কুহু

কুহু

উইণ্ড স্পিড ওয়ান এইট্টি ডিগ্রি, থ্রি নট্‌স্। আকাশে হাল্কা অল্টো কিউমুলাস। পি.আর.ও পার্থ বসুর বাড়িতে স্টিরিওতে জ্যাজ বাজছে। কোকিল ডাকল। বসন্তকাল।

বসন্তকাল। একশো আশি ডিগ্রি থেকে হাওয়া আসছে হাল্কা হাল্কা। মৃদুমন্দ হাওয়া। বাতাসে অ্যানিলিনের গন্ধ। দক্ষিণ থেকে আসছে। প্ল্যান্টটা দক্ষিণ দিকেই।

আজ ছুটির দিন হলেও প্ল্যান্টটা চলছে। প্ল্যান্ট রোজই চলে। এখন মালের প্রচণ্ড ডিমাণ্ড। কারখানা চলছে। রক্ত তৈরির এই কারখানার কর্মচারীদের বসবাসের জন্য তৈরি হয়েছে এই হাউসিং কলোনি। কৌশিক এখন একটা সাইকেল নিয়ে কলোনিতে ঘুরছে। এই কলোনির পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে আছে কৌশিক। আগামীকাল পরিবেশ মন্ত্রী আসবেন। কোকিল ডাকল।

রাস্তাটা তকতক করছে। একটাও শুকনো পাতা পড়ে নেই। এ দিককার ঝাউ গাছগুলি প্লাস্টিকের। সফ্ট পি.ভি.সি.। বাতাসে ঝিরঝির। একটুকরো লন। তাজা ক্লোরোফিল রং নাইলনের দুব্বো-ঘাস রৌদ্রে ঝিলমিল। একাকী ফড়িং উড়ে উড়ে ভুল বুঝে চলে গেল।

কৌশিক ইন্সপেকশন করছে।এখন ‘এ’ জোনে আছে। ‘এ’ থেকে ‘বি’তে যাবে।‘এ’ জোন হ’ল অফিসার এবং একজিকিউটিভদের। বাতাসে অ্যানিলিনের খারাপ গন্ধ। একটা ট্রিটমেণ্ট করতে পারলে ভাল হ’ত, অন্তত এই অঞ্চলের জন্য। বেনজইল এসিটেট্ স্প্রে করলে কেমন হয়? এর জুঁইফুলের মত গন্ধ।

দখিনা বাতাসে অফিসার এলাকায় ছড়িয়ে যাবে গন্ধ। কোকিল ডাকল।

জুঁই কি বসন্তকালের ফুল? কৌশিকের কনফার্মেশন দরকার।

কিছুদিন আগেই অ্যাকাউণ্টস্ অফিসার মিঃ ঝা ভবভূতি পুরস্কার পেলেন। তাঁকে সংবর্ধনা দেবার জন্য গার্ডেন পার্টি হ’ল নাইলনের লনে। সাইকাডেলিক ছাতার তলায় গোল গোল টেবিল আর চেয়ার। ছাতার উপর লতানো মাধবী। গুচ্ছ গুচ্ছ মাধবী। বসেদের হাতে হুইস্কি। বসেদের বউদের হাতে লাইম জিন। মিঃ ঝা একবার তার সোয়েটারটা টেনে নিলেন, মাফলারটা নিলেন, তারপর একবার ফুলেদের দিকে চেয়ে, একবার নারীদের দিকে চেয়ে এক্সটেম্পোর কবিতা বললেন –

লা জবাব মাধবী লতা নিকলি

বিন মৌসম বিন বর্ষাত।

দেওতা নেহি, কুদরত শয়তান কা।

অব না জানে ক্যা হোগা

আখোঁ সে অংগারে

পেড়ো সে পানি

বাদলেসে ধুয়া।

মুর্দে শোয়ের্পে নর্ম বিস্তারা পর

আদমী হাওয়া মে ঝুল রাহা হোগা

শয়তানো কা তামাশা মে

আব ক্যা প্লাস্টিক কা লাড্ডু বাটরহা হোগা…

আসলে কিন্তু কৌশিকের সদিচ্ছার অভাব ছিল না। ঐ ফ্রেশ লটটা পাঠিয়েছিল শয়তান। শয়তান মানে হচ্ছে সাবস্টিটিউশন অ্যাণ্ড ইম্প্লিমেণ্টেশন টেকনিক অফ অ্যাবস্কন্ডিং নেচার।সংক্ষেপে SAITAN–এটি একটি প্রকৃতি-প্রেমিকদের সংগঠন।

ওরা খুব ভাল পি.ভি.সির তৈরি ফুলভর্তি মাধবীলতা। পাঠিয়েছিল, কৌশিক পরম সদিচ্ছায় কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু ঐ গার্ডেন পার্টিতে মিঃ ঝা’র কবিতা শুনে জেনারেল ম্যানেজার কৌশিকের দিকে যেভাবে তাকালেন তা মন খারাপ হবার পক্ষে যথেষ্ট।

তা জুঁই ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। উইণ্ড স্পিড ওয়ান এইট্টি থ্রি নট্স। টু অক্‌টা সিরোকিউমুলাস আকাশে। নেমপ্লেটে সীতানাথ ঝা! ব্রেক চাপে কৌশিক। ভাবে, জিজ্ঞাসা করবে বসন্তকালে জুঁইফুল ফোটে কিনা। কোকিল ডাকল। কোকিল এরকম এতবার ডাকে কেন? জানালা দিয়ে কৌশিক দেখল সীতানাথ ঝা কবিতা লিখছেন। কোকিলের ডাক শুনে লেখা তাঁর বাধা পায়। থেমে থেমে যায়। এ সময়ে মিঃ ঝা’কে কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না। খচে যাবে। সাইকেলে উঠে যায় কৌশিক।

সাইকেল কি করে যেন, কেন যেন সতের নম্বর রাস্তাটার দিকে যায়। ব্যালকনি থেকে অনুরাধার লতাপাতা আঁকা কাপড়টা হাওয়ার সঙ্গে খেলছে। কৌশিক বেল টিপল, আর ওমনি কুহু-কুহু-কুহু স্টপ। আগের দিন টিয়াপাখির ডাক ছিল। অনুরাধা দরজা খুলে দিল। আরে কী খবর, কৌশিকদা…। মুখময় হাসি। কিছুদিন আগে স্পোর্টস্-এ কৌশিক সব চেয়ে বেশি মডেল পেলে সব চেয়ে বেশি হাততালি দিয়েছিল অনুরাধা। সুব্রত সোফায় আধা শোয়া। একটা বই পড়ছে। মলাটটা দেখল কৌশিক। অ্যানাটমি অফ হিপোপটেমাস। সুব্রত হ’ল প্রোডাকশন ইঞ্জিনীয়ার। হেভি জেনারেল নলেজ। কুইজ মাস্টার। দেয়াল আলমারিতে অনেক কাপ, শীল্ড, রোবট। কাঠের বেদীতে একটা খুব সুন্দর পি.ভি.সি.র হরিণ। তলায় লেখা ঘাই হরিণী। ওটার দিকে তাকিয়ে কৌশিক বলল–বাঃ। বই থেকে কিছুটা চোখ তুলে সুব্রত বলল–ফাস্ট প্রাইজ। ইন্টার একজিকিউটিভস্ কুইজ কমপিটিশন। কৌশিক বলল–আমাকে একটু হেলপ্ করতে পারবেন মি রায়? একটু সমস্যায় পড়েছি। জুঁই কি বসন্তে ফোটে?

জুঁই? মানে একটা ফ্লাওয়ার তো? জেস্‌মিন?

হুঁ।

পারপাসটা কী?

এনভায়রনমেন্টে একটা ফ্লেভার দিতে চাই। ভাবছি জেস্‌মিন দেব।

হুঁ। বলছি।

সুব্রত ওর পার্সোনাল কম্পিউটারটা বার করে। কয়েকটা ছোট নব টেপে। স্ক্রিনে ভেসে আসে জ্যাক্‌…জ্যাক্‌ল…জ্যাসিন্‌থ…জেলি…জেলি…জিগ…

জেস্‌মিন সম্পর্কে কোনো ডেটা ফিড করা নেই বোধ হয়।

আবার কী একটা নব টিপল।

সব ফুলের। বল সাম… বেলি… চায়না রোজ… গার্ডেনিয়া… লিলি… লোটাস… সানফ্লাওয়ার… ওলিয়েণ্ডার… ন্‌নাঃ। সরি। কান্‌ট্‌ সে ডিটেইলস্‌ অ্যাবাউট জেস্‌মিন।

অনুরাধা বলল – জুঁই? দাঁড়ান বলে দিচ্ছি।

সুব্রত বলল – বিউটিশিয়ান্‌স্‌ হ্যাণ্ডবুকটায় দেখতো কিছু আছে কিনা, যেখানে সফটেনিং চ্যাপটারে ল্যানোনিন-জেস্‌মিন কম্বিনেশনের ব্যাপারটা আছে।

কিন্তু অনুরাধা তুলে নিল গীতবিতান। বইয়ের সাদা কাগজের কোনা ছুয়ে যাচ্ছে নখ চকচক গোলাপী আভা। অনুরাধা পাতা ওল্টাতে লাগল আর বলতে লাগল বসন্তের গানগুলির মধ্যে পেয়ে যাব। বসন্তে যদি জুঁই ফোটে, ঠিক গানের মধ্যে এসে গেছে। এসো বসন্ত ধরাতলে এসো মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে। এনেছ ঐ শিরীয বকুল আমের মুকুল। ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী। ঝুমকোলতার চিকন পাতা কাপেরে কার চমকে চাওয়ায়। পুলকিত চম্পার লহ অভিনন্দন। ওরে পলাশ ওরে পলাশ। বকুল গন্ধে বন্যা এল। আজি বসন্তের দিন চলে যায়।

অনুরাধা বইটা বন্ধ করল। চোখ বুঁজল। চোখ ঢাকল আঁখি পল্লব। কোকিল ডাকল। অনুরাধা বলল – মরি হায়।

মরি হায় শব্দটার মধ্যে সুর মেশাল অনুরাধা। গেয়ে উঠল – মরি হায়… বসন্তের দিন চলে যায়।

চলে যায়…

দূর শাখে পিক ডাকে

বিরামবিহীন

মরি হায়…

এবং কোকিল ডাকল পরপর পাঁচবার।

পিক মানে কি কোকিল? ইয়েস্। তাই মনে হচ্ছে। আবার ডাকল পিক। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না কৌশিক। কোকিলের ডাকটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না? প্রোগামিং তো এরকম ছিলনা। সিক্সটিন সিক্সটিন টু-টু টুয়েন্টিফোর সিক্সটিন সেকেণ্ড। নেচার পত্রিকা পড়ে এবং দি কাক্কু ভি-ডি-ও ফিল্ম দেখে এরকম প্রোগ্রামিং করা হয়েছিল। কিন্তু এখন যে যখন তখন কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে কি যে ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে না। ডাকটাকে কন্ট্রোলে রাখা যাচ্ছে না কেন?

কেন আজি অকারণে

সারা বেলা আনমনে

পরানে বাজায় বীণা কে গো উদাসীন

মরি হায়…

অনুরাধা গান গাইছে। কৌশিকের অনেক কাজ। কৌশিক উঠল।

সুব্রত বলল, অনুরাধা, কৌশিকবাবু চলে যাচ্ছেন। একদম দেখলে না। কিছু দাও…।

অনুরাধা গান থামাল। শ্বাস ফেলল দীর্ঘ করে।

সুব্রত বলল, নতুন ইলিশটা দিতে পারতে, অনুরাধা দেয়ালের শোকেস থেকে বার করল একটা ক্যাসেট। প্লেয়িং ক্যাপটা নিয়ে এল। আঁচলে খেলছে ফ্যানের বাতাস। কৌশিকের মাথায় বসিয়ে দিল ঐ ক্যাপ। ক্যাসেটটা ঢুকিয়ে দিল প্লেয়িং ক্যাপে।

সুব্রত বলল, এটা রিসেণ্টলি বাংলাদেশ থেকে আনানো। এক আরবের শেখ বাংলাদেশে গিয়ে জীবনের প্রথম ইলিশ মাছ ভাপা খেল। এটা সেই রেকর্ড। ইউ উইল এনজয় ইট।

ক্যাসেটটা চালালেই ভীষণ ভাল লাগতে লাগল কৌশিকের। জীবনে প্রথম ইলিশ খেয়ে যে অনুভূতি হয়েছিল ঐ আরবের মানুষটির মস্তিষ্কের কোষে কোষে সেই অনুভূতি পেতে লাগল কৌশিক।

ইলিশের পর অনুরাধা দিল নায়েগ্রা। কখনো নদী দেখেনি, জল, জলের উচ্ছাস দেখেনি, সাহারার এক প্রৌঢ়কে দিয়ে স্কের্ড করিয়ে নিয়েছিল স্কের্ড কোম্পানি। সেই মানুষটি প্রথম নায়েগ্রা দেখার অনুভূতির ক্যাসেট প্লে করল কৌশিক। প্লেয়িং ক্যাপের দু’পাশে দুটো অ্যানোড এবং ক্যাথোড রড কৌশিকের মাথার দুপাশ স্পর্শ করে আছে। আর কোনো এক বোধ কাজ করে যাচ্ছে মাথার ভিতরে।

কৌশিক একা থাকে ওর কোয়ার্টারে। ওর কেউ নেই। যে মহিলাটির গর্ভ ভাড়া নিয়ে ওর জন্ম, তাকে কোনোদিন দেখেনি কৌশিক। প্রতিপালিকা মা তার বালক হয়ে যাবার পর সেই কোথায় যেন কার সঙ্গে চলে গেছে। কৌশিকের কাছে রীতেশ কুমার পাত্তিয়া ভাটের হনিমুন ক্যাসেট আছে। এক ঘণ্টার ক্যাসেট। দু’রকমই আছে। রীতেশের মাথায় চাপিয়ে একটা, আবার পাপিয়া ভাটের মাথায় চাপিয়ে রেকর্ড করা আর একটা। পাপিয়ার রেকর্ডিংটা খুবই ইন্টারেস্টিং লাগে কৌশিকের। মিডল এজেড নিগ্রো উইল এইটিন ইয়ার্স আছে। কয়েকটি হরার ক্যাসেটও আছে। আকাশে মিসাইল, সাইরেনের শব্দ, ধ্বসে পড়া বাড়ির সামনে রক্তাক্ত সন্তানকে সামনে বসিয়ে ক্যাসেট ব্যবসায়ীরা এক বৃদ্ধার মাথায় লাগিয়ে দিয়েছিল রেকর্ডিং ক্যাপ। সেটা হট সেলার। বার বছরের বালকের সামনে তার মাকে ধর্ষণ করে গেল কয়েকজন। হট সেলার। অনুরাধা এবার দিল মাংকি। চিড়িয়াখানায় বাঁদরের খাঁচার সামনে দাঁড়ানো সাত বছরের শিশুর অনুভূতি। কৌশিকের সময় নেই। কোকিল ডাকছে বড় বেশি।

কৌশিক ওঠে। সাইকেল চাপে। ব্যালকনিতে অনুরাধা। আঁচলে ওয়ান এইট্টি ডিগ্রী ফোর নট্স হাওয়া খেলা করে।

মাস্টার কন্ট্রোলে যাবে কৌশিক। পথে ‘সি’ জোন। ‘সি’ জোনে লেবাররা থাকে। একটা ট্যাংক। কারখানার রিফিউজ এসে জমা হয় এখানে। বিষজলজমা পড়ে। পুকুর পাড়ে কয়েক গাছ মধুকুপী ঘাস।সফট পি.ভি.সি’র। ওয়াশ-এবল। পুকুরের বিষ জলে রাজহাঁস ঘোরে। ব্যাটারি চালিত।

পুকুরের পাড় দিয়ে রাস্তা। রাস্তা শেষ হ’লে কন্ট্রোলরুম। দেখল কোনো ভুল নেই। সিক্সটিন-সিক্সটিন টু-টু টুয়েন্টিফোর সিক্সটিন। এ ভাবেই কাঁটা নড়ছে। পুরো কলোনিতে চব্বিশটা গাছে স্পিকার বসানো আছে। এর মধ্যে চোদ্দটাই প্লাস্টিকের গাছ। এখন কোকিলের ডাক শুরু হয় সকাল সাতটা থেকে। চলে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত। ভোর পাঁচটায় শুরু হয় কাকলি। নানা রকম পাখির আওয়াজ। তখন একজিকিউটিভরা জগিং করেন।

এরই মধ্যে আবার সুপার-ইমপোজ করা কয়েকটা কুহু ডাক আছে এই স্প্রিং সিজনের জন্য। কাকলি ফেড আউট করিয়ে কোকিল দেয়া হয় এরপর। রাত্রে ঝিঁঝিঁ, কিন্তু বর্ষায় ব্যাঙ লো ভল্যূমে।

অপারেটার চঞ্চল সান্যালকে জিজ্ঞাসা করে কৌশিক–একটা ইনটামিট্যাণ্ট ইণ্টারাপশন হচ্ছে, বুঝতে পারছ?

চঞ্চল কিছু বুঝতে পারে না।

মাঝে মাঝেই প্রোগ্রামিং আউট হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছ?

কাঁটার দিকে চোখ রেখে চঞ্চল বলে–বুঝতে পারছি না স্যার।

আসলে ঘরটা কাচের। প্রায় সাউণ্ড প্রুফ। বাইরের শব্দতো ভিতরে আসেনা, ত ছাড়া সারা ‘সি’ জোনে মাত্র চারটি স্পিকার। বি জোন আর এ জোন-এ বেশি বেশি আছে। চঞ্চল বুঝতে পারে না কিছু। এমন সময় প্রিপ্‌ প্রিপ্‌।

ফোন এল।

–কৌশিকদা আছেন?

–বলছি

–আমি অনুরাধা। জানেন, একটা সত্যিকারের কোকিল ঢুকে পড়েছে এই কলোনিতে, ডাকছে।

–হ্যাঁ। আমিও ওরকমই অ্যাপ্রিহেণ্ড করেছিলাম। কোথায় আছে জানেন? রিদ্‌ম্‌ নষ্ট করে দিচ্ছে।

–কৌশিকদা,একটা রিকোয়েস্ট করব? স্পিকারগুলো অফ করে দেবেন? সত্যিকারের কোকিল ডাকছে।

–অফ করে দেব? এরপর যদি ঐ জ্যান্ত কোকিলটা না ডাকে? জ্যান্ত কোকিলের উপর কিন্তু আমাদের কোনো কন্ট্রোল থাকবে না।

–প্লিজ কৌশিকদা। একবার অফ করে দেখুন না কী হয়…

মেয়েটা কেমন বদখেয়ালি। কিছুদিন আগে যখন উইণ্ড থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি টু নট্‌স্‌ ছিল, টেম্পারেচার থারটিন, ফরটিন, তখন শিমূল না কি বলে ঐ গাছগুলো থেকে ঝিরি ঝিরি পাতা পড়ে ক্যাম্পাস নোংরা হত, তখন ঐ অনুরাধা একা একা ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকত, ঐ শুকনো সেলুলোজ ওর গায়ে পড়ত, ঘাড়ে, চুলে, শাড়িতে আটকে থাকত। ওটা একটা সত্যিকারের গাছ ছিল।

ঐ গাছগুলোতে পরে ফুল এসেছিল। টু আর্লি ঝরে গেল। আর দু’টা দিন থাকতে পারত। মন্ত্রী আসবেন। এদের উপর কোনো কন্ট্রোল নেই।

একটু পরেই আবার ফোন। মিঃ ঝা। প্লিজ কিপ দা কাক্কু মিঃ রায়।

কৌশিক বিপদে পড়ল। কী ডিসিসন্ নেবে বুঝতে পারে না। চঞ্চলকে বলল অফ দা অডিও, দেখি কি হয়। চঞ্চল অফ করল। এক মিনিট কেটে যায়, দু মিনিট কেটে যায়, অনেক অনেক মিনিট কেটে যায়…কোকিলের ডাক নেই। জ্যান্ত কোকিলের এই ফ্যাসাদ। কোনো কন্ট্রোল নেই। এমন সময় আবার ফোন। চঞ্চল ফোনটা ধরেই–ইয়েস স্যার, বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। আছেন স্যার, বলেই ফোনের মাউথ পিস্ হাতে চেপে শঙ্কিত উচ্চারণে জানাল–জি.এম.।ব্যস্ত হয়ে ফোন ধরার আগে এক মুহূর্তের জন্য কৌশিকের মনে হয় ভাগ্যিস ও এখন এখানে ছিল।

–কৌশিক স্পিকিং স্যার।

–হোয়াট হ্যাপেণ্ড?

জেনারেল ম্যানেজার কোকিলের ডাক শুনছেন না। কোয়ারি করছেন অডিও সিস্টেমে কোনো গণ্ডগোল হল কিনা।ওনার অ্যাংজাইটি হচ্ছে। মিনিস্টার কামিং।

কৌশিক বলেছিল, স্যার আমি অফ করে রেখেছি।

হোয়াই?

ফর এক্সপেরিমেণ্ট স্যার।

ফর চেকিং? ও-কে। নো মোর এক্সপেরিমেন্ট নাও। অন দি কাক্কু। ও-কে?

ইয়েস স্যার। কৌশিক জি.এম.কে বোঝানোর কোনো স্কোপই পেলনা যে একটা জ্যান্ত কোকিল এসেছে এই কলোনিতে।

ঐ জ্যান্ত ডাকের মহিমা বুঝবার চেষ্টা করছিল এতক্ষণ। সুইচ অন হল। ডেকে উঠল কাক্কু। সিক্সটিন-সিক্সটিন-টু টু টুয়েন্টিফোর সিক্সটিন।

তক্ষুনি ডেকে উঠল টেলিফোন।

কৌশিকবাবু…।

অনুরাধার গলা। হাইপিচ। অনুরাধা কিন্তু কৌশিকদাই বলে।

ইয়েস।

কথাটা রাখলেন না।

কোন কথা?

কোকিল?

জি.এম.-এর অর্ডার যে…

ছিঃ।

ফোন রেখে দিল অনুরাধা। ছিঃ শব্দটা বড় বেশি মেটালিক। অনেক ডেসিবল বেশি সাউণ্ড। অনেকটা বাতাস। পেশী কুঞ্চন।

ছিঃ শব্দটা বড্ড কানে লাগল কৌশিকের। শুধু কানে নয়। শরীরের ভিতরেও কোথাও যেন বিঁধেছে।

কৌশিক ওর কোয়ার্টারে যাবে। সাইকেলে ওঠে। কোকিল ঠিকমত ডেকে চলে। শব্দটা যেন মাছি। কেবলই ঘিন ঘিন করে। কৌশিক ঘরে আসে। শুয়ে পড়ে খাটে।

কেন তবু সেই ছিঃ শব্দ ঘুরে ঘুরে চলে আসে ফের। মাথার চারিপাশে, চোখের চারিপাশে, বুকের চারিপাশে ঘুরে যায়। কৌশিক তাড়ায়। ওটা যায় না।

একজন ফেরিওলা, পরনে ছেড়া প্যান্ট, পিছনে কিটস ব্যাগ একা একা হেকে যাচ্ছে পোগরামিং করাবেন, কমপিউটার পোগরাম…

ছেলেটাকে ডাকবে ভাবল। পার্সোনাল কমপিউটারে কয়েকটা প্রোগ্ররামিং করিয়ে রাখা দরকার। কৌশিক ডাকল না। ছেলেটা চলে যায়। অকসিজেন সিলিণ্ডারের নবটা একটু খুলে রাখে। আরও বেশি অকসিজেন থাকুক ঘরে কিছুক্ষণ। কৌশিক শুয়ে চুপ চাপ শুয়ে শুয়ে কোকিলের ডাক শোনে। প্রকৃত কোকিলের ডাকটা চিনে ফেলল। কি করে ক্রমশ যেন বুঝে যায় প্রকৃত কোকিল–কুহুর পৃথক মহিমা।

উঠে দাঁড়ায় কৌশিক ফোনের নব টেপে।

–ইয়েস। জি.এম. স্পিকিং।

–স্যার, একটা সত্যিকারের কোকিলের কথা বলছিলাম না, ওটা কলোনিতে এসেছে। ওটাকে এখানে পার্মানেন্টলি রেখে দিলে কেমন হয়?

–কোকিল? ওটাতো বাসা বাধতে পারে না। তাইতো?

–ইয়েস স্যার।

–কাকের বাসায় ডিম পাড়ে।

–ইয়েস স্যার।

–কাকতো নোংরা ছাড়া বাঁচে না।

–ইয়েস স্যার।

–তা হলে তো নোংরা খুঁজতে হয়।

ফোন রেখে দিলেন জি.এম.।

সূর্য পশ্চিমে চিমনিটার তলায় চলে গেল। ছায়া এগিয়ে আসছে। প্রকৃত ও প্লাস্টিকের গাছের একই রকম ছায়া। এলায়ে পড়েছে ছায়াগুলি। কারখানা থেকে আসা ভোঁ শব্দের সঙ্গে মিশল কুহু কুহু। নতুন শিফট শুরু হবে। কৌশিকের কেমন যেন মন খারাপ লাগে। বাতাসে মন খারাপ। কৌশিক, একা থেকে নেমে আসে। সাইকেল প্যাডেলে চাপ দেয়। সাইকেল আনমনে ঘুরে ঘুরে কি করে যেন সতের নম্বর রাস্তাটাই ধরে নেয়। এই রাস্তায় অনুরাধাদের বাড়ি।

অনুরাধা ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে আছে। দূরে কোথাও তার চোখ। একশো আশি ডিগ্রির হাল্কা বাতাসে উড়ছে ওর গোলাপী শাড়ি। একেই দক্ষিণা বাতাস বলে বুঝি। কোকিলের ডাক শুনলো কৌশিক। ও বুঝতে পারল এটা প্রকৃত কোকিল। অনুরাধা কৌশিককে দেখে বাতাসে নাড়াল হাত। হাতছানিতে ডাকল। কৌশিক দ্রুত ঘোরাল সাইকেল প্যাডেল। অনুরাধা বলল, ঐ যে কোকিলটা।

কৌশিক ওদিকে তাকাল,যেদিকে অনুরাধার ওচানো আঙুল। কৌশিক কিছু দেখতে পেলনা। শুধু ঝাউগাছ, প্রকৃত কিংবা প্লাস্টিকের। কৌশিক বাড়িতে ঢোকে। সুব্রত বই পড়ছে জিওলজি অফ দি স্যাটার্ন। কৌশিককে বলল–কোকিলটা চিল্লাচ্ছে। জানেন তো কোকিল কেন চেল্লায়?

কৌশিক না জেনে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে থাকে।

পেয়ার খুঁজছে। পেয়ার। ফিমেল পেয়ার। কোথায় পাবে?

কৌশিক ব্যালকনিতে যায়। কোকিল ডাকল। অনুরাধা কোনো কথা বলে না। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। কৌশিক খুব ভয়ে আর সংকোচে বলল, কোথায়? অনুরাধা দেখাল। কৌশিক দেখতে পেল একা প্লাস্টিকের ঝাউডালে কালো কোকিল ডাকল। একাকী কোকিল। অনুরাধা একাকী দাঁড়িয়ে আছে। হাতের পাতায় ওর মুখ। অনুরাধা আস্তে আস্তে গান গাইছে। অস্ফুটে। কৌশিক ওর কাছে যায়। কৌশিক শোনে; আমায় চেন কি। আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি।

কারখানার শিফ্‌ট পাল্টেছে। মানুষজন ফিরে আসছে। ১৭ নম্বর রাস্তায় পদশব্দ। কারখানার শিফ্‌ট পাল্টেছে। রোবটজন ফিরছে। ১৭ নং রাস্তায় খটখট শব্দ। প্লাস্টিক গাছে একাকী কোকিল। একটা রোবট বমি করল। কালো বমি। ম্যাংগানিজ ডাই অক্সাইড। ওর ড্রাই সেলে বেশি করে মশলা ভরা হয়েছিল হয়তো।

ঘরছাড়া এই পাগলটাকে এমন করে কে গো ডাকে

করুণ গুঞ্জরি।

কোকিল ডাকছে। প্রকৃত কোকিল। কারখানা ফেরত মানুষজন ওদিকে তাকায় না। রোবটজন এদিকে ওদিকে তাকায় না। পদশব্দ মিলিয়ে যায়।

যখন বিদায় বাশির সুরে সুরে শুকনো পাতা যাবে উড়ে

সঙ্গে কে রবি

আমি রব উদাস হব ওগো উদাসী…

অনুরাধার চোখের কোনায় ওটা কী? জল? ইয়েস, জলইতো।ওর দুঃখ? দুঃখ কেন? গানটা থেমে গেলেও অনুরাধের নাকের দু পাশে দু ফোঁটা রয়ে গেল।

–কাঁদছেন মিসেস রায়? কীসের দুঃখ আপনার? এ্যাঁ?

অনুরাধা মৃদু হাসল। গাল থেকে ঝরে গেল ফোঁটা দুটো।

–ভীষণ আনন্দ হচ্ছে কৌশিকদা। ভীষণ।

আনন্দ? আনন্দ হলে কেউ কাঁদে নাকি? কেমন আনন্দ সেটা?

এই আনন্দটা কি পাওয়া যায় না?

কৌশিক ঘরের ভিতরে যায়। রেকর্ডিং ক্যাপটা নিয়ে আসে। অনুরাধার কাছে যায়। খুব ধীরে ধীরে বলে অনুরাধা, আপনার আনন্দটা আমাকেও দেবেন?

অনুরাধা কিছু বলে না। শুধু মাথাটা আস্তে করে কাত করে।

কৌশিক ক্যাপটা পরিয়ে দেয় মাথায়। ক্যাসেট ভরে দেয়।

অনুরাধা মৃদু কিন্তু গম্ভীর স্বরে বলে, কৌশিকদা, এটার কোনে কপি করবেন না কিন্তু! এটা শুধুই আপনার।

আমার? আমারই শুধু? কৌশিক ঘরে যায় ফের। ফোন তুলে ধরে। চঞ্চল, চঞ্চল, বন্ধ করে দাও কলের কোকিল। অফ দা সুইচ।

শুধুই কৌশিকের জন্য ক্যাসেটটা ঘুরছে। অনুরাধা স্থির। গুন গুন করছে, আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি। প্রকৃত বাতাসে কাঁপে প্লাস্টিকের পাতা। অনুরাধার গলার গান মেশে বাতাসে। ক্যাসেট ঘুরছে, শুধুই কৌশিকের জন্য। কৌশিকের শরীরের ভিতর কেমন শিরশির। কচি পাতা উঠছে গা ফুঁড়ে। কচি কচি পাতা। বসন্তকাল। বুকের ভিতরে কী যেন, কে যেন ডাকছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *