তুরতুরির ডিম
বিখ্যাত বিজ্ঞানী বিরাট বিশ্বাস ব্যাবিলনে বাঁদর সম্পর্কিত একটি সেমিনারে বক্তৃতা সেরে বাড়ি ফিরে দেখলেন তাঁর স্ত্রী ব্যাজার মুখে চুপচাপ! বিরাট বিশ্বাস বললেন কিগো, দেখবে না, ব্যাবিলন থেকে কী এনেছি, হাড়ের তৈরি পিঠ চুলকোবার হাত, খেজুর বিচির মালা, ইউফ্রেতিসের জল… মিসেস বিশ্বাস ও-সবে কান না দিয়ে বললেন, পঞ্চু আজও আসেনি। ডাঃ বিশ্বাস বললেন, সে কী? আমি ব্যাবিলন থেকে ফিরে এলাম, অথচ পঞ্চু বর্ধমান থেকে এখনো ফিরল না? পঞ্চু আর বিশ্বাস একই দিনে রওনা হয়েছিল। পঞ্চু বলেছিল দুদিনের জন্য যাচ্ছে। অথচ দশ দিন হয়ে গেল…। ডাঃ বিশ্বাস জানেন পঞ্চু না এলে তাঁর স্ত্রীর ব্লাড প্রেশার নর্মাল হবে না, হার্ট বিট-এ গণ্ডগোল থাকবে। বিশ্বাস বললেন, চিন্তা কোরো না, আমি টেলিগ্রাম করছি।
টেলিগ্রামে কী হবে? কবে পাবে তার ঠিক নেই। মিসেস বললেন।
ঠিকই তো, ঠিকই তো। আমি নিজেই যাব। ডাঃ বিশ্বাস জানেন পঞ্চু ওঁর সংসারের বোন-ম্যারো। ওঁর সংসারের লিভার কিডনি হার্ট ও না হলে সংসার অচল। বিশ্বাস ভাবলেন ওর গ্রামে গিয়ে ওকে ধরে নিয়ে আসবেন। এর আগেও পঞ্চু দেশে গেছে। দু-দিনের নাম করেই যায় ও, তিন দিনের মধ্যেই চলে আসে। গত দশ বছরে একবারই মাত্র চারদিন হয়েছে। কিন্তু দশদিন কখনোই হয়নি।
মিসেস বিশ্বাস বললেন, কবে যাবে, আজই?
–আজ কী করে হবে, কাল যাব।
–কাল? দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ ঠিক আছে, কালই যাও। এবার দেখাও কী এনেছ।
–এই দ্যাখো কী সুন্দর আয়না। ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের তলায় বিক্রি হচ্ছিল…।
–এই তোমার সুন্দর? এ জিনিস তো গড়িয়াহাটের ফুটপাথে ঢেলে বিক্রি হয়, লে লো বাবু পাঁচটাকার মাল।
–এই দেখ ইউফ্রেতিসের জল।
–এই জলে আমার কী, বরং গোলাপজল হলেও কিছু কাজে আসত।
–এই দ্যাখো আখরোট গাছের ছাল।
–কী হবে।
–খুব ভালো জোলাপ।
–তুমি খাওগে। এসব চাই না। আমার পঞ্চুকে এনে দাও।
পঞ্চু বলে বটে বর্ধমান, কিন্তু ওর ঠিকানাটা খুবই জটিল। গ্রাম নসিবপুর ভায়া আদ্রাহাটি। আদ্রাহাটি যেতে গেলে বর্ধমান থেকে বাসে চড়তে হবে। ডাঃ বিশ্বাস ভাবলেন বহুদিন বাংলার গ্রাম দেখা হয়নি। এক ঠাণ্ডা ঘর থেকে এক ঠাণ্ডা ঘরেই তাঁর যাতায়াত। বহুদিন ঘাস মাড়ানো হয়নি, কাশফুল দেখা হয়নি। স্যাণ্ডউইচ, হটডগ, পেস্ট্রি, হ্যামবার্গার খাওয়া জিভ বহুদিন মুড়ি বেগুনির স্বাদ পায়নি। মিহিদানা সীতাভোগ খাওয়া হয়নি বহুদিন। ধানের গোলা দেখা হয়নি, ব্যাঙের ডাক শোনা হয়নি। বাঁদর নিয়ে বক্তৃতা করে এলেন, অথচ বহুদিন বাংলার বৃক্ষশালায় বাঙালি বাঁদরের অনুপম জিমনাস্টিক দেখা হয়নি। ডাঃ বিশ্বাস ভাবলেন পঞ্চুর খোঁজে নসিবপুর যাওয়াটা একটা রমণীয় এক্সকারশনই হবে। এক ধরনের রিলিফ। পরদিনই রওনা হলেন ডাঃ বিশ্বাস। মিসেস বিশ্বাস এক বোতল ফুটোন জল এবং টিফিন ক্যারিয়ারে স্যাণ্ডউইচ দিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে বিদায় দিলেন। বিশ্বাস এইসব স্যাণ্ডউইচ ট্যাণ্ডউইচ নিতে চাননি। ভেবেছিলেন ট্রেনে ঝালমুড়ি খাবেন। বাঁশের ঝুড়িতে লাল শালুতে জড়ানো সিঙাড়া-ভেজিটেবিলের চপ খাবেন, তাই ট্যাক্সিতে উঠে, ট্যাক্সিটা মিসেসের চোখের আড়াল হতেই স্যাণ্ডউইচগুলো রাস্তায় ফেলে দিলেন।
বর্ধমানে নেমে বিশ্বাস দেখলেন আদ্রাহাটির বাস তিন ঘন্টার পর। একজন বলল গলসী নেমে আদ্রাহাটির বাস পাওয়া যেতে পারে। ডাঃ বিশ্বাস তাই করলেন। ঝরঝরিয়া বাসের ঝাঁকুনিতে ট্রেনে খাওয়া ঝালমুড়ির ঝংকার। ছাগলছানা, মুরগি ও নোংরা পোশাকের মানুষজনের গাদাগাদিতে কোণঠাসা বিজ্ঞানী হ্যাণ্ডেল ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছেন, বাংলার সবুজ শ্যামলিমা জানালার পাশ দিয়ে হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে, ডাঃ বিশ্বাস দেখতে পাচ্ছেন না। শেষ অবধি আদ্রাহাটিতে যখন নামলেন, ডাঃ বিশ্বাস একটি ঠাণ্ডা ঘর, রিল্যাকসনের গদি, ও একটি নীল আলোর অভাব বোধ করলেন। আদ্রাহাটিতে নেমে শুনলেন নসিবপুর আট কিলোমিটার দূর। দামোদরের পাশ দিয়ে রাস্তা আছে, ভ্যান রিক্সা সুবাসগঞ্জ পর্যন্ত যাবে। ওখান থেকে পায়ে হাঁটা পথে পাঁচ কিলোমিটার।
ডাঃ বিশ্বাসের বুক ধুক্ধুক্ করে উঠল। পশ্চিমবাংলার কোণে কোণে পাকা রাস্তা হয়ে গেছে, এবং তাতে বাস চলাচল করে, এরকম একটা ধারণা ছিল ডাঃ বিশ্বাসের। সেই বিশ্বাসে চিড় ধরল। বর্ধমান একটা অতি উন্নত জেলা। তাতেই এই! বিশ্বাস হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে ডাঃ বিশ্বাস পথ চলতে লাগলেন। কাশফুল টাশফুল দু-চার ঝাক এখানে ওখানে নড়ছে, নডুক। দু-চার পিস প্রজাপতি উড়ছে, উড়ুক। দামোদরের বালি ছুঁয়ে হাওয়া আসছে, আসুক।
ডাঃ বিশ্বাস যখন নসিবপুরে পৌঁছলেন তার অনেক আগেই সূর্য দামোদরের ওপাড়ে গাছগাছালির তলায় সেঁধিয়ে গেছে। মশার ঝাঁক ডাঃ বিশ্বাসের মাথার ওপর একটা ছোটখাটো স্তম্ভ বানিয়ে ফেলেছে। ভনভন করছে, ইচ্ছেমতো কামড়াচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে শেষ পর্যন্ত যখন পঞ্চুদের বাড়িতে পৌঁছলেন ডাঃ বিশ্বাস, তাঁর আর কথা কইবার শক্তি নেই।
এটাই কি পঞ্চুর বাড়ি?
একজন থুরথুড়ে বুড়ি বললে, ‘বটে এজ্ঞে। কিন্তু আপনি কে বাবা? দারোগা?’
ডাঃ বিশ্বাস শুধু বলতে পারলেন পঞ্চু আমার বাড়িতেই কাজ করে। এটুকু বলেই দাওয়ায় পাতা তালপাতার তালাইয়ের ওপর শুয়ে পড়লেন। পঞ্চুর ঠাকুরমা তালাপাতার পাখায় বাতাস করতে থাকল। বাইরে ব্যাঙ ডাকছে, ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। এমনকী যা হয় না, দাঁড়কাকও ডেকে উঠল। ডাঃ বিশ্বাসের সব ‘কাকস্য পরিবেদনা’ হয়ে ষাচ্ছে। একটু পরে শেয়াল ডাকল। শেয়ালের ডাকে ভয় পেয়ে ডাঃ বিশ্বাস ধড়ফড়িয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় ডাকছে? পঞ্চুর ঠাকুরমা বলল, জঙ্গলে। পঞ্চুর মাও ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়েছে কাছে। আকাশে একফালি চাঁদ। জোনাকিগুলো বায়োলুমিনিসেন্স দিচ্ছে। সবই ননসেন্স লাগল ডাঃ বিশ্বাসের। উনি উঠে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পঞ্চু কোথায়, ওকে নিতেই তো এসেছি।’
পডুর ঠাকুরমা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার লাতিটাকে ওরা নিয়ে চলে গেল।
ওরা মানে?
ওরা মানে অন্য গেরোর লোক।
গেরো মানে?
গেরো মানে গেরো, আকাশে আছে না।
আরও দু-চারজন জড়ো হয়েছে পাড়া প্রতিবেশী। একটি ছেলে বলল, আকাশে সব গ্রহ নক্ষত্র আছে ন্য, সেরকম অন্য এক গ্রহর লোকজন এয়েছেন, তেনারা নে গেল।
–গাজা খেয়েছ?
–গাঁজার চাষ একদম বন্ধ। পুলিস প্যাঁদায়।
–তবে এসব কী বলছ?
–সত্যি বলছি, মা কালীর কিরে।
–কী করে চিনলে অন্য গ্রহর লোক?
–টি.ভি.র দ্বারা চিনলাম। আমাদের গাঁয়ে দুটা টি.ভি. আছে। বাবুল কোজরের আর গণেশ গড়াইয়ের। ব্যাটারি দ্বারা চালায়। ওদের বাড়িতে টিভিতে দেখেছি অন্য গ্রহের লোকজন। যারা এসেছিল, অবিকল ওরকম ভাব। বুকে ঘড়ি, গোলগোল চোখ, মাথায় শিং, ডগা দে আগুন বেরুচ্ছে।
–কীভাবে এল ওরা?
–যেভাবে টিভিতে আসে, সেভাবেই।
–ডেসক্রাইব কর। মানে বর্ণনা কর।
একটি ছেলে বলল–আমনের টুসুর জন্য গান বেন্ধেছি। শুনবেন?
আমার টুসুর আলোর ফোচাং
মাথায় কেমন শিং জেগেছে
হেলে দুলে রকেট চাপল গ
অনুরাধাপুর বেড়াতে গেছে…।
–অনুরাধাপুর মানে?
–অনুরাধা তারা আছে লাই, সেইখানে গেছে।
–কে বলল তোমায় অনুরাধা নক্ষত্রেই গেছে?
–ইটা কবি কল্পনা।
–কবি কল্পনা ছাড়ো। কী দেখেছ সত্যি বল।
–তবে বলি শুনুন। রেতেরবেলা হঠাৎ শুনি শব্দ। একশোটা ঝাড়াই মেশিনে যে শব্দ তার চেয়েও বেশি। ডিপ টিউকলে যখন জল ওঠেনা, শোঁ শোঁ শব্দ হয়, ওরকম শব্দও পাচ্ছি। বাইরে এলাম। মনসা মন্দিরের সামনে যেখানে ঝাপানের সময় মেলা বসে, সেই মেলার মাঠে দেখি আলো। বিরাট লম্বা একটা চোঙ লেবেছে। আমার ছেলের ফাইবের বইতে এরকম ছবি রয়েছে। ওটার আবার তিনটে ঠ্যাং। ঐ রকেটের পোঙা দে ধোঁয়া বেরুচ্ছে তোড়ে, আবার গা থেকে আলো ঝলকাচ্ছে। ধোঁয়ায় বেশ নজেন নজেন গন্ধ। ধোঁয়া থামলে পরে রকেটের দোর খুলল, আর লাফ দিয়ে পড়ল কয়েকটা লোক। কেমন দেখতে তো আগেই শুনেছেন। একটা কথা বলা হয়নি, লোকগুলো যখন ছোটে, তখন পেছন দে সাদা সাদা ধোঁয়া বের করে। সেই ধোঁয়াতেও নজেনের গন্ধ। আর হাতের আঙুলগুলো নম্বা নম্বা। অনেকগুলো করে আঙ্গুল। আঙ্গুলের ডগা দে আলোর ফোচাং বের হয়। আমরা তখন অনেকেই বাড়ি থেকে বেরোয়ে পড়েছি। দূর থেকে রগড় দেখছি। ভয় লাগেনি।
এমন সময় পঞ্চুর মা একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় একটা বড়সড় ডিমের ওমলেট দিয়ে গেল। বেশ গরম। ধোঁয়া উঠছে। খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল ডাঃ বিশ্বাসের। গপাগপ খেয়ে নিলেন। চামচ নেই, হাতেই খেলেন। ডিমের ওমলেট খেতে গেলে হাতের আঙ্গুলও স্বাদ পায়, গরম স্পর্শ পায়, অনেকদিন পরে ডাঃ বিশ্বাসের আঙুল এই আরামটা পেল। তারপর চা এল। চায়ে চুমুক দিয়ে ডাঃ বিশ্বাস বললেন, তারপর?
তারপর ওরা মেলার মাঠে নাচল, গাইল তারপর মই দিয়ে উঠে দরজা লাইগে শুয়ে পড়ল। পরদিন সকালবেলা আমরা উঠে পুকুরপাড়ে দাইড়ে আছি। ভাবছি তেনারা বাহ্যি ফিরতে এলেই ধরব। বলব আমাদের গেরামের উন্নতির জন্য চাঁদা দাও। মনসার ঝাপানের জন্য চাঁদা দাও। একজন বলল, ওদের গ্রহের টাকা কি এদেশে চলবে? তখন আমি বললাম তাহলে বরং সোনা চাইব। সোনার দাম সব জায়গায় আছে। অনুরাধাপুরেই যাও, আর ঐ মঘা-কিত্তিকা ভদ্রাপুরেই যাও। কিন্তু কী করে চাইব? আমাদের ভাষা কি বুঝবে? যাইহোক, একটু পরে তেনারা নামলেন। তেনারা ছিলেন চারজন। দুজন মেয়েছেলে, দুজন বেটাছেলে। ডাঃ বিশ্বাস বললেন, ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে বুঝলে কী করে?
বুঝব না? ওরা তো গায়ের জামা খুলে ফেলেছিল। বোধহয় গরম লাগছিল। ওদের সঙ্গে ছিল ওদের পোষা জন্তু। সবাই একটা করে জন্তু কোলে রেখেছিল, আর জন্তুটা জিভ দিয়ে গা চেটে দিচ্ছিল। আমি পরে কাছে গেছিলাম, আমারও গা চেটে দিল। জিভটা বরফের মতন ঠাণ্ডা।
তারপর!
তারপর তেনারা বেরিয়ে পড়ল। একটা ছাগল নাদতে নেগেছিল, তার নাদি কটা নিল, গরুর গোবর জরি প্যাকেট ভরে নিল,গাছের আতাফল পেড়ে নিল নম্বা হাত বাড়িয়ে। হাতের মধ্যে একটা কল আছে। হাতটা অনেক দূর পর্যন্ত যায়, যত লম্বা হয়, হাতটা তত সরু হয়। তেনারাও লম্বা হতে পারেন। যত লম্বা হন তত সরু হন, আবার যত বেঁটে হন, তত মোটা হন। একজন লোক তো ঐ মনসামন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে একবার লম্বা হচ্ছেন, একবার মোটা হচ্ছেন।ওটা বোধ হয় ব্যায়াম! একসাইজ। একটা জিনিস স্যার, ঐযে বললামনি, পোষা জন্তু, ঐ জন্তুছাড়া তেনাদের মোটে চলেনি। ঐ জন্তুটা সবার ঘাড়ে চড়ে থাকে। মাঝে মাঝে জিভ দে চাটে, আর একটু পর পর ঐ জন্তুটার পেটের মধ্যে হাতের আঙুল দে চাটা মারে, তখন ঐ জন্তুটা ভক্ করে একটা ডিম পাড়ে, আর ঐ লোকগুলান কপাৎ করে গোটা ডিমটা খেয়ে লেয়। বিরাট বিশ্বাসের চোখে বিরাট অবিশ্বাস। বললেন, কলকাতার লোক পেয়ে গুল দিচ্ছ না তো? ছেলেটা বলল, আপনাকে স্যার গুল দেব? আপনি আমাদের পঞ্চুর মনিব…।
ডাঃ বিশ্বাস বললেন, ঐ জন্তুটা কেমন দেখতে বল তো? আমাদের মুরগির মতন? ছেলেটা বলল, মুরগির মতো দেখতে হলে তো না বলে পাখিই বলতাম। ওটা ভারি আশ্চর্য দেখতে। কার মতো বলব? বেজিও নয়, আবার গোসাপও নয়, কেন্নোও নয়, আবার কাঠ বিড়ালিও নয়। সবরকম মিলিয়ে মিশিয়ে। জন্তুটা দেড় দু হাত লম্বা। গোসাপের মতো মুখ, বেজির মতে লোম, কাঠবিড়ালির মতো লম্বা লম্বা দাগ। একটা কেন্নোকে যদি অনেক ফুলিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে যেমন হত, লম্বাপানা, আর বেশ ঘাড়ে গলায় পেঁচিয়ে থাকতে পারে। কেন্নোর মতোই অনেকগুলো পা জন্তুটা তুরতর করে হাঁটে। ইটার নাম দিয়েছি তুরতুরিয়া।
জন্তুটা ডাকে?
ভারি সুন্দর ডাকে আইজ্ঞা, যেন টেলিফোন।
ডাঃ বিশ্বাস বললেন, জন্তুটা মনে হচ্ছে এণ্ডোপ টেরিগোটা শ্রেণীর ম্যালোফ্যাকোটিস্ বর্গের ল্যাসারটিলিয়া উপবর্গের এক ধরনের ভারটিব্রেটা। জন্তু কী খায়?
কিছু খেতে দেখিনি আইজ্ঞা।
জন্তুটা পার্জ করেছে? পার্জ।
এজ্ঞে?
বড় বাইরে করেছে? পটি?
এজ্ঞে স্যার?
ডাঃ বিশ্বাস এবার গলা চড়িয়ে বললেন, হেগেছে?
–না স্যার, মোটে হাগেনি।
–আর ঐ লোকগুলো?
–না স্যার, ঐ লোকগুলোনও হাগেনি তবে এরা অন্য একটা ব্যাপার করে।
খোলস পালটায়।
সেটা আবার কী?
স্যার, সে ভারি আশ্চর্য আজব। তিনজন লাইন দিয়ে দাঁড়াল, চার নম্বরজন করলে কি, ওদের ছাল ছাড়িয়ে দেল আঙুল দে টেনে। চরচর শব্দ করে ওদের ছাল বেইরে এল। ছাল বেইরে আসার পর ওদের নতুন চামড়াটা দেখি আরও চকচকাচ্ছে। তারপর বাকি তিনজনে মিলে চার নম্বর জনের চামড়া ছাড়িয়ে দিল।
কোথায়, সেই চামড়া কোথায়? দেখি, দেখি, দাও দাও… বিরাট বিশ্বাস উত্তেজিত।
–চামড়া? কী হবে গ?
–কী হবে মানে? কত কিছু হবে। শোন ঐ চামড়ার কথা আর কেউ জানে না তে? খবর কাগজের লোকজন এখনে কেউ আসেনি তো? বিজ্ঞানীর টিম আসেনি তে? তদন্ত কমিশন আসেনি তো? পরিবেশ বাঁচাও আসেনি তো? আমি প্রথম তো? এতগুলো প্রশ্নের আক্রমণে ছেলেটা যেন বেদিশা হয়ে পড়ল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ। ডাঃ বিশ্বাস বললেন, আমার আগে আর এসব কেউ জেনেছে?
–দারোগা জেনেছে।
–দারোগার কাছে গেছিলে কেন?
–যাব না? পঞ্চু ছিনতাই হয়ে গেল, দারোগাকে জানাব না?
–দারোগা কী বলেছে?
–বলেছে ওরা অনুরাধাপুরে যেতে পারবে না, ওখানে রকেট ছাড়া যাওযা যায় না।
কারণ থানায় একটা জিপ গাড়ি পর্যন্ত নেই।
–বাঃ ডায়রি নেয়নি তো!
–না।
–বেশ। তা হলে কেউ জানে না। আমিই প্রথম। তা দেখাও দেখি ঐ চামড়া ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের চামড়া। কসমিক লেদার। এটা নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরব। ডেমনস্ট্রেশন। বক্তৃতা। দেখাও চামড়া দেখাও! এক্ষুনি।
–সেই সমড়া আর কি আছে? আর নাই।
–কেন! কে নিয়ে গেল।
–কেউ নেয়নি।
–তবে?
–সব জ্বালানি হয়ে গেছে।
–জ্বালানি? মানে?
–মানে তো কিছু নাই। জ্বালানি।
–কেন?
–জ্বালানির অভাব। জঙ্গল কমিটি বলেছে, জঙ্গল কাটলে জেল হব্যে, ইদিকে কার্তিকের ধান উঠল। ধান ভাপাতে হব্যেক। তেনারা অনুরাধাপুর চলে গেলেন, তেনাদের খোলস পড়ে রইল খেলার মাঠে। চণ্ডী গড়াই প্রথম ঐ খোলস নিয়ে ধান ভাঙায়। ও বল্ল, খুব ভাল জ্বালানি। খুব তেজ। দু ঘণ্টা ধরে জ্বলল। তারপর অন্যরা সব লিয়ে জ্বালিয়ে দিল। আমার ভাগ্যে জোটেনি।
–বাঃ বেশ করেছ। এজন্যই বলে চাষার মরণ। এক্কেবারে এওয়ারনেস জন্মায়নি। জেলায় জেলায় নাকি সাক্ষরতা আন্দোলন। ক্যাচকলা। একটুকরো চামড়াও নেই?
–না আজ্ঞে।
–কেমন, রং সেই চামড়ার?
–রং নাই। জলরং। পলিথিন যেমন।
–থাম। ডাঃ বিশ্বাস গম্ভীর হলেন। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। কেরোসিন কুপির দুবলা আলোর শিখা পড়া-না-পারা বালকের মত বেঞ্চির উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর ডাঃ বিশ্বাস বলল, ওরা তারপর কি করল?
–ওরা সব খোলস পালটালো, আমরা সব দাঁইড়ে দাঁইড়ে দেখছি। এমন সময় ওদের একজন মেয়াঁ ছেলে কপ করে হাতটা লম্বা করে বাড়ায়ে আমাদের পঞ্চুকে ধরল। তারপর পঞ্চুকে টেনে নিল। একটু আদর করল। আমি ভাবলাম সর্বোনাশ। এড্স-এর গাড়ি যে বলে গেল অপরিচিতদের সঙ্গে মাখামখি করতে নেই। এডস হয়। আর ভাববার সময় হলনি। ওরা আমাদের পঞ্চুকে টেনে রকেটঘরে ঢোকাই নিল। আমি কী করব।
–তারপর?
–তারপর নজেন-নজেন ধুঁয়া ছেড়ে রকেট আকাশে পলাই গেল।
ডাঃ বিশ্বাস কিছুক্ষণ চুপ। কোনটা যে এওয়ারনেস, আর কোনটা এওয়ারলেস্ বোঝা মুস্কিল। ডাঃ বিশ্বাস আবার বললেন – আচ্ছা, ওরা যে এসেছিল তার কোন প্রমাণ নেই? কিচ্ছু রেখে যায়নি?
–কিছু বইলতে মোক্ষম জিনিসটা দিয়ে গেছে এই বুড়িকে। পঞ্চুর ঠাক্মাকে।
–কী?
–ডিম।
–মানে!
–ঐ তুরতুরি জানোয়ারটার ডিম। ঐযে বল্লাম না, ওরা এই পৃথিবীর জিনিসপত্র নিচ্ছিল, ছাগলের নাদ, গাছের ফল, এইসব তখন ঐ বুড়ির কাছে মুরগির ডিম মাঙল। বুড়ির তো অনেক মূরগি!
–কী ভাষায় চাইল!
–আকার ইঙ্গিতের ভাষায়–
বুড়ি বল্লল, ছাগল-ঘরের কোনায় মুরগি থাকে। ওরা ঘরে ঢুকে দেখল দুটো ডিম। ডিম দুটো ঐ খঁকারা নিল। তারপর ওরা করলে কি, ওদের ঘাড়ে পেঁচানো তুরতুরি জানোয়ারটার পেটে একটু টেপন দেল, ওর জানোয়ারটার পিছন থেকে ডিম বেরুল। দু জনের ঘাড়ের দুইটা জানোয়ারের থেকে চারটা ডিম পাওয়া গেল। আমার কিছু লোসকান হয়নি। দুটো ছোট ছোট মুরগীর ডিমের বদলে চারটে বড়বড় তুরতুরির ডিম পেলাম।
–তো ডিমণ্ডলো দেখি, দাও, এক্ষুনি দাও…
–সে ডিম কি আর আছে?
–কেন?
–আজ সকালেইতো হাটে বেচে এলাম। ঘরে আরও কটা হাঁসমুরগির ডিম ছিল। তার সঙ্গে ঐ ডিমগুলো মিশিয়ে বেচে দিয়েছি। খদ্দের বল্ল – এটা বুঝি বিলিতি হাঁসের ডিম? আমি বল্লাম দাম বেশি। বেশি দামেই বেচা হল।
–চারটে ডিমই বেচে দিয়েছ?
–না আজ্ঞে। চারটাতো হাটে লিয়েই যাইনি তো চারটে বেচব কি করে!
–কটা নিয়েছিলে!
–তিনটা!
–আর একটা কী হল!
–কী হল মানে? একটু আগে আপনাকে মামলেট বাঁনায়ে দিলাম নি?
ধরনী–দ্বিধা হও। ডাঃ বিশ্বাসের শরীরের ভিতর ফিসন ফিউশন হতে শুরু করে। গ্রহান্তরের জীবের পাড়া ডিম এতক্ষণে ডাঃ বিশ্বাসের পেটে গ্যাস্ট্রিক এ্যাসিড, প্যাংক্রাইটিস জুস, বাইল, ইত্যাদির কারসাজিতে হজম হয়ে চলেছে। এই হজম প্রক্রিয়া বন্ধ করার উপযুক্ত প্রযুক্তি ডাঃ বিশ্বাসের জানা নেই।
স্টুল একজামিন থেকে কিচ্ছু পাওয়া যাবে না? কোন আনডাইজেস্টেড অংশ? কোন নতুন ধরনের প্রোটিন বা রেয়ার মেটাল কিছুতো আসতে পারে। ডাঃ বিশ্বাসের পেটের ভিতরে অমূল্য সম্পদ। ওটাকে অন্যকিছু দিয়ে এডালটারেটেড করবেন না। রাত্রে কিচ্ছু খেলেন না। শুধু মশার কামড় খেলেন। জলও খেলেন না। কারুর সঙ্গে কথাবার্তা বল্লেন না। ভোর হতে হতেই যাত্রা করলেন। কলকাতা পৌঁছেই পেটের জিনিসটা অনুপুঙ্খ পরীক্ষা করবেন। দামোদরের ধার দিয়ে হাঁটছেন। অনেকটা হাঁটতে হবে। চাও খান নি। পেটের জিনিসটা রাখতেই হবে। একটু পরেই পেটে মোচড়। এরকম মোচড় রাত্রেও হয়েছিল। এখন ক্রমশ বাড়ছে। তুরতুরির ডিম সহ্য হয়নি। হজম হয়নি। হজম না হওয়া মানে ওর অরিজিনাল বৈশিষ্ট কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। একটা নতুন পেপার হবে। এগ অফ তুরতুরি, এ্যান অ্যান্যালিসিস। আর পারা যাচ্ছে না। দামোদরের ধারে বসে যেতে হবে মনে হচ্ছে। বসে গেলেন মাথায় হাত দিয়ে।
কাছেই এসে দাঁড়ালো দুটো কালো শুয়োর। তুরতুরি সম্পর্কে শুয়োর প্রজতির কোনই উৎসাহ নেই। হায় ওরা এখন ওদের খাদ্যের জন্য তুমুল এবং অবুঝ অপেক্ষা করছে।