দ্বিতীয় পর্ব – ২০০৮

দ্বিতীয় পর্ব – ২০০৮

আবার সে এসেছে ফিরিয়া!

আবার সে এসেছে ফিরিয়া! আবার সেই নীল সোনালি আলো বাতাসে, দুই মহাসমুদ্রের তীরে, সেই টেবল মাউন্টেনের রৌদ্র ছায়ায়, সুন্দরী কেপটাউন নগরীর অতিথি হয়ে নবনীতা সকন্যা পুনরাবির্ভূতা। ভুল হল, সমাতৃকা নন্দনা সেন পুনরাবির্ভূতা। ইতিমধ্যে তিনি আরও বার দুই ঘুরে গিয়েছেন শুটিং করে, এবারে মেয়ে আবার মাকে নিয়ে এসেছে। তার প্রাণে দুর্ভাবনা হয়েছে, মায়ের পা আর চোখ দু’টোই যেন সলাপরামর্শ করে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, আলসেমি এবারে মাকে পেয়ে বসবে, অত দৌড়ঝাঁপ করিয়ে মা হয়তো আর বাইরে বেরুতে চাইবেন না। তাই হাত ধরে টেনে এনেছে। মায়ের অবিশ্যি তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তার মাকে কেউ যত্ন করে ডাকলেই মা নাচতে নাচতে তার সঙ্গে চলে যান। শরীরে দিলে। গিয়ে ভালও লাগে। এই তো সেদিন মায়ের স্নেহভাজন একটি ছেলে ডেকেছিল মুকুন্দপুরের কাছে একটা লিটিল ম্যাগাজিন উদ্বোধন করতে, নাম, জলাভূমি। নামটি শুনেই পছন্দ হল, যেহেতু কলকাতা শহরের বৈশিষ্ট্য ছিল এর চারিধারে জলাভূমি, মাছের ভেড়ির বড় বড় বিল, সব নষ্ট হতে শুরু করেছে সেই নকশাল সময় থেকে। জোতদারের জমি বলে কিছু জলাভূমি কেড়ে নিয়ে ধান বুনে দেওয়া হল। আর আরেকবার শুরু হল আশি নব্বই থেকে জলাভূমি বুজিয়ে বাড়িঘর তৈরি করা। বারণ করলে শুনি, এত মানুষ, থাকবে কোথায়? আর জলাভূমি তো শুধু মাছই দিত না, ঠান্ডা হাওয়া বাতাসও দিত, আর সবচেয়ে বড় কথা শহরের সব ময়লা জল নিষ্কাশনে সাহায্য করত। বৃষ্টির এত জল যাবে কোথায়? তাই আগে যা শুধু ঠনঠনে কালীতলার কুখ্যাতি ছিল, বর্ষাকালে রাস্তায় কোমর প্রমাণ বৃষ্টির জল, সেটা এখন সারা কলকাতার সমস্যা। সব ওই জলাভূমি বুজিয়ে দেওয়ার অভিশাপ! তো, সেদিন খুব ব্যস্ততা ছিল, অনেকগুলো কাজের মধ্যে জলাভূমিতে গেলুম, যেতে যেতে আর পথ যেন ফুরোচ্ছে না। যাচ্ছি নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও থেকে সেই রাস্তা তো ভীষণ ভিড়ের। অনেকক্ষণ পরে অতি কষ্টে গন্তব্যে পৌঁছলুম। মুকুন্দপুরের কাছে কি না জানি না, আমি যেখান থেকে রওনা হলুম সেখান থেকে অনেক দূর। সঙ্গে ছিলেন একজন নবীন লেখক, মনোমোহন ব্যাপারী, তিনি অনেকগুলি নামে লেখেন (যেমন, জিজীবিষা), বাংলার দলিত লেখক বলে ভারতে পরিচিতি লাভ করেছেন, এবারে আন্তর্জাতিক খ্যাতির দিকে এগিয়েছেন, একদা তিনি রিকশা চালাতেন, যাদবপুরে। এখন কোনও এক মেসের রান্না করেন দেড়শো লোকের জন্য। নিয়মিত লেখেন, গল্প, কবিতা, উপন্যাস। এই অসাধারণ শিল্পী ব্যক্তিত্বের প্রতি পুরো শ্রদ্ধা রেখে, এবং বাংলা দলিত সাহিত্যের প্রতি কোনও অসম্মান না দেখিয়েই বলতে চাই, যে পশ্চিমবঙ্গের ‘দলিত লেখক’ নিয়ে কিন্তু নানা প্রশ্ন আছে। যখন মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, দাক্ষিণাত্যের দলিত সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করি, সেখানকার জাতপাত ভিত্তিক সামাজিক অত্যাচারের সঙ্গে তুলনা করি, মনে হয়, আমাদের শব্দ ব্যবহারটা কি ঠিকঠাক হচ্ছে? দলিত সাহিত্য তো শুধু দারিদ্র্য নিপীড়িত মানুষের সাহিত্য নয়, জাতিভিত্তিক সামাজিক আচারের উচ্চজাতির দ্বারা অস্পৃশ্য মানুষদের পদদলিত হওয়ার অমানবিক অস্তিত্বের ছবি। একদা আমাদের বাঙালি সমাজেও যা অপরিচিত ছিল না, কিন্তু সে অনেক পুরনো কথা। এই প্রায় মধ্যবয়স্ক পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কি এখনও এটা পশ্চিমবঙ্গের প্রচলিত অবস্থা বলে মানবেন? সে যাই হোক, আমরা যেখানে পৌঁছলুম, সেখানে গাড়ি অনেকখানি সুন্দর পথ দুই ধারে জলের মাঝ দিয়ে চলল, এ পাড়ার মানুষের মাছ ধরাই প্ৰধান জীবিকা। তারপরে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে মেলার মাঠে পৌঁছানো। হ্যাঁ, মেলার মাঠ। জগদ্ধাত্রী পুজোর মেলা বসেছে, কাটাপোতা গ্রামে (কাটা না কাঁটাপোতা?) আল বেয়ে, মেঠো পথ বেয়ে দলে দলে গ্রামের মানুষেরা আসছেন ছেলেপুলের হাত ধরে বউ, মেয়ে, মায়েরা আসছেন, রাত করেই আসছেন, মনোমোহন বললেন, যত রাতে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয় তত ভাল, লোকজন বেশি আসবে। সারা রাত্রি অনুষ্ঠান আছে। প্রথমে পত্রিকা প্রকাশ। গ্রামের ছোটরা, বড়রা সবাই লিখেছেন। দশদিন ধরে উৎসব চলেছে, সাতদিন যাত্রা হয়েছে, নাটক হয়েছে, গান বাজনা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা হয়েছে, গ্রামবাসীদের জন্য। মেলাতে প্রচুর ছোট ছোট দোকান, আমার খুব দেখতে আর জিনিস কিনতে ইচ্ছে ছিল, কিন্তু রাত্রি বেড়ে যাচ্ছিল, ক্লান্তিও, সভার শেষে আর সময় ছিল না মেলায় ঘুরে বেড়াবার, বাদামভাজা, কাঠিভাজা, কি তিলের খাজা কেনার। চোখের ওপর দিয়ে চলে এলুম, অথচ হ্যাজাক জ্বেলে ওরা তো আমার মতন হ্যাংলাদের জন্যেই বসে আছে! শুনলুম পরের দিনে আরও বেশি লোক আসবেন হাজার দশেক, কাল বাজি পোড়ানো হবে! এ যে পৌষ মেলার বাজির দিনের মতো উত্তেজনা আশেপাশের গ্রামে। কলকাতার এত কাশে সোনারপুরের এলাকার মধ্যেই পড়ে এই জলাভূমি, মৎস্যজীবীদের গ্রাম কাটাপোতার এই চমৎকার জগদ্ধাত্রী পুজোর মেলা। অথচ খবর রাখি না।

ইস, আজ এই মুহূর্তে আমি কোথায়, আর সেই কাটাপোতা গ্রাম কোথায়। ভুলেই গিয়েছিলুম আমরা তো এখন অনেক, অনেক দূরে। মনে মনে চলে গিয়েছিলুম চব্বিশ পরগনার এক অন্ধকার তারা ফোটা রাত্তিরে, এই কেপটাউনের আলো ঝলমলে বিলাসী হোটেলের দুপুরবেলাতে। এই তো তোমার মুশকিল, নবনীতা, কখন যে কোথায় থাক? শরীর এক জায়গায় তো মনটা পড়ে আছে আরেক জায়গায়। এই তোমার দ্বিতীয়বার কেপটাউনে আসা। খুঁজতে হবে সেবারের বন্ধুদের। সেটা ছিল ২০০৭-এর এপ্রিল মে মাস। এটা ২০০৮-এর নভেম্বর মাস। আমার বয়েস এক বছর বেড়েছে, কেপটাউনেরও। কিন্তু আমি তত পাল্টাইনি বোধহয়, কেপটাউন যতটা বদলেছে। তার ওয়াটার ফ্রন্ট অঞ্চল আর নাকি আগের মতো নেই, এই একবছরেই অনেক পাল্টে গিয়েছে। এক আরব শেখ নাকি ওয়াটার ফ্রন্টটা কিনে নিয়েছেন, এবং অদলবদল করাচ্ছেন। অনেক পুরনো রেস্তোরাঁ উঠে গিয়েছে। নন্দনার আর আমার পছন্দের একটা সুন্দর জ্যাজ জয়েন্ট আর নাকি নেই, ক্রিস্টিন বলেন। আরেকটা, বেশি দামি, গ্রিন ডলফিন এখনও আছে। এরকমও হয়? একটা শহরের সমুদ্রতীরের গোটা ফ্যাশনেবল পাড়াটা কিনে নেওয়া যায়? নাকি আমি কিছু ভুল বুঝেছি? এখানে কারুর সঙ্গে এখনও দেখা, কথা হয়নি, যার কাছে জিজ্ঞেস করে নেব। জোহানেসবর্গ থেকে প্লেনে আসার সময়ে আমার পাশে যিনি বসেছিলেন, সেই ক্রিস্টিন আমাকে এই খবর বললেন। তাঁর এখানেই জন্ম কর্ম, বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, কর্মক্ষেত্র। তিনি পুরোপুরি কেপটোনিয়ান, তাঁর মন খারাপ। পুরনো কেউটাউনকে তিনি ভালবাসেন। নানান গল্প হচ্ছিল ক্রিস্টিনের সঙ্গে। সবচেয়ে মজা আমরা চারজনে পাশাপাশি বসে আছি, তিনি তাঁর মাকে নিয়ে বেড়িয়ে ঘরে ফিরছেন, মা এয়ারপোর্টে আমার মতো হুইলচেয়ারে করে এলেন। নন্দনাও বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে, ওই হুইলচেয়ারে এয়ারপোর্ট পেরতে হয় তার মাকেও! আজকালকার এয়ারপোর্টগুলো তেপান্তরের মাঠের চেয়েও সুদূরপ্রসারী, প্রচুর হাঁটাহাঁটি লাগে। কেবল তফাত, বয়সে ক্রিস্টিন নিজেই আমার কাছাকাছি তার মা প্রায় নব্বই। ক্রিস্টিন গোলগাল মোটাসোটা আর ভীষণ হাসিখুশি, উচ্ছল স্বভাবের মেয়ে। আর মা চুপচাপ, গম্ভীর রোগাসোগা সরু লম্বা মতন। নিচু গলায় দু-একটা মন্তব্য করছিলেন। কিছুই বুঝতে না পারলেও আমার খুব ভাল লাগছিল ওই চুপচাপ মায়ের সঙ্গে প্রবল হইচই করে আফ্রিকান্স ভাষাতে ক্রিস্টিনের কথাবার্তা, তাই আলাপ করে ফেললুম। কেননা তিনি একই সঙ্গে ইংরেজিতেও কথা কইছিলেন এক বান্ধবীর সঙ্গে। কথায় কথায় শুনলুম ক্রিস্টিন গত মাসে জোহানেসবর্গের দিকে এক পাহাড়ি গ্রামে কালো শিশুদের একটি ইসকুলে গিয়েছিলেন মার্কেটিং-এর কাজে, বাচ্চারা তাঁকে দেখে জুলু ভাষাতে ‘সাদা লোক। সাদা লোক!’ বলে আওয়াজ দিয়েছিল, ক্রিস্টিনের তাতে খুবই মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই ওইখানেই একটি বয়স্কা কৃষ্ণাঙ্গী মহিলা ওকে দেখে জুলু ভাষাতে বলে উঠেছিলেন ‘ঈশ্বরের লোক! তখন ক্রিস্টিনের মন আবার ভাল হয়ে গেল। সম্ভবত আমাকে গল্পটা বলার উদ্দেশ্য, আজও এদেশে সব রকমই আছে, দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতার পরে এখনও সব কিছু সহজ হয়ে যায়নি। কেউ কেউ সাদাদের এখনও অবিশ্বাস করে, আর কেউ মনে করে তারা ঈশ্বরের লোক। আমার কানে অবিশ্যি ওই দু-রকম প্রতিক্রিয়াই প্রাক স্বাধীনতা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিক্রিয়া বলে মনে হল।

ইতিমধ্যে দাঁত দিয়ে জলের বোতল খুলে, নন্দনা ক্রিস্টিনের চুপচাপ মায়ের কাছে, আফ্রিকান্সে নয়, স্পষ্ট ইংরেজিতে এক ঝলক বকুনি খেল, “খবরদার ওরকম করে দাঁত দিয়ে বোতল খুলবে না। খুব বিপজ্জনক অভ্যেস।’ নন্দনা দেখলুম বকুনি খেয়ে যত না অবাক তার চেয়ে বেশি খুশি তার চোখে মুখে ফুটে বেরুচ্ছে এদেশে তো এরকম চট করে শোনা যায় না, মায়ের মতন সাবধানি গলা! অবিশ্যি কথাটা মা বললেই আর কিন্তু চোখে মুখে এই খুশিটি থাকত না, সেটা যে মায়ের মা-গিরি ফলানো হয়ে যেত! কে না জানে, মায়েরা অমৃতলোকে না গেলে মায়ের বকুনি অমৃতির মতো স্বাদু হয় না? (তা বলে আমি বাপু এখুনি আমার বকুনিতে মিষ্টত্ব আনতে অত দূরে যেতে রাজি নই! বকুনি থামাতেও রাজি নই। তাতে মেয়েদের মুখ যতই ভার হোক! মা হব আর মা-গিরিটুকু করব না? ইয়ার্কি? এটা তো দশ মাস ধরে অর্জিত অধিকার। বেশ করব বকুনি দেব। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ বাঁশ!)

সন্ত্রাস

আজ ২৬ নভেম্বর, ২০০৮। আমার শহর কলকাতাতে এখন রাত্রি সাড়ে বারোটা, আর দক্ষিণ আফ্রিকাতে রাত্রি ন’টা। সুয্যিমামা সাড়ে তিনঘণ্টা আগে উঁকি মারেন আমাদের দেশের জানালায়। এই বিদেশটা দক্ষিণ গোলার্ধে, এখানে শীত আর গ্রীষ্ম অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের মতো আমাদের দেশের বিপরীত সময়ে আসে। এখন কেপটাউনে বেশ গরম। আজ সারাদিন সমুদ্রতীরে বন্দরে একটা ইয়ট-এ কেটেছে, নন্দনার শুটিং চলছিল। সমুদ্রতীর হলে কী হবে গরম কম ছিল না।

নন্দনার রোজ অনেকক্ষণ শুটিং থাকে, ফিরে এসে আর খেতে যেতে ইচ্ছে করে না, রুমসার্ভিসে স্যুপ চেয়ে এনে আমাদের নৈশভোজ হয়ে যায়। দারুণ সুস্বাদু স্যুপ বানায় এখানকার স্যুপকারেরা। ব্রথ বলাই ঠিক। ঘন থকথকে, পেট ভরে যায়। তার অবিশ্যি আরেকটা কারণ আমার দন্তশূল হয়েছিল। আজকে নন্দনার শুটিং একটু আগে ফুরিয়েছে, আমাদের হাতে একটু সময় আছে, মেয়ে আর মা তাই কিঞ্চিৎ সাধ আহ্লাদ মেটাচ্ছি। সূর্যাস্তের গোলাপি আলোতে আমাদের সমুদ্রমুখী হোটেলে ফিরে নিচের তলার বাগানে পুলসাইড রেস্তোরাঁতে, পামগাছের সারি আর খোলা ফোয়ারার পাশে আয়েশ করে বসে রীতিমতো স্টাইলের মাথায় ডিনার খেয়ে এসেছি। পাঁচতারা কি অমনি অমনি? প্রথমে কী জানি কী এক অচেনা পাখির (তার শেষটুকু ‘বক’) সুস্বাদু স্টার্টারের পরে নরওয়েজিয়ান স্যামন স্টেক, আর অস্ট্রিচ ফিলে আর বোর্দো দিয়ে সেমি-সাউথ আফ্রিকান ডিনার সেরেছি। এখন ঘরে ফিরে কফি হাতে নিয়ে এলিয়ে বসে এখানকার টিভিতে ন’টার খবর শুনছি। পৃথিবীর খবর

ডেনমার্কের ৩০০ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে গ্রিনল্যান্ডের মানুষের শান্তিপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের খবর ছাড়া সবই দুঃসংবাদ। অশান্তিপীড়িত থাইল্যান্ডের প্রসঙ্গ, ব্যাঙ্কক আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট বন্ধ, অসহায় যাত্রীরা বন্দির মতো আটক, রাশিয়ার দীন দরিদ্র ক্রিশ্চান উত্তরাঞ্চলে ইসলামিক সন্ত্রাস, মালয়েশিয়াতে এক গৃহিণী তাঁর সংসারকর্মের সহায়িকার গায়ে গরম জল ঢেলে পুড়িয়েছেন এবং গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা মেরেছেন, তাঁকে মালয়েশিয়ার আদালত ১৮ বছরের জেল দিয়েছে, শেফিল্ডে এক পিতৃদেব তার নিজের মেয়েকে ২৫ বছর ধরে ধর্ষণ করে চলেছেন, মাঝে মাঝেই বাড়ি বদলাতেন, দশটি সন্তান মেয়ের গর্ভে, হয় জন্মেছে নয় ভ্ৰূণ হত্যা করেছেন, একটি দু’বছর বয়সী শিশুকে অত্যাচার করে খুন করেছেন, এই বিভিন্ন বিচিত্ৰ মহাপাপের জন্য বিলেতের আদালতে তাকে ২৫ বার প্রাণদণ্ড দিয়েছে (ঠিকই শুনেছি), যদিও মহামান্য আদালত থাইল্যান্ডে আর ইংল্যান্ডে চমৎকার বিচার করেছেন, সংবাদগুলি শুনতে শুনতে নিঃশ্বাস আটকে আসছিল, টিভি বন্ধ করে দেব ভাবছি, হঠাৎ লাল হরফে বিশাল করে ঘোষিত হল, ব্রেকিং নিউজ—টেররিস্ট অ্যাটাক ইন মুম্বই। কেঁপে উঠল আমার শরীর, যতই বিশ্বমানবী মনে করি না কেন নিজেকে, টিকি ধরে টান দিলেই টের পাই বিশ্বের ঠিকানাটা আসলে কোথায়।

টিভি বলছে আজ রাতে ভারতের বাণিজ্য কেন্দ্র মুম্বইতে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণে অন্তত ৮০ জন মৃত, আর ২৫০ জন আহত, তাজ আর ট্রাইডেন্ট ওবেরয়, এই দুই বড় হোটেলে এবং লিওপোল্ড কাফেতে গুলি চালানো, ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, মার্কিন ও ব্রিটিশ ভ্রমণকারীদের লক্ষ করে নাকি এই হত্যালীলা, (মারা গিয়েছেন যদিও প্রধানত হতভাগ্য ভারতীয় জনগণ, হোটেল কর্মচারী ও পুলিশেরা) বেশ কিছু বিদেশি মানুষকে ধরে হস্টেজে রাখা হয়েছে, এসব কীসের জন্যে, তাদের দাবিটা কী তা অবশ্য বলেনি সন্ত্রাসবাদীরা, দক্ষিণ-মুম্বই-এর প্রধান রেল স্টেশনে, আর কোনও এক হাসপাতালে বাজারেও সাধারণ মানুষের ওপরে যথেচ্ছ গুলি চালনা করা হয়েছে, এবং মুম্বই পুলিশের অ্যান্টি টেরিরিজম চিফ স্বয়ং নাকি ওই ৮০ জন মৃতের মধ্যে আছেন। ডেকান মুজাহিদিন (কখনও নাম শুনিনি বাপু। দাবি করেছে এটা তাদের কীর্তি, কিন্তু তারা এত বড় দুর্যোগের ঘটনা ঘটানোর মতো শক্তিমান কি না কেউ জানি না। হাত পা ঠান্ডা হয়ে কী হবে, এই তো সবে কলির সন্ধে। এরপরে আস্তে আস্তে খবর আসতে থাকবে, মৃতের সংখ্যা বাড়বে, আহতের সংখ্যা বাড়বে, বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ মতামত দেবেন, বন্দি হস্টেজদের উদ্ধারের নাটক হবে, ঈশ্বর করুন জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা যায় যেন বেচারিদের, ভারতের বিদেশি টুরিজমের তো মুণ্ড পতন হয়ে গেল, একেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, এখন ব্রিটেন আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভাল থাকলে হয়, ওসব হোটেলে বড় বড় কনফারেন্সও হয়, সেও শেষ। তাজ বড় সুশ্রী, বড় অভিজাতদর্শন হোটেল, অনেকদিন আগে একবার থেকেছিলুম এয়ারলাইনের খরচে, আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে শুনে বিপন্ন মানুষ ছাড়া সৌধটির বিপন্নতার জন্যেও মন খারাপ হচ্ছে। আমার বন্ধু ক্যামিলিয়া পঞ্জাবি সেখানে কাজ করতেন, ভারতের সর্বোচ্চ বেতনভুক নারী হয়ে। এখন নেই। লিলেট দুবের স্বামী রবি দুবে ওখানে অফিসার। কেমন আছেন? নন্দনা খবর নিল ভাল আছেন। সারা রাত টিভি দেখব, ঘুম আসবে না, মুম্বইতে স্বজন বন্ধুদের জন্যে বুক অস্থির, কয়েকটা ফোন করে ফেলি এত রাতেই, কেউ সেখানে ঘুমিয়ে নেই আজ! হয়তো একটু পরে আরেকটু ব্যাপারটা সমঝে নিয়ে মাননীয় মনমোহন সিংহ মাভৈ বলে বক্তৃতা দেবেন, হয়তো পাশের বাড়ির দুষ্টু ছেলেটাকে মৃদু বকুনি দেবেন। আমাদের পুব পশ্চিম দুই পাশের বাড়ি থেকেই তো আমাদের খোলামেলা বড় বাড়িতে ঢিল ছোড়ার পথ খোলা, অনুপ্রবেশ সহজ। এ কথাও সকলের জানা, যে দুই পারেই ঘটা পটা করে সন্ত্রাসবাদের প্রশিক্ষণ চলে অথচ বিশ্বের কেউ তা থামাতে পারে না। যুদ্ধ খারাপ, আমরা সবাই যুদ্ধবিরোধী। কিন্তু এই অবোধ সন্ত্রাস, এই নির্মম গণহত্যা যুদ্ধের চেয়ে আরও বেশি খারাপ, যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তত দুই পক্ষের সমান মরা- বাঁচার সুযোগ থাকে। এ কথা নতুন করে উচ্চারণ করতেও লজ্জা করছে, এটা এতই বাহুল্য, যে মানুষ খুন করার মধ্যে কোনও মহত্ত্ব নেই। অসংখ্য সম্পূর্ণ অপরিচিত, নিরপরাধ মানুষকে আচমকা ফন্দি এঁটে খুন করে জখম করে শেষ করে ফেললে, ভয় দেখানোই সফল হয় শুধু, এতদ্দারা কদাচ কোনও মহান উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না। স্বদেশ, ধর্ম, স্বধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস যা কিছুই প্রাথমিক উদ্দেশ্য হোক না, গণহত্যার পিছনে কোনও প্রকৃত আদর্শবাদ থাকতেই পারে না। (জেনোসাইড শব্দটা যেন আরও ভয়ঙ্কর) তার জন্যে যে ব্যক্তিগত আত্মত্যাগ, যেমন মানব বোমা, শেষ পর্যন্ত তার মধ্যেও কোনও বাহাদুরি, কোনও উজ্জ্বল আদর্শবাদের বর্তিকা প্রধান হয়ে ওঠে না। নানান মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, আরও অনেক আশপাশের জিনিসের পিছনে এসে দাঁড়ায়। ব্যাপারটার অত সহজ সরল ব্যাখ্যা চলে না। মগজধোলাই ভিন্ন গণহত্যা করা সম্ভব নয়।

সন্ত্রাস দানবিক, প্রাক্ ইতিহাসে দৈত্যরা সন্ত্রাস সৃষ্টি করত, দেবতা আর মানুষের ওপরে অত্যাচার করত, জীবনযাপন দুঃসাধ্য করে দিত বলে আমরা রামায়ণে মহাভারতে পড়েছি। কিংবদন্তী আমাদের বারবার বলেছে সন্ত্রাস সৃষ্টি অমানবিক, দুর্দৈব, সন্ত্রাসের সহায়তায় মানুষের মঙ্গল হতে পারে, এ কথা একেবারেই মান্য করা যায় না। পৃথিবীতে এতদিনে এই মোটা কথাটা উচ্চারণ করা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন হয়ে যাওয়া উচিত ছিল যে, কারণ যা-ই হোক, মানুষকে হত্যা করার মতো নারকীয় পাপকাজ কোনও শুভকর্মের উপায় হতে পারে না। যখন আধুনিক পৃথিবীতে চরম অপরাধী নরহত্যাকারীর পর্যন্ত প্রাণদণ্ড আদেশের বিরোধিতা চলছে, তখন আধুনিক জগতের কোনও আদর্শবাদই নিরপরাধের হত্যাকে বৃহত্তর মুক্তির উপায় বলে কোনও সুস্থ মানুষকে বোঝাতে পারবে না। আর গণহত্যা তো আরও নারকীয়, প্রচণ্ডতর অপরাধ। এসব উন্মাদ খুনিদের মস্তিষ্ক তো সুস্থ হতে পারে না, যত বেশি মানুষ মরে, অপারশেন ততই সাকসেসফুল বলে যাদের উল্লাস হয়!

যেদিকে তাকাই, মানুষের অমানুষিক হিংসার কাহিনি। দেশ বিদেশে, ঘরে বাইরে, গৃহিণী গৃহকর্মী, এমনকী বাপে মেয়েতেও নিরাপত্তা নেই। ত্রাস সর্বত্র, বিপন্নতা সর্বত্র, অনিশ্চয়তা সর্বত্র। সুরক্ষা শব্দটা আছে শুধু এয়ারপোর্টেই, সমাজে আর কোথাও আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আর সন্ত্রাস মানেই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নয়। অথবা সিস্টেমের বিরুদ্ধেও নয়।

সন্ত্রাস বলতে আমি বুঝি প্রাণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সভ্যতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সন্ত্রাস মানে মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ভিন্ন ভিন্ন আদর্শবাদ অনুযায়ী তার ডাকনাম যাই হোক, মাওবাদী বা মুজাহিদিন, আল কায়েদা বা বজরঙ্গবলী, ভাল নাম শুধু একটাই।

হিংস্রতা!

একদিন অরণ্যের আদিম হিংস্রতার বিরুদ্ধেই হয়েছিল মানুষের সভ্যতার অভিযান।

রাত বেড়ে চলেছে, নেশার মতো টিভির সামনে জেগে বসে আছি, চোখে ঘুম নেই, কাল আরও খবর আসবে। ইচ্ছে করলেও টিভি বন্ধ করতে পারছি না, এরই মধ্যে মৃত্যু বেড়ে ১০১। আহত ৩০০। একজন নাকি ধরা পড়েছে। সে আমাদের প্রতিবেশি দেশের নাগরিক। তার সঙ্গে আল কায়দার সংযোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। নন্দনা একের পর এক ফোন করে চলেছে তার বন্ধুদের, মুম্বইতে। ফোনে দু-রকমের দুটি দুঃসংবাদ এল। হবু বউকে নিয়ে তাজে ডিনার খেতে গিয়েছিল ওদের এক বন্ধুর ভাই, সন্ত্রাসবাদীরা তার মাথার পিছনে গুলি করেছে। আর মিটিং করতে গিয়ে অভিনেত্রী সোনালি কুলকার্নি তাজে আটকা পড়েছেন। এই লেখা প্রকাশিত হতে হতে আরও বারো দিন। তখন এ খবর বাসি হয়ে যাবে, এর যন্ত্রণা মিইয়ে যাবে, ততদিনে হস্টেজেরা মুক্ত হয়ে যাবেন, ততদিনে সব জানা যাবে। ততদিনে, ইনশাল্লা, আমিও কলকাতাতে পৌঁছে যাব।

আমার মনে পড়ছে নিউ ইয়র্কে নাইন ইলেভেনের সেই ভয়াবহ দিনেও আমি আর নন্দনা একসঙ্গে ছিলুম, সেবারে ছিলুম মুম্বইতে, অন্তরার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি টিভির সামনে, রাতভোর মা মেয়ে এমনি কাঠ হয়ে বসে দেখেছিলুম, বার বার দেখিয়েছিল, খুনি এরোপ্লেন দুটি কীভাবে নির্ভুল লক্ষে মানুষ বোঝাই যমজ টাওয়ারের মধ্যে ঢুকে গেল! আর দেশলাই-এর বাক্সের বাড়ির মতো মিনারগুলি ভেঙে পড়ল। মনে পড়ে যাচ্ছে ভেঙে দেওয়া বামিয়ান বুদ্ধের বিকৃত মূর্তি। বাগদাদ নগরীর কিংবদন্তিপ্রতীম সৌন্দর্যও ধ্বংস করেছে অন্যায় যুদ্ধের হিংসা। ধ্বংস হয়েছে গোলাপের জন্যে আর মুক্তোর জন্যে বিখ্যাত বুখারা

এই গ্রহের আর কী গতি হবে? দূরদৃষ্টিহীন মানুষের তো না আছে অতীতের প্রতি সম্মান, না ভবিষ্যতের প্রতি ভালবাসা। লোভ আর হিংসা আমাদের বর্তমানকে এমন অন্ধ করে রেখেছে, আমাদের আত্মরক্ষার পর্যন্ত বুদ্ধি নেই। একদিকে যন্ত্রের উদ্‌গীর্ণ নিত্যনৈমিত্তিক প্রলয়বিষে আকাশ বাতাস জল মাটি, ষড় ঋতুর সামঞ্জস্য, প্রকৃতির সব কিছু নিজস্ব হিসেব ধ্বংস করে চলেছি। তার ওপরে আমাদের মধ্যে শক্তির, সম্পদের প্রবল লোভ, নানা অজুহাতে মনুষ্যসমাজে সন্ত্রাস, আর যুদ্ধ তৈরি করে আরেক রকমের ফস্কাগেরো বেহিসেবি করে তুলেছে মানুষকে। এইভাবে আমরা আমাদের গোড়ায় কুঠারাঘাত করছি, মনুষ্যত্বের সব প্রাথমিক হিসেব ঘুচিয়ে দিয়ে নিজেদের গ্রহের অন্তিম প্রলয়ের পথ অবারিত করে দিচ্ছি প্রতি মুহূর্তে। যতই চন্দ্ৰযান চাঁদে যাক, নির্মম মানব সভ্যতার ফাইনাল সন্ত্রাস আসছে, মেরুর বরফ গলে সাত সমুদ্রে যে প্রলয়বান আসবে, সে বলছে, অবিমৃশ্যকারী মানুষের আর বেশিদিন নেই।

জীবন যেরকম

(হে আমাদের প্রতিরক্ষা দপ্তর, তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অবধি নাই। আরও কতকাল ধরিয়া আরও কত প্রাণ তোমার শ্রীচরণে বলি দিতে হইবে?)

শরীর কেপটাউনে মন মুম্বইতে। কপালের টিপের জন্যে কিনা জানি না আমি যে কোন দেশের লোক কেউ জিজ্ঞেস করে না, ধরেই নেয়। এখানে পথেঘাটে চেনা অচেনা সংবেদনশীল যে মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে তিনিই বলছেন, আহা, কি ভয়ংকর কাণ্ড, খুব দুঃখিত, তুমি মুম্বই থেকে নও তো? তোমাদের পরিবারের সবাই ঠিকঠাক তো? নন্দনার এই ফিল্মের সহকর্মীরা সবাই প্রায় মুম্বই-এর লোক। মুম্বই থেকে রোজ রোজ আরও খারাপ খবর আসছে। দিল্লিতে আমার মেয়ে জামাই প্রতীক আর অন্তরার একদার সহকর্মী বন্ধু সাবিনা বাচ্চি কারকরিয়ার মেয়ের বিয়েতে মুম্বই গিয়ে তাজে ছিল, সে আর ফেরেনি। শান্তিনিকেতনের চন্দনার বন্ধু বম্বের তাও গ্যালারির মালিক কল্পনা শাহের স্বামী ট্রাইডেন্ট ওবেরয়ে খেতে গিয়ে গুলিতে মৃত। নন্দনাদের ফিল্মের অন্যতম নায়ক, অভিনেতা আশিস চৌধুরির বোন আর জামাইবাবু ওই ট্রাইডেন্ট ওবেরয়ে খেতে গিয়েছিলেন, দু’জনেই গুলিতে নিহত। আশিসের পরশু রওনা হওয়ার কথা ছিল কেপটাউনে, স্বভাবতই সে ছেলেটি আসেনি, তার অংশের শুটিং পিছিয়ে গেল। আমাদের ফেরার টিকিট কনফার্ম করার কথা, কিন্তু মুম্বই-এর ট্রাভেল এজেন্টকে এই মুহূর্তে ধরার উপায় নেই। এখনও জানি না কবে ফিরতে পারছি।

কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। আমাদেরও আফ্রিকা সফর থেমে নেই। ৩০ নভেম্বর, ভীষণ কলকাতার জন্যে মন কেমন করছে। সেদিন বুদ্ধদেব বসুর শতবর্ষ উদ্যাপিত হল। ওই একই তারিখে আমার মায়ের ১০৫ বছরের জন্মদিন হত, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন। আমার শ্বশুরমশাইয়েরও ১০৭ হত, ওই একই দিনে। আর আমাদের ‘সই’-এর আট বছর পূর্ণ হল। প্রতি বছর তাই ভাল-বাসা বাড়িতে একটু উৎসব করি ৩০ নভেম্বর। এই বছরে হয়তো কলকাতাতে থাকলেও উৎসবের মুড থাকত না আমাদের।

কিন্তু রয়েছি কেপটাউনে। দেখা গেল এখানেও ৩০ নভেম্বর খুব জরুরি তারিখ, সারা শহর ওই তারিখে আমোদ আহ্লাদ করে। ওই দিন মেয়র শহরের বাৎসরিক আনন্দ উৎসবের বাতি জ্বেলে দিয়ে বড়দিনের ছুটির সময়টার সূচনা করেন। ক্রিসমাস আর নতুন বছরের জন্যে সারা শহরের কিছু অংশ আলোতে সাজানো হয়, সুইচ টিপে একই সঙ্গে সব আলো প্রজ্জ্বলন করেন মেয়র, সেইটে নিয়ে উৎসব। লন্ডনেও অক্সফোর্ড স্ট্রিটে বড়দিনের বাজারের উল্লাসে প্রথমদিনে ক্রিসমাস লাইটস জ্বালানো নিয়ে একটা হইচই হয়ে থাকে। কোনওদিনও তাতে যোগ দিইনি, কিন্তু আজ এখানকার এই উৎসবের জন্যে নন্দনার এক বন্ধু রেন্নান আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, ভিআইপি আসনের কার্ড দিয়েছেন, তদুপরি, নানারকম বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন যাতে ‘রোড ক্লোসড’ সাইন সত্ত্বেও, অকুতোভয়ে আমাদের গাড়ি শেষ অবধি যেতে পারে ভিআইপি এনক্লোসারে, নন্দনার খোঁড়া মায়ের যেন কোনও কষ্ট না হয়। অতএব ইচ্ছে তত না থাকলেও যেতে হল।

গিয়ে অবিশ্যি টের পেলুম খুব ভাল কাজ করেছি। কেপটাউনের সঙ্গে চেনাশুনো বাড়ল। শেষ অবধি আমার গেলুম পাঁচজনে। নন্দনা নেমন্তন্ন করল তার সহকর্মী মারটিন, আমাদের গাড়ির চালক আখমদ, আর তার রূপসী মালয়েশিয় আফ্রিকান পত্নী শিয়ামকে। শিয়ামের বয়েস সাঁইত্রিশ, পাঁচ ছেলেমেয়ে এবং এক নাতি। আখমদের তিন পুত্র। ওদের বিয়ের এক বছর এখনও পেরোয়নি। এই আটটি ছেলেমেয়ে বাপ মায়ের আগের অন্য বিয়ের সম্পত্তি। সন্তানেরা কেউ ওদের কাছে নেই। শিয়াম কাপড়ের কারখানাতে ভোর থেকে রাত্রি অবধি কাজ করে। তার বাচ্চারা দিদিমার কাছে থাকে। আখমদের ছেলেরা থাকে তাদের মায়ের কাছে। খরচ বাবার। ওরা কালার্ড, এবং মুসলমান, খানিক আফ্রিকান, খানিক মালয়ের শ্রমিকদের বংশধর। ওরা দক্ষিণ আফ্রিকার ন’টা দেশীয় ভাষার একটাও জানে না, ওদের ভাষা আফ্রিকান্স, ইংরেজি, আর একটু একটু আরবি। এখানে সাদা, কালো, কালার্ড, আর ইন্ডিয়ান, সমাজের বর্ণানুশ্রমিক সম্প্রদায় এইরকম ভাগ। কালার্ডরা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মতো মিশ্র জাতি। আপারথেইডের সময়ে ওরা সামান্য কিছু অতিরিক্ত সুযোগ পেত যা কালোরা পেত না। এখন কালোতে কালার্ডে সঙ্ঘর্ষ বেধেছে সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে।

বড়দিনের আলো উৎসবটি সত্যি সুন্দর। বিখ্যাত জ্যাজ গায়ক লোভিসো জমজমাট গাইলেন, তাঁর গানের তালে সারা শহরের দর্শক সবাই ঢেউ তুলে নাচতে লাগল নিজের আসনের সামনে দাঁড়িয়ে। শেষের গানটি তিনি গাইলেন সদ্য প্রয়াত মিরিয়াম মাকিবার স্মৃতির উদ্দেশ্যে, তাঁরই একটি জনপ্রিয় গান। আস্তে আস্তে শ্রোতারা সবাই যোগ দিল। তারপরের অনুষ্ঠান, ম্যাজিকের মতো। একটি শিশু লালজামা পরে মঞ্চে এল, বছর পাঁচ-ছয় বয়েস। তার নাম ‘কিড ড্রামার’ ড্যানিয়েল পিটারসেন। অসামান্য পারকাশ্যন বাজালেন তিনি, আপনি করে ছাড়া বলতে পারছি না এমনই অসাধারণ তাঁর দক্ষতা। উৎসবের পরে চা খেতে গিয়ে দেখা হল, কোলে তুলে একটু আদর না করে পারিনি। হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালালেন মোৎসার্ট-এর ছোট ভাই। বয়েস সত্যিই ছয়, অত বড় পারকাশ্যন ড্রামগুলো বাজানোর সময়ে কচি হাত দুটো যেন দেখাই যায় না বিশাল স্ক্রিনে, এত দ্রুত ওই কচি হাত পা চলে। না দেখলে বিশ্বাস হয় না। শুনলুম ওবামা তাঁর অভিষেকের অনুষ্ঠানে ড্যানিয়েলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাজাতে। আমার মনে পড়ল, আমাদের কলকাতাতে একজন শিশু তবলচি আছেন, ঋদ্ধদেব, তিনিও দারুণ তবলার কসরত দেখাচ্ছেন সেই কচি বেলা থেকে। তাকেও কেউ ডাকছেন নাকি?

তারপরে এলেন আসল লোক, মেয়র। করতালিতে ফেটে পড়ল বিশাল জনতা। এই বছর নাকি বিশ্বের সেরা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁর শাসনে কেপটাউন হয়েছে বিশ্বের সেরা নগরী। জানি না এসব ফলাফলের জন্যে অঙ্ক কোন হিসেবে কষা হয়। কিন্তু হয়েছে। তা নিয়ে কেপটাউনের গৌরবের শেষ নেই। মেয়র এসেই হাসি ঠাট্টা করে জমিয়ে দিলেন আসর। কোনও ফর্মালিটি নেই, কোনও দম্ভ অহংকার নেই, পদাধিকারের ফলে অনেক সময়ে মানুষের যে সব ক্ষতি হতে দেখেছি। মেয়র নারী, শ্রীমতী হেলেন জিলা, আপাতত কেপটাউনের অদ্বিতীয়, শীর্ষস্থানীয় নায়িকা। নানা ভাবে তিনি উন্নতি করেছেন এই শহরের। আমি তো তাঁর হাবভাব দেখেই মুগ্ধ, এত সহজ তিনি। সবচেয়ে ভাল কাজ করলেন পাঁচ মিনিট কথা কইলেন, সুন্দর সহাস্য সুরসিক কথাই, বক্তৃতা দিলেন না, না রাজনৈতিক, না সমাজনৈতিক, না তাত্ত্বিক। বললেন, ‘আজ বক্তৃতার দিন নয়, আনন্দের দিন, হইচই-এর দিন, আমিও হইচই করতে এসেছি, সামনের উৎসবের দিনগুলো যেন শুভ হয় আমাদের সকলের, এই শুভেচ্ছার সঙ্গে বাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছি। অবশ্য ক্রেডিট সবই এই বৈদ্যুতিক কোম্পানির।” বলে সেই কোম্পানির অনিচ্ছুক লোকটিকে মঞ্চে টেনে আনলেন হাত ধরে।

কিন্তু ওই খোলামেলা ছোট্ট ভাষণটি তিনি দিলেন তিনটে ভাষাতে, ইংরেজি, আফ্রিকান্স, এবং খোয়াসাতে। এটাই তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান জোর বলে আমার মনে হল, সাদারা কেউ (এক মিশনারিরা ছাড়া) ন’টা আফ্রিকান দেশীয় ভাষার একটাও শেখে না। সাদা নারী হেলেনের মুখে খোয়াসা অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ শোনাল। প্রবল করতালি পেলেন আবার।

শহরের আলোর সুইচ টিপে দিলেন, আলো ঝলমল করে উঠল। তার পরে দমাদ্দম বাজি পুড়িয়ে তুবড়ি উড়িয়ে শুরু হল প্যারেড। প্রথমেই খোলা গাড়িতে হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের হাসিখুশি মেয়র রানি। তারপরে বাকিরা। আর কার্নিভ্যাল। নামেই কার্নিভ্যাল, সাউথ আমেরিকার মতো নয়। শোভাযাত্রার চেহারা অবিকল আমাদের বিজয়ার শোভাযাত্রারই মতো। বিভিন্ন ক্লাব, ইসকুল, ব্যান্ডের দল, চার্চ, স্যালভেশন আর্মি, ইয়ুথ কয়ার, বিভিন্ন সম্প্রদায়, একে একে হেঁটে (নেচে গেয়ে বাজনা বাজিয়ে) গেল, ছোট বাচ্চা থেকে বৃদ্ধরা অবধি। একটি ছিল ভারতীয় দল, পুরুষরা ঢোল বাজিয়ে বাঁশি বাজিয়ে, আর নারীরা অপূর্ব ঘাগরা চোলি ওড়নাতে সেজে কাঠি নিয়ে গরবা নাচতে নাচতে গেল।

স্কটল্যান্ডের বাজনা বাজিয়ে গেল হাইল্যান্ডার্স, ক্যালেডোনিয়ান্স, পর্তুগালের দলও নাচতে নাচতে গেল। বেশ একটা বহুজাতিক চেহারা দেখা গেল দক্ষিণ আফ্রিকার। কেপটাউন যে আফ্রিকা তা মনেই থাকে না, এটা এতই ইয়োরোপীয়। অতীব মহার্ঘ বাড়িঘর, দোকানপাট, হোটেল রেস্তোরাঁ দেখে তৃতীয় বিশ্ব বলেও খেয়াল থাকে না। যদি না শহরের বাইরের আফ্রিকান টাউনশিপগুলিতে যাই। সেইখানে স্থানীয় কালো মানুষদের দরিদ্রতম বস্তির জীবন। ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি, ঝকঝকে শহরের ভিতরে তাদের বসতি বারণ। শহর সুন্দর থাকবে। শহরের সর্বত্র কাজের মেয়েরা, কাজের ছেলেরা কালো। দু’ঘণ্টা ধরে ট্রেনে, বাসে, ট্যাক্সিতে কালো মেয়েরা কাজ করতে আসে শহরে, সকাল আটটায় পৌঁছাতে হয়, ভোরে বেরুনো। আমাদের দেশের ঠিকে মেয়েদের মতোই জীবন। আখমদ বললে তাঁর স্ত্রী কেঁদে ফেলেছে এত সম্মান সে জীবনে কোনওদিন পায়নি। ভিআইপি এনক্লোশারে কোনওদিন ঢোকেনি আখমদ, বা তাঁর স্ত্রী। লক্ষ না করে পারিনি সেখানে অতিথিরা প্রধানত ছিলেন সাদা আর ভারতীয় আর দু’চারজন স্বচ্ছল কালার্ড পরিবার, কোনও কালো মানুষের পরিবারকে আমাদের কাছাকাছি আসনে দেখিনি, যদিও প্রচুর কালো পরিবারকে সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সেজেগুজে আসতে দেখেছি রাস্তায়। জানি না সমাজের বুকের ভিতর থেকে আপারথেইড কতটা গিয়েছে চোদ্দ বছরে। শুনি তো কালোদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ বিদ্বেষ এখনও প্রবল। রীতিমতো বিপরীত সমস্যা দেখা দিয়েছে।

প্রচণ্ড তুবড়ি পুড়িয়ে ব্যাণ্ড বাজিয়ে, গাড়িতে ফ্লোট সাজিয়ে, টিভি’র পরিচিত কমিক চরিত্র সেজে, বিচিত্র নেচে গেয়ে এই যে ঐতিহ্যময় শোভাযাত্রা হল, কেপটাউনের গর্ব এই প্যারেড কিন্তু আসলে আমাদের দেশের যে কোনও উৎসবের মতোই, শুধু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টটা অনেক বেশি নিপুণ। অতিথিদের আসনে বসানোর জন্য দোর খুলে দেওয়া, ভিড় সামাল দেওয়া সবই দেখলুম মেয়ে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবীদের কাজ, সভাস্থলে তো পুলিশের দেখা পেলুম না তেমন। দরকারও নেই। ভিড় খুব সুসংযত, এত মানুষ ছেলেপুলে নিয়ে আনন্দ করতে এসেছেন, কারুর কোনও তাড়া নেই। কেপটাউনের এটাই প্রধান গুণ, এখানে এলে মনে হয় কারুর কোনও তাড়া নেই।

মাকে নিয়ে যাচ্ছি…

নন্দনা ঠিক করে রেখেছিল এবারে যেহেতু তার রোজ রোজই দিনের বেলা শুটিং থাকছে, অন্তত দুটো দিন সে তার মাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুবেই। তাকে তো আলাদা গাড়ি আর সারথি দেওয়া হয়েছে, এটুকু সদ্ব্যবহার সে করবে না সেই সুবিধের? অতএব, নাইট শুটিং-এর সময়ে দুদিন দিনের বেলাতে সে বেড়াতে বেরুবে, একদিন তার মাকে নিয়ে একটা স্পা-তে যাবে। আর একদিন মাকে নিয়ে একটা সাফারি-তে যাবে, আফ্রিকার জন্তু জানোয়ার দেখতে। “সারারাত শুটিং-এর পরে ঘুরতে যাবি?” সে বললে, “কেন মা, সারাদিন ধরে দুজনে মিলে আরামসে রিল্যাক্স করা যাবে।” ঠিক হ্যায়, সেই কথাই রইল!

‘ফেয়ারি গ্লেন’ • আফ্রিকা’জ বিগ ফাইভ

প্রথমে গেলুম ভোরে উঠে একদিনের ‘অল ডে সাফারিতে। বেশি দূরের জঙ্গলে তো যাওয়া যাবে না, মেয়ের রাত্তিরে এসে শুটিং আছে। কাছাকাছির মধ্যে পাওয়া গেল ‘ফেয়ারি গ্লেন সাফারি’, সেখানে নাকি দক্ষিণ আফ্রিকার ‘বিগ ফাইভ’ এর প্রত্যেকটি পশুই উপস্থিত, আর কপাল খুব মন্দ না হলে তাদের দেখতে পাওয়া যায়। নন্দনার সারথি আখমেদ খুব উৎসাহী, সে বললে জায়গাটা চেনে। ‘ফেয়ারি গ্লেন’ নামটি ভারি সুন্দর। ওখানে বনের মধ্যে একটা জলাভূমি আছে, সেখানে রাত্তিরে আলেয়া দেখা যায়, আর জোনাকিরা নাচে বলে, অবুঝ শহুরে মানুষে ঐ জায়গাটাকে পরীদের পল্লি বানিয়ে ফেলেছিল। আমরা ব্রেকফাস্ট না খেয়েই চললুম, ওরাই বনের মধ্যে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ খাওয়াবে। প্রথমে ঢুকলুম এক আস্ত নকল হাতির তোরণ দিয়ে একটা ফাঁকা মাঠে, ঘেরাওর মধ্যে। আরে? এখানে জঙ্গল কোথায়? ‘ঐ যে’, পিছনের পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে আখমেদ বলে, ‘ঐখানে সব পশুরা থাকে। এরা এদের রেঞ্জারের গাড়িতে তুলে তোমাদের ঐখানে নিয়ে যাবে, এই গাড়ি তো জঙ্গলে ঢুকবে না।’ নন্দনা ওদের অফিসে গেল, খুঁটির মাথায় চালাঘরে অফিস। সেখান থেকে ব্যাজ আর টিকিট দিল, ব্যাজটা পরে থাকা আবশ্যক যাতে রেঞ্জারের সুবিধে হয় জানতে কে কোন গাড়ির যাত্রী। একজন সঙ্গে এল আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে, প্রায় পাহাড়ের কোলের কাছে নিয়ে গিয়ে গাড়ি থামাল এক সুন্দর খড়ের চালওলা কাঠের তৈরি কুটিরের পাশে। সেখানে প্রাতরাশের ব্যবস্থা। ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ! পাঁচতারা হোটেলের মতো অঢেল বুফের ব্যবস্থা, সব রকম আছে। কতরকমের মাংস, ইচ্ছেমাফিক ডিম, মাথ অবধি। পরিজ, কর্নফ্লেক্স, দুধ, দই, চা, কফি, ফলের রস, ঝুড়ি ঝুড়ি ফল, নানারকমের রুটি মাখন। আরো আশ্চর্য হয়ে দেখলুম সেখানে জড়ো হওয়া অতিথিরা গোগ্রাসে অস্বাভাবিক পরিমাণে ভোজনে ব্যাপৃত হয়ে পড়েছেন। জন্তু দেখতেই তো যাচ্ছি, এখানেই কি তবে দর্শন শুরু? খেয়ে উঠে একটু বসা হল সামনের পাথর বাঁধানো উঠোনে, ধূমপায়ীদের এখানেই শেষ ধূম্রপান। যাত্রার মধ্যে তো চলবে না।

গাড়ি রইলো ঐখানেই আখমেদকে নিয়ে, আমরা চললুম বনে।

যাত্রীদের দুই ভাগে ভাগ করে তোলা হল দুটো ‘খোলা কিন্তু খোলা নয় এমন, মাথায় ছাদ আছে কিন্তু দেওয়াল নেই, এরকম ট্রাকে। আমাদের সারথিই আমাদের গাইড, তিনি নিজেই একজন রেঞ্জার, আর আমাদের ভাগ্য খুব ভাল, তিনি শুধু যে প্রচুর জানেন তাই নয়, তাঁর সুন্দর কৌতুকবোধ আছে, এবং যারপরনাই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ। তাঁর সঙ্গে আমাদের বনভ্রমণ সুখের হয়েছিল, সার্থকও হয়েছিল, শুধু লেপার্ড ছাড়া বিগ ফাইভের সবই দেখতে পেয়েছি আমরা। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে জেব্রা পরিবারের সাংসারিক জীবন, বুনো গাধার দলের দৌড়, মাটিতে দাঁড়িয়ে উচ্চ বৃক্ষশাখে ভুরিভোজ সারতে দেখলুম লম্বু জিরাফ দম্পতিকে। ঝিলের জলে মুখ দেখতে দেখতে জল খাচ্ছেন গণ্ডার যুগল। অন্যমনে দাঁড়িয়ে কান নাচাচ্ছেন আফ্রিকান হস্তীরা। সিংহমশাই আর সিংহীনীকেও দেখা গেল অরণ্যের এক ফাঁকে বসে জিরোচ্ছেন কত্তা গিন্নিতে। অনেকরকমের পাখি দেখলুম, আরো বেশি পাখির ডাক শুনলুম, নদীর ধারে নেমে একটু বিশ্রামও করলুম ঘেরা জায়গার মধ্যে। এখানে পশুরা মুক্ত বলে মানুষকে ঘেরা দরকার। মাঝে ফিরে এসে একবার লাঞ্চ হল, তারপরে আবার বেরুনো বনপথে। লাঞ্চেও প্রভূত খাদ্য ছিল, এবং তার সদ্ব্যবহারের জন্য অতিথিদের চেষ্টার অভাব দেখিনি। অথচ কেপ পয়েন্টের পথে বনের মধ্যে প্রচুর হনুমান আর বেবুন দেখেছিলুম। এখানে সব চেয়ে বেশি দেখেছি হরিণ, কত যে হরিণ, আর কত ধরনের! নন্দনা নোট নিচ্ছিল, মোট নাত প্রজাতির হরিণ দেখেছি আমরা সেদিন ওখানে। সম্বর, নীলগাই ধরনের বিশাল বপু বিরাট শিং ওয়ালা বাইসনতুল্য হরিণও আছে, আবার ছোটো ছেটো সুন্দর হরিণও রয়েছে। ছোটো হলেও তাদের কারুর কারুর বড়ো বড়ো শিং আছে! রেঞ্জারের গাড়ি পশুরা আর তেমন ভয় পায়না তবু ভাগ্যিস ছোটো হরিণেরা ছুটে পালায়! দৌড়লেই ওদের সব চেয়ে সুন্দর দেখায়। বিকেলের চায়ের সময়ে আমাদের বনদর্শন সাঙ্গ হল। সারাদিন রোদ ছিল বটে কিন্তু আমাদের তেমন রোদ লাগেনি, ঠান্ডা বাতাস ছিল পাহাড়ের। গায়ে শাল জড়িয়ে বসতে হয়। শুধু লেপার্ডদের দিনের বেলাতে দেখা যায় না, তারা সত্যি সত্যি নিশাচর। এই একই কথা আমি পান্না অরণ্যে শুনেছিলুম, বাঘ সিংহদের দর্শন মেলে, লেপার্ডের মেলে না। তারা গাছে গাছে লুকিয়ে থাকে সারাদিন, লোকচক্ষুর আড়ালে। এখানে একটা প্রাচীন উইঢিপি দেখলুম, যা ঠিক পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে। মানুষ তার ওপরে উঠে দাঁড়ালেও কিছু হয় না। আমার ওটা দেখে মনে হল এটা যদি ভারতে থাকত আমরা নিশ্চয়ই বলতুম এটাই বাল্মীকির সেই বল্মীকদের তৈরি করা সাধু ঘর!

জঙ্গল তেমন ঘন নয়, আফ্রিকার জঙ্গল বলতে আমার মনে যে ছবি, পূর্ব আফ্রিকার মাসাইখারি জঙ্গলের মতো, এই অরণ্যের সঙ্গে তার মিল নেই। সেই অরণ্য দক্ষিণ আফ্রিকায় নেই। আফ্রিকা বিশাল মহাদেশ, তার প্রতিটি অঞ্চল ভিন্ন। আর আমরা তো শহর থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্ব এসেছি, সময় কই দূরের বনে বেড়াতে যাবার?

‘ম্যাঙ্গোয়ানানি’, দি অরিজিনাল আফ্রিকান ডে স্পা

কেপটাউন ছাড়ার আগের দিন স্পা। স্পা যাত্রাটা নন্দনার মতে আগে আগেই তার মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে অগ্রিম উৎসব, কেননা সেদিনটাতে তার আসা হবে না কলকাতাতে, শুটিং থাকছে হংকং-এ। কিন্তু এদিকে মার তো স্পা-তে যেতে উৎসাহ নেই। স্পা যে কী বস্তু নন্দনার মা জানে না। কখনো যায়নি, আর মেয়ের খরচটা কত হবে সেটা ঘটনাক্রমে জেনে ফেলে তো আর যেতে রাজিই হচ্ছে না নন্দনার মধ্যবিত্ত মা। (ও বাবা রে স্পা-টা কী রে এত্ত বড়ো হাঁ? এবার বুঝি ফেললে গিলে, মা গো মা?) গিয়ে মনে হবে না তো, কেন মরতে এলুম? কিন্তু দেখা গেল মায়ের আপত্তিতে মেয়ে প্রায় কেঁদে ফেলছে, সে যে অলরেডি টিকিট কিনে ফেলেছে হোটেলের রিসেপশন থেকে! শেষ দিনে মাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল সে, কিন্তু মা ঐ হোটেলের পাঠানো টুরিজমের কাগজপত্রেই এই স্পা-এর নাম ও খরচ আগেই দেখে ফেলেছে। নামটা বেশ। একটু আমের রং লাগা, আর সিন্ধী সিন্ধী শুনতে, ‘ম্যাঙ্গোয়ানানি’। কিন্তু অহংকার করে তারা ঘোষণা করছে ‘দি অরিজিনাল আফ্রিকান ডে স্পা!’ এবারে আমার একটু আগ্রহ হল, দেখা যাক অরিজিনাল আফ্রিকান স্পা কাকে বলে। আর পশুপাখি দর্শনে আমার চিরকালই উৎসাহ আছে, শুনেছিলুম এই অঞ্চলে তেমন ভাল জঙ্গল নেই, বন্য প্রাণীও কম। অবশ্য অনেক ‘সিংহ খামার’ আছে, সারাদিন সিংহদের সঙ্গে কাটানোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তাদের দেখা তো অন্যরকম। ইস্ট আফ্রিকাতে অন্য স্বাদের বনভ্রমণ হয়। তবু, আমি দুটোতেই রাজি হয়েছিলুম, আমার মেয়ের তো মাত্র এই দুটো দিনই বেড়ানো হবে। সারারাতের কাজের পরে সারাদিন ঘোরা আমার একটুও পছন্দের না হলেও, মাঝখানে ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে নেবার সময় ছিল তার। নন্দনার আগ্রহে আমি রাজি হয়ে যাই।

ভোরে উঠে পড়ি, উপায় নেই, নন্দনার ড্রাইভার আখমেদ এসে ডাকাডাকি করছে ফোনে। নন্দনা আগেই আমাকে বলে রেখেছিল, দুজনের জন্যে একটা ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে হবে। এক সেট করে জামাকাপড়, দুজনের সাঁতারের পোশাক, ক্রিম, চিরুনি ইত্যাদি। আর ক্যামেরা! সব গুছিয়েছি। কিছু ফল, জল, চকোলেটও নিয়ে নিই সঙ্গে। দুজনে বেরিয়ে পড়ি, কফি খেয়ে হোটেলের ঘরেই কফি তৈরির যন্ত্র আছে, লাগোয়া কিচেনেটে। স্পা-তে গিয়ে প্রথমে পাব ওয়েলকাম ফ্রুটড্রিংক, তারপরে ওদের যত ম্যাঙ্গোয়ানানি ফার্ম প্রডাক্টস দিয়ে বানানো অরগানিক ব্রেকফাস্ট। স্পা-তে নানারকমের বিউটি ট্রিটমেন্ট হয়, হেল্থ স্পা, নিশ্চিন্তে বিউটি ট্রিটমেন্ট নিতে পার কোনও অপকার হবে না, শরীরের উপকারই হবে। চামড়া, পেশি, স্নায়ু, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল, সব কিছুরই যত্ন নেবে ওরা সারাদিন। সুস্থ অবস্থায় সারাদিন ধরে নিজের শরীরের প্রতি সযত্ন নজর দেওয়া, এ যে তাদের মায়ের জীবনে কদাচ ঘটেনা, ঘটা কতটা অস্বাভাবিক, আমার মেয়েরা জানে। সে জন্যেই আরো জোর করছিল নন্দনা। কিন্তু আমরা ভোর ভোর বেরুলে কী হবে, ম্যাঙ্গোনিয়ানি আর আসেই না। আখমেদ যদিও বলেছিল সে জায়গাটা চেনে, যেতে ৪০ মিনিটও লাগবে না, কার্যত দেখা গেল সে অন্য নানান ছোটোখাটো সুদৃশ্য গ্রামে আমাদের নিয়ে সকরুণ ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে, কিছুতেই ঠিক এক্সিটটা ধরতে পারছে না, আমাদের আদ্যন্ত দেরি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে স্পা থেকে ফোন আসছে, তোমরা কোথায়? নন্দনা জানাচ্ছে, এই তো আমরা এই গ্রামে, আমরা এখন সেই গ্রামে। শেষকালে ওরা বললো, আর নয়, এবারে তোমরা হাইওয়েতে অমুক মোড়ে এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাক দিকিনি, আমরা আসছি, আমাদের পিছু পিছু এস। এত দেরি করলে তো সাতটা ট্রিটমেন্ট নিতে পারবে না, বিকেল পাঁচটাতে আমরা বন্ধ হয়ে যাই। তাই সকাল সাতটা থেকে শুরু করি। ওই গ্রামটি মোটেই পথে পড়ে না।

ম্যাঙ্গোয়ানানির পাকা আমের রং-এর বাহারি মিনিবাস এসে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো। অতি সুশ্রী কাঠের তৈরি খড়ের চালের ঘর, কাঠের সিঁড়ি, ভিতরটা অবশ্য শীততাপনিয়ন্ত্রিত। অনেকটা কলকাতার বৈদিক গ্রাম ভেদিক ভিলেজের মতো নকল গ্রামীণ স্টাইলের। পৌঁছে বোঝা গেল দৈনিক প্রোগ্রাম শুরু হয় একই সঙ্গে, সব অতিথিদের নিয়ে। তার পরে ট্রিটমেন্ট চলে একটার পরে একটা, ঘড়ির সময় মেপে, নইলে ওদের সম্মিলিত প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ চা-চক্র ইত্যাদির ধরাবাঁধা রুটিন সব এলোমেলো হয়ে যাবে। সারাদিনে মোট সাতটি ট্রিটমেন্ট, প্রতিটি ৪৫ মিনিটের। তার জন্যে পর্যাপ্ত সময় চাই তো?

নাঃ ওয়েলকাম পানীয় আমাদের কপালে নেই। আর সময় ছিল না, আমরা খাবার ঘরে ঢুকলুম যখন অন্যদের প্রাতরাশ তখন প্রায় সমাপ্ত। কেউ কেউ বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের হুড়মুড় করে নিয়ে গিয়ে একটি টেবিলে বসিয়ে দিল, তাতে আমাদের নাম ও একটি নম্বর লেখা কার্ড সাঁটা। সারাদিন ঐ নম্বরটাই হবে এখানকার কর্মী মেয়েদের কাছে আমাদের পরিচয় টেবিলে টেবিলে অতিথিরা খেতে বসেছেন, সবাই প্রায় জোড় বেঁধে এসেছেন, কয়েকজন একা একাও। কোনও মা মেয়ে জুড়ি চোখে পড়ল না। দুই বন্ধু জুড়ি অনেক।

ব্রেকফাস্টের মেনু জুস কর্নফ্লেক্স ডিমরুটি চা কফি নয়। অন্য। মোটামুটি এরকম : ওদের নিজস্ব খামারে চাষ করা শস্য দিয়ে তৈরি গ্রানোলা, গোশালার গরুর দুধ, মধু, ক্ষেতের আঙ্গুরের রস, বাগানের বড় বড় মিষ্টি লাল পেঁপের টুকরো, কলা, কমলা, আপেল, আঙুর, নানা ফল দিয়ে তৈরি ফ্রুট স্যালাড, ফুল ক্রিম দুধের তৈরি অরগ্যানিক ইয়োগার্ট, এবং স্মুদি আইসক্রিম, ওদের নিজস্ব বেকারির, নিজস্ব শস্যক্ষেত্রের ব্রাউন ব্রেড রোল, টাটকা মাখন, নানা রকমের ঘরে তৈরি জ্যাম জেলি মার্মালেড, এই সব।

প্রাতরাশ কোনওমতে সেরে আমাদের দৌড়ে দৌড়ে নিয়ে যাওয়া হল পোশাক বদলে ওদের তোয়ালের আলখাল্লা পড়াতে নবীন বেবো আমাদের পৌঁছে দিল হেড অ্যান্ড নেক মাসাজের জন্য নির্দিষ্ট একটি ঘরে যেখানে দুটি আফ্রিকান মেয়ে আমাদের যত্ন করে দুটো আরামকেদারাতে বসতে দিল। সামনে মস্ত বড় জানালা দিয়ে বাইরে সবুজে সবুজ! দ্রাক্ষাক্ষেত, সব্জিবাগান, আকাশ, উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। মেয়ে দুটি আমাদের নম্বর মিলিয়ে জেনে নিল আমাদের নাম, তার পরে জিজ্ঞেস করল কে কোন মাসাজটা নিতে চাই? ভারতীয় না আয়ুর্বেদিক? আয়ুর্বেদিকে মাথাটা আয়ুর্বেদিক তেলে ভিজিয়ে দেওয়া হয়, ভারতীয়তে সেটা হয় না। কেন, তোমাদের আফ্রিকান হেড মাসাজ নেই? নাঃ, নেই। তাহলে আমাদের ভারতীয়ই দাও। অত তেল চুপচুপে মাথা নিয়ে ঘুরতে চাই না। (পরে অবশ্য শুনলুম ঠকে গেছি, আয়ুর্বেদিকটা নিলেই ভাল হত, ওরা নিজেরাই সব তেল তুলে দিত!) তোয়ালে জড়িয়ে অপূর্ব হেড অ্যান্ড নেক ম্যাসাজের পরে ঘুম ঘুম লাগছিল, কিন্তু একটি মেয়ে এসে আমাদের ঘুমোতে না দিয়ে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গেল, ‘হ্যান্ড ট্রিটমেন্টের’ জন্যে। তার আগে আর একটি মেয়ে এসে হাসিমুখে তুলে ধরল স্বচ্ছ স্ফটিকের পাত্রে সুগন্ধি পানীয়। দেখা গেল প্রতি ট্রিটমেন্টের পরে বাইরে বেরুলেই এক স্বর্গীয় স্বাদের পানীয় দেওয়া হয়, নবোদ্যমে শক্তি সঞ্চারের জন্য। ‘এনার্জাইজিং ড্রিংক’-গুলি আসলে মদিরা নয়, শুধুই স্পার্কলিং ফলের রস, আপেল, আঙুর, ইত্যাদির। এবারে পরের যত্নটি নেবার জন্যে আমরা রেডি। সেখানে আমাদের রানির মতো বসিয়ে দুটি মেয়ে হাত দুখানা, আর নোখগুলিকে সুগন্ধী রোজ পেটাল জেল দিয়ে ঘষে, কবোষ্ণ জলে ধুলো, তার পরে আরেকটা সুগন্ধী ক্রিম দিয়ে মাসাজ করে চকমকে করে দিল। নেক্সট রাউন্ডে যাত্রা ‘আফ্রিকান ফেশিয়ালের’ উদ্দেশ্যে। চোখ বন্ধ, ঘর অন্ধকার, মুখে যে কী কী কারুকার্য করা হল আমার জানা নেই। তবে খুব আরাম। বেচারা আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছি! এই সবই হচ্ছে আলাদা আলাদা কামরাতে, আলাদা মেয়েরা নির্দিষ্ট এক এক কাজের জন্যে। এক ঘরে পাশাপাশি দুজন করে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা। চার নম্বর ট্রিটমেন্টে ‘আফ্রিকান হট স্টোন মাসাজ’, এটা কেউ কেউ সইতে পারেন না, আগেই এক তালিকা মিলিয়ে তাই জেনে নেয় কয়েকটি রোগ আছে কিনা। এই ঘরও প্রায় অন্ধকার, এক কোণে উনুনে আগুন জ্বলছে, পরিচ্ছন্ন শয্যায় শয়ন করিয়ে, সত্যি সত্যি হাতে গরম নুড়ি পাথর সর্বাঙ্গে ঘষে এক অসাধারণ মাসাজ। গরমটা সইয়ে সইয়ে লাগায়, গোড়াতেই দেখে নেয় কে কতটা গরম নিতে পারে। এটাতেও আমরা মায়ে ঝিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম! এখানে প্রত্যেকটা রূপচর্চাই যে খুব রিল্যাক্সিং তাতে সন্দেহ নেই।

এর পরে মধ্যাহ্নভোজনের ডাক এল। ঢুকেই সেই যে নিজের পোশাক পত্র ছেড়ে ওদের দেওয়া ধবধবে শাদা তোয়ালের আলখাল্লা পরেছি, খাবার ঘরেও উপস্থিত সকলেরই সেই বেশ! এখানেও সবই অর্গানিক হেলথ ফুডের ব্যবস্থা। মাছ বা মাংসের সঙ্গে বয়েলড ভেজি! রোস্ট মাছ, না রোস্ট চিকেন? নন্দনা নিল মাছ, আমি চিকেন, যাতে দুজনেই দুটি বস্তু টেস্ট করে দেখতে পারি। সুন্দর সব্জির ব্রথ, বাগিচার স্যালাড আর গোয়ালের গরুর দুধের দই তো আছেই। সঙ্গে আছে যে যত পাত্র চাও সাদা লাল দুই রকমের ওয়াইন, এদের নিজস্ব সেলারের তৈরি। এবারেও আমরা দু রকমই নিলুম, দুটিই খুব সুস্বাদু।

হঠাৎ শুনি ড্রাম বাজছে, চমৎকার ছন্দে। তার পরে গান শুরু হল, আফ্রিকার আঞ্চলিক ভাষাতে। বোধ হয় ক্ষোসা ভাষাতে। দেখি ম্যাঙ্গোয়ানানির কমলা রং-এর পোশাক পরা তরুণীরা হাত তালি বাজিয়ে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে আসছে, হাতে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে। তাদেরই একজন দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাচ্ছে, তারা এদিকেই আসছে। তাদের নাচের ছন্দে ছন্দে আমারই নাচতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আমি তো সুবচুনীর খোঁড়া হাঁস। তাই নন্দনাকে ঠেলি, “ওঠ না, ওদের সঙ্গে নাচ না!’ এটুকু বলার অপেক্ষায় ছিল সে, খাওয়া ফেলে আফ্রিকান মেয়েদের সঙ্গে নাচের দলে জুটে গেল সেও। ওদের গানের অচেনা খুশি খুশি সুরটি শেষ কালে হঠাৎ চেনা চেনা হয়ে আসে, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ এর সুর না? ভাষাটি যদিও অচেনা। ওমা! ওরা যে এদিকেই আসছে! আমার টেবিলে এসে আমাকে ঘিরে গাইতে থাকে এবারে। আমার জন্যে তাদের হাতে একটি মোম জ্বলছে, আমি তো হতবাকই, নন্দনাও অবাক। পরে আমরা বুঝি, মায়ের জন্মদিনের সেলিব্রেশন, কথাটা ওদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল নন্দনা, তাই মধ্যদিনের এই উৎসব। এটা তার কাছেও সারপ্রাইজ আমার কাছে তো বটেই! ঘরশুদ্ধু অতিথিরা সবাই এখন ইংরিজিতে গাইছেন আমার ভবিষ্যৎ জন্মদিনের জন্যে শুভেচ্ছাসঙ্গীত। অন্তত জন্মদিনটা পর্যন্ত বেঁচে যাবই!

তার পরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ‘লেগ ট্রিটমেন্টের’ জন্যে, উঠোন পেরিয়ে আলাদা একটি কাচের ঘরে, সেখানে জানালার সামনে সারি সারি আরামকেদারা পাতা, তার সামনে পা তুলে দেবার ব্যবস্থা, তোমার পাশে তোয়ালে আর গামলা, আর নানারকমের মালমশলা নিয়ে যে তোমাকে ট্রিটমেন্ট দেবে, সেই মেয়েটি। জানলা দিয়ে সবুজ পাহাড় ঘরে ঢুকে পড়েছে। ভিতরে আরো অনেকে আছেন, স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সাদা তোয়ালে সুশোভিত। আমাদের নির্দিষ্ট নম্বরী আসনে নিয়ে বসানো হল, এক অল্প বয়সী দম্পতির পাশে। এদের দেখে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ বলে মনে হয়। আমার তো স্বভাব আলাপ করা, ছেলেটি ও মেয়েটি তাদের বিবাহ বার্ষিকী সেলিব্রেট করছে, দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় ভারতীয় মুসলমান পরিবার। ওরা কেপ টাউনেরই পুরনো বাসিন্দা, ছেলেটির দোকান আছে, বৌ ঘরেই আছে আপাতত। মেয়েগুলি আমাদের পায়ে হাঁটু অবধি এবং হাতেও কনুই পর্যন্ত প্রথমে রোজ পেটাল জেল দিয়ে মুছল, তার পরে অরেঞ্জ সুগার স্ক্রাব ঘষে ঘষে পরিষ্কার করল, কী পরিমাণে চিনি নষ্ট, দানাদার চিনি সব হাতে পায়ে মেখে অপচয়, আমি স্ক্রাব করাব কি মনের দুঃখেই অস্থির। তার পরে কবোষ্ণ জলে ধুয়ে নরম তোয়ালে দিয়ে মুছে আবার পীচ ব্লসম ক্রিম মাখিয়ে তুলতুলে করে ছেড়ে দিল। যে মেয়েরা এসব করল তাদের জিজ্ঞেস করলুম এতদূরে এই দিকশূন্যপুরে তোমরা আসো কেমন করে? ম্যাঙ্গোয়ানানির বাস তাদের ভোরবেলা নিয়ে আসে, আবার সন্ধ্যায় শহরে ফিরিয়ে দেয়।

এর পরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল বসার ঘরে, টী ব্রেক। সুন্দর করে ইংরেজ কায়দায় হাই টীর ব্যবস্থা। ছোটো ছেটো স্যান্ডউইচ, মাফিন ফল, চীজ, ক্র্যাকার্স, বিস্কুট আর চমৎকার আর্ল গ্রে দার্জিলিং চা।

ভার ওপরে আছে যত খুশি ওয়াইন। চায়ের বদলে অনেকেই এই বিকল্প পানীয়টি নিয়েছেন। এক বর্ষীয়সী মহিলা আমার সামনে সাদা ওয়াইন নিয়ে বসেছিলেন, তিনি একাই এসেছেন, বললেন বছরে অন্তত দু বার আসেন। এটা তাঁর স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল।

পরবর্তী প্রোগ্রাম, ষষ্ঠ ট্রিটমেন্ট, তার জন্যে আবার বাইরে দিয়ে যেতে হবে, ছোট ছোট একক কেবিনে। সামনে ঢালু উপত্যকা, বুনো গাছপালা, এদিকে খামার নেই। কেবিনের মধ্যে ‘ফুল বডি মাসাজ’ দেবে এবারে, নানা চয়েস, আমি নিলুম সল্ট মাসাজ। চিনি তো হল, এবারে নুন হোক। শরীরটাকে রান্না করা সম্পূর্ণ হবে না নুন বিনে। মা মেয়ে এবারে বিচ্ছিন্ন, পাশাপাশি কেবিনে। শুরু হল আধো অন্ধকার ঘরে আপাদমস্তক নুনের শুশ্রূষা। আবার ঘুমিয়ে পড়ার পালা। টোটাল রিল্যাক্সেশন। ঘুম থেকে তুলে আমাকে আমার পথপ্রদর্শিকা বললে, এবারে শেষ ট্রিটমেন্ট, ‘জাকুসি বাথ’। আবার পোশাক পরার ঘরে গিয়ে সাঁতারের পোশাক ও আলখাল্লা পরে এসে জাকুসির কাছে পৌঁছই। পিছনের দিকে একটি ছোট্ট আলাদা উঠোনে রঙিন পাতাবাহার আর ফুলের টব দিয়ে ঘেরা গোল জাকুসির বাথটবে আমাদের জন্যে সুগন্ধী নীল উষ্ণ স্নানজল ভরে উঠছে, অজস্র বুদ্বুদের মুক্তোর মালায় সাজানো। স্বাস্থ্যকর আফ্রিকান বাথসল্টে সেই জল আমোদিত। শুধু নেমে পড়ার অপেক্ষা। স্ক্রীনের আব্রু আছে, মা মেয়ে টুক টুক করে জলে নেমে পড়ি, ভিতরে ধাপ আছে। তার পরে এল শ্যাম্পেন! আর সঙ্গে টাটকা ক্ষেতের আঙুর। সুগন্ধী জলে অর্ধনিমজ্জিত, হাতে শ্যাম্পেন আর আঙুর, নিজেদের অধঃপতিত রোমান সম্রাটদের মতো মনে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত মনে পাপবোধ দানা বাঁধবার আগেই উঠে গিয়ে স্নানের ঘরে শাওয়ার নিয়ে নিজেদের জামাকাপড় পরে, ভিজে পোশাকের পুঁটলি বেঁধে আমরা ফেরৎ রওনা হই। অরিজিনাল আফ্রিকান স্পা পরিদর্শন ভালয় ভালয় সমাপ্তি।

পাঁচটা বেজে গেছে, ম্যাঙ্গোয়ানানি ফাঁকা। আখমেদ খুব লজ্জিত। ‘ম্যাডামদের সবগুলো আইটেম হয়েছিল তো?’ হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি আর মন খারাপ করোনা আখমেদ।’ পথ চিনে ঠিকঠাকই ফিরে এলুম, পথে আমরা কিছুক্ষণ সমুদ্রের ধারে বসি। ঠিক এই সমুদ্রতীরটুকু আমাদের হোটেলের ঘরের বড় জানালাটি থেকে দেখা যায়, অথচ এতদিনে একটি বারও আসা হয়নি আমাদের। সময়ই হয়নি নন্দনার। আর আমার তাই আগ্রহ হয়নি তেমন একা একা আসার। আটলান্টিকের বাতাসটি আরেকবার যেন নুনের শুশ্রূষা বুলিয়ে দিল আমাদের সর্ব অঙ্গে। সূর্যদেব বিদায়ের পথে, আকাশে তাঁর রঙিন পতাকা উড়ছে। সমুদ্রেও তারই ছায়া। এবারের মতো কেপটাউনে আজই আমাদের বিদায় সন্ধ্যা।

আন্টি আগনেসের সঙ্গে এক সন্ধ্যা

জোহানেসবর্গে সেবার ছিলুম মেলভিলে, ‘মি কাসা সু কাসা’ নামের অতিথিশালাতে, নামের মতোই স্প্যানিশ ছিল তার গৃহসজ্জা। আমাদের এবারের আস্তানা রোজ ব্যাঙ্কে, ‘গ্রেস’ নামের একটি হোটেল, সাধারণত এত চমৎকার স্বনামধন্য হতে দেখিনি হোটেলদের, সত্যি বড্ড গ্রেসফুল জায়গা। ঢুকেই মনে হয় কোনও ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ হোটেলে এসে পড়েছি, একদম সেই ধরনের সাজসজ্জা, আলো, আসবাবপত্তর। এমনকী তার বার (এরা যাকে বলে পাব)-টিও বিশিষ্ট, ক্লাবের মতো, অন্যরুচির, চার পাঁচটি পুরনো স্টাইলের বিরাট উঁচু কাচের আলমারিতে ঘরের ছাদ পর্যন্ত ঠাসা বই সাজানো। কাচের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে মরক্কো বাঁধাই, কিছু কিছু বাঁধানো পুরনো পত্র পত্রিকাও আছে। সময়ও নেই, উপযুক্ত দৃষ্টিশক্তিও নেই, যে একটু সেগুলো ঘেঁটে দেখব! সবগুলো করিডরের দেওয়ালে সারি বেঁধে পুরনো সাউথ আফ্রিকার বিভিন্ন ধরনের ফোটোগ্রাফ টাঙানো, তাতে সামাজিক ইতিহাস ধরা পড়েছে। পিছনে চমৎকার একটি বাগান, ফোয়ারা, সুইমিং পুল, গোলাপ বাগিচা, সেখানে লনে চেয়ার টেবিল পাতা দেখেই আমি আর নন্দনা দৌড়ে গিয়ে ওখানে বসে চা, আর কফি খেলুম। যেন আমাদের জন্যেই সাজিয়ে রেখেছে বাগান, আমরা না গেলে এসব কে দেখবে? সূর্যাস্তের আকাশটা অসামান্য দেখাচ্ছিল সেদিন। সেটাই বা কে দেখত? রাত নামলে ফোয়ারাগুলোতে রঙিন আলো জ্বলে ওঠে। সুইমিং পুলের পুরো জলটা এক নীল স্বপ্নিল আলোয় ভরে যায়। আমাদের ঘরের জানালা দিয়ে তখন বাগানটা পরির দেশের মতো দেখায়। এই গ্রেস কাটিয়ে আমরা এসেছি আমাদের বন্ধু রাকেশ মহারাজের ব্যবস্থায়। রাকেশ আমাদের এই যাবতীয় কাণ্ডারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন

আমাদের প্রথম দিনের যাত্রা প্রিটোরিয়ার দিকে, গত বছরে প্রিটোরিয়া যাওয়া হয়নি। একদা দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। কখনও না কখনও এখানকার জেলে পচেছেন আফ্রিকার স্বাধীনতাসংগ্রামীরা সকলেই। আশির দশকে একটা সময়ে বেঞ্জামিন মোলোয়েজের ফাঁসির প্রসঙ্গে প্রিটোরিয়ার জেলখানার কথা কলকাতা শুনেছে। প্রিটোরিয়াতে প্রবেশের পথেই সেই সেন্ট্রাল প্রিজন। আমার এখানে এসে দু’বার অনেকগুলো জেলখানা দেখা হল, কেপটাউনের কুখ্যাত সেই দাগী অপরাধীদের কারাগার যেখানে রাজবন্দি, খুনি, ছিঁচকে চোর, পাতাখোর, ধর্ষক, আর কিশোর অপরাধীদের একসঙ্গে রাখে। তাতে কেউ উন্নত হয় না, হয়তো অবনত হয়ে যায়। চক্ষুলজ্জা চলে যায়। ওপারে রবে আইল্যান্ডের দ্বীপান্তরী অত্যাচার, এপারে এই ভীষণ অনাচারের ঠাঁই। এখন আর প্রিটোরিয়ার জেল দেখতে আমি ভিতরে ঢুকতে চাইনি। এতদূরই ভাল। আমরা দেখলুম ইউনিয়ন বিল্ডিংস, সেখানকার অনির্বাণ শান্তির অগ্নি শিখা, ফ্রিডম পার্ক, ক্রোগার স্কোয়্যার, এবং ভুর ফোক মনুমেন্ট। একটা উঁচু টিলার ওপরে তৈরি, আমাকে হুইল চেয়ারে উঠতে হল। উত্তুরে ইয়োরোপের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধে (যার নামই হয়ে গিয়েছে রক্তনদীর যুদ্ধ) বর্শা আর তীর ধনুক সম্বল আদিবাসীদের গুলি গোলা দিয়ে বেদম মেরেকুটে বিদেশি ওলন্দাজদের দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূল বিজয়ের ও শিশু-নারীদের সঙ্গে নিয়ে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে ডাচ উপনিবেশ স্থাপনের গৌরব ইতিহাস ধরে রেখেছে এই স্মৃতিসৌধ, এবং সংলগ্ন জাদুঘর। বেছে বেছে এই ক’টি দ্রষ্টব্যস্থান দেখে আমরা শহরের মধ্যে এই থাই রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ করে নিয়ে জোহানেসবর্গ রওনা হই। দারুণ রান্না ছিল কিন্তু।

রাকেশ এসব খবরে সিদ্ধকর্ণ! রাকেশ ডারবানের ভারতীয়, আকৈশোর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত, ম্যান্ডেলাকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখাও করিয়ে দিতেন, কিন্তু তার আগের দিনেই খবরের কাগজের প্রধান খবর ছিল ম্যান্ডেলার ছয় বছরের শিশু নাতনি স্কুলের সুইমিং পুলে ডুবে মারা গিয়েছে। সেই অবস্থায় দেখা করতে যাওয়ার প্রশ্নই উঠল না। রাকেশ আমাদের তার বদলে দেখা করিয়ে দিলেন আর একজনের সঙ্গে, যিনি ম্যান্ডেলার সহকর্মিণী ছিলেন, জেলের থেকে বেরিয়ে ত্রিশ বছর দেশান্তরে কাটাতে হয়েছে তাঁকে, ভারতে এবং ইউরোপে। তাঁরও এখন আশি, ম্যান্ডেলার মতোই। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, দিল্লিতে ছিলেন দশ বছর, এ এন সি-র একটি জরুরি শাখা-অফিস চালাতেন দিল্লি থেকে। ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সহজ বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। একটি সন্তানের জন্মও দিয়েছেন দিল্লিতে, সে ছেলে আবার হিন্দি ছাড়া কিছু বলত না ছোটবেলাতে। নাম মাণ্ডালা। মণ্ডলের মতো। শুনলুম, দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতার পরে ভারতবর্ষই তাকে প্রথম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে স্বীকার করে নেয়। মহিলার নাম আগনেস মিসিমাং। সারাটা জীবন তিনি উৎসর্গিত করেছেন আফ্রিকার স্বাধীনতার প্রতি। এখনও প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অফিসে বসেন, লুথুলি হাউসে, নিজের আনন্দে। পার্টির কাজকর্ম করেন। রাকেশ তাঁকে ডিনারে ডাকলেন আমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে। কথা হল আমরা ফেরার পথে তাঁকে তাঁর লুথলি হাউস অফিস থেকে তুলে নেব, অফিসের অন্যান্য মানুষের সঙ্গেও আলাপ হবে। কিন্তু আমাদের কারুরই ধারণা ছিল না যে যাওয়ার সময়ে যা ৪৫-৫০ মিনিট, ফেরার সময়ে সেটা তিনঘণ্টা হবে। সময়মতো তাঁর কাছে পৌঁছনো গেল না, এ.এন.সি অফিস বন্ধ হয়ে গেল, সবাই চলে গেলেন, আমরা দেরিতে পৌঁছে ফিরে এলুম। রাকেশ হার মানেন না, সে তাঁকে আন্টি আগনেস বলে ডাকেন,—আর বেশ আবদার করেন, রাকেশ ওঁর ছেলের বন্ধু। আন্টিকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিতে গিয়ে দেখি বসার ঘরে আন্টির সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধির বড় দুটি ছবি। আন্টি আগনেস খুব সেজেগুজে প্রস্তুত হয়েই বসেছিলেন, চমৎকার রংচঙে এক আফ্রিকান পোশাকে তাঁর পা পর্যন্ত ঢাকা। একমাথা কোঁকড়া চুল কুচকুচে কালো, ম্যান্ডেলার মতো নুন মরিচ পাক ধরেনি, হাসিটা ঝকঝকে সাদা। তাঁর নাতনি ভারি সুন্দরী তরুণী, দিদিমা বেরুচ্ছেন, এতে সে আমাদের ওপরে খুব খুশি। কোথাও নাকি যান না। আমার লাঠি দেখে আন্টি বললেন, ‘আমারও কোমরে ব্যথা হাঁটুতে ব্যথা, কিন্তু ওরা আমাকে লাঠি নিতে দেয় না, বলে বুড়ো দেখাবে।’ বলে হাসলেন। আমিও ব্যাপারটা জানি। অন্যের চোখে বুড়ো দেখায়। শক্তিহীন। যষ্ঠিনির্ভর মানেই জরাগ্রস্ত। অসুস্থতার কথা কেউ ভাবেন না। কত জনে যে এসে আমার কাছে শোকপ্রকাশ করেন, যৌবনের এই অকাল বিদায়ের ব্যথায়, ইস! নবনীতা তোমাকে লাঠি ধরতে হল?’ খেতে গেলুম ‘মোয়া’তে। সে এক দুর্দান্ত রেস্তোরাঁ আফ্রিকান ভোজ্যপেয়র জন্য বিখ্যাত। এবং গিয়ে দেখি সেখানে তিলধারণের জায়গা নেই। আফ্রিকান গান বাজনাও হচ্ছে একটি স্তরে, রেস্তোরাঁটি নানা স্তরে বিভক্ত তো। আমাদের গন্তব্য গুহার মতো অন্ধকার, মোমের বাতি জ্বলা বেসমেন্টে। গতবারের চেনা, নন্দনার বন্ধুর ভাই জেড আর তার স্ত্রী লেসলি আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। সুসজ্জিত ওয়েট্রেসরা ঘুরছেন। প্রথমেই অচেনা দক্ষিণ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ দম্পতিকে দেখে আন্টি ঝিনুকের মতো মুখ বন্ধ করে ফেললেন, কোনও কথা কইলেন না। জেড আসলে দুয়েকটা আলগা রঙ্গ রসিকতা করে ফেলেছিল যেগুলো আমারও কানে লেগেছিল। কিন্তু একটুক্ষণের মধ্যেই আন্টির সঙ্গে নন্দনার দিব্বি ভাব হয়ে গেল, শিশু এবং বয়স্কদের হৃদয় জয় করে নেওয়ার জাদু জানে ও। এরপরে রাজনীতি আলোচনা করতেই আন্টির মুখে বাক্য ফুটল। আপাতত এ.এন.সি.-র একটু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি চলেছে। চোদ্দো বছর একচ্ছত্র রাজত্ব করার পরে এ.এন.সি. আর ঠিকঠাক কাজ করছে না। এম্বেকির পরে জুমা, কিছু গুণে কিছু দোষে এঁরা সরকার চালিয়েছেন বটে, কিন্তু অজস্র ক্ষতিকর ভুলভ্রান্তি করেছেন, ম্যাণ্ডেলার মতো পটু ও জনপ্রিয় কর্ণধার হতে পারেননি। ফলে একটা নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে এখানে, ‘কোপ’ বলে, ‘কংগ্রেস অফ দ্য পিপল।’ তার সদস্যরা সকলেই একদা এ.এন.সি.-র কর্মী ছিলেন এখন মতানৈক্য হওয়ায় নতুন দল গড়েছেন। কিন্তু তাদের আইনত অনুমোদন দিচ্ছে না এ.এন.সি. সরকার, অর্থাৎ তাদের নির্বাচনে দাঁড়াতে দিতে চাইছে না। যে কোনও রাষ্ট্রযন্ত্রে সরকারের এক জোরালো প্রতিপক্ষ থাকা সর্বসাধারণের পক্ষে মঙ্গল। আর গণতন্ত্রে তো সেটা অত্যাবশ্যক। কিন্তু আন্টি আগনেসের দুটো আপত্তি। এক, ওই যে ‘কংগ্রেস অফ দ্য পিপল’ শব্দবন্ধটির জন্ম হয়েছিল ফ্রিডম চার্ট তৈরির সময়ে। ওই নাম ব্যবহারের অনুমতি ওদের দেওয়া উচিত নয়। ওটা এ.এন.সি.-র নিজস্ব। আর, দুই, তাঁর মতে ‘ওরা দল ভেঙে বেরিয়ে গেল কেন, দলের ভিতরে থেকেই তো সংশোধন করতে পারত ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো।’ সেই চিরাচরিত যুক্তি। দলের ভিতরে যখন কোনও কাজ করা যায় না, তখনই দল ভাঙে। অবিশ্যি দল না ভাঙলে বড় বড় পদের সৃষ্টি হয় না, সেগুলো অধিকারের সুবিধেও হয় না। যে কারণে বিদেশে এতগুলো করে বাঙালিদের পুজো হয়, এবং এক একটা পাড়াতেও দলাদলির ঘটনা ঠিক তাই। কর্তৃত্ব করার সুযোগের জন্যই এই নতুন দল চাইছে ওরাও, এটাই আন্টি আগনেসের অভিমত। রং ঝলমলে জাতীয় পোশাকে কী উজ্জ্বল সুশ্রী দেখাচ্ছিল মা কালীর মতো শ্রীময়ী আন্টিকে। মুম্বই নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন, বন্ধুদের কথা ভেবে ভীত। কোনও বন্ধু ওঁকে দিল্লি যাওয়ার একটা এয়ার টিকিট দিয়েছেন। বারবার বললেন, সামনের বছরে দিল্লি আসছি একবার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। আমি তখন কলকাতাতেও আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছি তাঁকে।

হোটেলে ফিরে এসে বেশি রাতে রাকেশের ফোন, আন্টির সেই ভারতীয় পুত্র আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে প্রিটোরিয়া থেকে। মাণ্ডালা ছেলেটি বেশ আধুনিক, হাসিখুশি, চটপটে ছেলে, মাথা কামানো, এ বছরে এখানে এটাই ছেলেদের স্টাইল, গায়ের রং মার মতো চিকন কালো নয়, বাদামি কালো, ফিল্মের কাজ করতে ভালবাসে, যদিও টেলিফোনের কোম্পানিতে চাকরি, এঞ্জিনিয়ার। আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও গিয়ে কাজ করেছে। ডকুমেন্টারি তুলেছে সে। ব্যাণ্ডের গাইয়েদের মতো সাজপোশাক। তার মা ওয়াইনও খান না। সে নিল সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি। আপাতত আসছে একটা রাজনৈতিক সভা থেকে। ‘কোপ’-এর সভা। সে কি, তুমি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নও? মাণ্ডালা বলল, ‘না। আমি নতুনের দলে। ফ্রেশ স্টার্ট চাই আমাদের। ওরা বুড়িয়ে গিয়েছে। কিছু নতুন কথা শিখতে চায় না, শুনতে চায় না, কোনও বদল চায় না, ভুল স্বীকার করে না, ভ্রম সংশোধনে রাজি হয় না, এভাবে দেশের উন্নতি স্থগিত থাকবে। দেশ পিছিয়ে পড়বে। এ.এন.সি থাকে থাকুক, তাদের কন্ট্রোল করতে নতুন দলটাও আসুক।’ আমি মিনমিন করে ‘কংগ্রেস অফ দ্য পিপল’ নামকরণের অনধিকারের প্রসঙ্গ তুলতেই মাণ্ডালা বলল, ‘সে কী কথা, ওরা কি বাইরের লোক? ওরাও তো ছিল তখন সেই সংগ্রামী দলে। ওদের ততটাই অধিকার আছে বৈকি।’ আমার কোনও মতামত দেওয়ার মতো জ্ঞানগম্যি নেই। নির্বাচন সামনের বছর, হাওয়া গরম। নতুন আর পুরনোর দ্বন্দ্ব তো আছেই জগতে। মা আর ছেলেকে ভিন্ন মতাদর্শের দেখে আমাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই। কলকাতাতে ঠাকুর্দা, বাবা আর নাতি, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট আর নকশাল, এ তো অনেক দেখেছি। বাবা ইস্টবেঙ্গল ছেলে মোহনবাগান, তাও দেখছি।

মাণ্ডালা চলে যাওয়ার পরে রাকেশ বললেন, ‘ও মুখে যাই বলুক, যে বাড়ির ছেলে, ভোটটা ঠিক এ.এন.সি-কেই দিয়ে ফেলবে।’ রাকেশ অটল অনড় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাপোর্টার।

তাঁর মুখেই শুনছিলুম কীভাবে বছরের পর বছর বিভিন্ন ঠিকানায় ছুটে বেড়িয়েছেন আগনেস, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। এদেশে ওদেশে। সারাক্ষণই কিন্তু এ.এন.সি.-র জন্য স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে চলেছেন। একদা রাকেশ ডারবান থেকে দেশে পড়তে গিয়ে দিল্লিতে এই আন্টি আগনেসের বাড়িতেই পেয়িং গেস্ট ছিলেন, গ্রেটার কৈলাসে। মায়ের মতো যত্ন করেছেন, ধমক দিয়েছেন, আদর করেছেন। ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর সংগ্রামী জীবনের পুরো কাহিনিটা রাকেশের জানা। এখন বিয়ে ভেঙে গিয়েছে, স্বামী এই বয়েসে আবার বিবাহ করেছেন। অল্পদিন আগে অবধি তিনি এ.এন.সি.-র কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। এইরকম শত সহস্র নামহীন আত্ম-নিবেদিত কর্মীর নিঃশর্ত আত্মদানের ফলেই আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস চলতে পেরেছে, দেশের স্বাধীনতা আনতে পেরেছে, অথচ ওদের নিয়ে কোনও তথ্যচিত্র হয়নি, ওদের নিয়ে কেউ গান বাঁধেনি, ওদের কাজের খবরই কেউ রাখে না। ইতিহাস ওদের পাশ কাটিয়ে যাবে। শুধু বড় বড় নেতাদের কথাই ইতিহাসে থাকে, আন্টিরা হারিয়ে যান। ১৫ ডিসেম্বর আগনেস মিসিমাং-এর ৮০ পূর্ণ হল জোহানেসবার্গ। জন্মদিনের প্ল্যান কী, জিজ্ঞেস করতে, আন্টি বললেন, উনি তাঁর ছেলেমেয়েদের বলেছেন, ‘সত্যি সত্যি মাকে খুশি দেখতে চাইলে, আমার জন্যে কিছু করো না। আমাকে কিছু না দিয়ে সেই টাকাতে অনাথ আশ্রমের শিশুদের ভাল করে নেমন্তন্ন খাইও, আর প্রত্যেকের হাতে কিছু প্রীতি-উপহার তুলে দিও, জন্মদিনে মা’র শ্রেষ্ঠ উপহার হবে ওদের খুশিটাই।’

আমি ১৫ই আন্টি আগনেসকে একটা জন্মদিনের প্রণাম এসএমএস করেছিলুম, আজ ১৯শে এখনও জবাব পাইনি, জানি না জন্মোৎসবে তাঁর ইচ্ছেপূরণ হল কি না।

নাদিনের সঙ্গে আলাপচারিতা • কলকাতা

নবনীতা : নাদিন, আগের বার দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আগে আমি গোপালকৃষ্ণ গান্ধিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বলুন তো, রবেন আইল্যান্ড দেখা ইত্যাদি বাদ দিলে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আর কী কী করা উচিত? গোপাল বলেছিলেন, পারলে ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে দেখা করবেন। তার চেয়ে ভাল কিছু হতেই পারে না। আর, ট্রাই টু মিট নাদির গর্ডিমার।

নাদিন : আর ম্যাণ্ডেলা?

নবনীতা : ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে সে বার দেখা হয়নি, তবে আমার সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছে যখন ম্যাণ্ডেলা আর গ্রাসা মাচেল এ দেশে এলেন, তখন। কথাবার্তাও হয়েছিল। ছোট্ট, কিন্তু খুব সুন্দর একটা আলাপচারি।

নাদিন : গ্রাসা কথা বলেননি?

নবনীতা : খুব একটা কথা বলেননি। তবে, মুখে একটা হাসি লেগেছিল। জানি না, কেন কথা বলেননি। অবশ্য, তখন সবে ওঁদের বিয়ে হয়েছে।

নাদিন : কিন্তু, গ্রাসা খুব একটা চুপ করে থাকেন না। আমার একটু অস্বস্তিই লাগে। গ্রাসা মাঝে মাঝে গিয়ে ম্যাণ্ডেলার চুল-টুল একটু ঘেঁটে দেন, যেন বোঝাতে চান যে, ম্যাণ্ডেলার উপরে ওঁর নিয়ন্ত্রণটাই চূড়ান্ত। তবে সে সব থাক, ম্যাণ্ডেলা ওঁকে জানেন, উনি ম্যাণ্ডেলাকে জানেন, এবং উইনির পরে ম্যাণ্ডেলা আবার প্রেমে পড়েছেন, গ্রাসাকে বিয়ে করেছেন, এর চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না।

নবনীতা : এত দূরে বসে এখানে আমরা জানতেই পারতাম না যে, উইনির কী হল…তারপর নানা রকম খবর আসতে শুরু করল, ভালয়-মন্দয় মেশানো সব খবর, অবশ্য সে সব নিয়ে কথা না বললেও চলে…

নাদিন : এটা একটা ট্র্যাজেডিও বলতে পারেন! পৃথিবীতে ওঁরা আশ্চর্য একটা দম্পতি হতে পারতেন। সম্পর্কটা থাকল না, ভেঙে গেল!

নবনীতা : নিঃসন্দেহে, আশ্চর্য দম্পতি! জানেন, সোয়েটো মিউজিয়ম-এ গিয়ে আমি খুব অবাক হয়ে দেখেছিলাম, সেখানে সব বিখ্যাত রাষ্ট্রনেতার পাশাপাশি তাঁদের প্রত্যেকের স্ত্রী-র নাম লেখা। সিসুলু-র স্ত্রীর নাম দেখেছিলাম…

নাদিন : অ্যালবাতিনা!

নবনীতা : ঠিক, অ্যালবার্তিনা। লেখা আছে, ওয়াল্টার এবং অ্যালবার্তিনা সিসুলু। নেলসন এবং উইনি ম্যাণ্ডেলা। ভারতে কোনও মিউজিয়ম-এ আপনি এই জিনিসটা পাবেন না।

নাদিন : অ্যালবার্তিনা কিন্তু আন্দোলনে খুবই সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। বিশেষত, উইনি। পঁচিশটা বছর ধরে উইনি আন্দোলনের সঙ্গে একেবারে সমার্থক… আচ্ছা, সনিয়া গাঁধি কী রকম কাজ করছেন? আগের বার আমার সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল…

নবনীতা : খুবই ভাল কাজ করছেন। কংগ্রেস দলটাকে পরিচালনা করছেন।

নাদিন : কংগ্রেস-এ ওঁর ‘পজিশন’টা কোথায়?

নবনীতা : সনিয়াই দলনেত্রী। কাজটা সহজ ছিল না। একেবারে অন্য একটা দেশ থেকে এসে এখানে মানিয়ে নেওয়া, তারপর স্বামীর ওই রকম একটা মৃত্যু, এই সব সামলেও যে সনিয়া জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন, বহু দিনের প্রাচীন একটা দলের শীর্ষ পদে সবাই তাঁকে মেনে নিয়েছে, গোটা ব্যাপারটা ভাবলে অবাকই হতে হয়। এখন তো ওঁর ছেলে রাহুলও সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন…নাদিন, একটু আপনার কথায় ফিরি। গত বছর মেয়ের সঙ্গে জোগানেসবর্গ-এ গিয়ে দেখি ‘নাদিন গর্ডিমার বক্তৃতা’ দিতে অমর্ত্য সেন উপস্থিত। অমর্ত্যও আমাকে, ওর মেয়েকে দেখে অবাক! উনি জানতেন না, আমরা ওই সময় ওখানে থাকব। এই ‘নাদিন গর্ডিমার বক্তৃতা’ নিয়ে কিছু বলুন। ২০০৪-এ প্রথম নাদিন গর্ডিমার বক্তৃতা দিয়েছিলেন আপনারই বন্ধু, সুসান সন্টাগ।

নাদিন : হ্যাঁ, সুসান আমার খুবই বন্ধু। প্রথম বক্তৃতাটা ও-ই দিয়েছিল, তার কিছু দিন পরে মারাও গেল। ওর পায়ে একটা অদ্ভুত ক্ষত দেখেছিলাম। বড় কুকুর কামড়ালে যেমন হয়, অনেকটা সেই রকম। বললাম, তোমার ম্যাস্টিফটা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নাকি? সুসান বলল, না, এই ক্ষতটা দেখে বুঝতে পারবে, আমার কী হতে চলেছে। তখন ওর ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ-এ। নবনীতা : আপনি কার্লোস ফুয়েন্তেস-এর আশি বছরের জন্মদিনের উৎসবে মেক্সিকো যাচ্ছেন?

নাদিন : আমরা কয়েকজন কার্লোস সম্বন্ধে ঠিক পাঁচ মিনিট পরে বলব। তার পর লিটারারি প্যানেল আছে। আমাদের প্রত্যেকের একটা করে বক্তৃতাও আছে। তবে, কার্লোস কড়া ভাবে বলে দিয়েছে, ওর সম্বন্ধে বা ওর লেখা সম্বন্ধে একটি কথাও বলা যাবে না। ঠিকই বলেছে। আমি ‘ওয়র্ড অ্যান্ড ইমেজ’ এই রকম একটা বিষয়ে কিছু বলব বলে ঠিক করেছি।

নবনীতা : আপনার ক্ষেত্রে যে জিনিসটা খুব ভাল লাগে, এবং আশ্চর্য লাগে যে, আপনি যখন কিছু বলেন, নোবেল বক্তৃতাই হোক, বা ধরুন, সে দিন কলকাতায় টাউন হল-এ আপনি যে বক্তৃতাটা দিলেন, কোথাও কিন্তু আপনি শুধুই ‘ইন্ডিভিজুয়াল অথর’ হিসাবে কথা বলেন না, বরং নিজেকে একটা বড় লেখকগোষ্ঠীর অংশ করে তোলেন। আপনি বলেছেন যে, একজন লেখক ইজ আর রেকর্ডার অব হার টাইমস। তাই আপনি যখন লেখেন তখন অনেকগুলি সৃষ্টিশীল কণ্ঠস্বর থেকে আপনার সময়কে ধরতে চেষ্টা করেন। এই ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লাগে। স্বভাবতই, নিজেকেও আমার এই সচেতন লেখকগোষ্ঠীর একজন বলে মনে হয়।

নাদিন : অবশ্যই। আমি তো বক্তৃতা দিচ্ছি, নিজের কথা ফলাও করে বলতে আসিনি। তবে আমার কিন্তু এই বক্তৃতা-টক্তৃতা দেওয়া ততটা পছন্দ নয়, তার চেয়ে নিজের লেখা পড়তে আমার অনেক ভাল লাগে, তখন এক-একটা চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়া যায়। সেটা অনেক মজার। এই তো মুম্বইতে আমি একটা গল্প পড়লাম, দ্য আলটিমেট সাফারি। শ্রোতারা অনেকেই এগিয়ে এসে আমার পুরনো নানা বই সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন।

নবনীতা : আপনার মতে, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি তো বিশ শতকের সব থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন, আর একজন ম্যাণ্ডেলা।

নাদিন : নিঃসন্দেহে। আর ভারতের সঙ্গে আমার বরাবরই একটা অন্য রকম সম্পর্ক। কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকায় অনেক ভারতীয় বন্ধু আছেন। আমাদের লড়াইতেও ভারতীয়রা একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই তো সত্যাগ্রহের শতবার্ষিকী উৎসবে দারুণ বক্তৃতা দিলেন আহমেদ কাথরাডা। রবেন আইল্যান্ড-এর জেলে ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে উনিও বন্দি ছিলেন। দুঃখের বিষয়, মিস্টার কাথরাডারও ক্যান্সার ধরা পড়েছে।

নবনীতা : বক্তৃতার কথায় মনে পড়ল, নাদিম গর্ডিমার বক্তৃতা যাঁরা দেন, তাঁরা কী নিয়ে বলেন?

নাদিন : বিষয়টা তাঁরাই ঠিক করেন, তবে কেউই নিজের সম্বন্ধে কিছু বলেন না। অবশ্য, এই বছর নাদিন গর্ডিমার বক্তৃতা হয়নি। ওই যে ভদ্রলোক, তুরস্কের লেখক, আগের বছর নোবেল পেলেন…

নবনীতা : পামুক।

নাদিন : হ্যাঁ, পামুক! ওঁরই এ বছর বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। হল না। বক্তৃতা কী নিয়ে সেটা লেখকের পছন্দ, ঠিকই, কিন্তু কিছু ‘ডেটস’ তো পাল্টানো যায় না। ফলে, বক্তৃতাটাই হল না। তা ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যাপারটা যারা দেখাশোনা করেন, সেখানেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যাঁরা এসেছেন, তাঁদেরও কিছু পছন্দ-অপছন্দ আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে, ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে গিয়েছে…

নবনীতা : আচ্ছা নাদিন, গত বার আমি যখন রবেন আইল্যান্ড-এর সেই কারাগারে গেলাম, একটি ছেলে আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। ছেলেটি নিজেও বেশ কয়েক বছর ওই জেলে বন্দি ছিল, ছাড়া পাওয়ার পরে গাইড হয়েছে, সে বারবারই বলছিল, ভারতীয় মহিলারা এ দিকে আসুন ইত্যাদি। খানিকক্ষণ পর একটি মেয়ে বলেই ফেলল, আমি কিন্তু ইন্ডিয়ান নই, আমি কেপটাউনিয়ান। আমরা সবাই কেপটাউনিয়ান। তা আমি তাড়াতাড়ি বললাম, এখানে আমিই শুধু ভারতীয়। সেই ঘটনা দেখার পর থেকে ভেবেছি, ওখানে কি ভূমিপুত্র-জাতীয় কোনও অনুভূতি আছে?

নাদিন : দেখুন, বিদেশিরা এলে যদি কেউ আলাদা করে ‘জার্মান ভিজিটর’, ‘চাইনিজ ভিজিটর’ এই সব বলে, তার তো কোনও মানে হয় না। ভদ্রলোকের বোঝা উচিত ছিল যে, সেই ভিড়ের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার লোকও থাকতে পারেন। তাঁরাও আবার ইন্ডিয়ান হতেই পারেন, সাউথ আফ্রিকান ইন্ডিয়ান। যেমন, ধরা যাক, সাউথ আফ্রিকান জুলু। আমিও তো দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ, কিন্তু আমার বাবা ছিলেন লাতভিয়ান, মা ইংল্যান্ডের। সে দিক থেকে দেখলে আমিও মিশ্র সংস্কৃতির ফসল। কিন্তু, ইউরোপ মোটেই আমার ‘হোম’ নয়।

নবনীতা : আপনি অ্যাথল ফুগার্ড-এর শেষ নাটকটা দেখেছেন, ভিক্টরি?

নাদিন : না। ওটা দক্ষিণ আফ্রিকায় মঞ্চস্থ হয়নি।

নবনীতা : না, হয়েছে। কেপটাউনে হয়েছে। খুব একট মঞ্চসফল হয়তো নয়, কিন্তু আমার কাছে নাটকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে লেখা এই নাটক। নতুন প্রজন্ম কী ভাবে মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে, কীভাবে সম্পর্কের তাৎপর্যগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে, যৌনতা, ক্রাইম, ড্রাগ আর অ্যালকোহলে কী ভাবে ডুবে যাচ্ছে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম, সেটাই এই নাটকের বিষয়।

নাদিন : অর্থাৎ, উনি দক্ষিণ আফ্রিকার বিষণ্ণ একটা নেগেটিভ ছবি এঁকেছেন। শুধুই খুনোখুনি, অপরাধ।

নবনীতা : না, শুধুই অপরাধ নয়…নয়… মূল্যবোধের সংকট—

নাদিন : কিন্তু, উনি দেশ থেকে অত দূরে বসে এ রকম নাটক লিখতে গেলেন কেন? এই সময় তো ওঁর মতো মানুষের দেশেই থাকা উচিত ছিল। কত লোক এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় আছে, যারা সংগ্রামে আদৌ যোগ দেয়নি। আর উনি নিজে লড়াই করেছেন, এখন যাকে ব্ল্যাক থিয়েটার বলা হচ্ছে, সেটা গড়ে তোলার পিছনে ওঁর বিরাট ভূমিকা আছে, অথচ উনিই দেশে নেই। আজ যখন দক্ষিণ আফ্রিকার নাটক নতুন দিগন্তের দিকে এগোচ্ছে, তখন ওঁকে দরকার ছিল। উই নিড হিম।

নবনীতা : আপনি কী ভাবে লেখালেখি করেন, সে বিষয়ে যদি একটু বলেন…আপনি কি ফোন-টোন সমস্ত বন্ধ করে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান?

নাদিন : দেখুন, বড় বড় ব্যবসায়ীর মতো আমাদের, মানে লেখকদের তো সেক্রেটারি ইত্যাদি নেই যে চব্বিশ ঘণ্টা আমাদের আড়াল করবে। তা বলে, প্রতি ঘণ্টায় দরজায় বেল, সারাক্ষণ ফোন, এটাও হতে পারে না। আমার ছোট্ট একটা কাজ করার জায়গা আছে। আমি যখন সেখানে কাজ করি, তখন আমি আর বাড়িতে নেই। সিম্পলি আই অ্যাম নট দেয়ার।

নবনীতা : কিন্তু, আমার লেখার সময় এই লাক্সারিটা নেই। আমাকে প্রতিটি ফোন ধরতে হয়, ফোন না-করে-চলে-আসা লোকেদের সঙ্গে দেখা করতে হয়, ‘ব্যস্ত আছি’ বললে ওরা আমাকে দাম্ভিক কিংবা হৃদয়হীন মনে করবেন, দুঃখ পাবেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে মেয়েদের বাড়িতে বসে ‘ব্যস্ত আছি’ বলার সুযোগ নেই। অফিসে থাকলে আলাদা কথা।

নাদিন : এ রকম করলে তো চলবে না। তোমাকে কাজের জন্য সময় করে নিতেই হবে। ইউ মাস্ট মেক আ স্পেস ফর ইওরসেলফ!

নাদিনের সঙ্গে আলাপচারিতা • জোহানেসব

গত বছর জোহানেসবর্গে উইটস বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নাদিন গর্ডিমার লেকচার’ শুনতে গিয়েছিলুম। বক্তা অমর্ত্য সেন। বক্তৃতার পরে ডিনার ছিল, মার্কেট থিয়েটারের সংলগ্ন আফ্রিকান রেস্তোরাঁতে। সেখানে নাদিনের সঙ্গে আলাপ বটে, কিন্তু বিশেষ কথাবার্তা বলার সুযোগ ছিল না টেবিলে মুখোমুখি বসা সত্ত্বেও, কারণ তিনি ভক্তপরিবৃত ছিলেন। কলকাতাতে কিন্তু সুযোগ হয়েছিল, রাজভবনে নৈশভোজে গিয়ে মুখোমুখি আসনে বসায় তাঁর সঙ্গে গল্প করতে পেরেছিলুম। তারই সূত্র ধরে পরের দিন গ্র্যান্ড হোটেলে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয়েছিল দুজনে। আমাকে টেলিফোন নম্বর দিয়ে বলেছিলেন কখনো জোহানেসবর্গে গেলে যোগাযোগ করো, আমাদের বাড়িতে এস। আমি পরের সপ্তাহেই দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছি শুনে তিনি একটু দুঃখিত হয়ে বললেন, কিন্তু আমি যে তখন মেক্সিকোতে থাকব? কার্লোস ফুয়েন্তেসের আশি বছরের জন্মদিনের উৎসব হবে, আমার ফিরে আসতে আসতে অমুক তারিখ হয়ে যাবে। আমি বলি, তাতে কি? আমিও তো প্রথমে যাচ্ছি কেপটাউনে। তিন সপ্তাহ পরে আসব জোহানেসবর্গে। ততদিনে তো তুমি এসে পড়বে। সেই কথাই রইল। দক্ষিণ আফ্রিকাতে গিয়ে আমি ফোন করে ওঁকে জানাব আমার আসার দিনক্ষণ।

নাদিনের বাড়িতে, সেদিন সকালে। ৫ ডিসেম্বর ২০০৮।

নাদিনকে দেব বলে একটি বই নিলুম সঙ্গে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ‘থ্রী সাইডস অফ লাইফ’, পাঁচজন বাঙালি লেখিকার পনেরোটি ছোটোগল্পের সংকলন। কিন্তু তাতে ফাইভ উইমেন রাইটার্স’ কথাটা আছে। আর গোলমালটি সেইখানেই। নাদিন কোনও ধরনের ‘নারীবাদ’ পছন্দ করেন না। লৈঙ্গিক বিভেদও বিভেদ, এবং সামাজিক বিভেদ মাত্রেই তাঁর কাছে আপত্তিকর। নারী লেখক প্রসঙ্গে গত বছরে জোহানেসবর্গে মার্কেট থিয়েটারের রেস্তোরাঁতে একটু বিতর্কও হয়েছিল আমাদের। কলকাতাকে আমাদের দুজনের আলাপচারিতার (যেটি অংশত আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছিল) আমি সতর্ক ছিলুম, ‘সই’-এর প্রসঙ্গ তুলিনি। পরের দিন উনি দিল্লি যাচ্ছিলেন, এবং সেখানে তাঁর সঙ্গে খোলাখুলি আলাপচারিতার একটি প্রোগ্রাম ছিল। সেটির আয়োজক ছিল দিল্লির উইমেন্স প্রেস ক্লাব, নিমন্ত্রণ বিলি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঝামেলা বাধলো শেষ মুহূর্তে। ‘উইমেন্স প্রেস ক্লাব’ এই নাম শুনেই নাদিন বেঁকে বসলেন। অন্তিম মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে দিল্লির ঐ অনুষ্ঠান বাতিল করা হল। আলাপচারিতাটি হবার কথা ছিল অন্তরা দেব সেনের সঙ্গে। সেদিনই অন্য এক লাঞ্চে দুজনের সাক্ষাৎ ও ভাবসাব হল। তার পরের দিনে অন্তরার ডাক এল, নাদিনের নিমন্ত্রণ, তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে। অন্তরা ও প্রতীকের সঙ্গে নাদিন অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন। জোহানেসবর্গে সেদিন সকালে আমি ওঁকে অন্তরা আমার মেয়ে বলতে, নাদিন সকৌতুকে বলেছিলেন, জোহানেসবর্গে গত বছরে বাবার সঙ্গে কথোপকথন, এ বছরে কলকাতাতে মায়ের সঙ্গে আলাপচারিতা, তারপরে দিল্লিতে মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। স্পষ্টতই তিনি খুব মজা পেয়েছিলেন, এই বিচিত্র কাকতালীয়তে।

কেপটাউন থেকে ফোন করলুম। খুব সহজেই চিনতে পারলেন এবং খুশি হয়ে সাদর নিমন্ত্রণ জানালেন। দুঃখের বিষয়, আমাদের একদম সময় নেই, সেদিনই সন্ধ্যায় আমরা দেশে রওনা হচ্ছি। তার মধ্যে আপারথেইড মিউজিয়ামটা দেখতে যেতে হবে। গতবারে সোয়েটাতে হেক্টর পিটারসেন মিউজিয়াম দেখেছিলুম। অসাধারণ। যেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা ইতিহাসটাই সেখানে ফোটোগ্রাফে ও অল্প কথা বিধৃত। ব্রেকফাস্টের পরে নাদিনের কাছে যাওয়া।

পথনির্দেশ দিতে গিয়ে নাদিন বললেন, “সাবধান, আমাদের গেটের সামনে থেকে তিনখানা গাড়ি চুরি হয়ে গিয়েছে। সোজা সাত নম্বর লেখা গেট ছাড়িয়ে চলে আসবে পরের রট আয়রনের গেটে, আমাদের উঠোনে ঢুকে পার্ক করো। তারপর কিচেন দিয়ে প্রবেশ।”

রোজ ব্যাংকের কাছেই পার্ক টাউন। যেতে সময় লাগল না। শুনলুম ভীষণ ধনী ইহুদিদের পল্লী এটি, বাড়ির দর আকাশ ছোঁয়া।

কিচেনের দরজায় ঘণ্টি বাজাতেই নাদিন নিজে এসে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। ভিতরে ঢুকে দেখি এপ্রন আর বনেট পরে, উপনিবেশের ছবির মতো একটি আফ্রিকান মেয়ে বসে আছে টুলের ওপরে। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাসল। বাদামি রং। ঝকঝকে তকতকে কিচেনে কোনওদিন কিছুই রান্না হয় বলে মনে হয় না।

আমাদের ভিতরে নিয়ে যেতে যেতে নাদিন বললেন, “আমার বাড়ির অনেক বয়েস তো, একশো পেরিয়ে গিয়েছে তাই ছোটখাটো গোলমাল লেগেই আছে। টয়লেট, বাথ, কিচেন, সবই পুরনো ধরনের।

বড় বাড়ি। রান্নামহলের এদিকটা বন্ধ করে দেওয়া যায়, মাঝের মস্ত দরজাটা ভেজানোই থাকে। নাদিনের সেন্স অফ প্রিভেসি অতি প্রসিদ্ধ। তিনি নিজের জীবন সম্পর্কে কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাব দেন না। কাউকে জীবনী লিখতেও দেন নি। একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান স্কলারকে অনুমতি দিয়েছিলেন এবং কাগজপত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু তিনি কথার খেলাপ করেন। যা লেখার কথা ছিলনা এমন কিছু লেখেন, যাতে জীবনীটির যাথার্থ্য নাদিন সরকারিভাবে অস্বীকার করেছেন। জীবনীটি নাকি লেখক তবুও প্রকাশ করেছেন অন্য ভাবে, আইন বাঁচিয়ে, সর্বত্র পাওয়া যায়। যেই আমি নাদিনকে জিগ্যেস করেছি, “তুমি আত্মজীবনী লিখবে না? কত ইতিহাসের সাক্ষী তুমি—”

জোরে জোরে সোনালি চুলগুলি দুলিয়ে নাদিন বললেন, “না। আই অ্যাম আ প্রাইভেট পার্সন, অ্যান্ড উড লাইক টু রিমেইন ওয়ান।” এই “প্রাইভেট” শব্দটি উনি আরেক বারও বলেছিলেন সেদিন।

কিচেন থেকে বেরিয়ে আমাদের দালান পার করে নিয়ে যাচ্ছেন বৈঠকখানাতে। পথে একটা পড়ার ঘর দেখলুম ঠিক ছবির মতো। মস্ত জানালার পাশে টেবিল, তাতে টাইপরাইটার আর অনেক কাগজপত্র ডাঁই হয়ে আছে। উঁচু উঁচু তাকে বই ভর্তি, খোলা জানালা দিয়ে বাইরে বাগান দেখা যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত তেরচা রোদ্দুর এসে পড়েছে প্রতীক্ষায় থাকা চেয়ারটার ওপরে আর টেবিলের একাংশে। ঘরের বাকিটা আলোছায়াতে রহস্যময়। মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি।

‘তোমার লেখাপড়ার ঘর?”

“আমার সব কিছু।”

“ওখানে তোমার একটা ছবি তুলতে পারি?”

“যেখানে খুশি আমার ছবি তুলতে পার এ বাড়িতে, শুধু ঐ ঘরটা বাদে। ওটা আমার প্রাইভেট স্পেস, ওখানে আমি লিখি, ওখানে আমি ভাবি। ঐ ঘরের ছবি আমি কাউকে তুলতে দিই না। চল না বসার ঘরে তুলবে, কিংবা বাগানে? আমি ঐ ঘরটাকে আমার শোয়ার ঘরের চেয়েও প্রাইভেট বলে মনে করি।”

“কোয়াইট, বিকজ দ্যাটস হোয়্যার ইউ ক্রিয়েট!”

“লেখার সময়ে আমি দরজা বন্ধ রাখি, ফোন ডিসকানেক্ট করে দিই, কারুর সঙ্গে দেখা করি না, আমি সম্পূর্ণ একা সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে লিখি। কেউ আমাকে বিরক্ত করতে পারে না।”

আমার মনে পড়ে গেল এই প্রসঙ্গটা আমাদের আলোচনাতে কলকাতাতেও উঠেছিল। আমি লিখি হাটের মধ্যে বসে। একবার বাজারের টাকা নিতে আসছে, আর একবার সেই বাজার দেখাতে আনছে, এই পিয়ন কাগজ সই করাতে আনছে, এই মিনিটে মিনিটে অচেনা মানুষের ফোন আসছে। কিংবা “এদিক দিয়ে যাচ্ছিলুম, ভাবলুম একটু ঢুঁ মেরে যাই” সেটা এমনিতে খুবই ভাল কথা, কিন্তু কাজ থাকলে, সেকাজ নষ্ট হয়ে যায় বৈকি। বিব্রত হই বিরক্ত হই না। কেননা মা বলেছিলেন লোক লক্ষ্মী, যতদিন ঘরে লোকজন আসছে ততদিনই সংসারে শ্রী থাকে। অর্থাৎ ততদিনই তোমাকে সমাজের প্রয়োজন আছে। নাদিন শুনে বলেছিলেন, “কিন্তু এমন করলে তো চলবে না, তোমাকে নিজের জন্য আলাদা সময় রাখতেই হবে, কঠোর হতে শিখতে হবে, নইলে কাজ ধ্বংস হয়ে যাবে যে!” আমাদের তো অন্যভাবেই কাজ করতে হয়েছে সারা জীবন। সংসারের, শিশুর, সমাজের, কর্মস্থলের, এবং শিল্পের নানা দাবি একই সঙ্গে মেটাতে হয়েছে। আমি একা নই, ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মেয়েই এইভাবে লেখেন।

“এ কি, নাদিন, তুমি এখনও টাইপরাইটারে লেখো? কম্পিউটার ব্যবহার করো না?” শিহরিত হয়ে নাদিন বলেন, “না বাবা না, ওসব নতুন নতুন যন্ত্রে আমার আগ্রহ নেই। দুটি বস্তু এ বাড়িতে নেই। কম্পিউটার আর সেলফোন। কোনওদিন ঢুকবেও না।” সদর্পে পা ফেলে তিনি বাগানের দরজার পর্দা টেনে খুলে দেন। বাগান ঘরে চলে আসে।

বৈঠকখানাটিও গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে সাজানো।

“এই সব ফুল তোমার বাগানের?”

নন্দনার প্রশ্নে একটু লজ্জা পেলেন, “না না সব নয়, কিছু উপহার।” তার পরেই বলেন, “চল বাইরে চল আমার বাগান ঘুরে দেখবে। অনেক রকমের গোলাপ আছে। আর আমার ফ্ল্যাঞ্জিপ্যানিতে ফুল ধরেছে।”

বেশ কয়েক বার ‘ফ্ল্যাঞ্জিপ্যানি’ শব্দটি জিবের ওপরে তারিয়ে তারিয়ে উচ্চারণ করলেন। এদেশে বোধ হয় দুষ্প্রাপ্য ফুল। এটি হাওয়াই দ্বীপের জাতীয় পুষ্প। ফ্ল্যাঞ্জিপ্যানির মালা পরিয়ে ‘আলোহা’ বলে হাওয়াই দ্বীপে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানোর প্রথা আছে।

হাওয়াইদ্বীপে গিয়ে ১৯৬১-তে আমি কী হতাশ। এই? ও মা, এ তো আমাদের গোলোক চাঁপা, এর আরেক নাম গুলঞ্চ, আমাদের বাড়িতেও আছে। তবু নাদিনের সঙ্গে বাইরে গিয়ে তার ফ্ল্যাঞ্জিপ্যানি দেখি।

“ঐ দ্যাখো, ছেয়ে গিয়েছে ফুলে ফুলে”, সগৌরবে গাছের দিকে তাকিয়ে বলেন নাদিন।

অতি সাধারণ একটি গাছ। ফুলও ধরেছে সাধারণই। কিন্তু তার এপাশে বিশাল সবুজ লন গড়িয়ে গিয়েছে আকাশে। তার সীমানা দেখা যাচ্ছে না। ওপাশে ফুলের বাগান, নন্দনা বেরিয়ে গেল বাগান দেখতে। আমি আর নাদিন ঘরে এসে বসি।

“তোমার মেয়েটি ভারি সুন্দরী,” নাদিন বলেন, “চা, না কফি, নাকি ফলের রস, না বিয়ার?”

আমি বলি, চা।

একটু পরে সেই মেয়েটি আসে, আমাদের জন্যে ট্রেতে চা সাজিয়ে। নাদিন উঠে পড়েন, টীপট নিয়ে চা ঢালেন প্রত্যেকের কাপে। ঢালতে ঢালতে বলেন, “ইস! কী ভয়ানক কাণ্ডই হল বম্বেতে। মানুষের পাগলামি আর নির্মমতা কোথায় পৌঁছেছে। সন্ত্রাস সারা পৃথিবী অসুস্থ করে ফেলছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করবে না আর।” নাদিন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, “তোমাদের কেউ ছিলেন না তো বম্বেতে?”

নন্দনার এক সহ অভিনেতার দিদি জামাইবাবু ট্রাইডেন্টে মারা গিয়েছেন। ওদের শুটিং পিছিয়ে গেছে। অন্তরার এক সহকর্মী মারা গিয়েছেন তাজ-এ।

শুনেই শিউরে উঠে নাদিন বললেন, “ওঃ আর বলো না তাজ-এর কথা। ভাবতে পারছি না, মাত্র কয়েকটা দিন আগেই আমি আর আমার নাতনি তো ওখানেই ছিলাম, আমার কাছে সারাক্ষণ লোকজন, তাই নাতনি সময় কাটাত জিম-এ। জিম-টা একেবারে অন্যদিকে। বাপ রে! যদি সেই সময়ে আমরা ওখানে থাকতাম তাহলে কি সর্বনাশ হত বলো তো, দুজন ছাড়াছাড়ি হয়ে যেতাম, ও এক জায়গায় আমি আরেক ঘরে। কী ভয়ংকর!”

আমার অবাক লাগল এই ভেবে যে তিনি কিন্তু মৃত্যুর কথা ভাবছেন না, মৃত্যুভয় পাননি, তাঁর শুধু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আতঙ্ক হয়েছে। সেই প্রচণ্ড ভীতির মুহূর্তে নাতনিকে বুকে করে আগলাতে পারতেন না, এই তাঁর ভয়, যার কল্পনাতে তিনি শিউরে উঠছেন। নাতনি যে মারাই যেতে পারত সে নিয়ে কিন্তু কিছুই বললেন না নাদিন।

নরীমান হাউসে ইহুদি হত্যার প্রসঙ্গ উঠল। নাদিন নিজে ইহুদি। আমি বলি, ভারতে ইহুদি ঘৃণার চিহ্নমাত্র ছিল না, বহু যুগ আগে এক হিন্দু রাজা পালিয়ে আসা ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। আজ সেই মাটিতে ইহুদি হত্যা হল। সন্ত্রাসের ফসল ফলানো হয় ঘৃণার চাষ করে। ইসরায়েল আর প্যালেস্টাইনের ঘৃণার ছাপ এই হত্যাকাণ্ডে স্পষ্ট। প্রসঙ্গ আবার ঘুরে গেল বিশ্বশান্তির দিকে, ইরাক, বুশ এবং ওবামা এসে পড়লেন। এসে পড়লেন ম্যান্ডেলা, তাঁর প্রাক্তন পত্নী উইনি, বর্তমান স্ত্রী গ্রেস। সকলকেই খুব ভাল করে চেনেন নাদিন। উইনি অনেক অন্যায় অনুচিত কাজকর্ম করেছেন, তবুও নাদিনের মতে উইনির কাছে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম চির ঋণী। আর নেলসন আর গ্রেস দুজনে এখন দিব্বি পরস্পরের প্রেমে পড়েছেন, গ্রেস ঘটা করে স্বামীর যত্ন আত্তি করেন। ম্যান্ডেলা বৃদ্ধ হয়ে পড়ছেন। একটু জবুথবু।

টেবিলের ওপর একটা চটি বই ছিল। সেটা নাদিন আমাকে দিলেন, “এই নাটকটা এক দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় ছেলের লেখা।

নন্দনা বইটি হাতে নিয়ে বলে ওঠে, “আরে, রাজেশ গোপী, একে তো আমি চিনি!”

আর কোথায় যায়, বালিকার মতো লাফিয়ে উঠে নাদিন তাকে ফোন করলেন, “এক্ষুনি চলে এস এখানে, তোমার বন্ধু আছে, নন্দনা।” কিন্তু বেচারা তখন রেডিওতে অডিশন দিতে গিয়ে বন্দি! আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই।

“তারপর, মেক্সিকো কেমন হল? কার্লোস ফুয়েন্তেসের জন্মদিন?”

একশোটা আলো জ্বলে উঠল ওঁর মুখে চোখে। “খুব সুন্দর। অপূর্ব। দারুণ আনন্দ করেছি সকলে। মাত্র দশজন লেখককে ডেকেছিল সারা পৃথিবী থেকে, মিনিট পনেরো করে বলতে, কিন্তু কার্লোসের সম্পর্কে নয়। অত্যন্ত সুন্দর বন্দোবস্ত করেছিল সিলভিয়া, ওর দ্বিতীয় স্ত্রী। আহা, ওদের তো দুই সন্তানই বড় হয়ে, ২৫ আর ৩০ বছরে মারা গিয়েছে, শুধু প্রথম স্ত্রীর মেয়েটি এসেছিল, সিসিলিয়া মাকাডো। চমৎকার একটা মধ্যাহ্নভোজ ছিল, ছোট করে অল্প লোকের জন্যে, অসামান্য সুস্বাদু সৃজনশীল রান্না করে সিলভিয়া। সব নিজে রেঁধেছিল। যেমন রূপসী তেমনি গুণী। একপিঠ এলো ব্লন্ড চুল,” আমার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে নিয়ে বলেন, “তোমার এক পিঠ কালো চুলও সুন্দর।”

“কেন, নাদিন, তোমার সোনালি চুলও তো খুব নজর কাড়ে।”

“কাড়তো, এখন পাতলা হয়ে যাচ্ছে। কার্লোসদের গোটা বাড়িটাই খুব মনের মতো, খুব অন্যরকম, কোনও ঘরটা কোনও ঘরের মতো নয়, অনেক সারপ্রাইজ আছে। সিলভিয়ার সবচেয়ে বড় গুণ কী জানো? কার্লোসের সব কাগজপত্র, সব বইপত্র, প্রত্যেকটা এডিশন, প্রত্যেকটা অনুবাদ, রিভিউ, লেকচার, পুরস্কার, ফোটো, সব গুছিয়ে তাকে সাজিয়ে এবং ফাইল করে রেখেছে। যখন যেটা চাই সেটা তক্ষুনি হাতের কাছে পাবে। আর আমার? ঠিক উল্টো। কোনও জিনিসটা যদি হাতের কাছে পাই! কেউ কিছু চাইলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, খুঁজতে খুঁজতে প্রাণ যায়। “

শুনে আমার প্রচণ্ড সহানুভূতি হল, আমারও তো সেই একই অবস্থা! কিছুই গুছোনো নেই, সব হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি নাদিনকে বলি, “তুমি একজন সেক্রেটারি রাখ না কেন?”

“রেখেছিলুম তো, খুব ভাল মেয়ে ছিল, কিন্তু সে যে মারা গেল। আর মনের মতো কাউকে পাচ্ছি না।” আহা, নাদিন আমিও কি কম খুঁজছি একজন গুছুনে সহকারি, ফুয়েন্তেসের সুন্দরী বৌ-এর মতো? যে আমার সব কাগজপত্তর ভালবেসে গুছিয়ে রাখবে?

“মেক্সিকো থেকে ফেরার পথে, মধ্য গগনে আমার ৮৫ পূর্ণ হল।”

হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক সুরে নীচু গলায় বলে ওঠেন নাদিন।

“সে কি? আকাশে? একা একা? উৎসব হলনা?”

‘আমিই চাইনি উৎসব। ছেলেমেয়েরা এসেছিল।’ হাসিমুখে যোগ করেন, “এই সব ফুল সেই দিনেরই!”

রাকেশ সবিনয়ে তাগাদা দেয়, মিউজিয়ামে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

“একটু দাঁড়াও তোমাকে আমার নতুন বইটা দিই, এটা নিশ্চয়ই পড়নি।” পাশের ঘরে গিয়ে একটি বই নিয়ে এলেন, তার পরে ঝর্ণা কলম নিয়ে তাতে লিখতে বসলেন, “ট ডিয়ার নবনীতা উইথ প্লেজার অ্যাট সিইং ইউ আগেন! ইন ওয়র্ম ফ্রেন্ডশিফ, নাদিন। “

ছোটগল্প সংকলন, নামটি খুব অভিনব, “বেঠোফেন ওয়জ ওয়ান সিক্সটিন্‌থ ব্ল্যাক।” ধন্য হয়ে বইটি গ্রহণ করি। তারপরে ঝোলা থেকে বের করি, “থ্রী সাইডস অফ লাইফ” আশাপূর্ণ, মহাশ্বেতা, নবনীতা, বাণী, সুচিত্রা। রুদ্ধশ্বাসে মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, নাঃ, উনি “ফাইভ উইমেন রাইটার্স” নিয়ে কোনওই গোল বাধালেন না, আগ্রহের সঙ্গে বইটি গ্রহণ করলেন।

“নাদিন, তোমার নতুন কী বই বেরুচ্ছে?”

“একটা নন ফিকশনের সংকলন বেরুচ্ছে, কিন্তু আমি নিজেকে নন ফিকশনের লেখক ভাবতে পছন্দ করি না।”

“উপন্যাস কিছু ধরেছ?”

নাদিনের মুখে হাসি, “হ্যাঁ, নতুন উপন্যাসে হাত দিয়েছি।”

“কী নিয়ে লিখছ, জানতে পারি?”

নাদিনের সুন্দর মুখ কঠিন হল, “আমি কখনও আমার অসম্পূর্ণ লেখার বিষয়ে কিছু বলিনা। সেটা গোপন রাখা পছন্দ করি।”

“বেশ, আমরা ধৈর্য ধরে থাকব।”

রাকেশ চঞ্চল হয়ে উঠছেন। আপারথেইড মিউজিয়ামের সময় চলে যাচ্ছে। নাদিনের কুকুরটি নাদিনের সঙ্গে সঙ্গে কিচেনের দোরগোড়া অবধি এল। আমাদের গাড়ি যখন ছাড়ল পিছন ফিরে দেখলুম পুষ্যিকে পাশে নিয়ে নাদিন দাঁড়িয়ে আছেন। বিদায় জানাতে একটি হাত ওপরে তোলা। বড়সড় দরজার এই ফ্রেমে ছোটখাটো নাদিনের এই ছবিটি মনের মধ্যে নিয়ে ফিরে এলুম।

এই দ্বিতীয় দফার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে এসে গত বছরের বন্ধুদের একজনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়নি কেপটাউনে। নাগেশকে পাইনি, কনসাল বদল হয়ে গিয়েছেন, রুচিরা এখানে নেই, নতুন কনসালও শহরে নেই। মরিয়ম আর রামগোবিনকে ধরতে পারিনি, তাঁরা ডারবানে। নির্মলা আর ফিলিপকে ফোনে পাইনি, ফোন ধরছেন না, পেনি আর রবার্ট জোহানেসবর্গে, ম্যালকমও তাই। পিপা আর নেই। আমি তাই একটু মনমরা। নতুন বন্ধু ভাল, কিন্তু পুরনোদের বদলে না, পাশাপাশি। একটাও চেনামুখ না দেখলে শহরটাকে চেনা শহর বলে ভাবব কেন? সেই চেনা জাহাজটার সঙ্গে পর্যন্ত দেখা হল না। শেষে নির্মলাকে পেলুম, আমার গলা শুনে খুশি। কিন্তু বললেন সামনের বেস্পতিবার তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে তো, নতুন বাড়িতে উঠে যেতে হচ্ছে? তাই নিয়ে ব্যস্ত, আর ছোট মেয়েটি একটু বিচলিত। সে পড়ছে ভারতে কৃষ্ণমূর্তি স্কুলে, কিন্তু এখন ছুটিতে এখানে। নির্মলার প্রথমা কন্যা আগের পক্ষের, সে নিজেই নিজের দায়িত্ব নিয়েছে, চাকরি করে। নির্মলা বললেন ফিলিপ চমৎকার মানুষ, চমৎকার পিতা, কিন্তু স্বামী হবার জন্যে তৈরি হয়নি। আমি ভাবি, ওদের বিয়ে তো বেশ কিছু দিনের, এবং দীর্ঘ প্রেমের পরে, স্বামী যে স্বামীত্বে বিফল, সেটা এতদিন বাদে টের পেল কেন! কিন্তু ভেঙে যাওয়ার গল্প শুনলে কারই বা মন ভেঙে পড়ে না?

ডারবান, জোহানেসবার্গ, সর্বত্র ফোন করে মেসেজ রেখেছিলুম, তার ফলে রামগোবিন আর মরিয়মের সঙ্গে ফোনে হাই আর বাই হল, ওঁদেরও কী মন খারাপ আমাকে মিস করেছেন বলে। আমরাও জোহানেসবর্গে এলুম, ওঁরাও কেপটাউনে ফিরলেন! রামগোবিনই বললেন, জোহানেসবর্গে এসে টলস্টয় ফার্মে না যেতে পেরে শোকের কিছু নেই, ওখানে গেলেই বেশি শোক হত, এক ভাঙাচোরা মাঠ ঝোপ-ঝাড় ছন্নছাড়া পড়ে আছে। সংরক্ষণ হয়নি গান্ধির স্বপ্নের টলস্টয় ফার্মের। কিন্তু কেন হয়নি? কী করছেন স্থানীয় ভারতীয়রা? রামগোবিন নিজে এল গান্ধির প্রাক্তন স্বামী, মণিলাল গান্ধির জামাই। তিনি তো নাটালের এম পি, তিনি কিছু করেন নি কেন? তিনি বললেন, “কেন, নাটালের ফিনিক্স সেটেলমেন্ট তো আমরাই পুনরুদ্ধার করেছি।’ কি জানি, জোহানেসবর্গ তবে হয়তো নাটালে নয়?

আমরা যেদিন জোহানেসবর্গ ছাড়ব তার আগের রাত্রে অকস্মাৎ, ম্যালকমের ফোন এল। যখন ধরেই নিয়েছি এবারে দেখা হল না, চমৎকার এক ব্রেকফাস্ট মিলন ঘটল আমাদের পরদিন সকালে। প্রাতরাশের টেবিল আলো করে এসে পড়লেন ম্যালকম, সঙ্গে পেনি আর রবার্ট। একেবারে মেঘ না চাইতেই জল! আমার খুব আনন্দ যে একবার অন্তত মুখগুলো তো দেখা গেল! সবাই ছুটিতে বাইরে ছিলেন। পেনি বললেন ইনগ্রিড ইয়ংকার কবিতার বই-এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে, আমাকে বইটি পাঠানোর শপথ পেনি ভোলেন নি। পিপার অনুপস্থিতি প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছিল, যদিও একজনও আমার পিপার কথা উচ্চারণও করলুম না সেই সকালে। মাত্র এক বছরের মধ্যে নির্মলা একা হয়ে গিয়েছেন, ম্যালকমও করাল কর্কটরোগে পিপাকে হারিয়েছেন। বাবার আদুরে মেয়ে, একমাত্র সন্তান, সুন্দরী ফিলিপার ডাকনাম ছিল পিপা। কিশোর পুত্রকে নিয়ে ম্যালকমের অবস্থা কাহিল, নিজে শোকের সময় পাচ্ছেন না। সভ্য সমাজের আদব কায়দায় শোক রইল নিরুচ্চার, হৈ হৈ হুটোপাটি চেঁচামেচি করে ম্যালকমের স্বভাবসিদ্ধ উষ্ণতায় সানন্দ প্রাতরাশ হতে থাকল যতক্ষণ না রাকেশ এসে জানালেন এবারে নাদিনের বাড়িতে যাবার সময় হয়েছে। গত বছরের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সঙ্গে এ বছরের ভ্রমণের পার্থক্য সেবারে পিপার চোখ দিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভিতর থেকে চিনেছিলুম আমি। নাদিনের সঙ্গে আমার পরিচয়ও পিপারই মারফতে। এবছরে পিপা নেই।

উপসংহার

কলকাতা ৯ জানুয়ারি ২০০৯

রাত্রি দশটা। দক্ষিণ আফ্রিকার ডায়ারি সম্পর্কিত বইটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতির পালা সমাপ্ত। কাল সকালে প্রেসে যাবে। সমস্যা নামকরণের। মেয়েরা বলছে ‘ডারবান ডায়ারি’ স্মার্ট নাম, ‘উত্তমাশা অন্তরীপ’ নাম ভানুদার পছন্দ। আমি খুঁজছি মধ্যপথ। ভাবতে ভাবতে আজকের চিঠিপত্র খুলছি, একটি বুকপোস্ট এসেছে বিদেশ থেকে। বাইরে অনেক পাখির রঙিন ছবির স্ট্যাম্প, দেখেই খুশি খুশি লাগে। কে পাঠিয়েছে? পেনি হিউবার্গার, জোহানেসবর্গ থেকে হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয় উল্লাসে, খোলার আগেই জানি কী এসেছে! পেনি তাঁর কথা রেখেছেন। পরিয়েছেন আমার এই বই-এর উপযুক্ত উপসংহার। ইনগ্রিড ইয়ংকারের কাব্যগ্রন্থ, ব্ল্যাক বাটারফ্লাইজ। আমি গত বছরে ইনগ্রিড ইয়ংকারের ওপরে একটি তথ্যচিত্র দেখে যার পর নাই বিচলিত হয়েছিলুম, এই আত্মধ্বংসী, ভালবাসার কাঙাল, বোহেমিয়ান শিল্পীর জন্যে অসহায় মমতায়। আর মুগ্ধ হয়েছিলুম সেই ছবিতে তাঁর কিছু কবিতা শুনতে পেয়ে। পড়তে চেয়েছিলুম। অনেক খুঁজেও কোনও বই-এর দোকানে ইনগ্রিডের কবিতা পাইনি। শুনলুম আফ্রিকান্স থেকে ইংরিজি অনুবাদ করা চলছে, খ্যাতনাম্নী কবি ও অনুবাদিকা শ্রীমতী আন্তজে ক্রোগ কাজ করছেন, যিনি ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীর অনুবাদ করেছিলেন। এবারে গিয়েও খোঁজ করেছি, শুনেছি প্রকাশিত হয়েছে, ভূমিকা লিখে ক্রোগের সঙ্গে আছেন ইয়ংকারের সর্বশেষ প্রেমিক ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত কথাশিল্পী আন্দ্রে ব্রিংক, যিনি একাধিকবার নোবেলের তালিকাভুক্ত হয়েছেন। পেনি বলেছিলেন পাঠিয়ে দেবেন। এবারে দেখা হতে মনে করিয়ে দিয়েছিলুম আজ ইয়ংকারের সেই বই আমার হাতে। ২০০৭-এর মে মাসে যে আকাঙ্ক্ষার শুরু হয়েছিল, ২০০৯-এর জানুয়ারিতে তার পূর্ণতা এল। নানা মাদকের সহায়তায় ইনগ্রিড যখন সমুদ্রের ভেতরে হেঁটে চলে গিয়ে আর ফিরলেন না, তখন তাঁর বয়েস ছিল মাত্র একত্রিশ। এই কবিতাটি ১৯৬৪তে লিখেছিলেন।

কেপটাউনের জন্য মন কেমন

সে আমাকে তার সহস্রজনের ভিড়ে ভরা কোলে আশ্রয় দেয়
সে আমাকে বলে আমার গলার নলি কেটে দেবে না কেউ
সে আমাকে বলে আমাকে কেউ গৃহবন্দি করে রাখেনি
সে আমাকে বলে দুরন্ত প্রেমের ক্ষয়রোগে আমি মৃতপ্ৰায় ন‍ই
সে জানে না আমার খিদে পেয়েছে
সে জানে না আমার ভয় করছে
সে জানে না ভোরের মোরগ আর গৃহবন্দিত্ব দুজনে সঙ্গমরত

আমি তার দুর্দান্ত শিশু
চায়ের কাপ দিয়ে সে টেবল মাউন্টেনকে সামলে রাখে সমুদ্রে
আর তার হাতগুলো চামচের মতো শীতল

(নস্ট্যালজিয়া ফর কেপটাউন, জুলাই ১৯৬৪)

ঠিক এক বছর পরে, জুলাই ১৯৬৫-র অস্থির এক মধ্যরাত্রে কেপটাউনের সমুদ্রেই ডুব দিয়েছিলেন ইয়ংকার। ইনগ্রিডের আরো একটি ছোট্ট কবিতা শুনিয়ে শেষ করি আমার এই দক্ষিণ আফ্রিকার কিস্সা।

কাচপোকা*

আমার মায়ের স্মৃতিতে

উজ্জ্বল গেরুয়া
একটা আলো এসে পড়ছে
সমুদ্র থেকে
উঠোনে,
কাচাকুচি আর একটা
ডালিমগাছের মাঝামাঝি কোথাও
তোমার হাসি আর সকাল
আকস্মিক আর ছোট্টো
এক কুচি কাচপোকার মতো
আমার হাতের পাতায় পড়ে

* (লেডিবার্ড)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *