ঊষা তাহার অরুণিমা-জালের চাঁপা আঙ্গুলের কোমল স্পর্শে ঘন আঁধাররাশিকে তরল করিয়া নিদ্রিত বিশ্ববক্ষে নব চেতনার সঞ্চার করিতেছে। প্রভাতবায়ু কুসুম-গন্ধ হরণ করিয়া মৃদুমন্দ গতিতে স্বাস্থ্য ও স্নিগ্ধতা বিতরণ করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। মধুরকণ্ঠে নানা ছন্দে সুললিত তানে বিশ্বপিতার মহিমা কীর্তন করিতেছে। ধীরে ধীরে মৃতবৎ জগৎবক্ষে কেন মনোহর ও মধুরভাবে নবজীবনে আবির্ভাব সূচিত হইতেছে।
এ হেন মধুর প্রভাতকালে অতি প্রত্যুষেই রায়গড়ের রাজপথের পার্শ্বে লোক সমাগম পরিদৃষ্ট হইতেছে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, রায়গড় তখন অতি ক্ষুদ্র শহর।
এই ক্ষুদ্র শহর আজ বিজাপুরের সেনাপতি মহাবীর আফজাল খাঁর অভ্যর্থনাহেতু পরম রমণীয়ভাবে সজ্জিত হইয়াছে। পথের মধ্যে মধ্যে নানাস্থানে বিচিত্র তোরণসমূহ নির্মিত হইয়াছে! পতাকা, পুস্প এবং কদলী বৃক্ষে সমস্ত রাস্তা গোলজার করা হইয়াছে। মহারাষ্ট্রগণ যথাসম্ভব উৎকৃষ্ট বেশ-ভূষার সজ্জিত হইয়া সোৎসুকচিত্তে অপেক্ষা করিতেছে! মহারাষ্ট্র রমণীগণ পুস্পগুচ্ছে কুন্তল সাজাইয়া বিচিত্র ভঙ্গীতে কোঁচা ও কাছা দিয়া শাটী পরিয়া অট্টহ্স্যে এবং কোলাহলের গগণ-পবন মুখরিত করিয়া রাস্তার এক এক স্থানে জটলা পাকাইতেছে। বহু সংখ্যক বালক ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করিতেছে।
এদিকে বাদ্যোদ্যমসহ মহারাষ্ট্রদিগের রাজা শিবাজী সহস্র সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্যসহ মুসলমান-পোষাকে উৎকৃষ্টরূপে সজ্জিত হইয়া সপারিষদ আসিয়া নগর তোরণের মূলে শ্রেণীবন্ধভাবে দন্ডায়মান হইলেন।
সহসা দূরে একটি তোপ গর্জন করিয়া উঠিল। সেই তোন গর্জনের সঙ্গেই সর্বত্র একটি অস্ফুট কলরব উত্থিত হইল। শিবাজী অশ্বারোহী সৈন্য এবং পারিষদগণকে সঙ্গে লইয়া বেগে অশ্ব ছুটাইলেন। নহবতে নহবতে শাহানার সুরে শানাই বাজিয়া উঠিল। রাস্তার পার্শ্বেই বাটী হইতে শঙ্খধ্বনি হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে শিবাজী, বিজাপুরের সেনাপতি বীরবর আফজাল খাঁকে পরম সমাদরে এবং বিপুল আড়ম্বরে অভ্যর্থনা করিয়া রাজপ্রসাদের দিকে অগ্রসর হইলেন। শিবাজীর সৈন্যগণ পতাকা উড়াইয়া এবং বিগল বাজাইয়া অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। পশ্চাতে আফজাল খাঁ সহস্র সংখ্যক বীর পুরুষগণ বিপুল উৎসাহে নানাবিধ শ্রুতিমধুর বাদ্য বাজাইতে বাজাইতে অগ্রসর হইল। তৎপশ্চাতে বিপুল জনতা ও পদাতিক সৈন্যগণ চলিতে লাগিল। মারাঠা রমণীরা চতুর্দিক হইতে হুলুধ্বনি দিতে লাগিল।
আকাশে সূর্য উঠিয়াছে! তরুণ অরুণের লোহিত কিরণরাগে গগণ-ভুবন মনোমোহন সৌন্দর্যে ভূষিত হইতেছে। কিন্তু বিশ্বলোচন সবিতা-দেবের প্রতি আজ কাহারো দৃষ্টি নাই। যে সমস্ত হিন্দু সূর্যোদয় “জবা কুসুম সঙ্কাশ” প্রভৃতি স্তব আওড়াইয়া প্রত্যহ সূর্যের উপাসনা করিত, তাহাদেরও আজ সেই উপাস্য সূর্য-দেবতার দিকে নজর নাই। আজ সকলের দৃষ্টিই বিজাপুরের বীর সেনানী রূপবান ও তেজীয়ান আফজাল খাঁর প্রতি! আফজাল খাঁ অশ্বারোহণে চলিয়াছেন! তেজীয়ান অশ্ব নৃত্যশীল গতিতে ধীরে ধীরে কি বাঁকা ভঙ্গিমাতেই চলিয়াছে! আফজাল খাঁ রূপের ছটায় এবং বীর্যগরিমায় চারিদিক যেন আলো করিয়া চলিয়াছেন। কিবা কমনীয় কান্তি! কিবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিব্যঞ্জন আয়ত লোচনযুগন! কিবা অঙ্কিত ভ্র! কিবা প্রশস্ত ললাট! কেমন বলিষ্ঠ ও পুষ্ট দেহ! মরি! মরি! কি তেজঃপুঞ্জ মূর্তি! কি বীরত্বব্যঞ্জক গোঁফ। যে দেখিল, সেই মুগ্ধ হইল। রমণীমহলে এই অপরূপ রূপের অস্ফুট স্বরে সমালোচনা উঠিল। সকলেই আফজাল খাঁর কোনও-না-কোনও অঙ্গের প্রশংসা করিতে লাগিল! তাঁহার সঙ্গীয় অশ্বারোহী সৈন্য এবং দেহরগিণেরই বা কি মনোরম গঠন-পারিপাট্য! কি বাঁকা ঠাম?
আফজাল খাঁর বাম পার্শ্বে শিবাজী চলিয়াছেন। শিবাজী মারাঠাদিগের মধ্যে সুশ্রী এবং সাহসী বীরপুরুষ বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। কিন্তু আজ মারাঠারা দেখিল-শিবাজীর শ্রী, চেহারার তেজঃ, গঠন-পারিপাট্য এবং পুষ্টি, আফজাল খাঁর তুলনায় কত নগন্য! চন্দ্রের নিকট তারকা তেমন, পদ্মের নিকট শাপলা যেমন, কর্পূর আলোর নিকট মৃৎপ্রদীপের আলো যেমন, ময়ূরের নিকটে পাতিহংস যেমন, আফজাল খাঁর নিকটে শিবাজীও সেইরূপ প্রতিভাত, হইতেছেন। শিবাজীও বিস্মিত দৃষ্টিতে এক একবার নেত্রকোণে আফজাল খাঁর কমনীয় কান্তি, রমণীয় গঠন এবং তেজঃপুঞ্জ মূর্তি দর্শন করিতেছেন, আর হৃদয়ে ঈর্ষার সর্প দংশনে জ্বলিয়া উঠিতেছেন! হায়! শক্রর এত রূপ! এত বীর্য! একি কখনও সহ্য হয়! তাঁহার স্বজাতীয় মারাঠাদিগের নিকট আজ যে তাঁহার সর্বপ্রকার হীনতাই সূচিত হইতেছে।
যাহা হউক, নগরের দৃশ্য দেখিতে দেখিতে অল্প সময়ের মধ্যেই শিবাজী আফজাল খাঁকে লইয়া রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারে উপনীত হইলেন।
এইখানে শিবাজীর আত্নীয়-স্বজন এবং তাঁহার গুরু রামদাস স্বামী অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আফজাল খাঁর উপস্থিতি মাত্রেই একশত এক তোপ সন্মখস্থ প্রান্তরে গর্জন করিয়া উঠিল! এই তোপ গর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই সহসা এক মহাবিপদের সঞ্চার হইল! শিবাজীর একটি প্রকান্ড হস্তী ভয়ে চঞ্চল হইয়া জনতার মধ্যে বেগে ছুটিতে লাগিল! মাহুত প্রাণপণে হস্তীটাকে থামাইবার চেষ্টা করিয়াও কিছুতেই কৃতকার্য হইতে না পারিয়া ভীষণে প্রহার করিতে লাগিল! ভীষণ ডাঙ্গশের প্রহারে হস্তীটি উন্মত্ত প্রায় হইয়া মাহুতকে সবলে স্কন্ধ দেশ হইতে আকর্ষণপূর্বক পদতলে নিষ্পেষিত করিয়া ফেলিল। ভীষণ পদাঘাতে এবং গুরুভারে মাহুত মুহূর্ত মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হইল।
মাহুতকে নিহত করিয়া আরও উন্মত্ত এবং ভীষণ হইয়া পড়িল। তাহার উন্মত্ততা এবং ভীষণতায় সেই সুসজ্জিত এবং সুশৃঙ্খল অগ্রভাগ একেবারেই বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত হইয়া পড়িল। সর্বত্র ভীতির কোলাহল পড়িয়া গেল। হস্তীর সম্মুখ হইতে সকলেই বেগে পলায়ন করিতে লাগিল। হস্তীটি বেগে ছুটিতে তাহার দক্ষিণ পার্শ্বের এক স্থানে, যেখানে মারাঠা স্ত্রীলোকেরা দাঁড়াইয়া মিছিল দেখিতেছিল, সেই দিকে ধাবিত হইল। স্ত্রীলোকেরা ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিতে লাগিল।
কিন্তু রত্নখচিত কৌষেয়বস্ত্র-সুসজ্জিত রাজকুমারী তারা পলায়ন করিতে যাইয়া মঞ্চে কাপড় আটকাইয়া পড়িয়া গেল। হস্তীটি এমন সময়ে বিকট চীৎকার করিয়া উঠায়, তারার দাসীগণ তারাকে ফেলিয়াই পলায়ন করিল। চতুর্দিকে ভীষণ আতঙ্কজনক উচ্চ কোলাহল উত্থিত হইল! এক পলকের মধ্যে হস্তী তারাকে পদ-বিমর্দিত করিবে! সকলেই হাহাকার করিয়া উঠিল।
শিবাজী-তনয়া তারার কোমল-দেহ-কুসুম কুঞ্জরপদতলে দলিত আর বেশি বিলম্ব নাই। হস্তী এক পা উঠাইয়াছে। সর্বনাশ! সর্বনাশ! সকলেই তারার মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হইয়া গেল।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! সহসা কেন হস্তীটি ভীষণ আর্ত-চীৎকার করিয়া উঠিল। সকলেই বিস্ময়বিস্ফোরিত নেত্রে অবাক হইয়া দেখিল যে, উন্মত্ত হস্তীটি কপালে তীর বিদ্ধ হইয়া তারাকে ত্যাগ করিয়া অন্যদিকে ছুটিয়া যাইতেছে। তীর একহস্ত পরিমিত মস্তিস্কের মধ্যে বিদ্ধ হইয়াছিল। সুতরাং হস্তীটি কিয়দ্দুর যাইয়া ভূপতিত হইল। রক্তধারা প্রবাহিত হইয়া জমিন সিক্ত হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে হস্তীটি প্রাণ ত্যাগ করিল!
কে এই আসন্নবিপদ হইতে তারাকে রক্ষা করিল? কে এমন অব্যর্থ লক্ষ্যে ভীষণ তেজে তীর নিক্ষেপ করিয়া এই মহাবিপদের অবসান করিল? কাহার বাহুতে এমন দুর্জন শক্তি যে, হস্তীর মস্তকের মস্তিস্ক পর্যন্ত তীরে বিদ্ধ করিয়াছে?
সকলেই দেখিতে পাইল যে, বীরকুল-চূড়ামণি আফজাল খাঁই মুহুর্ত মধ্যে ধনুকে জ্যা আরোপণ করিয়া সবল ও নিপুণ হস্তের অব্যর্থ লক্ষ্যে রাজকুমারী তারাবাঈকে আকস্মিক মৃত্যুর হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। চতুর্দিকে আফজাল খাঁর নামে জয়ধ্বনি হইতে লাগিল। সকলেই মুক্তকণ্ঠে আফজাল খাঁর সাহস এবং তেজের কথা আলোচনা করিতে লাগিল।
অতঃপর বিচ্ছিন্ন মিছিল আবার সুশৃঙ্খল করা হইল। শ্রেণীবদ্ধ হইয়া সৈনিকগণ তিনবার করিয়া কুর্ণিস করত আফজাল খাঁ এবং তাঁহার প্রভু বিজাপুরের সোলতানের দীর্ঘজীবন উচ্চকণ্ঠে কামনা করিল।
আফজাল খাঁ অশ্ব হইতে অবতরল করিলে সর্বপ্রথমে রামদাস স্বামী ধান্যদূর্বা দ্বারা আফজাল খাঁর মঙ্গলচর্না করিলেন। অতঃপর পুরুষ ও রমণীরা মিলিয়া আফজাল খাঁর শিরে ও সর্বাঙ্গে রাশি রাশি পূস্পবর্ষণ করিতে লাগিল। এত পুস্প বর্ষণ হইতে লাগিল যে, আফজাল খাঁ নিঃশ্বাস রুদ্ধ হইবার উপক্রম হইল। উপদ্রব দেখিয়া রামদাস স্বামী সকলকে ধমক দিলেন। কিন্তু যুবতীদিগের মধ্যে একটি রমণী নিষেধের পরও গোলাপের পাঁপড়ী আফজাল খাঁর মুখে বর্ষন করিতে লাগিল। রামদাস স্বামী তখন বিরক্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কি তারা, কি ক’রছ! তোমার কি হুঁস নাই?” কিন্তু তারা তবুও আর এক মুষ্টি পুস্প বর্ষণ করিয়া ক্ষান্ত হইল তারার ভঙ্গী ও পুস্প বর্ষণ মত্ততা দেখিয়া আফজাল খাঁ ঈষৎ স্মিতহাস্য করিলেন।
অতঃপর পরম যত্নে সুসজ্জিত প্রাসাদ্যভ্যন্তরে আফজাল খাঁকে লইয়া রামদাস স্বামী এবং শিবাজীর পিতা শাহজী তাঁহার সেবায় ও পরিতোষ-বিধানে নিযুক্ত হইলেন। সৈনিক পুরুষদিগকেও যথাযোগ্য বাসস্থান এবং আহার প্রদান করা হইল। আদর-অভ্যর্থনা এবং সন্মান-সম্বর্ধনা পুরামাত্রায় চলিতে লাগিল।