দৈব ও পুরুষকার

দৈব ও পুরুষকার

‘কথামৃতে’ আমরা দেখি, একদিন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার আর গিরিশ ঘোষের মধ্যে তর্ক হচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন শ্যামপুকুরের এক ভাড়াবাড়িতে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ আছেন, মাস্টারমশাইও আছেন। ঠাকুরের কাছে যাঁরা আসতেন অনেক সময় তাঁদের মধ্যে এরকম তর্ক-বিতর্ক হত, অনেক সময় তিনি নিজেই তর্ক বাধিয়ে দিতেন। সেসব তিনি উপভোগ করতেন, আবার মাঝে মাঝে নিজের সিদ্ধান্ত তাতে যোগ করে দিতেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: ঈশ্বরের ইচ্ছায় সবকিছু হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছা বই একটি পাতাও নড়বার যো নাই!

ডাক্তার—যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা, তবে তুমি বকো কেন? লোকেদের জ্ঞান দেবার জন্য অত কথা কও কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি বলাচ্ছেন তাই বলি। ‘আমি যন্ত্র—তিনি যন্ত্রী।’

ডাক্তার—যন্ত্র তো বলছো; হয় তাই বল, নয় চুপ ক’রে থাকো। সবই ঈশ্বর।

গিরিশ—মশাই, যা মনে করুন। কিন্তু তিনি করান তাই করি! A single step against the Almighty wil, কেউ যেতে পারে? (১-১৭-৪) ঈশ্বর অনন্ত শক্তিমান, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি কেউ কিছু করতে পারে?

ডাক্তার—Free Will তিনিই দিয়েছেন তো। আমি মনে করলে ঈশ্বর চিন্তা করতে পারি, আবার না করলে না করতে পারি।

গিরিশ—আপনার ঈশ্বর চিন্তা বা অন্য কোন সৎ কাজ ভাল লাগে বলে করেন। আপনি করেন না, সেই ভাল লাগাটা করায়। (ঐ) অর্থাৎ আপনার Free will বলে কিছু নেই। ডাক্তার সরকার মানছেন না, বলছেন: আমি কর্তব্য কর্ম মনে করে করি। ধর, একটি ছেলে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, তাকে আমি কর্তব্য বোধে বাঁচাতে যাই।

গিরিশ—ছেলেটিকে বাঁচাতে আনন্দ হয়, তাই আগুনের ভিতর যান; আনন্দ আপনাকে নিয়ে যায়। (ঐ)

শ্রীরামকৃষ্ণ তখন বলছেন: কর্ম করতে গেলে আগে একটি বিশ্বাস চাই, সেই সঙ্গে জিনিসটি মনে করে আনন্দ হয়, তবে সে ব্যক্তি কাজে প্রবৃত্ত হয়। মাটির নীচে এক ঘড়া মোহর আছে—এই জ্ঞান, এই বিশ্বাস, প্রথমে চাই। ঘড়া মনে করে সেই সঙ্গে আনন্দ হয়—তারপর খোঁড়ে। খুঁড়তে খুঁড়তে ঠং শব্দ হলে আনন্দ বাড়ে। তারপর ঘড়ার কানা দেখা যায়। তখন আনন্দ আরও বাড়ে। (ঐ)

অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশ ঘোষকেই সমর্থন করছেন। ডাক্তার সরকার বলছেন: ডিউটি (কর্তব্য কর্ম) করতে গেলে কেবল আনন্দ হয় তা নয়, কষ্টও আছে! (ঐ) তখন মাস্টারমশাই বলছেন: পেটে খেলে পিঠে সয়। কষ্টতেও আনন্দ। (ঐ) সেই আনন্দের জন্যই কষ্টটা আপনি বরণ করে নেন।

,গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি)—(ডিউটি) সরস; নচেৎ ডিউটি কেন করেন? (ঐ)

ডাক্তার—এইরূপ মনের ইন্‌ক্লিনেসন্। (ঐ) মনটা ঐ দিকে যেতে চাচ্ছে। মাস্টারমশাই হেসে বলছেন; যদি এক দিকে ঝোঁকই (ইন্‌ক্লিনেসন): হলোFree will কোথায়? (ঐ) স্বাধীন ইচ্ছা বলে তাহলে আর কিছু থাকল না।

বাস্তবিক, এটা একটা বিরাট প্রশ্ন—Free will or God’s will? স্বাধীন ইচ্ছা না ঈশ্বরের ইচ্ছা? অর্জুন বলছেন: আমি যুদ্ধ করতে পারব না। আত্মীয়স্বজনদের বধ করে আমি রাজ্য ভোগ করতে পারব না। শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালেন, বললেন: তুমি মারবে মনে করছ? এই দেখ, আমি এদের আগেই মেরে রেখে দিয়েছি। ‘ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্’—তুমি শুধু নিমিত্ত হও, আমার যন্ত্রস্বরূপ কাজ কর। আমি কিছু না—সব তুমি করছ। কেন করছ জানি না—কিন্তু তুমিই সব করছ। ‘আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী। আমি রথ তুমি রথী, যেমন চালাও তেমনি চলি।।’আমি যা কিছু করছি, সে তুমি আমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছ বলে করছি। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন:

ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি।

ভ্ৰাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।।

—হে অর্জুন, ঈশ্বর সকলের অন্তরে বিরাজ করছেন। সেখানে থেকে তিনি সকলকে তাঁর মায়ার সাহায্যে যন্ত্রের মতো ঘোরাচ্ছেন। রামপ্রসাদ বলছেন: ‘শ্যামা মা উড়াচ্ছো ঘুড়ি ভব সংসার বাজার মাঝে।’ ছোট ছেলেরা যেমন ঘুড়ি ওড়ায়, মা তেমনি ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন আমাদের নিয়ে। আমরা তাঁর ঘুড়ি। মায়ার দড়ি দিয়ে তিনি আমাদের ওড়াচ্ছেন—দড়িটা কিন্তু তাঁর হাতেই রেখে দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমরা স্বাধীন—কিন্তু আসলে আমরা তাঁর হাতে বাঁধা। মূল বক্তব্য হচ্ছে এই যে, সব শক্তির আকর ঈশ্বর। সবকিছুর মূল তিনি। তাঁর থেকেই সব শক্তি। আমাদের স্বাধীন শক্তি কিছু নেই। তাঁর থেকে আমরা আলাদা থাকতে পারি না। তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি’—তাঁর আলোতে সবকিছু আলোকিত হচ্ছে। তিনিই সব। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: সকলই ঈশ্বরাধীন। (২-৪-১) বেদান্তের একটি উপমা আছে—একটা ‘হাঁড়িতে ভাত চড়িয়েছে, আলু বেগুন সব ভাতে দিয়েছ; খানিক পরে আলু বেগুন, চাল লাফাতে থাকে, যেন অভিমান করছে ‘আমি নড়ছি’, ‘আমি লাফাচ্ছি।’ ছোট ছেলেরা দেখলে ভাবে, আলু, পটল, বেগুন ওরা বুঝি জীয়ন্ত, তাই লাফাচ্ছে। যাদের জ্ঞান হয়েছে তারা কিন্তু বুঝিয়ে দেয় যে, এই সব আলু বেগুন, পটল এরা জীয়ন্ত নয়, নিজে লাফাচ্ছে না। হাঁড়ির নীচে আগুন জ্বলছে, তাই ওরা লাফাচ্ছে। যদি কাঠ টেনে লওয়া যায়, তা হলে আর নড়ে না। জীবের ‘আমি কর্তা’ এই অভিমান অজ্ঞান থেকে হয়। ঈশ্বরের শক্তিতে সব শক্তিমান। জ্বলন্ত কাঠ টেনে নিলে সব চুপ।—পুতুলনাচের পুতুল বাজীকরের হাতে বেশ নাচে, হাত থেকে পড়ে গেলে আর নড়ে না চড়ে না! (১-১৭-৪) এই একটি দৃষ্টিভঙ্গি: সবকিছুর মূলে তিনি, তিনি আছেন বলেই সব হচ্ছে। কিন্তু আর-একটি দৃষ্টিভঙ্গিও আছে—‘দোষ কারো নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা’। আমি নিজে একটা কূপ খনন করেছি, সেই কূপের জলে আমি ডুবে মরছি। আমার এই যে বদ্ধ অবস্থা, আমার এই যে দুঃখ কষ্ট—এর জন্য আমিই দায়ী। আমি নিজেই এই অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করব। কোন্ অদৃশ্য শক্তির কাছে আমি মাথা নোয়াব? কার কাছে আমি হাত পাতব? আমি ভিক্ষুক নই—আমি সম্রাট। আমি যে মনে করছি আমি ভিক্ষুক—এটাই আমার মহা ভুল। আমার যত দুঃখের মূলে এই ভুল। এই ভুল আমিই দূর করব। আমি জানব যে, আমি রাজাধিরাজ। এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গি। একদল বলছেন: সব তুমি। আর একদল বলছেন: সব আমি। একদল বলছেন: দৈবই সব। আর একদল বলছেন: না, দৈব নয়—পুরুষকার। এ দুটোর মধ্যে কি কোন সমন্বয় সম্ভব?

এখন, দৈবই যদি সব হয়, তাহলে একটা প্রশ্ন হয়, আমরা যে পাপ করি, ভুল করি, অন্যায় করি—সে-ও তো ঈশ্বরের ইচ্ছায়? তাহলে আমি অন্যায় করে যাই না কেন? কারণ, তাঁর উপরে তো আমার কোন হাত নেই। যখন ঈশ্বরের ইচ্ছা হবে তখন আমি আর অন্যায় করব না। এ যদি হয়, তাহলে, আমাদের সব কর্মপ্রচেষ্টাই অর্থহীন হয়ে যায়। দৈবই যদি সব হবে, তাহলে আর সাধনভজনের কি দরকার? ঈশ্বরের যখন ইচ্ছা হবে তখন তিনি দেখা দেবেন। এখন আমি অন্যায় করে যাই, যা ইচ্ছা তাই করি—তাঁর ইচ্ছায় এ সব করছি, আবার তাঁর যখন ইচ্ছা হবে তখন তিনি দেখা দেবেন। কিন্তু আমরা দেখি যে, যুগ যুগ ধরে সাধকরা ঈশ্বরলাভের জন্য কত কষ্ট করেছেন, কত সাধনভজন করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ গঙ্গার ধারে মুখ ঘষতেন মায়ের দেখা পাচ্ছেন না বলে। তাঁর জীবনী পড়লেই দেখা যায় যে, কী কঠোর তপস্যা তিনি করেছেন। অথচ তিনিই বলছেন: সবই ঈশ্বরাধীন। বাস্তবিক, এটাও একটা বড় রহস্য যে, যাঁরা নিজেরা বলছেন ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা তাঁরাও কিন্তু ঈশ্বরলাভের জন্য কত তপস্যা করেছেন, কত ত্যাগস্বীকার করেছেন। তাহলে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ কথাটার অর্থ কি? শ্রীরামকৃষ্ণের কথা থেকে এর কি উত্তর পাওয়া যায় দেখা যাক।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: (পাপ-পুণ্য) আছে, আবার নাই। তিনি যদি অহংতত্ত্ব রেখে দেন, তা হলে ভেদবুদ্ধিও রেখে দেন, পাপ-পুণ্য জ্ঞানও রেখে দেন। (১-৯-২) এ ভেদ বোধ তাঁরই মায়া—তাঁর মায়ার সংসার চালাবার জন্য বন্দোবস্ত।(১-১৭-৪) ঈশ্বর দর্শন যতক্ষণ না হয় ততক্ষণ ভেদবুদ্ধি ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকবেই থাকবে। তুমি মুখে বলতে পারো, আমার পাপ-পুণ্য সমান হয়ে গেছে। তিনি যেমন করাচ্ছেন, তেমনি করছি। কিন্তু অন্তরে জান যে, ও সব কথা মাত্র; মন্দ কাজটি করলেই মন ধুগ্ ধুগ্ করবে। (১-৯-২) যতক্ষণ না ঈশ্বর দর্শন হয়, যতক্ষণ সেই পরশমণি ছোঁয়া না হয়, ততক্ষণ আমি কর্তা এই ভুল থাকবে। (১-১৭-৪) এ ভ্রম তিনিই রেখে দেন, তা না হলে পাপের বৃদ্ধি হত। পাপকে ভয় হত না। পাপের শাস্তি হত না।(২-৪-১) শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন যে, এটা ঠিকই যে, ঈশ্বরের ইচ্ছায় সবকিছু হচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরলাভ করার আগে পর্যন্ত আমরা সেকথা বলতে পারি না, বললে সেটা ‘মিথ্যাচার’ হয়ে যায়। কারণ, আমাদের ‘অভিমান’ আছে। আমার এই বোধ আছে যে, আমিই করছি। আমি যদি করি, তাহলে আমি ভালও করছি মন্দও করছি। ভাল করলে ভাল ফল পাব, মন্দ করলে মন্দ ফল পাব। শুধু মন্দটার সময় বলা চলবে না যে, ঈশ্বর করছেন। সেই ব্রাহ্মণের মতন হয় না যেন যে, বাগান আমি করেছি আর গরু মেরেছে ইন্দ্র। তা নয়। বাগানও আমি করেছি, গরুও আমিই মেরেছি। ভাল-মন্দ দুই-ই আমি করছি। সত্যি সত্যি সবকিছুই করছেন ঈশ্বর। কিন্তু যতক্ষণ আমার মধ্যে অজ্ঞান-আবরণ রয়েছে, ততক্ষণ আমার মধ্যে ‘আমি কর্তা’ এই বোধ রয়েছে, ততক্ষণ আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য আমি দায়ী। সত্যি সত্যিই যদি আমি বলতে পারি, ‘সকলই তোমার ইচ্ছা’ তাহলে আমার পাপ-পুণ্য কিছু নেই। শ্রীরামকৃষ্ণের যেমন দেখি—শিশুর মতো অবস্থা। শিশুর কোন পাপ নেই। শিশু যদি কোন একটা অন্যায় করে, ভুল করে, আমরা সেটা ধরি না। আইনের চোখেও সেটা কোন অন্যায় নয়। শিশু খেলতে খেলতে একটা হয়তো বন্দুকের গুলি ছুড়েছে, সেই গুলিতে হয়তো তার বাবাই মারা গেলেন। মাঝে মাঝে এরকম ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু শিশুর কোন শাস্তি হয় না। শিশুর কি লক্ষণ? সে নিরভিমান। তার ‘আমি’ বোধ নেই। যদি আমার শিশুর মতো অবস্থা হয়, আমি ভালও বুঝি না মন্দও বুঝি না, ঈশ্বরের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে আছি—তাহলে আমার কোন দোষ-গুণ নেই, পাপ-পুণ্য নেই। শ্রীরামকৃষ্ণের বেলাতে যেমন দেখি, কোন সামাজিকতা নেই। সাধুদের সঙ্গে খেতে বসেছেন। সাধুদের নিয়ম হচ্ছে অনেক মন্ত্র, শ্লোক প্রভৃতি আবৃত্তি করে তারপর খাওয়া আরম্ভ করা। শ্রীরামকৃষ্ণ খাবার পাতে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেতে আরম্ভ করেছেন। আর অন্যান্য সাধুরা বলাবলি করছেন। ‘এ কি?’ কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের কোন দোষ নেই। কোন নিয়ম নেই তাঁর। তিনি যে শিশু। তাঁর কাছে যাঁরা যেতেন তাঁরা বলেছেন তিনি শিশুর মতো চলতেন ফিরতেন। ‘আমি’ নেই তাঁর, ‘আমি’টা মুছে গেছে। কিন্তু এই ভাবটা ঈশ্বর-দর্শনের আগে সম্পূর্ণভাবে আসে না। তার আগে পর্যন্ত আমাকে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে হবে যাতে মনের মলিনতা দূর করতে পারি। ‘সকলই তোমার ইচ্ছা’ বলব ঈশ্বরলাভের পর। তখন সেটা ঠিক ঠিক বলা হবে। তার আগে পর্যন্ত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব: প্রভু, তুমি আমাকে কৃপা কর, যাতে আমি সত্যি সত্যি বলতে পারি, আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্ৰী—মন মুখ এক করে যেন একথা আমি বলতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে আমার বিচার-বুদ্ধি সবসময় জাগ্রত রাখব। কোন্‌টা ভাল, কোনটা মন্দ—এই বিচার সবসময় করতে হবে। বিচার করে মনকে মন্দ থেকে ভালর দিকে নিয়ে যাব। মনকে বোঝাব যে, সব ঈশ্বর করছেন, সব দৈব-নির্ভর; আবার পুরুষকার অবলম্বন করে মনকে ‘অসৎ’ থেকে ‘সৎ’-এর দিকে নিয়ে যাব, ‘Lower Truth’ থেকে ‘Higher Truth’-এর দিকে নিয়ে যাব। সেইজন্য দেখছি, গীতাতে বলছে:‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’— —নিজেই নিজেকে উদ্ধার করবে। এই সংসার-সমুদ্রে তুমি হাবুডুবু খাচ্ছ। তুমিই তোমার ত্রাণকর্তা। তুমি নিজে যদি নিজেকে উদ্ধার না কর—কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত গুরুও বলেন, আমি তো আছি—কিন্তু তুমি অন্তত এক পা এগিয়ে এসো। একজন বক্তৃতা করছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, এক পা যদি তুমি ঈশ্বরের দিকে এগোও তাহলে তিনি দশ পা তোমার দিকে এগিয়ে আসবেন। আর একজন সাথে সাথে বলছেন: না, দশ পা না, হাজার পা তিনি এগিয়ে আসেন। দশ পা-ই হোক কিংবা হাজার পা-ই হোক, সেই এক-পা কিন্তু আমাকে এগিয়ে যেতে হবে। সেইটুকুও যদি আমি এগিয়ে না যাই তাহলে হবে না। স্বামীজী বলছেন: তুমি রসায়নটা ভাল করে জানতে চাও। ঘরে বসে তুমি চেঁচাচ্ছ, হে রসায়ন-বিদ্যা, আমার কাছে তুমি ধরা দাও; আর কিছু করছ না—তাহলেই কি রসায়ন-বিদ্যা জেনে যাবে? কিছু জানতে পারবে না, যদি তুমি পড়াশুনা না কর, ল্যাবরেটরীতে গবেষণা না কর। আমরা বলি, কে পথ দেখাবে? কিন্তু আমাদের চেষ্টাটা যদি আন্তরিক হয়, তাহলে পথ-প্রদর্শকের অভাব হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে আমরা দেখি, গুরু আপনা-আপনি আসছে। তেমনি আমরা যদি আন্তরিক চেষ্টা করি, গুরু আপনা-আপনি এসে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: পুরী যাওয়ার পথ চেনো না। যেতে হবে দক্ষিণ দিকে, যাচ্ছ উত্তর দিকে। কিন্তু ভুল করলেও কেউ-না-কেউ তোমাকে ঠিক পথ বলে দেবে। সেইজন্য বলছেন: দ্বিতীয় কেউ নেই। তুমিই তোমার ভাগ্যনিয়ন্তা। গুরু আছেন। কিন্তু গুরুও কিছু করতে পারেন না যদি আমি নিজে চেষ্টা না করি। গুরু কি করেন? তিনি আমাকে পথ চিনিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে তো আমাকেই হবে। যদি আমি আন্তরিক চেষ্টা করি, আন্তরিক চেষ্টা করেও যদি আমি পথ গুলিয়ে ফেলি কিংবা কোন বিপদে পড়ি, তখন গুরু আমাকে সাহায্য করেন। কিন্তু নিজের চেষ্টা সব সময় দরকার। তাই ভগবান বলছেন: ‘নাত্মানমবসাদয়েৎ’—তুমি নিজেকে অবসন্ন কোরো না; নিজেকে দুর্বল, অক্ষম, হীন ভেব না। শাস্ত্রে বলছে ; এই হচ্ছে আত্মহনন। যে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে সে ক্ষুদ্রই হয়ে যায়। বিশ্বাস কর নিজেকে। তোমার মধ্যেই শক্তি রয়েছে—তুমিই পার। একজন যদি পেরে থাকে, তুমিও পারবে না কেন? কম কিসে তুমি? এই হচ্ছে শাস্ত্রের কথা। যে শক্তি বুদ্ধের মধ্যে রয়েছে—সে শক্তি তোমার মধ্যেও আছে। তুমি শুধু সেটা বিশ্বাস কর। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : যে শালা নিজেকে পাপী বলে, সে পাপীই হয়ে যায়। কেউ পাপী নয়। আজকে ভুল করছে, অন্যায় করছে—কিন্তু যে-কোন দিন, যে-কোন মুহুর্তে সে নিজেকে সংশোধন করতে পারে। কার জীবনে কখন যে শুভ মুহূর্ত আসবে কে বলতে পারে? কাজেই নিজেকে দুর্বল ভাবতে নেই, অক্ষম ভাবতে নেই। ভগবান বলছেন : ‘আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ’—তুমিই তোমার বন্ধু, তুমিই তোমার শত্রু। তুমি যদি মনে কর, তোমার মধ্যে অনন্ত শক্তি রয়েছে, সেই শক্তিকে যদি তুমি কাজে লাগাও, তাহলে —উদ্ধরেৎ আত্মনা আত্মানম্‌—নিজেকে নিজে তুমি উদ্ধার করছ ; তুমি তখন তোমার বন্ধু। আর যদি তুমি নিজেকে ক্ষুদ্র, দুর্বল, অবসন্ন মনে কর—তাহলে তুমিই তোমার শত্রু। অন্য কেউ তোমাকে সাহায্যও করে না, অন্য কেউ তোমার ক্ষতি করতেও পারে না। আমি যদি নিজেকে দুর্বল মনে করি, আমি যদি অসংযত হই, উচ্ছৃঙ্খল হই—তাহলে আমিই আমার শত্রু। শঙ্করাচার্য গীতার ঐ শ্লোকের ভাষ্যে বলছেন : হ্যাঁ, বাইরেও তোমার শত্রু থাকতে পারে। কিন্তু সেই শত্রু তুমিই তৈরি করেছ, তোমার আচরণ, তোমার ব্যবহারেই সেই শত্রু সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবিক, আমি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলাম তখন তো কেউ আমার বন্ধুও ছিল না, কেউ আমার শত্রুও ছিল না। পরে যে কেউ কেউ আমার বন্ধু হল কেউ কেউ শত্রু হল—সে নিশ্চয়ই আমার জন্যই হয়েছে। কাজেই আমি আমার বন্ধু, আমিই আমার শত্রু। আমরা হিন্দুরা আত্মনির্ভরশীল। আমরা এই বিশ্বাস করি যে, আমার কর্মের জন্য আমিই দায়ী। আমরা বলি : মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। নিজের সমস্ত কুসংস্কার পুরুষকারবলে দূর করতে পারে। শেষে সে দেখে যে, তার ইচ্ছা আর ঈশ্বরের ইচ্ছা এক হয়ে গেছে। Fatalism বা ভাগ্য-নির্ভরতা নয়। আমার ভবিষ্যৎ আমার হাতে। স্বামীজী বলছেন : এই যে লোকে জ্যোতিষীর কাছে যায়, সেটা দুর্বলতার লক্ষণ। ‘It is the coward and the fool who says, “This is fate”.-যারা কাপুরুষ এবং বোকা, তারাই ভাগ্যের কথা বলে । ‘But it is the strong man who stands up and says, “I will make my fate”.’—কিন্তু যারা বলবান, সাহসী—তারা বলে, আমার ভাগ্য আমি নিজেই গড়ে তুলব। ‘It is people who are getting old who talk of fate’—যারা বুড়ো হয়ে যায় তারাই সাধারণত ‘ভাগ্য ভাগ্য’ করে। ‘Young men generally do not come to astrology’ –যুবকরা সাধারণত জ্যোতিষ-ট্যোতিষ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কেন ঘামাবে? তাদের দেহে বল আছে, মনে জোর আছে, উদ্যম আছে—কেন তারা যাবে জ্যোতিষীর কাছে? কাপুরুষতা সেটা। পুরুষকালে সে ‘হয়’-কে ‘নয়’ করতে পারে। একটা গল্প বলছেন স্বামীজী। এক জ্যোতিষী রাজাকে বলেছেন : আপনার শিগ্‌গির মৃত্যু হবে। আর ছ মাস মাত্র বাঁচবেন। রাজা খুব বিমর্ষ। মন্ত্রী অনেক বোঝালেন রাজাকে : ওঁর কথা আপনি বিশ্বাস করবেন না, জ্যোতিষীরা ঐরকম বলেই থাকে—ঠিক হয় না। কিন্তু রাজার তবুও মন খারাপ। তখন মন্ত্রী সেই জ্যোতিষীকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলেন : আপনার হাতটা দেখুন তো, আপনি কতদিন বাঁচবেন? জ্যোতিষী বললেন : ও, আমি এখনও বারো বছর বেঁচে থাকব। মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে খাপ থেকে তরোয়াল বের করে সেই জ্যোতিষীর গলাটা কেটে ফেললেন। কেটে ফেলে রাজাকে বলছেন : আপনি এঁর গণনা বিশ্বাস করে এত বিমর্ষ হয়েছেন, অথচ দেখুন নিজের সম্বন্ধে এঁর গণনা তো মিলল না! ইনি তো বলেছিলেন এত দিন বাঁচবেন, তাহলে এখন ইনি মরলেন কি করে?

কাজেই স্বাধীন ইচ্ছা আছে। আমরা অনেক সময় বলি, কেন ভগবান আমার মনে এরকম কুচিন্তা দিচ্ছেন, এরকম রাগ দিচ্ছেন, এত লোভ দিচ্ছেন। ভগবানই তো দিচ্ছেন—কেন তিনি এই খারাপ জিনিসগুলো আমাকে দিচ্ছেন। আসলে ভগবান যে সব করছেন—এই অর্থে করছেন যে, সব কিছুর শক্তি তাঁর কাছ থেকে আসছে। কিন্তু তিনি নির্বিকার, তিনি কর্তা নন—অকর্তা। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন:একটা চুম্বকের কাছে একটা লোহা যদি থাকে লোহার মধ্যে আপনা-আপনি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। অথচ চুম্বক স্থিরই আছে। এটা ঠিক, তিনি আছেন বলেই ভাল-মন্দ সব ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু এই ভাল-মন্দের জন্য আমিই দায়ী। আমিই পারি আমার মন্দকে ভাল করতে, ভালকে আরও ভাল করতে। অভ্যাস করতে হয়, চেষ্টা করতে হয়। শুধু জানলে হয় না। অভ্যাসের ভিতর দিয়ে সংযম আসে। ধীরে ধীরে মানুষ সব দুর্বলতা জয় করতে পারে। অনেকে আছেন রোজ অনেকগুলি সিগারেট খান। একদিনের মধ্যে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলেন। আমরা এসব কাহিনী জানি—ডাকাত সৎ হয়ে যাচ্ছে। রত্নাকর বাল্মীকি হয়ে গেলেন। চণ্ডাশোক ধর্মাশোক হয়ে গেলেন। সেইজন্য বলা হয় : ‘No saint without a past, no sinner without a future.’ এ একমাত্র সম্ভব হয় অধ্যবসায়ের দ্বারা, সাধনার দ্বারা, পুরুষকারের দ্বারা।

ঠাকুর একটা সুন্দর উদাহরণ দিতেন—পুরুষকার আর দৈবের সম্বন্ধটা বোঝাতে। একটা গরু মাঠের মধ্যে একটা খোঁটাতে বাঁধা আছে। খানিকটা লম্বা দড়ি—হয়তো চল্লিশ হাত। ঐ চল্লিশ হাতের মধ্যে গরুটা দশ হাত দূরে ঘুরতে পারে আবার তিরিশ হাত দূরেও ঘুরতে পারে। কিন্তু চল্লিশ হাতের বাইরে যে বিরাট মাঠ সেখানে গরুটা যেতে পারে না। ঐ যে চল্লিশ হাত জায়গা—ঐটুকু পুরুষকারের গণ্ডি। তার বাইরে যে বিরাট মাঠ, সেটা দৈব-অনুগ্রহের এলাকা। কেউ যদি এসে দড়িটা ছিঁড়ে দেয়, তাহলেই গরুটা ঐ মাঠের যে-কোন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারে। না হলে পারে না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা কতটুকু জান? ঐ চল্লিশ হাতের মধ্যে। ভগবান যেন আমাদের সকলকেই কিছুটা শক্তি দিয়ে দিয়েছেন। ঐটুকু শক্তি যখন আমি পুরো ব্যবহার করি, তখনই ঈশ্বর আমাকে কৃপা করেন। তিনি এসে যেন ঐ দড়ি কেটে দেন। গোটা মাঠটাতে আমি তখন চরে বেড়াতে পারি। আমি তখন ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছি। অনন্ত শক্তিমান হয়েছি আমি। আমার ইচ্ছা আর ঈশ্বরের ইচ্ছা এক হয়ে গেছে তখন। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প বলছি। এক গাছে এক পাখি থাকত। গাছে তার কতগুলো ডিম ছিল। আর গাছটা ছিল সমুদ্রের একেবারে কাছে। একদিন ঝড়ে বাসাসুদ্ধ সেই ডিমগুলো মাটিতে পড়ে গেছে আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় ঢেউ এসে ডিমগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। পাখিটা সমুদ্রকে প্রথমে অনেক অনুরোধ করল ডিমগুলো ফিরিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু সমুদ্র সেকথা কানে তুলল না। তখন সে বলল : ঠিক আছে, ডিম যখন ফেরত দেবে না, আমি সমুদ্র শুষে ফেলব। সে তখন ঠোঁটে করে সমুদ্র থেকে এক ফোঁটা করে জল নিয়ে অন্য জায়গায় ফেলে দিয়ে আসতে লাগল। অন্য পাখিরা তাকে বারণ করল, তবুও সে শুনল না। দিনের পর দিন সমুদ্র থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল নিয়ে অন্য জায়গায় ফেলে দিয়ে আসছে। তার কোন ক্লান্তি নেই, হতাশা নেই। কিন্তু একটা পাখির ঠোঁটে আর কতটুকু জল ওঠে? কাজেই, সমুদ্র যেমন তেমনই আছে। একদিন দৈবক্রমে দেবর্ষি নারদ ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে উপস্থিত। তিনি দেখলেন পাখির কাণ্ড, তার সঙ্গে কথা বলে জানলেন সব— তার অধ্যবসায় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি গেলেন গরুড়ের কাছে, গরুড় হচ্ছে পাখিদের রাজা। নারদ তাকে বললেন : তোমার একজন প্রজা এইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তোমার উচিত সমুদ্রকে শাস্তি দেওয়া। গরুড় সব শুনে রেগেমেগে সমুদ্রের দিকে উড়ে চলল। সে গিয়ে তার পাখার ঝাপটায় সমুদ্রের জল এমন তোলপাড় করতে শুরু করে দিল যে সমুদ্র ভয়ে ভয়ে ডিমগুলো ফেরত দিয়ে দিল। পাখিটা তো নিজেই চেষ্টা শুরু করেছিল। অসম্ভব চেষ্টা। কিন্তু তবুও সে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তাই দৈব-অনুগ্রহও সে লাভ করল।

আর একটা গল্প মনে পড়ছে। একজন সন্ন্যাসী ভিক্ষার জন্য এক গৃহস্থের বাড়িতে গেছেন। গৃহস্থ জিজ্ঞেস করছেন সন্ন্যাসীকে ; কে আপনাকে নিয়ে এল এখানে? সন্ন্যাসী ক্ষুধার্ত ছিলেন। তিনি বললেন : আমার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ জঠরাগ্নিরূপে আছেন, তিনিই আমাকে তোমার কাছে এনেছেন। গৃহস্থ তখন বললেন : তাই নাকি? আমি তো তাঁরই সন্ধান করছি। তাঁকে আমার দু-একটি কথা বলবার আছে। আপনাকে আহার দেবার আগেই সেগুলো আমি নিবেদন করতে চাই। কারণ, এমনিতেই তো তিনি কানে একটু কম শোনেন। তার ওপর আপনার আহারের পর তাঁকে আর পাওয়া যাবে না। তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। সেইজন্য এখনই আমি কথাগুলি নিবেদন করতে চাই। সন্ন্যাসী বললেন : কি তোমার কথা? গৃহস্থ বলছেন : এই যে আমি সংসার-রঙ্গমঞ্চে বারবার আসছি আর যাচ্ছি, আর কতবার আমি এরকম করব? আমি এই যাতায়াত থেকে অব্যাহতি পেতে চাই। এইটাই তাঁকে আমার বলবার ইচ্ছা। তখন সন্ন্যাসী তাঁকে বলছেন : তোমাকে একটা কায়দা শিখিয়ে দিচ্ছি। শ্রীকৃষ্ণ এবার ফাঁদে পড়বেন। শ্রীকৃষ্ণকে তুমি বলবে ; দেখ, আমি চুরাশি লক্ষ বার জন্ম নিয়েছি, এই সংসার-রঙ্গমঞ্চে নাটক করে যাচ্ছি। এতবার তুমি যখন আমাকে রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসছ, বোধহয় আমার অভিনয় তোমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাহলে এবার আমাকে এমন পুরস্কার দাও—যাতে আমি মুক্তি পাই। আর যদি এতবার পরীক্ষা করেও মনে কর আমি উত্তীর্ণ হতে পারিনি, নট হিসেবে আমি ব্যর্থ, তাহলে আমাকে এই অভিনয় থেকে রেহাই দাও—আমাকে মুক্তি দাও। গৃহস্থ বললেন : সত্যিই তো খুব ভাল যুক্তি এটা! আমারও মনে হচ্ছে এবার এই যুক্তি যদি দিই, শ্রীকৃষ্ণ উভয়-সঙ্কটে পড়বেন! আমাকে মুক্তি না দিয়ে পারবেন না। তারপর গৃহস্থ সন্ন্যাসীকে খাওয়ালেন। সন্ন্যাসী খেয়েদেয়ে চলে গেলেন। কিছুদিন পর এসে সেই সন্ন্যাসী গৃহস্থকে জিজ্ঞেস করছেন : কি, শ্রীকৃষ্ণকে তুমি বলেছ, যা শিখিয়ে দিয়েছিলাম? গৃহস্থ বললেন : হ্যাঁ, বলেছিলাম। একদিন স্বপ্নে তিনি ত্রিভঙ্গমূর্তিতে দেখা দিয়েছিলেন। তখন আপনি যা-যা বলে দিয়েছিলেন, সব বলেছিলাম। তারপর আরও বললাম যে, দেখ, আমি বেশ বুঝতে পারছি আমি যেমন এই দেহের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছি, আমি যেমন দুঃখী, তুমিও তেমন দুঃখী। তোমার বাবা-মা তো কংসের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তুমিও চিরকাল বন্দী। এই সর্বভূতে তুমি বন্দী হয়ে আছ। তোমার ক্ষমতা আমি বুঝে নিয়েছি। তুমি আমায় কৃপা করবে কি? তোমার নিজেরই কৃপার প্রয়োজন। যাই হোক তোমার মুক্তির ব্যবস্থা আমি করব। তুমি আমার হৃদয়ে বন্দী হয়ে আছ। তুমি হতে পার সিংহ, কিন্তু জালে আটকা পড়েছ। এই মূষিকই তোমাকে জাল কেটে আমার হৃদয়পিঞ্জর থেকে মুক্ত করবে। আমি সেই মূষিক, অতি ক্ষুদ্র শক্তি আমার। কিন্তু আমি তোমাকে উদ্ধার করব। আমি আর চাতক পাখির মতন আকাশের দিকে ‘হাঁ’ করে চেয়ে থাকব না। এখন আমি হাতে খন্তা নিয়ে মাটি খুঁড়ব, মাটি থেকে জল বের করব। আমার জলের পিপাসা আমি নিজেই দূর করব। তোমার মুখাপেক্ষী আমি আর হচ্ছি না। তখন সেই সন্ন্যাসী খুব খুশি হয়ে বললেন : দেখ, তুমি মিথ্যে অভিমান করছ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন তোমার পথপ্রদর্শক হিসেবে। কারণ তোমার আত্মকৃপা হয়েছে। যখন নদীতে জোয়ার আসে তখন সাধারণ লোক বুঝতে পারে না, কিন্তু যাঁরা বিশেষজ্ঞ তাঁরা আকাশে চন্দ্র-সূর্যের অবস্থান দেখে বুঝতে পারেন যে, জোয়ার এসেছে। তেমনি যাঁর মধ্যে আত্মকৃপা জাগে, তিনি নিজে তাঁর অবস্থা বুঝতে পারেন না, কিন্তু উপযুক্ত লোকের কাছে তা ধরা পড়ে ; তাঁর হাবভাব, কথাবার্তা দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, তাঁর মধ্যে আত্মকৃপা জেগেছে, এতদিনে তাঁর সুদিন হয়েছে। কারণ, আত্মকৃপা হলেই ঈশ্বরের কৃপা হয়। এই যে তুমি বলছ, তুমি এবার নিজের হাতে খন্তা নিয়ে মাটি খুঁড়বে—এ থেকেই আমি বুঝতে পারছি যে, তোমার আত্মকৃপা হয়েছে। এবার ভগবানও তোমাকে কৃপা করবেন।

কঠোপনিষদে আছে :১০ ‘যমেবৈষ বৃণুতে তেনলভ্যস্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্‌।’ যে সাধক পরমাত্মাকে বরণ করেন অর্থাৎ তাঁকে লাভ করতে চান তাঁর কাছে পরমাত্মাও তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করেন। লাভ করতে গেলে সাধনার প্রয়োজন, অর্থাৎ অধ্যবসায় বা পুরুষকারের প্রয়োজন। পুরুষকার যেখানে দৈবকৃপাও সেখানে। আত্মকৃপা যখন পুরোপুরি জাগে তখনই দৈব-অনুগ্রহ কাজ করে। God helps those who help themselves.—যাঁরা নিজেদের সাহায্য করেন, ঈশ্বর তাঁদেরই সহায়তা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এক জায়গায় বলছেন : তপস্যা করলে তাঁর কৃপায় ঈশ্বর দর্শন হয়। (৫-১৫-১) তাঁর ‘কৃপায়’ ঈশ্বর দর্শন হবে, কিন্তু সেই ‘কৃপা’ হবে তপস্যা করলে পরে। খুব বাতাস বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নৌকোর পালটা যদি নামানো থাকে তাহলে সেই বাতাস কি আমার কোন কাজে লাগবে? তেমনি ঈশ্বরের কৃপা-বাতাস সবসময়ই বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাকে পালটা তো তুলতে হবে। তাঁর কৃপা ধারণের যোগ্যতা তো অর্জন করতে হবে। আমি যোগ্যতা অর্জন না করে যদি কোন জিনিস পাই, পেয়েও সেটা ধরে রাখতে পারব না। আমার হাতে প্রচুর অর্থ কেউ তুলে দিতে পারে, কিন্তু অর্থের সদ্ব্যবহার যদি না জানি, সেই অর্থ আমি দুদিনে নষ্ট করে ফেলব। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও তাই। যারা খুব কীর্তন করে, অনেক সময় তাদের কুলকুণ্ডলিনী হঠাৎ উপরে উঠে পড়ে—নানারকম ভাব বা অনুভূতি তাদের হয়। কিন্তু দেখা যায়, এদের মধ্যে যারা নিয়মিত সাধন-ভজনের অভ্যাস রাখে না, কীর্তনের পরেই তাদের মধ্যে অনেক সময় বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়। মনটা যেমন অনেক উপরে উঠেছিল—ঝট করে আবার তেমনি অনেক নীচে নেমে যায়, হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে ছিল, তার চেয়েও নীচে। সেইজন্য ঐ ‘পাল তোলা’র প্রয়োজন, সাধন-ভজনের বিশেষ প্রয়োজন। সব সাধকের জীবনেই তাই দেখা যায়, তাঁরা কত সাধন-ভজন করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : যাতে তাঁর কৃপা হয়, ব্যাকুল হ’য়ে তার চেষ্টা করো। (১-১২-৩) চেষ্টার উপরে জোর দিচ্ছেন। তাঁর কৃপার জন্য চেষ্টা করতে বলছেন। বস্তুত, তিনি যখন বলছেন, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা, তখন এই অর্থে বলছেন যে, শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর থেকেই সবকিছু এসেছে। কিন্তু ঈশ্বর আমাদের বিবেকবুদ্ধি দিয়েছেন, পুরুষকার দিয়েছেন—তা ব্যবহার করে আমার কর্মবন্ধন কাটতে হবে। কাজেই পুরুষকার অবশ্যই চাই। পুরুষকারের শেষে দৈব। আত্মকৃপার পরে দৈবকৃপা।

আকর-তালিকা

 । গীতা, ১১/৩৩

 । ঐ, ১৮/৬১

 । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৬/১৪

 । গীতা, ৬/৫

 । ঐ

 । ঐ

 । C. W.,Vol. VIII, 1959, p. 184

 । দ্রষ্টব্য মধুসূদন সরস্বতীর টীকা, গীতা, ৬/২৩ ; স্বামী প্রেমানন্দজীও এই গল্পটি বলতেন। দ্রষ্টব্য : প্রেমানন্দ, স্বামী ওঁকারেশ্বরানন্দ, ১৩৫৩, পৃঃ ৮৫-৭

 । দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ত সম্পাদিত ‘আত্মবোধ’-এর ভূমিকায় ‘কৃপাচতুষ্টয়’ দ্রষ্টব্য।

১০। কঠোপনিষদ্‌, ১/২/২৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *