নাইটস্কুলের কম্যান্ডো দল

নাইটস্কুলের কম্যান্ডো দল

এক

আমার ডাকনাম তারু। ভালো নাম তারাদাস মান্না। বেলেঘাটা খালপোল বস্তিতে থাকি। বয়েস পনেরো।

রিসেন্টলি আমার জীবনে একটা দারুণ ঘটনা ঘটে গেছে, যাকে বলে মেমোরেবল ইভেন্ট।

মাস ছয়েক আগে দাদু একবার ওই এসে—টাই আমাদের লিখতে দিয়েছিলেন। আ মেমোরেবল ইভেন্ট অফ ইয়োর লাইফ।

একটা কথা প্রথমেই বলে রাখি, যাঁকে দাদু বলছি তিনি কিন্তু রক্তের সম্পর্কে আমার দাদু হন না। তবে সম্পর্কটা তার চেয়ে কিছু কম গভীর নয়। এই গল্পটাও দাদুকে নিয়েই।

যা বলছিলাম। দাদু ওই এসেটা লিখতে দিয়েছিলেন। আমি তখনো অবধি যেটা সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা ছিল, সেটার কথাই লিখেছিলাম। লিখেছিলাম, যেদিন ট্রেনে ধূপ বেচতে গিয়ে আমার বাবার পা কাটা গেল সেই দিনটার কথা।

শেষকালে এটাও লিখে দিয়েছিলাম যে, বাবা এখন ভালো আছে। ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা করছে, তবে কাজকর্ম বিশেষ কিছু করতে পারে না। বই বাঁধানোর কাজটা জানত। কেউ বাড়িতে বই নিয়ে এলে বাঁধিয়ে দেয়। তবে খালপোল বস্তিতে আর কটা বাড়িতেই বা বই আছে? সেইজন্যেই আমি ইলেক্ট্রিকের দোকানে কাজ নিয়েছি আর মা বাড়ি—বাড়ি কাপড় কাচে, বাসন মাজে।

দাদু দেখি খাতাটা হাতে নিয়ে গম্ভীরমুখে বসে আছেন। আমি তো ভাবছি, খেয়েছে। তাহলে নিশ্চয় টেন্স—এর গণ্ডগোল করে ফেলেছি। দাদু সবসময় বলেন, ছোট ছোট সিম্পল সেন্টেন্সে লিখবি, তাহলে টেন্সের গণ্ডগোল হবে না। কমপ্লেক্স সেন্টেন্স বানাতে গিয়েছিস কি মরেছিস। আমার আবার সেন্টেন্সগুলো কেমন করে যেন একটু কমপ্লেক্স—ই হয়ে যায়। গুলে, বকাই, মান্তু আর টুকটুকির এই প্রবলেমটা নেই। ওরা বেশ ছোট—ছোট ভাগে ভাগ করে লিখতে পারে।

যাগগে, তারপর কী হল বলি।

দাদু তো খাতাটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে আছেন। তারপর একবার চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে ধুতির কোঁচায় চোখ মুছলেন, ফোঁসফোঁস করে দু’বার নাক টানলেন। বললেন, বুঝলি তারু, লেখাটা খুব ভালো হয়েছে। খুবই ভালো হয়েছে। এসব তো আর চিল্লারেসোমের বাচ্চাগুলোর মতন বই থেকে মুখস্থ করে লেখা নয়—অন আ সানি মর্নিং আই ওয়েন্ট টু ক্যালকাটা জু অ্যালং উইথ মাই পেরেন্টস। একেবারে জীবন থেকে তুলে আনা ঘটনা। ভালো তো হবেই।

চিল্লারেসোম মানে বুঝলে না তো? ‘চিলড্রেনস ওন হোম’—আমাদের খালপোল বস্তির সামনে বেলেঘাটা মেন রোডের ওপরেই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ওই স্কুলের বাচ্চাদের যে হিন্দুস্থানি ভ্যানওলাগুলো নিয়ে যায় নিয়ে আসে, তারা অত বড় ইংরিজি নামটা পরিষ্কার করে বলতে পারে না। তারা বলে কোন স্কুলের বাচ্চা? না, চিল্লারেসোমের বাচ্চা।

ওই স্কুলটার ওপরে দাদুর খুব রাগ, কারণ, উনি যখন ওই স্কুলের হেডমিস্ট্রেসকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন যে, আমাদের পাঁচজনকে একটু ওনার স্কুলে ভর্তি করে নিতে, ক্লাস করাতে হবে না, শুধু যাতে মাধ্যমিক পরীক্ষাটায় বসতে পারি তার জন্যে নামটা লিখিয়ে নিলেই হবে, তখন হেডমিস্ট্রেস দাদুকে খুব বাজে বাজে কথা বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর তাই রিক্সাওলাদের দেওয়া নামটা ওনার খুব পছন্দ। আমাদের খাতায় কোনো ভুলচুক দেখলেই বলবেন, ইসস, এটা তো চিল্লারেসোমের বাচ্চাগুলোও ঠিক করে দিত রে। আবার কখনও বলেন, একবার ডেকে নিয়ে আয় চিল্লারেসোমের দিদিমণিদের। দেখে যাক, ইউনিটারি—মেথড কেমন করে শেখাতে হয়।

যা বলছিলাম। দাদু তারপর ‘মেমোরেবল’ কথাটার চারপাশে লালকালি দিয়ে একটা গোল দাগ টেনে সেটার ওপরে পেন বোলাতে বোলাতে বললেন—কিন্তু বাবা তারাদাস! এই শব্দটার অর্থ বোধহয়, ‘আমরা যা মনে রাখতে চাই’। ‘যা মনে রাখা উচিত।’ আমরা কি দুঃখের কথা মনে রাখতে চাই? চাই না। বুঝতে পারছি তোমার বাবা—র ওই অ্যাকসিডেন্টটার কথা তুমি ভুলতে পারছ না, কিন্তু তোমার চেষ্টা করা উচিত ওটাকে ভুলে যাওয়া। ওটা ‘মেমোরেবল’ নয়, ‘ফরগেটেবল’, কেমন? ‘আর’—এর উচ্চারণটা সফট হবে। ‘ফঅগেটেবল’।

দাদুর এইরকম মাস্টারির চোটে আমাদের কথায় কথায় ইংরিজি বলার একটা হ্যাবিট তৈরি হয়ে গেছে। বাকি কাহিনিটা পড়তে পড়তেই সেটা বুঝতে পারবে। এ ব্যাপারে দাদুর বক্তব্য হচ্ছে, তোরা তো চিরকাল এরকম বস্তির ঘরে থাকবি না। একদিন না একদিন তোরা সকলেই সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াবি। তখন ইংরিজি বলতে না পারলে চলবে কেন?

দাদুর এই স্বপ্নটা একটু একটু করে গত তিন বছরে আমাদেরও বুকের ভেতরে গেঁথে গেছে। খালপোল বস্তিতে পড়ে থাকব না। পৃথিবীটাকে দেখব, জানব, উপভোগ করব।

দেখেছ, দাদুর কথা বলতে গিয়ে কেবলই কথার খেই হারিয়ে ফেলছি।

দাদু সেদিন খাতাটা আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, তুমি এই এসে—টা আবার নতুন করে লিখবে। লিখবে একটা আনন্দের স্মৃতির কথা।

আমি ভয়ে ভয়ে ডেকেছিলাম, দাদু!

বলো।

আমার যে সেরকম আনন্দের স্মৃতি কিছুই মনে পড়ছে না।

কেন? তোমার বাবা যেদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেন, সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে না?

আমি বললাম, হ্যাঁ। তা পড়ছে।

তাহলে, অ্যাকসিডেন্টের দিনটার কথা লিখছো কেন? সেই ফিরে আসার দিনটার কথা লেখো। সেটা কি একটা মনে রাখার মতন দিন নয়? একজন মানুষ মৃত্যুকে হারিয়ে দিয়ে তার সন্তানের কাছে, তার স্ত্রীয়ের কাছে, তার উপকারী প্রতিবেশীদের কাছে ফিরে এলেন। সেটার মধ্যে একটা প্রবল আনন্দের ব্যাপার নেই?

এই হচ্ছেন আমাদের দাদু—শ্রীযুক্ত বাবু মল্লার সোম। নিজের নামটা নিয়ে দাদু নিজেই মজা করে বলেন, বেলেঘাটায় দুটি ইসকুল—একটি চিল্লারেসোমের ইসকুল, আর একটি মল্লারেসোমের ইসকুল।

এবার তাহলে আমাদের স্কুল, মানে মল্লারেসোমের ইসকুল নিয়ে কয়েকটা কথা বলতেই হয়। আমাদের এই দ্বিতীয় মেমোরেবল এক্সপেরিয়েন্সের শুরুটা ওইখান থেকেই কিনা।

দাদুর বাড়িটা বেলেঘাটা মেন রোডের একেবারে ওপরেই, রাসমণি বাজারের গায়ে। একশো বছরের পুরোনো বেশ বড় দোতলা বাড়ি। এখন খুবই জরাজীর্ণ অবস্থা, কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় একসময় খুব সুন্দর একটা বাড়ি ছিল এটা। লাল টুকটুকে সিমেন্টের মেঝে, একশো বছর ধরে মানুষের হাঁটা—চলায় একেবারে তেল—সিঁদুরের মতন চকচকে হয়ে গেছে। বড় বড় জানলায় কাঠের পাখি দেওয়া পাল্লা। জানলা—দরজার ওপরের আর্চে পদ্ম আর আঙুর—লতার আলপনা। দাদুর কাছেই শুনেছি, যেভাবে ওই আলপনাগুলো দেওয়া হত, তাকে বলে পঙ্খের কাজ। দোতলায় ধনুকের মতন বাঁকানো বারান্দা আর সেই বারান্দার রেলিংগুলোর পায়ে অপূর্ব সুন্দর লোহার ঢালাইয়ের কাজ। কোনোটায় রাধাকৃষ্ণ, কোনোটায় ময়ূর—ময়ূরী।

দাদুর বাড়ির উঠোনে এমনকি একটা ফোয়ারা অবধি রয়েছে, যদিও সেই ফোয়ারায় আমরা তো কোন ছার, আমাদের বাবা—কাকারাও কোনোদিন জল উঠতে দ্যাখেনি। তবে ফোয়ারার মাঝখানে শ্বেতপাথরের পরীটাকে যদি কোনোদিন জ্যোৎস্নারাতে তুমি দেখো, তাহলে তোমার মনে হবে ওটা এক্ষুনি উড়ে চলে যাবে। এমনকি তুমি অল্প—অল্প ডানা নাড়ানোর আওয়াজও পেতে পারো। আমি তো পাই। গুলে, বকাই, মান্তু আর টুকটুকিকে জিগ্যেস করে দেখেছি, ওরাও পায়।

এই বাড়িরই বৈঠকখানা ঘরে আমাদের পাঁচজনকে নিয়ে দাদুর স্কুল। দাদু না থাকলে আমাদের লেখাপড়া শেখা হত না।

দাদু কেমন করে আমাদের পাঁচ ছাত্রছাত্রীকে জোগাড় করলেন?

আমার কথাই ধরো। আমি একটা স্কুলে ক্লাস সেভেন অবধি পড়েছিলাম। স্কুলটায় ক্লাসটাস বিশেষ হত না। হাতে গোনা কয়েকজন টিচার ছিলেন, আর প্রতিটা ক্লাসে একশোর ওপরে স্টুডেন্ট। ক্লাস হলেও মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারতাম না। তাই পড়াশোনা করতে একেবারেই ভালো লাগছিল না। ওদিকে সাদা খাতা জমা দিয়েও বছর বছর প্রমোশনটা ঠিক পেয়ে যাচ্ছিলাম। মা—বাবা ভাবতো ভালোই লেখাপড়া শিখছি বুঝি।

তারপর বাবার ওই অ্যাকসিডেন্টটার পরে আমাদের যখন প্রায় না খেতে পাওয়ার মতন অবস্থা তখন আমাদের বস্তিরই লোটনকাকা বলল, চল তারু, আমার দোকানে কাজ করবি। তোর বাবার এই অবস্থা, ছেলে হিসেবে তোর তো কিছু দায়িত্ব রয়েছে।

আমার তো ভারি আনন্দ হল। স্কুলটুল ছেড়ে দিয়ে শেয়ালদায় লোটনকাকার ইলেকট্রিকের দোকানে কাজে ঢুকে পড়লাম।

প্রথম প্রথম কাস্টমাররা আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই ভুরু কুঁচকে বলত, লোটনটার আক্কেল দ্যাখো। এইটুকুনি একটা ছেলেকে ফ্যান সারাতে পাঠিয়েছে! দেখিস বাবা, কারেন্ট খেয়ে মরিস না যেন। তাহলে আমাদের পুলিশে ধরবে। কিন্তু তারপরেই আমি যখন কোমরে প্লায়ার্স গুঁজে, তরতর করে ঘড়াঞ্চি বেয়ে ওপরে উঠে বড় বড় ফ্যানের হাঁড়ি মাথায় করে নামিয়ে আনতাম, কিংবা পোঁওও করে দেওয়ালে ড্রিল করে আলোর ব্র্যাকেট নিমেষের মধ্যে ফিট করে দিতাম, তখন সেই কাস্টমারদেরই মুখে কথা সরত না।

এমন অবস্থা হল, ক’দিন বাদ থেকে লোটনকাকার কাছে ফোন আসতে শুরু করল—তারুকেই পাঠাবি লোটন, অন্য কাউকে পাঠাস না।

লোটনকাকা আমার মাইনে বাড়িয়ে দিল।

দিব্যি কাটছিল দিনগুলো। শুধু মাঝেমাঝে কোনো স্কুলবাড়িতে লোটনকাকার সঙ্গে কাজ করতে গেলে ব্ল্যাকবোর্ড আর বেঞ্চিগুলো দেখে মনটা কেমন যেন করত। আমার পুরোনো স্কুলের বইগুলো একটাও ফেলিনি, সব চৌকির নীচে একটা বাক্সর মধ্যে জড়ো করে রাখা ছিল। মাঝেমাঝে বার করে দেখতাম, বিশেষ করে বাংলা গল্প—কবিতার বইগুলো। মনে হত, যদি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারতাম।

এইসময়েই একদিন দাদু মানে শ্রীমল্লার সোম একটা কাঁধব্যাগে খানচারেক ছেঁড়াখোঁড়া ইংরেজি বই নিয়ে, একে—ওকে জিগ্যেস করতে করতে, আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বাবা তখন উঠোনের একপাশে বসে মুড়ি খাচ্ছিল। দাদু বাবাকে বললেন, আমার এই বইগুলো হাতছাড়া করতে পারব না। ভীষণ দামি বই কিনা। আমি বসছি, তুমি আমার সামনেই এগুলো বাঁধিয়ে দাও।

বাবা নাকি দাদুকে চিনত। বেলেঘাটার অনেকেই চেনে। দাদুর বাবা ছিলেন বিরাট জমিদার। ওই ফোয়ারা—ওলা বাড়িটা তাঁরই বানানো। দাদু ইচ্ছে করলে বিলেত গিয়ে জজ—ব্যারিস্টার হয়ে ফিরতে পারতেন, কিন্তু তাঁর সেরকম ইচ্ছে হয়ইনি। তিনি চেয়েছিলেন, শিক্ষক হতে। হয়েছিলেনও তাই। প্রায় একা হাতে মৌলালির কাছে একটা স্কুল তৈরি করেছিলেন। সারা জীবন সেখানেই পড়িয়েছেন। এখন সেই স্কুলটার বেশ নামডাক; সরকারি সাহায্য—টাহায্যও পায়, কিন্তু স্কুলের কাজকর্ম দাদুর পছন্দ নয় বলে তিনি আর ওদিকটা মাড়ান না।

যাই হোক, বাবা তো দু—ঘণ্টা ধরে যত্ন নিয়ে বইগুলো বাঁধিয়ে দিল, আর পুরো সময়টা দাদু আমাদের উঠোনে বসে বাবার সঙ্গে গল্প করলেন। তার মধ্যে কী কথা হল কে জানে, আমি দোকান বন্ধ করে রাতে বাড়ি ফেরা মাত্র বাবা বলল, তারু, তুই এক্ষুনি একবার রাসমণি বাজারের গায়ে সোমবাড়ি চলে যা।

আমি বললাম, কেন? ফিউজ উড়ে গেছে নাকি? কাল সকালে গেলে চলবে না?

বাবা বলল, আরে ধুর। সোমকর্তা তোকে পড়াশোনা শেখাবেন। এমনকি তোকে মাধ্যমিক পাশ করানোর ব্যবস্থাও করে দেবেন বলেছেন।

আমি বললাম, কিন্তু আমার দোকানের কাজ?

বাবা বলল, সেইজন্যেই তো উনি তোদের রাত নটার পরে পড়তে বসাবেন। এক—দু’ঘণ্টা যা হয় পড়ে আয় না।

প্রথমদিন যে লজ্জা, যে ভয় নিয়ে রাসমণি বাজারের ওই বাড়িটাতে ঢুকেছিলাম তা আজও মনে আছে। পায়ে পায়ে বারান্দার লাগোয়া মস্ত ঘরটার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছিল খুব রোগা আর লম্বা একজন মানুষ একটা মস্ত বড় টেবিলের একপাশে বসে আছেন। গায়ে ধবধবে সাদা হাফহাতা গেঞ্জি আর ধূতি। তাঁর মুখটা বইয়ের দিকে নামানো, তাই শুধু একমাথা সাদা চুলই দেখতে পাচ্ছিলাম। ওনার উলটোদিকে বসে ছিল আমারই বয়সী দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ে।

আমি এসেছি এটা বুঝতে পেরেই বয়স্ক মানুষটা মুখ তুলে তাকালেন। তখন দেখলাম, মোটা কাচের চশমার আড়ালে বিশাল বড় বড় দুটো চোখ, খাড়া নাক আর চওড়া কপাল। একগাল হেসে যেই বললেন, তুমি কি তারাদাস নাকি? এসো এসো ভেতরে এসো। অমনি আমার সব ভয় আর লজ্জা কোথায় যেন উড়ে গেল। মনে হল, এই লোকটা আমার কত দিনের চেনা।

উনিই শেখালেন ওনাকে দাদু বলে ডাকতে। আলাপ করিয়ে দিলেন ওই ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে।

ছেলেদুটোর নাম গুলে আর বকাই। মেয়েদুটোর নাম মান্তু আর টুকুটুকি। ওদের ভালোনামগুলো এত খারাপ যে তোমাদের না শুনলেও চলবে।

গুলে থাকে চাউলপট্টিতে। ও—ও আমারই মতন কাজের চাপে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। দাদু জানতে পেরে ধরে নিয়ে এসেছেন নিজের বাড়িতে। এখন ও রোজ রাত্তিরে দাদুর কাছে পড়াশোনা শিখতে আসে।

গুলের মুখটা আমার চেনা চেনা লাগছিল। ও—ও দেখলাম আমাকে চেনে। ফিস ফিস করে বলল, তুই শান্তিসংঘে রাইট উইং—এ খেলিস না?

আমারও মনে পড়ে গেল, গুলেকে ফুটবলের মাঠেই দেখেছি। চাউলপট্টি নেতাজি সংঘের গোলকিপার। অসাধারণ কিপিং করে। সত্যি কথা বলতে কি, ওর জন্যেই লাস্ট সিজনে নেতাজি সংঘ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

প্রথমদিন কোনো বইখাতা ছাড়াই দাদু যা পড়ালেন, সে আমার কাছে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। মনে তো হল গল্প শুনছি, কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় বুঝলাম, ওই গল্পের জোরেই ইতিহাসের ইঙ্গ—মারাঠা চ্যাপটার—টা মাথার মধ্যে গেঁথে গেছে। ঠিক করলাম, রোজ আসবো। একটা দিনও বাদ দেব না।

সত্যিই গত তিন বছর ধরে তাই আসছি। খুব অসুবিধে না হলে কামাই করিনি।

প্রথমদিনেই ফেরার সময় গুলে, টুকটুকি আর বকাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প হল। আমার তো তবু বাবা বেঁচে আছে। গুলের বাবা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। ওর মা একটা প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করে। কিন্তু তাতে চলে না বলে গুলে সকালে বাড়িতে বাড়িতে খবরের কাগজ দেয়। বিকেলেও শিয়ালদা স্টেশনে ম্যাগাজিন বিক্রি করে। সেইজন্যেই ও স্কুলে যেতে পারে না।

টুকটুকির গল্পটাও প্রায় একই রকমের। শিয়ালদা ফ্লাইওভারের নীচে ফুটপাতে টুকটুকিদের একটা ভাতের হোটেল আছে। সেটা আমিও যাতায়াতের পথে দেখেছি। ফুটপাথের ওপরেই দুটো টেবিল পাতা। মাথায় কালো প্লাস্টিকের ছাউনি। ওই হোটেলেই কোলে মার্কেটের দোকানদার, ড্রাইভার আর খালাসিরা ভাত, তরকারি, মাছের ঝোল এইসব খায়। একেবারেই গরিব হোটেল আর কি। টুকটুকির মা নিজেই রান্না করে। ওর বাবা কাস্টমারদের খেতে দেয়। আর টুকটুকি সারাদিন টেবিল মোছে আর বাসন ধোয়। ওর বাবা—মাই ওকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছিল।

দাদু রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে টুকটুকির অবস্থা দেখে ওর বাবা—মাকে রাজি করিয়েছেন রাতের দিকে ওকে পড়তে পাঠাতে।

বকাইয়ের বাবার বেলেঘাটার খালপাড়ে একটা মোটরগাড়ি সারানোর গ্যারেজ আছে। পয়সার খুব একটা অভাব নেই। আমাদের মধ্যে একমাত্র বকাইয়েরই একটা মোবাইল ফোন আছে। ওদের একটা পুরোনো কিন্তু বেশ বড় ভ্যান—গাড়িও আছে। সেটা বকাইও কখনো কখনো চালায়। কিন্তু ফ্যামিলিতে পড়াশোনার ব্যাপারটা ছিল না। বকাইয়ের বাবা ইচ্ছে করেই বকাইকে স্কুলে ভর্তি করেননি। ভাবতেন, লেখাপড়া শেখার থেকে বকাই যদি ওনার সঙ্গে থেকে গাড়ি সারানোর কাজ শেখে তাতে লাভ বেশি। ওর বাবাকে অনেক বুঝিয়ে—সুঝিয়ে দাদু রাজি করেছেন রাত্তিরের দিকে পড়তে আসতে।

মান্তুর সম্বন্ধে আপাতত এইটুকুই বলি, ও দাদুর বাড়িতেই থাকে, যদিও দাদুর ও কেউ হয় না।

দাদু গত কয়েক বছর ধরে সারাক্ষণ এই কাজই করে যাচ্ছেন। যেখানেই স্কুল—ছুট বাচ্চা দেখতে পাচ্ছেন তাদের রাতের স্কুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টায় বেশিরভাগ সময়েই ফল হয় না। বাচ্চাদের বাবা—মারা বলে, ধুর পড়াশোনা করে কী হবে? আর সারাদিন খাটাখাটনির পর সন্ধে থেকেই ঘুমে ঢুলতে থাকে। পড়বে কেমন করে?

তাই আপাতত দাদুর নাইট—স্কুলে আমরা পাঁচজনই ছাত্রছাত্রী।

দুই

ক’দিন ধরে দেখছিলাম দাদুর মধ্যে সেই স্বাভাবিক হাসিখুশি ফুর্তিবাজ ভাবটা নেই। থাকতে না পেরে একদিন জিগ্যেস করলাম, আপনার শরীর খারাপ নাকি?

দাদু বললেন, উঁহু, মনখারাপ।

জিগ্যেস করলাম, কেন?

দাদু উত্তর না দিয়ে গুনগুন করে রবিঠাকুরের গান গেয়ে উঠলেন—’তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা। আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা। এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু, নামাও।’

আমরা তো বড় হয়ে গেছি, সবই একটু একটু বুঝতে পারি। তাই পাঁচজনেই বইয়ের দিকে মুখ নামিয়ে নিলাম। আমরা বুঝতে পারছিলাম, দাদুকে আবার গুন্ডাগুলো বাড়ি বিক্রির জন্যে হুমকি দিয়েছে।

দাদু নিজেই আমাদের বলেছিলেন, কয়েকটা গুন্ডা নাকি এই বাড়িটা বিক্রি করে দেবার জন্যে দাদুর ওপর ভয়ঙ্কর চাপ দিচ্ছে। ওরা এই বাড়ি ভেঙে এখানে শপিং—মল বানাবে। দাদু তাতে একেবারেই রাজি নন। ওনার স্বপ্ন, আমাদের এই পাঁচজনের স্কুলটাই একদিন অনেক বড় হবে। তখন ওপর—নীচ মিলিয়ে এই বাড়ির বারোটা ঘরেই ক্লাস বসবে। সামনের উঠোনে জিম তৈরি হবে। পেছনের বাগানে নার্সারির বাচ্চাদের জন্যে দোলনা আর স্লিপ বসবে। আর সবকিছুই হবে আমাদের মতন গরিব ছেলেমেয়েদের জন্যে।

লোকগুলোকে আমরা একদিন দেখেওছিলাম। তখন রাত নটা বাজে। আমি, বকাই, গুলে আর টুকটুকি সবে দাদুর বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। মান্তু আমাদের দেখতে পেয়ে ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়াল। বসার ঘরের খোলা দরজা দিয়েই দেখতে পেলাম সোফায় দুটো লোক বসে আছে। তাদের সামনে বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে দুটো হাত রেখে দাদু দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

ওরা একটা ব্লু—কালারের অডি গাড়ি নিয়ে এসেছিল। দুজনেরই হোঁতকা চেহারা। একজন সন্ধেবেলাতেও চোখে শেডস পরেছিল আর সারাক্ষণ চবড় চবড় করে পানমশলা চিবোচ্ছিল। তার নাকের নীচে মোটা গোঁফ আর তেল—চুপচুপে চুলগুলো ছিল উলটো করে আঁচড়ানো। অন্য লোকটার গায়ের রং কুচকুচে কালো আর সে পরেছিল ধবধবে সাদা সাফারি স্যুট। ওই লোকটার গোঁফ ছিল না। তবে ছোট করে ছাঁটা চুলে মেহেন্দি না কি যেন লাগিয়েছিল, ফলে মাথাটা দেখতে লাগছিল অবিকল পাকা পেঁপের মতন।

আমরা ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনলাম, দাদু ওদের বলছেন, দেখুন মিস্টার জয়সোয়াল, বাড়ি আমি ছেলের নামে লিখে দিয়েছি। সে যদি বিক্রি করতে চায় তো করবে।

লোকটা একটু থতমত খেয়ে বলল, তাই নাকি? সবাই যে বলল, আপনিই মালিক।

না, আমি মালিক নই। আমার পঁচাত্তর বছর বয়স। একবার ম্যাসিভ স্ট্রোক হয়ে গেছে। প্রতিদিন প্রেশারের ওষুধ খেতে হয়। তাই তিন বছর আগেই আমার ছেলের নামে সব প্রপার্টি ট্র্যান্সফার করে দিয়েছি। তাছাড়া আর একটা কথা…।

বলুন!

আমার ছেলেকেও বাড়ি বিক্রির কথা বলে লাভ নেই। কারণ, আমার এই বাড়ি বিক্রি করার একদমই কোনো ইচ্ছে নেই আর সে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবে না।

কেন ইচ্ছে নেই সোমসাহেব? লালচুলের লোকটা এমন ব্যঙ্গ—মাখানো গলায় প্রশ্নটা করল যে, বোঝাই গেল অন্যের ইচ্ছে—অনিচ্ছের কথাকে সে পাত্তা দেয় না।

দাদু বলল, এই বাড়িতে আমি একটা স্কুল বানাবো।

গোঁফওলা লোকটা তাই শুনে বলল, মিস্টার সোম, আপনাকে আমি রাজারহাটে এর ডবল জমি দিয়ে দেবো। কিংবা আপনি তিন কোটি টাকাও নিতে পারেন, ক্যাশ। আপনি যত ইচ্ছে স্কুল বানান না।

দাদু বললেন, আমার স্কুলে যারা পড়বে তারা রাজারহাটে থাকে না। বেলেঘাটার বস্তিতে থাকে।

দুটো লোকই ঘাড় ঘুরিয়ে প্যাট প্যাট করে আমাদের দিকে তাকাল। আমাদের গায়ে নোংরা জামা—প্যান্ট, পায়ে হাওয়াই চটি, হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে বইখাতা। ওরা একমিনিটেই যা বোঝার বুঝে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় গোঁফওলা লোকটা হঠাৎ বলল, যদি স্টুডেন্টরাই আপনার কাছে না আসে তাহলে স্কুলটা চালাবেন কাদের নিয়ে মিস্টার সোম?

দাদু অবাক হয়ে বললেন, কেন? স্টুডেন্টরা আসবে না কেন?

ভয়ে আসবে না, মিস্টার সোম। বাচ্চারা খুব ভীতু হয়। যদি দেখে তাদের একজন বন্ধু স্কুলে আসতে গিয়ে খুন হয়ে গেছে, তাহলে আর কেউ আসবে না।

এই বলে দুটো লোকই খুব হাসতে হাসতে উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে চলে গেল। একজন আবার যাবার সময় শ্বেতপাথরের ফোয়ারার ভেতরে পিচিক করে পানমশলার পিক ফেলে গেল। মান্তু তো ভয়ের চোটে প্রায় কেঁদেই ফেলে আর কি। আমি, গুলে, টুকটুকি আর বকাইও যে একটু চিন্তায় পড়লাম না তা নয়।

তার কয়েকদিন পরেই লোকগুলোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। তার কারণ হল, আমেরিকা থেকে শুভকাকার আগমন, যাকে এক কথায় শুভাগমনও বলা যায়।

শুভকাকা হচ্ছেন দাদুর একমাত্র সন্তান। বিরাট ইঞ্জিনিয়ার। আমেরিকায় থাকেন। ভালো নাম শুভায়ু সোম।

আমরা গত তিন বছরে চারবার শুভকাকাকে দেখেছি। এত সুন্দর দেখতে যে, বলবার কথা নয়। দাদুর মতনই লম্বা, ফর্সা আর টানা টানা চোখ—নাক। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল একদম ঘাড় অবধি লুটিয়ে পড়েছে। যদিও শুভকাকু সবসময়েই জিনস, টি—শার্ট আর পায়ে স্নিকার পরে থাকে, তবু কোথায় যেন ওই বয়সের রবিঠাকুরের সঙ্গে মুখের খুব মিল পাই। আর স্বভাবটাও একেবারে দাদুর মতন। সারাক্ষণ হো হো করে হাসছে, গান গাইছে।

এই দেখো, শুভকাকার কথা বলতে গিয়ে বেশিক্ষণ আপনি—আজ্ঞে চালাতে পারলাম না। আমার দোষ নেই। প্রথম যখন আলাপ হয়েছিল তখন শুভকাকাই আমাদের বলে দিয়েছিল, একদম আপনি—আজ্ঞে করবি না, তুমি বলবি। শুনতে মিষ্টি লাগে।

শুভকাকা কলকাতায় এলে আমাদের আর কাজে যেতেও ভালো লাগে না, বাড়ি যেতেও না। মনে হয় সারাক্ষণ দাদুর বাড়িতেই পড়ে থাকি। শুভকাকাও যেন যতটা সময় আমাদের সঙ্গে কাটাতে পারে, ততই বাঁচে। বিকেলবেলায় সোমবাড়ির ছাদে যখন আমাদের সঙ্গে রবারের বল নিয়ে ফুটবল খেলে তখন ওকে দেখে কে বলবে অত বড় ইঞ্জিনিয়ার?

শুভকাকা যতবার কলকাতায় আসে আমাদের পাঁচজনের জন্যে অ্যাত্তো জামাকাপড় নিয়ে আসে। আমাদের বাবা—মা ভাই—বোনেদের জন্যেও নিয়ে আসে। তাছাড়া মান্তু আর টুকটুকির জন্যে সাজুগুজুর হাজারটা জিনিস। শুভকাকা এখানে এলে আমাদের পাঁচজনের অন্তত গোটা পাঁচেক ভালো সিনেমা দেখা হয়ে যায়। তাছাড়া তখন সবাই মিলে যে একটা কোথাও বেড়াতে যাবো, সেটাও প্রায় নিয়মেই দাঁড়িয়ে গেছে। যেমন আগের বছর গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতন, আর আগের বার পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়, আর তার আগের বছর মন্দারমণি। একটা বড় গাড়ি ভাড়া করে শুভকাকা, আমি, বকাই, গুলে, মান্তু আর টুকটুকি বেরিয়ে পড়ি। দাদু যান না। এক তো ওনার হার্টের অসুখ। তাছাড়া উনি বলেন, ভালো কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলেই ওনার ঠাম্মার জন্যে খুব মন কেমন করে।

ঠাম্মা তো পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন, তাই রাসমণি বাজারের বাড়িতে এমনিতে সারাবছর তিনটি মাত্র মানুষ থাকেন—দাদু, মনুদিদা আর মান্তু। মনুদিদার বয়স দাদুর চেয়ে একটু কম। তিনি দাদুর কিরকম যেন বোন হন। সোমবাড়ির রান্নাবান্না, ঘর—সংসারের সব কাজ মনুদিদাই সুপারভাইজ করেন।

আমরা বেড়াতে গেলে দাদু আর মনুদিদা এই দুজন বাড়িতে থাকেন।

এবার দিন দুয়েক কলকাতায় কাটিয়েই শুভকাকা বলল, চল! সুন্দরবন ঘুরে আসি। ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম। ভারি চমৎকার লেগেছিল। এখনো মনে আছে, ওখানকার নদীগুলোর জলের রং নীল আর পাড়ের গাছগুলো ঝলমলে সবুজ। এমন কালার—কম্বিনেশন কোথাও দেখিনি।

চলে গেলাম হইহই করে সুন্দরবন। গলা খুলে গাইলাম ‘সুন্দরবনে সুন্দরীগাছ, সবচেয়ে সুন্দর সেই যে গাছ, গাছটি সুন্দরবনে এএএ।’ তারপর দু—দিন বাদে ফেরার পথ ধরলাম। আর ফিরে আসার পথেই খবর পেলাম, দাদু আগের দিন সন্ধেবেলা থেকে বাড়ি ফেরেননি।

শুভকাকার সেলফোনে মনুদিদাই দুঃসংবাদটা জানালেন। সেদিনটা ছিল সোমবার। ঘড়িতে তখন বাজে বারোটা। আমরা ক্যানিং—এর একটা রোডসাইড হোটেলে বসে পার্শে মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। খবরটা শুনে আমরা সকলেই খাওয়া ছেড়ে উঠে হাতটাত ধুয়ে তখনই গাড়ি স্টার্ট করে দিলাম, আর শুভকাকা এমন জোরে বাকি রাস্তাটা ড্রাইভ করল যে, আমরা ঠিক বিকেল তিনটেয় রাসমণি বাজারের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। তারপর আমরা যে ঘরটায় বসে পড়াশোনা করি, সেই ঘরে বসেই সকলে মনুদিদার মুখ থেকে পুরো ঘটনাটা গুনলাম।

আগের দিন, মানে রোববার রাত নটা নাগাদ একজন সুন্দরী মহিলা, পোশাক— আশাক দেখলে কোনো সন্দেহই থাকে না যে তিনি কোনো হসপিটালের নার্স, একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে এই বাড়িতে ঢুকে আসেন। তারপর দাদুকে জিগ্যেস করেন, আপনি কি মিস্টার মল্লার সোম?

দাদু বলেন, হ্যাঁ।

তখন সেই নার্স বলেন, আমি ডায়মন্ডহারবার রোডের সানসাইন হসপিটাল থেকে আসছি। আপনার ছেলে আর নাতি—নাতনিরা সুন্দরবন থেকে বেরিয়ে ফেরার সময় একটা বিচ্ছিরি রোড অ্যাকসিডেন্টে উনডেড হয়েছেন। আপনি শিগ্গিরি আমার সঙ্গে চলুন।

সেই কথা শুনে দাদু আর একটুও দেরি না করে ওই মহিলার সঙ্গে সেই সাদা অ্যাম্বাসাডরে চেপে রওনা হয়ে যান। তারপর থেকে তাঁর আর কোনো খবর নেই। দাদু ফিরছেন না দেখে মনুদিদা রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে অন্তত কুড়িবার দাদুকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করেন। প্রত্যেকবারই শোনেন ফোন সুইচড অফ। তখন মনুদিদা ভয় পেয়ে শুভকাকাকে ফোন করেন। কিন্তু শুভকাকার ফোনও ছিল সার্ভিস এরিয়ার বাইরে।

আমরা এই অবধি শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সত্যিই কাল আমরা পাথরপ্রতিমার যে ট্যুরিস্ট বাংলোটাতে ছিলাম সেখানে মোবাইলের টাওয়ার ছিল না।

শুভকাকা বলল, তারপর?

মনুদিদা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, তারপর আর কী? কাল রাত থেকেই একবার দাদার ফোনে আর একবার তোর ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছি। দাদার ফোন সারাক্ষণ সুইচড অফ, আর তোর ফোন সার্ভিস এরিয়ার বাইরে। শেষে আর থাকতে না পেরে পাশের বাড়ির অনিমেষবাবুকে সব ঘটনা বলে বললাম, আমাকে একটু সানসাইন হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবেন? শুভ, তারু, গুলে ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে তাই তো বুঝতে পারছি না। তা উনি নেট—টেট সার্চ করে বললেন, ডায়মন্ডহারবার রোডে সানসাইন বলে কোনো হসপিটালই নেই। ইন ফ্যাক্ট, সারা কলকাতাতেই ওই নামে কোনো হাসপাতাল নেই। শুনে তো আমার মাথায় বাজ পড়ল।

শুভকাকা বলল, তারপর?

তারপর বারোটা নাগাদ তোকে ফোনে ধরতে পারলাম। এবার তুই বল শুভ, আমি আর কী করতে পারতাম?

শুভকাকা দু—হাতে মাথাটা চেপে ধরে বলল, ও গড, ও গড! আমার বাবাকে তুমি কোন ধাতুতে গড়েছিলে ভগবান? কলকাতায় এমন কোন হাসপাতাল আছে, যারা রুগির আত্মীয়কে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে দেয়? বাবা এই জলের মতন মিথ্যে কথাটায় বিশ্বাস করে গাড়িতে উঠে পড়ল?

তারপর শুভকাকা বলল, মান্তু! বাবার একটা ফোননম্বর লেখা ডায়েরি ছিল। সেটা কোথায় রাখত জানিস?

মান্তু বলল, হ্যাঁ, ওই বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে।

নিয়ে আয় তো। দেখ, বেলেঘাটা থানার নম্বর—টা পাস কি না।

মান্তু সবে টেবিলটার দিকে পা বাড়িয়েছে, এমন সময় আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে দাদুর পুরোনো আমলের ল্যান্ডলাইনের রিসিভারটা ক্রিরিরিং ক্রিরিরিং করে বেজে উঠল।

শুভকাকা লাফ মেরে উঠে ফোনটা ধরল। তারপর মিনিট—তিনেক ধরে ওদিকের কথা শুনে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। আমরা দেখলাম, প্রথমত শুভকাকার কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। দ্বিতীয়ত ওর হাতদুটো কাঁপছে। আর তৃতীয়ত রিসিভারটা ক্রেডলের ওপর না রেখে শুভকাকা পাশে নামিয়ে রাখল। আমি শুভকাকার হাত ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে জিগ্যেস করলাম, কী হয়েছে শুভকাকা? কে ফোন করেছিল?

শুভকাকা বলল, কিডন্যাপার। এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। বাবা হ্যাজ বিন কিডন্যাপড।

ওরা কী বলল?—শুভকাকাকে কথাটা জিগ্যেস করতে গিয়ে দেখলাম আমার গলার ভেতরে কে যেন অনেকখানি আঠালো ঘুড়ির মাঞ্জা পুরে দিয়েছে আর তাই কথা বলতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। তাছাড়া বুকের ভেতরেও দুমদাম করে হৃদপিণ্ডটা লাফালাফি করছিল।

শুভকাকা বলল, স্ট্যাম্প—পেপার কাকে বলে জানিস? যে কাগজের ওপরে বাড়ি বিক্রির দলিল—টলিল লেখা হয়। সেরকম দশটা ফাঁকা স্ট্যাম্প—পেপারে সই করে রাখতে বলল। ওরা পরে বলবে, কাগজগুলো কোথায় রেখে আসতে হবে।

গুলে বলল, ‘ওরা’ মানে কি ওই দাদুকে যারা বাড়ি বিক্রির জন্যে চাপ দিচ্ছিল?

শুভকাকা অবাক হয়ে বলল, তোরা কি ব্যাপারটা জানিস নাকি?

বকাই বলল, হ্যাঁ জানি। এমনকি আমরা ওই গুন্ডাগুলোকে দেখেওছি। ওরা আর কী বলল শুভকাকা?

শুভকাকা বলল, যা বলে থাকে। পুলিশে এসব কথা জানালে বাবাকে আর জ্যান্ত দেখতে পাবো না।

আমরা প্রায় একসঙ্গে সবাই মিলে জিগ্যেস করলাম, তুমি কী করবে?

শুভকাকা বলল, কী করার আছে বল? এখন একবার শিয়ালদা কোর্টে গিয়ে স্ট্যাম্প—পেপার কিনে আনব। তারপর সই করে ওগুলো রেডি করে রাখব। যখন চাইবে দিয়ে দেব।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমরা পাঁচজন আস্তে আস্তে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। তারপর বেলেঘাটা মেন রোডের ফুটপাথ ধরে কিছুটা গিয়ে বাঁক নিলাম খালের দিকে। বলেছিলাম না, খালপাড়ে বকাইয়ের বাবার একটা মোটরগাড়ি সারাবার গ্যারেজ আছে?

গ্যারেজ মানে একটা বড়সড় চালাঘর। তার নীচে সব সময়েই তিন—চারটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। কোনোটার ইঞ্জিন বার করে সারানো হচ্ছে। কোনোটার বডিতে রং করা হচ্ছে। আবার কোনোটার কাচ পালটানো হচ্ছে। শুধু একপাশে একটা বহু পুরনো গাড়ি বছরের পর বছর ধরে পড়ে রয়েছে। পড়ে থাকতে থাকতে সেটার চারটে চাকাই মাটির ভেতরে অনেকটা করে বসে গেছে। ওই গাড়িটা আমাদের পাঁচ বন্ধুর গল্প করার জায়গা। ভেতরের ছেঁড়া সিটের ওপর বসে আমি, বকাই, গুলে, মান্তু আর টুকটুকি অনেক সময় এ ওর কাছ থেকে পড়া বুঝে নিই। কখনো এমনিই নানান গল্প করি, ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা বলি।

দাদুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজও গাড়িটার ভেতরে বসলাম ঠিকই, কিন্তু আমাদের কারুরই মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছিল না। আমাদের দুঃখের জীবনের মধ্যে দাদুর কল্যাণে মাত্র তিনটে বছর একটু স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছিলাম। সেই স্বপ্নটাও হঠাৎ করেই ভেঙে গেল।

দাদু ভেবেছিলেন সামনের বছরেই আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসাবেন। তার জন্যে উনি খান্না স্কুলে আমাদের অ্যাডমিশনও করিয়ে দিয়েছিলেন। দাদু বারবার এ কথাও বলতেন যে, একবার ভালোভাবে মাধ্যমিকটা পাশ করতে পারলে আর চিন্তা নেই। তখন আমরা নিজেদের রেজাল্টের জোরেই বাকি পড়াশোনাটা শেষ করে ফেলতে পারব। আর বই—খাতা, স্কুলের মাইনে—এসবের জন্যে দাদু তো ছিলেনই।

আমরা পাঁচজনেই জানতাম আমরা খুব ভালো রেজাল্ট করব। দাদুর মতন টিচারের কাছে এমনি এমনি তো আর তিন বছর ধরে পড়াশোনা করছি না। কিন্তু সবার আগে তো দরকার দাদুর আমাদের কাছে থাকা, ওই বাড়িটায় গিয়ে পড়াশোনা করা। বাড়িটাই যদি হারিয়ে যায়, দাদুই যদি আমাদের কাছে না থাকেন, তাহলে আর পড়াশোনা চালাব কেমন করে?

তাছাড়াও ভাবছিলাম, মান্তুকে ছেড়ে আমরা বাঁচব কেমন করে?

তিন

টুকটুকি হঠাৎ হাঁটুর ওপরে একটা ঘুষি মেরে বলল, নাঃ, ওরা এইভাবে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারব না। বকাই, তারু, গুলে, মান্তু—তোরা শোন! আমরা নিজেরাই দাদুকে খুঁজে বার করব।

বকাই বলল, কী যে বলিস পাগলের মতন? এই বিরাট কলকাতা শহর। এর মধ্যে একজন মানুষকে খুঁজে বার করা সম্ভব? হয়তো পুলিশ পারলেও পারতে পারে। ওদের শুনেছি ইনফর্মার থাকে। মোবাইলের পজিশন ট্র্যাক করার ব্যবস্থাও থাকে।

মান্তু বলল, দাদুর কেসটায় সে দুটো রাস্তায় হেঁটে সাকসেস পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

বকাই বলল, কেন?

মান্তু বলল, যে গুন্ডাগুলো দাদুর বাড়িটা কিনতে এসেছিল তারা এই শহরের ক্রিমিনাল নয়। দাদুর কাছেই শুনেছি, ওরা জামসেদপুরের লোক। কাজেই এখানকার ইনফর্মাররা ওদের চিনবে না। আর দাদুর মোবাইল তো ওরা শুরুতেই সুইচ অফ করে দিয়েছে। তাহলে সেটাকে ট্র্যাক করবে কেমন করে?

আমরা স্বীকার করলাম, মান্তুর কথায় যুক্তি আছে।

কিন্তু আমাদের মধ্যে টুকটুকিটার বুদ্ধিই সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া ও বেশ অন্যরকমভাবে চিন্তা করতে পারে—দাদু যেটাকে বলেন, ‘প্যারালাল থিঙ্কিং’। যে কোনো প্রবলেমে দেখেছি আমরা চারজন হয়তো অনেক ভেবেচিন্তে চার—রকম সলিউশন বার করলাম, কিন্তু টুকটুকি যেই ওর কথাটা বলল, তখনই মনে হল আমাদেরগুলো একেবারে ফালতু। ওরটাই একমাত্র ঠিক। ইদানীং তাই আমরা ভাবনা—চিন্তা করার কাজটা টুকটুকির ওপরেই ছেড়ে দিয়েছি। এখনও সবাই মিলে টুকটুকির মুখের দিকে তাকালাম।

টুকটুকি আমাদের ইচ্ছেটা বুঝতে পেরেই এই ভর সন্ধেবেলাতেও শুভকাকার কাছ থেকে গিফট পাওয়া সানগ্লাসটা টপ করে চোখে পরে নিল। তারপর গম্ভীরমুখে বলল, দ্যাখ, দাদুর কাছেই শুনেছি, ভালো ডিটেকটিভ হতে গেলে ক্রিমিনালের মনের মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়। তাদের চিন্তাকে ফলো করতে হয়। তাহলেই তুই ক্রিমিনালদের কাছে পৌঁছে যেতে পারবি।

বকাই বিরক্ত গলায় বলল, ঢোক না। কে বারণ করেছে?

টুকটুকি কিছু মাইন্ড করল না। বলল, দ্যাখ, কিডন্যাপারদের কাছে কিন্তু একটা চ্যালেঞ্জ হল দাদুকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ রাখা। একজন পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ, যাঁর অলরেডি একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, এবং যিনি রেগুলার প্রেশারের ওষুধ খান, তাঁকে এমন টেনশনের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ, তাই না?

মান্তু বাধা দিয়ে বলল, প্রথম কথা দাদুর অসুখ—বিসুখের কথা ওরা কেমন করে জানবে? দ্বিতীয় কথা, তুই ভাবছিস কেন, দাদুর প্রাণটা তোর—আমার কাছে যেমন দামি, ওদের কাছেও তাই? যদি দাদু মরেই যায়, ওদের কী?

টুকটুকি সানগ্লাসটা খুলে চোখ বড় বড় করে বলল, দাদুর প্রাণের দাম ওদের কাছে মিনিমাম তিন—কোটি টাকা, জানিস না? ওই অ্যামাউন্টটাই তো ওরা অফার করেছিল। দাদুকে সুস্থ শরীরে শুভকাকার হাতে ফেরত দিতে না পারলে ওই অ্যামাউন্টটাই তো ওরা লুজ করবে। আর দাদুর ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এত বড় বড় কানদুটো নিয়ে সেদিন কী শুনেছিলিস? দাদু নিজেই ওদের বললেন না, আমার বয়স হয়েছে, আমি অসুস্থ, তাই ছেলেকে সব প্রপার্টি লিখে দিয়েছি? কিচ্ছু মনে নেই?

মান্তু অত্যন্ত অফেন্ডেড মুখে বলল, আমার কানদুটো যদিও তোর থেকে বড় নয়, তবু বলে যা, যা বলছিলিস।

টুকটুকি বলল, এবার মনে—মনে কিডন্যাপারদের অবস্থাটা চিন্তা কর। ওরা কি এরকম একজন অসুস্থ লোককে নিয়ে খুব বেশিদূর ট্র্যাভেল করার রিস্ক নেবে?

বকাই একটু চিন্তা করে বলল, এটা ঠিকই বলেছিস। আমি তো এতক্ষণ ভাবছিলাম হয়তো সত্যিই ডায়মন্ডহারবার রোডের দিকে কোথাও…।

টুকটুকি বলল, বুদ্ধু! কিডন্যাপার—রা তোকে ঠিকানা জানিয়ে যাবে? যখন বলেছে দক্ষিণের রাস্তার নাম, তখন নিশ্চিত থাক ওরা উত্তরে কোথাও আছে। হয়তো খুব কাছাকাছিই কোথাও।

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল টুকটুকি। বলল, বুঝলি তারু, ভেবে দেখলাম, দাদু যেরকম মেজাজি লোক তাতে কিডন্যাপারদেরও খুব একটা রেয়াত করবেন বলে মনে হয় না। অন্য কেউ হলে ওরা হয়তো তাকে মাথায় একটা ডান্ডার বাড়ি মেরে কিংবা খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে চুপ করিয়ে দিত। দাদুর কেসে কোনোটাই করা সম্ভব নয়, কারণ দাদু হার্টের পেশেন্ট। কাজেই দাদুর প্রত্যেকটা ছোটোখাটো ডিমান্ড, বাড়িতে থাকলে যেগুলো মনুদিদা আর মান্তু মেটায়, সেগুলো এখন ওদের মেটাতে হবে। এবার একটা লিস্ট কর তো, দাদু ওদের কাছে কী কী চাইতে পারে?

বই ছাড়া এই পৃথিবীতে দাদুর আর কিছুর প্রয়োজন আছে বলে তো কখনো মনে হয়নি। আকাশ—পাতাল ভেবেও আমাদের কিছু মাথায় এল না, এমনকি দাদুর ঘরের লোক মান্তুরও না।

পরদিন দুপুরের দিকে আমরা পাঁচজন আবার মিট করলাম। আমি কোনোরকমে লোটনকাকার দোকান থেকে একঘণ্টা ছুটি ম্যানেজ করে পালিয়ে এলাম। বকাই তো বাবার গ্যারেজেই ছিল। গুলের কাগজ বিলির কাজ সকাল সাড়ে নটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। ও দুপুরের দিকটায় এমনিতেই ফ্রি থাকে, যদিও বিকেল থেকে আবার শিয়ালদা স্টেশনের ম্যাগাজিনের স্টলে গিয়ে বসতে হয়। সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছিল টুকটুকি।

তোমাদের তো আগেই বলেছি, টুকটুকি কাজ করে শিয়ালদা স্টেশনের ফুটপাথের ঝোপড়পট্টি হোটেলে। দুপুরের দিকেই ওর কাজের চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে। তবু ও যখন ওর বাবা—মাকে দাদুর হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল, আর বলেছিল সেই ব্যাপারেই দাদুর ছেলে শুভকাকা ওকে একটু ডেকেছেন, তখন ওনারা আর ওকে আটকাননি।

মান্তুর কথা তোমাদের এতক্ষণ বলিনি। এবার বলি। বিশ্বাস করা না করা অবশ্য তোমাদের হাতে। এটাও ঠিক, মান্তুর মতন মেয়েকে পড়াশোনা শেখানোর কথা একমাত্র দাদুর মাথাতেই আসতে পারে।

মান্তু হচ্ছে বাজিকরদের মেয়ে।

তোমরা নিশ্চয় কখনো না কখনো, কোনো না কোনো রাস্তায় বাজিকরদের খেলা দেখেছ। চওড়া ফুটপাথের ওপর কিংবা রাস্তার কোনায় ছোট পার্কে ওরা খেলা দেখায়। ছেলেদের পরনে থাকে হাঁটু অবধি মালকোঁচা মারা ধুতি আর কুর্তা। তাদের কানে মাকড়ি, বাবরি চুল আর মোটা গোঁফ। মেয়েরা পরে থাকে রংচঙে ঘাগরা আর কাচ বসানো লম্বা হাতার ব্লাউজ। তাদের চিবুকে উল্কি, হাতের কনুই অবধি কাঁসা—পেতলের গয়না।

তারা সবাই ঢোল আর কাঁসি বাজিয়ে লোক জড়ো করে। তারপর বাঁশের ওপর দড়ি খাটিয়ে সেই দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়ার খেলা দেখায়। ছোট্ট তারের রিং—এর মধ্যে দিয়ে তাদের বাচ্চারা অদ্ভুতভাবে শরীরটাকে দুমড়ে—মুচড়ে এদিক থেকে ওদিকে পার করে দেয়। হাওয়ায় ছোরা ছুঁড়ে দিয়ে দাঁত দিয়ে আবার সেই ছোরা লুফে নেয়। জাগলিং—এর খেলা দেখায়। যারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখে,তারাই খেলা শেষে কিছু টাকা—পয়সা দেয়। তাই দিয়ে গরিব বাজিকরদের সংসার চলে।

মান্তু এরকমই এক বাজিকরের মেয়ে। তিন বছর আগেও কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে খেলা দেখাত। একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দাদু দ্যাখেন, খেলার শেষে বাজিকরের বউ ফুটপাথে ইঁটের উনুন বানিয়ে রান্না চাপিয়েছে। অন্য বাচ্চাকাচ্চাগুলো ততক্ষণে ফুটপাথের ওপরেই তুমুল খেলা জুড়েছে কিন্তু একটা বছর বারোর মেয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে একমনে একটা পুরোনো বই কোলের ওপরে রেখে পড়ে যাচ্ছে।

দাদু সেই মেয়েটার পাশে উবু হয়ে বসে তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। গল্পে গল্পে জানতে পারেন, বছরে একবার মেয়েটা যখন রাজস্থানে তার দেশে যায় তখন দু’মাসের জন্যে একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করে, তারপর আবার দশমাসের যাযাবর জীবন। তখন মেয়েটা ওই দু—মাসের পড়াটাকেই আবার…আবার…অসংখ্যবার পড়ে পড়ে মুখস্থ করে ফেলে।

মেয়েটার সঙ্গে একটু কথা বলেই দাদু বুঝেছিলেন, ওর মাথা ভয়ঙ্কর শার্প। দাদু তখন প্রায় হাতে—পায়ে ধরেই মেয়েটার বাবা—মার কাছে থেকে মেয়েটাকে চেয়ে নেন। সেই মেয়েই হল মান্তু। তখন থেকেই মান্তু দাদুর কাছে থাকে। দাদু ওকে নিজের নাতনির মতনই ভালোবাসেন। আমাদের মধ্যে মান্তুই পড়াশোনায় সবচেয়ে ভালো।

মিটিং—এ মান্তু আমাদের জানাল, কিডন্যাপারগুলো আজ সকালে ল্যান্ডলাইনে আবার ফোন করেছিল। শুভকাকা ওদের কাছে দাদু যে বেঁচে আছেন এবং ভালো আছেন তার প্রমাণ চায়। তখন ওরা দাদুর সঙ্গে শুভকাকার কথা বলিয়ে দেয়।

দাদু কথা বললেন?

হ্যাঁ। বললেন, আমার নিজের জন্যে ভাবি না শুভ। কিন্তু আমি মরে গেলে ওই পাঁচটা ছেলেমেয়ের কী হবে? তার চেয়ে তুই বাড়িটা মাফিয়াগুলোকে দিয়েই দে। আমরা আশেপাশে কোথাও একটা ছোটখাটো বাড়ি কিনে থাকবো। স্কুলটা হবে না, তার আর কী করা যাবে? কোনো মানুষই কি আর সব যুদ্ধে জিততে পারে?

তারপর?

শুভকাকা জিগ্যেস করল, তোমাকে ওরা কোনো কষ্ট দিচ্ছে না তো বাবা? দাদু বললেন, আরে না। খুব তোয়াজে রেখেছে। এমন কি প্রেশারের ওষুধ অবধি কিনে এনে খাওয়াচ্ছে। জানে তো, যদি টেঁশে যাই তাহলে সব প্ল্যান মাটি হবে। শুধু সবকটা নিউজপেপার পড়তে পারছি না, এই যা দুঃখ।

তারপর?

তারপর দাদুর হাত থেকে ওরা ফোনটা নিয়ে নিল। মনে হয় ল্যান্ডফোনই হবে, কারণ দাদুকে কে যেন বলল, যান, আপনার আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ুন। কথাগুলো যে বলল, সে কিন্তু বাঙালি।

তারপর ওরা জিগ্যেস করল, শুভকাকা পুলিশে কিছু জানিয়েছে কি না। শুভকাকা বলল, না। তখন ওরা বলল, ব্যাগের মধ্যে করে শুভকাকার সই করা কাগজগুলো রেখে এলেই ওরা দাদুকে ছেড়ে দেবে। শুভকাকা বলল, কেমন করে জানবো, আমার বাবা তখনও বেঁচে আছেন কিনা। তখন ওরা বলল, আমাদের কাজ যদি মিটে যায়, তাহলে শুধুমুধু মানুষ খুন করে নিজেদের ঝামেলা বাড়াবো কেন? তবে আপনি যদি কোনোরকম বেগড়বাঁই করেন, তাহলে মল্লার সোমকে মারতে আমাদের একটুও হাত কাঁপবে না।

তারপর?

তখন শুভকাকা বলল, কবে বাবাকে ছাড়বেন? আজই সন্ধেবেলায় বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক না। লোকগুলো এত চালাক, বলল, চারদিন বাদে। মানে শনিবার। ওইদিন সল্টলেক স্টেডিয়ামে—মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের খেলা আছে। পুরো বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ—ফোর্স সেই খেলার মাঠে ব্যস্ত থাকবে। সেই সময়েই ওরা শুভকাকার কাছ থেকে কাগজগুলো নিতে আসবে, যাতে শুভকাকা ওদের পেছনে দৌড়নোর মতন পুলিশ জোগাড় না করতে পারে।

দাঁড়া, দাঁড়া। টুকটুকি মান্তুকে থামাল। ওরা বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের কথা বলল?

তাই তো বলল।

তার মানে এই কমিশনারেটের আন্ডারে কোনো জায়গাতেই দাদুকে নিয়ে আসছে। যদ্দূর মনে হয় এখনো দাদুকে ওরকম কোনো জায়গাতেই লুকিয়ে রেখেছে।

বকাই বলল, তা যদি রাখেও, আমরা জানছি কেমন করে? সল্টলেক, বাগুইআটি, লেকটাউন সব মিলিয়ে কমিশনারেটের আন্ডারে কি একটুখানি জায়গা?

আমরা হতাশ মুখে বসে রইলাম। টুকটুকি হঠাৎ বলল, আচ্ছা মান্তু, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই ফোনের কথাগুলো নিজের কানে শুনেছিস? তাই?

মান্তু বলল, শুনেছিই তো। আমাদের ল্যান্ডলাইনের একটা এক্সটেনশন আছে জানিস না? পাশের ঘরে সেটা কানে লাগিয়েই তো দাঁড়িয়েছিলাম।

টুকটুকির চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ও হাত বাড়িয়ে মান্তুর কাঁধটা চেপে ধরে বলল, তাহলে একটু মনে করার চেষ্টা কর না, ফোনের মধ্যে এমন কিছু শুনেছিলিস কিনা, যাতে জায়গাটার সম্বন্ধে একটা আঁচ পাওয়া যায়। ট্রামের শব্দ ছিল? কেউ কাউকে কোনো নাম ধরে ডেকেছিল?

মান্তু বলল, না, ওসব কিছু না। কিন্তু অন্যরকমের একটা আশ্চর্য শব্দ পেয়েছিলাম, জানিস! যেন বিরাট একটা ঘণ্টা, গম্ভীর আওয়াজ করে, থেমে থেমে বাজছে।

দমকলের ঘণ্টা?

না, না। বললাম না, গম্ভীর আওয়াজ। ঢং ঢং ঢং করে যেন কেউ একটা পেটা—ঘণ্টা বাজাচ্ছিল।

ক’বার বেজেছিল?—টুকটুকির মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে গিয়েছিল।

মান্তু লজ্জিতমুখে বলল, তা তো গুনিনি। আসলে আমার মন তো তখন ছিল ওদের কথার দিকে।

ঠিক আছে। একটা কথা বলতে পারবি? কিডন্যাপারদের ফোনটা কটার সময় এসেছিল?

আটটা আটান্নয়।

বকাই হেসে ফেলল। বলল, বাবা! এইভাবে কেউ সময় দেখে রাখে নাকি রে মান্তু? একেবারে আটটা আটান্ন? সেকেন্ডটাও বলে দিতে পারবি মনে হচ্ছে।

মান্তু জিভ ভেংচিয়ে বলল, হ্যাঁ, পারবো। আটটা আটান্ন মিনিট ষোলো সেকেন্ড। আমার সামনেই একটা ডিজিটাল টেবিল—ক্লক ছিল, বুঝলে? তাতে ওইভাবেই সময় দেখায়।

টুকটুকি হঠাৎ আকাশের দিকে ডানহাতের মুঠোটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ইয়েয়েয়েস! গট ইট!

আমরা অবাক হয়ে বললাম, জায়গাটা কোথায় বুঝতে পেরেছিস?

পেরেছিই তো। তোরা পারিসনি? ফোনের মধ্যে মান্তু যেটা শুনেছিল, সেটা একটা ঘড়িতে নটার ঘণ্টা বাজার শব্দ। কথা বলতে বলতে নিশ্চয় দু’ মিনিট কেটে গিয়েছিল আর তখনই ঘড়িটা বাজতে শুরু করেছিল।

আমরা অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু ওরকম রাজবাড়ির দেউড়ির মতন পেটা—ঘণ্টার ঘড়ি আজকাল কোথাও আছে না কি!

টুকটুকি মুচকি হেসে বলল, আছে। এবং তার চেয়েও যেটা ইম্পর্ট্যান্ট, বিধাননগর কমিশনারেটের আন্ডারে একটা জায়গাতেই আছে। লেকটাউনের মোড়ের বিগ—বেন। মনে পড়ছে?

আমরা চারজনেই এমন লাফিয়ে উঠলাম যে গাড়ির ছাদে মাথা ঠুকে গেল। সত্যিই তো। এখনো এক বছরও হয়নি, লেকটাউনের মোড়ে, ভি. আই. পি. রোডের ধারে, বিশাল উঁচু ক্লক—টাওয়ারের মাথায় লন্ডনের বিগ—বেনের নকল তৈরি হয়েছে। তাতে প্রতি ঘণ্টায় আসল বিগ—বেনের মতনই ঘণ্টা বাজে—একটার সময় একবার। দুটোর সময় দু’বার। সেই ঘণ্টার গম্ভীর আওয়াজ অনেক দূর থেকে শুনতে পাওয়া যায়। ওই সময়ে আশেপাশের বাড়িতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বললে নিশ্চয় সেই শব্দ অন্য প্রান্ত থেকে শোনা যাবে। মান্তুও নিশ্চয় সেই শব্দই শুনেছিল। গুনলে দেখতে পেতো ন’বার বেজেছে।

আমাদের উচ্ছ্বাসটা ঝিমিয়ে পড়তে অবশ্য ঠিক একমিনিট লাগল। ধরে নিলাম, জায়গাটা লেকটাউন। তাতেই বা কী? সেখানেও তো হাজার হাজার বাড়ি, যেসব বাড়ির জানলা দিয়ে বিগ—বেনের ঘণ্টার আওয়াজ ঢোকে। তার মধ্যে কোনটায় বন্দি আছেন মল্লার সোম, কেমন করে বুঝব?

টুকটুকি হতাশ গলায় বলল, কেউ যদি বলতে পারতিস এমন কোনো জিনিসের কথা, যেটাকে ফলো করে দাদুর খোঁজ পাওয়া যায়!

মান্তুর চোখদুটো হঠাৎ চকচক করে উঠল। ও চেঁচিয়ে উঠল, মনে পড়েছেএএ।

টুকটুকি ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি? কী রে মান্তু?

মান্তু বলল, দাদু কাল ফোনে একটা জিনিস পাচ্ছেন না বলে দুঃখ করছিলেন মনে আছে?

টুকটুকি বলল, হ্যাঁ, মনে আছে। নিউজপেপার।

ঠিক। দাদুর অভ্যেস হচ্ছে একসঙ্গে দুটো নিউজপেপার পড়া। তার মধ্যে বাংলাটা সব জায়গায় সব স্টলেই পাওয়া যায়। কিন্তু ইংলিশ নিউজপেপার যেটা দাদু পড়েন, সেটা জোগাড় করা কঠিন। দা হিন্দু।

গুলে কাগজের লাইনের লোক। বলল, ঠিক বলেছিস। খুব কম লোক ওই কাগজটা রাখেন। এক পিসের দাম এগারো টাকা।

সেইজন্যেই ওরা দাদুকে নিউজপেপারটা দিতে পারেনি।

টুকটুকি বলল, গুলে! তুই আজকেই একবার লেকটাউনের নিউজপেপারের ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে কথা বলবি তো। খোঁজ নিবি, নতুন করে কেউ ‘হিন্দু’র গ্রাহক হয়েছে কিনা।

বকাই বলল, ওরা কি দাদুকে অনন্তকাল ধরে রাখবে নাকি, যে গ্রাহক হবে?

আরে বাবা, আমিও কি অনন্তকালের জন্যে গ্রাহক হবার কথা বলেছি নাকি? যদি ধর আগামী তিনদিন প্রতিদিন হিন্দু দেবার কথা বলে? রোজ সকালে ওই কাগজ পাবার অন্য কোনো উপায় আছে কী?

আমাদের মনে হল, নেই। এবং এও মনে হল, টুকটুকির রাস্তাতেই একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখা যাচ্ছে।

চার

পরদিন সকাল সাতটায় সেই আলোতেই চোখে ধাঁধা লেগে গেল। দিব্যি চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখের ওপর এমন কড়া আলোর ফ্ল্যাশ এসে পড়ল যে, ঘুমটা গেল ভেঙে। চোখ খুলে দেখি রাস্তার দিকের জানলা দিয়ে গুলে ঘরে উঁকি মারছে। ওর হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেলে লাগানো গোল আয়না। আমি রেগেমেগে জানলার কাছে উঠে গিয়ে বললাম, এটা কোন দেশের ভদ্রতা রে?

ও দাঁত বার করে বলল, খালপোল বস্তির ভদ্রতা। কখন থেকে ডাকছি, যদি সাড়া না দিস কী করব? শিগ্নির বাইরে আয়, জবর খবর আছে।

গেলাম বাইরে। গুলে যা বলল, শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। গুলে বলল, ও কাল রাতেই শেয়ালদা থেকে গিয়েছিল উলটোডাঙায়, শিশির মাইতি বলে একজন ডিস্ট্রিবিউটরের অফিসে। শিশিরবাবুই নাকি লেকটাউন, বাঙ্গুর এইসব অঞ্চলে খবরের কাগজের সবথেকে বড় ডিস্ট্রিবিউটর। হিন্দু কাগজটা একমাত্র ওনার হাত দিয়েই ওইসব অঞ্চলে বিক্রি হয়।

শিশিরবাবু গুলেকে খুব ভালোবাসেন। গুলে যখন জিগ্যেস করেছে, লেকটাউন থেকে কেউ হিন্দু কাগজের জন্যে অর্ডার দিয়েছে কিনা, তখন তো শিশিরবাবু হাঁ। বললেন, তুই কেমন করে জানলি? আজ সন্ধেবেলাতেই তো লেকটাউনের একটা হোটেল থেকে ফোন করে বলল, আগামী তিনদিন ওদের ওখানে একটা করে হিন্দু দিতে। এমনিতে ওরা বোর্ডারদের ঘরে দেবার জন্যে প্রায় তিরিশ পিস অন্যান্য বাংলা— ইংরিজি কাগজ নেয়। তার সঙ্গে একটা করে হিন্দু যোগ হল।

গুলে তখন শিশিরবাবুর ডায়েরি থেকে সেই হোটেলের নাম, ঠিকানা আর ফোন—নম্বর তুলে এনেছে। শিশিরবাবু অবিশ্যি বলছিলেন, অ্যাড্রেস লেখার কোনো দরকারই নেই। লেকটাউনের মোড়ে ক্লক—টাওয়ারের পেছনের রাস্তাতেই ওই হোটেল। তবু গুলে সবই লিখে এনেছে।

আমি সব শুনে বললাম, শিগ্গির মিটিং ডাক।

ও জিগ্যেস করল, কোথায় ডাকবো? দাদুর বাড়িতে?

একটু ভেবে নিয়ে বললাম, উঁহু। শুভকাকাকে এখন কিছু না জানানোই ভালো। তুই সবাইকে কালকের মতন বকাইদের গ্যারেজেই আসতে বল। এখন আসতে বললে কেউই আসতে পারবে না। বরং দুপুরবেলাতেই আসতে বল সবাইকে।

গুলে ওর সাইকেল নিয়ে পোঁওও করে বেরিয়ে গেল। বাড়িতে—বাড়িতে কাগজ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও বাকি তিনজনকে এই খবরটাও দিয়ে দেবে।

দুপুরবেলায় বকাইদের গ্যারেজের সেই ভাঙা গাড়ির মধ্যে বসেই গুলে ওর বারমুডার পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করে বলল, এই যে, এই কাগজটাতেই সব লিখে নিয়ে এসেছি।

আমি তো আগেই দেখেছিলাম। মান্তু, টুকটুকি আর বকাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল কাগজটার ওপরে। টুকটুকির ভুরুদুটো আবার দেখি কুঁচকে গেছে। নিজের মনেই বলল, হোটেল কালীমাতা নামটা তো ওইরকম খানদানি এলাকার হোটেলের পক্ষে খুব ম্যাচিং নয়। তুই ঠিক লিখেছিস তো গুলে?

গুলে যে হোটেলটার ঠিকানা লিখে এনেছিল সেটার নাম কালীমাতাই বটে। আমারও আজ সকালে নামটা শুনেই স্ট্রাইক করেছিল, এরকম নাম ওই ঘ্যামা জায়গায় মানায় না। ঠিক যেরকম লেকটাউনের কোনো বাচ্চার নাম তারাদাস হলে মানায় না।

গুলে আমতা আমতা করে বলল, ব্যাপারটা কী জানিস? শিশিরদা তো খুব একটা পড়াশোনা জানা লোক নয়। ডায়েরিতে কাগের ঠ্যাঙ, বগের ঠ্যাঙ করে ইংরেজিতে লেখা ছিল Hotel Kalimati। তো আমি ভাবলাম, ‘কালিমাটি’ আবার কী? ওটা নিশ্চয় ‘কালীমাতা’ হবে। শেষের ‘এ’—টা নিশ্চয় ভুল করে ‘আই’ হয়ে গিয়েছে।

উঁহু। কোনো ভুল হয়নি। ওটা কালিমাটি—ই হবে। এই বলে টুকটুকি বকাইয়ের পকেট থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে কাগজ দেখে হোটেলের নম্বর ডায়াল করল। ওদিকে কেউ ফোনটা ধরল। টুকটুকি বেশ কায়দা করে জিগ্যেস করল, অ্যাম আই স্পিকিং টু দা রিসেপশন অফ হোটেল কালীমাতা?

ওদিকের উত্তরটা আমরাও শুনতে পেলাম। নো ম্যাডাম, ইট ইজ ‘হোটেল কালিমাটি’, অফ লেকটাউন, ক্যালকাটা।

স্যরি, আই ওয়জ মিসটেকেন।

ফোনটা কেটে দিয়ে টুকটুকি বেশ রেলার মাথায় আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভূগোল—ইতিহাস কী জন্যে পড়িস? জামসেদপুর শহরটা যে কালিমাটি নামে একটা আদিবাসী গ্রামের ওপরে তৈরি হয়েছিল তাও জানিস না? এখন অবশ্য জায়গাটার নাম সাকচি। তবে কালিমাটি রোড বলে একটা রাস্তা এখনো ওখানে রয়েছে।

জামসেদপুর!

নামটা শুনেই আমার মাথায় চড়াক করে বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমি বললাম, টুকটুকি, তুই কী ভাবছিস আমি বুঝতে পেরেছি। এই হোটেলটার মালিক হচ্ছে ওই জয়সোয়াল, যে দাদুকে কিডন্যাপ করেছে। মান্তু বলেছিল ওরা জামসেদপুরের লোক। ওদের নিশ্চয় জামসেদপুরে কালিমাটি গ্রুপের নামে অন্যান্য ব্যবসা আছে। তারই একটা অংশ হচ্ছে এই লেকটাউনের ‘হোটেল কালিমাটি’।

ঠিক ধরেছিস। তাহলে কতগুলো জিনিস একে—একে মিলে গেল দ্যাখ। ওরা তিনদিন বাদে দাদুকে হ্যান্ড ওভার করবে, কারণ, ওইদিন বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশফোর্স বড় ম্যাচ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

ওরা তার মানে দাদুকে আটকে রেখেছে বিধাননগরের কাছাকাছি কোনো এক জায়গায়, যে জায়গার জানলা দিয়ে ঘড়ির আওয়াজ ভেসে আসে।

সেরকম জায়গা হচ্ছে একমাত্র লেকটাউন, যেখানে পেল্লায় এক ঘড়ি রয়েছে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় যার আওয়াজ শোনা যায়—যে আওয়াজ মান্তু ফোনের মধ্যে পেয়েছিল।

দাদু সকালবেলায় যে কাগজটা হাতে না পেলে মহা অশান্তি শুরু করেন, সেই কাগজের অর্ডার দিয়েছে লেকটাউনেরই একটা হোটেল, যেটা না কি আবার ঠিক ক্লক—টাওয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

সেই হোটেলের নাম ‘হোটেল কালিমাটি’, অর্থাৎ জামসেদপুরের কানেকশন, যে জামসেদপুরের মাফিয়ারা দাদুকে কিডন্যাপ করেছে।

টুকটুকি বাদে আমরা বাকি চারজন মুহূর্তের মধ্যে ঠিক করে ফেললাম, তাহলে আর দেরি না করে এক্ষুনি শুভকাকাকে সব বলা দরকার। শুভকাকাও ইমিডিয়েটলি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দাদুকে ছাড়িয়ে আনুক।

কিন্তু ওই যে, আগেই বলেছি না, টুকটুকি কথা বললেই মনে হয়, ইসস। কেমন করে এমন ভুল করলাম?

টুকুটুকি আমাদের শান্ত হতে একটু সময় দিয়ে বলল, দ্যাখ, এইসব পুলিশি হানার সময় কিরকম পরিস্থিতি তৈরি হয় তা তোরা জানিস। সিনেমায়—টিনেমায় অনেক দেখেছিস। ধর ক্রস—ফায়ারে দাদু মরেই গেলেন। কিংবা দাদুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ওরা পালাতে চাইল আর দাদুর সেই টেনশনে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। তখন কী করবি?

আমরা বললাম, তাও তো ঠিক। কিন্তু তাছাড়া উপায়ই বা কী?

টুকটুকি বলল, কেন? আমরাই দাদুকে ছাড়িয়ে আনি না।

টুকটুকির মাথায় যে একটু ছিট আছে এটা বরাবরই জানতাম, কিন্তু সেটা যে এরকম ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা জানতাম না। চারজনেই অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।

টুকটুকি তখন বেশ দিদিমণির স্টাইলে বুঝিয়ে বলল—দ্যাখ, প্রথমেই কাজটাকে অসম্ভব ভেবে বসিস না। পুলিশের চেয়ে আমাদের অনেকগুলো ব্যাপারে অ্যাডভান্টেজ বেশি। আমাদের দেখে কেউ সন্দেহই করবে না আমাদের সঙ্গে দাদুর কোনো সম্বন্ধ রয়েছে।

মান্তু বলল, কিন্তু বন্দুক? রাইফেল? একটা লাঠি অবধি নেই আমাদের হাতে। ওই ভয়ঙ্কর ক্রিমিনালদের ডেরায় খালি হাতে ঢুকে পড়ব?

টুকটুকি বলল, এগজ্যাক্টলি। সেইটাই তো চাইছি। অস্ত্রশস্ত্র থাকা মানেই দাদুর আহত হবার সম্ভাবনা।

কিন্তু ওখানে ঢুকব কেমন করে? এবার আমি প্রায় চেঁচিয়েই উঠলাম।

টুকটুকি বলল, কেন? একজন পণবন্দির জন্যে পুরো হোটেলটা নিশ্চয় ওরা বন্ধ করে দেয়নি। লোকজনের আসা—যাওয়া নিশ্চয় আছে। তাহলে অন্যেরা যেভাবে হোটেলে ঢুকছে সেইভাবেই ঢুকবো।

কিন্তু যাই করি, কোনোভাবেই নিজেদের আইডেনটিটি ওদের বুঝতে দেবো না। যদি দেখি একান্তই দাদুর কাছে পৌঁছতে পারলাম না, তাহলে চুপচাপ ফিরে আসবো। তখন তো পুলিশে খবর দেওয়ার অপশন—টা রইলই।

বকাই গম্ভীরমুখে বলল, বুঝতেই পারছি, তোর একটা প্ল্যান আছে। সেটা যদি এবার একটু বলে ফেলিস তাহলে সুবিধে হয়।

টুকটুকি একগাল হেসে বলল, প্ল্যান তো আছেই। শোন।

পরের পনেরো—মিনিটে টুকটুকি ফিসফিস করে আমাদের পুরো প্ল্যানটা গুছিয়ে বলে দিল। শোনার পরে ব্যাপারটাকে খুব একটা অসম্ভব বলে মনে হল না। এমনকি এও মনে হল, আমরা না পারলে আর কেউই দাদুকে ছাড়িয়ে আনতে পারবে না।

ফেরবার পথে একবার রাসমণি বাজারের বাড়ি ঘুরে গেলাম। শুভকাকা উদাসমুখে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিল। আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে বসল। দেখলাম দু’দিনেই ওর চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে, গালে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় দাড়ি। বলল, কালকেও দু’বেলা বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। এমনিতে ভালোই আছে। এ. সি. ঘর। চব্বিশঘণ্টা একটা অ্যাটেন্ডান্ট। বলল, বাবার জন্যে স্পেশালি প্রেশারের ওষুধ, বাবার নিজের ব্র্যান্ডের দাঁতের মাজন এমনকি হিন্দু পেপারটা অবধি আনিয়ে দিয়েছে। তবে খাবার—দাবার খুব রিচ। বোধহয় কোনো হোটেল থেকে আনিয়ে দিচ্ছে।

বকাই সবে বলতে শুরু করেছিল, আনিয়ে আবার দেবে কি? হোটেলেই তো আছেন…। সিন—বোনে একটা লাথি মেরে ওকে থামাতে হল।

শুভকাকা বলল, রিচ খাবার বলে বাবার খেতে অসুবিধে হচ্ছে। ওরা বলেছে আজ থেকে একটা মেয়েকে ডেকে বাড়িতেই রান্না করাবে।

টুকটুকি জিগ্যেস করল, দাদুকে কোন রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছে, কোথায় রেখেছে কিছুই বলতে পারছেন না?

শুভকাকা বলল, নারে গাড়িতে ওঠার পরেই দু’দিক থেকে দুটো লোক বাবাকে জাপটে ধরে মাথার ওপর দিয়ে একটা ঢাকনা পরিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া বাবা যখনই ফোনে কথা বলছে, পাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। বাবা আপত্তিকর কিছু বলতে গেলেই ফোন কেড়ে নিচ্ছে। ভাবছি পুলিশের কাছেই চলে যাই। ডি. এস. পি. তো আমার প্রেসিডেন্সির ব্যাচ—মেট। নিশ্চয় জোরদার এফর্ট দেবে।

আমরা হাঁ হাঁ করে উঠলাম। বললাম, দাদুকে যারা কিডন্যাপ করেছে তারা খুব সাঙ্ঘাতিক লোক। পুলিশে খবর দিয়েছ জানলে দাদুকে মেরে ফেলতে ওদের একটুও হাত কাঁপবে না। এমনকি রেসকিউ অপারেশনের সময়ও দাদু মারা যেতে পারেন।

শুভকাকা বলল, তাহলে আর কী? শুয়েই থাকি।

এই বলে সত্যিই কপালে হাত রেখে শুয়ে পড়ল। আমরা পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

পাঁচ

আমি, টুকটুকি আর গুলে বাড়িতে বলেছিলাম, শুভকাকার সঙ্গে কাল খুব ভোরেই এক জায়গায় যেতে হবে। মান্তু মনুদিদাকে বলেছিস, বকাইদের বাড়িতে পুজো আছে, নেমন্তন্ন করেছে। আর বকাই ওর বাবাকে বলেছিল, শুভকাকার খুব ভোরে একটা গাড়ির দরকার। অন্য কেউ রাজি হচ্ছে না, তাই ওকেই যেতে হবে। বলা বাহুল্য সবকটাই গুল, তবে এরকম গুল আমরা মাঝেমধ্যে মেরে থাকি।

শেষমেশ বকাইয়ের ভ্যানে চেপে আমরা যখন লেকটাউনের মোড়ে পৌঁছলাম, তখন বিগ—বেনের ডায়ালের কাঁটাদুটো সময় দেখাচ্ছে সাড়ে—ছটা। আরো একটু আগেই আসতে পারতাম, কিন্তু গুলেকে সেদিনের খবরের কাগজের বান্ডিল এমনকি সাইকেলটা অবধি ভ্যানের পেছনে চাপিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। ওইজন্যেই একটু দেরি হল।

এত সকালে রাস্তায় লোকজন বিশেষ নেই। আমরা হোটেল খুঁজতে চললাম। একসঙ্গে নয় অবশ্যই, একজনের সঙ্গে আরেকজন অনেকটা গ্যাপ রেখে হাঁটছিলাম। গুলে আসছিল সবার পেছনে, সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে। সাইকেলের হ্যান্ডেলের ওপর ভাঁজ করা কাগজ আর ম্যাগাজিন। আর বকাই আমাদের সঙ্গে এল না। ও গাড়িটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল হোটেলের পেছনের একটা সরু রাস্তায়।

হয়তো চকচকে চেহারার চারজন ছেলেমেয়ে ভালো পোশাক—আশাক পরে এত সকালে রাস্তায় ঘোরঘুরি করলে লোকজনের একটু সন্দেহ হত। কিন্তু আমরা তো বাস্তবেই রাস্তার ছেলেমেয়ে। আমাদের ছেঁড়া জামা—প্যান্ট, চুলে সস্তার সেলুনের বাজে ছাঁট, মেয়েদুটোর চুলে জট। আমাদের পায়ে সস্তার স্যান্ডেল, হাতে ঘড়ি নেই, মোবাইল নেই। চারপাশে আরো যারা এই সাতসকালে ঘোরাঘুরি করছে—ওই ময়লাওলা, কাগজওলা, আনাজের ভ্যান টেনে নিয়ে যাওয়া ছেলে কিংবা লোকের বাড়ি বাসন মাজতে চলা মেয়ে—ওদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে মিশে গিয়ে আমরা লেকটাউনে ঢুকে পড়লাম।

সামনেই একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়েছিল। একজন অফিসার শিস দিয়ে গুলেকে ডেকে নিয়ে একটা বর্তমান কিনলেন। বান্ডিলের ভেতর থেকে সড়াৎ করে একটা কাগজ টেনে বার করে হাতে ধরিয়ে দেওয়া, তারপর এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে অন্য হাতে খুচরো গুনে ফেরত দেওয়া—এই সবকটা কাজই গুলে যেরকম এক্সপার্টের মতন করল, ওটা গল্পের বইয়ের ছদ্মবেশী ডিটেকটিভদের পক্ষে সম্ভব নয়।

হোটেল কালিমাটি সত্যিই একেবারে ক্লক—টাওয়ারের গায়েই। ভি আই পি রোডের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাঁচতলা বাড়ি। সামনে বড় লোহার গেট, অত সকাল বলে অর্ধেকটা মাত্র খুলেছে। তারপর ফুলের টব দিয়ে সাজানো ছোট উঠোন পেরিয়ে বাহারি কাচের পেল্লায় দরজা। দরজার ওপাশে নিশ্চয় রিসেপশন—ডেস্ক আর লাউঞ্জ রয়েছে।

প্ল্যানমতন প্রথম এন্ট্রি নিল গুলে। একেবারে একশো মিটার দূর থেকে সাইকেল চালিয়ে ফুল স্পিডে গেটের ভেতর ঢুকে পড়ল। অ্যাশ—কালারের ইউনিফর্ম পরে প্রাইভেট সিকিউরিটির যে ভদ্রলোক গেট সামলাচ্ছিলেন তিনিও মোড়ের ওই পুলিশকাকুর মতনই গুলেকে দেখেও দেখলেন না। কেনই বা দেখবেন? বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি—দিন সকালে যে আসছে, তাকে দেখার দরকার পড়ে কি? আমরা ক’জন মনে করতে পারি, আমাদের বাড়ির কাগজের হকারের মুখ?

গুলে হন্তদন্ত হয়ে রিসেপশনের সামনে গিয়ে বলল, হিন্দু কোন ঘরে?

একজন মহিলা গুলের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কী যা তা বকছ? হোটেলে আবার হিন্দুদের জন্যে আলাদা ঘর হয় নাকি?

ডেস্কের দুজন ম্যাডামের চোখেই রাতজাগার ক্লান্তি। শিফট চেঞ্জের সময় হয়ে গিয়েছে। তাঁরা এখন শুধু ভগবানকে ডাকছেন, কখন রিলিভার এসে ডিউটি ধরে, আর তাঁরা ছুটি পান।

শুধু রিসেপশনের স্টাফ নয়, সারা হোটেলের সমস্ত স্টাফেরই এখন মনোভাব ওইরকমই—পালাই, পালাই। টুকটুকি এটা জানত, কারণ, ও কিছুদিন ধর্মতলার একটা হোটেলের কিচেনে কাজ করেছিল। সেইজন্যেই অপারেশনের টাইমটা ও ঠিক করেছিল এই সাড়ে—ছটা—সাতটার সময়।

গুলে মেঝেতে পা ঠুকে বলল, আরে এই হিন্দু কাগজটা কোন রুমে দেব? আমার সময় নেই। শুধু আপনাদের এই একটা কাগজ দেবার জন্যে আমাকে দমদম পার্ক থেকে লেকটাউনে আসতে হয়েছে।

দাঁড়াও ভাই, দাঁড়াও! অত তাড়াহুড়ো করলে হয় না।

গুলে সমান মেজাজ দেখিয়ে বলল, তাহলে এখানেই রেখে যাচ্ছি। আপনি দিয়ে দেবেন।

অন্য রিসেপশনিস্টটি এবার মিষ্টি হেসে বললেন, রাগ করিস না ভাই। এখন শিফটচেঞ্জের সময়। যাকেই ডাকব সেই মেজাজ দেখাবে। এই বলে ইন্টারকমে কাকে যেন বললেন, দেবুদা, স্পেশাল গেস্টের নিউজ—পেপার এসেছে। পাঠিয়ে দেব? না, না, বাইরের লোক কেন হবে? কাগজের ডেলিভারি—বয়।

তারপর ফোনটা নামিয়ে রেখে বললেন, একদম ফোর্থ ফ্লোরে চলে যাবে। করিডরের শেষ মাথা…।

রুম—নাম্বারটা বলুন না! আমি খুঁজে নেব।

রুম—নাম্বার নেই বাবু। যা বলছি শোনো। করিডরের শেষ মাথায় গিয়ে দেখবে ছাদের সিঁড়ি উঠে গেছে। ছাদ অবধি যেতে হবে না। তার আগেই ল্যান্ডিং—এর দরজা। ঠিক আছে?

গুলে উত্তর না দিয়ে ব্যস্তসমস্ত ভাবে পা চালাল লিফটের দিকে।

কেমন দেখলি?—গুলে ফিরে আসা মাত্র আমরা হোটেলের পেছনের গলিতে ওকে চেপে ধরলাম।

কিচ্ছু দেখতে পাইনি রে। সাইকেলটা আবার বকাইয়ে ভ্যানের পেছনে ওঠাতে ওঠাতে গুলে জবাব দিল। একপাল্লার সলিড কাঠের দরজা, ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। যে ছেলেটা দরজাটা একটু ফাঁক করে আমার হাত থেকে কাগজটা নিল, সে বোধহয় এই ভ্যানটাকে এক হাতে তুলে ফেলতে পারবে। বিশাল লম্বা—চওড়া চেহারা। একটা ক্যাঁটকেঁটে লাল ট্রাকস্যুট পরেছিল। এমনকি মাথার টুপিটা অবধি খোলেনি, আর সেটার রংও লাল।

সাইকেলটাকে যথাস্থানে রেখে গুলে আমাদের দিকে ঘাড় ফেরাল। তারপর অবাক হয়ে বলল, আরে! টুকটুকি আর মান্তু কোথায় গেল?

বকাই মুচকি হেসে বলল, শিফট ধরতে গেছে। ওদের আবার আজ কিচেনে ডিউটি।

সত্যিই তখন টুকটুকি হোটেল কালিমাটির বিশাল কিচেনের একপাশে দাঁড়িয়ে একের পর এক পাঁউরুটি স্লাইস করে চলেছিল। পাশে দাঁড়িয়ে মান্তু বাটারের ব্লক থেকে বাটার লাগাচ্ছিল। কিচেন—ইনচার্জ একবার আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে অন্য একজন হেল্পারকে বললেন, মেয়েদুটোর তো তৈরি হাত দেখছি। কবে কাজে লাগল?

আজকেই কাজে লেগেছে স্যার। তবে ওদের কিন্তু টেম্পোরারি ডিউটি। কালকেই শেফ বলছিলেন, পাঁচতলার পেশেন্টের জন্যে হালকা রান্না করতে হবে। ওদের সেই কাজের জন্যে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছে। আমি জানতাম না। ওরা নিজেরাই এসে বলল, ওদের আগামী তিনদিনের কাজের কথা বলা হয়েছে।

কিচেন—ইনচার্জ দেখলেন মান্তু একটা ছোট টি—পটে চা ভিজোচ্ছে। টুকটুকি দুটো সেদ্ধ ডিম ফুটন্ত জল থেকে তুলে একটা ঠান্ডা জলের পাত্রের মধ্যে ডুবিয়ে দিল। তারপর ঠান্ডা জল থেকে তুলে আলতো হাতের চাপে পুরো খোলাটা সুন্দর করে তুলে আনল। তিনি বললেন, দ্যাখো, যদি পারো মেয়েদুটোকে পার্মানেন্টলি রেখে দাও। দে উইল মেক গুড কুকস।

টুকটুকি পায়ে পায়ে কিচেন—ইনচার্জের দিকে এগিয়ে এসে বলল, স্যার, অ্যাপ্রন কোথায় আছে?

ইনচার্জ বললেন, ওই কাবার্ডটার মধ্যে থেকে বার করে নাও। তোমাদের পেশেন্ট কফি খান! কফি নিয়ে যাচ্ছ যে?

না স্যার, পেশেন্টের জন্যে লিকার চা। কফি ওই—ঘরের অ্যাটেনডেন্টের জন্যে।

গুড, চলে যাও। ফিরে এসে আমাকে বলবে দুপুরের রান্নার জন্যে স্টোর থেকে কী কী লাগবে। আমি স্লিপ লিখে দেবো।

ওকে স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

টুকটুকি আর মান্তু লিফট ধরে ফোর্থ ফ্লোরের দিকে উঠে গেল। ওঠবার পথেই টুকটুকি ওর স্কার্টের পকেট থেকে একটা পুরিয়া বার করে অনেকটা সাদা গুঁড়ো কফির কাপে ঢেলে দিল। এটা ওকে জোগাড় করে দিয়েছে শিয়ালদা—বহরমপুর লাইনের বিখ্যাত কেপমার গোকুল পাল। ওই লাইনের কত প্যাসেঞ্জারকে যে এটা—ওটা খাইয়ে বেহুঁশ করে যথাসর্বস্ব নিয়ে পালিয়েছে গোকুল তার ঠিক নেই। গোকুল জেলের বাইরে থাকলে টুকটুকিদের হোটেলেই দুপুরে ভাত খায়। টুকটুকিকে প্রায় জন্ম থেকেই দেখছে, ওকে ভালোওবাসে খুব। তবে ওর পড়াশোনা শেখাটা কোনোদিনই ভালো চোখে দেখেনি গোকুলকাকা।

গুলের মুখ থেকে শুনে দাদুকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, সেই ঘরটা সম্বন্ধে বেশ পরিষ্কার আইডিয়া হয়ে গিয়েছিল টুকটুকির। সে সোজা সিঁড়ির ল্যান্ডিং—এর ওই দরজায় বেল বাজাল। যার দরজা খোলার কথা সেই দরজা খুলল। ক্যাঁটকেঁটে লাল ট্রাকস্যুট আর টুপি পরা দৈত্য।

মান্তু বাইরে দাঁড়িয়েছিল। টুকটুকি ব্রেকফাস্টের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। দরজার লাগোয়া সেই ঘরটা বসার ঘর। উলটোদিকের দেওয়ালে আরেকটা দরজা। ওই দরজা দিয়ে পাশের ঘরটায় যাওয়া যায়।

উলটোদিকের দরজাটার একটা পাল্লা অল্প একটু খোলা। তার ফাঁক দিয়ে যা দেখল তাতে টুকটুকির মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। টুকটুকি দেখল হাসপাতালের বেডের মতন একটা লোহার খাট। খাটটায় যিনি শুয়ে আছেন তাঁর ফরসা রোগা পায়ের গোছদুটো ছাড়া শরীরের আর কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। তবে হতাশ হওয়ার জন্যে ওইটুকুই যথেষ্ট। কারণ, একটা পা লোহার শেকল দিয়ে খাটের রেলিং—এর সঙ্গে বাঁধা রয়েছে।

ওদিকে অত দেখার কী আছে? ট্রে—টা টেবিলের ওপর নামিয়ে বেরিয়ে যাও। লাল দৈত্যের গলার স্বরটা কিন্তু অদ্ভুত ঠান্ডা। শুনলে শরীরে কাঁপুনি লাগে।

টুকটুকি একবার শেষ চেষ্টা করল। বলল, আমাকে বলেছে খাওয়া হয়ে গেলে বাসনগুলো নিয়ে যেতে।

আমি বলছি বেরিয়ে যেতে, বেরিয়ে যাও। খাওয়া হয়ে গেলে আমি রুম—সার্ভিসে ফোন করে দেব। তখন বাসন নিয়ে যেও।

আমি দাঁড়াচ্ছি স্যার। বারবার ওপর—নীচ করা…।

ঘাড়ের পেছনে একটা ছোট্ট ধাক্কা। টুকটুকি প্রায় উড়েই ল্যান্ডিং—এ বেরিয়ে এল। পেছনে শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল নম্বরছাড়া ঘরের দরজা।

টুকটুকির মুখটা লাল হয়ে গেল। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে একমিনিট কি যেন ভাবল। তারপর মান্তুকে বলল, তুই এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ছাদে উঠে যা। কেউ বাই চান্স ছাদে গেলে এমন ভাব করবি যেন ছাদে কাপড় মেলতে এসেছিস। আমি তারু আর বকাইকে পাঠাচ্ছি। ওরা বলে দেবে কী করবি।

আর তুই?—মান্তু নার্ভাস গলায় জিগ্যেস করল।

আমার কাজ আপাতত শেষ। আমি নীচে ওয়েট করছি।

নামবার সময় লিফট না ধরে টুকটুকি সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। দুটো লিফটেই এখন অনেক লোক। সকলেই প্রায় হোটেলের স্টাফ। নাইট—শিফটের শেষে বাড়ি ফিরবে বলে নীচে নামছে। সেইজন্যেই এখন লিফটে ওঠা একদম সেফ নয়।

তা ছাড়া অন্য একটা কাজ রয়েছে।

চারতলা থেকে যেখানে র্সিড়িটা ওপরের দিকে উঠেছে সেখানেই দেওয়ালের গায়ে একটু ওপরে একটা ফিউজ—বক্স। টুকটুকি চট করে একবার চারদিকে চেয়ে দেখে নিল, কেউ দেখছে কি না। তারপর ফিউজের সুইচটা অফ করে দিয়ে তরতর করে বাকি চারটে ফ্লোর নেমে এসে রিসেপশনের সামনে দাঁড়াল।

রিসেপশনের দুই ম্যাডামের মুখ দেখে মনে হল তাঁরা এখন মানুষ খুন করতে পারেন। সাতটা বাজতে চলল, অথচ রিলিভার আসেনি। টুকটুকিকে দেখে তাঁদের মধ্যে একজন অত্যন্ত অ—রিসেপশনিস্ট ভঙ্গিতে খেঁকিয়ে উঠলেন—কী হল?

টুকটুকি হোটেলের অ্যাপ্রন পরে আছে, কাজেই তার পরিচয় নিয়ে সন্দেহ নেই। তাকে ধমকানোই যায়।

টুকটুকি বলল, চারতলার ইলেক্ট্রিকের লাইন চলে গেছে।

জানি, এরমধ্যেই ছ’জন বোর্ডারের ফোন এসে গেছে। বেদম চেঁচাচ্ছে সবাই। এদিকে রঘুদা বলছে জেনারেটরের তেল ফুরিয়ে গেছে। কেউ কিছু দেখে না। একটা চিড়িয়াখানা হয়েছে এই হোটেলটা।

অন্য মহিলা বললেন, এত সকালে ইলেক্ট্রিশিয়ান কোথায় পাই বলো তো? এই বলে একটা ডায়েরি বার করে ভদ্রমহিলা বোধহয় এলাকার ইলেক্ট্রিশিয়ানদের নম্বরই খুঁজতে শুরু করলেন।

টুকটুকি বলল, আমার দাদা পাশেই থাকে। ইলেক্ট্রিকের কাজ জানে। ডাকব?

যাও তো বোনটি, ডেকে আনো। একটা হাঁফ ছেড়ে ভদ্রমহিলা ব্যাগ থেকে টিস্যুপেপার বার করে মুখ মুছতে শুরু করলেন। অন্যজন ততক্ষণে ইন্টারকমে বলে যাচ্ছেন—প্লিজ স্যার। পাঁচমিনিট সময় দিন। না স্যার, এখানে তো এমনিতে লোড—শেডিং হয় না। তাই জেনারেটর স্ট্যান্ডবাই থাকে না।

আমি দেখলাম টুকটুকি হন্তদন্ত হয়ে পেছনের গলিতে ঢুকছে। আমরা ওর দিকে এগিয়ে যেতেই ও আমাদের ঘাড় ধরে তড়বড় করে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে না হবে। সময় থাকলে ওর বুদ্ধির তারিফ অবশ্যই করতাম; আমরা মোটেই হিংসুটি নই। কিন্তু সময়টাই ছিল না। বকাইয়ের গাড়ির সিটের নীচ থেকে আমার যন্ত্রপাতির ক্যানভাসের ব্যাগটা বার করে আমি আর বকাই হোটেলে ঢুকলাম।

রিসেপশনের ভদ্রমহিলা বললেন, আমাদের কিচেনের মেয়েটা তোমাদের পাঠিয়েছে?

বকাই বলল, হ্যাঁ। কী হয়েছে?

থার্ড ফ্লোরের লাইন চলে গেছে। দেখে এসো।

বকাই লিফটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, সকালবেলায় ঘর থেকে ডেকে এনেছেন। পয়সা দেওয়ার সময় কথাটা মাথায় রাখবেন।

রিসেপশনিস্টদের মধ্যে একজন অন্যজনকে বললেন, এইটুকু—টুকু ছেলে, কেমন পয়সা চিনে গেছে, তাই না?

লিফটে উঠে বকাইকে বললাম, বাড়াবাড়ি করিস কেন?

বকাই মুচকি হেসে বলল, একটু ন্যাচারাল টাচ দিলাম আর কি।

চারতলার সিঁড়ির বাঁকে বকাইয়ের হাতে একটা প্লায়ার্স আর কিছুটা তার দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলাম। বললাম, যা পারিস খুটখাট চালিয়ে যা। শুধু ভুল করেও সুইচটাকে ওপরে তুলে দিস না। তাহলে লাইন চলে আসবে।

তারপর এদিক—ওদিক দেখে, কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ টপকে, ল্যান্ডিং—এর বন্ধ দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ব্যাগ থেকে স্ক্রু—ড্রাইভার বার করে খুব তাড়াতাড়ি চাবির ফুটোর ওপরে লাগানো স্টিলের পাতটা খুলে ফেললাম। বেশ বড়সড় একটা গর্ত পাওয়া গেল যেটার মধ্যে দিয়ে তাকালে পুরো ঘরটাই দেখা যায়। তাকালাম এবং যা দেখলাম তা মোটেই সুন্দর দৃশ্য নয়। লাল ট্রাকস্যুট পরা দৈত্যটি এখন একটা বড় সোফার প্রায় পুরোটা জুড়েই কেতরে পড়ে রয়েছে। টুকটুকি বলেছে, এইভাবে অন্তত বারো ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকবে। তাহলে এই ঘরের লকটা ভেতর থেকে খুলবে কে? দাদুর পা তো শেকল দিয়ে বাঁধা।

সময় নেই। একদম সময় নেই। শিফট চেঞ্জের সময় শেষ হয়ে আসছে। বড় জোর আর দশ মিনিট। তারপরেই মর্নিং—শিফটের লোকেরা যে যার পজিশন নিয়ে নেবে। চারিদিকে ঘুরতে শুরু করবে হোটেলের স্টাফ, সিকিউরিটি, এবং কে জানে, হয়তো মাফিয়া জয়সোয়ালের নিজস্ব লোকজন।

আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ছাদে উঠে গেলাম। আমাকে ভালো করে না দেখেই মান্তু একটা চাদরকে টান টান করে মেলতে শুরু করেছিল। আমি ওকে ডাকলাম। বললাম, ছাড় ওসব। এদিকে কাজ আছে, চলে আয়।

মান্তু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ওঃ, তুই! আমি ভাবলাম বুঝি…। একা দাঁড়িয়ে থাকতে যে কী ভয় করছিল, তোকে কী বলব তারু।

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। সময় নেই। ছাদের পাঁচিল দিয়ে ঝুঁকে দেখলাম, বড়জোর সাতফুট নীচেই একটা কার্নিশ। সেই কার্নিশের গায়ে যে জানলাটা দেখা যাচ্ছে, সেটাই নিশ্চয় ল্যান্ডিংয়ের ঘরের জানলা। আমি যন্ত্রের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে পাঁচিলের ওদিকে ঝুলে পড়লাম। তারপর হাতদুটো ছেড়ে দিতেই কার্নিশের ওপরে ল্যান্ড করলাম। ঠিক দু—সেকেন্ড বাদে আমার পাশে এসে দাঁড়াল মান্তু। তবে ও লাফ মারেনি। একটা জলের পাইপ ধরে ঠিক কাঠবেড়ালির মতন নেমে এসে কার্নিশের ওপরে দাঁড়াল।

আমি একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ও গা থেকে ধুলো ঝাড়ার ভঙ্গি করে বলল, ছেলেখেলা।

এবার দুজনেই তাকালাম বন্ধ জানলাটার দিকে। যথারীতি শক্ত লোহার গ্রিল দিয়ে জানলাটা ঢাকা। তার পরে কাঠের পাল্লাদুটোও ভেতর থেকে বন্ধ। এই জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকতে গেলে খাটতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ব্যাগ থেকে রেঞ্চ আর প্লায়ার্স বার করলাম। তারপর মান্তুকে জিগ্যেস করলাম, পারবি?

মান্তু বলল, যখন পেট ভরে খেতে পেতাম না, তখন অনেক সহজে করতে পারতাম। এখন একটু মোটা হয়ে গেছি। তবু মনে হয় পেরে যাবো।

দশ মিনিট লাগল উইন্ডো এ. সি.—টাকে ফ্রেম থেকে বার করে কার্নিশে নামিয়ে রাখতে। এ. সি. মেশিনটা খুলে নেওয়ার পরে জানলার গায়ে একটা চৌকো খোঁদল তৈরি হল। তার ওদিকে শ্রীমল্লার সোমের বিস্ফারিত দুটো চোখও দেখতে পাচ্ছিলাম। উনি বোধহয় চেঁচাতে যাচ্ছিলেন। আমরা দুজনেই একসঙ্গে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় বললাম, চুপ।

এ. সি. মেশিনটা খুলে নেওয়ার ফলে জানলার গায়ে যে দু—ফুট বাই দেড় ফুটের গর্তটা তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে দিয়ে কোনো বাঁদরের পক্ষেও গলে যাওয়া কঠিন। তবে শুনেছিলাম, তিন বছর আগেও নাকি মান্তু ওর চেয়ে অনেক ছোট একটা লোহার রিং—এর মধ্যে দিয়ে নিজের শরীরটাকে গলিয়ে দিতে পারত। সেটাই ছিল বাজিকরদের রোড—শোয়ে ওর স্পেশাল আইটেম।

সে খেলা আমি দেখিনি। আজ হোটেল কালিমাটির কার্নিশে গুঁড়ি মেরে বসে অবাক হয়ে দেখলাম, কেমন করে মান্তু ওর দুটো হাত আর দুটো পা—কে স্ট্রেচ করে, কোমরের ওপরের অংশটাকে থাইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে শরীরটা একটা সরল রেখা বানিয়ে ফেলল। তারপর সেই সরলরেখাটা ওই ছোট্ট গর্তের মধ্যে দিয়ে ঢুকে গেল ঘরের ভেতরে।

মান্তু ঘরে ঢুকে যেতেই আমি আবার পাঁচিল বেয়ে ছাদে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলাম। বকাইকে ইশারা করতেই বকাই পকেট থেকে মোবাইল বার করে কথা বলতে শুরু করল। বেশি কিছু বলার নেই। ও শুধু শুভকাকাকে বলবে, পুলিশ নিয়ে লেকটাউনের হোটেল কালিমাটিতে চলে আসতে। এখানেই রয়েছেন মল্লার সোম, যাঁকে গত রবিবার রাতে কিডন্যাপ করা হয়েছিল।

আমি ল্যান্ডিং—এর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় ডাকতেই মান্তু ভেতর থেকে ইয়েল—লক খুলে দিল। আমি ভেতরে ঢুকে আবার দরজা লাগিয়ে দিলাম। প্লায়ার্সের একটা মোচড়ে দাদুর পায়ের শেকলও খুলে ফেললাম। এবার পোশাক বদলের পালা এবং সেই কাজটাতেই সবচেয়ে বেগ পেতে হল। দাদু কিছুতেই ওই লাল ট্রাকস্যুট পরতে রাজি হচ্ছিলেন না। লাল রংটা নাকি হিংসার রং, তাই ওনার খুব অপছন্দ। আমি আর মান্তু কিছুটা জোর করে, কিছুটা বুঝিয়ে—বাঝিয়ে ওনাকে সেই ট্রাকস্যুট পরালাম। এমনকি লাল টুপিটা অবধি ওনার মাথায় পরিয়ে শেড—টা টেনে দিলাম নাকের ওপর অবধি। এর ফলে দাদুর সাদা চুল, সাদা ভুরু, সব ঢাকা পড়ে গেল। তারপর ওনাকে লিফটে চাপিয়ে নীচে নামলাম.। মান্তু ইতিমধ্যেই অ্যাপ্রনটা খুলে একটা ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ওটা গায়ে চড়িয়ে বেরোতে গেলে সিকিউরিটির প্রশ্নের মুখে পড়তে হত।

নামবার আগে ফিউজের সুইচটা অন করে দিয়ে আসতে ভুলিনি। কাজ শেষ করতে না পারলে রিসেপশনের ম্যাডামরা আমাদের যেতে দেবেন কেন?

হোটেল থেকে যখন বেরোচ্ছি তখনই গেটের কাছে একটা ব্লু—কালারের অডি এসে দাঁড়াল। গাড়ির মধ্যে থেকে নেমে এল দুই জয়সোয়াল। এক জয়সোয়াল লাল ট্রাকস্যুটের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল, কাঁহা যা রহে হ্যায় রে নন্দুয়া? তেরা মরিজ—কা হাল ক্যাসা হ্যায়?

আমাদের অবাক করে দিয়ে দাদু টুপির আড়াল থেকে সেই মার্কামারা ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন, ঠিক্কেই হ্যায় মালিক। মুঝকো ভেজায়া রসগুল্লা লানে কে লিয়ে। আভি হাম রসগুল্লা লেকে হি লৌটেঙ্গে।

হাঁ হাঁ। জলদি আ যা। হামকো মরিজসে মিলনা হ্যায়।

পেঁপে—মাথা জয়সোয়াল হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে মন্তব্য করল, আজিব বাংগালি লোগ। সুবে সুবে রসগুল্লা—কা নাশা চড় গ্যয়া হ্যায়।

তারপর আর কী? লেকটাউনের মোড়ে মিনিট দশেক দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে হুটার বাজিয়ে একটার পর একটা পুলিশের জিপ ঢুকে পড়ল ভেতরের রাস্তায়। তারই একটার মধ্যে থেকে শুভকাকা নেমে এসে দৌড়তে দৌড়তে আমাদের গাড়িতে উঠে পড়ল। তারপর অত্যন্ত উদ্বিগ্ন গলায় জিগ্যেস করল, এ কি! তোরা যে বললি বাবাকে রেসকিউ করেছিস? কোথায় বাবা?

মাথার টুপিটা খুলে ম্যাজিশিয়ানের কায়দায় বাও করে দাদু বললেন, এই যে। আমি এখানে।

তাই ভাবছি, মেমোরেবল এক্সপেরিয়েন্সের এসে—টা এখন লিখতে পারলে কত ভালো হত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *