৩
‘তোমার কপাল ভালো যে সাখাওয়াত মজুমদার বা আনিস রহমানের মতো লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়নি, হলে বুঝতে কত ধানে কত চাল হয়। পেয়েছ আমার মতো একটা ভ্যাবলাকান্ত হাঁদারাম, যে হাঁটা-শেখার বয়েস থেকে তোমার কাছে দাসখত লিখে দিয়ে বসে আছে, তাই এত চোটপাট করেও পার পেয়ে যাচ্ছ।’ চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে রাশেদ রীতিমতো হাঁপাচ্ছিল।
দৃশ্যপট : রাশেদ-সাব্রিনার বেডরুম। রাশেদ পাল্লা-খোলা ওয়ার্ডরোবের সামনে; দাঁড়িয়ে, তাকের ওপর হাত, কিন্তু কাপড় নামাচ্ছে না—কথা বলার সময় ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলছে, যাতে কথাগুলো ঠিকমতো সাব্রিনার কানে ঢোকে। কারণ সে জানে, সিনেমা-থিয়েটারে নায়ক-নায়িকা যতই একে অন্যের দিকে পেছন ফিরে কথা বলুক-না কেন আসল জীবনে পেছন ফিরে কথা বললে কথাগুলো ঠিকমতো ইথার-বাহিত হয়ে অন্যজনের কানে যায় না। সাব্রিনা ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসা। একদৃষ্টে রাশেদের দিকে চেয়ে আছে। রাশেদ থামতেই সে তার স্বভাবসিদ্ধ মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘সাখাওয়াত আর আনিস বৌদের কী করে?’
রাশেদ এবার বেগে সাবিনার দিকে ফিরে দাঁড়াল। চাপাগলায় তীব্র হিসহিস শব্দ তুলে বলল, ‘কী করে? অত বড়লোকের মেয়ে সাখাওয়াতের বউ, হোলিক্রস কলেজে-পড়া সেই মেয়েকে সাখাওয়াত কখনই একলা বাড়ি থেকে বেরোতে দেয় না। যখনই যাবে—হয় শাশুড়ি নয় ননদ, নয়তো নিজের ছেলেমেয়ে, কাউকে-না-কাউকে থাকতেই হবে তার সঙ্গে। আর আনিস? সে তার বউকে বড়শি করে বড়বড় রুই-কাতলা মক্কেল গাঁথে তার ছিপে। এখন তুমিই বিচার করে দেখ, কত ভালো অবস্থায় আছ তুমি! তুমি নিজে গাড়ি চালিয়ে ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি যেতে পার, তোমাকে আলাদা একটা গাড়িই দিয়ে দিয়েছি! তুমি আমার সঙ্গে ড্রিংক করতে, স্মোক করতে পার, বিউটি পারলারে গিয়ে আধুনিক কায়দায় চুল স্ট্রিম করে আনতে পার, পোশাক-পোশাকে তোমার ওপর কোনো রেস্ট্রিকশন নেই আমার। অথচ জান সাখাওয়াত তার বউকে স্লিভলেস ব্লাউজ পরতে দেয় না? তুমি বলতে পার, আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবসায়ী বা হোমরা-চোমরা বড় অফিসারদের কাউকে তোমায় একটু স্পেশাল অ্যাটেনশান দিতে বলেছি? নেভার। অথচ আনিসের বউটা কী লক্ষ্মী মেয়ে ছিল, আনিস ওকে ঠেলে দিয়েই বড়বড় কন্ট্রাক্টগুলো বাগায়।
সাব্রিনা রাশেদের কথার তোড়ে বাধা দিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, ‘তুমি কী করে জানলে ওদের বউদের এত হাঁড়ির খবর?’
রাশেদ হঠাৎ বোবা হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। হাঁড়ির খবর বাক্যটাই তাকে অতর্কিতে আঘাত করে থাকবে হয়তো। হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সে, প্রচণ্ড ক্রোধে তাতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কী ইঙ্গিত করতে চাও তুমি? সাখাওয়াত নিজেই ব্র্যাগ করে বেড়ায়, সে তার বউকে কেমন কব্জা করে রাখে। আর আনিসের বউর কথা তো তার মক্কেলরাই ভালো জানে।’
সাব্রিনাও সমান তোড়ে বলল, ‘আশা করি তুমি ওই মক্কেলদের একজন নও। আর মনে রেখ তোমারও কপাল ভালো যে, আমার মতো মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিল, যে গত দুবছর ধরে তোমার গতিবিধির ওপর গোয়েন্দা লাগায়নি মিসেস জামানের মতো।’ বলেই চট করে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
রাশেদ হঠাৎ পিন-ফোটানো বেলুনের মতো চুপসে দাঁড়িয়ে রইল। তার সমস্ত ক্রোধ, উত্তেজনা, তীব্রতা ঝরে গিয়ে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা হাওয়ায় যেন শিরশিরিয়ে উঠল সারা শরীর। সাব্রিনার এ কথার মানে? এরকম ঝাঁঝ তো সে আগে কখনো দেখায়নি! তবে কি সে টের পেয়ে গেছে রাঙামাটির পরীবানুর কথা? হঠাৎ খুব দুর্বল লাগল রাশেদের। সে বিছানায় বসে পড়ল। আজকে যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল। সকাল থেকে একটার পর একটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে সে, এখন সন্ধের পরেও এর শেষ হল না।
সকালে অফিসে গিয়েই এক ফোন চাটগাঁ থেকে। পরীবানু ফোন করেছে। একে তো তার ওপর কড়া নিষেধ আছে কখনো ঢাকায় যেন ফোন না করে, তার ওপর যে-খবরটা সে দিল তাতে রাশেদের মাথাই ঘুরতে লাগল বোঁ-বোঁ করে। কোনোমতে রাগ চেপে শুধু বলতে পারল, ‘ঠিক আছে, আমি আজই রাতের ফ্লাইটে যাচ্ছি চাটগাঁয়। তুমি ওখানেই থেকো।
আজ বৃহস্পতিবার। সাধারণত শুক্রবার বিকেলের ফ্লাইটে চাটগাঁ যায় সে। বিনা নোটিশে একদিন আগে চাটগাঁ যাওয়া মানে অনেক হুজ্জত। বুকিং নিয়ে অবশ্য দুশ্চিন্তা নেই, বশংবদ-বন্ধু ট্র্যাভেল-এজেন্ট, যে করেই হোক সীট একটা ম্যানেজ করে দেবেই। অফিসে কিছু জরুরি নির্দেশ, সেটাই যা একটু অস্বস্তিকর। ঢাকা-চাটগাঁর অফিসের লোকজনের মধ্যে টেলিযোগাযোগ হরহামেশাই হচ্ছে, চাটগাঁর অফিসে কোনো জরুরি কাজ পড়েনি অথচ বড় সাহেব একদিন আগে চাটগাঁ যাচ্ছে, ব্যাপারটা কর্মচারীদের কৌতূহল উদ্রেক করার মতো। আবার ব্যক্তিগত কাজে যাচ্ছি বললেও বিপদ আছে, কানে হাঁটতে হাঁটতে কথাটা একদিন আত্মীয়স্বজন কারো কানে গিয়ে উঠতে পারে। বাড়িতে যথাবিধি নোটিশ দিতে হবে। সাব্রিনা কিছু বলবে না, শুধু মুখটা কালো করবে সেটার ইমপ্যাক্ট যদিবা চোখ বুজে এড়ানো যায়, মা’র কমপক্ষে দশ-বারোটা প্রশ্নের জেরা কিছুতেই এড়ানো যাবে না; সেই সঙ্গে ঘ্যানঘ্যানানি, কী দরকার এত বেশি টাকা কামাইয়ের যার জন্য ছেলেমেয়ে বউ বুড়োমা সবাইকে প্রতি সপ্তাহে দু-তিনটে দিন একলা রেখে হাওয়া হবে। আল্লা যা দিয়েছেন, এই তো যথেষ্ট।
মা’র ঘ্যানঘ্যানানি এড়াবার জন্য দুপুরে বাড়ি যায়নি, অফিসেই লাঞ্চ সেরে নিয়েছে। আজ সাব্রিনার ক্লিনিক দুটো থেকে চারটে। রাশেদ হঠাৎ মনস্থির করে ফেলল লাঞ্চের পর ক্লিনিকে চলে যাবে সে, সাব্রিনাকে আজই চাটগাঁ যাবার কথাটা বলার জন্য। কথাটা সে দুটোর আগে যে-কোনো সময় বাসায় ফোন করেই সাবিনাকে বলতে পারত, কিন্তু মনের ভেতরে কোথায় একটা কী যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল। বিনা খবরে হঠাৎ সাব্রিনার ক্লিনিকে যাবার ইচ্ছে বেশ অনেকদিন থেকেই মনের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। মনের অগোচর পাপ নেই, তাই এতদিন সে লজ্জায় যেতে পারছিল না। আজ বেশ চমৎকার একটা অজুহাত পাওয়া গেছে। ‘এক্ষুনি—এই পনের মিনিট আগেই জরুরি খবরটা পেলাম, আজই সন্ধ্যায় চাটগাঁ যেতে হচ্ছে’— এটা বেশ চমৎকার একটা কারণ সাব্রিনার ক্লিনিকে যাবার। কারণ সাব্রিনা দুটোর সময় বাড়ি থেকে ক্লিনিকে চলে এসেছে, ক্লিনিকে ফোন নেই, সাব্রিনারও জানা দরকার খবরটা এক্ষুনিই। অতএব তিনটের সময় রাশেদ ক্লিনিকে চলে গেল।
সাব্রিনা একমনে একটা বছর ছয়েকের মেয়ের বুকে স্টেথেস্কোপ লাগিয়ে পরীক্ষা করছিল। হঠাৎ পিঠের ওপর কার হাতের চাপ এবং ঘাড়ে আলতো একটা চুমুর ছোঁয়া। সাব্রিনা চমকে উঠে ফিরে দেখে, রেনে দাঁড়িয়ে হাসছে। সে রেনের হাতের সীমানার বাইরে সরে গিয়ে হেসে বলল, ‘বাপরে! বেজায় চমকে দিয়েছিলে। এমন চুপেচুপে ঘরে ঢুকেছ কেন?’
‘চুপেচুপে মোটেই ঢুকিনি। তুমিই এমন মগ্ন হয়ে রুগী দেখছিলে যে আমার পদশব্দ তো ছার, সৈন্যদল মার্চ করে এলেও শুনতে পেতে না!’
‘বোগাস! তা হঠাৎ এখানে যে?
‘তুমি যাওনি গত দু সপ্তাহ-–’
‘সে তো বলাই ছিল যাব না। ক্লিনিক নিয়ে প্রথম-প্রথম বেশি ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, সময় পাব না আগেই বলিনি?’
‘নিশ্চয় বলেছ। তাই বলে আমার আসতে মানা নাকি? আমি দেখতে আসতে পারি না, তুমি কেমন ব্যস্ত আছ?’
‘নিশ্চয় পারো। ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম, মোস্ট ওয়েলকাম।
এই মুহূর্তে রাশেদ খোলা দরজায় এসে দাঁড়ায়। রেনে কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সাব্রিনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, সাব্রিনা মুখ উঁচু করে রেনের নীলচোখের দ্যুতি দেখতে-দেখতে হাসিমুখে কথাগুলি বলছিল। ঘরে আর কেউ ছিল না, রুগী বাচ্চাটি সাহেব দেখে নিঃশব্দে টেবিল থেকে উঠে চলে গেছে, রাশেদ ঢুকেই যেন হোঁচট খেল। সাব্রিনা-রেনে দুজনই জুতোর শব্দে এদিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন চমকে গেল। চমকাবার অবশ্য কোনো কারণ ছিল না, কারণ তারা এমন কিছু করছিল না—শুধু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথাই বলছিল, তবু যে-লোকের এখানে আসাটা সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত, তাকেই দেখতে তারা প্রস্তুত ছিল না বলেই হয়তো চমকেছিল। তাও পলকের জন্য। দুজনেই রাশেদকে ‘আরে তুমি যে হঠাৎ’ বলে অবাক অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। তারপর সহজ গলায় সাব্রিনা ওদেরকে চেয়ারে বসতে বলেছিল। তিনজনে কিছু মামুলি কথাও বলেছিল। কিন্তু বাড়ি এসে ফেটে পড়েছিল রাশেদ।
‘এই তোমার ক্লিনিকে কাজ? একটাও রুগী নেই, চার তল্লাটে লোকজন নেই, একা ঘরে সাহেবের সঙ্গে হাসাহাসি হচ্ছে–’ সাব্রিনা হঠাৎ রাশেদের এই বিস্ফোরণে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক মৃদু গলাতেই বলার চেষ্টা করেছিল, চারতল্লাট ভর্তিই লোকজন আছে দুঃস্থ জননী-নিবাসে। সময়টা সবারই নাওয়া-খাওয়ার বলে তারা ভেতর দিকে ছিল, আর রাশেদ ঢোকার আগেই শেষ রুগীটিকেও পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল বলেই সাব্রিনা রেনের সঙ্গে কথা বলার সময় পেয়েছিল। নইলে ফরেনাররা লোকের কাজের সময়ে বিনা—নোটিশে এসে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না।
বিনা-নোটিশে এসে ব্যাঘাত সৃষ্টির কথা বলাতে আরো উলটো ফল হল। রাশেদ ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠল, ‘ওহ্ আমাকে আবার খোঁটা মারা হচ্ছে। খুব মেমসাহেব হয়ে গেছ! তোমার কপাল ভালো যে…..’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
তারপরেই সাব্রিনার এই বেলুনে পিন-ফোটানো কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। তাদের পনের বছরের বিবাহিত জীবনের মধ্যে কখনো সাব্রিনা এরকম করে ফেটে পড়েনি। নাহ, রাশেদের একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে। অবশ্য তারই বা দোষ কী? পরীবানু যে-খবরটা দিল ফোনে, তাতে-যে রাশেদ এখনো ঘাড়ে মাথা রেখে হাঁটা-চলা করছে, এই তো ঢের।
কিছুদিন থেকেই পরীবানুর মতি-গতি তার ভালো ঠেকছে না। রাশেদ এন্টারপ্রাইজের পাবলিক-রিলেশান্স অফিসার মিস পরীবানু, কয়েকমাস থেকেই তার বর্তমান পোস্টে সন্তুষ্টচিত্তে কাজ করতে চাইছে না। রাশেদকে একা তার কোয়াটার্সে সে বেশি পছন্দ করছে। আগের মতো রাশেদের ক্লায়েন্টদের এন্টারটেইন করতে সে মোটেই আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। গতমাসে রাশেদ যখন তার দুইজন ভে-রী ইম্পরটান্ট ক্লায়েন্টকে নিয়ে কক্সেজবাজারের কটেজে দুটো দিন রেস্ট এ্যান্ড রিক্রিয়েশান-এর জন্য গেল, পরীবানু তখন প্রথমে সঙ্গে যেতে না-চেয়ে বেশ হুজ্জত বাধিয়েছিল। অবশ্য ম্যানেজ রাশেদ ঠিকই করে নিয়েছিল, কারণ পরীবানুর জীয়নকাঠি তার হাতে। পরীবানুর মতো সহায়সম্বলহীনা, অল্পশিক্ষিতা, মেয়ে
অল্পশিক্ষিতা মেয়ে এত মাইনের এত শান-শওকতওয়ালা ভালো চাকরি একবার খোয়ালে আর পাবে না। নামের আগে মিস লাগালেও আসলে তো সে স্বামী-পরিত্যক্তাই। রাশেদই তাকে শিখিয়েছে, বিদেশে ডাইভোর্সি মেয়েরা মিস লাগায়, তুমিও লাগাও। রাশেদ তাকে ভুলতে দেয় না সে চাকরি না-দিলে পরীবানু আজ কোথায় ভেসে যেত! ম্যাট্রিক ফেল মেয়ে, বাপ-মা নেই, স্বামী তালাক দিয়েছে। রাশেদ শুধু চাকরিই দেয়নি, তাকে পি-আর-ও পোস্টের উপযুক্ত ট্রেইনিংও দিয়ে নিয়েছে। চটপট ইংরেজি বলতে পারা, লেটেস্ট ফ্যাশানে পোশাক-আশাক পরে তাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারা, ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-ডিনারে কায়দামাফিক দেখাশোনা করতে পারা—সর্ববিষয়েই রাশেদ তাকে উপযুক্ত লোক রেখে ট্রেনিং দিয়ে নিয়েছে। এখন পরীবানু একটি রত্ন।
রাশেদ ইদানীং খুবই নিশ্চিন্ত বোধ করতে শুরু করেছিল, পরীবানুর উপর অনেকটা নির্ভর করতে পারা যায়। এমনও ভাবছিল—এখন আর প্রতি সপ্তাহে চাটগাঁ না-গিয়ে দু-সপ্তাহ পরপর যাবে। ঘরের কোণে যে-চাপা অসন্তোষের মেঘ জমতে শুরু করেছিল, তা সে আগেই টের পেয়েছে। এদিকে এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে সে সাব্রিনাকে নিয়ে হিজবুল বাহারে প্রমোদ-ভ্রমণ করে এসেছে। সাব্রিনার ক্লিনিকে কাজ করাটা তার খুব পছন্দ না হলেও একেবারে আপত্তি করতে পারেনি নিজের চাটগাঁর কীর্তি-কাহিনীর কথা ভেবেই। কারণ ইদানীং সাব্রিনার কিছুটা ভাবান্তর ও অন্যমনস্কতা তার মনে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আজকে সকালে পরীবানুর খবরটার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। ওই টেন্শনে এদিকেও সে চালে ভুল করে ফেলল। এখন সাব্রিনাকে না-সামলে চাটগাঁ যাওয়াও বেগতিক, আবার চাটগাঁ না গেলেও সমূহ সর্বনাশ। আগামীকাল সকালেই রাশেদের এক জাঁদরেল ক্লায়েন্টের রাঙামাটি যাবার কথা, সেখানে পরীবানু তাকে রিসিভ করবে এইরকম ঠিক ছিল। রাশেদ বিকেলের ফ্লাইটে চাটগাঁ পৌঁছে তার নিজস্ব স্পিডবোটে করে রাঙামাটি পৌঁছে যবে অতি অল্পক্ষণেই। অথচ পরীবানু আজ সকালে চাটগাঁ থেকে তাকে ফোন করে জানাচ্ছে যে, তার ভয়ানক বমি হচ্ছে গত দুদিন থেকে। মাথা ঘুরছে, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। এমন অবস্থায় তার পক্ষে রাঙামাটি গিয়ে হোস্টেসের পার্ট প্লে করা সম্ভব নয়।
‘বমি হচ্ছে কেন? কী খেয়েছিলে? ফুড পয়জনিং নয়তো?’ রাশেদের এইরকম অর্বাচীন প্রশ্নের জবাবে পরীবানু জানিয়েছিল, ‘সেসব কিছুই নয়। মনে হচ্ছে আয়াম প্ৰেগনেন্ট।
‘প্রেগনেন্ট’ কথাটা হাতুড়ির বাড়ির মতো শক্ত একটা ঘা মারে রাশেদের মাথায়। সেই থেকে রাশেদ কিছুই ঠিকমতো চিন্তা বা কাজ করতে পারছে না। পরীর উপর বিষম ক্রোধ জন্মেছে তার। প্রেগনেন্টই যদি সে হয়, তাহলে ইচ্ছে করেই হয়েছে। কারণ বিদেশ থেকে এনে-দেয়া নামি-দামি ভালো ভালো এতসব জন্মনিরোধক জিনিসপত্র সকসঙ্গেই ব্যর্থ হতে পারে না। রাশেদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে সবসময়ের জন্য ডবল, তিনডবল প্রি-কশান নেবে। তা সত্ত্বেও এইরকম প্রিপস্টারাস ব্যাপার কী করে ঘটতে পারে, পূর্ব-পরিকল্পনা ছাড়া? এ সমস্যা ছাড়াও এইমুহূর্তের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার ক্লায়েন্ট মি. চৌধুরীর এনটারটেইনমেন্টের জন্য আজ রাতের মধ্যেই বিকল্প ব্যবস্থা করা। সেজন্য তার নিজেরই চাটগাঁ যাওয়া দরকার। পরীবানুর মতো একমপ্লিশ্ড্ হোস্টেস আরেকটা পাওয়া মুশকিল। অতএব রাশেদ নিজে সরেজমিনে গিয়ে পরীবানুকেই চাঙা করবার চেষ্টা করবে; কারণ মি. চৌধুরীর আপ্যায়ন ঠিকমতো না হলে তার এত সাধের রাশেদ এন্টারপ্রাইজ-এর খুঁটি নড়বড়ে হয়ে যাবার ভয়।
অনেকক্ষণ থম ধরে বসে থাকার পর রাশেদ মনস্থির করে সাব্রিনার খোঁজে গেল। সাব্রিনা বারান্দার থামে হেলান দিয়ে সামনে দূরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রাশেদ চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কিনা, তারপর চাপাস্বরে নাটকের ডায়ালগ বলার মতো গড়গড় করে বলে গেল, ‘শোনো, আমি ভয়ানক একটা বিপদের মধ্যে আছি। চাটগাঁর ইনডাস্ট্রির ব্যাপারে একটা ঘাপলা হবার উপক্রম হয়েছে। সেইটা ঠেকাতে আমার আজ চাটগাঁ যাওয়া একান্ত জরুরি। আর একঘণ্টা পরে ফ্লাইট, এখনো কিছুই গোছানো হয়নি। এই টেনশনেই আজ আমার মাথা খারাপ হয়ে আছ, তাই কী বলতে কী বলে ফেলেছি। আমাকে মাপ করে দাও। ভালোয় ভালোয় সব মিটিয়ে ফিরে আসি, তারপর তোমার যা-খুশি হয় শাস্তি দিয়ো আমায়। এখন চল, সব গুছিয়ে হাসিমুখে বিদায় দাও। নইলে প্লেন অ্যাকসিডেন্ট হয়ে মারাও যেতে পারি।’ শেষের বাক্য দুটি বলে রাশেদ হা হা করে হেসে উঠল। যেন কত বড় রসিকতা করতে পেরেছে, এতেই সব মন-খারাপের গুমোট কেটে যাবে।
সাব্রিনা কথাটি না বলে ঘরে এসে রাশেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও মা’র সঙ্গে বসে দ্রুত ডিনার খেতে-খেতে রাশেদ মামুলি দু-চারটে কথা বলে রওনা হয়ে গেল। সাব্রিনা প্রথমে ছেলেমেয়েদের ঘরে গেল, ওদের সাথে কয়েকটা কথা বলে, ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আবার নিজের ঘরে এসে রেনেকে ফোন করল।
‘তুমি এখন কী করছ, রেনে?
রেনে ডিনার শেষ করে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোচ্ছিল। সাব্রিনার ফোন পেয়ে অবাক হল, সে তো কখনো ফোন করে না। তাও আবার এইরকম সময়ে। সে উদ্বিগ্নস্বরে বলল, ‘ডিনার খেয়ে বই পড়ছি। কী ব্যাপার? শরীর ভালো তো?’
সাব্রিনা বলল, ‘শরীর ভালো। তুমি একবার আসতে পারবে এখন?
রেনে আকাশ থেকে পড়ল। নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু অঘটন ঘটেছে। নইলে প্রথমে অসময়ে ফোন, তারপর সাব্রিনার বাড়িতে যেতে বলা। আজকে অপরাহ্নে ক্লিনিকে সাব্রিনার সঙ্গে রেনেকে দেখে রাশেদ যে মোটেই খুশি হয়নি, সেটা তার মুখ দেখেই রেনে অনুভব করেছিল। সেজন্যেই দুজনের মধ্যে কিছু হল নাকি? রেনে উদ্বিগ্ন-স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘সাব্রিনা, আর ইউ অলরাইট? এখন কোথায় যেতে বলছ আমায়? তোমার বাড়িতে?’ সাব্রিনার বুকটা খুব জোরে জোরে ওঠানামা করছিল, যথাসম্ভব কণ্ঠস্বর চেপে বলল, ‘ইয়েস, আয়াম হান্ড্রড পারসেন্ট অলরাইট। অবশ্যই আমার বাড়িতে আসতে বলছি। কেন, ভয় পাচ্ছ নাকি?’
রেনে একমূহূর্ত চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলল, ‘আমি আসছি এখনি। রাশেদ কি চাটগাঁ রওনা হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ গেছে। তুমি দেরি করো না, এক্ষুনি এসো।
.
সাব্রিনা সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, সালেহা খাতুন নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে বললেন, ‘অমন দুদ্দাড় করে কোথায় যাচ্ছ, রিনা?’
সাব্রিনা থমকে দাঁড়িয়ে অনলবর্ষী চোখে শাশুড়ির দিকে তাকাল, কিন্তু কণ্ঠস্বর শান্ত রেখেই বলল, ‘কেন, কোথাও যাবার মতো লাগছে নাকি দেখে?
শাশুড়ি একটু গুটিয়ে গিয়ে বললেন, ‘না, খাওয়া-দাওয়া কাম-কাজ সব সারা, এখন শুতে যাবার সময়, এমন সময় নিচে নামছ, তাই শুধালাম।’
সাব্রিনা ঠাণ্ডা হাসি হাসল, ‘আমার নিজের বাড়িতে আমি নিচে নামব, তার জন্যও কৈফিয়ৎ দিতে হবে আপনার কাছে?’
সালেহা খাতুন হকচকিয়ে গেলেন, এ-ধরনের কথাবার্তা তো সাব্রিনা কোনো কালেও বলে না। তিনি হঠাৎ ভয় পেয়ে ‘কৈফিয়ৎ দিতে হবে কেন? কী যে আবোল-তাবোল বল। যাও না, সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াও।’ বলেই ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন।
সাব্রিনা নিচে নেমে বারান্দা থেকে শুরু করে ফ্যামিলিরুম, ড্রয়িং-ডাইনিং সবকটা ঘরের সবগুলো বাতি জ্বেলে দিয়ে তিনটে ঘর জুড়ে পায়চারি করতে লাগল। দশমিনিট যায়, পনের মিনিট যায়, বিশ মিনিট, পঁচিশ মিনিট… গুলশান থেকে ধানমণ্ডি সাতাশ নম্বর রাস্তা আসতে এত সময় লাগে! হঠাৎ গাড়ির শব্দ শোনা গেল। সাব্রিনার নির্দেশে দারোয়ান আগে থেকেই গেট খুলে অপেক্ষা করছিল, সাব্রিনা তাড়াতাড়ি এগিয়ে সদর দরজার দুইপাল্লা হাট করে খুলে দাঁড়াল। একবার পিছন ফিরে দেখল, সিঁড়ির মাথায় কোণা ঘেঁষে নিজেকে লুকিয়ে উঁকি মেরে দাঁড়িয়ে আছেন সালেহা খাতুন। জানত যে থাকবেনই, তবু ওঁকে জানাবার জন্যই যেন ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, ——যেন বোঝাতে চাইল, আপনি যে ওখানে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তা আমার অজানা নেই।
গাড়ির হেডলাইটে মুহূর্তের জন্য সাব্রিনার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল, লাইট নিবতেই দেখল রেনের পাশে টিনাও বসে। ও, এইজন্যই তাহলে দেরি। গুলশান থেকে চোদ্দ নম্বরে গিয়ে টিনাকে তুলে তারপর সাতাশ নম্বর রোডে এসেছে।
সাবিনা, ওদের গাড়ির দরজা খুলে নেমে আসা পর্যন্ত আর দাঁড়াল না, আস্তেআস্তে পা ফেলে-ফেলে ফ্যামিলিরুম পার হয়ে বড় ড্রয়িংরুমটায় গিয়ে বসল। রেনে আর টিনা তার পেছন পেছন নিঃশব্দে এসে ওর দু-পাশে বসল।
অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই।
সাব্রিনা হঠাৎ সোজা রেনের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার নীরস গলায় বলল, ‘রেনে, তুমি টিনাকে সঙ্গে নিয়ে এলে কেন?’
রেনে হঠাৎ থতমত খেয়ে কী বলবে ঠিক করতে না পেরে তো-তো করতে লাগল।
সাব্রিনা সোজা স্থিরদৃষ্টিতে রেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে আসতে বলেছিলাম, তুমি টিনাকে নিয়ে এলে কেন? ‘
রেনের মুখ শুকিয়ে উঠল, সে থেমে-থেমে বলল, ‘মানে, আমি ভাবলাম—তুমি এমন অসময়ে বাসাতে আসতে বললে যা নাকি ‘কখনো করো না—তাই ভাবলাম…মানে…নিশ্চয় অস্বাভাবিক কিছু
সাব্রিনা একদৃষ্টিতে তাকিয়েই ছিল রেনের দিকে। তাতে রেনে আরো ঘাবড়ে গিয়ে কথা শেষ করতে পারল না।
টিনা তাড়াতাড়ি সাব্রিনার বাহুতে হাত রেখে বলতে গেল, ‘রিনা লক্ষ্মীটি, কী হয়েছে বল্ তো—’
সাব্রিনা একঝটকায় টিনার হাত সরিয়ে দিল। রেনের মুখ থেকে দৃষ্টি সরায়নি সে। আগের মতই নীরস কাটা-কাটা গলায় বলল, ‘তুমি ভয় পেয়েছ। যতদিন বলেছি ক্ষণিকের বান্ধবী হয়ে থাকব, কখনো একসঙ্গে বাইরে যাব না, কখনো ফোন করব না, কোনো ইমোশনাল ইনভল্ভ্মেন্ট থাকবে না—ততদিন ব্যবস্থাটা খুব মনঃপূত ছিল তোমার। আর ক’দিন পরে চলেই তো যাচ্ছ, তাই খানিকটা মানবিক দরদ দেখিয়ে মহত্ত্ব রেখে যেতে চেয়েছিলে। আজ হঠাৎ বাড়িতে ডেকে পাঠাতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলে? ভাবলে, যাবার আগে এ কিসে আবার পা জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই ভয়ের চোটে একেবারে বডিগার্ড সঙ্গে নিয়ে আসতে হল।’
রেনের মুখ রক্তশূন্য। টিনা রাগত চাপা-স্বরে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘পাগল হয়ে গেলি নাকি রিনা? কী সব আবোল-তাবোল বকছিস?’
সাব্রিনা দুইচোখে আগুন বর্ষণ করে টিনাকে বলল, তুমি চলে যাও টিনা। আমি রেনেকে ডেকেছি, তোমাকে নয়। রেনেকেই আমার দরকার। তোমাকে নয়। কেন তুমি আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছ? এত কৌতূহল কেন তোমার?’
টিনা উদভ্রান্তের মতো দরজার দিকে তাকাল। সাব্রিনার গলা কিছুটা চড়েছে। না, দরজার ওপাশে কারো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবে চাচিআম্মা কি আর সিঁড়ির অর্ধেকটা নেমে আসেননি! টিনা বলল, ‘বেশ, আমি চলে যাচ্ছি। তবে তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে। তোমাকে এভাবে এখানে রেখে আমি কিছুতেই যাব না, যত গালমন্দই কর না কেন। আর রেনেকে ভয় পাওয়ার কথা কী বলছ? রেনে ভয় পায়নি। তুমি একবার হ্যাঁ বললেই এক্ষুনি সে তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্য একপায়ে খাড়া। সে শুধু তোমার মুখের কথাকে বিশ্বাস করে তোমার মুখ চেয়ে নিজেকে বেঁধে রেখেছে।’
হঠাৎ রেনের বাঁধ ভেঙে গেল। সে দুহাতে সাব্রিনাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল, ‘ঈশ্বরের নাম নিয়ে বলছি সাব্রিনা, টিনা যা বলছে সব সত্যি। চল তুমি আমার সঙ্গে। তোমায় চিরটা জীবন বুকের মধ্যে এমনি করে জড়িয়ে রেখে দেব।’
সাব্রিনা কেঁদে দিল, ‘কিন্তু আমি তো যেতে চাই না, চাইনিও কোনোদিন। কিন্তু থাকতেও যে পারছি না আর এখানে।’ আস্তে রেনের দু বাহু সরিয়ে দিল, সোফা থেকে উঠে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে টিনার দিকে ফিরে বলল, ‘তোমার মনে আছে টিনা, ছোটবেলায় একটা সাদা খরগোশ পুষেছিলাম কিছুদিন। আসলে পোষ মানেনি সে, আমরা খাঁচায় পুরে রেখেছিলাম, সে খেতো আর খাঁচার মধ্যে ছুটোছুটি করত দেখে আমরা ভাবতাম সে খুব সুখে আছে। তারপর একদিন কী হল, সে হঠাৎ খাঁচার দরজাটার গায়ে মাথা ঠুকতে শুরু করল। মাথা ঠোকা মানে কী, আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগল। আমরা তো সব অস্থির হয়ে উঠলাম। ভেবেই পেলাম না, এত আরামে থাকতে থাকতে খরগোশটার কী হল! তারের খাঁচার গায়ে আছাড় খেতে খেতে তার ঠোঁট আর কানের পাশ দিয়ে রক্তের আভাস দেখা গেল। তখন আমরা ভয় পেয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, দরজা খোলা পেয়েও সে বেরিয়ে গেল না। আগের মতোই তারের গায়ে নিজেকে আছড়ে আছড়ে জখম করতে লাগল—’
টিনা শিউরে সোফা থেকে উঠে এসে সাব্রিনার মুখ চেপে ধরল, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলল।
হঠাৎ দরজার কাছে সালেহা খাতুনের ভয়ার্ত অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এসব কী কাণ্ড হচ্ছে বউমা। টিনা, তুমি কখন এলে? আর ঐ লালমুখো সাহেবটাই বা কেন এখানে এত রাত্রে?
টিনা মুখ তুলে চোখ মোছার কোনো চেষ্টা না করে কান্নাভেজা গলাতেই ধমক দিয়ে বলে উঠল, ‘আপনি ওপরে যান তো চাচিআম্মা। বুড়ো মানুষ, সব ব্যাপারে নাক গলাতে আসেন কেন? যান, ঘরে গিয়ে শোগে। যা শুনতে হয় কাল সকালে শুনবেন।’
সালেহা খাতুন ‘কী, আমার বাড়িতে আমারই ছেলের বউ’ বলে তেড়ে কীসব বলতে যাচ্ছিলেন, টিনা দ্রুত এসে কঠিন মুষ্টিতে সালেহা খাতুনের বাহু খামচে ধরে জোরে তাঁকে ঘুরিয়ে দিল সিঁড়ির দিকে। কঠিন-কণ্ঠে বলল, ‘যা বলছি তাই করুন। আমরা কিছু বাচ্চা ছেলে নই। যা করছি সবার ভালোর জন্যই করছি, কেলেঙ্কারি না চান তো ওপরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ঘুম না এলে অজিফা পড়ুন গিয়ে।’ বলে তাঁকে সিঁড়ির দিকে খানিকটা ঠেলে দিল টিনা। সালেহা খাতুন রাগে কি ভয়ে বোঝা গেল না, কাঁপতে কাঁপতে ওপরে উঠতে লাগলেন। টিনা বারান্দায় আর ড্রয়িংরুমে দুটো মাত্র বাতি জ্বালিয়ে রেখে বাদবাকি সব ক’টা বাতির সুইচ অফ্ করে দিল। ডাইনিংরুমে গিয়ে একটা আলমারির ডালা খুলে হুইস্কির বোতল বার করল, সাইডবোর্ড থেকে তিনটে গ্লাস নিল, ফ্রিজ থেকে বরফ খুলে গ্লাসে দিয়ে তার ওপর বেশ বড় একপেগ করে হুইস্কি ঢালল। রেনে এগিয়ে এসে দুটো গ্লাস তুলে নিয়ে একটা সাবিনার হাতে ধরিয়ে তার গা ঘেঁষে বসল। টিনা নিজের গ্লাস হাতে নিয়ে সাব্রিনার অপরপাশে গা ঘেঁষে বসল। সাব্রিনা মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘আমি অন দ্য রক্স্ কখনো খাইনি।-সহ্য হবে না।’
‘আজ হবে। খাও। আমাদের সবার এখন এটাই দরকার।’
ওরা নিজনে হুইস্কির গ্লাসে ধীরেধীরে চুমুক দেয়, একটিও কথা না বলে।
দীর্ঘ নীরবতা। রেনে আর টিনা দুজনেই অপেক্ষা করে আছে, সাব্রিনা কী বলে। রেনের একটি হাত বেষ্টন করে আছে সাব্রিনার কোমর। টিনার একটি হাত জড়িয়ে আছে সাব্রিনার গলা।
ফ্যামিলিরুমের চাইমিং ক্লকে একে-একে বারোবার মিষ্টিমধুর ধ্বনি বাজল। সাব্রিনা একসময় বলল, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে।’
রেনে গাঢ় স্বরে বলল, ‘কথা বল সাব্রিনা।
‘কী বলব?’
‘যা ইচ্ছে তাই। একটুখানি মুখ তো খুলেছিলে, আবার চেপে গেলে কেন? এত ভদ্র, এত নম্র, এত বাধ্য তোমাকে দেখতে আর সহ্য হচ্ছে না সাব্রিনা। একটু ফেটে পড়ো, চেঁচাও, গাল দাও, আমরা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।’
সাব্রিনা হাসল। ‘বেশ ভালো লাগছে, এমনিভাবে যদি অনন্তকাল বসে থাকতে পারতাম।
টিনা বলল, ‘অনন্তকাল না পারলেও আজকের রাতটা পারব বলে মনে হচ্ছে। চল রিনা, বারান্দায় গিয়ে মেঝেতে বসি। রেনে তুমি তিনটে কুশন উঠিয়ে নিয়ে যাও, আমি আরো তিনটে হুইস্কি নিয়ে আসি।’
.