দ্য ব্লু পিরিয়ড

দ্য ব্লু পিরিয়ড

আমার জীবনের আর মাত্র পঞ্চাশ দিন বাকি থাকতেই পরিবর্তন ঘটা শুরু হলো।

আগেই লিখেছিলাম যে, অন্যরা কে কী ভাবল সেটা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র ভাবছি না—এই মনোভাব নিয়ে চলাফেরা করাকে অনেকে খারাপ চোখে দেখেছিল। আমি যখন আমার ‘অদৃশ্য’ সঙ্গিনীর সাথে হাসিমুখে কথা বলতাম, অনেকেই কানাকানি করত, কেউ কেউ তো কুৎসিত কথাও প্রকাশ্যে ছুঁড়ে মারত আমার দিকে।

অবশ্য আমি কোনো অভিযোগ করিনি। কারণ তাদের তো আমিই ‘বিরক্ত’ করছি।

তিনজন মানুষ একদিন আমাকে এক বারে প্রায় আক্রমণ করে বসেছিল। কীরকম মানুষ সেটা বুঝিয়ে দিই-এরা জোরে জোরে কথা বলে, নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে দাবি করার সুযোগের খোঁজে থাকে, প্রতিপক্ষের সংখ্যা আর আকার দেখে প্রতিপক্ষ বেছে নিয়ে উগ্রতা প্রকাশ করে এরা। সেদিন বোধহয় তারা কোনো কাজ না পেয়ে বিরক্ত বোধ করছিল। তাই ওরা যখন দেখল আমি একা একা মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছি আর পাশের সিটের অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলছি, একজন গিয়ে আমার পাশে বসে আজেবাজে কথা শোনানো শুরু করল।

আগে হলে আমিও বেয়াড়ার মতো তাদের কথার প্রত্যুত্তর করতাম, কিন্তু আজকাল এসব কাজে শক্তি খরচ করার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছি আমি, তাই তাদের আগ্রহ হারিয়ে এখান থেকে উঠে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু যখন তারা টের পেল আমি কোনো প্রতিবাদ করতে যাচ্ছি না, তারা কেন জানি আরও উগ্র হয়ে গেল। এখান থেকে উঠে চলে যাওয়ার কথাও মাথায় এসেছিল। কিন্তু এদের দেখে মনে হচ্ছে এদের আজকে করার মতো কিছুই নেই, তাই সম্ভবত ওরা আমাদের অনুসরণ করতে পারে।

“ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না,” মিয়াগি আমার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।

ভাবছিলাম কী করা যায়, এমন সময় শুনতে পেলাম, “আরে, কুসুনোকি নাকি?”

পুরুষের কন্ঠস্বর।

কে আমাকে ডাকতে পারে ভেবেও বের করতে পারছিলাম না, তাই কিছুটা অবাক হলাম। কিন্তু পরের কথাটা আমাকে আর মিয়াগিকে পুরোপুরি নিস্তব্ধ করে দিল।

“আজকেও তাহলে মিয়াগির সাথে ঘুরতে বের হয়েছ।”

ঘাড় ঘুরিয়ে কে কথাটা বলছে তাকে দেখার চেষ্টা করলাম।

মানুষটা পুরোপুরি অচেনা কেউ নয়। আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিবেশী সে। প্রত্যেকবার মিয়াগির সাথে বের হবার সময় যে আমাদের দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলত, সেই মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে।

যতদূর মনে পড়ে, ওর নাম শিনবাশি।

শিনবাশি আমার সামনে এসে আমার পাশে বসে থাকা মানুষগুলোর একজনকে প্রশ্ন করল, “মাফ করবেন, ওখানে বসতে পারি কি?”

তার কথাবার্তা ছিল ভদ্র, কিন্তু আচরণটা তাদের ওপর চাপ ফেলে দিল। শিনবাশির দৈর্ঘ্য-প্রস্থের দিকে তাকাতেই (শিনবাশির উচ্চতা পাঁচফুট দশের কাছাকাছি, আর চোখের দৃষ্টি একদম হিংস্র-যেন প্রতিনিয়তই মানুষকে হুমকি দিতে অভ্যস্ত সে) তাদের আচরণ পালটে গেল।

শিনবাশি আমার পাশে বসে মিয়াগির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করল, “আমি প্রায়ই কুসুনোকির কাছে তোমার ব্যাপারে শুনি, কিন্তু কখনো তোমার সাথে কথা বলা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে পরিচয় হলো। আমার নাম শিনবাশি।”

মিয়াগি তার সিটে একদম জমে গিয়েছে, কোনো কথাই তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। কিন্তু সে কোনো উত্তর দিয়েছে, এমনটা ধরে নিয়ে শিনবাশি কথা চালিয়ে যেতে থাকল, “হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আমাকে চিনতে পেরেছেন তাহলে? খুব সম্মানিত বোধ করছি। আমরা একে অপরকে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ বেশ কয়েকবার পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছি, কিন্তু কথা হয়নি।”

তারা আসলে কিন্তু কথা বলছিল না। বোঝাই যাচ্ছে শিনবাশি মিয়াগি’কে আসলে দেখতে পাচ্ছে না।

সে শুধুমাত্র আমার জন্য ওকে দেখার ভান করছে, আমি ভাবলাম।

যে তিনটা মানুষ আমাকে বিরক্ত করছিল, তারা শিনবাশির কারণে আমার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাওয়া শুরু করল। তিনজন বিদায় নিতেই শিনবাশি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সেই সাথে এতক্ষণ হাসি ঝুলিয়ে রাখা চেহারাটাও তার মুখ থেকে বিদায় নিল।

“পরিষ্কার ভাষায় বলে দিচ্ছি,” শিনবাশি বলা শুরু করল, “তোমার সাথে যে মিয়াগি নামের একটা মেয়ে আছে, সে কথা আমি একটুও বিশ্বাস করি না।

“আমি জানি। তুমি আমাকে বাঁচাতে চেয়েছ, তাই না?” জবাব দিলাম। সেজন্য আমি তোমার প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। তোমাকে ধন্যবাদ।”

“না, সত্যি বলতে কী, সে কারণেও আমি তোমাকে বাঁচাইনি,” সে

মাথা নাড়তে নাড়তে বলল।

“তাহলে কী জন্য?”

“আমি জানি তুমি কিছুই স্বীকার করবে না, তবে আমার যা মনে হয় : তুমি আমাদের সবার সামনে একটা পারফর্মেন্স আর্ট করে বেড়াচ্ছ। মিয়াগি নামের অলীক একটা অস্তিত্বকে বিশ্বাস করানোটাই তোমার এই কার্যকলাপের উদ্দেশ্য। তুমি প্রমাণ করতে চেষ্টা করছ যে, এভাবে আচার- আচরণ করে মানুষের মনে প্রভাব ফেলা সম্ভব-আর তোমার এ এক্সপেরিমেন্ট আমার ওপর সফল হয়েছে।”

“তার মানে তুমি কি মিয়াগির অস্তিত্ব কিছুটা হলেও আঁচ করতে পার?”

“স্বীকার করতে চাচ্ছি না, তবে হ্যাঁ, আমি পারছি,” একটু অস্বস্তির সাথে শিনবাশি উত্তর দিল। “আর যেহেতু এ প্রসঙ্গে কথা উঠলই, তাহলে বলেই ফেলি। আমার ভেতরে এই যে পরিবর্তন, তা নিয়ে আমার বেশ আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তুমি আমাকে অনেককিছুই বিশ্বাস করাতে চেয়েছ, তার প্রতিদানস্বরূপ প্রায়ই মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরে, ‘আমি যদি মিয়াগির অস্তিত্ব মেনে নেই, তবে আমি কি ওকে দেখতে পাব?”“

“মিয়াগি মেয়েটা,” আমি বলা শুরু করলাম, “খুব একটা লম্বা না। খানিকটা রক্তশূন্য চেহারা আর দেখতে একদম ভঙ্গুর। তার দৃষ্টি বেশ শীতল, কিন্তু মাঝেমধ্যে সে তোমাকে ছোট্ট করে হাসি উপহার দেবে। যতদূর মনে হয় ওর দৃষ্টিশক্তি বেশ ক্ষীণ, কারণ ছোট করে ছাপা লেখা পড়তে হলে তাকে পাতলা ফ্রেমের একটা চশমা পরে নিতে হয়, সেই সাথে বোনাস হিসেবে তাকে দেখতেও অপূর্ব লাগে। তার চুল মাঝারি সাইজের, ভেতরের দিকে একটু বাঁকানো।”

“কী কারণে জানি না,” কৌতূহলের সাথে শিনবাশি বলল। “তুমি যে বিবরণটা শোনালে তা আমার কল্পনার মিয়াগির সাথে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে, এমনকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলোও একদম মিল।”

“আর সে তোমার সামনেই বসে রয়েছে। সে কী করতে চাইছে বলতে পারবে?”

শিনবাশি চোখ বন্ধ করল। “না, আমি পারছি না।”

“সে তোমার সাথে করমর্দন করতে চাইছে,” আমি বললাম। “তুমি কি তোমার ডান হাতটা বাড়িয়ে দেবে?”

কিছুটা সন্দেহের সাথে সে ডান হাতটা সামনের দিকে এগিয়ে দিল মিয়াগি খুশি মনে তার হাতটা ধরে ঝাঁকাল।

শিনবাশি লক্ষ্য করল, তার ডানহাতটা ওপর-নিচ করছে। “মিয়াগিই বোধহয় আমার হাতটা নড়াচ্ছে, তাই না?”

“ঠিক ধরেছ। তুমি হয়তো ভাবতে পার হাতটা আসলে তুমিই নাড়াচ্ছ, কিন্তু না। সেটা মিয়াগি করছে। হাত ধরে করমর্দন করতে পেরে সে অনেক খুশি।”

“আমার হয়ে তুমি ওকে ধন্যবাদ জানাতে পারবে?” মিয়াগি আমাকে অনুনয় করল।

“মিয়াগি তোমাকে ‘ধন্যবাদ’ জানাচ্ছে,” আমি তার কথা শিনবাশিকে পৌঁছে দিলাম।

“সেটা আন্দাজ করতে পারছি,” বেশ আশ্চর্য হয়েই শিনবাশি বলল। ‘তোমাকেও ধন্যবাদ।”

তারপর আমার সাহায্য নিয়ে মিয়াগি আর শিনবাশি কিছু কথার আদানপ্রদান করল।

নিজের টেবিলে ফিরে যাওয়ার আগে সে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে বলল, “আপনার পাশে যে মিয়াগি বসে আছে, সেটা কেবল আমিই একলা বুঝতে পারছি তা কিন্তু নয়। আরও অনেকেই সেটা অনুভব করছে, কিন্তু নিজেকে বোঝাচ্ছে ‘ধুর বোকা ওটা চোখের ধাঁধা’। কিন্তু সুযোগ পেলে-ধর সবাইকে যদি জানানো যেত যে, ওরা একলা নয়, তাহলে বোধহয় সবাই মিয়াগির অস্তিত্বটা আরও দ্রুত মেনে নিতে পারত। অবশ্য-সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছি না। তবে আশা করছি তাই যেন ঘটে।”

শিনবাশির ভবিষ্যদ্বাণী ঠিকই ফলে গিয়েছিল।

বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে, তবে এই ঘটনার পর থেকে আমার আশপাশের লোকজন মিয়াগির অস্তিত্ব মেনে নেয়া ও বিশ্বাস করা শুরু করল।

অবশ্য তার মানে এই না যে সবাই আচমকা একজন অদৃশ্য মানুষের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। এর মানে হলো তারা আমার এই ননসেন্স কাজকর্ম একত্রে মেনে নিয়েছে, সেই অনুযায়ী আমার সাথে আচরণ করা শুরু করেছে। তাদের কাছে মিয়াগির অস্তিত্ব ‘থাকতে পারে’ বলেই রয়ে গেল, তা সত্ত্বেও পরিবর্তনটা কিন্তু মন্দ ছিল না।

আমি প্রায় নিয়মিতই এলাকার বিনোদনমূলক স্থানগুলোতে ঘুরতে যেতাম। সেই সাথে হাইস্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা গ্রীষ্মকালে অনুষ্ঠিত উৎসব-কোনোটাই আমি বাদ দিতাম না। আস্তে ধীরে আমি এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হচ্ছিলাম—কথাটা বললেও কিন্তু ভুল হবে না। পাগলাটে কিন্তু সুখী একজন মানুষের অভিনয় করায় গোটা এলাকার মানুষ আমাকে চিত্তাকর্ষক একজন মানুষ হিসেবে ধরে নিয়ে সেই অনুযায়ী আচরণ করতে শুরু করল। বেশিরভাগই আমাকে আমার অদৃশ্য বান্ধবীর সাথে হাত ধরে হেঁটে যেতে কিংবা তাকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটা সস্নেহে দেখতে লাগল।

একদিন শিনবাশি আমাকে আর মিয়াগি’কে তার অ্যাপার্টমেন্টে আমন্ত্রণ জানাল।

“বাসায় খুব বেশি বিয়ার জমে গিয়েছে। সামনে বাড়ি ফিরে যাবার আগে যেভাবেই হোক এগুলো শেষ করতে হবে…তোমরা দুজন সাহায্য করতে পারবে?”

শিনবাশির অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতেই তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে দেখতে পেলাম-একজন পুরুষ আর দুজন নারী। তারা ইতোমধ্যে বিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিনবাশী আমি আসার আগেই তাদেরকে আমার কথা জানিয়ে দিয়েছিল। তাই তারা আমাকে মিয়াগির ব্যাপারে নানান প্রশ্ন করা শুরু করল। আমি একে একে সবকটা প্রশ্নের উত্তর দিলাম।

“তার মানে মিয়াগি সত্যিই আমাদের পাশেই বসে রয়েছে?” সুজুমি নামের এক লম্বা, গাঢ় মেকআপ দেয়া মেয়ে খানিকটা মাতাল হয়ে মিয়াগির হাত ঘেঁষে প্রশ্ন করল। “ও মা গো, সত্যিই তো মনে হচ্ছে আমার পাশে কেউ বসে রয়েছে!”

কোনো অনুভূতিই তার টের পাওয়ার কথা না, তবে হয়তো কিছুটা হলেও অস্তিত্ব আঁচ করা সম্ভব। মিয়াগি আলতো করে সুজুমির হাত ধরল।

আসাকুরা নামের শিনবাশির সেই পুরুষ বন্ধুটি বেশ দ্রুত চিন্তাভাবনা করতে পারে। সে আমাকে মিয়াগির ব্যাপারে কিছু তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করল, চেষ্টা করল আমার উত্তর থেকে কিছু গড়মিল বের করার। কিন্তু আমাকে বারবার একই উত্তর দিতে দেখে সে বেশ মজাই পেয়েছে বোঝা গেল। এরপর থেকে সে মিয়াগির জন্য রাখা কুশনের সামনের মেঝেতে একটা গ্লাস রেখে তাতে বিয়ার ঢেলে দিল।

“ওরকম মেয়েমানুষই আমার পছন্দ,” আসাকুরা বলল। “ভাগ্য ভালো মিয়াগি’কে আমি দেখতে পারছি না, তা না হলে আমি নিশ্চিত ওকে পটানোর চেষ্টা করতাম।”

“যা ইচ্ছে করতে পার। মিয়াগি কেবল আমাকেই ভালোবাসে।”

“অ্যাই, আমার নাম করে যা ইচ্ছে বলা বন্ধ কর,” খানিকটা প্রতিবাদের ভঙ্গিতে মিয়াগি বলে উঠল। কুশনটা তুলে আমাকে সেটা দিয়ে মেরে বসল সে।

রিকো নামের ছোটখাটো কিন্তু সুন্দর চেহারার মেয়েটা এ দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাতাল হয়ে গিয়েছিল। সে মেঝেতে শুয়ে ঘুমঘুম স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কুসুনোকি, কুসুনোকি, আমাদের সামনে প্রমাণ করে দাও তুমি মিয়াগিকে কতখানি ভালোবাস।”

“আমিও সেটা দেখতে চাই,” সুজুমি একমত হলো। শিনবাশি আর আসাকুরা দুজনেই আমার দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকাল।

“মিয়াগি,” আমি ওকে ডাকলাম।

“বলো।”

সে আমার দিকে খানিকটা লজ্জাবনত দৃষ্টিতে তাকাল। আমি তাকে সেখানেই চুম্বন করে বসলাম। মাতালগুলো সব একসাথে হইহুল্লোড় করা শুরু করল একসাথে। আমি জানি ব্যাপারটা একটু বেশি বেশিই হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষগুলোর একজনও মিয়াগির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। তারা একজন পাগলাটে কিন্তু হাস্যকর একজন মানুষের সাথে আড্ডা দিচ্ছে- এটুকুই তাদের বিশ্বাস।

কিন্তু তাতে সমস্যা কোথায়?

আমি এই গ্রীষ্মে এলাকার সবচেয়ে বড় ভাঁড়ে পরিণত হলাম।

ব্যাপারটা ভালো হোক কিংবা মন্দ।

.

এর কদিন পর এক রোদ ঝলমলে বিকেলে আমার কলিং বেল বেজে উঠল দরজার অপর পাশ থেকে শিনবাশির কণ্ঠ আমার কানে আসল।

দরজা খুলতেই শিনবাশি আমার দিকে কী যেন ছুঁড়ে মারল। হাত দিয়ে সেটা ধরতেই দেখি একটা গাড়ির চাবি।

“আমি বাড়ি যাচ্ছি,” শিনবাশি ব্যাখ্যা করল। “তাই কদিনের জন্য ওটা আমার ব্যবহার করা লাগবে না। তুমি চাইলে ঐ কয়েকদিনের জন্য সেটা ধার নিতে পার। চাইলে মিয়াগি’কে নিয়ে সমুদ্র কিংবা পাহাড় ঘুরতেও যেতে পার তুমি। সুযোগটা কাজে লাগাও!”

তাকে একদম মন থেকে ধন্যবাদ জানালাম।

চলে যাওয়ার আগমুহূর্তে শিনবাশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো, আমার কাছে কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে না যে তুমি মিথ্যা বলছ। মিয়াগির অস্তিত্ব তুমি বিশ্বাসযোগ্য মূকাভিনয়ের মাধ্যমে তৈরি করেছ, সেটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার হয়তো আসলেই এমন কোনো জগৎ রয়েছে যেটা কেবল তুমিই দেখতে পাও। হয়তো আমরা গোটা জগতের সত্যের কেবল ক্ষুদ্র একটা অংশ দেখতে পারি। হয়তো অপরের চোখে দৃশ্যমান হওয়ার জন্য সেটুকুই দরকার পড়ে।”

এটুকু বলেই সে বাসে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আমি আকাশের দিকে তাকালাম; চোখ ধাঁধানো সূর্যরশ্মি আগের মতোই চোখ ধাঁধানো ছিল, কিন্তু বাতাসে আগত শরৎ এর সুর টের পেলাম।

সিকাডারা দলবেঁধে তীক্ষ্ণ সুরে গুঞ্জন করতে করতে গ্রীষ্মের সমাপ্তি ঘোষণা করা শুরু করল।

ঐ রাতে আমরা দুজন বিছানায় একসাথে শুয়ে পড়লাম। আমাদের মধ্যে যে অদৃশ্য দেয়াল ছিল সেটা ইতোমধ্যে উধাও হয়ে গিয়েছে।

ঘুমন্ত অবস্থায় মিয়াগি আমার দিকে মুখ করল। একদম বাচ্চাদের মতো শান্তিপূর্ণ চেহারায় সে নিঃশব্দে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছিল। তার এই ঘুমন্ত চেহারা কখনোই আমার কাছে পুরোনো হবে না। দৃশ্যটা আমার কাছে সর্বদাই নতুন, সর্বদাই আপন রয়ে যাবে।

আমি আস্তে আস্তে লেপের তলা থেকে বের হলাম। উদ্দেশ্য : রান্নাঘরে গিয়ে একগ্লাস পানি খাব। লক্ষ্য রাখলাম যাতে মিয়াগির ঘুম ভেঙে না যায়। ফিরে এসে দেখি, তার স্কেচবুকটা কাপড়চোপড় পাল্টাবার ঘরের দরজার সামনে পড়ে রয়েছে। সেটা তুলে নিয়ে বেসিনের ওপরের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম। প্রথম পৃষ্ঠাটা খুললাম আমি।

যা আশা করছিলাম, তার থেকেও অনেক বেশি জিনিস আঁকা ছিল সেখানে।

স্টেশনের সেই ওয়েটিং রুম। নারুসের সাথে দেখা হয়েছিল যেখানে, সেই রেস্তোরাঁ। যে স্কুলে টাইম ক্যাপসুলটা পুঁতে রেখেছিলাম, সে স্কুলটা। বনের আড়ালে থাকা হিমেনোর সাথে বানানো সেই ‘গোপন দুর্গ টা। ঘরভর্তি কাগজের সারসের দৃশ্য। পুরোনো সেই লাইব্রেরি। গ্রীষ্মের সেই উৎসবের স্টলগুলো। হিমেনোর সাথে দেখা হবার আগের দিন যে নদীর পাড়ে হেঁটেছিলাম সেটার দৃশ্য। অবজারভেশন ডেক। যে কমিউনিটি সেন্টারে আমরা রাত কাটিয়েছিলাম। আমার বাইক। চকলেট বিক্রি করা সেই দোকান। ভেন্ডিং মেশিন। পাবলিক পে-ফোন। তারকা-শোভিত সেই লেক। পুরোনো বইয়ের দোকান। সোয়ান-বোট। ফেরিস হুইল।

আমার ঘুমন্ত চেহারা।

আমি পৃষ্ঠাটা উল্টিয়ে প্রতিশোধ হিসেবে মিয়াগির ঘুমন্ত চেহারাটা এঁকে ফেললাম।

মাথাটা কেমন জানি ঘোলাটে লাগছিল। তাই আঁকা শেষ হবার পর মনে পড়ল, কয়েক বছর পর এই প্রথম আমি আঁকাআঁকির জন্য পেন্সিল হাতে তুলে নিয়েছি।

আঁকাআঁকি করা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

মাত্র শেষ হওয়া ছবিটার দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক কিন্তু সন্তুষ্টবোধ করছিলাম। সেই সাথে মনের গহীনে অনবরত খোঁচা দিতে থাকা কিছু একটা অনুভূত হলো।

খুব সহজেই সেই অনুভূতিটাকে এড়িয়ে যাওয়া যেত। খুবই ক্ষুদ্র একটা অনুভূতি। অন্য কিছুর কথা মাথায় এলে যেটাকে এড়িয়ে যাওয়া যায়—এমন টাইপের অনুভূতি ছিল সেটা। চাইলেই সেটাকে অগ্রাহ্য করে স্কেচবুকটা মিয়াগির বালিশের পাশে রেখে দিতে পারতাম। সকালে উঠে মিয়াগি সেটায় তার ঘুমন্ত চেহারার ছবি দেখে কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে-এটা ভাবতে ভাবতে শান্তিমনে ঘুম দিতে পারতাম আমি।

কিন্তু অনুভূতিটার মানে আমার জানা ছিল।

মনোযোগ দিয়ে, মাথার ভেতরের সবটুকু চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা কোঠরে এই অনুভূতির পেছনের কারণ খুঁজতে লাগলাম।

কালো কুচকুচে এক সাগরের মধ্যে ভাসতে থাকা বোতলের মতো সে আমার হাত থেকে বারবার ফসকে যেতে লাগল।

প্রায় একঘণ্টা পর, যখন আমি হাল ছেড়ে দিয়ে পানি থেকে হাত উঠিয়ে নেবার তাল করছিলাম, ঠিক তখনই কাকতালীয় ভাবে সেটা আমার হাতের কাছে ভেসে উঠল

সতর্কের সাথে আমি সেটা সমুদ্র থেকে তুলে নিলাম।

তখনই ব্যাপারটা উপলব্ধি হলো আমার

পরমুহূর্তেই আমাকে কিছু একটা ভর করে বসেছিল। কেবল মাত্র একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে উৎসাহ সহকারে আমি পেন্সিল দিয়ে স্কেচবুকটা ভরিয়ে দিতে শুরু করলাম।

সেই উৎসাহ সারারাত স্থায়ী হলো।

.

কদিন পর আমি মিয়াগিকে নিয়ে আতশবাজির অনুষ্ঠান দেখতে বের হলাম। সূর্যাস্তের সময় ধানক্ষেত পেরিয়ে, রেলগাড়ির ট্র্যাক পার হয়ে, শপিং এরিয়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে অবশেষে যে স্কুলে আতশবাজির অনুষ্ঠান হবে, সেখানে পৌঁছালাম। অনুষ্ঠানটা এ এলাকায় বেশ জনপ্রিয়, তাই স্টলের সংখ্যা যেরকম হবে ভেবেছিলাম, তার থেকেও বেশি ছিল। ভিড় এতটাই বেশি ছিল যে, এ এলাকার বাসিন্দা আসলে কতজন সেটা আমার মনে প্রশ্ন জাগাতে বাধ্য হলো।

আমাকে মিয়াগির হাত ধরে হাঁটতে দেখে অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত করে সমস্বরে হাসতে হাসতে বলল, “ঐ যে মিস্টার কুসুনোকি!” হাসিটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল-বাচ্চাকাচ্চারা কিন্তু পাগলদের পছন্দ করে। আমি মিয়াগির হাত ধরে রাখা হাতটা আকাশে তুলে তাদের ডাকে সাড়া দিলাম।

একটা ইয়াকিতোরি স্টলের সামনে লাইন ধরে দাঁড়ালাম। কয়েকজকন হাইস্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়ে আমি এসেছি শুনে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। খোঁচা মেরে বলল, “আপনার বান্ধবী দেখছি অত্যধিক সুন্দরী।” আমি জবাব দিলাম, “ঠিক বলেছ। কিন্তু ওকে নিতে পারবে না তোমরা,” বলে মিয়াগির কাঁধের ওপর হাত রেখে তাকে কাছে টেনে নিলাম। তারা হেসে ফেলল। একজন তো শিস বাজাতেই শুরু করে দিল।

এরকম ঘটনা আমাকে বেশ আনন্দ দেয়। তারা আমাকে বিশ্বাস করুক কিংবা না করুক, আমার এই ‘মিয়াগি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে নামের ছোট্ট নাটকটা সকলেই পছন্দ করত।

সত্যকে এড়িয়ে যাবার চেয়ে কৃত্রিমতাকে উপভোগ করাই বরং ভালো।

ঘোষণা করা হলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আতশবাজির অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। ঘোষণার কয়েক সেকেন্ড পর প্রথম আতশবাজিটা ছোঁড়া হলো।

কমলা রঙের একটা আলো গোটা আকাশ রাঙিয়ে দিল। আনন্দে হইহুল্লোড় করে উঠল জনগণ, তার কয়েক সেকেন্ড পর সেই আতশবাজির কানফাটানো শব্দ বাতাসকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল।

অনেকদিন পর এভাবে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থেকে আতশবাজির অনুষ্ঠান উপভোগ করছি। কল্পনায় যেরকম ভেবেছিলাম, বাস্তবে তার থেকেও বেশি রঙিন, বেশি ক্ষণস্থায়ী আর আকারে বিশাল মনে হচ্ছে। ভুলে গিয়েছিলাম, এই বিশাল রঙের ফুলঝুরি কেবল মাত্র এক কি দুই সেকেন্ড স্থায়ী হয়, তারপর উধাও হয়ে যায়। কখনো ভাবিনি যে, আতশবাজির বিকট শব্দ এভাবে পেটে ঘুষি মারার মতো অনুভূতি জাগাতে পারে।

কয়েক ডজন আতশবাজি ফোটানো হলো সেখানে। আমরা দুজনে স্কুলের পেছনের প্রান্তরে একলা শুয়ে থেকে সেগুলো উপভোগ করতে লাগলাম। অকস্মাৎ মনে একটা ইচ্ছে জাগল-এরকম অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ঘোরগ্রস্ত মিয়াগিকে দেখব। তাই আকাশে আরেকটা আলোর ফুল ফুটতেই সে আলোয় তার দিকে তাকালাম। আবিষ্কার করলাম, সেও একই কথাই ভাবছিল। আমাদের দুজনের চোখাচোখি হলো।

“আমরা আবার একই ধারায় চিন্তাভাবনা করছি,” হেসে ফেললাম। এর আগেও এরকম ঘটেছে। ঐ যে, বিছানায়।”

“ঠিক ধরেছ,” মিয়াগি লজ্জা পেয়ে হাসল। “কিন্তু তুমি যখন ইচ্ছে তখন আমার দিকে তাকাতে পার। তাই এখন আতশবাজি উপভোগ করতে মনোযোগ দাও।”

“কথাটা কিন্তু সত্য না,” আমি বললাম।

হয়তো কাজটা করার সর্বোত্তম সময় এটা ছিল না। অবশ্য আতশবাজির অনুষ্ঠানে চোখের জল ফেলতে কেউ মানা করেনি।

“আমি জানি আগামীকাল আমার আবার ছুটি। কিন্তু পরেরদিনই তো আমি ফিরে আসব। আগেরবারের মতো দুদিন না, এবার মাত্র একদিনের ছুটি,” মিয়াগি আমাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল।

“না, সেটা নিয়ে ভাবছি না আমি।”

“তাহলে কী নিয়ে ভাবছ?”

“শোনো মিয়াগি, আমি আমাদের এলাকায় একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছি। আমাকে দেখলে মানুষজনের মুখে হাসি ফুটে উঠে-অর্ধেকে হয়তো তুচ্ছার্থে হাসে, কিন্তু বাকি অর্ধেক কিন্তু তা করে না। তারা কেন হাসছে, তা নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই; বরং আমি এর জন্য গর্বিত। এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, এরকম অনুভূতির থেকে বেশি আনন্দদায়ক অনুভূতি দুনিয়ায় খুব কমই রয়েছে।”

উঠে বসলাম। তারপর নিচে শুয়ে থাকা মিয়াগির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলাম,

“স্কুলে থাকতে এক ছেলেকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম। সে অনেক বুদ্ধিমান ছিল, কিন্তু সকলের কাছে সেটা লুকিয়ে রেখে বোকার ভান করত-যাতে মানুষজন তাকে পছন্দ করে। আমি ভাবতাম, মহা শয়তান তো ছেলেটা! কিন্তু আজকাল-মনে হয় আমি ওর এরকম করার কারণটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছি। সত্যি বলতে কী, আমি ওকে অনেক হিংসা করতাম। আমি আসলে মনে মনে ওর মতোই সকলের সাথে ভাব জমাতে চেয়েছিলাম। তোমার কারণে আমি আজ সেটা করতে সক্ষম হয়েছি। এ দুনিয়ার সাধারণ মানুষদের ভিড়ে ঢুকতে সক্ষম হয়েছি আমি।”

“তাহলে তো তোমার জন্য ভালোই হয়েছে,” মিয়াগিও এবার আমার মতোই উঠে বসল। “তো-তুমি আমাকে কী বলতে চাইছিলে?”

“আমি এতকিছুর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই,” আমি বললাম। “কিন্তু কীভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয়, সেটা আসলে আমার জানা নেই।”

“তোমরা বলতে চাইছ যে, ‘এবং ভবিষ্যতেও আরও অনেক কিছু করতে উন্মুখ আমি’, তাই না?” সে বলল। “তোমার হাতে এখনও একমাসের বেশি সময় রয়েছে। এসব কথা বলা খুব বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”

“শোনো মিয়াগি। তুমি আমার ‘ইচ্ছে’ জানতে চেয়েছিলে। আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, মাথায় আসলেই তোমাকে জানিয়ে দেব।”

মিয়াগি বেশ কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। তারপর মুখ খুলল,

“হ্যাঁ। যদি সেটা আমার সাধ্যের মধ্যে হয়, তবে যেকোনো কিছু করতে রাজি আমি।”

“ঠিক আছে। তাহলে আমি সরাসরি আমার ইচ্ছেটা বলে দিচ্ছি। মিয়াগি : আমি চাই আমার মৃত্যুর পর তুমি আমার ব্যাপারে সবকিছু ভুলে যাবে। সবকিছু। এটাই আমার একমাত্র ইচ্ছে।”

“না,” সাথে সাথে মানা করে দিল মিয়াগি। পরমুহূর্তেই সে বোধহয় আমার পরিকল্পনাটা আন্দাজ করতে পারল।

আমি আগামীকাল কী করতে যাচ্ছি, তা টের পেয়ে গেল সে।

“কুসুনোকি, আমি যা ভাবছি তা নিশ্চয়ই তুমি করার কথা ভাবছ না? প্লিজ ওরকম বোকার মতো কাজ করে বসো না। প্লিজ।”

আমি মাথা নাড়লাম। “ভেবে দেখো। কে ভেবেছিল ত্রিশ ইয়েন মূল্যের তুচ্ছ এই মানুষটা জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো এত আনন্দময় ভাবে কাটাবে? কেউ এটা কল্পনাও করতে পারবে না। তোমরা যে বিশ্লেষণমূলক রিপোর্ট দেখে কিংবা যেটা দেখে মানুষের জীবনের মূল্য নির্ধারণ কর, সেটা দেখে ভবিষ্যতে আমি যে এই অবস্থানে দাঁড়াতে পারব, তা মাথাতেও আনতে পারবে না। কল্পনাতীত জঘন্য একটা জীবন ছিল আমার, আর আজ আমাকে দেখো, কতটা সুখী আমি। তোমার ভবিষ্যতে কী ঘটবে, সেটাও তোমার জানা নেই। হয়তো আমার থেকেও বেশি কিছু তোমাকে দিতে সক্ষম এমন একটা মানুষ তোমার জীবনে আসবে আর তোমাকে সুখী করে দেবে।”

“কেউ আসবে না।”

“কিন্তু মিয়াগি, আমার জীবনেও তো তোমার মতো কারো সাথে দেখা হবার কথা ছিল না। তাই আমি মনে করি তুমিও–”

“কেউ আসবে না।”

আমি কথাটার জবাব দিতে পারলাম না, কারণ সে ততক্ষণে ধাক্কা মেরে আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।

মাটিতে পিঠ ঠেকিয়ে পড়ে গেলাম আমি, আর আমার বুকে মুখ গুঁজে সে বলতে শুরু করল, “কুসুনোকি, প্লিজ-”

এই প্রথম তাকে কাঁদতে শুনলাম আমি।

“দয়া করে তুমি পরবর্তী মাসটাও আমার সাথে কাটাও। আমি বাকি সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। তুমি যে অতি শীঘ্রই মারা যাবে, আগামীকাল ছুটির দিনে তোমাকে দেখতে পারব না, অন্যান্য মানুষজন যে আমাদের দুজনকে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যেতে দেখতে পাবে না, তুমি মারা যাবার পর আমাকে যে আরও ত্রিশ বছর একাকী বেঁচে থাকতে হবে—সবকিছু মেনে নিতে রাজি আমি। কিন্তু আমাদের এই একান্ত আপন সময়টুকু তুমি ছুঁড়ে ফেলো না-এই মুহূর্তগুলোতেই আমরা কেবল একত্রে থাকতে পারছি। প্লিজ এ কাজ কর না তুমি।”

বলে সে কাঁদতে থাকল। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকলাম।

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আমরা একে অন্যকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকলাম।

পুরোটা সময় জুড়ে মিয়াগি কেঁদেই যাচ্ছিল।

গভীর রাতে সে বাড়ি ছাড়ল।

দরজার সামনে দুজন দুজনকে আবার জড়িয়ে ধরলাম। অবশেষে সে বাঁধনটা হালকা করে নিঃসঙ্গ, দুঃখী চেহারার একটা হাসি উপহার দিল আমাকে।

“বিদায়। তুমি আমাকে অনেক সুখী করেছ কুসুনোকি।”

বলে সে আমাকে সম্মান দেখিয়ে মাথা নোয়াল, তারপর চলে গেল।

চাঁদের আলোয় সে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছিল।

.

পরের দিন সকালে আমি মিয়াগির পরিবর্তে আসা পর্যবেক্ষকের সাথে সেই পুরোনো, ভাঙাচোরা বিল্ডিং এ গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেই বিল্ডিং, যেখানে মিয়াগির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল।

সেখানে গিয়ে আমি আমার বাকি জীবনের ত্রিশটা দিন বিক্রি করে দিলাম।

আমি চেয়েছিলাম সবগুলো দিন বিক্রি করতে, কিন্তু ওদের নাকি শেষ তিনদিন কিনতে মানা করা হয়েছে।

বদলি হয়ে আসা পর্যবেক্ষক আমার রেজাল্ট দেখে চমকে গেল। “তুমি কি জানতে যে এরকম রেজাল্ট হবে? আর সেজন্যই এখানে এসেছ?”

“হ্যাঁ,” উত্তর দিলাম আমি।

ত্রিশ বা ত্রিশোর্ধ এক নারী আমার রেজাল্ট দেখে কিছুটা বিভ্ৰান্তিতে পড়ে গিয়েছিল। “সত্যিটাই বলছি আপনি এখন যেটা করতে যাচ্ছেন সেটা করা ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে এসে নিশ্চয়ই আপনার টাকাপয়সা সংক্রান্ত বিশাল কোনো সমস্যা তৈরি হবার কথা না, তাই না? আপনি যদি এই শেষ মাসটা ভালো দেখে কিছু আর্ট সাপ্লাই জোগাড় করে আঁকাআঁকি করেন, তবে আপনার নাম ভবিষ্যতের আর্টের বইগুলোতে স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা থাকবে। আপনি কি ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারছেন?”

তিনি আড়চোখে আমার বগলের নিচে রাখা স্কেচবুকের দিকে তাকালেন।

“মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আপনি যদি এখন আয়ু বিক্রি না করে বাসায় চলে যান, আপনি বাকি তেত্রিশটা দিন দিন-রাত এক করে আঁকাআঁকি করে কাটাবেন, যেন আপনার আয়ু এর ওপর নির্ভর করছে। পুরোটা সময় ঐ পর্যবেক্ষক মেয়ে আপনার পাশে থাকবে, উৎসাহ দিয়ে যাবে। সে কখনো সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করবে না। আর আপনার মৃত্যুর পর আপনার নাম আর্টের ইতিহাসে অনন্তকালের জন্য স্থায়ী হয়ে থাকবে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা টের পেয়ে গিয়েছেন? আপনার সমস্যাটা কোথায়?…বুঝতেই পারছি না আমি।”

“মৃত্যুর পর যদি টাকা অর্থহীন হয়ে যায়, তবে সে কথাটা ‘খ্যাতি’র ক্ষেত্রেও খাটে।”

“অনন্তকাল এ জগতে স্থায়ী হতে চাও না?”

“যে জগতে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই, সেখানে অনন্তকাল স্থায়ী হয়ে থাকাটা আমার কাছে অর্থহীন।”

“এ যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর্টিস্টদের একজন”।

সবার মুখে মুখে আমার নাম উচ্চারিত হবে। আমার শিল্পকর্ম প্রচুর তর্ক-বিতর্কের জন্ম দেবে, সেই সাথে আমাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান আর পরিচিতি এনে দেবে।

অন্তত তাই হবার কথা ছিল।

কিন্তু এখন যেহেতু আমি আমার জীবনের শেষ তেত্রিশ দিন থেকে ত্রিশ দিন বিক্রি করে এসেছি, তাই এই সম্ভাব্য ভবিষ্যতটাও আলোর মুখ দেখবে না।

আমার মতামতটা দিই। হয়তো প্রচণ্ড শ্রম আর সময় দিলে আমার আঁকাআঁকির দক্ষতা একসময় না একসময় ঐ পর্যায়ে যেত। কিন্তু তখন দেখা যেত যে, যথার্থ সময় আসার আগেই আচমকা কোনো গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে আমি হুট করে মারা গিয়েছি।

যে সময়টুকু আমার ব্যয় করে ঐ দক্ষতাটা অর্জন করার কথা ছিল, তা কিন্তু এই আয়ু বিক্রি, সেই সাথে মিয়াগিকে পাশে পাওয়ার জন্য চাপে পড়ে অল্প সময়েই বিকশিত হয়েছে। মৃত্যুর আগেই সেটা দেখে যেতে পারছি আমি।

অন্তত তাই আমি বিশ্বাস করি।

একসময় আমি আঁকাআঁকিতে ভালো ছিলাম।

কোনোকিছু দেখার পর একদম ফটোগ্রাফের মতো ছবিটা আঁকতে পারতাম আমি। কিংবা কোনো দৃশ্যকে সম্পূর্ণ এলোমেলো ভাবে বিভক্ত করে নতুন একটা ছবি আঁকার ক্ষমতা ছিল। কোনো ধরনের ট্রেনিং ছিল না আমার। জাদুঘরে যখন পেইন্টিং চোখে পড়ত, সেগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ আমি নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম। ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা জিনিসের সাহায্যে বুঝতে পারতাম অনেককিছুই–’এই জিনিসটা ওভাবে আঁকা ঠিক হয়নি’ এর জবাবে কেন ‘ওভাবেই আঁকা উচিত ছিল’, তাও বুঝে ফেলতাম আমি।

আমি যেভাবে সবকিছু দেখতাম, তা হয়তো পুরোপুরি সঠিক কোনো পদ্ধতি ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার ধারণা তখন আমাকে যারা যারা চিনত তাদের সকলেই টের পেয়েছিল আর্টের ক্ষেত্রে আমার সীমাহীন মেধা রয়েছে।

সতেরো বছর বয়সের শীতকালে আমি আঁকাআঁকি ছেড়ে দিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এভাবে যদি আমি এগোতে থাকি তবে হিমেনো’কে প্রতিজ্ঞা হিসেবে বলা সেই গুরুত্বপূর্ণ, সেরা একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া সম্ভব হবে না। এ পথ ধরে আগালে সর্বোচ্চ আমি একজন অখ্যাত আর্টিস্টে পরিণত হব, যার কোনো লাইনেই দক্ষতা নেই। সাধারণ মানুষের মাপকাঠিতে হয়তো সেটুকুই সাফল্যের খাতায় নাম লেখানোর জন্য যথেষ্ট, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে অনড় ছিলাম। একজন মানুষের পক্ষে যতটা স্বতন্ত্র হওয়া সম্ভব, তা হওয়ার জন্য মনোযোগ দিলাম। আমার মনে একটা বিপ্লব দরকার ছিল। নিতান্তই জড়তা থেকে আঁকাআঁকিতে রাজি ছিলাম না আর।

পরবর্তীতে যে সময় সবকিছু ঠিকঠাক মতো সংঘটিত হবে, ঠিক তখনই আমি আবার পেন্সিল হাতে তুলে নেব। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি পৃথিবীকে অন্যের দৃষ্টি থেকে আলাদা এক দৃষ্টিতে দেখতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে আঁকতে দেব না। সেটাই ছিল আমার সিদ্ধান্ত।

আমার কাছে সিদ্ধান্তটাকে ভুল মনে হয়নি।

কিন্তু উনিশ বছর বয়সের গ্রীষ্মে নিজের চাওয়াটাকে পাশে সরিয়ে আমি আবার পেন্সিল হাতে নিয়েছিলাম-শুধুমাত্র বিরক্তিবোধ থেকে। কদিন পরেই টের পেলাম, আঁকাআঁকি করার জন্য সবচাইতে জঘন্য সময় ছিল সেটা।

ফলাফলস্বরূপ, আমি আঁকাআঁকির ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেললাম। সামান্য একটা আপেলের স্কেচও আমার দ্বারা সম্ভব হচ্ছিল না। যে মুহূর্তে কোনো কিছুকে আঁকতে চাইতাম, ভেতরে একটা অবর্ণনীয় বিশৃঙ্খলা জন্ম নিত। ভয়ঙ্কর সেই বিশৃঙ্খলা, চিৎকারকে কোনোমতে চেপে রাখার সাথেই কেবল তা তুলনীয়। অস্থিরতা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আঁকতে বসে আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি বায়ু বাদে আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই, এমন এক পরিবেশে পা ফেলেছি। কোনো লাইনের, কোনো রঙের প্রয়োজনীয়তা আমি আর অনুভব করতে পারছিলাম না।

টের পেয়েছিলাম, আমার মেধাটা উধাও হয়ে গিয়েছে। হাত ফসকে সেটা আমার নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। আর সেটার জন্য পরিশ্রম করতে চাইনি আমি। আবার প্রথম থেকে শুরু করার সময় নেই আর, দেরি হয়ে গিয়েছে। পেন্সিল ফেলে দিলাম, প্রতিযোগিতায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফেললাম।

এক সময়ে আমি আমার আর্ট সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার পেছনে শ্রম দেয়া শুরু করেছিলাম। আমার ধারণা, ওখান থেকে মনের ভেতর বিশৃঙ্খলা জন্ম নিয়েছিল। যে জিনিসটা সকলেই উপভোগ করতে পারবে সেটা আঁকতে পারলেই তা সর্বজনীন আর চিরস্থায়ী হবে-এই বিশ্বাসটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল। যে সময়টায় আমি এরকম ভ্রান্তিতে ভুগছিলাম, সে সময়ে পেন্সিল হাতে নিয়ে নিজের প্রতিভাটাকে নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করেছিলাম আমি। যার ফলে আঁকাআঁকির ‘ক্ষমতা’ আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আশপাশের মানুষজনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে (যাতে তারা তোমাকে পছন্দ করে) কোনো কিছু আঁকলে সেটা আর যাই হোক, সর্বজনীন হয় না। সেটা আসে তোমার মনের কুয়ার একদম গভীর থেকে, তাও কঠোর পরিশ্রম করে সেই কুয়ার তলানি থেকে বের করে আনতে হয়। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আর ব্যক্তিগত পদ্ধতির ভেতরেই ঐ রকম ফলাফল লুকায়িত থাকে।

এ উপলব্দির জন্য আমাকে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজের তৃষ্ণা মেটাতে আঁকাআঁকি করতে হতো। মিয়াগি সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। তার ঘুমন্ত মুখটাই আমাকে আবার আঁকাআঁকির ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার মতো অসম্ভব কাজটাকে সম্ভব করেছিল। তাও সম্পূর্ণ নতুন এক পদ্ধতিতে-এভাবেও যে ‘আঁকা’ সম্ভব, তা আমার আগে জানা ছিল না।

পাঁচ বছর বয়স থেকেই আমি প্রতি রাতে একটা অভ্যাস মেনে চলে এসেছি, সে রাতে ওটারই পুনরাবৃত্তি করেছিলাম। প্রতিদিন রাতে আমার অভ্যাস ছিল ঘুমানোর আগে ‘যে জগতে আমি বাস করতে চাই’ সে জগতের দৃশ্য কাগজে এঁকে ফেলা। এমন সব স্মৃতি যার কখনো ঘটেনি, এমন সব জায়গা যেখানে আমি কখনো যাইনি, এমন এক সময় যেটা অতীত কিংবা ভবিষ্যত যেকোনো একটা হতে পারে-আমার আঁকার বিষয়বস্তু ছিল এই। আর সে রাতে মিয়াগির ঘুমন্ত মুখটা আঁকতে গিয়ে আমার ভেতরে জন্ম নেয়া চিন্তাগুলোকে কীভাবে প্রকাশ করা করা যায়, তা উপলব্ধি হয়েছিল। ঐ মুহূর্তটার জন্য বোধহয় আমি অপেক্ষা করছিলাম। যদিও মুহূর্তটা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে, তাও এখন আমি বলতে পারব-আমার টেকনিকটা এখন সম্পন্ন হয়েছে।

যে মহিলা আমার ভবিষ্যৎ পরীক্ষা করে দেখেছিলেন, তার মতামত অনুযায়ী এই শেষ ত্রিশ দিনে করা আমার আর্টগুলো দেখলে মনে হবে ‘দে চিরিকো (বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী) এর আর্টকে সেন্টিমেন্টাল এক্সট্রিম’ এ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্তত সেটাই ছিল তার ব্যাখ্যা। অবশ্য সেটা শোনার পর মনে হয়েছে, হ্যাঁ, এরকম কিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল।

আর্টের ইতিহাসে নাম খোদাই করার সুযোগটাকে বিক্রি করে যে টাকাটা আমি পেয়েছিলাম, তা দেখলে চোখ কোটর থেকে খুলে পড়বে। মাত্র ত্রিশ দিনের মূল্য ছিল সেটা, তাই মিয়াগির সম্পূর্ণ ঋণটা শোধ করা সম্ভব হয়নি। তবে সে যদি আর মাত্র তিনবছর চাকরি করে, তবেই সে এখান থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।

“ত্রিশ বছর সময় থেকেও ঐ ত্রিশটা দিন বেশি মূল্যবান,” মধ্যবয়স্ক পর্যবেক্ষককে বিদায় জানাবার সময় সে মুচকি হাসছিল।

এভাবেই আমি ‘অমর’ হবার সুযোগটাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।

কোনো এককালে হিমেনোর করা ভবিষ্যদ্বাণীতে বর্ণিত ‘দশ বছর পরের গ্রীষ্মে’র সময়টা অবশেষে শেষ হয়ে আসছে।

তার ভবিষ্যদ্বাণী অর্ধেকটা ফলেনি।

শেষের দিকে এসে আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কিংবা ধনী কোনো ব্যক্তিত্বে পরিণত হইনি।

অবশ্য বাকি অর্ধেকটা ফলে গিয়েছিল।

আসলেই ভালো কিছু ঘটেছিল এ জীবনে। আর সে কারণে আমি বেঁচে থাকার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ বোধ করছিলাম—ঠিক যেমনটা সে বলেছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *