তৃতীয় আপত্তি

তৃতীয় আপত্তি।

কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, বহুবিবাহ প্রথা রহিত হইলে, ভঙ্গ কুলীনদিগের সর্ব্বনাশ। এক ব্যক্তি অনেক বিবাহ করিতে না পারিলে, তাঁহাদের কৌলীন্যমর্য্যাদার সমূলে উচ্ছেদ ঘটিবেক। এই আপত্তির বলাবল বিবেচনা করিতে হইলে, ভঙ্গকুলীনের কুল, চরিত্র প্রভৃতির পরিচয় প্রদান আবশ্যক।

পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, বংশজকন্যা বিবাহ করিলে, কুলীনের কুলক্ষয় হয়, এজন্য কুলীনেরা বংশজকন্যার পাণিগ্রহণে পরাঙ্মুখ থাকেন। এ দিকে, বংশজদিগের নিতান্ত বাসনা, কুলীনে কন্যাদান করিয়া বংশের গৌরববৃদ্ধি করেন। কিন্তু সে বাসনা অনায়াসে সম্পন্ন হইবার নহে। যাঁহারা বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন, তাদৃশ বংশজেরাই সেই সৌভাগ্যলাভে অধিকারী। যে কুলীনের অনেক সন্তান থাকে, এবং অর্থলোভ সাতিশয় প্রবল হয়, তিনি, অর্থলাভে চরিতার্থ হইয়া, বংশজকন্যার সহিত পুত্রের বিবাহ দেন। এই বিবাহ দ্বারা কেবল ঐ পুত্রের কুলক্ষয় হয়, তাঁহার নিজের বা অন্যান্য পুত্রের কুলমর্য্যাদার কোনও ব্যতিক্রম ঘটে না।

এইরূপে, যে সকল কুলীনসন্তান, বংশজকন্যা বিবাহ করিয়া, কুলভ্রষ্ট হয়েন, তাঁহারা স্বকৃতভঙ্গ কুলীন বলিয়া উল্লিখিত হইয়া থাকেন। ঈদৃশ ব্যক্তির অতঃপর বংশজকন্যা বিবাহে আর আপত্তি থাকে না। কুলভঙ্গ করিয়া কুলীনকে কন্যাদান করা বহুব্যয়সাধ্য, এজন্য সকল বংশজের ভাগ্যে সে সৌভাগ্য ঘটিয়া উঠে না। কিন্তু স্বকৃতভঙ্গ কুলীনেরা কিঞ্চিৎ পাইলেই তাঁহাদিগকে চরিতার্থ করিতে প্রস্তুত আছেন। এই সুযোেগ দেখিয়া, বংশজেরা, কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া, স্বকৃতভঙ্গকে কন্যাদান করিতে আরম্ভ করেন। বিবাহিতা স্ত্রীর কোনও ভার লইতে হইবেক না, অথচ আপাততঃ কিঞ্চিৎ লাভ হইতেছে, এই ভাবিয়া স্বকৃতভঙ্গেরাও বংশজদিগকে উদ্ধার করিতে বিমুখ হয়েন না; এইরূপে, কিঞ্চিৎ লাভলোভে, বংশজকন্যাবিবাহকরা স্বকৃতভঙ্গের প্রকৃত ব্যবসায় হইয়া উঠে।

এতদ্ভিন্ন, ভঙ্গকুলীনদের মধ্যে এই নিয়ম হইয়াছে, অন্ততঃ স্বসমান পর্য্যায়ের ব্যক্তিদিগকে কন্যাদান করিতে হইবেক, অর্থাৎ স্বকৃতভঙ্গের কন্যা স্বকৃতপাত্রে দানকরা আবশ্যক। তদনুসারে, যে সকল স্বকৃতভঙ্গের অবিবাহিতা কন্যা থাকে, তাঁহারাও কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া, স্বকৃতভঙ্গকে কন্যাদান করেন। স্বকৃতভঙ্গের পুত্র, পৌত্র প্রভৃতির পক্ষেও স্বকৃতভঙ্গ পাত্রে কন্যাদান করা শ্লাঘার বিষয়; এজন্য তাঁহারাও, সবিশেষ যত্ন করিয়া, স্বকৃতভঙ্গ পাত্রে কন্যাদান করিয়া থাকেন।

স্বকৃতভঙ্গ কুলীন এইরূপে ক্রমে ক্রমে অনেক বিবাহ করেন। স্বকৃতভঙ্গেয় পুত্রেরা এ বিষয়ে স্বকৃতভঙ্গ অপেক্ষা নিতান্ত নিকৃষ্ট নহেন। তৃতীয় পুৰুষ অবধি বিবাহের সংখ্যা ন্যূন হইতে আরম্ভ হয়। পূর্ব্বে, বংশজকন্যা গ্রহণ করিলে, কুলীন এককালে কুলভ্রষ্ট ও বংশজভাবাপন্ন হইয়া, হেয় ও শ্রদ্ধেয় হইতেন; ইদানীং, পাঁচপুরুষ পর্য্যন্ত, কুলীন বলিয়া গণ্য ও মান্য হইয়া থাকেন।

যে সকল হতভাগা কন্যা স্বকৃতভঙ্গ অথবা দুপুরুষিয়া পাত্রে অর্পিতা হয়েন, তাঁহারা যাবজ্জীবন পিত্রালয়ে বাস করেন। বিবাহকর্ত্তা মহাপুরুষেরা, কিঞ্চিৎ দক্ষিণা পাইয়া, কন্যাকর্ত্তার কুলরক্ষা অথবা বংশের গৌরববৃদ্ধি করেন, এইমাত্র। সিদ্ধান্ত করা আছে, বিবাহ- কর্ত্তাকে বিবাহিতা স্ত্রীর তত্ত্বাবধানের, অথবা ভরণপোষণের, ভারবহন করিতে হইবেক না। সুতরাং কুলীনমহিলারা, নামমাত্রে বিবাহিতা হইয়া, বিধবা কন্যার ন্যায়, যাবজ্জীবন, পিত্রালয়ে কালযাপন করেন। স্বামিসহবাসসৌভাগ্য বিধাতা তাঁহাদের অদৃষ্টে লিখেন নাই; এবং তাঁহারাও সে প্রত্যাশা করেন না। কন্যাপক্ষীয়েরা সবিশেষ চেষ্টা পাইলে, কুলীন জামাতা শ্বশুরালয়ে আসিয়া দুই চারি দিন অবস্থিতি করেন, কিন্তু সেবা ও বিদায়ের ত্রুটি হইলে, এ জন্মে আর শ্বশুরালয়ে পদার্পণ করেন না।

কোনও কারণে কুলীনমহিলার পর্ভসঞ্চার হইলে, তাহার পরি- পাকার্থে, কন্যাপক্ষীয়দিগকে ত্রিবিধ উপায় অবলম্বন করিতে হয়। প্রথম, সবিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিয়া, জামাতার আনয়ন। তিনি আসিয়া, দুই এক দিন শ্বশুরালয়ে অবস্থিতি করিয়া, প্রস্থান করেন। ঐ গর্ভ তৎসহযোগসম্ভুত বলিয়া পরিগণিত হয়। দ্বিতীয়, জামাতার আনয়নে কৃতকার্য্য হইতে না পারিলে, ব্যভিচারসহচরী ভ্রূণহত্যাদেবীর আরাধনা। এ অবস্থায়, এতদ্ব্যতিরিক্ত নিস্তারের আর পথ নাই। তৃতীয় উপায় অতি সহজ, অতি নির্দোষ ও সাতিশয় কৌতুকজনক। তাহাতে অর্থব্যয়ও নাই, এবং ভ্রূণহত্যাদেবীর উপাসনাও করিতে হয় না। কন্যার জননী, অথবা বাটীর অপর গৃহিণী, একটি ছেলে কোলে করিয়া, পাড়ায় বেড়াইতে যান, এবং একে একে প্রতিবেশীদিগের বাটীতে গিয়া, দেখ মা, দেখ বোন, অথবা দেখ্ বাছা, এইরূপ সম্ভাষণ করিয়া, কথা প্রসঙ্গে বলিতে আরম্ভ করেন, অনেক দিনের পর কাল রাত্রিতে জামাই আসিয়াছিলেন। হঠাৎ আসিলেন, রাত্রিকাল, কোথা কি পাব; ভাল করিয়া খাওয়াতে পারি নাই; অনেক বলিলাম, এক বেলা থাকিয়া, খাওয়া দাওয়া করিয়া যাও; তিনি কিছুতেই রহিলেন না; বলিলেন, আজ কোনও মতে থাকিতে পারি না। সন্ধ্যার পরেই অমুক গ্রামের মজুমদারের বাটীতে একটা বিবাহ করিতে হইবেক। পরে, অমুক দিন, অমুক গ্রামের হালদারদের বাটীতেও বিবাহের কথা আছে, সেখানেও যাইতে হইবেক। যদি সুবিধা হয়, আসিবার সময় এই দিক হইয়া যাইব। এই বলিয়া ভোর ভোর চলিয়া গেলেন। স্বর্ণকে বলিয়াছিলাম, ত্রিপুরা ও কামিনীকে ডাকিয়া আন্, তারা জামায়ের সঙ্গে খানিক আমোদ আহলাদ করিবে। একলা যেতে পারিব না বলিয়া, ছুঁড়ী কোনও মতেই এল না। এই বলিয়া, সেই দুই কন্যার দিকে চাহিয়া, বলিলেন, এবার জামাই এলে, মা তোরা যাস্ ইত্যাদি। এইরূপে পাড়ার বাৰ্টী বাড়ী বেড়াইয়া জামাতার আগমনবার্তা কীর্ত্তন করেন। পরে স্বর্ণমঞ্জরীর গর্ভসঞ্চার প্রচার হইলে, ঐ গর্ভ জামাতৃকৃত বলিয়া পরিপাক পায়।

এই সকল কুলীমহিলার পুত্র হইলে, ডাহারা দুপুরুযিয়া কুলীন বলিয়া গণনীয় ও পূজনীয় হয়। তাহাদের প্রতিপালন ও উপনয়নান্ত সংস্কার সকল মাতুলদিগকে করিতে হয়। কুলীন পিতা কখনও তাহাদের কোনও সংবাদ লয়েন না ও তত্ত্বাবধান করেন না; তবে, অন্নপ্রাশনাদি সংস্কারের সময় নিমন্ত্রণপত্র প্রেরিত হইলে, এবং কিছু লাভের আশ্বাস থাকিলে, আসিয়া আভ্যুদয়িক করিয়া যান। উপনয়নের পর, পিতার নিকট পুত্রের বড় আদর। তিনি সঙ্গতিপন্ন বংশজদিগের বাটীতে তাহার বিবাহ দিতে আরম্ভ করেন; এবং পণ, গণ প্রভৃতি দ্বারা বিলক্ষণ লাভ করিতে থাকেন। বিবাহের সময়, মাতুলদিগের কোনও কথা চলে না, ও কোনও অধিকার থাকে না। পুত্র যত দিন অল্পবয়স্ক থাকে, তত দিনই পিতার এই লাভজনক ব্যবসায় চলে। তাহার চক্ষু ফুটিলে, তাঁহার ব্যবসায় বন্ধ হইয়া যায়। তখন সে আপন ইচ্ছায় বিবাহ করিতে আরম্ভ করে, এবং এই সকল বিবাহে পণ, গণ প্রভৃতি যা পাওয়া যায়, তাহা তাহারই লাভ, পিতা তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারেন না। কন্যাসন্তান জস্মিলে, তাহার নাড়ীচ্ছেদ অবধি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্য্যন্ত যাবতীয় ক্রিয়া মাতুলদিগকেই সম্পন্ন করিতে হয়। কুলীনকন্যার বিবাহ ব্যয়সাধ্য, এজন্য পিতা এ বিবাহের সময় সে দিক দিয়া চলেন না। কুলীনভাগিনেয়ী যথাযোগ্য পাত্রে অর্পিতা না হইলে, বংশের গৌরব- হানি হয়; এজন্য, তাঁহারা, ভঙ্গকুলীনের কুলমর্য্যাদার নিয়মানুসারে, ভাগিনেয়ীদের বিবাহকার্য্য নির্ব্বাহ করেন। এই সকল কন্যারা, স্ব স্ব জননীর ন্যায় নামমাত্রে বিবাহিতা হইয়া, মাতুলালয়ে কাল- যাপন করেন।

কুলীনভগিনী ও কুলীনভাগিনেয়ীদের বড় দুর্গতি। তাহাদিগকে, পিত্রালয়ে অথবা মাতুলালয়ে থাকিয়া, পাচিকা ও পরিচারিকা উভয়ের কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে হয়। পিতা যত দিন জীবিত থাকেন, কুলীনমহিলার তত দিন নিতান্ত দুরবস্থা ঘটে না। তদীয় দেহাত্যয়ের পর, ভ্রাতারা সংসারের কর্ত্তা হইলে, তাঁহারা অতিশয় অপদস্থ হন। প্রখরা ও মুখরা ভ্রাতৃভার্য্যারা তাঁহাদের উপর, যার পর নাই, অত্যাচার করে। প্রাতঃকালে নিদ্রাভঙ্গ, রাত্রিতে নিদ্রাগমন, এ উভয়ের অন্তর্বর্ত্তী দীর্ঘ কাল, উৎকট পরিশ্রম সহকারে সংসারের সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়াও, তাঁহারা সুশীলা ভ্রাতৃভার্য্যাদের নিকট প্রতিষ্ঠালাভ করিতে পারেন না। তাঁহারা সর্ব্বদাই তাঁহাদের উপর খড়্গহস্ত। তাঁহাদের অশ্রুপাতের বিশ্রাম নাই বলিলে, বোধ হয়, অত্যুক্তিদোৰে দূষিত হইতে হয় না। অনেক সময়, লাঞ্ছনা সহ্য করিতে না পারিয়া, প্রতিবেশীদিগের বাটীতে গিয়া, অশ্রুবিসর্জন করিতে করিতে, তাঁহাৱা আপন অদৃষ্টের দোষ কীর্ত্তন ও কৌলীন্যপ্রথার গুণ কীর্ত্তন করিয়া থাকেন; এবং পৃথিবীর মধ্যে কোথাও স্থান থাকিলে চলিয়া যাইতাম, আর ও বাড়ীতে মাথা গলাইতাম না, এইরূপ বলিয়া, বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া, মনের আক্ষেপ মিটান। উত্তরসাধকের সংযোগ ঘটিলে, অনেকানেক বয়স্থা কুলীমহিলা ও কুলীনদুহিতা, যন্ত্রণাময় পিত্রালয় ও মাতুলালয় পরিত্যাগ করিয়া, বারাঙ্গনাবৃত্তিঅবলম্বন করেন।

ফলতঃ, কুলীনমহিলা ও কুলীনতনয়াদিগের যন্ত্রণার পরিসীমা নাই। যাঁহারা কখনও তাঁহাদের অবস্থা বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন, তাঁহারাই বুঝিতে পারেন, ঐ হতভাগা নারীদিগকে কত ক্লেশে কালযাপন করিতে হয়। তাঁহাদের যন্ত্রণার বিষয় চিন্তা করিলে, হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়, এবং যে হেতুতে তাঁহাদিগকে ঐ সমস্ত দুঃসহ ক্লেশ ও যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইতেছে, তা বিবেচনা করিয়া দেখিলে, মনুষ্যজাতির উপর অত্যন্ত অশ্রদ্ধা জন্মে। এক পক্ষের অমূলক অকিঞ্চিৎকর গৌরবলাভলোভ, অপর পক্ষের কিঞ্চিৎ অর্থলাভলোভ, সমস্ত অনর্থের মূলকারণ; এবং এই উভয় পক্ষ ভিন্ন দেশস্থ যাবতীয় লোকের এ বিষয়ে ঔদাস্য অবলম্বন উছার সহকারী কারণ। যাঁহাদের দোষে কুলীনকন্যাদের এই দুরবস্থা, যদি তাঁহাদের উপর সকলে অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষ প্রদর্শন করিতেন, তাহা হইলে, ক্রমে এই অসহ্য অত্যাচারের নিবারণ হইতে পারিত। অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষের কথা দূরে থাকুক, অত্যাচারকারীরা দেশস্থ লোকের নিকট, যার পর নাই, মাননীয় ও পুজনীয়। এমন স্থলে, রাজদ্বারে আবেদন ভিন্ন, কুলীনকামিনীদিগের দুরবস্থাবিমোচনের কি উপায় হইতে পারে। পৃথিবীর কোনও প্রদেশে স্ত্রীজাতির ঈদৃশী দুরবস্থা দেখিতে পাওয়া যায় না। যদি ধর্ম্ম থাকেন, রাজা বল্লালসেন ও দেবীবর ঘটক- বিশারদ নিঃসন্দেহ নরকগামী হইয়াছেন। ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশে, এবং পৃথিবীর অপরাপর প্রদেশেও বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু, তথায় বিবাহিতা নারীদিগকে, এতদ্দেশীয় কুলীনকামিনীদের মত, দুর্দশায় কালযাপন করিতে হয় না। তাহারা স্বামীর গৃহে বাস করিতে পায়, স্বামীর অবস্থানুরূপ সাচ্ছাদন পায়, এবং পর্যায়ক্রমে স্বামীর সহবাসসুখলাভ করিয়া থাকে। স্বামিগৃহবাস, স্বামিসহবাস, স্বামিদত্ত গ্রাসাচ্ছাদন কুলীনকন্যাদের স্বপ্নের অগোচর।

এ দেশের ভঙ্গকুলীনদের মত পাষণ্ড ও পাতকী ভূমণ্ডলে নাই। তাঁহারা দয়া, ধর্ম, চক্ষুলজ্জা ও লোকলজ্জায় একবারে বর্জিত। তাঁহাদের চরিত্র অতি বিচিত্র। চরিত্রবিষয়ে তাঁহাদের উপমা দিবার স্থল নাই। তাঁহারাই তাঁহাদের একমাত্র উপমাস্থল। —কোনও অতি- প্রধান ভঙ্গকুলীনকে কেহ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ঠাকুরদাদা মহাশয়! আপনি অনেক বিবাহ করিয়াছেন, সকল স্থানে যাওয়া হয় কি। তিনি অম্লানমুখে উত্তর করিলেন, যেখানে ভিজিট[১] পাই, সেই খানে যাই। —গত দুর্ভিক্ষের সময়, এক জন ভঙ্গকুলীন অনেকগুলি বিবাহ করেন। তিনি লোকের নিকট আস্ফালন করিয়াছিলেন, এই দুর্ভিক্ষে কত লোক অন্নাভাবে মারা পড়িয়াছে, কিন্তু আমি কিছুই টের পাই নাই; বিবাহ করিয়া সচ্ছন্দে দিনপাত করিয়াছি। —গ্রামে বারোয়ারিপূজার উদ্যোগ হইতেছে। পূজার উদ্যোগীরা, ঐ বিষয়ে চাঁঁদা দিবার জন্য, কোনও ভঙ্গকুলীনকে পীড়াপীড়ি করাতে, তিনি, চাঁদার টাকা সংগ্রহের জন্য, একটি বিবাহ করিলেন। —বিবাহিত স্ত্রী স্বামীর সমস্ত পরিবারের ভরণপোষণের উপযুক্ত অর্থ লইয়া গেলে, কোন ভঙ্গকুলীন, দয়া করিয়া, তাহাকে আপন আবাসে অবস্থিতি করিতে অনুমতি প্রদান করেন কিন্তু সেই অর্থ নিঃশেষ হইলেই, তাহাকে বাটী হইতে বহিস্কৃত করিয়া দেন। —পুত্রবধূর ঋতুদর্শন হইয়াছে। সে যাঁহার কন্যা, তাঁহার নিতান্ত ইচ্ছা, জামাতাকে আনাইয়া, কন্যর পুনর্বিবাহসংস্কার নির্ব্বাহ করেন। পত্র দ্বারা বৈবাহিককে আপন প্রার্থনা জানাইলেন। বৈবাহিক পত্রোত্তৱে অধিক টাকার দাওয়া করিলেন। কন্যার পিতা তত টাকা দিতে অনিচ্ছু বা অসমর্থ হওয়াতে, তিনি পুত্রকে শ্বশুরালয়ে খাইতে দিলেন না; সুতরাং, পুত্রবধূর পুনর্বিবাহসংস্কার এ জন্মের মত স্থগিত রহিল। —বহুকাল স্বামীর মুখ দেখেন নাই; তথাপি কোনও ভঙ্গকুলীনের ভার্য্যা ভাগ্যক্রমে গর্ভবতী হইয়াছিলেন। ব্যভিচারিণী কন্যাকে গৃহে রাখিলে, জ্ঞাতিবর্গের নিকট অপদস্থ ও সমাজচ্যুত হইতে হয়, এজন্য, তাহাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করা পরামর্শ স্থির হইলে, তাহার হিতৈষী আত্মীয়, এই সর্ব্বনাশ নিবারণের অন্য কোনও উপায় করিতে না পারিয়া, অনেক চেষ্টা করিয়া, তদীয় স্বামীকে আনাইলেন। এই মহাপুরুষ, অর্থলাভে চরিতার্থ হইয়া, সর্ব্বসমক্ষে স্বীকার করিলেন, রত্নমঞ্জরীর গর্ভ আমার সহযোগে সম্ভূত হইয়াছে।

ভঙ্গকুলীনের চরিত্রবিষয়ে এ স্থলে একটি অপূর্ব্ব উপাখ্যান কীর্ত্তিত হইতেছে। কোনও ব্যক্তি মধ্যাহ্নকালে বাটীর মধ্যে আহার করিতে গেলেন; দেখিলেন, যেখানে আহারের স্থান হইয়াছে, তথায় দুটি অপরিচিত স্ত্রীলোক বসিয়া আছেন। একটির বয়ঃক্রম প্রায় ৬০ বৎসর, দ্বিতীয়টির বয়ঃক্রম ১৮।১৯ বৎসর। তাঁহাদের পরিচ্ছদ দুরবস্থার একশেষ প্রদর্শন করিতেছে; তাঁহাদের মুখে বিষাদ ও হতাশতার সম্পূর্ণ লক্ষণ সুস্পষ্ট লক্ষিত হইতেছে। ঐ ব্যক্তি স্বীয় জননীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা ইঁহারা কে, কি জন্যে এখানে বসিয়া আছেন। তিনি বৃদ্ধার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন,ইনি ভট্টরাজের স্ত্রী, এবং অল্পবয়স্কাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, ইনি তাঁহার কন্যা। ইঁহারা তোমার কাছে আপনাদের দুঃখের পরিচয় দিবেন বলিয়া বসিয়া আছেন।

ভট্টরাজ দুপুরুষিয়া ভঙ্গকুলীন; ৫।৬ টি বিবাহ করিয়াছেন। তিনি ঐ ব্যক্তির নিকট মাসিক বৃত্তি পান; এজন্য, তাঁহার যথেষ্ট খাতির রাখেন। তাঁহার ভগিনী, ভাগিনেয় ও ভাগিনেয়ীরা তাঁহার বাচীতে থাকে; তাঁহার কোনও স্ত্রীকে কেহ কখনও তাঁহার বাটীতে অবস্থিতি করিতে দেখেন নাই।

সেই দুই স্ত্রীলোকের আকার ও পরিচ্ছদ দেখিয়া, ঐ ব্যক্তির অন্তঃকরণে অতিশয় দুঃখ উপস্থিত হইল। তিনি, আহার বন্ধ করিয়া, তাঁহাদের উপাখ্যান শুনিতে বসিলেন। বৃদ্ধা কহিলেন, “আমি ভট্টরাজের ভার্য্যা; এটি তাঁর কন্যা, আমার গর্ভে জন্মিয়াছে। আমি পিত্রালয়ে থাকিতাম। কিছু দিন হইল, আমার পুত্র কহিলেন, মা আমি তোমাদের দুজনকে অন্ন বস্ত্র দিতে পারি না। আমি কহিলাম, বাছা বল কি, আমি তোমার মা, ও তোমার ভগিনী, তুমি অন্ন না দিলে আমরা কোথায় যাইব। তুমি এক জনকে অন্ন দিবে, আর এক জন কোথায় যাইবে; পৃথিবীতে অন্ন দিবার লোক আর কে আছে। এই কথা শুনিয়া পুত্র কহিলেন, তুমি মা, তোমায় অন্ন বস্ত্র যেরূপে পারি দিব, উহার ভার আমি আর লইতে পারি না। আমি রাগ করিয়া বলিলাম, তুমি কি উহাকে বেশ্যা হইতে বল। পুত্র কহিলেন, আমি তাহা জানি না, তুমি উহার বন্দোবস্ত কর। এই বিষয় লইয়া, পুত্রের সহিত আমার বিষম মনান্তর ঘটিয়া উঠিল, এবং অবশেষে আমায় কন্যাসহিত বাটী হইতে বহির্গত হইতে হইল।

কিছু দিন পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম, আমার এক মাস্তত ভগিনীর বাটীতে একটি পাচিকার প্রয়োজন আছে। আমরা উভয়ে ঐ পাচিকার কর্ম্ম করিব, মনে মনে এই স্থির করিয়া, তথায় উপস্থিত হইলাম। কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে, ২।৪ দিন পূর্ব্বে, তাঁহারা পাচিকা নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তখন নিত্যন্ত হতাশ্বাস হইয়া, কি করি, কোথায় যাই, এই চিন্তা করিতে লাগিলাম। অমুক গ্রামে আমার স্বামীর এক সংসার আছে, তাহার গর্ভজাত সন্তান বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন, এবং তাঁহার দয়া ধর্ম্মও আছে। ভাবিলাম, যদিও আমি বিমাতা, এ বৈমাত্রেয় ভগিনী; কিন্তু,তাঁহার শরণাগত হইয়া দুঃখ জানাইলে, অবশ্য দয়া করিতে পারেন। এই ভাবিয়া, অবশেৰে তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইলাম, এবং সবিশেষ সমস্ত কহিয়া, সজলনয়নে, তাঁহার হস্তে ধরিয়া বলিলাম। বাবা তুমি দয়া না করিলে, আমাদের আর গতি নাই।

আমার কাতরতা দর্শনে, সপত্নীপুত্র হইয়াও, তিনি যথেষ্ট স্নেহ ও দয়া প্রদর্শন করিলেন, এবং কহিলেন, যত দিন তোমরা বাঁচিবে, তোমাদের ভরণপোষণ করিব। এই আশ্বাসবাক্য শ্রবণে আমি আহ্লাদে গদ্গদ হইলাম। আমার চক্ষুতে জলধারা বহিতে লাগিল। তিনি যথোচিত যত্ন করিতে লাগিলেন। কিন্তু, উহার বাটীর স্ত্রীলোকেরা সেরূপ নহেন। এ আপদ আবার কোথা হইতে উপস্থিত হইল এই বলিয়া, তাহারা, যার পর নাই, অনাদর ও অপমান করিতে লাগিল। সপত্নীপুত্র ক্রমে ক্রমে সবিশেষ সমস্ত অবগত হইলেন। কিন্তু তাহাদের অত্যাচার নিবারণ করিতে পারিলেন না। এক দিন, আমি তাঁহার নিকটে গিয়া সমুদয় বলিলাম। তিনি কহিলেন, মা আমি সমস্ত জানিতে পারিয়াছি; কিন্তু কোনও উপায় দেখিতেছি না। আপনারা কোনও স্থানে গিয়া খাকুন; মধ্যে মধ্যে, আমার নিকট লোক পাঠাইবেন; আমি আপনাদিগকে কিছু কিছু দিব।

এই রূপে নিরাশ্বাস হইয়া, কন্যা লইয়া, তথা হইতে বহির্গত হইলাম। পৃথিবী অন্ধকারময় বোধ হইতে লাগিল। অবশেষে ভাবিলাম, স্বামী বর্ত্তমান আছেন, তাঁহার নিকটে যাই, এবং দুরবস্থা জানাই, যদি তাঁহার দয়া হয়। এই স্থির করিয়া, পাঁচ সাত দিন হইল, এখানে আসিয়াছিলাম। আজ তিনি স্পষ্ট জবাব দিলেন, আমি তোমাদিগকে এখানে রাখিতে, ৰা অন্ন বস্ত্র দিতে পারিব না। অনেকে বলিল, তোমায় জানাইলে কোনও উপায় হইতে পারে, এ জন্য এখানে আসিয়া বসিয়া ছিলাম। ঐ ব্যক্তি শুনিয়া ক্রোধে ও দুঃখে অতিশয় অভিভূত হইলেন, এবং অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, তিনি, ভট্টরাজের বাটীতে গিয়া, যথোচিত ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, আপনার আচরণ দেখিয়া আমি চমৎকৃত হইয়াছি। আপনি কোন্ বিবেচনায় তাহাদিগকে বাটী হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিতেছেন। এক্ষণে, আপনি তাহাদিগকে বাটীতে রাখিবেন কি না, স্পষ্ট বলুন। ঐ ব্যক্তির ভাবভঙ্গী দেখিয়া, বৃত্তিভোগী ভট্টরাজ ভয় পাইলেন, এবং কহিলেন, তুমি বাটীতে যাও, আমি ঘরে বুঝিয়া পরে তোমার নিকটে যাইতেছি।

অপরাহ্নকালে, ভট্টরাজ ঐ ব্যক্তির নিকটে আসিয়া বলিলেন, তাহাদিগকে বাটীতে রাখা পরামর্শ স্থির; কিন্তু, তোমায়, মাস মাস তাহাদের হিসাবে আর কিছু দিতে হইবেক। ঐ ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ স্বীকার করিলেন, এবং তিন মাসের দেয় তাঁহার হস্তে দিয়া কহিলেন, এই রূপে তিন তিন মাসের টাকা আগামী দিব; এতদ্ভিন্ন, তাঁহাদের পরিধেয় বস্ত্রের ভার আমার উপর রহিল। আর কোনও ওজর করিতে না পারিয়া, নিরুপায় হইয়া, ভট্টরাজ, স্ত্রী ও কন্যা লইয়া গৃহ প্রতিগমন করিলেন। তিনি নিজে দুঃশীল লোক নহেন। কিন্তু, তাঁহার ভগিনী দুর্দ্দান্ত দস্যু, তাহার ভয়ে ও তাহার পরামর্শে, তিনি স্ত্রী ও কন্যাকে পূর্ব্বোক্ত নির্ঘাত জবাব দিয়াছিলেন। বৃত্তিদাতা ক্রুদ্ধ হইয়াছেন, এবং মাসিক আর কিছু দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন, এই কথা শুনিয়া, ভগিনীও অগত্যা সম্মত হইল। ভট্টরাজ, কখনও কখনও কোনও স্ত্রীকে আনিয়া নিকটে রাখিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে, ভগিনী খড়্গহস্ত হইয়া উঠিত। সেই কারণে, তিনি, কখনও, আপন অভিপ্রায় সম্পন্ন করিতে পারেন নাই। ভঙ্গকুলীনদিগের ভগিনী, ভাগিনেয় ও ভাগিনেয়ীরা পরিবারস্থানে পরিগণিত; স্ত্রী, পুত্র, কন্যা প্রভৃতির সহিত তাঁহাদের কোনও সংস্রব থাকে না।

যাহা হউক, ঐ ব্যক্তি, পূর্ব্বোক্ত ব্যবস্থা করিয়া দিয়া, স্থানান্তরে গেলেন, এবং যথাকালে অঙ্গীকৃত মাসিক দেয় পাঠাইতে লাগিলেন। কিছু দিন পরে, বাটীতে, গিয়া, তিনি সেই দুই হতভাগা নারীর বিষয়ে অনুসন্ধান করিয়া জার্নিলেন, ভট্টরাজ ও তাঁহার ভগিনী স্থির করিয়াছিলেন, বৃত্তিদাতার অঙ্গীকৃত নূতন মাসিক দেয় পুরাতন মাসিক বৃত্তির অন্তর্গত হইয়াছে, আর তাহা কোনও কারণে রহিত হইবার নহে; অনুসারে, ভট্টরাজ, ভগিনীর উপদেশের বশবর্ত্তী হইয়া, স্ত্রী ও কন্যাকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছেন। তাঁহারাও, গত্যন্তরবিহীন হইয়া, কোনও স্থানে গিয়া অবস্থিতি করিতেছেন। কন্যাটি সুশ্রী ও বয়স্থা, বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে, এবং জননীর সহিত সচ্ছন্দে দিনপাত করিতেছে।

এই উপাখ্যানে ভঙ্গকুলীনের যাদৃশ আচরণের পরিচয় পাওয়া যাইতেছে, অতি ইতর জাতিতেও তাদৃশ আচরণ লক্ষিত হয় না। প্রথমতঃ, এক মহাপুরুষ বৃদ্ধ মাতা ও বয়স্থা ভগিনীকে বাটী হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিলেন। পরে, তাঁহারা স্বামী ও পিতার শরণাগত হইলে, সে মহাপুরুষও তাঁহাদিগকে বাটী হইতে বঞ্চিত করিলেন। এক ব্যক্তি, দয়া করিয়া, সেই দুই দুর্ভাগার গ্রাসাচ্ছাদনের ভারবহনে অঙ্গীকৃত হইলেন, তাহাতেও স্ত্রী ও কন্যাকে বাটীতে রাখা পরামর্শসিদ্ধ হইল না। স্বামী ও উপযুক্ত পুত্রসত্ত্বে, কোনও ভদ্রগৃহে, বৃদ্ধা স্ত্রীর কদাচ এরূপ দুর্গতি ঘটে না। পিতা ও উপযুক্ত ভ্রাতা বিদ্যমান থাকিতে, কোনও ভদ্রগৃহের কন্যাকে, নিতান্ত অনাথার ন্যায়, অন্নবস্ত্রের নিমিত্ত, বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিতে হয় না। ঐ কন্যার স্বামীও বিদ্যমান আছেন। কিন্তু, তাঁহাকে এ বিষয়ে অপরাধী করিতে পারা যায় না। তিনি স্বকৃতভঙ্গ কুলীন। যাহা হউক, আশ্চর্যের বিষয় এই, ঈদৃশ দোষে দুষিত হইয়াও, ভট্টরাজ ও তাঁহার উপযুক্ত পুত্র লোকসমাজে হেয় বা অশ্রদ্ধেয় হইলেন না।

ভঙ্গকুলীনের কুল, চরিত্র প্রভৃতির পরিচয় প্রদত্ত হইল। এক্ষণে, সকলে বিবেচনা করিয়া দেখুন, এক ব্যক্তি অনেক বিবাহ করিতে না পারিলে, ঈদৃশ কুলীনের অপকার বা মানহানি ঘটিবেক, এই অনুরোধে, বহুবিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকা উচিত ও আবশ্যক কি না। প্রথমতঃ, মেলবন্ধনের পূর্ব্বে, তাঁহাদের পুরাতন কুল এককালে নির্ম্মূল হইয়া গিয়াছে; তৎপরে, বংশজকন্যাপরিণয় দ্বারা, পুনরায়, তদীয় কপোল- কম্পিত নূতন কুলের লোপাপত্তি হইয়াছে। এইরূপে, দুই বার যাঁহাদের কুলোচ্ছেদ ঘটিয়াছে, তাঁহাদিগকে কুলীন বলিয়া গণ্য করিবার এবং তদীয় শশরিষাণসদৃশ কুলমর্য্যাদার আদর করিবার কোনও কারণ বা প্রয়োজন লক্ষিত হইতেছে না। তাঁহাদের অবৈধ, নৃশংস, লজ্জাকর আচরণ দ্বারা সংসারে যেরূপ গরীয়সী অনিষ্টপরম্পরা ঘটিতেছে, তাহাতে তাঁহাদিগকে মনুষ্য বলিয়া গণনা করা উচিত নয়। বোর হয়, এক উদ্যমে তাঁহাদের সমূলে উচ্ছেদ করিলে, অধর্ম্মগ্রন্ত হইতে হয় না। সে বিবেচনায়, তদীয় অকিঞ্চিৎকর কপোলকল্পিত কুলমর্য্যাদা হানি অতি সামান্য কথা। যাহা হউক, তাঁহাদের কুলক্ষয় হইয়াছে, সুতরাং তাঁহাৱা কুলীন নহেন; তাঁহারা কুলীন নহেন, সুতরাং তাঁহাদের কৌলীন্যমর্য্যাদা নাই; তাঁহাদের কৌলীন্যমর্য্যাদা নাই, সুতরাং বহুবিবাহপ্রথা নিবারণ দ্বারা কৌলীন্যমর্য্যাদার উচ্ছেদ- সম্ভাবনাও নাই।

এস্থলে ইহা উল্লেখ করা আবশ্যক, এরূপ কতকগুলি ভঙ্গকুলীন আছেন, যে বিবাহব্যবসায়ে তাহাদের যৎপরোনাস্তি বিদ্বেষ। তাঁহারা বিবাহব্যবসায়ীদিগকে অতিশয় হেয়জ্ঞান করেন, নিজে প্রাণান্তেও একাধিক বিবাহ করিতে সম্মত নহেন, এবং যাহাতে এই কুৎসিত প্রথা রহিত হইয়া যায়, তদ্বিষয়েও চেষ্টা করিয়া থাকেন। উভয়বিধ ভঙ্গকুলীনের আচরণ পরস্পর এত বিভিন্ন, যে তঁহাদিগকে এক জাতি বা এক সম্প্রদায়ের লোক বলিয়া, কোনও ক্রমে প্রতীতি জন্মে ন। দুর্ভাগ্যক্রমে, উক্তরূপ ভঙ্গকুলীনের সংখ্যা অধিক নয়। যাহা হউক, তাঁঁহাদের ব্যবহার দ্বারা বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হইতেছে, বিবাহ- ব্যবসায় পরিত্যাগ করা ভঙ্গকুলীনের পক্ষে নিতান্ত দুরূহ বা অসাধ্য ব্যাপার নহে।

  1. ডাক্তারেরা চিকিৎসা করিতে গেলে, তাঁহাদিগকে যাহা দিতে হত, এ দেশের সাধারণ লোকে তাকে ভিজিট্ (Visit} রলে।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *