থানা থেকে আসছি – দ্বিতীয় অঙ্ক

দ্বিতীয় অঙ্ক

(প্রথম অঙ্কের শেষই দ্বিতীয় অঙ্কের আরম্ভ। ঘরের ভিতর শীলা ও অমিয়। দরজার নিকট তিনকড়িবাবু।)

তিনকড়ি : (শীলা ও অমিয়র মুখের উপর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া, দরজা খোলা রাখিয়া অমিয়র দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতে আসিতে) — তারপর, মিস্টার বোস?

শীলা : (বিকারগ্রস্তের ন্যায় হাসিয়া উঠিয়া) দেখেছ অমিয়? আমি ঠিক বলেছি—

তিনকড়ি : (শীলাকে) কিছু বলেছেন বুঝি ওঁকে? কি বলেছেন বলুন তো?

অমিয় : দেখুন তিনকড়িবাবু—মানে আমি বলছিলাম কি, (বেশ চেষ্টা করিয়া নিজেকে আয়ত্তের মধ্যে আনিয়া) আমি বলছিলাম কি, মিস সেনকে এসবের মধ্যে টেনে আনাটা আর উচিত হবে না। আপনাকে যা বলবার ছিল, তা তো উনি বলেই দিয়েছেন। আজ সারাদিন ওঁর ঘোরাঘুরিও বড় কম হয়নি। তার ওপর সন্ধ্যেবেলা আজ এখানে একটা পার্টি গোছের ছিল। এর চেয়ে বেশি স্ট্রেন ওঁর নার্ভে সইবে বলে আমার তো মনে হয় না। আর আপনিও তো দেখছেন—মানে ধরুন যদি—

শীলা : (হাসিয়া) মানে, উনি বলছেন আমি যদি অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাই—

তিনকড়ি : হবেন বলে মনে হচ্ছে নাকি?

শীলা : ঠিক বলতে পারছি না। হলেও হতে পারি!

তিনকড়ি : তাহলে আপনি যেতে পারেন। আমার আর আপনাকে কোনো প্রয়োজন নেই।

শীলা : কিন্তু আপনার এনকোয়ারি তো এখনও শেষ হয়নি?

তিনকড়ি : না।

শীলা : (অমিয়কে) দেখেছ, আমি বলেছিলাম। (তিনকড়িকে) কিন্তু তাহলে তো আমি যাব না—আমি এখানেই থাকব।

অমিয় : কিন্তু কেন? এসব unpleasant ব্যাপারের মধ্যে থেকে লাভটা কি?

তিনকড়ি : ও, আপনিও তাহলে এই কথাই বলেন? মেয়েদের এসব unhpleasant ব্যাপার থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই ভালো?

অমিয় : যদি সম্ভব হয় নিশ্চয় ভালো।

তিনকড়ি : আমরা সবাই কিন্তু একটি মেয়েকে জানি — যাকে খুবই unpleasant কতকগুলো ব্যাপার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি।

অমিয় : এটা বোধহয় আমার পাওনা ছিল, কি বলেন তিনকড়িবাবু?

শীলা : কিন্তু সাবধান অমিয়—এর পরের পাওনাটা হয়তো আর সহ্য করতে পারবে না।

অমিয় : কিন্তু শীলা, আমি বলছিলাম এখানে থেকে সত্যিই তোমার কোনো লাভ হবে না। এখন তো খারাপ লাগছেই — পরে আরও খারাপ লাগবে।

শীলা : কিন্তু যা হয়েছে— তার থেকে আর খারাপ কি হবে? বরং এখানে থাকলে হয়তো একটু ভালো হলেও হতে পারে।

অমিয় : (তিক্তস্বরে) ও, বুঝেছি—

শীলা : কি বুঝলে?

অমিয় : তোমার নিজের এনকোয়ারি হয়ে গেছে, এখনতুমি দেখতে চাও আমার অবস্থাটা কি হয়!

শীলা : (তিক্ত স্বরে) ও, আমার সম্বন্ধে তাহলে তোমার এই ধারণা! যাক, ভালোই হল — সময় থাকতে জানিয়ে দিয়ে ভালোই করলে।

অমিয় : না না, আমি ওকথা মীন করিনি—

শীলা : (বাধা দিয়া) মীন করোনি মানে? নিশ্চয় মীন করেছ! যদি তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতে, তাহলে বলতে পারতে ওকথা? কখখনো বলতে পারতে না! বেশ একটা মজার গল্প শুনেছ-শুনেছ যে আমি একটা মেয়ের চাকরি খেয়েছি। এখন আমাকে কত কি বলে মনে হবে! মনে হবে আমি একটা ইতর—আমি একাট ছোটলোক—আমি একটা স্বার্থপর!

অমিয় : কখখনো না, ওসব কথা আমার মনেই হয়নি।

শীলা : নিশ্চয় হয়েছিল! তাই যদি না হবে, তবে কেন ওকথা বললে? — আমার হয়ে গেছে বলে আমি তোমার অবস্থা দেখে মজা পাব?

অমিয় : বেশ, ভালো কথা! I am sorry।

শীলা : হ্যাঁ সরি ঠিকই—কিন্তু ঐ সরি পর্যন্তই। আমার কথা তুমি মোটেই বিশ্বাস করোনি—

তিনকড়ি : (গম্ভীর স্বরে) মিস সেন! (শীলাকে থামিতে ইঙ্গিত করিয়া, অমিয়কে) আমি আপনাকে বলতে পারি কেন উনি এখানে থাকতে চেয়েছেন, আর কেনই বা উনি বললেন—এখানে থাকলে হয়তো ওঁর মনটা একটু ভালো হলেও হতে পারে। একটি মেয়ে আজ একটু মারা গেছে। সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে—কারো এতটুকু ক্ষতি সে কোনদিন করেনি। কিন্তু তবু তাকে মরতে হল যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে। ঘেন্নায়, লজ্জায় নিজেকে শেষ করে দিতে হল!

শীলা : (কাতর স্বরে) দোহাই আপনার, আর বলবেন না! আমি এমনিতেই ভুলতে পারছি না!

তিনকড়ি : (শীলার কথা গ্রাহ্য না করিয়া) কিন্তু একটু আগে, মিস সেন জানতে পেরেছেন, এই আত্মহত্যার খানিকটা দায়িত্ব তাঁর ওপরও গিয়ে পড়েছে। এখন যদি তিনি এ ঘরে না থাকেন, যদি আমার এনকোয়ারির বাকিটা না শোনেন, তাহলে তাঁর মনে হবে, হয়তো সমস্ত দোষটা তাঁরই। এ শুধু আজ বলে নয়, দিনের পর দিন — যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন এ দায়িত্বের গুরুভার তাঁকেই বয়ে বেড়াতে হবে।

শীলা : (ব্যাকুলস্বরে) হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন! আমি জানি দোষ আমারও আছে—কিন্তু তাই বলে সবটা নয়! মেয়েটির আত্মহত্যার জন্যে আমিও দায়ী। কিন্তু দায়িত্বটা কি শুধু আমার একারই? কখখনো না—এ আমি বিশ্বাস করি না!

তিনকড়ি : (দু’জনকেই কঠোরভাবে) এখন বুঝতে পারছেন—’আমি একা’ বলে কিছু নেই—আমরা সবাই সবায়ের ভাগীদার? ভাগ করার যদি কিছুও না থাকে, তাহলে অন্তত অপরাধের দায়-দায়িত্বটাও ভাগ করে নিতে হয়!

শীলা : (একদৃষ্টিতে সাব-ইন্সপেক্টরকে দেখিতে দেখিতে) হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। কিন্তু দেখুন—আমি আপনাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না—

তিনকড়ি : অকারণে আমাকেই বা বুঝতে যাবেন কেন?

(তিনকড়িবাবুর শান্ত দৃষ্টি গিয়া পড়িল শীলার মুখের উপর। শীলার মুখে চোখে ফুটিয়া উঠিল বিস্ময় ও সন্দেহ। ঠিক এমন সময় রমা সেনের প্রবেশ। তাঁহার মুখে চোখে একটা আত্মপ্রত্যয়ের ভাব। যে ঘটনা এখানে ঘটিতেছে তাহার পটভূমিকায় তাঁহাকে যে একেবারেই মানাইতেছে না, ইহা বুঝিতে শীলার বিশেষ দেরি হইল না।)

রমা : (মুখে হাসি ফুটাইয়া) ও, আপনি এসেছেন থানা থেকে? নমস্কার।

তিনকড়ি : (নমস্কার করিয়া) আজ্ঞে হ্যাঁ। পদ্মপুকুর থানা থেকে আসছি, নাম তিনকড়ি হালদার—সাব-ইন্সপেক্টর।

রমা : দেখুন তিনকড়িবাবু—আমার স্বামী—মানে মিস্টার সেনের কাছ থেকে আমি সব ব্যাপারটা শুনলাম। অবশ্য আপনাকে সাহায্য করতে পারলে আমি নিশ্চয়ই করতাম—কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করবার আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।

শীলা : (শঙ্কিত কণ্ঠস্বরে) মা!

রমা : (অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়াছেন এইরূপ ভান করিয়া) কি রে, কি হল?

শীলা : (ইতস্তত করিতে করিতে) না—মানে—

রমা : মানে? মানে কিসের?

শীলা : মানে আর কি? একেবারে গোড়াতেই তুমি ভুল করছ কিনা, তাই বলছি। শেষকালে দুমদাম করে কোথায় কি বলে বসবে—পরে যখন হুঁশ হবে, তখন দেখবে, আর হায় হায় করেও কোনো কুল পাচ্ছ না!

রমা : (শীলাকে) কি সব আবোলতাবোল বকছিস বল তো?

শীলা : আমরাও ঠিক ঐ ভুলটাই করেছিলাম মা। ভেবেছিলাম, কোথায় কি হল না হল তাতে আমাদের কি! কিন্তু যেই উনি মুখ খুললেন—সব বদলে গেল!

রমা : (তিনকড়িবাবুকে) আপনি দেখছি আমার মেয়ের মনে বেশ একটা ছাপ ধরিয়ে দিয়েছেন!

তিনকড়ি : ওটা কিন্তু আপনার মেয়ে বলে নয়—ঐ বয়সী প্রায় মেয়েদের বেলাই হয়। ওঁদের তো ছাপ নেবারই বয়স।

(দেখা গেল, তিনকড়িবাবুরও মিসেস সেনের দৃষ্টি পরস্পরের মুখের উপর নিবদ্ধ, কিন্তু সে বোধহয় মুহূর্তের জন্য।)

রমা : (শীলাকে) আচ্ছা, এখন এসব আবোলতাবোল কথা ছেড়ে শুতে যা দেখি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে—

শীলা : না মা, তা হয় না। একটু আগে তিনকড়িবাবুও আমাকে এঘর থেকে যেতে বলেছিলনে। কিন্তু আমি যাইনি। কেন মেয়েটিকে মরতে হল তা আমায় জানতেই হবে। না জেনে এঘর থেকে যাওয়া আমার হতেই পারে না!

রমা : আশ্চর্য! এই বাজে কৌতূহলের কোনো মানে হয়!

শীলা : না মা, এটা মোটেই বাজে কৌতূহল নয়—

রমা : মুখের ওপর চোপা করিস না শীলা! আমি বলছি, তোর এঘরে থাকার কোনো মানেই হয় না! আর তাছাড়া, মেয়েটা কেন অ্যাসিড খেয়েছে, তা আমরা কি করে জানব? ওসব মেয়েদের আবার…

শীলা : (বাধা দিয়া) তুমি কি কিছুতেই শুনবে না মা? কেন তুমি এইসব কথাবার্তা বলছ?

রমা : (বিরক্ত হইয়া) কি সব কথাবার্তা বলছি? দেখ শীলা—!

শীলা : তুমি ভাবছ—আমরা আলাদা আর মেয়েটি আলাদা। কিন্তু তা হচ্ছে না মা! তোমার ও দেওয়ালের আড়াল বেশিক্ষণ থাকছে না, তিনকড়িবাবুর একটি কথায় এক্ষুনি চুরমার হয়ে যাবে!

রমা : কি বলছিস তুই? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না! (তিনকড়িবাবুকে) আপনি পারছেন?

তিনকড়ি : আজ্ঞে হ্যাঁ — উনি ঠিক কথাই বলছেন।

রমা : (ত্রুদ্ধ স্বরে) তার মানে?

তিনকড়ি : মানে—আমি ওঁর কথা বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। উনি ঠিক কথাই বলেছেন।

রমা : দেখুন—যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কথাবার্তার ধরনটা আমার কিন্তু বেয়াড়া বলে মনে হচ্ছে। (শীলা হাসিয়া উঠিলে) হেসে উঠলি যে বড়—হাসির কথাটা কি হল শুনি?

শীলা : কি জানি মা, তোমার ঐ বেয়াড়া কথাটা বড় বেখাপ্পা শোনাল—তাই হেসে ফেললাম—

রমা : অবশ্য উনি যদি কিছু মনে করেন — তাহলে—

তিনকড়ি : (শান্ত কণ্ঠস্বরে) আজ্ঞে না। মনে করাটা আমার ডিউটির বাইরে।

রমা : অবশ্য মনে করার কথা আমাদেরই।

তিনকড়ি : দেখুন—ও মনে করা-করির ব্যাপারটা বাদ দিলে হয় না?

অমিয় : আমি তাই বলি—

রমা : না—মানে—

শীলা : থাক না মা ও কথা—

রমা : আচ্ছা, কথা হচ্ছে ওঁতে আমাতে—তোরা কেন কথা বলছিস বল তো? দেখুন, আপনি বললেন, আপনি এখানে এসেছেন একটা এনকোয়ারি করতে। কিন্তু যা শুনলাম, আর যা দেখছি—তাতে আপনার এনকোয়ারির ধরনটা খুবই বেয়াড়া বলে মনে হচ্ছে। আপনি বোধহয় আমার স্বামীকে—মানে, মিস্টার সেনকে খুব ভালো করে জানেন না। এমনিতে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি তো যথেষ্ট আছেই, তার ওপর আবার হয়তো দু-পাঁচ মাসের মধ্যে মিনিস্টার-টিনিস্টারও হয়ে যেতে পারেন—অন্তত এম.এল.এ যে হবেন, তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই! আর রমেশ—রমেশকে তো জানেনই—সে আবার আমাদের ভাগনে—

শীলা : (শঙ্কিত কণ্ঠস্বরে) কি পাগলের মতো যা তা বকছ মা! দোহাই তোমার, একটু চুপ করো—

তিনকড়ি : (মিসেস সেনকে) আপনি যা যা বললেন, সবই আমি জানি। এখন মিস্টার সেনকে যদি একটু খবর পাঠান, তাহলে বড় ভালো হয়।

রমা : তিনি এক্ষুনি আসছেন। আমার ছেলে—মানে তাপস—মানে— (থামিয়া গেলেন)

তিনকড়ি : হ্যাঁ বলুন—কি হয়েছে তাঁর?

রমা : না, মানে হয়নি কিছু—সারাদিন ঘোরাঘুরি গেছে—তার ওপর সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে একটা ছোটখাট পার্টি গোছের ছিল, তাই…

তিনকড়ি : (বাধা দিয়া) আচ্ছা—তাপসবাবু মদ খান তো?

রমা : মদ? তাপস? কি বলছেন আপনি? ঐটুকু বাচ্চা ছেলে মদ খাবে কি?

তিনকড়ি : আজ্ঞে না, বাচ্চা তো নয়। বছর পঁচিশেক বয়স হবে। ও বয়সের অনেক ছেলেকে আমি বোতল-বোতল মদ খেতে দেখেছি!

শীলা : ছোড়দা তাদেরই মধ্যে একজন তিনকড়িবাবু।

রমা : শীলা!

শীলা : আচ্ছা মা, এ না জানার ভান করে লাভটা কি? এটা কি তোমার মিসেস তলাপাত্রর বাড়ির পার্টি — যে রেখে-ঢেকে কথা বলছ? এখানে যত ঢাকবে, বিপদ তত বাড়বে। আর একটু পরেই হয়তো দেখবে ছোড়দা এমন জালে জড়িয়ে আছে আর বিন্দু-বিসর্গও আমরা কেউ জানি না। (তিনকড়িকে) না তিনকড়িবাবু— ছোড়দা আজ বছর ছয়েক ধরে ড্রিঙ্ক করছে আর বেশ রীতিমতো ভাবেই করছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে এক একদিন রাতে বেশ মাতাল হয়েই বাড়ি ফেরে। আমি দরজা খুলে দিই কিনা।

রমা : কখখনো না—মিথ্যে কথা। আচ্ছা, তুমিই বলো অমিয়—তাপস মদ খায়?

অমিয় : দেখুন সত্যি কথা বলতে কি—আমার চোখে বড় একটা পড়েনি। তবে বাইরে যা শুনি—তাতে তো মনে হয় আজকাল ডিঙ্কের মাত্রাটা খুবই বাড়িয়েছে।

রমা : (তিক্তস্বরে) এ কথাটা কি এখানে না বললে চলত না বাবা?

শীলা : না মা, না বললে সত্যিই চলত না! এ কথাটা বলার এইটাই তো ঠিক সময়। এইজন্যেই তো তোমাকে বলেছিলাম, দেয়াল তোলবার চেষ্টা করো না—ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে—

রমা : কিন্তু চুরমারটা তো উনি করছেন না—সেটা তো করছিস তুই!

শীলা : হ্যাঁ। কিন্তু বুঝতে পারছ না—উনি তো এখনও আরম্ভই করেননি!

রমা : (নিজেকে আয়ত্তের মধ্যে আনিয়া) আরম্ভ করলে হবেটা কি শুনি? করুন না ওঁর যা জিজ্ঞেস করবার আছে—আমি তো তৈরি হয়েই আছি। আর কি জিজ্ঞেসটা করবেন উনি আমাকে? আমি জানি কিছু, যে বলব?

তিনকড়ি : (গম্ভীরভাবে) হয়তো কিছু জানেন। তার হিসেবটা আপনার টার্ন এলেই নেব।

রমা : (বিস্মিত ও হতভম্ব অবস্থায়) ও, তাই নাকি—

(মিস্টার সেন প্রবেশ করিয়া দরজাটা আবার বন্ধ করিয়া দিলেন।)

চন্দ্রমাধব : (কণ্ঠস্বরে বিরক্তির আভাস) তাপসটাকে পঞ্চাশবার বললাম শুতে যা, কিছুতে গেল না! বলে, আপনি নাকি তাকে জেগে থাকতে বলেছেন?

তিনকড়ি : আজ্ঞে হ্যাঁ।

চন্দ্রমাধব : কারণটা জানতে পারি কি?

তিনকড়ি : নিশ্চয় পারেন। তাঁকে আমার দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে।

চন্দ্রমাধব : তাপসকেও আপনার কথা জিজ্ঞেস করবার আছে? আশ্চর্য। আমার তো মাথাতেই আসছে না, তাপসের সঙ্গে আপনার কি কথা থাকতে পারে।

তিনকড়ি : আপনার মাথাতে তো আসবে না। জিজ্ঞেস করব তো আমি।

চন্দ্রমাধব : (গরম সুরে) তাহলে দয়া করে সেটা এখন করে নিন—করে ছেলেটাকে ছেড়ে দিন।

তিনকড়ি : কিন্তু এখন তা নয়। I am sorry—তাঁকে ওয়েট করতেই হবে।

চন্দ্রমাধব : দেখুন তিনকড়িবাবু—

তিনকড়ি : আমি তো বলে দিয়েছি—তাঁর টার্ন না এলে নয়।

শীলা : (মিসেস সেনকে) দেখলে তো মা?

রমা : না, আমি কিচ্ছু দেখিনি! তুই থামবি!

চন্দ্রমাধব : দেখুন তিনকড়িবাবু আমি আগেও আপনাকে বলেছি, এখনও বলছি—কি আপনার কথাবার্তা, কি আপনার এনকোয়ারি, কোনোটাই আমার পছন্দ নয়। আমি এতক্ষণ আপনাকে চান্স দিয়েছি কিন্তু আর নয়।

শীলা : (কিছুটা অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় হাসিয়া উঠিয়া) তুমি ভুল করলে বাবা, চান্স তো উনিই আমাদের দিচ্ছেন! আমাদের লজ্জা পাবার কোনো চান্সই তো কোনোদিন ছিল না, সেটা উনিই করে দিচ্ছেন!

চন্দ্রমাধব : শীলার কি হয়েছে বলো তো?

রমা : হবে আবার কি? মাথা গরমের ধাত! ও তো বরাবরই ঐরকম। কোথাও একটু কিছু শুনল তো মেয়ের একেবারে খাত ছেড়ে গেল। বলছি তখন থেকে — ওরে শুতে যা, তো কে কার কথা শোনে! (হঠাৎ তিনকড়িবাবুর দিকে ফিরিয়া ত্রুদ্ধস্বরে) আপনি চুপ করে শুনছেন কি? বলুন, আপনার কি জানবার আছে?

তিনকড়ি : (গম্ভীরভাবে, এতটুকু বিচলিত না হইয়া) গেল বছর জানুয়ারির শেষে এই সন্ধ্যা চক্রবর্তীর আবার চাকরি যায়। কেন? না, মিস সেন নিজের ওপর একটু বিরক্ত হয়েছিলেন বলে। এর পরেও এধার ওধার চাকরির চেষ্টা সে করেছিল কিন্তু পায়নি। তখন ঠিক করলে নামটা বদলে একটু রকমফের করে দেখবে। (হঠাৎ অমিয়র দিকে ফিরিয়া) সন্ধ্যা চক্রবর্তীর নাম বদলে হল

অমিয় : (ফস করিয়া বলিয়া ফেলিল) ঝরনা রায়।

(শীলা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, অমিয়র থতমত অবস্থা।)

তিনকড়ি : আজ্ঞে হ্যাঁ। এখন বলুন তো মিস্টার বোস, এই ঝরণা রায়ের সঙ্গে কবে আপনার প্রথম দেখা হয়েছিল?

অমিয় : (নিজেকে আয়ত্তে আনিবার চেষ্টা করিয়া) না মানে—

শীলা : মিছিমিছি সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই অমিয়—

অমিয় : বেশ, তাহলে শনুন। ঝরনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় গেল বছর মার্চ মাসে প্যালেস ম্যাসেজ ক্লিনিকে, মানে পার্ক স্ট্রীটের ঐ ম্যাসজে ক্লিনিকটা—

শীলা : ওটা যে পাক স্ট্রীটে, শ্যামবাজারে নয় তা বোধহয় উনি জানেন অমিয়—

অমিয় : থ্যাঙ্কস শীলা। (হঠাৎ চটিয়া উঠিল) আচ্ছা শীলা, তোমার যা বলার ছিল, তা তো বলা হয়ে গেছে। এখন এখানে থেকে লাভটা কি? এসব কথা তোমার খুব ভালোও লাগবে না—

শীলা : ভালো না লাগলেও আমাকে এখানে থাকতে হবে অমিয়।

অমিয় : (অসহিষ্ণু হইয়া) কিন্তু কেন?

শীলা : বাঃ, খুব কাজ ছিল বলে, গেল বছর মে-জুন-জুলাই তুমি একেবারে এদিক মাড়াওনি! এরপর যখন এ রকম হবে, তখন অন্তত বুঝব যে তোমার একটা কাজ আছে, আর সে কাজটাও যে কি রকম তারও একটা আন্দাজ পাব!

তিনকড়ি : (শীলাকে থামাইয়া দিয়া) আচ্ছা থাক ও কথা — আপনাদের ঝগড়াটা না হয় পরেই সারবেন। (অমিয়কে) তারপর মিস্টার বোস? প্যালেস ম্যাসেজ ক্লিনিকে আপনার সঙ্গে ঝরনা রায়ের প্রথম দেখা — কেমন?

অমিয় : (অল্প ইতস্তত করিতে করিতে)—মানে—ওসব জায়গায় আমি এমনিতে বড় একটা—

তিনকড়ি : বুঝেছি অমিয়বাবু—আপনি ওসব জায়গায় এমনিতে বড় একটা যান না। কিন্তু সেদিন গিয়েছিলেন—

অমিয় : হ্যাঁ—মানে, শরীরটা ঠিক ফিট মনে হচ্ছিল না। তাই মনে হল একবার ঘুরেই আসি। ম্যাসেজের পর ঘর থেকে বেরিছি এমন সময় মানে—জানেনই তো—ওসব জায়গায় ঐ টাইপের মেয়েই বেশি আসে—

রমা : (কৌতূহলী হইয়া) ঐ টাইপের মেয়ে—?

তিনকড়ি : যাকগে, টাইপটা এখন নাই বা আলোচনা করলেন। বিশেষ করে ওঁর সামনে—(শীলাকে দেখাইয়া দিলেন)

রমা : (চটিয়া উঠিয়া) আমি যে তখন থেকে বলছি — শীলা, তুই এঘর থেকে যা!

শীলা : তুমি ভুলে যাচ্ছ মা—আজ বাদে কাল অমিয়র সঙ্গে আমার বিয়ে!—তারপর অমিয়? ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছ, এমন সময় জানতে পারলে ওখানে ঐ টাইপের মেয়েরাই বেশি আসে—তারপর?

অমিয় : (ত্রু�দ্ধস্বরে) খুব মজা লাগছে শুনতে—না শীলা! আচ্ছা শীলা, তোমার এতটুকু লজ্জা করছে না—

তিনকড়ি : (বাধা দিয়া) Come along মিস্টার বোস, তারপর?

অমিয় : না—মানে বেরিয়ে এসেছি—এমন সময় দেখি—মানে—ঐ মেয়েটি—মানে ঝরনা—একেবারে সামনে—(কিছুটা আত্মবিস্মৃতের ন্যায়) রঙ ফরসা, ঘন কালো চুল, টানা চোখ—(হঠাৎ থামিয়া গিয়া)—My god!

তিনকড়ি : কি হল মিস্টার বোস?

অমিয় : না, মানে—আমার ঠিক মনে ছিল না—

তিনকড়ি : (রূঢ়স্বরে) যে মেয়েটি একটু আগে মারা গেছে, এই তো সে?

শীলা : আর আমরাই তাকে মেরেছি, তাই না?

রমা : শীলা!

শীলা : তুমি চুপ করো মা!

তিনকড়ি : হ্যাঁ, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন ঐ মেয়েটি—তারপর?

অমিয় : দেখি আমাদের ধীরেশ তার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে। আর মেয়েটি প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাকে বাধা দেবার। তার মুখ চোখের ভাব দেখে মনে হল, ম্যাসাজ ক্লিনিকে খুব বেশি দিন সে আসেনি—

রমা : কিন্তু ধীরেশ? কোন ধীরেশ, অমিয়?

অমিয় : আমাদের ধীরেশ, কাকিমা—এস, এন-এর ছেলে—

রমা : সত্যি?

শীলা : হ্যাঁ মা, সত্যি। তুমি ভাব, বোকা-বোকা মুখ করে খোনে আসে, তোমাকে কাকীমা-কাকীমা করে, চা-টা খায়—অয়ন ছেলে আর হয় না। আমরা তো এসব ব্যাপার বহুদিন জানি! পাশের বাড়ির প্রতিভাদিকে চেনো?

রমা : কে প্রতিভা! ও—ঐ স্কুল-মিস্ট্রেস?

শীলা : হ্যাঁ। প্রতিভাদি ধীরেশের ছোট বোনকে পড়াত। দু-মাস পরে টিউশান ছেড়ে দিতে হল। কেন জানো? তোমাদের ঐ এস, এন-এর ছেলে দীরেশ দু-একদিন তার হাত ধরে—

চন্দ্রমাধব : (জোর ধমক দিয়া উঠিলেন) শীলা! (শীলা থামিয়া গেল)

তিনকড়ি : (অমিয়কে) আপনি থামলেন কেন? বলে যান—

অমিয় : মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমার যেন কি রকম মায়া হল। ধীরেশের হাত থেকে ছাড়িয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম—

তিনকড়ি : সেদিন কোথায় উঠলেন?

অমিয় : পাশের রয়াল হোটেলে।

তিনকড়ি : কিছু কথাবার্তা হয়নি?

অমিয় : হয়েছিল—তবে অল্প। নাম বললে ঝরনা রায়। কথায়-কথায় জানতে পারলাম, বাপ-মা কেউ নেই। আগে চাকরি করত, দু-দু’বার চাকরি যাওয়ায় কোথাও কিছু না পেয়ে, শেষে এই ম্যাসাজ ক্লিনিকে চাকরি নেয়। ম্যাসাজ ক্লিনিকের ব্যাপার যে খানিকটা জানত না তা নয়—জানত। কিন্তু অন্য কিছু না পেয়ে ওখানে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এদিকে কথা বলে খুব কম। আমাকে তো আগের কথা কিছু বললেই না—আমিও অবশ্য জোর করিনি। তবে কথার ফাঁকে শুধু এইটুকু জানতে পারলাম—হাতে টাকা-পয়সা কিচ্ছু নেই। না আছে আত্মীয়স্বজন, না আছে বন্ধুবান্ধব। কি জানি কেন বড্ড মায়া হল। হাতে কিছু টাকা দিয়ে আর ঐ হোটেলেই দিন পনেরো থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়ে সেদিনের মতো আমি চলে এলাম।

তিনকড়ি : তারপর—দিন পনেরো বাদে আপনি ঠিক করলেন—মেয়েটিকে আপনার নিজের কাছেই রাখবেন—এইতো?

রমা : অমিয়!

শীলা : এতে অবাক হওয়ার কিছু তো নেই, মা! গল্পের গোড়া দেখলেই তো শেষটা বোঝা যায়।—যাকগে অমিয়, তুমি বলো—মা তো একটু চমকাবেই!

অমিয় : পনেরো দিন বাদে আবার আমাদের দেখা হয়। সেদিন কি জানি কেন মনে হল, একা এই নিঃসঙ্গ অবস্থায় তাকে ছেড়ে যাওয়া খুবই অন্যায়। সে-সময় আমার এক বন্ধু মাস-পাঁচেকের জন্যে বম্বে গিয়েছিলেন। তাঁর ফ্ল্যাটের চাবিটা আমার কাছে ছিল।আমি তাকে ঐ ফ্ল্যাটটায় এনে রাখলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন তিনকড়িবাবু, কোনো অভিসন্ধি আমার ছিল না। আমি শুধু তার একটু উপকার করতেই চেয়েছিলাম—কোনো প্রতিদান আমি চাইনি—

তিনকড়ি : ও—

শীলা : (নিজের দিকে ইঙ্গিত করিয়া) দেখ অমিয়—কাকে বলার কথা, আর কাকে বলছ—

অমিয় : I am sorry শীলা, মানে—

শীলা : না না, মানে আমি বুঝি অমিয়—তুমি তো বলছ না, উনি তোমাকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন—

তিনকড়ি : আচ্ছা, তারপর থেকে ঝরনা আপনার সঙ্গেই রয়ে গেল — কেমন?

অমিয় : (হঠাৎ ত্রু�দ্ধস্বরে) সেটাও কি আপনাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে? কিচ্ছু বোঝেন না আপনি?

তিনকড়ি : বুঝি বই কি, তার দিকটা বেশ ভালো করেই বুঝি। একা অসহায় স্ত্রীলোক। আপনিই বোধহয় তার জীবনের প্রথম বন্ধু! কিন্তু আপনি? আপনি কি সত্যিই তাকে ভালবেসেছিলেন?

চন্দ্রমাধব : দেখুন তিনকড়িবাবু,—আমি চাই না, আমার বাড়িতে এসব কথাবার্তা হয়—

তিনকড়ি : কিন্তু, আপনি না চাইলেও হচ্ছে। মেয়েটিকে আপনিই প্রথম তাড়িয়েছিলেন।

চন্দ্রমাধব : সেটা শুধু আমি নয়, আমার মত যে কোনো এমপ্লয়ারই তাকে তাড়িয়ে দিত। যাকগে সে কথা। আমি চাই না আমার বাড়িতে, আমারই মেয়ের সামনে, এ ধরনের অভব্য কথাবার্তা হয়।

তিনকড়ি : আপনার মেয়ে কিছু চাঁদের দেশে নেই—ইঁটকাঠের দুনিয়ায় তাকে পা ফেলে চলতে হয়!—হ্যাঁ, তারপর মিস্টার বোস—আপনি কি সত্যিই মেয়েটিকে ভালবেসেছিলেন?

অমিয় : না—মানে, সে আমাকে—

তিনকড়ি : না না, তার কথা আমি জানি। সে আপনাকে ভালবেসেছিল—কিন্তু আপনি?

অমিয় : আমার একটা মোহ থাকা খুব অস্বাভাবিক কি?

শীলা : আর এই মোহটা বোধহয় তোমার মাস তিনেক ছিল, না অমিয়? তাই বোধহয় তিন মাস এখানে আসতে পারোনি? ঐ যে, গেল বছরের মে-জুন-জুলাই?

অমিয় : কিন্তু শীলাআমি তোমাকে মিথে কথা বলিনি। ঐ তিন মাস সত্যিই আমার কাজ খুব বেশি ছিল।

শীলা : কিন্তু ওখানে বোধহয় তুমি রোজই যেতে?

অমিয় : না, মোটেই যেতাম না—

তিনকড়ি : কিন্তু প্রায়ই যেতেন তো?

অমিয় : হ্যাঁ—

রমা : ছিঃ অমিয়—যত সব ডিসগাস্টিং ব্যাপার—

অমিয় : কিন্তু কাকীমা—আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না—

রমা : তার মানে?

তিনকড়ি : মানে, ব্যাপারটা আপনার কাছে ডিসগাস্টিং হলেও ওঁর কাছে নয়।

অমিয় : আপনার আর কিছু জিজ্ঞেস করবার আছে?

তিনকড়ি : হ্যাঁ—শেষে কি হল?

অমিয় : অগস্টের শেষে হপ্তা দুয়েকের জন্যে আমার বাইরে যাবার কথা হয়। যাবার আগে বেশ ভালো করে ভেবে দেখলাম—দেখলাম আর জের টানার কোনো মানেই হয় না। আমার আসা-যাওয়া কম দেখে ঝরনাও বুঝতে পেরেছিল। একদিন তাকে সব খুলে বললাম—

তিনকড়ি : কিভাবে নিলে সে?

অমিয় : খুব সহজভাবে। আশ্চর্য এত সহজভাবে যে নেবে সে, তা ভাবতেই পারিনি!

শীলা : (বঙ্গের সুরে) তোমার তো খুব ভালোই হল—

অমিয় : তুমি কত কম বোঝ শীলা, অথচ কথাবলো কত বেশী! সে আমায় কি বলেছিল জানো? বলেছিল, এত সুখ সে জীবনে কোনোদিন পায়নি। জানো শীলা, ঝরনা আমার ওপর এতটুকু রাগ করেনি। জিজ্ঞেস করতে বলেছিল—রাগ করতে যাব কেন? আমি তো গোড়া থেকেই জানি এ-সুখ আমার সইবে না! (দুই হাতে চোখ ঢাকিয়া অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠস্বরে) ওঃ, আজ যদি সে একবারও ফিরে এসে বলে যেত—যত দোষ, সব তোমার অমিয়, যত দোষ সব তোমার!—তাহলে বোধহয় আমি বেঁচে যেতাম শীলা!

তিনকড়ি : তারপর অমিয়বাবু—ঝরনাকে ঐ ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিতে হল, কেমন?

অমিয় : হ্যাঁ, অবশ্য যাবার আগে আমি তাকে কিচু টাকা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে নেয় নি। বললে—আমি যা দিতাম, তা থেকেই কিছু তার হাতে পড়ে আছে। আমি অনেক বললাম। কিছুতেই রাজী হল না। বলল, দু-একটা মাস, কোনো রকমে চলে যাবে—তার মধ্যে একটা-না-একটা কিছু জুটে তার যাবেই—

তিনকড়ি : কোথায় যাবে, কিন্তু বলেছিল আপনাকে?

অমিয় : না, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। তবে কথার আভাসে মনে হয়েছিল বোধহয় কলকাতায় থাকবে না। — আপনি জানেন কিছু?

তিনকড়ি : হ্যাঁ—মাসখানেকের জন্যে সে কলকাতার বাইরে চলে গিয়েছিল—নির্জন ছোট্ট একটা জায়গায়—

অমিয় : একা?

তিনকড়ি : হ্যাঁ, একা থাকবার জন্যেই তো গিয়েছিল। ছোট্ট নির্জন একটা জায়গা—বসে বসে সারাদিন ভাবত আপনার কথা, তার নিজের কথা—আর মনে রাখবার মতোঐ মে-জুন-জুলাইয়ের কথা—

অমিয় : কিন্তু আপনি এসব কথা জানলেন কি করে?

তিনকড়ি : ঐ যে বললাম—সে একটা ডায়েরি রেখে গেছে। সুদিনের খতা কে না মনে রাখতে চায় বলুন? দেখলে, সামনেই তার সময় খারাপ। তাই মনে রাখতে চায় বলুন? দেখলে, সামনেই তার সময় খারাপ। তাই সামনে না তাকিয়ে ঐ একটা মাস শুধু পেছনের কথাই ভাবলে—পেছনের ঐ তিনটে মাস।

অমিয় : ও—কিন্তু এর পরের খবর তো আমি রাখি না—

তিনকড়ি : আপনার কাছ থেকে এই খবরটাই আমি চেয়েছিলাম—এর পরেরটা নয়।

অমিয় : দেখুন—তাহলে—মানে—আমি যদি এখন একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি—(তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল) অবশ্য আপনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে—

তিনকড়ি : কোথায় যাবেন? বাড়ি?

অমিয় : না না, বাড়ি নয়—এই বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসব। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি ঠিক ফিরে আসব।

রমা : তার মানে? এখানেই তাহলে শেষ নয়?

অমিয় : কি জানি কাকিমা, আমার তো মনে হয়— না। তারপর—উনি জানেন—(তিনকড়ির দিকে ইঙ্গিত করিয়া বাহির হইয়া গেল।)

শীলা : কিন্তু তিনকড়িবাবু, আপনি তো ছবিটা অমিয়কে দেখালেন না?

তিনকড়ি : দরকার মনে করলাম না—মনে হল, না দেখানোই ভালো।

রমা : আপনার কাছে মেয়েটার ছবি আছে নাকি?

তিনকড়ি : আছে। একবার দেখবেন নাকি?

রমা : আমি কেন দেখতে যাব? দরকারটা কি আমার?

তিনকড়ি : না, দরকার কিছু নেই। তবু একবার দেখলে পারতেন?

রমা : আচ্ছা, কই দেখি—নিয়ে আসুন—

(তিনকড়িবাবু মিসেস সেনের নিকট আসিয়া পকেট হইতে ছবি বাহির করিলেন। মিসেস সেনের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। মনে হইল খুব ভালো করিয়া ছবিটি দেখিতেছেন।

তিনকড়ি : (ছবিটি যথাস্থানে রাখিয়া) চিনতে পারছেন নিশ্চয়?

রমা : তার মানে? আমি কি করে চিনব?

তিনকড়ি : সে কি? ছবিটা অবশ্য আগেকার তোলা। মুখের চেহারা একটু-আধটু বদলাতেও পারে। কিন্তু তাই বলে এত বদলে গেল যে, একেবারে চিনতেই পারলেন না!

রমা : দেখুন, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। কি বলতে চান আপনি?

তিনকড়ি : বুঝতে পারছেন না—না, বুঝতে চাইছেন না?

রমা : (ত্রু�দ্ধস্বরে) তার মানে?

তিনকড়ি : মানে, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।

রমা : তিনকড়িবাবু, ভদ্রভাবে কথা বলতে চেষ্টা করুন—

চন্দ্রমাধব : তার মানে? আগে উনি তোমার কাছে মাফ চাইবেন, তারপর অন্য কথা।

তিনকড়ি : কিন্তু ভুল করছেন—যা করছি, তা আমার ডিউটি, তার জন্যে মাফ চাইব কেন?

চন্দ্রমাধব : কিন্তু গালাগাল দেওয়াটা আপনার ডিউটি নয়। আপনি আমাদের রাম-শ্যাম-যদু-মধু পেয়েছেন নাকি? আমরা শহরের একটা নামজাদা ফ্যামিলি, তা জানেন?

তিনকড়ি : কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছে মিস্টার সেন, নামজাদা হিসেবে আপনাদের যেমন সুবিধেও আছে, তেমনি দায়িত্বও কিছু আছে।

চন্দ্রমাধব : তা হয়তো আছে। কিন্তু আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে কি জন্যে? দায়িত্বের কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে?

শীলা : খুব ঠিক করে কিন্তু বলা যায় না বাবা—হয়তো তা হলেও হতে পারে—

রমা : শীলা!

শীলা : আচ্ছা মা, তোমরা যে এই বড়মানুষী ভড়ং দিয়ে ব্যাপারটাকে ঢাকবার চেষ্টা করছ, কোনো মানে হয় এর? পাঁচটা টাকা বেশি মাইনে চেয়েছিল বলে বাবা তাকে তাড়িয়ে দিলেন। আমার চেয়ে দেখতে ভালো বলে, আমি রেগে গিয়ে তার চেন স্টোরের চাকরিটা খেলাম। অমিয় তার খেয়ালখুশিমতো তাকে নিজের কাছে এনে রাখলে—আর যেই দরকার ফুরোল, তাকে বিদায় করে দিলে। আর তুমি? তুমি ছবিটা নিয়ে দেখলে! পরিষ্কার বোঝা গেল, তুমি চিনতে পেরেছ! তুমি চিনতে পেরেও বললে — চিনি না, অথচ ওঁকে বলছ মাফ চাইতে! কেন উনি মাফ চাইবেন?

রমা : শীলা, তুই চুপ করবি! আমি যা ভালো বুঝেছি তাই বলেছি!

শীলা : কিন্তু ভালো যে তুমি বোঝ নি মা। তোমার এ মিথ্যে ভড়ঙে ব্যাপারটা যে ক্রমশঃ খারাপের দিকে যাচ্ছে—

(সদর দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল)

চন্দ্রমাধব : আঃ—আবার কে এল—?

রমা : বোধহয় অমিয় ফিরে এল—

তিনকড়ি : কিংবা দেখুন, হয়তো তাপসবাবু বাইরে গেলেন —

চন্দ্রমাধব : আমি দেখে আসি, বুঝলে? (দ্রুত বাহির হইয়া গেলেন)

তিনকড়ি : (রমাকে) আচ্ছা মিসেস সেন, আপনি তো নারীসহায়ক সমিতির প্রেসিডেন্ট—না? (মিসেস সেন চুপ করিয়া রহিলেন)

শীলা : বলো মা—চুপ করে রইলে কেন? এটাতে তো হ্যাঁ বলতে কোনো বাধা নেই! (তিনকড়িকে) হ্যাঁ, উনি প্রেসিডেন্ট, কিন্তু কেন বলুন তো?

তিনকড়ি : আচ্ছা, শুনেছি মেয়েরা বিপদে-আপদে পড়লে, আপনাদের কাছে আবেদন-টাবেদন করে—আপনারা নাকি নানারকম সাহায্য টাহায্য করে থাকেন—সত্যি?

রমা : (ত্রু�দ্ধস্বরে) সাহায্য-টাহায্য নয়—দরকার হলে রীতিমতো টাকা পয়সাও দিই—এমন অনেক কেসে আমরা দিয়েছি!

তিনকড়ি : আচ্ছা, হপ্তা-দুয়েক আগে আপনাদের একজিকিউটিভ কমিটির একটা মিটিং হয়ে গেছে, না?

রমা : আপনি যখন বলছেন,—তখন হয়েছে নিশ্চয়—

তিনকড়ি : (দৃঢ়স্বরে) আমি বলছি বলে নয়, আপনিও জানেন—হয়েছে। সে মিটিঙে আপনিই ছিলেন প্রেসিডেন্ট—

রমা : যদি থাকিই প্রেসিডেন্ট, তাতে আপনার কি?

তিনকড়ি : (কঠোর স্বরে) সাদা কথায় বলব আপনাকে? সহ্য করতে পারবেন?

(চন্দ্রমাধবের প্রবেশ)

চন্দ্রমাধব : বুঝলে, তাপসই—

রমা : আশ্চর্য—কোথায় গেল বলো তো! এই বলছিল শরীরটা খারাপ—

চন্দ্রমাধব : আরে শরীর খারাপ কি? তখন দেখলাম আবোল-তাবোল বকছে। বললাম — শুতে যা—তো কে কার কথা শোনে! বললে—ইন্সপেক্টর আমাকে জেগে থাকতে বলেছেন! আমি তবু বললাম—বলুক ইন্সপেক্টর—আমি বলছি, তোকে দরকার হবে না—

তিনকড়ি : আপনি ভুল বলেছেন, মিস্টার সেন — তাঁকে আমার সত্যিই দরকার। আর তিনি যদি শিগগির না ফেরেন, তাহলে আমাকেই গিয়ে খুঁজে-পেতে নিয়ে আসতে হবে—

(মিস্টার ও মিসেস সেন ভীতবাবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলেন)

শীলা : (তিনকড়িকে) না না, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। এখানেই কোথাও আছে—এক্ষুনি আসবে।

তিনকড়ি : এলেই ভাল।

রমা : কেন—ভাল কেন?

তিনকড়ি : আগে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, তারপর আমি আপনারটার দেব।

চন্দ্রমাধব : আর যদি উনি না দেন—

তিনকড়ি : উত্তর দিতে উনি বাধ্য—

চন্দ্রমাধব : কেন—জানতে পারি কি?

তিনকড়ি : নিশ্চয় জানতে পারেন। একটু আগে মিস্টার বোস বলে গেলেন, সেপ্টেম্বর মাস থেকে তাঁর সঙ্গে সন্ধ্যার আর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। আমার মনে হয় কথাটা তিন মিথ্যে বলেন নি। কিন্তু মাত্র দু-হপ্তা আগে—(মিসেস সেনকে দেখাইয়া) ওঁর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে—আর শুধু দেখাই হয়নি, কথাবার্তাও হয়েছে!

শীলা : মা—!

চন্দ্রমাধব : সত্যি রমা?

রমা : (এক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া) হ্যাঁ।

তিনকড়ি : সে এসে আপনাদের সমিতির কাছে সাহায্য চেয়েছিল?

রমা : হ্যাঁ।

নতকিড়ি : কিন্তু সন্ধ্যা চক্রবর্তী নামে নয়।

রমা : না—ঝরনা রায় নামেও নয়।

তিনকড়ি : তবে কি নামে?

রমা : রেবা সেন।

তিনকড়ি : আর কিছু বলেনি—বিয়ে হয়েছে, কি হয়নি—?

রমা : প্রথমে তো বলেছিল—বিয়ে হয়েছে। সিঁথিতে সিঁদুরও ছিল।

তিনকড়ি : তার স্বামীর নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন?

রমা : কিন্তু বিয়ে তার মোটেই হয়নি—

তিনকড়ি : যা জিজ্ঞেস করছি তাই বলুন। তার স্বামীর নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন?

রমা : (ত্রু�দ্ধস্বরে) করেছিলাম কিন্তু বলেনি—

তিনকড়ি : কোথায় বিয়ে হয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিলেন?

রমা : করেছিলাম—

তিনকড়ি : কি বলেছিল সে?

রমা : কিন্তু বিয়ে তার—

তিনকড়ি : (বাধা দিয়া) কি বলেছিল সে?

রমা : প্রথমে সে কিছুই বলেনি। তারপর যখন তাকে বললাম, সমস্ত ঠিকানা না দিলে হবে না, তখন সে বললে — তার স্বামীর ঠিক নাম সে জানে না—তবে তার স্বামী কথায় কথায় একদিন বলেছিলেন যে, তিনি নাকি ঘুঘডাঙার সেন-বাড়ির ছেলে।

চন্দ্রমাধব : সে কি?

তিনকড়ি : (চন্দ্রমাধবকে) ঘুঘুডাঙার সেনেদের আপনি চেনেন নাকি?

শীলা : আমরাই ঘুঘুডাঙার সেন, তিনকড়িবাবু।

রমা : আরে—ঐ শুনেই তো আমার রাগ হয়ে গেল! মিথ্যে কথা কেন বললে?

তিনকড়ি : আপনি তাহলে গোড়া থেকেই তার ওপর রেগে ছিলেন?

রমা : রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক!

তিনকড়ি : কিন্তু সেদিন কমিটিতে আপনি হ্যাঁ বললে সে নিশ্চয় সাহায্য পেত তাই না?

রমা : তা হয়তো পেত।

তিনকড়ি : হয়তোর কথা হচ্ছে না। আপনি হ্যাঁ বললে সে সাহায্য পেত কি না?

রমা : হ্যাঁ, পেত। কিন্তু কেন হ্যাঁ বলব! প্রথমত সে মিথ্যে কথা বলেছিল—

তিনকড়ি : কি করে জানলেন?

রমা : জেরা করতে নিয়েই বলে ফেললে। তখন শুনলাম, তার বিয়েই হয়নি—আর ঘুঘুডাঙার সেন-বাড়ির নামটা তার প্রথমেই মনে এসেছিল, তাই বলেছিল!

তিনকড়ি : সে সাহায্যটা চেয়েছিল কেন?

রমা : সেটা তো আপনি নিজেও জানেন—

তিনকড়ি : হ্যাঁ, আসল কারণটা জানি, কিন্তু আপনাদের ওখানে সে কি বলেছিল?

রমা : এখানে সেটা আলোচনা করবার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।

তিনকড়ি : আপনি না মনে করতে পারেন, কিন্তু আলোচনা আপনাকে করতেই হবে!

রমা : আমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলে কোন লাভ হবে না, তিনকড়ি বাবু। একটা ব্যাপারে আপনি গোড়া থেকেই ভুল করছেন। লজ্জা পাবার মতো কোন কিছু আমি করিনি। মেয়েটি সাহায্যের জন্যে আমার কাছে এসেছিল। সোজা এসে সত্যি কথা বললে, হয়তো সে সাহায্য পেত। কিন্তু তা সে বলেনি। তাই কমিটি যাতে তাকে সাহায্য না করে, সেই ব্যবস্থাই আমি করেছিলাম। পরে হয়তো মেয়েটি আত্মহত্যা করতে পারে। কিন্তু তার জন্যে আমার লজ্জা পাবার কোন কারণই নেই! কাজেই, বুঝতে পারছেন — আমি যদি আর কথা বলব না বলে ঠিক করি, আপনার সাধ্য নেই আমাকে দিয়ে কথা বলান!

তিনকড়ি : আমি কিন্তু আপনাকে দিয়ে কথা বলাতে পারি, সে ক্ষমতা আমার আছে।

রমা : না, নেই! আমি কোন অন্যায় কাজ করিনি, কাজেই আপনার কোন জোর আমার ওপর খাটবে না।

তিনকড়ি : কিন্তু ওখানেই আপনার ভুল, মিসেস সেন। আপনি যে শুধু অন্যায় করেছেন তাই-ই নয়—এমন একটা অন্যায় করেছেন, যার জন্যে সারা জীবন আপনাকে অনুতাপ করতে হবে। আজ যদি আপনি আমার সঙ্গে হসপিটালে যেতেন, তাহলে দেখতেন —

শীলা : তিনকড়িবাবু—দোহাই আপনার, ও কথাটা না হয় থাক—

তিনকড়ি : কিন্তু আপনি থাক বললেই কথাটা থাকছে না, মিস সেন। মেয়েটি মা হতে চলেছিল—

শীলা : (আর্তস্বরে) তিনকড়িবাবু—কি বলছেন আপনি—(দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া) না, তিনকড়িবাবু, বলুন—বলুন, একথা সত্যি নয়! ওঃ—কি করে সে অ্যাসিড খেল!

তিনকড়ি : কি করবে বলুন? এখান থেকে তাড়ায় ওখানে যায়, ওখান থেকে তাড়ায় এখানে আসে—এর শেষই তো এই!

শীলা : তুমি জানতে মা?

তিনকড়ি : নিশ্চয় জানতেন। ওই জন্যেই তো মেয়েটি ওঁদের কাছে গিয়েছিল।

চন্দ্রমাধব : দেখুন—মানে, এর মধ্যে আমাদের অমিয় নেই তো?

তিনকড়ি : না। তার সঙ্গে এ ব্যাপারের কোন সম্পর্কই নেই।

চন্দ্রমাধব : (স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া) যাক তবু ভাল—

শীলা : এটুকু ভাল নাই বা হ’ত বাবা—

তিনকড়ি : (মিসেস সেনকে) আপনার তাহলে আর কিছু বলবার নেই—কি বলেন?

রমা : তাকে যা বলেছিলাম, আপনাকেও ঠিক তাই বলব। এ ব্যাপারে সত্যিই যার দায়িত্ব, তার খোঁজ করুন—সেই লোকটার—

তিনকড়ি ) কিন্তু দায়িত্বটা কি আপনারও কিছু কম মিসেস সেন। আপনার কাছে সে কখন সাহায্য চাইতে গিয়েছিল ভেবে দেখুন। কিন্তু আপনি নিজে তো তাকে না বললেনই, তার ওপর এমনভাবে কেসটা প্রেজেন্ট করলেন—যাতে কমিটির আর সকলে তাকে না বলে। আপনার নিজেরও ছেলেমেয়ে আছে—মা হওয়া যে কি, তা আপনি বেশ ভাল করেই বোঝেন! একবারও ভাবলেন না—সে অসহায়, নিঃসম্বল। আপনি তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারতেন, নিজের মেয়ের মতো উপদেশ দিতে পারতেন—বন্ধু হিসেবে তাকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। কিন্তু আপনি সোজা তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন!

শীলা : ছিঃ—মা—

চন্দ্রমাধব : কিন্তু রমা, ব্যাপারটা করোনারেই গোলমেলে দাঁড়াতে পারে—আর কাগজওলাদের তো কথাই নেই—

রমা : চুপ করবে তোমরা! আচ্ছা, তোমরা আমাকে দোষ দাও কি করে? দয়াময়ী থেকে তাকে তাড়িয়েছিলে তুমি! চেন স্টোর থেকে তাকে তাড়াল শীলা! (তিনকড়ির দিকে ফিরিয়া) আমি তো এখনও বলছি—আমি কোন অন্যায় করিনি! মেয়েটা তো আরম্ভই করলে মিথ্যে দিয়ে! তারপর দেখলাম—আসল লোকটাকে সে ভাল করেই জানে। তখন আমি তাকে বললাম—সেই লোকটার কাছে যেতে! বিয়ে না করুক, সে অন্তত টাকাকড়ি দিয়ে সাহায্য করতে পারত!

তিনকড়ি : কি বললে সে?

রমা : যত সব বাজে কথা—

তিনকড়ি : সেটা কী তাই বলুন না?

রমা : (ত্রু�দ্ধস্বরে) কি বলব কী? আমার ভাল মনে নেই! ন্যায় অন্যায় বিবেক—সে সব বড়ো বড়ো কথা কি? আরে তোর মতো মেয়েদের মুখে আবার ওসব কথা কেন?

তিনকড়ি : (রুঢ়স্বরে) কার মতো মেয়ে মিসেস সেন? মড়া-কাটা টেবিলে আজ যে শুয়ে আছে—তার মতো? (চন্দ্রমাধব যেন প্রতিবাদে কি বলিতে চাইতেছিলেন — তাঁহাকে বাধা দিয়া) চুপ করুন—তখন থেকে বাজে বক-বক করছেন আপনি! জানবেন—আমারও ধৈর্য্যের একটা সীমা আছে! (মিসেস সেনকে) হ্যাঁ, কি বলেছিল সে?

রমা : (ভীতস্বরে) মানে—বলেছিল, লোকটার বয়স অল্প—তার ওপর মদ বড্ড বেশি খায়, বিয়ে হলে কারুরই ভাল হত না—

তিনকড়ি : লোকটা তাকে টাকাকড়ি দিত না?

রমা : হ্যাঁ, আগে দিত, কিন্তু পরে নিতে রাজী হয়নি—

তিনকড়ি : কেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন?

রমা : হ্যাঁ, করেছিলাম। কিন্তু উত্তরে যা বলেছিল, তা মোটেই বিশ্বাস করা যায় না।

তিনকড়ি : আপনি বিশ্বাস করেছেন কি না, তা আমি জিজ্ঞেস করিনি। সে কি বলেছিল তাই বলুন। কেন সে ঐ লোকটার কাছ থেকে টাকা নিতে রাজী হয়নি?

রমা : বলছি তো, যা বলেছিল তা মিথ্যে! দেখেছেন কখনও—ঐ টাইপের মেয়েরা টাকা দিতে এলে নিচ্ছে না!

তিনকড়ি : (অত্যন্ত রূঢ়স্বরে) দেখুন, এই টাইপের খথা বলছেন যত, কেস তত খারাপ হচ্ছে! যা জিজ্ঞেস করছি, তাই বলুন। কেন মেয়েটি টাকা নিতে রাজী হয়নি?

রমা : ছেলেটা নাকি একদিন মদের ঘোরে বলেছিল—টাকাটা তার নিজের নয়!

তিনকড়ি : তবে কার?

রমা : চুরির—

তিনকড়ি : তাহলে দেখুন, চুরির টাকা নেবে না বলেই সে আপনাদের কাছে গিয়েছিল—

রমা : কিন্তু বুঝতে পারছেন না, প্রথমে সে এক রকম বললে, তারপর আর এক রকম। প্রথমটা যদি মিথ্যে হতে পারে তো পরেরটাই বা হবে না কেন?

তিনকড়ি : কিন্তু ধরুন ব্যাপারটা সত্যি—ছেলেটা চুরির টাকাই এনে দিত। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে বুঝতে পারছেন? ছেলেটা যাতে বিপদে না পড়ে, সেই জন্যেই মেয়েটি আপনাদের সমিতিতে গিয়েছিল।

রমা : হয়তো তাই। কিন্তু ওরকম অবান্তর কথাই বা আমি ধরব কেন? আমার কাছে ব্যাপারটা সাজানো বলে মনে হয়েছিল, তাই আমি কমিটিকে দিয়ে না বলিয়েছিলাম—

তিনকড়ি : ও, তাহলে মেয়েটি অ্যাসিড খেয়ে মরেছে বলে আপনার কোন দুঃখ নেই?

রমা : দুঃখ থাকবে না কেন? ওভাবে কেউ মরেছে শুনলে সকলেরই দুঃখ হয়—কিন্তু তার জন্যে আমি কোন দোষে দোষী নই।

তিনকড়ি : দোষটা তাহলে কার?

রমা : প্রথমত তার নিজের—

শীলা : কি করে হল মা? একবার চাকরি খেল বাবা, আর একবার আমি—আর দোষটা হল তার?

রমা : (শীলার খথা কানে না তুলিয়া) আরে—দোষ সেই ছেলেটার! মেয়েটা যা বলেছিল, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে ঐ রকম অকর্মা মাতালের শাস্তি হওয়াই উচিত। মেয়েটার আত্মহত্যার জন্যে যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তবে দায়ী করুন তাকে, দায়িত্ব তার।

তিনকড়ি : তাহলে আপনি বলছেন, যদি মেয়েটার কথা সত্যি হয়, যদি ছেলেটা চুরির পয়সা—

রমা : হ্যাঁ, যদি হয়। কিন্তু তা তো নয়! তখন থেকে তো বলছি, কথাটা মিথ্যে—

তিনকড়ি : কিন্তু যদি কথাটা মিথ্যে না হয়—

রমা : (ধৈর্যচ্যুত হইয়া) তাহলে বলছি তো ছেলেটা দায়ী। ছেলেটার জন্যেই মেয়েটার ঐ অবস্থা। আর ঐ অবস্থায় পড়েছিল বলেই সে আমাদের কাছে এসেছিল, নইলে আসত না—

তিনকড়ি : তাহলে যত দায় ঐ ছেলেটির — কি বলেন?

রমা : ধরে তাকে এমন শাস্তি দিন যাতে চিরকাল মনে থাকে—

সীলা : (হঠাৎ শঙ্কিত হইয়া) মা—কি বলছ কি!

চন্দ্রমাধব : শীলা!

শীলা : কিন্তু বাবা, তুমি বুঝতে পারছ না—

রমা : (বাধা দিয়া) দেখ শীলা, চুপ করে থাকতে পারিস তো থাক, নয়তো শুতে যা! (তিনকড়ির দিকে ফিরিয়া) আশ্চর্য, আপনি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে রইলেন? এখানে সময় নষ্ট করে লাভটা কি? তারচেয়ে বরং ছেলেটাকে ধরবার চেষ্টা করুন, আর যদি ধরতে পারেন, তো কোর্টে উঠিয়ে দিন। সেটাই আপনার ডিউটি।

তিনকড়ি : আপনার কিচ্ছু ভাবনা নেই মিসেস সেন, আমার ডিউটি আমি ঠিকই করব। (হাতঘড়ি দেখিতে দেখিতে) তাহলে বলছেন—রেখে-ঢেকে কোন লাভ নেই, সোজা কোর্টে উঠিয়ে দেওয়াটাই ঠিক—

রমা : নিশ্চয়, আপনার ডিউটিই তো তাই! তাহলে এখন আসুন— নমস্কার—(হাত তুলিলেন)

তিনকড়ি : কিন্তু আমাকে তো এখন এখানেই থাকতে হবে মিসেস সেন—

রমা : এখানেই থাকতে হবে?—কেন?

তিনকড়ি : ঐ যে আপনি বললেন, আমার ডিউটি—

শীলা : (ভীতস্বরে) মা!

রমা : (এতক্ষণে বুঝিতে পারিয়া) কিন্তু—মানে, না কখনো না! এ কি বলছেন আপনি—(চোখ তুলিতে স্বামীর সহিত তাঁহার দৃষ্টি-বিনিময় হইল। উভয়েরই শঙ্কিত দৃষ্টি।)

চন্দ্রমাধব : (ভীতস্বরে) কিন্তু তিনকড়িবাবু—মানে আপনি বলতে চান—মানে—তাপস—

তিনকড়ি : ধরুন যদি তাপসবাবুই হন, তাহলে করতে যে কি হবে তা তো উনি বলেই দিয়েছেন—

রমা : (উত্তেজিত স্বরে) না, কখনো না, — তাপস হতেই পারে না— আপনি মিথ্যে কথা বলেছেন—বুঝলেন, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না—

শীলা : তখন যদি আমার কথা শুনতে মা, কথা যদি না বাড়াতে…

(তিনকড়িবাবু হাত তুলিয়া সকলকে চুপ করিতে বলিলেন। সদর দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। সকলে ঘরের দরজার দিকে চাহিলেন। দেখা গেল তাপস প্রবেশ করিতেছে, তাহার মুখ-চোখ শুকাইয়া গিয়াছে। ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল সকলের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি তাহার মুখের উপর নিবদ্ধ। পর্দাও এই সঙ্গে নামিয়া আসিল।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *