১১. তপস্যা
কোনো অজ্ঞাত বিষয়কে জানবার ও পাবার জন্য আত্মার আন্তরিক সাধনার নাম তপস্যা। জগতের সমস্ত সুখ-সুবিধা ও সৃষ্টির পশ্চাতে মানুষের আন্তরিক বহু কালব্যাপী তপস্যা আছে। তপস্যা ছাড়া, সত্য উদ্ধারের সুকঠিন ব্রত ছাড়া, জগতের কোনো কল্যাণ-সাধন। সম্ভব নয়। তপস্যার আন্তরিকতা, তন্ময়তা, আত্মার সুগভীর সুকঠিন বেদনা ব্যাকুলতা চাই। নইলে লক্ষ্যে পৌঁছা যায় না। হয়তো এক জীবনে কিছু হয় না। জীবনের পর জীবনে অসীম ত্যাগ দুঃখ ও সহিষ্ণু অন্বেষণ শেষে জয়যুক্ত হয়। চিকিৎসাশাস্ত্র, ঘরবাড়ি নির্মাণ বিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র, জগতের প্রত্যেক কল্যাণপ্রসূ শাস্ত্র মানুষের বহুযুগের তপস্যার ফল। বিনা তপস্যায় কোনোকিছু লাভ হয় না। বহুঁকাল বিদ্যালাভের চেষ্টা ব্যতীত কেউ বিদ্বান হয় না। কোনো একটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্র তৈরি একদিনে হয় নি! রেলগাড়ি, তার, উড়োজাহাজ, গ্রামোফোন সৃষ্টি, এ-কি দুই একদিনে হয়েছে?
সুখময়, চিন্তাভাবনাহীন, অন্বেষণহীন, ব্যাকুলতা ও চেষ্টাহীন জীবনে কোনো কল্যাণ লাভ হয়? মুসলমানের মধ্যে বর্তমানে কোনো তপস্যা আছে কি? মুসলিম জাতির পক্ষে এশিয়ায় ও ইউরোপে রাজত্ব স্থাপন কি সহজে সম্ভব হয়েছিল? নানা শাস্ত্রে তাদের কৃতিত্ব কি বহু তপস্যার ফল নয়? সে তপস্যা কই আমাদের এখন? আত্মার দিক দিয়ে যেন আমরা মরে গেছি। জীবনের চিহ্ন মাত্র নেই। ধর্ম ব্যাপারটা যা নাকি একেবারেই আত্মার বিষয়, তা তো এখন হয়েছে শরীরের ও ওষ্ঠের ব্যায়াম মাত্র। আল্লাহকে পাবার তপস্যাই-বা আমাদের কই? জীবনের সর্ব পাপ লয় হয়ে ধীরে ধীরে উন্নততর আত্মিক অবস্থায় যাবার চেষ্টা আমাদের কই? মিথ্যা, মাদকতা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ প্রভৃতি পশু ভাবকে জয় করবার তপস্যা এসব জীবনের বড় কথা–তা তো আমাদের নেই। স্রোতের মুখে কাণ্ডারীহীন ভেলার মতো চলেছি ভেসে।
জীবনহীনতার এই যে লক্ষণ–এ বড় সহজ বিষয় নয়। এই অহিফেন অবসাদ হয়তো তাকে একেবারেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। তার আস্ফালন ও গর্বের কোনো মূল্য নেই। জাতি হিসেবে জগতে তার অস্তিত্ব থাকবে না–থাকবে তার স্মৃতি, যেমন অতীতকালের ল্যাটিন ও গ্রিক জাতির কিংবা মুসলমান জাতি হবে জগতে গোলাম ও দাসের জাতি; কিংবা ইহুদিদের মতো–দেশহীন, জাতীয় সংঘবদ্ধতাবর্জিত জাতীয়তাবোধহীন জগতের পৃষ্ঠ হতে বিতাড়িত।
আল্লাহর শক্তি মানুষের ভিতর দিয়েই প্রকাশিত হয়। সেই ভাবময় জীবনময় সর্বশক্তির আধার সর্বকল্যাণের উৎস, আদি শক্তির তপস্যা কী? তার জীবন-মন্দিরে প্রবেশের পথ মুসলমানের জন্য রুদ্ধ হয়েছে। এ খুব নিরাশার কথা, কিন্তু খুব সত্য।
জীবনের কোনো কল্যাণকর বিষয়ে আমাদের তপস্যা নেই-তপস্যা আছে একটি জিনিসের দাসত্বের; পরপদ লেহনের, জাতিকে, সমাজকে, গ্রামকে, মানুষকে ভুলে আত্মসুখসর্বস্ব, পত্নী ও সন্তানসর্বস্ব জীবনের অনন্ত সম্ভাবনা বিস্মৃত চাকুরি জীবনের। ধি আমাদেরকে। বড়লোক হবার ব্যবসায়ে কৃতিত্ব লাভের, জাতির ভিতর মহাকাজ কারবার, পৃথিবী-বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবার, কবি ও দার্শনিক হবার, বুজর্গ ফকির হবার কোনো তপস্যা আমাদের নেই।
অতৃপ্তির হলাহল আকণ্ঠ পান না করলে কী মনুষ্য জীবনের মঙ্গল যাত্রা শুরু হয়। কোনো অসন্তোষ, কোনো অতৃপ্তি আমাদের নেই। যা আছি ভালোই আছি, আল্লাহ্ ভালোই রেখেছেন, এই হচ্ছে প্রভুর কাছে আমাদের সুতৃপ্তির উপাসনা।
কত নর-নারী… হায়! জীবনে এদের কারো তীর্থযাত্রা নেই। যে যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
.
১২. তীর্থ-মঙ্গল
প্রত্যেক জাতিই চলেছে বিজয়-শখ বাজাতে বাজাতে সম্মুখে-আমরা সবাই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু স্বর্গের স্বপ্ন দেখছি। প্রত্যেক মঙ্গল অনুষ্ঠানই ঈশ্বরের পূজা। এ নতুন পূজায় আজ যে যোগ না দেবে সে পশ্চাতেই পড়ে রইবে। মানব-জাতির প্রভু আজ নতুন সাজ পরেছেন, তাঁর পূজাও আজ করতে হবে নতুন রকমে। জীবিতদের কাছে কথা বলে লাভ হয়। মৃতের কাছে জীবন-মন্ত্র পাঠ করলে কী লাভ?
মুসলমানকে তপস্যা করতে হবে। জীবনের সংকীর্ণ চিন্তা কর, মানুষ হও, যথার্থ মুসলিম জীবনের পরিচয় দাও। নিজেকে অমন করে অবমানিত করে ফেলো না। যৌবনের ঐ দানকে, রক্তচক্ষু বিস্তার করে, মানুষকে চূর্ণ করে, সুপ্তির সুখময় আবেশে, অবসাদে, আলস্যে, হাসি-তামাসায় দায়িত্বহীন গানে, বাদ্যে, আত্মকলহে, ক্ষুদ্র পরিবারে, সংকীর্ণচিত্ততায়, গ্রামবাসীর সঙ্গে বিবাদ করে, জমিদারির স্বপ্নে, গর্বে, মিথ্যায়, মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ব্যর্থ করে দিও না। দোহাই তোমাদের। জীবনের এবং যৌবনের মহাসার্থকতা আছে। যৌবনের সুউচ্চ এবং সুউন্নত ব্যবহার কর–প্রভুর কাজে, প্রভুর পথে যৌবনের সমস্ত শক্তি উৎসর্গ কর। এই তো মুসলিম যুবকের কাজ।
কোন্ মা, কোন্ প্রভাতে জন্ম দিয়েছিলেন এক শিশুকে। সেদিন সমস্ত প্রকৃতি সেই শিশুর আগমন গানে পুলকিত হয়ে উঠেছিল। বাতাস সেই শিশুর জয়গানে আকাশ-পাতাল মুখরিত করেছিল। সেই দেবতার আশাবাদ একদিন বড় হয়ে জাতির মহামঙ্গল করবে। তার মহাজীবনের আশীর্বাদে জাতির মুক্তি এবং কল্যাণ হবে। তার মহাতপস্যা মহাব্রত উদ্যাপন না করে কখনও ভাঙ্গবে না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সেই শিশু অনাগত মহাভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হবে, তার পর একদিন সে তার সাধনা নিয়ে মঙ্গলযাত্রা করবে। জীবনে তার কঠিন তপস্যা আরম্ভ হবে। শৈশবের সুমিষ্ট সরল হাসি খেলাধুলা ভুলে মহাচিন্তায় সে গভীর ও তন্ময় হয়ে উঠবে? সে তার জীবনের রক্ত দিয়ে জাতির জীবন সৌধ গড়ে তুলবে। তার হৃদয় হবে বিশাল, বাহু হবে গগন-বিস্তারী, বক্ষ হবে সাগরশোষী। ধন্য সেই শিশু আর ধন্য তার মা।
তপস্যা কঠিন বিষয়। কোনো জিনিসকে পাবার জন্য জীবনের নিরবচ্ছিন্ন সাধনার নাম তপস্যা। তপস্যা ব্যতীত মানব জীবনের কোনো মঙ্গল সাধিত হয়? তপস্বীর তপস্যার ফলে জগতের নরনারী অফুরন্ত কল্যাণ লাভ করে। তপস্যা মানবজীবনের ঈশ্বরের মহাস্থান।
পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, চেষ্টার দ্বারা জগতের সমস্ত কাজই সম্ভব, শুধু কবি হওয়া সম্ভব নয়। ডিমসথেনিস নামক এক জগৎ-বিখ্যাত বাগ্মী গ্রিস দেশে এথেন্স নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার কণ্ঠস্বর সুপরিষ্কৃত এবং উচ্চ ছিল না–অতীতে এবং ভবিষ্যতে জগতে এরূপ দ্বিতীয় মহাবাগীর আবির্ভাব আর হয়তো হবে না। তিনি কঠোর তপস্যার দ্বারা, বহু বৎসর প্রান্তরে, নিবিড় অরণ্যে, সমুদ্র সৈকতে বক্তৃতা অভ্যাস করেন। তাঁর বাকশক্তি জগৎ সম্মুখে এক মহাবিস্ময়কর ব্যাপার।
তপস্যা অর্থ সাধারণ মানুষ মনে করে–নির্জন বাস এবং ঈশ্বর আরাধনা। মানব জীবনের যে কোনো গভীর, গূঢ় সত্য উদ্ধারের চেষ্টার নামই তপস্যা।
.
১৩. আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
যাদের হৃদয় অনুন্নত, তারা কি পথের ভিখারী রাণাপ্রতাপ এবং সর্বহারা ইমাম হোসেনের জীবনের মূল্য বুঝতে পারে? আজ তেরশত বৎসর ধরে মুসলিম জগতে কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ মহররম উৎসব নামে সুসম্পন্ন হচ্ছে। বাঙালি মুসলমান সমাজ সেই মুসলিম জগতের একটি অংশ। তারা সবাই নবীর ভক্ত–নবীর নামে দরুদ পড়েন, ইমাম হোসেনের জন্য শোকাশ্রু ফেলেন, মহররমের রোজা করেন–কিন্তু সত্যি কি তারা মহামান্য প্রিয়তম ইমাম হোসেনের জীবনের মূল্য অনুভব করেছেন? কিছু না, কিছু না। যদি করতেন, তা হলে তারা স্বাধীনতার মূল্য বুঝতেন। রাণাপ্রতাপের ভাই মণিসিংহ সম্রাট আকবরের মন্ত্রী হয়ে কত সুখেই না জীবন কাটাচ্ছিলেন। অন্যদিকে মহাপ্রাণ প্রতাপ পাহাড়ে পাহাড়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঘাসের রুটি খেয়ে স্বাধীনতার গৌরব রক্ষা করেছেন। এই মহাপুরুষদ্বয়ের জীবনের মূল্য মুসলমান বোঝেন কি? বাঙালি মুসলমানের কাছে একটা সাব-ডেপুটির পদ কত আকাঙিক্ষত বস্তু। একটা দারোগার কাজ পাওয়া তার পক্ষে কতবড় ভাগ্যের কথা–মন্ত্রীত্ব পাওয়া তো দূরের কথা।
এজিদ বল্লেন–হোসেন একটুখানি বশ্যতা স্বীকার করলেই আমি তাকে মহাসম্মানে, সুখ ও সম্পদের আসনে বসাব। একটুখানি সে নত হোক।
ইমাম; নবী–দৌহিত্র ইমাম হোসেন সত্য ও ন্যায়ের মর্যাদা অস্বীকার করে জীবন, সম্পদ ও সম্মান চান নি। আপন জীবনের, আপন বংশের এবং আপন ভক্ত আত্মীয় বন্ধুগণের হৃদয়-রক্ত দিয়ে মরুভূমির প্রতি বালুকণাকে স্বর্গের পুষ্পগন্ধে সুরভিত করে তুলেছিলেন–জেনে-শুনে মৃত্যুর হলাহল অমৃত বোধে আকণ্ঠ পান করলেন। এই জীবন বলি, এই কোরবানিই তাঁর কাছে গৌরবের মৃত্যু। হায় মুসলমান জাতি তোমরা কারবালার মহামৃত্যুর মূল্য বুঝবে কি? কারবালার যুদ্ধে শুধু পুরুষ নয়–নারীও আপন হৃদয়-রক্ত দিয়ে ইমামের স্বাধীনতা বোধের পূজা করেছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শোণিতপণ অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পূজা শুধু পুরুষকে দিয়ে হবে না নারীও চাই। পতনের সুগভীর গুহায় পড়ে মুসলিম নারী সমাজের শক্তি না হয়ে তাকে টেনে অন্ধকারের অতল তলে নামাচ্ছে। স্বাধীনতার মহাপূজারী মহাবীর রাণার পরী স্বামীর পশ্চাৎ পথে পথে ঘুরেছেন। মহাজীবনের পরম ভক্ত এই মহিষী নারীর সম্মান জগতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দেবশিশুগুলো ঘাসের রুটি খেয়ে স্বাধীনতার উপাসক পিতার পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাসি মুখে ছুটেছেন। এসব জীবনের গৌরব সাধারণ মানুষ কি আত্মায় অনুভব করতে পারে? ঈশ্বরের চরম স্পর্শ যারা আত্মার বেদিতে পেয়েছে তারাই জানেন স্বাধীনতার পূজা কেমন করে করতে হয়–ঈশ্বরের প্রকৃত কোরবানি কাকে বলে? বছর বছর মাংসের কাবাব খাওয়ার নাম কোরবানি নয়। জীবনের প্রতি কাজে প্রতিদিন প্রতিমূহুর্তে সর্বদুঃখ জয় করে সত্যের পূজা করে। এটাই মহামানুষের জীবনের চরম ও পরম উপাসনা।
রাণাকে এবং ইমামকে সে সময় অনেকেই বাতুল বলে উপহাস করেছিলেন আল্লাহর মহাদরবারে কিন্তু তাদের নাম সর্বোচ্চ স্তরে লিখিত হচ্ছিল। তাদের জীবনের দুঃখ বরণের এবং ত্যাগ স্বীকারের মূল্য প্রকৃত মানুষ ছাড়া কে আত্মায় অনুভব করতে পারে। উত্তর–কেউই না!
হোসেন মরণ বরণ করতেও সর্বত্র পূজিত। পৃথিবীর কোনো জাতির মধ্যে ইতিহাসের কোনো পৃষ্ঠায় অতীতে এবং বর্তমানে সত্য ও ন্যায়ের জন্য এমন স্বর্গীয় মরণ বরণের মহাদৃষ্টান্ত দেখা যায় না। আমরা কী এই মহাজনের অনুরাগী? রাণাপ্রতাপ পরাজিত হয়েও অনেক বিজয়ী সেনাপতির চাইতে শ্রেষ্ঠ, প্রতাপের মহাত্যাগের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত বিরল। স্বাধীনতার পূজারী জগতের আর কে? যে জাতির মধ্যে এমন মানুষ জন্মেছেন, সে জাতি মানুষের সম্মান ও আত্মীয়তার যোগ্য।
.
১৪. মনুষ্য পূজা
মানুষ মানুষকে কত প্রেম করে ভাবতে গেলে আশ্চর্য হতে হয়। মহাজীবনের পশ্চাতে কতকগুলো ভক্ত-প্রাণ থাকে, যারা সর্ব অবস্থায় আপন ভক্তির দেবতাকে প্রেম করে ধন্য হন। হয়তো মহাজীবনের চাইতে এইসব ভক্তের মূল্য বেশি। এরাই আপন আপন শক্তি ও প্রেমের বলে মহাজীবনকে জয়যুক্ত করেন–যদিও জগৎ তাদের একজনকেও জানে না।
নেপোলিয়ন আপন সৈন্যদলের সম্মুখে বের হলে তাদের হৃদয় যেন এক প্রচণ্ড বিদ্যুৎ শিহরণে জেগে উঠত। প্রভুর পদশব্দের তালে তালে তাদের হৃদয়-রক্ত তরঙ্গিত হতো। তারা অন্ধআবেগে, আপন প্রভুর জন্যে প্রেমের মাদকতায় চেতনাশূন্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন দিত। এই অন্ধভক্তির প্রভাবে নেপোলিয়ান সারা ইউরোপের রাজা হয়েছিলেন। হুমায়ুন পথের ফকির হলেন–সিংহাসনচ্যুত নিঃস্বার্থ পথের ভিখারি ভারতের সম্রাট হুমায়ুনের পশ্চাতে তাঁর কতিপয় বিশ্বস্ত প্রেমিকভক্ত ছাড়া আর কেউ ছিল না। এই ভক্তের দল তাকে জয়যুক্ত করেছিল–বিপদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, নিরাশার বুকে আশা দিয়েছিল। যখন আরবের পৌত্তলিকেরা প্রভু মহাম্মদকে হত্যা করবার জন্যে তরবারি হস্তে পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটেছিল, তখন তার সঙ্গে ছিল দুই ভক্ত, তাঁরা হলেন আলী ও আবুবকর। রসুলকে বাঁচান ছিল যাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ চিন্তা। নিজেদের জীবনের মায়া যাঁদের ছিল না। হলদী ঘাটের মহাযুদ্ধে রাণাপ্রতাপ মোগল হস্তে সাতটি আঘাত পেয়েছেন–তথাপি উন্নত অধীর আবেগে সমর উত্তেজনায় সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন। তার একান্ত ভক্তজনেরা তাকে অনেকবার শত্ৰুচক্রের ভিতর হতে পশ্চাতে টেনে এনেছেন। তথাপি তিনি শত্রু নিধনে জ্ঞানশূন্য। শেষবারে ঝাঁসীয়া রাজ আপন প্রাণ দিয়ে তাঁকে পতন হতে রক্ষা করলেন। ভক্তের এই জীবনদানের ফলে সেদিন প্রতাপ রক্ষা পেয়েছিলেন নইলে কিছুতেই রক্ষা পেতেন না।
পূজিত বীরের চাইতে তাঁর রক্তদানের জীবনের মূল্য কোনো অংশে কম নয়।
বীরকে জানা এবং তাঁকে সর্বপ্রকার প্রেম করা মহাজীবনের প্রকৃতি। ”মহামানুষ” ছাড়া মহাজীবন’ কে অনুভব করতে পারে।
.
১৫. মন্দতাকে ঘৃণা
যে যাবৎ না তোমাদের দেহের প্রতি শোণিতবিন্দু পাপকে ঘৃণা করতে শিখেছে, পাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছে,… তাবৎ তোমাদিগকে ঈশ্বর পথের পথিক বলা যায় না। পাপ ও কুৎসিত যা, যা মন্দ তাকে ঘৃণা কর, আন্তরিকভাবে ঘৃণা কর। মন্দ জীবন যেন কখনও তোমাদের কাছে সম্মানিত না হয়। যারা স্বাধীনতার উপাসক নয় যারা দায়িত্বহীন শাসনতন্ত্রের চাকর, সত্যের উপাসক যারা নয় স্বাধীন জীবনকে যারা সম্মানের চোখে দেখে না–তাদেরকে সম্মান করো না–তাদের গৃহে যেয়ো না–তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা না।
জীবন যার উন্নত নয়, সে জীবনের মন্দতা সম্বন্ধে সত্য ধারণা করতে পারে না। নিজের সুবিধামতো যুক্তিতে সে মন্দকে ভালো বলে। জীবনে একটা সান্ত্বনা না হলে মানুষ বাঁচে না। যে বেশ্যা তার জীবনেও যুক্তি এবং সান্ত্বনা আছে। কিন্তু সত্য ও বিচারের সম্মুখে মানুষের এই যুক্তি মোটেই টেকে না।
ঘুষখোরেরা সাধারণত বলে আমরা দুপয়সা নেই মানুষের উপকার করি। এক সেনাপতিকে এক সময় দেশীয় কোনো মন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক বিষয়ের জন্য বহু লক্ষ টাকা ঘুষ সেধেছিলেন। তিনি জীবনের আগৌরব করতে চান নি। ঘুষ গ্রহণ করেন নি।
এদেশের সর্বত্র ঘুষের চলন আছে। শিক্ষিত ছেলেরাও চাকরি পাওয়ার আগে বলে উপরি পাওনা আছে কিনা! এই ঘুষ গ্রহণ যে কত অধর্মের কাজ কতখানি ঘৃণিত নিন্দনীয়, তা বলবার নয়। অথচ এই ঘুষের ওপরই দেশের বহুলোকের উন্নত অবস্থা নির্ভর করে। লোভ, নীচতা ও মন্দতাকে পরিহার করে চলাই যে ধর্ম, তা যেন কেউ জানে না।
এক সিপাইকে একবার জিজ্ঞেস করা হল, দেখ, তোমরা কচি কচি দেশের স্বেচ্ছাসেবক ছেলেদের মাথায় লাঠির আঘাত কর। এরা কত সম্মানী লোকের ছেলে। তোমাদের প্রাণে মায়া হয় না? এদের হাতে কোনো অস্ত্র থাকে না। নিরস্ত্রের ওপর কেন লাঠির আঘাত কর?
সিপাই বলে : কি করি বাবু, যার নুন খাই তার গুণ গাইতে হয়। সরকারের নুন খেয়ে তাঁর ইচ্ছা অমান্য করতে পারি?
সিপাইয়ের ধারণা, সে সরকারের চাকর। তার বেতন সরকারই দেন। তার বেতন, তার নুন যে দেশের লোকেই যোগায়, এ ধারণা তার নেই। ন্যায়-অন্যায় না বুঝেই অনেক সময় জীবনের পথে এইভাবে চলে।
জীবনের ভুল ঠিকভাবে বুঝতে পারা সোজা কথা নয়। এই জন্য মনের বিচারযোগ্যতা থাকা চাই। এই জন্য জ্ঞান ও বিচারশক্তি থাকা দরকার। মন্দ কি, ভুল কি, অন্যায় কি–এ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞান যার নেই সে কী করে ন্যায়পথে চলবে? এক সাব-ডেপুটি গ্রামে এসে একদিন সাধারণ লোকের সঙ্গে অত্যন্ত দাম্ভিক ব্যবহার আরম্ভ করলেন। তিনি একজন এম. এ.। চৌকিদারকে তো তিনি একটা কুকুর-বিশেষ মনে করে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। তিনি এক হাকিম এ কথাও বল্লেন। লেখক একজন সাহিত্যিক এ জেনেও তার। সঙ্গে তিনি রূঢ়, অভদ্র পৌরুষের কণ্ঠে কথা বলতে লাগলেন। অনেক এম. এ.-কে জানি যারা অতিশয় সম্মানের সঙ্গে লেখকের সঙ্গে কথা বলে থাকেন। ইনি চাকরির প্রভাবেই নিজেকে দেশের মানুষের কাছে এতটা শ্রেষ্ঠ মনে করছিলেন। এ হচ্ছে চাকুরে জীবনের দুর্ভাগ্য। সেই একদিন কোনো বিশেষ কারণে আমাকে রাজপুরুষের সঙ্গে মিলিতে হয়েছিল, সেই অবধি বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া কোনো সরকারি চাকুরের সঙ্গে কথা বলবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। এই ভদ্রলোকের ধারণা, তিনি দেশের লোকের প্রভু, তিনি সাধারণের চাকর নন। চাকরির দিক দিয়ে নয়, সাধারণভাবে জীবনের কদর্যতা সম্বন্ধে তাঁর এখনও দৃষ্টি জাগে নি–তাই সাধারণের সঙ্গে এরূপ রূঢ় ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। অনেক চাকুরেই ক্ষমতার গর্বে সাধারণের সঙ্গে রূঢ় অভদ্র ব্যবহার করেন। তাতে তাদের জীবনের মতা কতখানি প্রকাশ পায় তা তারা বুঝতে পারেন না। মহাজনের কথা বাদ দিয়ে, যাবতীয় ভদ্রলোকেই জীবনের মন্দ প্রকাশে লজ্জাবোধ করেন। কথায়, ব্যবহারে-চিন্তায় সুন্দর হওয়াই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা। যে জীবনে মন্দের প্রতি ঘৃণা নেই সে জীবন কি অপবিত্র নয়? পাপের প্রতি, কুৎসিতের প্রতি সুবিপুল ঘৃণাই মানুষকে মহত্ত্বের পথে অগ্রগতি দান করে।
কলকাতায় একজন কোটিপতি ভদ্রলোক আমাদের খেতে দিয়ে করজোড়ে নিজেদের টি স্বীকার করতে লাগলেন। তার এই বিনয়ে তাঁর জীবনের কত সৌন্দর্যের প্রকাশ পেয়েছিল। তার এই বিনয় প্রকাশ না করলেও তো ক্ষতি ছিল না।
এক ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক একদিন আমার কাছে এসেছিলেন। আমি ভিতর থেকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, কে? তিনি স্কুলের বালকের মতো অতি তুচ্ছ, ক্ষুদ্র করে নিজের নামটি বলেন। আমি ভেবেছিলাম কোনো স্কুলের বালক হবে। বাইরে এসে দেখি সেই মান্যবর ভদ্রলোকটি। এই বিনয় তাঁকে কুৎসিত ও ছোট করে নি। অথচ প্রায়ই দেখতে পাই, একশ্রেণীর নিম্নস্তরের লোকেরা ক্ষমতার বলে সাধারণের সঙ্গে কথায় কথায় অভদ্র ব্যবহার করে। তাতে তাদের জীবনের জঘন্য কুৎসিত চিত্ৰই নগ্ন হয়ে দেখা দেয়। মানুষের দৃষ্টির অগোচরে, নিজের মনে জীবনের মন্দতা ধরতে শেখাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। যেখানে শিক্ষিত হয়েও মানুষ অন্ধ, সে শিক্ষার উদ্দেশ্য চৌর্যবৃত্তি। নাচওয়ালীর গান-বাদ্য শিক্ষার জন্যে অক্ষর পরিচয় লাভের মতো তা নিরর্থক।
প্রভুর আশীর্বাদ মানবসমাজের জন্যে বর্ষিত হোক এই প্রার্থনা।