দু’জনে দেখা হল
১৯২৬ সাল।
আইনস্টাইনের কাছ থেকে এক ভারী আন্তরিক, হৃদয়স্পর্শী চিঠি পেলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দেখাও হল সেই বছর আইনস্টাইনের বার্লিনের বাড়িতে।
তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। দু’জনের সম্পর্ক কেমন যেন আলগা হয়ে গেল।
১৯৩০ সালের মাঝামাঝি।
বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আইনস্টাইনের সঙ্গে আবার দেখা হল রবীন্দ্রনাথের।
একবার-দু’বার নয়। অন্তত চারবার পরস্পরের মুখোমুখি হলেন বিজ্ঞানী ও কবি। কখনও বার্লিনে, কখনও নিউ ইয়র্কে।
ভাব ও ভাবনার আদান-প্রদান ঘটল দুই অনন্য মানুষের মধ্যে। দু’জনেই ভুবনবিখ্যাত তাঁদের মৌলিক মননের জন্য। দু’জনেই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সংবেদী।
কিন্তু এঁদের মধ্যে ভাবনার আদান-প্রদানে মনের মিল হল কি? ক্রমশ কি বোঝা গেল ওঁদের ভাবনার জগৎ আলাদা, ওঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য সন্দেহাতীত?
দু’জনেই যতদূর সম্ভব পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করলেন মনের ভাব। এবং কেউই গেলেন না যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণের মধ্যে। কেউ নিজের মতকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতেও চাইলেন না। এই পারস্পরিক সহনশীলতাই রচনা করেছে আইনস্টাইন-রবীন্দ্রের বিখ্যাত সংলাপের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। এই সংলাপের আবেদন তাই এত বছরেও পুরনো হল না। দুটি উজ্জ্বল মননশীল মনের আলোয় এই সংলাপ আজও সন্দীপ্ত হয়ে আছে। আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনেকবার দেখা হলেও সেইসব আলাপের বিশেষ কোনও রেকর্ড নেই। কেউ ধরে রাখেননি তাঁদের বক্তব্যের নির্যাস। হারিয়ে গেছে সেইসব সংলাপ। শুধুমাত্র দুটি সংলাপ ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে। এবং এই দুটি সংলাপ থেকে ধারণা করা যায় আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায়, বিশ্বদর্শনে ভিন্নতা কোথায়। কোথায় তাঁদের মতের মিল হল না?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৩০ সালে আইনস্টাইন আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে আলোচনা, কথাবার্তা হয়েছিল তার মধ্যে।
এখানে গোড়ার কথাটা একটু বলে রাখি। ১৯৩০ সালে পঞ্চাশ পেরিয়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। আর রবীন্দ্রনাথের বয়েস ঠিক সত্তর। দু’জনেরই জীবন-অভিজ্ঞতা হয়েছে আরও ব্যাপ্ত, আরও গভীর। দু’জনেরই বিশ্বদর্শনে ক্রমশ এসেছে পরিবর্তন। বাস্তবের প্রতি আইনস্টাইনের বিশ্বাসের সার কথা হল, ‘truth is independent of man.’
এই কথাটার অর্থ কী?
অর্থ খুবই সহজ। আকাশে চাঁদ বিরাজ করছে। আইনস্টাইন বললেন, মানুষ দেখুক না দেখুক আকাশে যে চাঁদটা আছে, তাতে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ আকাশে চাঁদের অস্তিত্ব মানুষের দেখার ওপর নির্ভর করছে না।
তা তো হল। কিন্তু সাব-অ্যাটমিক পৃথিবীতেও কি আইনস্টাইনের এই ধারণা সত্য?
কাকে বলে সাব-অ্যাটমিক পৃথিবী?
অ্যাটমের থেকেও ক্ষুদ্র কণা নিয়ে যে অদৃশ্যভুবন, সেই পৃথিবীকেই বলা হয় সাব-অ্যাটমিক পৃথিবী।
আইনস্টাইন বললেন, সত্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা সাব-অ্যাটমিক পৃথিবীতেও প্রযোজ্য।
এই মর্মে শুরু হল আইনস্টাইনের সঙ্গে ওয়ারনার হাইজ়েনবার্গ (Werner Heisenberg) এবং নিল বোর (Niels Bohr)-এর মতো কোয়ান্টাম থিয়োরির পারঙ্গম বিজ্ঞানীদের ভীষণ বিতর্ক।
এই বিতর্ক শুরু হয় ১৯২৬ সালে, যখন আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দেখা। এবং বিতর্ক চলল ১৯৫৫ সালে আইনস্টাইনের মৃত্যু পর্যন্ত। আসল কথাটা হল, আইনস্টাইন যে-চোখে বাস্তবকে দেখতেন, যেভাবে বুঝতেন, সেভাবে বাস্তবকে দেখেননি, বোঝেননি রবীন্দ্রনাথ, বোর বা হাইজ়েনবার্গ। এইখানেই তাঁদের গরমিল।
বার্লিনে এলেন রবীন্দ্রনাথ।
বার্লিনের অদূরে কাপুথ (Caputh)-এ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের গ্রীষ্মনিলয়।
এই বাড়িতেই ঘটল রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইনের এক ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার।
ঠিক বিতর্ক নয়। এবারও কেউ জোর করে অন্যের ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন না।
এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটিকে বলা যায় মৃদুভাষ সংলাপ, ভাব ও ভাবনার বিদগ্ধ আদানপ্রদান।
দু’জনে হয়তো শেষ পর্যন্ত একমত হলেন না।
কিন্তু সেই মত-পার্থক্যের জন্য কোনও তিক্ততাও তৈরি হল না।
কেন হল না তিক্ততা?
কারণ আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথ, দু’জনে যেন দুই বিশাল গ্রহ, হঠাৎ তাঁরা এসে পড়েছেন কাছাকাছি।
দুই গ্রহের মধ্যে এযেন এক মহাজাগতিক সংলাপ।
পারস্পরিক তিক্ততার জায়গা কোথায়?
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ তাঁদের এক সাক্ষাৎকার নিয়ে লেখাও হয়েছিল এই অনন্য মন্তব্য— They simply exchanged ideas. But it seemed to an observer as though two planets were engaged in a chat.
আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ।
ভাবনার দুই মহাগ্রহ।
একটি গ্রহ এসেছে অন্য গ্রহের কাছে। অতিথি হয়ে।
দু’জনে বসেছেন মুখোমুখি।
হঠাৎ আইনস্টাইন মৃদুস্বরে বললেন, এই মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে দুটি পৃথক ধারণা চালু আছে।
একটি ধারণা অনুসারে এই জগৎ একটি ‘একক’ হিসেবে মনুষ্যজাতির ওপর নির্ভরশীল।
অন্য ধারণাটি বলছে, এই মহাবিশ্ব ‘বাস্তব’ অস্তিত্ব হিসেবে সম্পূর্ণ স্বাধীন, মানুষের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল নয়। There are two different conceptions about the nature of the universe— the world as a unity dependent on humanity, and the world as reality independent of the human factor.
আইনস্টাইনের এই উক্তিতে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন রবীন্দ্রনাথ।
নাটকীয় উদ্বেগে ভরা সেই অপেক্ষার মুহূর্ত।
কী বলবেন রবীন্দ্রনাথ? বিশ্ববিখ্যাত কবি কি ভুবনখ্যাত বিজ্ঞানীর সঙ্গে একমত হবেন?
রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ মগ্ন থাকলেন নিজের ভাবনার মধ্যে। তারপর অপকট বিশ্বাস থেকেই উঠে এল তাঁর উত্তর— This world is a human world— the scientific view of it is also that of the scientific man. Therefore, the world apart from us does not exist, it is a relative world, depending for its reality upon our consciousness.
এই জগৎ হল মানবিক জগৎ। জগৎ সম্পর্কে যে-বৈজ্ঞানিক ধরণা, তাও তো বিজ্ঞানীরই ধারণা। সুতরাং আমরা ছাড়া এ-জগতের কোনও অস্তিত্ব নেই। এ-জগৎ আপেক্ষিক— এই জগৎ তার বাস্তব অস্তিত্বের জন্য আমাদের চেতনার ওপর নির্ভরশীল।
রবীন্দ্রনাথের কথা শোনার পর বেশ কিছুক্ষণ ওই প্রসঙ্গে আর কথা বললেন না আইনস্টাইন।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভাবনাটুকুকে ধরে রাখলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পরে কথা বললেন আইনস্টাইন। রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরেই ফিরে এলেন একই সঙ্গে— রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করলেন আইনস্টাইন—
Truth, then, or beauty is not independent of man?
তা হলে সত্য বা সৌন্দর্য কি স্বাধীন নয়? তারা মানুষ নির্ভর?
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন রবীন্দ্রনাথ, না, স্বাধীন নয়।
রবীন্দ্রনাথের উত্তরে কিছুটা হয়তো বিস্মিত আইনস্টাইন। তিনি তখনই প্রশ্ন করলেন—
If there were no human beings any more, the Apollo Belvedere no longer would be beautiful?
যদি পৃথিবীতে মানুষ না থাকত তা হলে অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার কি আর সুন্দর থাকত না?
রবীন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত উত্তর, না।
আইনস্টাইন বেশ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন—
সৌন্দর্য সম্পর্কে আপনার এই ধারণা আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু সত্য সম্পর্কে আপনার মতামত আমি মানতে পারছি না।
I agree with regard to this conception of beauty, but not with regard to truth.
রবীন্দ্রনাথ তখনই বললেন,
Why not, truth is realized through men.
সত্য সম্পর্কে আমার ধারণাকে আপনার মানতে অসুবিধে কোথায়? মানুষের ভাবনার মধ্যে দিয়ে তো সত্যকে উপলব্ধি করা যায়।
রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির পর অনেকক্ষণ কথা বলেননি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
রবীন্দ্রনাথও চুপ।
দুই মহাগ্রহ পরস্পরকে বোঝবার চেষ্টায় অপেক্ষমাণ।
হঠাৎ খুবই কোমল স্বরে কথা বললেন আইনস্টাইন—
I cannot prove my conception is right, but that is my religion.
আমি এই প্রমাণ দিতে পারব না যে আমার ধারণা নির্ভুল। কিন্তু এই বিশ্বাসই আমার ধর্ম।
আরও কিছুক্ষণ আলোচনা চলল। তারপর আইনস্টাইন নিজের মত প্রকাশ করলেন এই ভাষায়—
আমি প্রমাণ করতে পারব না, কিন্তু আমি পিথাগোরাসের দর্শনে বিশ্বাসী— সেই বিশ্বাস হল সত্য মানুষের ওপর নির্ভরশীল নয়, সত্য স্বাধীন।
I cannot prove, but I believe in the Pythagorean argument, that the truth is independent of human beings.
রবীন্দ্রনাথ সূক্ষ্মভাবে বিরোধিতা করলেন এই ভাবনার। তিনি বললেন,
Brahman in the absolute truth, which cannot be conceived by the isolation of the individual mind or described by words.
ব্রহ্মই সেই পরম সত্য, যা কোনও একক মানবমন ধারণ করতে পারে না। ব্রহ্ম ব্যাখ্যা বা বর্ণনার অতীত। ব্রহ্ম অনির্বচনীয়।
আইনস্টাইন নীরব থাকলেন না। উত্তরে বললেন,
The mind acknowledges realities outside of it, independent of it. For instance, nobody may be in the house, yet that table remains where it is.
মানুষের মন কিন্তু সেই বাস্তবকেও স্বীকৃতি দেয় যে-বাস্তব তার বৃত্তের বাইরে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বর্তমান। যেমন ধরুন ওই টেবিলটা। যখন কেউ বাড়িতে নেই তখনও কিন্তু ওই টেবিলটা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ কী বললেন উত্তরে? বললেন,
Yes, it remains outside the individual mind but not the universal mind. The table is that which is perceptible by some kind of consciousness we possess.
ঠিক কথা, টেবিলটা কোনও একক মনের বাইরে থাকছে বটে, কিন্তু মহাজাগতিক মনের বাইরে সে কখনওই যেতে পারছে না। আমাদের মধ্যে এমন এক চেতনা আছে যা টেবিলটিকে দেখছে। টেবিলটি তাই কখনওই আড়ালে যাচ্ছে না।
আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একমত হলেন না। যুক্তি খাড়া করলেন এই ভাষায়—
If nobody were in the house the table would exist all the same, but this is already illegitimate from your point of view, because we cannot explain what it means, that the table is there, independently of us.
বাড়িতে কেউ না থাকলেও টেবিলটা যথারীতি থাকবে। কিন্তু আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিমধ্যেই এই বক্তব্য অবৈধ হয়ে পড়েছে। কারণ, আমরা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না এর মানে কী— এই যে টেবিলটা আমাদের দেখার ওপর কোনওভাবে নির্ভর না করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে থেকে যাচ্ছে।
আইনস্টাইন একটু থামলেন।
হয়তো রবীন্দ্রনাথকে কিছু বলবার সুযোগ দিলেন তিনি। কিছুই বললেন না রবীন্দ্রনাথ।
তিনি একাগ্রভাবে শুনছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বক্তব্য। বলতে শুরু করলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী—
Our natural point of view in regard to the existence of truth apart from humanity cannot be explained or proved, but it is a belief nobody can lack— not even primitive beings.
মনুষ্যজাতিকে বাদ দিয়ে সত্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের স্বাভাবিক ধারণা কোনওভাবে ব্যাখ্যা বা প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু এই বিশ্বাস সবার মধ্যে আছে— এমনকী আদিম মানুষের মধ্যেও।
এরপরে কি কিছু বলবেন রবীন্দ্রনাথ?
না, তিনি এখনও চুপ।
তিনি শুধু শুনছেন।
আবার শুরু করলেন বিজ্ঞানসাধক, কবির সামনে—
We attribute to truth a superhuman objectivity. It is indispensable for us— this reality which is independent of our existence and our experience and our mind— though we cannot say what it means.
সত্যের ওপর আমরা আরোপ করি এক অতিমানবিক নিস্পৃহতা। আমাদের পক্ষে এটি অপরিহার্য— এই বাস্তবতা যে-বাস্তবতা আমরা আছি কি নেই তার ওপর নির্ভর করে না; আমাদের অভিজ্ঞতা ও আমাদের মন, তার থেকেও সম্পূর্ণ স্বাধীন এই বাস্তবতা। যদিও আমরা বলতে পারি না, এর মানে কী।
এতক্ষণ কথা বলে থামলেন আইনস্টাইন।
রবীন্দ্রনাথের উত্তরটি ঋজু ও সংক্ষিপ্ত। তিনি শুধু বললেন—
In any case, if there be any truth absolutely unrelated to humanity, then for us it is absolutely non-existing.
যাই হোক, এমন কোনও সত্য যদি থাকে যার সঙ্গে মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই, তা হলে আমাদের কাছে সেই সত্যের কোনও অস্তিত্বই নেই।
শুনলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তারপর প্রায় চিত্কার করেই আইনস্টাইন বললেন—
Then I am more religious than you are!
মনে হল তিনি যেন তর্কে জিতে গিয়ে উত্ফুল্ল হয়ে একথা বললেন। কিন্তু এই তর্কে বা আলোচনায় হারজিতের কোনও প্রশ্নই আসে না।
রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনের এই সাক্ষাৎকারটি প্রসঙ্গে পরে বলা হয়, ‘A complete non-meeting of minds.’ রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইন— দু’জনেই অসামান্য মননশীল মানুষ, কিন্তু তাঁদের ভাবনার জগৎ ছিল আলাদা।
প্রশ্ন হল, যদি সত্যিই ওঁদের মনের একেবারেই কোনও মিল না হয়ে থাকে তা হলে কয়েক বছর ধরে কেন ওঁরা চারবার পরস্পরের সঙ্গে দেখা করলেন? দু’জনেই ছিলেন জগৎবিখ্যাত নোবেল লরিয়েট। কারোরই প্রয়োজন ছিল না অন্যের আলোয় আলোকিত হওয়ার। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, তাঁরা কোনও রহস্যময় কারণে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই পারস্পরিক আকর্ষণ হয়তো সম্ভব হয়েছিল দু’জনের বিশ্ববীক্ষণের কিছুটা একতার জন্য। আমি ব্যাপারটাকে এতটুকু হালকা না করেও বলতে চাই। আমাদের হঠাৎ মনে আসতে পারে, তিনটি অন্ধ মানুষের হাতির বর্ণনা করার সেই পরিচিত গল্প।
প্রায় নিশ্চিতভাবে মনে হয়, দু’জনেই উপলব্ধি করেছিলেন এক রহস্যময় অস্তিত্ব মহাসৃষ্টির পিছনে। কিন্তু তাঁদের পথ ছিল আলাদা। রবীন্দ্রনাথ পৌঁছেছিলেন এই উপলব্ধিতে অনুভব ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এবং আইনস্টাইনের পথ ছিল বৈজ্ঞানিক বাস্তব ও যুক্তির মধ্য দিয়ে।
চাপের মুখে আইনস্টাইন স্বীকার করেছিলেন তিনি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তবে বিশ্বাস না করে আইনস্টাইনের মতো মানুষ এইরকম স্বীকারোক্তি করবেন না— তাঁকে জোর করে কিছু বলানো যেত না। কিন্তু একথাও ঠিক, তিনি বলেছেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেও তাঁর প্রকৃতি তিনি জানেন না। যদি তিনি আজ বেঁচে থাকতেন তা হলে দেখতে পেতেন তাঁরই শুরু করা আধুনিক বিজ্ঞান বাস্তবের আসল চেহারা কীভাবে প্রকাশ করছে। আশ্চর্যের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম এই প্রকাশের কত কাছাকাছি! মনে হয়, যদি আজকের বিজ্ঞানের আলোয় আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথের আবার দেখা হত, তাঁদের মনের মিল গরমিলকে ছাপিয়ে উঠত।
যুক্তিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক বাস্তবের প্রবক্তা ছিলেন আইনস্টাইন। অবাক লাগে ভাবতে, যদিও তিনি ছিলেন কঠোর যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তববাদে বিশ্বাসী, তিনি মাঝে মাঝে স্বতঃপ্রণোদিত বিশ্বাসের পথেও গেছেন। যেমন, তিনি জীবনের শেষ তিরিশ বছর কাটিয়ে ছিলেন প্রকৃতির মধ্যে নিহিত ঐক্যকে বাস্তব সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তা হলে কি মনে হয় না আইনস্টাইনের মধ্যে ঘটে ছিল এক আশ্চর্য রসায়ন, কঠোর বাস্তববাদের সঙ্গে এক রকমের আধ্যাত্মিকতার সংশ্লেষ? তিনিই তো বলেছিলেন—
The intuitive mind is a sacred gift and the rational mind is a faithful servant. We have created a society that honours the servant and has forgotten the gift.
স্বতঃপ্রণোদিত মন এক পবিত্র প্রাপ্তি। আর যুক্তিবাদী মন হল বিশ্বাসী ভৃত্য। আমরা এমন একটি সমাজ তৈরি করেছি যেখানে ভৃত্যটি সম্মানিত আর ভুলে গেছি সেই পবিত্র প্রাপ্তিকে।
তা হলে কি মনে হয় না রবীন্দ্রনাথকে যখন আইনস্টাইন বললেন, then I am more religious than you are তিনি সত্যিই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলেছিলেন তাঁর মনের কথা? এই মন কি খুব দূরের রবীন্দ্রনাথের মন থেকে?
১৯৯২ সালে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন আইনস্টাইন-রবীন্দ্রের সাক্ষাৎকারটি প্রসঙ্গে করলেন এই জরুরি উক্তি—
Tagore is, I think, saying that truth is a subtler concept than Einstein realizes.
রবীন্দ্রনাথ সত্যের সেই সূক্ষ্ম রূপের কথাই হয়তো বলেছেন, যা আইনস্টাইন উপলব্ধি করতে পারেননি।
কেমনভাবে রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন সত্যের সেই সূক্ষ্ম রূপ? রবীন্দ্রনাথের কথাতেই এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়—
Its touch comes to me through the same unseen and trackless channel as does the inspiration of my songs.
সত্যের সূক্ষ্ম স্পর্শ আমার কাছে আসে সেই অদৃশ্য চিহ্নবিহীন মাধ্যমে, যে-পথে আসে আমার গানের প্রেরণা।
রবীন্দ্রনাথের কাছে সত্যের সূক্ষ্ম স্পর্শ যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে। সেই চিরসত্যকেই তিনি বলছেন, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে। সেইখান থেকেই নেমে আসছে তাঁর গানের প্রেরণা।
আজি এ কোন্ গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে আসিল নাবিয়া!
ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে,