০৬. আত্মীয়-বান্ধব
শুধু পরস্পরকে কোনো সম্বন্ধ ধরে ডাকলে মানুষ মানুষের আত্মীয় হয় না। জীবনের পথে কোনো সত্যনীতি, মন্ত্র, বিশ্বাস বা ব্রত উদযাপনের যে প্রচ্ছন্ন সাধনা মানব জীবনে থাকে, সেই সাধনায় এবং রোগে, শোকে, অভাবে, বিপদে পরস্পরকে সাহায্য করে, তারাই আত্মীয় এবং বান্ধব।
আত্মীয়তার দিন উঠে গিয়েছে। সভ্যতা, শিক্ষা এবং জ্ঞান মানুষকে পশু করেছে–আত্মীয় বলতে মুসলমান সমাজে কেউ নেই।
আত্মীয় বাড়িতে এলে তাকে পেট ভরে একদিন খাওয়ানোই আত্মীয়তা এবং প্রেম নয়। বন্ধুকে একদিন দই-মাংস খাইয়ে দেওয়াই বন্ধুত্ব নয়। জীবন-যুদ্ধে মাঝে মাঝে যে কঠিন সমস্যার উদয় হয়; সেই সমস্যা সমাধানের জন্য যারা শরীর, বুদ্ধি, অর্থ নিয়ে অগ্রসর হয় তারাই আত্মীয়।
যে নামের আত্মীয়, তাকে মানুষের কাছে আত্মীয় বলে পরিচয় দিও না। তার বাড়ির ত্রিসীমানায় যেয়ো না। সে বিশ্বাসঘাতক। ফাঁকি দিয়ে তোমার ঘরে প্রবেশ করেছে। তোমার সুখ-দুঃখের সহভাগী নয় যে–তার নাম না নেওয়াই উচিত। অথবা কাউকে আত্মীয় বা বান্ধব বলে শব্দের অপব্যবহার না করাই ভালো। ওতে মানুষ ভ্রান্ত হয়।
যার সঙ্গে দরদের বা জীবন-নীতির কোনো সংশ্রব নেই, তাকে আত্মীয় না বলে তার নাম ধরে ডাকাই উচিত।
দরদের ধন হযরত মুহম্মদ (সঃ) প্রতি প্রভাতে উঠে একবার পাড়া-প্রতিবেশীর খবর নিতেন। কই, সে প্রেম তো আজ মানুষের মধ্যে দেখি না। যার অবস্থা একটু ভালো, সে কি আর মনুষ্যের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেশীর খবর নেয়?
যে দরদ করে, দুঃখে সহানুভূতি জানায়, বিপদে আপনার জনের মতো পাশে এসে দাঁড়ায়, সেই আমাদের পরম বান্ধব, তার সঙ্গে রক্তের সংশ্রব থাক আর না থাক। যে সহোদর ভ্রাতা হয়ে দুঃখের সময় পরের মতো ব্যবহার করে, গত জীবনের কথা তুলে বিপদে প্রতিশোধ নিতে চায়, সে ভ্রাতা হলেও বেগানা। তার সঙ্গে কোনো সংশ্রব না রাখাই ভালো।
যে অসাধু এবং অত্যাচারী সে আপনার জন হলেও তার কোনো সাহায্য গ্রহণ করো না–কারণ সে অন্যায় করে। তার সাহায্য গ্রহণ করার অর্থ তার পাপ জীবনকে, আর পাপকে সমর্থন করা। পাপী দুরাত্মা ভ্রাতা হলেও সে আমাদের কেউ নয়। চিন্তা এবং ধর্মে যাদের সঙ্গে যোগ নেই তারা কখনও আত্মীয় নয়।
যারা মানুষের প্রতি প্রেমবশত হাসপাতাল নির্মাণ করেন–বিপন্ন, পীড়িত দরিদ্র কুষ্ঠরোগগ্রস্তদের জন্যে আপন ধনভাণ্ডার খুলে দেন, তারা মানুষের পরম আত্মীয়। মানুষের আত্মীয় হবার মতো সৌভাগ্য মানব জীবনে আর কি! হাজী মহসীন বাঙালি মুসলমানের পরম আত্মীয়। মনুষ্য-হিতাকাক্ষী মাত্রেই মানুষের আত্মীয়। জন হাওয়ার্ড, বানিয়র, কাউন্ট, টলস্টয়, সাধু ভিনসেন্ট, সারা মার্টিন, মিসেস ফ্লাই টানেল, রাইট এঁরা মানুষের পরম আত্মীয় ছিলেন।
জন হাওয়ার্ড সম্বন্ধে বাগ্মী বার্ক বলেছেন–দুঃখী বন্দিদের দুরবস্থা, তাদের প্রতি মানুষের নির্মম ব্যবহার সারা ইউরোপ ঘুরে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি ৪২ হাজার মাইল পথ হেঁটে ইউরোপের কারাগৃহসমূহ পরিদর্শন করেন। দুঃখী মানুষের প্রতি এমনিই তার মমতার টান। দুঃখীরা কীভাবে অন্ধকারে, রোগে-দুঃখে জীবন কাটায়, মানুষের নিষ্ঠুর ব্যবহার কীভাবে তাদেরকে আরও অমানুষ ও পশু করে, হাওয়ার্ড তার সবিস্তার বর্ণনা সর্বত্র প্রকাশ করেন। যতক্ষণ না চোখে আঙ্গুল দিয়ে সাধারণ সংসারী মানুষকে দেখিয়ে দেওয়া যায়, ততক্ষণ সংসারের মানুষ পরের বেদনা অনুভব করতে পারে না। কারাগারে পূর্বকালে বন্দিদের অবস্থা অতি ভয়ানক ছিল। যেমন সেগুলো মহাপাপের আড্ডা ছিল। মানুষকে কুকুরের মতো ব্যবহার করা হতো। জীবিত বন্দিদের শরীরে অস্ত্র চালনা করে ডাক্তারেরা শরীরতত্ত্ববিদ্যা শিখতেন, নানাপ্রকার ব্যাধি-পীড়ায় তারা আয়ু থাকতে মারা যেত। মেয়ে পুরুষ সবাইকে একই খোঁয়াড়ে আবদ্ধ করে রাখা হত, অতি কদর্য খাদ্য তাদেরকে দেওয়া হত। লঘু ও গুরু অপরাধের কোনো পার্থক্য ছিল না। বিচারের নামে মানুষের প্রতি নির্মম অবিচার হত। এইসব মনুষ্যপ্রেমিক এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। ফলে ক্রমে ক্রমে কয়েদিদের প্রতি মনুষ্যোচিত ব্যবহার করা হয়।
শুধু দিন-রাত্রি ঘরে বসে উপাসনা করাই আল্লাহর উপাসনা নয়। দুঃখী মানুষের সেবা করে, জগতে পাপ ও অন্যায়ের সংস্কার করে প্রেম ও আত্মীয়তার পরিচয় দিতে হবে। যে মানুষের আত্মীয় সেই মহাজন ঈশ্বরের আত্মীয়।
সাধু ভিনসেন্ট এক কয়েদিকে মুক্তি দিয়ে নিজে কয়েদির লৌহশৃঙখল পরেন। কর্তৃপক্ষ শেষকালে জানতে পেরে তাকে মুক্তি দান করনে। প্রেম, ভালবাসা, উপদেশ ও সহানুভূতিতে দুরন্ত মানুষকে যে আবার শান্ত সুবোধ করা যায়–এ কথা সরকারি কর্মচারীরা না বুঝলেও এইসব মানবপ্রেমিকেরা বুঝেছিলেন। এঁরা শত শত কয়েদিকে দীক্ষা দ্বারা আবার মানুষ করে তুলেছিলেন। অবহেলা ও নির্মম দণ্ডে যে মানব মনের কতখানি অবনতি হয়, তা আগে কেউ জানত না। ছোটকে ভালবাসো, এমন ব্যবস্থা করে যাও যাতে মানুষকে আর মন্দপথে না চলতে হয়। শাসক ও শাসিতের সঙ্গে সম্বন্ধ ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে পিতা-পুত্রের সম্বন্ধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের যারা প্রতিনিধি তাদের স্মরণ করা উচিত ঈশ্বরের নজর তাদের ওপর আছে। অত্যাচার ও ঘৃণায় মানুষ আরও পিশাচ হয়। দুরন্ত ছেলে যাতে সুবোধ ও সৎ হয় তার জন্য সহানুভূতিপূর্ণ চেষ্টা করা। উচিত। মানুষ যতই মন্দপথে হাঁটুক, সে তো মানুষ। তার ভিতর যে মহৎ বৃত্তিগুলো আছে। তাতে আঘাত কর, সে উত্তর দেবে। সে একেবারে পশু হতে পারে না। তাকে সন্তান ও ভ্রাতা বলে তার মঙ্গল কর। এতেই মহত্ত্ব ও উচ্চ মানবতার পরিচয় দেওয়া যায়।
সামান্য সামান্য মাসিক দানে দেশের সর্বত্র হাজার হাজার পীড়িতের আবাস, জলাশয় এবং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অবহেলিত সামান্য পয়সা এক জায়গায় সঞ্চিত হলে দেশের কত দরিদ্র মানুষের মঙ্গল হতে পারে। কেন অকৃতজ্ঞ নিন্দুক মানুষের উদর-সেবার জন্য অর্থ ব্যয় কর? বরং পীড়িত ও তৃষিতের মুখে শান্তির অমৃত তুলে ধর। এইভাবে দেশের মানুষের পরম আত্মীয় হও এবং জীবন ধন্য কর। আমাদের দেশে মহাপাপে, রোগে, দুঃখে, অনাহারে শত শত নরনারী মারা যাচ্ছে, তাদের কাতর চীৎকার তোমাদের পাষাণ হৃদয়কে গলাবে না কি? পাপ ও অন্ধকারের অতল হতে তাদের উদ্ধার করবে না? মানুষের আত্মীয় হবার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর পাবে না। সামান্য হলেও সেবা ও প্রেমের পথে দান কর। এইভাবে বাঙালি জাতির আত্মীয় হয়ে তোমরা আল্লাহর আশীর্বাদ লাভ কর। একজনের পক্ষে বিপুল অর্থ ব্যয় করা এবং সেবার পথে তা দান করা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। প্রভুর পথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান করা কোনোমতে কষ্টকর নয়। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় অনুষ্ঠানে, সেবা-প্রতিষ্ঠানে, রোগীর আশ্রমে কিছু কিছু দান করা উচিত। এতে কোনোমতে কৃপণতা করা উচিত নয়। যে এই দানে আপত্তি তোলে এবং যে এই সামান্য দানকে আপন জীবনের সুখ-সুবিধার অন্তরায় মনে করে, সে মানুষের আত্মীয় নয়। তার জীবনধারণ বৃথা। পরিবারে দুর্বল নিঃসহায় অধীনস্থদের প্রতি অত্যাচার, মৃত ভ্রাতার বিধবা পত্নী ও পুত্র-কন্যাদের ওপর অত্যাচার, বরিশাল জেলার বিকৃতমস্তিষ্ক ভ্রাতার স্ত্রী মনোরমার মতো নারীর ওপর অত্যাচার কখন ও আত্মীয়ের কাজ নয়।
পরিবারের বুড়া-বুড়িকে জীবনের শেষ অবস্থায় কোনোরকম অসম্মান করা ঘোর নিষ্ঠুরতা। যারা এরূপ করে তারা কখনও প্রিয়জন নয়। Wagram-এর যুদ্ধে ঊর. Sals dirf-এর একখানা পা গোলার আঘাতে একেবারে চূর্ণ হয়ে যায়। তার সম্মুখে একটা আহত সৈনিক গুলীবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল; ডাক্তার নিজে মৃত্যুর পথে দাঁড়িয়েও পরম আত্মীয়ের ন্যায় এই আহত সৈনিক-দেহে অস্ত্রোপচার করে তাকে বাঁচালেন। নিজের বেদনাকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। যিনি নিজকে ভুলে দুঃখীকে এমন করে জীবন দান করেন তিনি আপনার চেয়েও আপনার। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ কাজের সমষ্টিতেই এক একটা মহাজীবন রচিত হয়।
জনৈক কলেজের যুবক তার চাচা-শ্বশুরের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে জনৈক ডেপুটির সঙ্গে দেখা করে বল্লেন; মহাত্মন! আমি দরিদ্র, আমার এক পয়সাও ব্যয় করবার ক্ষমতা নেই। আমার বাড়ি-ঘর-দরজা কিছুই নেই। মৃত শ্বশুরের আত্মীয় নিরন্তর আমাকে নির্যাতন করেন। তাঁর আপন ভ্রাতুস্পুত্রীকে খুন করতে আসেন। আমরা উত্তরাধিকারি হলেও শ্বশুরের পরিত্যক্ত সম্পত্তির কানাকড়ি আমাদেরকে দিতে চান না। মহানুভব ডেপুটি যুবকের আবেদন গ্রাহ্য করলেন। বিনা খরচে তিনি যুবককে সর্ব বিপদ হতে রক্ষা করলেন। যুবকের বালিকা-পত্নী যখন কোটে উপস্থিত হন তখন ডেপুটি এইভাবে কথা বলেছিলেন; মা, তুমি ভয় করো না। সাহস করে আমার সম্মুখে কথা বল। আজ আমি ছাড়া তোমার আর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই–আমি তোমার মা-বাপ। সত্য কথা নির্ভীকভাবে বল, আমি তোমাদের নিরাপদময় ব্যবস্থা করে দেব।
আজকাল বিচারপতির মুখে বিচারপ্রার্থীর প্রতি এমন আত্মীয়ের মতো পরম ভরসার কথা, এমন নিরহংকার প্রেমের সম্বোধন প্রায়ই শোনা যায় না।
জনৈক ডেপুটিকে দেখেছিলাম, তার স্বভাব হাকিমী-চলন মোটেই ছিল না। তিনি সকলের বাড়িতেই যেতেন, সকলের সঙ্গে মিশতেন। বিবাহ উৎসবে যোগ দিতেন। স্বভাবে তাঁর অহঙ্কার ছিল না। একখানা কাপড় পরে সাধারণ মানুষের মতো রাস্তায় বেড়াতেন। বিচারের সময় বিচারকের আসনে গিয়ে বসতেন। অন্যথায় একেবারে সহজ-নিরহংকার ভাব গ্রহণ করতেন। বিচারপতিতে এই আত্মীয়তার ভাব বড়ই প্রশংসনীয়।
.
০৭. সত্য প্রচার
কতকগুলো উড়ে বেহারা আমাদের বাড়িতে থাকে। তাদের মাঝে যারা ধার্মিক তারা প্রভাতে এবং সন্ধ্যায় সূর্যকে মাটিতে মাথা রেখে প্রণাম করে। মানব-জীবনের এই অপমান আমি দেখেছি এবং দুঃখ পেয়েছি।
দরিদ্রদেরকে বড়বাবুর সম্মুখে ভীত বন্দির মতো হাত জোড় করে মাথা নত করে দাঁড়াতে দেখে মনে গোপনে অশ্রু ফেলেছি।
বুড়ো মানুষকে একটা পৈতাধারী অকালকুষ্মণ্ড ব্রাহ্মণ বালকের পদধূলি মাথায় নিতে দেখে মনে বেদনার ঝড় বয়েছে। মানব-জীবনের এই নিদারুণ অপমানের সম্মুখে মুসলমান
জাতি কি দায়ী নয়? তার ধর্ম কি শুধু রোজা-নামাজ?
যদি কোথাও গান-পাউডার থাকে তবে তাতে আগুন ধরিয়ে দাও, জীবন ওর সার্থক হোক! গন্ধে ভরা মানুষের চিত্তকুসুম ফুটিয়ে তোলো–এই হচ্ছে ভক্তের সাধনা। মানব জীবন সার্থক হোক। অন্ধকারে তাকে বিনষ্ট হতে দিও না। ওর মতো ক্ষতি আর নেই। মানুষকে এইভাবে প্রেম কর। বাইরে মানব সমাজে, পথেঘাটে, রাস্তায় ঈশ্বরের বন্দনা গীত গাও। শুধু মসজিদ ঘরে নয়। নিজের মুক্তির চিন্তায় নয়।
সর্বদা ঈশ্বরের গৌরব প্রচার কর। টিকিধারী, মুসলিম ভ্রাতাকে দেখে আমি ভয় পাই–যারা বলদের পিঠে চড়ে এক লম্ফে বেহেস্তের দরজায় উপস্থিত হতে চায়। যারা কোরবানি করে স্বর্গে যেতে চায়। যারা উচ্চকণ্ঠে কথা বলে এবং হঠাৎ মানুষকে কাফের বলে গালি দেয়।
প্রভুর সত্য সর্বত্র প্রচার কর–পাপের আগুন চারিদিকে জ্বলে উঠেছে–ও দৃশ্য দেখা যায় না। হায় মুসলমান! তুমি এখনও ঘরের মধ্যে বসে আছ? এই কি তোমার ‘জেহাদ’ (পাপের সঙ্গে যুদ্ধ)? কেমন করে তোমরা ঈশ্বরের এত অগৌরব সহ্য কর? অর্থের ভাণ্ডার খুলে দাও, প্রভুর রাজ্য বিস্তারে তোমার ধন-ভাণ্ডার লুটিয়ে দাও, নিজেকে, পুত্রদেরকে এবং আপন বংশকে প্রভুর পথে বিলিয়ে দাও। আল্লাহর পদতলে এইভাবে বলি হও এবং ধন্য। হও। মানব জাতি ধর্মের নামে কত অন্ধকারে পড়ে আছে। শত শত বছর অতিবাহিত হয়ে গেল, এখনও জগতে পৌত্তলিকতা রইল। এই কি তোমাদের নবী-প্রীতি! দরুদ পাঠের ফল! প্রতিদিন প্রভুর প্রচারের নামে মাত্র একটি পয়সাই দান কর। দানের বেলা তোমরা কঠিন এবং কৃপণ। শুধু কোরান পড়াতেই সহজ! কারণ তাতে পয়সা লাগে না এবং সমাজের নিমন্ত্রণ পাওয়া যায়। তাতে হৃদয়ের রক্ত ব্যয় হয় না। বালক! তুমি প্রভুর প্রচারের জন্য ১৫ দিনে একটি পয়সা দান কর। নারী! তুমি তোমার প্রভুর প্রচারের জন্য তোমার স্বতন্ত্র উপায়লব্ধ পয়সা থেকে মাসে মাত্র একআনা দান কর। দিকে দিকে ইসলামের বিজয়বার্তা প্রচার হোক। জগতের অন্ধকার দূর হোক–এই হচ্ছে তোমার বড় উপাসনা। চিরদিন কী ধর্ম-সাধনায় সর্ব নিম্নস্তরে পড়ে থাকবে? গভীর ধর্ম-জীবনের প্রচ্ছন্ন আহ্বান তোমার চিত্তে প্রতিধ্বনি তুলবে না? মানব সমাজ থেকে দিনের মধ্যে পাঁচবার মুখে আল্লাহর জয়ধ্বনি দিকে দিকে পাঠিয়ে দাও। কাজেও কি প্রভুকে প্রচার করবে না?
দেখ দেখি, পরজাতীয়রা প্রভুর প্রচারে নিজেদের জীবন কীভাবে উৎসর্গ করেছেন? হায়! তুমি কি অন্ধকারে ঘরের মধ্যেই বসে থাকবে? পরজাতীয়দের কাজ কী বিস্ময় উৎপাদক নয়! সমস্ত জগৎ যে তারাই অধিকার করল। হায়! কী করলে তোমরা? তোমার যে সর্বনাশ হয়ে গেল। ওরে পরাজিত, লাঞ্ছিত! তোমার যা কিছু ছিল, তাও যে বিনষ্ট হয়ে গেল। মুসলিম নরনারী অজ্ঞানতায় গভীর অন্ধকারে মরে গেল। কেউ দেখল না। সাংবাদিক গ্রাহক বৃদ্ধি করবার কাজে ব্যস্ত, ব্যবসায়ে লাভ বাড়াবার চিন্তায় মশগুল, পুস্তক প্রকাশক পুস্তকের কাটতির জন্যে চিন্তান্বিত, চাকুরে প্রমোশনের জন্যে ব্যাকুল–মানুষের বোর্ডের সভাপতি হবার জন্য কী উৎসাহ! প্রভুকে প্রচার করবার কথা কেউ ভাবল না? কূপমণ্ডুকেরা বলে–প্রভু নিজেকে নিজে প্রচার করছেন! হ্যাঁ ঠিক। ঠিক প্রভু নিজের সৃষ্টি নিজে ধ্বংস করে নিজের মহিমায় নিজে বিভোর থাকবেন। তোমাদের কোনো দরকার নেই। তোমাদের কিছু করবার নেই। তোমরা নিষ্কর্মা নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাক। উত্তম দাস তোমরা! মানুষের কাছে প্রভুর দাবি কী?-মহাজীবনের কাজ কী? প্রভুকে প্রচার করবে–তার বাণী মানুষের দুয়ারে দুয়ারে নেবে–এই তাঁর দাবি তোমার কাছে। মুসলমানদের জীবন শুধু জাগতিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য নয়। তোমরা কি কাফেরদের জীবন আদর্শ করেছ? তোমরা যাদেরকে কাফের বল, তারাই তো ঈশ্বরের ধর্মে দীক্ষা পেয়েছে, তোমরাই তো হয়েছ কাফের! খ্রিষ্টান সাধু সুন্দর সিং তিব্বতে উপস্থিত হলে সেখানকার ধর্মযাজকেরা তাঁকে জীবিত অবস্থায় এক কূপের ভিতর ফেলে দেয়। কয়েক বছর আগে কলকাতা T.M.C.A হলে তাঁর নিজ মুখে শুনেছিলাম, তিনি বললেন; কূপে ফেলে দিয়ে তারা আমাকে মাটিচাপা দিয়ে গেল। বাঁচবার আর কোনো আশা ছিল না। আমি নিরুপায় হয়ে প্রার্থনা করতে লাগলাম। তিন দিন পর ঠিক পাশ দিয়ে আর একটি কূপ খনিত হল, তারপর কারা যেন সেই গভীর অন্ধকার পাতাল থেকে আমাকে উদ্ধার করল। তারা কে তা আমি জানি নে। ঈশ্বর আমাকে এইভাবে রক্ষা করলেন।
পরজাতীয়দের প্রতি যদি আল্লাহ্ এত অধিক দয়ালু হন, তবে আল্লাহকে প্রচারের পথে তিনি তোমাদের প্রতি কত অধিক দয়ালু হবেন।
ইউরোপে খাজা কামালুদ্দীন ইসলাম প্রচার করছেন, তাতে ইউরোপে এক লাখ লোক এই ধর্মের সমাচার পেয়েছেন। অনেক সম্ভ্রান্ত ইংরাজ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তাঁদের দীর্ঘ তালিকা দেওয়া এখানে অনাবশ্যক। শুধু এইটুকু বল্লে হবে–মঙ্গলের বাণী, ঈশ্বরের বাণী, সত্য ও উন্নত ধর্ম জীবনের সুসংবাদ তোমরা আপন দেশে সর্বত্র নিয়ে যাও। নইলে আল্লাহর কাছে মানুষের পাপের জন্য তোমরা দায়ী হবে।
প্রভুকে প্রচার করতে হবে, তোমরা আমার এই কথাকে পণ্ডিতের পাণ্ডিত্য মনে করো না। এই হচ্ছে মানুষের প্রতি আল্লাহর চিরকালের আদেশ। কেউ ঈশ্বরের বাণী শোনে, কেউ শোনে না। আমি শুনেছি তোমাদেরকে বল্লাম। তোমরা গ্রাহ্য কর এবং বিশ্বাস কর!
প্রভুকে প্রচার কর, সর্বত্র আল্লাহর বাণী বহন কর। পতিতাকে, পাপী ও পথহারাকে সত্যের পথে আহ্বান কর। এই কাজে তোমরা প্রত্যেকেই দান কর। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানে তোমাদের ভাণ্ডার অফুরন্ত ধনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। যশ, প্রশংসা, স্বার্থ সকল আশা ত্যাগ করে প্রভুকে প্রচার কর। সত্য প্রচারের পথে কখনও অসহিষ্ণু হয়ো না–নিঃস্বার্থভাবে মানুষের মঙ্গল করে যাও, তাদেরকে মহৎ জীবনের বাণী শোনাও, কাউকে বলবার দরকার নেই–তোমরা আমাদের ধর্ম গ্রহণ কর।
.
০৮. নিষ্পাপ জীবন
অন্য জাতির সঙ্গে গভীরভাবে মেশবার আমার কোনো সুযোগ হয় নি। তবে মুসলমান জাতি সম্বন্ধে বলা যায়–এদের আত্মা যেন ভাবহীন, চেতনা-বর্জিত পাষাণে পরিণত হয়েছে। এরা মনুষ্যত্বের অতি নিম্নস্তরে নেমে চিত্তকে নাড়া দেয় না। জীবন ও ধর্ম সম্বন্ধে এদের কোনো উন্নত চিন্তা নেই। ধর্ম এদের প্রাণের সঙ্গে স্পর্শহীন আবৃত্তির বিষয়। এদের জীবনে কোনো পাপ-পুণ্যের সগ্রাম নেই–আত্মার বেদীতে অনুতাপের অশ্রু নেই–নিষ্পাপ সত্যময় শুদ্ধ নিষ্কলঙ্ক জীবনের কোনো ধারণা এদের নেই। কোনো মহা আদর্শ এদের সম্মুখে নেই। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবন এদের সম্মুখে দরুদ পড়ে শেষ করবার বিষয়। তিনি আজ মুসলমান জাতির জীবনে কোনো গতি ও প্রেরণা দেন না। একটি নমস্কার ও খানিক তোষামোদ পেয়ে তার দরজা থেকে তাকে এখন ফিরে যেতে হয়। ঈশ্বরের বাণী ও নবীর বাণী সবই আজ নিষ্ফল। কোনো স্বর্গীয় শাসনকে আর এরা ভয় করে না।
মানুষকে নিষ্পাপ সুন্দর হবার জন্য কী ধর্মের অনুশাসনের সত্যই প্রয়োজন, এ কাজ তো মানবাত্মার নিজের ধর্ম। মানুষ অশ্রু, বেদনা ও ক্রন্দনের মুক্তধ্বনি–মানুষ প্রেম দ্বারা কি পাপ সম্ভব? ওগো সুন্দরের দেবতা মানুষ! তোমায় নমস্কার। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই প্রকৃতির শান্ত দয়াল মূর্তিতে দেখি প্রভুর গগনজোড়া উচ্ছল অশ্রুর আর্তনাদ। শোকে, গানে, ক্রন্দনে, সুরে বেজে ওঠে প্রভুর অনুনয় মানুষের কাছে–ওরে আমার প্রিয়তম মানুষ! তোরা সবুজ নির্মল প্রকৃতির মতো নির্মল সবুজ সৌন্দর্যে বেড়ে ওঠ। তোরা সুন্দরই-নির্মলই। যে পৃথিবীতে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরছে সেখানে মানুষ কেমন করে মানুষকে দুঃখ দেয়, পাপ করে? স্বর্গের সন্তান তোরা ওরে মানুষ, কেমন করে তোদের হৃদয় পাপ-কালিতে কলঙ্কিত হয়? সমস্ত সবুজ গগনে দেখতে পাই প্রভুর মঙ্গল-বাহু। মানুষকে হাত তুলে তিনি নিষেধ করছেন–ওরে আমার অনন্ত সন্তান, তোরা শোকার্ত উন্মাদিনী সন্তানহারা মেঘ-কুন্তলা চির অমতি প্রকৃতির বুকে দাঁড়িয়ে হিংসার হাত তুলিস নে। তোদের কণ্ঠস্বর নামা। তোদের কথায় মধু ঝরুক। তোরা আপন মনের সহজ ধর্মের অপমান করিস নে। বাঁশি কাঁদে, সুরে কাঁদে, মানুষকে কেবল বলে–ওগো মানুষ, তোরা সুরের মতো সুন্দর হ নির্মল হ। এমন সুন্দর সুরের জগতে মানুষ তোরা পাপ করিস নে সুন্দর হ। এমন সুন্দর সবুজ প্রকৃতির অ–উৎসাহের মাঝে মানুষ কেমন করে পাপ করতে সাহস পায়, বুঝি না। মানুষ তোমরা সুন্দর হও।
তোমরা কাঁদতে শেখ–ভালো করে অশ্রু ফেলতে শেখ। না কাঁদলে কি মনের পাপ ধৌত হয়, মন নির্মল হয়? অশ্রুর গঙ্গায় প্রতি নিশীথে যেয়ে তোমরা আপন আপন জীবনের পাপ ধুয়ে ফেল। এস মানুষ! আমরা প্রেমের সংসার গড়ে তুলি, ফুল আর পাতা দিয়ে দেহ সজ্জিত করি! পাপ আর অত্যাচারের পোশাক পরার চাইতে ঐ পোশাকেই তো মানায় ভালো।
মুসলিমের জীবন শুধু ‘রোজা-নামাজ’ নয়। এরূপ মনে করা মুসলমান ভ্রাতার কোনোমতে উচিত নয়। তার ধর্মের নামেই তো প্রকাশ পাচ্ছে–সে শান্তির সন্তান। হিংসা, মানুষকে দুঃখ দেওয়া তার ধর্ম নয়। পরম শান্তির উপাসক সে। তার ঘরে-বাইরে শুধু প্রেম ও শান্তি বিরাজ করে। হায়! মুসলিম জীবনে এত অশান্তি, এত জ্বালা–এত দুঃখ–এতো অভিশপ্ত শয়তানের জীবন। যে জীবনে প্রভু কর্তৃত্ব করেন, সেখানে কি অশান্তি জ্বালা থাকতে পারে? শীঘ্রই তোমাদের হৃদয়, বাহু, চক্ষু, কর্ণ অবসন্ন হয়ে আসবে। নেপোলিয়ন, সিজার, হানিবল, আলেকজাণ্ডার, চেঙ্গিস খাঁ, সুলতান মাহমুদ, নাদির হালাকু সবারই হয়েছে। সে কথা কি ভাব না?
.
০৯. উপাসনা
একটা পূর্ণাঙ্গ, সুন্দর দুয়ে প্রেমময় মহাশক্তি সৃষ্টির প্রতি স্তরে কাজ করছে। ঐ শক্তি থেকে মানবচিত্ত প্রেরণা ও শক্তি লাভ করে। ঐ শক্তি মানুষ্য জ্ঞানের উৎস।
উপাসনা এই উন্নত মহাশক্তির কাছে চিত্তের প্রণতি, ভক্তি ও বশ্যতা।
উপাসনাহীন জীবন অপবিত্র। যে জীবন দিবা-রাত্রি কোনো সময় প্রভুর অনন্ত প্রেমের কথা স্মরণ করে না–সে জীবন এক অফুরন্ত সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু যেভাবে মুসলমান জাতি বর্তমানে উপাসনার অভিনয় করে থাকেন–তা নিরর্থক। আত্মার সঙ্গে যে উপাসনার যোগ নেই তাকে কোনো মতে উপাসনা বলা চলে না। প্রভুর সম্মুখে আত্মার পরম নিরর্ভরতা পরম অনুতাপের অবস্থা; হৃদয়ের বিগলিত অবস্থার নাম উপাসনা। আবৃত্তি কখনও উপাসনা নয়।
প্রভুর পথে অন্যান্য জাতির তুলনায় মুসলমান জাতি হিসেবে প্রত্যহ পঞ্চাশ মাইল পিছিয়ে পড়ছে। তার আধ্যাত্মিক অগ্রগতি নাই। এ ক্ষতি কোনোকালে পূরণ হবে না। কেউ কি প্রাণকে ফেলে দেহের পূজা করে। প্রাণহীন দেহের মূল্য কী? অথচ মোহবশত অনেকে দেহের পূজা করে। তোমাদেরও মোহ জন্মেছে। বোঝ না। ভাষার অর্থের প্রতি লক্ষ্য কর। না, শুধু আরবি ভাষাকে সম্মান কর। অক্ষর কি ভক্তির যোগ্য? এমন যে পূজিত রাজার শরীর, যা জীবনে কত যত্নে, কত সুখে পালিত হচ্ছে, প্রাণহীন হলে তাও দুর্গন্ধ এবং ঘৃণিত হয়ে উঠে–সে শরীর কেউ ঘরে রাখে না। যখন অর্থবোধ হয় না–তখন আরবি ভাষার কোনো মূল্য নেই। তোমরা শুধু মোহবশত ভাষাকে ভালবাসো–এ তো পৌত্তলিকতা। তোমরা তো পৌত্তলিক। অন্তরে যদি ভাব না থাকে, অনুভূতি না থাকে, তবে আল্লাহ্ তোমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করতে পারেন না–কারণ অন্তরে তোমার কোনো ভাব বা অনুভূতি নেই। ভাষা তো মানুষের তৈরি–ভাব মানবচিত্তে প্রথমে জাগে, মানুষ নিজেদের প্রস্তুত ভাষায় তাই প্রকাশ করে। যে চিত্তে ভাব নেই, অনুভূতি নেই, তার ওষ্ঠের ভাষা আল্লাহ্ বোঝেন না। আল্লাহর কাছে তা পৌঁছে না। কী তুমি চাও, তা নিজেই জান না–আল্লাহ্ তোমায় কী দেবেন?
না বুঝে প্রার্থনার ভঙ্গি করা, কোরান পড়া মহাপাপ। এই মহাপাপে মুসলমান জাতির সর্বনাশ হয়েছে, তার সমস্ত উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে গেছে। মুসলমান নরনারী ধর্মহীন, আল্লাহ্হীন, শক্তিহীন জীবনের সর্বকল্যাণ আশীর্বাদ হতে সে বঞ্চিত। তার জীবন ভয়াবহ অন্ধকারে ভরা, ঘোর অশান্তিতে পূর্ণ আগুনে সে পুড়ে মরে।
আল্লাহই মানুষের শক্তি ও প্রেরণার উৎস। মুসলিম জীবনে শক্তি ও প্রেরণা নেই তার জীবনে কোনো পরম ভরসা ও নির্ভরতা নেই। একটি মৌখিক বিশ্বাস সে করে মাত্র। জাতি হিসেবে তার যে সর্বনাশকর ক্ষতি হচ্ছে, তার মীমাংসা কোনো কালে হবে না।
প্রার্থনা সবসময় স্বরচিত ও মাতৃভাষায় হওয়া উচিত। দু-একটি মাত্র আল্লাহর কালাম সমাজের ঐক্য রক্ষার জন্য প্রার্থনায় ব্যবহার কর, বাকি সমস্তই আপন আত্মার রচিত কথা হওয়া উচিত। আল্লাহর কালাম অর্থাৎ কোরান পুনঃপুনঃ বুঝে পাঠ করলেই আত্মার প্রার্থনাকালে ভাষা আপনা থেকেই আসবে। আল্লাহর গ্রন্থের রস গ্রহণ করে নিজের রক্ত মাংসের অংশ করে ফেল।
Bengal Educational Conference The All Indian Muslim League-এর মতো অবিলম্বে (আমাদের যখন কোনো আমীর নেই তখন জাতিকেই আমীরের আসন গ্রহণ করতে হবে) ধর্ম সম্বন্ধে কী আমাদের কর্তব্য তা নির্ধারণের জন্য পণ্ডিতমণ্ডলীকে নিয়ে একটা (Bengal Religious Conference) নামে সভা গঠিত হওয়া উচিত। দীর্ঘ লম্বা-চওড়া বিশ-তিরিশ রাকাত (দুই প্রণতিতে এক রাকাত) নামাজ বাদ দিয়ে ঈমামের (Priest) ধর্মভাব-উদ্দীপক, প্রেম ও ভক্তিধারবর্ধক দীর্ঘ বক্তৃতা (Sermon) হওয়া অতি আবশ্যক। প্রার্থনায় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হওয়া কোনোমতে অন্যায় নয়। প্রচলিত প্রার্থনার ভাষা গান ছাড়া আর কী? সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর বিশিষ্ট ব্যক্তিকেই ইমাম বলা হয়। .
প্রত্যেক মহাজীবনের অন্তরালে প্রার্থনা আছে। মোস্তফা-কামাল-পাশা নিজের বলে জাতীয় জীবনে একটা পরিবর্তন এনেছেন এরূপ মনে করা বড়ই ভুল, অথচ একটা মূল্যহীন বাঙালি মুসলমান তাকে অধার্মিক বলতে একটু দ্বিধাবোধ করে না। প্রার্থনা প্রত্যেক মহাজীবনের পশ্চাতে থেকে তার জীবনের সমস্ত শক্তির রস গোপনে সরবরাহ করে। বাইরের লোক তা অনুভব না করতে পারলেও একথা মিথ্যা নয়।
শুক্রবারে আমাদের সাপ্তাহিক উপাসনার দিন, প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক মসজিদে অধীনস্থ অধিবাসীদের চাদা দ্বারা প্রতিপালিত সুশিক্ষিত একজন গ্রাজুয়েট ইমাম সমবেত ব্যক্তিগণকে যাতে ধর্মভাবে মুগ্ধ এবং প্রতি সপ্তাহে সকলের আত্মাকে উন্নততর করে গড়ে তুলতে পারেন, তার চেষ্টা করা একান্ত আবশ্যক। কেউ যেন উপাসনায় এসে না বলে–”তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন”। তার নাম কি উপাসনা? ছি!
.
১০. নমস্কার
আর নমস্কার করো না, জগতের অত্যাচার মানুষের মাথাকে চরম অপমান করেছে। মানুষকে সে দাবিয়ে রাখতে, ছোট করতে চেষ্টা করেছে। তাকে বুক দিয়ে ভালোবাসে নি–তাকে মাত্র শাসিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে–প্রেমে কাছে ডাকে নি। তাকে ভ্রাতৃ সম্বোধন জানায় নি।
মানুষকে প্রেমে বুকের সঙ্গে বরং চেপে ধরতার হস্ত প্রেমে হৃদয়ের উপর রাখ। প্রেমের ছলনা কর না মিথ্যা নমস্কার করে; লজ্জায় ও ভয়ে, ঘৃণায় ও গোপন ক্রোধে। আত্মার সহজ নিঃসারিত শ্রদ্ধার নিবেদনের নাম নমস্কার। এ জিনিসটা বল প্রয়োগের দ্বারা বা অনিচ্ছায় হওয়া ভালো নয়।
মানুষের কাছে নত না হলে, নমস্কার না করলে মানুষ দাম্ভিক এবং বিদ্রোহী বলে সন্দেহ করে। সুতরাং সময় ও পাত্র বুঝে নমস্কার করা উচিত।
নমস্কারের দ্বারা অনেক পাপ ঢাকা পড়ে। কোনো কোনো দুরাচার নমস্কার করে জীবনের পাপ ঢেকে রাখে। তাদের দোষ পদস্থ লোকেরা তাদের তোষামোদ ও নমস্কারের মোহে ভুলে যান। এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধিমান লোকদের খুব সাবধান হওয়া উচিত।
পরিবারের গুরুজনদের প্রতি ছোটদের শ্রদ্ধা নিবেদন ভালো। রাত্রিবেলা বিদায়কালে পরস্পরকে অভিবাদন জানিয়ে নেওয়া ভালো, তাতে পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব জাগে।
নমস্কার অর্থ আনুগত্য, বশ্যতা–কোনো অমিল ও বিদ্রোহের ভাব নয়। পুত্র পিতাকে, স্ত্রী স্বামীকে, পুত্রবধূ শাশুড়ী ও শ্বশুরকে, ছোট বড়কে সময় ও শোভনমতো অভিবাদন করা মন্দ নয়। বাড়াবাড়ি জিনিসটা ভালো নয়।
জীবনের পাপ ও অন্যায় ঢাকার জন্য যারা হরদম বিনয় প্রকাশ করে এবং নমস্কার করে, তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনে সুখী হবে না, তাদের সম্বন্ধে সতর্ক থাকবে।
হাত উঠিয়ে বা মাথা নাড়া দিয়ে অভিবাদন জানান হয়–তার অর্থ মুখের শব্দ অনেক সময় ভিড়ের মাঝে গোলমালে শোনা যায় না। অভিবাদনের ভাষা বিদেশী হওয়া মোটেই শোভন নয়। ”আচ্ছালামো”–ইত্যাদির পরিবর্তে আপনার মঙ্গল হোক, আপনি শান্তিতে থাকুন বলা ভালো।
ভাষার প্রতি মোহ কিছুই নয়–ভাব ও আত্মার চাইতে দেহ বড় নয়। পদ চুম্বন জিনিসটা সভ্য-জগতের মধ্যে নেই। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে অমর্যাদা করবার অর্থ ঈশ্বরের অপমান। অতি নিকটবর্তী গুরুজন যারা এবং সঙ্গে সঙ্গে সে পদলোভী বাজে লোক ও শুধু “শান্তি সম্ভাষণে” অর্থাৎ “আচ্ছালামো”…ইত্যাদি অভিবাদন বলে মনে করেন। সভ্যজাতির মধ্যে গুরুজন ও ভদ্রলোকদেরকে একই ধারায় সম্মান দেখান হয়–এর নানা রকম ধারা নেই।
সমাজে যা চলে আসছে বা চলছে তার পরিবর্তন সহজে সম্ভব নয়। তবে উচ্চস্তরের লোকেরা যা করেন, সাধারণ লোক তাই অনুসরণ করে।
মোটের ওপর মানুষের কাছে নত হওয়া, মানুষকে অভিবাদন করা, ভদ্রতা দেখান অতীতকালের উচ্চস্তরের লোকদের প্রকৃতি ছিল। দুষ্টের হাতে নমস্কারের অপব্যবহারে এর সার্থকতা সম্বন্ধে বর্তমানে মনে সন্দেহ জাগে।
অন্তরে ভাব নেই–প্রাণে শ্রদ্ধা নেই–বাইরে ভয় ও লজ্জাজনিত এরূপ নমস্কারের অভিনয় কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। যোগ্য ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা না জানানোও ভালো নয়। হযরত নবী সম্বন্ধে বলা হয়েছে–তাকে কেউ কোনো দিন আগে নমস্কার করতে পারে নি।
এক ব্যক্তিকে জানি, তাকে কোনোদিন কেউ আগে নমস্কার করতে পারত না–কিন্তু তার গোপন জীবন অতি কুৎসিত পাপে পূর্ণ ছিল অথচ নমস্কারের জোরে তিনি জীবনের সর্বস্তরে জয়ী হয়েছেন। এতে মনে হয়েছে, মানুষ মানুষের ভিতরের স্বভাবকে বিশ্লেষণ করে দেখতে যায় না। সে তোষামোদেই মোটের উপর তুষ্ট হয়। সেজন্য অতিরিক্ত নমস্কারে তুষ্ট হওয়া ভালো নয়, অতিরিক্ত নমস্কার করাও যেন ঠিক নয়।
এক যুদ্ধক্ষেত্রে জনৈক শত্রু (বোধ হয় ফরাশি) সেনাপতি ইংরেজের সুসজ্জিত কামান শ্রেণীর ভিতর এসে পড়েন। নিকটেই পাহাড়ের ধারে জঙ্গলের অন্তরালে যে সহস্র বন্দুকধারী সৈন্যদল অপেক্ষা করছে, এ তিনি বুঝতে পারেন নি। ইচ্ছা করলে, তখনই তাকে হত্যা করে ফেলা যেতো। কিন্তু শত্রু সেনাপতি ভদ্রতায় মাত্র একটা বন্দুকের শব্দ করে তার বিপদ সম্বন্ধে সজাগ করে দিলেন। ফরাশি সেনাপতি শত্রুর এই ভদ্রতার প্রত্যুত্তরে তৎক্ষণাৎ একটি অভিবাদন জানিয়ে মৃদু হেসে অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলেন। এই অভিবাদনটি তার পক্ষে তখন খুবই শোভন হয়েছিল।
এক বিচারপতি এক মহানুভব ব্যক্তির উপর অন্যায় করে জেনে-শুনে গুরুতর শাস্তির দণ্ড দিলেন। এই ব্যক্তি রাজাসনকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়ে এই দণ্ড নত মাথায় গ্রহণ করে বিচারালয় ত্যাগ করলেন। এই অভিবাদনের মূল্য অনেক বেশি। বিনয়ে নত হওয়া মানুষের স্বভাব। মানুষ ঈশ্বরজাত–ঐশ্বরিকভাবে তাই সে নত হয়।
ঈশ্বর ছাড়া কোনো মানুষকে নমস্কার, প্রণাম বা অভিবাদন করা ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ। একমাত্র ঈশ্বরই প্রণামের পাত্র। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মর্যাদা ইসলাম এইভাবে রক্ষা করেছে। কিন্তু তবু মানুষ মানুষের সামনে মাথা নত করে মানুষকে মানুষ ঈশ্বর জ্ঞান করে। মোগল এবং মুসলমান বাদশাহকে মানুষ কি কুৎসিতভাবে সেজদা। করতো! যে মানুষ এইভাবে সম্মান লাভ করে এবং যে এইভাবে সম্মান করে উভয়েই পাপী। একবার মি. জুসেনকে কলকাতায় জিজ্ঞেস করেছিলাম; মি. জুসেন, আপনি আপনার রাজাকে সম্মান দেখানোর জন্যে তাঁর সামনে জানু পেতে বসে, তাকে নমস্কার করবেন, না তার সামনে করমর্দন করবেন? তিনি বল্লেন; আমি তাঁর সঙ্গে করমর্দন করবো।
প্রণাম–যে সর্বহারা রিক্ত, তার পক্ষে জানা বড় কষ্টকর। যে বড় সেই ছোট হতে পারে। যে ছোট তাঁর ছোট হওয়া শোভা পায় না। প্রণাম, অভিবাদন, নমস্কার এসব মনুষ্যসমাজ থেকে একেবারে তুলে দেওয়া ভালো। এরমধ্যে যেন পৌত্তলিকতা আছে। রাজা-প্রজা, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে, ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, বন্ধুতে-বন্ধুতে প্রতিবেশী প্রতিবেশীতে প্রণতি না হওয়াই ভালো, কারণ এর দ্বারা জগতে অনেক পাপ ঢাকা পড়ে মিথ্যা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, মানুষের দাম্ভিকতাকে প্রশ্রয় দেয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের কথা ও ব্যবহারেই জানা যায় সে ভালো কি মন্দ। তার হৃদয়ে প্রেম আছে, না সে নিষ্ঠুর।
ইসলামের শান্তি সম্ভাষণ জিনিসটা খুবই ভালো। এতে কারো স্বাধীনতা নষ্ট হয় না, অথচ পরস্পরে প্রেমের ভাব বর্ধিত হয়। মানুষের জন্যে ঈশ্বরের কাছে কল্যাণ এবং শান্তি কামনা আরবি বাক্য ‘আচ্ছালামো আলায়কুমের অর্থ না বুঝার দরুনই বিদঘুঁটে লাগে। মাতৃভাষায় ওর অনুবাদ”শান্তি লাভ করুন–আপনার মঙ্গল হউক।”