থানা থেকে আসছি – প্রথম অঙ্ক

প্রথম অঙ্ক

(চন্দ্রমাধব সেনের বাড়ি। সুসজ্জিত ড্রয়িং-রুম। পর্দা উঠিলে দেখা গেল সাফা, কাউচ ইত্যাদিতে বসিয়া চন্দ্রমাধব সেন, শ্রীমতী রমা, শীলা, তাপস ও অমিয় গল্প করিতেছেন। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। ঘড়িতে সাতটা বাজে)

চন্দ্রমাধব : আচ্ছা শীলা বল তো, আজকের টি-পার্টির সবচেয়ে remarkable ব্যাপারটা কি?

শীলা : কি বাবা?

চন্দ্রমাধব : বাঃ — আজকের কাটলেট থেকে আরম্ভ করে পুড়িং পর্যন্ত সবই তো তোর মার হাতের তৈরি। করিমের তো আজ সারাদিন ছুটি।

অমিয় : তাই নাকি! তাই প্রত্যেকটা আইটেম অত চমৎকার হয়েছিল—

রমা : (মৃদু তিরস্কারের ভঙ্গিতে) আচ্ছা, তুমি কি বল তো? শীলা-তাপসের সামনে না হয় যা ইচ্ছে তাই বললে — কিন্তু তাই বলে—

(মৃদু হাসিয়া অমিয়র দিকে ইঙ্গিত করিলেন)

চন্দ্রমাধব : ও অমিয়? তা অমিয়র সামনে লজ্জা কিসের? ও তো ঘরের ছেলে!

অমিয় : না কাকীমা, এ আপনার ভারী অন্যায়। আপনিএখনও আমাকে পর বলে মনে করেন?

তাপস : সত্যি মা, এ তোমার ভারী অন্যায়! শেখরকাকার টেলিগ্রামচিঠি, দুই-ই এসে গেছে—

শীলা : বাঃ শুধুই তাই? আজ বিলিতি মতে এনগেজমেন্ট হয়ে গেল—সাতদিন বাদে দিশী মতে পাকা-দেখা —

তাপস : শুধু পাখা-দেখা? এক মাস বাদ দিয়ে—

অমিয় : না না তাপস,—বাবার চিঠি, টেলিগ্রাম, বিয়ের দিন ঠিক হওয়া, এসব না হয় আজকালের ব্যাপার। আগের কথাটা ধর। কাকাবাবু বাবার ছোটবেলার বন্ধু, ছোটবেলা থেকে আমার এখানে আসা-যাওয়া। মাঝে যে ক’বছর বিলেতে ছিলাম, সেই ক’বছরই যা আসতে পারিনি। নইলে দেখ, ফিফটি ওয়ানের ডিসেম্বরে ফিরেছি—আজ তিন বছর হতে চলল—নিয়মমতো এ বাড়িতে আমার আসা যাওয়া—

শীলা : উঁহু—অঙ্কে ভুল হয়ে গেল! ফিফটি-থ্রির মে-জুন-জুলাই, এ বাড়িতে তোমার চিকিটি দেখতে পাওয়া যায়নি—

অমিয়ি : বাঃ রে, আমি তোমাকে বলিনি—ফ্যাক্ট্রিতে ভীষণ কাজ পড়েছিল—

শীলা : না না—বলনি—সে কথা কি আমি একবারও বলেছি? দেখলাম হিসেবে ভুল করছ—তাই মনে করিয়ে দিলাম।

রমা : এ তোর ভারী অন্যায়, শেলী! বেচারীকে ভাল-মানুষ পেয়ে শুধু শুধু জ্বালাতন করা! কাজের চাপে দু-তিন মাস যদি না-ই আসতে পারে! পুরুষ-মানুষের কাজের তুই বুঝিসটা কি? ওদের কত কাজ—

চন্দ্রমাধব : নিশ্চয়। শেখর তো আজ দু-বছর হলো সব ওরই ওপর ছেড়ে দিয়েছে।

রমা : তবে? (শীলা বলিতে আরম্ভ করিয়াছিল — ‘কিন্তা মা’— তাহাকে বাধা দিয়া) আচ্ছা, তুই কি ভাবিস বল তো শীলা? বিয়ের পর দিনরাত ও তোর আঁচল ধরে ঘরে থাকবে? ও একজন বিজনেসম্যান! সময় সময় দেখবি কাজের চাপে, বাড়িঘর কোন কথাই ওর মনে নেই! না না, তুই ধারণা বদলাতে চেষ্টা কর শেলী—

শীলা : চেষ্টা করে দেখেছি মা—পারিনি! আর কোন দিন যে পারব তাও মনে হয় না! অতএব অমিয়বাবু, তুমি এখন থেকে সাবধান! (তাহার এই শেষের কথাগুলি শুনিয়া, দুই রকমই মনে হইতে পারে। মনে হতেই পারে, হয়তো সে অমিয়র সহিত রসিকতা করিতেছে—হয়তো সত্য সত্যই তাহাকে সাবধান হইতে বলিতেছে।)

অমিয় : না না, তুমি দেখে নিও শীলা—ঐ একবারই যা হয়ে গেছে— (কোথাও কিছু নাই অমিয়র কথা শুনিয়া তাপস হঠাৎ জোরে হাসিয়া উঠিল। মিঃ ও মিসেস সেন বিস্মিত হইয়া তাহার দিকে তাকাইলেন।)

শীলা : উঃ হেসে লুটিয়ে পড়লেন একেবারে! কেন, কিসের এত হাসি শুনি?

তাপস : (তখন অল্প হাসিতে হাসিতে) তা তো জানি না — হঠাৎ কি রকম হাসি পেয়ে গেল—

শীলা : (ত্রু�দ্ধ স্বরে) তা তো পাবেই! হাসি পাবার মত কথা বললাম আমরা — আর উনি হেসে আমাদের তুড়িতে ফুঁ করে দিলেন!

তাপস : না, কক্ষনো না—আমি কোন কিছু ভেবে হাসিনি—

রমা : আঃ — আবার দু’জনে ঝগড়া আরম্ভ করলি? আর শীলা, তোকেও বলি। কি সব কথাবার্তা বলছিস আজকাল? তুড়িতে ফুঁ করে দিলেন!—কোত্থেকে শিখেছিস এসব?

তাপস : তুমি বোধহয় ওর কথাবার্তা বিশেষ কান করে শোনো না মা—আজকাল ও ওই রকম কথাই তো বলে—

শীল : দেখ মা—আমি কারুর মান-টান রেখে কথা বলতে পারব না বলে দিচ্ছি! ছোড়দাকে ও রকম গাধার মত কথা বলতে বারণ করে দাও—

তাপস : দেখ শীলা —

রমা : (বাধা দিয়া) আঃ তোরা থামবি কিনা! দু’জনে দেখা হবার জো নেই একেবারে! দেখা হলেই ঝগড়া! (শীলাকে) আর ঝগড়া তো খুব করছিস? আজকের দিনে বাবাকে একটা প্রণাম করতে হয়, সে কথাটা মনে আছে কি?

শীলা : ঐ যাঃ — একেবারে ভুলে গেছি! (উঠিয়া মিঃ ও মিসেস সেনকে প্রণাম করিল—সেই সঙ্গে সঙ্গে অমিয়ও প্রণাম করিবার সময় মিঃ সেনকে ‘থাক বাবা থাক, হয়েছে’—বলিতে শোনা গেল।)

চন্দ্রমাধব : (রমাকে) বুঝলে, ওরা ভাবছে, আজ ওদেরই দিন। তোমার আমার কথাটা তো জানে না! শীলার সঙ্গে অমিয়র বিয়ে—এ আমাদের কতদিনের ইচ্ছে ! অমিয় যখন বিলেতে, তখন থেকে কথাবার্তা চলছে। এ বছর হবে সমস্ত ঠিক! এমন সময় শেখর বৌকে নিয়ে চলে গেল বম্বে। ভাবলাম এ বছরও হলো না। তারপর হঠাৎ কাল শেখরের টেলিগ্রাম—সামনের শনিবার পাকা-দেখা, সব ব্যবস্থা কর, আমি যাচ্ছি।

রমা : ওঃ—কাল যদি টেলিগ্রাম পাবার পর আমাদের অবস্থা দেখতে। কি যে করব, কাকে যে বলব, যেন কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না! আমি তো বলেছিলাম, আমাদের সার্কেলের সবাইকে আজকের পার্টিতে বলা হোক—

চন্দ্রমাধব : সেটা আমিই বারণ করেছিলাম অমিয়! আচ্ছা তুমিই বল, আজকের এই যে ঘরোয়া ব্যাপার—এটাই বেশ চমৎকার হলো না?

অমিয় : না না কাকীমা, এটা খুব ভাল হয়েছে। শনিবার একটা পাবলিক কিছু করলেই হবে।

চন্দ্রমাধব : হ্যাঁ, তারপর কি যেন বলছিলাম—? ও, শেখর আর আমি — আজই আমরা ফ্রেণ্ডলি রাইভ্যালস—কিন্তু একমাস বাদে? তখন আমরা আত্মীয়। সত্যি, আজ আমি স্বপ্ন দেখি—অমিয়, শেখর আর আমি এক হয়ে গেছি। অবিশ্যি শেখরের কনসার্ন আমার চেয়ে অনেক বড়, অনেক পুরোনো—তা হোক, তবু আমার মনে হয় দুইএ মিলে এক হবেই! বিরাট বিজনেস ট্রাস্ট গড়ে উঠবে—নাম হবে ধর, চন্দ্রশেখর নগর, কি শেখর-মাধব নগর—ট্রেডমার্ক হবে এনভিল আর হ্যামার। (উত্তেজিত হইয়া) তখনআর আমরা রাইভ্যালস নয় অমিয়, তখন আমরা এক হয়ে কাজ করছি, for lower costs and higher prices!

অমিয় : And for more profits! আমার মনে হয় বাবাও এতে রাজী হলেন কাকাবাবু।

রমা : আচ্ছা, তুমি যেন কি! আজকের দিনে আর কথা পেল না? সেই বিজনেস, বিজনেস আর বিজনেস।

শীলা : সত্যি বাবা— কোথায় সানাই বাজবে, না তোমরা দু’জনে খেরো খাতা নিয়ে বসলে!

চন্দ্রমাধব : না না, ও আমি এমনি কথায় কথায় বলছিলাম। কিন্তু যাই বল রমা — শীলা, অমিয়, এরা সত্যিই ফরচুনেট—

অমিয় : (শীলার দিকে চাহিয়া মৃদু হাসিয়া) অন্তত আমি যে ফরচুনেট এ বিষয়ে তো কোন সন্দেহ নেই!

রমা : (অল্প তর্জনের সুরে) কিন্তু শীলা —

শীলা : কি হলো মা? আবার কি করলাম!

রমা : বাঃ—কি করলাম মানে? (তাপসের দিকে ইঙ্গিত করিলেন)

শীলা : (ইঙ্গিত বুঝিতে পারিয়া) ঐ দেখ এক্কেবারে ভুলে গিয়েছিলাম! (তাপসকে প্রণাম করিয়া) আজকের দিনে তুই আমায় মাফ কর ছোড়দা—

তাপসা : (শীলার হাত ধরিয়া উঠাইয়া) দূর পাগলি! মাফ কিসের? তুই কি কোন দোষ করেছিস যে মাফ করব? বুঝলে অমিয়— শীলা একটু বদ-মেজাজি বটে, কিন্তু এরকম মেয়ে হয় না—

চন্দ্রমাধব : হ্যাঁগো, শলার এ আংটিটা নতুন গড়ালে বুঝি? বেশ চমৎকার হয়েছে তো!

রমা : আমি গড়াব কেন? ওটা যে অমিয় আজ শেলীকে প্রেজেন্ট করেছে—

চন্দ্রমাধব : বাঃ বেশ হয়েছে! শেলী — মাই গার্ল! সত্যি এ একটা বিয়ের মতো বিয়ে হচ্ছে, কি বল. আমার মেয়ে শেখরের ছেলে! পরে তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও—এ বিয়েতে ওরা দু’জনেই খুব খুশি হবে। হ্যাঁ, কিন্তু একটা কথা (শ্রীলাকে তখনও আঙুলের আংটির দিকে তাকাইয়া থাকিতে দেখিয়া) ওরে শোন শোন, কথাগুলো শুনে রাখা তোরও দরকার — আজ বাদে কাল একটা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের বউ হতে চলেছিস—

শীলা : না না, তুমি বল বাবা—আমি শুনছি—

চন্দ্রমাধব : না—মানে ঐ যে বলছিলাম না—সত্যিই তোরা খুবসুখী হবি! আর কেন হবি না বল? সত্যিই খুব ভাল সময়ে তোদের বিয়ে হচ্ছে। তুমি বল না অমিয়, সময়টা কি এমন খারাপ! বাইরের অবিশ্যি দু-চারজন লোকের মুখে সব সময়েই শুনতে পাবে — বাজার মন্দা, সময়টা বড্ড খারাপ! কিন্তু আমিও তো একজন দুঁদে বিজনেসম্যান? আমি তোমায় বলছি অমিয়, ওসব কথার কোন মানেই হয় না! যারা কোন কালে কিছু করতে পারে না তারাই ঐ সব কথা বলে! আরে—এখন তো সময় ভাল যাচ্ছেই, এরপর আরো ভাল সময় আসছে। বাইরে অবিশ্যি ঐরকম দু-চারজনের মুখে শুনতে পাবে— কোথায় সময় ভাল? আজ অমুক মিলে স্ট্রাইক, কাল তমুক ফ্যাক্টরিতে কাজ বন্ধ। ঐ যে—ওমাসে জেনারেল স্ট্রাইক না কি একটা হলো না—আরে সে কি হৈ-চৈ। এইবার লেবার-ট্রাবল আরম্ভ হলো—আর রক্ষে নেই—হেন-তেন সাত-সতের সে সব আরো কত কি! আরে, যতই যাই হোক — ফরটি-সিক্সের মত তো আর হবে না! কিন্তু কই, কিছু হলো কি? রায়ট বাধার সঙ্গে সঙ্গে কোথায় ভেসে গেল ইনকিলাব-জিন্দাবাদের দল! তারপর আমরা এমপ্লয়াররাও তো কিছু চুপ করে বসে নেই! আমরাও দেখছি যাতে ক্যাপিটালের ইন্টারেস্ট প্রপারলি প্রটেক্টেড হয়। আমি তোমায় বলছি অমিয়, আমাদের এখন ধনস্থানে বৃহস্পতি — ফল সম্ভোগ, অর্থ বৃদ্ধি—বুঝলে—

অমিয় : আমারও তাই মনে হয় কাকবাবু—

তাপস : আর পাঁচজনে কিন্তু অন্য কথা বলছে বাবা। তারা বলছে বিপ্লব, শ্রেণী-সংগ্রাম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ—আরো সব কত কি!

চন্দ্রমাধব : থামো থামো! বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রাম! সব অত সস্তা কিনা। মাঠে ময়দানে, দু-চারটে মিটিঙে লাল ঝাণ্ডা নিয়ে ইনকিলাব ইন-কিলাব করলে যদি বিপ্লব আসত, তাহলে আর ভাবনা থাকত না। আগে দেখ লোক কি চায়? এদেশের লোকের প্যাসিভ নেচার! তারা ওসব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যাবে কেন? ওসব হাঙ্গামায় তাদের লাভটা কি? আর বুদ্ধিমান লোক তো মোটেই ওসবের মধ্যে যাবে না। তারা এ বাজারে বেশ দু পয়সা করে খাচ্চে! তোমার আমার মতো নরম্যাল লোকের ওসব ঝঞ্ঝাট করে লাভ তো কিছুই হবে না—বরং লোকসান! এক লাভ হতে পারে কাদের—যারা অ্যাবনরম্যাল অকর্মা, বোকা, তাদের। কিন্তু তাদের সে শক্তি কই?—সে ক্ষমতা কোথায়?

তাপস : সব বুঝলাম — কিন্তু তবু—

চন্দ্রমাধব : আবার তবু কিসের শুনি, তবু কিসের? তোদের ধরনই এই! জানিস তো কত—কিন্তু তবু দেখ সব কথায় একটা করে তবু কেন-কিন্তুর ফোড়ন আছেই। ওরে বাবা, আমিও তো একটা দুঁদে বিজনেসম্যান, আমার কথারও তো একটা দাম আছে। দুনিয়াটার দিকে তাকিয়ে দেখ — দেখ how fast it is developing । যারা একটু বুদ্ধিমান, একটু চিন্তা করে, তাদের এখন ওসব কথা ভাববার সময় কই? এটা কি উনিশ শো আঠারো সাল—না রাশিয়া! জীবনের কমফর্টস লাক্সারি কত বেড়ে গেছে এখন! এই চোখের ওপর দুর্গা মিত্তিরকেই দেখছি! ছিল একটা পেটি বিজনেসম্যান! যুদ্ধের বাজারে দুটো পদে ব্যবসা আরম্ভ করলে, দেশী পদে চাল আর পুরনো লোহা, আর বিলিতি পদে বীফ! দু’দিনে একেবারে আঙুল ফুলে কলাগাছ। যা একটু বাকি ছিল, ব্যাঙ্কট্যাকে ফেল করিয়ে তাও পুষিয়ে নিলে। প্রথম প্রথম সবাই নাক সেঁটকাতে। আজ? আজ সে আমাদেরই একজন। কে বলবে সে একদিন বীফের ব্যবসা করত! গোহত্যা নিরোধের আজ সে একজন বড় পাণ্ডা! এই তো পরশু প্রসেশনের সঙ্গে মোটরে করে গেল, আবার মোটর থেকে নেমে গিয়ে পুলিশের লাঠি খেলে। আগে একখানা ভাঙা ফোর্ড ছিল — এখন দেখ চারখানা নতুন মডেলের গাড়ি। আগে কোন রকমে সেকেণ্ড ক্লাসে ট্রাভেল করত, এখন প্লেন ছাড়া কথা বলে না। এই তো কালই বলছিল— ছাতে প্লেন নামাতে পারলে ভারী সুবিধে হয়! আরে এখন কি দেখছিস? আবার তোদের ছেলেমেয়ের বিয়েতে যখন পার্টি দিবি, তকন দেখবি—লোকে দিব্যি আরামে রয়েছে, চারধারে র্যাপিড প্রগ্রেস, মালিকেরা সব এক জোট, লেবার ট্রাবলের কোন চিহ্নই নেই! দেখবি প্রত্যেকটা দেশ তখন আমেরিকার সঙ্গেসমান তালে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে—অবিশ্যি রাশিয়া চীন-ফিন বাদে! ওসব জায়গায় আজও ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, সেদিনও থাকবে না—কাজেই নো প্রগ্রেস।

রমা : (বিরক্ত হইয়া) আচ্ছা, তোমার আজ কি হয়েছে বল তো? আবার আজকের দিনে ঐ সব বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলে—

চন্দ্রমাধব : না, মানে—

রমা : না, কোন মানে নয়, চুপ একেবারে।

চন্দ্রমাধব : আচ্ছা আচ্ছা, এই চুপ করলাম—হয়েছে তো! কিন্তু না বলেই বা কি করি বল? বাইরে তো ঘুরতে হয় না, ঘুরলে দেখতে পেতে! যত ব্যাটা হতভাগা, অকর্মার দল! কেউ নাটক লেখেন, কেউ লেখেন গল্প-কবিতা, কেউবা খুচরো পলিটিক্স করেন! আর সব কথা বলছে কি! শুনলে মনে হবে দেশের নাড়ীনক্ষত্র সব কিছু জেনে বসে আছে একেবারে! আরে—দেশের বুঝিসটা কি? জীবনের দেখলি কি? ক্যাপিটাল আমাদের, বিজনেস আমাদের! যেটুকু বোঝবার, সেটুকু তো আমরাই বুঝি! তুমি কথা বলার কথা বলছ? এতদিন তো চুপ করেই ছিলাম। আজ ওরা আবোল-তাবোল বকছে বলেই না আমরা একটু-আধটু বলছি! অন্তত এটা তো ঠিক কথা — আমরা যেটুকু বলব, তা সলিড এক্সপিরিয়েন্স থেকেই বলব — ওদের মতো আবোল-তাবোল নয়!

(গোবিন্দর প্রবেশ)

গোবিন্দ : মা, স্যাকরা এসেছে, তাকে কি এখানে নিয়ে আসব?

রমা : না, ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা, আমি যাচ্ছি। শীলা, প্যাটার্ন আর ডিজাইনটা পছন্দ করে দিবি চল—অমিয়, চলে যেও না যেন বাবা, এখুনি আসছি—(অমিয় ‘না না আমি আছি কাকীমা’ বলিলে, মিসেস সেন ও শীলা উঠিয়া দরজার দিকে অগ্রসর হইলেন! বাহিরে যাইতে যাইতে তাপসকে) তুই একটু আয় তো তাপস,দরকার আছে! (তাঁহাদের পশ্চাতে তাপসের প্রস্থান।)

চন্দ্রমাধব : হ্যাঁ, একটা কথা অমিয়, অবিশ্যি তোমার আমার মধ্যে! আমি যতদূর জানি, তোমার মার বোধহয় বিশেষ মত ছিল না এ বিয়েতে—তাঁর বোধহয় ইচ্ছে ছিল স্যার এ.এন.-এর নাতনীর সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়—তাই না? (অমিয়কে ‘না মানে না মানে’ বলিতে দেখিয়া) না না, আমি বলছি না তাঁর অন্যায়। শেখর আমার বন্ধু হতে পারে—কিন্তু ঘর হিসেবে তোমরা আমার চেয়ে অনেক বড়। বিশেষ করে তোমার মা তো স্যার বীরেন মিত্তিরের মেয়ে। তবে আমারও পোজিশনখুব একটা নিচু এখন নয়! বার দুয়েক বিলেতেও ঘুরে এসেছি — আর অনার্স-লিস্ট এখন নেই তাই—থাকলে স্যার না হলেও একটা রায় বাহাদুর অন্তত হতাম। তবে একটা ভরসা আভাসে তোমার মাকে দিতে পার… এবার বোধহয় অ্যাসেম্বলিতে যাচ্ছি—

অমিয় : তাই নাকি?

চন্দ্রমাধব : হ্যাঁ, রিসেন্টলি ভুপেন মিত্তিরের সিটটা খালি হয়েছে না? ঐ সিটে —

অমিয় : বাঃ — কিরে এলেই মাকে আমি খবরটা দেব —

চন্দ্রমাধব : না না, এখনও সেন্ট পারসেন্ট সারটেন নয়—তবে তুমি তোমার মাকে বলতে পার। নমিনেশনটাও জাঁদরেল ব্লকের, আর এলাকাটাও ভাল। বেশির ভাগ ভোটারই ব্যবসাদার—খালি গোটা দুয়েক বস্তি আছে। কিছু যদি ভাঙতে পারি, আর মনে হয় পারব — তাহলে আর দেখতে হবে না—ইলেকশন সারটেন!

অমিয় : তাহলে মাকে খবরটা পরিষ্কার জানিয়েই দিই, কি বলেন?

চন্দ্রমাধব : না না, বলা কি যায়। ধর শেষ পর্যন্ত একটা স্ক্যান্ডালই হয়ে গেল—কোর্ট ঘর করতে হলো—

অমিয় : শুধু শুধু স্ক্যাণ্ডলই বা হতে যাবে কেন?

চন্দ্রমাধব : তা কি বলা যায়? চারদিকে কত পুয়োর রিলেশন্স। কখন যে কি কুকর্ম করে বসে তার ঠিক কি? তুমি বরং তোমার মাকে একটা হিন্ট দিয়ে রেখ—(তাপসকে প্রবেশ করতে দেখিয়া) কিরে, তোকে যে তোর মা দরকার বলে ডেকে নিয়ে গেল?

তাপস : দরকার না ছাই! স্যাকরা ডিজাইন-বুক দিয়ে চলে গেল, আর ওঁরা শাড়ি জর্জেটের কথা আরম্ভ করলেন। আমায় যে দরকার বলে ডেকে এনেছে, সে হুঁশই নেই কারুর! আমি একটা মজা দেখেছি বাবা, মেয়েরা কাপড় আর গয়নার কথা যখন আরম্ভ করে তখন বিশ্বসংসার ভুলে যায়!

চন্দ্রমাধব : কিন্তু কাপড় আর গয়নাটা তোদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হতে পারে — তবে ওদের কাছে নয়। তুই কি ভাবিস, মেয়েরা তাদের সুন্দর দেখাবে বলেই ওসব নিয়ে এত মাথা ঘামায়? কাপড় আর গয়না ওদের সেলফ-রেসপেক্টের একটা চিহ্ন — তা জানিস!

অমিয় : ঠিক বলেছেন আপনি —

তাপস : (ব্যস্তভাবে) হ্যাঁ হ্যাঁ আমারও মনে পড়েছে, (একটু থামিয়া) না মানে—

চন্দ্রমাধব : (বাধা দিয়া) না মানে? না মানে কি? তোর কি মনে পড়েছে?

তাপস : (অপ্রতিভ হইয়া) না, মানে—ও কিছু নয়—এমনিবলছিলাম—

অমিয় : (ঠাট্টা করিয়া) উঁহু তাপস, ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে—

চন্দ্রমাধব : তা যা বলেছ—কিছু বিশ্বাস নেই এদের! হাতে অবসরও প্রচুর, টাকাও প্রচুর। কাজেই কখন যে কি করতে পারে, আর কি করতেপারে না— তা জোর করে কিছু বলা যায় না। অথচ আমাদের ছেলেবেলার কথা মনে আছে—বাড়িতে এক মিনিট বসে থাকতে সময় পেতাম না। কিছু না থাকলে ঘরে কাজ করতে হতো। আর টাকা-পয়সা? মনে আছে যখন প্রেসিডেন্সিতে পড়তে যেতাম তখন বাসভাড়া আর জলখাবার মিলিয়ে দশটা করে পয়সা পেতাম। কিন্তু কেমন চলে যেত আমাদের—আবার ওরই মধ্যে একটু-আধটু আমোদ-আহ্লাদও করেছি—

অমিয় : তা তো করতেই হবে একটু আমোদ-আহ্লাদ, না করলে চলবে কেন?

চন্দ্রমাধব : সেই কথাই তো বলছি! তাপস ভাবছে, আমিআবার হয়তো বক্তৃতা শুরু করব। কিন্তু বক্তৃতা কোথায়—এটা একটা দরকারী কথার কথাটা তোমাদের কারুই মনে থাকে না—বোঝও না বোধহয় তোমরা। আজকে তোমরা যা পাচ্ছ—এ তো তৈরি জিনিস। আমরা তা পাইনি—আমাদের তৈরি করে নিতে হয়েছে। তোমাদের এগিয়ে যাওয়া কত সহজ—কিন্তু পারছ কই তোমরা আমাদের মতো এগুতে? কেন পারছ না জান? ঐ দরকারী কথাটা কেউ বোঝ না বলে। জানবে আজকের দিনে বড় হতে গেলে দুনিয়ায় নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখার নেই। জেনে রেখ — first you yoruself, second you yourself, and last you yoruself! তবে ফ্যামিলি থাকলে ফ্যামিলির কথাটাও কনসিডার করতে হবে। এই সেলফের নীতি-কথাটি যদি মনে থাকে, তবেই দেখবে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছ। আর নইলে বাইরের ঐ সব মাথা খারাপ হতচ্ছাড়াদের কথায় কান দিয়েছ কি মনে হবে—উঁহু, সেলফ তো ঠিক কথা নয়, সমাজের সকলের সুখ-দুঃখ দেখতে হবে। আর যত সব ননসেন্স কথা মনে আসবে, — সমাজ রাষ্ট্র, কো-অপারেশন, ব্রাদারফিলিং! — আর ঐ সব মনে হয়েছে কি তলিয়ে গেছ! আরে বাবা— আমি একাট দুঁদে বিজনেসম্যান, অভিজ্ঞতার পাঠশালায় আমার পাঠ নেওয়া! আমি তোমাদের বলছি—দুনিয়ার কোন লোকের জন্যএতটুকু দায় তোমাদের নেই! খালি নিজেকে দেখ, নিজের ফ্যামলিকে দেখ। আর তেল যদি দেবার দরকার হয় — দাও তেল—কিন্তু নিজের চরকায়।

(গোবিন্দর প্রবেশ)

গোবিন্দ : আজ্ঞে, থানা থেকে সাব-ইন্সপেক্টারবাবু এসেছেন—

চন্দ্রমাধব : কে এসেছে?

গোবিন্দ : আজ্ঞে সাব-ইন্সপেক্টারবাবু—

গোবিন্দ : (বিরক্তির সহিত) সাব-ইন্সপেক্টর? কিসের?

গোবিন্দ : আজ্ঞে পুলিসের। পদ্মপুকুর থানা থেকে আসছেন। নাম বললেন তিনকড়ি হালদার।

চন্দ্রমাধব : তিনকড়ি হালদার! (বোধহয় মনে করিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ও নামে কাহাকেও মনে পড়িল না।) — তা চায় কাকে?

গোবিন্দ : আজ্ঞে বললেন, আপনার সঙ্গে জরুরী দরকার।

চন্দ্রমাধব : আমার সঙ্গে? ননসেন্স! (উঠিবার উপক্রম করিয়া) আচ্ছা, বাইরের ঘরে বসা, আমি—(পুনরায় বসিয়া পড়িয়া) আচ্ছা, থাক, এখানেই পাঠিয়ে দে। (গোবিন্দর প্রস্থান)—ও হয়েছে— বুঝলি, রমেশ বোধহয় কোন দরকারে পাঠিয়েছে। (অমিয়কে) আমার ভাগ্নে রমেশ, সাউথের ডিসি, থাকেও পদ্মপুকুর থানার ওপরে, তাই বোধহয়—

অমিয় : (ঠাট্টার ছলে) কিংবা হয়তো দেখুন, আমাদের তাপস কিছু করে-টরে বসেছে কিনা!

চন্দ্রমাধব : (ঐ একই সুরে) তা হতে পারে! তোমাদের—মানে আজকালকার ছেলেদের বিশ্বাস নেই কিছু!

তাপস (অস্বস্তির সহিত অমিয়কে) তার মানে? কি বলতে চাও তুমি?

অমিয় : (হাসিয়া উঠিয়া) কি মুসকিল! কিচ্ছু বলতে চাই না! আচ্ছা পাগলকে নিয়ে পড়া গেছে যাহোক! ঠাট্টা বোঝে না?

তাপস : (পূর্ববৎ, অস্বস্তির সহিত) না, ঠাট্টা যদি ওরকম হয় তাহলে বুঝি না!

চন্দ্রমাধব : (ত্রু�দ্ধ স্বরে) তাপস! আজ তোর কি হয়েছে বলতো?

তাপস : (উদ্ধত স্বরে) হবে আর কি? কিচ্ছু নয়!

চন্দ্রমাধব : (ত্রু�দ্ধ স্বরে) তাপস!

(আরও কি যেন বলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময় সাবইন্সপেক্টর তিনকড়ি হালদারের প্রবেশ। তাঁহার পরিধানে সাবইন্সপেক্টরের পরিচ্ছদ। গুরুত্ব আরোপ করিয়া কথা বলার অভ্যাস, এবং কথা বলেন খুব সাবধানে, যেন কোথাও ফাঁক না থাকিয়া যায়, অথবা কোন অপ্রয়োজনীয় কথা না বলিয়া ফেলেন! লক্ষ্য করিবার মতো আরও একটি বিশেষত্ব আছে। কাহারও সহিত কথা বলিবার সময় তাঁহার অপ্রীতিকর প্রখর দৃষ্টি উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে রীতিমত বিচলিত করিয়া তোলে।)

তিনকড়ি : নমস্কার, আপনিই মিস্টার চন্দ্রমাধব সেন?

চন্দ্রমাধব : হ্যাঁ, আপনি?

তিনকড়ি : সাব-ইন্সপেক্টর তিনকড়ি হালদার — পদ্মপুকুর থানা থেকে আসছি।

চন্দ্রমাধব : (চেয়ার দেখাইয়া দিয়া) বসুন—(তিনকড়িবাবু বসিলে, সিগারেট কেস খুলিয়া সম্মুখে ধরিলেন) সিগারেট?

তিনকড়ি : নো, থ্যাঙ্কস।

চন্দ্রমাধব : (নিজে সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে) আপনি বুঝি সিগারেট খান না?

তিনকড়ি : খাই তবে অন ডিউটি নয়!

চন্দ্রমাধব : (তিনকড়ির মুখের দিকে তাকাইয়া) আপনি পদ্মপুকুরে নতুন এসেছেন, না?

তিনকড়ি : হ্যাঁ নতুনই, আজ নিয়ে পাঁচদিন।

চন্দ্রমাধব : আমারও মনে হচ্ছিল। আমার ভাগ্নে রমেশ, মানে আপনাদের সাউথের ডি-সি, ও তো থাকে ঐ থানার ওপরেই। ওর ওখানে প্রায়ই যাই তো — কিন্তু আপনাকে কখনও …

তিনকড়ি : (বাধা দিয়া) না, আমাকে আর দেখবেন কি করে—আমি তো মোটে পাঁচদিন হলো এসেছি।

চন্দ্রমাধব না, মানে আমিও তাই বলছিলাম। কিন্তু আপনি এ সময়ে, — রমেশ কোন দরকারে পাঠিয়েছে নিশ্চয়?

তিনকড়ি : না মিস্টার সেন।

চন্দ্রমাধব : (অসহিষু� হইয়া) তবে?

তিনকড়ি : আমি এসেছি দু-একটা খবর জানতে। অবশ্য আপনি যদি কিছু মনে না করেন।

চন্দ্রমাধব : খবর জানতে? এখানে?

তিনকড়ি : হ্যাঁ। আজ বিকেলে একটি মেয়ে কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে মারা গেছে। হসপিটালে পাঠানো হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে, কিনতু কিছুতেই বাঁচানো গেল না, ভেতরটায় কিচ্ছু ছিল না — সমস্ত জ্বলে গিয়েছিল!

তাপস : (শিহরিয়া উঠিয়া) উঃ! বলেন কি?

তিনকড়ি (তাপসকে) হ্যাঁ, সে বড় ভীষণ যন্ত্রণা, চোখে দেখা যায় না! (চন্দ্রমাধবকে) বুঝতেই পারছেন—সুইসাইড—

চন্দ্রমাধব : সে তো বুঝতেই পারছি—it’s a horrible business! কিন্তু আমার সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কি?

তিনকড়ি : মেয়েটি যেখানে থাকত সেখানে আমি গিয়েছিলাম। তার একটা চিঠি আর ডায়েরি আমি পেয়েছি। জানেন তো, অভিবাবকহীন অবস্থায় বিপদে-আপদে পড়লে মেয়েরা অনেক সময় অন্য নাম নেয়? এ মেয়েটিও নিয়েছিল। আমিঅবশ্য আসল নামটা ডায়েরি থেকে বার করে নিয়েছি— সন্ধ্যা চক্রবর্তী—

চন্দ্রমাধব : সন্ধ্যা চক্রবর্তী?

তিনকড়ি : হ্যাঁ, সন্ধ্যা চক্রবর্তী। মেয়েটিকে মনে আছে আপনার?

চন্দ্রমাধন : (ধীরে ধীরে) না—মানে—নামটা যেন কিরকম শোনা শোনা বলে মনে হচ্ছে—কোথায় যেন শুনেছি! কিন্তু সে যাই হোক—এসবের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি?

তিনকড়ি : আপনাদেরই একটা কনসার্ন—দয়াময়ী কুটীরশিল্প প্রতিষ্ঠান — মেয়েটি সেখানে এক সময় কাজ করত।

চন্দ্রমাধব : ও তাই বলুন। কিন্তু সেখানে তো একটা মেয়ে কাজ করে না। আর যারা করে তাদেরও কেউ পারমানেন্টলি নেই—আজ দুজন আসছে, কাল দুজন যাচ্ছে।

তিনকড়ি : এ-মেয়েটি খুব একটা সাধারণের পর্যায় পড়ে না মিস্টার সেন। আমি তার বাসা থেকে একটা ছবিও জোগাড় করেছি—আপনি হয়তো ছবিটা দেখলে চিনতে পারবেন।

(তিনকড়ি হালদার একটি পোস্ট-কার্ড সাইজের ছবি পকেট হইতে বাহির করিয়া মিস্টার সেনের নিকট গেলেন। অমিয় ও তাপস দুইজনেই ছবিটি দেখিতে গেল। কিন্তু তিনকড়িবাবু ছবিটিকে আড়াল করিয়া ধরায় তাহারা দেখিতে সক্ষম হইল না। তিনকড়িবাবুর এইরূপ ব্যবহারে তাহারা বিস্মিত তো হইয়াছিলই, বিরক্তও হইল। দেখা গেল মিস্টার সেন ছবিটি খুব ভাল করিয়া দেখিতেছেন, এবং মনে হইল যেন চিনিতেও পারিয়াছেন। তিনকড়িবাবু ছবিটিকে পকেটে রাখিয়া স্বস্থানে ফিরিয়া আসিলেন।)

অমিয় : (বিরক্তির সহিত) আচ্ছা তিনকড়িবাবু, ছবিটা আমাকে দেখতে দিলেন না কেন? বিশেষ কোন কারণ আছে কি?

তিনকড়ি : (শান্ত অথচ কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া) হয়তো আছে।

তাপস : আমার বেলায়ও কি তাই, তিনকড়িবাবু?

তিনকড়ি : নিশ্চয়। আপনি কি ভাবছিলেন আপনার জন্যে একটা আলাদা কিছু হবে?

অমিয় : কিন্তু কারণটা কি?

তাপস : সেটা তো আমার মাথাতেও ঢুকছে না—

চন্দ্রমাধব : তিনকড়িবাবু আমিও কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না, কেন আপনি ওদের…

তিনকড়ি : আজ্ঞে, আমার কাজ করার রীতিই এই। এক-একবারে এক-একজন। নইলে, সকলকে একসঙ্গে ধরলে বড় গণ্ডগোল হয়।

চন্দ্রমাধব : (কিছুটা চঞ্চল হইয়া) তাহলে অবিশ্যি বলবার কিছু নেই!

তিনকড়ি : (চন্দ্রমাধবের এই চাঞ্চল্য তিনি লক্ষ্য করিয়াছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করিলেন) আপনি তাহলে মেয়েটিকে চিনতে পেরেছেন, কি বলেন মিস্টার সেন?

চন্দ্রমাধব : হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে। মেয়েটি দয়াময়ীতে কাজ করত—আমরা তাকে বরখাস্ত করি—

তাপস : (উত্তেজিত হইয়া) বাবা, তাহলে কি সেইজন্যেই মেয়েটি..

চন্দ্রমাধব : তাপস! চুপ করে বসতে পারিস বস—নইলে এ ঘর থেকে যা। (তিনকড়িবাবুকে) কিন্তু এ আজ দু’বছর আগের কথা তিনকড়িবাবু, ফিপটি-টুর সেপ্টেম্বরের শেষে।

অমিয় : আমি এখন তাহলে বাইরে যাই, কি বলেন কাকা?

চন্দ্রমাধব : না না, বাইরে যাবার মতো হয়েছেটা কি!—কি তিনকড়িবাবু, অমিয়র এ ঘরে থাকাতে আপনার নিশ্চয়ই কোন আপত্তি নেই? (হয়তো আপত্তি থাকিতে পারে এই মনে করিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন)—মানে, আমার বন্ধু বোস ইনডাসট্রিজ-এর শেখর বোস—নাম শুনেছে নিশ্চয়? বাংলাদেশের একটা অতবড় বিজনেস ম্যাগনেট! অমিয় তাঁরই ছেলে—

তিনকড়ি : কি বললেন? অমিয় বসু—না?

চন্দ্রমাধব : হ্যাঁ—মানে, অমিয় আর আমার শীলা—সামনের মাসেই ওদের বিয়ে। তাই আজ একটু—

তিনকড়ি : (চিন্তা করিতে করিতে অমিয়কে) ও, আপনি আর শ্রীমতী শীলা—আপনাদের এই সামনের মাসেই বিয়ে, না?

অমিয় : (মৃদু হাসিয়া) এখনো অবধি আশা তো সেই রকমই, তবে—

তিনকড়ি : (গম্ভীরভাবে) না অমিয়বাবু, তাহলে আপনার বাইরে না যাওয়াই ভাল। আপনি বরং এ ঘরেই থাকুন।

অমিয় : (বিস্মিত হইয়া) আশ্চর্য! তা না হয় রইলাম, কিন্তু—

চন্দ্রমাধব : (অধৈর্য হইয়া) দেখুন তিনকড়িবাবু, আপনি যে ভাবছেন মিষ্টিরিয়াস কেলেঙ্কারি গোছের একটা কিছু হয়েছিল—তা মোটেই হয়নি, এর মধ্যে বাঁকা-চোরা কিছু নেই। স্ট্রেট কেস! তাও হয়েছে কবে?—না দু’বছর আগে। তার সঙ্গে এ সুইসাইডের সম্পর্কটা কি?—কিছুই নয়!

তিনকড়ি : না মিস্টার সেন, আমি আপনার কথা মেনে নিতে পারছি না।

চন্দ্রমাধব : কেন পারছেন না?

তিনকড়ি : কারণ খুব সোজা। চাকরি যাওয়ার পর যা কিছু ঘটেছে, তা হয়তো ঘটত না, যদি না তার ঐ চাকরিটা যেত। হয়তো ঐ পরের ঘটনাগুলোই তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। দেখুন—হয়তো ঐ চাকরি যাওয়া থেকে তার আত্মহত্যা অবধি সব এক চেনে বাঁধা!

চন্দ্রমাধব : আপনি যদি ওভাবে বলেন, তাহলে অবশ্য আপনার কথা খানিকটা ঠিক। কিন্তু আমি ওভাবে বলি না—কাজেই এ ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। আপনি যা বলছেন ও তো একটা কথার কথা! ওভাবে কাজ করতে গেলে কি চলে? চলে না। কত লোকের সঙ্গে আমাদের কাজ! আপনি কি বলতে চান তাদের জীবনে যা কিছু ঘটেছে সব দায়-দায়িত্ব আমাদের? বলুন না—আপনিই বলুন—কথাটা কি খুব অকওয়ার্ড নয়?

তিনকড়ি : নিশ্চয়, অকওয়ার্ড বইকি, খুবই অকওয়ার্ড।

চন্দ্রমাধব : আমাদের অবস্থাটা কি হবে একবার ভাবুন দেখি? কি রকম একটা ইমপসিবল সিচুয়েশনের মধ্যে গিয়ে পড়ব বলুন তো?

তাপস : ঠিক বলেছ বাবা। তুমি তো একটু আগেই বলছিলে, আগে নিজে তারপর অন্য কেউ—

চন্দ্রমাধব : যাকগে, ওসব বাজে কথা এখন থাক—

তিনকড়ি : কি কথা মিস্টার সেন?

চন্দ্রমাধব : ও কিছু নয়। আপনি আসবার আগে আমি এদের দু’একটা গুড অ্যাডভাইস দিচ্ছিলাম। যাকগে ওসব কথা, এখন কাজের কথায় আসা যাক। হ্যাঁ, কি যেন নাম বলছিলেন মেয়েটির?—ও মনে পড়েছে, সন্ধ্যা চক্রবর্তী। হ্যাঁ, মেয়েটি আমাদের দয়াময়ীতে কাজ করত—এমব্রয়ডারি সেকশনে। বেশ চালাক চতুর, দেখতে শুনতেও ভাল। হাতের কাজও চমৎকার। বোর্ড-মিটিঙে তো আমরা ঠিকই করেছিলাম—ওকে সেকশন-ইন-চার্জ করে দেব। কিন্তু হঠাৎ গোলমাল বাধল পুজোর বন্ধের ঠিক পরেই। সকলে মিলে স্ট্রাইক করে কাজ বন্ধ করলে! কি? না, প্রত্যেকের পাঁচ টাকা করে মাইনে বাড়িয়ে দিতে হবে। বুঝতেই পারছেন—আমরা refuse করলাম—

তিনকড়ি : না, ঠিক বুঝতে পারলাম না। কেন, refuse করলেন কেন?

চন্দ্রমাধব : (বিস্মিত হইয়া) কেন refuse করলাম?—মানে?

তিনকড়ি : হ্যাঁ, refuse কেন করলেন?

চন্দ্রমাধব : (ত্রু�দ্ধ হইয়া) দেখুন তিনকড়িবাবু, business আমার, আমার ইচ্ছে মতো সেটা আমি চালাই। এ নিয়ে আপনার মাথা ঘামাবার দরকার আছে বলে আমার তো মনে হয় না।

তিনকড়ি : আপনি কি করে জানলেন? দরকার হয়তো সত্যিই আছে, তাই মাথা ঘামাচ্ছি।

চন্দ্রমাধব : কিন্তু আপিন ওরকম চোখ রাঙিয়ে কথা বলছেন কাকে?

তিনকড়ি : তা যদি আপনার মনে হয়, তাহলে I am sorry। আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়েছি মাত্র।

চন্দ্রমাধব : কিন্তু আমি যা বলছি তা যুক্তিসঙ্গত—আর আপনি যা বকছেন, তা অবান্তর!

তিনকড়ি : কিন্তু আমি আপনাকে যা জিজ্ঞেস করেছি, তা আমার ডিউটির মধ্যে বলেই করেছি, নইলে করতাম না।

চন্দ্রমাধব : কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন। চাকরির দিক থেকে আপনারও যেমন একটা ডিউটি আছে, ব্যবসার দিক থেকে আমারও তেমনি একটা ডিউটি আছে!

তিনকড়ি : সেটা কি, জানতে পারি?

চন্দ্রমাধব : কেন পারেন না, নিশ্চয় পারেন? আমার ডিউটি হল labour costকে যতটা সম্ভব কমের মধ্যে রাখা। আমরা ওদের মাসে তিরিশ টাকা করে দিচ্ছিলাম। সেই জায়গায় যদি পঁয়ত্রিশ টাকা করে দিতে হত, তাহলে labour cost কত বাড়ত জানেন? Sixteen percent-এর উপর! এবার আপনার কেনর উত্তর নিশ্চয়ই পেয়েছেন? সব জায়গায় যা দেয়, আমরাও তাই দিচ্ছিলাম। তাদের পছন্দ হয় কাজ করুক, না হয় অন্য কোথাও যাক! আমি তো তাদের বলেই দিয়েছিলাম—it is a free country–এখানে না পোষায়, অন্য কোথাও যাও। আমি তো আর কাউকে ধরে রাখিনি।

তাপস : তাহলে এটা free country নয়! এ দেশে অন্য কোথাও যেতে চাইলেই কি যাওয়া যায়—না গেলেই কাজ পাওয়া যায়?

তিনকড়ি : ঠিক কথা।

চন্দ্রমাধব : (তাপসকে) আচ্ছা, তোর কি সব ব্যাপারে কথা বাল চাই! আমি তো তোকে বলেছি তাবস—চুপ করে বসে থাকতে পারিস বস, নইলে যা। সব তাতে কথা! (তিনকড়িবাবুকে) হ্যাঁ, কি বলছিলাম যেন? ও, স্ট্রাইকের কথা। স্ট্রাইক অবশ্য বেশিদিন চলেনি—

অমিয় : তা কখনো চলে! পুজোর বন্ধের পরই যে! হাতে তো কারো একটি পয়সা নেই, অফিস থেকে লোন না পেলে খাবে কি?

চন্দ্রমাধব : হলও ঠিক তাই! চারদিন পেরিয়ে পাঁচদিন গেল না, স্ট্রাইকও শেষ! আমরা অবশ্য কোন স্টেপ নিইনি। সকলকেই নিলাম—তবে হ্যাঁ, তিন-চারজন রিংলিডার বাদে। তা আপনার ঐ সন্ধ্যা চক্রবর্তী—তিনি ঐ তিন-চারজনেরই একজন! অনেকদূর এগিয়েছিলেন কিনা—তাই চাকরিটা গেল!

অমিয় : তা তো যাবেই! চাকরি এখানে থাকে কি করে?

তাপস : কেন থাকপে না? বাবা ইচ্ছে করলেই থাকত। বাবার ইচ্ছে ছিল না, তাই তার চাকরিও রইল না! বাবা তো তাড়িয়েই খালাস—মেয়েটার অবস্থাটা ভাব তো একবার—

চন্দ্রমাধব : রাবিশ! তুই এসব ব্যাপারের জানিস কতটুকু? আজ পাঁচ টাকা দে, কাল দশ টাকা চেয়ে বসবে! দে আবার দশ টাকা—দেখবি, পরদিনই বলছে, গোটা দুনিয়াটা আমাদের দাও!

অমিয় : ঠিক কথা।

তিনকড়ি : হ্যাঁ, তা ঠিক কথা—তবে ঐ চাইবে, ঐ পর্যন্ত—নিয়ে বসবে না।

চন্দ্রমাধব : (তিনকড়িবাবুর দিকে এক দৃষ্টিতে দেখিয়া) আচ্ছা কি যেন বললেন আপনার নামটা?

তিনকড়ি : তিনকড়ি হালদার।

চন্দ্রমাধব : ও, তিনকড়ি হালদার—না! আচ্ছা রমেশের সঙ্গে আপনার দেখা-সাক্ষাৎ হয়? রমেশ—মানে—আমাদের ডি সি?

তিনকড়ি : ডি সি যখন, তখন দেখা-সাক্ষাৎ হয় বই কি। তবে খুব বেশি নয় —

চন্দ্রমাধব : আপনি বোধ হয় জানেন না — রমেশ আমার ভাগ্নে। এখানে তো আসেই—তাছাড়া প্রায় রোজই ক্লাবে আমাদের দেখা হয়। আমিও আপনাদের পুলিসক্লাবে টেনিস খেলতে যাই কিনা—

তিনকড়ি : কি করে জানব বলুন?—আমি টেনিস খেলিও না আর খেলা দেখিও না।

চন্দ্রমাধব : (বিরক্তি-মিশ্রিত স্বরে) আঃ—কে বলছে যে আপনি টেনিস খেলেন বা দেখেন! আপনি যে টেনিস খেলেন না তা আমিও জানি—কিন্তু—

তাপস : (হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া) কিন্তু যাই বল বাবা, এটা খুবই লজ্জার কথা—

তিনকড়ি : কেন, লজ্জার কি আছে এতে? আমি খেলা জানি না, তাই খেলি না, আর দেখতে ভাল লাগে না, তাই দেখি না।

তাপস : না না, খেলা নয়—আমি ঐ মেয়েটির কথা বলছি, মানে ঐ সন্ধ্যা চক্রবর্তী! কেনই বা সে বেশি মাইনের জন্য চেষ্টা করবে না? আমরা চেষ্টা করি না, আমাদের জিনিস যাতে বাজারে বেশি দামে কাটে? আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে সে একটু বেশি স্পিরিটেড, কিন্তু তাই বলে তার চাকরিটা যাবে? (চন্দ্রমাধবকে) তুমি তো নিজেই বলছিলে বাবা, মেয়েটি কাজ করত ভালই! তাই যদি হয়, তবে তাঁকে ছাঁটাই-ই বা করলে কেন? কি জানি বাবা, আমি তো এর কোন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না! আমি হলে তো রেখেই দিতাম!

চন্দ্রমাধব : (ত্রু�দ্ধ স্বরে) তুই চুপ করবি কিনা! উঃ, আমি হলে তো রেখেই দিতাম! আরে রাখবি কোত্থেকে?—সে ক্ষমতা আছে তোর? অমুককে রাখব, তমুককে ছাঁটাই করব, এসব করতে গেলে মাথার দরকার—তোমার ঐ মোটা মাথার কর্ম ওটা নয়! আশ্চর্য, এত পয়সা খরচ করে লেখাপড়া শেখালাম, এতটুকু বুদ্ধি হল না তোর! যে গাধা সেই গাধাই রয়ে গেলি!

তাপস : (ক্ষুব্ধ স্বরে) এসব কথা কি তিনকড়িবাবুর সামনে না বললেই নয় বাবা?

চন্দ্রমাধব : তিনকড়িবাবুর সামনে আমার আর কোন কথা বলারই দরকার নেই! বলবার আছেই বা কি? ঐ সব ইনকিলাব জিন্দাবাদ আমাদের পছন্দ হয়নি, তাই তাকে ছাঁটাই করেছিলাম! তারপর তার কি হয়েছিল না হয়েছিল, তার কোন খবরই আমি রাখি না। কি হয়েছিল তিনকড়িবাবু? Did she get into trouble?

তিনকড়ি : (ধীর স্বরে) ট্রাবল—মানে হ্যাঁ ট্রাবলও বলতে পারেন— (শীলার প্রবেশ)

শীলা : (প্রবেশ করিতে করিতে লঘু স্বরে) ট্রাবল? কিসের ট্রাবল বাবা—পেটের নাকি? (তিনকড়িবাবুকে দেখিয়া) Oh sorry! আমি জানতাম না, আপনি এখানে আছেন! হ্যাঁ বাবা—মা জিজ্ঞেস করে পাঠালেন, তোমাদের কি খুব দেরি হবে? তাহলে না হয়—

চন্দ্রমাধব : না, না দেরি কিসের? কথাবার্তা আমাদের শেষ হয়ে গেছে—(তিনকড়িবাবুকে দেখাইয়া দিয়া) এবার উনি উঠবেন—

তিনকড়ি : কিন্তু আমি তো এখন উঠব না।

চন্দ্রমাধব : তার মানে?

তিনকড়ি : কথাবার্তা তো আমাদের এখনও শেষ হয়নি।

চন্দ্রমাধব : (ত্রু�দ্ধ স্বরে) তার মানে? যা জানি সবই তো আপনাকে বললাম!

শীলা : (কৌতূহলী হইয়া) কি হয়েছে বাবা?

চন্দ্রমাধব : কিছু হয়নি। তুই এখন এঘর থেকে একটু যা তো শীলা—আমরা এক্ষুনি আসছি।

তিনকড়ি : কিন্তু আমার যে ওঁকেও দরকার মিস্টার সেন।

চন্দ্রমাধব : তার মানে?

তিনকড়ি : মানে, ওঁকেও আমার দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে—

চন্দ্রমাধব : (ত্রু�দ্ধ ও উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে) না—ওকে আপনার কোন কথা জিজ্ঞেস করবার নেই! দেখুন তিনকড়িবাবু, যেটুকু ডিউটি সেটুকু করুন! তার বাইরে এভাবে ওপর-পড়া হয়ে কথাবার্তা বললে—আমি আপনার নামে রিপোর্ট করব!’ যেটুকু বলবার তো তো আমিই আপনাকে বললাম! তারপর তার কি হল না হল, তার সঙ্গে আমার কি? এরকম একটা বেয়াড়া ব্যাপারের মধ্যে আমার মেয়েকে টেনে আনবার কি অধিকার আছে আপনার?

শীলা : কি হয়েছে বাবা? ইনি তো দেখছি পুলিসের লোক। কোত্থেকে আসছেন ইনি?

তিনকড়ি : আজ্ঞে, আমি আসছি পদ্মপুকুর থানা থেকে। ওখানকার সাব-ইন্সপেক্টর—নাম তিনকড়ি হালদার।

শীলা : কিন্তু আপনি এখানে—মানে—

তিনকড়ি : আমি একটু এনকোয়ারিতে এসেছি। আজ বিকেলে একটি মেয়ে কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে মারা গেছে—

শীলা : কী সর্বনাশ! কার্বলিক অ্যাসিড?

তিনকড়ি : আজ্ঞে হ্যাঁ। মরবার আগে সে কি যন্ত্রণা!

শীলা : (অসহায়র কণ্ঠস্বরে) কিন্তু কেন খেল বলুন তো?

তিনকড়ি : কি জানি? বোধহয় মনে হয়েছিল আর বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না।

চন্দ্রমাধব : কিন্তু তাই বলে আপনি বলতে চান—দু’বছর আগে তাকে ছাঁটাই করেছিলাম বলে, আজ দু’বছর পরে সে আত্মহত্যা করেছে?

তাপস : কিন্তু বাবা, হয়তো ওই ছাঁটাই থেকেই তার দুঃখের শুরু—

শীলা : সত্যি বাবা? তুমি তাকে ছাঁটাই করেছিলে?

চন্দ্রমাধব : হ্যাঁ, করেছিলাম। মেয়েটা দয়াময়ীতে কাজ করত। খুব গণ্ডগোল আরম্ভ করেছিল, তাই তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। অন্যায় কিছু আমি করিনি—

অমিয় : না, অন্যায় কিসের? আমাদের হলে আমরাও তাই করতাম। (শীলাকে অতিমাত্রায় বিচলিত দেখিয়া) কিন্তু তুমি এত moved হচ্ছ কেন? সে তো তোমার কেউ নয়—

শীলা : কি জানি—তা তো জানি না। আমার খালি মনে হচ্ছে—আমরা যখন এখানে এত হাসি-ঠাট্টা করছি, তখন আর একজন কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে হসপিটালে যন্ত্রণায় ছটফট করছে! (তিনকড়িবাবুকে) আচ্ছা কত বয়স হবে মেয়েটির? খুব বেশী নিশ্চয় নয়?

তিনকড়ি : না না, খুব বেশী কোথায়? তেইশ-চবিবশের মধ্যে—একেবারে ফোটা-ফুলের মতো দেখতে। তবু তো আজ আমি তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখিনি। যখন গেছি তখন সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে!

চন্দ্রমাধব : আচ্ছা তিনকড়িবাবু, এখনও কি যথেষ্ট হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না আপনার?

অমিয় : আমি তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না—এভাবে এনকোয়ারি করে আপনার লাভটা কি? আপনার জানা দরকার—দয়াময়ী থেকে চাকরি যাওয়ার পর যা যা হয়েছিল। কিন্তু আমরা তার কি জানি বলুন?

তিনকড়ি : একেবারেই কি কিচ্ছু জানেন না মিস্টার বোস?

চন্দ্রমাধব : (অমিয় ও শীলার দিকে ইঙ্গিত করিয়া, বিস্মিত কণ্ঠস্বরে) তার মানে? আপনি বলতে চান — হয় এ, নয় ও মেয়েটির সম্বন্ধে কিছু না কিছু জানে?

তিনকড়ি : আজ্ঞে হ্যাঁ!

চন্দ্রমাধব : আপনি তাহলে শুধু আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে এখানে আসেন নি?

তিনকড়ি : আজ্ঞে না।

চন্দ্রমাধব : (নরম সুরে) এ কথাটা আগে বললেই পারতেন কোন গণ্ডগোলই হত না! আমি কি করে জানব বলুন? আমি ভাবছি, আমার যা বলার সবই তো আমি বলেছি—তবে কেন শুধু শুধু আপনি আমাদের উত্যক্ত করছেন। কিন্তু আপনি সব fact পেয়েছেন তো?

তিনকড়ি : কিছু কিছু পেয়েছি বই কি!

চন্দ্রমাধব : খুব একটা মারাত্মক কিছু নয়—কি বলেন?

তিনকড়ি : মানে—একটি মেয়ে কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে মারা গেছে। এটা যদি মারাত্মক কিছু হয় তবে মারাত্মক—নইলে নয়।

শীলা : তার মানে? আপনি বলতে চান ঐ মেয়েটির মৃত্যুর জন্যে আমরা দায়ী?

চন্দ্রমাধব : তুই চুপ কর দেখি—যা বলবার আমি বলছি। (নরম সুরে তিনকড়িকে) আচ্ছা তিনকড়িবাবু তার চেয়ে আসুন না—আমি আর আপনি—মানে একটু নিরবিলিতে বসে ব্যাপারটা সেটল করে ফেলি?

শীলা : কিন্তু বাবা, তুমিই বা কথা বলবে কেন? ওঁর তো তোমার কাছে এনকোয়ারি শেষ হয়ে গেছে। এখন তো উনি বলছেনই, হয় অমিয় না হয় আমি—

চন্দ্রমাধব : আরে, তোরা ছেলেমানুষ এসবের বুঝিস কি? আমি তোদের হয়ে কথাবার্তা বলে যা হোক একটা কিছু ঠিক করে নিচ্ছি—

অমিয় : কিন্তু আমার তরফ থেকে ঠিক করার কিছু নেই কাকাবাবু। সন্ধ্যা চক্রবর্তী বলে কাউকে আমি চিনিই না।

তাপস : ও নামে আমিও তো কাউকে চিনি না।

শীলা : কি নাম বললে? সন্ধ্যা চক্রবর্তী?

অমিয় : হ্যাঁ—

শীলা : আমি তো শুনিই নি কোনদিন—

অমিয় : (ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া) এখন কি রকম মনে হচ্ছে তিনকড়িবাবু?

তিনকড়ি : কেন? ঠিক আগে যেমন মনে হচ্ছিল। আমি তো আগেই আপনাদের বলেছি, মেয়েরা বিপাকে পড়লে অনেক সময় নাম পালটায়। এ মেয়েটিও পালটেছিল। তিরিশ টাকার জায়গায় পঁয়ত্রিশ টাকা চাওয়ার জন্যে মিস্টার সেন যখন তাকে ছাঁটাই করলেন তখন হয়তো তার মনে হল সন্ধ্যা চক্রবর্তী নামটা অপয়া—তাই সে নতুন একটা নাম নিলে—

তাপস : খুবই স্বাভাবিরক—

শীলা : পাঁচটা টাকা বাড়ালে কী এমন ক্ষতি হত বাবা? হয়ত সেজন্যেই—

চন্দ্রমাধব : রাবিশ! চাকরি গেছে দু’বছর আগে, আর আত্মহত্যা করেছে সে আজ। তার জন্যে কি আমি দায়ী? আচ্ছা তিনকড়িবাবু চাকরি যাওয়ার পর কি হয়েছিল, কিছু জানেন আপনি?

তিনকড়ি : আজ্ঞে হ্যাঁ। মাস-দুয়েক চাকরি ছিল না। বাপ-মা মরা মেয়ে, কাজেই যাবারও কোন জায়গা ছিল না। দয়াময়ীতে চাকরি করত, কাজেই বুঝতেই পারছেন, জমাতেও কিছু পারেনি। দু’মাস বেকার অবস্থায় কাটাবার পর, অবস্থা যা হবার ঠিক তাই হল। আত্মীয়-স্বজন নেই যে কারো কাছে চলে যায়, তেমন বন্ধু-বান্ধব নেই যে তাকে সাহায্য করে, হাতে এমন পয়সা নেই যে দু’দিন বসে খায়। কাজেই অবস্থাটা তো বুঝতেই পারছেন। প্রথম ক’দিন চলে অর্ধাহার, তারপর প্রায় অনাহার! এর চেয়ে ডেসপারেট অবস্থা আর কি হতে পারে বলুন?

শীলা : এর চেয়ে ডেসপারেট অবস্থা তো ভাবাই যায় না। সত্যিই বড় লজ্জার কথা! এভাবে যদি একটি মেয়েকে আত্মহত্যা করতে হয়—

তিনকড়ি : শুধু একটি মেয়ে কেন? আজকের দিনে কলকাতার মত প্রত্যেকটা শহরে গিয়ে আপনি দেখুন—দেখবেন, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ঠিক এইভাবে দিন কাটাচ্ছে। তাই যদি না হবে—তবে আজকের দিনে এমপ্লয়ারের সাধ্য কি যে, যে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ টাকায় একটা কুকুর-বেড়াল পোষা যায় না, সেই তিরিশ-পঁয়ত্রিশ টাকায় একটা মানুষ রেখে কাজ করায়! হাজার হাজার বেকার সন্ধ্যা চক্রবর্তী আত্মহত্যার দিন গুনছে বলেই না আজ মালিকদের এত সুবিধে। আজ তারা বেশ ভাল করে জানে — কোথায় গেলে তারা cheap labour পাবে। আমার কথা বিশ্বাস না হয়, আপনার বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন—

শীলা : কিন্তু এই সন্ধ্যারা তো cheap labour নয় — এরা যে আস্ত মানুষ তিনকড়িবাবু।

তিনকড়ি : আমারও তো মাঝে মাঝে তাই মনে হয়। মনে হয় আমরা যদি মাঝে মাঝে ওদের ছেঁড়া কাঁথার ওপর যাই, আর ওরা যদি আমাদের এই সোফা-কৌচের ওপর আসে, তাহলে আর কারো কিছু হোক আর না হোক আমাদের অন্তত কিছুটা ভাল হয়।

শীলা : তা যা বলেছেন। আচ্ছা তারপর কি হল?

তিনকড়ি : ওই এক ভাবেই চলছিল—আর চলতও তাই। কিন্তু মাসখানেক কাটার পর মনে হল, বোধহয় তার সুদিন আবার ফিরে আসছে। ধর্মতলার ঐ বড় চেন স্টোরটা আছে? ওখানে তার একটা চাকরি জুটে গেল — ক্লোদিং সেকশনের কাউন্টার গার্ল।

শীলা : চেন স্টোর! আমাদের জিনিসপত্রও তো সব ওখান থেকেই আসে! ওখানকার কাজ তো বেশ ভাল কাজ। ওদের মাইনেও ভাল, বেশ লাকি বলতে হবে।

তিনকড়ি : তারও নিজেকে খুব লাকি বলেই মনে হয়েছিল। আগের কাজটা ছিল ছোট একটা ঘরের মধ্যে। ঘিঞ্জির মধ্যে বসে সারাদিন শুধু ছুঁচের কাজ। এ ধরুন, বড় জায়গা, চারধারে দিনের বেলায় নিওন লাইটের আলো, মাইনেও সামান্য একটু বেশি। তার ওপর আবার ডিপার্টমেন্টটাও পোশাকের। জানেই তো মেয়েরা একটু শাড়ি-টাড়ি নাড়াচাড়া করতে বেশী ভালবাসে! মনে মনে ঠিক করলে, জীবনটাকে বেশ গুছিয়ে নিয়ে নতুন করে আরম্ভ করতে হবে। মানে, কি বলব, আপনি তো খানিকটা বুঝতেই পারছেন তার মনের ভাব-ভাবনাটা!

চন্দ্রমাধব : তারপর, ওখানেও আবার গণ্ডগোল বাধল বুঝি?

তিনকড়ি : মাস-দুয়েক বেশ কেটে গেল। দু’মাস পর সবে একটু স্থিতু হয়ে বসতে আরম্ভ করেছে—ম্যানেজারের হুকুমনামা সই হয়ে এল—চাকরি নেই।

চন্দ্রমাধব : নিশ্চয় কাজকর্ম সুবিধেমত করত না—

তিনকড়ি : আজ্ঞে না—দোকানে জিজ্ঞেস করলে তো উল্টোটাই শোনা যেত!

চন্দ্রমাধব : একটা কিছু গণ্ডগোল নিশ্চয় হয়েছিল—

তিনকড়ি : আজ্ঞে শোনা তো কিছু যায়নি। সে শুধু খবর পেয়েছিল কোন কাস্টমার নাকি তার নামে কমপ্লেন করেছে, আর চাকরি যাওয়ার কারণই নাকি তাই!

শীলা : (উত্তেজিত ও ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে) কবে হয়েছিল ব্যাপারটা বলতে পারেন?

তিনকড়ি : গেল বছর জানুয়ারির শেষে—

শীলা : মেয়েটিকে কি রকম দেখতে?

তিনকড়ি : (উঠিয়া, পকেট হইতে ছবি বাহির করিয়া) আপনি যদি একটু এদিকে আসেন—

(শীলা তিনকড়িবাবুর নিকটে আসিলে, তিনি সকলকে আড়াল করিয়া অতি সাবধানে আলোর দিকে রাখিয়া ছবিখানি শীলাকে দেখাইলেন। ভাল করিয়া দেখিবার পর শীলার মুখ-চোখের ভাব পরিবর্তিত হইয়া গেল। বোঝা গেল ছবিটি দেখিয়া সে চিনিতে পারিয়াছে। চিনিতে পারিবামাত্র সে অশ্রুরুদ্ধ অস্ফুট চীৎকার করিয়া দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। তিনকড়িবাবু ছবিটি যথাস্থানে রাখিয়া শীলার গমনপথের দিকে তাকাইয়া রহিলেন। দেখিয়া মনে হইল কি যেন চিন্তা করিতেছেন। বাকি তিনজনের চোখে-মুখে বিস্ময়, অবস্থা হতভম্বের ন্যায়।)

চন্দ্রমাধব : (তিনকড়িবাবু আসন গ্রহণ করিবার পর) কি আশ্চর্য! শীলার হল কি?

তাপস : বোধহয় ছবিটা দেখে চিনতে পেরেছে শীলা। তাই না তিনকড়িবাবু?

তিনকড়ি : আজ্ঞে হ্যাঁ।

চন্দ্রমাধব : যত নষ্টের মূল তো আপনি! কেন আপনি মেয়েটাকে এভাবে আপসেট করে দিলেন?

তিনকড়ি : ভুল করছেন। আমি আপসেট করিনি—উনি নিজেই আপসেট হয়ে গেলেন।

চন্দ্রমাধব : (ত্রু�দ্ধ স্বরে) সেইটাই তো জিজ্ঞেস করছি — কেন?

তিনকড়ি : আবার ভুল করছেন। কেন যে আপসেট হলেন তা তো আমি এখনও জানতে পারিনি। ওটা জানতেই তো আমার এখানে আসা।

চন্দ্রমাধব : বেশ, তাহলে আগে আমিই জেনে আসি—

অমিয় : চলুন, আমিও বরং আপনার সঙ্গে যাই কাকাবাবু, দেখি শীলাকে জিজ্ঞেস করে—

চন্দ্রমাধব : (উঠিয়া) না না, আগে আমিই দেখি ব্যাপারটা কি হল। তারপর তোমার কাকীমাকেও তো বলা দরকার। দেখি তিনি কি বলেন। (বাহির হইয়া যাইতে যাইতে তিনকড়িবাবুকে ত্রু�দ্ধস্বরে) আশ্চর্য! একটা এতবড় আনন্দের দিন। কেমন ছিলাম সন্ধ্যেবেলা, আর কোথা থেকে শনি এসে জুটলেন আপনি, সমস্ত আমোদটা পণ্ড হয়ে গেল একেবারে।

তিনকড়ি : (এতটুকু বিচলিত না হইয়া) আজ পাণ্ডে হসপিটালে ডেডবডিটার দিকে দেখতে দেখতে আমারও ওই একটা কথা কেবলি মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল—কত আমোদ আহ্লাদ, কি সুন্দর ফুটফুটে একটি জীবন—কোথা থেকে কারা এসে কি বিশ্রীভাবে পণ্ড করে দিয়ে গেল।

(মিস্টার সেন যাইতে যাইতে উত্তর দিবার জন্য ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। পরে হয়তো মনে হইল কিছু না বলাই ভাল, তাই কিছু না বলিয়াই বাহির হইয়া গেলেন। তাপস ও অমিয়র অস্বস্তিভরা দৃষ্টি পরস্পরের প্রতি নিবদ্ধ। তিনকড়িবাবু কিন্তু এসব কিছু গ্রাহ্যের মধ্যেই আনিলেন না।)

অমিয় : এবার ছবিটা আমি একটু দেখতে চাই তিনকড়িবাবু।

তিনকড়ি : আজ্ঞে না। সময় হলেই আপনাকে আমি দেখাব।

অমিয় : আশ্চর্য! আমি তো বুঝতে পারছি না, কেন আপনি—

তিনকড়ি : (বাধা দিয়া গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরে) দেখুন আমি তো আগেই একবার বলেছি—আমার এনকোয়ারি করার রীতিই এই রকম। আমি দেখেছি, সবাইকে একসঙ্গে ধরলে বড় গণ্ডগোল হয়। আপনাকেও আমি একটু পরেই ধরব। তখন আপনার যা বলার আছে বলবেন।

অমিয় : (অস্বস্তির সহিত) না না, মানে—বলবার আমার কিছু নেই, মানে—

তাপস : (হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া তিনকড়িবাবুকে) দেখুন মশাই, আমি আর পারছি না—

তিনকড়ি : (গম্ভীরভাবে) না পারাটাই স্বাভাবিক।

তাপস : না—মানে—আজ আমাদের এখানে একটা ছোটখাট পার্টি গোছের ছিল। আর কি জানেন? মানে, ঐ পার্টি জিনিসটা একেবারেই আমার ধাতে সয় না। আমার এখানে থাকা মানেই আপনাদের কাজের অসুবিধে। তাছাড়া মাথাটা বড্ড ধরেছে। তাই বলছিলাম কি—মানে আপনি যদি কিছু মনে না করেন—তাহলে আমি এখন বরং ভেতরেই যাই—কি বলেন?

তিনকড়ি : আজ্ঞে না, আমি তা বলি না।

তাপস : বলেন না? মানে? কি বলেন না?

তিনকড়ি : ওই আপনাকে ভেতরে যেতে।

তাপস : (প্রায় চিৎকার করিয়া) কিন্তু কেন?

তিনকড়ি : তাতে আপনার কষ্টটা কম হত। ধরুন, আপনি এখন ভেতরে গেলেন, কিন্তু হয়ত একটু পরেই আপনাকে আবার এ ঘরে আসতে হবে। এ ঘরে থাকলে এই যাওয়া-আসার কষ্টটা হত না।

অমিয় : আপনার কথাবার্তাটা কি একটু বেশি কড়া হয়ে যাচ্ছে না?

তিনকড়ি : হয়ত হচ্ছে। আপনারা সহজভাবে কইলে, আমিও সহজভাবেই কইব।

অমিয় : না—মানে—আমরা তো আর ক্রিমিনাল নই, রেসপেকটেবল সিটিজেনস—

তিনকড়ি : দেখুন—এই ক্রিমিনাল আর রেসপেকটেবল সিটিজেনস—এ দুটোর মধ্যে তফাতটা কি খুব পরিষ্কার? আমার তা মনে হয় না। কতটা অবধি রেসপেকটেবল, আর কোনখান থেকে ক্রিমিনাল, এ যদি আমাকে কেউ বলতে বলে, আমি তো বলতে পারব না।

অমিয় : অবশ্য আপনাকে কেউ বলতে বলেও না—তাই না?

তিনকড়ি : না, ঠিক তা নয়। সবটা না বলতে বললেও খানিকটা বলতে বলে। এই ধরুন আজকের এই এনকোয়ারির ব্যাপারটা—এটা তো আমার মতো লোকেই করে।

(শীলার প্রবেশ। মুখ দেখিয়া মনে হয়, খুব খানিকটা কাঁদিয়াছে। ভিতরে আসিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল।)

শীলা : (তিনকড়িবাবুকে) আচ্ছা এর মধ্যে আমি যে আছি, এ বোধহয় আপনি গোড়া থেকেই জানতেন—না?

তিনকড়ি : মেয়েটির লেখা ডায়েরিটা পড়ে মনে হয়েছিল, হয়ত আপনি আছেন।

শীলা : আমি বাবাকে সব বলেছি। তিনি তো বেশ বললেন — ও কিছু নয়, ও নিয়ে মন খারাপ করার কোন মানেই হয় না। কিন্তু আমার মন মানছে কই? এত বিশ্রী লাগছে যে কি বলব আপনাকে! আচ্ছা সত্যি বলুন তো, ওখান থেকে চাকরি যাওয়ার পর অবস্থাটা কি বড্ড খারাপ হয়ে পড়েছিল?

তিনকড়ি : আজ্ঞে হ্যাঁ, দুরবস্থার একেবারে চরম। চাকরিটা গেল অকারণে। তারপর এধার-ওধার চেষ্টা যে করেনি তা নয়—করেছিল। কিন্তু কিচ্ছু হয়নি। কাঁহাতক আর মানুষ না খেয়ে থাকে বলুন? ভাবলে, ভাল রকমে যখন হল না, তখন দেখা যাক একটু রকমফের করেছি পেটটা অন্তত ভরে।

শীলা : (অসহায় কণ্ঠস্বরে) সত্যি,আমিই তাহলে দায়ী, তাই না?

তিনকড়ি : না না, একেবারে আপনি দায়ী বললে ভুল বলা হবে। চেন স্টোরের চাকরি যাওয়ার পরেও তো কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে হ্যাঁ, আপনি আর আপনার বাবা—আপনারা খানিকটা দায়ী তো বটেই।

তাপস : কিন্তু শীলা করেছিলটা কি?

শীলা : করেছিলাম যা, তা খুবই অন্যায়। ম্যানেজারের কাছে মেয়েটির নামে কমপ্লেন করেছিলাম।

তাপস : কিন্তু ম্যানেজারই বা কি রকম লোক? তুই গিয়ে বললি, আর মেয়েটাকে ওরা ছাড়িয়ে দিলে?

শীলা : ওদের ম্যানেজার হীরেনবাবু যে ভয়ানক ভীতু লোক। তার ওপর দোকানের মালিক তো এক রকম অনন্ত জ্যাঠা। হীরেনবাবু তো জানে, অনন্ত জ্যাঠা শেলী-মা বলতে অজ্ঞান।

তাপস : কিন্তু তা হলেও—

শীলা : না না, তা হলেও নয়। কমপ্লেনটা আমি খুব সাধারণ কমপ্লেন করিনি। সোজা গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—মেয়েটিকে পেলেন কোত্থেকে হীরেন বাবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন — কেন, কিছু করেছে টরেছে নাকি? আমি বললাম — করেছে মানে? আমার দিকে তাকিয়ে অসভ্য ইঙ্গিত করেছে, অশ্লীল রসিকতা করেছে! কাল যদি এসে ওকে এখানে দেখতে পাই তো আপনার নামে জ্যাঠার কাছে রিপোর্ট করব—বলব, আপনি বিশেষ সুবিধে পাবার জন্যে যত সব খারাপ মেয়েছেলে এনে দোকানে ঢোকাচ্ছেন।

তিনকড়ি : কিন্তু কেন বললেন আপনি এসব কথা?

শীলা : আপনি বিশ্বাস করুন তিনকড়িবাবু—রাগে তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না!

তিনকড়ি : কিন্তু সে কি এমন করেছিল যাতে আপনার মাথাটা ঐরকম বেঠিক হয়ে গেল?

শীলা : আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি — মেয়েটি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে। মনটা সেদিন এমনিই খারাপ ছিল। ঐ মুচকি হাসিটুকুতে—কি বলব—সর্বাঙ্গ রাগে যেন একেবারে জ্বলে উঠল!

তিনকড়ি : কিন্তু সেটা কি তার দোষ?

শীলা : না না, তার দোষ হবে কেন? দোষ আমার নিজেরই! (হঠাৎ অমিয়কে) কি অমিয়, চোখ যে আর নামাতে পারছ না! বড় মীন বলে মনে হচ্ছে আমাকে—না? আরে আমি তবু তো সত্যি কথা বলবার চেষ্টা করছি. কিন্তু তুমি? তুমি কি বলতে চাও লজ্জা পাবার মতো কোন কাজ কোনদিন তুমি করনি?

অমিয় : (বিস্মিত হইয়া) করিনি—আমি বলেছি কি একবারও? আমি তো বুঝতে পারছি না, কেন তুমি আমাকে শুধু শুধু—

তিনকড়ি : (অমিয়কে থামাইয়া দিয়া) থাক, আপনাদের ও ব্যাপারটা পরে সেটল করে নেবেন। (শীলাকে) হ্যাঁ, কি হয়েছিল সব বলুন তো?

শীলা : আমি সেদিন ওখানে গিয়েছিলাম একটা লং কোট ট্রাই করতে। কোটটা নিয়ে এসে হেড-অ্যাসিস্ট্যান্ট বলল, এই কাটটা বোধহয় আপনাকে ঠিক ফিট করবে না, এটা এই রকম গড়নে ভাল ফিট করে। এই বলে ওই মেয়েটির কাছে গিয়ে তার কাঁধের সঙ্গে লাগিয়ে আমাকে দেখালে। দেখলাম সুন্দর ফিট করেছে। কিন্তু আমারও কি জানি কেমন জেদ চেপে গেল। বললাম, না ঐ কোটটাই আমি নেব। কিন্তু পরে দেখি, একেবারে মানায় নি, বিশ্রী দেখাচ্ছে। ঠিক সেই সময় আয়নার ওপর চোখ পড়ল। দেখি মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। মনে হল, যেন বলতে চাইছে, মেয়েটাকে কি বিশ্রী দেখাচ্ছে দেখ। রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। কোটটা হেড-অ্যাসিসট্যান্টের গায়ের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে চলে এলাম ম্যানাজারের কাছে। তারপর—তারপর যা হয়েছে সবই তো আপনাকে বলেছি। (অসহায় কণ্ঠস্বরে) না—জানেন, যদি মেয়েটিকে দেখতে একটা মন্দ-নয়-গোছেরও কিছু হত, তাহলে হয়ত আমি কমপ্লেনই করতাম না। কিন্তু ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল মেয়েটিকে! এতটুকু অসহায় বলে মনে হয়নি, তাই কমপ্লেন করে দুঃখও এতটুকু হয়নি।

তিনকড়ি : আপনার তাহলে বেশ একটু হিংসে হয়েছিল—কেমন?

শীলা : (অসহায়ভাবে) তাই হবে বোধহয়। তা নইলে, আমিই বা কেন কমপ্লেন করলাম—

তিনকড়ি : আর হিংসে হয়েছিল বলেই, অনন্ত জ্যাঠার ভাইজি হিসেবে, আর আপনার বাবার মেয়ে হিসেবে আপনার যেটুকু ক্ষমতা আছে, তা প্রয়োগ করলেন একটা নিরীহ মেয়ের ওপর। — ফলে তার চাকরিটা গেল! আর এত কাণ্ড করার কারণটা কি? না তার একটু মুচকি হাসি আপনার মাথাটাকে বেঠিক করে দিয়েছিল—এই তো?

শীলা : হ্যাঁ। কিন্তু আপনি বুঝে দেখুন—ব্যাপারটা যে এত সাংঘাতিক হতে পারে, তা আমার মাথাতেই আসেনি তখন! এখন আমি বুঝেছি! এখন যদি তার সাহায্যের দরকার হত, আমি তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতাম!

তিনকড়ি : (রূঢ়স্বরে) হ্যাঁ, বুঝেছেন ঠিক, কিন্তু বড্ড দেরী করে বুঝেছেন! এখন কোথায় পাবেন তাকে যে সাহায্য করবেন। সে তো আর বেঁচে নেই?

তাপস : মাই গড। ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে—

শীলা : (ঝড়ের বেগে) You shut up ছোড়দা! ব্যাপারটা যে বেশ জটিল, তা কি তোকে বলে দিতে হবে নাকি? আমি বুঝি না, কত বড় অন্যায় আমি করেছি? আপনি বিশ্বাস করুন তিনকড়িবাবু, ব্যাপারটার গুরুত্ব আমি বুঝেছি! যা করেছি, তা এই একবারই করেছি, আর কখনওকরব না। আজ বিকেলে আমি চেন স্টোরে গিয়েছিলাম। তখন গ্রাহ্যের মধ্যে আনিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ওখানে ক’জন যেন আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। বোধহয় আমাকে দেখে ওই মেয়েটির কথা তাদের মনে পড়ে গিয়েছিল! (দুইহাতে মুখ ঢাকিয়া)ওঃ কি লজ্জা! কোনদিন আমি আর ও পথ মাড়াতে পারব না! ওঃ—কেন এমন অঘটন ঘটল বলতে পারেন?

তিনকড়ি : (কঠোর স্বরে) আজ পাণ্ডে হসপিটালে, মেয়েটির মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে, আমিও নিজেকে ঠিক ঐ প্রশ্নটাই করেছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম, বুঝতে চেষ্টা কর তিনকড়ি, কেন ব্যাপারটা ঘটল, এ অঘটন না ঘটলে কি চলত না! তাই বুঝতেই আমার এখানে আসা—আর না বুঝে আমি এখান থেকে যাবও না।—কি কি Facts আমি পেয়েছি? দয়াময়ী কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান আপনার বাবার একটা কনসার্ন। সন্ধ্যা চক্রবর্তী নামে একটি মেয়ে সেখানে কাজ করত। মাসে মাইনে পেত তিরিশ টাকা। পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনে চেয়ে তারা স্ট্রাইক করে। স্ট্রাইক ফেল করার সঙ্গে সঙ্গে আপনার বাবা সন্ধ্যাকে ছাঁটাই করেন। ভয়, পাছে ও থাকলে আবার ঐ রকম স্ট্রাইক হয়। মাস-দুয়েক বেকার বসে থাকার পর ধর্মতলায় চেন স্টোরে আবার একটা চাকরি সে যোগাড় করে। এই নতুন চাকরিতে যখন সবে সে স্থিতু হয়ে বসতে আরম্ভ করেছে, ঠিক সেই সময় আবার তার চাকরি চায়। কারণ কি? না, লংকোটটা মানাচ্ছে না বলে আপনি নিজের ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন। সেই বিরক্তির জের গিয়ে পড়ল তার ওপর। ফলে এ চাকরিটাও তার গেল। এর পরেও এধার-ওধার চাকরির চেষ্টা সে করেছিল, পায়নি। কিন্তু বাঁচতে তো হবে? কাজেই ঠিক করলে একটু রকম-ফের করে দেখবে। কিন্ত রকমটার নেচারটা খুব ভাল নয়। কাজেই নামটা বদলাতে হল। প্রথমে ছিল সন্ধ্যা চক্রবর্তী, মাঝে চেন স্টোরে কি ছিল তা আমার জানা নেই, এবার নাম বদলে হল ঝরনা রায়।

অমিয় : (ভীষণভাবে চমকিত হইয়া) কি, কি নাম বললেন?

শীলা : (কঠোর দৃষ্টিতে অমিয়কে দেখিতে দেখিতে) ঝরনা রায়।

(দেখা গেল শীলা একদৃষ্টিতে অমিয়র দিকে চাহিয়া রহিয়াছে।)

অমিয় : (শীলার দিকে চোখ পড়িতে থতমত অবস্থায়) না—মানে—শীলা মানে—

তিনকড়ি : (উঠিয়া) আপনার বাবা কোথায় গেলেন মিস সেন?

শীলা : বাবা? বাবা ভেতরের ড্রয়িংরুমে মার সঙ্গে কথা কইছেন। আপনি যাবেন তাঁর কাছে? (তাপসকে) ছোড়দা, এঁকে একটু ভেতরে নিয়ে যা তো।

(তাপস উঠিয়া ‘আসুন তিনকড়িবাবু’ বলিলে, তিনকড়িবাবু একবার শীলার মুখের দিকে, আর একবার অমিয়র মুখের দিকে তাকাইলেন। তারপর ‘চলুন’ বলিয়া তাপসের সঙ্গে বাহির হইয়া গেলেন।)

শীলা : তারপর অমিয়?

অমিয় : কি বল?

শীলা : সন্ধ্যা চক্রবর্তীকে তাহলে তুমি জানতে?

অমিয় : না।

শীলা : মানে ঐ ঝরনা রায়কে? একই তো ব্যাপার—

অমিয় : ঝরনা রায়কেই বা আমি জানতে যাব কেন?

শীলা : বোকার মতো কথা বোলো না অমিয়! হাতে আমাদের খুব বেশি সময় নেই। তিনকড়িবাবুর মুখ থেকে ঝরনা রায় নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মুখের চেহারা পাল্টে অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল!

অমিয় : আচ্ছা বেশ—জানতাম। কিন্তু এ কথার এখানেই শেষ হোক।

শীলা : কিন্তু কি করে এখানে শেষ হবে — সেটা বল?

অমিয় : কিন্তু শীলা, তুমি বুঝতে পারছ না—

শীলা : (বাধা দিয়া) আমি খুব বুঝতে পারছি। তুমি শুধু তাকে চিনতে না, খুব ভাল করে চিনতে! তাই নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তোমার সঙ্গেই মুখ কালো হয়ে উঠেছিল। নিশ্চয় চেন স্টোর ছাড়ার পর তোমার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল। তখন সে নাম বদলে ঝরনা রায়, একটু রকমফের করে দেখছে, বাঁচতে পারে কি না! আজ আমি বুঝতে পারছি, গেলো বছর মে-জুন-জুলাইতে কেন তুমিএদিক মাড়াওনি। এখানে ওখানে দেখা হলে বলতে, ভয়ানক কাজ। ওই তিন মাস তুমি ওর সঙ্গেই ছিলে!

অমিয় : কিন্তু শীলা, সে ঐ তিন মাসেই শেষ হয়ে গেছে। তারপর এতদিন কেটে গেছে, একবারও তার সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। সত্যি বলছি শীলা, তুমি বিশ্বাস কর, এ আত্মহত্যার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই!

শীলা : আধঘন্টা আগে আমারও ঐ ধারণা ছিল। আমারও মনে হয়েছিল, এ ব্যাপারের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই!

অমিয় : সম্পর্ক তো নেই। কিন্তু দোহাই তোমার, এসব কথা যেন ঐ সাব-ইন্সপেক্টরটাকে বলো না।

শীলা : কি কথা বল তো? তুমি মেয়েটিকে জানতে, এই?

অমিয় : হ্যাঁ, ওটা তোমার আমার মধ্যেই থাক—

শীলা : (অদ্ভুতভাবে হাসিয়া উঠিয়া) তুমি কি বোকা অমিয়! সাব-ইন্সপেক্টর এ সমস্ত কথা জানে! আর শুধু এটুকু কেন? হয়ত দেখ—এমন অনেক কথা জানে, যা আজও আমরাই জানি না! দেখে নিও তুমি — এ যদি ঠিক না হয় তো কি বলেছি!

(এতক্ষণ অমিয়র কাছে নিজেকে বড় ছোট মনে হইতেছিল। এবার অমিয়র মুখ শুকাইয়া গিয়াছে দেখিয়া তাহার মুখে বেশ একটু হাসিও ফুটিয়া উঠিল। ঠিক এমন সময় দরজা খুলিয়া সাব-ইন্সপেক্টরের আবির্ভাব।)

তিনকড়ি : (দুইজনের মুখের উপর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া অমিয়কে প্রশ্ন করিলেন) তারপর মিষ্টার বোস?

(এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে পর্দাও নামিয়া আসিল।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *