কোনও প্রকারে ঘুষ না পেলে তুষ্ট নন৷ এদিক দিয়ে তাঁরা প্রায় দেবতার সগোত্র এইরূপ শোনা যায়।

সিগরেট উপহার লাভে আদ্যনাথের উৎসাহ দেখা দিল। ‘বলছি সব!’ বললেন তিনি: ‘দাঁড়াও, বাজে লোকগুলোকে আগে বিদেয় করে আসি।’

এই বলে একজন পাহারাদারের কাছ থেকে মোটা একটা লাঠি কেড়ে নিয়ে কৌতুহলী জনতাকে তিনি তেড়ে গেলেন। তার এই তাড়নায় দুইয়ে দুইয়ে তিনে তিনে, জোড়ে বিজোড়ে ইতস্তত যেসব জনতা জমেছিল বাত্যাতাড়িত জঞ্জালের মতো ইতোনষ্ট হয়ে স্ততোভ্রষ্ট হয়ে পড়ল। পড়বে কেন? কথায় বলে খুন খারাপি। খুনের সঙ্গে সঙ্গে খারাপিরা লেগে থাকে।

‘ওসব খারাপ লোকেদের ছেড়ে দাও।’ বলল কান্তিকুমার : ‘এখন কাজের কথা বলো। পদচিহ্নের খবর কী?’

কান্তি সটান কাজের কথায় পড়তে চায়: ‘পায়ের দাগ পাওয়া যায়নি? নাকি সেদিকে এখনও দৃষ্টি দেওয়ার ফুরসৎ হয়নি তোমার?’

‘দিয়েছি!’ জানালেন আদ্যনাথ: ‘সব প্রথমেই পায়ের দাগে আমার লক্ষ ছিল, সারা বাগানটাই পায়ের দাগে ভর্তি। এই যেমন দ্যাখো না—এই এক ধরনের পদচিহ্ন। একদম কাঠের পা।’

চাঁচাছোলা ঘাসালো জমির ওপর বিন্যস্ত একজাতীয় বিশেষ দাগের প্রতি কান্তিকুমারের দৃষ্টি তিনি আকর্ষণ করলেন।

‘এই দাগগুলো দ্যাখো। সহজে কি আমি দাগা পেয়েছি হে। এমনি আমার আক্কেল গুড়ুম।’

কান্তিকুমার দেখল।

‘এই লোকটার একটা পা বেমালুম কাঠ। এই কাঠের পাখাওয়ালা লোকটা’—বলতে লাগলেন আদ্যনাথ ‘যদ্দুর মনে হয় কোনও জাহাজের খালাসি। দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা বলেই মনে হয়। এভেন থেকে আসছে এখন। অল্পদিন হল করাচিতে এসেছে। করাচি থেকে ট্রেনে এসেছে কলকাতায়। পায়ের দাগ দেখলেই এ সমস্ত স্পষ্ট বোঝা যায়।’

কান্তিকুমার ঘাড় নাড়ল: ‘ঠিক।’

‘আরও বোঝা যায়’ বোঝাতে লাগলেন আদ্যনাথ: ‘যে এই লোকটার ডান হাতে একটা ছড়ি ছিল আর কোমরে ঘুনসিতে বাঁধা ছিল ছোট্ট একটা হুইশিল।’

‘তা বেশ দেখতে পাচ্ছি।’ কান্তিকুমার ভাবিত মুখে বলল, ‘এই হুইশিলটা ছিল আবার ডানদিকে বাঁধা। এই কারণেই ডানদিকে লোকটা একটু ঝুঁকে পড়েছে তাও বোঝা যাচ্ছে।’ বোঝাটাকে কান্তি আরও একটু ভারী করে দেয়।

‘তোমার কি মনে হয়, কান্তি, এই কেঠো পা খালাসিটাই এডেন থেকে এসে ওই খুন করেছে?’ আদ্যনাথ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন—’সেই কি করতে পারে—তোমার ধারণা?’

‘খুব পারে।’ কান্তি বলে: ‘এইসব খালাসিরাই তো এইসব কান্ড করে থাকে। খুন করতে পেলে তারা আর কিছু চায় না। জাহাজ থেকে নেমেই তারা খুন করে। লাস, আর খালাসির মধ্যে কেমন একটা জড়াজড়ি ভাব রয়েছে দেখছ না?’

বড় দারোগা ঘাড় নাড়লেন: ‘এবার এই দাগগুলো দ্যাখো: ‘মনে হয় যেন কোন কাবুলিওয়ালার! সুদের তাগাদায় যাতায়াত করা পা—দেখলেই বোঝা যায়। ঘাতকের অপেক্ষায় ওৎ পেতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা একনিষ্ঠ পা। এখানে সেখানে নড়েচড়ে দাঁড়ালেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ধরে গেছে—এ পায়ের দাগগুলো দেখলে তাই কি মনে হয় না? দ্যাখো না, কী রকম মাটির মধ্যে বসে গেছে গভীর হয়ে—’

‘হ্যাঁ—দেখছি।’ কান্তি মাথা নাড়ে: ‘এ লোকটাও খুন করতে পারে বটে।’

‘এইরকম আরও কত পায়ের দাগ!’ আদ্যনাথ বিবৃতি দেন: ‘আরও কত রকমের—কিন্তু সে সব কোনও কাজের নয়। বেশিরভাগ ওইসব অকর্মাদের।’ এই বলে কৌতুহলী জনতার দিকে আদ্যনাথ ভ্রূভঙ্গি করেন: ‘বাগান বাড়িটা আমরা এসে ঘেরাও করে ফেলার আগেই ওরা জায়গাটা চষছিল কিনা।’

‘একটু থামো৷’ কান্তিকুমার কী যেন ভেবে নেওয়ার চেষ্টা করে, ‘আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া যায়নি?’

‘আঙ্গুলের ছাপ?’ আদ্যনাথ হতাশ ভাবে ঘাড় নাড়েন, ‘আঙুলের ছাপের কথা আর বলো না। সারা বাড়িটাই আঙুলের ছাপে ভর্তি।’

‘তার মধ্যে বর্মীর আঙুলের দাগ হতে পারে এমন কিছু পেয়েছ?’ কান্তিকুমার উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে।

‘বর্মিয় আঙুলের দাগ তিন রকমের পেয়েছি।’ আদ্যনাথের মুখ আরও গম্ভীর হয়; ‘কিন্তু সে সব কোনও কাজের নয়।’

কান্তি আবার বিচক্ষণের মতো মাথা দোলায়।।

‘কিন্তু দারোগা সাহেব’, কান্তি নতুন সমস্যা নিয়ে আসে: ‘রহস্যময়ী নারীদের কী খবর? তাদের কাউকে কি দেখতে পাওনি এখানে এসে!’

‘রহস্যময়ী নারী? দেখেছি। সকাল থেকেই চারজন গেছে এ পর্যন্ত।’ আদ্যনাথ বাতলান: ‘একজন গেছে সকাল সাড়ে সাতটায় একজন সোয়া ন’ টায়।’ বিষন্ন সুরে অনুযোগ করেন: ‘আমার মতে তারা প্রত্যেকেই রহস্যময়। সব মেয়েই আমার কাছে রহস্যময়ী বলে মনে হয়।’

‘আচ্ছা, এইবার অন্য দিক থেকে আরম্ভ করা যাক,’ কান্তি বলে: ‘সমস্ত জিনিসটা নতুন করে গড়বার চেষ্টা করা যাক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে। যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে রহস্যের পার পেতে হবে—এই খুনের কিনারায় পৌঁছতে হবে।…ভাল কথা, কৃত্তিবাস সেন তো আইবুড়ো ছিলেন তাই না?’

‘আইবুড়োই বটে, বে থা করেননি, এবং বুড়ো হতে চলেছিলেন, এতবড় বাগানবাড়িতে একলাই থাকতেন তিনি।’ আদ্যনাথ জানান।

‘ভাল কথা। তা হলে নিশ্চয়ই তাঁর এক পেয়ারের খানসামা ছিল তো? তা না থাকলে তাঁকে দেখত শুনত কে? এবং সেই প্রিয় ভৃত্যটি নিশ্চয় তাঁর অতিশয় বিশ্বাসী আর পুরাতন—এবং বিশ বছর ধরে এক নাগাড়ে কাজ করছিল তাঁর কাছে?’

আদ্যনাথ সায় দিলেন মাথা নেড়ে।

‘তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বোধহয়’, জিজ্ঞেস করল কান্তি।

‘সবার আগে। চাকরদের আমরা কখনও ছাড়ি না—ছেড়ে কথা বলি না। বিশ্বাসী পুরনো চাকর হলে তো কথাই নেই, এবং তারাও ঠিক তাই-ই প্রত্যাশা করে। বলব কী কান্তি, এই চাকরটার নাম উদ্ধব। আমরা আসা মাত্রই আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করল, পালাতে পারত, কিন্তু পালায়নি। গ্রেপ্তার হবার জন্যই অপেক্ষা করছিল বোধহয়।’

‘ঠিক হয়েছে।’ কান্তি বলল—’তারপর দেখা যাক। ওই চাকর ছাড়া আর কে কে ছিল বাড়িতে? কোনও ঠাকুরমা-দিদিমা স্থানীয়, কোনও বুড়ি ঝি, দাই-মা গোছের—যে শিশু অবস্থা থেকে কৃত্তিবাসকে মানুষ করে তুলেছে? একেবারে বদ্ধ কালা এরকম কোনও মেয়েছেলে পাওয়া যায়নি বাড়িতে?’

‘একেবারে হুবহু।’

‘তার মানে?’

‘ঠিক ওই রকমের এক বুড়ি ঝি—দাই-মা গোছের—যে কৃত্তিবাসের শৈশব থেকে—’

‘বুঝেছি আর বলতে হবে না। তা সেই মেয়েটি কি এতবড় এই হত্যাকাণ্ডের সময়ে কোনও কিছু শুনতে পায়নি? কোনও অস্বাভাবিক আওয়াজ? ধস্তাধস্তির শব্দ বা—’

‘টুঁ শব্দটিও না। তবে খুব সম্ভব, এটা তার বদ্ধ কালামির জন্যই বোধহয়।’

‘হ্যাঁ, তাও হতে পারে।’ কান্তি ঘাড় নাড়ল। ‘আচ্ছা ও ছাড়াও এই বাড়ির পেছনে নিশ্চয় আস্তাবল আছে, সেখানে সহিস আর কোচম্যান বাস করে ঘোড়াদের সঙ্গে? একবার মোটর দুর্ঘটনা হবার পর মোটরের পাট তুলে দিয়ে কৃত্তিবাস সেন আজকাল ঘোড়ার গাড়ির চর্চা করছেন—তাঁর সেই ফিটন গাড়ির সহিস, কোচম্যানরা কোথায়?’

‘কোচম্যান এই খুনের রাত্রে সহিসকে নিয়ে কোনও এক সিনেমায় হোল নাইট শো দেখতে গেছল বাবুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে। ফিরেছে আজ সকালে। আমার এখানে আসার পরে, কান্তি, ওদিকে সন্দেহ করার কিছু নেই—ওসব আমরা খুঁটিয়ে দেখেছি।’

‘ওরা ক’জন ছাড়া আর কোনও ব্যক্তি কি ব্যক্তিনী ছিল না, যে এই বাড়ির সঙ্গে বা এই কৃত্তিবাসের সঙ্গে কোনও-না-কোনও প্রকারে বিজড়িত?’

‘হ্যাঁ, ছিল। ছিল কেন, আছে। কৃত্তিবাস সেনের লেডি টাইপিস্ট অলকা দত্ত। কিন্তু সে আসে সকালের দিকে—কর্পোরেশন ও কৃত্তিবাসের আপিস সংক্রান্ত কাজকর্মের ব্যাপারে; রাত্রির কাণ্ড সে কিছু জানে না।’

‘তুমি কি এই মেয়েটিকে দেখেছ?’ কান্তির সাগ্রহ প্রশ্ন—’মেয়েটি দেখতে কেমন?’

‘দেখেছি, দেখবার মতো!’ জানালের আদ্যনাথ, ‘দেখতে মন্দ নয়, খুশিই বলতে হয়।’

‘এবার এই মেয়েটির পালা। এবার এ বিপদে পড়বে, চাই কী মারা পড়াও বিচিত্র নয়। একে ঘিরেই হত্যাকারীরা চক্রান্ত করবে এবার স্পষ্ট আমি দেখতে পাচ্ছি।’ দেখতে দেখতে কান্তিকুমার ভাবিত হয়ে পড়ে।

‘কী করে বুঝলে?’ আদ্যনাথ বিস্মিত হয়। ‘খুন হবার মতো কোনও কারণ মেয়েটির কোথাও নেই কিন্তু।’

‘সেইজন্যই তো খুন হবে। কৃত্তিবাসের মধ্যে তেমন কোনও কারণ ছিল নাকি?’ সত্যি বলতে, এই কৃত্তিবাসই কিন্তু রামায়ণ লেখেনি—রামায়ণের জন্য দায়ী নয়। তবু খুন হল। এ মেয়েটির তেমন কোনও দায় না থাকলেও হত্যাকারীরা একে আদায় করতে পারে। কেন, ছাড়বে কেন?’

আদ্যনাথ জবাব দিতে পারেন না! কেবল দাড়ি চুলকোন।

‘কিন্তু যতই তারা চেষ্টা করুক, তারা ব্যর্থ হবে। বিপর্যস্ত হবে। হবেই। আমিই তাদের বিপর্যস্ত করব। তাদের কুকর্মে বাধা দেব। তাদের চক্রান্তজাল ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলব। এই মেয়েটিকে আমি বাঁচাব, বুঝেছ আদ্যনাথ?’

‘তা, তুমি বাঁচাতে পারো বটে। অনায়াসেই পারো।’ আদ্যোপান্ত খতিয়ে গোঁফ চুলকে বলেন আদ্যনাথ, ‘বাঁচাবার কোনও-ই বাধা নেই। কারণ, মেয়েটি বেঁচেই আছে। এবং থাকবেও আশাকরি।’

‘কিন্তু ওই চক্রান্তজাল? যা তার চারদিকে বিস্তৃত হয়েছে?’

‘মেয়েদের চক্রে এসে পড়লে সব চক্রান্তজাল আপনার থেকেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, তা কি তোমার জানা নেই কান্তি?’

কান্তি এবার দারোগাকে বললে, ‘আমাকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে চলুন।’

আদ্যনাথ আগে চলল। অতবড় আর অমন সুসজ্জিত বাড়ির ভেতরে কী অক্ষুন্ন শান্তি! কোথাও যেন এমন কিছু ঘটেনি।

‘গোলমালের কোনও চিহ্ন দেখছিনে কোনওখানে !’ বলল কান্তি।

‘না।’ জবাব দিলেন আদ্যনাথ। ‘কোথাও একটু চুলের এদিক ওদিক ঘটেনি। তবে, চুলচেরা ভাব দেখলে তা বড় ঘটেও না। যে লোকটি খুন হয় কেবল সে ছাড়া আর সবকিছুই ঠিকঠাক থাকে। তার নিজের দেহে ছাড়া আর কোথাও কোনও বিপর্যয় বড় একটা দেখা যায় না।’

ড্রয়িংরুমের দ্বার মুক্ত করে ভেতরে গেল তারা। ইলাহি ঘর, আশ্চর্য সব আসবাবে সাজানো। ‘চেয়ে দেখো, এইখানেও অতবড় বিপর্যয়ের কোনও লক্ষণ নেই।’ বলেন আদ্যনাথ।

জানলায় পর্দা নামানো, জামা পরানো টেবিল—চেয়ার, চাদর গায়ে দিয়ে পিয়ানো, ত্রিশঙ্কুর মতো ঝোঝুল্যমান বিজলি বাতির ঝালর। সব যে যার যথাস্থানে যথাযথ রয়েছে। কোথাও যেন ইতর বিশেষ কিছু ঘটেনি।

‘এসো ওপরে; বিলিয়ার্ডের ঘরে এসো।’ আদ্যনাথ বললেন: ‘লাস অবশ্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য। কিন্তু আর সবকিছুই ঠিক সেইভাবেই রাখা রয়েছে—একচুল নড়ানো হয়নি।’

তারা দু’জনে দোতলায় গেল। সিঁড়ি পেরিয়েই সামনের সেই বিলিয়ার্ড ঘর। প্রকাণ্ড বিলিয়ার্ড টেবিল ঘরের মাঝখানটিতে; কিন্তু কান্তি তার প্রতি দৃকপাত না করে সটান জানলার কাছে ছুটে গেল। ‘হা-হা-হা।’ হাসল সে—’এখানে কী? কী দেখছি এখানে?’

দারোগার মাথা নাড়ায় কোনও উত্তেজনা নেই। তাঁর কণ্ঠস্বর শান্ত। একটু বিচলিত না হয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ জানলাটা দেখলে মনে হয় বটে যে বাইরে থেকে খোলা হয়েছে। ধারালো কোনও অস্ত্রের সাহায্যে খড়খড়িটা বাইরে থেকে ফাঁক করা হয়েছে বলে মনে হয়। জানলার বাইরে কার্নিশের জমাট ধুলোয় আন্দোলনের চিহ্নও দেখা যায়। মনে হয় অসাধারণ সাহসী কোনও লোক তলপেটের ওপর ভর দিয়ে খড়খড়ির ফাঁকে হাত গলিয়ে ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে জানলার ছিটকিনিটা—কিন্তু ও নিয়ে ব্যস্ত হবার কিছু নেই কান্তিবাবু! বৃথা মাথা ঘামিও না। সব খুনখারাপির ব্যাপারেই ওরকমটা হয়ে থাকে, প্রত্যেক কেসেই দেখা যায়।’

‘সে কথা সত্যি।’ কান্তি ঘাড় নেড়ে সায় দিল। এবার সে ঘরে চারদিকে ইতস্তত তাকাতে লাগল। এবং তার কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ময়ের আরেক উচ্চনাদ উথলে উঠল—’ওই কুলুঙ্গিটা দেখেছ? পর্দার প্রায় আড়ালে প্রকাণ্ড ওই তাকটা? তাকিয়ে দ্যাখো একবার।’

‘বহু আগে দেখেছি!’ আদ্যনাথ জানালেন, ‘কুলুঙ্গির জমানো ধুলোর মধ্যে কিছু চিহ্ন দেখা গেছে। ধুলোর স্তর ইতস্তত করা—বেশ নড়ানো চড়ানো। পায়ের দাগের ছাপও অস্পষ্ট দেখা যায়। অসাধারণ ক্ষিপ্র কোনও লোকের পক্ষে ওই তাকের ওপরে লাফিয়ে উঠে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব নয় কিছু।’

‘ছাদের কাছটা দেখেছ?’ কান্তি এবার নজর উঁচু করে, ‘ছাদের কাছে ওই ঘুলঘুলিটা? একটু অস্বাভাবিক আকারের নয় কি? কী মনে হয় তোমার? ওখানেও কি একজন—?’

‘স্বচ্ছন্দে। কড়িকাঠে দড়ি লাগিয়ে দেওয়ালের গা বেয়ে উঠে একজন লোক অনায়াসে ওই ঘুলঘুলির ফাঁকে শুয়ে থাকতে পারে। অসাধারণ ধূর্ত কোনও লোক সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বসবাসের জন্য ওইরকম জায়গাই পছন্দ করবে বরং।’

‘এক মিনিট। থামো একটু।’ কান্তির আবার নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে, ‘ওই ভ্যানিটি ব্যাগের অর্থ কী? ওই যে ওখানে ঝুলছে!’

আধুনিক কোনও মহিলার অতি আধুনিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ স্বরূপ চমৎকার একটি ভ্যানিটি ব্যাগ দেওয়ালের গায়ে লাগা একটি আলনার আঁকশিতে লটকানো।

‘হ্যাঁ, ওটার কথাও যে ভাবা হয়নি তা নয়।’ বললেন আদ্যনাথ। ‘ওতে আমরা হাত দিইনি—ওটাকে ওখানেই রেখে দিয়েছি। কেমন যেন আমাদের মনে হয়েছে— ওইখানেই ওই রহস্যের কিনারা আছে। বিশেষ একটা মতলবেই ওটা অমনি রেখে দেওয়া হয়েছে। যে ওই ব্যাগটি নিতে আসবে, সে যে এই খুনের সঙ্গে কোনও-না-কোনওভাবে জড়িত তাতে আর কিছু ভুল নেই। আমাদের ধারণা—’

কিন্তু কান্তি আর উক্ত ধারণায় কর্ণপাত করছিল না। সে তখন বিলিয়ার্ড টেবিলের ধার ঘেঁষে এগিয়ে গেছে।

‘দ্যাখো, দ্যাখো!’ চিৎকার করে উঠেছে সে, ‘এইবার বুঝি রহস্যের একটা কিনারা পাওয়া গেল। বিলিয়ার্ড বলগুলোর পজিশন দ্যাখো। সাদা বলটা টেবিলের ঠিক মধ্যিখানে আর লাল বলটা টেবিলের শেষ পকেটের একেবার গায়ে গায়ে। এর কী, আদ্যনাথ, মানে কী এর?’

আদ্যনাথ দারোগাকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে কান্তি—’আদ্যপ্রান্ত ধরেছে। তার চোখে উদ্বেগ, কণ্ঠে ব্যাকুলতা। ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়ে আদ্যনাথকে চুরমার করতে চায় যেন সে।

‘আমার জানা নেই’, আদ্যনাথ জানালেন—’বিলিয়ার্ড খেলা আমি জানিনে।’ এই আকস্মিক জড়াজড়িতে তাঁকে যেন একটু বিভ্রান্তই দেখা গেল।

‘আমিও জানিনে।’ কান্তি বলল—’কিন্তু আমাকে জানতে হবে এর রহস্য। এক্ষুনিই। এর উপরেই এই হত্যাকাণ্ডের আসল ফয়সালা নির্ভর করছে। কাছাকাছি বিয়ের কোনও দোকান নেই নাকি? কিংবা কোনও লাইব্রেরি—ইংরাজি বইয়ের? একটা বিলিয়ার্ডের বই জোগাড় করা দরকার।’

এই বলে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে কান্তি উধাও হয়ে গেল। দারোগা আদ্যনাথ স্তব্ধ হয়ে চিন্তান্বিতভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাৎ নিজেকে তাঁর অত্যন্ত রোগা বলে মনে হতে লাগল। ‘চলে গেল!’ অস্ফুট স্বগতোক্তি বেরুল তাঁর গলা থেকে—তাঁর নিজের চিন্তাধারা ও মতামত নিজেকে বিড়বিড় করে জানানোর এই বিড়ম্বনা তাঁর বহুকালের, তাঁর এই বদ অভ্যাস থেকে মনে হয়, দেওয়ালের কান থাকায় তাঁর বিশ্বাস নেই।

আশ্চর্য। থরহরিবাবু কেন ওর ওপরে নজর রাখবার জন্য আমাকে টেলিফোনে জানালেন—? কান্তির গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখবার জন্য প্রত্যহ তিনি পঞ্চাশ টাকা করে দেবেন আমায়, তাও বলেছেন। কিন্তু কেন যে—!

পরমুহুর্তেই তাঁর চিন্তাধারা পালটে গেছে, ‘কান্তি বোধহয় বিলিয়ার্ড বইয়ের খোঁজে বেরিয়েছে। ততক্ষণ নিরিবিলি একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক।’

বলে সামনের কৌচে নিজেকে এলিয়ে দিলেন তিনি—’কাল সারারাত যা ধকল গেছে! সকালেও একটু চোখ বুজতে পারিনি। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, থরহরিবাবু কান্তিকেও বলেছেন আমার ওপর নজর রাখতে? এই কৃত্তিবাসী রামায়ণে আমাকেও জড়িত বলে হয়তো তিনি সন্দেহ করেন। কে জানে!’ আবার এক নতুন বিড়ম্বনা শুরু হয় তাঁর।

ইতিমধ্যে বিশ্ববার্তা কার্যালয়ে থরহরিবাবুর বাড়ি যাবার সময় হয়েছে। কাজ সেরে হুক থেকে তিনি কোট পেড়ে নিজের গায়ে চাপাচ্ছেন, এমন সময়ে একজন কর্মচারী, বোধহয় মনিবকে খুশি করার মতলবেই, অযাচিতভাবে এগিয়ে এল।

‘আজ্ঞে, আপনার কোটের হাতায় সবুজ মতো কী দেখা যাচ্ছে। কীসের যেন দাগ। বিলিয়ার্ডের খড়ির দাগ বলেই বোধ হচ্ছে যেন। মুছে দেব কি?’

থরহরি ঘুরে দাঁড়ালেন। কর্মচারীটির আপাদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ করলেন একবার। তারপর বললেন: ‘এ বিলিয়ার্ডের খড়ি নয়। ফেস পাউডার। বুঝেছ?’

এই বলে সেই বিরাট ব্যক্তিত্ব, এককথায় বিলিয়ার্ডের চকের মতো সেই লোকটাকেই যেন মুছে দিয়ে শান্ত গম্ভীর পদক্ষেপে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিজের মোটরে গিয়ে উঠলেন।

মোটরে উঠে তার মনে হল, কাশীপুরের বাগান বাড়িটার ধার ঘেঁষে গেলে হয় একবার। দেখা যাক না কী ব্যাপার।

কিন্তু পর মুহুর্তেই নিজের মত পালটালেন—হত্যাকারীরা নাকি কাণ্ডের পরে— সেই অকুস্থলে ফিরে এসে ফের আবার পরিদর্শন করে। ডিটেকটিভ বইয়ে এরকমটা তিনি পড়েছিলেন। তাই এই সুত্রে তাঁকেও যদি কেউ সন্দেহ করে বসে সেই ভয়ে, গাড়ির গতি তিনি পালটালেন না আর, বাড়ির দিকেই চললেন সটান।

খুনের পরদিন করোনারের তদন্ত শুরু হল। কিন্তু তার ফলে পরিষ্কার হওয়া দূরে থাক, নতুন নানান জট পাকিয়ে পেকে উঠে রহস্য যেন আরও জটিল হয়ে উঠল। ডাক্তারি পরীক্ষার দ্বারা বিশেষ কিছুই জানা গেল না—পরিশেষে অনেক কিছু জানা গেল। উক্ত ডাক্তারের মতে মৃতের দেহে আঘাতের চিহ্ন সুস্পষ্ট। কণ্ঠনালীর উপর চাপ পড়ায় নিশ্বাস-বায়ুর পথরোধে মৃত্যু ঘটেছে এমন সিদ্ধান্তও করা যায়, আবার আলজিভ আটকে গিয়ে মৃত্যু ঘটাও অসম্ভব কিছু নয়। গলগ্রন্থির অত্যধিক স্ফীতি দেখা যাচ্ছে। এদিকে মস্তিষ্কের স্নায়বিক শিরাও বিচ্ছিন্ন। এইসব নানাবিধ লক্ষণ ও দুর্লক্ষণের মধ্যে ঠিক কোনটি নিশ্চিতরূপে মৃত্যুর কারণ তা নির্ণয় করে নিশ্চিত রূপে বলা সুকঠিন।

তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার দেখা গেছে বটে। মৃতের পাকস্থলীতে আধসেরটাক আফিম গোলা পাওয়া গেছে তরল পানীয়ের আকারে। এই সম্পর্কে করোনার কোর্টের সরকারি উকিল এবং ডাক্তারের জিজ্ঞাসাবাদ বিশেষ তথ্যপূর্ণ।

‘পাকস্থলীর মধ্যে ওই পরিমাণের আফিম গোলা পাওয়া কি অস্বাভাবিক নয় মশাই?’ তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘বিশেষ করে একজন কাউন্সিলারের পাকস্থলীতে, আপনার কী মত?’

‘একটু অস্বাভাবিক বই কী।’ উত্তর হয়েছে ডাক্তারের: ‘তবে, সেটা সাধারণ পক্ষেই প্রযোজ্য, একজন কাউন্সিলারের পেটে কিছুই অস্বাভাবিক নয়।’

‘কিন্তু আধ সের আফিম গোলা একটু বেশি পরিমাণের বলে কি আপনার মনে হয় না?’

‘তা ঠিক বলা যায় না।’

‘তবে কি ওটা পরিমাণে কম আপনি বলতে চান?’

‘না, তাও বলতে চাই না।’

‘আধ সের আফিম গোলা গলাধঃকরণের ফলে মৃত্যু কি একান্তই অনিবার্য?’

‘কোনও কাউন্সিলারের বেলায় তা নাও হতে পারে। হতেই যে হবে তার কোনও মানে নেই।’

‘তবে কি—একজন কাউন্সিলারের পেটে আধ মন আফিম গোলা পেলেই আপনি আশ্চর্য হতেন? এবং সেটা মৃত্যুর কারণ বলে মনে হয়?’

‘মোটেই না। কাউন্সিলারের হজমশক্তি সাধারণত অসাধারণ।’ ডাক্তারি তদন্তের জের এইখানেই শেষ।

তারপরে কৃত্তিবাসের চাকর উদ্ধবের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। তার কাছ থেকে অনেক রহস্য বার হয়েছে—কিন্তু তা রহস্যের ওপর রহস্য, যেন কোয়ালিটির আইসক্রিমের ওপরে মালাই বরফ পড়ে সমস্যাটা আরও জমজমাট হয়ে গেছে যোগফলে। উদ্ধব দিব্যি গেলে বলেছে দুর্ঘটনার দিনে সে নিজের হাতে আধ সের আফিম মিছরির পানায় গুলে বিকেলের জলখাবারের সঙ্গে বাবুকে দিয়েছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে একথাও জানিয়েছে, এটা তার বাবুর নিত্য কর্মের মধ্যে প্রত্যহের বৈকালিক জলযোগ। সরকারি উকিলের জেরায় সে বলেছে যে, আফিমটা আধ সের নয় আধ ভরি ছিল মাত্র, মিছরির পানাটাই ছিল আধ সের। তবে দুটোয় মিলে আধ সের আধ ভরি হওয়া যে অসম্ভব নয়, এটা সে সম্ভব মনে করে। এই ভৃত্যটি, রবীন্দ্রনাথের পুরাতন ভৃত্যের ন্যায় সর্ব গুণান্বিত না হলেও, বিশ বছর ধরে কৃত্তিবাসের তদ্বির তদারক করেছে সে কথাও জানা গেল।

ঘোড়ার গাড়ির কোচম্যানকেও পুঙ্খানুপুঙ্খ জেরা হল। প্রায় তিন বছর থেকে সে কৃত্তিবাস সেনের এখানে কাজ নিয়েছে, দুর্ঘটনার দরুণ বাবুর মোটর গাড়ি অচল হওয়ার পর থেকেই সে আছে বলা যায়।

‘একথা কি সত্য যে দুর্ঘটনার দিনে কর্তার সঙ্গে তোমার ভয়ংকর কলহ হয়েছিল?’ করোনারের উকিল জিজ্ঞেস করেছেন।

‘কলহ কী জিনিস?’ পাল্টা প্রশ্ন তোলে কোচম্যান।

‘কলহ মানে ঝগড়াঝাটি।’ জানান সরকারি উকিল; ‘হয়েছিল কি তোমার বাবুর সঙ্গে?’

‘তা একটু হয়েছিল হুজুর।’

‘ঝগড়াটা কী নিয়ে তা কি আমরা জানতে পারি?’

‘আজ্ঞে, কর্তা সিনেমা দেখার ছুটি দিচ্ছিলেন না বলেই।’

‘সেই কারণে, কর্তাকে তুমি খুন করার ভয় দেখিয়েছিলে? সত্য কি?’

‘না। সে কথা বলিনি।’

‘কিন্তু লোকে যে শুনেছে তুমি খুন করব, খুন করব বলে চেঁচাচ্ছিলে?’

‘কথায় কথায় আমার মাথায় এমন খুন চেপে গেছল যে আমার কোনও কাণ্ডজ্ঞান ছিল না। আমার মাথায় খুন চেপে যাচ্ছে।’

হুজুর, ‘আপনি আমার সামনে থেকে সরে যান। এই কথাই আমি বলেছিলাম।’ বললে কোচম্যান।

‘তখন খুন চাপেনি৷ এখন খুনটা মানে, খুনের এই বুদ্ধিটা তোমার মাথায় চাপছে তাই না কি?’

‘না, হুজুর—’ বললে কোচম্যান!

করোনার তাঁর নথিপত্রের প্রতি তাকালেন, ‘অলকা দত্তকে ডাকা হোক,’ হুকুম হল তাঁর। অলকা দত্তের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সারা আদালতে চাঞ্চল্যের সাড়া পড়ে গেল। অলকা ধীর পদক্ষেপে সাক্ষীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালো।

ছিপছিপে পাতলা চেহারা অলকার। উজ্জ্বল ফর্সা মুখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। প্রত্যেক অকাণ্ডের কু-কাণ্ডের সঙ্গে সমস্ত বিপর্যয়ের মূলে কোনও না কোনও মেয়ে জড়ানো থাকে। আদালতের মধ্যে ডিটেকটিভ বইয়ের পাঠক যারা ছিল তাদের কাছে তা অজানা ছিল না। এই চমৎকার মেয়েটি কি এই বিদঘুটে ব্যাপারের সঙ্গে কোনওরূপ জড়িত নাকি? এই প্রশ্নটাই সেইসব পাঠকদের মনে বড্ড বেশি ধাক্কা মারছিল।

মেয়েটি কিন্তু সত্যই কাঁপছিল। সে যে খুব বিপন্ন বোধ করছে তার মুখ-চোখ দেখলেই তা মালুম হয়। কিন্তু তা হলেও পরিষ্কার স্বরে, আস্তে আস্তে, মিষ্টি সুরে সে তার বক্তব্য বলে গেল। তার সাক্ষ্যের কোনওখানেও একটুখানি হোঁচট খেল না।

প্রশ্ন হল, ‘কৃত্তিবাস সেনের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?’

অলকা। ‘আমি তাঁর লেডি টাইপিস্ট ছিলাম।’

প্রশ্ন। ‘কতদিন ধরে এ-কাজ করছেন আপনি?’

উত্তর। ‘প্রায় বছর তিনেক।’

প্রশ্ন। ‘কখন আপনি কাজে যেতেন, ফিরতেনই বা কোন সময়?’

উত্তর। ‘আমি সকালের দিকেই যেতাম কেবল। বেলা দশটার মধ্যে আমার যা কাজ সব সেরে আমি বেরিয়ে পড়তাম।’

প্রশ্ন। ‘সেখান থেকে বেরিয়ে আপনি যেতেন কোথায়?’

উত্তর। ‘চৌরঙ্গির এক রেস্তরাঁয় কিছু খেয়েটেয়ে বাড়ি ফিরতাম তারপর।’

প্রশ্ন। ‘রোজই কি আপনি এই রেস্তরাঁয় দুপুরে খেয়ে থাকেন?’

উত্তর। ‘হ্যাঁ, রোজ। এখনও।’

প্রশ্ন। ‘রেস্তরাঁটার নামটা আমরা জানতে পারি?’

করোনার সরকারি উকিলের এই প্রশ্ন বাতিল করে দিলেন—নিতান্ত ব্যক্তিগত বলে এ কথার উত্থাপন তিনি অনুমোদন করলেন না।

জুরিদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘শর্টহ্যান্ডও কি আপনার জানা আছে নাকি?’

‘হ্যাঁ পিটম্যানের।’

জুরিদের আরেকজন, ‘আপনি কি সিনেমায় যানটান?’

এই প্রশ্নের জবাবে অলকা জানিয়েছে, ‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝে, কেউ নিয়ে গেলেই।’

অলকার এই উত্তর আদালতের মনে খুব ভাল দাগ কেটেছে, তার সম্বন্ধে সজুরি করোনারের ধারণা একটু উচ্চতর হয়েছে যেন। এই একটি কথায় সেখানকার সর্বসাধারণের সহানুভূতি লাভ করল অলকা।

কিন্তু সরকারি উকিল তথাপি প্রশ্ন তুললেন: ‘কুমারী অলকা দত্ত, একটি কথা কি আমরা জানতে পারি? খুনের পরে বিলিয়ার্ড রুমে যে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলতে দেখা গেছে সেটি কি—সেটি কি আপনার?’

করোনার হাঁ হাঁ করে পড়লেন—’না না। এ প্রশ্ন আমি কিছুতেই অনুমোদন করতে পারি না’—হাত নেড়ে তিনি বাধা দিলেন: ‘এ কথা কেন? এসব অবান্তর কথা কেন? এ প্রশ্ন থাক। মিস দত্ত, আপনাকে আর কোনও কথার জবাব দিতে হবে না। আপনি এখন কাঠগড়া থেকে নামতে পারেন।’

কিন্তু সবচেয়ে বেশি শোরগোল পড়ল থরহরিবাবুর বেলায়। বিশ্ববার্তার পরিচালক থরহরিবাবু তাঁর সাক্ষ্যে জানালেন, ‘কৃত্তিবাসের খুনের দিন সন্ধ্যায় একত্রে এক সাহেবি হোটেলে খানা খেয়েছেন। এমনকী তাঁর নিজের মোটরে করে কাশীপুরের বাড়িতেও তিনি তাঁকে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন।

‘আপনি সেদিন সন্ধ্যা ঠিক ক’টার সময় কৃত্তিবাসবাবুর বাড়িতে গেছলেন?’ জিজ্ঞেস করলেন সরকারি উকিল; এবং কতক্ষণ ছিলেন তাঁর সঙ্গে?’

‘এ প্রশ্নের জবাব আমি দেব না’—বললেন থরহরিবাবু, ‘কিছুতেই না।’

‘কেন, এর দ্বারা কি আপনার এই ব্যাপারে জড়িত হয়ে পড়ার কোনও সম্ভাবনা আছে? জিজ্ঞেস করলেন থরহরিবাবুকে।

‘তা হতে পারে।’ বললেন থরহরি।

‘তা হলে এর উত্তর দেওয়া আপনার খুশি। আপনি স্বচ্ছন্দে নিরুত্তর থাকতে পারেন। আইনত সে অধিকার আপনার রয়েছে।’

থরহরিকে এই কথা বলে করোনার সরকারি উকিলের দিকে ফিরলেন: ‘তা হলে ওঁকে আর এই প্রশ্ন করবেন না, উনি ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। অন্য কিছু জিজ্ঞেস করুন।’

‘আচ্ছা বেশ।’ সরকারি উকিল থরহরির দিকে আবার ফিরলেন: ‘তারপরে, ওঁকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার পরে আপনারা দু’জনে অনেক রাত পর্যন্ত বিলিয়ার্ড খেলেছিলেন একথা সত্যি?’

‘থামুন, থামুন!’ করোনারের কাছ থেকে বাধা এল আবার, ‘করছেন কী! এ প্রশ্ন আমি কিছুতেই করতে দিতে পারি না। একেবারে সোজাসুজি নিতান্ত খোলাখুলি এ কী অভদ্র প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য তেমন সাধু নয়—এর মধ্যে বিচ্ছিরি কোনও ব্যাপারে ইঙ্গিত যেন আছে মনে হয়। আপনি অন্য কোনও প্রশ্ন করুন।’

‘বেশ তাই।’ ঘাড় নাড়লেন সরকারি উকিল। ‘আচ্ছা বলুন তো থরহরিবাবু, নীল রংয়ের এই খামখানা এর আগে আপনি কখনও দেখেছেন কি না?’

‘আমার জীবনে নয়।’ জানালেন থরহরি।

‘অবশ্যই উনি দেখেননি।’ বললেন করোনার, ‘এ বিষয়ে দ্বিরুক্তি করবার কী আছে? ওঁর মতন মান্য ব্যক্তি কি অকারণে নিঃস্বার্থভাবে নির্জলা মিথ্যে বলবেন? দিন তো দেখি খামটা, কী আছে ওতে?’

‘আজ্ঞে, এই খামখানা নিহত কৃত্তিবাসের জামায় আলপিন দিয়ে আঁটা ছিল হুজুর।’

‘তাই নাকি?’ বললেন করোনার, ‘কী আছে ওই খামে?’

আদালতশুদ্ধ রুদ্ধশ্বাস স্তব্ধতার মধ্যে সরকারি উকিল নীল খামের ভেতর থেকে সবুজ রংয়ের একখানা কাগজ বার করলেন। সবুজ খামখানায় আবার স্ট্যাম্প লাগানো। সবুজ পত্রের লেখাটা তিনি পড়তে লাগলেন তারপর—

‘আমি কাশীপুর কলিকাতা নিবাসী কৃত্তিবাস সেন বহাল তবিয়তে এবং সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় আমার এই সর্বশেষ উইল করিতেছি। এতদ্বারা আমার স্থাবর অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তির সম্পূর্ণ দখলি স্বত্ব আমার ভ্রাতুস্পুত্র এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী শ্ৰীমান কালু সেনকে দিয়ে গেলাম।’

সারা আদালত এই উইল শুনে একবারটি যেন খাবি খেল। কারও মুখে একটি কথা নেই। কেবল করোনার চারদিকে ঘুরে ফিরে তাকালেন একবার।

‘কালু সেন কি এখানে উপস্থিত আছেন?’ হাঁক পাড়লেন করোনার।

কোনও উত্তর এল না।

‘এখানকার কেউ কি এই কালু সেনকে দেখেছেন?’ আবার করোনারের ডাক শোনা গেল।

তবুও কোনও সাড়াশব্দ নেই।

আবার সেই এক প্রশ্ন। তথাপি কাউকে নড়তে চড়তে দেখা গেল না।

‘হুজুর, এই কালু সেনকে পাওয়া গেলেই এই মৃত্যু রহস্যের হয়তো কোনও কিনারা হতে পারে।’ শেষ কথা বললেন সরকারি উকিল।

‘হলেও হতে পারে।’

দশ মিনিট ধরে গবেষণা করে জুরি এবং জজ একমত হয়ে তাঁদের রায়ে এটাকে খুন বলেই সাব্যস্ত করলেন। কে বা কারা অগোচরে এসে কৃত্তিবাস সেনকে খুন করে গেছে এইকথা তাঁদের রায় থেকে জানা গেল। আরও জানা গেল যে, এই কাণ্ডকে কিছুতেই আত্মহত্যা বলে গণ্য করা যায় না। জনৈক জুরি তাঁর স্বতন্ত্র রায়ে জানালেন, এই খুন যে শ্রীমান কালুর কীর্তি, সে ছাড়া আর কারও না, সে বিষয়ে তিনি দশ টাকা বাজি ধরতেও রাজি আছেন।

করোনার উদ্ধব চাকরকে বেকসুর খালাস দিয়ে উক্ত কালুর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বার করার হুকুম দিলেন।

হতভাগ্য কাউন্সিলারের ধ্বংসাবশেষ মর্গ থেকে উদ্ধার করে স্বর্গের পথে রওনা করে দেওয়া হল। যতদূর সম্ভ্রম এবং সমারোহের সঙ্গে কাউন্সিলারের তুল্য একজন্যর সদ্গতি করা উচিত তার কোনও ব্যত্যয় হল না। তাঁর শব যাত্রাকে প্রায় শোভাযাত্রায় পরিণত করার প্রয়াস করা হয়েছিল—তবু কেবল রাস্তার কয়েকটা বকাটে চ্যাংড়া ছাড়া নিমতলা ঘাট অবধি শেষ পর্যন্ত কেউ গড়াল না। প্রত্যেক রাস্তাতেই এই চ্যাংড়ারা স্বাভাবিক কৌতুহলবশে কিংবা হরিবোল দেবার স্বর্গীয় প্রলোভনে কাউন্সিলারের পিছু নিয়েছিল, কিন্তু নিজেদের পাড়ার সীমানা পর্যন্ত এগিয়েই ফের পিছিয়ে এসেছে, যাই হোক, রিলে রেসের মতো বদলে গেলেও কোনও না কোনও রূপে এই চ্যাংড়ারাই, কাউন্সিলারটির শূন্যস্থান পূর্ণ করার কোনও স্বার্থ বা সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও এই অপূরণীয় জাতীয় ক্ষতির মহিমা এবং মর্যাদা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করেছে দেখা গেল।

কলিকাতা মহানগরী আবার তার সুস্থ অবস্থায় ফিরে এল। কৃত্তিবাস সেন এবং তাঁর মৃত্যু রহস্য আস্তে আস্তে ভুলতে বসল সবাই।

ভুলল না কেবল কান্তি। আহার নেই নিদ্রা নেই, কেবল টো টো করে ঘুরছে। রোদ নেই, বৃষ্টি নেই (এবং সেইজন্যই মাথায় ছাতা নেই) ঘুরছে সে। এই এখানে এই সেখানে—কোথায় নেই? সর্বত্র সে। কালু সেনের সন্ধানেই ঘুরছে কান্তি। যেখানেই কয়েকজন জড় হয়ে গুলতানি করছে কান্তি হাজির, আর কিছু না, কালু সেনের খোঁজে। হাওড়া শেয়ালদার মতো জায়গায়, হাজার হাজার লোক সর্বদাই যেখানে ওতপ্রোত হচ্ছে অনুক্ষণ, কত যাত্রীর যাতায়াত, কান্তি মিত্র সেখানে ক্লান্তিহীন। এই সে এধারে আবার সে ওধারে প্রত্যেকটি লোকের মুখে গভীর এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত বুলিয়ে নিতে ব্যস্ত সে। একবার এক টিকিট চেকার তো ওর ঘাড়খানাই ধরল, ‘কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এসব? লোকের মুখের দিকে অমন করে তাকাচ্ছ কেন হে!’ কান্তি বলল—’একজন দাগি আসামির সন্ধানে আছি আমি। আমি ডিটেকটিভ।’

‘মাপ করবেন, আমি জানতাম না। কিছু মনে করবেন না’, বলে কাঁপতে কাঁপতে সাত হাত পিছিয়ে গেছে সেই কর্মচারী। গোয়েন্দা আর সাপ কখন কাকে ছোবল মারবে বলতে পারে কেউ? শত হস্তেন গোয়েন্দানাং—একজন গোয়েন্দাও আরেকজনের থেকে একশো হাত তফাতে থাকে।

সারাদিন ধরে এধারে ওধারে নানাধারে কান্তি ইতস্তত করছে। কামাই নেই তার। ঘন্টার পর ঘণ্টা সে চায়ের দোকানে বসে—একটার পর একটা দোকানে এবং যত চা-পায়ী আসছে যাচ্ছে তাদের ওপর নজর দিতে তৎপর। এমনকী, তিনদিন সে ছুতোরের ছদ্মবেশ ধরে কী এক ছুতোয় থরহরিবাবুর বাড়ির দ্বারদেশে কাটিয়েছে—যদি সেখান থেকেই এই কালুর কোনও সন্ধান মেলে৷

কিন্তু তথাপি এই কালুর কোনও হদিশ নেই। যতদূর জানা আছে শ্রীমান তিন বছর আগে অবধি তার কাকা কৃত্তিবাসের আলয়ে থাকত, তারপর হঠাৎ সে একদিন, কেন বলা যায় না, সেখান থেকে উধাও হল। এই পাত্তাড়ি গুটোবার পর থেকে আর তার কোন খবর নেই। সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, বিশ্ববার্তার বিখ্যাত সম্পাদকীয় ভাষায় এই মন্তব্য করা হয়। ধরণী দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে হাঁ করে গিলে ফেলল নাকি তাঁকে? এ প্রশ্ন করা হয়েছিল তখন।

তিন বছর আগে বিশ্ববার্তার সম্পাদকীয় স্তম্ভে যাই বলা হোক না কেন, কান্তি কিন্তু হার মানার পাত্র নয়। উক্ত হাঁ করা ধরণী কে হতে পারে—তা নিয়ে অবিশ্যি সে একটু মাথা ঘামিয়েছিল। যেই হোক—কৃত্তিবাস সেনের কর্পোরেশনের প্রতিদ্বন্দ্বী ধরণী সেন নয়, এই বিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ হবার এক সপ্তাহ বাদেই সে আদ্যনাথের কাছে গিয়ে হাজির হল।

‘দারোগাবাবু’, বলল গিয়ে কান্তি, ‘আমার আরও কতকগুলি বিষয় জানা দরকার। আমাকে আর একবার কৃত্তিবাস সেনের কুটিরে নিয়ে চলো তো।’

দু’জনে আবার বরানগর কাশীপুরের সেই বিরাট অট্টালিকায় প্রবেশ করল। বিলিয়ার্ড ঘরে পা দেবার সময় কান্তি বলল: ‘প্রথমবারে হয়তো এখানকার কিছু কিছু আমাদের নজর এড়িয়ে গিয়ে থাকবে। আজও তা অসম্ভব নয়।’

‘তা তো হয়ই। নজর এড়িয়ে যায়ই তো—।’ কান্তিকুমারের অভিযোগে আদ্যনাথবাবু সায় দিয়েছেন।

‘আচ্ছা, এখন বলো তো’—কান্তি আরম্ভ করে (তারা তখন সেই বিলিয়ার্ড টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে—’এই খুনের ব্যাপারে তোমার নিজের ধারণাটা কী? তোমার, মানে পুলিশের ধারণার কথাই বলছি। ধারণাগুলি একে একে বাৎলাও দেখি। সবগুলিই আমার জানা দরকার।’

‘আমাদের প্রথম ধারণা কী ছিল তা তো তোমার অজানা নয় কান্তি। এই হত্যাকাণ্ড এডেন থেকে সদ্য আগত কোনও এক-পাওয়ালা (আরেক পায়া কাঠের) দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর দ্বারা ঘটেছে—এই ছিল আমাদের সর্বপ্রথম ধারণা।’

‘বেশ উচ্চ ধারণা। এমন কিছু অসঙ্গত নয়।’ সায় দিল কান্তি। ‘আমাদের ধারণা এই লোকটা হচ্ছে কোনও মালবাহী জাহাজের খালাসি’, একঘেয়ে সুরে একটানা পূর্ব বৃত্তান্ত দিতে শুরু করল আদ্যনাথ।—’এই লোকটা অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সাহায্যে ত্রিশ ফুট উঁচু এই বাড়ির গা বেয়ে উঠে—একজন রাজমিস্ত্রিও সারা দিনে যার সাত ফুটের বেশি উঠতে পারে না—উঠে এই বিলিয়ার্ড ঘরের জানলার বাইরে পৌঁছে অসাধারণ কৌশলের দ্বারা বাইরে থেকে খড়খড়ির খিল খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকেছিল, লোকটা যে অসাধারণ ধূর্ত তাও বেশ বোঝা গেছল নিহত কৃত্তিবাসের গলায় প্যাঁচানো রুমালের অদ্ভুত পাক দেওয়া দেখে। ওরকম কড়া পাক কেবল ভবানীপুরের সন্দেশের দোকানে আর এডেনের বাড়ি বাড়ি বদমাইশের রুমালেই দেখতে পাওয়া যায় এবং এও জানা গেছ্ল যে লোকটার একটা পা বিলকূল কাঠের—’

বলতে বলতে আদ্যনাথ দারোগা থামলেন! তাঁকে যেন একটু চিন্তাকুল দেখা গেল। কান্তি শুধালো, ‘কুল কাঠের বলছ?’

‘না, না, একদম কাঠের এইরকমই আমাদের ধারণা হয়েছিল প্রথম। কিন্তু কেন যে এরূপ ধারণা হল তা এখন আমি বলতে পারব না। একদম আমার মনে পড়ছে না।’

‘দুর, দূর! কী যে বলো তুমি আদ্যনাথ? এই ধারণা হবার কারণ এই যে বিলিয়ার্ড টেবিলের এধারের মেহগনির ওপরে লোকটির হাতের চাপ পড়েছিল এবং চাপটা বেশ একটু বেশি রকমেই পড়েছিল—সেটা সাধারণ মানুষের চাপ হিসেবে ঠিক স্বাভাবিক নয়। তাই থেকেই বোঝা গেল যে লোকটার উপরার্ধের ভার নিম্নার্ধের চেয়ে গুরুতর, তাই নয় কি? তাই থেকেই লোকটার কাঠের পা সম্বন্ধে ধারণা জন্মালো—পায়ের দিকটা তার মাথার দিকের চেয়ে হালকা বলেই না? এই কাঠের ধারণা তার সম্বন্ধে এমন কিছু কঠোর ধারণা নয়। কিন্তু এই প্রাথমিক ধারণা এখন আমরা বর্জন করেছি, তাই নয় কি?’

‘নিশ্চয়ই। প্রথমকার ধারণা আমার প্রথমেই বর্জন করে থাকি। আমাদের চিরকালের দস্তুর। আমাদের দ্বিতীয় ধারণা হচ্ছে—’

কিন্তু কান্তির কান আর সেদিকে ছিল না।—মেঝের ওপর কী যেন সে তীব্র নেত্রে নিরীক্ষণ করছিল।

‘হাঃ হাঃ! এ কী দেখছি মেঝেয়?’ আনন্দ কি দুঃখ কীসের আবেগে বলা যায় না, পুনঃ পুনঃ অট্টহাসি শোনা গেল কান্তির: ‘এর অর্থ কী? ‘হাঃ হাঃ হাঃ!’

মেঝের একটি অমার্জিত জায়গায় আদ্যনাথের দৃষ্টি সে আকর্ষণ করল!

‘এ তো আমরা দেখিনি।’ বললেন আদ্যনাথ: ‘আগে তো দেখিনি।’

‘পায়ের দাগ। পায়ের নয় জুতোর।’ বলতে বলতে কান্তি পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। ‘একজোড়া জুতোর ছাপ একটাও তার কাঠের নয়। নাগরা জুতো বলেই মনে হচ্ছে—লক্ষ্মৌয়ি নাগরা। তবে আগ্রার হলেও আশ্চর্য হব না। জুতোর তলায় বড় বড় কাঁটা মারা কিংবা ঘোড়ার পায়ে যেমন নাল লাগানো থাকে তাও হতে পারে। লোকটা পাঁচ ফুট সাড়ে ন’ ইঞ্চি লম্বা।’

‘একটু সবুর করো, কান্তি।’ আদ্যনাথ বাধা দিয়ে বললেন: ‘তুমি যে কী বলছ আমি ঠাওর করতে পারছি না। লোকটা যে ঠিক অতটাই লম্বা তা কী করে তুমি জানলে?’

‘পায়ের পাতার পরিধি থেকে পা কতখানি উঁচু তা ধরতে পারছি। আর পায়ের দৈর্ঘ্য পেলে লোকটার উচ্চতা টের পেতে অসুবিধা হয়? আদ্যনাথ, এই নাগরাওয়ালা লোকটাকে এক্ষুনি পাকড়াও। ওকে পেলেই এই খুনের রহস্য ভেদ হবে।’

এবং ঠিক সেই মুহুর্তেই সিঁড়ি দিয়ে নাগরা জুতোর খটাখট শোনা গেল। বিলিয়ার্ড ঘরের দরজা খুলে সেই নাগরাওয়ালা প্রবেশ করল তারপর।

কান্তি এবং আদ্যনাথ দু’জনেই একসঙ্গে চমকে উঠলেন। এমনকী, সেই ঘরে চোখের সামনে তখন নায়াগ্রা প্রপাত দেখলেও বোধহয় তাঁরা ততখানি বিচলিত হতেন না।

লোকটা ঠিক পাঁচ ফুট সাড়ে ন’ ইঞ্চি লম্বা। পায়ে তার নাগরা (লক্ষ্নৌ বা আগ্রা যেখানকারই হোক)। লোকটার পরণে কোচম্যানের পোশাক। আদব কায়দা কেতাদুরস্ত। পরলোকগত কৃত্তিবাসের ঘোড়ার গাড়ির কোচম্যান! দেখামাত্র বুঝতে কান্তি বা আদ্যনাথের কোন বেগ পেতে হল না।

‘আপনি কি কান্তিবাবু?’ জিজ্ঞেস করল সেই কোচম্যান—’একটি ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক।’

‘ভদ্রমহিলা! ভদ্রমহিলা এখানে কেন আবার!’ প্রশ্ন হল আদ্যনাথের।

হতচকিত কান্তি প্রশ্নাহত হয়ে বলল: ‘খুনের রহস্যের সঙ্গে মেয়েরা জড়িত থাকে তা কি তোমার জানা নেই আদ্যনাথবাবু?’

‘জানি।’ জানালেন আদ্যনাথ: ‘জানি বই কী। কিন্তু ভদ্রমহিলা কি মেয়ে? তারা তো পুরুষের কান কাটে। পুরুষের বাবা তারা!’

সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে কান্তি কোচম্যানকে বলল—’তাকে আসতে বলো।’

পরমুহূর্তে সিঁড়িতে প্রায় নিঃশব্দ পদধ্বনি শোনা গেল। লম্বা এবং চমৎকার একটি তরুণী অতি আধুনিক বেশভূষায় সুসজ্জিত হয়ে ঘরের মধ্যে পদার্পণ করলেন।

কুমারী অলকা দত্ত।

অলকার সাজসজ্জায় আধুনিকতার অত্যন্ত উগ্রতা থাকলেও তার হাতে যে ভ্যানিটি ব্যাগ ছিল না তা কান্তির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ায়নি।

‘কান্তিবাবু’, অলকা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল—’আপনিই কান্তিবাবু, তাই না? এরা বলছিল, আপনি এখানে এসেছেন। কান্তিবাবু, আপনি আমায় বাঁচান।’

অলকার দেহ থরথর করে কাঁপছিল। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছিল তার। ‘শান্ত হও কুমারী অলকা দত্ত।’ সান্ত্বনার ছলে বললে কান্তি। ‘বিচলিত হোয়ো না। এত ঘন ঘন তোমার নিশ্বাস বাজে খরচ করো না। এমন হাঁসফাঁস করবার কী আছে, আমাকে বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে বাঁচাব নির্ঘাত।’

‘আমারও তাই বিশ্বাস।’ নিশ্বাসের দ্রুতগতি অনেকটা কমিয়ে এনে বলল অলকা।

‘কী বলবার আছে আমায় তুমি বলো৷’ বলল কান্তি !

‘কান্তিবাবু’—নিজেকে সামলাতে পারলেও তখনও অলকার গলা কাঁপছিল, ‘আমার ভ্যানিটি ব্যাগটা আমার চাই।’

‘বোসো। দিচ্ছি এনে।’ এই বলে, কান্তি আলনার আঁকশি থেকে ব্যাগটা পেড়ে এনে অলকার হাতে তুলে দিল।

‘আঃ এটা ফিরে পেয়ে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে কী বলব।’ ব্যাগটাকে আদর করে নিজের গালে বুলিয়ে নিল অলকা।—আপনাকে যে কী ভাষায় ধন্যবাদ জানাব জানিনে। এটা নিতে আসতে যা ভয় করছিল আমার।’

‘না, না, ভয়ের কোনও কারণ নেই।’ আদ্যনাথবাবু জানালেন: ‘পুলিশের ধারণা এই ব্যাগটা হচ্ছে এই বাড়ির বুড়ি ঝির। আপনি স্বচ্ছন্দে এটা নিতে পারেন।’

কান্তি কিন্তু মেয়েটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল—’আমার মনে হয় এই খুনের ব্যাপারে অনেক কিছুই তুমি জানো। সত্যি কি না? তা হলে আমাকে বলল সে সমস্ত।’

‘বলব! আমি বলব কান্তিবাবু। ওঃ, কী ভয়ংকর সেই রাত—ভাবলে এখনও আমার বুক কাঁপে। এখানেই আমি ছিলাম তখন। সব দেখেছিলাম—না দেখলেও নিজের কানে শুনেছি সব।’

অলকা বারম্বার কেঁপে উঠল।

‘ওঃ, কান্তিবাবু, এমন ভয়ংকর দৃশ্য আমি জীবনে দেখিনি। সেদিন সন্ধ্যায় আমি এখানে এসেছিলাম। হাতের অনেক কাজ বাকি পড়েছিল, সেগুলো সারতে এসেছিলাম! কৃত্তিবাসবাবুর সেদিন সন্ধ্যায় কোথায় যেন নেমন্তন্ন শুনেছিলাম; কাজেই নিরিবিলি আপিস ঘরে বসে আমার কাজ সারতে কোনও বাধা হবে না ভেবেছিলাম। যখন এলাম, কেউ ছিল না তখন। এই বিলিয়ার্ড-ঘর পেরিয়েই তো গেলাম। এখানে আলনায় আমার ভ্যানিটি ব্যাগ রেখে ও-পাশের আপিস ঘরে গিয়ে নিজের কাজে মন দিয়েছি—কতক্ষণ একমনে কাজ করেছি তা মনে নেই—হঠাৎ বিলিয়ার্ড ঘরের ভেতর থেকে চেঁচামেচি আমার কানে গেল। চেঁচামেচি ক্রমশ ঝগড়া হয়ে দাঁড়ালো—দু’জনে দারুণ কলহ—শুনলাম। সমস্তই নিজের কানে শুনতে হল। শোনা খুব অন্যায় হয়েছে কি কান্তিবাবু?’

‘কিছুমাত্র না।’ বলল কান্তি, ‘চোখের পাতা বোজা যায়—অবাঞ্ছনীয় দৃশ্য আমরা ইচ্ছা করলে নাও দেখতে পারি কিন্তু কানের পাতা বোজবার যে কোনও জো-ই রাখেননি বিধাতা, অলকা দেবী।’

‘আপনার বলার ধরণ শুনে শরৎবাবুর উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে, কিন্তু সে কথা থাক কান্তিবাবু! তারপরে কী শুনলাম শুনুন; একজন বলছিল, ‘য়্যায় কী হচ্ছে? তুমি টেবিলের ওপর অতটা ঝুঁকি দিচ্ছ কেন?’ আরেকজন বলল, ‘আমার খুশি!’ তখন প্রথমজন বলল, ‘টেবিলের ওপর থেকে তোমার ভুঁড়ি সরিয়ে নাও। হঠাও তোমার ভুঁড়ি।’ দ্বিতীয়জন বলল, ‘হঠাব না। আমার ভুঁড়ি আমার—তোমার কী?’ তখন সেই এক নম্বর লোকটা বলল—ভয়ংকর গর্জে উঠল এবার—’তোমার ভুঁড়ি তোমার? বটে? এক্ষুনি সরিয়ে নাও বলছি, নইলে এই পিস্তলের গুলিতে, দেখছ তো, ওই ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেব!’ তারপরে খানিকক্ষণ চুপচাপ। তার একটু বাদেই করুণ আর্তনাদ শুনতে পেলাম—’ফাঁসিয়েছ, ফাঁসিয়েছ। সত্যি তুমি ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিলে!’ তখন অপর ব্যক্তিটি নরম গলায় একটু অনুতপ্ত সুরেই বলল যেন, ‘আমায় ক্ষমা করো ভাই। আমি ফাঁসাব বলে ফাঁসাইনি। আমার গুলি যে তোমার ওই গণ্ডারের চামড়া ভেদ করতে পারবে এ বিশ্বাস আমারও ছিল না।’

‘তারপর কী হল?’

তারপর আমার এমন ভয় হল, আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালিয়ে একছুটে নিজের বাড়িতে চলে এসেছি। পরদিনের খবরের কাগজে সে রাত্তিরের সমস্ত ঘটনা জানা গেল। আমার ব্যাগটা বিলিয়ার্ড রুমে পড়ে আছে তাও জানতে পারলাম। তারপর থেকে যে কী ভয়ে ভয়ে আমি রয়েছি—কান্তিবাবু, আপনাকে কী বলব! আপনি আমাকে বাঁচান!’

‘অবশ্যই বাঁচাব, তুমি ভয় খেয়ো না অলকা। নির্দোষীকে কেবল মারা নয়, মাঝে মাঝে বাঁচানোও আমাদের গোয়েন্দাদের ধর্ম বই কী? তুমি ঠাণ্ডা হও। এখন একটি কথা আমায় বলো দেখি, যে লোকটি কৃত্তিবাস সেনের বিপক্ষে খেলছিল—তাকে কি তুমি দেখেছিলে?’

‘একবার মাত্র, চকিতের জন্যই’ বলতে বলতে একটু ইতস্তত করল অলোকা, ‘দরজা একটুখানি ফাঁক করে—সেই ফাঁকে ঈষৎ একটু দেখেছিলাম… খুব অন্যায় করেছি, মাপ করবেন।’

‘কীরকম দেখতে লোকটা?’ জিজ্ঞেস করল কান্তি; মুখ দেখলে কি মনে হয় তার মনের মধ্যে প্রবেশ করা অতীব দুঃসাধ্য ব্যাপার, খুব দুর্ভেদ্য—অনেকটা এইরকম মুখ কি?’ কান্তি মিত্র কায়ক্লেশে নিজের মুখে অলকার সম্মুখে মৌখিকভাবে সেই দৃষ্টান্তটা দেখাবার চেষ্টা করে।

‘অবিকল!’

‘প্রকাণ্ড, লম্বা-চওড়া একটা মুখ—মনে হয় সমস্ত দেহে শুধু ওই মুখখানাই আছে কেবল?’

‘তাই মনে হয় বটে।’

‘অলকাদেবী,’ কান্তি জানাল: ‘এই মুখ সর্বস্ব লোকটির যখন আঁচ পেয়েছি, তখন এই খুনের রহস্য আমি প্রায় ভেদ করে এনেছি বলতে হবে। এর বাকিটুকুর যখন কিনারা করতে পারব তখন গোটা গল্পটা আগাগোড়া এসে বলব তোমায়। শুনবে তো তুমি?’

কান্তি ভরাট দৃষ্টি নিয়ে তাকাল অলকার মুখে।

‘শুনব বই কী। আপনি বলবেন; আমি শুনব না?’ জবাব দিল অলকা।—’আপনার কথা শুনব না কী যে বলেন?’

এবং এই কথা বলে কুমারী অলকা দত্ত নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে তেমনি নিশব্দ আওয়াজে নেমে গেল নীচে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কান্তি টেলিফোন হাতে করেছে, ‘হ্যালো এটা কী বিশ্ববার্তা আপিস? অ্যাঁ?… বিশ্ববার্তা? বড়কর্তার ঘরে দাও।… ও আপনি? বড়কর্তা?… আমি কান্তি। কাশীপুরের রহস্য আমি প্রায় সমাধান করে এনেছি।…’

বলেই কান্তি মুহূর্তখানেক কান খাড়া করে রইল—প্রতীক্ষা করতে লাগল। কিন্তু থরহরিবাবুর কণ্ঠস্বরে কিছুমাত্র থরহরি পাওয়া গেল না। অবিচলিত স্বরে তাঁর জবাব এল।

‘কালু সেন কি ধরা পড়েছে?’

‘থরহরিবাবু, কেবল কালু সেন নয়, এই মৃত্যুরহস্যের আগাগোড়া আমি ধরেছি। ধরতে পেরেছি।’—কান্তি বলল, তার বলার কায়দা আর প্রত্যেকটি কথায় বিশেষত্ব দিয়ে। বিশেষ ব্যঞ্জনা দিয়ে বলল কান্তি—’কার মৃত্যু তা সকলেই আমরা জানি। খুড়ো কৃত্তিবাস মরেছেন, এইটুকুই জেনেছি কেবল। এবং এও জানা গেছে যে, কৃত্তিবাসের ভাইপোই তাঁকে মেরেছে। কিন্তু কেন মেরেছে, কীভাবে মেরেছে এবং সেই ভাইপোই বা কোথায় এখন অবধি তার কিছুই আমরা জানতাম না। মৃত্যু কাহিনীর এই পরিচ্ছেদগুলো পাওয়া যাচ্ছিল না। এই পরিচ্ছেদগুলোই আমি পাকড়েছি, সেই কথাই জানাতে চাই আপনাকে।’

‘বটে? বেশ তো’, অচঞ্চলস্বরে বললেন থরহরি! ‘বেশ’।

‘এবং এই কাহিনীটাই আগাগোড়া, পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদ আপনাকে আমি শোনাতে চাই।’

‘কিন্তু এই টেলিফোন কানে শোনা তা কি সম্ভব হবে? যদি হয় তো শোনাও। দু’কথায় দু মিনিটের মধ্যে শোনাতে পারলে আমার আপত্তি নেই।’

‘কিন্তু দু’-মিনিটের রামায়ণ গান, স্বয়ং রামচন্দ্র কান পাতলেও, বোধহয় শোনানো যায় না।’ কান্তি খানিক ইতস্তত করে, স্বভাবতই, কিন্তু বেশিক্ষণ সে ইতস্তত করে না।

‘গল্পটা টেলিফোনে না বলে বিলিয়ার্ড টেবিলে বললে বোধহয় ভাল শোনাবে। সচিত্র করে বলা যাবে হয়তো।’

‘তার মানে?’ থরহরি প্রশ্ন করলেন।

‘তার মানে আপনি বিশ্ববার্তা থেকে সোজা আপনার বাড়িতে আসুন। আমিও যাচ্ছি। সেখানে আমাদের দু’জনের বিলিয়ার্ড খেলার ভেতর দিয়ে আমার বক্তব্যটা ব্যক্ত করব। এই ব্যাপারটার এমন কতকগুলি বিশেষ দিক আছে তা বিলিয়ার্ডের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে না দেখলে ধরা পড়বে না। যদি আপত্তি না থাকে, আপনাকে পঞ্চাশ পয়েন্টের খেলায় আমি চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত—তার মধ্যেই খেলা এবং আমার গল্প দুই-ই খতম হবে। বেশিক্ষণ আপনাকে কষ্ট দেব না আমি।’

থরহরি বললেন, ‘বেশ।’

‘শেষ হল তো ভালই, নইলে তোমাকেও আমি শেষ করব।’ সেইসঙ্গে একথাও তিনি মনে মনে বললেন কি না কে জানে। থরহরির দুর্গম মনস্তত্ত্বে প্রবেশ লাভ করা যে কোনও কল্পনাকুশলী লেখকের পক্ষেও যথেষ্ট কঠিন।

থরহরিকে বিলিয়ার্ড চ্যালেঞ্জ করা একটা যা তা নয়। তাঁর মতো ধীর মস্তিষ্ক এবং স্থির প্রতিজ্ঞ খেলোয়াড় শহরে খুব কমই আছে। তাঁকে বিলিয়ার্ডে হারাতে কদাচ কেউ পেরেছে। একচোটে নয় দশ কি বারো পর্যন্ত মারবার সুখ্যাতি শোনা যেত তাঁর। টেবিল থেকে বল উড়িয়ে দেওয়া তো তাঁর পক্ষে অতি সহজ ব্যাপার। তিনটে বলের কে কোথায় রয়েছে, তাঁর শ্যেনদৃষ্টির কাছে এড়াবার জো ছিল না, তাদের কোনদিকে কীভাবে পিটতে হবে স্বভাবতই তিনি টের পেতেন।

তবে কান্তিও প্রতিপক্ষ হিসাবে কিছু কম যায় না। আষাঢ়ির মার বলে একটা কিছু আছে—কান্তির ছিল সেই সুবিধে ! কান্তি বিলকুল আষাঢ়ি। বিলিয়ার্ডের বিষয়ে অল্পদিনের পুঁথিগত বিদ্যা তার। তবে, সংবাদপত্রের রিপোর্টারের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। কাজেই এর আগে কখনও আর না খেললেও কান্তি কোনও অংশে কম যায় না।

অদ্ভুত বিলিয়ার্ডের চাল কান্তির। কুশনের আড়ালে নিজের বল রেখে প্রতিপক্ষের আঘাত থেকে রক্ষা করছে এবং তার নিজের মারের বেলায় হয় সেই বল সবেগে নয় একলাফে ধারের পকেটে গিয়ে স্থান লাভ করেছে।

স্কোর খুব চটপট বেড়ে উঠল—দু’জনেই প্রায় সমান সমান! আধঘণ্টা খেলার শেষে এরও দশ ওরও দশ। থরহরি তাঁর ভারী মুখ আরও ভার করে উঠে পড়ে লেগেছেন—টেবিলের ওপরে তাঁর এক পা। কান্তি উত্তেজনার চুড়ান্ত সীমায় উঠেও অতীব শান্ত; বলের ওপর সে ঝুঁকে পড়েছে। বল আর তার চোখের মধ্যে এক ইঞ্চির ফারাক!

পনেরোর সময়েও তারা সমান। থরহরি হঠাৎ একচোটে তিন পয়েন্ট মেরে বসেছে। কিন্তু এ চোটেও সামলে নিয়েছে কান্তি। আরও মিনিট কুড়ি খেলার পর দু’জনে উনিশে এসে সমকক্ষ হয়েছে আবার।

কিন্তু কান্তিকুমার মিত্রের খেলায় জেতা ছাড়াও অন্য আরও কিছু ছিল বুঝি। এইবার সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। তার সুযোগ এল এতক্ষণে। দক্ষ হাতের এক মারে, খুব ওস্তাদও কদাচ যা পারে, কান্তি থরহরির বলকে বেশ একহাত দেখে নিল। লাল বলটা পকেটের হাঁ-এর মুখে গিয়ে দাঁড়াল, সাদা বলটা ঠিক মাঝখানে। কান্তি থরহরির মুখের দিকে তাকিয়ে।

বলগুলি ঠিক সেই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, কৃত্তিবাসের মৃত্যু তিথিতে তাঁর বাড়ির টেবিলে ঠিক যেমনটি করে দাঁড়িয়েছিল!

‘আমি ইচ্ছে করেই ওরকমটা করেছি।’ বললো কান্তি। সহজ সুরেই বলল।

‘তার মানে?’ জিজ্ঞেস করলেন থরহরি ।

বলের ওইরূপ অবস্থা দেখেও তিনি যে কিছু দুর্বল হয়েছেন তা মনে হল না। ‘তার মানে ওই বলের মধ্যেই রয়েছে।’ কান্তি জানাল। ‘থরহরিবাবু আসুন, এবার একটু বসা যাক! আপনাকে আমার কয়েকটি কথা বলার আছে। অবশ্যি যা বলব, তা আপনার অজানা নয়। আপনি বুদ্ধিমান, ইতিমধ্যেই তা আঁচ করতে পেরেছেন।’

কান্তির কথাতেও বেশ আঁচ। তার ভেতরে যে আগুন জ্বলছিল তারই আঁচ বোধহয় কান্তি আজ অগ্নিকাণ্ড না করে ছাড়বে না। যে থরহরি সারা বিশ্বময় বিশ্ববার্তাকে থরহরি কম্পিত করে রাখেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে এখনও সে অকম্পিত।

দু’জনে মুখখামুখি দুটো কুশন অধিকার করে বসল। থরহরি শান্তভাবে একটা সিগারেট ধরালেন। মনে হল তাঁর হাত যেন একটু কাঁপল—সিগারেট ধরানোর সময়ে। চকিতের জন্যই মনে হল কান্তির।

‘বেশ।’ সিগারেট মুখে তিনি প্রশ্ন করলেন—’কী বলতে চাও বলো?’

‘থরহরিবাবু’—কান্তির কান্তি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মনে হয়—’দু’সপ্তাহ আগে আপনি আমাকে এক জটিল রহস্য সমাধানের ভার দিয়েছিলেন! তার কিনারা আমি করেছি। আজ রাত্রে—এখানে—এই মুহুর্তে এখনই সেই সমাধান আপনাকে জানাতে পারি। আপনি কি তা জানতে চান?’

থরহরির কপালে কি কপোলে একটিও রেখা পড়তে দেখা গেল না।

‘বেশ তো।’ বললেন তিনি। জানাই যাক না।’

‘একটা মানুষের জীবন বিলিয়ার্ড খেলায় খতম করে দেওয়া যায়—স্বচ্ছন্দেই যায়— তাই না, থরহরিবাবু?’ কান্তি বলে, ‘আপনার কাছে অপরের জীবনের দাম বিলিয়ার্ডের চেয়ে বেশি নয় কি?’

‘তার মানে? তুমি বলতে চাও কী?’ এইবার থরহরির হুঙ্কার শোনা গেল: ‘তুমি কী বলতে চাও শুনি একবার?’

‘তার মানে—তুমি, তুমিই খুন করেছ কৃত্তিবাসকে।’ কান্তি বলল দৃঢ়স্বরে। থরহরির সামনে দাঁড়িয়ে কোত্থেকে—যে, কেবল স্বরে নয়, ব্যঞ্জনাতেও তার দৃঢ়তা এল কে জানে! এবং নিজের আমিত্বে পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে থরহরির সঙ্গে আপনা আপনিও যেন সে ভুলে গেল। স্রেফ তুমিতে তাঁকে পর্যবসিত করতে একটুও তার দ্বিধা হল না।

‘তুমিই! বিশ্ববার্তা পরিচালক শ্রীযুক্ত বাবু থরহরি দত্ত দুর্দান্ত প্রতাপশালী, চক্রান্তকারী এবং বদমায়েশ—এতদিনে তোমার স্বরূপ এবং চালচলন প্রকাশ পেয়েছে। তুমি ধরা পড়েছ !’

থরহরির বিপক্ষে তার মনে তার নিজের অগোচরে এতদিন ধরে যে এত রাগ এবং এত বেশি বিরাগ পুঞ্জীভূত হয়েছিল তা কান্তি নিজেই জানত না—কিন্তু কেন যে হয়েছিল তা না জানলেও, এবার তার প্রকাশের সরল ও সংগত পথ পেয়ে তার সমস্ত উষ্মা যেন লাভা প্রবাহের মতো টগবগ করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। থরহরিকে ধরে থোরের মতো কুচি কুচি করে কাটতে পারার ভেতর এত যে আনন্দ আছে তা সে জানত না। হাতিকে কাত দেখতে পেলে হস্তিদলিতদের যে অপার্থিব আনন্দ দেখা যায়—এ বুঝি সেই আনন্দ।

‘কুচক্রী, ভণ্ড এবং বিশ্বাসঘাতক বাবু থরহরি দত্ত—ওরফে তোমার আসল নাম বলতে আমার কোনও কুণ্ঠা নেই আর—ওরফে কালু সেন—তুমিই হচ্ছ কৃত্তিবাস সেনের হত্যাকারী।’

তবু, তথাপিও থরহরির কপালের একটি শিরাও কাঁপল না। একটি কথাও না বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। কান্তিও উঠে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গে। একটিও কথা না বলে থহহরি কান্তির গালে সজোরে ঠাস করে এক চপেটাঘাত করলেন। সেই থাপ্পড়টাই যেন তার একটি মাত্র কথা। যার পর নাই কথা।

‘তার মানে’ কান্তি গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলল।

‘তার মানে, শ্রীমান কান্তিকুমার মিত্র, তুমি একটা মিথ্যুক।’ থরহরির চড়টা তখনও তার গালে চড় চড় করছিল। জ্বলছিল গালটা।

‘কেবল মিথ্যুক নও, তুমি আস্ত একটা ধাপ্পাবাজ। কিন্তু কোথায় এসে চালাকি করছিলে তা টের পাওনি। পিরের কাছে মামদোবাজি চলে না। তুমি যে আসলে কে, তা গোড়া থেকেই আমার জানা ছিল—তোমার গোয়েন্দাগিরির প্রহসন শুরু হবার সময় থেকেই। তুমি জানো না কিন্তু জেনে রাখো যে তোমার প্রত্যেকটি পদক্ষেপের ওপর লক্ষ রাখা হয়েছিল। কোথায় তুমি যাও, কী করো না করো—তোমার সমস্ত চালচলনের ওপর কড়া নজর ছিল পুলিশের।

‘কান্তিকুমার মিত্র আসলে যে কালু সেন ছাড়া আর কেউ না, তা আমাদের অজানা ছিল না। তিন বছর আগে কালু সেন কৃত্তিবাস সেনের গৃহত্যাগ করেছে, আর অজ্ঞাতকুলশীল কান্তি মিত্রেরও ঠিক তিন বছর আগেই সাংবাদিকরূপে অভ্যুদয়। অতএব কান্তি মিত্র, ওরফে কালু সেন আমার বন্ধু নিহত কৃত্তিবাস সেনের হত্যার জন্য তোমাকেই আমি দায়ী করি, তবে তোমাকে পুলিশের হাতে দেওয়া না দেওয়া আমার ইচ্ছাধীন। আমার নিজের হাতেই তোমাকে আমি শেষ করতে পারি।’ একটানা এতবড় একটা বক্তৃতার পর তাঁর জীবনে এত অধিক বাক্যব্যয়ের বাহুল্য এই প্রথম। থরহরি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর নিজের হাতে সাক্ষাৎ কালু সেনকে আরেকবার মারের চোটে শেষ করার বাসনা প্রবল হলেও তেমন কোনও উদ্যম তাঁর দেখা যায় না।

এবার কান্তি মিত্র কুশন ছেড়ে উঠে এসে তাঁর নাকে এক ঘুঁষি লাগাল।—’মিথ্যাবাদী!’ চেঁচিয়ে ওঠে কান্তি, ‘আমি কালু সেন নই! কক্ষনও না।’

ঠিক সেই মুহুর্তে থরহরির জনৈক ভৃত্য দরজা ফাঁক করে প্রবেশ লাভ করে।

‘একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান কর্তা।’ সে জানায়।

‘কে?’ থরহরি জিজ্ঞেস করেন নিজের নাকের শুশ্রূষা থামিয়ে।

‘আমি চিনি না, তবে এই কার্ড দিয়েছেন।’

থরহরি দত্ত কার্ডটি হাতে নিলেন। কার্ডের ওপরে স্পষ্টাক্ষরে মুদ্রিত, কালু সেন।

কার্ড দৃষ্টে থরহরি এবং কান্তি—দু’জনে দু’জনের দিকে তাকাল—দুটি জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতোই যেন।—’কস্ত্বং? তাহলে—তাহলে কে তুমি—’ এটাই যেন প্রশ্ন তাদের।

একটু আগে যেখানে তত্ত্বমসির লড়াই চলেছে তুমিই সেই—সে ছাড়া আর কেউ না—এহেন উচ্চ দার্শনিকতা দেখা গেছে, কার্ডের পৃষ্ঠে দেগে দেয়া ‘কালু সেন’—এই দুটি কথায় তো যেন আলোর উদয়ে মসির তত্ত্বের মতোই তুচ্ছ হয়ে গেল। সোহং-এর আবির্ভাবে তছনছ হয়ে গেল সব।

‘লোকটাকে ওপরে নিয়ে এসো।’ বললেন থরহরি।

মিনিট দুই পরে লোকটা এল। কান্তির শ্যেন চক্ষু কালু সেনকে বিক্ষত করতে লাগল। তার সবুজ-রঙা পোশাক। রোদ-চটা তামাটে মুখ আর লম্বা লম্বা আঙ্গুল দেখলে লোকটা কী কাজ করে সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না; জাহাজের খালাসি বলে সহজেই তাকে চেনা যায়।

‘বোস।’ বললেন থরহরি।

‘ধন্যবাদ।’ বলল সেই খালাসি: ‘বসতে পারলে বাঁচি। আর কিছু না, আমার কাঠের পা-টা একটু স্বস্তি পায় তাহলে।’

থরহরি আর কান্তি আবার পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। লোকটার একটা পা কাঠের দেখে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেল, আরও দেখল, যা-তা কাঠ নয়, চন্দন কাঠ—। লোকটা (দয়া করে বা চটে গিয়ে) কারও গায়ে পা ঘষে দেয় তা হলে সেই পদাহত ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ গন্ধে ভুর ভুর করবে। এটা কেবল কাঠের সত্য নয়, কাঠোর সত্য।

‘আমি এডেন থেকে আসছি।’ উপবিষ্ট হয়ে কালু জানাল।

ঘাড় নাড়ল কান্তি। ‘এখন দেখতে পাচ্ছি।’ বলল সে: ‘থরহরি—থরহরিবাবু, আপনার সম্বন্ধে আমার ধারণা ভুল। মূলত এটা যে এডেনাগত কাঠের এক পা-ওয়ালা একজন লোকের কাজ, আগেই তা আমাদের ঠাওর করা উচিত ছিল। সে ছাড়া আর কারও কীর্তি নয়। এ ছাড়া অন্য কাউকে ঠাওর করতে যাওয়াই আমাদের অন্যায় হয়েছিল।’

‘সমবেত ভদ্রমণ্ডলী—!’ কাঠের পা-টাকে আরামে রেখে আরাম কেদারায় নড়ে চড়ে বসে কালু আরাম করে: ‘আমি আমার জবাবদিহি দিতে এসেছি। আমার স্বীকারোক্তি শুনুন। যদিও সাধারণত পুলিশের শিকার হবার পরই এই উক্তি করাটা দস্তুর। কিন্তু আর সময় নেই। আমি নিজেই আমার শিকার—দুর্ভাগ্যের শিকার। যতদূর মনে হয়, আমার আর বেশি সময় নেই। এখানকার—ঠিক ইহলোকের কি না জানি না—তবে এখানকার খাঁচা থেকে এখনই আমাকে উড়তে হবে।…যতক্ষণ সময় আছে আমার শেষ কথাটা শেষ করে নিই আগে।’

‘সেকী!’ কান্তি বিস্ময়ে নুয়ে পড়ে। ‘তুমি কি অন্তিম ক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছ নাকি? শেষ মুহূর্তে এসে দেখা দিয়েছ আমাদের?’

‘তাই কি স্বাভাবিক নয়? সেইটাই ঘটে না কি সচরাচর?’ পালটা প্রশ্ন এল কালুর দিক থেকে। ‘আপনারাই বলুন না!’

‘হ্যাঁ, তাই ঘটে থাকে বটে।’ কান্তি ঘাড় নাড়ল, ‘তা হলে নিশ্চয় তোমার বক্তব্যের মাঝে মাঝে গলার ঘড়ঘড়ানি উঠে তোমাকে বাধা দেবে বোধ হচ্ছে? হয়তো বেদম কাশিও আসতে পারে তোমার, তাই না?’

‘আপনি সর্বজ্ঞ। আপনাকে নমস্কার!’ কালু সেন পা তুলবার চেষ্টা করল, পারল না। অগত্যা কেবল হাত তুলেই নমস্কার জানাল। ‘ঠিকই ধরেছেন আপনি—তবে গলার ঘড়ঘড়ানিটা আমি উপসংহারের জন্য রেখেছি। বেদম কাশিটা মাঝে মাঝে আমদানি করব বটে, তবে তার দেরি আছে এখনও।’

‘গাল বেয়ে রক্তও গড়িয়ে পড়তে পারে হয়তো? অ্যাই?’ থরহরির আশঙ্কা হয়, তকতকে মেঝের দিকে তাকিয়ে।

‘আজ্ঞে না, অতদূর গড়াবে না।’ জবাব দিল কালু; ‘এবার তাহলে আত্মজীবনী শুরু করা যাক। বাল্যকাল থেকেই আরম্ভ করি—কেমন?’

‘না, না, দোহাই, তা কোরো না।’ কান্তি এবং থরহরি সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে। এমনকী এতদিনের ও এত কাণ্ডের পর অকম্পিত থরহরিকেও থরথর কাঁপতে দেখা যায়।

কালু সেন ভ্রূকুঞ্চিত করে। ‘আমার ধারণা আমার আত্মজীবনী শোনাবার ন্যায্য অধিকার আমার আছে।’ সে বলে—’যে লোকটা একজন লোকের প্রাণ নিয়েছে এবং অপর একজনের মানে, নিজের প্রাণ দিতে চলেছে—প্রাণের আদান-প্রদান যার কাছে এমন অকাতর এবং তুচ্ছ—তার যা খুশি সবাইকে শুনিয়ে দেবার অধিকার আছে বই কী। এটা বার্থ রাইট না হতে পারে, কিন্তু ডেথ রাইট যে, তাতে কোনও ভুল নেই। অতএব আমার কাহিনী আপনাদের শুনতে হবে। শুনতেই হবে—না শুনে উপায় নেই।’

‘ছোটবেলার থেকেই আমার দুর্দান্ত স্বভাব।’ কালু বলতে থাকে, ‘যখন যা মনে হয়েছে তাই করেছি। তখন-তখনই যদি শাসন করত, আমার স্বভাব শোধরাবার চেষ্টা করত, তাহলে বোধহয়—’

‘কিন্তু তা করা হয়নি।’ থরহরি বাধা দেন ‘তারপর?’

‘আমার কাকার তিনকুলে আমি একাই ছিলাম। আর কাকার ছিল অগাধ ঐশ্বর্য। অপর্যাপ্ত বিলাসের মধ্যে ছোটবেলা থেকে বর্ধিত হয়ে কোনওদিন যে আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে বা তার প্রয়োজন হবে, তা আমি কখনও বোধ করিনি।’

‘ভাল কথা’—কান্তি সবকিছুই চুলচেরা খতিয়ে দেখার পক্ষপাতী, বাধা দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘তখন তোমার ক’টা পা? মানে পায়ের সংখ্যা ছিল কত?’

‘দুই, মাত্র দুই। ভগবদ্দত্ত সবার যেমন থাকে। কিন্তু অল্পদিনেই বিলাস-ব্যসনের চূড়ান্তে উঠতে গিয়ে—’

‘তোমার পা ফসকালো। মানে একটা পা ! কালুভায়া, চটপট তোমার আসল কথায় এসে পড়ো। আমার ভারী খিদে পেয়েছে।’

‘এই এলাম।’ বলল কালু, ‘দেরি নেই কিন্তু মহাশয়রা যতদুর মনে করছেন ততটা নয়। খারাপ আমি ছিলাম বটে, কিন্তু একেবারে অতিশয় খারাপ কখনই ছিলাম না।’

‘না না, তা তো নয়ই।’ থরহরি এবং কান্তি সান্ত্বনার ছলে সায় দিল। ‘তা কে বলছে? পরের টাকা এবং দুশ্চরিত্র সকলেই বেশি বেশি দেখে; কিন্তু তাহলেও শতকরা নিরানব্বই জনের চেয়ে বেশি খারাপ কক্ষনওই তুমি ছিলে না।’

‘এমনকী আমার জীবনেও ভালবাসা দেখা দিয়েছিল। যেমন প্রত্যেকের জীবনেই

দেখা দেয়। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনে ভালোবাসা এলেও ঠিক তেমনভাবে আসে কি না সন্দেহ আছে। তেমনটি আমি কখনও দেখিনি। এ জেনেও না; এমনকী কোনও রাতেও নয়। তাকে দেখলে মনে হয় যেন মূর্তিময়ী করুণা। সেই কাশীর মহিষী করুণার মতোই। সে যেমন গরিবদের কুটিরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, ইনিও তেমনি গরিবের মনে—বেশি আর কী বলব? তিনবছর আগে সেই করুণা আমার কাকার বাড়িতে এল—’

‘জানি, জানি। টাইপিস্টরূপে। তারপর?’ কান্তি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।

‘এবং নাম তার করুণা নয়। মিস অলকা দত্ত।’ থরহরি মনে করিয়ে দেয়।

‘তারপর আমি তাকে না ভালবেসে পারলুম না। প্রথমে বোনের মতো—তারপর বন্ধুর মতো—তারপর?’

‘তারপর যৎপরোনাস্তি ঠিক যেমন হয়ে থাকে। তারপরে? তারপরের মোদ্দা কথাটা আমরা শুনতে চাই।’ থরহরি বললেন, ‘যদি বলতে চাও তো বলো।’

‘তারপর তাকে নিয়ে আমি সিনেমায় গেলাম। আমার কাকা, কী করে জানি না, টের পেলেন সেটা। সিনেমার ওপরে তিনি হাড়ে চটা ছিলেন। সিন আর সিনেমা তাঁর ধারণায় ছিল এক জিনিস, এমনকী সহিস কোচম্যানদেরও তিনি সিনেমা দেখার ছুটি দিতেন না— পাছে তারা ঘোড়াদের বখিয়ে ঘোড়েল করে দেয়—’

‘ঘোড়ার কথা থাক,’ কান্তি বলল, ‘তোমার কথা বলো। কাকা ওই কাণ্ড টের পাবার পর কী হল শুনি?’

‘ভারী তিনি চটে গেলেন। এমনকী ওই নিয়ে আমাদের মধ্যে ভীষণ কলহ পর্যন্ত হয়ে গেল। শেষে তিনি আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিলেন—’

‘ত্যাজ্য ভ্রাতুস্পুত্র। সঠিক বললে তাই নয় কি?’ কান্তি ভ্রম সংশোধন করে।

‘ত্যাজ্য ভ্রাতুস্পুত্র করে তাঁর অগাধ সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করে তাঁর বাড়ি থেকে তিনি বার করে দিলেন আমায়।’

কালু থামল, এইবার তার সেই পূর্ব প্রতিশ্রুতি কাশির ধমকানি দেখা দেবে বলে কান্তি মিত্রের ধারণা হয়। থরহরি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নিজের সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। বোধহয় এই তাঁর জীবনের প্রথম দীর্ঘ নিশ্বাস। নিজের জন্য যা কখনই তাঁকে ফেলতে হয়নি, কোনও কারণ ঘটেনি ফেলবার; অন্যের গৃহতাড়িত হবার দুঃখে অনেকদিনের সযত্ন-সঞ্চিত সেই দীর্ঘশ্বাস এই সুযোগে মোচন করার অবকাশ পেয়ে তিনি পরিত্যাগ করেন।

কালু সেনও দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরম্ভ করে আবার: ‘ছোটবেলায় আমার আরেক ভালবাসা ছিল। শিশুর থেকে আমি সমুদ্রকে ভালবাসতে শিখেছিলাম।’

‘কোন শিশুর থেকে?’ কান্তির সাগ্রহ প্রশ্ন।

‘রবীন্দ্রনাথের শিশু বইটির থেকে নয় নিশ্চয়ই?’ থরহরিও জানতে চান।

‘সমুদ্রের প্রতি টান আমার ছোটবেলায়। নৌকা দেখলে তার পালের আগে আগে ছুটতাম।’

‘নৌকোর পাল?’ কান্তি আরও অবাক হয় এবার। ‘তোমার সামুদ্রিক পরিভাষা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। নৌকোর পাল আবার কীহে? নৌকোরাও কি গোরুর মতো পালে পালে চরে নাকি? আর চরলেও, তাদের আগে না ছুটে পেছনে পেছনে দৌড়নোর কী বাধা ছিল তোমার?’

কালু সেন কান্তির কথার কোনও জবাব দিতে পারে না। কাশতে আরম্ভ করে। জবাব দিতে পারে না বলেই কাশীবাস শুরু করে বোধহয়। কিংবা পাল চাপা পড়েই বোধহয় সে নিরুত্তর হয়ে যায়। ‘বোম্বে থেকে আসবার পথে কি তুমি কাশীধাম ঘুরে এসেছিলে নাকি হে?’

কান্তির জানার কৌতুহল হয়।

‘তোমার এই কাশির ধমক দেখে সন্দেহ হয়।’ কান্তি জানায়: ‘কাশী প্রাপ্তির জন্যই লোকে সেখানে গিয়ে থাকে বলে শুনেছি। আর, সেখানে গেলে স্বভাবতই কাশিপ্রাপ্ত হতে হয় শেষ পর্যন্ত।’

কালু কোনও জবাব দিতে পারে না। বিনা বাক্যব্যয়ে কাশতে থাকে।

‘তোমার এই কাশি কি গয়া পর্যন্তও গড়াবে নাকি?’

তকতকে মেঝের দিকে তাকিয়ে থরহরি আতঙ্কিত হন। ‘কাশী গয়া সব এক পথেই পড়ে না? এক লাইনেই যাওয়া যায় তো?’

কালু তার কাশির মাঝখানে, খানিকক্ষণের জন্যই যেন, এক হলটিং স্টেশনে এসে দাঁড়ায়।

কাশি থামিয়ে কালু জানায়: ‘কাশির কথা থাক। পালের কথা কী শুধুচ্ছিলেন? সব পালাটা শুনুন আগে। কাকা আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে আমার সেই বাল্যকালের ভালবাসা মনে পড়ল। সমুদ্রকে আমি ভালবাসতাম। শিশুপাঠ্য বই পড়ে যে ভালবাসা জন্মেছিল, সিনেমায় সমুদ্রের ছবি দেখে জমে জমে তা বেড়ে উঠেছিল ক্রমে ক্রমে। একটা জাহাজে খালাসির কাজ নিয়ে যেদিকে দু’চোখ যায় বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম আমি যবদ্বীপের দিকে। সেখানে মালয় উপকূলের এক সামুদ্রিক ডাকাত আমার একটা পা ছিঁড়ে নিল। ভাগ্যিস মালয়ের বনে চন্দন সস্তা, প্রায় হিমালয়ের বরফের মতোই সুলভ! তাই আসল পায়ের চেয়েও দামি, চন্দনকাঠের এই মূল্যবান পদ আমি লাভ করেছি।’

‘তুমি তো মরতেই যাচ্ছ। যখন তোমার অন্তিমক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে তখন শেষ পর্যন্ত তোমাকে মরতেই হবে। যদি কিছু না মনে করো তাহলে স্মরণচিহ্ন স্বরূপ তোমার এই পা থেকে একটুখানি আমি কেটে নিতে চাই। আমার এক পিসির ভারী পুজো-আর্চার বাতিক, তিনি পেলে খুশি হবেন খুব। কেটে নিলে তোমার লাগবে না তো?’ কান্তি জিজ্ঞেস করে।

‘পায়ে লাগবে কি না জানি না। তবে, মনে লাগবে। কত কষ্ট করে এই পা বানানো, তা জানেন!’ কালু জানায়।

‘তবে থাক, থাক। দরকার নেই।’

‘এইবার আমি সেদিনের ঘটনায় আসব। কিছুদিন আগেকার সেই ঘটনায়। আমার কাহিনীকে আর অযথা বাড়াতে চাই না। থরহরি বাবুর বোধহয় খাবার সময় হয়েছে, খিদেয় ছটফট করছেন মনে হচ্ছে। এক কথায় সেরে ফেলব এবার। তিন বছর আগের কথাই বলছি—আমরা মালয় থেকে পাত্তাড়ি গুটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে রওনা দিলাম। তারপরে এই আড়াই বছর ধরে নানা দেশের নানান উপকূলে নানাবিধ জীবনযাত্রা দেখেশুনে অবশেষে একদিন এডেন হয়ে আমাদের জাহাজ বম্বে বন্দরে এসে পৌঁছল।’

‘আমরা জানতাম।’ বলল কান্তি।

‘আপনাদের অজানা কী আছে? গোয়েন্দারা কী না জানেন? তারপর যা বলছিলাম। বম্বেতে জাহাজ এলে আমি কিছু দিনের ছুটি নিলাম। ছুটি নিয়ে রেলে চেপে এলাম এই কলকাতায়…খক্ খক্ খক্।’

‘আসবার পথে কি তুমি কাশী হয়ে এসেছিলে নাকি?’ কান্তি বাধা দিয়ে তার আগের কথাটাই শুধোয় আবার।

‘কাশী? না তো! কাশী হয়ে আসিনি—এসেই কাশি হল। এই মারাত্মক কাশিটা—তারপর যা বলছিলাম।’

‘কথা ছিল, বম্বে থেকে আমাদের জাহাজ কলকাতার ডকে যেমনি এসে ভিড়বে, তেমনই আমারও ছুটি ফুরোবে। আমি এখান থেকেই জাহাজে আমার কাজে যোগ দেব। আমি দেখলাম এই সুযোগ—।’

‘খুড়োর গঙ্গাযাত্রা করানোর। তাই না?’ কান্তিও যোগ দেয়।

‘ঠিক ধরেছেন!…কলকাতায় আমার ভূতপূর্ব বাড়িতে ফিরলাম বটে, কিন্তু কী গেছলাম আর কী হয়ে এলাম। তিক্ত মন, আশাহীন জীবন, রিক্ত দেহের ভগ্নাবশেষ নিয়ে এ কী ফিরে আসা! কেবল একমাত্র এই চিন্তা তখন আমার মনে ছিল—আমার সর্বনাশের জন্য যিনি দায়ী, মূল কারণ আমার সেই কাকাকে এবার খতম করে যাব।’

আবার দ্বিতীয়বার কাশিটা এসে ধমক দিতে লাগল কালুকে। কাশতে কাশতে অস্থির হয়ে পড়ল বেচারা। থরহরি আর কান্তি উভয়ে উভয়ের দিকে কটাক্ষ করলেন। যার মর্ম হচ্ছে, লোকটি কি শেষ কথা বলার আগেই বলা শেষ করবে নাকি? খকখকানি যে থামেই না আর!’

অবশেষে থরহরিবাবু না বলে পারেন না,—’তোমার কাকাকে তো নিকেশ করেইছ, কিন্তু তাঁর শেষ কাণ্ডটা বর্ণনার আগে নিজে যেন খতম হয়ো না।’

‘ক্ষান্তি দাও কাশির।’ কান্তিরও অনুরোধ।

‘আমি কি ইচ্ছে করে কাশছি নাকি?’ কালু বলে—’ইচ্ছে করলে হাসা যায়। এমনকী অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাসতে পারে মানুষ।’

‘তাকে বলে কাষ্ঠ হাসি। জানি,’ কান্তি জানায়।

‘কিন্তু আমার এটা কি কাষ্ঠ কাশি বলেই আপনাদের বোধ হচ্ছে?’

‘না না, তা বলছি না, তবে এটা তোমার কাশির পরাকাষ্ঠা বটে।’ কান্তি বলে—কিন্তু কাশতে কাশতে কাঠ হয়ে যাওয়া এতটা কি ভাল?’

‘আমি কোথায় কাঠ হয়েছি? আমার একটুখানিই তো হয়েছে। এই পা-টা কেবল।’

কালু আকাঠের মতোই নিজের পা তুলে দেখায়। নিজেই নিজের পদোন্নতি ঘটায়।

‘তোমার যে বেশ পায়াভারী তা আমাদের আর জানতে হবে না।’ বলেন থরহরিবাবু: ‘তা আমাদের অজানা নয় ভাই।’

জবাবে কালু আবার তার কাশি বাজায়।

কাশির ধমকানি শেষ হলে কালু সেনের শুরু হল আবার: ‘সন্ধের পর অন্ধকার বেশ জমাট হয়ে এলে আমি কাকার বাড়ির মাটিতে পা দিলাম। রাত তখনও বেশি হয়নি; কিন্তু কাকার প্রিয় ভৃত্য উদ্ধবের টিকি দেখা গেল না। তাতেই বুঝলাম, কাকা বেরিয়েছেন। কাকা বাড়ির গাড়িতে বেরোননি তা বোঝা গেল।কেননা গাড়ি ঘোড়া আস্তাবলেই মজুদ ছিল, কিন্তু তা থাকলেও সহিস কোচম্যানরা কেউ ছিল না। একটা ঘোড়া আমাকে দেখে চিনতে পারল কি না জানি না কিন্তু হ্রেষারবে সেই প্রথম আমাকে স্বাগত জানাল।’

সদর দরজা খোলাই পড়ে ছিল; ইচ্ছে করলে স্বচ্ছন্দে সেই পথেই বাড়িতে ঢুকতে পারতাম। কিন্তু যে খুন করতে এসেছে তার ওভাবে গৃহে প্রবেশের কোনও মানে হয় না। ঝোপঝাড়ের আড়াল আর আবডাল থেকে কাজ সারাই তার সঙ্গত মনে হয়। কিন্তু কাকার বাগানবাড়ি নামেই বাগানবাড়ি। বাগান সেখানে নামমাত্র, ঝোপঝাড়ের অস্তিত্বই নেই। কিন্তু যেখানে ঝোপঝাড় নেই, আর যখন সদর দরজা খোলা এবং কেউ নেই কোথাও, তখন কী করি? অগত্যা আমার কাঠের পায়ার সাহায্যে বাধ্য হয়ে দেয়াল বেয়ে উঠতে হল আমাকে। অসাধারণ সাহসে ভর করে তাই উঠলাম। তা ছাড়া পথ ছিল না। দোতলা পর্যন্ত উঠে একটা জানলা পাওয়া গেল। কাকার বিলিয়ার্ড ঘরের জানালা। জানালার কার্নিশে বসে অসাধারণ কৌশলে তার ভেতরের খিলটা খুললাম। কৌশলটা আর কিছু না, ছুরি দিয়ে দিয়ে খড়খড়ি দু’ ফাঁক করে হাত গলিয়ে ভেতরের ছিটকানিটা খুলে ফেলা। ইচ্ছে করলে সদর দরজায় এগিয়ে অনেক আগে বিলিয়ার্ড ঘরে পৌঁছে ভিতর থেকেই জানালাটা খুলতে পারতাম ঢের সহজেই। কিন্তু কার্নিশে বসে খোলাটাই অসাধারণ। অন্যভাবেও খোলা যেত বটে, কিন্তু কাজটা নিতান্ত খেলো হয়ে যেত। পরদিন পুলিশের লোকেরা এসে কীসের এত অনুসন্ধান করত তা হলে? ক্লু খুঁজত কোথায়? অনুসন্ধান করার মতো কিছু না পেলে তারা খুব বিরক্ত হত না কি? ভাবত যে, আমি তাদের ডুবিয়ে দিয়েছি, তাদের সঙ্গে ঠিক সদ্ব্যবহার করিনি, আমার উপযুক্ত কাজ করিনি। মনে মনে তারা টিটকিরি দিত আমাকে। এইসব দিকে দৃষ্টি রাখা দায়িত্বজ্ঞানী হত্যাকারীর কর্তব্য। খুনখারাপির পথ অত্যন্ত সোজা, সহজেই খুন করা যায়, কিন্তু ইচ্ছে করেই আমরা সেটা ঘোরালো করে তুলি, তার মধ্যে ঘোর প্যাঁচ না থাকলে কিছুই থাকল না। কোনও মারপ্যাঁচ না করে যদি মারা যায়, তা হলে সেটা মারাই হল না। খুনের অভিধানে সেটা নিতান্তই অপকর্ম।’

কান্তি হাঁ করে কালুর মুখ থেকে এই হত্যারহস্য শুনছিল—থরহরি তাদের দু’জনকেই বাধা দিলেন। ‘ঢের হয়েছে। আসল কথা শুনি এবার।’ তিনি বললেন। ‘এইবার নিয়ে তিনবার।’

রান্নাঘর থেকে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ এসে অনেকক্ষণ থেকে তাঁকে বিব্রত করছিল। না বলে তিনি থাকতে পারলেন না। ‘জানালা খুলে ফেলে তারপরে আমি বিলিয়ার্ডের ঘরে পা নামালাম। খুনের নেশায় বুকের রক্ত তখন টগবগ করছে আমার। কিন্তু ভগবানকে ধন্যবাদ, আমাকে তিনি খুব বাঁচিয়েছেন। খুন আমাকে করতে হয়নি—’

‘অ্যাঁ, এই যে বললে তুমিই খুন করেছ? এখন আবার?’ কান্তি চেঁচিয়ে উঠে, ‘এই উলটো গাইছ কেন?’

‘এখনও আমি কিছুই বলিনি। করেছি কি করিনি, আমার কাহিনী শেষ হলে আপনারাই তার বিচার করবেন। করেছি কি করিনি আমি নিজেও আজও জানি না। আমি নিজেও তা জানতে চাই। আপনাদের কাছ থেকে জানতে হবে আমায়। আপনারাই তার বিচারক—’

‘আহা বলতেই দাও না ওকে। তুমি আবার কেন বাধা দিচ্ছ?’ বাধা দিয়ে থরহরি স্বয়ং এবার বললেন। বললেন কান্তিকেই।

‘হ্যাঁ, যেমনি না আমি বিলিয়ার্ডের ঘরে পা দিয়েছি তক্ষুনি সেই ঘরের বিজলি বাতি জ্বলে উঠল, আর আমার চোখের সামনে দেখতে পেলাম—কাকে দেখতে পেলাম তা আমি বলব না—তা আপনারা আমাকে খুনই করুন আর ফাঁসিই দিন, সেই দেবীর বর্ণনা আমার এই পাপ মুখে আমি করব না। সেই দেবী বললেন,—দেবীদের অজানা কী আছে? সকলের নাড়ির খবর তাঁদের হাঁড়িতে—মুক্ত কণ্ঠে তিনি বললেন আমায়—’পিল্টু, বুঝতে পেরেছি তোমার কাকাকে খুন করতে এসেছ। ও কাজটি কোরো না। দেবীর ওই কথায় আমার মন ঘুরে গেল। মত বদলে গেল আমার। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম ঠিক যেমন করে—যেমন করে—’

ভাষায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে কালু সেনকে থামতে হয়। থরহরি দাড়ি চুলকোল।

‘ঠিক যেমন করে বোকারা আর খোকারা কাঁদে।’ কান্তি বাতলে দেয়। ‘তারপর?’

কান্নাকাটি শেষ হলে নীচের থেকে কাকার গলার আওয়াজ এল। ‘চটপট’ বললেন সেই দেবী, ‘চট করে কোথাও লুকিয়ে পড়ো৷ উনি যেন তোমায় দেখতে না পান।’ এই বলে দেবী পাশের ঘরে পালিয়ে গেলেন। আমি চার ধারে তাকিয়ে কেবল একটি তাক দেখতে পেলাম। বেশ বড় তাক—পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দার আড়ালে কোনও রকমে তার মধ্যে গুড়িসুড়ি মেরে লুকিয়ে থাকা যায়। আমি সেই তাকে গিয়ে উঠলাম। কী করে উঠলাম বলব?’

‘না, নিজেই আমি মাথা ঘামিয়ে বার করতে পারব।’ কান্তি জবাব দিল—’যদ্দুর মনে হয়। তোমার ঐ কেঠা পা দিয়ে একলাফে উঠে গিয়ে দাঁড়ালে? অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সাহায্যেই—তাই না?’

কালু সেন জবাব দিল পা নেড়ে, সেই কেঠো পা-খানাকেই নেড়ে চেড়ে জানাল যে, তাই বটে।

‘তারপর, তোমার পর্দানশিন হবার পর?’

জিজ্ঞেস করে কান্তি।

‘অ্যাঁ?’

‘মানে বলছিলাম কি, পর্দা মানেই তো নো সিন—কোনও দৃশ্য নেই। কেননা, পর্দার ভেতর দিয়ে তো কিছুই আর দেখা যায় না।’

‘কেন দেখা যাবে না?’ প্রতিবাদ করল কালু—’বলেছি না পর্দার মাঝখানে একটা ছ্যাঁদা ছিল? সেই ছিদ্র পথে ঘরের সব কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম।’

‘মানুষমাত্রই ছিদ্রান্বেষী। কে না জানে?’ সায় দেন থরহরি।

‘আচ্ছা, বলে যাও এবার।’ কান্তির উৎসাহদান।

‘পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম কী হয়। কাকা এলেন, ‘থরহরিবাবু এলেন। কাকা বললেন, ‘এসো থরহরি একবাজি খেলা যাক।’

থরহরি জানালেন যে, তাঁর আপত্তি নেই। এক পেট গেলার এর বিলিয়ার্ড খেলায় নাকি হজমের সাহায্য হয়। এই নাকি তাঁর ধারণা।

তারপর দু’জনের খেলা শুরু হল।

‘আমি ওদের খেলা লক্ষ করতে পারলাম। পর্দায় একটি ছ্যাঁদা ছিল—বলেছি না? তার ভেতর দিয়ে নিজে অদৃশ্য থেকেও সমস্ত কিছু দিব্যি দেখা যায়—’

কান্তি বলল, ‘হ্যাঁ, পর্দার ছ্যাঁদাটা আমি দেখেছিলাম বটে। যদিও ছ্যাঁদার ভিতর দিয়ে কতদূর দেখা যায় তা লক্ষ করতে যাইনি।’

‘ওই তো গোয়েন্দাদের গলদ। আসল লক্ষ্য ফেলে উপলক্ষের পিছনে আপনারা ছোটেন। যাই হোক, দেখতে লাগলাম খেলাটা। খেলা কিন্তু আর শেষ হতে চায় না। এদিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার পা টনটন করতে লেগেছে। দুটো পা-ই। খেলতে খেলতে দু’জনে খুব মেতে উঠলেন এবং দেখতে না দেখতে তেতে উঠলেন দু’জনেই। অবশেষে ওই খেলা নিয়ে ঝগড়া বেধে গেল দু’জনার। থরহরিবাবু হেরে গেছলেন।’ কালু ফাঁস করে দিল।

থরহরিবাবু ঘোঁত ঘোঁত করে উঠলেন: ‘সে যে সেই সাদা বলটাকে—’ তার বেশি তিনি আর বলতে পারলেন না। এতদিন পরেও সেই কথা ভাবতে গিয়ে ভাবাবেগে তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।

‘ঠিক কথাই।’ কালু বলল, ‘আমার কাকা লাল বলটা মারতে পারেননি। তাঁর ফসকে গেছল। কান্তিবাবু, তাবত বিলিয়ার্ডের গবেষণাই তোমার ভুল। আগাগোড়াই গলতি। বিলিয়ার্ড খেলায় শেষ পয়েন্ট নিয়ে কেউ ব্যস্ত হয় না। তখনও টেবিলে দু’জনের নিরানব্বই। থরহরিবাবু টেবিল ছেড়ে চলে গেলেন। আমার কাকা তারপরও লাল বলটাকে মারবার তাক করতে লাগলেন। একলা একলা সব বিলিয়ার্ড খেলোয়াড়েই যা করে। আধখানা মারে বলটাকে টপকে নিয়ে গিয়ে টেবিলের পকেটজাত করা—সেই চেষ্টাই তিনি করতে লাগলেন বারম্বার। কিন্তু কিছুতেই পারছিলেন না। কত রকম ভাবে তিনি করলেন। কিন্তু কিছুতেই বলটাকে কাবু করতে পারলেন না তবুও।’

‘এই চেষ্টায় ক্রমশ তিনি দুর্বল হয়ে পড়লেন বোধহয়?’ কান্তি জিজ্ঞেস করল। খুঁটিনাটির দিকে তার খর নজর।

‘মোটেই না’—অবশেষে তিনি করলেন কী…আমি সেই পর্দার ছিদ্র ভেদ করে দেখতে লাগলাম—অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। পকেট থেকে রুমাল বার করে গলায় জড়ালেন, ফাঁসের মতো করে জড়ালেন, আর সেই ফাঁসের মধ্যে বিলিয়ার্ডের কিউটাকে রাখলেন। ‘এইবার বোধহয় আমি পারব।’ তিনি বললেন, ‘এইবার।’

‘হ্যাঁ, এবার আমি বুঝতে পারছি।’ বলল কান্তি।

‘হ্যাঁ, এবার পারবেন।’ কালু বলল, গলায় কিউ বেঁধে বলটার পশ্চাতে তিনি লাগলেন এবার। খুব উত্তেজনাপূর্ণ মুহুর্তে, বুঝতেই পারছেন। খেলা দেখতে দেখতে আমিও ভারী উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। কোথায় আছি; কী অবস্থায় কিছুই আমার খেয়াল ছিল না। কাকার মারটা দেখবার জন্য পর্দা ফাঁক করে ঝুঁকে দেখতে গেছি— আমার কাকা তখন তাক করছেন, আর একদৃষ্টে তাকিয়ে আমি। আমাদের এই তাকাবার মুহুর্তে তাক থেকে আমার পা ফসকে গেল। কাকা ছিলেন আমার সামনে, আমি তাঁর ঘাড়ে গিয়ে পড়লাম। কাকা পড়ে গেলেন। আমাকে নিয়ে তিনি পড়লেন। পড়লেন গিয়ে মেঝেয়।’

এখন দেখা যাচ্ছে। বলল কান্তি: ‘উপুড় হয়ে তিনি পড়লেন আর তাঁর মাথা ঠুকে গেল মেঝেয়। আর গলার ফাঁসে আর কিউয়ে আটকে গিয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু ঘটল ! বিলিয়ার্ডের লাঠি আর রুমালের ফাঁস এরাই হল তাঁর মৃত্যুর কারণ বুঝতে পারছি এখন।’

‘হুবহু তাই।’ কালু জানাল। ‘তারপর যখন আমি এই দৃশ্য দেখলাম, দেখলাম যে তিনি অক্কা পেয়েছেন, আর একদণ্ড সেখানে দাঁড়াবার আমার সাহস হল না। কিউটাকে ছাড়িয়ে এসে কাকার গলার ফাঁসটা আরও ভালভাবে আমি এঁটে দিলাম। হাতদুটো বিবেকানন্দের স্টাইলে সাজিয়ে রাখলাম। ওই স্টাইলটাই আমার ভারী ভাল লাগে। ওতে বুকে জোর পাওয়া যায়। তারপর যেমন এসেছিলাম তেমনই বেমালুম সে স্থান থেকে প্রস্থান করলাম।’

‘তেমনই দেয়াল বেয়ে? না, জানালা ডিঙ্গিয়ে?’ কান্তি প্রশ্ন করল।

‘না, এবার সদর পথেই। খুন করলে অবশ্যি অন্য পথ ধরতে হত আমায়।’

‘কিন্তু পিন দিয়ে তোমার কাকার বুকের কাছে গাঁথা সেই কাগজখানা? যাতে সম্পত্তির উত্তরাধিকার তোমার নামে উইল করে লিখে দেয়া হয়েছে—সেটার কথা তো কিছু বললে না হে?’

‘কী কাগজ? কই, আমি তো তার কিছুই জানি না। তেমন কিছুই তো আমি লিখিনি। সে সব লেখবার কথা আমার মনেও ছিল না। আমি তখন সেখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।’

‘তুমি না লিখলে কে আবার তবে লিখবে? তবে কি আমি লিখেছি?’ কান্তি এবার চটে ওঠে; তার ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না বলেই বোধহয়।

‘তা হলে—তা হলে কি সেই দেবী—সেই দেবীই নাকি?’ কালু সেন এই পর্যন্ত বলেই চেপে যায়।

‘তা হতে পারে। দেবীদের অসম্ভব কিছুই নেই।’ থরহরি বলেন: ‘দেবীদের রহস্য সাক্ষাৎ দেবতারাও টের পান না ভায়া।’

‘তোমার কাকার ওইভাবে মারা যাওয়াটা দৈব-দুর্ঘটনা হতে পারে—কিন্তু ওই কাগজের লেখাকে আমি দেবী মাহাত্ম্য মনে করে তোমার কথা মানতে আমি প্রস্তুত নই।’ কান্তি জানায়।

‘কালু গল্পটা তুমি বানিয়েছ মন্দ না।’ খানিকক্ষণ ভাবিত থেকে থরহরিবাবু বললেন: ‘এ পর্যন্ত যত খুনের কেচ্ছা পড়েছি…’

তড়বড় করে বলে যান থরহরি—

‘আর আমার কাগজে—বেরিয়েছে, তার সবগুলোকে টেক্কা দিয়েছ নিঃসন্দেহ। কিন্তু তবু তোমার গল্পের এক জায়গায় গলদ আছে—একটা কথা কিছুতেই আমি বুঝতে পারছি না। তোমার কাকার গায়ে যে দুটি বুলেটের দাগ দেখা গেছে—তার মানে কী? গুলির ওই গর্ত দুটো এল কোথা থেকে?’

‘সাবেক কালের গর্ত। বহু পুরনো।’ কালু ধীরে ধীরে বলে, ‘বলতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছে; কিন্তু আপনারা না বলিয়ে ছাড়লেন না! বড়লোক হবার আগে আমার কাকা একজন বড় দরের গুন্ডা ছিলেন। গ্যাঁড়াতলার গুন্ডার সর্দার ছিলেন তিনি। সেই সময়ে পুলিশের অনেক গুলি তাঁকে হজম করতে হয়েছে। পুলিশের পাল্লা থেকে পালাতে গিয়ে কতবার যে তিনি গুলি খেয়েছিলেন তার ইয়ত্তা হয় না। তার সারা দেহ অমন অনেক গুলিতে ঝাঁঝরা। বয়স বেশি হয়ে গেলে আর অতটা ঝক্কি নেওয়া তাঁর পোষাল না। অত ঝক্কি নিয়ে অর্থোপার্জনে শেষ পর্যন্ত মজুরি পোষায় না। তার চেয়ে সোজাসুজি আইনসঙ্গত উপায়ে টাকা কামানোর দিকে তাঁর নজর পড়ল। তিনি বলতেন, কেন, আইন বাঁচিয়ে কি চুরি-ডাকাতি করা যায় না? আইনের জোরে কী না হয়। এবং তার পরেই তিনি কর্পোরেশনের কাউন্সিলার হয়ে গেলেন। তিনি বলতেন, গুন্ডার সর্দারির চেয়ে মিউনিসিপ্যালিটির মুনসিআনিতে বেশি লাভ, অথচ প্রায় একই ব্যাপার নাকি—একই ওস্তাদির রকমফের কেবল।’

‘এমনকী তিনি আরও বলতেন যে পরমহংসদেব যেমন সব ধর্মের সমন্বয় করেছিলেন—সর্বধর্ম সমন্বয় করতে পারলেই কাউন্সিলার হওয়া যায়। কর্পোরেশনের তাঁরা এক একটি পরম পুরুষ। কর্পোরেশন থেকে লাটের দরবারে এমনকী বড়লাটের দরবারে, এমনকী মন্ত্রিসভায় খাস কেবিনেটে যাবার পর্যন্ত তাঁর লোভ হয়েছিল। সে সব জায়গার ব্যাপার নাকি আরও বড়দরের তিনি বলতেন। কিন্তু সে বাসনা চরিতার্থ করবার তিনি আর ফুরসৎ পেলেন না। আমার মুহূর্তের পদস্খলনের জন্যই তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে গেল।’ কালু সেন দীর্ঘ নিশ্বাস মোচন করল এই বলে।

‘একেই বলে একের পাপে অন্যের পতন।’ কান্তি মিত্রের মন্তব্য শোনা যায়।

কালু সেন নীরব। সকলেই চুপচাপ, কারও মুখে কথাটি নেই। অবশেষে কালুই স্তব্ধতা ভাঙল।

‘মশাইরা, আমার সময় খুব কম। (আবার এক কাশির ধাক্কা এল) আমার মনে হয় আমি বুঝি ভেঙে পড়ছি। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি আমি। মৃত্যুমুখেই উপনীত হয়েছি বোধ হয়। থরহরিবাবুর বাড়িতে মারা পড়ে তাঁকে আবার নতুন করে আরেক দায়ে জড়াতে আমি চাই না। যেটুকু অল্প সময় হাতে আছে তার মধ্যেই এখান থেকে কোনও রকম এই মুমূর্ষ দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আমি চলে যেতে চাই। কিন্তু নির্দোষ এবং কলঙ্কমুক্ত হয়ে এখান থেকে আমি যেতে পারি কি না সেই কথাই আমি ভাবছি এখন।’

‘তুমি নির্দোষ এবং নিরপরাধ।’ থরহরিবাবু দাঁড়িয়ে উঠে বললেন এবং খাবার ঘরের দিকে চললেন সটান।

কালু সেনের কলঙ্ক মোচনের পর দিন কয়েক কেটেছে। এই ক’দিন ধরে কান্তি মিত্র কেবলই ভেবেছে কী করবে। মিত্রতার পরিধি আরও বাড়াবে কি না এই ছিল তার প্রশ্ন, অবশেষে আজ সকালে কাঁচির কাপড়ের ওপর সিল্কের পাঞ্জাবি চড়িয়ে সর্বাঙ্গে অগুরু ছড়িয়ে সেই গুরুতর সমস্যাটার মুখোমুখি হবার মতলবেই সে বেরিয়ে পড়ল। সমস্যাটা দেখতে যখন সুশ্রীই, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে এমন কিছু অরুচিকর নয়, তখন তার সামনাসামনি হতে পেছপা হবার কী আছে? প্রয়োজনই বা কী, এই কথাই কান্তি ভাবল।

এবং এই ভেবেই সে অলকা দত্তর দ্বারদেশে গিয়ে উপস্থিত হল। কিন্তু তখনও তার ভাবনা তাকে ছাড়েনি। কড়া নাড়বে কি নাড়বে না? কড়ার আওয়াজ করা উচিত হবে কি? এমন কড়াকড়ি…? এই সব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তখন।

কান্তি মিত্র রোয়াকের ওপর বসে পড়ল, ভাবতে ভাবতে। ‘এই যে কাজ করতে যাচ্ছি, এর পরিণামে আমার ভাবী জীবন কি সুখময় হবে?’ এই কথা সে জিজ্ঞেস করেছে। পুনঃ পুনঃ নিজেকেই তার এই প্রশ্ন।

‘ভেবে দেখলে আমি কৃত্তিবাসের চেয়ে বেশি হঠকারিতা করতে চলেছি। সে নিজের গলায় বিলিয়ার্ডের কিউ বেঁধেছিল আর আমি জলজ্যান্ত একটি মানুষকে আমার গলায় বাঁধতে যাচ্ছি। ভাল করছি কিনা জানিনে।’ কান্তি ভাবনায় পড়ে।

‘আস্ত একটা মানুষকে গলগ্রহ করে সংসার সমুদ্রে সাঁতার দেওয়া কি আমার পক্ষে সম্ভব হবে? খোদাই জানেন।’ এমন কথাও ভাবছে কান্তি।

‘নাঃ, আর ভাবব না। কৃত্তিবাস যদি একজনের গলায় ফাঁস লাগাতে পারে— তাহলে আমি কেন দু’জনের গলায় লাগাতে পারব না? আমি কি তার চেয়ে কোনও অংশে কিছু কম?’

‘না, আমি তেমন কাপুরুষ নই।’ অবশেষে সেই স্বগতোক্তি করে কান্তি মিত্র উঠে পড়েছে। রোয়াক থেকে উঠে কড়া বাজিয়েছে দরজায়।

দরজা খুলে যেতেই জিজ্ঞেস করেছে: ‘অলকা দেবী আছেন?’

একটি আধবয়সি মেয়ে বেরিয়ে এসেছিল। ‘অলকা কালকে এখান থেকে চলে গেছে।’ সে বলল।

‘চলে গেছেন? কোথায়?’

কান্তি মিত্রের মনে হয় এবার আর রকের ওপরে নয়, পথের ওপরেই যেন বসে পড়েছে সে। নিজেকে ধরাশায়ী বলে তার মনে হতে থাকে।

‘তা তো বলতে পারব না।’ উত্তর এসেছে মেয়েটির কাছ থেকে।

‘আপনি কে? আপনি কি এখানকার—?’ কান্তি জিজ্ঞেস করে।

‘আমারা এই বাড়ির অন্য ভাড়াটে। অলকার সঙ্গে আমার ভাব ছিল। আপনি কি কান্তিবাবু? সেই রকমই যেন মনে হচ্ছে। তাহলে আপনার নামে একটি চিঠি আছে। অলকার চিঠি।’ বলে মেয়েটি চলে যায়: ‘দাঁড়ান, এনে দিচ্ছি।’

চিঠি না নিয়ে কান্তি মনে মনেই পড়ল—

প্রিয় কান্তিবাবু,

পিল্টু আর আমি গতকল্য আইনমতে পরস্পরকে বিবাহ করেছি। পিল্টুকে চিনতে পারবেন আশা করি। তার ভাল নাম হল কালু সেন। আমরা আজ জাহাজে চড়ে এডেনের দিকে যাত্রা করব। আজ সকালে আমাদের জাহাজ ছাড়বে। বসোরায় গিয়ে বাসা বাঁধবার বাসনা আমাদের—সেই বড় বড় গোলাপের দেশে।

আপনি শুনে খুশি হবেন, পিল্টুর কাশি এখন অনেকটা কম। চ্যবনপ্রাশ খাওয়াচ্ছি—কল্পতরুর চ্যবনপ্রাশ। কাশির পেয়ারা খেলেও সারত, ও বলছিল। কিন্তু তার আর পাচ্ছি কোথায়? তবে বোগদাদের আঙুর খেলে সেরে যাবে আশা হয়।

আরও সুখের বিষয়, কৃত্তিবাস সেনের অ্যাটর্নিরা তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পিল্টুকে দিতে ইতস্তত করেননি। কেননা যে কাগজখানা নিহত কৃত্তিবাস সেনের বুকে আঁটা দেখা গেছল, সেটা নাকি কৃত্রিম নয়। কৃত্তিবাসবাবুরই নিজের হাতের খসড়া। সে কথা আমি জানতাম। আমিই ওটি বার করে এনে তাঁর জামায় এঁটে দিই—তিনি দেহরক্ষা করার পর। পিল্টুর মুখ চেয়েই একাজ করেছিলাম, অন্যায় করিনি বোধহয়।

যাই হোক, ওই খসড়া আমার খুড়শ্বশুরের স্বহস্তে লিখিত বলে এ্যাটর্নিরা সনাক্ত করেছেন। তা ছাড়া ওই খসড়ার আরেক কপি রেজিস্ট্রিকৃত হয়ে তাঁদের দপ্তরে ছিল তাও জানা গেছে।

পিল্টু কৃত্তিবাস প্রদত্ত নিজের যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ টাকাটা তার বসোরার ঠিকানায় পাঠাবার ভার এ্যাটর্নিদের দিয়ে যাচ্ছেন। আশা করা যায় এই কাজের জন্য অ্যাটর্নিরা নিজের প্রাপ্য নিজেরা কেটে নিলেও তাঁদের কাছ থেকে ষোলো আনার এক আনা ভাগও ভাগ্যে থাকলে কোনও-না-কোনও সময়ে আমরা পাব। জীবদ্দশাতেই পেতে পারি হয়তো। আর তাই আমাদের যথেষ্ট।

আমাদের দু’জনের ধারণা, আপনার মতন গোয়েন্দা আর হয় না। পিল্টু তো বলেছে: আপনি না থাকলে সে আজ কোথায় দাঁড়াত।

ইতি—

আপনার স্নেহধন্য
অলকা দত্ত
ওরফে শ্রীমতী অলকা সেন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *