2 of 3

ধান ভানতে শিবের গীত

ধান ভানতে শিবের গীত

কোনো একটি বিশেষ ধরনের আলোচনা বা কাজের মধ্যে যদি অপ্রাসঙ্গিকভাবে অন্য কোনো আলোচনা বা প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয় তবে এই প্রবাদ-বাক্যটি প্রযোজ্য হয়। এই প্রবাদটি আবার ধান ভানতে মহীপালের গীত হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ধান ভানার কাজ যখন ঢেঁকিতে তখন শিবের বা মহীপালের প্রসঙ্গ নিতান্তই বেমানান। অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা বুঝাতেই এ প্রবাদের প্রয়োগ।

আমাদের দেশে পালবংশীয় রাজা প্রথম মহীপালের (৯৯৫-১০৪৩ খ্রি.) নামের সাথে অনেক দিঘি, নগর ও স্মৃতিবহ স্থানের নাম আজো বাংলায় জেগে আছে। রংপুর জেলার মাহীগঞ্জ, জয়পুরহাট জেলার মহীপুর, নওগাঁ জেলার মাহীসন্তোষ, মুর্শিদাবাদ জেলার মহীপাল, ফেনী জেলার মহীপাল নগরী এবং মুর্শিদাবাদ জেলার মহীপালের সাগরদিঘি ইত্যাদি রাজা প্রথম মহীপালের নামের সাথে জড়িত। ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে মহীপাল যে বিখ্যাত ছিলেন তা সহজেই বুঝা যায়। তিনি অসীম বীরত্বসহকারে পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

বৃন্দাবন দাসের (১৫০৭-১৫৮৯ খ্রি.) চৈতন্য ভাগবতের সূত্রে আমরা জানতে পারি যে, ষোড়শ শতকেও মহীপালের নামে প্রচলিত গীতিকা জনসাধারণের মধ্যে বেশ চালু ছিল। সেসব গীতিকা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। চৈতন্য-ভাগবত অন্ত্যখণ্ডে বলা হয়েছে—

যোগীপাল ভোগীপাল মহীপাল গীত।
ইহা শুনিতে যে লোক আনন্দিত ॥

দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯ খ্রি.) বলেছেন (১৯৩৫), “তিনি প্রজাদিগকে স্বীয় চরিত্রের নানাগুণে মুগ্ধ করিয়াছিলেন; তাঁহার কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে পল্লীগাথা এখনও উত্তরবঙ্গে গীত হইয়া থাকে। ধান ভানতে মহীপালের গীত এই প্রবাদবাক্য বাঙ্গলার ঘরে ঘরে প্রচলিত।…মহীপালের মৃত্যুর ৪/৫ শত বৎসরেও যে গীত বাঙ্গলার ঘরে ঘরে পূর্ণোদ্যমে গীত হইত এবং এখন কিঞ্চিন্যুন সহস্র বৎসর পরেও যাহা একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই, সেই গানের বিষয়ীভূত রাজচরিত্র যে কতটা জনপ্রিয় হইয়াছিল, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়।

মহীপালের একটি গানের উল্লেখ করে দীনেশ সেন বলেছেন—’একটি ক্ষুদ্র মহীপালের গানের আমরা জানিতে পারিয়াছি, লীলা নাম্নী এক ধনাঢ্য বণিককন্যাকে মহীপাল ভালবাসিতেন। তাহাকে পাওয়ার জন্য তিনি কত হিমপূর্ণ রাজ্য খুঁজিয়াছেন, গ্রীষ্মকালে উষ্ণ প্রদেশে গমনাগমন করিয়াছেন। একদিন তিনি শুনিলেন, তাহার নবনির্মিত দিঘিতে স্নান করিবার জন্য সেই সুন্দরী কন্যা আপনা হইতে আসিয়া জলে সাঁতার কাটিতেছে। মহীপাল নিজে জলে নামিয়া লীলার জটিল ও দীর্ঘ শৈবালের মতো হতস্ততোবিক্ষিপ্ত চুলের মুঠা ধরিয়া টানিয়া আনিলেন এবং তাহাকে বলপূর্বক লইয়া গেলেন। ইতঃপূর্বেই মহীপালের সংস্রবে লীলার একটা কলঙ্ককথা প্রচলিত ছিল, এইজন্য লীলার পিতামাতা তাহাকে মহীপালদিঘিতে যাইতে নিষেধ করিয়াছিলেন। লীলা সে কথা না মানিয়া দিঘির জলে নামিয়াছিল, ইহা দ্বারা মনে হয় রাজশিকারী যে পাখিটিকে শিকার করিয়াছিলেন, সে পাখি ধরা দিতেই তাহার কাছে আসিয়াছিল।

এই সকল গল্পকথার ঐতিহাসিক মূল্য কি তাহা জানি না। তবে পল্লীগাথা অনেক সময়েই সত্যের একটু ইঙ্গিতকে ভিত্তি করিয়া তাহার উপর কল্পনার সৌধ নির্মাণ করে। এই প্রাচীন গাথাটিতে যে সত্যের সেরূপ একটু ইঙ্গিত না আছে তাহাই বা কে বলিবে?’

শিবকথা বা শিবায়ন নামে শিবমাহাত্ম্যসূচক কাহিনী এদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে। অবশ্য তার আগেও গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট শিবের গান লোকসমাজে প্রচলিত ছিল। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম না আর। কারণ ইতোমধ্যেই আমিও ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেলেছি অনেকখানি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *