দুর্গম গিরি কান্তার মরু
‘You are a lazy dog’— অ্যালবার্ট আইনস্টানকে বললেন অঙ্কের মাস্টারমশাই হেরম্যান মিনকাউস্কি। ল্যাবরেটরিতে যিনি পরীক্ষানিরীক্ষার শিক্ষক ছিলেন সেই জঁ পারনেও আইনস্টাইনের লেখাপড়ায় খুশি নন।
একদিন বিশ বছরের আইনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে ঘটালেন এক বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণে আঘাত লাগল আইনস্টাইনের ডান হাতে— স্টিচ করতে হল। পারনে রেগে গিয়ে আইনস্টাইনকে বললেন, you are enthusiastic but hopeless in physics. আইনস্টাইনের উৎসাহ আছে বটে, কিন্তু শুধু উৎসাহ দিয়ে তো হবে না। পদার্থবিজ্ঞানে কোনও মাথা নেই আইনস্টাইনের, বললেন তাঁর শিক্ষক।
তা হলে কী করবেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন?
উপদেশ দিলেন তাঁর শিক্ষক।
কাকে দিলেন এই উপদেশ?
এ-যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীকে!
শিক্ষকটি রাগের মাথায় বললেন, অ্যালবার্ট তোমার ভালর জন্যেই বলছি, বিজ্ঞান পড়া ছাড়ো। বিজ্ঞান তোমার দ্বারা হবে না।
তা হলে কী পড়বে অ্যালবার্ট?
মাস্টারমশাই উপদেশ দিলেন, সাহিত্য পড়ো। কিংবা আইন পড়তে পারো। ইচ্ছে করলে ডাক্তার হতে পারো। কিন্তু বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখো না।
For your own good you should switch to something else, medicine, may be, literature, or law.
শিক্ষকের উপদেশ শুনে আইনস্টাইন অবশ্য বিষয় পরিবর্তন করলেন না।
১৯০০ সালে জুরিখের পলিটেকনিক থেকে একুশ বছর বয়েসে গ্র্যাজুয়েট হলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
এ-যুগের সেরা বিজ্ঞানী বিজ্ঞান পরীক্ষায় কেমন রেজাল্ট করলেন?
বলবার মতোই রেজাল্ট।
পরীক্ষা দিয়েছিলেন ছ’জন। হলেন পঞ্চম। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন লাস্ট হলেনও বলা যায়। কারণ ষষ্ঠজন পরীক্ষায় ফেল!
তিনি আইনস্টাইনের প্রেমিকা মিলেভা!
গ্র্যাজুয়েট তো হলেন আইনস্টাইন।
কিন্তু এত খারাপ পরীক্ষার ফল নিয়ে কোথায় পাবেন চাকরি? তাঁর চলার পথে যেন বাধা হয়ে দাঁড়াল দুর্গম পাহাড়, নিবিড় অরণ্য, ধু-ধু মরু।
এই অনিশ্চিত, কঠোর জীবনসরণি তিনি পেরোবেন কী করে? তিনি যে ভাবতেও পারেননি, বাস্তব এমন নির্মম হতে পারে।
এতদিন এক ধনী কাকিমা জেনোয়া থেকে অ্যালবার্টকে হাতখরচা পাঠাতেন।
অ্যালবার্টের পরীক্ষার রেজাল্টের কথা জানতে পেরে তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন।
যে-ছেলের পরীক্ষার রেজাল্ট এত খারাপ, তার দ্বারা কিছু হবে না, তাকে সাহায্য করা মানে টাকাটা জলে দেওয়া।
ইতালিতে অ্যালবার্টের পারিবারিক অবস্থাও বেশ খারাপ। বাবার ব্যাবসা চলছে না। সুতরাং অ্যালবার্ট যতদিন কাজ না পাচ্ছেন ততদিন যে বাবার কাছ থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য পাবেন, সে পথও বন্ধ। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে একটা কাজ জোগাড় করতেই হবে— তার বেঁচে থাকার লড়াই শুরু এইভাবে।
কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি খুঁজতে লাগলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
সারা ইউরোপের অধ্যাপকদের কাছে পাঠালেন চাকরির জন্যে আবেদনপত্র।
কিন্তু কোনও ফল হল না। কোথাও নেই আশার আলো। তাঁর নিজের কলেজ ‘পলি’-ও তাঁকে চাইল না!
আইনস্টাইন হতাশ হয়ে এক বন্ধুকে চিঠি লিখলেন—
From what people tell me, I am not in the good graces of any of my former teachers.
আমি লোকমুখে যা শুনছি তাতে বুঝলাম, আমার শিক্ষকদের কেউই আমাকে দেখতে পারেন না।
ইতিমধ্যে সুইত্জারল্যান্ডের নাগরিক হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আবেদন মঞ্জুর হল।
তা হলে কি ভাগ্য মুখ তুলে তাকাল?
সুইত্জারল্যান্ডে চাকরি পেতে সুইস নাগরিক না হলে চলবে না। আইনস্টাইন অবশেষে সুইস নাগরিক। এবং তাঁর প্রাণের দায় একটি চাকরি পাওয়া।
প্রেমিকা মিলেভাকে লিখলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন—
I decided the following about our future. I will look for a position immediately, no matter how modest it is. My scientific goals and personal vanity will not prevent me from accepting even the most subordinate position.
আমাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা হল— আমি এখুনি এই মুহূর্তে চাকরির সন্ধান করব। সে যত নিচু চাকরিই হোক না কেন, কিছু যায় আসে না। আমার বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য আর আমার ব্যক্তিগত অহংবোধ খুব নিচু চাকরি নিতেও বাধা দেবে না আমাকে।
তাই করলেন আইনস্টাইন।
উইনটেরহার (Winterhur)-এর এক স্কুলে তিন মাসের জন্যে অঙ্কের শিক্ষকের পদ খালি হয়েছে। সেই চাকরিতেই ঢুকলেন অ্যালবার্ট।
তারপর ইংল্যান্ড থেকে বোর্ডিং স্কুলে আসা একটি ছেলেকে কিছুদিনের জন্যে পড়ালেন আইনস্টাইন।
এসব কাজে পারিশ্রমিক ছিল খুবই সামান্য।
তারপর একদিন বস্-এর সঙ্গে ঝগড়া হল আইনস্টাইনের। এবং তার ফলে যা হওয়ার তাই হল।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের চাকরি গেল।
কিন্তু আকস্মিক সাহায্য এল এক পুরনো স্কুলবন্ধুর কাছ থেকে। সেই স্কুলবন্ধুর নাম মার্সেল গ্রোসমান।
গ্রোসমানের কাছে খবর এল বার্ন-এর সুইস পেটেন্ট অফিসে শিগ্গির একটা চাকরি খালি হবে।
এই অফিসের বড় কর্তা ফ্রিডরিখ হালার (Frierich Haller)। হালার গ্রোসমানের বাবার বন্ধু।
সুতরাং সুইস পেটেন্ট অফিসে যে একটি চাকরি খালি হয়েছে সে কথা স্বাভাবিকভাবেই জেনেছেন গ্রোসমান।
আর জানা মাত্রই জানিয়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইকে। গ্রোসমানের কাছে সুখবরটি পেয়ে লিখলেন আইনস্টাইন—
Dear Marcel,
When I found your letter yesterday I was deeply moved by your devotion and compassion which do not let you forget an old, unlucky friend.
প্রিয় মার্সেল,
গতকাল তোমার চিঠিতে এক পুরনো বন্ধুর প্রতি নিষ্ঠা ও সহৃদয়তার কথা জানতে পেরে আমি অভিভূত— এই সহৃদয়তাই তোমাকে ভুলতে দেয়নি আমার মতো এক পুরনো হতভাগ্য বন্ধুর কথা।
আইনস্টাইন চিঠি পাওয়ার পর বার্নের ট্রেন ধরলেন। গ্রোসমানের বাবা হালারের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলেন আইনস্টাইনের। হালার দু’ ঘণ্টা ধরে ইন্টারভিউ নিলেন তাঁর।
আইনস্টাইন ফিজিক্সের ছাত্র।
কিন্তু তাতে কী? বাবা-কাকার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে আইনস্টাইন টেকনিক্যাল জ্ঞানে কিছু কম নন। তাঁর বয়েস বেশি নয় বটে, কিন্তু অভিজ্ঞতায় কম নন।
শেষ পর্যন্ত হালারকে তিনি বোঝাতে পারলেন যে তাঁকে একটা ‘চান্স’ দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু সুইস সরকারের ব্যুরোক্রেসির জন্যে পদে পদে বাধা। তাই সহজে চাকরি পাওয়া গেল না।
আইনস্টাইনকে জানানো হল, অফিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু চাকরির জন্যে যে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মরণবাঁচন লড়াই।
কতদিন অপেক্ষা করতে হল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে?
এক বছরেরও কিছু বেশি।
এ যেন অন্তহীন অপেক্ষা। তবু আশার আলো অ্যালবার্টের মনে। চাকরিটা তিনি পাবেন। এবং চাকরিটা মোটামুটি। সুতরাং ১৯০১ সালে বার্নে বসবাস শুরু করলেন আইনস্টাইন। কবে যে চাকরি পাওয়ার খবর আসবে বলা যায় না। রোজই তার মনে হয়, আজ বুঝি আসবে সেই খবর। বার্নে একটা একতলার ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকেন আইনস্টাইন আর চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
আইনস্টাইনের সেই পারিবারিক বন্ধু ও শিক্ষক, যিনি আইনস্টাইনকে উপহার দিয়েছিলেন জ্যামিতির বই— তাঁর কথা মনে আছে তো?
সেই ম্যাক্স এলেন আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করতে। এবং এসে যা দেখেছিলেন লিখেছেন তিনি সেকথা—
His environment betrayed a good deal of poverty. He lived in a small, poorly furnished room.
ঘরের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়— চারধারে বেশ দারিদ্র্যের ছাপ। ছোট্ট একটা ঘর। আসবাবপত্রও তেমন নেই। এই ঘরে সে থাকে।
এমন দারিদ্র্যের মধ্যে প্রাত্যহিক খরচ চালাবেন কী করে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন?
১৯০২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি একটি বিজ্ঞাপন দিলেন আঞ্চলিক সংবাদপত্রে—
Private lessons in Mathematics and Physics for students and pupils given most thoroughly by Albert Einstien, holder of the Fed. Polyt. teachers diploma… Trial lessons free.
ভাবা যায়! যিনি হতে চলেছেন এ-যুগের মহত্তম বিজ্ঞানী, নোবেল প্রাইজ বিজয়ী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তিনি বিজ্ঞাপন দিলেন প্রাইভেট টিউশন করার জন্যে। পড়াবেন অঙ্ক আর ফিজিক্স।
তা ছাড়া, পড়ানোর ‘ট্রায়াল’-ও দেবেন।
তার জন্যে কোনও টাকাপয়সা লাগবে না। ভাল লাগলে পড়তে এসো, না লাগলে এসো না।
এই বিজ্ঞাপনে মাত্র দু’জন এল আইনস্টাইনের কাছে অঙ্ক আর ফিজিক্স শিখতে।
একজন স্থপতি। অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার।
খুব সামান্য পারিশ্রমিকে এদের পড়ালেন আইনস্টাইন।
কয়েক মাস পরে আবার ওই বিজ্ঞাপনটা কাগজে দিলেন আইনস্টাইন।
বিজ্ঞাপন দেখে একটি ছাত্রও এল। নাম, মরিস সলোভিন।
সলোভিন রুমানিয়া থেকে বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে দর্শন পড়তে।
তার খেয়াল হয়েছে একটু ফিজিক্স পড়ার।
আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হতেই তাঁরা ঘণ্টা দুই ধরে অনেক কথা বললেন। তারপর সলোভিনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল আইনস্টাইনের।
১৯০২ সালে ১৬ জুন: চাকরি পেলেন শেষ পর্যন্ত অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। সুইস পেটেন্ট অফিসেই চাকরি জুটল তাঁর।
যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর ভাগ্য অবশেষে কিঞ্চিৎ প্রসন্ন হল।
যে চাকরি চেয়েছিলেন তার অনেক নীচের চাকরি!
সমস্যার তবু কিছুটা সমাধান হল। পরের বছর বিয়েও করলেন মিলেভাকে। কিন্তু অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তো সুইস পেটেন্ট অফিসে সামান্য চাকরি করে জীবন কাটাবার জন্যে পৃথিবীতে আসেননি!
কবে খুলবে নতুন দিগন্ত? কী করেই বা জ্বলে উঠবে নতুন আলো?
শেষ পর্যন্ত দুর্গম গিরি কান্তার মরু কী করে পার হবেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন?
এখনও সাত বছর চাকরি করতে হবে তাকে সুইস পেটেন্ট অফিসে, যতদিন না জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের কাজ পাবেন। ১৯১১ সালে ফুল প্রফেসরশিপ পেলেন প্রাগের জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে।