এক মেয়ে ব্যোমকেশের কাহিনী

এক মেয়ে ব্যোমকেশের কাহিনী

বিগত বিশ্বমহাযুদ্ধের কাহিনী-

জাপানি বোমারু বিমানের আক্রমণে বর্মার আগাপাশতলা জুড়ে যখন একনাগাড়ে বোমাবর্ষণ চলছিল সেই কালের ঘটনা।

সারা বর্মা মুলুক জুড়ে ধারাবাহিক সেই বম্বকেসের মুখে, জলে জল বাধার মতন বোমায় বোমা টানে না? আমাদের নায়িকা এই মেয়ে ব্যোমকেশ সেই সময় গজিয়ে উঠেছিলেন। গজগজ করে উঠলেন হঠাৎ।

তারপর যা হবার। নায়িকার সোজাসুজি গজের কিস্তিতে বেচারা নায়ককে স্বভাবতই ঘোড়ার ভূমিকা নিয়ে আড়াই কদমের চাল দিয়ে দিগ্বিদিক খুঁজে বেড়াতে হয়—কিন্তু এই খোঁজাখুঁজির শেষ কি পায় কেউ?

মেয়ে মাত্রই ব্যোমকেশ। জন্মসূত্রেই এক একটি টিকটিকি। কেবল যে কথায় কথায় টিক টিক করে তা-ই নয়, যাকে সে গ্রাস করবে বলে সে তাক করে, সে বেচারা তার খর্পর থেকে বাঁচতে নিরুদ্দেশ হয়ে যেখানেই পালাক না, তার নায়ককে ঠিক ঠিক খুঁজে বার করবেই।

তার হাত থেকে ত্রাণ নেই তার কিছুতেই।

আমাদের এই কাহিনীর তরুণী নায়িকা সত্যসন্ধানী বিখ্যাত ব্যোমকেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পেরেছে কি না তার বিচার পাঠকের।

তবে এটুকু হয়তো বলা যায়, পুরাকালের সাবিত্রী যেমন একদা সত্যবানের অনুসরণে যমালয়ের দরজা অবধি এগিয়েছিল, এই নায়িকাটিও তেমনি তার সত্যবানের পিছু ধাওয়া করে বর্মা থেকে দেড় হাজার মাইল পেরিয়ে কলকাতায় এসে পৌঁছেছিল। এবং নিখুঁত ডিটেকটিভের মতোই যথাকালে যথাস্থানে যথোচিত ভাবে তার আসামিকে যথাযথ পাকড়েছিল। এবং বলা বাহুল্য, তারপর আর সে ছাড়ান পায়নি।

সত্যি বললে, মেয়ে মাত্রই এক একটি বোমা—শুধু যে শাশুড়ির সম্পর্কেই, তা-ই নয়। তাদের চোখে বোমা, কথাতেও মাঝে মাঝে তার বর্ষণ। আর মুখে-মুখে…? তার কথাই নেই। তার মুখেই বোমার সেই ব্রহ্মাস্ত্র—-যা মুহূর্তের মধ্যে তোমায় আকাশে উড়িয়ে দিতে পারে। তার চুমায় এক লহমায় আমরা আত্মহারা হয়ে উড়ে যাই, হাতে স্বর্গ পাই আমরা।

বনমালীবাবুর বাড়ি বেড়াতে গেছি। ইডেন উদ্যানের তিনি হর্তা-কর্তা। উক্ত উদ্যানের বৃক্ষলতা, ঝোপঝাড় এবং তাদের অন্তর্গত আদম-ইভদের (ইভনিং-এর দিকেই বেশির ভাগ)—এক কথায় ওখানকার জল-স্থল-উদ্ভিদ-জঙ্গল ও জীবনযাত্রার যাবতীয় প্রণালীর তিনি রক্ষক-বেক্ষক।

বাগানের এক টেরেই তাঁর টেরেস—-কয়েকখানি কুঠরি নিয়ে ছোট্ট দোতলা। আশে পাশে সংলগ্ন এক টুকরো জমি—ফুলগাছ লতাপাতার কেয়ারি করা ছোট্ট আঙিনার মতো-বাগানের মধ্যে বাগান এবং বাগানের মতো করে বাগানো।

সব সময়েই কিছু ভূমাতে সুখ নেই, ভূমিতেও সুখ আছে বই কী। ভূমিসাৎ হবার বাসনাও রয়েছে আমাদের মনে অবিকল প্রবলরূপেই—-যে বাসনা ভূমিকম্প হয়ে, নানাবিধ মদ্য হয়ে এবং যুদ্ধবিগ্রহ হয়ে দেখা দেয়। ভূমৈব সুখমেরই নানান রকমফের।

আবার বৃহৎ ভূমির চেয়ে ক্ষুদ্র ভূমিতে সুখ আরও। অত বড় ইডেন উদ্যানের সার্বভৌম হয়ে যত না সুখ, ছোট্ট এই নামমাত্র বাগানের তদারকি করে তার চেয়ে বেশি আনন্দ তাঁর। এই একানে জমিদারির একমাত্র ভূঁইয়া—বনমালী নিজে। মালিও তিনি, মালিকও তিনি!

গিয়ে দেখলাম—যেখানে আশা ছিল সেই বাগানে তাঁকে দেখলাম না—অন্য ভূমিতে একেবারে ভিন্ন ভূমিকায়—রান্নাঘরে তিনি বিরাজ করছেন দেখা গেল। হাঁড়ি-কুড়ি হাতা-খুন্তি, শিল-নোড়া, চাটু-কড়া নানান ইত্যাকারের মাঝখানে মহাসমারোহে তিনি পর্যবসিত। তাদের চাটুকারিতায় বিপর্যস্ত।

কড়াইয়ের ভেতর জমজমাট কী একটা জিনিসকে ঘোরতরভাবে ঘাঁটছেন দেখা গেল।

ঘাঁটছেন কি ঘাঁটাচ্ছেন বলা কঠিন। যেমন আর্তনাদ তেমনি বিচ্ছিরি এক গন্ধ বেরিয়েছে কড়াই থেকে। নাকে কাপড় চেপে জিজ্ঞেস করি, ‘এ কী, গাছপালার সখ্য ছেড়ে রান্নাবান্নার সখ কেন? ফুল ধরা হাতে হাতা ধরেছ দেখছি?’

‘আর বলো কেন?’ বলল বনমালী, ‘বউ বলেছে।’

বনমালীর এই কথায় ওর পত্নী-প্রাণতার আরেক কথা মনে পড়ে গেল। বেশিদিনের কথা নয়। একদিন এসে দেখি, বনমালী জামা টেঁকছে। বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, ‘বিয়ে করেছ, বউ রয়েছে ঘরে, নিজের জামা নিজেকে টেঁকতে হচ্ছে তোমায়? এ কী দশা?’

‘আরে, আমার নয়, বউয়ের জামা।’

কৈফিয়তের সুরে বলেছিল বনমালী। মনে কোনও মালিন্য ছিল না ওর। মুখেও নয়।

সেদিন মনে মনে ওর পায়ের ধুলো নিয়েছিলাম। দাম্পত্য-মিলনের মাধুরী বজায় রাখতে ওই টেঁকসই বনমালীই আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। এবং বনমালী সেদিন ব্লাউজ সেলাই করেই ক্ষান্ত হয়নি। নিজের উদাহরণকে আরও উজ্জ্বল করতে ফের আবার বউয়ের রুমালে ছুঁচ ফুটিয়ে পাতা তুলতে লেগেছিল।

কিন্তু রুমালের সেই পাতানো সম্পর্ক আর এমন কি! দিনদুপুরে এই রন্ধনলীলা-আনকোরা এক এনকোরিং ভূমিকা—সেই সূচিপত্রের পরে নতুন আরেক সূচনা।

জানা গেল আসন্ন বোমার আশঙ্কায় বনমালী তার বউ-ছেলেকে দেশে পাঠাতে চেয়েছিল। বউ কিন্তু কর্তার অভিভাবকত্ব ছেড়ে, বনমালীর বৃন্দাবন থেকে এক পা নড়তে রাজি নয়। সময়মতো নেয়ে-খেয়ে বনমালী নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না, সেই তার ভাবনা।

অন্ন-সমস্যাটাই বড়, অন্য সমস্যাগুলো তত নয়।

বনমালীকে তাই আজ রান্নার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। রাঁধতে পারলে তার পরে তো খেতে পারার সমস্যা। আর বউকে দেশে পাঠানোর কথা তার আগে নয়। কোমর বেঁধে লেগেছে বনমালী।

‘রিহার্সাল দিচ্ছি ভাই। রান্নার রিহার্সাল’—ওর গদগদ কণ্ঠ থেকে কান্নার মতো হয়ে বেরিয়ে আসে। —’তরকারি রাঁধছি ভাই, বেগুনের চচ্চড়ি।’

‘ও, তাই বুঝি ঘরকন্নায় লেগেছ? তা বেশ—বেশ তো। তা শুধু বউয়ের কাজ করতে পারলেই পাস, নাকি ঝিয়ের কাজও করতে হবে আবার?’ আমি জিগ্যেস করি, ‘গেরস্থালি করতে গেলে রান্নাই তো সবখানি নয়, থালা মাজার গেরোও আছে যে ফের।’

‘কে জানে!…বাসন মাজতে তো বলেনি এখনও।’ বনমালী কাতর হয়ে পড়ে। ওর আর্তনাদের সঙ্গে ওর কড়ার আওয়াজ পাল্লা দেয়।

‘পালিয়ে এসো। আর ঘাঁটিয়ো না, বিচ্ছিরি গন্ধ বেরিয়েছে।…জল ঢেলে দাও উনুনে—নইলে ঘরদোরে আগুন লেগে যাবে বোধহয়। কী রকম ধোঁয়া ছেড়েছে দেখছ? ভাল ঠেকছে না বাপু, বুক কাঁপছে আমার।’ বলি আমি, ‘তোমার ওই বেগুন-চৰ্চা রাখো।’

বাবা, রান্নার কী ঘটা! এর অনুসরণে ভয়ঙ্কর আরও কিছু ঘটা বিচিত্র নয়। দমকল ডাকতে হতে পারে।

‘বউ ছেড়ে তুমি বাঁচবে না। আমরাও মারা পড়ব, শোন বনমালী।’ কড়াইটা দপ্ করে উঠে আমার কথায় যেন সায় দেয়- তার ভেতরের জমজমাট জিনিসটা আরও জমকালো হয়ে ওঠে। মাঝখানের লৌহ-বেষ্টিত ব্যবধান সত্ত্বেও কি করে যে উনুনের আগুন আর কড়ার বেগুনের মধ্যে যোগাযোগ ঘটে, সমস্তটা অকস্মাৎ দেদীপ্যমান হয়ে দাঁড়ায়, সে-তত্ত্ব বড় বড় রাঁধিয়েরাই বলতে পারেন, কিন্তু সে রান্নায় জলাঞ্জলি দিতে আর দেরি করে না। দ্বিধা না করে এক বালতি জল সেই জাজ্বল্যমান সমূহের ওপরে ঢেলে দেয় তৎক্ষণাৎ।

আর আমি তার আগেই তাদের ড্রইংরুমে পালিয়ে আসি।

বনমালীও আমার পিছু পিছু এসে জড়ো হয়।

তার বউ সেখানে জমা ছিল—ছেলেপিলেরাও জমায়েত।

‘কবে যে এই ছাইয়ের যুদ্ধ মিটবে।’ হাতের জল আর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বনমালীর দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে।

‘আচ্ছা বাবা, কী করে যুদ্ধ বাধে, বলো না?’ ছোট্ট ছেলেটি জিগ্যেস করে বনমালীকে।

‘কেমন করে যুদ্ধ বাধে? যুদ্ধের আবার বাধাবাধি আছে?’ কথাটা এক কথায় উড়িয়ে দিতে চায় বনমালী, ‘ও বাধলেই হল।’

‘ও কী কথা?’ বনমালীর বউ ফোঁস করে উঠল, ‘ছেলে জিজ্ঞেস করছে একটা কথা-তার ও কী জবাব?’

সত্যি কথা।

পারতপক্ষে অবোধ শিশুদের জ্ঞান-পিপাসা মেটানোই উচিত।

‘এইরূপে ওদের তথ্যলালসা চরিতার্থ হতে হতে সেই অদম্য ক্ষুধাই ক্রমে ক্রমে এবং বেড়ে বেড়ে সামান্য পাঠশালা থেকে সিনেট হল মারফৎ অবশেষে কেরানিগিরির অফিসে গিয়ে ওদের দাঁড় করাবে—কৌতূহলের যেখানে চরম পরিণতি।’ বউয়ের কথায় আমি সায় দিই।

‘আচ্ছা আচ্ছা।’ বনমালী আরম্ভ করে, ‘এই মনে করো ইংরেজরা ফরাসিদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাল।’

‘কিন্তু’—বনমালীর বউ বাধা দেয়, ‘ফরাসির সঙ্গে ইংরেজের ঝগড়া বাধবে কেন? তাই কি বেধেছে?’

‘বাধেনি জানি৷’ বনমালী বলে, ‘আমি কথার কথা বলছিলাম।’

‘এইভাবে ছেলেপিলেদের তুমি ভুল শিক্ষা দিচ্ছ।’

‘না কিছুতেই না, ভুল শিক্ষা দেব কেন?’ বনমালী রুখে দাঁড়ায়-পদদলিত পতঙ্গও কি এক এক সময়ে বিগড়োয় না?

বিশেষত, সেই পতঙ্গকে একটু আগে যদি অগ্নিকাণ্ডের আকর্ষণ এড়িয়ে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসতে হয়ে থাকে।

‘হ্যাঁ দিচ্ছ।’

‘না দিচ্ছিনে।’

দু’পক্ষই একরোখা। দোরোখা। দাম্পত্য কলহ।

‘হয়েছে বাবা,’ বড় ছেলেটি তাড়াতাড়ি বলল, ‘যুদ্ধ কী করে বাধে, আমরা বুঝতে পেরেছি এখন।’

এই গৃহযুদ্ধের মাঝখানে টেলিফোনের ঘণ্টা ঝনঝনিয়ে উঠল আবার। রিসিভারে কর্ণপাত করে বনমালী চেঁচাতে থাকে।

‘শোনো ফের। এদিকে আবার আরেক ফ্যাঁসাদ। কতদিক যে সামলাই!’ আমি শুনতে লাগলাম। দু’দিকের কথাই শোনা গেল। স্পষ্টই। লেখকদের শুধু যে দিব্যদৃষ্টি থাকে তাই না, দিব্যকর্ণও মস্ত সহায়।

কেবল চেহারাটা দিব্য হয় না এই যা, তা হলে ত্রিদিবের সব দ্রব্যই তাদের করতলামলকবৎ হয়ে যেত। সেটা খুব ভাল হত কি না দিব্যি গেলে বলা কঠিন।

ইডেন গার্ডেনের বনেদি মালি বনমালীকে হাঁক পেড়েছে—বাগানের এক বিশেষ অঞ্চলে এক নির্বিশেষ ব্যক্তিকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। লোকটাকে দেখলে বিদেশি বলেই মনে হয়। ঝোপঝাড়গুলোর ঘাড় ছাঁটছিল এমন সময় তার নজরে পড়েছে।

বনমালী—কারও পকেট কাটবার মতলবে ঘুরছে না তো?

বনেদি মালি—কাছাকাছি কারও পকেট নেই।

বনমালী—পকেটগুলো গেল কোথায়?

বনেদি মালি—বাগানের ওধারটায় এমনিতেই কেউ যায় না। হাওয়া খাবার যারা তারা তো প্যাগোডার দিকটায় বেড়াচ্ছে।

বনমালী—পকেটকাটা নয় তা হলে? কী বলো?

বনেদি মালি—আজ্ঞে, কঁচি তো আমার হাতে।

বনমালী—তুমি? তুমি কঁচি নিয়ে কী করছ? উপরি উপায়ের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকলে কথাটা আমায় জানিয়ে ভাল করোনি। মনে রেখো আমি তোমার উপরওয়ালা।

আমি (বাধা দিয়ে বলি)—কেন, তোমাকে বখরা দিতে হবে নাকি তা হলে?

বনেদি মালি—আজ্ঞে, পকেট কাটা কঁচি নয়, পেল্লায় কাঁচি। ঝোপঝাড়গুলোর ঘাড় ছাঁটাই করছি বললাম না?

বনমালী—ও, সেই কাঁচি! সেই রাম কাঁচি! কাজ করছ?-করো করো। লোকটা কীভাবে ঘোরাফেরা করছে বললে?

বনেদি মালি—সন্দেহজনকভাবে। পা টিপে টিপে। পা টিপে টিপে বললে বোধহয় অত্যুক্তি করা হয়—ঠিক তা নয়—হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছে বললেই ঠিক হবে।

বনমালী—হামাগুড়ি দিচ্ছে—প্রজাপতি ধরবার ফিকিরে নেই তো? কোনও দুষ্টু প্রজাপতিকে ধরবার মতলবে নয় তো?

বনেদি মালি—আজ্ঞে আমার মনে হয় শত্রুপক্ষের কোনও চর।

বনমালী—তুমি হাসালে বিপিন! আমাদের আবার শত্রুপক্ষ কে? আমরা কার খাই না পরি? আমাদের পেছনে আবার কে চর লাগাবে?

‘চড় লাগাতে বলো।’ আমি বললাম।

বনমালী বলল, ‘অ্যাঁ?’

‘এক চড় মেরে ভাগিয়ে দিতে বলো না।’ আমি বাতলাই।

‘লোকটা ঝোপের আড়াল দিয়ে হাঁটু টিপে টিপে হাঁটছে। এখনও হাঁটছে। কোনওদিকে তাকাচ্ছে না। জাপানের গুপ্তচর বলেই আমার সন্দেহ হয়। ওই যে—খবরের কাগজে যাদের পঞ্চম-বাহিনী বলেছে—তারাই হয়তো।’ বিপিন জানায়।

বনমালী—কী সর্বনাশ! আমার আড়তে পঞ্চম বাহিনী। কোথায় যাব আমি। অ্যাঁ, লোকটা দেখতে কীরকম?

বিপিন—একদম বিদেশি। আধা বর্মি, আধা বাঙালি, আধা চিনেম্যান, অর্ধেক উড়ে, আধখানা মাদ্রাজি।

বনমালী—হুম। পঞ্চম-বাহিনী নির্ঘাত। লোকটার ওপর লক্ষ রাখো। কী করে ওইভাবে হামাগুড়ি দিতে দিতে কোথায় যায়, কদুর গড়ায়, ওত পেতে দ্যাখো। ইতরবিশেষ কিছু দেখলেই তৎক্ষণাৎ আমায় জানাবে। হঠাৎ লক্ষ্যভেদ কোরো না, বুঝেছ? ও যেন কিছু টের না পায়।

বিপিন—যে আজ্ঞে।

বনমালী ভাবনায় পড়ল। ভাবনার কথাই বই কী। ব্যাপারটা আগাপাশতলা ভেবে দেখলে কেবল ব্যস্ত নয়, ব্যতিব্যস্তই হতে হয়। শুধু কালমাহাত্ম্য না, ইডেন গার্ডেনের স্থান-মাহাত্ম্যও দেখতে হবে। দক্ষিণে সরকারি কেল্লা সাক্ষাৎ ফোর্ট উইলিয়ম, আর উত্তরে বাঙালদের দ্রষ্টব্য খোদ হাইকোর্ট, পশ্চিমে সর্বদা তটস্থ পোর্ট কমিশনারের ভাগীরথী, আর পূর্বে স্যার-গর্ভ লাটসাহেবের প্রাসাদ—এহেন ভৌগোলিক পরিবেষ্টনীর মধ্যে বনমালী সরকারের ইডেন গার্ডেনের পরিস্থিতিটা, এই অপ্রত্যাশিত উপস্থিতির দ্বারা সমস্ত জড়িয়ে কতখানি ক্ষতির সম্ভাবক, ক্ষতিয়ে দেখলে দুর্ভাবিত না হবার যো কী।

এই অঞ্চলে; এরূপ উদ্যানাঞ্চলে, যদি হামাগুড়িপরায়ণ পঞ্চম-বাহিনীরা ওতপ্রোত হতে থাকে, তা হলে স্বভাবতই একটু বিব্রত হয়ে পড়তে হয়। বিচলিত না হয়ে উপায় নেই।

বনমালীর বড় ছেলে বলল, ‘বাবা, আমরা তোমার বাগানে গিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলব?’

বনমালীর কপালে আরেকটা রেখা পড়ল।

‘খেলোগে, কিন্তু এয়াররেড শেলটার বাঁচিয়ে তোমাদের খেলার চোটে কোম্পানির বমব-প্রুফ শেলটারের কোনও হানি না হয়, সেদিকে যেন খেয়াল থাকে।’

‘যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলব তো। আমরা কী আর ক্রিকেট খেলছি যে বল গিয়ে লাগবে তোমার শেলটারের গায়ে?’

ছেলেরা চলে গেলে আমি বললাম, ‘সেকালেও পঞ্চম-বাহিনী ছিল—পঞ্চশরের পঞ্চম-বাহিনী। আজকের বনমালীদের মতো সেদিনের বনচারীদের তারা ধৈর্যচ্যুতি ঘটাত—কিন্তু এর চেয়ে আরও কত মুখরোচক ছিল ভাবুন তো! কী বলেন বউদি?’

গুরুতর মেঘলাটাকে পিঁজে হালকা করার আমি পক্ষপাতী।

বউদি বলেন, ‘সব সময় তোমার রসিকতা আমার ভাল লাগে না।’

‘বাস্তবিক, এই কি রসিকতার সময়? একটু আগে একটা বিপর্যয় গেছে—ঘোরতর বিপর্যয়—তার ওপরে আরেকটা হাঙ্গামা মাথার ওপর আসন্ন—এই সময়ে তোমার রসিকতা?’ বনমালীও তেতে ওঠে।

ছেলেদের কলোচ্ছ্বাস আর ছোট ছোট পায়ের শব্দ ভেসে আসে ছোট্ট বাগান থেকে। আকৃষ্ট হয়ে আমি আর বনমালী জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘সুখেই আছে ওরা।’ বনমালীর কপালের কুটিল রেখাগুলি সরল হয়ে আসে। ‘শিশুর মনে কোনও ভাবনা নেই।’ বললাম আমি।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে, বিগত শৈশবের কথা ভেবে বোধহয় আমাদের হাসি পায়। দেখি ছেলেদের লীলাখেলা।।

বড় ছেলেটি বলছিল, ‘আমি আর-এ-এফ—ইংরেজের বোমারু প্লেন, বুঝেছিস? আর তুই হচ্ছিস জার্মানির ট্যাঙ্কের কারখানা—কেমন তো?’

‘না। তা কেন হতে যাব?’ ছোট আপত্তি করে।

‘খুব খুউব খুউউব বড় ট্যাঙ্কের কারখানা—তুই হবিনে?’

এবার ছোটকে টলতে হয়। বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে। ছোট তো সে হয়েই আছে—বড় হবার এ সুযোগ সে ছাড়তে পারে না।

‘হ্যাঁ তা হলে হতে পারি।’ সে রাজি হয়। যুদ্ধু যুদ্ধু খেলা শুরু হয়ে যায়। এ রাম-রাবণের যুদ্ধ নয়—মোড়ার গর্ভজাত তির এবং ব্যাঁকারির ধনুকের সাহায্যে ছোটবেলায় আমরা যা খেলেছি—যুদ্ধের মোড় ফিরেছে—এখন আলাদা সমরকৌশল। ছোট ছেলেটি বাগানের এক কোণে গিয়ে দাঁড়ায়। আর বড়, দুই হাত, ঠিক পাখার মতো নয় চাকার মতো করে ঘোরাতে ঘোরাতে ভররর ভররর আওয়াজ ছেড়ে ট্যাঙ্কের কারখানার দিকে এগুতে থাকে। তির্যক বেগে এঁকেবেঁকে এগোয়। কাছাকাছি গিয়ে পকেট থেকে একখানা পাটকেল—আধখানা ইটও বলা চলে—বার করে কারখানার দিকে তাক করে লাগায়।

কারখানার কাণ্ড দেখি এবার। চক্ষের পলকে সে মাথা খেলিয়ে বোমার হাত থেকে আত্মরক্ষা করেছে। মাথা দুমড়ে সমস্ত দেহকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে কোমরের পরিশিষ্ট কারখানার বহির্ভাগকে আক্রমণকারীর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের ভাগ্য সামলেছে।

বিলিতি বোমারু ফিরে গেছে আকাশে। ‘বুম বুম—বুম বুম বুম। কেমন করে আমি ডাইভ বম করি দ্যাখ এবার।’ ঘুরতে ঘুরতে পাক খেতে খেতে এরোপ্লেনটা কারখানার পশ্চাদ্ভাগে এসে এক গোঁত্তা লাগিয়ে দিয়েছে এবার।

‘উঃ—জোচ্চোর!’ চেঁচিয়ে উঠল কারখানা—ঘুষি উঁচিয়ে।

‘আমাদের সমস্ত বিমান নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরেছে।’ সুদূরে গিয়ে ঘোষণা করল আর-এ এফ।

‘কোত্থেকে যে এসব শেখে।’ বলল বনমালী।

‘খবরের কাগজ, কোথায় আবার।’ আমি বলি৷

ধ্বংসপ্রাপ্ত কারখানা কিন্তু ছেড়ে কথা বলার পাত্র না। এক চাপড়া মাটি তুলে বীরদর্পে সে এগিয়েছে—আর এ-এফ এর এসপার ওসপার করে তবে ছাড়বে।

‘আরে আরে করছিস কী! ট্যাঙ্কের কারখানা বিলেতে এসে আক্রমণ করবে—তা হয় নাকি? মাঝে সমুদ্র নেই?’ বড় ছেলে ঘোরতর আপত্তি জানায়। ‘কারখানার কি পাখা আছে যে উড়বে?’

‘তবে এসো, অন্য রকম যুদ্ধ খেলি। যুদ্ধের পৈশাচিক নৃশংসতা খেলা যাক।’

‘পৈশাচিক নৃশংসতার মানে হচ্ছে ইনকম ট্যাকসো। বাবা বলেছে।’

‘কী সর্বনাশ!’ বনমালী বলে আর বনমালিনীর দিকে তাকায়। সভয়ে।

‘এখনই কী হয়েছে। আমি বলি, ‘এই তো সবে যুদ্ধের শুরু।’

‘না, অত শক্ত খেলায় কাজ নেই।’ বড় ছেলে বলে, ‘তার চেয়ে আমরা সন্ধি করি, সেই ভাল।’

‘সে কী করে হয়?’

শত্রুপক্ষ জানতে উৎসুক।

‘প্রথমে, আমি তোমার পেছন থেকে ছুরি মারব।’ বড় ছেলে জানায় অত্যন্ত সহজভাবে।

‘কেন?’

‘তা জানিনে।’ বড় ছেলে বলে, ‘তবে তাই নিয়ম। তা না হলে সন্ধি হয় না।’

‘আমি তোমার পেছনে ছুরি মারব, তারপর আমাদের যুদ্ধ মিটে যাবে, অস্ত্র সমর্পণ করব আমরা, আর আমাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা সম্মিলিত হব তখন।’

‘বেশ।’ ছোট ছেলে সম্মত হল। ‘ছুরি মারো, তবে খুব জোরে নয় কিন্তু।’

ছুরিকাঘাত পর্ব সমাপ্ত হবার পরেই হল সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা। উভয়পক্ষ মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। যথাশাস্ত্র—যেমন দস্তুর। ‘আমি সন্ধি চাই৷’ বলল বড় ছেলে— দু’হাত তুলে। ছোট ছেলেও তার পুনরুক্তি করল হাতে ও কলমে। ‘বেশ, তোমার যা কিছু আছে সমস্ত আমায় দিতে হবে। তা হলেই আর তোমার সঙ্গে আমার কোনও যুদ্ধ নেই।’ বলল বড়।

‘তা-ই হবে। কিন্তু এরপরে আমরা করব কী?’ ছোটর জিজ্ঞাস্য।

‘কেন?’

‘এরপর আমরা ফুর্তি করব আর গির্জার যত ঘণ্টা আছে সব বাজতে থাকবে।’

আর তার পরমুহূর্তে তারা ফুর্তি করতে শুরু করল—পাগলের মতো ছুটোছুটি করে। আর ঢং ঢং ঢং ঢং অবিশ্রান্ত আওয়াজ বেরোতে লাগল তাদের ভিতর থেকে।

‘মাটি করল! মাটি করল!! সমস্ত ফুলের কেয়ারি আমার মাটি করে দিল!!!’ বনমালী হায় হায় করে।

‘যুদ্ধে অমন অনেক মাটি হয়।’ আমি সান্ত্বনা দিই, ‘আবার ওই মাটি থেকেই নতুন ফুলের কেয়ারি গজায়!…যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে।’

ওদের ঢং দেখছি, এধারে ফের টেলিফোনের ঢনৎকার। বিপিন খবরদারি করছে।

বিপিন—লোকটা ওইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে—এখনও এগোচ্ছে।

বনমালী—এখনও হামাগুড়ি দিচ্ছে—কী ভয়ানক? কোনদিকে এগোচ্ছে?

বিপিন—লাটসাহেবের বাড়ির ওপর ওর নজর। সেই দিকেই এগোচ্ছে মনে হয়।

‘অ্যাঁ বলো কী?’ —বলে বনমালী। ওর বেশি আর বলতে পারে না, ভাবাবেগে ওর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। লোকটা ওই দিকেই এগোবে যেন ওর জানা ছিল—অবচেতনায় ভাবনাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে হয়। এখন ষড়গুণাবলিজারিত মকরধ্বজ হয়ে দেখা দিল।

“আজ্ঞে হ্যাঁ। লোকটা টোকিয়োর রাস্তা ধরেছে বলেই ধরা উচিত। যে হারে এগুচ্ছে। বিপিন জানায়, ‘তাতে আন্দাজ, মাসখানেকের মধ্যে লাটসাহেবের দরজায় গিয়ে পৌঁছবে। তারপরে টোকিয়ো পৌঁছতে—তা যাই লাগুক—ওর হালচাল আমাদের সামরিক গতিবিধির সঙ্গে ঠিকমতোই খাপ খায়। তাতেই আমার সন্দেহ আরও।’

‘আর এক মিনিট দেরি না করে, এক্ষুনি তুমি পার্ক স্ট্রিট থানায় দৌড় দাও—ট্যাক্সি ট্রাম বাস যা পাও সামনে বুঝেছ? খবর দাও গে থানায়।’

বিপিনকে উধাও করে দিয়ে বনমালী বললে, ‘আমিও লালবাজারে একটা ফোন করে দিই কী বলো? বড় দপ্তরে খবরটা যাক। সাবধানের বিনাশ নেই।’

হামাগুড়িদাতাকে পঞ্চম-বাহিনীর লোক বলে, পুলিশের কাছে পরিচিত করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না বনমালীর। এক দুগ্ধপোষ্য ছাড়া আর কারও হামাগুড়ি বরদাস্ত করতে পৃথিবী প্রস্তুত নয়——পুলিশ তো আরও কম।

ইডেন গার্ডেনের মতো জায়গায়—এই অসময়ে—এমন হামাগুড়ি—এর বেশি আর বলতে হল না। সত্যি বলতে, হামাগুড়ি দেয়ার পক্ষে (আপনার আমার কথাই বলছি) সব সময়ই অসময় আর সর্বত্রই অস্থান—এত বড় পৃথিবী একান্ত অপ্রশস্ত। আর সব কিছু আমরা দিতে পারি, যথাসর্বস্বই, কিন্তু একটা জিনিস—ওই হামাগুড়ি—সাধ হলেও দেবার আমাদের সাধ্য নেই। দাতাকর্ণকেও দিতে হলে তিন পা পেছোতে হবে।

‘চলো, পুলিশ কী করে দেখা যাক এবার,’ বনমালী বেরিয়ে পড়ল আমাকে নিয়ে। তার ছোট্ট কুঞ্জবন ভেদ করে চলেছি, কোত্থেকে একতাল কাদা এসে লাগল আমাদের গায়ে। সেই তাল সামলাতে না সামলাতে আরেক তাল এসে কাপড়জামা কলঙ্কিত করে দিল। যোদ্ধৃবৃন্দের লক্ষীভূত হয়েছি বোধহয়।

‘ইস! দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি,’ বনমালী ক্ষেপে ওঠে।

‘আর মজা দেখায় না। যুদ্ধের মজাই এই।…ওরা সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মিলিত হয়ে অস্ত্রধারণ করবে বলছিল না?’

আমার সুক্ষ্মদৃষ্টি খুলে যায় হঠাৎ, আমাদেরকেই সেই শত্ৰু ঠাউরেছে কি না কে জানে! ছোট বাগান থেকে বড় বাগানে এসে পড়েছি। প্যাগোডার ধার ঘেঁষে চলেছিলাম—একজোড়া সাহেব-মেমের পাশ কাটিয়ে।

সাহেবটা বলছিল, ‘I will give you a fur collar, if you let me kiss you, a fur cap if you let me hold tight, a fur coat if you…’

‘Stop! That’s far enough শোনা গেলো মেমটির ঝাঁঝালো গলায়—’No further.’

আমরা পৌঁছবার আগেই লালবাজার থেকে লরি বোঝাই কনস্টেবল আর সার্জেন্ট এসে পৌঁছে গেছে। মায় খোদ পুলিশ সাহেব পর্যন্ত। লড়ালড়ি শুরুর বিশেষ দেরি নেই।

পুলিশ সাহেব বললেন, ‘তোমরা চারধার ঘিরে থাকো, যেন পালাতে না পারে। আমি একাই ভেতরে যাব।’

সার্জেন্ট-কনস্টেবলে ঘেরাও করে ঘোরালো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল—তিনি একাই রিভলবার হাতে নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে অকুস্থলে প্রবেশ করলেন।

লোকটা তখনও তদগত ভাবে তদবস্থায় ছিল, দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও, বনমালী আর আমার নজর এড়ায়নি। ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে খানিকক্ষণ না হাতড়াতেই হামাদাতাটি সাহেবের হাতে এসে আটকে গেল। এক হাতে লোকটাকে হাতিয়ে, কলকাতার প্রথম পঞ্চম-বাহিনীকে হস্তগত করে, আরেক হাতে গোঁফে তা দিতে দিতে (রিভলবার তখন পকেটস্থ) পুলিশ সাহেব সগর্বে গার্ডেনের বাইরে এসে উপস্থিত হলেন। লোকটার হাতে হাতকড়ি পরিয়ে দিতে দেরি হল না বিশেষ। সব কিছুর হেস্তনেস্ত করে সাহেব তাঁর মোটরে গিয়ে উঠলেন।

লালবাজারি পল্টন তাদের শিকার নিয়ে চলে গেলে পার্ক স্ট্রিটের পুলিশ ফৌজ এসে হাজির হল তারপর। তাদেরও ইনস্পেক্টর, সার্জেন্ট, কনস্টেবলের কিছু কমতি ছিল না। লালপাগড়ির জলুসই বা কম কী!

লাল পল্টন নিয়ে সারা বাগানের সমস্ত কিছু ইনস্পেক্টর সাহেব নিজে তন্ন তন্ন করলেন। আর এইরকমের চুলচেরা খোঁজাখুঁজির ফাকে, কাঁটাঝোপের আড়ালে লুক্কায়িত আরেকজন ধরা পড়ল এবার। ইনস্পেক্টর সাহেব, নিখুঁতভাবে ইনস্পেকশন করে নিজেই তাকে পাকড়াও করলেন।

আর এইভাবে একমাত্র স্থলে একই দিনে কলকাতার দ্বিতীয় পঞ্চম-বাহিনী ধরা পড়ল।

এবার একটি মেয়ে।

এতবড় ট্রাজেডির পর বনমালীকে পরিত্যাগ করে আমি কার্জন পার্কে এসে বসলাম। ‘মা নিষাদে’র পরে এরকম বিষাদের ব্যাপার ইহলোকে খুব বেশি ঘটেছে বলে মনে হয় না। যাই হোক, এরূপ বিরাট আড়ম্বরের পরে কিছু লঘুক্রিয়া দরকার—চিনাবাদাম খেলে খুব মন্দ হত কি? পয়সার জন্য পকেট হাতড়াতে গিয়ে একটা পোস্টকার্ড পাওয়া গেল— নাকের বদলে নরুন।

একটা আলোচনা-সভার আমন্ত্রণ-পত্র। ‘যুদ্ধকালীন সাহিত্যের রূপ কী হতে পারে’— এই ছিল আলোচ্য বিষয়। আর আজ বিকেলেই ছিল সেই দুর্যোগটা।

যুদ্ধকালীন সাহিত্যের রূপ কী হতে পারে? বাস্তবিক এটা একটা ভাবনার বিষয় বটে। যখন আমরা ভালবাসি তখন আমরা ভালবাসার কোনও রূপ দিতে পারি না। ভাবতেই পারি না সে সম্বন্ধে। দেখতে পেলেও দেখাতে পারি না বোধহয়। তার ঢের পরে সেই ভালবাসা জীর্ণ হয়ে গেলে, হয়তো জরাজীর্ণ হয়ে গেলে, তখনই পূর্ব অনুভূতি রসোত্তীর্ণ হয়ে আমাদের রূপায়ণে অপূর্বতা লাভ করে। মানে, করলেও করতে পারে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, এর মানসিক প্রতিক্রিয়া সাহিত্যে রূপান্তর করতে গেলে তার বেলায় কি সেই রীতির কোনও ব্যত্যয় ঘটবে?

যুদ্ধ তো বলতে গেলে ভালবাসারই বিকৃতি—আশ্চর্য বিরূপান্তর। একজনকে আত্মসাৎ করবার যে লালসাকে আমরা প্রেম বলি, তা-ই অনেকজনের প্রতি প্রকারান্তরে প্রযুক্ত হলে যুদ্ধ হয়। অবশ্য, যুদ্ধের সময়ে ঐকান্তিক প্রেমের গল্প লেখা সম্ভব কিংবা সহজ না হতে পারে, কিন্তু যুদ্ধের গল্প লিখলেই যে তা সার্থক হবে—এবং তা লেখাই সর্বত প্রয়োজন, তার কী মানে আছে?

তবে সাহিত্যের রূপ যাই হোক, যুদ্ধকালীন সাহিত্যিকের একটা রূপ আছে নিশ্চয়ই। আমাদের দেশে অন্তত আছে। নানা দল ও দলাদলিতে বিভক্ত সদ্যোজাত যুদ্ধকালীন রাজনীতিজীবীদের মতোই তা বুঝি অপরূপ। কমুনিস্ট রূপ, নিয়মনিষ্ঠ রূপ, ফ্যাসিবিরোধী রূপ, গণতান্ত্রিক রূপ—তথাকথিত এঁরা গোত্র আর নামে আলাদা হলেও আসলে কিন্তু পরস্পরের অনুরূপ। কূটনীতিকের দাদার-জয়-গাওয়া প্রচারক রূপ, অর্থনীতিকের লোকের চোখে ধাঁধা দেওয়া প্রতারক রূপ প্রভৃতি কর্তাভজা বহুরূপের সঙ্গে বহুরূপী লেখকের যা ফারাক তা কেবল তালে আর মানে। তবু এসব রূপের মধ্যে চাকচিক্য আছে—রূপার চাকচিক্য। আর এঁদের বাইরে যারা-—হতভাগ্য আমরাই—তাদের বরাতে কাগজ নেই, প্রকাশক নেই, নিজের বই নিজের ছাপানোর উপায় নেই, (আর ছাপাবার টাকাই বা কোথায়?) এধারে লেখার মজুরি নামমাত্র—আমাদের একান্তই অপদার্থ রূপ। অবশ্য, খাঁটি সাহিত্যের পক্ষে সামরিক রসায়ন লাভের সম্ভাবনা এ সময়ে না থাকলেও, খাঁটি সাহিত্যিকের পক্ষে সামরিক রূপ নেবার কোনও বাধা ছিল না বোধহয়।

দেশে জাতীয় গভর্নমেন্ট স্থাপিত থাকলে অন্তরের স্বাভাবিক প্রেরণায় অতি সহজেই সেই রূপান্তর আমরা লাভ করতাম। এবং তা হলেই বুদ্ধি আর হৃদয়ের এই বিরোধ আর বঞ্চনা থেকে—এ যুগের বুদ্ধিজীবীদের যে ট্র্যাজেডির কথা নোগুচি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একদা বলেছিলেন—তারই বিকারন্তর থেকে আমাদের নিস্তার ছিল। দেশ স্বাধীন হলে, দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কলম ছেড়ে আর সকলের সঙ্গে অস্ত্র ধরাই লেখকদের উচিত ছিল নাকি? অস্ত্রকেই লেখনী করে নিজের শত্রুর সম্মিলিত রক্তাক্ষরে জীবনের পৃষ্ঠায় আরেক সাহিত্য-রচনার দায় ছিল নাকি তখন? তেমন হলে, আমার এই বীরবপু নিয়ে এমন কী আমিও হয়তো বিজাতীয় অভিযানের বিরুদ্ধে রুখে এগোবার পথ দেখতাম—পেছনের পথ পরিষ্কার না রেখেই। কিন্তু যে কারণেই হোক, তা যখন হয়নি, তখন অগত্যা আমাদের—আমাদেরও এই আত্মবঞ্চক বিজ্ঞরূপ—আর আমাদের রচনার এই নিতান্ত বিজ্ঞাপন-রূপ।

সাহিত্য-সভায় গিয়ে এই নব-রূপকথা ব্যক্ত করব কি না ভাবি একবার। মা ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম! তা ছাড়া আই মাস্ট নট হেলপ স্টর্ম ব্রইং! ফাঁসিবিরোধীরা নিজেদের কাজ গুছোচ্ছে, আমাকে তো ফাঁসি দিচ্ছে না—এখনও নয়। তবে কেন? চাই কী, কোনও কোনও দুঃসময়ে, ভগবান না করুন, তাদের কারও কাছে হয়তো দু’-চার টাকা ধার পাওয়া যেতে পারে। লাভ কী চটিয়ে?

এবং কাদালাঞ্ছিত নিজের রূপটাও তো দেখাতে হয় একবার। যুদ্ধকালে সাহিত্যিকের এই চেহারা সুহৃদদের দেখিয়ে কী সুখ?

অতএব চটেমটে একটা সিনেমায় চলে গেলাম এবং যুদ্ধকালীন চলচ্চিত্রের রূপ দেখে (প্রায় অবিকল রূপ!) বিরূপ হয়ে বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যায়।

ঘরে ঢুকতেই আশা করা গেছল চায়ের গন্ধ পাব। টোস্ট অমলেট বিস্কুট সাজিয়ে কল্পনা বসে আছে, দেখছিলাম কল্পনানেত্রে। কিন্তু না, চায়ের গন্ধ তো নেই-ই, কল্পনাও নিশ্চিহ্ন।

চায়ের আশা যখন লোপ, আরাম করে শুয়ে পড়া যাক গিয়ে। কী আর করা যাবে? শয়ন-কক্ষের দরজা ঠেলে প্রবেশ করি।

‘নমস্কার বাবা!’ দ্বারমুক্তির সঙ্গে সঙ্গে মুক্তকণ্ঠের আহ্বান এল উচ্ছ্বসিত ললিত অভ্যর্থনা।

ধাক্কা খেলাম, একথা অস্বীকার করব না।

প্রায় হার্টফেল করতে গিয়ে বেঁচে গেলাম বলতে চাই।

‘বাবা’ কথাটা আমার অপরিচিত নয়, একান্ত অশ্রুতপূর্ব যে তাও বলি না, তবে শব্দটা যতই সুমিষ্ট হোক আমার প্রতি নিক্ষিপ্ত হতে শুনিনি কখনও, ভাইফোঁটার দিনে পাত্তা না পেলেও দাদা হতে বাধে না, বিয়ে না করেও স্বামীত্বের কল্পনা করতে পারি, বিন্দু-বিসর্গ না জেনেও আসামি হওয়া যায়, এমনকী, না বিইয়েও কানায়ের মা হতে শুনেছি, কিন্তু অপুত্রক আমার পিতৃ-সম্বোধন-লাভের অভিজ্ঞতার কাছে সে সব বোধহয় কিছু নয়।

এত বেশি বিচলিত হয়েছিলাম যে, আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরুল না। আমার ভ্রাতৃতুল্য সেই পুত্রের দিকে নিষ্পলক হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।

বিপিনের ভাষায় বলতে গেলে, আধা বর্মি, আধা বাঙালি, অর্ধ চিনেম্যান, অর্ধেক উড়ে, আধখানা মাদ্রাজি। তার ওপরে তিন ভাগ ফিলিপাইন আর এক ভাগ নিউগিনি যোগ করলে হয়তো পুরোপুরি হয়। কিন্তু এই মোগলাই চিজ এখানে আমার ইজিচেয়ারে কেন?

আমাকে বিস্ময়াবিষ্ট দেখে ছেলেটি বলল, ‘ও আপনি বুঝি জানেন না? মা আমাকে পোষ্যপুত্র নিয়েছেন। আমার কাপড়জামা কিনতেই বেরিয়েছেন তিনি এখন।’

‘কৃতার্থ করেছেন।’ বললাম মনে মনেই। ‘কিন্তু, তুমি কে?’ মুখ ফুটে বেরুল আমার।

‘আমি একজন বার্মা-ইভ্যাকুয়ি।

‘বার্মা-ইভ্যাকুয়ি—’

আকাশ থেকে পড়তে হল। এখানে কেন—এ প্রশ্ন কোনও ইভ্যাকুয়িকে করা যায় না। কোনও বৰ্মা-ইভ্যাকুয়িকে তো নয়ই। সর্বত্র তাদের অবাধগতি। তবে এখন কেন, এ জিজ্ঞাসা করা চলে হয়তো বা।

‘য়্যাদ্দিন বাদে বর্মা-ইভ্যাকুয়ি—তা কী করে হয়?’

‘তাই হয়েছে বিশ্বাস করুন। ইংরেজের আমলে জাপানিদের বোমার সময়ে তবু কোনও রকমে টিকেছিলাম, কিন্তু জাপানিদের আমলে আপনাদের বোমার জ্বালায় এখন আর সেখানে টেকা যাচ্ছে না। দগ্ধে দগ্ধে মরি কেন, তাই চলে এলাম।’

‘বটে বটে? এরা গিয়ে খুব বোমাচ্ছে বুঝি?’ শুনে আমার অদ্ভুত পুলক হল।

‘আর বলবেন না।’ ছেলেটি বলে। ‘যৎপরোনাস্তি।’

ছেলেটিকে বেশ নিখুঁত বলতে হবে। নিরীহ গোছের জীব। ভদ্রভাবে লালিত-পালিত এবং সযত্নবর্ধিত বলেই সন্দেহ হয়। বসবার উদ্দেশ্যে আমি চারধারে তাকাচ্ছি দেখে তৎক্ষণাৎ সে আমার ইজিচেয়ারটা ছেড়ে দিল। নিজে গিয়ে বিছানার এক কোণে বসল।

‘তোমার নাম কী বাপু?’

‘বাপু বলবেন না, আপনি আমাকে বৎস বলে ডাকবেন?’

‘আচ্ছা তাই হবে। এখন নাম বলো তো।’

‘আজ্ঞে বিক্রম সিং প্রধান।’

‘তোমরা কী? বাঙালি—না অন্য কিছু?’

‘আমার বাবা ছিলেন রাজপুত ছত্রপতি সিং আর মা উড়ে—রত্নপ্রভা প্রধান—তবে আমি—বাঙালি—বাংলা ইস্কুলে পড়তাম কিনা—বাঙালিদের সঙ্গেই মিশতাম বেশি। তবে বর্মিও বলতে পারেন আমাদের।’ বলল বিক্রম সিং। ‘আপনার যা ইচ্ছে।’

ব্ৰহ্মদেশে বাঙালির বিক্রমের কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তার তাড়সে রাজপুতের সিং আর উড়ের প্রাধান্য উড়ে গেছে—সব মিলে মিশে যে জগাখিচুড়ি হয়েছে তা নিছক বাঙালিত্ব ছাড়া কিছু না। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য আর দৈবিক যা কিছু সব এক এক আনা করে নিয়ে মিশিয়ে ষোলো আনা করতে পারলে এবং তার উপরে স্বকীয় বুদ্ধি আরও আনা দুয়েক যোগে আঠারো আনা করলে, তখনি অত্যাশ্চর্যরূপে বাঙালিয়ানা পাওয়া যায়।

এ তো গেল বাঙালির ভৌগোলিক রূপ। এসব গোলমাল বাদেও বাঙালির পরিষ্কার সাংস্কৃতিক রূপ আছে। ঐতিহাসিক সূত্রেও আমরা বাঙালিকে পেতে পারি। প্রাক-উপনিষদের যুগ থেকে আরম্ভ করে বৈদিক, বৌদ্ধ, শঙ্কর, মোগলাই, ইংরেজি ইত্যাদি বিভিন্ন হুজুগ পেরিয়ে পাঁচশো বছর পরেকার অনাগত সময়ে ছিটে-ফোঁটাও খুঁজলে পাওয়া যাবে আমাদের মধ্যে। ধরাধামের আর নিরবচ্ছিন্ন কালের যাবতীয় আইডিয়ার আমরা আইডিয়াল রূপ—সর্বপ্রকার ঐতিহ্য এবং আদর্শের খর্বাকার প্রতিমূর্তি। পার্থিব বিদ্যা-বুদ্ধি-ভাষা-কৃষ্টির সঙ্গে অপার্থিব প্রতিভার সমন্বয়ে আমরা বাঙালি।

‘তা তুমি কি কেবল বোমার ঝামেলাতেই পালিয়ে এলে, নাকি, অন্য কষ্টও ছিল?’

‘হ্যাঁ, অন্নকষ্ট দেখা দিল বই কী। খাওয়া-দাওয়ার ভারী কষ্ট হতে লাগল।’

‘বর্মায় অন্নকষ্ট—বলো কী! শুনেছি সে যে সোনার দেশ—এই বাংলাদেশের মতনই নাকি! ধানচালের তো সেখানে অভাব নেই ভাই!’

‘তা তো নেই!’ বিক্রম সিং থামে। বোধহয় সমস্যাটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ক্ষমতায় কুলিয়ে উঠতে চেষ্টা করে।

‘তবে কি সেখানেও রাজায় মন্ত্রীতে কোটালে আর সওদাগরে ষড়যন্ত্র নাকি? কথামালার দেশের হবুচন্দ্র গবুচন্দ্রের যন্ত্রণা—সেখানেও?’

‘ঠিক তা নয়। খাবার-দাবার আছে, কিন্তু কিনব কী দিয়ে? টাকা নেই তো! টাকারই দুর্ভিক্ষ।’

‘সে আবার কী? সে তো কেবল আমাদের—এই লেখকদেরই একচেটে জিনিস। তোমাদের টাকার অভাব কেন?…তুমি কি লেখক?’

‘তা হলে শুনুন তবে। আমার বাবা অনেক টাকা রেখে গেছলেন—কয়েক লাখ টাকার কোম্পানির কাগজ—আমাদের দুই ভাইয়ের জন্যে। বাবা মারা যেতে টাকাটা আমরা ভাগাভাগি করে নিলাম। দাদা আমার উড়নচণ্ডী—তাঁর ভাগের টাকা মদ খেয়ে ফুঁকে দিলেন। তারপর পাছে তিনি আমার থেকে ধার নিতে শুরু করেন, সেই ভয়ে দাদার সঙ্গে আমি আড়ি করে দিলাম। এ ছাড়া আমার কিন্তু কোনও দোষ ছিল না। সমস্ত টাকা আমি জমিয়ে রেখেছিলাম। পাই-পয়সা পর্যন্ত খরচ করিনি, এমন সময় যুদ্ধটা বাধল।

‘জাপানিরা এক ধাক্কায় ব্রহ্মদেশটা দখল করে নিল—আমি ভারী ফাঁপরে পড়ে গেলাম। জাপানি আমলে ইংরেজি কোম্পানির কাগজের দাম থাকল না—যা দাম থাকল, তা নামমাত্র’—বিক্রম সিং দম নেবার জন্য থামল।

দামটা জানার কৌতূহল হয়—নিষ্কাম কৌতূহল যদিও। আমার কোনও কোম্পানির কাগজ নেই—কেনাবেচার উৎসাহও নাস্তি, কিছু নামগন্ধ না, তবু কোম্পানির কাগজের অনেক নাম—যোজন-গন্ধা খ্যাতি। তার নামমাত্র দামটাও না জানি কত বা!

‘সে আর বলে কী হবে?’ বিক্রম সিং মুখবিকৃত করে। ‘সে কোনও দামই নয়। কোম্পানির কাগজগুলো প্রথমে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে চার ধারে ছড়িয়ে ফেলতে হয়, তারপরে টুকরিতে ভরে বেচতে হয় কাগজওলার গুদামে—ছেঁড়া কাগজের যা দাম।’

ঠিক এইভাবে আমি অদ্যতনী গদ্যকবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। যে-কোনও দৈনিক মাসিক কি সাপ্তাহিক পত্রের যে-কোনও একটা পাতা বেছে নিতে হয়। এমনকী মশলাবাঁধা কাগজ বাংলা ভাষাভাষী হলে তার দ্বারাও বানানো যায়। প্রথমে সেই কাগজটিকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে টুকরোগুলিকে শূন্যের দিকে ছুঁড়তে হবে।

রচনাকে শূন্যগর্ভ করবার জন্যও বটে এবং কিছুটা রচনার নৈপুণ্যের খাতিরেও বই কী। তারপর সেই ছেঁড়া টুকরোগুলিকে ইতস্তত থেকে কুড়িয়ে এনে পরের পর সাজিয়ে যাও—পছন্দমতো ছোট-বড় লাইনে। কবিতা মাপসই হওয়া দরকার। কমা সেমিকোলন দাঁড়ি প্রভৃতি ইচ্ছামতো দেবে। ড্যাস ও ফুটকি প্রয়োজন-মাফিক। তারপর নিজের রুচির আন্দাজে ‘কাস্তে বাদুড় কাকের বীর্য’ ইত্যাদি একটু ছিটিয়ে নিলেই মুখরোচক একটি আধুনিক কবিতা প্রস্তুত হল। কাকস্য পরিবেদনা সেই রচনা নিয়ে সম্পাদককে তাড়া করুন তারপর। এ-জাতীয় কবিতা লিখতে বেগ পাবার কিছু নেই, তেমন জোর থাকলে একটানে এক টনও লেখা যায়। কেবল যে গদ্য-সাহিত্য ভেঙেই রচনা করতে হবে, তারও কোনও মানে নেই—শেয়ারমার্কেট রিপোর্ট, সমরাঙ্গনের খবর, সম্পাদকীয় স্তম্ভ, নিজস্ব সংবাদদাতার বার্তা এসবের থেকেও বানানো যায়—এমনকী এক গদ্য-কবিতা ছিঁড়েও এইভাবে আরেক গদ্য-কবিতা নিয়ে আসা চলে। একটাই যে আসবে তার কোনও স্থিরতা নেই, বীজাণুর ন্যায় নিজগুণে দ্বিগুণভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।একই তুলোকে বারংবার পিঁজে ধুনে, সাজানোর হেরফেরে অতুলনীয় নতুন নতুন কবিতা আমদানি করা যায়। এসব কবিতার মাথামুণ্ডু থাকে না বটে, কিন্তু কবিতায় সে-বালাই না-থাকাই ভাল নয় কি? বাণীর এ এক ছিন্নমস্তা রূপ—নিজের কণ্ঠসুধা পানে নিজেই বিভোর, কেবল অঙ্গভঙ্গির একটুখানি ধড়ফড়ানি আছে এই যা।

কোম্পানির কাগজের এহেন কবিতা-সুলভ দুর্দশায় আমার দুঃখ হয়। ‘কেন, ওগুলোর কি এক পিঠও সাদা থাকে না? তা হলে তো লেখা যায় বেশ।’

‘এইভাবে কোম্পানির কাগজ বেচে কত আর ইয়েন পাব? ক’দিন তাতে চলে আর? আমার দাদার কিন্তু রাত গেল ফিরে। যে-সব মদের বোতল দাদার জমেছিল—মদ খেতেন আর বোতলগুলো বাড়ির পেছনে বাগানে ফেলে দিতেন তো—তাই বেচে দিব্যি চলতে লাগল। বোতলের দাম বেড়ে গেল অসম্ভব। বলব কী মশাই, ভাঙা কাঁচ পর্যন্ত পড়তে পেল না—একেবারে আগুন। বোতল বেচে দাদার দশ লাখ টাকার ইয়েন হয়ে গেল—আঙুল ফুলে কলাগাছ! নিজেই গায়ে পড়ে ঝগড়া করেছিলাম, আর তো দাদার কাছে গিয়ে হাত পাততে পারি না। বাধ্য হলাম ভারতবর্ষে পালিয়ে আসতে। তবে এসেছি এক মতলব নিয়ে।’

‘কী মতলব?’

‘মিত্রশক্তিকে উসকাতে, যাতে চটপট বর্মাটাও ওঁরা জিতে নেন—জাপানিদের বরং সওয়া যায়—কিন্তু দাদার বোলবোলাও তো আর সহ্য হয় না বাবা।’

‘আর সেই সাথে তোমার কোম্পানির কাগজের কপাল ফেরাতে?’

‘সে কি আর আছে?’ বিক্রমের দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। ‘খেয়েদেয়ে চা গরম করে ফুকে দিয়েছি কবে। তবে দাদার ইয়েনের কাঁড়িরও সেই দশা হোক এই আমি চাই। জাপানিরাও তো কাগজই গছিয়েছে মশাই—স্রেফ কাগজ।’

‘তোমার দাদার সঙ্গে বোধহয় তুমি পেরে উঠবে না বিক্রম। নিশ্চয়ই তিনি সমানে মদ টেনে যাচ্ছেন—এখনও, দু’লাখ টাকার মদের বোতল বেচে যদি দশ লাখ ইয়েন হয়ে থাকে দশ লাখ ইয়েনের বোতল কতগুলো হবে আমার ধারণা হয় না। একটার পর একটা সাজালে হয়তো বিষুব-রেখা বেষ্টন করে আসবে মনে হয়। যতদিনে আমরা বর্মায় গিয়ে পড়ব ততদিনে তোমার দাদার সমস্ত ইয়েন ফাঁক, বিলকুল খতম, থাকবে খালি বোতল। আর সে বোতলের দাম তখন আরও দশ গুণ বেশি।’

ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করে বিক্রম হায় হায় করতে থাকে। ‘আমার এক বাঙালি বন্ধু এই কথাই বলত বটে। বলত যে, যে খায় চিনি তাকে যোগায় চিন্তামণি।’ সে সকাতরে জানায়।

চিন্তামণিকে চেনা দায়! ওর দাদার চিনি যোগাবার জন্য এতবড় একটা যুদ্ধই তিনি বাধিয়ে বসলেন। এতজনের দুঃখ-দৈন্য-নির্যাতনের কথা চিন্তাও করলেন না। ভাবলে চিন্তিত হতে হয় বই কী। কিন্তু সে চিন্তার চেয়েও ওর চিন্তাটাই এখন বড়।

‘তোমার বার্মা থেকে পালিয়ে আসার পথে কোনও কষ্ট হয়নি?’ ওর দুঃখ ভোলাতে আমি অন্য কথা পাড়ি।

‘কষ্ট হয়নি? খুব কষ্ট। তার ওপর একজন আমার পিছু নিয়েছিল আবার তার—চোখ এড়াতেই—’

‘জাপানি গেস্ টাপো বুঝি?’ আমি guess করি।

‘গেস্ ট—কী বললেন? তা গেস্ট বলা যায় হোস্টও বলা যায়—চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে।’

‘তা যা বলেছ, একবার ছুঁলে আঠারো ঘা, চিরকালের জন্য ঘায়েল। তার ওপরে নাছোড়বান্দা আত্মীয়তা। আমাদের এখানকার বন্ধুরাও কিছু কম যান না, প্রায় সগোত্রই বলতে হয়।’

‘হুম।’ বলে বিক্রম সিং অস্বাভাবিক রকম গুম হয়ে গেল।

না, ছেলেটি মন্দ নয়। শিক্ষিত, বিনম্র, ভদ্র এবং সাধু ভাষায় যাকে বলে, কৃষ্টিবান। তবে তেমন দুরদৃষ্টিবান নয় বলেই মনে হয়। সেটা অবশ্য বয়সের দোষ। চালসে পড়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসবার সাথে সাথে যথাসময়ে আসল দৃষ্টি খুলবে। এখন জ্ঞানাঞ্জনশলাকা দানে কোনও ফল নেই—চল্লিশের আগে তা খোলতাই হবার নয়। এখন হাজার ওকে চোখা করবার চেষ্টা করলেও গুরুর-উপর-টেক্কা-মারা গুরুতর কোনও পরাকাষ্ঠার সম্ভাবনা নাস্তি। চক্ষুবানও হতে পারবে না, চক্ষুদানও করতে পারবে না।

‘একগাদা বই জোগাড় করেছেন দেখছি।’ মনের গুমোট কাটলে আমার বইয়ের শেলফের দিকে সে তাকাল। ‘সেকেন্ডহ্যান্ড বইয়ের দোকানের মতো দেখাচ্ছে, তাই না? এর যদি সব আপনি পড়ে থাকেন, তা হলে খুব শিক্ষালাভ করেছেন বলতে হবে।’

‘বিশ্বকোষ, রাজতরঙ্গিণী, শব্দকল্পদ্রুম এইরকম খানকয়েক বাদে প্রায় সব বই-ই পড়ে দেখেছি বলতে পারো! কয়েক পাতা করে প্রায় সবই আমার ওল্টানো।’

‘উঃ! কী ভয়ংকর পড়াশুনা আপনার! আপনি পণ্ডিত লোক।’ ওর দু’-চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

আমি লজ্জিত হয়ে অন্য প্রসঙ্গ পাড়ি। আত্মপ্রশংসা আমার সয় না—একেবারে আধমরা করে দেয় আমায়।

‘বাড়ির এরা সব গেল কোথায়? কাউকে দেখছিনে যে, কোথায় গেছে বললে?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।

‘মা-র কথা বলছেন? তিনি একটু বাজার করতে গেছেন।’

‘মা? এবার দ্বিতীয় দফা আমার চোট লাগে। আবার দম আটকে আসে আমার। কল্পনাকে মাতৃতুল্য—মানে, অন্য কারও মাতৃস্থলাভিষিক্ত ভাবতেও হোঁচট খাই। এমন একটি বৃহদাকার বালককে আমার কাল্পনিক তনয় বলে ধারণা করতে পারি না।

‘হ্যাঁ’, বলে ও। ‘আপনি তাঁকে চেনেন নিশ্চয়ই। ওই যে’—দেওয়ালে কল্পনার ফটোর দিকে সে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে। ‘ওইখানে।’

‘তুমি কি মা বলো নাকি ওঁকে?…’

‘বাঃ মা-ই তো! কেন নয়? আমাকে পোষ্যপুত্র নিয়েছেন বলিনি কি?’

‘হ্যাঁ বলেছিলে যেন মনে পড়ছে। তোমাকে তিনি কী বলেন? বৎস?’

‘আমাকে? না, শুধু বিক্রম। তবে বলেছেন আরও একটু ঘনিষ্ঠতা হলে বিকু বলেই ডাকবেন। বিকুটাই বেশি মিষ্টি নাকি।’

উঃ আমার অবর্তমানে এই একবেলার মধ্যে এতদূর গড়িয়েছে! উই আর লিভিং ইন প্রেজেন্স অফ হিসটোরি—কথাটা মিথ্যে নয় দেখছি। এবং ইতিহাসের কী তীব্র গতি! এমন তীরবেগে চলেছে তার মারাত্মক ভাঙা-গড়ার পথে যে পদ্মার তীরও তার কাছে কোথায় লাগে। (তটস্থ হয়ে থাকব তার যো কী।)

বিক্রমকে নাইয়ে খাইয়ে শুইয়ে দেওয়া হল বাড়তি ঘরটায়। কল্পনাই এসব ঝক্কি পোহাল।

তারপরে ভাল কাজের অব্যর্থ আনন্দে গদগদ হয়ে বলল, ‘আমাদের একটি ছেলে ছিল না, বুড়ো হলে সেবা করবার ছিল না কেউ। এমন একটি ছেলে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ভালই হল, কী বল?’

‘অর্থাৎ এখন আমাদের সেবা করার মতো একটা হল এই বলছ তো? মানে, আমাদের সেবা—আমরাই সেবা করব যাকে এখন— যার সেবা করতে করতে বুড়ো হয়ে যাব আমরা, তাই না?’ কল্পনার কথাটাকেই আমি ভাষান্তরে প্রকাশ করি।

‘কী যে বলো’, কল্পনা বলে, ‘চমৎকার ছেলে আমাদের বিকু।’

ওর চমৎকারিত্বের বিরুদ্ধে কিছুই আমি বলি না। এবং আরও আমাদের চমৎকৃত করে দিল সে পরদিন প্রত্যুষে। তখনও ভাল করে ভোর হয়নি, দরজায় কার যেন বিক্রম দেখা গেল। ওই বিক্রমেরই। ওর করাঘাতে, কল্পনার ঘুমের ঘোর আর আমার ঘোরতর ঘুম— দুই-ই ভেঙে গেল একসঙ্গে।

‘মা মা। বাবা বাবা। তোমাদের চা বানিয়ে এনেছি। দ্বার খোলো।…’

ওর করাঘাতে মাটি হবার আগে চমৎকার এক ডিপ্লোমাটিক স্বপ্ন দেখছিলাম—যুদ্ধের স্বপ্ন, বিপ্লবের স্বপ্ন—এই যুদ্ধ কে বাধালে তারই এক স্বপ্নাদ্য কাহিনী!…

ভগবানের দেখা পাওয়া খুব রোমাঞ্চকর দৃশ্য। একটু আগে সেই ভগবদ্দর্শন ঘটেছিল আমার বরাতে, যদিও স্বপ্নযোগে , কিন্তু তা হলেও…

ভগবান তাঁর সপ্তম স্বর্গে বিরাজ করছেন। চারধারে ভক্তবৃন্দ। চলতি কথায় তাঁদের মোসাহেবও বলা যায়। স্বর্গেও উপসর্গের অভাব নেই—আর, একটু ফাঁক পেলেই তারা ভগবানের স্তবস্তুতি করে নিচ্ছেন।

নিজের পরকালের পথ পরিষ্কার করতে কসুর নেই কারও।

(যদিও, এই পরকালটা এরপরে পৃথিবীতেই এঁদের কাটাতে হবে কিন্তু তা হলেও, স্বভাবদোষে, চিরকালই এঁরা পরকালের জন্য কাতর। পূর্বকালে যেমন ধরাধামের প্রতি এঁদের বিন্দুমাত্রও রুচি ছিল না, এখন তেমনি—এমনকী তার চেয়েও ঢের বেশি—স্বর্গে এঁদের অরুচি। স্বর্গে বাস করেও এঁরা আরেক স্বর্গের জন্য লালায়িত।)

ভক্তদের মধ্যে নারদ একটু অম্লমধুর। ভগবানের অপ্রিয় সমালোচনা করতেও তিনি কখনও পেছপা হন না, এই কারণে নারদকে ভগবানের ভারী পছন্দ। মাঝে মাঝে মুখ বদলাতে হলে নারদের মতন চাটনি আর হয় না।

নারদকে জনান্তিকে ডেকে ভক্তদের দেখিয়ে তিনি বলছিলেন—’ওহে, এরা তো এখানে এসে পূর্ববৎ সেই ধান ভানছে। এইসব ধর্মের ঢেঁকিদের এ-বিষয়ে আর বেশি রপ্ত হতে না দিয়ে পরলোকে রপ্তানি করার চটপট একটা ব্যবস্থা করে দেখি—’

বলতে না বলতে পরলোকের দিক থেকে দারুণ এক আওয়াজ আসতে শুরু হল। ইংরাজি, ফরাসি, জার্মান, রুশীয় ইতালীয় ইত্যাদি বিবিধ ভাষায় জগাখিচুড়ি—তাকে আর্তনাদের ঐকতান বললেও অত্যুক্তি হয় না। উক্ত তানালাপ স্বর্গে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে দেবভাষায় অনূদিত হয়ে, সংস্কৃত রূপান্তরে, ‘ত্রাহি মধুসুদন’ হয়ে দাঁড়ালো।

ভগবান চমকে গেলেন। এ কী, পৃথিবী থেকে এমন পরিত্রাহি রব আসছে যে হঠাৎ? কুরুক্ষেত্র লড়াইয়ের সময় এরকমটা শোনা গেছল বটে, কিন্তু তখন তো তিনি স্বয়ং সেখানে সশরীরে উপস্থিত। আর সত্যি বলতে, তিনি নিজেই তো কুরুক্ষেত্র বাধান। তাঁর অবর্তমানে সেরকম কিছু বাধবার তো কথা নয়। এবং যতদূর তাঁর ধারণা, এখনও পর্যন্ত কোনও ভগ্নাংশেও তিনি মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হয়েছেন বলে তাঁর মনে হয় না—তা হলে—এ আবার কোন অবতার? কার অবতারণা?

ভগবান নারদকে খোঁজ নিতে বললেন—’ঘুরে ফিরে দেখে এসো তো হে ব্যাপারটা।’

চরের যা কিছু কাজ নারদের দ্বারাই তাঁর নিষ্পন্ন হত। ত্রিভুবন বিচরণ করে চরাচরের যা কিছু খুঁটিনাটি প্রভুর শ্রীচরণে এসে নিবেদন করাই দেবর্ষি নারদের পেশা ছিল। পেশাও বটে, নেশাও বটে। নগদা খবর না থাকলে তিনি স্বয়ং গোলমাল বাধিয়ে টাটকা-টাটকি বানিয়ে নিতেও দ্বিধা করতেন না। উপস্থিত ভক্তির ঢেঁকিদের একজনকে বাহন করে নিয়ে তক্ষুনি তিনি রওনা হয়ে গেলেন।

খানিক পরেই তিনি ফিরে এলেন খবর নিয়ে। সম্ভবত কোনও খবরের কাগজের খবর। ভূপৃষ্ঠে প্রথম যে দেশে তিনি পদার্পণ করেছিলেন সেই দেশেরই মুখ্যস্থানীয় ব্যক্তির বা কোনও জাতীয় মুখপত্রের মন্তব্য বলে মনে হয়।

‘হেলশালাসি বলে এক ব্যাটা কাফ্রি ভারী গোল বাঁধিয়েছে প্রভু!’ নারদ এসে খবর দিলেন, ‘তার জন্যই দুনিয়ায় যত হাঙ্গামা।’

‘অ্যাঁ, আমার শান্তির রাজ্যে অশান্তি বাধায়, এত বড় সাহস তার!’ ভগবান অত্যন্ত উষ্ণ হয়ে উঠলেন—’ডা-ডা-ডাকো শা-শা-শালাসিকে।’ একটুর জন্য ভগবত বাক্যের শালীনতা যেতে যেতেও থেকে গেল। তাঁর মুখের কথা খসতে না খসতে (ভগবান ইচ্ছাময়!) সম্রাট হেলশালাসি এসে হাজির। তাঁকে দেখে, তাঁর কালো রং দেখে, ভগবান আরও বেশি চটে গেলেন। নিজে তিনি কালাচাঁদ বলেই হয়তো কালোদের তাঁর এতই না-পছন্দ। ‘তুমি নাকি আমার পৃথিবীকে রসাতলে দিচ্ছ?’ এবার সম্রাটের ‘হেল্’— অংশটির ওপরেই বিধাতার বেশি চাপ পড়ল।—’যুদ্ধ বাধিয়ে আমার নরক ভর্তি করতে লেগেছ নাকি?’

হেলশালাসি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘প্রভু, আমি নই, মুসোলিনি। মুসো ব্যাটাই আগে আমার রাজ্য আক্রমণ করেছিল।—এই যুদ্ধ বাধানোর মূলে সেই-ই। আমি আমার রাজ্য আবার ফিরে পাবার চেষ্টা করছি মাত্র।’

‘ও, এই… আচ্ছা, যাও।’ হেলশালাসি খালাস পেতেই মুসোলিনির প্রতি তলব গেল।

‘প্রভু, মুষল ইনি কে?’ নারদ প্রশ্ন করলেন। আপনার যদুবংশ যার দৌলতে ধ্বংস হয়েছিল সেই মুষলং কুলনাশনং—এরা কেউ কি?’

‘খুব সম্ভব। তারই কোনও ভগ্নাংশ হবে হয়তো।’ বললেন ভগবান। ‘হয়তো সেই মুষল সম্পূর্ণ লীন হয়নি—তারই এক ধ্বংসাবশেষ নতুন এক মূর্তি ধরে এই মুষলিনি… না দেখলে ঠিক ঠাওর পাচ্ছি না।’

দেখতে না দেখতে মুসোলিনি গাল ফুলিয়ে গট গট করে এসে হাজির।

হেলশালাসিকে যে টেক্কা মারে সে চিড়তনের ওপরে আরেক-পোঁচ ইস্কাবন-মার্কাই হবে বিধাতার বোধহয় সেই ধারণা হয়েছিল, কিন্তু ধোপদুরস্ত ধপধপে রং দেখে তিনি সচকিত হলেন। ফর্সাদের প্রতি চিরকালই তাঁর কেমন টান—ধরাতলে যত উৎপাতই না বাধিয়ে থাকুক, মুসোলিনিকে খাতির না করে তিনি পারলেন না। সমাদরে বসিয়ে, খুব কিন্তু কিন্তু হয়ে কথাটা তিনি পাড়লেন।

প্রশ্নপত্র হাতে পাবামাত্র জবাব যেন মুসোলিনির মুখে লেগেই ছিল।

‘আমি যুদ্ধ বাধিয়েছি! কী যে বলেন! আমি যুদ্ধ বাধাব? আমি! আমার মতো ঠাণ্ডা নিরীহ ভদ্রলোক আর দু’জন আছে নাকি দুনিয়ায়? এ যুদ্ধ বাধিয়েছে চার্চিল। চার্চিলই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। পৃথিবীময় যত অশান্তি আর উপদ্রব দেখছেন কিংবা আপনার কানে আসছে, সে সমস্তর জন্য দায়ী হচ্ছে ওই চার্চিল।’

মুসোলিনি চলে গেল। ডাক পড়ল চার্চিলের।

চার্চিল আসতেই ভগবান উঠে গিয়ে মহা আপ্যায়ন করে তাঁকে আগিয়ে নিয়ে এলেন। মুসোলিনির বেলা যেটুকু তাঁর সৌজন্যের ব্যত্যয় ঘটেছিল, চার্চিলের বেলায় তা সুদে-আসলে পুষিয়ে দিলেন। আদতে, ধরিত্রীর ভাল-মন্দ যা কিছু, মায় ভদ্রতা পর্যন্ত, সবই তো শ্রীভগবানের থেকেই আমদানি, কাজেই তাঁর ভাঁড়ারে ভদ্রতার অভাব হলে চলবে কেন?

প্রশ্ন শুনে চার্চিল তো চৌচির। তিনি আকাশ থেকে পড়লেন যেন হঠাৎ।—’আমি— আমি যুদ্ধ বাধালাম! মুসোটা এতদূর মিথ্যেবাদী হয়েছে। সত্যি কথা যদি জানতে চান প্রভু, তা হলে বলি। যুদ্ধ একটা বেধেছে বটে, তাতে আমরা জড়িত হয়ে পড়েছি সে কথাও মিথ্যে নয়—কিন্তু সে যুদ্ধ আমরা বাধাইনি। বাধানো দুরে থাক—সে যুদ্ধে আগাগোড়া আমরা বাধা দিয়েছি। এমনকী, এখনও পর্যন্ত। এত বাধবার পরেও। আপনার যদি সন্দেহ থাকে, আমাদের পূর্বতন কর্মকর্তা, ছত্রপতি চেম্বারলেন তো এখানেই কোথাও—স্বর্গে কিংবা নরকে—রয়েছেন, তাঁকে ডেকে এনে আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন।’

এই বলে চার্চিল মুসোলিনির দেড়া গাল ফুলিয়ে অভিমানভরে বসে রইলেন গোঁজ হয়ে।

চেম্বারলেনের খোঁজ হল, কিন্তু ওই নামে স্বর্গে উপসর্গে বা বিসর্গে কিংবা আশে-পাশে কোথাও কারও পাত্তা পাওয়া গেল না। কাছাকাছি নামের একজন ছিল বটে, কিন্তু সে ঘাড় নেড়ে বিধাতার আক্রমণ প্রত্যাখ্যান করেছে। বলেছে যে—’কী বললে? চেম্বারলেন? হ্যাঁ, ওই ধরনের একটা নাম আমার মনে পড়ছে বটে। আমারই না কার যেন ছিল মনে হয়। বোধহয় আমারই ছিল—ঠাওর হচ্ছে। কিন্তু ইতিমধ্যে আমার ওপর দিয়ে বিস্তর যে ঝড়-ঝাপটা গেল—এই পোলান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, বেলজিয়াম, নরওয়ে—এইসব ধাক্কা চলে যাবার পর—এখন আমি সেই চেম্বারলেন নই। সামান্য লেন নই আর আমি—আমি এখন রীতিমতন চেম্বার রোড।’

ছত্রপতিকে স্বপ্নচক্ষে দেখে আমিও বিস্মিত হলাম। চেনা শক্তই বই কী! রোড না বলে ব্রডওয়েই বলতে হয়। এমনকী বাঁকা চোখে নয়, সোজাসুজি তাকিয়েও চেম্বার আভি New ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

চার্চিল বললেন, ‘বেশ, চেম্বারলেন না আসেন তিনি যদি চেম্বার রোড হয়ে থাকেন হোন গে—আপনি আমার সহযোগী স্ট্যালিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন। তা হলেই জানতে পারবেন, কে যুদ্ধ বাধিয়েছে। আমি নিজমুখে কিছু বলতে চাইনা। ইয়ারোপেই বা কারা যুদ্ধ বাধাল আর এশিয়াতেই বা কারা? এবং শুরু এস্তক কারা কেবল বাধা দিয়ে আসছে? হংকং, সিঙ্গাপুর, শ্যাম, মালয়, ব্ৰহ্মদেশ—এর কোনওখানে যদি আমরা যুদ্ধ বাধিয়ে থাকি, যদি তার প্রমাণ পান, তা হলে বলবেন আমায়। আরে মশাই, শত্রু কাছে এলে—শত্রুকে কাছাকাছি পেলে তবে তো যুদ্ধ করব? ডানকান থেকে আরাকান পর্যন্ত কোথাও যদি আমাদের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ করার এক ফোঁটাও কিছু পান তখন আমাদের বলবেন। আমরা কাটা কান ঢাকা না দিয়েই পাড়ার মাঝখান দিয়ে হাঁটছি— এবং সেজন্যে আমরা মোটেই লজ্জিত নই। যুদ্ধ আবার ভদ্রলোকে করে!’

চার্চিল চলে যেতেই স্ট্যালিন এসে হাজির।

ভগবান স্ট্যালিনকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন—কিন্তু অর্ধোত্থিত হয়ে, তক্ষুনি কী ভেবে বসে পড়লেন ফের। চেপেই বসলেন বেশ করে। স্ট্যালিন বেশি কথার লোক নন। চার্চিলের মতো তাঁর বাগ্মিতার বহর নেই। দু’কথায় নিজের কথাটি সেরে নিয়ে তিনি চলে গেলেন।

স্ট্যালিনের কাছ থেকে জানা গেল, চার্চিল নয়, হিটলারই এই যুদ্ধ বাধানোর জন্য দায়ী। এবং স্ট্যালিনের সামান্য বিবৃতির ভেতর থেকেই হিটলারের স্বরূপ জানতে তাঁর বিশেষ অসুবিধা হল না।

ভাবগ্রাহী জনার্দন তো!

হিটলারও এল সবশেষে।

কিন্তু ভগবান হিটলারকে দেখে উঠে খাতির করা দূরে থাক, নিজের চেয়ারে দিব্যি গ্যাঁট হয়ে বসে রইলেন। একটু নড়লেন না পর্যন্ত। বসতেও বললেন না তাকে।

হিটলার হাত-পা নেড়ে হই-চই করে কী যে বলল, তার একবর্ণও আমাদের মগজে ঢুকল না। ডান কান দিয়ে ঢুকে আরাকান হয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু কিছু বোঝা না গেলেও এই যুদ্ধ যে সে-ই বাধিয়েছে, তার দৃশ্যনাট্য থেকেই, সেকথা বুঝতে কোনও বেগ পেতে হল না। হি ওয়াজ প্রোটেস্টিং টু মাচ।

হিটলার অন্তর্হিত হলে দেবর্ষি নারদ ভগবানকে জিজ্ঞেস করলেন—’লীলাময়, তোমার লীলা বোঝা ভার! তুমি হেলশালাসিকে বা কেন অমন উপেক্ষা করলে, তাকে মাটিতে বসিয়ে রেখে মুসোলিনিকেই বা অমন আপ্যায়ন করলে কেন, আর চার্চিলের প্রতিই বা তোমার অতখানি খাতির কীসের? যদি বলো যে ভদ্রতার খাতির, তা হলে স্ট্যালিনের বেলাই বা তার অন্যথা হয় কেন—আর হিটলারের বেলায় তোমার এই ভদ্রতাবোধ উপে যায় কোথায়? এর রহস্য বিশদ করে জানবার আমার বাসনা হয়, দয়াময়।’

দয়াময় মুচকি হেসে বললেন—বৈকুণ্ঠে শুয়ে স্বপ্নযোগে সেই কথামৃত আমি শুনলাম)—’হেলশালাসির কথা তুমি বোলো না। যা কালো রং! ওর সঙ্গে ভদ্রতা-অভদ্রতার কোনও কথাই ওঠে না। আর সেই কারণেই মুসোলিনির প্রতি ভদ্র না হয়ে পারা যায় না। তা ছাড়া মুসোলিনিকে ভয় কীসের? দেখতে মুষলপ্রায় হলেও ওকে হটাতে বেশিক্ষণ লাগে না। ও আমার কোনও ক্ষতি করতে পারত না—সেইজন্যই ওর সঙ্গে একটু ভদ্রতা করলাম। আর চার্চিলকে খাতির করতেই বা বাধা কী? ওদের অগাধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য—সেইটুকু কোনওরকমে বজায় রাখতে পারলেই ওরা খুশি—তার বেশি ওদের খাঁই নেই আর। কিন্তু স্ট্যালিন! বাবা, ওকে মোটেই বিশ্বাস হয় না। উঠতে গিয়েই তক্ষুনি বসে পড়েছিলাম কেন জানো? যদি সুযোগ পেয়ে সেই ফাঁকে আমার গদি পালটে দ্যায়? দুনিয়ার হাল-চাল বদলে দেয় যদি? আর হিটলার বাপ্স! ওর কাছে তুমি ভদ্রতা রক্ষা করতে বলছ? ওর সামনে উঠলে কী আর রক্ষা ছিল? তক্ষুনি সে আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই আমার চেয়ার দখল করে বসত না? যা ওর হুমকি—দেখলে তো৷ তেমনি ওর রাজত্বের লোভ! বাবাঃ! তা হলে কী আর আমায় দেখতে পেতে এখানে? ওরই কোন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই আমাকে অদর্শন হতে হত এতক্ষণ!’

স্বপ্নপথে এই পর্যন্ত এগিয়েছি, এমন সময়ে কর্ণকুহরে বিক্রমের ‘দ্বার খোলো, চা এনেছি’, কুহরিত হতে লাগল। ওর চেঁচামেচি বন্ধ করার জন্য বাধ্য হয়ে উঠে দরজা খুললাম।

প্রকাণ্ড ট্রে হাতে প্রবেশলাভ করলে দেখা গেল সে ঢের কমিয়ে বলেছে; চা, কফি, কোকো, তিনটেই সে বানিয়েছে। কোনটা আমরা সকালে পান করি জ্ঞান না থাকায় তাকে যে ক’টা পেয়েছে সবই সে পানীয়ে প্রযোজনা করেছে। এবং প্রত্যেকটাই তিনজনের মতো, অঢেল পরিমাণে!

কিন্তু কোনটা খাই? কাকে ফেলে কাকে নিই? কাকে রাখি কাকে চাখি? বিক্রমই উপায় বার করল—চা, কফি, কোকো, দুধ আর চিনি মিলিয়ে অদ্ভুত এক পাঞ্চ বানাল, ওর দাদার নাকি পাঞ্চ ভারী পছন্দ, আমরাও তাই গরম গরম সেই পাঞ্চ খেলাম।

বিক্রম-সম্পাদিত সেই পঞ্চামৃত খেয়ে সারাদিন আমাদের কারও খিদে পেল না, আর কেমন গা বমি বমি করতে লাগল। কিন্তু বিক্রম খুব খুশি, স্বদেশে থাকতে ক্ষুধাহারী এই সুধা কেন সে আবিষ্কার করতে পারেনি এই শুধু তার আপশোস। তা হলে কেবল তার একার নয়, আর পাঁচজনের জন্যও এই পাঞ্চজন্য ছাড়তে পারত—

সারা মগের মুল্লুকের মগে মগে যার সাড়া ছড়িয়ে পড়তে দেরি হত না। কাল আবার সে এই মিশ্র পানীয় বানাবে, আমাদের শাসিয়ে রেখেছে। এমন সুপেয় নাকি আর হয় না। দয়ানিধি আমাদের রক্ষে করুন!

বিছানায় শুয়ে শুয়েই আওয়াজ পাচ্ছিলাম পাশের ঘরে বিক্রম আওড়াচ্ছিল— ‘আপনি তো বলছেন খালি হ্যালো আর হ্যালো, কিন্তু কত আর হেলব মশাই। হেলতে হেলতে তো মাটিতে শুয়ে পড়েছি পেরায়, আবার কোথায় হেলব?’

বলে কী বিক্রম! কীসের হেলাফেলার কথা বলছে ও? না, আর অবহেলা করা গেল না। সকালে সুখশয্যা ফেলে উঠতে হল।

পাশের ঘরে গিয়ে দেখি টেলিফোনের রিসিভার হাতে নিয়ে বিক্রম ধরাশয্যায় প্রায় অর্ধশায়ী।

‘কী হচ্ছে বিক্রম?’

‘এই দেখুন না! এই ভদ্রলোক। ক্রিং ক্রিং করতেই টেলিফোনের সাড়া দিয়েছি, কিন্তু উনি আর কোনও কথা নয়, খালি বলছেন, হ্যালো আর হ্যালো! কিন্তু কত আর হেলা যায় বলুন?’

‘দেখি তো আমি—’ ওকে নিষ্কৃতি দিয়ে রিসিভারটা নিয়ে কর্ণপাত করলাম.. ‘হ্যালো। কে কথা বলছেন আপনি?’

টেলিফোনের আওয়াজ: ‘এটা কি হগসাহেবে বাজার?’

‘কী বলছেন?’

‘এটা কি আপনার হগসাহেবের…?’

‘হগসাহেবের বাজার, ওরফে নিউমার্কেট… তাই কি চাইছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আজ্ঞে না। রং নম্বর।’ বলে রিসিভার রেখে দিলাম।

ইচ্ছে হল একবার টেলিফোন-অপরেত্রীকে ডেকে বলি কথাটা।

‘কেন রং দিলি এ ঢং করে’ গানের কলিটা তার কানের ওপর দেগে দিই একবার, কিন্তু ভেবে দেখলাম—লাভ কী? দূরভাষিণী মেয়েদের বেশির ভাগই রং-কানা, সে কথা আমার মতন কার আর বেশি জানা? দুনিয়ার যত রং নম্বর তারা আমাদের ঠিকানাতেই ছেড়ে দেয়—সারা দিন-রাত এত্তেলা দিতে দিতেই চলে যায় আমার—লিখতে বসার ফুরসত পাইনে। কিন্তু সত্যিই কি কোনও প্রতিকার নেই এর…?

আবার টেলিফোন ক্রিং ক্রিং করে গর্জে ওঠো।…

‘হ্যালো…?’

‘এটা কি হগসাহেবের বাজার?’

সেই কণ্ঠস্বর—সেই ব্যক্তিই আবার। আবার সেই রং নম্বর।

নাঃ, এবার অন্য পথ ধরতে হবে। বিষ দিয়েই বিষক্ষয় করা যায় কি না… দেখা যাক। ‘হ্যাঁ, বলুন, কী চাই আপনার বলুন?’

‘আমার কতকগুলো ডিমের দরকার ছিল।’

‘কী বললেন? সীমের দরকার? আজ্ঞে, এটা তো তরকারির বাজার নয়। আমাদের হচ্ছে চুড়ির দোকান।’

‘চুরি? চোরাই কারবারের কথা বলছেন?’

‘আজ্ঞে না। চুরি করা নয়। চুড়ি পরার ব্যাপার। এখান থেকে হকাররা চুড়ি কিনে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফিরি করে—বাড়ি বাড়ি চুড়ি পরায়। আপনি কোনও ফেরিওলা?’

‘নন্ সেন্স!’

‘কী বললেন—রাজি আছেন? তা হলে আবেদনপত্র হাতে চলে আসুন চটপট। কিন্তু তার আগে একটা কথা…’

‘কীসের কথা?’

‘কথা এই যে আপনার চেহারাটা কেমন? চুড়ি ফিরি করা যার-তার কম্ম নয় মশাই! চেহারাটা একটু ছিমছাম—চলনসই হওয়া চাই। বেশ স্মার্ট হওয়া দরকার। একটু ফিটফাট থাকাও চাই সঙ্গে সঙ্গে। কেবল চেহারাটা বেশ নয়, বেশভূষার পারিপাট্যও বাঞ্ছনীয়। নইলে, যার-তার হাতে মেয়েরা চুড়ি পরতে চাইবে কেন? পাণিগ্রহণের ব্যাপার, বুঝলেন কি না! আর কেমন ওসব পাণি, বুঝতেই তো পারছেন!’

‘ড্যাম ইওর চুড়ি।’

‘তা যা বলেছেন! একেবারে ছ্যাডাং ড্যাডাং ড্যাম। গলিতে গলিতে চুড়ি পরাতে গিয়ে অনেক সময় নরবলি হয়ে যায় বই কী! চুড়ি পরানোর ফাঁকে হৃদয় চুরি হয়ে যায় মশাই—এই পাণি গ্রহণ সেই পরম পাণিগ্রহণে গিয়ে দাঁড়ায়। একেবারে মোক্ষম ব্যাপার। তা তাকে আপনি সম্প্রদান বা বলিদান যাই বলুন!’

‘কে বলছে সেকথা?’

‘সেই কথা বলছেন? সাধারণত দুপুর বেলার দিকেই এই কাজটা—সে সময়টা বাড়ির কর্তারা বাইরে থাকেন সব। রবিবারটা বাদ—বিলকুল বরবাদ। সেদিন ছুটির দিন— কর্তারা সব বাড়ি থাকেন সারাদিন, সেদিন চুড়ি নিয়ে ছুটোছুটি করে লাভ নেই। সেদিন স্বচ্ছন্দে আপনি আপনার অন্যান্য কাজকম্ম…।’

‘চোর কাঁহাক্কা!’

‘স্বচ্ছন্দে। রোববার দিন চুড়ির কারবার বন্ধ। সেদিন চুড়ি নিয়ে কোনও মেয়েকে পীড়াপীড়ি—কোনও মেয়ের পাণিপীড়ন করতে বলব না আপনাকে আমরা।’

‘শাট আপ।’

‘সেদিন আপনার পকেট কাটার কাজ স্বচ্ছন্দে আপনি করতে পারেন। অন্য চুরিচামারিও চলতে পারে। কোনও বাধা নেই। আমরা তাতে আপত্তি করব না।’

‘কে চেয়েছে চুরি করতে? কে? শুনি?’

‘কে চায় না? অনেক বড় বড় বাড়ির ছেলে—অনেক মিত্তির বোস চকরবরতি—বহুৎ বড়লোক মেজলোক ছোটলোক—আমাদের এই ফিরির ফিকিরে জড়িত রয়েছেন, খবর রাখেন তাঁর? আপনি তো ভারী! বলি, কাজখানা কেমন? চুড়ি পরানোর সাথে সাথে মন চুরি পর্যন্ত হতে পারে—জানেন তো? অবশ্যি পরাতে জানা চাই। নরম নরম হাত আর হাতে হাতে লাভ। একেবারে নগদা-নগদি। বলি, ওমর খৈয়াম পড়েছেন?—’নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক।’—

নেপথ্যবর্তী (কিঞ্চিৎ ক্ষুন্ন কণ্ঠে): ‘জানেন, আমি একজন অধ্যাপক? আমার বয়স পঁয়ষট্টি বছর?’

‘তা হলে পঁয়ষট্টি দিন। কোনও আশা নেই আপনার। আপনাকে আমাদের দরকার হবে না। কোনও মেয়েই আপনার হাতে চুড়ি পরতে—মানে, আপনার সঙ্গে চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হতে চাইবে না।’

‘তা হলে উপায়? আমার যে এক কুড়ি ডিমের খুব প্রয়োজন ছিল?’

‘আচ্ছা দাঁড়ান একটু। আমাদের পাশেই এই মার্কেটের এনকোয়ারি আপিস—তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দিচ্ছি আপনার। তাদের কাছেই খোঁজ পাবেন সব। ধরুন একটুখানি।’

‘আঃ, বাঁচালেন মশাই। কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব—’

টেলিফোন রেখে একটু হাঁফ ছেড়েছি, বিক্রম প্রশ্ন করে বসল—’লোকটাকে তুমি-চুরি করতে বললে বাবা? কাজটা খুব খারাপ হল না?’

‘হ্যাঁ, বললেই শুনছে কিনা সে। চুরিতেই থেমে থাকবার পাত্র কিনা কেউ!’

‘চুরির পর জোচ্চুরি করবে, তারপর বাটপাড়ি, তারপরে আরও ওস্তাদ হয়ে ডাকাতি রাহাজানি—কিন্তু সেইখানেই থামবে না। শ্রাদ্ধ গড়াবে আরও। আরও বহুত দূরে সে যাবে। সহজে নিরস্ত হবার লোক নয় কেউ।’

‘কিন্তু কাজটা—’ বিবেকের বৃশ্চিক বুঝি ওকে দংশন করতে থাকে।

‘বলি প্রথম ভাগ পড়েছ তো?’ আমি শুধাই, ‘পড়েছ প্রথম ভাগ?’

‘কে না পড়েছে? বাঙালির ছেলে হয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রথম ভাগ পড়ব না?’

‘প্রথমে কী পড়েছ? অজ আম। কিন্তু সেই অজ আম ধরেই কি কেউ বসে থাকে? তারপর আরও এগোয়। গোপাল অতি সুবোধ বালক, বেণী অতিশয় খারাপ ছেলে—এদের ছাড়িয়ে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত সেই মাসিতে গিয়ে—তার ফাঁসির কারণে পৌঁছে, তবে থামে।’

‘মাসি, তুমিই আমার ফাঁসির কারণ।’ পুলকিত হয়ে সে স্মৃতিসায়রের পঙ্কোদ্ধার করে।

‘তেমনি চুরি তো হাতে-খড়ি। তার থেকে গড়িয়ে সুধী ছাত্র শেষ পর্যন্ত ফঁসিকাঠে গিয়ে লটকাবে। ইতিমধ্যে সে ছিনতাই থেকে শুরু করে খুন-জখমের কিছু বাকি রাখবে না। ওই ভদ্রলোককেও থামানো যাবে না হয়তো।’

‘কিন্তু এত সব করতে না বলে ওকে কালোবাজারি করতে বললেই পারতে। তা হলে একচোটে সবগুলোই তাঁর করা হত।’

‘কালোবাজারিতে?’ আমি একটু বিস্মিতই, ‘কীরকম?’

‘সব জিনিসেরই কালোবাজার হয়। যেসব জিনিস খুব চালু, বাজার থেকে তুলে এনে লুকিয়ে রাখলে, তারপর চাহিদা বুঝে একটু একটু করে দ্বিগুণ, চারগুণ, আটগুণ দরে ছাড়তে লাগলে বাজারে—তার নাম কালোবাজার। জানো না বাবা?’

‘এই যুদ্ধের বাজারে কে না জানে?’ আমি বলি, ‘কিন্তু তুমি বার্মামুলুকের মানুষ হয়ে এ-খবর পেলে কোথায়?’

‘বার্মাতেও বেজায় কালোবাজার এখন। দুনিয়ার কোথায় নেই বলো? এক ব্যবসাদার রাজ্যের যত ওষুধ লুকিয়ে রেখেছিল নিজের আড়তে, তারপর ভারী দামে ছাড়ছিল—আমি দেখে এসেছি। সে-সব ওষুধ ফুরিয়ে গেল তখন সে ওই সবের ভেজাল বার করে কালোবাজারি দামে ছাড়তে লাগল—তাতে মনে করো, তার চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ফেরেববাজি সবই হয়ে গেল একসঙ্গে। ওই এক কালোবাজারেই। এমনকী, খুন-জখমও হল শেষটায়।’

‘খুন-জখমও?”

‘হ্যাঁ। তার ভেজাল ওষুধের ইনজেকশন নিয়ে কত লোক যে মারা পড়ল সঙ্গে সঙ্গে, কত জনার পক্ষাঘাত হল, তা বলা যায় না। এমনকী, অন্য অন্য জেলার তার আত্মীয়-বন্ধুরাও না জেনে সেইসব ওষুধ খেয়ে মরে গেল কত জনা। তাই বলছিলুম যে, এক কালোবাজারেই সব কিছু হয়ে যায়… তাই যদি লোকটাকে—’

এমন সময় টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং করে উঠল আবার।

রিসিভার ধরে সাড়া দিলাম—’হ্যালো?’

‘এই যে আপনি!’ পরিচিত স্বর আপ্যায়িত সুরে ধ্বনিত হল—’খবর নিলেন এনকোয়ারিতে আপনাদের? আমার যে এককুড়ি ডিমের বড্ড দরকার বললাম।’

‘সীমের কথা বলছেন তো?’

‘সীম! সীম নিয়ে আমি কী করব?’

‘কেন, কবিতা? কবিতাই করা যায় তো। স্বয়ং রবিঠাকুর করে গেছেন। সীমের মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর। আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।’

‘ধুত্তোর! আপনি কিচ্ছু জানেন না। ঠিক ও ধরনের কোনও কবিতাই নেই কবিগুরুর। আপনি উলটো বুঝেছেন। সীম হচ্ছে খাবার জিনিস। খাননি কখনও সীম?’

‘মনে পড়ছে না। তবে হিমশিম খেয়েছি বটে। অনেক খেয়েছি। হিমশিমও খাবার জিনিস মশাই! তবে একথা আমি বলব, এটা খেতে মোটেই তত ভাল নয়।’

‘সে কথা থাক। আপনি যে বললেন, মার্কেটের এমকোয়ারি অফিসের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করে দেবেন…?’

‘এই যে.. করে দিচ্ছে কনেকশন…(তার একটু পরেই হেঁড়ে গলায় হাঁক ছাড়ি) হ্যালো…

‘মার্কেটের এনকোয়ারি এটা?’

‘হ্যাঁ। পাবেন বই কী। কুকুরের গলার বগলসও পাবেন। তবে একটু খোঁজাখুঁজি করতে হবে—এই যা। নইলে হগসাহেবের বাজারে কী না মেলে?’

‘হগসাহেবের বাজারে যখন সব মেলে বলছেন তখন সামান্য আমার কুড়ি ফ্রেশ এগ্স্… তাও আমি পাব আশা করি?’

‘না, হগসাহেবকে পাবেন না। ফ্রেশ অবস্থাতে তো নয়ই। দুঃখের বিষয়, বহুকাল আগেই তিনি দেহরক্ষা করেছেন। তবে ফ্রেশ হগ আর ফ্রেশসাহেব আলাদা আলাদা পাওয়া যায় অনেক। নিজে এসে খুঁজতে হবে। খুঁজে পেতে নিতে হবে আপনাকেই।’

‘সাহেব নিয়ে আমি কী করব?’

‘তবে কি আস্ত একটা মেমই চাই নাকি আপনার?’

‘না না—মেম নয়…’

‘মেমও নয়, সাহেবও নয়, তবে কী? কুকুরের গলার বগলসও তো আপনি চান না?’

‘বগলস নিয়ে আমি কী করব? আমার বাড়িতে আজ একটা ছোটখাট ব্যাপার ছিল। সেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেই একটু…’

‘কুকুরের মাংস চাই সেই জন্যে? ভোজের জন্য কুকুরের মাংস?না মশাই, মাপ করবেন, এ মার্কেট থেকে ও জিনিস সরবরাহ করা হয় না। একটা ভবঘুরে কুকুর, পাঁঠার চেয়ে দামে শস্তা পড়বে কি না বলা কঠিন… আর ধরতে গেলে যদি সে কামড়ে দেয় তো অনেক টাকার ধাক্কা। না মশাই না। কুকুর ধরা আমাদের কাজ নয়। আপনি বরং সি এস পি সি এ-তে খবর নিন। আমরা পারব না। ও কাজে আমরা অপারগ। মাপ করবেন।’

‘কুকুরের মাংস কে চেয়েছে? আমার দরকার এক কুড়ি ডিম। বুঝেছেন? আমার চাই ডিম—ডিম…’

‘ডিন্ডিম—যা বাজে? ছেলেদের সেই খেলনা নাকি?’

‘না, বাজে ডিম চাইনে, ফ্রেশ এগ্স্। টাটকা ডিম। সীম নয়। ডিম। বগলস নয়, খাবার জিনিস। কবিতা বানাবার বস্তু নয় রাঁধবার। সীম নয় কিন্তু… বুঝলেন এবার?’

‘হিমশিমও নয়। তা সেটা রাঁধবার না হলেও খাবার বস্তু ছিল… আমার ভারী খটকা লাগছে, বুঝতে পারছিনে ঠিক ঠিক। আমার একজন ওপরওয়ালাকে ডেকে দিচ্ছিই—মার্কেট ইন্সপেক্টারকে। দয়া করে ধরে থাকুন খানিক…’

ওকে সদয় হতে বলে এ-ঘর ও-ঘর এক-আধ গাল ডালমুট চানাচুর চিবিয়ে গায়ের জোর বাড়িয়ে আবার ওর নাগালে আসি।

একটু ওঁচা গলায় হাঁক দিই এবার, ‘হ্যালো। আমি এম আই—’

অপর পক্ষ একটু হতচকিতই যেন, ‘এমাই!’

‘হ্যাঁ, এম আই, মার্কেন্ট ইন্সপেকটার। কী চাই আপনার?’

‘আমি গোটা কতক ডিম চাইছিলুম। এগ্স্।’

‘লেগ্স্?’

‘অ্যাঁ?’

‘লেগস চাই আপনার? বেশ তো, ক’জোড়া চাই বলুন? টাকা ফেললে কী না পাওয়া যায় এই কলকাতায়। বিশেষ করে এই হগ সাহেবের বাজারে। তা কীরকম লেগ্ স চাই বলুন—ছেলের না, বুড়োর, না—’

উক্ত ভদ্রলোক বাধা দিয়ে প্লুতস্বরে কী যেন বলেন বোঝা যায় না।

‘লেগের ভাবনা কী? যত দরকার—এনতার যোগানো যায়। এদেশে সবই তো লেগস মশাই, মাথা আর কোথায়? আমার ফর্টি ক্রোরস অফ হেডস না বলে এইট্টি ক্রোরস অফ লেগ্স বললেই খাটি সেন্সাস দেওয়া হয় না কি? কিন্তু একটা কথা, প্রত্যেক জোড়া পায়ের সঙ্গে একটি করে মাথা আপনাকে নিতে হবে। মাথার জন্য অবিশ্যি বাড়তি কোনও দাম লাগবে না, ওটা অমনি, ফাউয়ের মধ্যেই ধরতে পারেন।’

ওই আওয়াজ (আর্তনাদ)—’মাথার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’

‘সম্পর্ক থাক বা না থাক, আমরা তা পা থেকে ছাড়িয়ে আলাদা করতে পারব না। পা আর মাথা পৃথক—সে আপনার নিজের করে নিতে হবে—আমরা পারব না। দেশের আইনে বাধে কিনা। যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া অন্যত্র ও কর্ম গর্হিত বলেই গণ্য—ওকে নাকি খুন-খারাপি বলা হয়। আইনের এই ব্যবস্থা। অন্যায় ব্যবস্থা বলতে পারেন, কিন্তু আমরা তো আইন বানাইনি—কোনও আইন অমান্য আন্দোলনেও যোগদান করিনি এ পর্যন্ত।’

‘কী সর্বনাশ।’

‘তা যা খুশি বলুন। কঁসিকাষ্ঠে পা বাড়াতে পারব না। আমাদের এই শর্তে রাজি থাকেন তো অর্ডার দিন, যত ডজন আপনার লেগ্স দরকার এই দণ্ডেই যোগাচ্ছি। বয়েজ—অ্যাডালটস্—অ্যাডালটারেটেড —যে রকমের লেগ চাই…’

‘অ্যাডালটারেটেড…?’

‘হ্যাঁ, ভেজাল পা-ও পাওয়া যাবে বই কী! আজকাল আর কোন জিনিসের ভেজাল বেরোয়নি বলুন! পায়ের ভেজাল, মানে, একখানা কিংবা দেড়খানা কাঠের পা—তাও আমরা সরবরাহ করতে পারব। তবে তা তেমন সুস্বাদু হবে কি না সে বিষয়ে আমরা গ্যারান্টি দিতে অক্ষম।’

‘হরিবল !’

‘দামের কথা বলছেন? তা দামটা এখন ঠিক বলতে পারছিনা। আসল পা-র চেয়ে কেঠো পা-দর বেশি পড়বে কি না বলা কঠিন। যাক, সে আপনি বিলের সময় টের পাবেন। তবে এটুকু বলতে পারি, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের লেগসের দর একটু বেশি। বোধহয় আদর বেশি বলেই। গ্রোন আপ মেয়েলি পা-র আরও বেশি চাহিদা। আর দামটাও একটু—হেঁ হেঁ—একটু বেশি পড়বে বোধহয়।’

‘এনাফ! এনাফ! খুব হয়েছে। আর আমি বেশি শুনতে প্রস্তুত নই।আপনার ওপরওলা কর্মচারী কেউ যদি থাকেন তো অনুগ্রহ করে তাঁকে একটু ডেকে দিন।’

‘তা হলে ধরে থাকুন খানিক। খোদ মার্কেট সুপারিন্টেন্ডেন্টকেই খবর পাঠাচ্ছি, তিনি অবিশ্যি আমার চেয়ে আরও ওয়াকিবহাল—অনেক কিছু খবর রাখেন।’

‘তা হলে তাঁকেই ডেকে দিন দয়া করে। ধন্যবাদ–উঃ!’

রিসিভারটা রাখতেই বিক্রমের মুখ ফোটে—’ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের পায়ের দর বেশি কেন বাবা? কেন, ছেলেদের পা কি মাগনা?’

‘মাগ না-ই তো। ছেলেরা কি কারও মাগ হয় নাকি? ছেলেদের কি কেউ বিয়ে করে কখনও? এমন কিন্তু তোমাদের মগের মুল্লুকেও কেউ তা করে না নিশ্চয়?’ তুমি কাউকে দেখেছ কোনও ছেলেকে বিয়ে করতে?’

‘হ্যাঁ, দেখেছি।’

‘বলো কী হে?’ আমি হতবাক হয়ে যাই—’কাকে দেখেছ শুনি?’

‘কেন, আমার ছোট পিসিকে আর আমার ভাইঝিদের। তারা সবাই একেকটা ছেলেকে বিয়ে করেছে।’

‘তুমি ভারী বোকা!’ বলে আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করি—’মেয়েদের পা সামান্য নয়—এমনকী তারা তোমার মাগ না হলেও। তাকে বলে পদপল্লব—স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ সেই পা নিজের মাথায় ধরে ধন্য হতে চেয়েছিলেন—স্মরগরলখণ্ডনম্ মম শিরসি মণ্ডনম্ দেহি পদপল্লবমুদারম্।’

‘কিন্তু ছেলেদের পা কি একেবারেই কিছু না?’ বিক্রম তথাপি নিজের গোঁ ছাড়ে না। ছেলেদের পক্ষ নিয়ে পরোক্ষে নিজের পাওনাগণ্ডা বুঝে নিতে চায় বুঝি।

এক নম্বরের গোঁয়ার!

‘কিছু নয় কে বলেছে?’ তারও কিছু দাম আছে বই কী! তবে ছেলেদের পা-কে কেউ পদপল্লব বলে না। বলে যে ঠ্যাং!’

‘ঠ্যাং!’

‘হ্যাঁ। অপরকে ঠ্যাঙাবার জন্যই তার যা প্রয়োজন। ছেলেরা কিক করতে ওস্তাদ—তা ফুটবলেই কী, আর অবাঞ্ছিত কোনও লোককেই বা কী!’

‘কিন্তু ছেলেদের পা ঠ্যাং হতে যাবে কেন?’ বিক্রম তবুও অবুঝ।

‘ঠ্যাংঠেঙে বলে—আবার কীসের জন্য’ আমি বলি, ‘তোমার, ছেলেদের পা কি ওই মেয়েদের মতন সুন্দর?’

‘কেন, ছেলেদের পা কি দেখতে ভাল হয় না? ছেলেদের কি সুন্দর হতে নেই?’

‘কদাচিৎ। আর হলেও তখন তাদের শুধু হ্যান্ডসাম বলা যায়। কিন্তু মেয়েদেরকেই লেগসাম বলা হয়ে থাকে—তারা যেমন হ্যান্ডসাম তেমনি লেগসাম। যাক এ নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না। এর রহস্য বুঝতে তোমার এখনও ঢের দেরি আছে!…

বলে ওকে বাতিল করে দিয়ে আমি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ি, এতক্ষণ ধরে টেলিফোনে গলাবাজি করে গলদঘর্ম হয়ে পড়েছিলাম, বের হয়ে সটান কফি হাউসে চলে যাই। আলুভাজা আর কফি খেয়ে তাজা হয়ে সেলুনে দাড়ি কামিয়ে চুলচর্যা সেরে তারপরে আরেক কাপ কফি খেয়ে দেড় ঘণ্টা বাদে বাড়ি ফিরি। তারপর…

ঢুকতেই বিক্রমের গলা পাই, ‘বাবা, লোকটা এর মধ্যে পঞ্চাশবার হ্যালো হ্যালো করেছে…’

‘দাঁড়াও, সাড়া দিচ্ছি।’ বলে আমার শখের call কারখানায় যোগ দিই।

‘হ্যালো—হ্যালো—হ্যালো’, বেশ কড়া গলায় হাঁক ছাড়ি এবার।

‘ওঃ, হ্যালো,—আপনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট? মাপ করবেন, আপনাকে বিরক্ত করতে হল। কষ্ট দেবার আগে মার্জনা চাইছি। দুঃখের বিষয়, আপনার বাজারের একজনও আমাকে ডিমের খবর দিতে পারল না।’

‘ডিমের খবর? কেন আজকের স্টেটসম্যানেই তো আছে। আর স্টেটসম্যানেই বা কেন—সব কাগজেই তো রয়েছে—প্রত্যহই বেরোয়। আজকালকার যা কিছু খবর সবই তো মশাই, ডিমের খবর। ঘোড়ার ডিমের খবর সব। যাক, নমস্কার, আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভারী খুশি হলাম। নমস্কার—গুডইভনিং!’

ম্যাচের ইন্টারভ্যালে ক্লান্তদেহে বিছানায় এসে লম্বা হয়ে পড়েছি। ভাল করে সটানও হইনি, আবার ফের ক্রিং ক্রিং ক্রিং। স্খলিত পায়ে টলতে টলতে গিয়ে রিসিভারের হাতে ধরা দিই। একটু আগে কড়া গলার পার্ট হয়ে গেছে, এবার একটু মিঠে গলায় শুরু করা যাক। মৌমাছি-নিন্দিত মিহি সুরে আরম্ভ করলাম, ‘হ্যালো, কাকে চাই বলুন?’

‘রাজশেখরবাবু কি বাড়ি আছেন?—আপনি তাঁর কে?’

‘আমি? আমি তাঁর ভাগনি।’

কে রাজশেখরবাবু এবং কোন রাজশেখরবাবু যতক্ষণ না সম্যক বিদিত হচ্ছে ততক্ষণ তাঁর ভাগনি রূপেই বিরাজ করা যাক।

‘ও! আপনি তাঁর ভাগনি? আপনি ভাগ্যবান। আই মিন—ভাগ্যবতী। আমি আপনার মামার যে কী দুর্দান্ত ভক্ত কী বলব মশাই। ওঁর লেখা দারুণ ভাল লাগে আমার। কী করে লেখেন কে জানে, কিন্তু কী ভালই যে লেখেন!’

এতক্ষণে বুঝলাম, রাজশেখরবাবু ওরফে পরশুরাম। পরশুর থেকে আজকের রামে— অদ্যকার আরামে অনেকখানি তফাত। মাঝখানে গোটা গতকল্যটাই বাদ। তবু নিজের সৌভাগ্যে যতদূর সম্ভব গদগদ হয়ে জানাই, ‘এ বিষয়ে আমরা একমত। যদিও আমাদের মামা, তবু আমরাও তাঁর কিছু কম ভক্ত নই। ডেকে দেব তাঁকে?’

‘তাঁকে ডাকবেন? তাঁকে আর কেন ডাকবেন? তিনি কাজের লোক—তাঁর কাজের সময় নষ্ট করতে চাইনে। আমার—আমার তো কোনও কাজের কথা না, আমার হচ্ছে কথার কাজ। আপনি দয়া করে তাঁর কাছ থেকে জেনে আসতে পারেন?’

‘কী জানতে হবে বলুন?’

‘দেখুন, আমি একজন লেখক। লিখতে লিখতে একটা বানানে আমার আটকেছে। সেই বানানটা জানার জন্যই কলম ছেড়ে ফোনে হাত দিয়েছি।’

‘কীসের বানান?’ আমারও ফনায় হস্তক্ষেপ—কেউকেটা নয়, এক কেউটের—সাক্ষাত একজন লেখকের!

‘জরি বানানটা কী, জানা দরকার। ব-য়ে শূন্য র, না ড-য়ে শূন্য ড়। আমার গল্পের নায়ক জড়িপার কাপড় পরেই মুশকিল করেছে। অবশ্যি, তাঁর কাপড় খুলে নেওয়া যায় না যে তা নয়—’

‘না না। তা করবেন না। তাতে কাজ নেই। সেটা ভারী বিসদৃশ হবে। বস্ত্রহরণের নিয়ম—মানে, ছেলেদের বস্ত্রহরণের নিয়ম তো নেই, কিন্তু সে কথা থাক! আমি এক্ষুনি জেনে আসছি—দাঁড়ান।’ বাধা দিয়ে আমি জানাই।

যদি তেমন অসুবিধা না হয় কাপড় খুলে হাফ-প্যান্ট পরিয়ে দেব না হয়, তার কী হয়েছে।’

‘আচ্ছা, একটু ধরে থাকুন আপনি। এলাম বলে।’

ইতিমধ্যে পাশের বাড়ির একটি বালকের সাথে পাশ্চাত্য সমরকৌশল নিয়ে মিনিট পনেরো কূটতার্কিক আলোচনা চালিয়ে—তার মতে উক্ত রণনীতি সংক্ষেপে একটি সংস্কৃত কথার একান্ত অভিব্যক্তি ছাড়া কিছু নয়, ‘যঃ পলায়তি স জীবতি’ এই চলতি সংস্কৃতির পদাবলী সংস্করণ—ধাবমান পাদটীকা মাত্র। সাদা বাংলায়, রানিং ফুটনোট। এ বিষয়ে ওর বাগবিস্তারের যার-পর-নাই প্রতিবাদ করে ফের টেলিফোনের খপ্পরে ফিরে আসি। যথাসাধ্য রাজশেখরবাবুর মতো গলদেশ করে হাঁকি—’হ্যালো!’

‘ও। আপনি! রাজশেখরবাবু? আমার কী সৌভাগ্য!’

‘হ্যাঁ, শুনুন বানানটা তো আমি অফহ্যান্ড বলতে পারছিনে। চলন্তিকাখানাও আমার হাতের কাছে নেই এখন আবার। আপনি এক কাজ করুন বরং।’

‘বলুন—বলুন।’ ব্যগ্র স্বর।—’যা বলবেন করব।’

‘যা খুশি একটা ‘র’ বসিয়ে যান। কখনও ব-য়ে শূন্য কখনও বা ড-য়ে শূন্য— যখন যেটা মর্জি বা যেখানা হাতের কাছে এসে যায় তাকে বসান।’

‘কিন্তু তাতে কি ভুল হবে না? একটা তো ওদের ভুল নিশ্চয়ই?’

‘ভুল তো বটেই। সেইজন্যই ওদের ঘাড়ে, এক কাজ করুন, একটা করে চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দিন।’

‘চন্দ্রবিন্দু কেন?’ কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা।

‘তা হলে অন্তত অর্ধেক বাংলার ভোট তো আপনি পাবেন। সারা পুব বাংলার; ভুল হলেও তারা ভোট দেবে। আর ভোটারি থাকতে আপনার ভয় কী মশাই? বইয়ের কাটতি নিয়ে কথা, তা হলেই হল।’

‘কিন্তু ও-ছাড়াও অনেকটা সমস্যা আছে যে, শাবাশ কথাটা তো সংস্কৃত নয়—ওটায় আমি তালব্য শ ব্যাভার করলে কী—’

‘খুব দুর্ব্যবহার হবে। তার চেয়ে ওর স-স্থানে দু’জায়গাতেই—ছ আদেশ করে দিন। তা হলে বাকি বাংলার—পাকিস্তানি আধখানার হাততালি আপনার একচেটে রইল। আর কী চাই?’

‘ছাবাছ বলছেন?’

‘হ্যাঁ, ছাবাছ। আচ্ছা, নমছকার। আছি তবে।’

অদৃশ্য লেখককে উৎসাহ দিয়ে, নিজের বিছানায় ফেরত এসে—একেবারে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু কপালে কলঙ্ক থাকলে রেহাই কোথায়? কলিযুগ খতম হয়ে এখন কলের যুগ এবং টেলিফোনের কলেই তার যত কাকলি! কাজেই একটু বাদেই আবার সেই কলকলোচ্ছ্বাস।

এবার চৌকিটাকে টেলিফোন রিসিভারের কাছে টেনে নিয়ে আসি। তারপর শুয়ে শুয়েই সেই কলধ্বনিতে কান দিই।

‘এটা কি বুকিং অফিস?’ এবার ওধার থেকেই বাণীনিন্দিত আওয়াজ পাওয়া যায়। আমাকে শশব্যস্তে পাশ ফিরতে হয়।

‘কীসের বুকিং?’

‘রংমহল থিয়েটার কি এটা?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ—ঠিক ধরেছেন।’ অম্লানবদনে ধরা দি।

‘আসছে রবিরার ম্যাটিনির দুটো সিট দিতে পারেন আমায়?’

‘পারি বই কী। একটু দাঁড়ান, প্ল্যানটা দেখে নিয়ে বলি।… হ্যাঁ, পারি। একটা সিট হবে গ-বর্গে; স্টেজ থেকে থার্ড রো-য়ে বুঝেছেন? সেখান থেকে স্টেজের দৃশ্য অতি সুচারু।

‘আরেকটা সিট পাবেন আর একটু পিছনে। একেবারে থ-বর্গে সেখান থেকে স্টেজের ঘটনা একটু সুদূরপরাহত মনে হলেও কিছু কম উপভোগ্য নয়। সুদৃশ্যই বলা চলে, তবে সুশ্রাব্য কিছু হবে কি না তা বলতে পারি না।’

‘দুটো পাশের সিট হয় না?’

‘পাসের সিট? না, পাস আজকাল বিলকুল বন্ধ?’

‘না, পাসের কথা বলছি নে৷ দুটো সিট পাশাপাশি হয় কি না, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।’

‘পাশাপাশি সিট চাচ্ছেন কেন জানতে পারি?’

কিছুক্ষণ কোনও সাড়া নেই। মেয়েটি যেন থ-বর্গে গিয়ে পড়েছে মনে হয়। একটু পরে আমতা আমতা করে বলে, ‘আমরা দু’জন যাব কিনা, দুই বন্ধুতে।’

‘নিশ্চয় কোনও পুরুষ বন্ধু, অনুমান করি?’ আমার পুরুষ কণ্ঠ।

আবার চুপচাপ। ধাক্কাটা সামলে মেয়েটি অর্ধস্ফুট স্বরে বলে, ‘এখনও পুরোপুরি স্বামী হননি বলেই বন্ধু বলেছি। নইলে—নইলে—’ বলতে বলতে সে থেমে যায়।

‘নইলে স্বামিত্বে ওঁর কোনও কসুর নেই।—এই তো বলতে চাইছেন?’ আমার বলা।

মেয়েটি নীরব।

‘যাক গে, সে বিষয়ে আমাদের মাথা ঘামিয়ে লাভ? উনি স্বামীর যূপকাষ্ঠে যাবেন, কী, শেষে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন—তাতে আমাদের কী? তা আমাদের দেখবার নয়, কিন্তু এরকম ক্ষেত্রে পাশাপাশি সিট দিতে আমরা অক্ষম। কেননা, সুনীতি বজায়ের দিকটাও আমাদের দেখতে হবে তো। থিয়েটার খুলেছি তো কী! সমাজের প্রতি কোনও দায়িত্ব নেই আমাদের? ওধারে আবার সুনীতি সঞ্চারিণী সভা আছেন, শনিবারের চিঠি রয়েছেন— তাঁদের অমান্য করা যায় না।’

‘কিন্তু ধরুন, থ-বর্গে আমার সিটের পাশে’, মেয়েটি বলতে গিয়ে ফের থতমত খায়।

‘হ্যাঁ, দু পাশেই দু’জন পুরুষ পাবেন। কিন্তু তাঁরা আপনার অচেনা পুরুষ। একেবারে আনকোরা পরপুরুষ? তবে তাঁরা ভদ্রলোক নাও হতে পারেন।’

‘তা হলে?’ মেয়েটি তার বক্তব্যকে যেন বিশদ করতে পারে না।

‘কেন দেখতে আসছেন। আড়ালে বলি আপনাকে, যাস্সেতাই বই। নোংরা ব্যাপার। পচা সব সিনারি। অনর্থক পয়সা নষ্ট আর সময়ের বাজে খরচ। বাসি বিলিতি নাটকের অতিশয় বাজে নকল—আর অভিনয় এত রাবিশ যে বলা যায় না। তার সঙ্গে সিট-ভর্তি ছারপোকা। তার ওপরে পানবিড়িওয়ালার চিৎকার। অবিশ্যি, ক্ষতিপূরণস্বরূপ মাঝে মাঝে এক-আধটু নাচগান আছে বটে, কিন্তু তাও আবার অতি আধুনিক মারপ্যাঁচের—অর্থাৎ নাকিকান্নার সঙ্গে তুড়িলাফ। মানে হয় না, রাগ হয়। মোটেই সুবিধের নয়। তবে কিনা এসমস্তই কিস্তিবন্দি হারে—একটানা অসহ্যতা না—কিন্তু ছারপোকাটা আগাগোড়া। তার চেয়ে রবিবারের দুপুরটা আরাম করে বাড়িতে শুয়ে ঘুম লাগান—কিংবা পাড়াপড়শির সঙ্গে কোঁদল করে কাটিয়ে দিন, ঢের সার্থক হবে।’

শুয়ে শুয়ে হাত বাড়িয়ে রিসিভার-রক্ষার অপচেষ্টায় চৌকি থেকে গড়িয়ে পড়তে পড়তে কোনওরকমে বেঁচেছি। আধঘণ্টাও বাদ যায়নি, আবার সেই করাল কলকল নিনাদ। শুয়ে শুয়ে হাত বাড়াই—

ওধার থেকে আওয়াজ আসে, ‘হ্যালো!’ এধারে বিছানায় শুয়ে হেলাভরে শুনতে গেলে যা হয় তার চূড়ান্ত করে জানাই: ‘হ্যাঁ, হেলেছি। বলো। বলে ফ্যালো।’

‘হ্যালো। দেবতোষ? তুমি?’

‘দেবতোষবাবু পাশের ঘরে। ধরে থাকুন, তাঁকে ডেকে আনছি। কে ডাকছেন বলব?’

‘কিছু বলতে হবে না। শুধু বললেই হবে।’

‘আপনি কে বলুন?’

‘কী পাপ! বলো গে হরিহর।’

‘হ্যালো—হরিহর, কী খবর?’

‘উঃ, এত দেরি। পাশের ঘর থেকে পৌঁছতে বুড়িয়ে গেলে যে হে! শোনো—বোর্ডের মিটিংয়ের কথাই বলছি। ব্যালেন্স শিট সব তৈরি তো?’

‘সেই কর্মেই তো এতক্ষণ ধরে লিপ্ত ছিলাম হে!—’

‘ও! ভাল। শোনো। দেবেনের সাথে আমার কথা হয়েছে। মিলের শেয়ারগুলো এই বেলা আমরা ঝেড়ে ফেলতে পারি। এরপর যত চটপট পারা যায় লালবাতি জ্বালাতে হবে। কোম্পানিকে লিকুইডেশনে দিয়ে তারপর আমাদের অন্য কাজ।’

‘পাজি! বদমাশ কোথাকার!’

‘কী বললে?’

‘কই, আমি তো কিছু বলিনি।—বোধহয় আর কেউ আমাদের লাইনে জড়িয়ে পড়েছে।—(একদম হতচ্ছাড়া গলায়) এই উল্লুক!—মিয়াও!—ম্যাও!’

‘মশাই, শুনছেন? লাইনটা ছেড়ে দেবেন দয়া করে?—এটা বেড়াল ডাকবার জায়গা নয়! হ্যালো! হ্যালো!—যাক আপদটা গেছে। ভাল কথা, শোনো, ভুলো না যেন।…হ্যাঁ, কাল রাত্রে এলে না কেন হে? আমার নতুন আলাপিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতাম।’

‘কোনটি বলো তো?’

‘আমার নতুন বান্ধবী। একে তুমি দেখোনি এর আগে,—কুমারী মঞ্জু সেন। আনকোরা গ্ল্যাকসো কোম্পানি।’

‘লিকুইডেশনে দিয়েছ, না দাওনি এখনও?’

‘অ্যাঁ, কী বলছ?’

‘তোমার মতে, কোম্পানি মাত্রই তো লিকুইডেট করার জন্যে—তাই না?’

‘মঞ্জু সেন তেমন নরম মাটি নন। ওই নামের একজনের সাথে ছেলেবেলায় আমার—না, বলব না। ইস্কুলে পড়বার সময় ব্যাকরণ মঞ্জুষার সঙ্গে এক মঞ্জু সেনকে মুখস্থ করেছি। সে-ই কী? সে-ই বোধহয়, নাঃ, সেকথা বলে কাজ নেই। আন্টাচড গ্ল্যাক্সো তো। সেসব শুনলে তুমি খেপে যেতে পারো। সব কথা সবাইকে বলতে নেই। একা মঞ্জু সেনই একজনকে ইনসেন করতে যথেষ্ট!—আচ্ছা মিটিংয়ে তো দেখা হচ্ছে আবার, এখন গুডবাই।—’

একটু বিশ্রাম নিতে না নিতেই আবার টেলিফোন-ঝঙ্কার।

‘হ্যালো।’

‘চিফ মিনিস্টারের বাড়ি?’ একেবারে বাজখাঁই গলা এবার। উত্তর দিতে, দম নিতে হয়।

‘চিফ মিনিস্টারের বাড়ি কি?’ অপর ব্যক্তির পুনরুক্তি।

‘হ্যাঁ, ঝাউতলা হাউস। বলুন।’ আমি বলি।

‘আমি হক সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ নইলে এখুনিই পৃথিবীর চরম সর্বনাশ আসন্ন এমনই যেন ওর ভাবখানা।

‘প্রাইভেট সেক্রেটারি এখন একটু ব্যস্ত আছেন। তাঁর আরদালিকে ডেকে দেব?’

‘আরদালিকে আমার দরকার নেই। ইয়ার্কি পেয়েছ, ঠাট্টা হচ্ছে?’

‘এক মিনিট।’

অনেক অনেক মুহূর্ত চলে যায়। এর মধ্যে আমি এ-ঘরে ও-ঘরে কয়েক চক্কর ঘুরে আসি। এতক্ষণ ধরে আনাড়িদের পাল্লায় পড়ে খিদেয় নাড়ি চনচন করছিল এই সুযোগে কিছু মাখন-বিস্কুট আর পাঁউরুটি-জেলির শ্রাদ্ধ করে সবল হয়ে নি। তারপরে নবোদ্যমে ফিরে এসে ফের আবার দ্বন্দ্বযুদ্ধে যোগ দিই।

‘হ্যালো—হ্যালো—’

‘হ্যালো! কাকে চাই?’

‘হাউস সুপারিন্টেন্ডেন্টকে ডেকে দাও—এক্ষুনি—’

‘সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্বয়ং কথা বলছেন—’

‘শুনুন—আমি একজন এম-এল-এ। আধঘণ্টা ধরে আমি—’

‘দয়া করে অত চেঁচাবেন না। কিছু শুনতে পাচ্ছি নে।…হ্যাঁ, কী বলছ তোমরা বলো তো? শাখাওয়াৎ স্কুলের মেয়েদের পক্ষ থেকে চিফ মিনিস্টারকে বরণ করতে চাও?’

‘হ্যালো— ! আমি একজন—’

‘অত হ্যালো হ্যালো করবেন না। পাশের লোকের কথা শোনা যাচ্ছে না।

‘—হ্যাঁ,কী বলছিলে? বরণ করার কথা হচ্ছিল, তাই না? কিন্তু ওটা কি সংবরণ করা যায় না? চিফ মিনিস্টারকে কি না নিয়ে গেলেই নয়?…নিয়ে যাও, কিন্তু দেখো যেন কোনও মিসচিফ না ঘটে! অনারেবল হকসাহেব নতুন আর কোনও কুমারীর পাণিগ্রহণ করতে অক্ষম। যে কটির বর আছেন তাই তাঁর যথেষ্ট, তার চেয়ে আর বেশি রমণীয় হতে তিনি নারাজ। হকসাহেবের প্রতি যেন নাহক কোনও জবরদস্তি না হয়।’

‘কী—হচ্ছে কী? কান দিচ্ছেন এধারে? আমি একজন বেঙ্গল অ্যাসেম্ব্লির মেম্বার—এক ঘণ্টা ধরে গলা ফাটাচ্ছি—’

‘কোনও মিসচিফ হবে না বলছ তোমরা? হ্যাঁ, মিসচিফ বাঁচিয়ে৷ আমরাও সেটা চাইনে। এই চিফ-কে সামলাতেই আমাদের প্রাণান্ত, এর পর আর একজন চিফ জুটলে…’

‘বলি, হচ্ছেটা কী? হকসাহেবকে বলে তোমার পিণ্ডি চটকাচ্ছি দাঁড়াও!’

‘শুনে দুঃখিত হলাম। বলুন, কী বলতে চান—বলে ফেলুন চট করে।’

‘কিছু বলতে চাই না আপনাকে। আপনার মত উজবুককে কিছু আমার বলার নেই। তার কোনও প্রয়োজনও করে না। চিফ মিনিস্টারের প্রাইভেট সেক্রেটারিকে আমি টেলিফোনে পেতে চাই।’

‘সেক্রেটারিদের মধ্যে কোনটিকে আপনি চান?’

‘হ্যালো। আমি খোয়াজা সার নাজিমুদ্দিনের বাড়ি থেকে বলছি—’

‘কে খোয়া গেছে বললেন?’

‘খোয়া নয়—খোয়াজা। সাদা বাংলায় খাজা।’

‘খাজা। বটে। আমি খাজা? বটে বটে! খাজা বলে আমাকে গাল দিচ্ছেন? কিন্তু আমায় গালাগাল দেবার আপনি কে? কী আপনার অধিকার—শুনি একবার?’

‘আহা, আপনি কেন খাজা হবেন? খাজা হতে যাবেন কেন? আপনাকে আমি খাজা বলিনি।’

‘তবে কাকে বলেছেন জানতে পারি?’

‘যিনি খাজা তাকেই বলছি। খাজা সার—’

‘স্পষ্ট করে বলুন।’

‘সার নাজিমুদ্দিন।’

‘বানান করুন। বোঝা যাচ্ছে না ঠিক।’

‘N-A-Z-I-M-U-D-D-I-N’

‘ও। আমাদের খাজা সার নাৎসিমুদ্দিন! তাই বলুন।’

‘নাৎসি। নাৎসি কেন? নাৎসি কেন বলছেন? উনি কি নাৎসি?’

‘নতুন বানানে—আবার কেন? এন-এ-জেড-আই উচ্চারণ কী হয়? বাংলা খবরের কাগজ পড়েন না কখনও? হিটলারি বাহিনীদের কী বলে ডাকা হয়ে থাকে? তা, তিনি কখন খোয়া গেছেন বললেন? খুব সর্বনেশে কথা তো! পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে?’

‘তিনি খোয়া যাননি, তাঁর কোনও কথাও না। তাঁর বাড়ি থেকে আমি কথা বলছি।’

‘কী ভয়ঙ্কর লোক মশাই আপনি। সামান্য একটা দুয়ানি বাঁচানোর জন্যে—তুচ্ছ কয়েক পয়সার খাতিরে—অমনি টেলিফোন করার সুবিধে নিতে অদ্দুর অবধি গেছেন? কী সর্বনেশে লোক আপনি! ইস!’

‘কোথাকার বেল্লিক। জানো, তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ জানো? খান বাহাদুর খোদ আবুবকর সাহেবের সঙ্গে কথা কইছ জানো? তোমার বেয়াদবির জন্যে অ্যাসেম্ব্লিতে অ্যাডজুর্নমেন্ট মোশন আনতে পারি তা জানো? তুমি হকসাহেবের বাড়ির সুপারিন্টেন্ডেন্ট হও আর যাই হও।’

‘আপনি যে আসল অকৃত্রিম আবুবকর তা অনেক আগেই টের পেয়েছি জনাব। এতক্ষণের আপনার বকর বকর থেকেই!’

‘ইয়া আল্লা। (মিনিট দুই চুপচাপ—তারপর ধাক্কা সামলে)। হ্যালো..কে তুমি?..যদি হকসাহেরের হাউস সুপারিন্টেন্ডেন্ট হও, তোমার সঙ্গে আমি আর কোনও কথা কইতে চাই না।’

‘আজ্ঞে সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেবকে এইমাত্র কর্তা ডাক দিলেন। রিসিভার রেখে এই তো ওপরে গেছেন। ডেকে দেব?’

‘না না একদম না। চট করে যদি পারো এই ফাঁকে চিফ মিনিস্টারের প্রাইভেট সেক্রেটারিকে খবর দাও। বলো যে খাঁ বাহাদুর আবুবকর সাহেব—’

‘আর বলতে হবে না। আপনি কি চিফ প্রাইভেট সেক্রেটারিকে চান? না অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রাইভেট সেক্রেটারিকে? না ডেপুটি চিফ সেক্রেটারিকে আপনার দরকার? নাকি, সাব ডেপুটি চিফকে চাইছেন? কিংবা সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ডেপুটি চিফ সেক্রেটারিকে ডেকে দেব? সব সুদ্ধ আমরা ছত্রিশ জন সেক্রেটারি রয়েছি—পরস্পরের মধ্যে আমাদের বহুৎ পার্থক্য বুঝতেই পারছেন।’

‘আপনি—আপনি কে? কোন সেক্রেটারি?’

‘সেক্রেটারির দিক দিয়ে কিছু না। তবে বি-সি-এস-এর—বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের দিক থেকে আমিও একজন বই কী! আমাকে সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ডেপুটি বলা যেতে পারে। আমি হকসাহেবের সদর দরজার হেড কনস্টেবল৷’

‘আপনার দ্বারা—আই মিন—তোমার দ্বারা হলেও হয়তো হতে পারে। তুমি হয়তো এটা পারতে পারো। ব্যাপার এই—’

‘একমিনিট। এই যে চিফ মিনিস্টার নিজেই এদিকে আসছেন। আপনি তাঁর সঙ্গে কথা কইতে ইচ্ছুক কি? কোনও আপত্তি নেই? তাহলে তাঁকে বলুন। সত্যি বলতে আমি এখন একটু ব্যস্তই আছি।’

‘নিশ্চয়ই—নিশ্চয়ই।… হ্যালো।’

‘হ্যালো।…আমি চিফ মিনিস্টার….হ্যাঁ…ও। আবুবকর!…তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে ভাই, মিনিট খানেক সবুর করবে? ততক্ষণ আমি আমার সেক্রেটারির সঙ্গে কথাটা আগে সেরে ফেলি।’

(একেবারে গলে গিয়ে) ‘নিশ্চয়..নিশ্চয়। কোনও তাড়া নেই..তেমন তাড়া নেই আমার…যতক্ষণ লাগে আপনি সারুন…’

তদবস্থায় তাকে ত্যাগ করে আমি বিছানায় ফিরে আসি। খাবাহাদুরের তরফ থেকে যে টেলিফোনের আর কোনও তাড়না আসবে না তা স্থির। তিনি নিজেই নিশ্চয় করে জানিয়েছেন তাঁর কোনও তাড়া নেই—টেলিফোনে কান দিয়ে তটস্থ থাকবেন। ওইভাবে অনন্তকাল ধরে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কথামৃতের অপেক্ষা করলেও আমি অবাক হব না।

বিছানা আমার অভাবে খাঁ খাঁ করছিল। কিন্তু শুতে না শুতেই ফের কলোচ্ছাস। আবার কান খাড়া করে দাঁড়াতে হল। নাঃ, আবুবকর না, হরিহরও নয়, একেবারে আলাদা খাঁড়া। তবে হ্যাঁ, কল দেবার মতো গলা বটে, এমনকী, শোনবার মতোও বলা যায়।

হ্যাঁ, কলকণ্ঠ যদি বলতে হয় তো একেই।

মধুক্ষরা মেয়েলি গলাই বলে—’হ্যালো, মেঘেন বাবু—’ কলকণ্ঠী মেঘেন ভ্রমে আমাকে সম্বোধন করেন।

‘কে আপনি? কোথ্থেকে বলছেন?’

আমিও মেয়েলি গলা বার করি একখানা। ওর বীণা-বিনিন্দিতর জবাবে আমার বিনি-বিনিন্দিত সুর।

‘তুমি? তুমি কে?’ মেয়েটির স্বর বিস্ময়ে ভেঙে পড়ে—আমার উপকূলেই এসে ভাঙে।

‘মেঘেনবাবুর কোনও বোন-টোন ছিল বলে শুনিনি তো। কীরকম বোন?’

মধুঝরা গলা চাখতে না চাখতেই হুলভরা হয়ে ওঠে।

‘বোন আবার কীরকম হয়? ক’রকম হয় শুনি? বোনের ফের রকমফের আছে নাকি?’ আমি জানতে চাই।

‘মানে, মেঘেনবাবুর তুমি কেমন বোন? তার সঙ্গে তোমাৱ কি রক্তের সম্বন্ধ? নাকি—’ না-টা যে কী তা সে ভাষায় কুলিয়ে উঠতে পারে না।

‘রক্তের সম্বন্ধ কি মাংসের সম্বন্ধ তা তুমি মেঘেনবাবুকেই জিজ্ঞেস কোরো না হয়। আমি তো জানি বোনের সঙ্গে হচ্ছে অস্থির সম্বন্ধ। এই আছে এই নেই—সম্বন্ধ আছে কি না তাই টের পাওয়া দায়। সর্বদাই অস্থির। শ্বশুরবাড়ি একবার গেলেই হল।’

‘তা বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর জন্যেই তো বোন। বোন নিয়ে কি কেউ বাস করে নাকি?’

‘অন্তত নিজের বোন নিয়ে তো নয়। বনবাসী হতে হলে—হ্যাঁ, কিন্তু সেসব ক্ষেত্রেও আমার তো মনে হয়, বোনের কোনও অস্তিত্বই নেই—অস্থিত্বই সার। বোনের সবটাই হার—হার বা হাঢ় যা বললা। সেখানে জেতার কোনও কথাই নেইকো। সেইজন্যেই বলছিলাম ব-য়ে ও-কার ন বোন, বা বি-ও-এন-ই বোন একই কথা—বোন সর্বদাই অস্থি-র, কেননা, কখনই সেই বোন, একজনের নয়—অনেকেরই, যাকে বলে ‘বোন অফ কনটেনশন’। অবিশ্যি, আমি মেঘেনবাবুর সে রকম বোন কি না তা আমি বলতে চাই না।’

‘বুঝেছি, আর বলতে হবে না—’ মেয়েটির গলা মেঘলা হয়ে আসে—গুরু গরজানি শোনা যায় এবার, ‘মেঘেনবাবুকে বলে দিও, একজন ফোন করেছিল, সে আর ফোন করবে না।’

‘আহা চটছ কেন ভাই। রাগ করে কি? ছি! আমি মেঘেনবাবুর সে রকমের বোন নই।’ আমি চাটুবাক্যে চটপট সন্দেহ-ভঞ্জনের চেষ্টা করি—ওর এই উচাটন দূর করতে চাই।

‘মেঘেনবাবুর মা-র পেটের কোনও বোন কখনও ছিল বলে জানতুম না তো।’ ঘুরে ফিরে ওর মুখে সেই এক কথা। ‘তুমি কি ওঁর মামাতো বোন?’

‘না। মামাতো বোন নই, মাসতুতো বোন নই, পিসতুতো বোন নই, কিসতুতো বোনও না—’

‘কীসের কথা বললে?’

‘কিসের কথা বললাম তো। কে-আই-ডবল-এস—কিন্তু সে সম্পর্কও মেঘেনবাবুর সঙ্গে নয় আমার।’

‘মাগো, কী কথার ছিরি!’

‘পাড়াটে বোন নয়, ভাড়াটে বোনও না—এমনকী, ‘নিজের চেয়ে পর ভাল পরের চেয়ে বোন ভাল’—বলে যে বোনের এত অপরিমিত প্রশংসা শোনা যায়, পরীর মতো পরের সে বোনও আমি নই।’

‘কী বললে? পরের বোন! পরের বোনের চেয়ে ভাল—হ্যাংলা ছেলেদের কাছে আর কী আছে।’ সে বলে।

‘তা বটে। দূরের মাঠ যেমন আরও সবুজ, পরের বোন তেমনই আরও মধুর।’— বনানীয় গভীরতায় আমার অনুপ্রবেশ।

‘তুমি কি মেঘেনবাবুর সেই রকমের বোন নাকি?’

‘পরস্মৈপদী বোন বলছ? না, তা নয়। সে-রকম বোন খুব বেশি দিন পর থাকে না— বোন ধুয়ে গিয়ে ক্রমেই বন্ধু হয়ে পড়ে—শেষে, উপসংহারে, Fool-শয্যায় ফেলে পরাস্ত করে দ্যায়। না, আমি কারও তেমন বোন নই—এবং হতেও চাইনে। তবে আমি মেঘেনবাবুর ঠিক মায়ের পেটের বোন না হলেও তাঁকে আমার সহোদর বলতে বাধা নেই। অভিন্নহৃদয় বলে একটা কথা শুনেছ তো। তেমনি আমার অভিন্ন-উদর।’

‘হয়েছে, হয়েছে, দয়া করে একটু মেঘেনবাবুকে ডেকে দেবে—বলবে যে, রনু ডাকছে।’ তারের এপারে থেকেও যেন তার স্বস্তির নিশ্বাস শুনতে পাই। এতক্ষণ পরে।

‘সেকথা বললেই হয়। ফুরিয়ে যায়। তা না, কী বোন, কার বোন, কেন বোন—এই সব বোনের কান্না—এত অরণ্যে রোদন কেন রে বাপু!’ এই বলে আমি নব মেঘদূত হয়ে মেঘেনবাবুর অন্বেষণে বেরোই—এক call পান্ত পার হয়ে!মেঘেনবাবুর কিন্তু মুহূর্তও বিলম্ব হয় না—খবর দিতে না দিতেই তিনি হাজির। রনু-কুলের প্রতি তিনি যে স্বভাবতই অনুকূল সেটা বেশ বোঝা যায়।—’হ্যালো!’

‘আমি রনু। রঙমহলে ফোন করেছিলাম। ম্যাটিনি শো-র দুটো পাশাপাশি সিট কিন্তু পাওয়া গেল না—’

‘তা রবিবার না হয় অন্যদিন হবে। রাত্তিরের শো-য় গেলেই বা ক্ষতি কি?’

‘না। রাত্তিরে হয় না। তা ছাড়া, আর হবেই না। কোনওদিনই হবে না বোধহয়। সুনীতি চাটুজ্যের কী একটা সভা ভারী গোল বাধিয়েছে। পাশাপাশি সিট ফর এভার দুর্লভ। তাই অন্য কোনও থিয়েটারেও আর খোঁজ নিইনি। তা হলে কী হবে বলুন তো?’

‘সিটি বুকিং-এ খুঁজেছিলে?’

‘কোথায়? কোথায় বললেন?’

‘রেলওয়ে বুকিং অফিসে। বোম্বে মেল, ম্যাড্রাস মেল, তুফান মেল ইত্যাদিতে হয়তো পাশাপাশি সিট পাওয়া যেত।’

‘মেঘেনবাবু আপনি—আপনি কি—?’ রনু যে আকাশ থেকে পড়ছে তার অনুরণন থেকেই বোঝা যায়।—’কী বলছ তুমি? সত্যি বলছ? মেঘেন, আমরা কি—ইলোপ করব আমরা?’

‘আপনি’ থেকেই এক ঝটকায় সম্পর্কটা আপনা-আপনির মধ্যে এসে দাঁড়ায়।

‘ইলোপ হয়তো বলা যায়, কিন্তু বিলোপ নয়। মানে কিনা—কী বলে গিয়ে—এই ইয়ে অবধি আমরা এগোব— কিন্তু বিয়ে নয়।’

‘তা মানে?’

‘অচিন্ত্যর ‘বিবাহের চেয়ে বড়ো ‘ পড়েছ নিশ্চয়—সেইরকম অচিন্ত্যনীয় কিছু একটা করলে কেমন হয়?’

‘আচ্ছা—সে তখন দেখা যাবে। গাড়িতে একবার চাপা যাক তো—তখনকার কথা তখন। আচ্ছা, তাহলে তাই ঠিক রইল। একটু দাঁড়াও—টাইম টেবিলটা দেখে বলে দিই তোমায়।—রবিবার হাওড়ায় সন্ধে সাতটায় পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে যে গাড়ি ছাড়বে তার প্রথম ফার্স্ট ক্লাসের কামরায় আমি অপেক্ষা করব। কিন্তু জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতে পারব না। যদি চেনা লোকের চোখে পড়ে যাই। তুমি সোজা এসে কাময়ায় ঢুকে পড়ো। দুটো টিকিট কেটে রাখব—সুদূর কোনও স্টেশনের। গাড়িটা হচ্ছে ম্যাড্রাস মেল—সেতুবন্ধ পর্যন্ত যাওয়া যায়। সে যাক, কোথায় যাচ্ছি তা গাড়িতে উঠেই জানতে পাবে। তুমি উঠবে গাড়ির গোড়ার থেকে প্রথম ফার্স্ট ক্লাস কামরা যেটা সেইটেয়, মনে থাকবে তো?’

‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট—এই তো? এ আর মনে থাকবে না? বেশ, আমিও তাহলে গাড়ি ছাড়বার ঠিক আধ সেকেন্ড আগেই উঠব—।’

‘বলি হ্যাঁগা, কার সঙ্গে এত কথা কইছ এমন করে?’ কল্পনা পাশে এসে দাঁড়ায়।—’কী এত কথা বাপু তখন থেকে?’

‘এই—এমনি একটু বাক্যালাপ করছিলাম আর কী।’ রিসিভার রেখে আমি বলি।

‘কার সঙ্গে এত কথা গো?’ ও জিজ্ঞেস করে।

‘যার তার সঙ্গে—কিছু কী ঠিক-ঠিকানা আছে। আর একজন কী? সকাল থেকে খালি রং নম্বরে ছিলাম। নিখরচায় একটু মজা করে নেওয়া গেল।’

‘ও!’ কল্পনা একটু মুখ টিপে হাসে মাত্র।

কলকলধ্বনি থামার সাথেই আমার বুক গুরু গুরু করে। ট্রেনের চাকার আওয়াজ শুনি—বুকের ওপর দিয়ে লাইন চলে গেছে—আমারই বুকের ওপর দিয়ে। চলেছে সেতুবন্ধের দিকে—সেই mad-rush mail, ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট—ঘট ঘটাং—আসন্ন মেলনের—মেল দুর্ঘটনার ইঙ্গিত বয়ে ঘনঘটা করে চলেছে গাড়িটা।

তার চাকার ঘট্টিকাব্য থেকে দেখতে দেখতে আরেক সুর বেরিয়ে আসে: ‘রেলের ভ্রমণ কি আপনার এতই জরুরি—।’এবম্ প্রকার শুনতে পাই। যুদ্ধ-বার্তাবহ সামরিক বিজ্ঞাপন, রেলের চাকায় ভাষান্তরিত হয়ে আমার অন্তরে সাড়া জাগায়।

না, এমন কিছু জরুরি নয়, জরুর এমন কোনও প্রয়োজন আমার নেই। কল্পনাই রয়েছে, ইহকালের ক’টা দিন কল্পনার দ্বারাই কাটানো যায়। অন্য কোনও দারার প্রয়োজন নাস্তি।

রেলের ভ্ৰমণ। না, কী এমন জরুরি। নিজের ভেতর থেকেই তার জবাব পাইঃ জরু-র তো এমন কিছু প্রয়োজন আমার নেই। বাড়তি জরু, মানে, জরুর বহুবচনে আরও স্ত্রী-বুদ্ধিতে প্রিয়জনতা কি কিছুমাত্র বাড়ে? গোদের উপর বিষফোঁড়া হলে কি আরও বেশি আরাম? আমার অভিজ্ঞতায় তার কোনও সায় পাই না।

যুদ্ধের রক্তপতাকাটা শুধু সীমান্তেই উঠছে না, নারীর সীমান্তেই নয় কেবল, দেশবিদেশ, ঘর-বার, আত্ম-পর নির্বিভেদে যুদ্ধভূমি। দশদিক থেকে অফুরন্ত আক্রমণ—নিস্তার কোথায়?

বার্থ কন্ট্রোল করেই যে বাঁচা যাবে তার জো কী? কিছুটা অন্তত রেহাই পাব ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু পেলাম কি? যার বার্থ রিজার্ভ করা আছে সে আসবেই—এক পথে না হলে অন্য পথে—বার্থরাইট কারও কিছু যাবার নয়। নিজের বিক্রমেই এসে উপস্থিত হবে। উপায় কী? মেরি স্টোপ্সকে এ নিয়ে বকতে যাওয়া বৃথা, শিশু ভোলানাথের হচ্ছে মেরি স্টেপস। কোথায় কীভাবে কখন তাঁর পদক্ষেপ হবে কেউ তা বলতে পারে না।

বিক্ৰম ক্রমে ক্রমে আধুনিক নৃত্যকলার ন্যায় পরিস্ফুট হতে লাগল। কল্পনার রণাঙ্গনে গিয়ে হানা দিল পর্যন্ত।

‘কী রাধছ মা?’

‘মাছের ঝোল।’

‘ভারী গন্ধ ছাড়ছে।’

কল্পনা কী কাজে রান্নাঘর থেকে একটু নড়তেই সে নিজে খুন্তি নিয়ে তৎপর হয়েছে। একগাদা তেজপাতা, আধকৌটো জমানো দুধ আর গুচ্ছের উচ্ছে ছেড়ে দিয়েছে ঝোলের মধ্যে। কল্পনা ফিরে আসতেই সগর্বে জানিয়েছে—’এখন আর ছাড়ছে না।’

ওর পোষ্যপুত্ৰত্বে আমি কিন্তু ভারী কাহিল বোধ করছিলাম। প্রতিবেশী অনুকূলবাবুর ঘাড়ে ওকে গছানো যায় কি না বাজিয়ে দেখলে হয়। বললাম গিয়ে একদিন, ‘এত বড় একটা মন্বন্তর গেল কারুক্কে একদিন একবেলা খাওয়ালে না। এ রকম সুযোগ জীবনে আর আসবে? একাধারে পুণ্যার্জনের আর নামার্জনের? সেই সঙ্গে চাল মেরে অর্থার্জনের কথাটা না হয় নাই ধরলাম। সরকারি চাল আর বেসরকারি ভাঁড়ার সবার ভাগ্যে তো সব সময় জোটে না ভাই। যাই হোক এখন একজন ইভ্যাকুয়ীর ভরণপোষণের ভারটা নাও অন্তত।’

‘নিয়েছি তো। দু’জন দুর্ভিক্ষ-পীড়িতের নিয়মিত ভরণপোষণের ভার নিয়েছি।’

‘অ্যাঁ !’ শুনে আমি হাঁ হয়ে যাই।—’বলো কী হে?’

‘হ্যাঁ । আমি আর আমার বউ।’ এই বলে আমার নাকের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে চলে গেল সে। অনুকূলের কাছ থেকে আনুকূল্য কোনওদিন পাইনি সেকথা ঠিক, কিন্তু এতখানি প্রতিকূলতাও কখনও ওর কাছে আমার প্রত্যাশা ছিল না।

কিন্তু অনুকুলই ওদের পরিবারের শেষ কথা নয়—ওর পরিবার আছে; ক’দিন পরে কোত্থেকে তিনি একটি আধা আসামি আধা বাঙালি মেয়ে কুড়িয়ে এনেছেন দেখা গেল। ঝি রাখবারই মতলব ছিল তাঁর গোড়ায়, কিন্তু আমাদের মহাজনী পদাঙ্ক অনুসরণ করে পোষ্যপুত্রী নেয়াই ঠিক করেছেন।

ওরকম গালভরা নাম দিলে ঝিকে আর বেতন দেওয়ার দরকার করে না। টাকাও বাঁচে, ঝৈন ধর্মও রক্ষা পায়। মহাযানের যাঁরা পথিক, বাহন তাঁদের বিনামূল্য। তবু আমি অনেকখানি সান্ত্বনা পেলাম। অনুকুলের দুর্ভিক্ষপীড়িত পরিবারের অন্য এক শ্রীমুখের আবির্ভাব কম সুখবর নয়।।

সুখের ওপরে সোয়াস্তি, কল্পনাকেও দেখা গেল। বিক্রমের দৃষ্টি যখন আমাদের দিকে থাকে না, সে তার দিকে দুষ্টুমিভরা চোখে তাকায়। মাতৃসুলভ চাহনি নয় ঠিক। বলতে আমি বাধ্য। বরং জামাতৃসুলভ বললেই ঠিক হয়।

তাকায় আর হাসে। বলে—’আহা। দুটি অনাথ বালক-বালিকা। কোন দেশ থেকে কী ঘটনাচক্রে পড়ে কত টাল খেয়ে এখন পাশাপাশি দুই বাড়িতে এসে জমেছে। যদি কোনও গতিকে এদের মধ্যে প্রাণের মিল হয়—তারপর কোন এক গোধূলি লগ্নে দু’ হাত এক হয়ে যায়—আহা।’

ওদের পরস্পরের অকস্মাৎ মিলন করিয়ে দিলে হয় না? এ সব ব্যাপারে চার চোখের মারপ্যাঁচ শুনেছি নাকি অব্যর্থ। আমারও বেশ উৎসাহ দেখা যায়। এক মেলায় রথ দেখা আর কলা বেচা—মন্দ কী? কল্পনাকে মাতৃত্ব-ভার থেকে বাঁচানো আর অনুকূলকে জামাতাবান করা—এক ধাক্কায় মাতৃদায় ও কন্যাদায়ের গ্রন্থিমোচন, মন্বন্তরের ওপরে মহামারি। মন্দ কী?

‘মেয়েটা যখন রাস্তার নলকূপ থেকে জল নিতে আসবে তুমি লক্ষ রেখো, বিক্রমকেও জল আনতে পাঠাব তখন।’ কল্পনা বাতলাল।—’বুঝেছ?’

এরকম লক্ষ রাখতে ভালই লাগে আমার—বিশেষ করে কল্পনার ছাড়পত্র পেলে তো কথাই নেই। রূপলক্ষের এই সব উপলক্ষ্য ছাড়বার নয়।

সাধুসংকল্প বেশিক্ষণ অচরিতার্থ থাকে না। সেই দিনই—কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুভলগ্ন এল। বিক্রমকে হেঁকে বললাম, ‘বৎস, যাও তো। পরিষ্কার করে এক পেয়ালা জল টিউব ওয়েল থেকে ধরে নিয়ে এস। গরহজম হয়ে বড্ড গলা জ্বলছে। নলকূপের জল উপকারী শুনেছি।’

‘যাই বাবা।’ বলে বিক্রম চলে গেল।

তারপর আর লক্ষ রাখতে পারা গেল না। কেমন বাধ বাধ লাগল। দুটি তরুণ-তরুণীর প্রথম মিলন—মিলনে-লগ্নের বিলগ্নতা—বিধাতা ছাড়া আর কারও সেখানে নজর দেওয়া উচিত নয়। কবিগুরুর ‘দু’জনে যেথায় মিলেছে সেথায় তুমি থাকো প্রভু, তুমি থাকো। দু’জনে ডাকিছে দোঁহারে তাদের তুমি ডাকো, তুমি ডাকো’ স্মর্তব্য।

জানালা থেকে সরে এসে কল্পনানেত্রে দৃশ্যটা দেখতে লাগলাম (কল্পনা পাশের ঘরে বসে দেখছিল আশা করি।)

পরমুহূর্তেই দুদ্দাড় পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। বিক্রম সিং সিঁড়ি ভেঙে একছুটে ঘরে এসে প্রবেশ করেছে—কিন্তু বিক্রমের কোনও চিহ্ন নেই। আগের বিক্রম নয় যেন। মাথার চুল খাড়া, মুখ হাঁ করা, চোখের চাউনি বিকট, হাতের গেলাস খালি।

হাসফাঁস করছে বেচারা। তার একটা আঙুল দেয়াল ভেদ করে নলকূপের দিকে নিবদ্ধ।

‘ওই। ওই মেয়েটা। …ওই মেয়েটা…।’ দম নিতে নিতে সে বলে।

‘কেন, কী হয়েছে মেয়েটার?’

‘কী বয়ানক!’ বিক্রম বলে। ভীত জড়িত কণ্ঠে জানায়। ‘উঃ, কী বয়ানক।’

বয়-আনক—সে তো বিয়ের পর, এখন কী তার। এখন boy আনার কথা ওঠে কেন? এ তো পূর্বরাগের কথা নয়। বিক্রমের উর্বশীলাভের লক্ষণ নয় এ বরং বৈরাগ্যের লক্ষণ—ভাবনার কথাই বলতে হয়।

কিন্তু ভেবে কোনও লাভ নেই। বিয়ের পরে ছেলেপুলেরা আসবে, ভয়ঙ্কর রূপেই আসবে। (এই প্রসঙ্গে, ‘বিয়ে হলেই পুত্র-কন্যা আসে যেন প্রবল বন্যা’—আরেক মহাকবির মহোক্তি স্মরণীয়।) আর রমণীরা তারই তোড়জোড়, তার কোনও ভুল নেই এবং সেই প্রবল বানের তোড়ে ভাসবার কালে অপূর্ব রাগ, এমনকী ঘোরতর রাগও দেখা দিতে পারে, কিন্তু সেই দূরদর্শিতার অজুহাতে আগেই জীবন থেকে পূর্বরাগের রমণীয়তা বাদ দেয়াটা বেকুবি ছাড়া কী বলা যায়। কেননা, রমণীর র-মেটিরিয়াল বাদ দিলে, বয়ানকত্ব বাদ দিয়ে যা থাকে, তাতে জহুরির হয়তো চলতে পারে, কিন্তু মানুষের চলে না। (এ মনি-হার আমায় নাহি সাজে, কবি কী আর সাধে বলেছেন। কল্পনার দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে আমিও তো কতদিন একথা ভেবেছিলাম।) এমনই হার, বলতে কী, রীতিমতন সাজার মতোই প্রায়।

‘অ্যাতো ভয় খাবার কী আছে?’ আমি চটে যাই, ‘তুমি একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, খুব সম্ভব তোমার মতোই ইভাকুয়ি। তোমার দেশের মেয়েই হয়তো। চেহারা দেখে তাই মনে হয়। এবং দেখতেও নেহাত মন্দ না, আমি ভাল করে দেখেছি। তোমার কি মাথা খারাপ নাকি?’

‘হ্যাঁ।’ বিক্রম ঘাড় নাড়ে।

বধ্য পশুর বন্য চাহনি ওর চোখে। আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিই, ‘ছেলেমানুষ। কখনও বোধহয় কোনও মেয়ের প্রেমে পড়োনি, ভয় খাচ্ছ তাই। কিংবা ওকে দেখে হয়তো তোমার দেশের কথা মনে পড়েছে—বোমার কথা, কোম্পানির কাগজের কথা—তাই না? পূর্বস্মৃতির বৃশ্চিক-দংশন যাকে বলো—হ্যাঁ?’

‘হ্যাঁ বাবা।’ সায় দেয় বিক্রম।

‘শোনো বলি, ভেবে দ্যাখো কথাটা।’ রমণীয় সুরে আমি শুরু করি এবার, ‘বিদেশ-বিভুঁয়ে তুমিও একা, ও বেচারিও একলাটি। তোমাদের দু’জনের মধ্যে ভাব হলে কি ভাল হয় না? তুমি এবাড়িতে—-ও ও-বাড়িতে—কয়েক গজের মাত্র তফাত। এমন কী আর ব্যবধান? পাশের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়া এদেশের রেওয়াজ।এ বাড়িতে দুষ্টু প্রজাপতি থাকে, ও বাড়িতে ফুটন্ত গোলাপ। রোমে যখন থাকবে, তখন রোমকদের মতোই থাকবে—তাই নিয়ম। আমাদের শাস্ত্রেও বলে দিয়েছে—যস্মিন দেশে যদাচার। তার মানে এদেশে এসে তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে—তাই কী নয়? আমরা তো মনে করেছি ওর সঙ্গে তোমার—মানে, ও যদি তোমার বউ হয় তো বেশ হয়—এ বিষয়ে তোমার—’

বিক্রম ভয়ার্ত চিৎকারে আমার দুই হাত জড়িয়ে ধরে: ‘বলবেন না বাবা, বলবেন না। ও—ও-ই আমার বউ।’

বিক্রমের কাছ থেকে এ রকম আঘাতের আশা আমি করিনি। সামলাতে আমার সময় লাগল!

‘তুমি বিয়ে করেছ, একথা তো বললানি বিক্রম?’

‘এখনও করিনি, তবে ওর সঙ্গেই আমার বিয়ের কথা হয়ে আছে।’ বিক্রম বলল: ‘বর্মা থেকে আমার পালিয়ে আসবারও একটা কারণ আপনাকে বলেছি তো।’

‘কখন বললে আমায়?’ আমি অবাক হয়ে যাই।

‘বলিনি কি, ও আমার পিছু নিয়েছিল—চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যাপার। বলিনি আমি আপনাকে?’

‘বলেছিলে বটে গেস্ট হোস্ট অনেক কথাই বলেছিলে—মনে পড়ছে এখন। আমি অন্য মানে ধরেছিলাম, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে তোমার এই দশশালার বন্দোবস্ত বুঝতে পারিনি।’ আমি বলি।

‘দশশালা বন্দোবস্ত আমি জানি। বাংলা দেশের জমিদারি ব্যবস্থা, তাই না বাবা?’ বিক্রম হাত নাড়ে—’তার মধ্যে জমিদার হচ্ছেন নম্বর এক, তারপর জমিদারের বেনামিতে জোতদার, তার পরে জমিদারের ছেলে, দৌহিত্র, ম্যানেজার,’—বিক্রম আঙুল গুনে যায়— ‘নায়েব, গোমস্তা, পেয়াদা, পাইক—এই তো হল আট। …আর দু’শালাকে খুঁজে পাচ্ছিনে।’

‘আদালতে খুঁজলে পাবে—উকিল আর মুহুরি।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বিক্রম উল্লসিত হয়ে ওঠে, ‘কিন্তু এসব তত জমিদারি ব্যাপার, এর সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ কী?’

‘বিয়েও যে একটা জমিদারি বৎস৷ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই যে। বিয়ে করলেও তো শালারা জোটে, সময়ে সময়ে দশজনাও জুটে যায় কখনও কখনও। তবে তোমার বরাত ভাল হতে চাই কি, দশ শালা না হয়ে দশ শালিও হতে পারে। না তেমন কপাল তুমি করোনি বুঝি?’

‘ওর সঙ্গে আমার কিছুতেই মনের মিল হচ্ছে না,’ বিক্রম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জানায়।—’নইলে বিয়ে করতে আর কী ছিল?’

‘সে তো বিয়ের পরেই হয় না গো, ওই তোমার মনের মিলন। কিন্তু তা কিসেদের বিয়ের আগেও হচ্ছে না?…তাহলে…’

‘তাহলে আর কী হবে।’ ওর দীর্ঘনিশ্বাসে আমিও ডিটো দিই অবশেষে।

কল্পনা কিছুদিনের জন্যে বোনের বাড়ি আসানসোলে বেড়াতে যাবে, তাকে তুলে দিতে গেছলাম স্টেশনে। দিতে গিয়ে আসানসোল অবধি তুলতে চলেছিলাম পত্নীভক্তির পরাকাষ্ঠা করে, অতুল কীর্তি রাখতে প্রস্তুত হয়েছিলাম, কল্পনাই কিন্তু বাধা দিল আমার বাহবাড়ম্বরে। ধরে বেঁধে শ্রীরামপুরেই নামিয়ে দিল আমায়।

‘জানি গো জানি, পত্নীভক্তি কত তা কী আমার জানা নেই। শ্যালিকা-ভক্তির জন্যেই ছুটে চলেছ তুমি মশাই।’ বলল ও।

এর পরে আর কোন মশাইয়ের প্রাণে না ঘা লাগে? প্রাণে এবং আত্মসম্মানে? আহত হয়ে আমি এই বি-শ্রীরামপুরে পদার্পণ করেছি। আর সেই থেকে ফিরতি ট্রেনের প্রত্যাশায় বসে আছি হাঁ করে। অর্ধাঙ্গহারা পথে পড়ে থাকা হাফসোলের মতোই প্রায়।

বসে আছি আর আমার যত বন্ধুভাগ্যকে ঈর্ষা করছি। কেবল বিবাহের দৌলতেই আমার বন্ধুদের কেউ প্রতিভাবান, কেউ বা বীণ-কার, কেউ আবার স্নেহ-ধন্য। কারও বা অলকা-বিলাস, কারও মতো মমতা-ময় আর হয় না। কেউ পৌত্তলিক, নিতান্তই পুতুলের পূজারী—কারও বা বেলুর-মঠ। কারও বা ‘তৎসবিতুর্বরেণ্যম্’—সেই সবিতার মতন বরেণ্য আর নেই। কিন্তু হায়, কল্পনা-কুশল আমাকে বলা যায় না কিছুতেই।

ওর কাছে কোনও কৌশলই খাটে না আমার। কল্পনালোকের নই, নিতান্তই আমি কাল্পনিক।

বসে আছি সেই কখন থেকে। ঝাঁ ঝাঁ রোদ। বেলা আড়াইটে হবে তখন। খাঁ খাঁ প্ল্যাটফর্মে দু’জন মোটে মানুষ। আমি আর আরেকজন। দূর থেকে তাঁকেও খুব চটিতং মনে হল। যেন সব কিছুর উপরই বিরক্ত হয়ে বসে আছেন। গাড়ির সংখ্যা কমে গেছে যুদ্ধের দরুন। তার ওপরে এ গাড়িটা আবার লেট। আমি বসে বসে মশা মারবার চেষ্টা করতে লাগলাম। এক একটা মশা কামড়াচ্ছিল এমন যে!

সেই বিরক্ত লোকটিরও এ ছাড়া করবার কিছু ছিল না। টিকিটঘরের সামনেকার বেঞ্চিটায় বসেছিল সে। খানিকক্ষণ মশাদের সঙ্গে মারামারি করে ক্লান্ত হয়ে বিধ্বস্ত লোকটা দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। আমার সারা জীবনে আমি এমন তিতবিরক্ত মানুষ দেখিনি। মনে হয় যেন কোনও নিগূঢ় দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে বেচারা—তা সে দুঃখ কোনও ভালবাসার প্রভাবে কিংবা একটা ভাল বাসার অভাবে—যাই হোক না।

হঠাৎ লোকটা মুখ তুলে তাকাল। প্ল্যাটফর্ম-প্রসারিত তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম। দেখবার মতো কোথাও কিছু ছিল না কিন্তু। অন্তত ওইভাবে তাক করে তাকানোর মতো আমার চোখে তো কিছু ঠেকল না।

কিন্তু ভয়ানক বিরক্ত লোকটিকে ভয়ঙ্কর উত্তেজিত দেখা গেল। কী যেন দেখে তড়াং করে সে লাফিয়ে উঠল—ছুট লাগাল প্ল্যাটফর্ম ধরে। আমি বেজায় অবাক হয়ে গেলাম। যেমনকার স্টেশন তেমনই আছে—দৃশ্যপটে কোথাও কোনও পরিবর্তন ঘটেনি৷ তিলমাত্র না। আপ কি ডাউন কোনও রেলগাড়ির যে টিকি দেখা গেছে তাও নয়। তুমি গাড়ি ধরবে কি তার তলায় পড়ে আত্মহত্যা করবে, সেই জন্যেই মরিয়া হয়ে ছুটেছ, তাও বলা চলে না।

আমি কিছু আন্দাজ করতে পারলাম না। লোকটার পশ্চাদ্ধাবন করলে হয়তো কিছু অনুধাবন হত, কিন্তু তারও কোনও তাগাদা বোধ করলাম না বিশেষ।

দেখলাম, লোকটা মাল ওজনের মেশিনের কাছে গিয়ে খাড়া হল। এর জন্যেই এত দৌড়োদৌড়ি? কী এমন দরকার ছিল এত? মেশিন কিছু পালিয়ে যাচ্ছিল না’—বললাম আমি আপন মনে।

মেশিনের ওপরে দাঁড়াল সে তারপরে। নিজের ওজন বুঝতে চেষ্টা করল। পরমুহূর্তেই সে লাফিয়ে নেমে পড়ল মেশিনের থেকে।

হাবভাবে মনে হল এক্ষুনি সে বুঝি মেশিনটাকে পদাঘাতে জর্জর করবে। এই মারে কি সেই মারে। কিন্তু কী কৌশলে সে আত্মসংবরণ করল জানি না, আস্তে আস্তে আবার সে টিকিটঘরের সামনের বেঞ্চটায় এসে পর্যবসিত হল। তার কাণ্ড দেখে আমি কৌতূহলাক্রান্ত হয়েছিলাম বলতে বাধা নেই।

পায়চারি করতে করতে গেলাম তার কাছে।

‘আজ দিনটা কী চমৎকার! আরম্ভ করলাম এই বলে। প্রথম ভাব করতে দিনক্ষণ দেখতে হয়—সেইটেই সভ্য কায়দা। দোস্তির দস্তুর।

‘যা বলেছ বলেছ, আর বোলো না।’ জবাব এল লোকটার কাছ থেকে। ‘তোমার কথা শুনলে যা মনে হয় তোমার যদি ততটাই মাথা খারাপ হয়ে থাকে, তোমাকে ওরা রাঁচিতে নিয়ে গিয়ে তালাচাবি দিয়ে রাখবে। মোটেই আজ চমৎকার দিন না। খুব বিচ্ছিরি দিন। দুনিয়াটাও যার-পর-নাই বিচ্ছিরি।’

‘দিন-দুনিয়ার মালিক খোদা’—নতুন করে শুরু করতে যাই।

‘চেপে যাও, চেপে যাও,’ সে বলে উঠল, ‘আর বেশি হাস্যকর হবার চেষ্টা কোরো না, তুমি কিছু শিব্রাম চক্কোত্তি নও।’

মন্দ নয়। সূত্রপাতের আগেই সূচিবেধ।—’কীসে যেন আপনি বড্ড কষ্ট পাচ্ছেন মনে হচ্ছে?’ আমি সহানুভূতি ভরে জিজ্ঞেস করি ভদ্রলোককে।

লোকটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল। তারপর উঠে দাঁড়াল চট করে। সটান খাড়া হল আমার সামনে।

‘তাকান—তাকান তো আমার দিকে।’ বলল চেঁচিয়ে। ‘কী রকম দেখছেন আমায়?’

আমি তাকালাম। ‘বেশ তো।’ তাকিয়ে আমি বললাম।—’ভালই তো দেখা যাচ্ছে! চমৎকার বোধ হচ্ছে আমার।’

‘ভাল করে তাকান।’ পুনশ্চ ঘোঁৎকার হল তার। ‘আরও ভাল করে দেখুন।’

আবার আমি তাকালাম। দিব্যি মনে হল তাকে আমার। অন্তত দেহের দিক দিয়ে তো বটেই। বহির্ভাগে কিছুই ত্রুটি নেই, তবে যদি মাথার ভাগে কোনও গোলযোগ ঘটে থাকে বলতে পারি না।

‘দৃশ্যের দিক থেকে কিছু খারাপ বলে ঠাহর হচ্ছে না তো৷’ তাকে জানালাম: ‘সিনারি মন্দ নয় তেমন।’

কিন্তু লোকটি আমার জবাবে এবার বেশি ঘোঁৎকার ছাড়ল।

‘যে লোকটি এই রেশনিং বার করেছে তাকে যদি একবার সামনে পেতাম…আমি সেই বদমাইশটাকে একবার বাগে পেলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খেতাম।’

‘বটে—অ্যাতো রাগ?’ আমি বলি, ‘কেন, কী করেছে লোকটা?’

‘আমার সর্বনাশ করেছে। আমি আর সে আমি নেই। সমস্ত কেবল ওই রেশনিং-এর জন্যেই।’

‘বটে বটে? খুব খারাপ কথা তো!’

‘খারাপ বলে খারাপ! অতিশয় খারাপ। দৈনিক বরাদ্দ দেড় পো চাল—তার বেশি এক ছটাক পাবার জো নেই—কোনও কালোবাজারে কি কোথাও আপনি পাবেন না। এখন একবার তাকিয়ে দেখুন আমার দিকে—আমিই তার পরিণাম।’

আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চুপি চুপি এবার সে একটা গোপন কথা কয়— ‘রেশনিং চালু হয়ে অবধি আমি আধপেটা নয়,সিকিপেটা না, দুয়ানিপেটা খেয়ে আছি। আগে আমি এবেলা দেড়সের ওবেলা দেড়সের চালের ভাত মারতাম মশাই। বিশ্বাস করবেন আপনি?’

আমি বিশ্বাস করি—দ্বিরুক্তি না করেই।

‘আমার ওজন কত বলুন তো এখন?’ ভোজন থেকে একেবারে ওজনের কথায় চলে আসেন ভদ্রলোক।

‘মণ দুয়েক হতে পারে,’ আমি আন্দাজ করি।

‘কিছু কম।’ সে বলল—’ওর চেয়ে কিছু—এই সের আড়াইটাক কম।’

এই বলে সে পকেট থেকে লম্বা এক কাগজের ফর্দ বার করে আমার চোখের ওপর মেলে ধরে। তাতে মেলাই অঙ্ক সে বলতে থাকেঃ ‘গত সপ্তাহে ছিলাম পাক্কা দু’ মণ, তার আগের হপ্তায় দু’মণ আড়াই সেরা এমন করে হপ্তা পিছু আড়াই সের করে কমে কমে কত দিনে আর হতে পারব। এত আস্তে আস্তে হলে আর কী করে হয়।’ ওর ভগ্নকণ্ঠে আবার আপশোস—দারুণ অসোয়াস্তি।

‘খুব আস্তে আস্তে হচ্ছে বুঝি?’ আমি বলি।

‘অনেক—অনেক সপ্তাহ লাগবে।’ সে বলে।

‘অনেক সপ্তাহ? কী বলছেন?’

আবার সে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে আরেকটা গুপ্ত কথা ব্যক্ত করল। যদিও সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি বা কানাকানি করার কোনও দরকার ছিল না—-’অথচ দেখুন, আমার বিজ্ঞাপন তৈরি। লিখেই রেখেছি, খবর কাগজে ছাপতে দিলেই হয়। দাঁড়ান দেখাচ্ছি আপনাকে।’

আরেক পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে আমার হাতের ওপর ফেলে দিল সে।

আমি বিস্ফারিত নেত্রে পড়লাম –

‘ঠিকানা লিখে রাখুন। এক এবং অদ্বিতীয়

হরধরচন্দ্র বর্ধন

বিখ্যাত জীয়ন্ত কঙ্কাল।

বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষীণকায় পুরুষ—এই চলমান কঙ্কালকে—আপনার প্রদর্শনীর জন্য অবিলম্বে সংগ্রহ করুন। দক্ষিণা বেশি নয়। পোস্ট বক্স নং..’

‘কিন্তু দেখুন তো কী মুশকিল। কোথাও এটা আমি ছাপতে পারছি না। ছাপানো যায় না এখনও। এখনও যে কত হপ্তা লাগবে কে জানে? এত আস্তে আস্তে আমার দৈহিক অবনতি ঘটছে—মাত্র আড়াই সের কম দু’মণ—এখনও বিস্তর দিন পড়ে আছে—বহুৎ-সপ্তাহ পড়ে রয়েছে, এখনও আমার অনেক বেকার দিন।’

লোকটার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে আসে। আমি সান্ত্বনা দানের ভাষা পাই না।

‘কেন বেকার কেন? এর আগে আপনি কী করতেন?’ আমি প্রশ্ন করি—’আর রেশনিং-এর সঙ্গেই বা আপনার বেকার দশার কী সম্পর্ক আমার তো মশাই এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আদৌ ঢুকছে না।’

‘কেন, এ তো খুব সোজা কথা। মাথায় ঢুকছে না আপনার? রেশনিং হয়ে আমার খাওয়া গেল কমে, আমি রোগা হতে শুরু করলাম আর সঙ্গে সঙ্গে আমার চাকরিটাও খোয়া গেল। তেমন সুখের চাকরি কি পাব আমি আর? আর তা পাওয়া যাবে না মশাই৷’

‘আর পাওয়া যাবে না?—এমন কী job?’ আমার তাজ্জব লাগে। তাহলেও চাকরি খোয়া যাওয়ার খোয়ার আমি জানি।

শুনে আমার দুঃখ হয়।—’কীসের চাকরি ছিল আপনার?’

‘আরাম করে সোফায় বসে থাকো। আর লোকে পয়সা দিয়ে খুশি হয়ে তোমায় দেখে যাবে। আপনি আমার নাম শুনেছিলেন কি না জানি না, আমিই সেই প্রসিদ্ধ হলধরচন্দর্ বর্ধন, এ যুগের ঘটোৎকচ। পৃথিবীর সবার চেয়ে হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তি বলে গণ্য ছিলাম আমি। যেমন হৃষ্ট তেমনই পুষ্ট—সাড়ে তিন মনের কাছাকাছি। কিন্তু না ঘরকা না ঘাটকা—এখন কী এই নগণ্য আমাকে দেখলে কেউ চিনতে পারবে?’

রেলগাড়িতে বাদুড়ঝোলা হয়ে প্রাণ এবং হ্যান্ডেল হাতে করে হাওড়ায় পৌঁছে সিনেমা-দর্শন সেরে বাড়ি ফিরলাম। সারা সময়টা হলধর বর্ধন মনের মধ্যে খোঁচাচ্ছিল। স্থূলত্বের সিংহাসনচ্যুত হয়ে এখন সে হুলের মতো সূক্ষ্ম হতে চায়—কোনদিক দিয়ে হুলুস্থূল না হতে পারলে তার সুখ নেই। হলধর চন্দর্ এ অবধি নিজেকে অর্ধচন্দ্রও দিতে পারেনি—এখনও সে বেকার। অতিমানবদের সগোত্র এই হলধরের অতিশয়োক্তি না হয়ে সোয়াস্তি নেই। সে রাশনাল মানুষ নয়, রেশনিং-এর বিরুদ্ধে সে।

আমারও স্বস্তি ছিলনা মনে। তারপর বাড়িতে পা দিতে না দিতেই সাইরেন বেজে উঠল। একটু যে আরাম করে বিছানায় গড়াব তারও জো রইল না।।

কম্বল দু’খানা আর বালিশটা বগলে নিয়ে গলে পড়া গেল। ক’ ঘন্টার ধাক্কা কে জানে। দরকার হলে লম্বা হওয়া যাবে সেখানেই।

আমাদের পাড়ার এক ধনিক ভদ্রলোক তাঁর বাড়িতে অনেক খরচ করে আন্ডারগ্রাউন্ড শেলটার বানিয়েছিলেন—মাটির নীচে বিরাট এক হল—পেল্লাই জায়গা। দিব্যস্থান—শোবার বসার বেরোবার কোনও অসুবিধা নেই—চেয়ার কুশন চৌকি সোফার ছড়াছড়ি। সাইরেন বাজলে আমাদের সবার সেখানে অবাধ আমন্ত্রণ ছিল এবং বলতে কী, সেখানে বসে নিশ্চিন্ত মনে বিমান-আক্রমণকে উপভোগ করতে ভালই লাগত বরং।

ফুটফুটে জ্যোৎস্না দিয়েছে—কিন্তু চাঁদমুখে যেন কালি ঢেলে দেওয়া হয়েছে। চাঁদনি রাত যে এমন হতে পারে কে জানত? চাঁদের আলো চিরদিনই আঁতে ঘা মারে, তা জানি,—কিন্তু সৃষ্টির শুরু থেকে এমন আঁতকানো গা ছম্ ছম্ করা জ্যোৎস্না কি ওত পেতে এতকাল ধরে আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিল?

শেলটারের মুখে গিয়ে আরেক কাণ্ড দেখা গেল, এক ছাগলছানা এবং আরেক ছোট্ট ছেলের দারুণ হাতাহাতি। ছেলেটা তার প্রিয় পাঁঠাটিকে নিয়ে ভূগর্ভে সেঁদুতে চায়, ছাগল কিন্তু মোটেই রাজি নয়। ছেলেটা অস্থির হয়ে পড়েছে, কিন্তু পাঁঠার মনে কোনও বিকার নেই—এতবড় বোমার ধাক্কায় নিজেকে বাঁচাতেও সে নারাজ।

ছেলেটার ফেলোফিলিং আমাকে মুগ্ধ করল, যদিও বড় হয়ে উঠলে সে বদলে যাবে, এই বন্ধুপ্রীতি তার থাকবে না, জানা কথা। তখন অন্যরূপ নিয়ে এই পাঁঠাকে উদরের পথে নিজের সহচর করতেই সে চাইবে, তবু আমি আজ তার সাহায্যে অগ্রসর না হয়ে পারলাম না।

সে আর আমি দু’জনে মিলে চ্যাংদোলা দোল পাঁঠাটাকে নিয়ে চললাম। হেঁটমুণ্ড জীবটি হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলল—তারস্বরে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছেড়ে। বলিরাজ স্বর্গ ফেলে পাঁচজন পণ্ডিতের সঙ্গে গোল্লায় যেতে প্রস্তুত ছিলেন—আর এতগুলি সুধিসজ্জন ইতর-ভদ্র আমাদের সঙ্গে রসাতলে প্রবেশ করতে এর কোথায় যে এত বাধ-বাধ—আমি তো তা বুঝি না। পাঁঠা আর কাকে বলে!—বলির ভয়ে ভড়কাচ্ছে কি না কে বলবে।

যাক, কোনওরকমে তো পাঁঠাশুদ্ধ শেলটারে পৌঁছনো গেল।…

বাঁশি বাজতে না বাজতে পাড়ায় প্রায় সকলেই সেখানে জমায়েত দেখলাম। কর্তা গিন্নি ছেলেপুলেরা কেউ পেছনে পড়ে নেই, আমিও এক কোণে গিয়ে একটা চৌকি দখল করে আমার কম্বল বিছালাম।

কোথাও তাসের আড্ডা বসে গেছে—কোথাও বা গল্পের আসর। কেউ বা কোনও এক কোণে গিয়ে নভেল পড়তে মশগুল।

কোনও দলে ভিড়তেই আমার উৎসাহ ছিলনা। সারা দিন ধকল গেছে ভারী। তার ওপর আবার সিনেমা শো। চোখ ক্লান্ত, মন কাহিল—চোখের পাতায় যত রাজ্যের ঘুমের ভিড়। এত ভিড় ঠেলে শুতে পারলে—এই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে বাঁচি। চৌকিতে বসে বসেই ঢুলতে শুরু করে দিয়েছি।

ওঁয়া-ওঁয়া-ওঁয়াও! নতুন সৃষ্টির কান্নাই বুঝি—আকাশে ভাসছিল তখনও। দু’একটা সদ্য ভূমিষ্ঠ বোমার আর্তনাদও ভেসে আসছিল সেই সঙ্গে। কিংবা আমাদের অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফটের আওয়াজই হবে হয়তো বা।

হঠাৎ চেনা গলার স্বরে চটকা ভাল। স্বরবর্ণ থেকে অক্ষর পরিচয়ে দেরি হবার নয়। আমাদের বিক্রম সিং যে! আমারই চৌকির অদূরে, আলো-অন্ধকারের আবছায়ায় আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে খিলান্ ঠেস দিয়ে বৎস সিংহই শ্রীবৎস রূপে বিরাজ করছেন। বিক্রম একা নয়, বিক্রম এবং আরেকজন। বিক্রমের উর্বশীই বোধ হয়, পাশের বাড়ির সেই মেয়েটিই মনে হল।

সজাগ হয়ে উঠতে হল। সবাইকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলেও চৌকিতে বসে চৌকিদারি না করা ভাল দেখায় না। জমিদারের ব্যাপার-স্যাপার লক্ষ করি। বলছিল বিক্রমঃ ‘ফাঁকা জায়গার চেয়ে এই ভিড়ই আমার ভাল লাগে। বেশ নির্জন-নির্জন। নির্জন আর নিঝঞ্জাট। কোনও ভয়ের কারণ নেই। এখানে কেউ আমাদের দেখছে না, কান খাড়া করেও নেই কেউ কোথাও। মিলতে হয় তো এমনি জায়গায়।’

পাঁঠাটা বললঃ ‘ব্যা ব্যা।’

সাদা বাংলায় তার সাধুবাদের মানে হচ্ছে, ‘বাহবা বাহবা।’

‘এই ভিড়ের ভেতর থেকে সরে পড়াও শক্ত আবার।’ বলল উর্বশী। ‘সেদিক থেকেও নিরাপদ—সেটাও বলো।’

‘বিশ্বাস করো আমি সেদিন পালাইনি। প্রভু তথাগতের দিব্যি।’

বিক্রম বলতে যায়।

পাঁঠাটা পাশ থেকে উচ্য-বাচ্য করে—’অরররর!’ অর্থাৎ আরও কী বলবার আছে বলো। এহ বাহ্য, আগে কহো আর—এই জাতীয় কথাটা বলতে চায় বুঝি!

‘পালাওনি তো সেই বড় বাগানটা কি তোমাকে গপ করে গিলে ফেলেছিল নাকি?…আমি একটু ফুল পাড়তে গেছি, আর অমনি দেখি তুমি পাশে নেই—’

আমি একটা ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়েছিলাম। এমনি, মজা দেখতে৷ তুমি কী করো দেখবার জন্যেই। এমন সময়ে দেখলাম সুন্দর এক প্রজাপতি একটা ফুলের ওপর বসছে, হামাগুড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে ধরতে যাচ্ছি তাকে, আর সে ব্যাটা কেবলই আমার হাত ফসকে এ-ফুল থেকে সে-ফুলে গিয়ে বসছে—ভারী দুষ্টু প্রজাপতিটা! ধরব ধরব করছি সে প্রজাপতিটাকে, মাঝখান থেকে একটা পুলিশ এসে আমাকে পাকড়াল—তারপর একদল পুলিশ—আমাকে লুফতে লুফতে নিয়ে গেল। উঃ, কী কষ্টটাই না গেছে বাবা আমার!’

‘আমাকেও ধরেছিল পুলিশে। কয়েকদিন আটকে রেখে ছেড়ে দিল তারপর। অনুকুলবাবুর বউ অবলাশ্রমের সেক্রেটারি—তিনিই আমাকে ছাড়িয়ে আনলেন।’

অন্ধকারের খানিকটা যেন ফিকে হয়ে আসে! ইডেন উদ্যানের সেই লোকটা—সেই হামান্ দিস্তা—সত্যি কি টোকিয়র রাস্তা ধরেছিল? নাকি, আসলে, প্রজাপতয়ে নমঃই ছিল তার আদত মতলব?

বনমালীর বুনো মাথা মনে পড়ে—আসামি বিক্রম সিং এবং অনুকূলপত্নীর আনুকুল্যলোভী উর্বশীর বিরহ-মিলন-কথার অনেকখানিই পরিষ্কার রূপ নেয়। পরের ব্যাপার তো জলের মতো স্পষ্ট। অবলাশ্রমের সেক্রেটারি আমার শ্রীমতী প্রতিবেশিনীর অবলার শ্রমের পক্ষপাতী হওয়া একান্ত স্বাভাবিক। অবলাটিকে সমর্থ দেখে টেনে এনে নিজের বাড়ির অনারারি পরিশ্রমে লাগিয়েছেন।

কিন্তু তারপরে আমার যত গোলমাল লাগে। সেদিনের বিক্রমের সন্ত্রস্ত চোখের সঙ্গে আজকের চোখা চোখা কথার খাপ খাওয়াতে পারি না। এর রহস্যবেধ করা আমার অসাধ্য মনে হয়।

‘তোমাকে তো বেশ চটকদার শাড়ি-ব্লাউজ দিয়েছে দেখছি,’ বিক্রম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে: ‘গিন্নি লোক তো বেশ ভাল।’

‘গিন্নি দেয়নি। কর্তা দিয়েছে।’ উর্বশীর জবাব।

‘কর্তা তো ভাল নয় তাহলে।’ রুক্ষ কণ্ঠ শুনলাম বিক্রমের।

খিলান ভেদ-করা শানিত দৃষ্টিও দেখতে পেলাম যেন।

‘কর্তাটাই ভাল।’ বলল উর্বশী: ‘তোমাকেও তো চমৎকার জামাকাপড় দিয়েছে। গিন্নিই বোধহয়?’

‘না, কর্তা দিয়েছেন।’ বিক্রম ঢোঁক গিলল।—’কর্তা তত খারাপ নয় আমাদের। তোমাদের কর্তার মতো না।’

আমি ঢোঁক গিললাম, কেননা আমি ওকে কাপড়জামা দিইনি।

‘তোমাদের কর্তার তুমি তো সব জানো।’ মনে হল, ঠোঁট উলটিয়েই কথাগুলো বলল যেন উর্বশী।

‘ইচ্ছে করলে আরেক প্রস্থ শাড়ি-ব্লাউজ তার কাছ থেকেও আমি বার করতে পারতাম।’—কর্তার উপর কর্তৃত্বের এই কথাটা দয়া করেই যেন সে উহ্য রেখে দিল মনে হয়।

‘হ্যাঁ, আমি জানব না তো তুমি জানবে। তাই বটে আর কী।’ উসকে উঠল বিক্রম—’আমাদের কর্তার নামে তোমার কোনও কথা আমি শুনব না।’

‘ঠিক কথা৷’—আমি মনে মনে ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।

একটু চুপ করে থাকার পর আবার ওর বিক্রম দেখা গেল।—’আমি বলছি ও বাড়িতে তোমার আর থাকা হবে না।’

‘বা, তা কেন?’ উর্বশী একটু বিস্মিতই।

‘কেন তা আমি বলব না। আমি বলছি এই যথেষ্ট।’

‘বারে, তুমি বললেই হল।’ উর্বশীও তেরিয়া।

‘এই জন্যেই তো তোমার সঙ্গে আমার মনের মিল হয় না।’ বিক্রম জানিয়ে দেয়।

‘তোমার আবার মন বলে কিছু আছে নাকি?’ উতোর গায় উর্বশী।

তারপর চুপচাপ। আবছা অন্ধকারে বিক্রমের দীর্ঘনিশ্বাস ভেসে আসে। একটার পর একটা।

‘যখন আমি একটা মিষ্টি কথা বলতে যাই অমনি তুমি একটা ঝগড়া বাধাও। কথাটা পাড়বার সুযোগ দাও না আমায়।’ বিক্রম ফোঁস ফোঁস করে—অনেকক্ষণ পরে।

‘কী করে জানব যে, তুমি মিষ্টি কথা কইতে আসছ? তোমার মনের তত্ত্ব পাব, আমি কি হাত গুণি?’

‘নারীসুলভ সহজ বোধশক্তি নেই তোমার?—কত নভেলেই তো লিখেছে—কোন বাংলা নভেলটা পড়তে বাকি রেখেছি—বিশেষ, আমাদের ব্রহ্মদেশের সেই শরৎ চাটুজ্যে—যিনি বাংলা মুলুকে এসে বাঙালি বনে অবশেষে আমাদের ভুলে গেলেন—তাঁর কোন বইটা তোমার পড়া আছে শুনি?—সেই সব পড়লেই তো মেয়েদের সহজ বোধশক্তি জন্মায়।’

‘মেয়েলি বোধশক্তিতে আমার বিশ্বাস নেই আর। বারবার তার ভুল হতে দেখেছি—কেন, এই তোমার বেলাতেই তো৷ প্রমাণ হয়েছে যে—’

‘না। প্রমাণ হয়নি।’ বিক্রম বাধা দেয়। প্রবল বিক্রমে।—’কিছু প্রমাণ হয়নি।’

‘প্রমাণ হয়েছে যে, নভেলের কথা সব মিথ্যে।’

‘না—মিথ্যে নয়।’ বিক্রম আগ্রহে উদ্গ্রীব। পরাক্রমে পরির দিকে প্রাগ্রসর। এখন, একজন উন্মুখ হলেই অপরের উদ্গ্রীবতা সার্থক হতে পারে। এখানে তেমন কোনও যোগাযোগ ঘটল কি না, আবছায়ার আড়ালে ভাল দেখা গেল না। হয়তো বা চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। তবে একটু উম্মুখের শব্দ এল যেন কানে। এই আড়ি পাতায় আমি নাচার। আড়ি দেওয়া আমার স্বভাব নয়। আড়ি করার মতোই স্বভাববিরুদ্ধ। তবে কিনা, চোখের পাতায় যত সহজে বোঝা যায়, কানের বেলা তা অসম্ভব। কানের হচ্ছে স্বাধীন চাল। কানরা আমাদের অবাধ্য—একদম অবাধ্য। (এই জন্যেই কি অবোধ ছেলের কান মলে তার শোধ তোলা হয়?)

অনেকক্ষণ বাদে অলক্লিয়ার আওয়াজ এল। আমিও কম্বল গুটিয়ে উঠলাম—ওদের পাশ দিয়ে—ওদেরকে না ঘাঁটিয়ে গুটি গুটি সকলের পিছু পিছু উঠে এলাম উপরে। আমিই এলাম সব্বার শেষে। সর্বশেষে আড়চোখে দেখে নিলাম হাত ধরাধরি করা ওরা দু’জনে তন্ময় হয়ে রয়েছে।

‘সবাই বেরিয়েছে তো?’ আমার বহির্গতির পরে জিজ্ঞেস করলেন গৃহকর্তা।

বিক্রমের কথা মনে করে আমি মাথা নাড়লাম—সম্মতিসূচক মৌনতায়। ফোটো আর ভালবাসা অন্ধকারেই ভাল ফোটে—প্রেমের ঘোরাল পথ ঠিক সেখানেই গিয়ে শেষ হয় যেখান থেকে পুনরায় শুরু—সনাতন পূর্ণনবার সেই শূন্য পূরাণ—পুনর্বার—ফের পুনর্বার।

ভদ্রলোক বিজলিবাতি নিবিয়ে দিলেন নীচের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *