নয় এ মধুর খেলা – ৪

চাইমিং ক্লকে দুবার বাজনা শোনা গেল। টিনার গলায় একটু অধৈর্যের সুর পাওয়া গেল —’পাক্কা দুটি ঘণ্টা তুই মুখ বন্ধ করে আছিস রিনা। এবার কথা বল্।’

‘কী কথা বলব?

‘রাশেদের সঙ্গে আজ কী হয়েছে? সে কি খুব খারাপ ব্যবহার করেছে তোর সঙ্গে? যা-তা বলেছে?’

‘মোটেই না। রাগারাগি করেছিল বটে তবে তার জন্য মাপও চেয়ে নিয়েছে যাবার আগে। চাটগাঁর অফিসে কী নাকি সব ঝামেলা হয়েছে।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে আর কী? ঐ যে খরগোশের কথা বললাম। তা ছাড়া একটুখানি ব্যাপার অবশ্য ছিল, তবে সেটা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। তোমাদের কল্পনার বাইরে।’

রেনে বলল, ‘সেটাই তাহলে বল আমাদের।’

‘আজকে রাশেদ হোমের ক্লিনিকে তিনটের সময় আমায় খবর দিতে যায় যে, সে আজই রাতের ফ্লাইটে চাটগাঁ যাবে। আমার একটুখানি খটকা লাগে। চারটের সময় তো বাড়িই ফিরি, একঘণ্টার তর সইল না, সময় নষ্ট করে ক্লিনিকে গেল অথচ এমন কিছু জরুরি নয় খবরটা। গত দুবছর ধরেই তো সে চাটগাঁ যাচ্ছে, কোনো সপ্তাহে একদিন আগে যাবে, তাতে আর কী আসে যায় আমার। কিন্তু ক্লিনিকে গেছে সে আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করতে। সেটা বুঝতে পারলাম রেনেকে দেখে সে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে এবং সেটা সে তার ব্যবহারে গোপন করতে পারে না দেখে। আমি তখন খেপে গেলাম। আমি বহুদিন আগেই পরীবানুর কথা শুনেছি কিন্তু কখনো খোঁজখবর নেবার কথা ভাবতেই পারিনি। কেমন যেন নিজেকে ছোট মনে হত, ভয়ও ধরত। কিন্তু আজ বিকেলে রাশেদকে লুকিয়ে তার পি.এ.-কে ফোন করে সরাসরি জানতে চাইলাম, পরীবানুর কাছ থেকে সকালে যে ফোনটা এসেছিল, সেটা ক’টা নাগাদ। আমি জানিনা কী মনে করে আমি এমনিভাবে কথা সাজিয়ে পি. এ.-কে জিজ্ঞেস করি, গলাটাও খুবই ক্যাজুয়াল ছিল। পি.এ.-ও বোধ হয় প্রস্তুত ছিল না, কী বলছে বুঝতে পারার আগেই বলে, ফেলেছে, দশটার সময়। তারপর আমি আরেক অসমসাহসিক কাজ করে ফেলি রাশেদ যখন গোসল করতে ঢোকে। চাটগাঁ অফিসের পি.এ. মবিনকে ফোন করি। কপাল ভালো, একবার ডায়ালেই এস.টি.ডি. লাইন পেয়ে গেলাম। তাকেও সরাসরি জিজ্ঞেস করি পরীবানু কেন সাহেবকে আজই চাটগাঁ যেতে বলেছে। সে তো এরকম সরাসরি প্রশ্নবাণে এক্কেবারে ঘায়েল, থতমত খেয়ে কী বলবেনা বলবে ঠিক করতে না পেরে তো-তো করতে থাকে——পরীবানু তো দুদিন ধরে খালি বমি করছে, মাথা তুলতে পারছে না। সে কেন সাহেবকে আসতে বলবে, তার কী এতবড় সাহস—ইত্যাদি ইত্যাদি। ততক্ষণে আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। আমার ভেতরে-ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়। আমি আর সহ্য করতে না-পেরে রেনেকে ফোন করি।

রেনের হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এসে থেমে থাকে, সাব্রিনা ধীরকণ্ঠে বলে, ‘সকালে আব্বার বাসায় চলে যাব। রাশেদের সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। কিন্তু রেনের সঙ্গে যাওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাব না।’

রেনে খুব কষ্টের সঙ্গে বলে, ‘কিন্তু সাব্রিনা, ঢাকায় স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে বাস করতে চাইলে তোমার জীবন হেল্ হয়ে উঠবে না? লোকের টিটকিরি উপহাসে, খারাপ লোকের উৎপাতে—’

সাব্রিনা হাতটা একটু তুলে নাড়িয়ে রেনেকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওসব পনের-বিশবছর আগে হত, এখন আর কেউ ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। দেখছ না, স্বাধীনতার পর সমাজে কীরকম লণ্ডভণ্ড কাণ্ড হয়ে গেছে? তা নইলে রাশেদ রক্ষিতা রাখতে সাহস পায়? থাকগে, আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে, তোমরা এখন যাও।’

টিনা উদ্বিগ্ন চাপা-স্বরে বলল, ‘তাই ভালো। তুমি এখন ঘুমোওগে যাও। এখুনি কিছু ডিসিশন নেবার তাড়া নেই। পরে ধীরেসুস্থে ভেবে—’

সাব্রিনা এক ঝাঁকুনিতে মাথা সোজা করে তীক্ষ্ণস্বরে বলে, ‘ডিসিশান তো নিয়েই ফেললাম। আবার পরে ধীরেসুস্থে ভাবার স্কোপ কোথায়? আমার ঘুম পাচ্ছে বটে, কিন্তু এখুনি শোব না। তোমরা বিদেয় হলে সুটকেসে জিনিসপত্র ভরে সব রেডি রেখে তারপর শুতে যাব। সকালে উঠে বাচ্চাদের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নেব। আর চাচিআম্মা যদি ওদের যেতে না দেন, তাহলে ওরা এখানেই থাকবে—’

টিনা ধমকের সুরে বলল, ‘এসব কী আবোল-তাবোল ভাবছিস তুই? চাচিআম্মা যেতে দেবেন না মানে? ওঁকে এতকিছু এখন বলারই বা কী দরকার? সকালে উঠে বাপের বাড়ি চলে যাবি, ব্যস্। সব সময় যেমন যাস্।’

‘কেন বলব না। এতদিন বহু লুকোচুরি হয়েছে, আর নয়। আমি সবাইকে চেঁচিয়ে গাড়ির বলে যাব- চাচিআম্মাকে, বয়বাবুর্চি, আয়াকে, গেটের দারোয়ানকে, ড্রাইভারকে কেন আমি স্বামীর সংসারে লাথি মেরে চলে যাচ্ছি।’

টিনার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের নিশ্চিত লক্ষণ, নাকি হুইস্কির প্রতিক্রিয়া? সে মনে-মনে প্রার্থনা করতে রাগল, ও গড, যেন হুইস্কির রিঅ্যাকশান হয়, নার্ভাস ব্রেকডাউন যেন না হয়। সে দুইহাতে সাবিনাকে জড়িয়ে ধরে দরজার দিকে নিয়ে যেতে-যেতে বলল, ‘ঠিক আছে, কাল সকালে সবাইকে বলেই যেয়ো। এখন সবাই ঘুমোচ্ছে, এখন কাউকে ডাকার দরকার নেই। চল, তোমার ঘরে যাই।’ রেনের দিকে ফিরে দ্রুতস্বরে বলল, ‘তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি আজ এখানে থাকব। হাসানকে খবরটা দিয়ে যেয়ো।’

সাব্রিনা টিনার কাঁধে মাথা হেলিয়ে বেশ লক্ষ্মীমেয়ের মতো দরজার দিকে হাঁটছিল। টিনার শেষ কথায় হঠাৎ মাথা তুলে দাঁড়িযে গেল, জেদি গলায় বলল, ‘কেন, তুমি কেন থাকবে? তুমি বুঝি ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

টিনা তাকে জোর করে টানতে টানতে শান্ত দৃঢ়স্বরে বলল, ‘না, আমার খুব টিসি লাগছে এত হুইস্কি খেয়ে। গা গুলোচ্ছে, এখন গাড়িতে গেলে বমি করে ফেলব। তাই তোমার ঘরে গিয়ে এক্ষুনি শুয়ে পড়তে চাই।’

.

সকালে নামাজ পড়ার পর বেশ অনেকক্ষণ কোরান তেলাওয়াত করেন মাসুদ সাহেব। তারপর বাড়ির সামনের বিরাট বাগানে হেঁটে বেড়ান। বাগানটা মাসুদ সাহেবের খুব প্রিয়। কতরকমের ফুলগাছ। বিশবছর আগের বানানো বাড়ি, বিশবছর ধরেই ফুলগাছের পরিচর্যা করে আসছেন। রোজ বিকেলে মালীর সঙ্গে নিজেও লেগে যান। বাগানে হাঁটতে হাঁটতেই বারান্দায় চায়ের ট্রলি এসে যায়। ট্রলি ঠেলে আনে কাজের মেয়ে রহিমা। তার পেছন-পেছন আসেন হাসিনা বেগম। তখন মাসুদ সাহেব সামনের চওড়া-বারান্দায় উঠে এসে চেয়ারে বসেন, হাসিনা বেগম টি-পট থেকে কাপে চা ঢেলে দুধ-চিনি মিশিয়ে স্বামীর হাতে তুলে দেন। সেই সময় দুজনের মুখেই একটা অনাবিল হাসি ফুটে ওঠে। সারাদিনের মধ্যে এই সময়টা মাসুদ সাহেবের সবচেয়ে ভালো লাগে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাসুদ সাহেব বলেন, ‘তুমি নাও।’ হাসিনা বেগম মৃদু হাসিমুখে ঘাড়টা একটু কাত করে নিজের জন্য পেয়ালায় চা ঢালেন। ছোট ছোট নোনতা বিস্কুট-রাখা পিরিচটা উঠিয়ে ধরেন মাসুদ সাহেবের সামনে। মাসুদ সাহেব একটা বিস্কুট দু-আঙুলে ধরে উঠিয়ে নেন। হাসিনা বেগম পিরিচটা আবার যথাস্থানে রেখে নিজেও একটা বিস্কুট তুলে নেন।

প্রতিদিন এইভাবে তাঁদের দিন শুরু হয়। পরিপূর্ণ সুখী দাম্পত্যজীবনের একটি চমৎকার নিটোল ছবি। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। সবাই নিজের নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে ডাক্তার, আমেরিকার নিউইয়র্কে রয়েছে বউ-বাচ্চা নিয়ে। দুবছরে একবার এসে বেড়িয়ে যায়। ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। সেও আমেরিকাতে পি.এইচ.ডি. করছে। একমাত্র মেয়ে সাব্রিনা ঢাকাতেই থাকে। তারও স্বামী-সন্তান-শাশুড়ি নিয়ে চমৎকার সংসার। তার সুন্দর তিনটি ছেলেমেয়ে, প্রায় প্রতি শনি-রবিবার তারা নানা-নানির সঙ্গে এসে থাকে। ঐ দুদিন তাদের ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুল বন্ধ থাকে। তাছাড়া প্রতি শনিবারে সাব্রিনা কীসব সোস্যাল-ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সেও রোববারটা এসে তাঁদের সঙ্গে কাটিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ফেরত যায় বিকেলে। জীবনসায়াহ্নে এসে দিনগুলি তাঁদের সুখেই কাটছে। এর চেয়ে বেশি কী আর আশা করে মানুষ আল্লাহর কাছে?

কিন্তু আজ যেন সেই স্নিগ্ধ, শান্ত, সুমধুর জীবন-যাপনের ছন্দে তাল কেটে গেল। আটটা বাজতে-না-বাজতেই গেটের ওপাশে মোটরের হর্ন। দারোয়ান গেট খুলে দিতেই সাব্রিনাদের পরিচিত গাড়িটা ভেতরে ঢুকল। আজ শুক্রবারের সকালে কেন? বাচ্চারা তো সাধারণত শনিবারের সকালে বা দুপুরে আসে। গাড়ির মধ্যেও যেন অনেক মানুষ বসে আছে বোঝা যায়। মাসুদ সাহেব, হাসিনা বেগম দুজনেরই বুক যেন একটু কেঁপে গেল মনে হল। ওঁরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন।

গাড়ি এসে পোর্টিকোতে থামামাত্র গাড়ি থেকে একে-একে নামল সাবিনা, টিনা, খুরশেদ, জামশেদ, জেরিনা। ওদের সবার হাতেই একটা করে এয়ার-ব্যাগ। আরো অবাক কাণ্ড, ড্রাইভার গাড়ির বুটি খুলে সুটকেস নামাচ্ছে। মাসুদ সাহেব, হাসিনা বেগম দুজনেই ধীরস্থির মানুষ। এসব দেখে বুক যতই ধড়ফড় করুক, বাইরে তা একটুও প্রকাশ হতে দিলেন না। সাব্রিনা, টিনা দুজনের পরনের কাপড়ই যেন দলামোচড়া ভাঁজ-ভাঙা, চুল উষ্কখুষ্ক-চোখ লাল, সেদিকে কেউই নজর দিলেন না। হাসিনা বেগম শুধু বললেন, ‘আয় ভেতরে আয়।’ মাসুদ সাহেব ‘নসু, নসু’ বলে কাজের ছেলেকে ডেকে সুটকেস নিতে বললেন। ড্রাইভার সামনে রয়েছে, তাই এই আত্ম-সংবরণ।

ড্রাইভারকে বোধহয় আগেই বলা ছিল— সে কোনো কথা জিজ্ঞেস না করেই গাড়ি ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল। সাব্রিনা কারো দিকে না-তাকিয়ে সোজা ভেতরে চলে গেল। তার পিছু-পিছু অন্য সবাই। এ বাড়িতে দোতলায় একটা ঘর সাব্রিনার জন্য আলাদা করে গোছানো থাকেই, সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে তার নিজের ঘরে ঢুকে গেল। টিনা সিঁড়ির কাছে থেমে গিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খুশ, জাম, জেরি—তোমরা বাগানে গিয়ে খেলা করোগে।’ খুরশেদ, জামশেদ, জেরিনা নীরবে আবার বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাগানে নেমে গেল। টিনা চাচির হাত ধরে চাচার দিকে চেয়ে নিচুস্বরে বলল, ‘চলুন আপনাদের ঘরে গিয়ে বসি।’

দোতলায় চাচা-চাচির শোবার ঘরে বসে টিনা খানিকক্ষণ মুখ নিচু করে চুপ করে রইল, বোধহয় মনে-মনে গোছাতে থাকল কীভাবে বলবে কথাটা। ওঁরাও কথাটি না-বলে চুপচাপ তাকিয়ে আছেন টিনার দিকে। অনেকক্ষণ পর টিনা বলল, ‘বড় চা’, বড় চাচি। রাশেদের সঙ্গে কিছু-একটা ব্যাপার নিয়ে রিনার মনোমালিন্য হয়েছে। এখনই সব খুলে বলতে পারছি নে, আপনারা প্লিজ ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। ও কিছুদিন থাকুক আপনাদের কাছে।’

হাসিনা বেগম বললেন, ‘বাপের বাড়িতে মেয়ে থাকবে, সেটা এমন কী কথা! কিন্তু হয়েছেটা কী? সেটা বলবে তো?’ এতক্ষণে তাঁর ঠোঁট কাঁপতে লাগল, চোখ পানিতে ভরে এল। মাসুদ সাহেবও আর তাঁর শান্তভাব অটুট রাখতে পারলেন না, অস্থির গলায় বললেন, ‘এ যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হচ্ছে। কী এমন গোলমাল হল যে এককাপড়ে বেরিয়ে আসতে হল? রাশেদ কি ওকে যা-তা কিছু বলেছে?’

হাসিনা বেগম কান্নাভেজা গলায় বললেন, ‘রাশেদ ওর গায়ে হাত তোলেনি তো?’

টিনা জিভ কেটে শশব্যস্তে বলল, ‘না না, কী যে বলেন আপনারা। ওসব কিছু নয়। হাজার হলেও রাশেদ আমাদেরই বংশের ছেলে তো। ও এতটা নীচে নামতে পারে না।’

হঠাৎ ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল সাব্রিনা, তীব্রকণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমাদেরই বংশের ছেলে, না? কতটা নীচে নামতে পারে না? যতটা নীচে বলছ, ও যে তার চেয়েও কত বেশি নীচে নেমে গেছে, সেটা বলছ না কেন? গায়ে হাত তোলার চেয়ে দশগুণ, একশোগুণ বেশি নীচে নেমে গেছে ও। বংশের মুখে কালি লেপে দিয়েছে। আমাদের বংশে কেউ ওর মতো লুচ্চা হয়নি। ও-যে রক্ষিতা রেখেছে, তা বলছ না কেন? ওর জন্য আমিও গায়ে কালি মেখেছি। আমি আর কখনই ওর ঘরে ফিরে যাব না। ‘

সাব্রিনা-যে আবার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাবা-মার ঘরের সামনে এসে ওদের কথা শুনে এরকম ফেটে পড়বে, সেটা টিনা বা তার চাচাচাচি কেউই আন্দাজ করতে পারেননি, আশঙ্কাও করেননি। এখন শশব্যস্ত হয়ে টিনা ওর মুখে হাতচাপা দিয়ে বলতে গেল, ‘চুপ, চুপ, চেঁচাসনে।’ সাব্রিনা একঝটকায় তার হাত উলটে ফেলে সরে দাঁড়াল, দুইচোখে আগুন-বর্ষণ করে আরো জোরে চেঁচিয়ে বলল, ‘কেন চুপ করব? শুনুক, কাজের লোকরা সবাই শুনুক। ও-বাড়িতে তুমি আমাকে মুখ খুলতে দাওনি, এখন আর পারবে না।

হাসিনা বেগম, মাসুদ সাহেব দুজনেই একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছেন। এরকম ঘটনা ওঁদের ভয়াবহতম দুঃস্বপ্নেও কখনো ঘটেনি। চেঁচামেচি শুনে কাজের লোকেরা আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কী বলবেন, কী করবেন বুঝতে না-পেরে দুজনেই কাঁপতে লাগলেন। হাসিনা বেগমের দু-চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে লাগল। টিনা রাগতস্বরে বলল, ‘দেখ, দেখ, বচ্‌চা কীরকম কাঁপছে। বচ্‌চাচি কাঁদছে। তুই ওঁদের এমন অস্থির করে তুললি? কেন, আস্তেধীরে বলা যেত না?’

সাব্রিনা প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার করে বলল, ‘না, যেত না, যেত না, যেত না’—বলতে বলতে সে জ্ঞান হারিয়ে ঠাস করে পড়ে গেল মেঝেয়। এরা কেউ ধরবার সুযোগই পেল না।

.

ডা. হক বললেন, ‘ব্লাডপ্রেশার এত হাই, আগে জানতেন না?’

হাসিনা বেগম ভীতস্বরে বললেন, ‘হাইপ্রেশার তো ওর কখনো ছিল না। ওর প্রেশার বরাবরই লো। বরং দুধ, ডিম, স্যুপ—এসব খাওয়াতে হত। বোধহয় মনের এইরকম অবস্থার জন্য হয়েছে।’

‘তাই হবে। এখন তো একটা ইনজেকশান দিয়েছি, তার জন্য খুব ঘুমোবেন। ঘুমটাই এখন ওঁর সবচেয়ে বড় ওষুধ। দেখবেন ওঁর ঘরে যেন কোনো শব্দ বা গোলমাল না হয়। আর কপালের পাশের ঐ ফোলাটায় কোল্ড কম্প্রেস দিতে থাকুন। ঘুম থেকে জাগলেই প্রেশারটা আবার চেক করাবেন। রাতে খাবার খাইয়ে আবার ঘুমের জন্য ট্যাবলেট দেবেন। এরমধ্যে কোনো অসুবিধে হলে আমাকে ফোন করবেন।

হাসিনা বেগম মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর দুপুরের খাওয়া? দুপুরে কি জাগিয়ে খাওয়াব?

‘না, তার দরকার নেই। নিজে থেকে যখন জাগবে, তখনই খাওয়াবেন। খাওয়ার চেয়ে ঘুমটাই বেশি দরকার।

সাব্রিনা নিঃসাড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়, তার কপালের পাশের ফোলা জায়গাটায় হাসিনা বেগম আইসব্যাগ চেপে বসে আছেন। মেয়ের দিকে চেয়ে মাসুদ সাহেবের চোখ পানিতে ভরে এল। তাঁর অতি আদরের একমাত্র মেয়েটার এ কী অবস্থা! ছোটবেলায় বাপ-মরে-যাওয়া রাশেদ—সেও তো সবার কম আদরের ছিল না। সে তলে তলে এমন অধঃপাতে নেমে গেছে যে, সাব্রিনার আজ এরকম মনের অবস্থা করে ছেড়েছে!

একপাশে টিনা দাঁড়িয়ে ছিল, তারদিকে চেয়ে ডা. হক মাথা কাত করে দরজার দিকে হাঁটা দিলেন, টিনা তাঁকে অনুসরণ করে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ডা. হক নিচুস্বরে বললেন, ‘এখন আর করার কিছুই নেই। আমি যাই। স্যার ও.টি. থেকে বেরোলে তাঁকে সব জানাব। তারপর উনি যা ভালো মনে করেন, করবেন।’

ডা. হক হাসানের নার্সিংহোমের মেডিসিনের ডাক্তার। ডা. হাসান আজ সকাল আটটাতেই অপারেশান থিয়েটারে ঢুকেছেন, তাই টিনা ফোন করে ডা. হককে আনিয়েছে। ডা. হক চলে গেলে টিনা খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইল। আজ আর অফিসে যাওয়া হল না। রেনেকে অবশ্য কাল রাতেই বলে দিয়েছিল আজ তার বসকে জানিয়ে দিতে যে, সে আজ অফিসে যেতে পারবে না। কী থেকে যে কী হয়ে গেল! কেন যে রেনে তাকে আরো আগে জানায়নি। একেবারে শেষ সময়ে—-শেষরক্ষা করা গেল না।

টিনা ভাবল রেনেকে একবার ফোন করে সব জানায়। আবার ভাবল, থাক্ অফিসে ফোন করে কাজ নেই। এইসব ভাবনা-চিন্তার মাঝেই পাশের ড্রয়িংরুমে ফোন বেজে উঠল। টিনা দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে ফোন ওঠাল, ‘হ্যালো’

কী আশ্চর্য! রেনেই ফোন করেছে। সে এতক্ষণ অপেক্ষা করে-করে আর উদ্বেগ চাপতে না-পেরে ফোন করেছে। টিনা সংক্ষেপে তাকে সব জানাল। রেনে বলে উঠল, ও গড়! সাব্রিনা ভালো হয়ে উঠবে তো? ওর সঙ্গে কি আমি কাল বা পরশু দেখা করতে পারি?’

টিনা মৃদুস্বরেই গর্জন করে বলল, ‘খববদার! ককখনো ও চেষ্টা করবে না। আমাকে আমার বাড়ি ছাড়া এখানেও আর কখনো ফোন কোরো না। আমিই তোমাকে মাঝেমাঝে ফোন করে সব জানাব। কিন্তু আবারো বলছি, তুমি একদমই এ-বাড়িমুখো হবে না।’

রেনের গলা কান্নার মতো শোনাল, ‘জানো টিনা, আমি কোথা থেকে ফোন করছি? বাড়ি থেকে।’

‘সে কী! তুমিও অফিসে যাওনি?

‘কী করে যাই? কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি, চোখ লাল, একদম মনোযোগ রাখতে পারছিনে। এ অবস্থায় অফিসে কাজ করা অসম্ভব ব্যাপার।

‘ভুল করেছ। অফিসে গেলে বরং কাজে ভুলে থাকতে পারতে।’

‘তুমি বুঝতে পারছ না টিনা—আমি এখন একদম একা থাকা ছাড়া একটা লাকেরও সঙ্গ সহ্য করতে পারছিনে। কুক আর মালীকে সারাদিনের জন্য ছুটি দিয়ে দিয়েছি।’

টিনার মুখে আর কথা জোগাল না। রেনের জন্য তার ভয় হল। কিন্তু ভয়টা ভাষায় প্রকাশ করতে পারল না। কী যে কাণ্ড ঘটে গেল গত চব্বিশঘণ্টার মধ্যে—একজন ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছেন, আরেকজন নির্জন বাড়িতে একা-একা অগ্নিবাষ্পে দগ্ধ হচ্ছেন। ওদিকে চাটগাঁয়ে আরেক রত্ন কী করছেন কে জানে। সিনেমাতেও এমনটি দেখা যায় না।

টিনার দিক থেকে কোনো সাড়া না-পেয়ে রেনে বলল, ‘টিনা, আর ইউ দেয়ার?’

‘হ্যাঁ, ভাবছিলাম। শোনো, আমি যে অফিস যাইনি, সেটা আমার বস-কে জানাতে পারোনি, না?

‘না না, জানিয়েছি। আমি আমার নিজের ছুটির কথাটা বলার সময় তোমার কথাও বলেছি। ও নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না। টিনা, প্রমিস মি, তুমি দু-ঘণ্টা পরপর আমাকে ফোন করে জানাবে?

‘যদি রিনা জাগে বা কোনো ডেভেলাপমেন্ট হয়, তবেই ফোন করব। ও ঘুমিয়ে থাকলে কিইবা তোমাকে জানাবার আছে!’

‘না না, প্লিজ টিনা–ও যে ঘুমিয়ে আছে এ কথাটাও আমি তোমার কাছ থেকে দু-ঘণ্টা পরপর শুনতে চাই। প্লিজ, প্রমিস মি, তুমি ফোন করবে? প্লি—জ—’

টিনা চোখ তুলে দেখল খুরশেদ, জামশেদ, জেরিনা সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠছে। সে আর কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন ছাড়ি।’

ঘর থেকে বেরিয়ে টিনা ওদের তিন ভাইবোনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই ওরা তিনজনেই এসে টিনাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সকাল থেকে কী যে ঘটছে, ওরা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। সকালে মা ওদের ঘুম থেকে উঠিয়ে বলল কয়েকদিন এখন ওরা সবাই নানার বাড়িতে থাকবে। শুনে ওরা তো খুব খশি। কী একটা উপলক্ষে ওদের স্কুল ছুটি যাচ্ছে গতকাল থেকে। কী মজা হবে, মা-সুদ্ধ নানার বাড়ি। তা নানার বাড়িতে পা দিতে-না-দিতেই যেসব কাণ্ড-কারখানা হল তাতে ওদের আত্মা শুকিয়ে গেছে। টিনা খালা ওদের তিন ভাইবোনকে সেই-যে বাগানে খেলা করতে বলল, তারপর আর কোনো খোঁজই নেই। সকালের নাশতা খাওয়া হয়নি, অথচ সে কথা কারো মনে নেই। মার যে কী হল, পড়ে মাথা ফুলিয়েছে। ভাগ্যি ভালো কার্পেটের ওপর পড়েছিল, নইলে মাথা ফেটেই যেত; সবাই মিলে ধরাধরি করে খাটে তুলে শুইয়েছে, ডাক্তার এসেছে। এসে ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।

টিনা ওদের গায়ে-মুখে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বলল, ‘তোরা ঘাবড়াসনে, তোদের মায়ের কিচ্ছু হয়নি। দেখবি খুব তাড়াতাড়িই সেরে উঠবে।’

বড় ছেলে খুরশেদের বয়স মাত্র তের। কিন্তু এই বয়সেই তার বুদ্ধি অনেক পরিণত, অনেক কিছুই বোঝে সে। তাকে দেখায়ও বয়সের চেয়ে বড়। সে চোখ মুছে বলে উঠল, ‘মা-র এই দশার জন্য আব্বাই দায়ী। আমি তো দেখছি—’

টিনা খুরশেদের ঠোঁটে আঙুল চাপা দিল, ‘ ছি খুশ, বাবার নিন্দে করতে নেই।’

‘না খালা, নিন্দে নয়, এটা বেয়ার ফ্যাকট, আব্বা ইদানীং খুব নেগলেক্ট করত মাকে—’

জেরিনার বয়স মাত্র আট, সে খুব নরম ধরনের মেয়ে। সে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, ‘আব্বু কী করেছে মাকে, খালা? মা বাঁচবে তো?’ বলতে বলতে সে আবার ফুঁপিয়ে উঠল। দশবছরের জামশেদ, সে এদের মধ্যে সবচেয়ে চুপচাপ, সে কোনো কথা না বলে বারবার চোখ মুছতে লাগল।

টিনা মাথায় করাঘাত করে বলে উঠল, ‘হায়রে, কী করি এই পাগলগুলোকে নিয়ে! ওরে, তোদের মায়ের কিচ্ছু হয়নি। দেখবি কাল সকালেই ভালো হয়ে যাবে। তোদের আব্বুও চাটগাঁ থেকে এসে পড়বে কাল-পরশু। দেখবি আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে। ওরে, তোরা কিছু খেয়েছিস সকাল থেকে?’

ওরা নীরবে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল।

‘হায় হায়, আমাদের নাহয় মনে ছিল না, তোরা তো রহিমার কাছে বলতে পারতিস? চল্ চল্ তোদের খাইয়ে দিই।’ বলতে বলতে টিনা ওদের টেনে নিয়ে খাবার ঘরের দিকে হাঁটা দিল। তার নিজের পেটেও এতক্ষণে খিদে চাড়া দিয়ে উঠেছে। বেলা তো কম হয়নি। এগারটার ঘর পেরিয়ে গেছে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *