কেপটাউনের চালচিত্র

কেপটাউনের চালচিত্র

কেপটাউন ওয়াটার ফ্রন্ট

ভিক্টোরিয়া এবং অ্যালবার্ট মল এর সমুদ্রতীরে বসে আছি। কেপটাউনের বিখ্যাত ওয়াটার ফ্রন্টে। আমার মুখে নোনা বাতাসের গন্ধ এসে লাগছে। সামনে অতলান্তিক পোশাক বদল করে সূর্যাস্তের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। আর বাইরে সমুদ্রসৈকতে মোহিত হয়ে বসে থাকার বিলাসিতা চলবে না। দিনটা এমন জোরাল সূর্যের দাসত্বে কেটেছে যে সঙ্গে শীতের কাপড় নিয়ে বেরুইনি। এখানে আবহাওয়ার তুঘলকি মেজাজ। এই সোনালি এই কালিঝুলি। মল এর ভিতরে বসতেও ভাল লাগবে। প্রকৃতি সুন্দরী কিন্তু সংস্কৃতি কম কি! হাট বাজারের আলাদা মায়া আছে, মানুষের মুখে কি কম সম্মোহন? ভিতরে ঢুকি। আঃ উষ্ণতা! দু’পাশে নানারকমের দোকানপাট। কলকাতাতে এখন মল এর প্রাদুর্ভাব। কিছুদিন আগেও দেশের লোককে বোঝানো মুশকিল হত মল কী বস্তু। অথচ আমাদের শহরে চিরকালই একটি জবরদস্ত মল ছিল, কেবল আমরা সেটাকে মল বলে ভাবতুম না। মল বলতেই বাঙালির শুধু দার্জিলিং আর ঘোড়ায় চড়া মনে হত। এ মল, সে মল নয়। আমাদের প্রাচীনতম মল নিউ মার্কেট।

হগ সাহেবের বাজার তো মলই একটি ছাদের নিচে একটা গোটা বাজার। কত দোকান, কেক থেকে হিরে জহরত, বেনারসি শাড়ি থেকে সুইমসুট, পুতুল খেলনা, ফলফুল, সব্জি মাংস, ঘড়ি সুটকেস থেকে ছাতা জুতো, কী ছিল না? আমাদের শৈশবে স্কুল পাঠ্য বইতে কলকাতার বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া, অক্তারলোনি মনুমেন্ট, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, ইডেন গার্ডেনের প্যাগোডা, পরেশনাথের মন্দির, জিপিও আর কালীঘাটের সঙ্গে হগ সাহেবের বাজারেরও নাম লিস্টিতে থাকত। এখন ভাবি কই রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়ি তো দ্রষ্টব্য ছিল না? ছিল না মল্লিকদের বাড়ির জাদুঘরের কথাও। এখন কলকাতার দ্রষ্টব্যস্থানগুলোর অনেক বদল হয়েছে, বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম, সায়েন্স সিটি, আর অগুনতি মল, আর সিনেপ্লেক্সগুলো গ্রামের লোকেরা এসে দেখতে যান। আমি তাদের মতোই এই মল-এ বসে আছি। মুগ্ধনয়নে নিরীক্ষণ করেছি জীবন। জীবন ঝলমল করছে চতুর্দিকে।

আমি এসে বসেছি একটি কফিশপে। ভিতরে বসিনি, খুব গরম নাহলে আমার সর্বদা বাইরে বসতে ভাল লাগে। এখানে তো গরমের প্রশ্ন আপাতত নেই। দোকানটার নামটাও আমাকে আকর্ষণ করল, খুব খোলাখুলি, সাদামাটা কোনও ঠকানোর চেষ্টা নেই, ঠিক আমি যা চাই, তাই। কফি অ্যাণ্ড বাইট। এক চুমুক কফি, এক কামড় আর কিছু? সুপ স্যালাড? ফিশ এন চিপস? আমি একটা ক্যাপচিনো আর একটা গ্রিলড চিজ স্যাণ্ডউইচ চাই। আমার টেবিলে একটি কমলা রঙের মোম জ্বলছে, যদিও চারিদিকে অজস্র আলো জ্বলে উঠেছে, এটুকুতে কী করে জানি না অল্প নরম আলো আঁধারি মায়া। বাইরে সাগরে কখন সূর্য অস্তে গেলেন, আমি ভিতর থেকে শুধু অন্ধকারের নেমে আসাটুকুই দেখলুম, মন কেমন করা একটা ভোঁ বাজল কোনও জাহাজে।

আগে এল ক্যাপচিনো। চুমুক দিতে দিতে দেখছি মানুষের স্রোত বইছে। সমুদ্রের চেয়ে কিছু কম রহস্যময় নয়। কত রঙের মানুষ। যেন মানুষের বাগানে বসে আছি। ওঃ! স্থান-মাহাত্ম্য একেই বলে। জায়গাটা যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকা, তাই যে শব্দটি প্রথমেই মনে এল, সেটি রঙ। কত রকমের মানুষ নয়, কত রঙের মানুষ। যেন মানুষের বাগানে বসে আছি। এ দেশের বর্ণবিদ্বেষের কলঙ্ক আইনত ঘুচে গেলেও জীবনযাত্রার তার রেশ কিন্তু ঘোচেনি। এত তাড়াতাড়ি কি এতটা মনের বদল সম্ভব? গ্রিলড চিজ স্যাণ্ডউইচের সঙ্গে চলে এল চমৎকার এক বাটি টাটকা সবজির স্যালাড আর তৈলহীন ফিঙ্গার চিপস। আমি তো দেখে মহা আহ্লাদিত। এ যে বেণীর সঙ্গে মাথা। যে পরমাসুন্দরী মেয়েটি নিয়ে এল ট্রে, তার কাছে আনন্দ প্রকাশও করে ফেলি। সে হেসে গড়ায় কেন, তুমি মেনুতে দ্যাখোনি? লেখা ছিল তো। আমি যে স্পষ্ট করে বড় হরফে সাদাতে কালোতে ছাপা নাহলে কিছুই পড়তে পারি না জোরালো আলো এবং আতসকাচ ছাড়া, ওদের ফ্যাশনেবল রঙিন মেনু যে আমি পড়িনি, অমনি পড়ার ভান করে অর্ডার দিয়েছি সেটা ওকে বলে লাভ নেই। আমি অন্য কথা পাড়ি। তুমি কি কেপটাউনের মেয়ে?

সে হেসে মাথা দোলায়। না।

তুমি বড় সুন্দরী। একটা ছবি তুলতে দেবে?

সে আবার হাসে নিশ্চয়ই! কোথায় দাঁড়াবে?

ছবি তোলার পরে বলি, তুমি কি দক্ষিণ আফ্রিকার?

সে বলে, না। তারপরে আমার কানে কানে বলে ….. আমার দেশ বুরুণ্ডি। নাম শুনেছ? –বাঃ বুরুণ্ডির নাম শুনিনি? রোয়াণ্ডা আর বুরণ্ডিতে এমন প্রবল যুদ্ধ চালাল, সর্বনাশ করে ফেলল দেশ দুটোর, নাম না শুনে উপায় আছে? তুমি বুঝি পালিয়ে এসেছ?

—হ্যাঁ। বাঁচতে হবে তো? তোমার দেশ কোথায়?

—ভারতবর্ষে। নাম শুনেছো?

–বাঃ,কেন না শুনেছে ভারতবর্ষের নাম? এখানে অনেক ভারতের লোক আছে, তারা তোমার মতো পোশাক পরে না। এদেশীয় সাজসজ্জা করে।

—তুমিও তো এদেশীয় সাজসজ্জা করেছ?

—আমরা তো ইউনিফর্ম পরে আছি।

তিনটি মেয়ে কাজ করছে, লাল কালো পা অবধি লম্বা স্কার্ট এপ্রন, মাথায় টুপি নেই। তিনজনের কেশবিন্যাস তিন রকমের। তিন রকমের সুন্দর দেখতে তিনজনকে। তিনজনেই কৃষ্ণা, বুরুণ্ডির বালিকাকে প্রশ্ন করি,—তোমার নাম কী?

জানেৎ। তারপরে জানেৎ বলে তুমি ফরাসি জানো?

মোটামুটি। কেন, তোমার ফরাসিতে বেশি স্বচ্ছন্দ? কিন্তু তোমার তো ইংরেজি খুবই ভাল।

—এই কাজে ভাষা শেখা হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে একজনই শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে, জেনি। ওই যে। কাউন্টারের মহিলার দিকে দেখায়। এদের চেয়ে বয়সে বড়, তিনিও সুন্দরী, দেখছি বুঝে হাত নাড়েন। ইতিমধ্যে এখানে আড্ডার গন্ধ পেয়ে অন্য মেয়েটিও এসে জোটে। সে আসতেই জানেৎ চলে যায়।

আমি রুটিন প্রশ্ন করি। –তোমার দেশ কোথায়?

সে ঝকঝকে এক মুখ সাদা হাসি হেসে বলে, কঙ্গো।

—তুমিও পালিয়ে এসেছ?

হাসি মিলিয়ে যায়। কাজের খোঁজে এসেছি। ওখানে কাজ নেই। এখানে অনেক সুবিধা।

এই মেয়েটির নাম ডাসিয়া তারও ভাষা ফরাসি, ওরা দুজনে একসঙ্গে থাকলে ফরাসি বলে। এখানকার লোকে ফরাসি বলে না।

-তোমার ছেলেমেয়ে আছে?

—হ্যাঁ, আছে?

–তোমাদের বিয়ে হয়েছে?

ও হাসে এখনও না। তুমি কি এখানেই থাকো, দক্ষিণ আফ্রিকাতে?

–না, ভারতে থাকি, বেড়াতে এসেছি।

–তোমার ছেলেমেয়েদের আনোনি?

—তারা তো বড় হয়ে গিয়েছে। একজন এখানে এসেছে। তার সঙ্গেই আমি এসেছি। সে এখানে শুটিং করছে একটা সিনেমার।

—সিনেমা? মহা উল্লসিত হয়ে মেয়েটি অন্য মেয়েটিকে ডাকল।

—মাম্মার মেয়ে সিনেমাতে অভিনয় করে। বম্বে।

-তোমরা দেখেছ?

—দেখি মাঝে মাঝে। টিভিতেও দেখি।

–তোমরা কখনও ফিরে যাওয়ার কথা ভাবো?

—এই তো সবে গুছিয়ে বসেছি, এখনই ফেরার কথা ভাবছি না। তুমি? মাম্মা? –আমি তো ফিরে যাব বলেই বাইরে বেরুই, আমরা তিন সপ্তাহের জন্য বেরিয়েছি। মেয়ের কাজ ফুরোলেই আমারও ছুটি ফুরোবে।

মাঝে মাঝে কফির খরিদ্দারেরা আসছেন, মাঝে মাঝে ওরা চলে যাচ্ছে আবার ঘুরে ফিরে চলে আসছে আমার টেবিলে। আফ্রিকার ড্রামের বাজনা বাজছে দোকানের পটভূমিতে। এটা নাকি টুরিস্টদের ঋতু নয়, তবু তো অনেক ভ্রমণকারী দেখছি। অল্প বয়সীদের কোলে পিঠে শিশু বাঁধা, কিংবা সামনে ঠেলাগাড়িতে। বৃদ্ধাদেরও দেখা যাচ্ছে। বাজার করে নিয়ে যাচ্ছেন। বৃদ্ধ দেখলুম না কিন্তু। তারা কি ঘরে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখছেন? সুসজ্জিতা মহিলারা বিখ্যাত ব্র্যান্ড নেমের দোকানের ব্যাগ হাতে মহার্ঘ কেনা কাটা করে ফিরছেন। একটি ছোট বাচ্চা ছেলে তার বাবার হাত থেকে ঝুলতে ঝুলতে চিলচিৎকার করতে করতে চলছে। মা তাদের দু’জনের কাউকেই আপাতত চিনছেন না, প্র্যাম ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলেছেন। দুটি ছাত্র-ছাত্রীর মতো দেখতে বাদামি ছেলেমেয়ে হঠাৎ থেমে পড়ে চুমু খেল। এখানে পথে ঘাটে তত শরীরী প্রকাশ দেখা যায় না। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার আপাতত অন্যতম প্রধান সমস্যা আফ্রিকানদের ‘মধ্যে প্রবল যৌন অসংযমের অভ্যাস। সামাজিক কোনও বাধা, বা লোকলজ্জার ব্যাপার নেই। একাধিক শয্যাসঙ্গী স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই থাকতে পারে একই সময়ে। কেউ কিছু মনে করে না। কিন্তু শরীরের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। এখানে সরকারি ও বেসরকারি বহু সচেনতা সৃষ্টি সত্ত্বেও এইচ আই ভি এবং এডস-এর ছড়িয়ে পড়া আটকানো যাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে ১৫থেকে ২৫ এর মধ্যে, বিশেষত নারী। বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যা এখানেই। কিন্তু দশ বছরের মধ্যে নাকি ভারতবর্ষ এই খেলাতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিতে চলেছে।

সব বয়সের সাদা কালো বাদামি গিন্নিরা বড় বড় শপিং কার্ট ঠেলে গাড়ির দিকে চলেছেন অজস্র ঠোঙাতে সমৃদ্ধ হয়ে। সংসারের গেরস্থালির বাজার করে নিয়ে যাচ্ছেন পিক অ্যাণ্ড পে সুপারমার্কেট থেকে। আমারও মনে পড়ল, দুধ, ডিম, হ্যাম সসেজ, রুটি, কলা, কমলার রস, আরও কীসব যেন কেনার ছিল, লিস্টি করেছিলুম বটে। পিক অ্যাণ্ড পে ওই দোতলার ওপরে। আমি তো ওই সুন্দর সিঁড়িটি দিয়ে উঠতে পারব না। নিশ্চয়ই কোনও লিফট কিংবা এসক্যালেটর আছে কোথাও। কিন্তু কোথাও খুঁজতে যাওয়ার মতো উৎসাহ নেই। কাল সিঁড়ি চড়তে বাধ্য হয়ে আজ পায়ে ব্যথা। বাড়ি ফেরার সময় হল। টুনিন আর ক্রিস্টেল আমাকে নিতে আসবে। ততক্ষণ বরং ওই সামনের আফ্রিকান কুইন দোকানে গিয়ে অন্যান্য দ্রব্য নেড়ে চেড়ে দেখা যেতে পারে। উঠে দাঁড়াতেই কঙ্গো থেকে ডাসিয়া আর বুরুণ্ডি থেকে জানেৎ ছুটে এল, আলিঙ্গন, চুম্বন করে বলল, গুড বাই মাম্মা! বলল, রিমেম্বার আস ইন ইণ্ডিয়া!

কেপটাউন থেকে ক্যালটাউনে

সবটা মন কি আর সঙ্গে করে আনতে পেরেছি কেপটাউনে? আধখানাই পড়ে রয়েছে সেই পোড়া কলকাতা শহরে।

তবু বলব এখানে এসে মনোনিবেশের সুযোগ হয়েছে। সারাদিন কোনও ফোন আসে না, দিনভর দরজায় ঘণ্টি বাজে না, মিনিটে মিনিটে চিঠিপত্র আসে না, রান্না বাজার, কিছুর দায় নেই, নিজের মনে থাকতে পারি, লিখতে পারি, ভাবতে পারি। নিঃসঙ্গতায় সুখ না থাক সুবিধা আছে। দেশের জীবনে ভালবাসাবাসি আর ভদ্রতা করতে করতে কাজে বড্ড বাধা পড়ে যায়। লিখতে লিখতে ফোন না ধরলে শুধু চেনা মানুষেরাই নন, অচেনা লোকও চটে যান। দুঃখিত, জরুরি কাজ করছি, ইমার্জেন্সি না হলে এখন বরং থাক, পরে কথা হবে,—এই অসহায় বাক্যাংশগুলো তাঁদের প্রাণে মমতার আহা উহু বর্ষণ করে না। বরং বড্ড ব্যস্ত আছি, এই বাক্যটি স্পষ্টতই রুক্ষ, অপমানজনক ঠেকে। অফিসে কাজ থাকলে ঠিক আছে, সসম্মানে সেই ব্যস্ততা গৃহীত হবে, কিন্তু বাড়িতেও যে মানুষের প্রোফেশনাল কাজ থাকতে পারে, অন্নসংস্থানের ব্যাপার থাকতে পারে, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর উপার্জনের উদ্দেশ্য ছাড়াও গৃহগত মানুষের তো কোনও জরুরি কাজে একনিষ্ঠ মনসংযোগ অত্যাবশ্যক হতেই পারে? সঠিক শব্দটির জন্য যখন উথালপাথাল মন, তখন তপোভঙ্গ করলে অভিসম্পাত দেওয়ার ঘোরতর সম্ভাবনা। এত পুরাণ পড়েও ছাই সেই ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথাটাও কারুর মনে আসে না?

মনের কথাটা বলি। করেই ফেললি সেই আত্মঘাতী কাজ। তবে কি ওয়ার্ক কালচার বলে আমাদের তেমন কিছু সত্যিই গড়ে ওঠেনি? একটা মানুষ কাজ করছে বললে তার কাজকে সম্মান করতে হয় না বুঝি? কেন, যেহেতু আমি তোমাদের ঘর মুছি না? আমি যদি জয়নগর থেকে এসে তোমাদের কাপড় কেচে ঘর মুছে বাসন মেজে দিতুম, আর আমার কাজের মধ্যে তুমি মিষ্টি করে বলতে, যা মা এক কেজি চিনি এনে দে তো মা দোকান থেকে, আমি খরখরিয়ে বলতুম, পারবুনি, আমার টেইম নি। আমার সেটা মুখ বুজে মেনে নিতে হত। অতএব ওর সময়ের মূল্য আছে সেটা তোমরা বোঝো। কিন্তু তোমাদের মনে মনে আমার সময়ের মূল্য নেই। আমি তো ঘরে বসে লিখি। সেটা আবার একটা কাজ হল? লেখালেখির কাজটাকে তোমরা সম্মান করো না। তাই আমি আজকাল অসাহিত্যিক যে কোনও অনুষ্ঠানে যেতে হলে বলি, আমার সময়ের জন্য মূল্য চাই। অনেকের উৎসাহ তাতেই উবে যাবে, এটা আশা। আর যাদের যাবে না, তাদের সময় দিতে আমার আপত্তি নেই। আশির দশকে লিখেছিলুম, সভাতে গাইয়ে, বাজিয়ে, সঙ্গতকারি, মঞ্চ, আলো, মাইক,শতরঞ্চি, চেয়ার, ফুল, মায় ফুলদানি, সব কিছুরই পয়সা লাগে শুধু সভাপতি আর প্রধান অতিথি ফ্রি। সেই ট্রাডিশন আজও চলেছে।

বাড়িতে থাকা মানেই যেন দুই অঞ্জলিতে অনন্ত অবসর নিয়ে অসীমের পথ চেয়ে বসে থাকা। যিনি ফোন করেছেন, বা যিনি ফোন না করেই সোজা চলে এসেছেন, তাঁরা ধরে নিয়েছেন, এই অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি হাতের সব অকাজ ফেলে তাঁদের দিকে নজর দেবে। আমার দিক থেকে লৌকিকতায় পাশনম্বর সেটাই। কিন্তু তাঁদের দিক থেকেও তো কিছু ভাবনা, কিছু সহানুভূতি আশা করা যেতে পারে? লেখার মাঝখানে উঠে গেলে, কলমের সহজ গতিতে বাধা পড়ে, সুর কেটে যায়, লেখাটির ছন্দপতন হয়। ভাবনার খেই হারিয়ে যায়, তা সে কবিতাই হোক, প্রবন্ধই হোক, অথবা গল্প। সবিনয়ে সামাজিকতা সেরে ফিরে এসে নিজের মধ্যে সেই একমুখী স্রোতের টানটা আর অনুভব করতে পারি না। এমনিতেই আমি ভীষণ পিটপিটে, একটা লেখা একশোবার বদল করি, তাই এরকম বিঘ্ন হলে আমার পরিশ্রম বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। কখনও ডেডলাইনের তাড়ায় আর লেখার উন্নতিসাধনের সময় থাকে না, অনুপায় অবস্থায় অমনোমত রচনাই ছাপতে চলে যায়। আর সারাদিন আমার মনখারাপ হয়ে থাকে।

এই ভাবে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যেতে যেতে, সময়াভাবে আমি যখন খারাপ লিখব, তখন তো যাঁরা এখন ভালবেসে অসময়ে আসছেন, অসময়ে ফোন করছেন সভা সমিতিতে ডাকার জন্যে, তাঁরাই ফ্লোর ক্রসিং করে উল্টো কথা বলবেন, ওঃ নবনীতা আজকাল কী খারাপ লিখছে, ওর আর লেখালিখিতে মন নেই। কেবল মিটিং আর মিটিং টিভি খুললেই নবনীতা।

আবার তারাই কিন্তু প্রতিদিন আদর করে দূত পাঠান, এস ভাই আমাদের সভার নৈবেদ্যের . মাথায় বাতাসা হবে এস। কী করি, সুনীলকে পেলাম না, মহাশ্বেতাদি বকুনি দিলেন এদিকে হল ভাড়া হয়ে গিয়েছে, তারিখ বদল হবে না, তুমিই এস, সভার ওজন সত্তর কেজি অন্তত বাড়ুক!

আপনাদের গোপনে বলি, আমার কিন্তু আরও একটা স্পেশাল কাজ জুটেছে। ইদানীং দেখছি আমি একটি ফ্রি ইনফর্মেশন সার্ভিস চালাই।………. মহাশ্বেতা দেবীর ঠিকানাটা যেন কী? জয় গোস্বামীর ফোন নম্বর পাচ্ছি না, আপনি যদি…। আচ্ছা, দিদি, এটা যদিও আপনাকে বলা উচিত নয়, তবু বলি, শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত গেছোদাদার সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানাটা এই মুহূর্তে ঠিক কী? পৃথিবীর কোন প্রান্তে? আচ্ছা প্রফেসর সেন মশাই আগামী অমুক মাসে কি কলকাতাতে আসছেন? একটু তারিখগুলো বলতে পারেন? …..গায়ত্রী স্পিভাকের আমেরিকার ফোন নম্বর ও ই-মেল অ্যাড্রেসটা অনুগ্রহ করে একটু যদি ….আচ্ছা বাংলা আকাডেমিটা ঠিক কোথায়….যাদবপুরে ভর্তি হবার তারিখ কবে শেষ হচ্ছে বলতে পারেন? …পাগল হতে হতে আজকাল আমি অসহযোগ আন্দোলনে ব্রতী হয়েছি। বিনা ঘুষে নাহি দিব সূচাগ্র সংবাদ।

আপনারা আমাকে ভালবেসে আমার সঙ্গে এমন করলে আমি কাজে মন বসাব কী করে? মাঝে মাঝেই আমার ভিতরের মেয়েটা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে ওঠে, বা রে, সৌজন্য শুধু কেন আমারই একার দায় হবে? এদের কারোর বুঝি আমি বেচারার প্রতি একটুও হৃদয়ের দায় নেই?

তবে হ্যাঁ এই টেলিফোন-এর কল্যাণে আমি এমন অসাধারণ কয়েকজন পাঠক পাঠিকার সঙ্গে যোগাযোগের সৌভাগ্য পেয়েছি যার জন্য আমি ঈশ্বরের কাছে চিরনম্র। এমন অমূল্য সব ফোন আসে মাঝে মাঝে, যাতে মনে হয়, যাক, আমার কলম ধরা সত্যি সার্থক। ভাগ্যিস ফোন ছিল, তাই তো অমন সব স্নেহ ভালবাসার ঐশ্বর্য সঞ্চয় সম্ভব হল আমার? আমার কাছে তাঁদের কিছুই চাইবার নেই, তাঁরা আমাকে দু-হাত ভরে দিতেই ফোন করেন। আমার লেখার কাছে হয়তো কবে তুচ্ছ কিছু পেয়েছেন, সেই খুশিটাই কষ্ট করে আমাকে জানান। আমি ধন্য হয়ে যাই। এই তো লেখকের জীবনে সব চেয়ে বড় পুরস্কার। অচেনা পাঠকের আ-মাপা ভালবাসাই আমার পাওয়া শেষ্ঠ সম্মান।

কেপটাউনের বন্দরে জাহজের ভোঁ বাজলে এই শান্ত, বিজন জলের ধারের ঘরে বসে আমার হঠাৎ কলকাতার সেই ফোনগুলোর জন্যে মন কেমন করে ওঠে।

‘মারিনা’তেও আমার ঘরে বসে আমি একটি জাহাজের মাস্তুল দেখতে পাই, আর তার ভোঁ শুনি মাঝে মধ্যে। তাই থেকে একটা কবিতা জন্মেছে।…..

অর্ণবপোত

ওই শোনো, ভোঁ দিল জাহাজ!
যে জাহাজ ডকে বসে আছে
সে জাহাজও ভেঁপুটা বাজায়

তুমি ভাসো, কিংবা না ভাসো
নীল মেঘে পাতাকা উড়িয়ে
অন্তত বাঁশিটা বাজাও—
সমুদ্র যে ভুলে যাবে,
তোমাদেরও দেখা হয়েছিল?

সঙ্গমে • উত্তমাশা অন্তরীপ

দুদিনের আলাপেই কেপটাউনের ভারতীয় কনসাল জেনারেল রুচিরা কাম্বোজের বুদ্ধিমান, মধুর স্বভাবের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হয়ে যায়। সরকারি ক্ষমতার পদাধিকার তাকে সহজ বিনয়ের আত্মস্থতা থেকে এতটুকুও বিচ্যুত করতে পারেনি। অপরকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে তার জুড়ি নেই। অন্যের বিষয়ে ভাবনা, সংবেদনশীলতা রুচিরার স্বভাবগত গুণ। সেই ধারণা প্রমাণিত হল যখন না চাইতেই আমাদের উত্তমাশা অন্তরীপ দেখাতে চেয়ে সে নিজের রথ ও সারথি পাঠিয়ে দিল একদিন সারাদিনের জন্যে। আর মরিয়মকে নিজেই অনুরোধ করল আমার সঙ্গী হতে, যেহেতু অফিসের কাজ ফেলে রুচিরা আমার সঙ্গে যেতে পারছে না। নন্দনা আজও ব্যস্ত, বেচারীর আর সময় নেই। সুখের কথা, এর আগের বারে কেপটাউনে শুটিং করতে এসে নন্দনা উত্তমাশা অন্তরীপ ইত্যাদি অঞ্চল ঘুরে এসেছে, তাই তার ফাঁকি পড়ার দুঃখু নেই। আমারই একটু দুঃখু, মেয়েটাকে সঙ্গে পেলুম না। কিন্তু নন্দনার বদলে মরিয়মকে সঙ্গী পেয়ে আমার কম আনন্দ হল না, এই কদিনে মরিয়মের সঙ্গে আমার খুব ভাব জমে গিয়েছে। কেপটাউনে কয়েক বারই তার সঙ্গে বেরিয়েছি। বড় চমৎকার মেয়েটি। সহজ, আর সহৃদয়। সে অবশ্য গিয়েছে বহুবার। তবু আবার যেতেও তার আপত্তি নেই। “কেপ পয়েন্ট দেখতেই তো কেপটাউনে আসা, জগতে আর কোথাও এরকম দ্বিতীয় জায়গা নেই, আফ্রিকার সর্বশেষ প্রান্ত।’ মরিয়ম বলে।

রুচিরার আরামপ্রদ গাড়ি, আর পুরনো ড্রাইভার শামীমকে নিয়ে সেদিন সকালে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লুম সারাদিনের জন্যে উত্তমাশা অন্তরীপ দেখে আসতে। আকাশিয়া পার্কে এম পি-দের বাংলো থেকে মরিয়মকে তুলতে গেছি, মেওয়া স্বয়ং এসে শামীমকে সযত্নে নির্দেশ দিলেন ভারত মহাসাগরের কূল ধরে যেতে, আগে পেঙ্গুইন ও সীল মাছেদের দেখে, বিভিন্ন বনানী উদ্ভিদ উদ্যান দেখতে দেখতে কেপ পয়েন্ট গিয়ে, সন্ধ্যায় পাহাড়ি উপত্যকার পথে এসে নোএর্ডহোক থেকে অতলান্তিকের কূল ধরে ছবির মতো সৈকতের শহরগুলি দেখতে দেখতে ফিরতি পথে সূর্যাস্ত হবে অসাধারণ।

শামীম ডারবানের ছেলে তার পরিবারেরও দুজায়গায় দুটি মুদিখানার দোকান আছে, এবং রঙের ব্যবসা, যদিও পূর্বপুরুষেরা ভারত থেকে এসেছিলেন মজুরের কাজে। অনেকদিন ভারতীয় কনসালটের জন্যে কাজ করছে, আমি কলকাতার লোক শুনে জিজ্ঞেস করি, “ এখন তো শ্রী গোপাল গান্ধি ওখানে গর্ভনর

“আরে তুমি কী করে জানলে!”

“আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল উনি যখন এখানে পোস্টেড ছিলেন, বড় চমৎকার মানুষ, আমি তাই ওঁর খোঁজখবর রাখি।’

—শামীমের হাসিমুখ বিয়ারভিউ মিররে দেখা যায়। আমার এত ভাল লাগল, একদা এদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত, শ্রী গোপাল গান্ধির পক্ষে এটি মস্ত বড় কমপ্লিমেন্ট।

শামীম আমাদের যাত্রাসঙ্গী হল ভালই, গল্প করতে করতে পথ চলা গেল তিন জনে। আমরা ধরলুম ব্লু রুট, এম-৪ নিয়ে মুজিয়েনবর্গ দিয়ে ফিশহোয়েক দিয়ে, সমুদ্রতীর ধরে চললুম। পেঙ্গুইনদের কলোনিতে পৌঁছে ঢুকতে গিয়ে আমার আর ঢোকা হল না। অনেকটা হাঁটা আছে, অনেকখানি নিচে জলের কাছে নেমে, তারপরে আবার ওপরে ওঠা আছে, এসবের কোনওটাই আমার যাচ্ছেতাই পদযুগলের সাধ্য নয়। অতএব গিয়েও না গিয়ে ফিরতে হল। কিন্তু না দেখে নয়। একটুখানি এসেছি, শামীম গাড়ির গতি শামুকের মতো করে ফেলল আর বলল, “ঐ যে, ঐ যে, জলের মধ্যে ঐ পাহাড়টাকে দেখুন!”

সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখি ছোট্ট একটা পাথুরে দ্বীপের ওপরে একশো পেঙ্গুইন পাখি। কেউ জল থেকে উঠে আসছে কেউ জলে নামছে। হাঁটাচলা করছে কেউ কেউ। বাকিরা বসে আছে, যেন সভা করছে! একসঙ্গে অত!

“ঐ তো পেঙ্গুইনদের কলোনির পাহাড়।” মরিয়মও বলে, তোমার আর দুঃখু নেই, নামতে হল না।”

সীলদের কলোনিটার বেলাতে আমার অত ভাগ্য ছিল না, দু-চারজন সীলমাছ জলের ধারে বিশ্রামরত ও জলে সন্তরণরত দেখা গেল রাস্তা থেকে। এই ফলস বে’র জলস্রোত আসছে ভারতমহাসাগর থেকে, তাই উষ্ণতর, তাই জলের প্রাণীরা এখানে বসবাস পছন্দ করে, অতলান্তিকের পানি সুশীতল। সেদিকে এরা সাধারণত ঘর বাঁধে না। এসব সংবাদ আমাকে সরবরাহ করছে শামীম। অতিথিদের এসব অঞ্চলে আনতে আনতে সে আপনি গাইড হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে বহু উদ্ভিদের শোভা, ফুলের শোভা, ফাইন বোস, ফাইন বুশ চারিদিকে, সংরক্ষিত উদ্ভিদ, সংরক্ষিত বনফুল, গাছ-গাছালি। মূলত ফলস্ বে ধরে সাইমন্স টাউনের নৌ ঘাঁটির দিক দিয়ে ভারত মহাসাগরের পাশ দিয়ে এলেও কেপ পয়েন্ট পৌঁছোনোর মুখে কিছুক্ষণ পাহাড়ের ওপাশ থেকে অতলান্তিকের জলও দেখা গিয়েছিল, কোথাও সুন্দর গ্রামের রেখা টানা, আবার কখনও রুক্ষ পাহাড়ের গা দিয়ে পথ, সেখানে বসতি চোখে পড়ে না। পথে কিছু বনজঙ্গল আছে যেখানে নানা জাতের হরিণ, আর প্রচুর বেবুন, এবং অজস্র ধরনের পাখির বাস। মরিয়ম শাসিয়ে রেখেছিল, মরিয়মকে এক বিশাল রেবুন একবার শিভ্যালরি করে গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে গাড়ির দরজা খুলে ধরেছিল! আমরা বনের মধ্যে দু-একটি সঞ্চরমাণ হরিণ, ও পথের ধারে এক সংসারী বেবুন দম্পতি দেখলুম, একজনের কোলে আরেকজন শুয়ে আছে, শান্তিতে উকুন বাছা চলছে। আফ্রিকার বেবুনের সঙ্গে ভারতের হনুমানের আচরণ ফারাক চোখে পড়ল না। কেপ পয়েন্টে প্রবেশ পথ একটি এবড়ো খেবড়ো মেঠো জমির মধ্য দিয়ে, নানা সুরক্ষার ফটক পেরিয়ে। সেটি দক্ষিণ আফ্রিকার আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অতি সংরক্ষিত উদ্ভিদের বাগিচা, টেবল মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্ক (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট) কেপ পয়েন্টে যার অংশ। মরিয়ম ‘বলল—মোট ১,১০০ রকমের দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ আছে এই বন্য বাগানে। তার পরেই এসে পড়ল সেই অত্যাশ্চর্য অন্তরীপ, যেখানে আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিমতম প্রান্তে, প্রকৃতির দুই মহান শক্তি, ভারত মহাসাগর আর অতলান্তিকের নিঃসকোচ কোলাকুলি হচ্ছে। সমুদ্রে যেটা এত সহজে সম্ভব, পৃথিবীতে সেটা কেন যে এত কঠিন?

শামীম আমাদের যেখানে নামিয়ে দিল, সেইখানে সমুদ্রের ধারে চমৎকার একটি খানাপিনার ঠাঁই আছে, টু ওশন্স রেস্তোরাঁ, আমাদের খিদে পেয়েছিল, কিন্তু যে কোনও সময়ে বৃষ্টি নেমে যায় এই খামখেয়ালি আকাশের দেশে, তাহলে কেপ পয়েন্টে মুশকিল হবে, সব খোলা তো, কোনও ছাদ পাব না, দুই সমুদ্রের মিলন দেখাও সহজ থাকবে না বিষ্টিজলের পর্দা ভেদ করে। তাই ঠিক হল আগে তো দেখে আসি, তর পরে জমিয়ে খেতে বসবো এখানে এসে। সমুদ্রের ধারে জায়গাটিও ভারি আকর্ষণীয় ফলস বে’র দিকে টেবল মাউন্টেনের দৃশ্য সামনে।

একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ি টিকিটঘরে ফুনিকুলার ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্চে। কিউ দিয়ে টিকিট কিনে পর্যটকেরা কেপ পয়েন্টে যাচ্ছেন। ট্রেকাররা হেঁটেই মেরে দেন, তবে সে আর কজন? ফুনিকুলার ট্রেন ট্রামের মতো ইলেকট্রিকের টিকি দিয়ে বাঁধা থাকে, আর পায়ের কাছেও তার শিকল, দাঁত, সব আছে চাকার সঙ্গের দাঁতগুলো রেল লাইনের দাঁতগুলোকে কামড়ে কামড়ে অতি সাবধানে পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে ওঠে, মা ধরিত্রীর আকর্ষণের চোটে ক্ষুদে রেলগাড়িটির পতন ও মুর্ছা আটকানোর জন্য এই দাঁতে দাঁতে কিড়ি মিড়ি ব্যবস্থা। আর তার আদরের নাম,দ্য ফ্লায়িং ডাচম্যান! সে কিংবদন্তীও এই উত্তমাশা অন্তরীপে জাহাজডুবি হওয়া এক জেদী ওলন্দাজ নাবিকের শপথ নিয়ে তৈরি। সে বলেছিল আমি অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করবই,তাতে যদি মৃত্যুর পরে নরকে যেতে হয় তবুও। তারই ছায়াশরীর নাকি আজও এখানকার আকাশে উড়ে বেড়ায়। আমাদের আকাশচুম্বী বাহনটির তাই নাম!

টিং টিরিরিং করে ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে মিনি ট্রামের মতো এক কামরারা ফ্লায়িং ডাচম্যান এলেন। আমরা উঠে বসি। আমার মনে পড়ে গেল আমি প্রথমবাব ফুনিকুলার ট্রেনে চড়েছিলুম বালিকাবয়সে, মা বাবার সঙ্গে ইণ্টারলোকেন থেকে আল্পসের ইয়ুংফ্রাও শিখরে উঠতে। সেটা ছিল ১৯৫০। এই দ্বিতীয়বার। সেবারে ছিলুম সুইজারল্যাণ্ডে, ইয়োরোপে। এবারে আফ্রিকা মহাদেশে। তখন আল্পসের শিখরে চড়ে দেখেছিলুম অবিশ্বাস্য সীমাহীন শুভ্র তুষারের রাজ্য, এবারের কেপ পয়েণ্টে পৌঁছে দেখব বুক কাঁপানো দুই সিন্ধুর সমারোহ।

ওপরে উঠে প্রথমেই যা বুক ভরিয়ে দেয়, মন মজিয়ে দেয়, এবং শ্রীকৃষ্ণের মতো বস্ত্রহরণও করে, তা হলে সিধে দক্ষিণ মেরু থেকে বয়ে আসা তরতাজা, নিষ্কলুষ, বাধাহীন দাপুটে বাতাস। কাপড় চোপড় সামলে সামনে তাকিয়ে চোখ আর ফেরে না। রুক্ষ কর্কশ খোঁচা খোঁচা পাথুরে সৈকত, পাহাড়ের অনেকটা ওপরে আছি আমরা, অনেক নিচে ঘন নীল সমুদ্র গজাচ্ছে, পাথরের ওপরে পাথরের ওপরে আছড়াচ্ছে, সাদা ফেনা ছিটকে উঠেছে ফোয়ারা হয়ে, বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। কেপ পয়েন্ট ২৪৯ফিট উঁচু, জগতের সব চেয়ে খাড়া ফ্রিজ গুলির একটি। আমার কিন্তু নিচের দিকে তাকিয়ে আর একটি ক্লিফের কথা মনে পড়েছিল। কে কত ফুট জানিনা, কিন্তু বালিদ্বীপের হনুমান মন্দিরের পাহাড়ের খাড়াই ধারটা থেকে নিচের দিকে তাকালে, চোখে পড়বে ভারত মহাসাগরের অবিকল এমনি ক্রুদ্ধ তরঙ্গাঘাত!

কেপ পয়েন্টের প্রথম নাম ছিল কেপ অফ টর্মেণ্ট, ঝঞ্ঝার/ যন্ত্রণার অন্তরীপ। এই নামকরণ যে পর্তুগিজ নাবিকের করা (কাবো তোর্মেনতোসো), তিনিই বার্থলোমিউ দিয়াজ, ১৮৮৮ তে আফ্রিকার এই দক্ষিণ পশ্চিম বিন্দুর অন্তরীপটি সর্বপ্রথম সাফল্যের সঙ্গে প্রদক্ষিণ করেন। অসংখ্য জাহাজডুবি হয়েছে এখানে, ঝোড়োবাতাস আছে, দিক নির্দেশ ভুল হয়ে যায়, জলের নিচে সর্বনেশে ডুবো পাহাড় আছে, অ্যালবাট্রস রক তার মধ্যে অন্যতম কুখ্যাত খুনি পাহাড় ২৬টি ডুবে যাওয়া জাহাজের ভগ্নস্তুপ পাওয়া গিয়েছে এখনও পর্যন্ত। ভাস্কো ডা গামাও এই বিপদসঙ্কুল অন্তরীপ সাফল্যের সঙ্গে প্রদক্ষিণ করেছিলেন ভারতবর্ষে যাবার পথে। তার পর থেকেই এই জলপথটি পর্তুগিজ নাবিকদের নৌ-মানচিত্র পরিচিত হয়ে ওঠে। চতুর্দিকে মৃতদের স্মরণে পাথরের ক্রস চিহ্ন, চারিদিকে ডুবে যাওয়া জাহাজের কংকালেরা পড়ে আছে, যারা অনেক স্বপ্ন নিয়ে রওনা হয়েছিলেন ইউরোপ থেকে, কিন্তু আফ্রিকার কূল থেকে আর ফিরতে পারেনি। যে পর্তুগিজ নাবিকেরা সফল অভিযানে আফ্রিকার এই দক্ষিণ পশ্চিম তীরে পৌঁছেছিলেন, তাদের সম্মানের স্মৃতিতে ‘দিয়াজ ক্রস’ আর ‘ভাস্কো ডা গামা ক্রস’ এর পাথরের রেপ্লিকা রয়েছে কেপ পয়েন্টের পাহাড়ের গায়ে। ভাস্কো ডা গামাকে নিয়ে পর্তুগিজ কবি ক্যামোএনসের লুসিডাস কাব্যে এই অভিশপ্ত অন্তরীপের যক্ষ অ্যামাস্টারের কাহিনি পাওয়া যায়। ভাস্কো ডা গামার জাহাজ যখন এখানে এলো তখন এক বিশাল কালো মেঘ এসে আকাশ ঢেকে ফেললো। তারপরে সেই কৃষ্ণ মেঘ ক্রমে দানবীয় মানুষের রূপ ধরে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, ‘এই উপকূলে যে আসবে তারই সর্বনাশ হবে।’ সকল নাবিকদের প্রতি উদ্দিষ্ট এই অভিসম্পাত। অ্যাডমাস্টর এই অঞ্চলের জলবায়ু যক্ষ হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করেছিল, কোনও নাবিককে এই অন্তরীপ পেরিয়ে মহাসাগরে যেতে দিতে সে চাইতো না, ভয়াবহ বাধা সৃষ্টি করত। এই অঞ্চলের আবহাওয়ার মারাত্মক চরিত্র থেকেই তার সৃষ্টি। পরে তাকে নিয়ে এই কেপ অঞ্চলে অনেকেই সাহিত্য রচনা করেছেন। অ্যাডমাস্টর আসলে একটি অভিসম্পাতের নাম। যে অভিসম্পাত অগুনতি নাবিকের প্রাণ নিয়েছে।

কেপ পয়েন্ট পার হয়ে সুস্থ শরীরে ভারত মহাসাগরে ভেসে যাবার লক্ষ্যে পর্তুগিজ নাবিকদের সাফল্যের পরে কেপ অফ টরমেন্টস নাম বদল করে কেপ অফ গুড হোপ এই শুভ নামটি রেখেছিলেন পর্তুগালের রাজা জর্জ। উত্তমাশা অন্তরীপ নামটা ছোটবেলা থেকে আমার খুব আকর্ষণীয় লাগত।

আমার এক দাদা পড়া শেষ করে বিলেত থেকে ফিরছিলেন, তখন সুয়েজ খাল বন্ধ হয়ে গেল। অগত্যা মুকুলদাদার জাহাজ উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে অনেক দিন দেরি করে ফিরলো ভারতে, ভাস্কো ডা গামার নির্দিষ্ট পথে। তখন মুকুলদাদার ভাগ্যকে মনে মনে হিংসে হয়েছিল। আনি নিজেও যে কোনওদিন সেখানে আসতে পারব, এই দুই সমদ্রের মিলনবিন্দু স্বচক্ষে দেখতে পাব কল্পনা করিনি।

পাথুরে কাঁকুরে মাটির সরু পথে হাঁটা রাস্তার পথে নানা রকমের ঝোপ ঝাড়, রঙিন ফুল, লতাপাতা কিছুই স্পর্শ করার কথা নয়। ভ্রমণকারীর অতিরিক্ত ভিড় নেই, কিন্তু অনেকে এসেছেন। লাইট হাউসে আমি উঠতে পারলুম না, খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে চড়তে হয়। মরিয়ম বলল, সে বহুবার উঠেছে। দুজনে নিচের অংশটি প্রদক্ষিণ করলুম যতদূর রাস্তা আছে, যতদূর যাওয়া যায়। মাঝ সমুদ্রে একটি পাথর দেখিয়ে মরিয়ম, স্বপ্নে, ‘ঐ দ্যাখো দু দিক থেকে দুই সমুদ্র এসে ঐ পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে। আমি দেখলুম নীল জলের বুকে একটি বিন্দুতে খুব সাদা ফেনার ফোয়ারা উঠছে বটে। সত্যি মিথ্যে, ঠিক ভুল, যাই হোক, সেই মুহূর্তে আমার ভাবতে ভাল লাগল ঐ পাথরের ওপরে একদিক থেকে ভারত মহাসগার আর অন্যদিক থেকে অতলান্তিক এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

আমি দেখলুম নীল জলের বুকে একটি বিন্দুতে খুব সাদা ফেনার ফোয়ারা ইচ্ছে উঠছে বটে। সত্যি মিথ্যে, ঠিক ভুল, যাই হোক, সেই মুহূর্তে আমার ভাবতে ভাল লাগল ঐ পাথরের ওপরে একদিক থেকে ভারত মহাসাগর আর অন্যদিকে থেকে অতলান্তিক এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

ঠাণ্ডা হওয়ায় সমুদ্রের ধারে পাথরের উপরে বসে গল্প করলুম দুজনে। নামতে ইচ্ছে করছে না তবু নামতে হয়। লাঞ্চের জন্য পাকস্থলী ব্যাকুল। এখানকার কাহিনি মরিয়ম অনেক কিছু জেনে গিয়েছে। তার মুখে লালু দিয়ো কোয়াসের গল্প শুনলুম এখান থেকে নেমে গিয়ে, ফলস বে’র তীরে টু ওশন্স রেস্তোরাঁতে সমুদ্রে টাটকা মাছ ভাজা লাঞ্চ খেতে খেতে।

“এখানে একজন মুসলিম পীরের বাস ছিল, জানো? সমুদ্রতীরে পাহাড়ের গায়ে আন্তেনজ গ্যাট বলে একটা গুহা আছে, তার যে কিংবদন্তী, একজন ইন্দোনেশীয় সুলতান রাজবন্দি তার নায়ক। ইন্দোনেশিয়াতে সুমবাওয়া দ্বীপে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৭৫২তে কিছু মানুষ বিদ্রোহ করেছিল, বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছিল। ইনি আর এর ছেলে ধরা পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকাতে নির্বাসিত হন। লালু আবদুল কাদরে জিলানী দিয়ে কোয়াস, ওর নাম। এখানে এনে সাইমন্স বে- তো ওল্ড কোর্ট হাউসে ক্রীতদাসদের শাস্তির জন্যে তৈরি ঠাণ্ডা অন্ধকার কারাগারে ওকে আর ওর ছেলে ইসমাইলকে বন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু তিন বছর ধরে সিঁদ কেটে পাঁচিলে গর্ত খুঁড়ে ওরা পালিয়ে আসেন। বনে বনে ঘুরে বেড়ান। ঐ আন্তোনিজ গ্যাটে গোপনে গুহার মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। একবার এক চাষীর ভেড়া হারিয়ে গিয়েছিল, সে ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে। উনি করুণা করে মনে মনে গুনে বলে দেন কোন্ বনে, কোন্ ঝরনার ধারে, কোন ঝোপের মধ্যে ভেড়াগুলো ঠিকঠাক আছে। সত্যিই ভেড়া সেইখানে পাওয়া গেল, উনিও সেই থেকে এখানকার চাষীদের গুরুদেল হয়ে গেলেন। চাষীরা ওঁর কাছে আধ্যাত্মিক কথা শুনতে আসত, ওঁর কাছ থেকে নানা বিষয়ে উপদেশ নিত। ইসলামি ধর্মনীতি আর রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ এই দুটি জিনিস এখানকার চাষাভুষোদের মধ্যে উনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। এখনও মুসলমান ভ্রমণকারীরা এসে অনেক সময়ে এখানে প্রার্থনা করেন, আমি অবশ্য করি না! ‘

মরিয়ম রামগোবিন তার ভুবনমোহিনী হাসিটি হাসে।

লাইট হউসে উঠতে না পেরে নিজের আর মরিয়মের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করছিলুম। ওখানটা আরো উঁচুতে, আনেরা অনেক দূর অবধি দেখা যায়। হঠাৎ মরিয়ম বললে, আমার অর লাইট হাউসে যেতে ইচ্ছে করে না। খুব বিশ্রী একটা জিনিস দেখেছিলাম ওখানে একবার।

‘কী। কী দেখেছিলে?

‘সে বড় বিশ্রী।’

‘সুইসাইড নয় তো? বাপ রে!’

‘প্রায় সেইরকমই। একটি নব বিবাহিত দম্পতি এসেছিল বেড়াতে। কেপ পয়েন্ট কিন্তু নববিবাহিতদের কাছে অতি জনপ্রিয়। এখানকার সিন্ধু মিলনের ব্যাপারটা বোধ হয় ওদের টানে। সেই দম্পতির দিব্যি প্রেম প্রণয় চলছিল, হঠাৎ যে কী হল, প্রবল কলহ শুরু হয়ে গেল দুজনের। ঐ উঁচু পাথরের ওপরে তখন দুজনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। আমার তো দেখে ভয়ই করছিল মেয়েটি এক সময়ে আঙুল থেকে বিয়ের আংটিটা খুলে ছুঁড়ে সমুদ্রে ফেলে দিল।’

মরিয়ম স্তব্ধ হয়ে যায়। আমিও ফিরতি পথে এলুম এম ৬ রুটে, পার্বত্য মালভূমির উপর দিয়ে চমৎকার দৃশ্যপথ। স্কারবরো, কুয়াশা শিখরে (মিস্টি ক্লিফস) ওপর দিয়ে বাড়ি চলে এলুম অতলান্তিকের পরিচিত সৈকত ধরে, নোস হোয়েক, হাউট বে, চ্যাপম্যানস পীকের পথে। এবং ঠিক যেমনটি বলেছিলেন, অসামান্য এক সূর্য-অস্ত দেখলুম, সমুদ্রে এবং পর্বতে টকটকে লাল রঙের ছিড়িয়ে দিবাকর বিদায় নিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার আকাশ মাটি জলে খুনখারাপি ঘটিয়ে। অবকিল এমনি একটা পোস্ট কার্ড দোকানে দেখে ভেবেছিলুম ব্যবসার খাতিরে বাড়াবাড়ি, এখন বুঝলুম সত্যিই বড় বিপজ্জনক এখানকার আকাশ। দেখলে ভয় করে, প্রকৃতির এই দুর্ধর্ষ রং খেলায় সৌন্দর্যের চেয়েও যেন হিংস্রতার ভাব রয়েছে বেশি। কারণেই সেই অ্যাডমাস্টরের অভিসম্পাতটা মনে পড়ে গেল।

মুজিয়েমবার্গ গ্রামের নতুন বন্ধু • পেনি আর রবার্ট

নন্দনার সেদিন শুটিং ছিল না, পিপা আর ম্যালকমের সঙ্গে এক বৃষ্টিভেজা সকালে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো হল লক্ষ্যহীন আনন্দে, অন্তরীপের দুই তীরেই, কিছুক্ষণ ভারত মহাসাগরের তীরে আর কিছুক্ষণ অতলান্তিকের তীরে। এটাই তো কেপটাউনের মজা। কেপ অফ গুড হোপ, প্রচণ্ড ঝড় ঝঞ্ঝার পরে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসে নাবিকরা যেখানে শান্ত আবহাওয়ায় আশার আলো দেখতেন, সেই উত্তমাশা অন্তরীপ, দুইমহাসাগরের মিলনস্থলে। কেপটাউন অতলান্তিকের তীরে, শহর ছেড়ে একটু দূরে বেরুলেই ভারত মহাসাগরের দেখা পাওয়া যায়। আমরা দেখতে গেলুম ভারত মহাসমুদ্রের ধারে ধারে সীল মাছের বাসা, পেঙ্গুইনের উপনিবেশ, মাছ ধরার গ্রাম। এরা উষ্ণ জলের স্রোতে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। অতলান্তিকের জল শীতল আর ভারত মহাসাগরের ঢেউ উষ্ণ। অন্তরীপের দুই তীর ঘেঁষে বহমান দুই মহাসাগরের স্রোত। ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। অবশ্য আমি যে দেশের মানুষ সেখানে এক অসামান্য অন্তরীপের মিলনবিন্দুতে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে বঙ্গোপসাগর আর আরবসাগরের ঢেউ জড়িয়ে যায়। সূর্য উদয় আর সূর্য অস্ত সকালে আর সন্ধ্যাবেলায় একই জায়গা থেকে দেখা যায়। কন্যাকুমারিকাতে যেটি ঘটে, কেপ পয়েন্টে সেটি হবে না।

মাছ ধরার গ্রামে গিয়ে টাটকা মাছ ভাজা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল চারজনেরই, কিন্তু বৃষ্টির জন্যে নামা গেল না। পিপা বলছিলেন, এই ফিশহোয়েক গ্রামে নাকি শুধু বুড়ো মানুষদের বাস, এরা খুব ধর্মভীরু, রক্ষণশীল, প্রাচীনপন্থী। নির্বাচকের সময় টের পাওয়া যায় এদের গোঁড়ামি। অল্পবয়সীরা অন্যত্র চলে গিয়েছে। রেস্তোরাঁতে মদ বিক্রি হয় না এখানে। বার নেই। এই গ্রামে নাকি মদের দোকানই নেই। শীধু পানের ইচ্ছে হলে পাশের গ্রামে যাও। সেখানে স্বাভাবিক জীবন, সমকালের বাতাস। শুনতে শুনতে আমার চোখে পড়ল ওয়াইন লেখা একটি ছোট সাইনবোর্ড। পিপা দেখে অবাক হয়ে বলেন, ‘যাক! তা হলে হাওয়া বদল হচ্ছে! অল্পবয়সীরা ফিরছে গ্রামে।’

কালকে বে’তে মাতিস নামের এক সাগরতীরের রেস্তোরাঁতে আমরা ব্রাঞ্চ খাওয়ালুম। ওদের। আর অনেক গল্প হল সেদিন।

আমাদের ঘোরাফেরার পথে পড়েছিল নর্ডহোয়েকে প্রিন্সেস ডায়ানার দাদা আর্ল স্পেন্সরের এস্টেট, বিলাসবহুল খামারবাড়ি ও মহার্ঘ ঘোড়াদিগের আস্তাবল। তারপরেই এসে যায় দীনদরিদ্র টাউনশিপ, খায়েলিৎসা বস্তি, কালোদের গেটো পল্লি। আফ্রিকানরা এখানে অধিকাংশই খোসাভাষী ডারবানে ছিল জুলু ভাষা। ভাঙাচোরা ঘরের ঝোপড়পট্টি, টিন অ্যাসবেস্টস, প্লাস্টিকের ছাদের অবাধ ছন্দপতনের শোভা। আগে তো কালোরাও মুল শহরেই থাকত, ক্রমশ তাদের ভাগিয়ে দেওয়া হয়েছে শহর থেকে দূরে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার ক্রিস্টিন বলেছে ওরা ট্রেনে করে দু-ঘণ্টা ধরে এসে, তারপরে ট্যাক্সি কিংবা বাস ধরে শহরে যে যার কাজের জায়গায় পৌঁছয়। ট্যাক্‌সি মানে মিনিবাস। রোজ ছ’ঘণ্টা যায় যাতায়াতে। অবিকল আমাদের লক্ষ্মীকান্তপুরের মেয়েদের মতো এরা রাত থাকতে বেরোয়, রাত হলে ফেরে। (অথচ আমাকে বন্ধুবান্ধবেরা সব্বাই বারণ করেছে ট্রেনে চড়তে। ট্রেনটা নাকি এড়িয়ে চলে সবাই। কেন, টাইমে চলে না বুঝি? তবে যে সব কাজের মেয়ে, কাজের ছেলেরা ট্রেনে করেই কাজ করতে রোজ শহরে আসে? আটটাতে কাজ শুরু সর্বত্র। ওরা পারে কী করে? আরে, কী মুশকিল ওদেরই তো ভয়!!) কিন্তু এই বস্তির অঞ্চলটি যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বড় উৎকৃষ্ট, টুরিস্টদের হোটেল তৈরির পক্ষে আদর্শ হবে, তা তো আগে ভাবেনি কেউ! এখন, ইখানে তোদের মানাইসেনা রে, ইককেবারে মানাইসেনা রে! শুনলুম ভাবনাচিন্তা হচ্ছে বস্তি আবার সরিয়ে দেওয়ার। এবারে কিন্তু এই ভাবনা ভাবছে স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্রিস্টিনের চব্বিশ বছরের ছেলে জেকব মোগোটসি গ্রাজুয়েশন করে বসে আছে, কোনও কাজ পাচ্ছে না, তার মনমেজাজ খারাপ। ক্রিস্টিনের মনে শান্তি নেই। ওর স্বামী ছেড়ে গিয়েছে যখন, ছেলে তখন শিশু ছিল। বিশ বছরের পরিশ্রমে একলা ছেলেকে মানুষ করেছে সে। জেকব আই টি পড়তে চায়, টাকা জোগাড় করে উঠতে পারছে না ক্রিস্টিন। সে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের অনেকগুলো ঘরের সাফসুতরোর দায়িত্বে।

কত টাকা পাও? ষোলো সতেরোশো র‍্যাণ্ড মাস মাইনে। যাতায়াতের খরচেই অনেকটা বেরিয়ে যায়। আটটার মধ্যে না পৌঁছলে ফাইন। অন্ধকার থাকতে বেরোয়, অন্ধকার হওয়ার পরে ঢোকে বাড়িতে।

এই সৈকতের রাস্তাটি বড় সুন্দর। একবার ঘুরে গিয়েছি টিউনিনের সঙ্গে, সেদিন সূর্যালোক ছিল। আজ সিক্ত উপকূলের আরেক রূপ

কেপটাউন থকে বেরিয়ে একের পর এক ছোট ছোট ধনীদের শহর। গ্রিন পয়েন্ট, সি পয়েন্ট, ক্যাম্পস বে, একটি আইরিশ নামের উপকূল, ডবল এল দিয়ে শুরু কঠিন কেলটিক বানান, এখন ভুলে গিয়েছি নর্ড হোয়েক, আরও কত। চ্যাপম্যানস, পিকে ওঠার পথে এই সব পথ পার হতে হয়। চ্যাপম্যানস পিক পাহাড়ের থেকে সমুদ্রের দৃশ্য আসাধারণ। টিউনিনের সঙ্গে এসে সূর্যাস্ত দেখেছিলুম সেখান থেকে। পথে টেবল মাউণ্টেনের পাশ দিয়ে যাত্রা, টেবল মাউণ্টেনেই শুধু আমি উঠতে পারিনি, আর কিছু বাকি নেই কেপটাউনের দ্রষ্টব্যস্থল। ওই পাহাড়ের অদ্ভুত কিছু শিখর আছে, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে সন্ন্যাসীর মধ্যে পরপর বারোটি শিখরের নাম টুয়েলভ অ্যাপসলস। সবই কিছু ধার্মিক কল্পনা নয় তাই বলে। মস্ত বড় একটি একক শৃঙ্গের নাম লায়নস হেড

টেবল মাউন্টেনের মাথাটা সত্যি সত্যি টেবিলের মতো চ্যাপটা আর যখনই সেখানে সাদা মেঘ ভাসে ঠিক মনে হয় টেবিলের উপর বুঝি টেবিলক্লথ পাতা।

এখানে সূর্যাস্তের সময় অদ্ভুত একটা টকটকে লাল গেরুয়া কমলা মেশানো খুনখারাপি রং এর আকাশ হয়, আর টেবল মাউন্টেনকে সিলুয়েটে প্রথমে বেগুনি তারপরে কালো দেখায়। না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আমি আগে দোকানে পোস্টকার্ড দেখলুম, ফোটোগ্রাফ, লাল আকাশ,লাল সমুদ্দুর,কালো পাহাড়, ঠিক যেন কলকাতার কোনও সস্তা ক্যালেণ্ডারের ছবি। দূর! বিশ্রী। কে কিনবে? তারপরে সূর্যাস্ত দেখলুম। নিজের চোখের ক্যামেরাতে ধরা না পড়লে ভাবতুম ফোটোশপের ক্যারদানি। অবিকল ওই কার্ডটা কে যেন এনলার্জ করে বড় করে আকাশ সাগর পাহাড় সব কিছু জুড়ে ফেলেছে।

এখানকার নৌ ঘাঁটি সাইমন্স টাউন ছাড়িয়ে পিপাদের সঙ্গে সেদিন মুজিয়েমবার্গ গ্রামে গিয়েছিলুম। ফলস বে-তে ভারত মহাসাগরের উষ্ণ স্রোত বইছে। এই শান্ত সৈকতে ইচ্ছে মতো সার্ফিং করা যায়, আর বাচ্চারা খুশিমতো খেলা করতে পারে এর নিরাপদ উষ্ণ কোলে। হিংস্র সামুদ্রিক জীব নেই ওখানে। এদেশে এসে শুনলুম ভারতমহাসাগরের জল উষ্ণ আর অতলান্তিকের ঢেউ শীতল। ডারবানের সমুদ্র নাকি ডারবানের ভারতীয় মানুগুলোর মতোই উষ্ণ। কেপটাউন দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে প্রিয় বেড়ানোর জায়গা, এরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোথাও নেই। দেশের মানুষে শখ করে এখানেই আসে ছুটি কাটাতে।

ম্যালকম -পিপারও তাই এসেছেন জোহানেসবার্গ থেকে! মুজিয়েমবার্গে নিজস্ব কটেজে ছুটি কাটাচ্ছেন পিপার মাসতুতো বোন পেনি ও রবার্ট। তাঁরাও জোহানেসবার্গের বাসিন্দা, পিপার মতোই। ঘুরতে ঘুরতে ওদের বাড়িতে চা খেতে গেলুম আমরা। বড্ড বৃষ্টি, নামতে পারা যাচ্ছে না কোথাও। সেখানে দোরগোড়ায় ছিলেন গাইয়া নাম্নী মোটাসোটা গুরুগম্ভীর মার্জারী, আমরা যেতেই আমাদের ভাল করে শুঁকে সিকিওরিটি চেক করে গেলেন। কিন্তু পরে দেখলুম তিনি টেবিলে উঠে গোলাপ ফুলের গন্ধও শোঁকেন। গরম চায়ের কাপেও তাঁর বিপজ্জনক কৌতূহল আছে। এঁদের পরিবার জোহানেসবর্গের বহু পুরনো বাসিন্দা। এদেশে এদের মতে ইংরেজ ও ওলন্দাজ বাসিন্দারাই ঔপনিবেশিকদের মধ্যে বনেদি আভিজাত্য দাবি করেন। পিপা, পেনি ইংরেজ, ম্যালকম, রবার্ট মধ্য ইউরোপের। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মতো, এখানেও দেখা গেল উচ্চশিক্ষিত ইহুদি সম্প্রদায় সাধারণভাবেই উদার ও বামপন্থী।

এখন অবশ্য আমেরিকাতে হয়ত ব্যাকলাশ হিসেবেই একদল নতুন করে ধর্মান্ধ অতিরিক্ত রক্ষণশীল ইহুদির উদয় হয়েছে, যারা বুড়ো বয়সে হিব্রু শেখেন, ইস্রায়েলে বাড়ি করে সেখানেই রিটায়ার করেন। ১৯৯৫তে জেরুসালেমে উলপানে হিব্রু পড়তে গিয়ে আমার একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একদিন স্থির হয়েছে বাগানে গাছের তলায় আমরা কয়েকজন বসব, লেমোনেড আর স্ন্যাকস খাওয়া হবে। আমি কবিতা পড়ব। আমার পাশের ঘরে থাকতেন সুইজারল্যাণ্ডের এক উৎসাহী ইহুদি ছাত্রী, তাঁর বয়েস বাহাত্তর। আমি তখনও ছটফটে করিৎকর্মা, তাঁকে ছোটোখাটো নানা ব্যাপারে সাহায্য করতুম, একসঙ্গে খেতে যেতুম, একসঙ্গে ক্লাসে যেতুম। তিনি হাসিমুখে এক প্যাকেট কাজুবাদাম নিয়ে গাছের তলায় এসে,হঠাৎ সেখানে জর্ডনের আর ইয়েমেনের মুসলমান ছাত্র দুটিকে দেখেই অ্যাবাউট টার্ন করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন ‘হয় ওরা থাকবে নয় আমি।’ এই অবিশ্বাস্য উচ্চারণে ছেলে দুটি উঠে পড়ে অপ্রস্তুত মুখে হস্টেলের দিকে চলে যায়। সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিন্তু একটু সামলে নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা কয়েকজন ছুটে উঠে গিয়ে ওদের বুঝিয়ে হোস্টেল থেকে ধরে নিয়ে এল। আমিও ওদের সঙ্গে যাই। এবারে মহিলা কঠিন মুখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ওকে, ওরা থাকুক, আমি তাহলে যাচ্ছি।’ আমি বলি ‘সরি, কলেৎ আমি তোমার ঘরে গিয়ে কবিতা শুনিয়ে আসব।’ ইহুদি নয় এমন ছাত্র ওরা দুজন ছাড়া আরও দু’জন ছিলুম, এক তো আমি নিজেই আরেকজন রোমান ক্যাথলিক। কলেৎ-এর আমাদের দু’জনকে নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না কিন্তু ইসলাম অন্য কথা। জর্ডন আর ইয়েমেন ওর কাছে শত্রুশিবির। আমার যেমন শক লেগেছিল সামনাসামনি এই রকম সৌজন্যবিহীন সাম্প্রদায়িক ঘৃণার প্রকাশ দেখে, তেমনি মন ভরে গিয়েছিল অতগুলো অল্পবয়সী ইহুদি ছেলেমেয়ে এতে লজ্জা পেল দেখে। এরা বেরুতে পেরেছে ঘৃণার অগ্নিজাল থেকে। অথচ ওরা ইহুদি সংস্কৃতিকে চিনতে চায়, নিজেদের ধর্মপুস্তক পড়তে চায় বলেই তো হিব্রু পড়তে উলপানে এসেছিল ইংলণ্ড, ফ্রানস, জার্মানি, সুইডেন, রাশিয়া কানাডা আর আমেরিকা থেকে।

ইদানীং আমেরিকা এবং ইউরোপ ভ্রমণের সময়ে নিরাপত্তা কড়াকাড়ির তুলকালামে বিদেশিরা সবাই অস্থিমজ্জাতে টের পেয়েছি যে ইসলামকে শত্রু মনে করতে আর ইহুদি হতে লাগে না, ক্রিশ্চানদেরও সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস আপাতত চরমে। ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের কল্যাণহস্তের কৃপায় ইসলামী নাম কেন, চামড়া ঈষৎ বাদামি হলেই ইউরোপে-আমেরিকাতে সন্দেহের তীর সেদিকে ছুটে যায়। এক শতাংশ মানুষের অবিমৃশ্যকারিতার মূল্য দিতে অত্যাচারিত হচ্ছে বাকি ৯৯ শতাংশ নিরপরাধ মানুষ। যুক্তিহীনভাবে আস্তে আস্তে নিঃশব্দে বদলে যাচ্ছি আমরা, বদলে যাচ্ছে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ, বর্ণভেদবিরোধিতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, এসব মূল্যবোধ আগের মতো আর এখন শিক্ষিত মানুষের চারিত্রিক গুণ নয়, ভদ্রলোকের স্বাভাবিক সামাজিক অবস্থান নয়। পরস্পরকে অকারণ সন্দেহ আর ঘৃণা করা আমাদের কাছে আর অসহনীয় নয়, অমার্জনীয়ও থাকছে না। সভয়ে আবিষ্কার করেছি, সত্যি সত্যি ঠগ বাছতে গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে তা হলে। বিশ্বায়িত মানুষের বৃত্ত কেবলই ছোট হয়ে যাচ্ছে কেন?

পিপা আর ম্যালকমের মতো পেনি আর রবার্টের সঙ্গেও দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল একদিনেই, এদের সঙ্গে পৃথিবীর সব কিছু নিয়ে কথা বলা যায়। খেলা (তখন ওয়ার্ল্ড কাপ চলছে), বই বিজ্ঞান, সঙ্গীত শিল্প, সিনেমা, গাছপালা, জীবজন্তু, দেশ বিদেশ, মানুষ, ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি। পেনি ভালবাসেন সাহিত্য, উদ্ভিদ আর প্রাণীজগৎ, রবার্ট গান, সিনেমা, বিজ্ঞান। বিশ্বের রাজনীতি আর ইতিহাসে উৎসাহী দুজনেই। বিদায় নেওয়ার সময় হতে না হতেই বুঝতে পেরেছি এই মস্ত পৃথিবীতে আরও দুটি বন্ধুলাভ হল—ইতিহাস ভূগোলের সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের হাত ধরে রুচি আর মূল্যবোধ।

ফ্রানৎস শোয়েক থেকে গর্ডন্স বে

আজ কেপটাউনকে আরো ঝকঝকে দেখাচ্ছে। পয়লা মে, ছুটির দিন। মেওয়া রামগোবিন জানালেন তিনি আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে পিকনিক যেতে চান। আমাকে দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াইন কান্ট্রি দেখিয়ে আনবেন, আমাদের তো ফেরার সময় হয়ে এল। নন্দনার সেদিন শ্যুটিং। সে বেচারা সবকিছু থেকে বাদ পড়ে যায়। আমি তো পিকনিকের নামে এক পায়ে খাড়া। মরিয়ম বললে মেওয়া আমাকে তুলে নেবেন। মেওয়া, মরিয়মের সঙ্গে ছিলেন ওঁদের বন্ধু লভিতা আর ধরমরাজ। এঁরা সকলেই দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসী। দিনটা পিকনিকের পক্ষে খুব সুন্দর। মেওয়া বললেন, আজ ড্রাইভার নেওয়া হবে না—তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে যাবেন। আমরা যাব ফ্রান্ৎস শোয়েক অঞ্চলে। আমাদের দ্রষ্টব্য K.W.Vনামে একটি বিশেষ ওয়াইন এস্টেট এবং ডিস্টিলারি। শুনলুম একটি দক্ষিণ আফ্রিকার বৃহত্তম। K.W.V.এখানকার অতি জনপ্রিয় ওয়াইনারি। –এদের সেলারের ওয়াইনের খুব সুনাম। মেওয়া এবং রাজের উদ্দেশ্য সেখান থেকে বেশ কিছু সাদা ও লাল ওয়াইনের বোতল সংগ্রহ করে নিজেদের ভাণ্ডারে মজুত করা

খুব সুন্দর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। দুদিকে আঙুরের ক্ষেত। এখানে ওখানে পথের ধারে আঙুর বিক্রি হচ্ছে। আমাদের গন্তব্য পার্ল শহর। স্টেলেনবশের পথে এই পার্ল শহর পড়ে। স্টেলেনবশ কেপটাউনের কাছাকাছি শহর, ওয়াইনারির জন্য বিখ্যাত অঞ্চল। পৌঁছে দেখি একটি ছোট নদীর এধারে ওধারে দু-পাশে বিশাল বিশাল রিফাইনারি, ডিস্টিলারি, কিন্তু হায় রে! সবই বন্ধ। K.W.V.কোম্পানির সেলারের মূল ঠিকানায় যেতে তারা আমাদের কিছু দূরে একটা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিল। সেটা খোলা। নদী পার হয়ে সেখানে গিয়ে দেখি— ওমা, সেটাও বন্ধ। এ যে আমাদের দেশের মতো খবর দেওয়া। —হাসি হাসি মুখে সেখানকার তরুণ দ্বারপাল বললেন আজ ১ মে, এ অঞ্চলের কোনও ওয়াইনারিই খোলা পাবেন না।

যেতে যেতে রাজ বললেন, আঙুর ক্ষেতগুলোর একটা সুন্দর পরিচয়পত্র আছে। সাদা আঙুর থেকে সাদা ওয়াইন হয়, আর কালো আঙুর থেকে লাল ওয়াইন, কিন্তু সব আঙুরলতাই তো এক রকম দেখতে। মালিক কেমন করে বুঝবেন তাঁর কোন ক্ষেতে লালা সুরা কোন ক্ষেতে সাদা? সমস্যাটির একটা সুশ্রী সুগন্ধি সমাধান আছে। প্রত্যেকটি লতার সারির সামনে একটি করে গোলাপ গাছ। সাদা গোলাপ ফোটা মানে সাদা আঙুর আর লাল গোলাপ মানে কালো আঙুর। নো প্রবলেম। এই অপূর্ব হিসাবটা আমি অস্ট্রেলিয়াতে ‘শান্দোন’ ওয়াইনারিতে প্রথম দেখি। এখানে এসে বুঝলুম যে এটা সারা পৃথিবীরই আঙুর চেনানোর ব্যবস্থা, ওয়াইন কেনা হল না, কিন্তু আঙুর কেনা হল। সারা রাস্তা আমরা আঙুর খেতে খেতে চললুম। পথের ধারে ধারে প্রচুর ফুল ফুটে আছে, নানান রং, হলুদই বেশি। নানা ধরনের প্রোটিয়া ফুটছে। যদিও বুনো ফুল, কিন্তু স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। প্রচুর জায়ান্ট প্রোটিয়া ফুটে আছে। প্রোটিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার ‘জাতীয় কুসুম’। টিউনিনের সঙ্গে বেরিয়েও দেখেছিলুম, যদিও কোথাও কিছু লেখা নেই, তবু সকলেই জানে, গাছে, ফুলে, পাতাতে হাত দিতে নেই। সবই সংরক্ষিত জাতীয় সম্পদ। যাবতীয় জাতীয় উদ্ভিদ দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার সযত্নে রক্ষা করে।

ফ্রানৎসশোয়েক মানে ফরাসি শহর। একসময় ফরাসিরা এদেশে এসে এই সুরা ব্যবসার পত্তন করেছিল। এই আঙুর ক্ষেতগুলি তাদেরই হাতে তৈরি। ফ্রান্স থেকে নিয়ে আসা আঙুর লতার বীজ থেকে এই বিস্তীর্ণ আঙুরক্ষেত জন্ম নিয়েছিল। মেওয়া বললেন ফরাসি হিউগিউনটদের সুরা ব্যবসায়ীরা আঙুরক্ষেত তৈরির উপযুক্ত জমি খুঁজতে খুঁজতে পাহাড় পেরিয়ে এপারে নতুন পাড়ায় চলে এসেছিল। সেখানেই গড়ে উঠেছিল এই ফরাসি বসতি, ফরাসি শহর। সব দোকানপাটবন্ধ। বাজার হাট এমনকী রেস্তোরাঁ পর্যন্ত। কিন্তু ঘরদোর দেখেই মনে হচ্ছিল যেন ফ্রান্সে এসে গেছি। পার্লে মেওয়া আমাদের একটি ঐতিহাসিক মনুমেন্ট দেখাতে নিয়ে গেলেন। টিলার ওপরে মনুমেন্টটি তৈরি হয়েছিল আফ্রিকান্স ভাষার সম্মানে। বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার এই অত্যাচারী শাসকের ভাষাকে মুক্ত মানুষেরা ভালবাসে না। তবু মনুমেন্টটির যত্ন -আত্তির অভাব নেই।

আমরা পিকনিকের উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে খুঁজতে এবারে আঙুরক্ষেত ছেড়ে পাহাড় পেরিয়ে উল্টোপথে ওপারের দিকে যাই। কিছুতেই মনের মতো পিকনিক স্পট পাওয়া যাচ্ছে না! ওপারে যেমন আঙুর, পাহাড়ের এপারে আবার তেমনি প্রবল উৎসাহে আপেলের চাষ। চতুর্দিক আপেল বাগানে বাগানে ভরা। গাছে গাছে ফল ধরে আছে, মাটিতে ঘাসের ওপর ফল ছড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলটার নাম এলগিন। এলগিনের আপেল দক্ষিণ আফ্রিকায় বিখ্যাত। এখানেই আপেলের সব থেকে বড় ক্লোড স্টোরেজ, ‘আপেল সমবায়িকা’ আছে এলগিনে।

এদিকে আমাদের খুব খিদে-তেষ্টা পেয়ে গেছে। সঙ্গে পিকনিকের ভোজ্য দ্রব্যের বড় বড় বাস্কেট এসেছে। আমার মন তো তখন সেদিকেই। কিন্তু বসব কোথায়? এদেশে ব্যবস্থার অভাব নেই। দু-পাশের মাঠে গাছের তলায় মাঝে মাঝেই পিকনিকের জন্য কাঠের চেয়ার টেবিল পাতা। আমরা একটা গাছের নীচে বসতে যাব, ওমা, আমাদের আগেই একদল লোভী পাখি এসে কলরব শুরু করল, মারিয়ম লাভিতা পালাল-তোল্ তোল্ এরা আমাদের এখানে খেতে দেবে না। একটু দূরে আরেকটা সুন্দর মাঠে ছায়া দেখে নেমে যেই বাক্সপ্যাঁটরা খুলে গুছিয়ে বসেছি, কোত্থেকে রাশি রাশি মাছি এসে ভনভন করতে লাগল। আবার চল মুসাফির বাঁধো গাঠেরিয়া! আরো একবার যাত্রা শুরু নতুন পিকনিক স্পটের খোঁজে। এবার কোনও চান্স না দিয়ে মেওয়া তাঁর চেনা জায়গার উদ্দেশ্যে চললেন। একটি আপেল বাগানে Orchard Coffee Shopনামে একটি চমৎকার কফি-শপ আছে। সেখানে টয়লেট আছে অতি পরিচ্ছন্ন। আর পিছনের মাঠে পিকনিকের টেবিল চেয়ারও পাতা আছে। ঝক্‌ঝকে তক্তকে। পাশে একটি ওয়েস্ট বাস্কেট,আর একটি নোটিশ— “ যাবার সময় জায়গাটি পরিষ্কার রেখে যাবেন। ধন্যবাদ।’ গুছিয়ে বসে সেখানেই আমাদের প্যাটরা খোলা হল। দারুণ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা— অত সকালে উঠে রান্না করে এনেছেন সবাই মিলে। মরিয়ম এনেছে হাতে গড়া টাটকা রুটি আর মাংসের ভিন্দালু, লাভিতা এনেছে অপূর্ব সুগন্ধী পোলাও, রাজমা, স্যালাড আর রায়তা।

ওখানে একটা গাছ ছিল ছোট্ট ছোট্ট চেরীর মতো টুকটুকে লাল ফল। গাছটা দেখতে আপেল গাছেরই মতো, পাতাগুলোও তাই কিন্তু ফলগুলো অবিকল চেরীর মতো। গাছের নীচে যত ফল পড়ে ছিল সবই পাখি আর কাঠবিড়ালীর খাওয়া। আমি দুঃসাহস করে গাছ থেকে কয়েকটি ফল পেড়ে আনি। জানি ফল পাড়া ঠিক নয়। কিন্তু “আগ্রহ মোর অধীর অতি”! কী ফল জানতে হলে খেতে হবে। আপেল হলে তার ‘কোর’ এ থাকবে ছোট ছোট লম্বাটে চ্যাপটা বীচি। আর চেরী হলে তার থাকবে কুলের বীচির মতো গোল আঁটি। ফল হাতে নিয়ে সকলেরই মনে হল এটা আপেল ও চেরীর মিশ্রণ। আমি সাহস করে কামড় দিলুম। ওমা! এতো আপেল। ‘মিনি আপেল’। পাকা মিষ্টি আপেল টোপা কুলের মতো সাইজ। কিন্তু এক কামড়েই শেষ। এতটুকু আপেল এরাও কেউ কখনও দেখেননি। এবার সকলেই দুটো একটা করে সঙ্গে নিলেন সবাইকে দেখাবেন বলে। আমিও নিলুম দু-চারটে –নন্দনাকে দেখাতে হবে না? (একেবারে কলকাতা অবধিই এনেছিলুম, এখানেও প্রদর্শিত হয়েছে।)

আমাদের ফেরা পাহাড়ি পথ বেয়ে। একবার নেমে এলুম ক্যালেডন নদীর উপত্যকায়। সে যে কি সুন্দর নদী আর তার বাঁধ—আর বাঁধ থেকে তৈরি সরোবর। তার ব্রিজে দাঁড়িয়ে মনে হয় পৃথিবী বড় সুন্দর। কোথাও কোনও লোকালয় চোখে পড়ে না, নদী, আকাশ, হ্রদ, পাহাড় দেখে দেখে চোখ ফেরে না। আমরা পথে Sir Lowry’s Pass-এ থামলুম সূর্যাস্ত দেখতে। এই জায়গাটি সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখানকার মানুষদের বড় প্রিয়। সেখান থেকে নীচে দেখা যাচ্ছে গর্ডন’স বে। দূরে দুটি সমুদ্র, আর শেষ সূর্য।

সেখানে একজন পসারী মাটিতে সতরঞ্জি পেতে হাতে গড়া কাঠের মূর্তি বিক্রি করছিল। সে আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল—”বাংলাদেশ?” ছেলেটি খুব কালো এবং খুব মিষ্টি দেখতে। তার মূর্তিগুলির পাশে একটি নোটিশ—”সাপোর্ট আফ্রিকা”। ছোট ছোট মূর্তিগুলি এত সুন্দর যে আমি কয়েকটি না কিনে পারলুম না। মেওয়া বললেন “ইস্টার্ন কেপ -এ বাস্টুস্তান বাস্টুদের দেশ। ‘ ৯৪ সাল থেকে কেপ টাউনে ঢুকতে তাদের অনুমতিপত্র দরকার হয়। এই ছেলেটি সাউথ আফ্রিকার নয়। তাহলে বলত সাপোর্ট সাউথ আফ্রিকা। ও জিম্বোবোয়ে, মোজাম্বিক, কঙ্গো—যে কোনও দেশের ছেলে হতে পারে। ও বিদেশি।” আমার অবাক লাগল দক্ষিণ আফ্রিকা, ও বাকি আফ্রিকার মধ্যে স্বদেশি আর বিদেশি, এই বিচ্ছিন্নতার মনোভাব দেখে। আমার কাছে তো সবই আফ্রিকা। যে দেশ থেকেই আসুক, ছেলেটি আফ্রিকান এবং দরিদ্র। উপার্জনের চেষ্টা করছে। আমার ডারবানের সমুদ্রতীরের সেই বাংলাদেশি আর পাকিস্তানি ছেলেগুলিকে মনে পড়ল।

ইতিমধ্যে আকাশ সিদুরে লাল হয়ে উঠেছে। তার গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে টেবিল মাউন্টেন ও লায়ন’স হেড। ঠিক এইরকম একটা ফোটো পোস্টাকার্ড কিনেছি আমি, সিলুয়েটে অবিকল এই দৃশ্য! সমতলে নেমে সমুদ্রের ধারে ‘স্ট্র্যান্ড’ শহরে থামা হল। মহা উৎসাহে মেওয়া এবং মরিয়ম গেলেন মাছ কিনতে। রাজ আর লাভিতা নিরামিষ। খুব চমৎকারভাবে জ্যান্ত মাছ কাটিয়ে প্যাক করিয়ে নিয়ে এলেন তাঁরা। মাছের নামটা শুনেছিলুম বটে, এখন মনে নেই। ফেরার পথে বেরলো চকোলেট আর ঘরের তৈরি সিঙাড়া। কেউ বলতে পারবেন না যে বেড়াতে বেড়িয়ে আমরা খিদেয় কষ্ট পেয়েছি।

মেওয়া রামগোবিনের বয়স ৭৫। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্টে একজন ক্ষমতাশীল সাংসদ, সুপরিচিত রাজনীতিবিদ। কিন্তু কি অমায়িক, কি উষ্ণ তাঁর ব্যবহার! আমাকে মারিনা অ্যাপার্টমেন্টসে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন আমার কেপটাউনের বন্ধুরা। মরিয়ম বলে গেল সে পরদিন আবার আসবে আমাকে গেট্সভিলে ভারতীয় খাবার দাবার পোশাক-আসাক, মশলাপাতির বাজার নিয়ে যাবে। আর রাইল্যাণ্ডে ভারতীয় উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের পল্লি দেখাবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন সিনেমা এবং নতুন নাটক

আমাদের মুজিয়েমবার্গের নতুন বন্ধুরা, পেনি আর রবার্ট সেদিন এক তরুণী কবির জীবন নিয়ে সদ্য তৈরি একটি সিনেমা দেখতে কেপটাউনে আসছেন, জিজ্ঞেস করলেন আমরাও দেখতে চাই কিনা। নন্দনা, পিপা ম্যালকমের সেদিন কাজ ছিল। সন্ধেবেলা আমি ফ্রি। তরুণী কবি ইনগ্রিভ ইয়ংকার এর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র দেখার সুযোগ আমি ছেড়ে দিতে চাই না। ঠিক হল ওরা এসে আমাকে তুলে নিয়ে যাবেন। মহানন্দে বিকেলে আমি ওদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট ওয়াটারফ্রন্টের মল এ বসে খুব আনন্দ করে হল আমাদের আইসক্রিম খাওয়া আর পরে হল-এ গিয়ে ছবি দেখা। আমাদের সঙ্গে পেনির এক বয়স্কা বান্ধবী এসেছিলেন, জোহানেসবার্গের অতিথি, মেরি। তিনি ওখানে রান্নার কাজ করেন।

প্রায় দু-ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে ছবি দেখে বেরিয়ে চেষ্টা করলুম ইনগ্রিড ইয়ংকার এর কোনও কবিতার বই বা জীবনী গ্রন্থ কিনতে পারি কিনা।

সিনেমা হল-এর নিচেই দু-খানা বড় সড় বই এর দোকান। রমরমিয়ে কবি ইনগ্রিড ইয়ংকার এর জীবনচিত্র চলেছে, অথচ কি আশ্চর্য, ছবিটি যার জীবন নিয়ে তার একটিও বই নেই সেই দুই দোকানের একটিতেও। একজন বিক্রেতা বিরক্ত হয়ে বললেন, ইদানীং প্রায়ই লোকে এই লেখিকার বই এর খোঁজ করছে, ইনি আফ্রিকান্স ভাষাতে লিখতেন, তাঁর কবিতার বই আছে জীবনী নেই। ইংরেজি অনুবাদে তাঁর সিলেকটেড পোয়েমস অবশ্য বুকস ইন প্রিন্ট-এ আছে, একমাসের মধ্যে আনিয়ে দিতে পারে অর্ডার দিলে। দোকানের সংলগ্ন সিনেমা হল এ চলছে আফ্রিকান্স ভাষার লেখিকার জীবনীচিত্র। তীব্র আপারথেইড বিরোধী, নানা নেশায় বিধ্বস্ত ছিন্নস্নায়ু, মেধাবিনী, প্রতিবাদী কবি, সুন্দরী দুঃখিনী ইনগ্রিভ ইয়ংকার এর জীবনের তথ্যচিত্র। এর জীবনের তথ্যচিত্র। তরুণ। রোমান্টিক শিল্পীদের কবি-সঙ্গিনী, অবিকল উনিশ শতকের ফরাসি কবিদের মতো, স্বেচ্ছায় উচ্ছন্নে যাওয়া, বহু প্রণয়িনী ইনগ্রিভ যেন স্বভাব-নায়িকাও। ইনগ্রিডের মধ্যে আশ্চর্য একটা অসহায়তা, শিশুসুলভ সারল্য ছিল, বাস্তব জীবনের কঠোরতার সঙ্গে তাঁর স্বভাব যেন কোনওদিনই মানিয়ে নিতে পারেনি। মাঝে মাঝেও মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হত। মনের মানুষ খুঁজে পাননি, পেলে রাখতে পারেননি। প্রেমে স্থিরতা, বিশ্বস্ততা তাঁর চরিত্রে ছিল না। তবু বন্ধুদের ভালবাসা ছিল তাঁর জন্যে। তা সত্ত্বেও অস্থির ইনগ্রিভ নিতান্ত অল্পসময়ে জীবন থেকে অসময়ে ছুটি নিয়ে নিয়েছিলেন, শিশু কন্যাকে ফেলে।

ছবিটা পেনি ও পিপার এক বান্ধবীর দশ বছরের একান্ত আত্মনিবেদিত প্রচেষ্টায় তৈরি। আবাল্য মাতৃস্নেহে বঞ্চিত, ক্ষমতাশীল পিতার অকারণ শত্রুতায় নিপীড়িত, অথচ সেই পিতারই ভালবাসার ভিখারি, একাধিক প্রণয়ে ছিন্নভিন্ন, বিভ্রান্ত, উচ্ছৃঙ্খল, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া সেই রূপসী মেধাবিনী কবি তিরিশের আগেই ইচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন, শ্রীচৈতন্যের মতো মধ্যরাত্রে সমুদ্রের মধ্যে হেঁটে গিয়ে। শিশু কন্যাটি শূন্য বাড়িতে বসেছিল মায়ের জন্যে, পথ চেয়ে, একা। সিনেমাতে যেটুকু পেলুম, কবিতাগুলো অসামান্য, কিন্তু কিছুতেই কিনতে পারিনি তাঁর কোনও কবিতার বই। বাই তো নয়ই, ইনগ্রিভ ইয়ংকার -এর কোনও কবিতা পর্যন্ত পাইনি। অথচ তাঁরই কবিতা, স্বাধীনতা, আফ্রিকান্স লিখিত হলেও নেলসন ম্যাণ্ডেলা পাঠ করেছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পার্লামেন্টে, প্রেসিডেন্ট হয়ে তাঁর প্রথম বক্তৃতাতে। অন্তত এই কবিতাটি ইংরেজি অনুবাদে গুগল সার্চ করে পাব ভেবেছিলুম। কিন্তু পাইনি। ইনগ্রিড ইয়ংকার এর অসহায় মুখ আর তাঁর সবল কবিতা আমার মনে টিপ ছাপ রেখে গিয়েছে। এক রাশিয়ান কবি, মরিনা ৎশেতায়েভার কবিতা পড়ে আমার এরকম লেগেছিল। কিন্তু এর কবিতা তো শুধু শুনলুম। পড়ার সুযোগ হল কই? আসার আগে পেনি গুডবাই করতে এলেন তাঁর এক বান্ধবীকে নিয়ে। তাঁর নাম রায়েদা বেকার, পার্লামেন্টের মিউিজিয়ামের কিউরেটর। তিনি বললেন, ইনগ্রিডের সব কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন আন্তজিয়ে ক্রোগ নাম্নী প্রসিদ্ধ অনুবাদিকা। ইনিই ম্যাণ্ডেলার আত্মকথা আ লং ওয়ক টু ফ্রিডম আফ্রিকান্সে অনুবাদ করেছিলেন। নন্দনার ছবি আনসিন ওয়লর্ড এর এডিটর রোনেলও বলেছিলেন এঁর কথা। পেনি কথা দিলেন ইয়াংকার এর ইংরেজি বইটা আমাকে পাঠাবেন। রোনেল বলেছেন আন্তজিয়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন, ই-মেল-এ। জানি না আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড হয়ে যাবে কি না। আমিই হয়তো কলকাতাতে ফিরে ইনগ্রিডকে ভুলে যাব।

দক্ষিণ আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের নবতম নাটক।

কেপটাউনে যাওয়ার আগে থেকেই ম্যালকম বলে রেখেছিলেন আমাদের একদিন নাটক দেখাবেন। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলে স্বীকৃত মার্কিন-প্রবাসী লেখক আথোল ফুগার্ডের নবতম নাটক ভিকট্রির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার চলছে কেপটাউনে বিখ্যাত নাট্যমঞ্চ ব্যাকস্টার থিয়েটারে। ম্যালকম সেখানেই নিয়ে গেলেন আমাদের। থিয়েটার বলে কথা! সুন্দর একটা শাড়ি পরলুম, ও তো আর সিনেমা নয়! থিয়েটারের একটা রিচুয়াল আছে না? ছোট নাটক, ইন্টারমিশন নেই, তাই শো শুরুর আগেই আমাদের এক ঢোঁক করে শাবলি, আর কাজু খাওয়াতে ভুললেন না ম্যালকম। নন্দনা অতি সুন্দর একটি পোশাক পরেছিল, মানুষের ধাক্কা লেগে তাতে একটুখানি শাবলি উছলে পড়েও গেল। ‘লাকি’, বলে কাটিয়ে দিচ্ছিল মেয়ে। আমি কিন্তু বোতলের জল রুমাল ভিজিয়ে মায়ের করণীয় কর্ম করে ফেল্লুম। পরে দাগ হয়নি। সাদা ওয়াইন বলে বাঁচোয়া।

মোট তিনটে মঞ্চ আছে ব্যাকস্টারে, দুটি বড় অডিটোরিয়াম, বড় মঞ্চ সমেত, মিউজিক্যাল ইত্যাদি হয় সেখানে, আর সবচেয়ে ওপর তলাতে একটি ছোট গোল অডিটোরিয়াম আছে, মাঝখানে, ছোট মঞ্চ, দর্শন আসন ঘিরে থাকে মঞ্চটিকে। ফুগার্ডের নাটক এখানেই চলছে। আমাদের অভিনয় ও নির্দেশনা যত ভাল লেগেছে নাটক তত ভাল লাগেনি। নির্দেশনায় আছেন ম্যালকমের এক বন্ধু লারা ফুটনিউটন, প্রধান ভুমিকায় একজন পঁচাত্তরোর্ধ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রসিদ্ধ সাদা অভিনেতা, কোভাস রোসো, নায়িকা এক ভারতীয় মেয়ে, থিয়েটারের ছাত্রী আমিরা প্যাটেল, ও নায়ক একটি কালার্ড ছেলে, ওয়েন ভ্যান রুয়েন। তিনজনের অভিনয়েই প্রাণ মন ভরে যায়। আমিরা যে মতিচ্ছন্ন কৃষ্ণাঙ্গ টিনএজার নয়, লাজুক গুজরাটি মেয়ে, তা মঞ্চে বোঝা যায় না। নাটকের পরে চারজনেই এসে মহা আনন্দে ম্যালকমের সঙ্গে দেখা করলেন, ম্যালকম সকলকেই ডিনারে ডাকলেন, শুধু নায়ক ওয়েন ফ্রি ছিলেন, আর সবাই ব্যস্ত। জানা গেল ওয়েন জোহানেসবার্গে ম্যালকমের প্রাক্তন ছাত্র, যখন উইটস-এ ড্রামার অধ্যাপক ছিলেন ম্যালকম। নাটকের বিষয় সাদা কালোর দ্বন্দ্বে মূল্যবোধের সমস্যা। একদিকে কালোদের নতুন প্রজন্মের দারিদ্র ও ড্রাগ অ্যাবিউস প্রসূত মনুষ্যত্বহীনতা, সাদাদের প্রতি ক্ষোভ বশত টেবিল উলটে দিয়ে তাদের উপর বিপরীত অত্যাচারের কাহিনি, আর অন্যদিকে পুরনো প্রজন্মের সাদা মানুষদের অভ্যস্ত দায়িত্বহীনতা, কালোদের কথা দিয়ে নির্বিকার কথা না রাখার গল্প। নায়িকার নাম ভিকট্রি, ও সেদিন জন্মেছিল যেদিনে দক্ষিণ আফ্রিকা স্বাধীন হল। কিন্তু জয়ী সে হতে পারেনি। ড্রাগের কবলে বন্দি সে আর তার বয়ফ্রেণ্ড। একদা যার কাছে সে আর তার মা শুধু অর্থ আর আশ্রয় নেয়, প্রচুর স্নেহ পেয়েছে, সেই বৃদ্ধকে অনায়াসে মারধর করে, নতুন জন্মের চেনা বাড়িতে চুরি ডাকাতিতে ভিকট্রি পিছপা নয়। এই নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা অর্থহীনতা মানবিকতার পরাজয়ের কাহিনি, আশার আলোবিহীন এই নাটকের মূল কথা আমি এইটুকুই বুঝলুম, এর বাইরে তেমন কিছু খুঁজে পেলুম না। নাটকটি যে হয়তো তেমন সফল নয় এমন সন্দেহের আরও একটি কারণ, নাটকের পরে আমরা তার নায়ককে নিয়ে ইতালির রেস্তোরাঁতে নৈশভোজে গিয়ে একবারও আর নাটকটি নিয়ে আলোচনা করিনি। আমাদের মনে দাগ কাটেনি। ফুগার্ডের বয়স হয়েছে, অনেকদিন নতুন নাটক লেখেননি। ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রবাসযাপন করেন এখনও। দু’বছর পরে নাটক লিখলেন, তাই এত সাড়া পড়েছে মনে হয়।

আমার সৌভাগ্য দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন প্রজন্মের তৈরি একটি চলচ্চিত্র, আর বরিষ্ঠ লেখকের নতুনতম নাটক দেখে এসেছি। ইনগ্রিভ ইয়ংকাকে আবিষ্কার করেছি, বিখ্যাত ব্যাকস্টোর থিয়েটার ফুগার্ডের নাটক দেখেছি, কোনওটাই আলাদা করে সংস্কৃতি চর্চার উদ্দেশ্যে নয়। ভাগ্যক্রমে ঘটে গিয়েছে।

শুটিং • দ্য ওঅর্লড উইদিন

নন্দনার শুটিং আছে কেপটাউনে, সেই সুবাদেই আমার সাউথ আফ্রিকা ভ্রমণ। মেয়ে আদর করে সঙ্গে নিয়ে এসেছে, এক গাদা খরচ করে ফার্স্ট ক্লাসে, মায়ের যাতে কষ্ট না হয়। জলের ধারে মারিনা অ্যাপার্টমেন্টে অতি চমৎকার দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট নিয়েছে, মায়ের আরামের জন্য। ফলত অবিলম্বে দেখা গেল তার ইউনিটের লোকেরা আমাকে মাম্মি বলে ডাকছে। এবং ত্রস্ত -ব্যস্তে আমার সেবায় মনোনিবেশ করেছে। মাম্মির জন্যে ঘরে রেখে যাচ্ছে টাটকা কফির গুঁড়ো, তরতাজা ফুলের কুড়ি, ওয়াইনের বোতলও। আর কি, মাম্মি এবার মুনি ঋষিদের মতো শান্তিতে নদীতীরের নির্জনতায় তপস্যা মগ্ন থাক, সারাদিন ফলাহার কর, সকালে সুগন্ধি কফি, সন্ধ্যায় কিঞ্চিত ওয়াইন পান কর, আর লেখ। ইউনিটের লোকেদের অনেকের সঙ্গেই আলাপ হয়ে গিয়েছে, তারা কৌতূহলী হয়ে নন্দনার লেখিকা মা জননীকে দর্শন করে যাচ্ছে এসে এসে। কিন্তু যে শুটিং এর জন্যে এখানে আসা, মাম্মিকে তো অন্তত একদিন সেই শুটিং দেখাতে নিয়ে যেতে হবে? নইলে ভাল দেখায় না।

দিন স্থির হল, নন্দনা তো ভোর পাঁচটাতে বেরিয়ে যায়, বেলা হলে ওদের ড্রাইভার অড্রে এসে আমাকে নিয়ে যাবে, কেপটাউনের বাইরে এক জায়গাতে শুটিং হচ্ছে, যেতে এক ঘন্টা, আসতেও তাই। দিনটা বৃষ্টি বৃষ্টি, ভিজে ভিজে, তাতে অসুবিধা নেই, শুটিং ইনডোরে হচ্ছে আজ। গাড়ি থেকে নামতেই আশ্চর্য হয়ে যাই, একটা শেডের নিচে টানা লম্বা টেবিলে নানা রকম খাবার সাজানো, কিছু নর নারী সেখানে গম্ভীর মুখে ঘোরাফেরা করছেন, খাওয়া দাওয়া চলছে। কোথাও কোনও ক্যামেরার চিহ্ন নেই। লাইটের ব্যবস্থা নেই। মানুষগুলিকে অচেনা লাগছে, তাদের পরনে পোশাক-আসাক আধুনিক পশ্চিমের সমাজে এখন আর চলে না, এদের মান্ধাতার আমলের গাউন, এদের ডাবল ব্রেস্টেড স্যুট, এদের টুপি, পঞ্চাশ বছর আগে হয়তো চলত। বেশির ভাগই এদেশি কালো মানুষ। এরা কি তবে কালো বলেই এত পিছিয়ে আছেন? উঁচু টুপি পরা শেফ আছেন, তিনি চিজ বার্গার বানাচ্ছেন, সাদা গ্লাভস হাতে স্টুয়ার্ড আছেন তিনি কফি ঢালছেন, সবার পরণে ইউনিফর্ম, কিন্তু এই টিনের শেডের নিচে এদের মানাচ্ছে না। এ আবার কোথায় এলুম? কী হচ্ছে এখানে? শুটিং যে হচ্ছে না তাতে সংশয় নেই। আমার মেয়েটাকেই বা পাব কোথায়? ভীড়ের মধ্যে থেকে একটি গোমড়ামতো সাহেব, আর একটি গ্রে রং-এর স্যুট পরিহিতা তরুণী মেম আমার দিকে এগিয়ে এল। তার ম্যাচিং টুপি থেকে লেসের জাল ঝুলছে আধখানা মুখের ওপরে, সুন্দর মুখখানাতে রহস্যের ওড়না লাগিয়ে। মেম যেই নেটের আড়াল থেকে সোল্লাসে ডেকেছে—’মা!’ বলে, অমনি দেখি আরে এ তো মেম নয়, এতো আমার বঙ্গললনা। একেবারেই চেনা যাচ্ছে না।

সাহেব অবিশ্যি সাহেবই। তিনি নন্দনার স্বামীর ভূমিকাতে, এখন ভুলে গেছি নাম কি নন্দনার এখন শুটিং নেই, অন্যদের চলছে। এই জায়গাটাও ওদের খাবার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এখানে যাঁরা ঘোরাফেরা করছেন, সকলেই অভিনেতা, কয়েক জন বাদে সকলেই এক্সট্রা। এঁরা সবাই পঞ্চাশ বছর আগের সাজে সেজেগুজে আছেন, রেস্তোরাঁতে খাবেন, পথে হাঁটবেন, পার্টিতে নাচবেন, হাটে বাজার করবেন। তাঁদের নাম নেই। আমরা দাঁড়িয়ে গল্প করছি, বসার ব্যবস্থা নেই, এলোমেলো কয়েকটা চেয়ারে লোকে বসে আছেন। হঠাৎ একটি কালো মতো ছেলে এসে আমাকে হাঁটুতে প্রণাম করে এক গাল সাদা দাঁতের হাসি চড়িয়ে বলল” নমস্তে আম্মা।” আমি ওকে চিবুক ছুঁয়ে আদর করে বলি ‘তুমি কোথাকার ছেলে? তোমার নাম কী বাছা? এখানে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই কে এদেশি কে ওদেশি, রং মুখচ্ছবি, সব একই।” আই অ্যাম ফ্রম অন্ধ্র, আম্মি, নাগেশ্বর রাও, জাস্ট কল মি নাগেশ, বাট ফার্স্ট, লেট মি গেট ইউ আ সীট।” এবং মুহূর্তের মধ্যে কাকে যেন আসনছাড়া করে আমাকে একটি চেয়ার এনে দিল নাগেশ। পিলানীর ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ার ছেলে জোহানেসবার্গে চাকরি করত, কিন্তু এখানে ইণ্ডিয়ান রেস্তোরাঁ খুলেছে অফিসপাড়াতে, কাবাব, তন্দুরি, রোলের ব্যবসাতে চাকরির চেয়ে বেশি উপার্জন তার। অফিসগুলো বন্ধ হলেই নাগেশ তার দোকানও বন্ধ করে ফেলে। নইলে জীবনে আনন্দ করবে কখন? এখানে এসেছিল দুদিনের কড়ারে এক্সট্রা হয়ে, পার্টিতে নাচতে। মূলত মজা দেখতে। তার শুটিং সারা। আকস্মিক এই অ-জায়গায় পরনে দক্ষিণী শাড়ি, কপালে কুমকুমের টিপ, গোলগাল গিন্নিবান্নি মানুষটিকে দেখে তার খুব ভাল লেগে গেছে, তার মায়ের কথা মনে পড়েছে। মাকে হারিয়েছে ছ বছর বয়সে। পড়েছে হস্টেলে থেকে। আফ্রিকাতে আছে পাঁচ বছর। এদেশের আগে ছিল কিনিয়াতে। নন্দনার সঙ্গে ওর তেমন ভাব হয়নি এখনও। এরপর যতদিন কেপটাউনে ছিলুম, নাগেশ ছিল আমার অন্ধের যষ্টি। শুটিং এর লাভ নগেশ, এক। আর দুই রোনেল, এডিটর। সে কবিতা ভালবাসে, আমরা আসার দিনে একসঙ্গে খেতে গিয়েছিলুম। আমার তার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ হয়েছিল। আম্ভজিয়ে ক্রোগের অনুবাদ করা শেষ হলেই রোনেল বলেছে ইনগ্রিড ইয়ংকার কবিতার বই পাঠাবে আমাকে।

পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে আপারথেইডের কঠোর আইনের মধ্যে ভারতীয়দের জীবন যাপনের জটিলতার গল্প এই ছবি। নন্দনার সঙ্গে তার যমজ ভাই ও নিপীড়িতা ভাতৃবধূর ভূমিকাতে আছে পরভীন দাভাস আর লিসা রে, এদেরকে চিনি ‘মনসুন ওয়েডিং’ আর ‘ওয়াটারে’ দেখেছি। লিসা রে-র বান্ধবীর ভূমিকায় এক ভারতীয় আমেরিকান মেয়ে, তাকে চিনি না বলে নাম মনে নেই।

শুধু কালোদেরই নয়, ভারতীয়দের সঙ্গেও শ্বেতাঙ্গদের সামজিক মেলামেশা বে-আইনি ছিল, বিবাহ তো ছিল অকল্পনীয়। আইন ভাঙলে অপরাধীদের কঠিন শাস্তি হত, দীর্ঘ কারাবাস হত। ভারতীয়রা ছিলেন প্রচণ্ড রক্ষণশীল, প্রাচীনপন্থী, সাদাদের সম্মান ও কালোদের ঘৃণা করে চলতেন। এই ছবিতে সেই সময়ের দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় সম্প্রদায়ের সামাজিক অবস্থান ও তার সমস্যাগুলি তুলে ধরা হয়েছে। নন্দনার ভূমিকা এক বিদ্রোহিনীর যে আইন ভঙ্গ করে এক শ্বেতাঙ্গকে বিয়ে করে প্যারিসে পালিয়ে গিয়েছিল, ছ বছর পরে স্বামীসমেত অল্পদিনের জন্যে ফিরে এসেছে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে কিন্তু লুকিয়ে বেড়াচ্ছে পুলিশের হাত থেকে। ডিরেকটরের এই প্রথম ছবি তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় মেয়ে, এখন থাকেন ইংলন্ডে। নিজেদের পরিবারের অভিজ্ঞতা জড়িয়ে আছে কাহিনিতে। তাঁর ঐ একই নামের উপন্যাসটি ইংলন্ডে প্রচুর সমাদৃত হয়েছিল, তাই এই ফিল্মের প্রয়াস। অতএব ডিরেকটর ও কাহিনিকার নারী। এই ছবির সবচেয়ে আশ্চর্য দিকটি এর নারী শক্তি। একে একে আমার সঙ্গে আলাপ হচ্ছে আর আমি অবাক হয়ে দেখছি, প্রোডিউসারও নারী। স্ক্রিপ্ট রাইটারও নারী। এডিটরও নারী। আর্ট ডিরেকটরও নারী। একমাত্র সিনেমাটোগ্রাফার পুরুষ কিন্তু তাঁর সহকারী নারী। নন্দনার মেক আপ ভ্যানে গিয়ে দেখি মেকাপ করাচ্ছেন মেয়ে, ড্রেসার, হেয়ার ড্রেসার সবাই মেয়ে। নন্দনার গাড়ির চালকও এক মহিলা। অড্রের স্ত্রী। পুরোদস্তুর নারী বাহিনী একেবারে। শুটিং-এর সময়ে ফ্লোরে ঢুকে দেখি সত্যি পুরনো জিনিস সযত্নে সংগৃহীত, যথাযথ, সেই সময়ের চরিত্র বিশিষ্ট, এখন দুর্লভ। আমার ভাগ্য ভাল, আজ নন্দনার, তার সাহেব স্বামীর, পরভীনের, আর লিসারের একই সঙ্গে সীন ছিল, রেস্তোরাঁতে খাওয়া ও কথোপকথন, ওদের শুটিং ফুরালে সেদিনের মতো প্যাক আপ। তার পরে আমাদের আদর করে তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করলেন ডিরেকটর কিন্তু পাহাড়ের উপরে বাড়ি, অনেকগুলো সিঁড়ি হেঁটে উঠতে হবে, অতএব আমার যাওয়া হবে না।

শুটিং এর পরে আমরা মায়েতে মেয়েতে “মাম্মা আফ্রিকা” তে গেলুম আফ্রিকান গান শুনতে আর আফ্রিকান ডিনার খেতে। পরভীনও এল আমাদের সঙ্গে। গানবাজনা ও খাদ্য পানীয় সবই ছিল আকর্ষণীয়, তবে ভিড়ও প্রচুর। টুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য, ‘এথনিক’সংস্কৃতির স্বাদ দেবার উদ্দেশ্য এটির জন্ম। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যে তৈরি জায়গাতে না গেলে স্থানীয় সংস্কৃতির আসল স্বাদ পাওয়া যায় না। যেখানে খেতে এসেছে শুধুই বিদেশিরা সে খানা জেনুয়িন কিনা কে বলবে কিন্তু বাজনা ও গান খুব ভাল। যদিও আমেরিকান ব্লুজ- এর সংমিশ্রণ শুনলুম।

কেপটাউনের জ্যাজ

আমি ষাটের দশকে বেড়ে ওঠা মেয়ে, বাই ডিফ্লট আমরা জ্যাজের ভক্ত। সোয়েটোতে না হলেও, জোহানেসবার্গের মেলভিলেনো হলেও, কেপটাউনে এসে মেয়ের সঙ্গে রাত্তিরে বেলাতে গিয়ে প্রাণ ভরে শুনলুম জ্যাজ সঙ্গীত। ওর শুটিং এর পরে। এক রাত্রে আমরা গেলুম মাম্মা আফ্রিকাতে, সেখানে আছে নির্জলা আফ্রিকান ফোক মিউজিক, নানারকমের স্থানীয় আফ্রিকান যন্ত্র ও কণ্ঠ সঙ্গীত। শুনেছিলুম ব্ল্যাক আমেরিকার গানের মিশেল নেই, কিন্তু কাৰ্যত তা নয়। বেশ কিছু পরিচিত ব্লজও শোনা গেল। ঐ যে বললুম মাম্মা আফ্রিকার খাদ্য পানীয় অতি চমৎকার, তবে আবহাওয়া টুরিস্টিক। ইউরোপিয়ান টুরিস্টরা ক্যামেরা বাগিয়ে মুচ্ছো যাচ্ছিলেন দেখলুম, কিন্তু তেমন কিছু আহামরি লাগেনি আমরা। বরং আরেক রাত্রে আমরা দুজনে, মায়েতে মেয়েতে ওয়াটারফ্রন্টের বিখ্যাত ডলফিন রেস্তোরাঁতে, আলোর ছায়া কাঁপা কালো জলের ধারে, মোমের আলোয়, রোমান্টিক নৈশভোজে গিয়ে জ্যাজ মিউজিশিয়ানদের অপূর্ব বাজনা শুনলুম যতক্ষণ না তারা সে রাতের মতো বাজানো বন্ধ করলেন। এটি শুধু টুরিস্টদের জন্য নয়, এখানে আলাদা করে বিশুদ্ধ আফ্রিকার গানবাজনা হয়, বেঠোফেনও আছেন, থেলোনিয়াস মন্কও আছেন। কিঞ্চিৎ বিশ্রামের সময়ে পিয়ানো বাদকটি নন্দনাকে হঠাৎ চিনতে পারলেন,” তোমাকে আমি আগে দেখেছি না? তুমি কি এখানে থাক?

নন্দনা তো একেবারে হতবাক, হ্যাঁ চার বছর আগে সে কেপটাউনে গিয়েছিল একটি বিজ্ঞাপনের শুটিং -জন্য, তখন জ্যাজ শুনতে ওখানেই গিয়েছিল,এবং সেই পিয়ানো শিল্পীই তখন বাজিয়েছিলেন। ওদের টেবিল সামনেই ছিল, সেখানে বসেই সামান্য মুগ্ধতার বাক্য বিনিময় হয়েছিল, নন্দনা তাঁকে একটি গোলাপফুল উপহার দিয়েছিল, এইটুকু। চিরজীবন মনে রাখার মতো নয়। তাঁর কিন্তু মনে আছে। বাজানো শেষ হবার পরে আমরা কিছুক্ষণ গল্প করলুম। রং ফরসা কিন্তু নাক মুখে কৃষ্ণাঙ্গ ছাপ। কেপটাউনে তাঁর জন্ম কর্ম, কিন্তু এখন থাকেন সুইডেনে, প্রতি বছর সস্ত্রীক আসেন বাজাতে। সুন্দরী বাদামি স্ত্রীর বয়স হয়েছে। দেখে মনে হয় দুজনেই কালার্ড সম্প্রদায়ের মানুষ। কালো না, সাদাও নন। ভারতীয় নন, চীনেও নন।

শিল্পী বললেন,– আর কতদিন এভাবে আসতে পারব জানি না। ট্রাভেলিং ক্রমশ কষ্টকর হয়ে উঠছে। অনেকটা দূর।

—একথা কেন? হঠাৎ?

—বয়সটা ভাবতে হবে তো?

—এত তাড়াতাড়ি?

—আমার বয়স কত বল তো?

–দেখে মনে হয় পঞ্চাশ পঞ্চান্ন, ষাট?

 খানিকক্ষণ অট্টহেসে শিল্পী বললেন-

—সামনের জন্মদিনে আশি বছর হবে আমার।

–ধ্যাৎ। সত্যি? ওঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করি।

অনাবিল হেসে তিনি উত্তর দেন, –মানুষ তো সোজা নয়, পঁচিশটা বছর স্রেফ লুকিয়ে রেখেছে আমার এই হাতব্যাগে। আমাদের ছেলের বয়েস ঊনষাট।

গেটওয়ে টু রবেন আইল্যান্ড

আমার প্রবল দুঃখ, কেপটাউন ছেড়ে যাবার সময় হয়ে এল, রবেন আইল্যান্ডে যাবার সঙ্গী পাচ্ছি না। সারা দিনে অনেকগুলো ফেরি যাওয়াত করে, কিনতু নন্দনা বেচারির কোনও দিনই অতক্ষণ সময় একটানা ছুটি নেই। সকালের দিকে জাহাজ ধরে রবেন আইল্যান্ডে যেতে হয়, দেখাশুনো সেরে মানুষ বিকেলের দিকে ফিরে আসে। আমাদের এই মারিনা অ্যাপার্টমেন্টের পাশ থেকেই রবেন আইল্যাণ্ডের জাহাজ ছাড়ে, ওয়াটারফ্রন্টের লাইট হাউসের কাছে তার ফেরিঘাট আছে। নাম নেলসন ম্যাণ্ডেলা গেটওয়ে। আমি যত বলছি একাই চলে যেতে পারব, কোনও মুশকিল হবে না, কিন্তু টুম্পুশি মাকে কিছুতেই জাহাজে করে একা একা যেতে দেবে না।

এই দক্ষিণ আফ্রিকাতে সে আমার অভিভাবক! মা জননীর যতই বুকের পাটা থাকুক, তার নড়বড়ে পদযুগলকে মেয়ে বিশ্বাস করে না। জাহাজ তো নিজেও টলোমলো করে, আর মা এমনিতেই টলোমলায়মানা। সে মায়ের সঙ্গী জোগাড়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রবেন আইল্যান্ড না গিয়ে কেপটাউন থেকে কলকাতা ফিরে আসা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর। কবে থেকে শুনে আসছি নেলসন ম্যাণ্ডেলা সিসুলুদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বন্দি করে রেখেছিল ওই চরম শাস্তির দ্বীপান্তরে, অপারথেইডে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে। আন্দামানের সঙ্গে তুলনীয় ওই দ্বীপ, শুধু এটা মূল ভূখণ্ডের অনেক কাছাকাছি। কিন্তু কোনও বন্দি প্রাণ নিয়ে পালাতে পারেনি সেখান থেকে। পেনি আর রবার্টের সঙ্গে কথায় কথায় জানা গেল পেনিত তার বন্ধুদের সঙ্গে তিন তিন বার রবেন আইল্যান্ডে গিয়েছে,রবার্টের একবারও যাওয়া হয়নি। ব্যস, তৎক্ষণাৎ ঠিক হল রবার্ট আর আমি, আমরা দু’জনে মিলে যাব রবেন আইল্যান্ডে বেড়াতে। অমনি হাই ফাইভ, আমাদের হাতে হাতে থাবড়া পড়ে গেল—দ্যাটস আ ডেট!

দেশে ফিরে আসার আগের দিন গেলুম দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দামান! ম্যাকসিমাম পেনাল্টি প্রিজন, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের কারাগার, রবেন আইল্যান্ড। রবার্টের সঙ্গে খুব গল্প করতে করতে জাহাজে সময় কেটে গেল, আজ আকাশে সূর্য ছিলেন, কী ভাগ্য বৃষ্টি হয়নি। ঝড় বৃষ্টির দিনে ফেরি ছাড়ে না। কেপটাউনের মোটে মতিস্থির নেই, এই বৃষ্টি এই রোদ্দুর! আহ্লাদী সুয়োরানির মতো প্রকৃতি।

রবার্ট যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, সেখান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র-ছাত্রী আইন পাস করেছেন। এদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান নেতারা, সিসুলু, ম্যাণ্ডেলা সকলেই আইনজ্ঞ এবং ইউনিভারসিটি অফ ফোর্ট হেয়ার এর প্রসিদ্ধ আইন বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের দেশেও এই ধারাটি ছিল, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে আইনজ্ঞ ছিলেন কত জন, ভাবুন? ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার ফসল এঁরা সকলেই, নেলসন ম্যাণ্ডেলাও। প্রসঙ্গত ম্যাণ্ডেলার আদি নাম ছিল রোলিহলাহলা। মানে যে ঝামেলা বাধায়। এটি একটি থেম্বু নাম, উনি ছিলেন থেম্বু উপজাতির রাজবংশীয়। নেলসন নাম তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর মাস্টারমশাই, ব্রিটিশ লর্ড নেলসনের নাম থেকে। ম্যাণ্ডেলার এ বিলিতি নাম একটুও পছন্দ ছিল না।

ম্যাণ্ডেলা তাঁর আত্মজীবনীতে নিজের বড় হওয়া বিষয়ে লিখেছেন, তাঁদের সব কিছু হল ব্রিটিশ। ব্রিটিশ ধ্যান ধারণাই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। ব্রিটিশ শিক্ষা ব্রিটিশ আইন, ব্রিটিশ জীবনদর্শন, ব্রিটিশ ভাবনাচিন্তা, ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান, ব্রিটিশ সংস্কৃতি, যা কিছু ব্রিটিশ সবই তাঁরা সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে মনে করতে শিখেছিলেন। আফ্রিকার সংস্কৃতি বলেও যে কিছু থাকতে পারে, এরকম কোনও ধারণাই তাদের প্রাপ্ত শিক্ষা থেকে তৈরি হয়নি। সে ধারণা তিনি পেয়েছিলেন পরে, তাঁর নিজস্ব উপজাতির এক বর্ষীয়ান নেতার কাছ থেকে।

জাহাজ থেকে নামার পরে ওরা বাসে তুলল আমাদের, দ্বীপটি মোটামুটি ঘুরিয়ে দেখাল প্রথমে। ঝোপে ঝাড়ে দু’ধরনের বুনো হরিণ দেখা গেল, এমন কিছু সুন্দর না। অনেক সিন্ধু সারস, বক। গভর্ণরের প্রাসাদ এখন কনফারেন্সের হোটেল হয়েছে, সাহেবদের ক্লাব হাউস হয়েছে বাচ্চাদের ইস্কুল। চার্চ অফ দ্য গুড শেপার্ড, এটি কুষ্ঠ রোগীরা নিজের হাতে তৈরি করেছিল, কালো আফ্রিকানদের নিজেদের গির্জে। আর্কিটেক্ট লরি বেকারের পরিকল্পিত এই ছোট্ট সুন্দর গির্জেটি। আমি কেরালাতে তাঁর অনেক কাজ দেখেছি, আমাদের বন্ধু কে এন রাজ, টি এন কৃষ্ণণ, লীলা গুলাটি, এঁদের চমৎকার বাড়িগুলি এই দক্ষিণ আফ্রিকার আর্কিটেক্টের তৈরি। হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, সেই সস্তার মালমশলা দিয়ে অপূর্ব টেকসই বাড়ি বানানো এঁর বৈশিষ্ট্য। পুরনো লাইটহাউসটি দেখেিয় বাস আমাদের নিয়ে গেল একটা বেড়া -ঘেরা খটখটে ন্যাড়া উঠোনের মধ্যে ছোট্ট একটা ঘরের সামনে। সেকালের মুনি ঋষিরা তপস্যা করার জন্যে যেমন ঘরে থাকতেন বলে আমরা সিনেমা থিয়েটারে দেখি, তেমনি। শুধু গাছপালা, ঘাসটাস নেই। রুক্ষ, শুণ্য, নিষ্প্রাণ। জনপ্রাণীর চিহ্নহীন। গোটা চেহারাটার মধ্যেই একটা নিষ্ঠুরতার ছাপ লেগে আছে। শুনলুম এট একটি আইসোলেটেড সিঙ্গল সেল জেলখানা, এখানে রবার্ট সোবুকুয়েকে রাখা হয়েছিল। ছ’জন সাদা আফ্রিকান প্রহরী ছিল ওঁকে আগলাতে, দু’বেলা দরজা খুলে লাথি মেরে খাবারের বাটিটা ঢুকিয়ে দিত, কিন্তু তাদের কারুর সঙ্গে বাক্যালাপের অনুমতি ছিল না তাঁর। সরকার বছরে মাত্র একটি দিন বাড়ির লোকেদের সঙ্গে দেখা করার অনুষ্ঠানিক অনুমতি দিত। আবেদনের ছ’মাস বাদে সরকার দর্শকের দিন স্থির করে দিত। সেদিন যদি ঝড়ে জলে জাহাজ না ছাড়ে, তা হলে নতুন করে আবেদন, আবার ছ’মাস অপেক্ষা। যখন সোবেকুয়ে ওখানে একক কুঠুরিতে বন্দি, তখন ম্যাণ্ডেলাও রবেন আইল্যান্ডে বন্দি ছিলেন, কিন্তু দ্বীপের অন্যদিকে, অন্য জেলের ভিতরে। কেউ জানতে পারনেনি অন্য জনের উপস্থিতির খবর। অথচ ওঁরা প্রথম থেকেই পিরলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের সহকর্মী ছিলেন। সেই দ্বীপে ছ’বছরের কারবাসের মধ্যে কখনও দেখা হয়নি। সোববুকুয়ের সঙ্গে কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তির। একাকিত্বের ভার সবাই বহন করতে পারেন না। সকলের মানসিকতা সমান শক্তিসম্পন্ন হয় না। প্রবল ডিপ্রেশানে স্নায়ু জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন সোবুকুয়ে। ভগ্ন দেহে, ভগ্ন মনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ৫৪ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন সোবকুয়ে, তবু মুক্তির মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে সুযোগ পাননি। সোবকুয়ের অপরাধ ছিল, তিনি কালো মানুষদের ‘পাসবই পরিচিতিপত্র বহন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে একত্র করেছিলেন। নিজের দেশের ভিতরে যাতায়াত করতে, এধার থেকে ওধারে যেতে পাসপোর্ট লাগবে, শুধু কালো বলেই, এ কেমন অন্যায় ব্যবস্থা? এ কখনও চলতে পারে না। তাঁর ডাকে শাপভিলে পাসবই বিরোধী প্রতিবাদ সভাতে প্রচুর কালো মানুষ জড়ো হয়েছিলেন সারা দেশ থেকে। আপারথেইড সরকার গুলি চালিয়েছিল, ২১ মার্চ ১৯৬০, মারা গিয়েছিলেন ৬৯ জন কালো মানুষ। স্পেশাল পার্লামেন্ট এর সেশন ডেকে সোবুকুয়েকে রবেন আইল্যান্ডের আইসোলেটেড সিঙ্গল সেল এ দীপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। শার্পভিল ম্যাসাকার আফ্রিকার ইতিহাসে কালিমালিপ্ত দিন,২১ মার্চ এখন সেখানে হিউম্যান রাইটস ডে।

সিসুলু এবং ম্যাণ্ডেলার কিন্তু দেখা হত, তাঁরা একই জেলের বিভিন্ন সেলের বাসিন্দা ছিলেন। উঠোনে যখন বন্দিদের গতরে খাটানো হত সেখানে তাঁরা দুজনেই কাজ করতেন। আমরা তাদের দু’জনের কথোপকথনের একটি বড় ফটোগ্রাফ দেখলুম জেলের ভিতরে। পরনে স্বাভাবিক ভদ্রস্থ জামাকাপড়। শার্ট প্যান্ট জ্যাকেট জুতো -মোজা সবই আছে।

অথচ এই যে শুনলুম কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিদের একটা হাতকাটা ফতুয়া আর হাফপ্যান্ট পরিয়ে রাখা হত সারা বছর, কী শীতে কী গ্রীষ্মে। খালি পা। জুতো মোজা নেই। —শীতে শীতবস্ত্র নেই। তাহলে এই ছবিতে কেন এই রকম? গাইড জানালেন ওইদিন ইনস্পেকসনে এসেছিলেন সরকারি হর্তাকর্তা কেউ একজন( নামটা আমার মনে নেই)। সেদিন বন্দিদের স্পেশাল ট্রিটমেন্ট মিলত। অন্যান্য দিনে বাক্যালাপের সুযোগও সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু কালার্ড বন্দিদের বেলায় আলাদা নিয়ম। তাদের পুরোহাতা শার্ট ফুলপ্যান্ট, শীতের জ্যাকেট, জুতো মোজা দেওয়া হত। দক্ষিণ আফ্রিকাতে দেহবর্ণ অনুসারে নাগরিকদের শ্রেণিভেদ ছিল। সবচেয়ে নিচে কালোরা, যাদের মাতৃভূমি আফ্রিকা। সবচেয়ে উপরে শ্বেতাঙ্গ শাসক ঔপনিবেশিক। মাঝখানে কালার্ড এরা সংকরজাতি, কালো মেয়েদের সঙ্গে সাদা পুরুষের সম্পর্কের ফল। সাদারা এদের পিতৃত্ব স্বীকার করে নিজেদের নাম, ও স্পেশাল সুযোগ সুবিধে দিত। কালার্ড বন্দিদের খাদ্যও ছিল আলাদা। ম্যাণ্ডেলারে টানা একমাস ধরে শুধু পরিজ ডায়েট দিত, দুধ চিনিবিহীন জোলো পরিজ এক বাটি, চুমুক দিয়ে খেয়ে নেবার মতো। দু’বেলাই তাই। খাবে খাও। না পারলে খেয়ো না। পেটে কিল মেরে থাক। প্রকৃতিকেও নানা ভাবে অপব্যবহার করা হত অত্যাচারের জন্যে। ম্যাণ্ডেলার বইতে এই রবেন আইল্যান্ডে আর পিল্সনুর জেলে থাকার বর্ণনা আছে, সেখানে আফ্রিকানদের প্রহরীদের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনিও আছে। পিল্সনুর জেলখানা কেপটাউনের ঠিক বাইরে, দেখেছিলুম বাইরে থেকে নিষ্ঠুরতার জন্য নিন্দিত কারাগার। সেখানে সাধারণ অপরাধীদের সঙ্গে খুনি আসামিদের সঙ্গে রাজনৈতিক অপরাধীদের রাখা হত। আজও যাবজ্জীবন দণ্ডিত বন্দিরা আর তুচ্ছ অপরাধের কিশোর আসামিরা একত্রে থাকে। অল্পবয়সিদের নিয়মিত ধর্ষণ করে অত্যচার চালায় পাকা দীর্ঘমেয়াদি আসামিরা। মাদকের ব্যবসায়ীদেরও ঠাঁই ওইখানে। নেশার অভ্যাস হয়ে যায়, বেরিয়েও এলেও আবার সেধে অপরাধ করে জেলে ফিরে যায় পিরের বন্দিরা। বাইরে বেশিদিন থাকা তাদের পোষায় না। নেশার টানে চোর হয়ে ওঠে খুনি।

আমাদের গাইডের নাম স্পার্ক, তিনি নিজেও একদা এই জেলে রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন সাত বছর, কিন্তু এক কামরাতে, নয় তাঁর ঘরও দেখালেন, বেশ বড় আলো বাতাসওলা হলঘর ডরমিটরি। জনা পঞ্চাশেক বন্দি থাকতে পারে। এখন এখানেই চাকরি করেন, সংসার করেছেন, মেয়ে এখানে ইস্কুলে পড়ে।

ম্যাণ্ডেলা তাঁর ২৭ বছরের কারবাসের মধ্যে ১৮ বছরই কাটিয়েছিলেন এই রবেন আইল্যান্ডে। তাঁর একক বন্দিত্বের সরু লোহার কুঠুরিটা সবাইকে দেখানো হয়। তিনটে কম্বল, একটি বালতি, একটি টুল। একটি বাটি, একটি চামচ। একটি কম্বল ভাঁজ করে মাথার বালিশ হয়, একটা মেজেতে পাতার তোশক, একটি গায়ের। একটি বিছানা। শীতে খুব শীত আর গ্রীষ্মে খুব গরম। মলমূত্র ত্যাগের জন্য ওই বালতি আছে ঘরের কোণে। নিজেকেই পরিষ্কার করতে হয় যখন বাইরে উঠোনে পাথর ভাঙতে নিয়ে যাওয়া হয় বন্দিদের। সেই ছবিও আছে, সারি বন্দি উঠোনে পাথর ভাঙছেন ম্যাণ্ডেলা সিসুলুরা। তারই ফাঁকে কিন্তু লিখিত হয়ে গিয়েছিল ম্যাণ্ডেলার বিখ্যাত আত্মজীবনী, ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’। এই বাগানের গাছগাছালির ফাঁকে লুকিয়ে রাখতেন বইটি। নিজের হাতে বাগান করতেন ম্যাণ্ডেলা, তাই ওকেই দিয়েছিল বাগানের যত্ন নেবার ভার। বার বারের চেষ্টায় সেই বই অবশেষে গোপনে পাচারও হয়ে গিয়েছিল কেপটাউনের ছাপাখানাতে। যদিও প্রকাশিত হয়নি তাঁর মুক্তি পাবার (১৯৯১) আগে, এবং ১৯৯৪-এ স্বাধীনতার পরে ১৯৯৫-তে অ্যালান পেটন পুরস্কার পায়। বইটি উৎসার্গিত তাঁর ছয় সন্তানের নামে ও নাতি নাতনিদের প্রতি। উৎসর্গপত্রে নেই উইনি ম্যাণ্ডেলার নাম, দীর্ঘ ২৭ বছর যখন তিনি জেলে, উইনি তখন একা সন্তানদের সামলে শক্ত হাতে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন গোপনে। পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত জীবন যাপনে উইনি নানান ভ্রান্ত পথে বিচরণ করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ ছিল। তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটেছিল উইনিরই প্রেম বাতিকের কল্যাণে। কিন্তু এত ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও ইতিহাস স্বীকার করে উইনির দীর্ঘ, দৃঢ় সহায়তা ভিন্ন দক্ষিণ আফ্রিকার এই মুক্তিযুদ্ধ সার্থক হত না। আজও দক্ষিণ আফ্রিকাতে বিশেষত মেয়েদের মধ্যে ‘মাম্মা উইনি’ এক জনপ্রিয় ডাকনাম।

একটি পাঠশালা অবশ্য ছিল বন্দিদের জন্যে, একটা বন্ধ দরজাতে ‘স্টাডি’ লেখা দেখলুম, ভিতরে যাইনি কেউ, জানি না কী ধরনের বইপত্র থাকত, কেমন বসার ব্যবস্থা, কতক্ষণ পড়ার অনুমতি ছিল।

দ্বীপান্তরিত বন্দিদের শ্রেণিভাগ ছিল, এ, বি, সি। অপরাধ অনুযায়ী এক এক শ্রেণির বন্দির শাস্তি এক এক জাতীয়। শুধু কামরার ফারাক, খাদ্যের তফাত নয়, শুধু পোশাক-আসাক নয়, বন্দিত্বের মেয়াদ, শ্রমের কঠোরতাই নয়, এমনকী শ্রেণী অনুযায়ী অতিথিদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার অধিকারেরও প্রচুর পার্থক্য ছিল। সি ক্লাসের কয়েদির বছরে একদিন মাত্র অতিথি সন্দর্শন, আধ ঘন্টা। বি ক্লাসের বছরে দু’দিন, ওই আধ ঘন্টা করে। আর এ ক্লাসের বেলাতে বছরে চার দিন, প্রতিবার আধ ঘণ্টার মেয়াদ। আত্মীয় বা বন্ধুদের ছ’মাস আগে আবেদন করতে হবে, আবেদন গৃহীত হলে, সরকার দেখা করার দিন নির্দিষ্ট করে দেবে, তখন জাহাজ ধরে যাত্রা। আর ধরুন যদি সেদিন ঝড় জলে জাহাজ ছাড়ল না। এরকম এখনও হয়। ফেরি ক্যানসেল তো আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টও ক্যানসেল। এমনকী আবেদনও বাতিল। সময় তো দেওয়া হয়েছিল, জাহাজ নেই তো সাঁতরে আসনি কেন? আবার নতুন করে আবেদন করা চাই, আবার ছ’মাস ধরে আকুল, অধীর প্রতীক্ষা। সি শ্রেণীর কয়েদি হলে হয়তো সেই বছরের মতো আর প্রিয়জনদের মুখ দেখাই হল না। সিঙ্গল সেলে বন্দি হলেও ম্যাণ্ডেলা, সিসুলুরা আইসোলেটেড ছিলেন না সোবুকুয়ের মতো। অন্যান্য বন্দিদের পরস্পরের সঙ্গে চোখের দেখা হত উঠোনে শ্রমদানের সময়ে। ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’এ রবেন আইল্যান্ডের বিষয়ে অনেক কথা আছে। তাঁর ২৭বছর কারাগারবাসের দীর্ঘতম সময় ১৮ বছর কেটেছে রবেন আইল্যান্ডের এই ঘুপচি লোহার কুঠুরুরিটিতে। বাকি নবছর অন্য দু-দুটি জেলখানায়

কেপটাউনে পার্লামেন্টের সদস্য নাটালের প্রতিনিধি মেওয়া রামগোবিন মণিলাল গান্ধির কন্যা এলাকে বিয়ে করেছিলেন। এখন তাঁরা বিচ্ছিন্ন বটে কিন্তু রামগোবিন গান্ধির একান্ত ভক্ত। সত্যাগ্রহের শতবর্ষ উদযাপন করতে রামগোবিন সরকারের পক্ষ থেকে রবেন আইল্যান্ডে একটি জবরদস্ত স্মারক সভা ডেকেছিলেন, ও সভার ৩০০ আমন্ত্রিতকে ভারতীয় ভোজ দিয়েছিলেন সেই দ্বীপে। আমাকে তার ডিভিডি উপহার দিয়েছেন। এই বছরে নানা ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে সত্যাগ্রহের ১০০ বছর নিয়ে উৎসব হচ্ছে। পিটার মারিসবার্গে গান্ধির মূর্তির কাছে শুনেছি ম্যাণ্ডেলার মূর্তি বসছে।

শহরের ফেরার সময় হয়ে এল আমাদের, এবারে জাহাজঘাটে হেঁটে ফেরো। বাস নেই। আমি তো হাঁটতে পারব না, হাতে লাঠি থাকার কল্যাণে একটি গাড়ি জুটিয়ে আনলেন প্রহরীমশাই। একটা মজা হল, জেলখানা দেখতে দেখতে। আমাদের দলে একটি ভারতীয় পরিবার ছিল, দুটি শিশুসমেত স্কার্ট পরা তরুণী মেমসাহেব মা, তার সালোয়ার কামিজ পরা মা বা শ্বশ্রুমাতা, নিজেরা হিন্দিতে কথা বলছেন। বাদামি স্বামী ছবি তুলতে ব্যস্ত। এত বড় টিপ পরা শাল নেওয়া আমাকে ছেড়ে গাইড হঠাৎ তরুণী মেয়েটিকে এক গাল হেসে বললেন, “তুমি তো ভারতীয়?”মেয়ে ফোঁস করে উঠল, ‘মোটেই নয়, আমি এখানকার লোকাল। গাইডও তেমনি। ছাড়ে না। “ কিন্তু তোমরা তো আদিতে ভারতের লোক?”

মেয়েটি আরও চটে উঠে বলল, “একেবারেই ভুল, আমি খাস কেপ্টোনিয়ান। এখানেই জন্ম কর্ম। আমি ভারতবর্ষ জানি না।”

তার সঙ্গীরা নীরব। তার শিশুরা মুগ্ধ। গাইড এবারে আর ঘাঁটালেন না।

আমি বাপু বেশ বিরক্ত হলুম মনে মনে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভারতীয় উপমহাদেশের লোক, যে কেউ বুঝবে, আর সমানে অস্বীকার করে চলেছে নির্বোধের মতো?

রবার্ট পরে আমাকে বুঝিয়ে বললেন, “মেয়েটার তত দোষ নেই। এখানে ইমিগ্রেশন নানা ঝামেলা শুরু করেছে দিশি বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে, তাই এরা এত অ্যালার্ট হয়ে গিয়েছে সাউথ আফ্রিকান আইডেন্টিটি বিষয়ে। ইমিগ্রেশন পুলিশের ভয়ে ওরকম অ্যাগ্রেসিভ আচরণ করেছেন মেয়েটি।”

আমি বুঝি, যদিও এখানে ইমিগ্রেশন পুলিশের নজর নেই, তবু ম্যাক্সিমাম সিকিওরিটির জেলখানার নিজস্ব একটা ভয়াবহ আবহাওয়া আছে তো, স্বভাবতই মানুষের বিপন্ন লাগে। আত্মরক্ষার প্রবণতা জন্মায়।

ফিরে আসবার সময়ে দেখতে পেলুম অনেক পেঙ্গুইন আর করমোর‍্যান্ট পাখি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে রবেন আইল্যাণ্ডে, মুক্ত প্রাণী। তারা উড়ে বেড়ায় না, হেঁটে বেড়ায়। আর গভীর জলে ঝাঁপ দিয়ে মাছ ধরে। তাদের কেউ ধরে না, মারে না আক্রমণ করে না। দক্ষিণ আফ্রিকার বনে জঙ্গলে মাঠে ঘাটে জন্মানো সুন্দর অসুন্দর যাবতীয় স্বভূমিজাত বন্য উদ্ভিদের মতো, এদেশের পশুপাখিরাও সকলেই সরকারের আইনে সংরক্ষিত। কেপটাউনে একদিন বেড়াতে বেরিয়ে বনের মধ্যে একটা ঝোপের থেকে ল্যাভেণ্ডারের তীব্র সুগন্ধ পেয়ে আমি যেই একটু পাতা ছিঁড়ে হাতে করে ডলেছি, অমনি আমার সঙ্গী, জিল আর নির্মলের ছেলে টিউনিন হাঁ হাঁ করে ওঠে, “ছিঁড়ো না ছিঁড়ো না কেন জানে কোন ঝোপটা কোন্ সংরক্ষিত উদ্ভিদ! এখুনি ধরে ফাইন করে দেবে।” কেপটাউনে ‘ফাইন বোস’ বলে নিজস্ব বুনো উদ্ভিদগুলি (আফ্রিকান্স ভাষাতে তার মানে, ফাইন বুশ, সুন্দর গুল্ম) সব সংরক্ষিত। যখন ফুল ধরে তখন নাকি অপূর্ব দৃশ্য হয়, বনেবাদাড়ে নন্দন কানন। চতুর্দিকে নানা ধরনের বুনো ঝোপঝাড় আছে, সব কিছুর নাম ফাইন বোস। এদের জাতীয় পুষ্প, প্রোটিয়ারও নানান বিভিন্ন প্রজাতি আছে, ছোট থেকে বিশাল, ঘাস ফুলের মতো থেকে পদ্মফুলের মতো আকার। আর কত যে রঙের বাহার তার। সেও বনে বাদাড়ে আপন মনে প্রভূত পরিমাণে মোহিনী মায়া ছড়িয়ে ফুটে থাকবে, কিন্তু তুমি মুগ্ধ হয়ে তাকে স্পর্শ করে ফেললেই ফাইন। রবেন আইল্যান্ডে কিন্তু ফুলটুল কিছু চোখে পড়ল না। ঘাসও খুব বেশি নয়, রুক্ষ পাথুরে জমি, জেলখানারাই উপযুক্ত মেজাজ এই দ্বীপের মাটির।

জাহাজে করে ফেরার পথে বেশ খিদে পেয়ে গেল, কিন্তু জাহাজের খাদ্য কিনে খাওয়ার প্রশ্ন নেই। আজেবাজে খাবারের আজে বাজে দাম। হঠাৎ দেখি সকলেই দাঁড়িয়ে উঠেছে, চেঁচামেচি করে ক্যামেরা নিয়ে জানলাতে আর ডেকে ছুটছে। আমি তো হুজুগে বাই নেচার। কী ব্যাপার? কী ব্যাপার? এক পাল ডলফিন আমাদের জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে ডিগবাজি খেতে খেতে আসছে। হায়, সবাই ছবি তুলল আমি ছাড়া। একটু বাদে আবার হট্টগোল। আবার এসেছে ওরা? না না, এবারে ওরা নয়, শান্তশিষ্ট সীল মাছেরা সাঁতার দিয়ে আমাদের পাশে পাশে আসছে। কিন্তু কেউই বেশি দূর আসে না, তীরের কাছাকাছি যাবার ইচ্ছে নেই তাদের, একটু পরে ফিরে যায়।

বন্দরে নেমে দেখি আরে বাব্বাঃ চমৎকার জায়গায় নেমেছি। আশে পাশে শুধুই ভাল ভাল খাবারের দোকান, ছাতার তলায়, শামিয়ানার তলায়, রোদ্দুরের মধ্যে, ঘরের ভিতরে। যা চাইবে তাই পাবে। ভারতীয় খানা, ইতালীয় খানা, থাই, চিনে, মার্কিনি ফাস্ট ফুড। আমরা একটি সুশ্রী ছাতার তলায় বসে আরাম করে লাঞ্চ খেলুম, হ্যারিস প্যানকেক হাউসে। অ্যাভোকাডো আর মাশরুমের অসাধারণ একটি প্যানকেকের স্বাদ এখনও জিবে জড়িয়ে আছে। সঙ্গে কফি। সাউথ আফ্রিকাতে এসে অবধি আমি চা খাই না, বড় বিশ্রী চা এদের। রুবিবস (রবি বোস) নামে লাল টুকটুকে, টক টক চা এরা গর্ব করে পান করে। আর যাই হোক পানীয়টি চা নয়। কিন্তু কফিটা দারুণ! হ্যারিস প্যানকেক হাউসের সামনেই উঠোন আছে লাইট পল্লীগীতি গাইছিলেন এক দল শিল্পী। খুবই ভাল আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছিল এই ভর দুপুরেও। এক সময়ে শূন্য থেকে যেন উড়ে সেখানে এসে পড়লও এক সারি নীল পোশাক পরা আফ্রিকান তরুণের দল। হইহই করে এসেই তারা নাচগান শুরু করে দিল। তাদের সঙ্গে নৃত্যের তালে তালে বাজানো শুরু করলেন বাদ্যকরেরা। দারুণ জমে উঠল মধ্যাহ্ন ভোজের আসর।

খাওয়া সেরে উঠে পড়েছি, উপরে রাস্তাতে এসে গাড়ির পার্কিং এর দিকে যাত্রা শুরু করেছি। দেখি একটি ভারতীয় পরিবার আসছেন, শাড়িপরা এক মহিলা আছেন সঙ্গে। এখানে এসে পথেঘাটে এই প্রথম শাড়ি। মহিলা সোজা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, নমস্কার। নবনীতা দেব সেন? আমি উত্তর দেবার আগেই তাঁর স্বামী বললেন, আমি তো তখন থেকেই জানি। ছবি দেখেছি, টিভিতে দেখেছি। কলকাতার লোক, ছেলেবউ এর কাছে জোহেনসবর্গে এসেছেন, তারা মা বাবাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। এখন যাচ্ছে রবেন আইল্যান্ডে। ছেলেবউ দুটি নেহাত বাচ্চা ছেলে মেয়ে। তারা প্রণাম করে বলল, আপনার সব লেখা পড়ি যা কিছু চোখে পড়ে। আবার কী চাই! মন ভরে গেল। এত দূরের দেশেও পাঠক জুটে গেল, জগতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

রবার্ট গেলেন গাড়ি আনতে, আমি একটা জায়গায় বসে থাকি। সেখানে কয়েকজন ভারতীয় দর্শন তরুণ বসে ছিলেন। কথায় কথায় জানতে পারি তাদের দু’জন তেলুগু ভাষী, দুজন বাঙালি, একজন সিন্ধি। সকলেই নাবিক। চারমাস তেলের জাহাজে সমুদ্রে বাস করে, পৃথিবী ঘুরে এবারে ভুমিষ্ঠ হয়েছেন। তিনটে দিন পরেই অকাশে উড়বেন, দেশের পথে। আজ বেরিয়েছেন কেপটাউন বেড়াতে। গল্প করতে করতে গাড়ি এসে গেল। একটি ছেলে সসংকোচে বললে, আচ্ছা কিছু মনে করবেন না দিদি, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। আপনি কি কখনও টিভিতে খবর পড়তেন?

আমি হেসে বলি, না।

রবার্ট গাড়ি নিয়ে এসে যান। ছেলেগুলি উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় জানায়। বোঁ ভোয়াজ! নাবিক ছেলেদের বলি, শুভ যাত্রা। ভালয় ভালয় বাড়ি যাও ঘরে ছেলেরা ঘরের যাও। আহা, আমিও যে মনে মনে তোমাদেরই একজন, তোমাদের সঙ্গে যে আমার নাড়ির যোগ আছে, তোমরা তো সেটা জান না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *